1 of 3

০৩৬. বিস্ময়টাকে চট করে লুকিয়ে

বিস্ময়টাকে চট করে লুকিয়ে রেমি হাসিমুখে ছেলেটিকে বলল, আরে! আসুন, আসুন।

ধ্রুব যে পাগল সে বিষয়ে রেমির বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। সেই পাগলামিকে সে নিজেও খানিকটা প্রশ্রয় দেয়। তবে সে এ-ও জানে যে, ধ্রুব পাগল হলেও সন্দেহ-পিশাচ নয়। রেমি যদি অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে প্রেম করে তাতে ধ্রুব উত্তেজিত হবে বা রেগে যাবে বলে রেমির মনে হয় না। ততটা ভালবাসে কি তাকে ধ্রুব? ততটা নিজের জিনিস বলে মনে করে কি তাকে?

এই ছোকরাকে ঘরে ডেকে এনে তার সঙ্গে ভিড়িয়ে দেওয়ার যে ছেলেমানুষি চেষ্টা ধ্রুব করছে সেটা রেমির কাছে আরও অপমানকর। ধ্রুব চায় রেমি তাকে ছেড়ে অন্য দিকে কিছুক্ষণ মন দিক। নইলে সত্যি বলতে কী, এই ছেলেটার কাছে ঘটা করে কৃতজ্ঞতা জানানোর কিছু নেই। রেমিকে তো এ সমুদ্রের ভিতর থেকে উদ্ধার করেনি, আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকেও বাঁচায়নি। শুধু ঢেউ যেখানে তাকে ছুড়ে ফেলেছিল সেখান থেকে নিরাপদ দূরত্বে টেনে এনেছে। না আনলে বিপদ হতে পারত, নাও হতে পারত।

ছেলেটা কিছু অপ্রতিভ ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকল। মুখে হাসি। হেঁ হেঁ ভাব। তার অলক্ষে রেমি কিছু কঠোর চোখে ধ্রুবর দিকে চাইল।

ধ্রুব ত্রুক্ষেপ না করে বলল, এ হচ্ছে মনো বিশ্বাস। নাগপুরের বাঙালি। বুঝলে! ব্রিলিয়ান্ট বয়। ইন ফ্যাক্ট আমি প্রবাসী বাঙালিদেরই বেশি প্রেফার করি। বাঙালিদের ইনহেরেন্ট কতগুলো দোষ এদের থাকে না।

প্রগলভ ধ্রুবর মতলবটা আন্দাজ করার অক্ষম একটা চেষ্টা করছিল রেমি। মনো বিশ্বাসকে খুব মন দিয়ে লক্ষ করছিল না। ছেলেটা বেশ সুপুরুষ সন্দেহ নেই। লম্বা চওড়া চেহারা। তবে চোখের দৃষ্টি নিরীহ এবং মুখের ভাব অতিশয় বিনয়ি।

বসুন।–রেমি বলো।

মনো বিশ্বাস বসল এবং বিনয়ের সঙ্গে মৃদু-মৃদু হাসতে লাগল।

ধ্রুব রেমিকে বলল, ওর সঙ্গে আমার খুব জমে গেছে।

তুমি তো জমানোর ব্যাপারে খুব ওস্তাদ। তুমি বোসো, আমি মনোবাবুকে একটু চা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে আসি।

শুনে ধ্রুব হাঁ হাঁ করে উঠে বলল, এই অবেলায় চা খাবে কী! চা-ফা বিকেল চারটের মধ্যে! এখন অন্য জিনিস।

রেমি ভ্রু কুঁচকে যতদূর সম্ভব কঠোর মুখভঙ্গি করে বলল, কেন বেচারাকে স্পয়েল করবে?

স্পয়েল করব কী? ও তো কুমিরের মতো খায়।

তুমি জানলে কী করে?

ওসব জানা যায় হে, তুমি বুঝবে না।

তোমরা দুজন যদি ওসবই খাও তা হলে আমার থেকে লাভ কী? আমি বরং সি-বিচ থেকে ঘুরে আসি।

মনো এতক্ষণ কথা বলেনি। স্বামী-স্ত্রীর চাপান-উতোর শুনছিল। এবার খুব বিনয়ের সঙ্গে বলল, আমার ড্রিংক না হলেও চলবে। আমি মাঝেমধ্যে খাই বটে, কিন্তু নেশা নেই।

তখন লক্ষ করেনি রেমি, এখন করল, ছেলেটার কথায় পশ্চিমা টান আছে। রেমি ধ্রুবর ওপর চটেই ছিল। বলল, ও আপনাকে বোধহয় শেষ অবধি ছাড়বে না।

মনো নিরীহভাবে ধ্রুবকে বলে, আজ থাক না হয় দাদা। আমরা দুজন ড্রিংক করলে বউদি তো লোনলি ফিল করতেই পারেন। আজ প্রথম দিন বরং একটু গল্পই করা যাক।

ধ্রুব ঠোঁটটা উলটে বলল, গল্প-টল্প ভাই, আমি বেশিক্ষণ শুকনো মুখে চালাতে পারি না। তোমরা করো, আমি বরং ঘুরে আসি একটু।

সিদ্ধান্তটা বড় সহজ হল না। তিনজনে কিছুক্ষণ টানা-হ্যাঁচড়া চলল। তবে মদের ব্যাপারে একটিও কথা আর বলল না ধ্রুব। রেমি লক্ষ করছে, ইদানীং মদ প্রায় ছুঁচ্ছেই না ধ্রুব। বাস্তবিক যাদের নেশা থাকে তারা একদম না খেয়ে পারে না। ধ্রুব একদম না খেয়েও পারে। দিনের পর দিন পারে। হয়তো ওর সত্যিকারের নেশা নেই। কিংবা কে জানে কী!

ধ্রুব শেষ অবধি থাকল না। দুজনকে রেখে বেরিয়ে গেল।

রেমি অচেনা পুরুষের সামনে আগে অস্বস্তি বোধ করত না। আজকাল করে। তার শ্বশুরবাড়িতে বাড়ির বউরা বাইরের লোকের সামনে হুটহাট বেরোয় না। সেই অভ্যাসই তাকে সংকুচিত করে রেখেছে খানিকটা।

সে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কি বরাবর নাগপুরে? কলকাতায় কেউ নেই?

মনো বলে, কলকাতা নয়। আমাদের বাড়ি ছিল মুর্শিদাবাদ শুনেছি। কিন্তু আমরা কখনও যাইনি। নাগপুরে আমাদের চারপুরুষ হয়ে গেল। কলকাতায় একবার গিয়েছিলাম ইন্টারভিউ দিতে।

কেমন লাগল কলকাতা?

আরি বাপ! লাখো গাড়ি, কোটি লোক।

রেমি হেসে ফেলল। বলল, সে তো মুম্বাইতেও লাখো গাড়ি, কোটি লোক।

সে ঠিক, কিন্তু কলকাতার মতো— যাক গে কলকাতার নামে কিছু বললে বাঙালিরা চটে যায়।

কিন্তু বাঙালি বললে চটে না। আপনি তো বাঙালি!

সে বটে, তবে কলকাতার বাঙালিদের আমরা একটু সমঝে চলি।

কেন? তারা কি খাবাপ?

না, না। খারাপ কেন হবে। তবে আমাদের মতো অন্য প্রভিন্সের বাঙালিদের তারা পছন্দ করে। ধরুন কয়েক পুরুষ অন্য স্টেটে থাকলে তো মাদার ল্যাংগোয়েজে একটু ভুল হবেই, কালচারটাও ভাল মেনটেন করা যাবে না, হ্যাবিটস পালটে যাবে। হবে না এসব বলুন?

তা তো হতেই পারে।

কিন্তু আপনারা–অর্থাৎ ওরিজিন্যাল বাঙালিরা এসব ভাল চোখে দেখেন না। বিভূতিভূষণের লেখা পড়িনি বলাতে একজন বাঙালি আমার ওপর দারুণ চটে গিয়েছিলেন। উনি আমাকে মেরেই বসতেন যদি জানতেন যে আমি বাংলায় রবীন্দ্রনাথও কিছু পড়িনি। বাংলা লেখা বা পড়ার পাটই নেই আমাদের।

কিন্তু আপনি তো বলেন।

সে বলি। বলাটার একটু চল আছে এখনও বাড়িতে।

তারপর কী হবে?

মনো মৃদু হেসে বলে, হয়তো এরকমই থেকে যাবে। খুব খারাপ হলে একটা বাঙালি পরিবার বড় জোর নন-বেঙ্গলি হয়ে যাবে। তার বেশি কিছু না। প্রবাসী বাঙালিকে আজকাল বাঙালি বলে ধরেই না অনেকে।

কথাটা শুনে রেমির একটু দুঃখ লাগছিল। মাথা নেড়ে বলল, অনেক প্রবলেম আপনাদের, না?

মনো মাথা নেড়ে হেসে উঠে বলল, আরে না, প্রবলেম আমাদের হবে কেন? প্রবলেম আপনাদের, যারা বাঙালি বাঙালি করে কেবল গলা শুকোয়। আমরা যাবা বাইরে জন্মেছি তাদের মধ্যে অত প্রভিন্সিয়ালিজম নেই। আমার দুই দিদির বিয়ে হয়েছে মধ্যপ্রদেশ আর মহারাষ্ট্রের পাত্রের সঙ্গে। আমার দাদা বিয়ে করেছে এক দিল্লিওয়ালি সর্দারনিকে। উই হ্যাভ নো প্রবলেম।

তার মানে কী? হ্যাং উইথ বেংগলিজ?

মনো বিশ্বাস খুব হাসল। বলল, অতটা নয়। নো বিটার ফিলিং। একজন বাঙালি যদি এখনও নোবেল প্রাইজ পায় বা ওলিম্পিক থেকে সোনার মেডেল নিয়ে আসে তা হলে অ্যাজ এ বেঙ্গলি আমি প্রাউড ফিল করব। তা বলে প্রভিন্সিয়ালিজম আমাদের নেই।

বাঙালিদের খুব প্রভিন্সিয়ালিজম আছে বুঝি?

মনো বিশ্বাস ঠোঁট উলটে বলে, কে জানে কী বউদি। তবে আমার সঙ্গে কয়েকজন ওরিজিন্যাল বাঙালির পরিচয় হয়েছে, এক্সপেরিয়েন্সটা খুব সুখের হয়নি।

রেমি মৃদুস্বরে বলল, সেটা আপনার অভিজ্ঞতা। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা অন্যরকম।

সেটা কীরকম বউদি?–মনো নড়েচড়ে বসল। সকৌতুকে তাকাল রেমির দিকে।

রেমি তার শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গ করে রাজনীতি একটু বুঝতে শিখেছে। সে বলল, কলকাতা বাঙালির শহর নয়। সেখানে কোনও বাঙালি-অবাঙালি ফিলিং নেই। তা ছাড়া বাঙালি-অবাঙালিতে মারপিটও পশ্চিমবঙ্গে হয় না।

মনো মাথা নেড়ে বলে, আরে মারপিটের কথা বলিনি। আমি বলছি যেটা তা অন্য জিনিস। বাঙালিরা আর ভেরি মাচ প্রাউড অফ দেমসেলভস।

রেমি মাথা নেড়ে বলে, সেটা স্বাজাত্যাভিমান।

ওই হল।

রেমি বলল, না, হল না। আপনার রিডিং ঠিক নয়। আমাদের অনেক দোষ আছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের প্রবলেম অনেক। আফটার পার্টিশন দেশটার অবস্থা কী তা কখনও খোঁজ করেছেন? আপনি কি জানেন আমাদের স্টেটের বিগ বিজনেস আর বিগ ইন্ডাষ্ট্রি কোনওটাই বাঙালিদের হাতে নেই? কলকাতায় যে কটা স্কাইস্ক্র্যাপার আছে তার ওনারশিপ বেশিরভাগই নন-বেঙ্গলির।

দোষটা কার বউদি?

আমাদেরই। বলছিই তো, এসব আমাদের দোষ। শুধু ভাষা আর কালচার নিয়ে আমাদের একটু অহংকার আছে। কোনও বাঙালি যদি সেটুকুও হারিয়ে বসে থাকে তবে আমরা দুঃখ পাই। সেটা প্রভিন্সিয়ালিজম হতে যাবে কেন?

না, আপনি ওরিজিন্যাল বাঙালিদের মতোই কথা বলছেন। তবে অ্যাগ্রেসিভ নন।

রেমি একটু হাসল।

মনো বিশ্বাস হঠাৎ প্রসঙ্গ পালটাল। গলাটা খাটো করে বলল, একটা কথার ঠিকঠাক জবাব দেবেন?

বলুন না।

আজ আপনি যখন জলে নামলেন, আমি আমার হোটেলের বারান্দা থেকে দেখছিলাম। মনে হল, ইট ইজ অ্যান অ্যাটেম্পট ফর সুইসাইড। অ্যাম আই কারেক্ট?

রেমির বুকের মধ্যে একটা তোলপাড় দেখা দিল। কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারল না। তারপর বলল, যাঃ।

আমি একটু বোকা আছি, বউদি। যা মনে আসে বলে ফেলি। কিছু মনে করবেন না। কথাটা এখনও বলতাম না। কিন্তু আপনাকে দেখে কেন যেন আনহ্যাপি মনে হচ্ছে।

রেমি রাগ করতে পারত। কিন্তু এ ছেলেটি একদমই সরল এবং বোধহয় একটু বোকাও। মনের কথা চেপে রাখতে জানে না। তাই রেমি একটু হেসে বলল, মেয়েদের মনের খবর পাওয়া অত সহজ নয় ভাই। সমুদ্রে আমি নেমেছিলাম অ্যাডভেঞ্চারের জন্য।

তা হলে বলতে হয় আপনি দারুণ সাহসী।

তাও নয়। হঠাৎ মাথায় ভূত চাপে না মাঝে মাঝে? সেরকমই।

যাক, ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল।

রেমি টুক করে অন্য একটা প্রসঙ্গে চলে গেল, আপনি কি পুরীতে একা এসেছেন?

ঠিক একা নয়। সঙ্গে একজন বন্ধু আছে। তবে সে পাগল।

পাগল!–রেমি অবাক হয়ে বলে, সত্যি পাগল?

হ্যাঁ। আগে ছিল না। এখন হয়েছে। তাকে সঙ্গ দিতেই আসা।

সেও কি বাঙালি?

না। মধ্যপ্রদেশের ছেলে।

পাগল হল কী করে?

সে অনেক ব্যাপার বউদি। আর-একদিন শুনবেন। আজ বরং আমি উঠি।

আরে! চা খাবেন না?

চা? থাক গে। ও আমার না হলেও চলবে।

আরে বসুন, আপনি গেলেই আমি একা হয়ে পড়ব। চা খেতে খেতে সেই বন্ধুর কথা বলুন। আমি পাগলদের গল্প শুনতে খুব ভালবাসি।

মনো বিশ্বাস একটু হাসল, বলল, শোনার মতো গল্প নয়। বাজে ব্যাপার।

অশ্লীল কিছু নয় তো!

না, তা নয়।

তা হলে বসুন, চা বলে আসি।

রেমি খুব দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে তড় তড় করে নীচে নেমে এল। সিঁড়ির গোড়ায় সে একটু থমকে দাঁড়ায়। বস্তুত মনো বিশ্বাসের সঙ্গে বক বক করা বা ওর বকবকানি শোনার কোনও ইচ্ছাই তার হচ্ছিল না। বরং এ সময়ে একা বসে নিজের অভ্যন্তরের ক্ষতগুলির কথা ভাবতে তার ইচ্ছে। হচ্ছে। কিন্তু ধ্রুব সঙ্গে তাকে তো কোনও না কোনওভাবে পাল্লা দিতে হবে! এই ছেলেটিকে বসিয়ে রেখে অত্যন্ত অভদ্রভাবে ধ্রুব বেরিয়ে গেছে। তাকে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে যে, সে পরোয়া করে না। বেশ, ধ্রুবর সেই ছুড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জ সে লুফে নেবে। সম্ভব হলে এই ছেলেটির সঙ্গে অনেক রাত অবধি সে গল্প করবে, সমুদ্রের ধারে বেড়াবে। আজ, কাল, পরশু, রোজ। দেখা যাক কী হয়।

বেয়ারার পিছু পিছুই উঠে এল রেমি। তারপর মুখোমুখি বসে মনোকে বলল, এবার বলুন।

কী বলব? আমার পাগল বন্ধুর কথা?

হ্যাঁ।

বউদি, কিছু মনে করবেন না, আপনিও একটু পাগলি আছেন কিন্তু।

রেমি ভ্রু কুঁচকে চেয়ে বলল, নিজের ঘরের লোকের কাছে দিনরাত ওই কথা শুনছি।

তা হলে কথাটা ঠিক?

পাগল তো সবাই।–বলে রেমি মুচকি হাসল।

আমাকে কি আপনার তাই মনে হয়?

একটু-একটু হচ্ছে। এবার গল্পটা বলুন।

গল্প কিছু নেই। একদম বাজে ব্যাপার। গঅরুণ ছিল খুব সিনেমার পোকা। সিনেমা দেখতে দেখতে ওর কাছে লাইফটা একটা স্বপ্নের মতো হয়ে গেল। ও ভাবত সিনেমায় যেমন হয় জীবনটাও সেরকইম। রিয়াল লাইফেও ওরকমই সব ঘটনা ঘটে। হিন্দি সিনেমা তো জানেন, সাধারণ মানুষকে খুশি রাখার একটা কৌশল। ও সেইসব ছবি দেখে সেরকমই সব কাণ্ড ঘটাতে লাগল।

সেটা কী রকম?

যেমন ধরুন ড়ুয়েট গান। নায়ক নায়িকাকে দেখে গান ধরে ফেলল, নায়িকাও গলা মিলিয়ে দিল। অরুণ সেরকমই সব করতে লাগল। রাস্তায় একটা সুন্দরী মেয়ে যাচ্ছে, ও তার পিছু নিয়ে গান ধরল। বা হিন্দি সিনেমার নায়কের মতো যেখানে সেখানে মারপিট লাগাল। এইরকম সব আর কী! হিন্দি সিনেমা ওকে একদম হিপনোটাইজ করে ফেলেছিল। মনে মনে নিজেকে সেইসব ছবির নায়ক ভেবে নিয়ে সব পোশাক করতে থাকে, চুলের কায়দা পালটে ফেলে। সব সময়ে হিন্দি ছবির মুখস্থ করা ডায়ালগ দিয়ে আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা চালাত। এইরকম হতে হতে মাথা খারাপ হয়ে গেল একদম।

এখন কীরকম?

ভাল নয়। এখনও ঘোরটা কাটেনি। ইন ফ্যাক্ট আজ আপনাকে সমুদ্রে নামতে ও-ই প্রথম দেখে। জানালার ধারে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে বলল, মনো, একটা মেয়ে ড়ুবে যাচ্ছে! শি ইজ ট্রায়িং টু কমিট সুইসাইড। এই বলে দরজা খুলে দৌড়ে আসার চেষ্টা করে। আমি জোর করে ওকে ঘরে ভরে দিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে ছুটে যাই আপনার কাছে।

রেমি একটু শিউরে উঠল। তবে মুখে বলল, ওকেই কাজটা করতে দিলেন না কেন?

কেন?— বলে মনো একটু হাসল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, কাজটা ঠিক হত না বউদি। ও তো সুস্থ নয়, হয়তো হিরো বনবার জন্য জলে নেমে আর উঠতে পারত না। দ্বিতীয় আর-একটা কারণ হল, আপনাকে যদি উদ্ধার করতে পারত তা হলে নির্ঘাৎ একটা প্রেমের সিচুয়েশন ক্রিয়েট করত।

রেমি হেসে ফেলল, তাই নাকি?

মনো ম্লান মুখে বলল, হাসছেন! জানেন না তো, কতবার ও এইসব কাণ্ড করে মারধর খেয়েছে, অপমানিত হয়েছে। লোকে তো সবসময়ে পাগল বলে ছেড়ে দেয় না। তাই সব সময় গার্ড দিয়ে রাখতে হয়। কখন যে কী করে বসবে তার ঠিক নেই। ইমাজিনেশন আর রিয়ালিটি একদম গুলিয়ে ফেলেছে।

তা হলে আপনি ওর সঙ্গে এক ঘরে আছেন কী করে?

মনো ম্লান মুখে বলল, খুব রিসক নিয়েই আছি। পরশু গভীর রাতে আমার বুকের ওপর উঠে বসেছিল মারবে বলে। ওর ধারণা হয়েছিল, আমি একজন ভিলেন।

ও বাবা! তারপর?

অনেকক্ষণ বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঠান্ডা করতে হয়েছিল।

আপনার ভয় করে না?

না। খুব বন্ধু ছিলাম আমরা। তাই তেমন ভয়ের কিছু নেই। অরুণ ছেলেটা তো খারাপ ছিল না। আমরা সবাই অল্পবিস্তর ওই ধরনের স্বপ্নরোগে ভুগি।

তাই নাকি? আপনিও খুব সিনেমা দেখেন বুঝি?

না। তবে শুধু সিনেমা কেন বউদি? আমাদের চারদিকে একটা দৈন্যের চেহারা যেমন আছে, তেমনি ঐশ্বর্যেরও তো স্রোত বইছে। আমরা যারা বড়লোক নই তাদের তো স্বপ্ন দেখা ছাড়া আর কোনও গতি নেই। আর এ ব্যাপারে বাঙালিরা তো চ্যাম্পিয়ন।

রেমি একটু হাসল। কিন্তু একটু ভাবলও। স্বপ্ন! স্বপ্ন ছাড়া মানুষের আর কীই বা আছে!

মনো বিশ্বাস চা শেষ করে যখন উঠল এবং বিদায় চাইল তখন অন্যমনস্ক রেমি তাকে বাধা দিল। তার একটা কবিতা লিখতে ইচ্ছে করছিল। কবিতাটার নাম হবে স্বপ্নের পাগল।

কবিতাটা শেষ হল রাত দশটা নাগাদ। আশ্চর্য! ধ্রুব ফেরেনি।

রেমি ঘড়ির দিকে চেয়ে থেকে উঠল। এত দেরি তো পুরীতে এসে কখনও করেনি ধ্রুব!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *