মুখোশের মুখ

মুখোশের মুখ

সারকামস্ট্যান্সিয়াল এভিডেন্সের বাংলাটা কী যেন?

–পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ।

–খটোমটো বাংলা! পবিত্র অধিকারী কেমন একটু হেসে বললেন। তার মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ।–আজকের কাগজে দেখলাম কথাটা। জজসায়েব ওই সাক্ষ্যের ভিত্তিতে লোকটার মৃত্যুদণ্ড–মানে, হি শ্যাল বি হ্যাঁঙ্গড় টিল ডেথ। ওঃ!

কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের মুখে চুরুট। হাতে একটা ফাইল। তাতে খবরের কাগজের অজস্র টুকরো কাটিং। তিনি সেদিকেই দৃষ্টি রেখে বললেন–লোকটা জঘন্য অপরাধ করেছিল। এদের মতো লোককে বাঁচিয়ে রাখা বিপজ্জনক পবিত্রবাবু!

–আই এগ্রি কর্নেল সায়েব। তবে…

তবে কী?

–আইনে নাকি বলছে, এই কেসে এমন রায় একান্তভাবে জজসায়েবের ডিক্রিশন। বলে একটু উত্তেজিত হয়ে উঠলেন পবিত্রবাবু। ফের বললেন–কিন্তু কর্নেল সায়েব, চিন্তাভাবনা করে আমার মনে হয়েছে, কথাটা কী যেন, হ্যাঁ, পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়াটা গোলমেলে। দা বেসিস অব দিস ক্যাপিট্যাল পানিশমেন্ট মে বি মিসলিডিং! জাস্ট থিং।

কর্নেল ফাইলে দৃষ্টি রেখেই বললেন–হ্যাঁ। মিসলিডিং হতেও পারে।

পবিত্র অধিকারী উৎসাহে নড়ে বসলেন।–কথাটা আপনার মুখেই শুনেছিলাম।হোয়াট অ্যাপিয়ার্স মে নট বি রিয়্যাল।

এতক্ষণ চুপচাপ একটা রঙিন পত্রিকার পাতায় চোখ রেখে ওঁদের কথা শুনছিলাম। এবার একটু হেসে বললাম–পবিত্রবাবু! কর্নেল আমাকে প্রায়ই বলেন, আমাদের লজিকে কাকতালীয় যোগ বলে একটা স্বতঃসিদ্ধ কথা আছে।

পবিত্রবাবু চঞ্চল হয়ে বললেন–স্বতঃসিদ্ধ মানে? আমার আবার বাংলাটা তত আসে না। সরি!

বললাম–ওটা ইংরেজিতে অ্যাজিয়াম।

–ব্রিলিয়ান্ট!

–গাছে তাল পেকেছে। দৈবাৎ একটা কাক উড়ে এসে বসল। আর, অমনই একটা তাল পড়ে গেল। এটাই কাকতালীয় যোগ। নিছক সমাপতন। ইংরেজিতে যাকে বলে কোইন্সিডেন্স।

–আউটস্ট্যান্ডিং! খুশিতে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন পবিত্র অধিকারী। জয়ন্তবাবু! কর্নেল সায়েব। আপনিও প্লিজ শুনুন। কী যেন কথাটা? হ্যাঁ। পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য সেটাও তো কতকটা তা-ই! দা পুওর গার্ল ওয়াজ রেল্ড অ্যান্ড ব্রুট্যালি মার্ডার। ঠিক আছে। কিন্তু ঘটনার সময় কিংবা একটু আগে পরেও কেউ সেখানে হাজির ছিল না।

সায় দিলাম।–ঠিক। প্রত্যক্ষদর্শী ছিল না।

লোকটাকে পালিয়ে যেতে দেখেছে মাত্র একজন। পরে নিছক সন্দেহে পুলিশ তাকে তার গ্রামের বাড়ি থেকে অ্যারেস্ট করেছিল। পবিত্রবাবু চাপাস্বরে আবার বললেন–আপনাদের দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা, আফটার অল দা। লার্জেস্ট সাকুলেটেড নিউজ পেপার। আমার মেয়ে রঙ্গনা আজ এককপি। কিনেছিল। খুঁটিয়ে পড়ে শোনাল। তারপর আমার ওপিনিয়ন সাপোর্ট করে বলল, দা রিয়্যাল কালপ্রিট প্ল্যান করে হারুদাকে ফাঁসিয়েছে। সত্যি বলছি বাবা, এমন কিছু জঘন্য কাজ সে করতেই পারে না।

রঙ্গনা লোকটাকে চেনে তাহলে?

–চিনবে না কেন? দা পুওর গার্ল ওয়াজ হার ক্লাসফ্রেন্ড! পর্ণাদের ফ্ল্যাটে রঙ্গনা প্রায়ই যাতায়াত করেছে। অবশ্য পর্ণা আমাদের ফ্ল্যাটে এসেছে কি না মনে পড়ছে না। আমার অ্যাবসেন্সে আসতেও পারে। রঙ্গনার মনের অবস্থা বুঝে তাকে কিছু জিগ্যেস করিনি। হরঙ্গনার মায়ের মৃত্যুর পর আমি আর বিয়ে করিনি। বাইরে থেকে একটি মেয়ে এসে কাজকর্ম করে যায়। আগে কানু নামে একটা লোক এসব করত। পর্ণার শোচনীয় মৃত্যুর পর তাকে না করে দিয়েছিলাম। জয়ন্তবাবু, বুঝতেই পারছেন…..

দ্রুত বললাম–বুঝেছি।

এতক্ষণে ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে আবার কফি দিয়ে গেল। কর্নেল ফাইলটা বন্ধ করে টেবিলে রাখলেন। তারপর কফির পেয়ালা তুলে নিয়ে চুমুক দিলেন। পবিত্রবাবু সহাস্যে বললেন–আমাদের ডিস্কাশন্ কর্নেল সায়েব শোনেননি। নাকি শুনেছেন?

কর্নেল ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললেন–আমার চোখ আর কান একইসঙ্গে দুটো কাজ করতে পারে।

বললাম–হ্যাঁ। মিলিটারি লাইফের অভিজ্ঞতা। তাছাড়া পাহাড়-জঙ্গলে গেরিলাযুদ্ধের ফলে নাকি আপনার একটা ইনটুইশন…

পবিত্রবাবু সাগ্রহে তাকিয়ে ছিলেন। হাতে কফির পেয়ালা। তিনি বলে উঠলেন– ওয়ান্ডারফুল! তাহলে আমি আর জয়ন্তবাবু যাতে এগ্রি করেছি, সে সম্পর্কে হোয়াট ইজ ইওর ওপিনিয়ন? উই মাস্ট অ্যাপ্রিশিয়েট দ্যাট আ ভ্যালুয়ে। ম্যাটার।

হঠাৎ কর্নেল তুম্বো মুখে রেশমিসাদা দাড়ি মুঠোয় ধরে আস্তে বললেন– গত একবছরে এই মহানগরের নানা প্রান্তে একইভাবে কাছাকাছি বয়সের মোট পাঁচটা কুমারী মেয়েকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে। প্রত্যেকটি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মেলেনি। কিন্তু পুলিশ অন্তত সন্দেহবশেও ফ্ল্যাটের কাজের লোকগুলোকে তন্নতন্ন খুঁজে বেড়িয়েছে। আশ্চর্য তারা যেন পৃথিবী থেকে মুছে গেছে। শুধু হারু-হারাধন গাঙ্গুলি ব্যতিক্রম। বেঘোরে প্রাণদণ্ড।

বললাম–একটা প্রশ্ন।

-বলো!

–সব কেসেই কি ফ্ল্যাটের কিছু চুরি যায়নি? হারুর কেসে যেমন কিছু চুরি যায়নি শুনেছি।

-হাঃ। ফ্ল্যাটে একা পেয়ে ধর্ষণ আর খুন। কিছু চুরি যায়নি।

পবিত্র অধিকারী নড়ে বসলেন–যৌবনে একটা ফিল্ম দেখছিলাম। একই হরি ইনসিডেন্ট। কী যেন নামটা…

দ্রুত বললাম–হিচককের সাইকো!

–ইউ আর ড্যাম রাইট জয়ন্তবাবু। পবিত্র অধিকারীর আত্মবিশ্বাস যেন ফিরে এল। মুখে তৃপ্তির ছাপ ফুটে উঠল।

কর্নেল এবার তার প্রশস্ত উজ্জ্বল টাকে হাত বুলিয়ে নিয়ে বললেন অপরাধবিজ্ঞানে এসব কেস সেক্সয়াল ম্যানিয়াকদের কাজ। হোমিসাইডাল ম্যানিয়াকও বলা যায়।

উত্তেজিত পবিত্রবাবু বলে উঠলেন–হুঁ ইজ দ্যাট ব্রুট ম্যানিয়াক ইন আওয়ার মেট্রোপলিস? হ্যাভ ইউ এনি গেস কর্নেল সায়েব?

–এখনও মগজ ঘামাচ্ছি। কিন্তু আশ্চর্য লাগছে, পুলিশ এখনও কি ঘটনাগুলোর জায়গা চিহ্নিত করে একটা ম্যাপ তৈরি করেনি? করা জরুরি ছিল।

-রাইট! রাইট! তবে তা করলেও হাতের তাস পুলিশ কাকেও কি দেখাবে? নো! নেভার!

মুখে একটু কৌতুক ফুটিয়ে বললাম–লালবাজারের ডি.সি.ডি.ডি. মিঃ অরিজিৎ লাহিড়ি আপনাকে বস্ বলে মানেন।

কর্নেল চাপা শ্বাস ছেড়ে বললেন–এ-ও আশ্চর্য! অরিজিৎ এখনও নিশ্চুপ। শুধু মাসপাঁচেক আগেকার একটা ইংরেজি নিউজ-কাটিংয়ে লক্ষ করছিলুম, বুদ্ধিমান রিপোর্টার এ-রকম একটা হিন্ট দিয়েছেন। পুলিশের রথী-মহারথীরা তো কাগজ পড়েন।

–আমি দেখেছি, কাগজে ছাপা খবরকে পুলিশ তত গুরুত্ব দেয় না।

পবিত্রবাবু চার্জ করলেন–হোয়াই? কেন?

কর্নেল কফি শেষ করে নতুন চুরুট জ্বেলে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন–জয়ন্ত! তুমিই ব্যাখ্যা করো।

উত্তেজিত পবিত্র অধিকারী আমার দিকে তাকালেন। তার হোয়াই দুচোখে উজ্জ্বল।

এবার হাসি চেপে বললাম–আহা! এসব খবর তো পুলিশেরই সান্ধ্য ব্রিফিং টু দা রিপোর্টারস। তাদেরই মেপে-বলা ভার্সান। কোনও রিপোর্টার কূট প্রশ্ন তুললে খ্যাক করে ওঠা কিংবা শান্ত স্বরে নো কমেন্ট।

পবিত্রবাবু ঘড়ি দেখে চমকে উঠে বললেন–মাই গুডনেস! সাড়ে দশটায় আমাদের ট্রেডিং কর্পোরেশনে আর্জেন্ট কনফারেন্স। উঠি কর্নেল সায়েব! চলি জয়ন্তবাবু। আসলে আমার মেয়ের ক্লাশফ্রেন্ডের খবর। কিন্তু ওই যে–কী যেন?

কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানছিলেন। বললেন–পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য।

উঠে দাঁড়ালেন পবিত্র অধিকারী। বললেন–এরকম সাক্ষ্যে দুম করে মৃত্যুদণ্ড? রঙ্গনাও প্রশ্ন তুলেছে। হারাধন গাঙ্গুলি, আফটার অল হি ইজ আ ব্রাহ্মিন… এ তো ব্রহ্মহত্যা! তবে কর্নেল সায়েব, শুধু সে-জন্য নয়। রঙ্গনা তার চেনা লোক গোবেচারা হারুর ফেঁসে যাওয়া পয়েন্ট বাই পয়েন্ট এক্সপ্লেন করেছে। তাই আমি ছুটে এসেছিলাম আপনার সঙ্গে ডিসকাস করতে। আই অ্যাম সিওর দ্যাট দা রিয়্যাল কালপ্রিট ধরা পড়েনি। কর্নেল সায়েব! হিউম্যান লাইফকে ম্যাথমেটিক্‌সের বেসিসে বিচার করা ঠিক নয়। পুলিশের আর কী? একটা কড়া চার্জশিট কোর্টে সাবমিট করতে পারলে এবং জজসায়েব তা মেনে নিলে পুলিশের প্রোমোশন পাওয়ার চান্স বাড়ে। দেশে পুলিশের প্রতি ক্ষোভ কমে যায় কিছুটা। সত্যি বলছি, খবরটা শুনে আমিও বিচলিত।

বললাম–আপনার চিন্তার কারণ নেই পবিত্রবাবু। হারাধনের পক্ষ থেকে আবার কোর্টে নিশ্চয় আপিল করা হবে। হয়তো সুপ্রিম কোর্ট অবধি গড়াবে।

-হারু ইজ আ ভেরি পুওর পার্সন। যজমেনে ব্রাহ্মণের বংশধর। গ্রামে ওদের অবস্থা কেমন, তা রঙ্গনা জানে। সে একটা প্রোভার্ব শুনিয়েছে। বাংলায় বলা চলে, হাজারটা দোষী খালাস পাক। কিন্তু একজন নির্দোষেরও যেন শাস্তি না হয়। চলি জয়ন্তবাবু। কর্নেল সায়েব।

কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে চুরুট টানছিলেন। শুধু বললেন বাই।

–বাই! বাই! বলে হাত নেড়ে একটা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের একজিকিউটিভ অফিসার পবিত্র অধিকারী ড্রয়িংরুমের পর্দা তুলে সবেগে প্রস্থান করলেন।

তারপর কর্নেল ধ্যানস্থ। আমি রঙিন পত্রিকার পাতায় সুন্দরীদের খুঁজছিলাম। তারা কেউ নেই। আছে ফুল আর প্রজাপতি। অগত্যা ফুলে ফুলে প্রজাপতিদের মধুপান দেখতে মন দিলাম। ছবি অনেক সময় নিষ্প্রাণ হয় না…

.

সময়টা ছিল মার্চের মাঝামাঝি একটা কাজের দিন। মনে পড়ছে, সেটা ছিল মঙ্গলবার। সোমবার সেশন জজ হারাধন গাঙ্গুলিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। পবিত্র অধিকারীর মতোই নেহাত পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড মেনে নিতে পারিনি। তবে তদন্তকারী পুলিশ অফিসার এই কেসে মরিয়া হয়ে একটার পর একটা তাস সাজিয়ে চার্জশিট দাখিল করতেই পারেন, এই বিশ্বাসটা কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে এসে দৃঢ় হয়েছিল। কারণ কর্নেলের ওই ফাইল! এর আগে ঠিক এমন জঘন্য কেসের সংখ্যা পাঁচ। এখন আমার বিস্ময়, পাঁচটি পরিবারে একই লোক পরিচারকের ভূমিকা নিয়েছিল কি না পুলিশ খতিয়ে দেখে চেহারার বর্ণনা নিয়েছিল। সেই বর্ণনার ভিত্তিতে পুলিশের চিত্রকর ছবি এঁকেছিল। কাগজে তা ছাপাও হয়েছিল। কর্নেলের কাছে শুনেছিলুম, একই লোক পাঁচ-পাঁচজন কুমারীকে ধর্ষণ করে মেরেছিল। পুলিশের উপর সরকারের চাপ বেড়েছিল। অবশেষে পর্ণা রায়ের হত্যাকাণ্ডের পর হারাধনকে পুলিশ পাকড়াও করে তার গ্রামের বাড়ি থেকে। হারাধনের বক্তব্য ছিল, ঘটনার দিন ভোর ছটা নাগাদ সে বাড়ি আসে। পর্ণার বাবা অরবিন্দ রায় কোটিপতি ব্যবসায়ী। তার কাছেই নাকি হারাধন আগের দিন ছুটি চেয়েছিল। কিন্তু অরবিন্দবাবু ছুটি দেওয়ার কথা অস্বীকার করেন।

কিন্তু এ-ও আশ্চর্য। কর্নেলের কাছেই শুনেছিলাম, আগের কেসে পাঁচটি পরিবারের লোকেরা কেউই বলেনি, এই হারাধনই সেই লোক! পর্ণার কেসে। চার্জশিটে অবশ্য হারাধনের ছদ্মবেশ ধরার দক্ষতা দেখানো হয়েছিল। এর ভিত্তি আপাতদৃষ্টে বিশ্বাসযোগ্য। কারণ ছোটবেলা থেকেই হারাধন যাত্রাদলে অভিনয় করত। অরবিন্দবাবুর বাসস্থানের কাছে একটা ক্লাব আছে। সেখানে হারাধন থিয়েটারেও অভিনয় করত। কিন্তু তদন্তের সময় ক্লাবের যুবকরা নাকি বলেছিল, হারুর মেজাজ ছিল খারাপ। তুচ্ছ কারণে রেগে যেত! রাস্তায় কোনও সুন্দরী মেয়েকে দেখলে অশালীন রসিকতা করত। আর এইসব পয়েন্ট : পঁচিশ বছর বয়সী হারু গাঙ্গুলির শারীরিক ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। প্রতিদ্বন্দ্বী একটি ক্লাবের ছেলেদের সঙ্গে তরুণ সংঘের ছেলেদের সংঘর্ষে হারু লিড নিয়েছে। তার ঘুষিতে বিপক্ষের কতজনের দাঁত ভেঙেছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

কর্নেলের কাছে এতসব জেনেও আমার কিন্তু মনে হয়েছিল, হারাধন গাঙ্গুলির বিরুদ্ধে চার্জশিটটা আসলে তাসের ঘর নয় তো?

.

কর্নেল কখনও-কখনও প্রসঙ্গক্রমে আমার উদ্দেশে সকৌতুকে বলেন– ময়রা কখনও সন্দেশ খায় না। জয়ন্ত চৌধুরী দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার স্পেশাল রিপোর্টার। অথচ সে খবরের কাগজ পড়ে না। ভাবা যায়?

কথাটা মিথ্যা নয়। খবরের ঘরে বসে খবর লেখা দেখি। আঁতুড়ঘরে কাটাতে হয় বলে সদ্যোজাতদের চাঁচামেচিতে কান ঝালাপালা হয়। বেরিয়ে পড়ার পর মুক্তির স্বাদ পাই।

কিন্তু হারাধন গাঙ্গুলির কেসের কোনও খবর দৈবাৎ পেয়ে যেতে পারি। তাই ইংরেজি-বাংলা সব কাগজ চা খেতে খেতে পাতা উল্টে খুঁজতাম। মাসের শেষশেষি একদিন প্রশস্ত নিউজরুমে বসে একটা ইংরেজি পেপারব্যাক থ্রিলার পড়ছি। বিকেল চারটেতে আমাদের আদালতের সংবাদদাতা সমীর সোম ঘরে ঢুকেই ঘোষণা করল হাইকোর্ট হারু গাঙ্গুলির ফাঁসি আজ অ্যাপ্রুভ করেছে। বাপস! এত দেরির কোনও মানে হয়?

সমীরের মুখে উল্লাসের হাসি। সারা নিউজরুম জুড়ে একই উল্লাসের হল্লা উঠল। কেউ বলল–অসহ্য সুখবর। কেউ বলল–এটাই চাইছিলাম। কেউ বলল জানোয়ারটার উচিত শান্তি হয়েছে। এদেশে গুলি করে মারার আইন থাকা উচিত ছিল! নিউজ বিউরোর চিফ সত্যদা সেক্রেটারিয়েট টেবিল চাপড়ে হুংকার দিলেন– স্টপ! স্টপ দা শাউটিং।

এবার ঘরে যাকে বলে পিনড্রপ সাইলেন্স! সত্যদা গম্ভীর কণ্ঠস্বরে বললেন–আমি তোমাদের সঙ্গে একমত। কিন্তু সমীর! হাইকোর্ট সেশনকোর্টের ডেথ সেন্টেন্সে অ্যাপ্রুভ্যাল দিতে এত দেরি করল কেন? আই মিন, এই পয়েন্টটার ব্যাখ্যা দেবে খবরে। ব্যাখ্যার পয়েন্ট নিশ্চয় অ্যাডভোকেটদের জল্পনায় শুনেছ?

সমীর সোম সহাস্যে বলল–শুনেছি সত্যদা। আসলে নেহাত পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড! তাই অনারেবল জাজদের তিনজনকে নিয়ে গড়া বেঞ্চে সেশনকোর্টের রায় এবং কেসটার সমস্ত নথিপত্র নিয়ে ডিটেলস আলোচনা হয়েছে। এদিকে জুনে গ্রীষ্মের ছুটি। শেষাবধি বেঞ্চ কতকটা চোখ বুজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

–ঘ্যাড। সত্যদার মুখে উত্তেজনায় গুড হয়ে যায় ঘ্যাড়। সমীর! ভেরি কেয়ারফুলি প্রসিড। লক্ষ রাখবে যেন আদালত অবমাননার দায়ে না পড়ি। নো পার্সোনাল কমেন্ট!

সমীর তার নোটবই খুলে একটা নিউজপ্রিন্টের প্যাড টেনে নিল। তারপর বেয়ারা হরিপদকে সবিনয়ে বলল–হরি! এক কাপ চা এনে দাও প্লি-ই-জ!

হরিও হাসছিল। হারু গাঙ্গুলির ফাঁসি তাকে খুশি করেছিল। করবারই কথা! ওরকম শোচনীয় হত্যাকাণ্ডের ভিলেন থাকা সত্যিই তো সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক।

সহসা চমকে উঠলাম। আমি কি মনে-মনে ভিলেন শব্দটা বললাম? বইটা বুজিয়ে রেখে ব্যাগে ভরে শব্দটা সেদিনই কার মুখে শুনেছিলাম মনে পড়ল না। কিন্তু শব্দটা তীক্ষ্ণ হয়ে মগজে বিঁধে আছে, সেটা কি কারও হিংস্র উচ্চারণে?

বেরিয়ে পড়ার সুযোগ খুঁজছিলাম। সত্যদা চেয়ার ছেড়ে গিয়ে সমীরের কাঁধের কাছে উঁকি দিতেই সুযোগ পেলাম। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে চুপচাপ নিউজরুম থেকে বেরিয়ে লিফটে উঠলাম। তারপর নীচে গিয়ে সোজা আমার ফিয়াট গাড়িতে বসলাম। তারপর শর্টকাটে এগিয়ে ইলিয়াট রোড এলাকায় কর্নেলের ডেরায় পৌঁছুলাম।

ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই কর্নেল বললেন–এস জয়ন্ত! কিছুক্ষণ আগে লালবাজারের ডিটেকটিভ অফিসার নরেশ ধর টেলিফোনে আনন্দের খবর–হ্যাঁ, কথাটা তারই… তো খবরটা দিয়ে তিনি বললেন, ছটা কেসের দায়…

সোফায় ধপাস করে বসে তার কথার উপর বললাম–হাইকোর্ট হারাধনের ফাঁসির হুকুমে সায় দিয়েছে।

-হ্যাঁ। তবে নরেশবাবু বলছিলেন যুক্তিসঙ্গত কারণের ভিত্তিতে হারুকে আপিলের জন্য মাত্র একসপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছে।

শ্বাস ছেড়ে বললাম–কেন যেন মনে হচ্ছে ভুল লোককে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে।

কর্নেল হাসলেন। বুঝতে পারছি পবিত্রবাবু তোমার মগজে ঢুকে পড়েছেন।

-না। ওই পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড যদিও মাননীয় সেশন জজের ডিক্রিশন, তদন্তকারী পুলিশ অফিসারের চার্জশিট পিওর ম্যাথ যেন। কর্নেল, আপনাকে বলা হয়নি, চার্জশিটের একটা কপি আমাদের আদালতের সংবাদদাতা সমীর সোমের কাছে ছিল। আমি খুঁটিয়ে পড়েছি।

–আমিও একটা কপির তস্য কপি হস্তগত করেছি। তো..

ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে দুপেয়ালা কফি আর স্ন্যাক্স রেখে গেল। কর্নেল পেয়ালা তুলে নিয়ে চুমুক দিলেন।যাই হোক জয়ন্ত! তোমাকে বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে। আগে কফি খেয়ে নার্ভ চাঙ্গা করো। তারপর বলছি।

ষষ্ঠীর হস্তশিল্প বলা যায় তার তৈরি কফিকে। চুমুক দিতে সত্যি চাঙ্গা হয়ে উঠলাম। বললাম–বলুন এবার!  

–হুঁ। চুরুট জ্বেলে বলছি।

অধীর হয়ে বললাম–গত আড়াই মাস আপনি ঘরে বসে মগজ না ঘামিয়ে সরেজমিন তদন্তে নামতে পারতেন।

চুরুট ধরিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছড়িয়ে কর্নেল বললেন–সরেজমিন তদন্তে নেমেছি জয়ন্ত! পবিত্রবাবুর মেয়ে রঙ্গনার ক্রমাগত ফোনে অতিষ্ঠ হয়েই আমি মাঝে-মাঝে বাইরে পা বাড়িয়েছি।

–আমাকে সঙ্গী করেননি!

করিনি। কারণ আমার কাজের কোনও নির্দিষ্ট রুটিন ছিল না। হঠাৎ হঠাৎ বেরোতে হয়েছে। বলে কর্নেল নিঃশব্দ হেসে চোখে কৌতুকের ঝিলিক তুললেন। সঙ্গী নিইনি। কিন্তু প্রতিবার একজন সুন্দরী সঙ্গিনী পেয়েছি। এখন আমার অভিজ্ঞতা বলছে, অপরাধের তদন্তে সঙ্গীর চেয়ে সঙ্গিনী দুর্লভ কিছু সুযোগ-সুবিধে দেয়।

একটু হেসে বললাম–রঙ্গনা আপনার সঙ্গিনী ছিল!

–ছিল। তার বাবার মতামতের ভিত্তি যুক্তি! কিন্তু রঙ্গনা তার বন্ধু হতভাগিনী পর্ণার চেয়ে হারু গাঙ্গুলির বেশি ভক্ত ছিল। তার হারুদা তাদের দুজনকেই অদ্ভুত সব গল্প শোনাত। তাদের গ্রাম দশঘরার পাশে ঝিল আর তার ধারে শ্মশান আছে। সেই শ্মশানে মড়াখেকো পিশাচের গল্প। রঙ্গনা আমাকে বলছিল, গল্পগুলো পর্ণার চেয়ে সে বেশি এনজয় করত। আর পর্ণা ছিল একটু অন্তর্মুখী মেয়ে। তবু সে কখনও-কখনও বলত, তোমাদের গ্রামে একদিন ভূত দেখাতে নিয়ে যাবে হারুদা? হারু গাঙ্গুলি হাসতে হাসতে বলত, ভূত তত দিনে দেখা দেয় না! রাত্রে তোমাদের কেমন করে নিয়ে যাব? সায়েব-ম্যাডাম কি যেতে দেবেন? ওদিকে রাত্রে দশঘরাতে প্রচণ্ড মশার কামড়। এখনও ইলেকট্রিসিটি যায়নি। যাবে বলেও মনে হয় না। একেবারে অজ পাড়াগাঁ। রাত্রে ঝিলের দিকে শেয়াল আর পেঁচার ডাক। জয়ন্ত! হারু গাঙ্গুলি শেয়াল আর পেঁচার ডাক শোনাত। সে নাকি হরবোলাও ছিল।

রঙ্গনার ভার্সান?

–আবার কার? এখানে বিশেষ একটা কথা আছে। রঙ্গনা আমাকে বলেছিল, মেয়েরা পুরুষদের কুদৃষ্টি টের পায়। তার হারুদার চোখে কখনও তেমন কিছু দেখেনি রঙ্গনা। স্কুল ফাইনালে পাস করতে পারেনি হারু গাঙ্গুলি। হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছিল।

–পর্ণাদের ফ্ল্যাটে কোন সূত্রে চাকরি পেয়েছিল সে?

–চার্জশিটের কপি খুঁটিয়ে পড়োনি দেখছি।

–ওতে কী আছে?

–প্রধান সাক্ষীর নাম আছে। ভানু শর্মা। তার মামার বাড়ি দশঘরা ভানু পর্ণাদের পাড়ায় এক দুর্ধর্ষ রাজনৈতিক নেতার বডিগার্ড। দৈবাৎ হারু গাঙ্গুলির সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়। রায়সায়েবের একজন কাজের লোকের দরকার ছিল।

–কোন পাড়া যেন? মানে, পর্ণাদের ফ্ল্যাটটা?

–পার্ল রোড। রাস্তাটার নাম বদলেছে। কিন্তু এখনও পার্ল রোড বলে লোকেরা। পার্ক সার্কাস এরিয়া। একটা বস্তি ভেঙে সেখানে কয়েকটা ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে।

-তারপর? বডিগার্ডের সুপারিশে হারু গাঙ্গুলি অরবিন্দ রায়ের ফ্ল্যাটে কাজ পেল?

কর্নেল হাসলেন।–তুমি চার্জশিটের কপি কি সত্যি পড়েছ জয়ন্ত?

–পড়েছি। কিন্তু এখন মাথার ভিতরটা এলোমেলো হয়ে গেছে। পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ফাঁসি! কোথায় যেন পুলিশের ভুল হয়েছিল।

-কেসের প্রধান সাক্ষী তার মালিকের বাড়ির ছাদ থেকে পর্ণাদের ফ্ল্যাটবাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে হারু গাঙ্গুলিকে চুপিচুপি পালাতে দেখেছিল। তখন প্রায় দশটা বাজে। পর্ণার বাবা চৌরঙ্গিতে তাঁর হেড অফিসে গিয়েছিলেন। পর্ণার মা অপালা দেবী সাড়ে ছটায় নিজের গাড়ি চালিয়ে দমদম এয়ারপোর্টে তার দিদিকে রিসিভ করতে গিয়েছিলেন। রায়দম্পতি হারুকে খুব বিশ্বাস করতেন।

দ্রুত বললাম–ওগুলো তে চার্জশিটে আছে। তদন্তকারী পুলিশ অফিসারের ভার্সন।

–আছে। অথচ হারু এজলাসে কেঁদেকেটে বলেছে, তার ম্যাডাম বেরিয়ে যাওয়ার পর তার সায়েবের কাছে বিদায় নিতে গিয়েছিল। কিন্তু রায়সায়েবের দেখা পায়নি। অরবিন্দ রায় তোর ছটা নাগাদ তার কারবারের শরিক রমেশ জৈনের বাড়ি গিয়েছিলেন।

–চার্জশিটে এসব আছে।

-মনে পড়ছে তা হলে? ডার্লিং! কফি সত্যি ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়া নার্ভকে চাঙ্গা করে।

-হ্যাঁ। মনে পড়ছে, রায়সায়েবকে বেরুতে দেখে তার স্ত্রী বলেছিলেন, ফ্ল্যাটে পর্ণা একা থাকবে?

–আর রায়সায়েব বলেছিলেন, হারু তো আছে! আমার পোষা ডালকুত্তা।

কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে চুরুট টানতে থাকলেন।

বললাম–প্লেন লেট করেছিল। তাই ম্যাডাম রায়ের বাড়ি ফিরতে দেরি হয়েছিল। ড্রয়িংরুমের দরজাতে ইন্টারলকিং সিস্টেম আছে। আপনার দরজার মতো বাইরে থেকে চাবি ছাড়া খোলা যায় না। ভিতর থেকে হাতল ঘোরালেই খোলা যায়। কর্নেল!

-বলো। শুনছি।

–আপনার কী ধারণা?

 –কী ব্যাপারে?

 –হারু গাঙ্গুলি দোষী না নির্দোষ?

–এখনও সিদ্ধান্ত করিনি।

–প্রভাবশালী লোকের একমাত্র মেয়ে। তার শোচনীয় অবস্থা দেখে অরবিন্দবাবু হারুর বিরুদ্ধে ক্রুদ্ধ হয়ে পুলিশের কাছে মিথ্যাকথা বলতে পারেন।

–হুঁ! ওই অবস্থায় কারও মাথার ঠিক থাকে না। প্রতিহিংসায় সে উন্মত্ত হতেই পারে।

-গরিব হারু গাঙ্গুলির পক্ষে আপিলের মামলা লড়া কি সম্ভব? তা ছাড়া সেদিন আপনি বলছিলেন, হারুর ওই জঘন্য কীর্তির জন্য কোনও আইনজীবী সে পায়নি। শুধু তার বাবা-মায়ের কান্নাকাটিতে সরকারের গড়া গরিবদের জন্য লিগ্যাল এইড সার্ভিসের একজন মাত্র অ্যাডভোকেট হারু গাঙ্গুলির সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন।

–হুঁ। সব্যসাচী মিত্র।

–আপনার সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছে?

হয়েছে। তিনিও নেহাত পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড মেনে নিতে পারেননি।

ঘড়ি দেখে বললাম–এবার উঠি। সাড়ে নটা বাজে।

কর্নেল সোজা হয়ে বসে চোখ খুললেন। তারপর পোড়া চুরুটটা অ্যাশট্রেতে ঘষে নেভালেন। তারপর বললেন–আজ রাতে ডিনারে তোমার নেমন্তন্ন। তোমার ঘরটা ষষ্ঠীচরণ পরিষ্কার করে রেখেছে। তোমার গাড়ি নীচে আমার খালি গ্যারাজে থাকবে।

একটু অবাক হয়ে বললাম–থাকতে বলছেন কেন?

–কাল ব্রেকফাস্টের পর তোমার গাড়িতে অ্যাডভোকেট সব্যসাচী মিত্রের বাড়ি যেতে চাই।

-কোথায় থাকেন উনি?

–সার্কাস এভিনিউতে নিজস্ব বাড়ি।

–মাই গুডনেস! পার্ল রোড তো রাস্তাটার দক্ষিণে।

 কর্নেল ডাকলেন–ষষ্ঠী!

ষষ্ঠীচরণ ভিতরের একটা দরজার পর্দা তুলে উঁকি দিল। বলল–কফি বাবামশাই?

কর্নেল চোখ কটমট করে বললেন–তোর দাদাবাবু আমার সঙ্গে ডিনার খাবে।

-রেডি বাবামশাই!

কাছে আয়। নীচের গ্যারাজঘরের চাবিটা নিয়ে যা। জয়ন্তের গাড়িটা থাকবে। জয়ন্ত! ওঠো। ওর সঙ্গে যাও।

অগত্যা উঠে দাঁড়ালাম। তবে একটা তীব্র কৌতূহল আমার মাথার ভিতরে ভনভন করছিল।…

.

পরদিন ইংরেজি-বাংলা সব কাগেজেই লিড নিউজ বেরিয়েছিল। পাঁচ কলাম জুড়ে বড় হরফে ছাপা হেডিং। প্রায় একইরকম হেডিং। হাইকোর্টের রায়ে ফাঁসি অনুমোদন। বুঝতে পারছিলাম, এই খবর পড়ে দেশব্যাপী মানুষের উল্লাস। এটাই স্বাভাবিক ছিল। হেডিংয়ের তলায় ঈষৎ ছোট হরফে ছাপা হয়েছিল, ছয়টি কেসের ভিলেনকে খুঁজে পাওয়া গেল। এটা কলকাতা পুলিশ কমিশনারের মন্তব্য।

ভিলেন শব্দটা এবার আমাকে চাবুক মারল। কে তীক্ষ্ণ পেরেকের মতো ওটা আমার মগজে বিদ্ধ করেছিল মনে পড়ছে না। খবরের কাগজে ছাপা ভিলেন এবার চাবুকের মতো পিঠে পড়ল।

কর্নেলকে শান্ত দেখাচ্ছিল। নটা নাগাদ ব্রেকফাস্ট সেরে দুজনে বেরিয়ে পড়েছিলাম। কর্নেল খবরের ব্যাপারে আমাকে মুখ খুলতে দেননি। তারপর গাড়ি বাঁক নিতেই মনে পড়ে গেল। অফিসে যাওয়ার পথে একটা রাজনৈতিক জনসভায় এক বক্তার মুখে ভিলেন শব্দটা মাইক্রোফোনে শুনেছিলাম। বক্তা একজন বেঁটেখাটো মানুষ। চেহারাটাও আবছা মনে পড়ছিল। হাবভাবে কোনও শক্তিমান। নেতার আদল। কর্নেলকে কথাটা বলতে ভরসা পেলাম না। মুখ খুললেই আমাকে থামিয়ে দেবেন হয়তো। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, জনসভা করে সেই নেতা নারীধর্ষণ আর হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতেই ভিলেন-দমনে অকর্মণ্য সরকার এবং পুলিশের বিরুদ্ধে গর্জন করেছিলেন।

মিনিট পনেরোর মধ্যেই সার্কাস অ্যাভিনিউয়ে পৌঁছে কর্নেলের নির্দেশে বাঁদিকের ফুটপাত ঘেঁষে গাড়ি দাঁড় করালাম। একটা বাড়ির গেটের গরাদ দিয়ে দেখা যাচ্ছিল, একজন বলিষ্ঠ চেহারার মধ্যবয়সী ভদ্রলোক প্যান্ট আর স্পোর্টিং গেঞ্জি পরে লনে পায়চারি করছিলেন। আমার গাড়ির হর্নের শব্দ তিনি শুনতে পাননি। না পাওয়ারই কথা। রাস্তায় কত গাড়ি যাতায়াত করছে। অকারণ হর্ন দিচ্ছে।

কর্নেল গেটের সামনে যেতেই ভদ্রলোক হন্তদন্ত এগিয়ে এসে গেট ফাঁক করে বললেন–আসুন! আসুন কর্নেল সায়েব। আপনার প্রতীক্ষায় অস্থির ছিলাম। আজ আমার হাতে কোনও কেস নেই। তাই কোর্টে যাচ্ছি না।

কর্নেল লনে হাঁটতে হাঁটতে বললেন–আমার এই তরুণ সঙ্গী জয়ন্ত চৌধুরী। প্রখ্যাত সাংবাদিক।

সব্যসাচী মিত্র একবার ঘুরে হাসিমুখে বললেন–আই নো হিম বাই হিজ নেম। নমস্কার জয়ন্তবাবু।

নীচের তলায় তার অফিস। তিনি দোতলায় তার ড্রয়িংরুমে আমাদের নিয়ে গেলেন। একটি কাজের মেয়েকে কফি আনতে বললেন। সুসজ্জিত ঘর। তিনটে র‍্যাকভর্তি বই। বইগুলোর দিকে তাকিয়ে অবাক হলাম। বাংলা-ইংরেজি সাহিত্যের বই। রবীন্দ্রনাথের পুরো সেট। বাঃ! হারু গাঙ্গুলিকে আইনি সাহায্যের পরিপ্রেক্ষিত তাহলে আবিষ্কার করা গেল। সাহিত্য মনকে সংবেদনশীল করে। এই বাক্যটা আমার তৈরি নয়। কোথায় পড়েছিলাম মনে নেই। তবে এই লাইনটা মনে গেঁথে আছে।

সোফায় কর্নেলের মুখোমুখি বসে সব্যসাচী মিত্র আস্তে বললেন–ছবিগুলো আগে দেখতে চাই।

কর্নেল শার্টের পকেট থেকে পোস্টকার্ড সাইজের একটি হৃষ্টপুষ্ট খাম এগিয়ে দিলেন। কীসের ছবি তা দেখতে পাচ্ছিলাম না। সব্যসাচীবাবু একটার পর একটা দেখতে দেখতে বললেন–বাঃ! অসাধারণ। একই লোকের চেহারাকে ছবিতে এমন আলাদা করা যায়, ভাবতে পারিনি। তবু তো আপনার ক্যামেরায় টেলিলেন্স ফিট করে অত দুর থেকে তোলা মাত্র একটা কি দুটো ফোটোগ্রাফ!

কর্নেল বললেন–তিনটে শট। লোকটা আমাদের দিকে ঘুরতে দেরি করছিল। এবার আপনার কাজের কথা বলুন।

সব্যাসাচী মিত্র একটু হাসলেন।-কফি আসুক।

একটু পরে সেই মেয়েটি সুদৃশ্য ট্রেতে তিন পেয়ালা কফি রেখে গেল। ঘরে ঘন গুমোট স্তব্ধতার মধ্যে আমাদের কফিপান শেষ হল। কর্নেল চুরুট ধরালেন। সব্যসাচীবাবু হাত বাড়িয়ে পাশের একটা উঁচু টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা বিদেশি সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন। তারপর আমার দিকে সেটা এগিয়ে দিয়ে মৃদু হেসে বললেন–চলবে?

বললাম–থ্যাংকস! ছেড়ে দিয়েছি।

-কর্নেল সায়েবের মতো স্মোকারের সান্নিধ্যেও সিগারেট ত্যাগ আপনার মানসিক শক্তির পরিচয়।

 কর্নেল কোনও মন্তব্য করলেন না। একটু পরে তিনি বলনেল-নাও প্লিজ প্রসিড মিঃ মিত্র।

সব্যসাচী মিত্র সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে মৃদুস্বরে বললেন–গতরাত্রে অরবিন্দ রায়ের ফ্ল্যাট থেকে আমাকে অবাক করে এক মহিলা ফোন করেছিলেন। তিনি যে মিসেস রায় নন, এটুকু জানিয়ে প্রথমে ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বরে বললেন–একজন নরপিশাচকে আপনি বাঁচাতে গিয়েছিলেন। পারলেন কি? তার ফাঁসি আটকানো যাবে না। কিন্তু রায়সায়েবের একটা খুবই দামি রিস্টওয়াচ ছিল। সেটার কথা উনি ভুলে গিয়েছিলেন। হঠাৎ মনে পড়ে ঘড়িটা খোঁজাখুঁজি করলেন। পেলেন না। ওটার সঙ্গে তার কী একটা স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তো ওটা যে আপনার ক্লায়েন্টই চুরি করে নিয়ে পালিয়েছিল। এতে ভুল নেই। তাই বাধ্য হয়ে আপনাকে অনুরোধ করছি, আপনার মক্কেলকে বলুন। ফাঁসিকাঠে ঝোলার আগে সে যদি ওটা লুকোনো জায়গা থেকে কারও সাহায্যে ফেরত দেয়, আমাদের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি ক্ষোভ থাকবে না। বরং মৃত্যুর আগে নরপিশাচটারও কিছু পুণ্য হবে।

-কী ঘড়ি এবং কেমন সাইজ তা উনি বলছেন কি?

–একটা সুইশ কম্পানির তৈরি মোটা বেঢপ সাইজের ঘড়ি। রঙটা কালো।

 –হুঁ!

ছবিগুলো লক্ষ করুন।

বলে খামটা সব্যসাচীবাবু কনেলকে দিলেন। কর্নেল ছবি বের করে বললেন দেখতে পাচ্ছি। কালা ফিল্ম। তাই ঘড়িটা যে কালো আর সত্যি বেঢপ, তা মোটামুটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

সব্যসাচী মিত্র গম্ভীর মুখে বললেন–তা হলে?

–আপনাকে ভদ্রলোক পছন্দ না করতে পারেন। তবু কোনও অছিলায় দেখা করুন। আমরা আপনার সঙ্গী হব।

কে জানে কেন, ভদ্রলোকের প্রচণ্ড প্রভাব এই এরিয়াতে। অথচ উনি যেন প্রাণভয়ে সবসময় ভীত। কিছু বোঝা যায় না।

কর্নেল একটু হাসলেন।–কোনও শত্রু থাকতে পারে না কি?

পারে। ওঁর যা স্বভাব! কিন্তু এখনও মনে হচ্ছে আমার যাওয়াটা রিস্কি হবে। লক্ষ্য ব্যর্থ হবে। আপনারা সঙ্গে থাকলেও হবে।

–এক মিনিট। একটা ফোন করতে চাই। আপনি রেডি হয়ে আসুন।

 –ঠিক আছে।

বলে সব্যসাচী মিত্র ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। এবার বললাম–ছবিগুলো দেখতে পারি?

–পরে! আমি ফোন করে নিই।

টেলিফোন ওঁর হাতের কাছে একটা কারুকার্যখচিত টুলে ছিল। কিন্তু উনি ঘুরে বসে ডায়াল করার পর চাপাস্বরে কার সঙ্গে কথা বললেন। তারপর রিসিভার রেখে ঘুরে বসে একটু হেসে বললেন–একটা শোচনীয় ট্রাজিক নাটকের শেষ দৃশ্যে স্টেজে নামতে চলেছি। সতর্ক থাকবে জয়ন্ত।

বিরক্ত হয়ে বললাম–খুলে বলবেন কিছু?

-মুখে বলা আর কাজে করার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য থাকে। ওয়েট অ্যান্ড সি ডার্লিং।

সব্যসাচী মিত্র কালো প্যান্ট-শার্ট আর একটা মানানসই টাই গলায় এঁটে ফিরে এলেন। একটু হেসে বললেন–আমার দেখা করাকে গুরুত্ব দিতে আদালতের পোশাক পরতে হল। ভুল করেছি কি?

কর্নেল এবার তুম্বো মুখে ঘড়ি দেখে বললেন–আপনি বুদ্ধিমান। ঠিক পোশাকই পরেছেন।

বেরোই তাহলে?

একটু অপেক্ষা করতে হবে। আধঘণ্টাও লাগতে পারে। তখন তাকে পাব কি?

-হ্যা! উনি বেলা প্রায় বারোটা পর্যন্ত সম্রাটের মতো দরবারে থাকেন।

প্রায় মিনিট কুড়ি-পঁচিশ পরে টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল আগের মতো ঘুরে রিসিভার তুলে চাপাস্বরে সাড়া দিলেন। তারপর শুরু বললেন–তা হলে আমরা বেরুচ্ছি। কণ্ঠস্বর অবশ্য চাপা। কিন্তু এবার ওঁর কথাগুলো কানে এল।

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–চলুন। বেরুনো যাক।

–আপনারা আসুন। আমি গাড়ি বের করতে যাচ্ছি।

কিছুক্ষণ পরে গাড়িটা অলি-গলি ঘুরে মোটামুটি চওড়া ও মসৃণ রাস্তায় গেল। তারপর একটা দোতলা পুরনো বাড়ির সামনে গিয়ে থামল। আমরা বেরোলাম। সামনে কয়েকটা সাদা অ্যাম্বাসাডার গাড়ি পার্ক করা আছে। আমাদের সঙ্গে নিয়ে সব্যসাচী মিত্র খোলা গেট পেরিয়ে গিয়ে একটা প্রশস্ত ঘরের দরজায় দাঁড়ালেন। ভিতর থেকে গম্ভীর কণ্ঠস্বরে কেউ বলল–কী হে মিত্তির! নাকে ঝামা ঘষে দিল তো! তারপর খ্যাখ্যা বিকট হাসি।

সব্যসাচীবাবু নম্র কণ্ঠস্বরে বললেন–একটু বিপদে পড়ে এসেছি দাদা!

–তা বুঝেছি। সঙ্গের ওঁরা কে?

–যদি অনুমতি দেন, ঘরে ঢুকে বসার পর বলব। তবে আমার আর্জিটা প্রাইভেট অ্যান্ড কনফিডেন্সিয়াল। আপনার ঘরে লোকজন আছে। প্লিজ যদি ওঁদের…

–ঠিক আছে। তোমরা কেটে পড়ো হে! মিত্তির কী গোপন বার্তা এনেছে, শুনতে হবে।

ঘর থেকে একদল লোক বেরিয়ে গেল। তারপর আমরা গিয়ে তার কাছাকাছি বসলাম। ভদ্রলোকের চেহারা চেনা মনে হচ্ছিল। তারপর চোখ পড়ল তার পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বলিষ্ঠ গড়নের যুবকের দিকে। সব্যসাচীবাবু বিনীতভাবে বললেন–ও থাকবে?

-থাকবে। সবাইকে যেতে বলতে পারি। একে পারি না। ডু ইউ অন্ডারস্ট্যান্ড মিত্তির?

কর্নেল নিষ্পলক চোখে যুবকটিকে দেখছিলেন। সহাস্যে বলে উঠলেন-বাঃ। তোমার রিস্টওয়াচটা তো অসাধারণ। বিদেশি দামি ঘড়ি মনে হচ্ছে। অবশ্য ইমিটেশন, মানে-নকলও হতে পারে। হংকং থেকে…

ভদ্রলোক ভুরু কুঁচকে বললেন–ঘড়ির কথা ছাড়ুন। কেন এসেছেন, তাই বলুন! মিত্তির! এঁরা কারা?

কর্নেল বললেন–আপনার বডিগার্ডের রুচি আছে কিন্তু।

যুবকটি ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে ছিল। বিকৃত মুখে বলল-বুড়ো হয়েছেন। বুদ্ধিসুদ্ধি পাকেনি। অন্য কেউ হলে এতক্ষণে টুপি ছুঁড়ে ঘিলু বের করে দিতাম।

আমাকে অবাক করে কর্নেল তার প্রসিদ্ধ অট্টহাসি হেসে উঠলেন। তারপরই লালবাজারের ডিটেকটিভ অফিসার নরেশ ধর সদলবলে ঘরে ঢুকলেন। তার হাতে রিভলভার। এক লাফে এগিয়ে যুবকটির গলায় রিভলভারের নল ঠেকিয়ে বললেন– ভানু শর্মা! তোমাকে অ্যারেস্ট করা হল। শিউচরণ! হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দাও।

একটু আগে থেকে যা আঁচ করছিলাম, তা ঠিক। এদিকে রাজনৈতিক নেতা ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে গর্জন করছিলেন–কেন আমার বডিগার্ডকে অ্যারেস্ট করছেন আপনারা! ও কী করেছে!

নরেশ ধর বাঁকা হেসে বললেন–এ পর্যন্ত এই দুবৃত্ত ভানু ছটা কুমারী মেয়েকে ধর্ষণ করে খুন করেছে। বেচারা হারু গাঙ্গুলির মতো যাত্রা-থিয়েটারে অভিনয় না করুক, বাস্তব জীবনে করেছে। চেহারা বদলাতে এই জানোয়ার মহা ওস্তাদ!

নেতা ভদ্রলোক ধপাস করে তার সিংহাসনাকৃতি চেয়ারে বসে পড়লেন। তারপর ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে বললেন–তা হলে মিত্তির! তুমি হেরো গাঙ্গুলির ফাঁসি আটকাবে ভেবেছ? দেখা যাক। আমাকে তো চেনো। আমি…

নরেশবাবু রুষ্টমুখে বললেন–শার্ট আপ। আপনাকেও আমরা অ্যারেস্ট করতে পারি।

নেতামশাই বুড়ো আঙুল নেড়ে বললেন–করতে পারেন। তারপর বদলি হবেন সুন্দরবনে।

নরেশবাবু হেসে ফেললেন। তার আগে নতুন করে একটা মামলা শুরু হবে। আর সুন্দরবন দেখাচ্ছেন? সুন্দরবন আপনি ভালো চেনন। সেখান থেকে হিংস্র একটা বাঘ ধরে এনে পোয্য প্রাণী করেছিলেন। সাবধান মশাই! যে বাঘ আপনাকে পাহারা দেবে ভাবছেন, সে-ই সুযোগ পেলে আপনার গায়ে থাবা বসাবে। বাই দা বাই, আপনার আশা করি তরুণী কন্যাসন্তান আছে? নিশ্চয় আছে। তাই ভানু আপনার বডিগার্ড হতে এ বাড়িতে ঢুকেছিল।

কর্নেল বললেন–এবার ওঠা যাক। রোমাঞ্চকর নাটকের শেষ দৃশ্যটা ভালো জমেছিল। এস জয়ন্ত! মিঃ মিত্র!

ভানু শর্মাকে ততক্ষণে পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল। আমরা এতক্ষণে বেরিয়ে এলাম।…