এপম্যান রহস্য

এপম্যান রহস্য

নরবানর এবং গোপন ফাইল

নভেম্বর মাসের এক রবিবারের সকাল। ইলিয়ট রোড এলাকায় কর্নেলের তিনতলার অ্যাপার্টমেন্টে আড্ডা দিতে গিয়েছিলুম। কর্নেল কফি পান শেষ করে চুরুট জ্বেলে একটা প্রকাণ্ড বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিলেন। সম্ভবত তিনি কিছু। খুঁজছিলেন। মুখটা বেজায় গম্ভীর। আমি সোফার এককোণে বসে একটা সচিত্র। রঙিন পত্রিকার ভিতর ছবি দেখছিলুম। পত্রিকাটি বিদেশি এবং বিজ্ঞানবিষয়ক। অদূরে প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার–আমাদের প্রিয় হালদারমশাই সেদিনকার একটা খবরের কাগজ পড়ছিলেন। তার ডানহাতের দুটো আঙুলে। একটিপ নস্যি। তখনও নস্যিটা নাকে গোঁজেননি।

হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন–আরেঃ! কয় কী? নরবানর!

 বললুম–এপম্যান হালদারমশাই! লক্ষ লক্ষ বছর আগেকার ক্রোম্যাগনন প্রজাতি। মানুষ আর বানরজাতীয় প্রাণীর মাঝামাঝি আর কী!

–খাইসে! হালদারমশাই নস্যিটুকু নাকে গুঁজে রুমালে হাত আর নাক মুছলেন। কাগজে লিসে, নরবানর প্রথমে দিল্লিতে, তারপর গুজরাটে, শেষে ঝাড়খণ্ডের বরমডিহায় উৎপাত বাধাইছে। পিঠে ডানা আছে কিনা ল্যাখে নাই। জয়ন্তবাবু! আপনাগো সাংবাদিকরা সত্যি দিনকে রাত্র বানাইতে পারেন!

বলে প্রাইভেট ডিটেকটিভদ্রলোক তার ডানহাতের তর্জনী তুলে অদৃশ্য ম্যাপ দেখালেন।–দিল্লি! এইখানে গুজরাট! আর এইখানে হইল গিয়া ঝাড়খণ্ড।

কর্নেল বলে উঠলেন–একটা ত্রিভুজ!

 অমনই গোয়েন্দাপ্রবর উত্তেজিতভাবে বললেন কী কইলেন? কী কইলেন?

-দিল্লি থেকে গুজরাট পর্যন্ত ত্রিভুজের একটা বাহু। গুজরাট থেকে ঝাড়খণ্ডের বরমডিহা দ্বিতীয় বাহু। বরমডিয়া থেকে দিল্লি পর্যন্ত একটা রেখা টানলে হবে তৃতীয় বাহু। ত্রিভুজের তিনটি বাহু। কোণও তিনটে। ব্যাপারটা স্রেফ জ্যামিতি হালদারমশাই।

গোয়েন্দাপ্রবর কী বুঝলেন কে জানে। বললেন–ঠিক কইছেন। তবে পিচাশ হইলে কথা ছিল। লিখছে, নরবানর। জয়ন্তবাবু কইলেন এপম্যান! আর কী কইলেন য্যান?

হালদারমশাই পিশাচকে পিচাশ বলেন। ওঁকে শুধরে দেওয়ার চেষ্টা বৃথা। বললুম–এপম্যান বলতে ক্রোম্যাগনন বোঝায়। এমন হতেই পারে, দৈবাৎ হিমালয়ের কোনো দুর্গম গুহায় এতকাল এপম্যানবংশের একজন বেঁচে ছিল। কোনো কারণে এবার সে বেরিয়ে এসেছে।

হালদারমশাইয়ের একথা মনঃপূত হল না। তিনি বললেন–মশয়! চল্লিশ বৎসর পুলিশে চাকরি করছি। কত শ্মশানমশান বনবাদাড়ে ঘুরছি। লোকে কইত, শ্মশানে পিচাশ থাকে। একখানও দেখি নাই। তো আপনাগো এপম্যান!

কর্নেল বললেন–নরবানরের চেহারার সঙ্গে পিশাচের চেহারার মিল অবশ্য আছে।

হাসতে হাসতে বললুম–হালদারমশাই! আপনি বরমডিহা চলে যান। এপম্যানকে গ্রেফতার করে পুলিশের হাতে তুলে দিন। আপনার নাম সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে।

হালদারমশাই হাসলেন না। তিনি আবার খবরটা পড়তে থাকলেন। উত্তেজনায় তার গোঁফের দুই ডগা তিরতির করে কাঁপছিল।

এদিকে কর্নেল আবার সেই বইয়ের পাতায় চোখ রেখেছেন। একটু পরে তিনি আপনমনে বিড়বিড় করে বললেন–পেফিওপেদিলাম্ ভিল্লোসা!

গোয়েন্দাপ্রবর আবার চমকে উঠে বললেন–কী কইলেন? কী কইলেন?

–এক বিরল প্রজাতির অর্কিড। পাহাড়ি এলাকায় জন্মায়। ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে ফাদার জনসন চেরাপুঞ্জি এলাকা থেকে এর একটা চারা নিয়ে ছোটোনাগপুর অঞ্চলে চাষ করেন। তিনি সফল হয়েছিলেন।

বললুম–ওটা অর্কিডের বই?

–হ্যাঁ। বলে কর্নেল তার সাদা দাড়ি থেকে চুরুটের ছাই ঝেড়ে ফেললেন।

ফাদার জনসনের গির্জাটা কি বরমডিহায়?

কথাটা কৌতুকে বলেছিলুম। কিন্তু বৃদ্ধ প্রকৃতিবিজ্ঞানী আমাকে অবাক করে বললেন– ঠিক ধরেছ। ঘটনা হল, আজকের কাগজে বরমডিহার খবরটা পড়ে মনে হয়েছিল নামটা আমার চেনা। তাই এই বইয়ে খোঁজাখুঁজি করছিলুম। শেষে পেয়েও গেলুম। এই দেখ। কী অসাধারণ ফুল! আর এই দেখ ফাদার জনসন এবং তার গির্জার ছবি। ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দের বরমডিহার অবস্থাও টের পাবে।

হালদারমশাই বললেন–কর্নেল স্যার কি কখনও বরমডিহা পিছলেন?

বছর পাঁচেক আগে ওই অর্কিডের খোঁজে গিয়েছিলুম। একটা চারা এনেছিলুম। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, সেটা বাঁচাতে পারিনি। কলকাতার আবহাওয়া আর ছোটোনাগপুর পাহাড় এলাকার আবহাওয়া এক নয়। সবখানে পাহাড়ের উপর আবহাওয়াটা মোটামুটি ঠাণ্ডাই থাকে।

হালদারমশাই খবরের কাগজটা তুলে ধরে বললেন–খবরে লিখছে, নরবানর দিল্লি আর গুজরাটে লোকেদের রাত্রিকালে শুধু তাড়া করছে। কিন্তু বরমডিহায় গিয়া সে দিনেও লোকেরে দেখা দিছে। পুলিশ তারে রাইফেল লইয়া তাড়া করছিল। গুলিও ছুড়ছিল কয়েক রাউন্ড। কিন্তু আশ্চর্য ঘটনা, নরবানর গুলি খাইয়াও মরে নাই। এক্কেরে ভ্যানিশ হইয়া গেছে।

কর্নেল মিটিমিটি হেসে অর্কিডের বই টেবিলে রাখলেন। তারপর ড্রয়ার খুলে ক্লিপে আঁটা একগোছা খবরের কাটিং বের করে বললেন–আগের খবরগুলো আপনার চোখ এড়িয়ে গেছে। এই নিন। পড়ে দেখুন। দিল্লি আর গুজরাটে নরবানর কী কী করেছে, তার ডিটেল বিবরণ পেয়ে যাবেন।

গোয়েন্দাপ্রবর কাটিংগুলো নিয়ে সোজা হয়ে বসলেন। তিনি ঢ্যাঙা শক্তসমর্থ গড়নের মানুষ। তবে মোটাসোটা নন। মাথার চুল খুঁটিয়ে ছাঁটেন। তাতে তার ছদ্মবেশ ধরার নাকি সুবিধে হয়। নভেম্বরে কলকাতায় এখনও ফুল স্পিডে পাখা ঘুরছে। অর্থাৎ শীত পড়েনি। তাই তার পরনে শুধু প্যান্টশার্ট। এতক্ষণ ব্যাপারটা নিয়ে তার সঙ্গে কৌতুক করছিলুম। কিন্তু কর্নেল নরবানরের খবরের একগোছা কাটিং রেখেছেন এবং তাকে পড়তে দিলেন দেখে আমি অবাক হয়েছিলুম।

বললুম–কর্নেল! খবরগুলো তো গত গ্রীষ্মের।

কর্নেল হাসলেন। তাঁ। তোমাদের দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা ফলাও করে ছেপেছিল।

–সে তো আমাদের দিল্লি আর সুরাটের সংবাদদাতার পাঠানো খবর।

-কিন্তু আজকের খবর তোমাদের রাঁচির সংবাদদাতা পুলিশসূত্রে পেয়েছেন। বরমডিহায় তিনি ছাড়া আরও অনেক কাগজের রিপোর্টার, এমনকী টিভির লোকজনও ক্যামেরা নিয়ে ছুটে গেছে। জয়ন্ত! এপম্যান বা লক্ষ লক্ষ বছর আগের ক্রোম্যাগনন হোক, পুলিশ যখন এবার তাকে স্বচক্ষে দেখেছে এবং গুলি ছুঁড়েছে, তখন ঘটনাটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলুম এবার। বললুম–দিল্লি বা সুরাটের পুলিশ এপম্যানের গুজব শুনেছিল শুধু। তাকে দেখতে পায়নি। তাহলে কি–

আমার কথায় বাধা পড়ল। ডোরবেল বাজল এবং কর্নেল যথারীতি হাঁক দিলেন–ষষ্ঠী!

একটু পরে ষষ্ঠীচরণের পিছনে একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক ড্রয়িংরুমে ঢুকে কর্নেলকে নমস্কার করে তার সামনাসামনি সোফায় বসলেন। তার চেহারায় স্মার্টনেস স্পষ্ট। গায়ের রং ফরসা। পরনে স্যুট-টাই এবং হাতে একটা ব্রিফকেস। কর্নেল বললেন–ষষ্ঠী! কফি নিয়ে আয়। আমরাও আরেক দফা কফি খাব।

ষষ্ঠী দ্রুত চলে গেল। আগন্তুক আমাকে এবং হালদারমশাইকে একবার দেখে নিয়ে বললেন–কর্নেল সরকার! আমিই গতরাত্রে নিউ আলিপুর থেকে আপনাকে ফোন করেছিলুম। আমার নাম অনিমেষকান্তি সিংহ। তবে আমি এ কে সিনহা নামেই পরিচিত। এই আমার নেমকার্ড।

কর্নেল নেমকার্ড নিয়ে বললেন–আগে কফি আসুক। তারপর কথা হবে। আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। কফি নার্ভ চাঙা করে।

মিঃ সিনহা কর্নেলের কথায় একটু হাসবার চেষ্টা করে বললেন–হ্যাঁ। আমি ক্লান্ত। তবে সেটা ট্রেনজার্নির জন্য নয়। আমার মানসিক অবস্থার কথা আপনি বুঝতেই পারছেন। তো–

বলে তিনি আবার আমার এবং হালদারমশাইয়ের দিকে তাকালেন। কর্নেল বললেন– এঁদের সামনে আপনার কথা বলার অসুবিধে নেই। এঁদের দুজনই আমার সহযোগী। আলাপ করিয়ে দিই। জয়ন্ত চৌধুরি। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সুখ্যাত সাংবাদিক। আমার স্নেহভাজন বন্ধু। উনি মিঃ কে কে হালদার। প্রাইভেট ডিটেকটিভ এবং সরকারে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের একজন প্রাক্তন অফিসার। গণেশ অ্যাভিনিউয়ে ওনার একটা প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি আছে।

আমরা পরস্পর নমস্কার করলুম। মিঃ সিনহা এবার মুখ নামিয়ে হাতের আঙুলের আংটিগুলো নাড়াচাড়া করতে থাকলেন। দেখলুম, তাঁর বাঁহাতের চারটে আঙুলেই নানা রঙের আংটি। বুঝলুম, উনি জ্যোতিষে বিশ্বাসী। জ্যোতিষীর পরামর্শে আঙুলে গ্রহশান্তির রত্ন ধারণ করেছেন। নিশ্চয় ওঁর জীবনে কিছু অশান্তির ব্যাপার আছে।

গোয়েন্দাপ্রবর গুলিগুলি চোখে তাঁকে দেখছিলেন। এবার বললেন–আপনি বিজনেস করেন?

মিঃ সিনহা বললেন–আপনি প্রাক্তন পুলিশ অফিসার। আপনার অনুমান মিথ্যা হতে পারে না। হ্যাঁ–আমি বিজনেসও করি। তবে আমার কিছু কলকারখানা আছে। কাজেই সেই কলকারখানার উৎপন্ন জিনিসপত্র নিয়েই আমার বিজনেস।

এই সময় ষষ্ঠিচরণ এসে কফির ট্রে রেখে গেল। কর্নেল বললেন–কফি খান মিঃ সিনহা। তারপর কথা।

মিঃ সিনহা কফির পেয়ালায় কয়েকবার চুমুক দেওয়ার পর বললেন–কর্নেল সরকারকে গতরাত্রে ফোনেই বলেছি, বরমডিহার ফাদার হফম্যানের কাছে কথাপ্রসঙ্গে আপনার পরিচয় পেয়েছিলুম।

কর্নেল বললেন–ফাদার হফম্যান এখনও বরমডিহায় আছেন জানতুম না। জেনে খুশি হয়েছি।

ফাদার বলছিলেন বরমডিহা এলাকা আপনার সুপরিচিত।

–হ্যাঁ। তবে পাঁচবছরে সেখানকার অনেক পরিবর্তন হওয়া স্বাভাবিক।

–পরিবর্তন হয়েছে। বরমডিহা এখন মহকুমা শহর হয়ে গেছে। তবে ফাদার হফম্যানের মিশন অফিস, চার্চ, স্কুল এখনও শহরের বাইরে থেকে গেছে। যাইহোক, আমার বিপদের কথা বলি।

হালদারমশাই উত্তেজিতভাবে বলে উঠলেন–নরবানরের পাল্লায় পড়ছেন?

কর্নেল একটু হেসে বললেন–কথাটা ওঁকেই বলতে দেওয়া উচিত হালদারমশাই!

মিঃ সিনহা একটু বিরক্ত হয়েছেন, তা ওঁর মুখ দেখেই বোঝা গেল। তিনি বললেন– নরবানর হোক কিংবা গোরিলা-শিম্পাঞ্জি হোক, আমার বিপদ তার জন্য নয়। বরমডিহার কাছেই আমার ইলেকট্রনিক গ্যাজেট তৈরির কারখানা আছে। সেখান থেকে তৈরি সব জিনিস টাউন এরিয়ায় আমার কোম্পানির অফিসের পিছনে গোডাউনে এনে রাখা হয়। আজ রবিবার। গত শুক্রবার রাত্রে গুদাম খালি করে কারা প্রায় এক কোটি টাকার জিনিস ডাকাতি করেছে। দুজন সশস্ত্র দারোয়ান গোডাউন পাহারা দিত। ডাকাতরা তাদের খুন করেছে। বন্দুকদুটো টুকরো টুকরো করে ভেঙে ছুঁড়ে ফেলেছে।

কর্নেল বললেন–খুন করেছে কীভাবে?

গোডাউনটা অফিসের পিছনে একটা টিলাপাহাড়ের গায়ে। ডাকাতরা দারোয়ানদের তুলে নিয়ে গিয়ে টিলার পশ্চিমে প্রায় তিনশো ফুট নীচের ছোট্ট নদীতে ছুঁড়ে ফেলেছিল। কিন্তু নদীতে পাথর আছে। সেই পাথরে পড়ে দুটো লাশও দলা-পাকিয়ে বীভৎস হয়ে গেছে।

হালদারমশাই বলে উঠলেন–নরবানর! ডাকাতেরা নরবানর পুষছে। আপনি কইলেন, আপনার বিপদ নরবানর বাধায় নাই। কিন্তু এ কাজ নরবানরের ছাড়া আর কারুর না।

মিঃ সিনহার মুখে আবার বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠল। তিনি বললেন–আপনি প্রাক্তন পুলিশ অফিসার। পুলিশের মতোই আপনার ধারণা। বরমডিহার পুলিশও তা-ই বলেছিল। কিন্তু খুঁটিয়ে তদন্ত করে রাঁচি থেকে আসা পুলিশের এক্সপার্ট টিম বলেছেন, ডাকাতরা মানুষ। রাত্রে শিশির পড়ে। কাজেই মানুষের জুতোর ছাপ স্পষ্ট পড়েছিল। নরবানর বলুন, কিংকং বলুন, গোরিলা-শিম্পাঞ্জি বলুন; তারা কি জুতো পরে? বরমডিয়ার পুলিশ যে কালো লোমশ প্রাণীটিকে টর্চের আলোয় দেখতে পেয়েছিল, তার পায়ের পাতা প্রকাণ্ড। তার পায়ের ছাপ তুলে রাঁচিতে ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টে আগেই পাঠানো হয়েছিল। আমার অফিস আর গোডাউনের কাছে বা দূরে তেমন কোনো অস্বাভাবিক পায়ের ছাপ পাওয়া যায়নি। তার চেয়ে বড় কথা, নরবানরকে বরমডিহা টাউনের মধ্যে বা কাছাকাছি কোথাও দেখা যায়নি। দেখা গিয়েছিল মউলি নদীর ওপারে পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যে আদিবাসীদের বস্তিতে। তাদের কাছে খবর পেয়ে পুলিশফোর্স গিয়ে রাত্রে ওত পেতেছিল। তারা নাকি জন্তুটাকে গুলি করেছিল। কিন্তু জন্তুটা উধাও হয়ে যায়।

কর্নেল গম্ভীর মুখে শুনছিলেন। এবার বললেন–আপনি গতরাত্রে ফোনে আমাকে বিপদে পড়েছেন বলেছিলেন। আজ এ ঘরে ঢুকেও তা-ই বললেন। মিঃ সিনহা! কোটি টাকার মাল ডাকাতি হওয়াটা আপনার পক্ষে বিপদ তো নিশ্চয়! কিন্তু আপনি যদি ডাকাতির কিনারা করে দিতে বলেন, সেটা তো আমার করার মতো কাজ নয়। ওটা পুলিশের কাজ। ফাদার হফম্যান আশা করি এই কারণে আপনাকে আমার পরিচয় দেননি?

মিঃ সিনহা জোরে শ্বাস ছেড়ে বললেন–আপনি ঠিক বলেছেন কর্নেল সরকার! আমি সেজন্য আপনার কাছে ছুটে আসিনি!

–তাহলে সেই কথাটা এবার বলুন!

অনিমেষকান্তি সিংহ একটু চুপ করে থাকার পর বললেন–ব্যাপারটা অত্যন্ত গোপনীয়।

নির্দ্বিধায় বলতে পারেন। এঁরা আমার ঘনিষ্ঠ সহযোগী। এঁদের কাছে আমার কিছু গোপন থাকে না।

একটু ইতস্তত করার পর মিঃ সিনহা আস্তে বললেন–কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিরক্ষা বিভাগের এক উচ্চপদস্থ অফিসারের সঙ্গে আমার আত্মীয়তা আছে। প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত গবেষণাগারে স্থলবাহিনীর জন্য একটি বিশেষ যন্ত্র উদ্ভাবিত হয়েছে। সেই যন্ত্রটি চালু করতে হলে ইলেকট্রিক পাওয়ার সার্কিটসংক্রান্ত একটি সুইচ দরকার। সুইচটির জন্য তো প্রকাশ্যে টেন্ডার ডাকা যায় না। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে গোপনে বিশ্বস্ত কোনো কোম্পানিকে অর্ডার দেওয়া হয়। সেই অর্ডার আমি পেয়েছিলুম। সুইচটি তৈরি করা এখনও যায়নি। কাজ চলছিল খুব গোপনে। এদিকে প্রতিরক্ষা গবেষণাগারের উদ্ভাবিত যন্ত্রের নকশা এবং প্রয়োগকৌশল সংক্রান্ত পেপারের একটা জেরক্স কপি আমাকে দেওয়া হয়েছিল। ওটার সাহায্যেই সুইচ তৈরি করতে হবে। তো সেই নকশা ও পেপারের গোপন ফাইলটি কীভাবে আমার কাছ থেকে সেই ডাকাতির পর চুরি গেছে।

–কোথায় রেখেছিলেন ফাইল?

–এটাই আশ্চর্য! ফাইলটা আমি প্রতিদিন সঙ্গে নিয়ে কারখানায় যেতুম। রমেশ লালা এবং সিদ্ধেশ্বর রাও নামে দুজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার সুইচ তৈরির চেষ্টা করতেন। অর্থাৎ, আমরা তিনজন শুধু ব্যাপারটা জানতুম। দিনের শেষে ফাইলটা আমি কারখানা থেকে নিয়ে গিয়ে বাড়িতে রাখতুম। আমার বাড়ি বলতে একটা টিলার গায়ে বাংলোবাড়ি। ফাইলটা রেখে দিতুম আমার বেডরুমে আলমারির লকারে। শুক্রবার রাত্রে গোডাউনে ডাকাতির খবর পেয়ে ছুটে গিয়েছিলুম। তখন ফাইলটার কথা আমার মনে ছিল না। বাড়ি ফিরে বিকেলে রমেশ আর সিদ্ধেশ্বরকে ফোনে জানিয়েছিলুম, আজ আমি যাচ্ছি না। তারা কাজ করুক। তারপর ফাইলটা আলমারি থেকে বের করতে গিয়ে দেখি লকারের তালা ভাঙা। ফাইল উধাও।

মিঃ সিনহা দু-হাতে নিজের দুই গাল চেপে ধরলেন। বুঝলুম, এটাই ওঁর হতাশাপ্রকাশের ভঙ্গি।

কর্নেল বললেন–বাংলোয় কে কে থাকেন?

মিঃ সিনহা ধরা গলায় বললেন–আমার স্ত্রী বেঁচে নেই। দুই মেয়ে। তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। দু-জনেই থাকে আমেরিকায়। আমার দুই জামাইয়ের একজন ডাক্তার, অন্যজন বিজনেসম্যান। বাংলোয় থাকে কেয়ারটেকার প্রদোষ সেন। জয়ন্তবাবুর বয়সি। খুব বিশ্বাসী। কলকাতার নিউ আলিপুরে আমার ছোটোভাই অধ্যাপক অরিন্দম সিংহের ছাত্র ছিল সে। দু-বছর আগে সে বরমডিহায় আমার কাছে গিয়েছিল। সে অনাথ আশ্রমে মানুষ হয়েছিল। এছাড়া থাকে দারোয়ান রামবিলাস। মালি নরহরি এবং তার বউ চামেলি। আর আছে রান্না ও বাজার করার লোক গয়ানাথ ঠাকুর।

হালদারমশাই বলে উঠলেন–অগো জেরা করছেন?

মিঃ সিনহা মাথা নেড়ে উত্তেজিতভাবে বললেন–আমি কি উন্মাদ? রাষ্ট্রের নিরাপত্তাসংক্রান্ত গোপন ফাইল চুরি যাওয়ার কথা–

গোয়েন্দাপ্রবর তাঁর কথায় বাধা দিয়ে বললেন–তা কইতাছি না। আলমারির লকার ভাঙার কথা অগো জানাইতেই পারেন! কী কন কর্নেলস্যার?

কর্নেল চুপচাপ তুম্বো মুখে এবং চোখ বুজে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে টাকে হাত বুলোতে থাকলেন। মিঃ সিনহা বললেন–আমার দৃঢ় বিশ্বাস শুক্রবার শেষরাত্রে আমি ডাকাতির খবর পেয়েই ছুটে গিয়েছিলুম। বেডরুমের দরজায় তালা দিতে ভুলে গিয়েছিলুম। ওই অবস্থায় মাথার ঠিক ছিল না। বাংলোয় ফিরেছিলুম বেলা তিনটে নাগাদ। তারপর কিছু খেয়ে নিয়ে বেডরুমে গিয়ে রমেশ আর সিদ্ধেশ্বরকে ফোন করি। তারপর আলমারি খুলি।

কর্নেল চোখ বুজেই বললেন–আলমারির ডুপ্লিকেট চাবি?

–ডুপ্লিকেট চাবি লুকোনো থাকে দেয়ালের তাকে গণেশমূর্তির তলায়। কিন্তু লকারের ডুপ্লিকেট চাবিটা খুলে আমি অন্য চাবির গোছায় রেখেছিলুম। এই দেখুন। লকারের দুটো চাবি।

মিঃ সিনহা ব্রিফকেস খুলে একগোছা চাবি বের করে কর্নেলকে দেখালেন। কর্নেল এবার চোখ খুলে চাবির গোছা দেখে নিয়ে বললেন–গণেশমূর্তির তলার ডুপ্লিকেট চাবিতে শুধু আলমারিটা খোলা যায়। তাই তো?

–ঠিক বলেছেন।

–সেই চাবিটা কি যথাস্থানে আছে দেখেছিলেন?

—হ্যাঁ। চাবি আছে। সেখানেই আছে।

—নিউ আলিপুরে আপনার ছোটোভাই অরিন্দম সিংহ কলেজে কী পড়ান?

—সায়েন্স। সম্ভবত পদার্থবিজ্ঞান।

-কেয়ারটেকার প্রদোষ তার ছাত্র ছিল। তাহলে নিশ্চয় সে পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র ছিল?

মিঃ সিনহা নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে বললেন–অরিন্দমের ছাত্র যখন, তখন সে তা-ই।

–অরিন্দমবাবুকে কি কখনও প্রতিরক্ষা বিভাগের ওই সুইচ তৈরির কথা বলেছিলেন?

–একটু আভাস দিয়েছিলুম গত মাসে। যদি সে কোনো সাহায্য করতে পারে!

–ফাদার হফম্যানের সঙ্গে কখন আপনার দেখা হয়েছিল?

–কাল বিকেলে বাংলোর নীচের রাস্তায়। তাকে–একমাত্র তাকেই ফাইল চুরির কথাটা বলেছি। তিনি প্রভাবশালী মানুষ। তাছাড়া তিনি আমার হিতৈষী। একটু খুলেই বলি। আমার ঠাকুরদা রাঁচিতে ওকালতি করতেন। বাবা সেখানেই ব্যবসা করতেন। আমরা দু-ভাই রাঁচিতেই বড় হয়েছি। ক্যাথলিক মিশন স্কুলে পড়েছি। পরে অরিন্দম কলকাতায় আমার পিসেমশাইয়ের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেছিল। পিসেমশাইয়ের সন্তানাদি নেই। তাই সে নিউ আলিপুরে। পিসেমশাইয়ের বাড়িতেই থেকে গেছে। যাইহোক, ফাদার হফম্যান স্কুলে আমার শিক্ষক ছিলেন। পরে উনি বরমডিহায় চলে যান। আমার সঙ্গে ওঁর সম্পর্ক পিতা পুত্রের মতো। আমি অরিন্দমের মতো উচ্চশিক্ষা পাইনি। বাবার মতো ব্যবসাতে নেমেছিলুম। ফাদার হফম্যানের সাহায্যে বরমডিহায় গিয়ে আমার পেশায় সাফল্য এসেছিল। তাই ফাদারের কাছে আমার কোনো কথা গোপন করি না।

কর্নেল বললেন–আপনার এই ব্যাকগ্রাউন্ডটা আমার জানা দরকার ছিল। বাই এনি চান্স আপনি অরিন্দমবাবুকে ফাইল চুরির কথা বলেছেন?

–বলিনি। কারণ অরিন্দম …

মিঃ সিনহা হঠাৎ চুপ করে গেলেন। তার মুখে উদবেগের ছাপ ফুটে উঠল। কর্নেল বললেন–বলুন মিঃ সিনহা! আপনি কিছু গোপন করলে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারব না। আলেয়ার পিছনে ছুটতে আমি রাজি নই।

মিঃ সিনহা আস্তে বললেন–ওকে বলিনি। গোপন ফাইলে যে যন্ত্রের সুইচ তৈরির প্রস্তাব ছিল, গত মাসে সেই ব্যাপারে তার সাহায্য চাওয়ার সময় লক্ষ। করেছিলুম, সে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। সরকারি গবেষণাপত্রটা সে দেখতে চেয়েছিল। আপনাকে এবার বলা উচিত মনে করছি। অরিন্দম আমাকে বলেছিল, মূল যন্ত্রটার ফর্মুলা এবং নকশা পেলে সে নিজেই ওটা তৈরি করতে পারবে এবং বিদেশে বিক্রি করলে কোটি টাকা পাওয়া যাবে। আমাকে তার অর্ধেকটা সে দেবে।

হালদারমশাই বলে উঠলেন–ঘরের শত্রু বিভীষণ! এখনই তারে জেরা করনের দরকার আছে।

কর্নেল বললেন–হালদারমশাই! তাড়াহুড়ো করবেন না। দড়িকে অনেক সময়। সাপ বলে ভুল হয়। মিঃ সিনহা! এবার একটা কথা জানতে চাই। প্রদোষ সেন। অনাথ আশ্রমে ছিল বলছিলেন। কোন অনাথ আশ্রমে? তাছাড়া সে অরিন্দমবাবুর ছাত্র হয়েছিল কীভাবে?

মিঃ সিনহা বললেন–এ ব্যাপারে আমার তত বেশি জানা নেই। অরিন্দমকে বছর দুই আগে আমার বাড়ি দেখাশোনা এবং পারিবারিক কাজকর্ম তদারকের জন্য একজন বিশ্বাসী তোক খুঁজে দিতে বলেছিলুম। আমার ওই বাংলোবাড়ির আগের কেয়ারটেকার টাকা চুরি করে পালিয়েছিল।

–তাহলে অরিন্দমবাবু তার ছাত্র প্রদোষকে আপনার কাছে পাঠিয়েছিলেন?

–হ্যাঁ। প্রদোষ ওর চিঠি নিয়ে এসেছিল। প্রদোষের নিজের মুখে শুনেছি, সে তার স্যারের দয়ায় কলেজে পড়াশোনা করেছে। পাস করলেও তার রেজাল্ট ভালো হয়নি। সে একটা চাকরি খুঁজছিল।

কর্নেল সোজা হয়ে বসে বললেন–আপনার ভাইয়ের ঠিকানা আর ফোন নম্বর চাই। না–আমি আপনার ভাইকে পুলিশে ধরিয়ে দেব না। আপনার ফাইল চুরির কথাও তাকে বলব না। তবে অরিন্দমবাবুর ব্যাকগ্রাউন্ডসহ প্রদোষ সেনের ব্যাকগ্রাউন্ড আমাকে সতর্কভাবে জেনে নিতে হবে। আপনি চিন্তা করবেন না। ফাদার হফম্যানকে বলবেন, আমি তার সঙ্গে শিগগির দেখা করব। আমার উদ্দেশ্য, আপাতত দুর্লভ প্রজাতির অর্কিড সংগ্রহ। হা– অরিন্দমবাবুর ঠিাকানা আর ফোন নম্বর লিখে দিন। আর আপনাকে একটা পরামর্শ দিই। চুপচাপ ফিরে যান বরমডিহায়। গিয়েই থানায় একটা ডায়ারি করবেন। আপনার অনুপস্থিতিতে আলমারির লকার ভেঙে টাকা চুরি গেছে! কেমন? তারপর কারখানা চালু করুন। কারখানার নিশ্চয় বীমা করা আছে? বীমা করা থাকলে বীমা কোম্পানি আপনাকে টাকা দেবে।

মিঃ সিনহা বললেন–হ্যাঁ। তবে বীমার টাকা না পেলেও আমার কারখানা চালানোর মতো টাকাকড়ি আছে।

কর্নেল টেবিল থেকে একটা কাগজের ছোট্ট প্যাড দিলেন তাকে। বললেন– সাবধান! পুলিশকে ফাইল চুরির কথা বলবেন না। বলবেন, টাকাকড়ি চুরি গেছে।…

.

নিউক্লিয়ার ফিজিক্স এবং হুমকি

 মিঃ সিনহা তার ভাইয়ের নাম ঠিকানা এবং ফোন নম্বর লিখে দিলেন। তারপর ব্রিফকেস খুলে একশো টাকার নোটের একটা বান্ডিল বের করে বললেনফাদার হফম্যান আমাকে বলেছেন, ফি-এর কথা তুললে আপনি অসন্তুষ্ট হবেন। কিন্তু এই জটিল রহস্যের পিছনে ছোটাছুটি করতে আপনার টাকা খরচ হবে। প্লিজ কর্নেল সরকার! এতে হাজার পাঁচেক টাকা আছে। আপনি অন্তত যাতায়াত খরচ এবং হোটেল খরচ বাবদ এই টাকাটা নিন। না নিলে আমি মনে জোর পাব না।

ভেবেছিলুম, কর্নেল এবার খাপ্পা হয়ে ভদ্রলোককে চলে যেতে বলবেন। কিন্তু আমাকে অবাক করে তিনি গম্ভীর মুখে বললেন–হ্যাঁ। এই কেসে ছুটোছুটির ব্যাপার তো আছেই। কিন্তু নীতিগতভাবে আমি টাকা নেব না। বরমডিহায় আমি যাব আমার নিজস্ব কাজে। অর্কিড সংগ্রহ এবং সুযোগ পেলে নরবানর দর্শন আমার উদ্দেশ্য। ক্যামেরায় দুর্লভ প্রজাতির পাখি-প্রজাপতি এবং জন্তুজানোয়ারের ছবি তোলাও আমার হবি। নরবানরের ছবি তুলতে পারলে বিদেশি পত্রিকায় একটা সচিত্র ফিচার লিখব। অন্তত শপাঁচেক ডলার দক্ষিণা আশা করা যায়। যাইহোক, টাকাটা আপনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিঃ হালদারকে অগ্রিম ফি হিসেবে দিয়ে যান। হালদারমশাইয়ের কাছে আশা করি তার এজেন্সির চুক্তিপত্র আছে?

গোয়েন্দাপ্রবর হাসলেন।–হঃ! সঙ্গে সবসময় আমার ডিটেকটিভ এজেন্সির কনট্রাক্ট পেপার লইয়া ঘুরি। কখন কোথায় একখান ক্যাস হাতে পাই তা কওন যায় না।

তখনই মিঃ সিনহার সঙ্গে হালদারমশাইয়ের দু-কপি চুক্তিপত্র সই হয়ে গেল। কর্নেল এবং আমি সাক্ষীর ঘরে সই করলুম। টাকার বান্ডিল প্যান্টের পকেটে চালান করে হালদারমশাই বললেন–পরে বিল কইরা দিমু। সব টাকা খরচ না হইলে ফেরত দিমু। চিন্তা করবেন না।

অনিমেষকান্তি সিংহ চলে যাওয়ার পর বললুম–ভদ্রলোক একজন শিল্পপতি। টাকার কুমির। হালদারমশাই দশ হাজার চাইলেই পারতেন।

আমার কৌতুকে হালদারমশাই কান দিলেন না। বললেন–প্রথমে কী করুম কন কর্নেলস্যার?

কর্নেল বললেন–আপনাকে তখন একটা ত্রিভুজের কথা বলেছিলুম!

–হঃ! কিন্তু ত্রিভুজ দিয়া কী হইব?

–খবরের কাটিংগুলো কি মন দিয়ে পড়েননি?

–পড়ছি। কিন্তু ত্রিভুজ ক্যান?

–গত মে মাসে দিল্লিতে প্রথম নরবানরের আবির্ভাব। তার কয়েকদিন পরে বিখ্যাত কনট্রাক্টর মহাবীর জয়সোয়ালের অফিসে ডাকাতি এবং একইভাবে দারোয়ানের হাড়গোড়ভাঙা দলা-পাকানো লাশ পাওয়া যায়। দিল্লির পুলিশ এই ঘটনার সঙ্গে নরবানরের যোগাযোগের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখেছিল। কিন্তু তদন্তে কোনো প্রমাণ মেলেনি। যারা নরবানরকে দেখেছে বলেছিল, তারা পুলিশের জেরায় কথাটা অস্বীকার করেছিল।

–মনে পড়ছে। বলে হালদারমশাই খবরের কাটিংগুলো ওলটাতে ব্যস্ত হলেন।

 কর্নেল বললেন–থাক। আমার মুখেই শুনুন। গুজরাটের শাহাবাদ শহরে নরবানরের আবির্ভাব হয়েছিল জুন মাসে। জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে শাহাবাদে শিল্পপতি ভজনলাল জৈনের কারখানা রাতারাতি আগুন লেগে ছাই হয়ে গিয়েছিল।

–হঃ। পড়ছি।

সেখানেও দু-জন সশস্ত্র দারোয়ানের দলা পাকানো লাশ পাওয়া গিয়েছিল। পুলিশ দিল্লির মতোই প্রথমে নরবানরের সঙ্গে ঘটনাটা জড়াতে চেয়েছিল। কিন্তু তদন্ত করে তার কোনো প্রমাণ মেলেনি।

এবার না বলে পারলুম না–বরমডিহার ঘটনাতেও একই ব্যাপার দু-জন দারোয়ানকে তিনশো ফুট নীচে নদীর মধ্যে পাথরে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে।

কর্নেল হাসলেন।মিঃ সিনহার কাছে জানা গেল, তিনি কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা বিভাগের কোনো শাখা থেকে একটা অর্ডার পেয়েছিলেন। দিল্লির মিঃ মহাবীর জয়সোয়ল এবং শাহাবাদের ভজনলাল জৈনও কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা বিভাগের বিভিন্ন শাখার অর্ডার সাপ্লাই করতেন। এটাই অদ্ভুত ব্যাপার।

হালদারমশাই উত্তেজিতভাবে বললেন পড়ছি! পড়ছি!

আমি রসিকতা করে বললুম–তাহলে তো প্রতিরক্ষা বিভাগের গুপ্তচররা এতদিন কাজে নেমে পড়েছেন। তাঁদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কি কর্নেল এঁটে উঠবেন?

কর্নেল তুম্বো মুখে বললেন–আমি একজন রিটায়ার্ড কর্নেল! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তরুণ বয়সে বর্মাফ্রন্টে যুদ্ধ করেছি। গেরিলাযুদ্ধেও আমার দক্ষতা আছে। জয়ন্ত! তুমি ভুলে যেয়ো না, কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক বিশেষ পরিচয়পত্র দিয়েছেন। আমাদের দেশের সরকারি গুপ্তচরদের কাছে সম্ভবত আমার নামটা অজানা নয়।

বুঝলুম, আমার বৃদ্ধ বন্ধুর আঁতে ঘা দিয়ে ফেলেছি। বললুম–প্লিজ কর্নেল! ঘাট মানছি। রসিকতা শোনার মুড আপনার নেই, তা বুঝতে পারছি।

এবার কর্নেল তাঁর বিখ্যাত অট্টহাসি হাসলেন। তারপর বললেন হালদারমশাই! ত্রিভুজ-পরিক্রমা করুন। প্রথমে দিল্লিতে মিঃ জয়সোয়াল। তারপর যান শাহাবাদে মিঃ জৈনের কাছে। তারপর বরমডিহাতে ফিরে আমার সঙ্গে দেখা করবেন।

হালদারমশাই বললেন কিন্তু ওনারা কি আমারে পাত্তা দেবেন?

–হালদারমশাই! আপনি তো সাধুসন্ন্যাসীর ছদ্মবেশ ধরতে পটু! মিঃ জয়সোয়াল আর মিঃ জৈনের বাড়ির ঠিকানা জেনে নিয়ে তাদের বাড়িতেই দেখাসাক্ষাতের চেষ্টা করবেন। একজন হিন্দু। অন্যজন জৈন। হিন্দুশাস্ত্রের জ্ঞান আপনার আছে। তা অনেক কেসেই দেখেছি। এবার জৈনশাস্ত্র সম্পর্কে কিছু জ্ঞান সংগ্রহ করে নেবেন। ট্রেনে যেতে যেতে জৈনধর্মের বই পড়ে নেবেন। ইংরেজিতে এসব বই পাওয়া যায়। বরং আজই কলকাতার পরেশনাথ মন্দিরে গিয়ে খোঁজখবর নিন। একটা কথা। সঙ্গে আপনার লাইসেন্সড ফায়ার আর্মস রাখতে ভুলবেন না যেন। আর যাওয়ার সময় আমাকে ফোন করবেন।

গোয়েন্দাপ্রবর সবেগে প্রস্থান করলেন। ….

এদিন কর্নেল আমাকে সল্টলেকে ফিরতে দিলেন না। খাওয়াদাওয়ার পর অভ্যাসমতো আমি ড্রয়িংরুমের ডিভানে ভাতঘুম দিয়ে নিতে চিত হয়েছিলুম। কর্নেল তার ইজিচেয়ারে বসে চুরুট টানছিলেন। একবার ঘুরে আমার উদ্দেশে বললেন–এখন দেড়টা বাজে। ঠিক আড়াইটে নাগাদ আমরা বেরুব।

চোখ বুজে আসছিল। শুধু বললুম–হুঁ।

তারপর নিশ্চয় ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। কর্নেলের ডাকে চোখ খুলে বললুম–কী বিপদ!

–বিপদ কিসের? এ ঘরে নরবানরের উপদ্রব ঘটেনি। উঠে পড়ো। দেড়ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিয়েছ।

উঠে দাঁড়িয়ে দেয়াল ঘড়ি দেখে বললুম–তিনটে বাজে দেখছি। আপনি আড়াইটেতে বেরুবেন বলেছিলেন!

কর্নেল বললেন–যাঁর কাছে যাচ্ছি, তিনি সাড়ে তিনটে-চারটের মধ্যে যেতে বলেছেন। কারণ বিকেল পাঁচটায় তার কোথায় একটা জরুরি মিটিং আছে।

–কে তিনি?

–আর কথা নয়। বেরিয়ে পড়া যাক। বলে তিনি হাঁক দিলেন–ষষ্ঠী! আমরা বেরুচ্ছি। কেউ ফোন করলে নাম আর নম্বর লিখে রাখবি। আমরা ছটার মধ্যেই ফিরব।

নীচে লনের পাশে পার্কিং জোনে আমার ফিয়াট গাড়িটা রাখা ছিল। গাড়িতে আমার বাঁদিকে বসে কর্নেল বললেন–নিউ আলিপুর। শর্টকাটে যাব।

স্টার্ট দিয়ে বললুম–তাই বলুন! অধ্যাপক অরিন্দম সিংহের বাড়ি যাবেন।

কর্নেল কোনো জবাব দিলেন না। হাতের ইঙ্গিতে পথনির্দেশ করলেন। বরাবর দেখে আসছি, কলকাতার অলি-গলি তার নখদর্পণে।

, রবিবার বলে ট্রাফিকজ্যামের পাল্লায় পড়িনি। আধঘণ্টার মধ্যে নিউ আলিপুর পশ এরিয়ায় পৌঁছে গেলাম। তারপর কর্নেলের নির্দেশমতো একটা সাততলা। হাউজিং কমপ্লেক্সের গেট দিয়ে ঢুকে পার্কিং জোনে গাড়ি রাখলুম। গেটে দারোয়ান  ছিল। সম্ভবত কর্নেলের ফরসা রং, সাদা দাড়ি আর টুপি দেখে সায়েবসুবো ভেবে। কোনো প্রশ্ন করেনি। বরং সেলাম দিয়েছিল।

বি ব্লকের অটোমেটিক লিফটে উঠে কর্নেল পাঁচতলা অর্থাৎ ফোর্থ ফ্লোরের বোতাম টিপলেন। তারপর লিফট থেকে নেমে করিডরে এগিয়ে একুশ নম্বর। অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় ডোরবেলের সুইচ টিপলেন কর্নেল। আমি তার পিছনে ছিলুম। একটু পরে দরজা খুলে পাজামা-পাঞ্জাবি পরা সুদর্শন চেহারার এক ভদ্রলোক ভুরু কুঁচকে বললেন–কর্নেল নীলাদ্রি সরকার?

কর্নেল তার নেমকার্ড দিলেন। বুঝলুম, ইনিই অধ্যাপক অরিন্দম সিংহ। বয়স অনুমান করলুম চল্লিশের ওধারে। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন–ইনি?

আমি আমার নেমকার্ড বের করে তাঁকে দিলুম। তিনি ঠোঁটের কোণে হেসে বললেন– কর্নেল সরকার প্রকৃতিবিজ্ঞানী। তাঁর সঙ্গে একজন সাংবাদিক। এনিওয়ে! ভিতরে আসুন।

অধ্যাপক সিংহ যে উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষ, তার পরিচয় বসবার ঘরে ঢুকেও পাওয়া গেল। তাছাড়া ঘরে আধুনিক শিল্পসংস্কৃতির নমুনাও প্রচুর। র‍্যাকে পরিচ্ছন্ন নানা আকারের বই ঠাসা। সোফায় আমাদের বসতে বলে অধ্যাপক সিংহ ঘড়ি দেখলেন। তারপর বললেন–চা কিংবা কফি?

কর্নেল বললেন–ধন্যবাদ! আমার হাতেও সময় কম। শুধু দু-চারটি কথা বলতে এসেছি।

–বলুন!

–আপনি জানেন কি আপনার দাদা মিঃ এ কে সিনহা আমার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন?

কোনো এক কর্নেলসায়েবের কাছে জরুরি কী কাজে দাদা দেখা করতে গিয়েছিল, এটুকু জানি। দাদা পরে রিং করেছিল, সে বরমডিহা চলে যাচ্ছে। আমার এখানে আর ফিরছে না।

–প্রদোষ সেন আপনার ছাত্র ছিল?

অধ্যাপক সিংহের মুখে গাম্ভীর্যের ছায়া পড়ল।–হ্যাঁ, ছিল। কেন?

–নিছক কৌতূহল। বলে কর্নেল তার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকালেন।–শুনেছি প্রদোষ পিতৃমাতৃপরিচয়হীন সে কোনো অনাথ আশ্রমে ছিল এবং আপনি তাকে নিয়ে এসে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন?

–কতকটা তা-ই। তবে আমাদের কলেজে অনাথ ছেলেদের জন্য তিনটে সিট সংরক্ষিত আছে। কাঞ্চনপুর অনাথ আশ্রমে উচ্চমাধ্যমিক স্কুল আছে। আশ্রমের স্বামীজি প্রদোষের জন্য আমাকে অনুরোধ করেছিলেন। আমি প্রিন্সিপ্যালকে বলে তার পড়ার ব্যবস্থা করেছিলুম।

–সে আপনার ব্যক্তিগত ল্যাবে আপনার গবেষণায় সাহায্য করত?

—দাদা আপনাকে একথা বলেছে?

–না। আমার অনুমান এটা।

অধ্যাপক সিংহ বাঁকা হেসে বললেন–আপনার অনুমান কিছুটা সত্য। তবে আমার মনে হচ্ছে, আপনি অন্য কোনো সূত্রে কথাটা জেনেছেন। যাইহোক, প্রদোষের তত মেধা ছিল না। আমার ল্যাবে প্রদোষ উৎপাত বাধাত। দাদা একজন বিশ্বস্ত কেয়ারটেকার খুঁজছিলেন। প্রদোষকে তাই দাদার কাছে পাঠিয়েছিলুম। কিন্তু তার সম্পর্কে আপনার কৌতূহলের কারণ জানতে পারি?

–নিছক কৌতূহল। প্রদোষের পদবি সেন কেন বলতে পারেন?

জানি না। কাঞ্চনপুর অনাথ আশ্রমের স্বামীজি নিশ্চয় জানতেন তার বাবার পদবী সেন ছিল।

–আপনার অরিন্দম ছাড়া কি অন্য কোনো নাম আছে?

—এ ধরনের ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না। বলুন, আর কী কথা আছে?

–বরমডিহায় আপনার দাদার গোডাউনে ডাকাতির কথা শুনেছেন কি?

–শুনেছি! মাই গুডনেস! নড়ে বসলেন অধ্যাপক সিংহ।–আপনি কি কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর অফিসার? অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আপনি। আপনার চুল-দাড়ি সাদা হলেও বার্ধক্যের লক্ষণ আপনার মধ্যে দেখছি না। কাজেই আপনি সি বি আই অফিসার হতেই পারেন। কিন্তু বরমডিহার ঘটনা সম্পর্কে আমার কাছে কেন?

কর্নেল হাসলেন। –সেখানে একটা নরবানরের উপদ্রব ঘটেছে। শুনেছেন কি?

–শুনেছি। খবরের কাগজে বেরিয়েছে। কিন্তু হঠাৎ নরবানর কেন? আমি কি নরবানর? আপনি এবার আসতে পারেন।

–আর একটা প্রশ্ন। প্লিজ উত্তেজিত হবেন না। আপনার দাদা প্রতিরক্ষা বিভাগের একটা শাখা থেকে এক ধরনের সুইচ তৈরির অর্ডার পেয়েছেন। আপনি তাঁকে সাহায্য করবেন বলেছিলেন। করেছিলেন কি?

–ও মাই গড! দাদা আমাকে ফাসাতে চাইছে দেখছি! চাইবেই তো। আমি দাদার বৈমাত্রেয় ভাই। দাদা আমাকে পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছিল। তবু আমি তাতে দুঃখ পাইনি। আমি একজন সেলমেড ম্যান। দাদাকে ফোনে জানিয়ে দেব, সে যেন আমার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রাখে। আপনি দয়া করে এবার আসুন!

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। তার গলায় যথারীতি ক্যামেরা আর বাইনোকুলার ঝুলছিল। তিনি দ্রুত ক্যামেরা তুলে শাটার টিপলেন এবং আলো ঝিলিক দিল। আপনার একটা ছবি নিলুম। ছবি তোলা আমার হবি।

অধ্যাপক সিংহ কর্নেলের ক্যামেরার দিকে হাত বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু কর্নেল দ্রুত বেরিয়ে পড়লেন। আমিও তাকে অনুসরণ করলুম। লিফটে চেপে নামতে নামতে বললুম–আপনি যা নাটক করলেন, এবার গেটে সিকিউরিটি আটকাবে আমাদের এবং পুলিশ আসবে।

কর্নেল বললেন–দেখা যাক।

কেমন করে বুঝলেন যে উনি গেটে আমাদের আটকানোর ব্যবস্থা করবেন না?

–ভদ্রলোক নিউ আলিপুর থানায় ফোন করে আমার নামটা নিশ্চয় বলবেন। কাজেই কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের কাজে পুলিশ বাধা দিতে আসবে না। বরং যদি আসে, সিকিউরিটির হাত থেকে পুলিশ আমাদের উদ্ধার করবে। চিন্তা করো না।

–আমার সত্যি একটু ভয় হচ্ছে কর্নেল!

–তুমি সাংবাদিক। অধ্যাপক সিংহের গবেষণা সম্পর্কে খবর নিতে এসেছিলে। মনে রাখো কথাটা। তাছাড়া আমি বাড়ি থেকে বেরুনোর আগেই নিউ আলিপুর থানায় জানিয়ে এসেছি। এতক্ষণ পুলিশের জিপ গেটে এসে পৌঁছুনোর কথা জয়ন্ত! তুমি বোঝ সবই–তবে দেরিতে।

নীচে নেমে হতবাক হয়ে গাড়িতে উঠলুম। লক্ষ করলুম, গেটের বাইরে সত্যিই পুলিশের একটা জিপ দাঁড়িয়ে আছে। একজন পুলিশ অফিসার বেটন হাতে পায়চারি করছেন।

আমার গাড়ি গেটে পৌঁছুলে দারোয়ান গেট খুলল না। সিকিউরিটির উর্দিপরা কয়েকজন লোক গেটের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। তখনই পুলিশ অফিসার বেটন তুলে তাদের ধমক দিলেন। তারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সরে দাঁড়াল। গেটও খুলে গেল।

বেরিয়ে যাবার পর কর্নেলের নির্দেশে গাড়ি দাঁড় করালুম। সেই পুলিশ অফিসার কাছে এসে বললেন–ব্যাপার কী স্যার?

কর্নেল একটু হেসে বললেন–তেমন কিছু না। অলক! তুমি এ থানায় এসেছ জানতুম না!

–সবে এসেছি স্যার! দু-সপ্তাহ আগে।

–ঠিক আছে। আমার কাজ শেষ। তুমি থানায় ফিরে যাও। ও সি গণেশবাবুকে বলবে, আমি তার সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছি।…

যেতে যেতে বললুম–মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। আপনার এই আয়োজন–আর অধ্যাপক ভদ্রলোকের ফোটো ভোলা ব্যাপারটা কী? আর অধ্যাপকই বা আপনার সঙ্গে অভদ্র ব্যবহার করছিলেন কেন?

কর্নেল বললেন–মাথা থেকে ব্যাপারটা বের করে দাও। আমাদের জীবদ্দশায় বাড়ি ফিরতে হবে।

তার মানে?

–আঃ জয়ন্ত! ঠাণ্ডা মাথায় গাড়ি ড্রাইভ না করলে অ্যাকসিডেন্ট বাধাবে যে!….

কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে সোফায় ধপাস করে বসে বললুম–আপনার সংসর্গে অনেক জ্ঞানীগুণী বিখ্যাত মানুষকে দেখেছি। কোনো কলেজের একজন বিজ্ঞানশিক্ষকের এমন আচরণ দেখে আমার সত্যিই বড় অবাক লেগেছে।

কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে ষষ্ঠীচরণকে কফি আনতে বললেন। তারপর হেলান দিয়ে চোখ বুজে ধ্যানস্থ হলেন। আমার কথা তার কানে গেল কি না জানি না। একটু পরে ষষ্ঠীচরণ কফি আর স্ন্যাক্সসহ ট্রে এনে সেন্টারটেবিলে রাখল। মৃদুস্বরে সে বলল–কফি বাবামশাই!

কর্নেল চোখ খুলে সোজা হলেন। তারপর কফির পেয়ালা তুলে চুমুক দিয়ে বললেন–কেউ ফোন করেছিলেন?

ষষ্ঠী সবে পা বাড়িয়েছিল, ঘুরে দাঁড়িয়ে জিব কেটে বলল-ওই যাঃ! বলতে ভুলেছি।

–ভুলবিই তো! টি ভি-তে ক্রিকেট খেলা দেখছিলি।

–আজ্ঞে বাবামশাই, এক ভদ্রলোক ফোন করেছিলেন। নাম বললেন না। নম্বর চাইলুম। বললেন, ছটার পর আবার ফোন করব।

–বেরো! ক্রিকেট খেলা দ্যাখ গে!

ষষ্ঠী কাচুমাচু মুখে চলে গেল। আমি বললুম–হঠাৎ অধ্যাপক সিংহের ফোটো তুললেন কেন, তা জানতে পারি?

কর্নেল একটু হেসে বললেন–যে আমাকে দেখে সি বি আই অফিসার বলে সন্দেহ প্রকাশ করছে, কোনো অজানা কারণে তার কোনো বিষয়ে দুর্বলতা আছেই। অতএব তাকে আরও ভড়কে দিতে ফোটো তুলতেই হল।

–শুধু ভড়কে দিতে বলে মনে হচ্ছে না!

–জয়ন্ত! ক্যামেরায় লোড করা ফিমে আর একখানা মাত্র ছবি তোলা যেত। তাই সেটা কাজে লাগিয়েছি।

–ভদ্রলোকের চেহারা, চুলের কেতা দেখে সিনেমার হিরো মনে হচ্ছিল।

–কলেজে নিউক্লিয়ার ফিজিক্স পড়ান বলে একটু রূপচর্চা করবেন না?

—নিউক্লিয়ার ফিজিক্স? পারমাণবিক পদার্থবিদ্যা? আপনি কী করে জানলেন?

জয়ন্ত! কেন যে তুমি সাংবাদিক হয়েছ, বুঝি না। চোখ! চোখের চেয়ে শক্তিমান ইন্দ্রিয় মানুষের নেই। র‍্যাকের মাথায় বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা সেমিনারে ওঁর বক্তৃতা দেওয়ার একটা ছবি ছিল। র‍্যাকটা ছিল সোফার পাশেই। ছবির তলায় ওঁর বক্তৃতার বিষয় ছাপা ছিল বোল্ড টাইপে। আশ্চর্য! ইনিও লেখেন এ কে সিনহা। তবে গোড়ায় প্রোফেসর শব্দটা থাকে। এই যা তফাত।

বুঝলুম! তা এমন একজন বিজ্ঞানী কলেজে পড়ে আছেন কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার যোগ্যতা তার তাহলে অবশ্যই আছে।

–তা নিয়ে আমার তদন্ত করার সময় নেই। শুধু এটুকু অনুমান করতে পারো, ওঁর জীবনে কোনো ব্ল্যাক স্পট থাকা সম্ভব।

ভদ্রলোক অমন একটা অ্যাপার্টমেন্টে বাস করেন। পশ এরিয়া। ঘরে ঢুকে মনে হচ্ছিল ইউরোপ আমেরিকার কোনো ধনী লোকের ঘরে বসে আছি। পা দেবে যাওয়া দামি কার্পেট! আর ওইসব আসবাবপত্র! কলেজের মাইনে থেকে এভাবে উপরে ওঠা যায় না। হা–আপনি ওঁর ব্যক্তিগত ল্যাবরেটরির কথা জানলেন কোন সূত্রে?

কর্নেল হাসলেন।–নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে যাঁর ডিগ্রি আছে এবং যার আর্থিক অবস্থা এত সচ্ছল, তার একটা পার্সোন্যাল ল্যাব থাকবে না এ যুগে?

–কিন্তু কর্নেল. কলেজে কি নিউক্লিয়ার ফিজিক্স পড়ানো হয়?

—সায়েন্স কলেজে অবশ্যই হয়।

–তাহলে সায়েন্স কলেজে খোঁজখবর নিলেই তো ওঁর সম্পর্কে সব খবর জানা যাবে।

দেখা যাক।

কলকাতায় ফ্যান ঘুরলেও প্রকৃতির খাতায় দিনের দৈর্ঘ্য কমে এসেছে। ষষ্ঠীচরণ এসে আলো জ্বেলে দিয়ে গেল। কর্নেল আবার ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে। চোখ বুজে ধ্যানমগ্ন হলেন।

কিছুক্ষণ পরে টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল সিধে হয়ে বসে রিসিভার তুলে নিলেন। তারপর কার সঙ্গে অন্তত পাঁচ মিনিট ধরে কথাবার্তা হল কিছু বুঝতে পারলুম না। কর্নেল গলার ভিতরে হুমহাম করে কী বলছিলেন। তারপর রিসিভার রেখে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন–এক ভদ্রলোকের ফোন।

-ষষ্ঠী যাঁর কথা বলছিল?

–হ্যাঁ। নাম বললেন না। কণ্ঠস্বর আর কথাবার্তা শুনে মনে হল শিক্ষিত। আমি বরমডিহায় যাব, সে-খবর উনি জানেন। আমি সেখানে গেলে নরবানর আমাকে তুলে ছোটোনাগপুর পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় ছুঁড়ে ফেলবে। অতএব আমি যেন সেখানে না যাই এবং এ কে সিনহার কেসে নাক না গলাই! অর্থাৎ একখানা হুমকি।

 চমকে উঠেছিলুম হুমকি শব্দটা শুনে। বললুম–তাহলে নরবানরের পিছনে একটা দুষ্টচক্র আছে?

কর্নেল তুম্বো মুখে বললেন–যাইহোক, আমি যে সঠিক পথে পা ফেলছি তাতে ভুল নেই।…

.

ত্রিভুজের আত্মপ্রকাশ

আমরা বরমডিয়া স্টেশনে পৌঁছেছিলুম পরদিন সোমবার রাত সাড়ে নটায়। একটা হিলস্টেশন বলা যায়। কর্নেলের পরামর্শে গরম পোশাক নিয়েছিলুম সঙ্গে। কিন্তু প্ল্যাটফর্মে পা দিয়েই মনে হচ্ছিল হাতে দস্তানা পরা উচিত ছিল। কনকনে ঠাণ্ডায় শরীর যেন নিঃসাড়।

প্ল্যাটফর্ম জনশূন্য। ট্রেন থেকে শুধু আমরা দু-জন যাত্রীই নেমেছিলুম। টিকিট নেওয়ার জন্য গেটে কেউ ছিল না। বুঝতে পারছিলুম, নরবানরের ভয়ে লোকেরা যে-যার ঘরে ঢুকে পড়েছে। স্টেশন সংলগ্ন ছোট্ট বাজারটা বন্ধ এবং জনহীন। বিদ্যুতের আলো কুয়াশায় ঢাকা। দুধারে অজস্র সাইকেল-রিকশ আর ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তাদের চালকরা নেই। বেচারা শীতার্ত ঘোড়াগুলো ছবিতে আঁকা ঘোড়ার মতো স্থির। তার মালিকরা নরবানরের হামলা ওই চারঠেঙে প্রাণীগুলোর উপরই হোক, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে কোথায় আত্মগোপন করে আছে কে জানে!

গেটের বাইরে গিয়ে কর্নেল থমকে দাঁড়ালেন। বললুমকোথায় আপনার পাদ্রিবন্ধু? আপনি বলেছিলেন, উনি গাড়ি নিয়ে স্টেশনে থাকবেন!

কর্নেলের গায়ে ওভারকোট। মাথায় টুপি। পিঠে তার কিটব্যাগ–যার মধ্যে ক্রুড্রাইভার থেকে পেরেক, দড়ি থেকে জাঙ্গল নাইফ–মানুষের জীবনে ছোটোখাটো যা কিছু লাগে, সবই আছে। গলা থেকে ঝুলছে ক্যামেরা আর বাইনোকুলার। কিটব্যাগ থেকে প্রজাপতিধরা জালের স্টিক বেরিয়ে আছে। তার সেই চিরাচরিত মূর্তি কুয়াশামাখা আবছা আলোয় যেন এক ভাস্কর্য।

কর্নেল আমার কথার জবাব দিলেন না। ওভারকোটের পকেট থেকে একটা চুরুট বের করে লাইটার জ্বেলে ধরালেন। তারপর আপনমনে বললেন–এসে যাবেন। কোনো কারণে দেরি হয়েছে।

স্টেশনবাজারের পিছনে কালো-কালো টিলায় আমি ততক্ষণে নরবানর খুঁজতে শুরু করেছি, তার একমাত্র কারণ উদ্বেগ। এই পাহাড়ি এলাকায় এমন ঠাণ্ডাহিম রাত্রে পায়ে হেঁটে যাওয়া বড় কষ্টকর।

কিছুক্ষণ পরে কর্নেল বলে উঠলেন–আশা করি ফাদার হফম্যান এতক্ষণে আসছেন। ডানদিকে পাহাড়ের গায়ে ওঁর গাড়ির আলো দেখা যাচ্ছে। ওই দেখ!

দূরে অন্ধকারে কুয়াশার মধ্যে দুটো আলো জুগজুগ করছিল। আলোদুটো এবার অদৃশ্য হল। কিছুক্ষণ পরে হিমরাত্রির নৈঃশব্দ চুরমার করে ঘর্ঘর গর্গর শব্দ করতে করতে আমাদের সামনে একটা গাড়ি এসে থামল। গাড়িটা দেখে মনে হল জাদুঘরে রাখা ভিন্টেজ কার। গাড়ি থেকে কর্নেলের মতো তাগড়াই চেহারার এক পাদ্রিসায়েব নেমে কর্নেলের দিকে হাত বাড়িয়ে বাংলায় বললেন প্রিয় বন্ধু কর্নেল সরকারের কুশল কামনা করি! দেরির জন্য দুঃখিত। মউলি জলপ্রপাতের কাছে আমার প্রিয় অস্টিন কিছুক্ষণের জন্য থেমে গিয়েছিল।

কর্নেল বললেন–তা অনুমান করেছিলুম। এমন শীতের রাত্রিতে ইঞ্জিন গণ্ডগোল করতেই পারে।

–উঠুন! উঠুন! বলে ফাদার হফম্যান আমার সঙ্গে করমর্দন করলেন। — আপনি কর্নেল সরকারের তরুণ বন্ধু জয়ন্ত চৌধুরি। কেমন? ঠিক বলেছি না?

পাদ্রিসয়েবকে বেশ আমুদে মানুষ মনে হল। সামনের সিটে কর্নেল তার পাশে বসলেন। আমি কর্নেল এবং আমার লাগেজ নিয়ে পিছনে বসলুম। গাড়ি স্টার্ট দেওয়াই ছিল। যখন চলতে শুরু করল, ঝাঁকুনিতে সে এক অস্থির অবস্থা। যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। আর তেমনই বিকট গর্জন।

কর্নেলের সঙ্গে ফাদারের কথাবার্তা একটুও শোনা যাচ্ছিল না। তারপর লক্ষ করলুম, বরমডিহা শহর বাঁদিকে পূর্বে রেখে আমরা চলেছি দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। কিছুদূর চলার পর ছোট্ট একটা নদীর ব্রিজ পেরিয়ে এবার সোজা দক্ষিণে গাড়ি চলল। পিচের রাস্তাটা তত মসৃণ নয়। ডানদিকে পশ্চিমে অসমতল প্রান্তরের আভাস পাচ্ছিলুম। বাঁদিকে নদী। নদীর ওপারে উঁচুতে অজস্র আলো জুগজুগ করছিল। আরও কিছুদূর চলার পর দু-ধারে অন্ধকারে ঘন জঙ্গল এবং চড়াই উতরাই পুনঃপুনঃ। তারপর আবার সেই নদীর ব্রিজ। কিন্তু এই ব্রিজটা চওড়া আর মসৃণ। এতক্ষণে কানে এল, কর্নেল বলছেন-রাঁচি যাওয়ার হাইওয়ে তৈরি হয়ে গেছে দেখছি।

ফাদার হফম্যান বললেন–হ্যাঁ। আমার মিশনের পক্ষে খুব সুবিধা হয়েছে।

–আপনি চেষ্টা না করলে হত না।

–সদাপ্রভুর ইচ্ছা কর্নেল সরকার। আমি সামান্য মানুষ।

–আপনার মিশন এরিয়া ওইটে না?

–হ্যাঁ। ওই যে গাছের ফাঁকে আলো দেখছেন!

 এবার গাড়ি বাঁদিকে উত্তরে সংকীর্ণ একটা রাস্তায় ঘুরল। তারপর চড়াই শুরু হল। একটু পরে বাঁদিকে একটা টিলার গায়ে আলো দেখা গেল। ফাদার পিছনে মুখ ঘুরিয়ে সহাস্যে আমাকে বললেন–জয়ন্তবাবুর জন্য সুসমাচার। নতুন সরকারি বাংলোর দোতলায় উৎকৃষ্ট সুইট আদায় করতে পেরেছি।

বললুম–ধন্যবাদ ফাদার!

টিলার গায়ে ঘুরে ঘুরে গাড়ি উঠে যাচ্ছিল। তারপর অপেক্ষাকৃত সমতল জায়গায় বাংলোর গেটের সামনে পৌঁছে ফাদার তার গাড়ির সেকেলে ভেঁপু বাজালেন। দারোয়ান সেলাম ঠুকে গেট খুলে দিল। লক্ষ্য করলুম, দু-জন সশস্ত্র প্রহরী কাঠের ছোট্ট ঘরে টুলে বসে আছে।

উজ্জ্বল আলোয় সুদৃশ্য লন এবং ফুলবাগান দেখা যাচ্ছিল। পোর্টিকোর নীচে গাড়ি থামলে আমরা নেমে গেলুম। দুটি উর্দিপরা লোক সেলাম ঠুকল। একজন আমার কাছ থেকে লাগেজ নিল। অন্যজন কাঁচের দরজা খুলে দিল। বাংলোর কেয়ারটেকার নমস্তে করলেন। ফাদার বললেন–প্রসাদজি! ইনিই সেই কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। ইনি একজন সাংবাদিক। শ্ৰীমান জয়ন্ত চৌধুরি।

প্ৰসাদজিও আমাদের সঙ্গে দোতলায় উঠলেন। দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ডাবলবেড স্যুইটে ঢুকে আরাম পেলুম। ফায়ার প্লেস আছে। মেঝেয় কার্পেট আছে। পরিচ্ছন্ন ঘর। জানালাগুলোতে দামি পর্দা ঝুলছে। প্রসাদজি বললেন–ডিনার রেডি স্যার!

কর্নেল একটু হেসে বললেন–তার আগে কফি পাওয়া যায় না?

জরুর। প্লিজ ওয়েট আ পিট।

 প্রসাদজি এবং সেই উর্দিপরা লোকটি চলে যাওয়ার পর ফাদার হফম্যান বললেন আমার গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে রেখেছি। আমাকে এখনই ফিরতে হবে। কর্নেল সরকার যখন প্রয়োজন তখনই যোগাযোগ করবেন। এখন চলি!

ফাদার হফম্যান যাওয়ার পর বললুম–নরবানর সম্পর্কে ফাদার কী বলছিলেন আপনাকে? গাড়ির বিকট শব্দে বুঝতে পারছিলুম না।

 কর্নেল আস্তে বললেন–আদিবাসীদের গ্রাম করমডিহার কাছে একটা পুরোনো ফরেস্ট বাংলো আছে। সেখানে এক যুবক এবং এক যুবতি হনিমুনে এসেছিল। নরবানরকে তারাই দেখে করমডিহায় দৌড়ে গিয়েছিল। তারপর জোর গুজব রটে যায়। আদিবাসীদের কেউই প্রাণীটাকে দেখেনি। তারা সরল মানুষ। দেখতে পেলে নিশ্চয়ই বলত। তারপর বরমডিহার একজন কাঠব্যবসায়ী ওই জঙ্গলে গিয়েছিলেন। তিনি প্রাণীটাকে দেখে পালিয়ে আসেন। গুজব ক্রমে বাড়তে থাকে। গত সপ্তাহে বরমডিহা শহরেও কিছু কিছু লোক নরবানরকে নাকি দেখতে পায়। এরপর পুলিশবাহিনী এলাকা তোলপাড় করে। একজন পোস্টম্যান চিঠি বিলি করে সাইকেলে ফিরছিল। বরমডিহার কাছে জঙ্গলে সে নরবানরটাকে দেখে সাইকেল ফেলে পালিয়ে আসে। সে থানায় খবর দেয়। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। পুলিশ সেখানে গিয়ে দেখে, পোস্টম্যানের সাইকেল আছাড় মেরে কেউ ভাঙার চেষ্টা করেছে। চাকা বেঁকে গেছে। পুলিশবাহিনী জঙ্গলে ঢুকে ওত পেতে বসেছিল। রাত দশটা নাগাদ একজন কনস্টেবল টর্চের আলো ফেলে নাকি প্রাণীটাকে দেখতে পায়। সঙ্গে সঙ্গে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। কিন্তু নরবানরের পাত্তা পাওয়া যায়নি। ফাদার হফম্যানের মতে, কনস্টেবলের চোখের ভুল। এটা সম্পূর্ণ সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার। জঙ্গলে আলোছায়ায় নরবানরের কল্পনা বিভ্রম সৃষ্টি করতেই পারে।

বললুম–লোম বা অন্য কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি?

–রাত্রে কিছু পাওয়া যায়নি। সকালে একদল আদিবাসী মেয়ে মলি নদীর বালির চড়ায় অস্বাভাবিক গড়নের পায়ের ছাপ দেখতে পেয়েছিল। খবর পেয়ে রাঁচি থেকে ফোরেনসিক এক্সপার্টরা এসে সেই ছাপ তুলে নিয়ে গেছেন। বিশেষ টাস্কফোর্স এসে ফরেস্ট বাংলোয় ডেরা পেতেছে।

এই সময় বন্ধ দরজায় টক টক শব্দ হল। কর্নেল বললেন–কাম ইন!

একজন পরিচারক ট্রেতে কফি আনল। কর্নেল তাকে বললেন–আমরা আধঘণ্টা পরে ডিনার খাব।

সেলাম ঠুকে সে চলে গেল। কফিতে চুমুক দিয়ে চাঙা হয়ে বললুম–আমি এবার অন্য কথা ভাবছি। এই বাংলোয় থাকা এবং খাওয়াদাওয়ার খরচ তো অনেক টাকা

আমার কথায় বাধা দিয়ে কর্নেল মুচকি হেসে বললেন– আমরা সরকারি অতিথি। চিন্তা করো না। ফাদার হফম্যানের মাধ্যমে এই ব্যবস্থাটা হয়েছে। নরবানরের রহস্য ফাঁস করার জন্য আমি এসেছি। না–নিজে থেকে আসিনি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের নির্দেশে ঝাড়খণ্ড সরকার আমাকে আমন্ত্রণ করে এনেছেন। এটাই মোদ্দা কথা।

–বাঃ! আপনি হোমওয়ার্ক করেই এসেছেন। আমাকে বলেননি তো!

এবার বললুম। তুমি গতরাত্রে তোমার সল্টলেকের ফ্ল্যাটে ফিরে যাওয়ার পর আজ দুপুর অবধি আমি এই হোমওয়ার্ক সেরে নিয়েছিলুম! তবে মনে রেখো, ওটা আমাদের ভিতরকার পরিচয়। আমাদের বাইরের পরিচয়, আমরা যা, তা-ই। অর্থাৎ আমি প্রকৃতিবিজ্ঞানী। তুমি সাংবাদিক।

–ফাদার আমাদের ওই পথে আনলেন কেন? শহরের মধ্য দিয়ে তো আসা যেত!

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন–ওই পথে আসবার কারণ, যদি সত্যিই নরবানরের দেখা আমরা পেয়ে যাই! প্রস্তাবটা ছিল আমারই। কারণ কলকাতায় উড়ো ফোনে লোকটি বলছিল, বরমডিহা গেলে নরবানর আমাকে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় ছুঁড়ে ফেলবে তাই চান্স নিয়েছিলুম। কিন্তু দেখা গেল, তেমন কিছু ঘটল না।

আঁতকে উঠে বললুম–সর্বনাশ! বড্ড বেশি ঝুঁকি নিয়েছিলেন!

কর্নেল চুপচাপ কফিতে চুমুক দিতে থাকলেন। মাঝে মাঝে লক্ষ্য করেছি, কর্নেল আমার কাছে যেন দূরের মানুষ হয়ে যান। এ মুহূর্তেও তাকে সেইরকম মনে হচ্ছিল।

তারপর কিছু প্রশ্ন আমার মাথায় এসে গেল। নিউ আলিপুরে অধ্যাপক অরিন্দম সিংহের ছবি হঠাৎ করে ক্যামেরায় তোলার দুটো কারণ উনি দেখিয়েছিলেন। অধ্যাপক সিংহকে একটু ভড়কে দেওয়া এবং কর্নেলের ক্যামেরায় লোডকরা ফিমে নাকি মাত্র আর একটা ছবিই তোলা যেত। সত্যিই কি তা-ই? ওদিকে প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদারকে ওইভাবে দিল্লি আর গুজরাটের শাহাবাদে পাঠানোর আসল উদ্দেশ্যটা কী? হালদারমশাই দিল্লির মতো বিশাল শহরে জনৈক জয়সোয়লতে কী করে খুঁজে বের করবেন? শাহাবাদ সেই তুলনায় ছোটো জায়গা। কিন্তু সেখানে তিনি কী করে যাবেন এবং জনৈক ভজনলালকে কী করে খুঁজে বের করবেন? বরাবর দেখে আসছি, এই প্রাক্তন পুলিশ অফিসার ভদ্রলোক খুব হঠকারী স্বভাবের মানুষ এবং একগুঁয়ে। কতবার নিজেই বিপদে পড়েছেন এবং কর্নেল তাকে উদ্ধার করেছেন। কিন্তু এই কেসে কোথায় দিল্লি, কোথায় শাহাবাদ আর কোথায় এই বরমডিহা! সত্যিই একটা ত্রিভুজ আঁকা যায়। এই তিনটে জায়গা নিয়ে। সমস্যা হলহালদারমশাইকে ত্রিভূজ পরিক্রমা করাতে গিয়ে কর্নেলকে দিল্লি বা. শাহাবাদে পাড়ি জমাতে হলে আমাকেও তিনি ল্যাজে বাঁধবেন এবং আমার অবস্থা হবে শোচনীয়। হা–দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার চিফ অফ দ্য নিউজব্যুরো সত্যদাকে আমি ফোনে জানিয়ে এসেছি, কোথায় কী কারণে যাচ্ছি এবং কার সঙ্গে যাচ্ছি। সত্যদা অন্যান্যবারের মতো উৎসাহ দিয়ে বলেছেন, টাকার দরকার হলে জানাবে। চিফ এডিটরকে বলে টাকার ব্যবস্থা করে পাঠিয়ে দেব। নরবানরের জবর খবর পাবলিক খুব খাবে! মনে রেখো, এক্সকুসিভ রিপোর্ট ছাপব আমরা।

কর্নেলের ডাকে সম্বিৎ ফিরল।–জয়ন্ত! ডিনার ঘরেই দিয়ে যেতে বলছি। তুমি পোশাক বদলে নাও। বাথরুমে গিজার আছে নিশ্চয়। গরম জল পাবে।

বলে তিনি হাত বাড়িয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন।…

ট্রেনজার্নির ক্লান্তি আর কম্বলের স্নিগ্ধ ওমে ঘুমটা গম্ভীর হয়েছিল। ঘুম ভেঙেছিল কারও ডাকাডাকিতে। তাকিয়ে দেখি, সকাল হয়েছে এবং উর্দিপরা পরিচারক চায়ের কাপ-প্লেট হাতে খোলা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। কর্নেলের বিছানা খালি। বুঝতে পারলুম, উনি অভ্যাসমতো প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছেন এবং যাবার সময় আমাকে বেড-টি দিতে বলে গেছেন। দেয়াল ঘড়িতে সাতটা বাজে। কর্নেল আবার আমার কাছের মানুষ হয়ে গেলেন।

বিছানায় উঠে বসে চা নিলুম। জিজ্ঞেস করলুম-তোমার নাম কী?

পরিচারক সেলাম দিয়ে বলল–স্যার! হামি বাবুরাম আছি। ছে-সাত বরষ আগে হামি কলকাত্তায় ছিল। থোড়াসা বাংলা জানি।

–আচ্ছা বাবুরাম! বরমডিহাতে নাকি বনমানুষ দেখা গেছে?

বাবুরাম মুখে ভয়ের ছাপ ফুটিয়ে বলল–উও তো কালা দেও আছে স্যার! হামি শুনেছে, কোই খতরনাক আদমি কালা দেও সাথে বিয়ে কঁহা-হা মুলুকে যাচ্ছে। আর যার উপর তার রাগ আছে, তার কলকারখানা লুঠ করছে।

বুঝলুম, কালা দেও মানে কালো দৈত্য। বললুম–শুনেছি, এখানে এক বাঙালি সায়েবের কারখানা নাকি কালা দেও লুঠ করেছে?

– হ্যাঁ স্যার। সিনহসাব আছেন উনি। ক্রৌড়পতি আছেন। লেকিন বহুত ধান্দাবাজ!

-কেন? কী করেন তিনি?

 বাবুরাম চাপা স্বরে বলল–হামি গরিব আমি আছি স্যার! কোই শুনে লিবে তোতা আমার জান যাবে।

কাউকেও বলব না। বলো!

–স্যার! উনহির কারখানাতে হামার ভাতিজা কাম করে। তার কাছে শুনেছি, ওহি বাঙালিসাব কোই ছুপা কারবার করে। ঝাড়খণ্ড মুলুকে বড়া বড়া ডাকু আছে। তাদের খতরনাক হাতিয়ার, রাইফেল পিস্তল রিভলবার সবকুছ সাপ্লাই করে সিনহাসাব। পুলিশ কি জানে না কুছু? সব জানে।

বারান্দায় কেউ যেতে যেতে ডাকল–হোই বাবুরাম! পরসাদজি তুঝে বোল রাহা।

বাবুরাম ইশারায় আমাকে মুখ বন্ধ রাখতে বলে আবার সেলাম ঠুকে বেরিয়ে গেল। বুঝলুম, বাবুরাম সেই ধরনের লোক, যারা কিছু সত্য বা মিথ্যা খবর হজম করতে পারে না। একটু মিঠে কথায় গলে গিয়ে খবরটা উগরে দিয়ে আরাম পায়। যাইহোক, কর্নেল ফিরলে কথাটা বলতে হবে। এ কে সিনহার আগ্নেয়াস্ত্রের চোরা কারবার আছে বলে গেল বাবুরাম। সত্যি না মিথ্যা, জানা উচিত কর্নেলের।

চা খেয়ে বাথরুম সেরে রাতের পোশাক বদলে নিলুম। প্যান্ট-শার্ট-সোয়েটার জ্যাকেট পরে বারান্দায় গেলুম। কুয়াশামাখা রোদে সে এক অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপ। দূরে নীল পাহাড়, কাছে এদিকে-ওদিকে টিলার গায়ে রঙিন বাড়ি, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা এবং অদূরে হাইওয়ে দেখা যাচ্ছিল।

কিন্তু বেশিক্ষণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা গেল না। টিলার গায়ে এই সরকারি বাংলোর দোতলার বারান্দায় ঠাণ্ডাহিম হাওয়ার প্রচণ্ড উপদ্রব। ঘরে ঢুকে পড়লুম।

কর্নেল ফিরলেন সওয়া আটটা নাগাদ। অভ্যাসমতো বললেন–মর্নিং জয়ন্ত! আশা করি স্বপ্নে কোনো নরবানরের পাল্লায় পড়নি।

বললুম–না। তবে একটু আগে কালা দেও অর্থাৎ কালো দৈত্যের পাল্লায় পড়েছিলুম।

কর্নেল পিঠের কিটব্যাগ, বাইনোকুলার আর ক্যামেরা টেবিলে রেখে বললেনকালে দৈত্যের পাল্লায় আমিও পড়েছিলুম।

চমকে উঠে বললুম–তার মানে?

–তুমি যেভাবে পড়েছিলে! কর্নেল আরামকেদারায় বসলেন। হ্যাঁ, স্থানীয় সাধারণ মানুষজন প্রাণীটাকে কালা দেও আখ্যা দিয়েছে। গুজব খুব সাংঘাতিক মারিজীবাণু জয়ন্ত! তবে আমার ধারণা, তুমি বাংলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে কালো দৈত্যটিকে খুঁজছিলে!

হেসে ফেললুম।–আপনি বাইনোকুলারে আমাকে বারান্দায় দেখেছিলেন। তবে না–কালো দৈত্যের পাল্লায় সরাসরি আমি পড়িনি। বাংলোর পরিচারক আমাকে …

আমাকে থামিয়ে দিয়ে কর্নেল বললেন–বাবুরামকে তোমার বেড-টি পাঠাতে বলার সময় সে আমাকে কালা দেও সম্পর্কে সাবধান করে দিয়েছিল। লোকটি রোম্যান্টিক স্বভাবের।

এবার চাপা স্বরে বাবুরামের কাছে শোনা এ কে সিনহার চোরাকারবারের কথা কর্নেলকে বললুম। কর্নেল কোনো মন্তব্য করলেন না। চুপচাপ শুধু শুনলেন। ইতিমধ্যে কফি আর স্ন্যাক্স নিয়ে আবার বাবুরাম এলো এবং আমার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেল।

কফি পান করতে করতে কর্নেল বললেন–সেই ফরেস্ট বাংলোয় গিয়েছিলুম। টাস্কফোর্স অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঘাঁটি গেড়েছে। তারা পাহাড়ি জঙ্গলগুলোতে কম্বিং অপারেশন চালাচ্ছে শুনলুম। কমান্ড্যান্ট শিবপ্রসাদ আমাকে প্রথমে ফাদার হফম্যানের মতো বিদেশি পাদ্রি ভেবেছিলেন। আমার নেমকার্ড দেখে সেলাম দিলেন। কিছু খোঁজখবর পাওয়া গেল। কাজে লাগতে পারে।

জিজ্ঞেস করলুম–নরবানরের খোঁজখবর নয় তো?

কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন–ফেরার পথে ফাদার হফম্যানের ঘর থেকে ফরেস্ট অফিসের রেঞ্জারকে ফোন করেছিলুম। পুরোনো ফরেস্ট বাংলোয় যে দম্পতি ছিল, তারা বাঙালি। কলকাতা থেকে হনিমুনে এসেছিল। মিঃ এ কে সিনহার সুপারিশে তাদের ওই বাংলোয় থাকতে দেওয়া হয়েছিল।

–তাহলে তারা মিঃ সিনহার চেনা লোক!

–হ্যাঁ। সুশান্ত রায় আর মালবিকা রায়। তারা নরবানর দেখে ভয় পেয়ে পালিয়ে এসেছিল। এটা বৃহস্পতিবার রাত্রের ঘটনা। মিঃ সিনহার বাংলোয় তারা সে-রাত্রে ছিল। মিঃ সিনহা এবং রেঞ্জারসায়েব দু-জনেই থানায় খবর দেন। পুলিশবাহিনী ফরেস্ট বাংলোয় ছুটে যায়। এদিকে মিঃ সিনহা রায়দম্পতিকে হোটেল সানশাইনে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। শুক্রবার নরবানরের খবর বরমডিহাতে রটে যায়। ওদিকে আদিবাসী গ্রাম করমডিহাতেও মউলি নদীর বালির চড়ায় অস্বাভাবিক পায়ের ছাপ নিয়ে হইচই বাড়তে থাকে। তার ফলে বুঝতেই পারছ, সন্ধ্যার আগেই বরমডিহা জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে। রাত্রে মিঃ সিনহার গোডাউনে ডাকাতি হয়।

–এসব তো জানা কথা। নতুন কী জানতে পেরেছেন?

হোটেল সানশাইনে টেলিফোন করে খোঁজ নিলুম, রায়দম্পতি শনিবার সকালে চেক আউট করেছিল। তাদের বিল মেটানোর কথা মিঃ সিনহার। হোটেল তার কাছে আজ বিল পাঠাবে।

–মিঃ সিনহা কেন এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটা আপনাকে জানাননি?

–হয়তো দরকার মনে করেননি। কর্নেল চুরুট ধরিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে ফের বললেন–ওঁকে ফাদার হফম্যানের ঘর থেকে ফোনে জানিয়েছি, আমরা এসে পৌঁছেছি। সরকারি বাংলোয় আছি। উনি যেন শিগগির দেখা করেন।…

আমরা নটায় ব্রেকফাস্ট করার পর কেয়ারটেকার প্রসাদজি নীচের অফিস থেকে টেলিফোনে খবর দিলেন, মিঃ এ কে সিনহা গাড়ি পাঠিয়েছেন। ওঁর ড্রাইভার বলেছে সায়েব জরুরি কাজে ব্যস্ত আছেন। কর্নেলসায়েব যদি দয়া করে তার বাড়ি যান, তিনি খুশি হবেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা নীচে গেলুম। উর্দিপরা ড্রাইভার সেলাম দিয়ে বিনীতভাবে বলল, তার সায়েব খুব ব্যস্ত। কর্নেলসাব যেন কিছু মনে না করেন।

বিদেশি গাড়ি। ভিতরে হিটিং ব্যবস্থা আছে। চড়াই-উতরাই এবং সমতল রাস্তায় গাড়িটা নিঃশব্দে এগোচ্ছিল। মিনিট পনেরো পরে সরকারি বাংলোর মতোই একটা টিলার গায়ে একটা সুদৃশ্য বাংলোবাড়ির গেট দিয়ে ঢুকে পোর্টিকোর তলায় গাড়ি থামল।

গাড়ির জানালার নীলচে কাঁচ এতক্ষণ বাইরের সবকিছু আবছা করে রেখেছিল। একটা লোক দরজা খুলে দিলে আমরা নামলুম। সে আমাদের সুসজ্জিত বসার ঘরে নিয়ে গেল। তার চেহারা এবং পোশাকে স্মার্টনেস আছে। কর্নেল তাকে বললেন–হয়তো ভুল করছি না। আপনিই কি প্রদোষ সেন?

–হ্যাঁ স্যার। প্লিজ, আমাকে তুমি বললে খুশি হব। আপনারা একটু বসুন। সিনহাসায়েব এখনই এসে যাবেন।

সে পর্দা তুলে একটা ঘরে ঢুকে গেল। একমিনিট পরে অনিমেষকান্তি সিংহ সেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নমস্কার করে কর্নেলের মুখোমুখি বসলেন। বললেন–আমি কোম্পানির পার্টনারদের সঙ্গে কাল থেকে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। কিছুক্ষণ আগে তাদের পেয়ে গিয়েছি। তাদের সঙ্গে কথা বলছিলুম। কর্নেলসায়েবের কোনো অসুবিধে হয়নি তো?

 কর্নেল বললেন–একটুও না। ফাদার হফম্যান কেমন মানুষ, তা তো আপনি জানেন!

–আপনি কফির ভক্ত। আগে কফি খেয়ে নিন।

কফির আগে জরুরি কথাটা বলে নিই। কলকাতা থেকে সুশান্ত রায় এবং মালবিকা রায় এখানে বেড়াতে এসেছিল। আপনি তাদের পুরোনো ফরেস্ট বাংলোয় থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। তাই না?

লক্ষ্য করলুম, মিঃ সিনহা যেন একটু বিব্রত বোধ করছেন। তিনি বললেন– হ্যাঁ। সুশান্ত আমার পিসতুতো দাদার ছেলে। বিয়ের পর হনিমুনে এসে আমার বাংলোয় থাকতে চেয়েছিল। এখানে থাকার অসুবিধে ছিল। তাছাড়া ওদের নির্জনতা দরকার হতে পারে। এই ভেবে আমি পুরোনো ফরেস্ট বাংলোয় থাকার ব্যবস্থা করেছিলুম।

–নরবানরের ভয়ে তারা পালিয়ে আসার পর আপনি তাদের হোটেল সানশাইনে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। আপনিই বিল মেটানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন।

–কী করব? সুশান্ত একটা সাধারণ চাকরি করে। বুঝতেই পারছেন, ওটা আমার কর্তব্য।

তারা আপনাকে কি না জানিয়েই কলকাতা ফিরে গেছে?

–হ্যাঁ। আমি সুশান্তের এভাবে চলে যাওয়ায় খুব অবাক হয়েছি।

—মিঃ সিনহা! আপনি আমাকে বলেননি আপনার কোম্পানির আরও মালিক আছে!

হকচকিয়ে গিয়ে মিঃ সিনহা বললেন–তখন খুঁটিয়ে বলার মতো মানসিক অবস্থা ছিল না!

কর্নেল তার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন–এবার একটা ত্রিভুজের ব্যাপারে প্রশ্ন করতে চাই। আপনার কোম্পানির তিনটি শাখা। হেড অফিস দিল্লিতে। একটা ব্রাঞ্চ গুজরাটের শাহাবাদে এবং অন্যটা এখানে। আপনার একজন পার্টনারের নাম মহাবীর জয়সোয়াল, অন্যজন ভজনলাল জৈন। তাই না?

মিঃ সিনহা মুখ নামিয়ে শুধু বললেন–হ্যাঁ।

আমি চমকে উঠেছিলুম। কর্নেলের দিকে তাকিয়ে রইলুম। কর্নেল বললেন এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটা আপনি আমাকে কেন জানাননি মিঃ সিনহা?

মিঃ সিনহা আড়ষ্টভাবে চাপা স্বরে বললেন–আসলে আমি শুধু আমার এখানে যা ঘটেছে, সেটুকুই জানানো দরকার মনে করেছিলুম। কিন্তু আপনি কেমন করে আমাদের কোম্পানির ব্যাকগ্রাউন্ড জানলেন কর্নেল সরকার? কে আপনাকে জানাল? ফাদার হফম্যান?

না। আজই আমি অন্য সূত্রে এসব কথা জেনেছি। কলকাতায় কথাটা আপনি বললে আমি অন্য পথে পা বাড়াতুম।

–প্লিজ কর্নেল সরকার! আপনার জানার সূত্রটা যদি বলতেন।

কর্নেল এবার হাসলেন। –সূত্রের কথা জানাতে পারছি না। তবে জয়সোয়াল, জৈন এবং আপনার কোম্পানি যে একই কোম্পানির তিনটি শাখা, সেই খবরটা সম্পর্কে আমার একটু সংশয় ছিল। ভেবেছিলুম, খবরটা যিনি আমাকে দিয়েছেন, তিনি আমাকে ভুল পথে চালাতে চান না তো? আমি কি তার ফাঁদে পা দিয়ে গোলকধাঁধায় ঢুকে হন্যে হব? কিন্তু আপনার কাছে আসার পর আপনি নিজেই মুখ ফসকে বলে ফেললেন, পার্টনারদের সঙ্গে আপনি যোগাযোগের চেষ্টা করছিলেন এবং কিছুক্ষণ আগে যোগাযোগ করতে পেরেছেন। কাজেই বুঝতে পরালুম, আমাকে মিসলিড করা হয়নি।

–আমাকে ক্ষমা করবেন। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে আপনার কাছে। কথাটা গোপন করিনি। আমি শুধু আমার ঘর থেকে চুরি যাওয়া জিনিসটা উদ্ধার করতে চেয়েছিলুম।

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–দিল্লি শাহাবাদ বরমডিহা! এই ত্রিভুজটা এবার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল। এতে আমার সুবিধেই হল। হ্যাঁ–আপনি ফিরে এসে লকার ভেঙে টাকাকড়ি চুরির ব্যাপারে থানায় ডায়ারি করেছেন তো?

মিঃ সিনহাও উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। বললেন–হ্যাঁ। করেছিলুম। কাল পুলিশ এসে তদন্ত করে গেছে। প্রদোষ, দারোয়ান, মালি, মালির বউ এবং গয়ানাথ ঠাকুরকে জেরা করেছে। আমি প্রদোষকে বিশ্বাসী বলে জানি। প্রদোষই জেরার মুখে পুলিশকে বলেছে, শুক্রবার আমার পিসতুতো দাদার ছেলে সুশান্ত আর তার স্ত্রী মালবিকাকে সে আমার বেডরুম থেকে বেরুতে দেখেছিল। দু-জনেই নাকি একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল প্রদোষকে দেখে। সুশান্ত বলেছিল, মামাবাবুর ঘরে মামিমার ছবিটা দেখছিলুম। সুশান্ত আমাকে মামাবাবু বলে।

চলুন! আপনার বেডরুমটা একবার দেখে নিই।

 মিঃ সিনহা ডাকলেন–প্রদোষ!

প্রদোষ সেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল-স্যার!

–তুমি কিচেনে যাও। গয়ানাথকে বলল, গেস্টদের জন্য কফি করতে হবে।

প্রদোষ বেরিয়ে গেল। তারপর মিঃ সিনহা আমাদের তার বেডরুমে নিয়ে গেলেন। তারপর পাশাপাশি দাঁড় করানো দুটো আলমারির একটা দেখিয়ে বললেন–একমিনিট। আলমারিটা খুলে দিই।

তিনি আলমারিটা খুললেন। কর্নেল আলমারির দিকে না তাকিয়ে কার্পেটে ঢাকা মেঝে পরীক্ষার জন্য হাঁটু মুড়ে বসলেন। তারপর আতস কাঁচ বের করে। কার্পেট পরীক্ষা করতে থাকলেন। মিঃ সিনহা তাকে লক্ষ্য করছিলেন। আমি লকারটা দেখছিলুম। লকারের পাল্লাদুটো উঁচু-নিচু হয়ে আছে। কোনো শক্ত জিনিস দিয়ে তালা ভাঙা হয়েছে। দুটো পাল্লায় আঁচড় কাটার দাগ স্পষ্ট। এই সময় কর্নেল এগিয়ে গিয়ে খাটের তলায় একটা পায়ার কাছ থেকে দলা-পাকানো একটুকরো কাগজ কুড়িয়ে নিয়ে ভাঁজ খুলে বললেন মিঃ সিনহা! এটা একটা হাতে আঁকা ম্যাপ। দিল্লি, শাহাবাদ আর বরমডিহার অবস্থান আঁকা আছে। রেখা টেনে একটা ত্রিভুজও আঁকা হয়েছে। বরমডিহার মাথায় টিক দেওয়া হয়েছে। এটা কি আপনি এঁকেছিলেন?

মিঃ সিনহা উত্তেজিত হয়ে বললেন না তো! এটা কেউ এঁকে খাটের তলায় ফেলেছে। কে সে?…..

.

আবার নরবানর!

কর্নেল মিঃ সিনহার প্রশ্নের উত্তরে একটু হেসে বললেন–ত্রিভুজের আড়ালে আরেকটা ত্রিভুজ আছে মনে হচ্ছে।

–একটু খুলে বলুন।

–এখনও যা আমার কাছে স্পষ্ট নয়, তা খুলে বলা যায় না মিঃ সিনহা! বাই দ্য বাই, আপনার বেডরুম কি লক করা থাকে না?

–আমি যখন বাড়িতে আছি, তখন বেডরুম লক করার প্রশ্ন ওঠে না।

–চলুন। কফি খেতে ইচ্ছে করছে।

–একমিনিট! ওই দেখুন! গণেশের মূর্তির তলায় আলমারি খোলার ডুপ্লিকেট চাবি লুকিয়ে রাখতুম।

কর্নেল একবার তাকিয়ে দেখে বললেন–আর কিছু দেখার নেই। আপনার আলমারির লকারে নিশ্চয় আর চাবি ঢোকাতে পারছেন না?

মিঃ সিনহা লকারে চাবি ঢোকানোর চেষ্টা করে বললেন–তালা ভেঙে ভিতরটা ব্লক হয়ে গেছে। আলমারি কোম্পানিকে খবর দিয়েছি। তারা নতুন লক বসিয়ে দেবে।

কর্নেল বেডরুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার পিছনে আমি এবং মিঃ সিনহা। ড্রয়িংরুমে আমরা বসার পর প্রদোষ এবং একজন টিপিক্যাল চেহারার টিকি ও পইতেধারী ঠাকুরমশাই কফির ট্রে হাতে এলেন। মিঃ সিনহা বললেন– আমার বেডরুমে খাটের তলায় ….

কর্নেল দ্রুত বললেন–আবর্জনা জমে ওঠা স্বাভাবিক! ও নিয়ে ভাববেন না।

প্রদোষ বললকদিন ধরে যা ঝামেলা যাচ্ছে, ঘরের কার্পেট পরিষ্কার করার সময় পাইনি।

—-তুমিই এ সব কাজ করো নাকি?

কর্নেলের প্রশ্নের উত্তরে মিঃ সিনহা বললেন–সাফাই মেশিন আছে। প্রদোষ নিজে সবকিছু করে। মালির কাজও তদারক করে। ঠিক আছে প্রদোষ! তুমি নিজের কাজে যাও।

আমার সন্দেহ হল, মিঃ সিনহা কি প্রদোষকে কর্নেলের কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ দিতে চান না? কর্নেল অবশ্য চুপচাপ কফি পান করতে থাকলেন। আমি বললুম–পুলিশ আপনার বেডরুমে এসে তদন্ত করে গেছে। কিন্তু ওই ত্রিভুজ আঁকা কাগজটা পুলিশের চোখে পড়েনি?

মিঃ সিনহা বললেন–না। পুলিশ লকার পরীক্ষা ছাড়া আর কিছু করেনি।

কর্নেল বললেন–পুলিশ যেভাবে চুরির তদন্ত করে, সেইভাবেই করেছে। খাটের তলায় তাদের উঁকি মারার কারণ ছিল না। উঁকি মারলেও দলা-পাকানো কাগজটা সহজে চোখে পড়ত না। ওটা ছিল একটা পায়ার আড়ালে।

কফি শেষ করার পর কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে চুরুট ধরালেন। তারপর পা বাড়িয়ে বললেন–মিঃ সিনহা! আমরা একবার হোটেল সানশাইনে যেতে চাই। সেখান থেকে আপনার কারখানায়। আপনার সেই দু-জন ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই, যাঁরা ইলেকট্রনিক সুইচ তৈরির চেষ্টা করছিলেন। তাদের কাছে আমার কিছু জানার আছে।…

এবার মিঃ সিনহা নিজে গাড়ি ড্রাইভ করছিলেন। হোটেল সানশাইন বেশি দুরে নয়। পুরোনো শহরের বাজার এলাকার কাছাকাছি। এদিকটায় ভিড় আছে। রাস্তার ধারে একটা জলাশয়ের তীরে হোটেলটা দেখে আমার মনে হল, সানশাইন নামটা মানানসই নয়। পুরোনো দোতলা সাধারণ হোটেল। জলাশয়টাও নোংরা।

হোটেলের ম্যানেজার বেঁটে নাদুসনুদুস চেহারার মানুষ। তিনি মিঃ সিনহা এবং আমাদের দেখে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। কর্নেল বললেন–সুশান্ত এবং মালবিকা যে-ঘরে ছিল, সেটা কি খালি আছে?

ম্যানেজার হিন্দিতে বললেন–সব ঘরই খালি হয়ে গেছে। কালো দৈত্যের গুজব এই মরশুমে আমার সর্বনাশ করেছে।

মিঃ সিনহা বললেন–চলুন! আমার আত্মীয়রা যে-ঘরে ছিলেন সেটা ইনি দেখতে চান। আপনার বিল রেডি থাকলে তা মিটিয়ে দিয়ে যাব।

ম্যানেজার দোতলায় উঠে একটা ঘরের তালা খুলে দিলেন। তারপর ভিতরে ঢুকে সুইচ টিপে আলো জ্বাললেন। ডাবলবেড রুম। দুটো চেয়ার, একটা টেবিল, কাপড় রাখার জন্য একটা কাঠের আলমারি আর একটা ড্রেসিং টেবিল আছে।

কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন-ঘর কি পরিষ্কার করা হয়েছে?

ম্যানেজার বললেন–হ্যাঁ সাব!

কর্নেল ঘরের মেঝে, বিছানার তলা এবং কাঠের আলমারিটা খুলে খুঁটিয়ে কী দেখলেন, তিনিই জানেন। আলমারিটা খোলাই ছিল। ভিতরে একটা অ্যালুমিনিয়ম রড থেকে কতকগুলো প্লাস্টিকের হ্যাঁঙার ঝুলছিল।

এরপর কর্নেল ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার টেনে ভিতরটা দেখে নিলেন। ওদিকে ম্যানেজার পাংশুমুখে মিঃ সিনহার দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে আমার হাসি পাচ্ছিল। ভদ্রলোকের অবশ্য ভয় পাওয়ারই কথা। মিঃ সিনহা অবাক হয়ে কর্নেলকে লক্ষ করছিলেন।

কর্নেল এবার বললেন–চলুন! রায়দম্পতি তাদের কোনো চিহ্ন রেখে যাননি।

সিঁড়িতে নামবার সময় মিঃ সিনহা বললেন–সুশান্ত সম্পর্কে কি আপনার কোনো সন্দেহ হয়েছে?

কর্নেল হাসলেন।–সেই কবিতাটি পড়েননি? যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলে পাইতে পারো অমূল্য রতন! আসলে আমার এই একটা বদ অভ্যাস। এবার হোটেল রেজিস্টারে সুশান্তবাবু কী ঠিকানা লিখে গেছেন, দেখতে চাই।

নীচে নেমে কাউন্টারে ঢুকে ম্যানেজার রেজিস্টার বের করে কর্নেলকে দিলেন। কর্নেল রেজিস্টার খুলে পাতা উলটে দেখতে থাকলেন। মিঃ সিনহা বললেন সুশান্ত শ্যামবাজারের দিকে থাকে। ঠিকানাটা আমি ভুলে গেছি। তবে ওদের বাড়িটা চিনি। পরিতোষদা বেঁচে থাকতে কখনও-সখনও কলকাতা গেলে দেখা করতে গেছি।

কর্নেল ঠিকানা পড়ে বললেন–সুশান্তবাবু এখানে ভবানীপুর এলাকার ঠিকানা লিখেছেন।

বলে তিনি নোটবই বের করে ঠিকানাটা লিখে নিলেন। মিঃ সিনহা বললেন– তাহলে পৈতৃক বাড়িতে সে আর থাকে না। আমার সঙ্গে ওর কথাবার্তা সামান্যই হয়েছিল।

–পুরোনো ফরেস্ট বাংলোর রেজিস্টারে কিন্তু শ্যামবাজার এলাকার ঠিকানা লিখেছেন সুশান্তবাবু!

মিঃ সিনহার মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠল।–সুশান্ত তো অদ্ভুত ছেলে! এসবের অর্থ কী? প্রদোষ তাহলে যে সন্দেহ করছিল, তা ঠিক।

–কী সন্দেহ?

–আমার বেডরুমে ঢুকে সুশান্তই আলমারির লকার ভেঙে টাকা চুরি করেছে। প্রদোষ তো জানে না লকারের ভিতর থেকে কী চুরি গেছে! কিন্তু সুশান্ত–না, না! তার মতো চুনোর্পটির পক্ষে কোনো দুষ্টচক্রে জড়িয়ে পড়া সম্ভব নয়। আমি খুব অবাক হচ্ছি ওর আচরণে।

ম্যানেজার এই সময় তাঁকে সুশান্তবাবুর হোটলে থাকার খরচ বাবদ বিল দিলেন। মিঃ সিনহা পার্স বের করে টাকা দিলেন। শতিনেক টাকার বেশি নয়। হোটেলটা অবশ্য সস্তা হওয়াই সম্ভব।

কর্নেল ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলেন-সুশান্তবাবু কখন চলে গেছেন আপনাদের চোখে পড়েনি?

ম্যানেজার হিন্দিতে উত্তর দিলেন–আমি তখনও ঘুম থেকে উঠিনি। খুব ভোরে ওঁরা চলে যান। হোটেলে তখন একজন লোক ছিল। সে-ও লক্ষ্য করেনি।

–আগের রাত্রে কী সুশান্তবাবুকে কেউ টেলিফোন করেছিল।

ম্যানেজার নড়ে উঠলেন। সাব! রাত সাড়ে দশটায় ফোন এসেছিল। রামু বাবুজিকে ডেকে এনেছিল। কী কথা হচ্ছিল আমি শুনিনি। অন্যের কথা শোনার অভ্যাস আমার নেই।

-কে ফোন করছেন বলেননি?

–কী নাম বলেছিলেন, বুঝতে পারিনি। তবে তিনি বাঙালি। বাঙালি হিন্দি বললে বুঝতে পারি।

–কোথা থেকে বলছেন, তা বলেননি?

রাঁচি থেকে।….

হোটেল সানশাইন থেকে বেরিয়ে কর্নেলের কথামতো মিঃ সিনহা তার কারখানায় নিয়ে চললেন। গাড়ি পূর্বে চড়াই পথে কিছুদূর চলার পর উতরাইয়ের দু-ধারে আদিবাসীদের বসতি দেখতে পেলুম। তারপর চড়াইয়ে উঠে মাঝে মাঝে দু-ধারে জঙ্গল আর অসমতল রুক্ষ প্রান্তর। তারপর কলকারখানার চিমনি দেখা যাচ্ছিল। মিঃ সিনহা বললেন–এটা ইনডাস্ট্রিয়াল এরিয়া। শেষপ্রান্তে ধারিয়া নদীর ব্যারেজ আর জলাধার আছে।

কর্নেল বাইনোকুলারে চোখ রেখে বসে ছিলেন। বললেন– শীতে জলাধারে পাখি আসে তো আগের মতো?

–পাখি আসা কমে গেছে। কলকারখানার জন্য জলাধারের জল দূষিত হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। সরকারি হুকুম কোনো কারখানার মালিক মানতে চান না। আমাদের অবশ্য ইলেকট্রনিক্স্-সংক্রান্ত কাজকারবার।

একটু পরে ডাইনে মোরামবিছানো রাস্তায় গাড়ি ঘুরিয়ে একটা কারখানার গেটের সামনে মিঃ সিনহা গাড়ির হর্ন বাজালেন। উঁকি মেরে দেখলুম, বিশাল সাইনবোর্ডে লেখা আছে, আলফা ইনডাস্ট্রিজ প্রাইভেট লিঃ। তার তলায় ছোটো অক্ষরে আরও কিছু কথা। গেট খুলে দিল দু-জন বন্দুকধারী প্রহরী। গাড়ি ভিতরে সুদৃশ্য ফুলবাগানে রেখে মিঃ সিনহা বললেন–আসুন। ভিতরে ঢুকলে আপনাদের অসুবিধে হবে। তাছাড়া বিশেষ পোশাক পরে ঢোকার নিয়ম আছে। দৈবাৎ ইলেকট্রিক শক খেলেই বিপদ। আরও বিপদ, নানারকম রশ্মি চোখ আর গায়ের চামড়ার ক্ষতি করতে পারে।

সামনে অফিস ঘরে একজন স্যুট-টাইপরা ভদ্রলোক বসেছিলেন। তিনি উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। মিঃ সিনহা বললেন মিঃ ত্রিবেদী! রমেশ আর সিদ্ধেশ্বরকে খবর দিন। কাজ ফেলে রেখে এখনই আসতে বলুন।

মিঃ ত্রিবেদী টেলিফোনে মৃদুস্বরে কথা বললেন। আমরা তার সামনে বসলুম। মিঃ সিনহা এবার আলাপ করিয়ে দিলেন। কারখানার ম্যানেজার রাকেশ ত্রিবেদী শক্তসমর্থ গড়নের মানুষ। কর্নেল ও আমাকে করজোড়ে নমস্কার করলেন। ভদ্রলোকের হাবভাব দেখে মনে হল, যেন তিনিই এই কারখানার মালিক।

দেয়ালে ইতস্তত অনেক গ্রুপফোটো, যন্ত্রাংশ আর যেন অদ্ভুত কিউবিক চিত্রকলার নিদর্শন আঁটা আছে। আমি সেদিকে তাকিয়ে আছি দেখে মিঃ সিনহা বললেন–ওই ছবিগুলো আমাদের কারখানার নেক্সট জেনারেশনের উৎপন্নের জিনিসের মডেল। এই ছবি দিল্লি হেড অফিস থেকে পাঠানো হয়েছে।

কর্নেল একটু হেসে বললেন–মারণাস্ত্রের ছবি নয় তো?

মিঃ ত্রিবেদীর মুখটা কেন কে জানে গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি একটা রঙিন পত্রিকার পাতায় মন দিলেন। মিঃ সিনহা হাসবার চেষ্টা করে বললেন–আমি এখনও জানি না ওগুলো মারণাস্ত্রের প্রতীক কি না। তবে দেশের স্বার্থে মারণাস্ত্র তৈরিতেও আমার আপত্তি নেই। কোম্পানির পার্টনারদের কারও নেই।

মিঃ ত্রিবেদী বললেন–চা বা কফি বলি?

কর্নেল বললেন–ধন্যবাদ। হাতে সময় কম।

একটু পরে পাশের দরজা দিয়ে হলুদ পোশাক পরা এবং কাঁচে ঢাকা মুখোশ ঘাড়ের পিছনে ঝুলিয়ে দু-জন ভদ্রলোক এলেন। মিঃ সিনহা বললেন–রমেশ! সিদ্ধেশ্বর! আলাপ করিয়ে দিই।

কর্নেল বললেন–পরে আলাপ করাবেন। আমি প্রথমে মিঃ রমেশ লালার সঙ্গে বাইরে গিয়ে দু-একটা কথা বলব। তারপর মিঃ সিদ্ধেশ্বর রাওয়ের সঙ্গে বলব। মিঃ সিনহা! আপনার কি কোনো আপত্তি আছে?

মিঃ সিনহা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি যেন অনিচ্ছার সঙ্গে বললেন– নাঃ। রমেশ! ইনি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। আমিই কলকাতা থেকে ওঁকে ডেকে এনেছি। কেন, তা নিশ্চয় বুঝতে পারছ। তুমি যাও! উনি কী জানতে চান, ঠিক ঠিক উত্তর দেবে।

রমেশ লালা গম্ভীর মুখে কর্নেলকে অনুসরণ করলেন। বাইরে গিয়ে মাত্র মিনিট তিনেক কথা বলার পর রমেশ লালা ফিরে এসে বললেন–স্যার! আমি ওয়ার্করুমে যাচ্ছি। রাও! তুমি যাও। কর্নেল সরকার তোমার সঙ্গে কথা বলবেন।

তিনি চলে গেলেন ভিতরে। সিদ্ধেশ্বর রাও কর্নেলের সঙ্গে কথা বলতে গেলেন। লক্ষ্য করলুম, মিঃ ত্রিবেদীর মুখ আরও গম্ভীর হয়েছে।

এবার প্রায় পাঁচমিনিট পরে সিদ্ধেশ্বর ফিরলেন। চুপচাপ তিনি ভিতরে চলে গেলেন। তারপর বাইরের দরজায় কর্নেলকে দেখা গেল। তিনি বললেন–মিঃ সিনহা! আমরা এবার বাংলোয় ফিরতে চাই।

মিঃ সিনহা বললেন–চলুন। আমি মিঃ ত্রিবেদীর সঙ্গে একটা জরুরী কথা বলে নিই।

বেরিয়ে গিয়ে কর্নেল গাড়ির কাছে দাঁড়ালেন। ঘড়ি দেখে বললেন–আজ দুপুরের মধ্যে হালদারমশাইয়ের দিল্লি থেকে একটা ফোনের আশা করছি।

ওঁকে ফোন নম্বর দিলেন কী করে? সরকারি বাংলোর ফোন নম্বর কি আপনি জানতেন?

রবিবার রাত দশটায় হালদারমশাই হাওড়া স্টেশন থেকে ফোন করেছিলেন। তখন ওঁকে ফাদার হফম্যানের ফোন নম্বর জানিয়েছিলুম। যে-ট্রেনে দিল্লি গেছেন উনি, সেটা আজ মঙ্গলবার সকাল নটার মধ্যে পৌঁছুবে।

কিন্তু জয়সোয়ালের বাড়ির ঠিকানা ওঁকে জোগাড় করতে হবে। তারপর তো—

কর্নেল আমার কথার উপর বললেন–জয়ন্ত! তুমি সাংবাদিক। তোমার জানা উচিত, এ যুগে সব ইনডাস্ট্রিয়াল কোম্পানির খবরাখবর সংক্রান্ত গাইডবই বাজারে পাওয়া যায়। হালদারমশাই দিল্লিতে কোথায় তা পাবেন, তাঁকে জানিয়ে দিয়েছি।

মিঃ সিনহা এসে গেলেন। কর্নেল তার বাঁ-পাশে বসলেন। আমি আগের মতো পিছনে বসলুম। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে মিঃ সিনহা বললেন–আমার দু-জন এক্সপার্টের কাছে কর্নেল সরকার কি ফাইল চুরির কোনো আভাস পেতে চেয়েছিলেন?

কর্নেল হাসলেন।–নাঃ! সেই সুইচ বিষয়ে টেকনিক্যাল কিছু তথ্য পেলুম।

-বলেন কী! আপনি মডার্ন ইলেকট্রনিক গ্যাজেট সম্পর্কে খবর রাখেন তাহলে?

-যৎকিঞ্চিৎ।

–আমার কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক।

সেই সশস্ত্র রক্ষীরা গেট খুলে দিল। বাইরে মোরাম রাস্তায় পোঁছে কর্নেল বললেন– জানতে পারলুম, যে-মূল যন্ত্রটা চালু করার জন্য আপনার কোম্পানি প্রতিরক্ষা বিভাগ থেকে সুইচের অর্ডার পেয়েছেন, তার তিনটে পার্ট। রমেশ লালা এবং সিদ্ধেশ্বর রাও একটা পার্ট তৈরির চেষ্টা করছেন। বাকি দুটো তৈরি হচ্ছে দিল্লি এবং শাহাবাদে। আমি বুঝতে পারছি না, কেন একথা আপনি আমাকে খুলে। বলেননি!

মিঃ সিনহা কিছুক্ষণ গম্ভীর মুখে থাকার পর পিরাস্তায় বাঁদিকে গাড়ি ঘুরিয়ে বললেন–কর্নেল সরকার, প্রতিরক্ষা বিভাগের কাছে এসব গোপনীয় অর্ডার নিতে হলে কিছু শর্ত পালন করতে হয়। সেই শর্ত অনুসারে আমি আপনাকে অত ডিটেলস কিছু জানাইনি। লালা আর রাও তা জানাল কেন, বুঝতে পারছি না।

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন–তারা আমার প্রশ্নের জবাবে শুধু হ্যাঁ বা না বলেছে। আমার প্রশ্ন ছিল পূর্বপরিকল্পিত। সেইসব প্রশ্ন এমনভাবে সাজিয়েছিলুম, যার জবাব শুধু হ্যাঁ বা না হবে। এই প্রক্রিয়ায় আমি গোপন সত্যটা জেনে নিলুম। ওঁদের কোনো দোষ নেই। এমন প্রশ্নের জন্য ওঁরা তৈরি ছিলেন না।

–ঠিক আছে। আমার ফাইল উদ্ধার যাতে হয়, সেইজন্য আপনাকে আমি অবাধ স্বাধীনতা দিলুম।

মিঃ সিনহা! আমি এদেশেরই একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার। স্বদেশের প্রতি আমার নৈতিক আনুগত্য অসামরিক ব্যক্তিদের চেয়ে বেশি।

মিঃ সিনহা বিব্রত হয়ে বললেন–প্লিজ কর্নেল সরকার! আমাকে ক্ষমা করবেন।…

সরকারি বাংলোয় আমাদের পৌঁছে দিয়ে মিঃ সিনহা চলে গেলেন। কর্নেল কেয়ারটেকার প্রসাদজিকে জিজ্ঞেস করলেন, তাকে কেউ ফোন করেছিল কি না। প্রসাদজি বললেন না স্যার। তবে এক ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তিনি পরে আপনাকে ফোন করবেন।

-ধন্যবাদ প্রসাজি!

 দোতলায় আমাদের ঘরের দরজার তালা খুলে কর্নেল বললেন–জানালাগুলো খুলে দাও জয়ন্ত! আমি ফাদার হফম্যানকে ফোন করি।

টেলিফোনে জিরো ডায়াল করলে বাইরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা যায়। আমি জানালাগুলো খুলে দিয়ে স্নান করব কি না ভাবলুম। বাথরুমে গরম জলের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আবহাওয়া শুধু ঠাণ্ডা নয়, কেমন স্যাঁতসেঁতে মনে হচ্ছিল। বারোটা কুড়ি বাজে। তবু নীচের উপত্যকায় কুয়াশার ঘোর লেগে আছে। কর্নেলকে টেলিফোনে বলতে শুনলুম–এই বাংলোর নম্বর দিয়েছেন যখন, তখন যে-কোনো মুহূর্তে উনি ফোন করবেন। ধন্যবাদ! রাখছি।

জিজ্ঞেস করলুম–হালদারমশাই নাকি?

-হ্যাঁ।

–তো এখানে ফোন করেননি কেন?

–কোনো কারণে সময় পাচ্ছেন না হয়তো। তুমি স্নান করে নাও!

–ইচ্ছে করছে না।

–একটায় লাঞ্চ সেরে নিতে হবে। তারপর পরবর্তী পরিকল্পনা।

এই সময় টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল হাত বাড়িয়ে রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। তারপর ইংরেজিতে কার সঙ্গে বাক্যালাপ চালিয়ে গেলেন। কিছু বুঝতে পারলুম না। শুধু বুঝলুম, কোনো এক গুপ্টাসায়েবের সঙ্গে কর্নেল কথা বলছেন। একেবারে হিং টিং ছট বলা যায়।

রিসিভার রেখে কর্নেল আমার দিকে তাকালেন। বললুম–গুপ্টাসায়েব কে?

সন্ধ্যার দিকে তার সঙ্গে দেখা হবে।

–আহা! তিনি কে?

কর্নেল একটু হেসে বললেন–তুমি কেন্দ্রীয় গুপ্তচরদের কথা বলেছিলে মনে আছে? এ ক্ষেত্রে গুপ্তচর কথাটা খারাপ। মিঃ প্রশান্ত গুপ্টা ডিফেন্স ইনটেলিজেন্সের একজন অফিসার। কলকাতায় তিনি থাকেন। তার সঙ্গে আমার অনেকদিনের আলাপ। আজ সকালে ওঁকে বাইনোকুলারে মউলি নদীর ধারে দেখতে পেয়ে তখনই তার কাছে গিয়েছিলুম। মিঃ গুপ্টা একজন রিটায়ার্ড মেজর। তবে তার বয়স আমার চেয়ে অনেক কম।

কথাটা শোনার পর বললুম–সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি না হয়ে যায়!

কর্নেল জোরে হেসে উঠলেন।বাঃ! দারুণ বলেছ তো!..

বেলা একটা নাগাদ ঘরে খাবার দিয়ে গিয়েছিল সেই বাবুরাম। আবার আমার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে সে একবার তাকিয়েছিল। বুঝতে পেরেছিলুম, মিঃ সিনহার চোরা আগ্নেয়াস্ত্রের কারবারের কথা বলে বেচারা পরে খুব ভয় পেয়েছে। খাওয়ার সময় কর্নেলকে কথাটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলুম। কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বলেছিলেন–তোমাকে বরাবর বলে আসছি জয়ন্ত, খাওয়ার সময় কথা বলতে নেই। প্রথমত, খাবার শ্বাসনালিতে আটকে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, খাবারের স্বাদ পাওয়া যায় না।

খাওয়ার পর যথারীতি ভাতঘুমের আশায় বিছানায় চিত হয়েছি, বাবুরাম এসে এঁটো থালাবাটি গ্লাস ট্রেতে নিয়ে গেল। তার দিকে আমি তাকাইনি। কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বারান্দায় বসে ছিলেন। এমন সময়ে টেলিফোন বেজে উঠল। আমি চোখ বুজে শুয়ে রইলুম। কর্নেল ঘরে ঢুকে রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। …. হ্যাঁ। বলছি। আপনার খবর বলুন হালদার মশাই!… হ্যাঁ। আপনার খবর নির্ভুল। … তাই বুঝি? ও নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমি দেখছি। ..খুব ভালো। আপনাকে উনি প্লেনে নিয়ে যেতে চাইলে তা-ই যান। … হ্যাঁ। শুনুন! ওখানেও প্লেনের ব্যবস্থা করে দিতে বলবেন।… হ্যাঁ, হ্যাঁ। কাজ হবে। … পাটনায় পৌঁছে বাসে চেপে বরমডিহায় আসুন। আমরা নতুন সরকারি বাংলোয় আছি। …. ঠিক আছে। ওয়েলডান হালদারমশাই!… আরে না না! আপনি যখন পুলিশ ছিলেন, তখন না হয় তামসিক … না। এখন আপনি সাত্ত্বিক। কাজেই পাপপুণ্যের প্রশ্ন নেই। একটা কথা। কী ভাষায় কথা… ইংলিশ? বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছেন। এযুগে সাধু সন্ন্যাসীরা ইংলিশ বললে সম্মান বেড়ে যায়। …. আচ্ছা। উইশ ইউ গুড লাক। …

চোখ খুলে বললুম–হালদারমশাই দারুণ জমিয়েছেন তাহলে?

 কর্নেল রিসিভার রেখে বললেন–হ্যাঁ। তবে শেষরক্ষা করতে পারলে হয়।

-কেন?

–ওঁর পিছনে সম্ভবত সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্সের লোক লেগেছে!

—আপনি গুপ্টাসায়েবকে বলে দিন।

–দেখা যাক। সন্ধ্যায় দেখা হলে ওঁকে বলব। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এভাবে নিজের হাতের কোনো তাস কাকেও দেখানো আমার রীতি নয়। তুমি তো জানো, আমি নিজের সম্পর্কে একটা গর্ব পোষণ করি! আমিই তুরুপের তাস এতকাল মেরে আসছি!

–কিন্তু কর্নেল! হালদারমশাই বিপদে পড়লে আপনাকেই ছুটে যেতে হবে!

–হুঁ।

এই সময় বাইরে বারান্দায় কাদের পায়ের শব্দ এবং চাপা উত্তেজনাপূর্ণ কথাবার্তা কানে এলো। কর্নেল বেরিয়ে গেলেন। আমিও গেলুম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে উর্দিপরা কয়েকজন পরিচারক এবং রাশভারি চেহারার কিছু ভদ্রলোক দক্ষিণ পশ্চিম কোণে কী দেখছিলেন। কর্নেল বললেন কী ব্যাপার?

সেই বাবুরাম চোখ বড় করে বলল–কালা দেওয়ের দেখা মিলেছে। মিলিটারির লোকেরা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে যাচ্ছে। আওয়াজ আসছে, শুনুন!

বললুম–আবার নরবানর?………

.

কালো গাড়ি এবং প্রদোষ সেন

কর্নেল ঘরে ঢুকে বাইনোকুলার নিয়ে এলেন। তারপর তিনি দূরে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে কী ঘটছে দেখতে থাকলেন। জিজ্ঞেস করলুমকী ব্যাপার?

কর্নেল বাইনোকুলারটা আমাকে দিলেন। সম্ভবত বরমডিহা বসতি প্রথমে স্পষ্ট ফুটে উঠল। পাহাড়ের গায়ে আদিবাসীদের সেই বসতি থেকে নানাবয়সি মানুষজন পাহাড়ের একটা চাতালে দাঁড়িয়ে দক্ষিণের জঙ্গলে কিছু দেখছে। ককেজনের হাতে তির-ধনুক, বল্লম আর টাঙিও দেখা যাচ্ছিল। বাঁদিকে একটা টিলার উপর একটা টালিচাপানো বাংলো ঘর। ওটাই সম্ভবত সেই ফরেস্ট বাংলো। সামনের চত্বরে মিলিটারি চকরাবকরা সবুজ উর্দি আর মাথায় হেলমেট পরে টাস্কফোর্সের সৈনিকেরা রাইফেল তাক করে আছে। গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে না। শোনা সম্ভব নয়। কারণ বাতাস বইছে উত্তর থেকে। তারা আছে দক্ষিণে। আরও বাঁদিকে নীচে গাছপালাঘেরা জায়গায় একতলা অনেকগুলো বাড়ি দেখা গেল। ওটাই তাহলে ফাদার হফম্যানের মিশন অফিস এবং স্কুল। তার এদিকে হাইওয়েতে একটা কালো পুলিশ ভ্যান এবং একটি পুলিশ জিপ দেখতে পেলুম। গাড়ি দুটো মিশনের শেষপ্রান্তে গিয়ে থামল।

বাইনোকুলার নামিয়ে দেখি, কর্নেল নেই। ঘরে ঢুকে দেখলুম, তিনি টেলিফোন করছিলেন। রিসিভার রেখে আমার হাত থেকে তিনি বাইনোকুলার নিলেন। তারপর হাসতে হাসতে বললেন–দিনদুপুরে লোকেরা এপম্যান–তোমার ক্রোম্যাগনন মানুষ দেখতে পাচ্ছে। তোমাকে বলেছিলুম গুজব মারিজীবাণু। দ্রুত তা সংক্রামিত হয়। দিল্লি এবং শাহাবাদে রাত্রে লোকেরা তাকে দেখতে পেয়েছিল। ও দুটো জায়গা ঘনবসতিপূর্ণ শহর। আর বরমডিহা পাহাড়ি এলাকা। বনজঙ্গল চারপাশে। এখানে তাই দিনদুপুরেও এপম্যানের আবির্ভাব খুবই সম্ভব।

বললুম–আপনি ফোনে কার সঙ্গে কথা বলছিলেন?

ফাদার হফম্যানের সঙ্গে। তিনি বললেন, বরমডিহার কাঠগোলার মালিক চেতনলাল মিশনের ওদিকে জিপগাড়িতে চেপে সেগুনের জঙ্গলে গিয়েছিলেন। তিনিই নাকি নরবানর দেখে পালিয়ে এসে টাস্কফোর্সের ক্যাম্পে খবর দেন। আচমকা এই খবর পেয়ে উত্তেজিত সৈনিকেরা সেগুনবনের দিকে তাক করে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। ওদিকে আদিবাসীরাও ব্যাপারটা অনুমান করে উত্তেজিত হয়ে ওঠে।

–চেতনলালকে পুলিশ জেরা করছে না কেন?

–তাকে ফাদার বসিয়ে রেখে পুলিশকে খবর দিয়েছেন। কিন্তু এটাই আশ্চর্য, বরমডিহা শহরে এত দ্রত খবরটা রটলো কী করে?

–চেতনলালের লোকেরা রটিয়েছে নিশ্চয়! বাবুরামকে ডেকে জিজ্ঞেস করব?

তাকে ডেকে নিয়ে এসো।

বাইরে গিয়ে দেখলুম, বাবুরাম হাত তুলে কিছু দেখাচ্ছে। তার মুখে উত্তেজনার ছাপ স্পষ্ট। তাকে ডাকলুম। সে আমার সঙ্গে ঘরে ঢুকে কর্নেলকে সেলাম দিল। কর্নেল বললেন–কালা দেওয়ের খবর তোমরা কার কাছে পেয়েছ বাবুরাম?

বাবুরাম বলল–লছমন এখানে কাম করে স্যার! সে সাইকেলে চেপে বাজারে গিয়েছিল। বাজার থেকে ফেরত আসছে, এমন সময়ে কাঠগোলার দো আদমি ছুটে আসছিল। জঙ্গলের মধ্যে তাদের মালিক কালা দেও দর্শন করেছে। তারা হোশিয়ারি দিতে দিতে বরমডিহা টোনের দিকে চলে গেল। তো লছমন এসে খবর দিল। পরসাদজি দারোয়ানদের দরওয়াজা বন্ধ করে বন্দুক হাতে রেডি থাকতে বললেন। সাথ-সাথ খবর জেনে হামরা দোতলায় উঠল।

–ঠিক আছে। তুমি কালা দেও দর্শন করো।

বাবুরাম চলে গেল। কর্নেল হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসে রইলেন। আমি বিছানায় গিয়ে কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লুম বটে, কিন্তু আর ভাতঘুম এলো না। কাঠ-ব্যবসায়ী চেতনলাল কি সত্যি নরবানর দেখেছেন? নাকি ওঁর চোখের ভুল? কর্নেল বলছেন, গুজব মারিজীবাণু ছড়ায়। সত্যিই কি নিছক গুজব?

একটু পরে কর্নেল ডাকলেন-জয়ন্ত! উঠে পড়ো। বেরুব।

উঠে দাঁড়িয়ে বললুম–কালো দৈত্যদর্শন করতে যাবেন নাকি?

কর্নেল হাসলেন।–সে সৌভাগ্য কি আমার হবে?

বলে তিনি বেরুলেন। পিঠে যথারীতি কিটব্যাগ, গলায় ঝুলন্ত ক্যামেরা আর বাইনোকুলার। ইতিমধ্যে তার ইঙ্গিতে জানালাগুলো বন্ধ করে দিয়েছিলুম। দরজায় তালা এঁটে দিলেন কর্নেল। সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় তিনি আস্তে বললেন–যানবাহন পাব না। হাঁটতে হবে।

বললুম–ফাদার হফম্যানকে ফোন করলেই পারেন। কিংবা থানায় ফোন। করলে পুলিশের গাড়িও কি পাওয়া যাবে না?

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন–প্রকাশ্যে পুলিশের গাড়িতে গেলে আমরা চিহ্নিত হয়ে পড়ব। জয়ন্ত আমার ধারণা, এখানে নরবানরের মালিকদের কাজ এখনও শেষ হয়নি।

-নরবানরের মালিকদের মানে? আপনি কি বিশ্বাস করেন—

কর্নেল আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন–চুপ! আর কোনো কথা নয়।

তিনটে বেজে গেছে। প্রসাদজি কর্নেলকে হয়তো বের হতে নিষেধ করতেন। তিনি সে-সুযোগ পেলেন। বন্দুকধারী দারোয়ানদ্বয় সেলাম দিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। ঘোরাল রাস্তাটা নীচে সমতলে চওড়া রাস্তায় মিশেছে। কর্নেল হাঁটার গতি বাড়ালেন। আমাকে তার সঙ্গ ধরতে প্রায় নাকাল হতে হচ্ছিল। নীচের রাস্তায় নেমে উত্তর এবং দক্ষিণে তাকিয়ে কর্নেল বললেন–একেবারে নিঝুমপুরী! রূপকথার গল্পের মতো। অবশ্য এতে আমাদের সুবিধে হল।

কর্নেল জনমানবহীন রাস্তায় কিছুদূর এগিয়ে বাঁদিকে পাহাড়ের ঢালু গায়ে শালবনে ঢুকলেন। আমাদের জুতোর চাপে শুকনো পাতার স্তূপে শব্দ হচ্ছিল। শালবনটা এই শীতে শ্রীহীন হয়ে আছে। কর্নেলকে অনুসরণ করে একটা সংকীর্ণ নালার ধারে পৌঁছোলুম। নালাটা পাথরে ভরা। পাথরের ফাঁক দিয়ে ঝিরঝিরে জল বয়ে যাচ্ছে। আমাদের ডাইনে পশ্চিমদিকে নালার উপর চওড়া রাস্তার ব্রিজ দেখা যাচ্ছিল। বোঝা গেল, এটা পাহাড়ি ঝরনা। সম্ভবত ঝরনাটা দূরে মউলি নদীতে গিয়ে মিশেছে। পাথরে সাবধানে পা রেখে দু-জনে নালাটা পেরিয়ে গেলুম। আবার পাহাড়ের ঢালে একটা শালবন। শালবন পেরিয়ে ডাইনে একটা লালমাটির সংকীর্ণ রাস্তায় পৌঁছে কর্নেল বাইনোকুলারে পশ্চিমদিকটা দেখে নিলেন। এখানে পাহাড় ও জঙ্গলের ছায়া ঘন হয়ে পড়েছে। কর্নেল বললেন–এই রাস্তায় আমাদের যেতে হবে।

বললুম–আমরা কোথায় যাচ্ছি?

–এপম্যানের কাছে।

–কর্নেল! প্লিজ আর হেঁয়ালি করবেন না।

–হেঁয়ালি নয়। একটু পা চালিয়ে গেলেই তার সঙ্গে দেখা করে সন্ধ্যা নাগাদ বাংলায় ফিরতে পারব। কুইক মার্চ।

শীতকাল বলেই কর্নেলের সঙ্গে সমান তালে পা ফেলে প্রায় জগিং করার ভঙ্গিতে হাঁটছিলুম। অন্য ঋতু হলে ঘেমে হাঁপিয়ে এতক্ষণ ক্লান্ত হয়ে পড়তুম। রাস্তাটা লালমাটির ভেবেছিলুম। ক্রমে দেখলুম নিছক মাটি নয়। পাথুরে মাটির উপর দু-ধারের গিরিমাটি বর্ষার জলে ধুয়ে নেমেছে। এখানে মোটরগাড়ির টায়ারের ছাপ চোখে পড়ল। বুঝলুম, জঙ্গল থেকে এই পথেই ট্রাকবোঝাই কাঠ আসে।

কর্নেল একটু থেমে বাইনোকুলারে কিছু দেখে নিলেন। তারপর ব্যস্তভাবে বললেন–জয়ন্ত! বাদিকে ওই পাথরটার আড়ালে চলো। কুইক।

রাস্তার বাঁ-ধারে ঝোঁপজঙ্গল আর প্রকাণ্ড সব পাথর। আমরা একটা পাথরের আড়ালে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লুম। একটু পরে কর্নেল চাপা স্বরে বললেন আমরা দেরি করে ফেলেছি। গাড়ি পেলে ওদের আগেই এপম্যানের কাছে পৌঁছে যেতুম।

কথা বলতে যাচ্ছি, গাড়ির শব্দ কানে এল। অমনি চুপ করলুম। মিনিট দুয়েকের মধ্যে একটা কালো অ্যামবাসাডর গাড়ি আমাদের সামনে দিয়ে চলে গেল। কর্নেল নোটবই বের করে তৈরি ছিলেন। গাড়ির নম্বরটা লিখে নিলেন।

কিছুক্ষণ পরে আমরা পাথরের আড়াল থেকে রাস্তায় গেলুম। বললুম–ওই গাড়িতে কি এপম্যানকে কেউ নিয়ে গেল।

কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। চলো ফেরা যাক।

-কী আশ্চর্য! এপম্যান তো বিশালকায় প্রাণী। অ্যামবাসাডর গাড়িতে তার জায়গা হবে কী করে?

কর্নেল হাঁটতে হাঁটতে বললেন–হবে কী বলছ? হয়েছে। একটা কাজ করতে অবশ্য পারতুম। গুলি করে গাড়িটার টায়ার ফাঁসিয়ে থামানো যেত। কিন্তু গাড়িতে এপম্যানের মালিকরা নিশ্চয় সশস্ত্র। রিভলবার নিয়ে এ কে ফোরটি সেভেন রাইফেলের সঙ্গে লড়াই করা যায় না।

কর্নেল! প্লিজ আর হেঁয়ালি করবেন না। ব্যাপারটা খুলে বলুন।

তার চেয়ে তোমার জানতে চাওয়া উচিত কীভাবে আমি এপম্যানের হদিস পেলুম!

তা-ই বলুন!

–তুমি তো জানো। পাঁচবছর আগে এই এলাকায় এসে অর্কিড, প্রজাপতি আর বিরল প্রজাতির পাখির খোঁজে চারদিকে অনেকদূর অবধি ঘোরাঘুরি করেছিলুম। তখন বরমডিহা এমন সুন্দর আধুনিক শহর হয়নি। ওই পূর্বদিকের শিল্পাঞ্চল ছিল না। কিন্তু প্রকৃতি পরিবেশ তত কিছু বদলায়নি। আজ দুপুরে বাংলোর দোতলার বারান্দা থেকে কয়েক মিনিটের জন্য এই রাস্তায় একটা কালো গাড়ি দেখতে পেয়েছিলুম। এটা তো গহন জঙ্গলের পথ। এ পথে কাঠ ব্যবসায়ীদের ট্রাক যায়। অ্যামবাসাডর সচরাচর যায় না। পরে শুনলুম কাঠ ব্যবসায়ী চেতনলাল নরবানর দেখতে পেয়েছেন। সেগুন গাছের জঙ্গল এই রাস্তার ডানদিকে পড়ে। সেই জঙ্গল একটা উঁচু পাহাড়ের উপত্যকায় দেখেছিলুম। কালো গাড়িটা ফেলে চেতনলাল নিশ্চয় পালিয়ে আসেননি! তার পক্ষে গাড়িতে চেপে যাওয়া এবং পালিয়ে আসাই স্বাভাবিক। অতএব কালো গাড়িটা তাঁর নয়। এরপর সিদ্ধান্ত নিতে বেশ দেরি করে ফেলেছি। তাই নরবানরকে নিয়ে কারা চলে গেল।

-ওঃ কর্নেল! নরবানর ওখানে যদি সত্যি থাকত, টাস্কফোর্সের গুলিতে মারা পড়ত। আপনি ওই সেগুন বনে নরবানর আছে কী করে জানলেন তা-ই বলুন!

কর্নেল হাসলেন। –তুমি না শুনে ছাড়বে না দেখছি! তাহলে শোনো! আজ প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে প্রথমে এই রাস্তায় গিয়েছিলুম জঙ্গলে অর্কিডের খোঁজে। তারপর শর্টকাটে ফরেস্ট বাংলোয় গেছি। যাইহোক, সেগুনের জঙ্গলের উল্টোদিকে অর্থাৎ এই রাস্তার বাঁদিকে একটা টিলা আছে। টিলায় দাঁড়িয়ে বাইনোকুলারে দক্ষিণ এবং পশ্চিমদিকটা খুঁটিয়ে দেখছিলুম। সেগুনবনের শেষপ্রান্তে একটা পাহাড়ের গায়ে একটা বটগাছ দেখে মনে পড়ল, সেবার ওই। গাছটার মাথায় একটা সেক্রেটারি বার্ড দেখেছিলুম। বাংলায় কেরানি পাখি বলা। যায়। কারণ দেখলে মনে হয় পাখিটার কানে কলম গোঁজা আছে। পা দুটো খুব লম্বা। সারসজাতীয় পাখি। বাইনোকুলারে হঠাৎ চোখে পড়ল বটগাছটার নীচে একটা গোরিলার মতো প্রাণী দাঁড়িয়ে আছে।

চমকে উঠে বললুম–তারপর? তারপর?

তারপর সেগুনবনের ভিতর দিয়ে চুপি চুপি হেঁটে টিলার নীচে গেলুম। কালো দৈত্য বলল, কি এপম্যান বলল, কি ক্রোম্যাগনন মানুষ বলল, সে যেমন দাঁড়িয়ে ছিল, তেমনই দাঁড়িয়ে রইল। চুপিচুপি তাকে দেখে টিলার নীচের ঝোঁপজঙ্গল পেরিয়ে ফাঁকা অসমতল মাঠে গেলুম। সেখান থেকে ফরেস্ট বাংলো।

কর্নেল! আপনি ছেলেভুলানো গল্প কেন শোনাচ্ছেন, জানি না।

–গল্প নয়। যথাসময়ে দেখতে পাবে। ফিরে গিয়ে গাড়িটার নম্বর থানার অফিসার-ইন-চার্জ মিঃ হরিহর পাণ্ডেকে জানাব। গাড়িটা এখন আটক করে লাভ নেই। নরবানরকে লুকিয়ে রাখা হবে। আমার ধারণা, আজ রাত্রে নরবানরের আবির্ভাব ঘটবে শহরের মধ্যে। আপাতত গাড়িটার মালিকের নাম জানা দরকার।

–গাড়ির নম্বর প্লেট ভুয়ো হতে পারে!

–তা পারে! তবে বরমডিহার মতো শহরে কালো অ্যামবাসাডর বেশি আছে বলে মনে হয় না। আজকাল মধ্যবিত্ত লোকেরাও নতুন মডেলের সুন্দর-সুন্দর গাড়ি কিনছে।….

ডাকবাংলোয় পৌঁছুতে দিনশেষের ধূসরতা ঘন হয়ে উঠেছিল। সেই সঙ্গে কুয়াশাও জমেছিল। আলোগুলো ভূতুড়ে দেখাচ্ছিল। প্রসাদজি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। কর্নেল তাকে শিগগির কফি পাঠাতে বলে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন।

কিছুক্ষণ পরে বাবুরাম কফি আর পকৌড়া দিয়ে গেল। তার মুখ এখন বেজায় গম্ভীর। কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন–আগে কফি খেয়ে নার্ভ চাঙা করে নিই। তারপর থানায় ফোন করা যাবে।

কফি শেষ করে কর্নেল চুরুট ধরিয়েছেন, এমন সময় দরজার দিকে কেউ বলে উঠল–মে আই কাম ইন?

কর্নেল ঘুরে পর্দার ফাঁকে একজন তাগড়াই চেহারার ভদ্রলোককে দেখে সম্ভাষণ করলেন–আরে! আসুন! আসুন মেজর গুপ্টা! আমি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলুম।

ভদ্রলোকের কাঁচাপাকা চুল, মিলেটারি চেহারা। তিনি চেয়ারে বসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন–আপনি কি মিঃ জয়ন্ত চৌধুরি? নমস্তে। আমি মেজর প্রশান্ত গুপ্টা।

নমস্কার করে বললুম–কর্নেল আপনার কথা আমাকে বলেছেন!

 কর্নেল বললেন–পটে কফি আছে। একটা পেয়ালা আনতে বলি?

মেজর গুপ্টা বললেন–ধন্যবাদ কর্নেল সরকার! আমি এইমাত্র কফি খেয়ে বেরিয়েছি।

—আপনি নিশ্চয় পায়ে হেঁটে আসেননি?

—না। নরবানরের চেয়ে বরমডিহার ঠাণ্ডাটা বেশি ভয়ংকর।

–আজ দুপুরে কাঠ-ব্যবসায়ী চেতনলাল সেগুনবনে নরবানর দেখেছেন।

মেজর গুপ্টা হাসলেন।–জানি। ও সি মিঃ পাণ্ডের কাছ থেকেই আমি আসছি।

কর্নেল চুরুটের একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন–ছবিটা আশা করি পাঠানো হয়েছে?

–হ্যাঁ। স্পেশাল মেসেঞ্জার দিয়ে পাঠিয়েছি। রাঁচি থেকে সে প্লেনে দিল্লি যাবে। কাল দুপুরের মধ্যে খবর পেয়ে যাব আশা করছি। তবে আমার মনে হয়েছে, ভদ্রলোককে আমি অন্তত বারদুয়েক দেখেছি। অশোকনাথ বা অলোকনাথ নাম ছিল। বাঙালি। পদবি মনে নেই। অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারে কাজ করতেন।

তারপর সরকারি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে রাশিয়ায় গিয়ে নিখোঁজ হন।

–তাহলে আপনার স্মৃতি শেষপর্যন্ত আপনাকে নিরাশ করেনি?

–না। সকালে আপনাকে বলেছিলুম কিছুটা সময় লাগবে। ছবিটা দেখার পরই দিল্লিতে ফোন করে স্মৃতিটা ঝালিয়ে নিয়েছি। তবে প্রকৃত নামটা পুরোনো ফাইল ঘেঁটে খুঁজে বের করতে সময় লাগবে।

–চেতনলালের নর-নর-দর্শন সম্পর্কে মিঃ পাণ্ডের কী ধারণা?

–ও সি মিঃ হরিহর পাণ্ডে কাঠ-ব্যবসায়ী ওই ভদ্রলোককে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। চেতনলাল নিরীহ আর ভীতু স্বভাবের মানুষ। তার বিরুদ্ধে পুলিশের রেকর্ডে কোনো অভিযোগ নেই। তাছাড়া তার জিপে দু-জন সঙ্গীও ছিল। তারা অবশ্য তার কাঠগোলার কর্মী। তারাও নরবানর দেখেছে।

–ঠিক কোন জায়গায় দেখেছে?

–সেগুনবন থেকে পশ্চিমে একটা টিলা দেখা যায়। সেই টিলায় দেখেছে। ওখানে বটগাছের তলায় নরবানরটা দুলছিল।

আমি বললুম–দুলছিল?

মেজর গুপ্টা একটু হেসে বললেন– মিঃ পাণ্ডে এবং আমারও ধারণা, ওদের চোখের ভুল। ব্যাপারটা স্রেফ সাইকোলজিক্যাল। নরবানরের গুজব থেকে অনেক ভীতু মানুষ হ্যালুসিনেশন রোগে আক্রান্ত হতেই পারে।

তারপর?

নরবানর হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যায়। চেতনলাল এবং তার কর্মীরা প্রাণের ভয়ে পালিয়ে এসে জিপে ওঠেন। তারপর জিপ নিয়ে সোজা ফরেস্ট বাংলোয় টাস্কফোর্সের কাছে চলে যান।

কর্নেল বললেন–মেজর গুপ্টা! কলকাতা থেকে কোনো খবর আসেনি এখনও?

মেজর গুপ্টা ঘড়ি দেখে বললেন–না। তবে বাড়িটা আমাদের লোকেরা নজরে রেখেছে। এবার আমি উঠি। কাল দুপুরের মধ্যে ছবির লোকটির সব তথ্য পেয়ে যাব। আপনাকে জানাব।

বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন। আমি বললুম–ছবিটা কার, তা আমি বুঝতে পেরেছি।

কর্নেল টেলিফোনের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন–পারবে বইকী। তোমার সামনেই যে ছবিটা তুলেছিলুম।

–কী আশ্চর্য! অধ্যাপক অরিন্দম সিংহ কেন্দ্রীয় পরমাণু গবেষণাকেন্দ্রে চাকরি করতেন। তিনি নাকি রাশিয়া গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যান। অথচ তিনি দিব্যি কলকাতার সায়েন্স কলেজে অধ্যাপনা করছেন! এ যে বড্ড গোলমেলে ব্যাপার!

-উনি সায়েন্স কলেজে কেন, কোনো কলেজেই অধ্যাপনা করেন না।

–মিঃ এ কে সিনহা তাহলে কি তার বৈমাত্রেয় ছোটোভাইয়ের এইসব গোপন ব্যাপার আপনাকে খুলে বলেননি?

-বলেননি। কেন বলেননি শিগগির জানা যাবে।

একটু পরে আমার মনে পড়ল, মিঃ সিনহার বেডরুমে খাটের তলায় দলা পাকানো কাগজটার কথা। বললুম–কর্নেল! মিঃ সিনহার খাটের তলায় ত্রিভুজ আঁকা কাগজটা সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?

একটু ধৈর্য ধরো। আমি অফিসার-ইন-চার্জ মিঃ পাণ্ডের সঙ্গে কথা বলে নিই।

কর্নেল টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করতে থাকলেন। তারপর বললেন–মিঃ পাণ্ডের সঙ্গে কথা বলতে চাই।… আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।…. সরকারি ডাকবাংলো থেকে। … নমস্তে মিঃ পাণ্ডে!…. হ্যাঁ। মেজর গুপ্টা একটু আগে আমার কাছে এসেছিলেন। শুনুন! একটা জরুরি কাজ করা দরকার। একটা কালো অ্যামবাসাডর গাড়ির নম্বর দিচ্ছি। লিখে নিন… কর্নেল গাড়ির নম্বর পকেট থেকে খুদে নোটবই খুলে জানিয়ে দিলেন। তারপর বললেন–নম্বরটা ভুয়ো হতেও পারে। তবে আমার মনে হয় বরমডিহাতে কালো অ্যামবাসাডরের সংখ্যা কম। একটু চেষ্টা করলেই খোঁজ পাওয়া যাবে। …. নম্বরে না মিললে গাড়িটার চাকা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করবেন। গিরিমাটির গুড়ো টায়ারের খাঁজে পাওয়া যেতে পারে। … না। না। আমার ধারণা, গাড়ির মালিক চাকা ধোয়ার কথা চিন্তা করবে না। যদি চাকা ধোয়া হয়, সেটাও আপনারা বুঝতে পারবেন। … হ্যাঁ। চাকা ধোয়ার জল চোখ এড়িয়ে যাবে না। এরপর গাড়িটা সিজ করবেন। মালিককে অ্যারেস্ট করবেন। ….কারণটা শুনতে চান?…. ওই গাড়িতে চাপিয়ে নরবানরকে জঙ্গল থেকে আনা হয়েছে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। মিঃ পাণ্ডে! এরও কারণ আছে। সম্ভবত আজ রাত্রে কোথাও নরবানর দেখা দেবে। তাকে আবার দেখা দিতেই হবে। চেতনলাল যে মিথ্যা বলেননি, তা প্রমাণ করার জন্য তো বটেই, উপরন্তু বরমডিহাতে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য তার আবির্ভাব ঘটবে। … হ্যাঁ। শহরের যেসব জায়গা উঁচু এবং গাছপালা আছে, সেখানে যদি সম্ভব হয়, সশস্ত্র পুলিশবাহিনীর গোপনে টহল দেওয়া উচিত। … হ্যাঁ। ঠিক ধরেছেন। রাখছি। নমস্তে।

কর্নেল রিসিভার রেখে নিভে যাওয়া চুরুটটি ধরালেন। তারপর হেলান দিয়ে বসলেন। আমি বললুম–সেই দলা-পাকানো কাগজে আঁকা ত্রিভুজের ব্যাপারটা কী?

–আরও কিছুক্ষণ ধৈর্য ধরো। বলে কর্নেল চোখ বুজে ধ্যানমগ্ন হলেন। চুরুটের নীল ধোঁয়া উঠে তার প্রশস্ত টাক ছুঁয়ে কেলা করতে থাকল।

মিনিট পনেরো পরে বারান্দায় জুতোর শব্দ শুনতে পেলুম। কারা দ্রুত হেঁটে আসছে সম্ভবত। তারপর মিঃ সিনহার কথা শোনা গেল।–ঠিক আছে। তুমি নীচে অপেক্ষা করো।

কর্নেল চোখ খুলে সিধে হয়ে বসলেন। ডাকলেন–আসুন মিঃ সিনহা!

মিঃ সিনহার মুখে উত্তেজনার ছাপ স্পষ্ট। ঘরে ঢুকেই শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে বললেন–প্রদোষকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিকেল তিনটেতে সে সাইকেলে বাজার গিয়েছিল। তার দেরি দেখে গয়ানাথ ঠাকুরকে পাঠিয়েছিলুম। গয়ানাথ ফিরে এসে বলেছিল, প্রদোষের সাইকেল একটা স্টেশনারি দোকানের সামনে দাঁড় করানো আছে। সেই দোকানের মালিক বলেছে, প্রদোষ সাইকেল তার জিম্মায় রেখে কোথায় গেছে। এখন প্রায় সাতটা বাজে। তার পাত্তা নেই।

 কর্নেল বললেন সেই স্টেশনারি দোকানে খোঁজ নিয়েছেন?

–আমি সেখান থেকেই আসছি। প্রদোষ সেখানে ফেরেনি। স্টোরের মালিক সাইকেলটা দোকানে ঢুকিয়ে রেখে আমার বাংলোয় ফোন করেছিল। আমি তখন বেরিয়ে পড়েছি। আমি বুঝতে পারছি না, প্রদোষ এমন একটা সাংঘাতিক বিপদের সময় কোথায় থাকতে পারে। বিশেষ করে চেতনলাল আজ নাকি নরবানরটাকে দেখেছে। আতঙ্কে পাঁচটার মধ্যেই বরমডিহার দোকানপাট এবং বাড়িঘর সব বন্ধ হয়ে গেছে। স্টেশনারি দোকানের মালিকও দোকানের দরজা বন্ধ করে আলো জ্বেলে ভিতরে বসে ছিলেন। প্রদোষ আমার লোক তাই তিনি তাকে খাতির। করেন। সে না ফেরা পর্যন্ত উনি অপেক্ষা করছিলেন।

কর্নেল পকেটের ভিতর হাত ভরে একটা কাগজ বের করলেন। দেখলুম, সেই দলা-পাকানো ত্রিভুজ আঁকা চিরকুটটা। কর্নেল বললেন–আপনি এটা দেখেছিলেন। আবার দেখুন। দিল্লি, শাহাবাদ, বরমডিহা লেখা আছে ইংরেজিতে। এই লেখাটা প্রদোষের বলে আমার বিশ্বাস।

মিঃ সিনহা কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখার পর বললেন–আশ্চর্য! এটা প্রদোষেরই লেখা। কিন্তু কেন সে এটা লিখে দলা-পাকিয়ে আমার খাটের তলায় ফেলে রেখেছিল?

কর্নেল হাসলেন। তখন আমরা আপনার ড্রয়িংরুমে বসে এই ত্রিভুজ নিয়ে কথা বলছিলুম। সে আড়াল থেকে শুনে তখনই ত্রিভুজ এঁকে তিনটে স্থাননাম লিখে আপনার খাটের তলায় দলা-পাকিয়ে ফেলে এসেছিল।

–কেন এ কাজ সে করেছে?

–আমাকে বিভ্রান্ত করাই তার উদ্দেশ্য ছিল। রহস্যটা যাতে আরও জটিল হয়ে ওঠে, সেইজন্য প্রদোষ এই কাজটা করেছিল। মিঃ সিনহা! প্রদোষ সম্ভবত নিজের বিপদ আঁচ করে তার গার্জেনের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। চলুন! আমরা তার বাড়িতে হানা দিই। তবে পুলিশের সাহায্য দরকার। আমরা থানা হয়েই যাব।

মিঃ সিনহা বললেন কিন্তু কে তার গার্জেন?

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–আপনার কারখানার ম্যানেজার রাকেশ ত্রিবেদী।

.

নরবানর এবং অলোককান্তি

 নীচে গিয়ে দেখলুম, বন্দুক হাতে একজন ষণ্ডাগণ্ডা চেহারার লোক প্ৰসাদজির সঙ্গে কথা বলছিল। আমাদের দেখে সে সেলাম দিল। মিঃ সিনহা বললেন–আমার কারখানার গার্ড নাথুরামকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছি। আজ কালো দৈত্য সম্পর্কে যা গুজব রটেছে, একা বেরুতে সাহস পাইনি। ওকে ডেকে পাঠিয়েছিলুম।

নাথুরাম আগেই সামনের সিটে তার মালিকের বাঁদিকে উঠে বসেছিল। আমি ও কর্নেল পিছনে বসলুম। কর্নেল বললেন–আগে থানায় চলুন মিঃ সিনহা!

রাস্তার দু-ধারে কুয়াশার মধ্যে আলোগুলো নিষ্প্রভ দেখাচ্ছিল। জানালার কাঁচ তুলে দিতে হল। গাড়ির হেডলাইটে রাস্তা একেবারে জনমানবহীন দেখছিলুম। একটু পরে কর্নেলকে চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলুম-প্রদোষ সম্পর্কে আপনি এত সিওর হলেন কী করে?

কর্নেল আমার কথায় কান দিলেন না। নাথুরাম জানালার কাঁচ তোলেনি। তাই ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকে প্রচণ্ড শীত করছিল। একটু ঝুঁকে কর্নেল ডাকলেন–নাথুরাম!

বন্দুকবাজ লোকটি মুখ ঘুরিয়ে বলল–বোলিয়ে সাব!

কর্নেল হিন্দিতে বললেন–হঠাৎ কোথাও কালো দৈত্যকে দেখতে পেলে যেন গুলি ছুঁড়ো না।

–কেন সাব?

–সে আমাদের গাড়ি তুলে দূরে ছুঁড়ে ফেলবে। তুমি কি শোনননি তার গায়ে গুলি বেঁধে না?

শুনেছি। পুলিশ তাকে গুলি করে মারতে পারেনি।

—তাহলে মনে রেখো, দৈবাৎ তাকে কোথাও দেখতে পেলেই আমাকে জানাবে। মিঃ সিনহা! আপনাকেও একই পরামর্শ দিচ্ছি। দেখামাত্র আমাকে জানাবেন। তারপর আমি যা করতে বলব, তাই করবেন।

মিঃ সিনহা বললেন–ঠিক আছে। কিন্তু রাকেশ ত্রিবেদী…

–এখন ওকথা নয় মিঃ সিনহা!

এবার কিছুটা সমতল জায়গায় দু-ধারে ঘন বসতি দেখা যাচ্ছিল। সব ঘরের জানালা বন্ধ। শীত এবং নরবানর বা কালা দেওয়ের আতঙ্ক এর কারণ। রাস্তায় মাঝে মাঝে একটা করে গাড়ি যাতায়াত করছিল। তাদের স্পিড চোখে পড়ার মতো। ডাইনে-বাঁয়ে ঘুরতে ঘুরতে গাড়ি এগোচ্ছিল। কিছুক্ষণ পরে যেখানে থামল, সেখানে দু-ধারে গাছের সারি। হেডলাইটে মসৃণ পিচের পথ বাঁদিকে বেঁকে যেতে দেখলুম। মিঃ সিনহা বললেন–গাড়ি এখানেই রাখছি! গেটের ভিতর ঢুকতে দেবে না।

কর্নেল বললেন–নাথুরাম পাহারা দিক! কালো দৈত্য থানার কাছে আসবে না। পুলিশকে কে না ভয় পায়?

নাথুরাম হাসবার চেষ্টা করল মাত্র। আমরা তিজনে গাড়ি থেকে নেমে থানার গেটের ভিতরে এগিয়ে গেলুম। গেটে সেন্ট্রি ছিল। বাধা দিল না। সম্ভবত মিঃ সিনহাকে চেনে। কিংবা তাগড়াই চেহারার কর্নেলকে দেখে বিদেশি সায়েসুবো ভেবেছে।

কর্নেল আস্তে বললেন–পুলিশফোর্স সম্ভবত টহলদারিতে বেরিয়েছে। থানায় লোজন কম দেখছি।

বারান্দায় একজন পুলিশ অফিসার কর্নেলকে দেখে ইংরেজিতে বললেন বলুন! আপনার জন্য কী করতে পারি?

 কর্নেল পকেট থেকে তার নেমকার্ড দিয়ে বললেন–ও সি মিঃ পাণ্ডের সঙ্গে দেখা করব। তাকে এই কার্ডটা পৌঁছে দিলে খুশি হবো।

পুলিশ অফিসার একটু হেসে বললেন–আপনিই কর্নেল সরকার? আসুন। আসুন!

ও সি মিঃ হরিহর পাণ্ডে প্রকাণ্ড মানুষ। গায়ের রং ফরসা। তা না হলে তাবে কালো দৈত্যের ভূমিকায় চমৎকার মানিয়ে যেত। তার সামনে মেজর গুপ্টা বসে ছিলেন। কর্নেল সহাস্যে বললেন–গুড লাক! আপনাকে পেয়ে ভালো হল।

মিঃ পাণ্ডে আমাদের নমস্তে করার পর বসতে বললেন। মিঃ সিনহা তার পরিচিত। তাকে দেখে মিঃ পাণ্ডে বললেন–আবার গোডাউনে ডাকাতি নাকি? দেখবেন স্যার! পরপর এভাবে বিশেষ ধরনের ইনডাস্ট্রিতে ডাকাতরা হানা দিলে চাকরি বাঁচানো যাবে না। কী বলেন মেজর গুপ্টা?

কর্নেল বললেন–মিঃ সিনহার বাড়ির কেয়ারটেকার প্রদোষ সেন বেলা তিনটে থেকে নিখোঁজ।

মিঃ সিনহা সংক্ষেপে ব্যাপারটা জানিয়ে বললেন–কর্নেল সরকার বলছেন, প্রদোষ তার গার্জেন রাকেশ ত্রিবেদীর কাছে আশ্রয় নিয়েছে। আপনি মিঃ ত্রিবেদীকে চেনেন?

মিঃ পাণ্ডে ভুরু কুঁচকে বললেন–রাকেশ ত্রিবেদী? আপনার কারখানার ম্যানেজার? তো কর্নেল সরকার যখন কথাটা বলেছেন, তখন এর ভিত্তি আছে। বাই দ্য বাই, কর্নেল সরকার! রাজকুমার ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির একটা কালো অ্যামবাসাডর আছে। গাড়িটার নম্বর আপনার দেওয়া নম্বরই বটে। কোম্পানির মালিক রাজকুমার সিংহ বলেছেন, গাড়িটা গতকাল থেকে আগামীকাল পর্যন্ত তিনদিনের জন্য ধরমবীর নামে তার পরিচিত এক ভদ্রলোক ভাড়া নিয়েছেন। ধরমবীর ক্যাথলিক মিশন স্কুলের একজন ক্লার্ক। মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে তাকে এখানে-সেখানে নাকি ছোটাছুটি করে বেড়াতে হচ্ছে।

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন–মেয়ের বিয়ের জন্য ধরমবীরজি কি নরবানরকেও আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছিলেন?

মিঃ পাণ্ডে অট্টহাসি হেসে বললেন–আপনি ঠিক বলেছেন কর্নেল সরকার। নরবানর গাড়িটা দূরে গভীর জঙ্গলে ছুঁড়ে ফেলেছে। ধরমবীরের পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট, ধরমবীর বরমডিহার লোক নন। তাঁর বাড়ি দেহাত এলাকায়। মিশনে রাজকুমার সিংহের ছোটো ছেলে পড়ে। সেই সূত্রে ধরমবীরের সঙ্গে তাঁর আলাপ।

কর্নেল এবার গম্ভীর হয়ে বললেন–আর দেরি করা উচিত নয় মিঃ পাণ্ডে। প্রদোষকে খুঁজে বের করতে হলে রাকেশ ত্রিবেদীর বাংলোতে হানা দিতে হবে। এই কাজটা পুলিশের। আপনার সাহায্য ছাড়া এটা একেবারে সম্ভব নয়।

মিঃ পাণ্ডেও গম্ভীর মুখে বললেন–থানায় এখন ফোর্স নেই বললেই চলে। টহলদারিতে পাঠিয়েছি। চারটে গ্রুপ নির্দিষ্ট এলাকায় ঘুরবে। একমিনিট! আমি দেখি এস আই সীতেশ শর্মাকে পাই নাকি। সীতেশ এসব কাজে এক্সপার্ট।

মেজর গুপ্টা বললেন–ওয়াকিটকি আছে তো ওঁদের কাছে?

–হ্যাঁ। তাছাড়া ওয়্যারলেস ভ্যানও একটা গ্রুপের সঙ্গে আছে। আমি সীতেশকে ধরি। বলে তিনি টেলিফোন ডায়াল করতে থাকলেন। একটু পরে সাড়া এলে তিনি বললেন–সীতেশ! তোমার দলবল নিয়ে মিঃ এ কে সিনহার কারখানার ম্যানেজার রাকেশ ত্রিবেদীর বাংলো ঘেরাও করতে হবে। শোনো! একটু দূরে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে গোপনে ঘেরাও করতে হবে। আমি বজরংবলীর মন্দিরের কাছে থাকব। আমার সঙ্গে মেজর গুপ্টা থাকবেন। আর যাঁরা থাকবেন, তারা এই অপারেশনে যোগ দেবেন।… হ্যাঁ। রাকেশ ত্রিবেদীকে তুমি তো ভালো চেনো। মিঃ সিনহা এখানে আছেন। তার কেয়ারটেকার সেই বাঙালি ছোকরা প্রদোষ নিখোঁজ। পরে সব জানতে পারবে। কুইক! আমরা বেরুচ্ছি।…।

তখনই একটা সাদারঙের অ্যামবাসাডর গাড়িতে মিঃ পাণ্ডে ও মেজর গুপ্টা উঠে বসলেন। পিছনের আসনে একজন সশস্ত্র কনস্টেবল বসল। মিঃ সিনহার গাড়িতে আমি ও কর্নেল উঠলুম। গার্ড নাথুরাম বন্দুকটা নামিয়ে পায়ের কাছে রাখল। বন্দুকটার কি লাইসেন্স নেই? নাকি পুলিশের সামনে বন্দুক হাতে রাখতে ভয় পাচ্ছে সে?

একটু পরে চাপা স্বরে বললুম কর্নেল! এতক্ষণে আমার সন্দেহ হচ্ছে, ফাদার হফম্যানের কাছে আজ সকালে আপনি এমন কোনো গোপন কথা জানতে পেরেছেন, সেই সূত্রে আপনি প্রদোষের গার্জেনকে …

কর্নেল বললেন–চুপ!

চুপচাপ বসে রইলুম। মিঃ সিনহার গাড়ির আগে মিঃ পাণ্ডের গাড়ি মন্থর গতিতে যাচ্ছিল। মিনিট দশেক পরে ঘনবসতি এলাকায় একটা মন্দিরের সামনে বটগাছের তলায় দুটো গাড়িই থেমে গেল। একটু পরে ডানদিকের রাস্তায় গাড়ির আলো দেখা গেল। তারপর দেখলুম, একটা পুলিশ ভ্যান এসে গাছের ছায়ায়। দাঁড়াল। আমরা গাড়ি থেকে নামলুম। পুলিশ ভ্যান থেকে একজন অফিসার এবং একদল সশস্ত্র কনস্টেবল নেমে এল। মিঃ পাণ্ডে চাপা স্বরে বললেন–এখান থেকে আমরা পায়ে হেঁটেই যাব। শর্টকাটে রাকেশ ত্রিবেদীর বাংলো পনেরো মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাব। সীতেশ! তুমি তোমার ফোর্স নিয়ে হোটেল সানশাইনের পিছনে। পুকুরের পূর্বদিক দিয়ে যাও। আমরা যাচ্ছি অন্য পথে। আমি না পৌঁছুনো অবধি। অপারেশন শুরু হবে না। সাবধান! আর একটা কথা। রাকেশ ত্রিবেদী নিশ্চয় একা এবং নিরস্ত্র নয়। পালটা আঘাতের জন্য তৈরি থেকো।

সীতেশবাবু তার বাহিনী নিয়ে চলে গেলেন। পুলিশ ভ্যানে ড্রাইভার এবং একজন সশস্ত্র কনস্টেবল বসে রইল। মিঃ সিনহা নাথুরামকে তার গাড়িতে অপেক্ষা করতে বলে আমাদের সঙ্গে চলে এলেন। বসতির অলিগলি ঘুরে কখনও চড়াই কখনও উতরাইয়ে নেমে অবশেষে একটা টিলার নীচে মিঃ পাণ্ডে দাঁড়িয়ে গেলেন। টিলার গায়ে একটা বাংলোবাড়ির চারদিকে আলো জ্বলছিল। আমি কর্নেলের কাছাকাছি ছিলুম। হঠাৎ কর্নেল চাপা স্বরে বলে উঠলেন–মিঃ পাণ্ডে! কোথাও নরবানর দেখতে পেলে যেন গুলি করবেন না।

মিঃ পাণ্ডে বললেন–ঠিক আছে। কিন্তু এখানে কোথাও তার আবির্ভাবের চান্স আছে কি?

–আছে! কর্নেল থেমে গেলেন। তারপর তেমনই চাপা স্বরে তিনি বলে উঠলেন–গুড়ি মেরে বসে পড়ুন সবাই। কুইক!

টিলার নীচে এখানে ঝোঁপঝাড় আছে। রাকেশ ত্রিবেদীর বাংলোয় উঠে যাওয়ার পথটা তার পাশে। সেখানে গুঁড়ি মেরে বসে মিঃ পাণ্ডে জিজ্ঞেস করলেন–নরবানর নাকি?

কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। এটাই আশা করেছিলুম। বাংলোর ডানপাশে ওই গাছটা লক্ষ করুন।

মিঃ পাণ্ডে বলে উঠলেন–ও মাই গড!

আমি খুঁজছিলুম। এবার দেখতে পেলুম ঝকড়া গাছটার সামনে আলো-ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে দুলছে একটা লোমশ ও কালো রঙের গোরিলার মতো প্রাণী। তার দুটো হাত অস্বাভাবিক লম্বা। চোখদুটো আলোর ছটায় জ্বলজ্বল করছে। দাঁতগুলো বেরিয়ে আছে।

মিঃ সিনহা এতক্ষণে প্রাণীটাকে দেখতে পেয়ে ফিসফিস করে বললেন– সর্বনাশ! রাকেশ ত্রিবেদীর বাংলোর কাছে সাংঘাতিক প্রাণীটা এসে গেছে! রাকেশ কি বাড়ি পাহারার ব্যবস্থা করেনি?

কর্নেল বললেন–সীতেশবাবুর দল এখনও এসে পৌঁছোননি। মিঃ পাণ্ডে! শুধু আপনি আমার সঙ্গে আসুন! জয়ন্ত আর মিঃ সিনহা এখানে বসে থাকুন।

মিঃ পাণ্ডে একটু দ্বিধার পর টিলার দক্ষিণদিক ঘুরে কর্নেলকে অনুসরণ করলেন। রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষায় ক্রমে নিঃসাড় হয়ে উঠছিল আমার শরীর। কিছুক্ষণ পরে উঁচুতে বাংলোর নিচু পাঁচিলের বাইরে সেই ঝকড়া গাছের কাছে কর্নেলের মাথা দেখা গেল। তারপর মিঃ পাণ্ডেকে দেখতে পেলুম। দু-জনে পাঁচিল ডিঙিয়ে, ভিতরে ঢুকলেন। নরবানরটা তখন তেমনই দাঁড়িয়ে হিংস্র দাঁত বের করে দুলছে আর দুলছে। তারপরই অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল।

কী একটা শব্দ কানে ভেসে এল এবং নরবানর অদৃশ্য হল। কিন্তু কর্নেল এবং মিঃ পাণ্ডেও কি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। নাকি নরবানর তাদের ধরে নিয়ে গেল দূরে ছুঁড়ে ফেলার জন্য? আতঙ্কে শিউরে উঠলুম।

তারপর আশ্বস্ত হয়ে দেখলুম, মিঃ পাণ্ডে একটা লোকের মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে বাঁহাতে তার গলার কাছে জ্যাকেট খামচে ধরেছেন। কর্নেল তার পাশে উঠে দাঁড়ালেন। তার এক হাতে একটা প্রকাণ্ড কালো একটা বোঁচকা এবং অন্য হাতে উদ্যত রিভলবার।

তারপরই মিঃ পাণ্ডে চিৎকার করে বললেন–স্টার্ট দ্য অপারেশন!

বাংলোর গেটে দারোয়ানকে দেখা গেল এতক্ষণে। ওদিকে নিচু পাঁচিল ডিঙিয়ে সীতেশবাবু এবং তার বাহিনী ঢুকে পড়েছে। আমরা নীচে আছি এবং বাংলোর চারদিকে আলো থাকায় ঘটনাটা দেখতে পাচ্ছিলুম। উৎসাহে উঠে দাঁড়িয়ে মিঃ সিনহা বললেন–চলুন জয়ন্তবাবু!

দারোয়ান সামনে পুলিশ দেখে পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে। আমরা গিয়ে দেখলুম, গেট বন্ধ। মিঃ সিনহা ধমক দিলেন-গেট খুলে দাও হাজারিলাল!

দারোয়ান প্রাণ ফিরে পেয়ে গেটের তালা খুলে দিল। তারপরই সব আলো নিভে গেল এবং পরপর তিনবার গুলির শব্দ হল। আমি এবং মিঃ সিনহা তখনই মাটিতে গুঁড়ি মেরে বসে পড়লুম। ততক্ষণে টর্চের আলো একের পর এক ঝলসে উঠল। মিঃ পাণ্ডে গর্জন করলেন রাকেশ ত্রিবেদী! তোমার বাংলো আমরা ঘিরে ফেলেছি। তোমার পোষা-নরবানর আমাদের হাতে বন্দী! গুলি ছুঁড়লে তোমার বাংলোসুদ্ধ তোমাকে গুঁড়ো করে ফেলব। দশ গোনার মধ্যে তুমি মেইন সুইচ অন করো।

ওয়ান… টু … থ্রি …. ফোর … ফাইভ …. সিক্স ….

আবার আলো জ্বলে উঠল। বাংলোর বারান্দায় রাকেশ ত্রিবেদী বেরিয়ে করুণ মুখে বললেন–এ কী অত্যাচার! মিঃ পাণ্ডে, আমার বাংলোয় এভাবে আপনার হানা দেওয়ার কারণ কী?

কর্নেল তাঁর পায়ের কাছে সেই প্রকাণ্ড কালো বোঁচকা ছুঁড়ে ফেললেন। –মিঃ ত্রিবেদী! এই নিন আপনার নরবানর! কালো কাপড়ে নরবানর কাট-আউট তৈরি করে তাতে কালো পশম সেঁটে হালকা অ্যালুমিনিয়ম পাত দিয়ে কাঠামো তৈরি করেছিলেন। অসাধারণ আপনার দক্ষতা! পিছনের একটা প্রিংয়ে চাপ দিলে কাট আউটটা ছড়িয়ে গিয়ে নরবানর হয়ে উঠত। দ্বিতীয়বার স্প্রিংয়ে চাপ দিলে ওটা মুহূর্তে গুটিয়ে যেত। লোকেরা ভাবত, নরবানর অদৃশ্য হয়ে গেল। আসলে তখন ওটা মাটিতে পড়ে গুটিয়ে যেত ভঁজে-ভঁজে। মিঃ পাণ্ডে! আপনারা আইনের কাজ শুরু করুন।

মিঃ পাণ্ডে বললেন–সীতেশ! আগে ত্রিবেদীকে অ্যারেস্ট করো। কর্নেল সরকার! এবার আমরা বাংলো সার্চ করতে চাই। আসুন!

বলে তিনি একজন সশস্ত্র পুলিশকে ইশারা করলেন।–একে ধরে রাখো।

কনস্টেবলটি লোকটার দুটোহাত পিছনে টেনে প্যান্টের পকেট থেকে দড়ি বের করে বেঁধে ফেলল। রাকেশ ত্রিবেদী করুণ মুখে মিঃ সিনহাকে বললেন–এসব কী হচ্ছে স্যার?

মিঃ সিনহা দাঁতমুখ খিঁচিয়ে সাদা বাংলায় বললেন–বিশ্বাসঘাতক! তোমার। বাপের ছেরাদ্দ হচ্ছে। কোথায় সেই প্রদোষ ব্যাটাচ্ছেলে?

ততক্ষণে কর্নেল এবং মিঃ পাণ্ডে ভিতরে ঢুকেছেন। আমিও ঢুকে পড়লুম। কর্নেল একটা ঘরে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন–দরজা না খুললে ভেঙে ফেলা হবে।

তিনি দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করলেন। ওদিকে মিঃ পাণ্ডে পাশে বাথরুমের দরজায় লাথি মারছিলেন। একটু পরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল মিঃ সিনহার কেয়ারটেকার প্রদোষ সেন।

মিঃ সিনহা তাঁর কারখানার ম্যানেজার রাকেশ ত্রিবেদীকে ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢোকালেন। রাকেশবাবুর হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিয়েছিলেন সাব-ইস্পেকটর সীতেশবাবু। তিনিও ঘরে ঢুকলেন। মিঃ সিনহা ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বরে বললেন– স্কাউন্ড্রেল! তুমিই প্রদোষ হারামজাদাকে দিয়ে গোপন ফাইল চুরি করিয়েছ, এতে কোনো ভুল নেই। শিগগির বলো, কোথায় সেই ফাইল?

আমি মেজর গুপ্টাকে খুঁজছিলুম। বাংলোয় ওঠার সময় তাকে লক্ষ করিনি। এতক্ষণে দেখলুম, তিনি একজন শিখ ভদ্রলোকের কানের পাশে রিভলবারের নল ঠেকিয়ে তাকে ধরে আনছেন। বললুম–এঁকে কোথায় পেলেন মেজর গুপ্টা?

মেজর বললেন–ইনি গ্যারেজে লুকিয়ে ছিলেন। উত্তরদিকের পাঁচিল ডিঙিয়ে পালানোর সময় আমাকে দেখে এই ভদ্রলোক গ্যারেজে ঢুকে পড়েছিলেন। মনে হচ্ছে, এই চক্রেরই লোক।

সীতেশবাবু রাকেশ ত্রিবেদীকে বললেন–ওই ঘরে কারা আছে?

রাকেশ ত্রিবেদী বললেন–আমার মিসেস। ভয়ে দরজা খুলছেন না।

মিঃ সিনহা বললেন–এই মিথ্যাবাদী! গত সপ্তাহে তোমার বউ-ছেলেমেয়েদের দিল্লি পাঠিয়েছ বলছিলে। যাও! দরজা খুলতে বলল। দেখি তোমার ফ্যামিলির চেহারা!

মিঃ পাণ্ডে কর্নেলের পাশে গিয়ে দরজায় লাথি মারছিলেন। একটা দরজা ভেঙে পড়ল। তারপর ওঁরা ভিতরে ঢুকে গেলেন। আমি গিয়ে দেখি, খাটের কোনার দিকে জড়োসড়ো হয়ে কম্বলমুড়ি দিয়ে দু-জন বসে আছে। মিঃ পান্ডে কম্বলদুটো টেনে ফেলে দিলেন। একজন শক্তসমর্থ গড়নের যুবক এবং একজন সুন্দরী যুবতী বেরিয়ে পড়ল কম্বলের আড়াল থেকে। কর্নেল বললেন–তুমি সুশান্ত?

যুবকটি কিছু বলার আগেই মিঃ সিনহা ছুটে এসে বললেন–কর্নেল সরকার! এই সেই সুশান্ত। আর এই মেয়েটা ওর বউ সেজে এসেছিল। এখন আমার সন্দেহ হচ্ছে, মেয়েটা ওর বউ নয়।

কর্নেল খাটের তলায় টর্চের আলো ফেলে বললেন–মনে হচ্ছে, ওই সুটকেসটা এদেরই।

তিনি টেনে সেটা বের করতেই মিঃ সিনহা বললেন–চিনেছি। সুশান্তর সুটকেস!

কর্নেল বললেন–সুটকেসের চাবি দাও সুশান্ত! না দিলে তালা ভাঙতে বাধ্য হবো।

সুশান্ত সোয়েটারের তলা দিয়ে হাত ভরে একগোছ চাবি বের করল। তারপর কঁদোকাঁদো মুখে বলল–আমি চুরি করিনি। প্রদোষ মামাবাবুর আলমারির লকার ভেঙে ফাইল চুরি করে আমাকে দিয়েছিল। আমি ভিতরকার ব্যাপার একটুও জানি না। এই মাধবী সব জানে। সে আমাকে এখানে আসতে বলেছিল। সে আমাকে যা বলেছে, আমি তা-ই করেছি।

কর্নেল চাবি নিয়ে নির্দিষ্ট চাবি দিয়ে সুটকেস খুললেন। কাপড়ের তলায় কালো রঙের একটা চেন আঁটা ফাইল দেখা গেল। মিঃ সিনহা উত্তেজিতভাবে বললেন– এটাই আমার সেই গোপন ফাইল! ওটার চেন টেনে খুলুন তো কর্নেল সরকার! দেখি, নকশা আর কাগজপত্র আছে কিনা।

কর্নেল চেন টেনে খুলে তাকে ভিতরটা দেখালেন। মিঃ সিনহা জোরে শ্বাস ছেড়ে বললেন–সব আছে। ভগবান আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন কর্নেল সরকার।

মিঃ পাণ্ডে বললেন–কর্নেল সরকার। এই সুশান্ত আর মাধবী কার জন্য। প্রদোষের সঙ্গে চক্রান্ত করে মিঃ সিনহার এই গোপন ফাইল চুরি করেছে, আপনি কি জানেন?

কর্নেল বললেন–এটুকু জানি, সুশান্ত মিঃ সিনহার পিসতুতো দাদার ছেলে। কার জন্য সে ফাইল চুরি করেছে, দেখা যাক।

মিঃ সিনহা বললেন সুশান্ত এখানে হনিমুনে আসতে চেয়েছিল। আমি তাদের জন্য পুরোনো ফরেস্ট বাংলো বুক করে রেখেছিলুম। তারপর সেখানে ওরা নরবানর দেখে ভয় পেয়ে পালিয়ে আসে। তারপর…

তাঁর কথায় বাধা পড়ল। ড্রয়িংরুম থেকে মেজর গুপ্টা ডাকলেন–কর্নেল : সরকার! আপনার সেই ছবির মানুষকে দেখবেন আসুন।

কর্নেলের সঙ্গে আমি ড্রয়িংরুমে এলুম। অবাক হয়ে দেখলুম, সেই শিখ। ভদ্রলোকের ছদ্মবেশ মেজর গুপ্টা খুলে ফেলেছেন এবং বেরিয়ে পড়েছেন অধ্যাপক অরিন্দম সিংহ!

মিঃ সিনহা আমাদের পিছনে ছিলেন। তিনি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন–এ কী! অরু, তুমি! শিখ সেজে রাকেশের পাল্লায় পড়েছ কেন? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!

কর্নেল বললেন–মিঃ সিনহা! আপনার বৈমাত্রেয় ভাইটি একসময় কেন্দ্রীয় পরমাণু গবেষণাকেন্দ্রের বিজ্ঞানী ছিলেন। নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে এঁর ডিগ্রি আছে। কবছর আগে রাশিয়া সফরে গিয়ে ইনি নিখোঁজ হয়ে যান। সেই খবর সব কাগজে বেরিয়েছিল। তাঁর ছবিও ছিল খবরের সঙ্গে। আমার কাছে তার কাটিং আছে। ইনিও আপনার মতো এ কে সিনহা। তবে প্রোফেসর এ কে সিনহা।

মেজর গুপ্টা বললেন–দেখা যাচ্ছে, ইনি ভারতে গোপনে ফিরে এসেছিলেন। কোনো গোপন উদ্দেশ্য নিশ্চয় ছিল। তাই নরবানরের কাট-আউট এবং দুটো প্রকাণ্ড লোহার পায়ের পাতা তৈরি করেছিলেন। সেই পা দুটো গ্যারেজে আছে।

কর্নেল বললেন কলকাতায় গিয়ে মিঃ সিনহা তার ভাইয়ের ব্যাপারে কথাপ্রসঙ্গে আমাকে বলেছিলেন, সুইচ তৈরিতে সাহায্য চাইলে তার এই ভাই তাকে লোভ দেখান গোপন সরকারি নকশাটি বিদেশে বিক্রি করলে কোটি-কোটি টাকা পাওয়া যাবে। এই কথা শোনার পর তার ভাইয়ের ফোন নম্বর আর ঠিকানা নিয়ে সেদিন বিকেলেই দেখা করতে গিয়েছিলুম। নিউ আলিপুরের মতো পশ এরিয়ায় তার বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট দেখে সন্দেহ হয়েছিল। নিছক একজন। অধ্যাপকের আর্থিক অবস্থার সঙ্গে এই বৈভবের কোনো সঙ্গতি নেই। তাছাড়া তার। পার্সোনাল ল্যাবরেটরিও আছে। তারপর তার মুখের দিকে তাকিয়ে খবরের কাগজের কাটিংয়ে নিখোঁজ পরমাণুবিজ্ঞানী অলোককান্তি সিংহের আশ্চর্য মিল লক্ষ্য করছিলুম। ক্যামেরা রেডি ছিল। তার ছবি তুলেই ঘর থেকে কেটে পড়ি। আমার সঙ্গে জয়ন্তও ছিল। সে এক নাটকীয় ব্যাপার। আমি বাড়ি ফেরার আগেই চালাকি করে ইনি আমাকে ফোন করেছিলেন। পরে আবার উড়ো ফোনে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছিলেন। ইনি খুবই ধূর্ত।

মেজর গুপ্টা বললেন–এই সেই অলোককান্তি! আসল নামটা আমার এতক্ষণে মনে পড়ল।

মিঃ সিনহা নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে ছিলেন। এবার তিনি বলে উঠলেন– হ্যাঁ। বাবা নাম রেখেছিলেন অরিন্দম। আর ওর মা-আমার বাবার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী সুরঞ্জনা দেবী নাম রেখেছিলেন অলোককান্তি। বিমাতা হলেও আমার প্রতি তার স্নেহ ছিল অকৃত্রিম। আমার নাম অনিমেষকান্তির সঙ্গে মিলিয়ে অলোককান্তি। কিন্তু বাবার দেওয়া নামটাই ও পছন্দ করত। তাই আমিও অরিন্দম বলতুম। ডাকতুম অরু নামে। ওর একটা অদ্ভুত অভ্যাস ছিল। ও নিজের নেমকার্ডে আমার মতোই এ কে সিনহা লিখত। শুধু নামের আগে প্রোফেসর শব্দটা থাকত।

এই সময় মিঃ পাণ্ডে সুশান্ত ও মাধবীকে ভিতরের ঘর থেকে নিয়ে এলেন। মিঃ পাণ্ডের এক হাতে ওদের সুটকেস। মিঃ সিনহার হাতে সেই কালো ফাইল নেই দেখে বুঝলাম, ফাইলটা সুটকেসে ঢোকানো হয়েছে। কারণ এটা একটা রীতিমতো অপরাধমূলক কেস। মিঃ সিনহার ওই ফাইল পেতে দেরি হবে।

মিঃ পাণ্ডে অরিন্দম বা অলোককান্তিকে দেখে সহাস্যে বললেন–এটি কে?

মেজর গুপ্টা বললেন–এটিই সেই মূল আসামী। শিখ ভদ্রলোক সেজে গ্যারাজে ঢুকেছিল। টর্চের আলোয় ওখানে দুটো লোহার পা দেখেছি। নরবানরের পায়ের ছাপ ফেলার জন্য তৈরি। থানায় ফিরে সব বলব। কালো একটা অ্যামবাসাডরও গ্যারেজে আছে।

মিঃ সিনহা বললেন–হ্যাঁ। রাকেশ ত্রিবেদীর নিজস্ব একটা গাড়ি ছিল। ওর মুখেই শুনেছি। গাড়িটা বেচবে বলেছিল। কারণ আমার কোম্পানি ওকে একটা মারুতি গাড়ি দিয়েছে। কিন্তু গাড়িটা দেখিনি।

কর্নেল বললেন–তাহলে রাজকুমার ট্রান্সপোর্টের কালো গাড়িটার নম্বর মিঃ ত্রিবেদীর গাড়িতে আজ ঝোলানো হয়েছিল! উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর ফন্দি!

মিঃ পাণ্ডে সুশান্ত ও মাধবীর দিকে তাকিয়ে বললেন–জেরার চোটে এরা স্বীকার করেছে, মিঃ সিনহার ভাই নাকি বিজ্ঞানের অধ্যাপক। তার ল্যাবে এরা কাজ করে।

মেজর গুপ্টা হাসলেন।–এই সেই বিজ্ঞানের অধ্যাপক। প্রোফেসর এ কে সিনহা।

মিঃ পাণ্ডে বললেন–নরবানরের পিছনে সুইচ টেপার জন্য যে লোকটা দাঁড়িয়ে ছিল, সে-ও কি বিজ্ঞানের অধ্যাপকের ল্যাবে কাজ করে?

সীতেশবাবু বললেন–এই ঠাণ্ডার রাতে হাজতঘরে ঢুকলে সব কথা বেরিয়ে আসবে।

মেজর গুপ্টা বললেন–তাহলে এবার থানায় ফেরা যাক।

কর্নেল বললেন–আপনারা যান! নরবানরের বোঁচকাটা নিয়ে যেতে ভুলবেন না। মিঃ সিনহাকে তো আপনাদের সঙ্গে থানায় অবশ্যই যেতে হবে। আমি আর জয়ন্ত ডাকবাংলোয় ফিরতে চাই। মিঃ পাণ্ডে আশা করি আমাদের যাওয়ার জন্য একটা ব্যবস্থা করবেন।

নিশ্চয় করব। সীতেশের গাড়ির ড্রাইভার আমার গাড়িতে আপনাদের পৌঁছে দেবে। বলে মিঃ হরিহর পাণ্ডে ঘোষণা করলেন–দ্য অপারেশন ইজ ওভার। তারপর ঠাণ্ডাহিম নিঝুম রাত্রিটাকে বিকট অট্টহাসিতে কাঁপিয়ে দিলেন।…

.

হালদারমশাইয়ের প্রত্যাবর্তন

ডাকবাংলোয় ফিরে কফি খেতে খেতে বললুম–আমার প্রশ্নের উত্তর দেননি কর্নেল!

কর্নেল বললেন কোন প্রশ্নের?

–আপনি কেমন করে জানলেন প্রদোষ মিঃ ত্রিবেদীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে?

তোমার দৃষ্টিশক্তি তীক্ষ্ণ হলে তুমিও জানতে পারতে!

–ওঃ কর্নেল! এখনও হেঁয়ালি করছেন!

–আজ বিকেলে আমরা পাথরের আড়ালে বসে কালো গাড়িটাকে আসতে দেখেছিলুম। তুমি আমার পাশে ছিলে। তাহলেও আমাদের প্রায় নাকের ডগা দিয়ে যখন গাড়িটা চলে গেল, তখন গাড়িটার ডানদিকে ড্রাইভারের সিটে বসে ছিলেন রাকেশ ত্রিবেদী। আর তার বাঁ-পাশে ছিল প্রদোষ। কয়েক সেকেন্ডের দেখা। কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, ওরকম পুরোনো কালো অ্যামবাসাডর মিঃ সিনহার কারখানার ম্যানেজারকে মানায় না। তাছাড়া কারখানায় গিয়ে যে কয়েকটি গাড়ি দেখেছিলুম, সবগুলোই নতুন মডেলের নতুন গাড়ি। তাহলে এই অ্যামবাসাডরটি কার? আমার একটা ভুল ধারণা মাথায় গজিয়েছিল, ওই গাড়ির মালিকও দুষ্টচক্রে জড়িত আছে। তবে যদি দিল্লি-শাহাবাদ-বরমডিহাতে দারোয়ানদের ছুঁড়ে ফেলার শক্তি সম্পর্কে প্রশ্ন করো, তাহলে বলব, দু-জন বলিষ্ঠ লোক উঁচু থেকে কাকেও নীচে ছুঁড়লে তার দেহ দলা পাকিয়ে যাবে।

–ঠিক বলেছেন। বেশি উঁচু থেকে কাকেও ছুঁড়ে নীচে ফেললে হাড়গোড় ফেঙে দলা-পাকানো মাংসপিণ্ড হয়ে পড়বে। কিন্তু বেচারা হালদারমশাই এই অপারেশনে এবার আমাদের সঙ্গী হতে পারলেন না। ওঁর পিচাশদর্শনও হল না।

কর্নেল হাসলেন।– তার বদলে হালদারমশাই সন্ন্যাসী সেজে জামাই আদরে কাটালেন। প্লেনে কখনও চাপেননি বলে উনি দুঃখ করতেন। সেই সাধ মিটল। আগামীকাল পাটনায় পৌঁছবেন প্লেনে। কল্পনা করো জয়ন্ত! তারপর নিজমূর্তি ধরে বাসে চেপে বরমডিহা আসবেন।

কফি শেষ করে কর্নেল চুরুট ধরালেন। এই সময় হঠাৎ কথাটা মনে এলো এবং সোজা হয়ে বসে বললুম–মাই গুডনেস! আপনি আজ সকালেই নরবানরটা যে নিছক একটা কাট-আউট, তা বুঝতে পেরেছিলেন! তাই নরবানরটা রাকেশ ত্রিবেদীর বাংলোর পাশে দেখে ভয় পাননি!

–জয়ন্ত! বরাবর দেখে আসছি। তুমি বোঝো সবই। তবে একটু দেরিতে।

রাতে খাওয়ার পর সবে শুয়েছি, এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল ফোন ধরে সাড়া দিলেন। তারপর বললেন–হালদারমশাই নাকি? কোথা থেকে বলছেন?….পাটনায় পৌঁছে গেছেন? হ্যাঁ। প্লেনে মোটে দু-ঘণ্টার জার্নি। …জয়সোয়ালজি, না ভজনলালজি হোটেল বুক করে দিয়েছেন?… জয়সোয়ালজি কি পাটনার পূর্বাচল হোটেলকে জানিয়ে দিয়েছেন তাঁর গুরুদেব এক সাধুবাবা … বুঝেছি। তাহলে কী আর করবেন? রাত্রিটা সাধুবাবা সেজে পূর্বাচলে কাটিয়ে ভোরবেলা কেটে পড়বেন। … হ্যাঁ। ছদ্মবেশ বদলানোর মতো জায়গা পেয়ে যাবেন। গঙ্গার ধারে একটা পুরোনো মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ আছে। … ঠিক আছে, আমরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। আপনি এলে গোপন কথাটা শোনা যাবে। রাখছি। গুডনাইট।…

প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার–আমাদের প্রিয় হালদারমশাই পরদিন বেলা দশটা নাগাদ ডাকবাংলোতে এসে পৌঁছেছিলেন। এখানকার ঘটনা তাকে বলার আগে কর্নেল তাঁর সংগৃহীত গোপন তথ্যটি জানতে চেয়েছিলেন।

হালদারমশাই যা বলেছিলেন, তার সারমর্ম এই :

প্রতিরক্ষা বিভাগ থেকে একটি বিশেষ ধরনের পারমাণবিক অস্ত্রের একটি সুইচ তৈরির অর্ডার পেয়েছিলেন জে এ বি ইনডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন। জে-তে জয়সোয়াল। এ-তে অনিমেষকান্তি এবং বি-তে ভজনলাল। সুইচটির তিনটি পার্ট। মূল পার্টটি নিরাপদ এবং গোপনে তৈরির জন্য অনিমেষকান্তি সিংহ বরমডিহা কারখানায় নিয়ে যান। মূল পার্ট বলেই নকশা এবং খুঁটিনাটি বিবরণের একটি জেরক্স কপি মিঃ সিনহার কাছে ছিল। অন্য দুটি পার্ট তৈরির দায়িত্ব নেন জয়সোয়ালজি এবং ভজনলালজি! গত জুন মাসে দিল্লি এবং শাহাবাদে নরবানরের আবির্ভাব হয়। দু-জনেরই গোডাউন লুঠ করা হয়। নরবানরের ভয়ে রাত্রি জনমানবহীন ছিল। সেই সুযোগ সৃষ্টির জন্যই নরবানরের আবির্ভাব। নরবানরকে সাধুবাবা প্রেমানন্দ মহারাজ বজরংবলী অর্থাৎ হনুমানজীর অবতার বলে বর্ণনা করেন এবং তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য যাগ-যজ্ঞের প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি ধ্যানবলে জেনেছেন বজরংবলীর অবতার এখন বরমডিহাতে আছে। তিনি শিগগির সেখানে। যেতে চান। ধর্মভীরু জয়সোয়ালজি এবং ভজনলালজি যখন টের পান, প্রেমানন্দ মহারাজ প্রতিরক্ষা বিভাগের গোপন অর্ডারের কথা জানেন; তখন স্বভাবত তারা ভক্তিতে আপ্লুত হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে বরমডিহায় মিঃ এ কে সিনহার নাম শুনে তারা সাধুবাবার ভক্ত হয়ে ওঠেন।

তার বিবরণ শোনার পর কর্নেল বলেন–আপনি ঠিকই বলেছিলেন। হনুমানজির চেলা সেই নরবানর গতরাত্রে আমাদের হাতে ধরা পড়েছে।

হালদারমশাই লাফিয়ে উঠেছিলেন। কন কী? হালা পিচাশেরে ধরছেন?

কর্নেল বলেছিলেন ব্রেকফাস্ট করে নিন। তারপর আপনাকে পিশাচটা দেখাতে নিয়ে যাব।

হালদারমশাই উত্তেজনাবশে বলেছিলেন-হালার পিচাশ! আমারে সারা ভারত ঘুরাইয়া মারছে।

আমি বলেছিলুম–বাঃ! আপনার কেমন প্লেনে চড়া হয়ে গেল।

অমনি গোয়েন্দাপ্রবর সহাস্যে বলেন–হঃ। তা ঠিক কইছেন।…..