1 of 3

০৪৯. এক তীব্র, যন্ত্রণাময় অশ্বখুরধ্বনি

এক তীব্র, যন্ত্রণাময় অশ্বখুরধ্বনি শুনতে পাচ্ছিল শচীন। বুকে তার ঘনিয়ে উঠছে ব্যথা। অস্ফুট শব্দ করে পাশ ফিরল সে। তারপরই সজাগ হয়ে চোখ মেলল।

কোথাও আলোর রেশমাত্র নেই। অবোধ কঠিন গভীর এক অন্ধকার। ঘোড়র পায়ের শব্দ এখনও দৌড়চ্ছে। সে শব্দ তার বুকের ভিতরে। শব্দ তার হৃৎপিন্ডের।

শচীনের সামনের অন্ধকার রূপময় হয়ে যেতে লাগল। বহুরঙা এক ময়ূর পেখম ধরেছে যেন। সেই রং আরোপিত হচ্ছিল এক প্রতিমায়। চপলা।

তার স্বল্পকালের জীবনে সে আর কোনও মেয়েকে দেখেন যার সঙ্গে চপলার তুলনা হতে। পারে। জবুথবু শাড়িতে মোড়া মেয়েদেরই এতকাল দেখেছে সে! চপলা শাড়ি পরে, সিঁদুর দেয়, ঘোমটা টানে, সবই ঠিক কথা। কিন্তু তার ব্যাকগ্রাউন্ড অন্যরকম। সে ঘোড়া এবং সাইকেলে চাপতে জানে, চালাতে পারে রাইফেল। চমৎকার ইংরিজিতে কথা বলতে পারে। ইংরেজদের সঙ্গে বহু ডিনার খেয়েছে সে। তবু সব ছেড়েছুড়ে বাঙালির গৃহস্থঘরের বউ হতেও তার বাধেনি।

চপলা সম্পর্কে এটুকু ছিল শচীনের প্রাথমিক মুগ্ধতা। তারপর জল আরও গড়াল, যখন সে এই মহিলার অসামান্য মুখশ্রী ভাল করে লক্ষ করল একদিন।

একথা ঠিক, চপলা একটু লঘু স্বভাবের মেয়ে। ইয়ার্কি ঠাট্টা তার ভীষণ প্রিয়। চিমটি দিয়ে কথা বলতেও সে ওস্তাদ। কিন্তু ওটুকু শচীনকে আরও পেড়ে ফেলেছে।

নিজের শাসে মৃদু কম্পন টের পায় শচীন। দুই সন্তানের মা, চৌধুরীবাড়ির বউ চপলার প্রতি তার সমস্ত সত্তার একমুখী স্রোত দুরন্ত এক গতিতে নিয়ে চলেছে তাকে। উজান বাইবার শক্তি তার নেই। সে ভেসে যাচ্ছে এক অমোঘ লক্ষ্যে। নিয়তির নির্দেশে।

বুকের মধ্যে ঘোড়ার তীব্র দৌড় টের পায় শচীন। বুক ব্যথিয়ে ওঠে যন্ত্রণায়। মাঝরাতে আজকাল প্রায়ই তার এইরকমভাবে ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম আসেও না বড় সহজে। কাটাছেড়া তন্দ্রার মধ্যে সারাক্ষণ হানা দেয় চপলার মুখ। এক প্রলয় বাতাসে ভেঙে পড়েছে প্রতিরোধের দ্বার। কী করবে শচীন?

তার ভিতরকার বুদ্ধিমান ও বিবেচক উকিলটি মাঝে মাঝে তাকে সাবধান করে দেয়, কুল ভাঙবে, মর্যাদা নষ্ট হবে, কোথাও ঠাই হবে না তোমাদের। নিষিদ্ধ ফলের দিকে হাত বাড়িয়ো না।

নিষিদ্ধ ফল? শচীন যেন অবাক হয়ে ভাবে, চপলা কেন নিষিদ্ধ ফল হতে যাবে? নিষিদ্ধই যদি, তবে অত সুন্দর কেন? অত দুষ্টু কেন? কেনই-বা অত গা-ঘেঁষা?

শচীনকে নিজের জন্য কখনওই চিহ্নিত করত না চপলা, ননদের জন্যই নির্দিষ্ট রেখেছিল তাকে। কিন্তু সবসময়ে কি সব হিসেবমতো ঘটে?

শচীন যতদূর দেখতে পায়, তাদের দুজনের মধ্যে বিদ্যুৎ খেলেছিল সেই জলসায়। শচীন তার গাঢ় গভীর গলায় গজল গাইতে গাইতেই দেখল, চপলার মুখে-চোখে এক অদ্ভুত অপার্থিব মুগ্ধতার ভাব নেমে এসেছে কখন। চোখদুটিতে গভীর সম্মোহন। চোখের ফাদে সেই যে ধরা পড়ল শচীন, তারপর থেকে কেবল ছটফট করে ভিতরটা।

চপলা তেমন ভাল গান জানে না। বলতে কী, তার খাকতি হয়তো ওই একটাই। তবু কয়েকটা রবীন্দ্রসংগীত শুনিয়েছিল সেদিন। রূপমুগ্ধ শচীনের সে গান খারাপ লাগেনি।

পরদিন শচীনের কাছে কাছারিঘরে এসে হানা দিল চপলা। কর্মচারীরা তটস্থ। চপলা বলল, কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করে ওপরে আমার ঘরে আসুন।

শচীনের লুব্ধ মন এই আমন্ত্রণের ভালমন্দ বিচার করল না। ভিতরে এক শিহরিত আনন্দের উজ্জীবক স্পর্শ তার চোখ-মুখকে উজ্জ্বল করে দিল। সে বলল, যাব।

সেদিন সন্ধ্যায় চপলার ঘরে আর কেউ ছিল না। শুধু চপলা আর শচীন।

চপলা একটু সেজেছিল। ফ্রিলওলা খুব আধুনিক ব্লাউজ তার গায়ে এবং ঝলমলে একটা শাড়ি।

পরিপাটি বাঁধা খোঁপা। মুখে কিছু প্রসাধন এবং গায়ে দামি সুগন্ধ।

চপলা বিনা ভূমিকায় বলল, উকিল হয়ে পচে মরবেন কেন? জীবনে উন্নতি করার ইচ্ছে হয় না আপনার?

শচীন এই আচমকা কথায় সামান্য নাড়া খেয়ে বলল, কেন? ওকালতি কি খারাপ?

খারাপই তো। প্রেস্টিজ পেতে হলে ব্যারিস্টার হতে হয়। পারবেন না?

উকিল পাত্র কি আপনার ননদের পছন্দ নয়?

ননদকে টানা কেন আবার! আমার নিজের পছন্দ নয়।

শচীন একটু প্রগম্ভ হয়ে সাহস করে বলল, আপনার তো আর পাত্রের চিন্তা নেই। থাকলে আমিই প্রথম ক্যান্ডিডেট হতাম।

চপলার সঙ্গে বউদি-দেওর সম্পর্কে এরকম ইয়ার্কি চলতে পারে বটে, কিন্তু চপলা একথায় কেমন যেন হয়ে গেল। কিছুক্ষণ কথা না বলে দুটি চোখ পেতে রাখল শচীনের মুখের ওপর।

তারপর চোখ সরিয়ে নিয়ে খুব চাপা গলায় বলল, আমার জীবনটা খুব সুখের নয় শচীনবাবু।

আবহাওয়াটা হঠাৎ ভারী হয়ে ওঠায় শচীন বিব্রত বোধ করতে থাকে।

চপলা একটা ডেকে রাখা কয়েকটা পত্রপত্রিকা নাড়াচাড়া করতে করতে বলে, এ জায়গায় বিয়ে করার একটুও ইচ্ছে ছিল না আমার। কথা ছিল, বিলেত যাব, ব্যারিস্টারি পড়ব বা আই সি এস কমপিট করব। বাবা রাজি থাকলেও শেষ অবধি মা আর ঠাকুমা বেঁকে বসে। কিছুই হল না। একদম জলঘট হয়ে রইলাম।

শচীন মিনমিন করে বলে, তা কেন?

জলঘট নয়? আমার স্বামী দেখতে কার্তিকঠাকুর হলে কী হয়, একদম আনস্মার্ট। ভাল করে কথা বলতে জানে না। জমিদারনন্দনরা যেরকম হয় ঠিক তেমনি। না লেখাপড়ায় ভাল, না আর কিছুতে। আমি অনেক কষ্টে খানিকটা মানুষ করার চেষ্টা করেছি। ইচ্ছে ছিল বাবাকে বলে ওর বিলেত যাওয়ার ব্যবস্থা করি। কিন্তু ভেবে দেখলাম, পাঠিয়ে লাভ নেই। সাহেবদের দেশে গিয়ে শুধু কয়েকটি কু-অভ্যাস নিয়ে আসা ছাড়া ওর দ্বারা আর কিছু হবে না।

শচীন মৃদু একটু হাসল বটে, কিন্তু তারপর বিষণ্ণ গলায় বলল, কনকদা ঠিক আগের মতো নেই। আগে কীরকম ছিল? আরও খারাপ?

না। ঠিক খারাপ নয়। এমনিতে ভালমানুষ, কিন্তু একগুঁয়ে ধরনের।

আহা, আর সার্টিফিকেট দিতে হবে না। আমার চেয়ে ভাল তো কেউ জানে না। এক কথায় বোকা আর জেদি।

শচীন কী আর বলবে, মাথা চুলকোল একটু।

চপলা বলল, আমি একটু ঠোঁটকাটা। স্পষ্ট কথা বলতে ভালবাসি। কিছু মনে করবেন না।

না, না।

পান্তাভাতের মতো পুরুষমানুষের ঘর করতে কবতে আমার ভিতরটা মরে যাচ্ছে। এই যা দেখছেন ভালমানুষ বউ সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছি এটা আমার ছদ্মবেশ। সারাজীবন কি ছদ্মবেশ পরে কাটিয়ে দেওয়া যায়! সবসময় মনে হচ্ছে আমি অন্য এক নারীচরিত্রে অভিনয় করে যাচ্ছি মাত্র।

শচীনের বুকের ধকধকানিটা শুরু হল এ সময়ে। সে বুঝতে পারছিল, চপলা তাকে একটা কিছু বলতে চায়। এ হল তারই ভূমিকা। সেই চরম কথাটা কী তাও সে আন্দাজ করতে পারে। একই সঙ্গে বুকের মধ্যে তীব্র চিনচিনে আনন্দ ও ভয় হচ্ছিল তার। দুঁদে উকিল হয়েও সে কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। শুধু বলল, সে তো ঠিক কথা।

চপলা বলল, এত অল্প বয়সে ওকালতি করা কি আপনাকে মানায়! সুন্দর ওই চেহারায় কালো কোট প্যান্ট পরে মক্কেলদের পিছন পিছন ঘোরা আমি একদম সইতে পারি না। তার চেয়ে ব্যারিস্টার হয়ে আসুন। ব্যারিস্টারের প্রেস্টিজই আলাদা।

শচীন একটু অবাক হয়। মনের গহনে এরকম একটা ইচ্ছে যে তার ছিল না তা নয়। কিন্তু ইচ্ছেটাকে খুঁচিয়ে দেওয়ার কেউ ছিল না। গরিবের ছেলে ওকালতি পাশ করে কিছু পয়সার মুখ দেখেই ভেবেছিল, জীবনে এর চেয়ে বেশি আর কী চাওয়ার থাকতে পারে? এই তো চূড়ান্ত সফলতা! কিন্তু কারও কারও চোখে ওকালতিটাও যে যথেষ্ট না মনে হতে পারে এটা সে ভাবেনি। এখন ভাবল। তার মনে হল, বুদ্ধিমান ও উদ্যোগী ছেলেদের কোথাও থেমে যাওয়া উচিত নয়। তাদের উন্নতির পথ দূরপ্রসারী। বিশেষ করে চপলার মতো মেয়ের মন রাখার চেয়ে সৎকর্ম আর কী আছে?

শচীন বলল, ব্যারিস্টারি পড়তে অনেক টাকা লাগে। আমরা কিন্তু তত বড়লোক নই।

জানি। ওই কারণেই তো মুখপুড়ি আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি। কিন্তু আমার মনে হয়, চেষ্টা যারা করে তাদের টাকার অভাব কোনও বাধা নয়।

আমি ব্যারিস্টার হলে আপনি খুশি হন?

হই। ভীষণ খুশি হই।

আপনার ননদের সঙ্গে বিয়ে হবে না জেনেও?

বিয়ে যে হবেই না একথা কে বলল?

হবে বলছেন?

হতেও তো পারে। বিয়ের ব্যাপারে কত অঘটন ঘটে। আমাকে দেখছেন না? আমার কি কনককান্তির মতো ভেড়ার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা!

রক্ষণশীল পরিবারের ছেলে শচীন একটু চমকে উঠল। সে কখনও তার আত্মীয় বা পবিচিত মহলে কোনও মহিলাকে স্বামীর নাম উচ্চারণ করতে শোনেনি। তার সঙ্গে ভেড়া বিশেষণ তো নয়ই।

শচীন জবাব দিচ্ছে না দেখে চপলা আবার জিজ্ঞেস করে, বলুন না! আমার মতো সব দিক দিয়ে চৌকস মেয়েকে কি এ সংসারে মানায়? একটু পান থেকে চুন খসলেই এদের জাত যায়। আমার এত রেসট্রিকশন ভাল লাগে না বলেই কলকাতায় পালিয়ে গেছি। কিন্তু গেলে কী হবে! যাকে নিয়ে জীবন সেই তো জলঘট। কাজেই বিয়ের কথা কিছু বলা যায় না। বিশাখার সঙ্গেও আপনার একদিন হুট করে বিয়ে হয়ে যেতে পারে।

বোধহয় নয়।

কেন নয়?

শচীন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আর বোধহয় তা হয় না।

কারণটা কী? হঠাৎ এমন কী ঘটল?

ঘটেছে বউঠান। আপনি বুঝবেন না।

হঠাৎ চপলা তীব্র রহস্যময় এক কটাক্ষে শচীনকে বিদ্ধ করে বলল, একেবারেই যে বুঝিনি তা নয়।

শচীন মুখ আড়াল করল।

বেচারা! অত লাজুক হলে কি চলে? একটু সাহসী হতে হয়। ডাকাতি করতে গিয়ে চোরের মতো হাবভাব ভাল নয়।

একথায় শচীনের ফরসা রঙে রক্তিমাভা দেখা দিল।

শচীনের অবস্থা দেখেই বোধহয় চপলা দয়া করে তাকে রেহাই দিতে বলল, আজ গান শোনাবেন!

শচীন সেদিন গানের মধ্যে ঢেলে দিয়েছিল নিজেকে।

শেষ হলে চপলা এক পেট খাবার খাওয়াল তাকে। বলল, উকিল যে এমন গায়ক হতে পারে জানা ছিল না।

কেন? উকিলরা কি গাধা?

তাই বললাম বুঝি! বলছিলাম উকিল পেশাটার সঙ্গে গান যেন ভারী বেমানান।

ব্যারিস্টার হয়ে গান গাইতে হবে তা হলে!

চপলা দৃঢ় স্বরে বলল, হ্যাঁ। মনে রাখবেন ব্যারিস্টার বা আই সি এস কিছু একটা আপনাকে হতেই হবে। আমি জানি আপনি পারবেন।

সেদিন এই পর্যন্ত।

তারপর জল আর-একটু গড়িয়েছে। কতদূর গড়িয়েছে তা হিসেব করা শচীনের অসাধ্য। সে নিজের মনের কথা বলতে পারে। এক পাগল প্লাবনে ভেসে গেছে বিশাখা, ভেসে গেছে জমিদার শ্রীকান্ত রায়ের মেয়ে। তার মনের মধ্যে এখন শুধু একটিমাত্র মুখ। সকাল থেকে গভীর রাত অবধি সেই মুখ একবারের জন্যও অস্ত যায় না। ঘুম ভেঙে যায় বারবার। এক অশ্বখুরধ্বনি মথিত করে শচীনের বুক। সর্বনাশের নেশায় নাচে হৃৎপিণ্ড।

শচীন অনেকটা জল খেল ঘটি থেকে। তারপর মশারি তুলে বাইরে এসে জানালার ধারে দাঁড়াল। জানালার ধার থেকেই আমরাগানের শুরু। সেখানে ঝুপসি আঁধার। অজস্র জোনাকি জ্বলছে। ঝিঝি ডাকছে সুতীব্র ঝালায়। আচমকা শেয়াল ডেকে উঠল দুরে। দমকা এক বাতাসে টিনের চালে ঘষটান খেয়ে গেল সুপুরির পাতা। আকাশে মেঘ চমকাল। বৃষ্টি আসবে। মেঘ ডাকছে দূরে কোথাও।

শচীনের মনে হচ্ছিল তার গা ভরে জ্বর এসেছে বুঝি। চোখে জ্বালা। এক-একবার তার মনে হচ্ছে, এ কী করছে সে? একটা সংসার ভেসে যাবে, দু-দুটি অবোধ শিশু পড়বে ভীষণ বিপাকে, তাছাড়া তাকেও তো ভেসে পড়তে হবে সব বন্ধন ছেড়ে। চেনা মানুষের কাছে মুখ দেখানোর জো থাকবে না। এ কি সম্ভব? এ কি উচিত হবে?

কিন্তু ক্ষণকালের জন্য মাত্র এইরকম যুক্তিশীল আচরণ করে তার মন। পর মুহূর্তেই একটা আবেগ ভিতরকার সব নীতিবোধের চৌকাঠ ডিঙোয়, বেড়া ভাঙে, সীমানা লঙঘন করে। কী করবে শচীন?

তালি এক হাতেও বাজছে না। শচীন তবু অবিবাহিত, পিছুটান ছাড়লেও খুব বেশি কিছু যাবে আসবে না। উকিল মানুষ, যেখানেই হোক পসার পাবেই। কিন্তু চপলাকে ছাড়তে হবে তার বহুগুণ বেশি। তবু চপলার ভিতর তেমন কোনও দুর্ভাবনা নেই।

শচীন খবর পেয়েছে, কনককান্তিকে কলকাতায় রওনা করে দিয়েছে চপলা। নিজে থেকে গেল। এই থাকার অর্থও খুব স্পষ্ট আর উত্তেজক।

শচীন যে সঠিক কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছে তাও নয়। তার মাথা পাগল-পাগল, মন অস্থির। সবচেয়ে বড় কথা, চপলার সঙ্গে তো স্পষ্ট কোনও কথা হয়নি। শুধু আভাস ইঙ্গিত মাত্র। এখনও তারা আপনি থেকে তুমিতে নামেনি। এমনকী, শচীনের মতো পাগলামিও পেয়ে বসেনি চপলাকে। সে দিব্যি বাড়ির লোকের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলছে, শিশুদের পরিচর্যা করছে, সংসারের ধকল সামলাচ্ছে। মেয়েরা হয়তো পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি শক্ত হয়। এদিকে শচীন তার মামলার সওয়াল গুলিয়ে ফেলছে। দুটো মামলার শুনানি পিছিয়ে দিতে চেয়ে জজকে খোশামোদ করেছে।

সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, শশিভূষণের মামলা উঠতেও দেবি নেই। হেমকান্ত তাকেই শশিভূষণের উকিল হয়ে বরিশাল পাঠাবেন বলে স্থির করেছেন। অথচ সেই মামলার প্রস্তুতি হিসেবে যেসব আরগুমেন্ট সাজানো উচিত ছিল তা আজও করে উঠতে পারেনি শচীন।

বাড়ির লোকের সঙ্গে সে ভাল করে কথা বলতে পারে না। বড্ড অন্যমনস্ক থাকে। তিনবার ডাকলে সাড়া দেয়। এরকম চলতে থাকলে সে অচিরেই ধরা পড়ে যাবে। কী লজ্জা!

সুফলা একদিন বলেই ফেলল, দাদা কেবল বুঝি চৌধুরীদের কুটনি মেয়েটার কথা ভাবো!

তোকে কে বলল? ফাজিল!

সুফলা গোঁজ হয়ে বলে, ভীষণ পাজি, জানো না তো?

আমি মামলা-মোকদ্দমার কথা ভাবি। ওসব ভাববার সময় কই?

ওদের বাড়ির বউ আমাদের বাড়ি আসে, জানো?

একটু কেঁপে উঠে শচীন বলল, আসে! কখন?

রোজ দুপুরের দিকে। তুমি বেরিয়ে গেলে।

কী চায়?

কী আবার চাইবে! ধরেবেঁধে তোমার সঙ্গে বিশাখার বিয়ে দিয়ে তবে ছাড়বে।

আমি বিয়ে করলে তো!

তুমি ওবাড়ি যাও, সবাই তো জানে।

সে যাই কাছারির কাজে। টাকা দেয়।

টাকা দিলেই কী? ওবাড়ির চৌকাঠও ডিঙোনো উচিত নয়।

তোকে এত পাকা কথা শেখাচ্ছে কে?

সুফলা সাহস করে দাদাকে অনেকটা বলেছে। এবার ভয় পেয়ে চুপ করে গেল।

বউঠান এসে কী বলে?—শচীন জিজ্ঞেস করে।

কিছু বলে না। ধানাই-পানাই গল্প করে মার সঙ্গে। আসল মতলব তো আমরা জানি।

জানিস তো জানিস, খবরদার দুম করে অপমান-টপমান করে বসিস না যেন। যা কুঁদুলি তোরা!

আমরা অপমান করব কেন? আমরা কি ওদের মতো যে লোককে মানুষ বলে মনে করি না!

সেদিন বিকেলে দেখা হল চপলার সঙ্গে। রোজই কাছারির কাজ শেষ হলে নীচের তলার একটা ঘরে তার সঙ্গে দেখা হয় চপলার। ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু হয় কি না তা ভেবে দেখার চেষ্টা করেনি শচীন। আর ভাবতে ভাল লাগে না।

সে চপলাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি যে আমাদের বাড়িতে প্রায়ই যান তা তো বলেননি কখনও আমাকে?

চপলা বিষণ্ণ গলায় বলল, কী সুন্দর সংসার আপনাদের! ভারী শান্তি, শ্রী। এরকম বাড়িতে যে কেন বিশাখা যেতে চায় না তা আমার মাথায় ঢোকে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *