০২. ঘরে বসে বাবার কথা খুব মনে হয় অনিমার

ঘরে বসে বাবার কথা খুব মনে হয় অনিমার। বাবাকে একা রেখে অন্য আর একটি সংসারে ঢোকা কি ওর পক্ষে সম্ভব হবে? পরক্ষণে রাজীব ওকে আচ্ছন্ন করে। ও একটি সাদা কাগজে আঁকিবুকি কাটে। নিজেকেই বলে, বলেছিলে ফিরে আসবে। আসছ না কেন? আর কত দিন অপেক্ষা করব আমি? কত দিন ট্রেন এলে ছুটে যাব স্টেশনে।

ও কাগজটা ভাঁজ করে পাখি বানায়। সেটা ছুঁড়ে দেয় উপরে। বলে, জানি এ চিঠি কোনো দিন তোমার কাছে পৌঁছাবে না। ভীষণ মনে পড়ে, একদিন রাজীব আর ও একটি কাঠঠোকরা পাখির বাসা খুঁজতে অনেক দূরে গিয়েছিল। রাজীব ওকে হাত উঁচিয়ে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া অতিথি পাখির সারি দেখিয়েছিল। ও বাবার অফিসে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়।

তখন তৌফিক তন্ময়কে জিজ্ঞেস করে, তুমি আমাকে নদীর কথা জিজ্ঞেস করেছিলে কেন?

আমি প্রকৃতি ভালোবাসি। কিন্তু প্রকৃতির সৌন্দর্য আছে, মানুষের মতো চেহারার রকমফের নেই। প্রকৃতির ভেতর সম্পর্ক তৈরি হয় না।

প্রকৃতির চেহারার অনেক রকমফের আছে। জায়গাভেদে প্রকৃতির ভিন্নতা তুমি দেখোনি? প্রকৃতির ভেতরে সম্পর্কও তৈরি হয়। একশবার হয়।

হয়, কীভাবে?

মৌমাছি ফুলের পরাগরেণু দিয়ে প্রকৃতিতে জীবনের সঞ্চার ঘটায়। শাপলা ফুলের পরাগায়ন হয় নদীর মাধ্যমে। বাতাসেও পরাগায়ন হয়। নদী পলিমাটি ফেলে জমি উর্বর করে। এগুলো কি সম্পর্ক নয়?

তন্ময় এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে, এত গভীর কথার উত্তর আমার জানা নেই। তবে মানব সম্পর্কের মধ্যে যে সুখ-দুঃখ, আনন্দবেদনা আছে তা প্রকৃতির নেই। আমি আপনার আর একটা ছবি তুলি?

তোল। ছবির কপি তুমি আমার মেয়েটাকে দিও কিন্তু।

তন্ময়ের ক্যামেরা ক্লিক করে। ও ক্যামেরা ব্যাগে ঢোকানোর আগেই অনিমা ঢোকে। তৌফিক হেসে বলে, আয় মা। দেখ কেমন পাগলের পাল্লায় পড়েছি। এই ছেলেটার নাম তন্ময়। ছবি তোলা ওর নেশা।

অনিমা তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে, আপনাকে আমি ট্রেন থেকে নামতে দেখেছি।

তন্ময় অনুচ্চ কণ্ঠে বলে, জানি।

তৌফিক প্রবল উচ্ছাসে বলে, এই ছেলে, তুমি আমার মেয়ের সঙ্গে একটা ছবি তুলে দাও।

অনিমা লজ্জা পায়। বাবার পিঠে হাত রেখে বলে, আহ্ বাবা তুমি যে কি?

লজ্জা পাচ্ছিস কেন মা, আয়।

হ্যাঁ, আসুন, এখানে দাঁড়ান। ছবি তুলতে আমি ভীষণ ভালোবাসি।

বাবা-মেয়ে তন্ময়ের ক্যামেরায় পোজ দেয়। তন্ময় ছবি তুলে দিয়ে চলে যায়।

সাবিহা বানু তখন গভীর আগ্রহে তন্ময়ের চিঠি পড়ে। কাজ শেষে তাহেরা এসে সাবিহা বানুর কাছে বসে। বলে, আম্মা এটটু ঠাণ্ডা হইতে আইলাম। সাবিহা ওর কথায় মাথা নাড়ে। কিন্তু তন্ময়ের চিঠি থেকে চোখ ওঠে না তার, মা, আমার রুপালি মা আমার, আমি এখন একটি ছোট্ট স্টেশন, নাম ফুলমসি। স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। ভদ্রলোক যথেষ্ট বুড়ো নয়, কিন্তু ভেতরটা বুড়িয়ে গেছে বলে আমার মনে হয়েছে। মানুষের এই বুড়িয়ে যাওয়া দেখতে আমার ভালো লাগে না। তার স্ত্রী মারা গেছে। একটি মেয়ে নিয়ে তার সংসার। ঠিক আমাদের মতো মা। যেমন একটি ছেলে নিয়ে তোমার সংসার। হাঃ হাঃ। ইতি তোমার আদরের রবীন্দ্রনাথ তন্ময়।

সাবিহা মৃদু হেসে চিঠিটা বুকে জড়িয়ে ধরে। তারপর তন্ময়ের লেখা চিঠির বাক্সে ভাঁজ করে রেখে দেয়।

তাহেরা কৌতূহলী কণ্ঠে বলে, এতক্ষণ আপনের পোলার চিঠি পড়লেন আম্মা?

সাবিহা মাথা নাড়ে।

ওর চিঠি পড়তে আমার খুব ভালো লাগে। এই চিঠিটাই আমাদের মা-ছেলের সেতু। ছেলেটা ঠিকই টের পায় যে আমি কখন ওর একটা চিঠির জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠি।

তাহেরা খুশি হয়ে বলে, এরেই কয় মায়ের লগে পুতের নাড়ির টান।

সাবিহা চমকে ওঠে, নাড়ির টান! তারপরেই তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। তারপর বিষণ্ণ হয়। শেষে উৎফুল্ল হয়ে বলে, না-না নাড়ির সম্পর্কটম্পর্ক কিছু না তাহেরা, ভালোবাসা একদম ভিন্ন জিনিস–ভালোবাসতে জানলে মানুষের অনেক অভাব পূরণ হয়।

তাহের দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আল্লাহ যে ক্যান আমারে একটা পোলা দিল না। সাবিহা কথা না বলে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। তাহেরা। আবারও বিলাপ করে, আল্লাহ যদি আমারে একডা মাইয়াও দিত। আমি ক্যান এমন হতভাগী হইলামী

সাবিহা ওকে আশ্বস্ত করার জন্য বলে, দুঃখ করছ কেন তাহেরা? তুমি একটা মেয়ে পালক নিলে না কেন?

আমি চাইছিলাম নিতে। আমার স্বামী রাজি অয় নাই। কয় পরের মাইয়া খাওয়াইতে পারমু না।

তোমার স্বামী যে আবার বিয়ে করল–

ওই সংসারেও কিছু অয় নাই। আল্লাহ দ্যায় নাই। আল্লায় বিচার করছে। তাহেরা বুড়ো আঙুল নেড়ে নেড়ে তার বিচারের মনোভাব প্রকাশ করে। তারপর হি-হি করে খানিকটুকু হাসে। সাবিহা বানুর কাছে তাহেরার হাসি সুস্থ মানুষের হাসির মতো মনে হয় না। ওর বুক কেমন করে। ভয়ও পায়।

তাহেরাকে শাসনের সুরে বলে, এভাবে হেসো না তাহেরা।

তাহেরা সাবিহা বানুর কথায় কর্ণপাত করে না। নিজের মতো করে ভেবে বলে, আম্মা আমি ঠিক করছি এইবার দ্যাশে গেলে কুমার বাড়ি গিয়া মাটি দিয়া পুতুল বানানো শিখুম। পরান দিতে পারমু না, কিন্তু মানুষের মতন তো হইব। মনে করমু ওইগুলা আমার সন্তান। আমি জন্ম। দিছি।

সাবিহা গভীর মমতায় উচ্চারণ করে, ওহ তাহেরা!

তাহেরা কাঁদতে শুরু করে, আম্মাগো–

সাবিহা ওর কান্নায় চিন্তিত বোধ করে। ভাবে, মনে হয় ওকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো উচিত। আশ্চর্য, কার বুকের ভেতরে কোথায় কী কান্না আছে, কে জানে!

তাহেরা কাঁদতে কাঁদতে কপাল চাপড়ায়, খানিকটা অস্বাভাবিক আচরণ করে। মাটিতে শুয়ে পড়ে। ঘরে সাবিহা বানুর উপস্থিতি ও ভুলে যায়।

সাবিহা ওকে শান্ত করার জন্য ধমক দিয়ে বলে, এই তাহেরা ওঠো।

যাও তো দেখো বাগানে মালি কী করছে। ওকে ডেকে নিয়ে এসো।

তাহেরা চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ায়।

আপনে চা খাইবেন আম্মা?

সাবিহা মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ আনো, সঙ্গে দুটো বিস্কুট দিও।

তাহেরা খানিকটুকু এগিয়ে আবার ফিরে আসে। শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বলে, আম্মা আপনের পোলারে আপনে চিঠি ল্যাখেন না?

চিঠি! সাবিহার কপাল কুঁচকে যায়, দ্রুত নিজেকে সামলে নেয়। হেসে বলে, আমার ছেলেটা নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ায় তো সেজন্য ওর ঠিকানার ঠিক থাকে না। তাই আমার লেখা হয় না, তবে ও আমাকে চিঠি লিখতে ভোলে না। দেখছ না চিঠির বাক্সটা কেমন ভরে গেছে। আমার একটা বাক্স কিনতে হবে।

তাহেরা দু-হাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে বলে, এইবার একটা সিন্দুক কিনবেন আম্মা। অ্যাত্তো বড়–।

দুজনে হা-হা করে হাসতে থাকে। সাবিহার মনে হয় হাসতে বেশ লাগছে। তাহেরা কাজের বুয়া বলে হাসিটার মধ্যে কৃত্রিমতা তৈরি হবে, এমন ভাবনা ওর মধ্যে কাজ করে না। তাহেরা আবারো বলে, আম্মা আপনের পোলা আমার একডা ছবি তুলছিল। আপনে তারে কইবেন আমারে একডা ছবি দিতে।

তুমি কিছু ভেব না। ও তোমাকে ঠিকই ছবি দেবে। আর তুমি যে আমার কাছে আছ তা তো ও জানেই। একদিন দেখবে তোমার ছবি আমার চিঠির সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছে।

তাহেরা খুশিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বলে, হ ঠিক। ঠিক কইছেন আম্মা। আপনে যেমুন ভালা, পোলাডাও ঠিক তেমুন। হঠাৎ করে বদলে যায় ওর আচরণ কণ্ঠে কেমন অস্বাভাবিক টান, সাবিহার কানে খট করে লাগে। তাহেরা কি সুস্থ নেই? ওর কি কোনো সমস্যা হচ্ছে? সাবিহা স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। সাবিহা একটু পরেই শুনতে পায় সুর করে বলা তাহেরার প্রলাপ। ছবি পামু আল্লাহরে। শেষের দিকে ওর কণ্ঠে আর্তনাদ ধ্বনিত হয়। সাবিহার বুক ধক করে ওঠে। ওর মনে হয় তাহেরা বুঝি পাগল হয়ে যাবে। সাবিহা প্রবল অস্বস্তিতে উঠে দাড়াতেই ফোন বাজে। তন্ময় কি ফোন করেছে? না, তন্ময় কখনো ফোন করে না। ফোন আসে মালিহার, ছোট বোেন। একা থাকে। পাঁচ বছর আগে বাড়ি ছেড়ে বলেছিল, বেশি মানুষের সঙ্গে থাকা আমার পোষায় না। আমি নিজের মতো থাকতে চাই।

ফোন ওঠাতেই মালিহা বলে, আপু তুমি কেমন আছ?

দিন চলে যায়। ভালোই যায়। তুই কেমন আছিস?

আমি খুব আনন্দেই আছি বাপু। পবন আর আমি একসঙ্গে থাকছি।

একসঙ্গে? সাবিহা ভীত হয়ে যায়। কী বলছিস মালি?

আপু, বিষয়টা তোমাকে ছাড়া আর কাউকেই বলতে পারব না। সেজন্যই তোমাকে বলছি।

ভালো করে খুলে বল।

এইটুকু বুঝতে তোমার এত সময় লাগছে?

সত্যি নিজেকে ভীষণ বোক বোকা লাগছে।

আপু, আমরা লিভ টুগেদার করছি। বিয়েটিয়ে করা আমার হবে না।

ওতে আমার বিশ্বাসও নেই। কী হলো, চুপ মেরে গেলে যে?

তোর ইচ্ছের ওপর আমার কি কোনো হাত আছে রে!

হা-হা করে হাসে মালিহা। হাসতে হাসতে বলে, একদিন পবনকে নিয়ে আসব। তোমার স্পেশাল কিছু রান্না আছে, সেগুলো করবে। রাগ করবে না তো?

তুই আমাকে চিনিস না মালিহা?

চিনব না কেন? তুমি আমার সুইট বোন। রাখি। বাইরে কোথাও যাবার কথা ভাবছি। যাবার আগে তোমাকে বলে যাব। রাখি আপু। ও আচ্ছা শোনো, মাকে কিন্তু তুমি কিছু বলো না। ওল্ড ভ্যালুসের মানুষ–বিশাল একটা ধাক্কা খাবে। মাকে ধাক্কাটা দিতে চাই না।

হয়েছে থাম। অনেক কথা বলছিস।

আর কথা না বলে মালিহা ফোন রেখে দেয়। সাবিহা ব্ৰিত বোধ করে। ভীষণ মন খারাপ হয়। নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। তন্ময়ের কথা ভেবে বুক তোলপাড় করে। তারপরও সাবিহা নিজেকে ঠিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় বালিশে মুখ গোঁজে। আসলে জীবনের সবটুকু খতিয়ান মেলাতে পারে না। ও মালিহার মতো সাহসী নয়, যা খুশি তা করার জন্য পা বাড়াতে পারে না, ভয় পায় এবং ভীতি তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখে ছকবাঁধা জীবনের কুঠরিতে আটকে রাখে। এটুকুতেই সে নিজের স্বস্তি খোঁজে। তাহেরা চা-বিস্কুট নিয়ে এলে ও বলে, এখন খাব না। তুমি নিয়ে যাও।

তাহেরা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বিড়বিড় করতে করতে ফিরে যায়। সাবিহা আবার চমকে ওঠে। নিজের খারাপ লাগার মধ্যেও ওর মনে হতে থাকে যে তাহেরা সুস্থ নেই। ওর উৎকণ্ঠা সীমা ছাড়িয়ে যায় এবং বুঝতে পারে যে তাহেরার সামনে বিপদ। ওকে রক্ষা করা কঠিন।

 

অনিমার স্কুল ছুটি হয়েছে। প্রতিদিনের মতো ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্কুল থেকে ফিরে। এই ফেরার মধ্যে ওর ভাবনার নানা কিছু ঢুকে থাকে, যেসব নিয়ে ওর ভাবনা বিস্তৃত হয়। অনিমা জীবনের চারপাশের দেখার দেয়ালটা ভেঙে দেয়–সামনে তো দিগন্তছোঁয়া প্রান্তর, কত দূর যাবে ও–নাকি আটকে থাকবে এই মাঠে–শুধু ছেলেমেয়েরা বড় হতে থাকবে, ওরা ঢুকবে জীবনের নানা দরজা দিয়ে, কারো কারো সামনে বন্ধ থাকবে দরজা, তখন কেউ কেউ বন্ধ দরজার এপাশেই টিকে থাকার চেষ্টা করবে, যেটাকে ঠিকভাবে টিকে থাকা বলা যাবে না। অনিমার বুকটা বেদনায় ভার হয়ে ওঠে। মনে হয় এ জীবনে কিছুই পাওয়া হলো না, পথটাও বেশি পাড়ি দেয়া হলো না, ও নিজেই তো বদ্ধ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। দরজা যে খুলবে সে সুযোগ কই? তখন ও দূর থেকে তন্ময়কে দেখতে পায়।

ও উল্টো দিক থেকে কখনো ছবি তুলে, কখনো চারদিকে তাকাতে তাকাতে পাখি দেখে, হাঁটু গেড়ে বসে বুনো ফুল দেখে, ক্ষুদে পোকা দেখে এসব করতে করতে তন্ময় এগিয়ে আসে। অনিমার মনে হয়, তন্ময় বেশ আছে, ও দরজার অপর পাশের জীবনযাপন করছে। দরজার চৌকাঠে হোঁচট খেতে হয়নি তন্ময়কে। অনিমার বুক খচ করে ওঠে–ও বুঝতে পারে যে ও তন্ময়কে ঈর্ষা করছে। খানিকটুকু এগিয়ে অনিমাকে দেখে ও ছুটে কাছে এসে দাঁড়ায়–একদম মুখখামুখি। অনিমাই হেসে কথা শুরু করে, এখনো ছবি তোলা শেষ হলো না আপনার?

শেষ হবে কী করে, আপনার একার ছবিই তো এখনো তোলা হয়নি। কত পোজ যে দিতে হবে তার কি শেষ আছে। দেখবেন এক একটা ছবিতে কেমন অদ্ভুতভাবে ফুটে উঠেছেন আপনি। নিজেকে চিনতে কষ্ট হবে। মনে হবে, এ কোন অনিমা, আমি কি একে চিনি?

অনিমা হাসতে হাসতে বলে, বেশ লম্বা বক্তৃতা দিলেন। বেশ সুন্দর করে গুছিয়ে বলতে পারেন। আমি বলি কি, আমার ছবি ওঠালে আপনার ক্যামেরা ভাঙবে।

তন্ময় অনিমার মুখের ওপর আঙুল নেড়ে বলে, ভুল, সবই ভুল, আপনার ছবি তোলার পরে আমার ক্যামেরার উজ্জ্বলতা বাড়বে। যে জ্যোতি ঝলকাবে তা–

হয়েছে, হয়েছে থামেন। অনিমা লাজুক হাসে। আমার ছেলেমেয়েরা আপনার কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।

রাখেন ছেলেমেয়েদের কথা, আমাকে পোজ দেবেন কখন বলেন তো?

অনিমা গম্ভীর হয়ে বলে, ভেবে দেখি।

বাব্বা, একদম রানীর গাম্ভীর্য নিয়ে কথা বলছেন। দেখবেন সময়টা যেন হয় দিনের প্রথম আলোয়, কিংবা পূর্ণিমা রাতে, অথবা আকাশ ভেঙে নেমে আসা ঘোর বৃষ্টির মধ্যে।

অনিমা উচ্ছসিত হাসিতে ভেঙে পড়ে। হাসতে হাসতে বলে, কবিতা লেখেন? কবি হবেন, নাকি হয়ে গেছেন?

এই ক্যামেরাই আমার কবিতা।

অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেমেয়েগুলো কলরব করে ওঠে, আমাদের ছবি তুলে দেন স্যার।

এক একজন করে দাঁড়াও। সবার একটা করে ছবি তুলে দেব।

ছবি তুলতে তুলতে চমৎকার সময় কেটে যায় প্রতিটি ছেলেমেয়ে কত প্রাণবন্ত, কত উচ্ছল। কত দীপ্তি ওদের দুচোখে। তন্ময়ের মনে হয় এভাবে মানুষকে ধরা মানুষেরই জীবন। তারপরও একটু ফাঁক থেকে যায়, বাস্তবতার ফাঁক, জীবনযাপনের সঙ্গে যেটুকু আর মেলে না। ওদের ছবি তোলার সময় অনিমা পথের ধারে বসে থাকে। ছেলেমেয়েগুলো অন্যরকম আনন্দ পাচ্ছে, তন্ময় ওদের সময়টা ভরিয়ে দিচ্ছে, এটুকু ভেবেই অনিমা খুশিতে আপুত হয়। যাক, অল্প একটু সময় হলেও ওদের দরজা একটুখানি ফাঁক হয়েছে। অনিমা মনে মনে তন্ময়কে কৃতজ্ঞতা জানায়।

তখন খঞ্জনি বাজাতে বাজাতে মাসুম আসে। ওর হাতে লাল-সবুজ পতাকা দেখতে যারা অভ্যস্ত, তারা জানে ওর লাল পতাকায় ট্রেন থামে, আর সবুজ পতাকায় ট্রেন ছাড়ে। ও এক চলন্ত ছেলে। কিন্তু ওর নেশা খঞ্জনি। খঞ্জনি বাজাতে বাজাতে নাচে-গায়। অনিমার মনে হয় মাসুমও দরজার ওপারে যেতে পেরেছে। বন্ধ দরজা মাসুমের চলা আটকাতে পারেনি। ছেলেমেয়েদের ছবি তোলার মাঝখানে মাসুম এসে দাঁড়ায়। ওদের ছবি তোলা শেষ হলে ও বলে, সুন্দর কাজ করেছেন তন্ময় ভাই। এবার আমার একটা ছবি তোলেন।

সঙ্গে সঙ্গে অনিমা উঠে দাঁড়িয়ে বলে, তোমার একটা ছবি তোলো। তারপর অন্য একটা ছবি তোলা হবে।

তন্ময় উৎসুক হয়ে বলে, কী ছবি তোলা হবে?

ওই ছেলেমেয়েরা মাসুমের খঞ্জনি বাহিনী। ওদের একটা খঞ্জনি নৃত্যের ছবি তোলা হোক।

মাসুম লাফিয়ে উঠে বলে, ঠিক কথা। আয় পোলাপান।

ও ঝোলা থেকে খঞ্জনি বের করে ছেলেমেয়ের হাতে দেয়। ছেলেমেয়েরা খঞ্জনি বাজাতে শুরু করে। মাঠজুড়ে খঞ্জনির সুর বাতাসে মিশে ছড়াতে থাকে–গ্রামের সীমানা পেরিয়ে, অন্য গ্রামে–অন্য শহরে–কোথায় যায় না! অনিমার বুক হুহু করে। কিছু কিছু ধ্বনি অজস্র স্মৃতি তোলপাড় করে ওঠা। সে স্মৃতি বুকের এত গভীরে থাকে যে সে শব্দ নিজের কাছে শুধু পৌঁছায়ু, আর কারো কাছে নয়।

মাসুম ছেলেমেয়েদের নিয়ে খঞ্জনি বাজিয়ে নাচতে নাচতে অনেক দূরে চলে যায়। তন্ময় অনেকগুলো ছবি তোলে। এই দৃশ্যটি ওর ক্যামেরায় ধরা পড়েনি। দুজনেই নৃত্যরত ছেলেমেয়েদের চলে যাওয়া উপভোগ করে। একসময় তন্ময় অনিমার দিকে তাকিয়ে বলে, এখন আমাদের সময়। প্রবল হাসিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে অনিমা বলে, আমি নাচতে জানি না। আমার হাতে খঞ্জনিও নেই। ওটা বাজানো কঠিন। শিখতে হয়।

তন্ময় ব্রিত হয়ে বলে, আমি নাচের কথা বলিনি। বলেছি, ওরা আমাদের একা রেখে গেছে।

জানি। তবে আপনার কথা অনুযায়ী একা থাকার সুযোগটা আমরা কাজে লাগাতে পারি।

হ্যাঁ, আমরা গল্প করতে পারি। গল্প করতে আমার খুব ভালো লাগে। সুন্দর গল্প হলে সময় দারুণভাবে ভরে যায়।

অনিমা ভ্রূ নাচায়। বলে, ছবি তোলার কী হবে?

তন্ময় মুগ্ধতায় মাথা নাড়ে–চমৎকার সময় ওর বুকের ভেতরে তোলপাড় করে। গভীর আবেগে বলে, আমরা না হয় একটু পরেই ছবি তুলি।

অনিমা মাথা নাড়ে, ঠিক আছে।

আমি আপনার বিভিন্ন মুহূর্তকে আমার ক্যামেরায় ধরব। জানতেও পারবেন না। জিজ্ঞেস করব না। নো পারমিশন। নো বিজনেস।

আমি কিন্তু পরীক্ষা নেব। দেখব কতটা পারেন।

না পারলে?

শাস্তি পেতে হবে।

কী শাস্তি?

সেটা ভেবে দেখব।

আমি কি নিজের শাস্তির কথা নিজে বলব?

বলুন দেখি কী?

বলব?

হ্যাঁ, অবশ্যই বলবেন। শাস্তি দিতে তো আমার কোনো ভয় নাই।

শাস্তিটা হবে—

থামলেন যে–

আপনার মুঠিতে আমার হাত জায়গা পাবে।

এত অল্প শাস্তি?

আরো কঠিন শাস্তি দেবেন?

দিতেও পারি।

সেটা নিতে আমি রাজি।

দুজনে হাসিতে মেতে ওঠে। হাসতে হাসতে মেঠোপথে এগোয়। দেখা যায় জনশূন্য রাস্তায় দূর থেকে একদল হাটুরে আসছে। দুজনে স্টেশনে আসে।

তৌফিক অফিসে ব্যস্ত। মাসুম সবুজ পতাকা ওড়াচ্ছে। ট্রেন আসছে। দুজনে মানুষের ওঠানামা দেখে। তারপর তন্ময় একাই স্টেশন মাস্টারের ঘরের দিকে এগোয়। দরজায় দাঁড়িয়ে কর্মরত তৌফিকের একটি ছবি তোলে কুঁচকানো কপালের ওপর লুটিয়ে থাকা একগুচ্ছ চুল, কাঁচা-পাকা ভ্রু এবং মোটা নাকের আদল, নত চোখের পাতা তন্ময়ের ক্যামেরায় শিল্পের আবেদন ফুটিয়ে তোলে। ক্যামেরার ক্লিক শব্দে তৌফিক মুখ ফেরায়। তন্ময় ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে, আমি আপনার একটি বিশেষ সময়কে ধরে রাখলাম। যখন অবসরে ছবিগুলো দেখবেন মনে করবেন এই সময়টা আপনার জীবনে ছিল।

তৌফিক হাসিমুখে মাথা নাড়ে। বলে, বসো বাবা। আমার ছেলে নেই। অনিমা আমার কাছে ছেলে-মেয়ে দুয়েরই আনন্দ। তোমার মধ্যে আমি ছেলের ভালোবাসা পাচ্ছি। মনে হয় পরজনমে তুমি আমার ঘরেই জন্মাবে। জন্মাবে তো?

তন্ময় হাসতে হাসতে বলে, আপনার মতো বাবা পেলে আমি। নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করব।

তৌফিক চোখ মোছে। তন্ময় বোঝে জীবনের টানাপড়েন তাকে অনেক ভেতরে টেনে রাখে। অনেক কষ্ট, বেদনা এবং বিষাদের সমুদ্রের চারদিকে এই বুড়ো লোকটি একা একা কলার ভেলায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এক জীবনে তার সমুদ্র পাড়ি দেয়া সম্ভব হবে না। ড়ুবতে হবে এই বিষাদের সমুদ্রেই। তখন ও জিজ্ঞেস করে, আপনার জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল স্মৃতি কি?

সবচেয়ে উজ্জ্বল বা অনুজ্জ্বল বলে কোনো স্মৃতি নেই। স্মৃতি একটাই আছে।

মাত্র একটা?

হ্যাঁ, গৌরবের স্মৃতি একটা থাকলেই হয়।

আপনার গৌরবের স্মৃতির কথা আমি শুনতে চাই। বলবেন কি?

তোমাকে একা কেন, তোমার মতো হাজার ছেলেমেয়ের কাছে বলতে চাই। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা।

উত্তেজনায় তৌফিক দাঁড়িয়ে পড়ে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলে, তখন আমার বয়স ছিল আঠারো। তারপর দম নেয়। চেয়ারে বসে। সরাসরি তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বলে, জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলাম নয় নম্বর সেক্টরে। সে একটা দারুণ সময় ছিল আমার জীবনে। প্রতিদিন মৃত্যুর মুখখামুখি হয়েও মৃত্যুকে ভয় পাইনি। কী সাহস ছিল, কী শক্তি, কী উত্তেজনা। এখনো ভাবলে আমার শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করা যে-কোনো মানুষের পণ্যের কাজ তলায়।

তনায় অভিভূত কণ্ঠে বলে, আমার বয়সটা যদি তখন এমন থাকত তাহলে আমিও যুদ্ধ করতাম। কেন যে আমি যুদ্ধের সময়টা মিস করলাম! নিজের জন্মের ওপর এজন্য আমার রাগ হচ্ছে। সঠিক সময়ে সঠিক বয়স থাকা ভাগ্যের ব্যাপার। আমি আপনার মতো ভাগ্য পেলাম না।

হো-হো করে হাসে তৌফিক। বলে, তুমি যে আফসোস করলে সেজন্য আমার গর্ব আছে, বুঝতে পারছি আমাদের ছেলেরা সংকট মোকাবেলার জন্য তৈরি আছে।

এ সময় ফোন এলে তৌফিক ব্যস্ত হয়ে যায়। তন্ময় দেখতে পায় অনিমা দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়ায়। ওকে দেখে তন্ময় বেরিয়ে আসে। অনিমা মৃদু স্বরে বলে, বাবাকে হাসতে দেখে আমি ভাবলাম কী ব্যাপার ঘটল! বাবা হাসছে কেন, মা মারা যাওয়ার পরে গত দু’বছরে বাবা এমন প্রাণখুলে হাসেনি। বাবা যে কত প্রাণবন্ত একজন মানুষ ছিলেন!

দুজনে হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনের অপর প্রান্তে এসে বেঞ্চের ওপর বসে। টেলিফোন ছেড়ে তন্ময়কে না দেখে তৌফিক অকস্মাৎ শূন্যতা বোধ করে। ছেলেটির সঙ্গে কথা বলতে ভালোই লাগছিল। গেল কোথায় ও? দরজায় দাঁড়াতেই দেখতে পায় ওরা দুজনে তন্ময় হয়ে গল্প করছে। মেয়ের কথা ভেবে তৌফিকের বুক ভরে যায়। মৃদু হাসি নিয়ে ফিরে এসে চেয়ারে বসে।

 

তন্ময় এবং অনিমার সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। খুব গভীরভাবে দুজনে দুজনকে বুঝেছে তা নয়, তারপরেও ভালো লাগার প্রচ্ছন্ন আবেশ দুজনের মুগ্ধতাকে প্রগাঢ় করে। দুজনে হাত ধরে রেললাইনের ওপর দিয়ে হেঁটে যায়। তন্ময় বলে, বেশ সুন্দর এ জায়গাটা। তবে দুঃখ

একটাই।

অনিমা অবাক হয়ে বলে, কী?

অনিমা বুঝতে পারে তন্ময়ের মুখে দুষ্টুমির হাসি। ও একটা কিছু বলে মজা করবে। তন্ময় একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, ধারেকাছে নদী নেই। তবে—

এস অনিমা পরেরটুকু শোনার জন্য অপেক্ষা করে। কিন্তু তন্ময় থেমে যায়। অনিমার কাছ থেকে শুনতে চায় প্রতিধ্বনি। অনিমা নিজেও মৃদু হাসির সঙ্গে বলে, তবে? তবে কি নদীর বিকল্প অন্য কিছু?

হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই। সে নদীর নাম অনিমা। নদীর মতো মেয়ে।

তাই! বেশ সুন্দর উপমা। প্রকাশটা দারুণ হয়েছে। দুজনে হাসে। হাসতে হাসতে বলে, কয়টা মেয়ের সঙ্গে তোমার পরিচয় আছে?

পরিচয় অনেকের সঙ্গে আছে। তবে কারো সঙ্গে প্রেম নেই। ঘুরে বেড়ানোর এই নেশা আমাকে সুস্থির রাখে না। তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছে অনিমা। আমি তোমাকে ভালোবাসি।

অনিমার দৃষ্টি বিষণ্ণ হয়ে যায়। তন্ময় ওর জীবনে থাকবে তো? না–ও আর ভাবতে চায় না। অন্যদিকে তাকায়। তনায় খানিকটা দমে গিয়ে বলে, অনিমা, আমি কি–।

অনিমা বাম হাত দিয়ে তন্ময়ের মুখ চেপে ধরে ডান হাতটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ধরো।

তন্ময় দুহাতে অনিমার হাত ধরে বলে, তুমি একবার বলো, ভালোবাসি।

অনিমা প্রবল উচ্ছ্বাসে ভালোবাসি বলে, গানের সুরে বলে এবং বলাটাকে আকাশ-প্রকৃতির পটভূমিতে বাঅয় করে তোলে।

আবেগ থিতিয়ে এলে তন্ময় স্টেশনে সিগনাল স্ট্যান্ডের ওপর লেখার প্যাড রেখে মাকে চিঠি লেখে।

 

সাবিহার বাড়িতে তখন মধ্যদুপুর। ডাকপিয়ন চিঠি দিয়ে গেছে। চিঠির খাম দেখেই বোঝা যায় যে কোনটা তন্ময়ের চিঠি। মায়ের জন্য ও বিশেষ খাম এবং প্যাড ব্যবহার করে। সেটা অন্য কোনো কাজে ব্যবহার হয় না। এটা সাবিহা বানু জানে এবং এই ভেবে স্বস্তি বোধ করে যে তার প্রতি ছেলেটা যত্নশীল এবং মায়ের জায়গাটুকু একদম আলাদা। সেখানে আর কারো প্রবেশ নেই। তন্ময় লিখেছে, মা, আমার সোনা মাগো, তুমি এবার জেনে খুশি হবে যে আমি অনিমা নামের একটি মেয়েকে ভালোবেসেছি। তুমি বলো যে তোমার ছেলের ঘরের টান নেই। তুমিই তো আমার সবচেয়ে বড় টান। তার সঙ্গে যুক্ত হবে আর একজন। হাঃহাঃহাঃ। তোমার ছেলে সূর্যরথী তন্ময়।

সাবিহার মনে হয় এতদিনে তন্ময় একটি অন্যরকম চিঠি লিখেছে। ও এবার ঘরমুখো হবে। এই খুশিতে সাবিহা বানুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তাহেরা বেগম সাবিহার মুখ দেখেই বুঝতে পারে যে ঠিকই ছেলের চিঠি পড়ছে। এতে কোনো দ্বিধা নেই। তারপরও জিজ্ঞেস করে, কী হইছে আম্মা?

আমার ছেলে এবার সংসারী হবে, আমার ঘরে বৌমা আসবে। তারপর নাতিপুতি। আমার ঘরে মানুষ বাড়তে থাকবে তাহেরা। ভাবতেই আমার হাতে চাঁদ এসে ঢুকেছে এমন মনে হচ্ছে।

আপনের অ্যাত্ত বড় বাড়ি–কেমুন মাইয়া জানি আনে আপনের পোলায়–

এসব নিয়ে আমি ভাবি না তাহেরা–আমার ছেলে যাকে ভালোবাসবে সে আমারও ভালোবাসার মেয়ে হবে। আমার ছেলের খুশি আমারও খুশি।

তাহেরা বিস্ময়ে একটুখানি তাকিয়ে থেকে বলে, আল্লাহ আপনার মেলা ধৈয্য দিছে আম্মা।

সাবিহা নিজেকে শুনিয়ে বলে, কেউ জানবে না ও যে আমার জীবনের কত বড় সম্পদ। তন্ময়ও বোঝে আমি ওর জীবনের কতটা জায়গা নিয়ে আছি।

সাবিহা উঠে ঘরের কোনায় রাখা তন্ময়ের ছবিটা হাতে নিয়ে দেখে। চিঠির বাক্সটা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে দেয়। ঘরের অন্যান্য জিনিসগুলো ডাস্টার দিয়ে ঝেড়েমুছে রাখার সময় শুনতে পায় তাহেরা বিড়বিড় করছে, আল্লাহ আমারে ক্যান পোলাপান দিল না। আমি ক্যান একড়া মাইয়াপোলা পাইলাম না। পরক্ষণে চিৎকার করে ডাকে, আম্মা!

সাবিহা ওর বিড়বিড় শুনতে পাচ্ছিল, ডাক শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। রেগে গিয়ে বলে, কী হয়েছে তাহেরা?

আমি আর আপনের এইহানে থাকুম না। দ্যাশে যামু। আমার টাকা-পয়সা দিয়া দ্যান। আমার ভালো লাগতাছে না। আপনেরে দেইখলে আমার বুক পুইড়া যায়। এই বাড়িতে থাইকলে আমি পাগল হইয়া যামু।

এসব কী বলছ তুমি? আমি কি তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি?

এত কথা কইয়েন না আম্মা। আমার টেকা দিবেন কি-না কন।

কেন দেব না। তোমার টাকা তুমি পাবে। আমার ছেলে তোমাকে। এনেছে। আমি তোমাকে একটু বেশি টাকাই দেব। কিছু ভেব না। যখন বলবে তখনই দেব।

দিবেন না ক্যান, একশ বার দিবেন। আমার পোলা থাকলে ওহ আল্লাহরে আমি ক্যান আপনের মতো ভাইগ্য পাইলাম না–

ও দরজার সামনে ঘুরপাক খেতে থাকে রান্নাঘরের দিকে যায়, আবার ফিরে আসে, সাবিহর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে গিয়ে গড়িয়ে পড়ে। সাবিহা বানু ওকে হাত ধরে উঠিয়ে বলে, আমি তোমাকে একজন ডাক্তারের কাছে পাঠাতে চাই তাহেরা।

ক্যান, ডাক্তারের কাছে পাঠাঁইবেন ক্যান। আমার টাকাগুলো মাইরা খাইতে চান? হইব না, হইব না, টাকা নিয়া আমি ওই মাইয়াডারে দিমু–মাইয়াডা আমার সতীন হইলে কী হইবে, আমারে মান্য করে–টাকা দিলে ও আমারে দুই মুঠা ভাত দিব–ও আবার ঘরের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে, অস্বাভাবিক আচরণ করে–লাফায়, দাঁড়ায়, অদৃশ্য কাউকে ঘুষি দেখায় আর বলতে থাকে, ভাত খামু, মাছ খামু, নাকে ত্যাল দিয়া ঘুমামু–ওই বেডার গায়ে থুতু দিমু।

সাবিহা মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে। তাহেরার সঙ্গে কথা বলে। ওকে ওর মতো থাকতে দেয়। ভাবে এই মুহূর্তে তন্ময় বাড়ি এলে ও তাহেরাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে পাঠাবে কি-না, নাকি ওকে অন্য কিছু করা হবে তা জানতে পারব। তাহেরার পরিবারের সিদ্ধান্ত ছাড়া ওর কি কিছু করা উচিত? সিদ্ধান্ত কি একতরফা নেবে ও? সাবিহা ভাবনায় পড়ে।

তন্ময় তখন অনিমার সঙ্গে গাঁয়ের মেঠোপথে হেঁটে যায়। ধানক্ষেতের আল দিয়ে হাঁটতে ওর ভালো লাগে। আলের ধারে শামুকের ডিম দেখা যায়, বাইত্যা ইঁদুরের গর্ত দেখে ইঁদুরের লেজ নড়তে দেখার জন্য মুখোমুখি উবু হয়ে বসতে পারে, ঘাসফড়িং ধরার জন্য ছেলেমানুষি আচরণ করা যায়, আর বুনো ফুল ছিড়ে তন্ময় বলতে পারে, ফুলটা তোমার চুলে রাখো। অনিমা খিলখিলিয়ে হেসে বলতে পারে, আমার চুল কি ফুলদানি? তন্ময়ের উচ্ছ্বাস, তার চেয়েও বেশি। এমন প্রাকৃতিক ফুলদানি তো ফুলের প্রকৃত জায়গা। অনিমার অনুরাগ-মিশ্রিত হাসি তন্ময়কে মুগ্ধ করে দেয়। দুজনেই ভাবে, কী দারুণ সময় কাটানো। এমন সময় যেন জীবনভর থাকে।

আজো দুজনে ধানক্ষেতের আলের ধারে বসে গল্প করে। সামনে সোনালি ধান নুয়ে পড়েছে–দু-একদিনের মধ্যে কৃষকরা কাটবে। তন্ময়ের মনে পড়ে একদিন এই সোনালি ধানের শীষ দেখে একটি শহরের বাচ্চা মাকে বলেছিল, মা দেখো দেখো কী সুন্দর ফুল! সেদিন ওর মনে হয়েছিল মেয়েটির ফুল দেখার চোখ আছে। এ চোখ আছে অনিমারও। ও অনিমার হাত ধরে বলে, তোমার মা নেই, আমার বাবা নেই। বেশ মিল না! দুজনের বন্ধনটা গাঢ় হবে। আমরা পরস্পরকে ছেড়ে থাকব না।

পরস্পরকে ছেড়ে থাকব না! ঠিক বলেছে, জীবনের মিল দিয়ে আমরা জীবনভরের মিল বানাব। আমাদের একটু মিলের কথা বললে। আরো বাকি। আর একটু জানতে চাই। বলো আর কী মিল খুঁজতে চাও।

আমার মা পাঁচটি মৃত সন্তানের জন্ম দেন। আমি বাবা-মায়ের একমাত্র জীবিত সন্তান। তোমার ভাইবোন নেই?

তন্ময় উদাস কণ্ঠে বলে, জানি না।

অনিমা অবাক হয়, মানে? ভাইবোন আছে কি নেই তা তুমি জানো না? আশ্চর্য!

তন্ময় খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে, আমার একটি গল্প আছে অনিমা।

গল্প! অনিমা বিস্মিত হতেও ভুলে যায়। হাঁ করে তন্ময়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

তন্ময় একটি ধানের ছড়া ছিড়ে নিজের গলায় বোলাতে বোলাতে বলে, বর্তমানে যিনি আমার মা, আমি তার পালিত সন্তান। আমার জন্মের পরপরই আমার গরিব মা আমাকে তাঁর কাছে বিক্রি করে দেন। তিনি আমাকে তাঁর প্রাণের সবটুকু দিয়ে বড় করেছেন।

অনিমা অস্ফুট আর্তনাদ করলে তন্ময় মুখ ফিরিয়ে বলে, ভয় পেলে? নাকি ঘেন্না?

অনিমা জোরের সঙ্গেই বলে, ছিঃ ঘেন্না কিসের!

তন্ময় হো-হো করে হাসে। জায়গাটা খোলা প্রান্তর না হলে তোমার ভয় বা ঘেন্না উড়িয়ে দিতে আমার এক সেকেন্ড লাগত।

কীভাবে?

মাত্র একটি চুমু, গভীর এবং লম্বা চুমু।

ধ্যাৎ, কেবল বাজে মতলব।

বাজে? সত্যি বাজে, আবার বলো।

ওই প্রসঙ্গ আর নয়। তোমার বাবা কি মারা গেছেন?

আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে তিনি মারা যান।

তোমার নিজের বাবা-মায়ের ঠিকানা নেই?

একটা ঠিকানা আছে আমার মায়ের কাছে। আমি সেখানে খুঁজতে গিয়েছিলাম। কাউকে পাইনি। ভাসমান মানুষদের স্থায়ী ঠিকানা থাকে না অনিমা।

তোমার কি খুব কষ্ট?

কষ্ট? হ্যাঁ, কষ্ট তো থাকবেই। তবে আমি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করি।

তুমি কী করে জানলে বিষয়টি?

আমার আট বছরের জন্মদিনের উৎসব শেষে মা আমাকে নিয়ে ছাদে গেলেন। রাতে ঘুমুতে যাবার আগে মা বললেন, তোমাকে একটি গল্প বলব সোনা।

আমি খুশি হয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরিয়ে বলেছিলাম, হ্যাঁ, আমি গল্প শুনব।

মা আমাকে একটি খুব পুরনো গল্প বললেন। সাদামাটা গল্প। আমার জন্মের আগেই আমার বাবা মাকে ফেলে চলে যায়। আমাকে লালন-পালন করার সাধ্য মায়ের ছিল না। আর আমার বর্তমান মায়ের সন্তান হওয়ার আশা ছিল না। শুনেছিলাম সমস্যা ছিল আমার বাবার।

অনিমা তন্ময়ের সাদামাটা গল্পটি শুনে জিজ্ঞেস করে, গল্পটি শুনে। তুমি কেঁদেছিলে?

আমার স্পষ্ট মনে আছে যে আমি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলাম, তুমিই আমার মা। আমার আর কোনো মা নেই। তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই।

তারপর? গল্পটা খুব সাদামাটা নয় তন্ময়।

আমার চেয়ে সেটা আর কে বেশি বোঝে! মায়ের অভাব আমি বুঝিনি। বুঝেছি মায়ের ভালোবাসার স্বাধীনতা। এই জীবনে আমার অনেক পাওয়া হয়েছে।

তন্ময় একটি উড়ে যাওয়া পাখির ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা তাক করে। অনিমা আঙুল তুলে পাখি দেখাতে দেখাতে বলে, উড়ে যাওয়া পাখি দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। পাখির সারি হলে তো সেটা দারুণ দৃশ্য।

তন্ময় মুখ ফিরিয়ে বলে, আমার জীবনের গল্পে তুমি কতটুকু আহত হয়েছ?

আহত? আহত হবো কেন?

এই যে পরিচয়হীন একটি ছেলে!

তোমার পরিচয় তো তুমি নিজে তন্ময়।

আমি যদি তোমার জীবনে উড়ে যাওয়া পাখি হই?

তোমার জীবনে যেমন আমি নদী।

তন্ময় হেসে বলে, পাখি কিন্তু নীড়ে ফেরে। নদী শুধুই বয়ে যায়।

নদীরও যাওয়ার জায়গা আছে। নদী সাগরে গিয়ে মেশে। মনে করে সেটাই তার ঘর।

তন্ময় নতি স্বীকার করে বলে, নাহু, তোমার সঙ্গে কথায় পারা গেল না!

দুজনে রেললাইনের পথ ধরে বাড়ি ফেরে। অন্যদিক থেকে দুটি কিশোরী মেয়ে শাপলা নিয়ে হেঁটে আসছে। তন্ময় অনিমার হাত টেনে ধরে বলে, দেখো কী সুন্দর লাগছে ওদের।

সুন্দর! এটা আমার কাছে একটা সাদামাটা দৃশ্য। ছোটবেলা থেকে বাবার সঙ্গে বিভিন্ন স্টেশনে ঘুরে অনেক গায়ে এমন দৃশ্য দেখেছি আমি। নতুন না।

তন্ময় ক্যামেরা খুলতে খুলতে বলে, দাঁড়াও ওদের ছবি তুলি। মেয়ে দুটি কাছে এলে বলে, এই যে শোনো, তোমরা একটু দাঁড়াও। তোমাদের একটা ছবি তুলি।

ছবি! ছবি ক্যান তুলবেন?

আমাগোরে একড়া ছবি দিবেন?

অনিমা ওদের পরিচয় দিয়ে বলে, এরা দুই বোন। এর নাম কলি, ওর নাম তুলি। তোদেরকে অবশ্যই ছবি দেয়া হবে। এই এখানে দাঁড়া।

আপা, ভাইজানে ছবি না দিলে আমরা কিন্তু আপনেরে ধরুম।

আচ্ছা ধরিস। ও পালালে আমি ঠিকই ওকে ধরব।

দুজনে দাঁড়ালে তন্ময় ছবি তোলে। মেয়েরা চলে যায়। তন্ময়ের ডিজিটাল ক্যামেরায় ওরা উদ্ভাসিত হয়ে আছে, কৈশোরের লাবণ্যে ওরা আশ্চর্য মধুর। তন্ময় অনিমাকে দেখিয়ে বলে, দেখো অনিমা, কী সুন্দর ছবি! মেয়ে দুটোর নিস্পাপ সরলতা–

থামো তন্ময়। এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে ছবি সব সময় সত্য প্রকাশ করে না।

বুঝিয়ে বলো, কেন তোমার এ কথা মনে হলো।

কারণ ওই মেয়ে দুটোর পরিবার এতই গরিব যে, আজ দুপুরে নাকি ওদের মা ওদের ভাত দিতে পারবে না। দেবে এই শাপলা সেদ্ধ। মেয়ে দুটো সে শাপলা কুড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

তোমার কথার আরো ব্যাখ্যা আছে আমার। মেয়ে দুটোর আকার, পোশাক, স্বাস্থ্যহীনতা এবং শাপলার বোঝা বলে দেয় সমাজে তার অবস্থান কী। সে ভাত খাবে না শুধু শাক খাবে, একজন অর্থনীতিবিদ বা রাজনীতিবিদকে তা বুঝতে হবে। যদি তিনি এমন একটি গ্রামের কথা নাও জানেন তবু এই ছবি কিন্তু সত্যই প্রকাশ করছে অনিমা। আর ওদের ওই স্নিগ্ধ নিস্পাপ সরলতা আমাদের জীবনে সত্য। আমরা এটা ধরে রাখতে চাই। একজন অর্থনীতিবিদ বা রাজনীতিবিদকে এই হাসি ধরে রাখার অঙ্গীকারে কাজ করতে হবে। এই সত্যি কি জীবনের সত্যি নয়?

বাব্বা, খুব সুন্দর বুঝিয়েছ, কেন যে তুমি শিক্ষকতা করলে না!

দুজনে রেললাইন পেরিয়ে প্লাটফর্মে ওঠে।

 

তৌফিক অফিসের কাজে ব্যস্ত। টেলিফোনে জংশন স্টেশনে কথা বলে ফোন রেখে দিয়ে ড্রয়ার থেকে অনিমার মায়ের একটি ছবি বের করে। ছবির দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে, তোমার মেয়ে একটি ছেলেকে পছন্দ করেছে। ছেলেটিকে আমারও খুব পছন্দ হয়েছে। ওর বিয়ে দিতে পারলে আমার শান্তি হয়। ওকে একা রেখে আমি তো মরতে পারব না।

নিজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে চোখের জল মোছে। দিন যত যাচ্ছে, বয়স যত বেড়েছে, মানসিক স্বস্তি ততই কমছে। তৌফিকের মনে হয়, এখনই মেয়েটার বিয়ে দেয়া উচিত। ওর জীবনও তো স্থির হতে হবে–মানুষের জীবনচক্রের স্থিরতা।

তখন ব্যস্ত হয়ে ঘরে ঢোকে মাসুম।

স্যার।

কী হয়েছে রে?

সিগনালটা ডাউন হচ্ছে না স্যার। বোধহয় কোনো সমস্যা হয়েছে।

আমি জংশন স্টেশনে ফোন করে দিচ্ছি। বিকেলের আগে তো কোনো ট্রেন আসবে না। ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

মাসুম স্টেশন মাস্টারের ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পরে তন্ময়ের মুখোমুখি হয়। তন্ময়ের মনে হয় ও কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত। ও আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, কেমন আছ মাসুম?

মন খুব খারাপ তন্ময় ভাই।

গাঁয়ের একজন চাচি শহরে গিয়েছিল কাজ করতে। পাগল হয়ে ফিরে এসেছে।

পাগল হয়ে?

যাবেন দেখতে? আমি ওই বাড়িতে যাচ্ছি। মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে।

আমিও যাব তোমার সঙ্গে।

যেতে যেতে মাসুম তার চাচির অনেক গল্প বলে, কিন্তু সেই চাচি যে তাহেরা এটা তন্ময়ের জানা ছিল না। বাড়িতে ঢুকে তাহেরাকে দেখে ও স্তম্ভিত হয়ে যায়। তাহেরাকে বারান্দার খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। আলুথালু চেহারা। দৃষ্টিতে অসীম শূন্যতা সামনে এক থালা ভাত। ও মাসুমকে জিজ্ঞেস করে, উনি কবে শহর থেকে ফিরেছে মাসুম?

সাত দিন হলো। তাকে স্টেশনে দেখে আমি তো অবাক। তারপর বাড়িতে নিয়ে আসি। কীভাবে যে ঢাকা থেকে এসেছে আল্লাহই জানে।

ওদের গলা পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ফজর আলি ও হনুফা। ফজর আলি ওদের দেখে বিরক্ত হয়ে বলে, আপনারা?

তন্ময় ফজর আলির বিরক্তি টের পায়। তারপরও সহজ কণ্ঠে বলে, ওনাকে দেখতে এসেছি। উনি শহরে আমার মায়ের বাড়িতে ছিলেন।

হনুফা খুশি হয়ে বলে, আপনের মা খুব ভালো মানুষ। বুজানরে মেলা টেকা দিছে। বুজান সব টেকা আমারে দিছে। আপনার মা একটা চিঠিতে লিখছেন যে, আপনাদের বাড়ির দারোয়ান ওনাকে ট্রেনে তুলে দিয়েছে। ওনার গলায় একটা কাগজ লাগায়ে দিয়ে লিখে দিয়েছিলেন, ওনাকে য্যান ফুলমসি স্টেশনে নামায়ে দেওয়া হয়। আহা রে কত দরদ!

তন্ময় রাগত স্বরে বলে, ওনাকে বেঁধে রেখেছেন কেন?

ফজর আলি বিরক্ত কণ্ঠে বলে, খুব পাগলামি করে। বাড়ি ছাইড়া চইলা যায়।

হনুফা তড়িঘড়ি বলে, ওনারে মারতে যায়। একদিন দা নিয়া তাড়া করছিল। ক্যাবল আমারে কিছু কয় না। দিন দিন ক্যাবল পাগলামি বাড়তাছে। একদিন আমারেও মারতে আসবে।

ফজর আলি রেগে উঠে বলে, হইছে থাম। মাগির বেশি কথা। য্যান মায়ের প্যাডের বইন পাইছে একড়া। আপনেরা অহন যান। দেখলেন তো, আর কত দেখবেন।

তন্ময়ও রেগে বলে, রেগে যাচ্ছেন কেন? উনি আমার মায়ের যত্ন করেছেন। ওনার জন্য আমার দরদ আছে। আমি ওনার একটা ছবি তুলব।

তাহেরা কী বুঝল কে জানে? তন্ময়ের ক্যামেরা দেখে হি-হি করে হাসতে হাসতে ছবি তোলার জন্য পোজ দেয়। তন্ময় অনেকগুলো ছবি তোলে। ওর হঠাৎ মনে পড়ে যে ও আগে তাহেরার একটি ছবি তুলেছিল। ও ব্যাগ খুঁজে ছবিটা বের করে তাহেরার দিকে এগিয়ে দেয়। বলে, খালা আপনার মনে আছে কি যে আমি আপনার ছবি তুলেছিলাম? আপনি বলেছিলেন আপনাকে এক কপি দিতে। এই যে দেখেন, কী সুন্দর ছবি।

তাহেরা খপ করে ছবি নেয়। বেশ কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে। তারপর টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ছুঁড়ে ফেলে। মাসুম টুকরোগুলো কুড়িয়ে নিয়ে বলে, চাচি এইগুলা জোড়া লাগাইয়া আপনেরে দিমু। আমাগো বেবাকেরই তো জোড়া লাগানো বাঁইচা থাকা।

মাসুমের কথাগুলো তন্ময়ের বুকের ভেতর ধাক্কা দেয়। ও নিজের দিকে ফিরে দেখতে গেলে সামনের দৃশ্যটা উলটেপালটে যায়। তারপর বিষণ্ণ হয়ে যায় ওর দৃষ্টি। ও তো জানে নিজেকে আড়ালে রেখে হেঁটে যাওয়া কত কষ্টের। তবু সত্যটা বুকের ভেতর খলবলিয়ে উঠলে ও জীবন খোঁজে, বেঁচে থাকার অর্থ খোঁজে এবং অর্থবহ জীবনের দরজায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে তোলে। পরিস্থিতি সামলে নিয়ে ফজর আলি ও হনুফার দিকে তাকিয়ে বলে, আপনাদের একটা ছবি তুলি?

হনুফা মহাউৎসাহে সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে, হ-হ তোলেন। তাহেরার পাগলামি পেছনে রেখে ফজর আলি ও হনুফার ছবি তোলে তন্ময়। তাহেরা তখন দু’হাতে চুল টানছে। চুল ছেড়ার চেষ্টা করছে এবং নিজেকে বেঁধে রাখার অবস্থান থেকে মুক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টায় শরীর মোচড়াতে থাকে।

 

তন্ময়ের মনে হয় অনেক দিন হলো এখানে। এবার মায়ের কাছে। যেতে হবে। মাকে অনিমার কথা বলতে হবে। বিয়ের আয়োজন করতে হবে। অনিমাকেও সে কথাই বলে।

আমার মাকে তোমার কথা বলার জন্য ঢাকায় যেতে হবে অনিমা। মা ভীষণ খুশি হবেন। তারপর আমি আবার ফিরে আসব।

কবে আসবে?

যত দিন না আসি তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করবে অনিমা।

অপেক্ষা! অনিমার জ কুঁচকে চায়–বিষণ্ণ হয়ে যায় দৃষ্টি।

এই শব্দটা কি তোমার কোনো দুঃখের কারণ?

অনিমা মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ। আসবে বলে ফিরে আসেনি। দুর্ঘটনায়–

থাক, আর জানতে চাই না। আমি ঠিকই ফেরত আসব অনিমা। দাও, তোমার হাত ধরি। দেরি হলে ভেব আমার ঘুরে বেড়ানো স্বভাবের কারণে দূরে কোথাও চলে গেছি কিংবা মায়ের কোনো কাজে যদি আটকে যাই তাহলে দেরি হতে পারে। কিন্তু ফিরব, তোমার কাছে আমাকে ফিরতেই হবে।

শুধু জেনো যত দিন না আসসা, তত দিন ট্রেন এলেই আমি প্লাটফর্মে এসে দাঁড়িয়ে থাকব তোমার জন্য।

থেকো। ফিরে এসে অন্য কাউকে দেখার আগে আমি তোমাকেই দেখতে চাই।

চলে যায় তন্ময়।

 

অনিমার দিনগুলো আবার আগের মতো হয়ে যায়। ঘর-স্কুল-স্টেশন–একই মানুষ চারদিকে। একদিন বাবাকে তন্ময়ের জন্মের কথা বলতেই ক্রোধে ফেটে পড়ে তৌফিক। ঘরময় পায়চারি করে। অনিমা চুপ করে বসে থাকে। ওর মাথা কাজ করে না। বাবাকে তো গোপন করার কিছু নেই। বাবাকে বলতেই হতো। কিন্তু ওর ভাবনা ওলটপালট করে দিয়েছে ওর বাবা। যে ছেলেটিকে কয়েক দিন ধরে তিনি এত কাছ থেকে দেখলেন, পছন্দ করলেন, এখন তার জন্মের পরিচয় বড় হয়ে গেল তার কাছে? অনিমার বুক ভেঙে যায়। রাগারাগি করে এক পর্যায়ে তৌফিক ঘোষণা দেয়, তোমার সঙ্গে তন্ময়ের বিয়ে আমি কিছুতেই মেনে নেব না। যে ছেলের জন্মের ঠিক নেই তার সঙ্গে বিয়ে!

বাবা জন্মের ঠিক নেই নয়, গরিবের ঘরে জন্মেছে।

ওই একই কথা হলো। অবৈধ সন্তান কি না তাইবা কে জানে!

বাবা, বাবা তুমি—

চুপ করো।

তোমার মতো এত খারাপ চিন্তা আমি করি না বাবা!

তৌফিক ধমক দিয়ে বাড়ি মাথায় তোলে, তোমার মা নেই বলে ভেব না আমি তোমার সব আবদার মেনে নেব। আমি অনেক দিন সহ্য করেছি। আর করব না। আমার চাচাতো ভাইয়ের ছেলেটি তোমাকে পছন্দ করে। আমার কাছে ধমক খেয়ে ও আর আসে না, কিন্তু সেদিনও ওর বাবা আমাকে ফোন করে বলেছে, তার ছেলেটি তোমার অপেক্ষায় আছে।

অপেক্ষা!

হ্যাঁ, অপেক্ষা, অপেক্ষা। ওর বাবা ওকে অন্য কোথাও বিয়ে দিতে পারছে না। ওর বাবা আমার সঙ্গে রাগারাগি করছে।

অন্য একজন রাগারাগি করলেই তুমি তোমার মেয়েকে বলি দেবে!

তৌফিক রেগে ঝাঁঝের সঙ্গে বলে, এটা বলি দেয়া হলো। একটি ছেলের ভালোবাসার মূল্য নেই তোমার কাছে? রাজিবের দুর্ঘটনার পরে আমি তোমাকে জোর করিনি। কিন্তু আমি আর একদিনও অপেক্ষা করব না। আমি সাদেক আলিকে বিয়ের কথা পাকা করার জন্য আসতে বলব। অনিমা অনুনয়ের স্বরে বলে, বাবা, আমার সোনা বাবা, তুমি আমাকে আর একটা বছর সময় দাও।

তৌফিক বিস্ময়ে চেঁচিয়ে ওঠে, এক বছর।

বাবা তোমাকে একা রেখে চলে যাওয়ার জন্য আমাকে তৈরি হওয়ার সময় দাও। বাবা আমার এই একটি কথা রাখো।

তৌফিক কেঁদে ফেলে। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলে, তুই যা চাস তার বাইরে তো আমি যেতে পারব না। তবে মনে রাখিস এক বছর। এর একদিনও বেশি চাইতে পারবি না।

 

দিন গড়ায়। তন্ময়ের কোনো খবর নেই। অনিমার দিনগুলো দাঁড়িয়ে থাকে। দিনগুলো ও ছাড়তে চায় না, ছেড়ে দিতে চাইলেই যে পাগলের মতো দৌড়াবে, সেজন্য ও দমবন্ধ করে দিনের গতি আটকে রাখে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *