০৩. পাঁচ হাত উঁচু মাটির দেয়াল

পাঁচ হাত উঁচু মাটির দেয়াল, আর খাপরার চালা। জামকাঠের জীর্ণ দরজার একটা কপাট খোলা, একটা কপাট ভেজানো। বড়কালুর গায়ে যখন বিকালের রোদ গড়িয়ে পড়ে, তখনও মধুকুপির এই ঘরের ভিতরে দুটি মানুষের প্রাণ সাড়া হারিয়ে নিঝুম হয়ে পড়ে থাকে। আকাশের দিকে তাকিয়েও দাশুর চোখ দুটো যেন মধুকুপির বিকালের এই চেহারাটাকে চিনতে পারে না। আর, মুরলীও বোধহয় বুঝতে পারে না, কতক্ষণ ধরে ওর মাথাটা হেঁট হয়ে আছে, আর হাতটা শুধু মেঝের মাটির উপর নখের দাগ এঁকেছে।

মধুকুপির আকাশ কাঁপিয়ে আবার শব্দের সেই ভয়ানক খেলা মেতে উঠেছে। বুম বুম্ শব্দ করে বাতাস ফাটে, গুর গুর করে বাতাস কাঁপে, আবার বাঁশি বাজিয়ে শিউরে ওঠে বাতাস।

চমকে ওঠে দাশু, যেন দাশুর জীবনের একটা অবসাদের ঘুম হঠাৎ ভয় পেয়ে ভেঙে গিয়েছে। এইবার মুখ ঘুরিয়ে দেখতে পায় দাশু, না, পালিয়ে যায় নি মুরলী। যদিও দরজা খোলা, দাশুর হাতে টাঙ্গিও নেই। নেশার ঘুমের চেয়েও বেশি নিরেট একটা অবসাদের ঘোরে দাশুর চোখের পাতাগুলি নেতিয়ে পড়েছিল।

মাটির উপর নখের দাগ আঁকছে মুরলী। হিসেব করছে মুরলী। মুরলীর শান্ত চোখের তারা দুটো যেন নিজের আলোর অহংকারে চিকচিক করছে। মুরলীর ওই হেঁট মাথা কি মরদের টাঙ্গির ভয়ে ভীরু হয়ে যাওয়া কোন নারীর মাথা?

না, ভয় পায় নি মুরলী; ওর জীবনের স্বপ্ন একটুও ভীরুও হয়ে যায় নি। এই ঘরকে ঘৃণা করে, এই ঘরের ছোঁয়াচ থেকে আলগা হয়ে, গুটিশুটি হয়ে বসে আছে মুরলী। নিশ্চয় হিসেব করে দেখেছে, চলে যাবার সুযোগ কি আবার পাওয়া যাবে না?

একবার একটা আমগাছের মাথায় জাল পেতে একটা কোকিল ধরেছিল দাশু। ঘরের মধ্যেই কানের কাছে যখন-তখন কোকিলের ডাক শুনতে পাওয়া যাবে; অনেক আশা করে, অনেক হেসে কোকিলটাকে একটা বাঁশের খাঁচায় বন্ধ করে ঘরের ভিতরে রেখেছিল। কিন্তু ডাকেনি কোকিলটা। একবারও না। খাঁচায় বন্ধ হওয়ামাত্র যেন প্রতিজ্ঞা করে ডাক বন্ধ করে দিয়েছিল চতুর পাখিটা। শেষে, কোকিলটাকে ছেড়ে দিতে হয়েছিল। আজও মনে পড়ে দাশুর, এই ঘরের দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে দেখতে আর শুনতে পেয়েছিল দাশু, খাঁচা থেকে বের হয়েই কোকিলটা ফুড়ুৎ করে উড়ে গিয়ে পথের ধারে ওই নিমের ডালে বসল আর ডেকে উঠল, কু-কু-কু। মনের সুখে যেন পাগল হয়ে ডেকে ডেকে আর দাশুকে ঠাট্টা করে তারপর উধাও হয়ে গেল পাখিটা।

মুরলীর প্রাণও ঠিক সেই কোকিলটারই মত চালাক। খাঁচায় বন্ধ হয়েছে মুরলীর প্রাণ। হাসবে না, নাচবে না, গাইবে না মুরলী। দাশু ঘরামির সব আশা আর কল্পনাকে জব্দ করে দেবে। একদিন, যেদিন ছাড়া পাবে মুরলী, ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে দাশু, সেদিন আনন্দেরই ডাক ডেকে হাসতে হাসতে চলে যাবে। নেই, এই ঘরের মধ্যে পড়ে থাকলেও মুরলী আর নেই। এভাবে টাঙ্গির ভয়ে পড়ে থাকা যে মরে থাকার মতই না-থাকা।

মুরলীর চোখদুটো হাসছে। চমকে ওঠে দাশু। মাথা তুলেছে মুরলী, মুখ ঘুরিয়ে দাশুর মুখের দিকে কটমট করে তাকিয়েছে। দাশুর টাঙ্গির চেয়েও বেশি শাণিত আর প্রখর, মুরলীর সেই হিসেব করা ভাবনাগুলি যেন হেসে উঠেছে।

মুরলী বলে-টাঙ্গি হাতে নিয়ে তেড়ে এলে, কিন্তু মারলে না কেন?

দাশু বিড়বিড় করে-আর একবার চলে যেতে চেষ্টা করে দেখ না কেন, মারি কি না।

মুরলী–মারলে মরবে কে?

দাশু–মরবে মহেশ রাখালের বেটি, খিরিস্তানী হবার সাধ হয়েছে যে কিষাণী মাগির।

মুরলী–তোমার ছেইলাটা মরবে না?

দাশুর বুকের হাড়ের উপর যেন টাঙ্গির কোপ পড়েছে। চোখ দুটো কেঁপে ওঠে।

মুরলীর কটমট করে তাকানো সেই চোখের মধ্যে একটা চতুর ধিক্কারের হাসিও জ্বলতে থাকে! মুরলী বলে–মহেশ রাখালের বেটি যদি একটা শিকড়বাকড় খেয়ে পেট খালি করে দেয়; তবে…।

–থাম থাম, কিষাণের মাগ হয়ে ডাইনির মত কথা আর বলিস না! বুকফাটা একটা আর্তনাদ কোনমতে চেপে রেখে, আর কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ায় দাশু। এমন ভয় জীবনে কোনদিন পায় নি দাশু। মুরলীর চোখের মধ্যে সত্যিই শাণিত টাঙ্গির ছায়া দেখতে পেয়েছে দাশু। দাশুর জীবনের সবচেয়ে মিষ্টি লোভটা, দাশুর ছেইলার প্রাণটা যে এই মুরলীর দয়ার কাছে বাঁধা পড়ে গিয়েছে।

বলতে বলতে আবার ঘরের মেঝের মাটির উপর অলসভাবে বসে পড়ে দাশু। পাথুরে ছাঁদে গড়া এত শক্ত শরীরের সব হাড়ের গিটগুলি যেন খুলে ভেঙে ঢিলে হয়ে গিয়েছে। আনমনার মত হাত তুলে কি-যেন খোঁজে দাশু। বোধহয় একটা গামছাকে হাতের কাছে পেতে চায়। তারপর শিথিল হাতটা তুলে আস্তে আস্তে চোখ মোছে।

আস্তে আস্তে দাশুর কাছে এগিয়ে আসে মুরলী। দাশুর মুখের দিকে কটকটে চোখের একটা নতুন অস্থিরতা নিয়ে তাকিয়ে থাকে, অনেকক্ষণ। মুরলীর চোখে যেন হঠাৎ একটা ভয়ানক কাটার খোঁচা লেগেছে। জ্বলছে চোখ, কিন্তু জ্বালাটা যেন ভীরু হয়ে আস্তে আস্তে গলে যাচ্ছে।

দাশুর মাথার উপর হাত রাখে মুরলী : কি হলো?

উত্তর দেয় না দাশু দাশুর মাথার উপর আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে মুরলীর হাতটাও কাঁপতে থাকে : তুমি কাঁদলে কেন বল?

কথা বলে না, বোধহয় বলারই শক্তি নেই, কিংবা সাহস নেই দাশুর। মহেশ রাখালের মেয়ে মুরলীকে জীবনে কোনদিন এত ভয় করে নি দাশু। নইলে মুরলীর হাতের ছোঁয়া মাথার উপর আদর বুলিয়ে দিলেও দাশুর গায়ের পেশীতে একটা শিহরও কি না কেঁপে থাকতে পারে?

দেখতে পায় না দাশু, মহেশ রাখালের সেই মেয়ে একটা হাত তুলে আস্তে আস্তে নিজেরই কটমটে চোখ দুটোকে কেমন করে মুছছে। মুরলী ডাকে—আমার কথাটা শুনছো কি?

দাশু–কি?

মুরলী-কোন কিষাণের দূরে কি জোয়ান মেয়ে নেই?

দাশু–থাকবে না কেন? অনেক আছে।

মুরলী-তবে তোমার ভাবনা কিসের?

দাশু–কি বলছিস তুই?

মুরলী-তুমি তো আবার একটা বিয়া করতে পার, ছেইলাও পেতে পার।

দাও কুটি, করে তাকায়। মুরলীও সেই মুহূর্তে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে—মুরলী মরে যাক না কেন? তোমার ভাবনা কিসের? কত কিষাণের মেয়ে তোমার হাতের সিঁদূর মাথায় নিয়ে খুশি হয়ে তোমাকে ছেইলা দিবে।

দাশু বলে-না।

মুরলী–কেন না?

দাশু–জানি না। আমি তোর মত হিসাব জানি না।

কিন্তু জানতেই হবে, শুনতেই হবে। মুরলী বলে–বলতেই হবে। আমি আজ জবাব নিয়ে ছাড়বো। যেন দুর্বার একটা জিদ মুরলীর মনের ভিতর কঠোর হয়ে চেপে বসেছে।

হিসাব করতে জানে না যে মাথাটা, দাশু তার সেই মাথা দু হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে। কেন কিসের জন্য কি পেতে চায়, ঠিক বুঝতে পারে না দাশুর যে বুকটা, সেই বুকের উপর একবার হাত বুলোয় দাশু। যা বলতে চায় তা ঠিক করে গুছিয়ে বলতে পারে না দাশুর যে মুখটা, হাত তুলে সেই মুখ একবার মুছে নেয় দাও। তারপর ঘরের দরজার দাওয়ার উপর বিকালের ছড়ানো আলোর দিকে তাকিয়ে আনমনার মত বিড়বিড় করে? তুই রাগ করলে আমার যে বাঁচতে সাধ হয় না। কথাটা বুঝিস না কেন?

সরে যায় মুরলী। কিন্তু দাশুরই মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বোধহয় মুরগীর হিসেব করে চলা ভাবনার আর বুদ্ধির সব জোর হঠাৎ একটা ধাক্কা খেয়ে এলোমেলো হয়ে গিয়েছে।

ঘরের ভিতর ছটফট করে ঘুরে বেড়াতে থাকে মুরলী। কান দুটো যেন দাশুর মাদলের বোল শুনতে পেয়েছে, তাই দুপায়ে নাচের নেশা চঞ্চল হয়ে উঠেছে। বার বার চুমুক দিয়ে হড়িয়ার নেশা বুকের ভিতর ভরে নিতে ইচ্ছে করে। ভিজে গিয়েছে ঠোঁট দুটো। হবে, খুব হবে। এই মানুষটার শুধু কোমর ধরে সারা জীবন এই ঘরের ভিতর পড়ে থাকলেও সুখ হবে, অনেক সুখ।

বিছানাটাকে একটা টান দিয়ে গুটিয়ে পাকিয়ে এক দিকে সরিয়ে দেয় মুরলী। সেলাইয়ের কলটাকে চোখে পড়ে। একটুকরো চট দিয়ে কলটাকে বোঁচকার মত বেঁধে ঘরের এক কোণে রেখে দেয়। তারপর নিজের চেহারাটার দিকেও চোখ পড়ে। সত্যিই, একটা নতুন নেশার সুখে মত্ত হয়ে শাড়ি জামা আর সায়া দিয়ে তৈরী করা এই সাজটাকেও সরিয়ে দিতে চায় মুরলী।

ঘরের দরজার কাছে তেমনই নীরব নিরেট অলস আনমনা চেহারা নিয়ে বাইরের পথের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে দাশু। যখন বিকালের আলো মরে আসে, আর ঘরের চালার উপর ক্লান্ত পাখির মেলা বসে যায়, তখন দাশু ঘরামির স্তব্ধ চোখ দুটি যেন ধোঁয়া লেগে কটকট করে ওঠে।

সত্যিই ধোঁয়া। ঘরটা ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছে। রেড়ির তেলের বাতিটা জ্বলছে। ঘরের কোণে উনানের ভিতরে শুকনো বাঁশপাতার আগুন জ্বলছে। রান্না করছে মুরলী। ভাতের হাঁড়িতে টগবগ করে জল ফুটছে।

আর মুরলীর চেহারাটা একেবারে কিষাণী হয়ে গিয়েছে। খাটো শাড়ি দিয়ে জড়ানো মহেশ রাখালের মেয়ে সরু কোমরের উপর ছোট আঁচলের ঝালর ঢলে পড়েছে। হাত চালিয়ে কাজ করছে মুরলী। মুরলীর আদুড় গায়ের নরম নরম গড়নগুলি দুলছে কাঁপছে দুমড়ে যাচ্ছে।

একটা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় দাশু। যেন এতক্ষণে পাঁচ বছর আগের একটা আনন্দের জীবন্ত মাদলকে চোখে দেখতে পেয়েছে। মুরলীকে শক্ত করে দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বুকের উপর তুলে নেয় দাশু।

–মুরলী, তুই আমার মুরলী। তুই কোথায় যেতে চাস বল্? চেঁচিয়ে ওঠে দাশু।

মুরলী মুখ টিপে হাসে-তুমি যেথা নিয়ে যাবে।

দাশু–আজ কোথাও যাব না।

মুরলী-যেও না।

দাশু–কাল যাব।

মুরলী–যেও।

দাশু–কিষাণ আর কিষাণীতে মিলে একসাথে যাব, কেমন?

মুরলী–হ্যাঁ।

দাশু–ঈশান মোক্তারের কুঠিতে গিয়ে চিঠা নিব।

মুরলী–নিও।

দাশু–তিন বিঘা জমি নিয়ে ভাগজোত করব।

মুরলী–করো।

বুকে জড়ানো মুরলীকে আদরের চাপে যেন পিষে দিয়ে দোলাতে থাকে দাশু। ডরানির স্রোতের মত কলকল করে মুরলীর বুকের ভিতর থেকেও একটা উতলা খুশির হাসি উথলে পড়তে থাকে। মধুকুপির কিষাণ ও কিষাণীর জীবনের ঝুমুর এতক্ষণে সব অভিশাপের জ্বালা থেকে মুক্তি পেয়ে নেচে উঠতে পেরেছে।

মুরলীর দু’হাত ধরে হেসে হেসে আর দুলে দুলে সুর করে ছড়া গেয়ে ওঠে দাশু–তু যাস কুথাকে, হেই কিষাণী।

মুরলী চোখ টিপে হাসে–নাইহর যাব, ডহর জানি।

দাশু–কিসের এত গমর হয়।

মুরলী–উমর কমর বুড়া নয়।

দাশু–কিষাণী তুর চিকণ চুল।

মুরলী–কে দিবেক ঝিঙ্গা ফুল।

দাশু–মোর ঘর যাবি কি?

মুরলী–মন দিব লিবি কি?

দাশু—ছল মন লিব না।

মুরলী–যৈবন দিব না।

চেঁচিয়ে ওঠে দাশু–কি বললি?

দাশুর মুখ একটা হাত দিয়ে চেপে ধরে মুরলী বলে—চুপ কর।

 

ভোর হয়েছে। চালার ফুটো-ফাটল দিয়ে মধুকুপির আকাশের চোখ দাশু ঘরামির ঘরের ভিতর হেসে হেসে উঁকি দেয়। ঘুম ভেঙেছে দাশুর, আর মুরলীর ঘুমন্ত শরীর তখনও ছোট মাদলটার মত দাশুর দু হাতের শক্ত বাঁধনে বাঁধা হয়ে দাশুর বুকের সঙ্গে সেঁটে আছে।

দাশু ডাকে—শুনছিস!

ভাঙা ভাঙা ঘুমের মধ্যে ফিসফিস করে মুরলী–হ্যাঁ, শুনছি।

দাশু–তবে ওঠ না কেন?

মুরলী-না।

দাশু–ভুলে যাস কেন?

মুরলী–কি?

দাশু–রাতের বেলা কত কথা হলো, মনে নাই?

রাতের বেলার কথা? কি কথা? না, মুরলী মনে করতে পাছে না। শুধু মনে পড়ে হাঁড়িতে মহুয়ার জল ছিল না, তবু দুজনে মিলে, মধুকুপির কিষাণ আর কিষাণী সেজে একসঙ্গে বসে এক থালাতে ফেনভাত খেয়ে আর হেসে হেসে যেন একটা মিথ্যা নেশার আবেশে বিভোর হয়ে মিছিমিছি অনেক গল্প করেছিল।

দাশু বলে-ভুলে গেলি কেন, এখন একবার ঈশান মোক্তারের কুঠিতে যেতে হবে?

মনে পড়ে মুরলীর। আর মনে পড়া মাত্র ভয় পেয়ে চমকে ওঠে। ঠিক কথা, রাতের বেলা দাশু কথাটা বলেছিল বটে। অন্তত বিঘা তিনেক জমি ভাগজোত করবার জন্য ঈশান মোক্তারের কুঠিতে গিয়ে চিঠা নিতে হবে।

মুরলী বলে–যাও না কেন?

আশ্চর্য হয় দাশু : আমি তে যাবই। কিন্তু তুই কি যাবি না?

মুরলী–না।

দাশু–তুই যে বললি, যাবি।

মুরলী–বলেছিলাম; কিন্তু আমি যেতে পারবো না।

দাশু–কেন? তুই আবার কি ভাবলি?

মুরলী–আমি যাব না।

দাশু–কেন?

মুরলী–লাজ লাগে।

দাশু–আমার সাথে যাবি, তাতে লাজ কিসের?

মুরলীকে শক্ত কবে জড়িয়ে ধরে থাকা দাশুর হাত দুটোকেই হঠাৎ একটা ঠেলা দিয়ে চমকে দেয় মুরলী।—ছাড়।

হাতের বাঁধন আলগা করে দিয়ে মুরলীকে ছেড়ে দেয় দাশু। মুরলী আস্তে আস্তে সরে গিয়ে ঘরের মেঝেয় মাটির উপর চুপ করে বসে থাকে। নিজের চেহারার দিকে শুধু নয়, যেন নিজের জীবনের দিকে আবার চোখ পড়েছে মুরলীর। মুরলীর ঘুম-ভাঙা চোখ দুটো এই খাটো শাড়ি ও আদুড় গায়ের দিকে তাকিয়ে ভয়ানক লজ্জা পেয়েছে।

–কি হলো? বেশ একটু শক্ত স্বরে, দাঁত চিবিয়ে প্রশ্ন করে দাশু।

মুরলী বলে–আমি যাব না।

মুরলীর গলার স্বরে একটা অদ্ভুত আতঙ্ক। ভয় পেয়েছে মুরলী। মধুকুপির মাটির কাকর ধূলো আর কাটার মধ্যে জীবনটাকে সঁপে দিতে হবে, ভাবতেই যে মুরলীর বুকটা কেঁপে উঠেছে। অসম্ভব। সারা মধুকুপির মানুষ এই পাঁচ বছর ধরে মুরলীর নতুন চেহারা দেখেছে, আর হিংসেয় জ্বলছে। তবে আবার কেন? মধুকুপির কিষাণ আর কিষাণীগুলির চোখে-মুখে ঠাট্টার সুখ জাগিয়ে দেবার জন্য নিজেকে ছোট করে দিতে পারবে না মুরলী। সিস্টার দিদির এত উপকারের অপমান করতে পারবে না। কেন, কিসের দুঃখ, কার ভয়ে কিষাণী হয়ে যেতে হবে?

দাশু বলে—তুই যাবি, যেতে হবে।

মুরলী-না, আমি তোমার কামিন নই।

দাশু উঠে দাঁড়ায় : আবার সেই কথা!

মুরলী–আমি কিষাণী হতে পারবো না।

দাশু–কিষাণের মাগ তুই কিষাণী হবি না তো কি হবি?

উত্তর দেয় না মুরলী। মুরলীর আরও কাছে এগিয়ে এসে চাপা গর্জনের মত স্বরে প্রশ্ন করে দাশু–কার মাগ হতে তোর সাধ হয়েছে রে?

উত্তর দেয় না মুরলী। একটা হাত এগিয়ে দিয়ে মুরলীর হাত ধরবার চেষ্টা করে দাশু : চল।

হাত দুটো গুটিয়ে পেটের কাছে লুকিয়ে মুরলীও শক্ত হয়ে একটা কঠোর অবাধ্যতার গর্বে অনড় হয়ে বলে না।

দাশু–আমি তোর ঝুঁটি ধরে হিঁচড়ে নিয়ে যাব।

দাশুর চাষাড়ে আক্রোশ হঠাৎ যেন মরিয়া হয়ে মুরলীর একটা হাত ধরবার জন্য মুরলীর

উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

কিন্তু পিছন থেকে জামকাঠের কপাটটা যেন প্রচণ্ড টিটকারি দিয়ে বেজে ওঠে। কপাটের উপর যেন হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে। ভোতা ভোতা ভারি শব্দ।

দাশু ঘরামির কান চমকে ওঠে। তারপর শরীরটাই স্তব্ধ হয়ে যায়। তারপর এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয় দাশু।

-এই যে, মাল যে ঘরের ভিতরেই আছে দেখছি।

কী কুৎসিত উল্লাসের স্বরে চেঁচিয়ে উঠল একটা লোক! পিতল ধাঁধানো মোেটা ও বেঁটে একটা লাঠি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। এই লোককে জীবনে কখনও দেখেছে বলে মনে করতে পারে না দাশু। খাকি গরম কোট গায়ে, খাকি পা-জামা পরা। রুমাল দিয়ে মাথাটা এক পাক বাঁধা। লোকটার গরম কোটের বুকের কাছে পকেটের মধ্যে ছোট একটা বই আর পেন্সিল। লোকটার ঠোঁটের উপর মোটা মোটা একজোড়া গোঁফ নেতিয়ে রয়েছে।

এই লোকটারই পাশে আর একজন দাঁড়িয়ে আছে। তাকে চিনতে পারে দাশু। রামাই দিগোয়ার; নীল উর্দি গায়ে, কোমরে চামড়ার পেটি, হাতে চকচকে টাঙ্গি। এই রামাই দিগোয়ার বাবুরবাজার ফাঁড়ির চৌকিদার।

রামাই দিগোয়ার ডাকে–চলে এসো দাশু।

সঙ্গী রামাই দিগোয়ারের মুখের দিকে তাকিয়ে উর্দির লোকটা মাথা দোলায় আর বিড়বিড় করে—আমার আর সন্দেহ নাই, রামাই; এ বেটা গুপীর দলের একটা পাপী বটে; না হলে শালার চোখ দুটো এত ডাঁট করে তাকায় কেন?

দাশু–কেন? কোথায় যাব? আমাকে আবার মিছা কেন ডাকছো, রামাই?

রামাই মিচকে হাসি হেসে গোপালো লোকটাকে দেখিয়ে দেয়।–চৌধুরীজীকে শুধাও।

লোকটা বলে-আমি গোবিন্দপুর থানার পুলিস মুন্সী।

দাশু ফ্যালফ্যাল করে পুলিস মুন্সী চৌধুরীজীর কঠোর টার দিকে তাকিয়ে থাকে। চৌধুরীজী তার হাতের পিতল বাঁধানো লাঠির গায়ে হাত ঘষে চেঁচিয়ে ওঠে-এ শালা খুব শক্ত মাল বটে রামাই। দেখছিস না, শালা একটা সেলামও করছে না।

দাশুর হাত কাঁপে। চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকেও বুঝতে পারে, মুরলী এসে পিছনে দাঁড়িয়েছে। দাশুর হাতের কাঁপুনি যেন হঠাৎ হিংস্র হয়ে আবার টাঙ্গি খুঁজে নিতে না পারে; তাই বোধহয় পিছনে এসে পথ আটক করেছে মুরলী। বেশ তাই হোক।

রামাই দিগোয়ার বলে—আজ তিনদিন হলো তুমি ছাড়া পেয়েছ। কিন্তু থানাতে হাজিরা দিতে যাও নাই। কোথায় ছিলে তুমি?

দাশু–ঘরে ছিলাম।

রামাই হাসে-বেশ তো, চল এবার; থানাতে গিয়ে এই কথাটি বলে এসো।

গর্জন করে চৌধুরীজী–মিথুক চোট্টা! এই দুই দিন গাঁয়ের একটা লোকও তোমাকে দেখে নাই। সারা গা ঘুরে আমি রিপোর্ট নিয়েছি।

অভিযোগ মিথ্যা নয়। দাশু ঘরামির এই তপ্ত মাথাটাও স্মরণ করতে পারে, এই দুটি রাত আর একটি দিন, সারাক্ষণ মহেশ রাখালের সুন্দর-মুখ মেয়ের সোহাগ ভিক্ষে করতে করতেই পার হয়ে গিয়েছে। ঘর থেকে বের হয়ে গায়ের কোন মানুষের সঙ্গে সুখদুঃখের একটা কথাও বলে নি দাশু।

-চল। পিতল বাঁধানো লাঠিটাকে দরজার কপাটে ঠুকে হাঁক দেয় পুলিস মুন্সী চৌধুরীজী।

-চলেন। কথাটা বলেই ছোট্ট আর্তনাদের মত তীক্ষ্ণ ও করুণ একটা শব্দ আছড়ে দিয়ে দরজার চৌকাঠ থেকে একটা লাফ দিয়ে দাওয়ার উপর নেমে পড়ে দাশু।

-যেতে হবে না, যদি দশটা টাকা দাও। লাঠির মাথাটাকে শুঁকে শুঁকে কথা বলে চৌধুরীজী।

-না, দিব না। জবাব দেয় দাশু।

–তবে চল। চেঁচিয়ে হাঁক দেয় চৌধুরীজী।

আগে আগে পুলিস মুন্সী চৌধুরীজী, মাঝখানে দাশ, পিছনে রামাই দিয়োয়ার। মধুকুপির সকালবেলার রোদ গায়ে মেখে ছোট একটা অদৃষ্টের মিছিল সড়কের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যেতে থাকে। রামাই দিগোয়ারের টাঙ্গিতে টাটকা রোদের হাসি চিকচিক করে। আর দাশুর গায়ের নতুন গেঞ্জিতে সিঁদুরের ছোপগুলি ছোট ছোট শুকনো রঙের ছোপের মত সকালের রোদে পুড়তে পুড়তে চলে যায়।

দরজার চৌকাঠের কাছে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে মুরলী। শুকনো খটখটে চোখ। মুরলীর সে চোখে শুধু ধোঁয়া আছে, জল নেই। যেন স্মৃতি হারিয়েছে মুরগী। কে চলে গেল, কেন চলে গেল, যেন বুঝতেই পারছে না মুরলী।

দরজার চৌকাঠ থেকে একটা দৌড় দিয়ে ছুটে গিয়ে সড়কের পাশে নিমের ছায়ার কাছে উঁচু পাথরের টিলার উপর দাঁড়ায় মুরলী। এখনও দেখতে পাওয়া যায়, তিনটে মানুষের মিছিল হন হন করে হেঁটে ডরানির ছোট পুলের দিকে এগিয়ে চলে। দাশুকে দেখবার জন্য গাঁয়ের ছেলেমেয়ে আর মাগি-মরদ ছুটে এসে পথের পাশে ভিড় করেছে।

টিলার উপর দাঁড়িয়ে হাঁপাতে থাকে মুরলী। না আর দেখা যায় না। পথের বাঁকে ওরা ঘুরে গিয়েছে। ছি ছি, লোকটা যে একবার মুখ ফিরিয়ে তাকালও না। পাঁচ বস্তু আগে গ্রেপ্তার হয়ে চলে যেতে যেতে ওই লোকটাই তো ছলছল চোখ নিয়ে মুখ ফিরিয়ে মুরলীর দিকে বার বার তাকিয়েছিল।

যাবে আর কোথায়? ছাড়া পেয়েই তো আবার ছুটে আসবে। মহেশ রাখালের বেটি মুরলীকে না জ্বালাতে পারলে মানুষটা যে মরেই যাবে।

ধোঁয়াটে চোখের জ্বালা হাত দিয়ে মুছে ফেলতে চেষ্টা করে মুরলী। সামনের ঐ সড়কের আঁকাবাঁকা চেহারার দিকে আর তাকাতেও ইচ্ছা করে না। তাকালেই চোখে জ্বালা লাগে। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে পুব দিকের ফাকা পথের ছায়া-ছড়ানো শান্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকে।

ও কে বটে গো? কে আসছে? চমকে ওঠে মুরলী।

আস্তে আস্তে হেঁটে, বন্দুকটাকে কাঁধের উপর রেখে, দুলতে দুলতে সকালবেলার ঠাণ্ডা বাতাসের সঙ্গে মুখের ফুরফুরে হাসি একেবারে মিশিয়ে দিয়ে এই দিকেই এগিয়ে আসছে

পলুস হালদার।

এদিকেই যদি আসছে তবে ওখানে পথের উপর ওভাবে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো কেন পলুস হালদার? চুপ করে আর শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেই বা কি? হ্যাঁ, জীয়লে ফুল ধরেছে। কিন্তু শিকারীর চোখ কি গাছে ফুলের শোভা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল? তাই কি দেখতে পেল না যে, মুরলী এখানে দাঁড়িয়ে আছে?

মুরলীর মনের ভিতরে যেন একটা অভিমান হতাশ হয়ে যায়। ভুল হয়েছে। পলুস হালদারকে একটুও বুঝতে আর চিনতে পারে নি মুরলী। রাত জেগে মাচানে বসে থাকা একটা ক্লান্ত শিকারীর দু চোখের নকল পিপাসাকে একেবারে একটা খাঁটি প্রাণের ডাক বলে মনে করে মুরলী বৃথা নিজের বুকটাকে একটা মিথ্যা গর্বে ভরে দিয়েছিল। শুধু এক ঘটি জল খেয়ে খুশি হবার জন্য এসেছিল পলুস হালদার। তার চেয়ে বেশি কোন পলুস হালদারের চোখে ছিল না।

পাথুরে টিলার উপর একটা পাথুরে ছবির মত শক্ত হয়ে বোধহয় আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকত মুরলী, যদি মুরলীর স্তব্ধ শরীরটাই হঠাৎ সিরসির করে না উঠত। মুরলীর হাঁটুর কাছে অদ্ভুত একটা অস্বস্তি সুড়সুড় করে উঠছে। একটা ফড়িং, বেশ সুন্দর দেখতে একটা রঙিন চেহারার ফড়িং মুরলীর হাঁটুর উপর বসে পাখনা কাঁপিয়ে ফরফর করছে।

চমকে ওঠে মুরলী। ফড়িংটার দোষ কি? মুরলীর খাটো শাড়িতে যে মুরলীর হাঁটুও ঢাকা পড়ে নি। একেবারে খাটি একটা পাতা-কুড়ুনি আর আগাছা বাছুনি কিষাণীর মত মুরলীর চেহারাটা যে আধ-উলঙ্গতায় বেলাজ হয়ে রয়েছে। ছি ছি ছি! মুরলীর এই চেহারা চোখে পড়লে পলুস হালদারের চোখ ভয় পেয়ে শিউরে উঠবে। পলুস হালদার যে কোন দুঃস্বপ্নে সন্দেহও করতে পারবে না, গড বাবার মেয়েটির মত দেখতে সেই সুন্দর সাজে সাজানো মুরলীর আবার এরকম একটা জংলা চেহারা থাকতে পারে।

ভালই হয়েছে। মুরলীকে চোখে পড়ে নি, কিংবা চোখে পড়লেও মুরলী বলে বুঝতে পারে নি পলুস হালদার। হাতের এক ঝাপটে রঙিন ফড়িংটাকে খেদিয়ে দেয় মুরলী। খাটো শাড়িতে জড়ানো আদুড় শরীরটাকে কুঁকড়ে আরও ছোট করে একেবারে লুকিয়ে ফেলবার জন্য বসে পড়ে। তার পরেই টিলা থেকে নেমে পড়ে। দৌড়ে গিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে কপাট বন্ধ করে দেয়।

বেশ কিছুক্ষণ পার হয়ে যায়। চুলের উপর চিরুণি চালিয়ে নতুন করে খোঁপা বাঁধে মুরলী। শাড়ি সায়া জামা পরে। চটি জোড়াও পায়ে দিতে ভুলে যায় না। মুরলীর যে-চেহারা দেখে পলুস হালদারের চোখে সেই আশার পিপাসা আবার চমকে উঠবে, সেই চেহারা একেবারে নিখুঁত করে নিয়ে বদ্ধ দরজার কপাটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে মুরলী। আসবে পলুস হালদার, এই দিকেই আসবে, এই ঘরের এই দরজার কপাটের কাছে এসে পলুস হালদারের জুতোর শব্দ থমকে যাবে।

কিন্তু কই? আসছে না কেন পলুস হালদার? জীয়লের ফুলের দিকে এতক্ষণ ধরে হাঁ করে অকিয়ে থাকবার কি দরকার আছে? এখনও কি মানুষটার তেষ্টা পায় নি?

পলুস হালদারের উপর সন্দেহ করে আবার একটা অভিমান মুরলীর নিঃশ্বাস কাঁপিয়ে দিত নিশ্চয়, কিন্তু হঠাৎ মনে পড়ে মুরলীর, মনে পড়তেই মুরলীর চোখে-মুখে একটা আমুদে হাসির আভা চমকে ওঠে। মনে পড়েছে, অনুমান করতে পারছে মুরলী, শিকারীর চোখ একটা শিকার দেখতে পেয়েছে, তাই জীয়ল গাছের মাথার দিকে তাকিয়ে আর শক্ত হাতে বন্দুকটাকে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাই আসতে দেরি করছে।

ওই জীয়লের মাথার উপরে পাতার ঝোপের আড়ালে দুটো মোটা মোটা ডালের চিপার মধ্যে কাদা দিয়ে লেপা ছোট্ট একটা বাসা আছে। আজ প্রায় দশদিন হল, ডিম মজাবার জন্য বাসার ভিতরে নিজেকে বন্ধ করেছে পাখিটা, একটা ধনেশী। ধনেশটা বাসার বাইরে বাসাটারই প্রায় গা ঘেঁষে বসে থাকে আর পাহারা দেয়। মাঝে মাঝে উড়ে যায় ধনেশটা, আর ঠোঁট ভরে ফড়িং নিয়ে এসে কাদালেপা বাসার ছোট ফুটোর ভেতর দিয়ে মুখ ঢুকিয়ে ধনেশীকে খাওয়ায়। মনে পড়ে মুরলীর, কদিন আগে একটা বেদিয়া এসে ঐ বাসা ভেঙে ধনেশীটাকে ধরবার জন্য গাছে উঠেছিল। কোথা থেকে লাঠি হাতে নিয়ে গালি দিতে দিতে তেড়ে এল পল্টনী দিদি-ভাগ এখান থেকে খালভরা, চোরের পুত, ড্যাকরা।

পল্টনী দিদির রাগ দেখে আর বেদিয়াটার ভয় দেখে হেসে ফেলেছিল মুরলী। বেদিয়াটা কাচুমাচু হয়ে মুরলীর কাছেই আবেদন করেছিল—তু বল তো দিদি, আমার কসুরটা কি? ধনেশীটাকে তেল করে বাতের ওযুধ বানিয়ে তুদিগেরই কাছে বেচে যাব, তুদিগেরই ভালাই

হবে।

পল্টনী দিদি আবার তেড়ে আসে? ভাগবি কিনা রে কসবির বেটা, নয় তো আজ তোকেই আগুনে চড়িয়ে তেল করে নিব।

দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিল বেদিয়াটা।

বন্ধ দরজার কপাটের কাছে দাঁড়িয়ে মুরলীর মুখে এখন সেদিনের হাসিটা নতুন করে যেন আরও আমুদে আবেগে চঞ্চল হয়ে কাঁপতে থাকে। নিজের হাসির শব্দ শোনে মুরলী, তার পরেই অন্য একটা শব্দ শোনে, বন্দুকের গুলির আওয়াজ। নিশ্চয় সেই বেহায়া মাদিকাতুরে ধনেশটা, যেটা কাদালেপা বাসার গা ঘেঁষে বসে থাকে আর বাসা পাহারা দেয়, সেই ধনেশটাকে মেরেছে পলুস হালদার।

কপাট খুলে, দরজার চৌকাঠের কাছে দাঁড়ায় মুরলী। এইবার, এই দিকে না এসে আর কোন্ দিকে যাবে পলুস হালদার?

মুরলীর অনুমান মিথ্যে নয়। ভাবতে ভুল করে নি মুরলী। হ্যাঁ, এদিকেই আসছে, এসে পড়েছে পলুস হালদার। পলুস হালদারের হাতে মরা ধনেশটা ঝুলছে। পাখিটার পা দুটোকে যেন খিমচে ধরে রয়েছে পলুস হালদার। পাখিটার প্রকাণ্ড চওড়া ঠোঁট আর অসাড় মাথাটা প্রায় সড়কের ধুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দুলছে।

–কেমন আছ সরদারিন? বলতে বলতে কাছে এগিয়ে এসে আর দাওয়ার উপরে উঠে মুরলীর প্রায় পায়েরই কাছে রঙীন একটা উপহারের মত রক্তমাখা পাখিটাকে ফেলে দিয়ে হাসতে থাকে পলুস হালদার।

–জল খাবেন কি? না, দরকার নাই? হাসতে হাসতে মুরলীও প্রশ্ন করে।

–খাব। জবাব দেয় পলুস।

একটি ঘটি জল নিয়ে আসে মুরলী। পলুস হালদার সেই জল ঢক ঢক করে খেয়ে হাঁফ ছাড়ে : আমি এতটা ভাবি নাই সরদারিন।

-কি?

–আমি চাই নাই, কিছু বলিও নাই, তবুও তুমি বুঝে ফেলেছে।

-যা বলেন, মুখ খুলে বলেন না কেন?

–আমার পিয়াস তুমি বুঝতে পার।

–কিন্তু আপনি তো কিছু বুঝেন না।

-কি বুঝি না?

-আপনার এখানে আসা ভাল নয়, আর আমার হাতের জল খেয়েও আপনার কোন লাভ হবে না।

-তুমি জল দিলে আমি জল খেলাম। লাভ নেই বলছো কেন মুরলী?

মুরলীর চোখের তারা চমকে ওঠে : আমার নাম জানলেন কিসে?

পলুস হালদার হাসে : জেনেছি।

মুরলী ভ্রূকুটি করে : নাম ধরছেন কেন?

পলুস-ইচ্ছা হলো।

—এমন ইচ্ছা ভাল নয়।

–জানি।

মুরলী চেঁচিয়ে ওঠে : জেনেও বুঝি আমাকে জ্বালাবে তুমি?

মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকায় মুরলী। মুরলীর চোখ যেন একটা তীব্র অভিমান, একটা সন্দেহ, একটা উদ্বেগ। কিন্তু মুরলীর সেই উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে পলুস হালদারের চোখের সব আশার উদ্বেগ একেবারে শান্ত হয়ে গিয়েছে। মুরলীর রাগের ভাষাটা যে এরই মধ্যে পলুসকে ডাক দিয়ে আপন করে নিয়েছে।

পলুস ডাকে–মুরলী।

মুরলী বলে–না।

পলুস–কিসের না?

মুরলী-আমাকে জ্বালাবে কেন তুমি? কেন পিয়াস ঠাণ্ডা করতে এখানে আসবে তুমি? তোমাকে জল দিবার মানুষ নাই?

পলুস–নাই।

–কেন? ঘরণী গেল কোথায়?

–বেঁচে আছে, কিন্তু ঘরে নাই।

–কেন?

–ঘরে এলো না। অনেক ডেকেছিলাম, তবুও না।

–এলো না কেন?

–আমি খিরিস্তান হলাম, সে খিরিস্তান হলে না। অনেক সেধেছিলাম, তবু সে খিরিস্তান হতে রাজি হলো না।

–সে এখন আছে কোথায়?

–আমার ঘর ছিল যে গাঁয়ে, সেই কুলডিহাতে আছে।

–কোন্ সুখে আছে?

–সে খুব ভাল সুখে আছে। বড়পাহাড়ির পূজা করে, আর আমার মরণ মানত করে।

–ছি, ছি। হালদারিন কি পাগল হয়েছে?

অস্ফুট স্বরে একটা আক্ষেপ করে পলুস হালদারের মুখের দিকে অপলক চোখের একটা সমবেদনাতুর বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে মুরলী। পলুস হালদারের জীবনে বেদনা আছে; কি আশ্চর্য, সে বেদনা যে ঘহু মুরলীর জীবনেরই বেদনার মত। আর অভিযোগ নয়, উদ্বেগও নয়, মুরলীর দুই চোখে যেন দুর্বার এক সান্ত্বনার আবেগ ঝকঝক করে।

পলুস বলে–ওর কথা আর ভাবি না, ওকে আমি ঘিন্না করি।

মুরলী–হালদারিনের সাথে দেখা হয় কি?

-এই বছরে আর দেখা হয় নাই।

মুরলী মুখ টিপে হাসে : গত বছরে?

পলুস-হ্যাঁ।

মুরলী-কেন? কেমন করে দেখা হলো? সে এসেছিল, না, তুমি গিয়েছিলে?

পলুস-আমি গিয়েছিলাম।

মুরলী আবার হাসে : তাই বল। হালদারিনকে ভুলতে পার নাই?

পলুস অপ্রস্তুত হয়ে বলে-তখনো ভুলি নাই।

মুরলী-তারপর ভুললে কেন?

পলুস-শুনতে চাও?

মুরলী সন্দিগ্ধ হয়ে, আর এতক্ষণের ঠাট্টার তরল হাসি একেবারে স্তব্ধ করে দিয়ে বলেশুনবো।

পলুস-পিয়াস লেগেছিল, এক ঘটি জল চেয়েছিলাম। কিন্তু সে তবু আমাকে জল দেয় নাই।

মুরলীর চোখ দুটো বোধহয় ছলছল করে উঠবে; পলুসের জীবনের পিয়াসের মধ্যে এত বেদনা আছে কল্পনাও করতে পারে নি মুরলী।

পলুস বলে–বুঝলে তো মুরলী; কেন আমার পিয়াস লাগে?

মুরলী–বুঝেছি।

পলুস–তবে?

মুরলী-বল, আমি কি করতে পারি?

পলুস–যখন এতই বুঝেছ, তখন আরও একটু বুঝে নাও।

মুরলীর বুক দূরদূর করে, দুই হাঁটুর জোড় যেন খুলে যাচ্ছে, টলমল করে এখনি দাওয়ার উপর আছাড় খেয়ে পড়ে যাবে শরীরটা।

পলুস বলে-বল মুরলী।

দরজার কপাট শক্ত করে আঁকড়ে ধরে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে মুরলী। তারপর, যেন জোর করে একটা টোক গিলে সেই সঙ্গে এই মুহূর্তের সব দুর্বলতা গিলে ফেলতে চেষ্টা করে। না, কখনই না, আর কিছু বুঝতে চেষ্টা না করাই ভাল। পলুস হালদার এই মুহূর্তে চলে গেলেই ভাল। হতাশ হোক, রাগ করুক, মুরলীকে একটা ছলনার ডাইনী বলে মনে করে ভয় পেয়ে চলে যাক পলুস হালদার।

খিল খিল করে হেসে একটা অন্য জগতের হাসাহাসির মধ্যে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে মুরলী। মুরলী বলে-কানারানী তোমাকে বুঝিয়ে দিবে, ওর পিছে আর যেও না।

–কানারানী কে বটে?

–বাঘিনটা গো, যেটাকে মারবার লেগে তুমি জঙ্গল ঢ়ুঁড়ছে।

পলুস হালদার-কে কাকে বুঝিয়ে দিবে, দেখে নিও।

মুরলী-আমি শুধাই, কানারানী তোমার কোন্ কলিজা খেয়েছে যে, ওর উপর তোমার এত রাগ?

পলুস হাসে : তোমাকে খেতে এসেছিল, তাই।

মুরলী–কিন্তু খায় তো নাই।

পলুস—কিন্তু তোমার গন্ধ নিয়ে গেছে। আবার আসবে।

ঘরের দাওয়ার চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে কানারানীর থাবার দাগগুলিকে খুঁজতে থাকে পলুস হালদার : না, কাল রাতে আর এপাকে আসে নাই বাঘিনটা। এই সবই পরশুর দাগ।

মুরলী–কানারানী ভেগেছে কি?

পলুস–না। পৌষের জাড়া না এলে বাঘিনটা ভাগবে না। কিন্তু আমি তার আগেই…।

হঠাৎ কথা থামিয়ে পলুস হালদার আবার হাসতে থাকে। কিন্তু বুঝতে পারছি না, বাঘিনটার রাগটা এত মজার রাগ কেন?

–কি বললে?

বুঝলে না?

–না।

–তোমার শাড়িটা টেনে নিয়ে গিয়ে কাঁটায় ফাঁসিয়ে ছিঁড়েছে, মনে নাই?

মুরলী বিব্রতভাবে বলে—তাই বল।

পলুস-শাড়িটাকে পেল কেমন করে?

মুরলী হাসে-পেয়ে গেল।

পলুস–নিশ্চয় ভুল করে রাতের বেলায় এই দাওয়াতে শাড়িটাকে মেলে রেখেছিলে?

মুরলী হাসে : হবে, মনে নাই।

পলুস হো-হো করে হাসে। বেচারী তেতরি ঘাসিনের একটা লাল সায়াকেও বেড়ার উপর থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে কানি করে দিয়েছে বাঘিনটা।

চমকে ওঠে মুরলী। কানারানীর ধূর্ত চোখের ওই জ্বলজ্বলে রাগের মধ্যে যেন ভয়ানক একটা শাসন আছে। নইলে…।

পলুস বলে-ফুলকি কিষাণীরও খবর নিয়েছিল বাঘিনটা। ফুলকিকে দিয়ে মা ডাক ডাকিয়ে ছেড়েছে।

-আঁ! আবার চমকে ওঠে মুরলী।

পলুস–ফুলকির দরজার ফাঁক দিয়ে থাবা ঢুকিয়ে ওর খোঁড়া ভাতারটার পা ধরে টেনেছিল বাঘিনটা। কিন্তু ভাগ্য ভাল ফুলকির; ফুলকি মাগো মা বলে চেঁচিয়ে উঠতেই বাঘিনটা ভেগে গেল। চুপ করে, আর বুকের ভিতরের একটা ছমছমে ভয়ের শিহর নিয়ে শুনতে থাকে মুরলী। পলুস বলে-ঈশান মোক্তারের একটা বলদকে মেরেছে আর বড়কালুর মাথার উপরে নিয়ে গিয়ে খেয়েছে বাঘিনটা। ডরের মারে রেললাইনের কুলিগুলো কাজ ছেড়ে ভেগে যাচ্ছে। আমি বড়কালুর কাছে স্রোতের ধারে মাচান বেঁধেছি। বাঘিনের ছায়াটি একবার কাছে পেয়েছি কি ওকে আমি সেরেছি।

পলুস হালদার বন্দুকে হাত বুলিয়ে কোমরের পেটিতে সাজানো টোটা গুনতে থাকে। তারপর যেন নিজের গর্বের দুঃসাহসে দুলতে দুলতে বলে–মাত্র একটা গুলি খরচ করবো মুরলী। তুমি দেখে নিও। ও-জানোয়ারকে খতম করতে পলুস শিকারীর একটা বেশি গুলির দরকার হয় না।

পলুস হালদারের গর্বের গল্প শুনে হাসতে চেষ্টা করে মুরলী, কিন্তু হাসিটা যেন গলার ভিতর আটকে যায়। একটা চোখ জ্বলজ্বল করে, আর একটা চোখ নিভু নিভু হয়ে জ্বলে, কানারানীর সেই হিংস্র ধূর্ততার দৃষ্টিটা যেন মুরলীর বুকের ভিতর বিধছে। আনমনার মত তাকিয়ে ফিসফিস করে মুরলী ও কানারানীর প্রাণ মেরে তোমার কি লাভ?

পলুস-থানা দিবে পঁচিশ টাকা, ঈশান মোক্তার দিবে পাঁচ টাকা, আর রেল-কোম্পানির সাহেব বলেছে, বিশ টাকা বকশিশ দিবে। লাভ আছে মুরলী।

মুরলী-তাই বল। তুমি বাঘিনটাকে মারবার ঠিকা নিয়েছ?

পলুস-আরও দুইজন শিকারী ঠিকা নিয়েছে। কিন্তু আমি জানি, বাঘিনটার প্রাণ আমিই নিব। সব বকশিশ আমার, আর সেই বকশিশের টাকা দিয়ে আমি…বল দেখি মুরলী, আমি কি করবো ভেবেছি।

মুরলী-কি আর করবে? সোনা কিনে নিয়ে একটা সুন্দরী খরিস্তানীকে দিবে।

পলুস-না। তোমাকে দিব।

চমকে ওঠে মুরলী : আমি নিব না।

পলুস-কেন?

দু চোখের ভুরু কাঁপিয়ে কটকট করে তাকায় মুরলী : আমি তোমার রাখনি নই।

–ছিঃ! আতঙ্কিতের মত চেঁচিয়ে ওঠে পলুস ও তুমি কি মনে কর যে, আমি মেয়েমানুষ শিকার করে বেড়াই? আমি কি ডাকবাংলার রাতের বেলার বাবু? আমি কি ঈশান মোক্তার?

মুরলীর কঠোর ভাষার ধিক্কারটা পলুস হালদারের মনের গভীরে গিয়ে যেন একটা ক্ষত হয়ে জ্বলছে। খুব দুঃখ পেয়েছে পলুস হালদার। মুরলী লজ্জিত হয়, তবু মুরলীর সন্দেহের অভিমান যেন ভাঙতে চায় না। মুরলী বলে—তবে তুমি কি বট? কি কর তুমি?

পলুস-সিস্টার দিদি আমাকে ভাই বলে। সিস্টার দিদি আমাকে লিখাপড়া শিখালে। সিস্টার দিদি আমাকে কয়লা খাদের কলঘরের চাকরি করে দিলে। আমি চার কুড়ি টাকা তলব পাই, মুরলী। আমি জংলী কিষাণ নই।

পলুস হালদারের কথাগুলিও যেন পাল্টা ধিক্কার; কিষাণী মুরলীর মুখরতার উপর কঠোর আঘাত। পলুস হালদারের চোখ দুটোও যেন নিজের অহঙ্কারের উত্তাপে জ্বলছে। দেখতে পায় মুরলী, পলুস হালদারের সারা মুখের মধ্যে সেই পিয়াসের একটু ছায়াও আর নেই।

পলুস বলে—আমি পরের মাটি চষি না, ভুখা পেট নিয়ে কাঁদি না, আধপেটা খাওয়া খাই। নিতাই মুদির কাছে গিয়ে ধারের লেগে কাঁদি না, আর কোন বেটা ঈশান মোক্তারের কুঠিতে গিয়ে চিঠা নিতে হাত পাতি না।

ক্ষুদ্র কিষাণ জীবনের আঁতে ঘা দিয়ে কথা বলছে পলুস। মাথা হেঁট করে মুরলী। তাই বোধহয় দেখতে পায় না পলুস, মুরলীর চোখ দুটো যেন ফেটে গিয়ে ঝর ঝর করে জল ঝরাচ্ছে।

মুরলী বলে—আর কত গালি দিবে বল?

পলুস হালদার এইবার মুরলীর মুখটাকে দেখতে পায়; বিচলিত হয়ে এগিয়ে এসে মুরলীর হাত ধরে : আমি তোমাকে না, কাউকেই, কাউকে গালি দিচ্ছি না মুরলী। আমি গায়ের মানুষের দুখের কথা বলছি। আমিও এই দুখে বড় ভুগেছি।

হাত সরিয়ে নেয় না মুরলী। সরিয়ে নেবার ইচ্ছাটাও যেন মুরলীর পুরনো জীবনের মাটির মধ্যে এই মুহূর্তে একেবারে মিশে গিয়েছে। পলুসের জীবনের গল্পগুলি আরও শুনতে ইচ্ছা করে।

পলুস বলে-গোবিন্দপুরে মাটি কাটতে গিয়েছিলাম; তিনটা দিন কাজ পাই নাই। তিনটা দিন খাই নাই। বেঁহুশ হয়ে গাছতলায় পড়ে ছিলাম।

–কবে? পলুসের হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চোখ মুছে প্রশ্ন করে মুরলী।

–পাঁচ বছর আগে। বিয়া হলো যেদিন, ঠিক তার এক মাস পর। সকালী বলেছিল…।

-সকালী কে?

-সে, খিরিস্তানী হয় নাই যে, যাকে ভাবতে ঘিন্না লাগে। সে বলেছিল, না যেও না। কিন্তু না যেয়ে পারি নাই।

–কেন?

–সকালীকে একটা শাড়ি দিবার বড় ইচ্ছা হয়েছিল। ভেবেছিলাম, একটা মাস মাটি কেটে মজুরি জমা করে সকালীর শাড়ি কিনে নিয়ে গায়ে ফিরব। কিন্তু…।

-কি?

-সিস্টার দিদি এসে সেই গাছতলায় দাঁড়ালে, ডাকলে। ঘরে নিয়ে গিয়ে ভাত খেতে দিলে। তারপর…।

জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার যেন জীবনের এক প্রচণ্ড কৃতার্থতার আনন্দে হো-হো করে হাসতে থাকে পলুস? তারপর তো এই আমি, তুমি যাকে দেখছো, যার উপর এত রাগ করছে।

চোখ তুলে দেখতে থাকে মুরলী। হ্যাঁ, সিস্টার দিদি সত্যিই যে অদ্ভুত দয়ার জাদুকরী। মাটিকাটা হালদারকে একেবারে একটি নতুন মানুষ করে সাজিয়ে যেন মুরলীর জীবনের কাছে উপহার পাঠিয়ে দিয়েছে। পলুস হালদারের জীবনটাও পাঁচ বছর ধরে লিখা-পড়া শিখে, খিরিস্তান হয়ে আর কলঘরে চাকরি করে যেন মধুকুপির কিষাণী মুরলীকেই ডাক দিয়ে নতুন ঘরে নিয়ে যাবার জন্য তৈরি হয়েছে।

–মুরলী! ডাকতে গিয়ে পলুস হালদারের চোখের পিয়াস ব্যাকুল হয়ে ওঠে।

–কি বলছো?

–বুঝে দেখ।

–বুঝেছি।

–আমার ঘরে যাবে?

–যাব!

–খিরিস্তান হবে?

–হব।

পলুস হালদারের চোখের পিয়াস নতুন আলো নিয়ে জ্বলজ্বল করে। মুরলীর বুকের দিকে তাকায় পলুস হালদার। কাছে এগিয়ে আসে। কোন আপত্তি করে না, এক পাও পিছিয়ে যায় না মুরলী। নিথর হয়ে, পলুস হালদারের সেই ব্যাকুল পিয়াস বরণ করবার জন্য শাড়ি সায়া ও জামাতে সাজানো শরীরটাকে বিহ্বল করে দাঁড়িয়ে থাকে।

–মুরলী! পলুস ডাকে। কিন্তু পলুস হালদারের আহ্বানের ভাষাকে আর হিসেব করে বুঝতে চায় না মুরলী। হিসেব করা হয়ে গিয়েছে। যা জানবার ছিল, সব জেনেছে। কোন উত্তর দেয় না মুরলী। দু চোখ দিয়ে একেবারে স্পষ্ট করে জীবনের নতুন সুখের ছবিটাকে দেখতে পাচ্ছে মুরলী। পলুসের ঘরের ঘরণী হয়েই গিয়েছে মুরলীর প্রাণ। কয়লাখাদের কলঘর থেকে কাজ করে ঘরে ফিরেছে পলুস। তাই যেন আদর করে নাম ধরে ডাক দিয়েছে, এত কাছে এগিয়ে এসেছে, আর চাইছে সেই জিনিস, যা পেলে সুখের স্বাদে পাগল হয়ে যাবে পলুস! না, আপত্তি করবে কেন মুরলী?

মুরলীর কোমরে হাত রাখে পলুস হালদার। সেই মুহূর্তে চমকে ওঠে মুরলী। না বুকটা নয়, কোমরটা। কোমরের একটা ব্যথা।

–সর সর, সরে যাও! চেঁচিয়ে ওঠে, আতঙ্কিতের মত ঘোলাটে চোখ তুলে পলুসের মুখের দিকে তাকায় মুরলী। আর, পলুসকে শক্ত হাতের একটা ঠেলায় আলগা করে দিয়ে দু পা পিছনে সরে যায়।

জামকাঠের জীর্ণ কপাটের পিছনে ঘরের ভিতরটা অন্ধকার। দাশুর টাঙ্গিটা কোথায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, দেখা যায় না। দেখতেও পায় নি মুরলী। টাঙ্গিটা হিংস্র হয়ে লাফ দিয়ে উঠে এসে মুরলীর চোখের সামনে দাঁড়ায়ও নি। টাঙ্গির ভয়ে নয়, কোমরের এই ব্যথাটারই ভয়ে চমকে উঠেছে মুরলী, যে ব্যথাকে ভুল করে ছুয়ে দিয়েছে পলুস হালদার। ভুলতে পারে, ভুলে থাকবার সাধ্যি নেই মুরলীর, এই ব্যথা সৃষ্টি করেছে যে মানুষটা, সে এই তো মাত্র এক ঘন্টা আগে গোবিন্দপুর থানার কাছে জীবনের ভুলের জবাব দিতে চলে গিয়েছে।

পলুস বলে-কি হলো?

মুরলী-তুমি আমাকে ছুঁয়ে দিলে কোন্ সাহসে? লাজ নাই তোমার?

পলুস–কি?

মুরলী-আমার মরদ ঘরে নাই জেনে, আমাকে একলা পেয়ে…। চোর বট তুমি।

স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ মুরলীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে পলুস হালদার। পলুসের চোখ আর দপ দপ করে না। শিকারীর চোখ নয়, পিয়াসে ব্যাকুল চোখও নয়। একেবারে শান্ত ও ঠাণ্ডা এক জোড়া চোখ। যেন, মুরলীর মুখের এই গালি আর এই ভীত রুষ্ট ক্ষুব্ধ চেহারার মধ্যে শ্রদ্ধা করবার মত কিছু দেখতে পেয়েছে পলুস।

পলুস বলে–সরদার গেল কোথায়?

মুরলী—জান না?

পলুস-না।

মুরলী-গোবিন্দপুর থানার লোক এসে সরদারকে ধরে নিয়ে গেল।

পলুস-কেন?

মুরলী–কয়েদ থেকে ছাড়া পেয়ে ঘরে এসে বসেছিল, থানাতে হাজিরা দিতে যায় নাই। থানার লোক বিশ্বাস করে নাই যে মানুষটা ঘরে ছিল।

পলুস–তোমার সরদার কি দাগী?

মুরলী চেঁচিয়ে ওঠে—দাগী বটে, কিন্তু চোর নয়।

–আমি আর কখনও এই গাঁয়ে আসবো না। বন্দুকটাকে হাতে তুলে নেয় পলুস হালদার। আস্তে আস্তে হেঁটে চলে যায়।

দাওয়া থেকে নেমে, আঙ্গিনার ঘাস মাড়িয়ে তেমনই দুলতে দুলতে আর মচমচ জুতোর শব্দ বাজিয়ে সড়কের উপরে গিয়ে দাঁড়ায় পলুস হালদার। দেখতে থাকে মুরলী, পলুস হালদার ভুলেও একবার মুখ ফিরিয়ে তাকাল না। যেন এরই মধ্যে ভুলে গিয়েছে পলুস, ওর পিছনে এই এক ঘণ্টার ইতিহাসে কোন ঘটনা ঘটেছে, মুরলী নামে কোন নারী কোন ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ওরই দিকে তাকিয়ে আছে।

চলে গেল পলুস হালদার। কিন্তু মুরলীর চোখ দুটো আবার চমকে ওঠে।

সামনের সড়কের এদিকে ওদিকে আর সেদিকে, নিমের ছায়ার কাছে, কাটাশিরীষের ঝোপের কাছে আর বাঁশঝাড়ের কাছে ছোট ছোট এক-একটা ভিড়। এক-একটা বোব ভিড় যেন খুব সাবধানে উঁকি দিয়ে রয়েছে। মেয়ে-মরদ, বুড়োবুড়ি, আর ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে, সবাই। কে জানে কখন এসেছে ওরা? দাশু ঘরামির ঘরের কাছে কোন রহস্যের খেলা দেখতে পাবে বলে ওরা আশা করে এসেছে?

কী ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে আর ঘেন্না করে তাকিয়ে আছে জোড়া জোড়া চোখগুলি! ওরা যদি এখনি একসঙ্গে হাত চালিয়ে পথের পাথর তুলে মুরলীর গায়ে ছুঁড়ে মারত, তবু মুরলী বোধহয় একটুও কেঁপে উঠত না; একটা আর্তনাদও করত না। কিন্তু ধুলো নয়, ঢেলা নয়, পাথরের টুকরোও নয়, ওরা শুধু চুপ করে দাঁড়িয়ে একটা ভয়ানক বিস্ময়ের দৃষ্টি ছুড়ে মারছে; তাই কেঁপে উঠেছে মুরলীর বুকটা। গাঁয়ের ডাইনী ধরা পড়ে গেলে তার মুখের দিকে ঠিক এইরকমের হিংস্র বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে গাঁয়ের মানুষের চোখ।

মনে পড়ে মুরলীর, অনেকদিন আগে পরেশনাথ পাহাড়ের কাছে কুসুমদিদির শ্বশুরবাড়ির সেই ভেলিমুণ্ডিতে একবার পরব করতে যেতে হয়েছিল। হরতকীর জঙ্গলে দিনে বাঘ ডাকে আর ময়ূর নাচে, সেই ভেলিমুণ্ডি। কুসুমদিদির পেটে ছেলে ছিল তখন। কুসুমদিদির শাশুড়ি সেই কোমরভাঙা বুড়ি, ঝাকড়া আঁকড়া সাদা চুলে ভরা মাথাটা দুলিয়ে হাসত; আর হামা দিয়ে সারা আঙিনা ঘুরে বেড়াত।

পর পর চার দিনের মধ্যে সে-গাঁয়ের চারটে বাচ্চার কাঁচা প্রাণ পাখি-ঠোকরানো নটে ফলের মত পটপট করে ফেটে মরে গিয়েছিল। জ্বর হয়েছে, পেট ফুলেছে, তারপর ওই ফোলা পেট হঠাৎ চুপসে গিয়েছে। তিন ছেলের মা মঙ্গলীও ভেবে রেখেছিল, তার নতুন ছেলের নাম হবে পাঁচু। কিন্তু সেই মঙুলীর নতুন ছেলে জন্ম নিয়ে একটা শব্দও করে নি। কেঁপে উঠল বাচ্চার পেটটা, আর তখনি মরে গেল। চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল মঙ্গলী-কে রে, কোন ডাইনী আমার ছেইলার প্রাণ নিলে রে!

মার মার, ডাইনী মার! হাতে নিমের ডাল নিয়ে একশো মানুষের ভিড় তেড়ে এল। কুসুমদিদির শাশুড়ি সেই কোমরভাঙা বুড়িকে চুল ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল। ওরা কুলকাঠের আগুন জ্বালিয়েছিল। কিন্তু বুড়িকে পুড়িয়ে মারতে পারে নি। ভাগ্যিস সড়ক সাহেবের কুলির দল লাঠিসোটা হাতে নিয়ে তেড়ে এসে বাধা দিয়েছিল।

সবার আগে সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়ে ঝালদায় পালিয়ে এসেছিল কুসুমদিদি। কুসুমদিদির হাত ধরে মাঠের উপর দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে বেরমোবাজার যাবার মোটরগাড়ি ধরবার জন্য সড়কের উপরে এসে উঠেও মুরলীর বুকের দুরুদুরু থামে নি। বার বার মনে পড়ছিল, ডাইনী মারবার জন্য কী ভয়ানক একটা সাধের জ্বালা গাঁয়ের লোকের চোখে জ্বলছে!

মধুকুপির মানুষের চোখগুলিও চুপ করে জ্বলছে। চোখগুলি যেন নতুন রকমের এক ডাইনীকে দেখছে। শাড়ি সায়া ও জামা গায়ে দিয়ে রূপসী সেজেছে, লাগর রেখেছে, দাশু ঘরামির ঘরের মান আর জাতের মান মেরে কেমন ভালমানুষটির মত ঢং করে দাঁড়িয়ে আছে ঝালদার মহেশ রাখালের বেটি।

ভিড়ের ভিতর থেকে সবার আগে আস্তে আস্তে হেঁটে এগিয়ে আসে হলুদ ছোপানো শাড়ি গায়ে, গালার রসে রাঙানো নখ, ফুলকি মাসী। দাশুর ঘরের দাওয়ার উপর উঠে, একেবারে মুরলীর চোখের কাছে দাঁড়িয়ে ফুলকি মাসী তার দু চোখের চাহনি যেন একেবারে বিষিয়ে নিয়ে, কিন্তু বেশ একটু চাপা-চাপা স্বরে ধিক্কার দেয়।–ছিঃ, তুই তো আমার মত কপাল করিস নাই, তবে কেন, ছিঃ! যার মরদ খোঁড়া নয়, কানা নয়; সে মেয়ে ঘরের ভিতরে লোক ডাকে কেন? দাশুর কি হাত নাই, পা নাই? সে কি তোকে খাওয়াতে পরাতে পারতো না? ফুলকি মাসীর চোখ দুটো যেন কোনমতে দুঃসহ একটা ঘৃণার জ্বালা লুকিয়ে আস্তে আস্তে চলে গেল।

আর একটা ছায়া; হেঁটমাথা হয়ে মুরলী দাওয়ার মাটির যেখানে তাকিয়েছিল, ঠিক সেখানেই আর একটা ছায়া আস্তে আস্তে এসে ছড়িয়ে পড়ে। মুখ তুলেই দেখতে পায় মুরলী, কাছে এসে দাঁড়িয়েছে পল্টনী দিদি।

পল্টনী দিদির চোখ দুটো যেন রাগ করে ছটফট করছে।-ছিয়া ছিয়া, দাশু দাদার মত মানুষের বউ হয়ে তুই এ কি করলি মুরলী? তুই তো আমার মত কপাল করিস নাই, তোর মরদকে কপালবাবা কোন রোগ দেয় নাই, মারেও নাই? তোর কিসের দুখটা ছিল, বল্?

চলে গেল পল্টনী দিদি। পথের দিক থেকে আর একটা মূর্তি, উল্কিকাটা গলা আর হেঁড়া শাড়ি দিয়ে জড়ানো শরীর, তেতরি ঘাসিন এগিয়ে এসে মুরলীর কাছে দাঁড়ায়। কি লো মুরলী, তুই তো আমার মত কপাল করিস নাই, তোর মরদকে বাঘে ভালুকে মারে নাই, তবে কেন ধরম সরম ভুলে গেলি? কোন্ দুখে লো? কিসের সুখে লো? বলতে বলতে ছলছল করে ওঠে তেতরি ঘাসিনের চোখ। ছি ছি, চোখ মুছতে মুছতে চলে যায় তেতরি ঘাসিন।

পথের উপর ভিড়ের বোবা বিস্ময় এইবার মুখর হয়ে ওঠে। তিনটে গরুচরানী মেয়ে একসঙ্গে হাতের ঠেঙা দুলিয়ে, যেন বিচিত্র ঠাট্টার রসে চোখ-মুখ মজিয়ে আর হাসিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে-মুরলীর কল কলকলাইছে, লাগর লিয়ে ঢলঢলাইছে।

বুড়ো রতনের চাপা গলার স্বর যেন ফেসফাস করে-এ কিরকমটা হলো? দাশু ঘরে ফিরে এলো, তবু মাগি.মাগি জাতপঞ্চকেও ডর করে না?

জটা রাখাল–আমি বলেছিলাম কিনা, সব ধোঁকা, সব ধোঁকা। বলে কিনা গির্জাবাড়ির দিদির দয়া, বলে কিনা সিলাই কল চালিয়ে চিজ পয়দা করে আর টাকা কামায়! সব ধোঁকা। বলেছিলাম কিনা, মাগি কোন খিরিস্তানের সঙ্গে নষ্ট হয়েছে।

গাঁয়ের মানুষের এই পাঁচ বছরের বিস্ময়টা এতদিনে ভেঙে খান খান হয়ে গিয়েছে। যে নারীর মরদ পাঁচ বছর ধরে কয়েদ খাটছে, সে নারী কেমন করে আর কিসের জোরে এত সুখে থাকে? এত শাড়ি সায়া আর জামা? এত গরম? করম নাচে না; গাঁয়ের কোন কিষাণীর হাত ধরতেও যেন ওর ঘেন্না করে, মুরলীর এই পাঁচ বছরের অহংকারের রহস্য আজ ধরা পড়ে গিয়েছে। যা সন্দেহ করেছিল গাঁয়ের মানুষ, তাই সত্য হয়েছে।

আসুক ফিরে দাশু। তারপর বিচার হবে। লজ্জায় ফিসফাস করতে করতে, রাগে গজগজ করতে করতে, আর ঠাট্টায় চিড়বিড় করতে করতে পথের উপর সেই ছোট ছোট ধিক্কার আর

কুটির ভিড় আস্তে আস্তে চলে যায়।

হেঁটমাথা তুলে আবার যখন সামনের দিকে তাকায় মুরলী, তখন দেখতে পায়, রক্তমাখা মরা ধনেশটাকে কামড়ে ধরে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে একটা শেয়াল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *