কর্নেলের জার্নাল থেকে

কর্নেলের জার্নাল থেকে

০১.

মাঝে মাঝে এমনটা হয়েছে এক-একটা বিচিত্র এবং অদ্ভুত ঘটনা আমার জীবনকে একটুখানি ছুঁয়ে চলে গেছে। কিন্তু পরে মনে হয়েছে কী আশ্চর্য! সেই ঘটনার অন্তবর্তী তাৎপর্য খুঁজতে গিয়ে যেন মৃত্যুর ছায়া আমার বেঁচে থাকার খুব কাছে দিয়েই চলে গেছে। তার মানে সহজ করে বলতে গেলে জীবন এবং মৃত্যুর সংকীর্ণ সীমানা দিয়ে আমি হেঁটে গেছি। অথচ সেই সময়টাতে এতটুকু টের পাইনি একটু এদিক-ওদিক হলেই কী ঘটতে পারত।

এই ধরনের ঘটনাগুলিতে তত আড়ম্বর ছিল না। কেমন যেন নিঃশব্দে তা ঘটেছে। তারপর যখন তার অন্তর্বর্তী ভয়াল সত্যটাকে উপলব্ধি করে শিউরে উঠেছি তখন মনে হয়েছে এটা আমার ব্যক্তিগত জার্নাল লিখে রাখাই ভালো। তাই এই ঘটনাটাও আমি জার্নালে লিখে রাখছি।

সেবার সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতায় প্রচণ্ড বৃষ্টি। রাস্তাঘাট জলে ডুবে গেছে। এক রবিবারের সকালে ছাদের বাগানের গাছগুলোর পরিচর্যা করে এসে ড্রয়িং রুমে বসে আছি এবং কফি পান করতে করতে খবরের কাগজগুলোর উপর চোখ বোলাচ্ছি এমন সময় ডোরবেল বাজল।

অভ্যাসমত আমার প্রিয় পরিচারক ষষ্ঠিচরণকে ডাকতে গিয়ে হঠাৎ মনে হল ডোরবেলটা দুবার বেজেছে। কাজেই এটা আমার তরুণ সাংবাদিক বন্ধু জয়ন্তের নয়। তা ছাড়া আগের সপ্তাহে সে তার পত্রিকার পক্ষ থেকে চিন সফরে গেছে। কোনো কোনোদিন তার টেলিফোন পেয়েছি। কলকাতায় ফিরলে সে ফেরার পথেই ফোন করে আমাকে জানাত।

দোতলায় লিন্ডাদের ফ্ল্যাটে কুকুরের চেঁচামেচি হয়তো বৃষ্টির শব্দে আমি শুনতে পাইনি। কিন্তু আমার অ্যাপার্টমেন্টে ডোরবেলে দু’বার সুইচ টেপার অর্থ এটাও হতে পারে মফস্বলের কোনো মানুষ আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

কিন্তু আমাকে অবাক করে আঝর পরপর দু’বার ডোরবেল বাজল। তখন ষষ্ঠিকে ডাকতেই হল। ষষ্ঠি থাকে একেবারে উল্টোদিকে কিচেনের কাছে। কাজেই সে ডোরবেলের শব্দ শুনতে পায় না।

কিন্তু পরপর ওইভাবে ঘণ্টাধ্বনিতে কী যেন একটা অস্বাভাবিকতা আছে। আমার ইনটিউশন যেন আমাকে নাড়া দিল। তাই আমি নিজেই ড্রয়িং রুম থেকে বেরিয়ে ছোটো ওয়েটিং রুমের ভিতর দিয়ে গিয়ে দরজায় আই হোলে চোখ রাখলুম। দেখলুম এক মহিলা রেনকোট পরে দাঁড়িয়ে আছেন। তখনই দরজা খুলে দিলুম।

ভদ্রমহিলা নমস্কার করে বললেন, আপনাকে এমন সময় বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। আপনার ফোন নাম্বারটাও আমি জানি না। শুধু ঠিকানাটা জানতে পেরেই চলে এসেছি।

বললুম, আসুন। এই বৃষ্টির মধ্যে এসেছেন সেটা কোনো কথা নয়। কিন্তু আমাদের এই ইলিয়ট রোড এলাকা তো একেবারে জলে ভাসছে। যাই হোক আসুন।

ভদ্রমহিলা ভিতরে ঢুকে তার রেনকোটটা খুললেন। আমি ভদ্রতা করে সেটা হাতে নিয়ে ওয়েটিং রুমের ব্র্যাকেটেই ঝুলিয়ে রাখলুম। তারপর আবার বললুম, আসুন।

ড্রয়িংরুমে ঢুকে তাকে সোফায় বসতে বলে আমি আমার ইজিচেয়ারে বসলুম। ইতিমধ্যে যেভাবে হোক ষষ্ঠিচরণ টের পেয়েছে একটা কিছু ঘটছে। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ভদ্রভাবেই তাকে দেখছিল। বললুম, আমার কফিটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। শিগগির দু’কাপ কফি আর স্ন্যাক্স নিয়ে আয়।

ষষ্ঠি ভিতরে ঢুকে গেল। এবার আমি তীক্ষ্ণদৃষ্টে ভদ্রমহিলার দিকে তাকালুম। তার পরনের শাড়িতে রুচির পরিচয় আছে। ম্যাচিং ব্লাউজের হাতা কনুই অব্দি ছড়িয়ে এসেছে। কিন্তু তার চেহারার তীক্ষ্ণ লাবণ্য কেন যেন বৃষ্টিভেজা ফুলের মতোই মিইয়ে গেছে। মুখের উজ্জ্বল রং নিষ্প্রভ দেখাচ্ছে। তিনি আমার দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা হয়তো সহ্য করতে না পেরেই মুখ নামিয়ে ছোটো হ্যান্ডব্যাগটা কোলের উপর রেখে মৃদু স্বরে বললেন, আপনার চেহারা দেখে তখনই বুঝতে পেরেছিলুম আমি ঠিক জায়গায় পৌঁছেছি। আমার নাম পরমা রায়চৌধুরি।

একটু হেসে বললুম, বোঝা যাচ্ছে আপনি গাড়িতে এসেছেন। সম্ভবত গাড়িটা ডিজেলে চলে। তা না হলে আপনাকে প্রায় অর্ধেকটা শরীর ভিজিয়ে এখানে আসতে হত।

পরমা বললেন, আপনি ঠিকই ধরেছেন।

তার কথার উপরে বললুম, তার চেয়ে বড়ো কথা কোনো ঘটনার আকস্মিক চাপই আপনাকে এই দুর্যোগের মধ্যে আমার কাছে আসতে বাধ্য করেছে। যাই হোক, আপনি কফি খান। কফি নার্ভকে চাঙ্গা করে। তা ছাড়া এই বৃষ্টির মধ্যে স্ন্যাক্সের সঙ্গে কফি আলাপ পরিচয়ের চমৎকার আবহাওয়া গড়ে তোলে।

ষষ্ঠিচরণ তখন কফির ট্রে-টা সেন্টার টেবিলে রাখছিল। সে চলে যাবার পর পরমা বললেন, আমি কফি খুব কদাচিৎ খাই। তবে আপনি যখন বলছেন, আমার আপত্তি নেই। তবে একটা শর্ত। আপনি আমাকে তুমি বললেই খুশি হব।

এরপর কিছুক্ষণ পরমা চুপচাপ কফি খেতে থাকল। আমি ওর দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে ঘটনাটা বুঝবার চেষ্টা করছিলুম। আসলে লোকেরা আমার সম্পর্কে যা-ই রটাক, সত্যিই তো আমার কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নেই। শুধু আছে। পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা আমার দীর্ঘ সামরিক জীবন-পরবর্তী কাল থেকে এই পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাটা আমাকে শানিয়ে তুলতে হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার মনে হল আনুমানিক ত্রিশ-বত্রিশ বছরের এই সুন্দরী মহিলা কোনো অভিজাত বংশের তো বটেই তা ছাড়া সে বিবাহিতা। অগোছাল চুলের আড়ালে সিঁথির ফাঁকে ক্ষীণ একটা সিঁদুরের রেখা। অতএব পরমার স্বামীও বিত্তবান কোনো অভিজাত পরিবারের মানুষ।

একটু পরে আমি বললুম, আশা করি তোমার নার্ভ চাঙ্গা হয়েছে। এবার আমার প্রথম প্রশ্ন–আমার পরিচয় এবং ঠিকানা তুমি কার কাছে পেয়েছ?

পরমা বলল, আমার এক বন্ধুর কাছে। আপনাকে খুলেই বলছি। আমার এই বন্ধুটি কোনো মহিলা নয়, পুরুষ। কলেজ এবং ইউনিভার্সিটিতে আমরা একসঙ্গে পড়াশোনা করতুম। সে এখন একটা ট্রেডিং কনসার্নের এক্সিকিউটিভ। তার নাম শিলাদিত্য মজুমদার।

বললুম, নামটা আমার চেনা মনে হচ্ছে না। যাই হোক, সে কি তোমায় বলেছে কোন সূত্রে সে আমার নামটা জানে?

পরমা ঘড়ি দেখল। তারপর বলল, তাদের মহাবীর ট্রেডিং কোম্পানির একটা কেস আপনি হাতে নিয়েছিলেন। বছর দুই আগের কথা।

আমি কিন্তু স্মরণ করতে পারলুম না। বললুম, অনেক সময় রহস্যময় কিছু ঘটলে সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ার বাতিক আমার আছে। যাই হোক, বোঝা যাচ্ছে যে ঘটনার জন্য তুমি আমার কাছে ছুটে এসেছ, তা তোমার বন্ধু শিলাদিত্য জানে।

পরমা মৃদুস্বরে বলল, হ্যাঁ। তারই পরামর্শে আমি আপনার কাছে এসেছি। প্লিজ কর্নেল সাহেব, আপনি আমাকে সাহায্য করুন।

বললুম, তুমি নিশ্চয় কোনো নির্দিষ্ট কারণে নিজেকে বিপন্ন মনে করছ এই তো?

পরমা বলল, কর্নেল সাহেব, আমার বাবা-মা বেঁচে নেই। আমার দাদা থাকেন, অস্ট্রেলিয়ায়। তিনি খুব কদাচিৎ আসেন। আমাদের পৈত্রিক বাড়িটা একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।

তার কথার উপরে বললুম, আমার ধারণা তুমি তোমার স্বামীর দিক থেকে বিপদের আভাস পেয়েছ।

কথাটা শুনেই পরমা চঞ্চল হয়ে উঠল। তার চোখ ছলছল করতে থাকল। সে উত্তেজনা চেপে বলল, শিলাদিত্য ঠিকই বলেছে, আপনি সত্যিই অন্তর্যামী।

একটু হেসে বললুম, ওই শব্দটা শুনতে শুনতে আমার কাছে অর্থহীন হয়ে গেছে। তুমি বলো তোমার স্বামীর দিকে থেকে কী বিপদ আসতে পারে বলে তুমি আশঙ্কা করছ?

পরমা রুমালে চোখদুটো স্পঞ্জ করে চাপা স্বরে বলল, সে একজন খুনি ভাড়া করেছে।

-তুমি কী করে জানলে?

–শিলাদিত্যকে আমি বিশ্বাস করি। সে আমাকে বলেছে।

 –তোমার স্বামী তোমাকে খুন করছে চান কেন?

–আমার স্বামী কালীশ রায়চৌধুরী একজন ব্যবসায়ী। তার ট্রেডিং এজেন্সিটাও একসময় বেশ বড়ো ছিল। কিন্তু তার নিজেরই দোষে ব্যবসার অবস্থা এখন শোচনীয়। আমার বাবা-মা আমার এবং আমার দাদার নামে অনেক টাকা ব্যাঙ্কে এবং কোম্পানির পেপারে ডিপোজিট রেখে গিয়েছিলেন। আমার সঙ্গে কালীশের বিয়ের সময় আমার দাদা অর্ণব অস্ট্রেলিয়া থেকে এসে তার নিজের অংশটা তুলে নিয়েছিল আর আমার অংশটা কালীশের পরামর্শে আমার নির্বোধ দাদা আমাকে তুলে নিতে বলে এবং সবটাই আমাকে ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিট রাখতে বলে। এই ডিপোজিটের নমিনি আমার স্বামী কালীশ রায়চৌধুরী।

কথাগুলো শোনার পর আমি বললুম, অর্থাৎ তোমার দৈবাৎ একটা কিছু ঘটে গেলে টাকাগুলো–

পরমা দ্রুত বলল, পঁচিশ লক্ষ টাকা।

বললুম, তাহলে কালীশবাবুর দিক থেকে তোমাকে মেরে ফেলার একটা স্পষ্ট মোটিভ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তুমি তোমার বন্ধুর সাহায্যে ব্যাঙ্কের কাগজে নমিনি চেঞ্জ করে নিলেই পার।

পরমা আবার চঞ্চল হয়ে উঠল। সে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন কর্নেল সাহেব, যে-কোনো মুহূর্তে আমার স্বামীর ভাড়াটে খুনি আমাকে মেরে ফেলতে পারে। শিলাদিত্য গতকাল সন্ধ্যায় এই গোপন চক্রান্তের কথা জানতে পেরেছে। তারপরই আমার সঙ্গে দেখা করতে ছুটে গেছে। ওই সময় আমার স্বামী ক্লাবে ছিল। প্রতি শনিবার সে মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরে প্রায় দশটা সাড়ে দশটায়।

বললাম, আজ এখন তোমার স্বামী কোথায় আছেন?

পরমা বলল, আজ তোর ছ’টায় কালীশ তার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে। বলে। গেছে ডায়মন্ডহারবার রোডে একটা বাগানবাড়িতে তারা পিকনিক করবে। আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া নাকি সেখানে নিরাপদ নয়। কারণ তার বন্ধুরা মাতলামি করে পরস্পরের স্ত্রীর সঙ্গে নাচানাচি করে এবং কখনও সীমা ছাড়িয়ে যায়। কালীশ সেটা পছন্দ করে না। কিন্তু তার ব্যবসার স্বার্থেই নাকি তাকে সেখানে যেতে হচ্ছে।

পরমা আবার ঘড়ি দেখল। বললুম, তোমার কি অন্য কোথাও যাবার তাড়া আছে?

সে বলল, আমি আপনার এখান থেকে সল্টলেকে শিলাদিত্যের বাড়িতে যাব। দিনটা সেখানেই কাটাব। কর্নেল সাহেব, প্লিজ আপনি এই বিপদ থেকে আমাকে বাঁচান। আপনাকে আমি আমার বডিগার্ড হতে বলছি না। কী করলে আমি আত্মরক্ষা করতে পারি সেই ব্যবস্থাটা করে দিন। শিলাদিত্য বলেছে তা ছাড়া আমি নিজেও বুঝতে পারছি এই ব্যাপারটা নিয়ে সরাসরি পুলিশের কাছে গিয়ে কোনো লাভ হবে না। তারা হয়তো আমার স্বামীকে গ্রেপ্তার করবে এবং জেরা করে ভাড়াটে খুনির নাম জানার চেষ্টা করবে। কিন্তু তাতে আমার কোনো লাভ হবে না।

এবার একটু গম্ভীর হয়ে বললুম, এই যে তুমি বাড়ি থেকে এসেছ এবং সল্টলেকে যাবে বলছ-পথে তো তোমার বিপদ হতে পারে। বিশেষ করে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে খুনির পক্ষে কাজটা সোজা।

এবার পরমা তার হ্যান্ডব্যাগ খুলে একটা ২২ ক্যালিবারের সিক্স রাউন্ডার রিভলবার দেখিয়ে বলল, এটা আমার কাছে আছে।

তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললুম, এটা কি লাইসেন্সড?

পরমাকে নার্ভাস দেখাল। সে চাপা স্বরে বলল, জানি না। এটা আমাকে শিলাদিত্য দিয়েছে।

–কখন?

–কাল সন্ধ্যায় যখন সে নিউ আলিপুরে আমার অ্যাপার্টমেন্টে গিয়েছিল তখন সে এটা দিয়ে এসেছিল। এটা নাকি অটোমেটিক। কীভাবে এটা ব্যবহার করতে হয়, শিলাদিত্য আমাকে শিখিয়ে দিয়েছে।

আমি এতক্ষণে চুরুট ধরালুম। কারণ পরমা যেভাবে ঘটনাটা আমাকে শোনাচ্ছিল তাতে যেন আমার বোধবুদ্ধি কীরকম গুলিয়ে যাচ্ছিল। ক্রমশ একটা সন্দেহ মনে দানা বাঁধছিল কালীশ রায়চৌধুরীর স্ত্রীর প্রতি আক্রোশ কি শুধু তার অর্থ আত্মসাৎ করার জন্য নাকি প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য? পরমা এবং শিলাদিত্যের মধ্যে একটা গভীর সম্পর্কের কথা ভদ্রলোক নিশ্চয় আঁচ করেছেন।

পরমা আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। সে বলল এটা সারা পথ আমার সিটের পাশে ফেলে রাখি। সন্দেহজনক কাকেও দেখলে যাতে পালটা আক্রমণ করতে পারি।

আমি টাকে হাত বুলিয়ে বললুম, তোমার পুরো ঠিকানা আর ফোন নাম্বার আমাকে দাও। সেই সঙ্গে তোমার স্বামীর বিজনেসের ঠিকানা ও ফোন নম্বর আর তোমার বন্ধু শিলাদিত্যের অফিস এবং বাড়ির ঠিকানা, ফোন নম্বর আমার দরকার।

পরমা আবার তার ব্যাগ খুলে দুটো কার্ড দিল। দেখলুম একটা কার্ড তার স্বামীর কোম্পানির, অন্যটা শিলাদিত্যের। এরপর একটা প্যাডে সে তার এবং শিলাদিত্যের বাড়ির ঠিকানা এবং ফোন নাম্বার লিখে দিল। তারপর ঘড়ি দেখে বলল, এবার আমি যাই। প্রয়োজনে আপনাকে টেলিফোন করবে।

ফোন নম্বর এবং ঠিকানাগুলি দেখার পর আমি পরমাকে আমার একটা নেমকার্ড দিলুম। সে সেটা সযত্নে হ্যান্ডব্যাগের ভিতরে রাখল। তারপর আমাকে নমস্কার করে দ্রুত বেরিয়ে গেল।

.

০২.

সেদিন দুপুরের পরেই বৃষ্টি ছেড়ে গিয়েছিল এবং আকাশ প্রায় নির্মেঘ হয়ে উঠেছিল। আমার দিবানিদ্রার অভ্যাস নেই। দুপুরে খাওয়ার পর কালীশ রায়চৌধুরীর নিউ আলিপুরের বাড়িতে টেলিফোন করেছিলুম। কিন্তু কেউ টেলিফোন ধরেনি। তারপর শিলাদিত্যকে ফোন করেছিলুম। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, সল্টলেকে শিলাদিত্যের ফ্ল্যাটেও ফোন বেজে যাচ্ছিল, কেউ ধরেনি। সত্যি বলতে কী, এই ধরনের কেস কখনও আমার হাতে আসেনি। একটি মেয়ের পেছনে তার স্বামী নাকি ভাড়াটে খুনি লেলিয়ে দিয়েছে এবং সম্ভবত মেয়েটি তার বয়ফ্রেন্ড বা প্রেমিকের কাছে জানতে পেরে আমার কাছে ছুটে এসেছে। তা ছাড়া তার সেই প্রেমিক মেয়েটিকে আত্মরক্ষার জন্য একটা চোরাই বিদেশি রিভলবার দিয়েছে। কাজেই আমার মধ্যে একটা উত্তেজনা জাগছিল যেন যে-কোনো মুহূর্তেই আমি একটা খুন-খারাপির খবর পেয়ে যাব।

এই উত্তেজনাই আমাকে সন্ধ্যা ছ’টা অবধি একবার নিউ আলিপুরে একবার সল্টলেকে টেলিফোন করিয়ে ছেড়েছিল কিন্তু নিউ আলিপুরের ফ্ল্যাটে কেউ না থাকতেও পারে। সল্টলেকের ফ্ল্যাটে শিলাদিত্য এবং পরমার তো থাকার কথা।

উত্তেজনা আমাকে নাড়া দিলে আমার অভ্যাস কাপের পর কাপ কফি পান এবং চুরুট পোড়ানো।

সন্ধ্যা সাতটায় আমি ভাবছিলুম এবার নিউ আলিপুর বা সল্টলেক যেখান থেকেই হোক ফোন করলে নিশ্চয় সাড়া পাব। কিন্তু একরাশ চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে রিসিভারের দিকে হাত বাড়াতেই আমাকে চমকে দিয়ে টেলিফোনটা বেজে উঠল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সাড়া দিলুম-কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।

টেলিফোনের ওপার থেকে পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল-কর্নেল সাহেব, সত্যি আপনার কোনো তুলনা হয় না।

লালবাজার পুলিশ হেড কোয়ার্টার্স থেকে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে সাব ইনস্পেকটার আমার সুপরিচিত নরেশ ধরের কণ্ঠস্বর চিনতে আমার ভুল হয় না। কিন্তু নরেশবাবু আমাকে এই অসময়ে রিং করছেন, এতেই আমার চমক জাগল। বললুম, প্লিজ নরেশবাবু, এই সুন্দর সন্ধ্যাবেলায় আমাকে কোনো ডেডবডির খবর যেন শোনাবেন না।

নরেশবাবুর হাসি ভেসে এলোকর্নেল সাহেব, এ তো ঠাকুরঘরে কে রে, আমি তো কলা খাইনি-র মতো হয়ে গেল।

বললুম, সর্বনাশ! আপনি দেখছি আমার চেয়েও ধুরন্ধর। কারণ আপনাকে খুলে বলতে বাধা নেই, আজ সারাদিন আমি একটা খুনখারাপির সম্ভাবনা নিয়ে উত্তেজিত ছিলুম।

-কর্নেল সাহেব, তাহলে আপনি শুনে খুশি হবেন আপনি যা চাইছিলেন তাই হয়েছে। অর্থাৎ একটা ডেডবডি পাওয়া গেছে।

-কী সর্বনাশ! কোথায় পাওয়া গেল? রাস্তায়?

–না। নিউ আলিপুরের পশ এরিয়ার একটা অ্যাপার্টমেন্টে। আশা করি আপনি বুঝতে পারছেন অ্যাপার্টমেন্টটা কার!

উত্তেজনা চেপে বললুম, ওখানকার এক ভদ্রমহিলা পরমা রায়চৌধুরিকে আমি আমার নেমকার্ড দিয়েছিলুম। সম্ভবত তার কাছ থেকেই আপনারা আমার হদিশ পেয়েছেন। এই তত?

নরেশবাবু আবার একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ। তবে টেলিফোনে সব কথা বলা যাবে না। আমি মিসেস রায়চৌধুরির অ্যাপার্টমেন্ট থেকেই আপনাকে ফোন করছি। এই রবিবারেও লালবাজারের পুলিশ মহল ছুটে এসেছে এখানে। ওসি হোমিসাইড সদলবলে এসেছেন। কর্নেল সাহেব, আপনার এখানে আসা দরকার। কারণ মিসেস রায়চৌধুরী আপনার ক্লায়েন্ট। আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি। কারণ, আমার হাতে খবর আছে আপনার তরুণ সাংবাদিক বন্ধু জয়ন্ত চৌধুরী এখন চিন মুলুকে সফর করছেন। কাজেই তার গাড়ি আপনি এখন পাচ্ছেন না। ট্যাকের পয়সা খরচ করে ট্যাক্সি ভাড়া করেই বা আপনি এখানে আসবেন কেন? প্লিজ ওয়েট।

নরেশ ধর ফোন রেখে দিলেন।

হ্যাঁ পুলিশের গাড়িতেই আমাকে যেতে হবে। ততক্ষণ অপেক্ষা করা যাক। তার পরই মনে হল সল্টলেকে শিলাদিত্যকে একবার টেলিফোন করি।

ডায়াল করার পর কয়েকবার রিং হল, তারপর সাড়া এলো–ইয়া।

বললুম, আপনি কি শিলাদিত্য মজুমদার?

–ইয়া।

–আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।

–মাই গুডনেস। কর্নেল সাহেব, আমাকে আশা করি আপনার মনে আছে? আমাদের কোম্পানি মহাবীর ট্রেডিং এজেন্সির একটা কেসে আপনার সঙ্গে আমি অনেক ঘোরাঘুরি করেছিলুম।

তখনই মনে পড়ে গেল শিলাদিত্যকে হ্যাঁ, বলিষ্ঠ গড়নের এবং হ্যান্ডসাম চেহারার এই যুবকটি আমার চোখে ভেসে উঠল। একটা মূর্তি পাচার চক্রের জাল থেকে তাকে আমি বের করে আনতে পেরেছিলুম। শিলাদিত্য শুধু সাহসীই নয়, তার মৃত্যুভয়ও যেন নেই। তবে সে পুরোনো কেচ্ছা ঘেঁটে লাভ নেই। আমি বললুম–দেখো শিলাদিত্য, আমার বয়স তো থেমে নেই। অনেক ঘটনা আমার মনে চাপা পড়ে যায়। যাই হোক, এবার আসল কথাটা বলি। তোমার গার্লফ্রেন্ড-স্যরি, কিছু মনে করো না। এই বুড়ো বয়সেও আমি বড্ড রোমান্টিক।

শিলাদিত্য তখনই উত্তেজিতভাবে বলল, আমি পরমাকে আপনার কাছে। পাঠিয়ে দিলুম। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত পরমা আর আমি চৌরঙ্গী এলাকার একটা সিনেমা হলে ছবি দেখছিলাম। তারপর আমি ওর গাড়িতে নিউ আলিপুরে ওদের হাউজিং কমপ্লেক্স সুরঞ্জনা-র গেটে পৌঁছে দিয়ে ট্যাক্সি করে সল্টলেকে ফিরেছিলাম। তখন প্রায় ছ’টা। তার কিছুক্ষণ পরে পরমা আমাকে ফোনে জানিয়েছিল সে বাথরুমে ঢুকেছিল। তার স্নান করার ইচ্ছা ছিল। ভাগ্যিস সে আমার দেওয়া ফায়ার আর্মসটা হাতের কাছেই রেখেছিল। অ্যাপার্টমেন্টে কেউ নেই। অতএব সে পর্দা না টেনেই বাথটাবে নেমেছিল। সেই সময় আচমকা একটা মুখোশ পরা লোক ড্যাগার হাতে এসে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে পরমা তার রিভলবার থেকে পর পর তিনবার গুলি ছোড়ে। লোকটা পড়ে যায়। কিন্তু কর্নেল সাহেব, প্লিজ আপনি এইসব কথা গোপন রাখবেন।

বললুম, তাহলে বোঝা যাচ্ছে পরমা এরপর নিজেই লালবাজারে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে টেলিফোন করেছিল। তাই না?

শিলাদিত্য বলল, ঠিক ধরেছেন। আপনি বিজ্ঞ মানুষ। পরমা অবশ্য পুলিশকে এসব কথা জানায়নি। লোকটাকে গুলি করার পরই প্রথমে সে আমাকে ফোন করেছিল। আমার পরামর্শে সে রিভলবারটা লুকিয়ে রেখে পুলিশকে জানিয়েছিল, বাইরে থেকে ফিরে স্নানের জন্য বাথরুমে গিয়ে একটা মুখোশপরা লোকের ডেডবডি সে দেখতে পেয়েছে। তার খুব ভয় করছে ইত্যাদি।

বললুম, তারপর কি তোমাকে আর সে ফোন করেছিল।

শিলাদিত্য আমার কথার উপরই বলল, সে সাহসী তা ঠিক তবে বুঝতেই পারছেন, সে প্রাণের ভয়ে বেপরোয়া হয়েই তার আততায়ীকে গুলি করে মেরেছে। আমার অনুরোধ, আপনি প্লিজ আমাকে যেন আড়ালে রাখবেন। কারণ পরমার স্বামী কালীশ মূর্তিমান শয়তান। সে আমার সঙ্গে পরমার সম্পর্কের কথা যেভাবে হোক সম্প্রতি আঁচ করেছে।

বললুম, শিলাদিত্য, হাতে সময় কম। লালবাজারের ডিটেকটিভ অফিসারের তাগিদে আমাকে ঘটনাস্থলে যেতে হবে। যে কোনো সময় গাড়ি এসে পড়বে। তোমার কাছে শুধু এই কথাটি জানতে চাই, তুমি কেমন করে জানলে যে কালীশবাবু তার স্ত্রীকে খুন করার জন্যে ভাড়াটে খুনি জোগাড় করেছেন?

শিলাদিত্য বলল, আপনি আমাকে বিশ্বাস করুন কর্নেল সাহেব, কীভাবে কথাটা আমি জানতে পেরেছিলুম তা আমি আপনাকে পরে মুখোমুখি জানব।

বললুম, তাহলে তুমি এ বিষয়ে সিওর ছিলে। যাই হোক, শিলাদিত্য, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে খুনি তোমার চেনা এবং সে পরমার সঙ্গে তোমার সম্পর্কের কথা জানত। তাই সে তোমার সাহায্য চেয়েছিল এবং তার বদলে তোমাকে তার প্রাপ্য টাকার ভাগ দিতে চেয়েছিল। কী?

শিলাদিত্যের কণ্ঠস্বর যেন কেঁপে গেল। সে বলল, প্লিজ কর্নেল সাহেব, আমার সারা শরীর জুড়ে যেন ইলেকট্রিক কারেন্ট বয়ে যাচ্ছে। আপনি আমার ভরসা। আপনি এখন বেশি কিছু জানতে চাইবেন না। আমি তো আপনাকে কথা দিয়েছি যথাসময়ে সব বলব। তবে আপতত কিছুদিন আমি গা-ঢাকা দেব। সে ফোন রেখে দিল। আমি রিসিভার হাতে ধরে অন্তত এক মিনিট চুপচাপ থাকার পর রেখে দিলুম। শিলাদিত্য ধুরন্ধর তা বোঝা গেল। কারণ কালীশবাবু তাকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেবেন, তা সে বুঝেছে।

ভেবেছিলুম আবার এক কাপ কফি খাব। কিন্তু তখনই ডোরবেল বাজল এবং ষষ্ঠিচরণ এসে বলল, নালবাজার থেকে পুলিশের গাড়ি এয়েছে বাবামশাই। ডেরাইভারবাবু বললেন তোমার সাহেবকে আসতে বলে। আমি নীচে থাকছি।

সুরঞ্জনা হাউজিং কমপ্লেক্সের মেইন গেট দিয়ে পুলিশের গাড়ি এগিয়ে গেল। তখন প্রায় আটটা বাজে। এমন একটা উত্তেজনাময় ঘটনার ফলে প্রতিটি ব্লকের আলোগুলো জ্বলছিল। সি ব্লকের সামনে গিয়ে গাড়ি থামল। চারিদিকে পুলিশ ব্লকটাকে ঘিরে রেখেছে।

নরেশ ধর আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি গোঁফের নীচে একটুখানি হেসে চাপা স্বরে বললেন, ওয়েলকাম কর্নেল সাহেব।

চাপা স্বরে বললুম, ডেডবডিটা কার তা শনাক্ত করতে পেরেছেন?

নরেশবাবু বললেন, পেরেছি। লিফটে উঠে কিছুটা আভাস দিচ্ছি। আমাদের উঠতে হবে সিক্সথ ফ্লোরে।

লিফটটা নীচেই ছিল। ভিতরে ঢুকে সুইচ অন করে নরেশবাবু বললেন, মিসেস রায়চৌধুরি বলছিলেন লোকটাকে তার চেনা লাগছে কিন্তু ঠিক চিনতে পারছেন না। এদিকে আধঘণ্টা আগে তার স্বামী কালীশ রায়চৌধুরি পিকনিক করে বাড়ি ফিরেছেন। তিনি কিছুটা মত্ত অবস্থায় ছিলেন। পিকনিকের ব্যাপার তো। ড্রিঙ্কটা বেশিই হয়েছিল। যাই হোক, তিনি ডেডবডিটা দেখা মাত্র বলে উঠেছিলেন, এই স্কাউলে তো আমার চেনা লোক, এর নাম বাপি বোস। তারপর তিনি সংক্ষেপে জানিয়েছেন, লোকটা থাকত টালিগঞ্জ এরিয়ায়। তার এক বন্ধু শচীনের কাছেই তাকে নাকি তিনি প্রথম দেখেন। শচীন সেন রাজনীতি করেন। বাপিকে তিনি নাকি কাজে লাগান। যাই হোক, যথাস্থানে সব শুনবেন।

লিফট সিক্সথ ফ্লোরে পৌঁছেছিল। লিফট থেকে বেরিয়ে দেখলুম একজন উর্দিপরা অফিসার এবং কয়েকজন আর্মড কনস্টেবল সামনের করিডরে প্রতিমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। এগিয়ে গিয়ে দেখলুম ছশো ছ’নম্বর। অ্যাপার্টমেন্টের দরজা খোলা। সেখানেও দু’জন পুলিশ কনস্টেবল দু’ধারে দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে ঢুকতেই ওসি হোমিসাইড হেমেন্দ্র হাজরা সোফায় বসে আছেন। তার মুখোমুখি যিনি বসে আছেন তাঁর গায়ের রং শ্যামবর্ণ, মাথায় কঁচাপাকা একরাশ চুল, মুখে। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। একটু তফাতে বসে আছে পরমা রায়চৌধুরি। সে আমাকে দেখা মাত্র উঠে দাঁড়িয়েছিল। দুই চোখ লাল এবং ছলোছলো। অগোছাল চুল। আমি তাকে ইশারায় বসতে বললুম। ওসি হোমিসাইড মিঃ হাজরা আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশ্যেক করে বললেন, আমাদের পরম সৌভাগ্য, প্রখ্যাত রহস্যভেদী কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে আমরা এই ঘটনা বা দুর্ঘটনায় সঙ্গে পাচ্ছি। বসুন কর্নেল সাহেব।

আমি তার উলটোদিকে বসার পর পরমা ভাঙা গলায় বলল, আমি কর্নেল সাহেবের জন্যে কফি করতে বলি।

বললুম, থাক। আমি কফি খেয়েই বেরিয়েছি।

ইতিমধ্যে ফ্রেঞ্চকাট দাড়িঅলা ভদ্রলোক কেমন চোখে তাকিয়ে আমাকে দেখছিলেন। মিঃ হাজরা বললেন, আলাপ করিয়ে দিই। ইনি মিসেস রায়চৌধুরির স্বামী মিঃ কালীশ রায়চৌধুরি আর মিঃ রায়চৌধুরি, ইনি প্রখ্যাত

তার কথার উপর দ্রুত বললুম, আমি একজন ন্যাচারোলজিস্ট। মিঃ হাজরা আমার নেমকার্ডটা নিশ্চয়ই পরমার কাছ থেকে পেয়েছেন, সেটা এঁকে দেখাতে পারেন।

আমার কথা গ্রাহ্য না করে কালীশবাবু জড়ানো গলায় বললেন, কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছি না বাপিকে কে তিনটে গুলি করল। কে সে? কে? তা ছাড়া বাপি আমার অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকল কী করে? পরমা! এখনও সময় আছে তুমি সত্য কথা বলো।

.

০৩.

লালবাজারের ওসি হোমিসাইডাল মিঃ হাজরা–কুঁচকে কালীশবাবুর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। লক্ষ করলুম তিনি বেজায় বিরক্ত। সেই সঙ্গে এ-ও বুঝতে পারলুম কালীশবাবু তাঁর স্ত্রী পরমাকে এর আগেও এ ধরনের প্রশ্ন করেছেন। কারণ এবার মিঃ হাজরা বলে উঠলেন, কালীশবাবু এটা আপনাদের দাম্পত্য কলহের ব্যাপার নয়। এখানে সাংঘাতিক একটা মার্ডার ঘটেছে। আপনার স্ত্রীকে যা জেরা করার তা আমরা ইতিপূর্বে করেছি এবং আরও করব। সেই সঙ্গে আপনাকেও জেরা করার প্রচুর কারণ আছে।

কালীশবাবু চুপ করে গেলেন। আমি নরেশবাবুর দিকে তাকালুম। তার ঠোঁটের কোণে কেমন একটা হাসির রেখা চোখে পড়ল। আমি বললুম, নরেশবাবু, ডেডবডি কি মর্গে পাঠিয়েছেন?

নরেশবাবু বললেন, আধঘণ্টা আগে পাঠিয়েছি।

–আশা করি যথাযথভাবে সুরতহাল অর্থাৎ বডির পজিশন ইত্যাদি যা নোট করার দরকার, নোট করেছেন।

-নোট আমি করেছি তবে এক্ষেত্রে সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে দেবেন লোকাল থানার অফিসার-ইন-চার্জ প্রসন্ন তরফদার।

বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন।

জিজ্ঞেস করলুম, ওসি মিঃ তরফদার কি এখানে আছেন?

নরেশবাবু বললেন, না। তার যেসব কাজ ছিল সেগুলো করে নিয়ে উনি থানায় ফিরে গেছেন। যেহেতু পরমাদেবী লালবাজারে টেলিফোনে খবরটা দিয়েছিলেন। তাই আমাদের এই মিঃ হাজরার নির্দেশে কেসটা আমাদের সি আই ডি হাতে নিয়েছে। এবার চলুন, আপনাকে ঘটনাস্থলে নিয়ে যাই। মিঃ হাজরা কি সঙ্গে আসবেন?

 মিঃ হাজরা গম্ভীর মুখে বললেন, আপনি কর্নেল সাহেবকে দেখিয়ে নিয়ে আসুন। ততক্ষণে আমি কালীশবাবুর সঙ্গে দরকারি কিছু কথা বলে নিই।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললুম, পরমা, তুমি আমাদের সঙ্গে এসো।

নরেশবাবু বললেন, হ্যাঁ। ওঁকে তো সঙ্গে নিতেই হবে। কারণ উনি ঘটনাটা বর্ণনা করবেন।

প্রশস্ত ড্রয়িং রুম থেকে একটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে যে ঘরে ঢুকলুম সেটা কালীশবাবুর অফিস বলেই মনে হল। তারপর সেই ঘর থেকে বেরিয়ে একটা সংকীর্ণ করিডর।

নরেশবাবু বললেন, বাঁদিকের এই ঘরটা বেডরুম। বেডরুম থেকেও বাথরুমে যাওয়া যায়। আবার এই করিডর দিয়েও যাওয়া যায়।

একালের বিত্তশালীদের অ্যাপার্টমেন্টে ইউরোমার্কিন আদলের বাথরুম থাকাই স্বাভাবিক। বাথটবের কিনারায় খানিকটা জমাট বাঁধা রক্ত চোখে পড়ল। বাথটবে জল নেই দেখে জিজ্ঞেস করলুম, আমার ধারণা ছিল আততায়ী বাপি বোস পরমাকে এখানেই খুন করতে চেয়েছিল। কারণ পরমা সম্ভবত

আমার কথার উপরে পরমা দ্রুত বলল, হ্যাঁ, আমি স্নান করব বলেই আসছিলুম। হঠাৎ দেখলুম এখানে একটা লোক রক্তাক্ত শরীরে পড়ে আছে। তখনই আমি ছুটে গিয়ে লালবাজারে পুলিশ ডিপার্টমেন্টে ফোন করলুম।

নরেশবাবু বললেন, এই যে কার্পেটের উপরে বডির পজিশন চক দিয়ে লাইন টেনে দেখানো হয়েছে। লোকটা উপুড় হয়ে বাথটবের পাশে পড়ে ছিল। তার ডান হাতটা ছিল বাথটাবের বাইরে। একটা বড়ো ড্যাগার হাতে ধরা ছিল। ওই যে রক্তের চিহ্ন দেখছেন, ওটা ওর রক্ত থেকে ওখানে পড়েছে। আমি রক্তটা ধুতে দিইনি শুধু আপনাকে দেখাব বলে। বাথটাবের পাশে কার্পেটের উপর প্রচুর রক্ত ছিল, দেখেই বুঝতে পারবেন তা পরিষ্কার করা হয়েছে।

আমি কথা শুনছিলুম বটে কিন্তু আমার দৃষ্টি মাঝে মাঝে পরমার মুখের দিকে নিবদ্ধ ছিল। অবাক হয়ে ভাবছিলুম এই মহিলা আজ সকালে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই এক হাঁটু জল ভেঙে গাড়ি চালিয়ে আমার কাছে ছুটে গিয়েছিল। তখন তাকে খুব বিচলিত মনে হচ্ছিল। কিন্তু এখন তার চোখে মুখে কঠিন শীতলতা স্থির হয়ে আছে।

বললুম, আচ্ছা নরেশবাবু, আপনারা যখন এসে ডেডবডিটা দেখেছিলেন তখন কি রক্ত জমাট বেঁধে ছিল না কি–

পরমা কিছু বলতে ঠোঁট ফাঁক করেছিল। কিন্তু সে কিছু বলল না। নরেশবাবু বললেন, সেই রহস্যভেদ করার জন্যই তো ওই রক্তটা আমি মুছতে দিইনি। এখন রাত আটটা পঁচিশ। আপনি এবার রক্তটা পরীক্ষা করে দেখুন। আপনি তো এসব বিষয়ে একজন এক্সপার্ট। কথাটা বলে নরেশবাবু হেসে উঠলেন।

আমি প্যান্টের পকেট থেকে আতস কাঁচ বের করে বাথটাবের পাশে হাঁটুমুড়ে বসলুম। তারপর আতস কাঁচের সাহায্যে রক্তটা পরীক্ষা করে উঠে দাঁড়ালুম।

নরেশবাবু ব্যস্তভাবে এবং চাপা স্বরে বললেন, কী বুঝলেন বলুন?

বললুম, আপনি ঠিকই বলছিলেন, সারা জীবন আমি রক্ত ঘেঁটে আসছি। ডাক্তারি বিদ্যায় আমার তত জ্ঞানগম্যি নেই। তবে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ থেকে এ ব্যাপারে একটা অভিজ্ঞতা এসে যায়। আমার মনে হল খুনটা হয়েছে অন্তত দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে।

এই সময় পরমা বলে উঠল, আমি ছ’টায় বাইরে থেকে এসেই স্নান করতে এসেছিলুম। তখনই ডেডবডিটা দেখতে পাই। রক্তের দিকে তখন আমার তাকানোর মতো সাহস ছিল না। কর্নেল সাহেব, আপনি চিন্তা করুন আমি কেন, আমার মতো যে কোনো সাধারণ মেয়েই তার বাথরুমের পাশে রক্তাক্ত ডেডবডি দেখতে পেলে তার মানসিক অবস্থা কীরকম হতে পারে। আমি তখনই বেডরুমে ঢুকে লালবাজারে পুলিশ কন্ট্রোলে ফোন করেছিলুম। তারাই নরেশবাবুর সঙ্গে আমার যোগাযোগ করিয়ে দেয়।

নরেশবাবু বললেন, আজ আমার অফিসে যাওয়ার কারণ ছিল না। নেহাৎ রুটিন ডিউটি। তারপরই কন্ট্রোল রুম থেকে টেলিফোন। ওদিকে কন্ট্রোল রুম মিঃ হাজরাকেও জানিয়ে দিয়েছে নিউ আলিপুরে একটা মার্ডার হয়েছে। সি আই ডি-তেও খবরটা দেওয়া হয়েছে, আপনি তো জানেন মিঃ হাজরা আমার প্রতি বড্ড ঈর্ষাকাতর। কারণ আমার ডিপার্টমেন্ট নাকি খুনখারাপির সব ক্রেডিট নিতে সবসময় তৎপর। যাই হোক, বলা যায় সাপে নেউলে একত্র হয়ে এখানে কিছু ফোর্স নিয়ে ছুটে এলুম। অবশ্য আসার আগে লোকাল থানার ওসিকে খবরটা দিয়েছিলুম। আমরা এসে দেখি ওসি মিঃ তরফদার সদলবলে এসেছেন কিন্তু এই ঘরে পৌঁছননি। মিঃ হাজরার মতে এটা মিঃ তরফদারের প্রচণ্ড গাফিলতি। তিনি সঙ্গে সঙ্গে উঠে এলে হয়তো বা খুনিকে দেখতে পেতেন।

নরেশবাবু চাপা হাসছিলেন।

বললুম, একেবারে লালবাজার ছুটে আসছে দেখে লোকাল ওসির পক্ষে আগ বাড়িয়ে কিছু করতে যাওয়া উচিত হবে না–এই ভেবেই মিঃ তরফদার আপনাদের অপেক্ষা করছিলেন।

পরমা এবার চাপা স্বরে বলল, কর্নেল সাহেব, আমি এখনও বুঝতে পারছি না এই লোকটা আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকল কোন পথে?

জিজ্ঞেস করলুম, অ্যাপার্টমেন্টের কোনও ইমারজেন্সি ডোর নেই?

পরমা কিছু বলার আগেই নরেশবাবু বললেন, ইমার্জেন্সি ডোর খোলা ছিল।

পরমা চমকে উঠে বলল, এ তো খুব আশ্চর্যের ব্যাপার! ওই দরজা কে খুলে রেখেছিল?

নরেশবাবু ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে বললেন, এই সুযোগে কথাটা সেরে নেওয়া যাক। পরমাদেবী বলেছেন আজ সকালে তিনি আপনার কাছে গিয়েছিলেন। কেন গিয়েছিলেন তাও বলেছেন।

পরমা বলল, হ্যাঁ। কিছুদিন থেকে আমার স্বামীর হাবভাব দেখে সন্দেহ হচ্ছিল সে অন্য কোনো মেয়ের প্রতি আসক্ত। আমি বিশ্বস্ত সূত্রেও জানতে পেরেছিলুম কিছুদিন থেকে ওদের ক্লাবে একজন সুন্দরী মহিলার সঙ্গে তাকে দেখা যায়। কর্নেল সাহেব, এবার আপনি নিজেই বলুন কেন আপনার কাছে গিয়েছিলুম।

আমি একটু বিব্রত বোধ করছিলুম। কিন্তু আপাতত পরমাকে আমার অনুগত রাখতেই হবে। তাই বললুম, হ্যাঁ। তুমি আমার কাছে গিয়েছিলে যদি কোনো উপায়ে তোমার স্বামীকে ভয় দেখিয়ে নিবৃত্ত করতে পারি। তা ছাড়া তুমি কী করা উচিত এ বিষয়ে আমার পরামর্শও চেয়েছিলে।

পরমা বলল, আপনার নেমকার্ডটা যাতে আমার স্বামীর চোখে পড়ে সেই উদ্দেশ্যেই আমি আমাদের বেডরুমে মাথার কাছে টেবিলটায় কাঁচের তলায় রেখে দিয়েছিলুম। ওই টেবিলে টেলিফোন আছে। তাই ওই ধরনের অনেক নেমকার্ডও রাখা আছে।

নরেশবাবু হাসিমুখে বললেন, আপনার ওই নেমকার্ডের সঙ্গে আমি খুবই পরিচিত। বিশেষ করে নেচারোলজিস্ট শব্দটা চোখে পড়ার মতো ভঙ্গিতে ছাপা আছে। তাই সেটা আমার চোখে পড়েছিল এবং আমি পরমা দেবীকে জেরায় প্রায় জেরবার করে ছেড়েছি। উনি হয়তো এখনও আমার উপর মনে মনে খাপ্পা হয়ে আছেন।

পরমা বলে উঠল, না না মিঃ ধর, আমি আপনাকে কথার উত্তর দিতে কিছু গোপন করিনি। কর্নেল সাহেবের কার্ড আমি আজ সকালে পেয়েছি, সেকথাও আমি আপনাকে বলেছি।

আমি ইচ্ছাকৃতভাবে গম্ভীর মুখে বললুম, ইমার্জেন্সি ডোর আগে থেকে খোলা ছিল। তারপর এখানে বাথটাবের কাছে একটা ডেড ডি পাওয়া গেল। তার হাতে সাংঘাতিক ড্যাগার। এদিকে দেখা যাচ্ছে বডিটা যার তার নাম বাপি বোস, তাকে কালীশবাবু বিলক্ষণ চেনেন। এখন প্রশ্ন হল ইমার্জেন্সি ডোর ভিতর থেকে যেই খুলে রাখুক, এই বাপি বোসের জন্যই সে এমনটা করেছিল। তারপর বাপি বোস সম্ভবত তার ভিকটিমকে কোনো ঘরে না দেখতে পেয়ে ভেবেছিল সে বাথরুমে আছে। অতএব সে বাথরুমের কাছে গিয়েছিল। এবার প্রশ্ন, কে তাকে গুলি করে মারল?

কথাটা বলে আমি মুচকি হেসে পরমার দিকে তাকালুম। বললুম, পরমা, তুমি লোকটাকে গুলি করে মারোনি তো?

মুহূর্তে পরমার মুখে আতঙ্কের ছাপ পড়ল। সে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলে উঠল, না-না, আমি ফায়ার আর্মস পাব কোথায়? আর পেলেও কীভাবে গুলি করতে হয় তাও তো আমি জানি না। তা ছাড়া কোনও লোককে একলা ঘরে ড্যাগার হাতে মুখোমুখি দেখলে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব।

নরেশবাবু বললেন, হ্যাঁ। এইজন্যই আমি পরমাদেবীর কাছে জানতে চেষ্টা করেছিলুম তার কোনও হিতৈষী বন্ধু আছেন কি না? তা ছাড়া তিনি যখন বাইরে থেকে ফিরে আসেন তখন তার গাড়িতে তেমন কেউ ছিলেন কি না? পরমা দেবী জোর কথায় সে কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি সল্টলেকে আত্মীয়ের বাড়িতে আজ সারাদিন ছিলেন।

পরমা বলল, হ্যাঁ। কর্নেল সাহেবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এসে সারা দিন একা থাকতে ভয় পেয়েছিলুম। পাছে আমার স্বামী সেই মেয়েটিকে বিয়ে করার জন্য আমাকে গুম করে দিতে পারে।

নরেশবাবু বললেন, যাই হোক, এ বড়ো অদ্ভুত রহস্য। পরমাদেবীর অনুমানে যুক্তি আছে যে, বাপি বোস তাকেই হত্যা করতে এসেছিল। কিন্তু এর পরের প্রশ্ন বাপিকে গুলি করে মারল কে?

বললুম, ঠিক বলেছেন নরেশবাবু। আমার ধারণা বাপিকে ফলো করে তার কোনো শত্রু এখানে এসেছিল। তার সেই শত্ৰু সে পথে বাপি ঢুকেছিল সেই পথেই ঢুকেছিল। বাপিকে খুন করার মোটিভ কী, সেটাই প্রথম গুরুত্বপূর্ণ।

নরেশবাবু বললেন, কর্নেল সাহেব, সিকিউরিটির চোখ এড়িয়ে এই হাউজিং কমপ্লেক্সে বাইরের লোকের ঢোকা কঠিন। অন্তত এখানকার কোনো বাসিন্দার সঙ্গে বাইরের লোক আসতে পারে। আর তা ছাড়া অচেনা কেউ এলে সদর গেটে সিকিউরিটি থেকে টেলিফোন করে জানতে চাওয়া হয় ওই ব্লকের বাসিন্দার কাছে এই নামের কোনো লোক এসেছে। তাকে যেতে দেওয়া হবে কি না জেনে নিতে হয়। আবার খাতাতেও তার নাম ঠিকানা, কার কাছে যাচ্ছে এসব লিখে তার সই নেওয়া হয়। কাজেই বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা কত রহস্যময়।

পরমা বলল, পিছনের দিকে বাইরে যাওয়া-আসার একটা দরজা আছে। ওদিকটায় গাছপালা আর ফুলের বাগান আছে। মালী পরিবার থাকে। তা ছাড়া আরও কয়েকজন কর্মচারীও ওদিকটায় থাকে। কাজেই ওই দরজা আগে থেকে কেউ খুলে না রাখলে দু-দুটো লোক কীভাবে আসতে পারে।

আমি চাপাস্বরে বললুম, নরেশবাবু, এমন তো হতে পারে কালীশবাবু পরমাকে মার্ডার করার জন্য ভাড়াটে খুনি আনবার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। পাছে তার উপর কোনো দায় চাপে তাই তিনি কোথায় পিকনিক করতে গিয়েছিলেন।

নরেশবাবু বললেন, একথা আমিও ভেবেছি। কিন্তু ভাড়াটে খুনিকে ফায়ার আর্মসের গুলিতে খুন করল কে পরমা দেবী তো জোর গলায় বলছেন তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না।

এই সময় একজন পুলিশ অফিসার এসে বললেন, মিঃ ধর, মিঃ হাজরা আপনাকে ডাকছেন।

নরেশবাবু বললেন, ঠিক। আমরা তো আর সারারাত এখানে কাটাতে পারি না। লালবাজারে ফিরতেই হবে। কিন্তু যাওয়ার সময় অন্তত একজনকে সন্দেহভাজন অপরাধী বলে নিয়ে যেতেই হবে। এখন দেখা যাক, মিঃ হাজরার সিদ্ধান্ত কী?

আমি একটু হেসে বললুম, তোমাদের সামনে দুজন সন্দেহভাজন ব্যক্তি। কালীশবাবু আর তাঁর স্ত্রী পরমা।

লক্ষ করলুম পরমার শীতল মুখে বাঁকা হাসি ফুটে উঠেছে।

নরেশবাবু পা বাড়াতে গিয়ে হঠাৎ বলে উঠলেন, কর্নেলসাহেবকে আসল কথাটা বলাই হয় নাই।

জিজ্ঞেস করলুম, কী কথা?

–বডির পজিশন চক দিয়ে চিহ্নিত করে রেখেছি। কিন্তু তার বডিতে কোথায় কোথায় গুলি লেগেছিল বলা হয়নি।

আমি শিলাদিত্যের কথা বিশ্বাস করেছিলুম কেননা আজ সকালে পরমার কাছে একটা বিদেশি রিভলবার দেখেছিলুম। তাই বললুম ওটা আমি অনুমান করতে পেরেছি। বাপিকে গুলি করা হয়েছিল মুখোমুখি। কারণ আচমকা বাপি পিছনে হয়তো পায়ের শব্দ শুনেই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। কাজেই তার বুকে গুলি লাগার সম্ভাবনা।

নরেশবাবু বলে উঠলেন, না কর্নেল সাহেব। গোড়াতেই আমার বলা উচিত ছিল বাপিকে পিছন থেকে গুলি করা হয়েছে। তাই তিনটে গুলির মধ্যে একটা মাথার পিছনে লেগেছিল, অন্যদুটো পিঠের দু’পাশে। তাই বডি পড়েছিল উপুড় হয়ে।

এবার আমি চমকে উঠলুম। তাহলে শিলাদিত্য কি ভুল বলেছে? এ ও হতে পারে সে পরমার কাছে ফোন পেয়ে সাধারণ জ্ঞানেই ধরে নিয়েছে বাপির বুকে গুলি লেগেছে। এদিকে পরমাও হয়তো ওই অবস্থায় তাকে বিস্তারিতভাবে ঘটনাটা বুঝিয়ে বলতে পারেনি।

নরেশবাবুকে অনুসরণ করে যাওয়ার সময় আবার তীক্ষ্ণদৃষ্টে পরমার দিকে তাকালুম। দেখলুম সে এবার যেন প্রচণ্ড বিব্রত বোধ করছে। আমি তার দিকে ঘুরে তাকানোর জন্যই সে বিচলিত কণ্ঠস্বরে বলে উঠল, আমি [টিয়ে লক্ষ করিনি। বডি কীভাবে পড়ে আছে সেটা আমার মাথায় আসেনি। তবে তার ডান হাতে ড্যাগার আর বডিতে রক্ত দেখে তখনই এখান থেকে সরে গিয়েছিলুম।

নরেশবাবু যেতে যেতে বললেন, হ্যাঁ, এটা স্বাভাবিক যেমন আমার ব্যাপারটাই দেখুন, আপনাকে বডির পজিশন দেখাতে এসেছিলুম অথচ সে যে উপুড় হয়ে পড়েছিল সে কথাটাই মাথায় আসেনি। আসলে এই অ্যাপার্টমেন্টে মার্ডার কেসটা খুবই সারপ্রাইজিং। একজন খুনির পিছনে আর একজন খুনি। কর্নেল কি কখনও এমন ঘটনা কোথাও দেখেছেন?

বললুম, দেখিনি বলেই মনে হচ্ছে। এই ঘটনাটা সত্যি বিস্ময়কর।

.

০৪.

ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখলুম ওসি হোমিসাইড মিঃ হাজরা আঙুল তুলে কালীশবাবুকে হুমকি দিচ্ছেন। কালীশবাবুও পালটা তাকে হুমকি দিচ্ছেন। কালীশবাবু বলছেন, আপনি আমার সঙ্গে ভদ্রভাবে কথা বলবেন। আপনি জানেন না আমার মাসতুতো দাদা আপনাদের ডিপার্টমেন্টেই একজন উচ্চপদস্থ অফিসার। তিনি আই পি এস।

এবার লক্ষ করলুম মিঃ হাজরা যেন কিছুটা দমে গেলেন। তিনি বললেন, তাই বলে আইন আইনের পথে চলবে না এটা তো হতে পারে না। আপনাকে আমি অ্যারেস্ট করতেই পারি। কারণ প্রাইমা ফেসি কেসে এটা বোঝা যাচ্ছে আপনাকে সন্দেহের অনেক কারণ আছে।

নরেশবাবু গিয়ে বললেন, হ্যাঁ। মিঃ হাজরা ঠিকই বলেছেন। এই কেসটা আমাদের সি আই ডি-র হাতে চলে যাবে। আমাদের ডি ডি ডি সি মিঃ অরিজিৎ লাহিড়ীর কনসেন্ট পাওয়া গেছে। আমি এখানে এসেই ম্যাডামের বেডরুম থেকে মিঃ লাহিড়ীকে ফোন করে সব জানিয়েছি। সেই সঙ্গে ম্যাডামের ঘরে কর্নেল সাহেবের কার্ড পাওয়া এবং পরমা দেবীর তার কাছে যাওয়ার কথাও জানিয়েছি। মিঃ লাহিড়ী আমাকে কথাটা শোনামাত্র বলেছেন আমরা কেসটা টেক আপ করছি। আপনি প্রসিড করুন। সেই জন্যই আমার সঙ্গে প্লেন ড্রেসে কয়েকজন অফিসারও এসেছেন।

মিঃ হাজরা বললেন, ঠিক আছে। এবার আপনি বলুন কালীশবাবুকে অ্যারেস্ট করার পক্ষে যুক্তি আছে কি না?

নরেশবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, আছে। এর প্রধান কারণ তাঁর স্ত্রী পরমা দেবী তার স্বামীর বিরুদ্ধে যে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন তাতে বোঝা যায় ড্যাগার হাতে বাপি। পরমাদেবীকেই খুন করতে ঢুকেছিল। দ্বিতীয় কারণ এই প্রচণ্ড বৃষ্টি বাদলার দিনে কালীশবাবু তার বন্ধুদের সঙ্গে ডায়মন্ডহারবার রোডে কোন বাগানবাড়িতে পিকনিক করতে গিয়েছিলেন। সকালের দিকে যা অবস্থা ছিল তাতে পিকনিক ক্যানসেল করারই কথা। অথচ কালীশবাবুর কথায় বুঝেছি যেভাবে হোক পিকনিক করাতে তার উৎসাহ ছিল বেশি।

এবার মিঃ হাজরা উঠে দাঁড়িয়ে একজন পুলিশ অফিসারকে বললেন,আপনি আর কমলবাবু আর্মড কনস্টেবল সঙ্গে নিয়ে এই ভদ্রলোককে লালবাজারে কাস্টডিতে নিয়ে চলুন। আশা করি ওঁর গায়ে হাত দেবার দরকার হবে না। উঠুন কালীশবাবু।

দু’জন অফিসার এবং আমর্ড কনস্টেবলরা কাছে এসে দাঁড়াতেই কালীশবাবু বাঁকা হেসে বললেন, ঠিক আছে। পুরো ব্যাপারটা কার চক্রান্ত তা আমি বুঝে গেছি। পরমা, তুমি কিন্তু পরে এর পরিণাম বুঝতে পারবে।

পরমা বলে উঠল, শুনছেন আপনারা। আমার স্বামী আমাকে থ্রেটন করছে।

কালীশবাবু তার কথা গ্রাহ্য করলেন না। বললেন, আমি আপনাদের সঙ্গে যাওয়ার আগে ল-ইয়ারের সঙ্গে কথা বলতে চাই। আপনারা জানেন আইনত আমি এটা করতে পারি।

নরেশবাবু অর্থপূর্ণ দৃষ্টে আমার দিকে তাকালেন। মিঃ হাজরা কিছু বলার আগেই আমি বললুম, হ্যাঁ। আইনকে নিজের পথে চলতে দিতে হলে এই অধিকারটা কালীশবাবুর প্রাপ্য।

কালীশবাবু যেখানে বসেছিলেন, তার পাশেই একটা টেলিফোন ছিল। তিনি রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন এবং সাড়া পেয়ে চাপা গলায় কার সঙ্গে অন্তত মিনিট পাঁচেক ইংরেজিতে কথাবার্তা বললেন। তারপর রিসিভার রেখে উঠে দাঁড়িয়ে ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বরে বললেন, আপনারা অন্যায় ভাবে আমাকে হ্যারাস করছেন। এর পরিণাম ভালো হবে না।

এরপর তিনি পরমার দিকে ঘুরে কিছু বলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু মিঃ হাজরা বললেন, আর একটি কথা নয়। নরেশবাবু, আপনার কি আর এখানে থাকার দরকার আছে?

নরেশবাবু বললেন, প্লিজ মিঃ হাজরা, করিডরে হাসান সাহেব আর মিঃ বক্সি আছেন। ওঁদের অপেক্ষা করতে বলুন। আমি একটু পরে বেরুব।

ওসি হোমিসাইডাল মিঃ হাজরা মুখে যে হম্বিতম্বিই করুন, তিনি যাওয়ার সময় লক্ষ করলুম আগের মতো দাপট তাঁর যেন নেই। এটা স্বাভাবিক। কালীশবাবুর কোনও মাসতুতো ভাই যদি সত্যিই আই পি এস অফিসার হন তাহলে একটু বুঝেসুঝে তাকে চলতেই হবে।

মিঃ হাজরা সদলবলে চলে যাওয়ার পর পরমা বলল, আপনারা বসুন। আমি এখনই কফি করে নিয়ে আসছি।

নরেশবাবু মুচকি হেসে বললেন, আপনাদের অ্যাপার্টমেন্টে ইমার্জেন্সি ডোর আমরা লক করে দিয়েছি। কাজেই আপনার পালানোর চান্স নেই।

নরেশবাবুর এই কথার মধ্যে কৌতুক ছিল। তাই পরমাও ঈষৎ কৌতুকে বলে গেল, আমার আর পালানোর কোনও পথ নেই মিঃ ধর। তা ছাড়া কর্নেল সাহেব আমার গার্জেন। কাজেই আমি পালাব কেন?

পরমা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তারপর নরেশবাবু উঠে গিয়ে সদর দরজার পর্দা সরিয়ে করিডরে দাঁড়িয়ে থাকা প্লেন ড্রেসের একজন সহকর্মীকে চাপা গলায় কী নির্দেশ দিলেন শুনতে পেলুম না। ফিরে এসে তিনি আমার মুখোমুখি বসলেন। তারপর বললেন, এই সুযোগে আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলে নিই।

বললুম, বলুন। তবে কফি খেয়ে নার্ভ চাঙ্গা করে আপনার কথা শুনলে ভালো হত। কিন্তু উপায় নেই। কারণ পরমাকে তো আর বলা যায় না তুমি ভেতরে কোথাও গিয়ে বোসো।

নরেশবাবু মুচকি হেসে খুব চাপা স্বরে বললেন, কর্নেল সাহেব, মেয়েরা কিন্তু আড়ি পেতে কথা শুনতে ওস্তাদ। কাজেই এখনই কথাবার্তা সেরে নিই।

এরপর নরেশবাবু তেমনই চাপা স্বরে বললেন, আপনার কাছে পরমাদেবী কেন গিয়েছিলেন তা আমাদের তিনি বলেছেন। এবং আপনাকে আমি তা জানিয়েছি। প্লিজ, তার এই কথাটা সত্যি কি না আপনার কাছে জানতে চাই।

আমাকে ইচ্ছে করেই তাঁর কথায় সায় দিতে হল। কারণ আমার হাতের তাস আপাতত আমি পুলিশকে দেখাতে রাজি নই।

এরপর নরেশবাবু বললেন, পরমাদেবী আজ সল্টলেকে তার যে আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলেন তার ঠিকানা আমাকে দিয়েছেন। ওখানে থাকেন তাঁর এক। পিসতুতো দাদা শিলাদিত্য…। আমাকে এই ব্যাপারটা যাচাই করে নিতে হবে। যদি সত্যিই পরমাদেবী সেখানে দিন কাটিয়ে সন্ধ্যা ছ’টা নাগাদ বাড়ি ফিরে থাকেন তাহলে ঘটনাটা আরও রহস্যময় হয়ে উঠবে। কারণ কালীশবাবু স্ত্রীকে খুন করার জন্য খুনি ভাড়া করতেই পারেন। আর ডাকাতির লোভে উচ্চবিত্তদের বাড়িতে খুন এবং ডাকাতি আজকাল প্রায়ই হচ্ছে। কাজেই কালীশবাবুর পক্ষে এই কাজটা স্বাভাবিক হতেই পারে। শুধু জানতে হবে তিনি কোন ক্লাবের মেম্বার এবং তার প্রেমিকাটি কে?

নরেশবাবু হয়তো আরও কিছু বলতেন কিন্তু এই সময় ট্রেতে কফি আর দু’প্লেট স্ন্যাক্স নিয়ে পরমা এসে গেল।

সে বলল, আমার কাজের মেয়েটিকে সকালেই বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলুম। কারণ আমার স্বামী পিকনিক করতে গেছেন এবং আমাকেও বেরুতে হবে।

এরপর আমরা চুপচাপ কফি খেতে থাকলুম। একটু পরে বললুম, ওপাশে তোমার স্বামীর অফিস ঘর দেখলুম। উনি কি বাড়িতেও অফিস করেন?

পরমা বলল, হ্যাঁ। তবে এটা কালীশের প্রাইভেট অফিস তার মানে যেসব কাজ সে তার কোম্পানির অফিসে করতে পারে না কিংবা করার পক্ষে বাধা আছে

নরেশবাবু তার কথার উপর বলে উঠলেন, অর্থাৎ কনফিডেন্সিয়াল, গোপনীয় কাজকর্ম।

পরমা বলল, আমি ওসব কিছু বুঝি না। ওর কাজ কারবারের ব্যাপারে আমার কোনও আগ্রহই নেই।

নরেশবাবু বললেন, জিজ্ঞেস করতে সংকোচ হচ্ছে তবু আমি পেশার খাতিরে আপনার কাছে জানতে চাইছি–আপনাদের বিয়ে হয়েছে কতদিন আগে?

পরমা মুখ নামিয়ে আঙুল খুঁটতে খুঁটতে বলল, দু’বছর।

–কিছু মনে করবেন না, এবার আমি জানতে চাইছি আপনাদের বিয়ে কি গার্জেনদের অ্যারেজমেন্টে হয়েছিল না কি পরস্পরের মধ্যে কোনও ইমোশনাল অ্যাফেয়ার ছিল?

পরমা গলার ভিতরে বলল, আমি নির্বোধের মতো ওর পাল্লায় পড়েছিলুম।

-আপনাদের কোনও সন্তানাদি নেই?

–না।

 এরপর নরেশবাবু তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা এবং তার স্বামীর কাছে প্রতিদিন কী ধরনের লোকজন যাতায়াত করেন এইসব নিয়ে কথাবার্তা চালিয়ে গেলেন। অবশ্য কথা বলার ধরন যা-ই হোক এটা যে একজন ধুরন্ধর সরকারি ডিটেকটিভের জেরা তা বুঝতে পারছিলুম।

ইতিমধ্যে কফি শেষ করে আমি চুরুট ধরিয়েছি। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে ঘড়ি দেখে বললুম, সওয়া ন’টা বাজে। আমাকে তো এবার উঠতে হবে।

নরেশবাবু বললেন, হ্যাঁ। আমিও উঠব। তবে পরমা দেবীর সেফটির জন্য কী করা যায় সেটাই প্রশ্ন।

পরমা বলল, আপনি এ নিয়ে কিছু ভাববেন না। এই হাউজিং কমপ্লেক্সে সিকিউরিটির ব্যবস্থা আছে। বেডরুমে একটা সুইচ টিপলেই সিকিউরিটির লোকেরা ছুটে আসবে।

বললুম, কিন্তু তোমার বাথরুমের বাথটবের পাশে ডেডবডি দেখে তুমি ওই বোতামটা না টিপে সরাসরি লালবাজারে ফোন করেছিলে কেন?

পরমা নির্বিকার মুখে বলল, ওদের ডাকলে এখানকার সব লোক এসে ভিড় জমাতো। ব্যাপারটা আমি সামলাতে পারতাম না। ইতিমধ্যেই অবশ্য সবাই জেনে। গেছে, কিন্তু পুলিশ ফোর্সের কড়া পাহারা দেখে কেউ নাক গলাতে আসেনি। তা। ছাড়া এমনিতেই এই হাউজিং কমপ্লেক্সের লোকেদের মধ্যে বিশেষ বিশেষ। পালাপার্বণ বা অনুষ্ঠান উপলক্ষে মেলামেশা হয় এই পর্যন্ত। আমরা কেউ কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাই না।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললুম, আমি তাহলে চলি। পরমা, তুমি প্রয়োজন হলে। টেলিফোনে আমার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে নিও। কারণ আমি সব সময় বাড়িতে থাকি না।

নরেশবাবু হাসতে হাসতে বললেন, নেচারোলজিস্টের ব্যাপার। বিরল প্রজাতির প্রজাপতি, অর্কিড, ক্যাকটাস–এসবের পেছনেই ছুটে বেড়ানোর জন্য তৈরি থাকেন।

পরমা আস্তে বলল, জানি।

নরেশবাবু বললেন, আমি অলরেডি আমার লোকেদের বলে দিয়েছি, ওরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। আপনার জন্য গাড়িও রেডি আছে। কোনও অসুবিধা হবে না। যথাসময়ে আবার আপনার সঙ্গে দেখা হবে। আমি পরমাদেবীর সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে তারপর স্থানত্যাগ করব।

পরমার কাছে বিদায় নিয়ে এবং তাকে সাহস দিয়ে আমি বেরিয়ে গেলুম। একজন সাদা পোশাকের পুলিশ আমাকে সেলাম ঠুকে বলল, আপনি কি বাড়ি ফিরছেন স্যার?

বললুম, হ্যাঁ। চলুন, আমাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসবেন।

.

০৫.

আমার অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে গিয়ে ষষ্ঠির মুখে শুনলুম কে একজন ফোন করেছিলেন। সে বলল আমি বললুম, বাবামশাই বেইরেছেন। তখন তিনি বললেন, আমি পরে আবার ফোন করব।

বললুম, তুই কি নাম জিজ্ঞেস করেছিলি?

ষষ্ঠি বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ। তিনি কোত্থেকে ফোন করছেন তাও জিজ্ঞেস করেছিলুম। কিন্তু তিনি বললেন পরে আবার ফোন করবেন।

তাকে কফি করতে বলে ইজিচেয়ারে বসে অভ্যাসমতো চোখ বুজে পুরো ঘটনাটা ভাবতে থাকলাম। শিলাদিত্যের বর্ণনা অনুসারে পরমা যখন বাথটাবে ছিল তখনই নাকি খুনি তার সামনে আসে এবং সে তাকে পরপর তিনবার গুলি করে। যদি সত্যি তাই হত তাহলে বুকে বা শরীরের সামনের দিকে গুলি লাগলেই লোকটা সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যেত। কারণ কাছে থেকে গুলি করলে ভেলোসিটি বা গতিবেগ প্রচণ্ড হবে এবং খুনি চিত হয়ে পড়বে। বাকি দুটো গুলি তার শরীরের সামনে লাগারই কথা। অথচ লোকটাকে গুলি করা হয়েছে মাথার পিছনে এবং পিঠের দু’পাশে। তাই সে উপুড় হয়ে পড়ে ছিল। তাহলে শিলাদিত্য কি ইচ্ছে করেই আমাকে মিথ্যা কথা বলেছিল এবং এটা বলার পিছনে তার কি কোনো উদ্দেশ্য ছিল? পরক্ষণে মনে হল শিলাদিত্যের সঙ্গে পরমার যে সম্পর্ক তাতে শিলাদিত্যের পক্ষে এমন কিছু বলা সম্ভব নয় যাতে পরমা বিপদে পড়ে। তবে এর একটা অন্যদিকও ভেবে দেখার আছে। পরমা শিলাদিত্যকে নিশ্চয় খুব উদ্বিগ্ন এবং ব্যস্ত ভাবে ঘটনাটা জানিয়েছিল। হয়তো সে শুধু বলেছিল একটা লোক ড্যাগার হাতে এসে পড়ায় সে আতঙ্কে মরিয়া হয়ে গুলি ছুঁড়েছে। শিলাদিত্য তার কথা শুনেই ঘটনাটা নিজের মতো করে সাজিয়ে আমাকে জানিয়েছে। হ্যাঁ, আমাকেও যদি পরমা জানাত তার বাথরুমে একজন আততায়ী ড্যাগার হাতে ঢুকেছিল এবং সে তাকে গুলি করেছে তাহলে আমার চোখেও স্বাভাবিকভাবেই শিলাদিত্যর মতো একটা চিত্র ভেসে উঠত।

ষষ্ঠিচরণ কফি নিয়ে এল। সে বলল, আপনার ডিনার খাওয়ার সময় আসতে আর মিনিট কুড়ি বাকি। আপনি বললেন তাই কফি দিলুম। কিন্তু এখন কফি খাওয়া বোধহয় ঠিক হচ্ছে না বাবামশাই।

আমি বললুম, ষষ্ঠি, এখন যদি আমি কফি না খাই তাহলে আমি পাগল হয়ে যাব।

কথাটা গম্ভীর মুখে বললেও আসলে তাতে কৌতুক ছিল। কিন্তু আমার প্রিয় পরিচারকটি আঁতকে উঠে চোখ বড়ো করে বলল, ওকি কথা বলছেন বাবামশাই। কেউ আপনাকে খারাপ কিছু খাইয়ে দেয়নি তো? আপনার শরীর ঠিক আছে তো? নাকি তারকবাবু ডাক্তারকে খবর দেব?

এবার আমি জোরে হেসে উঠলুম। বললুম, শিগগির কফি না খেলে পাগল হয়ে তোর কানে কামড়ে দেব। তুই কেটে পড়।

ষষ্ঠিচরণ সভয়ে চলে গেল। ভিতরের ঘরে ঢুকবার আগে আমাকে একবার দেখেও নিল। যাই হোক, এইভাবে ষষ্ঠির সঙ্গে একটু রসিকতা করতে পেরে আমার মন-মেজাজ বেশ হালকা হয়ে গেল। কারণ আজ সকাল থেকে সারাদিন যা ঘটেছে তা এমন অদ্ভুত রহস্যে ভরা যার জট ছাড়ানো খুব কঠিন। নানা রকম অঙ্ক কষেও খেই পাচ্ছিলুম না।

এতক্ষণে হালকা মেজাজে কফি পানে মন দিলুম। আমি যতক্ষণ কফি খাই ততক্ষণ আর কিছু চিন্তা করি না। কারণ, তা হলে কফির স্বাদ পাওয়া যাবে না।

কফি শেষ করে চুরুট ধরিয়ে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়েছি, এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। সাড়া দিয়ে বললুম, শিলাদিত্য, তুমি এর আগে একবার ফোন করেছিলে, তাই না? আমার পরিচারক ষষ্ঠিচরণ ফোন ধরেছিল।

শিলাদিত্যের কণ্ঠস্বরে চমক টের পেলুম। সে বলল, আশ্চর্য, আপনি কি মন্ত্র বলে জানতে পারলেন যে আমিই ফোন করছি?

বললুম, এটা আমার একটা বিশেষ ক্ষমতা বলতে পার। যাকে একবার দেখি অর্থাৎ বিশেষ কোনও পরিস্থিতিতেই যাকে দেখি, তার মুখের চেহারা আমি ভুলি না। ঠিক তেমনই বিশেষ একটা পরিস্থিতিতেই তোমার কণ্ঠস্বর শুনেছিলুম। তাই তুমিই যে কথা বলছ তা আমি বুঝতে পেরেছিলুম যাই হোক, তুমি কি গা ঢাকা দিয়ে সত্যিই ঘুরে বেড়াচ্ছ?

সে বলল, আমার গা ঢাকা দেওয়ার একটা মাত্রই জায়গা আছে। আমি সেখান থেকেই আপনাকে ফোন করেছিলুম। এখনও করছি। আপনি তো পরমাদের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়েছিলেন!

বললুম, বোঝা যাচ্ছে আমি ওখানে থাকবার সময়ই পরমা তোমাকে একথাটা জানিয়েছে। আমাকে গণক ভেবো না। তবু আমি অঙ্ক কষেই বলছি, পরমা যখন আমার জন্য কফি তৈরি করতে গিয়েছিল–তা ধর, এখন থেকে পঞ্চাশ ষাট মিনিট আগে, তখনই সে তোমাকে ফোন করার সুযোগ পেয়েছিল।

শিলাদিত্য বলল, এখন প্রায় দশটা বাজতে চলেছে। লালবাজারের এক সি আই ডি অফিসার তাকে অনেক পরামর্শ দিয়ে মিনিট দশেক আগে চলে গেছেন। কাজেই পরমা আমাকে ফোন করার সুযোগ পেয়েছিল।

তার মানে তোমার এই গা ঢাকা দিয়ে থাকার জায়গাটা পরমার চেনা।

–ঠিক বলেছেন কর্নেল সাহেব। তো পরমা আমাকে বলল বাপিকে সে। সামনাসামনি গুলি করেনি। আমি তখন তার কথা পরিষ্কার বুঝতে পারিনি। কারণ অমন একটা সাংঘাতিক অবস্থায় কেউ গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। আর তা ছাড়া কথাটা শুনে আমি এত উত্তেজিত হয়েছিলুম যে আপনাকে আমিও গুছিয়ে ঘটনাটা বলতে পারিনি। আসলে পরমা বাথরুমে ঢোকার আগে বাপি আগে থেকেই তৈরি হয়ে বাথরুমের ভিতরে দেওয়ালের আড়ালে ওৎ পেতে দাঁড়িয়ে ছিল। পরমা তখন বাথরুমে যাবে বলে তৈরি হচ্ছিল। সে পর্দার তলা দিয়ে দুটো পা নিঃশব্দে। এগিয়ে যেতে দেখে। জুতোয় রবারের সোল থাকায় কোনো শব্দ হয়নি। কিন্তু। দরজা বন্ধ করা অ্যাপার্টমেন্টে এই দৃশ্য দেখেই পরমা তখনই রিভলবারটা বের করে। তারপর নিঃশব্দে দরজার পর্দা ফাঁক করে দেখতে পায় একটা টিশার্ট আর জিনস পরা তোক বাথরুমে হাতে ড্যাগার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সে এদিকে পিছন ফিরে বাথরুমের দেওয়ালে একটা ছবি দেখছে। কর্নেল সাহেব আপনাকে বলা দরকার কালীশ ব্যাটাচ্ছেলে একজন পারভার্টেড লোক। সে বাথরুমে এখানে ওখানে কয়েকটা ছবি টাঙিয়ে রেখেছিল। সব ছবি ন্যুড।

জিজ্ঞেস করলুম, তুমি বলতে চাইছ নেকেড উওম্যানের ছবি?

হ্যাঁ। সব ছবি যুবতী মেমসাহেবদের ফোটোগ্রাফ। ওই ধরনের অশ্লীল ছবির একটা প্যাকেট একবার হংকং থেকে এনে আমাকে উপহার দিয়েছিল কালীশ। কর্নেল সাহেব, আমি ব্রহ্মচারী নই, কিন্তু আমার রুচিতে এসব বাধে। বিশ্বাস করা না-করা আপনার ইচ্ছা। পাছে ছবিগুলো পরমার চোখে পড়ে, আমি সবগুলো নষ্ট করে দিয়েছিলাম। সেই সঙ্গে বলা দরকার, পরমাকেও ওই শুয়োরের বাচ্চা ওই সব ছবির প্যাকেট দেখাতে চাইত।

আমি ঘড়ি দেখে বললুম, তাহলে বোঝা যাচ্ছে আতঙ্কিত পরমা ড্যাগার হাতে বাপিকে দেখামাত্র নিঃশব্দে বেরিয়ে ক্লোজ রেঞ্জে গুলি পরেছিল। তাই না?

-হ্যাঁ, কর্নেল সাহেব। একটু আগে পরমা আমাকে ডিটেলসে সব কথা বলেছে।

–তাহলে পরমাকে যাতে পুলিশ খুনি সাব্যস্ত না করে সেজন্য—

 আমার কথার উপর শিলাদিত্য বলে উঠল, কালীশ গুলি করেছে এটাই আমরা প্রমাণ করতে চেষ্টা করব। আমি বলব, আমি পরমাকে তার অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে দেওয়ার সময় ঘটনাটা ঘটেছিল। অর্থাৎ ওদের অ্যাপার্টমেন্টে দরজা খোলার সময় আমি ভিতরে গুলির শব্দ শুনেছিলুম। আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন পরমাদের ফ্ল্যাটটা ওই ব্লকের শেষ দিকে। কাজেই গুলির শব্দ শোনার চান্স অন্য বাসিন্দাদের পক্ষে অসম্ভব। তা ছাড়া পয়েন্ট ব্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করলে এমনিতেই তত শব্দ হয় না।

আমি একটু ব্যস্ততার ভঙ্গি করে বললুম, নির্দিষ্ট সময়ে ডিনার সেরে না নিলে আমার শরীর খারাপ হয়। কাজেই তুমি এবার বলো এই কেসের ব্যাপারে আমার পক্ষে তাহলে আর কী করার আছে?

শিলাদিত্যও ব্যস্তভাবে বলল, প্লিজ কর্নেল সাহেব, আপনি এই কেসের ব্যাপারে যেন আর পা বাড়াবেন না। আমার অনুরোধ পরে পরমাও আপনাকে অনুরোধ করবে। আপনি যেন এই কেসটা এড়িয়ে চলেন। তা ছাড়া আপনি তো বুঝতেই পারছেন পরমাকে খুন করার জন্য কালীশই বাপিকে ভাড়া করেছিল। আর বাপি এই কাজটা একা না করতে পেরে আমার সাহায্য চেয়েছিল। বাপি জানত না পরমার সঙ্গে আমার পরিচয় বা কোনো সম্পর্ক আছে।

আমি বললুম, ঠিক আছে। আমি না হয় এড়িয়ে থাকার চেষ্টা করব। কারণ, তুমি পরমাকে ওই সাংঘাতিক অস্ত্রটা না দিলে বাপি তাকে নিশ্চয় খুন করত। কাজেই খুনি তার শাস্তি পেয়েছে।

-ধন্যবাদ কর্নেল সাহেব।

বলে শিলাদিত্য ফোনের লাইন কেটে দিল। আমি সেই মুহূর্তে ঠিক করতে পারছিলুম না সত্যিই আমার কী করা উচিত।

পোশাক বদলে রাতের পোশাক পরে নিয়ে আমি ডাইনিং রুমে গেলুম। ষষ্ঠি টেবিল সাজিয়ে রেখে অপেক্ষা করছিল। সে বলল, বাবামশাই, আমি মুখ্যসুখ্য মানুষ। কিন্তু আজকাল আমার মনে আপনার জন্যে খুব ভাবনা হয়। আপনি এইসব কাজে আর নিজেকে যেন জড়াবেন না।

চোখ কটমটিয়ে বললুম, ওরে হতভাগা। তুই তাহলে আড়ি পেতে কথাবার্তা শুনিস। নাকি আমার বেডরুমে ঢুকে ওই টেলিফোনটা তুলে দুই পক্ষেরই কথাবার্তা শুনিস। সাবধান ষষ্ঠি, তুই দেখছি আমাদের হালদার মশায়ের মতো সত্যি একজন টিকটিকিবাবু হওয়ার তাল করেছিস।

ষষ্ঠি কাঁচুমাচু মুখে বলল, আজ্ঞে না, না। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আপনি বরং খেতে বসুন। আজ আধ ঘণ্টা দেরি হয়ে গেল।

সে রাতে আমাকে আর কেউ টেলিফোনে জ্বালাতন করেনি। বিছানায় শুয়ে পড়ার পর অবশ্য অনিবার্যভাবেই পুরো ঘটনাটা আমার মাথার ভিতরে ঢুকে মাছির মতো ভনভন করছিল। একসময় হঠাৎ মনে হল আমার তরুণ সাংবাদিক বন্ধু জয়ন্তকে আমি প্রায় বলে থাকি হোয়াট অ্যাপিয়ারস ইজ নট বিয়াল ন্যায়শাস্ত্রে একে বলে অবভাস তত্ত্ব। চোখের সামনে যা দেখছি, আর প্রকৃতপক্ষে যা ঘটছে, অনেক সময় দুটো এক নয়। আজকে যা ঘটেছে এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনো রহস্যের একটা জট আছে।

পরদিন ভোরে উঠে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে আসার পর ছাদের বাগানে গাছপালার পরিচর্যা করলুম। প্রজাপতিগুলোকে খুঁটিয়ে লক্ষ করলুম। তারপর বেলা আটটা নাগাদ নীচে নেমে গেলুম। ড্রয়িং রুমে আমার ইজিচেয়ারে বসে কফি খাচ্ছি, সেই সময় টেলিফোন বেজে উঠল।

রিসিভার তুলে আমি ধরেই নিয়েছিলুম পরমার কণ্ঠস্বর শুনতে পাব। কিন্তু ভেসে এলো আমার বিশেষ স্নেহভাজন ডিসি ডিডি ওয়ান অরিজিৎ লাহিড়ীর কণ্ঠস্বর।

–মর্নিং বস। আমার কেন যেন ধারণা আপনার সুনিদ্রা হয়নি।

বললুম, মর্নিং অরিজিৎ। তুমি যা ভেবেছ, তেমন কিছু ঘটেনি। ঘুমোনোর আগে অবশ্যি আমি তোমাদের এই কেসটা নিয়ে কিছুটা চিন্তাভাবনা করেছিলুম। কিন্তু তাতে আমার অনিদ্রার কারণ ছিল না।

অরিজিতের হাসি ভেসে এলো-কর্নেল, আমি কিন্তু ধরেই নিয়েছি আপনি একটা জটিল রহস্যের আঁচ পেয়েছেন।

–জটিল রহস্য। ডার্লিং। কাল গিয়ে যা দেখেছি এবং বুঝেছি তাতে আমার ধারণা তোমাদের ওসি হোমিসাইডাল মিঃ হাজরা ঠিকই ধরেছেন। কালকের অমন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় বউকে ফেলে স্বামীর পিকনিক করতে যাওয়া, এদিকে বাথরুমে ঢুকে ভদ্রলোকের স্ত্রী একটা ডেডবডি আবিষ্কার। ব্যাপারটা তো এই। তুমি বলতে পারও খুনিকে কে তাহলে খুন করল?

ঠিক বলেছেন। স্বামীর যদি স্ত্রীকে খুন করানোর উদ্দেশ্য থাকে তাহলে সেটা এমন কিছু কঠিন নয়। কিন্তু এমন যদি হয় খুনির জন্য কালীশবাবু ইমার্জেন্সি ডোর খুলে রেখেছিলেন। আর পরমাদেবীর সেটা চোখে পড়েছিল। তখন তিনি স্বামীর চক্রান্ত টের পেয়ে তাঁর প্রেমিককে ফোন করেছিলেন।

-প্রেমিক? তোমরা কি এ বিষয়ে সিওর?

–সিওর। কাল রাত্রে আপনি ওখান থেকে চলে যাওয়ার পর নরেশবাবুর জেরার চোটে পরমা স্বীকার করেছেন তার একজন হিতৈষী আত্মীয় আছেন। তার নামধাম জানার পর গতরাতেই সল্টলেক থানার সাহায্যে আমার জানতে পেরেছি যুবকটির নাম শিলাদিত্য…। থানার ইনফরমার পাশের বাড়িতে থাকেন। তিনি শিলাদিত্যর কাছে এক যুবতীর যাতায়াতের কথা জানেন।

–তাহলে কি বলতে চাও ওই শিলাদিত্যই পরমার সঙ্গে সন্ধ্যা ছ’টায় ওখানে গিয়েছিল এবং

অরিজিৎ দ্রুত বলল, না। এমার্জেন্সি ডোর দিয়ে ঢুকেছিলেন স্বয়ং কালীশবাবু। এবং স্ত্রীর প্রেমিক ভেবে যাকে গুলি করেছিলেন সে অন্য লোক। সে অর্থাৎ বাপি এসেছিল শিলাদিত্য ও পরমা দেবীর সঙ্গে। ঘটনাটা মুখোমুখি জানাব। একটু আভাস দিচ্ছি। বাপি ওই সময় বাথরুম সেরে নিতে সেখানে ঢুকেছিল। আর কালীশবাবু তাকেই শিলাদিত্য ভেবে গুলি করেছিলেন। কর্নেল, একটা কথা আপনাকে তখন নরেশবাবুরা সম্ভবত জানাননি। অ্যাপার্টমেন্টের মেন সুইচ নামানো ছিল।

এবার একটু চমকে উঠে বললুম, মাই গুডনেস। তাহলে তো তোমাদের অঙ্কটা মিলে যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে গুলি করার পরই শিলাদিত্যের চোখে পড়ার ভয়ে এমার্জেন্সি ডোর দিয়ে কালীশবাবু কেটে পড়েন।

অরিজিৎ সায় দিয়ে বলল, ঠিক ধরেছেন। কিন্তু তার আগে স্ত্রীর প্রেমিককে খুনি সাজাবার জন্য কালীশবাবু একটা ড্যাগার ভিকটিমের হাতে গুঁজে দিয়ে চুপিচুপি কেটে পড়েন। ঘরের ওদিকটা অন্ধকার থাকায় তাঁর পালানোর সুবিধা হয়েছিল। এরপর কী ঘটেছিল বোঝা যায়। শিলাদিত্য ব্যাপারটা আবিষ্কার করার পর চুপিচুপি পরমাদেবীর পরামর্শেই ইমার্জেন্সি ডোর দিয়ে পালিয়ে যায়।

পরমা কি সেটা স্বীকার করেছে?

–সরাসরি স্বীকার না করলেও নরেশবাবুর জেরার জবাবে যা সব বলেছে। তাতে নরেশবাবু এইরকমই অনুমান করেছেন। যাই হোক, রাখছি বস। যথাসময়ে নরেশবাবু আপনার কাছে যাবেন। কারণ তার কিছু প্রশ্ন আছে।

বললুম, ওকে ডার্লিং। আমি নরেশবাবুর জন্য প্রতীক্ষা করছি। উইশ ইউ গুড লাক।

রিসিভার রেখে চুরুট টানতে টানতে আমি লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের থিয়োরিটা যাচাই করতে থাকলুম। শিলাদিত্যর সঙ্গে বাপির চেনাজানার তথ্য যেভাবেই হোক ওঁরা পেয়েছেন। তা না হলে অরিজিৎ বলত না বাইরে থেকে পরমা তার গাড়িকে শিলাদিত্য এবং বাপিকে সঙ্গে নিয়ে কাল সন্ধ্যায় অ্যাপার্টমেন্টে ফিরেছিল।

এই যুবকটির চেহারার দিকে আমি মনে-মনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলুম। হ্যাঁ, এমনটা হতেই পারে। পরমা শিলাদিত্যের পরামর্শে তার স্বামীকে ফঁসানোর জন্য আমাকে সাক্ষী গোপাল করতে চেয়েছে এমন তো হতেই পারে।

তা-ই যদি হয় তাহলে আমার পক্ষে এটা খুব অপমানজনক ব্যাপার। এযাবৎ কাল অনেকেই নিজেই অপরাধ করে আমার কাছে এসেছে যাতে তার অপরাধ ধরা না পড়ে। সেই জন্যই আমাকে সাক্ষীগোপাল করতে চেয়েছে। কাজেই পরমার পক্ষেও শিলাদিত্যের পরামর্শে সেই রকম প্ল্যান অস্বাভাবিক নয়।

.

০৬.

শিলাদিত্য আমাকে তার অজ্ঞাতবাসে থাকার জায়গা থেকে কোনও ফোন নাম্বার দেয়নি। তার কাছে ওখানকার ফোন নাম্বার দাবি করা আমারই উচিত ছিল। এবার যখন সে টেলিফোন করবে তখন সুকৌশলে তার ওই নাম্বারটা আমাকে জেনে নিতে হবে।

পরক্ষণে মনে হল পরমার পক্ষে নিশ্চয় ওই জায়গাটা কোথায় এবং সেখানকার ফোন নাম্বার কত তা জানা সম্ভব। কিন্তু পরমার ক্ষেত্রেও আমাকে কৌশল প্রয়োগ করতে হবে। কারণ অরিজিতের কথা শোনার পর থেকে সঙ্গত কারণেই আমার মনে হচ্ছে পরমা এবং শিলাদিত্য দু’জনেই অতিশয় ধূর্ত।

এইসব ভাবতে গিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। শিলাদিত্য আমাকে পরোক্ষভাবে এই কেসটা এড়িয়ে যেতে বলেছে। তার সোজা মানে আমার সাহায্যের আর কোনও দরকার তাদের নেই।

তবু একটা ক্ষীণ আশা ছিল পরমাও হয়তো টেলিফোন করে আমাকে ওই রকম কোনও কথা বলবে। কিন্তু এখনও সে ফোন করছে না। খেয়াল হল আমি এদিনের খবরের কাগজগুলো পড়িনি। প্রথমেই দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা তুলে নিলুম। দেখলুম প্রথম পাতাতেই পুলিশসূত্রে পাওয়া বাপি সেনের হত্যাকাণ্ডের খবর ছেপেছে। শিরোনাম চমকপ্রদ। সুরঞ্জনা আবাসনে রহস্যময় হত্যাকাণ্ড। কালীশ রায়চৌধুরীকে পুলিশের অ্যারেস্ট করার কথাও ওতে আছে। তবে বিশ্বস্ত সূত্রের নামে আইন বাঁচিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অপর একটি মহিলার কথাও স্টাফ রিপোর্টার বেশ রসকষ দিয়ে জুড়েছে। ভাগ্যিস আমার উপস্থিতি সে জানতে পারেনি। কাজেই তার বিশ্বস্ত সূত্রটি তার মগজেরই ফসল।

লালবাজার সি আই ডি-র সঙ্গে আমার অলিখিত চুক্তি আছে যে তারা আমার অনুমতি ছাড়া কোনও কেসে আমার নাম যেন না জড়িয়ে ফেলেন। যাই হোক, এরপর অন্যান্য ইংরেজি বাংলা কাগজগুলিতে চোখ বুলিয়ে দেখলুম খবরটা সবাই ছেপেছে। কারণ সুরঞ্জনা আবাসনে যারা বাস করেন তারা সবাই বিত্তবান এবং বিভিন্ন বিষয়ে খ্যাতনামা মানুষ। লক্ষ করলুম প্রত্যেকটি কাগজেই যেন অনিবার্য ভাবে একটি ত্রিকোণ এবং অবৈধ প্রেমের আভাস দেওয়া হয়েছে।

ষষ্ঠির ডাকে ব্রেকফাস্ট করতে গেলুম। ষষ্ঠি নিশ্চয় আমার চেহারায় গত রাত্রি থেকে এমন একটা ছাপ আবিষ্কার করেছে যা সে এযাবৎ কাল দেখেনি। গত রাতের মতো সে একটু কঁচুমাচু হেসে বলল, বাবামশাইকে কেমন যেন মনমরা দেখাচ্ছে।

চোখ কটমটিয়ে জিজ্ঞেস করলুম, মনমরা মানে? আমার মন মারা গেছে?

ষষ্ঠি হাসবার চেষ্টা করে বলল, আজ্ঞে বাবামশাই, ওটা কথার কথা। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছিল আপনি যেন কেমন ঝিমিয়ে পড়েছেন।

খাওয়ার সময় কথা বলা আমি পছন্দ করি না কারণ প্রথমত এতে খাওয়ার দিকে মন থাকে না। তার ফলে খাবারের স্বাদও যেমন পাওয়া যায় না, তা ছাড়া আচমকা শ্বাসনালীকে খাদ্য আটকে বিপদের সম্ভাবনাও থাকে। ষষ্ঠিচরণ তখনও আমাকে উপদেশ দিয়ে যাচ্ছিল এবার থেকে খামোখা কোনও ঝামেলায় যেন না জড়িয়ে পড়ি তার কথার দিকে কান করছিলুম না বটে কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছিল আমি একটা প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছি এবং বেশি এগিয়ে গেলে অতর্কিতে আমি বিপন্নও হতে পারি।

ব্রেকফাস্টের পর এক কাপ কফি খাওয়ার অভ্যাস আমার আছে। ষষ্ঠি কফির পেয়ালা সময়মতো তৈরি রেখেছিল। আমি সেটা হাতে নিয়ে ড্রয়িং রুমে গেলুম এবং ইজিচেয়ারে বসে কফি পানে মন দিলুম। তারপর চুরুট ধরিয়ে কেন যেন একটা অস্বস্তি অনুভব করলুম। তারপরই আমার একটা হাত চলে গেল টেলিফোনের দিকে। পরমার নাম্বার আমার ইতিমধ্যে মুখস্ত হয়ে গেছে। রিসিভার তুলে তার নাম্বারেই ডায়াল করলুম। তারপরই সাড়া এলো। তখন বললুম, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।

মহিলা কন্ঠে কেউ বলল, আপনি কাকে চান?

বললুম, এটা কি সুরঞ্জনা আবাসনের পরমা রায়চৌধুরির টেলিফোন নাম্বার?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু দিদিমণি তো বাইরে গেছেন। ফিরতে দেরি হবে।

–কোথায় যাচ্ছেন তা কি বলে গেছেন?

–না স্যার।

–আপনি কে?

–আমি স্যার দিদিমণির বাড়িতে কাজ করি। আমার নাম কাজল।

একটু ইতস্তত করে বললুম, কাজল, তোমার দিদিমণি আমাকে ফোন করব বলেছিলেন। তা ছাড়া কথা ছিল শিলাদিত্যবাবু নামে এক ভদ্রলোক তার কাছে আসবেন এবং দু’জনে আমার সঙ্গে দেখা করবেন।

আমার এই কথাটা ঠিক জায়গায় পৌঁছেছিল। কাজল বলল, শিলাদিত্যবাবুই তো দিদিমণিকে ফোনে ডেকেছিলেন। তাই উনি তখনই বেরিয়ে গেলেন।

–তুমি কি করে জানলে শিলাদিত্যবাবু তাকে ডেকেছেন?

–আজ্ঞে স্যার, আমিই তো ফোন ধরেছিলুম। উনি তো দিদিমণিকে প্রায়ই ফোন করেন, দিদিমণিও করেন। এবার আমি রাখছি স্যার। আপনি কী নাম বললেন যেন? দিদিমণি এলে তাকে আপনার নাম তো বলতে হবে।

–বলবে কর্নেল নীলাদ্রি স-র-কা-র। মনে থাকবে? বরং তুমি শুধু বলবে কর্নেল সাহেব ফোন করেছিলেন। এবার বলো দেখি কী বলবে?

কাজল দিব্যি বলল, বলব কর্নেল সাহেব নীলাদ্রি সরকার ফোন করেছিলেন।

বাহ। তুমি বুদ্ধিমতী কাজল। আর একটা কথা কাল তো তুমি ও বাড়িতে ছিলে না। কাল কী হয়েছে তোমার দিদিমণি তোমাকে তা বলেননি?

এবার কাজল বলে উঠল, এ ব্যাপারে আমাকে কিছু বলতে মানা করেছেন দিদিমণি। আমি রাখছি কর্নেল সাহেব।

কাজল লাইন কেটে দিল। তার কাছে নতুন কোনও তথ্য পেয়েছি বলে মনে হল না। শুধু জানতে পারলুম শিলাদিত্য ফোন করে তার অজ্ঞাতবাসের ডেরায়। ডেকেছিল এবং পরমা সেখানে চলে গেছে।

এতক্ষণে আমার মনে হল শিলাদিত্যের নির্দেশ মতো পরমা আমাকে এবার এড়িয়ে চলবে। এই কথাটা ভাবতে গিয়েই আমার মনে তীব্র ক্ষোভ জাগল। এবং তখনই ঠিক করলুম এই কেস থেকে আমি সরে যাব না। আমাকে জানতেই হবে প্রকৃতপক্ষে কাল সন্ধ্যায় পরমাদের অ্যাপার্টমেন্টে কী ঘটেছিল। পরমার কাছে সিক্স রাউন্ডার একটা রিভলবার আমি দেখেছি। পরমা বাপিকে ওই অস্ত্র থেকে গুলি করে মেরেছে নাকি তার স্বামী কালীশবাবু ভুল করে নিজের পাঠানো খুনিকেই গুলি করে মেরেছেন। বাপির হত্যাকারী কে–এই প্রশ্নটা আমাকে উত্ত্যক্ত করতে থাকল।

কিছুক্ষণ পরে ডোরবেল বাজল এবং আমিও অভ্যাসমতো হাঁক দিলুম, ষষ্ঠি।

একটু পরে সি আই ডি সাব ইনস্পেকটার নরেশ ধর যথারীতি প্লেন ড্রেসে ড্রয়িংরুমে ঢুকে সহাস্যে বললেন, গুড মর্নিং কর্নেল সাহেব।

তাঁকে দেখে খুশি হয়েছিলুম। বললুম, মর্নিং নরেশবাবু বসুন। আমি আপনার প্রতীক্ষা করছিলুম। কারণ অরিজিৎ আমাকে জানিয়েছিল আপনার আসার সম্ভাবনা আছে। যাই হোক, আগে কফি খান। সেই সুযোগে আমিও আরেক কাপ কফি খাব। কারণ আমার মাথার ভিতরটা আজ সকাল থেকেই কেমন যেন বেগড়বাঁই করছে।

নরেশবাবু হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, আপনি অভিজ্ঞ মিলিটারি অফিসার। তা ছাড়া এ যাবৎকাল নানা রকমের সাংঘাতিক সব অপরাধ রহস্য ফাঁস করেছেন। এখন আপনি বলছেন বাপি সেন নামে এক কুখ্যাত গুণ্ডার মার্ডারে আপনার মাথা নাকি বেগড়বাঁই করছে। আমি সামান্য মানুষ মাত্র। নেহাৎ চাকরির সূত্রে এ লাইনে আমাকে মাথা খাটাতে হয়। আমার সেই মাথার অবস্থাটা একবার চিন্তা করুন। খুলেই বলি। মিঃ হাজরার থিয়োরি মেনে কালীশ রায়চৌধুরিকে লালবাজারের কাস্টডিতে নিয়ে গেছি বটে, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এই মার্ডারের পেছনে অন্য কেউ আছে অবশ্য ওই অ্যাপার্টমেন্টে গিয়েই আমরা তন্নতন্ন করে সার্চ করেছি। কোথাও কোনো ফায়ার আর্মস পাইনি।

ভাবলুম নরেশবাবুকে বলি, তারা কি পরমার হ্যান্ডব্যাগ সার্চ করেছিলেন? কিন্তু আপাতত কথাটা চেপে গেলুম। আর এই সময় ষষ্ঠিচরণ ট্রেতে দু’পেয়ালা কফি নিয়ে এলো কারণ সে বুঝেছে আমি আবার এক কাপ কফি খেতে চাইব।

নরেশবাবু কফিতে চুমুক দিয়ে এবার গম্ভীর মুখে বললেন, গতরাত্রি থেকে শিলাদিত্যের পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না। সে ওখানে একটা বাড়ির দোতলায় থাকে। নীচের তলাটা নাকি একসময় তার কোনও বন্ধুকে ভাড়া দিয়েছিল। সেই বন্ধু অন্য কোথায় ফ্ল্যাট কিনে চলে গেছে। সল্টলেক থানার পুলিশ খোঁজখবর নিয়ে আমাদের জানিয়েছে মাঝেমাঝে শিলাদিত্য তার সল্টলেকের ওই বাড়িতে থাকে না। কখনও এক সপ্তাহ পর্যন্ত বাইরে কোথায় কাটিয়ে ফিরে আসে আর তার কাছে মাঝে মাঝে যে মেয়েটি যায় সে যে পরমা রায়চৌধুরি তা আমরা বুঝতে পেরেছি। পরমা তাকে পিসতুতো দাদা বলেছেন। কিন্তু পাশের বাড়িতে পুলিশের যে ইনফরমার থাকেন–খুলেই বলি, তিনি একজন রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার। তা ছাড়া তার সবকিছুতেই নাক গলানোর অভ্যাস আছে। খুব সন্দেহপ্রবণ মানুষ। কাজেই আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন শিলাদিত্য এবং পরমাদেবী তাঁর সুনজরে পড়েছেন।

আমি বললুম, কুনজরে বলুন।

নরেশবাবু হাসতে হাসতে বললেন, ঠিক বলেছেন। মহীতোষ বসাক অর্থাৎ সেই রিটায়ার্ড পুলিশ ইনস্পেক্টর শুধু শিলাদিত্যের বাড়ির দিকে নয়, আশপাশের অন্যান্য বাড়ির দিকেও কুনজর ছড়িয়ে দেন।

বললুম, সল্টলেক থানার ওসিকে বলুন তাদের এই সুযোগ্য ইনফর্মার ভদ্রলোককে যেন অনুরোধ করেন শিলাদিত্য কোথাও বেরুলে তিনি যেন তাকে অনুসরণ করেন। সল্টলেকে যখন বাড়ি, তখন তার গাড়ি না থেকে পারে না। আর শিলাদিত্যেরও একটা গাড়ি থাকা খুবই সম্ভব।

নরেশবাবু বললেন, হ্যাঁ। তার একটা গাড়ি আছে।

কফি খাওয়া শেষ করে নরেশবাবু একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, যাকগে ওসব কথা। যে জন্যে আপনার কাছে এলুম, এবার সেই কথা বলি। কালীশবাবু ডায়মন্ডহারবার রোডের ধারে সে বাগানবাড়িতে পিকনিক করতে গিয়েছিলেন আজ ভোরবেলা সেখানে আমাদের লোক লোকাল পুলিশের সাহায্যে হানা দিয়েছিল। বাগানবাড়ির মালিক জনৈক মোহনলাল পাটোয়ারি। ব্রাবোর্ন রোডে তাঁর ইলেকট্রনিক্স গুডসের কারবার আছে। মোহনলাল কিন্তু বাস করেন সপরিবারে নিউ আলিপুরের ওই সুরঞ্জনা হাউজিং কমপ্লেন্সের ‘এ’ ব্লকে। খবর। পাওয়ার পর তার অ্যাপার্টমেন্টে আমাদের লোক গিয়েছিল। সঙ্গে লোকাল থানার অফিসারও ছিলেন। খুনখারাপির খবর ওই আবাসনের সবাই জেনে গেছেন। যাই হোক, মোহনলালকে জেরা করে জানা গেছে কাল তার বাগানবাড়িতে সত্যিই পিকনিক হয়েছিল। তিনি তার ব্যবসায়ী বন্ধুদের নিয়ে মাঝে মাঝে ওখানে গিয়ে পিকনিক করেন। তিনি বলেছেন কালীশবাবু তার সঙ্গেই বাড়ি ফিরেছিলেন। বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা সাতটা বেজে গিয়েছিল।

বললুম, তাহলে কালীশবাবুর অ্যালিবাই শক্ত।

নরেশবাবু বললেন, কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, মোহনলাল বলেছেন বেলা বারোটা নাগাদ কালীশবাবু বাগানবাড়ি থেকে একবার বেরিয়ে ছিলেন। তিনি ফিরে আসেন ঘণ্টা দুই পরে। কোথায় তার নাকি একটা জরুরি কাজ ছিল। তাহলেই বুঝুন কেসটার অন্য একটা অ্যাঙ্গেল এসে গেল।

বললুম, এ ব্যাপারে তোমরা কালীশবাবুকে কি জেরা করেছ?

নরেশবাবু গোঁফে হাত বুলিয়ে বললেন, না। তাকে জেরা করা হবে আরেকটা সূত্র হাতে আসার পরে।

বললুম, সেটা বলতে আপত্তি আছে?

নরেশবাবু একটু হেসে বললেন, টালিগঞ্জের বাপির বাড়িতে বাপির বাবা খবরটা শুনে কিন্তু তত বেশি বিচলিত হননি। বরং প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়ে ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, “আমি ঠিক বুঝেছিলুম, দুপুরবেলা গাড়ি চেপে রায়চৌধুরিবাবু বাপিকে ডেকে গিয়ে গেলেন। তখনই বুঝতে পেরেছিলুম ওই বজ্জাত লোকটা বাপিকে খারাপ কাজে লাগাতে নিয়ে যাচ্ছে।”

নরেশবাবু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। আমি তার কথার উপরে বললুম, বাগানবাড়িতে যখন কালীশবাবু ফিরে যান তখন তিনি একাই গিয়েছিলেন, না কি

অন্য কেউ তাঁর সঙ্গে ছিলেন, এই কথাটা কি মোহনলালকে আপনারা জিজ্ঞেস করেছিলেন?– নরেশবাবু বললেন, অবশ্যই। কালীশবাবুর সঙ্গে কোনও লোক ছিল না। এ থেকে মনে হতে পারে কালীশবাবুই বাপিকে পিছনের ইমার্জেন্সি ডোর দিয়ে তার অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে পরমাকে খুন করতে বলেছিলেন। এবং অ্যাপার্টমেন্টে পরমার সাড়া না পেয়ে বাপি সেনকে ড্যাগার হাতে সম্ভবত কোথাও লুকিয়ে অপেক্ষা করতে বলেছিলেন।

বললুম, তা যদি হয় তাহলে বাপির লুকিয়ে থাকার উপযুক্ত জায়গা বেডরুমের খাটের তলা। বেডরুমটা আমি কাল দেখেছি। বেডকভার দু’পাশেই ঝুলে আছে। কাজেই তলায় কেউ শুয়ে থাকলে কারও টের পাওয়ার কথা নয়।

নরেশবাবু বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন। এই পর্যন্ত ঘটনাটার খেই পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বাপিকে তাহলে গুলি করল কে?

বললুম, আপনার কী ধারণা?

নরেশবাবু বললেন, ঘুরে ফিরে ওই শিলাদিত্যের নামটাই চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আপনি নিশ্চয় ইতিমধ্যে মনে মনে একটা অঙ্ক করেছেন?

বললুম, হ্যাঁ। এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ শিলাদিত্যকে খুঁজে বের করা।

নরেশবাবু সায় দিয়ে বললেন, ঠিক বলেছেন। এই পর্যন্ত ঘটনাটার খেই পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বাপিকে তাহলে গুলি করল কে?

বললুম, আপনার কী ধারণা?

নরেশবাবু বললেন, ঘুরেফিরে ওই শিলাদিত্যের নামটাই চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আপনি নিশ্চয় ইতিমধ্যে মনে মনে একটা অঙ্ক কষেছেন?

বললুম, হ্যাঁ। এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ শিলাদিত্যকে খুঁজে বের করা।

নরেশবাবু সায় দিয়ে বললেন, ঠিক বলেছেন।

বললুম, আইন অনুসারে যাকে গ্রেপ্তার করেছেন আজই তো তাকে কোর্টে হাজির করার কথা। তা ছাড়া তার বিরুদ্ধে একটা প্রাইমাফাঁসি চার্জ গঠন করে কেসও খাড়া করতে হবে, তাই না?

নরেশবাবু বললেন, হ্যাঁ। আমরা কেসটা একভাবে সাজিয়েছিলুম। কিন্তু এবার বাপির বাবা আর সুরঞ্জনা আবাসনের মোহনলাল পাটোয়ারির সাক্ষীর ভিত্তিতে কেসটা অন্যভাবে সাজিয়েছি। কালীশ রায়চৌধুরী বাপি সেনকে ভাড়া করে স্ত্রীকে খুনের চক্রান্ত করেছিলেন। কিন্তু তখন অ্যাপার্টমেন্টে পরমা না থাকায় বাপি কোথায় লুকিয়েছিল। বলে নরেশবাবু উজ্জ্বল মুখে হাসলেন। ফের তিনি বললেন, তার লুকিয়ে থাকার যুক্তিপূর্ণ জায়গা আপনার মুখেই পেয়ে গেলুম। সে বেডরুমে খাটের তলাতেই লুকিয়ে ছিল। তারপর পরমা শিলাদিত্যের সঙ্গে ফিরে আসেন। সময়টা সদর গেটের সিকিউরিটির কাছে জানতে পেরেছি। পরমা ফিরে আসেন সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। তার গাড়ির পিছন দিকের কাঁচ তোলা ছিল, এটা সিকিউরিটির গোপাল সাউ লক্ষ করেছেন। তার মানে শিলাদিত্যকে ব্যাকসিটে বসিয়েই পরমা বাড়ি ফিরেছিলেন। তারপর সিক্স ফ্লেরে অটোমেটিক লিফটে দু’জনে উঠে গেছেন। হ্যাঁ, একটা কথা বলতে ভুলেছি। গোপাল সাউকে পরমা জিজ্ঞেস করেছিলেন সাহেব ফিরেছেন কিনা?

বললুম, কালীশবাবুর নিশ্চয় নিজের আরেকটা গাড়ি আগে গ্যারাজে গাড়ি রাখতে গেলেই পরমা তো তা বুঝতে পারত।

নরেশবাবু বললেন, এটা স্পষ্ট পরমা অতটা রিস্ক নিতে চাননি। কারণ, গ্যারাজেও সিকিউরিটি আছে। শিলাদিত্য তার চোখে পড়ে যেত। কাজেই আগে শিলাদিত্যকে লিফটের সামনে নামিয়ে সে গ্যারাজে গাড়ি রেখে আসে। বাকিটা আর ব্যাখ্যা করার দরকার নেই। শিলাদিত্যকে নিয়ে পামা উপরে যায়। তারপর তাদের দরজা খোলার শব্দ পেয়ে বাপি তখনই বাথরুমে লে যায়। পরমার সকাল সন্ধ্যা দু’বার স্নানের অভ্যাসের কথা কালীশবাবু জানতেন, আমরা এটা তাকে জেরা করে জেনেছি।

এবার একটু অধীর হয়েই বললুম, তাহলে তোমরা শিলাদিত্যকেই বাপির মার্ডারার করতে চেয়েছ?

নরেশবাবু ঘড়ি দেখে বললেন, পরমা বাপিকে দেখতে পেয়েই শিলাদিত্যকে কথাটা জানায়। তখন বাপি বাথরুমের ভিতর অশ্লীল ছবিগুলো দেখছিল এবং শিলাদিত্য পরমাকে যে রিভলবার দিয়েছিল, সেটা নিয়ে সে বাপিকে পিছন থেকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করে।

.

০৭.

যাওয়ার সময় নরেশবাবু বলে গিয়েছিলেন ডি সি ডি ডি ওয়ান লাহিড়ীসাহেব আমাকে জানাতে চেয়েছিলেন কীভাবে কেসটা দাঁড় করানো হবে। এর পরে ফাইনাল চার্জশিট দেওয়ার সময় আরও ভালো করে কেসটা সাজিয়ে নেওয়া হবে।

সেদিনটা আমার বইপত্র পড়েই কেটে গিয়েছিল। অবশ্য একটা ক্ষীণ আশা ছিল পরমা আমাকে ফোন করতে পারে। কারণ, তার কাজের মেয়ে কাজল নিশ্চয় তাকে আমার কথা বলবে। কিন্তু এটাই আশ্চর্য সন্ধ্যা ছ’টা অবধি তার টেলিফোন পেলুম না কিংবা সে নিজেও এলো না। সন্ধ্যা সাতটায় নেহাৎ কৌতূহলে নরেশবাবুকে ফোন করলুম। তিনি অফিসেই ছিলেন। তার কাছে জানা গেল পরমাকে তারা বেলা বারোটায় লালবাজারে যেতে বলেছিলেন। কারণ তাকে দিয়েই এফ আই আর লেখানো হয়েছে। তাকে কোর্টে উপস্থিত থাকতে হবে। সে কোর্টে গিয়েছিল। তারপর এদিন আর তার সঙ্গে নরেশবাবু যোগাযোগ করেননি।

এইসব কথা শোনার পর পরমা সম্পর্কে আমি একটু সতর্ক হয়েছিলুম। আমি জানতুম সি আই ডি আমাকেও এই কেসের একজন সাক্ষী করবে। কিন্তু যতবার ভাবছিলুম পরমা কেন আমাকে ফোন করল না, ততবার আমার মনে ক্ষোভ জাগছিল। রাত আটটা পনেরোতে যখন টেলিফোন বাজল তখন আমার আশা ছিল ফোনটা পরমার। কিন্তু রিসিভার তুলে সাড়া দিতেই কেউ জিজ্ঞেস করল, এটা কি কর্নেল সাহেবের বাড়ি?

বললুম, হ্যাঁ। আপনি কে বলছেন?

–আপনি স্যার আমাকে চিনবেন না। আমার নাম মোহনলাল পাটোয়ারি।

একটু চমকে উঠেছিলুম। তারপর সতর্কভাবে বললুম, বলুন।

মোহনলাল বললেন, আমি কাল আপনার সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই। আপনি যদি সকাল ন’টা থেকে দশটার মধ্যে আমাকে টাইম দেন, ভালো হয়। কারণ আমি বিজনেস করি। সব সময় সেই কাজে আমাকে ব্যস্ত থাকতে হয়।

বললুম, আমার সঙ্গে দেখা করার আগে যদি আমাকে জানিয়ে দেন আপনার সাক্ষাতের উদ্দেশ্য কী, তাহলে আমারও ভালো হয়। কারণ আমিও নানা কাজে ব্যস্ত থাকি।

মোহনলাল বললেন, কর্নেল সাহেব, আপনি আমার নামটা নিশ্চয় জানেন। কারণ গতকাল আমি যে এখানে থাকি সেখানে একটা খুনখারাপি হয়েছে এবং আপনিও পুলিশের সঙ্গে সেখানে এসেছিলেন। কালীশ রায়চৌধুরি আমার বন্ধু। তার অ্যাডভোকেট অমলেন্দু ব্যানার্জির মাধ্যমে সে আমাকে আপনার সঙ্গে শিগগির দেখা করতে বলেছে। ওই মার্ডারের ব্যাপারে আপনাকে কিছু গোপনীয় কথা আমি জানাতে চাই।

বললুম, কথাটা পুলিশকে জানালেই তো হয়।

মোহনলালের হাসি ভেসে এল-কর্নেলসাহেব, আমি আপনার পরিচয় জানি। মহাবীর ট্রেডিং এজেন্সির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর পবনদাস অগ্রবালের কাছে আমি আপনার কথা শুনেছিলাম। এতদিন পরে অমলেন্দুবাবুর মুখে আপনার নাম শুনে সেই সব কথা মনে পড়ে গেছে। আমাকে প্লিজ আপনার সঙ্গে দেখা করতে একটু সুযোগ দিন কর্নেলসাহেব।

এবার আমি আর দ্বিধা করলুম না। বললুম, ঠিক আছে, আপনি কাল ন’টার মধ্যে আসুন।

ধন্যবাদ। অনেক ধন্যবাদ কর্নেলসাহেব।

 রিসিভার রেখে দিয়ে নিভে যাওয়া চুরুটটা লাইটার জ্বেলে ধরিয়ে কয়েকবার টান দেওয়ার পর একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে সেই ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে রইলুম। ফ্যানের বাতাসে ধোঁয়াগুলো মিলিয়ে গেল। তারপর আমি টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা নোটবই বের করলুম। পবনদাস অগ্রবালের টেলিফোন নাম্বারটা খুঁজে বের করে তখনই তাকে রিং করলুম। মিনিট দু’তিন পরে কেউ সাড়া দিল, আপকৌন হ্যায়?

একটু রসিকতা করে বললুম, আমার মুখে সাদা দাড়ি আর মাথায় চকচকে টাক আছে।

অমনি হাসির শব্দ ভেসে এল–কী আশ্চর্য! আমি ভাবছিলুম আমার এই প্রাইভেট নাম্বারে কোনো চেনা লোক ফোন করছে। কিন্তু সেটা যে কর্নেলসাহেব, তা আমার মাথায় আসে নাই। নমস্তে নমস্তে কর্নেলসাহেব, বলুন আপনার জন্য কি করতে পারি?

বললুম, নিউ আলিপুরের সুরঞ্জনা আবাসনের মোহনলাল পাটোয়ারিকে কি আপনি চেনেন?

পবনদাস ব্যস্তভাবে বললেন, খুব চিনি। বুঝতেই পারছেন আমরা কারবারি লোক। আর তার চেয়েও বড়ো কথা আজ সন্ধ্যায় মোহনলালজি আমাকে ফোন করেছিলেন। ওদের ওখানে একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে। সেখানে আপনিও নাকি গিয়েছিলেন। তাই মোহনলালজি আমাকে আপনার ঠিকানা ও ফোন নাম্বার চেয়েছিলেন। এখন আমার মনে হচ্ছে তাকে আপনার ফোন নাম্বার এবং ঠিকানা দিয়ে কোনো ভুল করিনি তো?

বললুম, একটুও ভুল করেননি। মোহনলালজি আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। আমি তাকে কাল সকাল ন’টার মধ্যে আসতে বলেছি। এবার আপনার কাছে। দু’একটা কথা জানতে চাই।

পবনদাস দ্রুত বললেন, বলুন, বলুন। যা জানতে চাইবেন তা যদি আমার জানা থাকে তাহলে নিশ্চয় বলব। আপনি সেবার আমার যে উপকার করেছিলেন তা আমি কখনও ভুলতে পারি!

বললুম, শিলাদিত্য নামে আপনার অফিসে কেউ কাজ করেন?

–হ্যাঁ। শিলাদিত্যবাবু বয়সে যুবক হলেও আমার কাজকর্মের ব্যাপারে তিনি খুব বিচক্ষণ। উনি এক্সিকিউটিভ র‍্যাঙ্কে কাজ করেন। বলেই পবনদাস অগ্রবাল হেসে উঠলেন–কেন, আপনার তো তাকে মনে পড়া উচিত। অমন একটা সাংঘাতিক কেসে শিলাদিত্যবাবুই তো আপনার সঙ্গে বেশি ঘোরাঘুরি করেছেন?

বললুম, হ্যাঁ এতক্ষণে মনে পড়েছে। তো তার সল্টলেকের বাড়িতে ফোন করে আজ সারাদিন পাইনি। রিং হয়ে গেছে, কেউ সাড়া দেয়নি। অগ্রবালজি, সে তো আপনার বিশ্বস্ত লোক। তার আর কোনও ফোন নাম্বার আপনার জানা আছে?

পবনদাস বললেন, এক মিনিট। সল্টলেকে তিনি বাড়ি করেছেন তা জানি। কিন্তু তার মা-বাবা ভাই বোন এখনও কালীঘাট এরিয়ায় থাকেন। ওই বাড়িতে ওঁদের নিজের বাড়ি। তাই তার মা-বাবা বা ভাইবোন ওই বাড়ি ছাড়তে চান না। সল্টলেক তাঁদের পছন্দ হয় না।

বললুম, শিলাদিত্যবাবু তাহলে মাঝে মাঝে ওই বাড়িতে গিয়ে কাটান। ওই বাড়ির ফোন নাম্বার আপনার নিশ্চয়ই জানার কথা।

পবনদাস বললেন, হ্যাঁ। এতক্ষণ আমি তার ওই বাড়ির ফোন নাম্বার খুঁজছিলুম। হ্যাঁ, নাম্বারটা পেয়ে গেছি। লিখে নিন।

আমি টেবিলে রাখা প্যাডে নাম্বারটা লিখে নিয়ে বললুম, অসংখ্য ধন্যবাদ অগ্রবালজি।

পবনদাস বললেন, আমার মনে একটু খটকা লাগছে। আপনি শিলাদিত্যবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছেন। নিশ্চয় কোনও কারণ আছে। একটা কারণ মোহনলালজির মুখে যে ঘটনার কথা শুনেছি তার সঙ্গে কি শিলাদিত্যবাবুর কোনও সম্পর্ক আছে?

হাসতে হাসতে বললুম, মোহনলালজি আপনাকে কিছু বলেননি?

–কিছু কথা বলেছেন তবে শিলাদিত্যবাবুর কথা বলেননি।

বললুম, আজ কি শিলাদিত্যবাবু অফিসে যাননি?

-না, উনি এক সপ্তাহের ছুটি নিয়েছেন।

 বললুম, ঠিক আছে। আপনার উদ্বেগের কোনও কারণ নেই। আমি অন্য একটা ব্যাপারে ভদ্রলোককে খুঁজছি। আবার ধন্যবাদ।

রিসিভার রেখে দিয়ে আমি চুরুটাকে শেষ করে ফেললুম। তারপর লেজটুকু অ্যাশট্রেতে ঘষে নিভিয়ে অগ্রবালজির দেওয়া নাম্বারে ডায়াল করলুম। বার চারেক রিং হওয়ার পর মহিলা কণ্ঠে সাড়া এলো, হ্যালো?

বললুম, শিলাদিত্যবাবু কি আছেন? তাকে একটু ডেকে দিন।

–আপনি কে বলছেন?

–আমি এন সরকার বলছি। উনি বাড়িতে আছেন তো?

না। দাদা বেরিয়েছে। ফিরতে রাত হতে পারে। তবে বেশি রাত হলে দাদা বাড়ি ফেরে না। তার সল্টলেকের বাড়িতেই থেকে যায়। বলেই শিলাদিত্যের বোন রিসিভার রেখে দিল।

লক্ষ করলুম আমার মনের ভিতর জমে ওঠা প্রায় সারাটি দিনের উত্তেজনার এতক্ষণে উপশম হয়েছে।

পরদিন সকাল পৌনে ন’টায় এলেন কালীশ রায়চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু সেই মোহনলাল পাটোয়ারি আমি পরমার ওখানে কালীশবাবুর ফোটো দেখেছি। তার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। তার বন্ধু মোহনলালের বয়স আনুমানিক চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যে। বেশ বলিষ্ঠ গড়ন এবং গায়ের রং ও ফরসা। ভদ্রলোককে সৌখিন মনে হল। কারণ তার ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে পারফিউমের সুগন্ধ টের পেলুম। পরনে টাই স্যুট। চুলেও কেতা আছে। আর বাঁহাতের তিনটে আঙুলে রত্নখচিত আংটি। ব্রিফকেসটা সোফায় রেখে তিনি নমস্কার করে বললেন, পুলিশের খাতায় আমার বন্ধু কালীশ একজন অপরাধী। কোর্ট তাকে জামিন দেয়নি। কিন্তু এ ব্যাপারে আমি আপনাকে কিছু জরুরি কথা বলতে চাই। এটা স্বাভাবিক যে আমি আমার বন্ধুর যাতে ভালো হয় সেই চেষ্টাই করব।

একটু হেসে বললুম, ঠিক আছে। আপনাকে ব্যস্ত মনে হচ্ছে। আপনি সংক্ষেপে যা বলার আছে বলুন।

মোহনলাল বললেন, আমি শুধু কালীশের সূত্রে নয়, অন্যান্য বিশ্বস্ত সূত্র থেকে জানি কালীশের সঙ্গে তার স্ত্রী পরমার সম্পর্ক ভালো নয়। এ ব্যাপারে কে বেশি দোষী তা বিচার করার অধিকার আমার নেই। আমি শুধু বলতে চাই পরমা রায়চৌধুরি একজন যুবকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করে। কালীশও তা কোনও সূত্রে জানতে পেরেছে। সেই যুবকটি কে তা আমিও জানি। সে আমার আরেক ব্যবসায়ী বন্ধু পবনদাস অগ্রবালের কারবারে চাকরি করে। কালীশের ধারণা সেই যুবকটি তাকে খুন করার জন্য টালিগঞ্জ এরিয়ার কুখ্যাত গুণ্ডা বাপি সেনকে পাঠিয়েছিল। ভাগ্যিস কালীশকে আমি একরকম জোর করেই পিকনিকে নিয়ে গিয়েছিলুম।

বললুম, আপনি পুলিশকে বলেছেন আপনার বাগানবাড়ি থেকে কালীশবাবু ঘণ্টা দুয়েকের জন্য একবার বেরিয়ে ছিলেন।

মোহনলাল নিষ্পলক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যাঁ। সে তার স্ত্রীকে সেই প্রেমিকের সঙ্গে হাতে-নাতে ধরার জন্য সুরঞ্জন আবাসনে গিয়েছিল। কিন্তু সেখানে তার স্ত্রীকে পায়নি। তাদের কাজের মেয়ে কাজলকেও দেখতে পায়নি।

বললুম, বেশ। কিন্তু আমি কালীশবাবুকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?

–পবনদাস অগ্রবালের কাছে আমি আপনার কীর্তিকলাপের কথা শুনেছি। পরমার সেই প্রেমিকের নাম শিলাদিত্য…। অগ্রবালজি আমাকে বলেছেন সে দিন সাতেকের ছুটি নিয়েছে। আপনি তাকে যদি খুঁজে বের করতে পারেন তাহলে এই কেসে কালীশের কিছু সুবিধা হয়।

বললুম, তিনি একথা পুলিশকে বলছেন না কেন?

মোহনলাল বললেন, পুলিশকে না বলার কারণ আমি জানি না। কালীশ অনুরোধ করেছে আপনি তাকে খুঁজে বের করে পুলিশের হাতে তুলে দিন।

বললুম, হ্যাঁ। কাল রাত্রে আপনি ফোন করার পর আপনার আরেক বন্ধু অগ্রবালজিও আমাকে একটা বলছেন।

মোহনলাল দ্রুত চাপা স্বরে বললেন, শিলাদিত্যবাবুর গতিবিধি অগ্রবালজি জানেন। কিন্তু নিজের বিশ্বস্ত কর্মচারীকে তিনি রক্ষা করতে চাইবেন, এটাই। স্বাভাবিক।

ঘড়ি দেখে মোহনলাল উঠে দাঁড়ালেন। বললুম, অন্তত এক কাপ কফি খেয়ে যান। ওই দেখুন আপনার জন্য কফি আসছে।

মোহনলাল ব্রিফকেসসহ দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে বললেন, ক্ষমা করবেন কর্নেল সাহেব। আমি চা কফি কিছুই খাই না। তাহলে আপনার উপর আমার ভরসা রইল। কালীশকে বাঁচাতে পারলে আপনাকে যথাসাধ্য দক্ষিণা দিতে সে রাজি।

কথাটা বলেই তিনি বেরিয়ে গেলেন। আমার মাথায় দপ করে আগুন জ্বলে উঠেছিল। কিন্তু শান্ত থাকার চেষ্টা করলুম। ষষ্ঠিকে বললুম, ওই কফিটা তুই খেয়ে নিস ষষ্ঠি। ওই সাহেব তোর কফি খেতে চান না।

ষষ্ঠি হাসতে হাসতে আমার পেয়ালাটা রেখে ট্রেতে অন্য পেয়ালাটা তুলে নিয়ে চলে গেল।

কফি পান করার পর চুরুট কেস থেকে একটা চুরুট বের করে লাইটার জেলে ধরালুম, ঠিক সেই সময় আমার মনে মোহনলাল পাটোয়ারির কথাটা ভেসে এল। পবনদাস নিজের কর্মচারীকে রক্ষা করতে চাইবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। তাহলে পবনদাস কি আমাকে শিলাদিত্যের প্রাইভেট ফোন নাম্বারটা–দিয়ে তার বাবার ফোন নাম্বার দিয়েছেন।

তখনই উঠে গিয়ে পোশাক বদলে নিলুম। তারপর গলায় ক্যামেরা এবং বাইনোকুলার ঝুলিয়ে আমার রিভলবারের বুলেটগুলো ঠিকঠাক আছে কি না দেখে নিয়ে প্যান্টের পকেটে ঢোকালুম। আমি এবার মরিয়া হয়ে উঠেছি। শিলাদিত্যকে খুঁজে বের করতেই হবে।

ষষ্ঠিকে যথারীতি সতর্ক করে দিয়ে বেরোতে যাচ্ছি, টেলিফোন বেজে উঠল। রিসিভার তুলে সাড়া দিতেই পরমার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। সে চাপা স্বরে বলল, আমি কেন আপনাকে ফোন করিনি তা মুখোমুখি হলে বলব। আমি বাইরে থেকে আপনাকে ফোন করছি। আপনি যদি দয়া করে আমার অ্যাপার্টমেন্টে শিগগির আসেন, ভালো হয়। ওখানে শিলাদিত্য আছে। কাজলকে সঙ্গে নিয়ে কাজের ছলে আমি বেরিয়েছি। শিলাদিত্য আমাকে ব্ল্যাকমেল করার জন্যই ফন্দি এঁটেছিল। সব কথা যথাসময়ে বলব। আপনি চলে আসুন।

.

০৮.

ট্যাক্সি চেপে যেতে যেতে হঠাৎ মনে হল আমি ভুল করছি। পথেই ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিলুম। বললুম, আমি নিউ আলিপুর যাব ভেবেছিলুম কিন্তু টালিগঞ্জে আমাকে একটা কাজ সেরে নিতে হবে, তা ভুলে গিয়েছিলুম।

ট্যাক্সি ড্রাইভারকে ভাড়ার অতিরিক্ত কিছু টাকা দিতেই তার মুখের বিরক্তি ভাবটা কেটে গেল। আমি একটু এগিয়ে গিয়ে একটা ওষুধের দোকান দেখতে পেলুম। সেখানে ঢুকে বললুম, একটা ফোন করতে পারি কি?

ওষুধের দোকানে খদ্দের নেই। তরুণ কর্মচারীটি সবে দোকান খুলেছে। সে আমার সাহেবি চেহারা দেখে বিনয়ের অবতার হয়ে বলল, ফোন করবেন তো করুন স্যার।

আমি নরেশবাবুকে তার কোয়ার্টারে টেলিফোন করলুম। তিনি বললেন, আমি অফিসে যাবার জন্য রেডি হচ্ছিলুম। সল্টলেকের সেই প্রাক্তন পুলিশ অফিসার মহীতোষবাবু সল্টলেক থানায় জানিয়েছেন গতরাত্রে কখন শিলাদিত্য ফিরেছিল তিনি জানেন না। কিন্তু মর্নিংওয়াকে বেরিয়ে তিনি তাকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখেছেন। সে একা ছিল।

বললুম, নরেশবাবু, আপনি নিজে এবং কয়েকজন সশস্ত্র কনস্টেবল নিয়ে নিউ আলিপুরের সুরঞ্জনা আবাসনে পরমাদের ব্লকে উপস্থিত থাকবেন। আমি সেখানে যাচ্ছি।

নরেশবাবু বললেন, সিকিউরিটি গার্ডরা আমাকে চিনে ফেলেছে, তা ছাড়া আইডেন্টিটি কার্ড দেখিয়ে ভিতরে ঢুকতে আমাদের অসুবিধে নেই। কিন্তু ‘সি’ ব্লকের সামনে ভিড় করে দাঁড়ালে আশেপাশের বাসিন্দাদের কৌতূহল জাগবে, একটা সিন ক্রিয়েট হতেও পারে।

বললুম, হ্যাঁ। ঠিক বলেছেন। আপনারা লিফটে উঠে সিক্সথ ফ্লোরে পরমাদের অ্যাপার্টমেন্টের সামনে করিডরে অপেক্ষা করবেন। আপনাদের আগেই কিন্তু আমি সেখানে পৌঁছে যাচ্ছি। যদি কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে আপনারা পুলিশের লোক এবং ওখানে একটা মার্ডার হয়েছে, সেই ব্যাপারে তদন্তে আসার কথা বলতেই পারেন।

নরেশবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোথা থেকে ফোন করছেন?

বললুম, টালিগঞ্জ এলাকার একটা ওষুধের দোকান থেকে।

রিসিভার রেখে দিয়ে তরুণ কর্মচারীটির হাতে একটা পাঁচ টাকার নোট দিলুম। সে গদগদভাবে বলল, মোটে একটাকা লাগবে স্যার। কিন্তু আপনার কথা শুনেই বুঝেছি, আপনি বড়ো পুলিশ অফিসার। আপনার কাছে টাকা নিতে পারব না।

আমার কাছে খুচরো ছিল না। অগত্যা পাঁচ টাকার নোটটা ফেরত নিয়ে বেরিয়ে আসতে হল। পিছু ফিরে দেখলুম সে কাউন্টার থেকে বেরিয়ে আমার দিকে লক্ষ রেখেছে। একটা খালি ট্যাক্সি দেখতে পেয়ে দাঁড় করালুম এবং নিউ আলিপুরের দিকে ট্যাক্সিটা ছুটে চলল।

সুরঞ্জনা আবাসনের সামনে নেমে ট্যাক্সিভাড়া মিটিয়ে সদর গেটের কাছে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে থাকলুম। এই এলাকাটা এমনিতেই নিরিবিলি। কিন্তু আমার কেন যেন অস্বস্তি লাগছিল। পরমা আমাকে কোনও ফাঁদে ফেলাতে মতলব। করেনি তো? সত্যি বলতে কি তার কাছে আগ্নেয়াস্ত্রটা দেখার পর থেকে তার সম্পর্কে আমার মনের এক কোণে ঈষৎ সন্দেহের ছায়া পড়ে ছিল। এই মহিলাটি সাহসী এবং বেপরোয়া তা অবশ্য তখনই বুঝেছিলুম। তাছাড়া তার বিবাহিত জীবনেও একজন প্রেমিক আছে এটা আমার খুব ভালো ঠেকেনি। আমি তথাকথিত রক্ষণশীল নই। কিন্তু স্বামী তাকে খুন করার জন্য ভাড়াটে খুনি লাগিয়েছে এর কারণ কি শুধু তার ব্যাঙ্কে রাখা টাকা আত্মসাৎ করার জন্যই?

আমি সতর্ক চোখে চারদিক দেখে নেওয়ার পরে গেটের দিকে এগিয়ে গেলুম। দারোয়ান আমাকে সেলাম দিল এবং সিকিউরিটির একজন লোক বেরিয়ে এসে সেলাম দিয়ে বলল, আসুন স্যার। মিসেস রায়চৌধুরি এইমাত্র বাইরে থেকে ফেরার সময় বলে গেলেন আপনি আসবেন।

একটু হেসে জিজ্ঞেস করলুম, আপনি কি পরশু সন্ধ্যায় পুলিশের সঙ্গে আমাকে দেখতে পাননি?

সে বলল, নিশ্চয় দেখেছি স্যার। আপনি যে একজন কর্নেল সাহেব, তাও জানতে পেরেছি।

থ্যাঙ্কস, বলে আমি ফুলবাগিচা এবং সুদৃশ্য গুল্মলতায় সাজানো লন দিয়ে সি ব্লকে পৌঁছলুম। তারপর অটোমেটিক লিফটে সিক্সথ ফ্লোরে উঠে গেলুম। তারপর ডাইনের করিডর দিয়ে এগিয়ে সদর দরজায় বোতাম টিপতেই দরজা খুলে গেল। পরমা চপা স্বরে বলল, আমি জানালা দিয়ে আপনাকে দেখতে পেয়েছিলুম। একটা কথা আগে বলে নিই। শিলাদিত্য গেস্টরুমে বসে আছে। সে জানে না আপনি আসবেন। আর একটা কথা, সে কাল রাতে টেলিফোন করে বলেছিল সকালে সে আসবে। সকাল সাড়ে সাতটায় সে আসবার পর তার কথা শুনে আমি ভীষণ চমকে গেছি। সে আমার কাছে এক লাখ টাকা দাবি করছে। আমার সঙ্গে ওর কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি হয়েছে। আমি বুঝতে পেরেছি সে আমাকে ব্ল্যাকমেল করার জন্যেই ফায়ারআর্মস দিয়েছিল।

কথাগুলো বলে সে ঘরের ভিতরে ঢুকল। তারপর ইশারায় কাকে ডাকল। দেখলুম প্রায় তারই বয়সী কাজের মেয়েটি তার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। পরমা তাকে চাপা স্বরে বলল, কাজল, যদি শিলাদিত্য জিজ্ঞেস করে কে এসেছে, তুমি বলবে বি ব্লকের এক ভদ্রমহিলা এসেছিলেন। আমার সঙ্গে তিনি করিডরে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন।

পরমা দরজা বন্ধ করে করিডরের এক পাশে এগিয়ে গেল। তারপর আরও চাপা স্বরে বলল, আপনাকে আসল কথাটা বলার সুযোগ আবার কখন পাব জানি না, তাই এখনই কথাটা বলতে চাই। বাপি সেনকে আমি গুলি করে মারিনি। শিলাদিত্যের সঙ্গে চৌরঙ্গীতে সিনেমা দেখে আসার পর সে আমাকে বেডরুমে নিয়ে গিয়েছিল। তার কী উদ্দেশ্য ছিল, আপনি আমার বাবার মতো, আপনার সামনে তা বলতে পারব না। আপনি প্রাজ্ঞ মানুষ। কথাটা বুঝে নিন। সে আমাকে পীড়াপীড়ি করছিল। তখন আমি তাকে বলি আমাকে বাথরুম থেকে আসতে দাও। এরপর আমি পর্দা একটু সরাতেই দেখতে পাই বাথরুমের ভিতর পিছু ফিরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। দেখামাত্র বুঝতে পারি সে অশ্লীল ছবিগুলো দেখছে। তা ছাড়া সে নিশ্চয় আমার স্বামীর ভাড়া করা খুনি, কথাটা আমার মাথায় এসে যায়। তখন চুপিচুপি শিলাদিত্যকে কথাটা বলতেই সে আমার হ্যান্ডব্যাগ থেকে রিভলবারটা বের করে বাথরুমের দিকে এগিয়ে যায়। পরপর তিনবার গুলির শব্দ শুনতে পেয়েছিলুম। ফিরে এসে শিলাদিত্য আমার হাতে রিভলবারটা দিয়ে বেরিয়ে যায়। যাবার সময় সে বলে আমি যেন মিনিট কুড়ি পঁচিশ পরে লালবাজারে পুলিশকে ফোন করি। লোকাল পুলিশের চেয়ে লালবাজারের পুলিশ বেশি দক্ষ। কারণ তাদের হাতে নাকি ওই ভাড়াটে খুনির অনেক রেকর্ড আছে।

আমি তার মতোই চাপা স্বরে বললুম, তোমার সেই রিভলবারটা কি তোমার কাছে আছে?

পরমা বলল, এখন নেই। এখানে আসার পরই আমার হ্যান্ডব্যাগ থেকে সে ওটা বের করে দিয়েছে। যখন সে ওটা চাইছিল তখন আমি তার উদ্দশ্য বুঝতে পারিনি। তা ছাড়া অস্ত্রটা তো তারই। কিন্তু তারপর যখন সে টাকা দাবি করল তখন বুঝতে পারলুম দরকার হলে সে আমাকে এবং কাজলকে গুলি করে মেরে রেখে যাবে।

বললুম, সে গেস্ট রুমে বসে আছে কেন?

পরমা বলল, যে-কোনও সময় আবার পুলিশ অফিসাররা এখানে তদন্ত করতে আসবেন বলে তাকে ভয় দেখিয়েছি। তখন সে একটু দমে গিয়ে বলেছে আমাকে গেস্ট রুমে নিয়ে চলো। আমি ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেব। তুমি যেন পুলিশকে আমার কথা জানাবে না। যদি জানাও তাহলে বিপদে পড়বে। বলে পরমা দরজার সামনে গেল এবং কোমরের কাছ থেকে চাবি বের করে দরজা খুলল। বুঝতে পারলুম এটার ল্যাচ কি সিস্টেম আমার ঘরের দরজার মতো। ভিতর থেকে খোলা যায় কিন্তু বাইরে থেকে দরজা খোলা যায় না।

আমাকে সে তার বেড রুমে নিয়ে গিয়ে বসাল। তারপর চাপা স্বরে কাজলকে কফি তৈরি করতে বলল।

এই সময় অ্যাপার্টমেন্টের ভিতর দিকে শিলাদিত্যের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলুম। সে বলল, আমার হাতে সময় কম। তুমি চেক বই বের করে সেলফ চেকে এক লাখ টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করো। আমি কিন্তু সিরিয়াস পরমা।

পরমার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, আমি যদি তোমার কথা না শুনি তাহলে কি তুমি আমাকে গুলি করে মারবে?

শিলাদিত্য বলল, না। পুলিশের কাছে তোমার কীর্তি ফাঁস করে দেব। এই রিভলবারে আরও তিনটে গুলি আছে। আমি এটা রুমালে জড়িয়ে তোমার হ্যান্ডব্যাগে রাখছি। কারণ এতে তোমার আঙুলের ছাপ পাওয়া যাবে। তারপর আমি এখান থেকেই লালবাজারে সি আই ডি অফিসে ফোন করে জানাচ্ছি–

কথা শেষ না-করে সে থেমে গেল। তারপর বলে উঠল, এই কাজল, কার জন্য চায়ের ট্রে সাজিয়ে নিয়ে যাচ্ছিস? নিশ্চয় তাহলে পরমার কোনও বন্ধু এসেছে।

পরমা বলল, হ্যাঁ এসেছে। কাজল তুমি যেখানে যাচ্ছ যাও।

ততক্ষণে আমি প্যান্টের পকেট থেকে আমার অস্ত্রটা বের করে দরজার পর্দার এক পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। কাজল ভিতরে ঢুকে টেবিলে কফির ট্রে রাখল। তারপর দ্রুত বেরিয়ে গেল।

এবার যা ভেবেছিলুম ঠিক তাই ঘটল। পর্দা সরিয়ে শিলাদিত্য ঘরের ভিতর পা বাড়াতেই আমি তার কানের পাশে চোয়ালের নীচে আমার রিভলবারের নল ঠেকিয়ে বললুম, শিলাদিত্য, সেবার আমার সঙ্গে তুমি ঘোরাঘুরি করেছিলে বটে, কিন্তু আমাকে সঠিক চিনতে পারোনি। তোমার ফায়ার আর্মসটি ফেলে না দিলে তোমার মৃত্যু অনিবার্য।

শিলাদিত্য আচমকা হামলায় হকচকিয়ে গিয়েছিল। সে তখনই তার রিভলবারটা পায়ের কাছে কার্পেটের উপর ফেলে দিল। ওই অবস্থায় তার শার্টের কলার। বাঁহাতে খামচে ধরে আমি তাকে ঠেলে নিয়ে গেলুম।

বুদ্ধিমতী পরমা তখনই রিভলবারটা তুলে নিয়ে শিলাদিত্যের পিছনে দাঁড়িয়ে বলল, কর্নেল সাহেব যদি তোমাকে না-ও মারেন, আমি তোমাকে ছাড়ব না।

আমি বললুম, পরমা তুমি কাজলকে দরজার বাইরে পাঠিয়ে জেনে নাও সাদা পোপাশাকে লালবাজার থেকে একদল পুলিশ আসার কথা।

কাজল এগিয়ে যেতেই ডোরবেল বাজল। তারপর কাজল দরজা খুলে দিতেই নরেশবাবুর সাড়া পেলুম–কই কর্নেল সাহেব, আপনি কোথায়?

কাজল তাদের বলল, আমার সঙ্গে আসুন স্যার। কী সাংঘাতিক কাণ্ড নিজের চোখে দেখবেন।

নরেশবাবু এ-ঘরে ঢুকেই হো হো করে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, শর্মাজি, আপনারা এই লোকটিকে পাকড়াও করুন। হা, দুটো হাত পিছন দিকে টেনে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে দিন। তারপর একে নিয়ে গাড়িতে অপেক্ষা করুন। আমি যাচ্ছি।

শিলাদিত্য ভাঙা গলায় বলল, পরমা, আমি কিন্তু তোমার উপকারই করেছি। তোমার স্বামী যে খুনি ভাড়া করেছে, আমিই কিন্তু তোমাকে জানিয়েছি। আশা করি তুমি কিন্তু এই উপকারের কথা ভুলবে না।

লালবাজারের লোকেরা শিলাদিত্যকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। তারপর পরমা ক্লান্তভাবে বলল, চলুন আমার বেডরুমেই আপনি বসবেন। কাজল, আরেক কাপ কফি করে নিয়ে এসো।

প্রশস্ত বেডরুমের একপাশে একটা সোফাসেট যেখানে আমি এবং নরেশবাবু পাশাপাশি বসলুম। নরেশবাবু বললেন, কর্নেলসাহেবের কফি ঠান্ডা হয়ে যাবে। আপনি শুরু করে দিন। আমি ততক্ষণ এই আলুভাজা আর চানাচুর চিবোতে থাকি।

পরমা দাঁড়িয়ে ছিল। বললুম, বসো পরমা। এবার তুমি নিজের মুখেই বলো। রবিবার সন্ধ্যার ঠিক কী কী ঘটেছিল?

পরমা তার হাতের রিভলবারটা নরেশবাবুকে দিল। তিনি সেটা পরীক্ষা করে দেখার পর বললেন, হ্যাঁ, তিনটে বুলেট ফায়ার করা হয়েছে। বাকি তিনটে অক্ষত আছে। রিভলবারটা মনে হচ্ছে বিদেশি, কিন্তু অটোমেটিক নয়। তাহলে ফায়ার করা বুলেটগুলো বুলেট কেস থেকে বেরিয়ে নীচে পড়ে যেত। হ্যাঁ, এবার বলুন ঠিক কী ঘটেছিল?

আমি বললুম, নরেশবাবু, সত্যি করে বলুন তো আপনি কি শিলাদিত্যকেই বাপি সেনের হত্যাকারী ভেবেছিলেন?

নরেশবাবু বললেন, ভেবেছিলুম কিন্তু নিশ্চিত ছিলুম না। আমার থিয়োরির কথা তুলে এখন আর লাভ নেই। তবে এটা তো আপনি জানেন শিলাদিত্যকে খুঁজে বার করার জন্য আমরা পুলিশের পক্ষ থেকে যথাসাধ্য করেছি। যাই হোক, এবার। আপনি বলুন আপনার অঙ্কের কথা।

এই সময় কাজল নরেশবাবুর জন্য কফি এনে দিল। পরমা তাকে বলল, কাজল। তুমি নিজের কাজ করো গে।

সে চলে যাওয়ার পর আমি বললুম, আমার অঙ্ক মিলে গেছে কিন্তু এই অঙ্কটা আমার গোড়া থেকেই মাথার ভিতরে এক কোণে কষা হচ্ছিল। শিলাদিত্যের কথামতো আমি পরমাকে বাপির হত্যাকারী বলে মেনে নিতে পারিনি। কারণ বাপির বডি লক্ষ করে যা বুঝেছিলুম তাতে মনে হয়েছিল এই কাজটা আনাড়ি হাতের নয়। কারণ তিনটে গুলির চিহ্ন রেখা টানলে একটা ত্রিভুজ হয়ে ওঠে। মাথার পিছনে একটা এবং পিঠের দু’পাশে দুটো ক্ষতচিহ্ন।

নরেশবাবু বললেন, আমাদের হাতে খবর ছিল শিলাদিত্য সল্টলেক থেকে ভোরবেলায় নিজের গাড়িতে চেপে বেরিয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে সে পরমা দেবীর কাছেই এসেছিল। বলুন পরমাদেবী, সে কেন এসেছিল?

পরমা বলল, শিলাদিত্য আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে এসেছিল। সে এক লাখ টাকা দাবি করছিল। এবং বুঝতে পারছিলুম সে এরপর ক্রমাগত আমাকে ব্ল্যাকমেল করে যাবে। কারণ, আমাদের কাছে সে একটা রিভলবার দিয়েছে।

নরেশবাবু সহাস্যে বললেন, যাই হোক, ওস্তাদের মার শেষ চালে। কর্নেল সাহেবকে কৃতিত্ব না-দিয়ে উপায় নেই।