০৯. ছেলেটিকে দোকানেই দেখেছিল সে

সে গিয়েছিল কন্ডো*ম কিনতে। কন্ডো*ম ফুরিয়ে গেছে তার। কন্ডো*ম ছাড়া সে কারওকেই কখনও গ্রহণ করে না। ছেলেটিকে দোকানেই দেখেছিল সে। আর দেখামাত্রই ভাল লেগেছিল তার। চিকণ শরীর। গালে মাখা বিষণ্ণতা। চশমার আড়ালে শুন্যে ভাসা চোখ। সে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল। যদি চায়। চায়নি। সে তখন তার পিঠ বরাবর দাঁড়ায় এবং ছেলেটির নিতম্বে চাপ দিতে থাকে। একটিবার ঘাড় ঘুরিয়েছিল সে। বলেনি কিছুই।

সে যখন রাস্তায় দাঁড়ায়, আর কোনও কামার্ত পুরুষ তাকে আবাহন করে, তখন সে দেখে পুরুষটির রুচিবোধ। গড়ন। পরিচ্ছন্নতা। বলিষ্ঠ, রুচিবান ও পরিচ্ছন্ন পুরুষরাই একমাত্র লাভ করে তাকে।

ইদানীং নিত্যনতুন সুনায়র নেয়ই না সে। প্রয়োজন নেই। যৌনতা বৃত্তি হলেও সে যৌনদাস নয়। শুধুমাত্র এই বৃত্তিই তার গ্রাসাচ্ছাদনের সহায়ক নয়। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় কাজ করে সে। ভাল মাসোহারা পায়। পড়ায় সে যৌনকর্মীদের। নিরক্ষরকে অক্ষর চেনায়। সে পড়তে-লিখতে

 

পারে, তাকে দেয় বহির্জগতের দীক্ষা। আর দেয় স্বাস্থ্যজ্ঞান। জন্ম থেকে এ অঞ্চলে থেকে সে দেখেছে, শরীরই সব, শরীরই একমাত্র সারবস্তু, জীবনের মূলধন। কিন্তু শরীরকে যত্ন করে না কেউ। সাজায়। ক্রিম মাখে। শ্যাম্পু করে। গয়না পরায়। দামি পোশাক তোলে। কিন্তু যত্ন করে না। অসুখ করলে চেপে রাখে, যতক্ষণ না দগদগে হয়ে দেখা দেয়।

কন্ডো*ম ব্যবহার করতে রাজি হয় না অনেক খদ্দের। কিছু না করে চলে যাবে বলে ভয় দেখায়। আর বেশ্যার দল উপার্জন হারানোর ভয়ে রাজি হয়ে যায় তখন। আর সংবহন করে রোগজীবাণু।

তাদের শরীরে থিকথিকে রোগ। থিকথিকে অপষ্টি। ভাবলে তার বুকের মধ্যে টনটন করে। যক্ষ্মা, রক্তাল্পতা ও যৌনরোগে সমস্ত প্রাণশক্তি ধ্বংস হয়ে যায়। ইদানীং মড়কের মতো ঢুকে পড়ছে এডস। ভয়াল, ভয়ঙ্কর, এডস।

সে শুধু বোঝাবার চেষ্টা করে। সকলেই সংহত হলে, সকলেই কমে পরার দাবি জানালে, যারা আসে, তারা বাধ্য হবে। চলে যাবে না কোথাও। যাবে না কারণ বেশ্যাদের দুয়ারে যারা আসে তারা কামপীড়িত। সঙ্গম না করে তাদের উপায় নেই।

বেশ্যার দল হেসে-হেসে ঢলে পড়ে এ ওর গায়ে। বলতে থাকে, এবার থেকে বাবুদের টুপি পরিয়ে বসাবে তারা। টুপি পরালে শিশ্নসমূহ কীরকম বেড়ালের ল্যাজের মতো নরম হয়ে যায় তারা আলোচনা করে।

সে নিজে এ সব শব্দ ব্যবহার করে না। তার জিভ আটকে যায়। এইসব বেশ্যাদের মতো সে নিজেকে রাখতে পারে না কুঠুরিবদ্ধ জীবনে। এই অঞ্চলে, এই সব বেশ্যাদের জীবন তার মনে হয়, চির্ডিয়াখানার জন্তু-জানোয়ারের মতো অনেকটা। শুধু তোষণ। শুধু দেহানুরঞ্জন। বিনিময়ে ক্ষয় হয়ে যাওয়া। পেট পুরে খেতে পর্যন্ত পায় সব।

খোলতাই চেহারা থাকলে রোজগার ভাল হয় যদিও। একেবারে সোনা-গয়নায় মুড়ে যায় শরীর। যেমন তার নিজের বাড়ছে ব্যাঙ্কে জমানো টাকার পরিমাণ। কিন্তু তাতেও, সে দেখেছে, এই সব মেয়েদের জন্ম খিদে একটি সংসারের জন্য। স্বামীর জন্য। সমাঁজের স্বীকৃতির জন্য। এই সব স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাজও সেই সব নিয়ে। স্বাস্থ্য সচেতনতা গড়িয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে যৌন কর্মীদের সামাজিক প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন সংগঠিত করা। যৌনকর্মীদের তারা শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃত করতে চায়।

সে নিজে এই সব আন্দোলনে যোগ দেয় না। সে এমনকী বিশ্বাসও করে না, শ্রমিকের স্বীকৃতি পেলেই যৌনকর্মীরা সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। গৃহস্থ পাড়ায় বাস করে পাশের বাড়ির কাকিমার হাতে রান্না করা কাঁচকলার কোপ্তা পাবে, অথবা কাকুর কাছে হয়ে উঠবে ঘরেরই মৌটুসী।

হবে না। হবে না এমন। হাজার বছরের পুরনো এই বৃত্তি টিকে আছে। ঘৃণিত হয়েই। এই ঘৃণা মুছতে চলে যাবে আরও হাজার বছর। ঠিক যেমন করে সমাজে দেবতারা প্রতিষ্ঠিত হয়, আর পেয়ে যায় এক অনন্ত আয়ু। কিন্তু অনন্তও শেষ হয়ে যায় একদিন। কারণ অনন্ত পরিবর্তিত হয়ে পায় অন্য অনন্তধারা। এক অসীম অন্য অসীমে ধাবিত হয়। এক যম, আজও জীবিত থেকে পরিবর্তিত হয়েছেন কতবার। পুরাণে যম ন্যায়ধর্মের অধিপতি ধর্মরাজ। ধর্মাধর্ম বিধানজ্ঞ সর্বধর্ম প্রবর্তক। ঋগ্বেদে যম অগ্নিস্বরূপ। অগ্নিরূপী যম উচ্যতে। তিনি অপশক্তিরূপে সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সংযমিত করেন। আবার এই ঋগ্বেদেই যমকে বলা হচ্ছে সূর্য। সমস্ত কিছুর মধ্যে থেকে সারা বিশ্বভূমন্ডলকে প্রতিপালিত করছেন সুর্য। যিনি সূর্য তিনিই যম! অন্তরীক্ষ তিনি। মাধ্যমিক। মাধ্যমিকো যম ইত্যাহুঃ।

আবার সূর্য ও যম অভিন্ন বলেই যমের আরেক নাম তুর। কারণ যম তীব্র গতিসম্পন্ন। সূর্যের আলোকরশ্মির চেয়ে দ্রুতগতি আর কিছুই নেই এ মহাবিশ্বে। অতএব যম শব্দ তরণার্থক। তুর শব্দের অর্থ দ্রুত গমনশীল যম। তরণার্থক তৃ ধাতু থেকে বা শীঘ্রত্ব পরিচায়ক ত্বর ধাতু থেকে তুর। যম তরণশীল। সূর্য তরণশীল। দ্রুতগতিতে প্রতিদিন পার হয়ে যান মহাকাশ। তরণশীল ও তুর্ণগতি।

এরপর যম হয়ে উঠলেন কিংবদন্তি। মহাভারতে যমের বর্ণা আছে… পুরুষং রক্ত বাসসম্‌। বদ্ধমৌলিং বপুষ্মন্তমাদিত্যমতেজসম্‌ ॥ শ্যামাবদাতং রক্তক্ষং পাশহস্তং ভয়াবহম্‌।

এখানে যম হয়ে উঠেছেন ভয়াবহ। রক্তবাসবদ্ধমৌলি। দিবাকরের ন্যায় তেজস্বী। শ্যামবর্ণ। রক্তনয়ন। ভয়ানকৃপুরুষ। দিবাকরের মতো তেজস্বী–অর্থাৎ যম এখানে স্বয়ং সূর্যনন আর। পাশ হস্তে তিনি দন্ডায়মান। অর্থাৎ এখন আর তিনি জগতের প্রতিপালক নয়। তিনি পীতবস্ত্রখাতোয়মিব তোয়ন্দলশ্যামং পীতাম্বনেও তিনি ধর্মরা ধর্মরাজ বটে। কিন্তু ঘাতক।

কালিকাপুরাণে যমকে বলা হয়েছে প্রাণদণ্ডস্য সাধন। এখানে তিনি ভয়াল দর্শনকৃষ্ণাস্ত্ৰং স্থূলপাদং বহিনিঃসৃতদন্তক ভয়াভয়প্রদং নিত্যং নৃণাং মহিষবাহন ॥ মহিষের পিঠে বসে থাকেন যম। তাঁর সঙ্গে কালো অস্ত্র, পাগুলি স্থূল আর মুলোর মতো দাঁত। মানুষকে নিত্য ভয়-দান করেন, অভয়ও।

মৎস্যপুরাণে যমের রূপ একটু খুলেছে। এখানেও তিনি ধর্মরাজ এবং প্রাণহরণকারী। নীলোৎপলদলশ্যামং পীতাম্বরধরং প্রভুম৷ বিদ্যুতা নিবদ্ধাঙ্গং সততায়মিব তোয়দ। নীলপদ্মের পাপড়ির মতো শ্যামবর্ণ যম, পীতবস্ত্রধারী যেন বিদ্যুৎবেষ্টিত জলভারাক্রান্ত মেঘ।

পদ্মপুরাণে যম পাপীগণকে দণ্ডপ্রদান করছেন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে যম আবার স্বয়ং ধর্ম নন। যদিও এখানে যমের অনেক নাম। যেমন–ধর্মরাজ, শমন, কৃতান্ত, দণ্ডধর ও কাল। পাপীগণের শুদ্ধিনিমিত্ত তিনি দণ্ডধারণ করেন, কিন্তু তিনি স্বয়ং ধর্ম নন। ধর্মের অংশ।

শেষ পর্যন্ত টিকে আছেন যম। কথায়, ভাবনায়, বাগধারায়। কিন্তু ধর্মরাজ হিসেবে তাকে আর মনে রাখে না কেউ, যতখানি তিনি আছেন কৃতান্ত হয়ে, শমন হয়ে। যুগে যুগে রূপ এবং মর্যাদা পাল্টে পাল্টে গিয়েছে স্বয়ং কৃতান্তের।

এমনই হতে থাকবে এই বৃত্তির। এই বেশ্যাবৃত্তির। ভোল পাল্টাবে হয়তো। কিন্তু কৃতান্ত হয়েই টিকে থাকবে আরও হাজার হাজার বছর। ঘৃণিত হয়ে টিকে থাকবে।

তবু সে চায় এই আন্দোলন সফল হোক। যা আছে তাকে নেই বলার ভণ্ডামির মুখে প্রস্রাব করা যাবে তাহলে। হাড় জিড়জিড়ে বেশ্যার কাছ থেকে বখরা খিচে নেওয়া পুলিশের মুখে লাথ কষানো যাবে। খুশি হবে সে, খুব খুশি হবে, যদি স্বীকৃতি পেয়ে যায়। আদালতে গিয়ে মানুষের মতো অধিকার তো চাইতে পারবে। এমনকী সুরক্ষিত হতে পারবে সন্তানের ভবিষ্যৎ।

সে ছেলেটির দিকে তাকায়। কোমল মুখ। কিন্তু চোখের তলায়। ক্লিষ্টতার ছাপ। ঘুমোচ্ছে। ডাক্তার বলে গিয়েছেন, তাকে যেন ঘুমোতে দেওয়া হয়। কপালের এক জায়গায় ফোলা, থ্যালানো। ওষুধ দিয়ে লিউকোপ্লাস্ট লাগানো হয়েছে সেখানে। তার গা থেকে ধুলোমাখা শার্ট খুলে দিয়েছে সে। পরিয়ে দিয়েছে নিজের নতুন পাঞ্জাবি। ছেলেটি তখন ঘোরের মধ্যে চন্দ্র বলছিল। চন্দ্রাবলী উচ্চারণ করছিল। চন্দ্রাবলী কে সে জানে না। কিছুই জানে না ছেলেটি সম্পর্কে। শুধু নাম জানে। শুভদীপ। শুভদীপ ভট্টাচার্য। শার্টের পকেটে নামপত্র ছিল। অবশ্য যদি নামপত্ৰখানা তার নিজেরই হয়ে থাকে।

ডাক্তারকে এই নামই বলেছে সে। শুভদীপ। আর শুভদীপ ছেলেটির রক্তচাপ নিম্নগামী। সে যে দোকান থেকে বেরিয়েই মাথা ঘুরে পড়ে যায়, সেসব এ কারণেই। ডাক্তার বেশ কিছু রক্ত পরীক্ষা করার প্রয়োজনীয়তার কথা লিখে দিয়েছেন। ছেলেটি জেগে উঠলে সে সব পরীক্ষার জন্য তাকে নিয়ে যেতে পারত। তার ভাল লেগেছে, শুভদীপকে ভাল লেগেছে।

তার কাছে যারা খদ্দের হয়ে আসে এখন, বেশির ভাগ চেনা হয়ে গেছে। দূরভাষে সময় নির্দিষ্ট করে নেয় সে। এবং সে জানে, কার কী পছন্দ। পেশাগত যৌনতার সময় তার নিজের পছন্দের কোনও জায়গা নেই। সে চায় পরিচ্ছন্ন লোক। যদিও তার অভিজ্ঞতা আছে, পরিচ্ছন্ন, মূল্যবান পোশাক পরা সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত মানুষ অন্তর্বাসে বড়ই নোংরা। নোংরা অন্তর্বাসের নীচে তাদের যৌনকেশে ময়লা চিটচিটে হয়ে লেগে থাকে।

প্রথম প্রথম যখন তার দারিদ্র ছিল–সে, চোখ বুজে, দম বন্ধ করে চোষণ করত। খদ্দের চলে গেলেই বমি করত হড়হড় করে। বাড়তি খরচ করার সঙ্গতি হওয়ার পর সুগন্ধি লাগানো তোয়ালে দিয়ে সে সমস্ত শরীর মুছে দেয় আগে। অতিরিক্ত পরিষেবা হিসেবে প্রত্যেকেই উপভোগ করে এই প্রক্রিয়া।

এদের কারও প্রতি তার ভাললাগা মন্দলাগা নেই৷ এদের দেহে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এদের ইচ্ছে-অনিচ্ছেতেও সে অভ্যস্ত। গোটা খেলায় তার আছে কিছু নিয়মানুগ প্রক্রিয়া। কিছুক্ষণ-আলিঙ্গনে আবদ্ধ থাকা। তারপর কানের লতি থেকে শুরু হয় লেহতার আগে অবশ্য নিজেকে পোশাক-মুক্ত করে নেয় সে।

কানের লতি থেকে ধীরে ধীরে নীচের দিকে নামে। স্তনবৃন্তে দু’ঠোঁটের চাপ দিলেই পুরুষগুলো ছটফট করে। উঃ আঃ করে।

দেখে-দেখেই চমৎকার নাচ শিখেছিল সে। তার শরীরে আছে মেয়েলিপনা। ছিপছিপে, ফর্সা, টানা টানা নাক-চোখের কারণে, কোঁকড়ানো মাথাভর্তি চুলের মহিমায়, সে জানে সে আকর্ষণীয়। যতখানি মেয়েদের কাছে, তার চেয়ে অনেক বেশি পুরুষদের কাছে। মেয়েদের সঙ্গে মিশতে সে পছন্দ করে কিন্তু মেয়েদের প্রতি তার কোনও যৌন আকর্ষণ নেই। নিজের আনন্দের জন্য সে চায় সুদর্শন ছিপছিপে পুরুষ। যেমন এই শুভদীপ ছেলেটি।

ভাল নাচ করে বলে একটি হিজড়ের দলের মধ্যমণি হয়ে বহুবার লগানে গিয়েছে সে। বিহারের নানা অঞ্চলে ঘুরেছে। এক-একবার গেলে দশ থেকে পনেরো হাজার টাকা উপার্জন হত তার। এই লগানই তাকে দারিদ্র থেকে মুক্তি দেয়। শেষ পর্যন্ত সে এই যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। কারণ হিজড়ের দল তাকে তাদের গুরুমার কাছে দীক্ষা নিতে বলে এবং শিশ্ন কর্তন করার পরামর্শ দেয়।

সে হিজড়ে নয়, সে জানে। লিঙ্গ পরিবর্তন করতেও সে চায় না। সে সমকামী। সে টের পায় তখন, হিজড়েরা তাকে নিজের লোক মনে করতে পারছে না। কলেজে স্নাতক স্তরের চূড়ান্ত পরীক্ষা এসে গিয়েছিল তখন। সে সব বন্ধ করে পড়াশোনায় মন দেয়। সেই থেকে আর যায়নি। হিজড়ে নাচের ওই ঢং ও অশ্লীল অঙ্গভঙ্গিতে ও বাক্য ব্যবহারের সঙ্গে নিজেকে মানাতেও পারছিল না সে। অর্থবান বিহারিদের আঙিনায় নাচ দেখানো, প্রায় ভিক্ষের মতো লাগত।

নাচের পেশা সে ছাড়েনি। নাচ অবলম্বন করে এক নতুনতর পেশায় তাকে নিযুক্ত করেন অলকবাবু।

অলকবাবু বেশ্যাদের দালাল। বেশ্যাপাড়ার ছিচকে দালাল নন। তার কাজ বড় মাপে। প্রতিষ্ঠিত, ক্ষমতাবান মানুষদের জন্য সমাজবালিকা সরবরাহ করেন তিনি। এই বালিকারা কেউ-ই নির্দিষ্ট অঞ্চলের নয়। হাড়কাটা গলি বা কালীঘাট বা ইকবালপুরও সোনাগাছিয়ার নয়। এরা থাকে বড় ফ্ল্যাটে, বিলাসে, আরামে।

এই অলকবাবুর কিছু খদ্দের আছেন মহিলা। তাঁদের উচ্চপদস্থ বা ব্যবসায়ী স্বামীরা ব্যস্ত থাকেন সারাক্ষণ। হুট করতেই দেশে বিদেশে চলে যান। উপোসী ও উপেক্ষিতা স্ত্রীরা তখন পুরুষ খোঁজেন। প্রেম নয়, ভালবাসা নয়। শুধু দেহ। তাঁরা দেহ খোঁজেন। তরুণী হলে পুরুষ শিকার সহজ। কিন্তু প্রৌঢ়া হলে, ঠোঁটে যতই রং থাকুক, ব্লাউজের পরিমাপ যতই হোক অন্তর্বাসের মতো সরু, পুরুষ পাওয়া সহজ হয় না। তখন দালাল লাগে।

অলকবাবু অনেক খদ্দের দিয়েছেন তাকে। প্রথমে তাঁর প্রস্তাব ছিল মহিলা খদ্দের নেবার। সে তখন তার অপারঙ্গমতা জানায়। অলকবাবু তখন ভাবনাচিন্তা করে অন্য প্রস্তাব পাড়েন। বড় বড় শহরে যেমন হচ্ছে, তেমন তিনি চালু করেন এ শহরেও।

এক-একটি বাড়িতে কয়েকজন মহিলা সমবেত হন। সেখানে মঞ্চের মতো নাচের জায়গা করা হয়। সেই মঞ্চে সে নাচতে নাচতে একটি একটি করে পোশাক খুলতে থাকে। শর্ত, কেউ তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। একঘণ্টা নাচের জন্য কুড়ি হাজার টাকা।

সে নাচে। খুলে ফেলে আঁটো পোশাক। খুলে ফেলে উৰ্ববসনা হাত মোজা। খুলে ফেলে প্যান্ট এবং জাঙ্গিয়া পরে নাচতে নাচতে একসময় অন্তর্বাসও খুলে ফেলে। তখন.. তুমুল হর্ষধ্বনি ওঠে। মহিলারা, চুম্বন ছুড়ে দেন। কেউ কেউ শর্ত ভুলে তাকে জড়িয়ে ধরার জন্য ছুটে আসেন। অনেকে এ ওর ব্লাউজ খুলে স্তনে হাত রাখে। সে নাচে। মুক্ত হয়ে নাচে। আর নগরদেবীরা পরস্পর কামড়াকামড়ি করে চরম কামনায়।

সে বিশ্বাস করে, অদ্যাবধি বিশ্বাস করে, পৃথিবীময় কাম। গোটা পৃথিবী কাম দ্বারা পরিচালিত হয়। মানুষ মরণ মুহূর্তেও এক-একজন জাগ্রত কামুক।

আরও একবার ছেলেটিকে দেখতে যায় সে। ঘুম অঙেনি এখনও। পাশ ফিরে শুয়েছে। ঠোঁট অল্প ফাঁক হয়ে আছে। কম্বল সরে গিয়েছে গা থেকে। মশা ঘুরছে।

মশা তাড়াবার যন্ত্রটি প্লাগে বসিয়ে দেয় সে। জ্বালে, কম্বল দিয়ে শরীরটা ভাল করে ঢেকে দেয়। এসে দাঁড়ায়ঝোলকনিতে। দীর্ঘদিন পর সে আজ তীব্র তৃষ্ণা বোধ করছে। ছেলেটি যখন অজ্ঞান হয়ে রাস্তায় পড়ে যায়, সে ছুটে এসে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল। আশ্চর্য শান্তিতে ভরে গিয়েছিল শরীর। তার জড়িয়ে ধরার মধ্যে এমন এক নিশ্চয়তা ছিল, আবেগ ছিল যে পথচারী ও দোকানিরা ছেলেটিকে তার আত্মীয় মনে করে।

তাকে বিছানায় শুইয়ে জামা ছাড়িয়ে দিচ্ছিল যখন, খোলা শরীরের সৌন্দর্য তাকে পরিপূর্ণ মুগ্ধ করে। সে, সেই খোলা শরীর স্মরণ করে ব্যালকনির গ্রিল জড়িয়ে থাকা লতার ত্রিকোণ পাতাগুলোয় হাত বোলায়। ছেলেটির ওষ্ঠ স্মরণ করে আপন হস্তের ত্বকে চুম্বন করে। মনে মনে সংকল্প নেয়, ছেলেটিকে আহ্বান করবে সে। যদি প্রত্যাখ্যাত হয়, মেনে নেবে। যদি না হয়, নিজের শরীর দিয়ে আরেকটি শরীরের কোষে কোষে ছড়িয়ে দেবে প্রেম।

প্রেম। সে আশ্চর্য হয়। সে প্রেম ভাবছে! প্রেম! কাকে বলে প্রেম, জানে না সে। সে শুধু জানে স্পর্শ, জানে শরীর। শরীরের পরিমাণ মূল্য। সে নিজেকে জানে না। নিজের অন্তরকে জানে না। প্রেম জানে না। এই ছেলেটিকে জড়িয়ে-তার শরীর জুড়ে শান্তি নেমেছিল। এর নামই কি প্রেম? কিংবা এই স্পর্শ করার আকুলতা?

সে যখন ছোট ছিল, তার এই মেয়েদের মতো চলনবলন যে-কোনও মেয়ের চেয়েও মেয়েলি হয়ে দেখা দিত। তার মা বেশ্যাপাড়ারই এক মধ্যবয়সিনী, চার সন্তানের জননী–তার নাম রেখেছিল বুলা। সে জানে না, তারা চার ভাইবোন একই পুরুষের সন্তান কিনা। না হওয়াই সম্ভব। চারজনের চেহারাতেও মিল নেই। যদিও সে নিজে জ্ঞান হওয়া অবধি দেখে আসছিল বিনোদবাবুকে। মায়ের বিনোদবাবু। তারাও ডাকত বিনোদবাবু। বিনোদবাবু আসার পর তার মা আর অন্য পুরুষ নেয়নি।

বিনোদবাবু যত্ন করতেন মাকে। তাদের পুরো পরিবারে প্রতিপোযণ করতেন। তাদের জন্য নিয়মিত উপহার আনতেন। বিনোদববুর তাগিদেই মা তাদের সকলকে ইস্কুলে ভর্তি করে দেয়।

তার মনে আছে, মায়ের একটু জ্বর হলেই বিনোদবাবু মাথার কাছে বসে থাকতেন ঠায়। কপালে হাত বুলিয়ে দ্ভিতেন। বিনোদবাবু তাদের সত্যিকারের বাবা হলেন না কেন, এই আলোচনা তারা প্রায়ই করত। বড়দি একটু বড় হয়ে উঠলে বিনোদবাবুই তার বিয়ে দিয়ে দেন।

এই বিনোদবাবু পাগল হয়ে গেলেন। মায়ের তখন মধ্যবয়স। যৌবন দাঁত কামড়ে ঝুলে আছে প্রত্যেকটি বাঁধনে। বিনোদবাবুর যত্নে কোথাও এতটুকুও যন্ত্রণার ছাপ পড়েনি। তার নিজের বয়স তখন তেরো। মেজদির আঠারো। সেজদির যোলো।

দিশেহারা হয়ে গেলেন মা। কিছুদিন কান্নাকাটি করলেন। তারপর হাল ধরলেন শক্ত করে। পাগল বিনোদববুও রয়ে গেলেন এ বাড়িতেই। মা তাঁকে পৌঁছে দিতে গিয়েছিলেন তার নিজের বাড়ি, কিন্তু খুঁজে পাননি কোথাও। ঠিকানা জানা ছিল না। শুধু একটা ধারণা। তাই ফিরিয়ে আনলেন বাড়িতে। খেতেন না, ঘুমোতেন না, শুধু একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতেন বিনোদবাবু। মা কয়েক গ্রাস ভাত জোর করে তাঁর মুখে পুরে দিতেন। তিনি মুখে নিয়েই বসে থাকতেন সেই সব। কোনও এক সময় গিলে ফেলতেন। নিয়ম করে মা প্রাকৃতিক ক্রিয়াদির জন্য স্নানঘরে নিয়ে যেতেন বিনোদবাবুকে। যন্ত্রের মতো বসে থাকতেন বিনোদবাবু। শরীর ধর্মে মলমূত্র ত্যাগ করতেন কিন্তু শৌচ করতেন না। মা তাঁকে এক শিশুজ্ঞানে সাফসুতরো করে দিতেন।

এই বাসস্থান, যেখানে সে নিশ্চিন্তে থাকে এখন, বিনোদবাবুর করে দেওয়া।

কিছু টাকা ছিল মায়ের আর ভারী ভারী গয়না। সব গয়না বিনোদবাবুর দেওয়া। সেই সব দুই মেয়ের বিয়ের জন্য আগলে কাজে নামলেন মা। জমা টাকা ভাঙিয়ে খেলে সব ফুরিয়ে যাবে একদিন, মা এমনই বলতেন।

পুরনো বৃত্তিতে অনায়াসেই ফেরা সম্ভব ছিল মার পক্ষে, কিন্তু মা কয়েকটি বাড়িতে রান্নার কাজ নিলেন। একে একে দিদিদের বিয়ে দিলেন। খেয়ে-পরে বাঁচবার মতো বিয়ে দিতে গিয়ে সব টাকা আর গয়নাগুলো চলে গেল। আর বিয়ের সময় বিনোদবাবুকেই পিতা হিসেৰ্কে দেখানো হয়েছিল।

যেমন হঠাৎ পাগল হয়ে গিয়েছিলেন বিনোদবাবু তেমনি হঠাৎ মরে গেলেন একদিন। ঠিক পনেরো দিনের মাথায় মাও চলে গেলেন।

ভালবাসা বলে একে? এই সম্পর্ককে? এইটানকে? যা স্বার্থের সীমা ছাপিয়ে যায়, দেওয়া-নেওয়ায় বাঁধা থাকে না, অর্থলিপ্সাকে যে হেলায় দেয় পাশে ফেলে?

হয়তো। হয়তো। তার কখনও হয়নি এমন। ইস্কুলে পড়ার সময় মেয়েদের মতো আচরণ ছিল বলে, সে মূত্রত্যাগ করতে গেলে অন্য ছেলেরা উঁকি মেরে তাকে দেখতে চাইত। উঁচু ক্লাসের ছেলেরা জড়িয়ে ধরত তাকে। চুমু খেত। একদিন একাদশ শ্রেণির দেবকান্তিদা তাকে ইস্কুল থেকে বাড়িতে নিয়ে যায়। এবং জোর করে তাকে ধর্ষণ করে।

অসম্ভব যন্ত্রণায় চিৎকার করছিল সে। যেন একটি ছুরিকা দিয়ে মাংসগুলি খণ্ড খণ্ড করা হচ্ছে তার। হাড়গুলি মুড়মুড় করে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। দেবকান্তিদা হঠাৎ হয়ে উঠেছে অসীম বলবান। আর দেবকাস্তিদার শিশ্ন যেন ধাতব দণ্ড, যেন ইস্পাতের ফল।

সেই যন্ত্রণাকে কী ব্যাখ্যা দেওয়া যায় সে জানে না। সে শুধু জানে, তার অজ্ঞান হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। ওই কষ্ট সজ্ঞানে হজম করার নয়। সে গলা মাধ্যমে যে স্বর তখন বার করে আনছিল তাকেই বলে আর্তনাদ। আর্ত নাদ। সে কাঁদছিল। খুব কাঁদছিল। হঠাৎ দেবকান্তিদা তার পিছন-সামন ক্রিয়া থামিয়ে স্থির হয়ে যায়। নিজেকে ঠেসে ধরে তার পশ্চাতে এবং ধীরে ধীরে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়।

সে তখন ওই অবস্থাতেই শুয়ে পড়েছিল মাটিতে। তার আর কান্নারও ক্ষমতা ছিল না কারণ যন্ত্রণায় দমবন্ধ হয়ে আসছিল। ডাঙায় ছেড়ে দেওয়া জলচরদের মতো মুখে বড় হাঁ রচনা করে খাবি খাচ্ছিল সে। পায়ুদ্বারের যন্ত্রণায় নিজের অজান্তেই রেখেছিল হাত। হাতে রক্ত উঠে এসেছিল। আমোদ পাওয়া গলায় দেবকান্তিদা বলেছিল, সে শুধু নারীসুলভই নয়, সতীত্বের সমস্ত লক্ষণ তার মধ্যে আছে। নথ ভাঙানোয় কী রকম রক্তপাত হচ্ছে! তার সতীচ্ছদ টুটিয়ে দেবকান্তিদাই তাকে করে তুলেছে পরিপূর্ণ নারী।

সে তখনও পড়ে পড়ে কাঁদছে দেখে তাকে লাথি কষিয়েছিল দেবকান্তিদা। সে যেন আর ছেনালি না করে এমন আদেশ করেছিল। বেশি ছেনালি করলে সে আরও একবার…

ভয়ে উঠে বসেছিল সে। মাথা টলছিল তারা কোনওক্রমে প্যান্ট পরে সে বেরিয়ে আসে বাইরে। ভয়ানক রাগ হয়েছিল তার। ঘৃণা হয়েছিল দেকান্তিদার ওপর। উঁচু ক্লাসের যত ছেলেকে সে চিনত, তাদের সকলের প্রতি ঘৃণা হয়েছিল। যন্ত্রণার সঙ্গে, রাগের সঙ্গে, ঘৃণার সঙ্গে–অপমানবোধ মিশে দুই কান ঝাঁ ঝাঁ করছিল তার। এই অপমান ও যন্ত্রণার কথা সে বলেনি কারওকে। কোনও দিন। আজ অবধি বলেনি।

সেদিন বাড়ি ফিরে সে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছিল। চিৎ শোয়ার উপায় ছিল না এমন যন্ত্রণা। সর্বাংশেই সে নির্দোষ ছিল। অথচ মনে মনে সে হয়ে উঠেছিল বিষম ভিরু। তার প্যান্টে রক্তের দাগ লেগেছিল। একটি বড় স্ফোটকই এর কারণ–এমনই ব্যাখ্যা করেছিল সে। দশদিন ইস্কুলে যায়নি। ক্ষত সারিয়ে নিতে থাকার সেই দিনগুলিতে অসম্ভব উদ্বেগ তাকে তাড়া করত। মনে হত, ইস্কুলে পৌঁছলেই হা-হা হাসির তোড়ে সে ভেসে যাবে। ধর্ষিত হওয়ার কারণে সবাই তাকে দুয়ো দেবে। যদিও শেষপর্যন্ত তেমন হয়নি। ইস্কুলে যাবার পর কোনও হা-হা হাসি তাকে তাড়া করেনি। দেবকান্তিদা বলে দেয়নি কারওকে কিছুই। এখন সে বুঝতে পারে, ভয় তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল দেবকান্তিদার। সে যদি বলে দিত মাকে বা কোনও চিকিৎসককে, কিংবা প্রধান শিক্ষক মহাশয়কে তাহলে দেবকান্তিদাই চরম শাস্তি পেত। অথচ সে বারো বছর বয়সের বোকামি ও ভিরুতায় নিজেই মুখ বুজে গুটিয়ে ছিল নিজের মধ্যে।

ওই ঘটনার পর প্রথম যেদিন দেখা হয় দেবকান্তিদার সঙ্গে, সে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। সে জানে না কেন, সেই অমানুষিক যন্ত্রণার কথা মনে করে তার চোখে জল এসে গিয়েছিল। দেবকান্তিকে এড়িয়ে সে চলে যায়। চোখের জল ও যন্ত্রণাকে মহাবিশ্বের কারও সঙ্গে ভাগ করে নিয়ে, সে সব কিছু মুছে ফেলেছিল গোপনে।

ইস্কুল ছুটির সময় দেবকান্তিদা তাকে ধরে। ভয়ে তার মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে দেবকান্তিদা সেইসব প্রসঙ্গেই গেল না। বরং তাকে রোল খাওয়াল। ক’দিন পর খাওয়াল চিনে খাবার। আস্তেআস্তে একটু একটু করে, দেবকান্তিদার প্রতি তার রাগ ও ভীতি চলে যাচ্ছিল। একেবারে সম্পূর্ণ মুছে গেল যেদিন দেবকান্তিদা তাকে উপহার দিল একটি কিশোরকুমার এবং একটি লতা মঙ্গেশকরের ক্যাসেট। সে অভিভূত হয়ে গেল সেদিন। এমনকী দেবকান্তিদাকে অল্প-অল্প পছন্দ করতেও শুরু করল সে।

প্রায় ছ’মাস কেটে গিয়েছে এর মধ্যে। সে তখন অষ্টম শ্রেণির। দেবকান্তিদা বারোর। ‘শোলে’ এসেছে, আবার। সে ‘শোলে’, দেখেনি শুনে দেবকান্তিদা তাকে নিয়ে গেল। সে মুগ্ধ হয়ে বসে থাকল সারাক্ষণ। হেলেনের উন্মত্ত নাচ, তারও রক্তে নাচের দোলা লাগিয়ে দিল তখন। গভীর ঘোর নিয়ে সে বেরিয়ে এল যখন, দেবকান্তিদা তার কাঁধে হাত রেখে জিগ্যেস করল, সে দেবকান্তির বাড়ি যাবে কিনা। সে না করতে পারল না।

সেই শুরু। তারপর থেকে ভাল রেস্তোরাঁয় খাওয়ার বিনিময়ে, টিশার্ট বা ক্যাসেট প্রাপ্তিতে, কিংবা চলচ্চিত্র দেখাবার শর্তে সে তার পেশা চালিয়ে যেতে থাকল।

দেবকান্তিদার সঙ্গে দেখা হয়েছিল কিছু দিন আগে। সঙ্গে বউ ছিল। তাকে দেখামাত্র বোকার মত হেসেছিল দেবকান্তিদা। কীরকম ভয় পাওয়া আকুটে মুখ করে কথা বলল। একবার বাড়িতেও যেতে বলল না। কোথায় থাকে বলল না তাও। ভয়, ভীষণ ভয় পেয়েছিল দেবকান্তি। সে জানে। যদি সে ওর বউকে সব কীর্তির কথা বলে দেয়।

একা একাই হাসতে থাকে সে। ভয়! ভয়তাড়িত হয়ে ঘুরে বেড়ায় সমস্ত মানুষ। সে নিজেও। প্রত্যেকে। প্রত্যেকেই যেন ভীত সন্ত্রস্ত। সন্দিহান। কেউ কারওকে বিশ্বাস করে না। কেউ কারও কাছে আসে না। বাজারের থলে হাতে বেরুলেই যেমন সন্দেহ জাগে, এই বুঝি ওজনে ঠকাল, এই বুঝি দাম বেশি নিল, তেমনই ক্রেতা-বিক্রেতা মানসিকতা সর্বত্র। কয়েক বছর ধরে যাঁরা আসছেন তার কাছে, তাঁদের মধ্যে এমনকী আছেন বিবাহিত পুরুষরাও। পরিবার-পরিজন নিয়ে ছা-পোষা পুরুষ। পথে-ঘাটে দেখা হলে তাঁদের চোখেও ত্রাস ফুটে ওঠে। অচেনার ভান করে এড়িয়ে যান তাকে। বিশ্বাস নেই। কারও মনে বিশ্বাস নেই।

সে চা করবে বলে ভেতরের দিকে গেল। আজ রাত্রি মটিায় একজনের আসার কথা। একজন খরিদ্দার। এই ছেলেটি না এলে তার জীবন নিত্যছন্দেই চলেছিল। ছেলেটিকে সে আরেকবার আকাঙ্ক্ষা করে মনে মনে। এবং টের পায়, আকাঙ্ক্ষা করার মত আর কিছুই তার জীবনে নেই। একজন মনের মতো মানুষ ছাড়া আর কী-ই বা সে চাইবে। বাড়ি আছে, অর্থের অভাব নেই, পেশাগুলির প্রতি তার কোনও অভিযোগ নেই। সে কোনও বাবা হতে পারবে না। মা-ও না। কেউ তার স্ত্রী হবে না কখনও, স্বামীও হবে না। সে শুধু পেতে পারে মানুষ একজন। পুরুষমানুষ। বন্ধু। যৌনতার অংশীদার। জীবনের অংশীদার।

চা করার আগে, ছেলেটি জেগে উঠেছে কি না দেখতে গেল সে। একসঙ্গেই চা করবে তা হলে। ঘরে ঢোকার আগেই সে দেখতে পেল, ওঠেনি শুধু, বসে আছে বিছানায়।

কাছে গেল সে। মাথায় হাত রাখল। জিগ্যেস করল কেমন বোধ করছে। মাথা নাড়ল ছেলেটি। মাথা থেকে সরিয়ে দিল তার হাত। সে বিছানার কিনার ঘেঁষে বসে পড়ল তখন। ছেলেটি চশমা চাইল। চশমা এগিয়ে দিয়ে ছেলেটির বুকে হাত রাখল সে। হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। বলতে লাগল কীভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল সে। কীভাবে তাকে নিয়ে আসা হয় বাড়িতে। ডাক্তার কী বলে যান। আর এই সব বলতে বলতে তার জিভ শুকিয়ে আসছিল। বুকের মধ্যে তোলপাড় করছিল। ছেলেটির ঠোঁটদুটো বড় মসৃণ, নাক তীক্ষ্ণ, চশমার কাচের নীচে দুটি উদাস নয়ন। এলোমেলো চুলে, কপালের ক্ষতকারুণ্যে আর হালকা চন্দন রঙের পাঞ্জাবিতে তাকে দেখাচ্ছে যেন বিরহক্লিষ্ট প্রেমিকপুরুষ। তার মাথার পেছনে জ্যোৎস্না উদ্বেলিত চাঁদ, তার পায়ের তলায় অসীম বিস্তৃত সুনীল সমুদ্র, তার চারপাশে নারী। অগণিত, আকুল, বিবসনা। তার মধ্যে একাই

সে দিশ্বসন। একাই সে পুরুষদেহী পুরুষকামনা।

ছেলেটি হাত নামিয়ে দেয় তার। শার্টের খোঁজ করে। তার অসুস্থতার পর থেকে, জ্ঞান ফিরে আসার পর থেকে, ডাক্তারের আগমন ও নির্দেশগুলি সমস্তই তার মনে আছে, সে জানায়। একটি গভীর নিদ্রার ঘোর তাকে আচ্ছন্ন করেছিল মাত্র। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগও ছিল। শুধু ওঠার শক্তি ছিল না।

ছেলেটি পাঞ্জাবি খুলতে চায়। আর মেয়েলি হিল্লোল তুলে সে বারণ করে তাকে। ছেলেটি শোনে না। সমস্ত কিছুর জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ দিতে দিতে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। পাঞ্জাবি খোলে ও শার্ট পরিধান করে। মুহূর্তকালের জন্য তার নির্মেদ বুক-পেট চুনি-পান্নার সম্ভার উদ্ভাসিত হয়। তার ইচ্ছে করে, ছুটে গিয়ে মুখ রাখে সেখানেbচুনিবৃন্তে ঠোঁট স্থাপন করে শুষে নেয় প্রেম। বুকে পান্নার মতো রোমরাজিতে মুখ ঘষে।

কিন্তু পারেনা কিছুই। শুধু ইচ্ছেরা সংগোপনে মাথা কুটে মরে। কোমল আঙুল ছেলেটির শার্টের বোতাম এঁটে দিতে যায় আর বোতামের ছলনায় নিজস্ব ভাষায় কথা বলে বুকের সঙ্গে। কিন্তু ছেলেটি নির্বিকার থাকে। নারীসুলভ পুরুষের শরীর তাকে জাগাতে সক্ষম হয় না। কোমল আঙুলগুলি প্রত্যাখ্যান করে সে নিজেই লাগিয়ে নেয় সমস্ত বোতাম। এমনকী চা পানের অনুরোধও ঠেলে দেয় সে। বরং ধন্যবাদ দেয়। বারংবার ধন্যবাদে অপরিচয়ের দূরত্ব প্রতিষ্ঠা করে। তার মনে পড়ে ছেলেটির গেঞ্জিটি মেলে দিয়েছিল খুলে। ছেলেটির মনে পড়ছে না। সে-ও বলে না আর। বলে না কিছুই। আপাদমস্তক জুড়ে কী গভীর ঔদাস্য! তার ইচ্ছাকে সবলে প্রতিহত করে। সে চূড়ান্ত হতাশায় ভাললাগা ছেলেটিকে চলে যেতে দেয়। ছেড়ে দেয়। গেঞ্জির কথা বলে না কারণ, এ দিনের স্মৃতি হিসেবে সে রেখে দেবে ওই বাস।

এ কি স্বাভাবিক? সে ভাবে। হয়তো স্বাভাবিক নয়। শুধু দেখা, শুধু একটি দুর্ঘটনা দ্বারা সম্পর্ক রচিত হয় না। হতে পারত, যদি সে হত নারী! পুরুষ হয়ে পুরুষকে কামনা না করে সে যদি নারী হয়ে পুরুষকে কামনা করত, তবে এই দুর্ঘটনা, স্পর্শ, শুশ্রুষা কাহিনি হতে পারত। এই প্রথম, নারী নয় বলে কষ্ট হয় তার। সে আলমারি খোলে। তার মনে হয়, এই যে রক্তপরীক্ষার নির্দেশ—এই সব তারই করার কথা ছিল। এই ওষুধের নিদান—এই সব তারই দেবার কথা ছিল। সে তো কোনও দিন কিছু করেনি কারও জন্য। সে শুধু নিজেকে কেন্দ্র করে বিনিময় করে গেছে। এ তার নতুনতম বোধ। এই উপচিকীর্ষা। এই আপন করে নেবার ইচ্ছা। সে একটি খামে চিকিৎসকের নির্দেশপত্র পুরে দেয়। সঙ্গে থাকে তিন হাজার টাকা। এটুকুই ছিল তার কাছে। সে দিয়ে দেয়। বলে কিছুই। চিকিৎসকের নির্দেশপত্র হিসেবে ধরিয়ে দেয় ছেলেটির হাতে। ছেলেটি আবারও ধনাবাদ দিয়ে খাম ব্যাগে পোরে। সে দেখতে পায়, তার প্রেমের প্রণামী চলে যাচ্ছে ব্যাগের গহ্বরে।

ছেলেটি ধন্যবাদ ছাড়া একটিও কথা বলে না আর। নাম বলে না। নাম জানতেও চায় না। বাইরে বেরিয়ে আসে।ঞ্জসে-ও সঙ্গে সঙ্গে আসে। ছেলেটি ট্যাক্সি ডাকে। সে দাঁড়িয়ে থাকে। ট্যাক্সির দরজা বন্ধ হয়ে যায়। সে দাঁড়িয়েই থাকে। ছেলেটি জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয়। সে তৎক্ষণাৎ চেপে ধরে সেই হাত। ট্যাক্সি চলার উপক্রম করে আর সে ছেলেটির হাতে চুম্বন এঁকে দেয়। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে হাত ছাড়িয়ে নেয় ছেলেটি৷ ট্যাক্সি চলতে থাকে। ক্রমশ একটি কালো বিন্দুর মন্ত্রে মিলিয়ে যায় দুরে।

সে ঘরে ফিরে আসে। ফাঁকা লাগে। খুব যফাঁকা লাগে। মেলে দেওয়া গেঞ্জিটি হাতে নেয় সে। গন্ধ শোঁকে। নতুন পুরুষের গন্ধ। যাকে ভাল লেগেছিল, পেল না। পাবার সম্ভাবনাও নেই। আফসোস হয় তার। যে কার্ডটা পেয়েছিল, রেখে দিতে পারত। কপালে করাঘাত করতে থাকে সে। ভেতরটা হাহাকারে ভরে যায়। যে বালিশে শুয়েছিল ছেলেটি শুভদীপ? সে কি শুভদীপ? জেনে নেওয়া হল না আর। যে-বালিশে শুয়েছিল সে-তাতে মুখ রেখে, গেঞ্জিটি বুকে চেপে ফুপিয়ে ওঠে রমণীসুলভ পুরুষ। কিছুক্ষণ। তারপর টেলিফোন টেনে নেয়। ফোন করে। আজ আর লোক নেবে না সে। তার ভাল লাগছে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *