১৫. কৃষ্ণের পাঞ্চজন্য শঙ্খ

১৫

কৃষ্ণের পাঞ্চজন্য শঙ্খের লগে অর্জুনের দেবদত্ত শঙ্খ আর তার উত্তরে ভীষ্মের শঙ্খের নাদে কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ শুরু হইয়া যায়। মাঠের পশ্চিমে কুরু আর পূর্বে খাড়ায়া আছে পাণ্ডব-পাঞ্চাল। দুই রঙের পোশাকে দুই পক্ষ দাঁড়াইছে যাতে পরিষ্কার চিনা যায় পাট্টি আর বিরোধী দল। হাতির সামনে হাতি, ঘোড়ার সামনে ঘোড়া; পায়দল খাড়া পায়দলের সম্মুখে; গদারু গদা বাগাইয়া আছে গদারুর দিকে; তিরন্দাজ-তিরন্দাজ মুখোমুখি আর বর্শাতি-ভল্লব খাড়া পরস্পর কপাল নিশানা করে। সকলেই রেডি হইয়া প্রস্তুত আছে সেনাপতির হুংকারের অপেক্ষায় আর ঠিক এই সময় যুধিষ্ঠির ঘটাইল কাণ্ডখান…

যুধিষ্ঠির আছিল দুই দলের মাঝখানে; পাণ্ডব-পাঞ্চালের সকলেরই আছিল তার দিকে চোখ। হঠাৎ সে অস্ত্র ফালাইয়া; বর্ম ছাইড়া; রথ থাইকা নাইমা হাত জোড় কইরা হাঁটা দিলো শত্রুসেনাপতি ভীষ্মের দিকে…

শত্রু দলের ভিতর দিয়া হাঁটা দিছে নিরস্ত্র যুধিষ্ঠির; দৌড়াইয়া গিয়া ভীম তারে আটকায়-দুর্যোধনের সেনা দেইখা যুদ্ধের আগেই কি সারেন্ডারের পিলান করতাছ তুমি?

যুধিষ্ঠির কথা কয় না। হাঁটে। ভীমেরে আটকাইয়া কৃষ্ণ হাসে- যাইতে দেও। যুদ্ধ নিয়মের পয়লা ফায়দাটা উঠাইতাছে রাজা যুধিষ্ঠির। নিয়মমতো নিরস্ত্র যুধিষ্ঠির এখন সম্পূর্ণ নিরাপদ…

ভীষ্ম যখন যুধিষ্ঠিরের কাছ থিকা আশা করতাছিল আক্রমণ তখন সে পাইল সাষ্টাঙ্গে প্রণাম। যুদ্ধের মাঠে এইরকম বেকুব জীবনেও আর বনে নাই সে। অস্ত্রমস্ত্ৰ ছাইড়া আইসা যুধিষ্ঠির তার পায়ে পেন্নাম ঠুইকা খাড়ায়- আপনের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার অনুমতি চাই পিতামহ; আর আশীর্বাদ করেন যাতে বিজয়ী হই…

যুধিষ্ঠিরের এমন কাণ্ডে গঙ্গাপুত্রের আবেগ জল হইয়া মাঠেতে গড়ায়- নাতিরে; কী আর কমু। খালি ভাতের দায়ে ঠেইকা আছি দুর্যোধনের লগে। নাইলে আমি তো তোর লগেই যাইতে চাই আর জয়ও চাই তোর…

ভীষ্মের কাছ থিকা সইরা যুধিষ্ঠির একইভাবে গিয়া খাড়ায় গুরু দ্রোণের সামনে- পেন্নাম গুরুদেব। গুরুরে পেন্নাম না কইরা আমি কোনো দিনও অস্ত্র ধরি নাই; তাই শত্রুপক্ষে থাইকাও আপনেরে পেন্নাম করি মুই…

সারা জীবন অর্জুনরে বড়ো শিষ্য কইলেও দ্রোণের শিষ্যগো মাঝে পদে সব থাইকা বড়ো যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ করা চক্রবর্তী সম্রাট; যার সামনে শত শত ব্রাহ্মণ হাত জোড় কইরা থাকনের কথা; সেই যুধিষ্ঠির শত্রু হইয়াও শুধু গুরু হইবার কারণে তারে আইসা পেন্নাম কইরা অনুমতি চায়। এমন কাণ্ডে ভরদ্বাজের লোভী পুত্রের চোখও চক চক কইরা উঠে; জগতে এমন বিরল সম্মান মাইনসেরে না দেখাইলে কী হয়?

যদিও যুধিষ্ঠির জিতা গেলে সব থিকা বড়ো ক্ষতি দ্রোণেরই। কারণ পাশা খেইলা যুধিষ্ঠির যেই রাজ্য হারাইছে সেই ইন্দ্রপ্রস্থের বর্তমান রাজা স্বয়ং এই গুরু দ্রোণ; যুদ্ধে যুধিষ্ঠিরের জিতা যাওয়া মানে কিন্তু দ্রোণের রাজ্য হারাইয়া আবার ভিক্ষুক বামুন বইনা যাওয়া। কিন্তু এতগুলা মাইনসের সামনে গুরু বইলা সম্মান দিলো; গুরুর গাম্ভির্য রাইখা তারেও তো কিছু তো কইতে হয়। তাই সকলরে দেখাইয়া দ্রোণ যুধিষ্ঠিরের আশীর্বাদ কইরা কানে কানে কন- ভাতের দায়ে দুর্যোধনের কাছে বান্ধা পইড়া আছিরে বাপ; তবু কিন্তু আমি তোমারই জয় চাই…

যুধিষ্ঠির তারপর যায় মামা শল্যের কাছে। পেন্নাম-টেন্নাম কইরা কয়- কথাটা মনে রাইখেন মামা। আপনে কইছিলেন যে যুদ্ধের সময় কর্ণের মাথা আউলা কইরা রাখবেন…

শল্য কয়- হ ভাগিনা। মনে আছে। করব। আর তুমি যে আমারেও সকলের সামনে পেন্নাম করলা তাতে খুব খুশি আমি…

যুধিষ্ঠির ফিরতি পথ ধরে আর কৃষ্ণ ভীম অর্জুনরে কয়-  তোমরা যুদ্ধ জানতে পারো; কিন্তু পলিটিক্স বোঝে রাজা যুধিষ্ঠির। যুদ্ধের আগেই দেখো কেমনে শত্রুপক্ষের তিন পালের গোদারে প্রণাম নমস্কার কইরা আবেগে ভাসাইয়া দিছে। এখন নিশ্চিত থাকতে পারো; খালি একটা প্রণামের কারণেই এই তিনজন কোনোভাবেই পাণ্ডবগো উপর অস্ত্র উঠাইব না; যদি না পাণ্ডবরা আগে উঠায়…

যুধিষ্ঠির যখন মুরুব্বিগো পটাইতে ব্যস্ত তখন কৃষ্ণ গিয়া খাড়াইছিল কর্ণের সামনে- ভীষ্ম না মরলে তো তুমি কৌরবপক্ষে যুদ্ধ করবা না। তা অত দিন বইসা না থাইকা না হয় আমাগো পক্ষেই যুদ্ধ করো। ভীষ্ম মরলে আবার গিয়া যুদ্ধ করবা দুর্যোধনের পক্ষে…

কর্ণ কৃষ্ণের দিকে তাকাইয়া হাসে- আমি তো আর তোমাগো মতো ভাড়াটিয়া সিপাই না কৃষ্ণ; যে যার কাছে বেতন পাব তার পক্ষেই অস্ত্র ধরব। যুধিষ্ঠির বেতন দিতে পারব না দেইখা তুমি যেমন তোমার সৈন্য দুর্যোধনরে ভাড়া দিয়া নিজে একলা গেছো পাণ্ডবগো লগে আবার পয়সার লোভে পাণ্ডবগো মামা শল্য আইসা যোগ দিছে দুর্যোধনের লগে; আমারে তুমি সেই দলে ফেললেই ভালো। আমি যুদ্ধ করি বা না করি; দুর্যোধনের পক্ষেই আছি…

নিজের দলে ফিরা আইসা যুধিষ্ঠির একটা আওয়াজ দেয়-কুরুপক্ষের কেউ কি দল ছাইড়া আমাগো দলে আসতে চাও?

এই ডাকে নিজের দল ছাইড়া পাণ্ডবপক্ষে আইসা যোগ দেয় ধৃতরাষ্ট্রের দাসীগর্ভজাত পোলা যুযুৎসু। এইটাও যুদ্ধের নিয়মের মধ্যে পড়ে। গতকাল দুই পক্ষ মাঠে উপস্থিত হইবার লগে লগেই দুই দলের মাঝখানে আইসা খাড়াইছিলেন কুরু-পাণ্ডব পিতামহ কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন- কিছু নিয়মকানুন ঠিক কইরা দিতে চাই যুদ্ধ শুরুর আগে…

– যেহেতু দুই পক্ষই পরস্পর আত্মীয়; তাই যুদ্ধ শেষ হইবার পর কিংবা শুরু হইবার আগে কারো ভিতর কোনো শত্রুতা থাকতে পারব না; আত্মীয় হিসাবে পরস্পরের লগে পরস্পরের যেমন সম্পর্ক থাকব তেমনি পরস্পরের শিবিরেও থাকব পরস্পর যাতায়াতের অবাধ অধিকার। এইটা আমার পয়লা বিধান…

দ্বৈপায়নের কথায় দ্বিমত করার কোনো লোক থাকার কথা না। তিনি কথা বাড়াইতে থাকেন- দ্বিতীয় কথা হইল গালাগালির উত্তর মুখ খারাপ কইরাই দেওন লাগব। যারা অস্ত্র ফালাইয়া ভাগব তাগোরে কিন্তু মারা যাইব না। যুদ্ধ কিন্তু হইতে হইব সমানে সমান; হাতির লগে হাতি সওয়ার; ঘোড়ার লগে ঘোড়সওয়ার; রথীর লগে রথী আর পায়েদলের লগে পায়েদল মানুষই কেবল যুদ্ধ করবার পারব…

সক্কলে সকল কথা মাইনা নিতাছে দেইখা তিনি আরো ছোটখাটো নিয়ম বাড়াইতে থাকেন আরেকখান কথা; কারো সম্পর্কে না জাইনা কিন্তু তারে আক্রমণ করা যাইব না। কেউ যদি কাউরে দেইখা ডরে তাক্কা খায় তবে কিন্তু তারেও কেউ মারতে পারবা না। কিংবা ধরো যে লোক অন্য কারো লগে লড়াই করতাছে; কিংবা কেউ যদি আত্মসমর্পণ কইরা ফালায় কিংবা কারো যদি বর্ম না থাকে; তাগোরেও যেমন মারা যাইব না তেমনি কোনো সারথি কিংবা জোগানদার বাদ্যকার কিংবা কামলাগোরে আঘাত করতে পারবা না কেউ…

দ্বৈপায়নের কথায় ভীম মিনমিন করে কৃষ্ণের কানে- শর্ত চাপাইতে চাপাইতে তো দেখি দাদায় যুদ্ধরে পোলাপাইনের খেলাধুলা বানায়া ফেলতেছে…

কনুইয়ের গুতা দিয়া ভীমেরে থামায় কৃষ্ণ- নিয়ম মাইনা নেওয়া মানেই কিন্তু নিয়ম পালন করা বোঝায় না। নিয়ম থাকলে মাঝেমইধ্যে নিয়মের কিছু সুবিধাও পাওয়া যায়। ঠাকুরের নিয়মগুলা কামে লাগব। থাউক…

কারো কোনো কথা নাই বুইঝা দ্বৈপায়ন এইবার হাত ধইরা সঞ্জয়রে আইনা খাড়া করেন সকলের সামনে- এরে চিনা রাখো সকলে। গবলপুত্র এই সঞ্জয়ের যুদ্ধের যেকোনো স্থানে যাতায়াতের থাকব অবাধ অধিকার। কেউ তারে যেমন বাধা দিতে পারব না; তেমনি কেউ তারে চাইপা ধইরা সংবাদ নিবারও চেষ্টা করতে পারব না। এই সঞ্জয় সংবাদ সংগ্রহ কইরা জানাই আন্ধা রাজা ধৃতরাষ্ট্ররে।

এইটাই আমার শেষ বিধান…

দুই দলই তিনটা কইরা বাহিনী নামায় পয়লা দিন। কুরুতে পয়লা বাহিনীর নেতা দ্রোণ; তার পিঠ বাঁচাইয়া দ্বিতীয় দলের নেতা ভীষ্ম আর সকলের পিছনে তৃতীয় দলে দুর্যোধন স্বয়ং। পাণ্ডব-পাঞ্চালে পয়লা দলেই পাণ্ডব সেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্ন; এক্কেবারে দ্রোণের মুখামুখি। দ্বিতীয় দলের নেতা তিনজন; ভীম সকলের সামনে তারপর অর্জুন তারপর অর্জুনের পিঠ সামলাইবার লাইগা পিছনে সাত্যকি। আর সব শেষ দলের তিন নেতার মধ্যে থাকেন বিরাট দ্রুপদ আর স্বয়ং যুধিষ্ঠির…

কর্ণের লগে আলাপে কৃষ্ণের ঠিক করা তারিখেই শুরু হইছে যুদ্ধ, কার্তিক মাসের অমাবস্যার দিন। এই সময়ে গ্রামেগঞ্জে শস্য যেমন ভরপুর আছে তেমনি ফসল উইঠা যাওয়ায় মাছিরাও আর মাঠেঘাটে ভন ভন করে না এখন। কিছু দিন আগে বৃষ্টির কারণে চাইরপাশে ঘাসপাতা পশুখাদ্যের যেমন অভাব নাই তেমনি পুকুর আর কূপগুলা এখনো স্বচ্ছ পানিতে ভরপুর; আবার বৃষ্টি উইঠা যাওয়ায় পথে মাঠে কাদাও যেমন নাই; ধুলাও তেমনি নাই। না শীত না গরম এই কালটা যুদ্ধের লাইগা খুবই উপযুক্ত সময়…

হিরন্বতী নদীর দক্ষিণ তীর ঘেঁইষা পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত কয়েকটা মাঠ নিয়া এই কুরুক্ষেত্র। কৃষ্ণের পরিকল্পনায় পাণ্ডবগো শিবির তৈরি হইছে এক্কেবারে নদীর তীর ঘেঁইসা পূর্ব দিক বরাবর। পাণ্ডব আর অন্যান্য রাজাগো শিবিরের চাইরপাশে খাল কাটা হইছে যাতে অকস্মাৎ কেউ না আক্রমণ করতে পারে। শিবিরে বসানো হইছে সৈন্যনিবাস জোগানদার আর সেবাদারগো পাড়া; কামার দোকানদার কবিরাজ সাপ্লায়ার জোগালি পশুরাখাল চাকরবাকর আর বেশ্যাপল্লি। প্রচুর পানি ঘাস পশুখাদ্য কয়লা ঘি ধুনা আর অস্ত্রের লাইগাও করা হইছে আলাদা আলাদা গুদাম। পাণ্ডব শিবিরের দক্ষিণে পড়ছে যুদ্ধের মাঠ; উত্তরে নদী; পূর্ব দিকে দ্বৈপায়ন হ্রদ এবং পাহাড় জঙ্গল আর পশ্চিম দিকে কৌরব শিবির…

কৌরব শিবিরেও একই ব্যবস্থা হইছে। তারা শিবির করছে নদীর তীর ঘেঁইসা পশ্চিম দিক বরাবর। পাশাপাশি যেহেতু দ্বৈপায়ন হ্রদ আর পাহাড় জঙ্গল পইড়া গেছে পাণ্ডব শিবিরের পিছনে; তাই তারা খেয়াল রাখছে কুরুক্ষেত্র ঘুরাইয়া দ্বৈপায়ন হ্রদ আর বনে যাইবার পথটা যেন শত্রুরা বন্ধ কইরা দিতে না পারে। তাছাড়া এই পথটা তাগোর সরবরাহ সাপ্লাইয়েরও পথ…

যুদ্ধের মাঠে দুই দলেরই বিন্যাস প্রায় একই রকম। সামনে পদাতি আর গদারু বাহিনী। প্রতি তিনটা লাইনের পিছনে এক লাইন ফাঁকা জায়গা কমান্ডার আর সরবরাহিগো যাতায়াতের লাইগা। পদাতি বাহিনীর পিছনে হাতি সোয়ার বাহিনী; হাতিগুলা মূলত রথেরই বিকল্প; কিন্তু মাঝে মাঝে হাতি নিজেও যুদ্ধে যোগ দিয়া পাড়াইয়া সিধা করে সেনাসৈনিক। আর দুই পাশে তিরন্দাজ দল। তিরন্দাজরা শত্রুর দিকে তির মাইরা পদাতিগো জায়গা কইরা দেয় আউগাইয়া যাবার। আর সুবিধামতো সেনাপতিরা রথেও চড়েন; হাতিতেও চড়েন আবার দরকার মনে করলে দৌড়াইয়া গিয়াও সৈন্যগো নির্দেশনা দেন…

যুদ্ধের শুরুতে অবশ্য অর্জুন বেশ ঝামেলাই পাকাইছিল। অর্জুন নরম দিলের মানুষ। সে ভীষ্ম দ্রোণরে সামনে দেইখা কাইন্দা-কাইট্টা অস্ত্র ফালাইয়া কয়-  আমি যুদ্ধ করতে পারব না কৃষ্ণ। তুমি কও ক্যামনে আমি পিতামহ ভীষ্ম আর গুরু দ্রোণের দিকে তির চালাই?

কৃষ্ণ তারে ধাতানি দেয়- সংকটের সময় নপুংসকের মতো ন্যাকামি বন্ধ কইরা তোমার যা করার তাই করো তুমি। অস্ত্র উঠাও। তোমারে দেইখা মনে হইতাছে তুমি এই পরথম জানলা যে ভীষ্ম দ্রোণের গায়ে তোমার তির মারতে হবে?

অর্জুন কয়-  আমি আগে জানতাম ঠিকই কিন্তু এখন মনে হইতাছে এগোরে মাইরা কী লাভ হইব আমাদের?

কৃষ্ণ একটা চূড়ান্ত ধাতানি লাগায় অর্জুনরে- লাভ ক্ষতির লগে তোমার কী সম্পর্ক? তোমার কাম হইল অস্ত্র চালানো তুমি সেইটা করবা। ব্যস…

যাউক গা। ভীষ্ম- ভীম আর ভীমের পোলা ঘটোৎকচ ছাড়া সকলেই মূলত হাত মশকো করে পয়লা দিন। ভীষ্ম আর ভীম গণমাইর দিয়া ছত্রভঙ্গ কইরা দেয় বহু সেনাসৈনিক। বিরাটের দুই পোলার মধ্যে উত্তর মারা যায় শল্যের হাতে আর শ্বেত মরে ভীষ্মের হাতে। কুরুপক্ষের বড়ো কেউ মরে না এই দিন। কিন্তু সেনাসৈন্যের দুরবস্থা দেইখা দিনের শেষে যুধিষ্ঠির যায় ঘাবড়াইয়া-যুদ্ধ যা করার তা তো দেখি একলা ভীমই করল। অর্জুন তো উদাসীন। এই অবস্থায় ভীষ্মরে সামলাইব কেডা? একলা ভীম তো একশো বছরেও এই যুদ্ধ কুলাইতে পারব না…

কৃষ্ণ কয়-  অর্জুনের পক্ষে ভীষ্মরে মারা যেমন সম্ভব না তেমনি সম্ভব না গুরু দ্রোণেরেও আঘাত করা। আপনে বরং দ্রুপদের দুই পোলা শিখণ্ডী আর ধৃষ্টদ্যুম্নরে খাড়া করেন এই দুইজনরে ঠেকাইতে। যদিও শিখণ্ডী আর ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণেরই শিষ্য কিন্তু তাগো যেমন চোখের পর্দা নাই তেমনি দ্রোণের শিষ্য হইবার কারণে তারা দ্রোণের দুর্বলতাও জানে…

দ্বিতীয় দিন পাণ্ডবগো লগে ভীষ্ম আর দ্রোণের কিছু তিরাতিরি হইলেও দুই পক্ষই দুই পক্ষরে এড়াইয়া চলে কৌশলে। অর্জুন শুরু করে সেনাসৈনিক মারা। দুর্যোধন গিয়া ভীষ্মরে কয়-  আপনের লাইগা আমার দোস্ত কর্ণ ঘরে বইসা খায়; আর আপনে যুদ্ধ করতে আইসা ভাগেন অর্জুনের ডরে…

দুর্যোধনের গুতা খাইয়া ভীষ্ম গিয়া আবার অর্জুনের লগে কিছু তিরাতিরি করেন। ভীম কলিঙ্গের রাজা শতায়ু আর তার পোলাপান প্রায় সবাইরেই শুয়াইয়া ফালায়। সেইটা ঠেকাইতে আইসা রথের ঘোড়া মাইরা ভীমরে থামাইতে গেলে ভীম গদাম দিয়া ভীষ্মের সারথি শুয়াইয়া তার লগে সত্যি সত্যি যুদ্ধ শুরু কইরা দিলে তিনি রথ ছাইড়া ঘোড়ায় চাইপা দেন সটান…

তিন নম্বর দিনে ভীম তির মাইরা দুর্যোধনরে তার নিজের রথের উপর ফালাইয়া দেয় অজ্ঞান কইরা। তার উপরে তার গদামের চোটে সৈন্যসামন্ত পুরাই ছত্রখান। জ্ঞান ফিরা পাইয়া দুর্যোধন ভীষ্মরে কয় আপনে আমারে আগেই কইতে পারতেন যে পাণ্ডব- সাত্যকি আর ধৃষ্টদ্যুম্নের লগে যুদ্ধ করতে আপনে ডরান। আপনে দ্রোণ আর কৃপাচার্য অত ডরালুক জানলে আমি আপনাগো লগে যুদ্ধের প্লান না কইরা কর্ণের লগেই করতাম। আপনেরা কেউ যুদ্ধ যেমন জানেন না; তেমনি লড়াই করার সাহসও নাই কারো…

দুর্যোধনের খোঁচায় ভীষ্ম আবার শুরু করেন খ্যাপা যুদ্ধ। অর্জুনের লগে একেবারে সত্যি সত্যি যুদ্ধ। খ্যাপা ভীষ্মরে দেইখা অর্জুন বেকুব বইনা যায়। রথ ঘুরাইয়া- ঘোড়া দাবড়াইয়া কৃষ্ণ অর্জুনরে। বাঁচাইতে পারলেও অর্জুন কাবু হইয়া পড়ে। ভীষ্মের তিরে অর্জুনরে ঘায়েল হইতে দেইখা পাণ্ডব পাঞ্চাল সৈনিকরা শুরু করে পলায়ন। সাত্যকি পিছন থাইকা ডাইকাও কাউরে ফিরাইতে পারে না। শেষে অবস্থা বেগতিক দেইখা যুদ্ধ করব না এই প্রতিজ্ঞায় মাঠে নামলেও নিজের চক্র নিয়া গিয়া কৃষ্ণ খাড়ায় ভীষ্মের সামনে…

কৃষ্ণরে অস্ত্র তুলতে দেইখা ভীষ্ম ধনুক নামাইয়া হাসেন- তুমি না কইছিলা যুদ্ধ করবা না? কৃষ্ণ কয়-  তির খাইয়া মইরা গেলে মুখের কথার কী দাম?

কৃষ্ণ আগাইয়া যায় ভীষ্মের দিকে। দৌড়াইয়া গিয়া তার পায়ে পইড়া অর্জুন কৃষ্ণরে থামায়। ভীষ্মের হাত থিকা অর্জুনরে বাঁচাইয়া দেয় কৃষ্ণ আর কৃষ্ণের হাত থিকা ভীষ্মরে বাঁচায় অর্জুন। মারামারি কাটাকাটি চলতে থাকে মাঠের অন্য দিকে; এই দিকে দাদায়-নাতিতে আবার সমঝোতা ভাগাভাগি হয়…

যুদ্ধের চাইর নম্বর দিনটাও ভীমের। ভীমের গদামে পুরা একদল কুরুসেনা যুদ্ধ ছাইড়া পলায়। পরে ভীষ্ম আইসা ভীমেরে ঠেকান। ভীমের লগে যুদ্ধে এখন ভীষ্ম অনেক বেশি সতর্ক। এই মাকুন্দা দাদাফাদা বোঝে না; গদার পুরা শক্তি দিয়াই বাড়িখান মারে। ভীমের লগে ভীষ্মের লড়াইর ফাঁকে। দুর্যোধন তির মাইরা ভীমেরে অজ্ঞান কইরা ফালায়। কিন্তু হুশ ফিরা পাইয়া সে শল্যরে পিডাইয়া মাঠ ছাড়া করে। আর মাটিতে পাইড়া ফালায় ধৃতরাষ্ট্রের আট আটটা পোলারে; জলসন্ধ-সুষেণ- উগ্র অশ্ব- কেতু- বীরবাহু- ভীম আর ভীমরথ…

ভীমেরে আটকাইতে আসে ভগদত্ত। ভগদত্তের হাতি বাহিনীর সামনে ভীম এক্কেবারে বেকায়দায় পইড়া রথের ডান্ডা ধইরা ঝুইলা বাঁচার উপায় খোঁজে। বাপেরে এমন ডান্ডাঝোলা দেইখা ভগদত্তের সামনে আইসা খাড়ায় ঘটোৎকচ। এই ঘটোৎকচের যুদ্ধকলায় আর্যাবর্তের সকলেই দারুণ আনাড়ি। বাকিরা বাকিদের শিক্ষার ঘরানা জানে বইলা আক্রমণের কৌশলও যেমন জানে; ঠেকানোর কায়দাটাও জানে। কিন্তু সম্পূর্ণ হড় কৌশলের এই মায়াযোদ্ধার কোনো কায়দা সম্পর্কেই কারো কোনো ধারণা নাই। জঙ্গলে পশুর লগে যুদ্ধ করা ঘটোৎকচ বাহিনী হাতি সোয়াররে আক্রমণ না কইরা শুরু করে হাতির শুড়ের মইদ্যে তির আর বর্শা বিন্ধানো; আর লগে লগে শুরু হয় হাতি বাহিনীর আউলাঝড়া দৌড়…

ঘটোৎকচের হাত থিকা ভগদত্তরে রক্ষা করতে আইসা দ্রোণ ভীষ্ম নিজেরাই ফাইসা পড়েন। ঘটার হাত থিকা ভগদত্তরে বাঁচাইবেন নাকি নিজেরা বাঁচবেন তার কূলকিনারা না পাইয়া শেষ পর্যন্ত ভীষ্ম সূর্য ডোবার আগেই সেই দিনের মতো যুদ্ধবিরতি ঘোষণা কইরা বসেন…

পাঁচ নম্বর দিনের অবস্থাও চাইর নম্বর দিন থাইকা ফারাক করে না খুব। ভীম আর তার পোলায়ই পিটাইতে থাকে সমানে। ভূরিশ্রবার হাতে মারা পড়ে সাত্যকির দশ পোলা। ভীষ্মের হাতে কিছু পাণ্ডব সৈনিক মরে। ছয় নম্বর দিনেও ভীম দাবড়ায়; একবার তির মাইরা দুর্যোধনরে বেহুঁশও কইরা। ফালায়। পরে কৃপাচার্য রথে তুইলা নিয়া দুর্যোধনরে বাঁচান। অভিমন্যু আর দ্রৌপদীর পোলাগো হাতে মারা পড়ে ধৃতরাষ্ট্রের চাইর পোলা; বিকর্ণ-দুর্মুখ-জয়সেন আর দুষ্কর্ণ। চাইর নম্বর দিন যুদ্ধ শেষ হইয়া গেছিল সূর্য থাকতে থাকতেই। ছয় নম্বর দিন যুদ্ধ গড়ায় সূর্যাস্তেরও কিছুক্ষণ পর…

কিন্তু এমন দুঃখ কই রাখে দুর্যোধন। যার গদাগদি করার কথা সেই ভীম নাকি তারে তির মাইরা কাবু কইরা ফালাইল দুই দুইবার। সে দৌড়াইয়া যায় ভীষ্মের কাছে-আপনে হাতপা গুটাইয়া বইসা আছেন বইলাই এই দুর্দশা আমার…

ভীষ্ম কন- হাত পা ছড়াইয়াই বা করবটা কী? পাণ্ডবপক্ষে যারা আছে তাগো লগে পাইরা উঠা অত সোজা না। ভীম অর্জুন তো দূরের কথা; ভীমের পোলা ঘটারে ঠেকাইতেই জান বাইরাইয়া যাইতাছে সবার। তোমার লাইগা আমি সর্বোচ্চ যা করতে পারি তা হইল জানের মায়া বাদ দিয়া যুদ্ধ করা। যাও কথা দিলাম; কাইল থাইকা জানের মায়াটাও ছাইড়া দিলাম…

দুর্যোধন যখনই গুতা দেয় তখনই নিজের বাহাদুরি দেখাইতে ভীষ্ম গিয়া খাড়ান অর্জুনের সামনে। সাত নম্বর দিনেও হইল তাই। কিন্তু সেই দিন কৃষ্ণের খেইপা উঠা দেখে আইজ আর অর্জুনের লগে সত্যি সত্যি যুদ্ধে যান না তিনি। কৃষ্ণরে বিশ্বাস নাই। যুদ্ধ করব না কইয়া গা বাঁচাইয়া থাকলেও সময়মতো ঠিকই আইসা সে যুদ্ধে যোগ দেয়। তাই দুর্যোধনরে দেখাইবার লাইগা কতক্ষণ তিনি অর্জুনের লগে তিরাতিরিই করেন। অন্য দিকে দ্রোণের হাতে মারা যায় বিরাটের পোলা শঙ্খ। সাত্যকির দাবড়ানি খাইয়া মাঠ ছাড়ে অলঘুষ আর আইজ ঘটোৎকচরে ঠাঠা প্যাদানি দিয়া যুদ্ধক্ষেত্র থাইকা ভাগাইয়া দেয় ভগদত্ত…

অর্জুন-উলুপীর পোলা ইরাবান মাইর দেয় অবন্তি দেশের বিন্দু আর অনুবিন্দু বাহিনীরে। আর নকুল সহদেব তাগো মামা শল্যের লগে খেলাখেলা কিছু যুদ্ধও কইরা নেয় ফঁকতালে এই দিন…

দ্রৌপদীর ভাই শিখণ্ডী গিয়া খাড়ায় ভীষ্মের সামনে। কিন্তু ভীষ্মের অস্ত্রপাতি আর চেহারা দেইখা দেয় পিছটান। সেইটা দেইখা যুধিষ্ঠির কয়-  তুমি না পণ করছিলা যে ভীষ্মরে মারবা? এখন পলাইতাছ ক্যান? যুধিষ্ঠিরের খোঁচা খাইয়া শিখণ্ডী আবার আগাইয়া যায় ভীষ্মের দিকে কিন্তু মাঝখান থাইকা বাগে পাইয়া শল্য তারে ভালোই পিটানি দেয়। সেইটা হজম কইরা শিখণ্ডী আবার ভীষ্মের সামনে পৌঁছাইতে পৌঁছাইতে সূর্য অস্ত গিয়া সেই দিনের মতো যুদ্ধ শেষ হইয়া যায়…

আট নম্বর দিনে ভীমের হাতে মরে ধৃতরাষ্ট্রের আরো আট পোলা; সুনাভ-অপরাজিত-কুণ্ডধার পণ্ডিত-বিশালাক্ষ-মহোদর-আদিত্যকেতু আর বস্নাশী। এইটা দেইখা দুর্যোধন আবার গিয়া ধরে ভীষ্মরে- আপনে আসোলে কোনো বালও ছিঁড়তাছেন না আমাগো লাইগা…

ভীষ্ম কন- কী ছিঁড়ার আছে না আছে জানি না। কিন্তু একটা সত্য কথা হইল যে ভীমের হাত থিকা তুমি আর তোমার ভাইগোরে ভগবানেও বাঁচাইতে পারব না। ভীম ধৃতরাষ্ট্রের পোলাগো যারে পাইব তারেই মারব; সুতরাং তোমারে কই; মরার কথা মাথায় রাইখা ঠান্ডা মাথায় যুদ্ধ করো; তাতে যদি কিছু হয়…

এই দিন অর্জুনের পোলা ইরাবান শকুনির ছয় ভাইরে মাইরা শেষ পর্যন্ত গিয়া মইরা যায় অলঘুষের হাতে। যুদ্ধে পাণ্ডব বংশের পয়লা সন্তানের মৃত্যু এইটা। কাকাতো ভাইরে মরতে দেইখা পাগলা খ্যাপা খেইপা উঠে ভীম-হিড়িম্বার পোলা ঘটোৎকচ। স্বয়ং দুর্যোধন ঘটোৎকচরে সামলাইতে আইসা বেসামাল হইয়া পড়ে। দুর্যোধনরে বাঁচাইতে আইসা ঘটার হাতে নিজের ধনুকটাও হারাইয়া ফেলেন ধুনর্বিদ্যার গুরু দ্রোণ। বাপেরে বাঁচাইতে আইসা ঘটার হাতে ডবল পাদানি খায় অশ্বত্থামা। তিনজনরে আড়াল দিতে আইসা থাবড়ানি খায় মদ্ররাজ শল্য আর ঘটোৎকচের হাতে কুরুবীর দ্রোণ দুর্যোধন শল্য অশ্বত্থামার দুর্দশা দেইখা কুরু সৈনিকরা শুরু করে পলায়ন। ভীষ্ম আর সঞ্জয় তাগোরে পিছন থাইকা ডাকেন কিন্তু সৈনিকরা ভাগতে ভাগতে কয়-  বেতন না দিলে নাই; কিন্তু এর সামনে যাইতে কইয়েন না মোদের…

দুর্যোধন দৌড়াইয়া যায় ভীষ্মের কাছে- দাদাজান কিছু করেন। আমি তো অত দিন খালি ভীমের হিসাব করতাম। কিন্তু এখন দেখি ভীমের পোলায়ই আমাগো পিডাইয়া যুদ্ধ শেষ কইরা ফালাইব। কিছু করেন দাদাজান… ভীষ্ম কন-পোলাপাইনগো রক্ত গরম; গায়ে-গতরে শক্তিও বেশি; ফুসফুসে জিগরও বেশি। তুমি বরং তোমার বয়সী যুধিষ্ঠির আর তার ভাইগো লগেই যুদ্ধ কইরো। ভাতিজা টাতিজা জাতীয় জোয়ান পোলাপানগো সামনে তোমার না যাওয়াই ভালো…

কুরু বাহিনীর একমাত্র ভগদত্তই ঘটোৎকচরে কাবু করতে পারছিল যুদ্ধের সাত নম্বর দিন। তাই ভীষ্ম গিয়া ভগদত্তরে তেলান- আপনে ছাড়া ভীমের পোলারে সামলানোর কেউ নাই; আপনে একটু আউগান জংলিটার দিকে…

ভগদত্তের হাতে গতকাল মাইর খাইয়া তারে সামলানোর কৌশল বাইর কইরা ফালাইছে ঘটোৎকচ। আইজ আর ঘটার সাথে সুবিধা করতে পারে না ভগদত্ত। ঘটা সমানে পিটাইতে থাকে তারে। পিটাপিটি কইরা আবর্জনা সরানোর কাম আছিল ভীমের। কিন্তু বাপের কাম পোলায় কইরা ফালাইতাছে দেইখা ভীম গদা থুইয়া তির নিয়া খেলানেলা করতে করতে ধৃতরাষ্ট্রের আরো সাত পোলা; অনাবৃষ্টি-কুণ্ডভেদী- বিরাজ-দীপ্তলোচন-দীর্ঘবাহু- সুবাহু আর কনকধ্বজরে মাইরা ফালায়…

অন্য দিকে পোলা ইরাবানের মরার সংবাদ শুইনা অর্জুন ভীষ্ম আর কৃপরে আক্রমণ কইরা বসে। কিন্তু ততক্ষণে সূর্যও ডুইবা যায় আর যুদ্ধও শেষ হইয়া যায়…

রাত্তির বেলা দুর্যোধন আবার সকলরে ধাতায়; ভীষ্ম- দ্রোণ-কৃপ- শল্য- ভূরিশ্রবা কেউই যুদ্ধের কোনো বালও বোঝেন না…

কর্ণ কয়-  ভীষ্ম না জানেন যুদ্ধ; না আছে তার শইলে অস্ত্র চালানোর শক্তি। আবার অন্য দিকে আমারেও যুদ্ধ করতে দিবেন না তিনি। তুমি ভীষ্মরে কও অস্ত্র ছাইড়া দিতে। তাইলে আমি পাণ্ডবগো টাইট দিতে পারি…

কর্ণের এত বড়ো খোঁচা হজম করা ভীষ্মের পক্ষে কঠিন। তিনি দুর্যোধনের দিকে তাকান- খাড়াও যুদ্ধ কারে কয় কাইল দেখামু আমি…

নয় নম্বর দিন ভীষ্ম সত্যিই যুদ্ধ দেখান। তছনছ কইরা দেন পাণ্ডবগো। শিখণ্ডীও কোনো সুবিধা। করতে পারে না। কৃষ্ণ অর্জুনরে টাইনা নিয়া যায় ভীষ্মের সামনে কিন্তু ভীষ্মের মাইরে অর্জুন কাহিল হইয়া পড়লে আবারও যুদ্ধ না করার প্রতিজ্ঞা ভাইঙ্গা; রথের চাকা তুইলা ভীষ্মরে দাবড়ানি দিয়া; গায়ে তির খাইয়া অৰ্জুনরে বাঁচাইতে হয় কৃষ্ণের। এই দিন অবশ্য অর্জুন-সুভদ্রার পোলা অভিমন্যু ভালোই দাবড়ায় কৌরবগো; অলম্বুষও পলায় অভিমন্যুর হাতে মাইর খাইয়া। কিন্তু তার পরেও দিনের শেষে এক্কেবারে ভাইঙ্গা পড়ে যুধিষ্ঠির- কোন আক্কেলে যে আমি ভীষ্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিছিলাম। কৃষ্ণ; ভাইরে যুদ্ধটুদ্ধ বাদ দে। আমি বনে যামু। বনবাসই আমার লাইগা ভালো…

কৃষ্ণ কয়-  ঘাবড়াইয়েন না বড়ো ভাই। কাইল একটা ব্যবস্থা করব ভীষ্মের। ধৈর্য ধইরা খাড়া থাকেন…

বুইড়া মানুষের হুঁশবুদ্দি ঠিক নাই। নাতিগো লাইগা তার মায়া মমতাও যেমন আছে তেমনি তাগোরে মারতেও চান না তিনি; কথাখান ঠিক। কিন্তু যখনই দুর্যোধনের ধাতানি খান তখনই পাণ্ডবগো লাইগা মায়াটায়া ভুইলা সত্যি সত্যি মারামারি শুরু করেন। এইরকম দুপেলুয়া মাইনসেরে ভরসা করা কঠিন। ইনারে পাইড়া ফেলাই সব থিকা ভালো; যদিও ইনি পড়লে কর্ণ নামব যুদ্ধে; সেইটা আরো ভয়ানক। কিন্তু কর্ণের ক্ষেত্রে একটা সুবিধাও আছে; কর্ণের কাছ থিকা কেউ মায়ার মাইর যেহেতু আশা করে না; সেহেতু তার সামনে অসতর্কও থাকব না কেউ। কিন্তু এই বুইড়ারে দাদা বইলা কাছে গেলে তিনি শত্রু হইয়া মারেন তির। এইরকম চেমা দোস্ত থাইকা কড়া শত্রু কর্ণ বহুগুণ ভালো…

অর্জুন নরম দিলের মানুষ। দাদা ভীষ্মরে টারগেট করতে অর্জুনের হাত কাঁপে কৃষ্ণ তা জানে। তাই অর্জুনরে পিছনে রাইখা দশ নম্বর দিনে ভীষ্মের সামনে কৃষ্ণ শিখণ্ডীরে পাঠায়- আইজ ভাগলে কিন্তু খবর আছে তোর…

শিখণ্ডী চোখ বন্ধ কইরা তির চালায় বুড়া ভীষ্মের গায়ে। ভীষ্মরে যারাই বাঁচাইতে আসে তাগোরে পিছন থাইকা ঠেকায় অর্জুন। শিখণ্ডীর এমন ঝাড়া আক্রমণে ধুপ কইরা রথ থাইকা পইড়া যান। গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম। ভীষ্মের পতনে যুদ্ধ থাইমা যায়। কুরুপক্ষে শুরু হয় হাহাকার আর পাণ্ডবপক্ষে মাটি দাপাইয়া নাচে ভীম-বুড়া হাবড়া তবে শুইছে অত দিনে…

দুই পক্ষের নরম দিলের সকলে গিয়া খাড়ায় মাটিতে পইড়া থাকা ভীষ্মের সামনে। অর্জুন কাইন্দা কাইট্টা নিজের তিরের ঝুড়ি ভীষ্মের মাথার নিচে দিয়া বালিশ বানায়। ভীষ্ম হাসেন-একটা যোদ্ধারে তার উপযুক্ত বালিশই তুমি দিলা নাতি…

ভীষ্মের চিকিৎসা চলতে থাকে কিন্তু কেউই আশা করে না যে এত তির খাওনের পর এমন লেতর মানুষটা আবার উইঠা খাড়া হইতে পারে। তিনি পইড়া মরণের অপেক্ষা করেন আর দুর্যোধনের হাত ধইরা কন- যুদ্ধ করিস না ভাই…

কান্দাকাটি কইরা সকলে চইলা গেলে ভীষ্মের পা ছুঁইয়া নিঃশব্দে আইসা খাড়ায় কর্ণ- আপনি যারে দুই চোখে দেখতে পারেন না; আমি সেই রাধাপুত্র কর্ণ…

ভীষ্ম দেইখা লন তার আশেপাশে আর কেউ আছে কি না; আছে খালি কিছু সেনাসৈনিক। তিনি তাগোরে দূরে সরতে কইয়া কর্ণের হাত জড়াইয়া ধরেন- আমি জানি তুমি কুন্তীর পোলা। তুমি পাণ্ডবগো পছন্দ করো না আর দুর্যোধনের দোস্ত তাই তোমারে ছুডু করার লাইগাই এত বাজে কথা কইতাম। কিন্তু আমি ভালো কইরাই জানি যে তোমার যুদ্ধকৌশল আর শক্তি কৃষ্ণের সমান কিংবা তার থিকাও বেশি। যত যাই হোক; পরশুরামের শেষ শিষ্য তুমি। তোমার ধ্বংস-ক্ষমতাও আমি জানি। তাই মরারকালে তোমার কাছে আমার মিনতি; আমার মরার মধ্য দিয়াই যেন সব অশান্তির শেষ হইয়া যায়। পাণ্ডবরা তোমার ভাই। তোমারে অনুরোধ করি; তুমি তাগো লগে মিলা যুদ্ধটা বন্ধ কইরা দেও…

কর্ণ কয়- কুন্তীর পোলা হইতে আমারে কইয়েন না আপনে। রাধার পোলা হিসাবে যেমন বাঁইচা। আছি; মরলেও যেন মরি রাধার পোলা হিসাবেই। আর আমার জীবনের সব সম্মানই আমি পাইছি দুর্যোধনের কাছে; তার লাইগা আমি জীবনটাও দিতে রাজি। বুড়া হইয়া রোগে ভুইগা মরার ইচ্ছা আমার নাই। গায়ে শক্তি থাকতে যেন যুদ্ধেই মরি সেই আশীর্বাদ করেন…

তিন কূলে মূলত নির্বংশ ভীষ্মের কেউ নাই। এই সব কুরু-পাণ্ডব নাতিটাতি সব তার সত্য সত্যবতীর পোলার বংশধর। তিনি মিত্র থাকলে শক্তি বাড়ে তাই কুরু বংশ তারে মাথায় তুইলা রাখে। তিনি শত্রু হইলে বিপদ বাড়ে তাই পাণ্ডব বংশ তারে তেলায়। কিন্তু দুই পক্ষই যখন দেখে ভীষ্মের শত্রুতা-মিত্রতা দুইটারই দিন শেষ; তখনই সইরা পড়ে সব। আর তিরের জ্বালা নিয়া মাঠের এক কোনায় ছাপড়ার নিচে শুইয়া মৃত্যুর অপেক্ষা করেন শান্তনুর নিঃসঙ্গ সন্তান দেবব্রত ভীষ্ম…

.

১৬

কর্ণ কুরুপক্ষের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা তাই পাণ্ডবপক্ষের প্রধান শত্রুও সে। তার পণ আছিল ভীষ্ম না মরলে অস্ত্র তুলব না। এই কারণে ভীষ্মরে না মাইরা আধমরা কইরা রাখছে পাণ্ডবরা। কিন্তু মনে হয় কর্ণ তার পণ কিছু বদলাইছে অথবা ভীষ্মের পতনরেই মরণ হিসাবে ধইরা নিয়া যুদ্ধে নামছে সে। সেইটা যাই হউক কিন্তু যুদ্ধের পয়লা দশ দিন তার প্রতিজ্ঞার সুযোগ পাণ্ডবরা পুরাটাই নিছে। একলা ভীষ্ম পয়লা দশ দিন পাণ্ডবগো যে পরিমাণ নাড়াইছেন; তার লগে যদি যোগ হইত কর্ণের আগ্রাসন তয় অত দিনে নিভা যাইত পাণ্ডবগো চিতার আগুন। অবশ্য এখনো কর্ণ থিকা আরো কিছু সুবিধা পাইব পাণ্ডবজনে। অর্জুন ছাড়া বাকি পাণ্ডবগো কাউরেই হত্যা করব না সে; কেউ না জানলেও কুন্তী জানে এই কথা মাতা কুন্তীরে সে দিছে…

অত দিন ভীষ্ম আছিলেন কৌরবগো প্রধান সেনাপতি। দুর্যোধন কর্ণরে জিগায়। কর্ণ দ্রোণের নাম কয়-  তুমি দ্রোণাচার্যরে প্রধান করো; অন্য কাউরে করলে দ্রোণ আনুগত্য দিবেন না…

কুরুপক্ষে দ্বিতীয় প্রধান সেনাপতি হইলেন ভরদ্বাজপুত্র দ্রোণাচার্য; ভীষ্ম যেমন আছিলেন পরশুরামের ছাত্র; দ্রোণও তাই। কিন্তু দুইজনের মূল তফাতটা হইল; ভীষ্ম আছিলেন যোদ্ধা; বহু যুদ্ধ করছেন তিনি; বহু সেনা চালাইছেন জীবনে। কিন্তু দ্রোণ অস্ত্রগুরু অস্ত্রবিশারদ; অস্ত্রশিক্ষা দিতেন; কিছুকাল ধরে রাজাগিরিও করেন। কিন্তু জীবনে কোথাও কোনো যুদ্ধ তিনি করেন নাই কুরুযুদ্ধের আগে। ভীষ্মের অধীনে মাত্র দশ দিন যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়া তিনি হইলেন কুরুপক্ষের দ্বিতীয় প্রধান সেনাপতি…

সেনাপতি হইয়া বড়োই আপ্লুত দ্রোণ। দুর্যোধনরে কন- গাঙ্গেয় ভীষ্মের পর তুমি যে আমারে সেনাপতি বানাইছ তাতে আমি যে কী খুশি কেমনে তোমারে কই? কও বাপ; তুমি কী চাও আমার কাছে? যা চাইবা; তোমার জন্য তাই করব আমি… দুর্যোধন কয়-  বেশি কিছু করা লাগব না গুরুদেব। আপনে যদি খালি যুধিষ্ঠিররে আমার কাছে জ্যান্ত ধইরা আনতে পারেন তাইলেই হয়…

দ্রোণ একটু থতমত খাইয়া কন-তুমি যুধিষ্ঠিররে মারতে না কইয়া জ্যান্ত ধইরা আনতে কইলা; বিষয়টা আমারে একটু বুঝাও তো বাপ…

দুর্যোধন কয়-  যুধিষ্ঠিররে মারলে যে পাণ্ডব পাঞ্চালরা কিলাইয়া আমাগো ভর্তা বানাইব সেইটা তো দশ দিনেই টের পাইছেন। তার থিকা যদি যুধিষ্ঠিররে জ্যান্তা ধইরা আইনা আবার পাশা খেলায়। হারাইয়া বনে পাঠাইতে পারি তয় আন্ডাবাচ্চা নিয়া পাণ্ডবরা আবার সন্ন্যাসী হবে। এইটাই সব থিকা ভালো উপায়…

যা চাইব তাই দিবার কথা দিয়া চিপায় পড়েন দ্রোণ। পাণ্ডবগো যুদ্ধের যে নিশানা তাতে এখন পর্যন্ত যুধিষ্ঠিরের কাছে কেউই পৌঁছাইতে পারে নাই। দুর্যোধন কয় কি না তারে ধইরা আনো গুরুদেব…

দ্রোণ কথা ফিরানও না আবার কথা দেনও না। আমতা আমতা কইরা কন-আইজ আমি অবশ্যই যুধিষ্ঠিররে ধইরা তোমার কাছে দিমু তয় খালি অর্জুন যদি না তার আশেপাশে থাকে। বোঝোই তো অর্জুনের সামনে থাইকা যুধিষ্ঠিররে ধরা অসম্ভব…

কথাখান পৌঁছাইয়া যায় যুধিষ্ঠিরের কানে। অর্জুনরে ডাইকা কয়-  তুই ভাইরে ফালাইয়া আইজ সরিস না কোথাও। না হয় কোন ফিকিরে হয়ত গুরু আইজ আমারে বাইন্ধা নিয়া গিয়া পাশা খেলতে বসায় তা মোর কপালই জানে…

অর্জুন কয়-  ধইরা না হয় নিলেন। কিন্তু আপনে পাশা না খেললেই তো হয়…

যুধিষ্ঠির কয়-  এমন কথা কইস না ভাই। জানোসই তো পাশা খেলার প্রস্তাব ফিরাইতে পারি না মুই…

অর্জুন কয়-  সমস্যা নাই। তিনারে হত্যা করতে আমার আপত্তি হইলেও দাবড়ানি দিতে কোনো অসুবিধা নাই। ডরাইয়েন না…

এগারো নম্বর দিনে দ্রোণশিষ্য ধৃষ্টদ্যুম্ন আটকাইয়া রাখে গুরুরে বহুক্ষণ। শিষ্যের ঘাট পার হইয়া দ্রোণ মুখামুখি হন ধৃষ্টদ্যুম্নপিতা আর নিজের বাল্যবন্ধু দ্রুপদের; যে কি না আবার দ্রোণপিতা ভরদ্বাজের শিষ্য। অভিমন্যু বৃহদবলের ভুড়ি মাটিমাখা কইরা জয়দ্রথরে নাকানি-চুবানি দেওয়া শুরু করলে শল্য আইসা তারে ঠেকান। অভিমন্যুর আক্রমণে শল্যের সারথি মরলে শল্য অভিমন্যুর লগে গদাগিরি করতে যায় আর ভীম আইসা অভিমন্যুরে কয়-  ঘটোৎকচ আমার অর্ধেক কাম সাইরা ফালাইতাছে লাগাইয়া-কিলাইয়া। এখন তুমি ভাতিজাও যদি গদাগিরি করো তয় আমার তো যুদ্ধে। রিটায়ার নিয়া আবার বাবুর্চির কাম নিতে হয়। তুমি রেস্ট করো। বেইমান মামুর হাড্ডিরে আমিই বরং পাঞ্জিপুঁথি ছাড়া অমাবস্যা-পূর্ণিমা চিনাই…

শল্য কিন্তু নাদান না। ভীমের গদামে সে মাটিতে পইড়া হাঁপাইতে লাগলেও ভীমেরেও সে মাটিতে পাইড়া ফালায়। ভীম উইঠা খাড়ায় কিন্তু ততক্ষণে কৃতবর্মা নিজের রথে কইরা শল্যরে নিয়া পলায়…

ভীষ্মের অভাব এক দিনেই বোঝে কুরুক্ষেত্রের মাঠ। পাণ্ডবপক্ষের সকলেই কমবেশি পিটাইতে থাকে কুরু সেনাসৈনিক। পাণ্ডবগো মাইর খাইয়া নেতৃত্বহীন কুরু সৈন্যরা পলায় যে যে দিকে পারে। নয়া সেনাপতি দ্রোণ এরে ডাকে তারে ডাকে কিন্তু কে শোনে কার ডাক। এমন অবস্থায় নিজের নেংটি বাঁচাইতে দ্রোণ চিক্কর দিয়া কন- তোমাগো পলাইবার যেমন কোনো কারণ নাই; তেমনি যুদ্ধ করারও দরকার নাই। তোমরা খাড়াইয়া দেখো আমি একলাই কেমনে যুধিষ্ঠিররে বন্দি কইরা যুদ্ধের ইতি টাইনা দিতাছি দুর্যোধনের পক্ষে…

সকলে খাড়াইয়া এইবার সত্যি তামাশা দেখে। দ্রোণ বাহাদুরি দেখাইতে যুধিষ্ঠিরের দিকে আগাইতে গিয়া পয়লা চোটেই বুকে তির খায় যুধিষ্ঠিরের দেহরক্ষী কুমারের হাতে। তার পরেও দ্রোণ আগায়। তার হাতে মারা পড়ে অগ্রবর্তী দলের ব্যঘ্রদত্ত আর সিংহসেন। এমন সময় দ্রোণের সামনে আইসা খাড়ায় অর্জুন। অর্জুনরে দেইখা দ্রোণ পিছনের রাস্তা মাপতে মাপতে সূর্যাস্ত হইবার আগেই ঘোষণা কইরা দেন যুদ্ধের সমাপ্তি…

যুদ্ধের এগারো নম্বর দিনটা আছিল কর্ণের পয়লা দিন। এই দিন কিছু খুচরা সৈন্য মারা আর রাজা বিরাটের লগে তিরাতিরি কইরা হাতের জাট ভাঙ্গা ছাড়া কিছুই করে না সে। তার পোলা বৃষসেন বরং এই দিন বাপের থাইকা বেশিই কোপায়…

রাত্তির বেলা দ্রোণ দুর্যোধনের কাছে মিনমিন করেন- আমি আগেই কইছিলাম অর্জুন থাকলে যুধিষ্ঠিররে আমি কিছু করবার পারব না। কিন্তু তুমি তো অৰ্জুনরে যুধিষ্ঠিরের কাছ থিকা সরাইবার কোনো ব্যবস্থা করতে পারলা না। তাই আবারও কই; কেউ যদি অর্জুনরে যুদ্ধে চ্যালেঞ্জ দিয়া সরাইয়া নিয়া যায়; তাইলে আমি কিন্তু সত্যি সত্যি যুধিষ্ঠিররে ধইরা আনতে পারি…

কথাখান লুইফা নেয় ত্রিগর্তরাজ সুশৰ্মা আর তার ভাইয়েরা; যারা রাজা বিরাটের গরু চুরি করতে গিয়া পাণ্ডবগো প্যাদানি খাইছিল অজ্ঞাতবাসের শেষ দিকে। সুশর্মা কয়-  হয় দুনিয়াতে অর্জুন থাকব; না হয় থাকব ত্রিগর্তজাতি; এই পণ করলাম আমরা। আমাগো সংশপ্তক বাহিনী কাইল হয় অর্জুনরে মারব না হয় মরব অর্জুনের হাতে। এইবার বাকিদের আপনেরা সামলান গুরু দ্রোণ…

বারো নম্বর দিনে সংশপ্তক ত্রিগর্ত বাহিনী মাঠের দক্ষিণ দিক থাইকা অর্জুনরে চ্যালেঞ্জ দিয়া বসে। কেউ চ্যালেঞ্জ দিলে যদি না নেওয়া হয় তবে তো মান-সম্মানের বিষয়। অর্জুন কয়-  ভাইজান জানের থাইকা বড়ো মান। আমারে তো এখন যাইতেই হয় ত্রিগর্ত বাহিনীর ডাকে…

যুধিষ্ঠির কয়- তুই যাইতে চাইলে আমার লাইগা একটা ব্যবস্থা কইরা যা; যাতে দ্রোণের খপ্পরে না পড়তে হয় আমার…

অর্জুন পাঞ্চাল বংশীয় সত্যজিৎরে দেখাইয়া কয়-  আইজ সত্যজিৎ আপনেরে আগলাইয়া রাখব। আর যদি সত্যজিৎ মইরা যায়; তয় আপনি ভাগল দিয়েন। যা করার বাকিটা করব পরে…

সংশপ্তকরা পুরাটাই ভুজুং। মশামাছির মতো মরতে থাকে অর্জুনের বাণে। তির খাইয়া প্রতিজ্ঞা টতিজ্ঞা ভুইলা ভাগতে থাকে সুশর্মার বাহিনী সংশপ্তক। পরে এদের সাপোর্ট দিতে পিছে আইসা খাড়ায় কৃষ্ণের কাছ থিকা দুর্যোধনের ভাড়া করা নারায়ণী সেনা। এরাও মরে পঙ্গপালের মতো…

অর্জুন মারতাছে। কিন্তু সংখ্যায় তারা বহু তাই অর্জুনরে ব্যস্তই থাকতে হয় দক্ষিণে। এই সুযোগে দ্রোণ কোমর বাইন্ধা আগান যুধিষ্ঠিরের দিকে। তার লগে আছে দুর্যোধন আর তার ভাইবেরাদর; যাদব বংশীয় কৃতবর্মা; কৃপাচার্য-ভূরিশ্রবা শল্য- বিন্দু-অনুবিন্দু- সুদক্ষিণ- অশ্বত্থামা- জয়দ্রথ; হাতি বাহিনীসহ ভগদত্ত আর সকলের পিঠ বাঁচাইবার লাইগা সবার পিছে কর্ণ। মানে প্রায় পুরা কৌরব বাহিনী…

দ্রোণ বাহিনীরে পয়লা ঠেকায় ধৃষ্টদ্যুম্ন। আটকাইতে না পারলেও সে দ্রোণের বাহিনী ছত্রভঙ্গ কইরা দেয়। সত্যজিৎবহুক্ষণ দ্রোণরে আটকাইয়া মইরা গেলে অর্জুনের কথামতো যুধিষ্ঠির পলায়। এর ফাঁকে পাঞ্চাল কেকয় আর মৎস্য যোদ্ধারা দ্রোণরে ঘিরা ধরে। এক পর্যায়ে সাত্যকি- চেকিতান ধৃষ্টদ্যুম্ন- শিখণ্ডী সকলেই দ্রোণ বাহিনীর হাতে নাস্তানাবুদ হইতে থাকলে পাণ্ডব বাহিনী শুরু করে যুধিষ্ঠিরের মতো ভাগল। এই দেইখা দুর্যোধন করে কয়-  পাঞ্চালরা ভাগতাছে। এখন খালি ভীমের ভাগল দিবার বাকি…

কর্ণ কয়- ভুল হিসাব কইরো না দুর্যোধন। মাকুন্দা ভীম মইরা যাইতে পারে; কিন্তু ভাগব না; তারে ডর দেখানোও সম্ভব না। আমাগো বরং দ্রোণরে বাঁচাইবার লাইগা আগানো উচিত। নাইলে সবাই যেমতে তারে ঘিরা ধরছে তাতে দ্বিতীয় সেনাপতিরেও না আইজ তোমার হারাইতে হয়…

দ্রোণরে বাঁচাইতে আগাইল কর্ণ আর দুর্যোধন। অন্য দিকে হাতি বাহিনীসহ ভীমরে আক্রমণ কইরা বসে ভগদত্ত। কুরুক্ষেত্রের সবচে বড়ো হাতি বাহিনী দুর্যোধনের শ্বশুর ভগদত্তের। এই হাতিগুলা বর্মপরা হাতি। তির-বর্শার সামনেও এইগুলা দাবড়াইতে পারে। আর হাতিসোয়ার যোদ্ধার ক্ষেত্রে তির ছাড়া অন্য অস্ত্র প্রায় অচল। দূর থাইকা হাতির ডাক শুইনা অর্জুন কৃষ্ণরে কয়-  ভগদত্তরে। থামাইতে না পারলে আইজ হাতি দিয়া পাড়াইয়া সে আমাগো চ্যাপটা কইরা দিব। তুমি ভগদত্তের দিকে রথ ঘোরাও…

সুশৰ্মা আর সংশপ্তকেরা অর্জুনের পিছু ধাওয়া করলেও সে গিয়া খাড়ায় ভগদত্তের সামনে। অর্জুনরে দেইখা ভীম ছাইড়া ভগদত্ত আগাইয়া যায় অর্জুনের দিকে। অর্জুন না যত কৌশলী যোদ্ধা তার থিকা বড়ো কৌশলী সারথি কৃষ্ণ। ভগদত্ত হাতি নিয়া দাবড়ানি দেয় অর্জুনের রথে। কিন্তু হাতির সুবিধা যেমন তার দৌড়ের গতি আর শইলের ভার; তেমনি তার অসুবিধাও তাই। হাতি একবার দৌড় শুরু করলে তারে সহজে না যায় থামানো; না যায় ঘোরানো। সে এক ধাক্কায় বহুদূর গিয়া আস্তে আস্তে থামে…

হাতির দৌড়ের লাইন ছাইড়া কৃষ্ণ অর্জুনরে নিয়া খাড়া করে ভগদত্তের হাতির পিছনে আর ভগদত্তর হাতি থামবার আগেই তার বিচিতে ঢুইকা যায় অর্জুনের কয়েকটা তির…

হাতির বিচিতে গাঁথে তির; সেই তির নিজের রানে বাড়ি খাইয়া আবার গিয়া গুতায় সেই বিচিতেই।

এরই মাঝে উথাল-পাতাল হওয়া হাতির সোয়ার ভগদত্ত বর্শার এক নিখুঁত নিশানা কইরা বসে অর্জুনের দিকে। অর্জুন পুরা বেখেয়াল আর অসহায় আছিল এই বর্শায়। কিন্তু আঘাতটা ঠেকাইয়া দেয় কৃষ্ণ তার ঢালে…

ভগদত্তের মাহুত শেষ পর্যন্ত আর হাতি সামলাইতেই পারে না। হাতিটা থামতে গিয়া হুড়মুড় পইড়া গড়াগড়ি খায়। মাটিতে পইড়া ভগদত্ত নিজেরে সামলাইতে হামাগুড়ি দেয় আর অর্জুন কৃষ্ণরে কয় যুদ্ধ করবা না কইয়া তুমি কিন্তু আবারো যুদ্ধে অংশ নিলা ঢাল ব্যবহার কইরা…

কৃষ্ণ কয়- অংশ না নিলে ভগদত্তের এই বর্শা খাইয়া অতক্ষণে আমারে আর এই প্রশ্ন করার সুযোগ থাকত না তোমার। লও এইবার ভগদত্তরে গাঁথো…

বুকে এক তির খাইয়া দুর্যোধনের শ্বশুর ভগদত্ত আর উঠে না কুরুক্ষেত্রের মাঠে…

কর্ণের কথাই ঠিক। ভীম এখনো একবারের লাইগাও আড়ালে যায় নাই। কর্ণ দুর্যোধন আর অশ্বত্থামা আইসা উপস্থিত হইলে ভীম তাগোরেও আক্রমণ কইরা বসে। এতগুলা বড়ো যোদ্ধার লগে ভীম একলা লড়তাছে দেইখা শেষ পর্যন্ত সাত্যকি নকুল সহদেব আইসা তারে হাত দেয়। এই ফাঁকে ধৃষ্টদ্যুম্ন আবার দ্রোণরে আক্রমণ করে আর একটু পরে দক্ষিণ দিক সাফ কইরা দ্রোণের সামনে আইসা খাড়ায় অর্জুন। অর্জুনরে দেইখা দ্রোণ কর্ণরে ডাকেন অর্জুনরে ঠেকাইতে। কর্ণ অর্জুনরে ঠেকায় কিন্তু তার তিন ভাই মইরা যায় অর্জুনের হাতে। এর ফাঁকে ভীমের গদামে শুইয়া পড়ে আরো কয়জন…

সন্ধ্যায় দুর্যোধনের ধাতানি খাইয়া কোঁকায় দ্রোণ- কইছিলাম তো যুধিষ্ঠিররে ধইরা আনব। কিন্তু এইটাও তো কইছিলাম যে যদি অর্জুন তার আশেপাশে না থাকে। আইজ তো পিরায় তারে ধইরা ফালাইছিলাম। কিন্তু অর্জুন তো আইসা পড়ল শেষে…

–আপনার মতো যুদ্ধমূর্খরে সেনাপতি করাই ভুল হইছে। আপনার কারিগরি খালি মুখে…

দ্রোণ আরো বহুক্ষণ মিনমিন করে। তারপর আবারও সে পরের দিনের লাইগা প্রতিজ্ঞা ঝালাই করে দুর্যোধনের কাছে। তবে এইবার সে যুধিষ্ঠিররে ধইরা আনার কথা আর কয় না। কয়-  কাইল নিশ্চয়ই পাণ্ডবগো কোনো এক বড়ো বীর ফালামু আমি। এইটা নিশ্চিত। তোমারে কথা দিলাম…

দুর্যোধন খাকারি দেয়- পাণ্ডবগো বড়ো বীর তো অৰ্জুন আর ভীম। অর্জুনরে তো আপনে ডরানই। আর ভীম একলাই তো আইজ আপনাগো সন্ধ্যা পর্যন্ত পিটাইয়া তক্তা বানাইল। ঠিকাছে। দেখি কাইল কী ছিঁড়েন আপনে…

কর্ণ যে দুই দিন ধইরা যুদ্ধে নামছে; সেই দুই দিনই কৃষ্ণ অর্জুনরে দূরে দূরে রাখে। আবার সেনাপতি দ্রোণও কর্ণরে রাখেন সকলের পিছনে পিঠ বাঁচানোর কামে; কারণ পাণ্ডবগো যুদ্ধ পরিকল্পনার কোনো হিসাবই মিলাইতে পারছেন না তিনি…

তেরো নম্বর দিনেও অর্জুন দক্ষিণে যায় সংশপ্তকদের লগে যুদ্ধে। পাণ্ডববীর ধরার ফাঁদ বানাইতে দ্রোণ রচনা করেন চক্রব্যুহ। এইটা একটা গাণিতিক হিসাব। কোন দিকে আক্রমণ দেখাইব আর কোন দিকে আক্রমণ শানাইব তা বুঝতে শত্রুরা ধান্দায় থাকে সামনে আগাইতে আগাইতে। সৈনিকরা বহুদূর ঢুইকা যায় কিন্তু মূল আক্রমণটা আসে পিছন কিংবা অন্য অসতর্ক দিক দিয়া। সেনাবিন্যাস দেইখা কৌশল ঠিক করতে হয় চক্রব্যুহ মোকাবেলা করার। এই কামটা খুব ভালো জানে কৃষ্ণ অর্জুন কৃষ্ণের পোলা প্রদ্যুম্ন আর কিছুটা জানে অর্জুন-সুভদ্রার ১৭ বছর বয়সের পোলা অভিমন্যু…

দ্রোণের চক্রব্যুহ দেইখা ঘাবড়ায় যুধিষ্ঠির। অর্জুন দক্ষিণে গেছে; কৃষ্ণও গেছে তার লগে। এখন এই ব্যুহের ফান্দে পইড়া না সকলের প্রাণ যায়। যুধিষ্ঠির দৌড়াইয়া গিয়া অভিমন্যুর হাতে ধরে- আইজ তুই ছাড়া তোর বংশ রক্ষার আর কেউ নাই বাপ…

অভিমন্যু কয়-  আমি যাইতে পারি কিন্তু ফান্দে পইড়া গেলে কেমনে এর থাইকা বাইর হইতে হয় সেইটা তো আমার জানা নাই জ্যাঠা… যুধিষ্ঠির কয়- তুই ভাঙ্গতে পারলেই হবে। তোর পিছে পিছে আমরা গিয়া তোরে সাপোর্ট দিমু…

অভিমন্যু সামনে আর পিছনে বাকি পাণ্ডবেরা- ভীম নকুল সহদেব যুধিষ্ঠির। অভিমন্যু ব্যুহ ভেদ কইরা ঢুইকা পড়ে দ্রোণ সৈনিকের ভিতর; কিন্তু ঠিক তখনই সে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে কাকা-জ্যাঠার বাহিনী থিকা। এইটাই এই ব্যুহের কৌশল। একজন একজন কইরা আটকাইয়া কতল করা।

অভিমন্যুরে ব্যুহে ঢোকার সুযোগ দিয়া অগ্রবর্তী দলের জয়দ্রথ বন্ধ কইরা দেয় বাকি পাণ্ডবগো ঢোকার পথ…

ব্যুহের ভিতরে ঢুইকা অভিমন্যু দেখে কৌরবপক্ষের সকল বড়ো যোদ্ধার সামনে সে এক্কেবারে একা।

সমানে আক্রমণ করতাছে দুর্যোধন দ্রোণ অশ্বত্থামা কৃপাচার্য কর্ণ শল্য…

শল্য বইসা পড়ে অভিমন্যুর তির খাইয়া। শল্যের ভাই যায় মইরা। এই দেইখা ঘাবড়াইয়া যায় দ্রোণ। কৃপাচার্যের কাছে গিয়া কয়-  অর্জুনের পোলাও দেখি অর্জুনের সমান। এরে সামলানোও তো সহজ হইব বইলা মনে হয় না আমার…

দ্রোণের এই কথা কানে যায় দুর্যোধনের। সে কর্ণ আর দুঃশাসনের গিয়া কয়- বুইড়া বামুন ডরাইছে অর্জুনের বাচ্চা পোলারে দেইখা। এরে তোমরা ফালাও…

দুঃশাসন কয়- খাড়াও ভাইজান। আমিই ফালাইতাছি তারে…

কিন্তু অভিমন্যুরে মারতে গিয়া অভিমন্যুর তিরে নিজেই অজ্ঞান হইয়া পড়ে দুঃশাসন। কর্ণ আগাইয়া আইসা কয়েকটা তির খাইয়া আবার পিছায়। দ্রোণ কৃপাচার্য নিজেগো জান বাঁচাইয়া থাকে দূরে… এর মাঝে অভিমন্যুর হাতে মারা গেছে শল্যের পোলা রুক্মরথ আর দুর্যোধনের পোলা লক্ষণ। নিজের পোলার মরণ দেইখা পাগলা চিল্লান চিল্লাইতে থাকে দুর্যোধন। দুর্যোধনের ধাতানি খাইয়া আবার সকলে আইসা ঘিরা ধরে অভিমন্যুরে; দ্রোণ কৃপ কর্ণ অশ্বত্থামা বৃহদবল আর কৃতবর্মা। এর মাঝেও বৃহদবলরে মাইরা ফালায় অভিমন্যু। দ্রোণ আবারও ডর খায়। কয়-  আমার তো মনে হয় আমি অর্জুনরেই দেখতাছি চোখের সামনে। সে কোন দিকে যায় আর কোন দিকে মারে তাই তো ঠাহর করতে পারি না। কর্ণ তুমি ছাড়া এরে ঠেকাইবার মতো কাউরে দেখি না বাপ। যদি পারো তয় এর হাত থিকা ধনুক ফালাও আর রথ ভাঙ্গো…

কর্ণের তিরে অভিমন্যুর হাত থিকা ধনুক পড়ে। কর্ণ তার সারথি আর ঘোড়া মারে আর তার উপর একলগে তিরাইতে থাকেন দ্রোণ কৃপ অশ্বত্থামা দুর্যোধন শকুনি…

রথ সারথি আর ধনুক হারাইয়া অভিমন্যু তলোয়ার নিয়া খাড়ায়। সেইটাও দ্রোণের তিরে হাত থাইকা ছুঁইটা গেলে ভাঙ্গা রথের চাকা নিয়া অভিমন্যু সবাইরে দাবড়ায়। সেইটাও হাত থিকা পইড়া গেলে হাতে নেয় গদা; কিন্তু ততক্ষণে দুঃশাসনের পোলার গদার বাড়িতে মাটিতে গড়ায় সে…

অভিমন্যুরে হারাইয়া কান্দে যুধিষ্ঠির। আর সন্ধ্যায় ফিরা পাগলা হইয়া উঠে অর্জুন। যুদ্ধে এইটা তার দ্বিতীয় পোলার মৃত্যু। এর আগে গেছে ইরাবান। অর্জুনের বিলাপ থামাইতে পারে না কেউ। সকল ভাইরে সে ঝাড়ি লয় তার পোলারে রক্ষা না করার লাইগা। শেষে কৃষ্ণ আইসা তারে ধরে- হাহুতাশ। কইরা কী লাভ? দ্রোণের চক্রব্যুহের মূল দারোয়ান তো হইল জয়দ্ৰথ। সে যদি বাকিদের ঠেকাইয়া না রাখত তবে কি আর অভিমন্যুর এই পরিণতি হইত আইজ?

অর্জুনের সকল রাগ গিয়া পড়ে জয়দ্রথের উপর। সে সকলরে শুনাইয়া কয়- কাইল যদি না সূর্য ডোবার আগে আমি জয়দ্রথরে মারতে পারি তয় আগুনে ঝাঁপ দিয়া নিজে মইরা যামু কইলাম…

অর্জুনের পণ শুইনা ঘাবড়াইয়া যায় জয়দ্রথ। রাত্তিরে দুর্যোধনরে গিয়া কয়-  হয় আমারে রক্ষার লাইগা তোমরা একটা ব্যবস্থা করো; নাহয় আমি নিজের দেশে গিয়া পলাইয়া নিজের জান বাঁচাই। কারণ অর্জুন যখন কইছে কাইল আমারে মারব; সে মাইরাই ফালাইব আমারে…

দুর্যোধন কয়-  অত ডরাও ক্যান? তুমি নিজেও দ্রোণের শিষ্য আর বহুত বড়ো যোদ্ধা। তার উপরে আমরা তো আছিই তোমার লগে…

দ্রোণ কন- ডরাইও না। আমি কথা দিলাম কাইল আমি তোমারে রক্ষা করব অর্জুনের হাত থিকা। কাইল আমি এমন ব্যুহ বানামু যে অর্জুনের পক্ষে তা ভাইঙ্গা তোমারে ধরা সম্ভব হইব না…

কথাখান কইয়া নিজেই ডর খান দ্রোণ। সেনাপতি হইয়া পয়লা দিন কইছিলেন যুধিষ্ঠিররে ধইরা আনবেন। সেইটা তো পারেনই নাই। শেষ পর্যন্ত তিনি অর্জুনের ১৭ বছরের পোলা মাইরা দুর্যোধনের দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাইছেন। এখন যে কইলেন- কাইল অর্জুনের হাত থিকা তোমারে আমি রক্ষা করব। যদি না পারেন?

ইজ্জত বাঁচাইবার লাইগা দ্রোণ নিজের কথার লগে একখান লেঞ্জা জুইড়া দেন- তয় বাপ। জন্মিলে মরিতে হয় এইটা তো জানো। আমরা কেউই বাঁচব না চিরকাল। তাই তোমারে কই; মরণের চিন্তা বাদ দিয়া তুমি যুদ্ধ করো। আমরা তো আছিই। কপালে থাকলে যে কারো মরণ হইতে পারে যেকোনো দিন…

রাত্তিরে অর্জুন ঠান্ডা হইলে কৃষ্ণ কয়-  তুমি আমারে না জিগাইয়া বেকুবের মতো যে পণ করলা কাইলই জয়দ্রথরে মারবা না হয় নিজে মরবা। এত বড়ো দুঃসাহস করাটা ঠিক হয় নাই তোমার। কর্ণ-ভূরিশ্রবা-বৃষসেন-কৃপ আর শল্যের মতো যোদ্ধারা আছে জয়দ্রথের লগে। এই অবস্থায় কামটা যদি করতে না পারো তয় সকলে যে আমাগো নিয়া হাসব সেইটা ভাবছ?

অর্জুন কয়-  সর্বদাই তোমার পরিকল্পনায় আমি অস্ত্র চালাই কৃষ্ণ। কাইল না হয় আমার লাইগাই তুমি পরিকল্পনা করবা…

পাণ্ডব শিবিরে কারো ঘুম নাই। অর্জুন এমন এক পণ করছে যে; হয় সে কাইল জয়দ্রথরে মারব না। হয় নিজে মরব আগুনে ঝাঁপ দিয়া। কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিররে সান্ত্বনা দেয়- আমার উপরে ভরসা রাখেন ভাই। একটা ব্যবস্থা হইব কাইল যাতে সাপ না মরলেও লাঠি থাকে ঠিকঠাক…

কৃষ্ণ পরিকল্পনা শানায়। নিজের চ্যালাগো ডাক দিয়া কয়-  চাইর ঘোড়া জুইড়া আমার রথ রেডি রাখো সকল অস্ত্র বোঝাই দিয়া। দরকার পড়লে কাইল নিজেই চালামু অস্ত্র আমি…

চৌদ্দ নম্বর দিনের সকালে জয়দ্রথরে দ্রোণ রাখেন সকলের পিছে। হাতি বাহিনী নিয়া সবার আগে অর্জুনের সামনা-সামনি হয় দুর্যোধনের ভাই দুর্মর্ষণ। সেইটারে সরাইয়া অর্জুন মোকাবেলা করে দুঃশাসনের। মাইর খাইয়া দুঃশাসন দ্রোণের শরণে গেলে অর্জুন আইসা তারে সেলামালকি দেয় পেন্নাম গুরুদেব। আপনে আমার কাছে ভগবানের সমান। আমার পণ রক্ষায় আপনে আমারে আশীর্বাদ করেন…

অর্জুনের কথায় দ্রোণ হাসেন-তেলাইয়া পার পাইবা না অর্জুন। আমারে না মাইরা কিন্তু জয়দ্রথরে ছুঁইতে পারবা না তুমি…

অর্জুন শুরু করে দ্রোণেরে মারা। কৃষ্ণ কয়- খামাখা সময় নষ্ট করো ক্যান? ইনারে ফালাইবা না যখন তখন তিরাতিরি বন্ধ করো তার লগে…

কৃষ্ণ রথ সরাইয়া নেয়। পিছন থাইকা দ্রোণ টিটকারি মারেন- অর্জুন কি ভাগতাছে দ্রোণাচার্যের ডরে?

যাইতে যাইতে অর্জুন কয়-  গুরুরে জয় করা যেমন গৌরবের কিছু না; তেমনি গুরুর সামনে থাইকা ভাগাও কিন্তু লজ্জার কিছু না গুরুদেব…

কৃষ্ণ এইবার দেখায় তার রথ চালানোর আশ্চর্য কৌশল। সকলের ফাঁকে-ফোঁকরে সে প্রায় গিয়া খাড়ায় জয়দ্রথ বাহিনীর সামনে। দুর্যোধন দৌড়ায় দ্রোণের নিকট- খাড়াইয়া করেনটা কী আপনে? আমি তো বিশ্বাসই করতে পারতাছি না যে আপনে জীবিত থাকতে অর্জুন আপনার পাশ কাটাইতে পারে। আমার তো মনে হইতাছে আপনি আমার কাছ থিকা মোটা বেতন নেন আর কাম করেন পাণ্ডবগো। ভুলটা আমারই হইছে। জয়দ্রথ যখন পলাইতে চাইছিল তখন আপনার মতো বেইমানের ভরসাতেই আমি তারে কুরুক্ষেত্রে রাখছি…

দ্রোণ শুরু করেন অজুহাত-বাপ তুমি আমার কাছে আমার পোলা অশ্বত্থামার মতো। তোমার কাছে সত্য কইতে শরম নাই। তুমি নিজেই তো জানো যে কৃষ্ণের থাইকা বড়ো সারথি এইখানে কেউ নাই। তুমি তো নিজেই দেখছ যে আমি যখন তির ছাড়ি অর্জুনরে গাঁথার লাইগা; আর সেই তির যখন। গিয়া মাটিতে পড়ে তখন কৃষ্ণের ঘোড়া দাবড়ানির কারণে অর্জুন থাকে তির থাইকা একশো হাত দূরে। তিরের মুখ তো আর ঘোড়ার মতো মাঝপথে বদলান যায় না বাপ। তাছাড়া আমার যা বয়স; আমি কেমনে অর্জুনরে ধাওয়া করি বলো?

এই সব অজুহাতে দুর্যোধন আবার ধাতানি লাগায়। এইবার দ্রোণও একটু গরম দেখান-শোনো। আমি কিন্তু অর্জুনের বিষয়ে তোমারে কোনো দিনও কোনো কথা দেই নাই। আমি তোমারে কথা দিছি যুধিষ্ঠিররে ধইরা দিবার বিষয়ে। এখন যুধিষ্ঠিররে বাদ দিয়া তোমার কথামতো আমি অর্জুনের পিছে ধাওয়া দিতে পারি না। আমি আমার পণ রক্ষা করতে গেলাম। তুমি নিজে গিয়া অর্জুনরে ঠেকাও…

দ্রোণ ভাগল দিতে চান। দুর্যোধন গিয়া তার সামনে খাড়ায়- তিরন্দাজ হইয়া আপনে অর্জুনরে ঠেকাইতে পারেন না; আর আমারে কেমনে কন গদা নিয়া গিয়া তিরন্দাজ ঠেকাও?

দ্রোণ এইবার একটা বর্ম আগাইয়া দেন দুর্যোধনের দিকে এই বর্ম পইরা তুমি অর্জুনের সামনে খাড়াও কারো তিরই এই বর্ম ভেদ করতে পারব না। এর বেশি তোমারে কোনো সাহায্য আমি করতে পারব না বাপ। আমারে মাফ কইরা দেও…

সূর্য প্রায় ডুবু ডুবু। কৃষ্ণ-অর্জুন এখনো জয়দ্রথরে ধরতে পারে নাই। অর্জুন কৃষ্ণরে কয়-  ঘোড়াদের পেটে দানাপানি নাই। একটু থামা দরকার। আমারও কিছু দানাপানি খাওয়া লাগে…

কাদা খুঁইড়া অর্জুন পানি বাইর কইরা খায়। কৃষ্ণ ঘোড়াদের দানাপানি দেয়। কিছু বিশ্রাম কইরা আবার রওনা দেয় তারা। এইবার তারা সামনে জয়দ্রথরে দেখে। কিন্তু পথ আগলায় দুর্যোধন। কৃষ্ণ কয়- বাদ দেও জয়দ্রথ। পালের গোদারে যখন পাওয়া গেছে তখন দুর্যোধনেরই পাড়ো এইবার…

দুর্যোধনরে তির মারতে গিয়া অর্জুন তার বর্মটা চিনতে পারে- এইটা গুরু দ্রোণ দুর্যোধনরে দিছেন। এই জাতের বর্ম অর্জুনও বান্ধে। এই বর্মে তির বিন্ধানো কঠিন। কিন্তু দুর্যোধন জীবনের পয়লা দিন বানছে বইলা বান্ধনে কিছু ফাঁক রইয়া গেছে। অর্জুন কয়- অসুবিধা নাই। এরেই তবে ধরি এইবার…

অর্জুনের তিরে দুর্যোধনের হাত থিকা ধনুক পড়ে। বর্মের চিপা দিয়া কিছু তির বিন্ধে তার দেহে। দুর্যোধনের ঘোড়া আর সারথি মরে। এমন সময় দুর্যোধনরে কভার দিতে আইসা খাড়ায় কর্ণ ভূরিশ্রবা কৃপ আর শল্য। অর্জুন বেকায়দা দেইখা বাজায় তার দেবদত্ত শঙ্খ। কৃষ্ণও বাজাইতে থাকে তার পাঞ্চজন্য শঙ্খ পাণ্ডবগো সাহায্যের আশায়…

এর মাঝে অন্য মাঠে অলমুষরে মাইরা ফালাইছে ভীমের পোলা ঘটোৎকচ। দ্রোণ তিরাতিরি করেন পাঞ্চাল বাহিনীর লগে। এমন সময় অর্জুন আর কৃষ্ণের শঙ্খ শুইনা যুধিষ্ঠির সাত্যকিরে কয় তোমার দুই গুরু অর্জুন আর কৃষ্ণ বিপদে আছে। তুমি ছাড়া তাগোরে রক্ষার কেউ নাই… সাত্যকি কয়-  আমি সইরা গেলে কিন্তু দ্রোণ আপনেরে বন্দি কইরা ফালাইতে পারে…

যুধিষ্ঠির কয়-  তুমি যাও। আমি গিয়া ভীম আর ঘটোৎকচের বগলে খাড়াইলে দ্রোণের সাহস হইব না কিছু করার…

দ্রোণ আগান না যুধিষ্ঠিরের দিকে। তিনি গিয়া সাত্যকির সামনে খাড়ান- তোমার গুরু অর্জুন তো আমার সামনে থাইকা পলাইছে। আশা করি তুমিও পলাইতে চাইবা না ডরে…

সাত্যকি দ্রোণরে পাশ কাটাইতে গেলেও তিনি তারে আক্রমণ কইরা বসেন। সাত্যকি থামে না। যাইতে যাইতে তির মাইরা দ্রোণের ঘোড়া আর রথের সারথিরে ফালাইয়া আগাইবার আগে কয়েকটা তির বিন্ধাইয়া দেয় দ্রোণের শরীরে। দ্রোণ ফিরা যান শরীরের ক্ষত মেরামত করতে। আর সাত্যকি আগায় অর্জুনের দিকে…

রাস্তায় দুর্যোধন বাহিনীরে নাস্তানাবুদ কইরা আগায় সাত্যকি। তার দাপট দেইখা দুঃশাসন আইসা দ্রোণের বগলে খাড়ায়। দ্রোণ কন- কও তো জয়দ্রথ কি জীবিত আছে এখনো? তা তুমি ভাইগা আইলা ক্যান? পাশা খেলার আসরে তুমি না কইছিলা পাণ্ডবরা সব নপুংসক? তোমার সেই লাফানি এখন কই?

দ্রোণের খোঁচায় দুঃশাসন আবার সাত্যকির পিছু নিয়া মাইর খাইয়া দেয় আরেকটা ভাগল…

সন্ধ্যার আগে দ্রোণের হাতে মরে কেকয় রাজের পোলা বৃহৎক্ষেত্র; শিশুপালের পোলা ধৃষ্টকেতু আর ধৃষ্টদ্যুম্নের পোলা ক্ষত্রধর্মা। কৃষ্ণ আর অর্জুনের কোনো সাড়াসংবাদ না পাইয়া যুধিষ্ঠির ভীমরে কয় আমার কেমন যেন সন্দেহ হয়। তুই গিয়া দেখ কী হইতাছে ওই দিকে এখন…

ভীম কয়-  অর্জুনের লগে যতক্ষণ কৃষ্ণ আছে ততক্ষণ ডরের কিছু নাই তবুও যখন কইছ তখন আমি যাই…

দ্রোণ পাহারা দিতাছেন কোন সময় যুধিষ্ঠিররে একলা পাওয়া যায়। সামনে আগানও না; আবার সরেনও না। তার সামনে দিয়া যখন ভীম যাইতেছিল একটা তির ছুঁইড়া তিনি তারে নাড়ান-অর্জুন ভাগছে ডরাইয়া। আশা করি আমার ডরে তুমিও ভাগবা না ভীম?

মুখ না খুইলা হাত চালায় ভীম। তার গদামে দ্রোণের ঘোড়া আর সারথি মইরা গেলে তিনি নিজে মাটিতে লুটান। ভীম গিয়া খাড়ায় তার সামনে- আমি অর্জুনের মতো ভদ্দরলোক কিংবা দয়ালু কোনোটাই না। তোর মতো ছোটলোক বামনারে সম্মান দেখানোর ঠেকাও আমার নাই। আমি গেলে তোরে মাটিতে পুঁইতাই অন্য দিকে যামু…

ভীমরে গদা উঠাইতে দেইখা পড়িমরি দৌড়াইয়া আরেকটা রথে উইঠা নিজের জান বাঁচান দ্রোণ বাপরে। মাইজা পোলাটারে আদব-কায়দা কিছুই শিখায় নাই কুন্তী…

রাস্তায় ভীমের হাতে মরে ধৃতরাষ্ট্রের আরো তিন পোলা; বিন্দু-অনুবিন্দু আর সুবর্মা। কিছুদূর আগাইয়া অর্জুন আর কৃষ্ণরে অক্ষত দেইখা শঙ্খ বাজাইয়া যুধিষ্ঠিররে কুশল সংবাদ দেয় ভীম; কৃষ্ণ অর্জুনও শঙ্খ বাজাইয়া সংবাদ দেয় তাগো অক্ষত দেহে বাঁইচা থাকার…

দুর্যোধন আবার দৌড়াইয়া আসে দ্রোণের কাছে- গুরুদেব। পয়লা অর্জুন আপনেরে অতিক্রম কইরা গেলো। তারপর গেলো সাত্যকি। এখন দেখি ভীমরেও আপনে ঠেকাইতে পারলেন না। আপনে তো দেখি কোনো কামেরই না…

দুর্যোধনের কথায় দ্রোণ আবোল-তাবোল বকতে শুরু করেন- আমি আর কী করব? শকুনির বুদ্ধিতে তুমি যদি পাশা না খেলতা; নিজের কাকাতো ভাইগো লগে যদি যুদ্ধে না জড়াইতা তাইলে আইজ আর এই দশা হইত না…

ধুর্বাল বইলা দুর্যোধন আবার ছোটে জয়দ্রথরে বাঁচাইতে…

রাস্তায় কর্ণরে দেইখা ভীম পাশ কাইটা যায়। কর্ণ তারে ডাকে- তোমার সম্পর্কে জীবনেও যা কেউ কল্পনা করে নাই আইজ তুমি তাই করলা ভীম। শত্রুরে ডরাইয়া পাশ কাইটা গেলা…

একমাত্র কর্ণরেই ডরায় ভীম। বনবাসের তেরো বছর যতবারই ভীম বন থিকা বাইর হইয়া হস্তিনাপুর আইসা মারামারি করতে চাইছে। ততবারই যুধিষ্ঠির কর্ণের ডর দেখাইয়া তারে ঠেকাইছে। কিন্তু এত বড়ো কথার পর ভীমের পক্ষে সইরা যাওয়া কঠিন। ভীম ফিরা আইসা ধুমা তির চালাইতে থাকে কর্ণের দিকে। কর্ণ বেশ মজা পায়-গদারু মানুষ হইলেও তুমি দেখি ভালোই তির চালাইতে পারো…

কর্ণ ভীমরে মারে না। খালি তার মাইর ঠেকায় আর তারে নিরস্ত্র করে; কর্ণ ভীমের হাত থিকা ধনুক ফালাইয়া দেয় তির মাইরা। রথের ঘোড়া মারে। ভীম রথ ছাইড়া ঢাল তলোয়ার নিয়া আগাইয়া আসে কর্ণের দিকে। কর্ণ ভীমের ঢাল ভাইঙ্গা ফালায়। ভীম খেইপা তলোয়ার ছুঁইড়া মাইরা কর্ণের হাত থিকা ধনুক ফালাইয়া দেয়। কর্ণ আরেকটা ধনুক তোলে। ভীম এইবার গিয়া মরা হাতি আর ভাঙ্গা রথের। আড়ালে লুকাইয়া রথের টুকরা টাকারা ছুঁইড়া মারে কর্ণের দিকে। কর্ণ কয়েকটা তির মাইরা ভীমরে কাবু কইরা সামনে গিয়া ধনুকের আগা দিয়া তার পেটে গুতা মাইরা হাসে- মাকুন্দা বৃকোদর। খালি যুদ্ধ করার লাইগা ফাল পাড়লেই হয় না; যুদ্ধ জানাও লাগে…

ভীম বেকুব বইনা যায়। কর্ণ তারে মারে না ক্যান? ভীম হা কইরা তাকাইয়া থাকে। কর্ণ হাসে- যাও। কৃষ্ণ আর অর্জুনরে সাহায্য করতে আসছিলা হয় সেইখানে যাও; অথবা বাড়ি ফিরা যাও; যুদ্ধক্ষেত্রে তোমার থাকার দরকার নাই…

ভীমের আঁতে লাগে। কয়- ছোটলোকের বাচ্চা আমারে দয়া দেখাইতে হবে না তোর। হয় মার না হইলে আমার লগে মল্লযুদ্ধ কর। তোরে দেখাইতাছি আমি লড়াই জানি কি না…

কর্ণ হাসে- সেইটাও একটা কথা। আমার মতো বড়ো যোদ্ধার লগে যেমন তোমার মতো নাদানের যুদ্ধ করা ঠিক না। তেমনি আমার মতো ছোটলোকের লগেও কিন্তু তোমার মতো রাজপুত্তুরের লড়াই করা মানায় না…

ভীম আবারও হা কইরা থাকে। অর্জুনের চোখে পড়ে ভীমের কাছে কর্ণ। অর্জুন তাড়া দিয়া আসে কর্ণের দিকে। ভীম সইরা গিয়া সাত্যকির রথে উঠে। কর্ণ গিয়া খাড়ায় দুর্যোধনের কাছে…

ভীমরে অর্জুনের কাছে রাইখা আসার পথে সাত্যকি মুখোমুখি হয় ভূরিশ্রবার। ভূরিশ্রবা সাত্যকিরে মাটিতে পাইড়া ফালায়। তারে লাইখাইতে লাইখাইতে এক হাতে চুলের মুঠা ধইরা আরেক হাতে তলোয়ার তোলে মাথা নামাইতে। ঠিক তখনই কৃষ্ণের চোখে পড়ে সাত্যকির দুরবস্থা। কৃষ্ণ অর্জুনরে কয়-  সাত্যকিরে বাঁচাও…

অর্জুনের তির আইসা বিঁধে তলোয়ার ধরা ভূরিশ্রবার হাতে। তলোয়ার পইড়া যায়। ভূরিশ্রবা অর্জুনের দিকে তাকায়- খুব বাজে কাম করলা অৰ্জুন। জাউরা যাদবের কথায় যুদ্ধের নিয়ম লঙ্ঘন করলা তুমি। আরেকজনের লগে যুদ্ধ করা কারো উপর আক্রমণ করা যুদ্ধ নিয়মে নিষেধ…

ভূরিশ্রবা অর্জুন আর কৃষ্ণরে গালাগালি করতে ব্যস্ত এরই মধ্যে সাত্যকি উইঠা যে অস্ত্র ভূরিশ্রবার হাত থিকা পড়ছিল সেইটা তুইলাই ভূরিশ্রবার মাথাটা আগলাইয়া ফালায়। আশপাশে সকলে হায় হায় কইরা উঠে- যুদ্ধ নিয়মের আরেকখান লঙ্ঘন; গালাগালিরত কাউরে অস্ত্র দিয়া আঘাত করতে নিষেধ কইরা দিছেন দ্বৈপায়ন… সাত্যকি কয়-  যেকোনো উপায়ে শত্রু কমানোই যুদ্ধের সব থিকা বড়ো নিয়ম…

সূর্যাস্তের আর সামান্য বাকি। দুর্যোধন কর্ণরে কয়-  আরো কিছুক্ষণ যদি অর্জুনরে ঠেকানো যায় তবে তার প্রতিজ্ঞা বিফলে যাবে আর তারে গিয়া ঢুকতে হবে আগুনে…

সাত্যকি ভীম অর্জুন। তিন বাহিনীর আক্রমণে বেসামাল হইয়া উঠে কুরু সেনাসৈনিক। অর্জুন পৌঁছাইয়া যায় জয়দ্রথের কাছে। জয়দ্রথের সারথি আর ঘোড়া মইরা গেলে জয়দ্রথ পলাইতে থাকে। পলাইতে পলাইতে গিয়া সে হাজির হয় তার পিতা বৃদ্ধক্ষত্রের আশ্রমে। বৃদ্ধক্ষত্র নিজের পোলারে রাজ্য দিয়া বহু দিন থাইকাই কুরুক্ষেত্রের পাশে সামন্তপঞ্চকে ব্রহ্মচর্য জীবন যাপন। করেন। অর্জুন আর কৃষ্ণও পিছু নেয় জয়দ্রথের। এর মধ্যে সূর্য ডুইবা যায়। সূর্য ডুইবা গেছে তাই এখন অর্জুনের আগুনে ঝাঁপ দিয়া নিজের জীবন শেষ করার পালা। দুর্যোধনের বাহিনী গা ঢিলা দিয়া হাসাহাসি করে- জয়দ্রথ বাঁইচা গেলো। চলো এখন গিয়া দেখি অর্জুন কেমনে আগুনে ঝাঁপ দিয়া মরে…

পাণ্ডব বাহিনীও যুদ্ধ শেষের আড়মোড়া ভাঙ্গে। অর্জুন ধনুক নামায়। জয়দ্রথ ভালো কইরা আকাশে দেখে সূর্যের কোনো চিহ্ন আছে কি না। নাই। সূর্য ডুইবা গেছে। অর্জুনের প্রতিজ্ঞা বিফলে গেছে তাই

অর্জুনও অস্ত্র নামাইয়া ফালাইছে। এখন আর তার প্রাণের ভয় নাই। নিশ্চিন্ত জয়দ্রথ এইবার আইসা খাড়ায় পিতা বৃদ্ধক্ষত্রের আশ্রমের আঙ্গিনায়। আর তখনই আশ্রমের বাইরে ঘাপটিমারা কৃষ্ণ অর্জুনের কানে কানে কয়-  গাঁথো হালারে…

অর্জুনের তিরে ভ্যাবাচেকা জয়দ্রথ লুটাইয়া পড়ে ব্রহ্মাচারী বাপের সামনে আর পোলার এমন মৃত্যুতে হার্ট অ্যাটাক কইরা বাপ বৃদ্ধক্ষত্র লুটাইয়া পড়েন পোলা জয়দ্রথের পাশে…

অর্জুন কইছিল জয়দ্রথরে মারব সূর্য ডোবার আগে। কিন্তু জয়দ্রথ মরল সূর্য ডোবার পরে। সকলেই কানাঘুসা করে। কেউ মাঠ ছাইড়া যায় না। দুর্যোধন খেইপা উঠে দ্রোণের উপর- আপনে না আছিলেন সকলের সামনে। আপনের না কথা আছিল পাণ্ডবগো ঠেকাইবার। গত কাইল আপনের বাহাদুরি সফল করার লাইগা পাণ্ডবগো যে জয়দ্রথ একলাই আটকাইয়া রাখল ব্যুহের বাইরে আইজ তারেই রক্ষা করতে পারলেন না আপনে। আমার কপালটাই খারাপা যারে আমি বিশ্বাস কইরা সেনাপতি বানাই সেই আমার লগে বেইমানি করে। পিতামহ ভীষ্ম আমার সেনাপতি হইয়া পাণ্ডবগো লগে দয়ার যুদ্ধ কইরা গেছেন। আপনেও অর্জুন ভীম আর সাত্যকিরে ডরাইয়া জয়দ্রথরে খুন করাইলেন আইজ…

দ্রোণ এইবার পাল্টা খোঁচা মারেন- খালি আমার উপরে দোষ চাপাও ক্যান? আমি তো বরাবরই কই যে অর্জুনের লগে পাইরা উঠা সম্ভব না আমার পক্ষে। কিন্তু আইজ তো তুমি কৃপ কর্ণ শল্য অশ্বত্থামা সকলেই জয়দ্রথের পাশে ছিলা; তোমরা কেন পারলা না অর্জুনরে ঠেকাইতে? কৃষ্ণ আর অর্জুন যেভাবে যুদ্ধ করে; জয়দ্রথ ক্যান; এখন তো নিজের জানের লাইগাও ডর লাগে আমার…

— আপনে এতটা অকর্মা আর কাপুরুষ তা আমি জানতাম না গুরুদেব…

দুর্যোধনের এই কথায় আবার খেইপা উঠেন দ্রোণ- রাত্তিরেও যুদ্ধ হবে আইজ। আমি কথা দিলাম; সমস্ত পাণ্ডবসেনা ধ্বংস না কইরা বর্ম খুলব না আমি…

দুর্যোধন কয়- রাত্তিরে যুদ্ধ করতে চান করেন। কিন্তু বড়ো গল্প আর দিয়েন না। পয়লা দিন কইছিলেন যুধিষ্ঠিররে ধইরা আনবেন; তার বালও ছিঁড়তে পারেন নাই এত দিনে। তার উপরে আপনি সেনাপতি হইবার পর থাইকাই আমার বড়ো বড়ো যোদ্ধাগুলারে হারাইতাছি আমি…

দ্রোণ বাইরাইয়া যান সৈন্যসমাবেশ করতে। দুর্যোধন কর্ণরে কয়-  আমার নিজের কাছে নিজেরেই পাপী মনে হইতেছে এখন। জয়দ্রথ আমার ছোট বইনের স্বামী। প্রাণ রক্ষার লাইগা সে পলাইতে চাইছিল। কিন্তু এই দ্রোণের উপর ভরসা কইরাই আমি নিজের বইনরে বিধবা করলাম। কর্ণরে; বিশ্বাসঘাতক সেনাপতির দল নিয়া এই জগতে আমার মতো আর কেউ যুদ্ধ করছে জানি না। কিন্তু একটা কথা তোমারে কইয়া দেই; কেউ না থাকলেও আমি কিন্তু যুদ্ধ কইরা যামু…

কর্ণ দুর্যোধনরে সান্ত্বনা দেয়। গুরু দ্রোণরে আর কিছু কইও না তুমি। তিনি যুদ্ধ করতাছেন ঠিক। কিন্তু বয়স্ক মানুষ; নড়তে চড়তে কষ্ট হয় তার; অস্ত্র চালাইতেও হাতে জোর পান না। যুদ্ধে তার অভিজ্ঞতাও নাই। তার পক্ষে পাণ্ডবগো জয় করা কোনো দিনও সম্ভব না। আর জয়দ্রথের পুরা। বিষয়টাই কৃষ্ণের চাল। সূর্য থাকা পর্যন্ত আমরা কিন্তু অর্জুনরে ঠিকই ঠেকাইয়া রাখছিলাম। সূর্য ডোবার পর জয়দ্রথও নিশ্চিন্ত হইয়া বাইরাইয়া আসছিল বাপের আশ্রমের আঙিনায়। কিন্তু কৃষ্ণ যে সূর্য ডোবার পরেও অর্জুনরে দিয়া জয়দ্রথরে হত্যা করাইব ঘুণাক্ষরেও কেউ তা অনুমান করতে পারে নাই। সূর্য ডোবার পরে আমরা সকলেই ঢিলা দিছিলাম। আর সেই সুযোগটাই নিছে কৃষ্ণ…

রাত্তিরের যুদ্ধে ভূরিশ্রবার বাপ সোমদত্ত পুত্র হত্যার প্রতিশোধ নিতে আইসা আক্রমণ করে সাত্যকিরে। কিন্তু উল্টা তির খাইয়া ভাগতে হয় তার। অশ্বত্থামার হাতে মারা যায় ভীমের নাতি আর ঘটোৎকচের বড়ো পোলা অঞ্জনপৰ্বা। পোলার মৃত্যুসংবাদ শুইনা অশ্বত্থামার উপর ঝাঁপাইয়া পড়ে ঘটা। অবস্থা বেগতিক দেইখা অশ্বত্থামা কয়-  বাপ ঘটোৎকচ। আমি তোমার পিতার সমতুল্য; তোমার বাপ ভীম আমার থাইকা আট বছরের ছোট। তোমার লগে আমার যুদ্ধ করা ঠিক না; তুমি সম্পর্কে আমার ভাতিজা হও…

এই সব ভুজুং আটকাইয়া রাখতে পারে না ঘটোৎকচরে। সে হামলাইয়া পড়ে অশ্বত্থামার উপর। সোমদত্ত আবার ফিরা আইসা একই সাথে পইড়া যায় ভীম আর সাত্যকির সামনে। ভীমের গদাম আর সাত্যকির তিরে তারে আর উইঠা খাড়াইতে হয় না যুদ্ধের মাঠে। এরপরে সোমদত্তের বাপ। বাত্নীকরাজ আগাইয়া আসলে ভীমের এক গদামেই তার যুদ্ধের শখ মিটা যায়…

কুরু সেনাদের অবস্থা খুবই খারাপ। দুর্যোধন কর্ণের কাছে যায়- দোস্ত তুমি ছাড়া আমার সৈনিকদের রক্ষা করার কেউ নাই… কর্ণ কয়-  আমি জীবিত থাকতে তোমার চিন্তি হইবার কোনো কারণ নাই…

কর্ণের কথা শুইনা কৃপাচার্য হাসেন- হালা গাড়োয়ানের পুত। তোমার খালি মুখে মুখেই ভড়ং। যাও না। পাণ্ডবগো সামলাইয়া দেখাও একবার… কর্ণও খেইপা উঠে- অক্ষম ব্রাহ্মণ। বাজে কথা কইলে জিব কাইটা ফালামু কইলাম… তারপর আবার দুর্যোধনের দিকে ফিরে- এই আরেকটা কালসাপ পুষতাছ তুমি। খায় তোমার আর গান গায় পাণ্ডবগো…

কৃপাচার্য হইল গিয়া অশ্বত্থামার মামা। ঘটোৎকচের হাত থাইকা পলাইয়া অশ্বত্থামা আসছিল বিশ্রাম করতে। মামারে কর্ণ এমন গালাগালি করতাছে দেইখা তলোয়ার নিয়া কর্ণের দিকে ধাওয়া করে অশ্বত্থামা- তুই হইলি গিয়া এক নম্বর অক্ষম। খালি নিজের ভড়ঙ্গে দুনিয়ায় আর কাউরে চোখে পড়ে না তোর। অর্জুন যখন তোর সামনে জয়দ্রথরে মারল তখন তোর ভড়ং কই আছিল? মামায় তো ঠিকই কইছে; পাণ্ডবগো লগে লড়তে গেলে তোর নিজের গু নিজেরই খাইতে হবে। আইজ তোর ভড়ং ছাড়ামু আমি…

দুর্যোধন আর কৃপাচার্য অশ্বত্থামারে আটকান। দুর্যোধন কয়- তোমরা যদি নিজেরা মারামারি করো তয় আমি কার উপর ভরসা করি কও…

কৃপাচার্য কর্ণের দিকে ফিরেন- খালি দুর্যোধনের লাইগা আমরা তোমারে ক্ষমা কইরা দিলাম। তয় কইয়া দেই তোমার ভড়ং কিন্তু অর্জুনেই ভাঙ্গব…

অশ্বত্থামা দুর্যোধনরে কয়-  আমি বাঁইচা থাকতে তোমার চিন্তার কিছু নাই। আমিই অর্জুনরে ঠেকাইয়া রাখব… দুর্যোধন কয়-  গুরু দ্রোণ পাণ্ডবগো এড়াইয়া চলেন। তুমিও তাই করো। এখন কেমনে কও তোমার উপর ভরসা করি? অশ্বত্থামা কয়-  বাদ দেও পিছনের কথা। এখন দেখো কী করি না করি…

সন্ধ্যা শেষ হইয়া অনেক অন্ধকার। তবুও যুদ্ধ থামে না। দুর্যোধন আর যুধিষ্ঠির দুইজনই নিজেগো অর্ধেক পদাতি সৈন্যের হাতে মশাল ধরাইয়া দেয় শমিত্র চিনা যুদ্ধ করার লাইগা। প্রত্যেকটা হাতির পিঠে সাতটা; রথের উপর দশটা ঘোড়ার উপর দুইটা আর সৈনিকদের সামনে-পিছনে দেওয়া হইল দরকারমতো মশাল…

যুদ্ধের আগামাথা কেউ ঠাহর করতে পারে না। কোথাও পাণ্ডবরা দাবড়ায়। কোথাও কৌরবরা। সৈনিক আর বীরেরা নিজেগো নাম উচ্চারণ কইরা শত্রুর উপর আক্রমণ শানাইতে থাকে। অর্জুনের পাগলা তিরে কৌরবরা দিশাহারা হইয়া পলায়। দুর্যোধন দৌড়াইয়া গিয়া দ্রোণের সামনে খাড়ায় আপনি আরেকটা ফাউল ভড়ং দেখাইতে আইজ রাত্তিরে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিছেন। এখন পাণ্ডবগো মাইর খাইয়া আমার সেনারা পলাইতাছে আর আপনে খাড়াইয়া তামাশা দেখতাছেন…

কর্ণও শুরু করে পাগলা তির। কর্ণের তিরে পাণ্ডবরা ভাগতে থাকলে যুধিষ্ঠির গিয়া অর্জুনরে ধরে ওই দিকে কর্ণ আমার সবগুলা সৈনিক সাফ কইরা ফালাইতাছে আর তুমি এইখানে বইসা তিরাতিরি করতাছ। যাও গিয়া কর্ণরে ঠেকাও…

জয়দ্রথরে মারার সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কোনো সিদ্ধান্তই অর্জুন নেয় না কৃষ্ণরে না জিগাইয়া। যুধিষ্ঠিরের কথা শুইনা অর্জুন কৃষ্ণের দিকে তাকায়-কৃষ্ণ। আমাগো মনে হয় কর্ণের সামনে যাওয়া উচিত…

কৃষ্ণ নড়ে না। কয়- কর্ণের সামনে তোমার যাওয়া ঠিক হইব না অর্জুন। কর্ণের ধনুক সাড়ে চাইর হাত; তোমার ধনুক থাইকা আধা হাত লম্বা। তার তিরও তোমার তির থাইকা বেশি দূর যায়। অন্য যেকোনো ভয়ংকর অস্ত্রেও কর্ণ বহুত কঠিন যোদ্ধা। তাছাড়া এই যুদ্ধে কর্ণ এখনো অক্ষত আছে। কর্ণের সামনে তোমার যাওয়া ঠিক না। কর্ণের সামনে ঘটোৎকচরে পাঠানো দরকার এখন। সে রাত্তির কালে যুদ্ধে যেমন এক্সপার্ট তেমনি গায়ের শক্তি আর অস্ত্র চালনায়ও কর্ণরে ঠেকাইয়া রাখার মতো। তুমি থাকো…

কৃষ্ণ ঘটোৎকচরে গিয়া ফুলায়- তুমি ছাড়া কর্ণরে ঠেকাইবার মতো আমাগো পক্ষে আর কেউ নাই বাপ। তুমি ভীষ্ম দ্রোণ অশ্বত্থামা ভগদত্ত দুর্যোধন শল্য সবাইরে দাবড়াইছ; খালি বাকি আছে কর্ণ। এইবার তোমার কর্ণরে থাবড়ানির পালা…

অর্জুন কয়-  হ ভাতিজা। আমার মতেও এই যুদ্ধে তুমি তোমার বাপ ভীম আর সাত্যকিই হইলা গিয়া সব থিকা বড়ো বীর। আর রাত্তিরের যুদ্ধে তোমার উপ্রে কেউ নাই। তুমি কর্ণের দিকে আগাইয়া যাও। সাত্যকি পিছন থাইকা তোমারে হাত দিব…

ঘটোৎকচ একটা হাসি দেয় কৃষ্ণের দিকে- কাকা অর্জুনরে কর্ণ থিকা দূরে রাখতে চাও কাগু? অসুবিধা নাই। যদি মরি তয় ছুডু মারে গিয়া কইবা; ঘটোৎকচ নাদানের মতো বেঘোরে খুন হয় নাই। যুদ্ধ কইরা মরছে সব থিকা বড়ো যোদ্ধার লগে…

ঘটোৎকচ যাইবার আগে অর্জুনের সামনে খাড়ায়-যদি মইরাও যাই তবু নিশ্চিন্ত থাইকো কাকু। কর্ণরে ঘায়েল না কইরা মরব না আমি…

ঘটারে নিয়া দুর্যোধনের চিন্তার সীমা নাই। দুর্যোধনের পক্ষে বড়ো হড় যোদ্ধা আছিল অলম্বুষ। আজকেই ঘটা তার কম্ম সাবাড় কইরা দিছে। এখন যখন সে কর্ণের দিকে আগাইতে গেলো তখন আরেক হড় যোদ্ধা অলায়ুধরে দুর্যোধন পাঠায় ভীমেরে আক্রমণ করতে; যাতে বাপেরে বাঁচাইতে ঘটা ব্যস্ত হইয়া কর্ণ বাহিনী থাইকা দূরে থাকে। কিন্তু ভীমের কাছে পৌঁছাইবার আগেই ঘটা অলায়ুধের মাথা কাইটা ফিককা ফালায় দুর্যোধনের সামনে। ঘটার আক্রমণে কর্ণের অগ্রবাহিনীর সকল কুরুসৈনিক পলায়। বেগতিক দেইখা দুর্যোধন দৌড়ায় কর্ণের কাছে-রাক্ষসটার হাত থিকা আমাগো রক্ষা করো কর্ণ। ভীমের এই পোলারে আইজ পর্যন্ত কেউ ঠেকাইতে পারে নাই…

কর্ণ আগাইয়া যায়। ঘটোৎকচ আগাইয়া আসে। বর্শার আঘাতে কর্ণের চাইর ঘোড়া মাইরা কর্ণরে মাটিতে নামাইয়া আনে ঘটা। কর্ণ রথ থাইকা নাইমা আসে আর ঘোর অন্ধকারে কাসার বর্ম পরা কোকড়া চুলের ঘটোৎকচ সোজা গিয়া খাড়ায় তার মুখামুখি- পেন্নাম জ্যাঠা…

কর্ণ থতমত খায়। ঘটা হাসে-বুঝাইতে চাই যে অন্যরা যা জানে না তা আপনে যেমন জানেন; আমিও তেমনি জানি। আইসেন জ্যাঠা। আইজ কুন্তীর ফালাইয়া দেওয়া পোলা আর ফালাইয়া দেওয়া নাতির মইদ্যে একজন যাবে নিশ্চিত…

বহু বছর আগে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে ভীমের এই পোলাটা তারে প্রণাম কইরা নিজের পরিচয় দিয়া কইছিল- দ্রৌপদী ডর দেখাইছে যে কর্ণরে দিয়া খুন করাইব তারে। কিন্তু কর্ণ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে নাই যে ঘটোৎকচ তার পরিচয়ও জানে…

কর্ণ কিছুটা উদাসীন। ঘটোৎকচ হাসে- হয়ত ছুডু মা দ্রৌপদীর অভিশাপ সইত্য হইব আইজ। আপনের হাতেই মরব আমি। কিন্তু আমারে ছুডু লাঠিয়াল ভাইবেন না জ্যাঠা। কাগুকৃষ্ণ ডরাইয়া অর্জুন কাকারে পাঠায় নাই আপনের সামনে। পাঠাইছে আমারে। সুতরাং বুঝতেই পারতাছেন…

কর্ণ কয়-  শুরু থাইকা আইজ পর্যন্ত এই কুরুক্ষেত্র টের পাইছে তোমার ক্ষমতা। তোমারে কেন; কোনো শত্রুরেই ছোট ভাবি না আমি…

– তাইলে আসেন জ্যাঠা। হইয়া যাক জ্যাঠায় ভাতিজায়। আপনের ঘোড়া মাইরা ফালাইলাম বইলা মনে কিছু নিয়েন না। রথের উপর বইসা তিরাতিরিতে কোনো বাহাদুরি আছে বইলা মনে হয় না আমার। আসোল লড়াই হইল সামনা-সামনি…

অন্ধকারে দীর্ঘ বর্শাই জুতসই হাতিয়ার। কর্ণ আর ঘটা দুইজনের হাতেই বর্শা। হাতিয়ার লড়াই আর গায়ের শক্তিতে অর্ধেক বয়সী ঘটোৎকচ খুব সহজ হইবার কথা না কর্ণের কাছে। তার উপর ঘটোৎকচের মূল কৌশল তার মায়াযুদ্ধ। কালো কুচকুচে ঘটা অন্ধকারে এক দিকে আক্রমণ কইরা মুহূর্তে অন্য দিকে সইরা যায় পাল্টা আক্রমণের টারগেট থাইকা; কিন্তু কর্ণ তিরাতিরির লাইগা বিখ্যাত হইলেও কুড়ালি পরশুরামের ঝুলিঝাড়া ছাত্র। অল্পকাল লড়াই কইরাই সে বুইঝা ফালায় ঘটার কলাকৌশল। ঘটা হাতের থাইকা পায়ের কাম করে বেশি। কর্ণ তার পা মাপে। নিশ্চিত হইয়া যায় ঘটা এর পরে কোনখানে লাফ দিব। এবং ঘ্যাঁচ…

ঘটা যেই দিকে গিয়া লাফ দিয়া খাড়াইব সেই দিকেই ঘটার হৃৎপিণ্ড বরাবর দুই হাতে বর্শা চালান দেয় কর্ণ। বর্শাটা ঘটার কাঁসার বর্ম ভাইঙ্গা বুকে বিঁধে পিছন দিকে বাইর হইয়া যায়। ঘটা পড়ে না আর কর্ণও বর্শাটা বাইর কইরা আনতে পারে না ঘটার বুক থাইকা; তার মধ্যেই আরেকটা ঘ্যাঁচ। ঘটার বর্শা বিধে যায় কর্ণের দেহে…

নিজের বর্শা ছাইড়া লাফ দিয়া সইরা আসে কর্ণ। বিন্দুমাত্র শব্দ না কইরা নিথর হইয়া পড়ে ঘটোৎকচ…

ঘটোৎকচ মরায় দুর্যোধন বাহিনী খুশি তাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু পাণ্ডবপক্ষে রথের উপর উইঠা খুশিতে নাচতে থাকে কৃষ্ণ। অর্জুন বড়ো বেশি বিরক্ত হয় কৃষ্ণের উপর- ঘটোৎকচ কথা কওয়ার সময় তোমারে ছাইড়া কথা কইত না ঠিক; কিন্তু তার মানে এইটা না যে সে মরায় দুর্যোধনের মতো তুমিও খুশিতে লাফাইবা। তোমার মনে রাখা উচিত সে আমার ভাতিজা; তার বাহিনীটাই আছিল আমাগো পয়লা সম্বল। আর সে আমাগো পক্ষের সবচে বড়ো যোদ্ধাদেরও একজন…

কৃষ্ণ কয়-  কেন লাফাই বুঝতে পারলে তুমিও লাফাইতা অর্জুন। ঘটোৎকচ মরার আগে কর্ণের বগলে বর্শা গাঁইথা গেছে। বাম হাতেই কিন্তু কর্ণ গুনে টান দিয়া তিরের নিশানা করে। ডানহাতি তিরন্দাজ কর্ণের বাম বগলে বর্শা বিধা মানে তার তিরাতিরির প্রায় শেষ এইটা বুঝলে খুশিতে তুমিও লাফাইতা অর্জুন। কর্ণ এখন পঙ্গু…

.

১৭

বড়ো বেঘোরে অসম্মানের মরা মরলেন দ্রোণ। নিজের শিষ্য তার চুলের মুঠায় ধইরা তলোয়ার দিয়া মাথাটা আলগা কইরা ফিককা ফালাইল কুরুক্ষেত্রের মাঠে। শত শত লাশের ভিড়ে শেষ পর্যন্ত তার নিজের পোলায়ও শেষকৃত্যের লাইগা খুঁইজা বাইর করতে পারল না দ্রোণের দেহখান…

মানুষটা জন্মাইছিল বিদ্বান পরিবারে; সাক্ষাৎ ঋষি অঙ্গিরার বংশে। বৃহস্পতি তার পিতামহ পিতা ভরদ্বাজ। কিন্তু কী জানি কী কারণে বিদ্যা শিক্ষা মুনিঋষিগিরি কিংবা পুরোহিতের কাম টানে নাই তারে। হইতে পারে তার শৈশবের দারিদ্র তাড়না। বাপ ভরদ্বাজ থাকতেন অন্যের বাড়িতে আশ্রিত হয়ে। বিছানা-বালিশ কিছুই দিতে পারতেন না দেইখা পোলারে তিনি ঘুম পাড়াইতেন শস্য রাখার ধামায়। সেই ধামা বা দ্রোণে শুইয়া শৈশব পার করলেও সারা জীবন দারিদ্রচিহ্ন দ্রোণ নামটাই হইয়া উঠে তার পরিচয়। বড়ো হইবার পর তার মনে হইল ঋষিপুত্র বা ব্রাহ্মণ হইলেও রাজা হওয়া যায়। সামনে তার আদর্শ আছিলেন জমদগ্নিপুত্র পরশুরাম; যিনি একাধারে ঋষি রাজা যোদ্ধা আর অস্ত্র বিশারদ…

বাপের টোলে পঠনপাঠন ছাইড়া তিনি গিয়া অস্ত্রে দীক্ষা নেন পরশুরামের ডেরায়। অস্ত্রবিদ্যা বহুত শিখলেও দারিদ্র্য তখনো তার পিছু ছাড়ে নাই; তখন হইছে তার দ্বিমুখী জ্বালা। বিদ্যাশিক্ষা করা। ব্রাহ্মণ থুইয়া তারে না ডাকে কেউ পুরোহিতের কামে; পরশুরামরে থুইয়া না আসে কেউ তার কাছে অস্ত্রশিক্ষা নিতে। অবস্থা তার এমনই হইল যে একমাত্র পোলা অশ্বত্থামারে এক ফোঁটা দুধ দিতে না পাইরা খাওয়াইতেন পিটুলিগোলা। তো এই অবস্থায় হঠাৎ তার মনে হইল ছুডুকালের সখা আর বাপের টোলের সতীর্থ দ্রুপদ এখন পাঞ্চালের সম্পদশীল রাজা…

বৌ-পোলা নিয়া তিনি তার কাছে হাজির হইয়া কন- দোস্ত। ছোটবেলা আমরা যা পাইতাম দুই বন্ধুতে আধাআধি ভাগ কইরা খাইতাম। তো তোমার এখন যে রাজ্য আছে তার আদ্ধেক আমারে দেও…

— বেকুবে কী কয়? ছোটকালের মিঠাইমণ্ডা ভাগাভাগি আর রাজ্য ভাগাভাগি কি এক?

দ্রুপদ তারে খেদাইয়া দিলে বৌবাচ্চা নিয়া তিনি আইসা আশ্রয় নেন হস্তিনাপুর রাজ্যের কুলগুরু তার বৌয়ের ভাই কৃপাচার্যের ঘরে। এই সময়টাতে ভীষ্ম তার নাতিগো লাইগা ভাবতাছিলেন অস্ত্রশিক্ষার কথা। কৃপাচার্যের সুপারিশে ভীষ্ম তারে মাস্টারির চাকরি দিলেন আর তিনি খালি দ্রোণ থাইকা হইয়া উঠলেন গুরু দ্রোণ কিংবা দ্রোণাচার্য…

রাজবাড়ির চাকরিতে ভালোই দিন যাইতেছিল তার। রাজকীয় বেতন-ভাতার বাইরে আশপাশের তরুণগো শিক্ষা দিয়া উপরি ইনকামও নেহাত মন্দ আছিল না তার। খানাদানা আর সম্মান সবই একলগে পাইবার কারণে হস্তিনাপুরের গদির নিকট তার আনুগত্যও আছিল প্রশ্নের অতীত। কোনো দিনও তিনি ধৃতরাষ্ট্রের কোনো কথায় যেমন রা করেন নাই; তেমনি পোলাগো যে কাণ্ডে ধৃতরাষ্ট্র নিশ্চুপ থাকছেন গুরু দ্রোণও সেই দৃশ্য না দেইখাই থাকছেন সর্বদা। যাদের লগে হস্তিনাপুরের শত্রুতা কিংবা সামান্য রেষারেষি আছিল; তাগো কারো পোলারেই তিনি জীবনে গ্রহণ করেন নাই নিজের অস্ত্র শিক্ষার স্কুলে…

আর্য জনজাতির হাতে নিজেগো ভিটামাটি হারানোর ক্ষোভে আদিবাসী নিষাদজাতি বরাবরই ক্ষত্রিয়গো জাতিগত শত্রু। এই কারণে নিষাদ বংশজাত হিরণ্য ধনুর পোলা একলব্যরে তিনি শিষ্য না কইরা ফিরাইয়া দিছিলেন। কিন্তু তার পরেও যখন গুরুকুলের বাইরে দূর থাইকা শিষ্যগো লগে দ্রোণের কারিগরি দেইখা নিজের চেষ্টায় একলব্য এক ভালো তিরন্দাজ হইয়া উঠল; তখন। হস্তিনাপুরের রাজবাড়িরে খুশি রাখার লাইগা তিনি তার বুড়া আঙ্গুলটাই কাইটা ফালাইলেন; যাতে জীবনেও আর কোনো দিন সে তির চালাইতে না পারে। কারণ তিনি জানতেন তার পক্ষে কোনো দিনও ভীষ্ম-ধৃতরাষ্ট্ররে বোঝানো সম্ভব হইব না যে কেন একলব্য কুরু-পাণ্ডব থাইকা বড়ো তিরন্দাজ হইয়া উঠল তার দেখাদেখি…

রাজকীয় চাকরি হারাইয়া না খাইয়া থাকার ডর তারে যেমন সারা জীবন অনুগত কইরা রাখছে হস্তিনাপুর গদির তেমনি নিজের পোলারে রাজা বানাইবারও একমাত্র অবলম্বন হিসাবে তিনি সারা জীবন নিজেরে অনুগত রাখছেন হস্তিনাপুর গদির। তিনি বিশ্বাস করতেন ধৃতরাষ্ট্রের পরে দুর্যোধনই হবে রাজা; তাই তার সমস্ত কোয়ালিশনই ছিল ধৃতরাষ্ট্র পোলাদের সাথে। যদিও তিনি শিষ্যগো মাঝে গর্ব করতেন অর্জুনরে নিয়া; বিশ্বাস করতেন যুধিষ্ঠিররে আর মুখে ছ্যা ছ্যা করলেও বিপদে ভরসা করতেন কর্ণের উপর…

হস্তিনাপুরের গুরুকুলে যখন তার পয়লা ব্যাচের শিক্ষা সমাপ্ত হইল তখন তিনি তার সকল শিষ্যের কাছে সম্মিলিতভাবে গুরুদক্ষিণা চাইয়া বসলেন জীবন্ত দ্রুপদ- দ্রুপদরে বন্দি কইরা আমার কাছে আইনা দেওয়াই হবে তোমাদের গুরুদক্ষিণা…

শত কুরু পাঁচ পাণ্ডব আর কর্ণ। এই একশো ছয়জন এক পক্ষ হইয়া জীবনে মাত্র একবারই যুদ্ধযাত্রায় গেছে; আর তা গেছে দ্রোণের খায়েশ পূরণ করতে…

শিষ্যরা দ্রুপদরে ধইরা আনলে মুক্তিপণ হিসাবে আদ্ধেক রাজ্য নিয়া নিজের পোলা অশ্বত্থামারে তিনি বানাইয়া ফালাইলেন দক্ষিণ পাঞ্চালের রাজা। কিন্তু তার পোলার তো কোনো রাজনৈতিক মিত্র নাই; দ্রুপদ যে থাবা দিয়া আবার তার রাজ্য ফিরাইয়া নিব না তার কী গ্যারান্টি? সেই গ্যারান্টি তিনি পাইলেন আবার সেই ধৃতরাষ্ট্রের কাছে দুর্যোধনের কাছে; আর তার বিনিময়ে সারা জীবন কুরুপক্ষে বান্ধা থাকলেন আনুগত্যের শিকলে…

ধৃতরাষ্ট্র আর দুর্যোধন তারে বহু কিছু দিছে। ধৃতরাষ্ট্র তারে দিছেন মন্ত্রীর পদ। দুর্যোধন তারে দিছে পাশায় জিতা পাণ্ডবরাজ্য ইন্দ্রপ্রস্থের রাজত্ব আর ভীষ্ম মরার পর কুরুপক্ষের প্রধান সেনাপতির পদ। কিন্তু যুদ্ধে মানুষটার যেকোনো অভিজ্ঞতাই নাই; তিনি যুদ্ধে যোগ দিছেন নিজের রাজ্য আর পোলার রাজত্ব টিকাইয়া রাখার খাতিরে। যদি কুরুপক্ষ হাইরা যায় তবে তার নিজের ইন্দ্রপ্রস্থ তো যাবেই; সাথে সাথে জামাইগো নিয়া দ্রুপদ ফিরাইয়া নিব তার পোলার দখলে থাকা দক্ষিণ পাঞ্চাল…

তিনি সেনাপতি হইবার পর পরিকল্পনা আর নেতৃত্বের অভাবে কুরুপক্ষের যুদ্ধ পুরাই আউলাঝাউলা হইয়া উঠে। যত দিন তিনি নেতৃত্ব দিছেন তত দিনই খালি একটার পর একটা প্রতিজ্ঞা করছেন আর বদলাইছেন কিন্তু কোনোটাই ঠিকমতো করতে পারেন নাই। আর অন্য দিকে পাণ্ডবেরা ধুমায়ে পিটাইছে কৌরব বাহিনীরে এই কয় দিন। এই কয় দিন তিনি ডরাইয়া দিন থাকতে যেমন যুদ্ধবিরতি ঘোষণা কইরা দিছেন তেমনি দুর্যোধনরে কিছু একটা দেখাইবার লাইগা রাত্তিরে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিছেন; বিরতি না দিয়া টানা যুদ্ধ করছেন; কিন্তু কিছুতেই কোনো ফল আসে নাই; উল্টা নিজের কপালে জুটছে শিষ্য দুর্যোধনের অকথ্য অপমান…

তার সেনাপতিত্বের পাঁচ দিন একমাত্র যে বুদ্ধিমানের কামটা তিনি করছেন; তা হইল সর্বদাই সবার পিঠ বাঁচাইবার লাইগা কর্ণরে কভারে রাখা; না হইলে হয়ত চারপাশ থিকা ঘিরা ধইরা পাণ্ডবেরা কৌরবগো পিটাইয়া তক্তা বানাইত অত দিনে…

চৌদ্দ নম্বর দিন জয়দ্রথ মরার পর রাত্তিরের যুদ্ধে কর্ণের হাতে ঘটোৎকচ মরায় পাণ্ডবপক্ষের কমান্ডের চেইন পুরাটাই ভাইঙ্গা পড়ে যুধিষ্ঠিরের আবেগে। জীবনে মাত্র একবার কৃষ্ণের উপর প্রকাশ্যে খেইপা উঠে যুধিষ্ঠির- ধিক কৃষ্ণ। ধিক। এই পুরা যুদ্ধটা তেরো বছর দেরিতে হইছে শুধু যেই কর্ণের ভয়ে; তেরোটা বছর ধইরা অর্জুন যেখানে প্রস্তুতি নিছে কর্ণরে মোকাবেলার; শুধু যে কর্ণরে ঘায়েল করার লাইগা তুমি নিজে হইছ অর্জনের সারথি; সেইখানে কি না তুমি না পাঠাইলা অর্জুনরে; গেলা নিজে কর্ণের সামনে; ঘটোৎকচ পোলাটারে তুমি মরতে পাঠাইলা কর্ণের হাতে। ধিক কৃষ্ণ ধিক…

ঘটোৎকচ মরায় বুক চাপড়াইয়া কান্দে যুধিষ্ঠির- যে পোলাটায় বাপ-জ্যাঠার কাছ থিকা এক ফোঁটা আদর খাদ্য শিক্ষা কিংবা সুরক্ষা কোনো দিনও পায় নাই; তবু বনবাসের দুর্দিনে জ্যাঠা-কাকার মালপত্র টানা; এমনকি সৎমায়েরে কান্ধে নিয়া পর্বত পার করার বেগারটারও দিছিল বিনা প্রশ্নে যার বাহিনীটা আছিল আমাগো পয়লা সম্বল; সেই ঘটোৎকচ মরায় তুমি দুর্যোধনের মতো খুশিতে লাফাও? ধিক কৃষ্ণ ধিক…

পাণ্ডবপক্ষের যুদ্ধ পুরাটাই কৃষ্ণ-যুধিষ্ঠিরের পরিকল্পনা আর অর্জুন-কৃষ্ণের পরিচালনা। জীবনেও কেউ কৃষ্ণের উপর যুধিষ্ঠিররে খ্যাপতে দেখে নাই। এই খ্যাপা যুধিষ্ঠিরের সামনে যাইতে কৃষ্ণ ডরায়।

অন্য কেউ সাহস করে না কিছু কইতে; পোলা হারাইয়া ভীম বইসা থাকে হাঁটুতে মুখ গুঁইজা আর যুধিষ্ঠির নিজের বর্ম ঠিকঠাক করে- ঠিকাছে কৃষ্ণ। তুমি নিরাপদ থাইকা নিজের আর অর্জুনরে জান বাঁচাও। আমিই যাই। একটার পর একটা পোলাপানের মরণ দেখার থাইকা কর্ণের হাতে মইরা যাওয়াই বহুত ভালো আমার…

যে যুধিষ্ঠির তেরো বচ্ছর ঠিকমতো ঘুমায় নাই কর্ণের ডরে; সে আইজ রওনা দিছে কর্ণের লগে যুদ্ধ করতে। কৃষ্ণ অনুমান করে এইটা শুধু ঘটোৎকচের মৃত্যুই না; ঘটোৎকচের ছোট পোলা বর্বরীকের মৃত্যুর কারণেও যুধিষ্ঠির মনে মনে খ্যাপা কৃষ্ণের উপর…

ঘটার ছোট পোলা বর্বরীক এই বয়সেই ঋষি হিসাবে বহুত সুখ্যাত ছিল। যুদ্ধকৌশলে সে সবাইরে ছাড়াইয়া গেছিল একলগে তিনটা তির ছোঁড়ার ক্ষমতায়। একবারে ধনুক টান দিয়া লক্ষ্যে তিন তিনটা বাণ ছুঁড়তে পারত বইলা তিনবাণধারী নামে এরই মাঝে সে বিখ্যাত ছিল। এতে পাণ্ডবগো সুবিধাই হইবার কথা আছিল। কিন্তু এই তিনবাণধারী বর্বরীকেরে তার মা অহিলাবতী ছোটকালে কইছিল সর্বদা দুর্বলের পক্ষে থাকতে সেজন্য সর্বদাই হারুপাটির পক্ষে থাকতে থাকতে এক্কেবারে ঋষি হারু কি সহায় হইয়া উঠছিল সে। তো যুদ্ধ শুরুর আগে যখন সৈন্যসামন্তের কমান্ড ঠিক করা হয় তখন এই হারু কি সহায় বাঁধাইল ঝামেলা- মোর মায়ে মোরে কইছে বরাবর দুব্বলের পক্ষে থাকতে…

কৃষ্ণ তারে নিরালায় নিয়া জিগায়- তা তুমি কেমনে দুব্বল আর সবল ঠিক করবা নাতি? বর্বরীক কয়-  যুদ্ধে পয়লা আমি কারো পক্ষই নিমু না। খাড়াইয়া দেখব কারা হাইরা যাইতাছে। তারপর সেই হারুপাট্টির লগে গিয়া যোগ দিমু…। কৃষ্ণ কয়-  আইচ্ছা মনে করো যুদ্ধ শুরু হইবার পর দেখা গেলো তোমার বাপ-দাদার দল পাণ্ডবপক্ষ হাইরা যাইতাছে; তাইলে তো তুমি গিয়া পাণ্ডবপক্ষে যুদ্ধ করবা। ঠিক কি না?

বর্বরীক কয়-  হ ঠাকুরদা। এক্কেবারে ঠিক কৃষ্ণ কয়-  তো নাতি; তিরাতিরিতে যেহেতু তোমার সুমান কেউ নাই। তো ধরো গিয়া তুমি পাণ্ডবপক্ষে আধা বেলা যুদ্ধ করলে তোমার মাইর খাইয়া কুরুপক্ষ আবার দুব্বল হইয়া পড়ব। তখন তুমি কি কুরুপক্ষে যাবা?

বর্বরীক কয়-  অবশ্যই যাব। এইটাই আমার ফিলসফি; দুব্বলের পক্ষে থাকা; এইটাই মোরে মোর মায়ে শিখাইছে…

কৃষ্ণ কয়-  তোমার মা খুব বুদ্ধিমান নারী; ভালো জিনিসই শিখাইতে চাইছে তোমারে; কিন্তু মনে লয় গুলাইয়া ফেলাইছ তুমি। আইচ্ছা; তারপর কুরুপক্ষ থাইকা তোমার মাইর খাইয়া যখন আবার পাণ্ডবরা দুব্বল হইয়া পড়ব তখন?

— তখন আবার পাণ্ডবপক্ষে আসুম

— তারপর আবার কুরুপক্ষ দুব্বল হইলে তাগো পক্ষে?

বর্বরীক কয়-  হ। তাই তো হিসাব…

কৃষ্ণ হাসে- এই হিসাবে চললে তো যুদ্ধের শেষে তুমি ছাড়া যেমন জীবিতও থাকব না কেউ; তেমনি বিজয়ীও হইব না কেউ। দুই পক্ষের সবাইরে মরতে হইব তোমার কেরামতি তিরে…

— মরলে মরব। কারণ জয়-পরাজয় বাঁচা-মরা এইগুলা আমার দেখার বিষয় না। আমার দেখার বিষয় হইল আমি দুব্বলের পক্ষে আছি কি নাই…

এমন বেকুব ষাঁড় যুদ্ধের লাইগা বড়োই মুশকিল। তার বাপ ঘটোৎকচ যতই তক্ক করুক না কেন পাণ্ডবগো নিকট তার আনুগত্য প্রশ্নের অতীত। ঘটার বড়ো পোলা অঞ্জনপৰ্বাও বাপের মতো। কিন্তু ছোট পোলা বর্বরীক অসাধারণ তিরন্দাজ হইবার পাশাপাশি অতি শিক্ষিত হইয়া বাঁধাইল গন্ডগোল। যুদ্ধের মাঠে অনিয়ন্ত্রিত কিংবা অতি স্বতন্ত্র মিত্র শত্রুর থাইকা ভয়ানক; যার ফলাফল এরই মাঝে। টের পাইতে শুরু করছে দুর্যোধন। তার পক্ষে বহুত বড়ো যোদ্ধা আছেন; কিন্তু সকলেই চলেন নিজস্ব সিদ্ধান্তে। নিজের অহংকারে এরই মাঝে দুর্যোধনরে যুদ্ধে ঠেইলা দিয়া ঘরে বইসা তামাশা দেখতাছে কর্ণ। কে জানে পরে বাকিরা কী করে। কিন্তু পাণ্ডবপক্ষে সেইটা হইতে দেওয়া যাবে না…

ঘটোৎকচের পোলা হারু কি সহায় তিনবাণধারী ঋষি বর্বরীকরে আর কেউ দেখে না কোথাও। কৃষ্ণ তার কাটা মুন্ডুটা উঁচা এক পাহাড়ের উপর রাইখা আইসা কয়-  ঋষিসাব বাপদাদাগো বিজয় কামনায় স্বেচ্ছায় আত্মবলিদান দিয়া পাহাড়ের উপর বইসা নিরপেক্ষভাবে যুদ্ধ দেখার সিদ্ধান্ত নিছেন…

কেউ কিছু কয় না। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের মনে হয় নাদান নাতিটারে জানে না মাইরা অন্য উপায়েও হয়ত যুদ্ধ থাইকা সরানো যাইত…

কৃষ্ণ আর অর্জুনের উপর খেইপা যুধিষ্ঠির রওনা দিছে কর্ণরে মারতে। যুধিষ্ঠির হাঁটে আর বকবক করে-এখন পর্যন্ত দ্রোণ কিংবা কর্ণের বিষয়ে কারো মাথাব্যথা নাই। অথচ তারাই সবচে বড়ো শত্রু। যুদ্ধ তো একলাই করতাছে ভীম। অভিমন্যু মারা যাওয়ায় আমিও কষ্ট কম পাই নাই। কিন্তু তাই বইলা জয়দ্রথের পিছনে কেন অত বড়ো প্রতিজ্ঞা? অভিমন্যুরে মারছে দুঃশাসনের পোলা; জয়দ্রথরে মাইরা কী লাভ হইল কৃষ্ণ কিংবা অর্জুনের?

একে তো কর্ণের দিকে যুধিষ্ঠির রওনা দেওয়ায় পাণ্ডবপক্ষ পুরাটাই বেকুব তার উপরে তারা উতলা হইয়া উঠে যখন দেখে কৃষ্ণরে খুঁইজা পাওয়া যাইতাছে না কোথাও। অর্জুন খাড়াইয়া একবার যুধিষ্ঠিররে দেখে আরেকবার সারথিবিহীন রথের দিকে তাকায়…

যুদ্ধ বাদ দিয়া পাণ্ডবপক্ষ হায় হায় করে আর গোস্বায় গোঁ গোঁৎ কইরা হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ যুধিষ্ঠির শোনে- খাড়াও। বেকুবি করতাছ ক্যান? কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের গলা। কৃষ্ণ ধইরা আইনা কৃষ্ণ দ্বৈপায়নরে খাড়া কইরা দিছে খ্যাপা যুধিষ্ঠিরের সামনে…

দ্বৈপায়ন যুধিষ্ঠিররে আটকাইয়া কন- আইজ ঘটোৎকচ না মরলে অতক্ষণে অর্জুনের মরণ কান্দনে

যে তোমার বুক চাপড়াইতে হইত এইটা বোঝো? বড়ো শত্রুরে একলা ঘায়েল করা যায় না। ধাপে ধাপে অনেকের সম্মিলিত চেষ্টাতেই কাবু হয় বড়ো বড়ো শত্রু। ঘটোৎকচ মরার আগে কর্ণরে বড়ো রকমে ঘায়েল কইরা গেছে; এখন অর্জুন যুদ্ধ করলে তারে পরাজিত করা সম্ভব। বুঝছ?

কৃষ্ণ আইসা তার রথের লাগাম ধরে কিন্তু পাণ্ডবপক্ষে আর কেউ সেই রাত্তিরে যেমন যুদ্ধের কথা ভাবে না; তেমনি কুরুপক্ষও ঘটা মরার আনন্দে কিছু লাফাইয়া যুদ্ধের চিন্তা বাদ দেয়। টানা এক দিন এক রাইতের ক্লান্তিতে দুই পক্ষই যে যেখানে পারে ঝিমায়। আর কুরুক্ষেত্রের মাঠে পাগলা খোঁজা খুঁইজা দুর্যোধন শেষ পর্যন্ত ডেরায় আইসা দেখে নাক ডাকাইয়া ঘুমাইতাছেন সেনাপতি দ্রোণ…

দুর্যোধন ঝাঁকি দিয়া তারে জাগাইয়া খেক খেক কইরা উঠে-ঘুমান ক্যান? ঘুমাইয়া কী সুযোগটা ছাড়ছেন আপনি জানেন? ঘটা মরায় বেসামাল পাণ্ডবগো উপর আক্রমণ করলে যে অতক্ষণে যুদ্ধ শেষ হইয়া যাইত এইটা বোঝেন?

দ্রোণ চোখ ডলেন। দুর্যোধন ঝাড়ি লইতে থাকে- ঘুমান ঘুমান। ব্রাহ্মণের তো আবার সবকিছু উপরে খাওন আর আরাম। নাক ডাকাইয়া ঘুমান। তারপর কাইল সকালে পাণ্ডবরা যখন বিশ্রাম কইরা তাগড়া হইব তখন গিয়া আপনে তির দিয়া তাগো বগল চুলকাইয়া দিয়েন…

দুর্যোধনের ধাতানি খাইয়া ঘুম ফালাইয়া দ্রোণ চিক্কর লাগান- যুদ্ধ কিন্তু বিরতি হয় নাই। আক্রমণ…

দুর্যোধন কয়- হ। ঘরে বইসা আক্রমণ কইলেই আক্রমণ হয়। হালার অকম্মা বামুন; খালি ভড়ং…

দ্রোণ আর অপমান গায়ে মাখেন না। নিজের বর্মটর্ম পরতে পরতে কন- তোমারে আমি কথা দিলাম; সমস্ত পাঞ্চালগো না মাইরা বর্ম খুলব না আমি…

দুর্যোধন কয়-  আপনে তো ডেলি ডেলি নতুন পণ করেন আর দিনের শেষে পয়দা করেন ঘোড়ার আন্ডা। যাউক গা; পণ কইরাও পাণ্ডবগো তো কিছু করতে পারলেন না; এখন পাঞ্চালগো কিছু করতে পারলেও একটা কামের কাম হয়…

দুর্যোধনের কাছে পাদানি খাইয়া দ্রোণ সূর্য উঠার আগেই বিরাট আর দ্রুপদরে মাইরা ফালান। কিন্তু তারপর অন্ধকারেই তার সামনে আইসা খাড়ায় ভীম আর ধৃষ্টদ্যুম্ন। ভীম ধৃষ্টদ্যুম্নরে কয়-  আইজ বাপের শেষকৃত্যের চিন্তা করবা নাকি প্রতিশোধ নিবা সেইটা এখন তোমার ভাবনার বিষয়…

পনেরো নম্বর দিন সূর্য উঠার পর দুর্যোধন গিয়া পড়ে বাল্যবন্ধু আর সতীর্থ সাত্যকির সামনে।

দুর্যোধন কয়-  দোস্ত কী দিন আছিল আর কী দিন আসলো রে ভাই। তুমি আর আমি কত খেলাই না একলগে খেলছি আচার্যের ঘরে। কিন্তু কী থাইকা কী যে হইল। আইজ তুমি আর আমি অস্ত্র লইয়া মুখামুখি। তুমি কি কইতে পারো বন্ধু আমাদের খেলার দিনগুলা কই গেলো আর কেনই বা শুরু হইল এই যুদ্ধ? আর যেসব কিছুর লাইগা এই যুদ্ধে জড়াইছি আমরা; তা পাইলেই বা কী লাভ হইব আমাদের? সাত্যকি কয়-  সকল আকাম-কুকাম সাইরা এখন আফসোস কইরা কী লাভ? খেলাঘরের বয়সে খেলছি; এখন যুদ্ধে যা করার তাই করা ভালো। আসো…

দ্রুপদ মরার পর পাঞ্চালরা এমনিতেই কিছুটা মনমরা আছে। তার উপর দ্রোণ আইজ পুরাই খ্যাপা পাঞ্চালগো উপর। কৃষ্ণ অর্জুনরে কয়-  দ্রোণরে থামাইতে হবে। পোলা অশ্বত্থামার মৃত্যুসংবাদ শুনলে তিনি বেদিশা হইয়া উঠবেন। তুমি তার কানে অশ্বত্থামার মৃত্যুসংবাদ পৌঁছাইবার ব্যবস্থা করো…

অর্জুন কয়-  ছি ছি ছি। এমন মিছা কইয়া জয়ের থাইকা পরাজয়ই তো ভালো…

অর্জুনের যুক্তিতে পাত্তা দেয় না কেউ। সকলে এই বিষয়েও একমত হয় যে কথাখান যুধিষ্ঠির কইলে বিনা প্রশ্নে দ্রোণ তা বিশ্বাস যাইবেন। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের আবার সত্য বলার বাতিক আর সুনাম দুইটাই আছে। সে মুলামুলি করে- এক্কেবারে ঠাডা মিছা কেমনে কই কৃষ্ণ? একটা ব্যবস্থা করো না যাতে সংবাদটাও গুরুর কানে দেওয়া যায় আর আমার সত্য বলার সুনামটারও ক্ষতি না হয়…

কৃষ্ণ কয়-  মালবরাজ ইন্দ্রবর্মার একটা হাতির নাম অশ্বত্থামা। ভাই ভীম; যান তো; ইন্দ্রবর্মার হাতি অশ্বত্থামারে গদা দিয়া শুয়াইয়া আসেন…

ভীম ইন্দ্রবর্মার হাতি অশ্বত্থামারে মাইরা দ্রোণের নিকট গিয়া দেয় চিক্কর-অশ্বত্থামারে মাইরা ফালাইছি হোহ হো…

দ্রোণ কাইপা উঠেন। হাত শিথিল হয় তার। মিথ্যা বলায় ভীমের গলা কাপে না জানলেও কথাখান ফালাইয়া দিতে পারেন না দ্রোণ। যুদ্ধ থুইয়া তিনি দৌড়ান যুধিষ্ঠিরের কাছে- বাপ। আমি জানি মইরা গেলেও তুমি মিছা কও না। ভীমে যে কইল সে অশ্বত্থামারে মাইরা ফালাইছে; তুমি কও তো বাপ কথাখান কি হাছা?

কৃষ্ণ আইসা খাড়ায় যুধিষ্ঠিরের পিছনে; হালায় না আবার সত্য বলার বাহাদুরি নিতে যায়। কৃষ্ণ কানে কানে কয়-  মনে রাইখেন দ্রোণ আরো আধা বেলা যুদ্ধ করলে কিন্তু আমাগো খবর আছে। যেমনে যা কইছি তেমনে তা কন…

ভীম আরেকপাশ থাইকা যুধিষ্ঠিররে গুঁতা দেয়- জীবন রক্ষার লাইগা মিথ্যা কইলে পাপ হয় না। বাঁইচা থাকাই সবচে বড়ো পুণ্যের কাম। যেরাম পরিকল্পনা হইছে সেরামই কইবা কিন্তু। আর সবচে বড়ো কথা হইল আমি তো হাতি অশ্বত্থামারে সত্য সত্যই মারছি। কৃষ্ণ যেমন শিখাইয়া দিছে; তেমনি খালি কও-হ। অশ্বত্থামা মইরা গেছে…

যুধিষ্ঠির আমতা আমতা করে। কৃষ্ণ আর ভীম তারে চাইপা ধরে। দ্রোণ তাকাইয়া আছেন যুধিষ্ঠিরের দিকে-তুমি না কইলে আমি বিশ্বাস যামু না যে অশ্বত্থামা মইরা গেছে ভীমের গদায়…

আরেকবার কৃষ্ণ আর ভীমের দিকে তাকাইয়া; টোক গিলা দ্রোণের দিকে চোখ রাইখা চিক্কর দিয়া যুধিষ্ঠির কয়-  অশ্বত্থামা মইরা গেছে গুরু। তারপর একটু থাইমা আস্তে আস্তে কয়-  তবে সেইটা একটা হাতি…

পরের কথাটা দ্রোণের কানে যায় না। যুধিষ্ঠির কৃষ্ণ আর ভীমের দিকে তাকায়- তোমরা যা কওয়াইতে চাইছিলা তাও যেমন কইলাম তেমনি শেষের কথাটা জুইড়া দিলাম যাতে আমারে কেউ মিথ্যুক না কয়…

দ্রোণ আউলা হইয়া উঠেন। অশ্বত্থামা মইরা গেলে কার লাইগা এই সব? ধৃষ্টদ্যুম্ন আর ভীম সবেগে আক্রমণ শানায় দ্রোণের দিকে। ধৃষ্টদ্যুম্নের তিরে রথ থাইকা মাটিতে পইড়া যান দ্রোণ। ভীম কাছে গিয়া দেয় গালি-হালা লোভী ছোটলোক বামুন। এক পোলারে রাজা বানাইবার লাইগা বহুত আকাম করছ তুমি। এইবার মিটাইবা হিসাব…

রক্তাক্ত দ্রোণ মাটিতে পইড়া সাহায্যের আশায় কর্ণ দুর্যোধন কৃপ কইয়া চিল্লাইতে থাকেন আর বিশাল এক তলোয়ার বাগাইয়া ধৃষ্টদ্যুম্ন দৌড়াইতে শুরু করে দ্রোণের দিকে। পিছন থাইকা হায় হায় কইরা উঠে অর্জুন- ধৃষ্টদ্যুম্ন। দোহাই; গুরুরে মাইরো না; তারে জীবিত বন্দি করো কিন্তু মাইরো না গো ভাই…

ধৃষ্টদ্যুম্নের হাতে তলোয়ার দেইখা মাটিতে মাথা নামাইয়া গলা লুকান দ্রোণ কিন্তু এক হাতে চুলের মুঠা ধইরা অন্য হাতে গুরুর টানটান গলায় তলোয়ার চালাইয়া মাথাটা আলগা কইরা ফালায় নিজের শিষ্য ধৃষ্টদ্যুম্ন…

দ্রোণের মৃত্যুতে ধৃষ্টদ্যুম্নর উপর অশ্বত্থামা খ্যাপে বাপের চুলের মুঠা ধরায় আর অর্জুন খেপে গুরুরে মারায়। দ্রোণের মৃত্যুতে যুধিষ্ঠিরের উপর অশ্বত্থামা খ্যাপে মিছা কথা কওয়ায় আর অর্জুন খ্যাপে শেষ বয়সে আইসা খালি জয়ের লাইগা কলঙ্ক মাখায়। দ্রোণের মৃত্যুতে অশ্বত্থামা খেইপা শুরু করে পাগলা মাইর আর অর্জুন খেইপা বইসা থাকে হাত পা গুটাইয়া…

যুধিষ্ঠির সবাইরে ডাইকা কয়-  মহাপাপ মহাভুল হইছে আমাদের। আমরা আমাদের মহান শুভাকাঙ্ক্ষী গুরুরে মাইরা ফালাইছি; যিনি পাশার আসরে পাঞ্চালীর প্রশ্নে মুখ ঘুরাইয়া নিছিলেন। যিনি অভিমন্যু হত্যার পরিকল্পনা করছিলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন; তুমি বহুত করছ ভাই এইবার তোমার সেনা নিয়া তুমি বাড়ি ফিরা যাও। সাত্যকি তুমিও বাড়ি ফিরা যাও তোমার লোকজন নিয়া। কৃষ্ণ যা করে করুক; আমি গুরুমারা পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে ভাইবেরাদর নিয়া আগুনে ঝাঁপ দিমু। এতে অর্জুনও খুশি হইব আর আমাদেরও গুরুমারা পাপ খণ্ডণ হবে…

যুধিষ্ঠির অর্জুনরে শুনাইয়া শুনাইয়া এই সব কথা কয় আর কৃষ্ণ গিয়া সকল সৈনিকরে কয় অস্ত্র ফালাইয়া দিতে। কৃষ্ণের কথাটা ভীম ধরতে পারে না তাই গদা নিয়া খাড়াইয়াই থাকে। কৃষ্ণ গিয়া ভীমের গদা টান দিয়া হাত থিকা ফালাইয়া কয়-  দ্বৈপায়নের নিয়ম মনে নাই? ভীম বুইঝা চোখ তুইলা দেখে তার বুক বরাবর তির ধইরা বেকুব হইয়া থাইমা গেছে অশ্বত্থামা পাণ্ডবরা অস্ত্র ফালাইয়া বইসা থাকলে সে আক্রমণ করে কেমনে?

অশ্বত্থামা ফিরা যায় আর ভীম কয়- হ। দ্বৈপায়ন ঠাকুরের নিয়মগুলা বেশ কামের…

.

১৮

অবশেষে কর্ণ আর অর্জুন মুখামুখি

সতেরো নম্বর দিন শেষ বিকালে বিনা ঘোষণাতেই দুই পক্ষের সকল অস্ত্র থাইমা যায়। কেউ কাউরে মারে না; সকলে দর্শকই হইয়া আইসা খাড়ায় দুই যোদ্ধার লড়াই দেখতে…

দ্রোণ মরার পর ষোলো নম্বর দিন থাইকা কর্ণ কুরু সেনাপতি। এর আগের দুই সেনাপতি হইছিল কর্ণের প্রস্তাবে আর কর্ণের নাম প্রস্তাব করে অশ্বত্থামা। দুর্যোধন কয়-  আইজ আমি আমার মূল সেনাপতিরে পাইলাম সূতপুত্র; তুমি সামনে থাকলে অর্জুন-কৃষ্ণ কেউই সাহস করব না আগাইতে…

ষোলো নম্বর দিন পাণ্ডবগো সকল চেষ্টা কর্ণরে ঘিরা রচিত হইলেও অর্জুন সামনে আসে নাই তার। অর্জুন দূরে দূরে খুচরা সেনাসৈনিক মারছে আর কৌরবগো পিটাইছে সাত্যকি ভীম…

গুরুমরার দুঃখে ষোলো নম্বর দিনও অর্জুন উদাসীন কিন্তু আগের দিনের মতো সেদিনও গুরুপুত্র তিরাইতে ছাড়ে না তারে। অশ্বত্থামা তিরাইয়া কৃষ্ণ অর্জুন দুইজনরেই রক্তাক্ত কইরা ফালানোর পর কৃষ্ণের খোঁচায় অর্জুন উইঠা অশ্বত্থামারে ভাগায়। তারপর কৃষ্ণ তারে টাইনা নিয়া গেলে হাতি বাহিনীর নেতা মগধরাজা দণ্ডধররে ফালাইয়া আইসা আবার সে সংশপ্তকগো লগে তিরাতিরি করে…

অশ্বত্থামা মারে পাণ্ডরাজরে। নকুল গিয়া খাড়ায় কর্ণের সামনে- আইজ তরে নরকে পাঠামু আমি… কর্ণ কয়-  আগে তুমি কী কী যুদ্ধ জানো তা আমারে দেখাও…

কর্ণ নকুলের রথ আর ঘোড়া শুয়াইয়া ফালাইলে নকুল একটা মুগুর নিয়া আগায়। সেইটাও কর্ণের আঘাতে পইড়া গেলে নকুল দেয় ভাগল। কর্ণ দৌড়াইয়া গিয়া ধনুকের ছিলায় নকুলের গলা আটকাইয়া থামায়- পলাও কেন বাহাদুর? আগে যা কইছিলা তা আরেকবার কও তো শুনি?

নকুল কথা কয় না। কর্ণ কয়- যাও। নিজের থাইকা বড়ো কারো লগে যুদ্ধ না করাই ভালো…

কর্ণ তারে ছাইড়া দিছে এইটা নকুল বিশ্বাস করতে পারে না। সে বেকুবের মতো গিয়া যুধিষ্ঠিরের রথে উঠে- ভাইজান। বন্দি কইরাও কর্ণ আমারে ছাইড়া দিছে…

যুধিষ্ঠির দীর্ঘশ্বাস ছাইড়া কয়- কার মনে কী আছে কে জানে ভাই। তবে আমরা কিন্তু পাইলে তারে ছাইড়া দিমু না…

ষোলো নম্বর দিনে কর্ণের হাতে পাঞ্চাল; অর্জুনের হাতে ত্রিগর্ত সংশপ্তক; ভীমের হাতে কুরুসেনা ছত্রখান হয়। যুধিষ্ঠিরের মাইর খাইয়া দুর্যোধন অজ্ঞান আর সত্যসেনের শাবলের আঘাতে বাম হাত বিদ্ধ হইয়া কৃষ্ণ রথ থাইকা পইড়া গেলেও দিনের শেষে দেখা যায় লাভের হিসাব পাণ্ডবগো দিকেই। ভারী…

সতেরো নম্বর দিন কর্ণের শুরু হয় অর্জুনের হাতে মরা কিংবা অৰ্জুন মারার প্রতিজ্ঞা আর শল্যরে নিজের সারথি কইরা…

গাড়োয়ানের পোলার রথে গাড়োয়ানি করতে রাজা শল্য সহজে রাজি হয় নাই। দুর্যোধন বহুত তেলানির পর; কৃষ্ণের লগে তুলনা করার পর সে রাজি হয় একটা শর্ত দিয়া- একটা শর্তে আমি ছোটলোকের পোলার সারথি হমু আর তা হইল তারে যা ইচ্ছা গালাগালি করার অধিকার থাকব আমার…

সকলে শর্ত মাইনা নিলে শল্য কয়-  দুর্যোধন। কর্ণ যদি অর্জুনরে মাইরাও ফালায় তবু মনে রাইখ; কৃষ্ণ কিন্তু তোমাগোরে শুয়াইয়া ফালাইব। আইজ পর্যন্ত কৃষ্ণের বিপক্ষে কাউরে জিততে শুনি নাই আমি…

দুর্যোধন কয়-  আরে রাখেন। আপনে আছেন না? কৃষ্ণ কি কোনো দিন আপনের সামনে খাড়াইছে?

শল্য ফুইলা উইঠা নিজের সম্পর্কে বহুত কথা কর্ণরে শুনায়-হ। আমি হইলাম গিয়া ইন্দ্রের সারথি হইবার যোগ্য। তোমার সাত জন্মের কপাল যে আমি তোমার সারথি হইছি। যাউক গা; চিন্তা কইরো না; আমি তোমার রথ চালাইলে তোমার ভয়ের কিছু নাই…

কর্ণ কয়-  আপনে খালি রথটা ঠিকমতো চালাইয়েন। যা করা লাগে আমিই করব…

শল্য কয়-  তুমি দেখি আমারে অবহেলা করার লগে লগে পাণ্ডবগোও অবহেলা শুরু কইরা দিলা। তুমি কি জানো যে অর্জুনের গাণ্ডিবের আওয়াজ শুনলে তোমার গুমুত বাইরাইয়া যাইব ডরে?

কর্ণ কয়-  চলেন যাই; পাণ্ডবগো দিকেই নিয়া চলেন…

সূতপিতা অধিরথের নিজের হাতে তৈয়ারি কর্ণের রথের চাকায় ঘরঘর শব্দ হয় না। চার ঘোড়ায় টানা এই হালকা রথ প্রায় নিঃশব্দে চলে। শল্য রথ চালায় আর কর্ণরে খোঁচায়- আমার কিন্তু সত্যি সত্যি হাসি পায় গাড়োয়ানের পুত; তুমি যাইতাছ অর্জুনরে মারতে; হি হি হি। কই নরশ্রেষ্ঠ অর্জুন আর কই নরাধম তুমি। এরেই কয় তালের গোটা আর বালের গোটায় তুলনা…

শল্য ঘ্যান ঘ্যান কইরা অর্জুন বন্দনা করে আর কর্ণরে খোঁচায়- আইজ তোমার বাঁচার একমাত্র পথ হইল যুদ্ধ ছাইড়া ভাগল দেওয়া। না হইলে বেঘোরে মরণ নিশ্চিত তোমার…

পাণ্ডবগো সামনে আইসা কর্ণ দেখে অর্জুন কোথাও নাই। সে চিল্লায়- যে আইজ অর্জুনরে দেখাইয়া দিতে পারব; তারে আমি যা চায় তাই পুরস্কার দিমু…

শল্য কয়-  অর্জুনরে খুঁজতে হইব না আর পুরস্কারের লাইগা তোমার টেকাও খর্চাইতে হইব না। যখন তোমার মরণ ঘনাইয়া আসব তখন অর্জুন আপনাতেই তোমার সামনে আইসা খাড়াইব। অপেক্ষা করো…

কর্ণ কয়-  আপনের মতো মিত্র থাকলে আর শত্রুতে কী কাম? আমার তো মনে হয় অর্জুনের তিরে মরার আগে আপনের কথার বিষেই মইরা যামু আমি। আপনে আমার সারথি হইছেন নাকি আমার রথে উঠছেন আমারে ডর দেখাইতে?

শল্য কয়- ডর দেখানোর আবার কী আছে? তুমি হইলা গিয়া একটা পাতিশিয়াল আর অর্জুন একটা সিংহ। সিংহের লগে শিয়ালের যুদ্ধে কী হইতে পারে তা কইলে কি ডর দেখানো হয়?

কর্ণ কয়- কথা দিয়া শূল বিদ্ধ করেন বইলাই মনে হয় আপনের নাম হইছে শল্য। অন্য কোনো গুণের কথা তো আপনের নিজের মুখ ছাড়া কারো মুখে শুনে নাই। আর আপনে যে কৃষ্ণ আর অর্জুনরে নিয়া অত প্যানপ্যান করেন; আপনে জাইনা রাখেন যে আমি কৃষ্ণ আর অর্জুনের ক্ষমতা সম্পর্কে যতটা জানি; তার থাইকা বেশি কেউ জানে না। তারপরেও আমি তাগোর সামনে যাইতাছি; এর মানে অবশ্য আপনের বোঝার কথা না যে আমার আত্মবিশ্বাস আর ক্ষমতা কতটুকু। আমার দুর্ভাগ্য; অর্জুনের রথ চালায় তার বন্ধু আর আমার রথ চালায় এক বিষাক্ত বাঁচাল…

শল্য খেক খেক কইরা উঠলে কর্ণও খ্যাপে- আরে তোমাগো ছাতু খাওয়া মদ্রদেশের মাইনসের স্বভাবই তো এই মাছে-মাংসে-মদে যারা একলগে মাখাইয়া খায় তাগো কাছ থিকা কথার চেয়ে বেশি আর কীই বা আশা করা যায়? এর লাইগা সবাই কয়; মদ্রদেশের লোকের লগে শত্রুতা মিত্রতা দুইটাই জঘন্য। সাপুড়েরা বিষ ঝাড়ার সময় মিয়া তোমাগো নাম কইরা সাপের বিষ নামায়। তোমরা এতই বিষাক্ত যে তোমাগো নাম শুনলে সাপের বিষও নাইমা যায়। তোমাগো দেশের মাইয়ারা মদ খাইয়া ন্যাংটা হইয়া নাচে; উট আর গাধার মতো খাড়াইয়া ঠ্যাং চেগাইয়া মোতে আর মদের পয়সার লাইগা পোলা কিংবা স্বামীরেও বেইচা দেয়। সেই দেশের মানুষ হইয়া বড়াই করো মিয়া? হালা পাণ্ডবের দালাল। তুমি খালি প্রকাশ্যে দুর্যোধনের পক্ষে আছ আর আমারও মাইনসেরে মাফ কইরা দিবার অভ্যাস আছে তাই তোমার জানটা আইজ আমার হাত থিকা বাঁইচা গেলো…

শল্য থামে না। কর্ণরে হাঁসের পালক পরা কাউয়া কইয়া গালাগাল করে। যুদ্ধে পঙ্গু লুলাটুন্ডা অক্ষম কয়।

কর্ণ আবার নিজেরে সামলায়- মদ্ররাজ মনে রাইখেন। ভয় পাওয়ার লাইগা কর্ণ জন্মায় নাই। শল্য ছাড়াই আমি শত্রু জয় করতে পারি…

শল্য কয়-  সেইটা আমিও পারি। হাজারটা কর্ণ যেই সব যুদ্ধ জিততে পারে না; সেই সব যুদ্ধ আমি একলাই জিততে পারি…

এই কথাটা কর্ণের পক্ষে হজম করা কঠিন। সে আবার খেইপা উঠে। শেষ পর্যন্ত দুর্যোধনরে আইসা থামাইতে হয়

কর্ণ-শল্যের প্যাঁচাল থামার পর কর্ণ কয়-  যথেষ্ট হইছে এইবার রথ চালান…

শল্য রথ চালায় কিন্তু একবার দূরে অর্জুনরে দেইখা আবার হইহই কইরা শুরু করে অর্জুন বন্দনা- এইবার আসতাছে তোমার যম। এইবার আসতাছে কৃষ্ণ আর অর্জুন একলগে। এইবার বুঝবা ঠেলা…

কিন্তু দিক বদলাইয়া অর্জুনের রথ সরাইয়া নিয়া যায় কৃষ্ণ আর কর্ণের সামনে আইসা খাড়ায় পাঞ্চালসেনা। কর্ণ তাগো খেদাইয়া দেখে সামনে যুধিষ্ঠির এক পাশে শিখণ্ডী অন্য পাশে সাত্যকি। কর্ণ শিখণ্ডী আর সাত্যকিরে ভাগাইয়া সামনে আগাইলে পাণ্ডব আর পাঞ্চাল বাহিনীর ভিতর লুকাইতে লুকাইতে যুধিষ্ঠির কয়-  সূতপুত্র। তুমি সর্বদাই দুর্যোধনের লগে মিলা আমাগো লগে শত্রুতা করো; অর্জুনরে মারতে চাও। এইটা কিন্তু ঠিক না। আইজ দেখবা তুমি মজা…

যুধিষ্ঠির বাহিনী আক্রমণ করে কর্ণরে। কর্ণের বাম পাশ আহত হইলেও কর্ণ পৌঁছাইয়া যায় যুধিষ্ঠিরের কাছে। যুধিষ্ঠিরের রথ আর বর্ম যায় কর্ণের ভল্পের আঘাতে। আহত যুধিষ্ঠির অন্য রথে উইঠা পালায়। কর্ণ দৌড়াইয়া গিয়া তারে ধরে। কর্ণ তার কান্ধে হাত রাখে- তুমি না রাজা? তয় জান লইয়া ভাগো ক্যান?

বন্দি যুধিষ্ঠির থরথর কাঁপে। কথা কয় না। কর্ণ কয়-  নিজেরে না তুমি কুন্তীর বড়ো পোলা কও? এইরকম কাপুরুষ বড়ো পোলার কাছে কুন্তী অত কিছু আশা করেন ভাবতেও করুণা হয়। যাও মায়ের কাছে যাও…

কর্ণ ছাইড়া দিলে যুধিষ্ঠির নড়তে পারে না। ডরে কাটা দিয়া উঠে তার শরীর। তবে কি যেই সত্য ঘটোৎকচ জানত সেইটা কর্ণও জানে?

মাথা নিচা কইরা যুধিষ্ঠির নিজের বাহিনীতে গিয়া হম্বিতম্বি করে আর বেকুবের মতো হা কইরা চাইয়া থাকে শল্য- হালায় যুধিষ্ঠিররে মারল না কেন? ওরে মারলেই তো যুদ্ধটা এখন শেষ হইয়া যাইত? কে জানে এই কর্ণটার ভিত্রে কী আছে…

অন্য দিকে ভীম পিটাইতেছিল কুরু বাহিনী। শল্য আবার নিজের বেকুবতা কাটাইয়া পাণ্ডব বন্দনা শুরু করে। এইবার কর্ণরে কয়-  দেখো একলা ভীমই তো তোমার সব সৈন্য সাফ কইরা ফালাইতাছে। তোমারে পাইলেও সে ভর্তা বানাইব আইজ…

কর্ণ কয়-  ভীমের কাছেই চলেন…

ভীম চালাইতেছিল তির। কয়েকটা তির কর্ণের শরীরেও বিদ্ধ কইরা ফালাইলে কর্ণ সইরা আইসা অর্জুনরে খোঁজে। কিন্তু অর্জুনরে ভিড়-বাট্টায় সরাইয়া রাখে কৃষ্ণ। শল্য রথ চালায় আর খিস্তি খেউড় করে। কর্ণ কিছুটা হজম করে আর কিছুটা ফিরাইয়া দেয়…

যুধিষ্ঠিররে ঘায়েল কইরা অশ্বত্থামা গিয়া পৌঁছায় অর্জুনের কাছে। অশ্বত্থামারে ঘায়েল কইরা অর্জুন আবার মিলাইয়া যায় জনতার ভিড়ে। কর্ণ অর্জুনরে খোঁজার কৌশল বদলায়। সে গিয়া আক্রমণ শানায় যুধিষ্ঠিরের দিকে। যুধিষ্ঠির আক্রান্ত হইলে কৃষ্ণ নিশ্চয় অর্জুনরে নিয়া আসব রাজারে বাঁচাইতে…

যুধিষ্ঠির আক্রান্ত হয় কর্ণের হাতে। ভীম আসে। আসে নকুল সহদেব। আসে ধৃষ্টদ্যুম্ন। কর্ণের বর্শার আঘাতে যুধিষ্ঠিরের বুক বিদ্ধ হয়; রাজমুকুট মাটিতে গড়ায়; কিন্তু অর্জুন আসে না রাজারে বাঁচাইতে কর্ণের হাত থিকা…

যুধিষ্ঠিরের বেকায়দা দেইখা শল্যমামা ভয় পাইয়া যায়। যেভাবে কর্ণ দাবড়াইতাছে একটু পরে তো যুধিষ্ঠিররে মাইরা যুদ্ধই শেষ কইরা দিব। সে কয়-  আরে বাদ দেও। আধা ব্রাহ্মণ যুধারে মাইরা তোমার কী লাভ? ওরে তো এর আগে তুমি ছাইড়াই দিছিলা। চলো ভীমের কাছে যাই; অন্তত একটু হইলেও মারামারির মজা পাইবা তুমি…

পাণ্ডবমামা শল্য কর্ণরে নিয়া যায় ভীমের কাছে আর আহত যুধিষ্ঠির আহত নকুলের লগে আহত সহদেবের রথে উইঠা পলায়…

ক্ষতবিক্ষত যুধিষ্ঠির তাঁবুতে গিয়া শরীর থাইকা তির বর্শার ফালি খোলে। আর দূর থাইকা ভীমের লগে কুড়াল নিয়া যুদ্ধ করা কর্ণরে দেখাইয়া অৰ্জুন কৃষ্ণরে কয়- কর্ণের ভার্গবাস্ত্র চালানোর কায়দাটা দেখো; এই আঘাতগুলা না যাবে সামলানো; না যাবে তার লগে যুদ্ধের সময় পলানো; কী যে সংকট আমার…

কৃষ্ণ কয়-  সময় হইলে দেখা যাবে। এখন চলো শিবিরে গিয়া রাজা যুধিষ্ঠিররে একবার দেইখা আসি। তিনি কর্ণের হাতে আহত হইছেন। একটু রেস্টও কইরা আসা যাবে…

যাইতে যাইতে পথে অর্জুন ভীমরে যুধিষ্ঠিরের সংবাদ জিগায়। ভীম কয়- কর্ণের হাতে মারাত্মক মাইর খাইলেও মনে হয় বাঁইচা যাবে…

অর্জুন কয় আপনে গিয়া তার সংবাদ নিয়া আসেন। আমি থাকি…

ভীম কয়- তুই যা। আমি মাঠ ছাইড়া গেলে পাব্লিকে কইব আমি ডরাইয়া ভাগছি…

কৃষ্ণ কয়- হ। ভাই ভীম বাঁইচা থাকতে কেউ তারে ডরালুক বলার সুযোগ দেওয়া ঠিক না। তার থিকা চলো আমরা গিয়া দেইখা আসি…

পাঁচ পাণ্ডবের মাঝে মাঠে লড়াই করে ভীম আর চাইর পাণ্ডব গিয়া আশ্রয় নেয় শিবিরে…

কৃষ্ণ আর অর্জুনরে একলগে শিবিরে দেইখা যুধিষ্ঠির খুশিতে লাফাইয়া উঠে- কর্ণরে নিশ্চয়ই মাইরা আসছ তোমরা…

খুশিতে যুধিষ্ঠির লাফাইতেই থাকে কাউরে কিছু বলতে না দিয়া- যে গাড়োয়ানের পোলার ডরে আমার পুরা জগৎ অত দিন কর্ণময় আছিল। আরেকটু হইলে আইজ যে আমারে মাইরাই ফালাইত। সাবাশ অর্জুন সাবাশ…

যুধিষ্ঠির নিশ্চিত যে কর্ণরে না মাইরা কৃষ্ণ আর অর্জুন শিবিরে ফিরে নাই। নিজের উচ্ছ্বাসরে আরেকটু চাগাইয়া নিতে এইবার সে গিয়া অর্জুনরে ধরে- ক তো ভাই; কেমনে মারলি তুই পাপিষ্ঠ কর্ণরে; আমারে একটু বিস্তারিত বর্ণনা শোনা তো ভাই। যার ডরে আমি তেরো বচ্ছর শান্তিতে ঘুমাইতে পারি নাই; যার ভরসায় ধৃতরাষ্ট্র আর দুর্যোধন আমাগো পাঁচটা গ্রামের অনুরোধও ফিরাইয়া দিছিল সেই কর্ণরে কেমনে তুই মারলি আমারে একটু ক…

কৃষ্ণ আর অর্জুন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। যুধিষ্ঠির অর্জুনরে ঝাঁকায় কর্ণ হত্যার বিস্তারিত জানতে। অর্জুন তারে ধুনফুন বোঝায়- ভাইজান আমি আইজ বহুত মানুষ মারছি। অশ্বত্থামারে মাইরা ফালাফালা কইরা দিছি…

যুধিষ্ঠির কয়-  সেইটা তো ডেলি ডেলি করস; কর্ণরে কেমনে মারলি সেইটা ক।

অর্জুন কয়- কর্ণের অস্ত্র চালনা যে কী জিনিস আইজ নিজের চোক্ষে তা আমি দেখছি ভাইজান…

যুধিষ্ঠির কয়-  সেইটা আমিও দেখছি কিন্তু তুই কেমনে কী করলি সেইটা ক…

অর্জুন কয়-  শুনছি আপনি কর্ণের আক্রমণে আহত হইছেন…

যুধিষ্ঠির কয়-  পিরায় মাইরাই ফালাইছিল আমারে কিন্তু সেইটা কোনো বিষয় না। তুই কেমনে কর্ণরে কাবু করলি সেইটা ক…

অর্জুন আমতা আমতা করে- আমি আসছি আপনেরে দেখতে ভাইজান। ফিরা গিয়া মারব কর্ণরে…

ধপাস কইরা বইসা পড়ে যুধিষ্ঠির- সবাইরে কর্ণের হাতে ছাইড়া জান নিয়া পলাইয়া আসছ তোমরা? অর্জুন তুই মায়ের গর্ভরে কলঙ্কিত করলি আইজ। অথচ তোর ভরসাতেই আমি কর্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সাহস করছিলাম। থুক দেই তোর গাণ্ডিবের বড়াইরে। তুই যদি কর্ণরে এতই ডরাস তয় তোর গাণ্ডিব অন্য কাউরে দেস না ক্যান? ছি ছি ছি। জন্মের আগে ক্যান কুন্তীর গর্ভেই মইরা গেলি না তুই?

এই ধিক্কার সহ্য হয় না অর্জুনের। তার হাতে উইঠা আসে তলোয়ার। কৃষ্ণ থাবা দিয়া ধরে-করোটা কী?

অর্জুন তড়পায়- যে আমার গাণ্ডিব নিয়া কথা কয় তার ধড়ের উপরে মাথা থাকার কোনো অধিকার নাই…

— হ মার। কৃষ্ণ ওরে ছাড়ো। ও আমার শরীর থাইকা মাথাটা নামাইয়া দেউক। সেইটাই বরং কর্ণরে জীবিত রাইখা বাঁইচা থাকার চেয়ে আমার লাইগা সম্মানজনক আর অর্জুনের লাইগাও ভালো। কারণ ওর পক্ষে যেহেতু অস্ত্রধারী কর্ণরে মারা সম্ভব না; সেই হেতু আমার মতো নিরীহরে মাইরাই ওরে গর্ব করতে দেও। কাট। মাথাটা কাইট্টা ফালা আমার। কাপুরুষ অর্জুনের ভাই হইয়া বাঁইচা থাকার চেয়ে ছোট ভাইয়ের তলোয়ারে মইরা যাওয়া অনেক সম্মানের…

কৃষ্ণ অনুমানও করতে পারে নাই বিষয়টা অত দূর যাবে। অর্জুনরে সে সরাইয়া নিয়া আসছে যুদ্ধের মাঠ থিকা। সেইটাই অর্জুনের লাইগা যথেষ্ট অপমানের আছিল। তার উপর যুধিষ্ঠিরের এই খোঁচা। কিন্তু অর্জুন অতটা খেইপা উঠব ভাবতেও পারে নাই সে। অর্জুনরে সে ঝাড়ি লাগায়। যুধিষ্ঠিররে তেলায়। কিন্তু কেউ থামে না।

অর্জুন কয়-  তুমি যে কথা কইলা সেইটা যদি ভীম আমারে কইতেন তবে আমি তা মাইনা নিতাম। কারণ ভীম নিজে যুদ্ধের মাঠে আছে। কিন্তু কর্ণের ডরে পলাইয়া আইসা আমারে এমন কথা কেমনে কও তুমি?

যুধিষ্ঠির কয়-  যা করার তা তো ভীমই করে। কিন্তু এই জীবনে তুমি আর তোমার গাণ্ডিব কোন কামটায় লাগছে আমার?

কৃষ্ণ কাউরে থামাইতে পারে না। অর্জুন জীবনেও যুধিষ্ঠিরের মুখে মুখে তর্ক করে নাই; খারাপ কথা কওয়া তো দূরের কথা। কিন্তু আইজ অর্জুনের কথা বাঁধ ভাইঙ্গা পড়ে- শত শত রথী-মহারথীরে হারাইয়া আমি দ্রৌপদীরে জয় করছিলাম; তুমি আমার সেই বৌরে নিয়া শুয়াইছ নিজের বিছানায়। তোমারে সম্রাট বানাইবার লাইগা ভীম আর আমি আশপাশের সব রাজারে তোমার অধীন করছি। আমার কারণেই তুমি রাজসূয় যজ্ঞ কইরা সম্রাট বনছিলা। আমি নিজে কৃষ্ণরে নিয়া যে ইন্দ্রপ্রস্থ রাজ্য বানাইছিলাম তোমার জুয়ার নেশায় তা হারাইয়া বনবাসে যাইতে হইছে। তোমারে আবারও রাজা বানাইবার লাইগা যুদ্ধে আমার দুই-দুইটা পোলা মরছে। আর তুমি কও আমি কোনো কামে লাগি নাই তোমার?

কৃষ্ণ অর্জুনরে ঠেইলা নিয়া যায় বাইরে- চুপ কইরা বইসা থাকো এইখানে। সারা জীবন ধইরা যখন যুধিষ্ঠিররে কিছু কও নাই তখন এখন কওয়া ইত্ৰামি। বইসা ভাবো কিছুক্ষণ। কর্ণ জীবিত শুইনা যুধিষ্ঠিরের রাগ হইতেই পারে; কারণ যুদ্ধের আগে কর্ণ ছাড়া অন্য কারো কথা ভাবে নাই সে। বইসা ভাবো…

অর্জুনরে বাইরে বসাইয়া কৃষ্ণ আইসা যুধিষ্ঠিরের সামনে খাড়ায়-অর্জুনরে মাঠ থাইকা আমি সরাইয়া নিয়া আসছি যাতে সে একটু বিশ্রাম নিতে পারে। কর্ণ টানা কয়েক দিন ধইরা যুদ্ধ করতাছে; বিকাল পর্যন্ত যুদ্ধ করলে সে কাহিল হইব; তখন নতুন তেজে অর্জুন তার সামনে খাড়াইলে তারে কাবু করা যাবে। কর্ণ সহজ যোদ্ধা না সেইটা আপনেও জানেন। খালি খালি তার সামনে যাওয়া আর আত্মহত্যা করা এক সমান। তাই আমি অর্জুনরে তার সামনে নিতে চাই না যতক্ষণ পর্যন্ত না কর্ণরে। পরাজিত করার সময় আসে। আর আপনার ভুইলা যাওয়া উচিত না যে আমি অর্জুনরে পাইলা পুইষা রাখতাছি খালি কর্ণের লাইগা। এমন উল্টাপাল্টা কথা কওয়া ঠিক হয় নাই আপনার। কারণ আপনার এই সমস্ত কথায় যদি অর্জুন আউলা হইয়া উঠে তবে কর্ণের সামনে গেলে হিতে বিপরীতও হইতে পারে…

যুধিষ্ঠিরের রাগ কমে নাই। সে কয়-  তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু সে আমারে কইলোটা কী তুমি শুনলা?

কৃষ্ণ কয়-  শুনছি কিন্তু কানে তুলি নাই। ধইরা নেন তা আপনেও শোনেন নাই। অর্জুন আপনের কাছে মাপ চাইব। আপনি তারে খুশি কইরা দিবেন এইটাই আমার শেষ কথা। আমি আপনার কাছে। রাজা যুধিষ্ঠিরের আচরণ চাই; যে যুদ্ধের সময় তার দরকারি সৈনিকের মাথা আউলা করে না। আমি অর্জুনরে নিয়া আসতাছি…

কৃষ্ণ বাইরাইয়া যায়। অর্জুন ঝিমায়। কৃষ্ণ জিগায়- কিছু ভাবলা?

— ভাবছি। তলোয়ার যখন খুলছি তখন একটা না একটা মাথা তো কাটতেই হবে। ভাইজানেরটা যেহেতু কাটতে পারব না সেহেতু নিজেরটাই কাটার সিদ্ধান্ত নিছি…

— তাইলে তো যুধিষ্ঠিরের কথাই ঠিক। কর্ণের ডরে ভাইগা আইসা শরমে অর্জুনের আত্মহত্যা…

অর্জুন খেইপা উঠে কৃষ্ণের উপর- তোমার লাইগাই আইজ আমার এত অপমান। আমি তোমারে কইছিলাম মাঠ ছাইড়া গেলে পাব্লিকে কইব আমি ডরাইছি। তুমিই আমারে জোর কইরা নিয়া আসছ এইখানে। আইজ সারা দিন ধইরা কর্ণ আমারে বিছরায় আর তুমি আমারে নিয়া পলাও। তার থাইকা তো ভালো ছিল কর্ণের লগে যুদ্ধ কইরা মইরা যাওন…

–তাইলে এখন কর্ণের সামনে যাইতে ডরাইতাছ ক্যান?

কৃষ্ণের মুখে এই কথা হজম করা অর্জুনের লাইগা কঠিন। অর্জুন তলোয়ার নিয়া লাফ দিয়া খাড়ায় কৃষ্ণের সামনে। কৃষ্ণ সইরা গিয়া হাসে- কর্ণরে জ্যান্তা রাইখা একবার যুধিষ্ঠিরের গলায়; একবার নিজের গলায় আর আরেকবার আমার গলায় তলোয়ার ধরা; এইগুলার মানে বোঝো অর্জুন? উল্টাপাল্টা ছাইড়া চলো মাঠে যাই; কর্ণের সামনে…

অর্জুন রওনা দেয় কিন্তু কৃষ্ণ থামায়- আগে ভিত্রে চলো। বড়ো ভাইর কাছে তোমার মাপ চাওয়া লাগবে…

অর্জুন কথা তুলতে চায়। কৃষ্ণ দাবড়ানি দেয়- কোনো কথা শুনতে চাই না। কর্ণের ডরে যুধিষ্ঠির যা ইচ্ছা বলতে পারেন; কিন্তু তোমারও তার মতো অত আউলা হওয়া সাজে না। চলো…

অর্জুন আইসা পায়ে পড়ে যুধিষ্ঠিরের- এর পরে যদি আপনার সামনে আইসা খাড়াই তবে জানবেন কর্ণ মৃত আর যদি আমারে দেখতে না পান তবে জানবেন কর্ণের লগে যুদ্ধ কইরা অর্জুন মারা গেছে কিন্তু পলাইয়া আসে নাই…

যুধিষ্ঠির তারে জড়াইয়া ধরে- মাথাটা আউলা হইয়া গেছে রে ভাই। তরে বহুত কিছু কইছি। আমারে মাপ কইরা দিস…

অর্জুনরে নিয়া কৃষ্ণ যাইতে যাইতে কয়-  অর্জুন তুমি বহুত বড়ো যোদ্ধা কিন্তু ভুলেও কর্ণরে অবহেলা কইরো না। মনে রাইখো; কর্ণের উদ্দেশ্য যুদ্ধজয় না; বীরত্ব দেখানো। কিন্তু তোমার উদ্দেশ্য যুদ্ধজয়…

সেই ভোর থাইকা কর্ণ অর্জুনরে খুঁইজা বেড়াইছে আর পথে পথে যুদ্ধ করছে অন্যদের লগে। কিন্তু এখন যখন কর্ণ অন্যদের লগে যুদ্ধে ব্যস্ত তখন কৃষ্ণের রথ চোখে পড়ে শল্যের। সে কর্ণরে কয় সারা দিন ধইরা যারে খুঁজতাছিলা সে এখন তোমার দিকেই আসতাছে কর্ণ…

কিন্তু অর্জুন আসে না। অর্জুনের রথ আসতে আসতে আবার ঘুইরা ভীমের কাছে গিয়া যুধিষ্ঠিরের কুশল সংবাদ জানায়; ভীমের যুদ্ধে হাত লাগায় আর কর্ণের দিকে আগাইয়া আসে পাঞ্চাল বাহিনী…

আবারো অর্জুনের রথ আগাইতে থাকে কর্ণের দিকে। তার পিছনে ভীম। তির মারতে মারতে ভীমরে ঠেকাইতে আসে দুঃশাসন। তিরাতিরিতে দুইজনই আহত হয়। দুইজনই তির ছাইড়া বর্শা আর গদার মারামারিতে যায়। মাথায় ভীমের গদার বাড়ি খাইয়া মাটিতে গড়ায় দুঃশাসন। দুঃশাসনের উপর ভীমের প্রচুর রাগ। এই ব্যাটাই চুলের মুঠি ধইরা দ্রৌপদীরে টাইনা আনছিল রাজসভায়; এই ব্যাটাই রাজসভায় দ্রৌপদীরে বিবস্ত্র করছিল সকলের সামনে…

দুঃশাসন পইড়া আছে চিত হইয়া। রথ থাইকা একটা তলোয়ার নিয়া নামে ভীম। পা দিয়া দুঃশাসনের গলা চাইপা তলোয়ার চালাইয়া দেয় দুঃশাসনের বুকে। রক্ত যখন ফিনকি দিয়া বাইরাইয়া আসতাছে তখন হাতের অঞ্জলি নিয়া ভীম পান করে দুঃশাসনের রক্ত। ভীম থামে না। তলোয়ারের কোপে। দুঃশাসনের মাথা আলগা কইরা তুইলা ধরে মুখের উপর; তারপর মুন্ডু থাইকা গড়াইয়া নামা রক্ত খাইতে থাকে গলগল করে…

বেকুবের মতো সকলে তাকাইয়া থাকে। এমনকি কৃষ্ণ অর্জুন কর্ণ। অত দিনের যুদ্ধে বহু মানুষ মারা গেছে বহু মানুষের হাতে। ভীমের হাতেও মারা গেছে অসংখ্য মানুষ কিন্তু এমন দৃশ্য কেউ দেখে নাই…

কর্ণের দিকে যাইতে যাইতে অর্জুনের রথ আরেকবার গতি বদলায়। গিয়া হাজির হয় কর্ণপুত্র বসুসেনের সামনে। বসুসেন যুদ্ধ করতাছিল অন্যদের লগে। কৃষ্ণ অর্জুনরে কয়-  এরে ফালাও…

অর্জুনের আকস্মিক তিরে মারা যায় কর্ণপুত্র বসুসেন। পোলার লাশ কোলে নিয়া হাহাকার করে কর্ণ আর ঠিক তখন তার সামনে গিয়া খাড়ায় কৃষ্ণার্জুনের রথ…

অবশেষে কর্ণ আর অর্জুন মুখামুখি। শল্য একেবারে চুপ; তার মুখে কোনো গালি উঠে না কর্ণের নামে; কোনো প্রশংসাও করে না সে অর্জুনের। এমন যুদ্ধে সারথি হওয়া কপালের বিষয়। নিশ্চুপ শল্য তার ম্যাজিক দেখায় ঘোড়ার লাগামে এইবার…

অর্জুন কয়- কৃষ্ণ আইজ হয় কর্ণের বৌয়েরা বিধবা হবে না হয় ফিরা গিয়া তোমার পিসি কুন্তী; বোন সুভদ্রা; সখী দ্রৌপদী আর রাজা যুধিষ্ঠিররে সান্ত্বনা দিবা তুমি…

নিরুত্তাপ কৃষ্ণ কয়-  আমি কী করব না করব সেইটা আমি বুঝব। তুমি তোমার কাম করো। অত আবেগি হইও না। মনোযোগ দিয়া কর্ণরে দেখো…

কর্ণ অর্জুন একে অন্যরে চক্কর দেয়। শত্ৰুমিত্র যুদ্ধ থামাইয়া দুই যোদ্ধার পক্ষে দর্শক হইয়া খাড়ায়। দুই পক্ষই নিশ্চিত এই লড়াইয়েই নির্ধারিত হবে যুদ্ধের পরিণাম। দুই পক্ষই নিজের পক্ষে আশাবাদ রাখে আর বিপক্ষের ক্ষমতায় ডরায়। ডরে কাঁপে পাণ্ডব। ডরে কাঁপে কৌরব। সকল শত্রুতা আর হিংসা ভুইলা দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা গিয়া দুর্যোধনের হাত ধরে- দোস্ত ক্ষেমা দেও। যথেষ্ট হইছে। আমি অনুরোধ করলে অর্জুন থামব। কৃষ্ণও বিরোধ চায় না। তুমি খালি একবার শান্তির কথা কও; আমি কর্ণরেও থামামু অনুরোধ করে…

দুর্যোধন স্থির- বহু দেরি হইয়া গেছে দোস্ত। ভীম যেমনে দুঃশাসনরে মারল তাতে শান্তির আর কোনো পথ নাই। কর্ণরে বারণ কইরো না তুমি…

ততক্ষণে কর্ণ আর অর্জুনের অস্ত্র বিনিময় শুরু হইয়া গেছে। কর্ণের ধনুক সাড়ে চাইর হাত দীর্ঘ আর অর্জুনের ধনুক চাইর। কর্ণের তিরে লোহার ফলা ছোট আর অর্জুনের তিরে দীর্ঘ। কর্ণের হালকা তির যায় বহুদূর আর অর্জুনের ভারী তির ধ্বংসাত্মক বেশি। কর্ণ আহত আর টানা কয় দিনের যুদ্ধে প্রচুর কাহিল। অর্জুন বিশ্রামে তরতাজা কিন্তু অতি উত্তেজনায় বেসামাল…

কুড়ালি পরশুরামের শিষ্য কর্ণ প্রায় তিরের সমান দূরত্বে নিক্ষেপ করতে পারে বর্শা। অর্জুনের তির গায়ে বিঁধে না কর্ণের কিন্তু কর্ণের বেশ কিছু তির আর বর্শার আঘাত আইসা বিঁধে অর্জুনের গায়…

অত দিন বিনা বিশ্রামে যুদ্ধ করা ভীমও এখন দর্শক। অর্জুনরে আহত হইতে দেইখা খেইপা উঠে সে- তুমি মাইর খাইতাম কেন অর্জুন? সামলাইতে না পারলে সইরা খাড়াও। আমিই গাড়োয়ানের পোলারে গদা নিয়া পিটাই…

কৃষ্ণও খাঁকারি দিয়া উঠে- করতাছ কী তুমি? এখন পর্যন্ত একটাও তির বিন্ধাইতে পারো নাই। হয় ঠিকমতো কাম করো না হয় ভাগো। আমিই চক্র নিয়া নামি কর্ণের সামনে…

আইজ কী হইছে অর্জুনের। তার ভরসাতেই পাণ্ডবপক্ষ কর্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবার সিদ্ধান্ত নিছে। আর আইজ যখন তার কর্ণের সামনে যাইবার সময় তখন যুধিষ্ঠির কয় ধনুক ছাড়তে; ভীম কয় সইরা খাড়াইতে; কৃষ্ণ কয় পলাইতে। এত অপমান কই রাখে অর্জুন। অর্জুন চোখ বন্ধ কইরা সব ভুইলা যাইতে চায়। তারপর ধীর ধৈর্যে হাতে তুইলা নেয় দীর্ঘ আর ভারী এক তির…

শত্রুর নিশানা এড়াইয়া বাতাসের বেগে চক্কর খায় কৃষ্ণ আর শল্যের রথ। কৃষ্ণ রথ চালায় অদ্ভুত। শল্য কম না মোটেও। এই মুহূর্তে শল্য যেন শুধুই কর্ণের সারথি। অথবা কর্ণের কথা ভুইলা সে রথ চালায় কৃষ্ণরে পাল্লা দিয়া। এর মাঝে স্বয়ং রাজা যুধিষ্ঠিরও আইসা খাড়াইছে দর্শক সারির ভিতর…

অর্জুন সুযোগ খোঁজে। অর্জুন তার তির ছাড়ে কিন্তু কর্ণের ঢালে তা ফিরে যায়। ভীমের চোখে পড়ে ঢাল দিয়া ফিরাইলেও এই আঘাতে কর্ণের ঢাল বিদ্ধ হইছে। ভীম চিৎকার কইরা উঠে- একই তির আবার মারো অর্জুন…

অর্জুন বিনা চিন্তায় আবারো প্রক্ষেপ করে সেরকম আরেকটা তির। কিন্তু ব্যর্থ। অর্জুনের একটা তিরও আঘাত করতে পারে না কর্ণের দেহে…

অর্জুন পাগলের মতো তির মারতে থাকে কর্ণের দিকে। তির ধরা আর তির ছোঁড়ায় প্রায় কোনো সময় ব্যবধান থাকে না তার। একটা তির লক্ষ্যে পৌঁছাইবার আগেই গুন থিকা বাইর হইয়া যায় আরো দুইটা তির। আর এই পাগলা তিরানোর ফলে ঠাস কইরা ছিঁড়া যায় তার গাণ্ডিব ধনুকের ছিলা…

এইবার শুরু হয় কর্ণের তির বৃষ্টি; ঝাঁকে ঝাঁকে কর্ণের ক্ষুদ্রক বাণে ছেয়ে যায় কৃষ্ণার্জুনের রথ। অতি ক্ষুদ্র তির; হত্যা করে না কিন্তু ঝাঁজরা কইরা দেয়। আর মাঝে মাঝে কর্ণ ছেড়ে বক্ষ বিদীর্ণকারী তার দীর্ঘ লোহার তির; নারাচ…

গাণ্ডিবে নতুন ছিলা পরাইতে পরাইতে অর্জুন আহত। কৃষ্ণও জর্জর কর্ণের তিরে…

নতুন ছিলা নিয়া অর্জুনের তির বৃষ্টিতে কর্ণ কিছুটা আচ্ছন্ন হয়। আহত হয় শল্য। আশপাশের সবাই দূরে সইরা যায়। শুধু খাণ্ডবদাহনের সময় অর্জুন আর কৃষ্ণ যে নাগ জাতিরে উচ্ছেদ করছিল পিতৃভূমি থাইকা; সেই জাতির নাগপুত্র অশ্বসেন কাছে আইসা কর্ণের হাতে তুইলা দেয় এক দীর্ঘ আর ভারী তির। প্রায় বর্শা আকারের এই তিরের ফলা চ্যাপটা আর ধারালো। কাছ থিকা কারো উপর মারলে হাড় পর্যন্ত ভাইঙ্গা ফালাইতে পারে; আর গলায় গিয়া আঘাত করলে তার কার্যকারিতা তলোয়ারের কোপের সমান…

কর্ণের হাতে এই তির দেইখা হাহাকার কইরা উঠে সকলে। শল্য ভয় পাইয়া কয়-  এই তির দিয়া তুমি অর্জুনের কিছু করতে পারবা না… কর্ণ কয়-  আমি একবার কোনো তির হাতে নিলে তা আর বদলাই না। তুমি অর্জুনের কাছে যাও…

অর্জুন বোঝে না কর্ণের তিরের মর্ম। সে ছোট তির দিয়া বৃষ্টি চালায়। আর অর্জুনের তির বৃষ্টির ফাঁকে খুব কাছ থাইকা কর্ণের সাড়ে চাইর হাত দীর্ঘ ধনুক ফুঁড়ে অর্জুনের দিকে নিক্ষিপ্ত হয় লোহার ভারী একটা তির…

তীরটা খেয়াল করে কৃষ্ণ। চাবুকের এক বাড়িতে ঘোড়া দাবড়াইয়া সে নিজের রথরে নিয়া কাত কইরা ফালায় খাদে আর আরেক হাতে থাবা দিয়া অর্জুনরে বসাইয়া দেয় নিচে…

কৃষ্ণের থাবা খাইয়া বেকুব অর্জুন বসতে বসতে আবিষ্কার করে কর্ণের তিরের আঘাতে তার মাথার মুকুট ভাইঙ্গা গিয়া পড়তাছে দূরে। কর্ণ তিরটা মারছিল তার গলা বরাবর। কৃষ্ণ থাবা দিয়া বসাইয়া না দিলে অতক্ষণে কর্ণের তিরে গলাটাই কাটা পড়ত তার…

নাগ অশ্বসেন আবারও আরেকটা তির নিয়া আসে কর্ণের দিকে। কর্ণ এইবার খেয়াল করে তারে– তুমি তো আমার তির জোগালি দলের লোক না। তয় তুমি কেন আমারে তির দেও?

অশ্বসেন কয়-  আমি নাগ জাতির লোক যাদের শত্ৰু কৃষ্ণ আর অর্জুন। তাই তুমি আমাগো মিত্র…

কর্ণ কয়- কর্ণ কোনো দিন অন্যের শক্তি দিয়া জয়ী হইতে চায় না। জানলে তোমার আগের তিরও আমি হাতে নিতাম না। তুমি যাও…

অশ্বসেন নিজেই অর্জুনের দিকে তির মারা শুরু করে আর অর্জুন রথ থাইকা নাইমা হত্যা করে অশ্বসেনরে। যুদ্ধের নিয়ম মাইনা কর্ণ খাড়াইয়া অপেক্ষা করে অর্জুনের রথ ঠিক হইবার আর এই সুযোগে কৃষ্ণ আবার নিজের ত্যাড়া রথ খাড়া করে মাটির উপর…

যুদ্ধ চলতে থাকে। দুইজনই আহত হইতে থাকে। কর্ণের মুকুট যায়। শরীরে তির খায়। আর এক সুযোগে অর্জুন একটা ভারী তির বিদ্ধ কইরা ফালায় কর্ণের বুকে। কর্ণ টইলা উঠে। হাত থিকা ধনুক পইড়া যায়। যুদ্ধের নিয়ম মাইনা অর্জুন তির থামাইয়া দেয়। কিন্তু কৃষ্ণ ধাতানি দিয়া উঠে- থামলা কেন অর্জুন? বেকুবি কইরো না। বুদ্ধিমানরা শত্রুর দুর্বল সময়রে কামে লাগায়। মারো। তির মারো। না হইলে একটু পরেই কর্ণ মারব তোমারে…

কৃষ্ণের কথায় অর্জুন তির চালায় ধনুকহীন কর্ণের উপর। কিন্তু কর্ণ সামলাইয়া উঠে। অর্জুন আর কৃষ্ণের উপর আবারো আইসা পড়তে থাকে কর্ণের তির…

তিরন্দাজরা ঢালের তেমন সুযোগ নিতে পারে না। দুই হাতই ব্যস্ত থাকে তিরে আর ধনুকে।

প্রতিপক্ষের তিরের বিপরীতে তিরন্দাজের মূল ভরসা গায়ের বর্ম; লাফ দিয়া তিরের লাইন এড়াইয়া চলা আর রথের উপর থাকলে সারথির ক্ষিপ্রতা। তিরন্দাজরা যখন আহত হয় তখন সারথির ক্ষিপ্রতার উপরই নির্ভর করে তাগো আবার উইঠা দাঁড়ানোর অবসর। সারথিরা রথ চক্কর দেয় আর সেই সুযোগে শরীর থাইকা তির খুইলা আবার খাড়ায় তিরন্দাজ…

কর্ণ আর অর্জুনরে তিরাতিরি এখন বন্ধ। দুইটা রথ এখন বেশ দূরে দূরে চলে। কর্ণার্জুন দুইজনই আহত। দুজনেই ক্লান্ত। দুজনেরই কারো হিসাব মিলে নাই। দুজনেরই দূরপাল্লার ক্ষুদ্র তির যেমন দুজনের বর্মে ব্যর্থ হইছে তেমনি নিকট যুদ্ধে দুজনের ভারী অস্ত্রও ব্যর্থ হইছে সারথির কৌশলে। ঘটার হাতে আহত কর্ণের সুবিধা যেমন পাইতাছে না অর্জুন তেমনি নিজে কম লড়াই কইরা তরতাজা থাকারও কোনো ফলাফল দেখাইতে পারতাছে না সে…

কুরুক্ষেত্রের মাঠে ম্যাজিকের মতো একের নিশানার ফাঁক গইলা চক্কর মারে কৃষ্ণ আর শল্যের রথ। চক্কর মারতে মারতে অর্জুনরে নিয়া কৃষ্ণ পিছাইতে থাকে। কুরুক্ষেত্রের পুরা মাঠ কৃষ্ণের নখদর্পণে। চক্কর দিতে দিতে তিরের নিশানার বাইরে থাইকা কৃষ্ণ দূরে সইরা যায়। কৃষ্ণ দূরে যায় অর্জুনরে নিয়া আর শল্য আগায় কর্ণরে নিয়া। যাইতে যাইতে কৃষ্ণ গিয়া খাড়ায় ছোট এক জায়গায়। কৃষ্ণ এমনভাবে খাড়ায় যে শল্য সোজা ধাওয়া দিয়া আসে তার দিকে। আর অর্জুনের দিকে সোজা রথ দাবড়াইতে গিয়া শল্য রথের চাকা ঢুকাইয়া দেয় কাদায়…

কর্ণের রথ ত্যাড়া হইয়া আটকাইয়া যায় আর শল্যরে ঠিকমতো কাদায় গাড়তে পাইরা হাইসা উঠে কৃষ্ণ। কিন্তু এতে কর্ণ বিচলিত না। কারণ যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী কোনো যোদ্ধার রথ আটকাইয়া গেলে তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি। কেউ কোনো আঘাত করব না এখন…

কাইত হইয়া থাকা রথে অস্ত্র নামাইয়া খাড়াইয়া থাকে কর্ণ। কিন্তু হঠাৎ সে আবিষ্কার করে বিশাল। ভারী এক তির বাগানো অর্জুনরে নিয়া কৃষ্ণের রথ কাছে আসতাছে তার। কর্ণ চিৎকার কইরা উঠে কাপুরুষের মতো নিয়ম ভাঙতাছো ক্যান অর্জুন? অস্ত্র নিয়া জায়গায় খাড়াও। আমার রথটা উঠাইতে দেও…

অর্জুন কিছু কয় না। কৃষ্ণ চিকুর দেয়- যুদ্ধের একমাত্র নিয়ম হইল শত্রু মারা কর্ণ। পারলে ঠেকাও…

মুহূর্তে ধনুক তুইলা নেয় কর্ণ। আর অর্জুন বাণ চালাইবার আগেই একটা ভারী তির বিন্ধাইয়া দেয় অর্জুনের বাহুর ভিতর…

মাথা চক্কর দিয়া হাত থিকা গাণ্ডিব পইড়া যায় অর্জুনের। কর্ণ আর অস্ত্র চালায় না। অস্ত্র ছাইড়া নিজেই নাইমা ঠেলা দেয় রথের চাকায়। সারথির পোলা সে; আটকানো রথের চাকা কেমনে তুলতে হয় সে জানে। কিন্তু কাদাটা বড়োই কঠিন…

কর্ণ রথের চাকা ঠেলে আর কৃষ্ণ ঠেলে অর্জুনরে- উঠো। তির চালাও…

যুদ্ধের আগের রাত্তিরে কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের সাক্ষাতে যুদ্ধের যে নিয়মগুলা ঠিক করা হইছিল; কাদায় আটকানো রথের চাকা ঠেলতে ঠেলতে কর্ণ ভাবতেই পারে নাই তারে কাদাতে ফালাইয়া সেই নিয়মগুলা লঙ্ঘন করব কৃষ্ণ। কর্ণ রথের চাকা ঠেলে আর কৃষ্ণ অর্জুনরে নিয়া আইসা খাড়ায় তার কাছে। একদম কাছে…

কৃষ্ণের চোখে চোখ রাখে কর্ণ। কৃষ্ণ চোখ সরাইয়া নেয়। ততক্ষণে অর্জুনের ধনুকের ছিলা থাইকা বাইরাইয়া গেছে চ্যাপটামুখ ভারী অঞ্জলিক তির। তিরের দিকে তাকাইয়া কর্ণ একটা হাসি দেয়। তার হাসিমুখ বন্ধ হয় না আর। অর্জুনের তিরটা আইসা বিদ্ধ হয় কর্ণের শ্বাসনালির ভিতর…

শল্য নির্বাক। কর্ণ অর্জুনের যুদ্ধ বেশিক্ষণ সহ্য করতে না পাইরা যুধিষ্ঠির ফিরা গেছিল শিবিরে। অর্জুন শিবিরে গিয়া তার পায়ে ধইরা খাড়ায়- প্রতিজ্ঞা বিফল হয় নাই ভাই…

কৃষ্ণের রথে উইঠা অর্জুনের লগে যুধিষ্ঠির আইসা হাজির হয় মৃত কর্ণের সামনে- শান্তিতে ঘুমাও বীর…

সবাই অস্ত্র নামাইয়া রাখছে বহুক্ষণ আগেই। এখন না আর কেউ ভাবে অস্ত্র তোলার কথা; না ভাবে কেউ যুদ্ধসমাপ্তি ঘোষণার কথা। পাণ্ডবরা বিশ্বাস করতে পারে না যে কর্ণ নাই তাই পাণ্ডব শিবিরে কোনো বিজয়োল্লাস করে না কেউ। কুরুপক্ষ বিশ্বাস করতে পারে না যে কর্ণ নাই তাই কুরুপক্ষেও হাহাকার করতে পারে না কেউ। শুধু থাইকা থাইকা শোনা যায় দুর্যোধনের মাতম- হা কর্ণ। বন্ধু আমার। আমার ভাই…

.

১৯

দুর্যোধন পলাইছে। শল্য মরার পরপরই ভাগল দিছে দুর্যোধন…

কর্ণ মরার রাত্তিরে কৃপাচার্য আইসা দুর্যোধনরে কইছিলেন যুদ্ধ বাদ দিয়া দিতে। কিন্তু দুর্যোধনের কথা হইল- যুদ্ধ বাদ দিয়া আমার লাইগা যারা মরছে তাগো প্রতি অসম্মান দেখাইতে পারি না আমি।

আমি শান্তিবাদী বুড়া হইয়া মরতে চাই না গুরু কৃপাচার্য। হয় আমি রাজা হইয়া মরব না হয় যুদ্ধ কইরা মরব সৈনিকের মতো…

আঠারো নম্বর দিন কুরুপক্ষ শুরু করছিল শল্যরে সেনাপতি কইরা আর পাণ্ডবরা শুরু করছিল শল্য মারার পরিকল্পনা কইরা…

সহদেব মারে শল্যের পোলারে। ভীম মারে শল্যের ঘোড়া; শল্যের সারথি। কৃপাচার্য শল্যরে সরাইয়া নিলে পাণ্ডব বাহিনী আবারো গিয়া তারে ধরে। অত দিন যে যুধিষ্ঠির মেন্দামারা রাজা হইয়া আছিল; কর্ণ মরার পরে সেও আইজ বিশাল এক বীর। সে সকলরে ডাইকা কয়-  তোমরা সকলেই বহুত বীর মারছ। আইজ মোরে শল্য মারার সুযোগখান দেও…

যুদ্ধ শুরুর দিন যুধিষ্ঠির শল্যরে মামু কইয়া অনুরোধ করছিল সাহায্যের আর আইজ নিজেই ঘোষণা করল শল্যের সহযোগিতার পুরস্কার- নিজ হাতে মারা…

ভীম আগে; সাত্যকি ডানে; ধৃষ্টদ্যুম্ন বামে; অর্জুন পিছনে আর মাঝখানে যুধিষ্ঠির। দ্বিতীয়বার অশ্বত্থামা শল্যরে সরাইয়া নিয়া গেলেও পাণ্ডবরা আবার গিয়া তারে ধরে…

শল্য যুধিষ্ঠিরের ঘোড়া মারে। ভীম মারে শল্যের ঘোড়া। শল্য ঢাল আর তলোয়ার নিয়া আগাইলে ভীম শাবল দিয়া ফালাইয়া দেয় শল্যের ঢাল-তলোয়ার আর যুধিষ্ঠির তার বুকে ঢুকাইয়া দেয় একখান বর্শা…

কুরু সৈনিকদের পলায়ন আর ঠেকাইতে পারে না কেউ। দুর্যোধনের কথায় তারা একবার অস্ত্র ধরে তো আরেকবার দেয় দৌড়। দুর্যোধনের শেষ হাতি বাহিনীও ভীম- শিখণ্ডী- সাত্যকি আর ধৃষ্টদ্যুম্নের হাতে বিনাশ হইলে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ সাংবাদিক সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্ররে সংবাদ সাপ্লাই বাদ দিয়া চাইরজন অনুচর নিয়া খাড়ায় ধৃতরাষ্ট্রের পোলাদের পক্ষে…

অর্জুন তাগো হাতে-পায়ে মারে তির; সাত্যকি তাগোরে লাঠি দিয়া পিটায়…

অর্জুন হিসাব করে কৃষ্ণের লগে- ধৃতরাষ্ট্রের পোলাগো মাঝে বাকি আছে দুর্যোধন আর সুদর্শন। তাগো দুই ভাইর লগে আছে অশ্বত্থামা-কৃপাচার্য-সুশর্মা-শকুনি- উলুক আর কৃতবর্মা; এই ছয়জন। আর কিছু ঘোড়া এবং পদাতিক…

হিসাব শেষ কইরা অর্জুন সাত্যকিরে কয়-  আমার মনে লয় দুর্যোধন ভাগল দিছে। সঞ্জয়রে পাদানি দিলে তার সংবাদ পাওয়া যাবে। এ কুরুপক্ষের সবকিছু জানে…

পাণ্ডবগো ঝাড়া আক্রমণে অর্জুনের হাতে মরে সুশৰ্মা; ভীমের হাতে মরে সুদর্শন; সহদেবের হাতে মরে শকুনি আর শকুনিপুত্র উলুক। বাকি থাকে মাত্র চাইরজন; কৃপাচার্য- অশ্বত্থামা-কৃতবর্মা আর দুর্যোধন। এবং এই চাইরজনই দিছে ভাগল…

পিছমোড়া কইরা হাত বাইন্ধা ধৃষ্টদ্যুম্নের লগে সাত্যকি সঞ্জয়রে পিটায়- দুর্যোধন কই?

এর মাঝেই শোনা যায় একটা ধমক- খবরদার…

স্বয়ং কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন খাড়া সাত্যকি আর ধৃষ্টদ্যুম্নের সামনে- সঞ্জয়রে ছাড়ো…

দ্বৈপায়নের আদেশে মুক্তি পাইয়া সঞ্জয় দৌড়ায়। যাইতে যাইতে দুই মাইল গিয়া দেখে একলা একটা গদা নিয়া দুর্যোধন পলায়। দুর্যোধন কয়-  তুমি গিয়া বাবারে কইও তার পোলা দ্বৈপায়ন হ্রদে লুকাইয়া আছে। আমি আর রাজ্যে ফিরা যামু না সঞ্জয়। আমার ভাই নাই; বন্ধু নাই; সৈনিক নাই; পুত্ররা মারা গেছে যুদ্ধে। এমন অবস্থায় আধমরা হইয়া বাঁইচা আছি আমি…

দুর্যোধন লুকাইয়া থাকে হ্রদের পাড়ে জঙ্গলে আর একটু পরেই সেইখানে আইসা হাজির হয় কুরুপক্ষের বাকি তিনজন; কৃপাচার্য কৃতবর্মা আর অশ্বত্থামা। অশ্বত্থামা কয়-  আমরা তো এখনো মরি নাই তবে রাজার পলানোর কী কাম?

সন্ধ্যা পর্যন্ত দুর্যোধনের কোনো সংবাদ না পাইয়া যুদ্ধ শেষ বইলাই ধইরা নেয় সকলে। কুরুপক্ষের জোগানদারেরা কুরুক্ষেত্রে আর কোনো কাম নাই ভাইবা জিনিসপত্র নিয়া ফিরতে শুরু করে রাজ্যের দিকে। পাণ্ডবেরাও শিথিল…

যুদ্ধের শুরুর দিন ধৃতরাষ্ট্রের দাসীগর্ভজাত যে পুত্র পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিছিল; সেই যুযুৎসু যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়া হস্তিনাপুর রওনা দেয় পিতা আর বিদুররে সকল সংবাদ দিতে…

সন্ধ্যায় আবারও কৃপ অশ্বত্থামা আর কৃতবর্মা গিয়া হাজির হয় দুর্যোধনের কাছে- রাজা চলো আবার গিয়া যুদ্ধ করি… দুর্যোধন কয়- কাইল সকালে যুদ্ধ করব। আইজ রাত্তিরে বিশ্রাম নেন সকলে

অশ্বত্থামা কয়-  আমি শপথ কইরা কই; আইজ রাত্তিরেই আমি একটা কিছু ঘটামু

পাণ্ডবরা দুর্যোধনরে খুঁইজা না পাইয়া শিবিরে ফিরে…

ভীমের আছিল কিছু অতিরিক্ত অভ্যাসের সাথে কিছু মানুষের লগে বাড়তি যোগাযোগ। চোলাই মদ আর বিচিত্র শিকারের মাংসে আছিল তার দারুণ রুচি। তাই আশপাশের শিকারিরা ভালো শিকার পাইলে তা নিয়া আসত ভীমের কাছে পুরস্কারের আশায়। তার সেই শিকার জোগানদার দলের লোকরা সন্ধ্যায় বন থিকা ফিরার সময় দুর্যোধনরে দেইখা লাফাইয়া উঠে- আরে; আমাগো ভীম ভাইয়ের লগে মারামারি কইরা হুমুন্দির পুত দেখি এইখানে লুকায়…

তারা সোজা আইসা হাজির হয় ভীমের তাবুতে আর সন্ধ্যাকালেই পাণ্ডবেরা রওনা দেয় দ্বৈপায়ন হ্রদে। তাগোরে দেইখা কৃপাচার্য অশ্বত্থামা কৃতবর্মা সইরা যায় আর দুর্যোধন লুকাইয়া থাকে বনে। কিন্তু হ্রদের পাড়ে অসংখ্য ঝোঁপঝাড়। যুধিষ্ঠির কয়-  এই অন্ধকার বনে দুর্যোধনরে কই খুঁইজা পাই?

কৃষ্ণ কয়- বন তছনছ কইরা তারে পাওয়া যাবে না। আপনে চিল্লাইয়া তারে টিটকারি মারেন। দুর্যোধন মরতে রাজি হইব কিন্তু টিটকারি সহ্য করব না…

জীবনে একটামাত্রবার দুর্যোধনের মূল নাম ধইরা ডাইকা উঠে কেউ; আর সেইটা যুধিষ্ঠির- সূর্যোধন; নামটা তার বাপে রাখছিল বড়ো আহ্লাদ কইরা। কিন্তু অকামে-কুকামে তার সূর্যোধন নামটা বদলাইতে বদলাইতে দুর্যোধন হইয়া যায়…

বনের পাড়ে অন্ধকারে খাড়াইয়া যুধিষ্ঠির তার আদি নাম ধইরা ডাকে- সূর্যোধন। বীর সূর্যোধন কাপুরুষের মতো লুকাইয়া আছ ক্যান? আসো যুদ্ধ করো আমাগো লগে। তুমি যদি জানের ডরে পলাইয়া থাকো তয় যারা তোমার লাইগা মরল তাগো কাছে পরলোকে মুখ দেখাইবা কেমনে?

যুধিষ্ঠির চিল্লায় কিন্তু অন্য দিকে কোনো সাড়াশব্দ নাই। যুধিষ্ঠির কয়-  এখন বুঝতে পারতাছি। তুমি মূলত আছিলা একটা কাপুরুষ কিন্তু করতা বীরের বড়াই…

এমন টিটকারিতে দুর্যোধনের সাড়া না দিয়া উপায় নাই। বনের ভিতর থাইকা সে চিল্লাইয়া উঠে- মুখ সামলাইয়া কথা কবা যুধিষ্ঠির। দুর্যোধন জানের ডরে পলায় নাই। আমি নিরিবিলি বিশ্রামের লাইগা এইখানে আসছি। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো; আমি তোমাগো সকলের লগেই যুদ্ধ করব…

যুধিষ্ঠির কয়-  সেইটা তো আমি জানিই। আমিও তো জানি যে দুর্যোধন মরলে বীরের মতো যুদ্ধ কইরা মরব তবু কাপুরুষের মতো পলাইয়া বাঁচব না সে…

আড়াল থাইকা দুর্যোধন কয়- এর লগে বাঁচা-মরার সম্পর্ক নাই। আমার সকল আত্মীয়-বন্ধু নিহত। তাগো বাদ দিয়া রসকষহীন বিধবা দুনিয়ায় আমি বাঁচতেও চাই না আর। যত দিন ফুর্তি নিয়া রাজত্ব করা যায় তত দিন আমি তা করছি। এখন বুড়া বয়সে বিধবাভারাক্রান্ত রাজ্যের রাজত্ব তুমিই করো যুধিষ্ঠির। আমার আর কোনো দাবি নাই…

এই হইল দুর্যোধন। ডরে লুকাইয়া আছে; যুদ্ধে হাইরা ভাগছে তবু বনের আড়ালে লুকাইয়া সে রাজ্য দান কইরা দিতাছে পাণ্ডবদের; যেন আমার যা খাওয়ার খাইছি অতক্ষণ; এইবার দয়া কইরা তোমাগো ছোবড়া চুষতে দিলাম…

যুধিষ্ঠিরও খেইপা উঠে- আমি এইখানে তোমার দান নিতে আসি নাই। রাজা যদি হইতেই হয় তবে তোমারে মাইরাই তা হমু। তাছাড়া তোমার তো এখন রাজ্যই নাই; তয় তুমি কেমনে তা আমারে দান করো? এমন কাপুরুষের মতো আড়ালে থাইকা বকবক বন্ধ কইরা বাইরে আইসা যুদ্ধ করো…

বন দাবড়াইয়া উইঠা খাড়ায় দুর্যোধন- তোমরা অতগুলা মানুষ রথ আর অস্ত্রপাতি নিয়া নিরস্ত্র একলা আমার লগে যুদ্ধ করতে আসছ যুধিষ্ঠির? তোমরা যদি একজন একজন কইরা আসো তবে আমি একে একে তোমাগো সবাইরে নিশ্চিত মারব…

দুর্যোধন আধা প্রকাশ্য হইছে। যুধিষ্ঠির তারে পুরা প্রকাশ্য করার লাইগা কিছু না ভাইবাই কইয়া বসে- সাবাশ দুর্যোধন। আমি জানি যুদ্ধে ডরাও না তুমি। ঠিকাছে; আমি তোমারে কইতাছি তুমি আসো এবং তোমার পছন্দমতো অস্ত্রে আমাগো যেকোনো একজনের লগেই যুদ্ধ করো। আমাগো মধ্যে যেকোনো একজনরে হারাইতে পারলেই তুমি তোমার কুরুরাজ্য ফিরত পাইবা; সেই নিশ্চয়তা দিতাছি আমি…

যুধিষ্ঠিরের কথায় কৃষ্ণ চমকাইয়া উঠে- হালা জুয়াড়িটা ঘাটে আইসা আবার নৌকা ডুবাইয়া দিলো। সে গিয়া যুধিষ্ঠিররে ধরে- কী কথা কইলেন আপনে? আপনি যে কইলেন যেকোনো একজনরে হারাইলেই সে রাজ্য ফিরা পাবে? আপনি তো সব ডুবাইয়া দিলেন। গদাযুদ্ধে দুর্যোধনের ক্ষমতা আপনি জানেন? সঠিক নিয়মে গদাযুদ্ধে দুর্যোধনরে হারানোর মতো কোনো মানুষ তো দূরের কথা; দেবতার নামও আমার জানা নাই…

কৃষ্ণ পুরাই হতাশ- আপনে একবার কারো লগে কোনো কথাবার্তা না কইয়া শকুনির কাছে জুয়া খেইলা সকলরে বিপদে ফালাইছিলেন। আইজ আবার আরেকটা বেকুবি কইরা পুরা যুদ্ধটাই মাটি কইরা দিলেন…

কৃষ্ণ হাহুতাশ করে- আমাগো মধ্যে একমাত্র ভীমই পারে তার সামনে খাড়াইতে। ভীমের শক্তি দুর্যোধন থাইকা বেশি। ভীমের সহ্যক্ষমতাও বেশি কিন্তু গদার লড়াইয়ে দুর্যোধন বেশি এক্সপার্ট। তাও যদি ভীম যায় আমি তারে বুদ্ধি দিয়া সাহায্য করতে পারি। কিন্তু আপনি কিংবা অর্জুন কিংবা নকুল সহদেব তার সামনে গদা নিয়া খাড়াইলে কেমনে কী?

অন্ধকারে বাকি পাণ্ডবরা থ মাইরা থাকে যুধিষ্ঠিরের বেকুবিপনায়। কৃষ্ণ প্রায় বিলাপ করে-রাজা হইবার লাইগা কুন্তীর পোলাগো জন্ম হয় নাই। বনবাস আর ভিক্ষা কইরা বাঁইচা থাকার লাইগাই ফুপি জন্ম দিছিল এই সব কুলাঙ্গার…

ভীম আইসা ধরে কৃষ্ণরে- চিন্তা কইরো না। দুর্যোধনরে মারতে অসুবিধা হইবা না আমার। আমার গদা দুর্যোধনের গদার থিকা দেড়গুণ ভারী…

কৃষ্ণ কয়-  তোমার হাতেই যুধিষ্ঠিরের সিংহাসন আসব সন্দেহ নাই। কিন্তু ভাইজানের বেকুবির লাইগা এখন যদি দুর্যোধন অন্য কারো লগে যুদ্ধ করতে চায়?

ভীম কয়-  তা করব না। দুর্যোধনরে আমি চিনি। বাকি পাণ্ডবরা মাথা পাইতা দিলেও আমারে রাইখা সে অন্যদের মারব না। আমারে গদাযুদ্ধে হারাইয়া বাকিদের তিলে তিলে মারাই তার বহু দিনের খায়েশ। জয়ের থাইকা বীরত্বটাই তার কাছে বড়ো…

কৃষ্ণ কয়-  সেইটাই ভরসা। দুর্যোধনের অহংকার আর বীরত্বের গরিমাই এখন আমাগো শেষ ভরসা। কিন্তু বলা যায় না হঠাৎ কইরা যদি তার মাথায় রাজনীতি খেইলা যায়? যদি সে তোমারে বাদ দিয়া অন্য কারো লগে যুদ্ধ করতে চায়?

ভীম কয়-  সেই ব্যবস্থা আমি করতাছি। সে কাউরে বাছার আগেই আমি তারে যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ দিয়া গালাগালি শুরু কইরা দিমু। তাইলে সে যেমন না পারব আমার চ্যালেঞ্জ ফিরাইতে তেমনি না পারব রাজনীতি নিয়া ভাবতে…

অন্ধকারে বন নাড়াইয়া দুর্যোধন প্রকাশ্য হইবার আগেই ভীম শুরু করে খিস্তিখেউড়- আয় পাপিষ্ঠ আয়। তুই আর তোর বাপে মিলা যত পাপ করছস আইজ তার হিসাব চুকামু আমি। তুই দ্রৌপদীরে লাঞ্ছনা করছিলি; শকুনির লগে মিলা আমাগো রাজ্য নিছিলি; সবার মরার ব্যবস্থা কইরা এখন আমার ডরে আইসা বনে লুকাইছস। আয়; বাইরাইয়া আমার লগে মারামারি কর; তোর যুদ্ধের শখ আইজ মিটামু হালা ডরালুক। সাহস থাকলে আইসা আমার সামনে খাড়া…

দুর্যোধন গদা কান্ধে সোজা আইসা খাড়ায় ভীমের সামনে- মশা মাইরা হাত লাল করার অভ্যাস দুর্যোধনের নাই। গদা দিয়া পিটাইয়া যদি কাউরে মারতে হয় তয় তোরে মাইরাই কিছুটা আরাম পামু আমি। তারপর বাকিগুলারে তো পা দিয়া ডলা দিলেই হয়…

দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরের দিকে ফিরে- ভীমের লগে লড়াই করব আমি…

হাফ ছাইড়া বাঁচে কৃষ্ণ। যুধিষ্ঠিরও বাঁইচা যায় নিজের বেকুবি থাইকা…

বনের অন্ধকারে যখন ভীম আর দুর্যোধন গদা নিয়া মুখোমুখি ততক্ষণে সংবাদ পাইয়া কুরুক্ষেত্র থাইকা বহু মানুষ আইসা হাজির হইছে দ্বৈপায়ন হ্রদের তীরে। কর্ণ আর অর্জুনের তিরযুদ্ধ যেমন কেউ মিস করতে চায় নাই তেমনি ভীম আর দুর্যোধনের গদাযুদ্ধও মিস করতে চায় না কেউ। কিন্তু এইবার একজন বাড়তি মানুষও আইসা উপস্থিত। তিনি গদাযুদ্ধের উস্তাদ বলরাম। তারে দেইখা কৃষ্ণ কয়-  ভালৈই হইছে। আপনের দুই শিষ্যের লড়াই দেখতে পাইবেন এখন…

বলরাম কয়-  গদাযুদ্ধের লাইগা এইটা কোনো জায়গা হইল? বনের অন্ধকারে গদাযুদ্ধ হয় কেমনে? আমি কই কি তোমাগো উচিত কুরুক্ষেত্রের পাশে কোনো পরিষ্কার আর সমান জায়গায় গিয়া দুর্যোধন ভীমের লড়াই আয়োজন করা…

বলরামের কথা ফেলার সুযোগ নাই। সকলেই রওনা দেয়। গদা কান্ধে নিয়া পাশাপাশি হাঁটে দুর্যোধন আর ভীম। ভীমের লগে সকলে থাকলেও দুর্যোধন একা। কিন্তু তবুও সে নির্ভীক আর সে রাজা…

কুরুক্ষেত্রের পাশে কিছু দিন আগে যজ্ঞ করার লাইগা একটা জায়গা পরিষ্কার করা হইছিল। সেই সমান জায়গাটাই বলরাম ঠিক করে ভীম-দুর্যোধনের লড়াইর স্থান হিসাবে। শুরু হয় ভীম দুর্যোধনের গদার লড়াই। গদা বাগাইয়া ঘুরতে থাকে দুইজন দুইজনের ফাঁক খুঁজতে খুঁজতে আক্রমণ শানায় আক্রমণ দেখায় কিন্তু আঘাত হয় না বিশেষ। একজন মারলে আরেকজন পিছায় পায়ের ক্ষিপ্রতায়…

দুর্যোধন একটা বাড়ি বসায়ে দেয় ভীমের মাথায়। ভীমও পাল্টা বাড়ি মারে কিন্তু দুর্যোধন মাথা সরাইয়া ফেলায়। বুকে দুর্যোধনের আরেকটা বাড়ি খাইয়া ভীম পড়ে মাটিতে। উইঠা দুর্যোধনের পাশে একটা বাড়ি বসাইয়া দেয়। দুর্যোধন পইড়া গিয়া উইঠা আরেকটা মোক্ষমে ভীমেরে মাটিতে শুয়াইয়া ফালায়…

ভীমের বর্ম ভাঙ্গে। ভীম রক্তাক্ত। নকুল সহদেব ধৃষ্টদ্যুম্ন সাত্যকি দুর্যোধনের দিকে তাড়াইয়া যায়। ভীম তাগোরে থামাইয়া আবার খাড়ায়। অর্জুন যায় কৃষ্ণের কাছে- মাধব। সত্য কইরা কও তো এই দুইজনের মধ্যে কে ভালো গদারু?

কৃষ্ণ কয়- দুইজনের মধ্যে ভীমের শক্তি বেশি হইলেও দুর্যোধন বেশি কৌশলী আর আর দক্ষ। দেখো না দুর্যোধন কেমনে মাইরগুলা এড়াইয়া যাইতাছে…

অর্জুন কেন প্রশ্নটা করছে কৃষ্ণ বোঝে। সে যোগ করে- নিয়ম মাইনা যুদ্ধ করলে ভীমের পক্ষে দুর্যোধনরে হারানো সম্ভব না। নিয়ম ভাইঙ্গাই তারে কাবু করতে হবে…

দুর্যোধন আর ভীমের লড়াই দেইখা অর্জুনও চিন্তিত হয়। এইভাবে চললে ভীমের শক্তি অতি দ্রুত ক্ষয় হইয়া যাবে। অর্জুন গিয়া খাড়ায় ভীমের কাছাকাছি। ভীম লড়াই করতাছে। অর্জুন নিজের উরু চাপড়াইয়া দেখায় ভীমেরে। নিয়ম অনুযায়ী গদার লড়াইয়ে কোমরের নিচে আঘাত করা নিষেধ।

কোমরের নিচে কেউ আঘাত করে না বইলা গদারুরা কোমরের নিচে যেমন না পরে কোনো বর্ম তেমনি না নেয় কোনো সতর্কতা…

অনেকক্ষণ লড়াইর পর ভীমেরও মনে হয় এমন যুদ্ধ অনন্তকাল চললেও জয়ী হওয়া সম্ভব না। দুর্যোধনের শরীরে সে আঘাতই বসাইতে পারছে না। অথচ ফাঁকে-ফোকরে দুর্যোধন তারে বসাইয়া দিতাছে বাড়ি আর গুতা। দুর্যোধনের একটা বিরাশি শিক্কার বাড়ি খাইয়া পইড়া যায় ভীম। ভীম আবার উইঠা খাড়ায়। এইবার সে অন্য সুযোগ খোঁজে এবং একটা সুযোগে সমস্ত শক্তি দিয়া বাড়িটা বসায় দুর্যোধনের উরাতের হাড়ে…

মড়াৎ কইরা ঊরু ভাইঙ্গা মাটিতে গড়ায় দুর্যোধন। ভীম গিয়া পা দিয়া দুর্যোধনের মাথা চাইপা ধরে হালা ভণ্ড…

খেইপা উঠে বলরাম- অসম্ভব। আমার সামনে গদাযুদ্ধের নিয়ম ভাঙ্গা। এ হইতেই পারে না। দুর্যোধনের উরাতে আঘাত কইরা মারাত্মক অন্যায় করছে ভীম। এর শাস্তি পাইতে হবে তার…

বলরাম নিজের লাঙ্গল বাগাইয়া যায় ভীমের দিকে। কৃষ্ণ দৌড়াইয়া যাইয়া জাপটাইয়া ধরে ভাইজান থামেন। পাণ্ডবেরা আমাদের মিত্র; আত্মীয়। এদের জয়ে আমাদেরই জয়। তাছাড়া দুর্যোধনের ঊরুভাঙ্গা পাশার আসরে ভীমের প্রতিজ্ঞা আছিল ভাইজান…

গোস্বা কইরা বলরাম চইলা গেলে ধীরে ধীরে যুধিষ্ঠির মুখ খোলে- যে যাই বলুক; কৃষ্ণের নির্দেশে চইলাই আমরা যুদ্ধের সমাপ্তি টানছি আইজ…

যুধিষ্ঠির ভীমরে জড়াইয়া ধরে- মায়ের নিকট; দ্রৌপদীর নিকট আর নিজের প্রতিজ্ঞার নিকট আইজ তুই ঋণমুক্ত হইলি ভাই…

পাণ্ডবেরা ফিরার উদ্যোগ নেয়। ঊরুভাঙ্গা দুর্যোধন হাতের উপর ভর কইরা উইঠা বসে। কৃষ্ণরে ডাকে- কংসদাসের পোলা। এই জগতে যদি নিয়ম ভাঙ্গার কেউ থাকে তবে তা তুমি; চক্রান্তকারী। তুমি চক্রান্ত কইরাই হত্যা করছ ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ আর আমারে। নিয়ম মাইনা আমাগো লগে যুদ্ধ করলে কিছুই করতে পারতা না তুমি…

পাণ্ডবেরা কিছু কইতে গেলে কৃষ্ণ থামায়- সর্বদা সত্য কথা কয় বইলাই কিন্তু ওর আরেক নাম সত্যবাক। ওর কথাই ঠিক। ওরা চাইছিল বীরত্ব দেখাইতে; তারা তা দেখাইছে। আমরা চাইছিলাম বিজয়; আমরা তা পাইছি। চলো…

পাণ্ডবরা চইলা আসার পর দুর্যোধনের কাছে অশ্বত্থামা গিয়া হাজির হয় কৃপ আর কৃতবর্মারে নিয়া। সকল শুইনা অশ্বত্থামা কয়- বাপের অপমানেও অত দুঃখ পাই নাই যত দুঃখ পাইছি তোমার লগে তাগো আচরণে। তুমি আমারে সেনাপতি বানাইয়া যুদ্ধের অনুমতি দেও…

মাটিতে শুইয়া দুর্যোধন অশ্বত্থামারে সেনাপতি বানায়। অন্ধকারে দুর্যোধনরে ফালাইয়া কৃপ আর কৃতবর্মারে নিয়া মিলাইয়া যায় অশ্বত্থামা। অন্য দিকে দুর্যোধনের পতন সংবাদের লগে লগে কুরু সৈনিকরা আত্মসমর্পণ কইরা ফালায় পাণ্ডবগো কাছে। পাণ্ডব সৈনিকরাও শুরু কইরা দেয় কুরু শিবিরে লুটপাট। আর যুধিষ্ঠির কয়-  চলো আমরা হস্তিনাপুর যাই…

কৃষ্ণ আর পাণ্ডবেরা যায় হস্তিনাপুর। সেইখানে আন্ধাপোলা ধৃতরাষ্ট্রের পাশে বইসা আছেন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। ধৃতরাষ্ট্রের হাত ধইরা কৃষ্ণ কয়- মহারাজ; আপনি জানেন কুলক্ষয় আর যুদ্ধ বন্ধের লাইগা কুন্তীপুত্ররা কী চেষ্টাই না করছিল। শেষ পর্যন্ত মাত্র পাঁচখান গ্রাম চাইছিল তারা। আপনে তাও দেন নাই। ভীষ্ম দ্রোণ কৃপও আপনারে অনুরোধ করছিলেন। কিন্তু আপনে শোনেন নাই। এখন আপনের পিণ্ডদানের লাইগা পাণ্ডব ছাড়া আপনের বংশে আর কেউ নাই। আপনে আর মাতা গান্ধারী কাউরে দোষ দিয়েন না। ভাতিজাগো বরণ কইরা নেন…

যুদ্ধ শেষ হইয়া গেছে ভাইবা কৃষ্ণ আর পাণ্ডবরা যেমন চইলা আসছে হস্তিনাপুর তেমনি গা ঢিলা দিয়া পাঞ্চাল আর পোলাপানরা শিবিরে ঘুমাইতাছে বেঘোর। আর তখনই জঙ্গলের ভিতর কৃপাচার্য আর কৃতবর্মারে ঘুম থাইকা জাগাইয়া অশ্বত্থামা কয়-  এখনই পাণ্ডব শিবির আক্রমণ করব আমি…

কেউ পলাইতে গেলে মারার লাইগা কৃপ আর কৃতবর্মারে বাইরে রাইখা অশ্বত্থামা ঢোকে পাণ্ডব শিবিরে। প্রথমেই ধৃষ্টদ্যুম্নের ঘর; লাত্থি দিয়া তারে ঘুম থাইকা জাগায়। এক পায়ে গলায় চাপ দেয় আর অন্য পায়ের গোড়ালির ঘায়ে তার শ্বাস বাইর কইরা ফালায়। কৌরবপক্ষের শেষ সেনাপতির পায়ে বিনা প্রতিরোধে প্রাণখান বাইরাইয়া যায় পাণ্ডবপক্ষের আগাগোড়া প্রধান সেনাপতির…

ঘুমন্ত পাণ্ডব শিবিরে তাণ্ডব চালায় অশ্বত্থামা। কেউ কেউ প্রতিরোধ করতে চাইলেও সকলেই কাটা পড়ে অশ্বত্থামার তলোয়ারে। কাটা পড়ে দ্রৌপদীর ভাই শিখণ্ডী। কাটা পড়ে পঞ্চ পাণ্ডবের ঔরসে দ্রৌপদীর পাঁচ পোলা প্রতিবিন্ধ্য- সুতোসোম- শ্রুতকর্মা- শতানীক আর শ্রুতসেন…

মানুষ মাইরা অশ্বত্থামা পাণ্ডবগো হাতি-ঘোড়া মারে। যারা পলাইতে যায় তারা মারা পড়ে বাইরে খাপ ধইরা থাকা কৃপাচার্য আর কৃতবর্মার হাতে…

দুর্যোধনের আশপাশ ঘিরা আছে শিয়ালের দল। অতি কষ্টে শিয়াল তাড়াইয়া বাঁইচা আছে রক্তবমি করা দুর্যোধন। এরই মাঝে অন্ধকার যুঁইড়া তার সামনে আইসা খাড়ায় অশ্বত্থামা-পাণ্ডবপক্ষে জীবিতের সংখ্যা এখন মাত্র সাত। পাঁচ পাণ্ডব; কৃষ্ণ আর সাত্যকি। পাণ্ডবগো বাকি সব বংশধর। সমস্ত পাঞ্চাল; এমনকি হাতিঘোড়ার একটাও অবশিষ্ট নাই…

দুর্যোধন কয়-  অশ্বত্থামা তুমি এক রাত্তিরে যা করলা; অত দিন যুদ্ধ কইরা ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণও তার একাংশ করতে পারে নাই। আইজ আমার থাইকা সুখী কেউ নাই। যুধিষ্ঠির হয়ত জয়ী হইছে কিন্তু তার আনন্দ করার ক্ষমতা কাইড়া নিছি আমি। যুধিষ্ঠির এখন এক হাহাকার রাজ্যের রাজা। হা হা হা…

কৃপ আর কৃতবর্মারে নিয়া অশ্বত্থামা চইলা গেলে একলা যে মানুষটারে নুয়াইতে না পাইরা সারা যুদ্ধের সমস্ত সমীকরণ তৈয়ারি হইছে; সেই দুর্যোধন নেতাইয়া পড়ে অন্ধকার মাঠে আর মৃত সিংহের মাংসে দাঁত বসাইতে ধীরে ধীরে আগাইয়া আসে শিয়ালের দল…