০২. তখনো অন্ধকার ভালো করে কাটেনি

তখনো অন্ধকার ভালো করে কাটেনি। রাহানুম দ্রুত পায়ে নিঃশব্দে সাগরের পাড়ে এসে দাঁড়ায়। দেখে এসেছে নিঃসাড় ঘুমচ্ছে আবুল হাশেম। সুখদীপ ওর গলা জড়িয়ে রেখেছিল। রাহানুম হাত ছাড়িয়ে উঠে এসেছে। ভোরের ঠাণ্ডা বাতাসে ঘুমের আমেজ কেটে যায়। বড়ো বড়ো ঢেউ এসে গড়িয়ে যাচ্ছে সৈকতে।

এ সময়ে এভাবে সাগরের পাড়ে ছুটে আসা ওর এক প্রিয় অভ্যেস হয়েছে। ঘুম ভেঙে গেলে জোর করে আর চোখের পাতা বুজে রাখতে পারে না–তোলপাড় করে বুক; মন খারাপ প্রবল হয়ে উঠতে থাকে, তখন ও ভোরের স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে মেখে ছুটে আসে। ও জানে এই ছুটে আসা ওর মুক্তি–নইলে ভেতরটা গুড়িয়ে যেতে থাকে। এই অভ্যেস ওর এই নতুন জীবনের–আগে ও কখনো সাগর দেখেনি। সাগর থেকে বেশ খানিকটা দূরে ছিল ওদের গ্রাম–এভাবে চাইলেই ছুটে যেতে পারত না। এখন সাগর এত আপন হয়েছে যে বিশ বছর ও সাগর

দেখে কাটিয়েছে, এটা ওর মনেই হয় না। এই আপন হয়ে ওঠা ওর এক দারুণ অভিজ্ঞতা–ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছে অবিরত দুঃখের দংশন থেকে। ও জলের ভেতর লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে নিজেকে উজাড় করে। ফেলে।

আজো রাহানুম এক পা, দু’পা করে পানিতে নামে। আজ আর ঝাপিয়ে পড়ে না ও। একটু একটু করে পানির সঙ্গসুখ অনুভব করতে চায়। ও এভাবেই উপভোগ করে। প্রতিদিন একইভাবে নিজেকে উজাড় করে না। একটু একটু করে এগুতে ওর মনে হয় যতই পানির স্পর্শ বাড়ে ততই শিরশির করে শরীর। বিশ বছর বয়সে মা হয়েছিল ও, বিয়ে হয়েছিল আঠারোতে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তো ভেঙে গেল সব। ঢেউ ওর গলা সমান হয়েছে, আর একটা ঢেউ এলে তলিয়ে যাবে ও। তারপর ভুস করে মাথা জাগিয়ে উঠবে।

কিন্তু গলা সমান পানি থেকে ও আবার তীরের দিকে যায়, এত তাড়াতাড়ি ড়ুবতে চায় না। এটুকুই ওর মজা, এক ধরনের সুখ। অনেকটা যৌন সুখের মতো, বিয়ের পরই যে অনুভূতি ওকে আচমকা ধাক্কায় বদলে দিয়েছিল। এই বিস্ময়ের ঘোর কাটতে সময় লেগেছিল ওর। এখন মনে হয় বিশ বছর বয়সে একজন নারীর জীবন থেকে পুরুষ হারিয়ে গেলে হয়তো এমনই হতে পারে। ও জানে না এমন হয় কি না, ও বোঝে না এমন হওয়া উচিত কি না। শুধু ওর জীবনে এটুকু কি সম্পদ হয়ে থাকবে? অনুভূতির সম্পদ? ও বিড়বিড়িয়ে বলে, থাকুক, থাকুক।

শাড়িটা ওর গায়ে লেপ্টে গেছে। আলো ফুটলে ও নিজেকে পরিষ্কার দেখতে পাবে। দিনের প্রথম আলোতে নিজেকে দেখাটা ওর আনন্দ। কোথাও কেউ নেই, এ সময় কেউ থাকে না। তাই নিজেকে ছড়িয়ে রাখার এই জায়গাটা ওর আপন ঘরের কোণের মতোই লাগে–মনে হয় না এই খোলামেলা বিশাল চারপাশ অন্যদেরও, সবার। ও সৈকতে উঠে আসে। স্রোতে ভেসে আসা হিংরা কুড়ানোর জন্য ও বালুর ওপর হাঁটু গেড়ে বসে। রোদ উঠলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হিংরা কুড়ানোর জন্য ছুটে আসবে। এক একজন প্রায় ছোটখাটো এক ঝুড়ি হিংরা সংগ্রহ করতে পারে। রাহানুমও একটা টুকরি নিয়ে এসেছে। ও খুঁজে খুঁজে হিংরা তোলে আর গুনগুনিয়ে গান গায়। এই গানটা জামালের খুব প্রিয় ছিল। অন্ধকারে পুকুরপাড়ে দুজনে বসলে জামাল ওকে গান গাইতে বলত। ও চাপাস্বরে গাইত। ভয় ছিল পাছে বাড়ির লোকেরা শুনে ফেলে। জামাল ওর কণ্ঠে অভিভূত হয়ে বলত, আহা কী মিষ্টি গলা! আর একড়া গান গাও ময়না।

ধুত না। মানহে মন্দ বলবে।

অহনতো কোনো মানু নাই। ক্যাবল তুমি আর আমি।

তবু গলা ছেড়ে গান গাইতে ওর সংকোচ হতো। একটির বেশি দুটিও কখনো গাওয়া হয়নি। হিংরা তুলতে তুলতে মুহূর্তে হাত থেমে যায়। সাগরের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে, এখন জামাল কোথায়?

কিন্তু ভাবনা বেশিক্ষণ স্থিত হয় না। আবার ও ফিরে আসে নিজের বলয়ে–আবার কণ্ঠ গুনগুনিয়ে ওঠে। দ্রুত হাত চলে। প্রতিদিন ভোরবেলা সাগরে আসা হয় না। মাঝে মাঝে আসে, যেদিন করোটিতে রঙিন মাছ পাখনা মেলে ভেসে ওঠে সেদিন ও না এসে থাকতে পারে না, দেখতে চায় নিজেকে। ভোরের কুমারী আলোয় একজন কুমারী মেয়ের আকাক্ষা তীব্র হয়ে উঠলে–শরীরে রঙিন মাছ খুনসুটি করলে ও আর নিজেকে স্থির রাখতে পারে না। এই সাগর, বনানী, আকাশ এবং দিনের শুরুতে ও দেখতে পায় জলোচ্ছ্বাসে ধুয়ে যাওয়া একটি ছোট্ট জনপদ। আবুল হাশেমের সংসারে স্থিত হওয়ার পর ও আবুল হাশেমকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল নিজের গ্রামে, কিন্তু না সেখানে গ্রামের কোনো চিহ্ন নেই–একজন মানুষ, একটি ছাগল, একটি হাঁস কিংবা একটি গাছ কিছুই, কেবল খাঁ-খাঁ শূন্যতা, ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে যাওয়া সাদা মাটি। সেই শূন্যতায় কেমন অবশ হয়ে গিয়েছিল ওর চিন্তাশক্তি এমন করে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে একটি গাঁ? একফোঁটা চিহ্নও পেছনে ফেলে রাখবে না? ও ভাবতে পারে না। ফলে ওর কান্না আসে না, দুঃখও হয় না–ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শুধু। একসময়ে আবুল হাশেম ওর হাত ধরে বলে, চল মা?

ও আবুল হাশেমের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, কোমনে?

ক্যা মোর ঘরে?

আমনেহর ঘর?

তখন ওর সামনে ঘর ছিল না, ভিটেও না। দৃষ্টিতে শূন্যতায় বাধা পায় না। যতদূর চোখ যায় ঘর কোথায়? সে সময়ে ওর কোলে সুখদীপ কেঁদে ওঠে এবং সঙ্গে সঙ্গে সেই শূন্যতায় শিশুর কান্না জীবনের প্রবাহ ফিরিয়ে আনে। ও সুখদীপকে ঘাড়ের ওপর ফেলে পিঠ চাপড়ে কান্না থামাতে চায়। তারপর আবুল হাশেমের দিকে ফিরে বলে, বাবো, চলেন, আমনের ঘরে যাই।

তারপর ভেবেছিল জামাল বেঁচে থাকলে একদিন না একদিন ওকে খুঁজতে আসবে। আবুল হাশেমও ওকে এমন আশ্বাসই দিয়েছিল। ও আশায় আশায় দিন গুনেছে। কই এলো না তো, প্রতীক্ষার প্রহরই শেষ। সাগরের দিকে তাকিয়ে থেকেছে, কোনো ইঞ্জিন নৌকা কিংবা ট্রলারের আশায়। রাস্তার দিকে তাকিয়ে থেকেছে একটি মানুষের বিন্দু থেকে বৃহৎ হয়ে ওঠার আশায়, কিন্তু সবটাই অলীক, বৃথাই কেটে গেল কতগুলো বছর। সাগর যদি তিরিশ ফুট উঁচু হয়ে ওঠে, বাঁচতে পারে না অনেকে, যেমন মণিমালারা কিংবা জামালরা। শুধু আবুল হাশেমরা, রাহনুমরা বেঁচে থাকে আর একটি ঘর গড়ে তোলার আশায়। এবং সেই সঙ্গে একটি শিশুও। ওহ্ একটি শিশু! সেদিন দুধের ভারে কী বিশালকায় হয়ে উঠেছিল ওর স্তন। কী অপার আনন্দ ছিল একটি শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরার মধ্যে। আজ? আজ রাহানুম অন্যকিছু চায়–অন্য স্পর্শ, একটি হাত, একজোড়া ঠোঁট, গভীর নিঃশ্বাস। রাহামের সর্বাঙ্গে রঙিন মাছটা উঠে আসে–সোনালি শরীরের মাছে কালো ফোঁটা। সূঁচালো ঠোঁট। মাছের সুঁচালো ঠোঁট ওর শরীরে ঘুরে বেড়ায়। রাহানুম ব্রিত বোধ করে। ও হিংরার টুকরি রেখে আবার নেমে আসে জলে। পায়ের পাতার সমান জল–সেখানে মাছের সুঁচালো ঠোঁট। হাঁটু সমান জল–সেখানে মাছের ঠোঁট। কোমর সমান জল–সেখানে মাছের সুঁচালো ঠোঁট। বুক সমান জল, মাছের সঁচালো ঠোঠের ওপর বুক কাঁপে–কেঁপে কেঁপে এলিয়ে পড়ে, আলুথালু হয়ে যায়, অগোছালো হয়ে যায়–সাগরের তিরিশ ফুট ফুলে-ফেঁপে ওঠার মতো স্বাভাবিক, উন্মত্ত এবং গর্জমান হয়ে যায়। তখন স্রোতে ওর শাড়ি ভেসে গেলে ও নিজেই একটা রঙিন মাছ হয়ে যায়–স্বপ্নের, যন্ত্রণার এবং আগামী দিনের। রাহানুমের কান্না পায়। ও ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। নিজেকে ফাঁকি দিয়ে সাগরে এসে এই সুখ মেটানোর দায় থেকে ও নিজেকে মুক্ত করতে চায়। কেবলই ভাবে, এভাবে নয়, এভাবে নয়। এই নগ্ন শরীর নিয়ে ও কী করবে? ওর তো কিছু চাওয়া আছে।

তখনো সূর্য ওঠেনি। আকাশ লাল হয়েছে মাত্র। ও দু’চোখ মেলে দিগন্ত দেখে। এভাবেই তো বিশাল হওয়া–এভাবেই তো শুরু, এভাবেই। প্রথমে নীল ছিল আকাশ, তারপর সাদা হলো, তারপর লাল–রাহানুম নিজের মনে জোর খোঁজে এই ভেবে যে শুধু আকাশ বদলাবে কেন? কেন রূপান্তর সর্বত্র নয়? কেন নিজের মধ্যে নয়? যৌবনটা নীল ছিল, জামালের সঙ্গ-সুখ ছিল, মাতৃত্বের স্বাদ ছিল–সন্তানের আনন্দ–সবকিছু মুছে গিয়ে কেমন সাদা হয়ে গেল দিনগুলো, কত আর অপেক্ষা, কত? কোথাও থেকে তো জামাল আসে না–না সাগর থেকে, না বনভূমি থেকে, যেমন অনেক সময় অকস্মাৎ ফিরে আসত মাছ ধরা ফেলে রেখে, তখন ওর মধ্যে ঘরের টান প্রবল হয়ে উঠত–রাতগুলো হয়ে যেত নির্মল সাদা মেঘ। তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে দুজনে বসে থাকত পুকুরপাড়ে, মাথার ওপর শ্যামকুঁকড়ার ডাক। একটি নির্দিষ্ট গাছের মাথার দিকে তাকিয়ে থাকলে সেই মাথা দূর থেকে ক্রমাগত কাছে চলে আসত। একদম সামনে, একটি নকশিকাঁথার নকশা হয়ে–চিত্রিত ফুল বা হাঁড়ি, গাছ বা হরিণ–যেমন ঘন বন গজিয়ে উঠেছে ফাতরার চরে তেমন বন গজিয়ে ওঠে রাহালুমের চোখের সামনে। কোনো একটি জিনিস কাছে চলে এলে তখন ওর দুচোখের দৃষ্টি একসঙ্গে কাজ করে না। ডান চোখ দিয়ে তাকালে বাম চোখ সরে যায়, বাম চোখ দিয়ে তাকালে ডান চোখ। তখন আন্ধারমানিক নদী ওর মাথার মধ্যে খেলা করে–দৃষ্টির রেখা নদীর জল হয়ে সাগরের দিকে ছোটে।

জামালকে ও অনেকদিন বলেছিল সাগর দেখাতে নিয়ে যেতে। বলেছিল, মোর সাগর দেহার বড় সাধ। দেখমু ঢেউ কেমুন গর্জন করে।

তোমার ভয় করব না?

জামালের ঠোঁটে হাসির ঝিলিক।

ক্যা? পানিরে ভয় কী?

জামাল বলেছিল, ঠিক আছে, একদিন তোমারে সাগরে লইয়া যামু। ঢেউয়ের মদ্যে ভাসায়ে দিমু। তখন ভয় পাইলে–কথা শেষ না করতে দিয়ে রাহানুম বলেছিল, ভয় পাইলে কী? তুমি তো লগে থাকবা। তোমারে জাপটায়ে ধইরা রাখমু।

ক্যামনে ধরবা এহন দেহাও।

ধুত, ক্যাবল শয়তানি।

হাসতে হাসতে জামাল ওকে জড়িয়ে ধরে। জামাল জড়িয়ে ধরলে ওর কাছে তা সাগরে যাওয়ার সুখ হয়ে যেত।

এখন? এখন ও বোঝে পানি কত ভয়াবহ, প্রলয়ঙ্করী, ধ্বংসকারী হয়। কে বলে পানির অপর নাম জীবন? মরণ, মরণ বলতে বলতে রাহানুম জল ছেড়ে উঠে আসতে থাকে–ভিজে শাড়ি পায়ে জড়িয়ে। যায়। ওর দৃষ্টি সৈকতে আটকে থাকে। ও বাম চোখে দেখতে থাকে পানির একটি সবুজ রেখা আকাশ ছুঁয়েছে ডান চোখে দেখে এক বিশাল বালির পাহাড় মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে। অনবরত বালি ঝরছে সেখান থেকে। সে বালি ধুয়ে যাচ্ছে সাগরের জলে। যেদিন সুখদীপকে পেয়েছিল সেদিনও তো এমন বালি ধুয়ে যাচ্ছিল সাগরের জলে। সুখদীপ নামটা ওর রাখা। সেদিন সুখদীপকে না পেলে ওর জীবনটা হয়তো অন্য রকম হতো–যেমন আবুল হাশেমের সঙ্গে দেখা না হলে। ওর শরীর থেকে জল গড়িয়ে নামে। ও আর জলের ভেতর নেই। হিংরার টুকরিটা কাঁখে তুলে নিলে ও বুঝতে পারে ওর এবার ঘরে ফেরার সময়। ঘর? ঘর মানে কী? তিনজন মানুষ এক জায়গায় হলেই কি ঘর হয়? হৃদয়ের বন্ধন কি জোড়াতালির উর্ধ্বে, নাকি জোড়াতালির মধ্যে? রাহালুমের কাছে এর কোনো নির্দিষ্ট জবাব নেই। ও হাঁটতে থাকে। চারদিক খোলা এই হা-হা করা শূন্যতায় রাহালুমের একটা পাতানো ঘর থাকলেও রাহানুম বড়ো বেশি নিঃসঙ্গ বোধ করে। ধুয়েমুছে গেছে ওর বাবা-মা-ভাই-বোেন, ধুয়ে মুছে গেছে শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামী, ননদ–কিংবা ওরা কেউ কোথাও বেঁচে থাকলেও ও কারো হদিস জানে না। নিজের জীবন ছাড়া ওদের কোনো চিহ্ন নেই ওর কাছে। ওর এই নিঃসঙ্গতা কোনো আপাত নিঃসঙ্গতা নয়–এর বিস্তৃতি ব্যাপক এবং গভীর। এই গভীরতা থেকে ওর মুক্তি নেই। সৈকত পেরিয়ে আসার আগে ও একবার পেছন ফিরে তাকায়। এখানে কেবল চারদিকের সাদা আলো আর রাহানুম। আর কেউ নেই–আর কেউ কাছে এসে দাঁড়ায় না–শুধু স্বপ্নের মধ্যে রঙিন মাছটা সূচালো মুখ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। রাহানুম আর একা থাকতে চায় না–চায় আর কাউকে, আর একজন মানুষ। এই সাদা আলোর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা জীবনের একটা ভিন্ন স্রোত।

যে এসে বলবে, তোমার জন্য কতকাল ধরে অপেক্ষায় আছি, কেন তোমাকে খুঁজে পাই না, কেন লুকিয়ে থাকো? সেই কণ্ঠস্বর যেন উথালপাথাল করে আছড়ে পড়ছে কানের ওপর। শিরশির করে ওঠে শরীর। ও মনে মনে বলে, ক্যামনে তুমি মোরে পাইবা? মোর যে শরম করে। লোকটি এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে, শরম কেন রাহনুম? আমি তোমার কতকালের চেনা–তুমি আমার সব জানো–সব। আমি তাকালে আমার চোখে তুমি বাঁধা পড়ো, আমি কাছে দাড়ালে আমার গায়ের গন্ধ তোমাকে তাড়িত করে। আমি হাত বাড়ালে তুমি বিবি হাওয়া হয়ে ছুটে এসে দু’হাত বাড়িয়ে সে হাত ধরো। আমি আর তুমি হেঁটে যাই স্বর্গীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে, পেরিয়ে যাই উদ্যানের সীমানা। পেছনে পড়ে থাকে ঈশ্বরের হাহাকার। আমরা তাকাই না, ফিরি না–আমরা পৃথিবীর। আদর্শ মানুষ হয়ে নরম মাটিতে পা রেখে ঘর গড়ি।

চেতনার পথে কত কিছু কেমন করে ঢুকে যায়–এত কিছু ভাবনা ওর করোটিতে ভেসে আসে কোথা থেকে ও জানে না–মানুষের আদিম ভাবনা বুঝি এমন–এমন। ওর মন খারাপ হয়ে গেলে হিংরার টুকরিটা অসম্ভব ভারী মনে হয়। ওই বালুভূমি ছাড়িয়ে বনভূমিতে ওঠে। পায়ের নিচে দূর্বা ঘাস, মেটো পথের দুপাশে বৈচি, বনবরই আর ভট ফুলের ঝোপ। দূরে গোল হয়ে আছে মিঠে পানির জলাভূমি, তার ওপাশে ধানক্ষেত, নারকেল গাছগুলো সবচেয়ে উঁচু হয়ে মাথা তুলে রেখেছে। প্রতিদিনের চেনা এই পথ–প্রতিদিনের আসা-যাওয়া, তবুও এই পথের দু’পাশে কোথাও একটা ছন্দ আছে, সেটা ও অন্যদিন দেখতে পায় না, আজ পাচ্ছে। আজ ওর অন্যরকম লাগছে কেন? ওর ইচ্ছে হয় একটু বসতে। মনে হয় ইচেছইতো সব–ইচ্ছেইতো মানুষকে চালিয়ে নিয়ে বেড়ায়। ছুটতে বলে, বসতে বলে। খেতে বলে, ঘুমুতে বলে। ইচ্ছে না থাকলে কি চলা যায়? বেগবান হওয়া যায়? হঠাৎ করে মাথার ওপর পাখি ডেকে ওঠে। ও ওপরে তাকায়–পাখির ডাকে নিজের ইচ্ছেটাই যেন কচকচিয়ে ওঠে। রাহানুম খুশিতে চারদিক তাকায়। পাখিটা উড়তে উড়তে অনেকদূর চলে যাচ্ছে–মিলিয়ে যাচ্ছে, আর দেখা যাচ্ছে না। দেখাতো যাবেই না। সবকিছুই এক সময় না এক সময় জীবন থেকে মুছে যায়। উল্টো দিক থেকে উড়তে উড়তে আসে নতুন পাখি। ও জঙ্গলের ভেতর খানিকটা ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকে। হিংরার টুকরিটা কোমর থেকে নিচে নামায়। ভারী টুকরি বহন করার ফলে কোমরে কেমন খিচ ধরে আছে। নিজেকে টানটান করার জন্য ও দু’হাত ওপরে তোলে। বাঁয়ে ঝোঁকে, ডানে ঝেকে–আড়মোড়া ভাঙে। বেশ ঝরঝরে লাগছে।

তখন ওর মনে হয় কেন কেবলই ঘরে ফেরা? কেন দেরি করলে কী হয়? সুখদীপ খিদেয় কাঁদছে? সুখদীপ ওর ছেলে–ছেলের জন্য ওর বুকে মমতা আছে। সুখদীপ কাঁদলে ওর কষ্ট হবে। তাই ওকে হিংরা সেদ্ধ করে লবণ মাখিয়ে দিতে হবে। ও খাবে। খেয়ে দেয়ে খেলতে যাবে। ছেলেকে খুশি রাখা কি মার দায়িত্ব? হয়তো তাই। রাহানুম নিজেকে বোঝায়। শুধু সুখদীপ কেন, ঘরে আবুল হাশেম আছে। তাকেও খেতে দিতে হবে। সে হিংরা সেদ্ধ খাবে না। খাবে পান্তা, সঙ্গে বাসি তরকারি কিংবা একমুঠি পোড়া মরিচ। মরিচে লাল হয়ে যাবে ভাত-ভর্তি সানকি। খেয়েদেয়ে আবুল হাশেম বেরুবে। সংসারে কত কাজ আছে সেগুলো করতে হয়। তারপর রাহানুম নিজে ভাত খাবে। খেয়েদেয়ে বড়ো করে ঢেকুর তুললে ওর মনে হয় জীবনের একটা সীমানা আছে। এপার আর ওপার। জলোচ্ছাসের সেই কালরাত সেই সীমানা টানা লাইন। মোটা দাগে টানা, মুছে ফেলা কঠিন। ঢেকুর তোলার পর কি? রাতের এঁটো বাসনকোসন-হাঁড়িপাতিল ধোওয়া, উঠোন ঝাড় দেওয়া, গোয়াল পরিষ্কার। করা, দুপুরের রান্নার জন্য তৈরি হওয়া? এই যদি সব হয় তাহলে কেন ঘরে ফিরবে? না, আজ ও ফিরবে না। ও একটা বড়ো গাছের কাণ্ডে হেলান দিয়ে বসে থাকে। পা ছড়িয়ে দেয়, ভিজে শাড়ি গা থেকে আগলা করে পানি নিংড়ায়। ওপর থেকে শুকনো পাতা ঝরে পড়ে ওর কোলের ওপর। পাতাটা নেড়েচেড়ে নিরিখ করার জন্য চোখের সামনে ধরতেই দৃষ্টি ডান এবং বাম হয়ে যায়।

জামাল ওকে নিয়ে বেড়াতে অলোবাসতো। পুকুরপাড় থেকে উঠে আসতে রাত হয়ে যেত–ওদের চারদিকে জোনাকির ভিড় জমে উঠত। মাত্র দুটো বছর, তবুতো এখনো জামালই–সবকিছু ফুরিয়ে যাবার পরও ছয় বছর পেরিয়েছে তবু জামালই ওর জীবনে সত্য হয়ে আছে। এই সত্য এখন আর ওর মানতে ভালো লাগে না–এই সত্যকে ও অস্বীকার করে নতুনের প্রতিষ্ঠা চায়। যেমন করে একদিন জামাল ওর জীবনে নতুনের দরজা খুলেছিল। কত রাত, কত দিন ওদের ভালো লাগার মুহূর্ত পেরিয়েছে। ওদের খুনসুটি দেখে রাগ করত ওর ভাশুর। রাগী মানুষটির কাছে হৃদয়ের ব্যাপারগুলো ছিল উপেক্ষণীয়, মূল্যহীন। কিন্তু জামাল তার বড় ভাইয়ের মনোভাব কখনো মানেনি। রাহালুমের সঙ্গে ওর শারীরিক সম্পর্কের চেয়ে অনেক গাঢ় সম্পর্ক ছিল মনের। তাহলে জামালই কি ওর জীবনের একমাত্র মানুষ থাকবে? রাহানুম পাতাটা পায়ের নিচে রাখে। মনে মনে বলে, না, এই শুকনো পাতার মতো ঝরে যাবে জামাল। আবার বসন্ত, আবার নতুন পাতা গজানোর দিন। আমি কিছুতেই ফুরিয়ে যাব না।

আমি কি একজন মানুষ? না, অনেকজন? আমি কি ঢেউয়ের মতো ভেঙে ভেঙে বিশাল হই? ঢেউ যেমন স্রোতে মিশে যায়—খলখল কলকল শব্দে গড়ায়–গড়াতে গড়াতে–আহ আমি আর ভাবতে চাই না। ও তখন শুকনো পাতা পায়ের নিচে মাড়িয়ে চলে, একটি দিনের শুরু, আর একটি দিনের শেষ। অতএব আমি অনেক, অনেকজন। চারদিক থেকে সাদা আলো মুছে যাচ্ছে–দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। উঠবেই। তাই সরে যাচ্ছে গাছের মাথার ওপর থেকে ফিকে অন্ধকার। রাহানুম অস্থির বোধ করে। এক পা দুপা ফেলে জঙ্গলের ভেতর খানিকটা হেঁটে আসে। এখানে অন্য কোনো প্রাণী নেই, ভয় শুধু সাপ, নয়তো শুয়োপোকা। শুয়োপোকা ভীষণ ভয় পায় রাহানুম। হঠাৎ করে সেই ভয়ে ও চারদিক তাকায়–পাতার নিচ, পাতার ওপর দেখে। না কোথাও খুঁয়োপোকা নেই। সামনে পিছনে সাপও নেই। এই মুহূর্তে এটা ওর জন্য ভীষণ নিরাপদ জায়গা। তবুও ওকে ঘরে ফিরতে হবে।

এই মেঠো শুকনো মাটির পথ বেয়ে আমাকে পৌছুতে হবে ঘরে–ঘরে আমার জন্য অনেক কাজ অপেক্ষা করছে। আমি গেলে নড়বে গৃহস্থালি, সুস্থির হবে গৃহস্থালি–সেই ভুবন একটি স্বাভাবিক আকার পাবে। নইলে নকশা উল্টে যাবে, বেঢপ আকার গ্রাস করে ঘরের মানুষকে–প্রত্যেকে বিরক্ত হয়, মন খারাপ করে এবং তা কারোই কাম্য নয়। সুতরাং আমাকে যেতেই হবে। নিজের জন্যও এই যাওয়া। আমি এখন বৃত্তের মধ্যে প্রবেশ কর।

রাহানুম হিংরার টুকরি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। গাছের আড়াল থেকে তখনো বের হয়নি। পা দুরে কি দাবে না তখন পেছনে শুনতে পায় গানের সুর–কেউ বুঝি গান গাইতে গাইতে এগিয়ে আসছে। পরিচিত সুর নয়–গাঁয়ের চেনা কেউ হবে বলে ওর মনে হয় না। লোকটি এগিয়ে এসেছে। রাহানুম গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখে। না, লোকটিকে ও চেনে না। সম্ভবত ও ভিন্ন গায়ের কেউ। লোকটি অনেকটা এগিয়ে গেলে ও রাস্তায় ওঠে। পেছনে আর কেউ নেই, সামনে একজন মানুষ চলে যাচ্ছে। একজন মানুষকে চলে যেতে দেখলে মন খারাপ হয় ওর। ও দুপা এগিয়ে থমকে দাঁড়ায়। ওর এগুতে ইচ্ছে করছে না। লোকটি চলে যাক–একদম ওর দৃষ্টির আড়ালে গেলে তারপর ও এগুবে। ও জঙ্গলের ভেতর ঢুকে একগোছা স্বর্ণলতা ঘেঁড়ে, জানে না কী করবে? ছিড়লই বা কেন? স্বর্ণলতা দিয়ে দু’হাতে দড়ি পাকায়। তারপর ছুঁড়ে দেয় দূরে। ওটা কপলা গাছের ডালে গিয়ে আটকে থাকে।

মানুষটি চলে গেলে ওর মাথা এমন দড়ির মতো পাকিয়ে থাকে। মনের বিনুনি এমন জটিল হয়ে উঠেছে যে, ও কোনো শক্ত বাঁধনে নিজের সবটুকু বেঁধে রাখতে চায়। ও ঝরাপাতা না মাড়িয়ে নিঃশব্দে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসে। আজ অনেক বেলা হয়ে গেল ফিরতে। আর কোনোদিন ও এত দেরিতে ফেরেনি। এই দেরিতে ফেরার জন্য ওর কেমন সংকোচ হয়। গায়ে ভিজে শাড়ি লেপ্টে থাকলে ওর তি হওয়ার মাত্রা বেড়ে যায়। দু-একজন মানুষ পথে বেরিয়েছে, সবাই ওর চেনা, ওরা ট্রলারে যাচ্ছে। মাছ ধরতে যাবে। ওদের কারো পিঠে জাল, কারো ঘাড়ে পানিভরা কলস। নোনা সমুদ্রে গেলে মিঠে পানি সঙ্গে না থাকলে ওরা তৃষ্ণায় মরে যাবে। রাহালুমের বুক শিউরে ওঠে। তৃষ্ণা যে কত হাজার রকমের! ওহ মানুষের তৃষ্ণা কত প্রবল। মানুষ কেবল তৃষ্ণা নিয়ে ছটফট করে। ও বুঝতে পারে যারা ওর দিকে তাকিয়ে থাকছে তাদের ভাষা। ও কারো দিকে তাকায় না। দ্রুত পায়ে হাঁটে। সুখদীপের কথা মনে হতেই ওর মন খারাপ হয়ে যায়। ও হয়তো ঘুম থেকে উঠে কান্নাকাটি করছে–হয়তো ওর ভীষণ খিদে পেয়েছে। আহা বেচারা আবুল হাশেমের কথা মনে হতেই ওর ভয় করে। হয়তো চোয়াল কঠিন করে বারান্দায় বসে আছে, পছন্দ করতে পারছে না ওর এতটা বেলা পর্যন্ত ঘরে না ফেরা।

পথে বুড়ো মুনসি একগাল হেসে কুশল জিজ্ঞেস করে, কেমন আছো মা?

আছি ভালো।

রাহানুম হেসে মাথা নাড়ে। মুনসি চাচাকে ওর ভালো লাগে। হাসিভরা মুখের দিকে তাকালে মনে হয় আপনজন। মুনসির চেহারায় একজন পিতার প্রশ্রয় আছে। মুখ থেকে হাসি ফুরোয় না। কখনো রাগতে দেখা যায় না। আবুল হাশেম বলে মুনসি পুরুষ মানুষ না। রাগ না থাকলে পুরুষ মানুষকে মানায় না। আসলে মুনসির জালে প্রচুর মাছ ওঠে এটা আবুল হাশেমের ঈর্ষা এবং ক্রোধ। রাহানুমকে প্রায়ই এই কথা শুনতে হয়। এসব কথা মনে করে রাহানুম হেসে ফেলে, আমনহে ভালো। আছেন চাচা?

হ, আছি। সাগরে গেইল্যা বুঝি?

হ, গেইল্যাম।

ভালো, ভালো। হিংরা টোকাইছো?

হ, আইজ মেলা পাইল্যাম।

ভালো, ভালো।

মুনসি ঘন ঘন মাথা নাড়তে নাড়তে চলে যায়।

রাহানুম দেখে গাছ-গাছালির মাথায় রোদ ভরে গেছে। ওর জীবনে আর একটি দিনের আলো এবং রোদ শুরু হলো। আলো এবং রোদ–আলো এবং রোদ–ভাবতে ভাবতে রাহানুম বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ালে অবশ হয়ে যায় শরীর। দেখে সাগরের পাড়ে দেখা সেই লোকটি উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। কোমরে হাত রেখে চারদিকে তাকাচ্ছে। এখন রাহামের দিকে ওর পিঠ। ঘুরলেই রাহানুমকে দেখতে পাবে। ও চট করে ঘুরছে না। একভাবে দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দায় উঠবে কি না হয়তো তা ভাবছে কিংবা চিৎকার করে কাউকে ডাকবে কি না সেকথাও ভাবছে। রাহানুম বুঝে যায় যে আবুল হাশেম এবং সুখদীপ ঘুম থেকে উঠেনি। তাই ও কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। রাহানুম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হিংরাভা টুকরি নিয়ে রান্নাঘরের দরজার কাছে রাখে। তখন লোকটি রাহানুমকে দেখতে পায় এবং দু’পা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, এইডা কি আবুল হাশেমের বাড়ি?

হ।

রাহানুম সোজাসুজি লোকটির মুখে দিকে তাকাতে পারে না। মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। মাথার ঘোমটা ঘন ঘন টানে।

লোকটি ভরাট কণ্ঠে বলে, হের ধারে মোর কাম আছে?

আইছেন কোমনে দিয়া?

লতাচাপালি দ্যা আইছি।

বয়েন।

রাহানুম বারান্দায় বিছানো হোগলা দেখিয়ে দেয়। এতক্ষণে লোকটির চোখে চোখ পড়ে। লোকটি গভীর চোখে ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসে। ওর পায়ে জুতো নেই। পরনে সবুজের ওপর সাদা চেক-কাটা লুঙ্গি। সেটা পায়ের গোড়ালি থেকে অনেকখানি ওপরে ওঠানো। জুতো না পরে অনেকদূর থেকে হেঁটে এলে বুঝি লুঙ্গি এভাবে পরতে হয়। গায়ে ছিটের জামা। সাদার ওপর খয়েরি রঙের লতাপাতা আঁকা ছিটকাপড়। জামার ওপরের দিকে দুটো বোম খোলা। বুকের ঘন কালো পশম দেখা যায়। ওর বাম হাতে তাবিজ বাঁধা–বেশ বড়ো সাদা রঙের তাবিজ। ওর চোখে চোখ পড়ার পর থেকে রাহামের মনে হয় চোখ জোড়ায় এক ধরনের মায়া আছে।

মনে মনে দুরন্ত সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করে, আমনেহর নাম কি?

জবেদ আলী।

নাম বলে লোকটি মুচকি হাসে। বড়ো গোঁফ। খাড়া নাক। শরীরের বাঁধুনি ভালো। খুব অল্প সময়ে জবেদ আলীকে দেখা হয়ে যায় রাহামের। ওর ভালোই লাগে। ওর ভেজা শাড়ি শরীরে শুকিয়ে গেছে।

অনুভব করে আঁটসাঁট শরীরের বাঁধনে ফুরফুরে ভাব। দ্রুত দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে।

বাজান? বাজান?

জবেদ আলী বারান্দায় বসে রাহালুমের কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। মনে হয় এক আশ্চর্য কণ্ঠ–এর সঙ্গে সাগরের কলধ্বনির মিল আছে, তবু শুনতে ভালো লাগছে। রাতদিন শুনলেও ভালো লাগা ফুরোবে না। জবেদ আলী মনে মনে হিসেব কষে। ক্ষেত, লাঙ্গল, গরু, ফসল ইত্যাদির হিসেব। কত ধানে কত চাল সে হিসেবও মনের মধ্যে পাক খায়।

রাহানুম আরো দুতিন বার বাজান, বাজান বলে ডাকে। শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়েছে আবুল হাশেম। ধরতে গেলে প্রায় সারারাতই জাগা। তাই ঘুম ভাঙে না। আরো কয়েকবার ডাকতে হয় রাহনুমকে। যখন ঘুম ভাঙে তখন বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আবুল হাশেম, যেন পূর্ণিমার সুরা পান করে তার মগজে এখন খোয়ারি। রাহানুম ওকে ধাক্কা দেয়।

ও বাবো, ওঠেন। লতাচাপালি দ্যা আমনহের ধারে অউক্যা ব্যাডা আইছে।

কোমনে? ক্যা?

যেন আবুল হাশেমের কান পরিষ্কার নয়। ঠিকমতো শুনতে পাচ্ছে না।

লতাচাপালি দ্যা বাবো? লতাচাপালি?

রাহানুম কিছুটা চেঁচিয়ে বলে। আবুল হাশেম তবুও জিজ্ঞেস করে, ক্যা আইছে?

মুই জানি না।

অকস্মাৎ মন খারাপ হয়ে যায় রাহালুমের। অভিমানও হয়। লোকটিতো ওকে বলেনি যে কেন এসেছে। লোকটিতে ওকে বলতে পারত? বললে কী ক্ষতি হতো। অভিমানে ওর চোখ ছলছলিয়ে উঠতে চায়। ও ঠোঁট কামড়ে রেখে নিজের আবেগ দমন করে।

আবুল হাশেম বিছানায় উঠে বসে। ঘুমের আমেজ কাটতে চায় না। বসে বসে হাই তোলে। চোখ কচলায় আড়মোড়া ভাঙে। বালিশের নিচ থেকে গেঞ্জিটা টেনে বের করে গায়ে দেয়। গামছা খুঁজে নিয়ে ঘাড়ের ওপর ফেলে। রাহানুম ভেবে দেখল লোকটি যদি ওকে বলত কেন এসেছে তাহলে আবুল হাশেমের কাছে ও বেশ বাহাদুরি নিতে পারত। খবরটা বলতে পারলে আবুল হাশেমের কাছে ও গুরুত্বপূর্ণ হয় যেত। সেটি হলো না। এটি একটি পরাজয় বলে মনে হয় ওর।

এখন আবুল হাশেম উঠছে না দেখে ওর রাগ হয়। লোকটি বাইরে অপেক্ষা করছে। ও কতক্ষণ অপেক্ষা করবে? কাউকে বসিয়ে রাখলে তাকে গুরুত্ব কম দেওয়া হয়। রাহানুম দাঁত কিড়মিড় করে। আবুল হাশেম দ্রুত বেরিয়ে লোকটিকে আপ্যায়ন করলে লোকটির কাছে ওর গুরুত্ব বাড়ত। বুঝত বাবার সংসারে রাহামের ভীষণ প্রতিপত্তি। মনে হয় এখানেও ওর পরাজয় হলো। সকাল বেলার দারুণ সময় পেরিয়ে ও এখন খারাপ সময়ে প্রবেশ করেছে। ও বিষণ্ণ হয়ে যায়। খারাপ লাগতে শুরু করে।

আবুল হাশেম তখনো বিছানায় বসেই আছে। রাহানুম দৃষ্টিতে আগুন ঝরিয়ে বিড়বিড়িয়ে গাল দেয়, বুড়া হাবড়া। য্যান ল্যাংড়া অইছে। আঁটতে পারে না।

আবুল হাশেম রাহানুমকে ভ্রুক্ষেপ করে না। ধীরেসুস্থে স্পঞ্জের স্যান্ডেলে পা ঢোকায়। রাহানুম ঘরের কোণে গিয়ে এঁটো বাসনকোসন নিয়ে পুকুরঘাটে যাবার জন্য তৈরি হয়। পরক্ষণে ও চুপ করে বসে থাকে। ওই লোকটির সামনে দিয়ে পুকুরঘাটে যেতে লজ্জা করে। দুদুটো পরাজয় ওকে ম্রিয়মাণ করে রেখেছে। দেখতে পায় আবুল হাশেম ধীরেসুস্থে বাইরে যাচ্ছে। সুখদীপ ঘুম থেকে উঠে বাইরে গিয়েছিল–পুকুর থেকে হাতমুখ ধুয়ে এসেছে। হোগলার ওপর বসেই চেঁচিয়ে বলে, মা ভাত দাও।

রাহানুম তাকের ওপর থেকে একটা কাচের বাসন নামায়। সেই বাসনে সুখদীপকে পান্তা বেড়ে দেয়। সুখদীপের চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। ও বুঝতে পারে না মায়ের আজ কিসের খুশি যে ওকে কাচের বাসনে খেতে দিল? ও মার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কাচের বাসনে ভাত দিলে ও ভীষণ খুশি হয়, কিন্তু বাসন তো সবদিনের জন্য নয়। সুখদীপ ইচ্ছে করলেই কাচের বাসনে খেতে পারে না–তার জন্য বিশেষ দিন বা অতিথির প্রয়োজন হয়। ও ধরে নেয় আজ তাহলে মায়ের কাছে ওই লোকটি বিশেষ অতিথি। ও সাবধানে দু’হাত বাড়িয়ে মার হাত থেকে বাসনটা নেয়।

কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করে, বাসনে ভাত দিলা ক্যা মা?

রাহানুম মৃদু হাসে, কিছু বলে না। পান্তা ভাত সপসপিয়ে খায় সুখদীপ। রাহানুম ওর উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই ছেলেটিকে ও গর্ভে ধারণ করেনি, কিন্তু ও জানে ও ওর মা। এই স্বস্তি নিয়ে ছেলেটি কি সারাজীবন কাটাবে? না কি এখনই ওকে সবকিছু বলে দেওয়ার সময়? ও জেনে যাক ওর জীবনের এক কঠিন সত্যকে। কেন ওকে এই সত্য থেকে আড়াল করে রাখতে হবে? কী লাভ? তাতে ওর জীবনের ক্ষতিবৃদ্ধিই বা কী? রাহানুম নরম কণ্ঠে ডাকে, সুখদীপ।

ও মুখ তুলে তাকায়। মুখভর্তি ভাত, গাল ফুলে আছে। কথা বলতে পারছে না। ভুরু উঁচিয়ে ইশারায় ইঙ্গিত করে, কী?

রাহানুমের বুক তোলপাড় করে ওঠে। বলেই ফেলবে বুঝি সব। সুখদীপ কেঁাত করে ভাত গিলে বলে, কি মা?

তখন বারান্দা থেকে আবুল হাশেম প্রবল উচ্ছ্বাসে চেঁচিয়ে ওঠে, ও রাহানুম, সুখদীপ? হুইন্যা যা?

রাহানুম দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়, বাজান।

জবেদ আলী খবর আনছে আন্ধারমানিক নদী দ্যা যে চর জাগছে ওইডা মোর। ওহানে আগে মোর জাগা আল্যে। বেডারে তো মিষ্টিমুখ করান লাগে। গরে মিডা আছে?

আছে বাবো। তালের মিডা।

দে মিডা দে, ভাত দে।

রাহানুম বুঝতে পারে যে জবেদ আলী ওর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আবুল হাশেমকে কাজের কথা বলা হয়ে গেছে জবেদ আলীর। সুতরাং আবুল হাশেমের সঙ্গে কাজ শেষ। এখন সে মুক্ত মানুষ। অনায়াসে রাহামের দিকে মনোযোগ দিতে পারে। এখন আর কে তাকে বাধা দেবে? চোখে চোখ পড়লেও দেখে জবেদ আলীর দৃষ্টি একটুও নড়ে না, কাঁপে না–স্থির অচঞ্চল। ওর শরীর শিরশির করে। রঙিন মাছের সূঁচালো মুখটা ওর উরুতে এসে আটকে যায়। ও দ্রুতপায়ে ফিরে আসে আগের জায়গায়। সুখদীপের খাওয়া শেষ। ওর বাসনে পানি ঢেলে হাত ধুয়ে নেয়। একবার মুখ তুলে জিজ্ঞেস করে, কী অইছে মা?

রাহানুম আস্তে করে বলে, তোর দাদা নতুন চরের মহাজন অইছে।

ক্যামনে?

ওহানে আগে তোর দাদার জাগা আল্যে। নদী ওই জাগা ভাইঙ্গা নেয়। অহন ওহানে চর উঠছে।

মোরা যামু না?

জানি না বাজান।

রাহালুমের চিত্তে শঙ্কা। সুখদীপের মতো খুশিতে লাফিয়ে উঠতে পারে না। আবুল হামেশের অনেককাল আগের সম্পত্তি। তাতে ওদের কী? ওরাতো আবুল হাশেমের কেউ না। ফলে জমিতে ওদের কোনো ভাগ নেই। কোনো দাবিও নেই।

তাই বলে ওরা কি খুশি হবে না? আবুল হাশেম এই মুহূর্তে ওদের আশ্রয়দাতা, শুধু আশ্রয়দাতাতো নয়, আবুল হাশেম ওদের প্রিয়জন। ওরা আবুল হাশেমকে ভালোবাসে, আবুল হাশেম ওদের ভালোবাসে। তাই আবুল হাশেমের ভালোেমন্দের সঙ্গে ওদের জড়িত হওয়া উচিত। রাহানুম অকস্মাৎ খুশিতে গদগদ হয়ে বলে, হ, বাজান, মোরাও নতুন চরে যামু। তোমার দাদার চরতো মোগও চর। আল্লারে নতুন মাটির গন্ধ না জানি কেমুন।

হ মা, ঠিক কথা।

লাফিয়ে ওঠে সুখদীপ। একছুটে বারান্দায় গিয়ে আবুল হাশেমের কোল ঘেঁষে বসে।

রাহানুম তালের গুড়ভরা কলস নামায় তাকের ওপর থেকে। একটা কলসের গুড় তলানিতে এসে ঠেকেছে। ও সে কলসটা না নামিয়ে নতুন একটা কলস খোলে। নতুন মেহমানের জন্য একটু ভিন্ন আয়োজন। আবুল হাশেম ঘরে ঢোকে। ভীষণ উত্তেজিত। ফিরে পাওয়া সম্পত্তির কথা শুনে নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না। উত্তেজিত হলে আবুল হাশেম দ্রুত কথা বলে এবং কাঁধে রাখা গামছা ঘন ঘন নাড়ায়। বলে, কাচের বাসনে ভাত দে মা?

রাহানুম আরো দুটো কাচের বাসন মামায়। জবেদ আলী ওদের জীবনে ওলটপালট ঘটিয়ে দিয়েছে। রাহানুম হাতের কাজ বন্ধ করে আবুল হাশেমের দিকে তাকায়। আবুল হাশেম দুবার পায়চারি করে। আবার বলে, তুই জবেদ আলীরে ভাত দে মা। মুই পুকুর ধার দ্যা আই।

বাবো, বেডাটা কে? আগে তো দেহি নাই?

ওর বাপ মোর জমির বর্গাদার আল্যে।

অহন নাই?

জমিতো ছেল না। অহন চর জাগছে।

আবার বর্গা দেবেন?

দেহি, কী করি। আবুল হাশেম মাথা নেড়ে চলে যায়। উত্তেজনা রাহানুমকেও আচ্ছন্ন। করে। নতুন চর? কেমন দেখতে? মাটি কি ফকফকে সাদা নাকি লাল? সেটা কি পলিমাটির চর? নাকি কাদাভরা? স্বপ্নের মতো মনে হয় নতুন চরের গল্প। ছোটবেলার শোনা রূপকথা যেন। তেপান্তরের মাঠ আর পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় করে চড়ে আসা রাজপুত্র। ওই কী আনন্দ। বাবো একডা চরের মহাজন। ভাবতে ভাবতে পান্তাভাতের হাঁড়িতে হাত ড়ুবিয়ে কাচের বাসনে ভাত ওঠায়। বেশ বড়ো একটা বাটিতে গুড় ভরেছে। লোকটি কেমন খেতে পারে? অনেক? কী খেতে ভালোবাসে? কেমন তরকারি? কী মাছ বেশি পছন্দ? ও কি আইট্টা কলা দিয়ে ভাত মাখিয়ে খায়? মোষের দুধ খায় নাকি গরুর? ওর স্বাস্থ্য ভালো, চমৎকার তাগড়া। নিশ্চয়ই ও প্রচুর খায়। এই সিদ্ধান্তে আসার সঙ্গে সঙ্গে লোকটির খাওয়া সম্পর্কে ওর ধারণা হয়ে যায়। কাচের বাসনে ভাত বেড়ে ওর মনে হয় রাতের বাসি তরকারি দিয়ে ভাত দেওয়া ঠিক হবে না। ও দ্রুত মাচানের ওপর উঠে মাটির হাঁড়িতে তুষের ভেতর লুকিয়ে রাখা দুটো হাঁসের ডিম বের করে। রান্নাঘরে গিয়ে পেঁয়াজ-মরিচ কুচিয়ে ভেজে ফেলে। ওর খুব। ইচ্ছে করে আরো কিছু রান্না করতে, কিন্তু এখনতো সময় নেই। এখন ভোরের খাবার দিতে হবে। লোকটি অনেকদূর থেকে হেঁটে এসেছে, নিশ্চয়ই ভীষণ খিদে পেয়েছে। তাহলে কি লোকটিকে ও দুপুরে খেয়ে যাবার জন্য বলবে? মন্দ হয় না। আবুল হাশেম রাজি হতে পারে। বাড়তি ঝামেলা মনে করবে না। কারণ অতিথি তো ওদের তেমন কেউ আসে না। কেউ এলে কত যে খুশি লাগে আজ তা মনে হলো। ডিম ভাজা পান্তাভাতের ওপর সাজিয়ে দেয় ও। সরষে তেলে শুকনো মরিচ ভেজেছে অনেকগুলো। কয়েকটা মরিচ ভাতের ওপর গেঁথে দেয়, যেন উঁচু পাহাড়ের ওপর পতাকা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভাতের থালার দিকে তাকিয়ে থেকে ও নিজেই মুগ্ধ হয়ে যায় সারক্ষণে মনে হয় এতকিছু ভাবা কি সংগত না অসংগত? তাহলে ওকি অন্যকিছু ভাববে? ও কী কাজ করে? মাছ ধরে না জমি চাষ করে? ওর কি ঘরে বউ আছে? ছেলেমেয়ে? ওর কি সুখের সংসার? মুহূর্তে বিষণ্ণ হয়ে যায় রাহানুম। সঙ্গে সঙ্গে ওর মনে হয় এতকিছু ভাবা উচিত নয়। যে ভাবনা মন খারাপ করে সে ভাবনা। দূরে থাকুক বলে ও উঠে পড়ে।

ততক্ষণে আবুল হাশেম হাতমুখ ধুয়ে এসেছে। এতক্ষণ সুখদীপ ওর সঙ্গে কথা বলছিল। লোকটি কী কথা জিজ্ঞেস করেছে সুখদীপকে? ও সুখদীপকে ডাকে। সুখদীপ দৌড়ে আসে, কী মা?

এইগুলা লইয়া যাও।

সুখদীপের হাতে পানির জগ আর লবণের বাটি পাঠায়। নিজে ভাতের বাসন দুটো নিয়ে এসে বারান্দায় হোগলার ওপর রাখে। ডিম ভাজা এবং লাল মরিচ সাদা ভাতের ওপর বেশ নকশি করা মনে হচ্ছে, ভালোই লাগে রাহামের। বুঝতে পারে লোকটির কাছাকাছি এলে ওর বিষণ্ণতা কেটে যায়। শুধু বুকের ভেতর আশঙ্কা, ডিমভাজা লোকটার পছন্দ হবে তো?

ভাত দেখে দরজার এপাশে আসার সঙ্গে সঙ্গে ও নিজের আচরণে নিজেই বিব্রত বোধ করে। বুঝতে পারে না যে লোকটাকে খুশি করার জন্য ওর এমন আপ্রাণ চেষ্টা কেন? ও এমন ভাব করছে যেন লোকটার খুশি-অখুশির ওপর ওর অনেক কিছু নির্ভর করছে? এইসব ভেবে ও খুব লজ্জিত হয়। গুড়ের বাটিটা নিয়ে ও আর লোকটির সামনে যেতে পারে না। সেটা নিয়ে যাবার জন্য সুখদীপকে ডাকে।

লোকটি খেতে শুরু করলে আবুল হাশেম ঘরে ঢোকে। রাহানুম তড়িঘড়ি জিজ্ঞেস করে, বাবো আমনহের ভাত দিমু?

অহন না, পরে।

আবুল হাশেমের মধ্যে সেই আবুল হাশেম জেগে উঠেছে, যার বাড়িঘর, জমি জলোচ্ছ্বাসে ধুয়েমুছে যায়নি। যার জমি ছিল, ধান ছিল, গাভী-বলদের বাথান ছিল, অসংখ্য হাঁস-মুরগি, ডিম–শত শত ডিম। ছিল। সে কেন বর্গাচাষীর সঙ্গে ভাত খাবে? আবুল হাশেম খানিকটা দূরত্বে বসে জবেদ আলীর খাওয়া দেখে। বেশ খেতে পারে ছেলেটি। মুহূর্তে দু’প্লেট ভাত সাবাড় হয়ে যায়। রাহানুম খালি প্লেটে আবার ভাত দিয়ে পাঠায়। আরো এক বাটি গুড় পাঠায়। সুখদীপ ছুটোছুটি করে এসব আনা-নেওয়া করে। রাহানুম দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে খাওয়া দেখে। হ্যাঁ, খাওয়ায় দারুণ মানুষটি। সুখদীপ ওর সামনে বসে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এতক্ষণ এটা-ওটা প্রশ্ন করছিল। এখন একদম চুপ। জবেদ আলী এক জগ পানি খেয়ে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, আর এক জগ পানি লও।

মা, পানি দেও।

সুখদীপ জগ হাতে ঘরে ঢোকে। জবেদ আলী বুঝতে পারে তিনজন মানুষ অবাক হয়ে ওর খাওয়া দেখছে। ওর লজ্জা হয় না। বরং ওর আচরণে এক ধরনের বীরত্ব প্রকাশ পায়, যেন এভাবেই জয় করতে হয়। এভাবেই উপরে থাকতে হয়–নিজেকে প্রকাশ করতে হয়। অন্যদের চোখের সামনে দিয়ে বীরদর্পে হেঁটে যেতে হয়।

সুখদীপ জগভর্তি পানি এনে রাখে। ও ছুটোছুটি করে কাজ করে। পানি রেখে ছুটে গেলে রাহানুম ওর হাতে পানের থালা দেয়। সেটা রেখে এসে রাহানুমকে আস্তে করে জিজ্ঞেস করে, মা বেডারে কি কয়া ডাকমু?

চাচা।

মোর চাচা অয় বুজি?

চাচা অয় না। চাচা ডাকন লাগে।

মা, মোর বাপ কেমনে?

মুই জানি না।

বেডায় মোরে জিগাইলো।

কি?

মোর বাপ কোমনে? মুই কইছি, মুই জানি না। মোর বাপ নাই হুইনা বেড়ায় একটা হাস দিল। হাস দিলো ক্যা মা? বাপ না থাকলে কি হাস দেওন লাগে?

রাহানুম বুঝতে পারে সুখদীপ আহত হয়েছে। এতদিন ওকে কেউ বাপ নিয়ে কথা বলেনি। বয়স্করাতো সবাই জান ঘটনাটা। ছোটদের বাপ। নিয়ে মাথাব্যথা নেই। সুখদীপেরও এই নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না। লোকটি কেন শিশুটিকে খোঁচালো? কী মতলব ওর? সুখদীপের বাবা না থাকার ওপর কি ওর কিছু সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে। মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় ও তাড়িত হতে থাকে।

সুখদীপ ওর হাত ধরে ঝাকুনি দিয়ে বলে, কথা কওনা ক্যা মা? বাপ থাকলে কি হাস দেওন লাগে?

ও ওকে আদর করে বলে, অইছে যা অহন।

ওর মনেও চিন্তা গেঁথে থাকে, সত্যিইতো সুখদীপের বাবা না থাকলে ওকে হাসতে হবে কেন? এটা কি হাসির কথা? নাকি ওর বাবা না থাকাতে লোকটি খুশি হয়েছে?

তখন আবুল হাশেম ঘাড়ের ওপর ফেলে রাখা গামছা দোলাতে দোলাতে ঘরে ঢোকে। রাহানুম দ্রুত কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, বাবো ওনারে দুপুরে ভাত খাইয়া যাইতে কন?

দাওয়াত দিবি?

হ। আমনহে জমির মালিক হইলেন। এতবড়ো খুশির খবর।

খুশি?

আবুল হাশেমের দৃষ্টিতে রঙিন মাছটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ছাইরঙা শরীরে রুপোলি বুটি যেন আন্ধারমানিক নদীতে হাজার তারার বুজবুড়ি। উঠছে, এলিয়ে মিশে যাচ্ছে, আবার উঠছে, ওহ কী আনন্দ? ভাবতে ভাবতে আবুল হাশেমের ভুরু বারবার কপালে ওঠে। নাকের ফুটো বড়ো হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে ও একটা বিরাট হাঁচি দেয়। হাঁচি দিয়ে বলে, আলহামদুলিল্লাহ।

রাহানুম উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর প্রশ্নের উত্তর ও পায়নি। আবুল হাশেম কী বলবে ও তা জানে না। তাই আবার দ্রুত কণ্ঠে বলে, বাবো, মুই কতদিন পলাও রান্দি নাই। শাক্যরখানি চাউল আছে গরে। আমনহে মেলাদিন মুরাও খান নাই।

রাহালুমের দীপ্ত দৃষ্টিতে আবুল হাশেমের দৃষ্টি আটকে যায়। বুঝতে পারে মেয়েটির কণ্ঠে এক ভিন্ন রকমের ব্যাকুলতা। ওর মনে হয় নতুন চরের কথায় রাহনুমের মনে এমন খুশির জোয়ার। মণিমালা বেঁচে থাকলে হয়তো এমন খুশিই হতো। ও রাহামের সঙ্গে বড়ো বেশি একাত্মতা অনুভব করে। ওর দিকে তাকিয়ে মিগ্ধ হাসি হেসে বলে, যা রান্নাবাড়ার জোগান দে। মুই বেডারে খাইয়া যাতি কমু। দেহিস আভা পাড়া মুরা যেন জবাই করিস না। মেলা খিদা লাগছে। অহন মোরে ভাত দে।

রাহানুম আবুল হাশেমকেও কাচের বাসনে পান্তা বেড়ে দেয়। ডিম ভাজা এবং ভাজা লাল মরিচ দেয়। আয়োজন দেখে মুচকি হাসে আবুল হাশেম। রাহানুম জিজ্ঞেস করে, বাবো হাস দিলেন ক্যা?

আবুল হাশেম কোত করে ভাত গিলে বলে, এমনে।

ওদের মধ্যে আর কোনো কথা হয় না। ওর সব কাজ পড়ে আছে। রাতের হাঁড়িকুড়ি কিছুই দেওয়া হয়নি। নিজেরও খাওয়া হয়নি। পান্তা শেষ। এই বেলা ওর আর খাওয়া হবে না। মনে মনে ভাবে, থাক, না খেলে কী হবে? একবেলা না খেলে তো মানুষ মরে যায় না। রোজার সময় কতদিন সেহেরি খাওয়া হয়নি। সেদিন না খেয়েই রোজা রেখেছে। আর আজকের পরিস্থিতিতে অন্যরকম। একজন মানুষ হঠাৎ করে সাতসকালে উঠোনে এসে দাঁড়ালে তখন অন্য আর একজন মানুষের না খেয়ে থাকতে হয়। এই ব্যাকুলতাই কি ঘর? খুব কাছের কারো জন্য তীব্র আকাক্ষা। নইলে ঘরটা হয়ে যায় কেবলই বাসস্থান? শুধুই দিন কাটানোর আস্তানা? না এমন ঘর ও চায় না। ঘর হবে উষ্ণতার–ভালোবাসার; ব্যাকুলতার–তীব্রতার।

ঘরের স্বপ্নের ছবি দেখতে দেখতে ও পেছন দরজা দিয়ে উঠোনে নামে। কোন মুরগিটা ধরবে চিন্তা করতে থাকে। বাচ্চা ফুটানোর জন্য ধাড়ি মুরগিটা ডিমে তা দিচ্ছে। ওটার মুখ থেকে গরগর শব্দ বেরুচ্ছে। রাহানুম কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। মুরগিটা একটা ডিম ঠোকরাচ্ছে। এখন একটা বাচ্চা বের করবে। খোসাটা ভেঙে দুটুকরো হয়ে গিয়ে একটি বাচ্চা বেরুলো। ওটা নড়ছে। লোমহীন শরীরটা কাঁপছে। রাহনুম হাতে তুলে নেয়। কী নরম, কী তুলতুলে। রাহনুমের হাতের তালুতে ওর একটা অস্তিত্ব আছে। ওর হাতের তালুর রেখার মতো মুরগির বাচ্চাটির শরীর–আঁকাবাঁকা নীল রেখা বেড়ে উঠছে ওই শরীরে–পাতলা চামড়া ভেদ কের ফুটে উঠেছে অন্তরালের বস্তুনিচয়। ধাড়ি মুরগি গরগর শব্দে ক্রোধ প্রকাশ করছে, রাহানুমকে আক্রমণ করতে চাইছে, রাহালুমের উপস্থিতি ওর কাছে কাম্য নয়।

বাচ্চাটি রেখে দিয়ে ও নিজের করতলে তাকায়। যদি সমস্ত রেখাগুলো দেখা যেত? ও নিজের হাত কপালে ঠেকায়। এই মুহূর্তে ফুটে উঠুক কোনো সৌভাগ্যের চিহ্ন। আর একবার জ্বলে উঠকু ওর নিয়তি। আর একবার। ভাবতেই হৃদয় গুড়িয়ে যায় রাহানমের। বির হয়ে যায় শরীর। মুরগির খাঁচার সামনে থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না। একদিন ও নিজেও ডিমের খোলস-ভাঙা সন্তান পেয়েছিল। তারপর? ঘরের ভেতর থেকে আবুল হাশেমের ডাক শুনতে পায়, মা মাগো। তবুও উঠতে পারে না রাহানুম। আবার আবুল হাশেম ডাকে, মাগো কই গেলা, পানি দেও।

ও নড়ে না। ডাকুক, ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে যাক আবুল হাশেম। ও আর সাড়া দেবে না। আবুল হাশেমের প্রয়োজন ওর জীবনে দীর্ঘস্থায়ী হোক ও তা চায় না। কারণ সত্যিকারের ঘরের বাইরে ছিটকে পড়ে এইভাবে একা একা বেঁচে থাকা অর্থহীন। ও খোপ থেকে মুরগি নিয়ে পাশের বাড়িতে যায় মুরগিটা জবাই করার জন্য। পেছনে পড়ে থাকে আবুল হাশেমের ডাক।

দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পরিপাটি আয়োজন হয়। বাতাসে ভেসে বেড়ায় পোলাওর গন্ধ। সুখদীপ অন্তহীন খুশিতে ভরপুর। যতক্ষণ রান্না। হয় রাহালুমের হাতের কাছে থাকে। এটা-ওটা এগিয়ে দেয়। তারপর একসময় ফাঁক বুঝে চলে যায় জবেদ আলীর সঙ্গে।

খাওয়া-দাওয়ার সময়ে রাহাম ইচেছ করে নিজ হাতে পরিবেশন করে। সকালে যে সাহসটুকু অর্জন করতে পারেনি দুপুরে সেই সাহসটুকু ও অর্জন করে। সাহস হবে না কেন? কতদিন ও প্রিয়জনকে সামনে বসিয়ে ভাত খেতে দেয়নি। কতদিন হয়ে গেল, তাজা স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গেছে যে! সরাসরি মুখের দিকে না তাকালেও অনুভব করতে পারে যে জবেদ আলী গভীর দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায়। লোকটির ভাসা চোখে ডাক আছে–সাগর যেমন জেলেকে ডাকে তেমন ডাক। কখনো জেলে ঝড়-জল উপেক্ষা করে, বুঝতে পারে না বিপদের সংকেত, ভুলে যায় মরণের কথা, জবেদ আলী এখন তেমন একটা সাগর। ওকে মরণের ডাক দিয়েছে। বাসন ভর্তি করে পোলাও-মাংস এগিয়ে দেবার সঙ্গে চোখাচোখি হয় জবেদ আলীর সঙ্গে। লোকটি মুচকি হাসে, এত চেনা সে হাসি যে চট করে বোঝা যায় না। শুধু বুঝতে পারে রাহানুম একা।

একটু দূরে একটা জলচৌকিতে আবুল হাশেম বসে আছে। ঘোমটার আড়ালে রাহালুমের মুখ দেখা যায় না। তাই রাহামের আবেগ আবুল হাশেম বুঝতে পারে না। জমি ফিরে পাওয়ার খুশিই প্রধান বলে ধরে নেয়। সে জবেদ আলীর সঙ্গে নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলছে। জবেদ আলী ছোট্ট করে জবাব দিচ্ছে। কখনো হা-না করে মাথা নাড়ছে। ভাবটা এমন যে ওর কথা বলার খুব ইচ্ছে নেই। রাহনুমের ধারণা জবেদ আলী মন দিয়ে কথা শুনছে না। ওর আগ্রহ এখন খাবারে এবং রাহামে। দীর্ঘদিন এমন সুস্বাদু খাবার ও খায়নি। বছর দেড়েক আগে বউ মারা যাবার পর মা ছাড়া আর কেউ ওকে ভাত বেড়ে দেয়নি। জবেদ আলীর আজ সুখের দিন হবে না তো কার হবে?

ওর সঙ্গে সুখদীপ খাচ্ছে। পোলাও-মুরগি পেয়ে ও আজ খুব খুশি। কোনোদিকে তাকায় না, একমনে ভাত খায়। অনেকক্ষণ জবেদ আলীর সঙ্গে ঘুরেছে। পুকুরে গোসল করেছে। দুজনে অনেক গল্প করেছে। জবেদ আলী জেনে গেছে যে রাহানুম সুখদীপের মা, ওর বাবা নেই, কোথায় সেটা সুখদীপও জানে না। তবু জবেদ আলীর খানিকটুকু খটকা থেকেই যায়। ওর ধারণা রাহালুমের দৃষ্টিতে কুমারীর লজ্জা আছে, সংকোচও আছে–বিবাহিতা নারীর খোলামেলা ভঙ্গি ওর মধ্যে কম। কোথায় যেন খানিকটুকু ফাঁক থেকেই যায়। যেজন্য রাহানুম ওর কাছে কিছুটা রহস্য, কিছুটা বিস্ময়। বোঝাই যায় বিবাহিত জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ওর নেই–পুরোপুরি নারী হয়ে ওঠার শুরুতেই ও কোনো না কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সেটা কীভাবে, জবেদ আলী তা বুঝতে চায়।

ওর বাসনে ভাত প্রায় শেষ, তরকারিও তেমন নেই। রাহানুম নতুন করে পোলাও তুলে দেয়। তাঁর হাত কাঁপে। তরকারি দেবার সময় বাসনের বাইরে ঝোল পড়ে যায়। আবুল হাশেম হা-হা করে ওঠে, এইডা কী করলি মা? চৌউকখে দেহ না? গায়ে বল নাই। হাত কাঁপে ক্যা?

আবুল হাশেমের কড়া ধমকে জবেদ আলী ব্ৰিত বোধ করে। তবু মৃদু হেসে বলে, থাউক চাচা। কিছুতো অয় নাই।

না, না, কামডা ঠিক অয় নাই। মাইয়ামানষের হুঁশ থাকা লাগে।

আবুল হাশেম যে কিছুটা বিরক্ত তা বোঝা যায়। সে এখানে রাহানুমের উপস্থিতি পছন্দ করছে না। ভাবতেই রাহানুম মনে মনে ফুসে ওঠে। যদি ওর করতলে কোনো সৌভাগ্য চিহ্ন জেগে ওঠে তাহলে ও আর আবুল হাশেমের কর্তৃত্ব মানবে না। আবুল হাশেমের ধমক নিঃশব্দে হজম করলেও রাহামের চিত্ত অপ্রসন্ন হয় না। ও কিছুতেই ভুরু কুঁচকে রেখে নিজের ক্রোধ প্রকাশ করবে না বলে ঠিক করে। এ সময়ে মন খারাপ করলে চেহারায় তার ছাপ পড়বে, যেটা জবেদ আলীর ভালো নাও লাগতে পারে। ও বুঝতে পারে জবেদ আলীও আবুল হাশেমের ওপর বিরক্ত হয়েছে।

তখন আবুল হাশেম জবেদ আলীর দিকে মনোযোগ দেয়, খাও, বাজান খাও। মাগো, ওরে আরো দু’খান গোস্ত দাও। তোমারে মুই কত ছোড় দেখছিলাম। কতকাল মোগ দেহা নাই। তোমার বাপে ভালো আছে?

হ, ভালো আছে।

তোমার পরিবার কি বাজান?

মোর পরিবার নাই। বিয়া কইল্যাম। গত বছর মইরা গেছে। গুড়াগাড়াও নাই।

আহা, দুখের কতা।

জবেদ আলী মুচকি হাসে। আবুল হাশেমকে আড়াল করে রাহানুম ঝটিতে ওর মুখের দিকে তাকায়। মুচকি হাসি জবেদ আলীর স্বভাব। ওর ভালোই লাগে। রাহানুম বুঝতে পারে লোকটি ক্রমাগত ওকে টানছে–যতই দিন বাড়ছে সে টান প্রবল হচ্ছে। এখন ওর বউ নেই এবং ছেলেমেয়েও নেই শুনে ওর বুকের ওপর থেকে বিশাল ভার নেমে যায়। এবং সেখানে অকস্মাৎ বাঁধভাঙা আনন্দের স্রোত এসে ভরে যায়। ও সঙ্গে সঙ্গে একটি সিদ্ধান্ত নেয়, কঠিন সিদ্ধান্ত।

জবেদ আলীকে জানাতে হবে যেও সুখদীপের মা নয়। কোনো সুখদীপ ওদের মাঝে দেয়াল তুলে দাঁড়াবে না। ওর জীবনে পিছুটান নেই, ও একা–ভীষণ একা। অনায়াসে সুখদীপকে ছেড়ে জবেদ আলীর হাত ধরে চলে যেতে পারে। বউ-ছেলেমেয়ে না থাকার মতো এত ভালো খবর আজ ওর জন্য জমা ছিল–কী দারুণ দিন। নিশ্চয়ই করতলে সৌভাগ্য চিহ্ন ফুটে উঠেছে। ও দেখতে পাচ্ছে না; দেখার দরকারও নেই। শুধু সৌভাগ্যের ঘটনাগুলো ঘটে গেলেই হয়।

ও আবুল হাশেমের শ্রবণশক্তি আড়াল করে চাপা কণ্ঠে বলে, আমনহেরে আর দুগ্যা পোলাও দি?

দ্যান।

জবেদ আলী মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। ও নিজেও আবুল হাশেমের শ্রবণশক্তি আড়াল করতে চায়। কিন্তু বুঝতে পারে ঘটনাটি আড়াল করা হয় না। তা আবুল হাশেমের প্রখর দৃষ্টিশক্তি এড়ায় না। এই ছোট্ট নাটকটুকু ও ধরে ফেলতে পারে।

রাহানুম থালা ভরে পোলাও দেয়। নারকেলের দুধ দিয়ে ডিম রান্না করেছে, মুরগির ঝোল করেছে, সঙ্গে চিচিঙ্গার ভাজি। ও জবেদ আলীকে আরো দুটো ডিম তুলে দেয়। বুঝে যায় যে এ বেলাও ওর নিজের তেমন কিছু জুটবে না, হয়তো মুরগির নরলি বা পাখনা বা গিলা। কী এসে যায়? একজন মানুষ তো খুশি হচ্ছে, যার খুশির সঙ্গে নিজের খুশি যুক্ত করার জন্য ও উদগ্রীব হয়ে উঠেছে।

আবুল হাশেম বিড়ি ফুকছে, একটার পর একটা। সাধারণত এমন। একটানা টানে না ও। কিন্তু আজ ভেতরে ছটফটানি–বিড়ির নেশা একটা অবলম্বনের মতো। আবুল হাশেম একরাশ ধোয়া ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত কিছু চিন্তা করে। রাহানুমকে দেখে, সুখদীপকেও অন্য দৃষ্টিতে অবলোকন করে। বুঝতে পারে রাহানুম জবেদ আলীকে সামনে রেখে এই সংসারকে উপেক্ষা করছে। করুক, করতে পারলে মঙ্গলই হয়। এখন রাহামের মুখটা ওর সামনে জলোচ্ছ্বাসে আছড়ে পড়া ভাঙা ট্রলারের মতো মনে হয়–টুকরো টুকরো, বিক্ষিপ্ত। আবর্জনার মতো জমিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলেই হয়–পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। ও সুখদীপের দিকে আবার তাকায়–দেখে সুখদীপ একটা কাঁকড়া, কারো পায়ের। নিচে চাপা পড়ে মরে চ্যাপ্টা হয়ে আছে। ওটার ঠ্যাং ধরে সমুদ্রে ছুড়ে ফেলে দিলেই হয়। নদী থেকে যে মানুষের জমি জেগে ওঠে তার আর পুরনো জোড়াতালি চলে না। তাকে সবকিছু নতুন করে ঢেলে সাজাতে হয়।

ও তখন আকর্ণ বিস্তৃত হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে বলে, তুমি আজ রাতে আমার এহানে থাকো বাজান। কার্ল বেহানে আমি তোমার লগে নতুন চরে যামু।

রাহানুম চমকে আবুল হাশেমের মুখের দিকে তাকায়। ও দেখতে পায় বালুর ওপর কাঁকড়ার হেঁটে যাওয়ার মতো আঁকাবাকা রেখা জেগে উঠেছে সেই মুখে। ভুরু কুঁচকে আছে এবং দুভুরুর মাঝে প্রশ্নবোধক চিহ্ন। সেজন্যই বোধহয় চোখ জোড়া ছোট দেখাচ্ছে। আবুল হাশেম কেন জবেদ আলীকে থাকতে বলছে? কী মতলব? শুধুই কি জমি দেখতে যাওয়া নাকি অন্যকিছু? রাহানুম কিছু বুঝে ওঠার আগেই জবেদ আলী খুশিতে মাথা ঝাকায়। ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলে, হ, ঠিকই কইছেন চাচা। আমনহের যাওনেরই কাম।

কথাটা বলার পরপরই জবেদ আলীর সঙ্গে রাহালুমের চোখাচোখি হয়। রাহামের ঠোঁটে চিকন হাসির রেখা, প্রায় অদৃশ্য, গভীর দৃষ্টিতে না তাকালে দেখা যায় না, তবু সেই হাসির রেখা জবেদ আলীর দৃষ্টি এড়ায় না। বউ মরে যাওয়ার পর থেকে ওর মনে যে দুঃখবোধ জমাট ছিল এই মুহূর্ত থেকে তা দ্রবীভূত হতে শুরু করেছে। ও আশ্বস্ত হয় এই ভেবে যে যাক কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল। যে খানিকটা অন্যরকম, ভাবে প্রকাশ করে, শুধুই ঘরের বউ হবে না। সন্তানের মা হতে গিয়ে হয়তো মরেও যাবে না।

বিকেলে জবেদ আলীকে নিয়ে আবুল হাশেম হাটে যায়। ঘরে আতপ চাল ছিল। তার সঙ্গে খেজুরের গুড় দিয়ে রাহানুম পায়েস রান্না করে। সুখদীপ বসে আছে সামনে। ওর চোখে লোভ, কখন রান্না শেষ হবে। রাহানুম সুখদীপের মুখের দিকে তাকাতে পারে না। তাকালেই মনে হয় নিজের সুখের জন্য আজ ও এই ছেলেটিকে দূরে ঠেলে দেবে। এটা এক ধরনের চেষ্টা, মানুষ যেমন অনেক কিছু করার জন্য চেষ্টা করে এও তেমন। তারপর চেষ্টা সফল হলে ও চলে যাবে জবেদ আলীর সঙ্গে–লতাচাপালি, যে গায়ের কাছাকাছি একটি নতুন চর জেগে উঠলে ওর সৌভাগ্যের চিহ্ন হয়ে একজন মানুষ এই বাড়িতে আসে।

ও ধোঁয়া-ওঠা গরম হাঁড়ি চুলো থেকে নামায়। পাটালি গুড়ের খুশবুতে বেশ চনমনে হয়ে ওঠে খাবার ইচ্ছে। সুখদীপ জিভ চেটে বলে, মা, মোরে একটু দিবা?

মা, কে তোর মা?

রাহানুম প্রায় আঁতকে উঠে কথাটা বলতে চায়। কিন্তু পরক্ষণে নিজেকে শাসন করে। ছিঃ! কী কঠিন চেষ্টা। ও কেন ভাবছে এই ছেলেটির মা না হলেই ও কুমারী হয়ে যাবে? ও তো কুমারী নয়, জবেদ আলীর সঙ্গে ওর তো নতুন সংসার হবে না। জবেদ আলী যদি ওকে প্রত্যাখ্যান করে! তখন? রাহানুষের দুচোখে ছাপিয়ে জল আসে।

মা কান্দো ক্যা?

রাহানুম জবাব দেয় না। ছোট্ট একটা বাটিতে পায়েস বেড়ে দেয় সুখদীপকে। ও বাটি নিয়ে ঘরের বারান্দায় চলে যায়। ও যখন খুশি হয়ে কিছু খায় তখন গুনগুনিয়ে শব্দ করে। ওই শব্দ শুনলে রাহানুম বুঝতে পারে যে খাবারটি ওর খুব পছন্দ হয়েছে। ও তখন চুলোর আগুন নিভিয়ে। দিয়ে সুখদীপের কাছে এসে বসে। সুখদীপের খাওয়া শেষ। বাটি চেটেপুটে নিচ্ছে। তারপর রাহানুমের দিকে তাকিয়ে বলে, খুব মজা লাগছে মাগো।

রাহানুম মৃদু হেসে বলে, আর একটু নিবি!

ও লম্বা করে মাথা কাত করে। শূন্য বাটি এগিয়ে ধরে বলে, দেও।

মোর লগে আয়। হঠাৎ করে ওর মনে হয় আজ ছেলেটিকে খাইয়ে-দাইয়ে খুশি রাখা উচিত। বেচারা, কাল থেকে ভুলে যাবে মায়ের আদর। আর কাউকে কি ও পাবে যে ওকে এমন করে বুকে টেনে নেবে? যদি না পায়, তখন ও কী করবে? থাক, ভবিষ্যতের এতকিছুর ভাবনার দায় ওর নেই। যা ঘটবে তার অপেক্ষা করাই এখন দরকার।

বাটিভর্তি পায়েস নিয়ে দুজনে আবার বারান্দায় ফিরে আসে। সুখদীপ রাহনুমকে বলে, মা তুমি একটু খাইবা না?

না। অহন না?

মেহমান আল্যে খাইবা?

রাহানুম প্রশ্নের জবাব দেয় না। সুখদীপ আবার বলে, এমুন মেহমান পেত্যেক দিন আল্যে কত মজা! মাগো তাইলে তুমি কত কিছু রানধবা।

চুপ শয়তান ছেমড়া।

রাহানুম রাগে না, ওকে মিষ্টি আদর করে। ভাষাটা অমনই হয়।

সুখদীপ পুরো বাটি সাবাড় করে দিয়ে বলে, মাগো তুমি আইজকা এত খুশি ক্যা? আইজকা কিসের দিন? আইজতো ঈদ না।

ক্যাবল কথা। চুপ কর।

রাহানুম ধমকে ওঠে। তারপর বারান্দা থেকে নেমে বাইরে দরজার দিকে যায়। এখনো ফিরছে না কেন ওরা?

সন্ধ্যার পর জবেদ আলী হাট থেকে ফিরে আসে। হাতে দুটো বড়ো ইলিশ। তখন উঠোনে ফকফকে জ্যোৎস্না রাহানুম চুলা থেকে ভাত নামিয়েছে। মাছের অপেক্ষায় আছে। ওৱান্নাঘরের দরজায় চুপচাপ বসে থাকে। সুখদীপ উঠোনে দৌড়ে বেড়ায় আর ছড়া কাটে। ও মানুষটিকে উঠোনে ঢুকতে দেখতে পায়। মানুষটি সোজাসুজি রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়। মাছ দুটো ওর সামনে বাড়িয়ে দেয়, চাচার আইতে এটটু। দেরি অইবে।

বাবা কেমনে?

বিব্রত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে রাহানুম। যেন এই মুহূর্তে ওর গোপনীয়তার সব লজ্জা থেকে উদ্ধার করতে পারে আবুল হাশেম। নইলে একা একা নিজেকে আর সামলানো যাচ্ছে না।

জবেদ আলী একটি সিঁড়ি টেনে দরজার কাছে বসতে বসতে বলে, ক্যা বাবো না থাকলে ডর করে?

রাহানুম সাহস করে বলে ফেলে, ডর কিয়ের? আমনহে আছেন না?

হো হো করে হেসে ওঠে জবেদ আলী। হাসতে হাসতে বলে, মুই ভাবলাম বাবো না থাকলে মোরে বুজি তোমার ডর। মুই তো একটা বাঘ, না অইলে ভালুক।

মুই কি তা কইলাম?

না, না, কও নাই, কইবা ক্যা।

আবার হাসে জবেদ আলী। এখন আর মুচকি হাসি নয়। সন্ধ্যা নামলে, উঠোনে পূর্ণিমার আলো ছড়িয়ে গেলে পুরুষ মানুষের ঠোঁটে মুচকি হাসি থাকতে নেই–সে হাসিকে শব্দে বিশাল করে তুলতে হয়।

জবেদ আলী রান্নাঘরের দরজায় বসে থাকে দেখে রাহানুম খানিকটা বিব্রত বোধ করে। এমনিতেই জবেদ আলীর সশব্দ হাসিতে ওর ভেতরের সমস্ত কলকবজা বিকল হয়ে যাচ্ছে। ও স্থির থাকতে পারছে না–কত অসংখ্য দিন পেরিয়ে একজন পুরুষ মানুষ ওর কত কাছে। যদি ও হাত বাড়ায় তাহলে ওকে ছুঁতে পারে। একটি শিশু ছাড়া বাড়িতে কেউ নেই। লোকটির এমন ইচ্ছে হতেই পারে। ও এখন বুঝতে পারে লোকটি কেন বাঘ বা ভালুক হতে চায়। রাহানুম ভয়ে ঘামতে থাকে। তড়িঘড়ি বলে, আমনহে হাতনায় বয়েন।

ক্যা, এহানে থাকলে কী অয়?

বাবো, যদি আহে।

ডর কী?

জবেদ আলী আবার হাসে।

রাহানুম বলে, ডর না শরম লাগে।

লজ্জায় ওর মাথা হাঁটুর ওপর নেমে আসে।

মুই দূরে যামু ক্যা। মুই তোমার ধারে থাকবার চাই। মুহূর্তে জবেদ আলীর মুখের দিকে তাকায় রাহানুম। অন্ধকারে ভালো দেখা যায় না, কিন্তু বুঝতে পারে দৃষ্টি চকচক করছে। চুলোর আগুনের হালকা আভায় জবেদ আলীর দৃষ্টি ছুঁচালো হয়ে উঠতে থাকে। রাহানুম দ্রুত মাথা নিচু করে ফেলে।

জবেদ আলী বলে, শরম পাও ক্যা? শরম কিয়ের? কথা বলতে বলতে ও রাহামের দু’হাত জড়িয়ে ধরে। গাঢ় কণ্ঠে বলে, মুই জানি তুমি।

কী চাও। জানি না?

হ, জানেন।

রাহানুম দ্বিধাহীন মাথা নাড়ে। তারপর বলে, হাত ছাড়েন। মাছ কাটি। রান্দনের দেরি অইয়া যাইবে।

অউক।

খিদা পাইবে না?

পাইবে।

খিদা লাগলে সুখদীপ কানবে।

কান্দুক।

ভাত রান্দা না অইলে বাবো রাগ অইবে।

রাগ অউক।

রাহানুম ফিক করে হেসে ফেলে। প্রবল ছেলেমানুষি জবেদ আলীর। কণ্ঠে। দৃষ্টিতে দুষ্টুমি। ওর মুঠিতে রাহালুমের হাত ঘেমে ভিজে যায়।

জবেদ আলী বলে, যদি হাত না ছাড়ি? ছাড়ুম না। এই হাত ধইরা লগে লইয়া যামু।

ওহ্ ছাড়েন। সুখদীপ আইতে পারে।

তখন জবেদ আলী হাত ছেড়ে দিয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ওর বাপ কহন মরছে?

ও মোর পোলা না।

তোমার পোলা না?

না, মোর পোলা না।

জব্বর খুশির খবর। তাইলে তো তোমারে বিয়া করতে মোর বাধা কি? মোর মা-বাবো কিছু কইব না। একটা কথা, সুখদীপ তোমারে মা ডাকে ক্যা?

তখন রাহানুম জবেদ আলীকে জলোচ্ছ্বাসে আক্রান্ত সেই প্রলয়ঙ্করী রাতের গল্প শোনায়।

গল্প শুনে জবেদ আলী বলে, তোমার রিয়া অইছিলো এইডা মোগ বাড়িতে কারো ধারে কওনের কাম নাই।

তারপর ও শিস বাজাতে বাজাতে গিয়ে উঠোনে দাঁড়ায়। এদিক-ওদিক তাকিয়ে সুখদীপকে দেখতে পায় না। ও হয়তো বাড়ির বাইরে গেছে কিংবা পুকুরঘাটে। জবেদ আলী চিৎকার করে সুখদীপকে ডাকে।

রাহানুম কাঠে লাগানো বড়ো বটিতে মাছ কাটে, তাজা কচকচে মাছ। রক্ত বটির গা বেয়ে গড়াতে থাকে। মাছের পেট থেকে বড়সড় ডিম বের হয়, একগাদা নাড়িভূঁড়ি, কালো রঙের পিত্তথলি–এই থলিটি সাবধানে ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে ফেলে দেয় ও। পিত্ত গলে গেলে মাছটা তেতো হয়ে যাবে–বিস্বাদ লাগবে খেতে। জবেদ আলীর মুখেতো বিস্বাদ খাবার দেওয়া যায় না। বড়ো গামলায় করে মাছ ধুয়ে নেয় ও। কিছু মাছ ভাজবে, কিছু রাঁধবে। প্রচুর পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ দিয়ে দুইজোড়া ডিম সঁতলে নেবে। দারুণ হবে খেতে। তাজা ইলিশের গন্ধে ম-ম করে বাড়ি। রাহালুমের মনে হয় কত দিন পর বাড়িতে আজ উৎসব।

এইসব কাজের ফাঁকে জবেদ আলীর ডাক শুনে ওর কাছে ছুটে আসে সুখদীপ। এসেই হাত চেপে ধরে, ডাকেন ক্যা?

গেলহি কেমনে?

এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সুখদীপ খলখল করে হাসে। দুজনে। হাতনায় হোগলার ওপরে বসে।

তোর কাইল স্কুল নাই? অহন পড়ালেখা নাই?

স্কুলে যামু না।

ক্যা?

আমনহে যদি বাড়ি থাহেন—

মুই কাইল চল্যা যামু।

তখন সুখদীপ ওর গলা জড়িয়ে বলে, আইজ একটা খুশির দিন। মা কতকিছু রাব্দে। আমনহে আমার লগে একটা গল্প কন।

গল্প?

জবেদ আলীর চোখে হিংস্র আলো ফুটে ওঠে। একটু আগে ও রাহানুমের কাছে একটি গল্প শুনেছে। এই গল্পটি এই ছেলেটি জানে না। গল্পটি ছেলেটিকে জানতে হবে। গল্পটি ওকে জানিয়ে দিয়ে রাহনুমকে নিয়ে ওর নতুন সংসার।

ও তখন ছেলেটিকে গল্প বলতে আরম্ভ করে, ভয়াল হিংস্র রাতের গল্প। একটু একটু করে, গল্পের খোসা ছাড়ায়, একটু একটু করে এগোয়–রূপকথা নয়, অথচ ভিন্ন এক জীবন–ছেলেটির কাছে একদম নতুন। ও রুদ্ধশ্বাসে জবেদ আলীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, চোখের পলক পড়ে না, চোখের মণি নড়ে না, ওর কণ্ঠ রুদ্ধ। কারণ তখনো ও জানে না যে সুখদীপ নামের একটি ছেলে এই গল্পের নায়ক, অথচ সে শিশুটি প্রবল জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়ার পর থেকে ওই শিশুর জন্য ওর বুক ফেটে যাচ্ছে। শিশুটি মা খুঁজে পেলে ওর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। জবেদ আলী ইনিয়ে-বিনিয়ে গল্প বানায়, কণ্ঠ কখনো ওঠা-নামা করে, কখনো বিস্তৃত হয়, কুঁকড়ে যায় এমনকি হিসহিস শব্দে হিংস্রও হয়ে ওঠে। হিংস্র হয়ে উঠলে সুখদীপের ভয় করে। তখন ও জবেদ আলীর হাত চেপে ধরে। আবার ভালো মুহূর্তে হাত ছেড়ে দেয়।

রাহানুম রান্নায় ব্যস্ত। ছাঁকছুক শব্দে ও জানতেও পারে না যে জবেদ আলী আর একটি নাটক তৈরি করেছে। ওই নাটকে দ্রুত বদলে যাচ্ছে রাহানুষের জীবন। ও হারাচ্ছে সুখদীপকে, যে দায়িত্বটি ও নিজেই পালন। করতে চেয়েছিল, সে দায়িত্ব আর পালন করতে হবে না।

গল্পের শেষে সুখদীপকে যখন শোনানো হয় যে গল্পের শিশুটি ও নিজে তখন ও চিৎকার করে কেঁদে ওঠে, মিছা কতা। এক্কেরে মিছা কতা? মিছা কতা কন ক্যা?

মিছা না–হাছা কতা।

সাপের মতো হিসহিস করে জবেদ আলীর কণ্ঠ। ও এখন জল্লাদের মতো ক্রুর–একই নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে বলে যাচ্ছে, তোর বাপ নাই, মা নাই, কেউ নাই, তুই অউক্কা এতিম পোলা।

সুখদীপ ছুটে রান্নাঘরে যায়, মা তুমি মোর মা না?

রাহানুমের বুক কটকট করে। ও চট করে উত্তর দিতে পারে না। এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য যদিও ওর মনে মনে ভাবনা ছিল, কিন্তু প্রস্তুতি ছিল না। ও মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে নির্মম করে তুলতে পারে না। মনে পড়ে এইতো সেদিন ও সুখদীপকে বুকের দুধ খাইয়ে বড়ো করে তুলেছে। এ ছাড়া সুখদীপ আর কারো কাছে যেতে চাইত না। এখনো তো ওর গলা না জড়িয়ে ধরে সুখদীপ ঘুমোতে পারে না। মা, মা করে যখন ডাকে তখন ক্ষণিকের জন্যও মনে পড়েনি যে সুখদীপকে ও গর্ভে ধরেনি। তাহলে এত তাড়াতাড়ি–এত তাড়াতাড়ি সবকিছু–নাহ্ রাহানুম সুখদীপের প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না।

মার কাছ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে সুখদীপ আবার জবেদ আলীর সামনে এসে দাঁড়ায়। চিকার করে বলতে থাকে, মুই এতিম পোলাতো তোমার কি কুত্তার বাচ্চা? তুমি ক্যা মোরে এতিম বানাইবা? মায়েতো কিছু কয় না?

জবেদ আলী ওকে তেড়ে ওঠে, বাব্বা কেউটা একটা। কে তোর মা? এহানে তোর মা নাই। তোর মা ঝড়ের রাইতে মরছে।

সুখদীপ একথা শুনে আবার দৌড়ে রাহালুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। কান্নার চোটে ওর কণ্ঠ দিয়ে স্বর বেরুতে চায় না। ও এখন রীতিমতো ফোঁপাচ্ছে।

মা তুমি কতা কও না ক্যা? কও মা ওই বেড়া যা কয় হে মিছা? বেড়া সব মিছা কতা কয়?

রাহাম নিজেকে সামলে নেয়। সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জন্য তৈরি হয়ে যায়। নিস্পৃহ কণ্ঠে বলে, না বাবা, সব হাছা কতা।

রাহালুমের এই শক্ত উচ্চারণ করার সময় একটুও গলা কাঁপে না। বরং কথাটা বলতে পেরে নির্ভার হয়ে যায় ও। ধরে নেয় সুখদীপ কেঁদেকেটে চুপ করে যাবে। কিন্তু রাহামের কাছ থেকে ওই কথা শোনার পর ও মুহূর্তমাত্ৰ থমকে থাকে, তারপর দৌড়ে উঠোন পেরিয়ে পুকুরঘাটে চলে যায়। ওর ফোঁপানির শব্দ ভেসে আসছে। জবেদ আলী জানে, এটা নিয়ে ভাবার কিছু নেই। দুদিন কেঁদেকেটে ঠিক হয়ে যাবে সুখদীপ। তারপর নিজের ভাগ্য নিজেই বুঝবে। আবুল হাশেমের সংসারে থেকে যাবে ও। আবুল হাশেমের তো একজন কাউকে দরকার হবে।

আবুল হাশেম এখনো ফেরেনি। কোথায় গেল বুড়ো? ওর হাতে মাছ ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, তুমি যাও। মুই আহি। এতক্ষণে তো হাট ভেঙে গেছে। তাহলে আসছে না কেন? জবেদ আলী ট্র্যাক থেকে বিড়ি বের করে ধরায়। অন্ধকারে ধোয়ার কুণ্ডলী ওঠে। গোল্লা গোল্লা হয়ে ছড়িয়ে যায়। ছড়িয়ে পড়ে। গোল্লাগুলি রাহামের মুখ হয়–একজন নারী যে এতকাল ওরই প্রতীক্ষায় ছিল–প্রতীক্ষায় থাকাটাই সাধনা। প্রতীক্ষার অবসান মানে ফসল, গোলাভরা শস্যদানা। জবেদ আলীর ঠোঁটের কোণে চিকন হাসি ঝুলে থাকে, অন্ধকারে দেখা যায় না, ওটা শুধু ওর আত্মতৃপ্তি এবং আনন্দ।

রাহানুম ওর জন্য রান্না করছে, ভাবতে ওর ভালোলাগে–রান্নার চমৎকার গন্ধ আসছে, যেন খাবার নয়, তা রাহামের শরীর। চুল থেকে উঠে আসছে ফুলের গন্ধ–ছড়িয়ে যাচ্ছে বিছানায়, বালিশে, ঢুকে যাচ্ছে জবেদ আলীর ভেতরে। গন্ধ ওকে পাগল করে তোলে। জবেদ আলীর ঠোঁটে ঝুলে থাকা হাসি বিস্তৃত হয়–কতদিন নারীর শরীর স্পর্শ করা হয়নি, সেই আষাঢ় মাসে, প্রবল বৃষ্টির রাতে বউ মরে যাওয়ার পর। সেদিন আকাশে জ্যোৎস্না ছিল না–ওর সামনে উঠোনময় আলো ছিল না। প্রবল ব্যাঙের ডাকে তোলপাড় করছিল প্রান্তর, সেই রাতে মরে গেল ওর বউ। এখন রাহানুম ওর সামনে, ওর মুখে ভাষা আছে–চোখেও। যেন রহস্যময়ী নারী রাহানুম–গন্ধ এবং আলোয় ভরা। এইসব ভাবনার নিমগ্ন অবসরে সুখদীপ অন্ধকার ফুঁড়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। ওর হাতে উদ্যত দা। চমকে ওঠে জবেদ আলী একলাফে সরে যায়।

তুই মোগ বাড়ি আইছ ক্যা? কে তোরে আইতে কইছে? মুই তোরে কোপাইয়া শ্যাষ করমু।

হারামজাদা, কুত্তার বাইচ্চা, জাউরা শয়তান।

জবেদ আলী চিৎকার করে গালি দেয়। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে রাহানুম।

ও বাজান, বাজান তুমি কী হরো?

ও তোমারে কাইড়া লইতে চায় মা। আমি ওরে কোপাইয়া শ্যাষ করমু।

সুখদীপ বারান্দায় লাফালাফি করে।

হোন, বাজান, হোন।

রাহানুম ওকে ধরতে চায়। সুযোগ বুঝে জবেদ আলী পেছন দিক থেকে ওর হাতটা মুচড়ে ধরে। দা কেড়ে নেয় এবং গোটা কয়েক থাপ্পড় দিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। চিৎকার করে কাঁদে সুখদীপ। মাটিতে পড়ে গিয়ে ও আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। রাহানুম ধরতে গেলে ওর হাত কামড়ে দেয়। ও পাগলের মতো উঠোনে ঘুরপাক খায়। চিৎকার করে জবেদ আলীকে গালাগাল করে। জবেদ আলী ওকে তাড়া করলে বাড়ির বাইরের দিকে ছুটে চলে যায়। অন্ধকারে ওকে আর দেখা যায় না। ওর কান্নার শব্দও আর নেই।

তখন আবুল হাশেম উঠোনে এসে দাঁড়ায়।

অর কী অইছে?

রাহানুম কথা বলে না, নিঃশব্দে রান্নাঘরে চলে যায়। জবেদ আলীও চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। কারো কাছ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে আবুল হাশেমও আর কোনো কথা বলে না। সে নিজেও বেশ ক্লান্ত। ধরে নেয় সুখদীপের কী হয়েছে, এটা না জানলে ওর তেমন কোনো ক্ষতি নেই। বাচ্চাদের কত কিছু হতে পারে, সব জানার দরকারই বা কী? তবু মনটা খচখচ করে। আহা, এই ছেলেটিকে ও দুধের-শিশু থেকে পালছে। ওর কেউ না, তবুতো মনের মধ্যে একটা টান আছে। রাহানুম রান্নায় ফিরে গেছে। আজ ও কথা বলল না কেন? ওরইতো উচিত ছিল গলগলিয়ে সব কথা বলা। তবে ওর মুখ বন্ধ কেন? সুখদীপকে নিয়েতো ও-ই বেশি কথা বলে। ছেলে, ছেলে করে পাগল। আজ ওর মুখে কথা নেই, শুধু রান্নাঘরের কড়াইয়ে ইলিশ মাছের টুকরো তেলের ওপর ছ্যাকহঁ্যাক করে। এই শব্দ দিয়ে রাহামের কোনা কিছু বোঝা যায় না। ওর সবটাই আড়াল হয়ে থাকে। আবুল হাশেমের মনে হয় তাহলে কি বড়ো রকমের কোনোকিছু ঘটে গেছে?

এমন আশঙ্কা নিয়ে, অর কী অইছে, বলতে বলতে আবুল হাশেম বারান্দার হোগলার ওপর বসে। দু’হাত পেছনে ঠেস দিয়ে শরীর ছেড়ে দেয়। তখন অন্ধকার থেকে আবার তীরের মতো ছুটে আসে সুখদীপ।

দাদা, এই বেডা কয়, মুই তোমার কেউ না? মোরে তোমরা টোকায়ে আনছো? কও দাদা, এইডা এক্কেরে মিছা কতা?

আবুল হাশেম চুপ করে থাকে।

সুখদীপ ফোঁপাতে ফোঁপাতে একই কথা বলে।

আবুল হাশেম চুপ করে থাকে–ওর মাখার মধ্যে স্বপ্ন–নতুন চর জেগেছে, কিন্তু এই ছেলেটি ওর উত্তরাধিকার নয়, ওকে সত্যি কথাটা বলে দেওয়া ভালো। এখনই এক মহা মুহূর্ত। আবুল হাশেমের বুকের ভেতর উথালপাথাল। সুখদীপ ওর মুখখামুখি উবু হয়ে বসেছে, কান্নার ধ্বনি কমে এসেছে। ও এখন উদগ্রীব হয়ে আছে, ওর বুকের ভেতরে যাবতীয় কলকবজা চলাচল বন্ধ। অন্ধকারে সুখদীপের মুখ স্পষ্ট নয়, ওখানে কী বিচিত্র নকশা জেগেছে সেটা আবুল হাশেম দেখতে পাচ্ছে না। জ্যোৎস্না তত জোরালো নয়, কারণ চাদ ক্ষয়ে আসছে–চাদের কাছাকাছি এক টুকরো মেঘ। সুখদীপ একই কথা বারবার আউড়ে। যাচ্ছে। ওর কণ্ঠ ক্ষীণ। আবুল হাশেমকে নিশ্ৰুপ দেখে ওর ভেতরটা ক্ষয়ে গেছে, ও আর তেমন শক্তি পাচ্ছে না। নাকি ও এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণের অপেক্ষায় থম ধরে আছে?

রাহনুমের কড়াই থেকে ছ্যাঁকছ্যাঁক শব্দ আসছে না। ও কড়াইটা চুলো থেকে নামিয়ে রেখে উদগ্রীব হয়ে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। জবেদ আলী এগিয়ে এসে বলে, ছেমড়ারে হাছা কতাটা কয়েন। চাচা।

আবুল হাশেম তবু নিশ্ৰুপ। ওর করোটিতে রঙিন মাছ ভেসে এসেছে। বুঝে যায় কেন জবেদ আলীর এই তড়িঘড়ি ভঙ্গি–কেন ও সুখদীপকে রাহানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়! কী ওর আকাঙ্ক্ষা। আজ সকালে ও এসেছে, এর মধ্যে এমন বিচিত্র তোলপাড় এই সংসারে? জবেদ আলী যখন ঘটনাটা ঘটিয়েই ফেলেছে তাহলে তো আবুল হাশেমের জন্য এটা একটা সুযোগ! ও অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠে। নিজেকে বলে, এখনই সময়, এখনই। তিনজন মানুষ যে এক নয় ওটা তো সবাইকেই বুঝতে হবে। ওদের দায়িত্ব যে আবুল হাশেমের নয় সেটাও জানতে হবে। এই জানা যতই নির্মম হোক অতে ওর কি এসে যায়? কে সুখদীপ? কে রাহানুম? পথ চলতে কোনো একদিন দেখা হলেই কি আপন হবে? আবুল হাশেমের সামনে নিজের অতীত প্রবল হয়ে ওঠে। সে অতীতকে আঁকড়ে ধরে ওসামনে তাকাতে চায়–সে অতীতের আদলে ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে চায়। কারণ ওর জমি জেগে উঠেছে–নতুন জমি। এখনই তো সময় এই কয়টা বছর মুছে ফেলার।

সুখদীপ ওর সামনে বসে আছে। উবু হয়ে বসে ছিল, এখন হাঁটু মুড়েছে। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওর মুখের দিকে। ওর দৃষ্টি বিস্ফারিত, ফুলে উঠছে নাক–ওর জীবনে এখন এক রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। আবুল হাশেমের একটি কথার ওপর নির্ভর করছে ওর জীবনে অনেক কিছু। ওই মুখে আজ জ্যোৎস্না নয়, মেঘের মাখামাখি। ওই মেঘ গাঢ় হবে, অন্ধকার ঘনীভূত হবে–প্রবল বর্ষণে ধুয়ে যাবে প্রান্তর।

আবুল হাশেম খুব আস্তে করে কথাটা বললেও কথাটায় ষাঁড়ের গর্জন ধ্বনিত হয়। সে গর্জনে ছিটকে পড়ে যায় সুখদীপ। ওর দুকান ভরে বাজতে থাকে, হ দাদা, বেবাকটাই হাছা কতা।

তীব্র কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠে চিৎকার করে কাঁদে সুখদীপ। তারপর দৌড়ে পুকুরঘাটে চলে যায়। জবেদ আলী পিছু পিছু যায়। গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকে। সুখদীপ ঘাটলায় বসে দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদে। ওই শব্দে জবেদ আলীর কখনো মুহূর্তের জন্য খারাপ লাগে, সঙ্গে সঙ্গে ও তা ঝেড়ে ফেলে দেয়। ও সহানুভূতি জানাবার জন্য দাঁড়িয়ে নেই। লক্ষ্য রাখতে এসেছে যে ছেলেটি যেন কোনো অঘটন না ঘটায়। কিন্তু ও বসে আছে–ও হয়তো মৃত্যুর কথা ভাবছে না। এই বয়সে মৃত্যুর কথা ভাবা যায় না। তবে ওর ভেতর প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে। ও জবেদ আলীকে খুন করতে চায়। আজ রাতে একটুও না ঘুমিয়ে, ভীষণ নিঃশব্দে, দা নিয়ে এসে ও কি জবেদ আলীকে কুচিকুচি করবে? হয়তো করত যদি ও একটি পুরুষ হতো। কিন্তু ও শিশু। গায়ের জোরে কোনোকিছু করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। এসব ভাবতে ভাবতে জবেদ আলী কূর আনন্দে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে শিশুর কান্না শোনে–যে শিশুর কিছুক্ষণ আগেও ঘর ছিল, মা ছিল, দাদা ছিল, এখন ও এতিম। মুহূর্তের মধ্যে ওর সামনে সবকিছু নেই হয়ে গেছে। পৃথিবীতে ওর কেউ নেই। এই নিঃসঙ্গতা জাগতিক এবং মানসিক। সুখদীপ এখন কোথায় যাবে?

কোথায় যাবে তাতে জবেদ আলীর কী এসে যায়? ও নিজেকে শক্ত করে ফেলে। সুখদীপের কান্না এখন আর ওকে স্পর্শ করে না। ও গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে বিড়ি ধরায়। বিড়ির আগুন জোনাকির মতো জ্বলে। জোরসে টান দিলে আলো যেমন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তেমন চকচক করে জবেদ আলীর চোখ–ও মনে মনে,আঁক কষে, নষ্ট আঁক–কেমন করে জব্দ করবে একটি শিশুকে অর নকশা সে আঁকে। ঠিক করে সুখদীপের কান্না থিতিয়ে এলে জবেদ আলী প্রথমে ওর হাত ধরে মুচড়ে দেবে তারপর বশে এলে হ্যাঁচকা টানে ধাক্কা মেরে হিড়হিড় করে টেনে বারান্দায় নিয়ে ফেলবে। দরকার হলে বেশ কয়েক ঘা লাগিয়ে দেবে। ওকে মারলে কেউ কিছু বলবে না। ও বুঝে যায় যে আবুল হাশেম এবং রাহানুম কেউই শিশুটির পক্ষে নয়। ওরা নিজ নিজ খেলার কোর্টে দাঁড়িয়ে গেছে। এখন কেবল গোল্লাছুটের বাকি। এই পুঁচকে ছেলেকে জব্দ করা এক নিমেষের কাজ। জবেদ আলী জোরসে টান দিয়ে বিড়িটা ছুড়ে ফেলে দেয়। মনে হয় এখনও পুরোপুরি তৈরি। শিশুটি ওর নাগালের ভেতর। হাতটা ধরে মুচড়ে দিলেই হয়।

আবুল হাশেম জবেদ আলীর ব্যবহারে কিছুটা দ্বিধান্বিত। ও বুঝতে পারে না যে কেন জবেদ আলী সুখদীপকে রাহানুম থেকে আলাদা করে দিল? কী এর উদ্দেশ্য? ও কি রাহানুমকে বিয়ে করতে চায়? যেমন আবুল হাশেমের নিজেরও একটি পরিকল্পনা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে–যে জন্য ও হাট থেকে ফেরার পথে নূরুল আলমের বিধবা বোনের খোঁজ করতে গিয়েছিল–যার হাতের বানানো পান খেয়ে কিছুতেই উঠতে ইচ্ছে করছিল না, তাই এত রাত হয়েছে। জীবনে নারীর কথা ও ভুলেই গিয়েছিল–সেই নারী প্রথম পূর্ণিমার বিশাল চাদ, আলোকিত করে দিতে পারে আবুল হাশেমের এই জীবন। আবুল হাশেম চমকে নিজের দিকে তাকায়। এই জীবন! এই জীবন আবার কী? আর কত? অনেক, অনেক–নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দেয়। যার জীবনে হারানো চর নতুন হয়ে ফিরে আসে তার জীবনের তো সবে শুরু, তার আর বয়স কী, বার্ধক্য কী? আর দেরি নয়–আর বৃথা সময় নষ্ট নয়, এখন ওর গোছানোর পালা। কিন্তু জবেদ আলী কী চায়? রাহনুমকে? ভেবেছে রাহানুম আবুল হাশেমের মেয়ে?

আবুল হাশেমের প্রচণ্ড হাসি পায়। কিন্তু ও অতি কষ্টে নিজেকে দমন করে। এখনই এতকিছু প্রকাশ করতে চায় না। আগে জবেদ আলীকে বুঝতে চায়। ও যদি শুধুই রাহনুমকে বিয়ে করতে চায়, ভালো–আপত্তি নেই। কিন্তু রাহানুমকে আবুল হাশেমের মেয়ে ভেবে নতুন চরের উত্তরাধিকারী হতে চাইলে তো গোল বাধবে। কিন্তু পরক্ষণে নির্ভাবনা হয়ে যায় ও। গোলই বা বাধবে কেন? সময়ই সব কথা বলে দেবে। এত তড়িঘড়ি সব ফয়সালা না করাই ভালো। আজ রাতটুকু ওই শিশুটির রাত হয়ে থাক–নিজেকে জানার, কষ্টের এবং বড়ো হয়ে ওঠার।

এইসব ভাবতে ভাবতে আবুল হাশেম রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়। খিদে পেয়েছে। বেশ রাতও হয়েছে। এখন ঘুমুতে হবে। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। ও দেখতে পায় রাহামের রান্না শেষ। ও গামলায় ভাত বাড়ছে, বাটি ভর্তি মাছের তরকারি, চমৎকার খুশবু ছুটেছে। পেটের ভেতর নাড়ি পাক দিয়ে ওঠে। সেই কোন দুপুরে খেয়েছে, তারপর আর কিছু খাওয়া হয়নি। আগুনের আঁচে রাহালুমের চেহারা লালচে হয়ে উঠেছে, শ্যামলা গালে হাসিতে টোল পড়ে। ওর চোখের কোণে দুটো জল। ও কি কাঁদছে নাকি ঘাম? আবুল হাশেম গলা খাকারি দেয়। রাহানুম ওর দিকে তাকায় না। মুখ না তুলেই বলে, বাবো আমনহে হাতনায় বয়েন। মুই ভাত আনি। সুখদীপ? ও সুখদীপ?

রাহানুম গলা উঁচিয়ে ডাকলে আবুল হাশেম বাধা দেয়, থাক অরে ডাইকো না। মুই দেহি।

আবুল হাশেম দু’পা এগুতেই দেখতে পায় জবেদ আলী ওকে চ্যাংদোলা করে দোলাতে দোলাতে নিয়ে আসে। যেন ওকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যেটুকু জীবনশক্তি আছে সেটুকুও নিঃশেষ করা হবে। ও আর কোনোদিন ওদের পথের বাধা হয়ে থাকবে না। সুখদীপ হাত-পা ছুঁড়ছে, প্রাণপণে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। ও ওর সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়ছে। কিন্তু জবেদ আলীর সঙ্গে ও পারবে কেন?

ওই অবস্থায় আবুল হাশেম ওকে জাপটে ধরে কোলে নেবার চেষ্টা করে। বলে, থাম, দাদা ভাই, থাম। দেহি কার গায়ে বল বেশি। আয়, মোর ধারে আয়।

সুখদীপ আবুল হাশেমের হাত কামড়ে দেয়। তখন জবেদ আলী ওকে ধপ করে নিচে নামিয়ে দেয়। আবুল হাশেম উহ্ শব্দ করে কামড়ের জায়গায় থুতু লাগায়। দাতের দাগ বসে গেছে। জ্বালা করছে, তবে রক্ত বের হয়নি। আবুল হাশেমের মৃদু কাতরানিতে সুখদীপ ঘাড় বাঁকা করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। জবেদ আলী গজগজিয়ে বলে, ছ্যামড়া মানুষ না, শয়তানের ছাও। আস্ত ইবলিশ।

ততক্ষণে রাহানুম ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ও হাঁটু গেড়ে বসে সুখদীপকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে। বলে, আও বাজান, ভাত খাও। তোমার ভাত খাওয়া অইলে এউক্কা গল্প কমু।

গল্প? থুঃ।

সুখদীপ রাহামের মুখের ওপর থুতু ছিটায়। সে থুতু ছিটিয়ে ছড়িয়ে যায় চারদিকে। থুতু গিয়ে লাগে জবেদ আলীর মুখে এবং আবুল হাশেমের মুখেও।

ওরা কেউ থুতু মোছর জন্য নিজেদের হাত ওঠাতে পারে না, যেন এক শীতল স্পর্শ কামড়ে ধরে আছে ওদের চামড়া–ঘষলেই যা মুছে। যাবে না। ওই থুতু ওদের শরীরে এক স্থায়ী দাগ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *