1 of 3

৩৫. চপলার বাবা মস্ত শিকারি

॥ ৩৫ ॥

চপলার বাবা মস্ত শিকারী এবং ভয়ংকর সাহেব। চপলা নিজে থাকে কলকাতায়। তার মধ্যে শহরের ছোঁয়া আছে, আর আছে বাপের বাড়ির সাহেবিয়ানা। সে চমৎকার অর্গান বাজায়, ফুটন্ত ইংরিজি বলে, সাহেবদের সঙ্গে বসে নির্দোষ ম্যানারসে ডিনার খেতে পারে। আবার কলকাতাও তার মধ্যে সঞ্চার করেছে কিছু আধুনিকতা। দুয়ে মিলে চপলা খুবই সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারত এই পরিবারের পক্ষে। কিন্তু সেটা হয়নি। হয়নি চপলা বুদ্ধিমতী বলেই। এই সেকেলে, রক্ষণশীল এবং পুরোনো মূল্যবোধের ভিত্তিতে স্থাপিত পরিবারের আবহটা সে প্রথম থেকেই বুঝে গিয়েছিল।

কনককান্তিকে তার শ্বশুর কলকাতায় নিয়ে আবার রোপণ করেছেন বটে, কিন্তু সত্যিকারের বিচ্ছিন্ন করতে পারেননি। চপলা সেতুবন্ধ রচনা করে রেখেছিল। ইচ্ছে করলেই কনককান্তিকে মেনীমুখো স্ত্রৈণ ও ব্যক্তিত্বহীন এক পুরুষে রূপান্তরিত করতে পারত সে। করেনি। কারণ, ওরকম পুরুষকে স্বামী বলে ভাবতে তার কষ্ট হয়। নিজের স্বার্থেই কনকের ওপর খোদকারী করা থেকে বিরত থেকেছে।

বুদ্ধিমতী এই মেয়েটিকে হেমকান্তও শ্রদ্ধা করেন। তবে সেটা তাঁর খুব অভ্যন্তরের ব্যাপার। বাইরের লোক তা টের পায় না।

হেমকান্ত বউমাকে সন্ধেবেলা ডাকিয়ে আনলেন নীচের বৈঠকখানায়। ঘরটা খালিই থাকে। নিরালাও।

বোসো বউমা। একটু কথা আছে।

চপলা সশ্রদ্ধ দূরত্ব রেখে সংকোচের সঙ্গে বসল। মাথায় অনভ্যস্ত ঘোমটা।

হেমকান্ত বললেন, সংসারটা আমার কাছে বড় জটিল। তোমার শাশুড়ি বেঁচে থাকলে ততটা বিপন্ন বোধ করতাম না। পরামর্শ দেওয়ারও কেউ নেই। মুশকিলটা বিশাখাকে নিয়ে।

চপলা মৃদু একটু হাসল। তারপর হাসি গোপন করতে মুখ নামিয়ে নিল।

হেমকান্ত অতটা লক্ষ্য করলেন না। বললেন, রাজেন মোক্তারের ছেলের সঙ্গে ওর সম্বন্ধ করেছি। আমাকে তো সরাসরি কিছু বলে না। কিন্তু শুনেছি, এ বিয়েতে ও রাজি নয়।

কেন তা কিছু বলেছে?

আমাকে বলেনি। শুনেছি ওর নাকি কোকাবাবুর নাতি শরৎকে পছন্দ।

পছন্দ?

হ্যাঁ, ব্যাপারটা অদ্ভুত। শরৎকে ও কোথায় দেখেছে কে জানে। আজকাল যা সব হচ্ছে আমাদের আর কোনো ভূমিকাই নেই।

চপলা বলল, রাজেনবাবুর ছেলেটি কেমন?

খুব ভাল। সেলফ্‌ মেড ম্যান। স্বাবলম্বী। এরা কখনো খারাপ হয় না। সঞ্চিত সম্পদের অভিশাপ থেকে মুক্ত।

আপনার যদি পছন্দ হয়ে থাকে তবে বিশাখার আপত্তি কানে তুলছেন কেন?

জোর করতে বলছ?

জোর নয়। বিশাখা তো আর বাধা দেবে না।

তা দেবে না। তবে মা-মরা মেয়ে, হিতে বিপরীত হয় যদি! সেই জন্যই তো পরামর্শ করার লোক খুঁজছিলাম।

আমাকে একটু ভাবতে দিন।

ভাবো। তবে আমার মনে হয় শচীনই বরণীয় পাত্র। শরৎ খারাপ বলছি না। তবে একটু উগ্র প্রকৃতির। তাছাড়া সে বিয়ে করতে রাজি নয়। বিলেত যাবে।

তাহলে? সমস্যা তো মিটেই গেল।

হেমকান্ত মাথা নাড়লেন, না বউমা, মিটল না। শচীনকে যদি বিশাখা পছন্দ না করেই থাকে তবে শরতের বিলেত যাওয়াতে কিছু যায় আসে না। মেয়েদের মনে কোনো পুরুষের ছাপ পড়ে গেলে সেটা একেবারে উৎখাত না করে বিয়ে দিলে খারাপ হয়। আমি চাই শচীনকে ও বরণ করুক। তুমি কি সে কাজটুকু করতে পারবে?

তাহলে আমি বিশাখার সঙ্গে কথা বলে দেখি।

হেমকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, সেটা বড় কথা নয়। তুমি আগে নিজে বুঝে দেখ শচীন কেমন পাত্র। তোমার যদি এ সম্বন্ধ করণীয় মনে হয় তবেই পরবর্তী কাজের কথা ভাববে।

শচীনকে কোথায় পাবো?

হেমকান্ত হেসে বললেন, বেশী কষ্ট করতে হবে না। কাছারি ঘরে বসে এ সময়ে সে রোজ কাগজপত্র দেখে। তাকে আমি এস্টেটের উকিল ঠিক করেছি। যদি সংকোচ বোধ না কর তবে তাকে ডেকে পাঠাতে পারি। এ ঘরে বসেই কথা বলবে।

চপলা বলল, তার দরকার নেই বাবা। আমি দেখা করে নেবোখন। আপনি ভাববেন না।

হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, তোমরা দূরে থাকো বলেই আমি বড় অসহায় বোধ করি। সমস্যাটা হয়তো তেমন জটিল কিছু নয়। কিন্তু একা একা বসে ভাবতে ভাবতে ক্রমশ সবটা জটিল হয়ে ওঠে।

চপলা আবার একটু হাসল। বলল, আপনি ভাববেন না। সবদিক যাতে বজায় থাকে আমি দেখব। একটা কথা বলব বাবা?

বলো।

বন্দুকের ঘরের চাবিটা আমাকে একটু দেবেন?

হেমকান্ত অবাক হয়ে বলেন, কেন মা, হঠাৎ বন্দুকের ঘরের চাবি কেন?

মাথা নীচু করে চপলা খুব লজ্জা আর সংকোচের সঙ্গে বলে, এমনি, আমি শিকারীর মেয়ে তো। বন্দুকগুলো একটু পরিষ্কার করে তেল টেল দিয়ে রেখে দেবো।

হেমকান্ত হো হো করে কখনো উচ্চস্বরে হাসেন না। এখন হাসলেন। বললেন, তা বটে। বন্দুকের অযত্ন তোমার সহ্য না হওয়ারই কথা। ঠিক আছে। আমার খাটের পায়ের দিকে আলমারিতে যে হাতবাক্স আছে তার মধ্যে রেখেছি। যখন খুশি নিয়ে নিও। তুমি তো বোধহয় বন্দুক চালাতে পারো, না?

চপলা মৃদু হাসল।

হেমকান্ত দুশ্চিন্তার গলায় বললেন, কৃষ্ণটাও নাকি বন্দুকের জন্য পাগল। বাচ্চাদের বন্দুক নিয়ে খেলা আমার পছন্দ নয়। ওকে একটু সামলে রেখো।

কোনো ভয় নেই বাবা। কৃষ্ণ খুব বাধ্য ছেলে।

তা হবে। আমি আর ওকে কতটুকু জানি।

আমি জানি।

তুমি যদি এখানে থাকতে পারতে তবে বোধহয় কৃষ্ণটা মানুষ হত।

তার চেয়ে আমাদের কাছে কলকাতায় গিয়ে থাক না।

সে প্রস্তাবটাও ভাবছি। কিন্তু মুশকিল, ও যেতে চায় না।

আপনারও কষ্ট হয় বোধহয়।

হয়। বিশাখার বিয়ে হয়ে গেলে আমি কতটা একা হয়ে পড়ব সে তো আন্দাজ করতেই পারো।

পারি বাবা। আর সেইজন্যই চাপাচাপি করি না।

হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

হেমকান্তর কাছ থেকে উঠে বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে চপলা সোজা কাছারিঘরে এসে উঠল। বাড়ির বউ সচরাচর বারবাড়িতে আসে না, কাছারিঘরে তো নয়ই। চাকর, বাকর, দারোয়ান, মুনাস খাজাঞ্চিরা তটস্থ হয়ে উঠল।

চপলা দরজা দিয়ে উঁকি মেরে শচীনকে অপলক চোখে কয়েক সেকেণ্ড দেখল। লম্বা গড়নের চমৎকার চেহারা। মাথায় একরাশ মিশমিশে চুল। উকিলের পোশাক ছেড়ে সাহেবী বা বাবু পোশাক পরলে রূপ অনেক বেড়ে যাবে।

কাজটা ঠিক হবে কিনা তা নিয়ে মাথা ঘামাল না সে। নিঃশব্দে ঘরে ঢুকল এবং শচীনের মুখোমুখি মস্ত নীচু চৌকিটার এক ধারে বসে বলল, নমস্কার।

শচীন আকণ্ঠ ডুবে ছিল কাজের মধ্যে। বাহ্যজ্ঞান ছিল না। আচমকা মহিলার কণ্ঠস্বরে একটু অবাক হয়ে তাকাল।

চিনতে পারছেন?

শচীন চিনল না। তবে আন্দাজ করল। একটুও ব্যতিব্যস্ত না হয়ে এক গাল হেসে বলল, বড় বউদি নিশ্চয়ই!

ঠিক ধরেছেন। আমরা এসেছি শুনে দেখা করতে যাননি তো!

শচীন এবার একটু তটস্থ হল। হবু জামাই-এর স্ট্যাটাস আর তার নেই। সুতরাং এ বাড়ির অন্দরমহলের খবর নেওয়ারও প্রয়োজন পড়ে না।

শচীন মৃদুস্বরে বলল, সদ্য তো এলেন।

তা বটে, শুনেছি, আপনি এখন একজন সাঙ্ঘাতিক উকিল।

শচীন আবার হাসল। বেশ হাসিটি। চপলার একটু মায়া পড়ে গেল, সরল ও সহজ হাসিটি দেখে। শচীন বলল, সবে তো পাস করে প্র্যাকটিস শুরু করেছি। এখনো বাঘ ভালুক মারিনি।

একটু তরল স্বরে চপলা বলে, ভাল উকিল হতে গেলে প্যাঁচালো বুদ্ধি চাই। আপনাকে দেখে তো মনে হয় প্যাঁচঘোচ জানেন না।

শচীন একথার কী জবাব দেবে। চুপ করে রইল।

চপলা বলল, আপনার সঙ্গে একটু আলাপ করার ইচ্ছে। কিছু মনে করবেন না তো!

আরে না, না, কী যে বলেন।

শুনেছি আপনি গান জানেন।

ও কিছু নয়।

একদিন গান শোনাবেন?

শচীন লাজুক মুখে বলল, সে সামান্য একটু শিখেছিলাম। তেমন চর্চাও করা হয় না।

কী শিখেছেন?

টপ্পা, গজল, ঠুংরি।

বাঃ! কবে শোনাবেন বলুন।

যেদিন হুকুম করবেন।

হুকুম টুকুম নয়। কালই আসর বসাবো। রাজি?

কাল? বেশ তো। আর কে গাইবে?

অতি সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট। কেবল আপনি।

শচীন মাথা নাড়ল, ঠিক আছে।

রবীন্দ্রসঙ্গীত জানেন না?

শচীন মাথা নেড়ে বলে, জানি। দু-চারটে।

ওতেই হবে।

শচীন হঠাৎ একটু গম্ভীর ও ম্লান হয়ে গেল। হাতের পার্কার কলমটা বন্ধ করে বলল, একটা কথা বউদি।

বলুন।

এই গান শোনার পেছনে কোনো প্ল্যান নেই তো।

কী প্ল্যান?

শচীন বিব্রত হয়ে বলে, হয়তো স্পষ্ট করে বলতে পারব না, যদি দয়া করে বুঝে নেন তাহলে ভাল হয়।

ছেলেটা বুদ্ধিমান তা বুঝল চপলা। বলল, প্ল্যান যাই থাক আপনার সম্মানের কোনো হানি হবে না। কথা দিচ্ছি।

দয়া করে সেটা দেখবেন। আমি গরীবের ছেলে, বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়াতে চাই না।

চপলা হঠাৎ থমকায়। তারপর কিছু তীব্র গলায় বলে, নিজেকে ছোটো ভাববার কোনো কারণ তো আপনার নেই। কে বামন, কে চাঁদ তা আমি জানি।

চপলা বেরিয়ে এল। বস্তুত এবার শ্বশুরবাড়িতে আসার আগে সে ভয় করেছিল, সময়টা খুব একঘেয়ে কাটবে। কিন্তু কপাল ভালই। শ্বশুরবাড়িতে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উত্তেজক ঘটনাবলী ঘটতে চলেছে। বেশ চনমনে লাগছিল তার।

বিশাখাকে ছাদে ডেকে নিয়ে গেল সে।

কী রে মুখপুড়ি, শচীনকে পছন্দ করছিস না কেন?

পছন্দ করতেই বা হবে কেন?

খুব মুখ হয়েছে, না।

মোটেই না। মুখ কখন করলাম? বা রে!

এই তো করলি। আগে বল, ওর দোষ কোথায়।

ওর দোষ তো বলিনি।

তবে কার দোষ?

ওদের বাড়িটা ভারী গরীব-গরীব।

তুই কবে ওদের বাড়িতে গেছিস?

বিয়ের কথা ওঠার আগেও গেছি।

ঠিক আছে, আমি গিয়ে দেখে আসব।

দেখো।

শরৎকে তোর পছন্দ কেন?

শরৎকে পছন্দ কে বলল?

শুনছি।

খুব রটে গেছে তো ব্যাপারটা।

রটবেই। আগে কথার জবাব দে।

বিশাখা কিছুক্ষণ নতমুখে থেকে বলল, শরৎকে আমার পছন্দ নয়। তবে ওদের অবস্থা ভাল। তুই এত হিসেবী হলি কবে থেকে?

আমার বউদি, কেন জানি না, জমিদার ছাড়া অন্য ঘরে যাওয়ার কথা ভাবতেই ভাল লাগে না।

সে তো না লাগতেই পারে। কিন্তু জমিদারদের সবাইকার অবস্থাই তো আর ভাল নয়।

সে তো জানি।

ছাই জানিস। কোকাবাবু মরার পর থেকে ভাই ভাইতে কী গণ্ডগোল লেগেছে তা জানিস?

না।

কোকাবাবুর এক ছেলে তোর দাদার বন্ধু। আমি কলকাতায় থেকেই শুনেছি। কোকাবাবুর সেই ছেলে একজন ব্যারিস্টারের সঙ্গে পরামর্শ করতে কলকাতায় গিয়েছিল। মামলা লাগল বলে।

বিশাখা চুপ করে রইল।

জমিদারী ভাগ হয়ে যাবে। যা ভাগে পড়বে এক একজনের তাতে ঠাট বজায় রাখাও সম্ভব নয়। বুঝলি?

বিশাখা মৃদুস্বরে বলল, অত খবর তো রাখি না।

শরৎ দেখতে কেমন?

তা কি জানি! লাজুক গলায় বিশাখা বলে।

জানিস না? চপলা অবাক হয়ে বলে, তাহলে পছন্দ করলি কি করে?

বিশাখা মাথা নেড়ে বলে, সেরকম পছন্দ নয়।

তাহলে?

একদিন আমাদের আমবাগানে একটা পাগলা কুকুরকে গুলি করে মেরেছিল। সেদিন দেখেছি।

মোটে একদিন?

হুঁ

কিরকম দেখতে?

জানি না যাও।

ও বাবা, মনে মনে বহুদূর এগিয়েছে দেখছি।

মোটেই না। শচীনকে কাটানোর জন্য এমনি শরতের কথা তুলে দিয়ে মজা দেখছিলাম।

শরৎ রাজি হলে কি করতি?

ওঃ, তোমার সঙ্গে পারা যায় না।

আমি শচীনের সঙ্গে দেখা করেছি।

তুমি?

কেন, আমি দেখা করলে দোষ হয় নাকি?

তা বলিনি।

আমার বেশ লাগল।

সকলেরই লাগে। শুধু আমারই পোড়া চোখ।

কেমন দেখতে, কেমন স্বভাব তা আন্দাজ করার জন্য গেলাম।

কেমন লাগল তা তো জানি। সবাই বলে ভাল। কিন্তু আমার তো লোকটাকে নিয়ে আপত্তি নয়। আপত্তি বাড়ি নিয়ে।

তুই একটা বোকা।

সবাই তাই বলে।

যদি বিয়ে না করতে চাস তো তাই হবে। অত ভাবছিস কেন? শ্বশুরমশাই জোর-জবরদস্তি করবেন না।

বিশাখা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, এমন কি কৃষ্ণ পর্যন্ত ওর পক্ষ নিয়ে কথা বলে।

বলে? তাহলে তো তোর খুব বিপদ যাচ্ছে।

বিশাখা একটু হেসে বলে, তা যাচ্ছে। এখন তুমি এসে আবার কী প্যাঁচ কষো তা কে জানে।

প্যাঁচ কষব না। তবে একটা কাণ্ড করব।

কী কাণ্ড?

যা জম্মেও তুই ভাবিসনি। শচীনের সঙ্গে তোর আলাপ করিয়ে দেবো।

যাঃ! তাই হয় নাকি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *