২০. সর্বশেষ সংবাদ

২০

সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী গত সন্ধ্যায় পতিত হইছে দুর্যোধন। তার মানে যুদ্ধ শেষ। নকুল নিশ্চয়ই এই ভোরবেলা উপপ্লব্য নগরে আইসা উপস্থিত হইছে দ্রৌপদীরে সম্রাজ্ঞীর সংবর্ধনায় নিয়া যেতে…

নকুলরে উপপ্লব্য নগরে আসতে দেইখা এমনই ভাবে দ্রৌপদী। কিন্তু তার কোনো কথার উত্তর না দিয়া নিঃশব্দ নকুল তারে নিয়া আইসা পাণ্ডব শিবিরে পৌঁছাইলে সে পয়লা ধাক্কাটা খায়। সামনে তার দুই ভাইয়ের লাশ…

এই যুদ্ধে আগে গেছে তার বাপ। ভীষ্ম আর দ্রোণের লগে লড়াইতে যাদের কিছু হয় নাই তার সেই দুই ভাই খুন হইল যুদ্ধের পর…

দ্রৌপদী কান্দে। দ্রৌপদী চিল্লায়। দ্রৌপদী প্রশ্ন করে কিন্তু নিঃশব্দ পাণ্ডবগো ভিতর থাইকা ভীম তারে ধইরা অন্য দিকে নিয়া যায়। ভীম বরাবরই তারে সকল শোক থাইকা সরাইয়া রাখে। কিন্তু এইবার ভীম তারে ভাইগো লাশের কাছ থিকা নিয়া গিয়া ফালায় অন্য এক শোকের সাগরে…

তার পাঁচ-পাঁচটা পোলাই গত রাইতে খুন হইছে ঘুমে…

এইবার আর চিৎকার করতে পারে না দ্রৌপদী। এইবার আর কোনো প্রশ্ন নাই তার মুখে। তার মাথাটা শুধু চক্কর দিয়া চাইরপাশে ঘনাইয়া আসে অন্ধকার…

.

যুদ্ধ শেষ হইয়া গেছে। বাকি সব খুচরা আবেগ আর হিসাব-নিকাশও শেষ। ভাই আর পোলাদের দুঃখ সামলাইয়া দ্রৌপদী এক দফা দাবি জানাইছিল পাণ্ডবগো কাছে- অশ্বখামারে হত্যা কইরা তার মাথার মুকুটের মণি আইনা দিতে হবে তারে; অন্যথায় সে আত্মঘাতী হইয়া পোলা আর ভাইদের সাথে যাবে…

কিন্তু অশ্বত্থামা তো রাত্তিরের আকাম কইরা পলাইছে গভীর জঙ্গলে। যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীরে বহুত বোঝায় কিন্তু শেষ পর্যন্ত দ্রৌপদী তার দাবিখান জানায় তার সারা জীবনের ভরসা ভীমের কাছে আর ভীম গদা নিয়া রওনা দেয় বনে…

ভীম রওনা দিলে কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিররে কয়- ভুইলা যাওয়া উচিত না যে অশ্বত্থামা দ্রোণের পুত্র আর শিষ্য। একলা ভীমের গদায় তার নাগাল পাওয়া কঠিন…

কৃষ্ণের কথায় সকলেই গিয়া যখন অশ্বত্থামারে খুঁইজা পায় তখন দেখে সে নেংটি আর ছাই পইরা সাধু হইয়া বইসা আছে দ্বৈপায়নের ডেরায়…

ভীমের কাছে আশ্রম-টাম কিছু না। সে সোজা দাবড়াইয়া যায় অশ্বত্থামার দিকে। কিন্তু আশ্রমে বসলেও অশ্বত্থামা নিজের অস্ত্র ফালায় নাই। সেও পাল্টা আক্রমণ কইরা বসে পাণ্ডবদের…

ভীম বাঁইচা যায় কিন্তু অর্জুন তির নিয়া খাড়ায় অশ্বত্থামার সামনে। অশ্বত্থামা গিয়া লুকায় দ্বৈপায়নের পিছনে- ভগবান। ভীমের ডরে অস্ত্র চালাইলেও আমি কিন্তু যুদ্ধ ছাইড়া এখন সাধু হইয়া গেছি। আমারে বাঁচান…

দ্বৈপায়নের সামনে অস্ত্র চালায় না অর্জুন। কৃষ্ণ আগাইয়া আসে সামনে। অশ্বত্থামা ব্রাহ্মণ; তার উপরে মুনি ভরদ্বাজের নাতি; ঋষি অঙ্গিরা আর বৃহস্পতির বংশধর। এখন তওবা কইরা দ্বৈপায়নের আশ্রমে সাধু হইয়া আছে। তারে মারলে যুধিষ্ঠিরের প্রজারা ভালোভাবে নিবে না এই কাম। ব্রাহ্মণ হত্যা আর দ্বৈপায়নরে অসম্মানের দায়ে রাজা যুধিষ্ঠিররেই অস্বীকার কইরা বসতে পারে তারা। কিন্তু দ্রৌপদী কইয়া দিছে অশ্বত্থামার মুকুটের মণি তার চাই…

কৃষ্ণ সালিশে বসে দ্বৈপায়নের লগে। অশ্বত্থামা আত্মসমর্পণ কইরা মাথার মণি দিব পাণ্ডবগো আর অস্ত্র ছাইড়া বাকি জীবন সন্ন্যাসী হইয়া কাটাইব দ্বৈপায়নের লগে; এই শর্তে পাণ্ডবেরা প্রাণভিক্ষা দিব তারে…

গাঁইগুঁই করলেও শেষ পর্যন্ত শর্তগুলা মাইনা নেয় অশ্বত্থামা আর ভীম ফিরা আইসা অশ্বত্থামার মুকুটের মণিটা দেয় দ্রৌপদীর হাতে…

কুরুপক্ষে অশ্বত্থামা-কৃপাচার্য আর কৃতবর্মা; পাণ্ডবপক্ষে পঞ্চপাণ্ডব-কৃষ্ণ আর সাত্যকি; কুরুযুদ্ধ শেষে দুই পক্ষের হাতে গোনা লোকদের মধ্যে বাঁইচা থাকে মোট এই দশজন। যুদ্ধ শেষ হইবার পরে অবশ্য কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস আইসা হস্তিনাপুরে তার আন্ধাপোলা ধৃতরাষ্ট্রের সম্মান আর নিরাপত্তা দুইটাই নিশ্চিত কইরা গেছেন পাকাপোক্তভাবে- পাণ্ডবরা তোমারে নিজের বাপের মতোই শ্রদ্ধা আর সম্মানে রাখব; চিন্তা কইরো না তুমি…

এই সব খুচরা বোঝাপড়ার পর রাজ-অরাজ মাতা ভগিনী পত্নী কন্যারা অনুমতি পাইয়া কুরুক্ষেত্রে আসেন স্বজনদের লাশগুলা দেখতে। দুই চোখ বান্ধা মহারানি গান্ধারী কিছু না দেখলেও মৃত শতপুত্রের জননী হিসাবে বিধবা পুত্রবধূগো দলে থাকেন অগ্রগামী নেতা…

মাঠে কারো পোশাক দেইখা শরীর চিনা যায় তো খুঁইজা পাওয়া যায় না তার মাথা। কারো মাথা পাওয়া গেলে শরীরটা যে কই কে জানে। আঘাত খাইয়া মরার পর শরীরগুলার উপর দাঁত চালাইছে অসংখ্য শিয়াল আর শকুন। চিনা বড়ো দায় নিজের মানুষটারে। চিনতে পারলেও কাছে যাওয়া আরো দায় গন্ধে আর বীভৎসতায়। কেউ কান্দে কেউ হয় অজ্ঞান কেউ করে হাহাকার আর এর মাঝে গান্ধারী গিয়া খাড়ান কর্ণের লাশের সামনে। শিয়ালে-শকুনে তার দেহের বেশিটাই নিয়া গেছে। খাবলানো মাথাটা পইড়া আছে দূরে…

গান্ধারী কর্ণের মাথাটা কুড়ান। কোলে তুইলা হাত বোলান। কর্ণ তার পোলাগো একমাত্র বন্ধু; যার ভরসায় যুদ্ধ গেছিল তারা। কর্ণ তার পোলাগো মৃত্যুরও কারণ। কারণ কর্ণ না থাকলে এই যুদ্ধ হইত না আর মরতও না অতগুলা মানুষ…

গান্ধারী কর্ণের মাথাটা তার ছিঁড়াখোঁড়া দেহের পাশে রাখেন। তারপর উইঠা অন্য দিকে যান নিজের পোলাগো খুঁজতে। আর তার পিছনে নিঃশব্দে আসা আরেক রাজমাতা নিঃশব্দেই রওনা দেন বিজয়ী পাণ্ডব শিবিরের দিকে। কারণ তার আর দেখার কিছু নাই। তিনি কুন্তী…

কেউ জানল না কুন্তী কেন গান্ধারীর লগে আসছিলেন আর কেনই বা ফিরা গেলেন হঠাৎ। কিন্তু যেদিন পাণ্ডবেরা সকল আত্মীয়ের সৎকারের পর ধৃতরাষ্ট্ররে সামনে রাইখা গঙ্গায় রওনা দিলো মৃতদের উদ্দেশ্যে তর্পণের লাইগা; তখন কুন্তী গিয়া খাড়াইল পাঁচ পাণ্ডবরে সামনে- কর্ণের লাইগাও তর্পণ কইরো তোমরা…

যারা মারা গেছে তারা সকলেই কুরু বংশের আত্মীয় কিংবা গুরুজন। সকলের লাইগাই তর্পণ করা যায় কিন্তু যে গাড়োয়ানের পোলার লাইগা অতটা ভোগান্তি; তার স্মৃতির লাইগা কেন তর্পণ? অর্জুন বেকুব হয়। ভীম বিরক্ত হয়। যুধিষ্ঠিরের মুখে প্রশ্ন- এমন শত্রুর লাইগা কেন আমাগো প্রার্থনা করতে কও মা?

কুন্তী এই প্রশ্নটা আশা করে নাই যুধিষ্ঠিরের মুখে। যুধিষ্ঠির কর্ণের পরিচয় জানে। যুধিষ্ঠির কোনো দিনও কুন্তীরে প্রশ্ন করে না। কিন্তু যুধিষ্ঠির এখন সম্রাট আর কুন্তী এখন কেবলই এক গর্ভধারিণী নারী…

কুন্তী দাঁতে দাঁত কামড়ায়। বহুত হইছে যুধিষ্ঠির। বহুত কিছু করা গেছে তোমার লাইগা। কুন্তী তোমারে সম্রাট বানাইছে। যুদ্ধ জিতাইছে। সেই কুন্তীর কথায় গঙ্গার এক আঁজলা পানি তুইলা যদি তুমি বিনাপ্রশ্নে কর্ণের নামে গঙ্গায় ফিরাইয়া দিতে আপত্তি জানাও তবে আর কী থাকে বাকি? তবে আর কীসের লাইগা কুন্তীর অত গোপনতা…

কুন্তী গিয়া খাড়ায় সকলের সামনে। অতি ধীর কিন্তু অতি উদাত্ত- যে কর্ণ মারা গেছে অর্জুনের তিরে; যারে তোমরা জানতা রাধার গর্ভজাত গাড়োয়ানপুত্র বইলা; সেই কর্ণ জন্ম নিছিল আমারই গর্ভে তোমাগো সকলেরই আগে। কর্ণ তোমাদের বড়ো ভাই…

শরীরের সমস্ত শক্তি হারাইয়া মাটিতে বইসা পড়ে অর্জুন। ভীম পাথর। ভাইঙ্গা পড়ে যুধিষ্ঠিরের মহাযুদ্ধ জয় আর সাম্রাজ্যের অহংকার- মাটিতে হাঁটু গাইড়া নিজের হাতে মুখ লুকায় সম্রাট যুধিষ্ঠির- কী আগুন যে তুমি আঁচলে লুকাইয়া রাখছিলা জননী আর কী আগুন দিয়া যে ছারখার কইরা দিলা সব…

.

২২

অভিষেকের আসরে হায় হায় করে যুধিষ্ঠির- মানুষ হারতে হারতে জিতে আর আমি হতভাগা জিততে জিততে হারি। কী পাইলাম আমি যুদ্ধ কইরা? জয় তো পাই নাই আমি; গৌরবটাও নাই। যাগো মারছি তারা যেমন নিকটাত্মীয় তেমনি মারার বীরত্বও দাবি করতে পারি না আমরা। যুদ্ধ কইরা খালি গায়ের ঝাল মিটছে আমাদের। দুর্যোধন ঠিকই কইছে; সে আমারে বিষণ্ণ এক বিধবা দুনিয়া দান কইরা গেছে। আমার কিছু ভাল্লাগে না রে ভাই। এমন রাজত্ব আমি টানতে পারব না। আমি বনে যামু। ভিক্ষা কইরা খামু…

অর্জুন তারে বোঝায়- অত কিছু কইরা এখন এই সব কইলে হবে?

ভীম তারে ধাতানি দেয়- তুমি একটা আইলসা। তুমি কাজকর্ম বাদ দিয়া ঠোলা বামুনগো মতো বকবক কইরা দিন কাটাইতে চাও তাই এমন কথা কও…

নকুল সহদেবও তারে বোঝায়।

দ্রৌপদী কয়-  আপনের মাথায় গন্ডগোল দেখা দিছে। আপনেরে এখন গাছের লগে বাইন্ধা রাখা দরকার…

কৃষ্ণ কয়- যারা মইরা গেছে বিলাপ করলে তো আর ফিরা আসব না তারা…

সকলে বোঝায় কিন্তু বোঝে না যুধিষ্ঠির। সে খালি কয় আমি বনে যামু। ভিক্ষা কইরা খামু। শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন কন- রাজা হইয়া সন্ন্যাসীর মতো কথা কইও না যুধিষ্ঠির। তোমার যদি মন। উতলা হয় তবে যজ্ঞ কইরা প্রায়শ্চিত্ত কইরা লও। এর লাইগা সবচে ভালো যজ্ঞ হইল অশ্বমেধ…

যুধিষ্ঠির কয়-  আমি রাজকর্ম জানি না ভগবান। আপনি আমারে রাজকর্ম শিখান।

দ্বৈপায়ন কন- সেইটার লাইগা উপযুক্ত মানুষ হইলেন ভীষ্ম। তিনি এখনো জীবিত। তুমি তার কাছে যাও…

গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম এখনো শিখণ্ডীর তিরের জ্বালা নিয়া বাঁইচা আছেন। অভিষেকের পর সবাইরে নিয়া যুধিষ্ঠির তার কাছে হাজির হইয়া রাজকার্য আর ইতিহাস সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন জিগায় আর তিনি তার অভিজ্ঞতা থাইকা উত্তর দেন। বেশ কয়েক দিন চলে এইভাবে। তারপর যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুর ফিরা আসার মাস দেড়েক পর সংবাদ পায় ভীষ্মের অবস্থা যায় যায়…

তির খাওয়ার আটান্ন দিন পর মারা গেলেন ভীষ্ম আর ভগিরতীর তীরে তার শেষকৃত্য কইরা আবারও কাইন্দা গড়াগড়ি যায় যুধিষ্ঠির- কী চাইলাম আর কী পাইলাম মুই? এত দুঃখের ভার কেমনে টানি? ভীষ্ম আর কর্ণের মৃত্যুর কথা কেমনে ভুলি? আমি বনে যামু। ভিক্ষা কইরা খামু…

তার দুঃখ দেইখা শেষ পর্যন্ত মৃত পোলাদের বাপ ধৃতরাষ্ট্রও তারে বোঝান- দুঃখ করতে হইলে তো করা লাগে আমার আর গান্ধারীর। তুমি কেন অত দুঃখ পাও?

দ্বৈপায়ন ব্যাস এইবার খেইপা উঠেন- কোনোকালেই তোমার মাথায় পাকনা বুদ্ধি আছিল না; এখনো নাই। তুমি বারবার পোলাপাইনের মতো ন্যাকামি করতাছ আর সবাই তোমারে বেহুদা বুঝাইতাছে। হয় তুমি কারো কথায় পাত্তা দেও না; না হয় তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি পুরাটাই গেছে। তোমারে না কইছিলাম অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে? তো এমন ব্য ব্যা কইরা কান্তাছ ক্যান?

যুধিষ্ঠির কয়-  আমার যে যজ্ঞ করার পয়সা নাই ভগবান…

-অ এই কতা। তা কইলেই পারো সোজাসুজি…

দ্বৈপায়ন যুধিষ্ঠিররে এক গুপ্তধনের সন্ধান দেন হিমালয়ের ভেতর। কোনো এক কালে এক রাজা মরুত্ত এইগুলা সংগ্রহ করছিলেন নিজে যজ্ঞ করার লাইগা; সেইগুলা এখনো গচ্ছিত আছে হিমালয়ের ভিতর…

কিছু দিন পর সুভদ্রা আর সাত্যকিরে নিয়া কৃষ্ণ ফিরা যায় দ্বারকায় আর হস্তিনাপুরে বিষণ্ণ পাঁচ পাণ্ডবের লগে দ্রৌপদী বাঁইচা থাকে অভিমন্যুর গর্ভবতী বৌ উত্তরার দিকে তাকাইয়া। হয়ত উত্তরার গর্ভেই টিকা যাইতে পারে পাণ্ডবদের বংশের বাতি। পাশাপাশি চলতে থাকে যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন। যুযুৎসুরে ভারপ্রাপ্ত রাজা বানাইয়া যুধিষ্ঠির হিমালয়ে গিয়া মাটি খুঁইড়া নিয়া আসে মরুত্তর গুপ্তধন। আর উত্তরার সন্তান প্রসবের কাল হিসাব কইরা বলরামসহ পুরা পরিবার নিয়া কৃষ্ণ আইসা উপস্থিত হয় হস্তিনাপুর…

প্রসবের দিন বাকি সব পুরুষদের লগে কৃষ্ণও আছিল প্রসূতিঘরের বাইরে। কিন্তু ভিতরমহলে নারীদের সাড়াশব্দ হঠাৎ নিশ্চুপ হইয়া গেলে সমস্ত লজ্জাশরম বাদ দিয়া সাত্যকিরে নিয়া কৃষ্ণ গিয়া হাজির হয় ভাগিনাবধূউত্তরার প্রসূতিঘরে…

উত্তরার পোলা হইছে। কিন্তু বাচ্চাটা সম্পূর্ণ অচেতন। উত্তরা পাথর। দ্রৌপদী-সুভদ্রা কৃষ্ণরে ঘিরা ধরে; কুন্তী দেয় চিৎকার-কৃষ্ণ কিছু কর…

কৃষ্ণ যুদ্ধ বিশারদ। কৃষ্ণ কূটনীতিবিদ। কিন্তু যাদব বংশ একই সাথে বহন করে দুই মহান ভার্গব; ঔষধি বিদ্যার গুরু চ্যাবন আর শল্যবিদ্যার গুরু শুক্রাচার্যের উত্তরাধিকার…

কৃষ্ণের চেষ্টায়; কৃষ্ণের ঔষধিতে শিশুটা চিৎকার দিয়া উঠে আর পাণ্ডব বংশের একমাত্র উত্তরাধিকার পাইয়া চাইরপাশে বাইজা উঠে ঢোল নাকাড়া বাদ্য বাদন আর মানুষের হাসি…

বহু পরীক্ষা পাশ দিয়া পাণ্ডব বংশ পাইছে এই উত্তরাধিকার তাই কৃষ্ণ তার নাম রাখে পরীক্ষিৎ…

কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের নেতৃত্বে যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞ হইয়া যায় ভালোয় ভালোয়। অঢেল দান পায় ব্রাহ্মণসহ সকল গরিব আর দরিদ্রজন। কিন্তু দ্বৈপায়ন আবিষ্কার করেন নতুন এক প্রচ্ছন্ন দরিদ্র মানুষ–কুন্তী…

সম্রাট যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞ থাইকা দানে পাওয়া নিজের অংশটা তিনি আইসা তুইলা দেন পুত্রবধূ কুন্তীর হাতে- এইগুলা তোমার ব্যক্তিগত সম্পদ…

.

২৩

কাউরে কিছু না জানায়ে কুন্তী সিদ্ধান্ত নেয় ধৃতরাষ্ট্র আর গান্ধারীর লগে বনবাসে যাবার। ধৃতরাষ্ট্র আর গান্ধারীর বানপ্রস্থে যাওয়ার কথা সকলেই জানত। যুদ্ধের পনেরো বছর পরে ভীমের জ্বালায় ধৃতরাষ্ট্র বাধ্য হইছেন বানপ্রস্থ বাইছা নিতে…

সম্রাট যুধিষ্ঠির তারে মাথায় কইরা রাখছিল যুদ্ধের পর; যেমনটা নিশ্চিত কইরা গেছিলেন দ্বৈপায়ন। রাজকার্যে তার কোনো পরামর্শ কিংবা সিদ্ধান্তও ফিরাইত না সম্রাট। বাকি পাণ্ডবরাও ধৃতরাষ্ট্ররে কুরুপিতা না ভাইবা বাপের বড়ো ভাই বইলাই মানত। কিন্তু ব্যতিক্রম সেই ভীম; যার সম্পর্কে ধৃতরাষ্ট্র কইতেন- প্রতিশোধ ভোলে না কুন্তীর ট্যারাচোখ পোলা…

ভীম যাইচা গিয়া ধৃতরাষ্ট্ররে শুনাইয়া শুনাইয়া বর্ণনা করত তার কোন পোলারে কেমনে মারছে সে…

একটা পিতা। অন্ধ বৃদ্ধ অসহায়। রাজ্যবিলাসিতায় বড়ো বেশি লোভ ছিল তবু পনেরো বছরের বেশি তিনি হন্তারকের মুখে সহ্য করতে পারলেন না নিজ পোলাদের বীভৎস মৃত্যুর বর্ণনা শ্রবণ। তিনি গিয়া যুধিষ্ঠিররে কন- বয়স হইছে বাপ। এইবার বানপ্রস্থে গিয়া ভজন-সাধন কইরা মরবার অনুমতি দাও…

যুধিষ্ঠির রাজি হয় নাই। কিন্তু দ্বৈপায়ন আইসা নিশ্চিত করেন তার আন্ধাপোলার মুক্তির পথ- তারে বনে যাইতে দেও যুধিষ্ঠির…

বনে যাইবার সিদ্ধান্ত নিয়া তিনি চাইলেন তার পুত্র; তার সকল মৃত শুভাকাঙ্ক্ষীর নামে শেষবারের মতো কিছু দান খয়রাত করতে। কিছু পয়সা চাইলেন তিনি সম্রাটের কাছে। যুধিষ্ঠির বিনা প্রশ্নে রাজি। অর্জুনও রাজি কিন্তু অর্থমন্ত্রী ভীম রাজি না- ধৃতরাষ্ট্রের কুলাঙ্গার পোলাগো লাইগা একটা পয়সাও দেওয়া যাবে না…

যুধিষ্ঠির তারে তেলায়; অর্জুন নকুল সহদেব তারে মিনতি করে কিন্তু ভীম নড়ে না- ধৃতরাষ্ট্রের পোলারা নরকে পচুক। ভীষ্ম দ্রোণের নামে আমরাই দান করব আর চাইলে নিজস্ব তহবিল থাইকা কুন্তী দান করতে পারেন পাপিষ্ঠ কর্ণের নামে…

যুধিষ্ঠির আর অর্জুনের ব্যক্তিগত ভাতার টাকায় ধৃতরাষ্ট্র দান-খয়রাত করেন তার পোলাদের নামে। কিন্তু কর্ণ প্রসঙ্গে ভীমের কথাটা কুন্তীর কানে যায়। কুন্তী সিদ্ধান্ত নিয়া নেয়- যে পোলারে জন্ম দিয়া বুকের এক ফোঁটা দুধও দেই নাই অথচ তার কাছ থাইকাই মায়ের পরিচয় দিয়া চাইয়া আনছি তোগো জীবন। যারে জন্ম দিছি আমি আবার তোগো লাইগাই নিশ্চিত করছি যার মরণ। হা ভীম। আমি চাইলে তোগোর পুরা রাজ্যটাই হইতে পারত কর্ণের। সেই মরা কর্ণের আত্মার শান্তির লাইগা দুইটা পয়সা দিতে তোগো অত লাগে? অতই খিদা তোগো পেটে? খা তবে। তোগো সম্পদ তাইলে তোরাই খা…

কর্ণের মৃত্যুতে কাঁদে নাই কুন্তী। কিন্তু আইজ কর্ণের লাইগা তার চোখ ভাইঙ্গা আসে জল- আমার মরা পোলার লাইগা যে বাড়িতে দুইটা পয়সা হয় না; সেই বাড়ির অন্ন যেন আর কোনো দিনও না উঠে কুন্তীর মুখে…

ধৃতরাষ্ট্র আর গান্ধারীর লগে বনবাসে রওনা দেয় কর্ণমাতা কুন্তী। তার পথে আইসা খাড়ায় প্রজারা। তার পায়ে হুমড়ি খাইয়া পড়ে সম্রাট যুধিষ্ঠির। পথ আগলে দাঁড়ায় ভীম। কান্তে কান্তে মাটিতে লুটায় নকুল সহদেব দ্রৌপদী…

হাঁটতে হাঁটতে কুন্তী যুধিষ্ঠিররে কয়-  সবাইরে দেইখা রাখিস। ভীমেরে পথ থাইকা সরাইয়া কয় তোগো যাতে কারো কাছে হাত পাততে না হয় তাই তোগোরে আমি চালায়া নিছিলাম। এখন আমারে আমার পথে যাইতে দে…

বিদুর পা মিলায় বনবাসী দলে। আজীবন অনুচর সঞ্জয়ও চলে ধৃতরাষ্ট্রের লগে…

বনে চলেন শতপুত্র হারানোর শোক নিয়া গান্ধারী আর তার সাথে চলেন পাণ্ডবজননী কুন্তী; তার মনেও সন্তান হারানোর দুখ…

.

২৪

অবশেষে সব ছাইড়া দ্রৌপদী আর পঞ্চপাণ্ডব রওনা দিছে বনবাসে। কুরুযুদ্ধের ছত্রিশ বছর পরে…

কুন্তীরা বনে যাবার বছর খানেক পর পাণ্ডবেরা বনে গিয়া দেইখা আসছিল তাদের। ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী কুন্তী ভীষণ দুর্বল আর বিদুর বদ্ধ উন্মাদ; ন্যাংটা হইয়া বনে বনে ঘোরে…

যুধিষ্ঠির বনে গিয়া বিদুররে খুঁইজা বার করলে বিদুর যুধিষ্ঠিররে জড়াইয়া ধইরা আর ছাড়ে না। অবশেষে যুধিষ্ঠির অতি ধীরে ছাড়ায়ে নেয় প্রাণহীন বিদুরের আলিঙ্গন…

পাণ্ডবেরা দেইখা আসার বছর দুয়েক পরে দাবানল থাইকা পলাইতে না পাইরা আগুনে পুইড়া মারা যান ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারী আর কুন্তী। আগুনের হাত থিকা বাঁচতে পারে শুধু সঞ্জয়…

পাণ্ডবগো রাজ্য বিস্তার হইছে বহুত কিন্তু ভাইঙ্গা পড়ছে তাগো শক্তি আর শরীর। দ্বারকায় ভাইঙ্গা পড়ছে কৃষ্ণ আর বলরামের নিয়ন্ত্রণ…

কুরুযুদ্ধে যেসব বড়ো রাজা মারা গেছেন তাগো উত্তরাধিকার নবীন রাজারা অন্যদেশ আক্রমণের থাইকা নিজের রাজ্য গুছাইতে এখনো বেশি মনোযোগী। বাকি যে খুচরা বিদ্রোহী রাজ্য আছিল তারাও সবাই অশ্বমেধ যজ্ঞের কালে অর্জুনের কাছে আত্মসমর্পণ কইরা পাণ্ডবরাজের অনুগত এখন। আর একই সাথে যুদ্ধহীন আর্যাবর্তে পেশাদার যোদ্ধা যাদব বংশ পুরাপুরি বেকার; কোথাও কোনো যুদ্ধ নাই; তাই তাগো কোনো কামও নাই। বেকার সময়ে তাগো হাত কামড়ায়। অস্ত্র টাডায়। তাই মাতলামি আর নিজেগো মাঝে হাতাহাতি কইরা তারা সময় কাটায়। মারামারি করতে করতে মাতালেরা একসময় মারামারিতেও বৈচিত্র্য খোঁজে। লাঠি গদা অস্ত্রের বদলা তারা শুরু করে একে অন্যের পাছায় ডান্ডা ঢোকানোর কাজ। আর এই প্রক্রিয়ায় পুটকি দিয়া পয়লা ডান্ডাটা ঢোকে কৃষ্ণপুত্র শাল্বের …

কৃষ্ণের সেই তাকতও নাই; হুকুমদারিও নাই। কৃষ্ণ আর চক্র চালাইতে পারে না। মেরামতির অভাবে ভাইঙ্গা গেছে রথ। ছাইড়া দেওয়া ঘোড়াগুলা ভাইগা গেছে বনে। গাঙ্গে ঝাঁপ দিয়া দ্বারকার নারীরা আত্মহত্যা করে। লুটতরাজ আর চুরিচামারি হইতে থাকে প্রচুর আর চলতে থাকে যাদব বংশের মদ খাইয়া একে অন্যের পাছায় বাঁশ দিবার কাম…

বলরামরে নিয়া কৃষ্ণ চেষ্টা করে দ্বারকায় মদ তৈরি আর বিক্রি বন্ধ করার। কাজ হয় না। নিরুপায় কৃষ্ণ অবশেষে গোষ্ঠী আর পরিবার নিয়া দেশান্তরী হয় সমুদ্রতীরের প্রভাসতীর্থে। কিন্তু সেইখানেও বদলায় না কিছু। সাত্যকি বলরাম কৃষ্ণের সামনেও মাতলামি করতে থাকে পোলাপান। আর আস্তে আস্তে এই মহামারি ছড়াইতে থাকে বড়োদের মাঝেও…

খাইতে বইসা সামান্য ঝগড়ার সূত্রে সাত্যকি খড়গ দিয়া কৃতবর্মার মাথা আলগা কইরা অন্যদেরও কোপাইতে থাকে। অন্যরা হাতের থালাবাটি বাসন দিয়া পিটাইতে শুরু করে সাত্যকিরে। কৃষ্ণের পোলা প্রদ্যুম্ন সাত্যকির পক্ষ নিতে গেলে থালাবাটির বাড়ি খাইয়া কৃষ্ণের সামনেই সে মরে সাত্যকির লগে। সাত্যকি আর পোলার মৃত্যুতে কৃষ্ণও একটা মুগুর নিয়া সবাইরে পিটায়। শুরু হয় আউলাঝড়া মাইর। কে কার পক্ষে জানে না কেউ। সবাই সবাইরে পিটায়। শুধু যে মারা যায় সে থামে। কৃষ্ণের সামনেই মরে তার আরো চাইর পোলা; শাম্ব- চারুদেষ্ণু- অনিরুদ্ধ আর গদ…

এই গিয়াঞ্জামে বিষণ্ণ বলরাম তখন একলা বনে বনে ঘোরে। বহু কষ্টে কৃষ্ণরে কিলাকিলি থাইকা সরাইয়া বলরামের কাছে নিয়া আসে বদ্রু আর দারুক। বলরামের কাছে বইসা অর্জুনরে নিয়া আসতে দারুকরে হস্তিনাপুর পাঠায় কৃষ্ণ; হয়ত এই অন্তর্ঘাত থাইকা বংশের নারী আর শিশুগো অন্তত বাঁচাইতে পারব অর্জুন…

বলরামের কাছে বইসাই কৃষ্ণ বদ্রুরে পাঠায় বংশের নারীগো দেইখা আসতে। কিন্তু রাস্তাতেই বদ্রু মারা যায় কারো হাতে। এইবার কৃষ্ণ নিজে গিয়া নারীগো জানায় যে অর্জুনরে সংবাদ পাঠানো হইছে; দুশ্চিন্তার কিছু নাই। আর বাপ বসুদেবরে কয়-  অর্জুন না আসা পর্যন্ত যেইভাবেই হউক আপনে নারী আর শিশুগো আগলাইয়া রাখেন…

কৃষ্ণ আবার ফিরা আসে বনে বলরামের কাছে। কিন্তু তখন আর বলরাম নাই। এক সাপের কামড়ে এর মইদ্যেই মৃত্যু হইছে তার…

বলরামের মৃত্যুতে বিধ্বস্ত কৃষ্ণ বনে পায়চারি করে। পায়চারি করতে করতে কৃষ্ণ বনে বইসা ঝিমায় আর এক শিকারি তারে শিকার মনে কইরা বিন্ধাইয়া দেয় একখান তির…

মাত্র একটা তিরেই শেষ হয় দুর্ধর্ষ যাদব কৃষ্ণের জীবন…

কৃষ্ণ-বলরামহীন যাদবকুলের সকল সম্পদ ভাগিনা অর্জুনের হাতে তুইলা দিয়া পর দিন বসুদেব মারা গেলে কৃষ্ণ-বলরাম-বসুদেবের সৎকার শেষ কইরা পরিবারের সকল নারী আর শিশুদের নিয়া অর্জুন রওনা দেয় হস্তিনাপুর। কিন্তু রাস্তায় রাস্তায় লুট হইতে থাকে অর্জুনের বাহিনী; ধনরত্ন যায়; গবাদিপশু যায়; নারীদের লুইটা নিয়া যায় ডাকাতের দল কিন্তু গাণ্ডিব চালাইবার শক্তি আর নাই অর্জুনের গায়…

লুটের হাত থিকা বাঁইচা যাওয়া মানুষগুলারে পথে বিভিন্ন সহায়ে রাইখা ইন্দ্রপ্রস্থ ফিরে আসে বৃদ্ধ অর্জুন আর আবার সন্ন্যাস চাগান দিয়া উঠে যুধিষ্ঠিরের মনে…

এইবার আর তারে নিষেধ করে না কেউ। নদীর জলে গাণ্ডিব ফালাইয়া আইসা সন্ন্যাস দলে যোগ দেয় অর্জুন। যোগ দেয় ভীম নকুল সহদেব আর দ্রৌপদী…

উত্তরার পুত্র পরীক্ষিৎরে রাজা বানাইয়া দ্রৌপদীর লগে হিমালয়ের উত্তরে মানস সরোবর উদ্দেশ্য কইরা বানপ্রস্থে রওনা দেয় পঞ্চপাণ্ডব; আর তাগো পিছে আইসা যোগ দেয়া একটা কুকুর…

বনের পথে সবার আগে আগে হাঁটে যুধিষ্ঠির। তার পিছনে হাঁটে পাঁচটা মানুষ আর একটা কুকুর। হাঁটতে হাঁটতে পড়ে যায় দ্রৌপদী: যুধিষ্ঠিরের পিছনে পা মিলায় চাইরটা মানুষ আর একটা কুকুর। পড়ে যায় সহদেব; যুধিষ্ঠিরের পিছনে চলে তিনটা মানুষ আর একটা কুকুর। পড়ে যায় নকুল; যুধিষ্ঠিরের পিছনে থাকে দুইটা মানুষ আর একটা কুকুর। পড়ে যায় অর্জুন; যুধিষ্ঠিরের পিছনে দৌড়ায় একটা মানুষ আর একটা কুকুর। পড়ে যায় ভীম; আর পিছনে একটা কুকুর নিয়া আগাইতে থাকে কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠির; যারে সর্ব অবস্থায় স্থির থাইকা সামনে আগানোর লাইগাই জন্ম দিছে কুন্তী; হোক তা ক্ষমতার দিকে আর হোক নিরুদ্দেশ যাত্রায়…

রচনাকাল: ২০১২.১১.০৯ – ২০১৪.১২.৩১

.

লেখক পরিচিতি

মাহবুব লীলেন গল্প বলেন বাংলার পালাকার ও বয়াতি-বাউলের মতো বৈঠকি ঢংয়ে। কবিতা, গল্প, মঞ্চ নাটক, পুরাণ মিলিয়ে প্রকাশিত বই এক ডজনের বেশি। সম্প্রতি লিখছেন রামায়ণের লোকায়ত আখ্যান ‘অভাজনের রামায়ণ’…

যোগাযোগ: [email protected]