০৫. রাতের মধুকুপির বাতাস বেশ ঠাণ্ডা

রাতের মধুকুপির বাতাস বেশ ঠাণ্ডা, অন্ধকারও বেশ নিবিড়। আর নীরবতাও যেন একটা থমথমে নেশার ঘোর।

দাশুর মাথার জ্বালা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। আর, চোখের লালও সাদা হয়ে আসতে থাকে। হাতে-পায়ে ক্লান্তি নেই, কিন্তু দু চোখে একটা অবশ ঘুম-ঘুম ক্লান্তির ভার জোর করে টেনে নিয়ে পথ হাঁটতে থাকে দাশু।

তবু, মাথার ভিতরটা ঝিমঝিম করে থেকে-থেকে ঝঝরের মত বেজে উঠছে। আর মনটাও কথা বলছে। সকাল সকালী! টি-হা টি-হা-টি-হা! সকালী আর দাশু!

দূর দূর। সকালী আর দাশু কেন? ওটা তোে পলাশবনের একটা ভয়ানক অভিশাপের ছবি। সে ছবি আবার এতক্ষণ পরেও চোখের উপর ছমছম করে কেন? চোখে তো আর নেশাও নেই। দূর দূর। মনে মনে যেন ধমক দিয়ে আর ঘেন্না করে কুৎসিত একটা ভয়ের ছবিকে খেদিয়ে দিয়ে পথ চলতে থাকে দাশু। কপালবাবার দয়া আছে, তাই সকালীর লাল চোখের ছলছল মায়ার কাছে মরতে গিয়েও মরে পালিয়ে আসতে পেরেছে দাশু।

কিন্তু সকালীর জন্য দুঃখ হয়। হালদারের জন্য যদি প্রাণে এতই পিয়াসের জ্বালা জ্বলে থাকে, তবে যাও না কেন, হারানগঞ্জের গির্জাবাড়ির সিস্টার দিদির কাছে গিয়ে খিরিস্তান হও। শাড়ি পর, জামা পর, ঢং করে হাঁস আর পলুস হালদারের সাথে ঘর কর।

সকালীর উপর একটা রাগও যেন দাশুর মাথার ভিতরে থেকে থেকে জ্বলে ওঠে। তুই মাগি মুরলীকে মরাবার কে রে? মরাতে হলে হালদারকে মরা না কেন, যে তোকে জংলী মাগি বলে ঘিন্না করে ছেড়ে দিয়েছে, তোকে মাগ বলে মেনে নিতে লাজ পায় যে হালদার?

বড়কালুর কাস্ত্রে একটা জঙ্গলে হরতকী ভাঙতে গিয়ে কতবার দেখেছে দাশু, নাগিনে নাগিনে লড়াই বেধেছে। গায়ে সোনা রঙের ছোপ, চিকচিক করে চোখ, এই লম্বা এক একটা নাগিন। লিকলিক করে ঘাসের উপর অলসভাবে ঘুরে বেড়ায়। আর, কোন নাগ-নাগিনকে একসঙ্গে দেখতে পেলেই ফণা তুলে নাগিনটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। নাগিনে নাগিনে কিভয়ানক হিংসার মারামারি চলে! ছোবল কামড় আর হুটোপুটি। গায়ের সোনা রঙের ছোপ রক্তে আর ধুলোয় ঢাকা পড়ে যায়। নাগটা চুপ করে একদিকে বিড়ে পাকিয়ে আর শুধু ফণাটুকু উঁচিয়ে চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে। যে নাগিন মরে, সে নাগিন সেখানেই পড়ে থাকে। যে নাগিন বাঁচে, তারই সঙ্গে আবার জড়াজড়ি করে নাগটা। সকালীও যেন হরতকীর জঙ্গলের একটা নাগিন; নইলে মুরলীকে মরাতে চায় কেন?

তেতরি ঘাসিনটা ভয়ানক মিথুক। মুরলীর নামে মিছা একটা নিন্দার কথা বলে দিয়েছে, আর সকালী নাগিনটাও সে-কথা বিশ্বাস করে ফেলেছে। তেতরি ঘাসিনকে এখন একবার কাছে পেলে ওর টুটি টিপে ধরে শুধাতে পারা যেত-কি লো ডাকবাংলার রাতের লুচ্চার দাসী, তুই কি দেখে মুরলীকে সন্দেহ করলি, আর এমন মিথ্যেটা রটালি?

হেসে ফেলে দাও। সকালীর জন্য মায়া হয়। ভুল করে কাকে জড়িয়ে ধরল সকালী নাগিনটা?

খুব জোরে একটা হোঁচট খায় দাশু, আর ভয় পেয়ে চমকে ওঠে। মুরলীর মরদ দাশু আজ ভুল করে কাকে জড়িয়ে ধরল? মুরলী যে পাগল হলেও সন্দেহ করতে পারবে না, দাশু ঘরামির চওড়া বুকটা দূরদুরে পিপাসায় শতবার ছটফট করে উঠলেও মুরলী ছাড়া আর কোন নারীকে কাছে টেনে নিতে পারে। দাশু ঘরামির বুকটা কি পাপী হয়ে গেল?

রিমঝিম করে মাথাটা, মুরলীর উপর একটুও রাগ হয় না, বরং একটু মায়া হয়। আর, মনটাও ভীরু ভীরু হয়ে স্বীকার করে, মুরলীর চোখের চাহনিকে সন্দেহ করে টাঙ্গি তুলবার শেষ সাহস দাশুর; মুরলীর চোখের চাহনিকে সন্দেহ করে টাঙ্গি তুলবার শেষ সাহস দাশুর বুক থেকে ঝড়ে পড়ে গিয়েছে।

পলুস আর মুরলী! দূর দূর! বেচারা পলুস হালদার! হালদারের কথা মনে পড়লে একটুও হিংসে হয় না, বরং করুণা হয়। পথ চলতে চলতে মধুকুপির ঠাণ্ডা বাতাসের ছোঁয়ায় নিঃশ্বাসের জোর আবার জমে উঠতেই দাশুর প্রাণে যেন একটা দেনা শোধের হাসি শব্দ করে বাজতে থাকে। পলুসের দয়াকে পাল্টা দয়া দিয়ে শোধ করে দিয়েছে দাশু। সকালীকে বুকের উপর থেকে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে।

গাঁয়ের পথে ঢুকতে সেই বড় পিপুলের কাছে পেঁৗছবার আগেই চমকে ওঠে দাশু। থমকে দাঁড়াতেও হয়। সোরগোলের মত একটা শব্দ। মনে হয় পিপুলতলার কাছেই হৈ-হৈ করে কারা যেন ঠেঙ্গা দিয়ে টিন পিটছে। তবে কি বাঘিন কানারানী আবার কারও গরুর ঘাড় ভেঙেছে? পিপুলতলার কাছে অনেক আগুন জ্বলছে দেখা যায়। অন্ধকার যেন ছিঁড়ে ছিঁড়ে ঘা-ঘা লাল-লাল হয়ে গিয়েছে।

সোজা ছুটে এনে পিপুলতার কাছে দাঁড়াতেই বুঝতে পারে দাশু, মধুকুপির বাতাস তেতে উঠেছে। ঝুরি কাঠের আগুন থেকে তাত উথলে উঠছে; আর দুখন গুরুজীর বাড়ির দাওয়ার উপর জাতপঞ্চের সভা বসেছে।

কানারানীর ভয়ে চারদিকে আগুন জ্বেলে আর একেবারে টাঙ্গিবল্লম হাতে নিয়ে সবাই এসে পঞ্চে বসেছে। ছেলেগুলোর হাতে টিন আর ঠেঙ্গা।

গুরুজীর বাড়িটাকে এখান থেকে বেশ স্পষ্ট করে দেখা যায়। এই পাঁচ বছরে গুরুজীর অবস্থা আগের তুলনায় বোধহয় পঁচিশ গুণ ভাল হয়েছে। নইলে বাড়িটার চেহারা এত কেঁপে উঠবে কেন?

পিপুলের ছায়ার আড়ালে জাতপঞ্চের চেহারাটাকে ভাল করে দেখতে চেষ্টা করে দাশু। এ কী চেহারা! জোয়ান বলতে দশ বার জনের বেশি হবে না; আর সবাই বুড়ো। কোথায় গেল নিধি, নটবর, হরিশ আর হরিপদ? দাশুর কাছাকাছি বয়সের আরও তো অন্তত পঞ্চাশজন মানুষ ছিল। তারাই বা কোথায়?

তাছাড়া জাতপঞ্চের সভা গুরুজীর বাড়ির দাওয়াতেই বা বসে কেন? গাঁয়ের মুখিয়া রতন সরদার কি নাই? মরেই গিয়েছে বুঝি?

না, মরে নাই। ওই তো দাওয়ার উপর হাঁটু মুড়ে বসে আছে বড় বুড়া রতন। শুকনো রোগা ও ঝিরঝিরে, একটা ভয়ানক দুঃখী চেহারা নিয়ে বসে আছে।

আর গুরুজী বসে আছে একটা চারপায়ার উপর। বাঃ, মধুকুপির জীবনের নিয়মটাও উল্টে গেল! গুরুজী না হয় ভাল টাকা-পয়সা আছে, কিন্তু জাতপঞ্চের সভায় গাঁয়ের মুখিয়া রতনের চেয়ে উঁচু ঠাঁই বসবে গুরুজী এটা কেমন করে হয়? পাঁচ বছর আগে এমনটা তো কোনদিন হতে দেখে নি দাশু।

যার নাম দুখন কাকা, তারই নাম গুরুজী। মধুকুপিতে জাতের মানুষের মধ্যে একমাত্র দুখন কাকা জোয়ান কালে গোবিন্দপুরে গিয়ে পাঠশালাতে কিছুদিন লেখাপড়া করেছিল। মনে পড়ে দাশুর, অনেকদিন আগে, দাশু তখন ছেলেমানুষ, এই দুখন কাকা একদিন জাতপঞ্চের সভায় সবাইকে জানিয়ে দিল—এবার থেকে দুখন দুখন বলবে না কেউ।

-কেন? বড় বুড়ো ওই রতনই প্রশ্ন করেছিল। রতনের চোখে সেদিন কত তেজ ছিল! দুখন কাকার চেয়ে বয়স বেশি হয়েও রতনের চেহারা সেদিন কী মজবুতই না ছিল!

-জিলা বোর্ড আমাকে এই গাঁ-এর গুরু করে দিয়েছে। পাঁচ টাকা মাসোহারা দিবে জিলা বোর্ড। বলেছিল দুখন কাকা।

জাতপঞ্চ একটু ভয় পেয়েছিল। বড় বুড়াও শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছিল।—তা শুরু হয়েছ যখন, তখন গুরুজী বলতে হবে।

তারপর দুখন কাকা যেদিন ঈশান মোক্তারের কুটির বড় গুমস্তা হল সেদিন থেকে দুখন কাকা বলে ডাকবার সাহসই আর কারও হয় নি। গুরুজী নামটাই স্থায়ী হয়ে গেল।

দুখন কাকা এই গাঁয়ের একমাত্র মানুষ, যে মানুষ জাতে কিষাণ হলেও কোনদিন নিজের হাতে লাঙ্গল ধরে নি। গারুজী হবার আগেও না, গুরুজী হবার পরেও না। গায়ের কোন লোক দুখন কাকার কাছে লেখাপড়া শেখে নি, দুখন কাকাও ভুলেও কোনদিন কাউকে লেখাপড়া শিখতে ডাকে নি। পাঁচ বছর আগে জেলে যাবার আগের মাসেও দেখেছে দাশু পাঁচ টাকা মাসোহারা আনবার জন্য সদরে চলেছে দুখন গুরুজী।

লড়াইয়ের সময় গুরুজীও, কে জানে কেমন করে, অনেক টাকার মানুষ হয়ে গেল। গুরুজী খুব ঘটা করে তার দশ বছর বয়সের মেয়ের বিয়ে দিল। মধুকুপির জীবনের ইতিহাসে সে এক নতুন ঘটনা। দশ বছর বয়সের মেয়ের বিয়ে; বিয়েতে মন্ত্র পড়ল এক বামুন পূজারী, ভুবনপুরের চক্রবর্তী। সবই অভিনব। গাঁয়ের লাইয়া সনাতন কেঁদে ফেলেছিল? এটা কেমনতর হলো? আমি থাকতে কিষাণের বেটির বিয়েতে একটা বামন এসে কাজ করাবে কেন?

গুরুজীও রাগ করে বলেছিল রাতুগড়ের জোরদার সহদেব সিংহ আমার কুটুম হয়েছে। আমার বেটা-বেটির বিয়াতে তোমাকে দিয়ে কাজ করালে আমার মান থাকে না হে সনাতন।

জাতের মানুষ হয়েও জাতের দুঃখ থেকে বেশ একটু দূরে সরে গিয়েছে যে, আর জাতের মানের চেয়ে নিজের মান উঁচু করে দিয়েছে, সে মানুষ আবার তার ঘরে জাতপঞ্চের সভা ডাকে কেন?

এই পাঁচ বছরে গুরুজীর চেহারাও বেশ বদলে গিয়েছে। গায়ে খাটো জামা আছে, পরনে বেশ বড় ধুতি আছে, পায়ে খড়ম আছে, আর কপালে হলদে রঙের একটা ফোঁটাও আছে। মাথার সব চুল সাদা হয়ে গিয়েছে। দেখতে ঈশান মোত্তারের ছোট ভাইটির মত মনে হয়।

চারপায়ার উপর বসে বড় বুড়া রতনের দিকে হাত তুলে বেশ কড়া মেজাজের সুরে কি যেন বলছে গুরুজী। এগিয়ে যায় দাশু।

দাশু এসেছে। দাশু এসেছে। সোরগোল পড়ে যায়। যেন হঠাৎ কতগুলি বিস্ময় আতঙ্ক আর বিদ্রপ একসঙ্গে হৈ-হৈ করে ওঠে। চেঁচিয়ে ওঠে জটা রাখাল-দাশু যখন এসে পড়েছে, তখন আগে ওর বিচার হয়ে যাক।

দাশু হাসে-তোমরাও কি আমাকে দাগী মনে করলে জটা? আমার মাথা মুড়াতে চাও নাকি?

জটা রাখাল-তা পঞ্চ যদি বলে তবে মুড়াতে হবে।

চমকে ওঠে দাশু। জটা রাখালের মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে-বুঝে কথা বল জটা, কার মাথা মুড়াবার সাহস হয়েছে তোমার? দাশু কিষাণের মাথা?

জটা রাখাল আবার চেঁচিয়ে ওঠে বাবু দুখন সিংহ এখনি বলে দিবেন, তোমাকে জাতে রাখা উচিত হবে কি হবে না।

–বাবু দুখন সিংহ কে বটে? বলতে বলতে আর দুঃসহ বিস্ময় সহ্য করতে করতে গুরুজীর মুখের দিকে তাকায় দাশু।

–আমি। ভ্রূকুটি করে দাশুর দিকে তাকায় সেই মানুষটি, যাকে এতদিন গুরুজী বলে জেনে এসেছে দাশু।

জটা রাখাল আবার চেঁচিয়ে কি যেন বলতে চেষ্টা করে। বাবু দুখন সিংহ ইসারায় জটা রাখালকে থামিয়ে দিয়ে আর বড় বুড়া রতনের মুখের দিকে ভ্রূকুটি করে তাকিয়ে বেশ উত্তপ্ত স্বরে আক্ষেপ করে ওঠে ও জাতপঞ্চ ডেকেছে, জাতের কথা বল। কেমন করে জাতের সুধার হবে, জাতের মান বড় হবে, সেই কথাটি ভাব। কে তোমাদিগে জমি দিবে কি দিবে না; ঈশান মোত্তার বীজ-লাঙ্গল দিবে কি দিবে না, পুলিস মুন্সী চৌধুরীজী কেন পরবী নিবে, এসব কথা নিয়ে যদি জাতপঞ্চের সভায় চেঁচাতে চাও তো চেঁচাও, আমি এসবে নাই।

–কেন নাই? চেঁচিয়ে ওঠে দাশু।

–কি বললে তুমি? আরও জোরে চেঁচিয়ে প্রশ্ন করে দুখন সিংহ।

দাশু জাতের মানুষ দুখ পায়, সে কথাটি ভেবে জাতপঞ্চ চেঁচাবে না তো কে চেঁচাবে?

দুখন সিংহ-যে যার করমফলে ভুগে। চেঁচালে কি হবে?

দাশু–কি বললে দুখন বাবু?

দুখন সিংহ করমফল।

দাশু–সেটা কি বটে!

দুখন সিংহ-তোমার দশাটি যা বটে।

রতন বলে—দাশুর কথাতে তুমি রাগ কর কেন দুখন বাবু? ঠিক বলেছে দাশু। তুমি পৈতা নিয়েছে, রাজপুত সিংহ হয়েছে, বামন লাগিয়ে বেটা-বেটির বিয়া দিয়েছে, তুমি বনচণ্ডীর মূর্তি বসিয়েছো, তাতে…।

–তাতে কি? আবার রুষ্ট স্বরে প্রশ্ন করেন দুখন সিংহ–হিংসা করে কথা বল কেন রতন?

রতন বোকার মত হাসে ও হিংসা করছি না। তুমি বল, তা হলে কি করলে আমাদিগের দুখটা মরবে?

দুখন সিংহ-আগে জাতের সুধার কর।

রতন বল, কি করতে হবে?

দুখন সিংহ–ধরম সুধার কর।

রতন-বল কি করতে হবে?

দুখন সিংহ-কুঁকড়া খাওয়া ছেড়ে দাও।

-কেন ছাড়বো? রুক্ষ স্বরে প্রশ্ন করে ওঠে দাশু।

দুখন সিংহ-তা না হলে চক্রবর্তী তোমাদিগের কারও বেটা-বেটির বিয়াতে কাজ করতে রাজি হবে না।

দা–না হবে তো না হবে। আমাদিগের বামনে কাজ নাই। আমাদিগের লাইয়া সনাতন কি মরেছে?

সভার ভিড়ের এক কোণ থেকে যেন আর্তনাদ করে ওঠে সনাতন–আমি বেঁচেই আছি দাশু। কিন্তু দুখনবাবু আমাকে মরাতে চায়। বামন চক্রবর্তীকে পাঁচ বিঘা জমি পাইয়ে দিয়েছে দুখনবাবু, আমাকে এক কাঠাও দিবে না বলেছে।

দাশ-কে তোমাকে মরাবে সনাতন? কপালবাবা কি নাই? জাহির বুরু কি নাই? সিনবোঙা কি দেখছে না?

–তুমি চেঁচাচ্ছ কেন দাশু, তুমি বুঝ কি? চোখ পাকিয়ে দাশুর দিকে তাকিয়ে থাকে বাবু দুখন সিংহ।

দাশু–তুমি বুঝিয়ে দাও দুখন বাবু।

দুখন সিংহ-সিনবোঙ আর জাহির বুরুকে পূজবে, কপালবাবাকে মানবে, কুদরাকে তুষবে, আমি মানা করছি না। কিন্তু চারটি মানা মানতে হবে, না হলে জারে কপালে সুখ নাই।

দাশু–বল, কি মানা মানতে হবে?

দুখন সিংহ-কুঁকড়া খাবে না, কুঁকড়া বলি দিবে না, করমে ঘরের বেটি বহিন বহুড়ি নাচবে না; আর বেটি বহিনের বিয়ার বয়স বারো বছরের বেশিটি হবে না। আর…।

দাশু–হা, বলে যাও দুখন বাবু। শুন পঞ্চ শুন।

দুখন সিংহ-আর বনচণ্ডীর পূজাও করতে হবে।

দাশু–বনচণ্ডীর পূজা করলে কি লাভ হবে, সেটা একটু বুঝিয়ে বল দুখন বাবু।

দুখন সিংহ–বনচণ্ডী হলেন মহামায়া। তুমি জান না দাশু, তুমি জেলে ছিলে, এরা সকলে জানে, আমি কত ভক্তি করে দেবীকে এই পিপুলতার ঠাঁই বসিয়েছি। জাতের ভাল মানত করে আমি অনেক ভেবেছি, অনেক করেছি দাশু; তুমি কিছু জান না। তাই চেঁচাচ্ছ।

মুখ ঘুরিয়ে পিপুলতলার দিকে তাকায় দাশু। দেখতে পায়; হ্যাঁ, ঠিকই তো, ইঁট দিয়ে গাঁথা ছোট একটা ঘর। ঘরের দরজার কপাটে সিঁদুরের ছাপও দেখা যায়। দুটো লাল জবার গাছও দুলছে।

দুখন সিংহ বসে-বনচণ্ডী কৃপা করলে মানুষ কি না পাবে? আর ভক্তকে দেবী কি না দিবে?

দাশ-জমি দিবে?

দুখন সিংহ-জমির কথা ছেড়ে দাও। ওসব ছার কথা। দেবী পুণ্য দিবে, মোক্ষ দিবে, আত্মার গতি করে দিবে, আর জনম নিতে হবে না।

জাতপঞ্চের সভার ভিড় হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। দুখন সিংহ যেন বীরু ওঝার মত সাদা মাথাটা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে নতুন রকমের ধুলাপড়া পড়ে মধুকুপির বুক নতুন ভয়ে ভরে দিচ্ছে; তাই হঠাৎ বোবা হয়ে গিয়েছে জাতপঞ্চ। কিছু বুঝতে পারা যায় না, তাই আরও বেশি ভয় করে।

দুখন সিংহ বলে-তোমরা পালা করে চক্রবর্তীর জমি চষে দিয়ে বামনের নমস্কারি দিবে। চক্রবর্তী খুশি হয়ে তোমাদিগের মাথায় পায়ের ধূলা দিবে। তোমাদের বেটি বহিনের বিয়াতে কাজ করবে।

ঝুরিকাঠের আগুনে চিড়বিড় করে ফুটতে আর দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। আগুনের ছায়া লেগে দপ দপ করে জাতপঞ্চের ডিড়ের মুখগুলি।

এই স্তব্ধতার ঘোর কেটে যেতে সময়ও লাগে। শুকনো রোগা ও ঝিরঝিরে বড় বুড়া, গাঁয়ের মুখিয়া রতন আরও কিছুক্ষণ উসখুস করে নিয়ে তারপর আস্তে আস্তে বলে-কেমন পূজাটা নিবে বনচণ্ডী?

দুখন সিংহ—সবই নিবে। চাল পুল আর ফল নিবে। যত ইচ্ছা ছাগবলি দাও, সব নিবে। পয়সাও নিবে। আর, স্নানটি করে ভিজা কাপড়ে মাটির ভাঁড়ে ভরে নিয়ে যে মহুয়াম দিবে, তাও নিবে। কিন্তু কুঁকড়া বলি নিবে না।

বড় বুড়া হাঁক দেয়–বল পঞ্চ, বল।

জাতপঞ্চের ভিড়ের মাথাগুলি দুলে ওঠে, কিন্তু চেঁচিয়ে সাড়া দিতে পারে না। দুখন সিংহের কথাগুলি সত্যিই ধুলপড়ার মত পঞ্চের মুখ যেন বেঁধে দিয়েছে।

আবার হাঁক দেয় বড় বুড়া রতনবল পঞ্চ বল, হ্যাঁ কি না?

–না। চিৎকার করে ওঠে দাশু।

সঙ্গে সঙ্গে জাতপঞ্চের সভার বোবা-বোবা আর ভীরু-ভীরু মুখগুলি ঝুরিকাঠের আগুনের মত নতুন বাতাস পেয়ে চিড়চিড় করে ফুটে ওঠে : না, না, না।

দুখন সিংহ ভ্রূকুটি করে একঠায় দাঁড়িয়ে থাকে; গলায় চাদর, কপালে হলদে কেঁাটা, পায়ে খড়ম, নতুন মানের মানুষ দুখন সিংহ। জাতপঞ্চের আপত্তির রব কর্কশ কোলাহলের মত বাজতে থাকে।

চেঁচিয়ে ওঠে দুখন সিংহ-কিসের না? বনচণ্ডীর পূজা দিবে না?

বড় বুড়া-তা দিব না কেনে? আমরা কি ভুবনপুরের কালীথানে ছাগবলি দিই নাই? গোবিন্দপুরের ঠাকুরবাড়িতে পূজা দিই নাই? বামনের ঠাকুর যদি পূজা নেয়, তবে পূজা দিব না কেন?

–কিন্তু জাহিরথানে কুঁকড়া বলি দিব। হাত তুলে হাঁক দেয় দাশু।

–নিশ্চয় দিব। চেঁচিয়ে সাড়া দেয় জাতপঞ্চ। সোরগোল ওঠে। এক একটা প্রতিবাদের শব্দ আক্রোশের স্বরে ফেটে পড়তে থাকে।

–গাঁয়ের সব মেয়ে করম নাচবে। নিশ্চয় নাচবে।

–বেটা-বেটির বিয়াতে বামনের দরকার নাই।

–কোন দরকার নাই।

–বামন পুষবার পয়সা নাই।

–বেটিবহিন ডাগর হবে, তবে বিয়া হবে।

নিশ্চয় হবে। রাঢ়ির বিয়া হবে, সাগাই বিয়া হবে। সব হবে। যেমনটি হয়ে এসেছে, তেমনটি হবে। জাতের সুধার চাই না।

সোরগোল আস্তে আস্তে থিতিয়ে আসে। জাতপঞ্চের সভাও আস্তে আস্তে হাঁপাতে থাকে। আর দাশুর দু চোখে একটা জয়ের হাসি ঝিক ঝিক করে। আজকের দিনটা দাশু ঘরামির জীবনে যেন সব বাধা জয় করা একটা অভিযানের দিন।

দুখন সিংহ বলে বাস, আমাকে কোনদিন আর কিছু বলতে এসো না। তোমাদিগকে বাঁচাবার সাধ্যি আমার নাই।

হেসে ফেলে দাশু : তুমি জাতের ঘরে বামন ঢুকাতে এসো না দুখন বাবু; তাতেই জাত বেঁচে যাবে।

এক লাফ দিয়ে ওঠে দাঁড়ায় জটা রাখাল : কিন্তু জাতের ঘরে খিরিস্তান ঢুকলে জাত বাঁচবে কি?

জাতপঞ্চের সভা সেই মুহূর্তে আবার স্তব্ধ হয়ে যায়। বড়া বুড়া রতন আবার ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়। সভায় ভিড়ের চোখগুলি দাশুর মুখের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে। এইবার মনে পড়েছে সবারই, দাশুর ঘরের গণ্ডগোল নিয়ে জাতের মান যে সমস্যায় পড়েছে, সেই সমস্যার একটা হেস্তনেস্ত করবার জন্য আজ বাঘিন কানারানীর উৎপাতের ভয়ে সন্ত্রস্ত এই রাত্রিতে দুখন সিংহের বাড়িতে জাতপঞ্চের সভা ডাকা হয়েছে। দাশু ঘরামি এই পাঁচ বছর ঘরে ছিল না। দাশুর ঘরের দাওয়ার উপর গির্জাবাড়ির মেম এসে খিরিস্তানী শোলোকে গান করে গিয়েছে। তবু ঘর থেকে ভেগে গিয়ে খিরিস্তানী হয়নি দাশুর মাগ মুরলী। কিন্তু গাঁয়ের ঘরে থেকেও, আর দাশু ঘরে ফিরে আসবার পরেও এ কেমন কাণ্ড? দাশু কি জেনেছে যে, মুরলীর সাথে খিরিস্তান শিকারীটার ঢলানি হয়েছে?

জটা রাখাল হাঁক দেয়বল পঞ্চ, বল।

দুখন সিংহ রাগ করে হাঁক দেয়—তুই মিছা হাঁকিস কেন জটা? এরা সব খিরিস্তান হবে আর মরবে। এদের মরতে দে।

-কে খিরিস্তান হবে রে জটা? কে মরবে গো দুখন বাবু? দাও ওঠে দাঁড়িয়ে চোখ পাকিয়ে আর গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করে।

জটা রাখাল আবার হাঁক দেয়বল পঞ্চ, বল। ঠিক কথাটা বল। দাশুর ঘরের কাণ্ডটা বল। বলতে এত লাজ কেন, ডর কেন?

জাতপঞ্চের মেজাজে আবার যেন ঝুরিকাঠের আগুনের আঁচ এসে লেগেছে দুলে ওঠে মাথাগুলি, আর একসঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠে মুখগুলি। কিসের লাজ?

কে ডরাচ্ছে? কিসের ডর? বল বড় বুড়া, বল।

বড় বুড়া রতন চেঁচিয়ে ওঠে-দাশু ঘরামির ঘরণী মুরলী খিরিস্তান শিকারীটাকে ঘরে ডাকে কেন?

জটা রাখালের গলা আরও বিষাক্ত স্বরে চেঁচিয়ে ওঠেশিকারীটা মুরলীর গা ছোঁয় কেন?

দাশুর চোখের সাদাও সেই মুহূর্তে যেন বিষের জ্বালায় লাল হয়ে ওঠে। জাতপঞ্চের মুখের দিকে কটমট করে তাকিয়ে প্রশ্ন করে-কোন্ মিথক বলেছে? কোন্ কানায় দেখেছে?

–কে না দেখেছে?

–সবাই দেখেছে।

–চুপ কর দাশু।

–চেঁচিও না দাও।

–ছিয়া ছিয়া ছিয়া!

জাতপঞ্চের ভিড়ের এক-একটা মুখ থেকে এক-একটা রুষ্ট ধিক্কার উথলে উঠতে থাকে। দুখন সিংহের ঠোঁটের ফাঁকে একটা কুটিল হাসি পাকিয়ে পাকিয়ে সাপের মত কিলবিল করতে থাকে। আর চুপচাপ দাঁড়িয়ে যেন পুড়তে থাকে দাশু। মধুকুপির রাতের বাতাসটাই আগুন হয়ে গিয়েছে।

বড় বুড়া রতন বলে জবাব দাও দাও।

–জবাব নাই। থরথর করে চোখ কাঁপিয়ে উত্তর দেয় দাশু।

–কোন জবাব নাই? বড় বুড়া রতন ও সেই সঙ্গে পঞ্চের সবাই রাগ করে চেঁচিয়ে ওঠে।

–মিথ্যা কথা বিশ্বাস করি না।

–কি? জাতপথের গলা এক সঙ্গে কেঁপে গরগর করে ওঠে।

–মিথ্যা কথা, তোমাদিগের মতলবের কথা, তোমাদিগের হিংসার কথা। বলতে বলতে যেন হঠাৎ পাগল হয়ে জাতপঞ্চের সভার ভিতর থেকে একটা লাফ দিয়ে বাইরে ছিটকে পড়ে দাশু, তারপরেই ছুটে পালিয়ে যায়।

 

বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। বিশ্বাস করে ফেললে দাশু ঘরামির পাজরগুলি এখনি পট পট করে ভেঙে যাবে; তাই ভয়ানক অভিযোগে মুখর ওই জাতপঞ্চের সভাকে একটা চিৎকার করে ধমক দিয়ে পালিয়ে এসেছে দাশু।

কিন্তু জাতপঞ্চের সভার ঝুরিকাঠের আঁচটা যেন দাশুর গা ঘেঁষে সঙ্গে সঙ্গে চলেছে, দৌড় দিলে এই আঁচটাও সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ায়। ছুটে চলতে আর ইচ্ছা করে না। হাঁটতে গিয়ে পা দুটো বার বার মধুকুপির কাকুড়ে মাটিতে ঘষা খায়; বুকটা হাঁপায়। অবিশ্বাস করবার জোরটাই আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়ছে, আর, ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে নিঃশ্বাসের সাহসও যেন ফুরিয়ে যাচ্ছে।

পলুস হালদারের দয়ার রহস্যটা যেন এই অন্ধকারের মধ্যেই দাশুর চোখ মুখের ব্যথাটাকে দেখতে পেয়ে মুখ টিপে হাসছে। পলুসের ঠাট্টার হাসি, গর্বের হাসি, জয়ের হাসি। গোবিন্দপুর থানার সন্দেহ থেকে দাশুকে ছাড়া পাইয়ে দেবার জন্য থানার কাছে গিয়ে একটা সত্য কথা বলেছে পলুস, ওটা যে পলুসের জীবনের জয়ের হুংকার। দাশু ঘরামি কয়েদ হয়ে দূরে সরে গেলেই বা কি, আর ছাড়া পেয়ে ঘরে থাকলেই বা কি? দাশুকে একটা বাধা বলে মনে করে না পলুস। মুরলীর মুখের হাসির অঙ্গীকার পলুসের আশার পিপাসাকে একেবারে নিশ্চিন্ত করে রেখে দিয়েছে। মুরলীর গা ছুঁয়ে সুখী হবার সুযোগ যখন খুশি তখন পেয়ে যায় পলুস; পেয়ে গিয়েছে আর পেতেই থাকবে পলুস।

এই তো ঘর। পথের উপর স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে দাও। ওই তো পুরনো জামকাঠের কপাট। কপাটের ফাঁকে আলো দেখা যায়। কে জানে, আলোটা এখন ঘরের ভিতরের কোন্ খুশির ছবি দেখছে? শিকারীটার বুকের উপর কি ঢলে পড়ে আছে মুরলী?

না, আর এগিয়ে যেতে ইচ্ছা করে না। পা টিপে টিপে নিজেরই ঘরের দিকে আজ চোরের মত এগিয়ে যেতে হবে, এই শাস্তি সহ্য করবার আর দরকার কি? কিন্তু একটা চরম জানা না জেনে নিয়ে চলে যাওয়াও যে যায় না। মধুকুপির রাতের জানোয়ারের মত আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে জামকাঠের কপাটের ফাঁকে চোখ ঘষে দাশু।

কিছু দেখা যায় না। কঃ টের উপর কান পাতে দাশু। শিউরে ওঠে দাশু ঘরামির পাথুরে গাঁথুনির শরীর; অভিমান করে ফেঁপাচ্ছে ঘরটা, কথা বলছে ঘরটানা আর এখানে থাকবো কেন? থেকে লাভ কি? আমি যাব, নিশ্চয় যাব।

জামকাঠের কপাট দু হাতের দশ আঙুলের নখ দিয়ে আঁকড়ে ধরে দাশু। ঠক ঠক করে মাথাটা কাঁপে। আবার গুন গুন করে কেঁদে এই ঘরটাকে ধিক্কার দিচ্ছে মুরলী-এ ঘরে থাকলে মরণ হবে। এ ঘরে আর থাকবে না। কভি না।

তবে কি পলুস হালদারের বুকের উপর ঢলে পড়ে আবেদন করছে মুরলীর প্রাণ?

না, আর বাধা দেবে না দাশু। টাঙ্গি হাতে তুলে নেবে না। হাতটাকে কপাটের উপর যেন আছড়ে দিয়ে ডাক দেয় দাশু–মুরলী!

খুলে যায় কপাট। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঘরের ভিতরটার দিকে উদাসভাবে তাকিয়ে থাকে দাও। ঘরের ভিতরে কোন নতুন ছায়া নেই। রেড়ির তেলের মেটে বাতিটা শুধু মিটমিট করে জ্বলে। যেন ঘরের শূন্যতাকে দাশুর ক্লান্ত চোখের উপর তুলে ধরে মিটমিট করে ঠাট্টা করছে বাতিটা।

কেউ নেই? এ কি করে হয়? একটা পাল্টা সন্দেহের চমক লেগে কেঁপে ওঠে দাশু ঘরামির উদাস চোখ। মুরলীর মুখের দিকে তাকায়। একটা লাফ দিয়ে এগিয়ে এসে মুরলীর হাত ধরে। ভয় পেয়ে, আশ্চর্য হয়ে, আর যেন হঠাৎ হোঁচট-লাগা একটা ব্যথার জ্বালায় ছটফট করে চেঁচিয়ে ওঠে দাশু ও তুই কাঁদছিস কেন মুরলী?

ঘরের মেজের উপর খেজুর পাতার চাটাই ছড়িয়ে পড়ে আছে। দাশুর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে। মুরলী আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে চাটাইয়ের উপর বসে পড়ে। তার পরেই দু হাত দিয়ে দু হাঁটু জড়িয়ে পেটের উপর চেপে ধরে নিথর হয়ে বসে থাকে।

মুরলীর মাথাটা ভেজা। জলের ঘটিটা কাছেই আছে। ঘরের মেঝের অনেকখানি মাটিও জলে ভিজে কাদা কাদা হয়ে উঠেছে।

-তোর কিসের কষ্ট হলো, বল মুরলী। ডাক দেয় দাশু।

দুই হাঁটু আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে, যেন ঘোর নেশার বেদনার মত শরীরের একটা বিবশ কষ্টের রহস্যকে ভয় পেয়ে আরও জোরে চেপে ধরে মুরলী। তারপর কেঁদেই ফেলে। সত্যি যে আমার ছেইলা আসছে গো?

আশ্চর্য হয় দাশু : কেন, তুই কি তবে আগে বুঝিস নাই?

ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে মুরলী? আগে বুঝেছিলাম, তোমার ছেইলা আসছে। আজ বুঝলাম গো, এটা আমার ছেইলা বটে!

বোকার মত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দাশু বুঝতে চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারে। মুরলীর প্রাণ আজ কেন হঠাৎ কেঁদে কেঁদে আর হিসাব করে এরকম একটা অদ্ভুত নতুন কথা বলছে? দাশু বলে-কেন বুঝলি, কেমন করে বুঝলি?

মুরলী—এটা যে আমার গতর জ্বলাতে শুরু করলে গো। শুতে পারি না, ঘুমাতে পারি না, দম উগরে উঠছে। আরও কত জ্বালা জ্বলাবে, কে জানে?

মুরলীর কাছে সরে আসে দাশু। মুরলীর ভেজা মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনার সুরে বলে—তুই ঠিক বুঝেছিস। কিন্তু কাঁদিস কেন?

মুরলী—আমি যাব। এ ঘরে আমার ছেইলা বাঁচবে না। আমি এখানে থাকবো না।

দাশু ঘরামির সান্ত্বনার হাত যেন হঠাৎ অপমানের আঘাতে ব্যথিত হয়ে কেঁপে ওঠে। দাশুর মনের একটা হেঁয়ালির ঘোরও কেটে যায়। এই কথা! এতক্ষণ ধরে এই খেজুর পাতার চাটাইয়ের উপর শুয়ে বসে মুরলী তা হলে ওর জীবনের একটা আশার সঙ্গে কথা বলছিল। চলে যেতে চায় মুরলী। কিন্তু কোথায় কার কাছে?

টাঙ্গিটা ঘরের এক কোণে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। সেদিকে নজর পড়লেও দাশুর হাতে আর সেই আক্রোশের জোর হিংস্র হয়ে ওঠে না। কিন্তু এই আক্রোশহীন অলস হাতের একটা অভিমানের জ্বালা দাশুর দু চোখের চাহনিতে ফুটে উঠে অলস হিংস্রতার মত মিট মিট করে জ্বলে। চেঁচিয়ে ওঠে দাশুজাতপঞ্চ আজ কি বলেছে শুনবি?

মুরলী–কি?

দাশু–তুই খিরিস্তান শিকারীটাকে ঘরে ডেকেছিস। সে-ও তোর গা ছুঁয়েছে।

মুরলী বলে-হ্যাঁ।

–হ্যাঁ! চেঁচিয়ে ওঠে দাশু। দাশুর পাঁজরের হাড় পট পট করে বেজে ওঠে।

মুরলীর গলার স্বরও যেন হিংস্র হয়ে জবাব দেয়া। শিকারীটাকে গালি দিয়ে আমি যে খেদিয়ে দিলাম, সে কথাটা জাতপঞ্চ বলে নাই?

দাশু–না।

মুরলী-তবে যাও, জাতপঞ্চকে বলে দাও, পলুস হালদার আর এ গাঁয়ে আসবে না।

বলতে গিয়ে মুরলীর গলার স্বর আবার ভারি হয়ে, অভিমানে ফুঁপিয়ে, আর অনুতাপে করুণ হয়ে কেঁপে ওঠে। হাঁটুর উপর মাথা নামিয়ে চোখ ঘষে মুরলী।

দাশু বলে-গোবিন্দপুর থানার হাজত থেকে আমাকে কে ছাড়া করিয়েছে জানিস?

মুখ তুলে তাকায় মুরলী কে? দাশু–পলুস হালদার।

মুরলীর চোখ দুটো ঝিলিক দিয়ে হেসে ওঠে। তারপর যেন অদ্ভুত বিস্ময়ের আবেশে ঢলঢল করতে থাকে। আনমনার মত অপলক চোখ নিয়ে যেন অনেক দূরের একটা বিরাট ছায়ার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে মুরলী—এটা আবার কেমন কাণ্ড করলে পলুস?

দাশু–হালদারের মনে বড় দয়া। আমার মান রেখেছে পলুস।

মুরলী-মান রাখতে জানে পলস। গাওয়ার কিষাণ নয় পলুস।

দাশুর চোখ জ্বলে ওঠে : গাওয়ার কিষাণও পলুস হালদারের মান রাখতে জানে।

মুরলীর ঠোঁটের ফাঁকে ছোট একটা হাসির রেখা সির সির করে : তুমি নেশা করেছ।

দাশু করেছিলাম, কিন্তু এখন আর নেশা নাই। নেশার কথা নয়; পলুসের মাগ সকালী মধুকুপির কিষাণ দাশুর কাছেই মরতে চেয়েছিল, কিন্তু…।

মুরলীর চোখের ভ্রূকুটি আরও তীব্র হয়ে ওঠে। কিন্তু কি? কালীকে পেয়েও ছেড়ে দিয়েছ?

–হ্যাঁ।

–কেন?

–তোকে ধুতরা খাইয়ে মরাতে চায় সকালী।

–কেন?

–সকালী শুনেছে পলুস তোর সাথে ঢলেছে।

–সকালী তোমাকে একথা বলতে আসে কেন?

–আমাকে চিনে নাই। তাই বলে ফেলেছে।

–না চিনুক, কিন্তু বলে কেন?

–ঘর ছাড়া বেদেনী হয়েছে সকালী।

–হয়েছে তো হয়েছে, কিন্তু তোমাকে মনের কথা বলে কেন?

–আমাকে ওর মরদ করে নিতে চায়।

–কেন চায়?

–আমার উপর রাগ করতে পারে নাই।

–কেন পারে নাই?

–আমি সেধেছিলাম, যেন রাগ না করে।

–কেন তুমি সেধেছিলে?

–ভুল হয়েছিল মুরলী।

–কি ভুল?

–সকালীকে ছুঁয়েছিলাম।

–ছুঁতে ইচ্ছা করেছিল?

–হ্যাঁ।

–ছুঁতে ভাল লেগেছিল?

–হ্যাঁ।

–তবে গেলে না কেনে?

–তোকে মরাতে চায় যে মাগি, তার সাথে আমি চলে যাব…আমি পাগল হই নাই মুরলী।

খিল খিল করে হেসে ওঠে মুরলী : তবে পলুসকে তুমি কি দয়াটা করলে বল? তুমি নিজেকে দয়া করেছ। সকালী তোমার মাগকে মরাতে চায় শুনে ভয় পেয়ে ওকে ছেড়ে দিয়েছ।

দাশু–সেটা কি আমার দোষ হলো?

মুরলী-দোষ নয়, কিন্তু গুণ কিসের?

দাশু–সকালীকে খেদিয়ে দিতে পেরেছি।

মুরলী-গরব করবে না গো কিষাণ? ডরানির জলে ভাসিয়ে দাও তোমার গরব।

–কেন? দাশুর গলার স্বর তপ্ত হয়ে ওঠে।

–সকালী যদি তোমাকে ঐ কথাটা না বলতো?

–কি কথা?

–মুরলীকে ধুতরা খাইয়ে মরাবার কথা।

–কি বললি?

–তোমার কপালবাবার নামে কিরিয়া করে বল তো; তবে কি তুমি সকালীকে খেদিয়ে দিতে পারতে?

যেন বোবা হয়ে আর কাতরভাবে তাকিয়ে থাকে দাও। এক মুঠো জয়ের ধুলোকে একটা জয়ের পাহাড় মনে করেছিল দাশু! মুরলীর স্বামী হয়েও পলাশবনের একটা নিরালার ইঙ্গিতে দাশু ঘরামির বুকের বাতাস কত সহজে সকালীর লাল চোখের কাছে মরবার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল। দাশু ঘরামির এই পাথুরে শরীরও ভুল করতে জানে, ভুল করতে পারে, ভুল করবার জন্য হঠাৎ পাগল হয়ে ওঠে।

খিল খিল করে হেসে ওঠে মুরলী। হাসিটা যেন দাশু ঘরামির মন প্রাণ আর শরীর, যত মরদানি স্বামিপনা আর টাঙ্গির অহংকার মিথ্যে করে দিয়ে ভয়ানক টিটকারির ঝুমুরের মত বাজছে।

হাসি থামিয়ে আর ভেজা চুলের খোঁপাটাকে একটু গুছিয়ে টান করে বেঁধে নিয়ে মুরলী বলে-সকালী বুড়ি বটে কি?

–না।

–সুন্দরী বটে?

–হ্যাঁ।

–তবে?

–কি তবে? বিরক্ত হয়ে রুক্ষ স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে দাশু। কিন্তু মুরলীর মুখের দিকে চোখ পড়তেই ভয় পেয়ে দাশুর পাথুরে গাঁথুনির বুকটাও দুরুদুরু করে। মুরলীর চোখের চাহনিতে যেন একটা ভয়ানক হিসাব, একটা সংকল্প, একটা ইচ্ছার জ্বালা ফুটে রয়েছে।

মুরলী বলে—তুমি সকালীকে ঘরে নিয়ে এসো।

দাশু–ও কথা বলিস না। বল, তুই চলে যেতে চাস?

মুরলী-হ্যাঁ।

–কেন?

—এ ঘরে কালী থাকলেই ভাল হবে।

–কেন?

–তুমি যেমন ঘরটি চাও, তেমন ঘরণীটি হবে সকালী। সকালী যেমনটি চায়, এই ঘর তেমনটি কিষাণের ঘর বটে, আর তুমিও তেমনটি মরদ বট।

–তুই কোথায় যাবি? ঝালদা?

–আমার কথা শুধাও কেন? আমার কপাল যেথা নিয়ে যাবে, সেথা যাব।

দাশু হাসে : কপাল যদি মানিস, তবে আর যাবি কেন?

মুরলী–তোমার লাজ লাগে না?

–কিসের লাজ?

–জাতপঞ্চ তোমার যে মাগকে নষ্ট বলে গালি দিয়ে জাতের বার করতে চায়, তাকে নিয়ে আর ঘর করবার সাধ কর কেন?

–জাতপঞ্চ কিছু বুঝে নাই, তাই গালি দিয়েছে। সব কথা শুনলে মাপ করে দিবে জাতপঞ্চ।

–যদি মাপ না করে?

–তবু, তবু তোকে আমি যেতে দিব না।

–আমাকে ঘরে রেখে তোমার লাভ কি?

–আমার মাগ আমার ঘরে থাকবে। আমার ছেইলা আমার কাছে থাকবে। লাভের কথা বলিস কেন? ঘর করা কি কারবার বটে।

–থাকবো তো, কিন্তু বাঁচাতে পারবে কি?

কি বললি? দাশুর গলার স্বর থর থর করে।

–আমার ছেইলাকে বাঁচাতে পারবে?

হঠাৎ দাশু ঘরামির দু চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে জল ঝরে পড়ে : কেন বাঁচাতে পারব?

–বুঝে দেখ।

–কপালবাবার দয়া আছে। আর কি বুঝতে বলছিস?

–বেশ। দাশু ঘরামির মুখের দিতে তাকিয়ে এইবার একেবারে নীরব হয়ে যায় মুরলী। খেজুর পাতার চাটাইয়ের উপর দু হাতে দুই হাঁটু জড়িয়ে চুপ করে বসে থাকে।

তিন হাত উঁচু মাটির দেয়াল, ফুটো-ফাটালে ভরা খাপরায় চালা, আর জীর্ণ জামকাঠের কপাট। দাশুও ঘরের মেঝের উপর চুপ করে বসে অনেকক্ষণ ধরে কি যেন ভাবে। তার পরেই এগিয়ে যেয়ে মুরলীর হাত ধরে : তুই কি আমাকে ঘিন্না করলি?

মুরলী—এমন কথা বল কেন?

–আমি যে সকালীর গতর ছুঁয়ে ফেলেছি।

–বেশ করেছ। শিকারীটাও তো আমাকে…।

দাশু–কিন্তু তুই তো আর সাধ করে ছোঁয়া নিস নাই। আমি যে নিজে সেধে..তুই মাপ কর মুরলী।

মুরলীর চোখের দৃষ্টি হঠাৎ উতলা হয়ে ওঠে। দাশুর মুখের কথাগুলি যেন একটা শিশু মানুষের বিশ্বাসের প্রলাপ, একটা ভয়ানক মিথ্যা প্রশস্তি। কি-যেন বলতে চায়, হাঁটুর উপর মাথা ঘষে কি যেন ভাবতে চেষ্টা করে মুরলী।

দাশু–কি বলবি, বল মুরলী।

আনমনার মত তাকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী : না, কিছু বলবো না। তুমি মাপটাপ চেয়ে আমাকে হাসাবে না।

শান্ত হয় দাশু। তারপরে ব্যস্ত হয়ে ওঠে : তুই কি আজ কিছু রাধিস নাই, কিছু খাস নাই?

মুরলী : ছেইলার জ্বালায় জ্বলবো, না, রাঁধবো?

দাশু–আমি রাঁধি। তুই শুয়ে থাক।

ঘরের এদিকে ওদিকে যত হাঁড়ি আর ঝুড়ি নেড়ে-চেড়ে আর হাতড়ে হাতড়ে যখন ক্লান্ত হয় দাশু, তখন মুরলী যেন একটা ভ্রূকুটি লুকোতে গিয়ে মুখ টিপে হেসে ওঠে হেই দেখ, খাটিয়ার তলে সরাতে মাইয়ের দানা আছে।

ছোট একটা মাটির সরা, তার মধ্যে আধ সের মত মকাইয়ের দানা। সরাটাকে হাতে নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে দাশু।

মুরলী বলে-ওই আছে, আর কিছু নাই। শুখা মরিচ দিয়ে হলুদ জলে সিঝিয়ে নাও।

হ্যাঁ, রাঁধতে হবে; ক্ষিদেটা যেন পা থেকে মাথা পর্যন্ত সব হাড়মাসের ক্লান্তি জিভ দিয়ে চাটছে। উনানের দিকে তাকায় দাশু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *