০৭. পৃথিবী শুধু জল আর মাটি নয়

পৃথিবী শুধু জল আর মাটি নয়। সমুদ্র বন পাহাড়-এর মধ্যেই পৃথিবীর সীমানা শেষ নয়। তার একটা ঊর্ধ্বলোক আছে। আকাশে মাধ্যাকৰ্ষণ যতদূর ততদূর তার সীমানা। আবার মাটির বুকের ভিতরে অন্ধকার গহ্বরে তার একটা অধোলোক আছে। সেই মাধ্যাকর্ষণের কেন্দ্র পর্যন্ত বিস্তৃত। বিচিত্র ভাবে এই মাটির তলায় যে বীজ ফাটে, সে মাধ্যাকর্ষণধূত থেকেও উপরের দিকে মাথা ঠেলে ওঠে। গাছের মূল থাকে মাটির নিচে, ফুল ফোটে আকাশে। পাখি ডানা মেলে আকাশে ওড়ে। আকাশে উঠে আরও আরও উপরে উঠতে চায় কিন্তু তার নীড় মাটির বুকে আটকানো গাছের ডালে, সেখানে তাকে নামতে হয়। সরীসৃপ থাকে মাটির বুকের অন্ধকার গহ্বরে; তাকে উঠে আসতে হয় মাটির উপরে, বায়ুর জন্য, আহারের জন্য, আলোর জন্য।

কৃষ্ণস্বামীর মন বিহঙ্গের মত আকাশ-বিহারী। আলো, আরও আলোর জন্য সে ডানা মেলেছে। রিনা ব্রাউনই একদিন সেই পাখা-মেলার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়েছিল। আশ্চর্য মানুষের জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের শক্তি, বাবা জেমস ব্রাউনের আঘাতে সেই রিনা ব্রাউন অন্ধকার গহ্বরের সরীসৃপ হয়ে গেল। কৃষ্ণেন্দু বাল্যজীবনে পুরাণে পড়েছিল একজন রাজা কার অভিশাপে অজগর হয়ে গিয়েছিলেন। মায়ের কাছে গল্প শুনেছিল কাজলহারার। কাজলহারা ঠিক রিনার মত স্ফটিকে-গড়া মেয়ে, তার সতীন তাকে জাদুদণ্ডের প্রহারে সাপিনীতে পরিণত করেছিল। ব্ৰাউন। ঘৃণায় অমর‍্যাদার ওই জাদুদণ্ড দিয়ে আঘাত করে তাকে ঠিক সাপিনীই করে দিয়েছে। রিনা উল্কা নয়, সে সরীসৃপ।

কিন্তু পাখিকেও মাটির বুকে নামতে হয়। সরীসৃপকেও মাটির উপরে আসতে হয়। হঠাৎ দুজনে দেখা হয়ে গিয়েছিল। তাই যেন হয়েছিল। কৃষ্ণস্বামীর সঙ্গে রিনা ব্রাউনের এই জীবনের দেখাটা ঠিক যেন তাই। অন্ধকার রাত্রে সরীসৃপরূপিণী রিনা বিহঙ্গ কৃষ্ণস্বামীর নীড়ে এসে বিষনিশ্বাসে গর্জন করে তাকে শাসিয়ে চলে গেল। আর দেখা হল না।

কৃষ্ণস্বামী কয়েকদিন অন্ধকার রাত্রে সরীসৃপের জন্য প্রতীক্ষা করলেন, কিন্তু সে আর এল না। কোথায় কোন দূরে নূতন অন্ধকার বিহারের সন্ধানে সে চলে গেছে।

কৃষ্ণস্বামী পক্ষ বিস্তার করে দিলেন আকাশে। উর্ধ্বে, আরও উর্ধ্বে উঠলেন তিনি। রিনা তার পথে গেছে, তিনি তাঁর পথ চলবেন। শুধু মাঝে মাঝে আকাশচারী বিহঙ্গের মাটির দিকে দৃষ্টি ফেরানোর মত রিনার কথা মনে পড়লে, দিগন্তের দিকে তাকিয়ে, ভগবানের কাছে তার মঙ্গল কামনা করেন। মঙ্গল করো প্রভু। রিনার চিত্তকে সুস্থ করো, শান্ত করো। কুষ্ঠরোগী এসেছিল তোমার কাছে, তুমি তাকে স্পর্শ করেছিলে। সে নবজীবন লাভ করেছিল। তেমনি করে রিনার চিত্তকে সুস্থ করো। বলো, বি দাউ ক্লিন। আবার কিছুক্ষণ পর রিনার চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে কাজের মধ্যে নিজেকে ড়ুবিয়ে দেন। অসময়ে বাইসিক্ল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়ান।

কেমন আছ হে তোমরা সব? অ্যাঁ? মহাশয়রা গো?

ভাল কোথা বাবাসাহেব? খুদ খেয়ে আর বাঁচে মানুষ, প্যাটের ব্যামো ধরে গেল। ছেল্যা। মেয়া ছা-ছিঙুড়ি সব–সব।

দেখছি, দেখছি, এস. ডি. ও-কে বলে দেখছি।

কিরাচিনি তেল আর কাপড়ের কথা বলবা বাবা।

বলব। কিন্তুক এখনই কারুকে হাত-টাত দেখতে হবে নাই তো?

ছুরুক-ছারুক অসুখ, ই আর কী দেখবেন গো?

ওই বাচ্চাটার পিঠে উ দাগটো কিসের বটে হে? দেখি দেখি!

হঠাৎ চোখে পড়েছে একটি ছেলের পিঠে ঘাড়ের কাছে একটি বিবৰ্ণ সাদা দাগ! দেখি রে খোকা, ইদিকে আয়, ইদিকে আয়, শুন শুন।

হা ক্যানেরে, হারামজাদা বজ্জাত! দেখা ক্যানে?

দেখেশুনে বলেন, তাই তো হে মহাশয়, কেমন পারা লাগছেক যেন গো! ইয়াকে তো দেখাতে হয়। নিয়ে যেয়ো ক্যানে আমার উখানে। ভাল করে পরীক্ষা করে দেখব।

আবার রওনা হন। কুষ্ঠের প্রসার দেখে মনে চিন্তিত হন, বেদনা অনুভব করেন। ভুলে যান। অন্য সবকিছু।

নিজের মাইক্রোসকোপ কৃষ্ণস্বামীর গোড়া থেকেই আছে, ছাত্রজীবনে যখন বন্ধুর সঙ্গে তার আওতায় থেকে প্র্যাকটিস করতেন, তখন থেকেই আছে। কম দামে যোগাড় করে দিয়েছিল ক্লেটন। কারবারটা চোরাই মালের তা জেনেই কৃষ্ণেন্দু কিনেছিল। তখন সে ছাত্র-আমলের কৃষ্ণেন্দু। দ্বিধা তার হয় নি। ওটা দিয়ে যখন কাজ করেন কৃষ্ণস্বামী তখন ভগবানের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করে নেন। সঙ্গে প্রণাম করেন মাকে-বাবাকে। মা তার সমস্ত গহনাই দিয়ে গিয়েছিলেন। কৃষ্ণেন্দুকে। সে গহনা বিক্রি করে সে ঠিক করেছিল বিলেত যাবে। তখনই ঘটল রিনার সঙ্গে জীবন দেওয়া-নেওয়া। এবং তার কিছুদিনের মধ্যে সব ওলটপালট হয়ে গেল। সে একটা কালবৈশাখীর ঝড়ের মত। জেমস ব্রাউন বললে—ক্রিস্টান হতে হবে। বাবার পায়ে ধরেও মত পেলে না। উন্মত্তের মত ফিরে এসে রিনাকে জিজ্ঞাসা না করেই ক্রিস্টান হল। রিনা ঘৃণা ও আতঙ্কভরে মুখ ফেরালে—একটি নারীর জন্যে তুমি তোমার এতকালের ভগবানকে ত্যাগ করেছ কৃষ্ণেন্দু? তুমি ভয়ঙ্কর। নানা। কৃষ্ণেন্দু বের হল সেই ঈশ্বরের সন্ধানে—যে ঈশ্বর রিনার কাছে তার চেয়েও বড়—পৃথিবীর সবকিছু থেকে বড়। টাকাটা থেকেই গিয়েছিল ব্যাংকে।

আগেকার কৃষ্ণেন্দু ছিল মায়ের গোপাল। সংসারের সব জিনিসে ছিল তারই অগ্র অধিকার। সে নিতেই জানত, দিতে জানত না। শেখে নি। প্রথম দিতে শিখল, রিনার হাতে নিজেকে দিয়ে। রিনা তাকে ঠেলে দিল ঈশ্বর সন্ধানের পথে। বৈজ্ঞানিক যদি বলে ফাস্ট্রেশনের পথে তো বলুক, সে একটু হাসবে, প্রতিবাদ করবে না।

থাক রিনার কথা। তার কথা ভাবতে ভাবতে সময়ে সময়ে মনে হয়, রিনা জন্ম থেকেই বোধহয় পেয়েছিল ঈশ্বরকে; তাকে ফিরিয়ে দেবার সময় তার সেই ঈশ্বরকে নাস্তিক কৃষ্ণেন্দুকে দিয়ে নিজে কাঙাল হয়ে গেল। হিন্দুপুরাণ মহাভারতের কর্ণের কথা মনে পড়ে। তার মায়ের নাম ছিল কুন্তী। কুন্তীর কুমারী-জীবনের সন্তান কর্ণ কবচকুণ্ডল নিয়ে জন্মেছিল। রিনার জন্মগত ঈশ্বরবিশ্বাসও তাই। কৰ্ণ কবচকুণ্ডল দান করে মৃত্যুবরণ করেছিল। রিনা ঈশ্বরবিশ্বাস তাকে দিয়ে তামসী হয়ে গেল। ঈশ্বর তার মঙ্গল করুন। হে ঈশ্বর, তার জীবনের কবরখানাকে জীবনময় করে তুলে তুমি নূতন করে জাগো। মানুষের প্রাণশক্তির শুভবুদ্ধি, তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকার আলো, হে ঈশ্বর, তুমি জাগ্রত হও। তোমার হাতে রিনাকে সমর্পণ করে কৃষ্ণস্বামী নিশ্চিন্ত। তার কল্যাণের জন্যই কৃষ্ণস্বামী নিঃশেষে নিজেকে সমর্পণ করবে তোমার পায়ে, তোমার কর্মে। অন্তরে কুষ্ঠরোগগ্ৰস্ত রিনাকে নীরোগ কর তুমি; কৃষ্ণস্বামী তোমার সংসারে কুষ্ঠরোগীর সেবা করে তোমাকে সেবা করবে।

এবার কৃষ্ণস্বামীর বাবার কথা মনে পড়ে যায়। স্বল্পবাক, নির্লিপ্ত মানুষ। আশ্চর্য কঠিন। তবুও তিনি তাঁর সম্পত্তি-বিক্রি-করা টাকা তাঁকেই দিয়ে গেছেন। এক কথায় কৃষ্ণেন্দুকে বলেছিলেন, যাও। প্রয়োজন নেই তোমাকে। বৃন্দাবনে চলে গিয়েছিলেন ঠাকুর নিয়ে। সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করেছিলেন। কিছু টাকা এবং ঠাকুরটি মঠে দিয়ে গেছেন। নিজের জীবনের জন্য সামান্য টাকাই খরচ করেছিলেন। বাকি তের হাজার কয়েক শো ব্যাংকে রেখেছিলেন, উকিলকে বলেছিলেন, কৃষ্ণের খোঁজ করে টাকাটা দিতে। সেটা কৃষ্ণস্বামী পেয়েছেন। তাই থেকেই চলে আশ্রম। এবার আশ্রমটিকে কুষ্ঠ হাসপাতাল করে তুলবেন তিনি। কিছুদিনের মধ্যেই প্রথমে একটা কুষ্ঠরোগীর ডিসপেনসারি খুললেন কৃষ্ণস্বামী। আউটডোর।

রিনার মঙ্গল হোক। এই কর্মের মধ্যে রিনার আকর্ষণ ছিন্ন করে দাও।

লাল সিং সিন্ধু সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। বাবাসাহেব! ই ত ভাল হচ্ছে নাই।

কৃষ্ণস্বামী হাসেন। মধ্যে মধ্যে প্রশ্ন করেন, তোমারও ভয় লাগছে লাল সিং?

লাল সিং মৌন থেকে জানায়, হা লাগছে।

সিন্ধু স্পষ্ট বলে, হ্যাঁ বাবাসাহেব। মহাব্যাধিকে ভয় কার নাই বলেন? হা—আপনকার নাই বটে। তা আপনার পুণ্য আছে, আমাদের তা নাই! কী করব কন?

বর্বরা ঝুমকি ভয় করে না। ঘৃণা করে। বলে, বড়া খারাপ বাসায়। গন্ধ কী! উঃ, আর কী হয়ে যায়—হাক থু!

মধ্যে মধ্যে সেই আমেরিকান মিলিটারি অফিসারটি আসে। এখন আর হে ম্যান বলে না। বলে, মর্নিং রেভারেন্ড!

মধ্যে মধ্যে সে রিনার খবরের কথা তোলে। বলে—ডোন্ট নোহোয়ার শি ইজ গন। শি ওয়াজ ওয়ান্ডারফুল! হঠাৎ সেদিন বললে,-শুনলাম আসাম ফ্রন্টে ঘুরছে। ঠিক তো বলা যায়। না। তবে অনেকটা মেলে সেই ডেয়ার-ডেভিল মেয়েটার সঙ্গে।

আসাম?

ইয়েস। গৌহাটি-শিলং। চিটাগং। জাস্ট লাইক হার, লাইক এ শুটিংস্টার।

সেই মুহূর্তে ঝুমকি এসে দাঁড়াল,–বাবাসাহেব!

অফিসারটি বুভুক্ষু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালে—এ যে কৃষ্ণমর্মর-মূৰ্তি রেভারেন্ড!

কৃষ্ণস্বামী মনে করিয়ে দেন, এটি আসলে একটি চার্চ, মিস্টার অফিসার!

সামনে যুদ্ধ। মাথার উপর মৃত্যুর পরোয়ানা যাদের, তারা যত উদ্দাম তত ভীরু। ঈশ্বরের রোষকে ভয় না করে পারে না। অন্তত ঘটাতে চায় না ঈশ্বরকে। গায়ে ক্রশ এঁকে সরে যায়।

 

কৃষ্ণস্বামী লাল সিংকে ডেকে পরদিন বললেন, লাল সিং, আমার শরীরটা বড় খারাপ মনে হচ্ছে, আমি কিছুদিন বাইরে যাচ্ছি।

কোথা যাবেন বাবাসাহেব? আপনি না থাকলে ইখানে আমরা কী করে থাকব?

পনের কুড়ি দিন। তার বেশি নয়। তোমরা গ্রামের মধ্যে যেমন থাক থাকবে।

পঁচিশ দিন পর ফিরে এলেন কৃষ্ণস্বামী। শরীর সারে নি, বরং শীর্ণ হয়েছে। সিন্ধু বললে, শরীর যে খারাপ করা এলেন বাবাসাহেব!

অনেক ঘুরেছি সিন্ধু। অনেক কাল ইখানেই থেকে মনটা হাঁপিয়ে ছিল। ছাড়া পেয়ে খুব ঘুরলাম। সেই একেবারে যুদ্ধের লাগালাগি জায়গাতে। শিলং গৌহাটি, ইখান-সিখান। ঘুরে ঘুরে শরীর খারাপ হবে বৈকি! তবে হ্যাঁ, মনটা ভাল হইছে।

চট্টগ্রাম থেকে গৌহাটি পর্যন্ত যুদ্ধের লাইনের স্থানগুলিতে খবর নিয়ে ফিরেছেন। হ্যাঁ, খবর পেয়েছেন। ঠিক এমনি একটি মেয়ে ছিল। সে মরেছে। কেউ তাকে খুন করে গৌহাটি থেকে শিলঙের পাহাড়ের পথে একটা খাদে ফেলে দিয়েছিল।

সম্ভবত কোনো নিষ্ঠুর সৈনিক। রিনার উদ্ধত ব্যবহারে ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে মেরে ফেলে। দিয়েছে। পোস্টমর্টেমে জানা গেছে, তার পেটে ছিল মদ, আর জানা গেছে যে, হতভাগিনী কদৰ্যব্যাধিগ্রস্তা ছিল।

নিশ্চিন্ত হয়েছেন কৃষ্ণস্বামী। রিনা তার জীবনের পাওনা-গঙা বুঝে নিয়ে চলে গেছে অথবা নিষ্ঠুর মূল্য দিয়ে এই উল্কা-জীবনের দেনা কড়ায়-গায় মিটিয়ে দিয়ে গেছে। পুলিশ বিভাগ তার কোনো পরিচয় পায় নি। কৃষ্ণস্বামীকেই তারা প্রশ্ন করেছিল, জানতেন নাকি একে?

না। এ সে নয়।

এই জবাব দিয়েই কৃষ্ণস্বামী চলে এসেছেন। মিথ্যা বলেন নি, এ সে নয়। কিন্তু ঈশ্বর, তুমি কেন তাকে দয়া করলে না! ভাল—তার বিচারের সময় তুমি তাকে দয়া কোরো। এইবার, হে ঈশ্বর, তোমার সেবায় আমাকে মগ্ন করে দাও। সেই সঙ্কল্প নিয়েই ফিরেছেন। কলকাতা থেকে অনেক কষ্টে ওষুধপাতিও কিনে এনেছেন। সেগুলো সেই দিনই সাজিয়ে ফেললেন। ড়ুবে গেলেন এই সেবাকর্মে।

* * *

বছরখানেক পর একদিন সকালে ঝুমকি এসে দাঁড়াল।

বাবাসাহেব!

কী?

লাল সিং কাল রেতে চলে গৈছে।

চলে গৈছে? সে কী? কোথা গৈছে?

কে জানে? সি উয়ারা জানে। বুললে, কুঠ নিয়ে কারবার করে সাহেবের কুঠ হল, আবার থাকে? চল সিন্ধু, পালিয়ে বাঁচি।

কী বললে? কার কুঠ হয়েছে?

ক্যানে, তুর হয়েছে!

বিস্ময়-বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন কৃষ্ণস্বামী। তাঁর কুষ্ঠ হয়েছে? কয়েক মুহূর্ত পরে তার বুদ্ধি সক্রিয় হল। কোথায়? কই?

নিজের আঙুলগুলি চোখের সামনে মেলে ধরলেন। ছোট আয়না দেওয়ালে টাঙানো ছিল, সেখানার সামনে দাঁড়ালেন। কই? কোথায়?

ঝুমকি বললে, ঊই। উঁহুঁ। যেমন দাগ দেখে তু বলিস–কুঠের লক্ষণ ইটা, তেমনি চাকাপরা দাগ একটো হইছে যে তুর। পিছা দিকে। তু দেখবি কী করে?

কোথায়?

কৃষ্ণস্বামীর জামাটা তুলে পিঠের এক জায়গায় আঙুল দিয়ে ঝুমকি বললে, এই যি! এইটো! কি বেটে ইটো? অ?

স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন কৃষ্ণস্বামী। পা থেকে মাথা পর্যন্ত একটা বিচিত্ৰ অনুভূতি সঞ্চারিত হয়েছে। তিনি যেন খানিকটা অবশ হয়ে গেছেন। আঘাত পেয়েছেন তিনি। এর জন্য প্রস্তুত তিনি ছিলেন না। এর সম্ভাবনা ছিল না এমন নয়, তবু যখন সত্য সত্য এল, তখন সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছে; বড় কষ্ট হচ্ছে। হয়েছে। ঝুমকি যেখানটায় আঙুল দিয়েছে সেখানকার সাড় নেই, ঝুমকির আঙুলের স্পর্শ তিনি বুঝতে পারছেন না।

রিনা! রিনার জন্য কোনো কিছু যেন মনের মধ্যে ধরা পড়ে নি। মন ওইদিকে এমনই ব্যর্থ ছিল যে, অন্য দিকের সবকিছুই চোখের উপর দিয়েই তার অলক্ষ্যে চলে গেছে।

মস্তিষ্কের মধ্যে কোষে কোষে বেদনার আবেগ ভূগর্ভবদ্ধ আগুনের মত ফেটে বেরুতে চাচ্ছে। কৃষ্ণস্বামী পাহাড়ের মত তাকে নিজের মধ্যে রেখেছেন। কাঁপতে দেবেন না। ফাটতে দেবেন না। আগুন ধরিত্রীগর্ভে প্রাণের উত্তাপে পরিণত হোক। প্রাণকোষে কোষে সে-আগুন সহস্ৰ প্ৰদীপশিখার মত জ্বলে উঠুক আনন্দ-দীপালিতে ভগবানের আরতিতে।

অনেকক্ষণ পর তিনি আত্মস্থ হয়ে বললেন, আমি বাঁকুড়া যাচ্ছি ঝুমকি।

বাঁকুড়ায় নূতন কী বলবে? বলবে, ব্যাধি সংক্রামিত হয়েছে। অনিবার্য এসেছে। এর পর? কোথায় যাবেন, ব। করবেন?

হ্যাঁ, এসেছে। কার্যকারণের পরিণাম! কৃষ্ণস্বামীকে তিরস্কারও শুনতে হল। এইভাবে সংঘবদ্ধ বৈজ্ঞানিক চেষ্টার বাইরে একক চেষ্টা করার অনিবার্য পরিণাম।

চুপ করেই গেলেন কৃষ্ণস্বামী। শুধু একটি হাস্যরেখা ধীরে ধীরে তার মুখে ফুটে উঠেছিল।

লর্ড, আই ক্রাই আন্টু দি : মেক হেস্ট আন্টু মি।

চিন্তার খুব কারণ আছে বলে মনে করি না। কিন্তু আর তো এইভাবে লোকের চিকিৎসা করে বেড়ানো ঠিক হবে না আপনার

নিশ্চয়। এ তার নির্দেশ। আসতে আসতে ভেবেছি আমি। আমি চলে যাব। কুম্ভকোণম লেপার অ্যাসাইলামে। সেখানে আমার চিকিৎসাও হবে, আমি ডাক্তার হিসেবে কিছু কাজও করতে পারব।

গড বি উইথ ইউ।

মান্দ্রাজ উপকূলে কুম্ভকোণম কুষ্ঠাশ্ৰম। বিরাট কুষ্ঠাশ্ৰম। নিপীড়িত ভগবানের সেবায়তন। আজ মনে পড়ল রিনা ব্রাউনকে। স্ফটিকে গড়া মূর্তির মত পবিত্র কুমারী রিনা ব্রাউন, আসানসোলের চার্চইয়ার্ডে তাকে প্রত্যাখ্যান করার সময় তার ঈশ্বরবিশ্বাসকে, তার ঈশ্বরকে কি এই পথে যেতে নির্দেশ দিয়েছিল? না এই পথ তিনি নিজে বেছে নিয়েছেন?

সেটু এ ওয়াচ, ও লর্ড, বিফোর মাই মাউথ : কিপ দি ডোর অব্ মাই লিপস্। একটা ক্ষুব্ধ বাক্যও যেন কৃষ্ণস্বামী উচ্চারণ না করে।

চল কুম্ভকোণম। শেষ আশ্রম।

***

সত্যের চেয়ে বিস্ময়কর আর কিছু নেই; টুথ ইজ স্ট্রেনজার দ্যান ফিকশন: সত্যে মৃত মানুষও বাঁচে, কল্পনার কাহিনীতে বাঁচালে অবিশ্বাস্য হয়। বাস্তব জগতে বস্তু থেকে প্রাণ কালোর সঙ্গে যুদ্ধ। করে তার সীমানা অতিক্রম করার জন্য যুগ যুগ ধরে ছুটছে, সম্মুখে দিগন্তে আলোর রাজ্য উজ্জ্বল মহিমায় আহ্বান জানাচ্ছে, তবু মানুষের কানের কাছে অবিশ্বাসী বুদ্ধি কূটতর্কে মুখর হয়ে বলছে, আলো নয়, আলেয়া। আলো মিথ্যা, কালোই সত্য। অমৃত কল্পনা, মৃত্যুই সত্য।

আরও আট মাস পর।

কুম্ভকোণম সেবায়তনে সেদিন ক্লান্ত শরীরে শুয়ে আছেন কৃষ্ণস্বামী। এখানেই তিনি তার স্থান করে নিয়েছেন। সবচেয়ে কঠিন রোগের রোগীদের তিনি চিকিৎসা করেন। তাঁর নিজের চিকিৎসাও হয়। রোগ বেশ খানিকটা বেড়ে গিয়ে এতদিনে তার গতি রুদ্ধ হয়েছে। নাকের পেটি ঈষৎ স্ফীত হয়েছে; মুখে, কপালে, গালে, অসুস্থ রক্তাভ মসৃণতা দেখা দিয়েছে; কানের পেটি দুটিও ফুলেছে। হাতের আঙুল ঠিক ফোলে নি, তবে তৈলাক্ত হাতের আঙুলের মত দেখায়। প্রথমদিকে দ্রুতবেগেই বেড়েছিল। এখন রোগের গতি রুদ্ধ হয়েছে।

এদিকে কালের পটভূমিতে বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেল।

যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে। ভারতবর্ষে বিস্ময়কর রাজনৈতিক বিপ্লব ঘটল। স্বাধীন হচ্ছে। ভারতবর্ষ। বিভক্ত হচ্ছে ভারতবর্ষ। কৃষ্ণস্বামী দেখেন আর নিত্য বলেন, এ জয় তোমারই জয়! মানুষের মধ্যে সত্যের তপস্যাই তুমি। তোমারই জয়। যা হচ্ছে তার মধ্যে ছলনা মিথ্যা যতই থাক মানুষের, তার চেয়েও বেশি আছে তোমার দেওয়া সত্যের তপস্যা। আমি জানি। রিনার জীবনের পাপ বড় নয়, প্রায়শ্চিত্ত বড়। আমি জানি। সে জীবন দিয়েছে নিজে। আমাকে দিয়ে গেছে তোমার করুণা। তার আত্মাকে তুমি শান্তি দিয়ে। তার সমস্ত পাপ আমার দেহে ব্যাধি হয়ে তার পাওনা শোধ করে নিক।

ক্লান্ত দৃষ্টিতে নিজের ঘরে খোলা দুয়ারের পথে তিনি সামনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। মনে মনে এই কথাগুলিই বলছিলেন। একজন ডাক্তার এসে বললেন, রেভারেন্ড, একজন ইংরেজ ভদ্রলোক সস্ত্রীক এসেছেন আপনার সঙ্গে দেখা করতে। আমি বলেছি আপনার শরীর অসুস্থ, কিন্তু তিনি বললেন, অনেক দূর থেকে আসছেন, এবং বললেন, বলবেন, আমার নাম জনি, জন ক্লেটন!

জন ক্লেটন! বিস্ময়ে চমকে উঠলেন কৃষ্ণস্বামী। জন ক্লেটন সস্ত্রীক তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে এই লেপার অ্যাসাইলামে! কই? কোথায়?

দূরে দেখা গেল শ্বেতাঙ্গ দম্পতি আসছে। কিন্তু–কিন্তু—এ কে? একি হল?

অকস্মাৎ ঘরগুলো দুলতে লাগল, পায়ের তলায় মাটি যেন দুলছে। সামনের গাছপালা আকাশ আলো সব যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে, কী হয়ে যাচ্ছে! জ্যোতির্লোকে যেন বিস্ফোরণ হচ্ছে। ক্লেটনের পাশে ও কে? কৃষ্ণস্বামী চিৎকার করে উঠলেন, রিনা!

ক্লেটনের পাশে রিনা! রিনা ক্লেটনের স্ত্রী।

***

হ্যাঁ কৃষ্ণেন্দু। আমি। আমাকে দেখে তোমার বিস্ময়ের কথাই বটে। কিন্তু তুমি, তুমি আমাকে আশ্চর্যভাবে অশরীরীর মত অনুসরণ করে আমাকে অহরহ ডেকে। কাম ব্যাক্ কাম ব্যাক, ফিরে এসো, ফিরে এসো বলে ডেকেছ। ফিরতে চাইলাম পালিয়ে গেলামও এলাকা ছেড়ে। কিন্তু কে আমাকে হাত বাড়িয়ে দেবে? কার হাত ধরে আমি আবার মানুষের হৃদয়ের রাজ্যে প্রবেশ। করব? তোমার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু পারি নি। ভয়ে পারি নি আমি গুলি করে

চুপ করে গেল রিনা। উচ্চারণ করতে পারল না সে-কথা।

কৃষ্ণস্বামীর বিস্ময় কেটে আসছে।

রিনা বললে, তুমি বলেছিলে, মানুষের অন্তরে ভগবানের পুত্রকে তার মন্দ বুদ্ধি নিত্য ক্রুশবিদ্ধ করে, নিত্য তিনি নবজীবনে জেগে ওঠেন। অনুভব করলাম এ সত্য। কিন্তু তবু তোমার সামনে যেতে পারলাম না। তোমার সেই ভয়ঙ্কর কথা আমার কানে বাজত। তুমি বলেছিলে, আমি এখানে থাকব টু বি ক্রুশিফায়েড এগেন। তুমি সন্ন্যাসী, তুমি সেইন্ট, তোমার পাশে আমি দাঁড়িয়ে কলুষিত করতে পারি তোমাকে? কিন্তু–

চোখ দিয়ে রিনার জল গড়িয়ে এল।

জন ক্লেটন যেন সেই কৃষ্ণের বন্ধু জনি নয়। অথবা কৃষ্ণস্বামী কৃষ্ণেন্দু নন। জন ক্লেটনও তাঁর সঙ্গে সমভরে কথা বলছে। অবশ্য ক্লেটনও আর সে ক্লেটন নয়। সে পরিণত-বয়স্ক মানুষ। পোড়-খাওয়া মানুষ। প্রথম স্ত্রী বিবাহ-বিচ্ছেদ করে চলে গেছে। যুদ্ধে বন্দি হয়ে দীর্ঘদিন পূর্বাঞ্চলের বন্দিশিবিরে কাটিয়েছে। আজও তার দেহ শীর্ণ। ভিতরে বাইরে আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট দেখা যায়। ক্লেটনের কানের পাশে গুলির দাগ। কপালে সারি সারি রেখা দেখা দিয়েছে। কণ্ঠস্বর তার শান্ত। তার জীবনেও বিরাট পরিবর্তন হয়ে গেছে।

ক্লেটন বললে, যুদ্ধে বন্দি হয়েছিলাম। মুক্তি পেয়ে ফিরে কিছুদিন পর গেলাম কাশ্মীর। শরীরটা একটু সুস্থ হবে। মনে ক্লান্তির সীমা নেই। হঠাৎ কাশ্মীরে দেখলাম রিনাকে। ঝড়ে ডানাভাঙা বোবা-হয়ে-যাওয়া পাখি দেখেছ কৃষ্ণে?

হেসে ক্লেটন বললে, তোমাকে কৃষ্ণেন্দু বলতে বাঁধছে রেভারেন্ড। তুমি সত্যই পবিত্র।

কৃষ্ণস্বামী বললেন, একমাত্র ভগবানই পবিত্র ক্লেটন। যারা জীবনের বেদনাকে তার পায়ে ঢেলে দেবার জন্যে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে থাকে, তাদের উপর তাঁর আলো পড়েই তাদের পবিত্র মনে হয়। নইলে তারাও মানুষ ক্লেটন।

বিচিত্ৰ হেসে তারপর বললেন, আমি ধারণা করেছিলাম, রিনা শিলং ফ্রন্টে। এখানকার একটি আমেরিকান অফিসার বলেছিল—রিনা শিলঙে। সেখানকার কে এক অফিসার তাকে একটি উন্মত্তপ্রায় মেয়ের কথা বলেছিল। তার ধারণা হয়েছিল—সে রিনা। আমি শিলঙে গেলাম। ওকে ফিরিয়ে আনব জীবনে। গিয়ে শুনলাম সে মেয়েটি মরেছে। তাকে কে রাত্রে খুন করে খাদে ফেলে দিয়েছিল।

রিনা সজল চোখে নিৰ্নিমেষ দৃষ্টিতে কৃষ্ণস্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল। সে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, কত খাদে, কত জঙ্গলে, এমন কত হতভাগিনীর জীবন শেষ হয়েছে, দেহ শকুন-শেয়ালে খেয়েছে, মাটির সঙ্গে মিশে গেছে, তার হিসেব নেই। আমারও যেত কৃষ্ণেন্দু যদি সেদিন তোমার সঙ্গে দেখা না হত, যদি তোমার স্মৃতি আমার পিছনে দেবদূতের মত অহরহ না ফিরত—তবে আমারও ওই হত। আমি পিয়ারাডোবা থেকে পালিয়ে গেলাম সেই রাত্রে। সেই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেই ক্যাম্পের দিকে যেতে যেতে গেলাম না। বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড যেন দুলছে, কাঁপছে, ভেঙে পড়ছে; ভেঙেচুরে আর একরকম হয়ে যাচ্ছে। মনে হল ক্যাম্পের মধ্যে আকাশের মেঘের মত পুঞ্জ পুঞ্জ বিরক্তি তিক্ততা জমে উঠেছে ঘুরপাক খাচ্ছে। ওখানকার মানুষগুলোকে বীভৎস কুৎসিত মনে হল। কী যেন মনে হয়েছিল ঠিক বলতে পারব না। তবে ওপথে যেতে যেতে অন্তরাত্মা চিৎকার করে উঠল—না। ওখানে নয়। না–না–না।

দাঁড়ালাম। তারপর দুরন্ত রাগ হল তোমার উপর। ফিরলাম দুরন্ত রাগে—তোমাকে খুন করব। দেখলাম তুমি সেই জলের মধ্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছ পথের দিকে তাকিয়ে। বুঝলাম—আমার জন্যে দাঁড়িয়ে আছ। মুহূর্তে আমি সাহস হারালাম, রাগ হারালাম; কাঁপতে লাগলাম। থরথর করে কেঁপেছিলাম। কেঁদেছিলাম। তারপর ভেবেছিলাম–মুখে রিভলবারের নল পুরে গুলি করে উন্মত্ত যন্ত্রণাজৰ্জর জীবনটাকে শেষ করে দেব। কিন্তু তাও পারলাম না। তুমি পাহারা দিয়ে দাঁড়িয়ে। আশ্চর্য শক্তি তোমার সেই স্থির মূর্তির! আশ্চর্য শক্তি! তারপর তুমি চলে গেলে আমি পালালাম। ছুটে পালিয়েছিলাম মাইলখানেক। তারপর একখানা জিপ পেয়েছিলাম। ব্যাঙ্গুরা এসে ট্রেন ধরলাম। কোথায় যাব? স্থির করলাম অনেক দূরে যাব। অনেক দূরে। প্রচণ্ড উন্মত্ত কোলাহল—ভয়–পাশবিকতার মধ্যে, মরণ নিয়ে খেলার মধ্যে যেখানে ভাববার অবকাশ নেই। আছে মরা আর মারা; আর অবসরের মধ্যে নেশা আছে, খাওয়া আছে—আর আছে উন্মত্ত দেহভোগ। এলাম আসামে। শিলঙে আমি যাই নি–আরও সামনে যুদ্ধক্ষেত্রে চলে। এলাম। যখন পৌঁছলাম,–তার আধ ঘণ্টার মধ্যে হল একটা এয়াররেড। একটা মাটির গর্তে লুকিয়েছিলাম। রেড শেষ হল। তখন পিছু হটার হুকুম হয়েছে। একজন অফিসার আমাকে জিপে নিয়ে নিলে মরণের মুখে ভোগলালসায়। রাত্রের সে অভিজ্ঞতা আমার চিরস্মরণীয়—আমি ভুলব না। অরণ্যভূমের ফাঁকে ফাঁকে জ্যোৎস্না পড়েছিল। আমি দেখলাম একা তুমি সহস্র হয়ে চারি পাশে ঘিরে রয়েছ আমাকে। তারপর চাঁদ ড়ুবল। অন্ধকারে জিপ ওল্টালে অজ্ঞান হয়ে গেলাম। জ্ঞান যখন হল তখন শেষরাত্রি। দেখলাম পড়ে আছি একা, খাদের কিনারায়; আর তুমি আমাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছ। হ্যাঁ, তুমি। নির্ভুল তুমি। আমার পিস্তলটা সঙ্গেই ছিল। আমি গুলি ছুঁড়লাম, তুমি নড়লে না। একবার কাপলে না, ধরেই রইলে মনে হল, বললে—আই অ্যাম হিয়ার টু বি কুশিফায়েড এগেন। আবার অজ্ঞান হয়ে গেলাম। আবার যখন জ্ঞান হল—তখন আমি হাসপাতালে। শুনলাম খাদের ধারে আমি একটা গাছে আটকে ছিলাম! নিচে আড়াই হাজার ফুট খাদ। কিন্তু আমি জানিগাছ সে নয়, হতে পারে না। আজও জানি—সে তুমি। অস্থির অধীর হয়ে উঠলাম। কোথায় যাব? কোথায় গেলে তোমার এই অশরীরী অনুসরণ থেকে রেহাই পাব? ফ্রন্টের আবহাওয়াই ভোগসর্বস্ব মানুষ তখন অসহ্য হয়েছে। তারা যেন রাক্ষস। হ্যাঁ, সমস্ত জীবনের ক্ষুধা পুঞ্জীভূত করে তখন তারা রাক্ষসের মত বুভুক্ষু।

ওদের নাগালের বাইরে দূর-দূরান্তরে পালিয়ে যেতে চাইলাম। ওদিক থেকে আমি চলে এসে পালালাম সিমলার দিকে। সেখান থেকে কত জায়গা। ক্লান্ত শ্ৰান্ত। দেহ ভেঙেছে, মন ভেঙেছে—চাইলাম বিশ্রাম। শুধু মদ খেতাম। আমি তখন কখনও মরে বাঁচতে চাই, কখনও আবার দারুণ ক্ষোভে উল্কার মত ছুটতে চাই। কিন্তু যতবার এগিয়েছি—ততবার ওই খাদের ধারে গাছের মধ্যে তোমাকে দেখার মত, কিছু না কিছুর মধ্যে তোমাকে দেখেছি। পথ আগলে দাঁড়িয়েছ। ওঃ! কতবার ওয়ার-জোনের দিকে অর্ধেক পথে গিয়ে ফিরে পালিয়ে এসেছি এমনিভাবে তোমাকে দেখে। তারপর গেলাম কাশ্মীরে। তখন আমি অর্ধমৃত। কিন্তু তবু রেহাই নেই। পিছনে লাগল বুভুক্ষু সৈনিক। একদিন মদ খেয়ে আত্মরক্ষা করতে পারলাম না। মাতাল হয়ে পড়ে গেলাম, একটা নির্জন জায়গায়। দুটো জানোয়ার আমার সঙ্গ নিয়েছিল—তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল।

স্তব্ধ হল রিনা। আর সে বলতে পারছে না।

কৃষ্ণস্বামীও স্তব্ধ হয়ে বসে শুনছেন, গভীর রাত্রে শান্ত সমুদ্রের মত।

ক্লেটন বাকিটা শেষ করলে। ওইখানেই রিনার সঙ্গে আবার দেখা হয়েছিল।

সন্ধ্যার পর সামরিক শাসনের ভয়ে তারা ফিরতে বাধ্য হল। রিনা তখন প্রায় অজ্ঞান, আর শুধু বিড়বিড় করে বকছে আপন মনে। তারা শবের কাছে আনন্দ পায় নি, তাকে ফেলে চলে যাবার সময় তাকে লাথি মারছিল। ক্লেটন আসছিল সেই পথে। সে দেখতে পেয়ে ছুটে যায়। অফিসারস্‌ ব্যাজ দেখে তারা পালায়। ক্লেটন দেখে শিউরে ওঠে।

রিনা! রিনা! হ্যাঁ, এই তো রিনা!

সে ডেকেছিল, রিনা, রিনা!

রিনা বিড়বিড় করে বকেই গিয়েছিল। ওরা যা বুঝতে পারে নিক্লেটনের তা বুঝতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয় নি। রিনা বকছিল, ইট ইজ দি ক, ইট ইজ দি ক, মাই সোল!

আর সন্দেহ থাকে নি, এই রিনা ব্রাউন! রিনাকে সে কাঁধে করেই প্রায় তুলে এনেছিল। বার বার কানে কানে বলেছিল, রিনা মাই ডার্লিং রিনা মাই লাভ, রিনা মাই এঞ্জেল! আই লাভ ইউ, আমি তোমাকে ভালবাসি, আমি তোমাকে ভালবাসি, আমি তোমাকে ভালবাসি।

রিনা চিৎকার করে বলেছিল—লিভ মিলিভ মিলিভ মি কৃষ্ণেন্দু! দি গেটস অব হেভেন উইল বি ক্লোজড টু ইউ ফর মি—ফর মি। আই ডোন্ট লাইক টু গো টু হেভেন। লিভ মি!

এক মাস প্রাণপণে সেবা করে চিকিৎসা করিয়ে রিনাকে সে সুস্থ করে তুলেছিল।

রিনা বিস্মিত হয়েছিল।

ক্লেটন রিনাকে বলেছিল নিজের কাহিনী। তারপর বলেছিল, যৌবনের সে আমি দুঃখের আগুনে পুড়ে গিয়েছে। গ্লানি আবৰ্জনাই পোড়ে, ছাই হয়; যা খাঁটি তা ছাই হয় না, পুড়ে শুদ্ধ। হয়। আমি তোমাকে এইটুকু বলি রিনা, ট্রাই মি, পরীক্ষা করে দেখ আমাকে। আর যদি বল চল তোমাকে কৃষ্ণের কাছে নিয়ে যাই।

চমকে উঠেছিল রিনা।–কার কাছে? না-না-না–। বোলো না, বলতে নেই। সে সেইন্ট!

***

রিনা বললে, কী করব? তোমার পাশে দাঁড়াবার মত শক্তি আমার তখন নেই। আমি ওকেই বিশ্বাস করলাম। এবং সে তো প্রমাণ করলে। সে ভালবাসাকে প্রমাণ করলে। দু-হাত। দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলে। তুমি আমাকে আশীর্বাদ করেছিলে কৃষ্ণেন্দু, আমাকে আশ্বাস দিয়েছিলে। সেটা এল ওর মধ্য দিয়ে। তুমি সেইন্ট কৃষ্ণেন্দু। তুমি সেইন্ট।

তারপর একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, আমার দুঃখ রইল, তোমার এই অবস্থায় তোমার সেবা করতে পারলাম না!

কৃষ্ণস্বামী সামনে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাকিয়ে থেকেই বললেন, এই হয়ত আমার পুরস্কার রিনা। এই দিয়েই তিনি আমার সব অতৃপ্ত কামনা তৃপ্ত করে দিলেন।

এবার হাসলেন, হেসে বললেন, দেখ, আমাদের দেশের শাস্ত্ৰে বলে, একসঙ্গে সাত পা হাঁটলে মিত্ৰতা হয়। আমাদের বিবাহে স্বামী-স্ত্রীতে অগ্নি সাক্ষী করে, সাত পা একসঙ্গে পা ফেলে হটে। কিন্তু যখন ভগবানকে খোঁজে মানুষ, তখন সে একা, কারুর সঙ্গেই সাত পা হাঁটা যায় না। বন্ধুর সঙ্গেও না। একা। সে পথে বিচিত্রভাবে আসে আশীর্বাদ, অভিশাপ! এবং—! সাত পা একসঙ্গে না হটলে সংসারের আনন্দে ফেরা যায় না। তোমরা হেঁটেছ, দোর খুলেছে। সুখে তোমাদের সংসার ভরে যাক। আমার যাত্রা–অ্যালোন! আমি সুখী।

স্তব্ধ হয়ে গেল সকলে।

ক্লেটন সে স্তব্ধতা ভঙ্গ করলে, আমরা আবার আসব। আমি ইংলন্ডে ফিরে যাচ্ছি না। রিনাকে নিয়ে এখানেই ঘর বাঁধব। বার বার আসব।

এখানে থাকবে তোমরা? তা হলে—তা হলে আমি একটা অনুরোধ করব। রিনা, তুমি আমার আশ্রম জান। সেখানে ঝুমকি বলে একটি অনাথা মেয়ে আছে-তাকে তোমাদের সংসারে নিও। আচ্ছা। আর নয়। জন, ইউ আর এ মেডিক্যাল ম্যান। চলে যাও, আর না। গুড বাই! গুড বাই! কেঁদো না, নো-নো-নো। আমি দেখতে চাই তুমি হাসছ। লুক ইন মাই ফেস। দেখ, আনন্দ ছাড়া আর কিছু কি আছে? গুড বাই! গুডবাই! গুড বাই!

দীর্ঘ হাতখানি তুলে দীর্ঘকায় পুরুষটি পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইলেন। স্থির কিন্তু। এ ওদের বিদায় সম্ভাষণ দিচ্ছেন, না শূন্যলোকে অদৃশ্য ঈশ্বরের পা দুটি শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়েছেন—সে কৃষ্ণস্বামীই জানেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *