০২. মহাতাপ কথাটা মিথ্যা বলে নাই

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

মহাতাপ কথাটা মিথ্যা বলে নাই; ওই হায় রে হায় কথাটা সেতাবের মুখে লাগিয়াই আছে। উঠিতে বসিতে সে বলে—সেদিনের কথা এর মধ্যে ভুলে গেলি সব! হায় রে হায়! হায় রে হয়। অর্থাৎ কথাটা সকলেই ভুলিয়াছে কেবল সেতাব ভুলিয়া যায় নাই। কথাটার মধ্যে সেতাবের জীবনের পরম অহঙ্কার নিহিত আছে। বেশি দিনের কথা নয়, সেতাবের বাপ প্রতাপ মণ্ডল হঠাৎ মারা গেল, সেতাবের বয়স তখন বার, মহাতাপের বয়স ছয়। মাঝের একটি ভাই তাহাদের নাই। প্ৰতাপের মৃত্যুর মাস কয়েক না যাইতেই মহাজন পর পর তিনটা নালিশ করিয়া প্রতাপের সম্পত্তি ক্রোক করিয়া বসিল।

প্ৰতাপ মণ্ডল হককের মানুষ ছিল। নামেও প্রতাপ কাজেও প্রতাপ ছিল। গ্রামের মাতব্বর, জমিদারের মণ্ডল, ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বার অনেক কিছু ছিল। গ্রামের কাছেই আধাশহর লক্ষ্মীপুরের ব্যবসায়ী মহাজন বাবুলোকদের কাছেও খাতির ছিল। মনটা ছিল উদার, মানুষটা ছিল দুর্দান্ত। বাড়িতে চাষের ধুম ছিল। লক্ষ্মীপুরের বাবুরাও অনটনের বর্ষায় তার কাছে ধান বাড়ি অর্থাৎ ধার লইত। হঠাৎ প্ৰতাপ মণ্ডল ব্যবসায়ে নামিয়া বসিল। নামিল নামিল এমন ব্যবসায়ে। নামিল যাহার সঙ্গে তাহার কোনো পরিচয় নাই। ইউনিয়ন বোর্ডের সেক্রেটারি জগাই পাঠককে শূন্য বরাদার করিয়া ঠিকাদারির কাজে নামিয়া পড়িল।

সালটা তখন ১৯২৬-২৭ সাল। সবে দেশে ইউনিয়ন বোর্ড হইয়াছে। প্রতাপ মণ্ডলের বোর্ডে হঠাৎ বছরের শেষাশেষি খবর আসিল—সরকার পানীয় জল সরবরাহের জন্য ইন্দারা করিতে টাকা দিবেন; শর্ত ইউনিয়ন বোর্ডকে এক-চতুর্থাংশ টাকা দিতে হইবে। এক-একটা ইন্দারার প্রায় পাঁচশো করিয়া টাকা খরচ, অর্থাৎ ইউনিয়ন বোর্ডকে একশো পঁচিশ আন্দাজ দিতে হইবে। প্রতাপ নিজের গ্রামে ইন্দারার জন্য চাঁদা তুলিতে চেষ্টা করিল কিন্তু পায়ে অনেক ধুলা মাখিয়া হাঁটাহাটি করিয়া পঁচিশ টাকা কয়েক আনার বেশি চাঁদা তুলিতে পারি না। এই সময় জগাই পাঠক তাহাকে পরামর্শ দিল—মোড়ল এক কাজ কর। ইন্দারাটা তুমি ঠিকে নিয়ে নাও। ঠিকাদারির একটা লাভ আছে তো, সেই লাভে ও টাকা উঠে যাবে! আমি দেখেশুনে সব ঠিক করে দেব।

ভয়ে ভয়েই প্রতাপ কাজে নামিল। কিন্তু ইন্দারাটা শেষ হইতেই ভয় কাটিয়া উৎসাহে মাতিয়া উঠিল। ঠিকা অর্থাৎ কনট্রাক্ট হইতে যাহা লাভ হইয়াছে তাহা দেয় সিকি টাকার বেশ কিছু উপরে উঠিয়া গিয়াছে। লোকাল কন্ট্রিবিউশান অর্থাৎ স্থানীয় চাঁদার দাবি ছিল সিকি অর্থাৎ শতকরা পঁচিশ, সেই স্থানে লাভ দাঁড়াইল শতকরা পঁয়ত্রিশ টাকা। বিল আদায় করিয়া নগদ পঞ্চাশ টাকা প্রতাপের হাতে তুলিয়া দিয়া সেক্রেটারি পাঠক বলিল দশ টাকা পুজো দিয়ে মোড়ল, পনের টাকা আমার, পঁচিশ টাকা তোমার।

প্রতাপের চোখ দুটো জ্বলিয়া উঠিল।

পাঠক বলিল, ইন্দারার কাজে তবু লাভ কম। রাস্তার ঠিকে কি সাঁকোর ঠিকে যদি হত না—তবে দেখতে অর্ধেক খরচ আর অর্ধেক লাভ। টাকায় টাকা। করবে ঠিকের কাজ? ইউনিয়ন। বোর্ডের নয়, ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের ঠিকে নেবে?

প্রতাপ কথা বলতে পারিল না, সেক্রেটারি পাঠকের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। পাঠক চতুর লোক, তাহার উপমা দিয়া লোকে বলে—মৃগেল মাছ। পাক কাটিয়া চলে আবার সমানে ভাসিয়া সাঁতারও কাটে। প্রতাপের দৃষ্টির অর্থ তাহার বুঝিতে দেরি হইল না। পুকুরের জলের মধ্যে ভাসমান টোপের সম্মুখে মাছ স্থির হইয়া পাঁড়াইয়াছে। হাসিয়া পাঠক বলিলরাস্তার কাজ পাথর কুড়িয়ে জমা করা আর কাকর কেটে তোলা, তারপর গরুর গাড়িতে বয়ে ফেলা। আলমপুরের বাবুদের জমিদারিটাই রাস্তার কাজের পয়সায়। কাঁচা পয়সা হে! তারপর দশ টাকা ওভারসিয়ারের পকেটে খুঁজে দিলে মাপ বাড়িয়ে বিশ টাকা পাইয়ে দেবে তোমাকে। লেগে যাও। আমি বরং সব দেখেশুনে দেব তোমার। আমাকে দিয়ে কিছু। শূন্য বরাদার করে নিয়ো।

কথাগুলার একটাও মিথ্যা বলে নাই পাঠক। আলমপুরের বিখ্যাত জমিদারবাড়ির অভ্যুদয় এই রাস্তার কাজে কন্ট্রাক্টারি হইতেই। প্রায় একশো বছর আগে দুইটা জেলায় বড় বড় রাস্তাগুলো তৈয়ারি ও মেরামতের কাজ ছিল তাহাদের একচেটিয়া। এই ঠিকাদারির লাভ হইতেই আলমপুরের চৌধুরীরা তিরিশ হাজার টাকা আয়ের জমিদারি কিনিয়া পেশা চাষের পরিবর্তে দলিলদস্তাবেজে পেশা জমিদারি লিখিতে শুরু করিয়াছিলেন। আর ওভারসিয়ারের পকেটে খামে পুরিয়া টাকা দেওয়ার গল্প না জানে কে? বাইসিক্ল চড়িয়া হেটকোট পরিয়া সে-ওভারসিয়ার বাবুদের সে দেখিয়াছে। ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বার হইয়া তাহাদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হইয়াছে। সুতরাং–

সুতরাং সে নামিয়া পড়িল। এবং নামিয়াই সে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিতে শুরু করিল। প্রথম বছরে লাভ হইল এক হাজার টাকার কিছু বেশি। প্রতাপ মূলধন লইয়াছিল তিন হাজারের কিছু কম। তিন হাজারে এক হাজার লাভ। দ্বিতীয় বৎসরে মূলধন বাড়াইয়া সে আট হাজার তুলিল; একটা ঘোড়া কিনিল, খান তিনেক সেকেন্ড হ্যান্ড বাইসিক্ল কিনিল এবং পাঠকের এক শালা ও এক ভাইপোকে কাজ দেখিবার জন্য মাসিক তিরিশ টাকা বেতনে কর্মচারী নিযুক্ত করিল। চার-পাঁচ জন সাঁওতাল সর্দার অর্থাৎ গ্যাঙ সর্দার, তিন জন গরুর গাড়ির সর্দার, এক জন রাজ মজুরদের। সর্দার নিযুক্ত করিয়া শোরগোল করিয়া কাজ জুড়িয়া দিল। নিজে ঘোড়ায় চড়িয়া ঘুরিতে লাগিল। পাঠক ঘুরিত একখানা নতুন বাইসিক্লে। প্রথম বছর তিনেক নিজের বাড়িতে ছিল সকল কাজের কর্মকেন্দ্র, বাইরের চাষের ঘরটাতেই চুন, সিমেন্ট, গাঁইতি, কোদাল, খাপত্র থাকিত; চতুর্থ বৎসরে নবগ্রামে ঘরভাড়া করিয়া আপিস বসাইয়া দিল। খাতায় পত্রে বাহিরের কাজ চলিতে লাগিল। পাঠক সদর শহরে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড আপিসে বিল হিসাব ইত্যাদি লইয়া মাসে পনের দিনের বেশি থাকিতে হয় বলিয়া সেখানে একটা ঘরভাড়া লইল।

প্রতাপ মোড়ল মোড়ল উপাধি ছাড়িয়া ঘোষ উপাধি কায়েম করিল। গ্রামের জ্ঞাতিকুটুম্বদের সঙ্গে ঝগড়া না করিয়াও পর হইয়া পাঁড়াইল। পোশাকে পরিচ্ছদে কথায় বার্তায় সে হইয়া গেল আর এক মানুষ। দলিলদস্তাবেজে সে পেশা চাষের বদলে পেশা ব্যবসায় লিখিতে আরম্ভ করিল। বাড়িতে প্রতাপের স্ত্রী শঙ্কিত হইল। প্রতাপ তাহাকে প্রায়ই বলিত, একটু সভ্য হও। চাষীর পরিবার যখন ছিলে তখন যা করেছ যা পরেছ যা বলেছ সেজেছে। এখন ভদ্রলোকের চালচলন শিখতে হবে। ও গোবর দেওয়া, কাপড় সেদ্ধ করা এসব ছাড়! মধ্যে মধ্যে বলিত, এখানকার ঘরবাড়ি যা আছে থাক, নবগ্রামে গিয়ে নতুন বাড়ি করব। অন্যদিকে ইউনিয়ন বোর্ডের সভ্যপদের উপর বক্রব্যঙ্গদৃষ্টি হানিয়া ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সভ্য হইবার আয়োজন করিল। এমন সময় হঠাৎ একদা সে কোথা হইতে টাইফয়েড ধরাইয়া আনিয়া বিছানায় শুইল। এবং চব্বিশ দিনের দিন মারা গেল। প্রতাপের স্ত্রী জগাই পাঠককে ডাকিয়া বলিল পাঠক মশাই, কি হবে?

পাঠক বলিল—তাই তো? আমি তো মাথায় হাত দিয়ে বসে গিয়েছি বাপু। হাজার দুয়েক টাকা না হলে তো সব অচল।

প্রতাপের স্ত্রী চমকিয়া উঠিল।

পাঠক যাহা বলিল তাহা এই। একটা বড় সাঁকোর ঠিকা ছিল, সাঁকোও হইয়াছে কিন্তু সেটা ফাটিয়া গিয়াছে। রাস্তার ঠিকায় কাকর পাথর যাহা মজুত করা হইয়াছে নতুন ওভারসিয়ার তাহার মাপ ঠিক দেয় নাই। প্রায় ছয় আনা পরিমাণ কাটিয়া দিয়াছে। বিল সমস্ত আটক পড়িয়াছে। এদিকে গাড়োয়ান, কুলি, রাজমিস্ত্রিদের তিন সপ্তাহের মজুরি বাকি। তহবিল শূন্য।–এখন অন্তত হাজার টাকা চাই। এ সময় বিপদের সময়। টাকার কথা মুখে আসে না। কিন্তু না বললেও নয়। গাড়োয়ান কুলি রাজমিস্ত্রিদের কথা শুনে আমার হাত পা পেটের ভেতর সেঁদিয়ে গিয়েছে। তারা বলাবলি করছে আমাকে ধরে মারবে আর—হুঁ।

বার দুই ঢোক গিলিয়া বলিল—আর বলছে দল বেঁধে এসে বাড়িতে তোমাদের চেপে বসবে। না খেয়ে তো তারা খাটতে পারবে না।

প্রতাপ জ্ঞাতি-কুটুম্ব ছাড়িয়াছিল, গ্রামের লোকও সরিয়া দাঁড়াইয়াছিল, প্রতাপের মৃত্যুর পর তাহারা প্রকাশ্যে শত্রুতা না করিলেও সাহায্য করিতে এক পা আগাইয়া আসিল না। নিজেদের বাড়ির দাওয়ায় বসিয়া অধিকাংশ লোকই বলিল—এ হবে তা তো জানা কথা।

*****

সেসব দিনের কথা সেতাবের মনে আছে। বাপ প্রতাপ মণ্ডলের ঠিকাদারির জমজমাট আমলে সেও বাপের মত নিজেকে এ গ্রামের সকল ছেলে হইতে পৃথক বলিয়া ভাবিতে শুরু করিয়াছিল। আর মহাতাপ একেবারে প্রায় আদুরে গোপাল বনিয়া গিয়াছিল। ছেলেবেলা হইতেই মহাতাপ সরল চঞ্চল। বাপের অবস্থার আকস্মিক উন্নতিতে সে আদর পাইয়া হইয়া উঠিয়াছিল দুর্দান্ত।

সবই মনে আছে সেতাবের।

ইউনিয়ন বোর্ডের সেক্রেটারি পাঠক সেদিন যে বলিয়া গেল গাড়িওয়ালারা ও মজুরেরা দল বাঁধিয়া পাওনার জন্য আসিবে এবং গোলা ভাঙিয়া ধান বিক্রি করিয়া টাকা উসুল করিয়া লইবে সে কথা সে মিথ্যা বলে নাই। একদিন সত্যই তাহারা আসিল। সঙ্গে আসিল প্রতাপের জ্ঞাতিভাই ধানের পাইকার গোপাল ঘোষ; ওই ঘোঁতন ঘোষের বাপ। সেতাব মহাতাপের মা তখন বউ মানুষ, বয়সও অল্প, তিরিশও হয় নাই; সেদিন সে ঘোমটা খুলিয়া গিয়া দাঁড়াইল মোটা মোড়লের বাড়িতে। মোটা মোড়ল ধর্মভীরু মানুষ এবং ভাল মানুষ। প্রতাপের সঙ্গে ইদানীং তাহার কথাবার্তা বড় একটা ছিল না। মোটা মোড়ল গ্রাম সম্পর্কে দাদা বলিয়া কয়েকবার প্রতাপকে সৎপরামর্শ দিতে চাহিয়াছিল, কিন্তু প্রতাপ সে কথার উত্তরে বলিয়াছিল—আমার উন্নতিতে বুক সবার টাটিয়ে গেল তা আমি জানি। পরামর্শ আমি কারুর চাই না। মোটা মোড়ল এ উত্তরে আঘাত পাইয়াছিল। সেদিন হরিকে স্মরণ করিয়া প্রতাপের নিকট হইতে চলিয়া গিয়াছিল এবং সেই হইতে এদিক আর বড় মাড়ায় নাই। পথে প্রতাপের সঙ্গে দেখা হইলে পাশ কাটাইয়া সরিয়া যাইত। কিন্তু প্রতাপের বিধবা বধূ সেদিন গিয়া দাঁড়াইবা মাত্র সে বলিল—সে কি! চল মা চল! দেখি।

সে আসিয়া খাতা দেখিয়া ধান বিক্রি করিয়া সকলের পাওনা শোধ করিয়া দিল। পাঠককে বলিল—হিসাবের খাতাটা যে একবার বার করতে হবে পাঠক মশাই!

পাঠক আকাশ হইতে পড়িলখাতা তো মোড়লের বাড়িতে। খাতাপত্র তো আমি জানি না। মোটা মোড়ল অনেক চেষ্টা করিয়াও পাঠককে কায়দা করিতে পারিল না। গোটা গ্রামের লোক প্রতাপের ছেলেদের বিরুদ্ধেই একরকম দাঁড়াইয়াছিল। মোটা মোড়ল একা কোনো রকমেই তাহাদের বুঝাইতে পারিল না। দোষী প্রতাপ মরিয়া গিয়াছে, তাহার ছেলেরা নির্দোষ নিরপরাধ একথা তাহারা কোনো রকমেই বুঝিল না। ওদিকে হঠাৎ মহাজন নালিশ করিয়া বসিল–সে টাকা পাইবে। তিন হাজার টাকা।

তিন হাজার টাকা? প্রতাপ মোড়ল টাকা ধার করিয়াছে?

পাঠক বলিল–করিয়াছে। হ্যান্ডনেটের বয়ান সে লিখিয়াছে এবং প্রতাপ সই করিয়াছে। ব্যবসায়ের জন্য টাকার প্রয়োজন হইয়াছিল। সকল ব্যবসায়ীকেই ধার করিতে হয়। ব্রাহ্মণ সন্তান হইয়া মিথ্যা বলতে পাঠক পারিবে না। আসল কথা কিন্তু অন্য। দরখাস্ত ইত্যাদির জন্য প্রতাপ কিছু সাদা কাগজে সই করিয়া পাঠককে দিয়াছিল। পাঠক মহাজনের সঙ্গে ষড়যন্ত্ৰ করিয়া সেই কাগজে হ্যান্ডনেট বানাইয়াছে।

এদিকে ছোট ছেলে মহাতাপ পড়িল জ্বরে। জ্বর দাঁড়াইল টাইফয়েডে। প্রতাপের টাইফয়েডের বিষ তাহাকে পাড়িয়া ফেলিল। যমে মানুষে টানাটানি করিয়া মহাতাপ বাঁচিল কিন্তু কেমন বোকা বুদ্ধিহীন হইয়া গেল। প্রথম প্রথম কথার জড়তা হইয়াছিল। কথা বলিলে বুঝিতে পারি না, ফ্যালফাল করিয়া মানুষের মুখের দিকে তাকাইয়া থাকিত।

সেতাবের মনে পড়ে সেতাবও সারা পৃথিবীর দিকে ফ্যালফ্যাল করিয়া তাকাইয়া থাকিত। সে নেহাত ছোট ছিল না। বুঝিবার বয়স তাহার হইয়াছিল। বাপ বাঁচিয়া থাকিতে শুনিত পাঠক বলিত, আরও দু-চার জন বলিত, মোড়ল, ছেলেকে তুমি ভাল করে পড়াও। ওকে ওভারসিয়ারি পড়াবে। ওভারসিয়ার হলে এ ব্যবসা একেবারে হইহই করে চলবে।

কথাটা কি করিয়া ছড়াইয়া পড়িয়া নবগ্রামের ইস্কুল পর্যন্ত পৌঁছিয়াছিল। সেখানে ঘোঁতন ছিল তাহার সহপাঠী। ঘোঁতন পড়াশুনাতে ভাল ছিল এবং নবগ্রামের আধাশহুরে ফ্যাশন ও কথাবার্তাতেও পাকা ছিল। সে তাহাকে ঠাট্টা করিয়া ওপোর স্যার বলিয়া ডাকিতে শুরু করিয়াছিল। তাহাতে সেতাব লজ্জা অনুভব করিত বটে কিন্তু তাহার মধ্যেও গোপন অহঙ্কার অনুভব করিত। হঠাৎ বাপ মরিতেই ঘোঁতনের ওই ঠাট্টাটা মারাত্মক রূপে অসহনীয় হইয়া উঠিল। অন্যদিকে গ্রামে পথে ঘাটে লোকজন তাহাকে দেখিয়া বলিতে শুরু করিল—ছেলেটা তো বড় হয়েছে, আবার পড়া কেন রে বাপু? এই অবস্থায়! যা হোক কুলকর্মে লাগলে দুমুঠো খেতে পাবে তো। পড়েই বা করবে কি? হুঁ।

ওদিকে ম গাজন নালিশ করিয়া ডিক্রি করিল। প্রায় বিঘা দশেক জমি বিক্রি হইয়া গেল। বৎসরের শেষে কৃষাণ মজুরেরা অবশিষ্ট জমির ধান তুলিয়া ভাগ করিয়া যে ধান লইয়া মণ্ডলবাড়ির উঠানে মরাই বাঁধিল তাহাতে বাড়ির উঠানের একটা কোণও ভাল করিয়া ভরিল না। অথচ আগে উঠানটার অর্ধেকটা মরাইয়ে মরাইয়ে ভরিয়া থাকিত। সেতাব মহাতাপের লুকোচুরি খেলার আদর্শ ক্ষেত্র হইয়া উঠিত।

সেতাবের মা মরাইয়ের দিকে তাকাইয়া দীৰ্ঘনিশ্বাস ফেলিল, সঙ্গে সঙ্গে চোখে জল গড়াইয়া আসিল। আর বছর দুয়ের মধ্যে আরও দুঃসময় আসিল। সেদিনও সেতাবের মা কাঁদতেছিল। সেতাব সেদিন ইস্কুল হইতে ফিরিয়া নির্বাক হইয়া বসিয়া ছিল। পরীক্ষায় সে একটা বিষয়ে ফেল করিয়াছে। প্রথম ডাকে প্রমোশন পায় নাই; দ্বিতীয় ডাকে পাইবে কি না তাহারও কোনো স্থিরতা নাই। তাই চুপচাপ বসিয়া ছিল, কথাটা মাকেও বলে নাই। হঠাৎ মায়ের চোখে জল দেখিয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইল। বার দুই পাক মারিয়া বলিল-আমি আর পড়ব না।

—পড়বি না? মা অবাক হইয়া ছেলের মুখের দিকে তাকাইল।

–না। এবার প্রমোশন পাই নাই।

বাধা দিয়া মা বলিল না পেয়েছিস এবার ভাল করে পড়। আসছে বার ভাল করে উঠবি?

–না। আর পড়ব না।

–করবি কি? আমার মুণ্ডু?

–না। চাষবাস করব। নইলে যা আছে তাও থাকবে না। ধার করে ধান খেতে হবে। তার দায়ে জমি বিকিয়ে যাবে।

সেতাব পড়া ছাড়িয়া সেই সংসারের হাল ধরিল। দেহ তাহার দুর্বল ছিল, নিজে হালের মুঠা ধরিয়া বিশেষ কিছু করিতে পারিল না কিন্তু দিনরাত্রি তদারকের ফলে চাষের উন্নতি হইল। অনাবৃষ্টির সময় গভীর রাত্রে সে মাঠে বাহির হইয়া লোকের জমির আল কাটিয়া নিজের জমি ভিজাইয়া লইত। চাষের আগে রাত্রে মাঠে গিয়া দশখানা জমি হইতে দশ ঝুড়ি আর উঠাইয়া নিজের জমিতে ছড়াইয়া দিয়া আসিত। পথ চলিতে চলিতে গোবর পাইলে গোবরটুকু উঠাইয়া লইয়া হয় জমিতে নয় নিজের সারগাড়িতে আনিয়া জমা করিত। বৎসর দুয়েক পর সে মাথা খাটাইয়া এক ব্যবসা বাহির করিল। তরির ব্যবসা ও তাহার সঙ্গে বীজের ব্যবসা। নদীর ধারে তাহাদের খানিকটা গোচর-অর্থাৎ গোচারণভূমি ছিল। সারা বর্ষাটা নদীর বানের জলে ড়ুবিয়া থাকিত। বান কমিয়া গেলে প্রচুর ঘাস হইত, বর্ষার তিন মাস ছাড়া বাকি নয় মাস গরুগুলি। সেখানে ঘাস খাইত। সেইখানে সে তরির চাষ শুরু করিল। এবং বাজারে প্রথম মরসুমে তরি তুলিয়া বিক্রয় করিত। তাহার আলু উঠিত কার্তিক মাসে। তখনকার দিনে আট আনা হয় আনা সের বেচিত টমাটো, বেগুন, মুলা তাহার প্রথম কেঁকে উঠিত। সে ফসল লইয়া সে নিজে গিয়া হাঁটে বেচিয়া আসিত। আবার, একদফা এইসব ফসল লগাইত একেবারে শেষ ঋতুতে। অর্থাৎ আলু তুলিত চৈত্র মাসে। সেই আলু পাকাইয়া বালির উপর বিছাইয়া রাখিত, বিক্রি করিত বর্ষার সময়, কতক বিক্রি করিত বর্ষার সময়, কতক বিক্রি করিত বীজ হিসাবে। মূলা-বেগুনও তাই। শেষ মরসুমে পাকাইয়া বীজ করিয়া ঘরে তুলিত এবং পরবর্তী ফসলের মরসুমে গায়ে গায়ে ফিরিয়া সেই বীজ চাষীদের সরবরাহ করিয়া আসিত। টাকা আদায় করিত ফসল উঠিবার পর। বীজে ফসল না জন্মিলে তাহার দাম লইত না। ইহাতেই তাহার দশাটা সে কিছু ফিরাইয়া ফেলিল। শুধু ইহাতেই নয়, বাড়ির হালচালও সে বদলাইয়া ফেলিয়াছিল। প্রতাপ মণ্ডল ব্যবসা ফাদিয়া ঘরে চুনকাম করাইয়াছিল, সে সেই চুনকাম-করা দেওয়ালের চুন ঢাকিয়া মাটি দিয়া নিকাইয়া দিল। খানকয়েক চেয়ার কিনিয়াছিল প্ৰতাপ মণ্ডল। সেগুলা বিক্রি করিয়া দিল। খান দুই বেঞ্চ ছিল, সেগুলার উপরে বীজের হাঁড়ি বসাইল। বাড়ির খাওয়াদাওয়া পোশাকআশাক সব বদলাইয়া দিল। তাহার মা তাহাতে আপত্তি করিল না। আপত্তি করিল মহাতাপ। খাওয়াদাওয়া ভাল না হইলে তাহার চলে না। সে অ্যাঁ-অ্যাঁ করিয়া চিৎকার করিত। দুই-তিন বৎসরে তাহার কথার জড়তা কাটিয়াছে, শরীরও সারিয়াছে, সেই পূর্বের মত সবল দেহ হইয়াছে কিন্তু মাথার গোলমালটা যায় নাই। মধ্যে মধ্যে সে সেতাবকে লাঠি লইয়া তাড়াও করিত।

সেতাব হাসিত। ভাগ্য তাহার ফিরিয়াছে, ভাইয়ের আবদারে রাগ করিতে মন উঠিত না।

ঠিক এই সময়েই একদিন এগার বছরের চাঁপাডাঙার বউ চেলির কাপড় পরিয়া, হাতে রুপার গাড়ু, গলায় মুড়কিমালা দোলাইয়া, দুই পায়ে চারগাছা রুপার মল বাজাইয়া মণ্ডলবাড়িতে

আসিয়া ঢুকিল।

সেও এক বিচিত্ৰ ঘটনা। লোকে বলিল, একেই বলে বিধির বিধান। যে যার হাড়িতে চাল দিয়াছে। নইলে ও মেয়ের বিয়ে হবার কথা কার সঙ্গে—হল কার সঙ্গে।

কথাটা মিথ্যা নয়। মেয়েটির বিবাহের সম্বন্ধ ছেলেবেলা হইতেই ঠিক ছিল গোপাল ঘোষের ছেলে ঘোঁতনের সঙ্গে। কিন্তু হঠাৎ সব ওলটপালট হইয়া গেল।

চাঁপাডাঙার বউ কাদম্বিনীর বাপ উমেশ পাল চাঁপাডাঙার সম্ভ্ৰান্ত চাষী। সম্ভ্ৰান্ত মানে আধুনিক কালের শিক্ষায় শিক্ষিত সম্ভ্ৰান্ত নয়, খটি এদেশের চাষী; গলায় তুলসীর মালা, কপালে তিলক, কাঁধে চাদর, পায়ে চটি তার পোশাক, বিনীত মিষ্ট কথা, অখল অকপট মানুষ, দিনে চাষ করে, নিজে হাতে লাঙল বয়, গো-সেবা করে, সন্ধ্যায় মোটা গলায় হরিনাম করে; ইংরেজি-জানা বাবুদের খাতির করে, ভয় করে, কিন্তু বিশ্বাস করে না, ঘৃণাও করে না। তবে তাহারা যখন তাহার বাড়িতে বর্ষার সময় ধানের অভাব পড়িলে ধার করিতে আসে তাহাদের মনে মনে অনুকম্পা করে। মুখে প্রকাশ করে না। ধান সে দেয়। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে ধান পাইবে না জানিয়াও দেয়। মুখে তখন সে বার বার বলে, হরিবোল হরিবোল!

এই উমেশ পালের স্ত্রী এবং গোপাল ঘোষের স্ত্রী অর্থাৎ ঘোতনের মা, এক গ্রামের মেয়ে, বাল্যসখী সই। গোপালের ছেলে ঘোঁতন ভূমিষ্ঠ হওয়ার ফলে উমেশের স্ত্রী বলিয়াছিল—আমার মেয়ে হলে তোমার ছেলেকে আমি জামাই করব। উমেশের প্রথম দুই সন্তান পুত্র, তৃতীয় সন্তান কন্যা কাদম্বিনী। কাদম্বিনী ভূমিষ্ঠ হইলে উমেশের স্ত্রী সইকে খবর পাঠাইয়াছিল যে…মেয়ে হইয়াছে। কথা যেন পাকা থাকে।

উমেশ পাল খুঁতখুঁত করিয়াছিল। কারণ গোপাল ঘোষ পাইকার অর্থাৎ দালাল মানুষ। ধানের দালালি করে। চাষবাস আছে কিন্তু ধানের দালালিতে ঝোঁক বেশি। সেই সূত্রে আধাশহুরে মানুষ। সদগোপ হইয়াও চাষ করে না, করে ধানের পাইকারিঅর্থাৎ ধান-চালের দালালি। দালালিতে কাজের চেয়ে কথা বেশি। কাজের চেয়ে যেখানে কথা বেশি সেখানে কথার সবই ভুয়া অর্থাৎ মিথ্যা। তবুও স্ত্রীর কথার প্রতিবাদ করে নাই। বাই যখন দিয়াছে মেয়ের মা, তখন না মানিলে উপায় কি? মেয়ের জন্মের পর কিছুদিন বেশ উৎসাহের সঙ্গে মধ্যে মধ্যে দুই বাড়িতে খবরাখবরের আদানপ্রদান চলিল। তত্ত্বতল্লাশও চলিল। তারপর ধীরে ধীরে সব কমিয়া আসিল। তারপর কাদুর বয়স হইল এগার। ওদিকে বাজারে গুজব টিল—নতুন আইন হইতেছে যে, মেয়ে যুবতী হওয়ার আগে বিবাহ দিলে জেল হইবে। বিবাহ নাকচ হইবে। কেহ বলিল চোদ্দ বছর, কেহ বলিল ষোল, কেহ বলিল আঠার বছর বয়স না হইলে মেয়েদের বিবাহ চলিবে না। ভীষণ আইন, সারদা আইন না কি আইন!

ওদিকে গোপাল ঘোষের ছেলে ঘোঁতন নাকি ম্যাট্রিক দিয়াছে। বিবাহের বাজারে ছেলের দর। খুব। গোপাল ঘোষ নাই, মরিয়াছে; উমেশ লোক পাঠাইল ঘোঁতনের মায়ের কাছে, অর্থাৎ স্ত্রীর সইয়ের কাছে। বিবাহ এক মাসের মধ্যেই শেষ করিতে অনুরোধ জানাইল। উত্তর দিল ঘোঁতন। সে বলিয়া পাঠাইল—বিবাহ করিতে সে এখন আদৌ ইচ্ছুক নয় এবং পরবর্তীকালেও সে যখন বিবাহ করিবে তখন লেখাপড়া-জানা মেয়ে বিবাহ করিবে। এগার বৎসর বয়সের মেয়েকেও সে বিবাহ করিবে না। ঘোতনের মা লোকের সামনে ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিল,—আমার দশা দেখে যাও বাবা। সইকে বোলো, সয়াকে বোলো, আমি নিরুপায়। দিনরাত চোখের জল সার হয়েছে আমার। আমার কোনো হাত নাই।

জবাব পাইয়া উমেশ পাল খানিকক্ষণ গুম হইয়া মাটির দিকে চাহিয়া রহিল, তারপর মুখ তুলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। ঠিক সেই মুহূর্তটিতেই পালের বাড়িতে প্রবেশ করিল সেতাব। তাহার সঙ্গে একজন ভারী। তাহার কাঁধের ভারে দুই দিকে বীজের বস্তা। উমেশ পালের মুখটা প্রসন্ন। হইয়া উঠিল। হ্যাঁ, পাত্র সে পাইয়াছে। ঠিক হইয়াছে। সেদিন গণকার কাদুর হাত দেখিয়া বলিয়াছিল—এ মেয়ের পাত্র পায়ে হেঁটে তোমার বাড়ি এসে উঠবে পাল। তুমি দেখে নিয়ো।

কথাটা শুনিয়া উমেশ পালও হাসিয়াছিল। ভাবিছিল,ভারি চতুর এই গণকার মশাই। ঘোঁতনের সঙ্গে কাদুর বিবাহের সম্বন্ধের কথা এখানে মোটামুটি সবাই জানে। সেই কথাটি সে তাকমাফিক চমৎকার ঝাড়িয়া দিয়াছে। আজ কিন্তু সে সেই কালো বামুনকে মনে মনে প্ৰণাম করিল। প্রতাপ মণ্ডল এ অঞ্চলের নামি মানুষ ছিল। তাহার ছেলে সেতাব। বংশ উচ্চ। ছেলের যোগ্যতা ছেলে নিজে প্ৰমাণ করিয়াছে। যে ছেলে ড়ুবন্ত নৌকাকে ভাসাইয়া তুলিতে পারে, সে নাই বা হইল ম্যাট্রিক পাস। উমেশ পাল পরের দিনই সেতাবের বাড়ি আসিয়া তাহার মায়ের কাছে কথা পাড়িল। এবং এক মাসের মধ্যেই বিবাহ শেষ করিয়া নিশ্চিন্ত হইল। সেতাবের মা বউ দেখিয়া খুশি হইল। মহাতাপ বউয়ের ঘোমটা খুলিয়া দিয়া বলিল-এঃ-এই আবার বউ হয়? এইটুকুন মেয়ে।

মা বলিয়াছিলেন—হয়। ওই বউ বড় হবে। তোমার বড় ভাজতোমার মায়ের তুল্য হবে। আমার ঘরের লক্ষ্মী।

সেতাব তাহার পর ধুলার মুঠা ধরিয়াছে, সোনার মুঠায় পরিণত হইয়াছে সে ধুলা। আবার সোনার মুঠা চোখের উপর ধুলায় পরিণত হইতে বসিয়াছে। সাধে সে হায় হায় করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *