ভণিতা
০১
কবিরা যুক্তি মানে না আর ধার্মিকেরা যুক্তি বানায়। এতে কোনো ঝামেলা নাই কারণ কাব্যকাহিনি যারা পড়ে আর ধর্মকথন যারা মানে তারা ভিন্ন ভিন্ন লোক; ভিন্ন ভিন্ন রঙের অন্তর নিয়া তারা বসবাস করে ভিন্ন ভিন্ন জগতে; যদিও দুই দলেরই ভিত্তি মূলত কল্পনায়। পার্থক্য শুধু এই যে কাব্যভক্তরা কল্পনারে কল্পনা জাইনা বিনোদিত হন আর ধর্মভক্তরা কল্পনারে সত্য জাইনা করেন বিশ্বাস…
এতেও কোনো ঝামেলা নাই। কিন্তু ঝামেলা তখনই বাঁধে যখন কবিরা ধর্মকথা কইতে যান কিংবা ধার্মিকেরা আসেন কাব্য রচনায়। আর তখনই তৈরি হয় বিশ্বাসের কাব্য কিংবা কাব্যিক বিশ্বাস কিংবা দুনিয়ার সব থাইকা বড়ো ভজঘট; মহাভারত…
উল্টাপাল্টা কিছু কইরা তারে জায়েজ করতে গেলে মাইনসে যুক্তি দেখায়। এতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হইল? আসোলে মহাভারত এমন একখান অশুদ্ধ জিনিসের শুদ্ধতম উদাহরণ যে কোনোমতেই তারে অশুদ্ধ করার সাধ্যি কারো বাপেরও নাই। অন্তত এইটা আমার উপলব্ধি…
০২
এখন থাইকা সাড়ে চাইর হাজার বছর আগে তৈরি একখান কাহিনি কথক-পালাকারের মুখে ঘুরতে ঘুরতে লিপিবদ্ধ পুস্তকের চেহারা পাইছে মাত্র হাজার দুয়েক বছর আগে। এই যে কথাটা কইলাম সেইখানেও কিন্তু বিশাল ভজঘট আছে। কারণ প্রাচীন দুই গণিতবিদ আর্য ভট্ট আর বরাহ মিহিরের রেফারেন্স টাইনা যেইখানে ড. অতুল সুর কন যুধিষ্ঠিরের রাজ্য অভিষেক হইছিল খ্রিস্টপূর্ব ২৪৪৮ সালে; সেইখানে প্রাচীন শাস্ত্র ঘাঁইটা আর বিস্তর গোনাগুনতি কইরা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কন কুরুযুদ্ধ হইছে খ্রিস্টপূর্ব ১৪৩০ সালে। প্রাচীন দুই গণিতবিদের মতো অতুল সুর কুরুযুদ্ধের অস্তিত্বে সন্দেহ করলেও কুরুযুদ্ধ আর যুধিষ্ঠিরের রাজ্য অভিষেক যেহেতু পিঠাপিঠি জিনিস তাতে সহজেই বলা যায় যে এই দুই মহারথীর গোনাগুনতির মইদ্যেও ফারাক প্রায় হাজার বছরের। এর বাইরেও আরো কথা আছে। কইতে কইতে কেউ কেউ সাক্ষী দলিল দেখাইয়া মহাভারতের ঘটনারে টানতে টানতে আরো বহু কাছাকাছি; মানে তৃতীয় চতুর্থ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নিয়া আসেন। তো এইটা হইল মহাভারতের ঘটনাবলির সময়কাল নিয়া গ্যাঞ্জাম। একইভাবে ভিন্ন ভিন্ন যুক্তি আর সিদ্ধান্ত আছে পুস্তক হিসাবে মহাভারত লিখিত হইবার সময়কাল নিয়া; যেইটা মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব ২০০ থাইকা ৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আটশো বছরের ঘাপলাকাল…
যে কালেই শুরু হউক আর যে কালেই লেখা হউক না কেন; মূল কথা হইল শুরু হইবার পর এই পুস্তক বহু জায়গায় বহু চেহারা পাইছে ভিন্ন ভিন্ন দেশে; ভিন্ন ভিন্ন গোত্র; ভিন্ন ভিন্ন মানুষের হাতে। এইটার চেহারা বদলাইছেন কবিরা; চেহারা বদলাইছেন ধার্মিকেরা; চেহারা বদলাইছেন রাজনীতিবিদেরা। মাঝে মাঝে নিজের জাতিরে ঐতিহ্যবান দেখাইতে গিয়া তৈরি হইছে লাখে লাখে উপকাহিনি-মহাভারতে বর্ণিত অমুক জায়গাখান কিন্তু মোগো বাসস্থান কিংবা কুরুযুদ্ধের অমুক চরিত্র হইল মোগো পূর্বপুরুষ। যদিও নৃতাত্ত্বিকেরা মহাভারতের কিছু ঘটনা আর কিছু কেন্দ্রীয় ভূগোলের ঐতিহাসিক বাস্তবতা স্বীকার কইরা নিলেও সম্পূর্ণ সন্দেহ করেন কুরুযুদ্ধের অস্তিত্ব নিয়া। তারা কন কোনোকালেই কুরুযুদ্ধ নামে কিছু হয় নাই। এর পক্ষে পয়লা দুইটা যুক্তি হইল দ্বৈপায়নের মহাভারত লেখার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বয়ানকার বৈশম্পায়ন আর উগ্রশ্রবা সৌতি যে কথাগুলা বলেন তার মধ্যেও যেমন কুরুযুদ্ধের কথা নাই তেমনি কুরুযুদ্ধের কোনো নামগন্ধ নাই ঋগ্বেদের পাতায়…
বেদের কথাবার্তায় মহাভারত ভরপুর থাকলেও এক হিসাবে বেদ কিন্তু তৈরি হইছে মহাভারতের বহুত পরে। ঋগ্বেদরে যারা অনেক প্রাচীন কইতে চান তারা কন এইটা তৈরি হইছে খ্রিস্টপূর্ব ১৩০০ তে আর যারা এরে আরো নবীন বলেন তারা কন খ্রিস্টপূর্ব ১২০০-তে; মানে বঙ্কিমচন্দ্রের হিসাবে কুরুযুদ্ধের কমপক্ষে ১৩০ বছর আর অতুল সুরের হিসাবে কমপক্ষে প্রায় সাড়ে এগারোশো বছর পর। বাকি বেদগুলার রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব হাজার থাইকা নয়শো পর্যন্ত হইলেও সেইগুলাতেও কুরুযুদ্ধের কোনো তথ্য-তালাশ নাই…
কেউ কেউ কন হইলে হইতে পারে মহাভারতের দশ-বিশজন পালোয়ান কোনো এক সময় কিছু কিলাকিলি আর লাঠালাঠি করছিল; আবার এমনও হইতে পারে যে কুরু-পাঞ্চাল মারামারিরে ফুলাইয়া-ফাঁপাইয়া কবিগণ আঠারো দিনের কুরুযুদ্ধ বানাইয়া ফালাইছেন। তবে এইটাও মনে রাখা দরকার যে পাঞ্চালজাতি সম্পর্কেও কিন্তু বেদে পরিষ্কার কিছু নাই; যদিও অনেকে অনুমান-টনুমান করেন যে বেদের অমুক কথায় বোধ হয় পাঞ্চালের কথা কওয়া হইছে। কিন্তু কারো কথার লগেই কারো কথা মিলে না। একজন একখান পুস্তক রচনা কইরা এক বয়ান করেন তো আরেকজন তা অন্য রচনায় বাতিল কইরা কন- তিনি যা কইছেন তা ঠিক না; মূলত মহাভারত কইছে অন্যকথা… তয় এইটা ঠিক যে মহাভারত কইছে বহুত কিছু কিংবা মহাভারতরে দিয়া কওয়ানো হইছে বহুত কিছু। মহাভারত চতুর্বর্ণের কথা কইছে। কিন্তু গুণীজন হিসাব কইরা কন চতুর্বর্ণের সংবিধান মনু সংহিতার রচনাকাল মাত্র খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতক। কেউ কেউ কন আরো পরে; খ্রিস্টপূর্ব ২০০ থাইকা ২০০ খ্রিস্টাব্দ। মহাভারতের পরতে পরতে আছে কর্মফল- জন্মান্তরবাদ আর পূর্বজন্মের কাহিনি। কিন্তু ঋষি যাজ্ঞবল্কের উর্বর মগজ থাইকা এই জন্মান্তরবাদের থিওরিখান নাকি বাইরাইছে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০’র দিকে; বর্ণপ্রথা চালুর সময়। মহাভারত জুইড়া অবতারগো বিশাল দাপট; স্বয়ং কৃষ্ণ সেইখানে অবতার; কিন্তু এই অবতারবাদের উদ্ভব হইছে যিশুখ্রিস্ট জন্মাইবার তিন থেকে। চাইরশো বছর পরে; গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়; যেইখানে এইটারে জোরালো বিশ্বাসে পরিণত করছে বৌদ্ধ ধর্মের জাতক কাহিনি। কুরুযুদ্ধে বহুত ভারী ভারী লোহার অস্ত্রের বর্ণনা পাওয়া গেলেও মানবজাতি কিন্তু লোহা আবিষ্কার করছে মাত্র খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ সালে আর তার ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পারছে আরো বহু পরে…
তো কথা হইল তাইলে মহাভারতে অত বর্ণপ্রথা জন্মান্তরবাদ অবতারবাদের থিউরি আর লোহার অস্ত্র সাপ্লাই দিলো কেডায়?
সাপ্লাই দিছে এখন থাইকা মাত্র দেড়-দুই হাজার বছর আগের কবিদল; মানে পুরাণ রচয়িতাগণ। পুরাণগুলারে যারা অনেক প্রাচীন কইতে চান তারা কন খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ থাইকা শুরু হইয়া ৫০০ খ্রিস্টাব্দের মইদ্যে রচিত হইছে এইগুলা আর যারা পুরাণের বয়স কমাইবার পক্ষে তারা কন
এইগুলা খ্রিস্টজন্মের ৬ থাইকা ১২ শতাব্দী সময়কালে উৎপাদিত জিনিস। আর ড অতুল সুর কন মহাভারতখান লিখিত রূপ পাইছে খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ থাইকা ৪০০ খ্রিস্টাব্দের মইদ্যে। মানে যা কারিগরি হইবার তা হইছে এই সময়টাতেই; মহাভারত লিখিত হইবার সময়। এই সময়ে লেখকগো হাতে মগজে বোঁচকায় যার যত অ্যাজেন্ডা আছিল সব তারা ঢুকাইয়া দিছে মহাভারতের পাতায়; আর তাতে চেহারায় বিষয়ে গল্পে পুরা ভজঘট পাকাইয়া হইয়া উঠছে বর্তমান লিখিত মহাভারত। যদিও লিখিত প্রাচীন মহাভারতও কিন্তু এক মহাভারত না; ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় ভিন্ন ভিন্ন ভার্সনের অস্তিত্ব বিদ্যমান; যদিও সকলেই নিজেরটা সম্পর্কে দাবি করেন- ইহাই আদি ও অকৃত্রিম দ্বৈপায়নের রচনা…
০৩
উপমহাদেশে আদি মহাভারত নামে যেইগুলা প্রচলিত তার মইদ্যে আছে কাশ্মীরি দেবনাগরি মৈথিলি নেপালি তামিল তেলেগু মালয়ালাম আর বাংলা মহাভারত; যদিও একটার লগে কাহিনি বহুত জায়গায় মিলে না আরেকটার…
বাংলায় মহাভারতের খণ্ড খণ্ড অংশ বহু আগে থাইকা অনুবাদ হইলেও ১৫১৫-১৫১৯ সালের মইদ্যে চট্টগ্রাম অঞ্চলে রচিত পরাগলি মহাভারতই হইল পরথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা মহাভারত; যদিও সংক্ষিপ্ত…
সূত্রমতে গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ’র চট্টগ্রাম অঞ্চলের লস্কর বা শাসনকর্তা পরাগল খাঁ কিংবা পরাগ আলী খাঁ মহাভারতের এই অনুবাদ করান তার সভাকবি পরমেশ্বর দাসরে দিয়া “এই সব কথা কহ সংক্ষেপিয়া দিনেকে শুনিতে পারি পাঁচালি পড়িয়া মানে এক দিনের মইদ্যে পুরাটা শোনা যায় এমন সাইজে মহাভারতের বাংলা পাঁচালি ভার্সন করতে কবি পরমেশ্বররে কইছিলেন পরাগল খাঁ। পরাগল খাঁর কথামতো কবি পরমেশ্বর দাস পাণ্ডববিজয় কাব্য; মতান্তরে বিজয়পাণ্ডব কাব্য নামে মহাভারত অনুবাদ কইরা কবীন্দ্র উপাধি পান; যে কারণে পরাগলি মহাভারতখান কবীন্দ্র মহাভারত নামেও পরিচিত। ড. কল্পনা ভৌমিকের সম্পাদনায় বাংলা একাডেমি কবীন্দ্র মহাভারত নামেই দুই খণ্ডে প্রকাশ করছে বইখান। বইখান খুবই কম প্রচারিত আর পরিচিত হইলেও এই বইখান প্রকাশ করতে গিয়া কল্পনা ভৌমিক যে বিস্তর গবেষণা করছেন তার সব তথ্য-উপাত্ত-ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও সংযুক্ত আছে দুই খণ্ডের কবীন্দ্র মহাভারতে। সাহিত্য মহাভারত নিয়া যারা ঘাঁটাঘাঁটি করতে চান তাগো যাত্রা শুরুর পয়লা ধাপ হইতে পারে ড. কল্পনা ভৌমিকের এই মহামূল্যবান গবেষণা…
তবে কেউ কেউ অবশ্য কিছু ঝামেলা পাকান পরাগলি মহাভারত নিয়া। তারা কন কবীন্দ্র পরমেশ্বর আর শ্রীকর নন্দী মূলত একই মানুষ। কিন্তু সত্য কথা হইল শ্রীকর নন্দী আলাদা মানুষ যিনি জৈমিনি মহাভারতের অশ্বমেধ পর্ব অনুবাদ করছিলেন পরাগল খাঁর পোলা ছুটি খার অনুরোধে; যা আবার পরিচিত আছিল ছুটিখানী মহাভারত নামে। জৈমিনি মহাভারত কিন্তু দ্বৈপায়ন মহাভারত থাইকা কিছুটা আলাদা; মূলত এর অশ্বমেধ পর্বটা; আর দ্বৈপায়ন মহাভারত নামে আমরা এখন যা পাই তা মূলত বৈশম্পায়ন ভার্সন; যা উগ্রশ্রবা সৌতি শুনছিলেন জন্মেজয়ের যজ্ঞে আর আর সৌতির মুখ থাইকা শুইনা সেইটা আমাগো বলতে আছেন অন্য কোনো এক অজ্ঞাত কথক…
দীনেশ চন্দ্র সেন অবশ্য কইতে চান যে সঞ্জয় রচিত মহাভারতই হইল পয়লা বাংলা মহাভারত। মানে পরাগলি মহাভারতেরও আগে তা রচিত হইছিল যা পরবর্তীতে সঞ্জয় ভারত নামে প্রকাশিতও হয়। দীনেশ চন্দ্ররে কেউ কেউ সমর্থন করলেও দীনেশ চন্দ্রসহ কেউই এই যুক্তির পক্ষে শক্ত কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেন নাই। অবশ্য সেই যুগে পরাগলি মহাভারত থাইকা সঞ্জয় ভারতের প্রচার আর প্রসার দুইটাই আছিল বেশি। পরাগলি মহাভারতখান কোনো কারণে পরাগল খার প্রাসাদের বাইরে তেমন একটা বাইরায় নাই; উল্টাদিকে সঞ্জয় ভারত সেই যুগে পরিচিত আছিল সিলেট-ত্রিপুরা-নোয়াখালী-চট্টগ্রাম-ফরিদপুর-বিক্রমপুর এবং রাজশাহী এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে…
সঞ্জয় ভারত হইল মহাভারতের জৈমিনি ভার্সনের রূপান্তর। কেউ কেউ কন যে সঞ্জয় মূলত কবীন্দ্র মহাভারতেরই একখান কপি করছিলেন নিজের মতো কইরা; যদিও কবীন্দ্র মহাভারত হইল বৈশম্পায়ন ভার্সন। তবে এইটা সত্য যে বিভিন্ন জনের রচনা হইলেও সকল প্রাচীন মহাভারতেই কিছু কিছু জিনিস অবিকলভাবে কপি-পেস্ট পাওয়া যায়। এইটার কারণ হিসাবে দীনেশ চন্দ্র সেন কন; লিখিত হইবার আগেও মহাভারতের বিভিন্ন গল্প কামরূপ আর সিলেট অঞ্চলে বসতি করা মগধের ভাট ব্রাহ্মণরা এইদিকে সেইদিকে বিভিন্ন সভায় গাইয়া বেড়াইতেন; সেইগুলারই কিছু কিছু অংশ কাটিং অ্যান্ড ফিটিং হইয়া ঢুইকা গেছে বিভিন্ন অনুবাদকের মহাভারতে; আর তাই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনের অনুবাদ হইলেও মিলের সংখ্যা প্রচুর…
সঞ্জয় ভট সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের মানুষ। ২০১৭ সালে সুনামগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমিতে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সঞ্জয় স্মারকস্তম্ভ নির্মাণের একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়। তিনারা সঞ্জয়রে প্রথম বাংলা মহাভারত লেখক হিসাবেই উল্লেখ করছেন সেই স্মারকস্তম্ভে…
সন্দেহ নাই বাংলা মহাভারত পয়লাবারের মতো লেখার দাবিদার দুইজনের মইদ্যে একজন সঞ্জয় ভট। কিন্তু এককভাবে তিনারে মহাভারতের পয়লা বাংলা লেখক কিংবা অনুবাদক কইবার দাবিটা বিতর্কহীনভাবে প্রমাণিত না। যুক্তি আর প্রমাণে এই ক্ষেত্রে বরং পরাগলি মহাভারতের লেখক কবীন্দ্র পরমেশ্বরই আগায়া আছেন…
পরাগলি মহাভারতের প্রায় দুই শো বছর পরে রচিত হইলেও বাংলায় সব থিকা জনপ্রিয় আর প্রচারিত মহাভারতখান কাশীরাম দাসের। এইটা মহাভারতের কাব্যিক ভাবানুবাদ। মহাভারতের অনেক বিষয় যেমন এইটাতে বাদ পড়ছে তেমনি মহাভারতের বাইরের বিষয়ও যোগ হইছে। আবার কাশীরামের নিজস্ব জিনিসও ঢুকছে এইখানে। ষোলো শতকের শেষ থাইকা সতেরোর প্রথমাংশ শতাব্দীকালে ভারত পাঁচালি নামে রচিত এই বইটা প্রকাশ হইছিল ব্রিটিশগো ইচ্ছায় এবং পয়সায় ১৮০১ থাইকা ৩ সাল পর্যন্ত। এই পুস্তকখান এখনো পাওয়া যায়; যদিও এইটার কোনটা যে আদি কাশীদাসি ভার্সন তা নিয়া যেমন বহুত মারামারি আছে তেমনি এর কতটা মূল কাশীদাসের আর কতটা অন্যদের অনুবাদ তা নিয়াও আছে বহুত মতামত দ্বিমত…
কালীপ্রসন্ন নিজে মহাভারত অনুবাদ করার শুরুর দিকে এই কাশীদাসের বহুত সমালোচনা করছেন এইটা বাদ দিছে ওইটা জুইড়া দিছে সেইটা কাব্য করছে কইয়া। কিন্তু নিজে একদল মানুষ নিয়া আট বছর মহাভারত ঘাঁটানির পর বোধ হয় বুঝছেন যে একলা কাশীদাসের কী অমানুষিক খাটনিখান গেছে পুরা মহাভারতের পদ্য অনুবাদ করতে। তাই পরের দিকে দেখি কালীপ্রসন্ন কথায় কথায় কাশীদাসরে পেন্নাম দিয়া কথা কন। আবার নিজেই উদ্যোগী হইয়া কাশীদাসের জীবনীও ছাপাইতে চান। কিন্তু কাশীদাস সম্পর্কে বিশেষ কিছু উদ্ধার করতে পারেন নাই তিনিও। তবে যদ্দুর নিশ্চিত তা হইল কাশীদাস আছিলেন বর্ধমান জেলার মানুষ…
যাই হউক। কাশীদাসি মহাভারতখানই বাংলায় সব থাইকা জনপ্রিয় মহাভারত। এইটা তার নিজস্ব একখান মহাভারত। পদ্যে রচিত এই পুস্তকখান হেইলা-দুইলা সুর কইরা পড়ার লাইগা যেমন দারুণ তেমনি রাক্ষস-খোক্কশের কাণ্ড কারখানা দেইখা হাসার লাইগাও দারুণ আবার ভক্তিতে গদগদ হইয়া চোখ বন্ধ কইরা ঝিমানোর লাইগাও দারুণ; কিন্তু তার পদ্যের ঠেলায় সেইখান থাইকা রক্তমাংসের মানুষগুলারে চিনা বড়োই কঠিন; ছন্দে যেদিকে টাইনা নিয়া যায় সেই দিকে তিনি মহাভারতরে ঠেইলা নিয়া গেছেন…
দুইখণ্ডে রচিত কালীপ্রসন্ন সিংহের বাংলা মহাভারতখানের সাইজ দেইখা সহজে কেউ হাত দিবার সাহস করে না। অতি বিস্তৃত অতি বিশাল। কাহিনি-উপকাহিনির ছোটখাটো বিষয়গুলাও তিনি ছাইড়া যান নাই। কাশীদাসি মহাভারতে কাশীদাস যেসকল জায়গা জটিল বইলা ছাইড়া গেছিলেন কিংবা ছাইটা ফালাইছেন কিংবা কাব্য কইরা গুলাইয়া ফালাইছেন কিংবা নতুন কাহিনি জুইড়া দিছেন সেই সব জায়গা তিনি ভরাট কইরা দেন গদ্য অনুবাদে। পুস্তকখান তার একলা অনুবাদ নয়; অনেকের অনুবাদ যার দলনেতা আছিলেন তিনি। দাবি করছেন তার পুস্তকখান মূলানুগ। এই বিষয়ে কিছু কওয়ার বিদ্যা আমার নাই; কিন্তু তার গ্রন্থের উৎসর্গপত্ৰখান দেখলে কেমন যেন মনের মইদ্যে খচাখচ করে…
তিনার অনুবাদখানও ব্রিটিশগো অনুদানের ফসল। তিনার বইখান তিনি উৎসর্গ করছেন উপনিবেশের মহারানি ভিক্টোরিয়ারে মারাত্মক তেলাইয়া আর যবন-মোগলগো কিলাইয়া চিরদুখি ভারতরে উদ্ধার করার লাইগা ব্রিটিশ জাতিরে ভারতের উদ্ধারকর্তা হিসাবে ধন্যবাদ দিয়া। পুরা। মহাভারত জুইড়াই পরিষ্কারভাবে রাজা-বাদশাগো তেলাইবার কথা কওয়া হইছে। কওয়া হইছে যে রাজায় যারে কিলাইব তার লাশ পাইলেও যেন প্রজারা দুই-চাইরখান লাত্থি বসাইয়া দেয় রাজারে খুশি করার লাইগা; সেইখানে যিনি ব্রিটিশ জাতি আর রানি ভিক্টোরিয়ার চির অনুগত প্রজা কইয়া নিজের পরিচয় দেন; তার হাতে মহাভারতের কাহিনিখান কি কোনো জায়গায় এই দিক-সেই দিক হয় নাই ব্রিটিশরে তেলানোর খাতিরে?
হইলে হইতে পারে। কিন্তু বড়ো কথা হইল বাংলায় তিনার আটখান বচ্ছরের পরিশ্রমই বোধ হয় এখনো আমাগো বিস্তৃতি মহাভারত পাঠের সব থাইকা নির্ভরযোগ্য সূত্র…
০৪
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উঁচা বর্ণের ধর্মবিশ্বাসী বামুন। তিনি কৃষ্ণরে ভগবান মাইনা মহাভারতে খুঁজতে যান কৃষ্ণের তত্ত্ব-তালাশ সূত্র আর ইতিহাস। কিন্তু কৃষ্ণ সন্ধানে গিয়া তিনি উন্মুক্ত করেন মহাভারতের পরতে পরতে ভজঘটের মহাসূত্রাবলি। কবিদের উপর তিনি মহাখাপ্পা হইয়া প্রথমে শুরু করেন মহাভারত শুদ্ধি অভিযান। একটার পর একটা প্রসঙ্গ ধইরা কইতে থাকেন এইটা প্রক্ষিপ্ত ওইটা প্রক্ষিপ্ত। মানে মূল রচনায় আছিল না; পরে কেউ ঢুকাইয়া দিছে; মহাভারতরে পুরাই আউলাইয়া ফালাইছে কবিরা; এর বংশতালিকা ভুল; সংখ্যার হিসাব ভুল; পাঞ্জিপুঁথি ভুল; সেনাসৈনিক ভুল; মহাভারতের কৃষ্ণও ভুল; মানে ভগবান কৃষ্ণরে সেইখানে খুঁজতে যাওয়া একখান যাচ্ছেতাই বিষয়…
তো মহাভারতে ভগবান কৃষ্ণরে না পাইয়া নিজের ভগবানের জীবনী নিজের মতো কইরা লিখতে যাইবার আগে তিনি কর্ণরে মনোহর হিসাবে চারিত্রিক সনদপত্র দিয়া মহাভারতের যে প্রক্ষিপ্ত ঘটনার তালিকা তৈয়ার করেন সেইটা ধইরা মহাভারত এডিট করতে গেলে অবশ্য মহাভারতে সাকুল্যে। পঞ্চাশখান পৃষ্ঠা টিকব কি না আমার সন্দেহ। সেইটা যাই হউক; মহাভারত নিয়া ঘাঁটাঘাঁটি করতে গেলে বঙ্কিমের কৃষ্ণ চরিত্র পুস্তকের বিশ্লেষণগুলা মূল্যবান জিনিস; বিশেষত মহাভারতের চুরি ধরার কৌশল বয়ান। এইটা চুরি কি না সেই বিষয়ে সন্দেহ আছে। কারণ দুনিয়ার অন্যসব জায়গায় যেখানে মাইনসে অন্যের লেখা নিজের নামে চালায়; সেইখানে উপমহাদেশে মাইনসে নিজের লেখা অন্য কোনো বিখ্যাত মাইনসের নামে চালায়। হয়ত বুইড়া মাতব্বরের সমাজে চ্যাংড়া পোলাপানগো কথায় পাত্তা না দিবার সংস্কৃতি থাইকা তরুণরা এই জিনিসটা উদ্ভাবন করছে-ব্যাটা আমার কথা যখন শুনবি না তখন তোর বাপের নামে কই…
তবে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রক্ষিপ্ত তালিকা আর প্রক্ষিপ্ত বাছাইর টেকনিক কিন্তু বিনা প্রশ্নে অনেকেই মানতে নারাজ। আবার কৃষ্ণ চরিত্র নির্মাণে মহাভারত ঘাঁটাঘাঁটিতে তিনার উদ্দেশ্যখানও খুব একটা সৎ আছিল না…
বঙ্কিমচন্দ্রের মূল খায়েশ আছিল ইংরেজগো কাছে গ্রহণযোগ্য একখান হিন্দুধর্ম নির্মাণ করার। কারণ বেদের মেয়াদোত্তীর্ণ বিধিবিধান আর শত শত পৌরাণিক কাহিনি কিংবা দেবদেবী মিল্লা যুক্তির টেবিলে হিন্দু ধর্মরে এক্কেবারে ছ্যারাবেরা কইরা থুইছে বহুকাল। তিনার বিশ্বাস আছিল ইংরেজগো কাছে যুক্তি দিয়া হিন্দু ধর্মরে গ্রহণযোগ্য কইরা তুলতে পারলে ইংরেজি শিক্ষিত কিংবা যুক্তিসঙ্গত ভারতীয়গো কাছেও হিন্দু ধর্মখান বিনা-শরমে পালনযোগ্য হইয়া উঠতে পারে। তো এই মিশনের লাইগা পয়লা তিনি নির্মাণ করলেন শ্রীকৃষ্ণের জীবনী; কৃষ্ণচরিত্র। পুরাণ আর লোক সাহিত্যের কৃষ্ণসংক্রান্ত আউলাঝড়া কাহিনিগুলারে কোথাও যুক্তি দিয়া; কোথাও গায়ের জোরে মুচড়াইয়া এবং বাইবেল থাইকা যিশু খ্রিস্টের জীবনের ছায়া-মায়া ছিটাইয়া তিনি নির্মাণ করলেন প্রায় একখান তথাকথিত ঐতিহাসিক এবং প্রায় দয়ালু এবং প্রায় একজন মাত্র নারীর স্বামী শ্রীকৃষ্ণের জীবনী…
এই কাম করতে গিয়া মহাভারতরে তিনি মোটামুটি তিনার বামুনদণ্ড দিয়া বহুত জায়গায় ধর্ষণও করছেন অবলীলায়। তবে সেই জীবনীতে কোত্থাও কৃষ্ণের কোনো ভগবানত্ব নাই; ভগবানত্ব আরোপের চেষ্টাও করেন নাই। সেইখানে তিনার মূল চেষ্টাটা আছিল কৃষ্ণের একখান ক্লিন ইমেজ তৈয়ারি করা। এমনকি রুক্মিণী ছাড়া কৃষ্ণের অন্য বৌদের ঘরের সন্তানগো কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না; এইরকম একটা আবাল যুক্তি দিয়া তিনি উপসংহার টাইনা দিলেন যে কৃষ্ণ আসলে একটার বেশি বিবাহই করেন নাই…
কোনো কোনো গবেষকে কন; সিরিয়া থাইকা আসা আভীর জাতির খ্রিস্টান মানুষ ভারতে বসতি করার পর তাগো কাছ থিকা শোনা খ্রিস্ট কথাটা লোকাল উচ্চারণে বদলাইয়া কেষ্ট হইয়া উঠছে। মানে যিশু খ্রিস্টের জীবনী থাইকা রচিত হইছে কৃষ্ণের জীবনী। ওই যুক্তিটা মিলে না। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণ চরিত্র পড়লে মনে হইতে পারে যে কৃষ্ণ আসলেই যিশুর একটা কালো পুত্তুলিকা মাত্র…
তো মনমতো কৃষ্ণ-গল্প লেখা শেষে বঙ্কিমচন্দ্র কইলেন- আমি কিন্তু কৃষ্ণরে ভগবান বইলা মানি। মানেন অসুবিধা নাই। নিজের ভগবানের জীবনী নিজে তৈয়ার করার ক্ষ্যামতা খুব কম মানুষেরই থাকে…
আমার হিসাবে বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণচরিত্র গ্রন্থখান সব কিছুর পরেও কৃষ্ণ বিষয়ক একখান ভালো পুস্তক। বিশেষত যারা মথুরার কৃষ্ণ আর মহাভারতের কৃষ্ণরে আলাদা মানুষ বইলা ভাবেন তারা নিজেগো পক্ষে বহুত যুক্তি পাইবেন এই পুস্তকে…
কিন্তু পণ্ডিত যখন সাম্প্রদায়িকতায় আক্রান্ত হয় তখন তারে ভণ্ডামি না কইরা উপায় থাকে না। বঙ্কিমচন্দ্র চূড়ান্ত কিছু ভণ্ডামি কইরা বসেন কৃষ্ণচরিত্রের সিকুয়াল তার ‘শ্রীমদ্ভগবদগীতায়’। এই পুস্তকটার মূল উদ্দেশ্য আছিল ইংরেজ আর ইংরেজি শিক্ষিতগো কাছে গীতার গ্রহণযোগ্য বিশ্লেষণ কিংবা টিকা তৈয়ারি…
গীতা বেদোত্তর ও বেদবিরোধী দর্শন। পৌরাণিক দেবদেবীরে সাইডলাইনে সরাইয়া আর বৈদিক ঝাপসা অচল ধর্ম দর্শনরে বাতিল কইরাই তৈয়ারি হইছে গীতার ভক্তিবাদী দর্শন…
গীতারে মহাভারতের কুরুযুদ্ধ চ্যাপ্টারে ঢুকাইয়া কৃষ্ণ-অর্জুনের ডায়লগ আকারে উপস্থাপন করায় প্রাথমিকভাবে এইটা হত্যার দর্শন মনে হইলেও এর মূলমন্ত্র কিন্তু ভক্তিবাদ; যেই জিনিসটা বেদে আছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত…
গীতার ভক্তিবাদের যুক্তিগুলা তৈয়ারি হইছে আত্ম-জন্মান্তরবাদ-কর্মফল আর চতুবর্ণ প্রথার ঘাড়ে ভর কইরা। আত্ম-জন্মান্তরবাদ-কর্মফল আর চতুর্বর্ণ প্রথার প্রেক্ষাপট মাথায় না রাইখা গীতা পড়তে গেলে আসলে কোনো মানেই খাড়ায় না পুস্তকটার…
তো ধার্মিকেরা যখন গীতার ব্যাখ্যা বা টিকা লিখছেন তখন তারা সকলেই আত্ম-জন্মান্তর এইসবে বিশ্বাস রাইখা সেই প্রেক্ষাপটে বিশ্বাসীগো লাইগা কথা কইছেন। মানে ধর্মের প্রেক্ষাপটে ধর্মের ব্যাখ্যা; পৌরাণিক প্রেক্ষাপটে পুরাণের বিশ্লেষণ…
কিন্তু ইংরেজগো ব্যাখ্যায় গীতা পড়া চূড়ান্ত মূর্খতা ঘোষণা কইরা বঙ্কিমচন্দ্র কাইল্লা ইংরেজগো লাইগা যেই গীতাখান রচনা করছেন; সেইখানে তিনি ধর্মের প্রেক্ষাপটে ধর্মরে উপস্থাপন না কইরা আত্ম-জন্মান্তরবাদ-কর্মফল এইগুলার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা-প্রমাণ দিবার একখান বেহুদা চেষ্টা চালাইছেন। বহুত বাণী কপচাইছেন চুতর্বর্ণ প্রথা আর বিধবা নারীগো প্রতি ঘিন্নারে সামাজিক বিজ্ঞানের সূত্র দিয়া যুক্তিযুক্ত করার…
ধর্মের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হয় মূর্খত না হয় ভণ্ডামি। বঙ্কিমচন্দ্র মূর্খ আছিলেন না। তিনি জাইনা বুইঝাই আত্মা আর জন্মান্তরবাদের বৈজ্ঞানিকতা প্রমাণের ভণ্ডামিটা করেন; সমাজবিজ্ঞান কপচাইয়া চতুবর্ণপ্রথা আর বিধবা-ঘিন্নারে জায়েজ করার নোংরামিটা করেন…
কৃষ্ণচরিত্র রচনার স্টাইলে গীতায়ও তিনি যেইসব শ্লোকের শেষ পর্যন্ত কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিতে পারেন না; সেইগুলারে গায়ের জোরে প্রক্ষিপ্ত কইয়া ফালাইয়া দেন…
বৌদ্ধ ধর্মরে ছ্যা ছ্যা দূর দূর করলেও বঙ্কিমের কৃষ্ণভক্তির ফর্মুলাটা প্রায় বৌদ্ধদের নির্বাণ-সূত্রেরই কাছাকাছি। মানে অর্জুনরে তিনি কৃষ্ণের উপদেশের ব্যাখ্যা দিয়া প্রায় বৌদ্ধ শমন পর্যায়ে নিয়া যান। পাশাপাশি তার কৃষ্ণের ভিতর থাইকা যেমন নাজারতের ক্ষমাশীল যিশু উঁকি মারেন তেমনি তার গীতার পাতা ফুইড়া মাঝে মাঝেই উঁকি মারে বাইবেলীয় রোমান সুসমাচার…
কৃষ্ণ বিষয়ে যাগো অধিক আগ্রহ আছে আমি তাগোরে নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর ‘মহাভারতের ভারতযুদ্ধ এবং কৃষ্ণ’ বইখান পড়তে সুপারিশ করি। অসাধারণ একটা পুস্তক। নৃসিংহপ্রসাদ কৃষ্ণ বিষয়ে পিএইচডি গবেষণা করছেন সুকুমারী ভট্টাচার্যের সুপারভিশনে। কিন্তু সুকুমারী যেমন ঠনঠন কইরা হাড্ডি বাজাইয়া কৃষ্ণরে বিশ্লেষণ করেন; নৃসিংহপ্রসাদ সেইপথ নেন না। আবার বঙ্কিমের পূর্ব নির্ধারিত ভগবান বিশ্লেষণের পথেও যান না…
নৃসিংহপ্রসাদের বইটার ধরন বইয়ের ভূমিকায় তারই দুইটা মন্তব্য থাইকা দারুণভাবে পাওয়া যায়; যার একটা হইল- জীবনকালেই কৃষ্ণরে বহুবিধ কারণে অভিযুক্ত করা হইছে বহুবার; মহাভারতেও হইছে; মহাভারতের বাইরেও হইছে। সুতরাং সেইগুলা কৃষ্ণপুরাণেরই অংশ; বেহুদা যুক্তি দিয়া সেইগুলা খণ্ডণ করতে যাওয়া কোনো কামের কথা না…
আর দ্বিতীয় কথাটা হইল- ভগবত্তা দিয়া কৃষ্ণের সামাজিক কলঙ্কমোচনের গুরুদায়িত্ব আমার নাই; এমনকি কৃষ্ণ কোন কাজ সঠিক না বেঠিক করছেন সেইটা বিচারের দায়িত্বও নাই…
এই বইটা কৃষ্ণের রাজনৈতিক জীবনের বই; কোন প্রেক্ষাপট আর কোন পরিস্থিতির ফলাফলে এক সাধারণ তরুণ ভারতকর্তা হইয়া উঠে তার বিবরণ। তার লগে কৃষ্ণ বিষয়ক বিখ্যাত সব রচনার অসাধারণ লিটারেচার রিভিউ; খণ্ডণ-সমর্থন দুইটাই। কৃষ্ণ বিষয়ক অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রচনাগুলার রিভিউ পড়ার লাইগা এই বইটার কোনো তুলনা নাই। বঙ্কিমের কৃষ্ণ চরিত্রের একটা বিশাল রিভিউও আছে এই বইটাতে…
নৃসিংহপ্রসাদ রাধার কৃষ্ণ আর মহাভারতের কৃষ্ণরে একই মানুষ বইলা মনে করেন; যেইটার লগে আমার দ্বিমত থাকলেও তিনার যুক্তিগুলারে ফুৎকার দিয়া ফালাইয়া দিবার সুযোগ নাই…
তবে নৃসিংহপ্রসাদ কিন্তু নৃতাত্ত্বিক গবেষক না। পৌরাণিক গবেষক। তিনি পুরাণের সূত্র দিয়াই পৌরাণিক চরিত্রগুলারে মূর্তিমান করেন। সেইটা করতে গিয়া তিনি বস্তুবাদী বহুত জিনিস বাদ দিয়া যান। যেইটা তার গবেষণার ধরনের লাইগা গুরুত্বপূর্ণও…
এই বইটা কৃষ্ণরে নিয়া হইলেও একই সাথে বইটা কিন্তু একটা ‘ভরত পুরাণ’। মানে ভরত থাইকা ভারতবর্ষের সূচনার যে পৌরাণিক কাহিনি; তার একটা অসাধারণ রূপরেখা আছে বইটায়…
একটা বিশাল বংশধারা বর্ণনা করছেন তিনি এই পুস্তকে। কেমনে তখনকার ভারতবর্ষের প্রায় সব রাজারা ভরতের বংশধর হইল সেইটা। তার সূত্রগুলা বিভিন্ন পুরাণ থাইকা নেওয়া। কিন্তু একটা জিনিস তিনি ছাইড়া গেছেন; হয়ত সচেতনভাবেই। সেইটা হইল সব ভরদ্বাজি বামুন কিংবা পরশুরামি বামুন যে রক্ত সম্পর্কিত না; বরং ভরদ্বাজ কিংবা পরশুরামের ইস্কুলে পড়ার কারণে অনাত্মীয় হইয়াও সকলেই ভরদ্বাজ কিংবা পরশুরাম বইলা পরিচিত; সেইটা বেদে আর পুরাণে আছে বইলাই নৃসিংহপ্রসাদ উল্লেখ করলেও তিনি কিন্তু পাশ কাটাইয়া যান ক্ষত্রিয়গো বংশ তালিকার ফাঁক…
ভরত থাইকা ভারতবর্ষের সব বড়ো গোষ্ঠীর উৎপত্তি এইটাতে যতটা না ভরত বংশের কৃতিত্ব তার থাইক কিন্তু বেশি কৃতিত্ব পুরাণ লেখক বামুন আর যারা নিজেগো ভরতের বংশধর বইলা দাবি করছেন তাদের…
ঘটনাটা হইল সেইকালে সকল অখ্যাত আর নতুন রাজারাই কিন্তু নিজেরে প্রতিষ্ঠিত বংশের মানুষ প্রমাণ করার লাইগা বামুনগো পয়সা দিয়া পুরাণের নতুন নতুন ভার্সন লেখাইতেন। কেউ কেউ নতুন নতুন কাহিনি তৈয়ারি করতেন। আর সকল পুরাণের লেখকই কিন্তু পেশাদার। সেইসব পেইড বামুনগো কাম আছিল একটাই; সেইটা হইল প্রচলিত ভরত পুরাণ টাইনা একটা লতা ধইরা। সেইখানে নতুন রাজারে প্রক্ষিপ্ত কইরা দেখাইয়া দেওয়া যে এই রাজা নতুন হইলেও কিন্তু সেই মহান ভরতবংশের উত্তরাধিকার…
এইটা এক্কেবারে পয়সা নিয়া ভার্জিলের ইনিড লেখার মতো। যেইখানে তিনি অজ্ঞাত অক্টাভিওনরে ইনিয়াসের বংশধর বানাইবার লাইগা মহাকাব্যখান লেখছিলেন…
তো শেষ পর্যন্ত যে বিপত্তিটা খাড়ায় সেইটা হইল এইসব পুরাণ এক জায়গায় জড়ো কইরা দেখলে দেখা যায় যে ভারতে আসলে ভরতের বংশধর ছাড়া গনবার মতো কোনো মানুষ নাই। নৃসিংহপ্রসাদের মহাভারতের ভারতযুদ্ধ এবং কৃষ্ণ বইটার দ্বিতীয় অধ্যায় কিন্তু সেই পৌরাণিক। ভরতবংশ বর্ণনা; যেইটা নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস দিয়া যাচাই করলে বহুকিছুই প্রশ্নবোধক হইয়া পড়বে। এই কথাটা নৃসিংহপ্রসাদের সবগুলা বইর বেলাতেই ঠিক। তবে এইটাও ঠিক যে তিনি নৃতাত্ত্বিক না; পৌরাণিক গবেষক। তার বইগুলা পৌরাণিক ইতিহাস না; বরং ইতিহাসের পুরাণ…
০৫
বঙ্কিমচন্দ্র কৃষ্ণ চরিত্র পুস্তকে মহাভারত বিশ্লেষণের কিছু সূত্র দিলেও তিনার উদ্দেশ্যখান সৎ আছিল না দেইখা শেষ পর্যন্ত তিনার সূত্র দিয়া মহাভারতের কোনটা আদি ভার্সন আর কোনটা প্রক্ষিপ্ত সেইটা বিচার করতে যাওয়া বেকুবি। তিনি আসলে তিনার মনমতো কৃষ্ণ চরিত্র আবিষ্কার করার লাইগাই মহাভারত ঘাঁটাইছেন…
তবে মহাভারতের মোটামুটি গ্রহণযোগ্য একখান প্রায় আদি বৈশম্পায়নী ভার্সন আছে এখন। সম্পূর্ণ বিতর্কহীন না হইলেও এইটা দিয়া ২৪ হাজার শ্লোকের মহাভারতের বৈশম্পায়নী ভার্সন ‘বিজয়’ বা ‘ভারত’ এর একটা চিত্র পাওয়া সম্ভব। আর একেবারে আদি দ্বৈপায়নী ভার্সন ‘জয়’ আছিল আরো ছোট; মোটামুটি নয় হাজার শ্লোকের…
মহাভারতের এই ভার্সনটা বাইর করছে পুনার ভাণ্ডারকর গবেষণা কেন্দ্র। মহাভারত সংশোধন সমিতি নামে একটা গ্রুপ গবেষণার পর মোট ২২ খণ্ডের পয়লা খণ্ড বাইর করে ১৯৩৩ সালে। ড. বিষ্ণু সুথংকর আছিলেন দলনেতা। তিনি মারা যান ৪৩ সালে। মারা যাবার আগে পর্যন্ত বেশ কয়েকটা খণ্ড বাইর হয়। তিনার পর এই টিম লিড দেন ড. কৃষ্ণপদ ভেলকর। ড. ভেলকরের নেতৃত্বে সর্বশেষ খণ্ড বাইর হয় ১৯৬৬ সালে। শেষ খণ্ড প্রকাশের আগেই ড. ভেলকর মারা যান। তবে তিনি মারা যাবার আগেই মহাভারতের উপাঙ্গ ‘হরিবংশ’ যেইটারে মহাভারতের অংশ বইলা কেউই মানে না; সেইটা ছাড়া বাকি সবটার মূল পাঠ উদ্ধার হইয়া যায়…
বর্তমানে প্রচলিত ১ লাখের বেশি শ্লোকের মহাভারত থাইকা ২৪ হাজার শ্লোকের ভার্সন উদ্ধার করতে ভাণ্ডারকর যে ২২ খণ্ড পুস্তক বাইর করছে সেইখানে যেইসব শ্লোক বাদ দেওয়া হইছে সেইগুলার প্রতিটা ধইরা ধইরা বিশ্লেষণ করা হইছে। কেন বাদ দেওয়া হইছে; কোন প্রদেশের কোন ভার্সনে কোনটা আছে আর কোন ভার্সনে কোনটা নাই; তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা আছে। আর সেইটা কইরা তারা ২৪ হাজার শ্লোকের আদি ব্যাখ্যা আর যুক্তিসহ বৈশম্পায়নী ভার্সনখান চিহ্নিত করছেন…
এইটার একটা বাংলা অনুবাদও আছে। শিশির কুমার সেন নামে এক রিটায়ার্ড বিচারপতি সেইটা করছেন ১৯৯০ সালের দিকে। তবে নেহাৎ গবেষণার দরকার না পড়লে ওইটা কাউরে পড়তে সুপারিশ করি না আমি। কারণ ওইটা মহাভারতের সাহিত্য না; নৃতত্ত্ব। সাহিত্য মহাভারতের ক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসুর কথাখানই সবথিকা দামি; সেইটা হইল- বহু হাত পার হইয়া আমাগো কাছে এখন যে পুস্তকখান আছে সেইটাই পূর্ণ সাহিত্য মহাভারত; বাকিগুলা গবেষণার উপাদান…
০৬
বর্তমান যুগে বাংলায় মহাভারত নিয়া কথা কইতে গেলে চাইরজন মানুষ সম্পর্কে আলাদাভাবে না কইলে মহাভারতমূর্খ কইতে হয় নিজেরে। তার পয়লাজন উপেন্দ্রকিশোর রায় দ্বিতীয়জন রাজশেখর বসু তৃতীয়জন বুদ্ধদেব বসু আর চতুর্থজন নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী…
উপেন্দ্রকিশোর যেখানে ছোটবেলায় মহাভারত পড়তে আগ্রহ তৈরি করেন; রাজশেখর বসু সেইখানে বড়ো হইবার পর মহাভারত বুঝাইয়া দেন। নির্লিপ্তভাবে পক্ষপাতহীন সাবলীল ভাষায় তিনি পুরা মহাভারতের মূল গল্পগুলা বর্ণনা কইরা যান। কোনো কিছু যোগও করেন না; কোনো কিছু বাদও দেন না নিজের থাইকা। নিরপেক্ষ থাইকা সংক্ষেপে খালি বুঝাইয়া দেন। আমি কই; কারো মহাভারতপাঠ শুরু কিংবা শেষ হওয়া উচিত না রাজশেখর বসুর মহাভারত বাদ দিয়া…
তুলনামূলক সাহিত্যের বিচারে কেউ মহাভারত দেখতে চাইলে তার লাইগা সেরা পুস্তক বুদ্ধদেব বসুর ‘মহাভারতের কথা’। সাহিত্যের চোখ দিয়াই সাহিত্য বিশ্লেষণ। দুনিয়ার সেরা সাহিত্যকর্মগুলার সাথে এক টেবিলে ফালায়া মহাভারতের আলাপ। কোনটা প্রক্ষিপ্ত আর কোনটা আদি; কোনটা ইতিহাস আর কোনটা রূপকথা সেইসব খটখটানি বাদ দিয়া আমাগো হাতে বর্তমানে যা আছে সেইটাই পূর্ণাঙ্গ ‘সাহিত্য মহাভারত’; আর আলোচনা সেইটারে নিয়াই…
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী বাইর কইরা আনেন মহাভারতের চরিত্রগুলারে। একেকটা চরিত্রই যেন একেকটা মহাকাব্য। তা হোক মহাভারতের নায়ক আর হোক প্রতিনায়ক কিংবা প্রবীণ কিংবা নারী কিংবা কৃষ্ণ। মহাভারতের মানুষগুলারে তিনি জীবন্ত কইরা তোলেন মহাকাব্যিক অসংগতিগুলা সংশোধন কইরা। আমার মনে হয় তিনি বিশ্বাস করেন যে মহাভারতখান একক কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের লেখা। দ্বৈপায়নের সবকিছুরে যেমন তিনি যুক্তি দিয়া প্রতিষ্ঠা করেন তেমনি দ্বৈপায়নের নামে চলা সবগুলা লেখারেও প্রমাণ করতে চান আদি ও অকৃত্রিম দ্বৈপায়নেরই অবদান কইয়া…
তিনি সংস্কৃত সাহিত্যের পণ্ডিত লোক হইলে হইতে পারে সংস্কৃত তর্কশাস্ত্রের নিয়মনীতিগুলা তিনি মাইনা চলেন। যেইখানে বেদ নিয়া তর্ক হয় আগে বেদ বিশ্বাস কইরা; বিশ্লেষণ কিংবা শ্লোকের পক্ষে যুক্তি পরিষ্কার করার লাইগা। কিন্তু কোনোভাবেই কোনো চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ নাই সেইটা মাইনা নিয়া। তিনি সেই স্টাইলেই মূলত মহাভারতে গাওয়া দ্বৈপায়নের সবকিছুরে জাস্টিফাইড করতে চান যুক্তি দিয়া। বহুত দুর্বল যুক্তিও দেন; কিন্তু দুর্বল যুক্তিরেও কেমনে আকর্ষণীয় কইরা কইতে হয় সেইটা একই সাথে সংস্কৃত আর বাংলার পণ্ডিত এই মানুষটা মারাত্মক ভালোভাবে জানেন…
মহাভারতের চরিত্রগুলারে আধা পুরাণ আর আধা বাস্তবের আবহে রক্তমাংস নিয়া চিনবার লাইগা নৃসিংহপ্রসাদের কাজগুলার থাইকা ভালো কাজ আছে কি না আমার জানা নাই…
মহাভারত সম্পর্কিত একটা বই নিয়া বহুত আলোচনা শোনার পরও প্রায় দুই যুগ ধইরা মহাভারত ঘাঁটাঘাঁটির সময়কালে সেই বইটা সংগ্রহ কইরা দেখতে পারি নাই; বইটা হইল প্রতিভা বসুর ‘মহাভারতের মহারণ্যে’। এই বইটা পড়তে না পারার আফসুস জানাইয়াই আমি অভাজনের মহাভারত বইখান পয়লা প্রকাশ করছিলাম…
কিন্তু অভাজনের মহাভারত প্রকাশ হইবার এক বছর পর সেই বইটা পইড়া মনে হইল মহাভারতের মহারণ্যে বইটা না পড়াই মঙ্গল হইছে আমার। কারণ ওইটারে মহাভারত সংক্রান্ত পুস্তক না কইয়া দ্বৈপায়ন- বিদুর আর যুধিষ্ঠিরের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন বলাই বোধহয় সব থিকা ভালো। যদিও বিদুর যে মূলত একখান ভিলেন চরিত্র সেইটা খিটখিট করতে করতে তিনি বহুত ভালো কইরাই দেখাইয়া দিছেন…
কিন্তু আগাগোড়া অবৈধ সন্তান-অবৈধ সন্তান কইয়া খিটখিট করা এই লেখক সম্পূর্ণ এড়াইয়া গেছেন যে মহাভারতের কালে কোনো মানুষের জন্মই অবৈধ হিসাবে গণ্য হইত না। মহাভারতে বহুত আদিমতা থাকলেও যেকোনোভাবে যেকোনো মনুষ্য জন্মরে স্বাগত জানাইবার মতো উদারতাখান আছিল তাদের। মনুষ্যজন্মরে অবৈধ বলার সংস্কৃতিটা মূলত যিশুপুরাণ প্রভাবিত ইউরোপিয়ান সভ্যতার দান…
আর সেই ইউরোপিয়ান সভ্যতার বর্ণবাদী চশমা দিয়া প্রতিভা বসু মহাভারতের দিকে তাকান বইলাই সারা মহাভারতে তিনি খালি অসভ্য কালা মানুষ আর অবৈধ সন্তানদের আবিষ্কার করেন…
মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছু নাই; এই কথাখান দুনিয়ার প্রাচীন সাহিত্যগুলার মাঝে একমাত্র মহাভারতেই উচ্চারিত হইছে; জিনিসটা চোখেও পড়ে না প্রতিভা বসুর। তিনার মহাভারতের মহারণ্য একখানা কুৎসিত পুস্তক। মহাভারত সম্পর্কে এত বর্ণবাদী কোনো পুস্তক আমি এর আগে আর পড়ি নাই…
০৭
ইন্দোনেশিয়ার পুরা সংস্কৃতি মহাভারতীয়; বহুত কাহিনি-উপকাহিনি আছে মহাভারতের। কিন্তু আমি কোনো ইন্দোনেশিয়ান অখণ্ড মহাভারতের সন্ধান পাই নাই। সম্রাট আকবরও নাকি ফারসি ভাষায় মহাভারতের একখান অনুবাদ করাইছিলেন; সেইটার কোনো আলোচনা-বিশ্লেষণ সংগ্রহ করার সুযোগ হয় নাই আমার…
ভারতীয় ভাষার বাইরেও মহাভারতের বিস্তার বহু। এশিয়ার বহু জায়গায় এর কাহিনি পাওয়া যায়। ইংরেজিতে আছে এর ভুরি ভুরি ভার্সন আর বিশ্লেষণ। ইংরেজিগুলা মূলত দুই ধরনের লোকজনের কাম; পয়লা দল হইলেন ভারতীয়; যারা এইখানকার কোনো আখ্যান ইংরেজিতে অনুবাদ করছেন আর দ্বিতীয় দল হইল অভারতীয়; যারা নিজেরাই নিজের বুঝ থাইকা লিখছেন মহাভারতের ঘটনা কিংবা কাহিনি কিংবা বিশ্লেষণ। এর মাঝে সব থিকা উল্লেখযোগ্য হইল আশির দশকে পিটার ব্রুকের রচনা ও পরিচালনায় ৯ ঘণ্টা দীর্ঘ ইংরেজি মঞ্চনাটক; যেইটারে তিনি পরে ৬ ঘণ্টার টিভি সিরিজ আর ৩ ঘণ্টার চলচ্চিত্র বানান। এইটারে নিয়া বহুত সমালোচনা থাকলেও আমার মনে হয় দুইটা জিনিস তিনি খুব ভালো কইরা করছেন; পয়লাটা হইল মহাভারতের অলৌকিক ঘটনাগুলার মানবিক চেহারাদান আর মহাভারতখানরে মানবজাতির রাজনৈতিক ইতিহাসের অংশ হিসাবে দেখা…
তবে ইংরেজি লেখাগুলায় বহুত উল্টাসিধা আছে তথ্য বানান আর উচ্চারণের ঝামেলায়। তারা কৃষ্ণ আর কৃষ্ণা একই বানানে পড়তে আর লিখতে গিয়া মাঝে মাঝে দ্রৌপদী আর যাদব কৃষ্ণের মাঝে যেমন গুলাইয়া ফেলায় তেমনি ইংরেজি ওয়াই বর্ণ দিয়া যাদব বানানের লগে যবন বানান মিলাইয়া কইয়া দেয় হইলে হইতে পারে কৃষ্ণ মূলত যবন; মানে গ্রিক বংশজাত। আবার কেউ কেউ রামায়ণের কুম্ভকর্ণের লগে মহাভারতের কর্ণরে মিলাইয়া কিছু আজাইরা হাইপোথিসিসও খাড়া কইরা দেয়…
মহাভারত নিয়া বাংলায় কবিতা বেশুমার। নৃতাত্ত্বিক গবেষণাও বেশুমার। সেইগুলা পড়তে যারা আগ্রহী তারা আগ্রহমতে উঁকি দিয়া দেখতে পারেন…
মহাভারতের কৃষ্ণসহ বাকি নায়কদের নিয়া যেইখানে প্রচুর ধর্মকাহিনি আছে; সেইখানে মহাভারতের প্রতিনায়ক কর্ণ দুর্যোধন আর অন্যদের নিয়া আছে অসংখ্য নাটক আখ্যান আর উপন্যাস। সব থিকা বেশি নাটক আর সিনেমা হইছে কর্ণরে নিয়া। এইটার একটা অর্থ হইতে পারে যে ধার্মিকেরা যাগোরে ফালাইয়া দিছে পাপী কইয়া; সংস্কৃতিকর্মীরা তাগোরেই কুড়াইয়া নিছে মানবিক মানুষ কইয়া। তয় সব থাইকা বেশি ছোটদের কমিক বই কিন্তু আছে ভীমেরে নিয়া; ধর্মে-অধর্মে কামে আকামে ভীমের থাইকা জনপ্রিয় বোধ হয় কোনো পৌরাণিক চরিত্র নাই…
মহাভারত নিয়া ইন্টারনেটনির্ভর তরুণগো কাজকর্ম বিস্ময়কর রকমের বিশাল। মহাভারতের চাইর পাঁচটা সম্পূর্ণ বাংলা এবং ইংরেজি ভার্সন অন্তত এখন ইন্টারনেটে মাগনায় গুতা মারলে পাওয়া যায়; পিডিএফও আছে আবার টেক্সটও আছে। কেউ কেউ ছোট ছোট খণ্ডে নিজেদের ব্লগে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে তার পছন্দমতো কোনো এক ভার্সন। এইটা মোটেই সোজা কাম না কারণ মহাভারতের মানুষ জায়গা আর জিনিসপত্রের নামগুলা এতই অপ্রচলিত যে প্রতিটা বানান পুস্তক দেইখা দেইখা টাইপ কইরা তিন-চাইরবার প্রুফ না দেখলে ভুল হইবার ভয় নিরানব্বই ভাগ।
অথচ ইন্টারনেটের ভার্সনগুলা ছাপা ভার্সন থাইকা বেশি নিখুঁত। এর বাইরে আছে মহাভারত সম্পর্কিত লাখে লাখে তথ্য বিশ্লেষণ আর আলোচনা; যার পুরাটাই মহাভারত ভালো লাগা থাইকা এই যুগের তরুণগো বেগার খাটনির ফসল; বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যারা নিজেদের নামটাও লুকাইয়া রাখে। এই তরুণগো লাইগা মহাভারতীয় কায়দায় আমার সাষ্টাঙ্গে প্রণাম। কারণ এদের অবদানগুলা সহজলভ্য না হইলে মহাভারত নিয়া অত প্যাচাল পাড়ার ক্ষমতা হইত না আমার…
তো এই বিষয়ে কথা শেষ করি রবীন্দ্রনাথের উপর কবিগিরি কইরা। তিনি মহাভারত সম্পর্কে কইছেন- ইহা কোনো ব্যক্তিবিশেষের রচিত ইতিহাস নয়; ইহা একটি জাতির স্বরচিত স্বাভাবিক ইতিহাস…
হ। কথা প্রায় সত্য। তয় ইহা একটি জাতির স্বরচিত স্বাভাবিক ইতিহাস নহে; ইহা বহু জাতির রচিত ঘাপলা ইতিহাস…
০৮
মহাভারতের কুরুযুদ্ধরে গীতার উৎপত্তিস্থল হিসাবে বিশ্বাস করা হয়। আত্মীয়স্বজন আর গুরুজনের বিপক্ষে অস্ত্র চালাইতে বিমুখ অর্জুনরে দায়িত্ব পালন আর কর্মফলের হিসাব-নিকাশ বুঝাইবার লাইগা কৃষ্ণ যে কথা যুক্তি আর উপদেশগুলা শোনান; দাবি করা হয় সেইগুলাই হইল গীতার মূলসূত্র। কিন্তু মূলত মহাভারতের লগে গীতার কোনো সম্পর্ক নাই। কুরুযুদ্ধ শেষে সম্রাট হইবার পর যুধিষ্ঠির কিন্তু কৃষ্ণরে খেদাইয়া দেয়। হস্তিনাপুর থাইকা নির্বাসিত হইবার পর বিষণ্ণ কৃষ্ণের জীবনে সামরিক আর কূটনৈতিক অধ্যায় শেষ হইয়া শুরু হয় এক লোক-দার্শনিকতার অধ্যায়। সেই সময়েই উৎপত্তি হয় গীতার…
মহাভারত আছিল বৈদিক ঘরানার উপাখ্যান আর গীতা হইল বেদবিরোধী ঘরানার দর্শন। পরবর্তীকালে গীতাবাদী দর্শনরে ভিত্তি কইরা বৈষ্ণব ধর্ম তৈয়ারি হইবার পর সমস্ত বেদের বৈষ্ণবায়ন ঘটাইবার কালে মহাভারত এডিট কইরা গীতাখান ঢুকাইয়া দেওয়া হয় গীতা দর্শনের প্রধান প্রতিপক্ষ দ্বৈপায়নের রচনা মহাভারতের ভিতর…
গীতা আমি সম্পূর্ণ বাদ দিয়া গেছি আমার গল্প থাইকা। আমি আমার গল্পটারে কইছি সম্পূর্ণ অলৌকিকত্ব বাদ দিয়া। রক্তমাংসের মানুষের গল্প। কৃষ্ণরে আবিষ্কার করতে চাইছি একজন কূটনীতিবিদ এবং যুদ্ধকলা বিশারদ হিসাবে। খণ্ড খণ্ড গোত্রপ্রধানগো শাসনের যুগে প্রথম সাম্রাজ্য চিন্তা আর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার নায়ক হিসাবেই কৃষ্ণ আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। একইসাথে দ্বারকায় রাজতন্ত্র উচ্ছেদ কইরা অভিজাততন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তার এক্সপেরিমেন্টখানাও রাজনীতি বিদ্যার ইতিহাসে আমার লাইগা আকর্ষণীয়। ব্যস এই হইল আমার কৃষ্ণ; রক্তমাংসের এক বুদ্ধিমান মানুষ…
আমি ইতিহাস আর নৃতত্ত্বের বইগুলা ঘাঁইটা চেষ্টা করছি রক্তমাংসের ঘটনাগুলা বাইর কইরা আনার। যেইখানে বইপুস্তক থাইকা নৃতাত্ত্বিক কিংবা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাই নাই সেইখানে নিজেই কিছু লৌকিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাইছি নিজের মতো করে মানে নিজেই মহাভারতের একজন কবি হইয়া গেছি…
০৯
যত দিন ধইরাই লেখা হউক আর যত মাইনসেই কাহিনি যোগ করুক না ক্যান; মহাভারতের কাহিনিখান এখনো প্রচারিত আছে একক মানুষ বেদব্যাস কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের নামে; এবং মহাভারতের প্রধানতম ভজঘট হইলেন স্বয়ং এই বেদব্যাস কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। তো এই কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের একখান কাব্যিক বর্ণনা দিছেন রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায় তার অন্নদামঙ্গলের পাতায়: “দাঁড়াইলে জটাভার
চরণে লুটায় তাঁর
কক্ষলোমে আচ্ছাদয়ে হাঁটু
পাকা গোপ পাকা দাড়ি
পায়ে পড়ে দিলে ছাড়ি
চলেন কতক আঁটুবাঁটু”
কক্ষলোম মানে বগলের লোম। বগলের লোমে নাকি দ্বৈপায়নের হাঁটুগুলাও ঢাইকা গেছিল। বুইঝেন কিন্তু; কবিরা স্বাধীনতা পাইলে পদ্য মিলাইবার লাইগা কত দূর পর্যন্ত যাইতে পারে। মাইনসের বগলের লোমে নাকি হাঁটু পর্যন্ত ঢাইকা যায়; কহিছেন রায়গুণাকর…
তো এমন মইনসের চুল আর দাড়িগোঁফ দিয়া যে রাস্তা মাপার আমিনগো গজফিতা বানানো যাইব সেইটা তো স্বাভাবিক কথা। এইখানে কিন্তু যুক্তি বিজ্ঞান; আর ইতিহাস পুরা অচল। মহাকবি নামে পরিচিত কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন নিজেই হাজার বছর ধইরা শত শত কবির রচনায় স্বয়ং একখান মহাকাব্যে পরিণত হইছেন। তার জীবনী পড়লে মনে হইব চুলদাড়ি জটাজুট নিয়া তিনি যেই জন্মাইছিলেন। তারপর খালি হাঁটতেই আছেন তো হাঁটতেই আছেন। হাঁটতে হাঁটতে তিনি বেদমন্ত্রগুলারে চাইরভাগে ভাগ করেন; রচনা করেন বেদের ব্যাখ্যা বেদান্ত; রচনা করেন আঠারোখান পুরাণ আর আঠারোখান উপপুরাণ এবং সর্বশেষ রচনা করেন একখান মহাভারত। তার নামে একখান রামায়ণেরও অস্তিত্ব আছে। যদিও হিসাবে নিকাশে গবেষণায় তার নামে প্রচলিত সব কর্ম নিয়াই আছে লাখে লাখে প্রশ্ন। যার মইদ্যে প্রধানতম প্রশ্ন হইল তার নামে প্রচলিত বেশির ভাগ পুস্তকই স্বাভাবিক নিয়মে তিনি মইরা যাইবার পরের রচনা…
মাইমল কন্যা সত্যবতীর গর্ভে ব্রাহ্মণ পরাশরের ঔরসে জন্ম নেওয়া এই দ্বৈপায়ন শুকদেব- ধৃতরাষ্ট্র- পাণ্ডু ও বিদুরের পিতা আর মহাভারত কাহিনির একখান চরিত্র…
গায়ের কালা রঙের কারণে কৃষ্ণ আর দ্বীপ বা চরে জন্ম নিবার কারণে দ্বৈপায়নের পাশাপাশি মুখে মুখে আউলাঝাউলা হইয়া ছড়ানো বেদমন্ত্রগুলারে তিনি বিষয়ভিত্তিক চাইরভাগে ভাগ করেন বইলা তার সম্মানজনক নাম বেদব্যাস মানে বেদের ভাগকর্তা… বেদের পাঠ যাতে নির্ভুল হয় সেজন্য তিনি বেদরে ভাগবাটোয়ারা করার পর চাইর শিষ্য; পৈল বৈশম্পায়ন- সুমন্ত আর জৈমিনি; প্রত্যেকরে একখণ্ড কইরা আর পুত্র শুকদেবেরে মুখস্থ করাইছিলেন একসাথে চাইর খণ্ড বেদ; যাতে শুকদেবের পাঠের লগে অন্যগো পাঠ মিলাইয়া সঠিক পাঠখান পাওয়া যায়…
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী আরেক ধাপ আগাইয়া গিয়া কন-দীর্ঘ দিন থাইকা শূদ্র আর নারীগো বেদপাঠ বিষয়ে যে নিষেধাজ্ঞা আছিল তা তিনি উঠাইয়া দিয়া সকলের লাইগা বেদ উন্মুক্তও কইরা দেন।
দ্বৈপায়ন সম্পর্কে তার আরো তিনটা আবিষ্কার বড়োই ভক্তিমূলক। তিনি কন দুনিয়াতে প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে দ্বৈপায়নই প্রথম উদ্যোক্তা; এক জায়গায় বেশি দিন থাকলে বনের ক্ষতি হয় এবং বনের পশুপাখি ধ্বংস হয় বইলা বনবাসকালে তিনি পাণ্ডবগো ঘন ঘন বন বদলাইতে পরামর্শ দিছেন। দ্বিতীয়ত দুনিয়াতে তিনিই পয়লা যুদ্ধকালীন নিয়মকানুন নির্ধারণ করেন। আর দুনিয়াতে যুদ্ধ সাংবাদিকতা এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সাংবাদিকের অবাধ অধিকার তিনিই পয়লা চালু করেন। সেই হিসাবে সঞ্জয় হইল দুনিয়ার পয়লা পেশাদার সাংবাদিক…
তো এই দ্বৈপায়ন ব্যাসরে তার মা সত্যবতী ডাইকা আনছিলেন মৃত সৎ ভাই বিচিত্রবীর্যের বৌদের গর্ভে সন্তান জন্ম দিতে। মায়ের বিবাহ রাজবাড়িতে হইলেও মা না ডাকা পর্যন্ত জীবনেও তিনি রাজবাড়ি আসেন নাই। মহাভারতের শেষ দিকে ভীষ্মের বয়ানে তখনকার যে সংস্কৃতি পাওয়া যায়; সেই সূত্রে তিনি মায়ের বিবাহকারণে মায়ের স্বামী রাজা শান্তনুর পোলা আর উত্তরাধিকার হইবার কথা। কিন্তু নিজে তিনি ঋষি মানুষ; নিয়ম মানেন না বরং নিয়ম বানান। তাই মায়ের বিবাহ রাজা শান্তনুর লগে হইলেও তিনি যেমন রাজবাড়িতে যান না; তেমনি নিজেরেও পরিচয় দেন না শান্তনুপুত্র কিংবা শান্তনুর উত্তরাধিকার হিসাবে; বরং নিজেরে তিনি পরিচয় করান নিজের নামে দ্বৈপায়ন কইয়া; এমনকি তার পিতা পরাশর খান্দানি বশিষ্ঠ গোত্রের বামুন হইলেও দ্বৈপায়নরে একবারের লাইগাও নিজেরে বাশিষ্ঠ কইয়া পরিচয় দিতে দেখা যায় নাই…
পয়লা দিকে হরিভক্ত এবং শেষ দিকে হরভক্ত এই স্বনামখ্যাত ঋষি টোল চালাইয়া বইপুস্তক লেইখা ঘুইরা বেড়াইবার পরেও আছিলেন বহুত সংসারী মানুষ। জঙ্গল জীবনেই অস্থায়ী বৌ ঘৃতাচীর গর্ভে তার আছিল এক পোলা; শুকদেব। যিনি পরে হইয়া উঠেন চতুর্বেদী ঋষি। কিন্তু এই শুকদেব যখন সন্ন্যাসী হইয়া গেলো; কাব্যমতে বৃদ্ধ বাপের কান্দনে জঙ্গলের গাছ কাইপা উঠলেও শুকদেব ফিরল না; তখন অন্যের খোপে পাইড়া যাওয়া ডিম ফুইটা যে তিনটা বাচ্চা হইছিল তার; তাগো কাছেই বিনা নিমন্ত্রণে বারবার ছুঁইটা গেছেন ব্যাস দ্বৈপায়ন। বড়ো পোলা ধৃতরাষ্ট্রটা আন্ধা আর লোভী; মাঝে মাঝেই মহাভারতে দেখি পোলারে আইসা বোঝান পিতা দ্বৈপায়ন। মাইজা পোলা পাণ্ডুটা অসুস্থ আর আঁটকুড়া; কিন্তু ক্ষেত্ৰজের যুগে যখন নির্বাসনে যুধিষ্ঠির জন্মাইল পুত্রবধূ কুন্তীর গর্ভে রাজবাড়িতে পরবর্তী উত্তরাধিকার জন্মাইবার সংবাদটাও পৌঁছাইয়া দিলেন দ্বৈপায়ন; যাতে তখনো অপুত্রক ধৃতরাষ্ট্র পরে কোনো বাগড়া না দেয় পোলাপাইনগো মাঝে যুধিষ্ঠিরের বড়োত্ব নিয়া। গান্ধারীর গর্ভসংকট? সেইখানেও দ্বৈপায়ন…
পাণ্ডু অকালে মইরা গেলেও রাজবাড়িতে তার পাঁচ পোলা নিশ্চিন্ত আছিল ভীষ্মের ছায়ায়। কিন্তু যখন জতুগৃহ পুড়াইয়া তারা পলাইল? তখন এই পাঁচ নাতির আক্ষরিক অর্থেই অভিভাবক আবার দ্বৈপায়ন। বুদ্ধি দেওয়া; নিজে হাত ধইরা ছদ্মবেশ পরাইয়া নিজের শিষ্যের বাড়িতে রাখা আর নিজে পুরোহিত হইয়া পাঁচ নাতিরে দ্রুপদের মাইয়ার লগে বিবাহ দিয়া আবারো শক্তিশালী করা…
তার ছোট পোলা বিদুর; বিচিত্রবীর্যের দাসীর গর্ভে জন্মাইছিল বইলা রাজবংশে উত্তরাধিকার পায় নাই। কিন্তু দ্বৈপায়ন যেমন বিদুরের মায়ের দাসত্ব মুক্ত কইরা দেন তেমনি ধৃতরাষ্ট্র আর পাণ্ডুর ক্ষেত্রে যেখানে কন তারা অম্বিকা আর অম্বালিকার পোলা; সেইখানে বিদুরের ক্ষেত্রে কন- আমার সন্তান।
আবার পুত্রহীন বিদুর মরার কালে তার শেষকৃত্যের লাইগা সম্রাটরেও মনে করাইয়া দেন- তুমি কিন্তু বিদুরেরই অংশ যুধিষ্ঠির। তার এই কথার সূত্র ধইরা অনেকে কন: যুধিষ্ঠির যে মূলত বিদুরের ঔরসজাত সেই বিষয়ে স্বয়ং দ্বৈপায়নই বইলা রাইখা গেছেন…
সবখানেই মহাভারতের লেখক দ্বৈপায়ন মহাভারতের সক্রিয় চরিত্র হইয়া মারাত্মক প্রকট; এমনকি কুরুযুদ্ধেও দেখি তিনি ঋষির গাম্ভীর্য নিয়া খাড়াইয়া দেখতে আছেন নিজের বংশনাশ…
কাব্যকাহিনি মতে ইনি নিজে কলম দিয়া লিখতেন না। লেখাইতেন গণেশরে দিয়া। কিন্তু নৃতত্ত্বমতে আর্যঘরানার মানুষগুলা আছিল অকাট নিরক্ষর; লেখাপড়া জানতই না তারা। লেখাপড়া জানত এই অঞ্চলের আদিবাসী মানুষ; মানে খ্রিস্টপূর্ব ২৮০০ থাইকা খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০ পর্যন্ত চলা সিন্ধু সভ্যতার মানুষ; যার মইদ্যে আছিল বিনায়ক বা গণেশ; যাগোরে আর্যঘরানার প্রাচীন সাহিত্যে রাক্ষস আর সিদ্ধিনাশক কইয়া বহুত গালাগালি করা হইছে। গণেশ নাকি তাগো সব সিদ্ধি নাশ কইরা দিত। কিন্তু বচ্ছরের পর বছর মাইনসের মুখে মুখে ঘুইরা যখন মহাভারত পাল্টাইয়া যাইতে শুরু করল; তখন তারা ভাইবা দেখল যে এইটারে লেইখা বান্ধাইয়া না থুইলে মাইনসে নতুন নতুন ভার্সন বানাইতেই থাকব দিনের পর দিন। আর সেই উদ্দেশ্যে তারা গিয়া গণেশরে শুরু করে তেলানি-মোগো পুস্তকখান লেইখা দেও মাস্টর…
কিন্তু গণেশ মাস্টার কি আর সহজে রাজি হয়? রাজি হয় না সে। তারপর আর্যরা তারে লোভায় সিদ্ধিনাশক থাইকা তোমারে সিদ্ধিদাতার পদে প্রমোশন দিমু মাস্টর; পুস্তকে তোমারে সম্ভ্রান্ত বংশজাত দেবতা কইয়া নমো নমো কইরা সকল দেবতার আগে করব তোমার পূজা…
বহুত তেলানোয় গণেশ রাজি হয় আর আমরা বিশ্বাসী মহাভারতে দেখি দ্বৈপায়ন মুখে মুখে শোলক বইলা যাইতাছেন আর শিবনন্দন গণেশ তা লিখতাছেন একটার পর একটা; যদিও গণেশের নামে যত কাহিনি আছে তার অর্ধেক কাহিনিতেও শিব-পার্বতীর লগে গণেশের কোনো সম্পর্ক নাই…
এইখানে একটা কথা কইয়া যাওয়া দরকার তা হইল আর্য কিন্তু কোনো জাতি আছিল না; আছিল একটা ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ। এই আর্যগোষ্ঠীর মইদ্যে বহুজাতির মানুষ যেমন আছিল; তেমনি অসুর নামে পরিচিতরাও কিন্তু আর্য। শুরুতে বোধ হয় দেবতা আর অসুরে কোনো ফারাকও আছিল না। প্রাচীন সাহিত্যে প্রায় সব দেবতারেই যেমন কোনো না কোনো সময় অসুর কওয়া হইছে তেমনি অন্যদেরও কওয়া হইছে আর্য…
যাই হউক; আমার হিসাবে কয় মহাভারত গ্রন্থখানও সত্যবতীপুত্র এবং শুকদেব- ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডু বিদুরের পিতা বেদব্যাস কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের লেখা না। এইটা হইতে পারে না। হইতে পারে এইটা বেদব্যাস কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের মা এবং তার বংশের কাহিনি কিন্তু কোনোভাবেই তার লেখা না। কারণ মহাভারতমতে ব্যাস জীবিত আছিলেন জন্মেজয়ের সময়। জন্মেজয়ের লাইগাই তিনি স্লিম সাইজের ‘জয়’ নামে মহাভারতের আদিপুস্তক রচনা কইরা শিষ্য বৈশম্পায়নরে পাঠান জন্মেজয়রে তা শুনাইয়া আসতে। জন্মেজয় হইল দ্বৈপায়নের নাতির নাতি পরীক্ষিতের পোলা। তো জন্মেজয়ের সময় পর্যন্ত কর্মক্ষম অবস্থায় বাঁচতে হইলে দ্বৈপায়নের কর্মজীবী বয়স হইতে হয় কমপক্ষে দেড়শো বছরের বেশি। এইরকম দীর্ঘ কর্মজীবী বয়স তখনই সম্ভব যখন বহুত প্রজন্ম মানুষের কাহিনি এক মানুষের নামে চালাইয়া দেওয়া হয়; অথবা এক মানুষের জীবনী কয়েকশো প্রজন্মের মানুষ লেখে; অথবা বয়সটা যখন ধর্মবিশ্বাস দিয়া মাপা হয়; অথবা যখন মাইনসের বয়স গুনার দায়িত্বখান কবিদের হাতে পড়ে তখন। কিন্তু ইতিহাস আর বিজ্ঞানমতে মানুষ বর্তমানে যতটা দীর্ঘজীবী; ইতিহাসের কোনো কালেই তার থিকা বেশি আছিল না কোনো দিন; বরং বহুত সংক্ষিপ্ত আছিল পুরানা মানুষের জীবনী আর সক্ষমতার কাল…
এই ক্ষেত্রে মহাভারতের বয়ানকার উগ্রশ্রবা সৌতির কথাখান ধরলে কিছু ভরসা পাওয়া যায় কয়েকজন কবি এই ইতিহাস পূর্বে বলে গেছেন। শুধু দরকার তার বাক্যের দুইটা শব্দ ‘ব্যাসপ্রোক্ত মহাভারতকথা’ কথাটারে বদলাইয়া যদি কওয়া হয় ‘ব্যাসের জীবনী মহাভারত কথা’ তাইলেই ধইরা নেওয়া যায় ব্যাসের বংশে ঘটা ঘটনা আগেও বহু কবি বইলা গেছেন; যা জন্মেজয় শুনছেন অন্য কোনো ব্যাসের কাছে আর শুনছেন সৌতিও…
সুকুমারী ভট্টাচার্যের হিসাবে বেদ এবং পুরাণের লগে বেদব্যাস দ্বৈপায়নের কোনো সম্পর্ক থাকারই কথা না। দ্বৈপায়নের নামে যতগুলা রচনা প্রচলিত আছে সেইগুলার তালিকা দিয়া সুকুমারী ভট্টাচার্য কন; যদি একজন মানুষরে এই সবগুলা পুস্তক রচনার কাম করতে হয়; তাইলে তার বাইচা থাকতে হবে কমপক্ষে আড়াই হাজার বছর। তাই ব্যাস মূলত একখান ‘সংজ্ঞা মাত্র’ কইয়া দ্বৈপায়ন সম্পর্কে ভারতীয় পুরাণের সবথিকা গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতিটা তুইলা ধরেন সুকুমারী- ‘ব্যাসের মৃত্যুর কথা শাস্ত্রে লেখে না…’
১০
কুরুযুদ্ধখান পুরাটাই রিটায়ার যাইবার বয়সী বুইড়াদের যুদ্ধ। কুরুযুদ্ধের সময় অত কারিশমার মহানায়ক অর্জুনের বয়স গল্পের খাতিরে মেকাপ-গেটাপ দিয়া কমাইতে কমাইতেও ৫৭ বছরের থাইকা কমানো সম্ভব হয় নাই আমার যেইটা আবার একটু মেকাপ উঠাইয়া দিলে গিয়া খাড়ায় ৮০’র উপরে। অর্জুন থাইকা ভীম এক বছরে বড়ো; তার থিকা এক বছরে বড়ো যুধিষ্ঠির আর অর্জুনের এক বছর কইরা ছোট হইল যমজ নকুল সহদেব। কর্ণ যুধিষ্ঠির থাইকা কমপক্ষে চাইর বছর বড়ো; দুর্যোধন ভীমের সমবয়সী এবং কৃষ্ণের বয়স অর্জুন আর ভীমের মাঝামাঝি; কয়েক মাস এদিক-সেদিক…
কুরুযুদ্ধের সময় যাতে অন্তত অর্জুনের গায়ে তির-ধনুক চালাইবার তাকত রাখা যায় তার লাইগা আমি যুদ্ধের সময় ৫৭ বছর হিসাব ধইরা আগাইছি। কিন্তু তাতে আবার ঝামেলা বাঁইধা গেছে অন্যখানে। এই হিসাবে আগাইলে স্বয়ংবরার সময় দ্রৌপদীর বয়স গিয়া খাড়ায় মাত্র ৪ বচ্ছর বুইঝেন কিন্তু। তো কেমনে আমি কুরুযুদ্ধে তিরাতিরির লাইগা অর্জুনের বয়স ৫৭-তে আটকাইয়া দিছি এইবার সেই হিসাবটা কই…
মহাভারতমতে পাণ্ডু মরার পর পোলাগো নিয়া কুন্তী যখন হস্তিনাপুর আইসা খাড়ায় তখন যুধিষ্ঠিরের বয়স ১৬। তারপরে মহাভারতে যুধিষ্ঠিরের বয়স পাই যখন যুবরাজ হিসাবে তার অভিষেক হয়; তখন সে ২৪। এক বচ্ছর যুবরাজগিরি কইরা বারণাবতে যাইবার সময় তার বয়স খাড়ায় ২৫। সময় উল্লেখ না থাকলেও বারণাবতে তারা কিন্তু বহু দিন বসবাস করে। ধরি কমপক্ষে ১ বছর। সেই হিসাবে জতুগৃহ পুড়াইয়া পাণ্ডবরা যখন হিড়িম্বের দেশে আসে তখন যুধিষ্ঠির ২৬। এইখানে হিড়িম্বার লগে ভীমের বিবাহ আর পোলা ঘটোৎকচের জন্ম হয়। এইখানে আড়েগড়ে আরো ১ বছর ধরলে জ্যাঠা যুধিষ্ঠির গিয়া খাড়ায় ২৭…
ঘটার জন্মের পর কুন্তী তার পোলাগো নিয়া মৎস্য কীচক ত্রিগর্ত আর পাঞ্চাল দেশ ঘুইরা একচক্রা নগরে আইসা বসবাস করে। ভীমেরে বক রাক্ষস মারতে পাঠাইবার আগে কুন্তী জানায় বহুকাল তারা এইখানে বসবাস করছে। বহুকাল মানে কতকাল জানি না কিন্তু বারণাবত থাইকা পাঞ্চালীর স্বয়ংবরা পর্যন্ত কমপক্ষে এক বছর ধরাই লাগে। কারণ মৎস্য দেশ মানে রাজস্থানের জয়পুর আর ড. অতুল সুর কন একচক্রা হইল বীরভূম। এই দীর্ঘ মানচিত্র হাঁটাহাঁটি কইরা পার হইতে ঘোড়ারও তো কমপক্ষে এক বচ্ছর লাগার কথা। তো যাই হোক; নায়কগো বয়স যখন কমাইতে বসছি তখন কমাইয়াই ধরলাম এক বচ্ছর। তার মানে দ্রৌপদীর স্বয়ংবরার সময় যুধিষ্ঠিরের বয়স ২৮ আর। অর্জুনের বয়স ২৬। এই পর্যন্ত নায়কেরা তরতাজাই আছে। তো আসেন এইবার বসি দ্রুপদের মাইয়া দ্রৌপদীর কুষ্ঠী গনায়…
দ্রুপদ মিয়া মাইয়ার বাপ হইল কবে? মহাভারত কয় দ্রুপদের মাইয়া হইছে দ্রোণ শিষ্যগো কাছে তার পরাজয় আর অর্ধেক রাজ্য হারাইবার পর। সেই ঘটনা ঘটে যুধিষ্ঠির যুবরাজ হইবার এক বছর আগে; মানে যুধিষ্ঠির তখন ২৩ আর অর্জুন ২১। তার এক বছর পর যখন অর্জুনের বয়স ২২ তখন ধৃষ্টদ্যুম্নের লগে যমজ হিসাবে জন্মায় দ্রুপদের মাইয়া দ্রৌপদী। এই হিসাবে দ্রৌপদী অর্জুন থাইকা কমপক্ষে ২২ বছরের ছোট আর বিয়ার সময় ৪ বছরের শিশু…
কিন্তু মহাভারতে কোথাও স্বয়ংবরার সময় দ্রৌপদীরে শিশু হিসাবে পাওয়া যায় নাই; তারে যুবতিই কওয়া হইছে। অবশ্য সেই যুগে ঋতু শুরু হইলেই মাইয়াগো যুবতি বইলা ধরা হইত। সেই হিসাবে স্বয়ংবরার সময় দ্রৌপদীর কমপক্ষে ১১-১২ বছর বয়স হইতেই হয়। আবার নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী বাপের বাড়িতে দ্রৌপদীর যে বিদ্যাশিক্ষার ব্যাপ্তি আর বিবরণ দিছেন তাতে তার বয়স আরো বাইড়া কমপক্ষে গিয়া খাড়ায় ১৬-১৭। কিন্তু দ্রৌপদীর বয়স বাড়াইলে তো অৰ্জুনেরও বয়স বাড়ে। স্বয়ংবরায় দ্রৌপদীর বয়স ১১ ধরলে অর্জুনের হয় ৩৩ আর কুরুযুদ্ধের সময় গিয়া খাড়ায় ৬৪; মানে লাঠি ভর দিয়া হাঁটার বয়স। আর বিয়ার সময় দ্রৌপদীর বয়স আরো বাড়াইলে অর্জুনের বয়স কই গিয়া খাড়ায় তা নিজেরা হিসাব কইরা দেখেন…
স্বয়ংবরায় দ্রৌপদীরে যুবতি ধইরা নিতে হইলে পাণ্ডবগো বয়স আরো বাড়াইতে হয়; না হয় ধইরা নিতে হয় দ্রোণশিষ্য কুরু-পাণ্ডবগো হাতে রাজ্য হারাইয়া দ্রুপদের যজ্ঞমজ্ঞের ঘটনা হইল ভুয়া জোড়াতালি। মূলত দ্রুপদ যখন কুরু-পাণ্ডবগো হাতে ধরা খায় তখনো তার পোলা-মাইয়া বেশ বড়োসড়ো আছিল। কেউ কেউ কন কুরুযুদ্ধে ব্রাহ্মণ দ্রোণের মরার কাহিনি জায়েজ করার লাইগা পরবর্তীতে বামুন লেখকেরা দ্রুপদরে দিয়া যজ্ঞমজ্ঞ করাইছেন; যাতে তার পোলা ধৃষ্টদ্যুম্নের হাতে দ্রোণ মরায় পাণ্ডবরা যেন ব্রাহ্মণহত্যার পাপে পাপিষ্ঠ না হয়; আবার পরবর্তীতেও কেউ যেন বামুনের দিকে অস্ত্র তোলার সাহস না করে। কারণ মহাভারতসূত্রমতে ব্রাহ্মণ হত্যা মানে পুরা গোষ্ঠীর নরকযাত্রা; একমাত্র দ্রুপদের পোলা ধৃষ্টদ্যুম্ন ব্যতিক্রম; কারণ যজ্ঞ থাইকা সে ব্রাহ্মণ মারার অনুমতিপত্র নিয়া জন্মাইছে…
তবে নকুল সহদেবের লগে দ্রৌপদী যেভাবে মায়ের মতো আচরণ করে; যেভাবে অর্জুন আর কৃষ্ণের লগে সমবয়সীর মতো বইসা আড্ডাটাড্ডা মারে আর দ্রৌপদীর যমজ ভাই ধৃষ্টদ্যুম্ন যেভাবে ভীমেরে পর্যন্ত নাম ধইরা তুমিতামি কইরা কথাবার্তা কয় তাতে মনে হয় দ্রৌপদী বরং অর্জুনের থাইকা বয়সে বড়োই…
এইবার আগাই কুরুযুদ্ধকালে পাণ্ডবগো বয়সের দিকে। বিয়ার কমপক্ষে ১ বছর পর যুধিষ্ঠির রাজা হয় ২৯ বছর বয়সে। তারপর ১৬ বছর রাজাগিরি কইরা শকুনির লগে পাশা খেইলা যখন নেংটি পর্যন্ত হারায় তখন তার বয়স ৪৫। তারপরে ১২ বছর বনবাস ১ বছর অজ্ঞাত বাস আর ১ বচ্ছর যুদ্ধের প্রস্তুতি। কয় বছর হইল? যুধিষ্ঠির ৫৯ আর অর্জুন ৫৭…
বয়স নিয়া আর বেশি কথা কমু না। তয় খালি কইয়া দেই যে অর্জুনের বয়স বাড়লে কিন্তু কর্ণের বাড়ে কমপক্ষে ৬ বছর; অশ্বত্থামার বাড়ে ৮-১০ বছর; অশ্বত্থামার বাপ দ্রোণেরও বয়স বাড়ে; আর সবচে বেশি বাড়ে সর্বপ্রধান মহানায়ক ভীষ্মের বয়স। ভীষ্ম হইলেন অর্জুনরে বাপ পাণ্ডুর বাপ বিচিত্রবীর্য থাইকা কমপক্ষে ৩০ বছরের বড়ো; দ্বৈপায়নের মা সত্যবতীর বয়সের কাছাকাছি; সেই হিসাবে কুরুযুদ্ধের সময় ইনার বয়স ব্যাটারি খুইলাও ক্যালকুলেটারে তিন ডিজিটের নিচে আনা অসম্ভব…
১১
কুরুযুদ্ধের একটা বিশাল অংশ জুইড়া আছে লোহার অস্ত্রপাতি; অথচ মহাভারতের ঘটনার সময় পর্যন্ত দুনিয়াতে লোহাই আবিষ্কার হয় নাই। অবশ্য তামা আবিষ্কার হইছে আরো বহু আগে; খ্রিস্টপূর্ব সাড়ে চাইর হাজার বছরে। ড. অতুল সুর কন তখনকার দিনে বর্তমান বাংলা অঞ্চলে আছিল তামার খনি আর ব্যাপারীরা সেইসব খনিজদ্রব্য আর সামগ্রী চালান দিত সিন্ধু সভ্যতায়। আর্যগোষ্ঠী সিন্ধুসভ্যতা তছনছ কইরা দিলেও হইলে হইতে পারে তামার যাতায়াত বাংলা থাইকা তখনো কুরুক্ষেত্র অঞ্চলে আছিল। কিন্তু মহাভারতের কোনো অস্ত্রপাতিতে তামার উল্লেখ নাই। মহাভারতে একবার তামার কথা আছে দ্রৌপদীর এক হাঁড়ির বেলায়; যা তারে পুরোহিত ধৌম্য দিছিলেন। ঘটোৎকচের বেলায় কওয়া হইছে সে পরতো কাসার বর্ম আর অনুমান করা যায় কর্ণের অভেদ্য বর্মখানও আছিল তামা কিংবা কাসার তৈয়ারি। কারণ দ্রৌপদীর হাঁড়ি আর কর্ণের বর্ম; দুইটার বেলাতেই সূর্যের একটা কইরা কাহিনি যুক্ত আছে। হইলে হইতে পারে মাটির বাসনের যুগে তামার একমাত্র হাঁড়িতে সূর্যের আলো পইড়া ঝিকমিক করত বইলা এর নাম সূর্যদত্ত হাঁড়ি আর পশুর চামড়া-টামড়া দিয়া বর্ম বান্ধনের যুগে কর্ণের তামা বা কাসার বর্মেও রোদ পইড়া ঝকমক করত দেইখা তারে কওয়া হইত সূর্যপ্রদত্ত বর্ম…
তামার অস্ত্র না থাকলে পুরা মহাভারতে আর কোনো ধাতুর অস্ত্র থাকবার কথাও না। হিসাব মতে ওই সময়ে সব লড়াই আছিল হাতে গদায় লাঠিতে বর্শায়। এমনকি তিরের বিষয়েও অনেকে সন্দেহ করেন। কিন্তু তির বাদ দিয়া মহাভারত কেমনে কয়?
হড় কিংবা সাঁওতাল জাতিতে তিরের ব্যবহার অন্য বহুত জাতির থাইকা আগে। ড. অতুল সুর পাঞ্চাল রাজ্যের বর্ণনা দিতে গিয়া কন এইটা বর্তমান বীরভূম জেলা আর সাঁওতাল পরগনার কাছাকাছি; এই পাঞ্চাল এলাকাটাই দ্রোণের জন্মস্থান। হইলে হইতে পারে আদিবাসীগো কাছ থিকা শিখে দ্রোণই তির-ধনুক রপ্তানি করছেন হস্তিনাপুরে তার শিষ্যগো মাঝে। পঞ্চমবর্ণের নিষাদেরা তির চালাইতে জানত না দেইখা নিষাদপুত্র একলব্য লুকাইয়া লুকাইয়া দূর থাইকা দ্রোণের তিরাতিরি দেইখা তির-ধনুক চালানো শিখে। অন্য কোথাও তির শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলে নিশ্চয়ই এতটা কষ্ট করত না সে…
মহাভারতে প্রথম জেনারেশনে যত তিরন্দাজ দেখি তারা কোনো না কোনোভাবে দ্রোণের শিষ্য; অর্জুন-কর্ণ- সাত্যকি- জয়দ্রথ- অশ্বত্থামা- ধৃষ্টদ্যুম্ন- শিখণ্ডী সবাই। কিন্তু এইখানে প্রশ্ন আইসা যায় তাইলে ভীষ্ম কেমনে তির চালান? তিনি তো আর দ্রোণের শিষ্য না। আমার উত্তর হইল ভীষ্ম মানুষ আছিলেন নাকি সেনাপতি পদের নাম আছিল ভীষ্ম সেইটা কেউ খুঁইজা দিতে পারলে কুরুযুদ্ধের সময় তার তিন ডিজিট বয়সী হাতে খালি তির কেন; আমি কামানও ধরাইয়া দিতে পারি। দেবতাগো রাজার পদের নাম যেমন আছিল ইন্দ্র; আমার ধারণা কৌরবগো প্রধান সেনাপতি পদের নামও তেমনি আছিল ভীষ্ম; মানে ভীষণ; মানে জাদরেল; মানে জেনারেল; মানে কমান্ডার…
কর্ণ তিরাতিরি লাইগা বিখ্যাত হইলেও সে কিন্তু অন্য ধরনের হাতিয়ার জাতীয় অস্ত্রই বেশি চালায়। বর্শা-ভল্ল- খড়গ- গদা আর ভার্গবাস্ত্র। ভার্গবাস্ত্র মানে ভৃগু বংশজাত পরশুরামের কাছ থিকা পাওয়া অস্ত্র। সোজা বাংলায় কুড়াল। কুড়াল বাদ দিয়া বাকি অস্ত্রগুলা ভীমেও চালায়। কর্ণের মল্লযুদ্ধের কাহিনিও পাওয়া যায় জরাসন্ধের লগে…
আমি যদি কই যে তখন তির-ধনুকের প্রচলনই হয় নাই তয় পাব্লিকে আমারে কিলাইব। কারণ তাইলে দুই মহানায়ক কর্ণ আর অর্জুনরে কুরুযুদ্ধের সাইড লাইনে বসাইয়া আঙ্গুল চুষাইতে হইব যুদ্ধের আঠারো দিন। কিন্তু তারপরেও কই; তির-ধনুকের যুদ্ধে অত আজাইরা কথাবার্তা কওয়ার সুযোগ কই? যেমনে তারা গালাগালি দিয়া লড়াই শুরু করে; নিজের লম্বা পরিচয় দেয়; আবার পেন্নাম-টেন্নামও করে; তির-ধনুকের নাগালের বাইরে অত দূর থাইকা অত খাজুইরা আলাপ যেমন সম্ভব না; তেমনি তিরাতিরি হইব কিন্তু একটা পাব্লিকেরও চোখে তির গাঁথব না এইটা কীভাবে সম্ভব? কুরুযুদ্ধে তির খাইয়া কিন্তু কারো চোখ নষ্ট হইবার কোনো কাহিনি নাই; অথচ ধুলাবালি থাইকা বেশি ছুটানো হইছে তির…
কৃষ্ণের চক্ৰখানের হিসাব মিলাইতে পারি নাই। সুবর্ণচক্রের বাইরেও কৃষ্ণ একবার যেমন রথের চাকা খুইলা ভীষ্মরে দাবড়ানি দেয়; ঠিক একইভাবে তার শিষ্য আর ভাগিনা অভিমন্যুও কিন্তু রথের চাকা নিয়া কৌরবগো দাবড়ায়। এতে কৃষ্ণ ঘরানায় চাকাজাতীয় অস্ত্রে সাবলীলতা বোঝা যায়। কিন্তু সুবর্ণচক্ৰখান এক্কেবারে চাকতি জাতীয় কিছু হইলে খুব ভালো অস্ত্র হইবার কথা না জুইতমতো ধরার জায়গার অভাবে। চক্ৰখান কিন্তু সে ছুঁইড়া শত্রুরে আঘাত করে…
আইচ্ছা কৃষ্ণের চক্র কি বুমেরাং-জাতীয় কিছু? যা চক্কর দিয়া মাইরা আবার চক্কর দিয়া ফিরা আসে দেইখা চক্র? নাকি আইজ পর্যন্ত শিখগো মাঝে প্রচলিত চক্রমই হইল কৃষ্ণের চক্র?
কৃষ্ণের চক্র যদি শিখগো চক্রমের মতো কিছু হইয়া থাকে তবে সেইটা দিয়া শিশুপালের মাথা কাটা সম্ভব হইলেও যুদ্ধের মাঠে সেইটা দিয়া খুব বেশি সুবিধা আদায় করা আদৌ সম্ভব কি না সন্দেহের বিষয়…
অবশ্য কৃষ্ণর কি আদৌ অস্ত্র হাতে সামনা সামনি যুদ্ধ করার কোনো ইতিহাস আছে? আমার তো মনে হয় না…
১২
মহাভারতমতে যাদব আর পাণ্ডব বংশ দুইটা শুরু হইছে ভৃগুমুনির পুত্র শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানী এবং তার সতিন; রাজা বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠার গর্ভ থাইকা; রাজা যযাতির ঔরসে। দেবযানী গর্ভজাত রাজা যযাতির বড়ো পোলা যদু থাইকা যাদব বংশ যার শেষ মাথায় পাই কৃষ্ণরে। শর্মিষ্ঠাগর্ভজাত যযাতির ছোট পোলা পুরু থাইকা পয়লা পুরু বংশ তার পর কুরু বংশ তারপর পাণ্ডব বংশ; যার শেষ মাথায় পাই পঞ্চপাণ্ডব। তো শর্মিষ্ঠার পোলা পুরু থাইকা আগাইলে দেখা যায় যে ২৪ নম্বর প্রজন্মে আছে যুধিষ্ঠির; যা ভৃগু থাইকা গুনলে হয় ২৬…
অন্য দিকে ঋষি অঙ্গিরার বংশধররাও মহাভারতে আছে। যার শেষ মাথায় যুধিষ্ঠির থাইকা কয়েক বছরে বড়ো অশ্বত্থামারে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু অশ্বত্থামা অঙ্গিরার মাত্র ৫ নম্বর প্রজন্ম। অথচ ঋষি অঙ্গিরা আর ভৃগুমুনি যেমন আছিলেন সমবয়সী তেমনি অঙ্গিরাপুত্র বৃহস্পতি আর ভৃগুপুত্র শুক্রাচার্যও আছিলেন সমবয়সী সতীর্থ। তো একই টাইমলাইনে যেইখানে অঙ্গিরা বংশ মাত্র ৫ প্রজন্ম গিয়া থামে সেইখানে ভৃগুর পোলা শুক্রাচার্যের মাইয়ার সতিনের বংশ কেমনে ২৬ পর্যন্ত পৌঁছাইয়া যায়? অথচ ভৃগুমুনির আরেক পোলা ঋচীকের বংশও কিন্তু অত উর্বর না। ঋচীকের পোলার ঘরের নাতি পরশুরাম হইলেন মুনি ভৃগু থাইকা চতুর্থ প্রজন্ম; যা অঙ্গিরার চতুর্থ প্রজন্ম দ্রোণাচার্যের লগে মিলে যায়; পরশুরাম দ্রোণের বয়সে বড়ো এবং গুরু; কিন্তু দুইজনই অঙ্গিরা এবং ভৃগুর চতুর্থ প্রজন্ম…
এইখানে প্রজন্মের ইতিহাস না খুঁইজা বরং মহাভারত সম্পাদনার ইতিহাসের দিকেই নজর দেওয়া ভালো। কওয়া হয় মহাভারত সবচে বেশি এডিট হইছে ভার্গব ব্রাহ্মণগো হাতে। ভার্গব ব্রাহ্মণ মানে ভৃগুমুনির বংশধর। এই এডিটের মূল উদ্দেশ্য আছিল মহাভারতের মহাক্ষেত্রে নিজেগো প্রতিষ্ঠা করা। এইটার পিছনে অবশ্য আরো পুরানা একখান ইতিহাস আছে…
বর্তমান তাজাকিস্তানের পশুরজন অঞ্চলের মানুষগুলারে আর্যরা সেনাপতি ইন্দ্রের নেতৃত্বে ভিটামাটি থাইকা পিটাইয়া খেদাইয়া দেয়। পশুরজনের এই পলানো মানুষগুলা পরবর্তীকালে পরিচিত হয় পারস্য- পারসিক বা পার্সিয়ান নামে…
ইন্দ্রের দলের আর্যরা নিজেগো কইত দেবতা। এককালের সেনাপতি ইন্দ্র পরবর্তী কালে পরিণত হন দেবরাজ ইন্দ্র নামে। অন্য দিকে ভূমি থাইকা উচ্ছেদ হওয়া পার্সিয়ানগো স্পিতামা গোত্রের মানুষ হইলেন মুনি ভৃগু। এই মানুষগুলা জীবনেও নিজেগোভিটা হারানোর ইতিহাস ভুলতে পারে নাই। বলা হয় দেবরাজ ইন্দ্রের নামের লগে যত চুরি-চামারির কাহিনি আছে সব এই পার্সিয়ান গোত্রেরই সংযোজন। এমনকি দীপাবলির রাইতে যে বাত্তি জ্বালানো হয় তাও নাকি প্রচলন হইছে ইন্দ্র যাতে বলির পশু চুরি করতে না পারে তার লাইগা। মানে ইন্দ্ৰ পুরাই একটা চোর বদমাশ লম্পট…
এই গোত্রের ভার্গব বংশে বহু বড়ো মানুষও জন্মাইছেন। চ্যাবন- শুক্র-জমদগ্নি-পরশুরাম- মনু বাল্মিকী; সবাই এই বংশের। ভৃগুমুনির পোলাগো মইদ্যে চ্যাবন ভেষজ-বিদ্যার বিশেষজ্ঞ তো শুক্র। আছিলেন যুদ্ধ বিশারদ আর শল্যবিদ্যার বিশেষজ্ঞ। অঙ্গিরা বংশ সর্বদাই ইন্দ্রের দলে থাকত বইলা ভৃগুপুত্র শুক্রাচার্য সব সময় থাকতেন অপজিশন; মানে অসুর-রাক্ষস আর দানবগো লগে। একলার বুদ্ধি আর কৌশলেই তিনি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলারে টিকাইয়া রাখতেন দেবতাগো আক্রমণের মুখে। তিনি নিজে ব্রাহ্মণ হইয়া; সংহিতামতে নিষিদ্ধ হইবার পরেও নিজের মাইয়া দেবযানীর বিবাহ দেন ক্ষত্রিয় রাজা বৃষপর্বার লগে। এই পার্সিয়ান স্পিতামা গোত্রের অন্য ধারায় আরেকজন বিখ্যাত মানুষ হইলেন পার্সিয়ান ধর্মের প্রবর্তক জরথুস্ট…
ভূমি হারানো এই মানুষগুলাই যুগের পর যুগ ধইরা ইন্দ্র আর অঙ্গিরা বংশরে ধরা খাওয়ানোর লাইগা কাঞ্চি চালাইছে পুঁথিপুস্তকের পাতায়। আর একই লগে মহাভারতের যাদব-পাণ্ডব দুই বংশরেই নিজেগো পকেটে ঢুকাইতে গিয়া প্রজন্ম গণনা আর বংশলতিকায় পাকাইয়া ফালাইছে বিশাল ভজঘট। যদু থাইকা যাদব বংশ এবং কৃষ্ণ পর্যন্ত আসতেও বহুত গোঁজামিল দিছে তারা…
মহাভারতে কিছু মাইনসের কোনো নাম নাই। গান্ধার রাজের মাইয়া বইলা ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রী গান্ধারী; তার আর কোনো নাম নাই। তেমনি নাম নাই নকুল সহদেবের মা মাদ্রীর। দেশের নামেই তাগোরে ডাকা হইছে আজীবন। দ্রৌপদীরে দেশের নামে পাঞ্চালী আর বাপের নামে দ্রৌপদী ডাকা হইলেও তার মূল নাম কৃষ্ণা পাওয়া যায়। আবার কিছু মানুষের নাম পুরাই বিকৃত কইরা দেওয়া হইছে। যেমন শকুনি-দুঃশাসন- দুর্যোধন। দুর্যোধনের মূল নাম আছিল সূর্যোধন; সেইটা পাওয়া গেলেও ধৃতরাষ্ট্রের বেশিরভাগ পোলাগো মূল নাম মোটেই উদ্ধার করা সম্ভব না মহাভারত থাইকা। পাণ্ডবপক্ষের ভক্তরা পুরাই খাইয়া ফালাইছে তাগোরে। তবে পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিবার কারণেই বোধ হয় ধৃতরাষ্ট্রের দাসীগর্ভজাত পোলার নামখান বেশ নাদুসনুদুসই আছে- যুযুৎসু…
এর বাইরে কিছু মাইনসেরে ডাকা হইছে জাতিবাচক নামে; যেমন হিড়িম্ব- হিড়িম্বা। হিড়িম্ব-হিড়িম্বা শুনলে কেমন জানি হড় জাতির লগে একটা মিল পাওয়া যায়। সাঁওতালরা নিজেগো জাতেরে কয় হড় জাতি। আর একইসাথে যখন ড. অতুল সুর কন সাঁওতাল পরগনার পাশে বীরভূমে আছিল হিড়িম্বার বাস আর এখনো সেইখানে আছে ঘটোৎকচের পোলার রাজ্যের চিহ্ন পাণ্ডুরাজার ঢিবি; তখন মনে হয় ঘটোৎকচের মা হিড়িম্বা মূলত আছিল সাঁওতাল বংশজাত নারী…
১৩
কুরুযুদ্ধে নাকি অংশ নিছিল ১৮ অক্ষৌহিণী সৈনিক; যাগো লগে হাতিঘোড়াও আছে আরো আছে জোগানদার কবিরাজ দাসদাসী বাদ্যকার বাবুর্চি পশুরাখাল দোকানদার এমনকি বেশ্যাও। তো ১৮ অক্ষৌহিণীরে বর্তমান সংখ্যা দিয়া কনভার্ট করলে খাড়ায় ৪৭ লক্ষ চব্বিশ হাজারের মতো। এর সাথে অন্য লোকজন যোগ দিলে পুরা যুদ্ধে বলতে হয় আছিল ৫০-৫৫ লক্ষ লোক; এবং তারা নাকি যুদ্ধ করছে একটা মাঠেই…
দুনিয়াতে সেই যুগে অর্ধকোটি মানুষ খাড়াইবার মতো কোনো মাঠ আছিল কি না আমার জানা নাই। তার উপ্রে আবার সেই মাঠে ছুটছে ঘোড়া; দাবড়াইছে হাতি; উড়ছে তির। মানে মানুষগুলার মাঝখানেও কমপক্ষে কোয়ার্টার কিলো বা পাঁচশো হাত জায়গা ফাঁকা আছিল ধাওয়া দেওয়া আর নিজেগো চান্দি সুরক্ষার লাইগা। সেইখানে মানুষ হাজির হইছিল যেমন; তেমনি মরছেও বেশুমার। একেকজন বীর একেটা তির মাইরা একলগে দশ-বিশ হাজার মানুষ মাইরা ফালাইছেন। তলোয়ার দিয়া কোপাইয়া এক বেলাতেই মাইরা ফালাইছেন হাজার দশেক সৈন্য…
যে কুড়ালি কুড়াল দিয়া গাছ কাটে সেও দিনে দশ হাজার কোপ বসাইতে পারে না নিরীহ নির্জীব গাছের উপর। আর সৈনিকরা নিশ্চয়ই গলা পাইতা খাড়াইয়া আছিল না; তারাও কোপাইছে; তারাও কোপ ফিরাইছে। তাছাড়া সেই সময় পুরা ভারতে অত মানুষ আছিল কি না সেইটা যেমন একটা প্রশ্ন তেমনি ইতিহাসবিদরা কন খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে মগধের নন্দ সাম্রাজ্যের আগে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এমন কোনো যোগাযোগ প্রায় আছিলই না যাতে রাজনৈতিক সম্পর্কের কারণে দুই পক্ষে অতগুলা মানুষ গিয়া জড়ো হইতে পারে। তয় যেহেতু এই মগধের নন্দ সাম্রাজ্যের সময়েই মহাভারত বিশাল আকার পাইয়া লিখিত হইছে; সেইহেতু মহাভারতের সংখ্যা রাজনীতি আর রাজনৈতিক ভূগোলটাও বোধ হয় রপ্তানি হইছে মগধের নন্দ সাম্রাজ্য থাইকা…
এতে অবশ্য মহাভারত পড়তে অসুবিধা হয় না; মাঝে মাঝে খালি বিরক্তি লাগে। তবে যেইখানে বলা হইছে অর্জুন তিরের বৃষ্টি চালায় সেইখানে ধইরা নিতে হইব যে একই ডিরেকশনে অর্জুনরে বাহিনী তিরাইতাছে। কারণ তির যুদ্ধের সাধারণ টেকনিকটাই হইল তাই; শত্রু নিশানায় আকাশের দিকে মুখ কইরা ঝাঁকে ঝাঁকে তির ফালাইয়া শত্রু বাহিনীরে ছত্রভঙ্গ করা। এই ক্ষেত্রে তির কাউরে টারগেট কইরা ছাড়া হয় না বরং তির ছাড়া হয় শত্রু বাহিনীরে টারগেট কইরা…
কুরুক্ষেত্রে সেই আঠারো দিনের যুদ্ধে নাকি বেশির ভাগ মানুষই মইরা গেছিল। সেই হিসাবে আঠারো দিনে যদি আঠারো অক্ষৌহিণী লোকের মরতে হয় তবে দৈনিক কমপক্ষে মরতে হয় আড়াই লক্ষর বেশি লোকের। এই পরিমাণ মানুষ যদি এক দিনে একটা মাঠে মরে তবে মরার গন্ধেই তো টিকা যাইব না কয়েক মাস। সেইখানে কেমনে বাকিরা হাইসা-খেইলা আঠারো দিন যুদ্ধ করে? তার উপরে আবার খাজুইরা আলাপও করে পিরিতি মাখাইয়া?
মহাভারতে আরেকখান গোলমাইল্লা সংখ্যা হইল গান্ধারীর গর্ভে ধৃতরাষ্ট্রের একশো পোলা। হইলে হইতে পারে অনেক বুঝাইতে শত ব্যবহার করছে কবিরা। আবার হইতে পারে রাজা যেহেতু অন্যগোও পিতা বইলা সম্মানিত হইতেন সেই হিসাবে ধৃতরাষ্ট্র তার বিশেষ বাহিনীরে পুত্র কইতেন আর তারাও তারে পিতা বইলা সম্বোধন করত। কারণ ভীষ্মের দাপটের সামনে ধৃতরাষ্ট্রের একটা নিজস্ব বাহিনী তখন অনিবার্য আছিল। হইলে হইতে পারে স্বয়ং দ্বৈপায়ন বিভিন্ন গ্রাম থাইকা আইনা একশোটা পোলা জোগাড় কইরা দিছেন ধৃতরে; সেইগুলা একলগে লাউয়ের খোলের দোলনায় দোল খাইত বইলা লাউ কাইট্টা পোলা জন্ম দিবার কাব্যিক কাহিনি জন্ম নিছে পরে। দাসীপুত্র যুযুৎসুসহ ধৃতরাষ্ট্রের একশো এক পোলার যে নামের তালিকাখান পাওয়া যায়; সেইটার মইদ্যে কয়টা আদৌ মানুষের নাম আর কয়টা খাইস্টা বিশেষণ তা দেখলেই বুঝতে পারা যায়…
এক নারীর পক্ষে সর্বোচ্চ কতটা সন্তান জন্ম দেয়া সম্ভব সেই প্রশ্নটা বাদ দিয়া গেলেও সন্তান যতটাই হউক মায়ে অন্তত সবগুলারে চিনব; সবগুলার কথা বলব; আর মরলে সবগুলার লাইগাই কানব; এইটাই সোজা হিসাব হইবার কথা। কিন্তু আমার যত দূর মনে পড়ে অত বড়ো মহাভারতে গান্ধারী চাইর-পাঁচটার বেশি পোলার নাম মুখেও আনেন নাই; আবার কান্দেনও নাই চাইর-পাঁচজনের বেশি পোলার মরণে। তো?
১৪
ভূগোল নিয়া বহুত ঝামেলা পাকাইছে মহাভারত। মগধ সময়কালের মানচিত্র আর রাজনীতি যে মহাভারতে ঢুইকা গেছে সেই প্যাচালও আগে পাইড়া আসছি। এর বাইরে মহাভারতের মূল জায়গাগুলারে বর্তমান কালে চিহ্নিত করা গেছে ঠিকঠাকমতোই। কুরুক্ষেত্র আর হস্তিনাপুর আছিল দিল্লির কাছে হরিয়ানায়। দ্বারকা হইল বর্তমানের গুজরাট। মৎস্যদেশ হইল রাজস্থানের জয়পুর তক্ষক নাগের রাজধানী তক্ষশিলা হইল রাওয়ালপিন্ডি; গান্ধার হইল কান্দাহার। মদ্রদেশ পাঞ্জাবে। মানে মূল ঘটনাটা ওই অঞ্চলের কাহিনি কারবার। কিন্তু যখনই এর লগে মাইনসে মহাভারতের সূত্র ধইরা কয় বর্তমান মণিপুরের কথা মহাভারতে আছে তখনই বাঁধে ঝামেলা। হিসাব মিলে না। রাজশেখর বসুও কন সেই মণিপুর এই মণিপুর না। কিন্তু তাতে মণিপুরের মানুষের মহাভারতের কাহিনির লগে নিজেগো কাহিনি মিলাইয়া ঐতিহ্য সন্ধান থাইমা থাকে না…
ড. অতুল সুর নৃতাত্ত্বিক সাক্ষীসাবুদ ভূগোল ইতিহাস ঘাইটা কন যে দ্রৌপদী আছিল বাঙালি নারী। এতে বাঙালিরা খুশি হইলেও অন্যরা কিন্তু যুক্তি দিয়া কিলাইতে পারে। কারণ অতুল সুর বারণাবত থাইকা পাণ্ডবগো নৌপথে পলাইয়া বীরভূম পর্যন্ত আসার একটা যুক্তিসংগত বিবরণ দিলেও পাঞ্চালের লগে হস্তিনাপুর বা বীরভূমের লগে হরিয়ানার অত দ্রুত যোগাযোগ কেমনে হইল সে বিষয়ে যেমন কিছু বলেন না; তেমনি মহাভারতের অন্য কোথাও নৌ যোগাযোগের কোনো সংবাদও পাওয়া যায় না…
আমার ধারণা অতুল সুর বিজ্ঞানচর্চা করতে গিয়াও আবেগি বাঙালি হইয়া কবিগো মতো কিছু ভাঙ্গা যুক্তি দিয়া দাবি কইরা বসছেন যে দ্রৌপদী হইল বাঙালি নারী। তার উপরে অনেকেই কন যে কর্ণের অঙ্গ রাজ্যের ভিতরে আছিল বর্তমান বাংলা অঞ্চল; মানে কর্ণ আছিলেন বাঙালির রাজা; এমনিতেই রবীন্দ্রনাথের কর্ণ-কুন্তী সংবাদ পইড়া বাঙালিজাতি কর্ণের লাইগা যে কান্দনটা কান্দে তার উপ্রে যদি প্রমাণিত হয় যে কর্ণ আছিল বাংলার রাজা তাইলে তো বাংলার কবিরা কৃষ্ণ অর্জুনরে ভর্তা বানাইয়া নতুন মহাভারত লিখতে বইসা যাইব কাইল…
কর্ণের অঙ্গরাজ্য কিংবা পাঞ্চালের লগে বাংলার সম্পর্কসূত্র খাড়ার উপ্রে বাতিল করতে না পারলেও হরিয়ানার লগে যখন আসামের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ঘটাইয়া দেওয়া হয়; তখন পুরাই আউলা হইয়া উঠে মহাভারতীয় ভূগোলের পাঠ…
ভগদত্ত নামে একখান চরিত্র আছে মহাভারতে। তিনি দুর্যোধনের স্ত্রী ভানুমতির বাপ। প্ৰাগজ্যোতিষপুরের রাজা নরক-এর পোলা। তার বাহিনীর মূল শক্তি হইল হাতি আর তার সৈনিকরা হইল চীনা আর কিরাত। দাবি করা হয় মহাভারতের প্রাগজ্যোতিষপুর হইল পরবর্তীকালের কামরূপ রাজ্য যার সীমানায় পড়ছে বর্তমান সময়ের আসাম এবং বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল…
আসাম থাইকা দিল্লির আকাশ-দূরত্ব দুই হাজার কিলোমিটারের মতো। আধুনিক মিলিটারিগো হিসাবমতে গ্রাউন্ড ডিসটেন্স কমপক্ষে এয়ার ডিস্টেন্সের ডাবল হয়। সেই হিসাবে আসাম থাইকা দিল্লির কাছাকাছি হরিয়ানার স্থল-দূরত্ব কমবেশি চাইর হাজার কিলোমিটার। যে যুগে ট্রেন বাস বিমান জাহাজ নাই; রাস্তাঘাট নাই; নদীতে ব্রিজ বা ফেরি নাই; থাকা-খাওয়ার লাইগা দোকানপাট কিংবা হোটেলপাতি নাই; সেই যুগে আসাম থাইকা হরিয়ানা যাইতে কত দিন লাগতে পারে?
মিলিটারিরা কয় ভালো রাস্তায় সৈনিকগো হাঁটার কার্যকর গতি গড়ে ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার। আর যেইখানে রাস্তাঘাট তেমন নাই সেইখানে গড়ে তা নাইমা আসে ৩ কিলোতে। দৈনিক কার্যকর হাঁটার ঘণ্টা হইল ১০ আর বচ্ছরে পায়ে হাঁটার কার্যকর মাস হইল সাত। মানে ২১০ দিনের কার্যকর বচ্ছর।
তো এই অবস্থায় এই গতিতে আসাম থাইকা রওনা দিয়া একলা এক সৈনিকের হরিয়ানা যাইতে হইলে হাঁটতে হইব মোট ১৩৪ দিন; মানে প্রায় ৮ ক্যালেন্ডার মাস। তাও যদি সবগুলা নদী-উপনদীতে তার লাইগা নৌকা রেডি থাকে তয়…
তো সেই যুগে বাহিনী আর হাতি নিয়া হাঁটার হ্যাপাগুলা কী? পয়লা কথা হইল সেনাপতিরা হাতিতেই যাউক আর ঘোড়াতেই যাউক; দলের মালপত্র টানা মুটে-মজুরগো চলার গতিই আছিল তাগো অগ্রগতির গড় গতি। সেনাপতিগো কিছুদূর গিয়া থামতে হইত; পায়েদল মজুররা আসার অপেক্ষায়। তারপর তারা আইসা আশপাশ থাইকা খাবারদাবার জোগাড় করত; রান্নাবান্না করত; থাকার ব্যবস্থা বানাইত; হাতিঘোড়ার খাবার দিত বিশ্রাম দিত। তার উপরে ঝড়বাদলা বৃষ্টিতে থাইমা অপেক্ষা করতে হইত; অসুখ-বিসুখে মানুষ মরত; কাহিল হইয়া পড়ত; পাহাড়-জঙ্গলের ভিতর রাস্তা বানাইতে হইত; লোকাল মাতবর কিংবা ডাকাত-ফাকাতের লগে মারামারি করতে হইত; তারপর হইত আগাইতে। তার উপরে আছে হাতিঘোড়া মালপত্র নিয়া ছোট বড়ো অসংখ্য নদী পার হইবার হ্যাপা…
বলা হইছে ভগদত্ত কুরুযুদ্ধে অংশ নিছে এক অক্ষৌহিণী সৈনিক নিয়া। এক অক্ষৌহিণী মানে হইল ১ লক্ষ ৯ হাজার সাড়ে তিনশো পায়দল সৈনিকের লগে ২১ হাজার ৮৭০টা কইরা রথ আর হাতি এবং ৬৫ হাজার ৬১০টা ঘোড়া। তো এইবার একেকটা হাতির লগে দুইজন কইরা মাহুত আর রথে কমপক্ষে একজন কইরা সারথি আর জোগানদার কামলা যোগ কইরা গুইনা দেখেন মোট পাব্লিক কত হইতে পারে এক অক্ষৌহিণী সৈনিকের ভিতর; এবং সেই বিশাল বাহিনীরে সেই যুগে আসাম থাইকা হরিয়ানা নিয়া যাইতে কত বছর লাগতে পারে? তো একজন রাজা; যার নিজের আছে বিশাল একখান রাজ্য; সে কেমনে কথায় কথায় গিয়া আসাম থাইকা অত বড়ো বাহিনী নিয়া হরিয়ানা হাজির হয়? তার উপরে আবার বিবাহ-শাদির সম্বন্ধ পাতায়? কেমনে সম্ভব? কেমনে সম্ভব গুজরাট থাইকা আসামে আইসা কৃষ্ণের পক্ষে ভগদত্তের বাপেরে মাইরা ফালানো?
মহাভারতের লগে ভগদত্তরে জুইড়া দেওয়ার কারিগরি ইতিহাস অন্য আরেকটা জায়গার ইতিহাস খুঁজলে বোধ হয় পাইলেও পাওয়া যাইতে পারে। ভগদত্ত প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা নরকের পোলা; যারে বামুন ঘরানার সাহিত্যে কইত নরক রাজ্য। সেই নরক রাজ্য যখন চতুর্থ শতকে বর্মন রাজ বংশের শাসনামলে প্রাগজ্যোতিষপুর নাম পাল্টাইয়া হইল কামরূপ; তখন বর্মন রাজারা দেশের মাইনসেরে শিক্ষাদীক্ষা দেওয়া আর বৈষ্ণব ধর্ম প্রতিষ্ঠার লাইগা মগধ সাম্রাজ্য থাইকা কামরূপে আমদানি করছিল ব্যাপক সংখ্যার ব্রাহ্মণ। বামুনরা কিন্তু সহজে কামরূপে আসতে চাইত না। তারা বাংলারে কইত পক্ষী জাতীয় মানুষের দেশ আর কামরূপরে কইত নরক। কোনো বামুন এই দিকে আসলে ফিরা যাইবার সময় তারে প্রায়শ্চিত্ত কইরা ঢুকতে হইত নিজের সমাজে। তো দেশ আর আত্মীয়-স্বজন ছাইড়া যেই সব বামুন সেই নরক রাজ্যে আসতে রাজি হইত তারা মূলত আছিল নিজেগো অঞ্চলে খাইতে না পাওয়া কিংবা পতিত কিংবা আকাম কইরা পলাইয়া থাকা বামুনের দল। কালে কালে তাই পতিত আর অকর্মা মানুষগো সর্বশেষ ঠিকানা হিসাবে নরক হইয়া উঠে একমাত্র গন্তব্যের নাম…
তো সেই নরকে কিংবা কামরূপে কিংবা আসামে-সিলেটে যে বামুনরা আসলো; মাইনসেরে শিক্ষাদীক্ষা দিলো; সেইটার প্রভাব কিন্তু এখনো রইয়া গেছে সিলেটি আর অহোমিয়া ভাষার শব্দে। আর উচ্চারণে। এই ভাষাগুলায় সংস্কৃত শব্দবাহুল্য; দীর্ঘ ক্রিয়াপদ আর উচ্চারণ এখনো বহন করে সেই ভাট বামুনগো অবদানের চিহ্ন। কিন্তু একবারও কি ভাইবা দেখা যায় না যে ৩৫০ থাইকা ৬৫০ সাল পর্যন্ত শাসন করা বর্মন রাজারা খালি নরকরে প্রাগজ্যোতিষপুর থাইকা কামরূপ বানাইয়া শিক্ষিত আর বৈষ্ণব করার পিছনেই পুরা ইনভেস্টমেন্ট খরচা করে নাই; বরং নতুন কামরূপের ঐতিহ্য নির্মাণেও তারা ইনভেস্টমেন্টের একটা বিশাল অংশ খরচা করছে?
ভিন্ন সমাজে এইরকম আরেকখান উদাহরণ দেখার লাইগা এইবার একটু ভার্জিলের ইনিড মহাকাব্যখানের শানেনুজুল স্মরণ কইরা নেন। গোত্র-পরিচয়হীন অক্টাভিওন যখন অগস্টাস সিজার হইয়া জুলিয়াস সিজারের উত্তরাধিকার হইল; তখন তার মা আতিয়া বালবা কবি ভার্জিলরে দায়িত্ব দিলেন পোলার একখান ঐতিহ্যময় বংশকাহিনি বানাইয়া দিতে…
তো সেই অ্যাসাইনমেন্ট নিয়া ভার্জিল হোমারের ইলিয়াড থাইকা ট্রয় যুদ্ধের সূত্র ধইরা একখান চরিত্র বাইর করলেন- ইনিয়াস। তারপর তিনি লিখতে থাকলেন ইনিড। কাহিনি বানাইয়া কইয়া দিলেন যে ট্রোজান রাজবংশের পোলা ইনিয়াস ট্রয় থাইকা পলাইয়া আইসা প্রতিষ্ঠা করছেন রোমান জাতির। মানে তিনি রোমান জাতির পিতা। তো যাই হউক ভার্জিল ইনিয়াসরে দিয়া রোমান জাতিটাতি প্রতিষ্ঠা করার পর কইলেন যে আতিয়াপুত্র অক্টাভিওন; মানে অগস্টাস সিজার হইলেন সেই মহান ইনিয়াসের বংশধর; মানে অতি সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান…
তো কি এমনো হইতে পারে যে কামরূপের বর্মন রাজারা নিজেগো বৈষ্ণব ঘরানায় ঐতিহ্যশালী করার ইচ্ছায় সংস্কৃত পণ্ডিতগো পয়সা-পাতি দিছে মহাভারতে তাগোরে ঢুকাইয়া দিবার লাইগা? হইলে হইতে পারে সেই সব পেইড কবিরাই ছক কইরা কৃষ্ণরে দিয়া ভগদত্তের বাপ নরকরে হত্যা করাইয়া কৃষ্ণের নাম ধইরা নিজেগো দেশ থাইকা পয়লা নরকের গন্ধ ছাড়ায়; তারপর কুরুযুদ্ধের মাঠে নিয়া কৃষ্ণ আর অর্জুনের হাতে প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা ভগদত্তরে মারে; তারপর শুরু করে বর্মন রাজবংশের অধীনে বামুন প্রভাবিত বৈষ্ণব ঘরানার নয়া কামরূপ…
মহাভারতের স্বর্গও কিন্তু বর্তমানের স্বর্গ না। অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ হিসাব কইরা অতুল সুর কন মহাভারতের স্বর্গ হইল মূলত হিমালয়ের উত্তর অংশ যেইখানে আছিল দেবরাজ ইন্দ্রের নগর আর রাজধানী অমরাবতী। যাই হউক মহাভারতের পুরা ভূগোলই কিন্তু এইরকম ব্যাপক ক্রিয়েটিভিটিতে ভরা…
ভীমের পোলা ঘটোৎকচরে নিয়াও বেশ আউলাঝড়া কাহিনি আছে। মহাভারতে সে গোঁয়ার মহাভারতের কবিরা তারে পুরা রাক্ষসও বানাইয়া থুইছেন। কিন্তু মহাভারতের ইন্দোনেশিয়ান কাহিনিগুলায় সে আবার অন্যরকম হিরো। আমার হিসাবে মহাভারতে যত উচ্চশিক্ষিত আর উচ্চ সংস্কৃতির চরিত্র আছে তাগো মাঝে মনে হয় ঘটোৎকচ পয়লা সারির একজন…
সেই সময় গুণী কইন্যাগো লাইগা বহু স্বয়ংবরা প্রচলিত আছিল; কিন্তু সেইসব স্বয়ংবরায় পাত্ররা কইন্যা জয় করত নিজের শানশওকত কিংবা বাহাদুরি দেখাইয়া। ঘটোৎকচও বিবাহ করছে স্বয়ংবরার আসর জিতা; কিন্তু সেইটা আছিল বুদ্ধি পরীক্ষার স্বয়ংবরা। এই রকম বুদ্ধি পরীক্ষার স্বয়ংবরা আমি দ্বিতীয়টা পাই নাই কোথাও। যদিও স্বয়ংবরায় বুদ্ধি পরীক্ষার প্রশ্নগুলা আমি উদ্ধার করতে পারি নাই; সবখানেই বলা হইছে অহিলাবতী স্বয়ং কিছু কঠিন কঠিন প্রশ্ন করছে পাত্ৰগো। আর সেইসব কঠিন কঠিন প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়া ঘটা তারে জিতা নিছে। এতে কিন্তু অন্তত তার বুদ্ধির একটা ঝিলিক পাওয়া যায়। দ্বিতীয় বিষয়টা হইতাছে মহাভারতে যেইখানে সকলেই নিজের পোলাপানগো বীর আর যোদ্ধা বানাইবার লাইগা অস্থির সেইখানে ঘটোৎকচ পড়ালেখা শিখাইয়া নিজের ছোট পোলারে বানাইতে চায় ঋষি। তার ছোট পোলা বর্বরীক ঋষি হয়ও। রাজস্থানে এক নামে আর নেপালে আরেক নামে বর্বরীকের মন্দিরও আছে…
এইটা কেমনে সম্ভব? একটা মানুষের ঐতিহ্যে যদি শিক্ষা-সংস্কৃতি আর বুদ্ধিচর্চার অস্তিত্ব না থাকে তবে হিড়িম্বার পোলা কেমনে বুদ্ধি পরীক্ষার স্বয়ংবরায় গিয়া নাগরাজ মুরুর মাইয়া অহিলাবতীরে বিয়া করে আর নাতি হয় ঋষি? মূলত আদিবাসী মানুষগুলারে বড়ো বেশি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হইছে মহাভারতে; যার প্রমাণ এই ঘটোৎকচ…
অবশ্য ঘটোৎকচের বৌ নিয়া কিছু ভিন্ন মত আছে। কোনো সূত্রে অহিলাবতী যাদব বংশজাত। কোনো সূত্রে কয় সে নাগ বংশজাত। ঘটোৎকচের আরেক বৌয়ের সন্ধান পাওয়া যায় ভার্গবী নামে। কোনো সূত্রে দেখা যায় ভার্গবী যাদব বংশজাত আবার কোনো সূত্র বলে ভার্গবী হইল অর্জুনের মাইয়া; সুভদ্রা গর্ভজাত। অবশ্য নেপালে যারা ইয়ালাম্বর নামে বর্বরীকের পূজা করে আর বলে যে সেই হইল নেপালি প্রথম কিরাত রাজা; তারা আবার ঘটোৎকচরেও কিরাত বানাইয়া ফালায়। কিরাতরা আবার অন্য কোথাও দানব নামে পরিচিত আর বৈশিষ্ট্যে মঙ্গোলয়েড গোত্রজাত। সেই ক্ষেত্রে কিন্তু মহাভারতের অস্ট্রিক গোত্ৰজাত ঘটোৎকচের লগে দুই কাহিনির একটা প্যাঁচ লাইগা যায়…
এক কাহিনি বলে ঘটোৎকচের পোলা বর্বরীক কৃষ্ণের সামনে আত্মবলিদান দেয় আর অর্জুনের পোলা ইরাবান মরে কুরুযুদ্ধে। কিন্তু অন্য কাহিনি বলে যুদ্ধের আগে আত্মবলিদান দেয় অর্জুনের পোলা ইরাবান। যারা দ্বিতীয় কাহিনি বিশ্বাস করে তারা আবার ইরাবানরে দেবতা ইরাবৎ কইয়া পূজাও করে। আমার আখ্যানে আমি হিড়িম্বারে সাঁওতাল কইন্যাই কইছি; ঘটার বৌ অহিলাবতীর লাইগা বাইছা নিছি নাগবংশের পরিচয়…
শিখণ্ডীরে অনেকেই হিজড়া কন; কিন্তু এই বিবাহিত ব্যাডার রীতিমতো পোলাপান আছে। মনে লয় ভীষ্মের মরণরে মহান বানাইতে গিয়া অম্বার পুনর্জন্ম-টুনর্জন্ম জুইড়া দিয়া শিখণ্ডীরে ছাইয়া বানাইয়া থুইছে কবিরা। আর ভীষ্ম যে হিজড়া দেখলে অস্ত্র ছাইড়া দেন সেইটাও কিন্তু পুরা ভুয়া। কারণ শিখণ্ডী তার লগে সাত নম্বর আর নয় নম্বর দিনেও যুদ্ধ করছে; তখন কিন্তু তিনি তারে দেইখা কুফা কইয়া অস্ত্র ছাড়েন নাই। তাইলে দশ নম্বর দিনে আইসা হঠাৎ শিখণ্ডীরে দেইখা ভীষ্ম অস্ত্র ছাইড়া দিবার নাটক করলেন ক্যান?
মহাভারতে বর্ণিত বংশ আর ভূগোলের একখান ব্যাখ্যা দিবার চেষ্টা করছেন নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী তার ‘মহাভারতের ভারতযুদ্ধ এবং কৃষ্ণ’ পুস্তকে। নৃসিংহপ্রসাদ বড়ো বেশি দ্বৈপায়নভক্ত মানুষ। তিনি কৃষ্ণ দ্বৈপায়নরে যেমন একক ব্যক্তি হিসাবে বিশ্বাস করেন তেমনি দ্বৈপায়নের নামে লিখিত প্রতিটা অক্ষররে ভক্তিসহকারে বিশ্বাস করেন। সেই অনুযায়ী তিনি মহাভারতে বর্ণিত ভরত থাইকা প্রবাহিত বংশের যেমন একখানা বর্ণনা উপস্থাপন করেন বিভিন্ন পুরাণের সূত্র দিয়া তেমনি পৌরাণিক সূত্র দিয়াই মহাভারতীয় ভূগোলের একখানা মানচিত্রও উপস্থাপন কইরা ফালান তিনার এই পুস্তকে…
কিন্তু কথা হইল পুরাণগুলা যেইখানে রচিত হইছে অন্যসব পুরাণের উপর ভিত্তি কইরা; সেইখানে শুধু পৌরাণিক রেফারেন্স দিয়া রচিত বই পৌরাণিক গবেষণা হিসাবে ঠিকাছে; কিন্তু কোনোভাবেই পুরাণের নৃতাত্ত্বিক গবেষণা নয়। অবশ্য সেই দাবি নৃসিংহপ্রসাদ নিজেও করেন নাই; তিনি পুরাণের মইদ্যেই থাকতে চাইছেন। সেই দিক দিয়া বিশ্বাসী মানুষদের লাইগা নৃসিংহপ্রসাদের এই গবেষণাটা একখানা ভালো রেফারেন্স পুস্তক…
১৫
মহাভারত পরিবারের দুই প্রধান পুরুষ ভীষ্ম এবং দ্বৈপায়ন দুইজনই আছিলেন নদীমাতৃক মানুষ; একজন গঙ্গাপুত্র তো আরেকজন দ্বৈপায়ন। হিসাবমতে ভীষ্ম দ্বৈপায়ন থাইকা বেশ কয়েক বছরের বড়ো হইবার কথা। কারণ শিক্ষাদীক্ষা শেষ কইরা যুবরাজ ভীষ্ম যখন সত্যবতীর বিয়ার ঘটকালি করেন তখন সত্যবতীপুত্র দ্বৈপায়নের বয়স বারো। যদিও মহাভারতে আমরা দেখি ভীষ্ম নতমস্তকে পেন্নাম করতে আছেন দ্বৈপায়নের চরণে। এইটা হইতে পারে দ্বৈপায়ন ঋষি হইবার কারণে; অথবা হইতে পারে বামুনবাদীগো বামুনসম্মান বাড়াইবার কৌশলের কারণে…
জীবনীর দিক থাইকা দ্বৈপায়ন আর ভীষ্ম আছিলেন অদ্ভুতভাবে একজন আরেকজনের একেবারে আয়নামুখ। পরাশর দ্বৈপায়নের মায়েরে ফালায়া গেলেও পোলারে নিয়া গিয়া লালন পালন দিছে। অন্যদিকে গঙ্গা ভীষ্মর বাপেরে ফালায়া গেছে কিন্তু পোলারে নিয়া বড়ো কইরা তুলছে শিক্ষায় দীক্ষায়…
দ্বৈপায়ন বাপের কাছে বড়ো হইয়া আইসা হাল ধরছেন মায়ের বংশের; আর ভীষ্ম মায়ের কাছে বড়ো হইয়া আইসা হাল ধরছেন বাপের সংসারে…
ভীষ্ম ব্যক্তি জীবনে সন্ন্যাসী কিন্তু সারা জীবন বান্ধা থাকছেন সংসারে। আর চাইর পোলার বাপ দ্বৈপায়ন বেশিরভাগ সময় সংসারের পিছনে অস্থির হইয়া দৌড়াইলেও জীবনটা কাটাইলেন সন্ন্যাসে…
১৬
কৃষ্ণসহ মহাভারতের বেশির ভাগ মানুষই আছিল দেখতে কালা; শিবপূজারি আর রাজা-বাদশা সকলেই বসবাস করত খড়কুটা কিংবা মাটির ঘরে। বারণাবতে যুবরাজের লাইগা ধুমধাম কইরা যে ঘর বানানো হয় সেইটা কিন্তু একটা বাঁশ বেত শণের ঘর। একই সাথে দেখা যায় সেই সময় মানুষ মাটির নিচে কিংবা গুহায়ও বসবাস করত। তার প্রমাণ সেই বারণাবতেই পাওয়া যায়। বিদুর এক কারিগর পাঠায় যে মাটির নিচে গুহাঘর বানানোয় এক্সপার্ট। তখন যদি এই জাতীয় ঘর বানাইবার প্রচলনই না থাকত তবে এক্সপার্ট মিস্ত্রি আইল কেমনে?
সিংহাসন মনে হয় খালি নামেই আছিল কিংবা পরে ঢুকানো হইছে। কামের ক্ষেত্রে চেয়ার জাতীয় কোনো আসন-টাসনের সন্ধান পাই নাই। মনে লয় মাটিতে আসন পাইতাই বসত সবাই। পোশাক আশাকেরও কোনো বিস্তারিত নাই। সুতা আর কাপড়ের প্রচলন তখন থাকলেও কথায় কথায় পশুর চামড়া আর ছালবাকলার পোশাকের বর্ণনা দেইখা মনে হয় একইসাথে গরিবগুর্বাগো মাঝে ছালবাকলার পোশাকের ব্যাপক প্রচলন আছিল তখন। বনবাসে অর্জুনরেও একবার ছালবাকলার পোশাক বানাইতে দেখা যায়। প্রচলন না থাকলে অতি সহজে যেমন পাওয়া যাইত না তেমনি অর্জুনও বানাইতে পারত না অত সহজে। সেই সূত্র ধইরা দ্রৌপদীর পোশাক নিয়া কথা কওয়া বিপজ্জনক। তবে রাজরানির পোশাক থান কাপড় জাতীয় কিছু হইলেও হইতে পারে; মানে পুরুষে পরলে হইত ধুতি আর নারীতে পরলে হইত শাড়ি। তয় মিলিটারিগো চিনার লাইগা কুরুযুদ্ধে ইউনিফর্মের সন্ধান পাওয়া যায়। অর্জুন না মরা পর্যন্ত কর্ণের জুতা না পরার প্রতিজ্ঞা থাইকা অনুমান করা যায় সেই যুগে জুতারও প্রচলন আছিল। তবে প্রায় সব ক্ষেত্রেই অতিথি বরণের সময় পা ধোওয়ার পানি দিবার ঘটনা দেইখা মনে হয় বেশিরভাগ লোকজনই খালি পায়ে হাঁটতো তাই ঘরে ঢোকার আগে এই পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা…
যুদ্ধের ব্লকিং নিয়া বহুত কথা থাকলেও বহুত হিসাব আবার মিলে না। যেই যুগে মহাভারতে কুরুযুদ্ধ ঢোকানো হইছে সেই যুগের মানুষেরা যুদ্ধে তির-ধনুক আর ঘোড়ার নিশ্চিত ব্যবহার করত। কিন্তু ঘোড়া আর তির-ধনুকের ব্লকিং যখন লাঠি গদা আর মল্লযুদ্ধের যুগের মহাভারতে ঢুকাইয়া দেওয়া হইছে তখনই লাগছে ভজঘট। কারণ ঘোড়া আর তির-ধনুকের ব্লকিং করতে গেলে ভীমেরে গদা চালাইবার জায়গা দেওয়া যায় না। আবার গদা আর মল্লযুদ্ধের অনিবার্য অংশ; মা-বাপ তুইলা গালাগালি করা কিংবা গুরুজনরে প্রণাম-টনাম রাখতে গেলে তির-ধনুক আর ঘোড়া বাদ দিতে হয়। তার উপরে আবার ঢুকছে চাইর-ছয় ঘোড়ার ফ্যাশনেবল রথ; যেইটা মোটেই সামনাসামনি যুদ্ধের উপযোগী কোনো বাহন হইতে পারে না; না গতিতে; না আকারে। তো এতে যা হইছে তা হইল সবকিছু মিলা একটা খিচুড়ি পাকাইয়া গেছে; যেইটা কাব্যে পড়তে সুন্দর; সিনেমায় দেখতে সুন্দর কিন্তু যুদ্ধবিদ্যার গ্রামারে কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত না…
১৭
নকুল-সহদেবরে মহাভারতে হালকার উপর মাদ্রীর পোলা কইলেও কাহিনি পইড়া তাগোরে কুন্তীর সতীনের পোলা মনে হয় না। অনেকেই দাবি করেন তারা কুন্তীরই পোলা। আমারো তাই মনে হয়। নকুল-সহদেব মাদ্রেয় না; কৌন্তেয়…
সেই কালের নিয়ম মতো কোনো নারী চাইরজনের বেশি পুরুষের লগে যৌনতা করলে বেশ্যা বইলা গণ্য হইত। সেই সূত্রমতেই পাঁচ পাণ্ডবের লগে বিছানা ভাগ করায় দ্রৌপদীরে বেশ্যা কইয়া খোটা দিছিল কর্ণ…
কর্ণ থাইকা অর্জুন পর্যন্ত জন্ম দিতে গিয়া বাইরের চাইরজন আর স্বামী পাণ্ডুরে নিয়া কুন্তীর কিন্তু পাঁচ পুরুষের লগে যৌনতা করা হইয়া যায়। কেউ কেউ কন; শুধু চাইরজনের অধিক পুরুষের বিছানায় সে যায় নাই এইটা প্রমাণ করতেই পরে আর কর্ণের জন্ম স্বীকার যায় না কুন্তী। এর উপরে নকুল সহদেবের জন্মগর্ভ স্বীকার করতে গেলে কর্ণের জন্ম লুকাইলেও কুন্তীর পাঁচ পুরুষের বিছানাযাত্রা প্রমাণ হইয়া পড়ে…
এর লাইগাই কুন্তী নকুল-সহদেবরে মাদ্রীর পোলা বইলা প্রচার করে। এতে কর্ণরে বাদ দিলে তার পুরুষসঙ্গীর সংখ্যা চাইরের বেশি হয় না…
কুন্তী ছাড়া পাঁচ পাণ্ডবের জন্ম আর পাণ্ডু-মাদ্রীর মৃত্যুর অন্য কোনো সাক্ষী কিন্তু মহাভারতে নাই। পাণ্ডু আর মাদ্রীর লাশের লগে ষোলো থাইকা তেরো বছর বয়েসি পাঁচটা পোলা নিয়া যখন কুন্তী হস্তিনাপুরে আইসা হাজির হয় তখন তার সাথে আসছিল কয়েকজন বনবাসী ঋষি। যারা হড়বড় কইরা পাঁচটা পোলারে মৃত পাণ্ডুর পুত কইয়া হস্তিনাপুর রাজবাড়িতে পরিচয় করাইয়া দিয়া। এক্কেবারে গায়েব হইয়া যায়; আস্ত মহাভারতে সেই লোকগুলারে আর দ্বিতীয়বার দেখা যায় না পাণ্ডু-মাদ্রীর মরণ কাহিনী থাইকা পাঁচ পাণ্ডবের জন্ম সবকিছুরই একমাত্র জীবন্ত সূত্র শুধু কুন্তী…
১৮
আইচ্ছা কর্ণ কি আদৌ কুন্তীর পোলা? সন্দেহ হয় আমার। কওয়া হইছে যে কুন্তী তারে ভাসাইয়া দিবার পর সন্তানহীন সূত অধিরথ তারে কুড়াইয়া আইনা পোষে। কিন্তু অধিরথের তো আরো পোলাপান আছে। কুরুযুদ্ধেই তারা যুদ্ধ করে। বলা হয় তারে স্তন্যদান করে সন্তানহীন রাধা। কিন্তু সন্তানহীন বন্ধ্যা নারী কেমনে স্তন্য পান করায়?
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী কন আরো বহু লোকই জানত যে কর্ণ কুন্তীর পোলা; কুন্তীর সন্তানদানের ক্ষমতা নিশ্চিত জাইনাই ভীষ্ম পাণ্ডুরে কুন্তীর স্বয়ংবরায় পাঠান। কারণ তার বংশটা আগের জেনারেশনে বহুত ভুগছে বংশের বাত্তি নিয়া; তাইলে প্রশ্ন হইল কৌরব আর পাণ্ডবরা এই কথা জানতো না ক্যান?
সেই কালের নিয়ম অনুযায়ী কুন্তীর কানীন সন্তান হিসাবে কর্ণ পাণ্ডুর পুত্র হিসাবে গণ্য হইবার কথা। এইটা প্রচলিত বিষয়। রাখঢাকের কিছু নাই। কিন্তু পাণ্ডুর অত সন্তানসংকট গেলেও একবারের লাইগাও কুন্তী কেন তারে কর্ণের কথা কইল না?
মহাভারতে বলা হইছে ভীষ্ম কৃপ দ্রোণ বিদুর জানতেন যে কর্ণ কুন্তীর পোলা। ভীষ্ম কৃপ দ্রোণ বিদুর বহুত চেষ্টা করছেন দুর্যোধনরে যুদ্ধ থাইকা ফিরাইতে। কিন্তু একমাত্র কর্ণের ভরসায় সে ফিরে নাই। তো ইনারা জানলে দুর্যোধন জানত না কেন? আর তারা যদি দুর্যোধনরে কর্ণের এই পরিচয়টা দিতেন তাইলেই তো কর্ণের উপর থাইকা তার বিশ্বাস আর ভরসা উইঠা যাইত। যুদ্ধ না করার লাইগা তারা তারে বহুত যুক্তি দেখাইছেন কিন্তু একবারের লাইগাও তো কন নাই যে অর্জুন হত্যার লাইগা কেমনে সে অর্জুনের মায়ের পেটের ভাইর উপরে ভরসা করে?
পোলাপাইন বয়সীগো মাঝে কৃষ্ণ জানত যে কর্ণ কুন্তীর পোলা; তাইলে কেমনে বিশ্বাস করা যায় যে যুধিষ্ঠির অর্জুন আর দ্রৌপদী তা জানে না?
একটা আখ্যান আছে যেইখানে কর্ণের পরিচয় গোপন রাখার লাইগা সম্রাট হইবার পরে যুধিষ্ঠির কুন্তীরে অভিশাপ দেয়- নারীজাতি কিছুই লুকায়ে রাখতে পারবে না কোনো দিন…
এই অভিশাপটা যুধিষ্ঠিরের মুখে কতটা মানায়? যে যুধিষ্ঠির জীবনে একবারের লাইগাও কুন্তীর চোখের দিকে চোখ তুইলা কথা কয় নাই। মায়ের সম্মান রক্ষার লাইগা বলতে গেলে যেকোনো কিছু যে করতে রাজি। সেই যুধিষ্ঠির হঠাৎ কইরা কুন্তীরে কেমনে অত তাচ্ছিল্য কইরা অভিশাপ দেয়?
আর সর্বশেষ ভীম। ভীম হইল মায়ের পোলা। মায়ের রান্নাবাড়া থাইকা মায়েরে কান্ধে নিয়া হাঁটা পর্যন্ত একলাই করছে ভীম। সেই ভীম কেন কর্ণরে কুন্তীর পোলা জানার পরেও পাপিষ্ঠ কইয়া তার শেষকৃত্যের লাইগা পয়সা দিতে রাজি হইল না? সে কেন কইল পাপিষ্ঠ কর্ণের শেষকৃত্য কুন্তী তার নিজের তহবিল থাইকা করবেন? ভীমের চরিত্রে ইতরামি মানায় কিন্তু কুন্তীরে ঠেস দিয়া কথা কওয়া মাইনা নেওয়া কঠিন…
পাণ্ডবগো অর্থমন্ত্রী ভীম রাজকোষ থাইকা পয়সা বরাদ্দ না দেওয়ায় ধৃতরাষ্ট্রের পোলাগো শেষকৃত্য হইল অর্জুন আর যুধিষ্ঠিরের ব্যক্তিগত পয়সায়। কিন্তু কর্ণের শেষকৃত্য কেন শেষ পর্যন্ত করল না কেউ? না পাণ্ডব না কুন্তী?
আমার খটকা লাগে। মনে লয় রাজবংশ ঘরানার বাইরে সাধারণ পরিবারের এই সন্তানের উইঠা আসা যেমন তার আশপাশের লোকজন মানতে পারে নাই তেমনি কবিরাও মানতে পারে নাই যে কর্ণ কোনো সম্ভ্রান্ত বংশজাত নয়। তাই কাহিনি জুইড়া তারে কুন্তীর পোলা বানাইয়া দিছে। যেমন ষাইট সত্তুর দশকে সিনেমায় রাজার পোলারে ধুমায়ে বাইদানির লগে প্রেম করানোর পর বিবাহের সময় দেখানো হইত সেই বাইদানি কিন্তু মূলত আরেক রাজার হারাইয়া যাওয়া মেয়ে মানে সমাজে সমাজে সমান রাখা। তো কর্ণরেও মনে লয় জোর কইরা এমন সম্ভ্রান্ত বানানো হইছে… কর্ণের চরিত্রও কেমন যেন খাপছাড়া। মাঝে মাঝে সে বহুত ভালো মানুষ আর মাঝে মাঝে চূড়ান্ত ইতর। একই সাথে তার মাঝে আছে যুধিষ্ঠিরের উদারতা; ভীমের ইতরামি আর অর্জুনের হিরোইজম। এই ভজঘটটা বোধ হয় হইছে কর্ণরে অভিজাত বংশজাত ভিলেন বানাইতে গিয়া। কিন্তু মূলত সে ভীষ্মের ঘোড়ার গাড়োয়ান অধিরথেরই পোলা; রাধাগর্ভজাত; যে তার নিজস্ব শিক্ষা শক্তি আর ক্ষমতায় রাজপুত্রগো ছাড়াইয়া উইঠা গেছিল বহুত উচ্চতায়…
১৯
বাংলা ভাষার মূল চরিত্রটা হইল কথা কইতে গিয়া যদি কোনো শব্দ মুখে আটকাইয়া যায় কিংবা চেহারা ভচকাইয়া তার উচ্চারণ করা লাগে তবে বাঙালি সেই শব্দটা বদলাইয়া ফালায়। দরকার পড়লে নতুন শব্দ বানায়; সুযোগ থাকলে বাইর থাইকা আইনা বাংলার লগে ফিট কইরা দেয়। এই পুস্তকে আমি সমস্ত বাঙালি জাতির ভাষা থাইকা যখন যে শব্দ পছন্দ হইছে সেইটাই নিছি; খালি খেয়াল রাখছি কোথাও আটকায় কি না। চেষ্টা করছি সহজিয়া বাংলায় গল্পগুলান কইতে; যেমনে মহাভারতের গল্পখান কইতে দিলে কইত বাংলার পালাকার কিচ্ছাকার বয়াতি বাউল…
পয়লা চেষ্টা। গোঁজামিল আছে বহুত জায়গায়। মাঝে মাঝে ইসকুলি বাংলা বাগড়াও দিছে। ধরাইয়া দিয়েন…
২০
মহাভারত নিয়া আমি শুরু করছিলাম সেই পিচ্চিবেলায় উপেন্দ্রকিশোর রায়ের কিশোর মহাভারত দিয়া। তারপর এক সময় ঢাউস ঢাউস পুস্তক ঘাঁটাঘাঁটি; ইন্টারনেট গুতাগুতি; বন্ধুবান্ধবগো চাপাচাপি; ফোনে ঠেলাঠেলি আর বৌম্যাডামরে কঠিন কঠিন প্রশ্নের মুখে ফালাইয়া ঘুটু পাকানো। বিষয়গুলার গিটটু খুইলা নিজে তৈরি কইরা নিছি মহাভারতের নিজস্ব পাঠখান। নিজস্ব পাঠ তৈরির ক্ষেত্রে মহাভারতের গিটঠু খোলার লাইগা জিগাইতে কাউরেই ছাড়ি নাই; তা হোক গ্রামীণ লাঠিয়াল আর হউক মিলিটারি অফিসার আর হউক কাঠখোট্টা ইঞ্জিনিয়ার। পাশাপাশি ধুমায়ে দেখছি এই সব বিষয়ের লগে সামান্যতম সম্পর্কযুক্ত সিনেমা নাটক টিভি সিরিয়াল…
তারপরে শুরু করছি লেখা। একটু একটু করে লেখি আর অনলাইন লেখক ফোরাম সচলায়তনে প্রকাশ করি। সচলায়তনে প্রকাশ করি আর শত শত মানুষের মন্তব্যে পরামর্শে রেফারেন্সে ডকুমেন্ট সমালোচনায় যেমন ভইরা উঠতে থাকে আমার পাঠের দুর্বলতা; তেমনি আমিও ধীরে ধীরে পাইতে থাকি নিজস্ব পাঠের স্বচ্ছ উপাখ্যান। এরপর যখন খসড়া দাঁড়ায়ে যায় তখন ভারতীয় পুরাণ বিশেষজ্ঞ থাইকা গল্পকার এমনকি নবীনতম পাঠক পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত পাঠক নিজেদের বিশ্লেষণ আর মেরামতির পরামর্শগুলা আমারে জানায়ে দেন। তাদের কারো কথা পুরাটাই রাখতে পারছি কারোটা পারছি আংশিক। কিন্তু তাদের আগ্রহ আমার কাছে যেমন বিস্ময়কর তেমনি তাগো কাছে আমার কৃতজ্ঞতাও অসীম; কারণ এই বইটাতে মন্তব্য করতে গিয়া অনেকেরই অনেক বইপুস্তক ঘাঁটাঘাঁটি করতে হইছে; নেটে গুতাইতে হইছে বহুত সময়…
তাগোরে কেমনে কৃতজ্ঞতা জানাই জানি না। তবে অনলাইনভিত্তিক এই পাঠক সমালোচক সহায়ক সমাজ না থাকলে এই বইটা আমার লেখা হইত না সেইটা এক্কেবারে নিশ্চিত…
বইখান গল্প আকারে লেখা শুরু হইছিল চুমকির ধাক্কায় আর শেষ হইছে টুটুলের গুঁতায়। অভিনয় শিল্পী নাজনিন হাসান চুমকিরে একবার কুন্তীরে নিয়া একখান মঞ্চনাটক লেইখা দেওয়ার কথা দিয়া ফালাইছিলাম। লিখতে গিয়া দেখি পারি না। মহাভারত নিয়া নিজস্ব গল্পের লাইনটা লিখিত না থাকায় নাটক লিখতে গিয়া বারবার ধাক্কা খাই। তো ভাবলাম আগে তাইলে কুন্তীর গল্পগুলান গোছাইয়া লই। সেইটা গোছাইতে গিয়া চুমকির কথা ভুইলা কুন্তীরে ছাড়াইয়া পুরা মহাভারতের গল্পগুলাই লিখতে শুরু কইরা দিলাম নিজের মতো কইরা। কিন্তু লেখা কিছু আগায় তো আবার বহু দিন বইসা থাকে। এর মাঝে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি এক দিন টাল হইয়া টুটুলরে কথা দিয়া ফালাইলাম যে বই কইরা ফালামু এইবার। টুটুল মানে আহমেদুর রশীদ। লেখক। শুদ্ধস্বর প্রকাশনী এবং আমার সবগুলা বইয়ের প্রকাশক। কিন্তু কইয়া তো পড়লাম বিপদে। বই তো গোছানো নাই। কেমনে কী? আমি যত কই যে টাল সময়ের কোনো কথা আমার মনে থাকে না; সে তত কয় শুধু টাল সময়ের কথাই নাকি তার মনে থাকে; বই তারে দিতেই হবে…
আমার দুর্গতি দেইখা বৌম্যাডাম দিনা ফেরদৌস; আমার কাছ থিকা বাপের ন্যাওটা দেড় বছরের মাইয়াটারে পুরা সরাইয়া নিয়া একখান আলাদা ঘর বাইর কইরা দিলেন-বইসা বইসা লেখো…
মাইয়া আইসা বাপ বাপ কইয়া দরজা থাবড়াইয়া চিল্লায় আর আমি দরজা লাগাইয়া ঘাপটি মাইরা বইসা করি মহাভারত। কিন্তু এত আউলাঝড়া জিনিস কেউ দেইখা না দিলে কেমনে হয়? পয়লা দুইজন মানুষেরই নাম আসে। রণ দা আর পাণ্ডব দা। রণ দা মানে রণদীপম বসু; লেখক। আর পাণ্ডব দা; জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আরিফ; লেখক। পাণ্ডব বংশের কেউ না; মহাভারত নিয়া লেখালেখিও করেন না কিন্তু নিজেরে পরিচয় দেন ষষ্ঠ পাণ্ডব কইয়া। দুইজনই মারাত্মক ব্যস্ত মানুষ কিন্তু তার উপরও খুঁটায়ে খুঁটায়ে মন্তব্য আসলো এই দুইজনের কাছ থিকা। সাহস বাইড়া গেলো আমার। আর লেখা যখন শেষ তখন আমার মারাত্মক কিছু ঘাটতি ধরাইয়া দিয়া অনেকগুলা তথ্য জোগান দিলো নজরুল; মানে ইন্টারনেটে আর মিডিয়াতে নজরুল ইসলাম আর ছাপা পুস্তকে যার নাম সৈয়দ দেলগীর…
পুলিশ মাইনসেরে বহুবিধ কারণে দৌড়ায়। কিন্তু বই লেখার লাইগা কাউরে তাইয়া দৌড়ের উপ্রে রাখা পুলিশ বোধহয় একজনই; মাসরুফ হোসেন। কঠিন পাঠক আর ভারতীয় পুরাণের এক ঘোরলাগা গ্রাহক। খণ্ড খণ্ড লেখার উপর শুধু মন্তব্যই না; বরং পুরা বইটা পইড়া অসঙ্গতি ধরার দায়টাও নিছে মাসরুফ প্রকাশের আগে…
কেউ কেউ আমারে কইছেন কই থাইকা কোন জিনিস নিছি আর কোন কথার সাক্ষী কোথায় পাওয়া যাবে তা তালিকাবদ্ধ কইরা দিলে পাঠকের নাকি সুবিধা হবে। কিন্তু এতে আমার আপত্তি আছে। প্ৰথমতো আমি লেখছি মহাভারতের গল্প; তালিকা-তুলিকা টাঙাইয়া এরে গবেষণাপুস্তক বানাইবার কোনো ইচ্ছা আমার নাই। দ্বিতীয়ত এই যুগে সবই পাওয়া যায় ইন্টারনেটে গুঁতা দিলে। তৃতীয়ত যদি কিছু নাও পাওয়া যায় কিংবা না মিলে আমার কথার লগে তবুও সমস্যা নাই; কারণ মহাভারত নিয়া নিজের মতো কইরা গল্প কইবার অধিকার মহাভারতই আমারে দিছে। সেই যে সৌতি কইছিলেন শত কবি কইছেন এর কথা আর বহু কবি কইবেন পরে…
তো আমিও কইলাম আমার মতো কইরা। যেকোনো বিষয়ে যে কাউরে দ্বিমত করার সম্পূর্ণ অধিকার দিয়া…
অভাজনের মহাভারত পয়লা আর পরবর্তী প্রকাশগুলার মাঝখানে পইড়া আছে অনেকগুলা লাশ; বেশ কিছু নির্বাসন এবং একটা প্রকাশনা সংস্থার স্বপ্নময় জন্ম আর দুর্বিসহ মৃত্যু যন্ত্রণার ছাপ…
বইটা পয়লা ছাপা ভার্সন প্রকাশিত হয় শুদ্ধস্বর প্রকাশনী থাইকা ২০১৫ সালের বইমেলায়। ওই বছরই শুদ্ধস্বর প্রকাশনী আর প্রকাশনীর লেখকদের অনেক কিছুই লণ্ডভণ্ড হইয়া যাইতে শুরু করে ইসলামি জঙ্গিদের আক্রমণে। শুদ্ধস্বর আগাগোড়াই সেকুলার ধারার বই প্রকাশ করে; মূল নীতির মইদ্যে লালন করে অসাম্প্রদায়িকতা আর বিজ্ঞানমনস্কতা…
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থাইকা ফেরার পথে টিএসসিতে জঙ্গিরা চাপাতি দিয়া কোপাইয়া হত্যা করে মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ রায়রে। মারত্মকভাবে জখম হন লেখক বন্যা আহমেদ। বছর জুইড়া মৌলবাদীরা একের পর এক খুন করতে থাকে লেখকদের। ৩১ অক্টোবর একই সাথে আক্রমণ করে ঢাকার দুই প্রকাশনী সংস্থায়; শাহবাগে জাগৃতি প্রকাশনীতে খুন হন। প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন আর লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের অফিসে হামলায় আহত হন প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল; লেখক রণদীপম বসু আর কবি তারেক রহিম…
শুদ্ধস্বরে আহতরা প্রাণে বাইচা যায়। কিন্তু হইতে হয় দেশান্তরী। আরো বহু লেখকই দেশান্তরি হইতে থাকেন জঙ্গিদের ভয়ে…
শুদ্ধস্বর প্রকাশনী থমকাইয়া যায়। বুকে হাত দিয়া বললে হয়ত বলতে হয় বন্ধই হইয়া গেছে চিরতরে। শুদ্ধস্বরের শুরু থাইকাই আমি আছি এর লগে। ২০০৪ সালে শুদ্ধস্বরের প্রথম দুইটা প্রকাশনীর একটা বই আমার; আর ২০১৫ সালে শুদ্ধস্বরের সর্বশেষ প্রকাশনীরও একটা বই আছিল আমার- অভাজনের মহাভারত…
বইটার দ্বিতীয় ছাপা ভার্সন প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে বাতিঘর থাইকা। তৃতীয় ভার্সন ই-বুক প্রকাশিত হইল বইদ্বীপ থাইকা। বইটার প্রথম আর পরের প্রকাশনাগুলার মাঝখানে সূত্রপথ হইয়া গাঁথা রইল লেখকদের রক্তের দাগ; নির্বাসনের অমর্যাদা আর একটা প্রকাশনী সংস্থার মৃত্যুযন্ত্রণার অস্বচ্ছ ইতিহাস…
মাহবুব লীলেন
আগস্ট ২০২০
.
ভণিতা বিস্তার
ক. মহাভারতের কৃষ্ণায়ণ এবং রামের বৈষ্ণবায়ন
খ. বেদবিরোধী গীতার বৈদিকায়ন এবং রামায়ণের অতীতযাত্রা
অভাজনের মহাভারত পয়লা প্রকাশের কালে কাঠখোট্টা কথা বইলা বইটা ভারী করতে চাই নাই রেফারেন্স দিয়া। গল্পে নিজে কোনটা কেমনে ভাবছি আর কেন ভাবছি তারই একখানা খতিয়ান জুইড়া দিছিলাম ভণিতায়। আর গীতা যেহেতু মহাভারতের পরের যুগে জুইড়া দেওয়া অধ্যায়; তাই গল্প বলতে গিয়া গীতা যেমন পুরা বাদ দিয়া গেছিলাম তেমনি ভণিতায়ও এই বিষয়টা বাদ দিয়া গেছি ধর্মটর্মের বিতর্কে যাইতে না চাওয়ার ইচ্ছায়…
কিন্তু বইটা প্রকাশ হইবার পর আবিষ্কার করলাম; আমি গীতায় যাইতে চাই না বলার পরও মাইনসে কোমর বাইন্ধা হাজির হয় গীতা বিতর্ক নিয়া। আর গীতা আইলে চইলা আসে অবতার কৃষ্ণের প্রসঙ্গ। আর সেইটার ল্যাঞ্জা ধইরা আসে অবতারবাদ আর অবধারিতভাবে রামের কথা…
আমাগো দেশে কৃষ্ণ আর রামের নাম যেমন পাশাপাশি উচ্চারণ হয়; তেমনি মহাভারত নিয়া কেউ বাক্য শুরু করলে শেষ করে রামায়ণ দিয়া। যদিও হইবার কথা না; কিন্তু এইটা হইয়া গেছে। কৃষ্ণের লগে রামের মিল বা সম্পর্ক যেমন নাই; তেমনি মহাভারতের লগে বাস্তবে রামায়ণের কোনো মিল বা সম্পর্কও নাই। কৃষ্ণ আর রাম যেমন আলাদা সমাজের মানুষ; তেমনি মহাভারত আর রামায়ণও আলাদা সময় আর সমাজের ঘটনা; ধরনও ভিন্ন…
যখন বেদ আর উপনিষদ বাতিল কইরা; শৈব ধর্মের লগে এডজাস্ট কইরা আর বৌদ্ধ ধর্মরে টেক্কা দিয়া গীতা নির্ভর বৈষ্ণব ধর্মটা ধীরে ধীরে দানা পাকাইয়া হিন্দু ধর্ম সৃষ্টি হইতে থাকল; তখন কাহিনির গোষ্ঠি সম্পাদনায় মহাভারত আর আর রামায়ণের ভিতর যেমন বহুত মিল তৈয়ার করা হইল; তেমনি কৃষ্ণ আর রামেরে আইনা খাড়া করা হইল এক লাইনে; অবতার বানাইয়া…
ফলে মহাভারত নিয়া কথা কইতে গিয়া রামায়ণের নাম উচ্চারণ না করলে যেমন মানুষ গোষ্ঠী অভিজ্ঞতা স্মরণ কইরা হাউকাউ করে তেমনি কৃষ্ণ বিষয়ে কথা শেষ কইরা দিবার পর কান খাড়া কইরা থাকে রামের বিষয়ে শুনতে…
কৃষ্ণ আর রাম একলগে আলোচনা করার পদ্ধতি আছে মাত্র দুইটা। এর একটা হইল ধর্মভক্তি যেইটা দিয়া আলাপ করলে কোথাও কোনো খটকা চোখে পড়ে না। আর দ্বিতীয়টা হইল তুলনামূলক আলোচনা; যেইটা মূলত একটা ধান্দা লাগা বিতর্ক। কারণ সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের দুইটা মানুষরে কবিরা কল্পনা দিয়া জোড়া দিছে এক জায়গায়। ফলে এই বিষয়ে আলোচনা হয় না; হয় বিতর্ক…
কিন্তু এড়াইবার যেহেতু উপায় নাই; সেহেতু এইখানে দুইটা অধ্যায় জোড়া দিয়া দিলাম। খটমটানি যাগো ভাল্লাগে না; তারা এইটা বাদ দিয়া যাইতে পারেন। আর যাদের খুঁতখুতানি আছে তথ্যমথ্য নিয়া; তারা দেখতে পারেন…
তবে রামায়ণের লগে যারা মহাভারতের তুলনামূলক সাহিত্যিকি আলোচনায় আগ্রহী তাগো লাইগা সুকুমারী ভট্টাচার্যের ‘আপেক্ষিক মূল্যায়নে রামায়ণ ও মহাভারত’ একখান অসাধারণ পুস্তক। এইটা সম্ভবত সুকুমারীর একমাত্র রচনা যেইটা পড়তে গেলে রামায়ণ বা মহাভারতের মূল গল্প বিষয়ে সামান্য ধারণা থাকা ছাড়া পাঠকের আর কোনো প্রাক-যোগ্যতার প্রয়োজন নাই…
যেহেতু ভণিতাটা লেখা হইছিল সরল পাঠকের লাইগা আর এই বাগাড়ম্বড়খান যুক্ত করা হইছে পণ্ডিতগো লাইগা; সেহেতু ঘটনা আলাপের সুবিধার লাইগা কিছু কিছু বিষয় দুইখানে রিপিটেশন আছে…
এই আলোচনায় কাহিনী উপকাহিনীর লাইগা আমি বাল্মিকীর নামে প্রচলিত প্রাদেশিক-আঞ্চলিক রামায়ণের আখ্যানগুলার লগে উপজাতি রামায়ণ আখ্যানগুলাও হাতড়াইছি। নির্ভর করছি প্রচলিত বেদ উপনিষদ এবং পুরাণ সংগ্রহে…
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কালীপ্রসন্ন সিংহ আর কাশীরাম দাসের বাংলা মহাভারত থাইকা ঘটনা উল্লেখ করলেও বুঝতে সুবিধাজনক বইলা কোটেশনের লাইগা বাইছা নিছি রাজশেখর বসুর গদ্য অনুবাদের সংক্ষিপ্ত মহাভারত ও রামায়ণ…
যুক্তিটুক্তি দেখাইতে গিয়া যেইখানে যার নামে ঠ্যাক দিছি; চেষ্টা করছি সেইখানেই বইপুস্তকের নাম বইলা দিতে। তবে কমপক্ষে যেইসব পুঁথিপুস্তক ঘাঁটাঘাঁটি করা থাকলে এই আলোচনার কথাবার্তাগুলা বাজাইয়া দেখতে সুবিধা হবে সেইগুলার মইদ্যে আছে কেদারনাথ মজুমদারের রামায়ণের সমাজ; রোমিলা থাপারের ভারতবর্ষের ইতিহাস; নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ীর বাল্মিকীর রাম ও রামায়ণ, মহাভারতের ভারতযুদ্ধ এবং কৃষ্ণ; বিপ্লব মাজীর বাল্মিকী রামায়ণে রাম- আদিবাসী রামায়ণে রাম; অতুল সুরের ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, মহাভারত ও সিন্ধু সভ্যতা, ভারতের বিবাহের ইতিহাস; সুকুমারী ভট্টাচার্যের প্রবন্ধ সংগ্রহ; ভবানীপ্রসাদ সাহুর ধর্মের উৎস সন্ধানে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কৃষ্ণ চরিত্র, শ্রীমদভগবদগীতা; বুদ্ধদেব বসুর মহাভারতের কথা; শিশির কুমার সেনের মহাভারতের মূল কাহিনি ও বিবিধ প্রসঙ্গ; জয়ন্তানুজ বন্দোপাধ্যায়ের ধর্ম ও প্রগতি; হরপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের রামায়ণ: খোলা চোখে, কৃষ্ণ কাহিনী মহাভারত…
ক. মহাভারতের কৃষ্ণায়ণ এবং রামের বৈষ্ণবায়ন
জনপ্রিয় ধারণায় রাম-রামায়ণ-বাল্মিকীরে কৃষ্ণ-মহাভারত-দ্বৈপায়ন থাইকা প্রাচীন ভাবা হইলেও ঘটনা কিন্তু ঠিক উল্টা। এর পক্ষে পয়লা জোরালো যুক্তিটা হইল দক্ষিণ দিকে আর্যগো ভারত বিস্তারের কালক্রমের লগে দখলি-মানচিত্রের হিসাব। মহাভারতের ঘটনাস্থল থাইকা রামায়ণ ঘটনাস্থল আরো বহুত পূর্ব দিকে। আর্যগো দক্ষিণ দিকে পা বাড়াইবার ঐতিহাসিক সময়কাল মাথায় রাইখা রমিলা থাপারও মন্তব্য করেন যে রামায়ণ তৈরি হইছে ৮০০খিপূর অন্তত পঞ্চাশ থাইকা একশো বছর পরে। মানে সাড়ে সাত থাইকা সাতশো খিপূর দিকে…
রমিলা থাপারের এই যুক্তিটা অতুল সুরও সমর্থন করেন। আর্য-যাত্রার সময়কালের লগে আর্যগো ভূগোল-পরিক্রমা নিয়া যারা কাজ করেন তাগো প্রায় সকলেরই হিসাব নিকাশ প্রায় এক। সকলেই মোটামুটি একমত যে কুরু-পাঞ্চাল এলাকাই হইল পয়লাবারের মতো আর্যগো সাম্রাজ্য স্থাপনের নিদর্শন; যেইখান থাইকা অযোধ্যা কিংবা কোশলের মতো দক্ষিণের ভূমি পর্যন্ত পৌঁছাইতে আর্যগো সময় লাগছে আরো কয়েক শো থাইকা হাজার বছর…
বাল্মিকীরে রামায়ণের সক্রিয় চরিত্র ধইরা রামায়ণ বিচার করতে গেলে রামায়ণের প্রাচীনত্ব কইমা আসে আরো কয়েকশো বছর। কারণ ঐতিহাসিকভাবে ধরা হয় বাল্মিকী খিপূ পাঁচ থাইকা চাইর শতাব্দির মানুষ। এমন কি বিপ্লব মাজীর মতো কেউ কেউ কন যে সংস্কৃতে রামকথার সব থিকা প্রাচীন নিদর্শন ভট্টিকাব্য। এবং বাল্মিকীর রামায়ণ রচনার আগেই কালিদাস তার রঘুবংশ লিখা ফালাইছিলেন। মানে বাল্মিকী কালিদাসেরও পরের মানুষ। রামায়ণে বাল্মিকীর উপস্থিতি সঠিক ধইরা নিতে গেলে তার পোলার বয়েসি রামের বয়সও কইমা আসে আরো বেশ কিছু। আর রামেরে অবতার ধরতে গেলে সেই হিসাবটা চইলা আসে আরো বহু বহু কাছে; বৌদ্ধ বিপ্লবের পরে আর খ্রিস্ট জন্মের সামান্য কিছু আগে। কারণ ধর্মের উৎস সন্ধানে বইয়ে ভবানীপ্রসাদ সাহু কন রামেরে অবতার হিসাবে পরিচিত করানো হইছে আর্যগো দক্ষিণ দিকের যাত্রার সময়; গুপ্ত যুগে…
অন্যদিকে মহাভারতের পাণ্ডবগো সপ্তম পুরুষের রাজত্বকালীন হস্তিনাপুরের কিছু নিদর্শনের বয়স মোটামুটি নির্ধারিত হইছে খিপু ৮০০’র মতো। এইটারে ধইরা রমিলা থাপার তার ভারতবর্ষের ইতিহাস পুস্তকে কুরুযুদ্ধের সময় নির্ধারণ করেন ৯০০খিপূ। বেশিরভাগের হিসাবে মহাভারত কমবেশি এক হাজার খিপু সালের ঘটনা। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হিসাবে কুরুযুদ্ধ হইছে ১৪৩০খিপূ সালে। অতুল সুর তার মহাভারত ও সিন্ধু সভ্যতা পুস্তকে বিশ্লেষণ কইরা দেখান যে প্রাচীন দুই গণিতবিদ আর্য ভট্ট আর বরাহ মিহিরের গণনায় যুধিষ্ঠিরের রাজ্য অভিষেকের সময় গিয়া খাড়ায় ২৪৪৮ খিপূ সাল। আর্যভট্ট-বরাহ মিহির কুরুযুদ্ধ নিয়া কিছু কন নাই আর সাক্ষী প্রমাণের অভাবে অতুল সুর কুরুযুদ্ধের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। কুরুযুদ্ধ বিশ্বাসীরা চাইলে এই তারিখ থাইকা তিরিশ বচ্ছর বিয়োগ দিয়া কুরুযুদ্ধের সাল বাইর কইরা নিতে পারেন…
এর বাইরে জনপ্রিয় প্রচলিত ধারণামতে মহাভারতের সময়কাল ৩১০০খিপূর কাছাকাছি। কিন্তু আর্যভট্ট-বরাহ মিহিরদের হিসাব কিংবা মহাভারতের আরো প্রাচীনত্বের দাবি মানতে গেলে আরেকটা বিকট ঝামেলায় পড়তে হয়। সেই ক্ষেত্রে মাইনা নিতে হয় যে মহাভারতের ঘটনা ঘটছে ভারতবর্ষে আর্যগো আগমন এবং ঋগবেদ তৈরির দেড় দুই হাজার বচ্ছর আগেই। সেইটা মানার যুক্তি আছে বইলা মনে হয় না। কারণ মহাভারতের চরিত্রগুলারে অন্তত প্রাক-আর্য হরপ্পা মহেঞ্জোদারোর মানুষ ভাবা প্রায় অসম্ভব…
ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম দিকে ঢোকা ইরানি মানুষ বা আর্যগো পয়লা দলের যে আগমন। ক্যালেন্ডার পাওয়া যায় তা সর্বোচ্চ ১৫০০ খিপূ সাল। ঘোড়ায় চইড়া প্রথমে আফগানিস্তানে ঢোকা এই ইরানিরাই নিজেগো আদিভূমি থাইকা স্মৃতিতে নিয়া আসছিল ঋগবেদের কিছু শ্লোক। পরে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে পাঞ্জাবে থিতু হইয়া আদিভূমির স্মৃতির লগে পাঞ্জাববাসের অভিজ্ঞতা মিলাইয়া মোটামুটি ঋগবেদরে একটা সাইজে নিয়া আসে; যদিও ঋগবেদ রচনা চলতে থাকে আরো প্রায় হাজারখানেক বছর। মোটামুটি আর্যগো সারা ভারত জয়কালীন পর্যন্ত চলতে থাকে ঋগবেদের সংযোজন পরিবর্ধন। এবং এর লগে লগেই তৈয়ারি হয় আরো দুইখানা কিংবা মতান্তরে তিনখান বেদ…
ভারতে আর্যগো আগমনকালের দিকে তাকাইয়া একটা জিনিস অন্তত নিশ্চিত কইরা বলা যায় যে খিপূ ১৫০০ সালের আগে ভারতবর্ষে বৈদিক কিংবা ইরানি-আর্যভাষাগোষ্ঠী সম্পৃক্ত কোনো ঘটনার কোনো অস্তিত্ব নাই; শাস্ত্রও না; ভগবানও না; রাজা-বাদশা-ঋষি-কবি-যুদ্ধ এইগুলা তো বহুত বহুত দূর। এর আগের বইলা যা কিছু দাবি করা হয় তা সবই মূলত সময় গুণতে না পারা ধর্মবিশ্বাস কিংবা লোকায়ত সাহিত্য…
এই হিসাবে মহাভারত ঘটনার বয়স সংক্রান্ত বঙ্কিমচন্দ্রের হিসাবটাও বাতিল না কইরা উপায় থাকে না। কারণ আর্যগো আগমন কাল থাইকা বঙ্কিমচন্দ্রের হিসাবে কুরুযুদ্ধকালের ব্যবধান সত্তুর বছর। আর হিসাবমতে কুরুযুদ্ধকালে যুধিষ্ঠিরসহ প্রায় সকলের বয়স আছিল কমপক্ষে ষাইটের কাছাকাছি কিংবা বেশি। এই ক্ষেত্রে বঙ্কিমের হিসাব মাইনা নিতে গেলে ধইরা নিতে হইব যে বিদুর পাণ্ডু- ধৃতরাষ্ট্র এদের সকলেরই জন্ম হইছে ভারতে আর্যগো আগমনের আগেই; অন্য কোথাও। তাছাড়া ঋগ্বেদরে যারা অনেক প্রাচীন কইতে চান তারা কন এইটা তৈরি হইছে খিপূ ১৩০০-তে আর যারা এরে আরো নবীন বলেন তারা কন ১২০০ খিপূ; মানে বঙ্কিমচন্দ্রের হিসাবে কুরুযুদ্ধের কমপক্ষে ১৩০ কিংবা ২৩০ বছর পরে…
মহাভারতরে ঋগবেদের আগের ঘটনা ভাবা কঠিন। কারণ ঋগবেদ যেখানে বেশ ভালো কইরাই আর্যগো ছোটখাটো ঘটনাবলীর ডায়েরি কইরা গেছে সেইখানে কিন্তু মহাভারত ঘটনার কিছুই নাই। আবার এইটাও সইত্য যে মহাভারত কাহিনিতে কিন্তু কিছু বৈদিক দেবতার অগোছালো উপস্থিতি ছাড়া বৈদিক সিস্টেমের প্রভাব প্রায় কিছুই নাই। আবার মহাভারতে বৈদিক দেবতাগো যে উপস্থিতি তাতে এইটারে বৈদিক দেবতাগো দাপটের কাল না কইয়া পতনকালের সময় হিসাবেই ধরবার যুক্তি বেশি মনে হয়। সেইখানে সূর্য আইসা কিশোরী কুন্তীর খেলায় সঙ্গ দেন; অগ্নী আইসা ভিক্ষা করেন কৃষ্ণ-অর্জুনের কাছে। দেবরাজ ইন্দ্র অর্জুনের কাছে মাইর খাইয়া পরে কুরুযুদ্ধে অর্জুনের ফুটফরমাস খাটেন। অথচ অন্যদিকে পাণ্ডবপক্ষের অর্জুন কিংবা কুরুপক্ষের অশ্বত্থামা কারো পক্ষেই কার্যকর বীরত্ব দেখানো সম্ভব হয় না বৈদিক সমাজে আত্মীকৃত নতুন অনার্য দেবতা শিবের আশীর্বাদ ছাড়া…
অবশ্য হিসাব মতে মহাভারতে বৈদিক দেবতার উপস্থিতি; মানে কুন্তীরে গর্ভবতী করা থাইকা কর্ণের অক্ষয় কবচ চুরি আর অবৈদিক দেবতা শিবের ভূমিকা; মানে দ্রৌপদীরে পাঁচ স্বামী দান করা থাইকা পাঁচ পোলা হত্যায় ইন্ধন দেয়া; দুইটার কোনোটাই আদি মহাভারতের অংশ না। দুই ধরনের দেবতার উপস্থিতিই পরবর্তীকালের ইনজেকশন। কিন্তু ইনজেকশনের ধরন দেইখাই সেইখানে বৈদিক দেবতাগো পতনকাল আর শিবের উত্থানকালের নিদর্শন কিন্তু অনুমান করা যায়…
আবার অন্যদিকে দ্বৈপায়নের মতো অনার্যগর্ভজাত এক ঋষি ছাড়া পুরা মহাভারত কিন্তু সম্পূর্ণভাবে সাধারণ ব্রাহ্মণগো দাপটমুক্ত আখ্যান। তবে দ্বৈপায়ন সেইখানে ঋষি হিসাবে নাকি কুরু-পাণ্ডবের পিতামহ হিসাবে সম্মানিত সেইটা কিন্তু বিতর্কের বিষয়…
সাধারণভাবে ব্রাহ্মণসেবা বা বামুন বন্দনা বলতে যা বোঝায় তার অস্তিত্ব মহাভারতে নাই। মহাভারতে পুরোহিত বামুনগো এক্কেবারে নিচু স্তরের রাজকর্মচারী ছাড়া অন্যকিছু ভাবা কঠিন। সম্রাট ধৃতরাষ্ট্রের পুরোহিত কৃপাচার্য শান্তনু পরিবারে পালিত এক না খাওয়া ঘরের সন্তান। ধৃতরাষ্ট্রের দূত সূতপুত্র সঞ্জয়রে আমরা সম্রাটের লগে যতটা বড়ো গলায় কথা কইতে দেখি কৃপাচার্যরে তার কণামাত্রও দেখি না। তিনি আগাগোড়া তলুয়া হিসাবেই আচরণ করেন। যুধিষ্ঠিরের পুরোহিত ধৌম্যরে পাণ্ডবগো পিছে পিছে ঘটিধরা মানুষ ছাড়া অন্য কিছু ভাবার সুযোগ নাই…
মহাভারতে আরেকজন রাজকীয় পুরোহিতের দেখা পাই; পাঞ্চাল রাজ দ্রুপদের পুরোহিত; যে পয়লাবার শান্তি প্রস্তাব নিয়া হস্তিনাপুর যায়। কিন্তু দ্রপদ যেইভাবে তারে কাজ বুঝাইয়া দিছেন আর রাজসভায় তারে যেইভাবে ভীষ্ম এমনকি কর্ণ পর্যন্ত ঝাড়ি দেয়; তাতে তার সামাজিক অবস্থান যে কোনোভাবেই উপরের দিকে না তা কিন্তু এক্কেবারে পরিষ্কার হইয়া যায়। উল্টাদিকে রামায়ণে বিশ্বামিত্র-বশিষ্ঠগো দাপট ছাড়াও গৌতমপুত্র তরুণ শতানন্দ যেই রকম ব্যক্তিত্ব নিয়া রাজার লগে কথা কয়; তাতে নিশ্চিত ধইরা নিতে হয় যে রামায়ণ সমাজে পুরোত বামুনের স্থান যেকোনো মন্ত্রী থাইকাও উপরে…
অন্যদিকে বুদ্ধদেব বসু আমাগো মনে করাইয়া দেন যে মহাভারতে একবারের লাইগাও কিন্তু কৃষ্ণের মুখে বামুন বন্দনা কিংবা শূদ্র নিন্দার কথা শোনা যায় না। মানে মহাভারত যুগ পর্যন্ত এই দুইটার কোনোটাই আছিল না। এর আরেকটা প্রমাণ যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে কুন্তীর আয়োজনে নয় পুত্রবধূর এক্কেবারে মাঝখানের আসনে শূদ্রেতর অনার্য নারী হিড়িম্বারে বসানোর ঘটনা থাইকাও আমরা পাইতে পারি…
কৃষ্ণভক্ত বামুন বঙ্কিমচন্দ্র যেইখানে খালি শূদ্রঘরে জন্মাইবার কারণে শূদ্রগো ছ্যা ছ্যা কইয়া তার ভগবদগীতায় ঘিন্না করেন; সেইখানে বঙ্কিমের ভগবান কৃষ্ণ কোনো শূদ্রনিন্দাই করেন নাই; কারণ চতুবর্ণ জিনিসটা মহাভারতের আরো প্রায় পাঁচশো বছর পরে বঙ্কিমচন্দ্রের মতো বামুনগো হাতে আবিষ্কৃত জিনিস। মহাভারতে যা আছে তা কিন্তু ব্যক্তির বন্দনা কিংবা নিন্দা; সেইটা তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের লাইগাই। তার জাতের লাইগা না। সেইখানে পরের ঘরের বৌ টানাটানি করার লাইগা ভরদ্বাজের মতো ঋষি বামুনের পোলারে আমরা পাব্লিকের হাতে পিটানি খাইয়া মরতে দেখি। অস্ত্র চুরির লাইগা সন্ন্যাসী বামুনরে ভীমের হাতে কিল খাইয়া মরতেও দেখি। তেমনি বিনাবাক্যে সকলরেই দেখি মাইমল কন্যা সত্যবতীর পোলা দ্বৈপায়নের কথা মাথা পাইতা নিতে…
বামুনরা ধীরে ধীরেই তাগো পরখাউকি পদ সুরক্ষিত করছে রাজতন্ত্রের ভিতর। বহুত বহুত সময় লাগছে এতে। বেদ প্রচার-যজ্ঞ- উপনিষদ-পুরাণ-গীতা এমনকি পূজা পদ্ধতি প্রচলন হওয়া পর্যন্ত চলছে বামুনগো অবস্থান নিশ্চিতকরণের প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ারে মাথায় রাইখা মহাভারতের দিকে তাকাইলে এইটা অন্তত মনে হয় যে মহাভারতকালে অগোছালোভাবে ঋগবেদ এবং হয়ত অন্য বেদগুলার কিছু কিছু বিধান বা শ্লোক প্রচলিত থাকলেও বৈদিক সিস্টেমের লাঠিটারে বামুনরা তখনো ঠিকমতো জুইত কইরা ধরতে পারে নাই। যেইটা রামায়ণ সময়ে আইসা মোটামুটি পোক্ত কইরা ধরছে তারা…
মহাভারত সময়ে বেদের শ্লোকগুলা অগোছালো অবস্থায় থাকার একটা ইংগিত মহাভারত রচয়িতার জীবনীতেই আছে। সেইখানেই কওয়া হইছে যে অগোছালো বেদগুলারে দ্বৈপায়নই পয়লা গুছায়া সংকলন করেন। সুকুমারী ভট্টাচার্যের ভাষায় ‘শাস্ত্রে ব্যাসের মৃত্যুর কথা লেখে না’ মাইনা নিলেও সত্য হইল যে দ্বৈপায়নের জীবনী রচনা করা হইছে তিনি মইরা যাবার অন্তত ছয়-সাতশো বছর পরে…
রামায়ণরে মহাভারতের পরের আখ্যান কইতে গেলে সব থিকা বড়ো বাধাটা আসে অবতারবাদী বৈষ্ণবগো কাছ থিকা। তাগো হিসাব মতে রাম বিষ্ণুর সপ্তম আর কৃষ্ণ হইলেন অষ্টম অবতার…
অবতারবাদী ধারণামতে বিষ্ণুর দশজন অবতারের মইদ্যে নয়জন আইসা গেছেন আর ভবিষ্যতে কল্কি অবতার নামে আরো একজন আসবেন। তবে আইসা পড়া নয় অবতারের তালিকায় কিন্তু ভিন্নতা আছে…
তালিকায় বিষ্ণুর অবতারগো মইদ্যে পয়লা তিন অবতার মাছ-কচ্ছপ-শূওর। চতুর্থ অবতার আধা মানুষ আধা সিংহ। পঞ্চম অবতার এক অপূর্ণ বা বাইট্টা মানুষ। বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার হইলেন ভার্গব বংশের পরশুরাম; পয়লাবারের মতো এক পূর্ণ মানুষ। এই তালিকার সাত নম্বরে রাম আট নম্বরে কৃষ্ণ। যদিও ছয় নম্বর পরশুরামরে আমরা সাত আর আট নম্বরের সময়ও কুড়াল হাতে নিয়া ঘুরাঘুরি করতে দেখি…
অবতার তালিকার নয় নম্বরে দক্ষিণ ভারতীয় তালিকায় আছে কৃষ্ণের ভাই বলরামের নাম। অন্যসব তালিকায় বলরামের জায়গায় গৌতম বুদ্ধ। আবার গৌড়ীয় আর নিম্বার্ক এর মতো মধ্যযুগীয় বৈষ্ণবগো তালিকায় অবতার হিসাবে কৃষ্ণর নাম নাই। এইসব মতে কৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান; কৃষ্ণ শুধু অন্যান্য অবতারগো উৎসই না; স্বয়ং বিষ্ণুরও উৎস তিনি…
কৃষ্ণ বিষ্ণুর উৎস কথাটারে সোজা বাংলায় অনুবাদ করলে কিন্তু খাড়ায় যে বিষ্ণু বা নারায়ণের সৃষ্টিকর্তা হইলেন কৃষ্ণ। বেদে বিষ্ণু বা নারায়ণের কোনো অস্তিত্বই নাই। যদিও বেদের কয়েকজন বসু কিংবা সূর্যর লগে বিষ্ণু বা নারায়ণের সম্পর্ক দেখানোর একটা চেষ্টা করা হয়; কিন্তু বেদে বসুরা যেমন নগণ্য দেবতা তেমনি সূর্যও তাই। মূলত ব্রহ্মা এবং শিবের মতো নারায়ণ বা বিষ্ণুও অবৈদিক লৌকিক দেবতা…
ঠিক এই জায়গাটায় সুকুমারী ভট্টাচার্য আর নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর রচনা সামারি করলে কিন্তু সরাসরি বইলা দেয়া যায় যে- আইজকার ভগবান নারায়ণ বা বিষ্ণুর সৃষ্টি হইছে স্বয়ং বাসুদেবপুত্র কৃষ্ণ এবং তার ভার্গব বংশজাত আত্মীয় স্বজনের হাতে। কৃষ্ণ দ্বারা নারায়ণী বা ভাগবতী বা পাঞ্চজন্য ধর্মের প্রচার আর তার সংকলন হিসাবে ভগবৎগীতা রচনা; সব কিছুই ঘটছে তথাকথিত কুরুযুদ্ধের পরে…
কৃষ্ণের বুদ্ধিতে কুরুযুদ্ধ জয় কইরা সম্রাট হইবার পর যুধিষ্ঠির কিন্তু কৃষ্ণরে ফালায়া দেয়। বলতে গেলে হস্তিনাপুর থাইকা খেদাইয়াই দেয়। রাজসূয় যজ্ঞে যেই কৃষ্ণরে যুধিষ্ঠির দেবতার অর্ঘ্য দেয়; সম্রাট হইবার পর তার অশ্বমেধ যজ্ঞে সেই কৃষ্ণরে নিমন্ত্রণখান পর্যন্ত করে না যুধিষ্ঠির। এই পর্বে যুধিষ্ঠির পুরাই চইলা যায় কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের কব্জায়। এই নিয়া ভাইয়েগো মাঝে গ্যাঞ্জামও হয়। যুধিষ্ঠিরের লগে গ্যাঞ্জামে অর্জুন ভিন্নভাতে বাস করতে থাকে ইন্দ্রপ্রস্থ গিয়া। আর বাকি তিন ভাই থাকে সম্রাটের লগে হস্তিনাপুর। এই পর্বে পাণ্ডবগো মাঝে কৃষ্ণের যোগাযোগ থাকে একমাত্র তার বন্ধু আর বইনের জামাই অর্জুনের লগে। যুধিষ্ঠিরের সাথে এক্কেবারেই না। এর পিছনে কিন্তু মূল কাঠি নাড়েন বেদজ্ঞ কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন…
কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন কৃষ্ণরে বেদবিরোধী মানুষ বইলাই প্রচার করতেন। এই পর্বটারে অনেকে কৃষ্ণের পতন কইলেও সেইটাই কিন্তু কৃষ্ণ-জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অধ্যায়। কারণ হস্তিানপুর থাইকা বহিস্কৃত হইবার পরেই অন্য এক পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করে কৃষ্ণ। যুদ্ধমুদ্ধ বাদ্দিয়া কৃষ্ণ শুরু করে ধর্মের প্রচার। ভক্তিবাদী ধর্ম। নারায়ণী অথবা ভাগবতী অথবা পঞ্চরাত্র। বহুত সম্পাদনা আর সংযোজন বিয়োজনের পর সেইটারই আজকের পুস্তক ভার্সন হইল গীতা আর প্রায়োগিক ভার্সন হইল বৈষ্ণব ধর্ম…
গীতারে বর্তমানে বেদ উত্তীর্ণ দর্শন হিসাবে সাফাই দিয়া বেদের লগে লাইনআপ করা হইলেও গীতা মূলত বেদবিরুদ্ধ দর্শন। যার লাইগা ঘাটে ঘাটে কৃষ্ণের এই দর্শন বাধাপ্রাপ্ত হয় দ্বৈপায়নের কাছে। কৃষ্ণের ধর্মপ্রচার থামাইতে না পাইরা পুরা যাদব বংশটারেই নির্বংশ কইরা দেন বেদব্যাস কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। মহাভারতে নারদ টারদের যেইসব অভিশাপে যাদবকূল ধ্বংস হইবার কথা পাওয়া যায় সেইগুলা ভুয়া। মূলত দ্বৈপায়ন আর তার বেদব্যাস ঘরাণাই যাদব বংশরে নাশ কইরা দেয়…
বড়ো বেঘোরে ধ্বংস হয় কৃষ্ণের বংশ। বড়োই করুণ মৃত্যু ঘটে কৃষ্ণের। বুদ্ধদেব বসুর ভাষায় মানবেতিহাসের হীনতম মৃত্যু। কিন্তু বংশনাশ হইয়া গেলেও কোনোভাবে টিকা থাকে কয়েকটা জিনিস; ভাগবতী বা নারায়ণী ধর্ম; বেদ বিরুদ্ধ ভগবতগীতা; দেবতা হিসাবে নারায়ণের প্রতিষ্ঠা আর নারায়ণ বা বিষ্ণুর প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে যাদব কৃষ্ণ স্বয়ং…
ভাগবতী ভক্তিবাদী দর্শন এক্কেবারে কিন্তু একলা কৃষ্ণের আবিষ্কার না; এর কিছু কিছু উপাদান আগেও আছিল। বিশেষ কইরা এর উপর উপনিষদের ব্রহ্মতত্ত্বের প্রভাব বহুত। তবে ব্রহ্মতত্ত্ব আর বৈষ্ণব ধর্মে বর্তমানে ফারাকের পরিমাণই বরং বেশি। কৃষ্ণ বৈদিক যজ্ঞ-মজ্ঞর স্থলে নিয়া আসেন ভক্তিরে; ধীরে ধীরে তৈরি হইতে থাকে গীতার দর্শন। অবতার জিনিসটা মূলত ভগবানরে নিজের ঘরে নিয়া আইসা ঘনিষ্ঠ হিসাবে অনুভব করানোর কৌশল। এই ভগবান বৈদিক লুজ কারেক্টার দেবতা না; যারে চাইলেই মাইর দেয়া যায়। আবার উপনিষদের নিরাকার ব্রহ্মাও না; যারে দেখাও যায় না ছোঁয়াও যায় না; অনুভব তো দূরের কথা…
উপনিষদের নিরাকার ব্রহ্ম কিন্তু কোনো বামুনের উদ্ভাবন না; একজন রাজার উদ্ভাবন। ক্ষত্রিয় রাজা প্রবাহণ তার নিরাকার ব্রহ্মারে পরিচয় করানোর লাইগা শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করেন ঋষি উদ্দালক আরুণীরে। প্রবাহণের ব্রহ্মতত্ত্বরে প্রচার করার লাইগাই ঋষি উদ্দালক তার পোলা শ্বেতকেতুরে নিয়া শুরু করেন উপনিষদ রচনা। উপনিষদ রচনা কিন্তু চলতে থাকে মোটামুটি খিপূ তৃতীয় শতক পর্যন্ত। মানে বৌদ্ধ ধর্ম আর বৈষ্ণব ধর্মের সমান্তরালে বহু বছর। কিন্তু এর মইদ্যেই বৈষ্ণব ধর্ম ছাপাইয়া উঠে বৈদিক-উপনিষেদিক কিংবা শৈবধর্মসহ বর্তমান হিন্দুবাদী অন্য সকল ধর্মের উপরে। আত্মা কর্মফল ভক্তি এই উপাদানগুলারে মিলায়া মিশায়া গেরস্থ কিংবা সন্ন্যাসী সকল ভক্তের কাছে ফলাফলহীন ভক্তি প্রত্যাশা কইরা কৃষ্ণ নিজেরে স্থাপন কইরা দেন স্বয়ং ভগবানের স্থানে; নারায়ণ; বিষ্ণু…
কৃষ্ণর ধর্মপ্রতিষ্ঠায় কৃষ্ণউত্তরকালে মূল কামটা করেন ভার্গববংশজাত তার আত্মীয়েরা। যে দ্বৈপায়ন গীতার বিরোধীতা করছেন; ভার্গবরা সেই গীতারেই নিয়া ঢুকাইয়া দেয় দ্বৈপায়নের মহাভারতের ভিতর। রচনা করে কুরুযুদ্ধের আখ্যান। আগাগোড়া বদলাইয়া দেয় মহাভারতের অধ্যায় কাহিনি এবং পুরা মহাভারতটারেই পরিণত করে কৃষ্ণ কাহিনিতে…
বেদ ছাইড়া কৃষ্ণরে স্বয়ং ভগবানের আসন দিয়া বৈষ্ণব ধর্ম ছড়াইয়া পড়ে বেদোত্তর কালে।
অবতারবাদীরা অবশ্য কৃষ্ণরে ভগবান না বইলা সিরিয়ালি অবতারগো মাঝে সব শেষে রাইখা বৈষ্ণব ধর্মরে পোক্ত করেন। কৃষ্ণরে আইসা পড়া নয় অবতারের শেষে রাখার উদ্দেশ্য হইল এর পরে যাতে আর কেউ কৃষ্ণকথার উপর খবরদারি করতে না পারে। অনেকটা নবী মোহাম্মদের পুরানা সকল নবীরে একটা কইরা সালাম দিয়া নিজেরে শেষ নবী ঘোষণা কইরা নতুন নবী আসার দরজায় পেরেক মাইরা দিবার মতো। তবে মোহাম্মদ যেমন ভবিষ্যতে একজন ইমাম মেহদি আসার একটা চিপা রাস্তা খোলা রাখছেন; তেমনি অবতারবাদীরাও একটা চিপা রাস্তা খুইলা রাখছে ভবিষ্যতে একজন কল্কি অবতার আসার লাইগা। কিন্তু এইটাও নিশ্চিত যে এখন কল্কি অবতার কইয়া কারো আর খাড়াইবার প্রায় কোনো চান্স নাই এই জটিল মনস্তাত্ত্বিক যুগে…
প্রশ্ন হইল অবতার হিসাবে কৃষ্ণের পরে রামের দরকার হইল ক্যান? অবতারের তালিকার দিকে তাকাইলে একটা জিনিস পরিষ্কার হইয়া যায় যে সেই তালিকায় কৃষ্ণের আগে যাগো নাম পাওয়া যায় তাগো মাঝে কৃষ্ণ ছাড়া কেউই কীর্তিমান না। সিরিয়ালি পয়লা চাইর জন এমনকি মানুষও না; বরং তারা মাছ কচ্ছপ শুওর আর সিংহ। অবতারের তালিকায় পয়লা যে মানুষের দেখা মিলে সে আবার বামন কিংবা অপূর্ণ মানুষ। তালিকার ছয় নম্বরে একজন পূর্ণ মানুষের নাম পাইলেও সেই পরশুরামের আদৌ কী বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে তা খুইজা বাইর করা মুশকিল। পরশুরামের যা গল্প পাওয়া যায় তার মইদ্যে আছে বাপের মরার প্রতিশোধ নিতে একুশখান বেহুদা হত্যাযজ্ঞের কাহিনি। আর আছে অস্ত্র শিক্ষার ইস্কুল চালানো। আর তার লগে আছে নিজের মায়েরে খুন করার মতো মাতৃঘাতী অপবাদ। বৌ নাই; পোলাপান নাই; সমাজ নাই; মানবজাতির উপকারের কোনো রেকর্ডও নাই…
সুকুমারী ভট্টাচার্যের ভাষায় অবতারগো মাঝে কৃষ্ণই একমাত্র ত্রাতা। তার সকল কাজই অন্যের লাইগা। শিশুপালের বাগদত্তা রুক্মিণীরে জোর কইরা বিবাহ করা ছাড়া নিজের শক্তি দিয়া নিজের লাইগা আর কিছু করেন নাই তিনি। বাকি সব কাজ অন্যের লাইগা। রাজা বানাইছেন কিন্তু রাজা হন নাই…
কিন্তু কৃষ্ণ এক নিম্নবর্গের চাষী পরিবারের কালা রংয়ের মানুষ। কোনোভাবেই কোনো রাজবংশের মানুষ না। একজন যোদ্ধা আর বড়োজোর দার্শনিক মাত্র। সবচে বড়ো বিষয় হইল কৃষ্ণের যুদ্ধটা পুরাপুরি বৈদিক সমাজেরই বিপক্ষে বামুনগো সম্মান টম্মান দেখানোর তেমন কোনো উদাহরণ নাই তার। বড়ো বেঘোরে নির্বংশ হইতে হইছে মানুষটারে। তার উপরে তার প্রকাশিত যোদ্ধা আর কূটনীতিবিদের জীবন; যেইখানে ভালো কাম করার থাইকা ভালো কইরা কাম করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ আছিল; যার লাইগা সততা ফততারে কূটনৈতিকের মতো হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করলেও কৃষ্ণের পক্ষে সেইগুলারে মাইনা চলা সম্ভব আছিল না…
কৃষ্ণ সত্যের কথা কইতেন; সততারে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতেন; কিন্তু কোনোভাবেই বলা যাবে যে তিনি আগাগোড়া আছিলেন একজন সৎ মানুষ। এর সাথে আছে তার বেহদ্দ মাতাল বংশের বদনাম; পরের বাগদত্তা টাইনা আনার দুর্নাম; নিজের মামারে খুন করার দুর্নাম; আছে ঘাটে ঘাটে বিবাহের ইতিহাস; পরিবারে নিজের পোলার লগে সৎমায়ের পরকীয়ার কেলেংকারি…
এইসব ঘটনার লগে গোয়ালা আয়ন ঘোষের ভাইগ্নার মামীরে লইয়া টানাটানি আর কদম ডালের বানরামিও যখন এই কৃষ্ণের ঘাড়েই মূর্খ বৈষ্ণব কবিরা চাপায়া দিলো তখন বৈষ্ণব ভার্গবগো দরকার পড়ল নারায়ণের বিতর্কহীন একজন রাজবংশীয় অবতার…
বিষয় হইল ততদিনে ললিত বিস্তারের কল্যাণে গৌতম বুদ্ধের ক্লিন ইমেজ কিন্তু বিশাল ফ্যাক্টর হইয়া উঠছে। বৌদ্ধ বিপ্লবে বামুনধর্মের অবস্থা পুরাই নাজুক। কোথাও কোথাও হিন্দু পণ্ডিতেরা ঘর সামলাইতে গিয়া স্বয়ং বুদ্ধরেই অবতার হিসাবে গ্রহণ কইরা ফালাইছেন। যদিও তখন পর্যন্ত ‘হিন্দু ধর্ম’ কথাটা চালু হয় নাই…
সমস্যা হইল বুদ্ধরে অবতার স্বীকার কইরা হিন্দুধর্ম প্রচার আর প্রচলিত হিন্দু ধর্মের বিপক্ষে বৌদ্ধ ধর্মের অবস্থান দুইটা সম্পূর্ণ দুই মেরুর জিনিস। বৌদ্ধরে হিন্দু অবতার কইলেও বৌদ্ধ ধর্মরে হিন্দু ধর্ম কওয়া সম্ভব না। বরং বৌদ্ধ ধর্ম হিন্দু ধর্মের বিপরীতেই অবস্থান করে। বিশেষত চতুবর্ণ কিংবা জাতপাত কিংবা মাইনসের ঘাড়ে বামুনদের ভূত হইয়া চইড়া বসা; যেইগুলা তখন মাইনসের জীবনরে নরক বানায়া রাখছে। তো এই অবস্থায় বুদ্ধরে পকেটে ঢুকানোর পরেও একজন সম্ভ্রান্ত খাঁটি হিন্দু বা বৈষ্ণব অবতার খুব বেশি জরুরি হইয়া পড়ল; যারে গৌতম বুদ্ধের মতো যেমন সম্ভ্রান্ত বংশের পোলা হইতে হবে; তেমনি তার থাকতে হবে বুদ্ধের কাছাকাছি রাজ্য ত্যাগের ইতিহাস; থাকতে হবে সহজ সরল জীবন যাপন; থাকতে হবে নির্লোভ জীবনী। তবে তারে শেষকালে রাজাও হইতে হবে একটা উপযুক্ত হিন্দুরাষ্ট্রের উদাহরণ প্রতিষ্ঠার লাইগা…
অবতারবাদীরা সম্ভ্রান্ত সেই সম্ভাব্য অবতারের সন্ধান পাইয়া যান বাল্মিকীর পুলস্ত্যবধ কাব্যে। রাজা দশরথের পুত্র রাম। বাপের কথা রাখতে গিয়া রাজ্য ত্যাগ কইরা বনে বনে ত্যাগি চেহারা নিয়া ঘোরে। পাশাপাশি পুলস্ত্য বা রাবণরে হত্যা কইরা পুলস্ত্যবধ কাব্যের বিজেতা নায়ক। চরিত্রখানও বহুত নিষ্কলুষ। বাপের সাড়ে তিনশোটা বৌ থাকার পরেও তার মাত্র এক বৌ। পরবর্তীকালে একজন রাজা। বামুনগো তাবেদার; আদিবাসী মাইরা বামুনের যজ্ঞ করার ব্যবস্থা কইরা দেয়। বামুনগো গ্রামের শত্রু নিধন কইরা দেয়। শূদ্র বেদ পইড়া যাতে বামুনগো ফাঁকি ধরতে না পারে তার লাইগা বিনা প্রশ্নে শূদ্রের মাথা নামায়া ফেলে কোপ দিয়া…
বাল্মিকীর পুলস্ত্যবধ কাব্যের বিজেতারে ধইরা বামুনগো লাইগা দরকারি সকল গুণই চাপানো হয় রামের উপর; অথবা কিছু কিছু আগে থাইকাই থাকে। পয়লা ধাক্কাতেই বাল্মিকীর পুস্তকখানের নাম পুলস্ত্যবধ কাব্য থাইকা বদলাইয়া করা হয় রামায়ণ। মানে পরাজিতের নামে লেখা কাব্যখান এইবার লেখা হইতে থাকে বিজেতা নায়কের নামে। আর নায়কের উপর ক্রমাগত চাপানো হইতে থাকে বৈষ্ণবগো লাইগা দরকারি সকল উপাদান; এমন কি বৌদ্ধ বিরোধিতাও…।
অবতার তালিকায় রাম আর কৃষ্ণের সিরিয়ালের বিষয়ে পৌরাণিক কালচক্রের আরেকটা যুক্তি হাজির করা হয়। বলা হয় রাম তো ত্রেতা যুগের আর কৃষ্ণ দ্বাপর যুগের অবতার। এই যুগ হিসাবটা বড়োই গোলমেলে; এইটা রৈখিক ক্যালেন্ডার না; কালের চক্র। এইসব দ্বাপর ত্রেতা কলি দিয়া কোনো সময়কাল বোঝানো হয় না। কবে থাইকা শুরু আর কবে কোন কালের শেষ তার হিসাব পুরাই ঝাপসা। এই যেমন কোনো এক অতীত কাল থাইকা এখনো চলতে আছে কলিকাল; কিন্তু তার কোনো হিসাব নাই। এইটা নিয়া বেশি ব্যাখ্যায় না যাইয়া খালি কই যে কৃষ্ণভক্ত বঙ্কিমচন্দ্রও এই কালচক্রের হিসাব উড়াইয়া দিছেন; কারো আগ্রহ থাকলে তিনার কৃষ্ণচরিত্র পুস্তকখান দেইখা নিতে পারেন…
রাম আর কৃষ্ণরে যে কালেই অবতার তালিকায় ঢোকানো হউক না ক্যান; মূল বিষয়টা হইল রাম আর কৃষ্ণের সিরিয়াল ঠিক করা হইছে তাগো সময়ের কমপক্ষে হাজার বছর পরে। অবতারের তালিকায় যেই আগে আর যেই পরে থাকুক না ক্যান; ঐতিহাসিক হিসাবে দেখা যায় যে অবতারবাদ জিনিসটাই আবিষ্কার হইছে খ্রিষ্টিয় তৃতীয়-চতুর্থ শতকের দিকে। গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়। এই
অবতারবাদ ধারণাটা মূলত বৌদ্ধ ধর্মের জাতক কাহিনির একটা রূপান্তর। বৌদ্ধগোরে গাইল্লাইতে গাইল্লাইতে পৌরাণিকেরা কিন্তু ক্রমাগতভাবে নিজেগো ধৰ্মরে বৌদ্ধ ধর্মের উপাদানের লগে এডজাস্ট কইরা গেছে। বুদ্ধদেব বসুর ভাষায়- মহাভারত বা রামায়ণে নাস্তিক বলতে সর্বদাই চার্বাকপন্থী বা বৌদ্ধ বোঝানো হইছে। মহাভারতে চার্বাক আছে। কন্ব মুনী কিন্তু চার্বাকপন্থী। আর রামায়ণে আছে বৌদ্ধ; রাজা দশরথের উপদেষ্টা জাবালি বৌদ্ধপন্থী মানুষ…
রামায়ণের সমাজ পুস্তকের লেখক কেদারনাথ মজুমদার পরিষ্কার কইরা কন যে; অবতার তালিকায় রামের অন্তর্ভুক্তি হইছে অবতার হিসাবে গৌতম বুদ্ধের অন্তর্ভুক্তির পরে। গুপ্ত যুগে অবতারের যা ইতিহাস পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় যে সেইখানে অবতার হিসাবে শুধুই বরাহ বা শূকর আর কৃষ্ণের পূজার নিদর্শন আছে; অন্য কেউ না…।
উপনিষদের মতো ব্রহ্মবাদী বা গীতার মতো ভক্তিবাদী দর্শনের মিশ্রণে যে বৈষ্ণব ধর্ম বা পরবর্তীকালে হিন্দুধর্ম তৈয়ারি হইছে; সেইটাতে চার্বাকপন্থা কিন্তু কট্টর নাস্তিক্যবাদ হিসাবে বাদই পইড়া গেছে। ভৃগু মুনীর শালা কপিলের বেদবিরোধী দর্শন ত্যাজ্য হইছে। হীনযান যুগের নাস্তিক্যবাদী বৌদ্ধধর্মও পুরা সাংঘর্ষিক আছিল উপনিষদ আর গীতার উত্তরাধিকারীগো কাছে। কিন্তু কালে কালে বৌদ্ধ ধর্মও সইরা আসে হিন্দুধর্মের কাছাকাছি। বুদ্ধের নাস্তিক্যবাদরে চাপাইয়া থুইয়া স্বয়ং বুদ্ধরে বানায়া ফালানো হয় ভগবান…
এই পুরা প্রক্রিয়াটা; মানে নারায়ণরে ভগবান হিসাবে প্রতিষ্ঠা- কৃষ্ণর প্রতিষ্ঠা-গীতা- অবতারবাদ চতুবর্ণ-বর্ণাশ্রম- মনু সংহিতা এবং মহাভারত- রামায়ণ সম্পাদনা দিয়া আধুনিক হিন্দু ধর্মের সূচনাটা ঘটে মূলত ভার্গব বংশ এবং তাগো আত্মীয় স্বজনের হাতে। মহাভারতকাল পর্যন্ত জাতে ব্রাহ্মণ নামে কিছুর অস্তিত্ব আছিল না। জন্মসূত্রে কেউ বামুন হইত না। কামে হইত। জন্মসূত্রে বামুন হইবার সিস্টেমটাও চালু করে এই ভার্গবেরা; যারা আবার নিজেরাই বামুন আছিল না সকলে; এখনো নাই…
আমরা যে মহাভারত এখন পড়ি; সেইটা এমন এক অজ্ঞাত ব্যক্তির মুখ থাইকা শুনি যিনি উগ্রশ্রবা সৌতির মুখে শুইনা শুইনা আমাদের বর্ণনা করতে আছেন ঘটনাখান- সৌতি আইলেন; পান তামুক খাইলেন তারপর কইলেন যে জন্মেজয়ের যজ্ঞে এই কাহিনি তিনি শুইনা আসছেন; তারপর তিনি কইতে শুরু করলেন সেই কাহিনি। তা তিনি যা কইলেন তা হইল…
এই সৌতি একজন ভার্গব বংশজাত মানুষ। সৌতিরে বলা হয় সূত; যাগো পেশা আছিল পুরাণ কথন অথবা রথ নির্মাণ; ভার্গবেরা প্রায় সকলেই কিন্তু আছিলেন সূত। ভার্গব বংশের প্রতিষ্ঠাতা ভৃগু মুনি স্বয়ং আছিলেন একইসাথে ঋষি-ধনুর্ধর-আর রথের মিস্ত্রি; মানে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় আর শূদ্র তিনটাই। মজার জিনিস হইল মহাভারত পড়লে মনে হয় ভৃগুমুনি বোধহয় ভারতে আসা আর্যগো এক্কেবারে পয়লা প্রজন্মের ঋষি। কিন্তু ঋগবেদ রচয়িতাগো মাঝে ভৃগু হইলেন এক্কেবারে শেষের দিকের ঋষি। আদি বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্রগো থাইকা বহুত প্রজন্ম পরের মানুষ…
বৈদিক আর ভারতীয় পুরাণ এবং সাহিত্য বিষয়ে সুকুমারী ভট্টাচার্যের অতিমানবিক বিশাল গবেষণার মইদ্যে একটা ছোট্ট প্রবন্ধ হইল ‘ভার্গব প্রক্ষেপণের প্রেক্ষাপট’। যাগো বেশি আগ্রহ আছে তারা পইড়া নিতে পারেন; ভৃগুর বংশধররা কেমনে মহাভারতরে কাটাছিড়া করছে। এমনকি কেউ কেউ বলেন আদতে দশ বিশজন মানুষের মাঝে লাঠালাঠি কিলাকিলির যে কুরু-পাঞ্চাল যুদ্ধ হইছিল সেইটাতে জয়ী হইছিল কুরুরাই। পরে সেইটারেই ভার্গবরা কুরু-পাণ্ডব যুদ্ধর আকার দিয়া পাণ্ডবগো জিতায়া দিয়া আজকের কুরুযুদ্ধের আখ্যান তৈয়ারি করছে কৃষ্ণরে স্থাপন করার লাইগা। সুকুমারী ভট্টাচার্যের হিসাবে এই ভার্গব বামুনরাই হইলেন আজকের হিন্দু ধর্মের উদ্ভাবক; শুধু মহাভারত দিয়া না; রামায়ণ এবং মনু সংহিতা দিয়াও। কারণ রামায়ণের বাল্মিকী যেমন ভার্গব; তেমনি মনু সংহিতার রচয়িতাও ভার্গব ঘরানার মানুষ…
দুর্বল হাতে; নিম্নমানের সাহিত্য দক্ষতা আর উচ্চমানের মূর্খতা নিয়া শত শত বছর ধইরা মহাভারত রামায়ণ সম্পদনা পরিবর্তন আর পরিবর্ধনের লাইগা যে বংশটারে সুকুমারী ভট্টাচার্য দায়ী গোষ্ঠী হিসাবে চিহ্নিত করেন; সেই ভার্গব বংশের কিছু কাহিনি আলাপ না করলে ভারতীয় পৌরাণিক আখ্যান তৈরির পিছনের একটা বড়ো বিবেচ্য যেমন বাদ থাইকা যাবে; তেমনি বাদ পইড়া যাবে আধুনিক হিন্দুধর্মের উৎপত্তির বহুত উপাদান…
খিপূ ২০০০ সালের দিকের ঘটনা। তখনো ইরানি বা আর্য মানুষেরা ভারতে ঢোকে নাই। তাগো একটা দল তখন বাস করত বর্তমান তাজাকিস্তানের পশুরজন আর নিম্ন মাদ্ৰজন অঞ্চলে। এই গোষ্ঠীটারে আরেকটা যাযাবর আর্যগোষ্ঠী ইন্দ্র নামে এক সেনাপতির নেতৃত্বে পিটায়া ভিটামাটি থাইকা খেদাইয়া ভূমি-সম্পত্তি আর নারীগো দখল কইরা নেয়। ইন্দ্র কিন্তু তখনো সেনাপতির পদ কিংবা নাম। মাইর খাইয়া পশুরজন থাইকা পলানো মানুষগুলা পরবর্তীকালে পরিচিত হয় পারস্য পারসিক বা পার্সিয়ান নামে…
খুব সম্ভবত সেনাপতি ইন্দ্রের নেতৃত্বে পশুরজনবাসীগো মাইর দেওয়া আর্যরাই পরবর্তীতে ধীরে ধীরে ভারতের মূল দখলটা নেয় আর ধীরে ধীরে এককালের সেনাপতি ইন্দ্রর নামটা কালে কালে পরিণত হয় দেবতাগো রাজার নাম হিসাবে। অন্যদিকে মাইর খাওয়া পশুরজনের লোকজন বা পার্সিয়ানরা দুইদিকে ছড়ায়; একদল আফগানের ব্যাকট্রা বা বহ্বীক থাইকা ইরানের মূল ভূখণ্ড। আরেকদল ব্যকট্রা থাইকা ভারতের মূল ভূখণ্ড…
ভারতে কিংবা ইরানে; কোথাও এই মানুষগুলা কিন্তু ইন্দ্র বাহিনীর হাতে নিজেগোভিটা হারানোর ইতিহাস ভুলতে পারে নাই। ভূমি থাইকা উচ্ছেদ হওয়া এই পশুরজন বা পার্সিয়ানগো স্পিতামা গোত্রের মানুষ হইলেন মুনি ভৃগু; যিনি ভারতভূমিতে ভার্গব বংশের প্রতিষ্ঠাতা। এক হিসাবে বেদের অবহেলিত দেবতা বরুণের পুত্র হইলেন এই ভৃগু মুনি; অন্য দিকে এই বরুণই হইলেন জেন্দাবেস্তার প্রধান দেবতা আহুর মাজদা…
ভৃগুমুনির বড়ো মাইয়া লক্ষ্মী; আখ্যানমতে নারায়ণের স্ত্রী; আইজ পর্যন্ত তিনি দেবী হিসাবে পূজিত হন। তার বড়োপোলা পুলমাগর্ভজাত চ্যাবন মুনি; যিনি ভেষজ-বিদ্যার বিশেষজ্ঞ আছিলেন। আখ্যান বিশ্লেষণ করলে এই চ্যাবনরেই ধইরা নিতে হয় ফুল-ফল-ফসল গ্যাজাইয়া চোয়ানি মদের আবিষ্কারক বা ঋষি সুরা হিসাবে। যিনি মদ বানায়া দুই শিষ্য অশ্বিনীকুমারগো দিয়া ঘোড়ায় দূর দুরান্ত পর্যন্ত চোয়ানি মদের বাণিজ্য করতেন। আরেক হিসাব মতে এই চ্যাবনই আদি বাল্মিকী; রামায়ণের আদি রচনাকার। আদি কবি। তবে অশ্বঘোষের মতে রামায়ণের আদি বাল্মিকী এই চ্যাবনমুনির পোলা…
ভৃগুমুনির দ্বিতীয় পোলা ঋচীক; নিজে তেমন বিখ্যাত ঋষি না; বিবাহসূত্রে তিনি বিশ্বামিত্রের বড়ো বইন সাবিত্রীর স্বামী। তবে ঋচীকের পোলা আর নাতি কিন্তু আবার বিখ্যাত মানুষ। তার পোলা জমদগ্নি আর নাতি পরশুরাম। পরশুরাম অস্ত্রবিদ্যার একটা স্কুলিং এর যেমন প্রতিষ্ঠাতা তেমনি বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার হিসাবেও গণ্য…
ভৃগুমুনির ছোটপোলা উশনা গর্ভজাত শুক্রাচার্য; ভারতীয় পুরাণে সব থিকা বড়ো যুদ্ধ বিশারদ আর শল্য-বিদ্যার বিশেষজ্ঞ। শুক্রাচার্যের আরেক উপাধী কিন্তু কবি…
অঙ্গিরা বংশ সর্বদাই ইন্দ্রের দলে থাকত বইলা ভার্গব শুক্রাচার্য সব সময় থাকতেন অপজিশন; মানে অসুর রাক্ষস আর দানবগো লগে। বেদের কোনো তোয়াক্কা করতেন না তিনি। একলার বুদ্ধি আর কৌশলেই তিনি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলারে টিকাইয়া রাখতেন দেবতাগো আক্রমণের মুখে। তিনি নিজে ব্রাহ্মণ হইয়া; সংহিতামতে নিষিদ্ধ হইবার পরেও নিজের মাইয়া দেবযানীর বিবাহ দেন ক্ষত্রিয় রাজা যযাতির লগে। আর সেই ঘটনার ফল হিসাবেই শুক্রচার্যের মাইয়া দেবযানীর বংশধারায় জন্ম নেন। বাসুদেব কৃষ্ণ…
আবার এই শুক্রাচার্যই নিজের জামাই যযাতিরে ধামকি দিয়া বাধ্য করেন রাক্ষসবংশজাত দাসী শর্মিষ্ঠারে রানির মর্যদা দিতে; যার ধারাবাহিকতায় জন্ম নেয় মহাভারতের শান্তনু পরিবার…
চতুবর্ণের শ্রষ্ঠা মনুও জন্ম নেন এই একই ভার্গব বংশের শাখায়। ভৃগু বংশের আত্মীয়গো মাঝে ভৃগুমুনির শালা কপিল কঠিন বেদবিরোধী হিসাবে পরিচিত। ঋচীকের শালা বিশ্বামিত্র বংশ আগাগোড়াই বশিষ্ঠ ও দ্বৈপায়ন গোত্রের বিরোধী মানুষ…
ভারতের বাইরে এই স্পিতামা গোত্রের আরেকজন মানুষ হইলেন পার্সিয়ান ধর্মের প্রবর্তক জরথুস্ট। জেন্দাবেস্তা আর ঋগবেদ শুধু সমসাময়িক গ্রন্থই না বহুত ভাষা আর শ্লোকও এক। মূলত দুইটারই আদিসূত্র বা আদিবাস একই অঞ্চলে হইবার কারণেই এইটা ঘটছে। কিন্তু জেন্দাবেস্তা বর্ধিত হইছে ইন্দ্র এবং ইন্দ্রসহচরগো নেতিবাচকভাবে চিহ্নিত কইরা। পার্সিয়ানরা আগুনরে খুব পবিত্র মনে করত আর মরা লাশেরে অপবিত্র; কিন্তু ঋষি অঙ্গিরা লাশ পোড়াইবার বিধান দিবার কারণেই ইন্দ্রের লগে লগে তাগো রাগ গিয়া পড়ে অঙ্গিরার উপর। অঙ্গিরার বংশধররা মোটামুটি আগাগোড়াই আছিলেন দেবরাজের রাজকীয় পুরোহিত। আর ভৃগুবংশ অপজিশন। অঙ্গিরা আর ভৃগু এক্কেবারে সমবয়েসি মানুষ…
মাইর খাওয়া একটা গোষ্ঠি যে হাজার বছর ধইরা মাইরের প্রতিশোধ নিয়া বেড়ায় সেইটা এই ভার্গব বংশটার ইতিহাস না পড়লে বোঝা অসম্ভব। বংশটায় এক পাশে যেমন যুদ্ধাস্ত্র আবিষ্কার আর যুদ্ধের ইস্কুল চালাইছেন ভৃগু-শুক্রাচার্য-পরশুরামেরা এবং তাগো আত্মীয় বিশ্বামিত্র কিংবা কপিলেরা; তেমনি অন্যদিকে বিদ্যালয় খুইলা বুদ্ধির যুদ্ধ চালাইছেন জরথুস্ট- চ্যাবন- সৌতি-বাল্মিকী- মনু আর হাজারে হাজার নাম না জানা ভার্গব সন্তান…
ভার্গবগো কোনো অস্ত্রের নিদর্শন আইজ আর নাই। ভার্গব বংশের একটা শাখা; ভিল উপজাতি ছাড়া ভার্গবগো অস্ত্রের কথা আইজ আর স্মরণও করে না কেউ। কিন্তু তাগো বিদ্যার প্রভাবে দুনিয়াতে দুই দুইটা ধর্ম তৈরি হইয়া টিকা আছে আইজ; হিন্দু আর পার্সিয়ান। এই দুইটা ধর্মই সেই ভূমিহারা স্পিতামা গোত্রের ভার্গব মানুষগো অবদান কিংবা আকামের ফল। এরাই লিখছে জেন্দাবেস্তা। লিখছে মনু সংহিতা। লিখছে রামায়ণ আর পুরাই বদলাইয়া দিছে বশিষ্ঠ বংশের হাতে রচিত মহাভারতের ঘটনা এবং কাহিনি…
কাকের বাসায় কোকিলের ছানা পয়দা করার আদর্শ উদাহারণ বোধহয় মহাভারতের থাইকা বড়ো কিছু নাই। বশিষ্ঠগোত্ৰজাত দ্বৈপায়ন পুস্তকখান লিখছিলেন বেদের শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে আর ভার্গবেরা সেইটা এডিট কইরা বানাইয়া থুইছে বেদ বিরোধী ভগবদগীতার ভাণ্ডার…
তবে একটা কথা মাথায় রাখা দরকার। তা হইল ভারতীয় পুরাণের ফেমিলি ট্রি নিশ্চিত কইরা বলা বোধহয় সম্ভব না। ‘ফেমিলি নেট’ হইতে পারে। কারণ এইখানে যে বংশের পরিচয় দেয়া হইছে তাতে একশোটা চ্যালেঞ্জ করা যাইতে পারে। চ্যাবন আদি ভৃগুর পোলা না হইয়া অন্য ভৃগুর পোলাও হইতে পারেন। আবার ঋচীক হইতে পারেন আরেক ভৃগুর পুত। শুক্রাচার্য চ্যাবন বা ঋচীকের ভাই না হইয়া ভাতিজাও হইতে পারেন। ভৃগুরে কবিও বলা হইত। সেই হিসাবে শুক্রাচার্য কবিপুত্র। আবার ভৃগুরে কবিপিতাও বলা হয়। সেই হিসাবে শুক্রাচার্য ভৃগুর নাতি। আবার শুক্রাচার্য নিজেই কবি। সেই হিসাবে…
আবার পরশুরাম ঋচীকের নাতি না হইয়া অন্য কোনো জমদগ্নির পোলাও হইতে পারেন। একইভাবে কপিল মুনি এক হিসাবে যেমন শুক্রাচার্যের মামা; মানে তার সৎভাই চ্যাবনের মামা; ভৃগুর শালা; অন্যদিকে কিন্তু শুক্রাচার্যের এক শিষ্যর নামও চ্যাবন মুনি। এখন কোনজন কেডা?
একইভাবে কোন বিশ্বামিত্র কোন ঋচীকের শালা; সেইটা কিন্তু বাইর করা অসম্ভব। কারণ ঋগবেদের আদি রচয়িতাগো মইধ্যে আছেন আদি বিশ্বামিত্র; যিনি ঋচীকের বাপ ভৃগুরও বহুত পূর্ব প্রজন্মের মানুষ; সুতরাং আদি বিশ্বামিত্র ভৃগুপুত্র ঋচীকের শালা হইবার কথা না। আবার আদি বিশ্বামিত্রের সমসাময়কি বশিষ্ঠ কিন্তু দ্বৈপায়নের বাপের ঠাকুরদা না; দ্বৈপায়নের বাবা পরাশর যেমন অন্য বশিষ্ঠের নাতি তেমনি রামায়ণের বশিষ্ঠ আরেকজন…
হইলে হইতে পারে দ্রোণাচার্যের বাপ ভরদ্বাজ বৃহস্পতি-মমতার সন্তানই না। না হইবারই সম্ভাবনা বেশি। হইলে হইতে পারে দ্রোণপিতা মূলত কোনো ভরদ্বাজী টোলে পড়া বামুন মাত্র; বৃহস্পতির লগে যার কোনো সম্পর্কই নাই। অবশ্য বৃহস্পতি বলতে কোন বৃহস্পতি সেইটাও একটা প্রশ্ন। হাজারো বৃহস্পতির মাঝে ঠিক কোনজন যে অঙ্গিরার মাইজা পোলা সেইটা কিন্তু বাহির করা মুশকিল…
মূলত যারা নিজের নামে ঘরনা তৈরি করতে পারে নাই তারা সকলে আগের বিখ্যাত ফ্যামিলি নেম বা ঘরানার নামে পরিচিত আছিল। বহুত লোক আছিল বৃহস্পতি ভৃগু বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্র বাল্মিকী দ্বৈপায়ন জমদগ্নি ভরদ্বাজ নামে পরিচিত। বহুত লোক শুক্রাচার্য চ্যাবন পরশুরাম কপিল নামে পরিচিত। আর ব্যাস বা বশিষ্ঠ নামে পরিচিত লোকজন তো দিব্যি এখনো আছে…
খ. বেদবিরোধী গীতার বৈদিকায়ন এবং রামায়ণের অতীতযাত্রা
ভারতীয় পুরাণ ঘাইটা ইতিহাস খুঁজতে যাওয়ার সব থিকা বড়ো ঝামেলাটা হইল এইসব পুরাণের রচয়িতা ঋষি কিংবা কবিদের অন্য কোন বিষয়ে কোন জ্ঞান আছিল আর কোন বিষয়ে আছিল না সেইটা নিশ্চিত না হইলেও একটা বিষয় পরিষ্কার যে তাগো মধ্যে বিন্দুমাত্র সময়-সংখ্যা কিংবা ইতিহাস জ্ঞানের কোনো অস্তিত্ব আছিল না; অথবা অদরকারি মনে কইরা তারা এই তিনটা জিনিসের লগে বাচ্চাপোলাপানের মতো খেলানেলা কইরা গেছেন। সময় মাপতে গিয়া তারা ষাইট বচ্ছর আর ষাইট হাজার বচ্ছরে যেমন কোনো ফারাক করেন নাই; তেমনি সৈন্যসংখ্যা একশোরে একশো কোটি কইতেও আপত্তির কিছু দেখেন নাই। একইভাবে নতুন কবিরা যখন সাহিত্য রচনা করছেন কিংবা পুরানা সাহিত্য সম্পাদনা করছেন তখনো কিন্তু আশপাশের ঐতিহাসিক উপাদানগুলারে বাদ দিয়া কোন কালের সেই কল্পিত ঐতিহ্যর লোকস্মৃতি ঢাইলা সাজাইছেন নিজের পুস্তকের সমাজ বাস্তবতা। যার লাইগা দুই হাজার বছর আগের আর পরের সাহিত্যের সমাজচিত্র মূলত কপিপেস্ট ছাড়া কিছু না…
ভারতীয় সংস্কৃতিতে ইতিহাস চর্চার মূল কনসেপ্টাই হইল কাল্পনিক এক সমৃদ্ধ অতীতের কাবিক্য চিত্রকল্প নির্মাণ। অনেকটা শাহ আবদুল করিমের গানের মতো আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম-এর নস্টালজিয়া অথবা জীবনানন্দের মতো কোনো এক শ্রাবস্তির কারুকার্য কল্পনা কইরা তাব্দা খাইয়া বইসা থাকা। সকলেই মনে করে আগের দিনগুলা আছিল বড়োই দারুণ। মূলত এইটা একটা নতুনত্বভীতি আর বুড়ামির প্রতীক। এর লাইগা সকলেই খালি কল্পিত এক আগিলা দিনের সাধনা করে; আর কবিরা সেইটা নতুন কইরা রচনা কইরা আবার প্রচারও করেন নতুনের মতো। কল্পিত রঙিন অতীত নির্মাণের এই বাজে অভ্যাসটা এখনো আছে আমাগো সংস্কৃতির মাঝে। বর্তমান সময়ে রচিত আমাগো গানগুলায় এখনো নদীর পাড়ে বইসা রাখাল বাঁশি বাজায় আর মেয়েরা কলসি নিয়া পানি তুলতে নদীঘাটে যায়। অথচ গত তিন দশক ধইরা যেমন রাখাল পেশাটাই বাংলাদেশ থাইকা নাই হইয়া গেছে আর চল্লিশ বছর ধইরা বাংলাদেশের মানুষ নদীর পানি খাওয়া বন্ধ কইরা দিছে সেইটার কোনো সংবাদ নাই এইসব লোক সাহিত্যের পাতায়…
পুরাণগুলার মইদ্যে যে টুকটাক ইতিহাসের উপাদান পাওয়া যায় সেইগুলা পাওয়া যায় মূলত সাহিত্যে ছড়ানো ঘিন্নার বাক্য কিংবা লেখকের মূর্খতার ফাঁক ধইরা। রামায়ণে যখন রামের মুখ থাইকা জাবালিরে বৌদ্ধ কইয়া গালি শুনি তখন আমাদের বুইঝা নিতে হয় যে; যেই সমাজে বইসা রামায়ণ লেখা হইছে সেই সমাজে তখন বৌদ্ধ বিপ্লবের ঠেলায় বামুনধর্ম বিপন্ন। আবার বিশ্বামিত্রের লগে যুদ্ধ করতে গিয়া যখন বশিষ্ঠের কামধেনুরে যবন সৈন্য উৎপাদন করতে দেখি তখন আমাদের ধইরা নিতে হয় যে মহাভারতের এই বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্র যুদ্ধটা হয় হইছে ভারতে গ্রিকদের আগমণের পর না হয় যারা এই গল্পটা মহাভারত-রামায়ণে ঢুকাইছেন তারা ভারতে গ্রিক অভিবাসনের পরের মানুষ। অথচ ঘটনার বর্ণনাগুলা কিন্তু সেই আদি কাল্পনিক। বশিষ্ঠ সেইখানে যেমন তার আদি কাল্পনিক অলৌকিকত্ব নিয়া বইসা আছেন তেমনি তার কামধেনুও কাল্পনিক; তার অস্ত্রপাতিও কাল্পনিকতার কপি পেস্ট…
মহাভারতে কুরুযুদ্ধ হউক বা না হউক; যুদ্ধ শেষে পাণ্ডবপক্ষ জিতুক বা কুরুপক্ষ জিতুক; যুধিষ্ঠিরের কিন্তু ঐতিহাসিকতা আছে। আর সেই ঐতিহাসিকতার হিসাবে যুধিষ্ঠির ভারতে লোহার ব্যবহার শুরু হইবার আগের যুগের মানুষ। কিন্তু যুধিষ্ঠিররে ঘিরা কবিরা যে কুরুযুদ্ধ রচনা করছেন তাতে পুরা লোহার খনি ঢাইলা দিছেন। পুরা কুরুযুদ্ধখানই লোহার অস্ত্রে ঝনঝন। অথচ যুধিষ্ঠিরের সমসাময়িক মানুষ মইরা গেছে লোহা আবিষ্কাররে বহুত বহুত যুগ আগে; সেই হিসাবটা আছিল না কবিগো মাথায়…
ভারত অঞ্চলে পয়লা শকাব্দ ক্যালেন্ডারটা বহিরাগত কুশানদের দান। আর্যগো কোনো ক্যালেন্ডার জ্ঞান আছিল না। বছর মাস এবং সপ্তা গণনার কোনো ধারণা আছিল না তাগো। সপ্তার সাত দিনের নাম জানত না তারা। কিন্তু সংখ্যা আর গণিতের ধারণা ভারতে বহুত প্রাচীন। তাইলে আর্যগো সাহিত্যে সংখ্যার অত ঘাপলা কেন?
এইটার একটা কারণ হইতে পারে যে আর্যভট্ট সংখ্যা এবং গণিতের যে হিসাব দিয়া বিজ্ঞান চর্চা করতেন কিংবা বরাহমিহির অপবিজ্ঞান চর্চা করতেন; সেইগুলা মূলত সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে আছিল। মানে শতকিয়া সাধারণ লোকজন জানত না। সাধারণ লোকজনের হিসাবের মাধ্যম আছিল গণ্ডাকিয়া; যেইটা মূলত হাত পায়ের আঙুলের সর্বোচ্চ চাইর কি পাঁচ গুণিতকের হিসাব; দশক বা শতকের না; হালি-কুড়ি-গণ্ডা-পণ…
সুকুমারী ভট্টাচার্যের কথা যদি মানি তবে স্বীকার কইরা নিতে হয় যে পুরাণ লেখক বা সম্পাদক কেউই উচ্চ শিক্ষিত মানুষ আছিলেন না; এরা বরং কম শিক্ষিত শ্রেণির পেশাদার দুর্বল লেখকই আছিলেন। বিভিন্ন স্থানীয় সামন্তগো পৃষ্ঠপোষকতায় সেই সামন্তের পূর্ব পুরুষের ইতিহাস রচনা করতে গিয়া কিংবা সেই সামন্তের বিধি বিধানরে ধর্মশাস্ত্রর চেহারা দিতে গিয়া নিজস্ব মূর্খতা আর দুবর্লতা নিয়াই তারা পেশাজীবী হিসাবে এইসব পুরাণ রচনা কইরা গেছেন। এবং তারা নিজেরাও নিজেদের অতই নগণ্য আর ক্ষুদ্র মনে করতেন যে কোনো রচনাতেই নিজের নাম পর্যন্ত দিতেন না; নিজের রচনাগুলারে আগের কোনো বিখ্যাত লেখকের নামে চালায়া দিতেন। পুরাণগুলারে ভজঘট করার লাইগা মূলত দায়ী এইসব দায়িত্বহীন আর অস্তিত্বহীন পেশাদার লেখকের দল। এদের না আছিল ভূগোল জ্ঞান; না সংখ্যা; না ইতিহাস। এগোর থাকার মধ্যে আছিল শুধুই দুর্বলভাবে কিছু একটা কল্পনা করা আর স্থানীয় সামন্তরে খুশি করার ক্ষমতা…
রামায়ণের ঘটনা ঘটছে মহাভারতের পরে; এই কথাটা প্রচলিত যুক্তি আর পৌরাণিক বিশ্বাসের সরাসরি বিরুদ্ধে যায়। প্রচলিত যুক্তি আর বিশ্বাসরে এক্কেবারে উড়ায়া না দিয়া রমিলা থাপার একটা শর্ত জুইড়া দিছেন। তিনি কন- যদি রামায়ণের ঘটনারে মহাভারতের আগে বইলা মাইনা নিতে হয় হয় তবে কিন্তু ধইরা নিতে হবে যে রাম-রাবণের যুদ্ধ আছিল গাঙ্গেয় উপত্যকার কৃষিজীবী আর বিন্ধ্য অঞ্চলের আদিবাসী শিকারী মানুষের যুদ্ধ। পরে কেউ এইটারে আরো দক্ষিণে সরায়া লঙ্কা জুইড়া দিছে। মানে রমিলা থাপারের এই শর্ত মাইনা রামায়ণরে মহাভারতের আগে কইতে গেলে পয়লাই রামায়ণ থাইকা অত ঘটনার লঙ্কাখানই বাদ দিয়া দিতে হয়। আর পণ্ডিতগো কথামতো রামায়ণের আদি রচনাকাল খিপূ৪র্থ শতক ধইরা নিলে লেখক বাল্মিকী আর তার পোলার বয়েসি রামরে কোনোভাবেই গৌতম বুদ্ধের পরের যুগের মানুষ ছাড়া অন্য কিছু ভাবা অসম্ভব…
বাল্মিকীরে চতুর্থ শতাব্দির মানুষ ধইরা নিবার পক্ষে আরো বহুত যুক্তি আছে। এর পয়লাটা হইল রামায়ণের ভাষা। রামায়ণের ভাষা যে আধুনিক সেইটার বিষয়ে বহুত আলোচনা আছে। কারো কারো মতে খিপূ ৪র্থ শতকে পাণিনি যে সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ সংগঠিত করছিলেন; রামায়ণ রচিত হইছে সেই ব্যাকরণ মাইনা। মানে বাল্মিকী পাণিনির পরের মানুষ; যেইটার লগে আবার মিলা যায় বিপ্লব মাজীর দাবি-বাল্মিকী কালিদাসেরও পরের কবি…
অন্য অনেকের মতো কেদারনাথ মজুমদারও কন- রামায়ণের ভাষা মহাভারতের থাইকা অনেক আধুনিক। ছন্দগুলাও আধুনিক। রামায়ণের অনুষ্টুপ ছন্দ বয়সে প্রাচীন হইলেও রামায়ণে ব্যবহৃত অনুষ্টুপ আধুনিক ফর্মে গাঁথা। এই কথা বলার লগে লগে কেদারনাথ মজুমদার বাল্মিকীর আদি কবিত্বের দাবি এক টোকায় উড়ায়া দেন। এক্কেবারে সোজা বাংলায় কইয়া দেন যে বাল্মিকী আদি কবি নহেন। শিকারিতে পক্ষি মাইরা ফালানোয় যে শ্লোকটা তিনার মুখ থাইকা বাইর হইছিল; যেইটারে কওয়া হয় আদি কবিতা। সেইটার ছন্দ বিশ্লেষণ কইরা কেদারনাথ সোজা কন- যে ধরনের অনুষ্টুপ ছন্দে ওই শ্লোকটা লেখা; সেই ছন্দে ঋগবেদ ভরপুর। অনুষ্টুপ ছন্দটা বাল্মিকীর আবিষ্কার। এইটাও ফালতু কথা। তাছাড়া বিষ্ণু পুরাণ রামায়ণের পরে হইলেও সেইখানে কিন্তু কেউ বাল্মিকীরে আদি কবি না কইয়া ব্রহ্মারে কইতেছে আদি কবি। সুতরাং বাল্মিকীর আদি কবিত্ব সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য না…
এই কয়েকটা যুক্তি দিয়া কিন্তু রামায়ণরে মহাভারতের আগে দাবি করার সবগুলা দাবি উড়ায়া দেয়া সম্ভব না। বিষয়গুলা ডিম আগে না মুরগি আগের মতো জট পাকায়া আছে দুইটা পুস্তকে। খোদ রামায়ণের ভিতরেই এমন কিছু উপাদান আছে যেইগুলারে যুক্তিতে গেলে অবশ্যই প্রাচীন উপাদান কইতে হয়…
প্রায় একশো বছর আগে ১৯২৭ সালে অমানবিক পরিশ্রমের গবেষণা কইরা কেদারনাথ মজুমদার রামায়ণের সমাজ নামে একটা বই প্রকাশ করেন ময়মনসিংহ থাইকা। রামায়ণ সোসাইটিরে ধইরা ধইরা সহজ ভাষায় এত ভালো বিশ্লেষণ খুব কমই পাইছি আমি। কেদারনাথ রামায়ণরে মহাভারতের পরের ঘটনা কইতে রাজি না। তিনি বরং মহাভারতরেই রামায়ণের পরের ঘটনা বলেন। তিনি বৈদিক ঘটনার উত্তরাধিকারগুলারে আলোচনা করার লাইগা ঋষি যুগ আর লৌকিক যুগ নামে ক্যালেন্ডাররে দুইটা ভাগে ভাগ করেন…
কেদারনাথের ভাগ অনুযায়ী খিপূ ১০০০ সালের আগের সময় ঋষি যুগ আর খিপূ ১০০০ সালের পর; তার মতে ভারতে গ্রিকদের আগমনের পরের সময়কালরে তিনি বলেন লৌকিক যুগ। তো রামায়ণের সময়কাল আলোচনা করতে গিয়া তিনি রামায়ণের মইদ্যে ঋষি আর লৌকিক দুই যুগের উপাদান নিয়াই আলোচনা করেন। তিনি যদিও রামায়ণের নতুন ঘটনা চিহ্নিত কইরা বলেন যে সেইগুলা পরে প্রক্ষিপ্ত; মানে আদি কাণ্ড আর উত্তরকাণ্ড যখন যোগ হয় তখনকার সংযোজন। তবুও তার তালিকা দুইটা নিরপেক্ষভাবেই খুব সমৃদ্ধ…
তিনি রামায়ণরে মহাভারতের আগে কইতে গিয়া যেইসব যুক্তি দেখান তার মধ্যে তিনি কন যে রাম হইলেন ভারতে লিপি বা লেখা প্রচলিত হইবার আগের যুগের মানুষ। রামায়ণে রামের লেখাপড়া শিক্ষার কোনো বিবরণ নাই। অথচ বুদ্ধদেবের শিশুকালে তার পড়ালেখা শিখার বিবরণ আমরা পাই। অবশ্য মহাভারতেও কারো লেখাপড়া শিখার কোনো উদাহরণ নাই। তিনি বলেন যে রামায়ণে লৌকিক দেবতা; মানে বাল্মিকী রামায়ণে ব্রহ্মা-বিষ্ণু- শিব কিংবা আরো পরের নারী দেবীরা নাই; রামায়ণে আছে খালি বেদের ৩৩ দেবতার কথা। রামায়ণে লিঙ্গপূজা-মূর্তিপুজা নাই। রাময়ণে ৪ বেদের কথা নাই; আছে ৩টা বেদের কথা। মানে লৌকিক যুগে তৈরি হওয়া অথর্ববেদের কথা রামায়ণে নাই। তিনার আরেকটা যুক্তি হইল রামায়ণকালে সপ্তা এবং বারের নাম এবং মাসের গণনা পদ্ধতি চালু হয় নাই। ধাতুর রাসায়নিক বা যৌগ ব্যবহার শুরু হয় নাই তখনো…
রামায়ণের লঙ্কায় গাদা গাদা স্বর্ণের বিষয়ে তিনি সন্দেহ করেন। তিনি কন যে সেইকালে কবিরা স্বর্ণ বস্তুটাই চিনত না। কারণ তারা যদি স্বর্ণ চিনত তাইলে হনুমান পুরা লঙ্কা পুড়াইয়া দিবার পরে আবার অক্ষত স্বর্ণ লঙ্কার বর্ণনা দিত না। স্বর্ণ চিনলে তারা নিশ্চয়ই জানত যে আগুনে পুড়লে স্বর্ণের কী অবস্থা হয়। এর থাইকা তিনি সিদ্ধান্ত করেন যে; হয় সেইযুগে অন্যকিছুরে কবিরা স্বর্ণ কইত; যেইটা আগুনে পুড়লেও গলে না বা বদলায় না; অথবা খাপছাড়াভাবে এইগুলা পরে কেউ ঢুকাইয়া দিছে লঙ্কায়। অবশ্য এর লগে তিনি এইটাও বলেন যে বর্তমান রামায়ণে রাবণের যে দানবীয় চেহারা আমরা দেখি; সেইটা আদৌ বাল্মিকী রামায়ণের রাবণ না। বাল্মিকী রামায়ণের রাবণ এক সাধারণ রাজা…
কেদারনাথ বলেন রামায়ণ সমাজে মেয়েরা সিঁন্দুর পরত না। সকলেই বেদ পড়তে পারত। তখন পর্যন্ত কাঁচ আর পারদের সংমিশ্রণে আয়না প্রস্তুতি শুরু হয় নাই। কোনো ধরনের মুদ্রা আবিষ্কার হয় নাই এবং সমাজে গোত্রপ্রথা চালু হয় নাই…
রামায়ণ সমাজে গোত্র প্রথা চালু হয় নাই এই কথাটার লগে কিন্তু আমার ব্যক্তিগত দ্বিমত যেমন আছে তেমনি সুকুমারী ভট্টাচার্যের গবেষণাও এই বিষয়ে দ্বিমত করে। রামায়ণের সময়কালে বরং ব্রাহ্মণ শূদ্র ক্ষত্রিয় এইগুলা বড়োই প্রকট আছিল…
রামায়ণের প্রাচীনত্বের পক্ষে তিনার আরো যেইসব যুক্তি আছে তার মইদ্যে আছে-কৈকেয়ীরে রাজা দশরথ বর দিতে চাইলে তিনি বহুত দেবতারে ডাইকা সাক্ষী মানেন কিন্তু ব্রহ্মা বিষ্ণু শিবের মতো কোনো দেবতারে ডাকেন না। তেমনি পোলার বিদায়ের সময় মা কৌশল্যা দেবতাগো নাম ধইরা ডাইকা পোলারে রক্ষা করার লাইগা প্রার্থনা করেন; সেইখানে তিনি বহু দেবতা এমনকি বনের পশু পাখির পর্যন্ত শরণাপন্ন হইলেও ব্রহ্মা বিষ্ণু শিবের মতো পৌরাণিক দেবতার নাম নিবার ধারে কাছেও যান না…
রামের বিদায়ের সময় কৌশল্যার বিষ্ণু পূজার একটা বিবরণ বর্তমান রামায়ণগুলায় আছে; কেদারনাথ সরাসরি এইটারে প্রক্ষিপ্ত কইয়া ফালায়া দেন। কেদারনাথ পরিস্কার বইলা দেন যে বুদ্ধদেব যখন হিন্দুর চিন্তায় অবতার তালিকার মইদ্যে ঢোকেন; সেই সময়েই মূলত রামও অবতারের মর্যাদা পান। বৌদ্ধ যুগের পূর্বে রাম বা বৌদ্ধ কেউই হিন্দু সাহিত্যে অবতার বইলা গৃহীত হন নাই; মানে কেদারনাথের হিসাব আর ভবানীপ্রসাদ সাহুর হিসাব প্রায় একই; আর্যগো দাক্ষিণাত্য বিজয়ের কাছাকাছি সময়…
রামায়ণের প্রাচীনত্বের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়া কেদারনাথ কন যে রামায়ণ সমাজে কোনো ঈশ্বর ধারণার অস্তিত্ব নাই। যেইটা বেদেও আছিল না। হিন্দু ধর্মে ঈশ্বর ধারণাটা মূলত রাজা প্রবাহণের উপনিষদভিত্তিক ব্রহ্মতত্ত্বরে ধইরা গীতায় দানা পাকাইছে। এইটা তুলনামূলক নতুন জিনিস। তাছাড়া রামায়ণে আমরা দেখি রাজা জনক নিজে মন্ত্র পইড়া নিজের মাইয়ার বিবাহ সম্পন্ন করতেছেন। এইটা আগের যুগের নিদর্শন; পরবর্তী যুগে এইসব কাম চইলা গেছিল বামুনগো হাতে…
চতুরাশ্রম ধারণার একটা অংশ হইল বাণপ্রস্থ। যেইটা বৌদ্ধ বিপ্লব পরবর্তী একটা সংযোজন। মহাভারতে আমরা এই বাণপ্রস্থের দেখা পাই; যা কোনোভাবেই কিন্তু রামায়ণে নাই। তবে এইটাও ঠিক যে সব নিয়ম একই লগে সব অঞ্চলে চালু হয় নাই বা মানা হয় নাই; হইতও না। মহাভারত আর রাময়ণের রচনাকাল খালি আলাদা না; বরং মানুষগুলার ঐহিত্যও আর ব্যকগ্রাউন্ডও আলাদা। কোনোভাবেই বলা যাবে না যে মহাভারতের সামাজিক নীতি আর রামায়ণের সামাজিক রীতি এক…
কেদারনাথ নিজে রামায়ণরে মহাভারতের আগের ঘটনা হিসাবে সমর্থন করলেও যেইসকল উপাদানের কারণে রামায়ণরে মহাভারতের পরের ঘটনা বইলা সন্দেহ হয় সেইগুলারও একটা বিশাল তালিকা করেন। যেইগুলার মইদ্যে তিনি এইটাও উল্লেখ করেন যে রামায়ণের বিবাহ পদ্ধতি অনেক আধুনিক। মহাভারতে উত্তরার বিবাহের লগে রাম সীতার বিবাহের কিছু মিল আছে। এর বাইরে মহাভারতে বেদ নির্দিষ্ট প্রাচীন পদ্ধতির দেবর-ভাসুর দ্বারা ভাইবৌর গর্ভে সন্তান উৎপাদন এবং এক নারীর একাধিক স্বামী দুইটাই আছে; যা কি না রামায়ণ সমাজে নাই…
বাল্মিকীরে আদি কবি হিসাবে চিহ্নিত করাটা বেশ ঝাপসা বিষয়। কোনোভাবেই মিলে না যে বাল্মিকী আদি কবি। হইলে হইতে পারে রামায়ণের উত্তর কবি; যিনি রামায়ণ এডিট করছেন তিনি রামায়ণ বা পুলস্ত্য বধ কাব্যের প্রথম রচনাকার বুঝাইতে গিয়া বাল্মিকীরে রামায়ণের আদি কবি কইছেন। যেইটা পরে সংক্ষিপ্ত হইয়া খালি আদি কবি হিসাবে টিকা আছে এখন…
রামায়ণ বহুত এডিট হইছে। হইতে হইতে রামায়ণে অবতারবাদ ঢুকছে। ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব ঢুকছে। নারায়ণ পূজার কথা ঢুকছে। লক্ষ্মী মূর্তির বর্ণনা আছে। মনুস্মৃতি আর গৌতম বুদ্ধের কথা ঢুকছে। রাশিচক্র এমনকি মাসের নামও ঢুকছে রামায়ণে। নাম খোদাই করা আংটির কথাও আছে। সমুদ্র বিদ্যার বর্ণনা আছে। বৌদ্ধ যুগের শ্রমণী বা ভিক্ষুণিগো কথাও আছে…
আরো অনেকের মতো এইগুলাও কেদারনাথ তালিকাবদ্ধ করেন। তবে এইগুলা যে আরোপিত আর বহুত পরে ঢোকানো জিনিস সেই বিষয়ে তর্ক করার কোনো যুক্তি নাই। রামায়ণ আর মহাভারত যত আধুনিকই হউক না কেন এইগুলা যে লৌকিক ধর্ম শুরু হইবার পরে কিংবা সংস্কৃত লিপি আবিষ্কার হইবার পরে রচিত হয় নাই সেইটা নিশ্চিত। তবে রামায়ণে বৌদ্ধ বিরোধীতার ঢং দেইখা একটা কথা ফালায়া দেয়া যায় না যে; হইলে হইতে পারে বৌদ্ধ বিপ্লবে হিন্দু ধর্মরে দুরবস্থা থাইকা উদ্ধারের যে সকল প্রচেষ্টা নেয়া হইছিল; তারই একটা ধাপ হইল রামরে অবতার বানানোর লগে লগে এই আধুনিক রামায়ণ রচনা…
রামায়ণের ভাষা মহাভারতের ভাষা থাইকা বহুত আধুনিক। এই একটা বিশ্লেষণ থাইকাই মহাভারতরে রামায়ণ থাইকা পুরানা বইলা ধইরা নেয়া যাইতে পারে; যদি না আরো কিছু ফ্যাক্টর এইখানে হিসাবে আনা হয়…
কথা হইল সংস্কৃত ভাষার কোনো লিখিত রূপ আছিল না বহুত শতাব্দি। মাত্র খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে পাওয়া যায় প্রাচীনতম ভারতীয় লিখিত ভাষার ইতিহাস। তবে সেইটা সংস্কৃত না; পালি ভাষার লিখিত ফর্ম ব্রাহ্মী লিপি; যেইটা দিয়া বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার হইছে; মৌখিকভাবে আবার লিখিতভাবেও। তামিল ব্রাহুই ভাষার লিখিত ইতিহাসও প্রায় সমান। কিন্তু সংস্কৃত ভাষার দেব নাগরী আসে আরো পরে। মূলত বৌদ্ধ ধর্মের লিখিত রূপ দেইখাই সংস্কৃত সাহিত্য কিংবা যোগাযোগে লিখিত ফর্ম ব্যবহার করার লাইগা শুরু হয় দেব নাগরী বা সংস্কৃতের লিখিত ফর্মের যাত্রা। যার মূল কিন্তু গুপ্তযুগের গুপ্ত লিপি। মানে গুপ্ত লিপি থাইকাই উৎপত্তি হইছে সংস্কৃতের লিখিত ফর্ম দেব নাগরির। আর সেইটা পয়লা দিকে আবোল তাবোল চলার পর সংস্কৃতের ব্যবহারিক ব্যকরণ সংগঠিত করেন পাণিনি। এর পর থাইকাই মূলত সংস্কৃত একটা সংগঠিত ভাষা…
কথা হইল সংস্কৃত লিপি আবিষ্কার এবং পাণিনি দ্বারা সংগঠিত হইবার পরেই এই গুপ্ত যুগে লিখিত হইতে থাকে প্রাচীন সব পুস্তকবাবলী; ঋকবেদ থাইকা শুরু কইরা সর্ব সাম্প্রতিক পুরাণ উপখ্যান পর্যন্ত…
এই যুক্তিটারে স্বীকার কইরা রামায়ণের প্রাচীনত্বের পক্ষের লোকজন বলেন- যে রামায়ণ লিখিত হইবার সময় লেখকরা ভাষা বদলাইয়া নতুন নতুন সাম্প্রতিক শব্দবন্ধ ব্যবহার করায় রামায়ণ প্রাচীন হইবার পরেও এর ভাষা নবীন হইয়া গেছে। কিন্তু কথা হইল এই একই সময়ের লেখকরা তো একই সময়ে বইসা স্মৃতি থাইকা ঋকবেদসহ সকল বেদ এবং মহাভারতেরও লিখিত রূপ দিছেন। সেইখানে তো তারা সাম্প্রতিক নতুন শব্দ দিয়া ঋকবেদের ভাষাও পাণিনির ব্যাকারণ অনুযায়ী কইরা দেন নাই। তাইলে শুধু রামায়ণের ক্ষেত্রে এইটা ঘটল কেমনে?
রামায়ণও তো তারা লিখছেন স্মৃতি থাইকা। অবশ্যই কিছু কিছু বাক্য শব্দ তারা বদলাইছেন; কিন্তু এক্কেবারে পুরা কাহিনিটা তারা নতুন ভাষায় অনুবাদ করছেন তা কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য না। সবচে বড়ো কথা রামায়ণ তো একজন কবির একটা কাব্য; মহাভারতের মতো জনজাতির আখ্যানও না; বেশিরভাগ গদ্যও না; যেইখানে যার ইচ্ছা সে কাহিনি ঢুকাইতে পারে। একটা সম্পূর্ণ কাহিনি কাব্যে নতুন শব্দ ঢোকানো অত সহজ না। পুরা নতুন অনুবাদ তো দূরের কথা। আমার হিসাবে লিখিত রূপ পাইবার সময় রামায়ণ নতুন ভাষায় লিখিত হইছে এইটা একটা ল্যাংড়া যুক্তি। মূলত এইটা রচিতই হইছে বহুত পরের সংস্কৃত ভাষায়…
আরেকটা বিষয়; মহাভারতের মূল কাহিনিতেই একটা কথা পরিস্কার যে মহাভারতকার দ্বৈপায়ন লিখতে পারতেন না। তার কোনো শিষ্যর লেখার ইতিহাসও নাই। বহুদিন মুখে মুখে চলার পর। মহাভারতের লিখিত রূপ দিবার লাইগা তাগোরে গিয়া আদিবাসী গণেশরে তেলাইতে হইছে। যে গণেশরে আগে সিদ্ধি-নাশক কওয়া হইত শেষ পর্যন্ত তারে দেবতার স্থান দিয়া; সিদ্ধিদাতা উপাধি দিয়া; সকলের আগে তার পূজা করার নিশ্চয়তা দিয়া মহাভারত লেখানো হইছে। কিন্তু রামায়ণে দেখেন; শিকারি পক্ষী মারায় বাল্মিকী দুঃখু পাইয়া কাব্য করলেন আর লগে লগে তার শিষ্য ভরদ্বাজ তা লেইখা ফালাইলেন। তার মানে রামায়ণ রচনার যুগে বাল্মিকী এবং তার শিষ্যগো মাঝে লেখার চর্চা আছিল; সময় হিসাবে যেইটা কোনোভাবেই খ্রিস্টিয় তৃতীয় শতকের আগে না। গুপ্ত যুগেই। এবং মহাভারতের লিপিকার গণেশ দেবতা হইছেন এই গুপ্ত যুগেই; এই সময়েই মহাভারতে ঢুকছে গণেশ আখ্যান। শিবপুত্র-টুত্রের কাহিনি এই সময়কারই। অবশ্য শিবও মহাদেব বেশি আগে হন নাই…
কেদারনাথ একটা কঠিন প্রশ্ন করেন- রাবণ কি বৌদ্ধ আছিল? রামের অভিযানটা কি মূলত আছিল বৌদ্ধ খেদানোর উদ্যোগ?
এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেয়া না গেলেও এইটা ভোলা সম্ভব না যে বৌদ্ধ রামায়ণ কাহিনি অনুযায়ী রাবণ কিন্তু বৌদ্ধ। আবার বিশ্বামিত্রের লগে গিয়া তাড়কা তাড়ানো থাইকা রাবণ হত্যা; রামের সব কামের লগেই কিন্তু আদিবাসী আর স্থানীয় মানুষ তাড়ানো-খেদানোর পাশাপাশি সাম্রাজ্য বিস্তার কিংবা শাসন পোক্ত করার একটা বিষয় আগাগোড়াই অতিশয় প্রকট…
কেদারনাথের বইটা অসাধারণ। তিনি উপাদানগুলা তুইলা ধইরা তিনার মতামত দিছেন। একমাত্র রামায়ণে গরু খাওয়ার ইসু ছাড়া কোথাও কোনো কিছুরে তিনি টুইস্ট করেন নাই তার পুস্তকে…
কেদারনাথের অসাধারণ বিশ্লেষণের বাইরেও আরো কিছু উপাদান শেষ পর্যন্ত মহাভারতরেই প্রাচীনত্বের দিকে নিয়া যায়। মহাভারতে বৈদিক দেবতারা তাগো বৈদিক চরিত্র নিয়াই প্রায় সবাই উপস্থিত; মানে মাইনসের লগে মারামারি করা- এর তার বৌর ঘরে ঢুইকা যাওয়া কিংবা মাইর খাইয়া নতি স্বীকার করা; বৈদিক দেবতাগো এইসব চরিত্রই কিন্তু মাহভারতে উপস্থিত। রামায়ণে কিন্তু তিনাগো তেত্রিশজনের কথা শোনা গেলেও বড়োই নিষ্ক্রিয় তারা। মেঘনাদের হাতে কোনো এক কালে ইন্দ্রের মাইর খাওয়া ছাড়া বৈদিক দেবতাগো সক্রিয় সংশ্লিষ্টতার কোনো সংবাদ নাই রামায়ণে। মানে তিনারা তখন রিটায়ার বা পরিত্যক্ত হইয়া গেছেন প্রায়। মহাভারতে কিন্তু বৈদিক দেবতাগো থাইকা শৈব ঘরানায় ট্রানকিজশনের একটা ট্র্যাক পাওয়া যায়। মহাভারতে শেষ পর্যন্ত বড়ো দেবতা হইলেন শিব। বৈষ্ণব সেইখানে শুরু হইছে মাত্র। অন্যদিকে রামায়ণ প্রায় পুরা বৈষ্ণব…
মহাভারতের যুগে মানুষের গুহাতে বাস করার প্রচলনও আছিল। যেইটা অনেক প্রাচীনতার সন্ধান দেয়। বিদুর বারণাবতে একটা মিস্ত্রি পাঠায় পাণ্ডবগো লাইগা গুহা খুইড়া ঘর বানাইবার লাইগা। গুহা খুইড়া ঘর বানাইবার এক্সপার্ট মিস্ত্রির অস্তিত্ব যেই যুগে আছিল সেই যুগে নিশ্চয়ই গুহার মইদ্যে বসবাসের প্রচলনও আছিল। পোশাক আশাকের দিকেও মহাভারত অনেক প্রাচীন। পাণ্ডবরা যখন বনে যায় তখন ছাল বাকলা পইরাই গেছিল। এবং বনবাসের সময় ছাল বাকলাই পরছিল। কিন্তু রাম বনে যাইবার সময় সীতার অতি রাজকীয় পোশাক ছাড়াও রাম লক্ষ্মণ যে দরিদ্র পোশাক পইরা গেছে; সেইটাও কিন্তু তাঁতে বোনা সুতার কাপড়। আরো সোজা কইরা কইলে কইতে হয় রাম লক্ষ্মণের পরনের পোশাকটা আছিল বৌদ্ধ চির অজীন। মহাভারতের সময় কাপড়ের প্রচলন নিঃসন্দেহে আছিল; কিন্তু একই সাথে পশুর চামড়া বা গাছের ছাল পরার অভ্যাস বা প্রচলনও আছিল নিশ্চিত। একটা জায়গায় এমনো দেখা যায় যে গাছের ছাল তুইলা অর্জুন পোশাক বুনতাছে। মানে জীবনের পয়লা চৌদ্দ পনেরো বছর বনে কাটানো পাণ্ডবরা গাছের ছালের পোশাক বানাইতেও জানতো ঠিকমতো। আশপাশে এইটার প্রচলন না থাকলে কিন্তু অত সহজে তা বানাইয়া পরতে পারার কথা না…
মহাভারতে রাজপুত্ররা প্রাচীন গদাযুদ্ধ মল্লযুদ্ধই শিখত রামায়ণে গদার উল্লেখ নাই। তীর ধনুকের ব্যবহারই বেশি। মহাভারতে চতুবর্ণ আছিল না। কিন্তু রামায়ণে তা পরিষ্কার। ভীম রাক্ষস বিবাহ করে। কুন্তীসহ পাণ্ডবেরা সকলের ঘরে খায়। কুমারের বাড়ি থাকে। নিজেগোরে ব্রাহ্মণ বইলাও পরিচয় দেয়; কিন্তু রামায়ণ সমাজে বর্ণ বিভাজনটা পরিষ্কার। রাম কিন্তু বালি কিংবা বিভীষণের ঘরে কিছুই মুখে দেয় না। শূদ্র রাজা গুহকের দেওয়া খাবার নিজে না খাইয়া ঘোড়ারে খাওয়ায়। আবার বেদ পড়ার অপরাধে শূদ্র শম্ভুকরে মাইরা ফালায়। মানে রাম পুরাই চতুবর্ণী রাজা…
হরপ্পায় পাথরের দালান ছিল; খ্রিপূ ২৫০০ সালে। আর্য প্রভাবিত ভারতীয়রা স্থাপনা বানাইতে শুরু করে খ্রিপূ ২৫০ সালে; তবে সেইটা কাঠের দালান; পাথর না। ভারতে আর্যগো হাতে পয়লাবারের মতো পাথরের দালান বানানো শুরু হয় গুপ্ত যুগে; ৩৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। তাইলে রাবণের বাড়িতে অত দালান আসে কেমনে?
রামায়ণে ইটের দালানের কথা আছে কিন্তু মহাভারতের পুরোচন বারণাবতে সম্রাজ্ঞী আর যুবরাজের লাইগা যে ঘরটা বানায় সেইটা কিন্তু বাঁশ-বেত শনের ঘর। অন্যদিকে রামায়ণে স্থপতিরা বেশ উপস্থিত। তবে লঙ্কায় ইটের দালান আছিল বইলা মনে হয় না। লঙ্কার সবগুলা বাড়িঘর আর প্রাচীরই আছিল সাধারণভাবে দাহ্য; মানে কাঠ বাঁশের স্থাপনা। যদিও রাবণের দশটা গুণ বা দক্ষতার মইদ্যে একটা আছিল বাস্তশিল্প বা আজকের যুগের স্থাপত্যশিল্প…
ময় দানব নামে মাত্র একজন স্থপতির কথা মহাভারতে শোনা যায়; কাব্যিক বর্ণনায় ময় দানবের তৈরি ইন্দ্রপ্রস্থের প্রাসাদ অনেক বিশাল আর উজ্জ্বল বইলা মনে হইলেও আসলে কিন্তু তা না। কারণ যুধিষ্ঠির সম্রাট হইবার পরে কিন্তু এই প্রসাদে থাকে নাই। আবার বলা হয় দুর্যোধন এই প্রাসাদ দেইখা হিংসায় জ্বইলা গেছিল; অথচ পাশা খেইলা জিতার পর কিন্তু প্রাসাদটা দিয়া দিছে দ্রোণাচার্যরে।
ইন্দ্রপ্রস্থের দালান যদি অতই আকর্ষণীয় হইত তবে তা দুর্যোধন নিজেই রাখত। কিন্তু তা হইল না…
এক নারীর একাধিক স্বামী- আনুষ্ঠানিকতা বর্জিত বিবাহ-বরের বাড়ি পাত্রী আইনা বিবাহ; এইগুলা যেমন পুরানা প্রথা তেমনি সন্তানের মায়ের নামে পরিচিতি বহুত প্রাচীন প্রথা। এইগুলা সবই মহাভারত সোসাইটির উপাদান। মহাভারত সোসাইটিতে লোকজনরে আমরা মাত্র বাপের নামে পরিচিত হইতে শুরু হওয়া দেখি। সেইখানে বলতে গেলে মাত্র একজন মানুষই মোটামুটি বাপের নামে পরিচিত। তিনি কৃষ্ণ। কৃষ্ণরে মহাভারতে খুব অল্প ক্ষেত্রে তার মায়ের নামে ডাকা হইছে। পাণ্ডবগো বাপের নামে ডাকা হইলেও বহুবার আমরা কৌন্তেয়- মাদ্রেয় কথাগুলা শুনি। মানে দুইটাই প্রচলিত আছিল। অন্যদিকে ভীষ্ম পুরাই গাঙ্গেয়…
রামায়ণ পুরাই বাপকেন্দ্রিক। বাপের নামে সন্তানের পরিচয় তুলনামূলক বহুত আধুনিক বিষয়। মূলত নারীর সারা জীবন এক স্বামীর লগে থাকার বিধান প্রচলিত হইবার পরেই বাপের নামে পরিচিতিটা প্রতিষ্ঠিত হয়। বলা হয় ঋষি উদ্দালক আরুণি; যিনি পাঞ্চাল রাজা প্রবাহণের শিষ্য হইয়া ব্রহ্মের তত্ত্ব প্রচার করছিলেন; তার ক্ষেত্রজ পুত্র শ্বেতকেতুই হইলেন নারীদের এক স্বামীর অধীন করার পয়লা প্রচেষ্টাকারী। পরে সেইটারে মোটামুটি পাকাপোক্ত করেন অঙ্গিরা বংশের আন্ধা ঋষি দীর্ঘতমা…
সন্তানের পিতার নামে পরিচিত হইবার লগে লগে রামায়ণে নারীর এক স্বামী- আড়ম্বরপূর্ণ বিবাহ অনুষ্ঠান- পাত্রীর বাড়িতে বিবাহ এই সকলই আছে। পাশাপাশি মরার লগে শবানুগমন জিনিসটা আর্য সমাজে আছিলই না; মহাভারতেও নাই। শবানুগমনের মতো এই নতুন সিস্টেমটাও কিন্তু রামায়ণ সমাজে আছে…
বলা হয় বেদ আগে বামুন ছাড়া শূদ্র আর নারীগো লাইগা নিষিদ্ধ আছিল। নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী তার মহাভারতের ছয় প্রবীণ গ্রন্থে কন যে দ্বৈপায়নই পয়লা ব্যক্তি যিনি নারী আর শূদ্রগো লাইগা বেদ উন্মুক্ত কইরা দেন। রামায়ণে আমরা অনার্য বংশজাত বালির স্ত্রী তারারে বেদ পড়তে দেখি। এই হিসাবে তো অবশ্যই এগোরে দ্বৈপায়ন পরবর্তী মানুষ বইলা ধইরা নিতে হয়। আবার রামায়ণের শেষ দিকে খালি বেদ পড়ার অপরাধে রাজা রামরে আমরা দেখি এক শূদ্রবংশজাত শম্বুকের মাথা কাইট্টা ফালইতে। তবে কি বেদ শূদ্রগো লাইগা আবার নিষিদ্ধ হইছিল রামের হাত ধইরা?
চতুর্বেদ কথাটা দ্বৈপায়ন থাইকা শুরু। বলা হয় অগোছালো বেদের মন্ত্রগুলারে তিনি চাইর ভাগে ভাগ করেন বিষয় অনুযায়ী। যদিও বেদগুলার মইদ্যে প্রচুর রিপিটেশন আছে আর অথর্ব বেদরে ঠিক অন্য তিনটা বেদের সম পর্যায়ে ধরা হয় না। তবুও আমরা রামায়ণে কিন্তু বিভাজিত বেদের রেফারেন্সই শুনি। অন্তত তিন বেদ সেইখানে পরিষ্কারভাবে উল্লিখিত। আখ্যানমতে দ্বৈপায়নের পুত্র শুকদেবই হইলেন দুনিয়ার পয়লা চতুর্বেদী মানুষ। বাকি যারা ত্রিবেদী বা চতুর্বেদী তারা সকলেই হয় শুকদেবের শিষ্য না হয় তস্য শিষ্য। কিন্তু রামায়ণে আমরা দেখি সুগ্রীবের মাইয়ার জামাই আর মন্ত্রী হনুমান একজন ত্রিবেদী বা চতুর্বেদী পর্যায়ের মানুষ। যদিও হনুমানের শিক্ষা বিষয় রামায়ণে পরিষ্কার নাই; তবু এই অনার্য মানুষটার মুখে নির্ভুল সংস্কৃত আর বৈদিক বিষয়ের উল্লেখ শুইনা রাম পর্যন্ত লক্ষ্মণের কাছে বিস্ময়ে হনুমানের বিদ্যার প্রশংসা করে। সারা রামায়ণে আমরা রামরে কি অন্য কারো গুণের প্রশংসা করতে শুনি? মনে হয় না…
কেউ কেউ মহাভারতে কুরুপক্ষে যুদ্ধ করা বৃহদ্বলরে রামের উত্তর পুরুষ কইয়া যুক্তি দেখান যে মহাভারত রামায়ণের পরে। কারো যুক্তিতে রামপুত্র কুশের ধারায় বৃহদ্বল রামের ১৫তম আর কারো তালিকায় ২৮তম উত্তর পুরুষ। কিন্তু রামায়ণের সমাজ বইয়ের লেখক কেদারনাথ মজুমদার পরিষ্কার কইয়া দেন যে লব কিংবা কুশ আদৌ রামের কেউ না; পুত্র তো দূরের কথা। মূলত উত্তরকাণ্ড যারা লেখছে; তারাই রামায়ণ গানের কথক লব আর কুশেরে রামের পুত্র বানায়া দিছে। মানে লব আর কুশ সম্পর্কে সেই ছোটবেলার গ্রামের ধাঁধা আরকি- ছেলের যখন জন্ম হলো মা ছিল ঘরে/ জন্মদাতা জন্ম দিলো না জন্ম দিলো পরে…
মানে লব আর কুশের জন্ম বাপেও দেয় নাই; মায়েও না; জন্ম দিছে কবিরা। মূলত রাম আর সীতা নিঃসন্তানই ছিলেন। বৃহদ্বলের কাশি নিবাসী পরবর্তী কোনো বংশধর বোধহয় বংশ গৌরব বাড়াইবার লাইগা বৃহদ্বলরে মহাভারতে ঢুকাইছে পরে। কারণ তখনকার দিনে রাজা বাদশাগো নিজের বংশ গৌরব বাড়াইবার লাইগা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পূর্ব পুরুষরে ঢোকাইয়া মাইরা ফালানো থাইকা সহজ কোনো পদ্ধতি আছিল না। বৃহদ্বলের লগে আসলে রামায়ণ মহাভারতের আগে-পরের কোনো সম্পর্ক নাই…
একইভাবে বিশ্বামিত্র-মেনকার মাইয়া শকুন্তলার স্বামী রাজা দুষ্মন্তর পোলা ভরত হইল মহাভারতের শান্তনু কিংবা কুরু বংশের পূর্ব পুরুষ; এইটা দিয়া রামায়ণরে আগের ঘটনা কইতে যাওয়া একটা ফালতু বিষয়। কারণ বেদে রাজা সুদাসের পুরোহিতের চাকরি হারায়া সুদাসের রাজ্য দখল করার লাইগা যে বিশ্বামিত্র আক্রমণ কইরা বসছিলেন তিনি যেমন বিশ্বামিত্র; তেমনি ঋগবেদের গায়ত্রী বা সাবিত্রী মন্ত্রসহ বহুত শ্লোক; বিশেষত তৃতীয় মণ্ডল এর রচয়িতাও বিশ্বামিত্র; আবার গৌতম বুদ্ধের জীবনী ললিত বিস্তারেও কিন্তু দেখা যায় যে তিনি যার কাছে লেখাপড়া শিখছেন তার নামও বিশ্বামিত্র…
ঋগবেদে বিশ্বামিত্রের চাকরি খাইয়া রাজা সুদাসের পুরোহিতের চাকরি যে বশিষ্ঠ নিছিলেন তিনি হইলেন মিত্রবরুণের ঔরসে উর্বসীর পোলা বশিষ্ঠ। আর রামায়ণের বশিষ্ঠের বাপের নাম ব্রহ্মা।
অন্যদিকে মহাভারতের বশিষ্ঠ কিন্তু বিশ্বামিত্রের লগে যুদ্ধে নির্বংশ হইয়া যান; তার পোলার পোয়াতি বৌর গর্ভে একমাত্র বংশ টিকা থাকে পরাশর; যে কি না দ্বৈপায়নের পিতা। অন্যদিকে রামায়ণের বশিষ্ঠের পোলা রীতিমতো এক চ্যাংড়া পুরোহিত; যে রাম বনবাসে যাইবার আগে তার সমস্ত দান খয়রাতের তদারকি করে…
বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠ এইগুলা মূলত গোষ্ঠী নাম; আইজকার যুগের চৌধুরী কিংবা ব্যানার্জিগো মতো। ঋগবেদে যত জায়গায় এইসব ঋষির নাম আছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা বহুবচনে আছে; মানে বশিষ্ঠগণ বিশ্বামিত্রগণ আর যজুর্বেদে ভৃগুগণ অঙ্গিরাগণ এই রকম। মানে ঋগবেদের কালেই এরা বংশ বা গোষ্ঠী হিসাবে পরিচিত আছিলেন। সুতরাং এইসব ঋষি পুরোহিতগো নাম দিয়া ইতিহাস বাইর করার কোনোই সুযোগ নাই। এবং তা অর্থহীনও…
একইভাবে রামায়ণে জন্মেজয় আর পরীক্ষিতের উল্লেখ আছে; পরীক্ষিৎ হইল অর্জুনের নাতি; এইরকম রেফারেন্স দিয়া আসলে রামায়ণ মহাভারত আলোচনা করার সুযোগ নাই। কারণ একই নামের ব্যক্তি হাজারে হাজার থাকে। বর্তমানে খুঁজলেও কয়েক লক্ষ রাম আর কৃষ্ণ পাওয়া যাবে দুনিয়ায়…
গীতায় কিন্তু বেশ কয়েকটা শ্লোকে বেদ বিরোধীতা বা বেদনিন্দা আছে। মহাভারতেও আছে বেদবিরোধীতা এবং বেদনিন্দা। তো বঙ্কিমচন্দ্র তার ভগবৎগীতায় গীতার সেই বেদবিরোধী। শ্লোকগুলার মইদ্যে ৪২-৪৬; তিনটা বেদ বিরোধী শ্লোকরে বহুত ঘুরাইয়া প্যাচাইয়া মুচড়াইয়াও বেদের পক্ষে আনতে না পাইরা বেশ চমৎকার একটা কথা কইছেন অপারগ হইয়া। সেইটা হইল “ভারতবর্ষ এই উনবিংশ শতাব্দিতে বেদ শাসিত। আজিও বেদের যে প্রতাপ, ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের তাহার সহস্রাংশের এক অংশ নাই। সেই প্রাচীনকালে বেদের আবার ইহার সহস্রগুণ প্রতাপ ছিল। সাংখ্যপ্রবচনকার ঈশ্বর মানেন না- ঈশ্বর নাই, এ কথা তিনি মুক্তকণ্ঠে বলিতে সাহস করিয়াছেন, তিনিও বেদ অমান্য করিতে সাহস করেন না-পুনঃ পুনঃ বেদের দোহাই দিতে বাধ্য হইয়াছেন। “শ্রীকৃষ্ণ মুক্তকণ্ঠে বলিতেছেন, এই বেদবাদীরা মূঢ়, বিলাসী; ইহারা ঈশ্বর আরাধনার অযোগ্য”…
এর পরেও তিনি বহুত পৃষ্ঠা খর্চা করছেন জোর কইরা এই শ্লোকগুলারে বেদের লগে লাইনআপ করতে। কিন্তু তিনি একটা কথা পরিষ্কার কইরা কইয়া দিছেন যে গীতায় যে বেদ বিরোধীতা আছে সেইটা পণ্ডিতেরা কিন্তু চাইপা গেছেন জানের ডরে; কিলের ভয়ে। হিন্দু ধর্মে ঈশ্বর না মানলে সমস্যা নাই কিন্তু বেদ না মানলে বহুত ঝামেলা…
তিনটা শ্লোকরে বেদের পক্ষে আনার বহু চেষ্টা করার পর ৫৩ শ্লোকে গিয়া বঙ্কিম পড়েন আবার বিপদে। আবারো বহুত প্যাচাল পাড়েন এইগুলারে বেদের পক্ষে আনতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবার অপারগ হইয়া ফট কইরা বইলা দেন- “এখন বেদে কিছু প্রয়োজন নাই, এমন কথা, আমরা ঊনবিংশ শতাব্দির ইংরেজ শিষ্য, আমরা না হয় সাহস করিয়া বলিতে পারি, কিন্তু শঙ্করাচাৰ্য্য কি শ্রীধর স্বামী এমন কথা কি বলিতে পারিতেন? প্রাচীন ভারতবর্ষীয়েরা বেদকেই একটা ঈশ্বররূপে খাড়া করিয়া তুলিয়াছেন। কপিল ঈশ্বর পরিত্যাগ করিতে পারিয়াছিলেন, কিন্তু বেদ পরিত্যাগ করিতে পারেন নাই। বৃহস্পতি বা শাক্যসিংহ প্রভৃতি যাঁহারা বেদ পরিত্যাগ করিয়াছিলেন, তাহারা হিন্দু-সমাজচ্যুত হইয়াছিলেন। অতএব শঙ্করাচার্য্য, কি শ্রীধর স্বামী হইতে এমন উক্তি কখন সম্ভব না যে, ব্রহ্মজ্ঞানী হউক বা যেই হউক, কাহারো পক্ষে বেদ নিষ্প্রয়োজনীয়। কাজেই তাহাদিগকে এমন একটা অর্থ করিতে হইয়াছে যে, তাহাতে বুঝায় যে, ব্রহ্মজ্ঞানেও যা, বেদেও তা, একই ফল। তাহা হইলে বেদের মর্যাদা বহাল রহিল।”
এক্কেবারে পরিষ্কার। শঙ্কাচার্য কিংবা শ্রীধরের মতো মানুষেরা সাহস কইরা কইতে পারেন নাই যে গীতায় বেদনিন্দা বা বেদ বিরোধিতা আছে। তাগো ডর আছিল; সমাজচ্যুত হইয়া একঘরে হইবার। ডর আছিল মাইর খাইবার। যেমন ঘটছিল বৃহস্পতি বা শাক্যসিংহের বেলায়…
তো কেদারনাথ মজুমদার পুরা রামায়ণখান দুর্ধর্ষভাবে বিশ্লেষণ কইরা সাইরা একটু মিন মিন কইরা যুক্তি দেখান যে; রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে রামের গোসব যজ্ঞের কথা আছে কিন্তু গরু খাওয়ার কথা তো পাই নাই। মনে হয় এইটা বঙ্কিমের সেই বিশ্লেষণের ধাচেই পড়ে। আমরা বুঝতে পারি কেদারনাথ কেন সেইটা পাশ কাইটা যান বা কমজোর গলায় কন- না তো। নাই তো। গোসব যজ্ঞের কথা আছে কিন্তু গরুর মাংস দিয়া মাখাইয়া ভাত খাইবার কথা তো নাই। যাউকগা। রামায়ণ সমাজে গরু খাওয়ার প্রচলন তো আছিলই উল্টা গরুর মাংসটাই আছিল শ্রেষ্ঠ মাংস বইলা গণ্য। গরু খাওয়া বন্ধ হয় মূলত বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে…
রামায়ণ সমাজে গরু খাওয়া হইত না; গোসব যজ্ঞ কইরা মূলত মধু দিয়া রান্না করা গরুর মাংস গাঙে ফালায় দেয়া হইত দেবতাগো খাইবার লাইগা; এইসব কথা কেউ কইলে অন্যদিকে ধইরা নিতে হইব যে তিনি বা তিনারা রামের বয়স বুদ্ধদেবের থাইকা কমাইয়া নিয়া আসছেন। আর রামায়ণরেও কইরা দিতে চাইছেন বৌদ্ধ উত্তর সাহিত্য…
মাহবুব লীলেন
সেপ্টেম্বর ২০১৬
.
মহাভারতের বিয়াশাদি ঘরসংসার
মহাভারতের বিয়াশাদি ঘরসংসার
অভাজনের মহাভারত প্রথম প্রকাশের পাঁচ বছর পার হইছে। এই সময়কালে সমালোচনা পাইছি; প্রশংসা পাইছি; পরামর্শ পাইছি আবার কিছু কিছু দাবিও আইসা জমা হইছে আমার কাছে। মহাভারতের কাহিনীগুলার হাজারো ভার্সনের ভিতর অভাজনের মহাভারত একটা। অন্যগুলার মতোই এই বইয়ে কিছু জিনিস আসছে যা অন্য কোথাও নাই; আবার অন্য কোথাও আছে এমন বহুত জিনিস বাদ গেছে… অনেকের দাবি; প্রচলিত কাহিনীগুলায় বর্ণিত বিয়াশাদি ঘরসংসার সম্পর্ক বিষয়ে একটা অধ্যায় সংকলন করার। এই অধ্যায়টা সেই দাবিরই একটা জোগান… এই অধ্যায়ের উপকরণগুলা প্রচলিত মহাভারতীয় আখ্যান-উপাখ্যান নির্ভর একটা সংকলন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রসঙ্গিক অন্য আখ্যানও উইঠা আসছে। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে একই ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন বিবরণও পাওয়া যায় ভিন্ন ভিন্ন কাহিনীতে…
ক. মহাভারতের বিয়াশাদি
মহাভারত মূলত একখান গেরস্থালি উপখ্যানের সমাহার। জমিজমা নিয়া মারামারি কামড়াকামাড়ির লগে লগে এই পুস্তকটা বিয়াশাদি-জন্মদান কিংবা পোলাপানের লগে সম্পর্কের বিবরণেও রীতিমতো বিচিত্র-ব্যাপক…
কৃষ্ণ উপাখ্যানের কারণে এক বেটার একাধিক বৌ থাকার কথা সকলেই জানে; দ্রৌপদীর কারণে জানে এক নারীর বহুপতির কথা। কুন্তীর কারণে একাধিক পুরুষ দিয়া নারীর গর্ভসঞ্চার কিংবা দ্বৈপায়নের কারণে ভাইয়ের বৌরে গর্ভবতী করার কথাও সকলের জানা…
অন্যদিকে কর্ণ কিংবা দ্বৈপায়নের জন্মঘটনার কারণে যে কোনো তরুণীরে চাইপা ধইরা গর্ভবতী করায় বামুনগো অধিকারের স্বীকৃত প্রচলনগুলা মহাভারতের প্রাথমিক পাঠ্য উপাদান। তাই এইসব বিষয়ে কথা না বাড়াই…
দ্রৌপদী আর উত্তরার বিবাহ দুইটা রীতির দিক থাইকা মহাভারতের অন্যসব বিবাহ থাইকা ভিন্ন। প্রথমতো; এই দুইটা বিবাহই ঘটছে কইন্যার বাড়িতে। মহাভারতের বাকিসব বিবাহ ঘটছে হয় বরের বাড়ি না হয় কোনো নিরপেক্ষ স্থানে…
সময়কালের হিসাবে উপমহাদেশে কইন্যার বাড়িতে বিবাহের আয়োজন তুলনামূলক নতুন সংযোজন। পুরানা সিস্টেমে বিয়া হইত বরের বাড়ি। রামায়ণে রাম-সীতার বিবাহও ঘটে কইন্যার বাড়িতে; আরো কিছু উপাদানের লগে রামায়ণরে মহাভারতের পরের ঘটনা হিসাবে যারা দেখাইতে চান তারা এই কইন্যা-বাড়ির বিবাহের কথাটাও খাড়া করেন যুক্তি হিসাবে…
কুন্তীরও স্বয়ংবরা হইছে বাপের বাড়ি কিন্তু পাণ্ডু তারে বিবাহ করছে নিজের বাড়ি আইনা। স্বয়ংবরায় দ্রৌপদীরে জিতার কালে নিজের বাড়ি নামে অন্তত একখান কুড়েঘর আছিল অর্জুনের; রাজকইন্যা দ্রৌপদী বিয়ার আগে-পরে সেইখানেই থাকে। কিন্তু তার বিবাহটা সেইখানে না হইয়া হইছে বাপের বাড়ি…
উত্তরার বিবাহের সময় পাণ্ডবরা বৈতল হইলেও বিবাহের পাত্র অভিমন্যুর কিন্তু থান আছিল; মামার বাড়িই আছিল তার বাড়িঘর; কিন্তু বিয়াটা সেইখানে হয় নাই; হইছে পাত্রীর বাপের বাড়ি…
দ্রৌপদী-উত্তরার বিবাহগুলা আরেকটা কারণে অন্যগুলা থাইকা আলাদা; সেইটা হইল পাত্রীপক্ষ কইন্যাদান করার পর কার লগে কইন্যার বিবাহ হবে সেইটা ঠিক করে পাত্রের পরিবার…
দ্রুপদ অর্জুনের হাতে মাইয়া দিবার পর দ্রৌপদীর বিবাহ করতে হবে পাঁচ জনরে; এই সিদ্ধান্ত করে কুন্তী আর যুধিষ্ঠির। এইটা নিয়া পরে দ্রৌপদীর বাপ-ভাই বহুত মুলামুলি করলেও সিদ্ধান্ত কিন্তু বদলায় না…
অন্যদিকে মৎস্যরাজা বিরাট কইন্যাদান করে অর্জুনরে; আর অর্জুন ঠিক করে উত্তরারে বিবাহ করব তার পোলায়…
এই ঘটনায় মনে হয় বাপের পাত্রীরে পুতের বিবাহ করতে কোথাও কোনো সামাজিক খচখচানির অস্তিত্ব আছিল না তখন…
মহাভারতে ভীম-হিড়িম্বার বিবাহটা প্রেমের…
অর্জুন-সুভদ্রার বিবাহ ভাগল দিয়া। এইটা কাজিন বিবাহ। সুভদ্রা অর্জুনের মামাতো বইন। সহদেবের বৌ দ্যুতিমৎ বা বিজয়া আছিল তার মামাতো বইন; মদ্ররাজ শল্যর মাইয়া। কৃষ্ণের এক বৌ মিত্ৰবিন্দও আছিল তার ফুপুতো বইন…
মহাভারতে চাচাতো ভাই-বইনের ভিতর বিবাহেরও একটা উদাহরণ আছে। সেইটা হইল ভীমের পোলা ঘটোৎকচের লগে অর্জুন-সুভদ্রার মাইয়া ভার্গবীর বিবাহ…
মহাভারতে কুমারীমাতার বিবাহের দুইখান বিখ্যাত উদাহরণ সত্যবতী আর কুন্তী। এর ভিতর সত্যবতীর কুমারীকালের সন্তানের ঘটনা আছিল প্রকাশ্য; অন্যদিকে কুন্তীর কুমারীকালের সন্তানের কথা সম্পূর্ণ চাইপা যাওয়ার চেষ্টা হইছে আগাগোড়া…
মহাভারতে বিধবা বিবাহের ঘটনা আছে একখান; উলুপী। অর্জুনরে বিবাহের আগে উলুপীর আরেকটা বিবাহ হয়; কিন্তু স্বামী মইরা যায়…
স্বামী থাকা অবস্থায় নারীরে বিবাহ করতে চাওয়ারও উদাহরণ আছে মহাভারতে…
ধৃতরাষ্ট্রের মাইয়া দুঃশলার স্বামী জয়দ্রথ একবার দ্রৌপদীর তুইলা নেওয়ার চেষ্টা চালায়। দ্রৌপদীর স্বামীরা জ্যান্ত জাইনাও সে কয় বিবাহ কইরা রানির মর্যাদা দিব তারে…
এতে মনে হয় বিবাহের পাত্রী হইবার যোগ্যতার ক্ষেত্রে নারীর বিবাহিত-অবিবাহিত-কুমারী কিংবা বিধবা কোনো বিষয় আছিল না ওই সমাজে…
বিবাহ কিংবা যৌনতার লাইগা পটানোর উদাহরণ মহাভারতে আছে প্রচুর। চিত্রাঙ্গদা অর্জুনরে পটায়। পরে আরেক অপ্সরা অর্জুনরে পটানোর চেষ্টা করে; অর্জুন রাজি হয় না। তবে পটানো চেষ্টার কারণে ক্ষ্যাপার কোনো ঘটনা মহাভারতে নাই; রামায়ণে আছে। রামায়ণে রাবণের বইন সুপর্ণখা লক্ষ্মণরে পটাইতে চায়। এর লাইগা লক্ষ্মণ রীতিমতো তারে শাস্তি দেয়; তার নাক-কান কাইটা ফালায়…
মহাভারতে বেশ কয়েকটা স্বয়ংবরার উদাহরণ আছে। সেইগুলাতে পাত্রীরা পাত্র পছন্দ করত হয় তার শান শওকতের বিবরণ শুইনা; না হয় পাত্র নির্বাচনের লাইগা থাকত বিভিন্ন রকমের যুদ্ধকৌশল কিংবা লড়াই কিংবা খেলার প্রতিযোগিতা। যে জিতত সেই পাইত মালা। আবার স্বয়ংবরা থাইকা প্রতিযোগিতার আগেই কোনো প্রার্থীরে অযোগ্য ঘোষণা করার ঘটনা আমরা দ্রৌপদীর স্বয়ংবরায় পাই…
কিন্তু মহাভারতে একটা স্বয়ংবরা কিঞ্চিত ভিন্ন রকমের। সেইটা হইল নাগ বংশজাত কইন্যা অহিলাবতীর স্বয়ংবরা। এই স্বয়ংবরাটায় প্রতিযোগিতা আছিল বুদ্ধি পরীক্ষার। পাত্রী অহিলাবতী নিজেই পাত্রগো কঠিন কঠিন প্রশ্ন করে আর সেইসব কঠিন প্রশ্নের উত্তর দিয়া তারে জিতা নেয় ভীম-হিড়িম্বার পোলা ঘটোৎকচ…
সাধারণ বিবরণে ঘটোৎকচরে নির্বোধ একটা গতরসর্বস্ব রাক্ষস হিসাবে বর্ণনা দিলেও এই ঘটনা থাইকা তার বুদ্ধিরও কিছু ঝিলিক পাওয়া যায়। আর তার চাইতেও বড়ো কথা হইল শান্তনুর আস্ত বংশধারায় একজন মাত্র মানুষ পরবর্তীতে ঋষি হয়; সেইটা হইল ঘটোৎকচ-অহিলাবতীর পোলা বর্বরীক। তার মানে হিড়িম্বার এই গোষ্ঠীরে লঘুতুচ্ছ করলেও এই বংশে যে জ্ঞান-বিদ্যা চর্চার অভ্যাস আছিল তার একটা প্রমাণ পাওয়া যায়…
ঘটোৎকচের পোলা অঞ্জনপর্বা বেশ প্রশিক্ষিত যোদ্ধা হিসাবেই কুরুযুদ্ধে অংশ নেয়। ঘটোৎকচের বাহিনীটাই আছিল কুরুযুদ্ধে পাণ্ডবপক্ষের প্রথম বাহিনী। আবার বাপ কাকারা সৎমায়রে নিয়া বনবাসে গেলে সেইখানে গিয়া তাগো মালপত্র টানার কামও করতে দেখি ঘটোৎকচেরে। এমনকি সৎমা দ্রৌপদীর কান্ধে কইরা পাহাড়ে পর্যন্ত বইয়া নিয়া যায় সে…
উল্টা দিকে রাজসূয় যজ্ঞে দ্রৌপদী হিড়িম্বারে অপমান করলে একেবারে রাক্ষসের মতো হুংকার ছাইড়া সামনে খাড়ায় ঘটোৎকচ…
হিড়িম্বার মতো পরিবারগুলাতে সম্ভবত পারিবারিক বন্ধনের কাঠামো কিঞ্চিত ভিন্ন রকমের আছিল; বাপ মায়ের প্রতি পোলাপাইনের নির্ধারিত কিছু দায়িত্ব আছিল। যেইটা দ্রৌপদীর পোলাগোরে কিছুই করতে দেখা যায় না…
মহাভারতে অন্তত একটা পরকীয়া কাহিনী আছে। আবার বিবাহিত বৌ ভাইগা গিয়া অন্যের লগে সংসার কইরা বাচ্চাকাচ্চা জন্মদিবার পরে ফিরা আইসা সংসার করার ঘটনাও এইটা…
দেবগুরু ঋষি বৃহস্পতির বৌ তারা তার ছাত্র সোমের লগে ভাইগা যায়। এইটা নিয়া দেবতাপক্ষ আর বৃহস্পতি বহুত চোটপাট এমনি লাঠিসোটাও আয়োজন করেন। কিন্তু সোমরে প্রশ্রয় দিয়া বসেন অসুরগুরু শুক্রাচার্য। ফলে দেবতারা আর তারে নাড়াইতে সাহস করে না। সোমের লগে সংসার করতে থাকে তারা। তাগো একটা পোলাও হয়…
এই দিকে বৌ ফিরত পাইবার লাইগা বৃহস্পতি শুরু করেন কাকুতি মিনতি। পরে শুক্র সোমরে বলেন তারারে তার স্বামীর কাছে ফিরত দিয়া আসতে। সোম তার পুতেরে রাইখা তারারে তার আগের স্বামী বৃহস্পতির কাছে ফিরায়া দেয়…
এইখানে তারার মতামতের বিষয়ে কিছু জানা যায় না। তারা নিজেই পলাইছিল সোমরে পটায়া। পরবর্তীতে তারারে বৃহস্পতির লগেই সংসার করতে দেখা যায়। বড়োই মায়া দিয়া মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই তারার মনের কথাগুলা আঁকছেন তার বীরাঙ্গনা কাব্যে…
খুব সম্ভবত কচ তারারই গর্ভজাত সন্তান; যারে কৌশলে শুক্রের গোপন বিদ্যা শিখার লাইগা পাঠান বৃহস্পতি। রবীন্দ্রনাথের বিদায় অভিশাপ কাহিনী কাব্যের কারণে বড়োই আবেগের সহিত এই কচ বিখ্যাত বাঙালির মনে…
পৌরাণিক ঋষিগো ভিতর কচই সম্ভবত প্রথম এবং একমাত্র তাত্ত্বিক গুরু বা প্রফেসর। অন্যসব গুরুরা বিদ্যা শিখাইতেন এবং নিজেও প্রয়োগ করতেন। কিন্তু কচ কোনোদিন নিজের বিদ্যা নিজে প্রয়োগ করত না; খালি ছাত্রগো পড়াইত। যেইটারে রবীন্দ্রনাথ দেবযানীর মুখ দিয়া অভিশাপ আকারে ‘শিখাইবে, করিতে পারিবে না প্রয়োগ’ বইলা কচের ভাণ্ডারে জমা করেন বাঙালির আবেগ…
অন্য দিকে দেবগুরু বৃহস্পতিরই আরেকটা পরকীয়া কিংবা ধর্ষণের ঘটনায় জন্ম নেওয়া শিশুর বিষয়ে মা বা বাপ দুই জনরেই দায়িত্ব অস্বীকার করতে দেখা যায়…
একবার দেবগুরু বৃহস্পতি তার বড় ভাই উতথ্যের বৌ মমতারে ধর্ষণ করেন; অথবা মমতার লগে পরকীয়া যৌনতা করেন। সেই ঘটনায় জন্মায় শিশু ভরদ্বাজ…
নিজের স্বামীর পোলা না দেইখা ভরদ্বাজরে মমতা পাঠায়া দেন বৃহস্পতির কাছে। কিন্তু বৃহস্পতি ভরদ্বাজের দায়িত্ব নেন না; ফলে ভরদ্বাজরে পালা খাইতে হয় গ্রামবাসীর কাছে…
বৃহস্পতির এই মমতা-ধর্ষণ কিংবা মমতা-যৌনতার লগেই সম্পর্কিত আছে নারীগো স্বামীর অধীন করার আরেকটা সমীকরণ…
মমতার লগে যখন বৃহস্পতি যৌনতা করতেছিলেন; তখন তা দেইখা ফালায় মমতার কিশোরপুত্র দীর্ঘতমা। সে আইসা কাকুরে শুরু করে কিল লাথি মারা। এতে ক্ষেইপা গিয়া বৃহস্পতি দীর্ঘতমার দুই চোখ অন্ধ কইরা দেন…
পরে আন্ধা হিসাবেই বড়ো হয় দীর্ঘতমা। ঋষি হিসাবেও বেশ নামডাক হয় তার। সে বিবাহ করে প্রদ্বেষা নামে এক নারীরে। কিন্তু নিজে চোখে দেখত না বইলা যৌনতার ক্ষেত্রে কোনো চক্ষুলজ্জা আছিল না দীর্ঘতমার। যখন তখন যেইখানে সেইখানে সে বৌরে চাইপা ধইরা শুরু করত কাপড় টানাটানি…
প্রদ্বেষা এইটাতে আপত্তি জানায়। বিষয়টা সহ্যের সীমা পার হইয়া গেলে এক পর্যায়ে প্রদ্বেষা লোকজন দিয়া পিটায়া গাঙে ভাসায়া দেয় দীর্ঘতমারে…
গাঙে ফালাইলেও মরে না দীর্ঘতমা। বাইচা উইঠা আরো ঋষিগিরি করে আর ধর্মীয় মোড়কে বিধান দেয়; বিবাহিত নারীরে যে কোনো অবস্থাতেই থাকতে হবে স্বামীর ইচ্ছার অধীন। মানে স্বামী যা চায় তা যে কোনো অবস্থাতেই সে করতে বাধ্য…
নারীগো স্বামীমুখী করার পয়লা বিধানিক উদ্যোগটা অবশ্য আসে আরেকটু আগে ঋষি শ্বেতকেতুর হাতে। সেইটা আছিল বিবাহিত নারীর বহুগামিতা নিয়ন্ত্রণের বিধান…
উপনিষদের প্রথম দিককার প্রচারক শ্বেতকেতু ঋষি উদ্দালকের ক্ষেত্রজ পুত্র। মানে উদ্দালকের বৌর গর্ভে অন্য কোনো পুরুষের ঔরসে জন্মানো পোলা। শ্বেতকেতুর তরুণ বয়সে তার এবং উদ্দালকের সামনে এক ব্রাহ্মণ আইসা শ্বেতকেতুর মায়েরে যৌনতার লাইগা নিয়া যায়। এতে বিস্মিত শ্বেতকেতু উদ্দালকরে জিগায়- এইটা কী হইল বাজান?
উদ্দালক কন- এইটা বিধানের মইধ্যেই পড়ে। কোনো ব্রাহ্মণ কিংবা অতিথি যৌনতার লাইগা ঘরের বৌরে চাইলে তা পাওয়ার অধিকার তিনি রাখেন…
এইটা শ্বেতকেতু মানতে পারে না। পরে বড়ো হইয়া সে বিবাহিত নারী স্বামী ছাড়া আর কারো লগে যৌনতা করতে পারব না বইলা বিধান প্রচার করে। যদিও তা কার্যকর হয় আরো বহু বহু পরে…
তবে অন্তত কুন্তী আর দ্রৌপদী পর্যন্ত এক নারীর চাইর পুরুষ পর্যন্ত যৌনতা গ্রহণযোগ্য আছিল। চাইরের অধিক পুরুষের লগে কোনো নারী যৌনতা করলে তারে বলা হইত বেশ্যা। এই সূত্র ধইরাই কুরুসভায় দ্রৌপদীরে বেশ্যা কইয়া ডাকে কর্ণ…
অন্যদিকে বিবিধ যুক্তিমতে নকুল-সহদেব কুন্তীর গর্ভজাত পোলা হইবার সম্ভাবনাই বেশি। তাগো লাইগা কুন্তীর অনুভূতি; মাদ্রীর লগে তাগো বিচ্ছিন্ন সম্পর্কবড়ো তিন ভাইর লগে সম্পর্কের গভীরতা; শল্যর লগে তাগো স্বাভাবিক মামা-ভাগিনা সম্পর্ক না থাকা; সব কিছুতেই ওই জমজরে কুন্তীর পোলা হিসাবেই ভাবতে প্ররোচনা দেয়…
অনেকের মতে কুন্তী এই দুই জমজরে মাদ্রীর পোলা কইয়া পরিচয় করাইছে শুধু নিজে বেশ্যা খেতাব এড়াইতে। কারণ কর্ণ থাইকা নকুল-সহদেব পর্যন্ত জন্ম দিতে তারে নিতে হইছে পাঁচ পুরুষের ঔরস। এর লগে আছে তার স্বামী পাণ্ডুর বিছানা; সব মিলা জানামতে অন্তত ছয় পুরুষের যৌনসঙ্গী হইছে কুন্তী…
ফলে প্রথম আর শেষ গর্ভ অস্বীকার কইরা স্বামীসহ স্বীকৃত চাইর পুরুষের যৌনসঙ্গই প্রতিষ্ঠা করতে হইছে কুন্তীরে; যাতে কেউ তারে বেশ্যা না কইতে পারে…
তবে পরপুরুষের দিকে নজর দিবার কারণে বৌ হত্যা এমনকি মাতৃহত্যার ঘটনাও আছে মহাভারতে তাও ঋষি পরিবারে…
ঋষি জমদগ্নির বৌ রেণুকার নজর পড়ছিল চিত্ররথ নামে এক রাজার উপর। রেণুকার গর্ভের পাঁচ পোলা তখন বড়ো। এর মাঝে সবার ছোট হইল পরশুরাম…
পরপুরুষের উপর বৌর নজর পড়ছে দেইখা জমদগ্নি বৌর মৃত্যুদণ্ড দেন; আর তা কার্যকর করতে বলেন নিজের পোলাদের। বড়ো চাইর পোলা সেইটাতে অস্বীকৃতি জানাইলেও বাপের আদেশে কুড়াল দিয়া মায়ের মাথা কাইটা ফালায় পরশুরাম…
তবে জমদগ্নি-পরশুরামের বংশে আরো আগের প্রজন্মে পরপুরুষে বৌ ছোঁয়ার বিষয়ে খুঁতখুঁতানি থাকলেও অত উগ্রতা দেখা যায় নাই…
জমদগ্নির বাপ ঋচিক। ঋচিক ভৃগু মুনীর দ্বিতীয় পোলা। ভৃগুর অন্য দুই পোলার মাঝে বড়োজন চ্যাবন মুনি আর ছোটপোলা শুক্রাচার্য। তিন পোলারই মা আলাদা আলাদা…
বিবাহের আগে চ্যাবনের মা পুলমার প্রেম আছিল গরিব এক সাধারণ তরুণের লগে। এর মাঝে পুলমারে দেইখা পছন্দ হওয়ায় ভৃগুমুনি গিয়া তার বাপের কাছে দিয়া বসেন বিবাহ প্রস্তাব। লগে লগে ভালো মূল্যের কইন্যাপণ…
ভালো কইন্যাপণ পাইয়া ভৃগুর কাছে মাইয়া দিয়া দেয় পুলমার বাপ। পরে এই ঘটনা জাইনা পুলমার প্রেমিক আইসা তারে স্বামীর বাড়ি থাইকা উঠায়া নিয়া গিয়া সংসার শুরু করে। আরো পরে চ্যাবন বড়ো হইয়া মায়ের প্রেমিকরে খুন কইরা মায়েরে ফিরায়া নিয়া আসে বাপের ঘরে। কিন্তু ভৃগু তারে আবার সংসারে নিতে রাজি হন না। পরে বহুত কান্নাকাটি আর সালিশের পরে ভৃগু আবার পুলমারে সংসারে গ্রহণ করেন…
পৌরাণিক কাহিনীমতে স্বামীর ঘরে ফিরার লাইগা পুলমা এমন কান্দনটা কানছিল যে সেই চোখের পানির স্রোতে বধূসরা নামে আস্ত একখান নদীই তৈরি হইয়া যায়…
কারো কারো যুক্তিতে আফগানিস্তানের বলখ নিবাসী চ্যাবন মুনীই হইলেন রামায়ণের আদি ভার্সন পুলস্ত্যবধ কাব্যের রচয়িতা বা আদি বাল্মিকী বা রামায়ণের আদি কবি। আর পুলস্তবধ্য কাব্যের মূল ঘটনাটা তার নিজের মায়ের অপহরণ ও উদ্ধার ঘটনারই কাব্যিক উপস্থাপন…
পরকীয়ার অবশ্য একটা বেশ সহিংস ঘটনা চলতি রামায়ণে আছে। ঋষি গৌতমের বৌ অহল্যা তার ছাত্র ইন্দ্রের লগে যৌনতায় ধরা পইড়া যায় স্বামীর হাতে। গৌতম ইন্দ্ররে ধইরা দুইটা বিচি গাইলা দেন। আর বৌরে শুকায়া মরার লাইগা বাইন্ধা রাখেন পাথুরে পাহাড়ে। পরে অবশ্য রাম অহল্যারে মুক্ত করে আর বিশ্বামিত্রের শালিসে গৌতম আবার অহল্যারে সংসারে ফিরায়া নেন…
স্বামীর একাধিক বিবাহে বৌর মাত্র একটা প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় মহাভারতে। সেইটা সুভদ্রারে বিয়া করার পর অর্জুনের উপর দ্রৌপদীর ক্ষেইপা উঠা। দ্রৌপদী নিজের পাঁচ স্বামী থুইয়া অর্জুনের আরেক বৌ মানতে পারে না…
অন্যদিকে একাধিক বিবাহ করা স্বামীরে নিজের বশে রাখা না রাখা নিয়া টেনশনের ঘটনাও মাত্র একটা মহাভারতে। কৃষ্ণের বৌ সত্যভামা একবার দ্রৌপদীরে জিগায়- স্বামীরে কেমনে বশে রাখা যায়…
আস্ত মহাভারতে স্বামী ধইরা রাখা বিষয়ে আর কোনো টেনশনের ঘটনা নাই; স্বামীর অন্য বিবাহে গোস্বা করারও ঘটনা নাই…
.
খ. ভীষ্মের মহাভারতীয় ঘটকালি
মহাভারতের দীর্ঘজীবী চিরকুমার দেবব্রত ভীষ্ম নিজের পরিবারে তিন প্রজন্মের লাইগা ঘটকালি করছেন মোট পাঁচখান। বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়া পাঁচটা বিয়াই একটা থাইকা আরেকটা সম্পূর্ণ আলাদা…
তার পয়লা ঘটকালি বাপের বিয়ার। বাপ শান্তনুর বিবাহের প্রস্তাব নিয়া তিনি গিয়া হাজির হন সত্যবতীর বাপের বাড়ি…
আবিয়াইত্যা সত্যবতীর একটা বারো বছরের পোলা থাকায় বিয়ার বাজারে তার অবস্থা আছিল খুবই খারাপ। তারে বিয়া করলে তার পোলারেও খাওয়াইতে হইবে চিন্তায় জোয়ান-তাগড়া কোনো বেটায় বিবাহের প্রস্তাব দিত না তারে। যে দুই একটা প্রস্তাব আসত সেইগুলা হয় বুড়াধুড়া না হয় এমন হাভাইত্যা যে কইন্যাপণ দিবারও ক্ষমতা নাই; ফলে প্রস্তাব ফিরায়ইয়া দিতো সত্যবতীর বাপ…
কইন্যাপণ জিনিসটা শুনতে পাত্রীপক্ষের নেওয়া যৌতুকের মতো মনে হইলেও জিনিটা ভিন্ন। মূলত মাইয়ারে লালন-পালন করতে বাপের যে খর্চা হইছে সেইটার প্রতীকী মূল্য কইন্যাপণ। কেউ কইন্যাপণ দিয়া মাইয়া নিয়া গেলে তার উপর বাপের আর কোনো অধিকার বর্তায় না। সে হইয়া পড়ে পাত্রপক্ষের মানুষ। পাত্রপক্ষ যা ইচ্ছা তাই করতে পারে সেই মাইয়ারে নিয়া। অনেকটা মাইয়ারে বেইচা দিবার মতো…
তবে সাময়িক বিবাহে ছোট অংকের কইন্যাপণজাতীয় মূল্য পরিশোধের একটা প্রচলন আছিল। সেইটা কইন্যার বাপ-ভাই-পরিবার পাইত না; সেইটা নিত পাত্রী নিজে…
এইটা অনেকটা ভাড়াটিয়ার বৌর ভাড়ামূল্যের মতো; চুক্তির মেয়াদ শেষ হইবার পর পাত্রী আবার স্বাধীন হইত। তবে চুক্তিকালীন সময়েও পাত্ৰীরে শাসন-টাসন কিংবা অন্য কোথাও বরাদ্দ দিবার অধিকার থাকত না স্বামীর। এইটা মূলত আছিল সন্তান জন্মদানের চুক্তি; সাধারণ বিবাহের মতো ঘর-সংসার করার চুক্তি না…
মারাত্মকভাবে জনসংখ্যার সংকটে আছিল মহাভারত সমাজের মানুষেরা; বিশেষত আর্য ঘরানার পরিবারগুলা। গেরস্থালির লাইগা বিশেষত বেটা মানুষ লাগত প্রচুর কিন্তু শিশু মৃত্যু আর রোগ বালাইয়ে মানুষের মরার হারও আছিল অতি উচ্চ। ফলে প্রতিটা পুরুষের অন্তত একটা পোলা জন্মদান প্রায় বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি যেকোনোভাবে মানবজন্ম; বিশেষত পুরুষজন্মরে স্বাগত জানানোর সংস্কৃতি গইড়া উঠছিল সেইসব সমাজে। একইভাবে পুত্র জন্মাইতে না পারা নারীরেও দেখা হইত অভিশাপের চোখে…
পুত্র জন্ম না দিয়া মইরা গেলে স্বর্গে যাওয়া অসম্ভব; এইটা মোটামুটি ধর্ম বিশ্বাসের মতোই আছিল সেইসব সমাজে…
কিন্তু হেডম ছাড়া বিয়াশাদি করাও কঠিন। মাত্র অল্প কিছু বেটায়ই পারত মাইয়া পটায়া-ভাগায়া উঠায়া কিংবা স্বয়ংবরায় গিয়া বিবাহ করতে। সাধারণ মানুষের মূল বিবাহপন্থাটা আছিল কইন্যাপণ দিয়া বৌ আনা…
আবার কইন্যাপণ দিবার সামর্থ্যটাও আছিল না বহুতের; বিশেষ কইরা তরুণ মুনি-ঋষিগো। একদিকে চালচুলা পয়সাপাতি নাই; অন্যদিকে পোলা জন্মাইতে না পারলে স্বর্গের রাস্তা যেমন বন্ধ তেমনি পুত্রহীন ঋষির পক্ষে বাজারে প্রতিপত্তি জমানোও কঠিন…
ফলে গরিব আর তরুণ ঋষিরা পুত্র জন্মানোর লাইগা বাইছা নিত কম খর্চার সাময়িক বিবাহের পথ।
এই সিস্টেমে বাচ্চা জন্মায়া দিবার লাইগা রীতিমতো মাইয়াগো একটা সম্প্রদায় গইড়া উঠছিল। এদের বলা হইত অপ্সরা…
অপ্সরাগো লগে চুক্তিতে পাত্র-পাত্রীর পরিবারের উপস্থিতি কিংবা অংশগ্রহণের প্রমাণ নাই। পাত্র নিজেই দরদাম কইরা নিতো পাত্রীর লগে…
চুক্তির মেয়াদ নির্ভর করত একেকটা জন্মদানের হিসাবে। মানে তুমি আমারে একটা পোলা জন্মায়া দিবা; এর বিনিময়ে আমি তোমারে দুইটা বা দশটা গরু দিব; লগে দিব এইটা আর সেইটা…
চুক্তির শর্ত শেষ হইবার পর একই অপ্সরা দিয়া আরেক বাচ্চা পয়দা করতে হইলে চুক্তি নবায়ন লাগত। আর চুক্তি নবায়ন না হইলে অপ্সরা আবার অন্য কারো কাছে যাইত ভাড়া খাটতে…
এই সিস্টেমেই অপ্সরা ঘৃতাচীর গর্ভে পোলা শুকদেবের জন্ম দেন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন… তবে মুনিঋষি ছাড়া গেরস্থগোও মাঝে মাঝে অপ্সরার গর্ভে বাচ্চা জন্মাইতে দেখা যায়। তেমনই একটা উদাহরণ হইল ভীষ্মের জন্মঘটনা…
বেশিরভাগ কাহিনীমতে ভীষ্মের মা গঙ্গাও আছিলেন একজন অপ্সরা। কোনো একটা কারণে বাচ্চা টিকাইতে পারত না রাজা শান্তনু। ফলে এক বাচ্চার চুক্তি কইরা গঙ্গারে পরপর আটটা বাচ্চা জন্মাইতে হয়। পয়লা সাতটাই মরে শান্তনুর হাতে; পরে ক্ষেইপা শান্তনুরে আর আট নম্বর পোলা দেবব্রত বা ভীষ্মরে ছুঁইতেও দেয় না গঙ্গা। নিজেই নিয়া গিয়া বড়ো কইরা বাপের কাছে পাঠায়…
অন্য কাহিনীমতে শান্তনুর লগে গঙ্গার আনুষ্ঠানিক বিবাহ হয়। পয়লা সাত পোলা মরে। অষ্টম পোলা জন্মের পর সে শান্তনুরে তালাক দিয়া পোলা নিয়া বাপের বাড়ি চইলা যায়। পরে পোলায় বড়ো হইয়া বাপের কাছে আসে…
উপাখ্যানগুলার বিবরণমতে এইটাই মহাভারতে একমাত্র তালাকের ঘটনা; যেইখানে স্ত্রী স্বামীরে তালাক দিছে বা ত্যাগ কইরা গেছে। মহাভারতের কাহিনীগুলাতে অন্য কোনো তালাকের ঘটনা আমার স্মৃতিতে নাই…
অবশ্য রামায়ণে স্বামীরা স্ত্রীরে তালাক দিবার অন্তত তিনটা ঘটনা আছে। আবার তালাক দেওয়া বৌ নিয়া ঘর করারও উদাহরণ আছে… রামায়ণে কেকয়রাজ অশ্বপতি তার পোলা মাইয়া যুধাজিৎ আর কৈকেয়ীরে রাইখা দিয়া বৌ তালাক দেন। এর পরে কৈকেয়ীর মায়ের আর পোলামাইয়ার লগে দেখা করারও কোনো ঘটনা পাওয়া যায় না…
অশ্বপতির মাইয়া কৈকেয়ীরে রাজা দশরথ পুত্রসমেত ত্যাগ করেন প্রকাশ্যে। কিন্তু এর পরে দশরথ যান মইরা; কৈকেয়ীর পুত ভরত হয় রাজা ফলে কৈকেয়ীরে আর অযোধ্যা ত্যাগ করতে দেখা যায় না; বরং দশরথের বিধবার মর্যাদা নিয়াই কৈকেয়ী অযোধ্যায় থাকে। যদিও দশরথ তার তালাক প্রত্যাহার করেন নাই…
রাম পয়লা লঙ্কায় সীতারে তালাকের ঘোষণা দেয় কিন্তু হনুমান আর বিভীষণ সীতারে আবার রামের কাছে গছায়া দেয়। আর রামও হাসতে হাসতে বৌ নিয়া বাড়ি আইসা ঘরসংসার করে। কিন্তু পরে তারে দ্বিতীয়বার তালাক দিবার পর আর ঘরে তোলে না…
মহাভারতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন স্বামী-স্ত্রীর অনেক উদাহরণ থাকলেও শান্তনু-গঙ্গা ছাড়া তালাক হওয়া বা সম্পর্ক ছিন্ন স্বামী-স্ত্রীর অন্য কোনো উদাহরণ নাই…
দ্রৌপদী ছাড়া পঞ্চপাণ্ডবের সবারই সংসার করার লাইগা অন্তত একটা কইরা বাড়তি বউ আছিল। এই বৌরা তাগো লগেই ইন্দ্রপ্রস্থ বা হস্তিনাপুর থাকত। কিন্তু এর বাইরে সংসার না করা বৌ অর্জুনের আছিল দুইটা; ভীমের একটা…
ভীমের সংসার বিচ্ছিন্ন বৌ হিড়িম্বা কিংবা অর্জুনের সংসার বিচ্ছিন্ন দুই বৌ উলুপী আর চিত্রাঙ্গদা থাকত তাগো বাপের বাড়ি। কিন্তু বৈবাহিক বা পারিবারিক সম্পর্ক ছিন্ন হয় নাই তাগো। রাজসূয় যজ্ঞের সময় পাণ্ডবগো নয় বৌরেই বিশেষ রাজকীয় আসনে আইসা বসতে দেখা যায়। এর মাঝে বংশের পয়লা বউ হিসাবে ভীমের সংসার বিচ্ছিন্ন বৌ হিড়িম্বারে কুন্তী নিয়া বসায় সকলের মধ্যিখানে… কারো কারো যুক্তিতে পাণ্ডব পরিবারে পয়লা বিবাহ আছিল যুধিষ্ঠির-দেবীকার। যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুরের যুবরাজ থাকতেই নাকি এই বিবাহ হয়। কিন্তু পরিবারের বড়ো বৌ হিসাবে হিড়িম্বারে কুন্তী নিজে আইনা নয়জন বৌর মাঝখানে বসানোর ঘটনায় মনে হয় পাণ্ডব পরিবারে দেবীকার বড়ো বৌ হইবার দাবিটা ঠিক না। হিড়িম্বাই পাণ্ডব পরিবারে পয়লা বৌ। হিসাবে বরং কয় ইন্দ্রপ্রস্থের রাজা হইবার পরেই বরং স্বয়ংবরায় গিয়া দেবীকারে বিবাহ করে অলরেডি বিয়াইত্তা যুধিষ্ঠির…
সেই কালে বিবাহ যে প্রকারেই হউক না ক্যান; নারীরা স্বামীর সম্পত্তি বইলাই গণ্য হইত; যেই কারণে যুধিষ্ঠির সম্পত্তি বিবেচনায় দ্রৌপদীরেও ধইরা বসে জুয়ার দানে; যেইটা নিয়া কোনো প্রশ্নও উঠায় না দ্রৌপদীর বাপ-ভাই…। একই কারণে কুরুযুদ্ধের আগে কর্ণরে পটাইতে গিয়া কৃষ্ণ বলছিল পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিলে সেও দ্রৌপদীর ভাগ পাবে। মানে দ্রৌপদীর স্বামীপক্ষ হিসাবে এগারো সন্তানের মায়েরেও কৃষ্ণ আরেক বেটার বিছানায় বরাদ্দ দিবার অধিকার রাখত…
বাপের বিবাহের লাইগা ভীষ্মের পয়লা ঘটকালিতে দেখা যায় সকল শর্ত চাপাইতেছে পাত্রীপক্ষ আর জি হ ঠিক ঠিক কইয়া পাত্রপক্ষ সব মাইনা নিতাছে বিনাতর্কে। সত্যবতীর মাইমল বাপ বুইঝা ফালাইছিল রাজা শান্তনু তার মাইয়ার পাঁকে পইড়া গেছেন আর শান্তনুপুত বাপেরে কথা দিয়া আসছে যেমনে হউক এই মাইয়ার লগে বিবাহ ঠিক কইরা দিব তার…
স্বয়ং রাজায় পাঠাইছে বিবাহ প্রস্তাব তাই সত্যবতীর বাপ কইন্যপণ নিয়া বেশি কথা না বইলা চাপাইতে থাকে ভবিষ্যতের শর্ত; তার মাইয়ার গর্ভের পোলাপানরে রাজা বানাইতে হবে। ভীষ্ম কয় ঠিকাছে আমি রাজা হমু না। তোমার নাতিরাই হবে। মাইমল কয়- তুমি ঠিকাছে কইলে হবে না। কয়দিন পর তুমি বিবাহ করবা; তখন তোমার পোলাপান করব গ্যাঞ্জাম। ভীষ্ম কয়- ঠিকাছে তাইলে আমি আর বিয়াই করব না। এইবার রাজি হও…
এইটা পরিষ্কার যে এইখানে খেলার বলটা পাত্রীপক্ষের নাগালে আছিল দেইখা মাইমলে খেলাইছে দারুণ। তবে বিবাহ নিয়া দরদামের ঘটনা আস্তা মহাভারতে কিন্তু এইটাই একমাত্র। আর কোনো ক্ষেত্রেই বিবাহের আগে শৰ্তমর্ত নিয়া কোনো কথাবার্তা পাওয়া যায় না কোথাও…
রামায়ণে শর্তের ঘটনা আছে একটা। কেকয়রাজ অশ্বপতি মাইয়া বিয়া দিবার আগে দশরথরে শর্ত দিছিলেন তার মাইয়ার গর্ভজাত পোলা সিরিয়ালে যত নম্বরেই থাকুক না ক্যান; তারেই বানাইতে হবে অযোধ্যার পরবর্তী রাজা। এই শর্তের কারণেই দশরথের বড়োপোলা রামের সিংহাসন দাবি থাকে না অযোধ্যায়; বৈধ দাবিদার হয় ভরত…
ভীষ্ম দ্বিতীয় ঘটকালিটা করেন তার ছোট ভাই সত্যবতীপুত্র বিচিত্রবীর্যের লাইগা। এইখানে কোনো কথাবার্তা নাই। সরাসরি কাশীরাজের বাড়িতে গিয়া তার তিন মাইয়ারে উঠায়া আইনা কন- আমার ছোট ভাইরে তুমগো বিয়া করা লাগব…
মাইয়া ধইরা আইনা বিয়া করার আরো ঘটনা আছে মহাভারতে। এর মাঝে আলোচিত অন্যটা হইল রুক্ষ্মিণীরে উঠায়া কৃষ্ণের বিবাহ; যদিও কেউ কেউ রুক্ষ্মিণীরে কৃষ্ণের প্রেমিকা বানায়া মাইয়া ছিনতাইর দায় থাইকা কৃষ্ণরে সাফাই দিতে চান…
বিচিত্রবীর্যের বিবাহ আয়োজনের ঘটনায় একটা ভিন্ন রীতির উপস্থিতি পাওয়া যায় মহাভারত সমাজে। সেইটা হইল বিবাহে পাত্রীর আপত্তি করার অধিকার…
ভীষ্ম উঠায়া আনেন কাশীরাজের তিন মাইয়া। এর মাঝে বড়ো কইন্যা অম্বা বিচিত্রবীর্যরে বিবাহ করতে অস্বীকার যায়। তারে জোর কইরা ধইরা আনলেও; বিচিত্রবীর্যরে বিবাহ করতে কেউ তার উপরে জোর খাটায় না; তারে ছাইড়া দেওয়া হয়…
আবার পাত্রের পক্ষে বিবাহে অস্বীকৃতি জানানোর ঘটনাও অম্বার কাহিনীতেই পাওয়া যায়। ভীষ্ম ছাইড়া দিবার পর অম্বা ফিরা যায় তার প্রেমিক শান্বর কাছে। কিন্তু ভীষ্ম তারে ছুঁইছে এই দোহাই দিয়া বিবাহে আপত্তি জানায় শাল্ব। এই আপত্তির লাইগা শাল্বর উপর অম্বারে জোরাজুরি করতে দেখা যায় না। তবে অম্বা বিয়ার লাইগা জোরাজুরি করে ভীষ্মরে…
শাল্বর কাছ থিকা ফিরা আইসা অম্বা ভীষ্মরেই প্রস্তাব দেয় তারে বিবাহ করতে। ভীষ্ম বিবাহ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে না; বরং নিজের কুমারব্রতের কথা জানায়া বিবাহে অপারগতা প্রকাশ করে। এইখানে বিয়াতে রাজি করানোর লাইগা জোরাজুরির ঘটনাও ঘটে। অম্বা ভীষ্মরে খালি চাপাচাপিই করে না; বিবাহে রাজি করাইতে এক পর্যায়ে সে লোকলস্কর নিয়া ভীষ্মের লগে রীতিমতো লাঠালাঠি করে। শেষে ভীষ্মের লগে কুলায়া উঠতে না পাইরা আত্মহত্যা করে সে…
বিবাহের লাইগা ভীষ্মরে অম্বার জোরাজুরিটা প্রচলিত রীতির চাইতে জেদ বা ক্ষতিপূরণ আদায়ের চেষ্টাই বেশি মনে হয়। রীতি অনুযায়ী অম্বা চাপাচাপি করলে শাল্বরে করার কথা। কিন্তু সে সেইটা না কইরা করে ভীষ্মরে। হয়ত তারে উঠায়া আইনা জীবন ছানামাখা কইরা দিবার কারণ অম্বার সকল রাগ গিয়া পড়ে ভীষ্মের উপর। ভীষ্মের উপর অম্বার সেই রাগের ঘটনা নিয়া পরে বহুত কাহিনীও তৈরি হইছে মহাভারতে…
রামায়ণে এর উল্টা একটা ঘটনা আছে। সেইখানে পুরুষ নারীরে চাপাচাপি করে বিবাহের লাইগা।
সীতারে উঠায়া আনার পর দেখা যায় রাবণ তারে চাপাচাপি করতে আছে বিবাহের লাইগা…
কাশীরাজের অন্য দুই মাইয়া অম্বিকা আর অম্বালিকার বিবাহে কোনো আপত্তি না থাকায় বিচিত্রবীর্যের লগে তাগো বিবাহ হয়; এই দুই বইন ধৃতরাষ্ট্র আর পাণ্ডুর মা…
এর দুই প্রজন্ম পরে বিবাহে কইন্যার আপত্তির আরেকটা উদাহরণ পাওয়া যায় দ্রৌপদীর স্বয়ংবরায়। সেই স্বয়ংবরায় বহু জাতের বহু কিছিমের প্রার্থী থাকলেও কর্ণরে বিবাহ করতে অনিচ্ছার কথা দ্রৌপদী প্রকাশ্যে ঘোষণা করে। ফলে প্রতিযোগিতা থাইকা কর্ণ বাদ যায়। এইটা নিয়া তখন কাউরে কোনো হাউকাউ করতে দেখা যায় না। মনে হয় কোনো এক উপায়ে কইন্যার এই অধিকারটা স্বীকৃতি আছিল তখন…
চিরকুমার ভীষ্ম তৃতীয় প্রজন্মে ঘটকালি করেন তিনখান। একখান বড়ো ভাতিজা ধৃতরাষ্ট্রের লাইগা; একখান ছোট ভাতিজা পাণ্ডুর লাইগা। আরেকখান বিদুরের লাইগা; ভীষ্ম অবশ্য বিদুররে ভাতিজা গণ্য না কইরা গণ্য করতেন বিচিত্রবীর্যের দাসীপুত্র হিসাবে…
ভাতিজা ধৃতরাষ্ট্রের বিবাহের লাইগা ভীষ্ম গান্ধারীর বাপ সুবলের কাছে দৃশ্যত বেশ আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব নিয়া যান। কিন্তু লগে নিয়া যান সেনাবাহিনী…
বিয়ার প্রস্তাব দিতে সেনাবাহিনী নিয়া যাওয়া বেশ বিকট। ভীষ্ম জানতেন তার আন্ধা ভাতিজার লাইগা সুবলে মাইয়া দিতে রাজি হইব না। তাই মূলত ধামকি দিয়াই সুবলরে বিয়াতে রাজি করান ভীষ্ম। কোনো কোনো কাহিনীমতে সুবলরে বাইন্ধা থুইয়া মাইয়ার বিবাহে রাজি করান ভীষ্ম…
শান্তনু পরিবারে ভীষ্মের তিন প্রজন্মের ঘটকালির ঐতিহ্য ভাইঙা ফালায় পাণ্ডু। নিজে নিজে স্বয়ংবরায় গিয়া নিয়া আসে কুন্তীরে। ভীষ্ম ক্ষ্যাপেন। পরে যখন দেখা যায় কুন্তীর ঘরে বাচ্চাকাচ্চা হয় না; তখন তিনি আবার পাণ্ডুর দ্বিতীয় বিবাহের ঘটকালির দায়িত্ব নিজে নিয়া নেন। আইনা হাজির করেন মাদ্রীরে…
মাদ্ৰীরে কিন্তু ভীষ্ম পয়সা দিয়া কিনা আনেন তার ভাই শল্যর কাছ থিকা। কারণ কইন্যাপণ নিয়াও পাণ্ডুর ঘরে মাইয়া দিতে রাজি হয় নাই কেউ…
কুন্তীর বিবাহপূর্ব সন্তান কর্ণের কথা মোটামুটি সকলেই জানত। পাণ্ডুর ঘরে কুন্তীর বাচ্চা না হওয়ার মূল কারণ যে পাণ্ডুর আটকুরামি সেইটা বুঝত সকলেই। ফলে নিশ্চিত আটকুরার ঘরে মাইয়া বিবাহ দিতে রাজি হয় নাই কেউ। বরং বহুত টেকা পয়সা নিয়া বইনরে বেইচা দেয় মদ্ররাজ শল্য…
শল্যের নীতি-নৈতিকতার মান আছিল নিচা। খালি টেকার লাইগা আটকুরার কাছে বইন বেইচা দেওয়ার ঘটনাই না; বরং কুরুযুদ্ধে সে আসছিল পাণ্ডবদলে যোগ দিয়া ভাইগ্নাগো পক্ষে যুদ্ধ করতে।
আইসা দেখে এগো পয়সা পাতি নাই; উল্টা দিকে দুর্যোধন দেখাইছে বেশি পয়সার লোভ; ব্যাস সে চইলা গেছে ভাইগ্নাগো শক্রশিবির কুরুপক্ষে…
গড় হিসাবেই মনে হয় মদ্র লোকজনরে কিছুটা খাইস্টা কিসিমের ভাবত অন্যরা। যেই কারণে কুরুযুদ্ধের শেষ দিকে আস্তা জাতবংশ তুইলা শল্যরে ধুমায়া গাইলাইতে দেখা যায় কর্ণের…
তবে পয়সা দিয়া কিনা আনলেও মাদ্রী কিন্তু দাসী আছিল না। পাণ্ডুরাজার স্বাধীন বৌই আছিল সে…
অন্য কোনো বিবাহের ক্ষেত্রে জাতপাত মানার ঘটনা না থাকলেও বিদুরের বিবাহে দেখা যায় ভীষ্ম জাতপাত গুনতেছেন…
বিদুরের মা আছিলেন পাণ্ডুর দাসী। এই কারণে বিদুর দাসীপুত্র হিসাবেই গণ্য। বিদুর কুরুরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হইলেও বিবাহের সময় ভীষ্ম তার লাইগা পাত্রী ঠিক করেন রাজা দেবকের শূদ্রা স্ত্রীর গর্ভজাত মাইয়া…
এই ঘটনা মহাভারতে কোন স্তরের সংযোজন ঠিক নিশ্চিত না। কারণ ভীম-অর্জুন দুইজনেই সরাসরি রাক্ষস নামে পরিচিত স্থানীয় শূদ্রেতর শ্রেণিতে বিবাহ করে। সত্যবতীও একজন শূদ্ৰাণি; সেইগুলাতে সমস্যা দেখা যায় না। কিন্তু বিদুরের লাইগা ক্যান বাইছা বাইছা শূদ্রকইন্যা আনা হইল বুঝি নাই…
মহাভারতে জাতপাতের বিষয়টা এক্কেবারে গুজামিল কইরা ঢোকানো। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে ভীষ্মের মুখ দিয়া শ্রেণি বিভাজনের যেই সূত্রগুলা বাইর করা হইছে; সেই সূত্র অনুযায়ী ভীষ্মর নিজের ক্ষত্রিয়ত্ব বাতিল হইয়া হইবার কথা উগ্র নামে একটা নিচু জাতের মানুষ। কৃষ্ণের ক্ষত্রিয় না হইয়া হইবার কথা সূত; মানে যেই সূত জাতীয় পরিচয়ের লাইগা কর্ণরে অপমানিত হইতে হইছে বারবার…
ভীষ্মের বিবরণমতে বাপ ক্ষত্রিয় আর মা ব্রাহ্মণ হইলে পুত হয় সূত। কৃষ্ণের পূর্বপুরুষ যদ্দুর বাপ যযাতি ক্ষত্রিয় আর মা দেবযানী ব্রাহ্মণ; সেই হিসাবে যদ্দুর বংশধর কৃষ্ণ সূতজাতীয় মানুষ…
আবার যযাতির ছোটপোলা পুরু হইল শান্তনু বংশের পূর্বপুরুষ। পুরুর বাপ ক্ষত্রিয় আর মা শর্মিষ্ঠা শূদ্রেতর রাক্ষসবংশজাত নারী। সেই হিসাবে শান্তনুপুত্র ভীষ্মের বয়ানমতে যযাতি-শর্মিষ্ঠার বংশধর হইবার কারণে তার নিজেরই জাত নাইমা যায় নিচে…
দাসীপুত্র হইবার কারণে মহাভারতে দুইটা মানুষরে বেশ লঘুতুচ্ছ হইতে দেখা যায়। এর একজন বিদুর আর আরেকজন ধৃতরাষ্ট্রের পুত যুযুৎসু…
কর্মের দিক দিয়া বিদুর কুরুরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী; ক্ষত্রিয় পদ। আবার বিদ্যায় বিদুর ঋষিতুল্য; ব্রাহ্মণ মর্যাদা পাইবার দাবিদার। বাপের দিক দিয়া মহাঋষি দ্বৈপায়নপুত্র; কিন্তু কী কারণে যেন তার শূদ্র পরিচয়টা কোনোদিনও মোছে নাই…
ধৃতরাষ্ট্রের দাসীগর্ভজাত পুত্র যুযুৎসু। যোগ্যতার দিক দিয়া মহারথ মর্যাদার যোদ্ধা। কিন্তু খালি মায়ের দিক দিয়া শূদ্রাণীপুত্র হইবার কারণে এই ক্ষত্রিয় যোদ্ধারে গণ্য করা হইত শূদ্র হিসাবে। এই জ্বালায় সে কুরুযুদ্ধকালে আইসা যোগ দেয় পাণ্ডবপক্ষে। শেষককালে শিশু পরীক্ষিৎরে অভিষিক্ত কইরা পাণ্ডবরা মহাপ্রস্থানে যাবার পর বহু বছর পাণ্ডব রাজ্যের তত্ত্বাবধায়কও আছিল এই যুযুৎসু। কিন্তু তার শূদ্র পরিচয় খণ্ডায় নাই…
কিন্তু খালি দাসীপুত্র হিসাবে কাউরে ছোটজাত হিসাবে গণ্য করা হইলে ভীষ্মগো পূর্বপুরুষ পুরুরও ছোটজাত গণ্য হইবার কথা। পুরুর মা শর্মিষ্ঠা খালি রাক্ষসবংশজাতই না; বরং আছিল রাজা যযাতির বৌ দেবযানীর দাসী। সেই হিসাবে ভীষ্মসহ পুরা কুরু-পাণ্ডবই দাসীগর্ভজাজতের বংশধর…
শুকদেব-ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ড-বিদুর চাইরজনই কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের ঔরসজাত সন্তান। আজব বিষয় হইল একই দ্বৈপায়নের পোলাগো মাঝে শুকদেব ব্রাহ্মণ; ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডু ক্ষত্রিয় আর বিদুর শূদ্র…
অনেকে বলেন সেইকালে কর্মের উপর ভিত্তি কইরা শ্রেণি নির্ধারণ হইত। সেইটা দ্বৈপায়নের ক্ষেত্রে হইছে; শূদ্রাণীর সন্তান কর্মগুণে ব্রাহ্মণ। শুকদেব চতুর্বেদী ঋষি; ব্রাহ্মণ ঠিকাছে। কর্ণরে পয়লা শূদ্র বলা হইলেও যখন দুর্যোধন তারে অঙ্গরাজ্যের রাজা ঘোষণা করে; তার পর থাইকা তারে ক্ষত্রিয় গণ্য করা হয়; ঠিকাছে। কিন্তু এই কর্মগুণে শ্রেণি নির্ধারণের বিষয়টা কোনো এক কারণে বিদুর বা যুযুৎসুর বেলায় প্রযোজ্য হয় নাই…
.
গ. মহাভারতের পোলাপান
মাইয়ার লাইগা বাপের কিংবা পরিবারের কিছু করার উদাহরণ মহাভারতে মাত্র দুইটা। এর মাঝে একটা দ্রৌপদীর বাপ দ্রুপদের। দৃশ্যত মাইয়ার পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়া ঝাড়ে বংশে উজাড় হয় দ্রুপদ…
কিন্তু কুরুযুদ্ধে দ্রুপদের এই অংশগ্রহণ কতটা তার মাইয়ার লাইগা আর কতটা কুরুরাজ্য-সমর্থিত দ্রোণাচার্যের কব্জা থাইকা তার হারানো অর্ধরাজ্য উদ্ধার করার লাইগা; সেইটা বোঝা মুশকিল…
কারণ দ্রৌপদীরে পাঁচ ভাইয়ে ভাগ কইরা নেওয়া কিংবা তার কোনো অপমান যন্ত্রণায়ই দ্রুপদরে আগাইয়া আসতে দেখা যায় নাই কোনোদিন…
আস্তা মহাভারতে; এবং জানামতে আস্তা ভারতীয় পুরাণে; যে কোনো অবস্থায় মাইয়ার পক্ষে খাড়াইতে দেখা যায় মাত্র একটা বাপরে; তিনি শুক্রাচার্য নামে পরিচিতি ঋষি উশনা…
মাইয়া দেবযানীর আব্দারে তিনি রাজি হইয়া যান শত্রুপক্ষের পুরোহিত বৃহস্পতির পোলা কচরে তার শল্যাবিদ্যা আর এন্টিসেপটিকের ফর্মুলা শিখাইতে। শুক্রাচার্যের এই ফর্মুলাগুলা আছিল মৃতসঞ্জিবনী নামে পরিচিত। শুক্ৰ আছিলেন এক ছোট এক দ্বীপরাজ্যের রাজা বৃষপর্বার পুরোহিত। সেইখানেই তিনি চালাইতেন নিজের যুদ্ধ আর চিকিৎসাবিদ্যার ইস্কুল…
তির-বর্শা-কুড়ালে যুদ্ধের সেইকালে বেশিরভাগ সৈনিকই যুদ্ধের মাঠে লগে লগে মরত না। বরং যুদ্ধে আহত হইয়া ক্ষত বিষয়া মরত গিয়া পরে। শুক্রাচার্য এই ইনফেকশন ঠেকাইবার সূত্র জানতেন। একই লগে শইলে গাঁথা তির-বর্শার ফলা তিনি অপারেশন কইরা বাইর কইরা সৈনিকগো সুস্থ কইরা তুলতে পারতেন। ফলে তিনি যেই পক্ষে থাকতেন সেই পক্ষের যুদ্ধে ফাইনালি মানুষ মরত খুবই কম। পুরাণের ভাষায় তাগো আবার জীবনদান কইরা দিতেন ভার্গব ঋষি শুক্রাচার্য…
অন্যদিকে তার প্রতিপক্ষ; দেবতাগো শল্যবিদ্যা কিংবা এই এন্টিসেপটিকের ফর্মুলা জানা না থাকায় যুদ্ধে আহত বেশিরভাগ সৈনিকই আর টিকত না পরে…
বৃহস্পতি তার পোলা কচরে পাঠান শুক্রের কাছ থিকা এই ফর্মুলা শিখা আসতে। কচ আইসা পটায়া ফালায় শুক্রের মাইয়া দেবযানীরে। আর মাইয়ার আব্দারে শুক্র রাজি হইয়া যান শত্রুপক্ষের প্রতিনিধি করে তার গোপন ফর্মুলা শিখাইতে…
রাজা বৃষপর্বা; এমনকি তার শিষ্যরা পর্যন্ত আপত্তি করে; কিন্তু পাত্তা দেন না শুক্র। তার একটাই কথা-মাইয়ারে আমি কথা দিছি; সুতরাং কচরে মূতসঞ্জিবনী বিদ্যা শিখাইতেই হবে…
শুক্রের কালে কোনো দিক দিয়াই তারে চ্যালেঞ্জ করার কেউ আছিল বইলা মনে হয় না। মাইয়ার এক গোস্বা নিবারণ করতে গিয়া যে রাজ্যে তিনি থাকতেন সেই রাজ্যের রাজকইন্যারে পর্যন্ত নিজের মাইয়ার দাসী বানায়া ফেলার ক্ষমতা আছিল তার…
শুধু মাইয়ায় পাত্র পছন্দ করছে বইলা সমস্ত শাস্ত্রের বিধান অমান্য কইরা তিনি দেবযানীর বিয়া দেন। এই বিষয়ে টু শব্দ করার সাহস করে না কোনো শাস্ত্রকার…
দেবগুরু বৃহস্পতির বৌরে তার ছাত্র সোম ভাগায়া আইনা আশ্রয় নেয় শুক্রাচার্যের কাছে। সোমরে ধরা-মারার লাইগা রীতিমতো যুদ্ধের আয়োজন কইরা বসে দেবতাকূল। কিন্তু সে শুক্রের আশ্রয়ে আছে শোনার পর হাত-পা গুটায়া ফেলে দেবতাকূল; বৌ ফিরত পাইবার লাইগা কান্নাকাটি ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না বৃহস্পতির…
রাজা বৃষপর্বার মেয়ে শর্মিষ্ঠা দেবযানীর সমবয়েসি এবং বান্ধবী। একদিন কোনো এক কথা কাটাকাটিতে শর্মিষ্ঠা টিটকারি মাইরা দেবযানীরে কয়- খাটাখাটনি যা করার তা তো করে আমার বাপ। তোর বাপ তো আমার বাপের ঘাড়ে বইসা খায়…
শুক্রের অপমানে দেবযানী কাইন্দা বাপেরে জিগায়- আমি কি তবে এক পরখাউকির মাইয়া? যদি সেইটা হয় তবে অন্য কোথাও চলো যেইখানে তুমি খাটনি দিয়া খাওয়াবা আমারে…
মাইয়ার হাত ধইরা শুক্র গিয়া হাজির হন বৃষপর্বার কাছে- গ্রাম উঠায়া নিতাছি আমি; উস্টা মারি তোমার ভাতে। আমি গেলাম…
এইখানে বইলা যাওয়া ভালো যে আদিতে গ্রাম বলতে স্থির কোনো স্থান বুঝাইত না। বরং একজন ব্রাহ্মণের পরিবার-পরিজন গরুবাছুর দাসদাসী চ্যালা-শিষ্য মিলা যে লটবহর; সেইটারে বলত গ্রাম…
গ্রাম আছিল ভ্রাম্যমাণ। গ্রামপ্রধান ব্রাহ্মণ সেইটারে সুবিধামতো এক জায়গা থাইকা তুইলা অন্য জায়গায় নিয়া বসাইতেন। অথবা বলা যাইতে পারে নিজের গ্রাম নিয়া ঘুইরা বেড়াইতেন ব্রাহ্মণেরা। সম্ভবত এই কারণেই এখন পর্যন্ত যেমন গ্রামের কোনো পরিস্কার সংজ্ঞা নাই তেমনি সীমানা কিংবা বৈশিষ্ট্যের কোনো সাধারণ মানদণ্ডও নাই…
যাউকগা; পোলাপাইনের কাইজায় তার উপর রাগ না করতে বৃষপর্ব কাকুতি মিনতি করেন শুক্রর কাছে। শুক্ৰ কন- আমার মাইয়ারে যদি তুমি খুশি করতে পারো; তবেই তোমার রাজ্যে গ্রাম বহাল রাখব আমি…
রাজা বৃষপর্ব দেবযানীরে জিগান- কী করলে খুশি হইবা তুমি? দেবযানী কয়- আপনের মাইয়া শর্মিষ্ঠারে আমার দাসী বানায়া দিলে আমি খুশি হব…
বিনা তর্কে রাজা তার নিজের মাইয়ারে পুরোহিতের মাইয়ার দাসী বানায়া দেন। মাইয়া খুশি তো শুক্রও খুশি; গ্রামও নড়ান না; টোলও চালাইতে থাকেন…
এই দিকে দেবযানী পইড়া গেছিল বৃহস্পতির পুত কচের প্রেমে। কিন্তু শুক্রর কাছে বিদ্যাশিক্ষা শেষ হইবার পর কচ দেয় ভাগল। ফলে রীতিমতো পুরুষ-পাগলি হইয়া উঠে ছ্যাকা খাওয়া দেবযানী…
এর মাঝে একদিন শিকারের কালে রাজা যতাতিরে দেখে দেবযানী। যযাতি তখন খুবই প্রতাপী রাজা; বিবরণমতে সুপুরুষও বটে। সোজা গিয়া দেবযানী তারে কয়- আমারে বিবাহ করো…
দেবযানীর পরিচয় শুইনা শইলের লোম খাড়ায় যযাতির। পয়লা কথা ক্ষত্রিয় হইয়া ব্রাহ্মণ কইন্যা বিবাহ নিষিদ্ধ; বিধানমতে ক্ষত্রিয়গো কাছে ব্রাহ্মণ কইন্যা মায়ের সমান। এই রকম কিছু ঘটাইলে সিংহাসন টইলা উঠব তার…
আবার অন্যদিকে শুক্রের মাইয়ারে ক্ষ্যাপাইলে কপালে কী গর্দিশ নাজেল হয় কে জানে। তাই পিছলা বুদ্ধি করে যযাতি। সে দেবযানীরে কয়- এই বিষয়ে আমি শুক্রাচার্যরেই সালিশ মানলাম। তিনি যা কন তাই হবে…
শুইনা শুক্ৰ কন- আমার মাইয়ায় তোমারে পছন্দ করেছ। এইখানে আবার কথা কীসের? তুমি তারে বিবাহ করো। যযাতি মিনমিনায়- আচার্য ধর্মের বিধান যে বাধা দেয়। শুক্র ধামকি লাগান-ধর্মের বিধান কি আমার থাইকা বড়ো?
যযাতি দেবযানীরে বিবাহ করায় বিধানমতে দেবযানীর দাসী শর্মিষ্ঠার লগেও যৌনতার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় তার। কিন্তু শুক্র শাসায়া দেন যযাতিরে-ওর দিকে নজর দিবা না কলাম…
এই দিকে জনসংখ্যা আকালের যুগে প্রতিটা নারীর প্রতিটা ঋতুস্রাবরে গণ্য করা হইত একেকটা জন্মের সম্ভাবনা হিসাবে। ঋতুমতি কোনো নারী কোনো পুরুষের কাছে আইসা সন্তানের বীজ চাইলে যদি পুরুষ সেইটা ফিরায়া দিত তবে বলা হইত মরার পরে নির্ঘাত নরকে হইব তার গতি…
ফলে শর্মিষ্ঠা ঋতুবতী হইলে বিধানমতে এর প্রতিকার চায় যযাতির কাছে। আর যযাতিও দেবযানীরে লুকায়া পুরুসহ দুইটা পোলা জন্মায় শর্মিষ্ঠার গর্ভে…
এই সংবাদ শুইনা শুক্র যযাতির উপর ক্ষেপলেও পরে তিনিই শর্মিষ্ঠারে দাসত্ব থাইকা মুক্তি দিয়া যযাতিরে বলেন তারেও রানির মর্যাদা দিতে…
শর্মিষ্ঠার গর্ভে দুই পোলা আর দেবযানীর গর্ভে দুই; মোট চাইর পোলার বাপ আছিলেন যযাতি। অসুখের কালে বড়ো তিন পোলা ঠিকমতো বাপের যত্ন না করায় ক্ষেইপা শর্মিষ্ঠা গর্ভজাত ছোটপোলা পুরুরেই সিংহাসন দিয়া যান যযাতি। এই পুরুরই বংশধর ভীষ্মের বাপ রাজা শান্তনু…
শুধু মহাভারত না; আস্তা ভারতীয় পুরাণের অন্য কোথাও মাইয়ার আব্দার মিটাইবার লাইগা বাপের পুরা ধর্ম এবং রাজশাসনের বিরুদ্ধে খাড়াইবার এমন দ্বিতীয় কোনো উদাহরণ আমি পাই নাই…
মাইয়ারা বরং অনেকটা বিনিময়যোগ্য সম্পদের মতোই গণ্য হইত। কুন্তীরেও তার বাপে ছোটবেলা দোস্তর বাড়িতে দান কইরা দেয়। কোনো কারণ ছাড়াই। আবার অবলীলায় শত্রুপক্ষেও মাইয়া দিয়া দিবার ঘটনা আছে। দুর্যোধনের মাইয়া লক্ষ্মণার বিবাহ হয় কৃষ্ণের পোলা শাম্বর লগে। কুরুযুদ্ধে সে শ্বশুরের বিপক্ষেই যুদ্ধ করে; আবার ভীমের হাতে মরা জরাসন্ধের মাইয়া করেণুমতি আছিল নকুলের বৌ…
কোনো এক অদ্ভুত কারণে স্বামীপক্ষের লগে পিতৃপক্ষের বিরোধে কোনো কথা কইতে দেখা যায় না মহাভারতীয় নারীদের। আস্তা ভারতীয় পুরাণে সম্ভবত শুধু শিবের বৌ সতী স্বামীরে শ্বশুরবাড়ি নিমন্ত্রণ খাইতে না ডাকায় বাপের লগে কাইজা করছিল…
মহাভারতে মা-পুতের সম্পর্কের কড়া উদাহরণ আছে দুইটা। এর একটা কুন্তীর পরিবার; আরেকটা সত্যবতী-দ্বৈপায়নের সমীকরণ…
কুন্তীরে আগাগোড়াই তার পোলাগো কেয়ার করতে দেখি। বুড়া বয়স পর্যন্ত কুন্তী তাগোরে আগলাইয়া রাখে। যুদ্ধের আগে যখন কুন্তীর পোলাগো নাতি নাতনি পর্যন্ত হইয়া গেছে তখনো তারে দেখি পোলাগো জীবন বাঁচাইতে কর্ণের কাছে গিয়া মিনতি করতে…
কিন্তু কোনো এক কারণে পোলারা রাজা হইবার পর কুন্তী তাগো লগে থাকে না। সে থাকে হস্তিনাপুর তার শ্বশুর বাড়িতে। এমনকি শেষ বয়সে পোলাগো থুইয়া সে ধৃতরাষ্ট্র আর বিদুরের লগেই বানপ্রস্থে গিয়া মরে…
কুন্তীর আরেকটা বিষয় বেশ বিস্ময়কর। তার পোলাগো শত্রুতা ধৃতরাষ্ট্রপক্ষের লগে থাকলেও সে আগাগোড়াই বসবাস করে ভাসুর ধৃতরাষ্ট্রের হস্তিনাপুর রাজবাড়িতে। এইখানে বইসাই সে পোলাগো পক্ষে কাজ করে। এইটা নিয়া কুন্তীর নিজের যেমন কোনো মানসিক বিকার দেখা যায় না; তেমনি তারে কেউ কোনো খোটা দিতেও দেখা যায় না…
এই রকম একটা পরিস্থিতি রামায়ণেও আছে। বিভীষণ রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কিন্তু তার বৌ সরমা আগাগোড়াই স্বাধীন-সাবলীল মানুষ হিসাবে থাকে ভাসুর রাবণের বাড়িতে…
বর্তমান নৈতিকতায় শত্রুতা আর না-শত্রুতার এই সমীকরণগুলা মিলানো কঠিন। হইলে হইতে পারে নারীরে কেউ গণায় ধরত না দেইখা কুন্তী কিংবা সরমার শত্রুপক্ষে থাকারে পাত্তা দেয় নাই কেউ। আবার এমনো হইতে পারে যে শ্বশুর বাড়িতে থাকা বিবাহিত নারীর স্বাভাবিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত আছিল যার লাইগা এই বিষয়ে প্রশ্ন উঠায় নাই কেউ। আবার হইলে হইতে পারে সেইসব সমাজে শত্রুতার নৈতিকতাগুলা এমন আছিল যে স্বামী বা পোলার লগে শত্রুতা থাকলেও মা কিংবা বৌরে শত্রু ভাবত না কেউ; যদিও এইটা প্রকাশ্যই আছিল যে কুন্তী ধৃতরাষ্ট্ররে ক্ষমতাচ্যুত করতে কাজ করতেছে আর সরমা সক্রিয়ভাবেই যুক্ত আছে রাবণরে টাইনা নামানোয়…
তবে স্বামীরে কাবু করার লাইগা বৌ ধর্ষণের ঘটনা নারায়ণী উপাখ্যানগুলাতে পাওয়া যায়। কাহিনীমতে স্বয়ং নারায়ণ জলন্ধর নামের এক অসুররে কাবু করতে তার বৌ বিন্দারে ধর্ষণ করেন…
একইভাবে স্বামীরে কাবু করতে বৌরে আক্রমণের একটা ঘটনা আছে রামায়ণে। রাবণরে উদভ্রান্ত কইরা তুলতে হনুমান রাবণের বৌ মন্দোদরীরে প্রকাশ্যে লাঞ্ছনা করে; কোনো কোনো কাহিনীমতে মন্দোদরীরে ধর্ষণ করে হনুমান…
মহাভারতে মাতৃত্ব-পিতৃত্ব কিংবা মা বাপের লাইগা সন্তানের আবেগ কিংবা পোলাপানের লাইগা মা বাপের আবেগের বিষয়গুলা খুব কমই উপস্থিত। দুর্যোধনের প্রতি ধৃতরাষ্ট্রের পক্ষপাত বাপ হিসাবে খুবই পরিষ্কার কিন্তু আবেগটা সেইখানে নাই; স্নেহ আছে; প্রশ্রয় আছে; সমর্থন আছে…
মহাভারতের কাহিনীমতে গান্ধারী একশো পুতের জননী। কিন্তু আজব বিষয় হইল গান্ধারী চরিত্রটার ভিতর বিন্দুমাত্র মাতৃত্বের আবেগ নাই। এইটা হইতে পারে ধৃতরাষ্ট্রের একশো পোলার একটাও তার গর্ভজাত না বইলা। আবার কুরুযুদ্ধের শেষে লাশ দেখতে গিয়া গান্ধারী খালি কয়েকটা নাম নিয়া কিছু আনুষ্ঠানিক বিলাপ করেন; কেউ কেউ কন গান্ধারীর মূলত দুযোর্ধন-দুঃশাসনসহ মাত্র পাঁচ ছয়টা গর্ভজাত পোলা আছিল…
গান্ধারী কিন্তু তার কথিত পোলাগো লাইগা যতটা আবেগ দেখান তার চাইতে বেশি আবেগ দেখান কর্ণের লাশ দেইখা। কর্ণের বিচ্ছিন্ন পচাগলা মাথাটা তিনি তুইলা আইনা দেহের পাশে রাখেন। কিন্তু এর বিন্দুমাত্রও আবেগও তিনি নিজের কথিত পুত্রগো লাইগা দেখান না…
কর্ণের লাইগা কুন্তীর আবেগটা গর্ভধারিণীরই আবেগ। কর্ণের লাইগাই কুন্তী শেষ পর্যন্ত রাজবাড়ি ছাইড়া বনে গিয়া মরে। কর্ণের শেষকৃত্যের লাইগা সে টেকা চাইছিল; কিন্তু পাণ্ডবগো অর্থমন্ত্রী ভীম সেইটা দিতে রাজি হয় নাই; এইটাই কুন্তীর রাজবাড়ি ছাইড়া দিবার সিদ্ধান্তের কারণ…
সম্পর্কের আবেগের দিক দিয়া কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন অনন্য। মা কিংবা সন্তানদের গর্ভধারণীগণ কিংবা পোলাগো লাইগা তার দায় মিটানো আগাগোড়াই মানবিক আবেগে ভরপুর…
মহাভারতে সবচে ব্যক্তিত্ববান আর অভিজাত সম্পকটা সত্যবতী আর তার পুত্র দ্বৈপায়নের। কথাবার্তা খুব কম। রাজবাড়িতে মায়ের বিবাহ হইলেও কোনোদিন রাজভোগ খাইতে আসে না পুত। কিন্তু যখনই মায়ের দরকার তখনই গিয়া আগলাইয়া খাড়ায়…
এবং শেষ বয়সে রাজবাড়ির গ্যাঞ্জাম থাইকা সত্যবতীরে নিজের কাছে নিয়া যান দ্বৈপায়ন। তার দুই সন্তানের দুই গর্ভধারিণী অম্বিকা-অম্বালিকারেও শেষকালে নিজের কাছে নিয়া যান দ্বৈপায়ন; মাঝে মাঝে মনে হয় অম্বিকা-অম্বালিকার জীবনে একমাত্র সম্মানপ্রাপ্তি এই ঘটনাটাই…
পুতের লাইগা দ্বৈপায়নের আবেগের সর্বোচ্চ দেখা যায় যখন শুকদেব নিজের নামে টোল খোলার লাইগা পিতার আশ্রম ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। বর্ণনামতে দ্বৈপায়ন জঙ্গলের গাছে গাছে ধইরা বুক ভাসায়া কান্দেন-পুত যাইও না…
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী তার মহাভারতের ছয় প্রবীণ পুস্তকে এই ঘটনাটার বড়ো অদ্ভুত একট উপসংহার টানছেন। তিনি কন-বৃদ্ধ পিতার কানের মূল্য বোঝেন নাই বইলাই শেষ পর্যন্ত শুকদেব শুধুই এক চতুর্বেদী ঋষি। আর পুতের বিদায়ে বুক ভাসায়া কানতে পারছিলেন বইলাই দ্বৈপায়ন হইলেন গিয়া মহাকবি…
দ্বৈপায়ন আগাগোড়াই আছিলেন তার পোলাগো পিছে। ঘুইরা ফিরাই দেখা যায় তিনি আইসা উপস্থিত তার লোভী আর আন্ধাপোলা ধৃতরাষ্ট্রর কাছে। আবার রাজনৈতিক গ্যাঞ্জামে রাজ্যহারা মৃত মাইজম পোলার ঘরের নাতিগো বনবাসকালে তিনিই আছিলেন প্রধান আশ্রয়; শিষ্যের বাড়িতে তাগোরে লুকায়া রাখার ব্যবস্থা করা থাইকা দ্রৌপদীর লগে পাঁচ ভাইর বিবাহ সিস্টেম করা সবখানেই দ্বৈপায়ন…
বিদুররে তিনি বরাবরই পুত্র বইলা সম্বোধন করতেন। শেষকালে যুধিষ্ঠিররেও দ্বৈপায়ন মনে করায়া দেন- তুমি কিন্তু বিদুরেরই অংশ…
শ্বশুর হিসাবে পুত্রবধু কুন্তীর বেলাতেও দ্বৈপায়নরে দেখি দায়িত্বশীল। কুরুযুদ্ধ শেষের যজ্ঞে ব্রাহ্মণ হিসাবে তিনি যে টেকাপয়সা পান; সবগুলাই তিনি কুন্তীরে দিয়া দেন। কোনো এক কারণে হয়তো তিনি বুঝতে পারছিলেন যে সম্রাট যুধিষ্ঠিরের কোষাগারে হাত পাততে কুন্তীর ব্যক্তিত্বে লাগবে…
দ্বৈপায়নের এই অনুমান সঠিকই হইছিল শেষ পর্যন্ত। পাণ্ডবেরা রাজকোষ থাইকা কুরুপাণ্ডব অনেকেরই শেষকৃত্য করে। কুন্তী কর্ণের শেষকৃত্য করার প্রসঙ্গ তুললে অর্থমন্ত্রী ভীম কর্ণের লাইগা টেকা দিতে অস্বীকার করে। আর এই একটা ঘটনাতেই রাজমাতা কুন্তী পোলাগো রাজবাড়ি ছাইড়া বনে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়া বসে…
মা-পুতের সম্পর্কের অন্য কিছু উদাহরণ হিড়িম্বাঘটোৎকচের উপকাহিনীগুলাতে পাওয়া যায়; বাকি কাহিনীগুলায় মায়েরা কেমন যেন অনুল্লেখে হারায়া যায় ঘটনার ভিড়ে…
মাতৃভক্তির বিষয়টা ঘটোৎকচের ভিতর খুবই পরিস্কার। পাণ্ডবগো রাজসূয় যজ্ঞে হিড়িম্বার অপমানে ঘটোৎকচ যেমন হামলায় পড়ে তেমনি বনবাসকালে সম্মা দ্রৌপদীরে পর্যন্ত কান্ধে কইরা পাহাড়। পার কইরা দেয় ঘটা…
মা-পুতের আরেকটা ঘটনা হইল ঘটোৎকচ-অহিলাবতীর পোলা ঋষি খাটোশ্যাম বর্বরীকের। মা অহিলাবতী পুতেরে বলছিল সর্বদা দুর্বলের পক্ষে থাকতে; সেই কথা মাইনা বর্বরীক ঋতিমতো ঋষি হারুকি সহায় নামে বিখ্যাত হইয়া উঠছিল…
কাহিনীগুলা পইড়া মনে হয় আর্য ঘরানার পরিবারগুলার চাইতে সম্ভবত অনার্য পরিবারগুলায় মায়ের অবস্থান কিছুটা মর্যাদাময় আছিল পোলাগো কাছে। কুন্তী সারা জীবন পোলাদের পাইলা পুইষা বড়ো করলেও শেষকালে পোলাগো পরিষ্কার অবহেলার শিকার হয় সে…
অম্বিকা-অম্বালিকা মহাভারতের বড়োই নীরব নারী। তাগো গর্ভের সন্তানেরা রাজা-বাদশা কিন্তু তাগো কোনো কথা নাই। একেবারে নীরব। একেবারে নগণ্য মানুষ তারা। এইটার কোনো মানে বুইঝা উঠতে পারি নাই আমি…
মহাভারতে দ্রৌপদী হইল এক স্রোতে ভাসা মানুষ। নিজে কোনো ঘটনারই জন্ম দেয় না; মোড়ও বদলায় না কোনো ঘটনার। কর্ণরে বিবাহ করতে রাজি না; এই কথাটা বলা ছাড়া আস্তা মহাভারতের কোনো ঘটনা সংগঠনেই দ্রৌপদীর প্রায় কোনো অবদান নাই; সবখানে সে থাকলেও; সবখানেই সে স্রোতে ভাইসা যাওয়া নারী…
গর্ভজাত ছয় মাইয়া আর পাঁচ পোলার লগেও দ্রৌপদী-জীবনের কোনো বিবরণ মহাভারতে প্রায় নাই…
কুরুযুদ্ধে পাঁচ পাণ্ডবই পোলাপান হারায়। এর মাঝে ঘটোৎকচ মরায় জেঠা যুধিষ্ঠিররে কিছুটা আবেগি হইতে দেখা যায়; কিন্তু ভীমের তেমন কোনো নড়ন চড়ন নাই। অভিমন্যু মরায় অর্জুন কিছু ঝিমায়; কিন্তু তাও খুবই সামান্য মনে হয়। অন্য পোলাগো মরণে অর্জুনের কোনো বিকার পাওয়া যায় না মহাভারতে… আরো অনেকেরই পোলাপাইন মরে কুরুযুদ্ধে; কিন্তু খুব একটা আবেগ দেখা যায় না কোথাও…
পাণ্ডবগো পোলাপানের হিসাব নিয়া বহুত গড়বড় আছে মহাভারতের কাহিনীগুলায়…
দ্রৌপদীর ঘরে পাঁচ পাণ্ডবের আছিল পাঁচ পোলা; বয়সের দিক দিয়া পয়লা যুধিষ্ঠিরের পুত প্রতিবিন্ধ্য; তারপর ভীমের পুত সুতসোম; তারপর নকুলের পুত শতানীক; তারপর সহদেবের পুত তসেন এবং সর্বশেষ অর্জুনের পুত শ্রুতকর্মা…
এই পাঁচ পোলাই কুরুযুদ্ধ করে আর যুদ্ধের শেষ দিকে অশ্বত্থামার তলোয়ারে ঘুমের মইদ্যে মারা যায়; এগো মরণে বুক চাপড়ায়া কান্দে দ্রৌপদী; এই কাহিনী মোটামুটি মহাভারতের মূল কাহিনীর অংশ; সকলেই জানে… কিন্তু দ্রৌপদী একই লগে আছিল অন্তত পাঁচটা মাইয়ার মা। কারো কারো হিসাবে অর্জুনের ঔরসে তার যমজ মাইয়া জন্মায়; সেই হিসাবে ছয় মেয়ের মা সে; মহাভারতের কাহিনীগুলায় এই মাইয়ারা প্রায় অনুপস্থিত…
দ্রৌপদীর প্রথম সন্তান যুধিষ্ঠিরের ঔরসে জন্মানো মাইয়া সুতনু। সুতনুর বিবাহ হয় কৃষ্ণ-সত্যভামার পোলা ভানুর লগে…
ভীমের ঔরসে দ্রৌপদীর মাইয়া সংযুক্তা। অর্জুনের ঔরসে দ্রৌপদীর মাইয়ার নাম প্রগতি; কেউ কেউ বলেন প্রগতির আছিল প্রজ্ঞা নামে আরেকটা জমজ বইন… নকুলের ঔরসে দ্রৌপদীর মাইয়া প্রিনতা; সহদেবের ঔরসে সুমিত্রা…
সুতনু ছাড়া দ্রৌপদীর বাকি মাইয়াদের অন্য কোনো তথ্যের অস্তিত্ব প্রায় নাই…
দক্ষিণ ভারতীয় কাহিনীমতে দ্রৌপদী-সুভদ্রা-উলুপী-চিত্রাঙ্গদা বাদেও আরো তিনটা বৌ আছিল অর্জুনের। মানে মোট সাতটা বিবাহ করছিল অর্জুন…
সুভদ্রার ঘরে অর্জুনের পোলা অভিমন্যুর কথা সকলেই জানে। সুভদ্রার একটা মাইয়াও আছিল ভার্গবী নামে; যার বিবাহ হয় ভীমের পোলা ঘটোৎকচের লগে…
পাণ্ডবগো বৌদের মাঝে ভীমের বৌ হিড়িম্বা আর অর্জুনের দুই বৌ উলুপী-চিত্রাঙ্গদা থাকত তাগো নিজ নিজ বাপের বাড়ি…
পাণ্ডবগো অন্য বৌদের ঘরেও পোলাপান জন্মাইছিল। যুধিষ্ঠির-দেবীকার পোলা আছিল যৌধেয়। যৌধেয় কুরুযুদ্ধে অংশ নিবার কোনো নিশ্চিত বিবরণ নাই। তবে কুরুযুদ্ধে তার নানা গোবাসন মইরা গেলে নানার সিংহাসনে সে শিবির রাজা হয়…
ভীম-বলন্ধরার পোলা সবগ। হিড়িম্বা আর দ্রৌপদী গর্ভজাত ভীমের দুই পোলা কুরুযুদ্ধে মারা গেলেও সর্বগ কুরুযুদ্ধে যোগ দেয় নাই এইটা নিশ্চিত। তার জীবনী সম্পর্কেও আর কোনো তথ্য নাই…
নকুল-করেণুমতীর পোলা নিরমিত্র আর সহদেব-বিজয়ার পোলা সুহোত্রর নাম পাওয়া যায়…
কুরুযুদ্ধে সুহোত্র কর্ণের হাতে মারা যায়; নিরমিত্রের কুরুযুদ্ধে যোগ দেয়া কিংবা অন্য কোনো সংবাদ বিশেষ নাই…
অন্যদিকে পাণ্ডবরা মহাপ্রস্থানে যাবার আগে অভিমন্যুর পোলা পরীক্ষিৎরে যখন রাজা বানায়া দিয়া যায় তখন তাগো অন্য বৌদের ঘরে জন্মানো পাণ্ডব পোলাপানের সেই রাজ্যে কোনো হিস্যা আছিল কি না তার বিবরণ মহাভারতে নাই…
ভীম-হিড়িম্বার পুত ঘটোৎকচের দুই বৌ নাগকইন্যা অহিলাবতী আর অর্জুন-সুভদ্রার মাইয়া ভার্গবী। অহিলাগৰ্ভজাত ঘটোৎকচের দুই পোলা অঞ্জনপৰ্বা আর বর্বরীকের বেশ বিস্তারিতই পাওয়া যায়; কোনো কোনো কাহিনীমতে তার তৃতীয় পুতের নাম আছিল মেঘবর্ণ…
ভার্গবীর কোনো সন্তানের সন্ধান পাই নাই আমি…
কিছু আখ্যানমতে যুদ্ধজয়ের আশায় কুরুযুদ্ধ শুরুর আগে ঘটোৎকচের ছোটপোলা বর্বরীকরে বলি দেয় কৃষ্ণ; আর কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ কইরা মরে অর্জুন-উলুপীর পোলা ইরাবান; যে কিনা দক্ষিণ ভারতে ইরাবত নামে পরিচিত। অন্য আখ্যানগুলায় দেখা যায় ইরাবান কুরুযুদ্ধ করে না বরং বর্বরীকের স্থলে সেই বলি হইতেছে কৃষ্ণের হাতে…
তবে ঘটনা হইল বর্বরীক আর ইরাবানের পূজা এখনো প্রচলিত আছে; মন্দিরও আছে। বর্বরীক পূজিত ঋষি ও বীর হিসাবে ইরাবান পূজিত বীর ও দেবতা হিসাবে…
অর্জুন-চিত্রাঙ্গদার পোলা বভ্রুবাহন কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ কইরা মরছে এবং যুদ্ধে আসে নাই; দুইজাতের কাহিনীই আছে…
দ্রৌপদী আর সুভদ্রা গর্ভজাত পাণ্ডব পোলপান ছাড়া অন্যরা পরবর্তী জীবনে পাণ্ডবগো পরিচয় দিছে কি না তারও খুব একটা বিবরণ পাওয়া যায় না…
পালক বাপের আদেশে ঋষি দুর্বাসার সেবা করতে গিয়া গর্ভবতী হয় কিশোরী কুন্তী; জন্ম হয় কর্ণের…
কর্ণ তার জন্মঘটনা জানত। কিন্তু নিজেরে সে বরাবরই পরিচয় করাইত সূতবংশজাত পালক মাতা পিতা রাধা-অধিরথের সন্তান হিসাবে। কুন্তীই তারে তেলাইছে ফিরা আসতে কিন্তু কোনোদিনও সে ছাড়তে চায় নাই তার সূত পরিচয়…
কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের জন্মটা হইছে পরাশর দ্বারা সত্যবতী ধর্ষিতা হইবার ফলে। ধর্ষণ শেষে কিশোরী সত্যবতীর হাতে কিছু বখশিশ রাইখা গেছিলেন পরাশর। আর পোলা জন্মের পর তার পড়াশোনার ভার নিছিলেন তিনি…
বাপের টোলে পড়লেও দ্বৈপায়ন পিতার বংশপরিচয় ব্যবহার করেন নাই কোনোদিন। বরং দ্বীপবাসী মায়ের পরিচয়ে দ্বৈপায়ন নামেই নিজেরে পরিচয় করাইছেন গায়ের রংয়ের কারণে কৃষ্ণ নামের এই ঋষি…
মাহবুব লীলেন
জুলাই ২০২০
Leave a Reply