০৪. সন্ধ্যা

সন্ধ্যা

শীতের সন্ধ্যা অনেক আগে নামে, তাই এত অন্ধকার। অন্ধকার আছে বলে সুজাতার বাড়ির ঘরে ঘরে আলো এত উজ্জ্বল। গত কয়েকদিন ধরে ব্যাঙ্কের পর বাড়ি এসে সুজাতা সাবান জলে ন্যাকড়া ডুবিয়ে জানালার কাচ পরিষ্কার করেছেন, তাই আলোর প্রভা এমন করে বাইরে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। কয়েকদিন আগে বষ্টি হয়েছিল। কালও সামান্য বৃষ্টি হয়েছে। তাই কয়েকটা পোকা এত শীতেও বাইরে থেকে কাচে পাখা ঠকছে, আলোর বৃত্তে ঘুরছে। এমনি হয়, এমনি হয়ে থাকে। শুধু যা যা নর্মাল নন্দিনীর কাছে তা চিরদিন আবনমাল হয়ে থাকবে। নন্দিনীর গায়ে একটা চাদর ছিল। ব্রতী শীতের সময় পুরনে, জীর্ণ শালটা গায়ে দিতে ভালবাসত।

দিব্যনাথ বহনক্ষণ ধরে দরজার কাছে আসছেন আর যাচ্ছেন নিশ্চয়। কেননা এখন তিনি মাঝের দ’বছরের নাম, বিবেচক কণ্ঠস্বর ভুলে গিয়ে ঠিক আগেকার দিব্যনাথের গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন।

এতক্ষণে বাড়ি ফিরতে পারলে? আশ্চর্য!

সুজাতা কথা বললেন না। দিব্যনাথ এবং সেই টাইপিষ্ট মেয়েটির সামনে যখন ব্রতী গিয়েছিল, সময়টা মনে মনে হিসেব করলেন। হ্যাঁ, সেই সময় থেকে ব্রতী তার স্কলারশিপের টাকা বাড়িতে দিতে শুরু করে। সুজাতা আজ বঝছেন, ব্রতী যে তখনি বাড়ি থেকে চলে যায় নি তার কারণ তিনি। ব্রতী তুই আমাকে কোন কথা বলিস নি কেন? আমার উপর তোর ভালবাসা অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল? যেন ছোট মেয়ের ওপর বাবার ভালবাসা?

সুজাতা প্যাসেজ পেরিয়ে আস্তে আস্তে ড্রয়িংরুমে ঢুকলেন। প্রতিটি ফুলদানিতে ফুল। উজ্জ্বল, উজ্জ্বল আলো। গোলাপের রং প্রগাঢ় নিখুঁত লাল। হায়! লালগোলাপের গুচ্ছে উজ্জ্বল আলোতে, যারা তাদের বিশ্বাস গচ্ছিত রেখেছিল, তারা তাদের বিশ্বাস ফিরিয়ে নিয়েছে কবে। তবু গোলাপ কি প্রগাঢ় লাল, আলো কি উজ্জ্বল, বিট্রেয়াল। নন্দিনী আর ব্রতীর সঙ্গে এরাও বেইমানী করেছে তবে। সুজাতা মাথা নাড়লেন।

বড় টেবিলটা নিচের বারান্দায় বের করা হয়েছে। স্কুলে পড়ার সময়ে কত বর্ষার দিনে টেবিল বের করে ব্রতী টেবিলটেনিস খেলেছে বন্ধুদের সঙ্গে। একবার এই বারান্দায় ব্রতীর রবীন্দ্রজয়ন্তী করেছিল। বাবলু চিরকাল চালবাজ। সেই বয়সেই বাবলু লিখেছিল, রবীন্দ্রনাথ খুব গরিব ছিলেন বলে ক্লাস এইটেই স্কুল ছেড়ে দিয়ে পদ্য লিখে পয়সা রোজগার করতেন। ব্রতী রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’ আবৃত্তি করেছিল। আলোকবর্ষ কেটে গেছে তারপর।

টেবিলের ওপর ধবধবে সাদা চাদর বিছানো। টেবিলের একটা পায়ার ব্রতীর জুতোর ঠোক্করে কাঠের চাকলা উঠে গিয়েছিল। টেবিলের ওপর কাঁটা, চামচ, ন্যাকপিন, ওয়াইন, গ্লাস, জল, কাচের গ্লাস, খাবার দেবার ডিশ, কফি দেবার পেয়ালা, সব সাজানো। এর কোন কিছুতেই ব্ৰতী নেই, কোথাও নেই। ব্রতীর বাড়ীতে, যে বাড়িতে সে বড় হল, জীবন কাটাল, সে বাড়িতে সে ব্রতীকে খুঁজে পাওয়া এত কঠিন। সুজাতা দেখলেন কালো রঙের ওপর লাল ও সোনালি চেরিফুল আঁকা পেয়ালা। ওগুলো নীপার। তবে নীপাও এসেছে।

খাওয়ার ঘরে ঢুকলেন। টেবিলে সন্দেশের বাক্স, রসগোল্লার হাঁড়ি, দই। ওয়ালডফ আর সাবিরের নাম লেখা খাবারের বাক্স। আজকের জন্যে দোকানে অর্ডার দেওয়া হয়েছিল। সাইডবোডের ওপর সস, ভিনিগার, মাসটাড, নন, গোলমরিচ, সালাড। বিনি কাটগ্লাসের বোলে লঙ্কা কুচিয়ে ভিনিগারে ভিজিয়েছে।

হেম!

হেম ছুটে এল।

এক গেলাস লেবুর শরবত।

হেম চলে গেল। দিব্যনাথ ঢুকলেন।

প্রৌঢ় ভোগী ও মাংসল চেহারা। এই প্রথম সুজাতার মনে হল অত ঘাড় চেছে চুলছাঁটা মুখে স্নো মাখা কুৎসিত। মনে হল দিব্যনাথের চিকনের পাঞ্জাবি আর পাড় দেওয়া শাল না পরলেও পারেন। পায়ের জুতো এই দিনের জন্যে কেনা, দিব্যনাথ সবচেয়ে দামী গেঞ্জীও পরেছেন সুজাতা জানেন।

কি ভেবেছ তুমি? জান, অন্তত পঞ্চাশজন লোক আসছে।

জানি।

মানে?

ব্যবস্থা করাই ছিল। নীপা এসেছে। তুমি বাড়িতেই ছিলে। ব্যবস্থা হয়েই গেছে যখন তখন আর কথা বাড়িও না।

কথা বাড়িও না! তুমি ভেবেছ কি?

তুমি—এই মুহূর্তে—এখান থেকে–বেরিয়ে না গেলে—আমি—আবার—বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাব—আর ফিরব না।

সুজাতা থেমে থেমে বললেন। ঘেন্না করছে, ভয়ানক ঘেন্না করছে। দিব্যনাথ আর টাইপিসট মেয়ে। দিব্যনাথ আর সুজাতার–দূর সম্পর্কের ননদ। দিব্যনাথ আর ওঁর এক জ্ঞাতি বউদি।

দিব্যনাথ যেন গালে চড় খেলেন। চৌত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনে সুজাতা একবারও এভাবে স্বামীর সঙ্গে কথা বলেন নি।

তুমি সারাদিন কোথায় ছিলে তা জিগ্যেস করতে পারব না?

না।

হোয়াট।

দু’বছর আগে, বত্রিশ বছর ধরে তুমি কোথায় সন্ধ্যা কাটাতে, কাকে নিয়ে গত দশ বছর ট্যুরে যেতে, কেন তুমি তোমার একস টাইপিসটের বাড়িভাড়া দিতে তা আমি কোনদিন জিগ্যেস করি নি। তুমি আমায় একটি কথাও জিগ্যেস করবে না। কোনদিন না।

গড!

যখন বয়স কম ছিল, তখন বুঝতাম না। পরে তোমার মা তোমার প্রত্যেকটি পাপ, হ্যাঁ পাপ ঢেকে চলতেন বলে কোনদিন জিগ্যেস করতে প্রবৃত্তি হয় নি। তারপর আই হ্যাড নো ইনটারেসট টু নো। তবে তুমি যেভাবে বাড়ি থেকে, তোমার পরিবারের কাছ থেকে, চুরি করে সময় কাটাতে, আমি তা করি না। আরো শুনতে চাও?

—তুমি আজ…

হ্যাঁ। হোআই নট? আজ নয় কেন? যাও।

যাব!

হ্যাঁ। যাও।

‘যাও’ কথাটা সুজাতা আদেশেয় মত করে বললেন। দিব্যনাথ বেরিয়ে গেলেন ঘাড় মুছতে মুছতে।

আজকের পর সুজাতা থাকবেন না। আর থাকবেন না। যেখানে ব্রতী নেই সেখানে থাকবেন না। ব্রতী থাকতে যদি একদিনও এমনি করে মনের কথা দিব্যনাথকে বলতে পারতেন! বলে যেরিরে যেতে পারতেন ব্রতীকে নিয়ে! তাহলেও ফেরাতে পারতেন না কিছুই হয়ত। শুধু ব্রতীর মনের কাছাকাছি আসা যেত। ব্রতী জেনে যেত সুজাতাকে সে যা জেনেছে, তাই সব নয়। জেনে গেল না।

হেম ঢুকল, শরবত দিল। সুজাতা এক ঢোকে খেলেন। বললেন গরম জল দাও হেম। স্নান করব। তুমি জল টেনে ওপরে তুল না, নাথু আছে ত?

নাথু বরফ আনতে গেছে পাশের বাড়ি।

বাড়িতে বরফ জমল না?

না, মিস্তিরি এসে বললে কি যেন খারাপ হয়ে গেছে। সারতে ষাট টাকা লাগবে। তাও এখন হবে নি।

তবে জল থাক।

এখন চান কর নি, পরে ক’রবে খন।

পারেই করব।

সারাদিনে কিছু খেইছিলে?

ও না। ইচ্ছে হয় নি।

এখন ওপরে যাবে ত?

হ্যাঁ।

কিছু খাবে?

না। নীপা কখন এসেছে?

সকালে। তিনি ত এখেনেই খেল।

মেয়েকে এনেছে?

না। তার ইকুলে কি হতেছে যেন।

ঘরদোর সাজালে কে?

কেন, বউদিদি।

কাপ, ডিশ, সব বের করল কে?

স–ব ছোড়দিদি করেছে। তুমি বেইরে যেতে সে অমায় খুব খানিক বকলে। আমি কাজ কত্তে পারি নি, বসে বসে খেতেছি, ছোটখোকার নাম ভাঙিয়ে তোমার কাছ হতে আদায় কত্তেছি সব।

বকল কেন?

চানের জল ফুটন্ত গরম হরে গিছিল। তা বাদে আরো কি বাটতে বলেছিল মনুকে মাখবে। অমি বন্ন, আমার মনে নি অত কতা।

তারপর?

তা বাদে ঘরদোর সাফ কত্তে লাগল। বউদিদি বলেছিল, কেন আমি কি নি? একটা দিন তুমি কার কে তার দে নিশ্চিত হতে জান নি। তা বাদে দুজনে খুব খানিকটা ঝগড়া বিবাদ হল। কি হল তা জানি নি, সব ইংরাজিতে ঝগড়া হচ্ছিল।

তুই শুনতে গিয়েছিলি কেন?

শোন কত! আমি কখনো ওদের কথা শুনতে যাই? দুজনে এমন চেল্লাচেল্লি করলে যে আস্তা হতে মানুষ শুনেছে।

 

তারপর?

তা বাদে ছোড়দি যেয়ে বুঝি বড়দিকে ফোন কল্লে। তিনি এসে বউদির মান ভাঙাল। তা বাদে বউদি সব সারলে। তা বাদে তিনোজনে খুব গল্প গাছা করলে, খেলে। তখন আর কিছু মুখভার দেখিনি বাব। তা বাদে তিনোজনে বেইরে যেয়ে কোথা হতে চুল বেদে এল! খুব হেসে হেসে ঢুকল।

তুলির বন্ধু চুল বাঁধতে আসে নি?

না।

আচ্ছা, তুই এবার যা।।

হেম চলে গেল। সুজাতা ঘর থেকে বেরোলেন। রেলিং ধরে ধরে ওপরে উঠতে লাগলেন, কষ্ট হচ্ছে, খুব কষ্ট। ব্রতী হবার আগের দিন শরীরে বড় কষ্ট ছিল। আর কারো জন্মের কথা তেমন করে মনে নেই, শুধু ব্রতীর কথা এমন করে মনে আছে কেন? ব্রতী তাঁর মনে একটা দুঃসহ ব্যথা হয়ে বেচে থাকবে বলে? সিঁড়ির এইখানটাই ব্রতী সেদিন…তলপেটে ব্যথা। ভেবেছিলেন তুলির বিয়ের পর অপারেশন করাবেন। এখন বুঝতে পারছেন আগেই করতে হবে। আজকের দিনটা কেটে গেলে সুজাতা বাঁচেন। কাল ভাববেন কাল কি করবেন।

আজকের তারিখে এনগেজমেন্টের দিন ফেলতে তাঁর ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তাঁর মত কেউ জিগ্যেস করে নি। টোনি কাপাডিয়ার মা’র গুরু সোয়ামীজী আমেরিকায় থাকেন। সোয়ামীজী এই তারিখটা ঠিক করেছেন। টোনি মা’র কথার ওপর কথা বলে না। মা’র টাকায় সে ব্যবসা করছে।

দিব্যনাথ খুব খুশি হয়েছেন। টোনি তাঁরই মত মাতৃভক্ত। মায়ের প্রতি কথায় টোনি ‘হ্যাঁ বলে। মাতৃভক্ত হওয়াটা এক্ষেত্রে অধিকন্তু। মাতৃভক্ত না হলেও টোনি তাঁর কাছে পাত্র হিসেবে খুবই আকাঙ্ক্ষিত হত। টোনিই দিব্যনাথকে শ-বেনসনের অডিট পাইয়ে দিয়েছে।

টোনির বিষয়ে দিব্যনাথ অত্যন্ত দুর্বল। তাছাড়া তুলি তাঁর প্রিয়তম সন্তান। তুলির চেহারা, স্বভাব দিব্যনাথের মা’র মত।

টাইপিসট মেয়েটির কথা তুলিই সবচেয়ে আগে জেনেছিল। জেনেও কথাটি চেপে যায়। ওর মনে দিব্যনাথের প্রতি কোনরকম বিরাগ বা ঘণা হয় নি। বরঞ্চ, পরে ভেবে সুজাতার গা ঘিনঘিন করেছে, মেয়েটির ঔদ্ধত্য এতদর বেড়েছিল, ও বাড়িতেই ফোন করে বলে দিত ওঁকে বলে দেবেন আজ সন্ধ্যায় আমি মাকেটে যাব। তুলি সে ফোন ধরেছে। তুলি ফোন ধরলে খবর দেওয়া চলবে, অন্য কেউ ফোন ধরলে খবর দিতে হবে না এ কথা নিশ্চয় দিব্যনাথই মেয়েটিকে বলে দেন।

তুলি ওর বাবাকে ঠিক মত খবর পৌঁছে দিত। সেই সময়টা ওর তুলির মধ্যে, বাবার বিষয়ে কি রকম একটা অধিকারবোধ এসে গিয়েছিল। তুলির তত্ত্বাবধানে সে সময়টা দিব্যনাথ ভাল জামাকাপড় পরেছেন। সন্ধ্যার আগে তাঁর রক্ষিতার সঙ্গে সময়টা কাটিয়ে আসবার পর (তুলি জানত ওঁর সোম-বধে-শুক্রবার দেখা করেন) তুলিই ছটে যেত বাবার সপে চিকেনসালাড নিয়ে ওপরে। খুব একটা তৃপ্তি ও গব অনুভব করত তুলি। যেমন ওর ঠাকুমা করতেন। ওর বাবা যে একজন পুরুষের মত পরষে, বিয়ে করতে হলে ওরকম পুরুষ মানষেই দরকার, এসব কথা তুলি সগবে বলত। বলত, দাদা একটা কাপুরুষ। বউয়ের আচল ধরে ঘোরে।

কথাটা যখন জ্যোতি শবশরকুলের কোন আত্মীয়ের কাছে জেনে আসে, বাড়িতে কথাবার্তা হয়, তখন তুলিই বলেছিল, দাদা! দোষ দেওয়া খুব সোজা। কিন্তু যারা এভাবে এসকেপ খোঁজে, তাদের জীবনে নিশ্চয় কোন আনহ্যাপিনেস থাকে। বাবার ত আছেই।

বলেছিল, ঠাকুমা ত বলতেন ঠাকুরদা কোন সন্ধ্যাই বাড়িতে কাটাতেন না। তাতে কি ঠাকুমা মানুষ হিসাবে কম ছিলেন?

ব্রতী কিছুই বলে নি। তুলি থাকলে সে টেবিলে বসে খেত না। তুলি যতক্ষণ বাড়ি থাকত, কথা বলত না। এখন মনে হয় ব্রতী সবই জেনেছিল। বোধ হয় ভেবেছিল যাঁর সবচেয়ে বেশি ক্ষদ্ধ হবার কথা সেই সুজাতাই যখন নীরব রয়েছেন, তখন সে কোন কথা বলবে না। কিন্তু সুজাতার বিষয়েও তার আনুগত্যবোধে নিশ্চয় ফাটল ধরেছিল, নইলে বাড়ি ছেড়ে যেতে চেয়েছিল কেন? সুজাতা ব্রতীকে কোনদিন বলতে পারবেন না কেন তিনি চুপ করে ছিলেন। ব্রতীর দিকে চেয়ে ব্রতী মানুষ হোক, পড়া শেষ করুক, তারপর ব্রতীকে নিয়ে চলে যাবেন ভেবে সুজাতা সব সহ্য করেছিলেন, ব্রতী তা জেনে গেল না। জানলেও কি সে পথ বদলাত? বদলাত না। বদলাত না জানেন বলেই ব্রতী তাঁর প্রিয়তম সন্তান। ব্রতী ছোটবেলায়ও মা’র মনের একটা দিক যে শূন্য তা বঝত বলেই মাকে বলত বড় হলে আমি তোমাকে একটা কাচের বাড়িতে রেখে দেব। ম্যাজিক কাচের বাড়ি মা, তুমি সবাইকে দেখতে পাবে, তোমাকে কেউ দেখতে পাবে না।

সেই জন্য ক্লাস টেনে, তোমার প্রিয় মানুষ’ রচনা লিখতে আমার মা, বলে রচনা লিখে এসেছিল। সেই ব্রতী! যে কেটে গেলে রক্ত দেখলে ভয় পেত, আবার সহ্য করত ঠোঁট টিপে। ব্রতীর মুখে আঙুল বোলাবেন, আদর করবেন। চোখ বুজে শেষবার আঙুল বলিয়ে দেখবেন অনুভবে নাকের খাঁজ, ভুরতে কাটা দাগ, মুখের রেখা, এমন অক্ষত একটি জায়গাও ব্রতীর মখে ছিল না। শুধু ত হত্যা উদ্দেশ্য নয় হত্যাকে বিলম্বিত করা, পৈশাচিক উল্লাসে মত্যুমন মানুষের ছটফটানি দেখা, সবই হত্যার প্যাটার্নের অমোঘ অঙ্গ।

হত্যা করা যায়, শাস্তি হবে না, কেননা ঘাতকরা অত্যন্ত চতুর, এর চেয়ে ভয়ঙ্কর পরিণতি আর কোন সমাজে হতে পারে? যারা তরুণদের হত্যার মন্ত্র দিয়েছিল তাদের কেন কেউ চিনিয়ে দেয় না? তাদের গায়ে কেন কাঁটার আঁচড় লাগল না? এমন দুর্বোধ্য কেন সবকিছ? আজ কি তারা সক্রিয়, অসম্ভব সক্রিয়? নন্দিনী বলেছে কিছুই কোয়ায়েট নয়। সুজাতা ত শুনেছেন, ওরা সহস্র প্রলোভন দেখায়, নখের নিচে ছচ, চোখে হাজার বাতির আলো, জঘন্যভাবে দেহের গোপন জায়গায় নির্যাতন, কত-শত অত্যাচার করে তাতেও ব্রতীর মত ছেলেরা নতি স্বীকার করে না, আজও করে না। তখন জে. সি. থেকে পি. সি.। জেল থেকে ফের পলিশের হেফাজত। তারপর ফাইল বন্ধ। দাঁড়ি। অজয় দত্তের মা বলেছিলেন, এবার হাবল দত্তের ফাইলটাও বন্ধ করে দিতে পারেন। হাবল ওরই অ্যাালায়াস। সঞ্জীবনের দিদিকে ওরা বলেছেন, মাকে ছবি দেখাবেন? একমাস বাদে আসন। বাহাত্তরটা ছবি উঠবে রিলে। আপনার ভাই ত সবে তিরিশ নম্বর। মাস খানেক রিলটা ফুরোক, তখন ছাপা হবে।

রেলিং ধরে ধরে উঠলেন সুজাতা। এই রেলিং চড়ে ছোটবেলা পিছনে নামত ব্রতী। হেম দুধের গেলাস হাতে সিঁড়ি ভেঙে উঠত, ব্রতী পিছনে নামত। হেম ওপরে উঠত, ব্রতী আবার ছুটে উঠত, আবার নামত। বড় হয়ে ওই রেলিঙে হাত রেখে কতবার নেমেছে ব্রতী, কিন্তু এ বাড়ির কোথাও ব্রতী নেই, ব্রতী আজও আছে, অন্যান্য জায়গায়, ফুটপাতের লাল গোলাপ-ফেস্টুনে, পথের আলোয়, মানুষের হাসিতে, সমুর মা’র মুখে, নন্দিনীর চোখের নিচের চিরস্থায়ী ছায়ায়—সুজাতা ব্রতীকে কোথায় খুঁজে ফিরবেন? তাঁর শরীর যে আর বয় না। ব্রতী কোথায় কোথায় ছড়িয়ে আছে বলে সুজাতা কি তাকে খুঁজে–তাকে খুঁজে খুঁজে–

তুলির ঘরে ঢুকলেন।

তুলি আর নীপা একরকম গাঢ় নীল বেনারসী পরেছে, একরকম ষ্টোল। আজকের বিশেষ দিনে দুই মেয়ে ও বিনিকে এই শাড়ি ও স্টোল দিব্যনাথের বিশেষ উপহার। তিনটে শাড়ি, তিনটে স্টোল নশো টাকার ওপর। নশো টাকায় সমুরে মা’র মত মানুষের বহ; অভাব দূর হয়ে যায়।

তুলি আর নীপা তাঁর দিকে তাকাল। আয়নায় তিনজনের ছায়া। সুজাতা দেখলেন তাঁর শাড়িতে ভাঁজ, চেহারা অবসন্ন, কাঁচা পাকা চুল বিস্রস্ত।

তুলি ও নীপা সুসজ্জিত, সুন্দর। দুজনের মুখের ভাবই তৃপ্ত হতে পারত, কিন্তু ওদের মুখের অতৃপ্তি ও অসন্তোষ প্রসাধনে ঢাকা পড়ে নি।

তুলি, তোর গয়না।

সুজাতা ব্যাগ খুলে গয়না বিছানায় ঢাললেন। কয়েকটা তলে আবার ব্যাগে রাখলেন।

ওগুলো সরিয়ে নিচ্ছ কেন?

নীপা আর বিনিকে যা যা দিয়েছি, তোকেও তাই দিলাম।

দেখলে দিদি? আমি বলি নি?

নীপা একই সঙ্গে মিহি আদুরে-উদার-ক্ষমাভরা গলায় বলল, ওগুলোও তুমি তুলিকে দাও মী। আমি কোন ক্লেমই করব না সত্যি।

তোর ক্লেমের কথা আসছে কোথা থেকে?

বিনিকেও ত দিয়েছ।

ব্রতী থাকলে ব্রতীর বউকে দিতাম। একটা সুমনকে, একটা তোর মেয়েকে দেব।

অন্যগুলো?

যা হয় করব।

তলি ক্রুদ্ধ হিসহিস, চাপা আক্রোশের গলায় বলল, আশ্চর্য! তুমি জান আমি অ্যাণ্টিক জুয়েল্‌রি কি রকম ভালবাসি! টোনি এগুলো মডেল করে কুস্ট্যুম জুয়েল্‌রি বানাবে, বাইরে পাঠাবে, সবই তুমি জানতে।

তই বলেছিলি, আমি শুনেছিলাম। এখন আমি মত বদলেছি।

কিন্তু, কেন?

এমনি। তোর ঠাকুমার দেওয়া বাবার দেওয়া সব গয়নাই দিয়ে দিলাম। এগুলো আমার বাবার দেওয়া, আমার কাছে থাক।

চমৎকার বিবেচনা।

এগুলো অন্যদের দেব ঠিক করেছি।

এগুলো না দিলেও পার।

না নিতে ইচ্ছে হয় ফেলে দে। আজ তোর সঙ্গে বেশি কথা বলব না তুলি, চেঁচাস না, সকালে যথেষ্ট চেঁচিয়েছিস।

কে বলেছে, হেম?

হ্যাঁ। তুমি এবাড়িতে যে কদিন আছ, হেমকে একটি কথাও বলবে না। হেমকে আমি আমার খরচে রেখেছি, তোমার বাবা রাখেন নি। হেম ব্রতীকে মানুষ করেছিল। ও যে কদিন থাকবে, তোমার ইচ্ছে হলে ভাল ব্যবহার করবে, কিন্তু খারাপ ব্যবহার করতে পারবে না। আজকের দিনে, ব্রতীর জন্মদিনে ও সকাল থেকে কাঁদছে জেনেও তুমি যে ব্যবহার করেছ তার ক্ষমা নেই।

আজকের দিনে! আজকের দিন সম্পকে ত তোমার ভারি সেন্টিমেন্ট তাই সারাদিন বাইরে কাটিয়ে এলে।

তারিখটা তোমরা আমার মতে ঠিক করনি, টোনির মা’র কথায়, করেছ। আমি যে ফিরেছি সেটাই যথেষ্ট মনে কর।

নীপা বলল, আমার কথাও ত ভাবতে পারতে মা? আমি ত রোজ রোজ ডে স্পেনড, করতে আসি না।

সুজাতা হাসলেন। বললেন, তুই সারা বছরে ক’দিন আমার কথা ভাবিস? এই রাস্তা ধরে গাড়ি চালিয়ে সবত্র যাস। অমিত টুরেই থাকে, তুই ঘরেই বেড়স। জ্যোতির টাইফয়েড হল, সুমনের জন্মদিন গেল, তুই একবারও আসতে পারিস নি।তোকেও দোষ দিই না আমি, এই রকমই হয়। তবে তুই আসবি বলে আমি বসে থাকব আশা করতে পারিস কি?

তুমি—

আর কথা নয় তুলি। আমি তৈরি হতে যাচ্ছি।

নিজের ঘরে গেলেন সুজাতা। আলমারি খুললেন। শরীরের প্রত্যেকটি শিরা ও প্লয় বলছে না-না-না। কিন্তু আজকের সন্ধ্যার কতব্যটুকু করতেই হবে। সলিটারি সেল। সুজাতা প্রত্যেককে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে যা করে করুক, তিনি অবিচল থাকবেন স্ব-কর্তব্যে। নিজেকে নিজেই কারাদণ্ড দিয়েছেন। এখন কি কারাগার ভেঙে বেরনো যায়? সাদার ওপর সাদা বুটিতোলা কাল-পাড় ঢাকাই শাড়ি, সাদা জামা বের করলেন।

আলমারি বন্ধ করলেন। বাথরুমে ঢুকলেন।

দরজা বন্ধ করে শাওয়ার খুলে মেঝেতে বসে পড়লেন সুজাতা। যত শীত হক, ব্যথার জন্যে শীত করছে না। ঠাণ্ডা জলে শরীর জড়িয়ে যাচ্ছে। বরফের মত ঠাণ্ডা জল। বরফ। আইস স্ল্যাব। বরফের স্ল্যাবে সদ্যোমৃত রক্তাক্ত শরীর ফেলে রাখলে রক্ত বন্ধ হয়। ঠাণ্ডা জল। শীতল। ব্রতীর আঙুলের মত, ব্রতীর কপালের, বকের, হাতের মত ঠাণ্ডা কোন শীতলতা হতে পারে না। আজ সারাদিন ব্রতীর সঙ্গে ছিলেন। ব্রতীর আঙুল কি ঠাণ্ড, হিম শীতল চোখের পাতা, নিমীলিত, ঘন কালো পল্লব চোখের, তামাটে হয়ে যাওয়া ফর্সা রং, চুল ঠাণ্ডা বরফজলে ভেজা, ঠাণ্ডা শীতল, শীতল, হিম, হিম, আজ সারাদিন ব্রতীর সঙ্গে ছিলেন। শ্মশানে রাত্তির। পুলিশ পাহারায় ব্রতী। শ্মাশানে ফ্লাটলাইট। দেওয়ালে লেখা। নামের পর নাম। নাম-নাম-নাম-নাম অ্যালুমিনিয়ামের দরজা ধড়াস করে নামল—ব্রতী। বিদ্যুৎবহ্নিতে ভেতরে ব্রতীকে সেঁকা হচ্ছে। সারাদিন ব্রতীর সঙ্গে ছিলেন। ছাই নেন, অস্থি নেন, মাটি দিয়া ধরেন, গঙ্গায় ফালাইতে হইবে। ব্রতীর সঙ্গে ছিলেন সারাদিন।

শাওয়ার বন্ধ করলেন। পরের পর সব করে যেতে লাগলেন। স্নায়ু-শিরা-হৃৎপিণ্ড-রক্ত বলছে না-না-না। সুজাতা গা মুছলেন, মাথা মুছলেন। কাপড় ছাড়লেন। গায়ে পাউডার মাখলেন। কাপড় জামা, সব পরলেন। ভিজে চুলই বাঁধতে লাগলেন হাত ফিরিয়ে।

ব্রতী বলত, সবসময়ে কেমন করে কর্তব্য কর মা?

সবসময়ে কতব্য করতে হবে এইভাবেই সুজাতাকে তৈরি করা হয়েছিল।

এইভাবেই সুজাতা তৈরি হয়েছিলেন। এইভাবে তিনি নিজেকেও তৈরি করে চলতেন। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সব, সব, বাজে খরচা, নিজের অপচয়। কাকে তিনি সাহায্য করতে পেরেছেন? দিব্যনাথ, নীপা, তুলি কাউকে নয়।

দরজা খুললেন। ঘরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। চোখের নিচে কালি। থাকুক। নন্দিনীর চোখের নিচে, অধপ্রায় চোখের নিচে কি প্রগাঢ় কালিমা, পাহাড়ের নিচের চিরছায়ার মত ছায়া ঢালা।

নন্দিনীর কাছে আর যাবেন না সুজাতা, আর যাবেন না সমুর মা’র কাছে। ব্রতীকে তিনি কোথায় খুঁজে বেড়াবেন? না কি একদিন তিনিও আর খুঁজবেন না?

সব মিটে যাবার পর দিব্যনাথ ছেলেমেয়ের কাছে হোহো করে কেঁদেছিলেন। বলেছিলেন, তোমাদের মার চোখে জল নেই। অনন্যাচারাল ওম্যান।

তাঁর চোখে জল নেই।

. একদিন কি আসবে, যেদিন সুজাতা যে কোন জায়গায়, যে কোন লোকের কাছে বসে কাঁদবেন, বলবেন ব্রতীর নাম?

ভাবতেই ভয় করল। শিউরে উঠল বুক। ব্রতী কি সেদিনই মরবে? এখনো কি তাঁর দুঃসহ শোকের বন্দীত্বে ব্রতী বেঁচে নেই? এখনো যে সব কোয়ায়েট নয়, জেলের পাঁচিল উঁচু, নতুন নতুন ওয়াচ টাওয়ার। বন্দীদের জন্য বড় ফাটক অব্দি খোলা হয় না। মাঝরাতে ভ্যান আসে। রেডিও সিগনাল দেয়। ওপর থেকে ক্রেন নামে। জন্তুর মত বন্দীকে যন্ত্রের নখে আঁকড়ে ক্রেন উঠে যায়, জেলের ভেতর নামিয়ে দেয়। অষ্টমী পুজোয় উন্মত্ত কলকাতা। গুলি-কালগাড়িগুলি পালাবার চেষ্টা—গুলি হাবল দত্তের ফাইল বন্ধ করে দিতে পারেন—গুলি-ফাইল বন্ধ—একটি পাহারাঘেরাও শবযাত্রা—পেছনে ক্রুদ্ধ-ভীষণ সংকল্পে কঠিন মখে শবযাত্রীরা হাঁটছে-তরুণ, তরুণ মুখ। ব্রতীর কথা তেমন করে সুজাতা বলে বলে সহজ হবেন, শোককে করে নেবেন আটপৌরে?

সাদা শাল নিলেন। চটি পরলেন। জল খেলেন। দরজায় টোকা। বিনি মুখ বাড়াল।

ঠিক তুলি ও নীপার মত চুলবাঁধা, একরকম শাড়ি, একরকম স্টোল। এখন এরা সকলের মত হতে চায়। শুধু নিজের মত হতে চায় না। এর নামই ফ্যাশন!

মা, হয়েছে?

হ্যাঁ। সুমন কি করছে?

আয়ার কাছে। এখন ঘুমোবে।

চল, নিচে চল।।

সুজাতা আলো নেভালেন। বেরিয়ে এলেন। ভেতর থেকে স্নায়ু-শিরা-হৃৎপিণ্ড বলছে না-না-না, কিন্তু জাত সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলেন। যা ভাল লাগে না, তাও করে চলার নাম কতব্য করা। নিজে খুব কর্তব্য করেন বলে মনের কোথাও কি খুব অহংকার ছিল? ব্রতী বলেছিল, নীপার মেয়ের জন্মদিনে যাওয়ার ব্যাপারে সজাতে বলেছিল, চোখের ডাক্তারের কাছে যাওয়া বেশি দরকার।

নীপা দঃখিত হবে।

দুঃখিত হবে না মা।

সুজাতা কিছুই বলেন নি।

দিদি দুঃখিত হবে এটা কনভেনশনের কথা। দিদির দুঃখ অথবা সখ যে তোমার বা আমাদের কোন ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে না তা ত তুমি জানই মা। তবে কেন চোখ দেখাতে যাবে না?

ব্রতী জানত, সব জানত। জানত বলে সকলকে ও অত সহজে বরবাদ করে দিতে পেরেছিল। শেষ অব্দি ও বেরিয়ে গিয়েছিল। ফিরেও এসেছিল। সুজাতাকে বলেছিল, চল চোখের ডাক্তারের কাছে।

তুই যাবি?

হ্যাঁ, চল না।

চোখে আট্রোপিন দিয়ে সুজাতা একা একা যাবেন, কষ্ট হবে, সেইজন্যেই ব্রতী ওঁকে নিয়ে গিয়েছিল ডাক্তারের কাছে। তারপর সুজাতাকে নীপার বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়েছিল।

ভেতরে যাবি না?

ব্রতী হেসেছিল। কথা বলে নি। সেদিন ও ধতি অার শাট পরেছিল। প্যান্ট পরেই চলাফেরা করত, কিন্তু ধুতি পরতে ব্রতী খুব ভালবাসত। শুধু সুজাতার চোখের ব্যাপারে নয়, যখন ব্রতী একেবারে অন্যরকম হয়ে গেল তখন কোন কোন কথা ওর একারই মনে থাকত। ব্রতী মারা যাবার পর, সেই যে সকালে সুজাতা কাঁটাপুকুরে যান, ফিরতে তাঁর অনেক দেরি হয়েছিল।

তিনি ভেবেছিলেন স্বভাবতই ব্রতীর দেহ তাঁর হাতে দেবে পুলিস। কিন্তু তা দেবে না, কোন সময়েই দেবে না শুনে তিনি একবার অবাকও হন নি। অবাক হবার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। ফিরে এসেছিলেন। তারপর খবর পেয়ে আবার চলে গিয়েছিলেন। দিব্যনাথের ঘোরাঘুরি, কাকুতিমিনতির ফলে পোষ্টমর্টেম সকলেরই আগে তাড়াতাড়ি হয়েছিল। লাশ-ঘরে ডাক্তার তখন ফর্মালিনে মুছে নগ্ন শরীর বিদ্যুৎগতিতে চেরাই-ফাঁড়াই করে দিত। না দিলে চলত। তখন কত যে ভ্যান কাঁটাপকুরের দিকে আসত দিনেরাতে!

বিকেল থেকে মশানে গিয়ে বসে থাকলেন সুজাতা, বাড়ি ফিরলেন রাত-দপরে। যখন ফিরলেন, তখন নিস্তব্ধ, বিমুঢ় কিভাবে ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা যাবে সেই সমস্যায় চিন্তাকুল বাড়িতে হঠাৎ সমুর মা’র মত স্বাভাবিক শোকে হেম কেঁদে ফেটে পড়েছিল মাথা ঠকে, সাত দিনেরটি আমার হাতে তুলে দিয়েছিলে, তোমার বাঁচার কথা ছিল না গো মা, আজ তারে কোতা একে এলে? বলেছিল, কে আমার শত কাজে বিস্মরণ না হয়ে বাতের ওষুধটুকু এনে দেবে, কে বলবে আস্তায় দেকে এশন নে হেটে যেতে আচে? রেকশো করে যেতে জান নি? কে রেকশো ডেকে তুলে দেবে গো!

কে সুজাতাকে সেই রাতে সবকিছু শেষ হয়ে যাবার পর বাড়ি ফিরতে কোলে মাথা নিয়ে বসেছিল। হেম, শুধু হেম। ব্রতী হেমকে সবসময়ে কত যে দেখত। অথচ দিব্যনাথ বলতেন অনিফীলিং সান।

সুজাতার বলতে ইচ্ছে হল, আজ আমি সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারছি না ব্ৰতী। ব্রতীকে বলতে ইচ্ছে হল, তুই যে বলতিস সবচেয়ে কঠিন নিজের মত হওয়া। আমি আজ নিজের মত করে যদি চলতে পারতাম ব্রতী।

কিন্তু সবসময়ে যদি নিজের ইচ্ছেমত চলতে পারতেন তাহলে ত ব্রতী আসতই না পৃথিবীতে। ফর্সা, নরম, রেশম চুল, জন্মচুল ও পইতেতেও ফেলেনি। মূল্য ধরে দেওয়া হয়েছিল শুধু। সুজাতার হাত চেপে না ধরে কোনদিন রাস্তা পেরোয়নি ছোটবেলা, সেই ব্রতী।

সুজাতা মাথা নাড়লেন। সামনে ড্রয়িংরুম। লোকজনের কথা-হাসি-হররা। পৃথিবীটা কি শুধু মৃতদেহের জন্য তৈরি? যে মৃতরা খায়, ঝগড়া করে, লোভে ও লালসায় উন্মত্ত হয়?

যারা শ্রদ্ধেয় হয় না, যাকে ব্রতী ভালবাসতে পারে।

ব্রতী শ্রদ্ধা করতে চায়, ভালবাসা পেতে চায়।

এখনো চায় কেননা এখনো কিছুই কোয়ায়েট নয়। অশান্ত, অস্থির, ক্ষুব্ধ, যন্ত্রণার্ত, বিদ্রোহী, অসহিষ্ণু সময়।

সুজাতা পদ সরিয়ে ঘরে ঢুকলেন।

 

মিসেস কাপাডিয়া ওঁর গুরুর কথা বলছিলেন। একটু দূরে নীপা হাতে স্কচ নিয়ে এর পেছনে তার পেছনে মুখে লকোচ্ছে। খিলখিল করে হাসছে। ওর পিসতুতো দেওর বলাই দত্ত কাঁটায় একটা মাংসের টুকরা নিয়ে ওকে তাড়া করছে। নীপার মুখে ও মাংসটা গুঁজে দেবেই দেবে।

টোনির বোন নার্গিস গেরুয়া নাইলন উলের অত্যন্ত অট জামা ও প্যান্ট পরে একটু একটু করে নাচছে আর ঘাড় ঘুরিয়ে কার সঙ্গে কথা বলছে। নার্গিস গুরুর ভক্তসেবিকা। ও ভারতবর্ষে সোয়ামীর ধর্ম প্রচার করবে। নার্গিসের এক হাতে লেমন কার্ডিয়াল। অত্যধিক মদ্যপানের জন্য ত নার্সিংহোমেই থাকে ডিপসেম্যানিয়ার রুগী হিসেবে। শুধু বিশেষ বিশেষ দিনে বেরিয়ে আসে। তবে গেরুয়া পরতে ভোলে না।

বিনিকে দেখা যাচ্ছে না। তুলি, নীপার বর অমিত, টোনি, টোনির বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে চেঁচিয়ে হেসে উঠল। তারপর গাল পেতে দাঁড়াল। টোনি ওর গালে চুমো খেল। কে ছবি তুলল ওদের!

মিসেস কাপাডিয়ার হাতে টল স্কচ্‌। সুজাতা ও অন্যরা ওঁর কথা শুনছেন। সুজাতার মুখে স্মিত হাসি। মাথা কাজ করছে না। শরীর অবসন্ন।

যেকোন সোয়মীকে দেখলাম মাইডিয়ার, তুমি বিশোয়াস করবে না, সামথিং ইন মি, কট্‌ ফায়ার জালে উঠল। তকুনি আমি দেখতে পেলাম সোয়ামীর মাতার পেচনে হেলো। ঠিক যেন আলো জোলচে। আলোটা গ্রু বাইটা অ্যানড ব্রাইটা, যেন এ থাউজেন্‌ড সানস।

ফেল্‌টমোড়া ঘরে কুশকে ওরা স্ট্রাপ করে ফেলে রেখেছিল। মুখের ওপর মাথার দিক থেকে দুটো হাজার ওয়াটের বাতি জ্বলছিল। আর জ্বলছিল। কুশের দশটা আঙুল থেকে নখ তুলে নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। শরীরের প্রত্যেকটা স্নায়ুকেন্দ্রে সূঁচ বেঁধানো হচ্ছিল আর তুলে নেওয়া হচ্ছিল। আটচল্লিশ ঘণ্টা, তারপর বাহাত্তর ঘণ্টা, তারপর বলা হয়েছিল য়ু আর ফ্রি। বের করে বাড়িতে আনা হয়েছিল। তারপর বাড়ির সামনে নামিয়ে কুশকে গুলি করা হয়। ওর চোখের মণি গলে গিয়েছিল।

কিন্তু মিসেস কাপাডিয়া হাজার সযের জ্যোতি দেখেও দৃষ্টি হারান নি। অন্তর্দৃষ্টি তাঁর খুলে গিয়েছিল।

দি সোয়মী ওঅজ ফ্লাইং হিজ ওন প্লেইন। হি জাষ্ট লকড অ্যাট মী, আর বললেন, এস আমার কাছে এস। মীট মী অ্যাট মায়ামি। আচ্ছা আমি যে মায়ামি যাব, তা কেমন করে জানলে বল ভিয়ার। বললেন ইউ আর দি গাল ইন দি বক ইউ আর ক্যারিয়িং। কি বই তা জান ডিয়ার ব্ল্যাক গার্ল ইন সাচ অফ গড। আমি ব্ল্যাক ছিলাম ডিয়ার। আমার সোল ব্ল্যাক ছিল। আই ফাউন্‌ড মাই গড। অ্যানিড অল ওঅজ লাইট। ইন বোথ সেন্‌স। আলো আর হাল্‌কা।

নন্দিনীর ভেতর কি যেন একটা মরে গেছে। মরে গেলে মানুষ ভারী হয়ে যায়। ব্রতীর হাতটা কি ভারী ছিল। অনুভূতি মরে গেলেও বোধহয় শবদেহের মত গারভার হয়ে যায়। সেই মত অনভূতির ভার টানছে বলেই কি নন্দিনী পা টেনে টেনে চলে? আর স্বাভাবিক হবে না ও, স্ত্রী হবে না, জননী হবে না। যারা পথের আলো থেকে, মানুষ থেকে প্রতিটি ধলোকে ভালবেসেছিল, তারা কোনদিন জননী হবে না। যারা সন্তানের সঙ্গ সহ্য করতে পারে না, পুরুষ থেকে পুরুষ, মদ থেকে হাশিশ, পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়, তারা স্নেহহীন, ভালবাসাহীন জীবনে শিশুদের আনবে, শুধু অপচয়।

সেই থেকে সোয়ামী আমার গুরু। নট ওনলি মাইন। সারা দুনিয়ার মানুষ একদিন সোয়মীর ডিসাইপল হবে। লাইক বিবেকানন্দ, আমেরিকা হ্যাজ ডিসকভারড হিম। নাউ ইনডিয়া উইল নো হিম।

যিশু মিত্র হাঁ করে মিসেস কাপাডিয়ার কথা শুনেছিলেন। তিনি সুজাতাকে বললেন, আলাপ করিয়ে দিন আমায় জাসট ডু। আই আম ডাইং টু নো হার। প্লীজ ডু।

মিসেস কাপাডিয়া, যিশু মিত্র! আমাদের বন্ধু।

সো প্লীজড!

মলি মিত্র ফিসফিসিয়ে সুজাতাকে বললেন, ভেবেছে তুমি ইংরেজী জান না, তাই বাংলা বলছে। হাউ ফানি! কি পরে এসেছে দেখেছ? ইনসাফরেবল বিচ। হীরে দেখাচ্ছে! আমাকে!

মিসেস কাপাডিয়া ‘হীরে’ কথাটা শুনলেন। হাসিমাখা উজ্জ্বল চোখে মলির দিকে তাকালেন। বললেন, ডায়মন্ডস পরতেই হবে। সোয়মী বলেন হীরে হচ্ছে সোলের সিমবল। পিওরিটি।

হাউ নাইস!

কিন্তু তোমায় আমি মাপ করিনি ডিয়ার।

হোয়াই?

ডগ শোতে তুমি আমার গোলডেন রিটিভারকে প্রাইজ নিতে দাও নি।

আমি নয় রোভার।

ইয়েস। আমি এত রেগে গেলাম। কিন্তু হোয়েন আই স ইওর ডগ।

সুজাতার দিকে ফিরে বললেন, তুমি বিশোয়াস করবে না ডিয়ার, সামথিং ইন মি ওয়েনট ম্যাড উইথ এনভি।

যিশু মিত্র বললেন, সোয়ামীর কথা বলুন।

তিনি গড। তিনি অলমাইটি। হি ওয়ান-টস ইনডিয়া টু হ্যাভ দিস পভারটি। তাই লোকের এত সাফারিং। হোয়েন হি উইলস, সবাই রিচ হবে।

সত্যি?

নিশ্চয়! যখন টোনি আর তুলির বিয়ের কথা জানালাম, হি ওয়েট ইনন্‌টু ধেয়ান। ধেয়ান করে বললেন মেয়েটি ভেরি ভেরি আনহ্যাপি। ওদের বাড়িতে একটা ইভিল ছায়া পড়েছে।

বললেন?

নিশ্চয়! বললেন, টোনি অর তুলি যখন স্টেট্‌সে যাবে, তখন উনি কয়েকটা ফুল দেবেন। সেগুলো বাড়ির চারিদিকে পুঁতে দিতে হবে।

মলি মিত্র হঠাৎ সুজাতাকে বললেন, তুমি কি করে কনভার্ট হবে সুজাতা? তোমার গুরু আছেন না?

কনভার্ট?

কেন, মিঃ চ্যাটার্জি যে বললেন হোল ফ্যামিলি সোয়ামীর বিলিভে কনভার্ট হবে।

জানি না ত।

গুরু থাকতে কি গুরু বদলানো যায়?

আমার কোন গুরু নেই মলি।

আহা, রণু আর ব্রতী একবার গেছলো না? যখন ওরা স্কুলে ছিল? পরীক্ষার ফল জানতে?

উনি শাশুড়ির পরত ছিলেন। শাশুড়ী ওঁকে দিয়ে ঠিকুজি করতেন।

লক্ষ্মীশ্বর মিশ্র। ব্রতীর ঠিকুজিও করেছিলেন। ব্রতীর ঠিকুজি কি বার বার দেখেন নি সুজাতা? দীর্ঘায়ু-অবধ্য-ব্যাধিভয়হীন আঘাত শঙ্কাহীন? সুজাতা ঠিকুজিটা ছিঁড়ে ফেলে দেন।

মলি মিত্র মিসেস কাপাডিয়াকে বলেন, য়ু নো, হর ইয়ংগার সান ব্রতী…

সুজাতা বললেন, মিসেস কাপাডিয়া, আমি একটু ওদিকে যাই।

তিনটি টল হুইসকির পর মিসেস কাপাডিয়ার মন অত্যন্ত টলটলে। চোখে রুমাল দিলেন উনি।

আই নো? ও ডিয়ার! হাউ ইউ মাসট বি সাফারিং! সোয়ামী কি বলেছেন শোন ডিয়ার।

নিশ্চয়।

সুজাতা উঠে গেলেন।

যিশু মিত্র বললেন, আজই ত তার ডেথ অ্যানিভার্সারি।

সত্যি?

মলি মিত্র বললেন, দ্যাট বয় ব্রতী। আই নেভার ট্রাস্টেড হিম। সেদিন যখন বাড়ি থেকে বেরোয় কি বলেছিল জানেন? বলেছিল রণুর কাছে থাকবে রাতে। অথচ ফাসট ইয়ারের পর থেকে রণুর সঙ্গে ওর কনটাকটই ছিল না। রণুর কাছে থাকব। অ্যাজ ইফ হি কুড় বি রণুজ ফ্রেন্ড। পরদিন ত কাগজে কিছু বেরোয় নি, মানে ব্রতীর নাম—যিশু ওয়েনট টু ক্লাব। হোঅট ব্লেসিং আওয়ার এরিয়া ওঅজ ফ্রি! ক্লাবে যাওয়া যেত, নইলে কি বাঁচা যেত? আমি ত কাগজ খুলতাম না। বাড়িতে কাউকে কাগজ পড়তে দিতাম না। কি হরিফাইং সব খবর। তা যিশু ক্লাব থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এসে বলল, জান, চ্যাটার্জির ছেলে মারা গেছে।

ওঃ। হাউ অ্যাননাভিং ফর ইউ!

তারপর আমার দাদা, হ্যাঁ ডি. সি.–ফোন করলেন ব্রতী এখানে এসেছিল কিনা? শুনেই যিশু রণুকে প্যাক অফ করল বম্বে।

ইউ ডিড রাইট।

ন্যাচারেলি আমরা এলাম কনডোলেন্স জানাতে। তখন চ্যাটার্জি হ্যাড এ ব্যাড টাইম। হাশ আপ করার জন্যে বেচারার কি ছুটোছটি, তখন আমাদের যা কষ্ট হত। জানেন, নিশ্চয় সুঙ্গাতা ইজ এ থরোলি আনফীলিং ওয়াইফ। শী স্পয়েল্‌ট হার সন। নইলে এ রকম ফ্যামিলির ছেলে কখনো…?

যিশু মিত্র বললেন, ওর কি দিন যে গিয়েছে তখন। আপনি তখন কোথায় ছিলেন?

স্টেট্‌সে।

টোনি?

এখানেই। আজ মলি সেইড, পার্কস্ট্রীট ক্যামাক স্ট্রীট, ফিউ এরিয়াজ ওয়্যার ফ্রি। টোনির বন্ধু সরোজ পালই ত তখন অপারেশন ইন-চাজ। ব্রিলিয়ান্ট বয়। কি কারেজ! যে ভাবে ধরত এদের।

সত্যি!

মলি মিত্র বললেন, কি ফুলিশনেস! সমাজের জয়েলগুলোকে তোরা মারলি। লাভ হল কি? তোরাও মরলি। মাঝখান থেকে অনেস্ট ট্রেডারগুলো ভয় খেয়ে এখান থেকে ক্যাপিটাল তুলে নিয়ে ভেগে গেল।

টেলিং মি টু স্টেটস থেকে আই ফ্লু টু ববে। বম্বে থেকে কেউ আমাকে কলকাতা আসতে দেবে না। কলকাতায় না কি বড়লোক দেখলেই মেরে ফেলছে তখন। আমি কি করলাম জানেন?

কি করলেন?

মিসেস কাপাডিয়ার মুখে গৌরবে জ্বলজ্বল করে উঠল। তিনি বললেন, সুতির শাড়ি পরে সেকেন্ড ক্লাসে চড়ে কলকাতা চলে এলাম। বললাম, মাই হাজব্যান্ড অ্যানড মাই সান নীড, মি। সোয়ামীর ব্লেসিং আছে, নো সোস ইনদি ওঅলড ক্যান কিল মি!

যিশু মিত্র এই কাহিনীর উপসংহারে বললেন, সুজাতাকে লাভলি দেখাচ্ছে কিন্তু। সাদা। গ্রিফ। অপূর্ব্ব।

মলি মিত্র বললেন, দ্যাটস এ স্টান্‌ট। সুজাতা জানেন ইভনিঙে সবাই রং পরবে। অ্যাজ এ কনট্রাস্‌ট, সাদা পরেছেন।

মিসেস কাপাডিয়া বললেন, কি মেকাপ ইউজ করেছে বলত, ডিয়ার? সামথিং আনইউজোল।

মেকাপ? সুজাতা? ডিয়ার কাপাডিয়া, শী নেভার ডাজ।

বাট, হোআই? শী ইজ বিউটিফুল।

টোনি বলল, লেট মি ইনট্রোডুস মাই বিউটিফুল মাদার-ইন-ল। মা, এ জার্নালিস্ট। আপনাকে দেখার জন্যে মরে যাচ্ছে।

টোনি বাংলাতেই বলল। কলকাতার ছেলে। বাংলা ভালই জানে।

জার্নালিস্ট বলল, চমৎকার পাটি। বিউটিফুল শাড়ি আপনার মেয়ের। মিঃ চ্যাটার্জি সংস্কৃত বললেন, কি চমৎকার! টিপিকাল, বাঙালী বাড়ি আপনাদের।

খেয়েছেন?

প্রচুর।

আচ্ছা, আমি আপনার ইন্টারভিউ নিতে পারি?

আমার?

আমি বশ্বের একটা ওম্যান্‌’স ম্যাগাজিনে লিখি। আপনি মা, স্ত্রী, আবার ব্যাঙ্কের অফিসার। হোম অ্যান্‌ড কেরিয়ার যে একসঙ্গে করা যায়…

আমি অফিসার নই।

বাট টোনি সেইড…

ক্লার্ক হয়ে ঢুকেছিলাম। কুড়ি বছরে সেকশন-ইনচার্জ হয়েছি।

হাউ নাইস!

কাজেই…

আচ্ছা আপনার ছেলে ত কিল্‌ড ফ্রম দি অ্যাংগল অফ এ সরোয়িং মাদার…

না। মাপ করবেন।

সুজাতা তখনি সরে গেলেন। মেয়েদের ম্যাগাজিনে সুজাতার ছবি। এ বিরীভ্‌ড মাদার স্পীক্‌স। এরা কিছুতেই ব্রতীকে তাঁর কাছে থাকতে দেবে না। অথচ আজ সারাদিন ব্রতীর সঙ্গে ছিলেন। সী…মাই সান ওঅজ…বম্বে সমাজের টপ মহিলারা, রেসের ঘোড়ার মালিক, শিল্পপতির বউ, চিত্রতারকা, সবাই সুজাতা ও ব্রতীর কথা পড়ছে।

সুজাতা অমিতের কাছে গেলেন।

অমিত, খেয়েছ?

হ্যাঁ, মা।

তোমার বন্ধুরা খেলেন কিন…

সবাই খেয়েছে।

হুইসকি আছে, তব তাঁর জামাই মাতাল হয় নি দেখে সুজাতা অবাক হলেন। অমিতকে বেছে এনেছিলেন দিব্যনাথ। নীপা, নীপার সেতারের মাস্টারের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল। ওকে ধরে এনে এক মাসের মধ্যে বিয়ে দিয়েছিলেন দিব্যনাথ। অনেক খরচ করেছিলেন। বলচিত্ত, ভিতু, বড় চাকুরে, বড়লোকের আদরে। ছেলে অমিত। নীপার বর।।

অমিতের জন্যে তাজার দুঃখ হয়। আগে ও মদ খেত না। এখন মাতাল হবার জন্যেই মদ খায়।

ওর বাড়িতে ওর পিসতুত ভায়ের সঙ্গে নীপা বলতে গেলে বসবাস করতে শুরু করার পর থেকে অমিত মদ খাচ্ছে।

সুজাতা বুঝে পান না অমিত কেন ওর পিসতুত ভাইকে কিছু বলে না। এরকম পরিস্থিতি হলে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে নেয় মানুষ। যদি আবহাওয়াটা হাতের বাইরে চলে গিয়ে না থাকে তবে চেষ্টা করে কথা বলে কয়ে নেয় পিসতুত ভাইয়ের সঙ্গে।

বের করে দেয় পিসতুতো ভাইকে।

চলে যেতে বলে স্ত্রীকে। আইন আছে, আদালত আছে, ব্যবস্থা করে।

অমিত কিছুই করে না, মদ খায়। দিব্যনাথ এসব মেনে চলেন বলে জামাইষষ্ঠীতে দজনে আসে এ বাড়িতে। অমিতের গুরুদেবের কাছে বছরে একবার দজনে যায়। অমিত শোয় তেতলায়। দোতলায় একটা ঘরে ওদের মেয়ে এবং মেয়ের আয়া ঘুমোয়। দোতলাতেই বলাই আর নীপার পাশাপাশি শোবার ঘর।

সব যেন কীটদষ্ট, ব্যাধিদুষ্ট, পচাধরা, গলিত ক্যানসার। মত সম্পুর্কের জের টেনে মত মানুষের বেঁচে থাকার ভান করছে। সুজাতার মনে হল অমিত, নীপা, বলাই, এদের গায়ের কাছে গেলেও বোধহয় শবগন্ধ পাওয়া যাবে। এরা ভ্রূণ থেকেই দুষ্ট, দূষিত, ব্যাধিগ্রস্ত। যে সমাজকে ব্রতীরা নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল সেই সমাজ বহুজনের ক্ষুধিত অন্ন কেড়ে নিয়ে এদের সযত্নে রাজভোগে লালন করে, বড় করে। সে সমাজ জীবনের অধিকার মতদের, জীবিতদের নয়। কিন্তু বলাই কি বলছে?

এখন বাপধনদের অবস্থা কি? সব ত পাড়া ছেড়ে পালিয়েছে। আরে বাবা, বরানগর-বরানগর বলে কেঁদে কেঁদে ধীমান কবিতা লেখেনি? কেঁদে কি হবে? সোজা কথা বরানগরে মোর দ্যান এ হানড্রেডকে কুচিয়ে কাটল বলে না বরানগর এখন শান্ত হয়েছে? যদিন কাটে নি তদ্দিন কি টেনশানই ছিল।

ধীমান কে? ধীমান রায়? যার কথা নন্দিনী বলল? সুজাতা দেখলেন একটি অত্যন্ত ফর্সা মেয়ে শালের ম্যাকসি পরে হাতে গেলাস নিয়ে বলাইয়ের কাঁধে হাত রাখল। বলল,

অপূর্ব লিখছে না এরা?

বলাই বলল, বিশ হাজার ছেলে জেলে বলে কাঁদুনি গাইছে ধীমান। ওসব কি বুঝি না ভাবছ? যখন অ্যাকশন-কাউন্টার এ অ্যাকশান চলছিল তখন সব হুমকি খেয়ে বাংলাদেশ-বাংলাদেশ

বলে কাগজে কাঁদছিল। এখন সব কন্ট্রোলে, নাউ হি ফিলস হি ইজ সেফ এনাফ টু রাইট।

ষাঃ! কি যে লিখছে! সেদিন একটা কবিতা পড়ে আমার ত কান্না পাচ্ছিল। এই যে, আপনার কবিতার কথা বলছি। হোয়েন ডু ইউ রাইট? এত বিজি থাকেন! রিয়েলি, ইউ আর ট্রুলি কমিটেড টু দি কজ!

ধীমান রায় উত্তর উল্লিশ, ভোঁতা চেহারা, অতি কুদর্শন। পাকা অভিনেতার মত মথে নিমেষে সংকোচের ভাব-ফোটালেন। খসখসে, মোটা গলায় বললেন, আর কিছু নিয়ে কি কবি লিখতে পারে?

রিয়ালি—যখন কবিতাটা পড়লাম! অনুপ দত্ত, উই নো হিম, অনুপ বলল, হি ফিল্‌স।

জানবেন, আজ সবাই ওদের কথাই ভাবছে।

ধীমান রায় অত্যন্ত নিপুণতায় মাখনের টুকরো কামড়ালেন, হুইসকিতে চুমুক দিলেন। সুজাতা শুনেছেন যথেষ্ট মাখন খেলে হুইসকিতে নেশা হয় না। ধীমান রায়কে দেখে বুঝলেন, মাতাল হওয়া ওর উদ্দেশ্য নয়।

জানি, হঠাৎ নীপা বলল। অত্যন্ত হুইসকি খেয়েছে নীপা। ওর চোখে মুখে ঔদ্ধত্য।

জান না কি? অমিত ব্যঙ্গ করল।

শিওর। একটা ওয়াশভ আউট কবি, পরের মুখে ঝাল খায়, তার কবিতায় আবার একস্‌পেরিপেনস্‌ কি থাকবে? আমার ভাই মরেছিল। তখন তোমাদের সিমপ্যাথেটিক কবি কি করেছিলেন? হাইডিং বিহাইন্‌ড হজ স্কার্টস? বলাই বলে নি আমায়? ব্রতীকে নিয়ে ত তুমি ফাঁপরে পড়েছিলে তখন। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল তোমার।

কে বলল?

আমি বলছি। তুমিই ত আমায় পইপই করে সাবধান করতে।

নট মি।

মিথ্যুক।

টেক দ্যাট ব্যাক।

আই ওন্‌ট।

আমি খিদিরপরের গাঙুলী বাড়ির ছেলে। তোমার মত একটা তিন পয়সার বেশ্যার কাছে…

অমিত!

সুজাতা নিচু গলায় ধমক দিলেন।

কয়েকটি অস্বস্তিকর মুহূর্ত বিস্ফোরক। সলতে পুড়ছে–পুড়ছে–পুড়ছে। বারুদের স্তূপ ছোঁয়-ছোঁয়-এই ছোঁবে। সলতেটা বারুদ ছুঁল না। কেননা নীপা হঠাৎ এক ঝাঁক পাখির মত কলকলিয়ে হাসল।

মা! তুমি যে কি! আমরা এ রকম ঝগড়া দারণ এনজয় করি।

নিজেদের সংসারে কর।

সুজাতা সরে গেলেন। পাটি জমেছে। টেম্পো উঠেছে। প্রায় সকলেই মাতাল। টোনির বোন নার্গিস দুটো অ্যাসট্রে বাজিয়ে সোয়ামী! সোয়ামী! বলে নাচছে। যিশু মিত্র উব, হয়ে বসে হাততালি দিচ্ছেন, একটু দুলছেন।

অমিত তিতিবিরক্তি হয়ে বলল, তোমার মা মাইরি একটা স্‌পয়েল জয়।

ও এখন স্থির করল, মাতাল হবে। নির্জলা হুইসকি গেলাসে ঢালল। গলায় উপুড় করল।

বলাই বলল, নীপা চল কাটি।

চল!

লেটস গো টু শরৎ’স। আজ ফিল্‌ম সেশন। ওর বাড়িতে প্যারিস থেকে আনা সব ছবি—

বলাই ঠোঁটে ও গালে জিভ ঘুরিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করল।

শব্দটা যেমন নগ্ন, তেমন মাংসল। শব্দটা শুনেই বোঝা গেল ছবিটা কি রকম হবে। নিশ্চয় উত্তেজক।

চল।

ওরা বেরিয়ে গেল।

ধীমান রায় অমিতকে বললেন, আপনি তো আচ্ছা লোক?

কেন?

বলাইয়ের সঙ্গে আপনার বউ যে ফিলম দেখতে গেল।

তাতে আপনার কি?

বলাই! ব্যাটা ক্যালেন্‌ডার পেলেও…

আরে বাবা! আপনি মদের গন্ধে গন্ধে বড়লোকদের কালটিভেট করেন, তাই এসেছেন। ফ্রি মদ পাচ্ছেন, খেয়ে যান। অত মাথা ঘামাচ্ছেন কেন?

বলাইয়ের সঙ্গে।

অমিত খিকখিক করে চালাক শেয়ালের মত হাসল। বলল, বলাইকে চেনাবেন না, ও আমার পিসতুত ভাই।

ভাই?

হ্যাঁ মশাই। মহিমারঞ্জন গাঙলীর পৌত্র আমি, দৌহিত্র ও।

তাই বলন।

ফেট মানেন। নিয়তি?

নিশ্চয় মানি না। ঈশ্বর মানি না, নিয়তি মানি না।

ক্যাপ!

কি বললেন?

রাবিশ। আপনার মত নাস্তিক দবেলা আমার অফিসে আসে।

আপনি মাতাল হয়েছেন।

আপনি হন নি? ফেট মানুন মশাই, ফেট আছে।

কি রকম?

ফেট ছাড়া কি? বলাই ফ্যামিলির একটা মেয়েকে ছেড়েছে যে, আমার বউকে ছেড়ে দেবে? আরে মশাই, আমার ছোট পিসি, ওর ছোটমাসি, তাকে দিয়ে ওর বদমাশি শুরু হয়। নীপাকে ও সহজে ছাড়বে তবে হ্যাঁ বলাই বনেদি মাল। ফ্যামিলি ছেড়ে বাইরে বদমাশি করে না।

বলাইয়ের সঙ্গে বউকে…

বলাই আমার ভাই, আবার বন্ধুও বটে। ওর কি কানেকশান জানেন? ওকে চটালে…

মশাই, আপনি দারণ লিবারাল।

ট্রুলি লিবারাল!

মিঃ কাপাডিয়া বললেন, আমি হচ্ছি সত্যি লিবারাল।

দিব্যনাথ বললেন, জানি।

মিঃ কাপাডিয়া নিভাঁজ সুটের কালো বোতামে আঙুল রেখে বললেন, আমার পলিসি যদি ফলো করে, তাহলে দেশের সব সমস্যা মিটে যায়।

হাউ?

মিঃ কাপাডিয়া নিখুঁত বাংলায় বলতে লাগলেন, দেশের সমস্যা কি বলনে? ইনটিগ্রেশন হচ্ছে না। বহ, ধর্ম, জাতি, ভাষা হবার। দুরন দেশটা ভেঙে যাচ্ছে। ফডে কোন সমস্যাই নয়। ফডরায়ট হচ্ছে কি? চাষীরা অত্যন্ত ওয়েল অফ। সবাই রেডিও কিনছে। এমপ্লয়মেন্ট? প্রচুর লোক চাকরি পাচ্ছে। ন্যাশনাল ওয়েলথ? সকলের হাতে পয়সা আছে। নইলে হাউ কাম, বাড়ি হচ্ছে, গাড়ি কিনছে সবাই, সবাই দামী মাছ মাংস খাচ্ছে?

ট্রু।

ভাষা আবার একটা সমস্যা নাকি? যে সেখানে আছে, নেখানকার ভাষা শেখে। আমি এখানে মদ বিক্রি করছি, বাংলা শিখেছি।

মাস্টার করেছেন।

করতেই হবে। টেগোরের ভাষা।

সত্যি।

ভাষার সমস্যা এইভাবে সলভ করলাম। তারপর ধর্ম? ধর্মের দরকার কি? বান ডাউন মন্দির মসজিদ, এভরিথিং ফলো সোয়ামী। সোয়ামী জ্যান্ত ঈবর। তাঁকে ফলো কর।

যা বলেছেন।

আমর, সোয়মীর চিলডরেন ইন ইনডিয়া, দিল্লী-বম্বে-কলকাতা-মাদ্রাজে আপিস খুলছি। ছ হাজার লোককে চাকরি দেব। প্লেন আর হেলিকপটর কিনছি। ভারতের সব ভাষায় সোয়ামীর মেসেজ ছাপব। আকাশ থেকে ভারতের সব জায়গায় মেসেজ ছড়াব। ইন নো টাইম, সবাই সোয়ামীকে ফলো করবে।

ট্রু।

ধর্মের সমস্যাও গেল! জাতের সমস্যা? ল করে দাও, কেউ নিজের রাজ্যের জাতের, ভাষার লোককে বিয়ে করতে পারবে না। বাঙালী ম্যারিজ পাঞ্জাবি, ওড়িয়া ম্যারিজ বিহারী, অসমীয়া ম্যারিজ মারাঠী, ব্যস। সব সমস্যা মিটে গেল।

টোনির সঙ্গে তুলি যেমন…

আমি গ্রেটফুল ভর দিস্‌।

সে কি মশাই? আমি গ্নেটফুল। প্রাউড।

আমিও।

গেট মোঙ্গল অফ দি ওয়াইনট্রেড তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক।

আপনিই বা কম কিসে?

টোনি ইজ এ গ্রেট বয়।

তুলি ইজ এ গ্রেট গার্ল।

জ্যাকি ইজ এ গ্রেট সান।

জ্যোতিও ভাই।

নার্গিজ ইজ এ গ্রেট গার্ল।

নীপা টু।

আপনাদের গ্রেট ফ্যামিলি।

আপনাদেরও। আপনাদের পেডিগ্রি…

আপনারা জমিদার।

আমরা কুলীন।

কুলীন? দ্যাট ইজ গ্রেট।

একদিন ফ্যামিলি ট্রি দেখাব।

নিশ্চয়।

দেখাবেন তখন…

একটা কথা চ্যাটার্জি–

কি?

মিসেস চ্যাটার্জি আপনার ছোট ছেলের শকটা–

না না। শী ইজ অলরাইট।

আপনার ছেলে হয়ে এ রকম…

মিসগাইডেড।

নিশ্চয়ই তাই হবে।

ব্যাড কম্পানি। ব্যাড ফ্রেন্ডস।

মাস্ট বি দ্যাট।

জানেন আমরা বাপ ছেলে কি রকম ক্লোজ ছিলাম?

শুনেছি তুলির মুখে।

বেবিদের মত। হ্যাড নো সিক্রেট ফ্রম ইচ আদার।

তাই ত হওয়া উচিত।

আমাকে ও গডের মত রেসপেকট করত।

করবে না; সাচ এ ফাদার।

সেই ছেলে যখন

ওঃ।

আমার হার্ট ভেঙে গিয়েছিল।

যাবেই ত।

আমি যে কি রকম শক পাই…

দুঃখ করবেন না। সোয়ামী বলেন, ডেথ বলে কিছু নেই। শরীরটা আপনারও মরে যাবে। হেভেনে আপনাদের গোলের দেখা হবে। তখন দেখবেন ছেলে আপনার সেইরকম আছে।

দেখব? সোয়ামী বলেছেন? নিশ্চয়। সোয়ামীকে আমরা ফলো করবই। করবেন।

এই যে আমার স্ত্রী। ওগো উনি কি সুন্দর সব কথা বলছেন শোন। শোন না। এদিকে এস।

শুনেছি। আমি পেছনেই বসেছিলাম।

মিসেস চ্যাটার্জি, হুইসকি?

ধন্যবাদ। আমি খাই না।

শরীর খারাপ লাগছে?

না।

সুজাতা উঠে গেলেন। বিনি ডাকছে। ব্যথা আসছে, ঘন ঘন আসছে। ব্যথার তরঙ্গ। ঢেউ যেন জোরে জোরে ভাঙছে। সব যেন দলছে, আবছা হচ্ছে, আবার স্পষ্ট হচ্ছে। জ্যোতি বোধহয় রেকড লাগিয়েছে; উন্মত্ত আজ।

কেন বিনি?

মা, তুলি ডাকছে।

কেন?

টোনির কোন পেশাল বন্ধু এসেছেন।

কই?

বাইরে।

বাইরে কেন?

গাড়ি থেকে নামবেন না।

নামতে বল।

মা, তোমার পা টলে গেল নাকি?

ব্যথা করছে।

তুমি বস।

না।

আমি ওঁকে ডাকছি ভেতরে।

না, আমিই যাই।

তুমি কেন যাবে? আমি যাই।

তুলি অশান্তি করবে।

তবে চল।

আমি ওঁকে নামতে বলি। তুমি খাবারের বাক্স নিয়ে সঙ্গে চল। নামলে ত ভালই। নইলে বাক্সটা দিয়ে দেব।

সেই ভাল।

ব্যথার সঙ্গে সঙ্গে, ব্যথা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, শীত কমে যায়, গরম লাগে।

সুজাতা শালটা রাখলেন। বাইরে বেরোলেন।

ঠাণ্ডা। শীত। উত্তরে হাওয়া। অন্ধকার বাগান। অন্ধকার। এই অন্ধকারে যদি হারিয়ে যেতে পারেন? ফিরে ও ঘরে ঢুকতেন না হয়। রাস্তায় গেটের সামনে কালো গাড়ি।

কালো গাড়ি। কালো ভ্যান। জানলায় জাল, পেছনের দরজায় জাল। জানলার জাল দিয়ে হেমলেট ঢাকা মাথা! সামনে কে? ড্রাইভারের পাশে? গাড়িটা গজাচ্ছে, স্টার্ট বন্ধ করে নি।

সাদা নিখুঁত পোশাক। পেতলের ব্যাজ।। ডি. সি. ডি. ডি.- সরোজ পাল। বাংলা মায়ের দুরন্ত ছেলে সিংহহৃদয় সরোজ পাল। ‘সরোজ পাল তোমার ক্ষমা নেই’ লেখা অ্যালুমিনিয়ামের দরজায়। ঝপ করে পড়ল। ভেতরে ব্রতী। শায়িত নিথর হিমশীতল। সরোজ পাল।

-ইয়েস, আমার মা আছেন।

-না, আপনার ছেলে দীঘা যায় নি।

–নো, এগুলো বাড়িতে থাকবে না।

—না, ছবি পাবেন না।

—ছেলেকে আপনি শিক্ষা দিতে পারেন নি।

-আপনার ছেলে গণ্ডদের দলে ভিড়েছিল।

—আপনার ছেলে যা করেছিল, তার ক্ষমা হয় না।

-আপনার উচিত ছিল ছেলের মন জেনে, তাকে আমাদের হাতে সারেনডার করতে বলা।

–না, বডি পাবেন না।

–না, বডি পাবেন না।

-না, বডি পাবেন না।

সুজাতা তাকালেন। সরোজ পাল তাকাল। হাজার চুরাশির মা, ব্রতী চ্যাটার্জির মা। একে দেখতে হবে বলেই ত আসতে চায় নি।

বিনি এগিয়ে এল।

নামবেন না?

না।

একবারও না?

না কাজ আছে।

টোনি আর তুলিকে উইশ জানাবেন।

খাবারের বাক্স নিন অন্তত।

দিন। তাড়া আছে। আচ্ছা নমস্কার।

স্টার্ট। গাড়ি গর্জাল। বেরিয়ে গেল।

এখনো কাজ? এখনো ইউনিফর্ম? কালো গাড়ি, জামার নিচে ইস্পাতের চেনের জামা, খাপে পিস্তল, পেছনের সিটে হেলমেট পরা সান্ত্রী?

কোথায় আনকোয়ায়েট, কোথায় কাজ? ভবানীপুর-বালিগঞ্জ-গড়িয়াহাট, গড়িয়া-বেহালা, বারাসত-বরনগর-বাগবাজার, কোথায় কাজ?

কোথায় দোকানে ঝাঁপ পড়বে, বাড়িতে বাড়িতে দরজা বন্ধ হবে, রাস্তা থেকে এস্তে পালাবে পথচারী-সাইকেল নেড়ী-কুকুর-রিকশা?

কোথায় বাজবে সাইরেন? দুপ দুপ দুপ–-রাস্তায় বটের শব্দ–ভ্যানের গজন খট খট খটাখট গুলির আওয়াজ হবে কোথায়?

কোথায় পালাবে, আবার পালাবে ব্রতী? ব্রতী কোথায় পালাবে? কোথায় ঘাতক নেই, গলি নেই, ভ্যান নেই, জেল নেই?

এই মহানগরী—গাঙ্গেয় বঙ্গে—উত্তরবঙ্গে জঙ্গল ও পাহাড় বরফ ঢাকা অঞ্চল-রাঢ়ের কাঁকর-খোয়াই-বাঁধ–সন্দরবনের নোনাগং–বন—শস্যক্ষেত্ৰ-কলকারখানা—কয়লাখনি— চা-বাগান কোথায় পালাবে ব্রতী? কোথায় হারিয়ে যাবে আবার? পালাস না ব্ৰতী। আমার বকে আয়, ফিরে আয় ব্রতী, আর পালস না।

তাকে যে সারাদিন খুঁজে পেয়েছিলেন সুজাতা, সে যে এই সব কিছুতে আছে, ছিল। আবার যদি ভ্যান চলে, আবার যদি সাইরেনের হকমিতে আকাশ চিরে যায়, ব্রতী যে আবার হারিয়ে যাবে। ঘরে ফের ব্রতী, ঘরে ফিরে আয়। তাই আর পালাস না। মার বুকে ফিরে আয় ব্রতী। এমন করে পালিয়ে যাস না। তোকে কেউ পালাতে দেবে নারে, যেখানে যাবি সেখান থেকে আবার টেনে বের করবে। আমার কাছে আয় ব্রতী।

মা! তুমি পড়ে যাচ্ছ।

বিনির হাত ঠেলে দিলেন সুজাতা। ছুটে ফিরে এলেন। ঘরের দরজায় দাঁড়ালেন।

দুলেছে, সব দুলছে ঘরছে-নড়ছে। শবদেহগুলো কে যেন নাচাচ্ছে। শবদেহ, শটিত শবদেহ সব। ধীমান-অমিত— দিব্যনাথ–মিঃ কাপাডিয়া—তুলি-টোনি-যিশুমিত্র-মলিমিত্র-মিসেস কাপাডিয়া–

এই শবদেহগুলো শটিত অস্তিত্ব নিয়ে পৃথিবীর সব কবিতার সব চিত্রকল্প—লালগোলাপ-সবুজ ঘাস—নিয়ন আলো-মায়ের হাসি—শিশুর কান্না—সব চিরকাল, অনন্তকাল ভোগ করে যাবে বলেই কি ব্ৰতী মরেছিল। এই জন্য? পৃথিবীটা এদের হাতে তুলে দেবে বলে?

কখনো না।

ব্রতী……

সুজাতার দীর্ঘ আত হৃৎপিণ্ডচেরা বিলাপ বিস্ফোরণের মত, প্রশ্নের মত, ফেটে পড়ল, ছড়িয়ে গেল কলকাতার প্রতি বাড়ি— শহরের ভিতের নিচে ঢুকে গেল, আকাশপানে উঠে গেল। হাওয়ায় হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ল রাজ্যের কোণ থেকে কোণে, দিক থেকে দিকে, ইতিহাসের সাক্ষী যত স্তুপের অন্ধকার ঘরে ও থামে, ইতিহাস ছড়িয়ে পরাণের বিশ্বাসের ভিতে সে কান্না শুনে বিস্মৃত অতীত, স্মরণের অতীত, গতকালের অতীত, বর্তমান, আগামীকাল, সব যেন কেঁপে উঠল, টেলে গেল। প্রত্যেকটা সখী অস্তিত্বের সুখ ছিঁড়ে গেল।

এ কান্নায় রক্তের গন্ধ, প্রতিবাদ, সুখী শোক।

তারপর সব অন্ধকার। সুজাতার শরীরটা আছড়ে পড়ল।

দিব্যনাথ চেঁচিয়ে উঠলেন, তবে অ্যাপেনডিক্‌স ফেটে গেছে।

1 Comment
Collapse Comments
রাণু শীল। July 9, 2023 at 2:30 am

একজন মা, একজন মানুষ, একজন কর্তব্য্য পরায়ণ মানুষ। সুজাতা, হাজার চুরাশির মা। অসাধারণ এক আখ্যান।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *