০১. রোজ ভোরে সালমার ঘরে প্রজাপতি আসে

রোজ ভোরে সালমার ঘরে প্রজাপতি আসে। এক এক দিন এক এক রঙের। কখনো সাদা দেয়ালের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণটায় চুপচাপ বসে থাকে, কখনো ঘরময় উড়ে বেড়ায়। তখন সালমার ঘুম ভেঙে যায়। বালিশট বুকের তলে চেপে উপুড় হয়ে পা নাচায় আর প্রজাপতি দেখে। রঙিন প্রজাপতি। চমৎকার রঙে চিত্রিত ডানা। ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ায়। সালমা একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে বলে, তুমি আমার বন্ধু। আমার ইচ্ছেগুলো ঠিক তোমারই মতো রঙিন। কেবল তোমার মতো উড়াল দিতে পারি না, এই যা। এ কী আমার কম দুঃখ! ঘুরে ঘুরে একসময়ে প্রজাপতিটা জানালা দিয়ে বেরিয়ে যায়। বাগানের বোগেনভিলার ঝোপে গিয়ে বসে। রঙে রঙে মিলে যায়। সালমা আর দেখতে পায় না। বালিশে মুখ গুজে চুপচাপ শুয়ে থাকে। পাশের ঘর থেকে ছোট ভাই সাকিবের স্প্যানিশ গিটারের সুর ভেসে আসে। মৃদু। সাগরপারের গানের মতো ফিসফিসানি যেন। সালমার বুকের তল টিপটিপ করে। দরজায় সবুজ পর্দা কাঁপে। কাঠ-বোঝাই নৌকার মতো সালমার ঘরটা আস্তে আস্তে বিরাট এক রোদ-বোঝাই নৌকা হয়ে যায়।

সালমা শুয়ে শুয়ে শোনে দোতলার ঘরে হাঁটাচলার শব্দ। নাসিমা আপা উঠেছে। বোধহয় তৈরি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার জন্য। নাসিমা আপার কথা উঠলেই সালমার মনটা টানটান হয়ে যায়। ধুৎ, পাপ বুঝি না। পাপ আবার কী? মানুষ যতক্ষণ নিজের বিবেকের কাছে অপরাধী নয় ততক্ষণ কোনো পাপ নেই। আসলে পাপ-পুণ্য নামক বায়বীয় শব্দগুলো অভিধান থেকে উঠিয়ে দেওয়া উচিত। কেনো এই শব্দ দুটো নিয়ে ভাবনা করতে গেলে সালমা কেমন তলিয়ে যেতে থাকে জলে-ডোবা মানুষের মতো।

হাজার চেষ্টা করেও আর ভেসে উঠতে পারে না। তখন বাবার মুখ মনে পড়ে। আস্তে আস্তে বাবার মুখটা এক তিমি মাছ হয়ে যায়। সালমা শেষ তৃণখণ্ড আঁকড়ে ধরার মতো চিৎকার করে ওঠে, বাবা, তুমি পাপের যে সংজ্ঞা দাও তা আমি বুঝি না। আমার মাথা ঘোলাটে হয়ে যায়। কেমন ম্যাজম্যাজ করে স্নায়ু। আমি কোনো বোধ হাতড়ে পাই না। বলো তুমি, তোমার মেয়ে সালমা আমি। তোমার আর মার ভাষায় একরত্তি মেয়ে। পৃথিবী সম্পর্কে কিছু বুঝি না। তবু কেন তোমার জ্ঞানের তলায় এত অন্ধকার দেখি, বাবা?

স্প্যানিশ গিটারের আওয়াজ এবার দ্রুত আসছে। সালমা চঞ্চল হয়। চমৎকার বাজায় সাকিব। ওর এই একটা গুণ আছে। সালমা কান পেতে থাকে। আওয়াজটা কেমন নেচে নেচে আসছে। মনে হয়, কোনো এক বিরাট আঙুর ক্ষেতের ওপর দিয়ে আসছে। আঙুরের টক-মিষ্টি স্পর্শ নিয়ে। মাতাল মাতাল স্বাদ। (আঃ, কেমন অবশ হয়ে আসে। ওই আওয়াজটার মতো সালমার সমস্ত জীবনটা যদি টক-মাতাল গন্ধে ভরপুর হয়ে থাকত! আর বিষণ্ণ হয়ে যায় ও। এবার কেমন ঢিমেতালে শব্দ আসছে। সমুদ্রের বুকে ক্লান্ত পাখির মতো। বুকে একটা ব্যথা হয় প্রায়ই। একটা ব্যথা টের পায় ও। আর ওই ব্যথা উঠলেই রাগ হতে থাকে। বালিশগুলো ছুঁড়ে ফেলে মেঝের ওপর। দ্রুতলয়ের বাজনার মতো ব্যথাটা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। সালমা খাটে বসে স্যান্ডেলে পা গলায়। স্প্যানিশ গিটার থেমে গেছে। ওর ঘর থেকে রোদ সরে গেছে। ঝিম ধরে আছে চার দেয়াল। মা একবার ডেকে গেছে। সালমা ওঠেনি। আবার ডাকছে। সালমা চুপচাপ বসে থাকে। সাড়া দেয় না। মাঝে মাঝে ওই কণ্ঠ ভীষণ কর্কশ লাগে। দয়ামায়াহীন নিষ্ঠুর জল্লাদের মতো। মা এবার দরজা ধাক্কা দিচ্ছে।

লিমা। ও লিমা?

আমি উঠেছি।

ক্লাসে যাবি না? নটা বাজে।

বাজুক। যত খুশি বাজুক। আমি ক্লাসে যাব না।

দরজা খোল না! দেখি শরীর খারাপ কি না?

আমি ঠিক আছি। তুমি যাও।

চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। তার বাবা বসে রয়েছে তোর জন্য।

বাবাকে খেয়ে নিতে বলল।

মা এবার রেগে যায়।

কেমন মেয়ে যে পেটে ধরেছি বাবা! আমার সাতজন্ম উদ্ধার করে ছাড়ল।

মা দুপদাপ চলে যায়।

সালমা বিনুনি খুলে মাথা আঁচড়ায়। সারারাতে বালিশের ঘষায়। চুলগুলো কেমন পাকিয়ে যায়। সকালে উঠে ঠিকমতো না আঁচড়ালে আর রক্ষা নেই। সালমা জানালার ধারে এসে দাঁড়ায়। মা ওকে নাসিমা আপার বাসায় যেতে দেয় না। নাসিমাকে বিশ্রী ভাষায় গালি দেয়। ওপরের রুম দুটো বাড়িওয়ালা কেন নাসিমাকে ভাড়া দিয়েছে এ জন্য বাড়িওয়ালার সঙ্গে ঝগড়া করেছে মা। নাসিমা চুপচাপ। কিছু বলে না। নোংরা কথাও বলে না। সালমাকে দেখে হাসে। ঝকঝকে দাঁতের হাসি। বড় বড় টানা চোখ নামিয়ে বলে, কেমন আছিস সালমা? নাসিমার ওইটুকু কথায় বিগলিত হয়ে যায় সালমা। মাথা ঝাঁকিয়ে বড় করে উত্তর দেয়, ভালো। মার অবর্তমানে চুপে চুপে নাসিমার বাসায় যায়। চেঞ্জারে গান শোনে। কী যেন একটা আছে নাসিমার মধ্যে। কিছু একটা অসাধারণ। কিন্তু সেটা কী ধরতে পারে না সালমা। কিসের আকর্ষণ? বড় বড় চোখের? গোছ গোছা চুলের? ঝকঝকে দাঁতের? নাঃ, সব মিলেয়ে কিছু একটা, যা সালমা ধরতে পারে না। আর ধরতে গেলেই সালমার মাথা ঘোলাটে হয়ে যায়। তখন নাসিমা আপার মুখটা মুছে গিয়ে বড় একটা গোলাপ ফুল ভেসে ওঠে। লাল টকটকে গোলাপ। রেড রোজ। সালমা বিড়বিড় করে। সত্যি, নাসিমা একটা রেড রোজ। চমৎকার রেড রোজ, যেমন সুগন্ধি, তেমন আকর্ষণীয়। নাসিমার গুণের শেষ নেই।

মা নাসিমাকে দেখতে পারে না। কেনো নাসিমা প্রচলিত সংস্কারের বেড়ি ভেঙেছে। তাই মার যত রাগ। সালমা জানালার কাছ থেকে সরে এসে খাটের ওপর পা গুটিয়ে বসে। হাঁটুর ওপর থুতনি রাখে। বাবা ক্লাসে যাবে। সাড়ে নটায় ক্লাস। বাবা দর্শনের অধ্যাপক হলে কী হবে, বাবা একদম ছেলেমানুষ। বাবা যখন ইচ্ছে করে একটা সত্যকে এড়িয়ে যেতে চায় তখন রাগ হয় সালমার। শুধু ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য বাবা নিয়মের অনেকটা বেমালুম হজম করে দিতে পারে। বাবার কোথাও বাধে না। মাও তাই। নিজস্ব গণ্ডির বাইরে মার কোনো ভাবনা নেই। ভাবতে গেলে স্বার্থ নামের নরম পনিরের একখণ্ড যদি ছুটে যায়। যদি হাতছাড়া হয়। আর সহ্য হয় না। হাউকাউ করে ওঠে। যেন হৃৎপিণ্ডের এক অংশ কেউ খুলে নিয়ে গেছে। মা অধ্যাপক গিনি। নিজে মেয়ে স্কুলের টিচার। মনে অহংকার। দেশের সেবায় নিয়োজিত আছেন। সালমা একলা ঘরে বসে ভেংচি কাটে। সেবা না কচু! ব্যাঙের ছাতা! দরজার মৃদু টুকটুক শব্দ হয়।

দিদিভাই?

সাকিব? দাঁড়া খুলছি।

মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সালমার। সাকিব আর ও মাত্র এক বছরের ছোট-বড়, অথচ সাকিবকে এখনো গাল টিপে আদর করতে ইচ্ছে করে। সালমার। ও নরমসরম। বাচ্চা পায়রার মতো। ভঙ্গিটা খুব সাবমিসিভ।

এত বেলা পর্যন্ত ঘুমোচ্ছিস দিদিভাই?

কই ঘুমোচ্ছি? শুয়ে শুয়ে তোর গিটারের বাজনা শুনেছি।

কেমন লাগল?

মনে হচ্ছিল, আমি যেন একটা স্বপ্নের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি।

সত্যিই?

হ্যাঁ রে সত্যি। চমৎকার হাত তোর যত শুনি তত ভালো লাগে।

জানিস দিদিভাই, মিতালিও তাই বলে।

মিতালি?

ও সালমার বিস্ময়ে সাকিব একটু লজ্জা পায়। ঘাড় কঁকিয়ে বলে, মিতালি আমার বন্ধু। একসঙ্গে পড়ি।

ও!

সালমা আর কৌতূহল দেখায় না। তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে ঢোকে।

মা তোর ওপর খুব ক্ষেপেছে দিদিভাই।

ক্ষেপুক। কিছু যায় আসে না।

তুই বেশি বেপরোয়া।

সালমা কথা না বলে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে। একটানা জল পড়ার শব্দ হয়।

সাকিব জানালা দিয়ে বাগান দেখে। দিদিভাইটা এমনি। কাউকে মানতে চায় না। আর সাকিব ইচ্ছে করলেও পারে না। ঘুরেফিরে আবার সেই একই জায়গায় এসে যায়।

অকারণে পথ হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে ছাউনিতে ফেরে। দিদিভাই বড় শক্ত। ক্লান্ত হলেও গণ্ডিতে ফেরে না। নতুন ছাউনি খোঁজে। বাগানের গেট খুলে নাসিমা বেরিয়ে গেল। নাসিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকোলজি পড়ায়। চমৎকার লেকচার দেয়। সাকিব তন্ময় হয়ে শোনে। ও সাইকোলজির ছাত্র। ফার্স্ট ইয়ার অনার্স ক্লাসে নাসিমার লেকচার ঝিরঝিরে নীল বরফপাতের মতো মনে হয় সাকিবের। যেমন উচ্চারণ তেমন বলার ভঙ্গি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী ছিল নাসিমা। ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিল। কেবল কাগুজে ডিগ্রি নয়, বিষয়ের ওপর চমৎকার দখল আছে নাসিমার। মনস্তত্ত্বের ওপর যখন পড়ায় তখন মনে হয় নাসিমা আপার সমগ্র জীবনটা বুঝি মনস্তত্ত্বের বিষয়। ছোটখাটো জিনিসকে চমৎকার বিশ্লেষণ করতে পারেন তিনি। শুধু পুঁথিগত বিদ্যা সে বিশ্লেষণের ধার বাড়াতে পারে না। গভীর কিছু অভিজ্ঞতা সে জ্ঞানকে পূর্ণতা দেয়। অন্তত সাকিবের তাই মনে হয়। সমুচ্ছ্বসিত মন নিয়ে গেটের দিকে তাকিয়ে থাকে সাকিব। আজ নাসিমার সঙ্গে ওর কোনো ক্লাস নেই। হিলতোলা জুতায় খুটখুট শব্দ তুলে নাসিমা যাচ্ছে। হাত দিয়ে ডেকে রিকশা থামাল। হাতে বড় ভ্যানিটি ব্যাগের সঙ্গে ভাঁজ করা ছোট গোলাপি ছাতা। কৃষ্ণচূড়ার লম্বা ছায়া ডিঙিয়ে রিকশাটা বেরিয়ে গেল। একটু পরে সাদা ড্যাটসান গাড়ি নিয়ে বাবা বেরোলো। মুখে পাইপ। পাইপ ছাড়া থাকতে পারে না বাবা। দর্শনের ওপর যখন বড় বড় প্রবন্ধ লেখে তখনো সারাক্ষণ মুখে পাইপ থাকে। সাকিব মনে মনে হাসল, বুদ্ধিজীবী হিসেবে বাবার খুব নাম। চমৎকার বক্তৃতাও দেয়। ও মাঝে মাঝে অবাক হয়। এমন সাজিয়ে কেমন করে বলে বাবা!

বাথরুম থেকে দিদিভাইয়ের গান ভেসে আসছে। অবশ্য গান নয়, গুনগুনানি, হঠাৎ কখনো গলা ছেড়েও দিচ্ছে। সাকিব ভাবল, দিদিভাইটা বড় খেয়ালি। ওর একটা নিজস্ব গণ্ডি আছে। ওখানে ও আপনমনে সুখ-দুঃখ সাজায়। সাকিবের তেমন কোনো নিজস্ব কিছু নেই। সাকিব জলে সাঁতরানোর মতো সবকিছু কাটিয়ে যেতে পারে। কোথাও বাঁধে না। দিদিভাই পারে না। দিদিভাই ঘাসেও হোঁচট খায়। আর হোঁচট না খেয়ে চলতে গেলে ওর মনে হয় ও থেমে গেছে। চলতে পারছে না। সোজা পথে চলাটা কি চলা নাকি! সাকিব হাসে। দিদিভাইটা সত্যি পাগল। এজন্যেই ওকে এত ভালো লাগে। আসলে ও কোথাও নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে না। আর পারছে না বলেই আশপাশের সবকিছুর ওপর ওর যত রাগ। যত বিতৃষ্ণা। এমনকি বাবা-মার নরম ভালোবাসাও সহ্য হয় না। বলে, বাবা-মা আমাকে করুণা করে। কেন করবে? জন্ম দিয়েছে বলেই আমার সব দায়দায়িত্ব তাদের নাকি? কে বলে আমাকে নিয়ে এত ভাবতে? তুই ওদের বলে দিস সাকিব, এসব আমার ভালো লাগে না।

সাকিব ঘরে ফিরে খাটের কাছে আসে। চাদরটা গোছায়। মেঝের ওপর থেকে বালিশ দুটো কুড়িয়ে এনে গুছিয়ে রাখে। বেড কভার দিয়ে ঢেকে দেয় বিছানাটা।

তারপর দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে ক্যালেন্ডার দেখে। রাশিয়ান ক্যালেন্ডার। প্রতিটি পৃষ্ঠায় বাচ্চার ছবি। চমৎকার স্বাস্থ্যবান বাচ্চা। দেখতে ভালো লাগে। হাসি-খুশিতে ফেটে পড়ছে যেন। একটা পৃষ্ঠায় এসে থমকে যায় সাকিব। বুদ্ধিদীপ্ত একজোড়া চোখ ঝলমল করছে। সাকিব মনে মনে ভাবে, এমন এক জোড়া চোখ আমি অনেকদিন ধরে খুঁজছি।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে সালমা। সাদা তোয়ালে দিয়ে ভিজে চুল মাথার ওপর জড়ানো। পাড়-ছাড়া নীল শাড়ি পরেছে। অদ্ভুত দেখাচ্ছে। সাকিব আনমনা হয়ে যায়। অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে থাকে সালমার দিকে।

কিরে, হাঁ করে কী দেখছিস?

তোকে দিদিভাই।

কেন?

দেখ, ঠিক এমন একজোড়া চোখ আমি খুঁজছি। তোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখলাম। না, মিলছে না।

সালমা শব্দ করে হাসে। বারান্দার তারে ভিজে কাপড় মেলে দেয়। বাগানে জলিল কলাবতীর ঝোপ পরিষ্কার করছে। শুকিয়ে যাওয়া মরা পাতাগুলো টেনে টেনে ফেলে দিচেছ। বেশ ঝরঝরে দেখাচ্ছে ঝোপটাকে। সালমা পায়ে পায়ে বাগানে নেমে আসে। সামনে-পেছনে দুটো বাগান আছে বাড়িটার। এজন্যে বাবা বাড়িটা খুব পছন্দ করে।

ভাড়া বাড়িয়েছে। তবু ছাড়ে না। সামনে ফুলের বাগান, পেছনে ফলের। একটা আঙুর গাছও আছে। টক আঙুর। সালমা কলাবতীর ঝোপটার সামনে এসে দাঁড়ায়। ওই ঝোপটা পরিষ্কার করার কী অর্থ জলিলের মনে আছে? সেটা জানতে ইচ্ছে করে।

এই ঝোপটা সাফ করছ কেন জলিল ভাই?

জলিল মিয়া অবাক হয়ে তাকায়।

কেন আবার, দেখছ না কেমন নোংরা হয়েছে।

নোংরা হলে কী হয়?

অতশত বুঝি না বাপু। তোমার বাবা বলেছে সাফ করতে।

ও, বাবা বলেছে বলে তুমি করছ।

সালমা একটু হতাশ হয়ে সরে আসে। জলিলকে আর ঘটায় না। ওর মেজাজটা একটু খিটখিটে। বেশি কথা বললে রেগে যায়। কামিনী ফুল গাছটার নিচে এসে দাঁড়ায় সালমা। ছোট্ট দুটো টুনটুনি পাখি ডালে ডালে লাফায়।

বুড়োদের নিয়ে যত জ্বালাতন!

কথাটা সালমা সবসময় বলে। ওর মতে, ষাট বছরের ওপরে আর কাউকে বাঁচতে দেওয়া উচিত না। এর মধ্যে কারো যদি স্বাভাবিক মৃত্যু না হয় তবে তাকে গুলি করে মেরে ফেলা দরকার। বাবা-মা ওর কথায় রাগ করে। আত্মীয়স্বজন বিরক্ত হয়। হলে কী হবে, সালমা অন্য কারো কথা মানতে রাজি নয়। ওর মতে প্রত্যেকেরই প্রচলিত ধারণাগুলো কিছু না কিছু বদলে ফেলা প্রয়োজন। তা না বুড়োগুলো পারে কেবল আঁকড়ে থাকতে। কোনো কিছু ভাঙতে হবে ভাবলে বুকটা ফেটে যায় ওদের। তাছাড়া বুড়ো বয়সটাও খারাপ। নতুন করে কিছু ভাবতে পারে না। এই যেমন জলিল মিয়া। খুব একটা বুড়ো হয়নি। তবু নিজের কোনো চিন্তা নেই। বাবা বলেছে বলে ঝোপটা পরিষ্কার করছে, আর কিছু ভাবতে পারছে না।

লাল রঙের একটা ফড়িং সালমার চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। ও কামিনীর পাতা ছিড়ে হাত দিয়ে টুকরো করে। আসলে কিছু করার জন্য হাতটা নিশপিশ করে। জলিল মিয়া হাত-পা ছড়িয়ে ঘাসের ওপর বসে আছে। অল্প একটু কাজ করতে গেলেই হাঁপিয়ে ওঠে। সালমা ঘুরেফিরে আবার জলিলের কাছে আসে। স্যান্ডেল খুলে ঘাসের ওপর বসে।

আচ্ছা জলিল ভাই, কলাবতীর ঝোপটা পরিষ্কার করতে করতে তোমার কী মনে হয়েছে?

জলিল ভুরু কুঁচকে চুপ করে থাকে। কী যেন ভাবে। কৃষ্ণচূড়ার পাতার ফাঁকে চিরল রোদ এসে পড়েছে ওদের গায়ে। কলাবতীর মরাপাতার স্তুপের ওপর একটা হলুদ প্রজাপতি। জলিল বিড়ি বের করে ধরায়। সালমার সামনে ওর কোনো সংকোচ নেই। সালমার জন্মের আগে থেকে এ-সংসারে আছে ও। বিয়ের পরই সালমার বাবা ওকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছে। তারপর থেকে জলিল মিয়া অন্য কোথাও যায়নি। সালমা কিছুক্ষণ জলিলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বয়সের চিহ্ন পড়েছে চেহারায়। রেখাগুলো স্পষ্ট। কালো মোটা ঠোঁটের ফাঁকে চিকন বিড়ি। কপালের ওপর থেকে অনেক চুল উঠে গেছে। অসম্ভব ঘোট চোখজোড়া প্রায় গর্তে ঢোকানো।

আমার কথার উত্তর দিচ্ছে না কেন জলিল ভাই?

সালমা একটু ধমকের সুরে কথা বলে। ওই লোকটার বুকের ভেতর কী ভাবনা তা ওকে জানতে হবে। করতোয়া নদীর পাড়ে বাড়ি ওর। অনেক দিন খেয়া পারাপারের কাজ করেছিল। এর বেশি কিছু সালমা জানে না। তবু লোকটাকে আজ জানতে হবে সালমার। ওকে বয়সে ধরেছে। ও এখন পৃথিবী সম্পর্কে বেশি কিছু ভাবতে চায় না। কিন্তু একদিন তো ওর যৌবন ছিল। সেই যৌবনের রেশ কি মনের কোথাও নেই? উত্তর দিতেই হবে সালমাকে। সালমা আজ ওকে ছাড়বে না। প্রায় ফিসিফিসিয়ে বলে, তুমি কী ভাবছ জলিল ভাই?

ভাবছি আমারও দিন ছিল আপামণি। বয়স থাকতে সেইসব দিন সাফ করিনি। এখন দেখি চারদিকে কেবল মরাপাতার বোঝ।

সালমার বুকটা ধক করে ওঠে। একটা মানুষের গোপন গুহার চিচিং ফাঁক হয়েছে ওর সামনে। হ্যাঁ, প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু গুপ্তধন থাকে। নিরক্ষর জলিল মিয়াও তার বাইরে নয়। সালমা একটুক্ষণ চুপ থাকে। জলিল মিয়ার বিড়ি নিভে আসছে। চিরলপাতার ফাঁকে রোদ গরম হচ্ছে। এই লোকটাকে এক্ষুনি না ধরলে ও হয়তো পালাবে। আবার নিজের মধ্যে গুটিয়ে যাবে। ওকে এখনই ধরা চাই।

তুমি বিয়ে করোনি কেন জলিল ভাই?

বিয়ে? জলিল মিয়া হলুদ দাঁত মেলে হাসল। দিন থাকতে এক হিন্দু। বিধবা মেয়েকে ভালোবেসেছিলাম।

জলিল মিয়া আর একটা বিড়ি ধরায়।

বিয়ে হলো না কেন?

ও রাজি হলো না।

কেন?

সংস্কার।

সেই থেকে তুমি বিরাগী হলে? তুমি একটা পাগল।

জলিল মিয়া উত্তর দিলো না।

সালমা ভাবল, মনের মধ্যে এইসব আবর্জনা জমাতে নেই। জমালে ওই বোঝায় চাপা পড়ে মরতে হবে। নির্ঘাত মৃত্যু।

ওর নাম কী ছিল জলিল ভাই?

বরদা।

জলিল মিয়া উঠে চলে যায়। বসলে হয়তো সালমার আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। এবং সেইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে ও রাজি নয়। জলিল মিয়া বোঝা বাড়িয়েছিল কিন্তু ভার বইতে পারেনি। বরদা? ভালোবাসার নাম বরদা। ব-র-দা। সালমা টেনে টেনে উচ্চারণ করে। করতোয়া পাড়ের ছেলে খেয়া বাইত। খেয়া বাইতে বাইতে নিজেই ড়ুবে গেছে। কাকে আর পারাপার করবে ও?

সালমা বসে বসে ঘাসের ডাটা ছেডে। এখনো অনেক বাকি। ওই লোকটাকে আরো বেশি করে জানতে হবে। দেখবে কোন সমুদ্রে ওর ঠাঁই। কেমন করে দিনকাল পেরিয়ে অবলীলায় পাড়ি দিলো করতোয়ার উতল স্রোত? কলাবতীর ঝোপটা বেশ দেখাচ্ছে। কচি সবুজ পাতাগুলো আরো উজ্জ্বল। লাল-হলুদ ফুলের রোশনাই বেড়েছে। আসলে উপযুক্ত স্থানে উপযুক্ত জিনিস দরকার। বোঝা বাড়ালে সব ম্লান হয়ে যায়। ম্রিয়মাণ দেখায়। সব বাজে ভাবনা ঝেড়ে ফেলে অমন হালকা ফুরফুরে হয়ে যেতে ইচ্ছে করে সালমার।

অ্যাই লিমা?

বারান্দার ওপর থেকে মা ডাকছে। স্যান্ডেলে পা ঢুকিয়ে দাঁড়ায় ও। মা স্কুলে যাবার জন্য তৈরি হয়েছেন। কালো কাজ করা হলুদ শাড়ি পরেছেন। মাথায় প্রজাপতি খোপা। ঠোঁটে হালকা রং। হাতে ব্যাগ। সালমা আস্তে আস্তে সামনে এসে দাঁড়ায়। মার মুখ গম্ভীর।

ক্লাসে যাবে না কেন?

ভালো লাগছে না।

শরীর খারাপ?

না।

তবে?

ইচ্ছে করছে না।

এইসব খামখেয়ালি ইচ্ছে-অনিচ্ছেগুলো কবে তোমার শেষ হবে বলতে পারো?

কোনো দিনও হবে না।

ফিক করে হেসে ফেলে সালমা। মা আর কথা বাড়ায় না।

নাশতা খাও গিয়ে। দশটা বাজে।

যাচ্ছি।

মা বেরিয়ে যায়। আসবে বিকেল চারটায়। সালমা খাবার ঘরে এসে ঢোকে। টেবিলের ওপর থেকে এক টুকরো পনির তুলে মুখে দেয়। হান্টার বিফও আছে দেখছি। এই জিনিসটা সালমার খুব প্রিয়। মা ওর জন্য প্রায়ই তৈরি করে। ও কী খেতে ভালোবাসে তার দিকে মার খুব নজর। তবু মার প্রতি তেমন কোনো নিবিড় আকর্ষণ খুঁজে পায় না। সালমা।

আপনাকে চা দেব আপামণি?

দাও।

কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে বেরিয়ে যায় আনুর মা। সালমার মনে হয় একেও জানতে হবে। দেখতে হবে এর ভেতরে কী আছে। আজ সকাল থেকে চারপাশের মানুষগুলোকে কেন জানি নতুন করে দেখতে ইচ্ছে করছে সালমার। প্রত্যেকেরই একটা জগৎ আছে। সালমার নিজস্ব নিয়মের মতো মানুষগুলো বুঝি ঘুরছে। হান্টার বিফের টুকরোগুলো শেষ করে ফেলে ও। আর কিছু খেতে ইচ্ছে করে না। অথচ এক এক সময় পাগলের মতো খেতে ইচ্ছে করে। যা পাওয়া যায় তাই খেতে ভালো লাগে। আনুর মা চা নিয়ে আসে। কাপটা টেবিলের ওপর রেখে টেবিল পরিষ্কার করতে লেগে যায়। আজ একটা চিকন পাড়ের বেগুনি শাড়ি পরেছে ও। জায়গায় জায়গায় ময়লার দাগ। আনু নামের একটা মেয়ে আছে ওর। বিয়ে দিয়েছে। আনুর মা একটু অবাক হয়।

কী দেখেন আপামণি?

কিছু না।

সালমা চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বারান্দায় আসে। সিঁড়ির ধারে বসে। সাকিব গুনগুন করে গান গাইছে আর ইউনিভার্সিটি যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে। পড়াশোনায় ওর খুব একটা আগ্রহ নেই। গান-বাজনায় ঝোঁক। গিটার নিয়ে বসলে আর সব কাজ ভুলে যায়। মাঝে মাঝে সাকিব অনেক রাত পর্যন্ত বারান্দায় বসে গিটার বাজায়। তখন ঘুম আসে না সালমার। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। মনটা ছটফট করে। মনে হয় ওর চারদিকে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আসছে। আর ওর পৃথিবী ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে। ও একটা ছোট নিঃসঙ্গ দ্বীপের অচিন পাখি হয়ে গেছে। কোথাও যেতে পারে না। পুল ভেঙে গেছে–খেয়া ড়ুবে গেছে–ডানায় শক্তি নেই। আর তখনই ও বুকের তলে। বালিশ আঁকড়ে ধরে। একটা কিছু অবলম্বন চাই। একটু কিছু। মাঝে মাঝে ভয় হয় সালমার। মনে হয় সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে ও অনবরত ভূমিতলস্থ অন্ধকারে চলে যাচ্ছে। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। চলার শেষ নেই। সামনে পেছনে ডানে বামে কেউ কোথাও নেই। আলো নেই। বাতাস নেই। ও যেন এক ফোঁটা আলো আর বাতাসের জন্য মরে যাচ্ছে। তখন চিৎকার করতে ইচ্ছে করে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে যে, আমি হারিয়ে যাচ্ছি। আমাকে খুঁজে নাও। টেনে তোলো। পথ দেখাও, কিন্তু কেউ আসে না। সালমা জানে ওর বুকের এই নিঃসঙ্গতা ভরিয়ে দেবার ক্ষমতা কারো নেই। কেন এমন লাগে? এমন অদ্ভুত একপেশে যন্ত্রণা। কখনো নীলপাখি হয়। কখনো রঙিন প্রজাপতি অথবা কখনো সাকিবের গিটার হয়ে যায়।

মাঝরাতে সাবিকের গিটারটা যখন সমস্ত বাড়ি গ্রাস করে তখন সালমার একাকিত্ব তীব্র হয়। তখন বিছানা ছেড়ে উঠে আসে, সাকিবের পাশে চেয়ার নিয়ে বসে।

দেখে বাগান চুপ। সিঁড়ি চুপ। সব আস্তে আস্তে তলিয়ে যায়। সালমার তখন রকিবের কথা মনে হয়। রকিব যতই ওকে ভালোবাসুক, সেই ভালোবাসা সালমাকে স্পর্শ করে না। সালমার স্নায়ুকে সাকিবের গিটারের মতো বাজায় না। রকিবকে তখন একঘেয়ে বিরক্তিকর মনে হয়। সালমার আপন ভুবন ভীষণ ক্লান্তিতে নিশুপ পড়ে থাকে। সাকিবের হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টে। অন্ধকারে তেমন পরিষ্কার দেখা যায় না। তবু মনে হয় ওই হাত যদি হৃৎপিণ্ডের তারকে এমন ঝংকারমুখর করে তুলতে পারত? কখনো বাড়ি বাগান সব মুছে গিয়ে এক বিরাট সমুদ্র জেগে ওঠে। হাত-পা শিথিল করে দিয়ে অথৈ পানিতে ভাসতে ভাসতে অনেক দূরে চলে যায় সালমা। রঙবেরঙের মাছ ঘুরে বেড়ায় চারদিকে। লাল সাদা সোনালি সবুজ হলুদ। কত বিচিত্র রঙের মাছ! মায়াবী এক জগতের মতো জনে হয় সবকিছু। নিঃসঙ্গ চেতনার পলেস্তারা কেটে যেতে থাকে ভেসে ওঠে নতুন জগৎ। সাড়া জাগানো। শব্দময়। সালমা তখন অতিরিক্ত একটা কিছু খুঁজে পায়। খুঁজে পায় আলোর ফোয়ারা। নিষিদ্ধ বাতাসের ঘ্রাণ। আস্তে আস্তে টেনে নিয়ে যায় সেই প্রত্যয়ে, যেখানে দাঁড়িয়ে সহস্র কণ্ঠে বলতে ইচ্ছে করে, আমি আছি। আমার অস্তিতের বাইরে আর কোনো মৌল সত্য নেই। সেই চেতনা সালমাকে উল্লাসের পরীর নাচ দেখায়।

প্রায়ই অনেক রাত হয়ে যায়, তবু ঘুম আসে না। গাঢ় রাত বাবা-মার নিশ্বাসের মতো গভীর হয়। সাকিবের বাজনা মৃদু হতে হতে থেমে যায়। কামিনীর ঝোপ থেকে পাখির ডানা ঝাপটানি ভেসে আসে। বারান্দার নিচ দিয়ে ইঁদুর চলে যায়।

দিদিভাই?

সাকিব আস্তে আস্তে ডাকে। জোরে ডাকার সাহস নেই।

অ দিদিভাই?

কী।

ঘুমাবি না?

তুই থামলি কেন সাকিব?

ঘুম পাচ্ছে।

ঘুম? এরপরও তোর ঘুম পায়? ওই বাজনাই তো তোর ঘুম।

অতশত বুঝি না।

তোকে আমার মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে।

ওঠ, উঠে ঘরে যা।

তুই আর একবার বাজাবি সাকিব?

না।

কেন?

ইচ্ছে করছে না।

তাহলে থাক।

সালমা শ্লথ পায়ে ঘরে চলে আসে। কিছুতেই আর ঘুম আসতে চায় না। এজন্যে কয়েকদিন সাকিবকে মারতে গিয়েছিল ও। রাগে-দুঃখে ওর গিটার ভেঙে ফেলতে চেয়েছিল। সাকিব শান্ত বলে ব্যাপার বেশিদূর গড়ায়নি। তবে এরপর দুদিন সাকিব সালমাকে না বলে নিঃশব্দে উঠে চলে গিয়েছিল। আর সারারাত সালমা বারান্দার চেয়ারের ওপর ঘুমিয়েছিল। ও টের পায়নি যে কখন সাকিব বাজনা থামিয়েছে। নিমজ্জিত চেতনার তলদেশ থেকে ফিরে না এসে ও আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়েছিল। দ্বিতীয় দিন সালমাকে ওই অবস্থায় বারান্দায় দেখে মা ভীষণ রাগারাগি করেছিল। এত বড় মেয়ে সারারাত বারান্দার চেয়ারের ওপর। কাটিয়েছে! মা ভাবতেই পারে না নিজের কপালকে ধন্যবাদ দিয়েছিল যে, কোনো দুর্ঘটনা হয়নি। বাবাও মুখ গম্ভীর করেছিলেন।

সালমা মনে মনে হেসেছিল। দুর্ঘটনা ঘটলেই বা কী হতো? প্রতিটি মানুষই তো এক একটি ঘটনার শিকার। ঘটনার বাইরে কি কেউ থাকতে পারে? মানুষের সমস্ত জীবনটাই তো একটা ঘটনা। আর ঘটনা ঘটানোর মধ্য দিয়েই নতুন মূল্যবোধ গড়ে ওঠে–অপরিচিত অজানা বিশ্বকে নিজের কাজের মাঝে পরিচিত এবং অর্থপূর্ণ করা যায়। নিজের ইচ্ছেকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়েই তো মানুষ ঘটনা ঘটায়। এই যেমন নাসিমা আপা। বাবুই পাখির মতো চমক্কার এক ঘটনার বাসা বুনে তার মধ্যে ড়ুব দিয়ে আছে। কারো তোয়াক্কা করে না। নিজস্ব মূল্যবোেধ বিশ্বাসী। তাতে কার বা কী এসে গেল? সালমার বাবা-মা নৈতিকতার দোহাই দিয়ে যত চেঁচাক, সালমার মনে হয় নাসিমা আপা একটা কিছু করতে পেরেছে। অন্তত নিজের ইচ্ছেমতো জীবনের শুকনো ডাল থেকে রস নিংড়িয়ে নিচ্ছে। আর এই ইচ্ছেমতো বেঁচে থাকার আকাক্ষাটাই তো এ সমাজের বড় দায়।

কাঠের গেটে মৃদু শব্দ করে সাব্বির ঢোকে। সাদা টেট্রনের প্যান্ট-শার্টে ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে। সাব্বির নাসিমার বন্ধু। সালমার সঙ্গে আলাপ আছে। সাব্বিরকে দেখে উঠে দাঁড়ায় সালমা।

কেমন আছেন সাব্বির ভাই? ভালো। তুমি? ভালো।

চাবির রিং ঘোরাতে ঘোরাতে বাম দিকের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে যায়। দুটো সিঁড়ি একসঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে। সালমার মনে হয় বিলেতি খরগোশের মতো। নিজে নিজেই ফিক করে হেসে ফেলে। আবার ধপ করে সিঁড়ির ওপর বসে পড়ে। মনে মনে ভাবতে চেষ্টা করে যে, সাব্বির এখন কী করছে? তালা খুলে ঘরে ঢুকেছে। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়েছে। ফ্রিজ খুলে এক টুকরা কেক মুখে দিয়েছে। বোতলের মুখেই পানি খাচ্ছে। সাব্বির ভাইয়ের এই এক অভ্যেস। নাসিমা আপা মাঝে মাঝে রাগ করে।

তোমাকে কিছুই শেখানো গেল না সাব্বির।

আমি এমন বনমানুষই থাকতে চাই নাসিমা। বেশি সভ্য হয়ে লাভ কী? সভ্যতার ওই মেকিটুকু যত গায়ে জড়াবে তত ঠুনকো হয়ে যাব। কী বলো সালমা?

সালমা হাসে। সাব্বির সালমার দিকে ফিরে হাত নেড়ে বলে, দেখো সালমা, তুমি কিন্তু তোমার বন্ধুকে কখনো এমন করে শাসন করবে না কেমন? মাঝে মাঝে দুজনে একদম পেঁয়ো মূখের মতো আচরণ করবে। মনে করবে তোমরা সভ্যজগতের বাইরে বসবাস করছ। নইলে জীবনে কোনো চার্ম থাকে না সালমা। নাসিমাকে আমি কিছুতেই এ কথাটা। বোঝাতে পারি না।

সালমা কিছু বলার আগেই শুরু হয়ে যায় দুজনের তর্কবিতর্ক। ও তখন নিঃশব্দে কেটে পড়ে। তবু ওরা বেশ আছে। সালমা ভাবল, সাব্বির ভাই এখন বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। অথবা বড় সোফাটার ওপর চিত হয়ে পা দোলাচ্ছে। মুখে দেদার শিস বাজাচ্ছে। খুব আস্তে করে চেঞ্জার বাজছে।

দৃশ্যগুলো কল্পনা করতে সালমার বেশ লাগছিল। মাঝে মাঝে এমনি করে দৃশ্য সাজাতে ভালো লাগে। রঙের পরে রং। ছবির পরে ছবি। চোখ বুজে একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টে যাওয়া। ভীষণ দুর্দান্ত ব্যাপার। দুর্দান্ত শব্দটা আসলে সালমার খুব প্রিয়। সামান্য কিছুকেই দুর্দান্ত ভাবতে ভালোবাসে ও। সাকিব মাঝে মাঝে বলে, তোমার শব্দ ব্যবহার ঠিক হচ্ছে না দিদিভাই।

কখনো ওই না-হওয়াতেই তো যত আনন্দ, যত রোমান্স। তুই কী বুঝবি হাঁদা কোথাকার।

শেষেরটুকু আবার বেশি বললি কিন্তু।

সাকিব এসে পেছন থেকে চুল ধরে টান দেয়।

তখন থেকে দেখছি বারান্দার ওপর বসে রয়েছিস?

তোর তাতে কী?

ইউনিভার্সিটি যাবি না?

না।

আমি চললাম।

সাকিব বেরিয়ে যায়। পরনে জিন্সের প্যান্ট। পায়ে কেডস। গায়ে বিদেশি গেঞ্জি। ব্যাডমিন্টনের চঞ্চল কর্কের মতো দেখাচ্ছে ওকে। সালমা হেসে ফেলল। এক একজনকে কেন্দ্র করে বেশ এক একটা উপমা মনে আসছে ওর।

সারা বাড়ি চুপচাপ। কেবল রান্নাঘর থেকে ছ্যাঁকছুঁক শব্দ আসছে। আনুর মা রাঁধছে। জলিল মিয়া বাগান ছেড়ে এখন ঘরদোর পরিষ্কার করছে। খাটতে পারে লোকটা। কাজের কথা বলতে হয় না। যতক্ষণ সময় পায় ততক্ষণ কিছু না কিছু করতেই থাকে। সালমা হাঁটতে হাঁটতে পেছনের বাগানে আসে। পেছন দিকটা একটু স্যাঁতসেঁতে। রোদ কম। তাছাড়া গাছগাছালির ঘন মাথার জন্য ভিজে ভিজে থাকে। সালমার খুব ভালো লাগে। নাসিমা মাঝে মাঝে বিকেলবেলা এখানে এসে বই পড়ে। এছাড়া আর কেউ আসে না। সালমার মনে হয়, এটা একলা ওর রাজত্ব। বড় কাঠের বাক্সে দুটো ধবধবে সাদা খরগোশ আছে। এ দুটো সালমার খুব প্রিয়। যত্ন করে পালে। নির্জন অবসরে ছেড়ে দেয়। কোলে নিয়ে ঘাস খাওয়ায়। চুপচাপ বসে ওদের ছুটোছুটি দেখে। আর তখনই মনে হয় এই সেই দ্বীপ। যে দ্বীপে ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিটকে পড়েছে। চারদিকে নীরব প্রকৃতি। আর কেউ ওকে সঙ্গ দেয় না। খরগোশ দুটো আনন্দ আর বেদনার মতো সালমার মনের মাঠে ছুটোছুটি করে। এর বাইরে আর কিছুই নেই। খরগোশ দুটোর নাম রেখেছে সুখ-দুঃখ। সালমার নির্জন পৃথিবীতে সুখ-দুঃখই একমাত্র সঙ্গী। এর বাইরে আর সব মিথ্যে। বাবা, মা, সাকিব, নাসিমা আপা, জলিল মিয়া সব মিথ্যে। ওদের উপস্থিতি সালমাকে তেমন নাড়া দেয় না। ওর না থাকলেও সালমার জীবন চলে। এই গাছগাছালির মতো নীরব অনুভূতি, দূরের আকাশের মতো এক টুকরো হৃদয়, মাটির মতো রক্তের উত্তেজনা, ওই খরগোশের ছুটোছুটির মতো আনন্দ আর বেদনা। এর বাইরে একটা মানুষের জীবনে আর কী থাকতে পারে? আর কিছু থাকারই বা প্রয়োজন কী? আর কী লাগে? আরো কিছু লাগে।

ধক্ করে ওঠে বুক। সেই সঙ্গটুকু লাগে, যা মানুষের অস্তিত্বের বিকাশ ও স্থিতি দীর্ঘ করে। সালমার তখন কিছু ভালো লাগে না।

ওই সঙ্গটুকু জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে খেলতে ইচ্ছে করে। খেলতে ক্লান্তি নেই। রকিব বলে, যতই তুই না বলিস ঘুরেফিরে কিন্তু ওই এক জায়গাতেই এসে দাঁড়াতে হবে তোর। জানিস সালমা, আমার ভাইয়ের ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে মাঝে মাঝে মজা করি। ওকে ওপর দিকে ছুড়ে দিয়ে বুকের মধ্যে লুফে নিই। ও বেশ আনন্দ পায়। খিলখিলিয়ে হাসে। আমাকে কিছুতেই থামতে দিতে চায় না। আমি থেমে গেলেই বলবে, কাকু আবাল। এও সেই আবাল খেলা সালমা। ভীষণ মজা।

সালমা চট করে জিজ্ঞেস করেছিল, তুই কখনো খেলেছিস রকিব?

রকিব মুখটা লাল করে বলেছিল, হ্যাঁ।

হয়তো সালমার সামনে খুব সহজে বলতে চেয়েছিল বলে মুখ লাল হয়েছিল। অথবা সালমাকে মিথ্যে বলতে চায়নি। কিংবা সালমার সামনে নিজের পৌরুষ জাহির করতে চেয়েছিল। সে যাই হোক, রকিবের উত্তরে সালমার মন খারাপ হয়নি। হাতে-পায়ের গিটে গিটে কেমন একটা অবসাদ জড়িয়ে থাকে। কেমন বিষণ্ণ চোখে রকিবের দিকে তাকিয়েছিল। বুঝতে চাইছিল, কোথায় রকিবের সুখ আটকে আছে। না, খুঁজে পায়নি সালমা।

তুই কার সঙ্গে খেলেছিলি রকিব?

তুই তাকে চিনবি না।

বল না কে?

বড় ভাবির ছোট বোন।

কোথায় খেলেছিলি?

নৌকায়। একদম মাঝ নদীতে।

কেমন করে পেলি?

ওকে শ্বশুরবাড়ি থেকে আনার জন্য একবার আমাকে পাঠানো হয়েছিল।

তুই সুযোগের ব্যবহার করেছিস?

মানুষে তো সারাজীবন ধরে সুযোগই খোঁজে সালমা।

সালমা আর কথা বলতে পারেনি। অনেক নাড়াচাড়া করেছে। রকিবের কথা নিয়ে। মানুষ সুযোগ খোঁজে। সুযোগ পেলে ঘটনা ঘটায়। আর অন্যজন সেই ঘটনার শিকার হয়। ভালো এবং মন্দ দুই অর্থেই ঘটনার শিকার হয়।

হঠাৎ সালমার খরগোশ দুটো দৌড়ে সালমার কোলের কাছে চলে আসে। ওর শাড়ির নিচ থেকে ভয়ে ভয়ে মুখ বাড়ায়। সালমা চারদিকে তাকায়। কী কারণে ওরা ভয় পেল? ছোট পেয়ারা গাছটার তলায় একটা বেজি মাথা উঁচিয়ে আছে। ও হাততালি দিতেই পালিয়ে যায়। খরগোশ দুটো কিছুতেই আর বেরোতে চায় না। নিরাপদ আশ্রয়ে দিব্যি বসে থাকে। সালমার বুকটা কেমন করে। সুখ-দুঃখ এমন করেই বুকের মধ্যে আশ্রয় খোঁজে। ঘটনা এসে বারবার তা বানচাল করে তোলে। কখনো এপাশে দোলায়, কখনো ওপাশে। নির্জন বাগানটার আপন বৃত্তে। সালমার খেলা জমে ওঠে। সমস্ত অনুভূতি আর আবেগ নিয়ে খেলা। কখনো ঘুম পায়। ভীষণ অবসাদে এলিয়ে পড়ে। যখন সজাগ হয় ফালি ফালি করে চিরে দেখে নিজেকে। কোনো সূত্র খুঁজে পায় না। বিষাদ, হতাশা–এমনি আরো কতকগুলো বাজে শব্দতাড়িত ভাবনা কাত করে ফেলে। আঙুর গাছের লতায় টুনটুনি লাফায়। বাংলাদেশের মাটি বলে অসম্ভব টক আঙুর। খাওয়া যায় না। বাড়িওয়ালার খুব শখের গাছ। সেজন্যে সালমাও যত্ন করে গাছটার। দোতলার জানালায় নাসিমার হলুদ পর্দা কাঁপে। ইংরেজি গান ভেসে আসছে। হয়তো এতক্ষণে নাসিমা আপাও এসে গেছে। ওরা এখন কী করছে? সালমা ভাবতে চাইল। ভাবতে পারল না। ভীষণ লজ্জা পেল।

আপামণি? ও আপামণিও সারাবাড়ি আপনাকে খুঁজছি।

কেন?

স্যার ডাকে।

আসছি।

বাবা ফিরেছে। বাবাকে স্যার ডাকে জলিল মিয়া। করতোয়া পাড়ের ছেলে শহরে এসে স্যার ডাকা শিখেছে। বাবা কখন ফিরল? গাড়ির শব্দ তো পায়নি সালমা। কটা বাজে? সূর্যটা খাড়া মাথার ওপর। গাছগাছালির ছায়া বলে তেমন জোরালো বোদ নয়। মাঘের শেষ। দিনরাত পাতা পড়ে। সালমার নির্জন পৃথিবীতে হলুদ পাতা বিছিয়ে আছে। জলিল মিয়া একবার করে পরিষ্কার করে। পায়ের নিচে মচমচ করে পাতা। এবং সালমা ইচ্ছে করে এক একটা শুকনো পাতার ওপর পা দেয়। মচমচ শব্দ শুনতে বেশ লাগে। মনে হয়, আদিম পৃথিবীর প্রথম ধ্বনি। সমস্ত মাটি কাঁপিয়ে উঠে আসে। অথচ কত মৃদু! সেতারের মতো।

সালমা ওর সুখ-দুঃখকে কাঠের বাক্সে ঢুকিয়ে দেয়। সবসময় ছেড়ে রাখে না। ছেড়ে রাখলে বেজির ভয়, বনবেড়ালের ভয়। আরো কত কী! পাশের বাসার দুষ্ট ছেলেটার ভীষণ লোভ এ দুটোর ওপর। ঘাসের শীতল শরীরের স্পর্শ নেবার জন্য সালমা স্যান্ডেল জোড়া হাতে নেয়। তারপর অকারণে একবার সারা বাগানটা বেড়ায়। মন্দ না। মনে মনে বলে, আমি বৃত্ত তৈরি করছি এবং তাকে প্রদক্ষিণ করছি।

আপামণি?

জলিল মিয়ার বিরক্ত কণ্ঠ।

বললাম তো আসছি।

স্যার খাবার টেবিলে বসে আছেন।

সালমা কথা না বলে পা বাড়ায়। অসহ্য! নিজের ইচ্ছেমতো কিছু করার জো নেই। কোথাও না কোথাও বাধা পড়বেই পড়বে। যত্তসব। বাগান পেরিয়ে গাড়ি-বারান্দা। সামনে লন। লনের একপাশ দিয়ে ঘরে ওঠার সিঁড়ি।

সালমা বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নেয়। খাবার ঘরে ঢুকে দেখল বাবা গম্ভীর মুখে বসে আছে। এখনো খাওয়া শুরু করেনি। সালমাকে দেখে প্লেট টেনে নিতে নিতে বলে, কী করছিলে?

কিছু না।

আমার আবার তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে।

তুমি খেয়ে নিলেই পারতে।

তুমি জানো, তোমাকে ছাড়া আমি খাই না। তাছাড়া তুমি যখন বাসায় রয়েছ।

মনে করতে আমি বাসায় নেই।

কী যা তা বলছ!

বাবার কণ্ঠস্বরে বিরক্তি। সালমা চুপ করে যায়। ভাবে মনে করা না করার মাঝ দিয়েই তো একজনের অস্তিত্ব উড়িয়ে দেওয়া যায়। যায় না? ও যদি এখন চোখ বুজে ভাবে যে বাবা নেই তাহলে কেমন হবে? এই করেই তো বাবাকে উপেক্ষা করা যায়। সালমা একটুক্ষণের জন্য চোখ বুজল। দেখল যে, না, হয় না। কিসের যেন শব্দ হতে থাকে। সেই শব্দ অস্তিত্বের জানান দেয়।

তোমার ঘুম পাচ্ছে লিমা?

না তো।

সালমা তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে বসে। বাবার সামনে ধরা পড়ে গেছে। একটু লজ্জাও পায়।

তুমি কিছু খাচ্ছ না?

খাচ্ছি।

দিন দিন কেমন শুকিয়ে যাচ্ছ?

তোমরা আমাকে নিয়ে বেশি ভাবো।

ভাবব না, তুমি আমাদের একটা মেয়ে—

আমার ভালো লাগে না।

বাবা একটু থমকে ওর মুখের দিকে তাকায়। সালমা চোখ নিচু করে। পরপর কয়েক গ্রাস ভাত মুখে গুঁজে দেয়।

অমন করে খায় না লিমা।

সালমা কথা বলে না। বাবার কণ্ঠ নরম শোনায়। বুকের ভেতরের একটা নির্দিষ্ট স্থান থেকে সে কথাগুলো উঠে আসছে। যে স্থানটা শুধু সালমার জন্য। আর কারো জন্য নয়।

তোমার কী ভালো লাগে বলো তো মা?

আমি চাই তোমরা কেউ আমার জন্য যেন বেশি না ভাবো।

আচ্ছা।

বাবার মুখটা অপরাধী দেখায়।

প্লেটের অবশিষ্ট ভাতগুলো চটপট খেয়ে ফেলে। জলিল মিয়া মিষ্টির বাটি রেখে যায়। খাওয়ার পর, মিষ্টি না খেলে বাবার ভাত হজম। হয় না। অথচ সালমা খুব বেশি মিষ্টি খেতে পারে না। মিষ্টি খেলে নসিয়ার মতো লাগে।

তুমি না বলছিলে, তোমার কোথায় যাবার তাড়া আছে।

হ্যাঁ, একটা মিটিং আছে।

বক্তৃতা করবে?

সালমার চোখে সকৌতুক হাসি।

দেখো না, ওরা আমাকে সভাপতি করে ছাড়ল। আমার একদম ইচ্ছে ছিল না। আমি না করেছিলাম, তা ওরা শুনলই না। বাধ্য হয়ে এখন যেতে হবে।

বাবা এমন একটা ভাব করল যেন ভীষণ অনিচ্ছায় যাচ্ছে। এসবের প্রতি তার কোনো মোহ নেই। সালমা ঠোঁট বাঁকায়। কিছু বলে না। সভা সমিতি বক্তৃতা ইত্যাদির প্রতি বাবা ভয়ানক দুর্বল। কেউ না ডাকলেও জোর করে যেতে চায়। কোনো সভা থেকে বাদ পড়লে রেগে যায়। বলার সময়ে বাবা কি না বলে জোর করে ধরল। বাজে কথা। এটুকু শুধু বলার জন্য বলা। সালমা তো চেনে ওর বাবাকে। বাবার বক্তৃতার কোনো অর্থ ও খুঁজে পায় না। নিজের জীবনের সঙ্গে যার কোনো যোগ নেই সেইসব বড় বড় কথা বাবা চমৎকার সাজিয়ে বলে। মানুষ এমন অবলীলায় কেমন করে মিথ্যে কথা বলে এটাই বুঝতে পারে না সালমা। বাবাকে না দেখলে ও হয়তো বিশ্বাসও করতে পারত না মানুষের। মুখোশপরা চেহারার আদল ভিন্ন। নিজে যা বিশ্বাস করে না অপরকে তা বোঝাতে চেষ্টা করে। শুধু হাততালি পাওয়ার জন্য সব ধরনের বুলি এরা কপচাতে পারে। একটুও ভেবে দেখে না কতটুকু বলা ঠিক হলো। সালমা প্রথম প্রথম বাবার সঙ্গে যেত। এখন যায় না। বাবাও নিতে চায় না। কেননা বাসায় এসেই সালমা বাবার সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেয়। নাজেহাল করে। বাবা বিরক্ত হয়। সালমার চিন্তার খেই ছিড়ে বাবা চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ায়। বাবা বারান্দার বেসিনে হাত ধুচ্ছে। সেই সময়টুকু অপেক্ষা করে সালমা। বাবা ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে টুক করে উঠে পড়ে।

আনুর মা অভিযোগ করে।

আপনি কিছু খাননি আপামণি।

ধুৎ, সবার মুখে কেবল এক কথা! বেশি খাও আর বেশি খাও। সালমা গজগজ করতে করতে বেরিয়ে যায়। নিজের ঘরে চলে আসে। ঘুমোতে পারলে মন্দ হতো না। কিন্তু ঘুম কি আসবে? ঘুমটাকে কিছুতেই। বাগে আনতে পারে না ও। সাজু বলে ঘুমের ওপর ওর নাকি আশ্চর্য দখল। ইচ্ছে করলে দুমিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে যেতে পারে। ঘুমুবার আগে পাঁচটার সময় উঠব মনে করে, যদি ঘুমোয় ঠিক পাঁচটায় ঘুম ভেঙে যায়। ফানি! কেমন করে সম্ভব? আর সালমা ঘুমুতে চাইলেই ঘুম পালায়। পঁচিশ মিনিট এপাশ-ওপাশ করার পর তারপর যদি ঘুম আসে। বিছানার ওপর শুয়ে শুয়ে পা দোলায় ও। দাঁতের নিচে এলাচের দানা। ঝাল ঝাল। মিষ্টি স্বাদ।

লিমা? ও লিমা?

আসছি।

বাবার এই এক অভ্যেস। কারণে-অকারণে সালমাকে শুধু ডাকবে। সালমা যত দূরে যেতে চায় বাবা তত কাছে টানতে চায়। মাঝে মাঝে রাগ হয়। ইচ্ছে করে জবাব দেয় না। কিন্তু এ করেও কি উপায় আছে! বাবা জোরজবরদস্তি করে কেবল। সালমা যেন একটা ঘোড়া। বাবা তাতে লাগাম জুড়ে রেখেছে। টানলেই দৌড়াতে হবে। বোগাস, সম্পর্কের অধিকার-টধিকার সব বোগাস। সম্পর্ক একটা আছে বলেই তো এত জোর খাটানো।

লি-মা-

কী বলছ?

দেখো তো মা, আমার ডায়রিটা কোথায়।

এই তো টেবিলের ওপর।

ওহ হো খুঁজে পাচ্ছিলাম না। দিন দিন কেমন ভুলো মন হয়ে যাচ্ছে আমার।

সালমা মনে মনে হাসল। ভুলো না ছাই। আসল জিনিস তোমার ঠিকই মনে থাকে। নিজের স্বার্থের ব্যাপারে তুমি কখনো ভুল করো কি। না বুকে হাত দিয়ে বলো তো দেখি? জানি উত্তর পাব না। ওই একটি ব্যাপারে তুমি খুব পারদর্শী। ভীষণ নিখুঁত। তুমি ঠিক জানো কোন। চালটা দিলে রাজাকে কায়দা মতো চেক দিতে পারবে। আমি তোমাকে এ পর্যন্ত ভুল করতে দেখিনি বাবা। আর তুমি কি না বলো সব তোমার ভুল হয়ে যায়। হাসতে গিয়ে সালমা আবার গম্ভীর হয়ে গেল। বাবা টাইয়ের নট ঠিক করছে। সালমা টেবিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বাবাকে দেখে।

জলিলকে একটা রিকশা ডাকতে বলো মা?

তোমার গাড়ি?

ওয়ার্কশপে দিয়েছি।

ও।

সালমা বেরিয়ে যায়। জলিলকে রিকশা ডাকতে বলে সিঁড়ির ওপর। দাঁড়িয়ে থাকে। কড়া দুপুরে ঝাঁ ঝাঁ রোদ চারদিকে। দূরের কোনো গাছ থেকে ঘুঘুর ডাক ভেসে আসছে। এখন বাবা বেরিয়ে যাবে। বাড়িটা আবার শব্দহীন হবে। সালমা ড়ুবে যাবে অন্তরের চোরাবালিতে। ডান পাশের দোতলার সিঁড়ি দিয়ে সাব্বির ভাই নামছে। শার্টটা কুঁচকে গেছে। মাথার চুল এলোমেলো। সালমার দিকে এক পলক তাকিয়ে মুখ ঘোরাল।

কোথায় যাচ্ছেন সাব্বির ভাই?

রাস্তার মোড়ে। সিগারেট আনব।

একই সঙ্গে বাবাও বেরিয়ে গেল। কাঠের গেটটা খোলা। বাবা বন্ধ করেনি। সালমা উঠে বন্ধ করে এলো। বাতাসে হলুদ পাতা উড়ে যাচ্ছে। খয়েরি পাখি কলাবতীর ঝোপে ডানা মেলে গুটিয়ে নেয়। নিজস্ব ইচ্ছের খেলা। সালমার এখন নিজের সঙ্গে খেলতে ইচ্ছে করছে, এলোমেলো খেলা। ছছাটবেলার মতো। হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়ির ধারে এলো। সাব্বির ভাই নেই। নাসিমা আপার ঘরে উঁকি দিয়ে আসি। কী করছে নাসিমা আপা? নিশ্চয় বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে ম্যাগাজিন পড়ছে। কত যে পড়তে পারে। পড়তে একটুও ক্লান্তি লাগে। না নাসিমা আপার।

সালমা পা টিপে টিপে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল। সামনের দরজা মুখে মুখে লাগানো। আস্তে করে ঠেলে ভেতরে ঢুকল সালমা। না, ড্রইংরুমে কেউ নেই। ফ্রিজের মুখ খোলা। মেঝেয় সিগারেটের টুকরো ছড়ানো। অ্যাশট্রে ভর্তি। টেবিল-ক্লথ সোফার ওপর। ফুলদানি উল্টে আছে। সালমা নাক কুঁচকাল। পরিপাটি সাজানো ঘরটা কেমন বিশ্রী করেছে ওরা। নিশ্চয় সাব্বির ভাইয়ের কাজ। সালমা ঘুরেফিরে হতাশ। ভাবল, চলে যাবে। অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। এভাবে অন্যের ঘরে ঢোকা ঠিক নয়। আবার কৌতূহল হলো। নাসিমা’পা কী করছে? সাড়াশব্দ নেই কেন?

সালমা পর্দা সরিয়ে বেডরুমে উঁকি দিল। শিরশিরিয়ে উঠল অনুভূতি। সালমা দেখল। একবার। দুবার। তিনবার। চোখ বুজে শুয়ে আছে নাসিমা। না, ঘুমোয়নি। শুয়ে শুয়ে হাতের আঙুল নাচাচ্ছে এবং নাসিমা’পা নগ্ন। সালমা যেমনি এসেছিল তেমনি নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। উত্তেজনায় হাত-পা কাঁপছে। আঙুল কামড়াতে ইচ্ছে করছে। কেমন যেন লাগছে সালমার। ঝিমঝিম করছে মাথা। বারান্দায় বাবার ইজিচেয়ারটার ওপর বসে পড়ে। একটু পরে সাব্বির সিঁড়ি দিয়ে উঠে। গেল। মুখের দিকে তাকায় না সালমা। আড়চোখে দেখল, হাতে ডানহিলের প্যাকেট। লাল রঙের সেই প্যাকেটটা অবিকল রকিবের মুখ হয়ে গেল। সালমার রক্তের লোহিত কণিকায় রকিবের নিঃশ্বাস বয়ে। যায়। ঘুম পায় ওর। কেমন সহজে ঘুম আসে। আশ্চর্য, সালমা ঘুম চাচ্ছে না, তবু ঘুম আসছে। স্বচ্ছন্দে ও তরতরিয়ে সালমার চোখের কূলে এসে ভিড়ছে ঘুমের তরী। সালমা বিড়বিড় করল, রকিব তুই কতবার আবাল খেলা খেলেছিস–রকিব তুই কি সুখ পেয়েছিস–নাসিমা’পার বোজা চোখে-নগ্ন বুকে নৃত্যরত আঙুলের ডগায় আমি নীল সুখ দেখেছি–রকিব তুই জানিস না আমার কেমন যেন লাগছে।

রকিব তুই কতজনের সঙ্গে আবাল খেলা খেলেছিস? কতজন–রকিব কতজন–কতবার–রকিব কতবার ক-ত-বা-র। কতরাত কতদিন তোর খুব কষ্টে কেটেছে রকিব। তুই অনেকবার সে গল্প করেছিস। জানিস আমার ইচ্ছে তুই আর আমি একদিন চলে যাব আমার সেই নির্জন দ্বীপে। শুধু তুই আর আমি। আর কেউ না রকিব। আর কেউ না। এমনকি আমাদের ইচ্ছেগুলোও আমাদের সঙ্গে নেব না। পোশাকের মতো সমস্ত ইচ্ছে, আকাক্ষা, বাসনা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে মানুষ নগ্ন হতে পারে না। বল না রকিব, পারে কি না? নাসিমা’পার মতো শুধু পোশাক খুলে নয়, আমি তেমন ন্যাংটো হতে চাই, যা আমাকে একদম বদলে দেবে। একদম অন্য মানুষ হতে পারলে জীবনটাকে বেশ উপভোগ করা যায়, কি বলিস? ধর, তুই সালমা হলি আমি রকিব? তাহলে কেমন হবে? মনে হবে না আমরা নতুন সৌরমণ্ডল গড়তে পেরেছি? নাসিমা’পা বড় অল্পে সুখ পেয়েছে। আমার তা ভালো লাগেনি। ওটাকে সুখ বলে না। এটা হলো ইচ্ছের দাসীগিরি করা। ধুৎ, বাজে! ওই নীল সুখ আমি চাই না। আমি আরো গভীরে যেতে চাই রকিব। আরো গভীরে। সে তলায় গিয়ে যেন আর ঠাঁই না পাই।

রকিব, তুই আমাকে নিয়ে যাবি সেই দ্বীপে? আমি যাব। স্লোমোশন ছবির মতো যাব। নিঃশব্দে। ভেসে ভেসে। আঃ, কী আনন্দ! সুখ পেতে হলে সুখের মতো করে পেতে হবে। একটু সুখে তৃপ্তি নেই। স্থূল হয়ে যায়। তুই আর আমি আলাদা জগৎ গড়ব। নিয়ম ভাঙব। সুখের রং দেব। পাখির ডাক বদলাব। গাছের পাতা বানাব। আমরা বিধাতার মতো হব। সৃষ্টির আনন্দে মাতব। আরো কত কী রকিব! কত কী!

সালমা চোখের পাতা খুলবার চেষ্টা করে। পারে না। ওপরে নিচে কে যেন আঠা লেপে দিয়েছে। সালমা বুঝতে পারছে পারিপার্শ্বিক নির্জন হয়ে যাচ্ছে। পশ্চিম আকাশে কাত হয়ে পড়া সূর্যের একফালি রোদ। সালমার পায়ের ওপর এসে পড়েছে কিসের মিনতি জানায়? সালমা। আস্তে আস্তে ঘুমের প্রশান্ত সমুদ্রে ড়ুবে যাচ্ছে। সালমার গোলাপি ঠোঁটে নীল সুখ কাপে। এবং মনে হয় নিজের মধ্যে কোথাও কোনো ভার নেই। সালমা একদম ন্যাংটো হয়ে গেছে। সে বোধের সঙ্গে সঙ্গে ওপরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। কোথাও আর কোনো সাড়া নেই। সালমার নির্জন পৃথিবীতে ও একা।

বাগানে রোদের লুটোপটি। কলাবতী ঝোপ থেকে টুনটুনি উড়ে গেছে। হলুদ প্রজাপতিও নেই। আনুর মা রান্নাঘরের বারান্দায় আঁচল পেতে শুয়ে আছে। জলিল মিয়া কামিনী গাছের নিচে বসে বিড়ি টানে। দুপুরে ঘুম আসে না ওর। করতোয়া পাড়ের ছেলে সহজে অলস হয় না। কাঠের বাক্সের ভেতরে সালমার সুখ-দুঃখ একে অপরের গাঁয়ে মুখ ঘষে। জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকে। বাটি থেকে দুধ খায়। অথবা তারের ওপর মুখ রেখে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। আম, নিম, আমড়ার পাতা ফস করে জ্বলে ওঠা দিয়াশলাইর কাঠির মতো টুপ করে ঝরে যায়। বেদনাহীন ঝরায় কোনো আলোড়ন নেই।

ওপরের ঘরে সাব্বির আবার দরজা লাগিয়েছে। ড্রয়িংরুমে আরো সিগারেটের টুকরো জমেছে। জানালার হলুদ পর্দার শরীরে বাতাসের কাঁপন। নাসিমার নগ্ন বুকে নীল সুখ থির থির করে। সুখ আস্তে আস্তে গাঢ় হয়। গাঢ় থেকে প্রগাঢ়। সাব্বিরের হাতের সিগারেট নিঃশেষ।

সালমা অনবরত তলিয়ে যাচ্ছে। শব্দময় জগৎ থেকে নির্বাসিত ও। সালমার পৃথিবী এখন ঈভের স্বর্গোদ্যানের মতো আশ্চর্য ঐশ্বর্যময়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *