1 of 3

০৩৩. পুজো আর আম-কাঁঠালের সময়

পুজো আর আম-কাঁঠালের সময় প্রবাসী ছেলে-মেয়েদের ঘরে আসার একটা রেওয়াজ ছিল এ বাড়িতে। আজকাল নেই। সুনয়নী বেঁচে থাকলে হয়তো আসত। মা-হীন এই লক্ষ্মীছাড়া বাড়ির প্রতি তারা বোধহয় আর কোনও আকর্ষণ বোধ করে না। বড় ছেলে কনক শীতকালে একবার আসবে বলে চিঠি দিয়েছিল। পরে মত পালটায়। মেজো জীমূতকান্তির শখ ছিল বিলেত গিয়ে আই সি এস হয়ে আসবে। সেটা হয়ে ওঠেনি বলে বাবার ওপর তার কিছু রাগ বা অভিমান থাকতেও পারে। সে প্রায় সম্পর্কই রাখে না। আসা দূরে থাক, চিঠি পর্যন্ত দেয় না। এই দুই ছেলের জন্য হেমকান্তর যে বিশেষ কোনও অভাববোধ আছে তা নয়। তবে মাঝে মাঝে ওদের একটু দেখতে ইচ্ছে করে, এই মাত্র।

কৃষ্ণকান্তরও তার দাদা-দিদিদের প্রায় ভুলবার দশা। ওঁরা যে সব আছেন সেটুকুও তার বিশেষ মনে পড়ে না। শুধু বড়দাদা কলকাতায় নিয়ে যাবে বলে চিঠি দেওয়ায় বড়দাদা বলে যে কেউ ছিল বা আছে তা টের পেয়েছিল।

পিছনের আমরাগানে বউল ছেড়ে আমের গুটি ধরল। কালবৈশাখীই মুড়িয়ে দিয়েছিল গাছ। তবু আম বড় কম ধরল না। খুব যে ভাল জাতের আম হয় বাগানে, তা নয়। তবে প্রচুর হয়। খাওয়া যায়। শ্যামকান্ত নানা দেশ থেকে ভাল জাতের আমের কলম আনিয়ে লাগিয়েছিলেন। মাটির দোষে অবশ্য তেমন ভাল জাতের আম হয় না। তবে দারুণ কঁঠাল হয়। এবারও হবে। পুবের বাগানে গোটা বিশেক গাছে গলগণ্ডের মতো শেকড় থেকে মগডাল অবধি এঁচোড় ছেয়ে গেছে।

ঠিক এই সময়ে একদিন বিনা খবরে কনককান্তি সপরিবারে এসে হাজির।

তখন সকালবেলা। ঘোড়ার গাড়ির ওপর চাপানো বাক্স বেডিং। গাড়িটা বার বাড়িতে এসে থামতেই চারদিকে একটা হইচই পড়ে গেল।

নেই-নেই করেও এই বিশাল বাড়িতে, কাছারিঘরের পিছনের কুঠুরি এবং আউট হাউসে গরিব আত্মীয়স্বজন এবং পরভৃত স্বভাবের আশ্রিত লোকের অভাব নেই। কর্মচারীরাও আছে। সবাই দৌড়ঝাপ লাগিয়ে দিল। চাকর-বাকররা এগিয়ে এল।

কনককান্তির চেহারাটা রাজপুত্রসুলভ। খুব লম্বা, তপ্তকাঞ্চনবর্ণ, চুলগুলো পর্যন্ত লালচে। তবে তার মুখশ্রীতে একটা রুক্ষ ভাব আছে। তার স্ত্রী চপলা প্রকৃত সুন্দরী বলতে যা বোঝায় তা নয়। তবে কলকাতার ফ্যাশনদুরস্ত মহিলা বলে চেহারাটা বেশ দেখার মতো করে তুলেছে। সামনে ফঁপানো চুল, লেস লাগানো ব্লাউজ, পাছাপেড়ে শাড়ি। গয়নার বাহুল্য নেই তার শরীরে। গাড়ি থেকে নেমে ঘোমটা টানল মাথায়। তাদের দুটি সন্তান। একটি ছেলে, অন্যটি মেয়ে। তারা ছোট। দুটি শিশুই বেশ দেখতে।

খবর পেয়ে হেমকান্ত নিজের ঘরে সাগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। বুকটা একটু দুরুদুরু। ছেলে তারই বটে, তবু যেন একজন অচেনা অজানা মানুষ। কী ভাবে কথা বলবে, কেমন স্বভাব, কিছুই যেন জানেন না। কী খেতে ভালবাসে! এসব অবশ্য মনু ভাববে। তবু তারও চিন্তা হয়।

কনককান্তি এসে প্রণাম করে দাঁড়াতে হেমকান্ত বললেন, একটা খবর দিয়ে আসোনি কেন?

খবর দিয়েছি। চিঠি বোধহয় পৌঁছোয়নি।

সামান্য কিছু কুশলপ্রশ্নাদির পর হেমকান্তর কথা ফুরিয়ে গেল। এই অচেনা সুদর্শন যুবাপুরুষটির সঙ্গে ভাববিনিময় করার মতো কিছু নেই আর।

কনককান্তি হঠাৎ বলল, ধনাকাকা মাঝখানে কলকাতায় গিয়েছিলেন কংগ্রেসের মিটিং-এ। তখন আমাদের বাড়িতে আসেন। তিনি বললেন, আপনার নাকি কী হয়েছে।

কী হয়েছে?— হেমকান্ত অবাক।

কনককান্তি বুদ্ধিমান ছেলে। প্রসঙ্গটা একটু পাশ কাটিয়ে বলল, আপনি এখন ভারচুয়ালি এখানে একা। নানারকম দুশ্চিন্তাও আছে। আমার ইচ্ছে এস্টেটের একটা বিলি-বন্দোবস্ত করে সবাই মিলে কলকাতার বাড়িতে গিয়ে থাকলেই হয়। সেখানে লোকজনের মধ্যে থাকলে মনটা ভাল থাকবে।

হেমকান্তও বোকা নন। তিনি বুঝলেন, খচ্চর এবং ঘড়েল সচ্চিদানন্দ সেই কুয়োয় বালতি পড়া এবং তজ্জনিত তার বার্ধক্যচিন্তার কথাটা কনককে জানিয়ে গেছে! বন্ধু আর কাকে বলে!

হেমকান্ত একটু হেসে বললেন, ধনা একটা গাড়ল। তোমাকে কী বলতে কী বুঝিয়েছে। মন কিছু খারাপ নেই। এখানেই বেশ থাকি আমি। চিন্তা কোরো না।

কুণ্ঠিত পায়ে চপলা এসে ঘোমটায় মুখ ঢেকে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। দুপাশে দুই ছেলে মেয়ে। বেশ দেখাচ্ছিল দৃশ্যটা। এরা সব তার আপনজন, আত্মীয়, উত্তরপুরুষ, বংশধর। হেমকান্তর মনে হল, তার আরও আনন্দ হওয়া উচিত। যতটা আনন্দ হওয়া উচিত ততটা যেন ঠিক হচ্ছে না। ওরা। হয়তো ভাবছে, বাবা আমাদের পেয়ে খুশি হয়নি।

কনককান্তি বিনীতভাবে বলল, আমরা আপনার জন্য দুশ্চিন্তায় থাকি।

হেমকান্ত আচমকাই একটা অপ্রিয় প্রশ্ন করলেন, কেন বলো তো! আমি কি খুব বুড়ো হয়ে গেছি নাকি?

কনক মাথা নেড়ে একটু হেসে বলে, না। বুড়ো হবেন কেন? কিন্তু মা চলে যাওয়ার পর দেখাশোনারও তত তেমন কেউ নেই।

হেমকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, সেটা কোনও কথা নয়। আমি সেলফ-মেড ম্যান। তোমরাও দেখেছ, চিরকাল আমি নিজের কাজ নিজেই করতে ভালবাসি। কোনও অসুবিধে হয় না।

কনক তর্ক করল না। মৃদু গলায় শুধু বলল, এস্টেটের তো আর তেমন কিছু ভবিষ্যৎ নেই। এ পাট চুকিয়ে দিলে কেমন হয়?

হেমকান্ত চমকালেন না। ছেলেদের এই মনোভাবের কথা তিনি তো জানেন। মাঝে মাঝে তার নিজেরও এরকম ইচ্ছে হয়। বিষয়-সম্পত্তি মানেই উদ্বেগ অশান্তি মামলা মন কষাকষি। মানুষকে খণ্ডিত করে দেয়, ছোট করে দেয়।

হেমকান্ত ভাবিত মুখে বললেন, চুকিয়ে দিলেও হয়। তবে শিকড়ে টান পড়ে, বুঝলে। এখানেই জন্মাবধি রয়েছি।

আমরাও তো এখানেই জন্মেছি। এ জায়গার জন্য আমাদেরও টান তো কম নয়। প্রয়োজন দেখা দিলে স্থানান্তরে যেতেই হয়।

হেমকান্ত বললেন, ঠিক আছে। আমাকে কিছুদিন ভাবতে দাও। প্রয়োজন হলে তো যাবই। শুধু কলকাতা কেন, কাশী আর পুরীতেও আমাদের বাড়ি পড়ে আছে। সেসব জায়গাতেও যাওয়া যায়।

সেটা বিবেচনা করে দেখবেন। আসল কথা, এখন এস্টেট রাখা মানে একটা প্রচণ্ড লায়াবিলিটি।

হেমকান্ত তা জানেন। কিন্তু নিজের জ্যেষ্ঠপুত্রের মুখে কথাটা তার ভাল লাগল না। কনক কি চাইছে এস্টেট বিক্রি করে তিনি ছেলেদের নগদ টাকা ভাগাভাগি করে দেন? কনকের কি এখন ব্যাবসার জন্য নগদ টাকার দরকার! সে জন্যই কি বিনা নোটিশে হঠাৎ এসে হাজির! এসব প্রশ্নের নগদ জবাব তিনি নিজের মনের মধ্যে খুঁজে পেলেন না। শুধু সন্দেহটা দেখা দিয়ে রইল।

চপলা এসে প্রণাম করতে তিনি তার মাথাটি স্নেহভরে স্পর্শ করলেন। নাতি আর নাতনিটির থুতনি নেড়ে দিলেন মাত্র। বাচ্চাদের কী করে আদর করতে হয় তা তার জানা নেই। সব পরিস্থিতিতেই তিনি অপ্রতিভ বোধ করেন।

দায়সারা গলায় বললেন, যাও বিশ্রাম করো। গাড়ির ধকল তো কম যায়নি।

সামনে থেকে ওরা সরে যাওয়ার পর হেমকান্ত হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

এই গৌরকান্তি দীর্ঘকায় লোকটি যে তার বড়দাদা এটা বুঝতে কৃষ্ণকান্তর অনেক সময় লেগে গেল। ধারে কাছে ঘেঁষবার কোনও ইচ্ছে সে বোধ করল না।

পিছনে বিশাল এবং অগাধ আমরাগান। বিপ্লবী শশিভূষণ অভুক্ত অবস্থায় গত শীতে এখানে তিন দিন গা ঢাকা দিয়ে ছিল। সেই থেকে এই আমরাগানটা কৃষ্ণকান্তের কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ ও রহস্যময় জায়গা হয়ে উঠেছে। অবসর সময়ের অনেকটাই সে এই আমরাগানে কাটায়। সঙ্গে থাকে গুলতি, এয়ার গান, তিরধনুক বা পেনসিলকাটা ছুরি। আমরাগানের আলো-আঁধারিতে সে হয়ে যায় পলাতক এক দেশপ্রেমিক। ইংরেজের শত্রু। কল্পনার বলগা ছাড়া পক্ষীরাজ তাকে কঁহা কাহা মুল্লুক নিয়ে যায়। গাছের একটি ডালে সে ফাঁসির দড়ি টাঙিয়েছে। কখনও কখনও একদৃষ্টে দড়ির ঝুলে থাকা ফসটির দিকে সে সম্মোহিতের মতো চেয়ে থাকে।

কনককান্তি আসার পর সে এই আমরাগানেই গা ঢাকা দিল। জানে, লাভ নেই। আমরাগানে তার এই গুপ্ত ঘাঁটির কথা অনেকেই জানে। দিদি বিশাখা, চাকর হরি, মনুপিসি, হর কম্পাউন্ডার! কেউ না কেউ ঠিক এসে ধরে নিয়ে যাবে।

আমরাগানে বসে সে সারা বেলা ধরে ভাবল, বড়দাদা তাকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার জন্যই এসেছে কি না। কলকাতায় যেতে যে তার ইচ্ছে করে না তা নয়, কিন্তু সে বেড়ানোর জন্য। কিন্তু এই ব্ৰহ্মপুত্র, চর, আমরাগান আর এই মায়াবী বাড়িটা দীর্ঘদিনের জন্য ছেড়ে যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। সে মরে যাবে। বড়দাদাকে তত ভাল করে চেনেই না। বউদির সঙ্গে তার কোনওদিন তেমন করে ভাব হয়নি। ওদের ছেলেমেয়ে দুটিকে সে তো বলতে গেলে এই প্রথম দেখছে।

অনেকক্ষণ ধরে ভাবতে ভাবতে সে কয়েকটা কাঁচা আম খেয়ে ফেলল। তারপর হাঁটতে হাঁটতে বাগান পেরিয়ে একটা পগারের ধারে এসে দাঁড়িয়ে মুখের সামনে হাতের পাতা লম্বালম্বি ভাবে রেখে বিচিত্র একটু ড়ু ড়ু শব্দ করল। এটা তার সংকেত।

পগারের ওপাশে কিছু গরিব প্রজার বাস। এদের বেশির ভাগই নমশুদ্র। খুব তেজি টগবগে মানুষ। কৃষ্ণকান্তর বয়সি গোটা বিশেক ছেলে আছে ওইসব টিন আর বাঁশের ঘরের বসতিতে। তারা সবাই তার বশংবদ। প্রজা বলে নয়, এমনিতেই তারা কৃষ্ণকান্তকে ভালবাসে।

কৃষ্ণকান্তর ডাক শুনে ঝটপট পাঁচ-সাতজন বেরিয়ে এল। ওদের সর্দার হল ঝড়। সবচেয়ে দীর্ঘকায় সবচেয়ে বলিষ্ঠ তাব গড়ন। পাথরে কেঁদা চেহারা। যেমন ডানপিটে, তেমনি পরোপকারী।

কৃষ্ণকান্ত ঝড়ুকে বলল, স্নান করতে গাঙে যাবি?

যাব।

চল তা হলে।

দলবল নিয়ে কৃষ্ণকান্ত মানে চলল।

ঝড়ু জিজ্ঞেস করে, তুমি নাকি বন্দুক চালাতে শিখে গেছ।

হ্যাঁ। শরৎদা শিখিয়েছে।

পাখিও মেরেছ অনেক!

অনেক নয়। একটা।

বন্দুক চালাতে কীরকম লাগে? শুনি নাকি এমন ধাক্কা মারে যে উলটে ফেলে দেয়।

ধাক্কা মারেই তো। কায়দা জানা চাই।

তোমাদের তো বন্দুক আছে। একদিন চুরি করে চলো চরে যাই। আমাকে শিখিয়ে দেবে।

দেব। দাঁড়া, বড়দাদা চলে যাক। তারপর।

বড়দাদা কি তোমাকে নিয়ে যাবে?

নিয়ে যেতে তো চাইছে। কিন্তু আমি যাব না।

গেলেই তো ভাল। কলকাতায় কত মজা! মনুমেন্ট, চিড়িয়াখানা, ট্রাম।

ধুস। আমার ওখানে থাকতে ভাল লাগে না।

তা হলে আমাকে পাঠিয়ে দাও না!

তোকে! তুই গিয়ে কী করবি?

আমি গিয়ে ওখানে কাজ-কারবার শিখব। বড়লোক হব।

কী কাজকারবার?

সে কতরকম আছে! তোমার বড়দাদাকে বলবে ছোটবাবু, আমাকে নিয়ে যেতে?

কৃষ্ণকান্ত প্রস্তাবটা ভেবে দেখল। ঋভু চলে গেলে তার নিজের কিছু অসুবিধে আছে। তার দলে ঝড়ুই সবচেয়ে সাহসী। ওরকমটা আর কেউ নেই। সে বলল, আচ্ছা ভেবে দেখি।

ঝড় বলল, তোমার বড়দাদার নিজের তো বিরাট ব্যাবসা। আমি তার মধ্যে ঢুকতে পারব না?

তা পারবি না কেন?

অবশ্য দরকার হলে বাড়িতে চাকরের কাজও করতে পারি। ঘর ঝটপাট দেওয়া, বাসন মাজা, খোকাখুকিদের হাওয়া খাওয়ানো।

কৃষ্ণকান্ত থমকে যায়। তারপর হঠাৎ রেগে উঠে বলে, কেন চাকরের কাজ করবি কেন? তুই আমার বন্ধু না!

ঝড়ু অবাক হয়ে বলে, তাতে কী? বড়দাদা তো নিজেদের লোক। ওর বাড়িতে কাজ করলে কী হয়? বড়কর্তা বললে আমার বাবা গিয়ে কামলার কাজ করে আসে না?

তা হোক। বাবার কথা আলাদা। বাবা কাউকে চাকর বলে মনে করে না। কিন্তু বড়দাদা কলকাতার বাবু, ওদের বাড়িতে কাজ করবি কেন?

ঝড়ু একটু মিইয়ে গিয়ে বলে, এমনি বললাম কথাটা। আমরা প্রজা তো। তোমরা হলে রাজা লোক।

তারা যে রাজা তা খানিকটা মানে কৃষ্ণকান্ত। তবু তার মধ্যেও একটু কিন্তু আছে। সে আজকাল শুনতে পাচ্ছে, রাজ্যের অবস্থা ভাল নয়, সম্পত্তি বিক্রি হয়ে যেতে পারে। এই কথাটা ভাবলে কৃষ্ণকান্তর কেন যেন ভয় করে। রাজ্য যদি না থাকে তবে সে রাজা হবে কেমন করে? রাজা হওয়ার জন্যই যে তার জন্ম!

 

কৃষ্ণকান্ত গাঙের ধারে এসে একটু আনমনা উদাস চোখে ব্রহ্মপুত্রের বিশাল বিস্তারের দিকে চেয়ে রইল। রাজ্য রাজা এসব শব্দ তার রক্তে এক ধরনের তরঙ্গ তোলে। রাজা কৃষ্ণকান্ত। রাজা কৃষ্ণকান্ত।

ঘণ্টাখানেক জলে থাকার পর যখন শরীরের চামড়ায় সাদা রং ধরে গেছে, আর চোখ লাল, তখন। ছটকু দারোয়ান এসে তাকে জল থেকে তুলল, কর্তাবাবু কখন থেকে ডাকতেছেন। চলল।

খুব ভয়ে আর সংকোচে মাথা নিচু করে বাড়িতে ঢোকে কৃষ্ণকান্ত।

কনককান্তি সদ্য স্নান করে আহ্নিক সেরে এসে ওপরের বারান্দায় বসেছে। রংটা যেন চারদিকে আললা করে আছে।

কত বড় হয়ে গেছে, আঁ!— কনকের বিস্ময় নিখাদ।

কনক হাত বাড়িয়ে ভাইকে কাছে টেনে নিল। কৃষ্ণকান্তের রূপবান চেহারাটা বোধহয় খুবই পছন্দ হল তার। মুখের দিকে কয়েক পলক মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থেকে বলল, বুঝলে চপল, কৃষ্ণ আমাদের বংশে সবচেয়ে সুপুরুষ হবে।

বউদির অবস্থানটা চোখ তুলে দেখেনি কৃষ্ণকান্ত। লজ্জা করছিল। চপলা বারান্দার আর-এক প্রান্তে রোদে চুল শুকোচ্ছিল দাঁড়িয়ে। পুঁচকে দেওরের দিকে চেয়ে একটু হেসে বলল, এই সেদিনও তো আমার কোলে পেচ্ছাপ করে দিয়েছিল।

লজ্জায় মরে গেল কৃষ্ণকান্ত। অখোবদন।

বড়দাদা তাকে ছেড়ে দিয়ে বলে, অত লজ্জা পাচ্ছিস কেন আমাদের? শুনলাম সারা সকাল নাকি পালিয়ে ছিলি!

ছিল গো বড়দা।–বিশাখা বউদির ছায়ায় দাঁড়ানো, সেই বলো।

লজ্জা সংকোচ সব কেটে গেল বিকেলের মধ্যেই। ভারী অদ্ভুত ভাল লাগতে লাগল কৃষ্ণকান্তর।

বড়দাদা একটু গম্ভীর মানুষ। খুব বেশি কথাটথা বলে না। প্রাথমিক কুশল প্রশ্নাদির পর বড়দাদা সকলের সঙ্গে খেতে বসল, দুপুরে ঘুমোল, বিকেলে সাজগোজ করে গাড়ি নিয়ে বেরোল পুরনো বন্ধুদের খোঁজে। খুব নাকি তাস খেলার নেশা বড়দাদার। তাড়াতাড়ি ফিরবে না।

বউদি চপলাকে ভাল লাগল অন্য কারণে। বাড়িতে পা দিয়েই বউদি যেন এ বাড়িতে একটা অন্যরকম আবহাওয়া তৈরি করে দিয়েছে। ঘোমটা টানা বউ, সিথিতে সিঁদুর এ দৃশ্যটাই কৃষ্ণকান্তর কাছে একটু সুদূর। সে তো বাড়িতে এরকম কাউকে দেখে না।

সারাদিন ঘুরে ঘুরে বউদি অনেক কাজ করতে লাগল। এ বাড়িতে কাজের লোকের অভাব নেই, কিছু করলেও চলে। কিন্তু বউদি বসে থাকল না। দুপুরে বাচ্চা দুটোকে ঘুম পাড়িয়ে গাছকোমর বেঁধে ঘরদোরের আসবাবপত্র চাকরদের দিয়ে এধার ওধার করাতে লাগল। সঙ্গে আঠার মতো কৃষ্ণকান্ত।

কিছুক্ষণ পরপরই বউদি তাকে জিজ্ঞেস করে, হ্যাঁ রে কৃষ্ণ, এই খাটটা দক্ষিণের জানালার ধারে পাতলে ভাল হবে না? টেবিলটাকে এই কোনায় আনলে কেমন হয় রে?

কৃষ্ণকান্ত এই যুবতীর মোহময় নৈকট্যে এক ধরনের সম্মোহনে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিল। সব কথাতেই সায় দেয়।

বউদি মানুষটা যে চমৎকার তা কৃষ্ণকান্ত আরও বুঝতে পারল ছোড়দির সঙ্গে তার ভাব দেখে। ছোড়দি অর্থাৎ বিশাখা বড় সহজে কাউকে সহ্য করতে পারে না। সেইজন্য ওর তেমন বন্ধুও নেই। কিন্তু বউদির সঙ্গে তার বেশ ভাবসাব লক্ষ করে সে।

বিকেলে ছাদের ওপর মস্ত পাটি পেতে বসল বউদি। তাকে ডেকে বলল, আজ বিকেলে আর তোকে খেলাধুলো করতে হবে না। আমার সঙ্গে বসে গল্প করবি আয়।

কৃষ্ণকান্ত এক কথায় রাজি। ফুটবলের অমোঘ আকর্ষণ ত্যাগ করে সে বউদির কাছটিতে বসে পড়ল।

তুই নাকি ভাল ছাত্র হয়েছিস!

কৃষ্ণকান্ত লাজুক ভাবে বলে, না না।

শুনেছি। কই চিঠি লিখে তো জানাসনি যে ক্লাসে তুই হার্স্ট হোস।

আমি তো চিঠি লিখি না।

লেখো না কেন হনুমান?

এবার লিখব।

আর লিখতে হবে না। তোকে এবার আমি আঁচলে বেঁধে নিয়ে যাব।

প্রস্তাবটা এবার আর তেমন খারাপ লাগল না কৃষ্ণকান্তর। লাজুক লাজুক হাসতে লাগল।

যাবি তো!

বাবা বললে যাব।

আচ্ছা, বাবাকে আমি রাজি করাব। কী সুন্দর দেখতে হয়েছিস রে? কদিন বাদে তো মেয়েরা পাগল হবে তোকে দেখে।

কথাটা কৃষ্ণকান্ত ভাল বুঝল না। মেয়ে পুরুষের সম্পর্ক তার কাছে তেমন স্পষ্ট নয়। কিন্তু এসব তো অভ্যস্ত সংস্কারের মধ্যেই থাকে। কাজেই সে রাঙা হয়ে উঠল।

চপলা মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেওরটিকে খানিকক্ষণ দেখে বলল, একমাথা চুল হয়েছে, কণ্ঠায় ময়লা, কানে ময়লা, কেউ নজর দেয় না তোর দিকে।

মাঝে মাঝে মনুপিসি ঘষে দেয়।

মনুপিসি ঘষে দিলে কী হবে! তোমার নিজের দায়িত্ব নেই।

বউদি তুমি থেকে তুইতে নামতে দেরি করেনি একটুও।

কী মিষ্টি যে লাগছিল বউদিকে তার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *