০৫. হাঁসের পালক

এভাবে হাঁসের পালক খসে পড়ার চাইতেও হাল্কা এবং তুচ্ছ এক মৃত্যু আবু ইব্রাহীমকে গ্রাস করে এবং তাকে নিয়ে সঙ্গতকারণেই আমাদের আর কোনো আগ্রহ থাকে না; তাকে আমরা বিস্মিত হই। শুধু মনে হয় যেন তার পৃথুলা স্ত্রী মমতা তাকে ত্যগ করতে পারে না। তার কবরকে কেন্দ্র করে মমতার বেঁচে থাকার এক ধরনের ছক রচিত হতে থাকে। আবু ইব্রাহীমের লাশ মমতা সিরাজগঞ্জ নিয়ে গিয়ে দাফন করে, বিন্দু আর শুভকে স্থানীয় স্কুলে ভর্তি করে দেয়। সিরাজগঞ্জ শহরের উপকণ্ঠে হোসেনপুর গোরস্তানে আবু ইব্রাহীমের কবরের উপর সবুজ ঘাসে ছেয়ে যায়, কবরের চারদিকে লাগানো মাদার গাছে বৃষ্টির দিনে লাল থোকা থোকা ফুল ফোটে। মমতা, বিন্দু আর শুভকে সঙ্গে নিয়ে নিয়মিত এসে কবরের দেখাশোনা করে। মমতার বিষণতায় তার বৃদ্ধ পিতা ক্লিষ্ট হয়, তাদের গোটা পরিবারে নিরানন্দ ছেয়ে থাকে। যুবতি বিধবার জন্য পুনরায় বিয়ের প্রস্তাব আসে, কিন্তু সে রাজি হয় না এবং এভাবে আবু ইব্রাহীমের মৃত্যুর পর দুটো বছর কেটে যায়। তখন ধানবান্ধি এলাকার মমতার বান্ধবী শেফালির বড় ভাই, আব্দুল হাকিমের স্ত্রী মারা যায় এবং এর কয়েক মাস পর শেফালি তার বড় ভাই এর সঙ্গে মমতার বিয়ের জন্য মমতার বাবাকে ধরে। তারা সকলে মমতাকে বোঝায়, তার বৃদ্ধ পিতা শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে বারান্দায় ক্যানভাসের ইজিচেয়ারের শুয়ে থাকে। মমতা ভেবে ভেবে কিছু ঠিক করতে পারে না। তারপর এক রাতে সে তার বড় ভাই এর সঙ্গে তুমুল বচসা করে এবং পৃথিবী ঘুমিয়ে গেলে সারা রাত ধরে আকুল হয়ে কাঁদে। মমতা সারা রাত ধরে কাদার তিনদিন পর শেফালির বড় ভাইএর সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যায় এবং বিয়ের পরদিনই শেফালির বড় ভাই তার কর্মস্থল খুলনা রওনা হয়। মমতা চোখ মুছে শুভ আর বিন্দুর হাত ধরে ট্রেনে গিয়ে ওঠে, তখন সে দেখে আব্দুল হাকিম আঙুলের স্পর্শে বিন্দুর চোখ বেয়ে নেমে আসা জলের ধারা মুছে দেওয়ার চেষ্টা করে। শেষ বিকেলের ম্লান আলোয় বাজার স্টেশন থেকে যখন ট্রেন ছাড়ে তখন আব্দুল হাকিম এবং তার বাহুর ভেতর বিন্দুর দিকে তাকিয়ে পুনরায় তার চোখ প্লাবিত হয়ে ওঠে। ঝমাঝম ঝমাঝম করতে করতে একটি কালভার্ট পার হয়ে সিটি বাজিয়ে ট্রেন যখন ছোটে তখন হোসেনপুর গোরস্তানে একটি কুকুর গরুর ফেলে দেওয়া নাড়িভুড়ি মুখে করে বয়ে এনে আবু ইব্রাহীমের কবরের অদূরে বসে। প্রথম কুকুরটির পিছন পিছন আসে দ্বিতীয় একটি কুকুর, তারপর গর্জন করে উঠে কুকুর দুটি মারামারি শুরু করে, চিল্কার আর হুড়োহুড়িতে চৌচির হয় কবরস্থানের বাতাস। তখন মারামারি করতে করতে একটি কুকুর নাড়িভুড়ির টুকরাগুলো মুখে করে টানতে টানতে নিয়ে বেরিয়ে যায়, গোরস্তানে আবার সুষুপ্তির নির্জনতা নামে, সন্ধ্যের বাতাস শীতল এবং প্রসন্ন হয়ে আসে। তখন দূরের দালানকোঠার ভেতর দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদ উঠে কড়ই গাছের বাতার ফাঁকে গ্যাস বেলুনের মতো লটকে থাকে এবং জ্যোত্সার ফ্যাকাশে আলোয় একটি পেঁচা উড়ে এসে মাদার গাছের ডালে বসে এদিক ওদিক তাকায়। তারপর পেঁচাটি হঠাৎ উড়ে গিয়ে যখন ঘাসের উপর ঝাপিয়ে পড়ে, তখন একটি ছুঁচো তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকার করতে করতে আগাছার জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ছুটে যায়, পেঁচা এঁকেবেঁকে অনুসরণ করে, বারে বারে ছোঁ মেরে নেমে আসে।

 

কবরস্থানের কবরের কথা আমরা এভাবে ভুলে যাই; সেখানে নির্মেঘ আকাশে চাঁদ হেসে উঠে, ছুঁচার চিৎকারে বাতাস মুখরিত হয়, সারারাত ধরে পাখা ঝাপটাতে ঝাপটাতে পেঁচা উড়ে।

(প্রথম প্রকাশ : নিপুণ, ৮ জুন, ১৯৯১)

Leave a Reply to পর্দা করা ফরজ Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *