১৬. পুরাতন নিয়মের পুস্তকাবলী

পুরাতন নিয়মের পুস্তকাবলী

বাইবেলের পুরাতন নিয়ম বিভিন্ন পুস্তকের সংকলন। এসব পুস্তক নানা আয়তনের এবং এসবের লেখকের সংখ্যাও কম নয়। লোকের মুখে মুখে প্রচলিত কাহিনী অবলম্বনে ওইসব লেখক নয়শত বছরেরও বেশি সময় ধরে নানা ভাষায় ওই পুস্তকগুলো রচনা করে গেছেন। কখনো কোনো ঘটনার সঙ্গে সঙ্গতি বিধানের জন্য অথবা জরুরি কোনো প্রয়োজনে বহুবার এসব রচনা সংশোধিত ও রূপান্তরিত হয়েছে এমনও দেখা গেছে যে, প্রথমবারের সংশোধন ও রূপায়ণের সময়কালের সাথে দ্বিতীয়বারের সংশোধন ও রূপান্তরের সময়কালের ব্যবধান ছিল বিরাট।

খুব সম্ভব খ্রিস্টপূর্ব একাদশ শতাব্দীতে ইহুদীদের রাজত্বের সূচনায় বাইবেলের পুরাতন নিয়মের ওইসব রচনা বিপুল পরিমাণে রচিত হতে শুরু করে। তখন রাজকীয় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে একদল লিপিকারের আবির্ভাব ঘটেছিল। এঁরা সবাই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত এবং শুধুমাত্র লেখা নকলের মধ্যেই এঁদের ভূমিকা সীমাবদ্ধ ছিল না। ইতিহাসে বাইবেলের যে অসম্পূর্ণ রচনার কথা উল্লেখ রয়েছি, সম্ভবত তা এই সময়কার। তখন বিশেষ কারণে এসব রচনা লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজন দেখা দেয়। কিছুসংখ্যক সঙ্গীতের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এদিকে হযরত ইয়াকুব ও হযরত মুসার প্রাপ্ত প্রত্যাদেশসমূহ এবং টেন-কম্যান্ডমেন্টস ছাড়াও সাধারণের জন্য আইনবিষয়ক বাণীসমূহ লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজন ছিল। কেননা, রাজকীয় আইন প্রণয়নের আগে এসব বাণী ধর্মীয় ঐতিহ্য গড়ে তুলতে সহায়তা করেছিল যথেষ্ট। এভাবে নানাস্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানাধরনের বিষয় ও বাণী-সম্বলিত রচনা নিয়েই গড়ে উঠেছিল বাইবেলের পুরাতন নিয়মের মূল গ্রন্থাংশ।

এর কিছুকাল পরে, সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব দশম শতাব্দীতে, ‘জেহোভিস্ট সংস্করণ’ নামে পরিচিত বাইবেলের পুরাতন নিয়মে পেন্টাটেক অধ্যায়ের মূল রচনা তৈরি হয়। এই নামকরণের জন্য যে, এইসব রচনায় স্রষ্টাকে বলা হত ‘জোহাভা’। এই মূল রচনাই ছিল হযরত মুসার কিতাব বলে পরিচিত তোরাহ্ বা তাওরাতের বুনিয়াদ। পরবর্তীকালে এর সাথে ‘এলোহিস্ট’ পাঠ এবং ‘সেকেরডোটাল’ বিবরণী সংযোজিত হয়। এসব পাঠের স্রষ্টাকে বলা হতো ‘এলোহিম’। প্রাথমিক পর্যায়ে জেহোভিস্ট বাইবেলের মূল রচনায় বিশ্বের উৎপত্তি থেকে হযরত ইয়াকুবের (জ্যাকব) মৃত্যু পর্যন্ত সময়ের বিবরণী স্থান লাভ করেছিল এই মূল রচনাসমূহ সংগৃহীত হয়েছিল দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য জুদাহ্ থেকে।

খ্রীস্টপূর্ব নবম শতাব্দীর শেষভাগ ও অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগ ছিল হযরত ইলিয়াস ও এলিশার নবুয়তের আমল। এই উভয় নবীর কিতাবও এখন আমরা পাচ্ছি। তখনই উপযুক্ত পোটেক বা পঞ্চপুস্তকের বিবরণীর এলোহিস্ট পাঠ রচিত হয়। এই রচনা অবশ্য জেহোভিস্ট রচনার চেয়ে সংক্ষিপ্ত। কেননা, এলোহিস্ট রচনায় শুধু হযরত ইবরাহীম, ইয়াকুব ও হযরত ইউসুফের বিবরণী স্থান লাভ করেছিল। বাইবেলের পুরাতন নিয়মের যশুয়া ও জাজেস (বিচারকগণ) পুস্তকখানিও এই সময়ের রচনা।

খ্রীস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে এমনসব নবীর আবির্ভাব ঘটে, যারা নিজেরাই ছিলেন লেখক। এ ধরনের লেখক-নবীদের মধ্যে আমোষ ও হোশেয় এবং জুদাহ-র নবী মিখাহর নাম উল্লেখযোগ্য। খ্রীস্টপূর্ব ৭২১ সালে সামারিয়ার পতনের মধ্যদিয়ে ইহুদীদের রাজত্বের পরিসমাপ্তি ঘটে। এরফলে ধর্মীয় উত্তরাধিকার ন্যস্ত হয় জুদাহ্ রাজ্যের উপর। তখনই পুরাতন নিয়মের প্রবাদসমূহ একক-পুস্তক হিসেবে সংকলিত হয়ে জেহোভিস্ট ও এলোহিস্ট উভয় সংস্করণের পেন্টাটেক বা পঞ্চপুস্তকের সাথে যুক্ত হয়। এভাবে তাওরাত হয় সংকলিত। তখনই ডেটেরোনমি বা গণনা-পুস্তক রচিত হয়। খ্রীষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে জোশিয়ার রাজত্বকালে আবির্ভাব ঘটে জিরমিয় নবীর। কিন্তু তার বাণীসমূহ পুস্তকাকারে সম্পূর্ণভাবে সংকলিত হতে সময় যায় প্রায় শত বছর।

খ্রিস্টপূর্ব ৫৯৮ সালে ইহুদীদের প্রথম নির্বাসনের আগেই পুরাতন নিয়মের তিনটি পুস্তক যথা সনিয়, নহুম ও হকুক সংকলিত হয়। এজেকেল নবীর সময়কালে সংঘটিত হয় ইহুদীদের প্রথম নির্বাসন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৭ সালে জেরুজালেমের পতনে ইহুদীদের দ্বিতীয় নির্বাসনের কাল শুরু হয় এবং এই নির্বাসন অব্যাহত থাকে খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮ সাল পর্যন্ত।

এজেকেল শুধু ইহুদীদের নির্বাসনকালের নবী ছিলেন না; তিনি ছিলেন নির্বাসনকালের শেষ উল্লেখযোগ্য পয়গম্বরও। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পূর্বে তাঁর কিতাব বর্তমান আকারে সংকলিত হতে পারেনি। যেসব লিপিকার-পুরোহিত তাঁর ‘আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার লাভ করেছিলেন, তাঁদের হাতেই তার বাণীর সংকলন সমাপ্ত হয়েছিল। এই লিপিকার-পুরোহিতরাই বাইবেলের আদি-পুস্তকের তৃতীয় সংস্করণ রচনার কাজে হাত দেন। এই সংস্করণ ‘সেকেরডোটাল’ নামে পরিচিত। এতে সৃষ্টির সূচনা থেকে হযরত ইয়াকুবের মৃত্যু পর্যন্ত বিবরণী স্থান পেয়েছে। এভাবে তাওরাতের জেহোভিস্ট ও এলোহিস্ট সংস্করণের মাঝখানে কেন্দ্রীয় যোগসূত্র হিসেবে স্থান লাভ করে এই তৃতীয় সংস্করণ। পরবর্তীকালে দেখা যায়, মোটামুটিভাবে দু’ থেকে চার শতাব্দী আগেকার পাঠের সাথে এই তৃতীয় সংস্করণের পাঠ যুক্ত হওয়ায় কি ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। যাহোক, পুরাতন নিয়মের বিলাপ পুস্তক তখনই প্রকাশিত হয়।

খ্রীস্টপূর্ব ৫৩৮ সালে সাইরাসের ঘোষণায় ইহুদীদের ব্যাবিলন নির্বাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে। এরপর তারা জেরুজালেমে ফিরে আসেন এবং সেখানকার উপাসনালয় পুনঃনির্মাণ করেন। এরপর বিভিন্ন পয়গম্বরের প্রচারকার্য চলতে থাকে। এসব নবীর বাণী সংকলন ক্রমান্বয়ে হগয়, সখরিয়, ইশাইয়ার তৃতীয় পুস্তক, মালাখি, দানিয়েল এবং বারোখ-পুস্তক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে (সর্বশেষ পুস্তকটি গ্রীক ভাষায় রচিত)।

ইহুদীদের নির্বাসনের পরবর্তী পর্যায়ে রচিত হয় ‘বুকস অব উইজডম’। প্রবাদ-সংক্রান্ত পুস্তকখানি নিঃসন্দেহে খ্রীস্টপূর্ব ৪০০ সালের দিককার রচনা। ইয়োব পুস্তকের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়। ইকলেসিয়াস্টিস বা কোহেলেথ রচিত হয় খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে। পরমগীত ও বংশাবলী প্রথম ও দ্বিতীয় ইষরা ও নহিমিয় পুস্তকগুলোও তখনকারই রচনা। ইলেসিয়াস্টিকাস বা সিরাহ প্রকাশিত হয় খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে। হিতোপদেশ পুস্তক ও মাকাবিস প্রথম ও দ্বিতীয় পুস্তক খ্রিস্টের জন্মের এক শতাব্দীকাল আগেকার রচনা। রুথ, ইস্টার ও জোনা (ইউনুস নবী) পুস্তকের সময়কাল নির্ণয় করা কঠিন। টবিট ও জুডিথ পুস্তকদ্বয় সম্পর্কেও একইকথা বলা চলে। অবশ্য, ইতোপূর্বে যেসব পুস্তকের রচনা ও সংকলনের সময়কাল দেয়া হয়েছে, ধরেই নিতে হবে যে, তখনকার পরেও এইসব পুস্তকে নানা বিষয় ও রচনা সংযোজিত হয়েছে। কেননা, খ্রিস্টজন্মের মাত্র এক শতাব্দীকাল আগে বাইবেল (পুরাতন নিয়ম) রচনার রীতিনীতি ও নিয়মকানুন ঘোষণা করা হয়। কিন্তু, এর অনেক নিয়ম-রীতি চূড়ান্ত হতে হতে খ্রিস্টজন্মের পরেও শতাব্দীকাল চলে যায়।

এভাবে, আদি থেকে খ্রিস্টধর্মের আবির্ভাব পর্যন্ত বাইবেল (পুরাতন নিয়ম) ইহুদী জাতির ধর্মগ্রন্থ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। খ্রিস্টপূর্ব দশম শতাব্দী থেকে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী পর্যন্ত বাইবেলের (পুরাতন নিয়মের) পুস্তকসমূহ বহুবার লিখন ও সংশোধনের পর চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে। বলা আবশ্যক যে, তওরাত তথা বাইবেল (পুরাতন নিয়ম) রচনার এই ইতিহাস কোনোক্রমেই কারো ব্যক্তিগত অভিমতের বিবরণ নয়। বাইবেলের ইতিহাস-সংক্রান্ত এই জরিপ গবেষণায় প্রয়োজনীয় তথ্যাদি গ্রহণ করা হয়েছে সলকরের ডমিনিক্যান ফ্যাকালটির অধ্যাপক জে. পি. সানড্রোজ প্রণীত এনসাইক্লোপিডিয়ার ‘বাইবেল’ অধ্যায় থেকে (প্যারিস, ১৯৪৭ সংস্করণ, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৪৬-২৫৩ দ্রষ্টব্য)। বাইবেলের পুরাতন নিয়ম (ওল্ড টেস্টামেন্ট) প্রকৃতপক্ষে যে কি ধরনের গ্রন্থ, তা বুঝতে হলে প্রাজ্ঞ ও অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞবৃন্দের গবেষণার দ্বারা আধুনিক যুগে সঠিকভাবে প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত এই তথ্যাবলীর সহায়তা নিঃসন্দেহে প্রয়োজন।

অনস্বীকার্য যে, বাইবেলের (পুরাতন নিয়মের) এইসব গ্রন্থে বিভিন্ন পয়গম্বর কর্তৃক প্রাপ্ত ওহী বা প্রত্যাদেশের সংমিশ্রণ অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু, তারচেয়েও বড় কথা, এইসব প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত বাণীর ভিত্তিতে তখনকার লেখকেরা নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে যেসব রচনা উপহার দিয়েছেন, সেগুলো এখন বাইবেলের পুরাতন নিয়ম (ওল্ড টেস্টামেন্ট) বা তাওরাত নামে চলছে। তখনকার এই লেখকেরা বিভিন্ন নবীর প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত বাণীর পরিবর্তন তো করেছেনই, অধিকন্তু, তাঁরা তাঁদের নিজ নিজ স্বার্থে নিজস্ব যুগের এবং পরিবেশের প্রয়োজনে বর্ণিত বিষয়বস্তুর ব্যাপক অদল-বদল এমনকি সংযোজন ঘটাতেও বিন্দুমাত্র কুষ্ঠাবোধ করেননি।

কিন্তু, এসব নিরপেক্ষ ও গবেষণালব্ধ তথ্যের সাথে যদি অধুনা জনসাধারণের জন্য সম্প্রচারিত এবং বাইবেলের ভূমিকায় পরিবেশিত বিভিন্ন বক্তব্যের তুলনামূলক বিচার করা হয়, তা হলে কি দেখতে পাই? দেখতে পাই সম্পূর্ণ ভিন্ন এক চিত্র ও বক্তব্য। দেখা যাচ্ছে, বাইবেল রচনার এই ইতিহাস সম্পর্কে আধুনিক বাইবেলের ভূমিকা-লেখক কোনো কথা বলছেন না। বরং তিনি এমনসব দ্ব্যর্থবোধক বক্তব্য পেশ করছেন যা সহজেই পাঠকদের বিভ্রান্ত করতে পারে। এছাড়াও, ভূমিকা-লেখক সঠিক তথ্য ও সত্যকে এমনভাবে ধামাচাপা দিয়ে অসম্পূর্ণভাবে এমনসব ভুল তথ্য তুলে ধরছেন যে, সেসব পাঠ করলে মনে হবে যেন, এরচেয়ে বড় সত্য আর কোনোটিই হতে পারে না।

 শুধু একটি বা দুটি বাইবেলে নয়, বিভিন্নসূত্রে প্রকাশিত বহু বাইবেলেই এই ধরনের বিভ্রান্তির ভূমিকা ও পরিচিতি সন্নিবেশিত রয়েছে। বাইবেলের অন্তর্ভুক্ত প্রায় সব পুস্তকই বেশ কয়েকবার করে সংশোধন ও সম্পাদনা করে প্রকাশ করা হয়েছে (উদাহরণ, পেন্টাটেক বা তাওরাতের পঞ্চপুস্তক) এবং প্রতিবারই বর্জিত বিষয় সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, ওইসব বাড়তি বিষয় খুব সম্ভব পরবর্তী সময়ের সংযোজন’। বাইবেল-সংক্রান্ত বিভিন্ন পুস্তকে আরো দেখা যাবে, গুরুত্বহীন কোনো বিষয় কিংবা অধ্যায় নিয়ে নানাকথা বলা হচ্ছে, কিন্তু যেসব সমস্যাসঙ্কুল বিষয় বা অধ্যায়ের জন্য বিস্তৃত আলোচনা ও ব্যাখ্যা প্রয়োজন, সেগুলো সম্পর্কে পালন করা হচ্ছে সম্পূর্ণ নীরবতা। আরো পরিতাপের বিষয়, এই ধরনের ভুল তথ্য ও অসত্য ভূমিকা ও পরিচিতি-সম্বলিত বাইবেল এখনো জনসাধারণের জন্য প্রচুর বাজারে ছাড়া হচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *