০৩. অন্যদিকে ঢাকায় এসে

অন্যদিকে ঢাকায় এসে মায়ের অসুস্থতায় আটকে পড়ে তন্ময়। সাবিহা বানু জরায়ু অপারেশনে এবং পরবর্তী জটিলতায় কয়েক মাস বিছানায় থাকে। একরকম যমে-মানুষে টানাটানি হয়। তন্ময় দূরে সরিয়ে রাখে নিজের প্রয়োজনীয় কথাটুকু। মা সুস্থ হলে আবার বাইরের টানে। ওর বেরিয়ে পড়ার তাড়না শুরু হয়। একদিন ভোরে মাকে চিঠি লেখে, মা, আমার পাগল করা মাগো, আমি আবার বের হচ্ছি। এবার একটু দূরেই যাব ভাবছি। তবে যেখানেই থাকি তুমি আমার চিঠি পাবে। তুমি ভালো করে সুস্থ হও। আমি ফিরে এলে আমার সঙ্গে ফুলমসি স্টেশনে যাবে। অনিমাকে নিয়ে আসব তোমার কাছে। তখন আমাদের জীবনের নতুন সূচনা হবে মাগো। তখন তোমার চেয়ে সুখী মানুষ এই পৃথিবীতে আর কে হবে! ইতি তোমার সোনালি ঈগল তন্ময়।

ঘুম ভেঙে ছেলের চিঠি পেয়ে সাবিহা বানু মৃদু হাসে। অসুখের পুরো সময়টা ও মায়ের যত্ন করেছে। খুব প্রয়োজন না হলে বিছানার পাশ থেকে নড়েনি। সাবিহা বানু ছেলের যত্নে ভীষণ খুশি। এমন ছেলে। পাওয়া ভাগ্য ছাড়া আর কি। বউ ঘরে এলে ও নিজেকে আটকাতে পারবে তো? সাবিহা বানু নিজেই চিন্তান্বিত হয়। ছেলেকে ভরসা করতে পারে না। মনে হয় তখনো ও মাঝে মাঝেই উধাও হয়ে যাবে।

মাকে চিঠি লিখে রেখে বেরিয়ে ফুল-বিক্রেতা ছোট সখিনার সঙ্গে ফুটপাথে দেখা হয় ওর। মেয়েটি পেছন থেকে দৌড়ে এসে ওর হাত ধরে।

আমার ছবি কই? দিলেন না তো?

ছবি তো আমার কাছেই আছে। আমি তো তোমাকে খুঁজতেই এই ফুটপাতে এসেছি। তুমি কেমন আছ সখিনা?

সখিনা ম্লান মুখে বলে, ভালা নাই। আমার মা মইরা গেছে।

তুমি আমার মায়ের কাছে থাকবে?

থাকুম। আমি একডা বাসায় থাইকা কাম করতে চাই।

গুড। তুমি একটা লক্ষ্মী মেয়ে।

ব্যাগ হাতড়ে সখিনার ফুল নিয়ে তোলা ছবিটা ওর হাতে দেয়। স্কুলের ইউনিফর্ম পরা ছবিটাও।

সখিনা ঠোঁট উল্টিয়ে বলে, এইডা আমার ছবি না। আপনে এইডা ফেরত লন।

ও স্কুল ইউনিফর্ম পরা ছবিটা ফেরত দেয়। তন্ময় ছবিটা না নিয়ে বলে, আমার মায়ের কাছে থাকলে তোমার ছবিটা এমনই হবে। চলো। সখিনাকে নিয়ে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে চিঠি লেখে মাকে, মা, আমার ধরিত্রী মা, আমি খুব ভালোভাবে জানি যে সখিনা তোমার কাছে আশ্রয় পাবে। ওকে তুমি পড়ালেখার সুযোগ করে দেবে ওকে নিজের পায়ে। দাঁড়ানোর তৈরি হওয়ার সুযোগ। এটুকু করতে তোমার একটুও কষ্ট হবে না মা। ওর দিকে তাকাও, দেখো ঘুটে কুড়ানি মায়ের সঙ্গে তোমার তন্ময়ের শৈশব খুঁজে পাও কি-না, মনে করো আমিই সখিনা, একদিন যাকে তুমি বুকে তুলে নিয়েছিলে। তোমার ঝোড়কাক তন্ময়।’

সখিনার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে সাবিহা বানু পাগল ছেলেটার জন্য ভীষণ মমতা অনুভব করে। পড়া হলে সখিনাকে বলে, পড়ালেখা শিখবি?

সখিনা ভয় পেয়ে যায়। ভীষণ ভয়ে মাথা নেড়ে বলে, না, পড়ালেহা শিখুম না। আমি আপনের কাম কইরা দিমু, আপনে আমারে ভাত-কাপড় দিবেন।

কিন্তু তোকে যে লেখাপড়া শেখাতে বলেছে আমার ছেলে।

ও খুশিতে লাফিয়ে উঠে বলে, সত্যি, তাইলে আমি লেখাপড়া শিখমু। স্কুলে যামু।

সাবিহা ওর মাথায় হাত রেখে বলে, তাই হবে। যা গোসল করে আয়।

সখিনার দৌড়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সাবিহার মনে হয়, তন্ময় ওকে নানাভাবে ভরিয়ে রাখার চেষ্টা করে, এটা যেমন নিজের দায়িত্ববোধ থেকে, তেমন মায়ের কথা ভেবেও, জানে মা এসব ভালোবাসে। দু’জনে মিলেই জগৎটা গড়তে চায়।

 

অনিমার সেদিন স্কুল বন্ধ। বাবা,অফিসে। ও এক টুকরো কাগজে লেখে। আর কত দিন অপেক্ষা কর? কবে আসবে তুমি! নাকি কোনো। দূর এলাকায় গিয়ে ভুলেই গেছ আমাকে। কাগজটা পাখির আকারে ভজ করে দেয়ালে টাঙানো ছোট একটি সুচের কাজ করা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখে। পাখির আকারে চিঠিতে ব্যাগটা ভরে উঠেছে। হঠাৎ ট্রেন আসার শব্দে চমকে ওঠে। ছুটে আসে প্লাটফর্মে। মাসুম সবুজ পতাকাটা ভাঁজ করে এগিয়ে আসে।

আপা, আপনি বসেন। আমি দেখি।

না, আমি দেখব। তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকো।

অনিমা এগিয়ে গিয়ে ট্রেনের কামরায় উঁকি দেয়। ট্রেন চলে যায়। ট্রেনের শেষটুকু অদৃশ্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে বলে, কী পাগলামি! তন্ময় এলে তো ও নিজেই ট্রেন থেকে নামবে। আমার খুঁজতে হবে কেন? মাসুম পাশে এসে দাঁড়ায়। বলে, আপা বাড়ি চলেন। অনিমা বিরক্ত হয়ে বলে, বাড়িতে কেন যাব? বাড়িতে কে আছে? আমার তো বাড়ি ভালো লাগে না।

মাসুম মনে মনে বলে, ভালো তো লাগবেই না! তন্ময় ভাইয়ের মতো মানুষের সঙ্গে দেখা হলে তার না থাকাটা যে কী কষ্টের তা আমিও বুঝি। আপনি তো আরো বেশি বুঝবেন আপা।

অনিমা বাড়ি যাবে না ভেবেই বাবার অফিস ঘরের দিকে যায়। শুনতে পায় তৌফিক ফোনে জোরে জোরে কথা বলছে তার চাচাতো ভাই সাদেকের সঙ্গে। অনিমা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পড়ে। বাবার প্রতিটি শব্দ যেন এক এক খণ্ড পাথরের টুকরোর মতো ওর বুকের ওপর চেপে বসে।

সাদেক তুমি কেমন আছ ভাই? না, আমার শরীর বেশি ভালো না। কেবলই মনে হয় কখন আছি, কখন নেই। আমি না থাকলে মেয়েটার আর কে থাকবে। হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি তো জানি তোমরা আমার মেয়েটাকে তোমাদের কাছে নেয়ার অপেক্ষায় আছ। তারেক এখন কি ঢাকায়? ভালো চাকরি করছে? শুনে খুব খুশি লাগছে। যাহোক, তোমরা একবার আসো। বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করার জন্য কথাবার্তা বলি।

অনিমার আর বাবার অফিসে ঢোকা হয় না। ও বাড়ি ফিরতে থাকে। যেন প্রবল ঝড় মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরছে, ও কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, এত অন্ধকার নেমেছে পথে। ওর পথ আটকায় তুলি আর কলি।

আপা সেই ভাইজান আমাদের ছবিগুলো দ্যায় নাই?

তোমাদের ভাইজান তো এখনো ফিরেনি। যখন ফিরবে তখন ঠিকই তোমাদের ছবিগুলো আনবে।

এতদিনে যহন আসে নাই, আর বোধঅয় আসবে না। শহরের মানুষগুলোই এমুন। যাই আপা।

অনিমার মনে হয় ঝড় থেমে গেছে। থমথম করছে চারদিক। ও বুকভরা শূন্যতা নিয়ে বাড়ির গেটে এসে দাঁড়ায়। তালা খোলে। স্টেশনের দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি আমাকে চিঠি লেখো না কেন তন্ময়?

 

তন্ময় এখন লন্ডনে।

হঠাৎ করেই এসে পড়েছে, অনিমাকেও বলার সুযোগ হয়নি। সাবিহা বানুই ছেলেকে ফটোগ্রাফিতে একটি কোর্স করানোর জন্য নিজের উদ্যোগেই ব্যবস্থা করেছে। ছয় মাসের কোর্স। বলেছে, দেখতে দেখতে কেটে যাবে বাবা। তাছাড়া ইচ্ছে করলে তুই আরো ছয় মাস বেশি থেকেও আসতে পারিস। তন্ময় মাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, এত দিন আমাকে না দেখে থাকতে পারবে তুমি?

দেশে থাকলেই কি তুই আমার চোখের সামনে সারাক্ষণ থাকিস? ঘুরে বেড়াস না?

বেড়াই তো। ঘুরতে না পারলে আমার দম আটকে আসে। আমি তোমার ভবঘুরে ছেলে।

হিথ্রো বিমানবন্দরে সব কাজ চুকিয়ে বাইরে আসার সঙ্গে সঙ্গে এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস নাক-মুখ ছুঁয়ে যায়। হালকা তুষার ঝরে পড়ছে। বেশ লাগছে ওর। প্রথমে টাকা ভাঙায়, তারপরে মায়ের সঙ্গে কথা বলে। ফোন বুথের সামনে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, অনিমার জন্য বুকের ভিতর টান ওঠে, কিন্তু অনিমাকে ফোনে যোগাযোগ করা যাবে না। ও একটি চমৎকার রেল স্টেশনে বাবার সঙ্গে থাকে, বাবা স্টেশন মাস্টার, যেখানে হুইসেল বাজিয়ে দারুণ শব্দ করে রেলগাড়ি ঢোকে, সেই শব্দের সঙ্গে ও নিজের বুকের ভালোবাসার ধ্বনি এক করেছে, অনিমা এখন ওর সবচেয়ে প্রিয় নারী, যার কাছে গিয়ে দাঁড়ালে, চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলবে, দাও তোমার হাতটা ধরি। আমাদের যাত্রা শুরু। ভেব না তুমি আমার প্রভু, আমরা ভালোবাসার কাঠগড়ায় দুজনে একসঙ্গে দাঁড়াব। জানবে, জীবনের সত্যে নারী-পুরুষের অবস্থানগত ভেদ নেই।

তন্ময় মৃদু হেসে নিজেকে ফোন বুথের কাছ থেকে সরিয়ে আনতে আনতে বলে, তোমার কথাই ঠিক অনিমা। আমি এখন থেকে মানবজীবনের সমতার জায়গাগুলো খুঁজব। আর প্রতিদিন একটি করে চিঠি লিখব, যেমন মাকে লিখি, আমার ভবঘুরে জীবনে এতদিন মা ছিল আমার চিঠির যোগসূত্র, এখন যুক্ত হলে তুমি। আমি তোমাকে রোজ। একটি করে চিঠি লিখব অনিমা।

ছোট একটা সুটকেস ছিল সঙ্গে ইচ্ছে করে বেশি বোঝা টানেনি, ও মাকে বলে দিয়েছিল যে পরিচিত কারো কাছে আমি যাব না, আমি এখানে যেমন ঘুরে বেড়ানো দিন কাটাই তেমন করেই বিদেশেও কাটাব মা। ঠিকানা, ফোন নাম্বার দিচ্ছ, দাও, কিন্তু যোগাযোগ করতে বলো না।

যদি কোনো বিপদে-আপদে পড়িস?

আচ্ছা, তেমন হলে যোগাযোগ করব, শুধু তোমাকে খুশি করার জন্য মা।

দেখো ছেলের কথা!

সাবিহা বানু ছেলের মাথা বুকে জড়িয়ে ধরেছিল। সেজন্য তন্ময়ের সঙ্গে লটবহর নেই, দেশ থেকে নানা মানুষের জন্য নানা কিছু আনার ঝক্কি-ঝামেলা নেই। নিঝঞাট অনুভবে তন্ময় খুব ফুর্তি অনুভব করে। আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন থেকে রেলে উঠে ও বাইরে তাকালে জীবনের জলছবি ওকে মায়ার বাঁধনে টানে। কী অপূর্ব লাগছে চারদিক! বাড়িঘর তেমন নেই, এখন পর্যন্ত দিগন্ত-বিথারি প্রান্তরজুড়ে অজস্র রঙের বিন্যাস, মিষ্টি রোদ, নীলাকাশের প্রান্তছোঁয়া নেমে আসার সঙ্গে নিজের দেশের সাদৃশ্য পেয়ে ও ভাবে, দিনগুলো ভালোই কেটে যাবে। অনিমা আমি তোমার কাছে ফিরে আসছি।

প্রথম দিনই ডরমিটরিতে পরিচয় হয় নীলিমার সঙ্গে, ও বাংলাদেশের মেয়ে। চট্টগ্রামে বাড়ি। বাবা শিল্পপতি, স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ায় পরে পড়তে এসেছে। বলেছে, দেশে না-ও ফিরতে পারে। কোর্স শেষ হলে ফেরার কথা ভাববে।

তনায় পরিচয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিজের সম্পর্কে এত কথা বলেনি। আগ বাড়িয়ে এত কিছু বলে দিলেই কি একজন মানুষের পরিচয়ের পর্ব শেষ হয়ে যায়? কত খোসা যে ছিলতে হয় তার কি শেষ আছে! তন্ময় গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায়। নীলিমা খানিকটা অবাক হয়। ভাবে, ছেলেটার সৌজন্য জ্ঞান কম, নাকি ও নারীর সঙ্গে কথা বলতে বেশি পছন্দ করে না? নীলিমা দ্বিধা নিয়ে ক্যান্টিনে খেতে যায়।

ওদের ক্লাস শুরু হয়েছে। নভেম্বর মাস। ভীষণ ঠাণ্ডা পড়েছে। ছেলেমেয়েরা বলাবলি করছে যে লন্ডনে নভেম্বর মাস খুব বাজে সময়। এ সময়ে আবহাওয়া বুঝে ওঠা দায়, হাড়-কাঁপানো শীতের সঙ্গে এই বৃষ্টি এই রোদ। প্রত্যেকেরই মেজাজ খারাপ। এমন আবহাওয়া সব আনন্দ মাটি করে দেয়। ক্লাসের বাইরে ডরমিটরির টানা বারান্দায় মাঝে মাঝে নীলিমার সঙ্গে দেখা হয়, হাই-হ্যালো হয়, এ পর্যন্তই। বড়জোর। আবহাওয়া নিয়ে কথা। ও তেতেমেতে বলে, দেখেছ কাণ্ড, এখানকার আকাশ দেখে মনে হচ্ছে কালো মেঘ এই আকাশের স্থায়ী ঠিকানা। দেশে বসে বর্ষার কালো মেঘ দেখে উফুল্ল হতাম, এখানে দেখতে পাচ্ছি তার উল্টো। এই আকাশ মেজাজ ঠিক রাখতে দেয় না। তারপরও ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি লেগে থাকে। যত্তসব।

আমার কিন্তু ভালোই লাগছে। নতুন কিছু যদি দেখতে না পাব তাহলে এলাম কেন? এখানে এসে যদি সেই দেশের ছবি বা আবহাওয়া পাব তাহলে–

বুঝেছি, যা কিছু উল্টাপাল্টা সেটাতেই তোমার আনন্দ। প্রথম দিনই। টের পেয়েছি যে তুমি একটা চিজ!

বাপস, চিজ! তুমি তো বেশ স্মার্ট মেয়ে। ঠাসঠাস কথা বলতে পারো। আরে বাব্বা।

হয়েছে রাখো, গেলাম।

কোথায়?

শুড়িখানায়। যাবে?

না, আমি ম্যাথুর ওখানে যাব। ও একটা দারুণ হিপ্পি। আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে।

ওর ওখানে আমাকে একদিন নিয়ে যেও তন্ময়। নেবে তো?

হ্যাঁ, যেও একদিন। আপাতত গুঁড়িখানা সেরে এসো।

নীলিমা চলে যায়। তন্ময় নিজের ঘরে আসে। বাইরে বেরুলে বৃষ্টির ছাঁট বরফের ছুরির মতো এসে বেঁধে। মা ওকে শীতের পোশাক কিছুই দেয়নি, বলেছিল ওখানে গিয়ে কিনে নিবি, আসার সময় ফেলে আসবি।

সোনা মা আমার, দারুণ আইডিয়া তোমার।

আইডিয়া হবে না। আমার ছেলেকে তো আমি চিনি। বোঝা যত কম হবে ওর সুখ তত আকাশছোঁয়া হবে। ছেলেকেই যদি না চিনব তো কেমন মা আমি!

এখানে এসে ও ওভারকোট, সোয়েটার, মাফলার, মোজা, উলের টুপি সব কিনেছে ক্যামডেন থেকে। এসব কিনতে গিয়েই তো ওর ম্যাথুর সঙ্গে পরিচয় হয়। ক্যামডেন টাউন বেশ মজার জায়গা। শনি আর রবিবারে এখানে অস্থায়ী দোকানের খোলাবাজার বসে, এটা হিপ্লিদের রাজত্ব–দোকানের মালিক বেশিরভাগ ওরাই। কত বিচিত্র ধরনের পোশাকই যে ওরা পরে। জিনসের প্যান্ট বিভিন্ন জায়গায় কেটে রাখে, কখনো টেনে হেঁড়ে, সুতো বেরিয়ে থাকে, সঙ্গে টি-শার্টও ঘেঁড়ার ফ্যাশন। তন্ময়ের মনে হয় ওর সঙ্গে অনিমা থাকলে হেসে গড়িয়ে পড়ত–বলত, তন্ময় আমি তোমাকে এই পোশাকে দেখতে চাই, বুঝব তুমি কতটা অচেনা হয়ে যেতে পারো আমার কাছে।

ও নিজেকেই বলে, না আমি তোমার কাছে অচেনা হয়ে যেতে চাই না। আমি তোমার চেনা মানুষ হয়ে থাকতে চাই কুট্টি সোনা।

লন্ডনে তো কত ধরনের মানুষ থাকে, কত দেশের ছেলেমেয়ে এখানকার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। ওদের মতো পারিপাট্য হিপ্পিদের নেই। নিজেকে অবহেলা করে ওরা আনন্দ পায়, মনে হয় অবহেলাই ওদের ভূষণ। মাঝে মাঝে কেউ কেউ আনরুলি হয়ে যায়, তখন ওদেরকে ভয় লাগে। মারমুখী ছেলেমেয়েগুলো অনেক সময় ক্ষিপ্ত হলে আক্রমণ করে। একথা শুনে নীলিমা বলেছিল, মারপিট করতে আমার খারাপ লাগে না। এ ব্যাপারে আমি পিছিয়ে থাকার পাত্র নই।

পাত্র বলছ কেন, ব্যাকরণের ভুল, তুমি পিছিয়ে থাকার পাত্রী নও।

এখানেই তোমার সঙ্গে আমার ভাবনার তফাত। তুমি নারী-পুরুষের সমতার বিষয়টি বোঝ না।

ঠিক আছে তুমি বুঝিয়ে দিও। আমি বুঝতেই চাই, যাতে অনিমা এ বিষয়ে আমাকে ঘায়েল করতে না পারে। তোমাকে দেখেই বুঝেছি সংসার একটি কঠিন ক্ষেত্র।

হো-হো করে হাসে নীলিমা। হাসতে হাসতে বলে, তোমাকে আমার কথা শোনাব। বুঝবে কীভাবে লড়াইটা হয়। তোমার সঙ্গে আজ আমি ক্যামডেন টাউনে যাব। আমার কিছু কেনাকাটা আছে। যাবে নাকি অজুহাত দেখিয়ে কেটে পড়বে?

তোমার খোঁচা হজম করতে করতে আমি অস্থির। একটুও ছেড়ে কথা বলো না। চলো যাই।

দুজনে হাঁটতে হাঁটতে ক্যামডেন টাউনে আসে। ওখানে একটি লেক আছে, লেককে যুক্ত করে আছে একটি সেতু। সেতুর ওপারে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে আছে ক্যামডেন রোডের দুপাশে খোলাবাজার। নীলিমার ছেলেমানুষি উচ্ছাস উছলে পড়ে নানা জিনিসকে নিয়ে। সারি সারি লোহার স্ট্যান্ডে হ্যাঙ্গার টাঙিয়ে পুরনো কাপড় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। শত শত জিনসের প্যান্ট আর শার্ট। নীলিমা তিন-চারটে প্যান্ট-শার্ট কেনে। শার্টের রঙ বাছাই করে দিতে হয় তন্ময়কে। নীলিমা হাসতে হাসতে বলে, আমাদের বৈশাখী মেলার মতো মনে হচ্ছে।

বৈশাখী মেলা হবে কেন? বঙ্গবাজারের মতো লাগছে।

মোটেই না। বঙ্গবাজারের দোকানগুলো খোলা জায়গায় নয়।

তা ঠিক বলেছ। সামনে গেলে বৈশাখী মেলার ক্যারেক্টারটা আরো স্পষ্ট হবে।

দুজন সামনে এগিয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় নীলিমা তন্ময়ের হাত চেপে ধরে। ভিড় ঠেলে এগুতে হচ্ছে দুজনকে। নীলিমা হাঁটতে হাঁটতে বলে, ঢাকায় এমন ভিড়ের মধ্যে হাঁটতে হলে কত যে পুঁতো খেতে হতো। এখানকার ভিড় বেশ ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে মানুষের শরীরের উষ্ণতার চমৎকার গন্ধ আছে। ভিড় ঠেলে দোকানগুলো দেখতে বেশ লাগছে। দেখো দেখো কাপড় দিয়ে কী সুন্দর খাপড়া তৈরি করা হয়েছে। সেখানে টেবিল পেতে নানারকম জিনিস রাখা হয়েছে।

এখানে এলে আমি উইন্ড চাইম দেখতে ভালোবাসি। দেখো বাতাসে কী সুন্দর টুংটাং বাজছে।

তুমি কি তোমার রুমের জন্য একটা কিনেছ?

না, কেনার কথা আমার মনে হয়নি, বরং এখানে এসে ওই শব্দটা শুনতে আমার ভালো লাগে। ঘরে থাকলে এখানে এসে শোনার আগ্রহ কমে যাবে।

আমি একটা কিনব।

কিনে ফেল। সারাক্ষণই শুনতে পারবে।

নীলিমা একটা উইন্ড চাইম কিনে বলে, এটা হাতে নিয়ে আমি দাঁড়াচ্ছি। তুমি এই ভিড়সহ আমার একটা ছবি তোলো তন্ময়।

তন্ময় ছবি তুলে দিয়ে বলে, একটা জিনিস আমার খুব প্রিয়। দেখো মাঝখানে সরু পথ, দু’পাশের দোকানগুলো একদম মুখোমুখি। যেখানেই যাই না কেন টুংটাং শব্দ আমার কানে পৌঁছে। এ গভীর আনন্দ আমি উপভোগ করি। আমার এখন মায়ের কথা মনে পড়ে।

অনিমার কথা মনে পড়ে না?

এই প্রসঙ্গে মাকেই মনে পড়ে বেশি। অন্য প্রসঙ্গে অনিমা আমার স্মৃতিতে আসে।

বাহ তুমি বেশ ব্যালান্স করতে পারো।

এটা আবেগের ব্যাপার নীলিমা, ব্যালান্সের ব্যাপার নয়। মাঝে মাঝে তোমার কথা শুনলে আমার খুব রাগ হয়।

ইচ্ছে করে আমাকে ছুড়ে ফেলে দিতে?

হ্যাঁ, তাও হয়।

তাহলে লেকের জলে ফেলে দাও।

একদিন কাজটা করেও ফেলতে পারি, কে জানে।

নীলিমা হো হো করে হাসতে হাসতে বলে, তুমি খুব মজার ছেলে। অনিমা তোমাকে নিয়ে সুখে সংসার করতে পারবে।

হয়েছে আর জ্যোতিষীর মতো ভবিষ্যদ্বাণী করতে হবে না। ওই দেখো সামনে কত জিনিস মোমবাতি, ফটোফ্রেম, খেলনা, চাদর বালিশের কভার, কাঠের চেয়ার, টেবিল, হাঁড়ি-পাতিল, চামচ–

হয়েছে থামো। ওসব কেনার আমার ইচ্ছা নেই। তোমার ম্যাথু কই? ও নিজেও কি এইসব হিপ্পির মতো সাদা ধুতি আর ভারতীয় বুটিকের ঢোলা পাঞ্জাবি পরেছে? এক একটাকে কেমন ফানি লাগছে না–

আমি মজা পাই।

ছবি তোলোনি?

অনেক ছবি তুলেছি। দেশে গিয়ে দারুণ একটা এক্সিবিশন করব।

আছো ধান্দায়।

এটাকে তুমি ধান্দা বলছ? ফটোগ্রাফি আমার ক্রিয়েটিভ কাজ। বুঝতে পারছি ক্লাসগুলো তুমি ঠিকমতো ফলো করো না।

ঠিকই ধরেছ, টিচারদের কথা শুনতে শুনতে আমি অন্যমনস্ক হয়ে যাই।

আমার জীবনের কথা আমি তোমাকে শোনাব তন্ময়। তাহলে হয়তো খানিকটুকু হালকা হবো। তুমি শুনবে তন্ময়?

শুনব, একশবার শুনব। এখানেই তো তোমার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছে, অন্যরা তো ক্লাসের বন্ধু, কিংবা যাওয়া-আসার পথের সাথী।

থ্যাঙ্কু তন্ময়। চলো না ম্যাথুর কাছে যাই।

তন্ময় ভিড় ঠেলে নীলিমাকে ম্যাথুর কাছে নিয়ে আসে। হিপ্পিদের বিভিন্ন দোকানে ভারতীয় জিনিসে ভরা, কিংবা আফ্রিকার কোনো কোনো দেশের কিন্তু ম্যাথু বোধহয় চীনের ভক্ত, ওর দোকান চীনা জিনিসে ভরা। এছাড়াও নিজে বিভিন্ন ধরনের লকেট বানায়। তন্ময় আর নীলিমা গিয়েও দেখল যে ম্যাথু একমনে লকেট বানাচ্ছে। দুজনে প্রথমে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, ম্যাথুর মনোযোগ নষ্ট করতে চায় না–ওর গ্যাট্টাগোট্টা শরীর, রঙ করা চুল, চেহারা খানিকটা ক্লিষ্ট, যেন অভাব তাকে ছাড়ে না, কিংবা যে রোজগার করে মদ খেয়ে বা জুয়া খেলে উড়িয়ে দেয়। জামাটা মলিন এবং ছেড়া, ইচ্ছা করে ছিড়েছে তা নয়। পুরনো হাওয়ার কারণেই ছিড়েছে, তারপরও ম্যাথু হিপ্পি। ওর পুরো অবয়বে এলোমেলো জীবনের ছাপ সুস্পষ্ট। শরীরের পেশিতে যৌবনের উন্মত্ততা আছে, চেহারার সঙ্গে যার অনেক ফারাক। নীলিমা ফিসফিস করে বলে, লোকটা বেশ হ্যান্ডসাম এবং অদ্ভুত।

তাহলে বোঝ আমি কেন ওকে পছন্দ করি।

তোমার পছন্দ আর আমার পছন্দ একরকম হবে না।

সে তো অবশ্যই, তুমি তো নারী, তুমি ওর বাহুবন্ধনে ধরা দিতে চাইতে পারো।

তুমিও পারো। গে-রা কী করে জানো না!

তখন নীলিমার হাতে কষে একটা চাপ দিয়ে বলে, এখানেই তোমার বৈশিষ্ট্য। জুতসই জবাব দিতে তোমার জুড়ি নেই নীলিমা।

তখন ম্যাথুজ কুঁচকে চোখ তোলে। তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে একগাল হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে।

তন্ময় নীলিমাকে দেখিয়ে বলে, আমার বন্ধু নীলিমা।

ম্যাথু ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, নাইস টু মিট ইউ।

নীলিমা টের পায় ম্যাথু ওর হাতে বেশ জোরে চাপ দিয়েছে। চাপটা শুধুই হ্যান্ডশেকের নয়, আর একটু অন্যকরম। ও সরাসরি ম্যাথুর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায়, সে গোঁফের নিচে ম্যাথুর ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা এবং সঙ্গে সঙ্গে ও এমনটা ভাব দেখায় যেন কাস্টমার রিসিভ করছে। নীলিমা বিষয়টি ভেবে দেখার জন্য কথা বাড়ায় না, এমনকি তন্ময়ের কাছেও বিষয়টি এড়িয়ে যায়। ম্যাথু চেয়ারে বসতে বসতে নীলিমাকে বলে, এগুলো সব আমার নিজের হাতে বানানো।

খুব সুন্দর! নীলিমার কণ্ঠে উচ্ছ্বাস।

লকেটগুলো নানা আকৃতির স্ফটিকের পাত। একটিও আকারে এক ইঞ্চির বেশি নয়। গাঢ় উজ্জ্বল রঙ যেন ছিটকে বেরুচ্ছে। গাঢ় গোলাপি, সমুদ্র নীল, মিশমিশে কালো, অনন্য বেগুনি, না বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। ছোট ছোট পাথরের ওপর ম্যাথু নানা ভঙ্গির পরী, টিকটিকি, ফুল, ব্যাঙ, পাখি ইত্যাদি বসিয়ে দিয়েছে। এগুলো রুপোর তৈরি, আকারে এক ইঞ্চির চার ভাগের এক ভাগ। একটা গোল পাথরের ওপর পরী বসানো লকেটটা তন্ময়ের খুব পছন্দ হয়। পরীর পা জোড়া বাঁকানো, বুকের কাছে হাত জড়ো করা, ডানা দুটো দেখে মনে হয় আকাশে বুঝি উড়ে যাচ্ছে। তন্ময় নীলিমাকে দেখিয়ে বলে, এই লকেটটা সুন্দর না? অনিমার জন্য কিনতে চাই।

হ্যাঁ, খুবই সুন্দর, কিনো ফেল।

তন্ময় নাড়াচাড়া করতে করতে বলে, আমি জানি ওকে খুব মানাবে, ও আমার শ্যামল পরী।

হা-হা করে হাসে নীলিমা। বলে, অনিমা তোমাকে বেশ পাগল বানিয়ে ফেলেছে।

নীলিমার কথা শুনে তন্ময় বলে,মায়ের কাছে শুনেছি কামরূপ। কামাখ্যায় নাকি পরীরা থাকে, ওরা পৃথিবীতে এসে বেছে বেছে সুন্দর ছেলেদের ধরে নিয়ে যায়। তারপর ওদেরকে পাগল বানিয়ে পৃথিবীতে ফিরিয়ে দিয়ে যায়। বলো তো কেমন অদ্ভুত কাণ্ড!

কিন্তু ছেলেরা যদি পাগল হয়েই ফিরবে তবে পরীদের কথা বলে কী করে? সমাজটাই এমন। পুরুষের তৈরি তো, নিজেদের ইচ্ছেমতো গল্প বানায়।

শুরু হয়ে গেল তোমার নারী-পুরুষ আলোচনা।

শুরু তো হবেই, তোমাদের অত্যাচারে যে আমরা অতিষ্ঠ। শোনো, একটা ছেলে পাগল হলে সেটা অসুস্থতা, আর একটি মেয়ে পাগল হলে তাকে ভূত বলা হয়। চিন্তা করো পরী আর ভূতের পার্থক্য। ছেলেরা ভালোবাসলে মেয়েটি হয় পরী, আর মেয়েটির কোনো দোষ পেলে তাকে বানায় ভূত। গায়ে ভূত ছাড়ানোর পদ্ধতি দেখেছ? কী বীভৎস। যে অত্যাচার মেয়েটিকে সহ্য করতে হয় তার কণামাত্র ছেলেটিকে করতে হয় না।

ম্যাথু হাসতে হাসতে বলে, তোমরা কি কোনো ইস্যুতে ডিবেট করছ?

নীলিমা গলা ভারী করে বলে, করছি। জেন্ডার ইস্যুতে ডিবেট।

জেন্ডার ইস্যু আমি বুঝি না। আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করিনি।

ঠিক আছে, আমি তোমাকে বুঝিয়ে দেব।

তুমি একটাও লকেট নেবে না?

নেব, তবে আর একদিন আসব, একা। তন্ময় আমার সঙ্গে আসবে না।

খুব ভালো, ম্যাথু হাসতে হাসতে মাথা ঝাকায়। ওর রঙিন চুলের গুচ্ছ এলোমেলো হয়ে যায়, দারিদ্র সত্ত্বেও ওকে বেশ সুখী মানুষই মনে হয়। ও আবার নিজের কাজে মন দেয়।

দুজনে অন্যদিকে যেতে যেতে বলে, একটা জিনিস খেয়াল করেছ যে আমাদের দেশের দোকানদারের মতো ওরা ডাকাডাকি করে না। যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত।

নিরক্ষর, প্রায়-নিরক্ষর, তারপর গরিব দেশের মানুষেরা পরিশীলিত হতে সময় লাগবে নীলিমা।

যাক এসব। চলো তোমাকে নান্দোস চিকেন খাওয়াই। খেয়েছ?

না, এই প্রথম তোমার কাছে নাম শুনলাম।

এটা একটি পর্তুগিজ রেস্টুরেন্ট। চিকেনের জন্য বিখ্যাত। অসম্ভব ঝাল মুরগি ভাজা হয়, পেরিপেরি সস দিয়ে খেতে হয়। ঝাল খেতে পারবে তো?

খুব পারব। তুমি পারলে আমি পারব না কেন?

ও আচ্ছা, প্রতিযোগিতা ভাবছ। ঠিক আছে ধরলাম বাজি।

দুজনে নান্দোসে ঢোকে। দুজনের ক্ষিদে পেয়েছে। নীলিমা ঝাল পেরিপেরি মুরগির অর্ডার দেয়। যে ছেলেটি অর্ডার নিচ্ছিল দুবার জিজ্ঞেস করে সবচেয়ে ঝালটাই চাচ্ছে কি-না। নীলিমা বিরক্তির ভাব দেখিয়ে মাথা ঝাকায়। টেবিলে বসতে বসতে নীলিমা বলে, কত আর ঝাল দেবে, দেখিই না। সঙ্গে তো ভাত আছে। জিহবা বেশি পুড়লে কোক খেতে থাকব। কী বলো? তন্ময় কথা বলে না। বাড়িতে ওর মা মাঝে মাঝে ঝাল দিয়ে রান্না করে। বেশি ঝালের তরকারি খাওয়ার অভ্যেস ওর নেই। সেজন্য ভেতরে ভেতরে তন্ময় একটু দমে থাকে। বেশ সময় নিয়েই ওরা খাবার সার্ভ করে। চমৎকার ভাজা মুরগি, ভাতের রঙ হলুদ, ঘ্রাণে জিভে জল আসে। কিন্তু এক টুকরো মুখে দিতেই দুজনের নাক-চোখ দিয়ে দরদরিয়ে পানি ঝরে। পর্তুগিজ ছেলেটা কাছাকাছি কোথাও ছিল, দ্রুত এসে মিষ্টি জাতীয় কিছু একটা সামনে দিয়ে চলে যায়। নীলিমাও ঝালে কাবু হয়ে গেছে, এত ঝাল ও আন্দাজ করতে পারেনি। কোক আর পর্তুগিজ পিঠা খেয়ে জিহ্বা সামলায়। তন্ময় সামলে নেয় নিজেকে, কিন্তু দেখতে পায় নীলিমার চোখের পানি আর ফুরাচ্ছে না। তন্ময়ের মনে হয় নীলিমা কাঁদছে, কিন্তু কেন? ও প্রবল অস্বস্তিতে নীলিমার বাম হাতের ওপর চাপ দিয়ে বলে, তুমি কি কাঁদছ?

এই মুহূর্তে কাঁদতেই আমার ভালো লাগছে তন্ময়। যে নীলিমাকে তুমি দেখছ এই নীলিমার বুকের ভেতরে হাজারটা নীলিমা আছে। তার এক একটি চেহারা আছে। আমি এখন অন্য চেহারায় ভীষণ আক্রান্ত। আমাকে আর প্রশ্ন করো না। কাঁদতে দাও।

তন্ময় দেখতে পায় পুরোটা সময় নীলিমা চোখের জল মুছতে মুছতেই ঝাল চিকেন আর ভাত খায়। এক সময় অস্ফুট স্বরে বলে, ওই পর্তুগিজ ছেলেটি যত্ন করে যে ছোট্ট খাবারটুকু দিয়ে গেছে, তা আমাকে খুব স্পর্শ করেছে। এমন ঘোট ঘোট ভালোবাসার আমি খুব কাঙাল। একজন মানুষের সঙ্গে ঘর করতে গিয়ে এর বিপরীত আচরণ পেয়েছি বলে সেই রক্তক্ষরণ আমাকে মরমে মারে। ছোট ভালোবাসায় আমি কাঁদতে ভালোবাসি।

 

অনেক রাতে অনিমাকে চিঠি লেখে তন্ময়।

প্রিয় অনিমা, প্রিয়তম নারী আমার, ব্যস্ত কদিন কাটানোর পরে তোমাকে লিখতে বসেছি। ব্যস্তত্ম শুধু নিয়মিত কাজের নয়, ভিন্ন দেশের অচেনা পরিবেশে নিজেকে খাপ-খাইয়ে নেয়ার চেষ্টাও। আসার আগে তোমাকে বলে আসা হয়নি, মা আমার এখানে আসার আয়োজন ঠিক করে রেখেছিল বলে, আমি আর ফুরসত পাইনি বুড়ি ছোঁয়ার মতো তোমাকে এক নজর ছুঁয়ে আসার। জানি তোমার মন খারাপ হলেও, রাগ করবে না, তুমি আমার অপেক্ষায় দিন গুনবে। এই মুহূর্তে আমাদের জীবনে অপেক্ষাই সত্যি। এটিও আমার ভবঘুরে জীবনের একটি অংশ।

আমার সঙ্গে একই কোর্সে পড়তে এসেছে নীলিমা–স্বামীর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেনি বলে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। বাবার পয়সা আছে, ফটোগ্রাফির নেশা তেমন আছে বলে মনে হয় না, সময় কাটানোই লক্ষ্য। আমার কাছে নিজের জীবনের কথা বলেছে। নীলিমা বেশ স্ট্রং মেয়ে। নীলিমা আমাকে ওর কথা যেভাবে বলেছে আমি অনেকটা ওর জবানিতেই তোমাকে জানাতে চাই অনিমা, হয়তো একটু হেরফের হতে পারে ভাষায়, কিন্তু মূল বিষয়টা আমি বুঝেই লিখছি। নীলিমার কথা শুনতে শুনতে নিজের দিকে তাকিয়েছি, নিজেদের সংসারের কথা আমাকে খুব ভাবাচ্ছে, তোমাকে যোগ্য মর্যাদা দিতে পারব তো, নাকি পুরুষ হিসেবে নিজের আধিপত্য দেখাতে চাইব, যেটা নীলিমার স্বামী করেছে! এখন পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারছি না, কারণ সংসারে তো এখনো ঢকিনি, কিন্তু প্রভু হওয়ার বাসনা নিজের ভেতর কতটা সেই দাঁড়িপাল্লায় এখন পর্যন্ত নিজের ওজন ভারী দেখছি না অনিমা, ট্র, একটুও মিথ্যে না। ভরসা করতে পারছি নিজেকে, কারণ নীলিমার একটি তীব্র কথা প্রকটভাবে আমার ভেতর গেঁথে আছে। ও বলেছে, গত পঁচিশ বছর ধরে জেন্ডার বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। গ্রামে-গঞ্জে নারী-পুরুষদের সমতার প্রশ্নে মানুষ’ করা হচ্ছে, কিন্তু শিক্ষিত ছেলেগুলোকে মানুষ করবে কে? সামাজিক ধারণায় এবং শ্ৰেণীগত অবস্থানে আমি তো শিক্ষিত এবং আরো একটু বেশিও নিশ্চয়, আমিও কি মানুষ হতে পেরেছি! লন্ডনের মাটিতে দাঁড়িয়ে নিজেকে এই প্রশ্নের সুযোগটি রেখেছি অনিমা।

নীলিমা কী বলেছে শোনো, আমার চৌদ্দ মাসের সংসার জীবনে আমি আমার স্বামীর কাছে অর্থ কিংবা বিলাস চাইনি, চেয়েছি নারী হিসেবে পুরুষের চোখে আমার মর্যাদা-সম্মান–এককথায়, সমতা–বলেছি, তুমি আর আমি সমান। ও মানতে পারেনি, ও আমার ওপর প্রভুত্ব ফলিয়েছে। ও তো পুরুষ হয়ে জন্মেছে, প্রভুগিরি করার অধিকার নিয়ে–সুতরাং এই জাতাকলের নিয়মে আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখবে সে। আমার অফিসে সন্ধ্যায় মিটিং থাকলে রেগে যেত ও ঘরে ফিরলে হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হতো, তাও আবার এমন সব প্রশ্ন যে শুনলে ঘেন্নায় মাথায় রক্তের ঘূর্ণি উঠত; অথচ ও নিজে রাত বারোটায় ফিরলে জিজ্ঞেস করা যেত না যে কোথায় ছিল। সংসারে সব সিদ্ধান্ত দেয়ার অধিকার ছিল ওর, আমার না। গানের কোন ক্যাসেটটা শুনব সেটাও ওর ইচ্ছের ওপর নির্ভর করত, তারপরও চালিয়েছিলাম অনেক দিন। কিন্তু যেদিন ঝগড়ার মুহূর্তে রাতদুপুরে ঘর থেকে বের করে দরজা লাগিয়ে দিল সেদিনই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে আর নয়, অনেক হয়েছে। আমিও যে মানুষ, আমারও যে ভালোমন্দ বোধ আছে, চিন্তা আছে–ইচ্ছে-অনিচ্ছে আছে সেটা আমি ওকে বোঝাতে পারিনি। এই ব্যর্থতা স্বীকার করে সংসারের ইতি টানার জন্য আমি তৈরি হয়ে গেলাম। বুঝলাম সংসার ভাঙার জন্য অনেক সময় বিশাল কোনো কারণ লাগে না, ছোট ছোট ঘটনার সমষ্টি এত মৌলিক প্রশ্নের জন্ম দেয় যে তার ওপর আর অন্য কথা চলে না। এই বিষয়টুকু বুঝেও কোনো নারী সিদ্ধান্তে নেয়। ছয় মাসে, কেউ পাঁচ বছরে, কেউ সিদ্ধান্ত নেয়ই না, একটি স্বাভাবিক মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন কাটায়। স্বামীর সঙ্গে মনের দিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েও দিন কাটায় সামাজিকতার নামে, সন্তানদের দায়ে। আমি চাইনি এসব দায় টেনে দিন কাটাতে। যদি কোনো ভালো মানুষ খুঁজে পাই তবে আবার সংসার করব, আমি ঘর চাই, সন্তান চাই–এই সম্পর্কের আনন্দ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চাই না। নীলিমার কথা আজ এতটুকু, আরো কথা হলে পরে লিখব। অনেক ভালোবাসা, তোমার তন্ময়।

খামটায় গাম লাগিয়ে স্কুলের ব্যাগের ভেতর রাখে, কাল পোস্ট করবে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে, রাত আড়াইটা। সকালে ক্লাস আছে। আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনে যাওয়ার চেয়ে ও বাসে যেতে ভালোবাসে, কারণ নিচ দিয়ে গেলে শহরটা দেখা হয় না, শহর দেখার চমকই ভিন্ন—মানুষ, প্রকৃতি, ভৌত কাঠামো এবং রাস্তাঘাটের শত রকম যানবাহন মিলে একটি শহরের চরিত্র তৈরি করে। লন্ডন ওর বেশ ভালো লাগার শহর হয়ে উঠেছে। শীতে কাবু হয়ে গেছে শহর। বাসস্ট্যান্ডে বাসগুলো বেশ দেরিতে আসে। মাঝে মাঝে শীতে জমে যাওয়ার জোগাড় হয়, এ এক ভারি অদ্ভুত অভিজ্ঞতা–দেশে এই অভিজ্ঞতা হতো না। বরফের ছবি তুলে মাকে পাঠিয়েছে। সাবিহা বানু প্রায়ই ওকে ফোন করে। নিজের কথা বলে, ওর কথা জানতে চায় বাতি বন্ধ করে লেপের নিচে শুতে শুতে ওর মনে হয় শহরটাকে ও বেশ চিনেছে–কোথায় সেলুন, কোথায় বইয়ের দোকান, অ্যান্টিক্স কোথায় পাওয়া যায়, কোথায় রানির বাড়ির লোকেরা শপিং করে কোথায় নেপালি রেস্তোরাঁয় ছেলেরা কপালে সিঁদুর লাগিয়ে খাবার সার্ভ করে, কোথায় নাইট ক্লাবের আলো সারাক্ষণ জ্বলে অথবা পুরনো রেকর্ড আর ক্যাসেটের দোকানের গান ভেসে আসে, সিনেমা, থিয়েটার দেখা, বড় শপিং সেন্টারে ঢুকে অকারণে জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করে সময় কাটানো–এসব এখন নখদর্পণে। হাইড পার্ক, মাদাম তুসো, সোয়াস, টেট গ্যালারি, কিউই গার্ডেন, টেমস নদী, আর্ট গ্যালারি–নইলে দূরে কোথাও, অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, লিডস, বার্মিংহাম, ব্রাইটন, ডোভার–নাহ, অনেক কিছুর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। যদিও সাবিহা বানু ফোনে সব সময় বলে, শেখার জন্য যা লাগে খরচ করবি, আমার মেধাবী ছেলেটি কোথাও আটকে যাবে এটা আমি ভাবতেই পারি না। সোনা আমার, অনেক বড় হবি। অনেক কিছু শিখতে হবে তোকে। হায়, মায়ের কত স্বপ্ন ছেলেকে নিয়ে! মানুষ’ হওয়ার শিক্ষাটাও তো এর মধ্যেই পড়ে। মা তো আলাদাভাবে মানুষ হওয়ার কথা বলে না। মা তো জানে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়া কি। কিন্তু খটকা লাগে তন্ময়ের, ও ছেলে না হয়ে মেয়ে হলে কি মা এভাবেই লালন-পালন করত, এভাবে স্বাধীনতা দিয়ে নিজের মতো করে বড় হওয়ার স্বাধীনতা? তন্ময় দুচোখ এক করার আগে ভাবে, বোধহয় না। এজন্যই তো নীলিমাদের চোখে এত জল।

চব্বিশ নম্বর বাসটা ধরার জন্য ওকে বেশ খানিকটা পথ হেঁটে যেতে হয়, অন্তত দশ মিনিট তো বটেই। এরপরই ক্যামডেন টাউনের কাছাকাছি এসে স্টপেজ। ওখান থেকে বাস মর্নিংটন ক্রিসেন্ট টিউব স্টেশনের কাছে এসে ডানে মোড় নেয়, সেখান থেকে সোজা ওয়ারেন স্টেশন ছুঁয়ে ম্যালেট স্ট্রিটে তন্ময়ের স্কুল। সব মিলিয়ে এক ঘণ্টার পথ, বাসে বসার জায়গা পাওয়া যায় না এমনটা হয় না, দেশের মতো বাসে ঠেলাঠেলি নেই। কত নিঃশব্দ, কত সৌজন্য, সব মিলিয়ে এক মিগ্ধ পরিবেশ–শুধু শীতে কষ্ট হচ্ছে, অপেক্ষা একদিন সামার আসবে, ফুরফুরে হয়ে যাবে শহরের জীবনযাপন। বড় বড় গাছগুলো নানা রঙের ফুলে ভরে উঠবে, তখন আর এক ধরনের ছবি ওঠাবে ও। এমন বৈপরীত্য দেশের আবহাওয়ায় নেই, ঋতু বদল আছে, সেটা আমূল বদলে দেয় না প্রকৃতির চেহারা। স্কুলে দেখা হয় মাধবী কুট্টির সঙ্গে, ও ভারতের কেরালার মেয়ে, নরমসরম, গোবেচারা ধরনের মেয়ে, নিজের মতো একা একা থাকতে ভালোবাসে। তন্ময়ের জানতে ইচ্ছে করে ওরও কি নীলিমার মতো সমস্যা আছে, নাকি ও ভীষণ সুখী মেয়ে, মাথার ওপর পুরুষের প্রভুত্বের কোনো চাপ নেই। কিন্তু ভিন্ন দেশের মেয়ে বলে ওর সঙ্গে ক্লাসের বন্ধুতু ছাড়া আলাপ বেশি দূর গড়ায়নি। আজো ওকে দেখে বলে, হাই! ব্যস এটুকুই। তন্ময়ও মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়। জিজ্ঞেস করে, আমি তো দেরি করে ফেলেছি, তুমি ক্লাসে যাওনি।

ক্লাস হবে না। প্রফেসর শরীর খারাপ বলে বোর্ডে নোটিশ দিয়েছেন।

তন্ময় হাত উল্টিয়ে এমন ভঙ্গি করে যে, সে ভঙ্গি দেখে মাধবী হেসে বলে, হতাশ হলে?

একটুও হতাশ হবো না, আমরা দুজনে ক্যান্টিনে বসে চায়ের কাপে ঝড় তুলব।

আমি রাজি।

চলো সোয়াসের ক্যান্টিনে যাই।

দুজনে রাস্তা পার হয়ে সোয়াসে আসে। তন্ময় এখান থেকে মায়ের সঙ্গে কথা বলে।

তুমি কেমন আছ সোনা মা আমার?

অপর প্রান্ত থেকে সাবিহা বানুর হাসির শব্দ শোনা যায়। তন্ময় জিজ্ঞেস করে, আমি তোমার ছেলে না হয়ে মেয়ে হলে কি তুমি আমাকে এমন স্বাধীনতা দিতে?

হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?

বলো না মা।

সাবিহা বানু ধীর কণ্ঠে বলে, আমাদের সমাজ মেয়েদের একা বড় হওয়ার সুযোগ দেয় না। আমিও তো এই সমাজের বাইরের কেউ না, তুই মেয়ে হলে আমাকেও রশি টানতে হতো, পুরো স্বাধীনতা দিতে পারতাম না।

সত্যি বলার জন্য থ্যাঙ্কস মা। তোমার কাছে ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি। রাখি এখন, একটি ইন্ডিয়ান মেয়ের সঙ্গে চা খেতে যাব।

ও ফোন রেখে দিলে মাধবী কুট্টি বলে, তুমি মাকে খুব ভালোবাসো তন্ময়?

হ্যাঁ, ভীষণ ভালোবাসি। তাছাড়া মাকে তো সব ছেলেমেয়েই ভালোবাসে। তুমি বাসো না?

বাসি, কিন্তু মায়ের সঙ্গে আমার বিরোধ আছে। চলো চা খেতে খেতে তোমাকে আমার গল্প বলব।

তন্ময় মনে মনে বলে, হায় ঈশ্বর, আবার গল্প!

দুজনেই যার যার পছন্দের চসিআর স্ন্যাক্স নিয়ে টেবিলে বসে। আশপাশে আর কেউ বাংলাদেশি বা ভারতীয় নেই, সবাই ইউরোপ বা আফ্রিকার, আমেরিকারও হতে পারে, বোঝা যাচ্ছে না। তন্ময় স্যান্ডউইচে কামড় দিয়ে বলে, আমার মা চমৎকার স্যান্ডউইচ বানায়। ছোটবেলায় আমি খুব স্যান্ডউইচ খেতাম।

মাকে নিয়ে তোমার অনেক স্মৃতি তন্ময়?

হ্যাঁ, অনেক, অনেক। মা আমার জীবনে ভীষণ আনন্দ।

ওর উচ্ছ্বাসে তেমন সাড়া দেয় না মাধবী কুট্টি। ধীরেসুস্থে স্যান্ডউইচ শেষ করে। দৃষ্টি প্লেটের ওপর, ভ্রু কুঁচকে আছে, ওর ঘন কালো লম্বা চুলের মোটা বেণিটা বুকের ওপর দিয়ে অনেকখানি নেমে এসেছে, বেণির মাথায় একটি সবুজ রঙের ফিতা জড়ানো। গায়ে হালকা নীল রঙের টি-শার্ট, ওকে সব সময় জিনস পরতেই দেখেছে তন্ময়। স্যান্ডউইচ খেয়ে ও চায়ের কাপে চুমুক দেয়। বলে, মায়ের কথা ভাবতে আমার বেশি ভালো লাগে না।

তন্ময় চুপ করেই থাকে, নিজের কথা নিজেই বলুক মাধবী, তন্ময় খুঁচিয়ে শুনতে চাইবে না, খোঁচাতে গেলে স্বতঃস্ফূর্ততা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ও গভীর মনোযোগ দিয়ে মাধবীকে লক্ষ্য কর বেশ কালো গায়ের রঙ, আবার ব্ল্যাকদের মতো কালো নয়–নারকেল গাছের সারিতে সুশোভিত সাগর-কন্যা কেরালার সবটুকু বৈশিষ্ট্য বুঝি ওর মাঝে আছে একদিন ভাস্কো-ডা-গামার জাহাজ এসে ভিড়েছিল এ রাজ্যের সমুদ্র উপকূলে। হঠাৎ খেয়াল করে মাধবীর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ল টেবিলের ওপর। ও মৃদু স্বরে ডাকে, মাধবী!

ও দু-হাতে চোখ মুছে বলে, সরি। তারপর হেসে বলে, কী ছেলেমানুষি করছি, আমরা তো চায়ের কাপে ঝড় তুলতে এসেছিলাম।

তার জন্য সময় শেষ হয়ে যায়নি।

পরিস্থিতিটা আমিই একটু অন্যরকম করে ফেললাম।

আমার ভালোই লাগছে।

চোখের জলও।

আনন্দেও মানুষের চোখে জল আসে। তোমার হয়তো কোনো আনন্দের স্মৃতি মনে পড়েছে।

না তন্ময়, আনন্দ নয়, কষ্টের। তুমি মায়ের সঙ্গে কথা বললে, আমি এখানে এসে একদিনও মাকে ফোন করিনি। আমার ভালো লাগে না তন্ময়। আমার ঘর ভাঙা মা মেনে নেয়নি। মা চেয়েছিল আমি স্বামীর সংসার মুখ বুজে করব। আমি তা মানতে পারিনি, সেজন্য …

থাক এসব কথা। মেয়েদের যে কবে এসব থেকে মুক্তি ঘটবে জানি না। যেতে হবে অনেক দূর।

চলো টেট গ্যালারি ঘুরে আসি।

হ্যাঁ, চলো টেমস নদীর পাড়েও কিছুক্ষণ বসে থাকতে পারব। নদী দেখতে আমার খুব ভালো লাগে।

আমারও। তুমি কি জানো আমাদের দেশটায় নদী ভরপুর। অসংখ্য নদী, নামগুলোও খুব সুন্দর।

তাহলে আমি একদিন বাংলাদেশে বেড়াতে যাব।

আমাকে যোগাযোগ করবে। আমি তো তোমাকে ঠিকানা দিয়েছি।

তোমার মাকে দেখতে আমার খুব ইচ্ছে। আর দেশে ফিরলে তো তুমি বিয়ে করবে। অনিমার সঙ্গেও আলাপ হবে।

তন্ময় মাধবী কুটির সারল্য উপভোগ করে। তারপর নদী দেখতে দেখতে মাধবী ওর কথা বলে, নীলিমার মতোই কথা, তফাত একটুখানি মাধবীর গল্পে মায়ের নেতিবাচক ভূমিকা আছে।

অনেক রাতে অনিমাকে মাধবী কুট্টির কথা জানাতে চিঠি লিখতে বসে তনয়। টেরই পায় না যে বাইরে তুষারপাত হচ্ছে। জানালায় মোটা পর্দা, ঘরে হিটারের ছড়িয়ে দেয়া উষ্ণতা। টেবিলে সাজানো অনিমার ছবিটা হাতে নিয়ে বলে, আমার চিঠিগুলো তুমি পাচ্ছ কি-না বুঝতে পারছি না। কত দূর ফুলমসি স্টেশন, ঢাকার চিঠি যেতে অনেক সময় লাগে, আর আমি তো সাত-সমুদ্র তেরো নদী পার থেকে লিখছি। ও টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিয়ে ঘরের অন্য বাতি বন্ধ করে দেয়। অনিমাকে লেখার জন্য চমৎকার একটি প্যাড কিনেছে, আজই এই রাইটিং প্যাডের প্রথম পৃষ্ঠার ব্যবহার–প্রিয় অনিমা, আমার ভালোবাসার প্রথম নারী, কেমন আছ তুমি, জানি সারাক্ষণ মনে করো আমার ফেলে আসা দিনগুলো। অপেক্ষা করে আছ আমার ফেরার। ফেরার আর বেশি দিন নেই। কোর্স শেস হলে একদিনও এ দেশে থাকব না।

আজ তোমাকে মাধবীর কথা শোনাব। ওর মুখেই শোনো : মা চেয়েছিল আমার বিয়েটি যেন ভেঙে না যায়। আর আমার মনে হয়েছিল, আমি আমার সন্তানকে ভাঙা পরিবারের সন্তান করব না। এই বাজে লোকটির কাছ থেকে আমার দ্রুত চলে যাওয়াই মঙ্গল। বাসররাতে লোকটি মাতাল হয়ে এসেছিল। পরে জেনেছিলাম বেশ কয়েকজন নারীর সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কও ছিল। আমার কোনো ইচ্ছা-অনিচ্ছার দাম ছিল না ওর কাছে। আমি ছিলাম ব্যবহার্য কাপড়ের মতো। মাকে এসব বলাতে মা বলে, মুখ বুজে ঘর করো। বেশি বাড়াবাড়ি করবে না। ও তো তোমাকে রানির হালে রেখেছে। আসলে লোকটার টাকা দেখে আমার মা আমাকে বিকিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু নিজের মর্যাদার কাছে আমি তো অর্থকে তুচ্ছ মনে করতাম। মাকে তা বোঝাতে পারিনি। তাই একদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে বান্ধবীর কাছে আশ্রয় নেই। নানা জায়গায় কাজ করি, তাতে নিজের চলবে তো, লোকটি আমার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগল। নানাভাবে হ্যারাস করা শুরু করল। শেষে একটা স্কলারশিপ জোগাড় করে এখানে চলে আসি। দেশে আর ফিরব না ঠিক করেছি। বলছিলাম মায়ের কথা, আমি একা বিদেশে আসব শুনে মায়ের তো ভিরমি খাওয়ার অবস্থা হয়েছিল। তারপরও কালিকট বিমানবন্দরে আমাকে বিদায় জানাতে এসেছিল মা। অন্য সময় আমি ভারতের অন্য কোনো জায়গায় গেলে জড়িয়ে ধরে চুমু খেত মা, এবার রাগী চেহারায় দাঁড়িয়ে রইল–বুঝলাম চাপা রাগ আর কান্নায় থমথম করছে মা। আমি তো বাইরের পৃথিবীতে পা দিয়েছি, ফেরার পথ একবারও ভাবছি না। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ, এবার আমাকে বিদায় নিয়ে ভেতরে ঢুকতে হবে আমি নিজে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলে মা আমাকে মৃদু ঠেলা দিয়ে সরিয়ে দিল ধাক্কাটা আমার গায়ে লাগেনি, লেগেছিল বুকে। মনে হয়েছিল মা-মেয়ের বন্ধনের যে সুতোর ওপর দাঁড়িয়ে ছিলাম সেটাও ছিঁড়ল। ছিঁড়ুক, বুক ফেটে যাচ্ছিল, কিন্তু চোখ থেকে জল ঝরতে দেইনি। গটগট করে ইমিগ্রেশন পেরিয়ে যেখানে যাত্রীরা অপেক্ষা করে সেখানে পৌঁছে যাই, একবারও পেছন ফিরে তাকাইনি। প্লেনে ওঠার পরে, প্লেনের সাথে সাথে আমিও অন্ধকারে ড়ুবে যাই, তখন আমার সামনে অসীম শূন্যতা ছাড়া আর কোনো গন্তব্যস্থল ছিল না। একজন আমার প্রিয় মানুষ ছিল, তার কাছ থেকে এত বড় আঘাতটা আসবে আমি ভাবিনি, আমি মেয়ে, বারবার তিনি আমাকে এটা বুঝিয়েছিলেন। তার দোষ নেই, তিনিও নারী হিসেবে এই রকম আচরণই পেয়েছিলেন। এবং সেই রকম পথেই আমাকে হাঁটতে হবে তা ধরে নিয়েছিলেন। তারপরও ভীষণ কষ্ট পেয়েছি যখন দেখেছি আমাকে সমর্থন না করে, তিনি ওই বাজে লোকটিকে ক্রমাগত সমর্থন করছিলেন। কারণ আমাদের সমাজে তো কখনো একা বড় হওয়ার সুযোগ দেয়া হয় না, একা থাকতে চাইলেও ক্রু কুঁচকায়। কিন্তু লন্ডনে এসে আমি নিজের মতো করে বেঁচে থাকার স্বাধীনতা খুঁজে পেয়েছি। একদিন খুব মন খারাপ লাগছিল। দেশে থাকতে সুখ-দুঃখ সামাজিকভাবে অনুভব করতে শেখানো হয়েছিল, এখানে এসে পেলাম ব্যক্তির মর্যাদা। বলছিলাম মন খারাপের কথা। প্রবল মন খারাপ নিয়ে ফুটপাথে বসে জোরে জোরে কাঁদছিলাম। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি এক বুড়ো দম্পতি আমার ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তা পার হয়ে অপর পাশে চলে গেল। আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে ওদের সম্মান দেখানো আমাকে খুব স্বস্তি দিয়েছিল। মানুষ হওয়ার যে যাত্রায় পা বাড়িয়েছি সেই লক্ষ্যে যেন পৌঁছাতে পারি সেই সাধনা করছি। প্রতিনিয়ত ভাবি আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার এই জীবন আমি চেয়েছিলাম। লন্ডন আমাকে এই স্বাধীনতা দিয়েছে।

একদিন তুমি এভাবে নিজেকে আবিষ্কার করতে চাইবে কি না আমি জানি না অনিমা। নীলিমা কিংবা মাধবী শুধু মেয়ে হিসেবে আমার বন্ধু নয় এখন, ওরা আমার সামনে এক একটি দরজা খুলে দিচ্ছে, সেই দরজা দিয়ে হুহু করে বাতাস এসে আমার ভাবনা এলোমেলো করে দিচ্ছে। আমি আমার মাকে দেখেছি একভাবে, তোমার সঙ্গে গড়ে উঠবে ভিন্ন সম্পর্কের সেতু, সেটা অনেক ভাবনার, অনেক চিন্তার সেতু। ভুল হলে সেই সেতু হুড়মুড়িয়ে ভাঙবে। তাই নিজেকে বুঝে ওঠার সুযোগটা আমি ছাড়তে চাই না। তোমার কাছে যখন ফিরে যাব, দেখবে ভিন্ন তন্ময়কে, যে তোমাকে বোঝার জন্য নিজের অনুভবের দরজা খুলে রাখবে। আজ এ পর্যন্ত–তোমার তন্ময়।

খামে গাম লাগিয়ে চিঠিটা স্কুলের ব্যাগে ঢুকিয়ে শুয়ে পড়ে তন্ময়। বাইরের তুষারপাত ওর দেখা হয় না। যে প্রবল তুষারপাত দেখার জন্য ও উদগ্রীব হয়েছিল। পরদিন শনিবার, স্কুল বন্ধ। বেশ বেলায় ঘুম ভাঙল–সকালের আনন্দ উপভোগ করার জন্য গড়াগড়ি করল অনেকক্ষণ, যেন লেপের সঙ্গে হুটোপুটি খেলা এবং শৈশবে ফিরে যাওয়া–এক অদ্ভুত শৈশব, আনন্দ এবং বেদনার ঘুণপোকা সেই শৈশব অনবরত কেটেছিল। তারপরও ভালো আছে ও। অনেকক্ষণ গড়াগড়ির পর টের পেল যে ক্ষিদে পেয়েছে। খাট থেকে নেমে জানালার পর্দা সরাতেই চোখ স্থির হয়ে যায়, বিস্ময়ে চোখের পাতা পড়ে না। জানালার কাছে গিয়ে কাচের ওপর নাক লাগিয়ে রাখে, বিস্ময়ে চোখ সরে না একদম পাল্টে গেছে, বাড়িঘর, গাছপালাগুলো। রূপকথার সেই অচিনপুরী, যা দেখা যায় কল্পনায়, বাস্তবের হিসাব সেখানে মেলে না। আকাশ থেকে অবিরাম নামছে সাদা তুলোর মতো হালকা বরফ, এ দৃশ্যের বর্ণনা করা দুঃসাধ্য, তন্ময় ক্ষিদের কথা ভুলে যায়। চারদিক ধোয়াশা করে দিয়ে বরফের কুচি ম্যাধুর হাতে তৈরি হওয়া পরীর মতো নাচছে। তন্ময়ের একবার ইচ্ছে হয় বাইরে গিয়ে সেই বরফের কুচির নিচে দাঁড়িয়ে থাকে, পরক্ষণে ভয় পায়, অসুস্থ হয়ে যাওয়ার একশ ভাগ, আশঙ্কা আছে। নিউমোনিয়া হলে তো রক্ষাই নেই। ও এক ছুটে গিয়ে কফি বানিয়ে সঙ্গে স্কটিশ কুকি নিয়ে জানালার কাছে চেয়ার টেনে বসে। বাংলাদেশের আষাঢ় মাসের আকাশ কালো করে নেমে আসা তুমুল বৃষ্টি ওর প্রিয় দৃশ্য–দোতলার বারান্দায় বসে বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে গিয়েও ও সেই বৃষ্টি দেখত, মায়ের বকুনি কোনো কাজে আসত না। তারপর ঠান্ডা লেগে গেলে সরষের তেলে রসুন দিয়ে গরম করে বুকে-পিঠে মালিশ করে দিত মা। এখানে তো কেউ নেই। বরফ পড়া বন্ধ হলে প্রথমেই মাকে ফোন করে খবরটা দিতে হবে। মা খুশি হয়ে বলবে, আমার সোনালি ঈগল, আজ তুমি আকাশে উড়তে যেও না। কে তোমার ঠান্ডা নামাবে, নিজের শরীরটাকে নিজেই দেখাশোনা করো। তন্ময় নিজের ভাবনায় মশগুল হয়ে বলে, তোমার কথা ভেবেই আমি পাগলামি থেকে পিছিয়ে আছি মা। আমি তোমার লক্ষ্মী ছেলে। জীবনের প্রথম বরফ দেখা উপভোগ করতে করতে দুপুর গড়িয়ে যায় তন্ময়ের। এখন কী করবে? রাস্তাটা কাদা-কাদা হয়েছে, হালকা পানির চিহ্ন দেখা যায় চারদিকে। ও আবার লেপের ভেতর ঢোকে।

সেদিন বিকেলেই নীলিমা কথাটা বলে।

ম্যাথুর সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব হয়েছে তন্ময়। ও দারুণ লোক।

কগ্রাচুলেশন্স নীলিমা।

উদারভাবে বলছ নাকি জেলাসি থেকে?

জেলাসি? তন্ময় অবাক হয়। তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমার আবার জেলাসি কি? তুমি আমার বন্ধু মাত্র। তোমাকে আমি ভালোবাসি

নীলিমা, যে জেলাস হবো।

বাব্বা, সামান্য একটি কথায় এত জবাব দিলে! যাকগে, শোনো, আমি ম্যাথুর বাড়িতে গিয়েছিলাম, ওর সঙ্গে এক রাত ছিলাম। ওর বাড়িকে পাথরের মিউজিয়াম বলা যেতে পারে। কত যে প্রকার, কত যে রঙ সেসব পাথরের দেখলে তুমি অবাক হবে। যাবে একদিন?

নিশ্চয়ই যাব। ম্যাথুকে তো আমিও খুব পছন্দ করি। তোমাকে বলেছি না?

তুমি না হলে তো ওর সঙ্গে আমার দেখা হতো না। তুমি আমাকে এই যাত্রা বাঁচিয়ে দিয়েছ তন্ময়। আমি ঠিক করেছি কোর্সটা শেষ হয়ে গেলে আমি আর ম্যাথু একসঙ্গে থাকব। আমিও ওর কাছ থেকে লকেট বানানোর কাজ শিখব।

তোমার ফটোগ্রাফি?

ওটাও থাকবে, দুটোই কাজ কিন্তু একটা আর একটার পরিপূরক। তোমার কী মনে হয়?

আমার আর একটু ভেবে দেখতে হবে।

আচ্ছা ভাব। তবে ভেবে কিন্তু রাতের ঘুম হারাম করো না।

বয়েই গেছে আমার। তোমার জন্য ভেবে রাতের ঘুম নষ্ট করব কেন? যাকগে, এখন কোথায় যাচ্ছ?

আজ তো ম্যাথুর দোকান বসবে। ওখানে যাব। তুমি যাবে?

হ্যাঁ, যেতে পারি।

দাঁড়াও আসছি, বলে নীলিমা একছুটে নিজের ঘরে যায়। তন্ময় বাইরে দাঁড়িয়ে ভাবে, অনিমাকে আর একটি চিঠি লেখার গল্প পাওয়া গেল। বড় দ্রুত নীলিমা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ও তো জানে, বছর দুই আগে ম্যাথুর বউ ওকে ছেড়ে যায়। ওদের কোনো বাচ্চা নেই। এর বেশি কিছু ম্যাথু ওকে বলেনি। তবে ম্যাথুর বাড়িতে ওর যাওয়া হয়নি, সে সুযোগও হয়নি–তেমন জোরালো বন্ধুত্বও তৈরি হয়নি যে ম্যাথু ওকে ডিনার খাওয়ার কথা বলবে। ও নিজেও ম্যাথুকে কোনো ক্যাফেতে নিমন্ত্রণ করেনি। কিন্তু নীলিমার সঙ্গে কত অল্পে একটি সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল—এটা নারী-পুরুষের সম্পর্ক, শেষ লক্ষ্য শরীর। আবার এই সম্পর্কের নানা জটিলতা নারীর জীবনকে দুর্বিষহ করে, তারপরও সম্পর্কের গিট্টু গাঁথা হয়। জীবনের কত যে মাত্রা। এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস ওকে স্পর্শ দিয়ে যায়, হিমশীতল স্পর্শ। তন্ময়ের শীতল স্পর্শ ভালোই লাগে, ও উপভোগ করে, সবসময় উষ্ণতা পেতে হবে এর কোনো যুক্তি নেই। তাছাড়া প্রকৃতির স্পর্শের মাত্রা ভিন্ন, এ স্পর্শ নারী বা পুরুষের নয়–এ স্পর্শ নির্লোভ-নিঃস্বার্থ, বিনিময় চায় না।

এসব ভাবনার মাঝে নীলিমা এসে দাঁড়ায়।

দূর থেকে মনে হচ্ছিল তুমি যেন কিছু ভাবছ?

স্পর্শের অনুভূতির কথা ভাবছিলাম। মানে?

এই যেমন প্রকৃতির স্পর্শে বিড়ম্বনা নেই, কিন্তু মানুষের স্পর্শে হাজার রকম বিড়ম্বনা তৈরি হয়।

ঠিক বলেছ। খুবই মৌলিক কথা।

স্পর্শের কারণে সম্পর্কও তৈরি হয় অল্প সময়ে।

ঠিক বলেছ, নীলিমা সঙ্গে সঙ্গে সায় দেয় এবং এও বলে যে, আমি জানি ম্যাথুর সঙ্গে আমার সম্পর্ক নিয়েই তোমার এত কথা।

হো হো করে হাসে তন্ময়। বুঝে যায় এলাকাটা নীলিমার খুবই চেনা হয়ে গেছে। নীলিমা আগে আগে হেঁটে যাচ্ছে, পেছন থেকে তন্ময় অন্য দিকে চলে যায়। দেখতে পায় যে যার কাজে ব্যস্ত, তা আয়না মোছাই হোক বা বন্ধুর সাথে আড্ডাই হোক। তন্ময় অকারণে ঘুরে বেড়ায়–গন্ধ নেয়, ছুঁয়ে দেখে, দাঁড়িয়ে থাকে, কারো গায়ে ধাক্কা লাগলে সরি। বলে। সারিবদ্ধভাবে চামড়ার বিভিন্ন ধরনের জিনসের দোকান সাজানো–এদের মধ্যে বেশি আছে জ্যাকেট, বুটজুতো, ব্যাগ। তন্ময় একটি কালো রঙের জ্যাকেট কেনে। ঘড়ির দোকান আছে কয়েকটা মায়ের জন্য একটি ঘড়ি কিনবে বলে ভাবে, কিন্তু সাবিহা বানুর কড়া নিষেধ আছে কিছু কেনার ব্যাপারে, বলেছেন, শুধু সখিনার জন্য একটা কিছু কিনতে। ও নেড়েচেড়ে রেখে দেয়। হিপ্পিদের পোশাকের দোকানগুলো বেশ দেখার মতো। মেয়েদের কিছু কিছু পোশাক দেখে ওর হাসি পায়। এসব পোশাক পরে কোনো মেয়ে ঢাকা শহরে হাঁটতে পারবে না, এমনকি বিদেশি মেয়েরাও নয়। ঘুরেফিরে ম্যাথুর দোকানে আসে। ম্যাথু ওকে দেখে উজ্জ্বল চোখে তাকায়, আগের মতো বিবর্ণ ভাব নেই ওর চেহারায়। হাত বাড়িয়ে দিয়ে হ্যান্ডশেক করে বলে, তুমি অনেক দিন আসোনি।

নীলিমা হাসতে হাসতে বলে, ও খুব ব্যস্ত। ও ফটোগ্রাফি কোর্সের সিরিয়াস ছাত্র। আমার মতো ফাঁকিবাজ নয়।

ম্যাথু হা হা করে হাসে। তন্ময় ওর আনন্দে সাড়া দিতে পারে না। গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। বলে, আজ কোন লকেটটা বেশি বিক্রি হলো।

নীলিমা আগ বাড়িয়ে বলে, পরীর। ওই লকেটটা সবার পছন্দ।

হা হা করে হাসে ম্যাথু। তন্ময় আকস্মিকভাবে উপলব্ধি করে যে ম্যাথু আজকে অনেক বেশি উচ্ছল–কারণে-অকারণে হেসে আনন্দ প্রকাশ করে মাথায় তুলছে ওর চারপাশ, নীলিমার স্পর্শ কি বদলে দিল ম্যাথুর সবটুকু প্রকৃতি? কোথাও একটুও ফাঁক নেই, এটাই সত্যি–এরই নাম জীবন। তন্ময়কে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে ম্যাথু হেসে বলে, নীলিমা চমৎকার মেয়ে, ঠিক পরীর মতো ওর মধ্যে স্বপ্ন এবং বাস্তব মিশে আছে।

সত্যি? তন্ময় চোখ বড় করে নীলিমার দিকে তাকায়। নীলিমা মৃদু হেসে আস্তে করে বলে, তোমাকে বলেছি তো সব। লুকাইনি কিছুই।

একটি বিষয় লুকিয়েছ।

কী?

আমাকে বাদ দিয়ে ম্যাথুর কাছে এসেছ। কবে এত কিছু হয়ে গেল জানতেও পারলাম না।

আগেভাগে সব কিছু জেনে গেলে চমক পাবে কী করে? চলো যাই। নান্দোসের চিকেন খেয়ে আসি।

আজ না। আর একদিন।

ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তন্ময় আবার একলা হয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে ভাবে, ওর আসল নাম আশরাফুল হক। আসল মাকে ও কোনো দিন দেখেনি। পালক মায়ের যে ভালোবাসা পেয়েছে সেটা মাধবী কুটির অভিজ্ঞতার বিপরীত, গভীরভাবে উল্টো, তাহলে ভালোবাসার সত্যিকার কোনো ঠিকানা নেই–জন্মের পরে অসংখ্য আসল মা তো শিশুদের ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। উপায়হীন সেসব মায়েদের নিজেদের ভাবনার জায়গা যেমন নেই, তেমনি নিজের সন্তানদের জন্যও ভাবনার জায়গা নেই। উন্নয়নশীল দেশে শিশুদের এটাই নিয়তি। লে বাব্বা, আমি আবার তাত্ত্বিক ভাবনা ভাবতে বসলাম, হয়েছে কি আমার। ও নান্দোস রেস্তোরাঁয় ঢোকে ঝাল চিকেন আর হলুদ ভাত খাওয়ার জন্য। এটা পর্তুগিজদের দোকান। ওকে দেখে পর্তুগিজ ছেলেটি ছুটে আসে। মেনুটা এগিয়ে দিয়ে বলে, হাই।

তন্ময় মাথা নাড়ালে বলে, তোমার গার্ল ফ্রেন্ড আসেনি?

তন্ময় মুচকি হেসে বলে, আমার ফ্রেন্ড অন্য কাজে ব্যস্ত। তুমি আমাকে সেদিনের মেনুটাই সার্ভ করো।

ছেলেটি চলে যায়। একটু পরে খাবার আনে, দূরে দাঁড়িয়ে থাকে, ওর চোখ দিয়ে জল ঝরতে শুরু করলে ও একটুখানি মিষ্টি জাতীয় কিছু নিয়ে ছুটে আসে না। তন্ময় কোক খেয়ে নিজেকে সামলায়। বুঝতে পারে, নীলিমা ওর ভালোবাসা পেয়েছে, নারী বলে কি? কে জানে, ওর হয়তো কোনো স্মৃতি আছে নীলিমাকে নিয়ে কিংবা নীলিমার মতো কাউকে ও পর্তুগালে রেখে এসেছে। কে জানে, ও হাত ওলটায়, ঝাল খেতে খেতে অনিমাকে চিঠি লিখবে বলে মনে করে, এখন পর্যন্ত অনিমার কাছ থেকে কোনো চিঠি পায়নি। তাতে কি, ফুলমসির মতো অখ্যাত স্টেশনে এত দূর থেকে কোনো চিঠি হয়তো পৌঁছায়নি।

ঘরে ফিরে ওর মন খারাপ লাগে। জানালার পর্দা টেনে দিয়ে ও অনিমার জন্য কেনা লকেটটা ঘরের বিভিন্ন জায়গায় রেখে অনেকগুলো ছবি তোলে। ছবিগুলো অনিমাকে পাঠাতে হবে। বাসার কাছেই একটি পোস্ট অফিস আছে, এটা ও আগে খেয়াল করেনি। একটা ডিপার্টমেন্ট স্টোরের ভেতর ছোট্ট এক কোনায় দুটো লোক এই পোস্ট অফিস চালায়। পরে জেনেছে এখানে অনেকে ব্যক্তিগতভাবে পোস্ট অফিস চালাতে পারে সরকারের অনুমতি নিয়ে। ধারণাটা মন্দ নয়, তাহলে বাংলাদেশের অনেকে কাজের জায়গী খুঁজে পাবে, মানুষের হাতের নাগালে থাকবে ডাক ব্যবস্থা। এক কাপ কফি খেয়ে তন্ময় অনিমাকে চিঠি লিখতে বসে। হঠাৎ করে উপলব্ধি করে মন খারাপের বোধ ও ছাড়াতে পারেনি। আসলে সেই পর্তুগিজ ছেলেটি কেন ওর জন্য খানিকটুকু মিষ্টি জাতীয় কিছু নিয়ে ছুটে আসেনি, তা ওর বুকে বেজেছে। নীলিমা থাকলে হয়তো ঠিকই আসত। পরমুহূর্তে নিজেকে শাসন করে ও, কেন এভাবে ভাবছে, নীলিমার সঙ্গে ওই ছেলেটির বন্ধুত্ব বেশি দিনের, ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে মাত্র একবার। ছেলেটির কাছে নীলিমার মতো প্রত্যাশা কেন ওর থাকবে? পরিচয় বেশি দিনের হলে ঠিকই ওর কাছে আসত। এর পরে যখন যাবে তখন ও ঠিকই আসবে, এমন ভাবনার সাথে সাথে ওর ভেতরের বরফ গলতে শুরু করে। যে কলমটা দাঁতে কামড়ে রেখেছিল সেটা নেমে আসে লেখার কাগজের ওপর। প্রিয় অনিমা, প্রিয়তম… কেমন আছ তুমি? অনেক কিছু তোমাকে লেখার আছে, কিন্তু লিখতে পারছি না। শরীরের এমন মারমুখী আচরণ, যখন তখন বেঁকে বসে, গাল ফোলায়, রাগ করে–ভারি বিপদ এই দুষ্ট ছেলেটিকে সামলাতে…। আর লেখা হয় না তন্ময়ের। লাইট বন্ধ করে লেপের নিচে ঢুকে পড়ে।

দুদিন পরে ডাকে একটি চিঠি আসে ওর নামে। মাধবী কুট্টি লিখেছে। এত দেখা-সাক্ষাৎ হয়, তারপরও চিঠি লেখা কেন মাধবীর? ও। চিঠিটা খোলে না, টেবিলে রেখে ক্লাসে যায়, ফেরার পথে সেফওয়েতে ঢুকে কিছু খাবার কেনে। রাতে ঘুমুবার আগে লেপের ভেতরে শুয়ে মাধবী কুট্টির চিঠি খোলে। নিজেকেই বলে, কেন এতটা সময় নিলাম চিঠিটা খুলতে? আমি কি ভেবেছি মাধবী আমাকে প্রেমের চিঠি লিখেছে? না, যে চিঠিই লিখুক না কেন চিঠিটা পেতে ওর খুব ভালো লেগেছে, সেজন্য এক ধরনের উত্তেজনা ছিল নিজের ভেতরে সুখ অনুভবের রেশ ছিল। মাথার কাছে রাখা টেবিল ল্যাম্পের উজ্জ্বল আলোয় গুটি গুটি অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা চিঠিটায় ও মগ্ন হয়ে যায়।

ডিয়ার তন্ময়, তোমাকে আমার ফেলে আসা দিনের অনেক কথা বলেছি। তোমাকে আমার খুব আপন মনে হয়েছে। তুমি অকারণে পুরুষের দৃষ্টি নিয়ে তাকাও না কোনো নারীর দিকে, আগ বাড়িয়ে, ঝুঁকে পড়ার কোনো ন্যাকামি নেই তোমার, নারীর কোনো অঙ্গ ছুঁয়ে ফেলার হ্যাংলামি নেই তোমার। অথচ তোমার পুরুষের দীপ্ত ভঙ্গি আছে, জীবনকে বড় করে দেখার উদারতা আছে, তোমাকে একজন দীপ্ত মানুষ মনে হয়েছে আমার। প্রিয় তন্ময়, এই শহরে তুমিই আমার প্রকৃত বন্ধু, যাকে আমি সব স্বার্থের ঊর্ধ্বে নির্ভর করতে পারি। সেজন্যই এই চিঠি লেখা। কথাগুলো আমি সামনাসামনি বসে তোমাকে বলতে পারতাম না। তোমার সঙ্গেই আমার নিজের কথা শেয়ার করতে ভালো লাগে, নইলে গুমোট দম বন্ধ করা অবস্থা আমাকে কুরে খায়। যত দিন যাচ্ছে ততই উপলব্ধি করছি কত ভাবে আমাকে মানসিক পীড়ন করা হয়েছিল। অবজ্ঞা, অবহেলা, কটুক্তি, অবিশ্বাস, অপমান কিছুই বাদ ছিল না। তুমি তো বোঝ যে দেশে মারধর করা স্বামীর অধিকারের মধ্যে পড়ে সে দেশে কথার পীড়ন তো কোনো আলোচনার বিষয়ের মধ্যেই পড়ে না। আমাকে আমার নিজস্ব যা কিছু বোধ তা শক্ত বাঁধনে আটকে রেখে বলা হবে স্বামী তার ভালোবাসার দায় পালন করছে। স্ত্রীকে মর্যাদা দিয়ে প্রতিপালন করা হচ্ছে। বলো তন্ময়, আমি কি শিশু! শিশুকেও খেলতে দেয়া হয়, শিশুর এক ধরনের স্বাধীনতা থাকে, বাবা-মায়ের বকুনি খেয়েও শিশু কিন্তু নিজের মতো আচরণই করে। কিন্তু আমি দেখেছিলাম আমার চারপাশে টানা ছিল লক্ষণরেখা, আমার সামনে ছিল সমাজ-সংস্কৃতি-ধর্মনিয়মকানুনের দেয়াল, আর ছিল সংসারের ভালোবাসার নামে শিকল। আমি আমার মতো করে ভাবতে পারতাম না, যা ভালো লাগে তা বলতে পারতাম না, যা চাই তা জানাতে পারতাম না।

তুমি তো জানো তন্ময়, সবাই মিলে আমরা অধিকারের কথা বলি, আমার জিজ্ঞাসা, এসব কি তার বাইরে? আমি কি শুধুই ভাত-কাপড়ের নিশ্চয়তাটকর জন্য এই সংসারটা ধরে রাখব? সে তো নিজেই জোগাড় করতে পারি। তন্ময় বিশ্বাস করো, আমি একজন মানুষকে চেয়েছি। জীবনযাপনের সঙ্গী হিসেবে। পুরুষ কিংবা স্বামী (প্রভু) নয়। একবার মনে হয়েছিল একটা বাচ্চা থাকলে মন্দ হতো না, নিজেকে স্বস্তিতে রাখার একটি অবলম্বন পেতাম কিন্তু পরে নিজের স্বার্থপরতার জন্য নিজেকে ধিক্কার দিয়েছি একটি ভাঙা পরিবারের সন্তান হিসেবে ওকে আনন্দহীন জীবনে ফেলে দেয়ার অধিকার কি আমার আছে, নাকি থাকা উচিত! একটা শিশুকে পৃথিবীতে আনলেই হলো? কী দায়িত্ব পালন। করতাম তার? খালি নিজেরটুকু ভাবি আমরা আনন্দ, বংশরক্ষা এবং শেষে মানবপ্রজাতির বেঁচে থাকা ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে আমরা প্রচণ্ড স্বার্থপর। নতুন প্রজন্মের জন্য কোনো ব্যবস্থা না করে যৌন সুখের তাড়নায় কিংবা অবলম্বনের অংশ হিসেবে সন্তানের কথা ভাবি। তোমার আর আমার দেশের অবস্থা একই তন্ময়। লন্ডনে শিশুদের জন্য কত কিছু–শত শত দোকান, জাদুঘর, পার্ক, কী নৈই ওদের জন্য–ওরাও ভাঙা পরিবারের সন্তান হয়, কিন্তু বস্তুগত সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় না। রিজেন্টস রোডের হ্যামলিস একটি চমৎকার দোকান। খেলনা যে কত রকমের হতে পারে এখানে না এলে বুঝতাম না। গতকাল হ্যামলিসের নিচের তলায় স্ন্যাকস কর্নারে গিয়ে গ্লাভস, টুপি, মাফলার খুলে বসেছিলাম। কফি খেলাম অকারণে বসে থেকে সেইসব বাচ্চাদের দেখছিলাম। যারা বাবা-মায়ের সঙ্গে খেলনা কিনতে এসেছে, কিংবা শুধু বাবা অথবা শুধুই মা। বুকভরা কান্নায় আমি নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না তন্ময়। আজ এ পর্যন্ত।

মাধবী কুটির চিঠি পড়ে তন্ময়ের মন ভারি হয়ে যায়। চিঠিটা ভাঁজ করে বালিশের নিচে রেখে দেয়। লেপ মুড়ি দিয়ে মাথা ঢাকার সঙ্গে সঙ্গে বারবারই মনে হয় ও নিজেও একটা পরিত্যক্ত শিশু। দরিদ্র জননী পালতে পারবে না বলে বিত্তশালী আর এক নারীর হাতে তুলে দিয়েছিল। বিধাতা ওকে ঠকায়নি, দুহাত পূর্ণ করে দিয়েছে। বঞ্চনার জীবন নয় ওর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *