• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

০৩১. হেমকান্ত জীবনে অনেক সৌন্দর্য দেখেছেন

লাইব্রেরি » শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় » উপন্যাস (শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়) » দূরবীন - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় » ০৩১. হেমকান্ত জীবনে অনেক সৌন্দর্য দেখেছেন

হেমকান্ত জীবনে অনেক সৌন্দর্য দেখেছেন, কিন্তু চৈত্রের শুরুতেই এক বিকেলে যে কালবৈশাখী এল তার মতো সম্মোহনকারক আর কিছুই হয় না।

হেমকান্ত রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার বই পড়ছিলেন ছাদে বসে। রোদ পড়ে গেলে ছাদটি আজকাল মনোরম। একটু থম ধরা ভাব ছিল চারধারে। বাতাস ছিল না। ঠিক এই সময়ে আচমকা একটা কুচুটে বাতাস বইতে লাগল। সেই বাতাসে প্রেতের শ্বাসবায়ু মিশে আছে, টের পেলেন হেমকান্ত। বাল্যকাল থেকেই ঝড়ের অভিজ্ঞতা তাঁকে অনুভূতিশীল করেছে। ফরফর করে কোলে রাখা বইটির কয়েকটা পাতা উলটে গেল। পাম গাছে হাহাকার বেজে উঠল। চোখ তুলে হেমকান্ত দূরে দিগন্তে এক অতিকায় কৃষ্ণবর্ণ মেঘস্তম্ভকে দেখতে পেলেন। ঘূর্ণমান এক কালান্তক চেহারা সেই স্তম্ভের। আকাশে রোদ ছিল তখনও। সেই আলোয় দেখা গেল, বহু ওপরে ঘুড়ির মতো কী যেন সব ঘুরপাক খাচ্ছে। ঘুড়ি নয়, হেমকান্ত ভাল করে দেখার জন্য হরিকে ডেকে দুরবীনটা আনতে বললেন।

হরি দুরবীন নিয়ে এসে বলল, ঘরে যাবেন না কর্তামশাই? ভীষণ ঝড় আসছে।

হেমকান্ত শুধু বললেন, হুঁ।

দুরবীন লাগিয়ে দেখলেন, বহু দূরে আকাশের গায়ে টিনের চাল উড়ছে কয়েকটা। আরও কিছু জিনিসও আছে, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। অতিকায় সেই মেঘস্তম্ভের মাথার দিকটা ছড়িয়ে পড়েছে আকাশে। ডাইনির চুলের মতো। বাতাসে একটা তীব্র চাপা গুমগুম শব্দ আসছে। কোথায় ঝলসাচ্ছে মেঘ! ব্রহ্মপুত্রের কালো জলে হঠাৎ তুমুল এক আলোড়ন ওঠে।

বাতাস শরীরী নয়। কিন্তু হেমকাও হঠাৎ টের পেলেন, বাতাস তাকে ধাক্কা দিচ্ছে। এক অদৃশ্য পালোয়ানের মতো শক্তিমান বাতাসের ধাক্কায় কয়েক হাত পিছিয়ে গেলেন হেমকান্ত। হড়-হড় করে তীব্র বাতাস ঢুকে যাচ্ছে ফুসফুসে। দম নিতে পারছেন তো ছাড়তে পারছেন না। শ্বাসকষ্ট হতে থাকে তাঁর।

হরি সিঁড়িঘরের কাছ থেকে দৌড়ে এসে তাঁকে ধরে।

কর্তামশাই, ঘরে চলুন।

এক ঝটকায় তার হাত ছাড়িয়ে দেন হেমকান্ত। ঘরে যাবেন কী? এই অপার্থিব দৃশ্য ছেড়ে কি কোথাও যাওয়ার উপায় আছে!

চোখের সামনেই মাঝদরিয়ায় একটা বেসামাল নৌকোকে নিশ্চিত ভরাড়ুবির সঙ্গে লড়াই করতে দেখতে পান তিনি। মস্ত এক ঢেউয়ের মাথায় চড়ে নৌকোটা এক ঘূর্ণি বাতাসের ঝাপটায় পাক খেয়ে ঘুরে পড়ে গেল নীচে। আবার উঠল।

পগারের দিকে গোড়াশুদ্ধ পুরনো কামরাঙা গাছটাকে উপড়ে ফেলল ঝড়। কলাঝাড়ের কয়েকটা গাছ শুয়ে পড়ল মাটিতে। হেমকান্ত তাঁর ইজিচেয়ারে বসে পড়লেন। চারদিক থেকে উন্মাদ বাতাস ছুটে আসছে। লয় করে দিচ্ছে সত্তা। হারিয়ে যাচ্ছে চিন্তাশক্তি। এমনকী অহংবোধ পর্যন্ত।

হরি আবার দৌড়ে যায় সিঁড়িঘরের দিকে। তার নিসর্গপ্রীতি নেই। সে আত্মরক্ষা বোঝে।

হেমকান্ত চোখ চেয়ে থাকতে পারলেন না। ধুলো আর কুটোকাঠি এসে এমন তীব্রভাবে ফুটছে গায়ে আর মুখে যে চোখ মেলে থাকা বিপজ্জনক। দুকান বধির করে ঝড়ের শব্দ বয়ে যাচ্ছে।

চোখে কিছু দেখছেন না, কানে শুধু ঝড়ের উন্মাদ শব্দ। তবু তিনি তাঁর পিপাসিত অনুভূতির প্রতিটি রন্ধ্র দিয়ে গ্রহণ করছিলেন এই মহান ঝড়কে। সম্মোহিত, স্তব্ধ, বাক্যহারা। পৃথিবীর ক্ষীণপ্রাণ জীবজগৎ, তাদের খেলনার মতো ঘরবাড়ি ও পলকা অস্তিত্বকে নিয়ে কিছুক্ষণ ছেলেখেলা করে গেল ঝড়। তারপর একসময়ে থেমে গেল।

শেষ দিকটা হেমকান্তর চৈতন্য ছিল না। যখন সম্বিৎ ফিরে পেলেন, তখন দেখেন, ইজিচেয়ারটা অনেকটা দূরে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। তিনি পড়ে আছেন শানের ওপর। রবীন্দ্রনাথের বইটি ধারে কাছে কোথাও নেই। বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ছে। ঠিক অশ্বক্ষুরের শব্দ।

হেমকান্ত ঘরে এলেন। অপ্রতিভ হরি জড়োসড়ো হয়ে সঙ্গে সঙ্গে এল। তার তত দায়িত্ব ছিল। কর্তামশাই ওরকম পাগল হলে সে কী করবে?

হেমকান্ত তাকে হাতের ইশারায় বিদায় করে দিয়ে জানালার ধারে বসে বাইরে বৃষ্টি দেখতে লাগলেন। বড় একা লাগছিল তাঁর। এই বিপুল পৃথিবীতে একা। ঝড় তাঁর একাকিত্বের বোধটিকে আরও অসহনীয় করে দিয়ে গেল আজ।

হরিকে ডেকে হেমকান্ত জিজ্ঞেস করলেন, কৃষ্ণ কোথায়?

আজ্ঞে ঘরে।

বিশাখা?

ঘরেই আছেন।

যাক, নিশ্চিন্ত। হেমকান্ত বললেন, খোঁজ নে তো, নদীতে একটা নৌকো বিপদে পড়েছিল। সেটা পোঁছেছে কি না।

যে আজ্ঞে।–হরি চলে গেল।

হেমকান্ত আবার বৃষ্টি দেখতে লাগলেন। চারদিকে অকালসন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। ধরে বাতি জ্বেলে দিয়ে গেল চাকর।

হেমকান্ত টেবিলের ধারে গিয়ে বসলেন। কারও সঙ্গে এখন কথা বলা দরকার। এমন কারও সঙ্গে, যে বোঝে, যে হৃদয়বান।

ভাই সচ্চিদানন্দ, আজ কবির মতো বলিতে ইচ্ছা করিতেছে “হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে”। তবু তাহা বলিব না। কারণ বাস্তবিক হৃদয় নৃত্যপর নহে। নাচিতে গিয়া বারবার তাহার ঘুঙুর স্মৃলিত হয়, গাঁটে আমরাতের ব্যথা প্রকট হইয়া ওঠে, মাথা ঘুরিতে থাকে। আজ নাচিবার ইচ্ছাটুকুই সম্বল, শক্তি নিঃশেষিত।

ভায়া হে, তুমি রবীন্দ্রভক্ত নহ, তাহা আমি জানি। রবীন্দ্রনাথকে বুঝিবার মতো সময় ও চিন্তাশক্তি তোমার নাই। পলিটিকসের ঘষায় অনুভূতিগুলা ভোতা হইয়া গিয়াছে। বেনাবনে মুক্তা ছড়াইয়া লাভ নাই জানি। তথাপি আজ তোমাকে আমার সেই অনুভূতির কথা বলিতে বসিয়াছি যাহা অন্য কেহ বুঝিবে না, তুমিও বুঝিবে না। তবে তোমার ধৈর্য আছে, আমাকে এখনও অসহ্য মনে করো না। পলিটিকসের ইহাই সবচেয়ে বড় গুণ। মানুষকে সহনশীল করিয়া তোলে।

একটু আগে এক রূপবান ঝড় আমার সমস্ত সত্তাকে আক্রমণ করিয়া ছিন্নভিন্ন করিয়া দিয়া গিয়াছে। মনে হইতেছে, আমি এখন দ্বিখণ্ডিত। এই ঝড়ের পূর্বে আমার যে জীবন ছিল তাহা প্রথম খণ্ড মাত্র। এই ঝড়ের পর আমি দ্বিতীয়বার জন্মগ্রহণ করিয়াছি। ইহা এক নতুন জীবনের সূচনা।

কেমন হইবে এই দ্বিতীয় খণ্ডের জীবনযাপন?

জানি না। কিন্তু বলিব, আজ ছাদের উপর যখন সর্বগ্রাসী ঝড়ের আঘাত আসিয়া আমাকে সমূলে উৎপাটিত করিল তখন মনে হইতেছিল আমরা কী ছাই ঘর সংসার সাজাইয়া ছেলেখেলা করিতে বসিয়াছি! একটি ফুকারেই যে সব উড়িয়া যায়! অনিত্য ভাবনা নতুন কিছু নহে। কিন্তু ঝটিকার মুখে যে বার্তা বহিয়া আসিল তাহা অনিত্য চিন্তা নহে, তাহা এক বৃহত্তর জীবনযাপনের আহ্বান। মনে হইতেছিল, আমি নিজেকে যাহা ভাবি আমি বুঝি মাত্র সেটুকুই নহি। আমার বিশ্বব্যাপী অস্তিত্ব আকাশ পাতাল জুড়িয়া মুখব্যাদান করিয়াছে।

আবার বলি, ইহার সহিত বৈরাগ্য বা ব্রহ্মানুভূতিরও কোনও সম্পর্ক নাই। ইহা এক উপচানো আনন্দ, ইহা এক অসহনীয় সুখবোধ। তাহার সহিত এক নিঃসঙ্গতার বেদনাও মিশিয়া আছে।

তোমার ধারণা, আমার জীবনে কোনও দুঃখ নাই। কোনও সমস্যা নাই। তাহাই হইবে। তবু বলি ভায়া, কাহারও জীবনই সম্পূর্ণ নিষ্কণ্টক নহে। যাহার বাহিরের সমস্যা নাই, তাহার মন নব নব সমস্যার জট পাকাইয়া তোলে। আমি বোধহয় সেইপ্রকারই একজন। নহিলে আমার অভ্যন্তরে সর্বদাই কেন এক প্রদোষের রহস্যময় আলো-আঁধারি? আজিকার ঝড়ে সেই রহস্যের আবরণ উড়িয়া গিয়া এক অদ্ভুত স্বর্গীয় আলো আসিয়া পড়িল, ক্ষণিকের জন্য এক বৃহৎ জগতের ছবি মেলিয়া ধরিল। মিলাইয়া গেল।

কত লোকের সর্বনাশ হইয়াছে, কতগুলা নৌকো ড়ুবিয়াছে তাহা এখনও জানি না। কালবৈশাখীর দক্ষিণা তো কম নহে। কিন্তু আজ সে কথা ভাবিতেছি না। ঝড়ের একটু আগেই ছাদে বসিয়া নিবিষ্টমনে রবিবাবুর কবিতা পড়িতেছিলাম। মনটা সিক্ত ছিল। কিছু বিষণ্ণও। অকস্মাৎ ঝড় আসিয়া সেই কাব্যপাঠেরই একটি সুসংগত উপসংহার টানিয়া দিয়া গেল। কবিতা আমাদের ভিন্ন জগতে লইয়া যায়। ঝড়ও আজ সেই কাজটুকুই করিয়াছে।

তুমি বাস্তববাদী। এইসব কথাকে বড় একটা মূল্য দাও না। তবু জানি, তুমি আমার কথাগুলিকে ওজন করিবে, সম্ভাব্যতা বিচার করিবে, তাহার পর হয়তো গালিই দিবে। তবু অস্বীকার করিবে না। তোমার এই বায়ুগ্রস্ত বয়স্যটির প্রতি তোমার যে এখনও একটু স্নেহ আছে তাহা কেন জানো? ওই বায়টুকুর জন্যই। বায়ুগ্রস্ত লোকদের তুমি উপেক্ষা করিতে চেষ্টা করে বটে, কিন্তু তোমার যাহা নাই। তাহা তাহাদের আছে, তুমি যাহা অনুভব করো না তাহা তাহারা করে, এই সত্যও তুমি কোনওদিন অস্বীকার করিতে পারিবে না। তোমার এই গুণটুকুই আমাকে তোমার সঙ্গে আঠার মতো জুড়িয়া রাখিয়াছে।

কৃষ্ণ আর বিশাখা ছাড়া আজ নিকটাত্মীয়েরা কেহই আমার নিকটে নাই। পুত্রেরা বিষয়কর্মে ব্যস্ত, কন্যারা ঘর-সংসারে ড়ুবিয়া আছে। আমি তাহাদের দোষ দিই না। মাঝে মধ্যে কর্তব্যবশে এক-আধখানা পত্র তাহারা লেখে, উহাই আমার কাছে যথেষ্ট। আমার এখনকার জীবনযাপনে এগুলি অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছে। তথাপি ঝড় থামিবার পর আজ যেন মনে হইল, আমি বড় একা। আজ স্ত্রী বাঁচিয়া থাকিলেও বোধহয় এরূপই মনে হইত।

কেন বলো তো? এই রহস্যময় একাকিত্বের উৎস কী?

ঝড় যখন আসিল তখন আমার ভৃত্য আমাকে গৃহাভ্যন্তরে লইয়া যাওয়ার চেষ্টা করিয়াছিল। আমি যাই নাই। সেই অপরূপ ঝড়ের সঙ্গে তখন শুভদৃষ্টি হইতেছে, যাই কী করিয়া?

যখন ঝড় থামিল তখন দেখি আমার আরামকেদারা ছিটকাইয়া কোথায় সরিয়া গিয়াছে। রবিবাবুর গ্রন্থটির হদিশ নাই। আমি মুহ্যমান অবস্থায় পড়িয়া আছি। ভৃত্যটি সিঁড়িঘরের নিরাপত্তায় আশ্রয় লইয়াছে। ভাগ্য ভাল, পলাইয়া যায় নাই।

অভিমান নহে। ঝড়ের নিসর্গদৃশ্য যত সুন্দরই হোক, তাহার ভয়াবহতাও কম নহে। একটা বিপদ ঘটিতে পারিত। তথাপি কেহ আমাকে জোর করিয়া ঘরে টানিয়া আনে নাই বা আমার বিপদের ভাগ লইবার জন্য আমার সহিত অবস্থান করে নাই।

বোধহয় এই সামান্য ঘটনা হইতেই আজ বড় নিঃসঙ্গতা অনুভব করিতেছি।

এইবার কিছু কাজের কথা বলি। রাজেনবাবুর কথা নিশ্চয়ই ভুলিয়া যাও নাই। কর্মঠ, আত্মনির্ভরশীল মানুষ। ঢাকার বিক্রমপুরে ইহাদের বাড়ি। রাজেনবাবুর পুত্র শচীন ওকালতি পাস করিয়া আইন ব্যবসায় করিতেছে। তাহার সহিত বিশাখার বিবাহের একটি কথা চলিতেছে। সম্বন্ধটি কেমন হইল, তোমার মনোমত হইল কি না তাহা জানাইয়ো।

কিন্তু এই বিবাহের সম্বন্ধে অন্যরূপ একটা বিপদ দেখা দিয়াছে। লোক পরম্পরায় শুনিতেছি, আমার কন্যার নাকি এই পাত্র বিশেষ পছন্দ নয়। বড়ই বিস্ময় বোধ করি সচ্চিদানন্দ। যুগের হাওয়া পালটাইতেছে বটে, তা বলিয়া পনেরো বৎসবের একটি মেয়ের নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দের সমস্যা দেখা দিবে তাহা ভাবি নাই। আমিই তাহার মত নিতে আগ্রহী ছিলাম। কিন্তু আশা ছিল, আমার মতের উপরে সে কথা কহিবে না। পনেরো বৎসর বয়সে কাহারও বিচারবুদ্ধি থাকে না। সুতরাং পিতামাতার বিচারবুদ্ধিই তাহাকে পথ নির্ধারণ করিতে সাহায্য করে। কিন্তু আমার হিসাব-নিকাশ কিছুই মিলিতেছে না।

আমি কি তাহার উপর জোর খাটাইব? না কি তাহার মতই মানিয়া লইব? কিছু স্থির করিতে পারিতেছি না। তুমি কি এ বিষয়ে আমাকে সাহায্য করিতে পারো?

এইসব সংকট সময়ে বড়ই মৃত স্ত্রীর কথা মনে পড়ে।-তোমার হেম।

 

সকালবেলায় রঙ্গময়ি একবার করে নিয়মিত এসে হেমকান্তর সঙ্গে দেখা করে যায়। কাজের কথা থাকলে তাও বলে। হেমকান্ত সকালের দিকটায় রঙ্গময়ির জন্য নিজের অজান্তেই কিছুটা প্রতীক্ষা করে থাকেন। আজও করছিলেন।

চৈত্রের শুরুতেই এবার কালবৈশাখীর দাপট দেখা দিয়েছে। কাল সন্ধেবেলায় তুমুল ঝড় বয়ে। গেল। গোয়ালের চালের টিন উড়ে গেছে। বাগানে বহুকালের পুরনো একটা কামরাঙা গাছ উপড়ে পড়েছে। ব্রহ্মপুত্রে দু-চারটে নৌকো ড়ুবেছে নিশ্চয়ই। এখনও অবশ্য খবর আসেনি, তবে ফি বছরই ডোবে। এছাড়া গাঁ-গঞ্জে, শহরতলিতে কী ঘটেছে তাও এখনও অনুমানের বিষয়। প্রজাদের অবস্থাই বা কী? অবস্থা যাই হোক, যে-কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়কেই তারা খাজনা না দেওয়ার অজুহাত হিসেবে দাঁড় করায়। হেমকান্ত বিষয়চিন্তা করতে চান না, কিন্তু বিষয়চিন্তা তার ঘাড়ে চাপবেই। সরকারের খাজনা শোধ করতে তার দম বেরিয়ে যাচ্ছে। পুরো জমিদারি না হোক, এক-আধটা মহল বিক্রি করে দিলে কেমন হয়?

এইসব সাত-পাঁচ ভাবছিলেন, এমন সময় রঙ্গময়ি এল।

কী খবর, মনু? কালকের ঝড়ে কী হল খবর পেলে?

আমি মেয়েমানুষ, কী খবর পাব? তুমি একটু ঘুরে সব দেখে এলেই তো পারো।

যাব-যাব ভাবছিলাম।

ভেবেই তোমার দিন যাবে।

মৌকো-চৌকো ড়ুবেছে নাকি?

ড়ুবেছে। তবে ব্রহ্মপুত্রে নয়, তোমার সংসারে।

এটা আবার কেমন হেঁয়ালি?

হেঁয়ালি হবে কেন? তোমার আদরের মেয়ে বেঁকে বসেছে, শচীনকে বিয়ে করবে না। তার কী করছ?

হেমকান্ত কার্পেটের ওপর মেরুদণ্ড সোজা করেই বসে ছিলেন, আরও টান হয়ে বললেন, কী করব বলল তো! ওর আপত্তি কীসের?

শচীনরা নাকি ভীষণ গরিব।

গরিব! শচীন গরিব হতে যাবে কেন? জমাট প্র্যাকটিস।

সে তোমার মেয়েকে বোঝাও গে।

আমি যে ওদের সঙ্গে কথা পেড়ে ফেলেছি।

রঙ্গময়ি বিরস মুখে বলে, বিয়ের কথা ওঠার পর থেকেই নানারকম আপত্তি তুলছিল। তোমাকে বলিনি, কারণ বললেই তুমি আকাশপাতাল ভাবতে শুরু করবে। কিন্তু এখন না বলেও তো উপায় নেই। মেয়েদের নিজস্ব মত থাকবে, তারা বিয়েতে আপত্তি তুলবে, এসব তো আমরা ভাবতেও পারি না।

হেমকান্ত মাথা নেড়ে বলেন, সেটা কথা নয়, মনু। আমি মেয়েদের মতামতকে গুরুত্ব দিই। কিন্তু আপত্তি যদি থাকেই সেটা প্রথমেই বলেনি কেন?

তোমাকে বলতে হয়তো লজ্জা পেয়েছে।

শুধু গরিব বলেই আপত্তি?

ও তো তাই বলেছে। শচীনদের বাড়ি থেকে নাকি চেয়েচিন্তে নিত এ বাড়ি থেকে। কথাটা মিথ্যেও নয়। কিন্তু তাতে বিয়ে আটকায় কেন তা বুঝছি না।

আর কোনও কারণ নেই?

রঙ্গময়ি একটু দ্বিধায় পড়ে দোনোমনো করে বলে, আছে বোধহয়। ওর মনে হয় কোকাবাবুর নাতি শরৎকে পছন্দ।

শরৎ মানে যে পাখি মারে?

হ্যাঁ। শরৎ তো একজনই।

হেমকান্তর মুখ একটু বিবর্ণ দেখাতে লাগল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, কোকাবাবুর পরিবারের আভিজাত্য আছে। কিন্তু পরিবারটার মধ্যে কেমন যেন মায়াদয়া কম। কোকাবাবু যখন মারা যাচ্ছিলেন সেই সময় শরৎ পাখি মেরে বাড়ি ফিরল। সে কী উত্তেজনা!

রঙ্গময়ি বলল, ওটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। খবর পেয়েছি, শরৎ বিলেত যাচ্ছে। বিয়ে-টিয়ে করবে না।

কে বলল তোমাকে?

কৃষ্ণ। শরতের সঙ্গে সেদিন পাখি শিকার করতে গিয়েছিল, মনে নেই? সেদিনই কথা হয়েছে।

হেমকান্ত ভ্রু কুঁচকে বললেন, কৃষ্ণের সঙ্গে শরতের এত ভাব কী করে হল বলল তো!

বন্দুক! তোমার ছেলের দিনরাতের ধ্যান-জ্ঞান এখন বন্দুক।

বন্দুক! ও বাবা!

ও বাবা আবার কী? বন্দুক কি নতুন কিছু নাকি?

হেমকান্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন রঙ্গময়ির দিকে। তারপর বলেন, বন্দুক ওকে ছুঁতে না দেওয়াই ভাল, মনু। বাঘ যদি রক্তের স্বাদ পায়—

Category: দূরবীন - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
পূর্ববর্তী:
« ০৩০. শ্বশুর আর জামাইয়ের সাক্ষাৎকার
পরবর্তী:
০৩২. থানায় যাওয়ার আগে ধ্রুব »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑