• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

০০৮. হানিমুন

লাইব্রেরি » শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় » উপন্যাস (শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়) » দূরবীন - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় » ০০৮. হানিমুন

ফার্স্ট ক্লাস কূপে কামরায় হানিমুনটা শুরু থেকেই জমে যাওয়ার কথা। একদিকে তরতাজা একটা ছেলে, অন্যদিকে টগবগে একটা মেয়ে। কিন্তু জমল না। গাড়ি শেয়ালদা ছাড়তে না ছাড়তেই ধ্রুব তার সুটকেসে জামাকাপড়ের তলায় সযত্নে শোয়ানো বোতলটি বের করে বসে গেল এবং খুব নিবিষ্টমনে প্রায় একনাগাড়ে মদ খেয়ে যেতে লাগল। ফলে খাওয়ার জলের বোতলটা বর্ধমান যেতে

যেতেই শেষ।

রেমি ধ্রুবর দিকে তাকাচ্ছিল না। জানালার ধারে আড়ষ্টভাবে বসে বাইরের চলন্ত প্রকৃতি দেখার চেষ্টা করছিল। এ কার সঙ্গে বিয়ে হল তার? একজন নেতা এবং বড়লোকের ছেলে, এই পরিচয় দেখেই কি বাবা ধ্রুবর সঙ্গে বিয়ে দিল তার? আর কোনও খোঁজখবর করল না? ধ্রুব সুপুরুষ সন্দেহ নেই। রেমি এও জানে, খাওয়া-পরা বা বিলাস ব্যসনের কোনও অভাব তার হবে না। কিন্তু সেইটেই তো সব নয়। এ লোকটা বিয়ের দিন থেকেই গণ্ডগোেল করে যাচ্ছে যে! বিয়ের দিন যখন সাজগোজ করানো হচ্ছে রেমিকে, সেই সময় একবার খবর এল ধ্রুবকে বাড়িতে পাওয়া যাচ্ছে না। দুটো মিনিবাস ভর্তি রুক্ষ ও উগ্র চেহারার বরযাত্রীরা এসে বাড়ি গরম করে ফেলেছে তখন। তাদের অনেকেই ভারী ভারী সোনার গয়না দিয়ে আশীর্বাদও করে গেল তাকে। অন্তত বিশ-ত্রিশ ভরি সোনা রোজগার করে ফেলল রেমি। কিন্তু বরের গাড়ি আসেনি, বর আনতে গিয়েছিল দাদা। সে-ই টেলিফোন করে জানাল, ধ্রুব বাড়িতে নেই। কৃষ্ণকান্তবাবু খুব রাগারাগি করছেন। এমনকী পুলিশকে পর্যন্ত কাজে লাগানো হয়েছে।

রেমির কানে খবরটা হয়তো এসে পৌঁছত না। কিন্তু সন্ধের লগ্ন পেরিয়ে যাওয়ায় ফিসফাস গুজগুজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। বাঙালরা একটু উচ্চস্বর হয়েই থাকে, বড় একটা ঢাকঢাক গুড় গুড় নেই। তাদের মধ্যে একজন রেশ চেঁচিয়েই বলছিল, দেখ কোথায় গিয়ে মাল খেয়ে গড়াগড়ি যাচ্ছে। ওর কি কোনও কাণ্ডজ্ঞান আছে! কৃষ্ণদা যে কেন এটার বিয়ে দিচ্ছেন তাই বোঝা যাচ্ছে না।

বাঙাল বাড়িতে বিয়ে নিয়ে রেমির আত্মীয়স্বজনের মধ্যে দ্বিধা এবং ভয় ছিলই। বাঙালদের রীতিনীতি আলাদা, আচার-ব্যবহার আলাদা, রেমিদের বাড়িতে আর কেউ বাঙাল বিয়ে করেনি। তাই বাঙাল ছেলের সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে অনেকে আপত্তি তুলেছিল। কিন্তু বাবার উপায় ছিল না। কৃষ্ণকান্তবাবুর কাছে অনেক ব্যাপারেই তার টিকি বাঁধা। তিনি নিজের ছেলের জন্য রেমিকে পছন্দ করায় বাবা আর আপত্তি করতে পারেনি। কিন্তু বর বেপাত্তা হওয়ায় সকলেই ঘাবড়ে গেছে। বরযাত্রীদের মন্তব্য বর সম্পর্কে তাদের আরও ভীত করে তুলল।

তবে কৃষ্ণকান্ত অতি ক্ষমতাবান লোক। সারা কলকাতা এবং গোটা রাজ্য জুড়ে তার অজস্র কর্ষিকা। বাড়িতে বসে শুধু টেলিফোন করে কৃষ্ণকান্ত তার কর্ষিকাগুলিকে সক্রিয় করে তুললেন। দলীয় কর্মী, পুলিশ, চামচা, ভক্ত, আত্মীয়স্বজন, আড়কাঠি, বন্ধুবান্ধব সকলেই সজাগ হয়ে উঠল।

পরের লগ্ন রাত এগারোটার কাছাকাছি। তার অন্তত আড়াই ঘণ্টা আগে নৈহাটি স্টেশনের কাছে রুটি এবং মাংস ভক্ষণরত ধ্রুবকে প্রায় এঁটো হাতেই তুলে আনা হল। শোনা যায় সেই শুভদিনে ছেলেকে ধরে আনার পর কৃষ্ণকান্ত নিজের হাতে তাকে চটিপেটা করেন। তবে তার প্রধান অভিযোগ ছিল, উপোস ভেঙে সে বিয়ের দিন রুটি মাংস খেয়েছিল কেন।

ধ্রুব যখন বিয়ের পিড়িতে এসে বসল তখন তার মুখ গম্ভীর এবং থমথমে। একটা মন্ত্রও সে উচ্চারণ করেনি বিয়ের সময়। শুভদৃষ্টির সময় কনের মুখের দিকে তাকায়নি। শুধু পাথরের মতো চুপচাপ বসেছিল। রেমি তখনই জানত, বাবা তাকে হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দিয়েছে। এটা বিয়েই নয়। এই লোকটা হয় পাগল, নয় বদমাশ। সারাজীবন একে স্বামী হিসেবে কল্পনা করাও তার পক্ষে কষ্টকর হবে।

ফুলশয্যার রাত্রে ঘরে এসেই একটা আলমারি খুলে মদের সরঞ্জাম বের করে বসে গেল দ্রুব। তাকে বলল, খাওয়ার ঘরের ফ্রিজ থেকে বরফের ট্রে-টা নিয়ে এসো তো।

অবাক রেমি বলল, তুমি আজ মদ খাবে?

খেলে কী? রোজ তো খাই, আজ নয় কেন?

আজকের দিনেও খায় কেউ?

মুখটায় রাজ্যের বিরক্তি ফুটিয়ে ধ্রুব বলল, প্যান প্যান কোরো না। নিজে না পারো তো একটা চাকরবাকর কাউকে বলো। এনে দেবে।

আমি পারব না।

ধ্রুব একটু স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রেমির দিকে। তবে বাড়াবাড়ি করল না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল, তুমি বেশ সুন্দরী। তবে তোমাকে কিন্তু আমি নিজে পছন্দ করে আনিনি। সুতরাং আমার বেশি দায়দায়িত্বও নেই।

রেমি একটু দাপটের সঙ্গেই বলল, তোমার দায়দায়িত্বের বোধ কেমন তা আমি জানি। আমাকে আর বোঝাতে হবে না।

ধ্রুব এই কথায় অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। বেল আর জুই ফুলে সাজানো ঘর মাতাল হয়ে উঠছিল গন্ধে। দামি সেন্ট ছড়ানো বিছানা অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য। চালু ছিল শব্দহীন এয়ারকুলাব। সেই অদ্ভুত মাদকতাময় ঘরে একা খাটের ওপর পা তুলে শিকারি বেড়ালের মতো তীব্র চোখে রেমি লক্ষ করছিল ধ্রুবকে। এই লোকটা কোনওদিন তাকে ছোঁবে বা আদর সোহাগ করবে ভাবতেও গা ঘিনঘিন করছিল তার।

অনেকক্ষণ চুপ করে অনড় হয়ে বসে রইল ধ্রুব। তারপর একসময়ে চেয়ারটা রেমির দিকে ঘুরিয়ে বসল।

রেমি দেখল ধ্রুবর মুখে রাগ নেই, বিদ্বেষ বা ঘৃণাও নই। এক ধরনের তীব্র ও গভীর বিষণ্ণতা আছে।

ধ্রুব ধীর স্বরে বলল, তোমার নাম তো রেমি!

রেমি সামান্য বিদ্রুপ করে বলল, না, আমার নাম বঙ্গবাসিনী।

ধ্রুব তার দিকে চেয়ে একটু হাসল। বলল, নামটা আমার জানা উচিত, তাই না?

তুমি কি উচিত-অনুচিত মানো?

ধ্রুব রাগল না। ধীর স্বরে বলল, ঠিক আমার মতো অবস্থায় না পড়লে তুমি কখনওই আমার সমস্যার কথা বুঝতে পারবে না রেমি। আমাকে ঘেন্না করা খুব সোজা। এই বাড়ির সকলেই আমাকে ঘেন্না করে। কারণ তাদের সেটা শেখানো হয়েছে।

কথাটা রেমি ভাল বুঝল না। তবে চুপ করে রইল।

ধ্রুব নিজেই খানিকক্ষণ বিরতি দিয়ে বলে, আমার মা নেই, জানো?

রেমি বলল, তোমার মা নেই তাতে কী হল? অনেকেরই থাকে না।

ঠিক কথা। কিন্তু আমার মায়ের এখনও বেঁচে থাকার কথা ছিল। মা গায়ে আগুন লাগিয়ে মারা যায়। আমি তখন ছোট, বছর দশেক বয়স হবে হয়তো। পদ্মপুকুরের বাড়িতে থাকতাম তখন। বাথরুমে ঢুকে মা গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়। গোটাটা পুড়ে গেল, অথচ মা একটাও শব্দ করেনি। হান্ড্রেড পার্সেন্ট বার্নিং, হাসপাতালে তিন দিন বেঁচে থেকে মারা যায়। সেই মৃত্যুটা যতদিন মনে থাকবে ততদিন তোমার শ্বশুরের সঙ্গে আমার লড়াই শেষ হবে না।

রেমি বুঝতে পারছিল না। বলল, কীসের লড়াই?

লড়াইটা বহুমুখী, কারণ বহু কিছুর জন্যই ওই লোকটা দায়ি। লোকটা বর্বর, নির্বোধ, ক্ষমতালোভী, নিষ্ঠুর, অহংকারী। জানো এসব?

না।—মাথা নাড়ল রেমি।

ধীরে ধীরে জানবে। তবে লোকটার গুণও অনেক। সমস্তরকমের বিরুদ্ধতাকেই জয় করতে পারে, সমস্ত প্রতিকূলতাকেই নিজের অনুকূলে ঘুরিয়ে নিতে পারে। ব্রিটিশ আমলে এ লোকটা বিস্তর সাফার করেছে, লাঠি গুলি ফাঁসির দড়িকে ভয় খায়নি। তাই লোকটাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সবচেয়ে বড় কথা কী জানো? সবচেয়ে বিস্ময়কর কথা? এই লোকটা নিজের দেশ এবং দেশের মানুষকে বাস্তবিকই ভালবাসে।

রেমি এই শ্বশুরপ্রসঙ্গ খুব উপভোগ করছিল না। ছেলের মুখে বাপের নিলে এমনিতেও সুস্বাদু নয়। সে বলল, আমার মাথা ধরেছে। আমি একটু শুচ্ছি।

ধ্রুব উদাস স্বরে বলল, এ বাড়িতে যে ঘেন্নার বীজাণু ঘুরে বেড়াচ্ছে তোমাকেও তা অ্যাটাক করেছে, বুঝলে? সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক। এনি ওয়ে, তুমি শুয়ে পড়ো। আমার বোধহয় আজ রাতে আর ঘুম আসবে না।

রেমি শুয়ে পড়ল এবং একসময়ে ঘুমও এল। খুব সকালবেলা তুমুল চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙল তার। বাইরের প্যাসেজে ধ্রুব চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলছিল, কোনও শালার রাইট নেই আমাকে আটকে রাখার। ছাড়ো আমাকে, ছাড়ো! নইলে আমি গুলি করে উড়িয়ে দেব সবাইকে, সুইসাইড করব…।

রেমি বুকে ধড়ফড়ানি নিয়ে দৌড়ে দরজায় গিয়ে দেখল, চার-পাঁচজন ষণ্ডামার্কা লোক চেপে ধরে আছে ধ্রুবকে। ধ্রুব রক্তচক্ষুতে চেয়ে চেঁচাচ্ছে। কিন্তু নড়তে পারছে না।

কৃষ্ণকান্ত সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন। টকটকে গৌরবর্ণ সুপুরুষ। দীর্ঘকায় এবং মজবুত গড়ন। এসে ছেলের সামনে দাঁড়ালেন। মুখে কথা নেই।

কিন্তু জোঁকের মুখে যেন নুন পড়ল। সপ্তম স্বর চিঁচিঁ করতে লাগল ধ্ৰুবর। সে বলল, দেখুন, আপনার লোকেরা আমাকে ধরে রেখেছে।

কৃষ্ণকান্ত গমগমে গলায় বললেন, ওদের ওপর সেরকমই হুকুম আছে।

কেন, আমি কী করেছি?

কৃষ্ণকান্ত বললেন, ওদের ওপর হুকুম আছে, তুমি বাড়ি থেকে পালানোর চেষ্টা করলে তোমাকে যেন ধরে আনা হয়।

আমি পালানোব চেষ্টা করিনি।

তবে কী করেছিলে?

মাথা ধরেছে বলে একটু বাইরে যাচ্ছিলাম। হাওয়ায়।

কৃষ্ণকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, আজকের দিনটা শুধু বেরিয়ো না। চেষ্টা করলেও বেবোতে পারবে না। তবে কাল যেখানে খুশি যেয়ো। কেউ বাধা দেবে না!

এই বলে কৃষ্ণকান্ত আবার ওপরে চলে গেলেন।

রেমির বুকের ধড়ফড় অনেকক্ষণ ছিল। লোকগুলো ধ্রুবকে আবার ঠেলে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে গেল।

রেমি জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছিলে?

ধ্রুবর মুখ-চোখ রাগে লাল। ঘনঘন শ্বাস ফেলছিল। চাপা গর্জন করে বলল, যেখানে খুশি যাচ্ছিলাম, তাতে তোমার বাবার কী?

রেমি দাঁতে দাঁত পিষে বলল, আমার বাবার কিছু নয়, তবে তোমার বাবার তো দেখলাম বেশ মাথাব্যথা।

ধ্রুব চেয়ারে বসে বোতল তুলে নিল। রেমি অবাক হয়ে দেখল, বোতলটা সারা রাত খোলেনি ধ্রুব। অর্থাৎ ফুলশয্যার রাতটা ধ্রুব বাস্তবিকই মদ খায়নি। তবে ভোরবেলা সেই অপমানের পর খেল।

পরদিনই পাহারা তুলে নিলেন কৃষ্ণকান্ত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ধ্রুব আর পালানোর চেষ্টা করল। খুব শান্ত হয়ে রইল কদিন। বেশি বেরোতও না বাড়ি থেকে।

রেমির সঙ্গে অবশ্য ধ্রুবর দেখা হত খুবই কম। পারিবারিক নিয়ম অনুযায়ি দিনের বেলা স্বামীর সঙ্গে দেখা করার উপায় ছিল না। দেখা হত রাত্রিবেলা। সেই কয়েকদিন ধ্রুব খুব শান্ত রইল বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে কেমন একরকম উদাসীন দূরত্ব বজায় রাখত। কথা বলত না একদম। দাড়ি কামাত নাবলে গালে কোমল দাড়ি গজিয়ে ভারী সুন্দর দেখা ওকে। আলাদা একটা ছোট খাটে শুয়ে থাকত।

খুবই কচি এবং কাঁচা বয়স ছিল তাদের। সেই সময়ে তো দুজনের ভিতরেই তীব্র চৌম্বক আকর্ষণ থাকার কথা। ধ্রুবর প্রতি বিদ্বেষ ও ক্ষোভ রেমিকে প্রথম কদিন উদভ্রান্ত রাখলেও একদিন অন্যরকম ঘটল।

সেদিন একটু রাত করেই ঘরে এসেছিল রেমি। ধ্রুব একটু কাত হয়ে শুয়ে আছে। ঘুমন্ত। লম্বা চুলওলা মাথাটা একটু গড়িয়ে গেছে বালিশ থেকে। লাল টুকটুক করছে ঠোঁট। বিশাল চোখের নীচে ক্লান্তির কালো ছোপ। গায়ে একটা ফরসা পাঞ্জাবি, সোনার বোতামগুলো ঝকঝক করছে। ফরসা বুকে কিছু রোম দেখা যাচ্ছিল। একটা তাবিজ ঝুলে আছে গলা থেকে।

বড় মায়া হল রেমির। মাথাটা তুলে দিল বালিশে। এ লোকটাকে তার ভালবাসতে ইচ্ছে করে। কিন্তু লোকটা যেন কেমনধারা। কিছুতেই কারও ভালবাসা নিতে হাত বাড়ায় না। বিদ্রোহী? কিন্তু সেই বিদ্রোহের রকমটা এরকম বিদঘুটে কন?

কয়েক মুহূর্তের বিভ্রম। রেমি ধ্রুবর মাথার চুলে একটা হাত বুলিয়ে দিল। তারপর তার পাশেই একটু জায়গা করে নিয়ে শুয়ে পড়ল। ডাকল, এই, ঘুমোলে? শোনো, আমার একা শুতে বুঝি ভয় করে না?

ধ্রুব বাস্তবিকই ঘুমিয়ে পড়েছিল। চোখ খুলে তাকে দেখে একটু অপ্রস্তুত হল। তবে রাগ করল, বিরক্তও হল না। বরং ঠাট্টা করে বলল, তুমি কোন শিবিরের লোক তা জানো তো?

জানি।

তোমাকে আমি তাই বিশ্বাস করি না।

নাই বা করলে।

আমাকে শোধরানোর জন্যই বাবা তোমাকে বউ করে এনেছে। কিন্তু আমি এত সহজে শোধরাব রেমি।

তুমি কি খুব খারাপ?

আমি খুব খারাপ হতে চাই।

এখন একটু খারাপ হও না ব্রহ্মচারী, দেখি।

খুব কাছ থেকে ধ্রুবর মুখখানা দেখে সম্মোহিত হয়ে গেল রেমি, কী সুন্দর! তার মেয়েলি অহংকার ভেসে গেল, উবে গেল অভিমান রাগ আর ঘৃণা। শরীর ও হৃদয় জুড়ে বেজে যাচ্ছিল এক দামামা। এই সেই রণবাদ্য যা অবশ্যম্ভাবী করে তোলে দুই বিপরীত শরীরের সংঘর্ষ ও সংঘাত।

একটি-দুটি রাত্রি কাটল শরীরের উন্মত্ততায়।

কিন্তু এই বাড়ির ভিতরে ভিতরে যে বিভেদ, বিদ্বেষ ও অবিশ্বাস জমেছে বহুদিন ধরে, তা ছাড়বে কেন তাদের?

বিয়ের একমাস পরেই ইলেকশন। কৃষ্ণকান্ত বিধানসভার নমিনেশন পেয়েছেন, বাড়িতে প্রচুর লোকের আনাগোনা এবং ভীষণ ব্যস্ততা দেখা দিল। রান্নাঘরে বিশাল উনুন জ্বলে সারাদিন। দলের কর্মীরা অনেকেই এসে খায়। তা হচ্ছে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা। বাড়িটা প্রায় বারোয়ারি বাড়ি হয়ে উঠল।

একদিন সন্ধেবেলা ধ্রুব একটা লোককে কলার ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে ভিতরে নিয়ে এল। চেঁচিয়ে কৃষ্ণকান্তের উদ্দেশে বলতে লাগল, দেখুন, আপনার লোকজনকে একটু দেখে যান।

কৃষ্ণকান্ত দলের লোকজনকে নিয়ে ওপরতলায় জরুরি মিটিং করছিলেন। মিটিং অবশ সারাদিন লেগেই থাকত। বিরক্ত মুখে কৃষ্ণকান্ত গাড়িবারান্দার ছাদে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, কী হয়েছে? চেঁচাচ্ছ কেন?

ধ্রুব বলল, এই লোকটাকে চেনেন তো! এ হচ্ছে আপনার একজন ক্যামপেনার। রঘুবীর দাশশর্মা।

চিনব না কেন? ও কী করেছে?

একটু আগে হাজরা পার্কের উলটোদিকের গলিতে এ দুটো ছেলেকে মেরেছে। তারা দেয়ালে লিখছিল। সেই দেয়াল নাকি আপনার। শুধু এই কারণে দলবল নিয়ে এ গিয়ে ওদের তাড়া করে। গলিতে নিয়ে গিয়ে পেটে ছোরা মেরেছে। তারপর এসে ফুটপাথে বেঞ্চ পেতে বসে বিড়ি ফুকছে।

কৃষ্ণকান্ত গমগমে গলায় বললেন, চেঁচিয়ো না, ছেড়ে দাও ওকে, আমি দেখছি।

কী দেখবেন?

সে আমি বুঝব।

আপনি বুঝবেন কেন? এ লোকটাকে পুলিশের হাতে দেওয়া উচিত।

কৃষ্ণকান্ত ধমক দিয়ে বললেন, ধ্রুব! ওকে ছেড়ে দাও। পুলিশে দেওয়ার দরকার হলে আমিই দেব। তুমি তোমার কাজে যাও।

সেটা তো আইন নয়।

আইন তোমার চেয়ে আমি ভাল জানি।

জানেন, কিন্তু মানেন না।

কৃষ্ণকান্ত একটু বিপদে পড়লেন। কারণ দলের লোকজন সব উঠে গাড়িবারান্দার ওপরে ভিড় করে পিতা পুত্রের নাটক দেখছে। নীচে এবং ফটকের বাইরেও লোক জমা হচ্ছে।

কৃষ্ণকান্ত মরিয়া হয়েই বললেন, ও যে মেরেছে তার কোনও সাক্ষী আছে?

আমিই সাক্ষী।

তুমি একা?

তা ছাড়া আর কে সাক্ষী দেবে?

তুমি ঠিক দেখেছ?

নিশ্চয়ই। আপনি থানায় টেলিফোন করুন। আমি সাক্ষী দেব।

রঘুবীর দাশশর্মা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। একটু হাসছিলও মাঝে মাঝে। সে জানে ধ্রুব একটু পাগলা গোছের। সে এও জানে কৃষ্ণকান্ত চৌধুরী যে-কোনও বিপদ থেকে তাকে উদ্ধার করবেনই।

কৃষ্ণকান্ত বললেন, আমি থানায় ফোন করছি। রঘুবীরকে ওপরে আসতে বলো।

ব্যাপারটা এইখানেই মিটে গেল অবশ্য। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পুলিশ এসে রঘুবীরকে ধরে নিয়ে যায় এবং তার পরদিনই রঘুবীর ছাড়া পেয়ে অন্য এলাকায় কৃষ্ণকান্তর হয়ে খাটতে থাকে।

কৃষ্ণকান্ত তখন একদিন রেমিকে ডেকে বললেন, বাক্সপ্যাটরা গুছিয়ে নিয়ে দামড়াটাকে সঙ্গে করে কদিন দার্জিলিং বেরিয়ে এসো তো মা। রিজার্ভেশন হয়ে গেছে।

সেই তারা হানিমুনে চলল। রক্ষণশীল পরিবারের পক্ষে দারুণ আধুনিক ব্যাপার।

মধুচন্দ্রিমা না নিমচন্দ্রিমা তা কে বলবে? ধ্রুব সেই আগের মতোই অস্বাভাবিক। কিছুতেই রেমিকে চিনতে চায় না। তাকায় না, কথা বলে না। দিনরাত একনাগাড়ে মদ খেয়ে যাচ্ছে।

ইলেকশনের সময় তাকে কেন সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে তা কি বোঝেনি ধ্রুব? ঠিকই বুঝেছিল। আর রেমি বুঝতে পারছিল মাত্র কয়েকদিনের শারীরিক প্রেম ধ্রুবর ফুরিয়ে গেছে। শরীর আর কতদিন শরীরের বাঁধনে বাঁধা থাকতে পারে। যেখানে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে যৌনতাই প্রধান সেখানে সম্পর্ক বাতাসের ভর সয় না।

বর্ধমানে ধ্রুব রেমিকে বলল, যাও না, প্ল্যাটফর্মের কল থেকে জলের বোতলটা ভরে আনো।

আমি?—রেমি অবাক হয়ে বলল, আমাকে জল আনতে বলছ?

কেন, তুমি আনলে কী হয়?

মেয়েরা কখনও এসব করে? যদি গাড়ি ছেড়ে দেয় আমি তো দৌড়ে এসে চলন্ত ট্রেনে উঠতেও পারব না।

চেষ্টা করলে সব পারা যায়। পারবে।

তুমি পারো গিয়ে। আমি তোমার মদ খাওয়ার জন্য জল আনতে পারব না।

তা হলে আমি বাথরুমের জলই মিশিয়ে খাব।

তা খেতে পারো।

খাব? তুমি আমাকে খেতে দেবে? জানো, গাড়ির জলে এক লক্ষ রকমের জীবাণু আছে?

তা আমি কী করব? তোমাকে তো আমি মদ খেতে বলিনি।

মাইরি, যাও না।

বলেছি তো পারব না।

ঠিক আছে, তা হলে আমিই নামছি। যদি গাড়িতে উঠতে না পারি তা হলে তুমি একাই দার্জিলিং যেয়ো।

এই বলে ধ্রুব নিজেই উঠল এবং জলের বোতল নিয়ে নেমে গেল। সেটা গ্রীষ্মকাল। প্ল্যাটফর্মের কলে দারুণ ভিড়। রেমি দেখল, ধ্রুব সেই ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি করে ঢুকে পড়ল। কিন্তু তারপর আর তাকে দেখা যাচ্ছিল না।

জল নিয়ে যাত্রীরা হুড়হুড়ি করে ফিরে আসছে। কল প্রায় কাঁকা হয়ে গেল। কিন্তু ধ্রুবকে আর দেখতে পেল না রেমি। গার্ডের হুইশিল বাজল। একসময়ে গাড়ি নড়ে উঠল।

কিন্তু ধ্রুব?

আতঙ্কে জানালা দিয়ে রেমি তারস্বরে চেঁচাতে লাগল, এই তুমি কোথায়? ওগো, তুমি এসো শিগগির! গাড়ি ছেড়ে দিল যে!

কিন্তু কোথায় ধ্রুব? বর্ধমান প্ল্যাটফর্ম ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে পিছন দিকে।

মরিয়া রেমি গাড়ির অ্যালার্ম চেন ধরে ঝুলে পড়ল। গাড়ি থামতেই সে নেমে পড়ল আগুন-গরম প্ল্যাটফর্মে। তারপর ছুটতে লাগল পিছন দিকে।

ধ্রুবকে অবশ্য পাওয়া গেল সহজেই।

খুব নিবিষ্টমনে হুইলারের দোকানে দাঁড়িয়ে একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছিল। রেমি গিয়ে তার হাত ধরতেই সে একটুও লজ্জিত না হয়ে একটা হাই তুলে বলল, প্রেমের চেয়ে তা হলে সিকিউরিটিই বড়! কী বলে?

Category: দূরবীন - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
পূর্ববর্তী:
« ০০৭. ভাই হেমকান্ত
পরবর্তী:
০০৯. সন্ধের কুয়াশামাখা অন্ধকার »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑