০৯. পিলাই কাটাই

পিলাই কাটাই। এজরা ব্রাদার্সের কয়লাখাদের ভিতরে ও বাইরে একটা ব্যস্ততার মহোৎসব।

বিকাল থেকে পিলার কাটাই শুরু হয়েছে। সন্ধ্যা পার হয়ে রাতেরও প্রায় আধ প্রহর পার হয়ে গিয়েছে। হাবিস করে হয়রান হয়ে যাচ্ছে টালোয়ান। অফুরান ক্ষুধার আবেগে খাদের গভীরে নেমে যাচ্ছে শুন্যেদের টবগাড়ি; আর এক একটা বিশ হন্দরের উদর ভর্তি করে চাপ চাপ কয়লার টুকরোতে পরিপূর্ণ হয়ে উপড়ে উঠে আসছে। ম্যানেজার দু বার খাদের ভিতরে গিয়ে পিলার কাটাইয়ের ব্যবস্থা তদারক করে গিয়েছে।

আজ সব ব্যাপারেই অতিরিক্ততা। বেশি করে মালকাটা লাগানো হয়েছে। বেশি করে টবগাড়ি ছাড়া হয়েছে। টবের হিসাব করবার জন্য দুজন বেশি মুন্সী খাদের নীচে নেমে গিয়েছে। একজনের জায়গায় তিনজন ওভারম্যান কাজে নেমেছে। ফার্স্ট এড় সরঞ্জাম নিয়ে ডাক্তারও খাদের ভিতরে নেমেছে।

দখিনা সুঁদের আগুতে আর মাল নেই; পাথরের ফাঁড় দেখা দিয়েছে। সেখানে আজ পিলার কাটাইয়ের মহোৎসব। ছাড় কয়লার যেসব পিলার পাথুরে ওভারবার্ডেন মাথায় নিয়ে চুপ করে সারি সারি দাঁড়িয়ে ছিল, তারই উপর আছাড় খেয়ে পড়ছে শত শত গাইতার কোপ। কয়লা-ডোর ঝটকা উড়ছে, হাজার শালের রোলা দিয়ে ঠেকানো পাথুরে ছাদের একটা অন্ধ আক্রোশের ভার পট পটু শব্দ করে ফাটছে। মাঝে মাঝে বিদীর্ণ পাষাণের শব্দ রাক্ষুসে হুংকারের মত ফেটে পড়ছে।

মালকাটার বুকের পাঁজর কেঁপে উঠলেও মালকাটার হাতের গাইতার দুঃসাহস একটু বিচলিত হয় না। পিলারের উপর কোপ দিয়ে কয়লার এক-একটা প্রকাণ্ড চাঙ্গড় টেনে এনে টব বোঝাই করছে সবাই। যে টব বোঝাই করতে অন্যদিন চার ঘণ্টা লাগে, সে টব আজ এক ঘণ্টায় ভরে ফেলেছে এক একজন মালকাটা। আজকের রোজগারের আশাও একটা ভয়ানক নেশা; লুঠেরা ডাকাতের মত হিংস্র হয়ে আর মরিয়া হয়ে যেন একটা ভাণ্ডার লুঠ করছে মানকাটার দল। তারই মধ্যে দেখা যায়, সব চেয়ে বেশি দূরন্ত দুঃসাহসে মরিয়া হয়ে গাঁইতা চালিয়ে যাচ্ছে মধুকুপির দাশু ঘরামি।

সরদার হাঁক দেয়-খবরদার! দাশু ঘরামি, খবরদার! আর আগে যাবে না, খবরদার!

কিন্তু দাশু বোধহয় শুনতে পায় না। মজুরী লুট করবার এই প্রচণ্ড মহোৎসবে মন-প্রাণ লুটিয়ে দিয়ে গাঁইতা চালিয়ে যাচ্ছে দাশু। এরই মধ্যে পাঁচ টব বোঝাই করে ফেলেছে দাৎ; কিন্তু তবু শ্রান্তি নেই। জিরোতে চায় না দাও।

ছাদ ফাটে, কালো ধুলোর ঝট্‌কা ছোটে, শালের রোলা ছিটকে পড়ে, আর মাথার উপরে অন্ধ পাথরের ভার গুমরে গুমরে আরও কাছে নেমে ঝুলতে থাকে। সরদার হাঁক দেয়খবরদার!

বার বার হুঁশিয়ারি দাগ এক লাফে টপকে গিয়ে ভাঙা পিলারের চাঙড় টেনেছে দাশু। চিৎকার করে ধমক হাঁকে সরদার ও মরবি নাকি রে দেহাতী গাধা। দাশুর গাইতার উপর লাঠি মেরে, দাশুকে ধাক্কা দিয়ে পিছনে সরিয়ে দেয় সরদার। চুপ করে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে থাকে দাশু।

সেই মুহূর্তে আতঙ্কিত হয়ে হাঁক ছাড়ে সরদার–গাঁইতা রোকো, মালকাটা। পিছে হঠো, মালকাটা। ঢিবরি নিভাও, মালকাটা। সুদ ছাড়ো, বাইরে ভাগো মালকাটা!

বেজে উঠেছে গ্যাসবাবুর হুইসিল। গ্যাস দেখা দিয়েছে। আতঙ্কের হুইসিলটা বাজতে বাজতে খাদের মুখের দিকে চলে যায়। ঢিবরি নিভিয়ে দিয়ে ওভারম্যানের সেফটি ল্যাম্পের সঙ্কেতের দোলানি লক্ষ্য করে মালকাটার দল ছুটতে থাকে।

কিন্তু একটা মিনিট পার না হতেই দখিনা সুঁদের অন্ধকারময় বিরাট রটা যেন গুমরে ওঠে; আর, প্রচণ্ড হাওয়ার একটা ঝাপ্টা ছুটে চলে যায়। মুখ থুবড়ে পড়ে যায় তিনটা মালকাটা। গ্যাসের শওয়া ফেটেছে।

খাদের মুখের কাছে সাইরেনের করুণ আর্তনাদ শিউরে শিউরে বাজতে থাকে। খোলা ভাঙা পার হয়ে দূরের মধুকুপির বড়কালুর আর ছোটকালুর মাথার উপর দিয়েও এই আতঙ্কের ক্ষীণ স্বর ভেসে চলে যায়। মাথা গুনতির পর দেখা গেল, চারজন মালকাটা নেই। দুশ্চিন্তিত ম্যানেজার বিচলিত স্বরে হাঁকডাক করেন : রে! রেস্তু!

টর্চ দড়ি স্ট্রেচার আর জল নিয়ে খাদের ভিতরে নামবার জন্য যে রেঙ্কু পার্টি প্রস্তুত হয়, তাদেরই একজনের মুখের দিকে তাকিয়ে ম্যানেজার বলেন-এক শো টাকা বকশিশ দেব, পলুস।

পলুস বলে–বহুৎ আচ্ছা স্যার।

কে না জানে, কলঘরের বড় মিস্তিরি এই পলুস হালদার এর আগে তিনবার এই খাদেরই তিনটে দুর্ঘটনায় রেস্কার কাজ করেছে। তিনবার বকশিশ পেয়েছে কলঘরের বড় মিস্তিরি পলুস হালদার। আর এক মুহূর্তও দেরি না করে সুড়ঙ্গের ঢালু ধরে খাদের গভীরে প্রায় দৌড়ে দৌড়ে নেমে যেতে থাকে পলুস আর রেস্ক্যু দল!

দখিনা সুঁদের মুখের কাছে এক জায়গায় জড়সড় হয়ে বসে ছিল যারা, তারা হলো জানুনগড়ার তিনজন দেহাতী মালকাটা। হাওয়ার ঝটকার চোট বুকে পিঠে লেগেছিল, হঠাৎ দম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, আর মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছিল। তাই মুখের এখানে-ওখানে চাম ছড়ে গিয়েছে, জখমগুলি সাংঘাতিক কিছু নয়। জখমের চেয়ে ওদের হতভম্ব চোখ আর মুখগুলি বেশি করুণ। এক হাতে নেবানো ঢিবরি আর অন্য হাতে গাঁইতা ধরে যেন একটা আতঙ্কের ভারে অনড় হয়ে বসে ছিল ওরা।

পৌঁছে যায় রেস্ক্যু দল; কলঘরের বড় মিস্তিরি পলুস হালদার, তিনজন মেশিন খালাসী, তিনজন কুলী মেট আর কম্পাউণ্ডার। রেস্ক্যু দলের হাঁকডাকে চমকে ওঠে তিন মালকাটা। উঠে দাঁড়ায়, জল খায়, তারপর হাঁপ ছেড়ে হাসতে থাকে। একজন কুলি মেটের হেপাজতে তিন মালকাটাকে খাদের বাইরে রওনা করিয়ে দিয়ে সুদের ভিতরে টর্চের আলো ছেড়ে পলুস।

বিপদ যত ভয়ানক বলে মনে হয়েছিল, তত ভয়ানক নয়। গ্যাসে আগুন লেগেছে বলে মনে হয় না। বোধহয় এঁদের ছাতের শেষ দিকটা ধসেছে; তাই প্রচণ্ড হাওয়ার ঝটকা ছুটে গিয়েছে।

কিন্তু আর একটা মালকাটা কোথায়? গ্যাসে জখম হয়ে সুদের ভিতরে কোথাও পড়ে আছে কি।

উপর থেকে তিনটে টবগাড়ি জলে ভরা বড় বড় ড্রাম নিয়ে নেমে আসে। তিন মেশিন খালাসী একসঙ্গে হাত লাগিয়ে পাম্প চালায়; হোস পাইপ হাতে তুলে নিয়ে সুদের ভিতরে জলের ফোয়ারা ছড়াতে থাকে পলুস হালদার।

-গ্যাস মরে এসেছে বোধহয়। বিড়বিড় করে কম্পাউণ্ডার।

–না মরলেও এই গ্যাসের তেজ নাই মনে হয়। ফিসফিস করে একজন কুলি মেট।

–তোমরা এখানে থাক। আমি একটুক তল্লাস করে দেখি। ভেজা গামছা নাকের কাছে ধরে রেখে, আর টর্চ হাতে নিয়ে সুদের ভিতরে এগিয়ে যায় পলুস। একশো টাকা বকশিশের সবটুকু পেতে হলে যে সাহস আর বুদ্ধি দরকার, তার সবটুকু কলঘরের বড় মিস্তিরি এই পলুস হালদারের আছে।

টর্চের আলো ছড়িয়ে দেখতে থাকে পলুস। না, কোন জখমী মালকাটার শরীর এঁদের ভিতরে কোথাও পড়ে নেই। মাঝে মাঝে ভিতরের দিক থেকে গুম গুম শব্দ, আর ছোট ছোট হওয়ার ঝটকা ছুটে আসছে। তবে কি ছাদের ধসে চাপা পড়ে গুঁড়ো হয়ে গেল মানুষটা?

গ্যাসের তেজ নাই ঠিকই; আরও ভিতরে এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় পলুস। কী আশ্চর্য, পলুসের পায়ের কাছেই পড়ে আছে একটা ঢিবরি। দেখে খুশি হয় পলুস। না, ধস চাপা পড়ে নি বোকা মালকাটা; এতদূর যখন পালিয়ে আসতে পেরেছে, তখন এদিকেই কোথাও না কোথাও পড়ে আছে। এঁদের গায়ের ডাইনে বাঁয়ে টর্চের আলো ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেখতে থাকে পলুস; তারপর একটা লাফ দিয়ে এগিয়ে যেয়ে একটা মানুষের হাত চেপে ধরে।

যেন কালো পাথরের হাত-পা দিয়ে তৈরী একটা মজবুত চেহারার লোক, কয়লার গুঁড়োতে চোখ মুখ ছেয়ে গিয়েছে; সঁদের গায়ে হেলান দিয়ে, মাথা ঝুকিয়ে, চোখ বন্ধ করে আর স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গাইতাটাকে তবু শক্ত করে এক হাতে আঁকড়ে ধরে রেখেছে লোকটা। লোকটার নাক দিয়ে রক্ত ঝরে পড়ছে।

লোকটার মুখের উপর টর্চের আলো সুস্থির করে ধরে রেখে, ভেজা গামছা দিয়ে লোকটার চোখ নাক মুখ মুছে দিতে থাকে পলুস : ডর নাই, কথা বল মালকাটা।

লোকটার কানের কাছে মুখ এগিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে ডাকতে থাকে পলুস। তারপর চমকে ওঠে, দু পা পিছিয়ে সরে যায়।

লোকটার নাক মুখ চোখ থেকে কয়লাডোর আবরণ ভেজা গামছার জলে ধুয়ে যেতেই ফুটে উঠেছে একটা চেনা মুখ। এই তো সেদিন, এক জঙ্গলের নিভৃতে ঘোর কালো রাতের অন্ধকারে একটা গাছের কাছে পলুসের হাতের এই টর্চেরই আলোর ঝাজ সহ্য করতে গিয়ে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল এই মুখটা; এরই নাম দাশু ঘরামি, পলুসের দয়ায় আর ক্ষমার যে মানুষটার প্রাণ বার বার দুবার অনেক শাস্তির মার থেকেই রেহাই পেয়ে গিয়েছে। এই লোকটা আজও মুরলীর মত নারীর জীবনের মরদ হয়ে আছে। মুরলীর দুর্ভাগ্য; আর পলুস হালদারের বুকের সেই দুর্বার পিয়াসেরও দুর্ভাগ্য।

দাশুর কাছে এগিয়ে এসে, দাশুর দু কাঁধের উপর হাত রেখে আর শক্ত একটা ঝাকুনি দিয়ে হেসে ওঠে পলুস-মধুকুপির দাশু ঘরামি বটে কি?

চোখ মেলে মিটমিট করে তাকায় দাশু। জোরে জোরে দুবার নিঃশ্বাস টানে; তারপর চোখ বড় করে একটা নিথর ও অপলক দৃষ্টি তুলে পলুস হালদারের ছায়াময় অস্পষ্ট মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর থরথর করে কেঁপে ওঠে। এখানেও পলুস হালদার! দাশুর জীবনের সেই অভিশাপের মূর্তি!

পলুস হাসে: মুরলীর মরদ, মধুকুপির কিষাণ এখানে কেন? কী অদ্ভুত পলুসের এই হাসির শব্দ! কিষাণের ঘরের সাধ আর শারি শত্রু হয়েছে। দো-আঁশ মাটির আর সবুজ ক্ষেতের শত্রুটা কথা বলছে। মধুকুপির মাদল-ঝুমুরের শত্রু সেই পলুস হালদার দাশুর ভাগ্যটাকে ঠাট্টা করছে। পরম জয়ের আনন্দে হি-হি করে হাসছে কালো নরকের দানব। দাশুর বুকের ভিতর থেকে যেন এক ঝলক তপ্ত রক্ত উথলে উঠে দাশুর চোখের উপরে ছড়িয়ে পড়ে। চোখ দুটো হঠাৎ লাল হয়ে রক্তপিপাসু নেশার জ্বালায় ছটফট করতে থাকে।

গাইতার হাতল দুহাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে আর-একবার কেঁপে ওঠে দাশু। তারপর একটা লাফ দিয়ে এগিয়ে যেয়ে পলুসের মাথা লক্ষ্য করে গাঁইতা তোলে।

-এ কি? তুমি কি পাগল হয়ে গেলে সরদার? পলুসের হাসিটা করুণ আর্তনাদ হয়ে কেঁপে ওঠে। পলুসের হাতের টর্চও থরথর করে কাঁপে। কিন্তু দাশুর গাইতার মুখটাও চিকচিক করে একটা শাণিত হাসি কাপাতে থাকে। দাশুর হাতের বধির গাঁইতা পলুস হালদারের এই আর্তস্বরের আবেদন যেন শুনতেই পায় নি। পলুসের মাথার উপর লাফিয়ে পড়ে একটা কোপ দিয়ে কাচা রক্তের ফোয়ারা পান করার জন্য দূরন্ত পিপাসার আক্রোশ নিয়ে আবার দুলে ওঠে গাঁই।

চেঁচিয়ে ওঠে পলুস-তুমি আমাকে মারবে কেন সরদার? ভুলে যাও কেন, আমি তোমাকে কত দয়া করেছি, তোমাকে কত সাজার ভয় থেকে বাঁচিয়েছি। আমি যে তোমার জখমের রক্ত এখনই নিজের হাতে মুছে দিয়েছি।

দয়া! পলুস হালদারের এই দয়াই যে দাশু ঘরামির অদৃষ্টের সবচেয়ে কঠোর সাজা। আর সহ্য হয় না এই দয়া। দাশুর নিশ্বাসের শব্দ আরও রুষ্ট হয়ে ঘড়ঘড় করতে থাকে। গাইতাটাকে একবার নামিয়ে “য়ে আবার পলুসের মাথার উপর কোপ দেবার জন্য তুলে ধরে আর লাফিয়ে ওঠে দাশু।

–দয়া কর সরদার। পলুসের বুকে ভিতর থেকে আরও করুণ ও আরও ভীরু স্বরের একটা আবেদন ঠিকরে বের হয়ে কারাতে থাকে।

দয়া চাইছে পলুস হালদার। দাশু ঘরামির জীবনকে বার বার দয়া করে নিষ্ঠুর দেমাকের বিষে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে পলুস হালদারের জীবনের যে অহংকার, সেই অহংকার এইবার দাশুর মুখের দিকে ভিক্ষুকের মত তাকিয়েছে।

দাশুর হারে গাঁইতা যেন পলুসের ভীরু প্রাণের প্রার্থনার শব্দ শুনে লজ্জায় পড়ে। নেতিয়ে পড়ে গাইতা। গাইতাটাকে মাটিতে নামিয়ে একহাতে অলসভাবে শুধু একটু ছুঁয়ে ধরে, আনমনার মত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে দাশু।

একটা লাফ দিয়ে এগিয়ে আসে পলুস। আর, গাইতাটাকে হাতে তুলে নিয়েই পিছনে সরে যায়, কয়লার ধুলোর উপর শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। দাঁতে দাঁতে ঘষে চেঁচিয়ে ওঠে-কিষাণের বাচ্চা কিষাণ!

দুহাত দিয়ে নিজেরই চুলের খুঁটি খিমচে ধরে কাঁপতে থাকে দাও।

–দাগী, ডাকু, চোট্টা, দেহাতী ভিক্ষুক! পলুসের মুখের এক-একটা গালির গর্জন যেন দাশুর বুকের উপর গাইতার কোপ মারতে থাকে।

দাশুর লাল চোখ দুটোও যন্ত্রণায় কুঁচকে যেতে থাকে।

–তোকে আমি এখানে মেরে এখানেই পুঁতে দিতে পারি। একটা লাথি মেরে এক রাশ কয়লার ধুলো দাশুর গায়ের উপর ছুঁড়ে দিয়ে চিল্কার করে পলুস।

-তাই দাও না কেন। চেঁচিয়ে ওঠে দাশু।

–না।

-কেন?

–মুরলীকে বুঝাতে চাই, তুই কত ছোট আর আমি কত বড়।

—তাতে তোমার লাভ কি?

–তাতে মুরলী আমার হবে।

–কি?

–হ্যাঁ। তোর ঘরে থুক ফেলে দিয়ে মুরলী আমার কাছে ছুটে আসে কিনা দেখি।

–তুমি কি চাও যে, মুরলী তোমার কাছে চলে আসুক?

–চাই।

–মুরলীকে সে কথা বল না কেন?

–বলেছি।

–কি বলে মুরলী?

–একবার বলে যাব, একবার বলে যাব না। কাছে ডেকে নিয়ে কোমর ছুঁতে দেয়, আবার চোর বলে গালি দেয়। মুরলীকে আমি চিনে নিয়েছি সরদার। লাফ দিবার আগে একটুক ছটফটিয়ে নিচ্ছে মুরলী। দেখ নাই কি, সতের জলে লাফ দিবার আগে হরিণগুলা কেমনতর ছটফট করে?

বলতে বলতে চেঁচিয়ে হেসে ওঠে পলুস। সেই ভয়ানক হাসির প্রতিধ্বনি সুদের পাথরে পাথরে ঠোকাঠুকি খেয়ে আর গুমরে গুমরে গড়াতে থাকে। আর দাশুর লাল চোখের দৃষ্টি সেই মুহূর্তে মড়ার চোখের দৃষ্টির মত ঘোলা হয়ে যায়। যেন একটা অন্তহীন শূন্যতার দিকে তাকিয়ে দাশুর চোখ দুটো গলে গলে ঝরে যাচ্ছে। না; মুরলী নেই। পলুস হালদারের হাতের ছোঁয়া কোমরের উপর বরণ করে কবেই মরে গিয়েছে মুরলী।

না না না, অসম্ভব। মহেশ রাখালের মেয়ের প্রাণ এত কপট হতে পারে না। দাশুর বুকের কাছে শুয়ে দাশুর ছেইলার প্রাণ বরণ করে নিয়েছে যে মুরলী, তার কোমর পরের লোভের ছোঁয়া যেচে নিতে পারে না। যতই হিসেব করে হাসক কাদুক মুরলী, হিসেব করে দাশুর ভালবাসার চোখে এমন ভয়ানক ধুলো দিতে পারে না।

-তুমি মিথুক বট হালদার। হুংকার দিতে চেষ্টা করে দাশু। কিন্তু পারে না। গলার স্বর জড়িয়ে যায়, আর বুকটা হাঁসফাস করে।

-তুমি একটা গাওয়ার বট দাশু পলুসের ঠাট্টাও হুংকার দিয়ে বেজে ওঠে।

কেঁপে কেঁপে হাঁপ ছাড়ে দাশু; চওড়া বুকটা যেন সব নিঃশ্বাস হারিয়ে চুপসে যায়। না, পলুসের এই ঠাট্টার হুংকার মিথ্যা হুংকার নয়। জাতপঞ্চও যে ঠিক এই রকম হুংকার দিয়ে মুরলীর কোমরের দুর্নাম ঘোষণা করেছে। দাশুর চোখ দুটোও যে স্পষ্ট করে দেখেছে, পলুসের নাম শুনলেই মুরলীর চোখের তারা দুটো ছটফট করতে থাকে। তবে আর এই মিথ্যা লড়াই লড়ে হয়রাণ হওয়া কেন?

তবু বিড়বিড় করে দাশু : তুমি যা খুশি বল হালদার। মুরলী না বললে আমি বিশ্বাস করবো না। দুনিয়া বললেও আমি বিশ্বাস করবো না। আমি মুরলীকে শুধাবো।

–আর কবে শুধাবে? গাঁইতাটা কাঁধে তুলে আর দাশুর চোখের উপর টর্চের আলো দুলিয়ে আবার হেসে ফেলে পলুস।

দাশু—আমি আজই এই কয়লাখাদের নরক ছেড়ে দিয়ে গায়ে চলে যাব।

–যেতে দিলে তো যাবে?

–কি বললে?

–তোমাকে যে আজই গোবিন্দপুর থানাতে যাওয়া করাবো। তুমি গুপী লোহারের সাকরেদ বট; তুমি আমাকে খুন করতে গাঁইতা উঠিয়েছিলে। এত শক্ত পাপীকে আর মাপ করা চলে না। তোমার ফাঁসি যদি না হয়, তবু তো দশ বছরের শক্ত কয়েদ হবে।

–যা ইচ্ছা হয় কর হালদার, কিন্তু আমাকে একবার গাঁয়ে যেতে দাও।

-কেন?

–মুরলীকে একবার শুধাতে চাই।

–মুরলীকে শুধায়ে কি হবে?

–জেনে নিব, কি চায় মুরলী।

–যদি বলে পলুসের ঘরে যেতে চাই?

–তবে পলুসের ঘরে যাবে মুরলী।

–তুমি যেতে দিবে?

–দিব।

–তোমার কপালবাবার নামে কি কর।

–কপালবাবার নামে কিরা করছি হালদার। চেঁচিয়ে ওঠে দাশু।

–তবে এসো। আমিও কসম করছি, তোমার নামে থানাতে এজাহার দিব না।

টর্চের আলো ফেলে আগে আগে চলতে থাকে কলঘরের বড় মিস্তিরি পলুস হালদার। আর, পলুসের ছায়ার পিছু পিছু দাশু। আশার পিছু পিছু একটা হতাশা। জয়ের পিছু পিছু একটা পরাজয়। ব্যস্ততার পিছু পিছু একটা ক্লান্ততা।

 

–চল বাপ। আর এ গাঁয়ে থাকবো না। এখানে থাকলে তোমার বেটির জান মান আর সুখ কুকুরে ছিঁড়ে খাবে।

বলতে বলতে কেঁদে ফেলে মুরলী; আর মুরলীর মুখের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে বুড়ো মহেশ রাখাল : চল, চল, এখনই চল।

ভুবনপুর ফাঁড়ির চৌকিদার ঝালদাতে গিয়ে যখন খবর দিয়েছিল, তখন ঠিক বুঝতে পারে নি মহেশ রাখাল, এই খবরের অর্থ কি? যে মেয়ে এই পাঁচ বছরের মধ্যে একবারও বাপের বাড়ি আসবার কথা মনেও করে নি সে মেয়ে আজ বাপকে ডাকে কেন? বাপের বাড়িতে ফিরে আসতে চাইছে, তাই বা কি করে হয়? এই মুরলীই যে বার বার তিনবার মহেশ বুড়াকে মধুকুপির এই ঘরের দরজা থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে? না আমি যাব না। যতদিন না সরদার ঘরে ফিরে আসে, ততদিন এঘরেই থাকবো। মেয়ের সেই দেমাকের কথাগুলি আজও মহেশ রাখালের মনে পড়ে।

কিন্তু আজ আর এক মুহূর্তও মধুকুপির আলোছায়ার ছোঁয়া সহ্য করতে পারছে না মুরলী। যার জন্য পাঁচ বছর অপেক্ষায় ছিল মুরলী, সেই দাশু কিষাণের ছায়াকেও ভয় পেয়ে পালিয়ে যাবার জন্য ছটফট করছে মুরলীর প্রাণ। কেন? জানতে পেরেছে মহেশ রাখাল, দাশু কিষাণ মানুষ নয়; দাশু একটা দাগী। মুরলীর কপালের সুখ মরাতে চায়। মুরলীর পেটের ছেইলাকে বাঁচিয়ে রাখবারও মুরোদ নাই। আর, দাগীর ঘরণীর গতর লুঠ করবার জন্য শয়তানের লোভ রাতের অন্ধকারে চুপি চুপি এসে ঘরের দরজা ভাঙতে চায়—চল চল, এখনই চল! আবার চেঁচিয়ে ওঠে মহেশ রাখাল।

ভুবনপুর থেকে যে গো-গাড়িতে চড়ে মধুকুপি এসেছে মহেশ রাখাল, সেই গো-গাড়ি সড়কের উপর দাঁড়িয়ে আছে। বড়কালুর গায়ে বিকালের রোদ ছড়িয়ে পড়েছে। আর দেরি করবার সময় নেই। দেরি করা উচিতও নয়। রামাই দিগোয়ার নামে সেই শয়তানের চর যদি হঠাৎ এসে যায়, তবে মুরলীর এত কষ্টের চালাকিটা আবার বিপদে পড়বে।

সেলাইয়ের কল, টিনের তোরঙ্গ, সুতোর নকশা আর লেসের গাঁটরি, আয়নাটা আর চিরুনিটাও, আর গোটানো জড়ানো বিছানাটা; মুরলীর নিজের রোজগারের যত গৌরব আর আশাময় ভাগ্যের যত উপহার এক এক করে তুলে নিয়ে গো-গাড়ির ভিতরে রাখে মহেশ রাখাল। জামকাঠের জীর্ণ কপাট ভেজিয়ে দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায় মুরলী। মুরলীর নীল রঙের রেশমি শাড়ির চুমকি বিকালের রোদের আলোতে ঝিকমিক করে হাসে।

কিন্তু চমকে ওঠে মুরলী। এ কি! সড়কের উপর এত মানুষের ভিড় কেন? কি ভেবেছে ওরা? যেন মুরলীর মুক্তির পথ আটক করে গেঁয়ো মধুকুপির একটা মতলব শক্ত হয়ে সড়কের উপর দাঁড়িয়েছে। তাই কি? ভুকুটি করে তাকিয়ে থাকে মুরলী।

সব চেয়ে আগে চেঁচিয়ে ওঠে সনাতন লাইয়া : শু দাদা ঘরে নাই; আর সরদারিন ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছে; এটা কেমন কাণ্ড বটে?

গরুচরানি মেয়েগুলি ফিকফিক করে হাসে। ফুলকি মাসী, পল্টনী দিদি আর তেতরি ঘাসিনের চোখ ধিকধিক করে জ্বলতে থাকে। ছিয়া ছিয়া ছিয়া। ভিড়ের মুখে মুখে একটা চাপা ধিক্কারের রব ফিসফিস করে।

মহেশ রাখাল হুমকি দেয় আমার বেটিকে আমি নিয়ে যাচ্ছি; তাতে তোমাদিগের কি? তোমরা এখানে ভিড় কর কেন?

মহেশ রাখালের চোখের সামনে এগিয়ে এসে রোগা চেহারাটাকে একেবারে ক্ষেপিয়ে নিয়ে একটা গর্জন করে জাতপঞ্চের বড় বুড়া রতন : এই গাঁ মধুকুপি বটে, ঝালদা নয়। এখানে তোমার বেটি তোমার কেউ নয়; আমার গাঁয়ের বউ। দাশুর ঘরণীকে তুমি নিয়ে যেতে পারবে না।

–নিয়ে যাব। মহেশ রাখাল চিৎকার করে।

—যেতে দিব না। বড় বুড়া রতনের গর্জনের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ভিড়ের গলাও চেঁচিয়ে ওঠে। সড়কের পাশে বাঁশঝাড়ও কটকট শব্দ করে দুলতে থাকে।

মুরলীর মুক্তির পথে বাধা। সেই বাধা নিরেট হয়ে সড়কের উপর দাঁড়িয়ে থাকে। বিকাল ফুরিয়ে আসে। বড়কালুর মাথার পিছনে সূর্য ড়ুবে যায়। সন্ধ্যার আস্থা আঁধারের সঙ্গে ডাঙার বুকের বাতাসও ঠাণ্ডা হয়ে ফুরফুর করে। তবু ভিড় নড়ে না।

হঠাৎ সব হল্লার রব শান্ত হয়ে যায়। ভিড়ের মুখগুলি নীরব হয়ে আর চোখগুলি অপলক হয়ে দেখতে থাকে, সড়কের একটার পর একটা নিমের কালো ছায়া পার হয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে এগিয়ে আসছে দাও।

থমকে দাঁড়ায় দাও। সড়কের গো-গাড়ির দিকে একবার, আর মহেশ রাখালের মুখের দিকে একবার তাকায়। দাশুর চোখে কোন ভ্রূকুটি নেই। শুকনো শ্রান্ত উদাস মুখের উপর কোন আক্ষেপ আর কোন আক্রোশ নেই।

মুরলীর দিকে তাকায়; আর এগিয়ে গিয়ে একেবারে মুরলীর চোখের সামনে দাঁড়ায় দাশু। মুরলীর সরু কোমরে রেশমি শাড়ির ঘের রঙীন পালকের মত কাঁপছে আর দুলছে। দাশুর চোখে-মুখে একটা অদ্ভুত শান্ত হাসির শিহর খেলতে থাকে।

-আমি তোকে শুধাতে এসেছি, মুরলী। মুরলীর মুখের দিকে তাকিয়ে এই সন্ধ্যার ফুরফুরে বাতাসের চেয়েও মৃদুস্বরে কথা বলে দাশু।

–কি?

–এই ঘরে থাকবি না?

–না।–কার ঘরে যেতে চাস? পলুসের ঘরে?

–হ্যাঁ।

–পলুসকে কোমর ছুঁতে দিয়েছিলি?

–হ্যাঁ।

–এতদিন কেন বলিস নাই?

–বলবার দরকার হয় নাই।

–ভাল কথা।

–আর কি শুধাতে চাও?

–কিছু না। আমার ছেইলা তোর কাছে আছে, মনে রাখিস। আমাকে ছাড়লি, কিন্তু ওকে ছাড়িস না।

-কেন ছাড়বো? ছেইলা কি আমার নয়?

–নিশ্চয়। ভঁইসাল ভাই বড় ঠিক কথাটি বলেছিল।…আচ্ছা।

দৌড়ে গিয়ে ঘরের ভিতরে ঢোকে দাশু। কিন্তু তখনি আবার ফিরে আসে। দাশুর হাতে কেঁদকাঠের একটা কুচকুচে কালো লাঠি। লাঠি দুলিয়ে ভিড়ের দিকে তাকিয়ে দাশুও যেন প্রচণ্ড এক মুক্তির আনন্দে মরিয়া হয়ে হাঁক ছাড়ে ও জাতপঞ্চ শুনে যাও।

হুড়মুড় করে দৌড়ে এসে সড়কের ভিড়টা ঘরের দরজার কাছে জড়ো হয়। ভ্রূকুটি করে তাকিয়ে দাশুর এই বিকট আনন্দের অর্থ বুঝতে চেষ্টা করে মুরলী। মহেশ রাখালের বুক দূরদূর করে কাঁপতে থাকে।

–মহেশ রাখালের বেটি আমার ঘর করবে না, পঞ্চ। ওকে চলে যেতে দাও। পঞ্চের কাছে আবেদন করে দাশু।

সনাতন লাইয়া চেঁচিয়ে ওঠে : তবে এখনি সিঁদূর মাটি করুক মহেশ রাখালের বেটি।

বড় বুড়া রতন হাঁক দেয়—তবে এখনি পাতপানি চিরে ফেল, দাশু।

গরুচরানি মেয়েগুলি চেঁচায়-ওর হাতের বালা এখনি ভেঙে দাও, দাশু দাদা।

লাল গালার বালা আছে যে হাতে, সেই হাতটা দাশুর চোখের সামনে এগিয়ে দিয়ে তেমনি ভ্রূকুটি করে তাকিয়ে থাকে মুরলী। কেঁদমাঠের কালো কুচকুচে লাঠির একটি বাড়ি দিয়ে মুরলীর হাতের বালা ভেঙে দু টুকরো করে দেয় দাশু। মুরলীও সেই মুহূর্তেও সেই হাত নামিয়ে আর চিমটি দিয়ে মাটির ধুলো তুলে নিয়ে সিঁথির সিঁদুরের উপর ঘষে দেয়। আর, বড় বুড়া রতন একটা পাকুড়পাতার উপর এক ঘটি জল ঢেলে দিয়ে পাতাটাকে দাশুর হাতের কাছে এগিয়ে দেয়।

জটা রাখাল এগিয়ে এসে বড় বুড়া রতনের কানের কাছে চেঁচিয়ে ওঠে : নাম বলতে হবে, নাম বলুক দাশু। তা না হলে পাতখানি চিরা হয় না।

রতন–কার নাম?

জটা রাখাল—যার সাথে নষ্ট হয়েছে সরদারিন।

–খিরিস্তান পলুস হালদার। চেঁচিয়ে ওঠে দাশু। আর, ভেজা পাকুড়পাতা ছিঁড়ে দু টুকরো করে দেয়।

মহেশ রাখালের পিছু পিছু হেঁটে আর এগিয়ে যেয়ে গো-গাড়ির ভিতরে উঠে পড়ে মুরলী।

ভিড় ভাঙে, ভিড়ের হল্লাও মিলিয়ে যায়; তার আগে মিলিয়ে যায় গো-গাড়ির চাকার শব্দ। সন্ধ্যার অন্ধকারে মধুকুপির ডাঙা কাঁপিয়ে ঝিঁঝিঁর ডাকের যে শব্দ উথলে ওঠে, জামকাঠের দরজার কাছে বসে সেই শব্দ শুনতে শুনতে যেন নিঝুম হয়ে যায়, দাশু ঘরামির শূন্য মন, ক্লান্ত প্রাণ, আর পাথুরে ছাঁদে গড়া অলস শরীরটাও।

এই শুন্যতা ক্লান্তি আর আলস্যও যে অদ্ভুত এক বিস্ময়ের জ্বালায় জ্বলছে। কত সহজে, মধুকুপির সব মায়া আর সব আক্রোশ তুচ্ছ করে চলে গেল মহেশ রাখালের বেটি।

অনেক তারা ফুটেছে আকাশে। ঘরের ভিতরে ঢুকে রেড়ির তেলের মেটে বাতিটা জ্বালতেই দেখতে পায় দাশু, ঘরের এক কোণে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে টাঙ্গিটা। না; এই টাঙ্গিরও সাধ্যি হল না; মুরলীর পথ আটক করবার মত কোন জোর এই মাটিমাখা মধুকুপির প্রাণের মধ্যেই নেই। খেজুরপাতার চাটাইয়ের উপর গড়িয়ে পড়ে, আর দুহাত দিয়ে দুই চোখ চেপে চেপে ধরে ছটফট করতে থাকে দাশু।

হঠাৎ গুমরে ওঠে মধুকুপির রাত্রে বাতাস। বড়কালু আর ছোটকালুর সব পাথর একটা ভয়ানক গর্জনের প্রতিধ্বনি সহ্য করতে গিয়ে গুম গুম করে বাজতে থাকে। হাঁক ছেড়েছে বাঘিন কানারানী।

বেশি দূরে নয় জঙ্গলের ভিতরেও নয়। বাঘিন কানারানীর গর্জন যেন ভুবনপুরে যাবার সেই সড়কের উপর ছুটোছুটি করছে, যে সড়কের কাঁকর মাড়িয়ে আজই কয়লাখাদের মালকাটা জীবনের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়ে মধুকুপিতে ফিরে এসেছে দাশু। কিন্তু, মহেশ রাখালের বেটি যে এখন গো-গাড়িতে চড়ে, নীল রঙের রেশমি শাড়িতে সাজানো গতর নিয়ে আন-মরদের পিয়াস আর পিয়ার নেবার জন্য এক ভয়ানক আশার অভিসারে ওই সড়ক ধরেই এগিয়ে চলেছে! কানারানীর হাঁক, যেন প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত একটা আপত্তির হাঁক। কানারানীর হাঁকে এমন ভয়ানক রাগের ধমক কোনদিন শুনতে পায় নি দাশু।

মহেশ রাখালের বেটির অভিসারের পথ আটক করেছে কি কানারানী? আতঙ্কিত গোগাড়িটা কি মরণভয়ে ভীরু হয়ে এক ছুট দিয়ে আবার এই পথে ফিরে এসে এই ঘরের সামনে ওই সড়কের উপর দাঁড়াবে? গো-গাড়ির ভিতর থেকে একটা লাফ দিয়ে বের হয়ে এসে জামকাঠের এই জীর্ণ কপাটের উপর মাথা ঠুকে আছড়ে পড়ে করুণ স্বরে চেঁচিয়ে উঠবে কি মুরলী?-কানারানী আমাকে যেতে দিলে না।

কে জানে কত রাত হয়েছে। এল কি মুরলী? সত্যিই ফিরে আসবে কি মুরলী? জানে না দাশু, অদ্ভুত এক আশার শব্দ শোনবার জন্য বদ্ধ দরজার দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ দুটো কখন ক্লান্ত হয়ে মুদে গিয়েছে।

বাঘিন কানারানীর হিংস্র ধমকের হাঁক আর শোনা যায় না। মানঝিপাড়ার আতঙ্কের হল্লাও অনেকক্ষণ হল ক্লান্ত হয়ে শেষে একেবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। ঝিঁঝিঁ ডাকা রাতটাও যেন নিজের ক্লান্তিতে এখন একেবারে নীরব হয়ে ঝিমোতে শুরু করেছে।

কয়লা-খাদের ধাওড়া থেকে বিদায় নেবার সময় সুরেন মানঝির কাছে দেনার হিসাব মিটিয়ে দেবার পর বার বার দু বার স্নান করেও মনে হয়েছিল দাশুর, এই কদিনের মালকাটা জীবনের কালো ধুলো জলে ধুয়ে গেলেও বুকের ভিতর সেই ধুলো যেন ভয়ানক এক অভিশাপের ময়লার মত এখনো লেগে আছে।

মধুকুপির ফিরে যাবার পথে ভুবনপুর সড়কেরই ধারে গালাবাজারের কাছে আবগারী ভাটিখানার বোতলা সরাব বিক্রি হয় যে লাইসেনী দোকানে, সেই দোকানের দাওয়ার উপর কিছুক্ষণ জিরোতে হয়েছিল। আর, একটু জিরোতে বসেই বুঝতে পেরেছিল দাশু, গলার ভিতর বড় পিয়াস, মাথার ভিতর বড় জ্বালা!

সুরেনের দেনা চুকিয়ে দেবার পরও মালকাটা জীবনের সেই উন্মত্ত রোজগারের বারোটা টাকা দাশুর কোমরের গোঁজের ভিতরেই ছিল। বুকের ভিতরের ময়লা ধুয়ে ফেলতে হবে। এক টাকা খরচ করে এক বোতল সরাব গিলে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিল দাশু। মাথার জ্বালাকেও সেই নেশা দিয়ে শান্ত করে নিয়েছিল দাশু। সেই নেশার রেশ অনেকক্ষণ হল ক্লান্ত হয়ে দাশুর চোখে একটা স্বপ্নের ঘোর ধরিয়ে দিয়েছে। ঘুমিয়ে পড়েছে দাশু।

স্বপ্নটাও যেন একটা ভাদুরে বিকালের বৃষ্টি। রিমঝিম করে বাজে, আর ঝির ঝির করে ঝরে পড়ে। তারপর বড়কালুর মাথার উপরে আকাশের এপার-ওপার জুড়ে রঙিন রামধনু ফুটে ওঠে। দাশুর কাঁধের উপর ছেইলাটা, বুকের কাছে মাদলটা, পাশে পাশে মুরলী। ধানের ক্ষেতের আলের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে আখড়ার দিকে যেতে যেতে দাশুর মাদলের বোল ভেজা বাতাসে মিষ্টি শব্দের শিহর তুলে বাজতে থাকে–দিপির দিপাং ধিতাং ধিতাং!

দাশুর স্বপ্নের মাদল যেন আর্তনাদ করে ছিঁড়ে যায়। চমকে ওঠে, ঘুম ভেঙে যায় দাশুর। মনে হয়, রাতের বাতাস একটা বন্দুকের গুলির শব্দে আহত হয়ে গুমরে উঠেছে।

ঠিকই, আবার বন্দুকের গুলির শব্দ। ভুবনপুর সড়কের দিক থেকে সেই শব্দের গোমরানি বাতাসে গড়িয়ে এসে আস্তে আস্তে এই মধুকুপির অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

খেজুর পাতার চাটাই থেকে এক লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় দাশু। আর একটা লাফ দিয়ে একেবারে দরজা পার হয়ে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ায়। শ্যা, সড়কে এখনও বেশ অন্ধকার আছে, আকাশে তারা আছে। রাত ভোর হতে বাকি আছে।

ফিরে এসে ঘরের ভিতরে ঢুকে দু হাতে বুক চেপে ধরে কাঁপতে থাকে দাশু। কার বন্দুক? কে গুলি ছাড়ল? কে মরল? কানারানী আর হাঁক দেয় না কেন?

খেজুরপাতার চাটাইয়ের উপর আবার গড়িয়ে পড়ে ছটফট করে দাশু। একটা ভয়ানক সন্দেহের বেদনার সঙ্গে মনে মনে লড়াই করতে থাকে। না না না, মিছা সন্দেহ। কানারানী আছে, নিশ্চয় আছে। এখনি আবার হাঁক দিবে কানারানী। ও যে বনমাতা! ও যে মধুকুপির কিষাণ দাশুকে ওর মানুষ ছেইলা বলে মনে করে। মুরলীও যে ভয় পেয়ে ওকে শাশুড়ী বলে মেনে ফেলেছিল। কিন্তু কই, সেই কানারানী আর হাঁক দেয় না কেন?

কখন ভোর হবে? ভোরের আলোর অপেক্ষায় ছটফট করতে করতে আবার কখন যে ঘুমে অসাড় হয়ে গিয়েছিল ছেঁড়া স্বপ্নের বেদনা, তাও বুঝতে পারে নি দাও। ঘুম ভাঙে যখন, তখন বাঁশঝাড়ের মাথার উপর সকালের রোদ লুটিয়ে পড়েছে। ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই চমকে ওঠে দাও।

মানঝিপাড়ার একদল লোক সামনের সড়ক দিয়ে যেন একটা উল্লাসের ঝড়ের মত ছুটে চলে গেল। কিন্তু এ কি ভয়ানক কথা চেঁচাতে চেঁচাতে চলে গেল ওরা কানারানী মরেছে! কানারানী মরেছে!

কলকল করে হেসে আর চেঁচিয়ে ছুটতে ছুটতে ছুটতে চলে গেল একদন গরুচরানী মেয়ে।ডর কেনে ডরানি এল গুড়ুম ভাই, চল শিয়ালিন বিহা কবি কানারানী নাই।

মরা কানারানীর মুখ দেখবার জন্য ছুটে যাচ্ছে ওরা? তাই তো। দারও পাদুটো টলমল করে ওঠে। তার পরেই যেন একটা বদ্ধ আর্তনাদের জ্বালায় পাগল হয়ে ঘরের দাওয়া এক লাফে পার হয়ে সড়কের উপর এসে দাঁড়ায়। ছুটতে থাকে দাও।

খুব বেশিদূর ছুটে যেতে হয় না। ভুবনপুর সড়কের পাশে সেই জোড়া ড়ুমুরের কাছে এসে থমকে দাঁড়ায় দাশু। সড়কের পাশেই ঘেসো মাঠের উপর কাত হয়ে পড়ে আছে একটা গরুর গাড়ি। গাড়ির একটা গরু গোবরমাখা ধড় নিয়ে গাড়ির কাছেই পড়ে আছে, এখনও যেন মরণ আতঙ্কে গরুটা ধুকছে। আর, ড়ুমুরের ছায়ায় চুপ করে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে একজন। চিনতে পারে দাও আর ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখতে থাকে, এই তো সেই গাড়িয়াল লোকটা। আর ওই তো সেই গাড়ি, মুরলীকে মধুকুপির কিষাণের ঘর থেকে তুলে নিয়ে আন-মরদের বুকের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য কাল সন্ধ্যাতে যে-গাড়িটা যাত্রা শুরু করেছিল।

সড়কের ডাহিনে যে মাঠ, সে মাঠের শেষদিকে একটা খাত, আর খাতের চারদিকে কেঁদ ও বাবলার ভিড়। চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে দাশু, সেই খাতের কাছে অনেক মানুষ জমা হয়েছে।

হাঁপ-ধরা বুকের ঢিপ ঢিপ শব্দ সামলে নিয়ে ফিস্ ফিস স্বরে প্রশ্ন করে দাশু–কি ব্যাপার বটে গাড়িয়াল?

উত্তর দেবার জন্য মুখ তুলেই দাশুকে চিনতে পারে আর চমকে ওঠে গাড়িয়াল লোকটা। আস্তে আস্তে বলে-বাঘিনটা মরেছে সরদার।

–কে মারলে?

উত্তর দিতে গিয়ে আবার যেন একটু কুষ্ঠিত হয়ে পড়ে গাড়িয়াল ও কয়লা খাদের বড় মিস্তিরী, পলুস হালদার।

-সে এখানে কেমন করে এল?

–আমি ডেকে নিয়ে এলাম।

–কেন?

–বাঘিনটার ডরে।

–কি করেছিল বাঘিনটা?

-সে আর শুধাও কেন? কি করে নাই বল? একটি থাবা মেরে গরুটাকে ছিঁড়ে নিয়ে চলে গেল আর টুটি ফেড়ে দিল বাঘিনটা।

সড়কের বাঁয়ে যে মাঠ, সেই মাঠের আর-এক দিকের শকুনের ভিড় একটা সাদা পিণ্ডের চারদিক ঘিরে নিরেট হয়ে বসে আছে। সেই দিকে হাত তুলে ফুঁপিয়ে ওঠে গাড়িয়াল লোকটা : হোই দেখ। এক মাসও হয় নাই সরদার, তেইশ টাকা দিয়ে গরুটাকে খরিদ করেছিলাম।

গাড়িয়ালের এই ফোঁপানির কোন করুণতার শব্দ যেন দাশুর কান স্পর্শ করে নি। চেঁচিয়ে ওঠে দাশু–আর কি কসুর করেছিল বাঘিনটা?

–বুড়া মহেশ রাখালকে ঘায়েল করলে; থাবা মেরে বুড়ার একটা হাত ছেঁচে দিলে  ঘিনটা।

-আর কি করলে?

-যমের বেটি আমার গাড়িটার কি দশা করেছে দেখ। সে কী লাফ, কী রাগ আর কী ধমক সরদার! এক থাবা দিয়ে গাড়ির ছাপর ভাঙ্গলে, সরদারিনের যত জিনিস কামড় দিয়ে এক-একটা আছাড় দিয়ে ছিটিয়ে দিলে। সিলাইয়ের কলটাকে লাথি মারলে।

-আর কি?

–আমাকে ছিঁড়ে দিত যমের বেটি; কিন্তু আমি পালাতে পেরেছিলাম, সরদার।

চেঁচিয়ে ওঠে দাশু–সরদারিনের কি হলো বল?

–সরদারিনের গায়ে একটা আঁচড়ও দাগে নাই বাঘিনটা। সরদারিন নিজেই ভয়ে বেশ হয়ে গেল।

ছলছল করে দাশুর চোখ, সেই সঙ্গে সারা মুখ জুড়ে অদ্ভুত এক প্রসন্নতার হাসি। দাশুর অন্তরাত্মা যেন কানারানীর এক অদ্ভুত করুণার রহস্যের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি হাসছে। মুরলীকে ব্যথা দেয় নাই কানারানী; ভুলে নাই কানারানী, মুরলীর পেটে যে দাশুর ছেইলার প্রাণটা ঘুমিয়ে আছে।

কানারানী! কেঁপে কেঁপে বিড় বিড় করে দাশুর ঠোঁট দুটো। গাড়িয়াল লোকটা এইবার আতঙ্কিতের মত দাশুর মুখের দিকে তাকিয়ে কি-যেন ভাবতে থাকে।

দাশু বলে-ওরা গেল কোথায়?

গাড়িয়াল ভয়ে ভয়ে বলে—সে কথা বললে তুমি আমার উপর রাগ করবে না তো সরদার?

–না।

–আমি ছুটে গিয়ে কয়লাখাদে খবর দিতেই খাদের সাহেব মটরগাড়িতে বড় মিস্তিরীকে আর আমাকে তখনি রওনা করিয়ে দিলে। মিস্তিরী বড় ভাল শিকারী বটে।

-সে আমি জানি।

–মিস্তিরী সরদারিনকে জানে বলে মনে হলো।

-হ্যাঁ, জানে।

–সরদারিনও মিক্তিরীকে…।

-কি?

–বড় পিয়ার করে মনে হলো।

–কেমন করে বুঝলে?

–মিস্তিরী এসেই সরদারিনকে কোলে তুলে নিলে; আর সরদারিনও মিস্তিরীর গলা জড়িয়ে ধরলে।

দাশুর চোখ দুটো হঠাৎ তপ্ত হয়ে রাঙ্গী কয়লার আগুনের মত লাল হয়ে জ্বলতে থাকে। আরও ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে ওঠে গাড়িয়াল লোকটা।আর আমি কিছু বলবো না, সরদার।

–বল গাড়িয়াল। শুনতে বড় মজা লাগছে!

–আর তেমন কিছু বলবারও নাই, সরদার। বুড়া আর বুড়ার বেটিকে মটরগাড়ি করে কয়লাখাদের হাসপাতালে রওনা করিয়ে দিলে মিস্তিরী।

-তারপর কি হলো, সেটা বল না কেন?

-তারপর বন্দুক হাতে নিয়ে এই ড়ুমুরের উপর মিঙ্গিী বসলে; আর ওই ড়ুমুরের উপর আমি।

-তারপর?

–শেষ রাতে চাঁদ উঠলো যখন, তখন বাঘিনটা আবার এল।

–তারপর?

–পর পর দুটো গুলি মেরেছিল মিস্তিরী। একটা গুলি বাঘিনের গলা ফুটা করে দিলে। আর একটা গুলিতে বাঘিনটার পা ভেঙে গেল।

-তারপর?

-আর শুধাও কেন সরদার? মরা বাঘিনকে দেখতে সাধ থাকে তবে দেখে নাও। মিস্তিরী খাদে খবর দিতে চলে গিয়েছে, এখনি খাদের লোক এসে বাঘিনের লাস বাঁশ-দড়ি করে বেঁধে গোবিদপুর থানায় নিয়ে যাবে। হেই যে, ওরা দেখছে দেখ।

হ্যাঁ, দেখতে সাধ আছে বইকি। আস্তে আস্তে হেঁটে মাঠ পার হয়ে কেঁদ আর বাবলার ছায়াময় ভিড়ের কাছে এসে মানুষের ভিড়ের মাথার উপর দিয়ে উঁকি দেয় দাশু। ভাল করে দেখবার জন্য আরও এগিয়ে যেয়ে একেবারে খাতের কিনারায় এসে মাটির উপর উবু হয়ে বসে পড়ে, বুকের ভিতরের একটা যন্ত্রণা চাপতে চেষ্টা করে।

খাতের ভিতরে একটা কালো পাথরের উপর মাথা রেখে যেন ঘুমিয়ে রয়েছে কানারানী। কাদামাখা গোঁফ নেতিয়ে পড়েছে। লেজ দিয়ে ভাঙা পা জড়িয়ে ধরে রেখেছে, কানা চোখের উপর পিচুটি জমে রয়েছে। একটা বোলতা কানারানীর শিথিল চোয়ালের উপর সুড় সুড় করে হেঁটে বেড়াচ্ছে। মরবার আগে বোধহয় কাকরের উপর খুব জোরে মুখ ঘষেছিল কানারানী, তাই মুখটা পানখাওয়া মুখের মত লাল হয়ে রয়েছে। গলার ফুটো থেকে ঝরে পড়া রক্ত লাল কাদার মত পাথরের উপর পড়ে আছে।

কাঁধের গামছা হাতে তুলে নিয়ে বার বার চোখ মোছে দাশু। একটা বুড়ি সাধুনীর শান্ত ও উদাস মুখের মত দেখতে কানারানীর এই মুখটা। সাধুনীটা যেন ভীরু সংসারের যত হিংসুটে সোরগোল আর ঝামেলা থেকে পালিয়ে এসে কেঁদবাবলার ঘন ছায়ার এই ঠাণ্ডা শান্তির মধ্যে লুকিয়ে পড়েছে।

না, আর কিছু দেখবার নেই। লোকের ভিড়, আর বাবলা ও কেঁদের ছায়ার ভিড়ের কাছ থেকে আস্তে আস্তে সরে যায় দাশু!

 

রেড়ির তেলের মেটে বাতিটা মিটি মিটি জ্বলে। উনানের আগুন চিড়চিড় করে। একলা ঘরের ভিতরে শুধু নিজের ছায়াটাকে সঙ্গে নিয়ে মকাইয়ের ঘাট্টা রাঁধে দাশু। তার আগে ছোট হাঁড়ি মুখের কাছে তুলে নিয়ে ঢক ঢক করে হাঁড়িয়া মদ গিলে নেয়।

নেশা দিয়ে একটা আশাকে যেন জইয়ে রাখতে চায় দাশু। একদিন নিশ্চয় ফিরে এসে এই ঘরের দরজার কাছে দাঁড়াবে মুরলী, আর দাশুর মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলবে। আশার ছবিটা মাঝে মাঝে যেন কথা বলে ফেলে : এই দেখ সরদার; তোমার ছেইলাকে তোমার কাছে নিয়ে এসেছি।

রেড়ির তেলের মেটে বাতি নিবিয়ে দিয়ে নেশাতুর চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়তে গিয়ে আরও একটা আশার ছবি দেখতে থাকে দাশু। ডরানির ধারে পাঁচ বিঘা ভাল দো-আঁশের কানালি কিংবা গরাঙ্গি। ধান ফলেছে। সব্জী ধরেছে। সজীক্ষেতের গুলঞ্চের বেড়ার উপর বসে কালা কোকিল ডেকেই চলেছে। আশ্চর্য হয়ে গিয়েছে মুরলী।কবে এমন ভাল ক্ষেত জোত করলে আর সব্জী ফলালে গো ছেইলার বাপ?

তাই তো হবে। মুরলীর ঐ লোভী আশার হাত দুটো কি চিরকাল পলুস মিস্তিরীর গলা জড়িয়ে ধরে থাকতে পারবে? ক্লান্ত হবে না কি হাত দুটো? দেখা যাক্, কতদিন মিস্তিরির ঘরের সুখের স্বাদ ভাল লাগে মুরলীর?

হ্যাঁ, ঈশান মোক্তারের কাছ থেকে পাঁচ বিঘা দো-আঁশ নিতেই হবে। জাতপঞ্চের সভা ডেকে বলতে হবে, ঈশান মোজার কেন আমাদিগে শুধু মনিষ খাটাবে, পঞ্চ? বিনা নজরানায় জমি বন্দোবস্ত দিবে না কেন? জমি নিব, জমি নিয়ে ছাড়ব।

ঘুমিয়ে পড়বার আগে জমিহারা জীবনের এই নতুন প্রতিজ্ঞার জ্বালাটা নেশার আবেশে নরম হয়ে হেসে ওঠে। কিষাণের ঘরের সুখের খবর পেয়ে আবার ফিরে এসে এই ঘরের দরজায় দাঁড়িয়েছে মুরলী। বলছে মুরলী-আমাকে কি আর ঘরে নিবে না সরদার? আমি যে তোমার মুরলী বটে গো।

দাশু কিষাণের জীবনের অহংকার ধন্য হয়ে যায়।—দেখলি তো, বলেছিলাম কিনা, এই ঘরেই অনেক সুখ হবে, অনেক মাদল বাজবে…।

দিপির দিপাং, ধিতাং ধিতাং! সত্যিই যে মাদল বাজছে। ধড়ফড় করে উঠে বসে আর ভাঙা ঘুমের চোখ ঘষে দাও।

ভাদ্রের সকালবেলার রোদ মধুকুপির ক্ষেতের বুকে ঝলমল করে। করম এসেছে। আখড়াতে মাদল বাজছে। করম গাছ ঘিরে ঝুমুর নাচের আসর এই সকালেই মত্ত হয়ে উঠেছে। গান গেয়ে উঠেছে মধুকুপির মাটিমাখা প্রাণ। হলুদ-ছোপানো শাড়ি, আর খোপাতে ধানের শিষ; কম পূজতে আর ঝুমুর নাচতে দলবেঁধে চলে যাচ্ছে গররানী মেয়েগুলি!

কিন্তু এত হাসে কেন ওরা? ঝুমুর গেয়ে বৃষ্টি ডাকবে, আর নেচে নেচে খুব সোহাগে ঢলে ঢলে হাত তুলে জল ছিটিয়ে কামের হাঁড়ির মাটিতে বীজ ফলাবে মেয়েগুলি; কোমর দুলিয়ে ধানের আঁটি মাথায় তুলে নিবার সাধও দোলাবে; কিন্তু জমি কই? আপন জমি না হলে যে এই নাচ নেশা আর গানেতে মনের সুখ ভরে না।

তবু দাশুর প্রাণটা আজ আর একলা হয়ে পড়ে থাকতে চায় না। একটা মাদল হাতে নিয়ে মধুকুপির এই উৎসবের মধ্যে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। কিন্তু ও কে বটে? এদিকপানে ছুটে আসে কেন?

সড়কের নিমগাছের ছায়ার দিক থেকে ব্যস্তভাবে হেঁটে এসে, আর একেবারে দাশুর চোখের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে থাকে সনাতন।

খুশি হয়ে চেঁচিয়ে ওঠে দাশু–আমাকে একটা মাদল দিবে সনাতন?

সনাতন হাসে–তা দিব। কিন্তু দুখনবাবু আবার জাতপঞ্চকে ডেকেছে। তুমি যাবে কি?

-কেন?

-রাগ করেছে দুখনবাবু; গাঁয়ের বউ বটি বহিন করমে যদি নাচে, তবে জাত ভাগ করবে দুখনবাবু।

-কি করবে দুখনবাবু? ভ্রূকুটি করে দাশু।

-আর একটা পঞ্চ করবে দুখনবাবু। যাদিগের বউ বেটি বহিন নাচবে, তাদিগের ভাতভাইয়ারিতে আসবে না দুখনবাবু।

দাশুর ভ্রুকুটিও আস্তে আস্তে কেঁপে কেঁপে হিংস্র হয়ে উঠতে থাকে। মধুকুপির প্রাণের এত রকমের শত্রুও ছিল!-চল। দাঁতে দাঁত চেপে, একটা আক্রোশে চাপতে চাপতে সনাতনের সঙ্গে চলতে থাকে দাশু।

 

পিপুলতলার ছায়ার কাছে মধুকুপির মনিষদের সমাবেশ আজকের উৎসবের দিনেও বেশ একটু বিষণ্ণ হয়ে উঠেছে। মনে হয়, উৎসবের আনন্দটা হঠাৎ আহত হয়েছে, যদিও মনিষদের সাজের মধ্যে রঙিন উৎসবের ছিটেফোঁটা দেখা যায়। কারও কারও কোমর হলুদ-ছোপানো গামছা দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। মনে হয়, করমের নাচে যাবার জন্য ওরা মাদল হাতে নিয়ে মাত্র তৈরী হয়েছিল। কারও কারও রুক্ষ চুলের উপর তেলের প্রলেপ পড়েছে। স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছে কালো কোকড়া চুলের রাশ। দু-চার চুমুক হাঁড়িয়ার পাতলা নেশার আবেশও কারও কারও চোখে এই সকালেই ফুটে উঠেছে। কিন্তু সকলেই জানে, রাগ করেছে দুখনবাবু।

নিকটেই যে বনচণ্ডীর মন্দির, তারই কাছে ঝুমকো জবার গা ঘেঁষে একটি চৌকির উপর বসে আছেন যিনি, তিনিই হলেন বনচণ্ডীর সেবাইত চক্রবর্তী। আজকের জাতপঞ্চের সভার দিকে তাকিয়ে চক্রবর্তীর চোখ দুটোও কি-যেন আশা করে রয়েছে।

সভার একেবারে মাঝখানে একটি চারপায়ার উপর বসে আছে দুখনবাবু। আর জাতপঞ্চের বড় বুড়া রতন তার শীর্ণ শরীরটাকে কুঁকড়ে নিয়ে সভার এক কোণে অসহায়ের মত বসে আছে।

সভার কাছে এসে দাঁড়ায় সনাতন লাইয়া, তার পিছনে দাশু। দাশুর মুখের দিকে একবার আড়চোখের দৃষ্টি হেনে সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে যায় দুখনবাবু।

চেঁচিয়ে ওঠে দাশু ও জাতপঞ্চের সভায় দুখনবাবু চারপায়ার উপর বসে, আর বড় বুড়া রতন মাটির উপর বসে কেন? তুমি চারপায়া থেকে নেমে যাও দুখনবাবু।

-কেন নামবো? দাঁতে দাঁত ঘষে দাশুর মুখের দিকে তাকায় দুখনবাবু।

দাশু বলে–জাতপঞ্চের সভায় চারপায়ার উপর যদি কেউ বসে, তবে বড় বুড়া রতন বসবে। তুমি না, আমিও না।

দুখনবাবু-ঈশান মোক্তারের কুঠিতে তোমরা যখন কাজ মাগতে আস, তখন তোমাদের বড় বুড়া কোন্ চারপায়াতে বসে হে?

দাশু–কুঠিতে তুমি বড় গুমা বট। সেথা তুমি চারপায়াতে বসবে, আর মনিষেরা ভুঁইয়ের উপর বসবে। কিন্তু, জাতপঞ্চের সভায় তুমি জাতের মানুষ বট। হেথা বড় বুড়ার মান তোমার মানের চেয়ে বড়। তুমি চারপায়া থেকে নেমে যাও, আর ভুঁইয়ের উপর বস।

দাশুর মুখের দিকে আর একবার কটমট করে তাকিয়ে চারপায়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় দুখনবাবু। কিন্তু সুইয়ের উপর বসে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায় জটা রাখাল ও আরও কয়েকজন। বাবু দুখন সিংহের উপর এই অপমানের আঘাত সহ্য করতে গিয়ে ওরা ব্যথিত হয়েছে। দাশুর মুখের দিকে রুষ্টভাবে তাকিয়ে কি যেন বলতে চেষ্টা করে জটা রাখাল। দাশু চেঁচিয়ে ওঠে-চুপ।

বড় বুড়া রতন তার শীর্ণ শরীরটাকে টান করে উঠে দাঁড়ায়, যেন নতুন মান পেয়ে বড় বুড়ার বিমর্ষ প্রাণটা হঠাৎ বলীয়ান হয়ে উঠেছে। বড় বুড়া বলে-কেন জাতপঞ্চ ডেকেছ, সেই কথাটা বলে ফেল দুখনবাবু।

দুখনবাবু—সেদিন যে-কথা বলেছিলাম, আজ আবার সে কথাই বলছি। জাতের সুধার চাই।

দাশু–সেটা কি বটে?

দুখনবাবু-গাঁয়ের বউ বেটি বহিন করমে নাচবে না।

দাশু–নাচবে।

দুখনবাবু-তবে জাতের সুধার হবে কেমন করে বল? যদি বামন না মান, যদি বনচণ্ডীর পূজা না কর, যদি বেটিবহিনের বিয়া দিতে লাজের বয়স পার করে দাও, তবে জাতের ভাল হবে না, পঞ্চ।

দাশু—জাতের ভাল হবে দুখনবাবু, যদি তুমি জাতের একটা কথা মান।

–কি কথা?

–জাতের মানুষকে জমি পাইয়ে দাও।

–জমি! চেঁচিয়ে ওঠে দুখনবাবু।

দাশু–হ্যাঁ; তোমার জাতের মানুষ ঈশান মোক্তারের জমিতে শুধু মনিষ খাটে, তাতে তোমার কি দুখ হয় না? যত ভাল ভাল দো-আঁশ আর দুই-ফসলী মাটিতে আমাদিগে মনিষ খাটাবে ঈশান মোক্তার, আর ভাগজোত করতে দিবে যত টাড় জমি; এটা কেমনতর বিচার বটে?

দুখনবাবু-কি চাও তোমরা?

দাশু—আমরা আর মনিষ খাটবো না। আমরা ভাল জমি ভাগজোত করবো। কুঠি বীজ লাঙ্গল দিবে।

দুখনবাবু–নজরানা?

দাও হাসে-তোমার গরীব জাতভাই নজরানা দিতে পারে কি দুখনবাবু? তুমি কি সেকথা জান না?

দুখনবাবু হেসে ফেলে-গরীব হয়ে গরীবের মত কথা না বলে ডাকাইতের মত কথা বলছে কেন?

দাশু–আমাদিগে তুমি ডাকাইত বলছো?

দুখনবাবু-হ্যাঁ। তোমার ঈশান মোস্তারের জমি লুটে নিবার কথা বলছো।

দাশু–লুটে নিলে দোষ কি?

দখুনবাবু-কি বললে?

দাশু–যদি ঈশান মোস্তারের ভাল জমি ভাগজোত করতে না পাই, তবে মধুকুপির কোন কিষাণ ওর জমিতে মনিষ খাটবে না।

দুখনবাবু হাসে-ভিন গাঁ হতে মনিষ আসবে, দাশু। ঈশান মোক্তারের চিন্তা নাই।

দাশু–তবে শুনে রাখ দুখনবাবু, ভিন গাঁ হতে মনিষ এলে ওরা মরবে।

দুখনবাবুকে মারবে ওদিগে?

জাতপঞ্চের নীরব মুখগুলির দিকে তাকিয়ে আর হাত দুলিয়ে চিল্কার করে দাশু–জবাব দাও পঞ্চ।

বড় বুড়া রতন উঠে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চাশজন মনিষের রুক্ষ ও কঠোর হাত একসঙ্গে দুলে ওঠে। চেঁচিয়ে ওঠে জাতপঞ্চের ভিড়? আমরা মারবো। মধুকুপির কিযাণের টাঙ্গি এখনও মরে নাই।

কেঁপে ওঠে দুখনবাবুর চোখ দুটো। জটা রাখালের দলও ভীরুর মত আস্তে আস্তে সরে গিয়ে দুখনবাবুর পিছন দিকে দাঁড়ায়।

কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে কি-যেন ভাবতে থাকে দুখন। তারপর হঠাৎ লজ্জিত হয়ে আর মৃদু হাসিতে চোখমুখ স্নিগ্ধ করে নিয়ে হাতজোড় করে জাতপঞ্চের উত্তেজিত মুখগুলির দিকে তাকায়। সেই মুহূর্তে শান্ত হয়ে যায় জাতপঞ্চের মত্ত আক্রোশের মুখরতা আর চেহারার রুদ্র।

–কি বলছো দুখনবাবু? বড় বুড়া রতন শান্ত স্বরে প্রশ্ন করে।

দুখনবাবু বলে ঠিক ঠিক ঠিক; খুব ঠিক কথা বলেছে পঞ্চ। আগে জমি চাই। আমি ঈশান মোক্তারকে বলে তোমাদিগে ভাগজোতের ভাল জমি পাইয়ে দিব। এক পয়সা নজরানা দিতে হবে না।

দাশু একটা লাফ দিয়ে এগিয়ে এসে দুখনবাবুর একটা হাত জড়িয়ে ধরে। ছলছল করে দাশুর উফুন্ন দুটো চোখের আশা তুমি জাতের দুখ বুঝেছ, তোমাকে কপালবাবা অনেক সুখ দিবে। অনেক দুখে তোমাকে কড়া কথা বলেছি দুখনবাবু; তুমি রাগ করবে না।

শান্তভাবে হাসতে থাকে দুখনবাবু, সেই সঙ্গে দুখনবাবুর চোখ দুটোও অদ্ভুতভাবে যেন ধিকধিক করে হাসতে থাকে? না হে দাশু, দুখন সিংহ রাগ করে নাই। দুখন সিংহ যদি বেঁচে থাকে, তবে তোমাদিগে জমির সুখ পাইয়ে দিবে। আমি আজই ঈশান মোজরের দরবারে যাব।

দিপির দিপাং।

আঁটি আঁটি ধান কাটি কানালির মাটি গো। কিষাণের ধিয়াপুতা কত সুখে খাটি গো! হে করম দয়া কর!

করম ডালে জল ঢেলেছে মেয়েরা। ঝুমুর গেয়েছে আর নেচে নেচে সারা হয়েছে। আর দাশুও যেন জমিহারা জীবনের সব অভিমান মুছে ফেলে মাদল হাতে নিয়ে সারা দুপুর আর বিকেলে মত্ত হয়ে উৎসবের আসরে একটা জয়ের নাচ নেচেছে। হাঁড়িয়ার তরল নেশার রসে দাশুর অমন পাথুরে পাটার মত বুকের ভিতরটা যেন ভিজে কাদা হয়ে গিয়েছে। জমি হবে, জমি হবে। বাবু দুখন সিংহ বলেছে, জাতের সব মানুষকে জমি পাইয়ে দিবে।

জমির স্বপ্নের মধ্যেই বার বার যার সুন্দর মুখের ছবিটা ফুটে ওঠে, সে আজ মধুকুপির এই মাদল বাঁশির মত্ত উল্লাসের আসর থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছে। কিন্তু দাশুর জীবনের এই সঙ্গীবিহীন শূন্যতার বেদনাও যেন আজকের একটা আশাময় মত্ততার কলরবে ভরে গিয়েছে। মুরলী আজ নেই; কিন্তু আসবে। দেখি, কেমন করে না এসে থাকতে পারে মুরলী? দাশু কিষাণের জমিতে ধানের শিস যেদিন দুলে উঠবে, সেদিন কয়লাখাদের বড় মিস্তিরীর ঘর মুরলীকে আটক করে রাখতে পারবে কি? কখনই না।

বিকেল হতেই মাদল রেখে দিয়ে আর সনাতন লাইযার হাত ধরে টলতে টলতে ঘরে ফিরে আসে দাশু। সনাতন বলে—আজ সাঁঝে আর আখড়াতে যেও না দাও।

দাশু হাসে-তুমি আমার নাচ দেখে ভয় পেলে নাকি সনাতন?

সনাতন–হ্যাঁ।

দাশু–কেন?

সনাতন–তুমি সরদারিনকে ভুলতে পার নাই।

দাশু–তুমি কেমন করে বুঝলে?

সনাতন-নাচতে নাচতে কাঁদলে কেন?

জলে ভরে যায় দাশুর চোখ : হ্যাঁ সনাতন। করমের দিনে মুরলী আমার কাছে নাই, এ কেমন দয়া করলে কপালবাবা?

সনাতন-ওসব কথা আর মিছা কেন মনে কর দাশু?

দাশু–কিন্তু মুরলী একদিন আসবে।

সনাতন–কেন?

দাশু—আমি ওকে আনা করাবো।

সনাতন–কেমন করে?

দাশু–জমি নিব, ক্ষেতজোত করবো, নতুন মাটি দিয়ে ঘর বানাবো। মুরলী তখন না এসে পারবে কেন? জমি নাই, তাই মুরলী নাই।

সনাতন হাসে-হলে বড় ভাল হয় দাশু। কিন্তু…।

দাশু–কি?

সনাতন—মধুকুপির কপাল ভাল নয় দাশু। আমার বড় ডর লাগছে।

দাশু–ছিয়া! গাঁয়ের লাইয়া হয়ে তুমিও এমন ডরের কথা বল, সনাতন?

সনাতন বোধহয় দাশুর এই অভিযোগের উত্তর দিত; কিন্তু সনাতন সত্যিই একটা নতুন ভয়ে ভীরু হয়ে সড়কের দিকে তাকিয়ে থাকে।

সড়কের উপর দাঁড়িয়ে দাশু কিষাণের ঘরের এই জীর্ণ জামকাঠের দরজার দিকে তাকিয়ে আছে একটা লোক। আধবুড়া চেহারার একজন বাবু মানুষ। গায়ে কালো কাপড়ের জামা। মালকোচা দিয়ে পরা ধুতি। পায়ে ধুলোমাখা একজোড়া জুতে, আর হাতে ছাতা ও একটা থলি। বাবু মানুষটা অপলক চোখ তুলে দাশুর ঘরের দিকে তাকিয়ে আছে। বাবু মানুষটার মুখটা মিটমিট করে হাসছে মনে হয়।

-ও কে বটে সনাতন? প্রশ্ন করে দাশু।

সনাতন—ওটা হারানগঞ্জের সিস্টার দিদির লোক। খিরিস্তান বটে। তোমার সরদারিনের যত সিলাই নকশা এই লোকটা কিনে নিয়ে যেত। এতদিন বাঘিন কানারানীর ডরে আসে নাই।

দাশুর লাল চোখ দপদপ করে-সিস্টার দিদির লোক আবার হেথা আসে কেন?

সনাতন–কে জানে?

দাশুর রুষ্ট গলার স্বরের শব্দ বোধহয় শুনতে পায় সিস্টার দিদির লোকটা। সেই মুহূর্তে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে হনহন করে হেঁটে পাকুড়তলার দিকে চলে যায়।

আবার কারা যেন গল্প করতে করতে ভুবনপুরের দিক থেকে সড়ক ধরে আস্তে আস্তে হেঁটে আসছে।

সনাতন বলে–বাস, আর কি? কানারানী নাই। আবার শুরু হলো দাশু।

দাশু–কি?

সনাতন-কয়লাখাদের ঠিকেদারের লোক আবার গাঁয়ে ঢুকছে।

দাশু–কেন?

সনাতন–মালকাটা যোগাড় করতে।

হঠাৎ হতভম্ব হয়ে যায় দাশু। ঠিকেদারের লোকগুলি মধুকুপির কিষাণের ঘর ভাঙবার জন্য কী কুৎসিত আনন্দের হাসি হেসে কত সহজে মধুকুপির মাটি মাড়িয়ে এগিয়ে আসছে। আস্তে আস্তে বিড়বিড় করে দাশু ও একটুক সেঁটে দিলে কেমন হয়, সনাতন?

সনাতন ভয় পেয়ে দাশুর হাত চেপে ধরে : তুমি ঘরের ভিতরে যাও আর শুয়ে থাক। হাত ধরে দাশুকে টেনে নিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে সনাতন চলে যায়।

নিঝুম হয়ে ঘরের ভিতরে খেজুরপাতার চাটাইয়ের উপর বসে থাকে, আর মাঝে মাঝে একটা অস্বস্তির জ্বালায় ছটফট করে দাশু। আজকের জয়ের উৎসবটার সব সুখ যেন বিস্বাদ হয়ে গেল। কয়লাখাদের ঠিকেদারের লোক গাঁয়ের ঘরে ঢুকে হাঁক দিয়ে মজুরির লোভ দেখাবে। মধুকুপি যে শুন্য হয়ে যাবে। সিস্টার দিদির লোক, ঐ পাপটা আবার মধুকুপির কোন কিষাণের ঘরের আশা ছিঁড়ে নিয়ে যাবার জন্য চোরনেকড়ের মত গাঁয়ের পথে ঘুরঘুর করছে? তুই কেন মরলি কানারানী? পাপগুলো যে মধুকুপির ঘরে ঢুকতে আর ভয়ে করে না!

না, বড় জোর নেশা ধরেছে। ঠিক বলেছে সনাতন। এখন ঘুমিয়ে পড়লেই ভাল হয়। খেজুরপাতার চাটাইয়ের উপর গড়িয়ে পড়ে দাশু। কিন্তু সেই মুহূর্তে করুণ চিৎকারের মত একটা বুকফাটা কান্নার শব্দ শুনে ধড়মড় করে উঠে বসে। কে কাদে? এমন সুন্দর করমের দিনে মধুকুপির কার প্রাণের দুখ এমন করে কেঁদে উঠল?

ঘর ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়াতেই দেখতে পায় দাশু, সড়কের উপর দাঁড়িয়ে আর অনেক দুরের দিকে তাকিয়ে ছটফট করছে, দু হাত ছুঁড়ে বুক চাপড়ে আর চিৎকার করে কাঁদছে পল্টনী দিদি।

পল্টনী দিদির পরনে একটা ছেঁড়া ঘাগরা। ময়লা একটা কথা গায়ে জড়ানো। মাথার চুলগুলি ক্ষেপী ভিখারিনীর চুলের মতো এলোমলো হয়ে মাথার চারদিকে ঝুলে রয়েছে।

দৌড় দিয়ে এগিয়ে আসে দাশু : কি হলো পল্টনী?

–নিয়ে গেল, নিয়ে গেল। ডাইনে আমার ছেইলা দুটাকে ছিনে নিয়ে গেল দাশুদাদা। চেঁচিয়ে কাঁদতে থাকে পল্টনী।

আশ্চর্য হয় দাশু : কে ডাইন? তোমার ছেইলা ছিনে নিয়ে যায় কেন ডাইন?

সড়কের অনেক দুরে, চলমান কয়েকটা ছায়ার দিকে তাকিয়ে বুক চাপড়ায় পল্টনী দিদি : হারানগঞ্জের সিস্টার দিদির লোক আমার ছেইলা দুটাকে অনাথবাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে, দাশুদাদা। কটা রে, মোটা রে! আমাকে এত দুখ দিতে কেন এসেছিলি রে!

সড়কের অনেক দুরের সেই চলমান ছায়ার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে দাশু, হা, আধবুড়ো বাবুটা ছাতা হাতে নিয়ে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে চলে যাচ্ছে। বাবুটার দুই পাশে ছোট চেহারার দুটো কচি ছেলে বোগা-বোগা দুটো ছায়ার মতো হেঁটে চলেছে।

বুকের উপর চাপড় মেরে কান্নাটাকে গুমরে তোলে পল্টনীদিদি-সিস্টার দিদি কতবার এসে হেইলা দুটাকে টেনেছে, তবু ঘড়ি নাই গো। বাঘিনের ডরে মাঠে যেতে দিই নাই? গো। ডাইনের ডরে বাজারে যেতে দিই না গো!

-পল্টনী! চেঁচিয়ে ওঠে দাশু।

–কি দাশু দাদা?

–তুই কাঁদিস না।

আরও জোরে চেঁচিয়ে কেঁদে ওঠে পল্টনীদিদি। দাশুও সেই মুহূর্তে ছুটে গিয়ে ঘরের ভিতর থেকে সেই মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা টাঙ্গি হাতে তুলে নিয়ে এসে আবার পল্টনীদিদিকে সান্ত্বনা দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে-আমি এখনই তোর কটা আর মোটাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসছি।

কিন্তু কী আশ্চর্য, পল্টনীদিদি হঠাৎ কান্না থামিয়ে, আর, একটা ঝাপ দিয়ে দাশুর গায়ের উপর লুটিয়ে পড়ে দাশুর টাঙ্গিটাকে শক্ত করে দু হাত দিয়ে চেপে ধরে। তুমি থাম দাশুদাদা। তোমার পায়ে পড়ি দাশুদাদা।

-কি বলছিস পল্টনী? হতভম্ব হয়ে পল্টনীদিদির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে দাশু!

পল্টনীদিদি বলে–মারতে হলে আমাকে মার। সিস্টার দিদির লোক কোন কসুর করে নাই।

–কেন?

-আমি ছেড়ে দিয়েছি, তবে না আমার কটা আর মোটাকে নিয়ে গেল। আস্তে আস্তে ফোঁপাতে থাকে পল্টনীদিদি।

-কেন ছেড়ে দিলি?

ময়লা কাঁথার কোণা তুলে চোখ মোছে পল্টনীদিদি : তিন দিন হলো ছেইলা দুটা কিছু খায় নাই। খেতে দিতে পারি নাই দাশুদাদা।

দাশুর লাল চোখের জ্বালা হঠাৎ জল হয়ে ঝরে পড়ে। কথা বলতে গিয়ে দাশুর গলার স্বর ভেঙ্গে যায়? কেন খেতে দিতে পারিস নাই?

-যে মাগির মরদ নাই, জমি নাই, সে মাগি তালপাখা বেচে আর কতদিন ছেইলা পুষতে পারে? আমার কটা আর মোটা আমার বুকের উপর থেকেও মরবে, তার চেয়ে সিস্টার দিদির অনাথবাড়িতে গিয়ে বেঁচে থাকুক। সেটা ভাল বটে কি না দাদাদা?

দাশুর শক্ত হাতের মুঠো হঠাৎ শিথিল হয়ে যায়। গেঁয়ো গর্বের টাঙ্গিটা অলস অক্ষম ও অসার বস্তুপিণ্ডের মত যেন একটা আবর্জনা হয়ে ধপ করে সড়কের ধুলোর উপর লুটিয়ে পড়ে।

আরও কিছুক্ষণ গুনগুন করে কাঁদে পল্টনীদিদি। তারপর সেই মৃদুস্বরের কান্নাটা যেন ধিক্কার দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে : গাঁয়ে আর থাকবো না, দাশুদাদা।

–কেন? আস্তে আস্তে টাঙ্গিটাকে আবার অলসভাবে হাতে তুলে নিয়ে উদাসস্বরে প্রশ্ন করে দাশু।

-গাঁয়ের ঘরে মান নাই, ভাত নাই, কিছু নাই।

–কিন্তু যাবি কোথায়?

–কয়লাখাদে যাব।

–কি বললি? ভ্রূকুটি করে দাশু।

-হ্যাঁ দাশুদাদা। ময়লা কামিন হয়ে খাদে খাটবো। ঠিকেদার বললে, দশ ঘণ্টা খাটলে এক টাকা সওয়া টাকা মজুরি হবে।

-কিন্তু তুই কি শুনিস নাই, দুখনবাবু গায়ের সব মানুষকে ভূমি পাইয়ে দিবে? জমি কর পল্টনী, মনের সুখে ক্ষেত-জোত কর। গাঁয়ের বার হবি কেন?

হেসে ফেলে পল্টনী–দুখনবাবুর নাম নিও না দাশুদাদা। গায়ের দুখ দেখে সাপও কদবে, কিন্তু দুখনবাবু কাঁদবে না।

–কেন?

–ডাকাইতের কুকুরও যে ডাকাইত বটে।

–ডাকাইতটা কে বটে?

কুঠিয়াল বাবুটা গো, তোমাদিগের ঈশানবাবু। আমার পাঁচ-পাঁচটা ছাগল ধরে নিয়ে গিয়ে কাটলে আর সাহেবদিগে খাওয়ালে; আজ তক দামটা দিলে না। টাকা মাগতে গেলে ডাকাইতটা বলে, রাতে এসে টাকা নিয়ে যাবি।

দাশু–কিন্তু খাদের ঠিকেদার বেটা কোন্ দয়ার দেবতা বটে? সে বেটা কি গাঁয়ের দুখে কাঁদে বলে গাঁয়ে ঢুকেছে?

পল্টনী—জানি না দাশুদাদা। কিন্তু গায়ে আর থাকবো না।

–ঠিকেদার বেটা কোনদিকে গেল? হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে, আর লাল চোখ দুটোকে কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে প্রশ্ন করে দাশু।

-দাশুদাদা! পল্টনীর গলার স্বরেও একটা আতঙ্ক কেঁপে ওঠে!

–কি?

–তুমি মিছা মাথা গরম করে খাদের ঠিকাদারের সাথে মারামারি বাধিও না।

পল্টনীর আতঙ্কের আবেদন তুচ্ছ করে, আর পল্টনীর আতঙ্কিত মুখটার দিকে একটা ভ্রক্ষেপও না করে হনহন করে হেঁটে সড়ক ধরে এগিয়ে যায় দাশু।

কিছু দূরে এগিয়ে যেয়েই থমকে দাঁড়ায়। সড়কের পাশেই যে অড়হরের ক্ষেত, তার পিছন দিকে একটা মেটে ঘরের কাছে চিল্কারের হানাহানি চলেছে। যেন একটা কঠোর হুংকারের সঙ্গে একটা করুণ অট্টহাসির ঝগড়া চলেছে। ওটাই যে তেতরি ঘাসিনের ঘর। কয়লাখাদের ঠিকেদার বেটা কি ভয় দেখিয়ে তেতরিকে ময়লা কামিন করে নিয়ে যাবার জন্য গর্জন করছে?

তেতরির ঘরের বেড়ার কাছে এসে দাঁড়াতেই একটা নির্মম লজ্জার ধাক্কা খেয়ে চমকে ওঠে, আর চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ে দাশু। বেড়ার গায়ে হেলান দিয়ে পড়ে আছে একটা সাইকেল। বেড়ার ফাঁকে উঁকি দিয়ে দেখতে পায় দাশু, ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে বাবুরবাজার ডাকবাংলার খানসামা। খানসামার পা ঘেযে একটা রোগা কুকুর হাঁ করে আর জিভ বুলিয়ে দিয়ে যেন একটা ঘটনার জন্য লোলুপ হয়ে ওৎ পেতে বসে আছে।

চিৎকার করে খানসামা-যাবি কি না বল মাগি?

–না, যাব না। বলতে বলতে একটা লাল রংয়ের ছেঁড়া সায়া হাতে তুলে নিয়ে পটপট করে ছিঁড়ে মাটির উপর ছুঁড়ে ফেলে দেয় তেতরি। রোগা কুকুরটা এক লাফ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ছেঁড়া সায়ার টুকরো কামড়ে ধরে আর ছুটে পালিয়ে যায়।

খানসামা-মনে করে দেখ তেতরি, ভুখা মরে যেতিস কিনা, যদি আমি তোকে দশটা টাকা দাদন না করতাম।

তেতরি–মনে আছে; কিন্তু তুমি এখন যাও।

খানসামা বলে–তা হলে আমার টাকা ফেরত দে।

তেতরি–না, দিব না।

খানসামা—তা হলে বল, কবে ফেরত দিবি।

তেতরি—সে বলবো না। যেদিন পিরবো ফেরত দিব।

খানসামা—সে হবে না। হয় আমার টাকা ফেরত দে, নয় আমার সাথে চল। কলকাতা থেকে ভাল বাবুসাহেব এসেছে। তাদিগে খুশী করে দিয়ে চলে আয়। তোর দুটা টাকা হবে, আমারও কিছু হবে।

তেতরি–না, যাব না।

খানসামা—তবে তোর ঘরের মাল বের করে দে।

তেতরি–তাই নিয়ে যা।

ঘরের ভিতরে ঢোকে তেতরি। পিতলের একটা থালা আর একটা ঘটি নিয়ে এসে খানসামার দিকে ছুঁড়ে দেয় : নিয়ে যা।

খানসামা—এতে কি দশ টাকা উসুল হয়?

আবার ঘরের ভিতরে ঢুকে একটা রূপার হাঁসুলির আধখানা টুকরো হাতে করে নিয়ে এসে খানসামার দিকে ছুঁড়ে দেয় তেতরি।

খানসামা চেঁচিয়ে ওঠে-হলো না। আর কি আছে বের করে দে।

একটুও বিচলিত না হয়ে একটাও কটু কথা না বলে যেন একটা নতুন অহূতকারের আনন্দে হেসে ওঠে তেতরি; আর, খানসামার দস্যুতাকেও তুচ্ছ করে।–আর কিছু নাই। তুমি এবার চলে যাও।

–না, যাব না। এতে উসুল হয় নাই। আবার চিৎকার করে খানসামা।

–তা হলে আমার মাথায় লাঠি মার, আমার লেহু পিয়ে নিয়ে চলে যাও। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে হাসতে থাকে তেতরি।

-তোর মত মাগির লেহু পিয়েও আমার রাগ যাবে না। তেতরির মুখের দিকে তাকিয়ে হুংকার ছাড়ে খানসামা।

ঘরের বেড়া মড়মড় শব্দ করে কাতরে ওঠে। ঘরের দরজার কাছে এগিয়ে এসে চেঁচিয়ে ওঠে দাশু–খানসামাটা যায় না কেন তেতরি? ভেবেছে কি?

দাশুর লাল চোখ আর হাতের চকচকে টাঙ্গির দিকে চোখ পড়তেই তেতরি ঘাসিনের মুখ শুকিয়ে যায় যাচ্ছে দাশুদাদা, এখনি চলে যাবে। তুমি ওকে কোন কথা বলবে না।

দাশু বলেওকে ঝাড়ু মার না কেন, তেতরি!

আর এক মুহূর্তও দেরি করে না খানসামা। থালা ঘটি আর হাঁসুলির টুকরো হাতে তুলে নিয়েই সরে যায়। দৌড়ে গিয়ে সাইকেলটাকে ধরে, আর অড়হর ক্ষেতের কিনারা ধরে উড়ন্ত ছায়ার মত পালিয়ে যায়।

হাঁপ ঘড়ে দাশু : তুই ওকে ঘরের চিজ ছেড়ে দিলি কেন?

তেতরি হাসে ও পাপের ধার শুধে দিলাম। ভাল হলো দাশুদাদা।

দাশু আশ্চর্য হয়ে তাকায় : তুই যেন কি মনে করেছিস তেতরি।

তেতরি—আর গাঁয়ে থাকবে না।

চমকে ওঠে দাশু ও কোথায় যাবি?

তেতরি–কয়লাখাদে যাব, কামিন খাটবো।

দাশু–খাদের মালকাটার ঠিকেদার এসেছিল?

তেতরি-হ্যাঁ।

দাশু–কোনদিকে গেল?

তেতরি-মানঝিপাড়ার দিকে গেল।

কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবে দাশু। তারপর অসহায়ের মত চোখ তুলে অড়হরের ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলে কয়লাখাদে যাবি?

তেতরি-হ্যাঁ; এমন গাঁয়ের এমন ঘরে থাকলে গতর পচে যাবে। মরে যাব গো দাদাদা। মানও নাই ভাতও নাই, এমন গাঁয়ে কেন থাকবো?

দাশু–জমি যদি পাস, তবে?

তেতরি–কে দিবে জমি?

দাশু–ঈশান মোক্তার দিবে। দুখনবাবু বলেছে, জমি পাইয়ে দিবে।

তেতরি হেসে ওঠে : দিবে না। ওরা আমাদিগে কখনো জমি দিবে না।

দাশু বিরক্ত হয় : কেন দিবে না?

তেতরি-ওরা যদি জমি দিবে, তবে আমাদিগে দুখ দিবে কে?

কী কঠোর অবিশ্বাস! যেমন পল্টনী, তেমনি তেতরি; ঈশান মোক্তার আর দুখনবাবুকে বিশ্বাস করবার মত একটা প্রাণী বলেও ওরা মনে করে না। পল্টনী আর তেতরির এই অবিশ্বাসের জ্বালা দেখে দাশুর মনের ভিতরেও একটা ভয়-ভয় অস্বস্তি শিউরে উঠতে থাকে।

চলে যায় দাশু। অলস হাতের মুঠোর মধ্যে টাঙ্গির হাতল শিখিলভাবে চেপে ধরে, আস্তে আস্তে হেঁটে, অড়হরের ক্ষেত পার হয়ে আবার সড়কের উপর এসে দাঁড়ায়।

সুর্য ড়ুবে যাচ্ছে। ছোটকালুর মাথার পিছনটা লাল হয়ে উঠেছে। ডরানির বুকের উপর দিয়ে বকের সারি উড়ে চলেছে। কিন্তু ওরা কারা?

চমকে ওঠে দাশু। একটা আশার চমক। মনে হয়, পল্টনী আর তেতরির এই অবিশ্বাসের হাসি, একটু বেশিরকমের রাগী দুঃখের হাসি। সত্যিই যে জমি পাইয়ে দেবে দুখনবাবু। সত্যিই যে ঈশান মোক্তারের দরবারে গিয়েছিল দুখনবাবু।

বেশ কিছু দূরে হলেও এখান থেকেই ওদের চিনতে পারা যায়। সড়ক থেকে নেমে কুঠির পথে সবার আগে এগিয়ে চলেছে যে, সে হল ঈশান মোক্তারের বড় ছেলে লালবাবু। পাঁচ বছর আগে দেখা লালবাবুর সেই চেহারা অনেক বদলে গিয়েছে। সেই রকমই ধবধরে ফরসা সুন্দর চেহারা আর বড় বড় কোঁকড়া চুল বটে, কিন্তু সেই কাঁচা মুখটি আর নেই। এক জোড়া কালো গোপ নিয়ে লালবাবুর মুখটা বেশ গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। বড় হয়েছে, বেশ ডাগর হয়েছে লালবাবুটা!

আগে আগে লালবাবু। তার পিছনে দুখনবাবু। তার পিছনে দুটো পালোয়ান চাকর। একটা চাকরের হাতে বন্দুক, আর একটা চাকরের হাতে ব্যাগ। আরও পিছনে একটা মোটরগাড়ি। বোধ হয় গাড়িটার তেল ফুরিয়েছে, অনেক লোক হল্লা করে গাড়িটাকে ঠেলে নিয়ে চলেছে। তার মধ্যে জটা রাখালের মুখটা বেশ স্পষ্ট করে চিনতে পারা যায়। গলার স্বর সবচেয়ে বেশি জোরে বাজিয়ে আর চেঁচিয়ে হাঁক দিচ্ছে জটা রাখাল : রাজাবাবু এইলেন, কত দয়া করলেন, হেঁইও।

–হেঁইও! একসঙ্গে দম ছাড়ে গাড়ি-ঠেলা ভিড়টা।

জটা রাখালরাজাবাবু খুশি হে, কত আশা পুষি হে, হেঁইও!

–হেঁইও!

বিকালের লাল আলোতে রঙিন হয়ে উঠেছে মধুকুপির ক্ষেত আর ডাঙ্গা। আখড়াতে করমের মাদল বাজতে শুরু করেছে। চুপ করে দাঁডিসে শুনতে থাকে দাশু। গাড়ি-ঠেলা ভিড়টাও বিশ্বাসের গান গাইছে। মধুকুপির বুকের উপর আশা আর আশ্বাসের উৎসব মেতে উঠেছে।

ওই তো লালবাবু; মনে পড়ে দাশুর জেলে যাবার ঠিক আগের বছরে শীতের সময় যেবার বড় ভাল গম ফলেছিল ডরানির কানা নালার দু পাশে, সেবার উরানির দহের নতুন হাঁস শিকার করতে এসেছিল লালবাবু। শীতের সকালে দহের জলে নতুন হাঁস ভাসতে দেখে ছেলেমানুষের চোখে সে কী খুশি, মুখে সে কী হাসি! ছেলে মানুষ হয়েও কী সুন্দর বন্দুক চালাতে পারত লালবাবু। সেদিন দাশুই তো লালবাবুকে কাঁধে চড়িয়ে ডরানির কনকনে ঠাণ্ডা জল পার হয়ে শিকার খেলাতে ওপারে নিয়ে গিয়েছিল।

মধুকুপির কিষাণের দুখ বুঝতে পেরেছে কি লালবাবু? তাই তো মনে হয়। হে কপালবাবা, তাই যেন হয়! পল্টনী আর তেতরির সন্দেহ যেন মিথ্যা হয়!

কপালবাবার জঙ্গলের দিকে তাকায় দাশু। কপালবাবা ছাড়া মধুকুপির কিষাণের আর কেউ সহায় নাই। এখনই কি কপালবাবার আসনের কাছে গিয়ে একবার মাথা ঠেকিয়ে চলে আসতে পারা যায় না? সন্ধ্যা হয়ে এল, কিন্তু তাতে কি আসে যায়? এক দৌড়ে যাওয়া, আর এক দৌড়ে ফিরে আসা, রাত হলেও কতই বা রাত হবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *