১৯. গীত-সংহিতা ও হিতোপদেশ পুস্তক

গীত-সংহিতা ও হিতোপদেশ পুস্তক

এই দুই পুস্তক মূলত অতুলনীয় সাহিত্যকীর্তি। গীত-সংহিতার সর্বোত্তম অধ্যায় হচ্ছে ‘সাম’ বা স্রষ্টার প্রশংসাগীতি। এটি হিব্রু কবিতার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মিনার বিশেষ। এই গীত-সংহিতার বেশিরভাগ কবিতা বা সঙ্গীত হযরত দাউদের রচনা; বাকিগুলো রচিত যাজক ও পুরোহিতদের দ্বারা। এসব গীতি কবিতার বিষয়বস্তু হচ্ছে স্রষ্টার প্রশংসা, প্রার্থনা এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানের বিবরণ। উপাসনা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এসব সঙ্গীত গাওয়া হত।

‘ইয়োব পুস্তক’, ‘হিতোপদেশ’ ও ‘উপদেশক’–এই পুস্তক তিনটি মোটামুটিভাবে চমৎকার : সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ থেকে ৫০০ অব্দে এগুলো রচিত হয়েছিল।

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে জেরুজালেমের পতনের উপরে ভিত্তি করে রচিত ‘বিলাপ পুস্তক খুব সম্ভব জিরমিয় নবীর আমলের রচনা।

এই প্রসঙ্গে পরমগীত পুস্তকেরও উল্লেখ করতে হয়। অলংকারবহুল ভাষায় রচিত এই ‘পরমগীত’-এর বিষয়বস্তু প্রধানত স্রষ্টার প্রেম। ‘উপদেশক’ পুস্তক হচ্ছে, হযরত সোলায়মান এবং তাঁর দরবারের কতিপয় বিজ্ঞ ব্যক্তি ও কিছুসংখ্যক পুরোহিতের উপদেশবাণীর সংকলন। একলেসিয়াটস বা কোহলেথ পুস্তকে বিজ্ঞজনোচিত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পার্থিব সুখ-শান্তির অসারতা তুলে ধরা হয়েছে।

সুতরাং, বাইবেলের পুরানো নিয়মের গোটা অংশটাতেই দেখা যায় কমপক্ষে সাতশত বৎসর ধরে নানাজনের লিখিত এমনসব অসম ও অসংলগ্ন রচনার সমাহার, যার তুলনা অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। এখানে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, কিভাবে এ ধরনের বহু পুস্তকের একটি সংকলন বহু শত বৎসর যাবত একটি অচ্ছেদ্য অখণ্ড পুস্তক হিসেবে টিকে থাকতে পারল? এবং সম্প্রদায়গতভাবে প্রকাশিত বিভিন্ন সংস্করণে কিছু কিছু পরিবর্তন দেখা গেলেও এই সংকলনটিই বা কিভাবে ইহুদী ও খ্রিস্টান উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মপুস্তক হিসেবে চালু হলো? উল্লেখ্য যে, দুর্বোধ্যতা ও অস্পষ্টতা এই পুস্তকের মূল সুর বলেই বাইবেলকে গ্রীক ভাষায় বলা হয়, ‘কানুন’ বা প্রামাণ্য বিধান : সে বিধান সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন চলে না।

বাইবেলের পুরানো নিয়মের মধ্যে বিভিন্ন অসংলগ্ন পুস্তকের এই যে সমাহার, এই সমাহার তথা সংকলন কিন্তু খ্রিস্টান আমলের নয়, বরং ইহুদীদের আমল থেকেই এই বাইবেল চালু রয়েছে। খুব সম্ভব খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে প্রাথমিকভাবে এই বাইবেল সংকলিত হয়ে সাধারণের ধর্মপুস্তক হিসেবে পরিগৃহীত হয়েছিল। পরবর্তী পুস্তকসমূহ সংযুক্ত হয়েছিল আরো পরে। উল্লেখ নিপ্রয়োজন যে, বাইবেলের পুরাতন নিয়মের প্রথম পঞ্চপুস্তক–যা তাওরাত বা পেন্টাটেক নামে পরিচিত, সেই পাঁচটি পুস্তকের মর্যাদা সবসময়ই ছিল সর্বোচ্চ। পরবর্তী পর্যায়ে কোনো নবীর ভবিষ্যদ্বাণী (যথা : অপরাধপূর্ণ কাজের জন্য শাস্তি প্রাপ্তির ভবিষ্যদ্বাণী) যখন পূর্ণ হয়েছিল, তখন তার বিবরণীও পূর্বোক্ত গৃহীত পুস্তকগুলোর সাথে অনায়াসে সংযুক্ত হতে পেরেছিল। তাছাড়া, যেসব নবী আশার বাণী শুনিয়ে সফল হন, তাঁদের বিবরণীও সম্ভবত একইভাবে সংযুক্ত হয়ে থাকবে। এভাবে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যেই নবীদের কানুন-সম্বলিত এই বাইকেল সংকলনের কাজটি সমাধা হয়।…

ইহুদীদের দ্বারা সংকলিত হলেও এই বাইবেল খ্রিস্টানদের দ্বারা গৃহীত হয় এবং ধর্মীয় দিকদিয়েও এ বিষয়ে তেমন কোনো অসুবিধা দেখা দেয়নি। কিভাবে এই ইহুদী-বাইবেল খ্রিস্টধর্মে পরিগৃহীত হয়েছিল, সে ব্যাপারে কার্ডিন্যাল ডানিয়েল প্রমুখ আধুনিক লেখক সবিশেষ গবেষণা চালিয়ে গেছেন। আদিতে খ্রিস্টধর্ম ছিল ইহুদী ধর্মেরই সম্প্রসারিত রূপ। তখন খ্রিস্টধর্ম পরিচিত ছিল ‘জুডিও-ক্রিশ্চিয়ানিটি’ নামে। খ্রিস্টধর্মের উপর পৌলের প্রভাব বিস্তারের পূর্ব পর্যন্ত সেই জুডিও-ক্রিশ্চিয়ান সমাজ বাইবেলের এই পুরাতন নিয়মকে নিজেদের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার হিসেবে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করে নিয়েছিল। বাইবেলের নতুন নিয়মের (ইঞ্জিল) লেখকগণও এই পুরাতন নিয়মের প্রতি ছিলেন সবিশেষ অনুগত। যদিও খ্রিস্টান সমাজ পরবর্তীকালে এ্যাপোক্রাইফা’ নামের বাহানায় নিজেদের সুসমাচারগুলোকে ঢেলে সাজাতে কার্পণ্য করেনি; তবুও বাইবেলের এই পুরানো নিয়মের পুস্তকসমূহের বেলায় তেমন কোন বর্জন বা সংশোধনের গরজ তাদের মধ্যে দেখা যায়নি; এর সবকিছু, মানে প্রায় সবকিছুই তারা গ্রহণ করেছিল বিনাদ্বিধায়।

মূলত, মধ্যযুগ শেষ হওয়ার আগে অন্য কোনো জায়গায় তো বটেই, এমনকি পাশ্চাত্য জগতেও কার এমন বুকের পাটা ছিল যে, বাইবেলের এই অসম ও অসংলগ্ন সংকলন-কর্মের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করতে পারে?

এ প্রশ্নের জবাব একটিই। আর তা হলো–তেমন কেউ ছিলেন না : তেমন কাউকে প্রায় পাওয়াই যায় না। মধ্যযুগ শেষ হয়ে আধুনিক যুগ যখন শুরু হলো, দেখা গেলো, একজন-দুজন করে সমালোচক এগিয়ে আসছেন। কিন্তু গির্জার কর্মকর্তারা নিজস্ব পন্থায় তাঁদের স্তব্ধ করে দিতে সক্ষম হয়েছেন। সন্দেহ নেই যে, অধুনা কিছুসংখ্যক খাঁটি সমালোচক বাইবেলের বাণী সম্পর্কে তাঁদের সমালোচনা অব্যাহত রেখেছেন। পক্ষান্তরে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, এক শ্রেণীর ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ সমালোচনার নামে বাইবেলের খুঁটিনাটি বিচার বিশ্লেষণে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন ঠিকই; কিন্তু যেসব বিষয়কে তারা বিনয়ের সঙ্গে জনগণের জন্য দুর্বোধ্য বলে রায় দিচ্ছেন, সেইসব অসম ও অসংলগ্ন বিষয়ের গভীরে যেতে তারা মোটেও রাজি হচ্ছেন না। বিজ্ঞানের আলোকে ওইসব জটিলতার গ্রন্থি উন্মোচনে তাঁদের কাউকে এগিয়ে আসতেও দেখা যাচ্ছে না। যেসব ক্ষেত্রে আদর্শগত বিচারে বাইবেলের বর্ণনা ইতিহাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, সেসব জায়গায় তারা বাইবেলের বক্তব্যকে ইতিহাসের সমান্তরালে এনে সুপ্রতিষ্ঠিত করছেন ঠিকই, কিন্তু এ যাবত তারা কেউই কোন বিশদ ও খোলাখুলি আলোচনার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সত্যের সাথে বাইবেলের বর্ণনার তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণে এগিয়ে আসেননি। তাদের এই এগিয়ে না আসার কারণ আর কিছুই নয়, একটা বিষয় তারা স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছেন যে, এতোকাল যাবত যদিও বাইবেলের বর্ণনা তর্কাতীতভাবে গৃহীত হয়ে এসেছে, তথাপি, এখন যদি এ ধরনের বৈজ্ঞানিক বিচার-বিশ্লেষণ পরিচালিত হয়, তবে ইহুদী ও খ্রিস্টান সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত এই ধর্মগ্রন্থটির সত্যতা সম্পর্কে জনসাধারণের মনে প্রশ্ন না জেগে পারবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *