০৪. সন্ধ্যার আগেই নিজের গ্রামে

সন্ধ্যার আগেই নিজের গ্রামে পৌঁছে যায় ও। আলীপুর বাজার থেকে তিন মাইলের পথ। আগের মতো হাঁটতে পারে না। বুকে হাঁফ ধরে। নইলে ও অনেক আগেই পৌঁছে যেত, তখনো হালকা আলো চারদিকে ছড়িয়ে। রাহানুম বাড়ির বাইরের রেন্ডি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে, কিছুটা বিষণ্ণ এবং উদাস। আবুল হাশেম ওকে দূরে থেকে চিনতে পারে না। ভাবে অন্য কোনো নারী। কাছাকাছি আসতেই রাহানুম চেঁচিয়ে ওঠে, ও বাবো।

কি অইছে?

আবুল হাশেম গাছের ছায়ায় এসে দাঁড়ায়, তখনো বুকের হাফ ছাড়েনি, শরীরে ঘাম, যেন গা পুড়ে যাচ্ছে এবং মনে গ্লানি। এতদিনে আবুল হাশেম বোঝে যে গ্লানি কাটিয়ে ওঠা কঠিন কাজ। বাবো সুখদীপ কুয়োকাটা গোনে চইল্যা গেছে।

কোম্মো?

ঢাকা।

ক্যামনে গেছে?

এক বেডা আর মাতারি আইলো বেড়াইতে। হেরা হেগো কামের মানু বানাইয়া লইয়া গেছে। সুখদীপ হেগো হামনে কান্দাকাটি করছে। কইছে মুই এতিম। মোরে আমনহেগো লগে লইয়া যান।

তোর ধারে কইয়া গেছে?

না। মোরে মনির আইয়া খবর কইছে।

মোগ কথা কিছু কয় নাই।

না। ঢাকায় যাইতে পাইরা ও খুব খুশি। কইছে আর কনুদিন ও ফিরা আইবে না।

সেয়ানা পোলা।

ও খুব দুখু পাইছে, না বাবো।

পাইছে মনে অয়।

হঠাৎ করে রাহানুম ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।

ও মোগ ভুইল্যা গেল ক্যামনে?

তখন আবুল হাশেম আজকের দিনের তৃতীয়বারের মতো আচমকা হাসি হেসে ওঠে। হা-হা হাসতেই থাকে। নিমেষে স্তব্ধ হয়ে যায় রাহানুমের কান্না, বিস্ফারিত চোখে শুকিয়ে থাকে আবুল হাশেমের দিকে। আবুল হাশেমের হাসি থামার পরও ও কেন হাসল এই প্রশ্ন করতে পারে না। আবুল হাশেম ঘরের দিকে পা বাড়াতে গিয়েও ফিরে। দাঁড়ায়। বলে, মোরাই তো ভুইল্যা গিয়া ওরে এতিম বানাইয়া দিলাম। হেইলে ও ভুলবে না ক্যা? ‘

কন দোষ কি মোগ?

ও যা হরছে ভালই হরছে। মোগ আর দুকুখ কি? মোরা তো ওরে তাড়াইতেই চাইলাম। ঠিক না মাগো?

রাহানুম আচমকা প্রশ্ন করে, বাবো আমনহে কি মোরেও তাড়াইতে চান?

মুই চামু ক্যা? তুমিতো যাইতে চাইল্যা মাগো? কতো সব পাকা অইছে।

বলতে বলতে আবুল হাশেম ঘরে চলে যায়। রাহানুম নড়তে পারে। আবুল হাশেম তো ঠিকই বলেছে। মিথ্যে নয়। তবু রূঢ় কথা শুনতে খারাপ লাগে। কোনো কিছু খারাপ লাগলে মাথাটা ঝিম মেরে যায়। তবু ও জোর করে শক্তি সঞ্চয় করে এবং সব ঝেটিয়ে নিজের হৃদয়ের দিকে তাকায়, সত্যিইতো ও তো চেয়েছিল সুখদীপের কাছ থেকে মুক্তি। সুখদীপ নিজের পথ বেছে নিয়ে চলে গেছে। ওকে বলে কয়ে বিদায় নেয়নি। তাতে কি এসে যায়? ও কেন এটা ভেবে আহত হচ্ছে? ছেলেটাকে আঘাত করার আগে ও তো সুখদীপ কতটা আঘাত পাবে তা একবারও ভাবেনি।

সন্ধ্যা হয়েছে। মাথার ওপরের গাছটায় পাখিগুলো তারস্বরে চেঁচামেচি করছে। ঘর তো আশ্রয়, তবে ওরা চেঁচায় কেন এমন? আনন্দেই? নিশ্চয়ই আনন্দের কলরব। এই ঘরের আকাঙ্ক্ষাইতো ওর মধ্যে দীপ্র হয়ে উঠেছে। ও আরো কিছুক্ষণ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থেকে করব শোনে, নিজের হৃদয় মেলে দেয়, ভরুক, এই শব্দে ভরে যাক ওর হৃদয়, যেন নিতে না হয় অনেক দূরের পাড়ি, আর কোনো অপেক্ষা নয়। রাহানুম দু’পা এগিয়ে আবার ফিরে আসে।

অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে, আকাশে মেঘ এবং চাঁদ, পূর্ণিমার শেষ। সামনের ধানক্ষেত, মেঠো রাস্তা, দূরের বাড়ি সবটাই জবেদ আলীর বুক। এবং পিঠের মতো। মনে হয় ওই রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে একজন মানুষ, তেল চপচপে চুলগুলো উল্টিয়ে আঁচড়ানো, সিথি নেই। গায়ে নীল রঙের জামা, পরনে সবুজ লুঙ্গি, লোকটার বুকে পাখিদের কলরব। রাহানুম দেখতে পায় কলরব বিস্তৃত হচ্ছে, প্রথমে ধানক্ষেতে। কলরবে ধানক্ষেতের মাথা কাঁপছে, কাপুনি মাদকতাময় শিহরণের জন্য, ওখানে লুকিয়ে আছে জবেদ আলী, এই অন্ধকারের মতো কালো শরীর, অনেকটা পোড়া কাঠের মতো। এরপর কলরব বিস্তৃত হয়ে মেঠো রাস্তায়, কলরবের তুমুল উদ্দামে মাটি চৌচির, গুঁড়িয়ে যায়, ধুলোতে ভরে যায়। পথ, লাল ধুলো ঢেকে ফেলে চারদিক, কোথাও কোনো মানুষ নেই, কিছুই দেখা যায় না, শুধু জবেদ আলী ভেসে থাকে ধুলোর ওপর, ওর সঙ্গে আকাশের মিতালী।

এরপর কলরব বিস্তৃত হয় গাছে, গাছের পাতার শিরা-উপশিরায় ধ্বনি, প্রবল ধ্বনি গর্জে ওঠে শাখায়, বাকলে, পত্রের রঙে, কোথাও কোনো নিঃশব্দ-নির্জন জায়গা নেই, ওই ধ্বনি একজনের কণ্ঠস্বর, সে মানুষ জবেদ আলী–একমাত্র মানুষ, যার কণ্ঠস্বর রাহালুমের অন্তর পর্যন্ত পৌঁছায়।

কলরব আরো বিস্তৃত হয় ঘরবাড়িতে, যে বাড়িগুলোতে মানুষেরা বসে আছে, প্রবল কলরব বুকে চেপে বসে আছে, ওরা অপেক্ষা করছে একটি আহ্বানের জন্য–সে আহ্বান জবেদ আলীর। ও ওদের ডেকে বলবে, আমি বউ নিয়ে এসেছি, তোমরা ওকে বরণ করো।

সঙ্গে সঙ্গে সব মানুষের হৃদয়ের অর্গল খুলে যাবে, ওরা গান গেয়ে উঠবে, নতুন কুলোয় ধান-দুর্বো, সুপোরি রেখে ওকে বরণ করবে।

গুরুজনের আশীর্বাদে ভরে যাবে ওর সৌভাগ্য। দুকান ভরে কলরব শুনতে শুনতে নিমগ্ন হয়ে যায় রাহানুম।

আবুল হাশেম বারান্দা থেকে তীক্ষঋরে ওকে ডাকে, ও শুনতে পায় না। ওর কানে তো একটাই কণ্ঠস্বর, সেটা ভেঙে ভেঙে শত হয়–সমবেত কণ্ঠ ওর মঙ্গলধ্বনি উচ্চারণ করছে। রাহানুম এতক্ষণে নিজেই এক থেকে বহুর মধ্যে বিস্তৃত হয়। বিস্তার সাগরের মতো বাড়ে।

আবুল হাশেম দ্বিতীয়বার আরো উচ্চকণ্ঠে ওকে ডাকে। ও শুনতে পায় না। এখনতো অন্যকিছু শোনার সময় নয়, এখনো তো কারো আহ্বানে সাড়া দেবার সময় নয়। ও নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত।

তখন আবুল হাশেম দ্রুত পায়ে এসে ক্রোধে ফেটে পড়ে। রাহানুম কোথায় থাকতে পারে অন্ধকারে তা অনুমান করে নেয়। চিৎকারে কণ্ঠে আলো প্রস্ফুটিত হয়, সে আলোয় রাহানুম দেখতে পায় আবুল হাশেমকে, সাদা ধবধবে চুল, দাড়ি, খালি গা, বুকের পশমও সাদা, সাদা লুঙ্গি পরে আছে, বাহাতুরে বুড়ো।

কতকুন ধইরা বোলাই কানে হোনো না?

ক্যা, বোলান ক্যা?

রাহানুম চড়াও হওয়ার চেষ্টা করে অনেকক্ষণ ধরে ডাকছে, সেটা মুখ্য নয়। একজন মানুষ আর একজনকে হাজারবার ডাকতে পারে। কিন্তু কেন ডাকবে? আবুল হাশেম কেম ওর নিজস্ব সময় নষ্ট করবে? ওরওতো কিছু ভাবনা থাকতে পারে, যেখানে ও কোনো গোলযোগ চায় না। ওরওতো কিছু একান্ত সময় দরকার, যেটা শুধু ওর একলার, আর কারো নয়, যেখানে ও কোনো ঝামেলা ঢুকতে দিতে চায় না। ও আবুল হাশেমকে উপেক্ষা করে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

আবুল হাশেম চেঁচিয়ে কড়া কণ্ঠে বলে, ঘরে ল। মায়ামানের আন্দারে গাছের তলায় থাহা ভালা না।

মোর গাছের তলায় থাকতে ভালা লাগে। কত পক্ষী বোলে।

ঘরে ল।

আবুল হাশেমের কণ্ঠে প্রচণ্ড ধমক, যেন রাহালুমের সামনে এক বিস্ফোরণ। ওর দাঁত কিড়মিড় করে ওঠে। কোনোদিন আবুল হাশেম ওর সঙ্গে এমন ধমক দিয়ে কথা বলেনি। পরক্ষণে মনে হয় ও নিজেও আবুল হাশেমের সঙ্গে এমন আচরণ করেনি। কত দ্রুত এবং কত অল্প সময়ে সংসারটা ওলটপালট হয়ে গেল। রাহানুম যে আচরণের সঙ্গে এতদিন পরিচিত ছিল না, আজ সে আচরণের শুরু। এখন ও ধমকের পরেও নড়ে না।

কি, গেলি না?

মুই যামু না। আমনহে যান।

আবুল হাশেমের রাগ পড়ে যায়, অসহায় বোধ করে। আবার ওর মধ্যে পরাজয়ের গ্লানি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আজ দুপুরে ও জবেদ আলীর বাপের কাছে পরাজিত হয়েছে। এখন রাহানুম। ভাবতেই ওর শরীর শিউরে ওঠে। নড়তে পারে না, অন্ধকারে ওর হাঁটু কাঁপে। কণ্ঠস্বর ভেঙে যায়, মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তে আবুল হাশেম এক বিপন্ন মানুষের কণ্ঠস্বরে বলে, মোর খিদা লাগছে মাগো?

এতক্ষণে রাহানুম নরম হয়। এই আবেদনের পর আর নিজেকে কঠিন রাখা সম্ভব নয়। ও নিজেও কোমল কণ্ঠে বলে, লন, ঘরে লন।

ও আবুল হাশেমকে পেছনে রেখে এগিয়ে যায়। গাছের নিচে রেখে আসে ওর ঘর-গেরস্তির স্বপ্ন। অজস্র জোনাকি সেই স্বপ্ন ঘিরে জ্বলতে থাকে। ঝিঁঝির ডাকও প্রবল হয়। আলো এবং ধ্বনি দিয়ে গড়ে ওঠে মানুষ। রাহানুম এখন তেমন মানুষ। ওর জীবনে জোনাকি এবং ঝিঁঝির ডাকও প্রবল হয়। আলো এবং ধ্বনির আবিষ্কার মানুষের জন্য, আলো এবং ধ্বনি দিয়ে গড়ে ওঠে মানুষ। রাহানুম এখন তেমন মানুষ। ওর জীবনে জোনাকি এবং ঝিঁঝি আলো ও ধ্বনি ছড়ায়। এবং এইসব অনুষঙ্গে জীবন ভরে উঠেছে বলেও শুধু পূর্ণিমা নয়, ঘোর অমাবস্যাও। চায়। অমাবস্যার অন্ধকারে হেঁটে যেতে ওর ভয় নেই।

কৃষ্ণপক্ষে ওর বিয়ে হয়। জবেদ আলীর বাপ চার-পাঁচজন লোক নিয়ে এসেছে। ছোট আয়োজন। নতুন শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট এনেছে। স্নাে, পাউডার, ফিতা-ক্লিপও দিয়েছে জবেদ আলী। আবুল হাশেম জবেদ আলীকে লুঙ্গি, গেঞ্জি, পাঞ্জাবি কিনে দিয়েছে। পুকুর থেকে বড়ো মাছ ওঠানো হয়েছে, মুরগি জবাই হয়েছে, পোলাও রান্না হয়েছে। রাহানুম ভোররাতে উঠে এসব রান্নার আয়োজন করেছে। বরপক্ষ আসার আগেই সব কাজ শেষ। পাশের বাড়ির করম আলীর বউ ওকে সাহায্য করেছে। এত কাজ তবু কোনো ক্লান্তি নেই ওর। বরং মনে হয়। অন্যদিনের চেয়ে তাড়াতাড়িই হয়েছে। সময় যেন উড়তে উড়তে চলে যাচ্ছে। সময়ের হাতে আজকের দিনটি একটি বড়ো লাল ঘুড়ি, নাটাইয়ে সুতো ছেড়ে দিয়েছে, সে সুতোর কোনো শেষ নেই।

কাজ শেষে পুকুর থেকে গোসল করে আসার পর ভীষণ সতেজ লাগে নিজেকে, মনে হয় দিনটি যদি লাল ঘুড়ি হয়, তবে নাটাইয়ের সুতো। এখন ওর হাতে। ও ইচ্ছে করলে যা খুশি তা করতে পারে। জবেদ আলীর পাঠানো নতুন কাপড়ের ভাঁজ খুললে সে গন্ধ ওকে মোহিত করে। সে শাড়ি পরার পর ওর আরো ঝকমকে অবস্থা। সোনালি জরির পাড়ের টকটকে লাল রঙের শাড়ি, সঙ্গে হলুদ রঙের ছিটের ব্লাউজ। বারবার আয়নায় মুখ দেখে ও। নিজের মুখই নিজের কাছে দারুণ মায়াময় মনে হয়। স্নাে মাখলে ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ে, কাজলে টানটান হয়ে যায় চোখ জোড়া। আহ কী সুন্দর, কী সুন্দর। অভিভূত হয় রাহানুম। কতকাল, ও ভুলে গেছে কতকাল আগে ও এমন করে সেজেছিল। ছোট আয়নায় নিজেকে বারবার দেখে ওর আশ মেটে না। মনে হয় ও কি নিজেই একটি লাল ঘুড়ি?

মৌলবি সাহেব এসেছে। বিয়ে পড়ানো হবে। রাহানুম চৌকির ওপর ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। বুকের ভেতর থরথর কাঁপুনি, কেমন অস্থির লাগে, কিছুই ভাবতে পারে না–শুধু বুকের ভেতর একটি শব্দ কবুল, কবুল। এছাড়া ওর কাছে আর কোনো ধ্বনি নেই, আর কোনো অনুভব নেই–মুছে যাচ্ছে পরিপার্শ্ব।

খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে দুপুর গড়িয়ে যায়। বিকেলে চলে যায় জবেদ আলীর বাপ ও অন্যরা। আজ রাতে আবুল হাশেমের বাড়িতে জবেদ আলী ও রাহানুমের বাসর। আগামীকাল ভোরে দুজনে চলে যাবে নতুন চরে।

অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে আবুল হাশেম। কিছুতেই ঘুম আসে না। ওরা ঘরের ঝপ বন্ধ করেছে অনেকক্ষণ। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। কুপিটা নিভিয়ে দিয়েছে ও। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বুকের ভেতর ভার-ভার লাগে। সাজানো গোছানো এই কয় বছরের জীবনে বেশ বড়ো পরিবর্তন হয়ে গেল। এই পরিবর্তনের ক্রান্তির সময়টুকু বুকে। বাজছে। আগামীকাল থেকে ও একা হয়ে যাবে, ওর পাশে কেউ থাকবে না। অমাবস্যা ওর ভালো লাগে না। তবু বসে রয়েছে ঘরের বাইরে, কী করবে, কোথায় যাবে? কোথায় স্থিতি? হঠাৎ হঠাৎ অনেক দূর থেকে রাতজাগা পাখির ডাক ভেসে আসে। মনে হয় দূর থেকে কেউ ডাকছে। কে? ডাকটা কি নিজের অন্তরের? ও মনেপ্রাণে তেমন কারো ডাক শুনতে চাইছে যে ওর নিজের ঔরসের কেউ, যার সঙ্গে ওর জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক। নতুন করে রাহানুম ওর বর্গাচাষীর বউ। এর বেশিকিছু তো নয়। হায় সম্পর্কের কি বিচিত্র বেড়াজাল! জবেদ আলী এ বাড়িতে আসার আগে ওরা কেউই ভাবেনি এমন একটা অদৃশ্য জলোচ্ছ্বাস প্রবল বেগে বয়ে যাবে ওদের ওপর দিয়ে। এখন থেকে রাহানুম ওর কাছের কেউ নয়। বর্গাচাষী স্বামীর মতো রাহানুম ওকে মহাজন বলবে কি?

আচমকা অন্ধকারে হা-হা করে হেসে ওঠে আবুল হাশেম। অন্ধকারে সে হাসি ধ্বনিতে-প্রতিধ্বনিত হয়। হাসির রেশ ফুরিয়ে গেলে ও একটা বিড়ি ধরায়। বিড়ির আগুন অন্ধকারে একবিন্দু আলো। নাকের ওপর দিয়ে তাকালে চোখ থেকে সে আলোর বিন্দুটি একটি সরলরেখা। আবুল হাশেম এক সময়ে সরলরেখা সরিয়ে দিয়ে একমুখ ধোয়া ছাড়ে। সেটি একটি গোলাকার বৃত্ত হয়। ও দেখতে পায় না। আগুনের সরলরেখা এবং ধোয়ার গোলাকার বৃত্ত নিয়ে ওর স্নায়ু শিথিল হতে থাকে–অর্থাৎ ঘুম পাচ্ছে।

পরদিন রাহানুম চলে গেল। যাবার সময় ভীষণ কান্নাকাটি করল। আবুল হাশেম ওকে নুতন জীবন দিয়েছে এমন কথা বলতে ভুলল না। সালাম করতে গিয়ে পায়ের কাছে বসে পড়েছিল ও। কান্নার দমকে অনেকক্ষণ উঠতে পারেনি। আবুল হাশেম ওর মাথায় হাত রেখে ভেবেছিল যেন নিজের মেয়ের বিদায় দিচ্ছে ও। মুহূর্তে কেমন অবশ লাগে ওর, এই আন্তরিকতাটুকু কি সত্য নয়? সেই থেকে নিজের ভেতরে খটকা থেকে গেছে। অনেক ভাবনাই মেলাতে পারছে না।

এখন শূন্য ঘরবাড়ি। আবুল হাশেম তার দূরসম্পর্কের খালাকে আনিয়েছে কিছুদিনের জন্য। অবশ্য বয়সে আবুল হাশেমের ছোট–নিঃসন্তান বিধবা। কিন্তু বাপের সংসারে তার প্রয়োজন ভীষণ, তাই বেশিদিন থাকতে পারবে না। চুপচাপ থাকে। সাত চড়ে মুখে রা নেই। বাড়িতে আছে কী নেই সেটাও ঝেঝা যায় না। মাঝে মাঝে মহিলার ওপর বিরক্ত হয় আবুল হাশেম। কিন্তু কিছু বলার উপায় নেই, বলা যায় না। আবুল হাশেম ঘরে বউ আনলে এই খালা চলে যাবে।

কেউ কেউ প্রস্তাব করেছিল এই নিঃসন্তান মহিলাকে তার সংসারে রেখে দেবার জন্য। যে কটা দিন বাঁচে সে কটা দিন নিরবিলি কাটিয়ে যাক। ভাইয়ের সংসারে বেচারাকে এই বয়সেও গাধার খাটুনি দিতে হয়। কিন্তু আবুল হাশেম ওদের প্রস্তাবে রাজি হয়নি। ঘরে বউ আনলে অন্য কাউকে এখানে রাখবে না ও। তাতে সংসারে অশান্তি। তাছাড়া অন্যের বোঝা টানার ইচ্ছেও ওর নেই। এখন ঝামেলামুক্ত জীবন চায়–চায় যৌবনের নিরিবিলি গৃহকোণ, যেখানে শুধুই দুজন, স্বপ্ন এবং খুনসুটির দিনরাত। আবুল হাশেম বাড়ির আঙিনা, চারপাশ ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার করার জন্য লোক ডাকে, নিজে দাঁড়িয়ে তদারক করে। কোথাও একফোঁটা ময়লা রাখতে চায় না। মুহূর্তে থমকে চায় ওর চিন্তা। তাহলে কি রাহানুম আর সুখদীপ ওর জীবনে আবর্জনা ছিল? যে ময়লা উড়ে গেছে বাতাসের ঝাঁটাতে? ওর চারদিক এখন সাফ-সুতরো–ময়লা নেই কোথাও? আহ না, এমন করে ভাবা উচিত নয়। বড়ো কঠিন ভাবনা–নির্মম ভাবনা। হৃদয় মানে না এমন ভাবনা। ওর কষ্ট হয়। আসলে রাহানুম আর সুখদীপ ওর সুখের স্মৃতি। হাজার হলেও ও মানুষতো–মানুষেরই তো উচিত মানুষকে নিয়ে ভাবনায় থাকা। এতো স্বার্থপর হচ্ছে কেন ও? কেন এতো তাড়াতাড়ি উড়িয়ে দিতে চায় সুখদীপ আর রাহানুমকে? নিজের আচরণের জন্য ওর খুব লজ্জা হয়। প্রচণ্ড গ্লানি অনুভবের কারণে ও মুষড়ে পড়ে। সাফ-সুতরো পরিষ্কার বাড়িঘরের দিকে তাকিয়ে ওর কান্নাই পায়।

দুদিন লাগে ওর নিজেকে শক্ত করে তুলতে। তৃতীয় দিন বিকেলে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে নূরবানুর ভাইয়ের কাছে যায়। প্রথমে বেশ অনেকক্ষণ জীবন-জগৎ সম্পর্কে নিজের ভাবনার কথা বলে, সে চিন্তায় বেশ খানিকটা দার্শনিক চিন্তার প্রতিফলন থাকে। নূরবানুর ভাই মুগ্ধ হয়েই। শোনে। একজন বুড়োকে কিছুটা সম্মান প্রদর্শনের জন্য ও ভেতরে ভেতরে উদ্বুদ্ধ হয়। আবুল হাশেমকে ওর ভালোই রাগে। পরক্ষণে আবুল হাশেমের জন্য ওর মায়া হয়–আহা বেচারা, পুরা সংসার হারিয়ে কেমন একা হয়ে গেছে। রাহালুমের বিয়ে এবং সুখদীপের চলে যাওয়ার খরবতো গায়ের সবাই জানে। আবুল হাশেম এখন একা একা কেমন করে থাকবে, ভাবতেই নূরবানুর ভাই দুরুদ অনুভব করে। মানুষ এভাবেই একজন আর একজনের কাছাকাছি চলে আসে। ভেতর থেকে পানসুপোরি আসে। আবুল হাশেম আয়েশ করে পান খায়, আঙুলের ডগায় চুন তুলে নেয়। পানের বোঁটা দিয়ে নাক চুলকায়। উসখুস করে নূরবানুর ভাই। বুঝতে পারে না একজন বুড়োকে আর কতক্ষণ সম্মান করতে হবে। দুজনে মিলে হাটের দিকে গেলে কেমন হয়? ও তখন ধীরে সুস্থে বলে, যেন কথাটা আবুল হাশেমকে স্মরণ করাচ্ছে এমন ভঙ্গি, আইজতে হাটবার, না? লন, হাটে যাই। মেলা সওদা করা লাগবে।

আবুল হাশেম চমকে তাকায়, সওদা? মোর সওদা লাগবে না।

মোর লাগবে।

আবুল হাশেম ওর ইঙ্গিত বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি বলে, তোমার লগে মোর এটটু কতা আছে গদু মাতবর।

কতা? কি কইবেন? কন।

আবুল হাশেম সরাসরি কিছু বলতে পারে না। অনেক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে নূরবানুকে বিয়ের কথা বলে। চমকে উঠে গম্ভীর হয়ে যায় নূরবানুর ভাই। আবুল হাশেম এমন একটা প্রস্তাব দিতে পারে তা ও ভাবতেই পারেনি।

নূরবানু ওর একমাত্র বোন। বছর দশেক আগে বিধবা হয়েছে। ছেলেমেয়ে নেই। ওর সংসারে থাকলে নূরবানুকে ও কখনো বোঝা মনে করেনি। বরং নূরবানু ওর সংসারের হাল ধরেছে বলে ওর বউ খানিকটা শান্তিতে আছে। ছেলেমেয়েগুলো তো সব ফুফু বলতে অজ্ঞান, ধানের মৌসুমে ওর স্ত্রীতো নুরবানু ছাড়া অচল। এসবের বাইরেও ওর সংসারে নূরবানুর এক গভীর মমতার স্থান আছে। তাছাড়া নুরবানুর বয়স নেহাৎ কম নয়, এ বয়সে বিয়ে দিলে লোকে কি বলবে?

নূরবানুর ভাই গদু মাতবর, গায়ের কেউকেটা নয়, তবে অবস্থা একদম খারাপও নয়, নিজের মান-সম্মানের ব্যাপারটি চিন্তায় রাখে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, আমনহে এইডা কি কইলেন?

ক্যা, খারাপ কত?

এই বয়সে কি আর বিয়া অয়?

অয় না ক্যা? বিয়া বইলেই অয়।

আবুল হাশেম মুচকি হাসে। বলে, আন্ধারমানিক নদীর মধ্যে মোর জায়গাগুলা জাইগ্যা উঠছে। মোর পোলা লাগে। জমির মালিক অইবে।

আমনেহ পাগল অইলেন?

পাগল হমু ক্যা? এইডাই সত্যি কতা। বংশ না থাকলে কী অয়? আমনহে আমনহের বইনেরে জিগাইয়া দেহেন। মুই আজ যাই। কাইল। আবার আমু।

গদু মাতবর হাঁ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কথা বলতে পারে না। আবুল হাশেম সেই মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে, যেন। বলতে চায় এ এক রাজ্যজয়ের খবর। এখন ওর বীরদর্পে হেঁটে যাবার সময়। ও গদ মাতবরের চোখে চোখ ফেলে ভরু উঁচ করে, যেন জিজ্ঞেস করতে চায় অমন করে তাকিয়ে আছ কেন? কিন্তু কথা বলে না, যেহেতু গদু মাতবরের মুখে রা নেই। তাই আবুল হাশেম কথা বলে ওর বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে চায় না। ওর সামনে দিয়ে বীরদর্পে হেঁটে যায়–এখন ওর অমন করে হাঁটার সময়–এখন ওর বয়সকে উপেক্ষা করার সময়–কারণ ওর সামনে নতুন বসতির স্বপ্ন। ও এক নতুন দ্বীপে এসে ঠেকেছে–সামনে অনেক কাজ। জঙ্গল কাটতে হবে, মাটি তৈরি করতে হবে, ক্ষেত বানাতে হবে–ফসল বুনতে হবে। খোলা দ্বীপের ওপর দিয়ে ছুটে আসে হা-হা বাতাস–বিশুদ্ধ স্নিগ্ধ বাতাস, বুকভরে টেনে নিয়ে ওর ভেতরটা সাফ-সুতরো হয়ে যায়। কষ্ট নেই, দুঃখ নেই, এখন কেবলই স্বপ্নের সুখ।

নূরবানুর ভাইকে বিয়ের কথা বলতে পেরে ও খুব হালকা বোধ করে। বীরদর্পে হাঁটলে কোথাও অকারণে দাঁড়ানো যায় না—এমন জায়গায় এসে থামতে হয় যেটা নিজস্ব সাম্রাজ্য, যে সাম্রাজ্য দিশপাশহীন। সেজন্য ও আর কোথাও না দাঁড়িয়ে সোজা সৈকতের চরে আসে। এটাইতো জায়গা, যেখানে নিজেকে খুলে ফেলা যায়। ওর এখন দরকার ওর নিজের মুখোমুখি হওয়া–আনন্দ, অপার আনন্দ চারদিকে থৈ-থৈ করছে। নতুন কোনো কিছুর শুরুতে মানুষের ভেতরে যেমন তীব্র উত্তেজনা থাকে আবুল হাশেমের মধ্যে এখন সেই উত্তেজনা। সৈকতে দাঁড়িয়ে ও একবার বনভূমির দিকে তাকায়, একবার সমুদ্রের দিকে। সমুদ্র ওকে প্রেরণা দেয়, বুকের ভেতর আনন্দের গর্জন। বনভূমির দিকে তাকালে মন স্নিগ্ধ হয়ে যায়–সংসারের কোলে নিবিড় শান্তি। আজ আর সোজা পূর্ব বা পশ্চিমে হাঁটে না ও। উত্তর-দক্ষিণে সাগর এবং বনভূমি বরাবর পায়চারি করতে থাকে। শুনতে পায় চারদিকে প্রবল তোলপাড়–কারা ডাকছে আবুল হাশেমকে? মণিমালা কি? না মণিমালার ডাক ও আর শুনবে না। ও আর পেছন দিকে যাবে না। এখন ওর সামনে নূরবানু। কতদিন আগে যেন নূরবানুকে একবার দেখেছিল? এখন আর মনে নেই। নূরবানুর কথা মনে হতেই শরীর শিরশির করে যেন পায়ের নিচ দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে বালুকণা বলছে, চলো অন্য কোথাও যাই। প্রতিটি বালুকণা নূরবানুর মুখ সেই ভুরু, নাক, চোখ, ছিপছিপে শরীর–সর্ব অবয়ব। নূরবানুর কথা ভাবলে আবুল হাশেমের পা থেমে যায়, ও দাঁড়িয়ে পড়ে। দেখে মোষের সারি ঘরে ফিরছে–কালো কুচকুচে মোষগুলো প্রকৃতির পটভূমিতে এক একটি বিশাল নক্ষত্র।

পরদিন দুপুরের পর গদু মাতবর ওর বাড়িতে আসে। ওকে দেখে আকস্মিক খুশিতে বিমূঢ় হয়ে যায় আবুল হাশেম। নুরবানুর ভাই তাহলে রাজি হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। সুখবরটা বাড়ি বসে পাবে ধারণাই করতে পারেনি। দুপুরের খাওয়াটা একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল। চমৎকার রান্না করে ওর খালা, মনে হয় এতদিনকার জীবনযাপনে এ রান্না একদম অন্যরকম। আয়েশ করে গড়িয়ে নিচ্ছিল বিছানায়। খানিকক্ষণের জন্য সামান্য তন্দ্রার মতো হয়। একটা ভালো স্বপ্নও দেখে। মনের এই প্রশান্ত অবস্থায় নূরবানুর ভাই, অর্থাৎ সৌভাগ্য। আবুল হাশেম তাই গদু মাতবরকে দেখে বিমূঢ় ভাবটা কাটিয়ে উঠে বোকার মতো হাসে। তড়িঘড়ি হাতলবিহীন চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে বলে, বয়েন।

বইতে আহি নাই।

নূরবানুর ভাই গম্ভীর–মুখজুড়ে বিরক্তি, দুই ভুরুর মাঝখানে কপালটা কুঁচকে থাকে। সেই থাকার ফলে চোখ ঘোট দেখায়। আবুল হাশেম আনন্দে বিহ্বল হয়ে ওঠার ফলে স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল না, গদু মাতবরের তিক্ত চেহারা প্রথমে খেয়াল করেনি। তাই উত্তরটা শুনে ও চমকে ওঠে এবং নিজের কাছে ধাক্কা খায়।

হোনেন হাশেম মিয়া মোর বইনে কইছে আমনহেরে ছামনে পাইলে দাও দিয়া কোপাইয়া কাইড়া ফালাইবো। কইছে, আমনহের এ্যাতো সাহস অইল ক্যামনে যে আমনহে বিয়ার কতা কন?

আবুল হাশেম চোখ গোল করে তাকিয়ে থাকে। মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না, যেন নিঃশ্বাসও বন্ধ হয়ে গেছে। গতকাল এই লোকটিকে অনেক বেশি সহানুভূতিশীল, বিনয়ী, ভদ্র মনে হয়েছিল। ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল ও যেন আবুল হাশেমের একজন খাটি দরদি। আর আজ এখন? গদু মাতবর মাটিতে পা দাপিয়ে বলে, এই কতা আমনহে। গেরামের কারো কাছে কইতে পারবেন না। মোর বইনের য্যান কোনো দুর্নাম না অয়। যেই কতা মুখ দ্যা বাইর করছেন তা আবার গিলা ফেলেন। একদম চুপ, খামোশ!

আবুল হাশেমের মুখের ওপর আঙুল নাড়ায় গদু মাতবর। আবুল হাশেমকে তা সহ্য করতে হয়। গদু মাতবরের ওপর ও ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে না, কারণ গদু মাতবর ওর চেয়ে তাগড়া। তাছাড়া ও নূরবানুর কাছ থেকে শক্তি সঞ্চয় করেছে। সেটাই এখন ওর বড়ো বর্ম। আবুল হাশেম দাঁতমুখ খিচিয়ে রাখা গদু মাতবরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। দেখতে পায় লোকটির মুখটা আর মুখ নেই–ওটা কাঁকড়া হয়ে আট পায়ে আবুল হাশেমকে রক্তাক্ত করছে।

যা কইলাম মনে থাহে’য্যান। না অইলে ফাটাফাটি অইবো। মোর বইনে কইছে একটা কতা য্যান এইদিক ওইদিক না অয়। অহন যাই।

খাড়াও।

প্রবলভাবে চিৎকার করে ওঠে আবুল হাশেম। এতক্ষণে ও নিজের ভেতর আত্মস্থ হতে পেরেছে। তর্জনী তুলে কঠিন স্বরে বলে, হোনো, তোমার বইন ছাড়া গেরামে আর মাইয়া নাই? মুই বিয়া করমু। অহন ঠিক করলাম কুমারী মাইয়া বিয়া করমু, মোর বেবাক সম্পত্তি দিলেই মাইয়া পামু। মোরও পোলা অইবো। তোমরা দেইখা লইও।

থুঃ বুড়া হগুন। নিজের বয়সের হিসাব নাই।

ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে আবুল হাশেম। চেঁচিয়ে বলে, কি কইলা? কি কইলা? বেডা মানষের আবার বয়স লাগে নাহি? বেড়া মানুষের জোয়ানি শ্যাষ অয় না। মুই দেহায়ে ছাড়ুম।

কচু। থুঃ।

গদু মাতবর বুড়ো আঙুল দেখাতে দেখাতে চলে যায়। আবুল হাশেম পেছনে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে চিৎকার করতে থাকে। গদু মাতবর ভ্রুক্ষেপ করে না।

আবুল হাশেম কিছুক্ষণের জন্য আবার স্তব্ধ হয়ে যায়। গদু মাতবর মুন্সির বাড়ির আড়ালে মিলিয়ে গেলে ও আচমকা হা-হা করে হেসে ওঠে। মুহূর্তে উড়িয়ে দেয় এতক্ষণের বাগবিতণ্ডা। নিজের সিদ্ধান্তে অটল হয়ে ওঠে। ও নিজেই নিজের হাসিতে শুনতে পায় সমুদ্রের গর্জন, ও ঠিক করে আগামীকাল ভোরেই মাছ ধরার জন্য বেরিয়ে পড়বে। দিন সাতেক সমুদ্রে থেকে এসে বিয়ের জন্য কনে খুঁজে বের করবে, ওর সমস্ত সম্পত্তি বাজি, তবু কুমারী মেয়ে চাই এবং সন্তান।

আবুল হাশেম হাঁটতে হাঁটতে সৈকতে আসে। ট্রলার ঠিকঠাক করে মহাজনের বাড়ি যাবে জাল গোছাতে এবং অন্য সঙ্গীদের খবর দিতে। জোয়ারে ট্রলার দুলছে। ও লাফিয়ে ট্রলারে উঠে পা ঝুলিয়ে বসে। ছোটবেলায় গাছে দড়ি বেঁধে যেমন দোলনায় দুলত, তেমন আমেজ ওকে আচ্ছন্ন করে রাখে। ও গুনগুনিয়ে ছড়া কাটে। চোখ বন্ধ করে, চোখ খুলে রাখে। পানিতে পা ভেজায় আবার পা উঠিয়ে নেয়। ছড়ার লাইন ভুলে গিয়ে মুখে গুনগুন শব্দ করে, যেন ও একটা থেকে আর একটা অবলম্বনে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে যায়। একসময়ে ও জোয়ারের হাঁটুজলে পা ড়ুবিয়ে। ছেলেবেলার মতো হেঁটে হেঁটে পাড়ের দিকে এগুতে থাকে। সূর্য পাটে গেছে, আর কিছুক্ষণের মধ্যে আলো নিভবে।

তখন ও দেখতে পায় পুবদিক থেকে দৌড়তে দৌড়তে একটি লোক আসছে। অচেনা না চেনা মানুষ, তা দূর থেকে ঠাহর করতে পারে না, শুধু ভঙ্গিমা চেনা চেনা লাগে মনে হয়, যেন পরিচিত কেউ। ও কে? কেন দৌড়চ্ছে? হয়তো ভিন গাঁয়ের কেউ। কারো জন্য সুখবর আনছে, নাকি দুঃসংবাদ? আবুল হাশেম আবার ট্রলারের কাছে ফিরে যায়, মনে হয় একটা ভয়ানক অবলম্বন চাই। অবলম্বনহীন দাঁড়িয়ে থাকলে ও জোয়ারের তোড়ে ভেসে তলিয়ে যাবে। লোকটি কাছাকাছি চলে এসেছে। এখন ওকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, অস্পষ্ট অবয়ব আর নেই, একজন জোয়ান তাগড়া লোক। লুঙ্গি মালকোচা মেরে পরা, হয়তো দৌড়নোর সুবিধার জন্য। গায়ে গেঞ্জি, লোকটি বড়ো বড়ো পা ফেলছে, খুব দ্রুত ওর দিকেই আসছে। তবু লোকটি কে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে আবুল হাশেমের আরো কিছুক্ষণ সময় লাগে। কাছে এলে ও চিনতে পারে, গফুর, জবেদ আলীর চাচাতো ভাই।

গফুর ওকে এখানে পাবে আশা করেনি, তাই দেখেই চেঁচিয়ে ওঠে, মহাজন।

তারপর জোয়ারের জল উপেক্ষা করে দৌড়ে ট্রলারের কাছে আসে। মহাজন সব্বোনাশ। সব্বোনাশ?

লোকটি হাঁফাতে থাকে। কথা বলতে পারে না। ওর দম নেওয়া প্রয়োজন–ওর বুক ঘন ঘন ওঠানামা করছে। পেট পিঠের সঙ্গে লেগে আছে, রোদে পোড়া গায়ের চামড়া, গলার চারপাশে ঘাম শুকিয়ে সাদা হয়ে আছে। লোকটি ট্রলারের সামনের দিকটা ধরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলাচ্ছে। একসময় ওর নিঃশ্বাস পড়া শান্ত হয়। এতক্ষণ আবুল হাশেম একটি প্রশ্নও না করে, ওকে দম নেবার সুযোগ দিয়েছে। নিজের আচরণে নিজেই অবাক হয়। কিভাবে এত সহিষ্ণু হলো? দুপুরের ঘটনার পর ও কি ধৈর্য ধরতে শিখে গেল? এই ধৈর্য ধরার অর্জন মানুষের জন্য কখনো কখনো ভীষণ জরুরি, যখন মানুষের চারদিকে সর্বনাশের শুকনো পাতা ওড়ে। তাই সর্বনাশ শব্দটি শোনার পর থেকে ওর ধৈর্য আরো বেড়ে যায়। ও একমনে গফুর মিয়ার হাঁফ-ধরা বুকের ওঠানামা দেখে।

গফুর মিয়া খানিকটা ধাতস্থ হলে আবুল হাশেম বলে, খবর ক দেহি।

কাইলকা নুরু মোল্লা নতুন চর দুখল কইরা নিছে। রাইতে জবেদ ভাইর ঘরে আগুন দেছে। ভাই-ভাবি পুড়া মরছে। এক্কেরে অঙ্গার হয়া গেছে মহাজন।

গফুর ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।

আবুল হাশেম নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। অঙ্গার? অঙ্গার কি? অঙ্গার কেমন? মানুষ কেমন করে অঙ্গার হয়? অঙ্গার হলে কেমন দেখায়?

তখনো কেঁদে যাচ্ছে গফুর।

আবুল হাশেমের মনে হয় ও কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। সামনে থেকে গফুর যায়। জেগে থাকে কান্নার শব্দ, যেন পৃথিবীতে ধ্বনি ছাড়া আর কিছু থাকতে নেই। কেবল ধ্বনিই পারে বিস্তৃত হতে। অল্পক্ষণে আবুল হাশেমের করোটিতে সে শব্দ পরিব্যাপ্ত হয় এবং ওর আর কিছুই মনে পড়ে না। ও নড়তে পারে না, হেঁটে কোথাও চলে যেতে পারে না। ওর পুরো অবয়ব যেন ট্রলারের সঙ্গে মিশে গেছে। ও পাটাতনের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে।

দেখে আকাশের সীমানা থেকে দিগন্তরেখার কাছাকাছি দুজন মানুষ অঙ্গার হয়ে ঝুলে আছে–এতক্ষণে ও বুঝতে পারে অঙ্গার কি, অঙ্গার কেমন। রাহামের জন্য ওর চোখ জলে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। সে জল গাল বেয়ে গড়ালে ও বুঝতে পারে যে নতুন চরটি হাতছাড়া হয়ে গেল–ওটা দখল করা ওর কোনোদিন হয়ে উঠবে না, কারণ ওর সেই লোকবল নেই, অর্থবলও নেই।

তখন ও গফুরের দিকে তাকায়। ওর কান্না থেমে গেছে। চোখও মোছে না। শান্ত হয়ে ট্রলারের ওপর মাথা এলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন কিছু ভাবছে, কিছু সমাধানের কথা। কিংবা নতুন করে শুরু করার জন্য কিছু। নয়তো আবুল হাশেম থেকে কিছু শোনার অপেক্ষায় ধৈর্য ধরে আছে।

আবুল হাশেম উৎকণ্ঠিত গফুরকে বলে, তুই বাড়ি যা গফুর। মুই একটু পর আমু।

জোয়ারের জলে ছপছপ শব্দ করতে করতে চলে যায় গফুর।

সন্ধ্যা হলে গোল চাঁদ ওঠে, বিশাল চাদ সমুদ্রের তরঙ্গে নাচে–সৈকতে বিছিয়ে থাকে পূর্ণিমার আলো। গফুরের কান্না থেমে গেছে, এখন আর শব্দ নেই কিন্তু শব্দ আছে আবুল হাশেমের করোটিতে। ও ট্যাক থেকে বিড়ি বের করে। চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ও বিড়ির ধোঁয়া ছাড়ে। বিড়ির মাথায় একবিন্দু আগুন জ্বলজ্বল করে। নাকের ওপর দিয়ে বরাবর তাকালে সে অণ্ডনের একটা সরলরেখা তৈরি হয়। ও জানে। ওই একবিন্দুই স্বপ্ন–স্বপ্ন ছাড়া মানুষের বেঁচে থাকা কঠিন। তখন ওই সরলরেখার মাথায় একটি রঙিন মাছ ভেসে ওঠে।

—————

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *