1 of 3

৩০. শ্বশুর আর জামাইয়ের সাক্ষাৎকার

॥ ৩০ ॥

শ্বশুর আর জামাইয়ের সাক্ষাৎকারটি একটু আড়াল থেকেই লক্ষ্য করছিল সে। ধ্রুব শ্বশুরবাড়িতে এল দ্বিরাগমনের পর এই প্রথম। চৌধুরিবাড়ির ছেলেরা শ্বশুরবাড়ি যায় না। তেমন প্রথা নেই। শ্বশুরবাড়ির বিয়ে বা অন্যান্য অনুষ্ঠানে তারা উপহার বা আশীর্বাদ পাঠায়, কিন্তু নিজেরা আসে না। শুধু মৃত্যু সংবাদ পেলে আসে। নিতান্তই সৌজন্যের খাতিরে। ধ্রুব আজ সেই প্রথা ভেঙেছে।

রেমির বুক কাঁপছিল। ধ্রুব মদ খেয়ে এসেছে কিনা তা সে জানে না। ট্যাক্সি থেকে নেমে সে খুব স্বাভাবিক পায়েই ঘরে ঢুকেছে বটে, কিন্তু সেটা কোনো কথা নয়। শ্বশুরবাড়ি আসছে বলে সে সতর্ক হবে এমন মানুষ কি ধ্রুব?

ঘরে ঢুকে ধ্রুব বেশ গম্ভীর চোখে শ্বশুরকে দেখল। ঘরে রেমির মা ছিলেন। জামাইকে দেখে, বোধহয় আতঙ্কেই, পালিয়ে এলেন ভিতরের ঘরে। রেমিকে রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় বললেন, ওরে, ধ্রুব এসেছে! যা, কাছে যা!

রেমি বলল, আমার কাছে যাওয়ার কী? এসেছে তো এসেছে।

রেমির মা তাড়াতাড়ি গিয়ে ভিতরের ঘরে ছেলেকে ঘুম থেকে তুলে বললেন, ধ্রুব এসেছে! খাবার দাবার কিছু নিয়ে আয়।

রেমি বিরক্ত হয়ে বলল, তুমি ও রকম কোবো না তো। আমি ওকে জানি। কিছু খাবে না।

না খাক, আমাদের ভদ্রতা তো করতে হবে।

লাভ নেই মা।

লাভ লোকসানের কথা নয়। দ্বিরাগমনের পর এই এল।

রেমি আর তর্ক করল না। অন্য একটা ঘর থেকে ভেজানো দরজার সামান্য ফাঁক দিয়ে দেখতে লাগল ধ্রুবকে। সামনে গেল না। তার কারণ সে সামনে গেলেই ধ্রুব হয়তো ইচ্ছে করেই অন্যরকম হয়তো বা অভদ্র ব্যবহার করতে শুরু করবে। আড়াল থেকে দেখাই ভাল।

ধ্রুব শ্বশুরের বিছানার পাশে একটা চেয়ারে দিব্যি গা ছেড়ে বসে বলছিল, আপনার আগে কখনো হার্ট অ্যাটাক হয়েছে?

না তো।

আপনার বয়স কত?

বাহান্ন পেরিয়েছে।

আপনার নরমাল স্বাস্থ্য তো ভালই।

হ্যাঁ, এর আগে কখনো এ রকম হয়নি।

আজ হল কেন? শুনলাম সকালে নাকি কয়েকটা গুণ্ডা এসে আপনাকে শাসিয়ে গেছে?

কী দুঃসাহস! রেমি অবাক হয়ে গেল। কী স্বাভাবিক মুখ! নিপাট ভালমানুষ যেন!

রেমির বাবা বললেন, আর বলো কেন। আমি সাতে নেই, পাঁচে নেই, হঠাৎ একদল লোক একটা জীপ গাড়িতে এসে—

শুনেছি। আপনার মেয়ে আমাকে টেলিফোন করে সব বলেছে। ইন ফ্যাকট ওই দলে আমার একজন বন্ধুও ছিল।

রেমির বাবা একটু তটস্থ হয়ে বললেন, হ্যাঁ, ওরা তোমার বন্ধু বলেই বলছিল।

ধ্রুব মাথা নেড়ে বলে, সবাই নয়। একজন। বাদবাকীরা ঠিক বন্ধু নয়। তবে চেনা লোক! কী বলছিল বলুন তো!

সে আর তোমার শুনে কাজ নেই।

ধ্রুব একটু হেসে বলে, সব অ্যাকশনেরই একটা রি-অ্যাকশন আছে।

তার মানে?

ধ্রুব উদাস গলায় বলল, এরকম ঘটনা যখন ঘটে তখন খোঁজ করে দেখা ভাল যে, এর রুটটা কোথায়। রুট একটা আছেই। কোনো কিছুই খামাখা ঘটে না।

রেমির বাবা সকালের ঘটনায় প্রচণ্ড নারভাস হয়ে গিয়েছিলেন। জামাইয়ের এই উক্তিতে তিনি আর উচ্চবাচ্য করবার সাহস পেলেন না। সেডেটিভের ক্রিয়া চলছে। ঘুম-ঘুম চোখে জামাইয়ের দিকে একটু তাকিয়ে থেকে চোখ বুজলেন।

রেমি শ্বাস বন্ধ করে দৃশ্যটা দেখতে লাগল।

রেমির বাবা চোখ খুলে বললেন, কোথাও কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে তা বুঝতে পারছি। কিন্তু ব্যাপারটা কী তা আমি আজও জানি না।

ধ্রুব মৃদু স্বরে বলল, আমিও জানি না।

বোধহয় একটা মিস আনডারস্ট্যানডিং! তাই না?

হতে পারে।

রেমির বাবা হাতটা বাড়িয়ে ধ্রুবর একখানা হাত ধরলেন। বললেন, আমি কনফ্রনটেশন চাই না। জয়ন্ত আমার ছেলে, তুমিও আমার ছেলে। জয়ন্ত যদি কোনো অন্যায় করে থাকে তবে আমি ওর হয়ে মাপ চাইছি।

ধ্রুব মৃদু একটু হেসে বলে, বয়োজ্যেষ্ঠ হয়ে বয়ঃকনিষ্ঠের কাছে মাপ চাওয়াটা দৃষ্টিকটু। আর আপনিই বা অন্য কারো হয়ে মাপ চাইবেন কেন? ওটা তো প্রোটোকল হয়ে গেল। যদি কেউ অপরাধ করেই থাকে তবে তারই উচিত মাপটাপ চাওয়া।

জয়ন্তর ওপর তুমি রেগে আছে ধ্রুব!

না, না। মিষ্টি হেসে সুন্দর শয়তানটি বলল, ওর ওপর আমি রাগ করব কেন! প্রত্যেক মানুষেরই নিজস্ব বিচারবোধ অনুযায়ী চলার অধিকার আমি স্বীকার করি। তবে তার পিছনে মেরুদণ্ড থাকা চাই। ও যদি কিছু বলতেই চায় তাহলে তা জোরের সঙ্গে বলুক। কূটকচালি কি পুরুষের কাজ?

তুমি রেগে আছে। ও ছেলেমানুষ। মাপ করে দাও।

ধ্রুব খুব উদার গলায় বলে, মাপ করা শক্ত কী? তবে কেসটাই তো আমি জানি না। ও কী করেছে বলুন তো!

রেমির বাবা ফাঁপরে পড়ে বললেন, বোধহয় কূটকচালিই কিছু করে থাকবে। রেমি জানে। রেমিকে যদি একবার ডেকে জিজ্ঞেস করো।

যাক গে। পরে জেনে নেওয়া যাবে।

আমরা খুব ভয়ে ভয়ে আছি।

ভয়ে ভয়ে থাকবেন কেন? ভয়ের কী আছে?

তোমরা ভি আই পি মানুষ, তোমাদের ভয় নেই। আমাদের আছে।

আপনি এই অবস্থায় বড্ড বেশী দুশ্চিন্তা করে ফেলছেন। এটা কিন্তু ভাল নয়।

তাহলে কথা দাও জয়ন্তকে ওরা কিছু করবে না।

করলে তো করেই ফেলত। নিশ্চয়ই সে রকম ইচ্ছে ছিল না।

আবার যদি আসে?

সেই সম্ভাবনা যাতে দেখা না দেয় তার জন্য জয়ন্তরই চেষ্টা করা উচিত।

রেমির বাবার চোখে জল টলটল করছিল। বললেন, আমি বুঝেছি বাবা। জয়ন্তকে যা বলার আমি বলব। তুমি ভেবো না।

ধ্রুব উদাস গলায় বলল, আমি কখনোই ভাবি না। ছেলেমানুষ, কত কী করে ফেলতে পারে। জয়ন্তর বয়স কত হল বলুন তো!

বোধহয় একুশ।

হাই টাইম টু বি অ্যাডাল্ট। যাকগে, বয়সটা কোনো কনসিডারেশন নয়।

তুমি রাগ করে আছো। আমি বরং রেমিকে ডাকি, ও তোমাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে পারবে।

ধ্রুব মাথা নেড়ে বলে, না না তার দরকার নেই। কী হয়েছে না হয়েছে তা ডিটেলসে না জানাই ভাল। আমার শালা আমার সম্পর্কে আড়ালে কী বলে বেড়ায় তা জানার আগ্রহ আমার নেই। তাছাড়া আড়ালেই যখন বলছে তখন আড়ালটা রাখাই তো ভাল।

ও তোমাকে এমনিতে খুব পছন্দ করে।

কার কথা বলছেন?

জয়ন্ত। দু একটা কথা বুদ্ধির দোষে বলে ফেলেছে হয়তো, কিন্তু তোমার সম্পর্কে ওর ধারণা খুবই উঁচু। ও বলে, জামাইবাবু ইচ্ছে করলেই সাংঘাতিক কিছু করে ফেলতে পারে।

ধারণাটা বোধহয় ঠিক নয়।

না না, আমাদের ধারণা তাই। শুধু যদি—রেমির বাবা থামলেন। ধ্রুব একটু ঝুঁকে মৃদু হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে, শুধু যদি?

আমি তোমার শ্বশুর, পিতৃতুল্য—তাই বলছি—কতগুলো অভ্যাস যদি ছাড়তে পারতে ধ্রুব!

ধ্রুব থমথমে মুখ করে কিছুক্ষণ সামনের দেয়ালের দিকে চেয়ে রইল। তারপর শ্বশুরের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, আপনারা রেমির ব্যাপারে বোধহয় খুব হ্যাপী নন, তাই না!

সে কথা বলিনি। আমার তো মনে হয় রেমি বেশ সুখী।

তাহলে অনর্থক দুশ্চিন্তা করছেন কেন? আপনাদের মেয়ে যদি অসুখী হত তাহলে না হয় কিছু বলার থাকতে পারত।

কিছু বলছি না। যা বলছি সেটাকে বলতে পারো থিংকিং লাউডলি। তুমি বিবেচক ছেলে, নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে।

ধ্রুব মাথা নেড়ে বলে, না, বুঝতে পারছি না।

আড়াল থেকে রেমির মনে হচ্ছিল, এবার তার হস্তক্ষেপ করা উচিত। যদি সে দেরী করে তাহলে দুজনের মধ্যে আবহাওয়াটা খারাপ হয়ে যেতে পারে। সে দেখতে পেল, মা বাইরের ঘরে ট্রে নিয়ে ঢোকার মুখে দ্বিধায় পড়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

এ বাড়ির সকলেই ধ্রুবকে কী মারাত্মক ভয় পায় তা আজ ভাল করে বুঝতে পারে রেমি। ধ্রুবর জন্য খাবার আনতে গিয়েছিল জয়ন্ত। সেও বাইরের ঘর দিয়ে যায়নি। মা সামনে যেতে ভয় পাচ্ছে। বাবা কথা গুলিয়ে ফেলছে। আর ওই সুন্দর শয়তানটা সবই টের পাচ্ছে মনে মনে এবং উপভোগও করছে হয়তো।

যাবে রেমি? দরজার দিকে হাত বাড়িয়ে রেমি থেমে গেল। মজাটা শেষ অবধি দেখবে নাকি! দেখাই যাক না।

মা ঘোমটা টেনে খুব সন্তর্পণে ভিতরে ঢুকলেন। ধ্রুব সসম্মানে উঠে দাঁড়াল বটে, কিন্তু প্রণাম- টনাম করল না। মা একটা টেবিলে সযত্নে খাবারের প্লেট আর চা সাজিয়ে সামনে টেবিলটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, একটু মুখে দাও বাবা।

ধ্রুব খাবারের প্লেটের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল একটু। তারপর বলল, আমি এ সব খাই না।

একটু কিছু?

ধ্রুব মাথা নাড়ে, না।

মুখে অত্যন্ত সরল হাসি তার। কিন্তু মতামত স্পষ্ট এবং চূড়ান্ত। তার ওপর কেউ চাপাচাপি করতে ভরসা পায় না।

মাও পেলেন না। একটু অপ্রতিভ হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, কত কাল পরে এলে!

ধ্রুব একটু হাসল মাত্র। এ সব কথার জবাব দেওয়ার প্রয়োজনই সে বোধ করে না।

মা পালিয়ে বাঁচলেন। রেমির হাসি পাচ্ছিল।

ধ্রুব আর একটুক্ষণ বসে উঠবার চেষ্টা করে বলল, আজ আসি। আপনি বরং একটু সাবধানে থাকবেন। শরীরের বিশ্রামটাই সব নয়। মনটারও বিশ্রাম দরকার। কোনো দুশ্চিন্তা করবেন না।

দুশ্চিন্তাকে কি ঠেকানো যায় বাবা? জয়ন্তকে একবার ডাকি! সে বোধহয় বাড়িতেই আছে।

ধ্রুব ভ্রূ কুঁচকে বলল, বাড়িতে থেকেও যখন সামনে আসছে না তখন বুঝতে হবে তার আসার ইচ্ছে নেই।

হয়তো লজ্জা পাচ্ছে।

পেতেই পারে। এখন তাকে জোর করা ঠিক নয়।

আমি চাই ও তোমার পায়ে ধরে ক্ষমা চাক।

ধ্রুব খুব উদারভাবে হেসে বলে, আরে ওসব তো ফরমালিটি! ওর দরকার নেই।

তাহলে কী করব বলো তো?

একবার যেন সময় পেলে আমার কাছে যায়।

তোমাদের বাড়িতে?

ক্ষতি কি?

ঠিক আছে। যাবে।

ওকে বলবেন কোনো ভয় নেই। ধ্রুব কথাটা বলে একটু অপেক্ষা করল। তারপর বলল, ওকে সম্ভব হলে এ কথাটাও বলবেন। লোকে স্ক্যানডাল পছন্দ করে, শুনতে চায় এবং বিশ্বাস করে। কিন্তু একজন লোক সম্পর্কে ভাল কথা বলা হলে লোকে তা শুনতে বেশী আগ্রহ বোধ করে না। খুব কমন সাইকোলজি। তাই একবার একটা স্ক্যানডাল ছড়িয়ে পড়লে সহজে সেটাকে ওল্টানো যায় না। কাজেই কারো সম্পর্কে খারাপ কিছু প্রচার করার আগে ভাল করে চিন্তা করা উচিত।

বলব বাবা। কথাটা খুবই সত্যি।

আমি আসি!!

যাবে? রেমি যে এখানে আছে। ও তোমার সঙ্গে যাবে না!

ধ্রুব একটু গোমরামুখে বলে, আমি তো এখন বাড়ি ফিরব না।

ও, তাহলে এসো।

রেমি বাঘিনীর মতো বারান্দায় গিয়ে ওত পেতে রইল। ধ্রুব বেরোতেই ধরল।

কোথায় যাচ্ছো?

আরে কী খবর?

এমনভাবে বলল কথাটা ধ্রুব যেন বহুকাল পরে কোনো চেনা মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে রাস্তায়।

খবর ভাল। কিন্তু তুমি কোথায় যাচ্ছো?

কেন বলো তো? অবাক হয়ে ধ্রুব জিজ্ঞেস করে, আজকাল আমার চলাফেরার হিসেব রাখছ নাকি?

রাখাই তো উচিত?

ধ্রুব হেসে বলে, ঠিক আছে বন্ধু, রাখো। আমি যাচ্ছি আড্ডায়। ফিরতে রাত হবে।

তোমার কোন বন্ধু এ বাড়িতে হামলা করেছে, তার নামটা বলবে?

কেন নাম দিয়ে কী হবে?

তুমি টেলিফোনে আমাকে বলেছিলে যারা হামলা করেছে তারা তোমার বন্ধু নয়।

বলেছিলাম। তখন জানতাম না।

এখন জানো তো। তার নাম বলো।

নাম জেনে কী করবে?

পুলিশে খবর দেবো।

তা তো দিতেই পারো। কিন্তু ব্যাপারটা ঘাঁটানো কি ঠিক হবে?

হবে। আমি ঘাঁটাতে চাই।

তুমি চাইলেও আমি আমার বন্ধুকে বিপদে ফেলতে চাই না।

তাহলে আমি তোমার নামেই পুলিশের কাছে ডায়েরী করব।

তাও ভাল। কেন, শ্বশুরমশাইকে জানাবে না?

জানাতে পারি, তবে উনি নিজের ছেলেকে কি আর জেল খাটাবেন?

তুমি নিজের স্বামীকে পারলে উনিও পারবেন।

তিনি যা খুশি করবেন। তবে আমি পুলিশকে ব্যাপারটা জানাতে চাই।

ধ্রুব একটু গম্ভীর হয়ে বলে, রেমি ছেলেমানুষী কোরো না।

আমি সব শুনেছি।

শুনতেই পারো। আমি কিছু লুকোচ্ছি না। তোমার বাবাকেও বলেছি।

এটা কি খুব একটা বীরত্ব? তোমার লজ্জা করল না কতগুলো থার্ড ক্লাস গুণ্ডাকে নিজের শ্বশুরবাড়িতে হামলা করতে পাঠাতে!

আমি পাঠিয়েছি কে বলল?

তাহলে কে পাঠিয়েছে?

কথাটা এখানে আলোচনা না হওয়াই ভাল।

বাড়ি ফিরে হবে?

হতে পারে।

তাহলে বাড়ি চলো। আমি শুনতে চাই।

পরে হলে হয় না?

না। ব্যাপারটা আমি জানতে চাই।

ধ্রুব একটা শ্বাস ফেলে বলল, মাঝে মাঝে তুমি বড্ড কঠিন হয়ে যাও। আচ্ছা ঠিক আছে। চলো।

ধ্রুব বড় রাস্তায় এসেই একজন ট্রাফিক পুলিশকে অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ট্যাকসি ধরে দিতে বলল। লোকটা পাঁচ মিনিটের মধ্যে ট্যাকসি দাঁড় করিয়ে দিল সামনে।

ধ্রুব বাড়ির দিকে গেল না। সোজা ময়দানের দিকে চালাতে বলল। একটু পরেই মত পাল্টে হুকুম দিল, পার্ক স্ট্রিট। রেমি গুম হয়ে বসে ছিল। এসব গ্রাহ্য করল না। গন্তব্য বড় কথা নয়, সে কথাটা শুনতে চায়।

শেষ অবধি পার্ক স্ট্রিটও নয়। গঙ্গার ধার।

বেশ রাত হয়ে গেছে। গঙ্গার ধার, এখন তেমন মনোরম কিছু নয়। একটা মোটামুটি নির্জন জায়গায় ট্যাকসি দাঁড় করাল ধ্রুব তারপর ড্রাইভারকে হুকুম করল, যাও তো, একটু ঘুরে-টুরে এসো। আমরা কথা বলব।

ড্রাইভার একবারও গাঁইগুঁই না করে নেমে গেল।

ধ্রুব আচমকাই জীবনে এই প্রথম, রেমিকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে একটি তপ্ত চুমু খেল। অনেকক্ষণ ধরে। তারপর বলল, আমাকে তুমি একদম বিশ্বাস করো না, না?

চুমুতে কেমন বিভ্রান্ত হয়ে গেল রেমি। ভিতরে যে শক্ত জমি তৈরি হয়েছিল তা আবার বেনোজলে হয়ে গেল কাদামাটি। পিছল, ভীষণ পিছল। রেমি দাঁড়াতে পারে না তার ওপর।

ধরা গলায় সে বলল, করি।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো সে চেয়ে রইল অপরূপ পুরুষটির দিকে। এখনো এই পুরুষটির প্রায় সবটাই তার জানার বাইরে। এতদিন একসঙ্গে শুয়ে বসেও কেন এর রহস্য ভেদ করতে পারে না সে?

ধ্রুব বলল, যাবে পুলিশের কাছে! ধরিয়ে দেবে আমাকে?

রেমি দুহাতে আঁকড়ে ধরে ধ্রুবকে বলে, তুমি আমাকে ভালবাসো না কেন? কেন? কেন?

কে বলল বাসি না?

বাসো না, আমি জানি।

এটা কি কেউ তোমাকে বুঝিয়েছে?

না। বর ভালবাসে কিনা তা বউ ছাড়া আর কে টের পাবে?

কি জানি। ভাবলাম আজকাল তো অনেকেই আমার সম্পর্কে তোমার কান ভারী করছে, ভালবাসার ব্যাপারেও করে থাকতে পারে।

করেনি।

শোনো রেমি, আমি চরিত্রহীন বা লম্পট নই।

রেমি তার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলে, ওসব শুনতে চাই না। জানি।

ধ্রুব মুখটা সরিয়ে নিয়ে বলে, জানা উচিত। কিন্তু সবচেয়ে যেটা স্যাড সেটা হল আমাকে নিজের মুখে কথাটা বলতে হচ্ছে। আমি যে চরিত্রহীন বা লম্পট নই তা তুমি ছাড়া আর কে বেশী জানবে?

জয়ন্ত ভুল করেছে।

ধ্রুব দুঃখিতভাবে মাথা নেড়ে বলে, আমি একটা লড়াই লড়ছি। সেটা আমার ব্যক্তিগত লড়াই। খুব সাঙ্ঘাতিকও। সেটা লড়তে আমাকে হবেই। সেটার জন্যই আমার ভিতরে কিছু অস্বাভাবিকতা আছে। কিন্তু অন্য কিছু নেই।

আর কেউ না জানুক আমি জানি।

জানো? ঠিক তো!

বলছি তো। এখন ওসব কথা নয়।

ক্লান্ত স্বরে ধ্রুব বলে, কিন্তু প্রেমের কথা যে আমি বেশীক্ষণ বলতে পারি না।

বলতে হবেও না। শুধু ধরে বসে থাকো।

চমৎকার কাটল দিনটা রেমির। বাড়ি ফিরেও প্রেমটা নিঃশেষ হয়ে গেল না। বিছানায় অনেকক্ষণ মাথামাখি হল তাদের। রাত জেগে গল্প।

কিন্তু সকাল হল অন্যরকম।

ভবানীপুর থানার ও সি বিনীতভাবে অপেক্ষা করছিলেন বাইরের ঘরে। কৃষ্ণকান্ত ধ্রুবকে ডেকে পাঠালেন। রেমিও গেল পিছু পিছু।

কৃষ্ণকান্ত তাঁর গম্ভীর গমগমে গলায় বললেন, ইনি এসেছেন তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে।

ধ্রুব দারোগার দিকে দৃকপাতও করল না। শুধু অপলক চোখে কিছুক্ষণ কৃষ্ণকান্তর দিকে চেয়ে রইল।

কৃষ্ণকান্ত চোখ সরালেন। বললেন, কোথায় কার বাড়িতে একটা হামলা হয়েছে। সেই ব্যাপারে।

বলে উঠে গেলেন কৃষ্ণকান্ত।

ও সি বললেন, ব্যাপারটা খুব অস্বস্তিকর ধ্রুববাবু। ঘটনাটা ঘটেছে আপনার শ্বশুরবাড়িতে। তাতে আপনার বন্ধুরাও ইনভলভড।

তাই নাকি? ব্যাঙ্গের স্বরে প্রশ্ন করে ধ্রুব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *