০৩. কৃষ্ণস্বামী তাঁর আশ্রমে ফিরে

কৃষ্ণস্বামী তাঁর আশ্রমে ফিরে ঘরের মধ্যে চুপ করে বসে ছিলেন। এটা তাঁর পক্ষে অস্বাভাবিক।

ঝুমকি এসে বিস্ময়ে বিস্ফারিত চোখে লাল সিং আর সিন্ধুর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললে, সিং বাবাসাহেবের কী হইছে?

লাল সিং আকাশের দিকে তাকিয়ে কোনো দূরে গর্জমান উড়োজাহাজের সন্ধান করছিল। ঝুমকির কথায় সে ফিরে তাকালে, কী হয়েছে!

বিড়বিড় করে কী বলছে, মন্তরটন্তর বুলছে শুনলাম আমি। ভয়ে পালিয়ে এলাম! চা দিতে পারলাম। তুরা দে গে যা। বাবা রে!

মন্ত্রটন্ত্রের মত কিছু শুনলে ঝুমকির ভয় করে। মনে হয় হয়ত তাকেই ডাইনী ভেবে মন্ত্ৰ আওড়াচ্ছে। দিনের বেলা হলে সে পালিয়ে যায় জঙ্গলের মধ্যে। চুপ করে বসে থাকে ঝোপের ভিতরে খরগোশ-শজারুর মত। অনেকক্ষণ কেটে গেলে ভয়টা ধীরে ধীরে কমে আসে। তখন গুনগুনিয়ে গান করে, তারপর উঠে আসে।

চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে লাল সিং কৃষ্ণস্বামীর ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। সে জানে, মধ্যে মধ্যে বাবাসাহেব বাইবেলের সার্মন আপন মনে বলে যান। সে আপনার কপালে গায়ে প্রথামত আঙুল ঠেকিয়ে আমেন বলে।

সত্যই বাবাসাহেব ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর আপন মনে বাইবেল বলে যাচ্ছেন। বাইবেল নয়, কৃষ্ণস্বামী আবৃত্তি করছিলেন :

It is the cause–it is the cause my soul—
Let me not name it to you, you chaste stars–
It is the cause.
Yet Ill not shed her blood.
Nor scar that whiter skin of hers than snow.

শেক্সপীয়রের ওথেলো থেকে আবৃত্তি করছেন কৃষ্ণস্বামী। আজ রামচরণের বাসা থেকেই ওথেলো মনে পড়ে গেছে। ওই মেয়েটার সঙ্গে কথাবার্তার মধ্যে তিনি ওথেলোর কথা কত ব্যবহার করেছেন।

লেট মি লুক অ্যাট ইওর আইজ। লুক অ্যাট মাই ফেস। পিস অ্যান্ড বি স্টিল। ওই সবই ওথেলো নাটকের সংলাপ।

পেশেন্স, ইউ ইয়ং রোজ-লিপ মেড–

এরও অনেকটা অংশ তাই। আমেরিকান অফিসারটির এসব বুঝবার কথা নয়। খাদ্য-মদ্য-নারী–হুল্লোড়-যুদ্ধাস্ত্র, এ ছাড়া এ-সব বুঝলে যুদ্ধ চলে না। অবশ্য কিছু কিছু উচ্চস্তরের লোক আছে, হয়ত অনেক কবি কলম ছেড়ে কোমরে রিভলভার ঝুলিয়ে রাইফেল কাঁধে এসেছে, কিন্তু তারা ক-জন? তারা অন্তত এমনিভাবে মেয়েটিকে ঘাড়ে নিয়ে বেড়াত না। বেড়ালে বুঝতে হবে তাদের জীবন-সত্য হেসে নাও দুদিন বৈ তো নয় ছাড়া আর কিছুই নয়। বাকি সব তারা মুছে দিয়েছে। হয়ত বা ভুলেই গেছে। রিনা ব্রাউনেরও তাই হয়েছে। অতীত বোধহয় মুছে গেছে। নইলে এমন কী করে হল? সেই রিনা ব্রাউন! আশ্চর্য ওথেলোর সেই অবিস্মরণীয় শব্দগুলি কানে ঢুকল কিন্তু তবু স্মৃতির ঘরের দরজা খুলল না? আশ্চর্য!

না। আশ্চর্যই বা কিসে? মদের নেশায় প্ৰমত্ত রিনা ব্রাউনই–সকল বিস্ময়ের সীমা শেষ। মদের প্রভাব আচ্ছন্ন করে রেখেছিল তার স্মৃতি, বুদ্ধি,–বোধহয় সমস্ত সত্তাকে।

চায়ের কাপটা নামিয়ে দিয়ে লাল সিং সসম্ভ্ৰমে সশ্রদ্ধ পদক্ষেপে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। ফাদার ঈশ্বরকে ডাকছেন।

 

রিনা ব্রাউনের মূল্যের তুলনায় একদিন ঈশ্বরের মূল্যও তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল কৃষ্ণস্বামীর কাছে। তখন তিনি কৃষ্ণস্বামী ছিলেন না। তখন তিনি ছিলেন কালাচাঁদ গুপ্ত। অবশ্য তখন কালাচাঁদ ঠিক ঈশ্বর মানত না। এবং কালাচাঁদ নাম পালটে সদ্য তখন সে কৃষ্ণ ইন্দু-কৃষ্ণেন্দু হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র।

কালাচাঁদ কৃষ্ণের প্রথম নাম। পাহাড়ী নদীর মত বন্য। কালাচাঁদ ঈশ্বরে অবিশ্বাস করত না কিন্তু বিশ্বাস করত নিজের প্রাণশক্তিকে। বন্য পাহাড়ী নদীর মত শুধু প্রাণচঞ্চল বেগবানই নয়—খানিকটা বর্বরও বটে। মেডিক্যাল কলেজে ঢুকবারও আগে।

পল্লীগ্রামের ছেলে। কালো হিলহিলে লম্বা, বড় বড় চোখ, কপাল পর্যন্ত পুরু ঘন চুল, মুখেচোখে পল্লীর সারল্য। পল্লীর কর্কশতায় ঈষৎ মলিন। কিন্তু আশ্চর্য প্রাণবন্ত, বুদ্ধিও তেমনি তীক্ষ। পল্লীগ্রামের নামকরা কামারের গড়া খ্ৰীটি ইস্পাতের দায়ের মত। ধারালো তীক্ষ্ণ অনমনীয় দৃঢ়; কিন্তু শান-যন্ত্রে ঘষামাজা পালিশ-করা ঝকঝকে নয়, একটু ময়লা।

পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতিমান বৈদ্যবংশের সন্তান। কিন্তু সে-খ্যাতি তখন অস্তোনুখ। প্রপিতামহ। এবং পূর্বপুরুষ ছিলেন প্রসিদ্ধ ভিষগাচার্য। আয়ুর্বেদের প্রসার কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবার উৎসাহ কমে গিয়েছিল। তিনি আয়ুর্বেদে মন না দিয়ে মন দিয়েছিলেন চাষবাস ও ধর্মেকর্মে। একমাত্র ছেলেকে ডাক্তারি পড়াবেন এই বাসনা। গ্ৰাম্য ইস্কুলে ম্যাট্রিক পাস করে কালাচাঁদ আই. এস. সি. পড়তে এল কলকাতার সেন্টজেভিয়ার্স কলেজে। আই. এস. সি. পাস করে মেডিক্যাল কলেজে ঢুকবে। সামান্য কৌতুকে হা-হা করে হাসে, দুড়দুড় করে সিঁড়ি ভেঙে নামে, ক্লাসের শতকরা আশিটি ছেলের মাথার উপরে হিলহিলে লম্বা কালাচাঁদের মাথাটা প্রায় ছ ইঞ্চি উঁচু হয়ে উঠে থাকে। অশুদ্ধ গ্রাম্য-উচ্চারণে অসংকোচে কথা বলে। অফুরন্ত কৌতূহল। অহরহই প্রশ্ন কী? কী? ক্যানে? ক্যানে? ক্যানে? তার সঙ্গে গ্রাম্য সুরে টান। শহরের ছেলেরা হাসে। কিন্তু সেসব কালাচাঁদ গ্রাহ্য করে না। সেও হাসে। কখনও কখনও গ্রামে-বসে-শেখা পুরনো ব্যঙ্গকথা বলে শোধ নিতে চেষ্টা করে।

বলে, তোমরা যে আমকে অ্যাঁব বল হে! তা হলে আমাকে কী বল? বলে অট্টহাসি হাসে।

হঠাৎ কালাচাঁদ বিখ্যাত হয়ে গেল। তখন সেন্টজেভিয়ার্সের পুরনো বাড়ি। কলেজের দক্ষিণে প্রশস্ত খেলার মাঠ। সে-মাঠে টিফিনের সময় কলেজের ছেলেরা ফুটবল খেলে। সবই কলকাতার ইস্কুলের ছেলে। মফঃস্বলের ছেলেরা দাঁড়িয়ে দেখে। অন্তত গ্রাম থেকে সদ্য-আগত ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেরা নামতে সাহস করে না। খেলোয়াড়দের সংখ্যা বাইশে আবদ্ধ থাকে না। বাইশ ছাড়িয়ে যায়। কয়েকদিন দেখে, বোধ করি মাস দেড়েক পর, আগস্ট মাস তখন, কালাচাঁদ বারান্দা থেকে নেমে গিয়ে গ্রাউন্ডের ধারে দাঁড়াল। গোল-লাইনের ধারে। টিপিটিপি বৃষ্টিতে পিছল মাঠ। খেলোয়াড়রা বল মারতে গিয়ে পিছলে পড়ে পাকাল মাছের মত চলে যাচ্ছে। হো-হো শব্দে হাসিতে ভেঙে পড়ছে দৰ্শক ছেলেরা। একটা সিক্সইয়ার্ড শট। গোলকিপার বলটি ঠিক জায়গায় রেখে সরে এল। ফুলব্যাক বল কিক করতে গিয়ে পা তুলে পিছলে পড়ে চলে গেল। খানিকটা দূরে। মুহূর্তে কালাচাঁদ পায়ের জুতো খুলে ফেলে ছুটে গিয়ে বলটা কিক করে দিল। নিপুণ খেলোয়াড়ের শক্তিশালী শট, বলটা উঁচু হয়ে গিয়ে পড়ল সেন্টার লাইন পার হয়ে ওধারের হাফব্যাক লাইনের সামনে।

কে হে ছেলেটা? কে হে? খোঁজ পড়ে গেল। কলেজটিমের ক্যাপ্টেন থার্ড ইয়ারের আশু দাস এগিয়ে এলেন। কী নাম? কোথায় খেলেছ? কোন পজিশনে খেল? ম্যাচ খেলেছ?

হ্যাঁ, অনেক ম্যাচ খেলেছি। এতগুলান মেডেল পেয়েছি। সিউড়ি, বর্ধমান, কাঞ্চনতলা, শান্তিনিকেতনে ম্যাচ খেলেছি। পাঁচখানা বেস্ট প্লেয়ারস মেডেল আছে। লেফট আউটে খেলাই। কর্নার কিকে বল গোলে ঢুকিয়ে দোব। ফুলব্যাকেও খেলতে পারি। লেফট ব্যাক সেন্টারেও খেলিয়েছি। গোলে পারি। দেন ক্যানে একটা কর্নার কিক, করে দেখিয়ে দি। দেবেন?

খেলাই মানে খেলিখেলিয়েছি মানে খেলেছি-ক্যানে মানে কেন—হুঁ। লোকে শুনে হাসে কিন্তু কালাচাঁদ একবিন্দু লজ্জা পায় না।

আনো তো হে বলটা! আনো তো!

বলেছিলেন ক্যাপ্টেন। এবং কালাচাদকে কর্নার কিক করতে দিয়েছিলেন।

কর্নার কিকে সত্যই বলটা গোলে ঢুকে গেল। একটা বিচিত্র ভঙ্গিতে বলটা গোলের সামনে। সিক্সইয়ার্ড সীমার ভিতরে এসে বেঁকে গিয়ে একেবারে কোণ ঘেঁষে ঢুকে গেল। সচরাচর এমনটি দেখা যায় না। এটা কালাচাঁদের পা আবিষ্কার করেছিল। সেন্টজেভিয়ার্সের ক্যাপ্টেন অন্তত দেখেন নি। সঙ্গে সঙ্গে কালাচাঁদ টিমের প্লেয়ার হয়ে গিয়েছিল।

কালাচাঁদকে লেফট আউটে খেলতেও দেওয়া হল। হিলহিলে লম্বা কালাচাঁদ পায়ে বল নিয়ে ছুটল। সে ছোটা তীরের মত। একেবারে ওপারে লাইনের ধার থেকে বল মারলে। পড়ল গোলের সামনে। নিজে পা পিছলে পড়লও কয়েক বার। লোকে হাসলে। কিন্তু কালাচাঁদ সে শুনতেই পেলে না, দেখতেই পেলে না। হঠাৎ এক সময় রেগে এসে সেন্টার ফরোয়ার্ডকে বললে, একটা গোলে ঢোকাতে পারলেন না? আমাকে খেলতে দেবেন সেন্টারে?

কালাচাঁদ সেন্টার-ফরোয়ার্ডে এসেই বল ধরে একটু উপরে তুলে গোলকিপারের হাতে যেন ফেলে দিলে। গোলকিপার বল ধরবার জন্য হাত বাড়াল, কালাচাঁদ লাফ দিয়ে বল মাথায় নিয়ে পড়ল গোলকিপারের উপর। পড়ল দুজনেই। কালাচাঁদের হেডে বল গোলে ঢুকে গেল।

দ্বিতীয়বারে গোলকিপার তাকে মারলে। নাক থেকে রক্ত পড়ে জামাটা ভেসে গেল।

মিনিট কয়েক মুহ্যমান হয়ে রইল, তার পরই উঠে দাঁড়াল। মাথার চুলগুলো রক্ত এবং কাদামাখা হাতেই সরিয়ে দিয়ে গ্রাউন্ডের ভিতর নেমে গেল। কিন্তু ক্যাপ্টেন দাস তাকে হাতে ধরে বললেন, না, আজ আর নয়। ঘরে ঘরে মারামারি করে না। কালাচাঁদ আশ্চর্য ছেলে! সে হেসে ফেললে। বললে, কী করে জানলেন আমি মারামারি করব? ওঃ, খুব বুদ্ধি আপনার।

হেসে ক্যাপ্টেন বললেন, আমরাও তো খেলি।

কালাচাঁদ বললে, তা বটে। আমাকে মারলে আমি না মেরে ছাড়ি না।

কালাচাঁদ বিখ্যাত হয়ে গেল কলেজে সেই দিনই। কিন্তু ওখানেই তার খ্যাতির শেষ নেই। দিন দিন খ্যাতি তার বাড়তে লাগল। কিছুদিন, বোধহয় মাসখানেক পরেই, বাঙলার অধ্যাপক ক্লাসে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। বাঙালি অধ্যাপক, সাহিত্যরসিক, সাহিত্যিক। ক্লাসের মধ্যে কে উচ্চকণ্ঠে কবিতা আবৃত্তি করছে। সদ্য-খ্যাতি-পাওয়া কালাচাঁদ আদুরে দুর্দান্ত ছেলের মত দুই ক্লাসের মধ্যে অধ্যাপকের ডায়াসে উঠে কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করে দিয়েছে। পিছনে একটু কথা ছিল। ক্লাসের রোল নম্বর ওয়ান, মৌলালীর কোন মুসলমান নেতার ছেলে–হালিম, ক্লাসে দুর্দান্তপনা করে। দুটি পিরিয়ডের মাঝখানে উঠে ডায়াসের উপর উঠে দাঁড়ায়। অধ্যাপকদের নকল করে ভেঙায়। যা খুশি তাই বকে। বোর্ডে খড়ি দিয়ে কার্টুন অ্যাঁকতে চেষ্টা করে। একটা ক্লাউনের মত। ছেলেরা হাসে। হঠাৎ সেদিন বাঙলার ক্লাসে হালিম নেই, সে বাঙলা পড়ে না। কালাচাঁদ বাঙলা কবিতা আবৃত্তি শুরু করে দিলে,

আজি এ প্রভাতে-প্রভাত বিহগ–
কী গান গাইল রে।
অতিদূর-দূর আকাশ হইতে–
ভাসিয়া আইল রে।

তারপর বললে, শোনো বন্ধুগণ, বয়েজ-বয়েজ-মাই ফ্রেন্ডস্-কমরেড্‌স্‌। কমরেড শব্দটা তখন এসেছে। উনিশশো আটত্রিশ ঊনচল্লিশ সন।

আমি কবিতা আবৃত্তি করছি শোনো। রবীন্দ্রনাথের নিৰ্ব্বরের স্বপ্নভঙ্গ।

কণ্ঠস্বর তার ভাল ছিল না। তার উপর বয়সের গাঢ়তা কণ্ঠস্বরে তখন সদ্য সঞ্চারিত হতে শুরু করেছে। গলাটা তখন ভাঙা-ভাঙা, খানিকটা চেরা-চেরা। কিন্তু সেসব তার খেয়ালও নেই, গ্রাহ্য করে না। সবকিছুতে একটা বিশেষ শক্তিতে সে নিজেকে ঢেলে দিতে পারে, ওই সঞ্চিত। জলরাশির নিম্নগতিবেগের মত, প্রতিটি জলবিন্দুর শক্তি প্রয়োগের মত এর দেহমন দুয়েরই প্রতি অণু পরমাণু যে কর্ম সে করে তাতেই তন্ময় হয়ে যায়। থরথর করে গলার স্বর কাঁপতে লাগল। বিদ্যুৎ শক্তির মত সকল শ্রোতার মনে সঞ্চারিত হল সে আবেগ।

আজি এ-প্ৰভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্ৰাণের পর।

কণ্ঠস্বর তার উচ্চ হতে লাগল। আবেগ যেন পুঞ্জীভূত মেঘের মত আবর্তিত হয়ে চলল। আগাগোড়া মুখস্থ কবিতাটি আবৃত্তি করে শেষ স্তবকে এল।

কী জানি কী হল আজি, জাগিয়া উঠিল প্ৰাণ
দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান।
ওরে
চারিদিকে মোর
এ কি কারাগার ঘোর
ভাঙ ভাঙ ভাঙ কারা আঘাতে আঘাত কর।

বলেই সে লাফিয়ে ডায়াস থেকে নেমে এসে ক্লাসের বন্ধ দরজায় দুম-দুম শব্দে কিলঘুষি মারতে শুরু করে দিল। ছেলেরাও হাইবেঞ্চে চাপড় মারতে শুরু করল।

ঠিক সেই মুহূর্তেই অধ্যাপক ঘরে ঢুকলেন। হেসে বললেন, দ্যাটস নট দি ওয়ে, দ্যাটস। নট দি ওয়ে, মাই ফ্রেন্ডস। ঝরনার জলের কারাগার ভাঙার ধারা আর মানব-হৃদয়ের পক্ষে রুদ্ধ। পথের বাধা ভাঙার ধারা এক নয়। কিন্তু তুমি তো আবৃত্তি ভাল কর কালাচাঁদ!

কালাচাঁদ আর একদফা খ্যাতি লাভ করলে।

সেবার ইন্টার-কলেজিয়েট আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় তাকে পাঠানোও হল। বাঙলা এবং সংস্কৃত প্রতিযোগিতায় আবৃত্তি করলে। প্রাইজ পেলে না, কিন্তু সংস্কৃত আবৃত্তিতে সে প্রশংসা অর্জন করলে। কণ্ঠস্বর তার সবচেয়ে বড় বাধা হয়েছিল, নইলে হয়ত পেত। উচ্চারণের জন্যও তার নম্বর কম হয়ে গেল।

খেলার মাঠ থেকে কলেজ পর্যন্ত; ওদিকে নামজাদা রেস্টুরেন্ট থেকে হোস্টেল পর্যন্ত কালাচাঁদের কণ্ঠস্বরে, গতিবেগে বায়ুস্তর চঞ্চল হয়ে উঠল। কিন্তু বাৎসরিক পরীক্ষায় ফেল হল। ও বললে, অন্য কলেজে চলে যাবে। কলেজ টিমের ক্যাপ্টেন রেক্টরকে বলে ওকে প্রমোশন দেওয়ালেন। রেক্টর ডেকে বললেন, তোমাকে সাবধান হতে হবে কালাচাঁদ। তুমি তো ডাল ছেলে নও। ইউ আর শার্প।

সেদিন কালাচঁদের মনে পড়েছিল তার বাবাকে এবং মাকে।

স্বল্পবাক গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ তার বাবা। পূজা আর অৰ্চনা নিয়ে থাকেন। মুখে-চোখে, আচারে-আচরণে একটি কী যেন আছে। যাতে তার কাছে গেলেই বিমর্ষ হয়ে যেতে হয়। বোধহয় একটি প্রচ্ছন্ন লজ্জার অনুশোচনা। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন। মুখে কিছু বলেন না। শুধু গৃহদেবতার দোরে প্রণাম করবার সময় আশপাশে কেউ না থাকলে বলেন, আমার অক্ষমতাকে তুমি ক্ষমা করো প্রভু! তোমার ভোগ কমাতে হয়েছে—এ দুঃখ আমি তোমাকে ছাড়া কাকে বলব?

মা তার প্রসন্নময়ী। মা তার কল্পতরু। সে যখন যা চেয়েছে, তাই তিনি তাকে যুগিয়েছেন। যে যা চায়, সে তা পাবেই, সে বিশ্বাস তার মা তাকে দিয়েছেন। অফুরন্ত দুধ ছিল তাঁর স্তনভাণ্ডে, অফুরন্ত স্নেহ ছিল তার বুকে, আর ছিল মনে অফুরন্ত আশা। অবাধ এবং অগাধ ছিল তার প্রশ্রয়।

তার মা তাকে সাঁতার শিখিয়েছিলেন। তিনি নিজে সাঁতার জানতেন। যে পুকুরে স্নান করতেন সে পুকুরে পদ্ম ফুটত। সে রোজ আবদার ধরত ফুলের জন্য। মা তুলে এনে দিতেন। কিছুদিন পর বলেছিলেন, তুই সাঁতার শেখ, শিখে তুলে আন, আমি পারব না। তার শেখার আতঙ্কে কয়েকদিন সে আর পদ্মের কথা তোলে নি। দিনকয়েক পর মা নিজেই একদিন গাছকোমরে বেঁধে ঘড়াটা ভাসিয়ে নিয়ে বলেছিলেন, আয়, পদ্ম তুলবি।

সে গিয়েছিল মায়ের সঙ্গে সঙ্গে। আসবার সময় বারকয়েক ঘড়াটা এগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, এটা ধর।

তারপর সে-ই তাকে নিত্য এনে দিত পদ্মফুল গৃহদেবতার পূজার জন্য।

মা তার কাছে শুয়ে গল্প করতেন ভবিষ্যতের। মস্ত বড় ডাক্তার হবি। বিলেতে যাবি, জার্মান যাবি। মস্ত বাড়ি করবি, গাড়ি কিনবি। দাসদাসী হবে।

ঐশ্বর্যের গল্প করে যেতেন। অত্যন্ত সহজ মানুষ ছিলেন। দান-ধ্যান-দয়া-স্বার্থ ত্যাগ এসব ছিল তাঁর কাছে নিজের ভোগের পরে। নিজে রোজগার করে আগে নিজে খাব, তারপর অন্যের কথা।

সে বলত, বিলেত গেলে জাত যাবে না?

আজকাল আর সেদিন নেই। তবে যায় যাবে। জাত নিয়ে কি তোর বাবার মত ধুয়ে ধুয়ে খাবি?

বাবা মত দেবে না।

তুই চলে যাবি। আমরা না হয় আলাদাই থাকব। বৃন্দাবন-টন চলে যাব। তুই তো বড় হবি!

ফেল হয়ে তবে সেদিন তাদের কথা মনে পড়েছিল।

এবং সে মনে পড়াটা ভোলে নি সে। অন্তত আই. এস. সি. পরীক্ষা দেওয়া পর্যন্ত ভোলে নি সে। ফাস্ট ডিভিশনে আই. এস. সি. পাস করেছিল।

মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হল।

এখানে সে কালাচাঁদ গুপ্ত নয়, কৃষ্ণেন্দু গুপ্ত। আই. এস. সি. পরীক্ষা দেবার আগেই কোর্টে এফিডেভিট করে, বিশ্ববিদ্যালয়ে দরখাস্ত করে নাম পালটে নিয়েছিল সে।

সেন্টজেভিয়ার্সের ফাদার রেক্টর তার পড়াশোনার উন্নতিতে তার উপর খুশিই ছিলেন। হেসে বলেছিলেন, হোয়াটস ইন এ নেম—কালাচাঁদ?

কালাচাঁদ হেসে বলেছিল, কালাচাঁদ ইজ ব্ল্যাক মুন, অ্যান্ড কৃষ্ণেন্দু মিনস্ দি সেম—দি ব্ল্যাক মুন। আই হ্যাভ চেঞ্জড দি ওয়ার্ড অনলি, নট দি মিনিঙ। আই অ্যাম দি সেন ওল্ড ব্ল্যাক মুন, ফাদার।

বাবাকে, মাকেও তাই লিখে উত্তর দিল। লিখলে—কালাচাঁদ সোনার চাঁদের চেয়েও খারাপ। আমার লজ্জা করে।

বাবা উত্তর দেন নি, মা উত্তর দিয়েছিলেন, বেশ করিয়াছ; তাহাতে আমরা মনে কিছু করি নাই।

কিন্তু কলেজে-কলেজে তার কালাচাঁদ নাম তখন তার নিজের মতই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। তাতে সে দমে নি। কেউ কালাচাঁদ বলে ডাকলেই বলত, নট কালাচাঁদ আই অ্যাম কৃষ্ণেন্দু, প্লিজ।

এইখানেই রিনা ব্রাউনের সঙ্গে পরিচয়। সেও ওই কালাচাঁদ নাম নিয়ে। রিনা ব্রাউন কলেজের নার্স মেট্রন পলি ব্রাউনের সৎ মেয়ে। পলির স্বামী জিমি ব্রাউনের প্রথম পক্ষের মেয়ে। কলেজের স্টাফ কোয়ার্টার্সের মধ্যে মিসেস ব্রাউনের বাসা। রিনার বয়স তখন পনের-ষোল। দীর্ঘাঙ্গী মেয়েটি তখনও কিশোরী। কিন্তু তখন থেকেই অপরূপ মোহময়ী। গায়ের রঙ সাদা হলেও বাঙলাদেশের একটি শ্যামলিমার আভাস তাতে স্পষ্ট। সবচেয়ে মোহর মেয়েটার চুল। ছোট কপাল ঢেকে এমন অপর‍্যাপ্ত পুরু ঘন কালো চুল দেখা যায় না। তৈলহীন রুক্ষতার মধ্যেও তার কালো-শোভা ক্ষুণ্ণ হত না, ধূসরতার আভাস ফুটত না। কপালের উপর ঘন কালো চুলের সম্ভারের সঙ্গে এখানকার লাল প্রান্তরের প্রান্তে ঘন শালবনের শোভার যেন মিল আছে। কৃষ্ণকুন্তলার চেয়ে অরণ্যকুন্তলার মত বললেই যেন ওর উপমা শোভনতর করে বলা হয়। তেমনি দুটি মোটা কালো ভুরু—কপালের মধ্যস্থল থেকে যেন আকৰ্ণবিস্তৃত। কাঁচা বাঁশের মোটা ধনুকের মত। অনুরূপ সুন্দর আয়ত দুটি চোখ তাকে সুন্দরতর করেছে তার চোখের পাতার দীর্ঘ ঘনকৃষ্ণ পৰ্মরাজি। ফুলের কেশরের মত দীর্ঘ। মনে হয় জন্ম থেকেই চোখের পাতায় কাজলরেখা আর স্বপ্নলুতা মেখে নিয়ে মেয়েটি জন্মেছে। রিনাকে একটা নির্দিষ্ট সময়ে ওদের ফ্ল্যাটের বারান্দায় দেখা যেত। সে সময়টাতে তখনকার দিনের মিলিটারি মেডিক্যাল স্টুডেন্টদের সেকেন্ড ইয়ারের ছেলেরা ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসত, ঠিক তার কিছুক্ষণ পর, বোধহয় দশ মিনিট পর মিলিটারি ছেলের দল প্রায় সব বেরিয়ে চলে যেত। থাকত শুধু জন ক্লেটন, মিলিটারি স্টুডেন্টদের সেন্টার হাফ। মারপিটে সিদ্ধহস্ত জনি গুণ্ডা। রিনা এবং জনি—কথা বলত হাসত। রঙিন হাসি। জানত সবাই।

জন ক্লেটন। যুদ্ধবিভাগের নামকরা আই. এম. এস. অফিসারের ছেলে। চার্লস ক্লেটনের গল্প সর্বজনবিদিত-অন্তত অফিসার মহলে। কৃষ্ণেও পরে এসব জেনেছিল ওদের কাছ থেকেই। উঁদে অফিসার, দুর্দান্ত মাতাল, নামকরা শিকারি, ভাল নাচিয়ে, মারামারিতে সিদ্ধহস্ত। ব্যক্তি ছিলেন চার্লস ক্লেটন। পলি ব্রাউন বলেছিল, যেখানে চার্লস ক্লেটন থাকত, সে ক্যান্টনমেন্টে অফিসারেরা সন্ত্রস্ত থাকত। ঝড়ের মত পরের ঘরসংসার ভেঙে দিয়েই ছিল তার উল্লাস। তার এই দুর্দান্তপনা মেয়েদের পক্ষে ছিল একটা আকর্ষণ। এই আকর্ষণে একদা নাকি পলি ব্রাউনও–তখন মিস পলি মরিসন পড়েছিল। কিন্তু ক্লেটন তখন বিবাহিত। স্ত্রী ছিল ইংলন্ডে, জন তখন শিশু। কিছুদিন মাখামাখির পর পলি মরিসন ভগ্নহৃদয়ে মিলিটারি বিভাগের কাজ ছেড়ে এসে কাজ নিয়েছিল কলকাতার মেডিক্যাল কলেজে। ক্লেটন সাহেব দুর্দান্ত হলেও পাষণ্ড ছিল না। কলকাতায় কাজ পেতে সে তাকে সাহায্য করেছিল। কয়েকটা বড় হাসপাতাল, যেগুলি ইউরোপীয়দের জন্য নির্দিষ্ট, সেগুলি ঘুরে সে মেডিক্যাল কলেজে এসে কাজ নিয়েছিল। তখন সে মিস পলি। এখানে থাকতেই সে মিসেস ব্রাউন হয়েছে। জেমস ব্রাউনকে যখন সে বিয়ে করে রিনা তখন দশ বছরের মেয়ে। জেমস আর রিনাকে নিয়ে পলি ব্রাউন সংসারে ড়ুবে ক্লেটনকে একেবারেই প্রায় ভুলে গিয়েছিল।

কৃষ্ণেন্দু যে বছর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হল–তার আগের বছর জন ক্লেটন এসে ভর্তি হয়েছিল মেডিক্যাল কলেজে। মিসেস পলি ব্রাউনের কাছে এসে একখানা চিঠি দিয়ে বলেছিল, মেজর চার্লস ক্লেটন অব দি কিংস ওন রেজিমেন্ট, আপনার কি তাকে মনে আছে?

মেজর চার্লস ক্লেটন, ডিয়ার চার্লি?

জন হেসে বলেছিল, আমি তাঁর ছেলে।

তুমি তার ছেলে?

হ্যাঁ, এখানে মেডিক্যাল কলেজে পড়ব বলে এসেছি।

বিস্মিত হয়েছিল পলি ব্রাউন। মেজর চার্লস ক্লেটনের ছেলে হোমে না পড়ে এখানে পড়বে ডাক্তারি! আই. এম. ডি. হবে? চার বছরে চিকিৎসাশাস্ত্ৰ শেষ! নন চালিয়ে এদেশের হাতুড়েরা ফোড়া কাটে। ওরা ছুরি চালিয়ে তার চেয়ে ভাল কাটতে পারে না। আই.এম. ডি-র ব্যবহারের জন্য ধারালো ছুরির বদলে ভেতা ছুরির ব্যবস্থা। কে জানে কখন ধারালো ছুরিতে বেশি কেটে ফেলে! ওদের ব্রিটিশ-আইরিশ রেজিমেন্টে চাকরি হবে না। কালা সিপাহীর রেজিমেন্টের মেডিক্যাল অফিসার হবে।

বিস্ময়ের অবধি ছিল না পলি ব্রাউনের। কিন্তু চিঠিখানা পড়ে পলি ব্রাউন নিজেই বলেছিল, স্ট্রেঞ্জ! স্ট্রেঞ্জ লাক্‌! কী বলব লাক্‌ ছাড়া?

মেজর ক্লেটনের জীবনে বিপর্যয় ঘটে গেছে। বিচিত্ৰ অদৃষ্টই বটে। পাঁচ বছর আগের কথা। ক্লেটন ছিল সি. পিতে একটা বড় ক্যান্টনমেন্টে। তখন তার স্ত্রী-পুত্র এখানে এসেছে। ক্লেটন ক্যাপ্টেন থেকে মেজর হয়েছে। স্ত্রী আসার জন্য অফিসারদের সমাজে ঘোরাফেরায় পদক্ষেপ সংযত করতে হয়েছে বাধ্য হয়ে। ক্লেটনের স্ত্রী মার্গারেটও ছিল শক্ত মেয়ে। সাহসে দৈহিক শক্তিতে দুইয়েই ছিল ক্লেটনের উপযুক্ত স্ত্রী। ক্লেটন সমাজ ছেড়ে মধ্যভারতের জঙ্গলে ঘুরতে শুরু করেছিল শিকারের সন্ধানে। শিকারের সন্ধানে বনে ঘুরবার সময় আরণ্য জাতির নারীদের উপভোগের পথটা বেছে নিয়েছিল সে। কিছুদিনের মধ্যে মার্গারেট তার আভাস পেলে। সেও একটা রাইফেল নিয়ে শিকারে তার সঙ্গিনী হল। শেষবার ঘটল বিচিত্ৰ ঘটনা।

ক্লেটন সেই ধরনের লোক, যারা কোনো কথা রেখে-ঢেকে বলে না। সত্যের প্রতি শ্রদ্ধা আছে বলে নয়, জীবনের কোনো ঘটনাই তার কাছে লজ্জার হেতু নয়। পলি ব্রাউনকে লিখেছে, পলি, ঘটনাটা আশ্চর্য। আমার মন আমাকে ঠকালে, না এটা নিয়তির খেলা, কি আমার কর্মফলের পরিণতি, আজও ভেবে পাই না। সে এক গভীর বনে একটা গ্রাম। মার্গো সঙ্গে। সেখানে এক বিচিত্র বাঘিনীর আড্ডা। সে মারত কেবল মেয়েদের। লোকে বলত প্রেতিনী বাঘিনী। তাকে মারতে গ্রামে এসে একটি আশ্চর্য বুনো যুবতীকে দেখলাম। মন আমার বাঘিনীর চেয়ে ওর দিকেই বেশি ঝুঁকল। কিন্তু মার্গারেট সঙ্গে। যাই হোক, মাচা বেঁধে দ্বিতীয় দিন রাত্রে বাঘ মারলাম। কিন্তু বাঘিনীটা নয়। মরল যেটা সেটা বাঘ। কোথায় বাঘিনীটা! তিন দিন আর পেলাম না তাকে। কিন্তু তার পায়ের ছাপ আশ্চর্যভাবে চারিদিকে দেখলাম। যেন সামনের দিকে না এসে পিছনের দিকে সে ঘুরেছে ফিরেছে। গ্রামের সর্দার বললে, ফিরে যাও সাহেব, এ বাঘিনী ভয়ঙ্কর। এ তোমার পিছু নিয়েছে। দিনের বেলা কথা হচ্ছিল। গ্রামের লোকেরা জড়ো হয়েছে। তাদের মধ্যে কিন্তু সেই বুনো আশ্চর্য মাদকতাময়ী মেয়েটি সকলকে লুকিয়ে ছিটিমিটি হাসছে। তুমি সেকালের চাৰ্লিকে ভোল নি! এ বিষয়ে সে ছিল নিপুণ শিল্পী। চার্লস ক্লেটন কি বাঘিনী পিছু নিয়েছে বলে ওই বুনো মদিরা পান না করে আসতে পারে? মার্গারেট ঠিক বোঝে। নি, কিন্তু তবু সে বলেছিল, ফিরে চল। আমি বলেছিলাম, আজকের দিনটা দেখে যাব। ঠিক এই সময়টিতেই বাঘিনী ঠিক গ্রাম-প্রান্তে দেখা দিয়ে একটা গৰ্জনে আমাকে নিমন্ত্রণ জানিয়ে বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি বেরিয়ে গিয়েছিলাম ছুটে। কিন্তু কোথায়? না পেয়ে ফিরে আসছি, হঠাৎ দেখা হল মেয়েটার সঙ্গে। ইশারায় নিমন্ত্রণ জানালে হেসে। আমি তাকে বললাম, রাত্রে আজ শিকারে যাব না, গভীর রাত্রে ঘর থেকে বেরিয়ে তার ইশারা পেলে আসব। মার্গারেটকে বললাম, শরীর খারাপ, মাচায় যাওয়া আজ ঠিক হবে না। থাকলাম আড়ায়। আড্ডা বুনোদেরই প্রধানের একখানা ঘর। মদ খেয়েছিলাম। মার্গারেটকেও খাইয়েছিলাম। তাকে ঘুম পাড়াতে হবে। সে ঘুমিয়েও ছিল। হঠাৎ খুটখাট শব্দ শুনলাম। কান পেতে শুনলাম। আমি শিকারি। আমি জানোয়ারের পায়ের শব্দ চিনি। আমি চার্লি ক্লেটন, আমি অভিসারিকার পায়ের শব্দও জানি। এ পায়ের শব্দ সেই বুনো মেয়ের। দরজা খুললাম সন্তৰ্পণে। ফাঁক করে দেখলাম। চাঁদ ছিল আকাশে। বনের মধ্যে জ্যোৎস্ন। আশ্চর্য তার রূপ। ঘন সবুজের ঘেরের মধ্যে সে-শুভ্রতার তুলনা খুঁজে পাই না। তার মধ্যে দেখলাম সে মেয়েকে। ভুল আমি দেখি নি। বুকের ভিতর রক্ত চলাত করে উঠল। আমি বেরিয়ে গেলাম। শিস দিলাম। সে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে। আমি এগিয়ে গেলাম। কিন্তু কোথায় সে? ঠিক এই মুহূর্তে বাঘের গৰ্জনে কেঁপে উঠল বনভূমি। পিছন থেকে বাঘিনী লাফ দিয়ে পড়ল আমার উপর। একটু সরতে পেরেছিলাম, তবু সে আমার ডান কাঁধের উপর পড়ল। সেই মুহূর্তে শুনলাম মার্গারেটের চিৎকার। তার পরমুহূর্তে শুনলাম বন্দুকের শব্দ। পর পর দুটো শব্দ। আবার বাঘের গর্জন। তারপর মনে নেই, জ্ঞান হল। হাসপাতালে দীর্ঘদিন পর। ডান হাতখানা কেটে ফেলতে হয়েছে। ডান কানটা নেই। ডান পায়, ফ্র্যাকচার হয়েছিল। তাতেও জোর নেই। বাঘিনী মার্গারেটকে টুকরো টুকরো করে দিয়ে মরেছিল। দুটো গুলিই লেগেছিল তার বুকে পেটে। মরবার সময় গড়াগড়ি খেয়ে এসে পড়েছিল আমার উপরেই। আলিঙ্গন করেছিল। আরও মজার কথা কী জান? সেই বুনো গ্রামে ওই মেয়েটার সন্ধান কেউ আমাকে আর দিতে পারে নি। আমি খোঁজ করেছিলাম। তারা বলে, কই, এমন মেয়ে তো গায়ে নেই! আজও আমি ভাবি কী জান? ওই মেয়েটা কি প্রথম থেকেই আমার মদ্যবিহ্বল মস্তিষ্ক এবং আমার নারীলোলুপ চিত্তের ভ্রান্তি? অলীক কল্পনা? যাই হোক, আজ আমি বিকলাঙ্গ অসহায়, সামান্য পেনশনের উপর নির্ভরশীল সামান্য ব্যক্তি। জনিকে ইংলন্ডে পাঠিয়ে পড়াবার সামর্থ্য নেই। ও কলকাতায় পড়তে যাচ্ছে। আমি জানি তুমি ওখানকার মেট্ৰন। জনিকে একটু দেখে।

ভগবানের নাম উচ্চারণ করে পলি ব্রাউন গায়ে ক্ৰশচিহ্ন এঁকেছিল। হে ভগবান! পুয়োর চার্লি শয়তানের হাতে পড়েছিল। কিন্তু তুমি বস জন। তুমি মেজর চার্লস ক্লেটনের ছেলে। মেজর ক্লেটন এক সময় আমার বস্ ছিলেন, বন্ধু ছিলেন। আমার বাড়ির দরজা তোমার কাছে অবারিত রইল। যখন খুশি আসবে।

আলাপ করিয়ে দিয়েছিল স্বামী জেমস ব্রাউনের সঙ্গে। জেমস ব্রাউন এক সময় মেদিনীপুর অঞ্চলে থাকত। মেদিনীপুরে ব্রিটিশ জমিদারি কোম্পানিতে কাজ করতেন জেমসের বাবা। সেখানে পাহাড় জঙ্গল কিনে ব্যবসা করতেন। জেমস ব্রাউনও সেই ব্যবসা করত। ব্যবসা ফেল পড়ার পর ইসলভেন্সি নিয়ে কলকাতায় এসেছে মেয়ে রিনাকে নিয়ে। তারপর দেখা হল পলি মরিসনের সঙ্গে। সে আজ চার বছরের কথা।

রিনা বড় ভাল মেয়ে।

ডবল বেণি ঝুলিয়ে রিনা বসে মিষ্টি হাসি হেসেছিল।

ওর বাবা ঠিক করেছিল, ওকে কনভেন্টে রেখে শেষ পর্যন্ত নান করে তুলবে। জিমির ধর্মকর্ম বাতিক। কনভেন্টে রেখেও ছিল। আমি নিয়ে এসেছি জোর করে। দেখ তো, কী মিষ্টি স্বভাব মিষ্টি চেহারা।

জন ক্লেটনের সঙ্গে রিনার প্রেমের কথা কলেজে কিছুদিনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। জন ক্লেটনের সঙ্গে ফুটবলের মাঠে কৃষ্ণের হল একদিন মারপিট। সেই সূত্র ধরে নয়—সেই সূত্রের টানেই যেন রিনা এসে দাঁড়াল কৃষ্ণের সামনে।

মিষ্টি স্বভাবের রিনা ব্রাউন ক্ষিপ্ত হয়ে সেদিন কৃষ্ণেকে বলেছিল, ইউ ব্ল্যাকি কালাচান্ড। ইউ হিদেন!

কৃষ্ণেন্দু কলেজের ভিতর খেলার মাঠে মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে বিজয়ী বীরের মত এসে সবে। নেমেছে, ছেলেরা তাকে উল্লাস-কলরবে অভিনন্দন জানাচ্ছে। রিনা ব্রাউন ওদের ফ্ল্যাট থেকে রাগে ফুলতে ফুলতে নেমে এসে গ্রাউন্ডের ভিতরেও খানিকটা ঢুকে চিৎকার করে ডেকেছিল, ইউ ব্ল্যাকি কালাচান্ড! ইউ হিদেন।

ওর পিছনে পিছনে এসেছিল ওর আয়া। একটি কটা এদেশী মেয়ে। মাথার চুলগুলি পেকে গিয়েছে। মোটা ভুরু। অদ্ভুত লাগত তাকে দেখে। তার অদ্ভুত ছিল চোখের দৃষ্টি। সর্বদাই যেন। আতঙ্কে বিস্ফারিত এবং পলক পড়ত না। সে পিছন থেকে চিৎকার করছিল—রিনা, রিনা, রিনা, রিনা! নহি, নহি!।

রিনা থামে নি। সে পা ঠুকে বলেছিল, ইউ, শুনতে পাও না তুমি?

কালাচাঁদ তার কাছে এসে বলেছিল, বর্ষায় ভিজে কাদার উপর এমন করে পা ঠুকো না। তোমার.এমন স্কার্টটা কাদার ছিটেতে ভরে গেল।

সত্যিই তাই গিয়েছিল। ছেলেরা হেসে উঠেছিল। রিনার মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল সেহাসির প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গে। কথার উত্তর খুঁজে পায় নি, সরাসরি সে অভিযোগ করে বলেছিল, কেন তুমি জনিকে এমন করে মেরেছ? হোয়াই? ইউ ব্রুট!

সে উত্তর দেবার আগেই কলেজ টিমের ফুলব্যাক বসন্ত বলেছিল, ওর মাথার ব্যান্ডেজটা দেখছ না? জনিই মেরেছিল ওকে আগে।

কৃষ্ণেন্দু বলেছিল, আমার বাগদত্তা নেই মিস ব্রাউন, থাকলেও সে এসে জনিকে এ প্রশ্ন করত না। সে জানে লড়াই আরম্ভ হলে যার জোর বেশি, তার আঘাতটা জোরালো হবেই। কীচকেরা চিরকাল ভীমের হাতে মরে। ছেলেরা হো-হো করে হেসে উঠেছিল।

ওই আয়া মেয়েটি হঠাৎ হাত জোড় করে কৃষ্ণেন্দুকে পরিষ্কার বাংলায় বলেছিল, হে বাবা। দয়া (দোহাই) তুমার পিতিপুরুষের, হেই ভালমানুষের ছেল্যা, আমি হাত জোড় করছি। ঘাট মানছি। উকে কিছু বল নাই। হেই বাবা!

মেয়েটা বাঙালি! সেই বিস্ময়েই সকল ছেলে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। রিনা এই অবসরে ছুটে পালিয়ে গিয়েছিল। চিৎকার করে বলেছিল, ইউ উইল বি পানিশূণ্ড, গড উইল পানিশ ইউ।

***

ঘটনাটা সব মনে পড়ছে। সে খেলা ঐতিহাসিক খেলা। খেলা নয় যুদ্ধ।

কলেজের ভিতরের খেলার মাঠে খেলার অধিকার নিয়ে সাধারণ ছাত্র আর অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মিলিটারি ছাত্রদের ঝগড়া, মারপিট-ভরা সে-যুদ্ধের কথা কলেজের ইতিহাসে লেখা আছে। সেই যুদ্ধ চলেছে তখনও। যুদ্ধের সেই মেলা সেদিন চলেছিল খেলার মাঠে। তার আগের দিন দুই দলের ম্যাচে জনিই একা করেছিল মারপিট। সেদিন শোধ নেবার জন্যে শপথ নিয়ে নেমেছিল কৃষ্ণেন্দু। জনিকে সে মারবে। বুটের সুযোগ তো ওদের চিরদিনের, তার উপরে জনি মারপিটে সিদ্ধহস্ত। জনি শুনে হেসেছিল। বেচারা জনি, কৃষ্ণেন্দুকে ঠিক জানত না। কিন্তু কৃষ্ণের ছ-ফুট লম্বা চেহারাখানা দেখে একটু সাবধান হওয়া উচিত ছিল। তা ছাড়া গত দুবছরে কালাচাঁদের খেলার খ্যাতির উপরেও শ্রদ্ধা করে মারবার আগে বিবেচনা করা উচিত ছিল। প্রথমেই সেন্টার হাফ জনি বুটের লাথি মেরে জখম করেছিল এদের সেন্টার ফরওয়ার্ডকে। বেচারার ডান হাঁটুর নিচে কাপ জখম হয়। উঠল বটে, কিন্তু তখন ছুটবার ক্ষমতা গিয়েছে। তার পরই এদের সেন্টার হাফের পায়ের বুড়ো আঙুল ফাটিয়ে দিলে। রেফারি তাকে সাবধান করে দিলেন। জনি সরে এসে রেফারিকে গাল দিলে সন অব এ বিচ বলে। কথাটা কানে গেল কৃষ্ণের। সেন্টার ফরওয়ার্ডকে নিজের জায়গায় দিয়ে সে এল সেন্টার ফরওয়ার্ডে, দাঁড়াল জনির মুখোমুখি।

জনি হেসে বললে, You are কালাচান্ড? দ্যাট অলরাইট। বহুট আচ্ছা ব্ল্যাকি। কাম অন।

কথাটা শেষ হতে না হতে বল এসে পড়ল দুজনের মধ্যে। জনি বুট ঝাড়লে ওর হাঁটু লক্ষ্য করে। কালাচাঁদ সুকৌশলে হাঁটু বাঁচিয়ে জনির উৎক্ষিপ্ত পাখানার তলার দিকে ঝাড়লে একখানি কিক। ছ-ফুট লম্বা মানুষের শক্ত বাঁশের মত পায়ের সে কিকে চিৎ হয়ে পড়ে গেল জনি। এবং হাঁটু বিনা রক্তপাতে জখম হল। কুদ্ধতর হয়ে উঠল জনি। এবং কিছুক্ষণ পরই জনি মারলে ওর মাথায়। কৃষ্ণের মাথাটা ফেটে গেল। রক্তমাখা বড় চুলগুলো পিছনের দিকে ঠেলে দিয়ে। কৃষ্ণেন্দু মিনিট দুয়েক পরেই ছুটল বল ধরতে। জনি প্ৰাণপণে ছুটে এসে রুখলে। বল তখন কৃষ্ণেন্দু ইন্সম্যানকে দিয়ে সামনে ছুটেছে। উঁচু বল এসে পড়েছে। জনি কৃষ্ণেন্দু সামনাসামনি, দুজনেই হেড দিতে লাফাল। কৃষ্ণেন্দু হেড দিলে, মর্মান্তিক আর্তনাদ করে জনি পড়ল মাটির উপর কাত হয়ে পেট চেপে ধরে, অজ্ঞান হয়ে গেল। ধরাধরি করে তুলে নিয়ে যেতে হল তাকে। পেটের অন্ত্রে আঘাত লেগেছে। এরপর কৃষ্ণেন্দু করলে হ্যাটট্রিক।

দেশী ছেলেদের কাঁধে চড়ে কৃষ্ণেন্দু চিৎকার করে গান ধরেছে—

দিন আগত ঐ–ভারত তবু কই–
সে কি রহিবে লুপ্ত আজি সবজন পশ্চাতে?
প্রেরণ কর ভৈরব তব দুর্জয় আহ্বান হে–জাগ্ৰত ভগবান হে।
জয় ভৈরব!

এই মুহূর্তেই রিনা ব্রাউন এল—ইউ ব্ল্যাকি কালাচান্ড। এবং শেষ পর্যন্ত বললে, গড উইল পানিশ ইউ।

কৃষ্ণেন্দু তারও উত্তর দিয়েছিল, উত্তর দিতে একটু দেরি হয়েছিল ওই আয়াটির মুখের আকুতিভরা বাঙলা কথা শুনে। বিস্মিত হয়ে আধ মিনিট দেরি হয়েছিল, চিৎকার করেই সে বলেছিল, হ্যালো মিস, হ্যালো। দেন আস্ক ইওর গড–তোমার ভগবানকে বলো আমার সামনে আবির্ভূত হতে। কিংবা আমাকে তার সামনে হাজির করাতে। জান, আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না। আমার একটা পরম লাভ হবে। আমি তাঁকে দেখতে পাব। তার জন্যে দরকার হয় তো বলো, তোমার জনিকে আবার তো মারব!

***

রিনা ব্রাউন! আমার ব্যঙ্গ ব্যর্থ করে তোমার ঈশ্বর আমাকে ধন্য করেছেন। তোমার ঈশ্বরকে আমি দেখেছি রিনা ব্রাউন! কিন্তু আশ্চর্য! ডাইনী অপরাধে অপরাধিনী আদিম আরণ্য নারী ওই ঝুমকির মধ্যেও তাকে দেখেছি। সিন্ধু, লাল সিং এদের মধ্যেও তাঁকে পেয়েছি। তোমার সঙ্গী ওই মরণ-ভয়-তাড়িত মদ্যপানবিতোর আমেরিকান অফিসারটির মধ্যে তাকে দেখলাম, তিনি রয়েছেন। যুদ্ধে যে প্রাণ নেবে তার মধ্যে নয়, যুদ্ধে প্রাণ দেবে বলে এতদূরে এসেছে তার মধ্যে যে তাকে আমি দেখলাম। কিন্তু তোমার মধ্যে থেকে তিনি কোথা অন্তৰ্হিত হলেন, রিনা ব্রাউন! হে ঈশ্বর, সেই মেয়েটিকে তুমি কেন পরিত্যাগ করলে! এ রিনা ব্রাউন ঈশ্বর-পরিত্যক্ত রিনা ব্রাউন। কৃষ্ণস্বামী মনে মনেই কথা কটি বললেন।

বাবাসাহেব! সেই মুহূর্তে ঘরে ঢুকল সিন্ধু।

কে? সিন্ধু?

হাঁ বাবাসাহেব। চা দিয়ে গেল, খেলে নাই। রাত কত হইছেক-খিদ্যা কি তুমার লাগে না বাবাসাহেব?

আমার রুটি ঢাকা দিয়ে রেখ্যা দাও সিন্ধু। ইয়ার পর যখুন হোক খাব।

উহঁ। আপনি খেয়ে লও—তবে আমি যাব।

না সিন্ধু! আজ আমাকে ছাড়ান দাও বেটি।

শরীর কি ভাল নাই বাবা?

শরীর ভাল আছে বেটি। মন ভাল নাই। বলেই উঠে পড়লেন কৃষ্ণস্বামী। ঘর থেকে এসে দাঁড়ালেন বারান্দায়। বারান্দা থেকে নামলেন খোল উঠানে।

চারপাশে বর্ষার ঘনশ্যাম শালবনে জ্যোত্যার আভা প্রতিফলিত হয়েছে। দূর দিগন্ত পর্যন্ত বনের মাথায় মাথায় চলে গেছে। নিঃশব্দ নয়, নিস্তব্ধও নয়। কিন্তু যেন থমথম করছে। গাছে। গাছে কুঁড়িগুলি পরিপুষ্ট হচ্ছে। কাল সকালে ফুটবে। পরশু যারা ফুটবে তারা বাড়ছে। আজ সকালে যারা ফুটেছিল, তাদের গন্ধ এখনও ছড়িয়ে রয়েছে বাতাসে। মাটির গভীর অন্ধকারে মূল পচনরস পান করছে কৃমির মত লক্ষ লক্ষ সূক্ষ্মাগ্ন মুখ বিস্তার করে। অবিরাম চলেছে বিচিত্র জীবনতপস্যা। পঙ্করস পুষ্প হয়ে ফুটেছে।

রিনা ব্রাউন মদ খেয়ে হয়ত নাচছে বা চিৎকার করছে, হয়ত আমেরিকান অফিসারের সঙ্গে বিকৃত লালসায় উন্মত্ত ব্যভিচারে নিজেকে ক্ষয় করছে। বস্তুজগতে একটা বিস্ফোরণ হয়েছিল, বৈজ্ঞানিকেরা বলে সেটা আকস্মিক ঘটনা। তা থেকেই জেগেছিল প্ৰাণ। সেই প্রাণের জাগরণেই ঈশ্বরের তপস্যার হেমকুণ্ড জ্বলছে। অনন্ত প্রাণের সমিধের আহুতি চলেছে তাতে। প্রাণে তেজ হল। তুমি তাতে কালি হয়ে ঝরে পড়লে, রিনা ব্রাউন! এমন কী করে হল? তাঁর অন্তরাত্মা হাহাকার করছে।

এগিয়ে চললেন কৃষ্ণস্বামী। তাঁর আশ্রমের সীমানা পার হয়ে বনের দিকে চললেন। বনের মধ্যে গাছেরা যেন কথা বলছে। বাতাসে, পাতায় পাতায় সাড়া জেগেছে, সুর জেগেছে। সারাটা দিন ওরা মানুষের জীবজন্তুর প্রাণের খাদ্য অক্সিজেনের ভাগ নিয়েছে। এইবার অক্সিজেন দিচ্ছে। রিনা, তুমি দিনরাত্রিই কার্বনডায়োক্সসাইড গ্রহণ করছ, সারা দিনরাত্রি কার্বনডায়োক্সসাইড দিচ্ছ। লয়ের মধ্যেও বিচিত্র সূক্ষ্ম স্থিতি আছে। রিনা, তোমার মধ্যে শুধু ক্ষয়, শুধু ক্ষয়, শুধু ক্ষয়।

বাবাসাহেব! ফাদার!

বাঙলোর দিক থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে এল। যোসেফ লাল সিং ডাকছে। তিনি বনের দিকে চলেছেন, তাই শঙ্কিত হয়েছে। বনে ভালুক আছে। বুনো শুয়োর আছে। মধ্যে মধ্যে চিতা। আসে। সেই ভয়ে তাকে ফিরে আসতে বলছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে ভারী গলায় কৃষ্ণস্বামী বললেন, বেশি ভিতরে আমি যাব না যোসেফ!।

না, বাবাসাহেব, গা থেকে লোক এসেছে।

লোক! তা হলে কারও বাড়িতে অসুখ! বিপদ! ঈশ্বর কি রিনার কথা ভাবতে নিষেধ করছেন? ফিরলেন কৃষ্ণস্বামী। বারান্দায় বসে আছে একক্রোশ দূরের একখানি ছোট গ্রাম থেকে, কৃষ্ণস্বামীর চেনা সবাই। এ যে বুড়ো শরণ লায়েক।

কী হল লায়েক মশায়? এত রাতে?

কী হবেক? বিপদ! তা নইলে তুমার কাছে আসব ক্যানে এত রেতে!

কার অসুখ? কই জানি না তো কিছু?

জানবা কী? এই আমার ছেল্যাটার বড় বিটিটো। পেথম পোয়াতি বটেক। সেই দুপুর থেকে বেথা উঠেছে। দাইটো এই রেতে বলে, আমি খালাস করতে পারব লায়েক; গতিক মন্দ বটেক লাগছে। তুমি বাবাসাহেবকে খবর দাও। মেয়াটা গোঙাইছে বাবা। শুনতে পারা যেছে না। যেতে একবার হবেক বাবা।

নিশ্চয়। হবেক বৈকি। কৃষ্ণস্বামী দ্রুতপদে উঠে গেলেন ঘরের ভেতরে। ডাকলেন, যোসেফ! তুমি চল। যন্ত্রপাতি নিয়ে ব্যাগটা গুছায়ে লাও হে। তোমরা আলো আনো নাই। লায়েক?

না গো বাবা, ত্যাল কুথাকে পাব গো। একটো কানাকুঁজো হারিকল আছে—তা সিটা দিলাম ঘরে। তা আকাশে জোস্তা রইছে—ঠিক চলে যাব।

আমাদের একটা হারিকেন নাও লাল সিং। ব্লেসেড ইজ হি দ্যাট কামেথ ইন দি নেম অফ দি লর্ড। চল লায়েক। থাক রিনার কথা। রিনা মৃত। ঈশ্বর তার কথা মনে করতে নিষেধ করছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *