১৫. অবশেষে সূর্যালোক নিভে গেলে

অবশেষে, সূর্যালোক নিভে গেলে একজন আলোকবর্তিকা হাতে তার পাশে এসে দাঁড়ায়। সাধারুণ পোশাকের সাধারণ লোক। শুধু চোখ দুটি করুণাময়। মুখে প্রসন্নতা কিন্তু দৃষ্টি ব্যথাতুরী যেন প্রত্যেকের যন্ত্রণা আহরণ করে দিনান্তে কাঁদবেন তিনি।

সময় হয়েছে, এইবার যেতে হবে। শুভদীপকে তিনি মনে করিয়ে দেন। শুভদীপ অন্যমনস্কতা থেকে বাস্তবে ফেরে। যেতে হবে। যেতে হয়। সময় হলেই চলে যেতে হয়। এই স্থান এখন গাঢ়তর অন্ধকার। সে আলোকবর্তিকা থেকে বিচ্ছুরিত আলোয় সমাধিস্তোত্র পড়তে পড়তে যায়। ধীরে হাঁটেন তিনি। সেও হাঁটে ধীরে। তিনি কথা বলতে বলতে পাশাপাশি। লক্ষ্য, যেন আঘাত না লাগে তার। সে দেখে আর শোনে। দেখে অধিকাংশ সমাধির গায়ে লেখা—Rest in Peace ঘুমোও। শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকো।

সে দেখে। দেখতে দেখতে যায়।

Though you left us, we will meet
again in the land where worries are at rest.

—তুমি চলে গেছ। পুনর্বার দেখা হবে দুঃখের কষ্টের শেষে। তোমাদের আমাদের সবাকার দেশে।

সে শোনে। শুনতে শুনতে পা ফেলে।

এসে যাবে মহাদিন। প্রচণ্ড হুহুঙ্কারে মিলিয়ে যাবে নভস্তল। পৃথিবী বিলীন হবে অগ্নিতে। হবে এক নতুন পৃথিবী। ধর্মের, সততার, প্রেমময় পবিত্র পৃথিবী। ধর্মের সমস্ত নির্দেশ পালনীয় তাই। পাপাচার পালনীয় নয়। ঈশ্বরপ্রেমই সেই শেষ কথা যেখানে পাপ আর পুণ্য এসে মেশে। ঈশ্বরই সেই সত্য যেখানে অন্ধকার চলে যায়, আলো জাগে। যে তরুণ অসৎকে জয় করে সে-ই শক্তিমান কারণ ঈশ্বরের বাণী তাদের অন্তরে জাগ্রত রয়েছে।

সে শোনে। শুনতে শুনতে পা ফেলে। সে দেখে। দেখতে দেখতে যায়।

And in Gods house for evermore my dwelling place shall be.

-ঈশ্বরের চিরকালের গৃহে, তখন হবে আমার পদার্থণী।

সে দেখে। এক ঝলকে দেখে নেয় স্তোত্রলিপি কিন্তু চলে যেতে যেতে সংখ্যা পড়তে পারে না। নামের থেকে চোখ পিছলে স্তোত্রে নেমে যায়। অতএব সে দেখে আর শোনে। দেখতে দেখতে যায়। শুনতে শুনতে পা ফেলে।

সংসারে নয় কখনও। বরং ঈশ্বরে নিবেদিত প্রাণ হতে হয়। কারণ ধর্মহীন সংসার নিম্নতর স্বভাব উদ্বুদ্ধ করে। কামনা জাগায়। তার চোখের লালসা জাগায়। অন্তরে ঐশ্বর্যের অহঙ্কার জাগায়। জিঘাংসায় ভরিয়ে দেয় মন। এই সংসার, এই অধার্মিক সংসার ধ্বংস হবেই একদিন। তখন শুধু বেঁচে থাকরে ধার্মিকেরা। নিস্পাপ ঈশ্বরের অনুগামীরা।

সে ধ্বংস আর লালসা, লালসা আর জিঘাংসা শুনতে শুনতে বোধ করে এমন যেন তার দু’পাশে এক্ষুনি কঙ্কালের নৃত্য শুরু হবে। দ্রুত পা চালায় সে আর সামনে দেখতে পায় বহির্ঘার। সেই দ্বার পেরুলেই পথ। শুনশান পথে পা রাখে সে আর ধন্যবাদ দেবার জন্য ঘুরে তাকাতেই সেই মানুষটি অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। চেনা রাস্তা, চেনা পথ। নিজের জন্য আলো লাগে না তার। সে তখন নিজের মতো এগোয়। সে কি পাপী? সে ভাবতে থাকে। সে কি অধার্মিক? সংসারে আসক্ত ও লালসায় পরিপূর্ণ তার মন? যদি হয় তো হোক, সে বেঁচে থাকতে চায় না। সে বরং চায় সেই প্রচণ্ড ধ্বংস—যখন সেও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সে সমাধিক্ষেত্রের প্রাচীরের দিকে তাকায়। এখানে জীবনের জয়গান নেই কোথাও, বরং আছে মৃত্যুর পূর্ণ আরাধনা। সে আরও একবার এইখানে আসবে বলে ভাবে। আর তক্ষুনি চন্দ্রাবলী হেঁটে যাচ্ছে দেখতে পায়।

তার অল্প আগে, দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে চন্দ্রাবলী। বেঁটে, মোটা, গোল, কালো চন্দ্রাবলী। বিশাল নিতম্বে আলোড়ন তুলে হেঁটে যাচ্ছে। ঘাড়ের ওপর বিশাল খোঁপা এলিয়ে পড়া। সেও, পা চালায় দ্রুত। চন্দ্রাবলীর কাছাকাছি পৌঁছে যায় প্রায়। চন্দ্রাবলী তখন গতি বাড়ায় আরও। প্রায় ছুটতে থাকে। সে-ও দিগ্বিদিক ভুলে, ন্যায়-অন্যায় ভুলে ছুটতে থাকে। আর দোদুল্যমান নিতম্ব দেখে বিবমিষা আসে তার। চন্দ্রাবলী স্মরণে ঘৃণা উপচে ওঠে। ঘৃণার সঙ্গে মিলিত হয় রাগ। আর সব নিয়ে ছুটতে ছুটতে তারা শুনশান পথ ছাড়িয়ে আলোকময় জনবহুলতায় পৌঁছয়। পেছয় আর হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে তাকায় চন্দ্রাবলী। সেও দাঁড়ায় মুখোমুখি। হাঁপায় না তেমন। এবং হতাশ হয়ে দেখে চন্দ্রাবলী নয় মেয়েটি কিছুতেই চন্দ্রাবলী নয়।

কিন্তু তার কী রকম ঘোর লেগে যায়। অসামান্য মোহটান আটকে ফেলে তাকে। মনে হয়, অন্যদিকে দৃষ্টি নিয়ে আবার এই মেয়েটির দিকে তাকালেই সে দেখতে পাবে চন্দ্রাবলী। নিশ্চিতই চন্দ্রাবলী। কিন্তু ঘটে না তেমন। বরং মেয়েটি বাঁকা চোখে জরিপ করে তাকে। তার বড় ইচ্ছে হয় ওই বিভ্রমে ডুবে থাকতে আরও কিছুক্ষণ। কথা বলতে ইচ্ছে করে। সে কী করবে ভেবে পায় না। মনের মধ্যে সমাধিস্তোত্র ঘুরপাক খায়।

The Call was short
The shock severe
To part with one
we love so dear

মেয়েটি অতর্কিতে এগিয়ে আসে কাছে। ফিসফিস করে কথা বলে। তার স্বর গাড়ির শব্দে হারিয়ে যায়। আর শুভদীপ সেই আশ্চর্য গন্ধ পায় আবার। ভালও নয়, মন্দও নয়, এমন গন্ধ। কটুও নয়, তীব্রও নয় এমন গন্ধ। মোহমাদকতাহীন অদ্ভুত নির্বিকার ঘ্রাণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *