১০. একবার কপালের ফোলা জায়গায়

একবার কপালের ফোলা জায়গায় হাত রাখল সে। বাথা কম লাগছে। ঘুম-ঘুম ভাবটা যায়নি, এখনও। ঠিকমতো ভাবতেও পারছে না। মস্তিষ্ক ক্লান্ত। সমস্ত শরীর জুড়ে গভীর বিয়াদ। ট্যাক্সিতে পিঠ এলিয়ে দেয় সে। এখনও অনেকটা পথ। তারপর বাড়ি। সে যেন বাড়ি যায়নি কত দিন! মাবাবা-ভাই আর শুচুকে দেখতে পায়নি কত দিন! আজ সকাল থেকে এই সন্ধে পর্যন্ত সে যেন কয়েকশো বছর পেরিয়ে এসেছে। ঘুমের ভেতর দিয়ে, ঘোরের ভেতর দিয়ে সে যেন পরিক্রমা করে গেছে শত শত বৎসরের পথ। সে ছুটি নেবে। ক্লান্ত সে। ক্লান্ত বড়ই।

ছুটি নেবে। কিন্তু কত দিন! চিকিৎসক বলেছিলেন তার রক্তচাপ নিম্নমুখী। হয়তো সে-কারণে দু’বার মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল। না। প্রথমবার ধাক্কা খেয়ে পড়েছিল। এবং জ্ঞান হারিয়েছিল। তা হলে জ্ঞান সে হারিয়েছিল দু’বার। একই দিনে। সে টের পায় বিশ্রাম প্রয়োজন তার। সকাল থেকে পর পর যা কিছু ঘটে গেছে মনে করে সে। শুচুকে মনে করে। তখন গাড়িচালক এফ এম বেতার চালিয়ে দেয়। সে একটি গানের শেষ কয়েকটি লাইন শুনতে পায়। ক্রমশ কি হয়েআসা গানের শব্দগুলি আনমনে শুনতে শুনতেশসে:আবিষ্কার করে, একটিই পক্তি বার কার গাওয়া হচ্ছে। বাঁধ ভেঙে জল এসেছে বানভাসি। সে জানে না কার গান। কিন্তু যে-গান সে জানে, তাকে চমকে দিয়ে সেই গানই বৈজে ওঠে অতঃপর। ধাঁধার থেকেও জটিল তুমি, খিদের থেকেও স্পষ্ট—! কী হতে পারে? তার শুচু মনে পড়ে, চন্দ্রাবলী মনে পড়ে, শুচু-চন্দ্রাবলী-শুচুচন্দ্রাবলী। চোখের সামনে সুবলের খাঁচা দুলতে দুলতে যায়। সে খাঁচা শূন্য। সুবল নেই। শূন্য খাঁচা একবাটি ছোলা নিয়ে, দুখানি কাঁচালংকা নিয়ে দুলতে দুলতে যায়। তার কান ঝালাপালা হয়ে যায়। ঘেন্না করো ঘেন্না কাে’ ‘ঘেন্না করো ঘেন্না করো’ বলতে বলতে কারা যেন ধাবিত হয় তার দিকে চোখ বড় করে তাকায় সে। দুজন পূর্ণবয়স্ক নারী। একজন অন্ধকার। বিপুলকায়। খোলাচুল মেলে দিয়ে উধর্ববাহু। অন্যজন শীর্ণ। শ্যামলা। দুই কাঁধে দুই বিনুনি ফেলে নতমুখী।

চশমা খুলে চোখ মোছে সে। পিঠ সোজা করে সামনে তাকায়। দ্রুত পিছলে যাচ্ছে পথ-ঘাট। পিছলে যাচ্ছে ‘ঘরবাড়ি, মানুষজন। কোথাও কোনও খাঁচা নেই। চন্দ্রাবলী নেই। শুধু নেই। তবুও এক বিরাট খাঁচা সে অনুভব করে। আর বিরাট খাঁচার সীমাবদ্ধতায়, বিরাটের সীমাবদ্ধতায় ছটফট করে প্রাণ। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। সিদ্ধান্ত নেয়, শুচুর সঙ্গে দেবনন্দনের বিয়েতে রাজি হয়ে যাবে। সিদ্ধান্ত নেয় সে এবং একরকমের আরাম বোধ করে তৎক্ষণাৎ। তার ঘুম পায় আবার। প্রলম্বিত জ্বম্ভণ দেখা দেয় মুখে। ট্যাক্সিতে ঘুমিয়ে পড়া উচিত হবে না ভেবেও সে অতঃপর এলিয়েই পড়ে। টুকরো টুকরো জন আসে তার চোখে। টুকরো টুকরো পাখির ডাক। হাড়ের টুকরো। একটি বিশাল কুয়োর গায়ে বন্ধ দরজা। সে পায়ে পায়ে দরজার কাছে দাঁড়ায়। তার ঠোঁটের দিকে ঠোঁট বাড়িয়ে দেয় এক মস্ত শকুন। সে হু-হাস্ করে, তাড়াবার চেষ্টা কর। পারে না। বরং সেই শকুল, সেই ফুয়ায় উঁচু প্রাচীরের গায়ে পা ঝুলিয়ে বসে মানুষের আদল নেয়। মানুষটি পুরুষ কিন্তু নারীসুলভ সে একটি প্রলম্বিত হাত বাড়ায়। নখ দিয়ে খুঁটে খুঁটে খুলে দেয় জামার বোতাম। সে দেখে, সরু সরু আঙুলে তীক্ষ্ণ নখ। নখে লাল রংকরা। হঠাৎই সেই কুয়োর দরজা থেকে একটি অন্ধকার ঘরে চলে যায় সে। টের পায় একটি উষ্ণ ও নরম কোলে সে শুয়ে আছে। তার চুলে আদরের আঙুলের টান দিচ্ছে কেউ। চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, তার ভাল লাগছে। খুব ভাল লাগছে। কিন্তু ঘাড় টনটন করছে। যে-কোলে শুয়ে আছে তার বেধ বড় বেশি। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে কারণ নাকের ওপর নেমে এসেছে ভারী স্তন। আর জন প্রসন্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন পায়ের কাছে। বলছেন মন জাগত নাহি। মন জাগত নাহি। ফির যাওল শাম। আহা! কী সুর! অবিকল চন্দ্রাবলী। তখন ছেলেটি তার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে দুধের গ্লাস। তাকে খেয়ে নিতে বলছে। গ্লাসের গায়ে তার আঙুলের নখে হলুদ রং করা। তার গা গুলিয়ে উঠছে। বমি পাচ্ছে। সে চন্দ্রাবলীর কাছে অনুযোগ করছে, দুধ খাবে না, কিছুতেই খাবে না। দুধ খেলে তার বমি হয়ে যাবে। আর চন্দ্রাবলী উধাও। সে দেখল সে বসে আছে ট্যাক্সিচালকের কোলে, আর চালক তার কাছ থেকে দু’লক্ষ টাকা চাইছে। দু’লক্ষ টাকা না হলে কিছুই হবে না, অস্ত্রোপচার হবে না। সে পড়িমরি করে উঠে বসেছে। দু’ লক্ষ টাকা! দু’ লক্ষ টাকা সে পাবে কোথায়!

চোখ মেলছে সে। চালকের পাশের খোলা জানালা দিয়ে হু-হু হাওয়া ঢুকে পড়ছে। হাত-পা হিম হয়ে আছে তার। জমাট অন্ধকারে পথ করে ছুটছে ট্যাক্সি। সে হয়তো বা একটি মাঠের পাশ দিয়ে যাচ্ছে। তার চোখে পড়ছে মাঠের কোনায় জলের ফোয়ারা। তার ওপর রঙিন আলো পড়ছে। ফোয়ারার জল নৃত্যপর। সে জানে, ওখানে গান বাজছে। আর গানের তালে তালে ফোয়ারার জল নৃত্যপর। সন্ধে যেতে না যেতেই জেগে উঠেছে নাগরিক মুনসিয়ানা।

সে ব্যাগের চেন খোলে। জনের দেওয়া খাম খোঁজে ভেতরে,আজও সে যেতে পারেনি সেই ভ্রমণ সংস্থায়, জনের দেওয়া বৃদামাতার অর্থে ভরসা করে ট্যাক্সি নিয়েছে। না হলে, এই অসুস্থ অবস্থায় তাকে বাসে চাপতে হত। এই সন্ধ্যায় ঘর-ফিরতি যাত্রী বোঝাই বাস। সে দম নিতে পারত না। ব্যথা জায়গায় ব্যথা পেত আবার। এই যেমন একটু আগে ঘুমিয়ে পড়েছিল, তেমনি হলে কেউ পা মাড়িয়ে জাগিয়ে দিত তাকে। কেউ কনুইয়ের তঁতোয়। ধীরগামী বাসে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হত ঠায়, আর এই শীতের সন্ধ্যায় এখন তার হাত-পা হিম হয়ে যাচ্ছে, তখন সে ঘেমে উঠত। সারাদিন পরিশ্রম করা, ক্লান্ত, বিরক্ত, তিরিক্ষি মেজাজের মানুষগুলির সঙ্গে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে ঘেমে উঠত। আর, হয়তো, কে জানে, অজ্ঞান হয়ে যেত আবার।

সে হাতে খামের অস্তিত্ব টের পায়। দুআঙুলে ধরে বার করে আনে। ট্যাক্সির ভিতরকার আধো আলো আধো অন্ধকার খামটি সম্পর্কে মনে বিভ্রম জাগায়। ঠিক এরকমই খাম তাকে দেননি জন। কিছু একটা তফাত। কিছু একটা অন্যরকম। সে মুখ খোলে। খোলা মুখ ডান হাতে ধরে বাঁ হাতে উপুড় করে দেয়। আর দেখতে পায়, একটি ভাঁজ করা কাগজের ওপর সার সার একশো টাকা। তার বাঁ হাতে ভর দিয়ে, খামে অর্ধাংশ লুকিয়ে সোজা। শিষ্ট। সে বার করে নেয় সব। গুনে মোট তিন হাজার টাকা আবিষ্কার করে। এবং কিছু বুঝতে পারে না। ভাঁজ করা কাগজটি খোলে। চিকিৎসকের নিদানপত্র। ছেলেটির মুখ ঝলকে মনে পড়ে যায়। সে বিশ্বাস ‘ করতে পারে না। নিজের উপলব্ধিকে বিশ্বাস করতে পারে না। সে সন্দেহ করে, জনের দেওয়া টাকা সে এই খামে পুরে ফেলেছে কিনা। ঘোরের মধ্যে, ঘুমের ঘোরের মধ্যে, সে এই ধরনের কাজ কিছু করে ফেলেছে কি না। এমনকী এই সম্ভাবনার কথাও বিশ্বাস করতে পারে না সে। সে তখন গুনতে থাকে। একে একে গুনতে থাকে। তিরিশে দাঁড়ায়। আবার গোন। আবার গোনে। আবার! তার কাছে তিন হাজার টাকা!

সে তখন আবার ব্যাগ খোঁজে। এবং আরও একটি খাম পেয়ে যায়। ব্যাখ্যাতীতভাবে তার মনের মধ্যে প্রত্যাশা জাগে—এই খাম খুলেও সে পেয়ে যাবে পরিষ্কার টান-টান ত্ৰিশখানা একশো টাকার নোট। গভীর আগ্রহে খামে উঁকি মারে সে৷ আছে। টাকা আছে। আগের খামটি উরুর নীচে চেপে রেখে সে গুনতে থাকে। তার ক্লান্তি হঠে যায়। কপাল ব্যথা করে না। নিম্নচাপমুখী রক্ত, ঊর্ধ্বচাপের সম্মুখীন হয়। আর ঝকমকে টানটান টাকার পরিবর্তে সে পায় ময়লা নরম একশোটি দশ টাকা। এক হাজার টাকা সর্বমোট। তার আর দ্বিতীয়বার গুনতে ইচ্ছা করে না। তার কাছে এখন চার হাজার টাকা! হঠাৎ নিজের ভাবনায় লোভী প্রত্যাশায় সে চমকে ওঠে। দারিদ্রের ধাক্কায় এ কোথায় নেমে এসেছে সে! লজ্জায় উত্তপ্ত হয়ে যায় কান। তার ইচ্ছে করে, সমস্ত টাকাই সে উড়িয়ে দেয় জানালা দিয়ে। এই পৃথিবীতে অনাদৃত উপলখণ্ডের মতো ফেলে রাখে ভুয়ো কিংবা ফিরিয়ে দিয়ে আসে সেই সব দাতা কর্ণদের।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারে না কিছুই। তার মনে পুড়ে, এই সব টাকার অনুগ্রহ এখনই সে নিয়ে বসে আছে। ট্যাক্সিভাড়া দিতে হবে তাকে। অসহায়তায় কান্না পায় তার। কেন তাকে এতখানি অনুগ্রহ করা হল। তাকে কি দেখলেই খুব দুঃস্থ লাগে এখন? দেখলেই কি মনে হয় সে মূল্যহীন। অক্ষম! সংসার প্রতিপালন করতে পারে না। এমনকী আত্মপালনেও দড় নয়। সে নিজের পোশাকের দিকে তাকায়। রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল বলে শার্ট ময়লা হয়ে আছে। কালই কাচা হয়েছিল বলে ইস্ত্রি করেই পরে নিয়েছে প্যান্ট। বাড়িতে ইস্ত্রি নেই। রাস্তার মোড়ে ইস্ত্রিওয়ালার কাছে যেতে হয়। তার আর ইচ্ছে করেনি। চন্দ্রাবলীকে মনে পড়ে তার। সে বলত, নিজের আচরণে, অবয়বে নিজের দৈন্য প্রকাশ করতে দিতে নেই। দৈন্য প্রকাশ পেলে মানুষ হয় তাচ্ছিল্য করে, নয়তো করুণা করে। তাচ্ছিল্ল্য ও করুণা দুই-ই মানুষকে করে দেয় মেরুদাঁড়াহীন।

সে কি তবে হয়ে যাবে মেরুদাঁড়াহীন, আর চেয়েচিন্তে, দয়া ও করুণার দ্বারা বেঁচে থাকবে আজীবন? ভয় করে, অসম্ভব ভয় করে তার। এই যে নগরের এত আলো, এই যে এত বড় শহরের এত প্রাণ, এত উল্লাস কিছুই দেখে না সে। শুধু দেখে অন্ধকার। আপামর অন্ধকার। আদিঅন্তহীন। লয় নেই, ক্ষয় নেই এক দুর্মদ অন্ধকারে সে একা একা তলিয়ে যেতে থাকে। আর টের পায়, টের পেতে চায়, এই অন্ধকারের অন্য নাম জীবন। কালো, কুৎসিত, জিঘাংসায় পরিপূর্ণ জীবন। এর থেকে মুক্তির আকুলতায়, আলোয় আলোময় মৃত্যুকে আঁকড়ে নেবার আকুলতায় সে ছটফট করে। কেবলই ছটফট করে।

আর তার অন্যমনস্কতায় ঊরুর ভাঁজে রাখা খাম নীচে পড়ে যায়। সে তুলে নেয় খাম আর মনে পড়ে ছেলেটিকে। মৃত্যুর রূপেপাসনা ছেড়ে সে তখন ছেলেটিকে ভাবে। তার আশ্চর্য আচরণ ভাবে সনে পড়ে যায় তার আঙুল সঞ্চালন। ছেলেটির মধ্যে কোথায় কিছু ব্যতিক্রমী ছিল। কী, সে বুঝতে পারে না। মেলাতেও পারে না কিছুচ্ছেলেটি অসুস্থ অবস্থায় তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। চিকিৎসক এনে তাকে পরীক্ষা করিয়েছিল। শুক্রয়া করেছিল তাকে। ময়লা শার্ট খুলে পাঞ্জাবি পরিয়েছিল। ছেলেটির বিছানায় শুয়েছিল সে। এবং বিনিময়ে সে নামও জিজ্ঞেস করেনি। চরম অভদ্রতা নামও জিজ্ঞেস করেনি।

তার সমস্ত ঘোর কেটে যেতে থাকে। মাথার জমাট মেঘ খুলে স্কুলে যায়। ভেসে যায় অন্য গাঁয়ে। অন্য দেশে। আর সে সন্ধানে ব্যাপৃত হয়। কারণের সন্ধানে রত থাকে। জনের অর্থপ্রদানের যুক্তিসম্মত কারণ বুঝতে পারে। কিন্তু ছেলেটির আচরণের থই পায় না। জীবনের গায়ে লেগে থাকা ব্যাখ্যাহীন সহস্র বিস্ময়ের সংশয় ক্লান্ত করে। সে এক সাদা-মাটা মানুষ তুচ্ছতর মানুষ, হঠাৎ জীবন, একটি দিনের জন্য তার কাছে হয়ে যায় পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা। আর এফ এম বেতারের গান প্রতিহত করে আর মনোঅনুরণিত হয় বহুদিন আগেকার সুর। কলেজ সময়কার সুর। কখণ্ড সময় আসে, জীবন মুচকি হাসে, ঠিক যেন পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা…তে রীতিমতো গুনগুন করে। বাইরের দিকে তাকিয়ে অপস্রিয়মাণ দোকান বাজার-লোক আনমনে দেখতে দেখতে সুমনকে গায়–

কখনও সময় আসে, জীবন মুচকি হাসে
যেন পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা
অনেক দিনের পর মিলে যাবে অবসর
আশা রাখি পেয়ে যাব বাকি দু’আনা।

একবার গায় সে। দু’বার গায়। এবং তৃতীয় বার গাইবার সময় মনে করতে পারে না পরের স্তবক। কী ছিল যেন! কী ছিল! কিছুতেই ধরা দেয় না শব্দগুলি।

সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গান কত প্রিয় ছিল তখন। মুখস্থ হয়ে যেত একের পর এক। কী ভীষণ অনুপ্রাণিত হত তারা প্রত্যেকে। সব বন্ধুরা। টিউশনের ঝক্কি গায়ে লাগত না। বাবার অসুখ, বোনের নীলাভ জীন গাঁয়ে লাগত না। সবসময় টগবগে, চনমনে ছুটতে থাকা এক। থিতিয়ে গল কবে থেকে স। বদলে গেল কত। চন্দ্রাবলীর নিরন্তর সান্নিধ্যে, কে শাস্ত্রীয় সংগীতে টান লেগে গেল তার। অতএব, যখন যতটুকু পারে, কিনে নেয় কিশোরী আমনকর, পদ্মা তলোয়ালকর, কিংবা উল্লাস কশলকর ও ভীমসেন যোশী। সেসবেও ধুলো পড়ে গেছে। শুচু শোনে না এসব। বিশ্বদীপও শোনে না। ঙ্গি কেবল একা একা এইসব এনেছিল ঘরে আর একা একা বিস্মৃত হয়েছে। নিজস্ব ভাললাগা প্রতিস্থাপন করেও. সে ভুলে গেছে সমস্ত আকাশ।সুমনের গান আর একটিও পুরোপুরি মনে নেই। রাগে রাগিণীতে সে আর নোনাধরা জীবনকে ভরিয়ে রাখে না ভোরে। সে শুধু ভাবে। মৃত্যু সম্বল করে পাড়ি দেয় রোজকার পথ।

তবু আজ, জীবনের ভার অনেকটা নির্মল করে দেয় সুমনের মনে পড়া গান। ঠিক যেন পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা এই গোটা দিন চার হাজার টাকা হয়ে তার হাতে পোষা বেড়ালের মতো বসে থাকে। মিনি পুষিটির মতো সে টাকাদের গায়ে হাতও বুলিয়ে দেয়। তারপর সযত্নে ব্যাগে পুরে রাখে। গুনে গুনে একশো টাকার দুইখানি নোট তুলে জামার পকেটে রাখে। ট্যাক্সির ভাড়া হিসেবে। বাড়ি নিকটতর হয়। আর সে ভাবে। বঁদ হয়ে ভাবে কী কী করবে এই টাকায়। থই পায় না। তার মনে হয় সমস্ত ছোট-ছোট চাহিদাগুলি পূর্ণ করা আছে। আর সমস্ত বড়বড় চাহিদাগুলি চার হাজারে পূর্ণ হয় না। অতএব এই টাকা মুহূর্তে অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়।

মাঝে-মাঝে টাকার কথা বলত চন্দ্রাবলী। অনেক টাকা পেলে কী কী করবে বলত। তার সেই দীর্ঘ তালিকায় শুভদীপের বাবা আর বোনকে বিদেশে না হোক, অন্তত ভেলোরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে আনার কথাও বাদ যেত না।

আর তিন বছর বাদের বৃহস্পতির দশা আসছিল তার। সে স্থির করেছিল সেই সময় কোটি টাকার লটারি কিনবে। যদি লেগে যায়। বৃহস্পতির দশাই জীবনের সেরা সময়। তখন একটা লটারি, লেগে যেতে পারে। ছোটখাটো প্রাপ্তি সে চায়নি। ধরা যাক, এক লাখ কি দু’লাখ সে চায়নি। সে চেয়েছিল—এমনই থেকে যাবে বরাকর যেমন আছে। নিম্নবিত্ততায়। অথবা বৈভবের শিখরে থাকবে সেঞকিছুটা পেল, যা সে খরচ করতেও পারল না প্রাণ খুলে, আবার-যাকে রাখতেও বিবেকে বাঁধল—এমন কিছু সে চায়নি। শুভদীপ লোভী ভাবত চন্দ্রাবলীকে। টাকার স্বপ্নে বিভোর ভাবত। একদিন বলে ফেলেছিল, এতই যখন টাকার চাহিদা তখন সে রবিদাকে ছেড়ে এল কেন!

চন্দ্রাবলী রাগ করেনি। কষ্ট পায়নি। শুধু চাপা স্বরে বলেছিল, সে কি জানে না, আত্মসম্মানের জন্য মানুষ সব করতে পারে! এক টানে ফেলে দেয় সব ইচ্ছা, সব স্বপ্ন, সব চাহিদা। জীবনে কখনও কখনও আসে এরকম প্রশ্ন। আত্মসম্মানের প্রশ্ন। আত্মসম্মানের বিনিময়ে সর্বস্ব খোয়াবার প্রশ্ন। সে কি জানে না? জানে না কি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *