৩৪. সাংগঠনিক পরিকল্পনা

সাংগঠনিক পরিকল্পনা

মূলত, কোরআনের ৯৫ নং সূরা ‘তীন’-এ (যেখান থেকে ‘তাকবীম’ শব্দ সম্বলিত আয়াতটি গৃহীত হয়েছে, সেখানে) আধুনিক বিজ্ঞানের দ্বারা প্রমাণিত মানবসৃষ্টির জাগতিক প্রক্রিয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, এভাবে আল্লাহর ইচ্ছানুসারে মানুষকে দৈহিকভাবে একটি অত্যুত্তম গঠন কাঠামো প্রদান করা হয়েছে; কিন্তু এই মানুষই আবার তুচ্ছাতিতুচ্ছ অবস্থায় নিমজ্জিত হয়ে যায় (বৃদ্ধ বয়সে জরাগ্রস্ত অবস্থার প্রতি ইঙ্গিতবাহী)। এই সূরার কোথাও কিন্তু গর্ভাশয়ে মানব-ভ্রূণের ক্রমবিকাশের কথা বলা হয়নি। বরং, মানবজাতির সাধারণ সৃষ্টি-প্রক্রিয়ার কথাই এতে বর্ণিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, ‘তাকবীম’ শব্দের দ্বারা একটি সাংগঠনিক পরিকল্পনার উল্লেখ করে সেই পরিকল্পনার অধীনে গোটা মানবজাতির সুষম গঠনাকৃতি লাভের প্রক্রিয়ার বিষয়টিই এখানে স্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে।

এই যে ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য এখানে তুলে ধরা হল, কোরআনের একটিমাত্র শব্দে এই গোটা আলোচ্য বিষয়টি তার সকল গুরুত্বসহ কি আশ্চর্যজনকভাবেই না ফুটে উঠেছে।

“(আল্লাহ) গঠন করিয়াছেন তামাদিগকে উন্নতির নানামাত্রায় (পর্যায়ক্রমে–বিভিন্ন পর্যায়ে –ধাপে ধাপে)।”–সূরা ৭১ (নূহ), আয়াত ১৪ (সূত্র নং ১৭) :

এখানে যে শব্দটির অনুবাদ করা হয়েছে ‘উন্নতির নানামাত্রায়’ (স্টেজেস) বা ‘বিভিন্ন পর্যায়ে’ অথবা ‘পর্যায়ক্রমে’–‘ধাপে ধাপে’ (ফেজেস) সেগুলোই হল, আরবী শব্দ ‘তাওয়ার’ (একবচনে ‘তাওর’)-এর সঠিক অর্থ ও তাৎপর্য। এটাই হল কোরআনের একমাত্র আয়াত–যেখানে এই শব্দটি বহুবচনে এসেছে।

‘উন্নতির নানা মাত্রায়’ বা ‘ধাপে ধাপে বিভিন্ন পর্যায়’ অর্থে এখানে এই যে শব্দটি (তাওয়ার) ব্যবহৃত হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে মানবসৃষ্টির ইঙ্গিতবাহী। এই পর্যায়ক্রমিক উন্নতির নানা মাত্রা’–বক্তব্যের দ্বারা কি শুধু গর্ভাশয়ের মানব-ভ্রূণের ক্রমবিকাশের কথাই বলা হয়েছে, নাকি এই শব্দের দ্বারা সময়ের ধারাবাহিকতায় দেহাবয়বের দিকথেকে মানবজাতিকে যে বিভিন্ন রূপান্তর ও পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে এগিয়ে যেতে হয়েছে তার কথাও বলা হয়েছে? উল্লেখ্য যে, অতীতের প্রায় সকল অনুবাদক ও তফসীরকারগণ এই তাওয়ার’ শব্দের অর্থ ও ব্যাখ্যায় মানব-ভ্রূণের ক্রমবিকাশের কথাই বলেছেন। এমনকি ড. মরিস বুকাইলিও তাঁর গবেষণামূলক পুস্তক “বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞানে সেই ধারণাই ব্যক্ত করেছেন। তবে, অধুনা পুংখানুপুংখ বিচার-বিশ্লেষণে, সর্বাধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, গবেষণা ও আবিষ্কারে এ কথা বিশ্বাস করার মত পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণ রয়েছে যে, কোরআনের এই তাওয়ার’ শব্দের দ্বারা এখানে সময়ের ধারাবাহিকতায় মানবজাতির দেহ-কাঠামোগত রূপান্তর ও পরিবর্তনের কথাই বলা হয়েছে। যদিও এ রকম শব্দের দ্বারা কোরআনের আর কোথাও এ ধরনের কথা বলা হয়নি, তবুও কোরআনের অন্যত্র ব্যবহৃত নানা শব্দে ও বাক্যে এ সম্পর্কে যে-সব বক্তব্য রাখা হয়েছে সেই নিরিখে এই ‘তাওয়ার’ শব্দটির অর্থ, ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য নিঃসন্দেহে ভেবে দেখার মত।

‘তাওয়ার’ শব্দ ছাড়াও কোরআনের অন্যত্র উল্লিখিত এতদসম্পর্কিত বক্তব্যের ইঙ্গিত রয়েছে। তবে, ‘তাওয়ার’ শব্দ-সম্বলিত উক্ত ৭১ নং সূরায় (নূহ) মূলত আল্লাহর মহাশক্তির কথা ব্যক্ত করে বলা হয়েছে যে, সেই মহাক্ষমতাসম্পন্ন সৃষ্টিকর্তাই সকলকিছু সৃষ্টি করেছেন। এ সূরার যে রুকু বা অনুচ্ছেদে আলোচ্য ‘তাওয়ার’ শব্দ-সম্বলিত ১৪নং আয়াতটি বিদ্যমান যা নিজ জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত হযরত নূহের (আঃ) ভাষণের অংশ) সেখানে মহান আল্লাহর অসীম রহমতের কথা স্মরণ করে বলা হয়েছে, কিভাবে তিনি তাঁর পরম করুণা ও মহানুভবতার দ্বারা মানুষকে নিষিক্ত করেছেন এবং শুধু মানুষকে নয়, বরং, তিনি সৃষ্টি করেছেন আসমান, জমিন, চন্দ্র, সূর্য–সমস্ত কিছু। সৃষ্টি সম্পর্কিত বক্তব্য-সম্বলিত এই সূরায় মাটি থেকে মানুষ-সৃষ্টির মধ্যে যে আধ্যাত্মিক তাৎপর্য বিদ্যমান, সে বিষয়ের উপরেও যথোচিত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

এই ৭১ নং সূরা নূহের কোথাও মাতৃজরায়ুতে শিশু-ড্রণের ক্রমবিকাশের কথা উল্লেখ করা হয়নি বা ইঙ্গিতও দেয়া হয়নি। অথচ, প্রাচীনকালের তফসীরকারগণ তওয়ার’ বলতে ভ্রূণের ক্রমবিকাশকেই বুঝিয়েছেন। যদিও এই সূরায় নেই; কিন্তু অন্য অনেক সূরায় প্রাণের ক্রমবিকাশ ও ক্রমোন্নতির বক্তব্য রয়েছে। অর্থাৎ তাওয়ার’ শব্দ-সম্বলিত আয়াতে গর্ভাশয়ে ভ্রূণের ক্রমবিকাশের ধারণা যেমন গ্রহণ করা যেতে পারে তেমনি এই শব্দে মানবজাতির দৈহিক ক্রমবিকাশের ধারণাও বাদ দেয়ার উপায় নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *