একটা দেশ যেভাবে দাঁড়ায় – রউফুল আলম
ভূমিকা
প্রায় দুই বছর আগে রউফুল আলমের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় তাঁর লেখার মাধ্যমে। দৈনিক প্রথম আলো ও সোশ্যাল মিডিয়ায়। উচ্চশিক্ষা ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিষয়ক তার কয়েকটি লেখা ও অভিমত আমার নজরে পড়ে। ইউরোপ-আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থা ও গবেষণা সংস্কৃতির রীতিনীতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পশ্চাৎপদতা, সামাজিক উদাসীনতা ও সীমাবদ্ধতা এবং তরুণদের আকুতি নিয়ে প্রেরণামূলক লেখাগুলো পড়ে আমি বেশ মুগ্ধ হই। একটা দেশ যেভাবে দাঁড়ায় বইটি মূলত দৈনিক প্রথম আলো এবং অন্যান্য বিজ্ঞান কাগজে বিভিন্ন সময় প্রকাশিত তাঁর। অণুপ্রবন্ধগুলোর (Short Articles) একটি সংকলন।
এই লেখাগুলোতে বিশ্বজুড়ে চলমান জ্ঞান-গবেষণার প্রতি লেখকের গভীর পর্যবেক্ষণ ও ভালোবাসা ফুটে ওঠে। পাশাপাশি বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গবেষণা ও তারুণ্যের মেধাশক্তি কীভাবে বৈপ্লবিক ভূমিকা রাখতে পারে, সে বিষয়গুলো তিনি তুলে ধরেছেন। কীভাবে শত সীমাবদ্ধতার মাঝেও এই প্রতিযোগিতাময় পৃথিবীতে বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে, এ দেশের নতুন প্রজন্মের মেধাবী তরুণেরা যুগোপযোগী পদক্ষেপ নিতে পারবে, সে বিষয়ক দিকনির্দেশনার প্রতিফলন ঘটেছে। দেশের গবেষণা সংস্কৃতির চলমান অবস্থা, নীতিনির্ধারকদের অজ্ঞতা এবং সীমাহী অবহেলা, শিক্ষক এবং গবেষক নিয়োগে অনিয়ম প্রভৃতি কীভাবে আমাদের মেধাবী তরুণ-তরুণীদের প্রতিনিয়ত বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় (Global Competition) পিছিয়ে দিচ্ছে–বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তসহ উপস্থাপিত হয়েছে বইটিতে।
আর ভবিষ্যতের পৃথিবীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপ্তি, প্রসার এবং সুযোগ মানব সভ্যতায় এক অভূতপূর্ব সামাজিক ও অর্থনৈতিক রূপান্তরের কারণ হবে। দেশে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের। এ কলে একবিংশ শতাব্দীর কিশোর ও তরুণদের আমরা। কীভাবে উদ্বুদ্ধ করব, কীভাবে তাদের মানবসম্পদে গড়ে তুলতে মানসম্পন্ন গবেষণার দ্বার উন্মোচন করব, নতুন শিল্পবিপ্লবের উপযোগী কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের বাহু এবং দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে পারব–তারই আলোচনা করা হয়েছে বইটিতে।
যারা দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন এবং কিশোর-তরুণদের জীবনকে পরিবর্তনের জন্য কাজ করতে চান–এ বইটি তাঁদের জন্য খুবই সহায়ক ও উদ্দীপক হবে বলে আমার বিশ্বাস।
–ড. সাইফ ইসলাম
প্রফেসর এবং বিভাগীয় প্রধান
ডিপার্টমেন্ট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া–ডেভিস, যুক্তরাষ্ট্র।
.
.
একটি সাবমেরিন বনাম পাঁচ হাজার জানালা
চাইনিজ ভাষায় আমেরিকার নাম হলো ‘মেইগুয়ো’। শব্দটির অর্থ। বিউটিফুল কান্ট্রি–সুন্দর দেশ। আমেরিকার কী দেখে ওরা সুন্দর। দেশ নামে ডাকতে শুরু করেছিল, সে তথ্য অবশ্য জানা নেই। তবে একজন চাইনিজ সত্যিকার অর্থে আমেরিকাকে কী দৃষ্টিতে দেখে, সেটা জানতে হলে তার সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব থাকতে হবে আপনার।
আমেরিকার সঙ্গে চীনের একটা রাজনৈতিক সমস্যা হলো। তাইওয়ান নিয়ে। তাইওয়ান বস্তুত দাঁড়িয়ে আছে আমেরিকার প্রত্যক্ষ সমর্থনে। চীন অবশ্য সম্মুখ শত্রুতায় যায় না সহজে। ওরা। খুবই কৌশলী জাতি। আর পরিশ্রমী জাতি হিসেবে ওদের খ্যাতি সারা দুনিয়ায়। ওদের লক্ষ্য একটাই–দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
চীন সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যেটি আমেরিকার তৈরি। গুগল, ফেসবুক ইত্যাদি কিছুই ব্যবহার করে না (জাতীয়ভাবে) তাদের নিজেদের মতো করে তারা এগুলো তৈরি করেছে। অন্যের কাছ থেকে জ্ঞান ধার করা ছাড়া ওরা অন্যকিছু সহজে ধার করে না। আফিম-যুদ্ধ (Opium War) নামে চাইনিজরা। একটা যুদ্ধ করেছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। সে যুদ্ধটার সূত্রপাত– হয়েছিল কেন জানেন? ব্রিটিশ সরকার পণ্য রপ্তানি করতে চেয়েছিল চীনে। চীনের রাজা কোনো পণ্যই আমদানি করতে চাননি। প্রত্যাখ্যান করেছিল সব। এদিকে চীন থেকে চা আমদানি করে ব্রিটিশদের বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে ব্রিটিশরা চীনের দক্ষিণাঞ্চলে আফিম বিক্রি শুরু করে। একসময় চাইনিজরা আফিম-আসক্ত হয় গেলে, চীনের সরকার ব্রিটিশদের এই অনৈতিক বাণিজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। চীন সে যুদ্ধে হেরে যায়। পরিণামে হংকং দ্বীপ ব্রিটিশদের অধীনে চলে যায় শত বছরের জন্য। বিদেশি পণ্য আমদানির বিরুদ্ধে কোনো দেশের এমন শক্তিশালী মনোভাব পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই।
কিন্তু এই দেশটি সারা দুনিয়ায় তাদের মানুষ পাঠায়। পুরো দুনিয়া থেকে তারা শেখে। আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি তরুণ গবেষক পাঠায় যে দেশটি, সেটা হলো চীন। শুধু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রায় ১০ হাজার চীনা ছেলেমেয়ে প্রতিবছর আমেরিকায় আসে। তারা সব প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে। গবেষণার অভিজ্ঞতা নেয়। এটাকে আমি বলি ইন্টিলেকচুয়াল স্ক্যানিং। হাজার হাজার ছেলেমেয়ে পাঠিয়ে এখানে গবেষণার যত ডিজাইন, অ্যারেঞ্জমেন্ট, টুলস-টেকনিক আছে, সেগুলো স্ক্যান করে নিয়ে যাওয়া। চীন তার দেশের ছেলেমেয়েদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য সহস্র মেধাবী প্রকল্প (Thousand Talent Plan) চালু করেছে। ইউরোপ-আমেরিকা থেকে মেধাবী তরুণদের ফিরিয়ে নিয়ে কয়েক হাজার কোটি টাকা তাদের দেওয়া হয়। তরুণেরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে গবেষণা করতে থাকেন। এমন একটি প্রকল্প মাত্র কুড়ি বছর চালু থাকলে, কুড়ি হাজার গবেষক তৈরি হয়ে যায়। কী দূরদর্শী ও টেকসই পরিকল্পনা তাদের!
চীন থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। যে দেশটি সারা দুনিয়া থেকে শেখে, তাদের কাছ থেকে আমরা প্রচুর জ্ঞান বিজ্ঞান নিতে পারি। কিন্তু জাতীয়ভাবে সেটা কি আমরা করছি? এই চীন থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা দিয়ে সরকার জাহাজ কিনেছে। দুই যুগের পুরোনো জাহাজ। অথচ সরকার চীনকে বলতে পারত, আমরা আগামী পাঁচ বছর পাঁচ হাজার তরুণকে তোমার দেশে পাঠাব। তারা কেউ কাজ করবেন মেডিসিন নিয়ে। কেউ এরো-ইঞ্জিনিয়ারিং, কেউ পারমাণবিক গবেষণা কিংবা কেউ অ্যাস্ট্রোফিজিকস (Astrophysics) নিয়ে গবেষণা করবেন। বিনিময়ে দেড় হাজার কোটি টাকাই আমরা দেব। চীন যে টাকা। পাওয়ার, সেটাই পেত। আর আমরা পেতাম কতগুলো জানালা। সে জানালা দিয়ে নতুন নতুন দিক দেখতে পেতাম আমরা। দেড় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে শত হাজার কোটি টাকার সম্ভাবনা তৈরি করা যেত। একটা জাহাজ কখনো পাঁচ হাজার জানালা খুলে দিতে পারে না। কোনো দিন না। রাষ্ট্র যদি একটু বুঝতে চাইত!
.
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দীর্ঘশ্বাসটুকু শুনুন
প্রায় দুই বছর ধরে ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া (UPenn)। গবেষণা করেছি। ল্যাবরেটরি থেকে বের হতে হতে প্রায়ই রাত। ৯টা-১০টা বাজত। কখনো কখনো ১১টা কিংবা ১২টা। বহুবার লক্ষ করেছি, এই গভীর রাতেও অনেকে বসে বসে কাজ করছেন। তাঁদের ঘড়িগুলো যেন বন্ধ হয়ে আছে। ঘড়ির কাঁটা তাঁদের সামান্যতম তাড়া দিতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রাত দুইটা পর্যন্ত কিছু বাস (শাটল) সার্ভিস দিয়ে রেখেছে। কেউ যদি গভীর রাতে বাসায় ফিরতে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, তাহলে সে গাড়িগুলো তাকে বাসার দরজায় পৌঁছে দেয়। সার্ভিসটা যেহেতু রাত দুইটা পর্যন্ত, তার মানে কেউ না কেউ সে সময় পর্যন্তই কাজ করছে। কী সাংঘাতিক ব্যাপার!
ভাবলাম, এই যে গভীর রাত পর্যন্ত রুমে রুমে আলো জ্বলছে, সেটার কারণেই এই দেশটা পৃথিবীর পরাশক্তি। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। খেটে যাচ্ছেন প্রতিযোগিতা দিয়ে। একটা প্রতিযোগিতা যখন। সঠিকভাবে দাঁড় করানো যায়, তখন সেখান থেকে সেরাদের সেরা বেরিয়ে আসে। আর এই প্রতিযোগিতায় লেগে থাকার জন্য, সমাজ পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে রেখেছে। রাষ্ট্র দিচ্ছে তরুণদের জন্য এক প্রাণবন্ত পরিবেশ। আর তরুণেরা দেশের জন্য দিচ্ছে মেধা ও শ্রম! কী ঐকতান!
আমরা প্রায়ই আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের অলস-অনাগ্রহী বলে দায়মুক্ত হয়ে যাই। আসলে কি ওরা অলস? একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছারপোকার কামড় খেয়ে হলে রাত কাটান। পাঁচ-ছয়জন শিক্ষার্থী ঠাসাঠাসি করে একটি রুমে থাকেন। ১৫-২০ টাকায় ৫-৭ বছর অখাদ্য খেয়ে পাকস্থলী পোড়ান। বাসের ডান্ডা ধরে বাদুড়ের মতো ঝুলে ঝুলে ক্যাম্পাসে যান। ভিড়ের মধ্যে অন্যের ঘামের গন্ধ শুঁকে, ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে থেকেই ইউনিভার্সিটিতে যাতায়াত করতে হয়। পরীক্ষার আগের রাতেও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পান না। টিউশনি করে মাস চালাতে হয়। কেউ কেউ সে টাকা দিয়ে পরিবারকেও দেখেন। একটা কম্পিউটার কেনার জন্য টাকাও অনেকের থাকে না। এত সংগ্রামের পরও তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। পড়ে যাচ্ছেন। বড় বড় স্বপ্ন দেখেন। আর যখনই ইউনিভার্সিটি থেকে বের হন, তখন তাদের হাতে শুধু একটি সনদ ধরিয়ে দেওয়া হয়। না কোনো গবেষণার অভিজ্ঞতা, না কোনো প্রফেশনাল জীবনের সঠিক প্রস্তুতি! উপরন্তু জীবন থেকে কেড়ে নেওয়া হয় কিছু সময়। আমরা এর নাম দিয়েছি সেশনজট। হারানো সময়ের সে হিসাব কোথাও লেখা থাকে না। সেশনজটের মতো ঘৃণ্য একটি বিষয় পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে নেই। হাজার হাজার ছেলেমেয়ের জীবন থেকে সময় কেড়ে নেওয়া রাষ্ট্রের জন্য ভয়ংকর অভিশাপ। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন। উপাচার্য কখনো বলেন না, ডিয়ার স্টুডেন্ট, উই আর সরি ফর দ্যাট। ইউ উইল ট্রাই টু মেইক থিংকস বেটার!
অথচ এই ছেলেমেয়েগুলোর মা-বাবার ট্যাক্সের টাকা দেশে লুট হয়ে যায়। কী নির্মম! পৃথিবীর আর কয়টা দেশে এত যুদ্ধ করে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে? একবার আন্তর্জাতিক স্টুডেন্টদের এক আড্ডায় আমাদের শিক্ষাজীবনের সংগ্রামের কথা বলেছিলাম। তা শুনে দেখলাম ওদের কেউ কেউ চোখ মুছছে। দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা কত সংগ্রাম করেন, কত কষ্ট করেন, সেটা আমি গভীরভাবে জানি। কারণ একটা নিরেট গ্রাম থেকে পড়াশোনা করে আমাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন পাড়ি দিতে হয়েছে।
এরপরও কি বলবেন, এ দেশের ছেলেমেয়েরা অনাগ্রহী-অলস! তারা পড়তে চায় না। তারা গবেষণা করতে চায় না! তাদের কতটুকু দিই–সেটা কি কখনো আমরা ভাবি? তাদের সামান্য চাকরির লোভে, এক কাপ চায়ের লোভে, একটি সিটের লোভে নেতার গায়ের গামছা বানিয়ে রাখি। বড় ভাইদের দাস বানিয়ে রাখি! এমন ঘৃণ্যতম সিস্টেম কি কোথাও আছে? দুনিয়ার আর কোনো সমাজে কি মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত ছেলেমেয়েদের সঙ্গে রাষ্ট্র এমন প্রতারণা করে?
তারপরও এই ছেলেমেয়েগুলোর অটুট লক্ষ্য খুব বিস্মিত করে। রাষ্ট্রীয় অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও ওরা স্বপ্নের সঙ্গে আপস করতে। চায় না। ওদের মধ্যে নিজেকে আলোকিত করার যে দৃঢ় প্রত্যয়, সেটাকে আমাদের সম্মান করা উচিত। আরও বহু গুণে জাগিয়ে তোলা উচিত। অথচ আমরা সেটা করছি না। আমরা বুঝতে চাই না, এই তরুণপ্রাণদের সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে একটি দেশ রাতারাতি এগিয়ে যায়। সারা দুনিয়ার উন্নত সমাজগুলো তা-ই করে।
যখন দেখি, ইউজিসির একজন চেয়ারম্যান রাজনৈতিক দলের গুণগান গেয়ে লেখার সময় পান অথচ দেশের হাজার হাজার তরুণ তরুণীর ভবিষ্যৎ নিয়ে বলেন না, লেখেন না, তখন খুব কষ্ট হয়। শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে যে এত মূল্যবান সময় কেড়ে নেওয়া হয়, সেটার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে কি দুবাক্য লিখেছেন? শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে সেশনজট নামক অভিশপ্ত বিষয়টি দূর করার জন্য কঠোর ও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ কি নিয়েছেন? নোংরা, ধ্বংসাত্মক, দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি বন্ধের কি কোনো কার্যকর পদক্ষেপ কেউ নিয়েছেন?
যে দেশ তার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের ভালো রাখার চেষ্টা করে, তাদের দুঃখ কান পেতে শোনে, সে দেশ। নীরোগ থাকে। সে দেশ রক্ষার জন্য বিদেশ থেকে সহস্র কোটি টাকার অস্ত্র কিনতে হয় না। প্রতিটি তরুণ প্রতিরক্ষার একেকা বারুদ হয়ে যায়!
.
চিত্ত যেথা ভয়যুক্ত, নিচু যেথা শির
জুলাই মাসের ৪ তারিখ হলো আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস। সরকারি ছুটির দিন। এখানের দোকানপাট, শপিংমলও সেদিন বন্ধ থাকে। অথচ ল্যাবরেটরিতে গিয়ে দেখতাম অনেক ছেলেমেয়েই কাজ করছেন। দেখতাম, আমার প্রফেসরসহ আরও কয়েকজন শিক্ষকের রুমের দরজা খোলা। স্বাধীনতা দিবসেও তারা কাজ করতে চলে এসেছেন। তাদের দেশ তাদেরকে জীবন, চিন্তা ও কর্মের প্রকৃত স্বাধীনতা দিয়েছে। এসব দৃশ্য অবশ্য বিদেশে নতুন কিছু নয়। ইউরোপ-আমেরিকায় বড়দিনের ছুটি হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সে সময় পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সচরাচর থাকে না। অথচ ছেলেমেয়েরা ল্যাবরেটরিতে কাজ করতে চলে আসতেন। জাতীয় নির্বাচনের দিন তারা কাজ করেন। কাজের জন্য তাদের দরজাগুলো কখনো বন্ধ থাকে না। এসব দেশে সব দিবসই কর্মদিবস–যদি কেউ কাজ করতে চান।
একটা দেশের শিক্ষক, গবেষক, তরুণেরা যদি এক মিনিট সময়ও ভালো কাজে মাথা খাটান, সে সময়টা দেশের সম্পদে পরিণত হয়। সেটা রাষ্ট্রের কোষাগারে জমা হয়। বিষয়টা বোঝার মতো জ্ঞান পৃথিবীর সব সমাজের মানুষের হয়নি। যাদের হয়েছে, তারাই আজ দুনিয়ায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তারাই আজ জগৎটাকে উল্টেপাল্টে দেখছেন। পশ্চিমের শিক্ষক-গবেষকরা কি দেশকে ভালোবাসেন না? দেশকে তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসেন! তবে তারা দেশপ্রেম দেখানোর জন্য ওয়াশিংটনের ছবি গলায় ঝুলিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ান না। তারা বরং কালে। নেশায় ওয়াশিংটনকেই ভুলে গেছেন। স্বাধীনতা দিবস ভুলে গেছেন। দেশকে তারা ভালোবাসেন বলেই ক্লান্তিহীন কাজ যাচ্ছেন। আর সে কারণেই ওয়াশিংটনের রেখে যাওয়া দেশ আজ দুনিয়ায় সবচেয়ে শক্তিশালী।
জর্জ ওয়াশিংটনের জন্মদিনকে আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট ডে হিসেবে উদ্যাপন করা হয়। আমার প্রফেসর, প্রেসিডেন্ট ডেতে কাজ করতে চলে এসেছিলেন। তাকে দেখে বিস্মিত হয়ে বললাম, তুমি আজও কাজ করতে চলে এলে? ওয়াশিংটন ডেতে বিশ্রাম। করতে পারতে। প্রফেসর উত্তর দিয়েছিলেন, Washington did his job. I must do my job. His life and work wont make me great!–ওয়াশিংটন তার কাজ করে গেছেন। আমাকে আমার কাজ করতে হবে। সে নিশ্চয় আমাকে মহান করবে না।–এই হলো ওদের দৃষ্টিভঙ্গি।
খবরে দেখলাম, পনেরোই আগস্ট দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ক্লাস নিচ্ছেলেন। সে সময় কিছু মূর্খ, নরাধম গিয়ে সে শিক্ষককে হেনস্তা করে, অপদস্থ করে। শিক্ষকটির অপরাধ–তিনি জাতীয় শোক দিবসে পড়াচ্ছেন! এই খবরটা পড়ে আমি বিমর্ষ হয়ে যাই। ঘৃণায়-ক্ষোভে মনে হয়েছিল, কোন দেশে জন্মেছিলাম! ছুটির দিনেও যে একজন শিক্ষক ক্লাস নিচ্ছেন, সেটার জন্য তাকে সাধুবাদ দেওয়া দরকার ছিল। তার। গলায় মাল্য দিয়ে বলা দরকার ছিল, স্যার, দেশটা আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আপনারা নুয়ে পড়লে দেশটা নুয়ে যায়। মেরুদণ্ড সোজা রাখুন। আমরা আপনাদের পাশে প্রহরা হন থাকব। অথচ এই কীটগুলো একজন শিক্ষককে অপদস্থ করে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি মহান শ্রদ্ধা দেখিয়েছে? শোক দিবসে কি না মহৎকর্ম সাধন করেছে?
শোক দিবসে কি জ্ঞানচর্চা নিষিদ্ধ? শোক প্রিন্স HOW বিষ। শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষক পড়াশোনা করতে পারবেন না? এমন কি নিয়ম আছে কোথাও? তা ছাড়া একজন শিক্ষককে ক্লাসে গিয়ে বাধা দেওয়ার মতো এমন স্পর্ধা ওরা পায় কোথায়? সমাজটা কি এসব গজমূর্খ অসভ্যদের কথায় চলবে?
পৃথিবীর এক প্রান্তের মানুষ যখন জ্ঞানসাধনায় ক্লান্তি ভুলে গেছে, অন্য এক প্রান্তের মানুষ সে সাধনায় বাধা দিয়ে বীরত্ব। দেখাচ্ছে। আমাদের শিক্ষাঙ্গনে চিত্ত ভয়শূন্য থাকে না। শির উঁচু। করে রাখা যায় না। কীটদের গ্রাসে যেন অন্ধকার নেমে আসছে সেখানে!
.
একটা দেশ যেভাবে দাঁড়ায়
ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ায় (UPenn) আমার। ল্যাবরেটরি সপ্তাহের সাত দিনই খোলা থাকত। পিএইচডি, পোস্টডক গবেষকদের কাছে চাবি থাকে। যার যখন ইচ্ছা তখনই গিয়ে কাজ শুরু করে দেন। দুনিয়ায় একেকজন মানুষ একেক সময় প্রডাক্টিভ। কেউ ভোরবেলায় পড়ে। কেউ পড়ে ভরদুপুরে। কেউ আবার মাঝরাত ছাড়া পড়তে পারে না। গবেষণার বিষয়টাও এমন। তাই দিন-রাত সবসময় সেখানে প্রবেশাধিকার থাকতে হয়। আমার ল্যাবে কয়েকজন কাজপাগল তরুণ ছিলেন। তারা কখন ঘুমাতেন আমি জানি না। ক্লান্তি ওঁদের স্পর্শ করে না। একটা ছেলে রীতিমতো ল্যাবরেটরিকে ঘর বানিয়েছেন। কাজ ছাড়া, তার কোনো কাজ নেই। তিনি ছিলেন পোস্টডক গবেষক। আমেরিকান ছেলে। বয়স ২৮। যথারীতি তার ৩৫-এর ওপর বৈজ্ঞানিক আর্টিকেল (Scientific Article) আছে।
একজন পিএইচডি স্টুডেন্ট আছেন, যিনি লাঞ্চের পর ল্যাবে আসেন। এই ছেলেটা কাজ করবেন রাত দুইটা-তিনটা পর্যন্ত। কখনো কখনো সে ল্যাবের করিডোরে ঘুমান। সকালে গিয়ে আমরা তাকে ডেকে দিই। আমার প্রফেসর তাঁকে অসম্ভব পছন্দ করেন। কারণ ছেলেটা তুখোড় ছাত্র। তাঁর জীবনের প্রথম পাবলিকেশন করেছেন তিনি সায়েন্স (Science) জার্নালে। এসব মেধাবী ও কর্মপাগল মানুষদের সান্নিধ্যে থাকা অত্যন্ত জরুরি। এদের সান্নিধ্যে থাকলে আপনার ভেতর ঘুমিয়ে থাকা স্বপ্নগুলো জেগে যাবে। স্বপ্নরা তাড়া দেবে। এমন মানুষদের সঙ্গে থেকে নিজের ভেতরের সম্ভাবনাকে বের করা যায়।
যা-ই হোক, আমেরিকার অন্য ল্যাবগুলোও এমনই। দিন-রাত খোলা থাকে। ইউরোপেও তা-ই। যদিও সেখানে কাজের সংস্কৃতি কিছুটা ভিন্ন। স্টকহোমে থাকাকালীন যখন-তখন ল্যাবে গিয়ে কাজ করতে পারতাম। ক্যাম্পাস ছিল অভয়ারণ্য। চীন-জাপানেও দিন-রাত কাজ হচ্ছে। এই দেশগুলো কাজের পরিবেশ তৈরি করে
তরুণদের ব্যস্ত রাখে। সেসব তরুণদের মধ্য থেকে কর্মপাগল। (Workaholic) মানুষ তৈরি করা হয়। আর সেসব মানুষ সমাজকে বদলে দেয়। সমাজের তরুণেরা যখন উদ্ভাবন-সৃষ্টির নেশায় দিন-রাত কাজ করেন, সেটা আশীর্বাদ হয়ে আসে। যে। সমাজের তরুণেরা যত কম বয়সে সৃষ্টির নেশায় বুঁদ হয়ে থাকেন, সে সমাজ ততই শক্তিশালী হয়।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সন্ধ্যার পর ভুতুড়ে হয়ে থাকে। চামচিকারা কিচকিচ করে। আমারা ভূতের ভয়ে ছাত্র-শিক্ষক মিলে বাড়িতে গিয়ে বসে থাকি। ভূতের আছর থেকে বেঁচে গিয়ে আমরা দেশ নিয়ে বড় বড় স্বপ্ন দেখি। কিন্তু আমরা কি কখনো গভীরভাবে ভাবি যে একটা দেশকে দাঁড় করাতে হলে কী দরকার! যেদিন বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়াবে সেদিন কি ইউরোপ-আমেরিকা কিংবা চীন-জাপান বসে থাকবে? যেদিন আমরা মহাকাশে যান পাঠাব, সেদিন এসব দেশ মহাকাশ দখল। করে বসে থাকবে। যেদিন আমরা একটা ড্রাগ বানাব, সেদিন এরা ডিএনএর গঠন পরিবর্তন করে জন্মনিয়ন্ত্রণ করবে, যেন মানুষ নীরোগ হয় (কথাটা গল্পের মতো শোনালেও, বাস্তবেই গবেষকেরা এগুলো নিয়ে কাজ করছেন)।
আমাদের বিদ্যালয়গুলো বছরের এক-তৃতীয়াংশ সময় বন্ধ থাকে। প্রচুর সরকারি ছুটি থাকে। সঙ্গে হরতাল, মারামারি ধরাধরি, ধর্মঘট, অবরোধ, আন্দোলন, ভিসি হটানোর জন্য ক্লাস। বণ। তার সঙ্গে নগরডুবি, যানজট। বেশির ভাগ ইউনিভার্সিটিতে নেই আধুনিক ল্যাব। আছেন গবেষণার অভিজ্ঞাতাহীন শিক্ষক! আছে শিক্ষকের অপ্রতুলতা। তাহলে মেধবী ও কর্মপাগল মানুষ তৈরি হবে কী করে? তদুপরি আছে শিক্ষার্থীদের আর্থিক টানাপোড়েন। দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেমেয়েগুলো টিউশনি করে জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট সময় নষ্ট করেন। টাকার জন্য এই কাজটা তারা নিরুপায় হয়ে করেন। দুই টাকার জন্য জীবনের দশ টাকার সময় নষ্ট করতে হয়। তাদের। এই সময়টুকু কি রাষ্ট্র কাজে লাগাতে পারত না?
একবার ভাবুন, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কতগুলো। ল্যাবরেটরি তৈরি করা হয়েছে। মেধাবী ও যোগ্য গবেষকদের সেখানে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ল্যাবগুলো দিন-রাত খোলা। সেগুলোতে কাজ করছেন কুড়ি থেকে ত্রিশ বছরের তরুণ ছেলেমেয়েরা। সরকার তাদেরকে গবেষণাকর্মের বিনিময়ে আর্থিক সাপোর্ট দিচ্ছে। টিউশনি করে তাদের আর সময় নষ্ট করতে হচ্ছে না। ল্যাবগুলোর সঙ্গে আছে ক্যাফেটেরিয়া। মানসম্পন্ন খাবার আছে সেখানে। ওঁরা সেখানে খাবেন। কাজ করে ক্লান্ত হয়ে আড্ডা দেবেন। পার্টি করবেন। ঘুম পেলে। সেখানেই ঘুমিয়ে নেবেন। তারপর আবার হাসতে হাসতে, গাইতে গাইতে কাজ করতে থাকবেন–আমাদের দেশের জন্য এগুলো স্বপ্নের মতো শোনালেও এমন পরিবেশেই সারা দুনিয়ার ছেলেমেয়েরা কাজ করছেন। দেশ তাঁর তরুণদের জন্য গবেষণার পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছে। তরুণেরা দেশের জন্য দিচ্ছেন সর্বোচ্চ মেধা ও শ্রম। আমরা যদি এমন পরিবেশ তৈরি করে দিই তাহলে দেশকে নিয়ে আর ভাবতে হবে না। দেশ দাঁড়াবে তার আপন গতিতে, স্বমহিমায়।
.
কোটা নাকি মেধা? জন্ম নাকি কর্ম?
অপরিকল্পিত কোটাব্যবস্থা হলো একটি দরিদ্র রাষ্ট্রকে পঙ্গু করার সর্বোত্তম উপায়। চাকরিতে দীর্ঘমেয়াদি কোটাব্যবস্থা বৈষম্য হ্রাস না করে বৃদ্ধি করে। এই ব্যবস্থা গরিব দেশের অগ্রগতির অন্তরায়। অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য শিক্ষিত ও দক্ষ করার ব্যবস্থা করতে হয়। পশ্চাৎপদ মানুষকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন হয়। বিনামূল্যে আধুনিক শিক্ষার ব্যবস্থা। আর তাদের জন্য কোটাব্যবস্থা থাকলে সেটারও নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকবে। শত বছর ধরে কোটাব্যবস্থা চলতে পারে না। চাকরিতে কোটা থাকবে প্রতিবন্ধীদের জন্য। কারণ তারা প্রাকৃতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। কোটা থাকা দরকার হিজড়াদের জন্য। কারণ এই লিঙ্গের মানুষগুলো সমাজে নিগৃহীত। সমাজে তারা খুবই অবহেলিত।
আমার পাশের টেবিলের অযোগ্য সহকর্মী যদি বাবার সাহসিকতার সনদ দিয়ে চাকরি পান, তাহলে আমার কাজের স্পৃহা হ্রাস পাবে। এটা হলো খুবই সাধারণ একটি বিষয়। উন্নত দেশে প্রতিযোগিতা টিকিয়ে রাখা হয় কেন? কারণ এতে নেট প্রডাক্টিভিটি বাড়ে। টিকে থাকার জন্য সবাই সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করেন। সমাজের অগ্রগতি হয় দ্রুত। তাছাড়া যে বিষয়ের ওপর আমার হাত নেই, সেটার কারণে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হব কেন! আমার বাবা যদি যুদ্ধ করে। থাকেন, সেটা তিনি করেছেন। তিনি সম্মানিত হবেন। আমি যে তার। সন্তান, এটা তো আমি নির্ধারণ করিনি। তাঁর বীরত্বের সঙ্গে আমার জন্মের কোনো যোগসূত্র নেই। আমি যে কুমিল্লা জেলায় জন্মেছিলাম এতে আমার হাত নেই। আমি যে কোনো সরকারি চাকরিজীবীরা সন্তান (পোষ্য) নই, সেটাতে আমার হাত নেই। আমি যে কোন ৫ মইনরিটি গ্রুপে জন্ম নিইনি, সেখানে আমার হাত নেই। আমি যে = (২ানো মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নই, সেখানেও আমার হাত ৯ ২ মানুষকে যেখানে শুধু জন্মের কারণে বঞ্চিত হতে হয়, সেখানে 5 বেতির অভিশাপ নেমে আসে। জন্মকে যখন কর্ম থেকে বড় করে। C. দেখা হয়, সেখানে কর্মবিশ্বাসীর সংখ্যা কমতে থাকে। কর্মস্পৃহ মানুষের সংখ্যাও হ্রাস পায়।
রাষ্ট্র একজন বীরের সন্তানদের খাবারের টাকা দেবে। পড়াশোনার জন্য খরচ দেবে। যোগ্য করার চেষ্টা করবে। বীরের সন্তান বলেই চাকরি দিয়ে ত্রিশ বছরের জন্য বসাতে পারে না। এটা খুবই আনপ্রডাক্টিভ! একটা সমাজ যখন এ ধরনের কাজ বছরের পর বছর করে, তখন বৈষম্য বাড়ে। মূল্যবোধ কমে। মিথ্যাশ্রয়ী ও সুযোগসন্ধানী মানুষের সংখ্যা বাড়ে। দীর্ঘদিন ধরে মুক্তিযুদ্ধ কোটা বহাল রাখায় বহু মানুষ নকল সার্টিফিকেট বানিয়েছে। সে মিথ্যা সার্টিফিকেট দিয়ে সুবিধা নিচ্ছে। সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে দেশে প্রায় পঁচিশ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ আছে।
পশ্চাৎপদ এবং বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে তুলে আনার জন্য কোটার প্রয়োজন আছে। কিন্তু কোটাব্যবস্থার জন্য থাকতে হয় সুস্পষ্ট নীতি। সব চাকরিতে কোটা রাখা যায় না। কারণ সমাজে সবার কাজের ভূমিকা থাকলেও, সবার কাজের ইমপ্যাক্ট সমান নয়। যেমন ইউনিভার্সিটির শিক্ষক, প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা, আইনজীবী, হাসপাতালের ডাক্তার, গবেষক, বিজ্ঞানী ইত্যাদি পেশাগুলো হলো সমাজের ভিত। এই ধরনের পেশায় সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে নিয়োগ দিতে হয়। তা ছাড়া, কোটাব্যবস্থা একটা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য চালু করা হয়। ধীরে ধীরে সেটাকে গুটিয়ে আনতে হয়। অথচ বাংলাদেশে প্রতিটি সরকার এই কোটাব্যবস্থাকে রাজনীতির সুবিধার্থে ব্যবহার করেছে। এক সরকারের চেয়ে অন্য সরকার আরও বেশি কোটাব্যবস্থা চালু করছে। এতে তাদের ভোট = তৈরি হয়। দুর্বল ব্যবস্থাপনার প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। রাজনীতিতে। ফলে কোনো সরকার আর কঠোর অবস্থানে তা পারে না। ভোট-ব্যাংক টিকিয়ে রাখার জন্য বরং আরও দুর্বল ব্যবস্থাপনা তৈরি করতে হয়। কী দুঃখজনক!
উন্নত দেশে কোটা আছে এবং সেটা প্রধানত মানুষকে শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য। তবে সেসব দেশে নকল সার্টিফিকেট তৈরির উপায় নেই। কিংবা কোটা দিয়ে একজন অযোগ্য ব্যক্তিকে চাকরি দেওয়া হয় না। শুধু ভোটের রাজনীতির জন্য যুগের পর যুগ। অপরিকল্পিতভাবে কোটাব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা হয় না। প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেটা চলে না। সব পেশার জন্য কোটা প্রয়োগ করা হয় না। দুনিয়ার বহু উন্নত সমাজে এখন চাকরিতে কোটাব্যবস্থাই প্রয়োগ। করা হয় না। ইউরোপ-আমেরিকায় বহু জাতের কিংবা ধর্মের লোকজন বাস করে। সেভাবে হিসাব করলে বহু শ্রেণির সংখ্যালঘ। সেসব দেশে আছে। তাই বলে কি ওরা কোটাব্যবস্থা পাচ্ছে?
বাংলাদেশের বেশির ভাগ মেধাবী ছেলেমেয়ের কোনো কোটা নেই। তাদের কোনো রাজনৈতিক যোগসূত্র নেই। ঘুষ দেওয়ার অর্থ নেই। ফোন করে সুপারিশ করার ক্ষমতাধর মামা নেই। সেসব ছেলেমেয়ে যখন সঠিক জায়গা থেকে বঞ্চিত হয়, রাষ্ট্রে তখন অভিশাপ নেমে আসে। এটাকে বলে ডিভাইন পানিশম্যান্ট–প্রাকৃতিক শাস্তি। যোগ্য ব্যক্তিরা যখন বঞ্চিত হন, তখন তাদের ভেতর কর্মস্পৃহা ও দেশপ্রেম হ্রাস পায়। সমাজের নেট প্রোডাক্টিভিটি কমে যায়। সমাজ পিছিয়ে পড়ে বহুগুণ। আমাদের রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রকেরা কি কখনো এটা উপলব্ধি করবেন!
সরকার সম্প্রতি কোটা বিলুপ্তির ঘোষণা দিয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা না রাখার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। এটা খুবই যুগোপযোগী উদ্যোগ। এখন সেটা সঠিকভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে, প্রতিটি ক্ষেত্রে মেধাবীদের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতাকে প্রাধান্য দেওয়ার সময় এসেছে। তবেই বাংলাদেশ দাঁড়াবে দ্রুত ও শক্ত ভিতে।
.
কর্মে হোক জন্ম জয়
আলবার্ট আইনস্টাইন তার পড়ার টেবিলের সামনে তিনজন। মানুষের ছবি ঝুলিয়ে রাখতেন। তাদের একজন আইজাক। নিউটন, দ্বিতীয়জন ম্যাক্সওয়েল এবং শেষজন হলেন মাইকেল ফ্যারাডে। ফ্যারাডে হলেন বিজ্ঞানের ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্ময়কর চরিত্র! প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা না করে দুনিয়ায় কবি সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, গায়ক, খেলোয়াড় হওয়া যায়। কিন্তু বিজ্ঞানী হওয়া যায়, সে উদাহরণ খুব বেশি নেই। ফ্যারাডে হলেন ইতিহাসের সেই বিরল উদাহরণ।
ফ্যারাডে তাঁর কৈশোরে কাজ করতেন বই বাঁধাইয়ের। দোকানে। তাঁর পরিবার ছিল গরিব। বেশ গরিব। তার বাবা তাঁকে বইয়ের দোকানে কাজ শিখতে দিয়েছিলেন। পুত্রকে পড়ানোর টাকা ছিল না। ফ্যারাডে যখন ২০ বছর বয়সের তরুণ, তখন একদিন এক লেকচার শুনতে গেলেন। সে লেকচারের বক্তার নাম হামফ্রে ডেভি–ইতিহাসের এক সেরা বিজ্ঞানী। ফ্যারাডের জীবন ঘুরে যায় সেদিন থেকে, সেই লেকচার শোনার পর। তিনি ডেভির কাজকে গভীরভাবে জেনে, একসময় নিজেই অসাধারণ বিজ্ঞানী হয়ে উঠলেন। তড়িৎ ও চৌম্বকত্ব। (Electricity and Magnetism) নিয়ে গবেষণা করে, ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।
দারিদ্র্যকে জয় করা মানুষের এমন উদাহরণ নেহায়েত কম নয়। নজরুল তার দারিদ্র্যকে জয় করেছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন এতই দরিদ্র ছিলেন যে তাদের একটি টয়লেট ছিল না। দক্ষিণ ভারতের এক অখ্যাত গরিব ঘরের সন্তান। ছিলেন রামানুজন। ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে সারা দুনিয়ায় খ্যাত হয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় শ্রীনিবাস রামানুজন যখন ইংল্যান্ডে পৌঁছালেন, তখন তার আশেপাশে দুনিয়ার খ্যাতনামা গণিতবিদগণ। তারা এসেছিলেন রামানুজনের লেকচার শুনতে। অথচ রামানুজনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিই ছিল না। গণিতে তাঁর অসামান্য মেধার জন্য তাকে নির্বাচিত করা হয়েছিল রয়েল সোসাইটির ফেলো।
ভারতের আম্বেদকার জন্মেছিলেন দলিত সমাজে। দলিত গোষ্ঠীর মানুষদের এখনো ভারতে নিচু ও অচ্ছুত হিসেবে অবহেলা করা হয়। মেথর-মুচি ইত্যাকার কাজ করেন বলে তারা সমাজে চরম অবহেলিত। অথচ সেই আম্বেদকার, আমেরিকার কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করে গিয়ে স্বাধীন ভারতের আইনমন্ত্রী হয়েছিলেন। তা ছাড়া তিনি ছিলেন ভারতের সংবিধানপ্রণেতাদের একজন। আমার প্রিয় এক গণিতবিদের নাম কার্ল ফ্রেডরিক গাউস। তিনি জন্মেছিলেন জার্মানিতে, খুবই গরিব পরিবারে। মা-বাবা কেউই পড়াশোনা করেননি। তাঁর জন্মতারিখটাও মনে রাখতে পারেননি। কিন্তু সেই ছেলেই উনিশ শতকে গণিতের দেবতা হয়ে উঠেছিলেন।
জন্ম হলো পৃথিবীতে আসার নিছক সূত্র। এর ওপর কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। মানুষের যেটার ওপর নিয়ন্ত্রণ আছে, সেটা হলো কর্ম। মানুষ দরিদ্র পরিবারে জন্মালেই সম্ভাবনাহীন হয় না। দারিদ্র মানুষের বড় হওয়ার পথে অন্তরায়, তবে একমাত্র বাধা নয়। আর জন্ম যেহেতু মানুষকে বড় করে না, সেটা নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করেও লাভ নেই। বাগানের ফুলকে যেমন মানুষ হাতে নেয়, পথের ধারে ফোঁটা ফুলকেও মানুষ হাতে নেয়, খোঁপায় গোঁজে। প্রস্ফুটিত ফুলে কি আর জন্মকথা লেখা থাকে?
দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে বলে অনেকেই দুঃখ ক, দারিদ্র্য নিয়ে হা-পিত্যেশ করে। দারিদ্র্যকে জয় করতে ভয় পায়। আমার কাছে যারা এই দুঃখ করে, তাদেরকে আমি পাথর থেকে ভাস্কর্য হয়ে যাওয়ার কথা বলি। পথের ধারে পড়ে থাকা পাথর কেউ লক্ষ করে না। অথচ সে পাথর দিয়েই যখন, ২য় মানুষ সেটি শিল্পের চোখে দেখে। দূর-দূরান্ত থেকে সে ভাস্ক দেখতে যায়। একটা মানুষের কর্ম ঠিক তেমনই। কম মানষের মধ্যে শিল্পের রূপ দেয়। মানুষকে পরিপূর্ণ করে তোলে। তাই পাথর হয়ে না থেকে কর্মগুণে ভাস্কর্য হয়ে যাও।
বাংলাদেশের অসংখ্য ছেলেমেয়ের মা-বাবা কোনো দিন স্কুলে যাননি। ছেলেমেয়েদের ঠিকমতো খাবার দিতে পারেননি। জামা কাপড় দিতে পারেননি। অথচ সেই ছেলেমেয়েরা আজ পৃথিবী জয়ের পথে নেমেছেন। আমি দিগ্বিদিক এমন মানুষের জয় দেখছি। আমি দেখছি তারা কী করে জন্মকে জয় করছেন। তারা কী করে ফুলের মতো প্রস্ফুটিত হওয়ার চেষ্টায় মগ্ন হয়ে আছে। ফুটতে জানলে কলির গল্পটা হয়ে যায় উপাখ্যান। তাই ফুটতে চেষ্টা করো। মানুষ হাতে নেবেই। জন্ম নিয়ে বৃথা দুঃখ কোরো। না। প্রতিটি মানুষ মহাবিশ্বের নক্ষত্রের মতো। কর্মগুণে যে আলোকিত, তাকেই মানুষ দেখতে পায়। ভালোবেসে দেয় নাম।
.
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিষ্পাপ প্রাণগুলো
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের পাঠ ও পাঠদানের মান নিয়ে খুবই হতাশা প্রকাশ করেন। শিক্ষকদের অবহেলা নিয়ে দুঃখ করেন। তারা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে আসতে চান। তাদেরও ইচ্ছা হয় বাইরে পড়াশোনা করবে, গবেষণা করবে। কিন্তু সেটার বুনিয়াদ তাঁরা পান না। সামান্যতম দিকনির্দেশনা সেখানে নেই। তদুপরি, সেশনজটের দুঃসহ বোঝায় তারা প্রাণশক্তিটুকু হারিয়ে ফেলেন। বছরে পর বছর ছেলেমেয়েগুলোর এই যে হতাশা, সেটা কত যন্ত্রণাময়, আমরা কি উপলব্ধি করি কখনো?
দেশের সবচেয়ে হতভাগ্য শিক্ষার্থী হলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা। রাষ্ট্র তাদেরকে বহুভাবে অবহেলায় রেখেছে। সমাজও তাঁদের হীনম্মন্যতায় ভুগতে বাধ্য করে। সমাজ ধরেই নেয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সেরা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রের সব কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তার পরের অবস্থান নেবেন। বাস্তবে এমন হওয়ার কথা ছিল না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতোই তারা সব সুযোগ-সুবিধার ন্যায্য দাবি রাখেন।
ভেবে দেখলাম, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যদি আরও উন্নত শিক্ষা দেওয়া যেত, তাহলে সমাজটা আধুনিক হতো আরও তাড়াতাড়ি। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নির্দিষ্ট জেলা শহরে। শিক্ষার্থীরা সেসব শহরে থেকেই পড়াশোনা করেন। গ্রাম থেকে বহু ছেলেমেয়ে সেসব প্রতিষ্ঠানে পড়তে গেলেও, গ্রামের সঙ্গে তাদের নিত্য যোগাযোগ ক্রমে কমে আসে। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলায় তা নয়। এর অধীন কলেজগুলো গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আর ছেলেমেয়ে প্রতিদিন বাড়ি থেকে কলেজে-আসা যাওয়া করেন। এই ছেলেমেয়েদের যদি পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে উন্নত এ আধুনিক শিক্ষা দেওয়া যেত, তাহলে এর একটা প্রত্যক্ষ প্রভাব। গ্রামগুলোতে পড়ত। গ্রামগুলোতে শিক্ষা ও সংস্কৃতির সুন্দর আভা ছড়িয়ে পড়ত। সমাজ আরও তাড়াতাড়ি আলোকিত হতো।
দেশের প্রচুর সম্ভাবনাময়ী ছেলেমেয়ে শুধু পারিবারিক আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অনেকেরই মেধার তারতম্য খুবই কম। একটু সুবিধা পেলে তারা অনেক ভালো করতেন। কিন্তু তাঁদের এই সম্ভাবনা ধ্বংস করা হয় রাজনীতি দিয়ে। ধ্বংস করা হয় তাদের অবমূল্যায়ন করে। ধ্বংস করা হয় সেশনজট দিয়ে, সঠিক দিকনির্দেশনা এবং আধুনিক শিক্ষা না দিয়ে। এই নিষ্পাপ ছেলেমেয়েদের একটি প্রতিষ্ঠানে ডেকে নিয়ে এই যে। অবহেলায় রাখা, এটা অন্যায়। এটা পাপ। একটি দেশ যখন তার সম্ভাবনাকে খুঁড়তে জানে না, বরং সম্ভাবনাকে পায়ে ঠেলে অবহেলায়, তখন সে দেশ বহুদিক দিয়ে ব্যাধিগ্রস্ত হয়।
স্টকহোম ইউনিভার্সিটির প্রো-ভিসি প্রফেসর হান্স এডলফসন। ছিলেন আমার শিক্ষক। অর্গানিক কেমেস্ট্রির প্রফেসর। তার সঙ্গে কথা হলেই শিক্ষার বিষয় ওঠে আসত। একবার জিজ্ঞেস করলাম, সুইডেন এত ছোট্ট একটি দেশ অথচ এতও” বিশ্ববিদ্যালয় তোমরা করে রেখেছ!–এত সুষম শিক্ষাব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য কী? স্বল্প উত্তরে সে বলেছিল, একটি সম্ভাবনাও যেন ঝরে না যায়, সেটাই তাদের মূল লক্ষ্য।
আমরা সম্ভাবনাকে গলা টিপে মারি। মারার আগে ক্রমাগত বলি, তোকে দিয়ে কিছু হবে না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য ও পাঠদানব্যবস্থা যদি যুগোপযোগী করা যায়, যদি সেখানে গবেষণা কার্যক্রম শুরু করা যায়, তাহলে ভেবে দেখুন কতগুলো শিক্ষার্থী রাষ্ট্রের সম্পদ হয়ে যাবে। মানুষের সম্ভাবনাকে বের করে আনতে হয়। এর জন্য লাগে নিবিড় পরিচর্যা। আমরা ভুলে যাই, উত্তম বীজতলায় খারাপ বীজও গাছ দেয়। উষর বীজতলায়, ভালো বীজও নষ্ট হয়। স্বপ্ন দেখি, একদিন এই নিষ্পাপ প্রাণগুলো প্রত্যেকে একেকটি প্রদীপ হয়ে জ্বলবে আপন ভুবনে। আর সে জন্য ওদের পরিচর্যা করতে হবে। ওদের সুযোগ দিতে হবে। বাঁচিয়ে রাখতে হবে ওদের স্বপ্নগুলো।
.
দেশটা যেভাবে হেরে যায়
বর্তমান দুনিয়ায় সম্ভবত বাংলাদেশেই সবচেয়ে সহজে ইউনিভার্সিটির শিক্ষক হওয়া যায়। শিক্ষাগত যোগ্যতা সেখানে সবসময় মুখ্য নয়। রাজনৈতিক দয়া-দাক্ষিণ্য নিয়ে অনায়াসে শিক্ষক হওয়া যায়। স্নাতক পাস করে শিক্ষক হওয়া যায়। গবেষণার কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই হর-হামেশা সেখানে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। দুনিয়ার কোনো সভ্য-শিক্ষিত দেশে এখন পিএইচডি ও পোস্টডক) ছাড়া ইউনিভার্সিটির শিক্ষক হওয়া যায় না। অন্তত বিজ্ঞান অনুষদে তো নয়ই। হয়তো আফ্রিকার কোনো ক্ষুধাপীড়িত দেশে সম্ভব। মিয়ানমার কিংবা মঙ্গোলিয়ায় সম্ভব। আমাদের পাশের দেশ ভারতে সম্ভব নয়। শ্রীলঙ্কা কিংবা পাকিস্তানেও সম্ভব নয়। অথচ আমাদের দেশে সেটা সম্ভব।
গবেষণার অভিজ্ঞতা ছাড়া ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক নিয়োগ। দেওয়া হলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তরুণ সৃষ্টিশীল প্রাণগুলো। একজন শিক্ষক পিএইচডি করার জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা। করছে। তাহলে কুড়ি-বাইশ বছরের মেধাবী ও উদ্যমী শিক্ষার্থীরা। কোথায় গিয়ে গবেষণা শিখবেন? কার কাছে গিয়ে বলবেন, আমাকে গবেষণা শেখান। রিসার্চ প্রপোজাল (Research Proposal) লেখা শেখান। আর্টিকেল লেখা শেখান। এগুলো তো। শিখতে হয় সে বয়সেই। ভারতের ছেলেমেয়েরা ২৫-২৬ বছর বয়সে আইআইটিগুলো থেকে পিএইচডি করে বের হচ্ছেন। আর। আমাদের ছেলেমেয়েরা? তাহলে আমরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকব কী করে!
ইউরোপ-আমেরিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হওয়া যত কঠিন, সেটা বিবেচনা করলে ওদের বেতন অনেক কম। সেখানে কেউ শিক্ষক হওয়ার আগে তাকে অবশ্যই পিএইচডি থাকতে হবে। পাশাপাশি এক বা একাধিকবার পোস্টডক গবেষণার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের পর নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তার শিক্ষকতা ও গবেষণার মানের ওপর নির্ভর করে পদ স্থায়ী হয়। কারও কারও ক্ষেত্রে সেটা পাঁচ-সাত বছর কিংবা আরও বেশি সময় লাগে। অর্থাৎ অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে কাজ শুরু করেও চাকরি স্থায়ী নয়। যেকোনো সময়ে তিনি চাকরি হারাতে পারেন! ইউনিভার্সিটির শিক্ষক হলেই কেউ নিশ্চিন্তে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারেন না।
সেসব দেশে কারও দয়া-দাক্ষিণ্য নিয়ে শিক্ষক হওয়া যায় না। নেতা-নেত্রীর সুপারিশ দিয়ে কাজ হয় না। আর ম্যাট্রিক ইন্টারমেডিয়েটের ফলাফল দিয়ে মেধা যাচাই হয় না। সেখানে শিক্ষক হওয়ার পূর্ব শর্ত হলো, গবেষণায় কৃতিত্ব! পিএইচডিতে কত ভালো কাজ করেছেন, পোস্টডক) কোথায় করেছেন, কত ভালো পাবলিকেশন আছে এবং রিসার্চ প্রপোজালের মান ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিক্ষক নিয়োগে এবং শিক্ষকদের জবাবদিহিতে কোনো ছাড় নেই! কারণ ওরা জানে, দুনিয়ার সবকিছু তৈরি করে মেধাবীরা আর মেধাবীদের তৈরি করেন শিক্ষকেরা। শিক্ষকেরা হলেন কারিগরদের কারিগর। তাদের মানের বিষয়ে হেলাফেলা করা যায় না।
সারা দুনিয়ার শিক্ষকেরা পড়াশোনা ও গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত। রাজনীতির সময় তাদের নেই। স্টকহোম ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করার সময় সুইডেনের দুটি জাতীয় নির্বাচন পেয়েছিলাম। সেখানের শিক্ষকদের মধ্যে নির্বাচনবিষয়ক কে মাথাব্যথাই দেখিনি। বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনায় একটি পোস্টারও চোখে পড়েনি। আমেরিকায় নির্বাচন হলো কিছুদিন আ এখানেও নির্বাচন নিয়ে শিক্ষকদের কোনো সাড়াশব্দ ড আর আমার দেশের শিক্ষকেরা ক্লাস করানোর সময় পান না কিল সাজনীতি করার সময় পান। লাল-নীল দল নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। শিক্ষার্থীদের জীবন নিয়ে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে অবহেলা করেন। একটা দেশের মেরুদণ্ড কী করে ভেঙে দেওয়া হয়, সেটা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গেলেই বোঝা যায়। তবে এমন। অনিয়মের মধ্যেও কিছু ত্যাগী, মেধাবী ও কর্মপাগল শিক্ষক নীরবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। কর্ম ও দেশের প্রতি দায়িত্ববান হয়ে কাজ করছেন। কিন্তু তারা সমগ্র সিস্টেম পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখেন না। হৃদয়ের গহিনে এক যন্ত্রণা নিয়ে তারা প্রতিটি দিন কাটান।
শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম করার অর্থ হলো, শত শত ছেলেমেয়েকে আধুনিক শিক্ষা ও জ্ঞান থেকে বঞ্চিত করা। এটা প্রতারণা। এটার নাম অসভ্যতা। শিক্ষার্থীদের ঠকানোর এই অধিকার রাষ্ট্র কিংবা এর প্রতিষ্ঠানের নেই। অথচ এই ঠকানো চলছে। এটি বন্ধ করার উদ্যোগ আমাদের নেই। আমাদের সবচেয়ে মেধাবী তরুণ-তরুণীরা প্রতিনিয়ত পিছিয়ে যাচ্ছেন। যে বয়সে তাদের ভেতর থেকে যতটুকু সম্ভাবনা বের করা যেত, সেটা বের করা যাচ্ছে না। আর এতে করে আমাদের দেশটা পিছিয়ে যায়। পৃথিবীর আধুনিকায়ন, উদ্ভাবন-আবিষ্কারের দৌড়ে আমরা হেরে যাচ্ছি। সে উপলব্ধিটুকু কী আমাদের হবে কোনো দিন!
.
সজাগ হও, হে তারুণ্য!
আমার রিসার্চ গ্রুপে চীন থেকে একটি ছেলে এসেছে। তার নাম জিপেং লু। বয়স ২২ বছর। ছেলেটা পড়ে সিচুয়ান ইউনিভার্সিটিতে (Sichuan University)। চীনের খ্যাতনামা ইউনিভার্সিটি সেটি। সে এসেছে আন্ডারগ্রেড রিসার্চ করতে। ছয় মাস কাজ করবে। ইউপেনের (UPenn) মতো একটি আইভিলিগ স্কুলে কাজ করে তার ভাবনার জগৎটাই পরিবর্তিত হয়ে যাবে। এখান থেকে ফিরে গিয়ে সে স্নাতক ডিগ্রি পাবে। তার লক্ষ্য, আমেরিকায় গ্র্যাজুয়েট স্টাডি করা। আসার আগেই সব প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা নিয়ে এসেছে সে। আমেরিকার ১০টা স্কুলে। আবেদন করেছিল, তন্মধ্যে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভর্তির ডাক পেয়েছে।
এই ছেলেটি যখন পিএইচডি শেষ করবে, তখন তার বয়স হবে ২৬ কী ২৭। তার সামনে পড়ে থাকবে একটি সম্ভাবনাময় জীবন। সে তার কালকে সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত থাকবে। তার দূরদর্শিতা এবং আগাম পরিকল্পনা আমাকে। বিস্মিত করেছে। ২২ বছরের একটি তরুণের যে পরিপক্কতা ও বোধগম্যতা, তাতে অভিভূত না হয়ে উপায় নেই। তার সঙ্গে আলোচনায় বুঝতে পারলাম, চীন দেশের লাখো ছেলেমেয়ে এমন দূরদর্শী। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতার সব প্রস্তুতি তারা শুরু করেন ইউনিভার্সিটির শুরু থেকেই। তাঁদের বয়স তখন ১৮ কী ১৯! তার কথামতে, চাইনিজরা পরীক্ষায় খুব ভালো স্কোর তুলতে পারেন। আমেরিকান ছেলেমেয়েরা যেখানে ৬০-৭০ ভাগ স্কোর পান, তাঁরা পান ৯০ থেকে ৯৫। তাই ইউরোপ-আমেরিকায় উচ্চশিক্ষার জন্য যেসব টেস্ট প্রয়োজন হয়, সেগুলোতে তার ভালো স্কোর তুলতে পারেন।
আমাদের দেশের অসংখ্য ছেলেমেয়ে ২০-২২ বছর বয়সে গবেষণার কথাই জানেন না। তাদের বলাও হয় না। বোঝানো হয় না। অনেকে জানেনই না, সারা দুনিয়ায় তরুণেরা গড়ে ২৬-২৭ এরমধ্যে পিএইচডি শেষ করেন। সে বয়সে আমাদের দেশের বহু শিক্ষার্থী স্নাতক শেষ করতে পারেন না। সেশনজট নামক এক জঘন্য বিষয় জীবনের সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দেয়।
তরুণদের বলছি, বর্তমান পৃথিবীর প্রতিযোগিতাটা আন্তর্জাতিক। প্রস্তুতিটা তাই খুবই কঠিন। দেশের সীমানা পেরিয়ে বের হলেই বুঝবে, কত কত জাঁদরেল ছেলেমেয়ে আঁকে ঝকে সারা পৃথিবী থেকে জড়ো হয়। সেখানে টিকে থাকাটা অনেক বড় পরীক্ষা। ইউরোপ-আমেরিকার যে জায়গাটার জন্য তুমি লড়ছ, সেটার জন্য শুধু চীন দেশের ১০টি স্টুডেন্ট এবং ভারতের ৮ জন লড়ছে। কারণ তারা সংখ্যায় আমাদের চেয়ে যথাক্রমে ১০ ও ৮ গুণ বেশি। তাদের সঙ্গে আমাদের কিন্তু লড়তেই হবে। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অর্থের জোর নেই। রাজনৈতিক নেতার সুপারিশ নেই। কোটার সুবিধা নেই। শুধু মেধার জোরেই টিকে থাকতে হয়।
যে ছেলেমেয়েগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত, তাদের বোধোদয় দরকার। তুচ্ছ মানুষের পেছনে স্লোগান দিয়ে। যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময় নষ্ট না করে নিজের স্বপ্ন তাড়া করা অনেক উত্তম। শ্রেষ্ঠতম কাজ! দলবাজি, চাঁদাবাজি আর নেতার পদলেহনের রাজনীতি, মাদকাসক্তি এগুলো থেকে বেরিয়ে এলে জীবন নিয়ে প্রত্যয়ী হও। ইন্দ্রজিৎ হওয়ার স্বপনে বিভোর থাকো।
স্রোতের বাধা ঠেলে মাছ উজানের দিকেই যায়। ছুটে চলে সামনে। মানুষের জীবনেও বাধা চিরন্তন। দেশের অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝেও, তোমার থেমে থাকা চলবে না। সীমাবদ্ধতার দোহাই দিয়ে জীবনের সময়টুকু পার হবে না। মানুষ। শুধু বিজয়ীর কথা শুনতে চায়। তোমার কী নেই, সেটা শুনতে কেউ বসে নেই। যা নেই, তা নেই। যা আছে, তাই দিয়েই করো সংগ্রাম। পৃথিবীর প্রতিযোগিতায় লড়াইয়ের জন্য অবতীর্ণ হতেই হবে। যুদ্ধে জয়ী হতে হলে, প্রস্তুতিটা হতে হয় কঠিন। সুতরাং সজাগ হতে হবে সঠিক সময়ে।
Leave a Reply