২০. বৈজ্ঞানিক বিচারের ফলাফল

বৈজ্ঞানিক বিচারের ফলাফল

বিজ্ঞানসংক্রান্ত বক্তব্য বাইবেলের পুরানো নিয়মে খুবই কম। সেজন্য, যেসব বিষয়ে বাইবেলের পুরানো ও নতুন নিয়মের বর্ণনার সাথে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত সত্যের বিরোধ দেখা যায়, সে ধরনের বিষয়ের সংখ্যাও খুব বেশি নয়। কিন্তু, যত কমসংখ্যকই হোক, বিজ্ঞানের সাথে বাইবেলের এই বিরোধ ও অসংগতির গুরুতু সত্যিই অপরিসীম।

বাইবেলের বর্ণনায় ইতিহাসগত ত্রুটি-বিচ্যুতি প্রচুর বলা অনাবশ্যক যে, পূর্বোক্ত ইহুদী ও খ্রিস্টান পণ্ডিতগণ স্বভাবগত প্রবণতায় বাইবেলের এইসব ত্রুটি-বিচ্যুতির গুরুত্ব কম করে দেখানোর প্রয়াস পেয়েছেন।

কেননা, তাঁদের মতে, বাইবেলের পুণ্যবান রচয়িতাবৃন্দ ধৰ্মীয়-তত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে ইতিহাসকে উপস্থাপিত করতে গিয়ে এবং ধর্মীয় কোনো প্রয়োজন পূরণের স্বার্থে ইতিহাসকে তুলে ধরতে গিয়ে যদি কোনো ভুল-ত্রুটি করেই থাকেন, তবে সেই ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো নাকি অস্বাভাবিক না হওয়ারই কথা!

যুক্তির বিচারে বাইবেলের পুরাতন নিয়মের বিভিন্ন অংশ থেকে বিপুলসংখ্যক অসংগতি ও অবাস্তব বিষয় চিহ্নিত করা সম্ভব। আদিতে সম্ভবত মূল বাইবেলের কোনো ঘটনার মাত্র দু’-একটি ভিন্ন পাঠ পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে সেই একই বিষয়ে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত বহু লেখকের রচনা বাইবেলে সন্নিবেশিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাইবেলের রচনাসমূহ বহুবারই নানাভাবে সংশোধন করা হয়েছে এবং পরবর্তী পর্যায়ে সেইসব সংশোধিত পাঠও বাইবেলের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়েছে। অনেকে অনেক ক্ষেত্রে বাইবেলের বিভিন্ন বর্ণনার টীকা অথবা ভাষ্য রচনা করেছেন। পরবর্তী সময়ে যখন নতুন কোনো সংস্করণ প্রকাশিত হয়, তখন, সেই টীকাভাষ্যগুলোও মূল রচনার অংশ হিসেবে জুড়ে দেয়া হয়েছে। এইসব সংশোধনী ও সংযোজনা অধুনা বাইবেল বিশেষজ্ঞবৃন্দ সহজেই সনাক্ত করে নিতে পারছেন। শুধু তাই নয়, বাইবেলের কোনো অংশ কখন কার দ্বারা রচিত হয়েছিল, তাও তাঁদের পক্ষে চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে।

উদাহরণস্বরূপ, বাইবেলে পুরাতন নিয়মের পেন্টাটেক বা পঞ্চপুস্তক (তাওরাত) অধ্যায়ের কথা বলা যেতে পারে। ফাদার ডি ভক্স তাঁর অনূদিত বাইবেলের আদিপুস্তকের (জেনেসিস) ভূমিকায় (পৃষ্ঠা, ১৩-১৪) এ ধরনের বহুসংখ্যক ভিন্ন-পাঠের কথা উল্লেখ করেছেন। উপস্থিতক্ষেত্রে সেসব উদ্ধৃতি প্রদান থেকে আমরা বিরত রইলাম।

যাহোক, এসব উদাহরণ ও বিশ্লেষণ থেকে যেকোনো পাঠকের মনে স্বভাবতই যে ধারণার সৃষ্টি হয়, তাহলো, বাইবেলের কোনো রচনাকেই শাব্দিক অর্থে–অন্যকথায়, বর্ণে বর্ণে গ্রহণ করার উপায় নেই। এখানে, একটি নমুনা পেশ করা হল :

বাইবেলের পুরাতন নিয়মের আদিপুস্তক (৬, ৩) রয়েছে, মহাপ্লাবনের ঠিক আগেভাগে আল্লাহ্ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন যে, অতঃপর মানুষের আয়ুষ্কাল একশত কুড়ি বৎসরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে : “পরন্তু তাহাদের সময় একশত বিংশতি বৎসর হইবে।” কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে এই আদিপুস্তকেই দেখা যায়, (১১, ১০-৩২) হযরত নূহের দশজন বংশধরের অনেকেই ১৪৮ থেকে ৬০০ বৎসর পর্যন্ত জীবিত রয়েছেন। দুই বক্তব্যের মধ্যে এই যে অসঙ্গতি, এ ধরনের। অসঙ্গতি প্রচলিত বাইবেলে রয়েছে অনেক। কিন্তু কেন যে এই অসঙ্গতি, তার অন্তরালবর্তী ব্যাখ্যাটিই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে, আদি পুস্তকের পূর্বোক্ত প্রথম বক্তব্য-সম্বলিত অধ্যায়টি (৬, ৩) জেহোভিস্ট আমলের রচনা। এই রচনার সময়কাল, যতটুকু জানা গেছে খুব সম্ভব খ্রিস্টপূর্ব দশম শতাব্দী। পক্ষান্তরে, সঙ্গতিহীন দ্বিতীয় বক্তব্য-সম্বলিত অধ্যায়টি (বাইবেল, আদিপুস্তক ১১, ১০-৩২) তার অনেক পরের রচনা (খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর) : আর এটি রচিত হয়েছিল সেকেরডোটাল আমলে। মূল রচনায় বংশ-তালিকা এবং মানুষের আয়ুষ্কালের সঠিক তথ্য ও পরিসংখ্যান সম্ভবত ছিল, কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে মানুষের হাতে পড়ে সেই তথ্য ও পরিসংখ্যানের অবস্থার হয়েছে এই দূর্দশা!

বাইবেলের এই আদিপুস্তকে আরো এমনসব বিবরণ পাওয়া যায় যা আধুনিক বিজ্ঞানের সুপ্রতিষ্ঠিত তথ্য-প্রমাণের সাথে সম্পূর্ণ অসঙ্গতিপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, এখানে তিনটি বিষয়ের আলোচনা তুলে ধরা হলঃ

১. বিশ্বসৃষ্টি এবং তার বিভিন্ন পর্যায়;

২. বিশ্বসৃষ্টির তারিখ ও পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের সময়কাল; এবং

৩. মহাপ্লাবনের বর্ণনা।

বিশ্বসৃষ্টির কাহিনী

ফাদার ডি ভক্স তার আলোচনায় দেখিয়েছেন যে, বাইবেলের পুরাতন নিয়মের আদিপুস্তকের শুরুতেই বিশ্বসৃষ্টি সম্পর্কে দুটি ভিন্ন ধরনের বক্তব্য পাশাপাশি বর্ণিত হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক সত্য ও তথ্য-প্রমাণের সাথে বাইবেলের এই বর্ণনার অসঙ্গতি কোথায়, তা নির্ণয়ের সুবিধার্থে পূর্বোক্ত দুটি বর্ণনারই পৃথক পৃথক আলোচনা তুলে ধরা হল :

বর্ণনাসমূহ

বাইবেলের আদিপুস্তকের প্রথম অধ্যায় জুড়ে এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথম অনুচ্ছেদে বিশ্বসৃষ্টির কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এরচেয়ে অসত্য বর্ণনা আর হয় না। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিচার-বিশ্লেষণের সুবিধার্থে এখানে একটি একটি করে অনুচ্ছেদ গ্রহণ করা হল। উদ্ধৃতিসমূহ বাইবেলের রিভাইজড স্ট্যান্ডার্ড ভার্সন (১৯৫২) (ডব্লিউ. এম. কলিন্স অ্যান্ড সন্স, ব্রিটিশ অ্যান্ড ফরেন বাইবেল সোসাইটি) থেকে গৃহীত।

“আদিতে ঈম্বর আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি করিলেন। পৃথিবী ঘোর ও শূন্য ছিল, এবং অন্ধকার জলধির উপরে ছিল, আর ঈশ্বরের আত্মা জলের উপরে অবস্থিতি করিতেছিলেন।”–অধ্যায় ১, বাণী ১ ও ২ :

স্বীকার করে নিতে অসুবিধা নেই যে, পৃথিবী সৃষ্টির আগে এখন আমরা যাকে বিশ বলছি, তা অন্ধকারে আবৃত ছিল। কিন্তু তখন পানির অস্তিত্ব ছিল। বলে বাইবেলে যা উল্লেখ রয়েছে, তা নিছক কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। প্রকৃতপক্ষে, বিশ্বসৃষ্টির সূচনায় গ্যাসজাতীয় বায়ুবীয় পদার্থের অস্তিত্বের যথার্থ প্রমাণ বিদ্যমান। এই অবস্থায় সেখানে পানির অস্তিত্ব থাকার কথা ভুল ছাড়া কিছু নয়।

“পরে ঈশ্বর কহিলেন, দীপ্তি হউক, তাহাতে দীপ্তি হইল। তখন ঈশ্বর দীপ্তি উত্তম দেখিলেন এবং ঈশ্বর অন্ধকার হইতে দীপ্তি পৃথক করিলেন। আর ঈশ্বর দীপ্তির নাম দিবস ও অন্ধকারের নাম রাত্রি রাখিলেন। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে প্রথম দিবস হইল।” –বাণী ৩ থেকে ৫

যে আলোক আকাশ ও জমিন জুড়ে বিস্তৃত, তা নক্ষত্রমণ্ডলীর জটিল প্রক্রিয়ার পরিণতি। বাইবেলের বর্ণনামতে, বিশ্বসৃষ্টির এই পর্যায়ে তখনও নক্ষত্র সৃষ্টি করা হয়নিঃ আদিপুস্তকে ১৪নং বাণীর আগে আকাশমণ্ডলীর এই ‘দীপ্তি’ অর্থাৎ, সূর্যসৃষ্টির কথা বলা হয়নি। এই বাণী অনুযায়ী সূর্য সৃষ্টি হয়েছিল বিশ্বসৃষ্টির চতুর্থ দিবসে। দিবসকে রাত্রি থেকে পৃথক এবং পৃথিবীর উপরে আলো প্রদান ইত্যাকার বর্ণনা মোটামুটি সঠিক। কিন্তু যেখানে আলোর উৎস (সূর্য) সৃষ্টি করা হয়েছিল বিশ্বসৃষ্টির তিনদিন পর, সেখানে সূর্য সৃষ্টির আগে বিশ্বসৃষ্টির প্রথমদিনেই পৃথিবীতে আলো ছড়িয়ে পড়ার বর্ণনা একান্তভাবেই যুক্তিহীন। কেননা, এখানে কোনো কারণ ছাড়াই কার্য সংঘটিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া, সূর্যহীন প্রথম দিবসেই সকাল ও সন্ধ্যার অস্তিত্ব নিছক কল্পনার বস্তু। কেননা, পৃথিবীকে তার প্রধানতম নক্ষত্র সূর্যের মণ্ডলে নিয়ে এসে তার আহ্নিক গতি তথা সূর্যকেন্দ্রিক আবর্তন সম্ভব করা হলেই শুধু দিবস পাওয়া যাবে; আর শুধু তখনই সম্ভব হবে সকাল ও সন্ধ্যার উপস্থিতি। তাই নয়কি!

“পরে ঈশ্বর কহিলেন, জলের মধ্যে বিতান হউক ও জলকে দুইভাবে পৃথক করুক। ঈশ্বর এইরূপে বিতান করিয়া বিতানের উধ্বস্থিত জল হইতে বিতানের অধঃস্থিত জল পৃথক করিলেন, তাহাতে সেইরূপ হইল। পরে ঈশ্বর বিতানের নাম আকাশমণ্ডল রাখিলেন। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে দ্বিতীয় দিবস হইল।” –বাণী ৬ থেকে ৮ :

এখানেও পানির অস্তিত্বের সেই অলীক বক্তব্য টেনে আনা হয়েছে। সেইসঙ্গে সেই পানিকে দুই ভাগে ভাগ করে একভাগ আকাশমণ্ডলে আর এক ভাগ পৃথিবীতে প্রবাহিত করার কথা বলা হয়েছে। পানিকে এভাবে দ্বিধাবিভক্ত করার কাল্পনিক বক্তব্য বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়।

“পরে ঈশ্বর কহিলেন, আকাশমণ্ডলের নিন্থ সমস্ত জল একস্থানে সংগৃহীত হউক ও স্থল সপ্রকাশ হউক; তাহাতে সেইরূপ হইল। তখন, ঈশ্বর স্থলের নাম ভূমি ও জলরাশির নাম সমুদ্র রাখিলেন। আর ঈশ্বর দেখিলেন যে, তাহা উত্তম। পরে ঈশ্বর কহিলেন, ভূমি, তৃণ বীজোৎপাদক ঔষধি ও সবিজ স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী ফলের উৎপাদক ফলবৃক্ষ, ভূমির উপরে উৎপন্ন করুক; তাহাতে সেইরূপ হইল। ফলত ভূমি-তৃণ, স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী বীজোৎপাদক ঔষধি ও স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী সবিজ ফলের উৎপাদক, বৃক্ষ, উৎপাদন করিলো, আর ঈশ্বর দেখিলেন যে, সে-সকল উত্তম। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে তৃতীয় দিবস হইল।”–বাণী ৯ থেকে ১৩ :

পৃথিবী সৃষ্টির ইতিহাসে দেখা যায়, মহাদেশসমূহ পানি থেকে ধীরে ধীরে জেগে উঠেছে। এক্ষেত্রে, বাইবেলের বর্ণনা তাই গ্রহণযোগ্য। কিন্তু যেখানে বলা হয়েছে যে, পরিকল্পিতভাবে গাছপালা, ঘাস-আগাছা, সজি ইত্যাদি গজিয়ে উঠেছে এবং তাদের বীজ থেকে পুনরায় চারা হচ্ছে, সে বক্তব্য কোনোক্রমেই সত্য বলে গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা, সূর্যের আলো ছাড়া এই সৃষ্টির প্রক্রিয়া সম্ভব নয়। (বাইবেলের এই আদিপুস্তকেই বলা হয়েছে যে, চতুর্থ দিবসের আগে সূর্য সৃষ্টি হয়নি। সুতরাং, এই পর্যায়ে দিন-রাত্রির আগমন তথা তৃতীয় দিবসের যে কথা বলা হয়েছে, তাও একই যুক্তিতে নাকচ হয়ে যায়।

“পরে ঈশ্বর কহিলেন, রাত্রি হইতে দিবসকে বিভিন্ন করণার্থে আকাশমণ্ডলের বিতানে জ্যোতির্গণ হউক; সে সমস্ত চিহ্নের জন্য, ঋতুর জন্য এবং দিবসের ও বৎসরের জন্য হউক, এবং পৃথিবীতে দীপ্তি দিবার জন্য দীপ বলিয়া আকাশমণ্ডলের বিতানে থাকুক, তাহাতে সেইরূপ হইল। ফলতঃ ঈশ্বর দিনের উপর কর্তৃত্ব করিতে এবং মহাজ্যোতিঃ ও রাত্রির উপরে কর্তৃত্ব করিতে তদপেক্ষা ক্ষুদ্র এক জ্যোতিঃ এই দুই বৃহৎ জ্যোতিঃ এবং নক্ষত্রসমূহ নির্মাণ করিলেন। আর পৃথিবীতে দীপ্তি দিবার জন্য, এবং দিবস ও রাত্রির উপর কর্তৃত্ব করণার্থে, এবং দীপ্তি হইতে অন্ধকার বিভিন্ন করণার্থে ঈশ্বর ঐ জ্যোতিসমূহকে আকাশমণ্ডলের বিতানে স্থাপন করিলেন এবং ঈশ্বর দেখিলেন যে, সে-সকল উত্তম। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে চতুর্থ দিবস হইল।”–বাণী ১৪ থেকে ১৯ :

এখানে বাইবেলের রচয়িতার এইসব বক্তব্য গ্রহণ করা যেতে পারে; কিন্তু তবুও এখানে সামগ্রিকভাবে সৃষ্টির যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে, তা সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। পৃথিবী এবং চন্দ্র উভয়ই তাদের মূল নক্ষত্র সূর্য থেকে উৎপন্ন। তাছাড়া, আধুনিক বিজ্ঞান সৌরমণ্ডল ও তার কার্যকারণ পদ্ধতি সম্পর্কে যেসব তথ্য আবিষ্কার করেছে, তা একান্তভাবে সুপ্রমাণিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত। সেই অবস্থায় পৃথিবীসৃষ্টির পরে সূর্য ও চন্দ্রসৃষ্টির বক্তব্য বৈজ্ঞানিক সত্যের সম্পূর্ণ বিরোধী।

“পরে ঈশ্বর কহিলেন, জল নানাজাতীয় জঙ্গম প্রাণিবর্গে প্রাণিময় হউক এবং ভূমির উধে আকাশমণ্ডলের বিতানে পক্ষিগণ উড়ক। তখন ঈশ্বর বৃহৎ তিমিগণের ও যে নানা জাতীয় জঙ্গম প্রাণিবর্গে জল প্রাণিময় আছে, সে সকলের এবং নানা জাতীয় পক্ষির সৃষ্টি করিলেন। পরে ঈশ্বর দেখিলেন যে, সে সকল উত্তম। আর ঈশ্বর সে সকলকে আশীর্বাদ করিয়া কহিলেন, তোমরা প্রাণবন্ত ও বহুবংশ হও, সমুদ্রের জল পরিপূর্ণ কর, এবং পৃথিবীতে পক্ষিগণের বাহুল্য হউক আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে পঞ্চম দিবস হইল।”–বাণী ২০ থেকে ২৩ :

বাইবেলের এইসব বাণীতে যে বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে, তাও গ্রহণযোগ্য নয়। আদিপুস্তকের বর্ণনা অনুসারে সামুদ্রিক প্রাণী ও পাখিদের সাথে সাথে পৃথিবীতে প্রাণিজগতের আবির্ভাব ঘটেছে। অথচ, এই বাইবেলেই অন্য বর্ণনায় রয়েছে যে, পঞ্চম দিবসে নয়, বরং ষষ্ঠ দিবসে পৃথিবীতে প্রাণিজগতের সৃষ্টি করা হয়েছিল।

এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, প্রাণের উৎপত্তি সমুদ্র থেকেই। সমুদ্র থেকে প্রাণের আবির্ভাব হয়ে পৃথিবীর বুক ভরে তুলেছে, আর এভাবেই গড়ে উঠেছে প্রাণিজগৎ। পক্ষান্তরে, পৃথিবীর বুকে বিরাজমান প্রাণী থেকে এবং বিশেষত পৃথিবী সৃষ্টির দ্বিতীয় পর্যায়ে একশ্রেণীর সরীসৃপ প্রজাতি থেকে পক্ষিকুলের আবির্ভাব ঘটেছে বলে ধারণা করা হয়। এই ধারণার কারণ এই উভয় ধরনের প্রজাতির মধ্যে একই ধরনের দেহগত বৈশিষ্ট্য। অথচ, আদিপুস্তকে ষষ্ঠদিনের আগের পৃথিবীতে পশুপ্রাণী সৃষ্টির কথা বলা হয়নি। অথচ, এর আগেই পাখি সৃষ্টি হয়েছে বলা হয়েছে। সুতরাং, পৃথিবীতে পশুপ্রাণীর আগে পক্ষিকুলের আবির্ভাবের এই বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

“পরে ঈশ্বর কহিলেন, ভূমি নানা জাতীয় প্রাণিবর্গ অর্থাৎ স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী গ্রাম্য পশু, সরীসৃপ ও বন্য পশু উৎপন্ন করুক, তাহাতে সেইরূপ হইল। ফলত ঈশ্বর স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী যাবতীয় ভূচর সরীসৃপ নির্মাণ করিলেন; আর ঈশ্বর দেখিলেন যে, সে সকল উত্তম।”

“পরে ঈশ্বর কহিলেন, আমরা আমাদের প্রতিমূর্তিতে, আমাদের সাদৃশ্যে মনুষ্য নির্মাণ করি; আর তাহারা সমুদ্রে মৎস্যদের উপরে, আকাশের পক্ষীদের উপরে, পশুদের উপরে কর্তৃত্ব করুক। পরে ঈশ্বর আপনার প্রতিমূর্তিতেই মনুষ্যকে সৃষ্টি করিলেন। ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতেই তাহাকে সৃষ্টি করিলেন, পুরুষ ও স্ত্রী করিয়া তাহাদিগকে সৃষ্টি করিলেন।”

“পরে ঈশ্বর তাহাদিগকে আশীর্বাদ করিলেন; ঈশ্বর কহিলেন, তোমরা প্রজাবন্ত ও বহুবংশ হও এবং পৃথিবী পরিপূর্ণ ও বশীভূত কর, আর সমুদ্রের মৎস্যগণের উপরে, আকাশের পক্ষিগণের উপরে এবং ভূমিতে গমনশীল যাবতীয় জীবজন্তুর উপরে কর্তৃত্ব কর। ঈশ্বর আরো কহিলেন, দেখ, আমি সমস্ত ভূতলে স্থিত যাবতীয় বীজোৎপাদক ওষধি ও যাবতীয় সজীব ফলদায়ী বৃক্ষ তোমাদিগকে দিলাম, তাহা তোমাদের খাদ্য হইবে। আর ভূচর যাবতীয় পশু ও আকাশের যাবতীয় পক্ষী ও ভূমিতে গমনশীল যাবতীয় কীট, এই সকল প্রাণীর আহারার্থ হরিৎ ওষধি সকল দিলাম। তাহাতে সেইরূপ হইল।”

“পরে ঈশ্বর আপনার নির্মিত বস্তুসকলের প্রতি দৃষ্টি করিলেন, আর দেখ, সে সকলই অতি উত্তম। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে ষষ্ঠ দিবস হইল।

–বাণী ২৪ থেকে ৩১ :

এইসব বর্ণনা মূলতঃ সৃষ্টিকর্মের চূড়ান্ত পর্যায়ের। এখানে বাইবেল-লেখক ইতিপূর্বে সৃষ্ট যেসব প্রাণীর বর্ণনা দেননি, সেসবের একটি তালিকা তুলে ধরেছেন এবং সেইসাথে মানুষ ও পশুর খাদ্যাখাদ্যের বর্ণনা পেশ করেছেন।

ইতিপূর্বের বর্ণনায় যে ভুলটি রয়েছে, তাহলো, পৃথিবীতে পক্ষিকুলের আগে পশুকুলের আবির্ভাব। অবশ্য, সমস্ত প্রাণিজগতের সর্বশেষ পর্যায়ে যে পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে, সে-বিষয়ে লেখকের বর্ণনা সঠিক।

সৃষ্টি-সংক্রান্ত বর্ণনা অবশ্য এখানেই শেষ হয়নি। দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথম তিনটি বাণীতেও এ বিষয়ের বর্ণনা স্থান লাভ করেছে। যেমন–

“এইরূপে আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী এবং এতদুভয়স্থ সমস্ত বস্তুব্যুহ সমাপ্ত হইল। পরে ঈশ্বর সপ্তম দিনে আপনার কৃতকার্য হইতে নিবৃত্ত হইলেন, সেই সপ্তমদিনে আপনার কৃত সমস্ত কার্য হইতে বিশ্রাম করিলেন। আর ঈশ্বর সেই সপ্তমদিনকে আশীর্বাদ করিয়া পবিত্র করিলেন, কেননা সেইদিনে ঈশ্বর সৃষ্ট ও কত সমস্ত কার্য হইতে বিশ্রাম করিলেন।”

বাইবেলের সাতদিনের এই বর্ণনা সম্পর্কে কিছু আলোচনা প্রয়োজন। প্রথমেই ধরা যাক, কয়েকটি শব্দের কথা : এখানে যে পাঠ উদ্ধত, তা গৃহীত হয়েছে উপরে উল্লিখিত ‘রিভাইজড স্ট্যান্ডার্ড ভার্সন অব দি বাইবেল থেকে। এখানে host শব্দটি তাৎপর্যপূর্ণ। এর দ্বারা অবশ্যই বিপুলসংখ্যক সৃষ্টির কথা বোঝানো হয়েছে। আর যেখানে বিশ্রাম করিলেন’ বলা হয়েছে, সেটি আসলে হিব্রু Shabbath শব্দের অনুবাদ। এ থেকেই এসেছে ইহুদীদের ‘বিশ্রাম দিবস’। ইংরেজিতে এই শব্দটিকে লেখা হয় ‘Sabbath’।

ছয়দিন কাজের শেষে ‘স্রষ্টা বিশ্রাম গ্রহণ করিলেন’ বলে যে কথা বলা হয়েছে, তা যে একটা লেজেন্ড বা উপকথা মাত্র তা দিবালোকের মতোই পরিষ্কার। এর একটি ব্যাখ্যা অবশ্যই রয়েছে। মনে রাখতে হবে যে, সৃষ্টিতত্ত্বের যে অধ্যায়টি এখানে পর্যালোচনার জন্য গ্রহণ করা হয়েছে, তা হচ্ছে তথাকথিত সেকেরভোটাল পাঠ বা পুরোহিতদের রচনা। এই পাঠ রচিত হয়েছিল ব্যাবিলনে ইহুদীদের নির্বাসনকালীন নবী এজেকেলের (বাংলা বাইবেলের জিহিস্কেল) আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী বলে পরিচিত পুরোহিত ও লিপিকারদের দ্বারা। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে। ইতিপূর্বে দেখা গেছে, পুরোহিতেরা বাইবেলের জেহোভিস্ট এলোহিস্ট বাণীগুলোকে নিজেদের ইচ্ছেমত ও প্রয়োজনানুসারে কিভাবে ঢোল সাজিয়ে নিয়েছিলেন।

সৃষ্টিতত্ত্ব-সংক্রান্ত বাইবেলের আদিপুস্তকের জেহোভিস্ট পাঠ বা বাণীসমূহ পুরোহিতদের রচিত বাণীর কয়েক শতাব্দী আগে রচিত হয়। সেখানে কিন্তু ছয়দিন ধরে সৃষ্টির কাজ করে স্রষ্টার ক্লান্ত হয়ে পড়ার ও বিশ্রাম গ্রহণের কোনো উল্লেখ নেই। পরবর্তীকালে পুরোহিতেরা বাইবেলে সেটি জুড়ে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা সপ্তাহের সাত দিনের মধ্যে কোন দিন স্রষ্টা কি কি সৃষ্টি করেছেন, তার বর্ণনা দিয়েছেন। নিজেদের বিশ্রাম গ্রহণের জন্য নির্দিষ্ট একটি দিন নির্ধারণ ও সাব্যস্ত করার জন্যই তারা এই রচনাটি জুড়ে দিয়েছেন এবং এর যৌক্তিকতা দাঁড় করাতে চেয়েছেন এই বলে যে, স্বয়ং স্রষ্টাই সবার আগে এই বিশ্রাম-দিনকে মর্যাদা দিয়ে গেছেন। এভাবে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তি দাঁড় করিয়ে নিয়ে উল্লিখিত পুরোহিতগণ নিজেদের জাগতিক প্রয়োজনীয়তা মিটিয়েছেন। কিন্তু, বৈজ্ঞানিক তথ্যের নিরিখে তাদের সেই ধর্মীয় যুক্তিকে নিছক খামখেয়ালী ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না।

সৃষ্টির বিভিন্ন পর্যায় উল্লেখ করতে গিয়ে এই পুরোহিত-লেখকবৃন্দ বাইবেলের বর্ণনাকে একটি ধর্মীয় রূপ দিতেচেয়েছেন ঠিকই; কিন্তু এক সপ্তাহের যে কাজ তারা দেখিয়েছেন, বৈজ্ঞানিক বিচারে তার কোনো ভিত্তি খুঁজে পাওয়া কঠিন। পর্যায়ক্রমেই পথিবী ও বিশ্বজগৎ সৃষ্টি হয়েছে বটে; কিন্তু এ বিষয়ে মানুষ এখন সম্পূর্ণভাবে অবহিত যে, প্রতিটি পর্যায়ে সষ্টির জন্য প্রয়োজন হয়েছে। সুদীর্ঘ সময়ের। স্রষ্টার বিশ্রাম গ্রহণের জন্য বিশ্রাম-দিনের কথা বাদ দিলেও দেখা যাচ্ছে, ষষ্ঠ দিনের সন্ধ্যায় বিশ্বসৃষ্টির কাজ সমাপ্ত হয়ে গেছে। এই যদি হয়, তবে আমাদের অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে যে, সপ্তাহের এই হিসেবটা আসলেই কি দিনক্ষণের হিসেবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নাকি এর অর্থ কোরআনের বর্ণনা মোতাবেক কোনো অনির্দিষ্ট কাল? সপ্তাহের বা দিনের হিসেব যদি সেই অনির্দিষ্ট কাল ধরা হয়, তাহলে সেক্ষেত্রেও পুরোহিতদের রচিত বাইবেলের এতদসংক্রান্ত বর্ণনা আরো বেশি করে অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়ে। বিশেষত সৃষ্টিতত্ত্বের বর্ণনায় বাইবেলের দিনের হিসেবে সন্ধ্যা ও সকালের যে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, তা বিজ্ঞানের মৌলিক জ্ঞানের সম্পূর্ণ বিরোধী।

সুতরাং, এসব বিচার-পর্যালোচনা থেকে যে-কেউ দেখতে পাবেন, সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কিত বাইবেলের যে বক্তব্য, বিশেষত যেসব বর্ণনার রচয়িতা পুরোহিতগণ, সেসব বর্ণনা যেমন কল্পনাপ্রসূত তেমনি নিছক জালিয়াতি ছাড়া আর কিছু নয়। সত্যকে প্রকাশ করা এসব রচনার উদ্দেশ্য নয়; বরং উদ্দেশ্য অন্যকিছু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *