০৭. নিঃসঙ্গতা ছাড়া আর কোনো সঙ্গী নেই

সালমা ভেবে দেখল নিঃসঙ্গতা ছাড়া এখন আর ওর কোনো সঙ্গী নেই। সারাক্ষণই একলা হয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছেলেমেয়ের মধ্যে চলতে চলতে ও অনুভব করে নিরন্তর শূন্যতা। চারপাশে এত লোক, এত হাসি, এত প্রাণবন্যা, তবু কী যেন নেই। চোখ বুজে শুয়ে থাকলে বুকটা চেপে আসে। মুচড়ে ওঠে। তারপর কাঁদতে ইচ্ছে করে। জোর বাতাস বইলে কান্না আসে। বৃষ্টি হলে কান্না আসে। তখন সালমা অনবরত মনের সমুদ্রে সাঁতরায়। সাঁতরাতে সাঁতরাতে ক্লান্ত হয়ে যায়।

বই-খাতা বুকে নিয়ে রোজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয়। লেকচার শুনতে হয়। পরীক্ষা এগিয়ে আসাতে সবাই ব্যস্ত। রকিব ওকে এড়িয়ে চলে। দেখা হলেও কথা বলে না। চোখাচোখি হলে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। সালমা নিজে থেকেও কথা বলে না। উৎসাহ পায় না। বান্ধবী নাজ একদিন যেচে বলে, তেদের কি ঝগড়া হয়েছে সালমা?

ঝগড়া? সালমা চোখ কপালে’তোলে, যেন এ শব্দটা নতুন শুনছে।

না, আমরা সবাই দেখছি, রকিবের সঙ্গে তোর আর তেমন ভাব নেই। দুজনে কেমন ছাড়া ছাড়া।

ও এই। সালমা জোর করে হাসে, হাসতেই থাকে।

অত হাসির কী হলো?

তোরা যে আমাদের ওপর বেশ নজর রেখেছিস, সেটা জেনে খুশি হলাম।

রকিব মনমরা হয়ে গেছে।

কাপুরুষ। জীবনকে ফেস করতে পারে না।

নাজ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।

এতদিন ধরে তোর সঙ্গে বন্ধুত্ব, তবু তোকে বুঝতে পারলাম না সালমা।

সেটা হলে তো আমাদের কোনো সমস্যাই থাকত না।

রকিবের জন্য তোর খারাপ লাগে না?

মাঝে মাঝে লাগে।

একসময় তুই ওর জন্য পাগল ছিলি।

সময় তো ফুরিয়ে যায়নি।

কী জানি বাবা বুঝি না।

নাজ হাত ওল্টায়। সালমা হাসে।

যাক তোকে অত বুঝতে হবে না। চল নাজ, সিনেমা দেখে আসি, একটা ভালো বই হচ্ছে মধুমিতায়।

কী বই?

স্পার্টাকাস।

ও খুব ভালো। চল।

সিনেমা হলের অন্ধকারে সালমা আবার নিজের অন্তর হাতড়ায়। মনে হয় নিজ অন্তরের সব সীমানা ভেঙে গেছে। তেপান্তরের মাঠের মতো। এলোপাতাড়ি বাতাস বয় কেবল। রকিব একটা দুরন্ত রাগী যুবক হতে পারে না। সিনেমার নায়কের মুখটা সালমার অন্তরে ঘোরাঘুরি করে। নায়িকার নীল পোশাক সালমাকে পেলব অনুভূতিতে ছেয়ে দেয়। ওদের ভালোবাসা? সালমা ভাবতে পারে না। ওদের বিদ্রোহ? ওদের যুদ্ধ আর তখনই মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়। রকিব তুই, কিছু না। আচ্ছা রকিব, তুই কেন আমার ওপর জোর করলি না? তুই কেন আমাকে বুনো ঘোড়ার ওপর চড়িয়ে দিগ্বিদিক ছুটে গেলি না? আমি তো সেই রকম একটা যুবক চাই। কাউকে আমার ভালো লাগে না। কাউকে না। অতৃপ্ত আকাক্ষা আমার বুকের ভেতর তুষের আগুনের মতো জ্বলে। আমি জীবনটাকে টুকরো টুকরো ছিন্নভিন্ন করতে চাই। জীবনের পেলব অনুভূতির নীল সরোবরে আমার ঘৃণা। তুই সব জানিস রকিব। আসলে তুইও আমাকে বুঝতে পারিস না। সে জন্যই নীরবে সরে গেছিস। দুর্বল ভাবাবেগ নিয়ে কেউ কোনোদিন জিততে পারে না। পদে পদে ঠকে পায়ে পায়ে মার খায়। তোর মধ্যে আমি এক শক্তিমান পুরুষ দেখতে চাই রকিব।

এই সালমা? কী বিড়বিড় করছিস?

নাজ ওকে ধাক্কা দেয়। সালমা আবার পর্দার ওপর ফিরে আসে। সিনেমার নায়ককে তখন কুশিফাই করা হচ্ছে। নাজের প্রশ্নের কোনো জবাব দেয় না ও। এ বইটা এর আগে দুবার দেখেছে। যতবার দেখে ততবারই ওর নতুন লাগে। আজ সিনেমা হলের অন্ধকারে এক গাদা লোকের সঙ্গে বসে থেকে কেবলই নিজের সঙ্গে মুখোমুখি হতে ইচ্ছে করে সালমার। নিজের সঙ্গে তন্ময় হয়ে কথা বলার মধ্যেও একটা আনন্দ আছে। আশপাশের অসংখ্য লোক যখন পর্দার বুকে দৃষ্টি ফেলে দিয়ে নিঃসাড়, ও তখন মাকড়সার মতো জাল বোনে। বিচিত্র সে জাল। চিকন সুতো অনবরত মনের লাটাই ছেড়ে বেরিয়ে আসে। সে সুতোয় নকশা হয়। চিকন সুতোয় জাল বোনা মাকড়সার মতো কি ও নিজেই সে জালে জড়িয়ে যাচ্ছে?

সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে দেখল, জাহিদ চৌধুরী বৈঠকখানায় বসে দুজন লোকের সঙ্গে কথা বলছে। সালমা নিজের ঘরে এলো। সটান শুয়ে পড়ল। গত সপ্তাহে জাহিদ চৌধুরী আমেরিকা থেকে ফিরেছে। বিদেশি জলবায়ু তার চেহারায় বেশ একটা ঝলমলে দীপ্তি দিয়েছে। জাহিদ চৌধুরীকে এখন আরো স্মার্ট এবং সপ্রভিত মনে হয়। কিন্তু বাবা কার সঙ্গে কথা বলছে? ও লোক দুটোকে সালমা আগে কখনো দেখেনি। বাজে ব্যাপার, ও নিয়ে ভাবার কোনো মানেই হয় না। বাবা যার সঙ্গে ইচ্ছে কথা বলুক তাতে সালমার কী এসে যায়। আর এসব অভ্যেস বড় খারাপ। মনকে উদার হতে বাধা দেয়।

সালমা চায়ের জন্য খাবার ঘরে এলো। কেউ নেই। মা আর সাকিবকে দেখল না। রান্নাঘরে এলো। আনুর মা, জলিল মিয়া পাশাপাশি ঘনিষ্ঠভাবে বসে। সালমাকে দেখে জলিল মিয়া উঠে দাঁড়াল।

কী চাও আপামণি?

চা খাব।

এই আনুর মা চা বানাও।

মা আর সাকিব কই জলিল ভাই?

তোমার খালাম্মার বাসায় গেছে। আম্মা তোমার জন্য ডিমের হালুয়া রেখেছে আপামণি। খাবার ঘরে এসো।

দুজনে খাবার ঘরে এলো। জলিল মিয়া কাঁধের গামছা দিয়ে টেবিলটা মুছে ফেলল। অন্যদিন যা সে করে না। সালমার মনে হলো জলিল মিয়া এক যেন একটু বেশি তোয়াজ করছে। সালমা মনে মনে হাসল। বুঝল কেন। ভাবল, একবার বলে ফেলে যে এসবের প্রয়োজন নেই জলিল ভাই। তুমি সহজেই থাক। আমাকে দিয়ে ভয় নেই। কিন্তু বলতে পারল না। বদলে চামচে করে ডিমের হালুয়া মুখে পুরল। জলিল মিয়া ফ্রিজ থেকে কলা বের করল, পানির বোতল বের করল। আনুর মা চা নিয়ে এলো। সালমা ইচ্ছে করে কথা ফাঁদল।

দেখো জলিল ভাই, আনুর মা আজকাল বেশ সুন্দর হচ্ছে।

জলিল মিয়া কথা বলতে পারল না। আনুর মা অনুচ্চ স্বরে বলল, কী যে বলেন আপামণি।

বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? তুমি একবার আমার ঘরে আয়নায় গিয়ে দেখো। আজকাল তোমাকে একদম অন্যরকম লাগে। তুমি কিছু বলছ কেন জলিল ভাই? বলো না, আমার কথা সত্যি কি না?

জানি না। আমি মূর্খ মানুষ, অতশত বুঝি না।

জলিল মিয়া আমতা আমতা করে।

সালমা শব্দ করে হেসে ফেলে। আর হাসি চেপে রাখা যায় না।

তুমি খুব চালাক হয়ে গেছ জলিল ভাই। বুঝলেও বলবে না। আনুর মা ততক্ষণে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। বেচারি লজ্জা পেয়েছে। টেবিলের ওপর সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে জলিল মিয়াও আস্তে আস্তে কেটে পড়ে। সালমা কৌতুক বোধ করে। ওরা হয়তো এখন রান্নাঘরে বসে এ নিয়ে মজা করছে। সালমার মনে হয় দুজনের মধ্যে একটা সহজ প্রাণবন্ত ভাব এসে গেছে। দুজনে একটা নির্জন দ্বীপ আবিষ্কার করেছে। এবং অনেক ঢেউয়ের মধ্যে সাঁতরে খুঁজে পাওয়া সে দ্বীপে এখন নারকেলের চিরল পাতার মৃদু বাতাসের শান্তি। সে দ্বীপের সবুজ ঘাসে রঙিন ফড়িংয়ের মেলা। কূলে বসে সাগরের ঢেউ গুনতে গুনতে ওরা কি অতীতকে স্মরণ করে? না, ওরা অনাগতের স্বপ্ন দেখে। সেজন্যই ওদের ভাষার দৃষ্টি স্বাপ্নিক চেহারায় নিজেদের অজান্তেই ফুটে উঠেছে মায়াবী জাদুর স্পর্শে। যে স্পর্শ নিয়ে ওদের নতুন জন্ম, সেখানে আর সব মিথ্যা। সালমার মনে হয়, ওরা ব্যর্থতাকে অতিক্রম করতে পেরেছে। হয়তো কখনো মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে সাকিবের গিটারের মতো টুকরো স্মৃতি টুংটাং করে ওঠে। তাতে কী! সে বেদনা থাকে বলেই তো জীবেনর উপভোগ নিবিড় হয়। সালমা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তন্ময় হয়ে থাকে। ভাবতে ভাল লাগে যে দুটি পোড়খাওয়া মানুষ আবার একটি জগৎ গড়তে পেরেছে। জীবনকে ছিনিয়ে নিয়েছে।

চা খেয়ে সালমা নিজের ঘরে আসে। টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে বই নিয়ে বসে। ফ্রেজারের গোল্ডেন বাউ। এ বইটা কয়েকদিন ধরে ও খুব মন দিয়ে পড়ছে। পড়তে ভালো লাগে। পড়তে পড়তে বেদনা ভুলে যায়। সালমার মনে হয় এই একটা চমৎকার ভুবন। কোনো একটা অবলম্বন না খুঁজতে গিয়ে বই নিয়ে বসে থাকা অনেক ভালো। ভাবনার দিগন্তসীমা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। বাড়তে বাড়তে একসময় নিজের অস্তিত্ব পর্যন্ত ভুলিয়ে দেয়।

আনুর মা এসে ঘরে ঢোকে।

আপামণি, সাহেব আপনাকে ডাকে।

কেন?

আমি তো জানি না।

আনুর মা সালমার ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে। ফিরিয়ে দেখে। দেখে দেখে সাধ মেটে না। সালমা মুখ টিপে হাসে। ওর বিকেলের কথাগুলো এখন আনুর মার মনের মধ্যে কাজ করছে। ও পরক্ষণে সালমা সম্পর্কে সচেতন হয়ে দাঁত দিয়ে জিভ কেটে বেরিয়ে যায়।

সালমা ভেবে পায় না যে বাবা কেন ডাকল। ও বারান্দায় এসে একটুক্ষণ দাঁড়ায়। ড্রয়িংরুমে বসে রয়েছে বাবা। লোক দুজন চলে গেছে। সালমা ঘরে ঢুকে সোফায় বসল। বাবার মুখটা গম্ভীর। থমথমে।

কী করছিলে?

পড়ছিলাম।

পরীক্ষা কবে?

সামনের মাসের পনেরো তারিখ।

পরীক্ষা দেবার মতো প্রিপারেশন হয়েছে?

এখনো বুঝতে পারছি না।

কবে পারবে?

দিন পনেরো পর।

তোমার মেধার ওপর আমার আস্থা আছে। তবু যদি পরীক্ষা দেবার মতো অবস্থা তৈরি করতে না পার তবে আমাকে জানিয়ে। সে অনুযায়ী আমি আমার সিদ্ধান্ত নেব।

সিদ্ধান্ত।

সালমা চমকে উঠে চোখ বড় করে। বাবা হাতের কাগজের ওপর দৃষ্টি নামিয়ে রেখেছে। সালমার সঙ্গে আর কোনো কথা বলার ইচ্ছে তার নেই। ও সেটা বোঝে। তবু একটু জোর দিয়ে বলে, কিসের সিদ্ধান্ত?

সে তোমার এখুনি জানার দরকার নেই। সময়মতো জানাব। যাও, পড়গে।

বাবার রূঢ় আচরণের জন্য সালমা প্রস্তুত ছিল না। একদম হকচকিয়ে যায়। এতদিনের ঠাণ্ডা স্নেহময় কণ্ঠ আজ কী কারণে পরিবর্তিত হয়ে গেল ও তা বুঝতে পারছে না। তবু বাবাকে আর কোনো কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয় না। নিঃশব্দে উঠে আসে। মনে মনে হাসে। বিদেশ থেকে বাবা কি একটা বিদেশি মেজাজও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে? নাকি ওদেশে জ্ঞান বিতরণ করতে পারার গৌরবে অহংকারে পেয়ে বসেছে। যাকগে। ওইসবে সালমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু মন থেকে ওড়াতে চাইলেও সবকিছু ওড়াতে পারল না। সিদ্ধান্ত শব্দটা মনের মধ্যে দৌড়ে বেড়ায়। কিসের সিদ্ধান্ত? জাহিদ চৌধুরীর ক্ষমতা সম্পর্কে তো ওর জানা আছে। বড়জোর ওকে একটা বিয়ে দিয়ে দিতে পারে। এর বেশি আর কী করবে? সেটা যদি করেই তার জন্য সালমার কোনো পরোয়া নেই। সেটা নিয়ে জাহিদ চৌধুরীর মুখখামুখি হতে পারার মতো মনের জোর ওর আছে। আর তখুনি সালমা ঠিক করে ফেলে যে পরীক্ষাটা দিয়ে দেবে। যা সময় আছে সে সময়টুকু ও পুরোপুরি কাজে লাগালে ও একটা ভালো সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে যাবে। কিন্তু পরক্ষণে মনটা খারাপ হয়ে যায়। এখন থেকে কেবল মাপা মাপা ছাঁকা ঘঁকা বই পড়তে হবে। ইচ্ছেমতো যেটা খুশি সেটা আর টেনে পড়া যাবে না।

বাইরে মা আর সাকিবের মৃদু কথা শোনা গেল।

দুজনেই হাসছে। সালমা গরজ করল না। সাকিব ঢুকল ওর ঘরে।

কীরে দিদিভাই কী করছিস?

দেখতেই তো পাচ্ছিস।

আজ খালার বাসায় গিয়েছিলাম।

কেন?

এমনি। বেড়াতে। যা মজা হলো না ওখানে। সব একদম ঠিক হয়ে গেল।

কিসের ঠিক?

ও কিছু না। যাই বাবা আবার আমার জন্য বসে রয়েছে কি না।

সালমা কোনো কথা বলল না। সাকিব যেমন এসেছিল তেমনি চলে গেল। ও এমন একটা ভাব কর যেন কোনো কিছুতেই ওর কোনো কৌতূহল নেই। তবে ভেতরে ভেতরে কিসের আয়োজন চলছে তা ও টের পেল। তুমি জাহিদ চৌধুরী আমার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবে? তুমি সিদ্ধান্ত নেবার কে? সেই ক্ষমতা কি তুমি অর্জন করেছ? তবু তোমার পরিবর্তনে আমি আনন্দিত। সব রকম পরিবর্তনই আমাকে আনন্দ দেয়। ভালো। দেখি তুমি কতদূর এগোতে পার। তোমাকে তো জানি চরিত্রের কোনো স্থিতি নেই। যেদিকে বাতাস বয় সেদিকেই এগোতে থাকো। উল্টো বাতাসের মুখোমুখি কি কোনোদিন দাঁড়িয়েছ? দাঁড়াওনি। কিন্তু আমি জানি কেমন করে উল্টো বাতাসের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। তুমি আজ জোর গলায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা ঘোষণা করেছ? বেশ ব্যাপার। বোঝা যাচ্ছে, তুমি শক্তি অর্জন করতে চেষ্টা করছ। করো, পারলে যা খুশি করো। তুমি তোমার মধুকণ্ঠকে বজ্রকণ্ঠে পরিণত করেছ। তুমি তোমার শ্যামল অন্তর রুক্ষ করেছ। আমার কিছু যায় আসে না তাতে। আমি ওইসবে কমই ভয় পাই। তুমি জানো না আমি কেমন মাল। তুমি যত কঠোর হবে আমি ততই শান্ত হয়ে যাব। বুঝবে না কোথা দিয়ে নতুন করে সুড়ঙ্গপথ তৈরি হবে। জাহিদ চৌধুরী তুমি অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন পড়াও। সভা-সমিতিতে বক্তৃতা দাও। বই লিখে নাম করো। ভিজিটিং প্রফেসর হয়ে বিদেশে যাও। ছাত্র-পিটিয়ে মানুষ করার গৌরবে অহংকার বোধ কর। কৃতী ছাত্রকে নিয়ে জোর গলায় কথা বলে আরাম পাও। কিন্তু সত্যি করে বলো তো

জাহিদ চৌধুরী, তুমি নিজের সম্পর্কে কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছ কি না? আজ তুমি আরেকজনের সিদ্ধান্ত নেবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছ। অথচ সেই ক্ষমতাই যে তোমার নেই তুমি তা একবারও তলিয়ে দেখছ না। আমি একটা সামান্য মেয়ে। তোমার ভাষায় একরত্তি মেয়ে। আমি নিজের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। তোমার মতো। বেঁকেচুরে যাই না। তোমার মতো ভুল পথে গিয়ে দীনতার গ্লানিতে হাবুড়ুবু খাই না। আমি সালমা অনায়াসে সাগর সাঁতরাতে পারি।

আপামণি।

কী?

রাত কত হলো খেয়াল আছে? খাবেন না?

আমার খাবার এই ঘরে দিয়ে যাও আনুর মা।

খাবার টেবিলে সবাই বসে আছে। আপনাকে ডাকে।

বলো গে আমি একটু পরে খাব।

আনুর মা চলে যায়। দুলাইন পড়তে না পড়তে আবার আনুর মা আসে।

আপামণি সাব রেগে গেছেন। জলদি আসেন।

সালমা উঠে এলো। খাবার ঘরের পরিবেশ থমথমে। সাকিব মুখ নিচু করে খেয়ে চলেছে। মা জলিল মিয়াকে কী যেন আনতে বলছে। বাবা চোখ বড় করে বলল, তোমাকে কতবার ডাকতে হবে লিমা?

সালমা কথা না বলে চেয়ার টেনে বসে।

কথা বলছ না যে? বাবার কণ্ঠে জেদ।

আমি পড়ছিলাম। ঠিক করেছি পরীক্ষাটা দিয়ে দেব।

বড় চট করে সিদ্ধান্ত নিলে যে?

মনের মধ্যে কোনো দুর্বলতা নেই তো সেজন্য চট করেই সিদ্ধান্ত নিতে পারি।

কথাবার্তাগুলো সাবধানে বলো। তোমাকে আদর দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছি।

আমি কোনোদিন তোমার আদর চাইনি। সালমার কণ্ঠে উষ্মা।

কী বললে?

যা বলেছি তুমি তো শুনতে পেয়েছ।

আহ্, সালমা চুপ করো।

মা ধমকে ওঠে। সালমা আর কথা না বলে খেতে আরম্ভ করে। জাহিদ চৌধুরী কিছুক্ষণ গুম হয়ে থাকে।

নাও, শুরু করো। তুমি বাবা হয়ে যদি মাথা গরম করো তাহলে চলে নাকি? ও তো বুদ্ধি হবার পর থেকে ধরে নিয়েছে যে, ও এই সংসার থেকে আলাদা।

জাহিদ চৌধুরী ততক্ষণে খেতে শুরু করেছে। রাগে উত্তেজনায় কথা বলতে পারে না। সালমা নির্বিকার। বারবার বাবার স্নেহময় শীতল কণ্ঠ জলের স্পর্শ নিয়ে কানে এসে লাগে। কিন্তু জাহিদ চৌধুরী একরত্তি মেয়ের কাছে হারবে না বলে কৌশল অবলম্বন করতে শুরু করেছে। তার জেদ চেপেছে। হ্যাঁ, মানুষের এই পরিবর্তন মন্দ না। তাতে জীবনে একটা বৈচিত্র্য আসে। সালমা অল্প খেয়ে উঠে পড়ে।

কী, হয়ে গেল? বাবার কণ্ঠ গম্ভীর।

হ্যাঁ।

এই মাংসগুলো খেয়ে ফেল। না খেলে ভালো করে পড়া যায় না। সালমা শিক্ষক-পিতার অযাচিত উপদেশ নির্বিবাদে শোনে এবং ধপ করে বসে পড়ে চেয়ারে চটপট মাংসের টুকর্কো খেয়ে নিয়ে উঠে যায়। সাকিবও ওর সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসে বারান্দার বেসিনে দু’ভাইবোন। একসঙ্গে হাত ধুতে থাকে। সাকিবের মুখটা গম্ভীর। সালমা পরিবেশ। হালকা করার জন্য বলে–মিতালির খবর কীরে?

ভালোই আছে।

অনেকদিন দেখি না?

আমার সঙ্গে রোজই দেখা হয়।

অ। তা তুই মুখটা অমন হাঁড়ির মতো করে রেখেছিস কেন রে?

তোর অনেক আচরণ আমার পছন্দ হয় না দিদিভাই।

তাই নাকি? সালমা সকৌতুকে হাসে। তা আচরণটা সকলের সুবিধে মতো করাই বোধহয় ভালো। তাই নারে?

নিশ্চয়।

সাকিব জোর দিয়ে কথা বলে। ওর গলাটা ভরাট শোনায়। কিছুটা পুরুষ পুরুষও। সালমা অবাক হয়। মনে হয় ইদানীং সাকিব বোধহয় নিজস্ব করে কিছু ভাবছে। আর সেজন্যই ওর চোখ-মুখের লাবণ্য বিলুপ্ত হয়ে রুক্ষ ভাবটা ফুটে উঠেছে। সাকিব হাত ধুয়ে ওর নিজের ঘরে চলে যায়। খাবার ঘর একদম নীরব। বাবা-মা দুজনেই কেউ কোনো কথা বলছে না। সালমা ঘরে আসে। মৌরি মুখে পোরে। আবার বই নিয়ে বসে। কিন্তু বেশিক্ষণ পড়তে পারে না। বারান্দা থেকে সাকিবের গিটারের শব্দ ভেসে আসছে। মৃদু। পাখির পালকের মতো হালকা।

আস্তে আস্তে সে সুর বুকের তলে লাফিয়ে পড়ে। যন্ত্রণা নামের শৌখিন অথচ মেজাজি বেহালা-বাদক হয়ে যায়। বুকটা খাখা করে। আবার সালমা তলিয়ে যেতে থাকে।

পরদিন লাইব্রেরির সামনে রকিবের সঙ্গে দেখা হয়। শুধু দেখা নয় দুজনেই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। সালমার বুকটা নেচে ওঠে। মনে মনে ও বুঝি রকিবকেই কামনা করছিল। মনে হয় কয়েক যুগ ধরে রকিবের সঙ্গে ওর দেখা নেই। রকিব একমাথা বড় বড় চুল নিয়ে ওর সামনে। দাঁড়িয়ে। জ্বলজ্বলে দৃষ্টিতে সুখের কাপন। সালমার বুকের ভেতর কথা আটকে যায়। রকিব মুখ খোলে আগে।

কোথায় যাচ্ছিস?

লাইব্রেরিতে।

পরীক্ষা দিবি?

হ্যাঁ।

কথাটা রকিব বিশ্বাস করতে পারে না। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে আবার জিজ্ঞেস করে, পরীক্ষা দিবি?

হ্যাঁরে হ্যাঁ, তোর বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি?

সালমা এক পলক হাসে।

জানিস ওই কাগুজে ডিগ্রিটাকে সম্বল করে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে আমাকে।

কী বলছিস?

সে তুই বুঝবি না। তোর খবর কী? কেমন আছিস?

তোর কী মনে হয়? কেমন থাকতে পারি?

ওইসব প্যানপ্যানানি ছাড়।

তাহলে ধরে নে নিজেই।

তুই কেমন আছিস?

ভালোই।

সালমা।

বল? কী থামলি কেন?

থাক। এখন থাক। নিজের সঙ্গে নিজে আরো একটু বুঝে নিই।

রকিবের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে সালমা শব্দ করে হাসে।

চল রকিব আমরা ওইদিকে গিয়ে বসি।

খুব যে সহজ হয়ে গেলি? ঠিক আছে চল।

দুজনে ঘাসের ওপর বসে। ছেলেমেয়েরা লাইব্রেরিতে যাওয়া-আসা করছে। মাথায় ওপর দিয়ে শব্দ করে প্লেন উড়ে যায়। আকাশটা হালকা মেঘের দরুন ছাই ছাই রঙের দেখায়। সালমা হঠাৎ করে আবার নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। আজকাল যখন ওই বোধটা ওকে আঁকড়ে ধরে, তখন কাঁদতে ইচ্ছে করে। আশপাশে কেউ থাকলেও মনের সেই উথালপাতাল ভাব কাটে না। রকিব একদৃষ্টে ওর দিকে চেয়ে আছে। সালমা কপালের ওপর থেকে চুল সরায়। বাতাস বারবার চুল উড়িয়ে এনে কপালে ফেলে। রকিবের উজ্জ্বল চকচকে দৃষ্টি অনুসরণ করে সালমা আবার হাসে।

তুই যেন কী বলতে চেয়েছিলি এবার বল রকিব?

তোকে কি কখনো কোনো নিঘুম রাত যন্ত্রণা দেয় না সালমা?

তারপর।

সালমা তোর কি এখনো কোনো সময় হয়নি? আমি ভালোবাসা চাই সালমা। ভালোবাসা ছাড়া বাঁচতে পারি না।

রকিবের দৃষ্টিতে পেরোয়া ভাব। কণ্ঠে মিনতি। সালমা কথা বলতে পারে না। গলার কাছে কী যেন একটা আটকে থাকে। মনে হয় অনেক কথা রকিবকে ওর বলার ছিল। কিন্তু বলতে পারছে না। রকিবকে নিয়ে এক নির্জন দ্বীপে যাবার ইচ্ছে আছে ওর। কিন্তু ডাকতে পারছে না। সালমা অনবরত ড়ুবে যাচ্ছে। আর সমস্ত পরিপার্শ্ব এক বিরাট তিমির মুখ হয়ে যাচ্ছে। ও যেন দু’হাত দিয়ে সবকিছু ঠেকিয়ে রাখছে। ও যেন। সব বাধা অতিক্রম করে সাফল্যের বন্দরে পৌঁছতে চাইছে।

সালমা?

রকিব ওর হাতের কবজি সজোরে চেপে ধরে। চেহারায় এক জ্বলজ্বলে ঔদ্ধত্য ভাব। যেন ইচ্ছে করলে এখুনি সালমাকে উঠিয়ে নিয়ে চলে যেতে পারে। ওর হাতের পেশিতে অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি কলকল করছে। সালমা সামান্য ব্যথাও পায়।

আহ্, রকিব ছাড়।

না।

চারদিকে ছেলেমেয়েরা ঘোরাঘুরি করছে?

তাতে আমার কিছু আসে যায় না।

তুই কি একটা সিনক্রিয়েট করবি?

দরকার হলে তাই করব।

সালমা মৃদু ধমকের সুরে কিছু অনুরাগ মিশিয়ে বলে, কী পাগলামি হচ্ছে ছাড় না।

রকিব হাত ছেড়ে দেয়। সালমা অনুভব করে সেই ভদ্র বিনয়ী রকিব আর নেই। ও এখন ভালোবাসার অধিকার চায়। পুরোপুরি অর্থে ভালোবাসা চায়। ও দুর্বিনীত হয়ে উঠতে চাইছে। আসলে ও সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছে। শুধু আবেগে এখন আর বিশ্বাস নেই। ওর ভেতর ভয়ানক শক্তি কাজ করে। এ উপলব্ধি বোধের সঙ্গে সঙ্গে সালমা ঘামতে শুরু করে। কিন্তু দুজনের কেউই আর আগের সুত্র ধরে কথা বলতে পারে না। রকিব মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে তাকিয়ে থাকে। গাঢ় নীল রঙের ঘাসফুল একটুখানি ঝোপের মধ্যে আলো ছড়াচ্ছে। এত সুন্দর রঙটা, রকিব মনে মনে ভাবে, আমার অন্তরের ছায়া হয়ে মাথা উঁচিয়ে আছে। লম্বা লম্বা ঘাসের মাথায় লাল ফড়িং উড়ে উড়ে এসে বসে। সালমা ওই ফড়িং হতে পারে। আমি ফুল। রকিব ভাবল। আমরা এমন মধুর আনন্দঘন ছন্দে জীবনের বৃত্ত ভরিয়ে রাখতে পারি। জীবনটা তো এমনিই। কখনো ফুল। কখনো ফড়িং। কখনো জুতোর তলে মাড়িয়ে যাওয়া থেতলানো ঘাসের মতো। আহ, সালমা তুই কিছু বুঝতে পারছিস না। আসলে কিছু বুঝতে চাচ্ছিসও না। রকিবের গলা ধরে আসে। কষ্ট। কষ্ট। ওই গাঢ় নীল ফুলের মতো কষ্ট। ফুলটা যেমন ভালোবাসা। তেমনি বেদনাও। ওই ফুলটা সব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *