২২. রবিবার বলে আজ

রবিবার বলে আজ সে বেশি সময় থেকে গিয়েছিল হাসপাতালে। কাল ছেড়ে দেওয়া হবে বাবাকে। বাড়ি ফিরে সে অবাক হল। বিশ্বদীপ কাজে বেরোয়নি। শুয়ে আছে বিছানায়।

জ্বর নেই। এমনিই শুয়ে আছে কাজে না গিয়ে। অভিযোেগ করল মা। সে বিশ্বদীপের পাশে বসে কপালে হাত রাখে। জ্বর নেই সত্যি। কিছুক্ষণ আগেই ছেড়ে গেছে জ্বরটা। জানায় বিশ্বদীপ। এখনও সে তৈরি হয়ে বেরুতে পারত। কিন্তু বড় অবসন্ন বোধ করছে সে। প্রায় সাতদিন হল এইভাবে রাত্রে জ্বর এসে সকালে ছেড়ে যাচ্ছে। আর ক্রমশ দুর্বল করে দিচ্ছে তাকে। বলতে বলতে সে কাশে। কাশির দমকে চোখমুখ লাল হয়ে যায়, চোখ ভরে ওঠে জলে।

স্নান করে খেয়ে নেয় শুভদীপ। তারপর বিশ্বদীপকে নিয়ে সদা ভরসা ডাক্তারের কাছে যায়। আর তাকে পরীক্ষা করে ডাক্তারের মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। কত দিন কাশি, কত দিন জ্বর ইত্যাদি বাঁধাধরা প্রশ্ন করে তিনি থুতু ও রক্তের পরীক্ষা লিখে দেন। সঙ্গে বুকের এক্স-রে।

ভয়ে শুভদীপের মেরুদণ্ডে শিরশিরানি লাগে। কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ করে না। ডাক্তারের বাড়ি থেকে সে সরাসরি রোগনির্ণয় কেন্দ্রে যাবার সংকল্প নেয়। দশ হাজার টাকার পুরোটা খরচ হয়নি। সে নিশ্চিন্ত বোধ করে। একটি রিকশায় উঠতে যাবার মুখে বিশ্বদীপের কাশির দমক লাগে। আবার। কাশতে কাশতে পেট চেপে উবু হয়ে বসে পড়ে সে রাস্তায়। গলা। থেকে একদলা থুতু ছিটকে আসে। আর বিশ্বদীপকে জড়িয়ে থাকতে থাকতে শুভদীপ দেখতে পায় থুতুর সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে রক্ত।

নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না সে। শরীরে কাঁপুনিধরে যায়। প্রশ্ন করে কত দিন থেকে হয়েছে এমন। দু’দিন হল।বেলে বিশ্বদীপ। বাবাকে নিয়ে এত ব্যস্ত সবাই, তাই সে কিছুই বলেৰি জ্বর কমাবার ওষুধ খেয়েছে। কাশতে কাশতে তার গলা চিরে রক্ত বেরুচ্ছে—এমনই বিশ্বাস করে সে। আর শুভদীপ সেই বিশ্বাসকে আঁকষ্ট্রেধরতে চায়। প্রাণপণে চায় সমস্ত পরীক্ষার ফলাফল হোক শূন্য। হোর্ক নেতিবাচক।

বাড়িতে কিছুই বলে না তারা। রক্ত পরীক্ষা বা বুকের এক্স-রে করানোর কথাও বলে না। সারাক্ষণ নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে বিশ্বদীপ। সন্ধের পর শুভদীপ আবার বেরিয়ে পড়ে হাসপাতালের দিকে। আজ রাতে তার না থাকলেও চলত। তবু সে ঝুঁকি নেয় না। চাদর নিয়ে, বাবার খাবার নিয়ে রওনা দেয়। বড় চাপ তার ভিতরে। বড় যন্ত্রণা। কারওকে যদি বলতে পারত একটু। একটু ভাগ করে নিত সব। দেবনন্দনকে আগে বলত অনেক কিছু। কিন্তু সেদিনের পর থেকে আর পারছে না। চন্দ্রাবলীর অনুপস্থিতি বড় বেশি করে বাজছে তার।

দেবনন্দন কেন গিয়েছিল ওখানে? কেন?

সে কেন গিয়েছিল? মালবিকার কাছে? চম্পাকলির কাছে? একদিনই মাত্র। তবু মালবিকার কাছে যাবার জন্য বড় অনুশোচনা হয়েছিল তার। আর চম্পাকলিকে বড় বেশি করে চন্দ্রাবলীর মতো দেখতে। সে কী রকম টানে পড়ে গিয়েছিল। কোনও ব্যাখ্যা নেই এসবের। সে জানে। যদি অন্য কেউ এরকম করত, তবে সে ধিক্কার দিত নিশ্চয়ই।

কিন্তু চম্পাকলির কাছে যাবার জন্য তার কোনও অনুশোচনা নেই। সে জীবনের এক অতুলনীয় যন্ত্রণা বুঝতেই পারত না যদি না যেত সেদিন। গত কয়েক মাসে তার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে।

এত যন্ত্রণা দেখছে চারপাশে, তবু নিজের যন্ত্রণাকেই তার মনে হয় সবার চেয়ে বেশি। আর এইসব ভাবতে ভাবতে সে বাবার কাছে পৌঁছে যায়।

তাকে দেখে হাসে বাবা। ডান দিক অসাড় হয়ে গেছে। বেঁকে গেছে মুখের ডান পাশ। তবু হাসছে বাবা। হাসছে বেঁচে গেছে বলে। আবার বাড়ি ফিরবে বলে। জীবনের কী আশ্চর্য অমোঘ টান।

চারপাশ লক্ষ করে সে। অভ্যাস হয়ে গেছে তার। কোন শয্যার রোগী কেমন আছে, বেঁচে আছে কিনা দেখে সে। আর চোখে পড়ে হাতে টিফিনের বাক্স নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে বাচ্চু। আর আপাদমস্তক সাদা চাদরে ঢেকে শুয়ে আছে তার বাবা। বাবার জন্য আনা ভাত আরুঠোওয়ানো হয়নি। মৃত্যু এসে গিয়েছিল আগেই।

 

মন খারাপ হয়ে যায় তার। বাবাকে চামচে করে খাওয়াতে খাওয়াতে সে বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যায়। বাবার মুখ চেয়ে গলা ভাত গড়িয়ে পড়ে। বার কথা ভাবে সে। এবং একসময় বা উধাও হয়ে যায়। চলে আসে বিশ্বদ্বীপ। আবার বিশ্বদ্বীপের জায়গা নিয়ে নেয় চন্দ্রাবলী। তার ভাবনার মধ্যেই বাবার খাওয়া হয়ে যায়। কৌটো ব্যাগে পুরে বাইরে বেরিয়ে আসে সে৷ জরুরি বিভাগের উল্টোদিকের চাতালে, তার শোবার জায়গায় এসে দাঁড়ায়। এবং সবিস্ময়ে দেখে টিফিনের কৌটো খুলে গ্রাসে গ্রাসে ভাত মুখে পুরছে বাচ্চু।

এক ছুটে নর্দমার পারে গিয়ে হড়হড় করে বমি করে ফেলে শুভদীপ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *