০৩. মফিজুদ্দিন গ্রামে ফিরে আসার পর

মফিজুদ্দিন গ্রামে ফিরে আসার পর গ্রামের লোকেরা যখন তা জানতে পারে, কিশোর এবং যুবকেরা তার কুঁড়েঘরের দরজায় এসে জড়ো হয় এবং তাকে মেঝেতে পাতা খড়ের ওপর আচ্ছনের মতো পড়ে থাকতে দেখে, তারা তখন তাকে নূতন হাটের বিষয়টি সম্পর্কে বলে, এবং তখন তার নয়নতারা এবং চন্দ্রভানের কথা মনে পড়ে। মফিজুদ্দিন তখন তিন দিন পর মেঝের খড়ের ওপর উঠে বসে এবং তার সবচাইতে প্রিয় বন্ধু করিম খাঁকে কুঁড়েঘরের ভেতর ডেকে এনে তার সম্মুখে নিজের নিতম্ব উন্মোচন করে জানতে চায়, সেখানে কি লেখা আছে। তখন করিম খাঁ হয়তো প্রথমে একটু হতভম্ব হয়ে পড়ে, তারপর পাটখড়ির বেড়ার ফাঁক দিয়ে আসা আলোয় মফিজুদ্দিনের নিতম্ব রেখে সে দেখে যে, তার কোমরের একটু নিচে, ডান দিকের নিতম্বে পাশাপাশি স্থাপিত তিনটি কালো জুড়ল। আকালুর কুঁড়েঘরের বাইরে দাঁড়ানো ছেলেদের যারা তখন ঘরের ভেতর উঁকি দেয়, তারা দেখে যে, ঘরের পূর্ব দিকের বেড়ার কাছে একটা চিকন আলোর রেখার সামনে মফিজুদ্দিন হাঁটু এবং হাতের ওপর উপুড় হয়ে লুঙ্গি তুলে নিতম্ব উন্মোচিত করে রেখেছে এবং এই নগ্ন পাছার খুব নিকটে মুখ নিয়ে করিম খ স্তম্ভিত হয়ে আছে। মফিজুদ্দিনের নিতম্বের জড়লগুলোর দিকে তাকিয়ে করিম খার মনে হয়েছিল যে, এগুলো আসলে জন্মদাগ; তখন মফিজুদ্দিন যখন তার নিতম্বের লিখন সম্পর্কে পুনরায় জানতে চায়, সে বলে যে, তার নিতম্বের ওপর একশ এগারো লেখা আছে। এরপর মফিজুদ্দিন ঘর থেকে বের হয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায় এবং সমাগত যুবকদের বলে যে, ফাল্গুন মাসের শেষ বৃহস্পতিবার তারা সুহাসিনীর হাট বসাবে এবং এই ছেলেরা ক্যানেস্তারা টিন নিয়ে চতুর্দিকের গ্রামে ছড়িয়ে যাওয়ার পর সে করিম খাঁকে বলে যে, সে চন্দ্রভানকে বিয়ে করতে চায়। তারপর যেদিন সুহাসিনীতে হাট বসে মফিজুদ্দিন এই হাটের নামকরণ করে নয়নতারার হাট এবং জনতার ভিড়ের ভেতর দিয়ে পার হয়ে, সেই বিকেলে একা আলি আসগর মিয়ার প্রাঙ্গণে গিয়ে দাঁড়ায়। সে সময় আলি আসগর মিয়া তার বৈঠকখানার সামনের বারান্দায় একটি চেয়ারে বসে গরগরা হুঁকোয় তামাক সেবন করছিল, তখন সে চেক লুঙ্গির ওপর হাতাকাটা জামা গায়ে মফিজুদ্দিনকে তার বাড়ির ভিটায় উঠে আসতে দেখে; তার সামনে এসে দাঁড়ানোর পর মফিজুদ্দিন চুপ করে অপেক্ষা করে এবং আলি আসগর মিয়া হাতে ধরা নলের প্রান্তটা কিছুক্ষণের জন্য মুখে তুলতে ভুলে যায়; তারপর সে দ্রুত আত্মস্থ হয় এবং হুকোয় একটা হালকা টান দিয়ে বলে, ভিতরে আসো, এবং বাইরে হুকো রেখে মফিজুদ্দিনকে নিয়ে সে বৈঠকখানার ভেতর প্রবেশ করে। গ্রামের লোকেরা বলে যে, বারান্দায় বসে হুঁকো টানতে ভুলে যাওয়ার সময়টিতেই আলি আসগর মিয়া তার নূতন ফন্দি আঁটে এবং বৈঠকখানার ভেতর ঢুকে চুপ করে থাকা মফিজুদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বলে যে, মফিজুদ্দিনের সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে সে দেবে, তবে সে জন্য মফিজুদ্দিনকে এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু মফিজুদ্দিন তার প্রস্তাবে রাজি হয় না, সে বলে যে, সেদিন বিকেলেই সে চন্দ্রভানকে বিয়ে করবে, আর এক দিনও সে অপেক্ষা করবে না, এবং আলি আসগর মিয়া যদি এতে সম্মত না হয়, তাহলে সে তার বন্ধু সেই জিনটাকে ব্যবহার করবে। গ্রামের লোকেরা বলে যে, তখন, আলি আসগর মিয়ার সামনে আর কোনো পথ খোলা থাকে না, সে অবস্থাটা বুঝতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত তা মেনে নেয়। আলি আসগর মিয়ার সিদ্ধান্তের কথা শোনার পর মফিজুদ্দিন তার বুড়ো বাপ এবং বন্ধুদের নিকট ফিরে যায় এবং তখন, সেই বিকেলেই আকালুর ছেলে মফিজুদ্দিনের সঙ্গে চন্দ্রভানের বিয়ের কথা শুনে মিয়াবাড়ির অন্দর মহলে কান্নার রোল পড়ে। আলি আসগর মিয়ার স্ত্রী তাদের একমাত্র সন্তানকে এভাবে পানিতে ভাসিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে চায় না, কিন্তু আলি আসগর মিয়া কোনো কথা না শুনলে সে কাঁদতে থাকে এবং চন্দ্রভান গিয়ে ঘরের দরজা দেয়। সেদিন সন্ধের পর মফিজুদ্দিন যখন তার বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে মিয়াবাড়িতে এসে হাজির হয় তখন দরজা ভেঙে চন্দ্রভানকে বার করা হয়, তারপর বৈঠখানার চৌকির ওপর পুরনো শাড়িপরা, কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলা চন্দ্রভানের বিয়ে পড়ানো হয়। জুম্মঘরের ইমাম সাহেব বিয়ে পড়ানোর পর যখন মফিজুদ্দিনকে কবুল করতে বলে, সে অদ্রুিত তা করে, তারপর একটা পর্দার আড়ালে বসা চন্দ্রভানকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় যে, আকালুর ছেলে মফিজুদ্দিনের বিয়ের প্রস্তাবে সে রাজি কি না, তখন ময়লা শাড়ি জড়ানো চন্দ্রভানের ক্ষীণ দেহটি কেঁপে ওঠে, বসে থাকা অবস্থায় তার দেহটি ভাঁজ হয়ে আসে এবং গুমগুম করে তার আকুল কান্নার শব্দ শোনা যায়। তখন পর্দার এ পাশে বৈঠকখানায় জড়ো হওয়া যুবকেরা হর্ষধ্বনি করে বলে ওঠে, কবুল কইরছে। সে রাতে আলি আসগর মিয়ার বাড়ির দক্ষিণদুয়ারি ঘরে মফিজুদ্দিনের বাসর হয়; রাতে খাওয়ার পর তার বন্ধুরা ফিরে গেলে সে সেই ঘরে প্রবেশ করে হারিকেনের আলোতে উঁচু খাটের ওপর এক কোণায় সেই পুরনো শাড়িপরা চন্দ্রভানকে বসে থাকতে দেখে, তখন মফিজুদ্দিন দরজায় খিল দেয়া মাত্র চন্দ্রভান চাপা আর্তনাদ করে ওঠে এবং মফিজুদ্দিন খাটের কাছে এগিয়ে এলে সে ফোঁপাতে থাকে; সে সময় সেই ক্রন্দনরত নারীর দিকে তাকিয়ে মফিজুদ্দিনের নয়নতারার কথা মনে পড়ে এবং তখন সে তার দুপায়ের মাঝখানে প্রস্তরের মতো শীতল এক অস্তিত্ব টের পায়। তখন মফিজুদ্দিন খাটের এক পাশে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে এবং চন্দ্রভান তার দিকে তাকিয়ে ক্রমাগতভাবে নিচু স্বরে কাঁদে, তারপর অনেক রাতে কান্না থামিয়ে চন্দ্রভান ঘুমিয়ে পড়লে মফিজুদ্দিন গড়িয়ে গড়িয়ে তার গায়ের কাছে এগিয়ে যায় এবং তখন সে সেই গন্ধ পায়, যে গন্ধ সে কিছুদিন আগে রৌহার বিলের পাড়ে চন্দ্রভানের পরিত্যক্ত কাপড়ে পেয়েছিল। মফিজুদ্দিন তার বাসররাত নবপরিণীতা স্ত্রীর দেহের সৌরভ শুকে কাটাতে থাকে, সে তার ঊরুর ফাকে হাত দিয়ে অনুভব করে এবং নৌকোর উপরকার নারীর মতো করে উচ্চারণ করে, একদম বরফ! মফিজুদ্দিন তখন উঠে গিয়ে এক টুকরো কাপড় খোজে, কিন্তু সেই ঘরে কোনো কাপড় না পেয়ে সে নিজের পরনের লুঙ্গি খুলে ভাঁজ করে হারিকেনের মাথার ওপর ধরে গরম করে এবং এই গরম কাপড় দিয়ে তার জননেন্দ্রিয়ে সেক দেয়। পরদিন সকালে দরজায় করাঘাতের শব্দে চন্দ্রভানের ঘুম ভেঙে গেলে সে দেখে যে, খাটের ওপর নগ্ন মফিজুদ্দিন পড়ে আছে, পায়ের কাছে চার কোণী করে ভাজ। করা রয়েছে তার লুঙ্গি; এই অবস্থায় উপায়ন্তর না দেখে সে পুনরায় চোখ বুজে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে, যতক্ষণ না মফিজুদ্দিন উঠে তার লুঙ্গি পরে নেয়। নগ্ন হয়ে শুয়ে থাকলেও চন্দ্রভান বুঝতে পারে যে, মফিজুদ্দিন তাকে রাতে ঘটায় নাই এবং দ্বিতীয় রাতে মফিজুদ্দিন দরজায় খিল দিলে সে পুনরায় কান্না শুরু না করে খাটের এক কোণায় গুটিশুটি হয়ে পড়ে থাকে। পরদিন সকালে সে পুনরায় দেখে যে, মফিজুদ্দিন তাকে এদিন রাতেও ঘটায় নাই, আগের দিনের মতোই সে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে এবং তার চারকোণা করে ভাজ করা লুঙ্গি মেঝের ওপর ফেলে রাখা। চন্দ্রভান বিষয়টা ভালোমতো বুঝতে পারে না, কিন্তু তৃতীয় রাতের পর সে যখন মফিজুদ্দিনকে একই অবস্থভায় দেখে, এবং দেখে যে, সে তাকে কোনোভাবেই ঘটায় নাই, তখন বড় রহস্যজনক কারণে তার মন খারাপ হয়ে যায় এবং সারা দিন তার মুখ কালো হয়ে থাকে। চতুর্থ রাতেই কেবল চন্দ্রভান বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারে, যখন খাটের ওপর এক কোণায় পড়ে থাকার সময় তার ঘুম আসে না এবং সে মফিজুদ্দিনকে খাট থেকে উঠে গিয়ে হারিকেনের তাপে লুঙ্গি গরম করে সেক দিতে দেখে বিস্মিত চন্দ্রভান এ কাজের অর্থ বুঝতে পারে না, খাট থেকে নেমে মফিজুদ্দিনের সামনে সে যখন দাঁড়ায়, মফিজুদ্দিন শুকনো কণ্ঠে বলে, ভয় পায় জুইমা গেছে; তখন চন্দ্রভান মফিজুদ্দিনের কাজটা নিজের হাতে তুলে নেয়, ঘরের মেঝেতে নিচু টুলের ওপর বসা মফিজুদ্দিনের সামনে সে হাঁটু গেড়ে বসে এবং জ্বলন্ত হারিকেনের ওপর পরনের শাড়ির আঁচল গরম করে স্বামীর বীজভাণ্ডার সেক দিয়ে উত্তপ্ত করে তোলে, এবং পরিণতিতে সেদিন শেষ রাতে সে গর্ভবতী হয়। সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, বিয়ের চতুর্থ রাতে চন্দ্রভান গর্ভধারণ করে এবং তার দুদিন পর গভীর রাতে মফিজুদ্দিনের ঘুম ভেঙে গেলে সে দেখে যে, তার বিছানায় নববধূ এবং অন্তঃসত্ত্বা চন্দ্রভান নাই, ঘরের দরজার কপাট হা-করে খোলা। মফিজুদ্দিন এক মুহূর্তের জন্য ভয় পায়, তারপর সে ব্যাপারটা বুঝতে পারে, এবং তা বুঝতে পারার পর তার অন্য এক ধরনের অনিশ্চিত আতঙ্ক হয়; সে বুঝতে পারে যে, তার চালাকির দিন শেষ হয়ে গেছে, চালাকি করে আলি আসগর মিয়ার মেয়েকে বিয়ে করা গেলেও তাকে সে ঘরে রাখতে পারে নাই। মফিজুদ্দিন সেই ব্রতে, তখন, ঘর থেকে বের হয়ে উঠোনে নামে এবং দেখে যে, ভেতরের প্রাঙ্গণের বেড়ার দরজা খোলা; সে বাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে রৌহার বিলের দিকে রওয়ানা হয়। রৌহার বিলের কাছে মফিজুদ্দিন যখন পৌঁছোয়, চন্দ্রভান তখন পাড়ের ওপর কাপড়-চোপড় ছেড়ে পানিতে নেমে গেছে; তখন মফিজুদ্দিন আগের সেই পুরনো জায়গাটিতে গিয়ে বসে এবং তার সম্মুখে তার বিবসনা স্ত্রী অন্ধকার কালো পানিতে ডুব দেয়া শেষ করে উঠে আসে। ফেরার পথে মফিজুদ্দিন, লঘু এবং দ্রুত পায়ে অগ্রসরমাণ তার নিদ্রিতা স্ত্রীর পেছন পেছন আসতে থাকে, ফলে একটু পরেই সেদিন তার আর এক বিপত্তি ঘটে, চন্দ্রভান দ্রুত বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে উঠোনের গেট লাগিয়ে দিলে মফিজুদ্দিন বাইরে পড়ে যায়, তারপর সে বেড়ার এক কোণার বাঁধন খুলে ভেতরে প্রবেশ করে কিন্তু চন্দ্রভান ততক্ষণে ঘরের দরজা লাগিয়ে স্বাভাবিক ন্দ্রিায় ফিরে গেছে। তখন ঘরে ঢুকতে পারার কোনো উপায় না দেখে মফিজুদ্দিন অবশিষ্ট রাত গোয়ালঘরের পাশে খড়ের গাদার ওপর শুয়ে কাটায় এবং সকালবেলা বাড়ির চাকরেরা যখন খড়ের গাদার ভেতর নূতন জামাইকে শুয়ে থকতে দেখে, তখন মিয়াবাড়িতে এই কথা নিয়ে কানাঘুষা শুরু হয় যে, তুলোর তোশকে শুয়ে মফিজুদ্দিনের চার পাঁচ দিন চোখে ঘুম আসে নাই, অবশেষে সে নূতন বৌ ঘরে ফেলে গোয়ালঘরে গিয়ে ঘুমের তৃষ্ণা মেটায়। সেদিন সকালে চন্দ্রভান যখন দরজা খুলে বের হয় সে খেয়াল করে না যে, মফিজুদ্দিন ঘরে নাই, তারপর সে যখন শোনে যে, মফিজুদ্দিন রাতে গোয়ালঘরের পাশে খড়ের গাদার ভেতর ঘুমিয়ে ছিল তখন তার মনে হয় যে, সকালে ঘরের দরজা আসলে হয়তো ভোলাই ছিল এবং সে যখন শোনে যে, তুলার তোশকে ওতে তার কষ্ট হচ্ছিল তখন সে তার চাকরকে ডেকে নিয়ে গিয়ে তোশক তুলে ফেলে দেয় এবং খাটের ওপর পুরু করে খড় পেতে তার ওপর কাঁথা বিছিয়ে শয্যা রচনা করে মফিজুদ্দিনের খোঁজে বের হয়। কিন্তু মফিজুদ্দিনকে তখন মিয়াবাড়িতে দেখতে পাওয়া যায় না, চন্দ্রভানের খড়ের শয্যা রচনাবিষয়ক কর্মকাণ্ড শুরু হওয়ার আগেই মফিজুদ্দিন চান্দাইকোনা রওনা হয়ে যায়। চান্দাইকোনা বাজারের উত্তর প্রান্তে ইয়াকুব আলি মৌলবির বাড়িতে গিয়ে মফিজুদ্দিন, মৌলবি সাহেবকে বাড়িতে পায় এবং সে তাকে তার দুর্গতির কথা খুলে বলে। মৌলবি ইয়াকুব আলি সবকিছু শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর বলে যে, মফিজুদ্দিনের স্ত্রীর আচরণের ব্যাখ্যা করা খুবই মুশকিল, হয়তো খুবই দুষ্ট কোনো জিন আসর করেছে এবং এই জিনই তাকে ঘর থেকে বার করে নিয়ে যায়। ইয়াকুব মৌলবি তখন মফিজুদ্দিনকে তার বৈঠকখানায় অপেক্ষা করিয়ে রেখে বাড়ির ভেতরে যায় এবং কিছুক্ষণ পর একটি নূতন মাটির হাঁড়িতে করে, দোয়া পড়ে ফু দেয়া পানি নিয়ে আসে এবং মফিজুদ্দিনকে বলে, প্রত্যেক দিন রাইতে শুইতে যাওয়ার আগে তোমার বৌয়ের গায়ে ছিটায়া দিব্যা। মফিজুদ্দিন এই পড়া-পানির জন্য ইয়াকুব আলি মৌলবিকে দুআনা পয়সা দেয়, তখন সে বলে যে, মফিজুদ্দিন যদি একই সঙ্গে তাদের বাড়িটা বন্ধ করে নেয়, তাহলে আরো ভালো হয়। মফিজুদ্দিন তার এ প্রস্তাবে সম্মত হয় এবং ইয়াকুব মৌলবি তখন তার কাছ থেকে আরো দুআনা নিয়ে পুনরায় বাড়ির ভেতর যায় এবং চারটে মন্ত্রপূত গজাল নিয়ে আসে। ইয়াকুব মৌলবি গজালগুলো মফিজুদ্দিনকে দেয় এবং বলে দেয় এগুলো সে কিভাবে ব্যবহার করবে; মফিজুদ্দিন কলার পাতায় মুখ ঢাকা মাটির হাঁড়িতে করে পড়া-পানি এবং জামার পকেটে কালো রঙের রটে ভারি লোহার গজাল নিয়ে সকালের সূর্য বেশি দূর ওঠার আগেই সুহাসিনীতে ফিরে আসে। গ্রামের লোকেরা এই সব বিষয়ে কিছু কিছু কথা জানতে পারে, তবে তারা বুঝতে পারে না যে, তারা যা শুনেছে তা সত্যি না মিথ্যা; তারা এসবের সত্যতা যাচাই করতে পারে না, কারণ, এইসব ঘটনার মূল ব্যক্তিবর্গ মফিজুদ্দিন চন্দ্রভান এবং আলি আসগর মিয়া, তাদের কাউকে তারা এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে পারে না, কেউ কেউ সাহস এবং কায়দা করে জিজ্ঞেস করলেও তারা কোনো নির্দিষ্ট উত্তর দেয় না। গ্রামের লোকেরা এই বিষয়টি জানতে পারে যে, মফিজুদ্দিন তার বিয়ের পর চতুর্থ রাতে চন্দ্রভানের কৌমার্যের পর্দা খোলে, ষষ্ঠ রাতে তুলোর তোশকের আরাম ত্যাগ করে গিয়ে গোয়ালঘরের পাশে খড়ের গাদায় ঘুমায় এবং সপ্তম দিন রাতে বাড়ির ভিটার চার কোণায় দোয়া পড়া গজাল পুঁতে দিয়ে বাড়ি বন্ধ করে, তারপর ঘরে এসে শোয়ার সময় মাটির একটি নূতন হাঁড়ির ভেতর থেকে পানি নিয়ে তার গর্ভবতী স্ত্রী চন্দ্রভানের মাথায় এবং শরীরে ছিটিয়ে দেয়। গ্রামের লোকেরা বলে যে, গজাল পুঁতে দিয়ে এবং দশ দিন, রাতে চন্দ্রভানের গায়ে পানি ছিটানোর পর মফিজুদ্দিন নিশ্চিত বোধ করে, যদিও তা খুবই ক্ষণস্থায়ী হয়। এক মাসের মতো কেটে যাওয়ার পর একদিন সে দেখে যে, তার খড়ের বিছানায় চন্দ্রভান নাই এবং সেদিন তখন সে উঠে গিয়ে পুনরায় রৌহার কালো শীতল পানিতে চন্দ্রভানকে দেখে। পরদিন মফিজুদ্দিন পুনরায় চান্দাইকোনায় ইয়াকুব আলি মৌলবির বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়, ইয়াকুব আলি মৌলবি মফিজুদ্দিনের নিকট থেকে সব শুনে পুনরায় নিশ্চিত হয় যে, খুবই দুষ্ট জিনের পাল্লায় পড়েছে মফিজুদ্দিনের স্ত্রী এবং সে পুনরায় দুআনা পয়সা নিয়ে তাকে আর-এক হাঁড়ি পানি দেয়, কিন্তু এবার সে বাজার থেকে মফিজুদ্দিনকে একটি তালা কিনে নিয়ে যাওয়ার উপদেশ দিয়ে বলে, রাইতের বেলা কপাটে তালা দিয়্যা রাইখো। মফিজুদ্দিন ধানঘড়া বাজার থেকে তালা এবং দরজার ভেতর দিকে লাগনোর জন্য এক জোড়া কড়া কিনে আনে এবং সুহাসিনীর লোকেরা এই কথা জানতে পারে যে, মফিজুদ্দিন তুলোর আরামের বিছানা ছেড়ে খড়ের বিছানায় সুন্দরী চন্দ্রভানকে নিয়ে শোয় আর কেউ যাতে খিল খুলে ঘরে ঢুকতে না পারে সে জন্য রাতে শুতে যাওয়ার আগে ঘরের ভেতর থেকে কড়ায় তালা লাগিয়ে রাখে। ঘরের দরজায় ভেতর থেকে তালা লাগিয়ে এবং খড়ের বিছানায় শুয়ে মফিজুদ্দিনের পুনরায় ভালো ঘুম হতে থাকে; কিন্তু গ্রামের লোকেরা বলে যে, সে পুনরায় তার অশান্তি খুঁজে বার করে, কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর একদিন তার মনে হয় যে, চন্দ্রভান যদি এই জিনের কবল থেকে মুক্ত হয়ে ভালো হয়ে যায় তাহলে সে কিভাবে তা বুঝবে? এবং এরপর থেকে মফিজুদ্দিনের ঘুম কমে যেতে থাকে, সে বুঝতে পারে যে, ঘুমের ভেতরও সে সজাগ হয়ে আছে এবং লক্ষ রাখছে চন্দ্রভান উঠে তালা দেয়া দরজার কাছের যায় কি না তার দিকে। এই আধো ঘুম আধো জাগরণের দিনগুলোতে সে দেখে যে, তালা লাগানো শুরু করার পর চন্দ্রভান দুদিন বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করে এবং তা করতে না পেরে পুনরায় বিছানায় ফিরে এসে শোয়। কিন্তু এই পাহারাদারি করতে গিয়ে মফিজুদ্দিনের শরীর ভেঙে পড়ে, বিয়ের পরের কিছু দিনে তার চেহারায় যে ঔজ্জ্বল্য ফুটে উঠেছিল তা নিদ্রাহীনতার কারণে দ্রুত নেমে যায় এবং ম্লান হয়ে ওঠে, তার চোখের কোণে কালি পড়ে এবং তাকে দেখা যায় দিনের বেলায় ঝিমোতে; তার শারীরিক অবস্থার এই অবনতিতে গ্রামের যুবকেরা শঙ্কিত হয় এবং চন্দ্রভান লজ্জা ও ভয়ে মুষড়ে পড়ে। তখন একদিন বিকেলে মফিজুদ্দিন অস্থির হয়ে তৃতীয় বারের মতো চান্দাইকোনায় ইয়াকুব মৌলবির কাছে ছুটে যায় এবং পুনরায় সব খুলে বলে। মফিজুদ্দিনের এই অসাধারণ ব্যক্তিগত সমস্যার যে সমাধান সেদিন ইয়াকুব আলি মৌলবি উদ্ভাবন করে, বহুদিন পর সুহাসিনীর লোকেরা তা ক্রমাম্বয়ে জানতে পেরে চমকৃত বোধ করে; মফিজুদ্দিনের সমস্যার কথা শুনে সে অনেকক্ষণ ধরে ভাবে এবং একসময় উঠে বাড়ির ভেতর গিয়ে একটি কাচের বোতলে কালচে বাদামি রঙের কিছু একটা নিয়ে ফিরে আসে এবং মফিজুদ্দিনকে বলে, এ্যার ভিতর তিসির ত্যাল আছে; তারপর সে মফিজুদ্দিনকে কিছু প্রামর্শ দেয় এবং বোতল আর তেলের জন্য এক আনা পয়সা নিয়ে, আল্লা মাবুদ রহম করো, বলে উঠে ভেতরে চলে যায়। সেদিন রাতে মফিজুদ্দিন ভেতর থেকে দরজার কপাটে তালা লাগানোর পর তার স্ত্রীকে যা বলে তা হচ্ছে এই যে, চন্দ্রভান কোনো অবস্থাতেই এই তালার গায়ে হাত দেবে না, সে যদি সকালে মফিজুদ্দিনের আগে ঘুম থেকে ওঠে, তাহলে সে নিজে তালা না খুলে মফিজুদ্দিনকে ডেকে তুলবে; এবং তখন চন্দ্রভান মফিজুদ্দিনের কথায় চিন্তাভাবনা না করেই সম্মত হয় এ কারণে যে, সে জানে সে কখনোই মফিজুদ্দিনের আগে ঘুম থেকে উঠবে না। এরপর থেকে গ্রামের লোকেরা মফিজুদ্দিনের উদ্ভট দাম্পত্য অচিরণের সর্বশেষ বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারে, এবং তারা দেখে যে, মফিজুদ্দিনের চেহারায় রঙ ফিরে আসে, চোখের কোণের কালি মুছে যায়। সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, মিয়াবাড়ির চাকরেরা তাদেরকে এইসব কথা বলে; তারা তাদেরকে বলে যে, কোনো কোনো সকালে মফিজুদ্দিনের শোবার ঘরের জানালার কপাট খোলা থাকলে এবং সেই খোলা জানালা দিয়ে তারা ভেতরে তাকালে কখনো কখনো তারা এমন এক দৃশ্য দেখতে পায়, যা দেখে তাদের যুগপৎ বিস্ময় জাগে এবং হাসি পায়। কোনো কোনো সকালবেলা খোলা জানালা দিয়ে তারা দেখতে পায় যে, খাটের ওপর খড়ের বিছানায় নিদ্রিতা চন্দ্রাভান একটি ছিন্নলতার মতো পড়ে আছে এবং তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে আছে মফিজুদ্দিন, তার করতলের ভেতর চন্দ্রভানের কর এবং সে অনেকক্ষণ ধরে বারবার নিচু হয়ে নিদ্রিতা চন্দ্রভানের এই কর শোকে। চন্দ্রভানের সঙ্গে মফিজুদ্দিনের এই আচরণে মিয়াবাড়ির চাকরেরা এবং তাদের কাছ থেকে এই গল্প শুনে গ্রামের লোকেরা রোমাঞ্চিত বোধ করে, তাদের মনের ভেতর অনেক প্রশ্ন জমা হয়, কিন্তু এইসব গোপন দাম্পত্য ক্রিয়ার বিষয়ে তাদের গোপন প্রশ্নের উত্তরের জন্য বহু বছর অপেক্ষা করতে হয়। মফিজুদ্দিন প্রতিদিন সকালে দ্রিামগ্ন স্ত্রীর দুহাতের তালু কুকুরের মতো ওঁকে দরজার তালা খুলে বাইরে বের হয় এবং বাড়ির পেছনের জঙ্গল থেকে নিশিন্দার ডাল ভেঙে মেছওয়াক করতে করতে সেইসব চাকর এবং গ্রামবাসীর সম্মুখ দিয়ে পুকুরের দিকে যায়, যারা তার এই অতিবিস্ময়কর আচরণের ব্যাখ্যাটি বোঝার জন্য তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু কিছু বুঝতে পারে না। এভাবে মফিজুদ্দিনের, চন্দ্রভানের হাত শোঁকার বিষয়টি যখন গ্রামের প্রায় প্রতিটি লোকের জানা হয়ে যায় তখন একদিন চন্দ্রভান একটি পুত্রসন্তান প্রসব করে এবং মফিজুদ্দিন তার প্রথম ছেলের নাম রাখে আব্দুল গফুর। আব্দুল গফুর পৌষের এক সকালে জন্ম নেয় এবং এর প্রায় এক বছর পর মিয়াবাড়ির চাকরেরা মফিজুদ্দিনের আচরণের বদল হতে দেখে এবং এবারও এই পরিবর্তনের কারণ তারা বুঝতে পারে না; তারা একদিন একে অন্যের নিকট থেকে জানতে পারে যে, মফিজুদ্দিন মিয়া তার শোবার ঘরের দরজা ভেতর থেকে তালা লাগিয়ে রাখার নিয়ম ত্যাগ করেছে, এবং সকালবেলায় তাদের ভেতরকার সাহসী চাকরেরা, যারা জানালা দিয়ে নজর ভেতরে রেখে গরুর জাবনা বানায় তারা মফিজুদ্দিনকে হাঁটু গেড়ে বসে ঘুমন্ত স্ত্রীর হাত শুকতে দেখে না। গ্রামের লোকেরা একসময় এই খবরটি জানতে পারে এবং তাদের মনে স্বাভাবিকভাবে অনেক প্রশ্ন দেখা দেয় এবং তাদের এই সব প্রশ্নের উত্তরের জন্যও তাদেরকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়। বহুদিন পর সুহাসিনীর লোকেরা, যারা তাদের শৈশবে মফিজুদ্দিনের এইসব কাণ্ডের কথা শুনেছিল, তারা এর ব্যাখ্যা এবং চন্দ্রভানের জীবনের এক রহস্যের কথা জানতে পারে। ভাদ্র মাসের বিপর্যয়কর পূর্ণিমা রাতের কিছুদিন আগে, একদিন খুব সকালে সুহাসিনীর কিছু লোক, যারা মিয়াবাড়ির পেছন দিকে ঘাটের কাছে খালে নৌকো নিয়ে যায়, তারা এই ঘাটের কাছে পানি ছুঁয়ে একটি নগ্ন নারীদেহ পড়ে থাকতে দেখে। উপুড় হয়ে পড়ে থাকা দেহটির লম্বা চুল দেখে তারা বুঝতে পারে যে, এটা একটি নারীর দেহ; কিন্তু নিতম্ব, পিঠ এবং ঊরু দেখে তারা বুঝতে পারে না, এই নারী দেহটি যুবতী, না বৃদ্ধার। এই ঘটনার পর গ্রামের লোকেরা চন্দ্রভানের পুরনো আচরণগত রহস্যের কথা জানতে পারে, তারা জানতে পারে যে, খালের ঘাটের কাছে যে নারীদেহটি পড়ে ছিল সেটা ছিল আসলে চন্দ্রভান; সেদিন সে মনে নাই, পানির কিনারায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল কেবল, এবং বহুদিন পরে সেদিন রাতে বৃদ্ধ মফিজুদ্দিন মিয়া তার কাঁঠাল কাঠের সিন্দুকের ভেতর থেকে একটি জং ধরা তালা এবং একটি পুরনো কাচের বোতল বের করে। মফিজুদ্দিন সেদিন তার ছেলেদের সামনে তাদের মা এবং এই তালা ও তিসির তেলের বোতলের রহস্য সম্পর্কে সকল কথা বলে এবং তখন, ষাট বছর পর, সুহাসিনীর প্রবীণেরা জানতে পারে যে, বিয়ের পর মফিজুদ্দিন নূতন বৌকে নিয়ে ঘরের ভেতর থেকে তালা দিয়ে শুতে, কারণ, তার বৌ চন্দ্রভানের নিশির ডাকে ঘর ত্যাগ করার অভ্যাস ছিল, এবং পরবর্তী সময়ে মিয়াবাড়ির চাকরেরা তাকে সকালবেলা ঘুমন্ত স্ত্রীর হাত নাকের ওপর চেপে ধরে বসে থাকতে দেখে। সুহাসিনীর লোকেরা তখন বহুদিন পূর্বে মফিজুদ্দিনের বিস্ময়কর আচরণের কারণ সম্পর্কে জানতে পারে, তারা জানতে পারে যে, মফিজুদ্দিন রাতের বেলা ঘরের ভেতর থেকে তালা লাগিয়ে দেয়ার পর, চান্দাইকোনার ইয়াকুব মৌলবির পরামর্শ অনুযায়ী এই তালায়, তিসির তেল মাখিয়ে দিত এবং সকালে চন্দ্রভানের হাত কে সে বুঝতে পারত, চন্দ্রভান রাতে উঠেছিল কি না; যেদিন সকালে চন্দ্রভানের হাতে তেলের গন্ধ পাওয়া যেত, মফিজুদ্দিন বুঝতে পারত যে, চন্দ্রভান দরজা খুলে বাইরে বেরোনোর চেষ্টা করেছিল এবং এভাবে মফিজুদ্দিন নিজের ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে তার স্ত্রীর গোপন সমস্যাটির প্রকৃতির ওপর নজর রাখতে পেরেছিল। আব্দুল গফুরের জন্মের ছয় মাস পর চন্দ্রভানের আবার গর্ভ হয় এবং এই সময় মফিজুদ্দিন সকালবেলা চন্দ্রভানের হাতের ঘ্রাণ নিয়ে ক্রমাগতভাবে তিসির তেলের বিশেষ গন্ধ পেতে ব্যর্থ হয় এবং পরবর্তী আট মাস চন্দ্রভানের হাতে এই গন্ধের অনুপস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে মফিজুদ্দিন রাতের বেলা ঘরের দরজায় তালা লাগানো ত্যাগ করে। মফিজুদ্দিন যেদিন চন্দ্রভানকে মুক্ত করে দিয়ে তালা এবং তিসির তেলের বোতল দূরে সরিয়ে রাখে তার তিন দিন পর, নির্দিষ্ট সময়ের আগেই চন্দ্রভান পুনরায় আরএকটি পুত্রসন্তান প্রসব করে এবং মফিজুদ্দিন তার এই ছেলের নাম রাখে, নূরুল হক। পরবর্তী আঠারো বছরে চন্দ্রভান নিয়মিতভাবে গর্ভবতী হয় এবং জন্ম হয় আরো দশটি ছেলের, মফিজুদ্দিন এদের নাম রাখে মোহাম্মদ জমিরউদ্দিন, আব্দুল খালেক, আব্দুল কাদের, মোহসিন আলি, দেলোয়ার হোসেন, শাহজাহান আলি, ফরিদ হোসেন, আব্দুল আজিজ, নাসিরউদ্দিন এবং আবুবকর সিদ্দিক। আবুবকর সিদ্দিকের যখন জন্ম হয় তখন মফিজুদ্দিনের বয়স সঁইত্রিশ এবং চন্দ্রভানের চৌত্রিশ। মফিজুদ্দিনের প্রথম ও দ্বিতীয় ছেলে আব্দুল গফুর ও নরুল হক, ষষ্ঠ, মোহসিন আলি এবং সপ্তম দেলোয়ার হোসেন তাদের শৈশবে অথবা যৌবনের প্রথমে মারা যায়। ফরিদ হোসেন প্রথম ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে তিনবার ফেল করে পরীক্ষায় পাস করার প্রচেষ্টা ত্যাগ করে, যদিও সুহাসিনীর লোকেরা এই কথা বলে যে, ফরিদ হোসেন অসীম সাহস নিয়ে ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাসের চেষ্টা করার পর ব্যর্থতার কারণে একসময় সরে পড়লেও বস্তুত তার সঙ্গে সুহাসিনীর মিয়াবাড়িতে বিদ্যাচর্চা দানা বেঁধে ওঠে, এবং গ্রামবাসীদের কেউ কেউ হয়তো এ কথা বলে যে, মফিজুদ্দিন মিয়ার অল্প বয়সের শুক্রাণুর চাইতে অধিক বয়সেরগুলো বেশি সক্ষম এবং সারবান ছিল। গ্রামের লোকেরা এই ব্যাপারটি বুঝে উঠতে পারে না যে, মফিজুদ্দিন তাদের কথা শুনতে পেয়েছিল কি না; তারা বলে যে, মফিজুদ্দিন হয়তোবা শুনেছিল অথবা শোনেনি, হয়তোবা সে নিজেই সেই সত্যটি বুঝতে পেরেছিল, যে সত্যটি গ্রামের লোকেরা বহুদিন থেকে ভেবেছিল, এবং তখন সুহাসিনীর লোকেরা জানতে পারে যে, মফিজুদ্দিনের বাড়িতে একই সঙ্গে দুই নারী গর্ভের বোঝা বয়ে বেড়ায়, এদের একজন মফিজুদ্দিনের নয় নম্বর ছেলে ফরিদ হোসেনের স্ত্রী এবং অপরজন হচ্ছে বৃদ্ধা চন্দ্রভান। মফিজুদ্দিনের সর্বশেষ ছেলে আবুবকর সিদ্দিকের জন্মের প্রায় ঊনত্রিশ বছর পর চন্দ্রভান আর-একটি পুত্রসন্তান প্রসব করে, তখন মফিজুদ্দিন তার এই ছেলের নাম রাখে রফিকুল ইসলাম এবং তখন কোনো একদিন চুল কাটার সময় সুহাসিনীর নাপিত তোরাপ আলি বৃদ্ধ মফিজুদ্দিন মিয়ার হাতের রেখার দিকে তাকিয়ে থাকলে মফিজুদ্দিন তাকে বলে যে, তার হাতের রেখা বেয়ে যা ঝরে পড়ে তা হচ্ছে জীবন। সেদিন এর পরও হয়তো তোরাপের চেহারায় কোনো এক ধরনের সংশয় দেখা গিয়েছিল এবং তার এই চেহারা দেখে অথবা কষ্ঠের বিভ্রান্ত স্বর শুনে, মফিজুদ্দিন এই নরসুন্দরের অবিশ্বাস এবং সংশয় অপনোদনের কথা ভাবে এবং সেই ভরদুপুরবেলা বিস্মিত তোরাপ আলির চোখের সামনে লুঙ্গি খুলে কোমরের একাংশ উন্মোচিত করে বলে যে, তার কোমরের এইখানে জন্ম থেকে লেখা হয়ে আছে যে, সে এক শ এগারো বছর বাঁচবে এবং এই এক শ এগারো বছর সে জীবনের আবাদ করে যাবে; কিন্তু তার পরেও হয়তো তোরাপ আলি তার কথা বুঝতে পারে নাই। সুহাসিনীর লোকেরা মফিজুদ্দিন মিয়ার প্রজননের সক্ষমতা সম্পর্কে অবগত ছিল, যদিও জীবনের আবাদ করে যাওয়া সম্পর্কিত মফিজুদ্দিন এবং তোরাপ আলির আলাপের বিষয়ে তারা জানতে পারে বহু বছর পর, মহির সরকারের উঠোনে বসে তোরাপ যেদিন এক পূর্ণিমার বর্ণনা দেয়। তবে মিয়াবাড়ির গাছতলায় চুল কাটার সময় মফিজুদ্দিনের কথার অর্থ তোরাপ আলি না বুঝতে পারলেও এবং সুহাসিনীর লোকেরা এই আলাপের কথা না শুনতে পেলেও মফিজুদ্দিনের সরাসরি জীবনের আবাদ রফিকুল ইসলামের জন্মের পর বন্ধ হয়ে যায়। রফিকুল ইসলামের জনের দুমাস পর ফরিদ হোসেনের স্ত্রী জরিনা সন্তান প্রসবের জন্য তার বাপের বাড়ি সিরাজগঞ্জ শহরে যায় এবং গ্রামের লোকেরা জানতে পারে যে, জরিনার একটি কন্যাসন্তান জন্মানোর খবর পাওয়ার পর তাদেরকে নিয়ে আসার জন্য কোলের ছোট বাচ্চা ফেলে সিরাজগঞ্জ যাওয়ার জন্য চন্দ্রভান অস্থির হয়ে পড়ে। মিয়াবাড়ির চাকরদের কাছ থেকে গ্রামের লোকেরা সব শোনে, তারা জানতে পারে যে, চন্দ্রভান বিনা কারণে, শুধুমাত্র জরিনা এবং তার মেয়েকে নিয়ে আসার জন্য শহরে যায় নাই; সে কোনোভাবে একটি বিষয় জানতে পেরেছিল, হয়তো মফস্বল শহরের মেয়ে জরিনাই তাকে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করেছিল, এবং চন্দ্রভান রফিকুল ইসলামের জন্মের পরেই হয়তো সিদ্ধান্তটা নেয় এবং তার পরিকল্পনা কার্যকর করে। গ্রামের লোকেরা জানতে পারে যে, জরিনার মেয়ের জন্মের খবর শুনে চন্দ্রভান সিরাজগঞ্জ গিয়ে সেখানে সাত দিন থেকে ছেলে বৌ এবং নাতনিকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসে, মফিজুদ্দিন স্ত্রীর এই অহেতুক শহরে যাওয়ার ঘটনায় বিরক্ত হলেও নবজাত মেয়েটির মুখ দেখার পর তার মন নরম হয়। কিন্তু চন্দ্রভানের ফিরে আসার পর সেদিন রাতে অথবা তার পরের রাতে অথবা অন্য কোনো এক রাতে মফিজুদ্দিনের বৃদ্ধ এবং অসাড় হয়ে আসা হাতের আঙুল চন্দ্রভানের নাভি থেকে নিম্নমুখী বয়ে গিয়ে দুই কুঁচকির সামান্য ওপরে তলপেটে দুটো ক্ষতচিহ্ন অনুভব করে, এবং কেবল মাত্র তখন মফিজুদ্দিন তার সিরাজগঞ্জ যাওয়ার আসল কারণ জানতে পারে; চন্দ্রভান মফিজুদ্দিনকে তার লজ্জা এবং বিদ্রোহের কথা বলে, সে তাকে বলে যে, সিরাজগঞ্জ শহরের হাসপাতালে গিয়ে সে তার ডিম্বনালি ছেদন করিয়েছে; মফিজুদ্দিনের বিভ্রান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলে, আমি লাইগেশন করাইছি। তখন প্রায় চল্লিশ বছর পর মফিজুদ্দিনের হাতের আঙুল তার পরিচিত নারীর স্পর্শের ভেতরও কুঁকড়ে আসে এবং তার পুনরায় যমুনার বুকে গণিকা নারী নয়নতারার কথা মনে পড়ে এবং সে অনুভব করে যে, চন্দ্রভান নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে সেকে যে ভাণ্ডার উষ্ণ এবং সক্ষম করে তুলেছিল এতদিন পর তার কোমরের নিচে দুপায়ের মাঝখানে তা শীতল এবং জমাট বেঁধে আসে। মফিজুদ্দিনের বিপর্যস্ত অস্তিত্বে তখন নয়নতারার কথার ধ্বনি অনুরণিত হয়, যমুনার বুকে তার দুই উরুর মাঝখানে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে সে বলেছিল, একদম ঠাণ্ডা বরফ!

যমুনার বুকের এই নারীটির কথা জীবনের প্রায় প্রতিটি বাঁকেই মফিজুদ্দিনের মনে পড়ে। সুহাসিনীর হাট যেদিন প্রথম বসে সেদিন সুহাসিনীর লোকেরা এই নামটি শুনতে পায় এবং দেখতে পায়, এই নাম উচ্চারণের সময় কি অসাধারণ পরিমাণ আবেগ মফিজুদ্দিনকে তাড়িত করে। সুহাসিনীর হাট প্রথম বসার দিন মফিজুদ্দিন যখন বলে যে, এই হাটের নাম হবে নয়নতারার হাট, তখন সুহাসিনীর লোকেরা বুঝতে পারে না, এই নামটি কার নাম এবং তখন মফিজুদ্দিন বলে যে, নয়নতারা একজন বেশ্যার নাম, নয়নতারা দেবীদের মতো একজন দেবীর নাম। সেদিন সে বলে, এই রহম ম্যায় মানুষ আর দেখি নাই, আর দেখমুও না; সে এমন এক মায়ামানুষ আছিল যে মায়ের নাহাল, বৌ আর বিটির নাহাল; এই হাটের নাম হবি নয়তারার হাট, এরপর মফিজুদ্দিন তার গলার স্বর নামিয়ে নেয় অথবা আবেগের তাড়নায় তা নিজে নিজেই নেমে আসে এবং সে বলে নয়নতারার নাহাল ম্যায়ামানুষ জীবনে দেহি নাই, নয়নতারা আমার মুর্শিদের নাম; সে হিন্দু আছিল, না মুসলমান আছিল, আমি জানি না, কিন্তু সে আমাক কইছিল, ভয় পায়ো না ভগমানের নাম নেও; সে আমাক কইছিল, ভয় পায়ো না আল্লা নবির নাম নেও। সুহাসিনীর হাট যেদিন প্রথম বসে সেদিন কড়ই গাছের বিস্তৃত শাখার নিচে মফিজুদ্দিনকে ঘিরে দাঁড়ানো গ্রামের লোকদের তার কথা শুনে একধরনের বিভ্রান্তি হয়, কারণ, সে এত কথা বলার পরেও তারা নয়নতারার বিষয়টি বুঝে উঠতে পারে না; তবে তারা তখন এই অনুমান করতে পারে যে, আর-একটি নারী মফিজুদ্দিনের জীবনে বড় হয়ে উঠেছে এবং পরবর্তী সময়ে তারা এ বিষয়ে পরিপূর্ণরূপে জানতে পারে। যমুনার বুকে নৌকোর ওপর হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বধ্যভূমি এবং সময়ের দিকে ভেসে যাওয়ার সময় এক কামুকী নারী বিষণ্ণ চোখে তার মুখের দিকে তাকায় এবং ভাতের নলা মুখের কাছে তুলে ধরে বলে, খাও। মফিজুদ্দিন আতঙ্ক এবং বিভ্রান্তির চাপে যখন গোঙায় এবং মুখের ভেতর খুঁজে দেয়া ভাত গিলতে পারে না, তখন এই নারী তাকে বলে, তুমি কি মুসলমান? ভয় পায়ো না, আল্লার নাম নেও; তুমি কি হিন্দু? ভয় পায়ো না, ভগবানের নাম নেও। তখন মফিজুদ্দিন তার কথার কিছুই বুঝতে না পেরে তার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলে সে তার বাম বাহুটি মফিজুদ্দিনের কাঁধের ওপর রাখে, তার চোখ পুনরায় চিকচিক করে এবং সে পুনরায় বলে, ভয় নাই; এরপর তাকে ছৈয়ের নিচে টেনে নিয়ে সেই নারী মফিজুদ্দিনের বরফের মতো যৌনাঙ্গ আবিষ্কার করে এবং উলঙ্গ ও কাত হয়ে পড়ে থাকা মফিজুদ্দিনের দেহ জড়িয়ে ধরে ছৈয়ের নিচে শুয়ে থাকে। এই সময় অথবা এর আগেই অন্য কোনো এক সময়ে এই নারী হয়তো একটি সিদ্ধান্ত নেয়, এবং এই বিষয়টি সম্পর্কে পরবর্তী সময়ে মফিজুদ্দিন বড় বিভ্রান্ত বোধ করে; তার অনেক সময় মনে হয় যে, নৌকোর ওপর এই নারীর সে সময়কার আচরণের পেছনে কোনো পরিকল্পনা ছিল না; সে যা করেছিল, তা সে কোনো কিছু না বুঝেই করেছিল; কিন্তু একই সঙ্গে তার মনে হয় যে, কোনো কারণ ছাড়া এ রকম আচরণ করার মানে কি? সে যে আচরণ করেছিল, কোনো নির্দিষ্ট কারণ বা উদ্দেশ্য ছাড়া তা করার কোনো দরকারই তার ছিল না। সেদিন ছৈয়ের নিচে মফিজুদ্দিনকে জড়িয়ে ধরে দীর্ঘক্ষণ শুয়ে থাকার পর মেয়েটি মাথা উঁচু করে বাইরে তাকায় এবং ছৈয়ের মুখের উপরে বসা হালাকুর দুপা ঝুলে থাকতে দেখে; তখন সে ঘষটে ঘষটে একটু এগিয়ে এক হাত বাড়িয়ে হালাকুর ঝুলে থাকা পা ধরে এবং অন্য হাতে তার পায়ের তালু জোরে চুলকে দেয়। পায়ের তলায় সুড়সুড়ির ফলে হালাকুর গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, সে লাফ দিয়ে নৌকোর পাটাতনের ওপর নেমে আসে এবং ছৈয়ের মুখের কাছে উবু হয়ে উঁকি দিয়ে দেখে যে, মফিজুদ্দিনের নগ্ন উরুর ফঁাকে নিজের শাড়ি আবৃত পা তুলে দিয়ে তাদের ভাড়া করে আনা মেয়েটি ছৈয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে; হালাকুকে তাকাতে দেখে সে হাসে এবং বলে, এইটা একটা খাসি, ভিতরে আইসা ধইরা দেখো, বিচি নাই! হালাকুর তখন পুনরায় রতি বাসনা জাগরিত হয়, সে মফিজুদ্দিনকে টেনে পুনরায় সামনের গলুইয়ের কাছে পাটাতনের ওপর নিয়ে আসে। তারপর হালাকু তার পরনের লুঙ্গি খুলে নগ্ন হয়ে লুঙ্গিটা ছৈয়ের এক দিকের মুখে পর্দার মতো ঝুলিয়ে দেয়, অন্য প্রান্তের মুখে বাঁধে মেয়েটার কালো এবং ময়লা সায়া, এবং তখন একটু পর নৌকোর সেই বিস্ময়কর দুলুনি শুরু হয়। নৌকোর কাঁপুনি যখন থামে তখন ঘর্মাক্ত এবং ক্লান্ত মেয়েটি তার ওপর চেপে পড়ে থাকা পুরুষটির দিকে নজর দেয় এবং পরবর্তী সময়ে মফিজুদ্দিনের যেমন মনে হয়, বিষয়টিকে একটি খেলায় পরিণত করে; মেয়েটি তার ওপরে পড়ে থাকা রতিক্লান্ত খুনির কানে কানে বলে যে, সে বধ্য লোকটি বা ছেলেটির সঙ্গে একটি বার সহবাস করতে চায়; এবং যতক্ষণ বা যতদিন মফিজুদ্দিন সে কাজের যোগ্য হয়ে না ওঠে ততদিন তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সে প্রস্তাব করে। হালাকু এবং জোবেদ কদিন পর কোনো বালুচরে মফিজুদ্দিনকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল তা বোঝা যায় না, তারা গণিকা নারীটির প্রস্তাব গ্রহণ করে কি না তাও বোঝা যায় না, তাদের নৌকো শুধু ক্রমাগত ভেসে যেতে থাকে। গণিকা মেয়েটি তখন তার ছলকালার রঙধনু মেলে ধরে; সে হালাকু এবং জোবেদকে বলে যে, তার বয়স যখন আরো কম ছিল তখন সে একবার কোলকাতায় ছিল, তখন সেখানে সে কিছু লেখাপড়া শেখে এবং বাৎসায়নের বই পড়ে; কামসূত্রের নাম শুইনছ? সে তাদেরকে জিজ্ঞেস করে। তার কথা শুনে হালাকু যখন হাঁ করে থাকে, নষ্ট মেয়েটির উচ্ছ্বসিত স্বলিত হাসি পানির শব্দের পাশাপাশি যমুনার বুকের ওপর দিয়ে বয়ে যায়; হালাকুর ফাঁকা নির্বোধ চাউনির দিকে তাকিয়ে সে বলে যে, সে চৌষট্টি কলা জানে এবং এ বিষয়ে হালাকু এবং জোবেদের মূর্খতার কথা বলে তাদেরকে বিভ্রান্ত এবং লোভী করে তোলে; তোমরা এই মজার কিছু জান না, সে বলে, বাৎসায়ন এই কামের নেইগা আশিটা আসনের কথা লেইখ্যা গেছে; এবং তারপর বলে যে, সে তাদেরকে এ সবই শেখাবে যদি তারা অপেক্ষা করে এবং কেবলমাত্র একবার মফিজুদ্দিনকে তার অভ্যন্তরে গ্রহণ করতে দেয়। এই প্রস্তাবে হালাকু এবং জোবেদ সম্মত হয় কি না তা বোঝা যায় না, তবে তারা নৌকোর মুখ ঘোরায় না; নৌকো ভেসে যেতে থাকে, বাইরে খোলা আকাশের নিচে রোদের ভেতর হাত-পা পিছমোড়া করে বাঁধা অবস্থায় পড়ে থাকে মফিজুদ্দিন, নৌকোর ছৈয়ের মুখে টাঙানো লুঙ্গির পর্দার ফাঁক দিয়ে হালাকু ও জোবেদ আধ ঘণ্টা পরপর ছৈয়ের ভেতরে যাওয়াআসা করতে থাকে, এবং সারা দিন, প্রায় সন্ধে পর্যন্ত, নৌকো একটানা দোল খায়। সেদিন সন্ধের সময় তারা পদ্মা এবং যমুনার মিলনস্থলের কাছে পৌঁছায়, এখানে এক গ্রামের কাছে নৌকো ভিড়িয়ে জোবেদ নেমে গিয়ে চাল, ডাল ও দেশলাই কিনে আনে এবং তারপর নৌকে পুনরায় ভাটির দিকে বয়ে চলে। সারা দিনের পরিশ্রমে হালাকু ও জোবেদ ইতোমধ্যেই ক্লান্ত হয়ে ছিল, রাতে ভাত খাওয়ার পর মেয়েটি যখন বলে যে, এবার তারা যোড়শতম আসনের চর্চা করবে, হালাকু তাকে নৌকোর পাটাতনের ওপর চিৎ করে পেড়ে ধরে। সে রাতে তারা কে কখন ঘুমায় তারা কেউ বলতে পারে না, তবে সকালে উঠে সূর্যের আলো দেখে তারা বুঝতে পারে যে, তারা পদ্মার বুকের ওপর আছে, নৌকো সোজাসুজি দক্ষিণ দিকে নেমে না গিয়ে যাচ্ছে, একটু দক্ষিণ মুখে কাত হয়ে, পূর্ব দিকে। তখন জোবেদ হাল ধরে বসে, হালাকু পাটাতনের ওপর সকালের রোদের ভেতর কিছুক্ষণ মরার মতো চিৎ হয়ে পড়ে থাকে এবং তখন ছৈয়ের তলায় গণিকা নারীটি জেগে ওঠে; সে হাই তুলে চোখ কচলে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছৈয়ের মুখের কাছে হালাকুকে পড়ে থাকতে দেখে এবং তার মাথায় প্রবৃত্তি অথবা পরিকল্পনা তৎক্ষণাৎ জেগে ওঠে, সে হাত বাড়িয়ে হালাকুর পায়ের তলায় জোরে খামচে দেয়। হালাকু এই রহস্যময়ী নারীর পরিকল্পনার বিষয়টি সম্পর্কে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বুঝতে পারে নাই, সে জানতেও পারে না যে, মধুর পাত্রে আটকে যাওয়া মাছির মতো সে এক মোহন ফাঁদে ধরা পড়েছে; গণিকাটি তার পায়ের তলায় খামচে দিলে তার ঘুমের ঘোর কেটে গিয়ে শরীর জেগে ওঠে, সে পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে আগের দিনের মতো ছৈয়ের পেছনের গলুইয়ের মুখে নিজের পরনের লুঙ্গি খুলে টাঙিয়ে দিয়ে ছৈয়ের নিচে ঝাপিয়ে পড়ে এবং নৌকো ঝঞায় পতিত হওয়ার মতো ঝকানি খায়। সেদিন সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত হালাকু ও জোবেদ প্রত্যেকে চব্বিশ বার নৌকোর ছৈয়ের তলায় প্রবেশ করে, এবং সন্ধের সময় সূর্য ডুবে যাওয়ার পর হালাকু পঞ্চবিংশতিতম বারের অভিজ্ঞতা অর্জন করে যখন বের হয়ে আসে, জোবেদ আর ভেতরে ঢুকতে চায় না। সে রাতে জোবেদ আর ছৈয়ের নিচে যায় না, হাল ধরে বসে থাকে; কিন্তু পরদিন সকালে সে হালাকুর আগেই এই ক্রিয়ায় যোগ দেয়। পরদিন সকালে সূর্য মাথার ওপর যখন অনেকটা উঠে আসে তখন হালাকুর ঘুম ভাঙে এবং চেতন হওয়ার পর চোখ না খুলেই সে নৌকোর ঢুলুনি টের পায় এবং ছৈয়ের তলায় তার শরীরের পাশ ঘেষে চূড়ান্ত সঙ্গমে লিপ্ত দুটো দেহের নিশ্বাসের চাপা বিস্ফোরণের শব্দ শোনে। হালাকু চোখ বুজে পড়ে থাকে, তারপর জোবেদ মেয়েটির ওপর থেকে নেমে গেলে সে চোখ না খুলেই কাত হয়ে এই ক্লান্ত নগ্ন নারীকে জড়িয়ে ধরে এবং নৌকোর দুলুনি অব্যাহত থাকে। এই লাগাতার রমণ চক্রের ভেতর পড়ে মনে হয় যেন খুনি দুজন এবং গণিকা খাওয়া-দাওয়া এবং বাইরে দিনের রোদ এবং রাতের ঠাণ্ডার ভেতর পড়ে থাকা মফিজুদ্দিনের কথা ভুলে যায়; সেদিন সন্ধে পর্যন্ত হালাকু তিন দিনে তার চল্লিশতম বারের সঙ্গম সমাপ্ত করে, শেষ বার যখন তার নির্গত হয়ে যায় সে নগ্ন নারীর দেহের ওপর নিজের অবশ হয়ে আসা দেহ ফেলে পড়ে থাকে, নেমে আসতে পারে না। সে রাতে মেয়েটি প্রথমবারের মতো ভাত রান্না করার দায়িত্ব নেয়, ভাত রাঁধার পর জোবেদ আর সে খায় এবং সানকিতে করে নিয়ে গিয়ে মফিজুদ্দিনকে খাওয়ায় এবং পুনরায় বলে, ভয় পায়ো না; হালাকু কেবল অভুক্ত অবস্থায় অঘোর নিদ্রায় ডুবে থাকে। পুরো পরিস্থিতিটা চতুর্থ দিনে মনে হয় যেন পরিপক্ক হয়ে ওঠে এবং গণিকা নারীটি যেন কিছু একটা ঘটানোর জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়, অথবা, মফিজুদ্দিনের পরবর্তী কালে যেমন বহুবার মনে হয় যে, এই মেয়েটি তার জাল পাতা এবং তাতে খুনি দুজনের ধরা পড়ার পর তখন সেই জাল ক্রমান্বয়ে গুটিয়ে আনতে থাকে; এবং দীর্ঘ পরিশ্রম ও কৌশলের পর চতুর্থ দিন মনে হয় যেন তার গোপন ষড়যন্ত্রের বৃক্ষে ফুল ফুটে ওঠে এবং শীঘ্রই তাতে ফল ধরে। সেদিন সকালে লগি টেনে তুলে যখন নৌকো ছাড়া হয়, হালাকু ও জোবেদ এত দুর্বল বোধ করে যে, তারা কেউ হালের বৈঠা ধরে বসতে পারে না, নৌকো কাণ্ডারিহীন অবস্থায় স্রোতের টানে ভেসে যায়; কিন্তু সিরাজগঞ্জ শহরের বাৎসায়ন পড়া গণিকার হাত থেকে তারা রেহাই পায় না, তারা পেছনের গলুয়ে হালের কাছে পাটানের ওপর পড়ে থাকে এবং একের পর এক হামাগুড়ি দিয়ে নৌকোর ছৈয়ের মুখে ঝুলিয়ে দেয়া শাড়ি সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে এবং নৌকো ক্রমাগতভাবে নেচে চলে। এভাবে সময় যখন পার হতে থাকে অথবা সময়ের গতি যখন একটি আবর্তের ভেতর পড়ে রহিত হয় এবং রতিক্রিয়ার একটি দীর্ঘ শৃঙ্খলে দুজন পুরুষ ও একটি নারী আটকা পড়ে যায়, সেদিন দুপুরের পর সবল জোয়ান এবং নিষ্ঠুর খুনি হালাকু তার পঞ্চান্নতম প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হতে থাকে, তার চোখে দ্রিার ঘোর নেমে আসে এবং তার দেহ যখন অতিক্লান্ত ঘোড়ার মতো দুই উরুর মাঝখান থেকে ক্ষরণ সম্ভব করে আনে, তখন তার মস্তিষ্কের ভেতরও ক্ষরণ ঘটে এবং তার চেতনা লুপ্ত হয়; হালাকু তার জীবনের শেষ বীর্যপাতের কথা জানতে পারে না। হালাকু যখন মেয়েটির নগ্ন দেহের ওপর দীর্ঘক্ষণ পড়ে থাকে, সরে না, সে তাকে ধাক্কা দিয়ে দেহের ওপর থেকে নামিয়ে দিয়ে বাইরে বের হয়ে আসে এবং তখন জোবেদ ছৈয়ের বাইরে বিকেল পর্যন্ত মেয়েটিকে নিয়ে থাকে। তখন মেয়েটি জোবেদকে বলে যে, তার বন্ধু হালাকু খুব দুর্বল পুরুষ ছিল, সে তার কাজ শেষ করার আগেই মারা গেছে, এখন তাই কামসূত্রের অবশিষ্ট আসনগুলো সম্পর্কে জানার দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে; কারণ, সে-ই হালাকুর চাইতে সমর্থ পুরুষ। হালাকুর মৃত্যুর খবরে জোবেদ প্রথমে ভয় পায়, কিন্তু তার পরেও গণনা এগিয়ে যায়, পঞ্চান্ন, ছাপ্পান্ন, সাতান্ন করে; আটান্নতম বারে জোবেদের গাত্রোত্থানের শক্তি রহিত হয় এবং তখন সে, তাকে চিৎ করে নিচে ফেলে তার দেহের ওপর নগ্ন ক্লান্ত গণিকাটিকে ঘোড়সওয়ারের মতো চেপে থাকতে দেখে। পদ্মা নদীর বুকে সে এক অসাধারণ খেলা ছিল এবং এই খেলার চরম পরিণতিতে মফিজুদ্দিনের জীবন রক্ষা হলেও এর জন্য গণিকা নারীটিকে চরম মূল্য দিতে হয়; নদীর বুকে কোনো এক অজানা জায়গায় খোলা আকাশের নিচে এক উলঙ্গ এবং ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা চেহারার নারীকে জোবেদ যখন তার দেহের ওপর চেপে মুখের কাছে নত হয়ে আসতে দেখে, তখন প্রবল অবসাদ এবং ক্লান্তির ভেতরও সে সম্ভবত তার মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, নৌকোর সামনের পাটাতনের ওপর পড়ে থাকা মফিজুদ্দিন প্রথমে কিছুই বুঝতে পারে নাই, তবে একসময় সে এই বিষয়টি বুঝতে পারে যে, নৌকোর চার দিনের ক্রমাগত ঢুলুনি থেমে গেছে; এবং তখন সন্ধ্যার আলো অনেক্ষণ ধরে ধীরে ধীরে মরে আসার পর রাত নামে। মফিজুদ্দিন সেদিন সারা রাত অভুক্ত পড়ে থাকে, গণিকা মেয়েটি তার কাছে ভাত নিয়ে আসে না, নৌকোয় কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না; কিন্তু তার পরেও মফিজুদ্দিনের বড় কোনো ধরনের সন্দেহ হয় না। সকালে পেটে প্রচণ্ড খিদে নিয়ে মফিজুদ্দিন জেগে ওঠার পর সূর্য ক্রমান্বয়ে মাথার ওপর উঠে আসতে থাকে, কিন্তু নৌকোয় কোনো নড়াচড়ার আভাস পাওয়া যায় না; তখন মফিজুদ্দিনের মনে একধরনের অস্পষ্ট সন্দেহ অথবা কৌতূহল হয়, সে কাত হয়ে থেকেই ঘষটে ঘষটে নৌকোর ছৈয়ের কাছে এসে পর্দার মতো ঝোলানো কালো পেটিকোট ঘাড় উঁচু করে মুখ দিয়ে কামড়ে নামায় এবং দেখে যে, হালাকু উপুড় হয়ে পড়ে আছে, তার কাত হয়ে থাকা মাথার কানের কাছ থেকে কালো রঙের শুকিয়ে যাওয়া রক্তের ধারা গাল বেয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে; ছৈয়ের নিচে হালাকু ছাড়া অন্য কাউকে সে দেখে না, এবং ছৈয়ের অন্য প্রান্তে কাপড় ঝোলানো থাকায় ছৈয়ের বাইরে পেছনের গলুইয়ের সম্মুখের পাটাতন সে দেখতে পায় না, তবে মফিজুদ্দিন এই অবিশ্বাস্য রকমের সত্যটি বুঝতে পারে যে, এই নৌকোয় সে ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো জীবিত প্রাণী নাই। এই অবস্থায় তার আতঙ্কের ঘোর দ্রুত অপসৃত হতে থাকে, সে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে; সে প্রথমে তার পায়ের বাঁধন খোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে, নৌকোর সঙ্গে বেঁধে রাখা দড়ি, পিছমোড়া করে বাঁধা হাত দিয়ে ছুঁয়ে অনুভব করে খোলে। নৌকোর পাটাতন থেকে মুক্ত হয়ে সে গড়িয়ে ছৈয়ের নিচে আসে এবং পাটাতনের এক পাশে মৃত হালাকুর বল্লমটা পড়ে থাকতে দেখে, তখন বল্লমের ফলার সঙ্গে ঘষে ঘষে সে তার হাতের দড়ি কাটে এবং তারপর পায়ের বাধন খুলে ফেলে। উপুড় হয়ে পড়ে থাকা নগ্ন মৃত খুনির পাশে বন্ধনমুক্ত হওয়ার পর মফিজুদ্দিন উঠে বসে উঁচু হতে গেলে ছৈয়ের সঙ্গে তার মাথা ঠেকে যায়, সে তখন উবু হয়ে ছৈয়ের খোলা মুখ দিয়ে পুনরায় বাইরে বের হয়ে আসে এবং হাতে বল্লমটা তুলে নেয়। সুহাসিনীর লোকেরা এই সব ঘটনা বিস্তারিতভাবে জানতে পারে; তারা বলে যে, সেদিন তখন মফিজুদ্দিন নিশ্চিতরূপে অনুভব করেছিল যে, নৌকোয় আর কেউ বেঁচে নেই, তবুও সে বল্লমটার তেল দিয়ে মাজা পাকা বাঁশের হাতল শক্ত মুঠোয় নিয়ে নৌকোর ছৈয়ের ওপর চড়ে অন্য প্রান্তে আসে এবং ছৈয়ের ওপর দাঁড়িয়ে থেকেই সেই দৃশ্যটি দেখে এবং তার অন্তর গণিকা মেয়েটির জন্য শঙ্কায় পূর্ণ হয়ে ওঠে; সে দেখতে পায় যে, নগ্ন এবং চিৎ হয়ে পড়ে থাকা জোবেদের দেহের ওপর নগ্ন গণিকার স্তব্ধ দেহ উপুড় হয়ে পড়ে আছে। এই বিষয়টি সম্পর্কে মফিজুদ্দিন পরবর্তী সময়ে একটি সিদ্ধান্তে আসে, সে বুঝতে পারে যে, জীবনের প্রান্তে পৌঁছে দুই নম্বর খুনি, জোবেদ, হয়তো বুঝতে পেরেছিল যে, নদীর ওপর ভাসমান এই নারী অথবা কুহকিনীর হাত থেকে তার রেহাই পাওয়ার কোনো উপায় নাই; তখন সে নিজের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটিকেও হত্যা করে। নৌকোর ছৈয়ের ওপর থেকে নিচে নেমে এসে মফিজুদ্দিন যখন চিৎ হয়ে পড়ে থকা জোবেদের দেহের ওপর থেকে নগ্ন গণিকাকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করে, সে দেখে যে, মেয়েটির কণ্ঠনালি জোবেদের চেপে বসা দুপাটি দাঁতের শক্ত কামড়ের ভেতর আটকা পড়ে আছে। হালাকু টের পায় নাই, কিন্তু জোবেদ হয়তো টের পেয়েছিল যে, তার জীবনের সেই সময়টি এসে গেছে, হয়তো তার অতিক্লান্ত শরীর তাকে এই সংকেতটি দিয়েছিল, এবং তখন, ভয় ও এক ধরনের ঘুম ঘুম ঘোরের ভেতর যখন নগ্ন নারী মূর্তিটিকে তার ওপর চেপে বসে তার মুখের দিকে নত হয়ে আসতে দেখে, সে অপেক্ষায় থাকে এবং নারী-মুখটি তার মুখের কাছ দিয়ে কাঁধের ওপর স্থাপিত হলে সে নিজের মুখটা অল্প ঘুরিয়ে, মেয়েটির লম্বা করে রাখা কণ্ঠনালির ওপর তার দাঁতের পাটি একটি সাঁড়াশির হা-এর মতো স্থাপন করে, মেয়েটি কিছু বুঝে ওঠার আগেই, কামড় দিয়ে ধরে। জোবেদের মস্তিষ্কে হয়তো তখনই একটি শিরা ছিঁড়ে গিয়ে লাল জবার মতো একটি ফুল বিকশিত হয়, কারণ, মফিজুদ্দিন দেখে যে, জোবেদের কানের পাশ দিয়েও চিকন সুতোর মতো রক্তের শুকনো ধারা নিচের দিকে নেমে গেছে; তবে গণিকা মেয়েটির মৃত্যু সম্পর্কে মফিজুদ্দিনের বিভ্রান্তি চিরদিনের জন্য থেকে যায়, সে বুঝে উঠতে পারে না যে, মেয়েটি দাঁতের সাঁড়াশিতে কণ্ঠনালি আটকে দম বন্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল, নাকি মারা গিয়েছিল গলা থেকে রক্তক্ষরণের কারণে সেদিন মফিজুদ্দিন যখন বুঝতে পারে যে, তার জীবন বেঁচে গেছে, সে তখন এই সঙ্গে বিস্ময়ের সকল ঘোরের ভেতর এই কথাটিও বুঝতে পারে যে, একটি পতিত মেয়ের দয়ায় তার এই বেঁচে থাকা; এই একটি বিষয় সে তার পরবর্তী জীবনে কখনো বিস্মৃত হয় নাই। সেদিন মফিজুদ্দিন পদ্মা নদীর ওপর এই গণিকা নারীর শেষকৃত্যের আয়োজন করে, সে তার কণ্ঠনালি মুক্ত করে শক্ত হয়ে আসা নগ্ন দেহ সরিয়ে সামনের পাটাতনের ওপর নিয়ে আসে, নদী থেকে পানি তুলে তাকে গোসল করায় এবং পাটাতনের ওপর শোয়ানো এই মৃত নগ্ন নারীর পায়ের কাছে বসে তার দুপায়ের পাতা নিজের দুই করতলের ভেতর কোনো এক পবিত্র সামগ্রীর মতো ধারণ করে বিড়বিড় করে, আল্লার নাম উচ্চারণ করতে করতে সেই মলিন পদযুগল চুম্বন করে; তখন, অপহৃত হওয়ার পর থেকে এতক্ষণ যে জিনিসটির দেখা পাওয়া যায় নাই, তার আবির্ভাব ঘটে, মফিজুদ্দিনের চোখ পানিতে পূর্ণ হয়ে ওঠে; সেদিন উন্মুক্ত আকাশের নিচে পদ্মার বিস্তৃত বুকের ওপর মরে শক্ত হয়ে যাওয়া এক দরিদ্র গণিকার চরণ মফিজুদ্দিনের চোখের পানিতে ভিজে যায়। তিনটি লাশ কাপড় দিয়ে জড়িয়ে নদীর পানিতে ফেলে দেয়ার পর মফিজুদ্দিন নৌকো কূলে নিয়ে এসে ভেড়ায় এবং নিকটবর্তী গ্রামে হেঁটে গিয়ে তার বিপর্যয়ের কথা খুলে বলে, এবং তখন এই গ্রামের লোকদের কাছ থেকে সে জানতে পারে যে, এটা হরিরামপুর থানার রাজখাড়া গ্রাম এবং এখান থেকে সিরাজগঞ্জ এবং সুহাসিনী অনেক দূর। এই গ্রামের লোকেরা মফিজুদ্দিনের থাকার ব্যবস্থা করে এবং দুদিন এখানে থাকার পর যখন একটু সুস্থ বোধ করে, তৃতীয় দিন খুব ভোরে গ্রাম ছেড়ে সে রওয়ানা হয়; তখন তার আশ্রয়দাতা কৃষক একটি পুরনো গামছায় তার জন্য চিড়া এবং গুড় বেঁধে দেয় এবং তার হাতে গুজে দেয় একটি রুপোর টাকা। এই গ্রাম ত্যাগ করার পর মফিজুদ্দিন কত পথ বা কতদিন ধরে হাঁটে তা সে হিসেব করতে পারে না, অথবা ভুলে যায়, তার শুধু কতগুলো গ্রামের কথা কিছুদিন মনে থাকে; রাজখাড়া গ্রাম থেকে লেছরাগঞ্জ, তারপর গোপীনাথপুর হয়ে বাল্লার ভেতর দিয়ে শিবালয়, সেখান থেকে যমুনা নদী পার হয়ে পুনরায় দীর্ঘ পথ হেঁটে সে সুহাসিনীতে এসে পৌঁছয় এবং তারপর সুহাসিনীর মানুষের চোখের সামনে মফিজদ্দি থেকে মফিজুদ্দিন মিয়া হয়ে ওঠে। এবং গ্রামে ফিরে আসার পর সে গ্রামের মানুষের কাছে এই ঘোষণা দেয় যে, সে এক শ এগারো বছর বাঁচবে, তাপর এক অপরিচিত নারীর নামে সুহাসিনীর নূতন হাটের নামকরণ করে এবং বিয়ে করে আলি আসগর মিয়ার নির্মল কুসুমের মতো কিশোরী মেয়ে, চন্দ্রভানকে।

আলি আসগর মিয়াকে যে জিনের ভয় দেখিয়ে মফিজুদ্দিন তার মেয়েকে বিয়ে করে সেই জিনকে পরিণতিতে সে কাবু করতে সক্ষম হয় না, চন্দ্রভানকে নিয়ে বাসরশয্যায় প্রবেশের চৌষট্টি বছর পর গ্রামের লোকেরা যেদিন মিয়াবাড়ির পেছনে খালের কিনারায় বৃদ্ধা চন্দ্রভানকে উলঙ্গ এবং সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে, এবং যেদিন মফিজুদ্দিন এসে পানি-কাদা মাখানো চন্দ্রভানের অজ্ঞান দেহটি ঘরে তুলে আনে, তখন তার কাছে পুরো বিষয়টির পরিহাসের দিকটি উন্মোচিত হয়। সে বুঝতে পারে যে, আলি আসগর মিয়া যে ফাঁদে পড়ে কাবু হয়েছিল এখন সে নিজে তাতে ধরা পড়েছে, তার শঙ্কা হয় এবং সে একই সঙ্গে বিভ্রান্ত বোধ করে; সে বুঝতে পারে না এটা আবার কেন ঘটাতে শুরু করে, এই জিনটা এই বিগত যৌবনা নারীর প্রতি পুনরায় কেন আগ্রহী হয়ে ওঠে! মফিজুদ্দিন সেদিন তার সন্তানদের ডেকে বাড়ির ভেতরের প্রাঙ্গণে বসে সমস্ত কথা খুলে বলে এবং সেদিন থেকে রাতের বেলা চন্দ্রভানের পুনরায় বন্দি জীবন যাপন শুরু হয়। এই সময় রফিকুল ইসলাম তার ভাই নাসিরউদ্দিনের কাছে একটি চিঠি লিখে বিষয়টি বর্ণনা করে এবং জানায় যে, তাদের মাকে এখন রাতের বেলা শোয়ার ঘরে ভেতর থেকে তালা বদ্ধ করে রাখা হয়। সুহাসিনীর লোকেরা এই সব বিষয় যখন জানতে পারে এবং তারা যখন এই সব নিয়ে কথা বলে, তারা তখন বলে যে, চন্দ্রভানের এই রহস্যময় আচরণের পুনরাবির্ভাব এবং এ বিষয়টি অবহিত করে রফিকুল ইসলামের লেখা পত্র, পরিবারের অন্যদের সঙ্গে ভাদ্র মাসের পূর্ণিমা রাতে মোল্লা নাসিরউদ্দিনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে দেয়। নাসিরউদ্দিন তখন নওগাঁয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিল, যখন সে একদিন তার ছোটো ভাই রফিকুল ইসলামের লেখা চিঠিটা পায় এবং নারীবর্জিত মোল্লা নাসিরউদ্দিনের হৃদয় মায়ের জন্য হাহাকার করে ওঠে; সে বুঝতে পারে যে, রাতের বেলা ঘুমের ভেতর ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়া এবং বিলের পানিতে ডুব দিয়ে আসা একটি রোগ এবং এর চিকিৎসা হওয়া প্রয়োজন। তখন নাসিরউদ্দিন দশ দিনের ছুটি নিয়ে সুহাসিনীতে এসে হাজির হয়, তাকে দেখে বৃদ্ধা চন্দ্রভান তার চিবুক টিপে দিয়ে বলে, আমার লায়েক ব্যাটা আইসা পইড়ছে; তখন চন্দ্রভানের এই কথা শুনে এবং আদর পেয়ে মোল্লা নাসিরুদ্দিনের বিষণ্ণ মুখ আরো বিষণ্ণ হয়ে ওঠে, কারণ, তখন তার হয়তো শৈশবের সেই সব ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়। সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, মফিজুদ্দিন মিয়ার এ রকম ইচ্ছে ছিল যে, তার ছেলেদের ভেতর একজনকে সে মাদ্রাসায় পড়াবে, যাতে করে একটি ছেলে পরিবারে ধর্মকর্ম চালু রাখতে পারে, এ জন্য নাসিরউদ্দিনকে সে শিশুকাল থেকে নির্বাচিত করে রাখে এবং সুহাসিনীর লোকদের এই কথাটি বিভিন্ন প্রসঙ্গে একাধিকবার অবহিত করে বলে, নাসিরউদ্দিনকে আমি আল্লাহর নামে মাদ্রাসায় দিমু; এবং গ্রামের লোকেরা এই কথা শুনে শুনে বিষয়টিতে এতটা অভ্যস্ত হয়ে ওঠে যে, নাসিরউদ্দিনকে তারা একসময় মোল্লা নাসিরউদ্দিন বলে সম্বোধন করতে থাকে। নাসিরউদ্দিন প্রথমে বিষয়টা বুঝে উঠতে পারে না, কিন্তু ক্রমান্বয়ে সে যখন বড় হয়ে উঠতে থাকে, মাদ্রাসায় পড়া, না-পড়ার বিষয়ে তার ব্যক্তিগত পছন্দ গড়ে ওঠে এবং সে এমন এক গোপন পরিকল্পনা করে যে, তাকে মাদ্রাসায় পড়ানোর তার পিতার ইচ্ছা পূর্ণ হয় না, যদিও তার নাম সারা জীবনের মতো মোল্লা নাসিরউদ্দিন হয়ে যায়। নাসিরউদ্দিনের বয়স যখন দশ বৎসর তখন গ্রামের আরো পাঁচটি ছেলের সঙ্গে তার খাড়া করানো হয় এবং এরপর মফিজুদ্দিন তাকে সিরাজগঞ্জ নিয়ে গিয়ে আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে জায়গির বাড় রেখে আসে, তিন মাস পর মাদ্রাসার ছুটিতে সে যখন গ্রামে ফেরে তখন গ্রামের লোকেরা তার কাজ-কারবার সম্পর্কে জানতে পারে। গ্রামের লোকেরা জানতে পারে যে, মাদ্রাসার ছুটিতে গ্রামে ফিরে আসার পর একদিন সকালে সে চন্দ্রভানের মুরগির খোয়াড় থেকে তিনটি বাচ্চা মোরগ ধরে সেগুলোর তলপেট কেটে কিছু একটা করতে উদ্যত হয়, তখন এই খবর শুনে চন্দ্রভান হা হা করে ছুটে আসে; নাসিরউদ্দিন তখন তার মাকে বিষয়টা খুলে বলে, এবং তাকে বাটা হলুদ এবং পান খাওয়ার চুন এবং সুই সুতো নিয়ে আসতে বলে। চন্দ্রভান একটি মাটির সরায় চুন ও হলুদ বাটা এবং সুঁই-সুতা নিয়ে আসে; তখন নাসিরউদ্দিন মায়ের সহায়তায় সিরাজগঞ্জে জায়গির বাড়িতে মোরগ খাসি করার বিষয়ে তার নবলব্ধ জ্ঞান তিনটি মোরগের বাচ্চার উপর প্রয়োগ করে। চন্দ্রভান একটি মোরগ চিৎ করে রাখে, নাসিরউদ্দিন তখন মোরগটার তলপেটের পালক সব ছিঁড়ে তুলে ফেলে, তারপর সে মোরগের পরিষ্কার করা পেট নরুন দিয়ে দুআঙুলের মতো কেটে একটা ফোঁকর তৈরি করে এবং এই ফোঁকর দিয়ে একটি আঙুল, ডান হাতের তর্জনী, মোরগটার পেটের ভেতর প্রবেশ করিয়ে দেয়। সে একটি আঙুল চালনা করেই এই পাখির পেটের ভেতর থেকে নরম অণ্ডকোষ দুটো আঙুরের মতো ছিঁড়ে একটি একটি করে বের করে এনে সরার উপর রাখে, তারপর কাটা অংশ সেলাই করে চুন ও হলুদ একত্রে মিশিয়ে, ক্ষতে এই মলম লাগিয়ে দেয়। তখন চন্দ্রভান এই মোরগটিকে প্রাঙ্গণের ওপর ছুড়ে দিয়ে দ্বিতীয় মোরগের বাচ্চাটিকে চিৎ করে ধরে এবং এভাবে মাটির সরার উপর মোরগের ছটি ছিন্ন অণ্ডকোষ জমা হয়। সেদিন যখন সব কাজ শেষ হয়ে যায়, মা এবং ছেলে একজন আরেক জনের দিকে তাকিয়ে হাসে এবং মধ্যবয়স্কা চন্দ্রভান একটি বালিকার মতো চপল হয়ে ওঠে, সে তার বালক ছেলের গাল টিপে দিয়ে বলে, আমার লায়েক ব্যাটা, এবং তখন সুহাসিনীর লোকেরা মোল্লা নাসিরউদ্দিনের এই গল্প জানতে পারে। চন্দ্রভানের খাসি করে দেয়া মোরগ তিনটি দুমাসের ভেতর লম্বা ঢ্যাঙা হয়ে ওঠে, তাদের লেজের চকচকে বাঁকানো পালক মাটিতে গিয়ে ঠেকে; তখন মিয়াবাড়িতে গ্রামের যারা যায়, তারা এই তিনটি রাজকীয় মোরগের চেহারা দেখে বিমোহিত হয়ে পড়ে। আরো তিন মাস পর মোল্লা নাসিরউদ্দিন একদিন বিকেলে পুনরায় গ্রামে ফিরে আসে এবং গ্রামের লোকেরা তা জানতে পারে, তখন পরদিন সকালে মিয়াবাড়ির লোকেরা ঘুম থেকে উঠে দেখে যে, তাদের প্রাঙ্গণে সুহাসিনীর দশ জন কৃষক হাতে দশটি মোরগের বাচ্চা নিয়ে অপেক্ষা করে আছে; বাড়ির লোকদের দেখে তারা বলে যে, তারা তাদের এই মোরগগুলো মোল্লা নাসিরউদ্দিনকে দিয়ে খাসি করাতে চায়। নাসিরউদ্দিন সেদিন তার নরুন, চুন-হলুদের মলম এবং সুঁই সুতো নিয়ে এসে তিন ঘণ্টায় দশটি মোরগের বিশটি বিচি বের করে আনে এবং গ্রামের লোকেরা, বাপু খুব কামের ছাওয়াল হইছ দেহি, বলে তাদের মোরগের বাচ্চা নিয়ে চলে যায়। কিন্তু তার পরদিন সকালে যখন আমরা বিশ জন কৃষককে মোরগের বাচ্চা হাতে অপেক্ষা করতে দেখা যায়, তখন মোল্লা নাসিরউদ্দিন ব্রিত বোধ করে, সে বলে যে, তার সময় নাই, গ্রামের সব লোকের জন্য সে এ কাজ করতে পারবে না। কিন্তু গ্রামের লোকেরা তার কথায় কর্ণপাত করে না, তরা মিয়াবাড়ির বৈঠকখানার সামনে ভিড় করে বসে থাকে, এবং বেলা যখন বাড়তে থাকে কিন্তু লোকগুলো তবুও ওঠে না তখন মোল্লা নাসিরউদ্দিন তার সরঞ্জাম নিয়ে আসে। এদিন প্রথম কৃষকটি, তার মোরগ খাসি করার কাজ সমাপ্ত হলে লুঙ্গির খুঁট থেকে এক আনার একটি মুদ্রা বের করে মোল্লা নাসিরউদ্দিনের সামনের সরার উপর রাখে, এবং এই দ্বিতীয় দিন মোল্লা নাসিরউদ্দিনের সরায় বাচ্চা মোরগের চল্লিশটি অণ্ডকোষ এবং এক আনার বিশটি মুদ্রা জমা হয়। এরপর রৌহা থেকে, বিশ্বাসপাড়া এবং কুমারচর থেকে, চকনূর এবং ধর্মদাসগাতি থেকে, সুরধ্বনি এবং তেবাড়িয়া থেকে কৃষকেরা মোরগের বাচ্চা হাতে সুহাসিনীর মিয়াবাড়িতে এসে হাজির হয়। এভাবে মোল্লা নাসিরউদ্দিনের শৈশবে সুহাসিনী এবং এর আশপাশের গ্রামের মোরগকুল নপুংসক হতে থাকে, নাসিরউদ্দিনের বাঁশের চোঙে বাড়তে থাকে জমানো মুদ্রার সংখ্যা, এবং মোল্লা নাসিরউদ্দিন এগিয়ে যায় তার জীবনের একটি পরিণতির দিকে। প্রথম মোরগটি নপুংসকে পরিণত হওয়ার দুবছর পর সুহাসিনীর দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে বসবাসকারী মোবারক আলির মেয়ে বালিকা দুলালি একদিন একটি মোরগের বাচ্চা কোলে করে মিয়াবাড়ির উঠোনে দুপুরের রোদের ভেতর এসে দাঁড়ায়, এ সময় বালক নাসিরউদ্দিন একটি গাব গাছের মগডালে উঠে পাকা গাব পেড়ে খাচ্ছিল, সেখান থেকে সে দুলালিকে মোরগ কোলে তাদের প্রাঙ্গণে দেখে এবং চিৎকার করে তাকে ফিরে যেতে বলে, কাইল বিয়ানে আসিস। কিন্তু দুলালি যখন নড়ে না তখন সে নেমে এসে উঠোনের এক কিনারায় গাছতলায় নরুন নিয়ে বসে। সেদিন নাসিরউদ্দিন যখন তার কাজ করতে থাকে, বালিকা দুলালি তার গায়ের ফর্সা রঙের বিষয়ে উৎসাহী হয়ে পড়ে, তুমি এমন ধলা ক্যা, সে বলে। নাসিরউদ্দিন বলে যে, এটা একটা রোগ; কিন্তু দুলালি তার পরিহাস বুঝতে পারে এবং তখন নিজের গায়ের শ্যামলা রঙের কথা তার মনে পড়ে, তার বালিকা হৃদয় এ কারণে দুঃখে ভরে যায়, নাসিরউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে সে অকপটে বলে, আমি এমন কালা যে আমার বিয়াই হইব না! নাসিরউদ্দিন তখন মোরগের পেটের ভেতর আঙুল প্রবেশ করিয়ে দিয়ে বিচি দুটোর অবস্থান ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিল, দুলালির কথা শুনে তার মজা লাগে এবং মাথার ভেতর নিষ্ঠুর বদমায়েশি উঁকি দেয়; সে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলে যে, দুলালি ইচ্ছে করলে গায়ের রঙ পরিষ্কার করতে পারে, দেখ না আমি এহন কেমন ধলা হয়্যা গেছি, আগে কত্তো কালা আছিলাম! দুলালির তখন বিভ্রান্তি হয়, মোল্লা নাসিরউদ্দিন আগে কখনো কালো ছিল কি না তা সে মনে করতে পারে না, সে বোকাটেভাবে হাসে এবং বলে, কেমন কইরা ধলা হইছো? নাসিরউদ্দিন তখন জীবনে প্রথম এবং শেষবারের মতো এই বালিকাকে প্রতারণা করে, সে বলে যে, মোরগের ডিম খেয়ে খেয়ে সে ফর্সা হয়েছে এবং সে তখন তার সামনে চিৎ করে রাখা মোরগের পেটের ভেতর থেকে দুটো বিচি বের করে সরার উপর রাখে এবং বলে, এই দেখ মোরগার আভা, এই দুইটা যুদি তুই কাঁচা খায়া ফালাইস তাইলে তুই অনেক ফর্সা হয়া যাবি! নাসিরউদ্দিন দুলালির হাতে মোরগটা ভালোমতো ধরিয়ে দেয় এবং একটি কলাপাতায় মুড়িয়ে মোরগের ছিন্ন অণ্ডকোষ দুটো বালিকার শাড়ির আঁচলে বেঁধে দিয়ে বলে, কাউক কইস না, বাড়িত যায় এই দুইট্যা টপ কইর্যা খায়া ফালাবি, তাইলে তুই ফর্সা হয়া যাবি, আর পট কইর্যা তর বিয়া হয়া যাইব! সুহাসিনীর লোকেরা এই সব গল্প শোনে এবং তারা দেখে যে, মোরগের বিচি খাওয়ার পরও দুলালির বিয়ে হয় না, সে বিয়ে ছাড়াই মরে যায় এবং মোল্লা নাসিরউদ্দিন তার বালক বয়সের এই বদমায়েশির মাশুল গোনে, মোরগের অণ্ডকোষ-খেকো দুলালির স্মৃতির ভেতর তার মায়ের নিশিগ্ৰস্ততার মতো আজীবন ঘুরপাক খায়। সেদিন সঙ্গে পয়সা না থাকায় অন্যান্য কৃষকের মতো মোল্লা নাসিরউদ্দিনকে পয়সা না দিয়ে দুলালি দুহাতে তার খোজা করা মোরগটিকে চেপে ধরে সুহাসিনীর দক্ষিণ-পশ্চিম কিনারায় নিজের বাড়ির ভিটায় ফিরে আসে, তখন সে তার পিতা মোবারক আলি, মা ছমিরুন্নেছা এবং সাত ভাইকে তাদের উঠোনে দাঁড়ানো দেখতে পায়। দুলালিকে দেখে তাদের উৎকণ্ঠা দূর হয়, তারপর দুলালি যখন তাদেরকে বলে যে, সে তার কোলের মোরগটিকে মোল্লা নাসিরউদ্দিনের কাছ থেকে খাসি করে এনেছে, তখন তারা হেসে ওঠে, তাদের বাড়িতে স্থাপিত কাপড়ের দশটি তাঁতের খটাখট শব্দকে ছাপিয়ে শোনা যায় সেই হর্ষধ্বনি। দুলালির সাত ভাই তার দিকে এগিয়ে আসে এবং শীঘ্রই দেখা যায় যে, তার সবচাইতে বড় ভাই আব্দুল জলিলের বাহুর ভেতর দুলালি দোল খায়; কিন্তু এর একটু পরেই মোবারক আলির সাত ছেলে বাড়ির প্রাঙ্গণে পুনরায় জড়ো হয় যখন তারা এই খবর শুনতে পায় যে, দুলালি হঠাৎ করে বমি করতে শুরু করেছে। দুলালির বমি করা দেখে ছমিরুন্নেছা প্রথমে ভয় পেয়ে যায়, তারপর দুলালিকে প্রশ্ন করে সে যখন এই তথ্য উদ্ধার করে যে, সে মোরগের দুটো ছিন্ন অণ্ডকোষ খেয়ে নিয়েছে, তখন সে দুলালির গলার ভেতর আঙুল প্রবেশ করিয়ে দিয়ে তাকে আরো বমি করায়। অল্প অল্প করে মোট তিনবার বমি হয়ে যাওয়ার পর ছমিরুন্নেছা মেয়েকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে পাশে বসে থাকে, তার কালো বালিকা কন্যার কাছ থেকে বিকেলের ঘটনাবলির বিশদ বর্ণনা শোনে এবং দুলালি যখন বলে যে, মোল্লা নাসিরউদ্দিন তাকে বলেছে মোরগের বিচি খেলে গায়ের রঙ ফর্সা হয়, তখন সন্তানের জন্য ছমিরুন্নেচার মন বেদনায় আপ্লুত হয়ে আসে এবং বদমাশ বালকের প্রতি ক্রোধ হয়। দুলালি তখন রসিকতাটি পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও ক্রমাগতভাবে বিষয়টি তার কাছে পরিষ্কার হয়ে আসে, মোরগের কঁচা বিচি খেয়ে নেয়ার কথা ভেবে দিনে দিনে তার অস্তিত্ব লজ্জিত হয়ে ওঠে এবং মোল্লা নাসিরউদ্দিনের ওপর তার রাগ হয়। মোল্লা নাসিরউদ্দিনের ওপর প্রতিশোধ ওঠানোর জন্য তাকে একটি বছর অপেক্ষা করতে হয়, যখন একদিন রায়গঞ্জ থেকে স্কুল শেষে বাড়ি ফেরার সময় সুহাসিনীর দিক্ষণ-পশ্চিম কোনায় খালের পাড়ে এসে দুলালি আটকে যায়, এখানে যে কলার ভেলায় করে মানুষ পানি পার হয় সে সেটা দেখতে পায় না, এবং এই সময় মোল্লা নাসিরউদ্দিন রায়গঞ্জের দিক থেকে এসে খালের পাড়ে দুলালিকে বসে থাকতে দেখে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *