১৩. কোরআন, হাদীস ও আধুনিক বিজ্ঞান

কোরআন, হাদীস ও আধুনিক বিজ্ঞান

হাদীস ও বিজ্ঞান-সংক্রান্ত আলোচনার বিষয়ে আমরা ‘বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান’ পুস্তকের মূল লেখক ডঃ মরিস বুকাইলির সাথে সবক্ষেত্রে একমত নই। সহীহ্ হাদীসগ্রন্থগুলোতেও সঠিক ও বিশ্বস্ত হাদীসের পাশাপাশি কিভাবে হযরতের (দঃ) নামে বেশকিছু প্রক্ষিপ্ত–মওজু—দুর্বল–জাল ও মিথ্যা হাদীস স্থানলাভ করেছে, মুসলিম হাদীসবেত্তা–ধর্মতত্ত্ববিদ ও চিন্তাশীল লেখকবৃন্দ সে সম্পর্কে বিস্তর আলোচনা-পর্যালোচনা করে গেছেন। বলা আবশ্যক যে, বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান গ্রন্থে লেখক মরিস বুকাইলি বিজ্ঞান-সংক্রান্ত যেসব হাদীস আলোচনার জন্য গ্রহণ করেছেন, তার অধিকাংশ, কিংবা সবগুলোই ওইরকম জাল, দুর্বল কিংবা মিথ্যা হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

তবুও মরিস বুকইলির মত পাশ্চাত্য জগতের একজন চিন্তাশীল গবেষক বিজ্ঞানী তার সাড়া জাগানো এই গ্রন্থটিতে ‘হাদীস ও বিজ্ঞান সম্পর্কে যে আলোচনার অবতারণা করেছেন, চিন্তাশীল গবেষক-বিজ্ঞানীদের এ বিষয়ের প্রতি আশু দৃষ্টি আকর্ষণের স্বার্থে আমরা এই অধ্যায়ের অবতারণা করছি। স্মর্তব্য যে, মরিস বুকাইলি নিজেও তাঁর আলোচনার জন্য গৃহীত এসব হাদীস আদৌ হযরতের (দঃ) বক্তব্য কিনা, অর্থাৎ, ‘সন্দেহজনক’ বলে উল্লেখ করেছেন। এ ধরনের সন্দেহজনক’ তথা দুর্বল, জাল ও মিথ্যা হাদীস কিভাবে হাদীসগ্রন্থসমূহে স্থান লাভ করেছে সে বিষয়ে যারা বিস্তারিতভাবে জানতে চান, তারা যেন মেহেরবানী করে মরহুম মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ রচিত সুবিখ্যাত ‘মোস্তফা চরিত’ গ্রন্থটির ৪র্থ থেকে ১০ম অধ্যায়ে মনোযোগের সাথে পাঠ করেন।

কোরআন ইসলামের ধর্মীয় নীতি ও বিধি-বিধানের একমাত্র উৎস নয় : মোহাম্মদের (দঃ) জীবদ্দশায় যেমন তেমন তাঁর মৃত্যুর পরেও ইসলামী আইন তথা শরা-শরীয়তের পরিপূরক বিধি-বিধান তাঁর বক্তব্য ও কাজের মধ্যথেকে খুঁজে নেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।

যদিও প্রথম থেকেই হাদীস লিপিবদ্ধ আকারে ধরে রাখার ব্যবস্থা ছিল, তথাপি বেশিরভাগ হাদীস এসেছে মৌখিক বর্ণনা থেকে। যারা এসব হাদীস সংকলন আকারে প্রকাশ করে গেছেন, তারা বিশেষ কষ্ট স্বীকার করে ভালভাবে খোঁজখবর নিয়েই অতীতের সেসব ঘটনা বা বক্তব্য লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এ ধরনের হাদীস-সংগ্রহে যারা লিপ্ত ছিলেন, তাঁরা জানতেন, নিখুঁতভাবে সঠিক হাদীস সংগ্রহের গুরুত্ব কতখানি। এ কারণে দেখা যায়, সংগৃহীত প্রতিটি হাদীস, এমনকি সে হাদীস যতই নাজুক হোক-না-কেন, কার নিকট থেকে কার মাধ্যমে তা সংগৃহীত হয়েছে, এবং একদম প্রথম পর্যায়ে কে বা কারা সে হাদীস মোহাম্মদের (দঃ) পরিবারের কোন্ সদস্য কিংবা তার কোন্ সাহাবার নিকট থেকে শুনেছিলেন, সংশ্লিষ্ট সেই হাদীসে সেসব তথ্যের বিশেষ উল্লেখ রয়েছে।

এভাবেই মোহাম্মদের (দঃ) বহুসংখ্যক বক্তব্য ও কর্মের বিবরণী লিপিবদ্ধ হয়ে পরিচিতি লাভ করেছে ‘হাদীস’ নামে। ‘হাদীস’ শব্দের অর্থ হল বক্তব্য বা উচ্চারণ। তবে প্রচলিত অর্থে মোহাম্মদের (দঃ) কর্মবিবরণীকেও ‘হাদীস’ নামে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।

সংকলন-গ্রন্থের আকারে কিছু কিছু হাদীস প্রকাশ পায়, মোহাম্মদের (দঃ) মৃত্যুর কয়েক দশক পরে। এভাবে তার মৃত্যুর প্রায় দু’শ বছরের মধ্যে হাদীসের কয়েকখানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংকলন প্রকাশিত হয়। এরমধ্যে সর্বাধিক বিশুদ্ধ বা সহীহ হাদীসগ্রন্থ হিসেবে আল-বুখারী ও মুসলিম সমধিক প্রসিদ্ধ। মোহাম্মদের (দঃ) মৃত্যুর দু’শ বছর পরে প্রকাশিত এই দুটি সংকলনে যেসব হাদীস স্থান লাভ করেছে, তা সর্বত্র বিশ্বস্ত বা সঠিক হাদীস হিসেবে সমাদৃত।

সম্প্রতি মদীনার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর মোহাম্মদ মুহসিন খান কর্তৃক সহীহ বুখারীর একখানি আরবি/ইংরেজি দ্বিভাষিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে (১ম সংস্করণ, ১৯৭১)। সঠিকত্ব ও বিশ্বস্ততার দিকথেকে হাদীস আল-বুখারীর স্থান কোরআনের পরেই। ইসলামিক ট্র্যাডিশন্স’ নামে ফরাসী ভাষায় আল-বুখারীর অনুবাদ প্রকাশ করেছেন হুডাস ও মারকাইস (১৯০৩-১৯১৪)। সুতরাং, যারা আরবি ভাষা না জানেন, তাঁরাও এখন এসব অনুবাদের মাধ্যমে হাদীস পড়ে দেখতে পারেন। তবে, হাদীসের বিভিন্ন অনুবাদের ব্যাপারে পাঠকদের অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কেননা, ফরাসী ভাষাসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষায় হাদীসের অনুবাদগুলোতে বড় বেশি ভুল ও অসত্য বক্তব্য ভরে দেয়া হয়েছে। অনেকক্ষেত্রে দেখা গেছে, এগুলো প্রকৃতপক্ষে অনুবাদ নয়; বরং ব্যাখ্যা। শুধু তাই নয়, কোনো কোনো অনুবাদে দেখা গেছে, হাদীসের মূল বক্তব্যের রদবদল তো করা হয়েছেই, সেইসাথে হাদীসে যা নাই তাই জুড়ে দেয়া হয়েছে হাদীসের নামে।

মূল বা উৎসের দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, মুসলমানদের হাদীস আর খ্রিস্টানদের বাইবেলের সুসমাচারসমূহ (ইঞ্জিলের ১ম চারখণ্ড) অনেকটা একই ধরনের ধর্মীয়-গ্রন্থ। বাইবেলের (ইঞ্জিলের) যেমন, হাদীসেরও তেমনি, কোনো লেখক বা সংকলনকারী বর্ণিত কোনো ঘটনা বা বক্তব্য লিপিবদ্ধ হয়ে যাওয়ার অনেক পরে সেগুলো সংকলনে স্থান লাভ করেছে। বাইবেলের সুসমাচারগুলোর ব্যাপারে যেমন, হাদীসের ব্যাপারেও তেমনি সেসবের মধ্যে বর্ণিত সবকিছুই বিশ্বস্ত প্রামাণ্য বা একদম সহীহ্ বলে সর্বসাধারণ কর্তৃক গৃহীত হয়নি। হাদীস বা সুন্নাহর ব্যাপারে যারা বিশেষজ্ঞ, তেমন ধারার অভিজ্ঞ আলেম-মুহাদ্দিসের নিকট স্বল্পসংখ্যক হাদীসই সর্বজনস্বীকৃত বিশ্বস্ত হাদীস হিসেবে অনুমোদন লাভ করতে পেরেছে। এ কারণেই আল-মুয়াত্তা, সহীহ মুসলিম ও সহীহ্ আল-বুখারী বাদে অন্যান্য হাদীসগ্রন্থে দেখা যায়, সহীহ্ বা সঠিক বলে পরিচিত হাদীসের পাশাপাশি এমনসব হাদীসও স্থান লাভ করেছে–যেসব হাদীস হল জাল, নতুবা বাতিল বলে পরিগণিত।

বাইবেলের যে কানুনিক গসপেল বা প্রামাণ্য চার সুসমাচার (ইঞ্জিলের ১-৪ খণ্ড) রয়েছে, বর্তমান সময়ে এসে সেসবের সঠিকত্ব নিয়েও কোনো কোনো বিজ্ঞ-বিশেষজ্ঞ প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু খ্রিস্টধর্মের সর্বোচ্চ পর্যায়ের পুরোহিত ধর্মগুরুরা সেসব প্রশ্নের জবাব দিতে এগিয়ে আসছেন না। বরং, তাঁরা এসব বিষয়ে একদম নীরব। পক্ষান্তরে, যেসব হাদীস একদম সঠিক ও সহীহ্ বলে পরিচিত, সেগুলোর উপরেও মুসলিম সমাজে গোড়া থেকেই নানা পর্যালোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ চালানো হয়েছে (এবং এখনো হচ্ছে)। ইসলামের ইতিহাসের সূচনাতেও দেখা যায়, ধর্মীয় বিষয়ে যারা বিশেষজ্ঞ, তাঁরাও এসব হাদীসের সঠিকত্ব নির্ণয়ে কম বিচার-বিশ্লেষণ চালাননি। তবে মূল ধর্মীয় গ্রন্থ (কোরআন) আগাগোড়াই ‘পবিত্র কিতাব হিসেবে ধর্মীয় শিক্ষা ও বিধি-বিধানের প্রধান উৎসরূপে বিরাজ করছে : কোরআনের সঠিকত্ব সম্পর্কে কোনোরকম প্রশ্ন কিংবা বাদানুবাদ এখনো দেখা দেয়নি।

হাদীস নিয়েও কৌতূহলের অন্ত নেই। হাদীসের বাণীকে তাই ড. মরিস বুকাইলি এই গবেষণার বিষয়বস্তু করে নিয়েছেন। একটিমাত্র কারণে : বিভিন্ন বিষয়ে হযরত মোহাম্মদ (দঃ) কিভাবে নিজের চিন্তাভাবনা ও বক্তব্য প্রকাশ করতেন, সে বিষয়টা সম্পর্কে ড. মরিস বুকাইলি সুস্পষ্ট ধারণা গড়ে তুলতে প্রয়াস পেয়েছেন। সেইসাথে তিনি আরো একটি বিষয় পরীক্ষা করে নিতে চেয়েছেন, ওহী বা প্রত্যাদেশের মাধ্যমে প্রাপ্ত ধর্মগ্রন্থ কোরআন ছাড়া মোহাম্মদের (দঃ)-এর নামে প্রচারিত তাঁর নিজস্ব অপরাপর বাণী ও বক্তব্য আধুনিক যুগের বৈজ্ঞানিক তথ্যজ্ঞানের বিচার-বিশ্লেষণে কতটা টেকসই।

যদিও সহীহ মুসলিম ও সঠিক ও প্রামাণ্য হাদীসগ্রন্থ হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত, তবুও তিনি তাঁর এই গবেষণা-পর্যালোচনায় সর্বাধিক প্রামাণ্য ও সঠিক বলে বিবেচিত আল-বুখারীকেই বেছে নিয়েছেন। এই পর্যালোচনায় তিনি একটি কথা সর্বক্ষণ মনে রেখেছেন যে, বিভিন্ন লোকের নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এইসব হাদীসগ্রন্থ সংকলিত হয়েছে মানুষের হাতেই। এসবের কোনো কোনোটা লিখিতাকারে থাকলেও বেশিরভাগই চালু ছিল মুখে মুখে। এসব হাদীসের কোনো কোনো বর্ণনা কমবেশি সঠিক। তাছাড়া, যেসব হাদীস সঠিক নয়, সেসবের ভ্রান্তির জন্য দায়ী তারাই যাদের মাধ্যমে এসব হাদীস চালু ছিল। পক্ষান্তরে, এমন ধরনের হাদীসও রয়েছে, যেসব হাদীসের রাবি বা বর্ণনাকারীর সংখ্যা অনেক, এবং সেসব হাদীসের সত্যতা ও প্রামাণিকতাও প্রশ্নাতীত (মুসলিম মুহাদ্দিসবৃন্দ ভ্রান্তিপূর্ণ কিংবা দুর্বল হাদীসকে ‘জান্নি’; এবং সম্পূর্ণ সঠিক ও প্রামাণ্য হাদীসকে ‘কাতী” নামে অভিহিত করে গেছেন)।

এতুদপ্রসঙ্গে আমরা এবার ড. মরিস বুকাইলির বর্ণনা পাঠান্তে বিষয়টি পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরছি : …. আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে বিভিন্ন হাদীসের উপরেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছি। ইতিপূর্বে কোরআনের বিভিন্ন আয়াত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের তথ্য-উপাত্ত যেভাবে ব্যবহার করেছি, এক্ষেত্রেও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার যে ফলাফল তা মুখে না বলে উদাহরণসমেত তুলে ধরে দেখা যাচ্ছে : আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে কোরআনে পরিবেশিত বৈজ্ঞানিক তথ্যাবলী যেখানে সত্য ও প্রামাণ্য বলে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে, সেখানে হাদীসে বর্ণিত একই বিষয়ের তথ্যাবলী একই ধরনের জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে সত্য কিংবা প্রামাণ্য হিসেবে প্রায় দাঁড়াতেই পারছে না। বলা আবশ্যক যে, এই মন্তব্য করতে গিয়ে আমি হাদীসের শুধু বিজ্ঞান-সংক্রান্ত বিষয়গুলোকেই বেছে নিয়েছি।

এমনও দেখা গেছে, কোরআনের কোনো কোনো বাণীর ব্যাখ্যা হিসেবে হাদীসের কোনো কোনো বাণীকে গ্রহণ করা হয়েছে এবং হাদীসের সেই ব্যাখ্যা টেনে তফসীরকারগণ কোরআনের বিভিন্ন বাণীর যেসব ভাষ্য রচনা করে গেছেন, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে সেসবও গ্রহণযোগ্য হতে পারছে না। ইতিপূর্বে আমরা কোরআনের একটি আয়াত (সূরা ৩৬, আয়াত ৩৮) নজরে এনে দেখেছি, সূর্য-সংক্রান্ত এই আয়াতটি আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ। আয়াতটি এই : “সূর্য ছুটিয়া চলিয়াছে, তাহার একটি নির্ধারিত স্থানের অভিমুখে। নিচে এই আয়াতের ব্যাখ্যা-সম্বলিত একটি হাদীস তুলে ধরা হল :

“ডুবিয়া যাওয়ার কালে সূর্য … আরশের নিচে নিজেকে সিজদায় নত করিয়া দেয় এবং পুনরায় উদিত হওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করে, এবং অনুমতি দেওয়া হয়। এবং তারপর (এমন এক সময় আসিবে) যখন ইহা প্রায় সিজদায় নত হবে … এবং নিজস্ব পথে যাত্রা করার অনুমতি প্রার্থনা করিবে; তখন নির্দেশ দেয়া হবে, সেই পথেই ফিরিয়া যাইতে, যে পথে সে আসিয়াছে। এবং এইরূপে উহা উদিত হইবে পশ্চিম দিক হইতে।” … (সহীহ আল-বুখারী)

এই হাদীসের মূল আরবিটি (সৃষ্টির সূচনাপর্ব, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮৩, ৫৪তম অংশ, ৪র্থ অধ্যায়, ৪২১ নং হাদীস) খুবই দুর্বোধ্য এবং তার অনুবাদ আরো দুঃসাধ্য। এই হাদীসটি একটি রূপকভাবের প্রকাশ। তথাপি, এটি এমনভাবে বর্ণিত হয়েছে, যা থেকে বোঝা যায় সূর্যই ঘুরছে এবং পৃথিবী স্থির হয়ে রয়েছে; অথচ, আধুনিক বিজ্ঞানের অভিমত এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সবচেয়ে বড় কথা, হাদীসটি আদৌ সহীহ, কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে (অর্থাৎ এটি জানি হাদীসের অন্তর্ভুক্ত)।

বুখারী থেকে গৃহীত আরেকটি হাদীসে (ঐ, অধ্যায় ৬, ৪৩০ নং হাদীস) গর্ভস্থ ভ্রূণের ক্রমবিকাশের ব্যাপারে এক অদ্ভুত হিসেব তুলে ধরা হয়েছে : “মানব-প্রজননের জন্য যেসব উপাদানের প্রয়োজন সেগুলো একত্রিত হয় ৪০ দিনে; দ্বিতীয় ৪০ দিন লাগে ভ্রূণটি যখন ‘আলাক’ বা ‘আটকানো অবস্থায় পৌঁছে; তৃতীয় ৪০ দিনে ভ্রূণটি উপনীত হয় ‘চিবানো গোশতের টুকরার মত অবস্থায়। তখন একজন ফিরিশতা আসেন, শিশুটির তকদিরে কি আছে তা। নির্দোষ করে দেয়ার জন্য এবং ভ্রূণটির মধ্যে আত্মাকে ফুকে দেওয়া হয়। বলা অনাবশ্যক যে, এখানে ভ্রণ সম্পর্কে যে তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, তা আধুনিক বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত তথ্যের সাথে কোনক্রমেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

কোরআনে যেখানে রোগব্যাধির উপশম-সংক্রান্ত বিষয়ে একটি মন্তব্য (সূরা ১৬, আয়াত ৬৯) বাদে আর কোনো বক্তব্য নেই, সেখানে হাদীসগ্রন্থের বিস্তৃত স্থান জুড়ে এ বিষয়ে নানা বক্তব্য পেশ করা হয়েছে। বলাবাহুল্য, কোরআনের উপযুক্ত আয়াতে মধু ব্যবহারের দ্বারা শুধু রোগব্যাধি নিরাময়ের সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া সেখানে নির্দিষ্ট করে কোনো রোগের নামও উল্লেখ করা হয়নি। পক্ষান্তরে, আল-বুখারী’র একটি সম্পূর্ণ অধ্যায়ই (৭৬নং) ব্যবহৃত হয়েছে ঔষধ-সংক্রান্ত নানা হাদীস বর্ণনায়। হুডাস ও মারকাইস অনূদিত ফরাসী ভাষার আল-বুখারীর ৪র্থ খণ্ডের ৬২ থেকে ৯১ পৃষ্ঠা এবং ডঃ মোহাম্মদ মুহসিন খানের দ্বিভাষিক আরবী/ইংরেজি বুখারীর ৭৮ম খণ্ডের ৩৯৫ পৃষ্ঠা থেকে ৪৪২ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য। সন্দেহ নাই যে, এইসব পৃষ্ঠায় যেসব হাদীস বর্ণিত হয়েছে তারমধ্যে অনেকগুলোই বানোয়াট (জানি); কিন্তু সার্বিক বিচারে এইসব হাদীস আবার গুরুত্বপূর্ণ ও কৌতূহলোদ্দীপক এই কারণে যে, খুব সম্ভব এই-সব হাদীসে সে সময়ের বিভিন্ন রোগব্যাধির প্রচলিত ঔষধপত্র ও নিরাময়-পদ্ধতি সম্পর্কেই অভিমত ও বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে থাকবে। আল-বুখারীর অপরাপর অধ্যায়ে ঔষধপত্র-সংক্রান্ত আরো যেসব হাদীস বিদ্যমান, এই প্রসঙ্গে সেগুলোর কথাও স্মরণ করা যেতে পারে।

এসব হাদীসের কোনো কোনোটিতে দেখা যায়, বদনজর, যাদুটোনা এবং মন্ত্রের দ্বারা ভূত ছাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। অবশ্য, এসব কাজে কোরআনের আয়াত ব্যবহার করা হলে, সে জন্যে পারিশ্রমিক গ্রহণের উপরে রয়েছে স্পষ্ট বিধি-নিষেধ। একটি হাদীসে দেখা যায়, বিশেষ একধরনের খেজুর যাদুমন্ত্রের ক্ষমতাকে বানচাল করে দিতে পারে। অন্যদিকে এও বলা হয়েছে যে, বিষাক্ত সর্পদংশন থেকে মানুষকে বাঁচাতে মন্ত্রশক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে।

এ ধরনের বক্তব্যে অবশ্য অবাক হওয়ার তেমন কিছু নেই। মনে রাখা দরকার, সেকালে ঔষধপত্রের বৈজ্ঞানিক ব্যবহার চালু হয়নি। বিভিন্ন রোগব্যাধি থেকে মুক্তির জন্য মানুষকে প্রধানত সাধারণ ব্যবস্থাপত্র প্রাকৃতিক পদ্ধতি প্রভৃতির উপরে নির্ভর করতে হত। এসব পদ্ধতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল শিংগা লাগানো, লোহা পুড়ে দাগ দেয়া, উকুন তাড়ানোর জন্য মাথা মুড়ানো, উটের দুধ ব্যবহার প্রভৃতি। তাছাড়াও, কালিজিরার মত নানাধরনের বীজও রোগব্যাধি নিরাময়ে ব্যবহৃত হত এবং একই উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হত নানাধরনের লতা-গুল্ম যেমন ইন্ডিয়ান কাস্ট। ক্ষতের রক্তপাত বন্ধের জন্য খেজুর পাতার চাটাই পুড়ে তার ছাই লাগনোর জন্যেও নির্দেশ দেয়া হত। এককথায়, আপদকালীন জরুরি প্রয়োজনে যা-কিছু হাতের কাছে পাওয়া যেত, তার সদ্ব্যবহারে কোনোরকম ত্রুটি রাখা হত না। অবশ্য, ক্ষেত্রবিশেষে এমনকিছু ব্যবহারের নির্দেশও দেয়া হত, যা রুচিকর বলে গণ্য হতে পারে না। যেমন উষ্ট্রমূত্র।

এ ছাড়াও, যে যুগে বিভিন্ন রোগের উৎস ও কারণ হিসেবে এমনসব ব্যাখ্যা দেয়া হত যা আজকের যুগে মেনে নেয়া মুশকিল। যেমন : জ্বরের মূল কারণ : ‘দোজখের আগুন থেকে জ্বরের উৎপত্তি। এ সম্পর্কে এ ধরনের মোট ৪টি বক্তব্য রয়েছে বুখারীতে (দেখুন, আল-বুখারী, ঔষধশাস্ত্র, ৭ম খণ্ড, অধ্যায় ২৮, পৃষ্ঠা ৪১৬)। প্রতিটি পীড়ার ঔষধ রয়েছে : “আল্লাহ এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি সাথে সাথে যার ঔষধ তিনি সৃষ্টি করেননি।” (ঐ, অধ্যায় ১, পৃষ্ঠা ৩৯৫) এই বক্তব্যের ব্যাখ্যায় মাছি-সংক্রান্ত একটি হাদীসে বলা হয়েছে : “তোমাদের কোনো পাত্রে যদি মাছি পড়ে, তাহা হইলে উহাকে (ওই পাত্রের ভেতর) পুরাটা ডুবাইয়া লও, তারপর মাছিটাকে ফেলিয়া দাও। কেননা, মাছির একটি পাখায় যেমন রোগ থাকে, তেমনি অন্যপাখায় থাকে উহার ঔষধ (প্রতিষেধক) অর্থাৎ চিকিৎসা ব্যবস্থা।” (ঐ অধ্যায় ১৫-১৬, পৃষ্ঠা ৪৫২-৪৫৩, আরো দেখুন, সৃষ্টির সূচনা অধ্যায়, ৫৪তম অংশ, অধ্যায় ১৫ ও ১৬)।

সর্পদংশনে গর্ভপাত ঘটে যেতে পারে (এমনকি অন্ধও হতে পারে) এ ধরনের বক্তব্য রয়েছে বুখারীর সৃষ্টির সূচনা অধ্যায়ে চতুর্থ খণ্ডে (অধ্যায় ১৩ ও ১৪, পৃষ্ঠা ৩৩০ ও ৩৩৪)।

মহিলাদের ঋতুস্রাবকালীন ভিন্নধরনের রক্তপাত : ‘আল-বুখারীর হায়েজ অধ্যায়ে চতুর্থ খণ্ড, ষষ্ঠ অংশ, ৪৯০ ও ৪৯৫ পৃষ্ঠায় দুই ঋতুস্রাবের মধ্যবর্তী সময়ে (অধ্যায় ২১ ও ২৮) রক্তপাত সম্পর্কে দুটি হাদীস রয়েছে। এতে দুজন মহিলার বিবরণ রয়েছে। একজনের ক্ষেত্রে এই রোগের লক্ষণ (বর্ণনা বিশদ নয়) দেখা দিয়েছিল। তার সম্পর্কে বলা হয়েছে, তার ওই রক্ত এসেছে রক্তবহা নাড়ী থেকে। অন্য মহিলার রোগ-লক্ষণ ছিল, সাতবছর যাবত তার দুই ঋতুস্রাবের মধ্যবর্তী সময়ে রক্তপাত হত। সেখানেও কারণ হিসেবে একই রক্তবহা নারীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা যেতে পারে, এই রক্তপাতের কারণ সম্পর্কে সেকালে এই ধারণাই পোষণ করা হত। যাহোক, রোগ-লক্ষণ নির্ণয়ে এই ধরনের বক্তব্যের পেছনে যুক্তি কি সে সম্পর্কে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। সবচেয়ে বড় কথা, এই ধরনের বক্তব্য আদৌ সঠিক নয়।

রোগব্যাধি, সংক্রামক নয় : আল-বুখারীতে এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি স্থানে আলোচনা করা হয়েছে (অধ্যায় ১৯, ২৫, ৩০, ৩১, ৫৩ ও ৫৪; ৭ম খণ্ড, ৭৬ নং অংশ–কিতাবুত্তিব)। বলা হয়েছে কুষ্ঠ (পৃঃ ৪০৮), প্লেগ (৪১৮ ও ৪২২), উটের পাঁচড়া (পৃঃ ৪৪৭) সংক্রামক ব্যাধি নয়। এছাড়াও, এইসব হাদীসে সংক্রামক ব্যাধি সম্পর্কে সাধারণ আলোচনাও স্থান পেয়েছে। উল্লেখ্য যে, এরই পাশাপাশি এমন হাদীসও রয়েছে, যেখানে সম্পূর্ণ বিপরীত বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে : যে স্থানে প্লেগ দেখা দিয়েছে, সেখানে যেন কেউ না যায়; এবং কেউ যেন কুষ্ঠরোগীর সংস্পর্শে না আসে।

এসব আলোচনা থেকে সম্ভাব্য এই সিদ্ধান্তই গ্রহণ করা চলে যে, হাদীসগ্রন্থসমূহে এমন হাদীসও বিদ্যমান, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যেসব গ্রহণযোগ্য নয়। এদিকে এসব হাদীস আদৌ সহীহ বা বিশুদ্ধ কিনা, তা নিয়েও সন্দেহ রয়ে গেছে। তবুও আমরা এসব হাদীস নিয়ে আলোচনা করছি, শুধু একটি উদ্দেশ্যে। আর তা হল, কোরআনের আয়াতের সাথে এসব হাদীসের তুলনামূলক বিচার। আমরা দেখেছি, কোরআনে বিজ্ঞান-সংক্রান্ত এমন একটি আয়াতও নেই–যা বৈজ্ঞানিক বিচারে ভুল। বলা আবশ্যক যে, আমাদের আলোচনার জন্য এই বিষয়টিই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।

আলোচনার সুবিধার জন্য মনে রাখা দরকার, মোহাম্মদের (দঃ) মৃত্যুর পর তার নিকট থেকে প্রাপ্ত শিক্ষার ধারা দু’টি পর্যায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে :

প্রথমত, বিপুলসংখ্যক ইমানদার ছিলেন কোরআনের হাফেজ। মোহাম্মদের (দঃ) মতই তাঁরা বহু বহুবার এই কোরআন সম্পূর্ণভাবে হেজ-খতম দিয়েছিলেন। তাছাড়া, কোরআন লিখিতাকারেও ছিল সংরক্ষিত। এমনকি হিজরতের আগে যতটুকু কোরআন নাজিল হয়েছিল, তাও সম্পূর্ণভাবে লিখিতাকারে সংরক্ষণ করা হয়েছিল।

হিজরতের ঘটনা সংঘটিত হয় মোহাম্মদের (দঃ) মৃত্যুর দশ বছর আগে ৬২২ সালে।

দ্বিতীয়ত, মোহাম্মদের (দঃ) একান্ত ঘনিষ্ঠজন, সাহাবী-সঙ্গীরা তো বটেই, বহু ঈমানদারও তাঁর বাণীর ও কার্যাবলীর প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ছিলেন। তাঁরা কোরআন ছাড়াও মোহাম্মদের (দঃ) ওইসব বাণী ও কার্যাবলীর মধ্যে শরা শরীয়তের বিধি-বিধান ও জায়েজ-না-জায়েজের প্রশ্নের জবাব খুঁজে নিতেন।

এই পরিস্থিতিতে মোহাম্মদের (দঃ) মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যে তাঁর রেখে যাওয়া এই দুই ধরনের শিক্ষাধারা-সম্বলিত বিষয়গুলো সংকলিত হওয়ার ব্যবস্থা গৃহীত হয়। হাদীস-সংক্রান্ত প্রথম সংকলন প্রকাশ পায় মোটামুটিভাবে হিজরতের চল্লিশ বছর পর। পক্ষান্তরে, কোরআন সংকলিত হয় আরো অনেক আগে, প্রথম খলিফা আবুবকরের (রাঃ) আমলে, বিশেষ করে তৃতীয় খলিফা ওসমানের (রাঃ)-এর সময়। এই ওসমানের (রাঃ) আমলেই অর্থাৎ মোহাম্মদের (দঃ) মৃত্যুর বারো থেকে চব্বিশ বছরের মধ্যেই কোরআনের চূড়ান্ত সংকলন কিতাব আকারে প্রকাশ পায়।

এই যে দুই ধরনের ধর্মীয় গ্রন্থ : একটি কোরআন এবং অপরটি হাদীস, এদের মধ্যে যে পার্থক্য, সেই পার্থক্যটার উপরেই সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন। কোরআন ও হাদীসের মধ্যকার এই গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যটা শুধু ভাষা বা সাহিত্যমানের দিক থেকে নয়; এ পার্থক্য বিষয়বস্তুর দিক থেকেও উল্লেখযোগ্য। প্রকৃতপক্ষে, কোরআনের ভাষা ও বাভঙ্গির সাথে হাদীসের ভাষা ও বাকভঙ্গির কোনো তুলনা তো দূরের কথা, তুলনা করার চিন্তাও করা যায় না। সবচেয়ে বড় কথা, এই দুই ধরনের ধর্মীয়গ্রন্থের বাণীসমূহ যখন আধুনিক বিজ্ঞানের তথ্য জ্ঞানের আলোকে বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়, তখন তাদের মধ্যে যে পার্থক্য বিরাট হয়ে ধরা পড়ে। তা লক্ষ্য করলে যে-কারোপক্ষেই বিস্ময়ে হতবাক না হয়ে উপায় থাকে না। আশা করি, সেই পার্থক্য ইতিমধ্যেই যথাযথভাবে সকলের কাছে ধরা পড়েছে। সেই পার্থক্যগুলো সংক্ষেপে নিম্নরূপ :

কোরআনে এমনসব বাণী ও বক্তব্য রয়েছে, যেগুলো দেখতে-শুনতে অতি সাধারণ মনে হলেও সে-সবের মধ্যে এমনসব তথ্য রয়েছে যেসব তথ্যের অর্থ ও মর্ম শুধু পরবর্তী পর্যায়ে এসে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে সত্য হিসেবে উদ্ভাসিত হয়েছে ও হচ্ছে।

পক্ষান্তরে, হাদীসে এমনসব বক্তব্য বিদ্যমান, যেগুলো তৎকালীন ধারণা ও প্রচলিত বিশ্বাসের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু আধুনিক যুগে এসে ওইসব হাদীসের বক্তব্য বিজ্ঞানের বিচারে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারছে না। এমনকি ইসলামী শরা-শরীয়ত বিষয়ে যেসব হাদীসগ্রন্থের সঠিকত্ব প্রশ্নাতীতভাবেই সর্বজনস্বীকৃত তাদের বিজ্ঞান-সংক্রান্ত বিভিন্ন হাদীসের বেলাতেও মোটের উপর একই অবস্থা ঘটছে।

সবশেষে, একটা বিষয় পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন : তাহল, কোরআনের বাণী সম্পর্কে স্বয়ং মোহাম্মদের (দঃ) দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তাঁর নিজের বক্তব্য-সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। কোরআনকে তিনি নিজেই ঘোষণা করেছিলেন, আল্লাহর নিকট থেকে প্রাপ্ত ওহী বা অবতীর্ণ আসমানী কিতাব হিসেবে। বিশ বছরের অধিককাল ধরে এসব বাণী তাঁর উপর অবতীর্ণ হয়েছিল। মোহাম্মদ (দঃ) নিজেই সবিশেষ সতর্কতার সাথে সেসব বাণী শ্রেণীবদ্ধ করে গেছেন। এ বিষয়টা নিয়ে ইতিপূর্বে বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। দেখা গেছে, কোরআনের ওইসব বাণী কিভাবে মোহাম্মদের (দঃ) জীবদ্দশাতেই লিখিতাকারে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল এবং যেসব বাণী হেফজ করে রাখা হয়েছিল বহুসংখ্যক ঈমানদার হাফেজের দ্বারা। শুধু তাই নয়, প্রতিটি নামাজে কোরআনের মুখস্থ করা কোনো-না-কোনো অংশ তেলাওয়াতের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। পক্ষান্তরে, হাদীস হচ্ছে প্রধানত মোহাম্মদের (দঃ) নিজস্ব বাণী, বক্তব্য ও ব্যক্তিগত কার্যকলাপের বিবরণী। তার সেইসব বাণী ও কার্যবিবরণী থেকে উদাহরণ নিয়ে নিজেদের আচার-আচরণ গড়ে নেয়ার দায়িত্ব তিনি মানুষের ইচ্ছার উপর ন্যস্ত করে গেছেন। তিনি এও বলে গেছেন, যদি তারা ভাল মনে করে তাহলে তারা তাঁর হাদীস সাধারণ্যে প্রচারও করতে পারে। তবে কোন ধরনের হাদীস মানুষ প্রচার করবে, সে বিষয়ে তিনি কোনো নির্দেশ দিয়ে যাননি।

সত্যি কথা বলতে কি, শুধু সীমিতসংখ্যক হাদীসেই মোহাম্মদের (দঃ) চিন্তা–ভাবনা ও ধ্যান-ধারণা সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। বাদবাকি হাদীসে যা প্রতিফলিত হয় তা অবশ্যই সে যুগের প্রচলিত সাধারণ মানুষের চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন। অর্থাৎ, তা সে যুগের প্রচলিত সাধারণ মানুষের চিন্তা-ভাবনা ছাড়া অন্য কিছু নয়।

আমরা এখানে যেসব হাদীস উদ্ধৃত করছি, সেসবের ক্ষেত্রে এই কথাটা বেশি খাটে। এ ধরনের কোনো দুর্বল কিংবা জাল হাদীসের বক্তব্যের সাথে কোরআনের কোনো আয়াতের তুলনা করে দেখলেই আমরা বুঝে নিতে পারব যে, এ দুয়ের মধ্যকার পার্থক্য কত বিরাট। আর এই ধরনের যে-কোনো তুলনায় যে সত্যটা ফুটে ওঠে (সেই সত্য ফুটে ওঠার ব্যাপারে আর কোনো প্রমাণের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না) তা থেকে আমরা অনায়াসেই সে যুগের প্রচলিত রচনার ধারা এবং লেখার ভঙ্গির একটি পরিচয় পেতে পারি।

বলা অনাবশ্যক যে, সে যুগে প্রচলিত বিজ্ঞান-সংক্রান্ত যে-কোনো রচনা আধুনিক বৈজ্ঞানিক বিচারে শুধু অসত্যই নয় বাতিল বলেও পরিগণিত হতে বাধ্য। পক্ষান্তরে, সেকালেই ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত বাণীর সংকলিত রূপ হিসেবে যে কোরআন আমরা পাচ্ছি; সেই কোরআন এই ধরনের যে-কোনো ভ্রান্তি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত’।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ ধর্মীয় বিষয়ের বিচারে, বিশেষত ধর্মীয় বিধি-বিধান হিসেবে হাদীসের সত্যতা প্রশ্নাতীত। কিন্তু কোনো হাদীসে যখন নিছক পার্থিব কোন বিষয় আলেচিত হয়েছে, দেখা গেছে, সেসব বক্তব্য সে যুগের সাধারণ মানুষের প্রচলিত ধারণা থেকে বেশি আলাদা নয়।

“ধর্মীয় বিষয়ে যখন আমি কোনো নির্দেশ দেব, তখন তোমরা তা অবশ্যই মান্য করবে ও পালন করবে। পক্ষান্তরে, জাগতিক কোনো ব্যাপারে আমি যখন নিজের অভিমত অনুসারে কোনো নির্দেশ দেব, তখন (মনে রাখবে যে, আমি একজন মানুষ।”

–আল সারাকসী তাঁর প্রিন্সিপ (আল-ওসুল) গ্রন্থে এই হাদীসটি তুলে ধরেছেন এভাবে : মোহাম্মদ (দঃ) বলেছেনঃ

“আমি যখন কোনো ধর্মীয় বিষয়ে তোমাদের জন্য কোনো বক্তব্য রাখি, তোমরা তদনুসারে ধর্মের কাজ করবে, কিন্তু আমি যখন দুনিয়াদারীর ব্যাপারে তোমাদের কোনো কথা বলি, তখন মনে রাখবে যে, তোমাদের দুনিয়াদারীর ব্যাপারে তোমাদের নিকটই উত্তম জ্ঞান রয়েছে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *