০১. মন দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছিল টুপুর

মন দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছিল টুপুর। পড়ছিল না বলে গিলছিল বলাই ভাল। মিতিনমাসির নির্দেশে ইদানীং এই অভ্যেসটা গজিয়েছে টুপুরের, ফাঁক পেলেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গলাধঃকরণ করে আস্ত কাগজখানা। খুদে খুদে বিজ্ঞাপনগুলোকে পর্যন্ত ছাড়ে না। মিতিনমাসি বলেছে খবরের কাগজের ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপনে অনেক সময়ে মজার মজার গল্প লুকিয়ে থাকে। চোখ মেলে খুঁজতে জানলে কখনও-সখনও ছোটখাটো রহস্যের সূত্রও নাকি মিলে যায়।

আজ অবশ্য বিজ্ঞাপন নয়, একটা খবরই চোখ টেনেছে টুপুরের। তৃতীয় পাতায় বেশ বড় করে বেরিয়েছে খবরটা। বার দুয়েক পড়ে টুপুর চোখ তুলল কাগজ থেকে। উত্তেজিত মুখে ডাকল,পার্থমেসো, ও পার্থমেসো।

পার্থ বাইরের ঘরের বড় সোফায়। কোলে খাবারের প্লেট। লুচির দিস্তে আর পাহাড়ের মতো আলুছেঁচকি নিয়ে বসেছে পার্থ। বাঁ হাতে খবরের কাগজের শব্দজব্দের পাতাখানা, ডান হাতে ডটপেন। মাঝে মাঝে ডটপেন নামিয়ে লুচি, আলুছেঁচকিতে থাবা বসাচ্ছে, পেটে চালান করেই ফের খুচখাচ কলম চালাচ্ছে শব্দের ধাঁধায়। রবিবার সকালে কোলে লুচি না থাকলে শব্দজব্দ মেলাতে পারে না পার্থ।

কচর কচর লুচি চিবোতে চিবোতে পার্থ ফিরে তাকাল। ভুরু কুঁচকে পালটা প্রশ্ন ছুড়ল, জুতোর একটা প্রতিশব্দ বল তো? তিন অক্ষরের?

টুপুর চটপট বলল, পাদুকা।

হল না।

খড়ম?

উহুঁ।

 চপ্পল?

 না, না।

তা হলে কী? কাবলি?

তুৎ, তুই একটি কেবলি। ব দিয়ে স্টার্টিং। না, না, বি দিয়ে।

টুপুর মাথা চুলকোতে শুরু করল, বি দিয়ে?

 ইয়েস। ব-এ হ্রস্ব ই বি।

পার্থ টুপুরের কথার মাঝেই মিতিন কখন ঘরে এসেছে। হাতে নিজের জলখাবারের প্লেট। টুপুরের উলটো দিকের সোফায় বসে বলল, শেষ অক্ষর কী? মা?

কারেক্ট।

লেখো, বিনামা। বাংলায় এত কম ফান্ডা নিয়ে শব্দজব্দ করতে বসো কেন?

পার্থ যেন শেষটুকু শুনতেই পেল না, টুকটুক করে ছক ভরতি করছে। আবার একটা লুচি তুলে টুপুরকে জিজ্ঞেস করল, তখন আমায় ডাকছিলি কেন রে?

শব্দের ধাঁধায় খেই হারিয়ে গিয়েছিল টুপুরের। এক সেকেন্ড থমকে বলল, আজ একটা নিউজ দেখেছ? কী সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড!

কী হয়েছে?

লেবুতলায় একটা দেড়শো বছরের পুরনো বাড়ি হঠাৎ ধসে পড়েছে! ভেতরে চাপা পড়ে মারা গেছেন এক বৃদ্ধ!

মিতিন খেতে-খেতে জিজ্ঞেস করল, এমনি এমনি ভেঙে পড়ল?

দমকল বলছে বাড়িটার হাল ভাল ছিল না। কিন্তু পুলিশ অন্যরকম সন্দেহ করছে। প্রোমোটাররা নাকি অনেক দিন ধরেই টার্গেট করেছিল বাড়িটাকে। মোটামুটি বড় বাড়ি। জমিও আছে বেশ খানিকটা। সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের প্রায় লাগোয়া। বাড়িটা ভেঙে নাকি মাল্টিস্টোরিড বানানোর ধান্দায় ছিল প্রোমোটার। বৃদ্ধ ভদ্রলোককে মাঝেমাঝেই নাকি চাপ দিচ্ছিল।

ভদ্রলোক একাই থাকতেন?

প্রায় একাই। মধ্যবয়সী এক মহিলা ভদ্রলোকের দেখাশুনো করতেন। গত বছর ভদ্রলোকের স্ত্রী মারা গেছেন। দুই বোন, দুজনেই বিদেশে। মহিলা বেঁচে গেছেন। তাঁর মুখ থেকেই প্রোমোটারবৃত্তান্ত জানতে পেরেছে পুলিশ। তা ছাড়া বাড়ি ভাঙার সময়ে একটা জোর বিস্ফোরণের আওয়াজও নাকি শোনা গেছে। মুচিপাড়া থানা তো কাছেই, সেখান থেকেও নাকি শোনা গেছে আওয়াজটা।

হুম। মিতিন ছোট্ট শ্বাস ফেলল, এই প্রোমোটারদের উৎপাতে কলকাতায় আর কোনও পুরনো বাড়ি বোধহয় থাকবে না। কত সুন্দর সুন্দর স্থাপত্য যে এদের দৌলতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।

অত আফসোস করার কিছু নেই। পুরনো না গেলে নতুন আসবে কী করে? তা ছাড়া কলকাতায় যা বিপুল জনসমস্যা, সেখানে পেল্লাই একটা বাড়িতে মাত্র একজন মানুষ থাকবে, এটাই বা কেমন কথা? পাৰ্থ সোফায় পা তুলে গুছিয়ে বসল। কাঁচালঙ্কায় কুটুস কামড় দিয়ে বলল, ইনফ্যাক্ট, লেবুতলা নামটার মধ্যেই একটা বাড়ি ভাঙার ইতিহাস জড়িয়ে আছে। যেসে বাড়ি নয়, একটা গির্জা।

টুপুরের চোখ গোল গোল হল, মানে?

এখন যে জায়গাটাকে আমরা লেবুতলা বলি, আই মিন সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার অঞ্চলটা, ওখানে একসময়ে সেন্ট জেমস গির্জা ছিল। রাস্তাটার নাম ছিল সেন্ট জেমস স্ট্রিট। কলকাতার প্রথম বিশপ টমাস ফ্যাশ মিডলটনের উদ্যোগে বানানো হয়েছিল গির্জাটা। তখন ওই জায়গাটাকে বলত কেরানিবাগান। কেন কেরানিবাগান বলত?

টুপুর থতমত মুখে বলল, কেন?

কারণ ওখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কেরানিরা বাস করত। তারা ছিল পর্তুগিজ। ওই কেরানিবাগানের আদি মালিক ছিলেন একজন পাঞ্জাবি। শিখ। নাম হুজুরিমল। এই হুজুরিমল ছিলেন সিরাজদ্দৌলার দরবারের আমিরচাঁদের শালা। আমিরাচাঁদ মানে উমিচাঁদ। তা হুজুরিমল বউবাজারের বৈঠকখানায় একটা পঞ্চান্ন বিঘের পুকুর কাটিয়েছিলেন। সেই পুকুর বুজিয়েই কেরানিবাগান। পরে এই কেরানিবাগানের মালিক হন মিস্টার রবার্ট ল্যাজেরাস দ্য অলিভিয়েরা। তিনি বিশপকে গির্জা তৈরি করার জন্য বাগানটা দান করে দেন। আঠারোশো কুড়িতে গির্জা তৈরি শুরু হল, শেষ হল আঠারোশো তেইশে।

মিতিন অধৈর্যভাবে বলল, পয়েন্টে এসো না। ঘুরপাক খাচ্ছ কেন?

কোনও কিছু জানতে হলে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানতে হয়। তাও তো আমি হুজুরিমলের পুকুরের নামটা বলিনি।

কী নাম? হুজুরিপুকুর?

আজ্ঞে না। পদ্মপুকুর।

টুপুর প্রতিবাদ করল, যাহ্, পদ্মপুকুর তো ল্যান্সডাউন রোডে।

কলকাতায় কতগুলো পদ্মপুকুর ছিল জানিস? এন্টালিতে একটা…

তুমি আবার ট্র্যাক চেঞ্জ করলে? গির্জার কথা বলো।

হ্যাঁ, গির্জা। চার্চ। শেষ লুচিতে তরকারি পুরে মুখে গুঁজল পার্থ। চিবোতে চিবোতে বলল, গির্জেটা তো তৈরি হল পুকুর ভরাট করা জমিতে। এখনকার প্রোমোটাররা যা আকছার করছে। পরিণতি যা হওয়ার তাই হল। আস্তে আস্তে বসে যেতে লাগল গির্জাটা। ভয় পেয়ে গির্জার কর্তাব্যক্তিরা গির্জার চূড়া বানানো বন্ধ করে দিলেন। লোকজনের কাছে গির্জার নামই হয়ে গেল ন্যাড়া গির্জা। জলা জমি হওয়ার কারণে উইপোকা ধরে গেল কড়িবরগায়। তৈরি হওয়ার মাত্র পঁয়ত্রিশ বছরের মধ্যে আঠেরোশো আটান্নর অগাস্টে বিকট শব্দ করে ভেঙে পড়ল গির্জার ছাদ। ব্যস, গির্জা গন। আরও আছে। তখন ওই গির্জার জন্য দান করা জমির একটা পোরশান গির্জার কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন রবার্ট ল্যাজেরাসের নাতি মিস্টার এলিয়ট। বাকিটা কিনেছিলেন এক বাঙালি। তখন ওই জায়গাটা মোটেই ঘিঞ্জি ছিল না। বরং বলা যায় একেবারেই বসতিহীন ছিল। ওই বাঙালি ভদ্রলোকই প্লট করে করে জমি বেচে এখানে লোকজন এনে বসান। জায়গাটায় প্রচুর লেবুগাছ ছিল, তাই নাম হয়ে গেল লেবুতলা বা নেবুতলা। কলকাতার লোক তো ল-কে বলত ন। নুচি নেবু নংকা নেবুতলা…

টুপুর বলল, ন্যাড়া গির্জা শেষে নেবুতলা? এ যে ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল!

উহুঁ। রুমাল টু বেড়াল, টু চশমা, টু দাঁতের মাজন।

 তা সেই বাঙালি ভদ্রলোকের নাম কী ছিল?

ইতিহাসের এটাই তো পরিহাস রে। কত ইম্পর্ট্যান্ট লোকের নাম যে ইতিহাস মিস করে যায়। দেখি, কোথাও যদি পাই তো নামটা তোকে বলে দেব। পার্থ আয়েশ করে একটা সিগারেট ধরাল, তা যা বলছিলাম। কলকাতার কত জায়গা যে কত ভাবে বদলেছে।

যেমন বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোড থেকে পার্ক স্ট্রিট।

বেরিয়াল কিংবা বেরিয়িং। কিন্তু নামটা বদলে পার্ক স্ট্রিটই বা হল কেন, বল তো?

ওই যে একটা পার্ক আছে ক্যামাক স্ট্রিটের সোড়টায়।

ঘেঁচু। এখন যাকে বলে মিডলটন রো, সেখানে লোরেটো হাউসটা দেখেছি তো? ওটা ছিল আসলে স্যার ইলাইজা ইম্পের বাড়ি। ইলাইজা ইম্পে কে ছিলেন নিশ্চয়ই বলতে হবে না?

ওয়ারেন হেস্টিংসের বন্ধু। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। ইলাইজা ইম্পের সঙ্গে চক্রান্ত করেই তো ওয়ারেন হেস্টিংস মহারাজা নন্দকুমারের ফাঁসি দিয়েছিলেন। পরে দেশে ফিরে গিয়ে এর জন্য ইলাইজা ইম্পে সাজাও পেয়েছিলেন। শেষ জীবনটা খুব কষ্টে কেটেছিল ইম্পের।

ব্র্যাভো! ইতিহাসে তো তুই লেটার পাবি রে। পার্থ চমৎকৃত, তা এই ইলাইজা ইম্পের বাড়ির চারদিকে ছিল এক বিশাল পার্ক। সেখানে হরিণটরিনও থাকত। লোকে বলত ডিয়ার পার্ক। উঁচু পাঁচিল ঘেরা ওই পাৰ্কটার জন্য কবরখানার রাস্তার নাম বদলে হয় পার্ক স্ট্রিট। তারপর ধর, এখন বেলেঘাটায় যেখানে কমার্শিয়াল ট্যাক্স অফিস, ঠিক ওইখানটায় ভিজিয়ানা গ্রামের মহারাজার প্রাসাদ ছিল। সেই প্রাসাদটারও ইতিহাস কম ইন্টারেস্টিং নয়। অরিজিনালি ওটা ছিল কালীপ্রসাদ দত্তর বাগানবাড়ি। তিনি বাড়িটি দান করেন এক মহিলাকে। সেই মহিলাকে বিয়ে করেন মুন্সিবাজারের মালিক মুন্সি আমির। তাদের বংশধর বাড়িটাকে বেচে দেয় ভিজিয়ানাগ্রামের রাজাকে। ওই বাড়ির দু-তিনটে বাড়ি পরেই আছে মুন্সি আমিরের বংশধর শেখ নবাব হোসেনের বাগানবাড়ি…

তুমি থামবে? মিতিন আর চুপ থাকতে পারল না, তুমি যে আজকাল মন দিয়ে কলকাতার ইতিহাস পড়ছ, আমরা বেশ মালুম পাচ্ছি। কিন্তু এবার যে তোমায় একটু গাত্ৰোত্থান করতে হয়।

কেন?

বাজার যাবে না? মেয়েটা মাসির বাড়ি বেড়াতে এসে শুধু জ্ঞান খেয়ে পেট ভরাবে?

পাৰ্থ তড়াক করে লাফিয়ে উঠল, কী রে টুপুর, কী খাবি আজ? চিকেন? মাটন? ইলিশ? চিংড়ি?

টুপুর লজ্জা-লজ্জা মুখে বলল, আনো না, যা হয় কিছু।

আজ তবে চিংড়ির মালাইকারি হোক। আর কষা কষা মাটন।

হোক।

রাঁধব কিন্তু আমি। একেবারে নিজস্ব কায়দায়। মোগলাই ঘরানায়। তোর মাসিকে বলে দে, সে যেন একদম নাক গলাতে না আসে।

আমার ভারী বয়ে গেছে। মিতিন একগাল হাসল, ভালই হল। আজ তা হলে ঝাড়া হাত-পা হয়ে ঘরদোরগুলো একটু গুছিয়ে ফেলি। টুপুর তো আছে, আমায় হেল্প করবে।

মিতিনমাসির কোনও কাজে সহকারী হতে টুপুরের কণামাত্র আপত্তি নেই। সে গোয়েন্দাগিরিই হোক, কি নিছক ঘরোয়া কাজ। সত্যি বলতে কী, এই জন্যই না গরমের ছুটি পড়তে না-পড়তে মিতিনমাসির বাড়ি চলে আসা। সর্বক্ষণ মিতিনমাসির গা-ঘেঁষে থাকবে, প্রতি পদে কিছু না কিছু শিখবে, আর এর মধ্যে যদি জম্পেশ একটা কেস এসে পড়ে তো কথাই নেই, ছুটিটা সার্থক হয় টুপুরের। গত বছর সারান্ডা বেড়াতে গিয়ে দারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেই চোরা হাতিশিকারিকে ধরার কথা মনে পড়লে এখনও টুপুরের গায়ে কাঁটা দেয়।

এ-বছর অবশ্য বেরোনোর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। পার্থমেসোর প্রেসে হুট করে অনেক কাজ এসে গেছে, এখন পার্থমেসোর পক্ষে দুতিন দিনের জন্যও কলকাতা ছাড়া অসম্ভব। আর টুপুরের বাবা তো এ বছর বেজায় ব্যস্ত। ইউনিভার্সিটির হেড এগজামির্নার হয়েছেন অবনী, রাশি-রাশি দর্শনের খাতা সামলাচ্ছেন, পরীক্ষকদের বাড়িতে ডেকে ডেকে খাতা বিলি করছেন, এখন তাকে কে নড়াবে! টুপুরের মারও শরীরটা ভাল যাচ্ছে না, হাঁটু কোমরের ব্যথা বেশ বেড়েছে। গরমের ছুটিটা কলকাতায় কাটানো ছাড়া টুপুরের এবার কোনও উপায় নেই।

পার্থ চা খেয়ে বেরিয়ে গেল বাজারে। মিতিনও কাজে নেমে পড়েছে। টুপুরকে নিয়ে। বসার ঘরের জিনিসপত্র বেশিদিন একভাবে রাখা পছন্দ করে না মিতিন, তাতে নাকি একঘেয়েমি এসে যায়। মাসি-বোনঝি ধরাধরি করে ঘোরাচ্ছে সোফাগুলো। সোফাকভারগুলোও খুলে ফেলল মিতিন। অন্য আর-এক সেট লাগাবে। তিনখানা পাতাবাহারের টব রাখা আছে বাইরের ঘরে, সেগুলোকেও ঠাঁইনাড়া করল। এখানে-সেখানে বসিয়ে দেখছে, মানাচ্ছে কি না।

কাজের মাঝেই ডোরবেল। দরজা খুলতেই হা-হা রবে ঢুকে পড়ল বুমবুম। সঙ্গে ভারতী। এ বাড়িতে মাস তিনেক হল কাজে ঢুকেছে ভারতী। ক্যানিং লাইনের ঘুটিয়ারি শরিফের মেয়ে। বয়স বছর কুড়ি। তেমন একটা চটপটে নয় বটে, তবে বুদ্ধি আছে। বেশ তাড়াতাড়ি শিখে নিচ্ছে কাজকর্ম। বুমবুমের সঙ্গে তার মোটামুটি পটেও গেছে। বুমবুমের স্কুল, কুংফু-ক্যারাটে ক্লাস, বিকেলের পার্ক, সর্বত্রই সে পাঁচ বছরের বুমবুমের ছায়াসঙ্গী।

বুমবুম হাহ্ হুহ হাহ্ হুহ করে ক্যারাটে প্র্যাকটিস করে চলেছে। টুপুর জিজ্ঞেস করল, কী রে, তোর না সাড়ে নটা অব্দি ক্লাস? সওয়া নটার মধ্যে চলে এলি যে?

 বুমবুম কিম্ভূত পোজ করে শূন্যে পা ছুড়ল, আজ আমায় তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে দিল।

সঙ্গে-সঙ্গে ভারতী হাউমাউ করে উঠেছে, না গো বোন, মিছে কথা। ওকে তো আজ কেলাস থেকে বের করে দিয়েছে।

সে কী? কেন?

 হাত-পা ছোড়া খেলতে খেলতে একটা ছেলের পেটে ক্যাঁত করে ঘুষি মেরে দিয়েছিল।

ও মা, তাই? মিতিনের ভুরু জড়ো হল, কেন মেরেছ বুমবুম?

মারিনি তো। বুমবুমের চটজলদি জবাব, কুংফু-ক্যারাটের সঙ্গে দীপকে একটু বক্সিং শেখাচ্ছিলাম।

দাড়াও, এবার আমি তোমাকে ওঠ-বোস করা শেখাচ্ছি।

শুনেই বুমবুম সামনে থেকে ধাঁ। তাকে পাকড়াও করতে পিছনে ধাওয়া করেছে মিতিন। টুপুর আর ভারতী ফিক ফিক হাসছে।

তখনই ফোনটা বেজে উঠল। টুপুর গিয়ে রিসিভার তুলেছে, হ্যালো?

ওপারে এক পুরুষকণ্ঠ, এটা কি পার্থপ্রতিম মুখার্জির বাড়ি?

হ্যাঁ। কিন্তু উনি তো নেই এখন। বেরিয়েছেন।

কখন ফিরবেন?

বাজারে গেছেন তো, আধঘণ্টা-চল্লিশ মিনিট দেরি হবে।

ও।

 ফিরলে কিছু বলতে হবে?

হ্যাঁ, মানে…না, মানে… আমি একটু পরে আবার ফোন করছি। আপনার নামটা জানতে পারি?

উৎপল। একটুখানি থেমে রইল গলাটা। তারপর কেটে-কেটে বলল, উৎপল ক্রিস্টোফার বিশ্বাস। আমি আর পার্থ একসঙ্গে কলেজে পড়তাম।

ও, আচ্ছা। আমি মেসোকে নিশ্চয়ই বলব।

ফোনটা রেখে দিতে যাচ্ছিল টুপুর, ও প্রান্ত আবার বলে উঠল, আচ্ছা, পাৰ্থর মিসেস কি বাড়ি আছেন? আই মিন, যাঁর ডিটেকটিভ এজেন্সি আছে?

হ্যাঁ হ্যাঁ, উনি আছেন। টুপুর ঝটপট বলে উঠল, ডেকে দেব?

প্লিজ। যদি না উনি খুব বিজি থাকেন।

এক মিনিট ধরুন।

রিসিভার সন্তৰ্পণে ক্ৰেডলে নামিয়ে রাখল টুপুর। মিতিনমাসি তাকে শিখিয়েছে বাইরে থেকে ফোন এলে এভাবেই নামিয়ে রাখতে হয় রিসিভার। এতে লাইনও কাটে না, এপারের কথাও শোনা যায় না ওপারে।

ছুটে টুপুর পাশের ঘরে এল। সেখানে চলছে এক আজব দৃশ্য। মিতিনমাসি আর বুমবুম যুগলে ওঠ-বাস করছে। মিতিনমাসির হাত দুটো শক্ত করে ধরে আছে বুমবুমের কান, অপমানে চোখ দিয়ে টপটপ জল পড়ছে বুমবুমের।

টুপুর হাসতে গিয়েও হাসল না। মিতিনকে তাড়া লাগাল, মিতিনমাসি, তোমার টেলিফোন।

কে?

মেসোর কলেজের এক ক্রিস্টান সহপাঠী।

তো আমি কী করব? বলে দে মেসো বাজারে গেছে।

বলেছি। মেসো নেই শুনে তোমাকেই ডেকে দিতে বলল, মনে হল দরকারটা তোমারই সঙ্গে।

কী করে বুঝলি?

 ডিটেকটিভ এজেন্সি সংক্রান্ত উৎপলের প্রশ্নটা চেপে গেল টুপুর। কায়দা করে বলল, ধরে নাও গেস। আমার সিক্সথ সেন্স বলছে।

বটে?

বুমবুমকে মুক্তি দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে এসে রিসিভার ওঠাল মিতিন। শান্ত স্বরে বলল, বলুন? আমি পাৰ্থর স্ত্রী বলছি।

ও আচ্ছা, নমস্কার। কিন্তু পার্থ তো…

…।

 আমার সঙ্গে দেখা করবেন?

..।

কী হয়েছে? প্রবলেমটা কী?

…।

ও। ঠিক আছে, চলে আসুন। আপনি কি বাড়ির ঠিকানাটা জানেন?

…।

হ্যাঁ হ্যাঁ, ঢাকুরিয়ায়। সতেরোর তিনের বি, বাবুবাগান লেন। একতলায়।

…।

হ্যাঁ, ঢাকুরিয়া বাসস্ট্যান্ডের কাছেই।

…।

এগারোটা নাগাদ আসবেন? নো প্রবলেম।

…।

নমস্কার।

ফোন রেখে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল মিতিন। অস্ফুটে বলল, গান বাজছিল। এলটন জন।

টুপুর সায় দিল, হ্যাঁ হ্যাঁ, একটা ইংলিশ টিউন কানে আসছিল বটে।

যে-সে গান নয়। সেই বিখ্যাত গানটা। প্রিন্সেস ডায়ানা মারা যাওয়ার পর এলটন জন যেটা কম্পাজ করেছিলেন। বলেই টুপুরকে প্রশ্ন, আর কিছু টের পেয়েছিস?

কী বলো তো?

 কুকুর আছে বাড়িতে। সম্ভবত ল্যাপ ডগ। ডাক শোনা যাচ্ছিল।

তাই?

হুঁ।

কিন্তু ভদ্রলোক হঠাৎ তোমার কাছে আসছেন কেন?

নিশ্চয়ই কোনও কারণ ঘটেছে।

তুমি কি কোনও রহস্যের গন্ধ পাচ্ছ?

মিতিন হেসে ফেলল, ওরে, ডিটেকটিভগিরি করি বলে কি সবই আন্দাজ করা যায়? তবে ভদ্রলোকের গলাটা একটু উদ্বিগ্ন লাগছিল। প্লাস, ওই উৎপল নিশ্চয়ই তোর মেসোর প্রাণের বন্ধু নয়, সম্ভবত নিয়মিত যোগাযোগও নেই। তেমন হলে তো আমি চিনতামই। এমন একজন খামোখা আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইবেই বা কেন? সমস্যা একটা হয়েছে তো বটেই।

তার মানেই ডালমে কুছ কালা হ্যায়!

দাঁড়া, আগে ডালটাকে দেখি। তবে না বুঝব।

 টুপুরের মনটা নেচে উঠল। গরমের ছুটিটা এবার তা হলে পুরোপুরি বিফলে না-ও যেতে পারে। বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়তেও পারে।