০৪. দুপুরের দিকে মাধবীর সঙ্গে দেখা

দুপুরের দিকে মাধবীর সঙ্গে দেখা হয় ওর। মাধবী চিঠির প্রসঙ্গ ওঠায় না, ও নিজেও বলে না। কেন, তা তন্ময়ের কাছে পরিষ্কার নয়, শুধু মনে হয় একটু লুকোচুরির খেলা চলুক, দেখা যাক কত দূর গড়ায়। মাধবী জিজ্ঞেস করে, কেমন আছ তন্ময়?

ভালো, তুমি?

আমিও ভালো।

ঠান্ডা তোমার কেমন লাগছে?

একদম ভিন্ন আমেজ। তোমার কাছেও তাই নিশ্চয়ই। কারণ আমরা কেউই এমন আবহাওয়ার সঙ্গে পরিচিত নই। চলো তোমাকে নিয়ে একটা নতুন জায়গায় যাব।

কোথায়?

রিজেন্টস রোডের হ্যামলিস দোকানে।

কী আছে ওই দোকানে?

হাজার রকম খেলনা।

খেলনা দিয়ে আমরা কী করব?

আমি দুটো খেলনা কিনব। একটা তোমার জন্য, একটা আমার জন্য। খেলনাটি যত্ন করে সাজিয়ে রাখব ঘরে, ভাবব ওই খেলনাটা আমাদের শৈশবের সময়।

বাহ, বেশ আইডিয়া তো।

তাহলে চলো যাই হ্যামলিসে। দোকানের নিচে স্ন্যাকস কর্নার আছে, কিছু খেয়ে নেব ওখানে।

তারপরে? তারপর দুজনে রিজেন্টস পার্কে গিয়ে ঘাসের ওপর বসে থাকব।

এই ঠান্ডায়?

তাহলে লেস্টার স্কয়ারে গিয়ে সিনেমা হলে ঢুকব।

তুমি দেখছি অনেক কিছু ভেবে রেখেছ।

হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে পুরো সময়টা কাটাব বলে এভাবে ভেবে রেখেছি। তোমার পছন্দ হয়েছে প্রোগ্রামটা?

খুব পছন্দ হয়েছে।

জানি তুমি এটাই বলবে। এজন্যই তোমাকে আমার এত পছন্দ।

মাধবী কুট্টির চেহারা বেগুনি আভায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, তুমি আর আমি একদিন ক্যামব্রিজে ঘুরতে যাব।

সারাদিনের জন্য, আমিও ভেবেছিলাম একাই একদিন ক্যামব্রিজের পথে বেরিয়ে পড়ব। ভালোই হলো যে তুমি সাথে থাকবে।

বাহ্, আমাদের মধ্যে টেলিপ্যাথি যোগ আছে।

মাধবী কুট্টির প্রাণখোলা হাসিতে মুগ্ধ হয় তন্ময়। মনে মনে ভাবে, ও যদি রোজ একটা করে চিঠি লেখে তাহলে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে করবে। এই অজানা শহরে একা একা বাস করার শূন্যতা ভরে উঠবে।

দুজনে হ্যামলিসে আসে। নানা উচ্ছাসে ঘুরে বেড়ায়। দুজনে দুটি খেলনা গাড়ি নিয়ে নেয়। কফি খায়, কিটক্যাট চকলেট কেনে। মাধবী তন্ময়ের হাত ধরে বলে, বেশ লাগছে, মনে হচ্ছে এখনই শৈশবে আছি, আমাদের সবচেয়ে ভালো সময়।

তন্ময়ের মনে হয় আজ ও নতুন করে মাধবীকে আবিষ্কার করবে, মানুষের ভেতরটাকে কখনো কখনো এমনভাবে দেখতে পাওয়া সুখী মানুষেরাই পারে। তন্ময় মাধবীকে বলে, আমি সত্যি একজন ভাগ্যবান। ছেলে, আমার যা হওয়া উচিত ছিল, আমি তার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছি, তোমাকেসহ মাধবী কুট্টি।

আমাকে সহ? মাধবীর কণ্ঠে বিস্ময়ের ধ্বনি।

তন্ময় মৃদু হেসে বলে, হ্যাঁ তোমাকেসহ, তোমার বন্ধুত্ব এবং ভালোবাসার পূর্ণতা।

তন্ময়, তুমি কী করে বুঝলে আমাকে?

একটি চিঠি।

ওহ্ চিঠি!

চিঠি পেতে আমি খুব ভালোবাসি।

আমি তোমাকে রোজ একটি করে চিঠি লিখব।

লিখবে তো, লিখবেই।

আমি এই দোকানের সব চকোলেট কিনে ফেলতে চাই।

থামো। তন্ময় ওর হাত জড়িয়ে ধরে বাইরে নিয়ে আসে। বলে, সামনে ক্রিসমাস। আমরা সেই ছুটিতে ক্যামব্রিজ যাব। আর কদিন পরেই।

 

এভাবেই শুরু। প্রতিদিন তন্ময়কে চিঠি লেখে মাধবী। অনিমার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় তন্ময়। বলে দেশে ও আমার অপেক্ষায় আছে।

একদিন দিনের প্রথম আলোয় তন্ময়ের দরজায় টুকটুক শব্দ করে মাধবী। উশকোখুশকো চেহারা। ওকে ভেতরে ঢুকিয়ে তন্ময় বলে, কী হয়েছে মাধবী?

তুমি যখন অনিমার কথা বলো তখন আমার খুব কষ্ট হয়। কাল সারারাত এসব ভেবে আমি একটুও ঘুমুতে পারিনি তন্ময়।

আমি তো তোমার সঙ্গে প্রতারণা করতে পারি না মাধবী।

আমি জানি, তুমি পারো না। তুমি তেমন ছেলে নও।

তুমি বসো, আমি কফি বানাই।

হ্যাঁ, কফি খেলে একটু ভালো লাগবে।

তন্ময়ের টেবিলের সামনের চেয়ারটায় বসে মাধবী নিজেকে সামলায়। টেবিলের ওপর রাখা অনিমার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে বলে, তুমিই জিতেছ। তন্ময় তোমারই। তন্ময় কফি আর স্কটিশ কুকি এনে টেবিলে রাখে। মাধবীকে ভীষণ উদভ্রান্ত দেখাচ্ছে, মাধবীর জন্য ওর খুব মায়াই হয়। ও নিজে কি এজন্য দায়ী? থমকে যায় তন্ময়। ওর আকস্মিক নিশ্ৰুপ হয়ে যাওয়াতে মাধবী অপরাধীর মতো বলে, আমি তোমাকে দুঃখ দিলাম তন্ময়?

ভাবছি, আমি তোমাকে কষ্ট দিলাম কি না।

না, তুমি আমাকে কষ্ট দাওনি। আমিই তো বেশি এগিয়েছি, আমিই তো আমার আবেগ ধরে রাখতে পারিনি। আমি তোমাকে ভালোবাসি তন্ময়।

দুজনে ধীরেসুস্থে কফি শেষ করে।

কারো মুখে কথা নেই। মাধবী কুট্টি চামচ দিয়ে কাপের গায়ে টুংটুং শব্দ করে। বলে, আগামী শুক্রবার আমাদের ক্যান্টিনে বিশেষ খাবার। দেয়া হবে।

ভীষণ মজা, তন্ময়ের উৎফুল্ল কণ্ঠ। পাঁচ পাউন্ডে দেয়া হবে টার্কি রোস্টের একটা টুকরা, ক্যানবেরি সস, আলুর সালাদ, রুটি, মাখন আর ক্রিসমাস পুডিং।

এই পুডিংটা খেতে আমার বেশি ভালো লাগে না।

তন্ময় চোখ বড় করে তাকিয়ে বলে, কেন?

পুডিং বললেও ওটা আসলে অনেক শুকনো ফল ঠাসা কেক, যার ওপরে কাস্টার্ড ঢালা হয়।

তন্ময় তার উৎফুল্ল ভাব না কমিয়েই বলে, আমার মনে হয় আমার। ভালোই লাগবে।

মাধবীর নিরুত্তাপ কণ্ঠ, কেন?

উৎসবটা ক্রিসমাসের, সেজন্য। খাবারের সঙ্গে সঙ্গে উৎসবেরও মজা আছে, তাই না?

মাধবী একটু চুপ থেকে মাথা নাড়ে, হ্যাঁ, তা ঠিক।

তন্ময় কণ্ঠ আরো উফুল্ল করে বলে, চাঙ্গা হও মাধবী। স্কুল থেকে আমাদেরকে দেয়া হবে বেলুন, কাগজের টুপি, বাঁশি আরো কী কী যেন। সবটাই ফান, ভীষণ মজা। আমি কিন্তু তোমার সামনে আমার বেলুনটা ফুটিয়ে দেব। আর তুমি তখন হাততালি দেবে।

হ্যাঁ, বেলুন তো ফোঁটাবেই।

মাধবী খুব বিষণ্ণ কণ্ঠে কথা বলে। ওর চোখের তারায় অদ্ভুত আঁধার, বিষণ্ণতা যে বেদনার এমন প্রতিচ্ছায়া হতে পারে ও ভাবতেই পারে না। এমন দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা তন্ময়ের জীবনে নেই। ও বিমূঢ় হয়ে যায়। তখন মাধবী ওর ডান হাতটা ধরে বলে, আমি জানি আমার ভালোবাসার বেলুনটা তুমি ফাটিয়ে দেবে তন্ময়। তোমাকে ফাটিয়ে দিতেই হবে। কারণ, অনিমা তোমার অপেক্ষায় আছে।

আমি এত কিছু ভেবে তোমাকে এ কথা বলিনি। আমি ফান করার। জন্য বলেছি।

আমি সরি তন্ময়, আমার মনে হচ্ছে আমি তোমার কাছে একটু বেশি চাইছি।

মোটেই না। তুমি আমার ভীষণ ভালো বন্ধু।

বন্ধু! মাধবী বিড়বিড় করে বলে। চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, চলো যাই।

ঘরে ফিরতে চাই না। তন্ময় উঠতে উঠতে বলে।

আমি তো ঘরে ফিরব না। অক্সফোর্ড স্ট্রিটে যাব। ক্রিসমাসের জন্য দারুণ সাজিয়েছে জায়গাটা। তুমি যাবে

যাবই তো। তন্ময় মাধবীর বিষণতা কাটাতে চায়। ওর ঘাড়ে হাত রেখে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। দুজনে আন্ডারগ্রাউন্ড রেলে করে অক্সফোর্ড স্ট্রিটে আসে। আলো ঝলমলে শহরটা স্বপ্নপুরীর মতো লাগছে। তন্ময় মাধবীর ঘাড়ে চাপ দিয়ে বলে, ওয়াও, দারুণ তো!

দোকানে দোকানে কী ভীষণ ভিড় দেখেছ?

হুঁ, আমি ভাবছি তোমার জন্য একটা পারফিউম কিনব।

ক্রিসমাস গিফট?

অবশ্যই।

আমিও তোমার জন্য গিফট কিনেছি কুট্টি।

কবে? কখন?

বলবো না। ক্রিসমাসের রাতে দেব। ম্যাথুর দোকান থেকে আমি তোমার জন্য পরীর লকেট কিনেছি। সঙ্গে রুপালি চেন। তোমার ক্রিসমাস স্কার্টের সঙ্গে দারুণ মানাবে।

মাধবী ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে। ওর চোখ জলে ভরে যায়। দ্রুত দুহাতে চোখের জল মুছে ও ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে যায়। এত অকস্মাৎ ঘটনাটি ঘটে যে তন্ময় ভিড় ঠেলে মাধবীর হদিস করতে পারে না। নিজেও ভিড়ের মধ্যে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকে মানুষের গুতো খেতে খেতে এগোতে থাকে। ও কোন দিকে যাচ্ছে ও নিজেও জানে না। জনস্রোতে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে ওর ভালোই লাগছে। মনে হয় অবসর কাটানোর এমন সুযোগ জীবনে কমই আসে।

 

দুদিন পরে নীলিমা চোখ বাঁকিয়ে বলে, মাধবীর সঙ্গে তোমার বন্ধুত্ব হয়েছে?

বন্ধুত্ব হয়েছে, তবে ম্যাথুর সঙ্গে তোমার যেমন বন্ধুত্ব, তেমন নয়।

নীলিমা হাত ওলটায়। কঠিন স্বরে বলে, তোমার কথা বেশ শার্প হয়েছে।

তোমাকে থ্যাঙ্কু নীলিমা, তোমার মতো কথা বলা শিখতে পেরেছি এটা আমার কৃতিত্ব, কী বলে?

নীলিমা কটমট করে তাকায়। হো-হো করে হাসে তন্ময়।

রাগ করছ কেন?

তোমার সঙ্গে রাগ করতে যাব কেন? ম্যাথু কেমন আছে?

জানি না।

মানে?

সহজ কথার মানে বোঝ না? ম্যাথুর খবর আমি জানি না। ওর সঙ্গে আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই।

ও বাব্বা! গতকালই ম্যাথুর সঙ্গে আমার দেখা হলো। খুবই হাসি-খুশি ছিল। ভাবলাম তোমরা দুজনে হেভি আছ।

তুমি ওকে কিছু জিজ্ঞেস করোনি?

আমি অন্যের প্রাইভেসিতে নাক গলাই না।

ও আচ্ছা, যাচ্ছি। বাই।

নীলিমা চলে গেলে তন্ময় অবাক হয় না। ম্যাথুকে একজন দারুণ মজার লোক বলে মনে হয়। একটা সম্পর্ক গড়ে অল্প দিনে ভেঙে দিয়ে বেশ আছে। অদ্ভুত মানুষ। আর ও নিজে অনিমাকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারে না। তাহলে ও কি ওল্ড ভ্যালুজের লোক? আধুনিক হতে পারেনি? তন্ময়কে বিষয়টি খুব ভাবায়। এই ভাবনায় দুদিন কেটে যায়। পরদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলে ঘরের মেঝেতে পায় মাধবীর চিঠি, দরজার নিচ দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। খামের ওপরে লিখেছে, তন্ময় চিঠিটা মাকে পাঠিয়েছি। তোমাকেও পড়ার জন্য দিলাম। কফি বানিয়ে টেবিলে এসে ল্যাম্প জ্বালিয়ে চিঠি পড়তে বসে তন্ময়।

প্রিয় মা,

তোমার ভাষায় আমি তোমার নষ্ট মেয়ে, ঠিকমতো মুরব্বিদের সঙ্গে আচরণ করতে শিখিনি। এটা তুমি ভাবতেই পারো, বিষয়টি বোঝাতে তুমি যে ইংরেজি শব্দটি ব্যবহার করে তা হলো ভ্যালুজ। তোমরা এক ধরনের ভ্যালুজ নিয়ে বড় হয়েছ মা। আমরা আর এক ধরনের। এমনটা তো হতেই হবে, না হলে মনে হবে সময় চলছে না। কিন্তু আমার গড়ে ওঠা ধারণাকে তুমি অবক্ষয় বলে সংজ্ঞায়িত করো। আমি তোমার এই ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছি মা। সেজন্য তোমার কাছে আমি খারাপ। ঠিকমতো শিক্ষা-দীক্ষায় বড় হইনি। আমাকে তুমি ভালোভাবে বড়ই করতে পারোনি। কিন্তু মা, মূল্যবোধের অর্থ যদি হয় নিজেকে বঞ্চিত করা, নিজের সাথেই হিপোক্রেসি; তাহলে সে মূল্যবোধ ক্ষয়ে যাওয়াই ভালো। প্রশ্ন হতে পারে, আমরা কেন নিজেদের এত ভালোবাসি, আসলে প্রশ্নটা ভুল জায়গায় হলো না, প্রশ্নের উত্তরও আমিই তোমাকে দেব। আসলে বিষয়টা হলো আমরা নিজেদের চাওয়া-পাওয়া, নিজেদের ভালোবাসা তোমাদের মতো করেই করি। পার্থক্য হলো আমরা বলে-কয়ে করি, অন্যায় করলে সেটা স্বীকার করতে দ্বিধা করি না, বলতে চাই আমরা যা আমরা তা, আমাদের লুকোছাপা নেই। তোমাকে স্পষ্ট করে বলতে চাই মা, যে সংকীর্ণ সংজ্ঞা দিয়ে নিজের বিশাল পৃথিবীটাকে ম্যাচ বাক্সে পুরে ফেলতে চাই না–সেজন্য নিজেকে জাতি-রাষ্ট্রের বাইরে নিয়ে যেতে আমার কোনো সমস্যা হয় না। এ এক অন্য সময়ের কথা মা। এ সময়কে যদি তুমি ধরতে না পারো তবে নিজেই পিছিয়ে পড়বে, নিজের মেয়ের সঙ্গেই সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হবে। তুমি হারাবে আমার বয়সী প্রিয়জনদের। তুমি তোমার সময়কে আমাদের ঢুকিয়ে দিতে চেও না। শুধু শুধু কষ্ট পাওয়া বাড়াবে, বিনিময়ে নিজেকে একা হয়ে যেতে দেখবে। আমি জানি আমাকে নিয়ে তোমার ভাবনার অন্ত ছিল না। অনেক রাত তুমি না ঘুমিয়ে কাটাতে। কী দরকার অংক কষার মা? সিস্টেম থিওরিতে কিন্তু আছে দুই আর দুই যোগ করলে হয় পাঁচ কিংবা ছয়, আবার তিনও হতে পারে। সুতরাং তুমি আমাকে বুঝতে চেয়ো না, বরং অনুভব করো। নিজের জীবনকে উপরে ছুঁড়ে দিয়ে আবার ধরার খেলা আমি শিখেছি মা। আমরা তো আমাদের জীবনের নানা ধারণার সংজ্ঞা বদলে ফেলেছি। জীবনকে খাঁচায় রেখে রঙ দেখা, ঝালাই করা, ছুঁড়ে ফেলা, কাছে টানা কিংবা চরম উদাসীনতা বা বৈরাগ্য নিয়ে বেরিয়ে আসার পরীক্ষা কেন্দ্রে আমি নিজেই নিজের গিনিপিগ। মা, সেখানে তুমি সনাতনী সুখী দাম্পত্য চেহারাটি আমার পাবে না। কিন্তু পাবে আমার ভিন্ন সত্তা, যে সত্তা নিজের মতো করে গৃহকোণ সাজায় ব্যক্তিত্বের অভিব্যক্তিতে। কিন্তু তোমাদের কাছে মেয়েদের এই চেহারা পছন্দের না। তোমরা ভালোবাসো নরমসরম–বোকা সেজে থাকা মেয়েদের। মেয়ে হবে কিন্তু ন্যাকামি করবে না, আবদারে গলে যাবে না, এ কি মেনে নেয়া যায়। এ ছাড়া আমাদের আর কোনো আইডেনটিটি কি নেই? আমরা একজন মানুষ, কিন্তু স্বতন্ত্র, বলতে পারো মা স্বতন্ত্র মানুষের শিক্ষা আমরা পরস্পরকে কবে দিতে পারব? যেখানে মেয়েরা বিকোয় তার জন্মসূত্রে পাওয়া লিঙ্গের ওজনে, সেখানে তো পরিবর্তনের আশা খুবই ক্ষীণ। তারপরও আমি বিপুল প্রত্যাশায় যুদ্ধে নেমেছি। নিজের সাথেই নিজের যুদ্ধ। এ খেলায় আমি হেরে যাব না। কারণ আমার কাছে হারা বা জেতা ভোটে যাচাইয়ের মতো ব্যাপার নয়। আমার দেখার বিষয় গুণের দিক। পরিমাণের দিক নয়। তাই নিজেকে সবসময় জিতিয়ে রেখে গুণের ভার বাড়ানো আমার লক্ষ্য। তবে তুমি জানো মা, জিতিয়ে রাখার ক্ষমতা অর্জন করার পথটা একদমই সহজ নয়। তবু অক্লান্ত চেষ্টার পথের যাত্রী হতে চাই।

তবে মাঝে মাঝে খুব ভেঙে পড়ি। ভেতরটা ভেঙে গুড়িয়ে যায়। বিশেষ করে যখন বৃষ্টি পড়ে। বুকের ভেতর উথালপাথাল করে, পাগল পাগল ভাব তড়পায়। এত জল ধারণ করার শক্তি কোথায় পাব বলো!

মাঝে মাঝে ভাবি কোথায় বিলং করি আমি। কখনো নিজেকে আন্তর্জাতিক ভাবি। আবার যখন দেখি নিজের দেশের সমস্যা তখন ক্রোধ জন্মায়, চিৎকার করি এই মুহূর্তে ভিন্ন দেশে বসবাস করার হীনম্মন্যতায় কুঁকড়ে আছি। ভাবি, কী আমার অধিকার এই দেশের মাটির কাছে! তখন মানসিক পীড়নে বিপর্যস্ত হয়ে ভাবি, আমি কোথাও বুঝি বিলং করি না। সুতো কাটা ঘুড়ির মতো হুস করে উড়ে যাই। উড়তে থাকি, নিজের প্রতি প্রবল মমতায় নিজের অবস্থানকে শক্ত করতে চাই। এই যে অজানা গন্তব্যে যাওয়ার বাসনা, সে এক প্রবল আনন্দ হয়ে টানে। মা তুমি ছকবাঁধা জীবনের ভেতরে থেকে কখনো এই গতির দেখা পাওনি।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ছেলে তন্ময় আমার ভীষণ ভালো বন্ধু। মা, ওকে পেয়ে আমি নিজের অনেকটুকু সামলে নিয়েছি। তবে আমি এটাও জানি যে, ও আমার জীবনের শেষ কথা নয়। ওকে নিয়ে এই আনন্দদায়ক সময়ও আমার সময়ের ক্রান্তিকাল সময়কে হেয় করার অভিযান। যদি এই সময় আমার জীবন থেকে ঝরে যায় তবে দুঃখ পাব না মা। আমি নিজেকে অতিক্রম করতে শিখেছি।

আমার জন্য একটুও ভেব না।

তোমার মেয়ে, কার্টরাইট গার্ডেন, লন্ডন, ২১ আগস্ট।

তন্ময় চিঠিটা ভাঁজ করে বালিশের নিচে রেখে দেয়। মাধবীকে মোবাইলে ফোন করে পেল না। ফোনটা প্রতিবারই বেজে বেজে থেমে গেল। রাতে ঠিকমতো ঘুমুতে পারল না তন্ময়। বারবার ঘুম ভেঙে গেল ওর।

পরদিন মাধবীকে কোথাও দেখতে পেল না, পরদিনও না।

বিকেলে মাকে ফোন করল তন্ময়।

মাগো মনে হচ্ছিল কত দিন যে তোমার সঙ্গে কথা বলিনি। তুমি কেমন আছ মা?

সাবিহা বানু ওর কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।

তুই কেমন আছিস সোনা?

খুব ভালো আছি মা।

তোর বাবার বন্ধু সালামত মিয়ার সঙ্গে দেখা করেছিলি?

করেছিলাম মা। তবে ওদের জন্য আমার দুঃখই হয়েছে। দীর্ঘদিন প্রবাসে থেকেও ওদের মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি মা। এখন থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে এ দেশে এসে ওরা একই সময়ের গণ্ডিতে ঘুরপাক খাচ্ছে। দেখেশুনে মনে হয়েছে ওদের রয়েছে কালচারাল শক। ভাষার দূরত্বসহ আরো অনেক কিছু ওদের গণ্ডিবদ্ধ করে রেখেছে।

তোর এসব অবজারভেশন ডায়রিতে লিখে রাখিস বাবা। তোর সঙ্গে কারো বন্ধুত্ব হয়নি?

তোমাকে তো ম্যাথুর কথা বলেছিলাম। ইদানীং মাধবী কুট্টি নামে ভারতের কেরালার একটি মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে। ও আমার সঙ্গেই ফটোগ্রাফির কোর্স করছে।

ও আচ্ছা। সাবিহা বানুর কণ্ঠ দমে যায়।

তন্ময় সোৎসাহে বলে, জানো মা ও না একটা দারুণ মেয়ে। দেশে পরিবারের সবার কাছ থেকে খারাপ ব্যবহার পেয়ে ঘর ছেড়েছিল, পরে দেশও। বলে, আর কোনো দিন দেশে ফিরবে না।

এসব সাময়িক কথা বাবা, ঠিকই দেশে ফিরবে। নিজের দেশে না ফিরলেও দেশের কথা মনে রাখতে হবে। নইলে তো ও শেকড়হীন হয়ে যাবে।

হো-হো করে হেসে তন্ময় বলে, তোমার কাছ থেকে এসব কথা শুনলে মাধবী বলবে, তুমি একদম ওর মায়ের মতো কথা বলছ। অর্থাৎ তোমরা একই জেনারেশনের মানুষ।

তা তো হবোই। তবে একই জেনারেশনের সব মানুষ কিন্তু একই সুরে কথা বলে না। তুই নিজে কি মাধবীর মতো ভাবিস?

সবটা ওর মতো ভাবি না। তবে আমার উত্তর শুনে ও বলবে তুমি পুরুষ, তোমার সঙ্গে আমার অনেক পার্থক্য। তোমরা সুবিধাভোগী শ্রেণীর মানুষ।

এটা ও ঠিকই বলে।

মায়ের কথা শুনে আবার হো-হো করে হাসে তন্ময়। বলে, তুমি মাধবীর দলে চলে গেলে মা।

সাবিহা বানু হেসে বলে, কোনো কোনো জায়গায় নারীদের সবার ভাষা একরকম হয়ে যায়। ব্রিটিশদের তোর কেমন লাগছে রে?

ওদের আমার অদ্ভুত লাগে মা। ওদের আছে শুধুই বেঁচে থাকা। মনে হয় ওরা বুঝি শুধুই বেঁচে থাকার জন্য আছে। কেন বাঁচতে হবে এ প্রশ্ন ওদের নেই। জীবনদর্শনহীন ক্রমাগত ছুটতে থাকা চারপাশের ব্রিটিশদের দেখে আমার করুণাই হয়।

হায়রে ছেলে, তোর এমন অভিজ্ঞতা হবে আমি ভাবতে পারিনি।

দুঃখ পেয়ো না মা। তুমি ভালো আছ তো?

হ্যাঁ, ভালোই আছি। তুই ভালো থাকবি। তোর ফেরার অপেক্ষায় আছি।

ফোন রেখে দেয় দুজনে। ফোন বুথের গায়ে হেলান দিয়ে হঠাৎই ওর মনে হয় লন্ডনে ওর আর ভালো লাগছে না। কোর্সটা শেষ না করেই ওর চলে যাওয়ার ভাবনা মাথায় আসে। এটা করলে মা কি রাগ করবে? তন্ময় ধীরেসুস্থে বের হয়ে ভাবে, ম্যাথুর কাছে গিয়ে আড্ডা দিলে ওর ভালো লাগতে পারে। ও বিশ মিনিটের রাস্তা হেঁটেই চলে যায়।

দূর থেকে ম্যাথু আর নীলিমাকে ঘনিষ্ঠ ভঙ্গিতে গল্প করতে দেখে ও খুশি হয়ে যায়। বুঝে ফেলে যে কোনো কারণে দুজনের ঝগড়া হয়েছিল, সেটা মিটে গেছে। ওর দিকে চোখ পড়তেই দুজনে হাত নাড়ে। তন্ময় কাছে গিয়ে সোজাসুজি নীলিমাকে বলে, মিলনের উৎসব পালন করে ফেল। ম্যাথু তো দোকান থেকে নড়বে না, যাও নান্দোস থেকে খাবার নিয়ে এসো।

এসেই একদম হুকুম জারি করছ?

করব না, এমন দৃশ্য দেখার ভাগ্য কজনের হয়?

ম্যাথু অবাক হয়ে বলে, কী হয়েছে?

তেমন কিছু না। নীলিমাকে খাওয়াতে বলেছি।

খুব ভালো করেছ। ম্যাথু ওর টেবিলের ড্রয়ার থেকে বিশ পাউন্ড বের করে বলে, আমি যাচ্ছি। তোমরা আমার দোকান সামলাও।

তন্ময় ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, ভাবতে অবাক লাগে যে এই মানুষটা ঝগড়া করতে পারে।

নীলিমা খোঁচা দিয়ে বলে, পুরুষ মানুষ যে কী চিজ তা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাই।

ঢালাও মন্তব্য করো না নীলিমা। নইলে তুমি ম্যাথুর কাছে আবার আসতে না।

আসিনি, পায়ে ধরে এনেছে।

তন্ময় হো-হো করে হাসে। বলে, দেবীদের তো পায়ে ধরতেই হয়। যাকগে, মাধবী কোথায় উধাও হলো বলো তো?

ও তো ক্যামব্রিজে গেছে। ওর এক বান্ধবী থাকে ক্যামব্রিজের কাছে কোনো একটা জায়গায়, আমি ঠিক জানি না। আজকালের মধ্যে ফিরবে।

তন্ময় মনে মনে চুপসে যায়। মাধবী ওকে না বলে ক্যামব্রিজে চলে গেল! যাকগে, যেতেই তো পারে। ওকে বলে যেতে হবে কেন মাধবীর? ও তো অনেকবারই বলেছে, আমি কোথাও নেই। আমি বলি আমি আমিই। কারো নই। কোথাও নেই। এভাবেই আছি, এভাবেই থাকব। নিজের সঙ্গেই আমার নিজের বোঝাপড়া। নিজের সাথে ঝগড়া এবং বাকি যা আছে তার সবটুকু। একদমই নিজের ভেতর ঢুকে যাওয়া। অথচ যখন বাইরে তাকাই তখন পৃথিবীটাকে অপূর্ব লাগে, তখন নিজেকে সবটুকু আনন্দ দিয়ে ভরিয়ে ফেলতে আমার এক মুহূর্ত দেরি হয় না। এখন আমি সেকেন্ড সিঙ্গল। দ্বিতীয় বার একা হয়ে যাওয়া এই জীবনটা নিয়ে আমার দুঃখ নেই।

নীলিমা খোঁচা দিয়ে বলে, কী ভাবছ? মাধবীর কথা?

যদি ভাবি, তাহলে কি তুমি জেলাস হবে? ওই দেখো কাস্টমার। ভারি সুন্দর মেয়ে দুটো।

চোখ লাগিও না।

তন্ময় উত্তর দেয়ার আগেই মেয়ে দুটো টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ায়। লকেটগুলো দেখতে দেখতে উচ্ছ্বসিত হয়। দুজনে অনেকক্ষণ ধরে গোটা দশেক লকেট পছন্দ করে এবং কিনে ফেলে। তন্ময় খুশি হয়ে বলে, তুমি দেখছি লাকি দোকানদার।

ম্যাথু খুশিতে বাগবাগ হয়ে যাবে।

ওই দেখো আরো দুজন আসছে। তোমার ভাগ্য যে এত ভালো ম্যাথু কি তা জানে!

নীলিমা ওর কথায় কান দেয় না। খদ্দেরের দিকে নজর দেয়, কত কিছু যে যত্ন করে দেখায় তার ঠিক নেই। কে বলবে নীলিমা মাত্র ক’মাস ম্যাথুর এই দোকানটা চেনে। ওদের কথা বলার ফাঁকে তন্ময় বেরিয়ে আসে। মেলার এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায় উদ্দেশ্যহীন, গন্তব্যহীনভাবে। সন্ধ্যার পরে একা একা নান্দোসে বসে ঝাল চিকেন খায়। আজ সেই পর্তুগিজ ছেলেটি নেই। মন খারাপ হয়ে যায়। ঝালে চোখে জল এলে কেউ এক টুকরো মিষ্টি এগিয়ে দেয় না। ঘরে ফিরে লেটার বক্স চেক করে মাধবীর চিঠি পায়। দ্রুত তালা খুলে আলো জ্বালায়। চমৎকার একটি খাম এবং চমৎকার কাগজ ব্যবহার করেছে ও। সুগন্ধি আসছে কাগজ থেকে। লিখেছে, প্রিয় তন্ময়, রাইসন থেকে তোমাকে লিখছি। আমি জানি চিঠি পেতে তুমি খুব ভালোবাসো। কিংসক্রস স্টেশন থেকে একটা স্টেশন পরেই রাইসন। এখানে আমার বান্ধবী কমলা থাকে। আমার বিয়ের আগেই ওর বিয়ে হয়েছিল একজন ব্রিটিশ ডাক্তারের সঙ্গে। তারপর থেকেই কমলা রাইসনে। ওদের বাড়িটা ছোট, বেশ নিরাভরণ এবং নিজের মতো করে ছিমছাম করে সাজানো। বাড়িতে বাড়তি কোনো বাহুল্য নয়। মনে হয়েছিল বাড়িটা বুঝি আমারই, আমার বাড়ি হলে আমি বোধহয় এভাবেই রাখতাম। এই ধারণা পেয়েছি বলেই দুদিন থাকব বলে এসে সাতদিন পার করে দিচ্ছি। কমলার স্বামী দিলীপ অফিসের কাজে ফ্রান্স গেছে। দু’বন্ধুর সময় দারুণ কাটছে। দুদিন আগে আমি আর কমলা একটি বুনো আঠে হাঁটতে গিয়েছিলাম। খুব মজা পেয়েছি সেই মাঠে হেঁটে। আমাদের দেশের মতো সাধারণ মাঠ নয়। মাঠটি পাহাড়ের উপরে, ছোটবেলায় ভূগোল বইয়ে যে মালভূমির কথা পড়েছিলাম, এটা সেই মালভূমি। এই মাঠের যে বৈশিষ্ট্য আমার নজর কেড়েছে সেটা একটি কাঠের বেঞ্চ। ছোট পাহাড়, উঠতে তেমন কষ্ট হয় না। মাঠের শেষ প্রান্তে যেখানে পাহাড় খাড়া হয়ে নেমে গেছে ঠিক সেখানে দিগন্ত দেখার জন্য বেঞ্চটা রাখা। ওই বেঞ্চটা তোমার মতো কাউকে নিয়ে বসার জন্য তন্ময়, অবশ্য কমলার সঙ্গে বসা যায় না, তা নয়, কিন্তু তারপরও বুকের মধ্যে ব্যথা মোচড় দিয়ে ওঠে। আমার সঙ্গে কমলাও স্বীকার করল যে, ভালোবাসার জন্য যে কারো কাছেই নতজানু হওয়া যায়, যদি সে সম্পর্কে ব্যক্তিত্বের অবমূল্যায়ন না হয়। আমাদের ছেলেরা জানে না ছেড়ে দেয়া পাখির ভালোবাসার গভীরতা বন্দি পাখির আর্তনাদে কখনো পাওয়া যায় না। খাঁচার পাখিই পালানোর সুযোগ খোঁজে এবং সুযোগ পেলে পালিয়ে যায়। ভেবে দেখো পালানোর কনসেপ্ট স্বাধীন পাখির নেই। পরিস্থিতি বিরূপ হলে ও অনায়াসে ঘোষণা দিয়ে সরে যেতে পারে। কমলা আমাকে বলল, দূরের দিকে তাকিয়ে দেখ। সামনের ঘরবাড়ি ফোঁটা ফোঁটা জলের মতো দিগন্তের কাছে জড়ো হয়েছে। ভাবলাম ফোঁটা ফোঁটা জল কি সমুদ্র হয়, নাকি হাওয়ায় উড়ে যায়? সামনে বনের গাছগুলো দিগন্ত পর্যন্ত সবুজ করে রেখেছে। নিচে যত দূর চোখ যায় দেখতে পাচ্ছি শর্ষে ক্ষেতের সোনালি আভা, আমাকে অভিভূত করে এমন অপরূপ দৃশ্য ভুলে যেতে চাই ক্ষণিকের দুঃখ, দুঃখ যেন আমাকে গ্রাস না করে তার প্রতিজ্ঞা করি। এই অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপ কে এঁকে রেখেছে। আমার কোনো প্রিয় শিল্পী কি? তন্ময় এখানেই শেষ করছি। বারবারই মনে হচ্ছে ওই বেঞ্চে তোমার সঙ্গে বসে যদি ল্যান্ডস্কেপটা দেখতে পেতাম! তন্ময় এভাবে নতুন দুঃখ তৈরি হয়। ভালো আছি। রাতে আমরা দুজনে টুনা ফিশের স্যান্ডউইচ খাব। সঙ্গে সালাদ আর রাইস পুডিং। ভালো থেকো। মাধবী।

চিঠিটা পড়ে তন্ময়ের মন খারাপ হয়ে যায়। ওর আবার মনে হয়। কোর্সটা শেষ না করেই চলে যাওয়া উচিত। ওর আর এখানে ভালো লাগছে না। অনিমাকে একটা চিঠি লিখবে বলে কাগজ নিয়ে বসে। কিন্তু লেখা হয় না, আঁকিবুকি কাটে, অনিমার মুখ আঁকে, নিজেকেও আঁকে এবং লন্ডনের বিভিন্ন রাস্তা, টিউব স্টেশনের নামে লিখে ইতি টানে। নিজের খোলা কতগুলো ছবি দিয়ে খামের মুখ বন্ধ করে। এখন পর্যন্ত অনিমার কোনো চিঠি পায়নি। ওর চিঠি কি অনিমা একটাও পায় না? এত কিছু ভাবনার মধ্যেও ওর চমৎকার ঘুম আসে এবং অনিমার হাত ধরে একটি শর্ষে ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এমন স্বপ্ন দেখে।

ভোরে স্কুলেই মাধবীর সঙ্গে দেখা হয়। মাধবী দূর থেকে হাত নাড়ে। সামনাসামনি কথা হয় না। ক্লাস শেষের পরে বলে, চলো সোয়াসের ক্যান্টিনে গিয়ে লাঞ্চ করব। আমার চিঠি পেয়েছ?

পেয়েছি। দারুণ লিখেছ। এমন ল্যান্ডস্কেপের ছবি তুলতে পারলে ভালো লাগত।

দারুণ মিস করেছ। তবে ক্যামব্রিজে ঘোরা আমার ভীষণ আনন্দের হয়েছে। ক্যামব্রিজের মাঠটা দারুণ সুন্দর। নদীর নাম ক্যাম। ওর ওপরে যে ব্রিজটা আছে সেজন্য নাম ক্যামব্রিজ। সুন্দর না?

ভীষণ সুন্দর।

তুমি যদি যেতে চাও তাহলে তোমাকে নিয়ে আমি আবার যাব।

তন্ময় চুপ করে থাকে। আকস্মিকভাবে ওর সব আগ্রহ উবে যায়। ক্যান্টিনের ভেতরে ছাত্রছাত্রীদের ভিড় জমে উঠেছে। দুজনে খুঁজেপেতে দুটো চেয়ার খালি পায়। মাধবী কুট্টি তন্ময়ের পরিবর্তন খেয়াল না করেই বলতে থাকে, ক্যামব্রিজের কুইন্স কিংস, ট্রিনিটি, কপার্স, ক্রিস্টি কলেজগুলো দেখেছি। স্থাপত্য শিল্প আমাকে মুগ্ধ করেছে। কত শত বছর আগে মানুষ কী করে যে ওসব নির্মাণ করেছে ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারি না।

চলো খাবার নিয়ে আসি।

চলো। চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ায় মাধবী। তন্ময়ের মনে হয় মাধবী নিজের মধ্যে বেশ মগ্ন হয়ে আছে। পরক্ষণে ও নিজেকে সোজা করে নেয়, জীবনের প্রতি মাধবীর দৃষ্টিভঙ্গিই তো এমন। ও সময়কে অতিক্রম করবে। কোনো সময় ওকে কাবু করতে পারবে না–এই মাধবী, এমনই মাধবী কুট্টি। খাবার নিয়ে এসে দুজনে আবার মুখোমুখি হয়। মাধবী নিজের কথা বলার জন্য খাবারসহ চামচটা মুখের কাছে উঠিয়ে আবার প্লেটের ওপর নামিয়ে রাখে। বলে, একটা প্রশ্ন নিয়ে আমি নিজের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি তন্ময়।

তন্ময় ওর উত্তর শোনার জন্য তাকিয়ে থাকে। প্রশ্ন করে না। মাধবী এক চামচ ভাত মুখে পোরে। বলে, একদিন সন্ধ্যাবেলা কিংস কলেজে গিয়েছিলাম। কমলা আমাকে কলেজের চ্যাপেলে প্রার্থনা সংগীত শোনার জন্য নিয়ে ঢুকল। কণ্ঠস্বর আর অর্গানের যৌথ শব্দ অপূর্ব ধ্বনির সৃষ্টি করে চ্যাপেলের ভেতরে। মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কত বছর আগে তৈরি হয়েছে ওই চ্যাপেল কে জানে। কিন্তু পুরনো জিনিসের অনাধুনিকতা। কোথাও পেলাম না। আমরা দুজনে দেড় ঘণ্টা বসে গান শুনলাম। লম্বা সাদা পোশাক পরে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন বয়সী ছেলেরা গান গাইছে। তো শ’খানেকের মতো। কণ্ঠের ওঠানামায় সুরের রেশ আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। আমার মনে হলো সময়টি আমাকে নিজেকে অতিক্রম করতে সাহায্য করছে। আমি চারদিকে তাকিয়ে দেখতে পাই চ্যাপেলের দেয়ালজুড়ে বিশাল জানালাগুলোর রঙিন কাচে যিশুর জীবনের বিভিন্ন সময়ের ছবি আঁকা। রঙের গাঢ়তা লক্ষণীয়। যেমন গাঢ় লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, কালো আর সাদা। এ অল্প কয়েকটি রঙের ব্যবহারে যে ঔজ্জ্বল্য সৃষ্টি হয়েছে তার তুলনা হয় না। মনে হচ্ছিল প্রতিটি ছবির দৃশ্যগুলো এই কিছুক্ষণ আগে ঘটেছে, কিংবা হয়তো কিছুক্ষণ পরে ঘটবে। আলো, রঙ, সুর এবং বাদ্যের মূর্ঘনায় কোথা দিয়ে যে সময় কেটে যাচ্ছিল টের পাইনি। চ্যাপেলের ভেতরে বসার জন্য সারি সারি বেঞ্চের ওপর যে গানগুলো গাওয়া হচ্ছিল তার একটা করে বই রাখা ছিল। গানের আবেশ কেটে যেতে একটুখানি ধাক্কা খেলাম। বইটি উঠিয়ে নিয়ে গানের বাণীতে চোখ পড়তেই মনটা বিষাদে ভরে গেল। রক্ষণশীলতায় ভরপুর গানের বাণী। তুমি আমাকে প্রশ্ন করতে পারো তন্ময়, রক্ষণশীলতার সংজ্ঞা কী? তুমি বলতে পারো, তোমার ধর্মীয় বিশ্বাস আর একজনের কাছে রক্ষণশীল হবে কেন? এসব নিয়ে তর্কবিতর্ক হতে পারে। কিন্তু আমার খারাপ লেগেছে অন্য বিষয়ে।

এই বলে মাধবী কুট্টি থামে। দু-চামচ ভাত খায়। ওর চেহারায় ভিন্ন। আলো খেলা করে। মাধবীর এমন চেহারা তন্ময় আগে দেখেনি। ও তখন নিজের থেকেই বলে, বাকিটুকু বলো।

এখনো আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে ক্যামব্রিজে পড়া ছেলেমেয়েরা সন্ধেবেলায় রাজার কাছে মাথা নত করার কথা সুর করে বলে বেড়ায়। মধ্যযুগীয় ধর্মকে বদলানোর সাহস এখন পর্যন্ত কারো হয়নি। সে রাতে রাইসনে ফিরে পরদিন আমি ট্রেনে করে লন্ডনে ফিরে আসি।

বেশ এক্সসাইটিং অভিজ্ঞতা।

তোমার তাই মনে হচ্ছে?

অবশ্যই হচ্ছে। আমিও তোমার মতো ভাবছি। নিজের দেশেও ধর্মের অপব্যাখ্যা শুনতে পাই ধর্মান্ধদের কাছে। ওরা প্রয়োজনে ধর্মকে হাতিয়ার করে।

এ রাজনীতি আমার দেশেও আছে নয়। এসো ভাত শেষ করি।

খাওয়া শেষ হলে তন্ময় বলে, আমি ঠিক করেছি কোর্সটা শেষ করব না। দেশে ফিরে যাব।

ভ্রু কুঁচকে মাধবী চেঁচিয়ে বলে, বাজে কথা বলছ কেন?

বাজে কথা নয় মাধবী। আমার আর এখানে থাকতে ভালো লাগছে না।

আমি চাই, আমার জন্য তুমি কোর্সটা শেষ করবে। এটা আমার দাবি।

মাধবী বাম হাত দিয়ে তন্ময়ের বাম হাতটা চেপে ধরে।

আজ রাতে আমি অনিমাকে চিঠি লিখব।

লেখো, আমার কথাও লিখো কিন্তু।

এখন মাকে ফোন করলে তোমার কথা আসে, অনিমাকে চিঠি লিখলে তোমার কথা আসে।

দারুণ! মাধবী খিলখিল হাসিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলে আশপাশের টেবিল থেকে অন্যরা ওদের দিকে তাকায়। তন্ময় মগ্ন কণ্ঠে বলে, তুমি আমায় অনেকটা বদলে দিয়েছ মাধবী কুট্টি।

মাধবী ওর ওপর থেকে চোখ সরিয়ে প্লেটের শেষ ভাতটুকু চামচে তুলে মুখে পোরে। ন্যাপকিন দিয়ে মুখ মুছে বলে, জানো দেশে একবার এক জ্যোতিষী আমার হাত দেখে চমকে উঠেছিল। বলেছিল, ত্রিভুজ মানে সুখ আর চতুর্ভুজ মানে দুঃখ। তোমার হাতে চতুর্ভুজ বেশি। আমি তার কথায় একটুও ঘাবড়াইনি। তবে ত্রিভুজগুলো জোড়া লেগে সব চতুর্ভুজ হয়েছে। কী পাগলামি দেখ তো! নিয়তি মানি না আমি। নিয়তি যতই আমার সামনে দেয়াল ওঠাবে আমি আমার সাহসের কুড়াল দিয়ে সেই দেয়াল ভাঙব। পারব না?

পারবে মাধবী, পারবে। আমি তোমার সাফল্য কামনা করছি।

চলো যাই।

দুজনে ট্রেসহ প্লেটগুলো উঠিয়ে নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে বেরিয়ে আসে। দেখতে পায় ম্যাথু আর নীলিমা ক্যান্টিনে ঢুকছে। খানিকটুকু দূরে বলে তন্ময় হাত নাড়ে, ওদিক থেকে ম্যাথু হাত ওঠায়। নীলিমা দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়। মাধবী এসে বলে, নীলিমা চায় না যে তুমি আমার সঙ্গে মেশা।

অন্যের চাওয়া-না চাওয়ায় আমার কী এসে যায়। সোয়াসে যখন এসেছি, এখান থেকে মাকে একটা ফোন করব। তুমি একটু দাঁড়াবে?

চলো আমি একটা বুথে ঢুকে কমলার সঙ্গে কথা বলি।

 

একটা রিং বাজতেই সাবিহা বানু ফোন ওঠায়। তন্ময় উচ্ছ্বসিত হাসিতে বলে, মা তুমি বুঝি জানতে যে আজ তোমার সোনালি ঈগলটা ফোন করবে, তাই ফোনের কাছে বসে ছিলে?

ঠিক বলেছিস।

জানো মা, আমার ধারণা দেশে ফিরলে তুমি ঠিকই টের পাবে যে তোমার ছেলে অনেকখানি বদলে গেছে।

তাই? এ আমার কাছে খুশির খবর।

মাধবীর সঙ্গে মিশে আমি অনেক নতুন ধারণার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। ওর কথা শুনলে মনে হয় আমার সামনে একটা পথ খুলে যাচ্ছে।

মাধবীর দেশে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা করেছি তোর জন্য। দিল্লিতে ফটোগ্রাফির ওপর একটা ওয়ার্কশপ হবে। আমি তোর যাবার ব্যবস্থা করেছি। তুই ফিরলেই যেতে পারবি।

ওহ মা, সোনা মা আমার।

লাইন কেটে যায়। বুথ থেকে বেরিয়ে দেখতে পায় অন্য কোনো বুথে মাধবী নেই। ও চলে গেছে। কখন গেল? তন্ময় হেঁটে ঘরে ফেরে। কফি খেয়ে চিঠি লিখতে বসে।

প্রিয় অনিমা, বিকেলে দেখে এসেছি টেমস নদীর পাড়ের ঘরবাড়িগুলোর ওপর শেষ বিকেলের আলো। মনে হয়েছিল কখনো কখনো সূর্য বুঝি অতিরিক্ত কিছু উজাড় করে দেয়। তখন নিজের অনেক কিছু খুঁজে পাওয়া যায়। আস্তে আস্তে অন্ধকার নেমেছিল টেমসের ওপরে। সেই পটভূমিতে বিগবেন, লন্ডন, টাওয়ার, সেন্টপল চার্চ ছায়ানৃত্যের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। দেখেছিলাম প্রাচীন লন্ডনের ছবি। এক সময় ভবনগুলো কালো হতে থাকে। এমন অন্ধকার রাতই তো তুমি আর আমি দেখেছিলাম ফুলমসি গ্রামে। কী অপরূপ রাত ছিল! ভাবলে আমি রোমাঞ্চিত হই অনিমা। এখনো এই লন্ডন শহরে বসে সেইসব রাত আমার কাছে স্বপ্নের মতো লাগে।

জানো, কয়েক দিন আগে এক বাদ্যযন্ত্রের দোকানে গিয়েছিলাম। বেশ ভিড় ছিল। প্রায় গায়ে গায়ে ধাক্কা লাগিয়ে হাঁটা বলতে পারো। ওয়েস্ট এন্ডের পুরনো পাথর বাঁধানো রাস্তায় হাঁটতে বেশ লাগছিল। এমন ভিড় দেখলে আমার সদরঘাট আর ফার্মগেটের ভিড়ের কথা মনে হয়। এমন স্মৃতি লালন করতে করতে নজরে আসে দোকানটা। দোকানিকে দেখে মনে হচ্ছিল মঙ্গোলীয় নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর হবে। না হলে চীনা তো হবেই। দোকানে টাঙানো উইন্ড চাইমটায় নাড়া দিয়ে টুংটাং শব্দ করি, শব্দ শুনে দোকানি জ্ব তুলে তাকিয়ে চোখ নামায় পত্রিকায়। দোকানের বৈচিত্র্যপূর্ণ বাদ্যযন্ত্র দেখে আমি বিস্ময়ে হাঁ করে। দাঁড়িয়েছিলাম। দোকানি জিজ্ঞেস করল, আপনাকে কোনটা দেখাব? আমি নিজেই আগে একটু দেখেনি বলে দু-পা এগুলাম। কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে দেখলাম গাছের ডালের মতো লম্বা একটা জিনিস। বড় একটা। বাঁশের ঝুড়িতে রাখা। তিন ইঞ্চি ডায়ামিটারে প্রায় দেড় ফুট লম্বা কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র দেখে আমার মুগ্ধতা কাটে না। একটা হাতে নিয়ে দেখলাম খুব হালকা, দেশে শুকনো ঝিঙ্গের যে আদল পেতাম সে অনুভূতি মনে আসে অনিমা, শুধু এই বাদ্যযন্ত্রের আকারটা ভিন্ন। দোকানি আমার বিস্ময় খেয়াল করে কাউন্টার ছেড়ে এগিয়ে আসে। বাদ্যযন্ত্রটা কীভাবে বাজাতে হয় তা দেখায়। প্রথমে মাথাটা নিচে, পরে উপরের দিকে নিয়ে বাজিয়ে শোনায়। আমি মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম, মনে হয়েছিল পানির স্রোতের মতো নেমে গেল একরাশি বাহারি পুঁতি, যেন আমার ক্যামেরায় তোলা সেই পাহাড়ি মেয়েটিকে আমি এই বাদ্যের সুরের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। এই মাত্র ছিড়ে গেছে তার রঙিন পুঁতির মালা, যা সে কোনো এক বিকেলে উঠোনে পা ছড়িয়ে বসে গেঁথেছিল। তার পুঁতিগুলো ঝমঝম শব্দে নেমে গেল জলের স্রোতে। আমি নিজেও দোকানির মতো করে বাদ্যযন্ত্রটি বাজালাম। আবার সেই মনোমুগ্ধকর ধ্বনি। আমি তোমার জন্য বাদ্যযন্ত্রটি কিনেছি অনিমা। আমরা দুজনে চাদনি রাতে যন্ত্রটি বাজাব।

এই বাজনার মগ্নতার রেশ যেন কেটে না যায় সেজন্য আমি দ্রুত বেরিয়ে আসি। মানুষের ভিড়ে যতই হাঁটি হাতের ওঠানামায় সুর ওঠে। আশপাশের লোকেরা খুশি হয়ে মাথা নাড়ে। কেউ কেউ বাদ্যযন্ত্রটি হাতে নিয়ে নেড়েচড়ে দেখে। আর আমার মুগ্ধতা তো কাটেই না।

এ শহরের ফুটপাথ ধরে হাটতে ভালো লাগে অনিমা। তোমাকে নিয়ে এই শহরে হানিমুন করতে আসব। তোমার শুনে ভালো লাগবে যে আমার স্কুলে যাওয়ার পথে একটি পার্ক পড়ে, সেই পার্কের মাঝখানে মহাত্মা গান্ধীর কষ্টিপাথরের মূর্তি আছে–পদ্মাসনের মতো হাঁটু ভাঁজ করা, পিঠে চাদর ফেলা। একদিন মাধবীকে মূর্তিটি দেখাতে নিয়ে এসেছিলাম। গান্ধীজির শুকনো শরীর–ঝরা পাতার সময়ে, বাতাসে, রোদে, বৃষ্টিতে আর কখনো হালকা তুষারপাতের মধ্যে নির্বিকার বসে থাকেন, যেমনি করে নিজের আদর্শে স্থির ছিলেন শেষ পর্যন্ত। এখানে নানা রঙের গোলাপ ফোটে। ভীষণ ভালো লাগে–কত গাছ, কত বৈচিত্র্য–মন ভরে যায়। লন্ডনের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সবুজের মিশেল আমাকে এই শহরের প্রেমে পড়িয়েছে। গান্ধীর মূর্তির অনেক ছবি তুলেছি, আর ঘরে ফিরতে ফিরলেভেবেছি এদের উন্নয়নের সঙ্গে গাছ কাটার সম্পর্ক নেই–খাল কাটার সঙ্গে সঙ্গে গাছ কেটে ফেলার রাজনীতি ওরা করে না কিংবা গাছ কেটে বিক্রি করে কালো টাকা বানায় না। নিজের দেশের জন্য খুব মায়া হয় অনিমা, এত ব্যর্থতা কেন আমাদের! আজ এ পর্যন্ত। তোমার হলুদ গোলাপ তন্ময়।

দুদিন পরে মাধবীকে গান্ধীজির মূর্তিটি দেখাতে নিয়ে যায় তন্ময়। ওই পার্কে বিশাল বিশাল কিছু গাছ আছে, যার ছায়ায় কাঠের বেঞ্চও পাতা আছে। ইচ্ছে করলে সময় কাটানো যায়, চিৎ হয়ে শুয়ে গাছের ডালপালা দেখা যায়। পার্কে একটি ছোট খাবার দোকান আছে। সেখানেও আড্ডা মারা যায়, ফুলের রঙ আর বিন্যাসের কারুকাজ তো সীমাহীন, কোনটা ফেলে কোনটার দিকে তাকাবে! মাধবী চারদিকে তাকিয়ে বলে, চমৎকার জায়গায় এনেছ। আমি পার্কটা খেয়ালই করিনি। এখানকার এত কিছুর পরেও আমার একটি বৈশিষ্ট্য চোখে পড়েছে।

কোনটা! আমি এত এসেও আলাদা করে কিছু দেখতে পাইনি।

তাহলে বোঝ, আমার চোখ তিনটা।

সেটা আমি তোমার কথা শুনেই বুঝতে পারি। তুমি যদি বলো যে তোমার চোখ দশটা তাও আমি মেনে নেব। এখন বলো আলাদা কী বৈশিষ্ট্য তুমি পেলে?

তাকিয়ে দেখো ছোট ছোট নানা রঙের ঘাসফুল, আর লতাগুল্ম পার্কটাকে কেমন উজ্জ্বল করে রেখেছে।

ঠিক বলেছ। আমিও দেখেছি, কিন্তু এভাবে ভাবিনি। কী খাবে বলো, আজ আমি তোমাকে খাওয়াব।

এক শর্তে খেতে রাজি আছি।

বলে ফেল।

আমার যতক্ষণ ইচ্ছে হবে ততক্ষণ এখানে বসে থাকতে হবে।

রাজি।

দুজনে রেস্তোরাঁয় ঢোকে। স্যান্ডউইচ আর কফি নেয়।

তন্ময় বিস্ময়ে বলে, শুধু এই?

আপাতত এই, ইচ্ছে হলে পরে নেব।

স্যান্ডউইচ শেষ করার আগেই একজন আফ্রিকান মহিলা এসে ওদের টেবিলে বসার পারমিশন চায়। দুজনে সায় দেয়। মহিলার নাম জুলিয়ানা। বেশ হাসি-খুশি। হো-হো করে হাসতে পারে যখন-তখন। তিনজনের আড্ডা ভালোই জমে ওঠে তবে আলোচনা শেষ পর্যন্ত মাধবী ও জুলিয়ানার জীবন ধারণায় গিয়ে গড়ায়। মাধবী এক পর্যায়ে বলে, আমার মা চেয়েছিল আমার বিয়েটা যেন টিকে যায়। কিন্তু আমি মাকে বোঝাতে পারিনি যে বিয়ে টিকে গেলে আমার সুখী হওয়ার আশাটি হবে শূন্য। কারণ সারাক্ষণ মাথা নত করার শেখার ভেতরে ঢুকে থাকার ব্যবস্থাটি একদমই সুখের নয়। ম্যারেজ ওয়ার্ক করলে কি ভালোবাসা ওয়ার্ক করে?

জুলিয়ানা তীব্র ভাষায় বলে, একদমই না।

জানো আমার স্বল্প দিনের বিবাহিত জীবনে আমি দেখেছি ভালোবাসা ও বিবাহিত জীবনের কোনো সম্পর্ক নেই।

জুলিয়ানা হাসতে হাসতে বলে, হোয়েন দ্য মিউজিক ইজ ওভার টার্ন অব দ্য লাইট। ওয়ান নিডস টু নো হোয়েন টু টার্ন ইট অফ।

ইয়েস, ঠিক বলেছ। মাধবী জুলিয়ানাকে সায় দিয়ে বলে, তোমার আর আমার অভিজ্ঞতা একই রকম। এশিয়া বা আফ্রিকা, মহাদেশ ভিন্ন হলেও কিছু যায়-আসে না–নারীর জন্য অবস্থা একই রকম। তন্ময় কিছু বলছ না যে?

তন্ময় হেসে বলে, আমি তোমাদের সঙ্গে একমত। এখন বিষয়টি আমি গভীরভাবে বুঝতে পারছি। আমার অভিজ্ঞতাও এমন যে দেখেছি নারীকে প্রেমের সময় যত তোয়াজ করা হয়, বিয়ের পরে তা পাল্টে যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। বিয়ের পরে সে হয়ে যায় সাবঅর্ডিনেট। তোমরা যা বলছ তা শুনে বুঝতে পারছি, সত্যি বলার সময় এসেছে।

ব্রেভা তন্ময়।

তারপর গালগল্পের প্রসঙ্গ পাল্টে যায়–কত বিচিত্র বিষয়–এশিয়া-আফ্রিকা-ইউরোপ-আমেরিকাসহ প্রতিটি মহাদেশ ছুঁয়ে যায়। সঙ্গে কফি, আইসক্রিম এবং স্যান্ডউইচ ও পুডিং। কেমন করে যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায় ওরা হিসাব রাখে না। অনেক রাতে ঘরে ফেরে তন্ময়।

দেশে ফেরার সময় হয়েছে তন্ময়ের। ওর গোছগাছ শেষ। আগের রাতে মাধবী ওকে ডিনার খাওয়াতে নিয়ে যায়। বিদায় নেবার আগে মাধবী বলে, তন্ময় দেশে গিয়ে যদি তুমি দেখো যে অনিমা তোমার কাছ থেকে দূরে সরে গেছে কিংবা ওর বাবা ওকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে, তাহলে তুমি কিন্তু লন্ডনে ফিরে আসবে–তুমি যদি চাও আমি বাংলাদেশেও যেতে পারি, তোমাদের নদীভরা দেশটা আমার খুবই পছন্দ–আমি আমার বাকি জীবনটা ওখানে কাটিয়ে দিতে রাজি আছি। আমি তোমার। জন্য অপেক্ষায় থাকব তন্ময়।

তন্ময় বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে বলে, অপেক্ষা!

হ্যাঁ, অপেক্ষা। তোমার জন্য আমার অপেক্ষা।

মাধবীর চোখে জল টলটল করে। তন্ময় হাত বাড়িয়ে সে জল মুছিয়ে দেয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *