১৩. যেমন দিনের পর দিন চলতে থাকে

যেমন দিনের পর দিন চলতে থাকে, তেমনই মুরলীরও দাবির পর দাবি চলতেই থাকে। টাকা দাও পলুস। আমার আরও পাঁচটা নতুন বহি চাই। খাতা চাই, কাগজ চাই। ছবি আঁকবার রং চাই।

কনভেন্টের স্কুলের বড় টিচার লুসিয়া দিদি বলেছে, পঁচিশ টাকা চাই, তবে মুরলীর লেখাপড়ার এইসব নতুন দরকারের জিনিসগুলি কিনে আনতে পারা যাবে। টাকা দিয়েছে পলুস। টাকা দেবার সময় হাসতে গিয়ে শুধু একটু গম্ভীর হয়েছে পলুস : তোমার লিখাপড়ার দাম যে বড় বেশি দাম বটে জোহানা।

মুরলী শুধু হাসে; সেই পরিষ্কার ঠাণ্ডা হাসি? যদি না পার, তবে বল না কেন, ঘরণীর একটা সাধ পুরা করবারও জোর নাই তোমার?

আবার ভয় পেয়ে চমকে ওঠে পলুস। পলুস হালদারকে জীবনের এক ভয়ানক পরাভব স্বীকার করে নেবার জন্য হেসে হেসে অনুরোধ করছে মুরলী। জোহানার হাসি যেন একটা ক্ষমাহীন শর্তের হাসি। কলঘরের বড় মিস্তিরী ক্ষণিক দূর্বলতার ভুলে ভীরু হয়ে যে মুহূর্তে এই অক্ষমতা স্বীকার করে ফেলবে, সেই মুহূর্তে খিল খিল করে আরও ভয়ানক ক্ষমাহীন হাসি হেসে উঠবে। জোহানা। জোহানা যে তা হলে এই ঘর ছেড়ে তখনই দরজার দিকে দৌড় দেবে; মুখটা ফিরিয়ে নেবে, আর ফিরে আসবেও না। বলে দেবে, খুব বলে দিতে পারবে জোহানা, তোমার ঘরে তুমি থাক গো মিস্তিরী। এমন ঘরে জোহানা থাকে না।

কয়লা-খাদের সর্দারদের কাছ থেকে প্রায়ই টাকা ধার করে পলুস। কারণ, মুরলীর ক্ষুধাটারও দাম দিন দিন বড় বেশি বেড়ে চলেছে। রান্না করতে বসলেই ঘি আর মাখনের হাঁক ছাড়ে মুরলী। রোজ খাসির মাংস না পেলে রাঁধতেই ভাল লাগে না। ভাল আনাজ না পেলে রাঁধতে ইচ্ছাই করে না। ভুবনপুর থেকে বাড়ি ফেরবার পথে রোজই একটা পাউরুটি কিনে আনে পলুস। নিজের জন্য নয়, মুরলীরই জন্য। গোবিন্দপুর গিয়ে রাংতা মোড়া চায়ের একটা প্যাকেট আর চা তৈরির যত সরঞ্জামও কিনে আনতে হয়েছে। লতাপাতা আঁকা চীনামাটির পেয়ালা, ডিশ আর কেটলি; আর পেতলের জালি দিয়ে তৈরি একটা ছাঁকনিও। একদিন লুসিয়া দিদির ঘরে গিয়ে চায়ের উৎসবের স্বাদ নিয়ে মুরলী যে ওর পিপাসার রুচিটাকেও নতুন করে ফেলেছে। তাই, যেসব জিনিস আনতে বলে দিয়েছে মুরলী, গোবিন্দপুরের বাজারের দোকানে দোকানে ঘুরে বেছে বেছে ঠিকই সেই সব জিনিস কিনে নিয়ে এসেছে পলুস। মুরলী বলে, গুড় দিয়ে চা খেতে হয় তো তুমি খাও পলুস, আমি খাব না।

পলুসের শুকনো মুখটা কেঁপে কেঁপে হাসতে চেষ্টা করে : ভাব কেন জোহানা? তোমার লেগে চিনি নিয়ে আসবো; দুই সের চিনিতে হবে না কি?

মুরলী-হলে হবে; না হয় তো আরও নিয়ে আসবে। আর যদি তোমার ডর লাগে, তবে আনবার দরকার নাই।

পলু-কিসের ডর?

মুরলী-চিনি কিনতে যদি পয়সার কমতি হয়, তবে…।

পলুস ভ্রূকুটি করে : চিনির দামকে তো ডরি না, ডরি তোমাকে।

মুরলী মুখ টিপে হাসে? কেন?

পলুস–চিনি তো আর তোমার মত…।

পলুসের মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে মুরলীই চেঁচিয়ে হেসে ওঠে : আমার মত ঠগ নয়।

পলুস হাসে ও দাম পেলে চিনি খুশি হয় আর মিঠাও হয়। কিন্তু তুমি দাম পেয়েও মিঠা হতে চাও না।

মুরলী হাসে ও দুই সের চিনি দিয়ে জোহানাকে কিনে নিতে চাও; জোহানাকে তুমি এত সত্তার সওদা মনে কর কেন, পলুস?

হাসপাতাল থেকে ঘরে ফেরবার পর এই তো মাত্র একটা মাস পার হয়েছে। মুরলীর মুখ একটু রোগা রোগা হয়ে আরও সুন্দর হয়েছে। কালো চোখ দুটো আরও কালো হয়েছে। কী সুন্দর ঝরঝরে হয়ে গিয়েছে শরীরটা! রঙিন শাড়ির আঁচল দিয়ে জড়ানো সরু কোমরটা ফুলো লতার মত সব সময় দোলে। পলুস হালদারের চোখ বার বার পিপাসু হয়ে তাকিয়ে থাকে। মনে পড়ে পলুসের, হ্যাঁ, আর ভাবনা করবার কিছু নাই। জোহানার এই গতর ঠগ গর নয়। পলুসকে এইবার ছেইলা দিতে পারবে জোহানা।

কিন্তু এক মাস ধরে পলুসের চোখের এই পিপাসার বিরুদ্ধে শরীরটাকে কী কঠোর সাবধান রেখেছে মুরলী। ঘুমের ঘোরেও চমকে জেগে ওঠে মুরলী : না না; তুমি সর পলুস। আমাকে মিছা জ্বালাবে না তুমি। পলুসের হাত ঠেলা দিয়ে সরিয়ে বিছানার উপর ধড়ফড় করে উঠে বসেছে মুরলী।

-সোয়ামিকে ছেইলা দিবে না, কেমন ঘরণী বট তুমি? মুরলীর গায়ে ঠেলা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠেছে পনুস। মুরলীও যেন ভাঙা ঘুমের বেদনার চোখ ঘষে ঘষে ছটফট করেছে, আর বিছানা থেকে নেমে গিয়ে বিড়বিড় করছে।–দূর দূর।

চিৎকার করে ওঠে পলুস–কাকে দূর দূর কর?

পলুসের চিৎকারের শব্দ শুনে বাইরের বারান্দার কোণে ঘুমন্ত কুকুরটাও চিৎকার করে ওঠে। মুরলী খিল খিল করে হাসে: কুকুরটা কার ছেইলা বটে পলুস? তোমার বটে কি?

মুরলীর হাসির শব্দ শুনে পলুসের কান দুটো জ্বলতে থাকে। আবার চেঁচিয়ে ওঠে পলুস-পলুস হালদারের ঘর রগড়ের ঘর নয়। এমনটি আর চলবে না জোহানা।

মুরলীর চোখ দুটো আবার অভিমানে কাতর হয়ে পলুসের দিকে তাকায়। পাসের তপ্ত মেজাটাও করুণ হয়ে যায়।-কি বটে?

মুরলী–আমি কি তোমার ধমকের কামিন?

পলুস হাসে : না জোহানা। বল না কেন, আর কি চাও তুমি?

মুরলী বলতে তো পারি; কিন্তু দিতে পারবে কি?

পলুস-নিশ্চয় দিব।

হার মানেনি পলুস। পাঁচটা নতুন শাড়ি কিনতে হয়েছে। গোবিন্দপুরও তিনবার যেতে হয়েছে, সাবান পাউডার আর গন্ধতেল কিনে আনতে হয়েছে। কিন্তু মুরলীর দাবীর ভাষা যেন বিকার রোগীব গানের মত থামতেই চায় না। রূপার সুতলির হার আর দুটা সোনার মটরদানা; এমন জিনিস ছুঁতে আমার ঘিন্না লাগে পলুস।

-কেন?

-আমি দেহাতের কিষাণী নই; জোহানকে খুশী করতে চাও তো এইরকমটি নিয়ে এসো।

সত্যিই একটা বই খুলে একটা সোনার হারের ছবি দেখিয়ে দেয় মুরলী। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে পলুল : এটার দাম যে দুশো টাকার বেশি হবে।

-তবে বল না কেন, দিতে পারবে না!

আবার পলুসের বুকের ভিতরে একটা ভীরু নিঃশসের আতঙ্ক চমকে ওঠে। এ তো সোনার হারের দাম নয়; জোহার এই সুন্দর গতর স্পর্শ করবার দাম। এই দাম দিতে না পারলে জোহানাকে হাতে ধরে বুকের কাছে টানবার কোন অধিকার হবে না। সেই ভয়ানক শক্ত শর্তের সত্যটি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে জোহানা।

ভুবনপুরের কাবুলী মহাজনের কাছ থেকে টাকা ধার করে দুশো ষাট টাকা দামের হার গোবিন্দপুর থেকে কিনে আনতে আর বেশি দিন দেরি করে না পলুস। সেই হার গলায় পরে; গলায়, বাড়ে, বুকে আর মুখে পাউডার ছড়িয়ে, আর নরম ঠোঁটের উপর লাল রঙের প্রলেপ বুলিয়ে রবিবারের সকালে যখন গির্জা যাবার জন্য তৈরি হয় মুরলী, তখন আবার একটা বিস্ময়ের জ্বালা সহ্য করতে গিয়ে বিড় বিড় করে পলুস : প্রেয়ার সাধতে যাবে, তাতে এত ঠাটের কি দরকার হয়?

কোন উত্তর না দিয়ে ঘরের দরজা পার হয়ে সড়কের উপর গিয়ে দাঁড়ায় আর গিজাবাড়ির চূড়াটার দিকে তাকায় মুবলী। ডিং ডাং ডিং ডাং-হারানগঞ্জের বাতাস যেন গান গেয়ে মুরলীর প্রাণের একটা স্বপ্নকে কাছে ছুটে আসার জন্য আহ্বান করছে। পলুস গির্জায় যাবে কি যাবে না, এই প্রশ্ন আর মুরলীর জীবনে নেই। পলুসের বওনা হবার আগেই রওনা হয়ে যায় মুরলী। মুরলীর সেই ছুটন্ত উল্লাসের দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে সেদিন গির্জা যাওয়াই বন্ধ করে দিয়ে ঘরে বসে থাকে পলুস।

সেদিন গির্জা থেকে ফিরে এসে মুরলীও একটু আশ্চর্য হয়। এত বোদ উঠেছে, এত বেলা হয়েছে, তবু এখনও কয়লা-খাদের কলঘরে যাবার জন্য পলুসের কোন ব্যস্ততা নেই। আজ কি সারাটা দিন ঘরে বসে থেকে আর মুরলীকে সামনে বসিয়ে রেখে মুরলীর গলায় সোনার হারটাকে ঘাঁটাঘাঁটি করবে পলুস?

পলুস ডাকে–জোহানা?

মুরলীর চোখের পাতা কেঁপে ওঠে। পল্‌সের আহ্বানের স্বর যেন একটা দূরন্ত গবের স্বর। সন্দেহ করে পলুসের মুখের দিকে তাকায় মুরলী; সেই মুহূর্তে বুঝতে পারে, ঠিকই সন্দেহ করা হয়েছে। জোহানাকে এখনই বুকের কাছে পাওয়ার জন্য লুসের চোখে নিবিড় পিপাসার ভাব টলমল করছে। পলুসের তাকাবার ভঙ্গীটাও যেন একটা কঠোর প্রতিজ্ঞার ভঙ্গী।

-কি পলুস? হাসতে চেষ্টা করে মুরলী।

পলুস-এসো।

না, আর উপায় নেই–পলুসের জীবনের হিসাব এইবার প্রচণ্ড হয়ে যেন একটা জয়ের উল্লাস ভোগ করতে চাইছে। হার মানে নি পলুস; আশি টাকা মাইনেব মিহিরী দুশো ষাট টাকা দামের সোনার হার নিয়ে এসে মুরলীকে উপহার দিয়েছে। খুশি না হবার যে আর কোন উপায় নেই মুরলীর। আর, পলুসের এই আহ্বান মিথ্যে করে দেবার জন্য সরে থাকবার মত কোন ছুতেই যে কল্পনা করতে পারে না মুরলী।

কলঘরের এই মিস্তিরীটার ছোঁয়া নিতে হবে, ওকে ছেইলা দিতে হবে, হায় গড, এ কোন্ ডাকাইত এসে জোহানার গতর লুঠ করতে চায়? এটার ছায়া ছুঁতেও যে ঘিন্না করে। এটাই তো সেই ডাকাইতটা, মুরলীর পেটের ছেইলাকে মুরলীর কোলে উঠতে দেয় নাই যে; এ ডাকাইতের মার খেয়ে রক্ত বমি করে মরে যাওয়া ভাল, তবু ওর ছেইলা পেটে নিব না। না না না…কভি না।

চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী—না।

পলুস-কি?

মুরলী–তুমি আমাকে ছুঁবে না।

হিংস্র ক্ষুধা বাঘের মত লাফ দিয়ে এগিয়ে এসে মুরলীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পলুস। মুরলীর গায়ের শাড়িটাকে এক টান দিয়ে খসিয়ে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। মেঝের উপর লুটিয়ে বসে পড়ে মুরলী। মুরলীর গায়ের জামাটা তিন টানে ফরফর করে ছিঁড়ে তিন ফালি নেকড়া করে দিয়ে দূরে ছুঁড়ে দেয় পলুস।

রেশমী কাপড়ের কুঁচিদার সায়া, বড় নরম আর বড় মোলায়েম, মুরলীর সরু কোমর ঘিরে নরম পালকের সাজের মত দুলছে যে রঙিন আবরণ, সেটাকেও তিন টান দিয়ে ফালি ফালি করে ছিঁড়ে দেয় পলুস। পলুসের নিঃশ্বাসের বাষ্প আর মুখের আঠা-আঠা থুথুর কণা মুরলীর আদুড় বুকের উপর ছিটকে পড়তে থাকে। দু হাতে শক্ত করে মুরলীর কোমরটাকে যেন চুপসে দিয়ে জড়িয়ে ধরে পলুস-জোহানা, খবরদার!

দুই হাত দিয়ে পলুসের মাথাটাকে ঠেলে দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী–না।

-জোহানা।

–না।

এক পাটি দাঁতের সাদা হিংস্রতা দিয়ে নিজেরই ঠোঁটের উপর কামড় বসিয়ে নিয়ে পলুসের মুখটা বীভৎস হয়ে ওঠে। মুরলীর যে অবাধ্য ও উদ্ধত হাঁটুটা বজ্রপাথরের বাধার মত কঠোর হয়ে পলুসের বুকের হাড়ে ঠেকে রয়েছে, পলুসের একটা হাত মাংসাশী আক্রোশের থাবার মত নখ বের করে মুরলীর সেই হাঁটুটাকে আঁকড়ে ধরে। বাধাটাকে নুইয়ে শুইয়ে আর মেঝের উপর চেপে রাখতে গিয়ে পলুসের হাতের হাড়ের গিটগুলি মটমট করে বাজতে থাকে।

চমকে ওঠে পলুস। হঠাৎ কুকুরটা ডেকে উঠেছে। সেই সঙ্গে আর একটা ডাকও শোনা যায় বড় মিস্তিরী ঘরে আছ? কয়লা-খাদের চাপরাসী ষ্টু মিঞার গলার স্বর।

পলুসের হাত কেঁপে ওঠে। হাতের হাড়ের সব আক্রোশও যেন নেতিয়ে পড়ে। উত্তপ্ত কপালের সব ঘাম হঠাৎ ঠাণ্ডা হয়ে যায়।

–বড় মিস্তিরী! কয়লা-খাদের খাজাঞ্চির গলার স্বর।

দরজা খুলে ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়ায় পলুস। খাজাঞ্চি বলে-তুমি আজ কাজে যাও নাই কেন?

পলুস-ঘরে কাজ ছিল।

খাজাঞ্চি—যাই হোক; তোমার এখনই রওনা হতে হবে। ম্যানেজার সাহেবের অর্ডার।

পলুস-কোথায় যেতে হবে?

খাজাঞ্চি-তুমি এখনই বাবুরবাজারে গিয়ে রামগড়ে যাবার বাস ধরবে। তারপর রেলের টিকিট কেটে সোজা চলে যাবে ডালটনগঞ্জ। সেখান থেকে তিন ক্রোশ হবে, মৌপুর সিমেন্টের কারখানা। আমাদেরই মালিকের কারখানা।

পলুস-সেখানে আমার কি কাজ?

খাজাঞ্চি—তুমি অন্তত একটা বছর সেখানে কলঘরে কাজ করবে। তোমাকে বদলি করা হয়েছে।

স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পলুস। খাজাঞ্চি এইবার একটু রুক্ষস্বরে হুকুম করেচলে এসো মিস্তিরী। সড়কে আমার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তোমাকে এখনই বাবুরবাজারে পৌঁছে দিয়ে চলে যাব। ম্যানেজার সাহেবের অর্ডার।

ব্যস্তভাবে কথা বলতে বলতে খাজাঞ্চি হঠাৎ নিজেই যেন একটু অব্যস্ত হয়ে যায়। দু বার টোক গিলে ও তিনবার গলাখাকারি দিয়ে আর ভুরু টান করে দরজার দিকে তাকায়। যার মাপের কথা বলতে বলতে বার বার দোক্তা আর পান মুখে পুরেছিল বিজু বাঈ, দরজার কাছে তারই রূপ দেখতে পেয়েছে খাজাঞ্চি। কী চমৎকার বেলাজ হয়ে, আদুড় শরীরের উপর শুধু একটা গোলাপী রঙের রেশমী শাড়ির ফিনফিনে বাহার এলোমেলো করে জড়িয়ে আর ছড়িয়ে, আর কী সুন্দর মুচকি হাসিটি হেসে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে মিস্তিরীর বউটা! এমন জিনিস ঘরের বার হতে চায়? ঠিকই বলেছে বিজু বাঈ, খবর পেলে লাখটাকার বাবু ওই তেজবাবু নিজেই গাড়ি হাঁকিয়ে ছুটে এসে এই ঘরের দরজায় দাঁড়াবে আর হাজার টাকা আগাম দিয়ে ওকে লুফে নিয়ে চলে যাবে।

আবার গলাখাকরি দেয় খাজাঞ্চিবাবু, পলুসের হতভম্ব মুখটার দিকে তাকিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে চেঁচিয়ে ওঠে-চল হে মিস্তিরী। দেখতে দেখতে একটা বছর পার হয়ে যাবে, তারপর ফিরে এসে হারানগঞ্জের হাওয়া যত খুশি খেতে চাও খেয়ো। এখন আর মিছিমিছি…।

মুরলীর কালো চোখের তারা দুটো ঝিলিক দিয়ে হেসে ওঠে, হেসে উঠেছে একটা। মুক্তির আশ্বাস। আঃ, গড বাবা তোমার ভাল করেন বিজু বাঈ।

দরজার কাছ থেকে সরে ঘরের ভিতরে চলে যায় মুরলী। আর, পলুস হালদারও ঘরের ভিতরে ঢুকে মুরলীর সেই উৎফুল্ল গোলাপী চেহারাটার দিকে একজোড়া হিংস্র চোখের জ্বালা ছুঁড়ে দিয়ে তাকিয়ে থাকে। তার পরেই ঝোলার মধ্যে কাপড়-চোপড় ভরে, একটা বালিশকে কম্বলে জড়িয়ে নিয়ে, আর দেয়ালের গায়ে ঝোলানো বন্দুকটাও তুলে নিয়ে এক হাতে জড়িয়ে ধরে পলুস।

–আমি তো চললাম। বলতে গিয়ে পলুসের দাঁতে দাঁতে ঘষা খেয়ে যেন একটা জব্দ অদৃষ্টের আক্ষেপ শব্দ করে বেজে ওঠে।

মুরলী বলে—যাও না কেন? আমি না বলবো কেন?

পলুস-তুমি আর এ ঘরে থাক কেন? যেথা মন চায় এখনই চলে যাও।

মুরলী-কেন যাব? আমি এ ঘরেই থাকবো।

পলুস-খাবে কি? কে টাকা দিবে?

মুরলী—তুমি দিবে।

পলুস-আমি দিব না।

মুরলী-বেশ, দিও না। সিস্টার দিদিকে বলবো, পলুস হালদার ওর ঘরণীকে ভুখা রেখে মরাতে চায়।

চমকে ওঠে পলুস। একটা ভয়ের চমক। সিস্টার দিদি বিরূপ হলে পলুসের চাকরি যে একটি অভিযোগের চিঠিতেই খতম হয়ে যাবে। পলুসের আশি টাকা মাইনের জীবনের সবচেয়ে বড় নির্ভয়ের মধ্যেই যে সবচেয়ে বড় ভয় লুকিয়ে আছে; সেই ভয়টাকে খুঁচিয়ে দিয়ে মুরলীর ঠোঁট দুটো কী ভয়ানক চতুর হাসি হাসছে!

কিন্তু সিস্টার দিদির কি বিচার নাই? কোন সাহসে এত ডর দেখায় জোহানা? নিজেরই ঘরের মরদের পিপাসাকে আজ অপমান করে যে পাপ করেছে জোহানা, জোহানার সেই পাপ কি মাপ করতে পারে সিস্টার দিদি?

চেঁচিয়ে ওঠে পলুস-আমি সিস্টার দিদিকে বলবো।

–কি বলবে?

–যা বলবার বলবো।

ভ্রূকুটি করে মুরলী-কবে বলবে?

পলুসের চোখে যেন শেষ প্রতিজ্ঞার আর চরম মীমাংসার শেষ আশাটা তপ্ত হয়ে জ্বলতে থাকে? যেদিন ফিরে আসবো।

-এসো তবে। একেবারে নির্বিকার শান্ত ও প্রসন্ন একটা মুখ নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে মুরলী।

বাইরে থেকে খাজাঞ্চির হাঁক শোনা যায-এসো মিস্তিরী।

চলে গেল পলুস।

 

পলুস হালদারের এই খবটাকে সহ্য করতে আর ইচ্ছা হয় না। এই একলা জীবনটাকেও সহ্য করতে ভাল লাগে না। কনভেন্টের স্কুলে যাবার সময়, প্রেয়ার সাবার জন্য গির্জাবাড়িতে যাবার সময়, আর মাঝে মাঝে লুসিয়! দিদির বাড়িতে পিয়ানোর বাজ সাধতে যাবার সময় যখন এই ঘরেব দরজার শিক তুলে দিয়ে তালা বন্ধ করে মুঘলী, তখন মুরলীব নিঃশ্বাসের শব্দও ছটফট করে ফুঁপিয়ে ওঠে। তার কতদিন?

প্রথম একটা মাস রোজই ঘরের নিভৃতে চুপ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একবার না একবার একটু আনমনা হতে হয়েছে। আয়নার বুকের উপর আঙুল বুলিয়ে আশার হিসাব নিতে গিয়ে হিসাবটা মাঝে মাঝে হিজিবিজির মত হয়ে গিয়েছে। দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়েছে। টাকা পাঠাবে কি পলুস? যদি না পাঠায়, তবে?

একটা মাস শুধু একটু ভাবতে ভাবতে পার হয়ে গেল। কিন্তু, শুধু একটি মাস, তারপর আর নয়। পলুসেরই পাঠানো চল্লিশটা টাকা ডাকপিওনের কাছ থেকে হাতে তুলে নিতে গিয়ে মুরলীর প্রাণ যেন মুখ টিপে হেসে ওঠে। কলঘরের মিস্তিরী এখনও বোঝে নি যে, জোহানাকে নিয়ে আর ওর ঘর করা হবে না, হতে পারে না। ঘর করবার জোর আর ওর নেই। কয়লা খাদের একটা সর্দার কিংবা কলঘরের একটা খালাসীর বেটিকে বিয়া করে নিয়ে এসে এই ঘরে থাকুক না কেন পলু।

পরের মাসগুলি যেন চমৎকার এক নির্ভাবনার হাওয়ায় ফুরফুর করে উড়ে যেতে থাকে। ফিরে আসে নি পলুস। এক মাস পরে নয়, দু মাস পরেও নয়। ছটা মাস পার হয়ে গিয়ে ফায়ূনের দিন এসে হারানগঞ্জের ডাঙার যত আম নিম আর অশথের গায়ে নতুন পাতার উৎসব ছড়িয়ে দিল, তবু ফিরে এসে শেষ প্রতিজ্ঞার হিসেব নিকেশ করবার সুযোগ পেল না পলুস। ছুটি পায় নি বুঝি লুস মিস্তিরী।

কনভেন্টের একটি ঘরে মেরিয়ার কাছে বসে লেস বুনতে বুনতে মুরলীর হাতের কাটা দুটোও যেন ব্যাকুল হয়ে ছটফট করতে থাকে। কথা বলতে গিয়ে মুরলীর মুখের হাসিও কলকল করে।

মেরিয়া বলে-তুমি তো হাসছো জোহানা, কিন্তু পলুস বেচারা যে এখন…।

মুরলী-কি?

মেরিয়া–কত তরাস ভুগছে বেচারা!

মুরলী-কেন, কিসের লেগে?

মুরলীর কোমরে একটা মৃদু অভিযোগের চিমটি কেটে হেসে ওঠে মেরিয়া—এটার লেগে।

মুরলীর মুখটা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায়। বেশ একটু বিরক্ত হয়ে ভুরু কুঁচকে বিড়বিড় করেছিয়া ছিয়া! এমন কথা আর বলবে না মেরিয়া; শুনতে ভাল লাগে না।

মেরিয়াও হঠাৎ হাসি থামিয়ে মুরলীর মুখের দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকায়। ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করে–পলুস কি তোমাকে চিঠি দেয় নাই?

মুরলী-কেন চিঠি দিবে? দরকার কি?

আরও আশ্চর্য হয় মেরিয়া—তুমি চিঠি দিয়েছ কি?

মুরলী চেঁচিয়ে ওঠে—আমি কেন চিঠি দিব? দরকার কি?

মেরিয়ার চোখের বিস্ময় এইবার কি-যেন সন্দেহ করে মুরলীর মুখের এই অদ্ভুত রাগটার দিকে মায়া করে তাকিয়ে থাকে। হ্যাঁ, কোন্ ঘরণী না এইরকম রাগটি করে, ঘরের মরদ যদি তাকে একা ঘরে রেখে দিয়ে দূর দেশে চলে যায়, আর ছয়টি মাসের মধ্যে একবারও ঘরে না আসে? জোহানার যে লিখাপড়ার বড় সাধ আছে; আরও কত কিছু শিখবার লেগে দিনরাত কত খাটছে বেচারা। তাই পলুসের সঙ্গে মৌপুর সিমেন্টের কারখানাতে যেতে পারে নি জোহানা। সেটা কি-এমন অপরাধ হল যে, চিঠি না দিয়ে জোহানার মনটাকে এত কঠোর সাজা দিচ্ছে পলুস? তাই তো জোহানার মনের রাগ আর অভিমান এমন কঠোর হয়ে উঠেছে!

মেরিয়া হাসে–কবে ফিরবে পলুস?

মুরলী–জানি না।

মেরিয়া-কতদিনের বদলি?

মুরলী–এক বছর।

মেরিয়া মুখ টিপে হাসে-তবে তো আরও ছটা মাস বটে জোহানা।

মুরলী-হবে।

মেরিয়া চোখ টিপে হাসে-বড় ভাল হবে।

মুরলী বিরক্ত হয়ে প্রাকুটি করে–কেন?

মুরলীর গায়ের উপর ঢলে পড়ে আর খিলখিল করে হেসে ওঠে মেরিয়া-যত বেশি রাগ হবে, যত বেশি দিন মিছা যাবে, মজাও তত বেশি জমবে।

মুরলী আবার ভ্রুকুটি করে-কিসের মজা?

মেরিয়া-ফিরে আসুক পলুস ভাই; তারপর দেখ না কেন, এক বছরের হিসাব কিরকমটি নিয়ে ছাড়ে!

-ছিয়া ছিয়া! গম্ভীর হয়ে মেরিয়ার এই অসার খুশির মুখতা আর মুখরতাকে যেন ধিক্কার দেয় মুরলী, আর মেরিয়াকে একটা ঠেলা দিয়ে সরিয়ে দেয়। তারপর ঘরের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের সড়কের দিকে তাকিয়ে থাকে।

বিকেল হয়েছে। তাই সড়কের দিকে তাকাতে হয়। মেরিয়ার ঘরে বিকেল পর্যন্ত বসে থাকার উদ্দেশ্য শুধু মেরিয়ার সঙ্গে হাসি-গল্প সেলাই আর লেস বোনবার জন্য ব্যস্ত ব্যাকুল একটা সাধের সাধনা নয়। বিকেল হলে এই সড়কের উপর দিয়ে সাইকেলে চড়ে বোজ একটি মানুষকে চলে যেতে দেখতে পায় মুরলী, ডাক্তার রিচার্ড সরকার। কিন্তু রিচার্ড সরকারের চোখ দুটো আজও উদাস হয়ে রয়েছে। জানালার দিকে তাকিয়েও যেন বুঝতে পারে না রিচার্ড, কেউ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। কিংবা, মুরলীকে দেখতে পেয়েও যেন চিনতে পারে না। অথবা চিনতে পেরেও একবার মুখ ফিরিয়ে তাকাবার দরকার আছে বলে মনে করে না। রিচার্ডের মত মানুষের চোখের কাছে একটা বিস্ময়ের শোভা হয়ে উঠতে মুরলীর জীবনে এখনও যে অনেক চেষ্টার কাজ বাকি আছে! রিচার্ডের চোখের সামনে গিয়ে দাঁড়াবার সময় এখনো আসে নি।

সড়কের উপর দিয়ে রিচার্ড সরকারের সাইকেল-চড়া মূর্তিটা চলে যেতেই ব্যস্ত হয়ে ওঠে মুরলী।–আমি চলি মেরিয়া। লুসিয়া দিদির সাথে আজ আমার ঝগড়া আছে।

মেরিয়া—কেন জোহানা?

মুরলী লুসিয়া দিদি আজও আমাকে কিছু শিখালে না কেন?

মেরিয়া আশ্চর্য হয়—তিন-তিনটা গান গাওয়া করতে আর বাজাতে শিখে ফেলেছো তুমি, আর কত শিখবে জোহানা? আর কত চাও তুমি?

মুরলী—ওরকম তিনটা টিটাং টিটাং শিখে কিছু হবে না। লুসিয়া দিদি যে মঙ্গল কোরাস বাজায় সেটা, যদি না শিখে নিতে পারি তবে…।

মেরিয়ার চোখের বিস্ময় আবার সন্দিগ্ধ হয়—তবে কি?

–তবে তোমার মাথা। হাসতে হাসতে মেরিয়ার গালে একটা মৃদু আত্মাদের চড় মেরে চলে যায় মুরলী।

ঘরে ফিরে এসে হাঁপ ছাড়ে মুরলী; কিন্তু এটা ক্লান্তিভরা জীবনের হাঁপ নয়। পলুসের এই ঘরের ভিতরে মুরলীর একলা-জীবন যেন অক্লান্ত চেষ্টা আর ব্যস্ততার জীবন। মাঝরাতের ঘুমভীরু পাখির ডাকও যখন ক্লান্ত হতে হতে শেষে একেবারে চুপ হয়ে যায়, তখনও জ্বলন্ত বাতির কাছে ভোলাবই রেখে পাঠ মুখস্থ করে মুরলী। কাগজের পাতা ভরে খোলা বইয়ের চমৎকার ভাষার কথাগুলি লিখে লিখে পড়ে। তারপর আর-একটা বই হাতের কাছে টেনে নেয়।

কী সুন্দর হিসাবের কথা লিখেছে এই বইটা, আট আনা দামের এই সরল-অঙ্ক। রোজের বাজার খরচ থেকে প্রতিদিন সাত আনা পয়সা বাঁচিয়ে জমা করে রাখতে পারলে কতদিনে তুমি ভুবনপুরের মেলা থেকে একটা ভাল গরু কিনতে পারবে? সে ভাল গরুর দাম সত্তর টাকা।

লিখে লিখে হিসাব করে মুরলী। হাসতে থাকে মুরলীর দুই চোখের তারা; সত্যিই গভীর রাতের কালো আকাশের তারার মত ঝিকিমিকি হাসি। কী ভেবেছে মেরিয়া, ঠিক হিসাব করতে পারবে না জোহানা? তুমি আমাকে ভুল বুঝেছ মেরিয়া বহিন; কোন হিসাবকে ডরায় না জোহানা।

সরল অঙ্কের প্রশ্নটাকে একটুও ভয় করে না মুরলী। কিন্তু সত্যিই ভয় পায় তখন, যখন হিসাব করে বুঝতে পারে যে, মাত্র আর ছটা মাস পরেই এই ঘরে ফিরে আসবে পলুস হালদার। তখন কী হবে উপায়? মুরলীর যে আরও অনেক কিছু শেখবার বাকি আছে। এখনও যে ঠিক তৈরী হতে পারে নি মুরলী। এখনও যে পলুসের পাঠানো টাকা হাত পেতে নিতে হয়। রিচার্ড সরকার যে এখনও মুরলীর মুখের দিকে ভাল করে তাকাতে চায় না।

যতদূর সাধ্যি, মন-প্রাণের সব চেষ্টা নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি তৈরী হতে চায় মুরলী। হে গড়, এই ছয়টা মাস যেন বেশি তাড়াতাড়ি করে ফুরিয়ে না যায়। কিন্তু মাসগুলি যেন বড় তাড়াতাড়ি হারানগঞ্জের আকাশের মেঘ হয়ে, ডাঙ্গার ধুণের ঝড় হয়ে আর জঙ্গলের শালের ফুল হয়ে উড়ে ঝড়ে শেষ হয়ে যেতে থাকে। ছুটোছুটি করে বার বার লুসিয়াদিদির কাছে যেয়ে, পিয়ানোতে হাত চালিয়ে সুর ঢালতে শিখেও বুঝতে পারে মুরলী, আশার কাজটা সোজা সহজ কাজ নয়। পুরা পাঁচটা মাস পার হয়ে গেল, তবু মঙ্গল কোরাসের সুরটা ঠিকমত তুলতে পারছে না মুরলী। লুসিয়াদিদি কিন্তু আশা করে হাসে-হবে হবে, আরও দুতিনটা মাস লাগবে, তোমার হাতে খুব ভাল সুর খেলবে, জোহানা।

আরও দু-তিনটা মাস? হায় আশা! মুরলীর প্রাণের সব আশার সুর স্তব্ধ করে দেবার জন্য আর একমাস পরেই যে মিস্তিরী পলুস হালদার এসে পড়বে।

যতক্ষণ কনভেন্টের স্কুলবাড়ির ভিতরে ঘোরাঘুরি আর ছুটোছুটি করে মুরলী, ততক্ষণ মুরলীর আশার প্রাণটাও যেন শান্ত ও নিশ্চিন্ত হয়ে থাকে। কিন্তু ঘরে ফিরে এসে যখন একলা হয়ে যেতে হয়, তখন মনটা মাঝে মাঝে খুব অশান্ত হয়ে ছটফট করে। একদিন স্বপ্ন দেখে চমকে উঠেছে বুকটা; কিন্তু ঘুম ভাঙতেই স্বপ্নটাকে একটা সান্ত্বনা বলে মনে হয়েছে। ভাল মজার স্বপ্ন; কলঘরের মিস্তিরী পলুস হালদারের একটা পা কাটা পড়েছে, হাসপাতালে গিয়েছে পলুস। ডাক্তার বলেছে, ঠিকমত সেরে উঠতে ছ’টা মাস সময় লাগবে।

রবিবার, তাই আজ আর কনভেন্টের স্কুলবাড়িতে যেতে হয় নি। শুধু সকালবেলাতে প্রেয়ার সাধবার জন্যে গির্জাবাড়িতে যেতে হয়েছিল। দেখতে পেয়েছে মুরলী, ডাক্তার রিচার্ড সরকারের সঙ্গে দু’টো জোয়ান বয়সের মেয়ে হাসাহাসি করে গির্জাবাড়িতে এল আর প্রেয়ার সেধে চলে গেল। কে ওরা? কোথা থেকে এল ওরা? কোথায় থাকে ওরা? ওদের সাথে এত হাসাহাসি করে কেন রিচার্ড সরকার?

বিকেলে এবার, আর সন্ধ্যা হলে একবার, দুবার স্নান করেছে মুরলী। কিন্তু মুরলীর বুকের দুরুদুরু ভাবনার কঁপুনিটা তবু শান্ত হয় নি। কী সুন্দর কথা বলে ওই দুটো মেয়ে। ওদের কথার মধ্যে যেন রাঙা পলাশের রং আছে, ফোঁটা গোলাপের গন্ধ আছে, আর মিষ্টি পিয়ানোর সুর আছে। ঠিকই তো, ওদের সাথে হাসাহাসি করবে না কেন রিচার্ড সরকারের মত মানুষ, যে মানুষ ফুলবাড়িতে থাকে?

-কে বটে তুমি? কে দাঁড়িয়ে ওখানে? চমকে ওঠে, উঠে দাঁড়ায়, আর ঘরের খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে মুরলী। দরজার কাছে একটা রঙীন শাড়ির আঁচল ফুরফুর করে উড়ছে, আর, সোনালী জরি দিয়ে বাঁধা মস্তবড় খোপা নিয়ে একটা মাথা কাত হয়ে রয়েছে। হাসছে একটা মুখ, জরদা দিয়ে পানখাওয়া একটা লালচে হাসির মুখ।

জরি দিয়ে বাঁধা খোপাটা দুলে ওঠে, আর, যেন হেসেও ফেলে-আমি গো; আমি বিজু বাঈ।

-তুমি এখানে এলে কেন? দুই চোখ শক্ত করে আর রুক্ষ স্বরে ধমক দিয়ে কথা বলে মুরলী।

বিজু বাঈ এগিয়ে এসে ঘরের ভিতরে ঢোকে আর খুবই আশ্চর্য হয়ে যায়। এরকমটি মেজাজ করে কথা বলছো কেন?

—তুমি যাও। চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী।

–যাবই তো, কিন্তু আমার কথাটা একবার শুনবে, তবে তো…।

-না, কিছু শুনবো না। জান না তুমি, এটা যে খিরিস্তানের ঘর? এখানে আসতে ডর লাগে না তোমার?

চেঁচিয়ে ওঠে বিজু বাঈ-থাম গো লাটের বোট। আমাকে মিছা ডরাতে চেষ্টা করবে না।

নীরব হয়ে, বিজু বাঈয়ের লালচে মুখের ধমকের কাছে যেন একটা স্তব্ধ ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মুরলী। বিজু বাঈ এইবার যেন করুণ অভিমানের সুরে কথা বলে-তুমিই বলেছিলে যে, সুখের ঘরে থাকতে চাও। তুমিই বলেছিলে তাই মিস্তিরীকে দুরে সরিয়ে দিলাম। তুমি খুশি হয়ে আমাকে একটা পানও দিলে না, উল্টা আমাকেই ধমক দিয়ে…।

হাসতে চেষ্টা করে মুরলী বল তুমি; তাড়াতাড়ি বল; কী বলতে চাও?

বিজু বাঈ-তেজবাবুর নাম শুনেছ কি? জিতগড়ের তেজবাবু?

মুরলী–না, শুনি নাই। শুনে কাজ নাই।

বিজু বাঈ-বিশ্বাস কর; টাকার খাদ আছে তেজবাবুর। টাকা দিয়ে দেয়াল গেঁথে তোমার সুখের ঘর করে দিতে পারে তেজবাবু। এক রাতের হরিণ শিকার খেলতে এক হাজার টাকা খরচ করে তেজবাবু! তাই বলতে এসেছি..।

মুরলী-কি?

বিজু বাঈ-তেজবাবুর একটা লোক, আমার নাগর সেই ঠিকাদার বেটা কাল রাতে তোমার এখানে আসবে।

-কেন আসবে? চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী।

বিজু বাঈ হাসে-পাঁচ শত টাকা, এক হাঁড়ি বালুসাই-ঝরিয়ার মতিচাঁদের বালুসাই গোএক থান সিলিক কাপড় আর এক বোতল বিলাতী সরাব নিয়ে দাদন করে যাবে ঠিকাদার তুমি ওকে বলে দিও, ঠিক কবে আবার এসে তোমাকে নিয়ে যাবে।

কলকল করে হেসে ওঠে মুরলী—একটু দেরি করতে বল দিদি; কাল যেন না আসে।

বিজু-তবে কবে?

মুরলীর গলার স্বর হঠাৎ একেবারে নিবিড় হয়ে করুণ মিনতির মত ছলছল করে। মিস্তিরীকে আরও একটা বছর দুরে সরিয়ে রাখ না কেন, দিদি? আমি যে এখনও মন ঠিক করি নাই দিদি। কিন্তু মিস্তিরী এসে পড়লে আমার সুখের সব আশা মরা ঘাসের পোকাটির মত মরে যাবে। তুমি আমার কথাটি রাখ দিদি।

বিজু বাঈ হাসে-বেশ তো; তাই হবে। তুমি ভেব না।

মুরলী–দেখো দিদি, মিস্তিরীটা যেন দুটা দিনের ছুটি না পায়।

–পাবে না, পাবে না। আমি সব ঠিক করে দিব। হেসে হেসে ছটফট করে একটা হাত এগিয়ে দেয় বিজু বাঈ-দাও দেখি, এক বাটি ভাল জল দাও, পিয়ে নিয়ে চলে যাই। ঠিকাদার বেটা সড়কের আঁধারে একা দাঁড়িয়ে আছে।

কাচের গেলাসে জল ভরে নিয়ে বিজু বাঈয়ের হাতের কাছে এগিয়ে দেয় মুরলী। জল খেয়ে নিয়ে আবার হেসে ওঠে বিজু বাঈ-এই জল চাই নাই গো, সুন্দরী।…আচ্ছা চলি।

চলে গেল বিজু বাঈ। মুরলীর চোখ জ্বলজ্বল করে। যেন আরও একটা বছরের সময় হাতে পেয়ে নির্ভর হয়েছে মুরলীর আশা। এই ফাগুন থেকে আর-এক ফাগুন, এর মধ্যে কোনদিনও মিস্তিরী পলুস হালদার আর এই ঘরে ফিরে আসতে পারবে না। হে গড, তাই যেন হয়।

 

মেরিয়ার নালিশ—দেখছো তো লুসিয়াদিদি, জোহানা আজও এল না।

যে জোহানা ঝড় বাদলের দিনেও কনভেন্টে এসেছে, স্কুলবাড়ির বারান্দার এক কোণে বসে নতুন বই পড়েছে আর নতুন লেখা লিখেছে, লেস বুনে বুনে মেবিয়ার সঙ্গে গল্প করেছে, আর পিয়ানোতে লুসিয়াদিদির হাতের সুরেলা খেলা দেখেছে, সে মোহনা একটা নতুন ব্যস্ততার কাজের কাছে হাজিরা দিতে গিয়ে এই ছ’টা মাসের মধ্যে অন্তত ত্রিশটা দিন কনভেন্টে আসতে পারে নি।

হরগঞ্জের দক্ষিণের ডাঙা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে একটা তালবন আছে। সেই তালবনের পাশে একটা বাড়ি আছে; কলকাতার স্যামুয়েল বাবুর বাড়ি। সামুয়েল শশিনাথ রায় তার দুই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এই ছ’টা মাস ওই শাড়িতে ছিলেন। জানে মেরিয়া, কাল বিকালেই আবার কলকাতায় চলে গিয়েছে স্যামুয়েল বাবু। তার সঙ্গে তাঁর দুই মেয়ে, লিলি আর মলিও চলে গিয়েছে। তাই মেরিয়ার নালিশ, আজ তো ওরা আর নাই, তবে জোহানা কেন আজ এখানে এসে একবারটি দেখা দিয়ে যাবার সময় পেল না?

হারানগঞ্জের আকাশের ভাদুয়া মেঘ তালবনের মাথা ছুঁয়ে আরও কালো হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বৃষ্টি ঝরবে না মনে হয়। যদি ঝরে, তবে এই দুপুরের মধ্যেই সে ঝরানি শেষ হয়ে যাবে। তাই, যদি আসতে ইচ্ছে থাকে জোহানার, তবে বিকাল হবার আগেই একবার আসতে পারে।

জানে মেরিয়া, লিলি আর মলির সাথে খুব ভাব হয়েছে জোহানার। জোহানা নিজেই বলেছে, কী সুন্দর কথাটি বলে ওরা, তুমি শুনেছ কি মেরিয়া?

মেরিয়া-শুনেছি।

মুরলী—দেখেছো কি?

মেরিয়া-কি?

মুরলী রিচার্ডবাবু ওদের কথা শুনে কত খুশি হয়?

মেরিয়া-দেখেছি।

কিন্তু বুঝতে পারে না মেরিয়া, কলকাতার মেয়েদের কাছে বারবার ছুটে যাবার মত কী কাজ থাকতে পারে জোহানার? ওদের সঙ্গে জোহানার ভাব করবার দরকারই বা কি? মাঝে মাঝে বেশ রাগ করে ফেলে মেরিয়ার মনটা, স্যামুয়েল বাবুর বাড়ির আয়া হবার সাধ হয়েছে নাকি জোহানার? তবে আর এত খেটে লিখাপড়া শিখে কেন জোহানা?

জোহানা গল্প করেছে; তাই জানতে পেরেছে মেরিয়া, একদিন তালবনের ভিতরে পিকনিক করেছে লিলি মলি আর জোহানা। ডিমের কারি বেঁধেছে জোহানা, আর লিলি মলি দুই বোনে হাত মিলিয়ে পোলাউ বেঁধেছে।

কিন্তু আজ তো পিকনিক হবে না। জোহানার দুই নতুন মিতালী এখন কলকাতার বাড়িতে বসে চা খেয়ে খেয়ে হাসছে। আর, বোকা জোহানা এখানে ওর ঘরের ভিতরে একলাটি চুপ করে বসে ভাবছে।

মেরিয়ার মনটা হঠাৎ চমকে ওঠে। কাঁদছে নাকি জোহানা? তা না হলে আজ এখানে একবার এল না কেন জোহানা?

দেরি করে না মেরিয়া। সড়ক না ধরে, সোজাসুজি ডাঙা পার হয়ে আরও কিছুদূর এগিয়ে যায়।

তালবনের মাথার মেঘ পালিয়ে গিয়েছে। বিকেলের রোদ লালচে হয়েছে। মুরলীর ঘরের দরজার ভেজানো কপাট আস্তে ঠেলে দিয়ে উঁকি দিতেই মেরিয়ার দুই চোখ হেসে ওঠে। আয়নার দিকে তাকিয়ে জোহানা বহিন মুখ টিপে হাসছে।

দরজার কপাটে টোকা দেয় মেরিয়া। চমকে ওঠে মুরলী। তাড়াতাড়ি শাড়ির আঁচলটাকে তুলে নিয়ে আদুড় বুকটাকে ঢাকা দেয়।

কী বটে জোহানা? কি দেখছিলে জোহানা? ছুটে এসে মুরলীর শাড়ির আঁচলটাকে টেনে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে মেরিয়া।

চোখ পাকিয়ে মেরিয়ার মুখের দিকে তাকায় মুরলী, সঙ্গে সঙ্গে হেসে ফেলে, আর নিজের হাতেরই একটা টানে বুকটাকা আঁচলটাকে সরিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে। এই দেখ।

মেরিয়া হাসে-তিল বটে।

মুরলী–হ্যাঁ, কিন্তু এটা তো ছিল না। এক মাস আগেও না।

মেরিয়া—তবে আর ভাব কেন? আর দেরি নাই, জোহানা।

মুরলী-কিসের দেরি নাই?

মেরিয়া-বুকের খবর নিবার মানুষ আসতে আর দেরি নাই। মু

রলী আবার চোখ পাকিয়ে তাকায়–মিছা কথা।

মেরিয়া হাসে-মিছা কথা নয়, জোহানা, শুন নাই, স্কুলের ছোট দিদি মিস মুরমুর কথা?

মুরলী-কি কথা?

মেরিয়া—এক মাসও হয় নাই, মিস মুরমুর গালে একটা নতুন তিল হলো; আর দুমকা থেকে চিঠিও এসে গেল, বিয়া হবে।

শাড়ির আঁচলটাকে গায়ে জড়িয়ে, মেরিয়ার একটা হাত নরম করে ধরে নিয়ে, মুখ টিপে হাসে আর কথা বলে মুরলী-তুমি বলছে, এটা তিল। আমি বলবো এটা আমার আশার তিলক। আমার মন যাকে সব সময় কাছে পেতে চায়, সে এখনও দূরে সরে রয়েছে। জানি না কতদুরে। কিন্তু বিশ্বাস করি মেরিয়া, আমার স্বপ্ন একদিন তাকে…।

–হেই জোহানা, থাম জোহানা। ছটফটিয়ে হেসে ওঠে মেরিয়া। সত্যিই যে একটা অদ্ভুত বিস্ময়, শান্ত ভাবে সহ্য করতে পারবে কেন মেরিয়া? মুরলীর হাতটাকে টেনে গলায় জড়িয়ে নিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে মেরিয়া-বুঝেছি জোহানা, তুমি এইরকমটি মিঠা কথা শিখে নিবে বলে তোমার নতুন মিতানীদের সাথে এত ভাব সেধেছিলে। তাই বটে কিনা?

মুরলী হাসে-হ্যাঁ, কিন্তু তাতে কোন দোষ হয়েছে কি?

মেরিয়া–না, দোষ নয়। কিন্তু কত তাড়াতাড়ি শিখে নিলে, জোহানা? ভাল হরবোলা তুমি।

আর, মাত্র কয়েকটা মাস পরে, যখন পলুস হালদারের ঘরের নিভৃতে সাইকেলটার গায়ে মরচের দাগ ঘন হয়ে উঠেছে, আর শীতের হাওয়া লেগে ঘরের চালার টালি থেকে শুকনো শেওলা ধুলো হয়ে ঝরে যেতে শুরু করেছে, তখন কনভেন্টের একটি ঘরের নিভৃতে মুরলীর মুখের দিকে তাকিয়ে একটা বিপুল আনন্দের বিস্ময় সহ্য করতে গিয়ে মুরলীরই গালে একটা আহ্লাদের মৃদু চড় মেরে ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে যায় মেরিয়া। তাজ্জব করলে জোহানা! সিস্টার দিদির পিয়ানোটার কাছে বসে দু হাত চালিয়ে আর মনপ্রাণ যেন বিভোর করে নিয়ে মইল কোরাস বাজিয়ে চলেছে মেরিয়ার প্রাণের সখী জোহানা।

সিস্টার দিদি এসেছে। কনভেন্টের কিতাবঘরে বসে এখন বই পড়ছেন। এই খবর জানে মেরিয়া।

সিস্টার দিদির কাছে গিয়ে একটা প্রবল খুশির চিৎকার ছেড়ে ছটফট করতে থাকে মেরিয়া-একবারটি তুমি আসবে কি দিদি?

সিস্টার দিদি চমকে ওঠেন–কি খবর, মেরিয়া? কিসের জন্য ডাকছ?

মেরিয়া-জোহানা বহিনকে একবারটি দেখবে চল, দিদি।

সিস্টার দিদির হাত ধরে টান দেয় মেরিয়া। সিস্টার দিদিও তার নীল চোখের একটা বিরক্তিকর বিস্ময় ধরে নিয়ে মেরিয়ার সঙ্গে হেঁটে এসে কনভেন্টের সেই ঘরের দরজার কাছে দাঁড়ান, যে-ঘরের ভিতরে জোহানার হাতের ছোঁয়ার চমক খেয়ে খেয়ে পিয়ানোর বুকের ভিতর থেকে মঙ্গল কোরাসের মিষ্টি শব্দের উৎস উথলে উঠছে।

দরজার কাছে একটু আড়াল হয়ে দাড়িয়ে শুনতে থাকেন সিস্টার দিদি, আর বিপুল কৃতার্থতায় প্রসা হয়ে সিস্টার দিদির চোখে একটা স্নেহাক্ত গৌরবের হাসি জ্বলজ্বল করতে থাকে।

মুরগীর চোখ দুটো যেন একটা সুস্বপ্নের ছবির দিকে অপলক হয়ে তাকিয়ে আছে। তাই দেখতে পায় না যে, সিস্টার দিদির খুশি চোখ দুটো সুন্দর আশীর্বাদী দৃষ্টি নিয়ে দরজার কাছে একটু আড়ল হয়ে মুরলীর দিকে তাকিয়ে আছে।

ঘরের ভিতরে ঢুকে মুরলীর কাছে এসে দাঁড়ায় মোরয়া; আস্তে আস্তে মুরলীর গায়ে হাত দেয়। রেশমী সুতো দিয়ে বোনা যে নেট গায়ে জড়িয়ে রয়েছে মুরলী, সেই নেটের ঝালর হয়ে ছোট ছোট লেসের ফুল দুলছে। নেটটাকে আস্তে আস্তে মুরলীর গা থেকে তুলে নিয়ে আবার ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে যায় মেরিয়া। সিস্টার দিদির চোখের কাছে নেটটাকে তুলে ধরে আর হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে ফিসফিস করে মেরিয়া? দেখ দিদি, এই ওড়না নিজের হাতে বানালে জোহানা।

আস্তে আস্তে হেঁটে ঘরের ভিতরে ঢুকে মুরলীর কাছে এসে দাঁড়ান সিস্টার দিদি। বাজনা থামিয়ে উঠে দাঁড়ায় মুরলী।

–জোহানা বহিন! ডাকতে গিয়ে সিস্টার দিদির গলার স্বরও মায়াময় হয়ে গলে যায়।

–কি বটে দিদি? প্রশ্ন করে সিস্টার দিদির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে মুরলী।

সিস্টার দিদি হাসেন-আজ আমি তোমার আর একটা পরীক্ষা নিতে চাই জোহানা।

মুরলী-নেন না কেন দিদি।

সিস্টার দিদি-পবিত্র বাইবেল পড়তে শিখেছ?

মুরলীর চোখে যেন একটা তৃপ্ত অহংকারের বিদ্যুৎ চমক দিয়ে ঝলসে ওঠে-শুধু পড়তে শিখি নাই; লিখতেও শিখেছি। আর, যদি শুধাও তবে মুখে মুখে অনেক পাঠ বলে দিব।

সিস্টার দিদি-পর্বতের উপর যীশুর উপদেশ?

মুরলী–জানি দিদি।

সিস্টার দিদি বল, শুনি।

মুরলী-যীশু বসিলেন, শিষ্যেরা তাহার চারিধারে উপস্থিত হইলেন। যীশু উপদেশ বলিলেন-হৃদয়ে যাহারা বিনত, তাহারা সুখী, কারণ ধর্মরাজ্য তাহাদিগের হইবেক। যাহাদিগের মধ্যে শক্ততা নাই, তাহারাই ঠিক সুখী, কারণ তাহারা পৃথিবীর প্রাপক হইবেক। যাহারা কান্দে তাহারা ঠিক সুখী, কারণ তাহারা স্বস্তি পাইবেক। পবিত্রতা পাইতে যাহারা ক্ষুধিত ও পিপাসিত, তাহারা ঠিক সুখী, কারণ তাহারা তুষ্ট হইবেক। যাহারা অপরকে দয়া করে, তাহারা ঠিক সুখী, কারণ তাহাদিগকেও দয়া করা হইবেক। যাহারা মনে পবিত্র, তাহারা ঠিক সুখী, কারণ তাহারা ঈশ্বরের সাক্ষাৎ পাইবেক।

-জোহানা! ডাক দিতে গিয়ে সিস্টার দিদির নীল চোখের কোণে দুটো বড় বড় জলের ফোঁটা টলমল করে ওঠে। মুরলীকে কিছুক্ষণ বুকে জড়িয়ে ধরে সিস্টার দিদিও যেন তার মনের উতলা খুশির আবেগ শান্ত করতে থাকেন। তারপর বলেন-স্কুলের ছোটদিদি মিস মুরম’র বিবাহ হবে, দুমকাতে চলে যাবে। সে আর স্কুলে পড়াতে পারবে না। আমার ইচ্ছা, তুমি ছোটদিদি হয়ে স্কুলের বাচ্চাদিগকে পড়াও।

মুরলী–আজ্ঞা করেন দিদি।

সিস্টার দিদি-হ্যাঁ, আজ্ঞা করলাম। তুমি চল্লিশ টাকা মাসোহারা পাবে; তাতে তুমি খুশি হবে কি জোহানা?

মুরলী-খুব খুশি হব দিদি। কিন্তু…।

সিস্টার দিদি–কি?

মুরলী-কিন্তু আমাকে কনভেন্টের ঘরে ঠাঁই দিতে হবে দিদি; একা ঘরে থাকতে আর মন করে না।

সিস্টার দিদি হাসেন-বেশ তো, যতদিন না পলুস ফিরে আসে, তুমি ততদিন কনভেন্টের ঘরে থাক।

এতদিনে মুরলীর আশার স্বপ্নটা নিজের জোরে ছুটে চলবার সৌভাগ্য পেয়ে ধন্য হয়ে গেল। প্রায় ছুটতে ছুটতে, সন্ধ্যার হারানগঞ্জের ডাডার বাতাস গায়ে মেখে ঘরে ফিরে আসে মুরলী। হ্যাঁ, কত তাড়াতাড়ি দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল আরও বারটা মাস। পলুসের সেই চকচকে সাইকেলটার সব লোহা কত তাড়াতাড়ি মরচেতে ছেয়ে গিয়েছে।

পলুস হালদারের এই ঘরের শেষ রাতটাকে একটা একটানা ঘুমের ঘোরে পার করে দিয়ে পরদিন সকালেই কনভেন্টে যাবার জন্য প্রস্তুত হয় মুরলী। আর্থারবাবু একটা গো-গাড়ি ডেকে দিয়েছে। নিজের জিনিসপত্র গাড়িতে তুলে দিয়ে দরজার কপাটে শিকও তুলে দেয় মুরলী, আর, তালাবন্ধ করেই হাঁপ ছাড়ে।

ঠিক সেই সময় ডাকপিওনও এসে হাঁক দেয়-আপনার টাকা এসেছে।

মুরলীর নরম ঠোঁট দুটো শিউরে শিউরে হাসতে থাকে টাকা নিব না।

ডাকপিওন-ফিরত যাবে কি?

মুরলী-হ্যাঁ।

 

আমি যীশুর ছোট মেষ! প্রতিদিন মোর সুখ অশেষ!!

শিশুদের প্রার্থনা। কনভেন্টের স্কুলের বাচ্চাদের ক্লাসে রোজকার পড়াবার পালা শেষ করবার পর এই প্রার্থনাকে গাওয়াবারও একটা পালা আছে। গাওয়াবার ভঙ্গীটা নামতা পড়বার মত। প্রার্থনার একটা লাইন প্রথমে একা গলায় গেয়ে ওঠে মুরলী; তার পরেই বাচ্চার দল একসঙ্গে গলা মিলিয়ে গায়। গলাটাকে যেন গানের কলের মত একদমে পনের মিনিট ধরে কোনমতে খাটিয়ে নিয়ে স্কুলঘর ছেড়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যায় মুরলী। চল্লিশ টাকা মাইনের চাকরিটার কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবার এই জীবনটাকেও কোনমতে সহ্য করতে হবে, যতদিন না মনটা নিজেই নতুন সাহসের সুখে বলে ফেলে, আর দেরি কর কেন জোহানা?

সেদিন বড় খুশী হলেন সিস্টার দিদি, যেদিন কনভেন্টের লাইব্রেরিতে ঢুকে আলমারির বই ঘেঁটে ঘেঁটে একটি বই হাতে তুলে নিল মুরলী।

সিস্টার দিদি-কি বই নিলে জোহানা?

মুরলী–জেরুসালেম কাহিনী।

সিস্টার দিদি-বই ঘরে নিয়ে যেতে চাও?

মুরলী-হ্যাঁ দিদি।

সিস্টার দিদি–কেন?

চমকে ওঠে মুরলী, যেন একটা আনমনা প্রাণ চমকে উঠেছে। মুরলীর নরম ঠোঁটের চটুল। ও সুন্দর বুদ্ধির হাসিটা হঠাৎ অপ্রতিভ হযে বিড়বিড়িয়ে কেঁপে ওঠে-একটা বড় বই যে..বড় যে দরকার বটে, দিদি।

সিস্টার দিদি-বড় বই? না, ভাল বই?

মুরলী-হা দিদি। একটা ভাল বই।

সিস্টার দিদি-ভাল করে পড়বার ইচ্ছা, তাই ঘরে নিয়ে যেতে চাও?

–হ্যাঁ দিদি। আবার ঝিকমিকিয়ে হেসে ওঠে মুরলীর মুখ আর চোখ।

-বেশ, আমি একটা ভাল বই দিচ্ছি, সেটা আগে ভাল করে পড়। এই নাও, পিলগ্রিমের পরমগতি।

বইটাকে হাতে তুলে নেয় মুরলী। সিস্টার দিদি বলেন—তুমিও একজন পিলগ্রিম। মনে রেখ, অটুট বিশ্বাস রেখে আর হতাশ না হয়ে জীবনের পথে সন্ধানীর মত একের পর এক বাধা জয় করে এগিয়ে যেতে হয়।

সেই দিনই হারানগঞ্জের ডাঙার উপর যখন বিকালবেলার শেষ রোদ লাল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে, তখন সিস্টার দিদির লেখা এক গাদা চিঠি হাতে নিয়ে সড়কের পাশের ডাকবাক্সের দিকে এগিয়ে যেতে গিয়ে ভয় পেয়ে চমকে ওঠে মেরিয়া, আর, যেন একটা হোঁচট খেয়ে সড়কের উপর থমকে দাঁড়ায়। ও কে বটে হোথা শিরীষের ছায়ার কাছে হাতে একটা কিতাব নিয়ে কালা পাথরটার উপর কে বসে আছে গো? হে গড, ওকে যে রিচার্ডবাবুর ঘরণী স্টিফানা বলে মনে হয়!

মেরিয়ার ভীত বিস্ময়টা তখনই লজ্জা পেয়ে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে শিরীষের ছায়ার দিকে ছুটে গিয়ে, আর কালো পাথরটার কাছে এসেই চেঁচিয়ে ওঠে মেরিয়া—এটা কি করেছো জোহানা?

মুরলী-কি করেছি?

মেরিয়া—এমনটি সাজলে কেন?

মুরলী–কেমনটি?

মেরিয়া—ঠিক স্টিফানার রকমটি? রিচার্ডবাবু এখন তোমাকে দেখলে যে তোমাকে ওর ঘরণী বলে মনে করে ফেলবে।

মুরলী হাসে : মনে করুক না কেন!

মেরিয়া-হাতও ধরে ফেলবে যে।

মুরলীধরে ফেলুক না কেন!

মেরিয়ার ঠাট্টার হাসিটা যেন একটা ভয়ানক সন্দেহের ধাক্কা লেগে এলোমেলা হয়ে যায়। ভয়ে ভয়ে ফিসফিস করে মেরিয়া-কেমনটি কথা বলছো?

মুরলী-যেমনটি তুমি শুনলে।

মেরিয়ার মুখরতার আবেগ এইবার স্তব্ধ হয়ে যায়। ঠিকই বটে, জোহানা যে একেবারে স্টিফানাটি হয়ে গিয়েছে। সাদা শাড়িতে সেজেছে জোহানা; গায়ে সাদা জামা। জামার হাতের কিনারায় নীল সুতোর জাল। খোপাতে সাদা ফুল। গলায় একটা সোনার হার, তার সঙ্গে এক টুকরো ঝকঝকে সাদা পাথরও দুলছে। চকচকে জুতো পায়ে দিয়েছে জোহানা। পাথরটা যেন রিচার্ডবাবুর ঘরের একটা সোফা। বইটাকে কোলের উপর রেখে আর পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে পাথরটার উপর বসে আছে। জোহানার শাড়িটাও ঠিক সেই স্টিফানার শাড়িটারই ত ভাজে ভাজে ফুলে আর ফেঁপে জোহানার পায়ের পাতা পর্যন্ত লুটিয়ে রয়েছে। সত্যিই যে ভুল করবে রিচার্ডবাবু! কিন্তু…।

মেরিয়ার চোখ-মুখের ভাবের মধ্যে যেন একটা বিষঃ কিন্তুর ছায়া ছটফট করছে। কিযেন একটা কথা বলতে চায় মেরিয়া। ভীরু আপত্তির মত একটা কথা, কিংবা উদ্বিগ্ন প্রশ্নের মত একটা কথা।

কিন্তু কোন কথা বলবারই আর সুযোগ পায় না মেরিয়া। রিচার্ড সরকার আসছে। প্রায় এসে পড়েছে।

রিচার্ড সরকারের সাইকেল চড়া মূর্তিটা সড়ক ধরে এগিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ মন্থর হয়ে গেল। একটা বিস্ময়বিবশ মন্থরতা। সাইকেল থেকে নেমে আর পথের উপর হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে মুরলীর দিকে অপলক চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে রিচার্ড। হারানগঞ্জের বিকালের হাওয়া লেগে রিচার্ডের গলার রঙিন টাই যেন স্বপ্নালু বিস্ময়ের নিশানের মত ফুরফুর করে উড়তে থাকে।

আস্তে আস্তে হেঁটে, দু চোখের চাহনিতে একটা উদ্বেল কৌতূহল কোনমতে চেপে রেখে শিরীষের ছায়ার কাছে এগিয়ে আসে আর হেসে ওঠে রিচার্ড-কেমন আছেন জোহানা হালদার?

–ভাল আছি। বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় মুরলী।

–আমি চলি জোহানা বহিন। এক নিশ্বাসে কথাগুলি বলে দিয়েই সড়কের পাশের সেই ডাকবাক্সের দিকে তাকায় মেরিয়া; প্রায় একটা দৌড় দিয়ে চলে যায়।

রিচার্ডও যেন একটা স্বস্তির হাঁপ ছেড়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে। চশমাটাকে চোখের উপর থেকে নামিয়ে নিয়ে রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে বলে—আপনাকে তো আর কোনদিন এখানে এভাবে বসে থাকতে দেখি নি।

মুরলী হাসে-দেখবেন কেমন করে? আজই যে প্রথম এলাম।

রিচার্ড-তাই বলুন।

মুরলী–আপনি ভাল আছেন?

রিচার্ড-হ্যাঁ, ভাল আছি। কিন্তু–

–কি?

–কই, আর একদিনও তো আমাকে একটা খবর পর্যন্ত দিলেন না যে, আপনি ভাল আছে কি না-আছেন।

–আপনিও তোত কোন খবর নিলেন না, আপনার রুগীটা বেঁচে আছে কি না-আছে।

–নেওয়া উচিত ছিল।

–আমারও উচিত ছিল, কিন্তু—

–কি?

–সারাদিনের কাজের মধ্যে এমন একটু সময়ও পাই না যে…

–কাজ? কি কাজ করেন আপনি?

–সে আর বলবেন না। সকালে উঠেই স্কুলের মাস্টারনীগিরি; দুপুর বেলা সিস্টার দিদির সঙ্গে লাইব্রেরীতে যত পড়াশুনা আর লেখালেখি; বিকালবেলা মেরিয়ার ঘরে বসে যত সেলাই আর কাটাকুরুশের কারিগরী। বিকেল শেষ না হতেই সিস্টার দিদির টেবিলের জন্য ফুলের তোড়া বাঁধা; সন্ধ্যে হতেই লুসিয়া দিদির বাড়িতে গিয়ে পিয়ানো বাজাও আর গান গাও। হাঁপ ছাড়বারও সময় পাই না রিচার্ডবাবু।

অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকে ডাক্তার রিচার্ড সরকার, যেন হঠাৎ ঘুমভাঙা চোখ। যেন এক জাদুকরীর মুখ থেকে তার জীবনের রূপকথা শুনছে রিচার্ড।

হেসে ওঠে মুরলী-আপনি কি-যেন ভাবছেন; আমার বাজে কথাগুলি একটুও শুনতে পাচ্ছেন না।

-শুনেছি, সবই শুনেছি জোহানা হালদার। কিন্তু…কী আশ্চর্য…আমি…আমি আপনাকে খুবই ভুল বুঝেছিলাম।

কিছুক্ষণ আনমনার মত শিরীষের ছায়াটার দিকে তাকিয়ে কি-যেন ভাবে রিচার্ড সরকার। তারপরই প্রশ্ন করে–আপনি নিশ্চয়ই বেড়াতে বের হয়েছে?

মুরলী-হ্যাঁ।

রিচার্ড-তবে চলুন, আপনার আপত্তি না থাকে তো আমিও আপনার সঙ্গে গল্প করতে করতে একটু এগিয়ে যাই।

মুরলী হাসেচলুন, আপনার সঙ্গে আমার একটু বাড়িতে যেতে হবে।

রিচার্ডের গলার স্বর যেন নিবিড় আবেদনের মত হঠাৎ মৃদু হয়ে যায়। তাই বলছি জোহানা হালদার। চলুন।

মুরলীর বুকের ভিতরে সব নিশ্বাস উতলা হয়ে ওঠে। সেই নিশ্বাসের একটা রক্তাভ ঝলক দিয়ে মুখের উপর ছড়িয়ে পড়ে। সত্যিই যে আরও ভাল নতুন জীবনের, আরও বড় সুখের বড় সড়কে এগিয়ে যাবার ডাক শুনতে পেয়েছে মুরলীর ভাগ্য।

সড়কের দু পাশের অনেক গাছের অনেক ছায়া পার হয়ে যাবার পর, যখন রিচার্ডের বাড়ির ফটকের সবুজ লতার বিতাটা দেখতে পাওয়া যায়, তখন মুরলী হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়

—এইবার আমি ফিরে যাই রিচার্ডবাবু। আর আমাকে এগিয়ে যেতে বলবেন না।

যেন আরও একবার পরীক্ষা করে দেখতে চায় মুরলী, সত্যিই এই পথে এগিয়ে যেতে আর কোন বাধা নেই, এতদূর এগিয়ে আসাও মিথ্যে আশার ছলনা নয়।

রিচার্ডের মুখটা হঠাৎ করুণ হয়ে যায়, যেন রিচার্ডের মনের একটা আশার ব্যাকুলতা হঠাৎ বাধা পেয়ে ব্যথিত হয়েছে। একটা কথা বলবো, কিছু মনে করবেন না।

–বলুন, আমি কিছুই মনে করবো না।

–সেই সেদিনের পর থেকে আপনি আর একদিনও আমার বাড়িতে এলেন না কেন?

–যাওয়া কি উচিত হতো?

–কেন উচিত হতো না?

–আপনি তাহলে আমাকে সন্দেহ করতেন।

–কেন কিসের সন্দেহ করতাম?

–ভেবে দেখুন।

–আমি কিছু ভেবে পাচ্ছি না।

–আমি বলতে পারি।

–রিচার্ড হাসে-তবে বলুন।

মুরলীও হাসে-আপনি তাহলে সন্দেহ করতেন যে, জোনা হালদারের মনে কোন মতলব আছে।

–ছি, ছি, কখনো না, আমি আপনার মত মানুষকে এরকম সন্দেহ করতেই পারতাম না।

–সন্দেহ না করলেই ভুল করা হত রিচার্ডবাবু।

রিচার্ডের চশমার কাচ যেন আশ্চর্য হয়ে চমকে ওঠে আর কিরকির করে-কি বললেন?

মাথা হেঁট করে মুরলী; চোখের পাতাও হঠাৎ ভিজে যায়–জেহানা আপনাকে ভালবাসে, আপনি কোনদিন স্বপ্নেও এমন সন্দেহ করতে পারেন নি, আজও পারবেন না। কিন্তু…।

–জোহানা! রিচার্ডের গলার স্বর কেঁপে ওঠে।

মুরলী–আমাকে আর কোন কথা বলবেন না। এইবার আমাকে যেতে দিন।

–কোথায় যাবে তুমি?

–কনভেন্টে।

–কনভেন্টে কেন?

–থাকবার ঠাঁই আর কোথাও নেই, তাই।

–পলুস হালদার কোথায়?

–সে আছে ডালটনগঞ্জে; মৌপুর সিমেন্টের কারখানায়। কি…

–কি?

–তার কোন কথা আমাকে আর জিজ্ঞেস করবেন না।

–কেন জোহানা?

–আমার জীবনের শাস্তির কথা তুলে আমাকে কষ্ট দেবেন না রিচার্ডবাবু। বলতে বলতে ফুঁপিয়ে ওঠে আর হাতের বইটা দিয়ে মুখ ঢাকা দেয় মুরলী।

–জোহানা! রিচার্ডের গলার স্বরও সমবেদনার আর্তনাদের মত ফুঁপিয়ে ওঠে।

মুরলী—এ দুর্ভাগ্য আর কতদিন সহ্য করতে পারবো জানি না। পৃথিবীতে এমন কাউকে দেখছি না যে, আমাকে ওই অভিশাপের হাত থেকে বাঁচাতে পারে।

রিচার্ড—আমি বাঁচাতে পারি। রিচার্ড সরকারের গলার স্বরে যেন একটা প্রতিজ্ঞাময় সৎসাহস গুমরে ওঠে।

মুরলী-আপনি ভেবে দেখুন।

রিচার্ড-ভেবে দেখেছি।

হেসে ফেলে মুরলী—এরই মধ্যে কখন্ ভেবে দেখলেন?

গলা দুলিয়ে কামিজের কলারের চাপ একটু আলগা করে দিয়ে রিচার্ড এইবার জোর গলায় চেঁচিয়ে ওঠে-হ্যাঁ, এরই মধ্যে ভেবে দেখেছি।

মুরলী-কি?

রিচার্ড—তোমাকে সত্যিই প্রাণ দিয়ে ভালবাসতে আর ঘরে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে, জোহানা।

-কেন রিচার্ড?

-স্টিফানা মারা যাবার পর থেকে আজ পর্যন্ত, এই তিন বছরের মধ্যে কোন মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে এত ভাল লাগে নি।

-স্টিফানাকে তুমি নিশ্চয় খুব ভালবেসেছিলে?

–খুবই ভালবেসেছিলাম।

–আজও ভালোবাসো নিশ্চয়।

–নিশ্চয়।

–তবে?

–কি?

–জোহানাকে পেয়ে কি স্টিফানার অভাব ভুলতে পারবে?

–পারবো।

-কেন?

–তোমাকে যে আমার সেই স্টিফানা বলেই মনে হয়। শুধু মুখটা আরও সুন্দর।

-স্টিফানার উপর যে মায়া করতে পারতে, আমার মত মানুষের উপর কি সে মায়া করতে পারবে?

-আরও বেশি মায়া করতে পারবো।

–কেমন করে বুঝলে?

–আমার মন বলছে।

রিচার্ডের মুগ্ধ মুখটার দিকে তাকিয়ে মুরলীর কালো চোখের বিদ্যুৎ এইবার ঝিকঝিক করে হেসে-হেসে যেন জ্বলতে থাকে। রিচার্ডের বাড়ির ফটকটাও যে একেবারে কাছে এসে পড়েছে। ফটকের লতা থেকে রঙিন ফড়িংগুলো মুরলীর খোঁপার উপর বসবার লোভে আকুল হয়ে ছুটে আসছে। মুরলীর আশার হিসাব চরম জয়ের আশ্বাস পেয়ে গিয়েছে।

রিচার্ড বলে—একটা অনুরোধ।

মুরলী-বল।

মুরলীর হাত ধরে রিচার্ড-এস।

মুরলী-কোথায়?

রিচার্ড—আমার ঘরে।

মুরলী যেন এখনই মাথাটাকে রিচার্ডের কাঁধের উপর হেলিয়ে দিতে চায়-আজ মাপ কর রিচার্ড। এত তাড়াতাড়ি করতে যে বড় ভয় করছে।

রিচার্ড-ছিঃ, কোন ভয় নেই। যে-ঘরে চিরকাল থাকবে, সে-ঘরে যেতে ভয় আবার কিসের?…এস।

-কে বটে গো? কে বটে গো? মুরলীকে চিনতে না পেরে দাইটা যেন একটা ভীরু বিস্ময়ের আবেশে কেঁপে কেঁপে চেঁচিয়ে ওঠে।

হেসে ওঠে রিচার্ড-কাছে এসে মুখ দেখে চিনে নাও, দাই। আর তাড়াতাড়ি চায়ের জল গরম কর।

রিচার্ডের ঘর, যে ঘরের দেয়ালে ছবির স্টিফানার চোখে এখনও সেই অদ্ভুত হাসি শিউরে রয়েছে। সেই ছবি, যার মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে সেদিন মুরলীর চোখ দুটো ভয় পেয়ে শিউরে উঠেছিল। সেকথা মনে পড়তেই মুরলীর চোখে যেন ছোট্ট একটা ঠাট্টার মিষ্টির শিহর হেসে ওঠে; স্টিফানার ছবির দিকে করুণাময়ী বিজয়িনীর মত একটা অদ্ভুত রকমের শান্ত প্রসন্ন দৃষ্টি তুলে তাকিয়ে থাকে মুরলী।

রিচার্ড বলে বসো জোহানা।

সেই সোফাটার উপরেই নিশ্চয় বসে পড়তো মুরলী; কিন্তু বসতে পারল না; কারণ, রিচার্ডই বাধা দিয়ে বলে–না, ওখানে নয়।

মুরলীকে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যেয়ে পিয়ানোর কাছে ছোট টুলের উপর বসিয়ে দেয় রিচার্ড : তোমার হাতের বাজনা আর তোমার গলার গান।

রুমাল তুলে মুখের ঢলঢলে লাজুক হাসিটাকে আড়াল করতে চেষ্টা করে মুরলীএখনই?

রিচার্ড-হ্যাঁ, এখনই। দাইটা এখনই বুঝে ফেলুক যে, তুমি আমার ঘরের মানুষ হয়ে গিয়েছ।

–প্রিয় জেসু যদি আসিবে। পিয়ানোর ঝংকারের সঙ্গে মুরলীর গলার স্বরও ঝংকার দিয়ে বেজে ওঠে।

রিচার্ডের চোখের চাহনিও যেন নীরবে ঝংকার দিয়ে চমকে ওঠে। কী আশ্চর্য, স্টিফানাও যে এই গানটাকেই রোজ একবার।

-মরুতে মরুতে সুধানদী যদি বহিবে! তুমি পিপাসিত কেন রহিবে? হা, সেই গানটাই গাইছে জোহানা। কিন্তু, জোহানার গলার মধুতে কত মিষ্টি হয়ে গিয়েছে গানটা! গাইতে গাইতে জোহানার কালো চোখ দুটোও যেন গানের রসে ভিজে গিয়ে চিকচিক করছে। গান গাইবার সময় স্টিফানাকে এত সুন্দর দেখাত না।

ট্রের উপর চায়ের পট আর পেয়ালা সাজিয়ে নিয়ে ঘরের ভিতরে ঢোকে দই, আর টেবিলের উপর রেখে দিয়েই চলে যায়।

গান থামিয়ে মুরলী বলে–এইবার আমাকে আমার ইচ্ছামত একটা কাজ করতে দাও।

–কি কাজ?

–আমি চা তৈরী করি।

–জোহানা! মুরলীর একটা হাত বুকের উপর তুলে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে রিচার্ডের গলার স্বর নিবিড় হয়ে ওঠে। চিরকাল এমনি করে তুমি আমার সব সাব…।

চায়ের পটে হাত দিয়ে মুরলী বলে–সে কথা কি তোমাকে বার বার বলতে হবে? আমাকে চিনেও কি চিনতে পারছো না?

–চিনেছি, তাই বলছি। আমার সব সম্মান তোমার হাতে ছেড়ে দিলাম। তুমি কথা দাও…।

–কি কথা?

–আমার সব মান তুমি বাঁচিয়ে রাখবে।

–নিশ্চয় রিচার্ড। তুমি যে আমারও মান।

চা খাওয়া শেষ হতেই উঠে দাঁড়ায় রিচার্ড-কাছে এস জোহানা।

আবার আহ্বান। মুরলীর জীবনের পথিক স্বপ্নটা যেন রিচার্ডের এক-একটা আশ্বাস সান্ত্বনা আর প্রতিশ্রুতির পুণ্যে এইবার পরম বিশ্রামের ঠাঁই পেয়ে গিয়েছে। আর বলবার কিছু নেই; আর জানবার কিছু নেই। রিচার্ড সরকারের এই সুখের ঘর মুরলীর জীবনের ঘর। কিন্তু এখনই কাছে ডাকছে কেন রিচার্ড?

টেবিলের ফুলদানির উপর থেকে ফুলের তোড়াটা তুলে নিয়ে মুরলীর হাতের কাছে এগিয়ে দেয় রিচার্ড। ফুলের তোড়াটাকে অদৃষ্টের চরম উপহারের মত বুকের উপর রেখে দু হাত দিয়ে সাপটে ধরে মুরলী। মুরলীর নরম ঠোঁট কাঁপে, কালো চোখ দুটো চিকচিক করে; এই মুহূর্তে একেবারে কুণ্ঠাহীন হয়ে মুরলী যেন রিচার্ডের ঠোঁট দুটোকে প্রতিদানে তপ্ত করে দিতে চায়।

রিচার্ড হাসেচল, এবার তোমাকে তোমার সিস্টার দিদির কাছে নিরাপদে পোঁছে দিয়ে আসি।

ফটক পার হয়ে সড়কের উপর উঠবার পর আর চলতে চলতে সড়কের পাশে সেই শিরীষের কাছে ফিরে এসে যখন দেখতে পাওয়া যায়, শিরীষের ছায়ার আশে-পাশে জ্যোৎস্না ছড়িয়ে আছে, তখন আর একবার মুরলীর হাতটাকে বুকের উপর রেখে কনভেন্টের ফটকের দিকে তাকায় রিচার্ড : আজ আর বেশি এগিয়ে যাব না, জোহানা।

মুরলী হাসে-কেন, কিসের লজ্জা?

রিচার্ড হাসে-হা, লজ্জা পেতে হচ্ছে। কনভেন্টের ফটকের কাছে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে।

-কে দাঁড়িয়ে আছে? ফটকের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠতে গিয়েই গম্ভীর হয়ে যায় মুরলী। কি-যেন সন্দেহ করে মুরলীর চোখ দুটো দপ করে জ্বলে ওঠে।

সিস্টার দিদি নয়, মেরিয়াও নয়। মনে হচ্ছে, অন্য কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। ফটকের কাছে জ্যোৎস্নামাখা লাল কাকরের উপর একটা কালো ছায়াদেহ। মুরলীর চোখের তারা দুটো যেন স্ফুলিঙ্গ চুটিয়ে সেই কালো ছায়াদেহের দুরাশা আর দুঃসাহসের আহ্বাদ এখনি পুড়িয়ে ছাই করে দিতে চায়।

রিচার্ড বলে—আজ তবে আসি জোহানা। মুরলীর হাতটাকে বুকের কাছ থেকে আস্তে আস্তে নামিয়ে দেয় রিচার্ড।

-এস। রিচার্ডকে বিদায় দিয়ে হনহন করে হেঁটে কনভেন্টের ফটকের কাছে এসে থমকে দাঁড়ায় মুরলী।

হারানগঞ্জের আকাশের চাঁদ। কনভেন্টের পাচিলের পাশে ঝাউয়ের পাতা মৃদু ঝড়ের সঙ্গে শ্বাস মিশিয়ে দিয়ে সির-সির করে আর শব্দ করে কাঁপে। দূরে হাসপাতালের কাছে আমের বাগিচাতে কোকিল ডাকে। ধবধবে সাদা সাজের মুরলী ফটকের লাল কাঁকরের উপর ধবধবে পাথুরে কঠোরতার মত শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ডাক দেয়-কে?

পলুস বলে–আমি এসেছি।

মুরলী-কেন?

উত্তর না দিয়ে শুধু মুরলীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে পলুস। পলুসের অপলক চোখ দুটো যেন নির্মম বিস্ময়ের নির্জীব পিণ্ড। ভীরু চোখ, ক্লান্ত চাহনি। যেন অনেক দুরের আকাশের একটা ধবধবে সাদা আগুনের চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে কলঘরের মিত্তিরীর হতভম্ব ভাগ্যটা।

এই কালো ছায়াদেহের হাড়মাংসের সবই যেন প্রাণ হারিয়ে ধুলো হয়ে গিয়েছে। চেঁচিয়ে ওঠে না পলুস। পলুসের সেই শক্ত চোয়াল কড়কড় করে বেজে ওঠে না। ছেলেমানুষের বিলাপের মত নাকি-সুরে একটা শব্দ করে কেঁপে ওঠে পলুসের মুখটা-আমার ঘরের চাবিটা?

হ্যাঁ, ঠিকই, পলুসের ঘরের চাবিটা মুরলীর কাছেই ছিল। কিন্তু একটুও মনে পড়ে না মুরলীর, কোথায় আছে চাবিটা? খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। মুরলী বলে-চাবিটা নেই।

-ভাল। মুখ ফিরিয়ে নেয় পলুস, আর, একবার পিছুপানে না তাকিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *