০৫. সকালে অনেক বেলায় সালমার ঘুম ভাঙে

সকালে অনেক বেলায় সালমার ঘুম ভাঙে। বুড়ি ঝি এসে তার নিত্যদিনের কাজে লেগেছে। নাসিমা গোসল সেরেছে। ঘরদুয়োর গোছায়। ফুলদানিতে ফুল বদলিয়ে নতুন ফুল সাজায়। জানালা-দরজা সব খোলা। চোখ ধাঁধানো আলোয় ঝলমল করছে সবকিছু। মৃদু হাওয়ায় পর্দা দোলে। নাসিমা ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে।

কী, ঘুম ভাঙল মেম সাহেবের?

সালমা লাজুক হাসে, উঠতে ইচ্ছে করে না। আর একটু গড়িয়ে নিতে চায় শরীর। অলস অলস ভাব দেহের জোড়ায় জোড়ায়।

থাক, উঠতে হবে না। ঘুমা।

নাসিমার কথায় আবার শুয়ে পড়ে। এটাই চাচ্ছিল ও। তবু নাসিমার সামনে শুয়ে থাকতে একটু লজ্জা লাগছিল। অনুমতি পাবার পর আর দেরি কী? কিন্তু শুলে কী হবে! ঘুম আর এলো না। বুড়ি ঝি এক কাপ চা দিয়ে গেল। গরম চায়ে অলসভাব কেটে যায়। আর তখুনি বাড়ির কথা মনে হয় সালমার। কাল সারারাতে একবারও মনে হয়নি। কী হচ্ছে সারা বাড়িতে? চিন্তা করতে গিয়েই মজা লাগল। ওরা ভাবুক। ভেবে ভেবে সারা হোক। সালমা চোখ বুজে শুয়ে থাকে। নাসিমা বই নিয়ে বসেছে। বাসন্তী রং শাড়ি পরেছে। হালকা সেন্ট মেখেছে গায়ে। বেশ মিষ্টি গন্ধ আসছে। সালমা ভাবল, নাসিমা’পার চারদিকে রুচির ছড়াছড়ি। তার কোনো কাজই রুচি বা আনন্দের বাইরে নয়। কোনো কাজে জোরজবরদস্তি নেই। শিল্পিত চেতনা পরিবেশিষ্ট বলে নাসিমা’পার হৃদয় সমুদ্রের মতো। ব্যাপ্তি গভীরতার রঙে কোথাও কোনো কমতি নেই। পাশাপাশি সাব্বিরকেও ভেবে দেখল সালমা। সাব্বির ভাইও ভালো। সুন্দর মানুষ। নাসিমা’পাকে অনেক কিছুর বিনিময়ে ভালোবাসে। সবচেয়ে বড় কথা নোংরামির উর্ধ্বে নিজেকে পরিষ্কার রাখতে পারে। সালমার মনে হয় প্রতিটি মানুষের এটাই সবচেয়ে বড় গুণ হওয়া দরকার। সবকিছুর ঊর্বে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত রাখা। নইলে নীচতা এসে ব্যক্তিত্বকে ছিন্নভিন্ন করে। মানসিকতায় ওরা চমৎকার। অথচ দজনে এমন একটা জীবনযাপন করে, যেখানে সমাজের কোনো স্বীকৃতি নেই। তাতে কি ওদের কিছু এসে যায়? ওরা তো আপন বৃন্তে ফুল ফোঁটায়, আনন্দের ফোয়ারা ছোটায়–রঙের আকাশ গড়ে তোলে। আর কী চাই? এমন নিবিড় প্রশান্তি পেলে সালমার হয়তো আর কিছু চাওয়ার থাকত না।

এই সালমা ওঠ? নাশতা খেয়ে নে।

খেলে হয় না, নাসিমা’পা?

সে কী কথা? জলদি উঠে পড়।

খিদে নেই। ওঠার তাগিদ অনুভব করে না সালমা। শুয়ে থাকতেই আরাম। এমন আরাম আর কি আছে? নাসিমা টেবিলে নাশতা খাচ্ছে। সালমা তাকিয়ে দেখে। এই ভোরবেলাতেও নাসিমা লম্বা লম্বা নখে গোলাপি কিউটেকস লাগিয়েছে। নখগুলো প্লেট এবং মুখের মাঝামাঝি ওঠানামা করছে। মন্দ লাগছে না দেখতে।

কিরে, হাঁ করে চেয়ে থাকলেই বুঝি পেট ভরবে?

সালমা তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে। বাথরুমে ঢুকে মুখ-হাতে পানি দেয়। আয়নায় নিজেকে দেখে। চোখ দুটো ফুলো ফুলো। গাল ফুলো পতলের মতো দেখায় ওকে। গত রাতে খুলে রাখা শাড়িটা পরে। ইস্তিরি নষ্ট হয়ে গেছে। ভঁজ ঠিক নেই। মনটা খুঁতখুঁত করে।

নোংরা শাড়িটা পরলি কেন তুই? আমার একটা পরলে হতো?

থাকগে। একটু পরেই তো নিচে নেমে যাব।

তুই থাক না হয়। আমি পাবলিক লাইব্রেরিতে পড়তে যাব।

তা যাও। আমিও যাই। দেখি বাসায় কেমন ঝড় বইছে।

বকবে না তোকে?

বকলেই বা। কে গায়ে মাখে!

সালমা বাটি টেনে নিয়ে পুডিং খায়। নাসিমা উঠে পড়ে। ঘরে গিয়ে চুল আঁচড়ায়। শাড়ি পালটায়। তারপর সালমাকে খাবার টেবিলে রেখেই রওনা করে।

তুই খেয়েদেয়ে গান শোন, আমি আসি।

না, অতক্ষণ থাকব না। তুমি ছাড়া এ বাসায় একলা থাকা যায় নাকি?

কী করব বল? ভীষণ জরুরি–

জানি জানি। পড়া ছাড়া তুমি কিছু বোঝে না। যাও, আমি কিছু মনে করব না। খেয়েদেয়ে কাটব।

নাসিমা হেসে বেরিয়ে যায়। এই একটা ব্যাপারে নাসিমা খুব সিরিয়াস। তখন ডানে-বাঁয়ে তাকায় না। বসে বসে এক বাটি পুডিং খেয়ে ফেলে সালমা। নাসিমার অবর্তমানে ঘরটা সৌরভহীন মনে হয়। বুড়ি ঝি ঘর ঝাঁট দিচ্ছে। সালমার মনে হয় এখানে ওর আর কিছু করার নেই। নিজেকে পরিত্যক্ত কাপড়ের মতো লাগে। মুহূর্তের জন্য এই ঘরকে কেন্দ্র করে গত রাতের স্মৃতি সব ম্লান হয়ে যায়।

সালমা শ্লথ পায়ে বেরিয়ে আসে। বুড়ি ঝি পেছন থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়। সালমা এক মুহূর্ত তাকায়। বন্ধ দরজার ওপর লাল পর্দা ঝুলছে। টকটকে লাল রং। সালমা মুখ ফিরিয়ে এক পা দু-পা করে সিঁড়ি দিয়ে নামে। মনে পড়ে একদিন ও এমনই এক পা এক পা করে সিঁড়ি দিয়ে নেমেছিল। সামনে ছিল জল টলটলে পুকুর। পুকুরের লাল পদ্ম। বারান্দার ওপর পা রাখতেই সাকিব চেঁচিয়ে উঠে, দিদিভাই? ছুটে আসে আনুর মা আর জলিল মিয়া। সে চিৎকারে সালমার কোনো ভাবান্তর হয় না। ও ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে এদের দিকে তাকিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ে। ধপ করে বিছানার ওপর বসে বড় একটি নিঃশ্বাস ছাড়ে। সাকিব ওর পিছে পিছে ঘরে ঢোকে। আনুর মা আর জলিল মিয়া দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে।

তুই কোথায় ছিলি দিদিভাই? বাবা-মা কাল সারারাত ঘুমোয়নি। ভোরেই দুজনে তোকে খুঁজতে বেরিয়ে গেছে।

কোথায়?

আত্মীয়স্বজনের বাসায়। পরিচিত সব জায়গায়।

ঠিকানা না জেনে ওভাবে খুঁজলে কি আর পাওয়া যায়?

সালমা শব্দ করে হেসে ওঠে। সে হাসি আর থামতে চায় না।

আহ্, দিদিভাই তুই কি পাগল হয়ে যাচ্ছিস? এই দিদিভাই?

সাকিব তুই এখন যা তো। আমার ঘুম পাচ্ছে।

সালমা বিছানায় শুয়ে পড়ে।

ফ্যানটা ছেড়ে দিয়ে যা। আর দরজাটা বন্ধ করে রাখিস।

সাকিব হাত উল্টে মুখভঙ্গি করে। কিছু বোঝার উপায় নেই। সালমার কথামতো ফ্যান ছেড়ে, দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে আসে।

সালমা চোখ বুজে শুয়ে থাকে। কপালের ওপর শিথিল হাত গড়ায়। শাড়ি থেকে কেমন বমি বমি গন্ধ আসছে। গা গুলিয়ে ওঠে, উঠে বাথরুমে যায়। কাপড় ছেড়ে আসে। আলনা থেকে শাড়ি নিয়ে পরে। আবার শুয়ে পড়ে। এখন বেশ লাগছে। মাথাটা হালকা হয়েছে। চোখ বুজলে একজোড়া লাল জুতোর কথা মনে পড়ে সালমার। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় বাবা ওকে একজোড়া লাল রঙের উঁচু হিলের স্যান্ডেল কিনে দিয়েছিল। ওই জুতোটা বেশিদিন পরতে পারেনি ও। মাস দেড়েক পরার পর পোলিও হয়েছিল। সেই ভীষণ অসুখটাকে মনে হয় ওর জীবনের একটা গভীর বাঁকবদল। অসুখের পর অনেক দিন লেগেছিল হাঁটা শিখতে। তারপর তো আর ওই জুতো পরার প্রশ্ন ওঠে না। এখনো সালমার কেন জানি ওই জুতোর কথা মনে হয়। অসুখের পর ওই স্যান্ডেল ওর সহ্য হতো না। ভাবতে গেলেই মনে হতো ওর একটা লাল অসুখ হয়েছে।

সালমা শুয়ে শুয়ে বারান্দায় পদশব্দ পেল। উৎকণ্ঠিত পদশব্দ। বোধহয় বাবা-মা।

ফিরেছে?

হ্যাঁ।

কোথায়?

ঘুমিয়েছে। এখন জাগিয়ো না।

সাকিবের কথায় আশ্বস্ত হয় সালমা। যাক, কিছুটা বুদ্ধি রাখে তাহলে। তবু ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে। নিঃশব্দে বাবা ঢোকে ঘরে, সালমার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে কী যেন দেখে।

সালমা টের পায় কিন্তু নিঃসাড় পড়ে থাকে। মনে মনে ভাবে, জাহিদ চৌধুরীর মোটা বুদ্ধি। সাধ্য নেই সালমার অভিনয় ধরার। তেমন সূক্ষ্ম শিল্পিত মন থাকলে ঠিক বুঝত সালমার প্রাণ এখন কোন কাঁটায় ঘুরছে। ভালোবাসা ভালোবাসা বলে বাবা চেঁচায়। কিন্তু ভালোবাসার সেই তীব্র স্পর্শবোধ কই যে, ঘ্রাণেই বুঝে নেবে ওকে?

বাবা যেমনি এসেছিল তেমনি আবার বেরিয়ে যায়। মা বারান্দায় চেয়ারে বসে গজগজ করছে। কত অজস্র কথা বলছে। এই মেয়ে না থাকলে বা কী–

এমন কথাও উচ্চারণ করছে। বাবা কিছু বলছে না। রাত জাগার ক্লান্তি দুজনের চেহারায়। সাকিবও বসে আছে বারান্দায়। ওরা সবাই বসে আছে সালমার অপেক্ষায়। কখন ওর ঘুম ভাঙবে। কখন ও কথা বলবে।

শেষ পর্যন্ত ঘুম আর আসে না সালমার। দুপুর পর্যন্ত মিছেমিছি শুয়ে থাকে। তারপর উঠে গোসল করে। মাথা আঁচড়ায়। লম্বা চুল পিঠের ওপর ছড়িয়ে দেয়। জানে এখুনি ওকে খেতে ডাকবে। একটুক্ষণ জানালার কাছে দাঁড়ায়। খরগোশের বাক্সটা দেখা যায়। খরগোশ দুটো বাক্সের ভেতরে দৌড়াদৌড়ি করছে। সালমার হাসি পেল। ওরা খেলছে। কী খেলা করছে? ওরা কি আবাল খেলা খেলবে?

আপামণি।

আনুর মা দরজা ফাঁক করে মুখ বাড়ায়।

আপনাকে খেতে ডাকে। সবাই বসে আছে।

আসছি।

সালমা দ্বিধায় পড়ে। সবাই বসে আছে? বিচারের দণ্ড নিয়ে? কিন্তু ওকে কিছু করার ক্ষমতা ওদের নেই। ওরা তো সালমার মতো মুক্ত মানুষ নয়। ওরা কী দণ্ড দেবে? ওদের মনে হাজারো ছিদ্র। ওই ছিদ্রপথে অনবরত দূষিত বাতাস বয়। ওরা সব দূষিত মানুষ। অপবিত্র। কলঙ্কিত।

সালমা পায়ে কোনো জড়তা না রেখে টেবিলে এসে বসে। মুখটা শিশির ধোয়া ফুলের মতো স্নিগ্ধ। তিনজনে এক পলক চায় ওর দিকে। কেউ কিছু বলে না। বাবা গম্ভীর। মা গম্ভীর। সাকিবের মুখটা ভীতু। সবাই যে যার প্লেটে খাবার তুলে নিচ্ছে। সালমার মজা লাগে। হাসিও পায়। তবু নিজেকে সংযত করে রাখে। ওরা যত বিজ্ঞ বিচারকের ভান করুক, ওদের হাতে বিচারের তুলাদণ্ড নেই। সবাই চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। মা এটা-ওটা তুলে দেয়। সালমা আজ আর কোনো আপত্তি করে না। একসময় সালমার এই নিপ্রাণ পরিবেশ অসহ্য লাগে। কেউ কথা বলছে না কেন? সাকিবটাও যেন আজ বোবা হয়ে গেছে। ও-ই তো মাতিয়ে রাখে। আজ আবার কী হলো? খাবারগুলো সালমার তেতো লাগে। অর্ধেক খাবার প্লেটে রেখে উঠে পড়ে। বাবা আজ আর ওকে খাওয়ার জন্য সাধাসাধি করে না। ধমকও দেয় না। নিজের ঘরে আসতে আসতে সালমা শুনতে পায় টেবিল থেকে কথা ভেসে আসছে। স্পষ্ট শুনতে না পেলেন সালমা বুঝল, ওকে নিয়েই আলোচনা করছে ওরা। সামনে কিছু বলছে না কেন? বাবা কি বুঝেছে যে ও আজ তাকে কড়া জবাব দেবে? নাকি বেশি ভালোবাসায় ওকে শক্ত কথা বলতে বাধছে বাবার? সালমা খাটের সঙ্গে হেলান দিয়ে মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে বসে। একগাদা পত্রিকা জমেছে। একদিনে একটাও দেখা হয়নি। একটু পর মা আসে।

লিমা।

কিছু বলবে মা?

হ্যাঁ, কথা ছিল।

সালমা হাতের পত্রিকা একপাশে রেখে সোজা হয়ে বসে।

বলো, কী বলবে?

তুমি এখন বড় হয়েছ লিমা—

সোজাসুজি বলো না।

বলছিলাম, আমাদের একটা মানসম্মান আছে। বিশেষ করে তোমার বাবার–

মানসম্মান নষ্ট হওয়ার মতো তেমন কিছু করিনি আমি। ভবিষ্যতে কী করি বলা যায় না।

লিমা।

তুমি অযথা কথা বলতে এসেছ মা।

রাগে গরগর করে ওঠে মা। পারলে এখুনি ঝাপিয়ে পড়ে মেয়ের ওপর।

কাল রাতে কোথায় ছিলে?

জেনে তোমার লাভ? চমৎকার একটা জায়গায় ছিলাম। অমন পরিবেশ তোমরা জীবনে তৈরি করতে পারবে না।

সালমার মুখে একটা পরিতৃপ্তির ভাব জেগে ওঠে।

আমি ভেবে দেখলাম মা, আমার এই তেইশ বছরের জীবনে তোমরা আমাকে একদিনও আনন্দের মধ্যে রাখখানি।

এসব কী বলছ তুমি? তোমার বাবা তোমার জন্য কী করে? অমন বাবা লাখে একটা মেলে।

হেসে গড়িয়ে পড়ে সালমা। হাসতে হাসতেই বলে, তুমি জেনে খুশি হবে না মা যে ওই বাবার পরিচয় দিতে আমার রীতিমতো লজ্জা হয়।

মার বড় বড় চোখ দিয়ে আগুন ছোটে। রাগে তোতলাতে থাকে। মুখ দিয়ে ঠিকমতো কথা বের হয় না। সেই সময়টুকুতে সালমা আবার মুখের ওপর পত্রিকা তুলে ধরে।

ধৃষ্টতার একটা সীমা থাকে লিমা। তুমি সেটাও পেরিয়ে গেছ। পড়তে অন্য কোনো বাবার হাতে, ঠিক টাইট থাকতে। লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় উঠিয়ে রেখেছে তোমাকে।

সালমা চুপ করে যায়। আর কথা বলে না। রাগ না, ক্ষোভ না, অভিমান না, কিছুই ওকে ঘায়েল করতে পারে না। মা তার রাগের বদলে এক সবুজ প্রশান্তি ছড়িয়ে দিয়ে গেল। ওই দুপদাপ করে চলে যাওয়ার ভঙ্গি সালমা অনেক দেখেছে। দেখে দেখে মুখস্থ হয়ে গেছে। মা রাগের সময় কোন পা-টা আগে ফেলে, কোন পা-টা কতটুকু জোরে ফেলে তাও জানে সালমা। মাথাটা কোনদিকে বাঁকিয়ে রাখে সেটাও ওর জানা। সালমা ভাবল, মা এখন বিছানায় উপুড় হয়ে কান্না শুরু করেছে। কেঁদে কেঁদে বাবাকে অনেক কথা বলছে। বাবা চুপচাপ শুনছে। হয়তো পরে একসময় সালমাকে ডাকবে যেসব কথা শুনতে নসিয়ার মতো। লাগে সালমার।

পত্রিকা পড়তে পড়তে তন্ময় হয়ে যায় সালমা। আর সে সময়ে সাকিব এসে ঢোকে।

দিদিভাই কী করছিস? পড়ছিস?

সাকিব পাশে বসে। সালমা চোখ ওঠায় না। একটা চমৎকার গল্প পড়ছে ও। গল্পটা শেষ করে আগে। সাকিব দু-একটা পত্রিকা নাড়াচাড়া করে। আবার রাখে। উল্টেপাল্টে দেখে। হাই তোলে। দু-এক কলি গান গেয়ে আবার থেমে যায়।

কীরে অমন ছটফট করছিস কেন?

ধুৎ, কিছু ভালো লাগে না।

কী হলো আবার? একটা কড়া ঘুম লাগিয়ে দে।

ঘুম আসছে না যে।

সাকিব পোষা বেড়ালের মতো তুলতুলে ভাব করে। সালমা মুখটা গম্ভীর করে বলে, হুঁ বুঝেছি, কোথাও গড়বড় বাঁধিয়েছিস নিশ্চয়?

দেখ না দিদিভাই, মিতালি আমাকে কিছু না জানিয়ে চিটাগাং চলে গেছে।

কেন?

সামান্য একটু ঝগড়া।

সালমা হো হো করে হেসে ওঠে।

তুই হাসছিস দিদিভাই?

সাকিবের চোখ ছলছল করে। এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে বুঝি। সালমার হাসি আর থামে না। সাকিব উঠে যেতে চায়। সালমা ওর হাত টেনে। ধরে।

বোস। তুই একটা পাগল।

বাবা-মা তোকে বলে পাগল আর তুই আমাকে বলিস পাগল। বেশ। বেশ।

সাকিব ন্যাকা মেয়েদের মতো মুখটা করুণ করে রাখে।

মিতালি তোর সঙ্গে ঝগড়া করল কেন?

ও করেনি। আমি করেছি।

কেন?

গত রোববার ও আর আমি সোনারগাঁ যাব বলে ঠিক করেছিলাম। শেষে ও আর যেতে রাজি হলো না। আমার রাগ হয়েছিল। আমি ওকে অনেক কড়া কথা বলেছিলাম। তুই বল দিদিভাই, তাই বলে আমাকে না। জানিয়ে চিটাগাং চলে যাবে?

তাই তো, ভারি মুশকিলের কথা। সালমা হাসি লুকিয়ে মাথা চুলকায়।

কবে আসবে মিতালি?

আগামী পরশু।

ইস্, আরো দুটো দিন! তোর জন্য আমার কী যে কষ্ট হচ্ছে সাকিব। তোকে ঠিক বোঝাতে পারছি না।

সালমা নিজের মুখে দুঃখ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে। দিদিভাই, ও যদি আর না আসে?

কী হবে? মিতালির মতো কত ভালো মেয়ে আছে। মিতালি গেলে অন্য মিতালি আসবে।

যাহ্, তা কি হয়? মিতালি ছাড়া আমি আর কাউকে ভালোবাসতে পারব না। জানিস দিদিভাই, মিতালি না চমৎকার মেয়ে। ও আমাকে খুব ভালোবাসে।

বলতে বলতে সাকিবের মুখটা দোয়েলের চকচকে ডানার মতো পিছল হয়ে যায়। কিছু লজ্জা, কিছু তৃপ্তির সংমিশ্রণে সাকিবের দৃষ্টি গিটারের ঝংকারের মতো চঞ্চল হয়ে ওঠে। সালমা একটু ভাবে। সাকিব এখনো কত ছেলেমানুষ। ও নিজেকে আড়াল করে দাঁড়াতে পারে না, নিজেই ধরা পড়ে যায়।

বারান্দায় বাবা-মার পায়ের শব্দ পাওয়া যায়। পোশাক দেখেই সালমা আঁচ করে যে, ওরা বাইরে যাচ্ছে। বাবা গরদের পাঞ্জাবি পরেছে, মা জামদানি শাড়ি। নিশ্চয়ই কোথাও সভা আছে। তবু নিশ্চিত হবার জন্য সাকিবকে জিজ্ঞেস করে, বাবা-মা কোথায় যাচ্ছে সাকিব?

সেমিনার আছে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে।

উপলক্ষ? রবীন্দ্রজয়ন্তী।

অ।

জানিস দিদিভাই, বাবা না সামনের মাসে ভিজিটিং প্রফেসর হয়ে আমেরিকা যাবে।

তাই নাকি?

আমি বাবাকে একটা ভালো স্প্যানিশ গিটার আর পপ গানের রেকর্ড আনতে বলেছি। তুই কী আনতে বলবি?

কিছু না।

সে সময়ে ফোন বেজে ওঠে। বাবা-মা বেরিয়ে চলে গেছে। সাকিব উঠে যায় টেলিফোন ধরতে। সালমা আবার পত্রিকা হাতে উঠিয়ে নেয়। ভালো লেখা খুঁজতে থাকে। নৃতত্ত্বের ওপর প্রবন্ধ পড়তে ওর ভালো লাগে। মর্গানের বইটা ও খুঁটিয়ে পড়েছে। কিন্তু কোনো ম্যাগাজিনে মনের মতো লেখা পায় না। খোঁজাখুঁজিই সার।

দিদিভাই তোর টেলিফোন।

সাকিব বারান্দা থেকে চেঁচিয়ে ডাকে। সালমা অবাক হয়। কে আবার এই অসময়ে ওকে স্মরণ করল!

হ্যালো?

হ্যালো সালমা।

জমজমাট দুপুরের মতো ভরাট কণ্ঠস্বর। সালমার রক্ত ছলাৎ করে ওঠে। বহুদিন এই কণ্ঠ শোনার জন্য ও অপেক্ষা করেছিল।

চিনতে পারছ সালমা?

হুঁ। সালমা লম্বা করে বলে। তুমি আমাকে এ কদিন টেলিফোন করোনি কেন? আমি অনেকদিন ভেবেছি, আজ তোমার টেলিফোন পাব।

সত্যি!

সেই ভরাট কণ্ঠের হাসির শিহরণ সালমার কানে এসে আছড়ে পড়ে। সমুদ্রের ঢেউ যেন। সালমা কান পেতে শোনে। মনে হয় বুঝি ঠিক এমনি স্বরে ইভ নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার মন্ত্র শুনেছিল। এরকম কণ্ঠই যে কাউকে যে-কোনো জায়গায় নিয়ে যেতে পারে।

হ্যালো সালমা?

বলো।

তুমি একটু থমকে গেলে যেন?

কই, না। তোমার হাসি শুনছি। অদ্ভুত কণ্ঠ তোমার।

তাই নাকি? জানো সালমা, তোমার কণ্ঠ আমার প্রাণে দখিনা বাতাসের মতো বয়ে যায়। আমি তোমার কণ্ঠের রং দেখতে পাই। সাইকেডেলিক কালার।

উহ্, আমারও তাই মনে হয়। মনে হয় তোমার কণ্ঠও সাইকেডেলিক কালার।

না তোমার।

না তোমার।

দুজনেই হাসে। সালমার রোমাঞ্চ লাগে। কেমন তীব্র আকর্ষণ অনুভব করে। ওর মনে হয় এ পর্যন্ত কোনো ছেলের জন্য ওর এমন আকর্ষণ হয়নি। এ লোকটা চুম্বকের পাহাড়ের মতো ওকে টানছে। সমুদ্রে ভাসা জাহাজের মতো সালমার অবস্থা। সেই পাহাড়ের টানে সালমা দিকভ্রষ্ট হয়েছে এবং মুহূর্তে সব রাশ ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে তার পায়ে চুর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবার সাধ হয়। আবার নিজেকেই প্রশ্ন করে, কেন সালমা কেন? ওকে তুমি দেখোনি তাই? দেখলে তোমার সব ইচ্ছে কপূরের মতো উবে যাবে। আমি তো জানি তোমাকে সালমা। কাছে পেলে তুমি আর ফিরে দেখতে চাও না। এই তোমার স্বভাব। যে জিনিস তোমার নাগালের বাইরে তার জন্য তোমার দরদ বেশি।

হ্যালো সালমা?

তোমার সঙ্গে আমার কি একবার দেখা হয় না বন্ধু?

দেখা? কেন তার কি কোনো দরকার আছে? এই তো আমরা ভালো আছি সালমা। পরিচয়ের এ বৃত্তটা বড় বেশি নিঃস্বার্থ বলে অনেক আপন। অনেক ভালো লাগার।

তা হয় না সালমা।

কেন হবে না। একশ বার হয়।

জেদ করে না সালমা।

বেশ তোমার টেলিফোন নাম্বারটা আমাকে দাও। আমার যখন মন চাইবে তখন তোমাকে ফোন করব।

না, সালমা না। সময় বুঝে আমিই তোমাকে করব। তোমাকে নাম্বার দিলে তুমি হয়তো এমন মুহূর্তে টেলিফোন করবে যখন এই আমি, আমি থাকব না। অন্য মানুষ হয়ে যাব। জানো তো বেঁচে থাকার বিশেষ প্রয়োজনে মানুষ বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন আমি হয়ে যায়। আমি তোমাকে আমার এই মুহূর্তগুলো দিতে চাই, যা একান্তই আমার। আর কারো প্রবেশের অনুমতি নেই সেখানে।

তুমি কেবল নিজের দিকের কথাটা বললে।

উচ্ছল হাসি শোনা গেল। সালমা আরো অনেক কথা বলতে চেয়েছিল। বলতে চেয়েছিল এমন সময় তো আমারও থাকতে পারে বন্ধু, যখন সেই সময়ে এই আমি তোমার আমি থাকব না। অন্য কারো প্রবেশ থাকবে আমার অন্তরে। কিন্তু কিছুতেই বলতে পারল না সালমা। হাসির আড়ালে সব চাপা পড়ে গেল।

সালমা তোমার কণ্ঠই আমার কাছে তোমার পরিচয়। এর বেশি আমি কিছু চাই না। আমরা দুজনেই কণ্ঠের সাইকেডেলিক কালারে বেঁচে থাকব সালমা।

অপর পাশে টেলিফোন রাখার শব্দ হলো। সালমা রিসিভার হাতে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।

দাঁড়িয়ে রইল দাঁত-ঠোঁট কামড়ে। ভাবল, হয়তো টেলিফোনে কথা। বলাটাই ওর বিলাস। এমনি আরো অনেক বন্ধু আছে ওর। টেলিফোনের। বাইরে সালমার কোনো দরকার নেই তার কাছে। ও মিছেই মাথা কুটে মরছে। সেই চুম্বকের পাহাড়ের কথা মনে হলো। ও চুম্বকের পাহাড়ের মতো! সমুদ্রের জাহাজগুলো অনবরত দিকভ্রষ্ট করছে। সশব্দে রিসিভারটা রেখে দেয় ও। কান্নার সঙ্গে ভেতর থেকে কী যেন বের করে। দিতে চায়। বাইরে জমজমাট নির্জন দুপুর হা হা করে।

বিকেলে রকিব এলো।

কীরে, তুই নাকি হারিয়ে গিয়েছিলি?

সত্যি সত্যি হারিয়ে গেলে তো বেঁচে যেতাম।

ইস্, দেখি দেখি তোর চোখগুলো অমন ফুলো ফুলো কেন? কেঁদেছিস নাকি?

এসেই জেরা শুরু করলি কেন? বোস না।

তাই তো।

রকিব একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ার টেবিলের সামনের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে। সালমা খাটের ওপর উঠে বসে। কখন রকিব এসেছে টের পায়নি। টেনেটুনে শাড়ির কুঁচি ঠিক করে। হাত দিয়ে এলো খোঁপা বাঁধে। সারা দুপুর অকারণ কান্নার পর বুকটা এখন হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে, ডানা মেলে দিব্যি উড়তে পারবে। রকিব ওকে পরখ করছে। মুখে। কিছু বলছে না। কদিনের মধ্যে ও বেশ বড় গোঁফ রেখেছে। ওকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। একটু রুক্ষও যেন। ওর চোখের দৃষ্টি কাঁপছে। সালমা খাট থেকে নেমে বাথরুমে যায়।

তুই বোস রকিব, আমি হাত-মুখ ধুয়ে নিই

সেই ভালো। ওই রকম মুখফোলা হুলো বেড়ালের মতো চেহারা দেখে বিকেলটা মাটি করতে চাই না।

সালমা হেসে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে।

হাতে মুখে চোখে জল দিতেই বদলে যায় লুকানো অন্তর। বেসিনের ওপর লাগিয়ে রাখা দেয়াল-আয়নায় নিজেকে অচেনা লাগে সালমার। মনে হয়, এই আমি কোনো আমি নই। ওই রকিব নামক যুবকটিকে আমি চিনি না। আমার শরীরে ওর স্পর্শ নেই। আমার অন্তরে ওর জন্য ভালোবাসা নেই। দূর, ভালোবাসা আবার কী? ভালোবাসা মানে ভিড় জমিয়ে মজা লোটা। চাই না। চাই না। চাই না।

সালমা চেঁচিয়ে উঠতে গিয়ে আবার মুখে হাত চাপা দেয়। জলের স্পর্শ এত মমতাময়ী যে, প্রিয়জনের মতো কানে কানে পথ বাতলে দেয়। জলের ভেতর কী আছে? সালমার ইচ্ছে হচ্ছে শাওয়ার ছেড়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে। খোলা ট্যাপ দিয়ে হড়হড় করে জল পড়ছে। বেসিনের ফুটো বন্ধ করে ছোট একটা পুকুরের মতো করে ফেলে তন্ময়। হয়ে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। মনে মনে ভাবে, রকিব আজ না এলেই ভালো করত। এই মুহূর্তে ওকে অসহ্য লাগছে।

কীরে সালমা, বাথরুমে ঘুমিয়ে গেলি নাকি?

রকিব চেঁচিয়ে ডাকে। ও ইচ্ছে করে উত্তর দেয় না। রকিব ডাকুক। ডেকে ডেকে চলে যাক। বউ-কথা-কও পাখির মতো অনন্তকাল ধরে ডেকে ডেকে ফিরুক। সালমা আর কোনোদিন সে ডাকে সাড়া দেবে না।

সালমা, অ্যাই সালমা–

আহ্, তুই আমাকে অমন করে ডাকিস না রকিব। কেউ আমাকে ডাকুক আমি চাই না। বেঁচে থাকার জন্য আমার একটা নিরাপদ পৃথিবী। দরকার। অযথা লোকের ভিড় বাড়িয়ে সে পৃথিবী আমি নোংরা হতে দিতে পারি না রকিব। তুই ফিরে যা। তোর জন্য সালমার কোনো ভালোবাসা নেই।

সালমা কী হলো? কথা বলছিস না কেন?

মিছে ডাকছিস রকিব। তোর এই আবাল খেলার স্বাদ তো তুই আমাকে দিয়েছিস। সত্যি, বড় চমৎকার। কিন্তু এত ক্ষণিকের যে আমি ভুলে যাই সে স্মৃতি। কেন আমার সোনার কৌটায় মানিক হয়ে জ্বলে না রকিব? কেন জোনাকির মতো জ্বলে নিভে যায়?

সালমা লক্ষ্মীসোনা দরজা খোল? আমি বুঝতে পারছি না যে তোর কী হলো?

রকিবের উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে হাসি পায় সালমার। বেসিন ভরে জল উপচিয়ে পড়ছে। ভিজে যাচ্ছে শাড়ি। পায়ের পাতা। এমনি করে ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় না কেন জলের স্রোত? ভাসতে ভাসতে ও নতুন জাগা দ্বীপে গিয়ে উঠবে। ওখানে দেখবে সব অন্যরকম। মাটি, ঘাস, পাখি, রোদ বর্তমানের চাইতে আলাদা। মাটির রং সাদা ফকফকে, ঘাস হলুদ, রোদ নিবিড় লাল। পাখি একটাও উড়তে জানে না। সে রাজ্য সালমার একলার। বর্ষা বসন্তে হেমন্তে সে দ্বীপের সমস্ত রং যাবে বদলে। এক একটা ঋতু হবে এক একটা রঙের প্রতীক। জলের রং থাকবে সকালে নীলাভ, দুপুরে ধূসর, সন্ধ্যায় বাসন্তি। সমুদ্রের পাড়ে বসে সালমা ঢেউ গুনবে।

সালমা প্লিজ–

রকিবের অস্থির কণ্ঠে অঢেল মিনতি। সালমার মন তার কল্পনার দ্বীপের মতো শান্ত হয়ে গেছে। ও খুট করে দরজা খুলে দেয়।

সালমা কী হয়েছে?

রকিব ওর খুব কাছে এসে দাঁড়ায়।

কই, কিছু না তো।

সালমা জল ছড়ায় দুহাতে।

ট্যাপটা বন্ধ করে দে, সব পানি পড়ে যাচ্ছে।

যাক না। জলের সঙ্গে খেলতে ভালোই লাগে।

রকিব একটু অবাক হয়।

সালমা, তোকে আমার চাই একান্ত আপন করে। নিবিড় করে–

রকিব ওকে পাগলের মতো চুমু খায়। রকিবের উচ্ছ্বাসের কবল থেকে নিজেকে জোর করে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে ও। রকিবের গায়ে যেন অসুরের শক্তি।

ঠাস করে চড় পড়ে রকিবের গালে। অপ্রস্তুত হবার সঙ্গে সঙ্গে শিথিল হয়ে যায় রকিবের হাতের বাঁধন। একটু পিছিয়ে আসে। সালমা ট্যাপটা বন্ধ করে দেয়। গোটা শাড়ি ভিজে গেছে ওর। সালমার মনে হয় ওর সারা গায়ে পোকা কিলবিল করছে। এবং ও নিজেই একটা বিরাট পোকা হয়ে গেছে।

ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে রকিব ফ্যানের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। ওর প্যান্ট-শার্ট অনেকখানি ভিজে গেছে। সালমার ভিজে শরীরে আশ্চর্য মাদকতা। ভিজে শাড়িতে সপসপ আওয়াজ তুলে সালমা আলনা থেকে একটা শাড়ি নিয়ে যায়। শাড়ি পাল্টে আসার পর ওকে কেমন ফ্যাকাশে দেখায়। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ক্রিম ঘষে মুখে। মিটিমিটি হাসে।

তোর কি খুব জোরে লেগেছে রকিব?

রকিব কথা বলে না। মুখটা গম্ভীর। সালমার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে আছে ও।

অ্যাই রকিব? র-কি-

ছেলেমানুষি দুষ্টুমিতে পেয়ে বসে ওকে। টেনে টেনে উচ্চারণ করে রকিবের নামটা এবং কখনো ভেঙে ভেঙে। তবু সাড়া দেয় না রকিব।

তুই কি আমার সঙ্গে কথা বলবি না রকিব? না বলাই বোধহয় ভালো। কেননা আমার কাছে তোর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।

কী বললি?

তোকে আমি আর চাই না।

সালমা?

সোজা সরল স্পষ্ট কথা বলছি।

কিন্তু তোকে আমার চাই। আমি তোকে ভালোবাসি।

ভালোবাসা? হেসে গড়িয়ে পড়ে সালমা। তোর ভালোবাসা তো আবাল খেলার জন্য।

সালমা।

সালমা দু’পা এগিয়ে আসে। সালমা হাসতেই থাকে। হাসি আর থামে না। হাসির দমকে ওর শরীর কাঁপে। থিরথির শান্ত জলের বুকে মৃদু স্রোতের মতো।

সত্যি বলছি রকিব, এখনই আসল সময়। আমাদের আর এগোনোর দরকার নেই। এগোতে গেলেই তিক্ততার সৃষ্টি হবে। আমি চাই না তোর সঙ্গে ঝগড়া করতে।

রকিব সালমার কাঁধ চেপে ধরে। সাঁড়াশির মতো হাত। ঘাড়ে ব্যথা লাগে।

একটু থমকে যায় সালমা। রকিব ওর চোখে চোখ রাখে। ঝুঁকে পড়ে মুখের ওপর।

আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। আমি শুধু তোকে চাই। তোর এই নরম মোমের মতো দেহ আমার আবাল খেলার জন্য অবশ্যই দরকার। আমার ভালোবাসা সব মিলিয়ে। বায়বীয় ভালোবাসা আমি বিশ্বাস করি না সালমা।

রকিব সালমার গালে গাল ঘষে। হাত দুটো পিঠের ওপর নেমে আসে। বাঁধন আরো গাঢ় হয়। সালমার অস্তিত্ব নষ্ট করে দিয়ে রকিব সেটা তার আপন দেহে মিশিয়ে নিতে চায়। সালমা এখন অসম্ভব শান্ত। শরীরের ভার ছেড়ে দেয়। রকিব ওকে পাঁজাকোলে করে বিছানায় শুইয়ে দেয়।

অবিন্যস্ত শাড়ি ঠিক করে। বুকের ওপর আঁচল টেনে দেয়। হঠাৎ করে সালমার ওপর অসম্ভব মায়া হয় ওর। মনে হয় সালমার কেউ নেই। ও ভীষণ একা, ভীষণ নিঃসঙ্গ। এদিকে সালমার ভেতর তখন ফুলে ফুলে ওঠে। চোখের কোণ বেয়ে জলের রেখা নামে।

সালমা তুই কাঁদছিস? তোহাই লাগে কাঁদিস না।

রকিব ওর ভিজে চোখে চুমু খায়। সব শুষে নিতে চায়। এই মুহূর্তে মনে হয় সালমার জন্য ও সব করতে পারে। ও বড় দুঃখী মেয়ে। দুঃখটা ওর নাড়ির পরতে পরতে।

সালমা লক্ষ্মী সোনা বল, তোর জন্য আমি কী করব?

ও কথা বলে না। অস্থির আবেগ রকিবকে কাঁপিয়ে দেয়। সালমার আঁচল দিয়ে চোখ মোছায়। নরম ঠোঁটে হাত রাখে। গালে মৃদু আঙুল ঘষে।

সালমা তোর কী চাই বল? তুই যা বলবি আমি তাই করব। বল সালমা বল।

রকিব ভীষণ কিছু প্রত্যাশা করে। প্রত্যাশা করে নতুন আমন্ত্রণ। সালমার শান্ত মুখে রঙধনু হাসি। মেঘের পরে মেঘ ছাড়িয়ে নীল আকাশে বিহার। সালমা ওকে সঙ্গী করে পথে নামবে। সালমা আস্তে কথা বলে।

রকিব।

বল।

আমি চাই তুই এখন চলে যা।

বেশ।

রকিব উঠে দাঁড়ায়। কোনোদিকে না তাকিয়ে চলে যায়। বাগানের কাঠের গেটটা অসম্ভব শীতল মনে হয়। যে বাড়িটা ও ছেড়ে যাচ্ছে সে বাড়িটাও যে মোমের মতো মেয়েটিকে ও ছেড়ে এলো সে যেন মমি হয়ে যাচ্ছে। এখন আর কোনো আকাশ নেই। জীবন নেই। কোলাহল নেই।

সালমার চোখের কোনায় জলের রেখা দ্রুত গড়ায়। চোখ বুজে শুয়ে থাকে ও। অন্তরে কোনো রকিব নেই। বাইরে সন্ধ্যা গাঢ় হয়। জলিল মিয়া বারান্দায় বাতি জ্বালিয়ে রেখেছে। সালমার ঘরে মিটমিটে আলো। সালমার চোখে জল। ঠোঁটে রকিবের স্পর্শ। গালে রকিবের স্পর্শ। বুকের ওপর রকিবের স্পর্শ।

কিন্তু অন্তরে কোনো রকিব নেই।

যখন তখন হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামে। ইউনিভার্সিটি বন্ধ। সালমার কখনো কখনো একঘেয়ে লাগে। কখনো ভালো। আজকাল ফাঁক পেলেই নাসিমার ওখানে উঠে যায়। ড্রাগস মোটামুটি ধাতে সয়ে গেছে। আর কোনো অসুবিধে হয় না। তবে ওতে সালমা অভ্যস্ত হয়নি। সাব্বির হাসে।

তুমি আমাকে অবাক করেছ সালমা!

কেন?

তুমি যে এত শক্ত মেয়ে, বাইরে থেকে তো বোঝা যায় না।

সালমা শব্দ করে হাসে। নাসিমা ফুল সাজাতে সাজাতে উত্তর দেয়, শক্তর কী দেখলে? ও আরো অনেক কিছু পারবে।

এই তো চাই, কী বলো সালমা? আমার ইচ্ছে করে কী জানো যে শ্লোগান দিই, আসুন আমরা যেমন তেমন করে বাঁচি। ছকবাঁধা জীবন আর কত?

নাসিমা ফ্রিজের ওপর ফ্লাওয়ার ভাস রাখতে রাখতে বলে, তোমার মতো সবার চাওয়াটা এক হলে তো হতোই।

সালমা প্রসঙ্গ পাল্টায়।

ঘরে বসে থেকে তুমি কিন্তু মুটিয়ে যাচ্ছ নাসিমা’পা।

তাই নাকি? তাহলে তো বিশ্রী ব্যাপার। তুমি কী বলল সাব্বির? আমাকে কেমন দেখাচ্ছে?

তরতাজা বিড়ালের মতো।

যাহ্।

যাহ্ নয়। সত্যি কথা।

সাব্বির মুখটা গম্ভীর করে রাখে। সালমার হাসি থামে না। নাসিমা ছেলেমানুষের মতো লাফালাফি করে।

অ্যাই তুমি মুখটা অমন করে রেখেছ কেন?

দেখ নাসিমা, আমি একটা জিনিস ভীষণ ভাবছি।

কী?

উঁহু বলব না।

এই তোমার এক দোষ। কথা শুরু করে আবার থামিয়ে দাও। বেশ, আমিও শুনব না। নাসিমা দুপদাপ শোবার ঘরে চলে যায়। সাব্বির হো হো করে হাসে।

ভাগ্যিস চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। নইলে এখন যদি ওর ছাত্রছাত্রী সামনে থাকত, তাহলে কেমন হলো সালমা?

না সাব্বির ভাই, আপনি নাসিমা’পাকে বড় খেপিয়ে দেন।

এই নিয়ে তো বেঁচে আছি। এক্ষুণি আমি সব ঠিক করে আসছি।

সাব্বির শোবার ঘরে যায়। এ ঘরে বসেই ওদের হুটোপুটির শব্দ পায় সালমা। সঙ্গে উচ্চ হাসি। পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখবার চেষ্টা করে। পারে না। শিরশির করে শরীর। সালমা ভাবল, ওরা কি ভুলে গেছে যে। সালমা এ ঘরে বসে রয়েছে! সালমা বয়স্ক মেয়ে। অথচ ও সীমিত আকাক্ষার মেয়ে নয়। রাগ হলো। ভীষণ রাগে হাত কামড়াল খানিকক্ষণ। বাইরে ঝুপঝুপিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। সালমা জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। ঘুরেফিরে ওদের কথা মনে হচ্ছে। ওরা এখন তেপান্তরের মাঠে দামাল যুবক-যুবত। ধুৎ! ভাবনাগুলো তাড়াতে চাইল। বাইরে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ছোঁয়া নিল। একসময়ে অবাক হয়ে দেখল ওদের শোবার ঘরের দরজা বন্ধ। লাল পর্দাটা শান্ত। সালমা বন্ধ দরজার ওপর দৃষ্টি ফেলে পঁড়িয়ে রইল। ছিটেফোঁটা বৃষ্টি এসে পিঠের। দিক ভিজিয়ে দিচ্ছে। খেয়াল নেই।

ঘরে পানি আসছে আপা!

বুড়ি ঝির খনখনে গা। সালমা ধমকে উঠল ওকে।

তাতে তোমার কী?

সোফা ভিজে গেলে বেগম সাহেব বকবে।

সে আমি বুঝব, তুমি যাও এখান থেকে।

সালমার রূঢ় কণ্ঠে বুড়ি ঝি ফিরে গেল। বুড়ি বিড়বিড়িয়ে কী যেন বলল। হঠাৎ সালমার মনে হলো ওর ওপর ও অকারণে রাগ করেছে। কোনো মানে হয় না এ রাগের। লজ্জা হলো মনে মনে। তবু হাতের পাশে টিপয়ের ওপর রাখা নাসিমার সাজানো ফ্লাওয়ার ভাস এলোমেলো করে ফেলল। লাল গোলাপের পাপড়ি টুকরো টুকরো করে উড়িয়ে দিলো বাতাসে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সেগুলো গিয়ে পড়ল নিচে ঘাসের ওপর। একে একে তিনটে গোলাপের পাপড়ি ও বাতাসে ওড়াল। জানালায় ঝুঁকে পড়ে তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ। তবু ঘরের দরজা। খুলল না। সালমার অস্থির লাগছে। ইচ্ছে হলো দরজার গায়ে দড়াম দড়াম লাথি মারতে। কিন্তু হাত কামড়ানো ছাড়া সালমা আর কিছু করতে পারল না।

তখুনি ঘরের আরেক পাশে চুপচাপ শুয়ে থাকা টেলিফোনটা শব্দ করে উঠল। সালমার বুকটা ধড়াস করে ওঠে। ভীষণ আকাঙক্ষায় দৌড়ে গিয়ে টেলিফোনটা ওঠায়।

হ্যালো?

হ্যালো, সাব্বির খান আছেন?

সরি, রং নাম্বার।

সালমা নিঃশব্দে টেলিফোনটা যথাস্থানে রেখে দিল। যেন ও কোনো মৃত মানুষকে কবরে নামিয়ে রাখল। যেন ও কারো শান্তি বিঘ্নিত করতে চাইল না। ও ভুলেই গিয়েছিল, এটা ওর বাড়ি নয়। এখানে সাব্বির খান থাকে। কিন্তু ও এখন সাব্বির খানকে ডাকবে কেমন করে? কেমন করে বলবে। টেলিফোনটা আবার বাজল।

হ্যালো, সাব্বির খান আছেন?

সালমা কথা না বলে রেখে দিলো।

টেলিফোন আবার বাজল। 9

দেখুন, আমি ভুল করছি না। এটাই সাব্বিরের নাম্বার। আমি ওর বন্ধু আতোয়ার। ওর সঙ্গে আমার ভীষণ জরুরি দরকার। বিজনেস পারপাস। প্লিজ, আপনি ওকে ডেকে দিন। ওকি বাসায় নেই? হ্যালো হ্যালো হ্যালো–

সালমা টেলিফোন কানে লাগিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কথা বলল। ওপাশ থেকে বিরক্তিসূচক শব্দ পাওয়া গেল। সালমা তব। রিসিভারটা কানে লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বিড়বিড় করল, বিজনেস পারপাসের চাইতেও ভীষণ জরুরি কাজে এখন সাব্বির খান ব্যস্ত। টেলিফোনটা নামিয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গে ওটা আবার বাজল।

হ্যালো? সালমা এবার সাড়া দিলো।

সাব্বির খান কি নেই? রূঢ় কণ্ঠ।

আছে।

কোথায়?

লাল পর্দার ওপারে।

লাল পর্দার ওপারে? কী বলছেন আপনি?

ঠিকই বলেছি।

নাসিমা কোথায়?

উনিও ওখানে।

কী করছে ওরা?

এবার সালমার ভীষণ হাসি পেল। কী বোকা লোকটা, কেমন অবলীলায় শুনতে চাইছে।

হ্যালো হাসছেন কেন? অধৈর্য কণ্ঠ। বলবেন তো কী করছে ওরা?

সে কথা কি বলা যায়?

লে বাবা, কিছুই বুঝতে পারছি না। আচ্ছা শুনুন, লাল পর্দার ওপারে আর কী আছে? আছে বার্মা টিকের খাট, ফোমের গদি, সার্টিনে মোড়া বালিশ, নাইলন নেটের মশারি—

মাথামুণ্ড কিছু বুঝতে পারছি না। আপনি জানেন না, আজকে কাজ করতে পারলে সাব্বিরের অনেক টাকা লোকসান হয়ে যাবে।

কাজ না করলে লোকসান হয়, তা তো জানা কথা।

ধুৎ। আমি আসছি।

ওপাশে টেলিফোন ছেড়ে দেয়। রিসিভার রেখে দিয়ে সালমা চিন্ত য় পড়ে গেল। লোকটা আসছে। কতক্ষণ লাগবে আসতে? দশপনেরো-বিশ মিনিট? না আরো কম? নাকি বেশি? না ভীষণ জরুরি কাজ বলেই লোকটা ছুটতে ছুটতে আসবে। তাঁর আগে চলে যাওয়া ভালো। জানালা দিয়ে বাতাস আসছে। লালপর্দা দুলছে। বুড়ি ঝিকে জানালা বন্ধ করতে বলে সালমা তরতরিয়ে নেমে যায়। আর তখনই ওদের। কাঠের গেটের সামনে এসে থামে একটা ধানি রঙের ড্যাটসান। বারান্দায় সাকিবের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় সালমার

তোর মুখ-চোখ অমন লাল দেখাচ্ছে কেন দিদিভাই। কী হয়েছে?

সালমা জবাব দিলো না। মনে মনে ভাবল, ভাগ্যিস ওই লোকটা ওকে দেখেনি। তবে সাব্বিরের কাছে গল্প করলে ওরা ঠিকই বুঝতে পারবে যে কার কাণ্ড। সাকিব পিছে পিছে ঘরে ঢোকে।

তুই দোতলায় গিয়েছিলি দিদিভাই?

হ্যাঁ।

বাব্বা, তোর কত সাহস। বাবা জানলে–

জানলে কী হবে? আমি তো সবসময় যাই।

সালমা হাত উল্টে মুখভঙ্গি করে। সাকিব ওকে আর না ঘাঁটিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়। জানিস দিদিভাই, মিতালি না ফিরে এসেছে?

খুব ভালো কথা। ঝগড়াঝাটি মিটমাট হয়েছে তো?

হ্যাঁ। সাকিব লাজুক হাসে।

ঝগড়াঝাঁটি বড় বাজে জিনিস, না দিদিভাই?

খুব বাজে। আর কখনো ঝগড়া করিস না।

আমি করি নাকি ও মাঝে মাঝে কেমন যেন করে!

সালমা হাসে।

বাবা-মা কী করছে সাকিব?

বাবা বেরিয়েছে। মা ঘুমুচ্ছে।

বেশ কথা। বৃষ্টি-পড়া দুপুরে ঘুমুতে মন্দ লাগে না।

সামনের সোমবার বাবা আমেরিকা যাচ্ছে।

ও।

প্লেনের টিকিট এসে গেছে।

ও।

বাবার যাওয়াতে আমার খুব খুশি লাগছে। মা-ও খুব খুশি।

হবেই তো। আমেরিকা থেকে বাবা কিছু জিনিসপত্র আনবে। মা এগুলোর জন্য খুশি।

আমার ঘুম পাচ্ছে দিদিভাই। যাই।

সাকিব জানে সালমা হয়তো আর কিছু বলে ফেলবে। এজন্য তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যায়। সাকিবের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সালমা মনে মনে হাসে। সাকিবের সঙ্গে ও আপস করেছে। কেননা সাকিব অনেক কিছুই না জেনে করে। আর ওর এই না জেনে করার ভঙ্গিটা সালমার প্রিয়। এজন্য ও সরল সহজ এবং পরিষ্কার জলের মতো টলটল করে। ওই পানিতে হাত ডোবাতে একটুও অসুবিধা হয় না সালমার।

কিন্তু এখন সালমা কী করবে? ওর তো ঘুম পাচ্ছে না। টিপটিপিয়ে বৃষ্টি পড়ছেই। মার ঘরের দরজা বন্ধ। সাকিবও দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। সালমা চেয়ার নিয়ে বারান্দায় এসে বসে। ধানি রঙের ড্যাটসান চলে গেছে। সালমার মনে হয় ও একা এই নির্জন বাড়িটার রাজকন্যে। রাক্ষস এসে মায়ার কাঠি দিয়ে সকলকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। কেউ কোথাও জেগে নেই। পরিচিত এই বাড়িটা অপরিচিত মনে হয় ওর। গোলকধাধার মতো লাগে। এ বাড়িতে এসে সালমা ওর পথ হারিয়েছে। কামিনী ফুল গাছটার চিকন ডালে একটা লাল-বুক টিয়া বসে বসে বৃষ্টিতে ভিজছে। হঠাৎ হঠাৎ অনেক সুন্দর পাখি এ বাগানটায় আসে। একটু ক্ষণের জন্য দেখা দিয়ে কোথায় উড়ে চলে যায়। আর কোনোদিন আসে না। সালমা বারান্দার এ-মাথা ও-মাথা পায়চারি করে।

সালমা ভাবল, এ বাড়িতে আরো দুজন লোক থাকে, তারা গেল কই? জলিল মিয়া, আনুর মা বৃষ্টি মাথায় করে বেরোলো নাকি? রান্নাঘরের পাশের ঘরটায় জলিল মিয়া থাকে। আনুর মার জায়গা হয়েছে স্টোররুমে। জলিল মিয়ার ঘরের দিকে এগোলো সালমা। জলিল মিয়াকে ডেকে নিয়ে এসে করতোয়া পাড়ের গল্প শুনবে এখন। ভরা বর্ষায় যৌবনবতী করতোয়া নাকি অনন্যা হয়।

কিন্তু ঘরের কাছে এসে থমকে গেল সালমা। ফিসফিসানি শব্দ ভেসে আসছে গোপনে। তবে কি? সন্দেহটা মনের মধ্যে খেলে গেল। পরক্ষণে হাসল, যদি তাই হয় মন্দ কী? আনুর মা জলিল মিয়া দুজনের বুকেই এখন করতোয়ার উন্মাতাল ঢেউ।

অ্যাই ছাড় না। ছিহ।

কী যে খালি না না করো।

সালমা আর দাঁড়াল না। ফিরে এলো। করতোয়া পাড়ের গল্প শোনা হলো না। সারা বাড়ি একটা নদীর মতো মনে হলো ওর। সেই নদীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সময়ের কাছে নতজানু হয়েছে ওরা। আরো আগে হওয়া উচিত ছিল। না, এ নিয়ে সালমার মনে কোনো গ্লানি নেই। ও বরং খুশি হলো। ওর মনে হলো সময়ের ঘড়িটা আরো একটু দেরিতে বাজুক। ওরা আরো সময় পাক। সময় পাক নিবিড় হবার–মাতাল হবার–ভোগ করবার। দুজনেই অনেক কষ্টের নদী পেরিয়েছে। অনেক ঘাট গড়িয়েছে। অনেক দীর্ঘ সময় পবিত্র রেখেছে। এখন কি আর সেইসব অপচয়ের দিনগুলোকে সুদে-আসলে ওঠানো যাবে? দরকার কী? যা হারিয়েছে তা হারাক। সামনের দিনগুলো ওদের পায়ে গোলাপ ছড়াক।

সালমা নিজের ঘরে এলো। টেবিলে ওপর রকিবের চিঠিটা এখনো পড়ে আছে। গতকাল ডাকে চিঠিটা এসেছে। আট পৃষ্ঠা চিঠি লিখেছে রকিব। পড়তে পড়তে হাই উঠেছে ওর। বিরক্তি লেগেছে। শেষ করতে পারেনি। ইনিয়ে-বিনিয়ে এত কথা যে মানুষের লেখার থাকে, সালমার জানা ছিল না। সালমা কোনোদিন কাউকে চিঠি লেখেনি। কেমন আছেন, ভালো আছি জাতীয় দুলাইন চিঠিও না। রকিব জানতে চেয়েছে সালমার শেষ কথা কী। সালমার হাসি পেল। কারো জীবনে কোনো শেষ কথা থাকতে পারে নাকি? নতুন নতুন কথা সৃষ্টি করতে না পারলে তো সে জীবন অর্থহীন, ক্লান্তিকর। সালমার জীবনে কোনো শেষ কথা নেই। রকিব একটা পাগল। তাই পাগলের মতো প্রলাপ বকেছে। যতসব ভাবনা। সালমা চিঠিটা টুকরো টুকরো করে ছিড়ে বাইরে ফেলে দেয়।

সাতদিন পর রকিব এসে হাজির। মুখটা গম্ভীর, রুক্ষ। ওর ভেতরে একটা ভীষণ ওলটপালট চলছে। চুলের ভেতর হাত ড়ুবিয়ে মাথাটা নিচু করে বসে থাকে। আজ আর ওর ঘরে আসে না। ড্রয়িংরুমে বসে। সালমা অনেকক্ষণ বসে থাকার পরও রাকব কিছু বলে না।

আমি কি উঠে চলে যাব রকিব? সালমা রাগতস্বরে জিজ্ঞেস করে।

তুই আমার চিঠি পেয়েছিস?

পেয়েছি।

জবাব দিলি না যে?

তার কি কোনো দরকার আছে?

আমার আছে।

আমি জবাব দিতে বাধ্য নই। তাছাড়া উত্তর দেবার মতো কোনো কথাও আমার নেই।

সালমা?

আমি কোনো কথা রেখেঢেকে বলি না রকিব।

তোর ইচ্ছেটা কী বল তো?

আমার ইচ্ছে? আমার অফুরন্ত ইচ্ছের শেষ আছে নাকি।

সালমা শব্দ করে হাসে। রকিবের মুখটা কালো হয়ে যায়।

তুই ভালোবাসা চাস না সালমা?

কখনো কখনো চাই। সবসময় না। তাছাড়া ভালোবাসার অধিকার আমার সহ্য হয় না। অধিকার যখন জোর করে দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তখন আমার মরতে ইচ্ছে করে।

এর পরিণাম কী?

পরিণাম জানি না।

তোর জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে।

তোর জন্য আমারও রকিব।

তুই আমাকে বুঝতে চাইলি না।

তোকে বুঝি বলেই ফাঁকি দিতে চাই না।

তোর জন্য আমি অপেক্ষা করব।

হেঁদো কথা ছাড়। ন্যাকা পুরুষ আমার পছন্দ না।

সালমা।

রকিবের কণ্ঠে আর্তনাদ বয়ে যায়।

তোর কাছে কি হৃদয়ের কোনো মূল্য নেই সালমা?

আছে। প্রয়োজন হলে তোকে আমি ডাকব।

ডাকিস।

রকিব উঠে দাঁড়াল। বারান্দা দিয়ে হাঁটল। সিঁড়ি দিয়ে নামল। লন পেরোলো। গেট খুলল। চলে গেল।

সালমা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখল। বুকের মধ্যে কট করে একটা শব্দ হলো। বাম দিকটা ব্যথা করছে যেন। রকিব ওকে ডাকিস বলে চলে গেল কেন? বললেই পারত ও ডাকলেও আর কোনোদিন রকিবের সময় হবে না। ডাক দিলেই কি আসা যায়? বোধহয় আসা যায়। নইলে গালিব অমন কথা লিখবেই বা কেন? গালিবের মতো মহান কবি তো আর মিথ্যে লিখতে পারে না—

অনুকম্পা হলে ডেকে নিও আমায়
যে-কোনো সময়ে;
আমি তো অতীতকাল নই যে
ফিরে আসতেই পারব না।

 

পেছন ঘুরতেই মার মুখখামুখি হয়ে গেল।

কিরে রকিব অমন করে চলে গেল যে। কী বলেছিস তুই?

বললাম, আর যেন এখানে না আসে।

সালমা হালকা গলায় কথা বলে।

তোর কপালে যে কী আছে? ছোঁউ করে শ্বাস ফেলে। তোর জন্য একটা মজার খাবার তৈরি করেছি। চল।

চলো।

নিজেকে পাখির পালকের মতো হালকা করে দিতে চাইল সালমা। মার পিছু পিছু খাবার ঘরে এলো। আনুর মার দিকে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আনুর মার মুখটা যেন ঝলমল করছে। কালো চামড়ার ওপর দিয়ে কী একটা অদৃশ্য ঝলক ভেসে বেড়াচ্ছে।

কী রে হাঁ করে ওকে কী দেখছিস?

সালমা লজ্জা পেল। তাড়াতাড়ি চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, আনুর মার স্বাস্থ্যটা একটু ভালো হয়েছে।

আনুর মা টেবিল মুছে চলে গেল। সালমা অনেকক্ষণ ধরে পিঠে খেল। মা তিন-চার রকম পিঠে বানিয়েছে আজ।

তোর বাবা কাল আমেরিকা যাচ্ছে। তুই যাচ্ছিস তো এয়ারপোর্ট?

ক’টায় প্লেন?

সকাল সাড়ে দশটায়।

আমার কাজ আছে। তোমরা যাও।

আমরা তো যাবই। সে কি আর তোকে বলতে হবে?

মা রেগে কথা বলে। সালমা আর কোনো কথা বলার উৎসাহ পায়। কথা বলা বৃথা। পেটপুরে খেয়েদেয়ে উঠে পড়ে। বারান্দা পেরোনোর সময় দেখল, ড্রইংরুমে সাকিব আর মিতালি কথা বলছে। ওদের দেখলে ওর সাদা খরগোশ জোড়ার কথা মনে পড়ে সালমার। ওরা মনের মধ্যে অমনি একটা কাঠের বাক্স বানিয়ে দিন-রাত ওর ভেতর ড়ুবে থাকে। সারাদিন খেলা করে। কখনো মান-অভিমান, কখনো ঝগড়া। আবার সব ঠিক। একটুও ক্লান্তি নেই ওদের। ওরা নিজেদের মধ্যেই মশগুল। মা পিঠে আর চা পাঠিয়েছে। মিতালিকে বাড়ির সবাই খুব পছন্দ করে। বাবাও কখনো ওকে ডেকে বসায়। বসে কথা বলে। সালমার মনে হয়, ওর অভাবটা কি ওরা মিতালির মধ্যে খুঁজে ফেরে? ও যা দিতে পারেনি মিতালি তা পারে? তাই ওর এত আদর? সত্যি ভালো মেয়ে মিতালি। ওরা কেউ সালমাকে দেখতে পেল না। ও ধীরেসুস্থে বাগানে নেমে এলো।

জলিল মিয়া বেলি ফুলের ঝাড় নিয়ে ব্যস্ত। সারা বাগানে সুন্দর গন্ধ ম ম করছে। গাছভর্তি ফুল ফুটেছে। আজ জলিল মিয়া সালমার দিকে মুখ তুলে চাইল না। করতোয়া পাড়ের ছেলে লাজুক হয়ে গেছে। সালমাও ওর সঙ্গে কথা না বলে বেলি ফুল তুলতে থাকে।

এত ফুল তুলছ কেন আপামণি?

মালা গাঁথব।

কার জন্য?

জলিল মিয়া হেসে ফেলে।

কেন নিজের জন্য? আমার খোঁপায় পরব।

অ। তাই বলো। আমি ভাবলাম আপামণি বুঝি এবার আমাদের মিষ্টিমুখ করাবে।

হুঁ, তুমি আমাকে মিষ্টিমুখ করাও না জলিল ভাই।

আমার কি আর নতুন খবর আছে আপামণি।

আছে আছে। অনেক আছে।

কথাটা বলেই সালমা লজ্জা পেল।

কী যে বলো তুমি।

জলিল মিয়া বেলির ঝাড়ের ওপর নুয়ে পড়ল যেন। সালমা কথা না। বলে ফুলগুলো নিয়ে ঘরে ফিরে এলো। সারা বিকেল বসে বসে মালা গাঁথল।

রাতে খাবার পর বাবা ডাকল ওকে।

মাসখানেকের জন্য আমি বাইরে যাচ্ছি লিমা!

শুনেছি।

ভালোভাবে থেকো। লেখাপড়া করো মন দিয়ে।

সালমা চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।

বসো না।

আর কিছু বলবে?

না, ঠিক কিছু বলার নেই। তুমি কাছে থাকলে আমার ভালো লাগে।

বাবা আমতা আমতা করে বলে। যেন খুব সংকোচের সঙ্গে, খুব দীনভাবে কথাগুলো বলছে। সালমার কাছে তার অনেক অপরাধ জমা হয়ে আছে। সেই করুণ চেহারার দিকে তাকিয়ে রাগ হলো সালমার। তবু কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব কোমল করে বলল, আমি যাই।

সালমা বেরিয়ে এলো। বাবা ডাকল না। মা ও সাকিবও কিছু বলল। সালমার সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলার মনও ওদের হারিয়ে গেছে। ওকে জোর করে কাছে বসাবার সাহস আর নেই। ওদের নির্বাক পুতুলের মতো বসে থাকার ভঙ্গি অসহ্য। নিজের মেয়ের শ্রদ্ধা যে অর্জন করতে পারেনি সে যাচ্ছে পাণ্ডিত্যের ঝুলি নিয়ে জ্ঞান বিতরণ করতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *