০৩. আন্ধারমানিক নদীর কিনারে

আন্ধারমানিক নদীর কিনারে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকে আবুল হাশেম। নতুন চরের গন্ধ ওর ফুসফুস বেয়ে নিচের দিকে নামতে থাকে। চর জেগেছে মাত্র–এই নিয়ে বিভিন্ন শরিকের মধ্যে বিরোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে–প্রভাবশালীরা অন্যায়ভাবে দখল করতে চাচ্ছে। কিন্তু আবুল হাশেম জানে শেষ পর্যন্ত কেউই টিকতে পারবে না, কারণ ওর কাগজপত্রে কোনো ফাঁক নেই। কিন্তু ভয় একটাই, চর দখলের সময় কেউ কাগজপত্রের ধার ধারে না। জোর যার মুল্লুক তার, এমন একটা ভাব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্ষমতাশীলরা। ওর খানিকটা মন খারাপও হয়ে যায়। কারণ ও জানে শক্তির জয় সর্বত্র–অন্যায়কারীরা অর্থের জোরে বিভিন্নভাবে প্রতিষ্ঠা পায়। আবুল হাশেমের তো এখন অর্থ নেই, লোকবলও নেই। কেমন করে ও শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে? ভয়ে বুকের ভেতর কুঁকড়ে যায়। ভয় পেলে, মন কুঁকড়ে থাকলে ওর করোটিতে সোনালি মাছ ডানা মেলে না। আর সোনালি মাছ ডানা না মেললে ও স্বপ্ন দেখতে পারে না।

আবুল হাশেম দ্রুত নিজের ভেতর থেকে ভয় তাড়িয়ে দিতে চায়। যৌবন ফিরে পাবার আকাঙ্ক্ষায় ও শক্তি সঞ্চয় করে মনে মনে। উড়িয়ে দেয় অমূলক আশঙ্কা। ধরে নেয় ও একাই এই একচ্ছত্র সাম্রাজ্যের মালিক। যে জমি একদিন ওর ছিল, যা একদিন নদীগর্ভে চলে গিয়েছিল, তা এখন আবার ওর মণিমালা হয়ে ফিরে এসেছে। ওর ভয় কী? ভয় কেন থাকবে? বিয়ের পরে ওদের যখন নতুন জীবন তখন মণিমালা ওকে ভালোবাসার কথা বলত। আর যে গভীর ভালোবাসা পায় সে তো সাহসী পুরুষ।

মণিমালা বলত, মোর জমি আমনহের জমি। আমনহেই বেবাক জমির মালিক। মোরে দু’গা ভাত দিবেন ক্যাবল।

আহ, কি প্রবল ভালোবাসা ছিল মণিমালার কণ্ঠে, দৃষ্টিতে, আচরণে। মণিমালা গভীর মমতায় ঘিরে রেখেছিল ওকে। ওর কোনো অভাববোধ ছিল না। মণিমালার মতো স্ত্রী থাকলে কোনো পুরুষ মানুষের ভয় থাকে না। ওর কোনো ভয় ছিল না। এখন তো মণিমালা ওর পাশে নেই–শুধু স্মৃতি। স্মৃতিটুকু আঁকড়ে ধরে ও নদীর কিনারে দাঁড়িয়ে পা দাবায়। থেমে যায় বুকের ভেতরের কাঁপুনি করোটিতে ভেসে আসে সোনালি মাছ। ও মণিমালার উদ্দেশে বঙ্গে, তুমি মোর বেবাক কিছু–মোর টাহার পাহাড়, মানুষের গায়ের বল। মণিমালার স্মরণে দীর্ঘকাল পর আবুল হাশেমের চোখে দুফোঁটা জল গড়ায়। এখন গভীর করে ওকে আর। তেমন মনে পড়ে না। এই মুহূর্তে শক্তি সঞ্চয়ের জন্য মণিমালাকে প্রয়োজন–কারণ মণিমালার স্মৃতি ছাড়া ওর পাশে আর কেউ নেই।

ও হাতের তালুতে চোখের জল মুছে ফেলে। জানে, ওর ভয় কেটে গেলে বর্তমানের জাগতিক নানা কিছু ওকে গ্রাস করবে, তখন তলিয়ে যাবে মণিমালা। বড়ো হয়ে উঠবে বেঁচে থাকা, পারিপার্শ্বিক এবং নিত্যদিনের ঘরগেরস্তির খুঁটিনাটি। তাই ও ভালোভাবে বেঁচে থাকার তাগিদে অল্পক্ষণের মধ্যে নিজের ভেতর শক্তি সঞ্চয় করে।

নদীর পানিতে তোলপাড়। ছোট ছোট ঢেউ ভাঙে আর গড়ে–গড়ে আর ভাঙে–যে ভাঙায় তৈরি হয় আবুল হাশেমের নিজের নকশা। পানির নিচে গুচ্ছ গুচছ ঘাস–ডানে বামে সামনে পেছনে ঘাসের বিস্তার। যে জায়গাতে পা রাখে না কেন সেটাই ওর জন্য স্বস্তি। দূরের প্রান্তর জুড়ে সবুজ দিগন্তের কাছাকাছি রেখাটি সবুজ এবং আবুল হাশেমের হৃদয় এখন সবুজ–যদি কেউ বলে ওটা ফসিল হয়েছে তাহলে ও মানবে না। মণিমালার স্মৃতিই ওর সব বলে মন মানতে চায় না। সে গণ্ডি পেরিয়ে ও যেতে চায় অন্য কোথাও, আরো দূরে। বাহাত্তর বছর বয়স হলেই হৃদয়ের রঙ পাল্টায় না, সেটা কাশফুল হয়ে যায় না। ওর শরীরের লোমগুলো ধানের কচি চারার মতো সবুজ হয়েছে–এখানে অন্য কোনো রঙ মানায় না। এই রঙ নিয়ে ও অনায়াসে একজন বিধবা নারীর কাছে যেতে পারে–তার গর্ভে উৎপাদন করতে পারে সন্তান।

জবেদ আলী বলেছে এই চরে ও ঘর ওঠাবে–নতুন বাঁশ, বাঁশের বেড়া, হোগলার ছাউনি দিয়ে ঘর। প্রথম বসতি হবে ওর। নতুন মাটিতে এক নতুন জীবনের শুরু। যার নাম সংসার। বলেছে, রাহানুমকে নিয়ে সংসার পাতবে ও। এই জমি ও চাষ করবে। লাঙল আসবে, হালের বলদ আসবে, বীজ আসবে। নতুন জমি বিক্ষত হবে লাঙলের ফলায়–বিক্ষত হবে রাহানুম, ওর জমিতেও চাষ হবে, বীজ বোনা হবে। সোনালি ফসলে ভরবে জমিন, ভরবে জীবন। দুয়ে মিলে গড়ে উঠবে সংসার। ওহ সংসার! আবুল হাশেম উত্তর দিকে মুখ করে দাঁড়ালে বাতাসে ওর চুল ওড়ে, ভুরু কাঁপে। বুকটা আইচাই করে। সংসার? মণিমালার সঙ্গে ওর একটা সংসার ছিল। সে স্মৃতি ঝাপসা হয়ে এসেছে, যদিও প্রয়োজনে সেই স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে নিজেকে ক্ষয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে চায়। কিন্তু সে অনুভূতি তাৎক্ষণিক, সাময়িক। এখন ও নূরবানুকে নিয়ে সংসার করার কথা ভাবছে। নতুন জমির মালিক হলে সংসার ছাড়া সে কর্তৃত্ব জমে না। জমি ওকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। কারণ রাত্রিবেলা ঘর থেকে বেরোলেই ওর সামনে থাকে ফকফকে জ্যোৎস্না। ও অমাবস্যা। ভালোবাসে না। ও একজন মানুষ। ওর কান্না পায়, সুখ হয়। মরণের সুখ, একাকিত্বের সুখ। কী যেন একটা ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। কী? জলোচ্ছ্বাসের গভীর কালো রাত? কুয়োকাটার পূর্ণিমা? গভীর সমুদ্র? সেই অদ্ভুত সুন্দর রঙিন মাছটা? তখন ওর মনে হয় ওই মাছটাই ওর সব। ওটাকে জুড়েই ওর আকাক্ষা এবং মন কেমন করা।

দেখতে দেখতে সাত দিন পেরিয়ে গেল এখানে। জবেদ আলীর সঙ্গে রাহামের বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়েছে। রাহানুমের মতামত নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আবুল হাশেম জানে রাহানুম বিয়ের জন্য মুখিয়ে আছে। জবেদ আলীর বাপ আপত্তি করেনি। তার বলার কিছু নেই। আবুল হাশেম জানে ওর নিজের মেয়ে হলে এই বিয়ে হতো না। মালিকের মেয়ের সঙ্গে বর্গাদারের ছেলের বিয়ে হয় না। হতে পারে না। মেয়ে যদি বর্গাদারের ছেলের প্রেমে পড়ে ঘর ছেড়ে পালিয়ে যেত তাহলেও ও মেয়েকে ধরে এনে দু’টুকরো করে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিত। এখন ও রাহানুমকে বিদায় করতে চাইছে। ওর জীবনে রাহালুমের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তাই ও অনায়াসে জবেদ আলীর বাপকে বলে দিতে পেরেছে যে রাহানুম ওর কোনো সম্পত্তি পাবে না। এসব নিয়ে বাপ-ছেলেতে যেন কোনো চিন্তাভাবনা না করে।

শুনে জবেদ আলী মুচকি হেসেছে। তারস্বরে বলেছে, মোর সম্পত্তি লাগবে না। মুই সম্পত্তি দি হরমু কী? আর নিচুস্বরে বলেছে, মুই। রাহানুমের ছাড়া বাঁচুম না।

শুনে আবুল হাশেম মনে মনে হেসেছে। যৌবনে ও মণিমালাকে বলেছিল, তোমারে ছাড়া মুই বাঁচুম না।

এখন ওর কাছে মণিমালার স্মৃতি ঝাপসা।

শৈশবের সুখদীপকে কোলে নিয়ে দোলাতে দোলাতে রাহানুম বলত, বাবো এই পোলাডারে ছাড়া মুই বাচুম না।

সুখদীপ ছিল রাহামের সুখের প্রদীপ। এখন? সব কেমন উল্টে গেল। তাহলে তিনজনের এই একত্রে বসবাস কি মিথ্যে? এখন তো ওরা একে অপরকে ছাড়া বাঁচতে চাইছে। এই বাঁচাকে সত্য করে তুলতে চাইছে। তাহলে এই এত বছরের দিনগুলোর কী হবে? নদীর মতো বয়ে যাওয়া দিন।

নদীর ধারে দাঁড়িয়ে শূন্য চরের ওপর দিয়ে তাকালে দূরের গাছপালা দেখা যায়–মাঠের পরে মাঠ, ছোট ছোট বাড়ি। আবুল হাশেম একটুক্ষণ পায়চারি করে। চমৎকার একটি কাচপোক ওর মাথার চারপাশে ঘঘারে। তারপর উড়ে গিয়ে নলখাগড়ার মাথার ওপর গিয়ে বসে–আবার উড়ে আসে। পোকাটি এক ধরনের শব্দ করে, সেই শব্দ অনুসরণ করে আবুল হাশেম নিজের দিকে তাকায়, দেখতে পায় এই নতুন চরের পলিমাটিতে ও ছাড়া আর কেউ নেই। এই নদী, কাচপোকা এবং ওর মধ্যে সখ্য স্থাপিত হয়েছে। এই তিনজনকে নিয়ে সংসার নয়। এই তিনজন একে অপরের পরিপূরক। পরস্পরের নির্ভরতা মাত্র, যেমন নির্ভরতা ছিল ওদের তিনজনের সংসারে। সেই সংসারে এখন ভাঙন, প্রবল ভাঙন, কারণ সেখানে নতুনের প্রবেশ ঘটেছে। তাই তছনছ হয়ে গেছে আশা, ভেসে যাচ্ছে সব, সব। কে ঠেকাবে? কেউ তো নেই। কেউ না।

একটু পর পর নৌকা বোঝাই বাঁশ, গোলপাতা ইত্যাদি নিয়ে জবেদ আলী এবং ওর বাপ আসে। ওরা আজ ঘর তুলবে। প্রথমেই দখল দেবে, তারপর অন্যদের সঙ্গে মারামারি-লাঠালাঠি ইত্যাদি। রক্ত ঝরবে এবং মৃত্যু ঘটবে, অবধারিত সত্য। এ অভিজ্ঞতা আবুল হাশেমের জীবনের।

 

কারণ ও জীবনের এইসব ঘটনার বাইরে নয়। বাইরে থাকতেও চায় না।

জবেদ আলীদের সঙ্গে আরো দুজন কামলা এসেছে। ওরা ঝটপট বঁশ পোঁতার কাজে লেগে গেছে। কোনোরকমে বাঁশ পুঁতে চারদিকে বেড়া দিয়ে ওপরে পাতার ছাউনি দিয়ে দিলেই হয়ে যায়। এটা দখলের প্রথম শর্ত।

কাচপোকা উড়ে এসে আবুল হাশেমের ঘাড়ে বসে। ঘাড়ে কাচপোকা নিয়ে ও দেখতে থাকে যে কেমন করে নতুন ঘর ওঠে–তারপরও ওর চোখের সামনে থেকে ছবি মুছে যায় না, দেখতেই থাকে ঘর ওঠার পরের দৃশ্যগুলো–ঘরের পাশে কতগুলো কলাগাছ লাগানো হয়, রসুই ঘরের পাশে চেঁকি বসে, সেই ঘরে প্রবেশ করে একজোড়া দম্পতি, হাঁড়িকুড়ি কেনা হয়, চুলো বসে, আগুন জ্বলে, ভাত খাওয়া হয়, দিন ফুরোয়, রাত নামে, ভাত খেয়ে ঘুমুতে যায় দম্পতি, আবার ভোর হয়। মাঠে যায় একজন–মাটি চষে, ধান বোনে। ঘরে থাকে একজন–ধান ভানে, আঙিনা নিকোয়। ঝকঝকে তকতকে ঘরদোর। বাতাসে লুঙ্গি শুকায়, শাড়ির আঁচল ওড়ে। কবুতর ঘর বাঁধে, শালিক উড়ে বেড়ায়–পেঁচা ডাকে রাতের বেলা। ফকফকে জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যায় গাছ, ঘর, মানুষ, মানুষ, মানুষ। আবার ভোর হয়। কাকা-ডাকা ভোর।

এইসব ভাবনার মাঝে জবেদ আলীর বাপ ওর কাছে এসে দাঁড়ালে কাচপোকা উড়ে যায়। লোকটির মুখে পাতলা দাড়ি। গায়ে তালিমারা পাঞ্জাবি, ও ভূমিহীন কৃষক, কাঁধে গামছা রাখে এবং ঘন ঘন কপালের ঘাম মোছে। খুব নিচুস্বরে বিনীত ভঙ্গিতে বলে, মহাজন বিয়ার সময় পোলাডারে কিছু দিবেন না?

যৌতুক?

হা-হা করে হেসে ওঠে আবুল হাশেম।

না, না যৌতুক না। মোর কি যৌতুক চাওয়ার সাহস অয়? না চাওয়া উচিত? আমনহের যা মনে লয়? বাপেতো মাইয়ারে আশীর্বাদ করে।

মাইয়া?

আবুল হাশেম হা-হা করে হেসে ওঠে। জবেদ আলীর বাপের মুখ কালো হয়ে যায়, খানিকটা অপমানিতও বোধ করে। তবু মরিয়া হয়ে বলে, মাইয়া না তো কী? বাপতো ডাকছে।

বাপ ডাকলেই মাইয়া অয়?

না, অয় না। আমনেহতো বাপ ডাকতে মানাও করেন নাই। মাইয়াডা বাপ ডাকছিল–

থাক, বেশি কথা কওন ভালো না।

আবুল হাশেম জবেদ আলীর বাপকে ধমক দেয়। তারপর ওর চোখের ওপর চোখ রেখে রূঢ় কণ্ঠে বলে, চর জাগছে, অহন মোর মেলা খরচ। মুই কিছু করবার পারুম না। পোলারে বিয়া করাইলে করাইবা, না। করাইলে নাই। ভাইবা দেহে, যা ইচ্ছা।

জবেদ আলীর বাপ একদম চুপসে যায়। ভেতরে ভেতরে ক্রোধ হলেও সেটা সে প্রকাশ করতে পারে না। প্রকাশ করার সাহস না করাই উচিত বলে মনে করে। ভেতরে ভেতরে ফুসতে থাকে। নিজেকে দমিয়ে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। কাচপোকাটা আবার কাছাকাছি উড়ে এলে ও হাত বাড়িয়ে খপ করে ধরে ফেলে। তারপর পায়ের নিচে পিষে মারে।

আবুল হাশেম তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলে, কামডা ঠিক করলা না।

মহাজন নতুন চর যদি আমনহের অয়, তাইলে পোকাড়া মোর। মোগ বিত্ত নাই, কিন্তু বনজঙ্গল-পোকামাকড় তো আছে। মুই যদি পোকাডারে পিষাই মারতে চাই, তাহলে হেইডা মুই মারি। আপনে না। কইবেন ক্যা?

আবুল হাশেম হাঁ করে লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রচণ্ডভাবে বিস্মিত হয়। লোকটি বলে কী? বর্গাচাষীর দাপট তো কম নয়? ও কি ছেলের বিয়ের কথা পাকাপাকির পর নিজেকে আবুল হাশেমের সমকক্ষ ভাবছে? ছেলের ব্যর্থ হিসেবে নিজেকে আবুল হাশেমের ওপরে স্থান দিচ্ছে। সেজন্যই কি’রাহানুমকে ওর মেয়ে বানানোর জন্য এত চাপাচাপি? হ্যাঁ এই হবে। আবুল হাশেম সিদ্ধান্তে এসে যায়।

জবেদ আলীর বাপ পোকা মেরে নদীর দিকে খানিকটা নেমে গেছে। ও এখন হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে। লুঙ্গি হাঁটু পর্যন্ত ওঠানো। ওর সরু পা পানিতে ড়ুবে আছে। ও আঁজলা ভরে পানি তুলে মুখে ছিটায়। ও কি প্রমাণ করছে যে নদীতে ওর প্রবল অধিকার? মানুষের সঙ্গে না পেরে ও প্রকৃতিকে নিজের দখলে রাখতে চাইছে। জবেদ আলীর বাপ এভাবে আবুল হাশেমকে উপেক্ষা করছে। আবুল হাশেম বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে বলে, কচু। জবেদ আলীর বাপ তো দেখতে পায় না। ওর পিঠ আবুল হাশেমের দিকে ফেরানো।

আবুল হাশেম নদীর পাড়ে দাঁড়িয়েই থাকে, নদীতে নামে না। ওর। জলের স্পর্শের প্রয়োজন নেই। কারণ ওর শরীরে রাগ নেই। ওর শরীর। রাগে টলছে না। হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়েই জবেদ আলীর বাপ গামছা দিয়ে। ঘাড় গলা মুছে নেয়। তারপর উঠে আসে নদী থেকে। আবুল হাশেমের দিকে তাকায় না। আবুল হাশেম এতক্ষণে মজা পেতে শুরু করেছে। লোকটি ছেলের বাপ–ওর আচরণে তা বুঝিয়ে দিচ্ছে এবং হনহনিয়ে হেঁটে পুবদিকে খানিকদুর চলে যায়। আবুল হাশেম ধরে নেয় বেশিক্ষণ লোকটি এই রাগ ধরে রাখতে পারবে না, একটু পরই শান্ত হয়ে যাবে। শান্ত ওকে হতেই হবে। কারণ আবুল হাশেম জমির মালিক। লোকটির এখানে কোনো কাজ নেই, ও দেখতে এসেছে কেবল এবং একই সঙ্গে আবুল হাশেমের কাছ থেকে কিছু আদায় করার ধান্দাও।

আবুল হাশেম লোকটির দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর হেঁটে যাওয়া দেখে, ঘন ঘন গামছা নাড়তে দেখে। লোকটি ছিপছিপে লম্বা, দূর থেকে ওকে আরো চিকন দেখায়, খুব ছোট একগোছা পাটকাঠির মতো। ও আবুল হাশেমকে মহাজন বলল কেন? আবুল হাশেম কি মহাজন? না, ঠিক তা নয়।

নদীর ভাঙনে তলিয়ে যাওয়ার আগে ওর কিছু জমি ছিল। তারপরতো সেগুলো নদী গ্রাস করল। এখন ওর তেমন কিছু নেই। শুধু ভিটে এবং সামান্য কিছু ধানি জমি। এতে ঠিকমতো হয় না বলে মৌসুমের বাইরের সময়টায় আবুল হাশেম মাছ ধরতে সাগরে যায়। ও নিজে জেলে, ওর ওপর একজন মহাজন আছে। আসলে জবেদ আলীর বাপ ওকে খুশি করার জন্য মহাজন বলেছে। মহাজনই যদি মানবে তবে এমন কঠিন করে কথা বলত না আবুল হাশেম দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মানুষ নিজের ইচ্ছার পূরণ দেখতে না পেলে রুষ্ট হয়, ক্ষিপ্ত হয়, তারপর দূরে দাঁড়িয়ে নিজের চিন্তাগুলো সংহত করার চেষ্টা করে।

তখন আবুল হাশেম পায়ের নিচে পিষ্ট হওয়া কাচপোকাটাকে দেখে। পোকাটার শরীর চকচক করছে, পাখনা খুলে পড়ে আছে অথচ জৌলুস তখনো কমেনি। ওর ইচ্ছে করে পোকাটাকে হাতে উঠিয়ে মুঠোর মধ্যে ধরে রাখতে। পরক্ষণে দু’পা পিছিয়ে যায়। যে জিনিসটি জবেদ আলীর বাপের পায়ের নিচে যায়, সেটা আবুল হাশেম হাতে ওঠায় না। ও নদীর পাড়ে পায়চারি শুরু করে।

দেখতে দেখতে ছোট ঘরটির চারদিকে বেড়া দাঁড়িয়ে যায়। দ্রুত কাজ করে ওরা। জবেদ আলীর উৎসাহ অন্তহীন। ও এক মুহূর্তও জিরোবার জন্য দাঁড়ায় না। ও রোদ উপেক্ষা করছে, পরিশ্রম উপেক্ষা করছে, দরদরিয়ে ঘাম ঝরছে তাও উপেক্ষা করছে। ও যেন একটা মৌমাছি–ব্যস্ত, ভীষণ ব্যস্ত আপন সঞ্চয়ের জন্য। রোদে ওর মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে। চারদিকে একটা গাছ নেই, কোথাও কোনো ছায়া নেই। ছায়া না থাকা যে কি ভীষণ ভয়াবহ আবুল হাশেম তা মর্মে মর্মে টের পায়। বুকের ভেতর এক অদ্ভুত তাড়না–কিসের ও তা বুঝতে পারে না। তখন ওর খুব খারাপ লাগতে থাকে।

একটু পর জবেদ আলীর বাপ আবার ওর কাছে আসে। হাঁটাতে বিনম ভঙ্গি। খানিকক্ষণ আগের লোকটি সে আর নয়। বিনীতভাবে বলে, মহাজন লন বাড়িত যাই। আমনহের মুখটা রোদে পুইড়া গেইলো।

আবুল হাশেম মৃদু হাসে। লোকটির বিনীত ভঙ্গি দেখে ওর ওপর আবুল হাশেমের আর কোনো রাগ নেই।

লোকটি আবার মৃদু স্বরে বলে, এই রোদে আমনহের কষ্ট অয় মহাজন। লন যাই। দুপুরের ভাত খাঅনের বেলা অইছে।

আবুল হাশেম পুলকিত বোধ করে। বলে, তুমি মোরে মহাজন কও ক্যা?

মহাজনরেতো মহাজনই কওন লাগে। মুই কি করুম? মোগ তো এক কুড়াও জমি নাই। আমনহেরতো আছে। অহনতো আবার চর জাগছে। আমনহেরে আর পায় কে। লন, নৌকায় যাই মহাজন।

নৌকায়? সাগরে মাছ ধরতে গেলে তো মোর রইদ লাগে না। রইদে মোর মুখও পড়ে না।

লোকটি হি-হি করে হেসে উঠে বলে, তহনতো আমনহে মহাজন থাহেন না। তহন আমনহে মহাজনের নৌকায় মাছ ধরেন। আমনহে তহন জাইল্যা। মাছ মারার কামলা।

লোকটি হাসতেই থাকে। খানিকক্ষণ আগে লোকটি রেগে গিয়েছিল, এখন ও হাসছে। কিছুক্ষণ আগে ওর শরীরে আগুন ছিল, তাই ও দ্রুত নেমে গিয়েছিল নদীতে। এখন ওর শরীর নদী, ও আর নদী চায় না। ও কণ্ঠের বিদ্রুপে তাতিয়ে দিচ্ছে আবুল হাশেমকে, আবুল হাশেমের এখন জলের স্পর্শ প্রয়োজন। আবুল হাশেম ওকে কিছু না বলে হাসার সময় দেয়। ও লোকটির দিকে কঠিন চোখেও তাকায় না। বরং কৌতুক বোধ করে। ঠোঁটের ওপর সূক্ষ্ম হাসির রেখা জাগিয়ে রেখে ও লোকটির দিকে তাকিয়ে থাকে। আবুল হাশেমের কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে একসময় লোকটির হাসি থেমে যায়। ও দ্রুত কণ্ঠে বলে, লন মহাজন যাই।

আবুল হাশেম মৃদু হেসে বলে, মহাজন মুই না তুমি?

লোকটি না শোনার ভান করে। লাফিয়ে নৌকায় ওঠে। আবুল হাশেম মাঝখানে বসে। জবেদ আলীর বাপ মাঝির বিপরীত দিকের গলুইয়ে চলে যায়। ওর মাথায় সাদা টুপি, ক্রুশে বোনা টুপি, হয়তো ওর বউ কিংবা মেয়ের তৈরি। সবুজ লুঙ্গি পরেছে লোকটা, নিচের দিকের খানিকটা অংশ ফাটা। ছোটবেলা থেকে মাঠে কাজ করতে করতে পায়ের আকার নষ্ট হয়ে গেছে। আঙুলগুলো ফাঁক ফাঁক। লোকটার মুখে অসংখ্য কুঞ্চন। চোখ বসে গেছে। বয়স কত বোঝা যায় না। লোকটা হাঁটুর ওপর দু’হাত জড়ো করে বসে আছে। ওর ভঙ্গিটা দেখে আবুল হাশেমের হাসি পায়, ও আচমকা হা-হা করে হেসে ওঠে। চমকে ওঠে জবেদ আলীর বাপ, বোকার মতো আবুল হাশেমের দিকে তাকায়। ভুরুজোড়া কপালের ওপর তোলা, কিন্তু কোনো প্রশ্ন করে না।

ওর হাসি থেমে গেলে মাঝি জিজ্ঞেস করে, মহাজন হাসেন ক্যা?

এউক্কা কতা মনে অইলো।

জবাব শুনে জবেদ আলীর বাপের ভুরু স্বাভাবিক জায়গায় ফিরে আসে, যেন কোনো কারণে আশ্বস্ত হয়েছে, এমন একটা ভাব। আবুল হাশেম দূরের দিকে তাকিয়ে থাকে। ফাতরার চরের গাছগুলো কালচে সবুজ হয়ে বেড়ে উঠেছে, দূর থেকে ঘন জঙ্গলের মতো দেখায়, মনে হয় আকাশের নিচে সবুজ পাথরের দেয়াল। ডানে অনেকদূরে বঙ্গোপসাগরের বিস্তার। কেবলই দিশপাশহীন পানি। যে পানি আবুল হাশেমের ধ্বংস, যে পানির সঙ্গে ওর সখ্য।

সাগরের দিকে তাকালে আবুল হাশেমের বুকের ছাতি প্রসারিত হয়। ঘৃণা এবং ভালোবাসা দুটোই প্রবল হয়। কারণ সাগরের সঙ্গে ওর শত্রু ও বন্ধুর সম্পর্ক।

জোয়ার আসছে। জোয়ারের বিপরীত যেতে হচ্ছে বলে নৌকার দুলুনি বেড়ে যায়। আবুল হাশেম শক্ত হয়ে বসে। নিজের অজান্তেই শরীর কেমন সতর্ক হয়ে যায়। সামনেই নদীর এক অদ্ভুত সমান্তরাল আছে–মিঠে পানি এবং নোনা পানির সমান্তরাল। নদীর এ এক আশ্চর্য মিলন। এ জায়গার ঢেউয়ে উথাল-পাথাল বেশি। তবু এ জায়গায় এলে আবুল হাশেমের মনে হাজার রকম দার্শনিক চিন্তা আসে। এই সমান্তরালকে ও জীবনের নানাক্ষেত্রে মিলনের সঙ্গে এক করে দেখতে ভালোবাসে। ওর মনে হয় এভাবেই মানুষ ও প্রকৃতি এক হয়। এইসব ভাবনা নিয়ে ও দূরের দিকে তাকিয়ে থাকে।

জবেদ আলীর বাপও শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। গতকাল টাকা ধার করে আবুল হাশেমের জন্য একটা ইলিশ মাছ কিনেছিল। তার কয়েক টুকরো আছে আজ দুপুরের জন্য–বউ বলে দিয়েছে সন্ধ্যায় হাটে যেতে হবে। হাটে যাওয়ার ইচ্ছে ওর নেই, কারণ পকেটে পয়সাও নেই। তাই দুপুরে খাইয়ে-দাইয়ে আবুল হাশেমকে বিদায় করার জন্য ও ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। লোকটিকে ও আর সহ্য করতে পারছে না। অথচ ওর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হচ্ছে–নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ আর কি? নিজের ছেলের ওপর রাগ বাড়তে থাকে জবেদ আলীর বাপের। কী একটা মেয়েকে দেখে এসে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে। অন্য জায়গায় বিয়ে করলে বেশ কিছু জিনিসপত্ৰতো ঘরে আসত। এই বিয়ে মানে ডডকলা–বউছাড়া বাকিটা শূন্য। রাগে, বিরক্তিতে জবেদ আলীর। বাপের ভুরু আবার কপালে ওঠে। সাদা টুপি কপালে এঁটে আছে–টুপির ফুটোর ফাঁকে চুল বেরিয়ে খাড়া হয়ে আছে। ও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য টুপিটা একবার খোলে এবং আবার পরে। ওর হাত নিশপিশ করে, ও একটা কিছু করতে চায়, নাগালের মধ্যে পানি ছাড়া কিছু নেই, ফলে ও বসে হাতটা নদীতে ড়ুবিয়ে দিয়ে পানি নাড়াচাড়া করে। তারপর ভেজা হাতটা মুখে বুলিয়ে নেয়। ওর এইসব দেখে আবুল হাশেমের হাসি পায় এবং আচমকা হা-হা করে হেসে ওঠে।

এবার আর জবেদ আলীর বাপের ভুরু কপালে ওঠে না। সরাসরি প্রশ্ন করে, হাসেন ক্যা মহাজন?

তোমার রাগ দেইক্যা হাসি।

মুই গরিব মানু। মোর আর রাগ কী?

বেড়া মানু রাগ করলে মনের জোর বাড়ে।

গরিবের ঠ্যাংয়ে জোর নাই, কোমরেও জোর নাই। কেবল মনের জোর দিয়া কি প্যাডের খিদা পুরে? যারা প্যাডের খিদা পুরাইতে পারে না হেরা কি বেড়া মানু? হেরা গলে মাইয়া মানু। মুই বেড়া মানু না। মহাজন।

কি কইলা?

হাছা কতাই কইছি। মুই ক্যাবল শাড়ি পিন্দি না। তফাৎ এই। মুই আর মোর বউ হমান। হেওতে ধান ভাইনা দুইডা টাকা কামাই করতে পারে। হাটে যাওনের সময় নিজের খুতি ভাইঙা টাহা দেয়। মুই সওদা আনি। হে ভাত রানধলে মোরা খাই। মোগ খিদা মিডে।

জবেদ আলীর বাপ কথাগুলো বলে ঈষৎ হাসে। এখন ওকে একজন পীরের মতো দেখাচ্ছে। আবুল হাশেম যেন ওর মুরিদ। কতকাল ধরে এই দরগায় পড়ে আছে ও। অথচ এই লোকটিকে এত কাছে থেকে আগে এমন করে দেখা হয়নি। আবুল হাশেম মনে মনে চমকে ওঠে। জবেদ আলীর বাপের হাসিতে ব্যঙ্গ না দুঃখ তা আবুল হাশেম বুঝতে পারে না।

একটু আগে আবুল হাশেম ওকে বিদ্রুপ করে দু’বার হেসেছে। এখন মনে হচ্ছে ও বেকুবের মতো হেসেছে। এই অর্থহীন হাসি হাসার জন্য আবুল হাশেম লজ্জিত হয়।

জবেদ আলীর বাপ মুখে হাসি রেখেই বলে, কিছু কইলেন না যে মহাজন?

থামো, বেশি বক বক কইরো না।

ও নিজেকে সামলে নিয়ে ধমক দেয়। কিন্তু দেখতে পায় জবেদ আলীর বাপের ঠোঁট থেকে হাসি মুছে যায় না। লোকটি আবার উদাস হয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। এগিয়ে আসছে গ্রাম। নৌকা খালে ঢুকেছে। ওর বাড়ির সীমানা দেখা যাচ্ছে।

ওর বাড়ি যত এগিয়ে আসে ততই শরমে মরে যায় আবুল হাশেম। নৌকা থেকে লাফ দিয়ে নামতে গিয়ে ওর একটা পা কাদায় পড়ে। স্পঞ্জের স্যান্ডেলটা ঢুকে থাকে কাদার মধ্যে। হা-হা করে ওঠে জবেদ আলীর বাপ। মাঝিকে কষে ধমক দেয়, হারামজাদা চোহে দেহ না? কাদার মধ্যে নৌকা গুলি ক্যা?

আর কোনহানে থুমু? জাগাতো নাই। অহন ভাটি না?

মাঝি গজগজ করে।

মহাজন চোহে দেইক্যা লাফ দেবে না?

হইছে, হইছে থাম তোরা।

আবুল হাশেমের রাগে শরীর কাঁপে। কিন্তু কিছু করার নেই। জবেদ আলীর বাপ কাদার মধ্যে থেকে ওর স্পটা টেনে বের করেছে।

খালের পানিতে পা ধুয়ে জুবেদ আলীর বাপের উঠোনে এসে দাঁড়াবার পরও ওর মনে হয় ও শরমে মরে যাচ্ছে। খিদেয় মাথা চক্কোর দিচ্ছে, তবু ওর খাবার কথা চিন্তা করতে ভালো লাগে না। একটু পর খাবার আয়োজন হয়। জবেদ আলীর মা রান্না ভালো করে। কিন্তু ঠিকমতো খেতে পারে না আবুল হাশেম, যেন কোনোকিছু ঠিকমতো গলা দিয়ে নামতে চায় না। ও ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করে। জবেদ আলীর বাপ দু’টুকরো ইলিশ উঠিয়ে দিতে গেলে বাম হাত দিয়ে বাধা দেয়।

দিও না, খাইতে ভাল্লাগে না।

রান্দা ভালো অয় নাই?

অইছে। মোর জিহ্বায় স্বাদ নাই।

বাড়ির লাইগ্যা মন পোড়ে?

ক্যা? পুড়বো ক্যা? বাড়িতে কেডা আছে?

মাইয়া।

আবুল হাশেম জবাব দেয় না। জবেদ আলীর বাপের মাইয়া শব্দটি শানে কেবল। জবেদ আলীর বাপ বিভিন্ন চেষ্টায় আবুল হাশেমের মনে মাইয়া শব্দটি প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। ওর মনে মতলব কাজ করে। তাই আবুল হাশেম উপেক্ষা করে–উপেক্ষা করে বোঝাতে চায় যে গায়ের জোরে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় না। তার জন্য খুব গভীর ভিত লাগে। রাহানুম এবং সুখদীপের সঙ্গে আবুল হাশেমের সম্পর্ক ছুটে গেছে। ও কাচের বাসনের ধারে মুখ লাগিয়ে ফুডৎ করে ডাল টানে। কিন্তু জবেদ আলীর বাপের দিকে তাকাতে পারে না। কিছুতেই ওর গ্লানি কাটে না।

হাত ধোয়ার সঙ্গে সঙ্গে পান এসে যায়। পানের খিলি মুখে পুরে আর দেরি করে না আবুল হাশেম। এখন না বেরুলে সন্ধ্যার আগে পৌছুতে পারবে না। এই মন খারাপের মধ্যে খুব আকস্মিকভাবে বাড়ির জন্য একটা টান ওঠে। একটু আগেও জবেদ আলীর বাপের প্রশ্নের উত্তরে ও বাড়ির কথা অস্বীকার করেছিল।

মহাজন, কতা তো পাকা?

হ। কতা পাকা। ছামনের মঙ্গলবার। তোমরা কয়জন আবা?

ধরেন চাইর-পাঁচজন আমু।

আচ্ছা, ঠিক আছে।

দরজার পাশ থেকে জবেদ আলীর মা কথা বলে, আবারো আইবেন মহাজন।

দেহি।

আবুল হাশেম পা বাড়ায়। ও পশ্চিম দিকে যাচ্ছে। সূর্য ঠিক ওর মুখের ওপর। খাড়া রোদ মাথা তাতিয়ে দেয়। দ্রুত পায়ে হাঁটে ও ঘাটে নৌকা তৈরি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *