২৪. পারছে না সে আর

পারছে না সে আর। পারছে না। জীবন চুকিয়ে দিয়েছে পরিপূর্ণ হিসেব। তাই সে আজ মহাসমুদ্রের পারে এসে দাঁড়িয়েছে। বড় বড় ঢেউ কালীয়নাগের মতো আছড়ে পড়ছে বেলাভূমিতে। আনন্দের ধারাস্নানে মেতে উঠছে মানুষ। সে-ই কেবল দাঁড়িয়ে আছে একা। নিরানন্দ। চার সব হিসেব চুকে গিয়েছে। স্বর্গদ্বার থেকে ভেসে আসছে গন্ধ। তীব্রত্ত নয়, কটুও নয়। ভালও নয়, মন্দও নয়। এক নির্মোহ গন্ধ।এই গঙ্কের রূপ সে চেনে এখন। অবয়ব চেনে। মাত্র কয়েক দিন আগেই এই গন্ধকে প্রত্যক্ষ করেছে সে।

সমস্ত সম্পর্ক ভেঙে মুচড়ে ঠুকরে রক্তাক্ত করে, লাল রক্তের সঙ্গে নীল রক্ত মিশিয়ে অদ্ভুত বেগুনি অন্ধকার ঠেলে অগ্নিময় হয়ে গেল, লেলিহান হয়ে গেল তার কাছে বার বার ঘুরে ঘুরে আসা এই গন্ধবোধ। অতএব সে চেনে, জানে। শুধু স্পর্শ করেনি এখনও। শুধু তার হাত ছাড়িয়ে ছুটতে লাগল শুচু একা, আর বিপদের কথা ভাবল না, সুখ-সন্তাপের কথা ভাবল, যে আসবে তার কথা–যারা আছে তাদের কথা ভাবল না, ভাবলই না, কেবল ছুটে ছুটে চলে গেল আর স্পর্শ করল সেই গন্ধের উৎস, আর শুয়ে পড়ল চোখ বন্ধ করে, শুয়ে পড়ল আর খুলল না চোখ যতক্ষণ না আগুন তার গলা অবধি, তার চিবুক অবধি, তার ঠোঁট নাক চোখ কপাল ও কেশা অবধি গ্রাস করে নেয়।

তারপর? তারপর? ও কি চোখ খুলেছিল? হেসেছিল কি? এক অনির্বাণ চিতার ও, আগুনের গর্ভে শুয়ে শুয়ে হেসেছিল কি ও?? দেখেছিল কি, সে, কত একাগ্র দৃষ্টিপাতে ধরে রেখেছে এক নরকরোটি, শিশুকরোটি। শ্মশানের পাশে মন্দিরের ভাঙা দেওয়ালে, গুঢ় কুলুঙ্গিতে রাখা ওই শিশুকরোটি। তার তলায় রাখা ছিল জ্বলন্ত প্রদীপ। হাওয়ায় তার শিখা কাঁপছিল। আর সে, দেখছিল, জ্বলে যেতে থাকা শুচুকে না দেখে দেখছিল–দেখছিল সেই কাঁপন, আলো-ছায়ার কাঁপন, আর-আর এ-ও দেখছিল যে করোটির অক্ষিকোটরে, মুখবিবরে, নাসিকা গহ্বরে চাপ চাপ অন্ধকার, অরিমিশ্র অন্ধকার, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের সমস্ত অপরিশোধিত অন্ধকার প্রদীপের ওই একরত্তি শিখা বড় দুর্বল ওই অন্ধকারের কাছে।

তখন নদীতে শব্দ উঠেছিল ছপাৎ-ছলাৎ, ছপাৎ-ছলাৎ। আর সকলের অগোচরে ছাই উড়ছিল। সে জানে না–এই ছিল কিনা ভুবন ছাড়িয়ে ভূমায় মিলিত হওয়ার প্রক্রিয়া। জানে না সে। জানত না। জানে না আজও। যেমন জানে না, শ্মশানে, ক্রন্দনমান ছিল যে দেবনন্দন–সে গিয়েছিল কেন মধ্যরাত্রের নির্বাচিত পাড়ায়? মানুষীভোজনে গিয়েছিল কেন সে?

জানে না সে। জানতে চায় না আর। সব মিটে গেছে। ফুরিয়েছে সব।

চন্দ্রাবলী গাইত মাঝে মাঝে।

দেহ ধরে কা দণ্ড হৈ সব কাহুকো হোয়।

জ্ঞানী ভুগতৈ জ্ঞান করি মূরখ ভুগতৈ রোয় ॥

—শরীর ধারণ করা মানেই কষ্ট। জ্ঞানী এ কষ্ট ভোগ করে জ্ঞানে। মুখ ভোগ করে রোদনে।

সে কি জ্ঞানী? সে কি মূর্খ? সে জানে না।সেপায়ে পায়ে নেমে যেতে থাকে মৃত্যুর দিকে। জল হাঁটু ছাড়িয়ে, বুক ছাড়িয়ে গলা অবধি পোঁছে যায়। এবং একটি বিপুল ঢেউ সবলে তাকে জলের গভীরে টেনে নেয়।

সন্তরণ জানে না সে। তার দম বন্ধ হয়ে যেতে চায়। বুকে অসম্ভব চাপ। জলের উথালপাথালে সে একবার ভাসে, ডুবে যায় আবার। আর তার ভয় করে। মৃত্যুকে ভয়। সৌন্দর্য হারিয়ে মৃত্যু সহসা হয়ে ওঠে করাল ও নির্মম। জীবনের চেয়ে অনেক বেশি নির্মম। সে তখন প্রাণপণে হাত তোলে। ডুবতে ডুবতে টের পায় দুটি শক্ত হাতের টান। সে জ্ঞান হারায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *