২৪. এককালের একমাত্র ঐতিহাসিক স্বীকৃত দলিল

এককালের একমাত্র ঐতিহাসিক স্বীকৃত দলিল

আধুনিক বিজ্ঞানযুগের সূচনার পূর্বপর্যন্ত বাইবেলের এই আদিপুস্তকের (উল্লিখিত উভয় পাঠ সম্বলিত) বর্ণনাই ছিল দুনিয়াতে মানুষ এবং অপরাপর জীবন্ত প্রাণীর আবির্ভাব সম্পর্কিত একমাত্র ঐতিহাসিক ও স্বীকৃত দলিল। অন্যকথায়, আধুনিককাল পর্যন্ত বাইবেলই ছিল এতদ্‌সংক্রান্ত যাবতীয় জ্ঞানের একমাত্র মৌল উৎস। এদিকে, আধুনিক যুগে এসে প্রকৃতি-বিজ্ঞানীরা নানা ধরনের ফসিল বা জীবাশ্ম আবিষ্কার করতে সমর্থ হন। এসব ফসিল পরীক্ষা নিরীক্ষার পর যে-সমস্ত সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়, তা অনেকটা বিস্ময়কর। কিন্তু, বাইবেলের বর্ণনাকে অস্বীকার করার ব্যাপারটা তখন ছিল অভাবিত। সুতরাং, প্রথম প্রথম প্রকৃতি-বিজ্ঞানীমাত্রই বাইবেলের বক্তব্যের সঙ্গে ওইসব আবিষ্কার, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সিদ্ধান্তের সামঞ্জস্য বিধানে উঠেপড়ে লাগেন। যেমন–বাইবেলে রয়েছে, প্রতিটি প্রাণীকে তাদের নির্ধারিত গঠন-কাঠামো দিয়েই সৃষ্টি করা হয়েছে।

এই অবস্থায় সেকালের প্রকৃতি-বিজ্ঞানীরা ধারণা করতে শুরু করেন যে, প্রাপ্ত ফসিলসমূহ সম্ভবত পাবন বা ওই ধরনের কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরিণতি। অর্থাৎ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সবকিছু ধ্বংস হলে পরে, নতুন গঠন কাঠামো দিয়ে নতুন করে প্রাণিকুল সৃষ্টি করা হয়েছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এসেও বিজ্ঞানী কভিয়ার দৃঢ়তার সঙ্গেই এই অভিমত সমর্থন করেন। পরবর্তী পর্যায়েও দীর্ঘদিন যাবত এই মতবাদের প্রভাব ছিল অক্ষুণ্ণ। এমনকি, ১৮৬২ সালেও বিজ্ঞানী অলসাইড ডি অরবিগনি উল্লেখ করেছেন যে, সৃষ্টির সূচনা থেকে তখন পর্যন্ত নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পৃথিবীর সবকিছু কমপক্ষে সাতাশবার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং প্রতিটি ধ্বংসকাণ্ডের পর সবকিছু নতুন করে সৃষ্টি করা হয়।

মূলত, বাইবেলের একটি ত্রুটিপূর্ণ বিবরণ থেকেই এই ধারণার উৎপত্তি। অবশ্য, বাইবেলের বিবরণটি ত্রুটিপূর্ণ ছিল ঠিকই; কিন্তু তার থেকে গৃহীত ধারণাটি ছিল আরো বেশি ত্রুটিপূর্ণ এবং অনেক বেশি বিভ্রান্তিকর। যেমন, বাইবেলে বলা হয়েছিল যে, নূহের তুফানে দুনিয়ার সবকিছু ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল (যা আধুনিক আবিস্কৃত তথ্য ও ঐতিহাসিক জ্ঞানের নিরিখে আদৌও সত্য নয়)।

পূর্বোল্লিখিত প্রকৃতি-বিজ্ঞানীরা বাইবেলের এই ভুল বক্তব্যকে সম্বল করেই তাদের নব-সৃষ্টির ধারণা গড়ে তুলেছিলেন। অথচ, যত ভুলভাবেই বর্ণিত হোক, বাইবেলে এ কথাও বলা হয়েছে যে, দুনিয়ার সবকিছু ধ্বংস হলেও নূহের জাহাজে চড়ে রক্ষা পেয়েছিলেন কতিপয় মানুষ এবং তাঁরা তাঁদের সঙ্গে জাহাজে তুলে নিয়েছিলেন জোড়ায় জোড়ায় জম্ভ-জানোয়ার। দুনিয়ার মানবজাতি এবং জন্তু-জানোয়ার নূহের সেই জাহাজে রক্ষাপ্রাপ্তদেরই বংশধর। সুতরাং, বাইবেলে এ কথা বলা হয়নি যে, তুফানের বিপর্যয়ের পর আবার সবকিছু নতুন করে সৃষ্টি করা হয়েছিল। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ত্রুটি ছিল প্রকৃতি-বিজ্ঞানীদের : এজন্য এই বক্তব্য ভুল হলেও বাইবেলকে দায়ী করা যায় না।

বাইবেল নতুন নিয়ম : পর্যালোচনা

বাইবেলের নতুন নিয়মে (ইঞ্জিল শরীফ) মথি ও লুক-রচিত সুসমাচারে যীশু বা হযরত ঈসার (আঃ) বংশলতিকা বা কুর্সিনামা বিদ্যমান। মথি-লিখিত সুসমাচারে হযরত ঈসার (আঃ) এই কুর্সিনামা টানা হয়েছে হযরত ইবরাহীম (আঃ) থেকে; আর লুক-রচিত সুসমাচারে এই বংশ-তালিকা ঠেকেছে হযরত আদম (আঃ) পর্যন্ত। অবশ্য, এই উভয় বংশলতিকা মূলত যোসেফের (যীশুখ্রিস্টের সৎ বাপ); যার সঙ্গে যীশুখ্রিস্টের জন্মসূত্রের কোনও সম্পর্ক নেই। ফলে, কম করে বললেও বলতে হয় যে, বাইবেল নতুন নিয়ম বা ইঞ্জিল শরীফে বর্ণিত যীশুর এই উভয় কুর্সিনামাই অযৌক্তিক ও অবান্তর।

মথি ও লুক উভয়ে অবশ্য যীশুর এই বংশলতিকা প্রণয়নে বাইবেল পুরাতন নিয়মের বিবরণীকে সূত্র হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তারপর নিজ নিজ উদ্দেশ্য পূরণের মানসে সেই সূত্রেরও হেরফের ঘটিয়েছেন যথেচ্ছোভাবে। হযরত ঈসার (আঃ) কুর্সিনামা প্রণয়নে এই দুই সুসমাচার রচয়িতার বর্ণনার মধ্যে যে গরমিল, তার কারণ এটাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *