০৭. বিকেলে লালবাজারে পৌঁছে

বিকেলে লালবাজারে পৌঁছে বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল টুপুরদের। কাল ভরদুপুরে শ্যামবাজারে একটা রোমহর্ষক ব্যাংক ডাকাতি হয়েছে, তাই নিয়ে প্রশ্নবাণ হানতে ডিসি ডিডির ঘরে হাজির হয়েছে সাংবাদিককুল, তাঁদের সামাল দিতে গোয়েন্দা প্রধান এখন মহা ব্যস্ত।

সাংবাদিকরা কাগজ কলম গুটিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডাক পড়ল মিতিনদের। ঢুকে টুপুর থ। পুলিশের অফিস বলে মনেই হয় না। ব্রিটিশ আমলের কী বিশাল ঘর। কী চমৎকার সাজানোগোছানো। ভেলভেট মোড়া কাচ বসানো প্রকাণ্ড টেবিলে। খানচারেক রংবেরঙের টেলিফোন। পাশে আর একটা টেবিলে। কম্পিউটার, প্রিন্টার, ফ্যাক্সমেশিন। ঘিয়েরং দেওয়াল ঝকঝক করছে। শ্যাওলারং ভারী ভারী পরদা ঝুলছে জানলায় জানলায়। দেওয়ালে অজস্র ফোটোগ্রাফ এক লাইনে সাজানো। সম্ভবত পূর্বতন অফিসারদের ছবি। বিদেশি, এদেশি। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষটির মেজাজই যেন আলাদা।

মিনি সিংহাসনের মতো ঘুরচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন অনিশ্চয়। মিতিনদের দেখেই গাল এঁটো করা হাসি। বললেন, কী সৌভাগ্য! আজ আমার ঘরে দেখি একের পর এক ভি আই পি!

ভুল বললেন। মিতিন ঠোঁট টিপে হাসল, প্রথমত, আমি নন ভি আই পি। দ্বিতীয়ত, জার্নালিস্টদেরও আপনি মোটেও কেউকেটা ভাবেন না।

টেবিলের পেপারওয়েটটা ঘোরালেন অনিশ্চয়, আপনি সবসময়ে পয়েন্ট সাজিয়ে কথা বলেন কেন বলুন তো? প্রথমত…? দ্বিতীয়ত…?

এ তো আপনার কাছ থেকেই শেখা দাদা।

শুনে বেশ খুশি হলেন অনিশ্চয়। প্ৰসন্ন মুখে বললেন, বলুন কীভাবে আপনার সেবা করতে পারি? এসিটা আর একটু বাড়িয়ে দেব?

না, না, ঠিক আছে।

তবু শুনলেন না অনিশ্চয়। বেয়ারাকে ডেকে ঘরের ঠাণ্ডা আরও জোরদার করালেন। টুপুরের সঙ্গে যেচে সেরে নিলেন আলাপটা। তারপর কোল্ডড্রিংকসের অর্ডার দিয়ে গুছিয়ে বসেছেন, এবার শুনি কী হেতু আগমন?

যেজন্য আসি আপনার কাছে। কিছু ইনফরমেশান চাই।

কী ব্যাপারে?

আপনাদের লেবুতলার কেসটা সলভ হয়েছে? সেই যে বাড়ি ভেঙে পড়ল?

একটা ফাউলপ্লে যে আছে, এটা প্রমাণিত হয়েছে। ফরেনসিক রিপোর্টও বলছে, একটা এক্সপ্লোশান হয়েছিল। আর তার এফেক্টেই বাড়িটা… আমরা অনেক ক্লু পেয়ে গেছি। আর দুটো দিন, দুষ্টুটাকে ঠিক পাকড়ে ফেলব।

কোনও পুলিশ অফিসার ক্রিমিনালকে দুষ্টু বলছে, এই প্রথম শুনল টুপুর। মিতিনমাসি ঠিকই বলে, অনিশ্চয় মজুমদার মানুষটা ভারী মজাদার। নিপাট গোবেচারা চেহারা, একটা জাঁদরেলি পুলিশি গোঁফ পর্যন্ত নেই। মাথাজোড়া টাক, ফোলা ফোলা গাল অনিশ্চয় মজুমদারকে তার বাবার মতন কলেজের প্রফেসর হলেই যেন মানাত বেশি। ভদ্রলোকের একটা মুদ্রাদোষও আছে। হাতের আঙুলগুলো নড়াচড়া করছেন সর্বক্ষণ। পেন তুলে নামিয়ে রাখছেন, ফাইল খুলে বন্ধ করছেন, কিছু না হলে টরেটক্কা বাজাচ্ছেন টেবিলে।

মিতিনের অবশ্য ওসব নিয়ে ভ্রূক্ষেপ নেই। বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করল, যদি বলতে আপত্তি না থাকে, জানতে পারি কাকে সাসপেক্ট করছেন? কোনও প্রোমোটার?

অবশ্যই।…কিন্তু আপনার এ ব্যাপারে কৌতূহল কেন? কেসটায় নেমেছেন নাকি? টকাটক উটপেন খোলা বন্ধ করতে করতে অনিশ্চয় বললেন, আপনি যেভাবে খুশি ডিটেকশান করুন, রাজনাথ সিং আমার মুঠো থেকে ছাড়া পাবে না।

কে রাজনাথ সিং?

সিং প্রপারটিজের মালিক। সুলতানগঞ্জের লোক। বিহারের নামকরা মাফিয়া। এখন কলকাতায় এসেও ছড়ি ঘোরাচ্ছে।

 সুরজমল অগ্নিদেব কোনওভাবে সেটায় জড়িত নেই তো? রিগাল প্রপারটিজের মালিক?

না, না। লেবুতলার কেসে সুরজমল পিকচারে নেই। অন্তত আমার যা ফাইন্ডিং। বলেই অনিশ্চয়ের ভুরুতে সেকেন্ড ব্র্যাকেট, আপনি কি সুরজমলকে সাসপেক্ট করছেন?

আমি কাউকে সন্দেহ করছি না দাদা। আমি ওই কেসেই নেই। সম্প্রতি অন্য একটা ব্যাপারে সুরজমলের সঙ্গে আমার মুখোমুখি হওয়ার একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তার আগে লোকটার সম্পর্কে একটু খোঁজখবর নিচ্ছিলাম আর কী।

তাই বলুন। অনিশ্চয় ডটপেন ছেড়ে আবার পেপারওয়েট ধরলেন, কী জানতে চান সূরজমল সম্পর্কে?

লোক কেমন?

প্রোমোটাররা ইউজুয়ালি যেমন হয়। ধূর্ত, কেজো এবং প্রয়োজন হলে রুথলেস। টাইপ মূলত রাজনাথ সিং-এরই, তবে পাক্কা সাহেব। স্যুট টাই পরে, ক্লাবটাবে যায়, তুখোড় ইংরজি বলে। আবার গুরুদেবও রয়েছে।

টুপুর বলে উঠল, মুক্তকেশানন্দ?

ইয়েস মিস ওয়াটসন। মুক্তকেশানন্দই সুরজমলের মূল মন্ত্রণাদাতা। লোকটার মাথায় জিলিপির প্যাঁচ। নিউ আলিপুরে একটা জমি হাতাতে গিয়ে গুণ্ডা লাগিয়ে সুরজমল প্রায় ফেসে যাচ্ছিল, মুক্তকেশানন্দই তাকে বাঁচার রাস্তা বাতলে দেয়। লোকটা আদতে ছিল একটা ছোট্ট চায়ের দোকানের মালিক। হঠাৎ রাতারাতি চায়ের দোকানের পাশে চালা বেঁধে স্বপ্নে পাওয়া কালীমায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করে, এবং তখন থেকেই সে এক মহান কালীভক্ত। উদ্দেশ্য অবশ্য একটাই ছিল। অন্যের জমি গ্রাস। ওই মন্দির এখন রমরমিয়ে চলছে, প্রতি শনি মঙ্গলবার গাড়ির ভিড় দেখলে তাক লেগে যাবে। ইদানীং প্রতি অমাবস্যায় আমাদের তো পুলিশ পোস্টিং করতে হয়। লোকটার একটাই প্লাস পয়েন্ট। নিজেরও মাথা ঠাণ্ডা, ভক্তদেরও মাথা গরম করতে দেয় না। সূরজমল তো ওর চ্যালা বনার পর থেকে গুণ্ডাবাজি অনেক কমিয়ে দিয়েছে।

মিতিন বলল, যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। দেখা হলেই লোকটা তেড়ে আসবে না।

আপনাকে চোখ রাঙায়, সাধ্য কার? আমি আছি না! অনিশ্চয় সোজা হয়ে বসলেন, তা আপনার কেসটা কী?

খিচুড়ি কেস।

মানে?

এক দিক দিয়ে অগ্নিদেব উঁকি দিচ্ছেন ঠিকই, তবে আর এক দিকে আছেন এক পবিত্র আত্মা।

কীরকম? কীরকম?

সংক্ষেপে জোনাথন মাইকেলের বাড়ির ঘটনাবলি অনিশ্চয়কে শোনাল মিতিন। শুনে হাস্যমুখ অনিশ্চয়কে ঈষৎ চিন্তিত দেখাল। বলে দিলেন যেন সামান্যতম প্রয়োজনে মিতিন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে।

লালবাজার থেকে বেরিয়ে মিতিন বলল, কী রে, টায়ার্ড লাগছে?

আজ টুপুরের শ্রান্ত হওয়ারই কথা। জোনাথন মাইকেলের বাড়ি থেকে ফিরেছিল প্রায় বারোটায়। স্নান খাওয়ার পর কতটুকুই বা জিরোনোর অবকাশ পেয়েছে, তিনটে বাজতে না বাজতেই তো আবার বেরিয়ে পড়া। তবু মিতিনমাসির সঙ্গে থাকা মানে ক্লান্তি ফ্লান্তি সব ভ্যানিশ।

টুপুর বলল, কেন? আর কোথাও যাবে?

ভাবছি।

কোথায়? উৎপলবাবুদের বাড়ি?

আজ ওখানে গিয়ে লাভ নেই।

 বা রে, দুপুরে উৎপলবাবু ফোন করে বললেন চেয়ারটেয়ার সব সরিয়ে দিয়েছেন। তারপর কী হয়, বিকেল সন্ধেয় সরেজমিন করে এলে হত না?

তার মানে তুই মাইকেলের বাড়ি যাওয়ার কথা বলছিস?

হ্যাঁ… উৎপলবাবুদের বাড়ির কথাও বলছি। তুমিই তো বলছিলে ওখানেও এক বার যাওয়া দরকার!

কিন্তু উৎপলরা তো এখন জিমনাশিয়ামে।

তবু বাড়িতে তো কেউ-না-কেউ আছে। অন্তত কুকুরটার জন্যে।

বলা যায় না। অনেকে তো কুকুরকে একা-থাকা অভ্যেসও করিয়ে দেয়।

তবু চান্স নিতে দোষ কী! যদি কেউ থাকে। ফাঁকায় ফাঁকায় উৎপলবাবুদের বাড়িটা ঘুরে নেওয়া যাবে।

দুটো মাইনাস পয়েন্ট আছে। প্রথমত, যে থাকবে সে অচেনা লোককে ঢুকতে দেবে, এ সম্ভাবনা কম। দ্বিতীয়ত, যে কারণে তুই যেতে চাইছিস, অর্থাৎ উৎপল-মির্না সম্পর্কে নিশ্চয়ই সামান্য হলেও তোর সংশয় জেগেছে, সেই উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। কারণ বারবার না জানিয়ে গেলে ওরা আমাদের মনোভাব টের পেয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং ওদের বলেকয়েই না হয় একসময়ে…

যা ভাল বোঝ। কিন্তু যাবেটা কোথায় এখন?

এদিকের কাজগুলো সব মিটিয়ে ফেলি। সুরজমলের বুড়িটাই ছুঁয়ে যাই। রোজ রোজ তো আর কম্পিউটার ক্লাস ড়ুব মারতে পারব না। কাছেই বিবাদি বাগের মিনিবাস স্ট্যান্ড। কথা বলতে বলতে দুজনে এসে দাঁড়িয়েছে যাত্রীদের লাইনে। সবে ভেঙেছে। অফিসপাড়া, জনস্রোত গাঢ় ক্ৰমশ। শেষ বিকেলের আলো এসে পড়েছে উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর মাথায়। লালদিঘির টলটলে জলে নীল আকাশের ছায়া। আলো আর ছায়ায় মাখামাখি হয়ে ডালহাউসি পাড়া এখন ভারী মায়াবী। ভিড় আর কলরোল সত্ত্বেও মিতিন কবজি উলটে ঘড়ি দেখল। বলল, আজ সময় নেই। থাকলে আমিও তোকে কলকাতার একটা দুটো অ্যান্টিক পিস দেখিয়ে দিতে পারতাম।

টুপুর বলল, কী গো?

এখান থেকে একশো গজ দূরে ব্রিটিশদের তৈরি প্রথম কেল্লাটার নিদর্শন আছে। জিপিওর সামনের ফুটপাথেই লোহার পাত আছে একটা। ওটাই ছিল কেল্লার সীমানা। সিরাজদ্দৌলা কলকাতা আক্রমণ করে ফোর্টটাকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। তারপর ধর, এখান থেকে হাইকোর্ট যেতে হলে পথে পড়বে সেন্ট জোনস চার্চ….

জানি। ওখানেই তো আছে জোব চার্নকের সমাধি।

ভেতরে গিয়ে কখনও দেখেছিস সমাধিটা?

নাহ।

খুব ইন্টারেস্টিং লাগে। জোব চার্নকের কবরের ওপর একটা সমাধিসৌধ আছে। তৈরি করে দিয়েছিলেন জোব চার্নকের বড় জামাই চার্লস আয়ার। জোব চার্নকের তিন মেয়ে ছিল। মেরি, এলিজাবেথ, আর ক্যাথরিন। তিন মেয়েই মারা গিয়েছিল কলকাতায়। তার মধ্যে বড় আর ছোটকে কবর দেওয়া হয়েছিল বাবার পাশে। শুধু তাই নয়, ওই গির্জারই এক কোনায় পড়ে আছে হলওয়েল মনুমেন্ট। সিরাজদ্দৌলা নাকি একরাশ সাহেব-মেমকে অন্ধকূপে পুরে মেরে ফেলেছিলেন, এমন একটা অপবাদ দিয়ে হলওয়েল তৈরি করেছিলেন ওই মনুমেন্ট। সুভাষ বোসের আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশরা মনুমেন্টটা সরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। এখনও ওই মনুমেন্টের গায়ে সাহেবদের লেখা মিথ্যেগুলো জ্বলজ্বল করছে।

আরও বোধ হয় কিছু বলার ইচ্ছে ছিল মিতিনের, তার আগেই পর পর দুটো বাস এসে গেছে। প্রথমটায় জায়গা হল না, পরেরটায় জানলার ধারে সিট পেয়ে গেল টুপুর। এবং যাত্রীঠাসা বাস মিনিট কুড়ি-পঁচিশের মধ্যে পৌঁছে গেছে ক্যামাক স্ট্রিটের মুখে।

রিগাল প্রপার্টিজের অফিস খুঁজে পেতে সময় লাগল না বিশেষ। শান্তিনিকেতন বিল্ডিং-এর কাছেই একটা বাড়ির তিনতলায়। ছোট্ট অফিস, কিন্তু ছিমছাম। ফিটফাট। সন্ধে নেমে গেছে, তবু অফিসে এখনও অনেক কর্মী আছে। কেউ বা করছে ড্ৰয়িং, কেউ বা হিসেবপত্র। সুরজমল অগ্নিদেবকেও পাওয়া গেল। ভিজিটিং কার্ড পাঠিয়েছিল মিতিন, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আহ্বান।

সুরজমলের বয়স খুব বেশি নয়, বছর চল্লিশ। সাফারি স্যুট পরে আছে, চোখে মিলেস চশমা, টেবিলে গড়াগড়ি খাচ্ছে মোবাইল। দাঁতে পাইপ চেপে আছে সুরজমল, মিঠে তামাকের গন্ধে ভরে আছে কাচঘেরা চেম্বারটা। সুরজমল ছাড়াও আর একজন আছেন ঘরে। বয়স্ক মানুষ। দুহাত নেড়ে কী যেন বোঝাচ্ছিলেন সুরজমলকে, চোখ অর্ধেক বুজে মাথা দোলাচ্ছিল সুরজমল। মাথার পিছনেই পাশাপাশি দুটো ছবি। মা কালী, আর মুক্তকেশানন্দ।

মিতিন টুপুরকে সামনের চেয়ারে বসতে বলল সুরজমল। স্মিত মুখে বলল, ইয়েস ম্যাম? হোয়াট ক্যান আই ড়ু ফর ইউ?

মিতিন ভদ্ৰভাবে বলল, আপনার সঙ্গে কিছু পারসোনাল কথা ছিল।

প্লিজ, বলুন।

আমি একটু প্রাইভেটলি কথা বলতে চাই।

সুরজমল কী বুঝল কে জানে, এক ঝলক দেখল মিতিনকে। তারপর বয়স্ক মানুষটিকে বলল, সে মিস্টার সানিয়াল, উই উইল বি মিটিং টুমরো লেট মি স্টাডি ইওর প্রবলেম, অ্যান্ড দেন উই উইল ডিসাইড ইট। ও কে?

ভদ্রলোক উঠে চলে গেলেন।

 মিতিনের চোখে চোখ রেখে সুরজমল বলল, ইয়েস….?

কোনও ভূমিকায় না গিয়ে সরাসরি মিতিন বলল, আমি মিস্টার জোনাথন মাইকেলের কাছ থেকে আসছি। নামটা নিশ্চয়ই আপনার অপরিচিত নয়?

হ্যাঁ, আমি চিনি। সুরজমলেরও মুখের পেশিতে কোনও ভাঙচুর হল না, রেসপেক্টেবল জেন্টলম্যান, বাট উইথ ফেডিং মেমারি।

আপনার সম্পর্কে মিস্টার মাইকেলের কিছু অভিযোগ আছে। বাড়ি ভাঙার প্রস্তাবে তিনি সম্মত নন জেনেও আপনি অন্যায়ভাবে তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন।

উনি বলেছেন আমি ওঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছি?

ব্যবহারটা বড় কথা নয় মিস্টার অগ্নিদেব। আপনি তাঁকে মিথ্যে করে বলেছেন তিনি আপনাকে বাড়ি বেচতে সম্মত হয়েছেন।

সুরজমল দুএক মুহূর্ত থেমে থেকে শান্তভাবেই বলল, দেখুন ম্যাডাম, আপনার কার্ড বলছে আপনি প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার। কিন্তু আমি আপনাকে চিনি না। আপনার প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কেও আমার কোনও ধারণা নেই। সবচেয়ে বড় কথা, আমি আপনাকে আদৌ কোনও কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই। তবু একজন ভদ্ৰলোক হিসেবে আপনাকে বলছি, আমি মিথ্যে বলিনি। আমার কাছে সত্যিই একটা ফোন এসেছিল। সেই ফোনে স্পষ্টভাবেই মিস্টার মাইকেল জানান তিনি বাড়ি বিক্রি করতে প্রস্তুত। আমি যেন শনিবারই ডিডের কাগজপত্র নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করি।

আমি যদি বলি আপনি কোনও ফোন পাননি? বানিয়ে বলছেন?

বলতে পারেন। আমার কাছে তো কোনও প্রমাণ নেই। আমি তো প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার নই যে প্রতিটি কল টেপ করে রাখব। তা ছাড়া আপনার কাছে প্রমাণ দেওয়ার আমার কোনও বাধ্যবাধকতাও নেই। আমি যা বলছি, তা অফ মাই ওউন। আপনার ব্যাগে নিশ্চয়ই টেপরেকর্ডার আছে, আপনি স্বচ্ছন্দে টেপ করে রাখতে পারেন।

টুপুর দেখল মিতিনমাসির মুখ লাল হয়ে গেছে। মিতিনমাসির হয়ে সে-ই জিজ্ঞেস করল, আপনি কবে পেয়েছিলেন ফোনটা?

গত বৃহস্পতিবার। দুপুরে। এই অফিসেই।

আপনি শিওর, ওটা মিস্টার মাইকেলের গলা ছিল?

আমি স্বরবিশেষজ্ঞ নই। তবে গলাটা ছিল বয়স্ক মানুষের। সামান্য কাঁপা কাঁপা। তিনি জোনাথন মাইকেল বলেই নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন।

মিতিন নিজেকে সামলে নিয়েছে। সহজ গলায় বলল, সে যাই হোক, শেষ পর্যন্ত মিস্টার মাইকেল রাজি নন দেখে আপনি তাঁর ওপর নানারকম উৎপাত শুরু করে দিলেন।

আমি? কী উৎপাত?

আপনি জানেন না?

অবশ্যই না।

ভূতের ভয় তৈরি করছেন না ও বাড়িতে?

সুরজমলের ভুরুতে ভাঁজ পড়েও মিলিয়ে গেল। মৃদু হেসে বলল, শুনুন ম্যাডাম, কাউকে বাড়িছাড়া করতে হলে ভূতটুতের ভয় দেখানোর আমার প্রয়োজন হয় না। এই কাজটা ভূতের চেয়ে মানুষ আরও বেশি ভাল পারে। তবে ওই জমি আমার কাছে এমন কিছু লোভনীয় নয় যে তার জন্য আমি অত ঝঞ্ঝাট পোয়াব। সত্যি বলতে কী, আমি মিস্টার মাইকেলকে যা অফার করেছি তার পরে আমার বিরাট কিছু লাভ থাকবে না। মনে রাখবেন, যতটাই জমি থাক, ওটা ব্যাক প্লট, সামনের রাস্তা সরু। ওখানে আমি চারতলার বেশি তুলতে পারব না। তুললেও সামনে অনেকটা জমি ছাড়তে হবে। আমার ইন্টারেস্ট ছিল পুরনো বাড়ি ভাঙলে ভাল কাঠ বিম পাওয়া যায়….. ভেবেছিলাম তাই দিয়ে সামান্য কিছু মেকআপ করতে পারব।

শুধু মূল্যবান কাঠের কথাই ভেবেছেন, নাকি আরও মূল্যবান কিছুর আশা ছিল?

বুঝলাম না।

টুপুর উৎসাহের চোটে গুপ্ত সম্পদের কথাটা বলে ফেলতে যাচ্ছিল, মিতিন পা চিপে দিল। সুরজমলকে বলল, আমিও তো অনেক কিছু বুঝছি না। যেমন, লাভ হবে না জেনেও বাড়িটার ওপর আপনার আদৌ আগ্রহ জন্মাল কেন?

কারণটা আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন? জোনাথন মাইকেলের বাড়িতে গিয়েই উত্তর খুঁজুন না। আমি তো যেচে ইলিয়ট রোডের বাড়িতে যাইনি, ওখান থেকে প্রস্তাব এসেছে বলেই…

কে দিয়েছে প্রস্তাব? আপনি কি মিস্টার মাইকেলের ওই কাল্পনিক ফোনটার কথা বলছেন?

ও তো অনেক পরের কথা। তার ঢের আগেই সামওয়ান আমার অফিসে এসেছিলেন।

আপনি কার কথা বলছেন?

প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার হয়েছেন, মিস্টার মাইকেল নিশ্চয়ই আপনার পেছনে পয়সাও ঢালছেন, আপনি নিজেই খুঁজে বার করুন। অনুগ্রহ করে আমাকে বা আমার কোম্পানিকে বদনামের ভাগী করবেন না। আফটার অল রিগাল প্রপার্টিজের একটা গুডউইল আছে। বলতে বলতে পিছন ঘুরে ছবি দুটোকে নমস্কার করল সুরজমল। মিতিনদের বলল, কিছু মনে করবেন না। আমায় এবার উঠতে হবে।

নীচে নেমে টুপুর বলল, ব্যাপারটা যে আরও গুলিয়ে গেল গো মিতিনমাসি।

হুম।

সত্যিই কি মিস্টার মাইকেলের বাড়ির কেউ সুরজমলের কাছে এসেছিল?

আসতেও পারে। কিংবা সুরজমল মিথ্যেও বলতে পারে।

যদি এসে থাকে, সে কে? ডিক, না মির্না? নাকি উৎপল?

কম্পিউটারের ফান্ডামেন্টাল প্রিন্সিপল্টা জানিস? সিগনাল পাঠানো হয়, সেগুলো যায় লজিক গেটের মধ্যে দিয়ে। সিগনালগুলো জুড়ে গেলে হয় অ্যান্ড। আর দুটো সিগনালের একটা যদি ঢোকে, তবে হয় অর। কোনওটাই না ঢুকতে পারলে হয় নর। এখন সবার স্টেটমেন্টকেই সিগনালের মতো করে মগজে ঢোকাতে হবে। দেখা যাক মস্তিষ্কের লজিক গেট কী বলে।

টুপুর কথাটা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। মিতিনমাসি কী যে হেঁয়ালি করে এক-একসময়ে।