ব্ল্যাক অ্যামবাসাডার

ব্ল্যাক অ্যামবাসাডার

০১.

সেবার অক্টোবরের পুজোর সময় কর্নেলের কথা ছিল তিনি আমাকে নিয়ে বিহারের ছোটনাগপুর এলাকায় পাড়ি দেবেন। সেখানে তার এক বন্ধুর প্রাসাদতুল্য বাড়ি আছে। কাজেই থাকবার জায়গার কোনও অসুবিধা নেই। কাছে নদী আছে। নদীর ওপারে পাহাড় আর ঘন জঙ্গল। নদীটার উৎস কয়েক মাইল দূরে একটা জলপ্রপাত।

কর্নেল বলেছিলেন এই প্রপাতের উৎস নিয়ে অনেক গল্প চালু আছে। সেই গল্পগুলি অবশ্য তিনি বলেননি। যেটুকু আভাস দিয়েছিলেন গেলে দেখা যাবে জলটা ভূগর্ভ থেকে উঠে আসছে। অর্থাৎ প্রস্রবণ বলা চলে। কিন্তু এতবড় প্রস্রবণ নাকি ভারতের কোথাও নেই। কিন্তু তার চেয়ে রহস্যময় ব্যাপার, মাঝে মাঝে প্রস্রবণের ওপরে সূর্যের আলো পড়ে রামধনু দেখা যায়। এই সুন্দর দৃশ্য দেখার জন্য পর্যটকরা ওখানে হানা দেয়। জলপ্রপাতটার নাম ইন্দ্রধারা। তবে কর্নেলের আগ্রহ অন্যদিকে। তাঁর বন্ধু বিজয়নারায়ণ সিংহ সম্প্রতি খবর দিয়েছিলেন ইন্দ্রধারা এলাকায় তিনি এক বিশেষ প্রজাতির প্রজাপতি দেখেছেন। বিজয়বাবু লেপিডকটারিস্ট অর্থাৎ প্রজাপতি বিশারদ নন কিন্তু অনেক জাতের প্রজাপতি চেনেন। কিন্তু এই প্রজাপতি প্রজাপতি তাকে অবাক করেছে। কারণ এদের আকার প্রায় ছোট্ট একটা ঘুড়ির মতো। এরা যখন ফুলে বসে থাকে কান পাতলে ক্ষীণ একটা সুর শোনা যায় কতকটা চড়া সুরে বাঁধা বেহালার মতো।

কিন্তু অক্টোবরের পুজো শেষ হয়ে গেল তার পরেও কর্নেল সেখানে যাবার নাম করছেন না। যখনই আমার কাগজের অফিস থেকে সময় পেলে তার অ্যাপার্টমেন্টে গেছি তখনই দেখেছি আমার বৃদ্ধ বন্ধু একটা প্রকাণ্ড বই খুলে ধ্যানমগ্ন। দাঁতের ফাঁকে চুরুট। একফালি নীল ধোঁয়া তার টাক ছুঁয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আমি গিয়ে সোফায় বসলে তিনি বইয়ের দিকে তাকিয়ে শুধু বলেছেন–বোসো, ষষ্ঠীচরণকে আরেক রাউন্ড কফি আনতে বলেছি।

অক্টোবরের শেষ সপ্তাহের এক রবিবার সকালে আমার সল্টলেকের ফ্ল্যাটে সবে ঘুম থেকে উঠেছি এমন সময় টেলিফোন বাজল। আমি টেলিফোন এলে বিরক্ত হই কারণ খবরের কাগজে খ্যাতিমান রিপোর্টারদের সঙ্গে লোকেরা কথা বলতে চায়। কিন্তু টেলিফোনটা বেজেই চলেছে অগত্যা রাগ করে রিসিভার তুলে বললুম–রং নাম্বার।

সঙ্গে সঙ্গে কেউ বলে উঠল, রাইট নাম্বার ডার্লিং। আশা করি সুনিদ্রা হয়েছে।

কর্নেলের কণ্ঠস্বর শুনে আমি হাসতে হাসতে বললুম–মর্নিং কর্নেল, আমার সুনিদ্রার ব্যাঘাত ঘটানোর মতো কিছু ঘটেনি।

-জয়ন্ত তুমি তো কাগজের লোক হয়েও কাগজ পড়তে চাও না। তুমি কি আজকের কোনও কাগজ পড়েছ?

–না কেন বলুন তো, কিছু কি পড়ার মতো বেরিয়েছে?

-কর্নেল একটু পরে বললেন, আশ্চর্য!

তোমাদের দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় খবরটা প্রথম পাতায় ছেপেছে। অবশ্যই বেশি জায়গা দেয়নি। কারণ নিউজ এজেন্সির খবর। সিংহগড়ে তো তোমাদের সংবাদদাতা নেই।

আমি একটু উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলুম।

বললুম–খবরটা কীসের বলুন তো।

-কর্নেল বললেন, খবরটার হেডিং : সিংহগড়ে সিংহের হুঙ্কার। আমি রাখছি, তুমি খবরে একবার চোখ বুলিয়ে এখনই চলে এসো।

রিসিভার রেখে সেদিনকার কাগজগুলো তুলে টেবিলে রাখলুম। তারপর দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার প্রথম পাতায় খবরটা খুঁজে বের করলুম। খবরটা নিয়ে যেন নাইট এডিটর কৌতুক করেছেন। একবার চোখ বুলিয়ে সারমর্ম বুঝে নিলুম।

ছোটনাগপুর অঞ্চলের সিংহগড়ে পরপর কয়েকটি রাত কোনও হিংস্র জন্তুর হুঙ্কার শোনা গেছে। সিংহগড়ের একদিকে শিল্পাঞ্চল অন্যদিকে পাহাড় আর জঙ্গল। সিংহগড় একটা সমৃদ্ধ শিল্পনগরী। সেখানে দক্ষিণপ্রান্তে এক সময় বাঙালিদের বসবাস ছিল। তাই বাঙালিটোলা বলা হয়। হুঙ্কার শোনা গেছে সেই এলাকায়।

সন্ধ্যার আগেই সেখানে সবাই বাড়িতে ঢুকে পড়ে। তবে ওটা সিংহের হুঙ্কার কি না তা নিয়ে সন্দেহ করা যায় না কারণ বাঙালিটোলার এক পুরুতঠাকুর শপথ করে বলেছেন। তিনি একটা সিংহের প্রকাণ্ড ঢাকের মতো মাথা এক পলকের জন্য দেখতে পেয়েছেন।

এই খবর নিয়ে কর্নেলের এত মাথাব্যথার কারণ বুঝতে পারলুম না। কেউ হয়তো নিছক আমোদ-প্রমোদের জন্যই সিংহ সেজে লোকেদের ভয় দেখাচ্ছেন। আর ওই হুঙ্কার ব্যাপারটা কীভাবে প্রচার করা যায় তা আমি কর্নেলের সঙ্গগুণে জানি। একবার মুখের কাছে জাপানি টেপরেকর্ডার বেঁধে একটা লোক বাঘের গর্জন শোনাত। ওই সব জাপানি যন্ত্রের এমন ক্ষমতা যে কোনও গর্জনকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে।

কিছুক্ষণ পরে সেজেগুজে বেরিয়ে পড়লুম। সঙ্গে আমার একটা ব্যাগ। ব্যাগে কিছু জামাকাপড় আর আমার ফায়ার আর্মর্স ভরে নিলাম। কারণ, কর্নেলের এই ডাকাডাকি মানেই সিংহগড় অভিযানের প্রস্তুতি আমি জানি। ভাগ্যিস এই খবরটা বেরিয়েছিল। পুজোর সময়ই বাইরে বেড়াতে যাবার অভ্যাস আমার আছে। বিশেষ করে কর্নেল পুজোর সময়টা কোনও সমুদ্রতীরে বা পাহাড়ে জঙ্গলে কাটিয়ে আসতেই ভালবাসেন। আমারও চমৎকার একটা ভ্রমণ হয়ে যায়।

আমার তেজি ফিয়াট গাড়িটা যখন ইলিয়ট রোড এলাকার কর্নেলের বাড়ির গেটে ঢুকল তখন আটটা বাজে। লনের একপাশে গাড়ি রেখে তিনতলায় কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে উঠে গেলাম। তারপর ডোর বেল সুইচ টেপার পর ষষ্ঠীচরণ দরজা খুলে ফিক করে হেসে চাপা স্বরে বলল, বাবুমশাইকে আজ এক ভদ্রলোক এসে বড্ড জ্বালাতন করছেন। আপনি গিয়েই দেখুন না।

ষষ্ঠী পাশের করিডর দিয়ে চলে গেল। এটা একটা ছোট্ট ওয়েটিং রুম বলা চলে। তারপর সামনে দরজার পর্দা সরালেই কর্নেলের জাদুঘর সদৃশ বিশাল ড্রইংরুম।

কানে এসেছিল কারও উত্তেজিত কণ্ঠস্বর। ড্রয়িংরুমে ঢুকেই দেখি কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে আছেন। তার চুরুট নিভে গেছে কারণ আর ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে না। আর সোফার ওপর একজন রোগাপটকা চেহারার ভদ্রলোক হাত নেড়ে তাকে বলছেন, এটা সামান্য ব্যাপার নয় কর্নেল সাহেব। বিজয় নারায়ণ আমাকে রাতের ট্রেনেই আপনার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আর আপনি বলছেন আমাদের কানের ভুল। কখখনো না। মা চণ্ডিকাঁদেবীর নামে দিব্বি দিয়ে বলছি আমার কানের ভুল নয়। ওহ! সে কি ভয়ঙ্কর গর্জন। ইন্দ্রধারা জলপ্রপাতের গর্জন তো শুনেছেন।

আমি থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। কর্নেল মুখ তুলে ঠোঁটের কোণে হেসে বললেন,

–বোসো জয়ন্ত। আলাপ করিয়ে দি। আমরা সিংহগড়ে বিচিত্র প্রজাতির প্রজাপতি দেখতে যাব ভেবেছিলাম। বার বার বাধা পড়ছিল। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে না গিয়ে উপায় নেই কারণ ইনি সিংহগড়ের আমার বন্ধু বিজয়নারায়ণ সিংহের ছোট ভাই অজয়নারায়ণ সিংহ। অজয়বাবু, এর নাম জয়ন্ত চৌধুরী, দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার স্পেশাল রিপোর্টার।

অজয়বাবু করজোড়ে নমস্কার করে উত্তেজিত হয়ে বললেন–ট্রেনে আসতে আসতে আপনাদের কাগজে পড়েছি। আপনারা প্রথম পাতায় খবরটা ছেপেছেন। ভালই হল। আপনিও সেখানে চলুন। যেভাবে খবরটা ছাপা হয়েছে তাতে অনেককিছু বাদ গেছে। সব কথা আমি কর্নেল সাহেবকে জানিয়েছি। সোফার অন্য প্রান্তে বসে লক্ষ্য করলুম ভদ্রলোকের পরনে সিল্কের পাঞ্জাবি আর ধুতি আর তার পাশে একটা ব্রিফকেস। আর সুদৃশ্য ছড়ি আছে। ট্রেনে ছড়ি নিয়ে আসার কোনও মানে খুঁজে পেলুম না। ইতিমধ্যে ষষ্ঠীচরণ কফি নিয়ে এল। কর্নেল বললেন আবার এক রাউন্ড কফি হোক অজয়বাবু।

 অজয়বাবু হাসার চেষ্টা করে বললেন আপনার কফি খাবার অভ্যাস তো দেখেছি। বারে বারে কফি খেলে আমার আবার ততটা সহ্য হয় না। কর্নেল হাসলেন–নিশ্চয় সহ্য হবে বরং আপনার নার্ভ আরও চাঙ্গা হবে। তিনি কফিতে। চুমুক দিয়ে বললেন এবার যাব আমার ভগ্নীপতির বাড়ি। আমার মেয়ে সুজাতা ওখানে থেকে যাদবপুরে এম. এ. পড়ছে। পুজোর আগেই তার যাবার কথা ছিল। কিন্তু কেন যে গেল না, চিঠি লিখে জানায়নি। এই একটা চিঠিরও জবাব পাইনি।

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, সুজাতা সম্ভবত আপনার ওপর রাগ করেই যায়নি। আপনি সুজাতার পিসেমশাই বা পিসিমাকে কি যেতে লিখেছিলেন।

অজয়বাবু কাঁচুমাচু মুখে বললেন, আসলে, এখানে ওদের বাড়িতেই পাঁচশো বছরের পুরোনো পুজো হয় তাই ওদের যেতে বলি কী করে। কিন্তু সুজাতা প্রতিবছর সিংহগড়ে বাঙালিটোলার পুজোয় না গিয়ে পারে না। এবার কেন যে গেল না কে জানে। যাই হোক, ওকে সঙ্গে করেই সিংহগড়ে ফিরব। আপনারা আমাদের সঙ্গে গেলে খুব আনন্দ হত।

কর্নেল বললেন, খবরটা নিশ্চয় আপনার মেয়ে পড়েছে। সে কি সিংহের চোখে পড়ার জন্য বাবার বাড়ি যেতে চাইবে। যা অবস্থা বললেন তাতে তো টুরিস্টরা জলপ্রপাত বা প্রস্রবণ দেখতে যাবে বলে মনে হচ্ছে না।

অজয়বাবু বললেন–না দিনের বেলায় ভয়ের কোনও কারণ নেই। দাদা পুলিসকে জানিয়েছেন। পুলিস রাত্রে তো বটেই, দিনের বেলাতেও জলপ্রপাত অবধি টহল দিয়ে আসে।–আচ্ছা সবই তো শুনলেন। এবার আমি উঠি। পরের ট্রেন সেই এগারোটায়, তাই ভাবছি দুপুরের ট্রেন ধরব, সিংহগড়ে এই ট্রেনটা থামে না। আমরা আগের স্টেশনে নেমে বাসে চেপে চলে যাব।

অজয়বাবু এক হাতে ছড়ি, অন্য হাতে ব্রিফকেস তুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। একটু পরে কর্নেল বললেন, এরা দুই ভাই পরস্পর বিপরীত, বিজয়বাবু মোটাসোটা বলিষ্ঠ গড়নের মানুষ, প্রায় আমার সমবয়সী; চালচলনেও আমার মতো বলতে পারো।

-বললুম, অর্থাৎ তিনি আপনার মতো সাহেব।

কর্নেল হাসলেন।

তা অবশ্য বলতে পারো তবে বিজয়বাবুর কণ্ঠস্বর এত চড়া না। তা ছাড়া কথা বলেন কম। একসময় ওঁর পূর্বপুরুষ ওই এলাকার জমিদার ছিলেন। তবে কেথা। আর যা বলছিল। ওঁর ছোটভাইকে তো দেখলে। রোগা পটকা মানুষ কিন্তু বেজায় সৌখিন। তারপর কথা বলেন খুব চড়া স্বরে।

-বললুম উনি ঢাক আর ইনি ঢাকী এই তো।

কর্নেল হাসতে গিয়ে হাসলেন না। চাপা স্বরে বললেন, আমার ধারণা সিংহগড়ে একটা সাংঘাতিক কিছু ঘটতে চলেছে। তা যাতে না ঘটে তার জন্যই আমরা আজই রাত এগারোটার ট্রেনে যাত্রা শুরু করব।

কথাটা বলে তিনি ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে তিনি নতুন একটা চুরুট ধরালেন তারপর চোখ বুজলেন। বুঝতে পারলুম তিনি কোনও গভীর বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছেন। কিছুক্ষণ পরে ডাকলুম-আচ্ছা কর্নেল, কর্নেল চোখ বন্ধ করে থেকেই বললেন, বলো।

আপনাকে মনে মনে খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছে। তাছাড়া সাংঘাতিক ঘটনা বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন? মার্ডার?

কর্নেল একই অবস্থায় থেকে বললেন–আমি সিওর নই। মার্ডারও হতে পারে আবার অভাবিত কিছু হতেও পারে।

–বিজয়বাবুরা বড়লোক তা এর আগে আপনার কথাতেই বুঝেছিলাম। কারণ তারা প্রাসাদতুল্য বাড়িতে বাস করেন। আপনি কি ওঁদের বাড়িতে ডাকাতির কথা ভাবছেন। কারণ একবার, আপনার মনে পড়তে পারে রামগড়ে আপনার সামরিক জীবনের এক বন্ধুর ফার্মহাউসে ডাকাতির আগে প্রতি রাত্রে বাঘের গর্জন শোনা যেত। এমনকী, সেখানে বাঘও দেখা গিয়েছিল। এভাবে ভয় দেখিয়ে ডাকাতদের চমৎকার একটা সুযোগ হয়, ভয়ে বাড়ি থেকে কেউ বেরোয় না। আর তারা নিশ্চিন্তে ডাকাতি করে চলে যায়।

কর্নেল আমার কথায় কান দিলেন না। তিনি সোজা হয়ে বসে হাত বাড়িয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুললেন। তারপর একটা নম্বর ডায়াল করে বললেন–কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি…হা মিস্টার ব্যানার্জি আপনার ডিপার্টমেন্টে কি ছোটনাগপুর সিংহগড় এরিয়ার কোনও বিশেষ ঘটনার খবর এসেছে। আসেনি। কিন্তু আজকের কাগজে সিংহের গর্জনের খবর বেরিয়েছে। পড়েছেন…। হ্যাঁ ইউ আর রাইট, তো শুনুন আমি আর জয়ন্ত সিংহগড়ে যাচ্ছি।…, না, আপনি যাকে বলে বাংলা বিহার উড়িষ্যার তাবৎ জঙ্গলের অধিপতি, তাই আপনাকে জানাতে হল। ওখানে যদি সম্ভব হয় একটা মেসেজ পাঠালে খুশি হব। ওখানে তো ট্যুরিস্ট লজ আছে। একটা টু বেড স্যুট। থ্যাঙ্কস মেনি থ্যাঙ্কস্ মিস্টার ব্যানার্জি।

রিসিভার রেখে কর্নেল আমার ব্যাগের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি রেডি হয়ে এসেছ। ভাল করেছ। যাও তোমার ঘরে গিয়ে ব্যাগ রেখে ব্রেকফাস্টের জন্য তৈরি হও। ব্রেকফাস্ট করে আমরা দুজনে বেরবো।

ব্রেকফাস্টের পর কর্নেল ড্রয়িংরুমে এসে আবার এক প্রস্থ কফি পান করলেন। তারপর উঠে দাঁড়াতে গিয়ে হঠাৎ সোফার তলা থেকে কী একটা কুড়িয়ে নিলেন।

–জিজ্ঞেস করলুম, কী ওটা।

-কর্নেল বললেন এটা সম্ভবত অজয়বাবু আমাকে দেখাতে চেয়েছিলেন। বারবার বলছিলেন তিনি এই জিনিসটা তাদের ঠাকুরবাড়ির পেছনে পুকুরের পাড়ে কুড়িয়ে পেয়েছেন।

-বলে কর্নেল জিনিসটা আমার হাতে তুলে দিলেন। অবাক হয়ে দেখলুম সেটা একটা রুপোর টাকার সাইজের চাকতি। ব্রোঞ্জের চাকতি বলেই মনে হল। চাকতির দুই পিঠেই কীসব আঁকাঝোকা আছে বোঝা গেল না। এই সময় কর্নেল হঠাৎ চাকতিটা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে সোফার নিচে যেখানে পড়ে ছিল সেখানেই রেখে দিলেন। তার পর চাপা স্বরে বললেন, এটার কথা অজয়বাবুর মনে। পড়েছে তাই উনি ফিরে এসেছেন।

-অবাক হয়ে বললাম, কী করে বুঝলেন।

–দোতলায় লিন্ডাদের কুকুরটা বেশ চেঁচামেচি করছে…

তুমি তো জানো একেবারে নতুন কোনও লোকের সাড়া পেলে জনি খুব রেগে যায়।

কর্নেলের কথা শেষ না হতেই ডোর বেল বাজল। কর্নেল যথারীতি হাঁকলেন, ষষ্ঠী।

অজয়বাবু হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢুকে বললেন কী সর্বনাশ! আমি আপনাকে দেখাতে চেয়েছিলুম জিনিসটা, কোথায় যে ফেললুম মনে পড়ছে না।

কর্নেল হাসিমুখে সোফার তলায় দেখিয়ে বললেন, আপনি জিনিসটা ওখানেই ফেলে গেছেন। ওই দেখুন! ওটা এখনও অদৃশ্য হয়ে যায়নি।…

.

০২.

আমি ভেবেছিলুম, অজয়বাবু হয়তো কর্নেলকে ওই ব্রোঞ্জের চাকতিটা শুধু চোখে দেখে পরীক্ষা করতে বলেছিলেন। তাই এবার তিনি ওটা ফেরত নিতে এসেছেন।

কিন্তু উনি বললেন, কফি খাওয়ার সময় কখন ওটা হাত ফসকে নিচে পড়ে গিয়েছিল।

বলে তিনি কর্নেলকে চাকতিটা দিলেন। কর্নেল বললেন, তখন এটা আপনার হাতে দেখে বুঝেছিলুম এটা কোনও প্রাচীন যুগের সিল।

অজয়বাবু বললেন–কর্নেল সাহেব আসলে ওটা আপনার কাছে রাখতে বলেছিলেন দাদা। আপনি ওটা পরীক্ষা করে দেখে সব কথা দাদাকে জানাবেন। আমিও জানতে পারব।

বলে অজয়বাবু ব্যস্তভাবে বেরিয়ে গেলেন। কর্নেল বললেন এইসব ছোট ছোট ঘটনা থেকে মানুষের চরিত্র জানা যায়। চিন্তা করে দেখো জয়ন্ত, তিনি এই চাকতিটা হাতে নিয়ে কতক্ষণ ধরে আমাকে তার পূর্বপুরুষের কাহিনি অনেক রঙ চড়িয়ে শোনাচ্ছিলেন। তিনি জানেন যে, আমি তাদের বাড়িতে গেছি এবং তার দাদা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। যাইহোক, চলো যেখানে যাচ্ছিলে। নিচের লনে পার্ক করে রাখা গাড়িতে সামনের সিটে বসলেন। লক্ষ্য করলাম শুধু গলায় ঝুলছে ওঁর সেই শক্তিশালী ক্যামেরা যা নাকি নিজেই আলো তৈরি করে অন্ধকারে ছবি তুলতে পারে।

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললেন অজয়বাবু সম্পর্কে আপনার ধারণাটা কী তা কিন্তু বলেননি। গেট দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর কর্নেল মৃদু হেসে বললেন–মানুষটিকে বোঝা খুব সোজা, উনি সব ব্যাপারেই খুব উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। অনেক কিছুই তার মনে থাকে না। তা ছাড়া অকারণ ব্যস্ততায় যারা মূল কাজটা ভুলে যায় তিনি সেই দলের মানুষ। হ্যাঁ, আমরা পার্ক স্ট্রিট দিয়ে যাব। কোথায় যেতে হবে তা যথাসময়ে জানতে পারবে। কর্নেলের নির্দেশে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ হয়ে শ্যামবাজারে পৌঁছলাম তারপর তাঁর নির্দেশে উত্তর কলকাতার বাঁকাচোরা পল্লী দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে কিছুক্ষণ পরে একটা পুরনো বাড়ির সামনে কর্নেল আমাকে গাড়ি দাঁড় করাতে বললেন। তার পরে গেটের পাশে আমাকে গাড়ি লক করতে বলে তিনি এগিয়ে গেলেন। গেটে দারোয়ান নেই কিন্তু উত্তর কলকাতার এই সব বাড়ি যে অভিজাত বনেদি পরিবারের বাড়ি তা আমি জানি। গেটের ভেতর দিক থেকে তালা বন্ধ ছিল। কর্নেল তালাটা বার কয়েক নাড়াতেই গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বরে বলে উঠল–ওরে মঘা দেখতে কে এসেছেন।

তারপর দেখলুম ভেতরের ছোট্ট লনে এক পাশ থেকে একজন কালো বেঁটে ফতুয়া পরা লোক এসে কর্নেলকে দেখামাত্র করজোড়ে ঝুঁকে নমস্কার করল। তারপর সে বলল-বাবুমশাই নিজের হাতে জঙ্গল সাফ করতে ব্যস্ত হয়েছেন। আমার কোনও দোষ নাই কর্নেল সাহেব। আমার নাকি নিজে থেকেই এসব কাজ করা উচিত ছিল। হ্যাঁ স্বীকার করছি তা তো ছিলই তাই বলে আমার উপর রাগ করে তিনি নিজেই

লোকটার কথা থেমে গেল। এবার দেখলুম ডানদিকের ঘন ঝোপঝাড়ের ভিতর থেকে এক ভদ্রলোক মুখ বের করেছেন। তিনি প্রায়ই চেঁচিয়ে উঠলেন–কী সৌভাগ্য! আসুন আসুন।

মঘা গেটের তালা খুলে আমাদের ভেতরে নিয়ে গেল। অপ্রশস্ত ইটে বাঁধানো একটা রাস্তা। গাড়ি বারান্দার তলায় পৌঁছেছে। তার মানে এক সময় এ বাড়িতে মোটরগাড়ি ছিল। কর্নেল লনের মাঝামাঝি গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে সহাস্যে বললেন আপনি একেবারে নিজেই মজুর খাটাতে শুরু করেছেন।

গায়ে গেঞ্জি, গোটানো ধুতি, পায়ে একটা চপ্পল এবং গায়ের রঙ পাতা-চাপা ফুলের মতে, এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক হাতে কাটারি নিয়ে এগিয়ে এলেন। তার মাথার চুল কর্নেলের মতোই সাদা। মুখে পেল্লাই গোঁফ আছে। শরীর দেখে বোঝা যায় একসময় নিশ্চয় তিনি নিয়মিত ব্যায়াম করতেন। তিনি মঘার হাতে কাটারি দিয়ে বললেন, আসলে আমি পরীক্ষা করে দেখছিলুম আমার শারীরিক ক্ষমতা আগের মত আছে কি না। তিনি কর্নেলের হাত ধরে এগিয়ে গিয়ে গাড়ি বারান্দার তলায় দাঁড়ালেন। তারপর আবার বললেন, একটা ফোন করে এলে কী ক্ষতি হতো।

কর্নেল হাসলেন–এটাকে সারপ্রাইজ ভিজিট বলতে পারেন। রাঘবেন্দ্র রায় চৌধুরী বরাবর অদ্ভুত অদ্ভুত কাজ করেন। এবারটা দেখে হতাশ হবেন। বুঝতে পারলুম ভদ্রলোকের নাম রাঘবেন্দ্র রায়চৌধুরী, বেশ ভারিক্কি নাম। কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠে বসার ঘরে তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন। ঘরের আসবাবপত্র সবই সেকেলে, পুরনো। তাহলেও এসব জিনিসের দাম বাজারে অনেক বেশি। বাকিটা দোতলা। সামনে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি দেখা যাচ্ছিল। রাঘবেন্দ্রবাবু বললেন, চলুন ওপরে ওঠা যাক।

কর্নেল বললেন–আমার হাতে সময় খুব কম। একটা জরুরী কথা জানবার জন্য আপনার কাছে ছুটে এসেছি।

রাঘবেন্দ্রবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই ছেলেটিকে তো কখনো দেখি নি।

কর্নেল বললেন, ওকে ছেলে বলবেন না। বয়স লুকিয়ে ছেলেমানুষ হয়ে আছে। ওর নাম জয়ন্ত। পেশা সাংবাদিক।

বলে কর্নেল একটা চেয়ার টেনে বসলেন। শ্বেতপাথরের ডিম্বাকৃতি বিশাল টেবিলের চারপাশে অনেকগুলো গদিআঁটা চেয়ারে রাঘবেন্দ্র আমাকে ইশারায় বসতে বলে নিজে বসলেন কর্নেলের পাশে তারপর মৃদু হেসে বললেন–কফি খাওয়াতে পারছি না। কারণ আমি কফি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। আপনি খবর দিয়ে এলে অবশ্য কফি আনিয়ে রাখতুম। তিনি এবার কণ্ঠস্বর চাপা করলেন, বললেন–সঙ্গে সাংবাদিক নিয়ে এসেছেন। খবরের কাগজে বুঝি কোনও খবর বেরিয়েছে!

কর্নেল মৃদু স্বরে বললেন খবর তো প্রতিদিনই বের হয় অনেক অদ্ভুত খবরও থাকে তবে আপনি ঠিকই ধরেছেন আজকের কাগজে সিংহগড়ের একটা মজার। খবর বেরিয়েছে। সিংহগড়ে সিংহনাদ। কিংবা ওরকম কিছু হেডিং আপনার চোখে পড়েছে?

লক্ষ্য করলুম রাঘবেন্দ্রবাবুর মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে এল। একটু চুপ করে থাকার পর বললেন খবরের কাগজ আমি পড়া ছেড়ে দিয়েছি। খালি রাজনীতি, দলাদলি আর খুনোখুনি। কিন্তু সিংহগড়ের খবরে কী যেন বললেন–সিংহনাদ।

কর্নেল বললেন ওই রকম একটা কিছু ধরে নিন না। সিংহ এসে রাত-বিরেতে গর্জন করছে। অথচ ওখানে তো সিংহ থাকার কথা নয়। ভারতে সিংহ থাকে একমাত্র গুজরাতের গির অরণ্যে। কোথায় গুজরাত আর কোথায় বিহারের ছোটনাগপুর।

এবার দেখলুম রাঘবেন্দ্রবাবুর মুখে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। তিনি বললেন আমি সিংহগড় ছেড়ে এসেছি প্রায় পনেরো বছর আগে। বাড়িটাও বেচে এসেছি। কিন্তু আপনার কথা শুনে আমি চমকে গেছি।

কর্নেল বললেন, আমি ঠিক এটাই অনুমান করেছিলাম। আপনি সিংহগড়ের পুরনো বাসিন্দা। কখনো কি এধরনের কোনও অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে দেখেছিলেন। রাঘবেন্দ্রবাবু আবার গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন–প্রায় বিশ বছর আগে সিংহগড়ে গুজব রটেছিল এক অলৌকিক শক্তিধর সাধুবাবার একটা পোষা সিংহ আছে। কিন্তু আমি সেই সাধুবাবাকে ইন্দ্রধারার ওপরদিকে জঙ্গলের ভিতর একবার দেখেছিলাম কিন্তু তার সঙ্গে কোনও সিংহ দেখিনি। তার পরেই একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছিল। বিজয়নারায়ণের খুড়তুতো ভাই ছিলেন ব্রহ্মচারী। সাধুর মতোই থাকতেন। তার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ জলপ্রপাতের কাছে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। পুলিশের মতে কোনও জানোয়ারের আক্রমণে তার মৃত্যু হয়েছিল। বিজয়নারায়ণ তো আপনার বন্ধু। একথা আপনার কাছেই শুনেছি। কিন্তু সেকি তার খুড়তুতো ভাইয়ের শোচনীয় ঘটনার কথা আপনাকে বলেনি? কর্নেল অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। বললাম-না তো। তার ছোট ভাই অজয়বাবু আজকে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তিনিও সিংহের গর্জন শোনার কথা বলেছিলেন, কিন্তু তাঁর খুড়তুতো ভাইয়ের ঘটনাটা বলেননি।

রাঘবেন্দ্রবাবু জোড়ে শ্বাস ছাড়লেন তারপর চাপা স্বরে বললেন–তারপর সেই ঘটনার সঙ্গে নারীঘটিত একটা কেলেঙ্কারি জড়িত ছিল। চিন্তা করে দেখুন, সত্যেন্দ্রনারায়ণের মতো ব্রহ্মচারীকে টলাতে পেরেছিল এক যুবতী। কুড়ি বছর আগের কথা বলছি। খেয়াল রাখবেন।

কর্নেল জিজ্ঞাসা করলেন–কে সেই যুবতী? তার নাম কী? সে কি বাঙালি ছিল?

রাঘবেন্দ্র বললেন–আপনার হাতে সময় নেই বলছেন। কিন্তু কথাটা যখন উঠল তখন আমি বাকিটুকু বলতে চাই। আর কথাটা আপনার জানা দরকার। এক মিনিট, আমি এখনই আসছি।

বলে তিনি সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেলেন। আমি চাপা স্বরে বললুম ব্যাপারটা রোমান্টিক এবং মিস্টিরিয়াস বলে মনে হচ্ছে।

কর্নেল ঠোঁটে আঙুল রেখে আমাকে চুপ করে থাকতে ইশারা করলেন। জিজ্ঞাসা করলুম এ-বাড়িতে কি আর কেউ নেই?

কর্নেল অন্যমনস্ক ভাবে বললেন–না। রাঘবেন্দ্রবাবু জীবন খুব ট্রাজিক। ওঁর স্ত্রী এবং একমাত্র পুত্র ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যায়। তারপর উনি এই পৈতৃক বাড়িতে এসে ওঠেন। আমার সঙ্গে রাঘবেন্দ্রবাবুর আলাপ হয়েছিল একটা সেমিনারে। ইনি একজন অর্নির্থলোজিস্ট। পক্ষীবিশারদ, তুমি তো জানো আমারও

তার কথার উপর বললুম–জানি বই কী। আপনি বাইনোকুলার হাতে পাখির পিছনে বনে জঙ্গলে উধাও হয়ে যান। কতবার আমি আপনার নাগাল না পেয়ে ফিরে এসেছি।

এই সময় রাঘবেন্দ্রবাবু নেমে এলেন। তার হাতে একটা খাম। খামটা বিবর্ণ। খুব পুরনো বলেই মনে হচ্ছিল। তিনি এসেই কর্নেলের পাশে বসলেন। তারপর খামটা কর্নেলকে দিলেন। কর্নেল খামটা সাবধানে খুলে একটা ফটোগ্রাফ বের করলেন। ফটোটা এক সুন্দরী মহিলার। যৌবনের দীপ্তি তার চেহারায় জ্বল জ্বল করছিল। কর্নেল তার অভ্যাসমতো পকেট থেকে একটা আতসকাচ বের করলেন। একটু অবাক হলাম। সঙ্গে তা হলে উনি আতস কাচ নিয়ে এসেছিলেন। তার মানে তিনি এই ছবিটা দেখার জন্যই এই ভদ্রলোকের কাছে এসেছেন।

আতস কাচ দিয়ে ছবিটা খুঁটিয়ে দেখার পর কর্নেল বললেন–এই মহিলার নাম কী?

 রাঘবেন্দ্রবাবু আবার বাঁকা হেসে বললেন–প্রতিমা রায়। বাঙালি মা আর বিহারী বাবার একমাত্র সন্তান-কর্নেল জিজ্ঞাসা করলে এই ছবি আপনি কোথায় পেলেন?

–এই ছবিটা আমি বিজয়নারায়ণের সেই ব্রহ্মচারী খুড়তুতো ভাইয়ের বিছানার তলায় খুঁজে পেয়েছিলুম। হা স্বীকার করছি, আমি চোরের মতো ওদের বাড়ির পেছনদিকে ঠাকুরবাড়ির পাশে একটা ঘর থেকে চুরি করেছিলুম। আপনার কাছে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। ওই ব্রহ্মচারীর সঙ্গে আমার ডুয়েল লড়ার প্রবৃত্তি হয়েছিল। আমি এই যুবকের সামনে সেই সব পুরনো কথা বলতে সঙ্কোচবোধ করছি। আপনি নিজেই বুঝতে পারছেন কী ঘটেছিল।

কর্নেল শান্তভাবে বললেন এই মহিলা কি এখনও বেঁচে আছেন জানেন। রাঘবেন্দ্রবাবু বললেন–জানি না। কারণ পনেরো বছর আমি সিংহগড়ে যাইনি। তাকে শেষবার দেখেছিলাম সেই চলে আসার সময়।

ভাবছিলুম কর্নেল আর কিছু প্রশ্ন করবেন কিন্তু তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন ছবিটা আপনাকে আমি শিগগির ফেরত দের। আমি শুধু এর একটা ফটোকপি তুলে রাখতে চাই। এই যে ক্যামেরাটা দেখছেন এটা দিয়ে সেই কাজ হবে না। আমাকে অন্য ক্যামেরা ব্যবহার করতে হবে।

রাঘবেন্দ্রবাবু খামটা কর্নেলের হাতে দিয়ে বললেন আমাকে আর ফেরত না দিলেও আর ক্ষতি নেই। এই মহিলা আমার জীবনের সুখ-শান্তি কেড়ে নিয়েছিল। এক ব্রহ্মচারীর জীবনেও নিষ্ঠুর আততায়ীর আঘাত নেমে এসেছিল। তাই এটা আমার কাছে একটা আতঙ্কের প্রতীক। আমার সমস্যা আপনি বুঝতে পারছেন কর্নেল সাহেব। এটাকে যে ছিঁড়ে ফেলব তাতে আমার হাত কেঁপেছে।

–ধন্যবাদ। অসংখ্য ধন্যবাদ মিঃ রায়চৌধুরী। পরে যদি আপনি এটা ফেরত চান নিশ্চয়ই পেয়ে যাবেন। আপাতত এটা আমার কাছেই থাক। 

আমাদের বিদায় দিতে রাঘবেন্দ্রবাবু গেট অবধি এলেন। তারপর বললেন, আপনি নিশ্চয়ই সিংহগড়ে যাচ্ছেন।

কর্নেল বললেন–হ্যাঁ যাচ্ছি। তবে আমার উদ্দেশ্য সিংহগড়ের রহস্য উন্মোচন নয়। বিজয়বাবু খবর দিয়েছেন। ইন্দ্রধারার ওদিকে জঙ্গলের মধ্যে এক বিশেষ প্রজাতির প্রজাপতি তিনি দেখেছেন। প্রজাপতি বিশারদ হয়েও তিনি বুঝতে পারেননি ওগুলো কোন প্রজাতির, আমার সিংহগড়ে যাবার উদ্দেশ্য শুধু এটাই।

রাঘবেন্দ্রবাবু তখনই গম্ভীর কণ্ঠস্বরে মঘাকে ডাকতে ডাকতে চলে গেলেন। ফিরে আসার পথে আমি বললুম–ওই ভদ্রলোকের কাছে এই ফটো আছে আপনি তা কি জানতেন?

কর্নেল একটু হেসে বললেন–জয়ন্ত, আমি তোমাকে বরাবর বলে আসছি অনেক সময় আমরা জানি না যে আমরা কি জানি। খবরটা পড়ার পর আমার মনে ভেসে উঠেছিল রাঘবেন্দ্র রায়চৌধুরীর মুখ। তিনি বেশ কয়েকবার আমাকে বলেছিলেন, তাঁর কাছে একটা বিচিত্র নিদর্শন আছে। তিনি আমাকে দেখাবেন। তারপর আমরা দুজনেই ভুলে গিয়েছিলুম কথাটা সেদিন হঠাৎ মনে পড়েছিল। কিন্তু সেটা যে একটা ছবি তা জানতাম না।

জিজ্ঞাসা করলুম-এর সঙ্গে কি সিংহগড়ের সিংহনাদের কী কোনও সম্পর্ক আছে?

সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কর্নেল বললেন–তুমি সাবধানে গাড়ি চালাও। দেখছ না সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ-এ এমন গাড়ির উৎপাত বেড়ে গেছে হয়তো কোথাওঁ জ্যাম ছিল।

.

০৩.

সিংহগড়ে আমি কখনো না এলেও মোটামুটি এ ধরনের জনপদের চেহারাচিত্র আমার জানা। কর্নেলকে দেখে বিদেশি ট্যুরিস্ট ভেবে ট্যাক্সিওয়ালারা ঘিরে ধরেছিল। কিন্তু কর্নেল একটা একাগাড়ি পছন্দ করলেন। কোচওয়ানের নাম আব্দুল। আমাদের গন্তব্য ট্যুরিস্ট বাংলোর পাশে আঁচ করে নিয়েছিল। ট্যুরিস্ট বাংলো যাওয়ার পথে যে ইন্দ্রধারার কাছে সেই প্রস্রবণের আশ্চর্য রামধনুর গল্প শোনাচ্ছিল। এই রাস্তাটা সিংহগড়ের এক প্রান্ত দিয়ে গেছে। ক্রমশ শহর এলাকা ছেড়ে চড়াই আর উতরাই হয়ে আমরা যাচ্ছিলাম। ডানদিকে ঢেউখেলানো প্রান্তর। মাঝে মাঝে একটা করে টিলা পাহাড় আর কদাচিৎ ঝোপঝাড় বা গাছ।

এক সময় কর্নেল তাকে জিজ্ঞাসা করলেন-ট্রেনে আসবার সময় শুনে এলুম তোমাদের এই সিংহগড়ে নাকি রাতবিরেতে একটা সিংহ এসে উৎপাত করছে।

আব্দুল বলল–স্যার ওসব গুজবে কান দেবেন না। এটা কারা যে রটাচ্ছে তা জানি না।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, শুনলুম সন্ধ্যা হতে না হতেই সবাই বাড়ির ভেতর ঢুকে দরজা এঁটে দেয়।

আব্দুল হাসতে হাসতে বলল সেটা ঠিক স্যার। আমি যে মহল্লায় থাকি সেটা সিংহগড়ের শেষ দিকে। ওখানেই নদী আছে। কিন্তু সিংহটা নাকি এই শহরের সদর রাস্তা দিয়ে হাঁকডাক করতে করতে ছুটে যায়। পুলিশ অনেকবার টহল দিয়েছে। শুনেছি। কিন্তু তারা কখনো সিংহের ডাক শুনতে পায়নি। আমার এক ভাতিজা থানার পাশেই চায়ের দোকান করেছে। তার নাম রশিদ। রশিদের কাছেই শুনেছি পুলিশ বলছে এই গুজব ছড়িয়ে কোনও ডাকাতের দল ডাকাতি করতে চায়। তাই পুলিশ মাঝে মাঝে টহল দেয় আর সবাইকে সাবধানে থাকতে বলে।

আমাদের বাঁদিকেও ঢেউখেলানো মাটির উপর ঘর-বাড়ি দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে একটা শালবনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে একাগাড়ি বাঁদিকে পূর্বে ঘুরল।

কর্নেল আমাকে বললেন–আমরা এবার বাঙালিটোলার শেষ প্রান্ত দিয়ে যাব। ট্যুরিস্ট বাংলো নদীর ধারেই।

সেখান থেকে বিজয়বাবুদের দোতলা প্রাসাদটা দেখা যায়।

 বললুম–সত্যই কি প্রাসাদ?

কর্নেল বললেন হ্যাঁ। প্রকাণ্ড সব পিলার এবং সব মিলিয়ে ইটালিয়ান স্থাপত্যের আদল তুমি দেখতে পাবে। ওটা তৈরি করেছিলেন বিজয়বাবুর ঠাকুরদার ঠাকুরদা। তার পদবি ছিল রাজাবাহাদুর।

কথাটা আঙ্গুলের কানে গিয়েছিল। সে বলল–স্যার, ওঁদের অবস্থা আগের মতো নেই। দুই ভাই আর কয়েকজন চাকরবাকর অতবড় বাড়িতে বাস করে। বড় রাজাবাবু বড্ড খেয়ালি মানুষ। একসময় জবরদস্ত শিকারি ছিলেন। এখন শিকার না করলেও বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান।

শালবন পেরিয়ে দুধারে সারবদ্ধ গাছ। আর ঝোপঝাড়ের মধ্যে মাঝে মাঝে কিছু ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়ছিল। কর্নেলকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন–এদিকটাই ছিল প্রাচীন আমলের সিংহগড়, এগুলি তারই ধ্বংসাবশেষ, বলে তিনি কৌতুকে চোখ নাচালেন। জয়ন্ত, হঠাৎ যদি এসব ধ্বংসাবশেষ থেকে সত্যই একটা সিংহ বেরিয়ে তাড়া করে।

–বললুম এ তো আফ্রিকা নয়, গুজরাটের গির অরণ্যও নয়। দিনের বেলায় সিংহ বেরবে না। বলে আমিও রসিকতা করলুম।

আব্দুলের এই ঘোড়াটা খাবার লোভে সিংহ বেরিয়ে পড়তেও পারে। আব্দুল কোচোয়ান হাসির চোটে অস্থির হয়ে বলল–স্যার, আমার কাজ সারাদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি স্টেশনে যাওয়া আর ফিরে আসা। এখন তো ট্যুরিস্টবাবুরা তত বেশি আসছেন না। আসবেন সেই শীতের সময়। সিংহ থাকলে কি আর আমাদের রেহাই দিত?

আরও কিছুটা এগিয়ে সামনে এবং দুধারে ছবির মতো সুন্দর বাড়ি দেখতে পেলাম। একটা টিলার কাঁধের ওপর দিয়ে এই রাস্তার একটা শাখা এগিয়ে গেছে। সেই পথ দিয়ে এগিয়ে ডাইনে ঘুরে দেখলুম এদিকেই একটা দোতলা সুদৃশ্য বাড়ি। গেটের কাছে এক্কা গাড়িটা থামল। তার পর কর্নেল তার ব্যাগটা নামালেন। আমি আমার ব্যাগটা তুলে কাঁধে ঝোলালুম। আব্দুলকে কর্নেল ভাড়া মিটিয়ে দেওয়ার পর সেলাম ঠুকে চলে গেল।

তার পরই দেখলুম বাংলোর গেট খুলে একজন টাই স্যুট পরা ভদ্রলোক এসে করজোড়ে কর্নেলকে নমস্কার করলেন। আমাকেও তিনি নমস্কার করলেন। কর্নেল বললেন–আশা করি আপনি ঠিকসময় খবর পেয়েছিলেন।

ইতিমধ্যে দুজন উর্দিপরা কর্মচারী এসে কর্নেল এবং আমার ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে গেল।

কর্নেল বললেন জয়ন্ত, ইনি এই বাংলোর ম্যানেজার মিস্টার সূর্যকান্ত রায় ইনি কিন্তু বাঙালি। আশা করি তা বুঝতে পেরেছ। মিস্টার রায় এ আমার তরুণ বন্ধু খ্যাতনামা সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরী।

মিস্টার রায় বললেন–আপনার জন্য দোতলায় পূর্ব-দক্ষিণ কোণে একটা ডাবল স্যুইট বুক করে রেখেছি। কর্নেল বললেন–এখনো কি ট্যুরিস্ট মরসুম শুরু হয়নি।

প্রশস্ত সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় ওঠার পর মিস্টার রায় চাপা স্বরে বললেন এখানে বলতে গেলে প্রায় সারা বছরই দেশি-বিদেশি ট্যুরিস্টের ভিড় হয় কিন্তু এবার একটা বাজে গুজবে ভয় পেয়ে কিছু টুরিস্ট চলে গেছেন। জনাতিনেক বিদেশি আছেন। তারা এসেছেন আমেরিকা থেকে। দরজা খোলা ছিল। ভেতরে লাল কার্পেট ঢাকা প্রশস্ত লাউঞ্জ। তার ওপাশে বারও আছে দেখলাম। বারের সামনে উঁচু টুলে বসে দুজন যুবক মদ্যপান করছিল। রিসেপশান কাউন্টারে এক সুন্দরী যুবতী এবং একজন বলিষ্ঠ ধরনের যুবক আমাদের লক্ষ্য করছিল।

রায় বিনীতভাবে বললেন–জাস্ট একটা ফরমালিটি। রেজিস্টারে আপনাদের নাম-ঠিকানা লেখা আছে। শুধু আপনি সাইন করে দিলেই হবে।

সুষমা তুমি আশা করি বুঝতে পেরেছ। ইনিই সেই কর্নেল সাহেব। তোমাকে যাঁর কথা বলেছিলাম। আর প্রদীপ বুঝতে পারছ ইনি কে? যুবকটি নমস্কার করে একটু হাসল মাত্র। সুষমা রেজিস্টার খুলে দিল। কর্নেল সই করে একটু হেসে মৃদু স্বরে বললেন সিংহটা আশা করি এই ট্যুরিস্ট বাংলোয় রাতদুপুরে এসে রুম বুক করতে চায়নি। নাকি এসেছিল সে।

মিস্টার রায়, সুষমা এবং প্রদীপ এক সঙ্গে হেসে উঠেছিল। মিস্টার রায় বললেন প্রদীপ একজন রাইফেল শু্যটার।

সিঁড়িতে কার্পেট বিছানো। সেদিকে এগিয়ে যেতে যেতে লক্ষ্য করলাম, লাউঞ্জে এক বৃদ্ধ দম্পতি এবং অন্য দিকে একজন কাটখোট্টা চেহারার ফো লোক। বসে পাইপ টানছে। সে বারবার কর্নেলকে দেখছিল। দৃষ্টিটা আমার কেন জানি মনে হল কেমন অর্থপূর্ণ কিন্তু এখন তা নিয়ে মাথা ঘামানোর মানে হয় না। উপরে চওড়া বারান্দা। উর্দি পরা লোক দুটি আমাদের সুইটের দরজা খুলে দিয়ে বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা ভিতরে ঢুকলুম। মিস্টার রায় বললেন–রঘু! জানলার পর্দাগুলো সরিয়ে দেয়নি কেন? আর রামলাল। তুমি কর্নেল সাহেবের জন্য কফি আর স্ন্যাক্স নিয়ে এসো। কলকাতা থেকে মিস্টার মুখার্জি আমাকে জানিয়েছেন কর্নেল সাহেব বার বার কফি খান।

ঘরটা মোটামুটি প্রশস্ত। পূর্বে দুটো এবং দক্ষিণে দুটো জানালা দুপাশে দুটো নিচু খাট। একটা সোফা সেটও আছে মাঝামাঝি জায়গায়। সেন্টার টেবিলে ফুলদানিতে সুন্দর রঙবেরঙের ফুল সাজানো। দেয়ালে বিদেশি চিত্রকরদের বিখ্যাত সব ছবির কপি ঝুলছে।

মিস্টার রায় চলে যাওয়ার পর আমি বাথরুমে ঢুকে প্রাকৃতিক কর্ম করে এলাম। দেখলুম বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইনোকুলারে দক্ষিণদিকের কিছু দেখছেন।

বললুম–সিংহ খুঁজছেন নাকি? কর্নেল একটু হেসে বললেন–দুটো টিলার ফাঁক দিয়ে জলপ্রপাতের দিকটা দেখছিলুম। তিন মার্কিন সাহেবকে দেখতে পেলুম।

বলে তিনি পূর্বদিকে গেলেন। আবার বাইনোকুলারে কিছু দেখার পর ফিরে এলেন। বললেন, বাঙালিটোলার রাজপ্রাসাদ তেমনি আছে। আসলে আগের দিনের স্থপতি এবং কর্মীরা নিজেদের কাজে খুব সিনসিয়ার ছিলেন। এখনকার কনট্রাকটরদের মতো ফাঁকি দেওয়ার অভ্যাস তাদের ছিল না। কর্নেলের কাছ থেকে বাইনোকুলারটা নিয়ে প্রাসাদটা দেখব ভাবছিলুম কিন্তু কর্নেল বললেন যথাসময়ে প্রাসাদে আমরা উপস্থিত হব। ভিতরে চলল। পোশাক বদলে নিতে হবে। অবশ্য তার আগে কফিটা আসুক।

কর্নেল পূর্বদিকে খাটটার কাছে গিয়ে বললেন–এটা আমি দখল করলুম। ঘরে একটা ইজি চেয়ারও ছিল। সেটা টেনে সোফার পাশে কর্নেল দুপা ছড়িয়ে বসলেন। ঘরের মেঝে পুরু কার্পেটে ঢাকা। আমি সোফায় বসে বললুম–সিংহের ব্যাপারটা নিয়ে আব্দুল কোচওয়ানের মতো ট্যুরিস্ট লজের লোকেরা হাসাহাসি করলেন। বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা এখনও অনেকেই সত্যি বলে মনে করে না।

এইসময় রামলাল ট্রে-তে কফি পট, দুটো সুদৃশ্য কাপপ্লেট, দুধ এবং চিনির পাত্র আর এক প্লেট পকোড়া রেখে সেলাম দিল। কর্নেল বললেন আচ্ছা রামলাল তোমাদের সিংহগড়ে নাকি সত্যি একটা সিংহ এসে রাত-বিরেতে উৎপাত করছে?

রামলালের মুখ মুহূর্তে গম্ভীর হয়ে গেল। সে চাপাস্বরে বলল হুজুর পরে সব খুলে বলব। শুধু এটুকু বলছি, কথাটা গুজব নয়। বলেই সে চলে গেল। কর্নেল কফি তৈরি করে বললেন রামলালের গল্পটা শোনা দরকার এতক্ষণে এই একটি লোককে পাওয়া গেল যে এই গুজবটা গুরুত্ব দেয়। আমি পকোড়া চিবোতে চিবোতে বললুম–কর্নেল, লবিতে একজন ষণ্ডাগণ্ডা লোক বসে পাইপ টানছিল। আর আপনার দিকে কেমন সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। আপনি কি তা লক্ষ্য করেছেন?

কর্নেল একটু হেসে বললেন–করেছি। লোকটাকে কোথায় যেন দেখেছি এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। তবে এটা ঠিক যে আমি ওকে কোথাও দেখেছি।

বললুম লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছিল ক্রিমিন্যাল টাইপ। আপনার তো সর্বত্র শত্রুর অভাব নেই। কর্নেল একটা পকোড়া তুলে নিয়ে চিবোতে চিবোতে বললেন, এমন হতেই পারে লোকটা আমার শত্রু নয়। কোথাও তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সে এখানে বেড়াতে এসে আমাকে দেখবার আশা করেনি, তাই হয়তো আমাকে স্মরণ করার চেষ্টা করছিল। বললুম, আপনি কোলকাতা থেকে বেরোবার সময় বলেছিলেন–সিংহগড়ে যেন আমরা সব সময় সজাগ থাকি। আপনার ইনটিউশন নাকি বলছে এখানে কোনও সাংঘাতিক ঘটনা ঘটতে পারে। কথাটা আশা করি ভুলে যাননি। কর্নেল বললেন–না ভুলিনি। তবে সারা রাত জেগে ট্রেন জার্নিতে দুজনেই ক্লান্ত। অবশ্য ভোরবেলা পৌঁছলে আমি তোমাকে শুইয়ে রেখে ইন্দ্রধারার কাছে একবার যেতুম। কিন্তু ট্রেনটা বড্ড বেশি লেট করেছে। নটা বাজে। দশটায় ব্রেকফাস্ট করে আমরা বেরুব। তার আগে বিজয়বাবুকে খবর দিতে হবে। এইখানে টেলিফোন আছে দেখতে পাচ্ছ তো। –টেলিফোনটা দেখে বললুম আপনার এতে অনেক সুবিধা হবে।

ব্রেকফাস্টের পর কর্নেল বেরিয়ে পড়লেন। আমাকে তার সঙ্গে যেতেই হল। যদিও ট্রেন জার্নির ক্লান্তি তখনো আমাকে পেয়ে বসেছিল। বাংলোর বাইরে খানিকটা সমতল জমির পর উত্তর এবং দক্ষিণে দুদিকেই সংকীর্ণ পিচের রাস্তা। সমতল জমিতে কয়েকটা সাইকেল রিকশা দাঁড়িয়ে ছিল। কর্নেল একটা রিকশা ডেকে বললেন–রাজবাড়ি যাব। ডানদিকে এগিয়ে কিছুদূর চলার পর একটা প্রশস্ত রাস্তা দেখতে পেলুম। সেই রাস্তায় যানবাহনের কিছু ভিড় ছিল। পূর্বদিকে চলার পর দেখলুম নদীর ওপর একটি ব্রিজ আছে। নদীটা দেখে মনে হচ্ছিল যেন সিংহের মতোই গর্জন করে দক্ষিণ থেকে উত্তরে বয়ে চলেছে। ব্রিজ পেরিয়ে গিয়ে আমরা নিরিবিলি একটা জায়গায় পৌঁছলাম। এবার আমরা উত্তরের দিকে যাচ্ছিলুম। বাঁদিকে গাছপালার আড়ালে নদীটা দেখা যাচ্ছিল। ডানদিকে উঁচু জমির ওপরে মাঝেমাঝে একটা করে পুরনো বাড়ি। কোনও বাড়ির বাউন্ডারি ওয়াল আছে। কোনওটার নেই। কর্নেল বললেন–এটাই সিংহগড়ের বাঙালিটোলা।

বাঙালিটোলায় মানুষজনের চলাফেরা বেশি দেখলুম না। কিছুটা চলার পর ডানদিকে চোখে পড়ল মোরাম বিছানো একটা রাস্তা নেমে এসে পিচরাস্তার সঙ্গে মিশেছে। সেখানে আমাদের নামিয়ে দিল রিকশাওয়ালা। কর্নেল তাকে ভাড়া মিটিয়ে দিলেন, তারপর বললেন–চলো এই মোরাম রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেলে রাজবাড়ি তোমার চোখে পড়বে। সামনে গাছপালার আড়াল বলে বাড়িটা দেখা যাচ্ছে না।

আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম। সেই সময় একজন কর্নেলের বয়সী এবং কর্নেলের মতই তাগড়াই চেহারার এক ভদ্রলোক কাঁধে বন্দুক বা রাইফেল নিয়ে কিছু দেখছিলেন। কর্নেল বলে উঠলেন–হ্যালো মিস্টার সিংহ!

ভদ্রলোক ঘুরে আমাদের দেখতে পেয়েই সহাস্যে বললেন–আসুন আসুন কর্নেল সাহেব। আমি অবশ্য রাইফেল হাতে সিংহ মারতে বেরোই নি। একটা পাগলা হনুমান বড্ড উৎপাত জুড়েছে। যাই হোক, আপনারা আসুন। অজয় তার মেয়েকে নিয়ে এসেছে সিংহ দেখাতে। বলে তিনি হাসি চাপলেন।

দেখলুম বাড়ির প্রকাণ্ড গেট পেরিয়ে জিনস আর হাতকাটা টপ পরে এক যুবতী বেরিয়ে আসছে।

.

০৪.

কথাটা বলেই বিজয়নারায়ণ জিভ কাটলেন। সহাস্যে বললেন–এই সুজাতা, আমার কথাটা শুনে ফেলিসনি তো।

সুজাতা চাপা হেসে বলল-জেঠু আমি সিংহ মারা দেখতে বেরোই নি।

তোমার হাতে রাইফেল দেখেই বুঝতে পেরেছিলুম তুমি সেই হনুমান বেচারাকে বধ না করে ছাড়বে না।

বিজয়বাবু বললেন–তোর সৌভাগ্য সুজাতা এই ভদ্রলোককে কখনও দেখেছিস?

সুজাতা কর্নেলের দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে বলল-হা চিনে ফেলেছি। ইনি স্বনামধন্য কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। আর ওই ভদ্রলোক তার সাংবাদিক বন্ধু জয়ন্ত চৌধুরী।

বিজয়বাবু মুখে বিস্ময় ফুটিয়ে বললেন–আশ্চর্য, তুই তো কখনো এঁদের দেখিস নি।

সুজাতা বলল–সব কি চোখে দেখে জানতে হয়।

বিজয় নারায়ণ বললেন–কলকাতা তোকে খুব স্মার্ট করেছে। যাইহোক, কর্নেল সাহেবরা এখন আমার অতিথি। আসুন কর্নেল সাহেব। ভেতরে গিয়ে বসা যাক! আর সুজাতা, তুই এখানে একা দাঁড়িয়ে থাকিস নে। সত্যি একটা পাগলা হনুমান কদিন থেকে এই এলাকায় উৎপাত করে বেড়াচ্ছে। বাইরে থাকিস নে। সুজাতা জেদ করে দাঁড়িয়ে থাকতে চাইছিল। কিন্তু বিজয়নারায়ণ তার কান ধরে আমাদের অনুসরণ করতে বাধ্য করলেন। সুজাতা কপট রাগ দেখিয়ে বলল–জেই আমি কিন্তু আর ছোট হয়ে নেই।

বিজয় নারায়ণ বললেন–বলবি রীতিমতো লেডি হয়ে উঠেছি, কিন্তু তুই আমার কাছে এখনো সেই ছোট্ট বালিকা হয়েই আছিস। বলে সস্নেহে তিনি তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন–তোর বাবা কি বেরিয়েছে?

সুজাতা বলল–অনেকক্ষণ আগে সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছে।

দেখলুম বিশাল গেটে দারোয়ান আছে। কিন্তু গেটের একটা পাশ খোলা। সেখান দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখলুম ডাইনে বাঁয়ে দুদিকেই মরসুমি ফুলের বাগান। উঁচু পাঁচিলের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে দেবদারু আর আম গাছের সারি। প্রশস্ত লনে নুড়ি বেছানো আছে। কর্নেল ঠিকই বলেছিলেন, ওপরতলায় এবং নিচের তলায় প্রকাণ্ড সব থাম। গথিক ভাস্কর্যের কথাই মনে করিয়ে দেন। আর দোতলার মাঝামাঝি শীর্ষদেশে ত্রিকোণ অংশটা ইটালিয়ান ভাস্কর্যের প্রতীক। এত বড় বাড়িতে এঁরা দুই ভাই থাকেন। তাছাড়া বাঁদিকের বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে কয়েকটা একতলা ঘর আছে। ওখানে সম্ভবত দারোয়ান আর মালির পরিবার বাস করে। ঠাকুরবাড়িটা কোন দিকে বোঝা গেল না। হয়তো এই প্রাসাদের পেছনদিকে অর্থাৎ উত্তরে সেটা আছে। এক পলকের জন্য দোতলায় থামের পাশে এক প্রৌঢ়া মহিলাকে দেখতে পেলুম। সম্ভবত উনিই সুজাতার মা। আমরা পোটিকোর তলা দিয়ে একটা হলঘরে ঢুকলাম। এই ধরনের ঘর সব অভিজাত বনেদি পরিবারই দেখেছি।

সুজাতা বিবর্ণ কার্পেট পাতা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে হন হন করে ওপরে উঠে গেল। বিজয়নারায়ণ বললেন ওপরে চলুন। আমার ড্রয়িংরুমেই বসা যাক। দোতলায় উঠে প্রশস্ত মার্বেল টালি বসানো বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে শেষপ্রান্তে একটা ঘরের তালা খুললেন বিজয়নারায়ণ। এদিকটা পূর্বদিক। বিশাল ঘর সেকেলে এবং একেলে আসবাবে ভর্তি। আলমারিতে প্রচুর বই আছে। দেয়ালে স্টাফ করা হরিণের মাথা এবং একপাশে মেঝের উপর বেদিতে স্টাফকরা চিতাবাঘও দেখতে পেলুম। বিজয়বাবু জানাল খুলে পর্দা সরিয়ে দিলেন তারপর আমাদের বসতে বললেন। আমরা সোফায় বসলুম। তারপর বিজয়বাবু কর্নেলের মুখোমুখি বসে। বললেন–একটা ব্যাপার আমাকে অবাক করেছে, আপনি যখন ট্যুরিস্ট বাংলো থেকে ফোন করলেন তখনই একটু চমকে গিয়েছিলাম আমার এখানে থাকলে কি আপনার কোন অসুবিধা হত।

কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে একটু হেসে বললেন তা হত কারণ প্রথমে আপনি আমাকে দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির প্রজাপতির খবর দিয়েছিলেন। আপনার বর্ণনার সঙ্গে আমি দেশ-বিদেশের প্রজাপতির মিল খোঁজার চেষ্টা করছিলাম। তাই এখানে আমার দেরি হচ্ছিল। এমন সময় অজয়বাবু গিয়ে হাজির।

সিংহের গর্জন সিংহগড়ে।

 বিজয়নারায়ণ হেসে উঠলেন। আমি এখনো গর্জন শুনি নি। গুজব শুনেছি। তবে আমার ইন্টারেস্ট অন্য একটা ব্যাপারে।

কর্নেল আস্তে বললেন–ব্রোঞ্জ চাকতির ব্যাপারে

হ্যাঁ ওটা ঠাকুরবাড়ির দিকে পুকুরপাড়ে কুড়িয়ে পেয়েছিল অজয়। সে আমাকে ওটা দেখিয়েছিল। আমি লোশন দিয়ে কিছুটা পরিষ্কার করেছিলাম। কিন্তু পরীক্ষা করার পর মনে হয়েছিল।

কর্নেল সকৌতুকে তার কথার উপরে বললেন–গুপ্তধনের কথা?

বিজয়নারায়ণ বাঁকা মুখে হাসলেন। ওগুলো অজয় বিশ্বাস করে। আর আমি বিশ্বাস করি একটা ঐতিহাসিক তথ্যে। সিংহগড় সংক্রান্ত একটা পুরনো বই আছে। লেখক জনৈক টিম আর্টিংটন। তাতে পড়েছি, আমাদের গৃহদেবতা চণ্ডীর যে মূর্তিটা উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা পেয়েছি ওটা নাকি হারিয়ে যাওয়া একটা মূল্যবান ধাতুর তৈরি দেবী চণ্ডীর নেহাত নকল। আপনি নিশ্চয় ব্রোঞ্জের চাকতিতে একটা অস্পষ্ট মূর্তি এবং কিছু তথ্য খোদাই করা আছে তা দেখে থাকবেন।

কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর থেকে সেই চাকতিটা বের করতে যাচ্ছিলেন। বিজয়নারায়ণ চাপা স্বরে বললেন–ওটা এখন নয়। আপনি এসেছেন তা সুজাতার মা দেখেছে। কাজেই এখনই যে কোন মুহূর্তে কফি এসে যেতে পারে।

তার কথা শেষ হবার পরেই একজন পরিচারিকা ট্রে হাতে ঘরে ঢুকল। আর তার পেছনে সেই মহিলা। তার মাথায় মাথা ঢাকা ঘোমটা। মহিলা যৌবনে সুন্দরী ছিলেন তা বোঝা যাচ্ছিল। ভাসুরের ঘরে তিনি যেভাবে সঙ্কোচে ঢুকলেন আমার মনে হল ইনি মেয়ের মতো স্মার্ট তো নন বরং হাবে ভাবে কিছুটা গ্রাম্য যেন।

কর্নেল তাকে বললেন, এই যে বউঠাকুরণ, এই বৃদ্ধকে যে আজ চিনতে পেরেছেন, এ আমার সৌভাগ্য।

বিজয়বাবু বললেন, রমলা কি সত্যই চিনতে পেরেছে নাকি মেয়ের মুখে। শুনেছে।

রমলা সঙ্কোচে একটু হেসে বললেন কর্নেল সাহেবকে আমি দোতলা থেকে রিকশায় আসতে দেখেছি। ভেবেছিলাম এখানে উঠবেন কিন্তু সঙ্গে কোনো জিনিসপত্র নেই।

কর্নেল বললেন–আমি এসেছি বিজয়বাবুর মতো প্রজাপতির পেছনে ছোটাছুটি করতে। আপনাদের এখানে উঠলে অনেক নিয়ম-কানুন মেনে নিতে হত।

 এই সময় সুজাতা এসে বলল, জেঠু শিগগির রাইফেল নিয়ে এসো। সেই হনুমানটা ঠাকুরবাড়ির ওদিকে একটা গাছে বসে কাকে ধমকাচ্ছে।

বিজয়বাবু বললেন, শ্রীরামচন্দ্রের চেলা। নিশ্চয় তোকে দেখতে পেয়ে সে আরও রেগে গেছে।

বিজয়বাবু নড়ছেন না দেখে সে তার মাকে টানতে টানতে বলল সত্যি বলছি মা তুমি জানালা দিয়ে দেখবে এসো। মধু পুকুরপাড়ে গিয়েছিল সে হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

রমলা বলে উঠলেন–কী সর্বনাশ, ও তো এবার আমাদের সবজি খেতে হামলা করবে।

ও মেয়ে চলে যাবার পর বিজয়বাবু বললেন পুকুরপাড়ে বেগুন ইত্যাদি কিছু কিছু তরিতরকারি ছিল। পাগলা হনুমানটা কবে তা শেষ করে দিয়ে গেছে। ওটাকে গুলি করে মারার হুকুম দিয়েছে বনদপ্তর। কিন্তু বিশেষ করে অবাঙালিদের যা সংস্কার ওরা ওই জন্তুটার হাতে প্রাণ হারাচ্ছে তবুও তার কিছু ক্ষতি করতে চায় না।

জিজ্ঞাসা করলুম প্রাণ হারাচ্ছে মানে? বিজয়বাবু বললেন–কিছু লোককে আঁচড়ে-কামড়ে দিয়েছিল। ঘা বিষিয়ে তারা মারা পড়েছে। এছাড়া আরও অনেককে আঁচড়ে দিয়েছে। তারা সব হাসপাতালে ভর্তি আছে।

বললুম–তাহলে এখনই আপনার দেখে আসা উচিত ওটা সেই পাগলাটা কি না। পাগলা হলে তাকে দোতলা থেকেই গুলি করে মারতে পারবেন।

বিজয়বাবু হাসতে হাসতে বললেন–এখন আর হনুমান বধের ইচ্ছে নেই। কর্নেলকে দেখে গুজবের সিংহটাকে গুলি করে মারার তীব্র ইচ্ছা জেগেছে।

কর্নেল চুপচাপ কফি খাচ্ছিলেন। একটু পরে বললেন সত্যিকার সিংহ ছোটনাগপুরে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। কাজেই সিংহটা মিথ্যে। এই মিথ্যে সিংহ এবং তার মিথ্যে গর্জনের পিছনে কি কোনও কারণ আছে। বিজয়বাবু নিশ্চয় রাঘবেন্দ্র রায়চৌধুরীর কথা তো আপনার মনে আছে।

বিজয়বাবু গম্ভীর মুখে বললেন, হ্যাঁ, এখানে অনেক কীর্তি করে বাড়ি বেচে দিয়ে তাকে পালাতে হয়েছে।

কর্নেল একটু হেসে বললেন–কীর্তিমান কুকীর্তি। যাই হোক, তার সঙ্গে ঘটনা চক্রে কিছুদিন আগে আমাদের দেখা হয়েছিল। তিনি এখন নাকি কলকাতাবাসী। তার কাছে শুনলুম আপনার এক খুড়তুতো ভাই সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। তিনি নাকি ঠাকুরবাড়ির ওখানেই একটা ঘরে বাস করতেন। পরে তাঁর মৃতদেহ জলপ্রপাতের ওপর দিকে জঙ্গলের মধ্যে পাওয়া যায়। সেই মৃতদেহ দেখে এখানকার লোকেরা নাকি বলেছিল সিংহের আক্রমণেই তিনি মারা গেছেন। তার মানে এর আগেও একবার সিংহের গুজব এখানে ছড়িয়েছিল।

বিজয়বাবু নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে কর্নেলের কথা শুনছিলেন। চাপা শ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন, যাঃ, এই ঘটনাটা আপনাকে বলা হয়নি। আসলে বলার প্রয়োজন মনে করিনি। কারণ, আপনি সেবার এসেছিলেন দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির অর্কিডের খোঁজে। তাছাড়া তখন ইন্দ্রধারার প্রস্রবণের ওপর রামধনু দেখা যেত না।

কর্নেল বললেন–তাহলে বোঝা যাচ্ছে ঘটনাটা সত্যি।

এবার বিজয়বাবু মুখ নামিয়ে চাপা স্বরে বললেন–অভয়ানন্দ ছিল ব্রহ্মচারী সন্ন্যাসী ছদ্মবেশে এক লম্পট। আর রাঘবেন্দ্র রায়চৌধুরীও তেমনি এক লম্পট। তখন আমার এতটুকু প্রবৃত্তি হয়নি যে এর পেছনের কেলেঙ্কারি পুলিশের কাছে ফাঁস করে রাঘবেন্দ্রকে শাস্তি দি। তাই রাঘবেন্দ্রর নাকে আঁচড়টি লাগেনি। কিন্তু যে মহিলাকে নিয়ে এই কেলেঙ্কারি তার প্রভাব ছিল প্রচন্ড। তার এক মামা ছিলেন এম পি। কাজেই রাঘবেন্দ্র অভয়ানন্দর শোচনীয় হত্যাকান্ডের পরও কয়েক বছর এখানে থাকতে পেরেছিল। তারপর আমার দিক থেকে কোনও ক্ষতির আশঙ্কা করে সে রাতারাতি পালিয়ে যায় বলতে পারেন।

কর্নেল কফি শেষ করে চুরুট ধরালেন তারপর একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, এখানকার সিংহের গুজবের পর অর্থাৎ মিথ্যা সিংহ এবং মিথ্যা গর্জনের পর আপনি কি তেমন কোনও হত্যাকান্ডের আশঙ্কা করছেন। বিজয়বাবু গলার ভিতরে বললেন ঠিক ধরেছেন। কর্নেল একটু হেসে বললেন আশাকরি এই সব ঘটনার সঙ্গে ব্রোঞ্জের চাকতিটার কোনও যোগসূত্র নেই।

বিজয়বাবু বললেন বুঝতে পারছি না, তবে আপনার জানা দরকার ঠিক এই রকম ব্রোঞ্জের চাকতি আমার খুড়তুতো ভাইয়ের বিছানার তলায় আমি খুঁজে পেয়েছিলুম। আসলে আমি চেয়েছিলুম একটা ফোটো খুঁজতে। কিন্তু সেটা-..

তার কথার উপরে কর্নেল বললেন আগেই সেটা একজন চুরি করেছিল। বিজয়বাবু চমকে উঠে বললেন–আপনি জানেন!

কর্নেল বললেন–জানি।

বিজয়বাবু বিস্ময়ে চমকে উঠলেন। কিন্তু কিছু বললেন না।

.

০৫.

ঘরের আবহাওয়া একটু গুমোট হয়ে উঠেছিল। আমি সেটা হালকা করার জন্য হাসতে হাসতে বললুম–কর্নেল বলছিলেন মিথ্যা সিংহের মিথ্যা গর্জন। কিন্তু এর সঙ্গে কোনও মহিলার ছবি কিংবা এক ব্রোঞ্জের চাকতির কী সম্পর্ক। আমার মনে হচ্ছে কর্নেল একটা প্রকাণ্ড মিথ্যার পিছনে ছুটে এসেছেন।

আমার কথায় বিজয়বাবুর মুখে একটু হাসি ফুটল। তিনি বললেন– আপনি সাংবাদিক, ব্যাপারটা ঠিকই ধরেছেন।

 কর্নেল বললেন–তাহলে জলপ্রপাতের জঙ্গলের প্রকাণ্ড ডানাওয়ালা প্রজাপতির গল্প মিথ্যা।

এই নিয়ে কিছুক্ষণ হাস্য পরিহাসের ফলে গুমোট আবহাওয়াটা কেটে গেল। তার পর হন্তদন্ত হয়ে সুজাতা ঘরে ঢুকল। সে বলল জেঠু-শিগগির এসো। পাগলা হনুমানটা মন্দিরের চূড়ায় বসে দাঁত খিচোচ্ছে।

বিজয়বাবু বললেন–তাহলে তো আমায় সমস্যায় ফেলল হনুমানটা। মন্দিরে যে আশ্রয় নিয়েছে তাকে গুলি করব। এতে অধর্ম হবে যে। সুজাতা খাপ্পা হয়ে বলল, কোনও মানে হয়। বাবার বন্দুকটা যে আলমারির ভেতর রেখে গেছে, তা না হলে আমি নিজেই ওটাকে মেরে ফেলতুম। মা বলছিল পুরো সবজির বাগান হনুমানটা খেয়ে শেষ করে ফেলেছে। আহ। এসো না জেঠু, তোমাকে মেরে ফেলতে বলছি না। অন্তত ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দাও ওটাকে।

অগত্যা বিজয়বাবু রাইফেল হাতে উঠে দাঁড়ালেন–চলুন কর্নেল সাহেব, পাগলাটাকে নিয়ে একটু মজা করা যাক।

বারান্দায় বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একেবারে উত্তরপ্রান্তে একটা ঘরে পৌঁছলুম। এই ঘরে কিছু ভাঙাচোরা আসবাব আর পুরনো লোহালক্কড় পড়ে আছে। ওদিকের দরজা খোলা। ওদিকটায় ব্যালকনি আছে। সেখানে দাঁড়িয়ে রমলা দেবী হনুমানটাকে অনুনয়-বিনয় করছিলেন। তিনি আমাদের দেখে চলে এলেন। ব্যালকনিতে প্রথমে রাইফেল হাতে বিজয়বাবু। তার পেছনে কর্নেল, তার পর আমি এবং সুজাতা পেছনে গিয়ে দাঁড়ালুম। বাউন্ডারি ওয়ালের একখানে একটা দরজা যেটা বন্ধ আছে। তার ওধারে গাছপালার ফাঁকে মন্দিরের চূড়া দেখা যাচ্ছিল। হনুমানটা চুড়ার সোনালি রঙের কলম এবং ত্রিশূল আঁকড়ে ক্রমাগত গর্জন করছিল। বিজয়বাবু রাইফেলের নল তাগ করে জোরগলায় বললেন–ওহে পবনপুত্র, তোমার কি সাহস যে দেবতার মাথায় চেপে রয়েছ। মন্দিরের ভেতরে কিন্তু রামচন্দ্র নেই, আছেন দেবী চণ্ডী।

হনুমানটা তার দিকে তাকিয়ে বার কয়েক ঘ্যাঁক ঘ্যাঁক গর্জন করল। তার পর সম্ভবত রাইফেলের নল দেখে বিপদ আঁচ করে একলাফে পাশের একটা একচালা ঘরের ছাদে লাফিয়ে পড়ল।

এর পরের ঘটনাটা আমার কাছে খুব নির্মম বোধ হল। বিজয়বাবু রাইফেল তাক করে সেফটিক্যাচ তুলে যে সত্যি ট্রিগার টানবেন আমি ভাবিনি, গুলি খেয়ে হনুমানটা ছিটকে ওধারে কোথায়ও পড়ে গেল তার পর আর কোনও সাড়া পেলুম না।

সুজাতা চোখ বড় করে বলল–জ্যেঠু তুমি সত্যই ওটাকে গুলি করে মেরে ফেললে!

বিজয়বাবু বললেন–কেন, তুই যে বললি ওটাকে মেরে ফেলতে।

সুজাতা ভয়ে চুপ করে গেল, তার মুখে একটা আতঙ্কের ছাপ লক্ষ্য করলুম। রমলা দেবীও বললেন–ওকে কি সত্যিই মেরে ফেললেন বড়দা?

বিজয় নারায়ণ তার কথার জবাব না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তার পর বারান্দা ধরে হন্তদন্ত এগিয়ে গেলেন। কর্নেল, আমি এবং সুজাতা তাঁকে অনুসরণ করলুম। নীচের তলায় নেমে একটা দরজা খুলে বাড়ির পেছনদিকে গেলেন তিনি। এদিকটায় ক্যাকটাস আর নানা আকারের ঝাউয়ের বাগিচা। পেছনে খোলামেলা একটা টানা বারান্দা আছে। মাঝামাঝি গিয়ে কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে নামলে নীচে নুড়ি বেছানোলন তার থেকে বাহির বাড়িটার দরজা। দরজাটা সাবধানে খুলে বিজয়বাবু বললেন এক মিনিট, আমি আগে দেখে নিই হনুমানটার সত্যিই গুলি লেগেছে নাকি ভয় পেয়ে নীচে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছে।

মন্দির প্রাঙ্গণ টালি বাঁধানো কিন্তু স্থানে স্থানে টালি ফেটে গেছে কোথাও বা দু-একটুকরো নেই। সেখানে ঘাস গজিয়েছে। কর্নেল বিজয়বাবু এ কথার তোয়াক্কা না করে ভিতরে গেলেন। আমি একটু ইতস্তত করে প্যান্টের পকেটে হাত ভরে আমার রিভলবারটা ধরে রাখলাম তার পর মন্দিরের পাশ দিয়ে কয়েকপা এগিয়ে গেছি। বিজয়বাবুর ডাক শোনা গেল। সুজাতা দেখবি আয় তোর মায়ের সবজি খেত ধ্বংসের শোধ নিয়েছি।

সুজাতা আমার পাশ কাটিয়ে দৌড়িয়ে এগিয়ে গেল। সামনে আর একটা দরজা। কর্নেল ইতিমধ্যে সেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেছেন।

আমি লক্ষ্য করলুম যে ডাইনে একতলা ঘর। ঘরের সামনে নিচু একফালি বারান্দা আছে। বুঝতে পারলুম এই ঘরেই বিজয়বাবুর খুড়তুতো ভাই ব্রহ্মচারী অভয়ানন্দ বাস করতেন। কিন্তু এখন হনুমানটার অবস্থা দেখতে তীব্র ইচ্ছা ছিল। বেরিয়ে গিয়ে প্রথমেই চোখে পড়ল একটা মাঝারি ধরনের চৌকো পুকুর। তা চার পাশে যে সবজি খেত ছিল তার অবস্থা শোচনীয়। সব মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। পুকুরের স্বচ্ছ কালো জলে অজস্র পদ্ম ফুটে আছে। চারিদিকে কাঠ পুঁতে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়েছে। হনুমানটা রক্তাক্ত দেহে ডানদিকের বেড়ার কাছে পড়ে আছে। বেশ তাগড়াই চেহারার হনুমান। কর্নেল বললেন, সত্যি এটা সেই পাগলা হনুমান তো, যেটাকে বনদপ্তর মেরে ফেলতে কুম জারি করেছেন। বিজয়বাবু রাইফেল নল দিয়ে উল্টে পাল্টে মৃত জন্তুটাকে দেখে বললেন, হ্যাঁ, এটাই সেটা, কারণ একজন একে লক্ষ্য করে তির ছুঁড়েছিল। ওই দেখুন তিরের ডগাটা ভাঙা কিন্তু তিরটা পায়ের কাছে বিধে আছে। কর্নেল বাইনোকুলারে কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে এদিক-ওদিক দেখছিলেন। অর পর দেখলুম তিনি পুকুরের ডান পাড় দিয়ে সোজা উত্তরে এগিয়ে যাচ্ছেন।

সুজাতা হনুমানের রক্ত দেখেই দুহাতে চোখ ঢেকেছিল সে চুপচাপ চলে গেল। আমার মনে হচ্ছিল এই পুকুরভরা পদ্মফুলের পাশে তাকে দাঁড় করিয়ে একটা ফটো তুললে দারুণ হতো। আমার কাছে ক্যামেরা নেই কিন্তু কর্নেলের কাছে। আছে। এদিকে দরজা দিয়ে, রমলাদেবী একবার উঁকি মেরে দৃশ্যটা দেখেই ভিতরে অদৃশ্য হয়েছিলেন। তার পর বাড়ির কাছের লোকেরা এসে ভিড় জমাল, বিজয়বাবু। বললেন, তোরা এখানে থাক। আমি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বাবুদের টেলিফোনে। খবর দিয়ে আসি।

আমি কর্নেলের দিকে এগিয়ে গেলুম। কর্নেল পুকুরের উত্তর পারে কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাইনোকুলারে কিছু দেখছিলেন। কাছে গিয়ে বললুম–সেই মিথ্যা সিংহটা সত্যি দেখতে পাচ্ছেন নাকি।

কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। একটু হেসে বললেন–হনুমান বধ দেখে তোমার মনে কি কোনও কষ্ট হচ্ছে।

বললুম, একেবারে হচ্ছে না বললে মিথ্যা বলা হবে। হনুমানটার পায়ের ওপর দিকে একটা তির বিধে আছে। আমার ধারণা এলাকার কোনও আদিবাসী জন্তুটাকে মেরে খেতে চেয়েছিল। আদিবাসীদের কোনও কোনও গোষ্ঠী হনুমান বা বাঁদরের মাংস খায়।

কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুটটা লাইটার দিয়ে ধরিয়ে বললেন–ঠিক বলেছ, সাংঘাতিক ক্ষুধার্ত বাঘ যেমন মানুষখেকো হয়ে ওঠে। তেমনি তিরবিদ্ধ হওয়ার পর হনুমানটা মানুষের ওপর খেপে গিয়েছিল। আর পাগলা হনুমানের মুখের লালায় সাংঘাতিক বিষ দেখা যায়। তবে এনিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই।

জিজ্ঞাসা করলুম-কিন্তু আপনি যেন কিছু নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন, তাই না? কর্নেল বললেন, এই রাজবাড়ির পিছনের দিকটা খুঁটিয়ে দেখছিলুম। কোথাও কোথাও পোড় এবং পাথুরে মাটি ও বড় বড় পাথর পড়ে আছে। আর ওদিকে পাহাড়। তুমি খালি চোখেই দেখতে পাবে ছোটনাগপুরের একটা মাউন্টেন রেঞ্জ সিংহগড়ের পাশ ঘেঁসে গেছে তবে একটা জিনিস আমাকে অবাক করল।

জিজ্ঞাসা করলুম–কী সেটা?

কর্নেল চাপাস্বরে বললেন–রাঘবেন্দ্র রায়চৌধুরী যে মহিলার ছবি দিয়েছেন সে যদি উপরের পশ্চিম দিয়ে ঘুরে উত্তর এবং দক্ষিণের পড়ে থাকা বড় বড় পাথরের আড়ালে এগিয়ে রাজবাড়িতে কারও সঙ্গে দেখা করতে চায় তা হলে অসুবিধা নেই। ওই একতলা ঘরে থাকতেন বিজয়বাবুর খুড়তুতো ভাই। লক্ষ্য করা, ঘরের পেছনের দেওয়ালে একসময় দরজা ছিল সেটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কাঁচটা খুলে নেওয়া হয়েছে কিন্তু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে পুরনো.আর নতুন পলেস্তারার মধ্যে তফাত আছে। হাসতে হাসতে বললুম–আপনি তাহলে সেই মহিলার অভিসারের পথও আবিষ্কার করে ফেলেছেন।

কর্নেল হঠাৎ বললেন–এসব কথা থাক। চলো, আমরা ভিতরে যাই। বাড়ির কাজের লোকেরা তখনও মৃত হনুমানটাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পুরুষেরা বারবার হাত জোড় করে কপালে ঠেকাচ্ছে। আর মেয়েরা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। মন্দিরের কাছে পৌঁছতেই বিজয়বাবুকে দেখতে পেলুম। তিনি বললেন–এক মিনিট। ফরেস্ট ডিপার্টের রেঞ্জারকে খবর দিয়ে এলুম, ওরা এসে বডি নিয়ে যাবে।

বলে তিনি দরজার কাছে গেলেন তার পর বললেন–লালু, ফরেস্টের সাহেবরা লাস নিয়ে যেতে আসছেন, তুই সব ব্যবস্থা করবি, আমরা ওপরে যাচ্ছি। কর্নেল তার সঙ্গে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, এবেলা আমি ইন্দ্রধারা জলপ্রপাতের এদিকটা ঘুরে আসতে চাই। অসুবিধা না হলে আপনি আমাদের সাথী হতে পারেন।

আমি মনে করিয়ে দিলুম-আপনিই নাকি কর্নেলকে বিশাল আকারের প্রজাপতির খোঁজ দিয়েছেন। কাজেই আপনি সঙ্গী হলে ভাল লাগবে।

বিজয়নারায়ণ চাপা স্বরে বললেন–আমার সব কথা শেষ হয়নি। তা ছাড়া আপনাকে আমার খুঁজে পাওয়া ব্রোঞ্জের চাকতিটা দেখানো হয়নি।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, আপনি যখন বলছেন তখন এবেলা জলপ্রপাতের ওধারে যাচ্ছি না।

বিজয়বাবু বললেন, চলুন দোতলায় আমার ঘরেই গিয়ে বসবেন আরও এক রাউন্ড কফি খাওয়া যাবে।

এর পর আমরা আগে যে ঘরে বসেছিলুম, সেই ঘরে গেলুম। কিছুক্ষণ পরে সেই কাজের মেয়েটি ঘোমটা টেনে কফির ট্রেতে কফি রেখে গেল। কফি খেতে খেতে বিজয়বাবু বললেন যে-আপনাকে এবার রাঘবেন্দ্রর কীর্তিটা বলি। সে প্রতিমা রায়ের প্রেমে পড়েছিল। কিন্তু প্রতিমা তাকে পাত্তা দিত না। আপনি জানেন কি না জানি না, প্রতিমা ছিল বালবিধবা। তার বাবা ছিলেন এখানকার রাজ হাইস্কুলের শিক্ষক। প্রতিমার মা তার বাল্যেই মারা যান। প্রতিমার বাবা জগদীশবাবু মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন তার এক ছাত্রর সঙ্গে। ছাত্রটি কি একটা অসুখে মারা যায়। এর পর প্রতিমার বাবার মৃত্যু হলে তার মামা সত্যেন্দ্র রায় তাকে নিজের বাড়িতে রাখেন। তিনি ছিলেন একজন এম.পি.। কাজেই বুঝতে পারছেন প্রতিমার দিকে হাত বাড়ানো কারও পক্ষে সহজসাধ্য ছিল না।

কর্নেল বললেন, এবার কথাটা খুলে বলতেই হয়, আপনার খুড়তুতো ভাইয়ের সঙ্গে প্রতিমার একটা গোপন সম্পর্ক ছিল এবং আপনি জানেন কি না জানি না। প্রতিমা আপনার ভাইয়ের ঘরে যাতায়াত করত।

বিজয়বাবু মুখ নামিয়ে বললেন–জানি। আমার রাইফেলের পাল্লা থেকে প্রতিমা একবার ছিটকে পড়ে নিজেকে বাঁচাতে পেরেছিল। তার পর অভয়ানন্দের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ জলপ্রপাতের উপরের জঙ্গলে পাওয়া যায়।

কর্নেল ঠোঁটের কোণে হেসে মৃদুস্বরে বললেন–তার বিছানার তলা থেকে একটা ফোটোগ্রাফ উদ্ধার করেছিলেন রাঘবেন্দ্র।

বিজয়বাবু বললেন ছবিটা আপনি দেখেছেন?

 কর্নেল বললেন–হ্যাঁ দেখেছি।

বিজয়বাবু বললেন–আমি জানতুম অভয়ানন্দের কাছে প্রতিমার একটা ছবি আছে। কিন্তু জানতুম না সেটা কখন রাঘবেন্দ্র চুপি চুপি এসে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। এই ঘটনার পর অভয়ানন্দের ঘরের পেছন দিকের দরজার কপাট খুলে। নিয়ে ইট দিয়ে গেঁথে বন্ধ করে দিয়েছিল। কর্নেল বললেন–সেবার যে মিথ্যা। সিংহ গর্জন করে বেড়াত সেই সিংহই কি রাঘবেন্দ্র রায়চৌধুরী। বিজয়বাবু হাসলেন। তার পর বাঁকা মুখে বললেন ওর পক্ষে অসাধ্য কিছু ছিল না। এমন হতেই পারে সে কাউকে নকল সিংহের চামড়া পড়িয়ে সিংহ সাজিয়ে গুজব সৃষ্টি করেছিল। আর গর্জনের কথাটা যদি বলেন তারও একটা ব্যাখ্যা আছে। সিংহগড়ের বাজারে টেপ রেকর্ডার যন্ত্র এসেছিল পনেরো-কুড়ি বছর আগে। খোঁজ নিয়ে জানতে পেরছিলুম জন্তু-জানোয়ারের ডাকের টেপরেকর্ডার আমদানি করা যায়।

আমি বলে উঠলুম-সেই রকম কিছু নয়তো?

বিজয়বাবু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। তার পর বললেন, তা হতেও পারে তবে রাঘবেন্দ্র চৌধুরীর যে ভূমিকা এখন কে আছে সেটা খুঁজে বের করার জন্যই কর্নেল সাহেবকে অনুরোধ করছি। সত্যি বলতে কী ওঁকে ডাকার উদ্দেশ্যও তাই।

.

০৬.

 রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে নীচের পিচরাস্তায় পৌঁছে কর্নেল বলেছিলেন- এবেলা জলপ্রপাতের ওদিকে যাচ্ছি না। কারণ ওখানে পায়ে হেঁটে যেতে হলে অনেকটা সময় লাগবে। বিজয়বাবুর অবশ্য গাড়ি আছে কিন্তু আমি গাড়ি চেপে ওখানে যেতে চাই নি।

হাইওয়ের দিক থেকে একটা খালি রিকশা আসছিল, কর্নেল সেটা দাঁড় করিয়ে চেপে বসলেন। তার পর বললেন–বাজারের দিকে যাব।

রিকশাওয়ালা আমাদের টুরিস্ট ভেবে দর হেঁকেছিল পঞ্চাশ টাকা। শেষ পর্যন্ত পঁচিশ টাকায় রফা হয়েছিল। রিকশায় উঠে কর্নেল বললেন–পায়ে হেঁটে যাওয়া যেত কিন্তু তোমার ক্লান্তির কথা ভেবে রিকশায় চাপলুম। এর পর রাস্তা কখনও চড়াই কখনও উতরাই হয়ে বাজার এলাকায় পৌঁছল। প্রচণ্ড ভিড়ে আমাদের রিকশা আটকে গিয়েছিল। কর্নেল বললেন, এখানেই নেমে পড়া যাক।

রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে ভিড় ঠেলে তিনি এগিয়ে চললেন। আমি তাকে অনুসরণ করলুম। তার পর অপেক্ষাকৃত কঁকা জায়গায় পৌঁছে কর্নেলকে জিজ্ঞাসা করলুম–এদিকে কোথায় যাবেন।

কর্নেল বললেন–কষ্ট করে এবার তোমাকে হাঁটতেই হবে।

বললুম–হঠাৎ আমার কষ্টের দিকে আপনার দৃষ্টিপাত কেন?

কর্নেল বললেন–কষ্টটা শুধু তোমার নয়। আমারও। কারণ অক্টোবরের এই চড়া রোদ আমার সহ্য হয় না।

–কিন্তু যাবেন কোথায়?

চুপ-চাপ আমাকে ফলো করো। যথাসময়ে জানতে পারবে।

 বাজার এলাকা ছাড়িয়ে গিয়ে বাঁদিকে একটা সংকীর্ণ রাস্তায় এগিয়ে চললেন কর্নেল। কিছুক্ষণ পরেই দেখলুম রাস্তাটা উঁচু হয়ে উঠে গেছে এবং দুধারে আধুনিক গড়নের বাড়ি এবং ফুলবাগিচা। কর্নেল বললেন–এটা সিংহগড়ের নিউটাউনশিপ এরিয়া।

চড়াই উঠে সমতল মাটির উপর কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দেখলুম সামনে নদীর ঘাট। এখানে নদীটা খুব ভদ্র এবং শান্ত মনে হল। কর্নেল এবার বাঁদিকে ঘুরলেন। আমরা নদীর দুধারে সারিবদ্ধ গাছের ছায়ায় হাঁটছিলুম। এপথে মাঝে মাঝে মোটরগাড়ি দেখা যাচ্ছিল। এক ভদ্রলোক পায়ে হেঁটে আসছিলেন, পরনে প্যান্ট-শার্ট। হাতে একটা ব্রিফকেস। কর্নেল তাকে বললেন–যদি কিছু মনে না করেন আপনার কাছে একটা কথা জানতে চাইব।

ভদ্রলোক কর্নেলের চেহারা দেখে বিদেশি টুরিস্ট ভেবেছিলেন। কর্নেলকে বাংলায় কথা বলতে শুনে মুখে বিস্ময় ফুটিয়ে বললেন আপনি বাঙালি! কর্নেল হাসলেন। আপনিও তো বাঙালি, যদি জিজ্ঞাসা করেন তা কী করে বুঝলুম। আমি বলব যদি মুখের গড়ন নয় বাঙালির দুটো চোখ লক্ষ্য করলেই একটা বিশেষ দীপ্তি চোখ এড়ায় না, দীপ্তিটা অবশ্যই বুদ্ধির। ভদ্রলোক কর্নেলের তোয়াজে অভিভূত হয়ে বললেন–নমস্কার। নমস্কার। আপনি কি এখানে বেড়াতে এসেছেন? বলুন আপনার জন্য কী করতে পারি।

কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে একটা খাম বের করলেন। খামটা চিনতে পারলুম। ওটার ভেতরে প্রতিমা রায়ের ছবি আছে। কিন্তু ওটা অনেক বছর আগের ছবি। চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখতে থাকলুম কর্নেলের ক্রিয়াকলাপ। তিনি ছবিটা বের করে ভদ্রলোকে দেখিয়ে বললেন এই মহিলা সম্পর্কে আমার আত্মীয় হন। এটা অনেক পুরনো ছবি। হয়তো পনেরো বছর আগেকার। তবু আমি শুনেছি নদীর ধারে এই নিউটাউনশিপ এরিয়ায় ইনি তার মামার বাড়িতে থাকেন। তার মামা একসময় এম.পি. ছিলেন। জানি না এখন তিনি বেঁচে আছেন কি না।

ভদ্রলোক ছবিটা কিছুক্ষণ ধরে দেখলেন তার পর বললেন। খুব চেনা মুখ। আমি সিংহগড়ে ট্রান্সফার হয়ে এসেছি মাস তিনেক আগে। একজন বাঙালি এম.পি. এখানে ছিলেন শুনেছি। কিন্তু এই মহিলাকে চেনা মনে হচ্ছে। কর্নেল বললেন–সেই এম.পি.র বাড়িটা কি এই এলাকাতেই।

হ্যাঁ শুনেছি এখানেই তিনি একটা বাংলো বাড়িতে বাস করতেন। তার পর বাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে চলে যান। কিন্তু এই মহিলা…এক মিনিট। ওই ভদ্রলোক আসছেন ওকে জিজ্ঞাসা করি।

একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক আসছিলেন। তার পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। আমাদের দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। তার পর প্যান্ট-শার্ট পরা ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলেন–কি প্রভাত, এঁরা কি তোমার পরিচিত?

প্রভাতবাবু বললেন–না প্রবীরদা। আচ্ছা আপনি তো এখানে অনেক বছর আছেন। দেখুন তো এই মহিলাকে চিনতে পারেন কি না, ইনি এই টুরিস্ট ভদ্রলোকের আত্মীয়া।

প্রবীরবাবু ছবিটা দেখইে বললেন–আরে কি কাণ্ড। এ তো সেই এম.পি.র ভাগ্নি। এম.পি. তো ভোটে হেরে বাংলো বাড়ি বেচে দিয়ে কোথায় গেছেন তা জানি না। কিন্তু ওর ভাগ্নি ওদিকটায় একটা আশ্রম করে সেখানে বাস করেন।

প্রবীরবাবু আমরা যেদিকে যাচ্ছিলুম সেদিকেই আঙুল তুলে দেখালেন। লক্ষ্য করলুম তার মুখে কেমন একটা বাঁকা হাসি।

কর্নেল বললেন–প্রতিমা কি সন্ন্যাসিনী হয়েছেন?

প্রবীরবাবু তেমনই হেসে বললেন–আজ্ঞে হ্যাঁ, সোজা চলে যান। নিউটাউনশিপের পরে একটা ছোট শালবন আছে। এই রাস্তাটা অবশ্য শালবনের গা ঘেঁষে বাঁদিকে ঘুরে গেছে। আপনারা শালবনের ভেতর দিয়ে পায়ে হাঁটাপথে আশ্রমে পৌঁছে যাবেন।

কর্নেল হন্তদন্ত হয়ে হাঁটতে থাকলেন। শালবনের কাছাকাছি গিয়ে দেখলুম এই সংকীর্ণ পিচ রাস্তাটা বাঁদিকে ঘুরে উতরাই নেমে গেছে। কর্নেল একটু দাঁড়িয়ে বললেন–যার কাছে ঠিকানা নিয়েছিলুম সে এখনকার সিংহগড় সম্পর্কে কিছু জানে না। আমরা বাজারের এলাকা থেকে সোজা এই রাস্তায় চলে আসতে পারতুম। অকারণ অতখানি ঘুরে আসতে হল। শালবনের ভেতর দিয়ে পায়ে চলা রাস্তায় গিয়ে বললুম–আমাকে একেবারে হতবাক করে দিয়েছেন আপনি। কিছু যে জিজ্ঞেস করব, মাথায় কোনও কথা আসছে না।

কর্নেল বাইনোকুলারে নদীর ডাইনে দিকটা দেখে নিয়ে বললেন–কেন? বললুম–প্রতিমা দেবীর ঠিকানা তো আপনি বিজয়বাবুর কাছে জানতে পারতেন। তবে আমার সবচেয়ে আশ্চর্য লাগছে তিনি যেমন প্রতিমাদেব সম্পর্কে কথা, বাড়ালেন না, আপনিও আর কিছু জানতে চাইলেন না। তখন আমার মনে হয়েছিল এর মধ্যে কোনও রহস্য আছে। কর্নেল বললেন–রহস্য খুজলে তুমি সর্বত্র সবকিছুতেই পাবে। তবে প্রতিমা যে আশ্রমবাসিনী তা আমি তোমাকে ইচ্ছা করেই বলিনি। বললে তুমি আমাকে প্রশ্নে উত্ত্যক্ত করে ছাড়তে। তার চেয়ে সঙ্গে এসেছ, স্বচক্ষে চুপচাপ সব দেখে যাও। : শালবন ছাড়িয়ে গিয়েই চোখে যেন অপার্থিব লাবণ্যের ছটা এসে পড়ল। নিচু পাঁচিলে ঘেরা এবং বৃক্ষলতা গুল্মে আর রংবেরঙের ফুলে সাজানো একটা বাঙালি ধাঁচের বাড়ি। কর্নেল কিছু না বললেও বুঝতে পারলুম প্রতিমাদেবীর মামা তাকে নিজের বাড়িটা দান করে গেছেন। স্থানীয় লোকের ততকিছু খোঁজ খবর রাখেন না। গেট বন্ধ ছিল। কর্নেল গিয়ে প্রথমে একবার কাসলেন, তার পর একটু গলা চড়িয়ে বললেন–কেউ কি আছেন এখানে?

ভেতরে বাংলোর পাশেই একটা ছোট মন্দির। মন্দিরের বারান্দাটা বেশ উঁচু। গেটের কাছ থেকেই দেখতে পেলুম গেরুয়া রঙের শাড়ি পরা এক মহিলা মন্দিরের বারান্দা থেকে দ্রুত নেমে আসছেন। তার চুল এখনও কালো। মুখের সৌন্দর্য যেন রঙিন পাথরে খোদাই করা ভাস্কর্য। কিন্তু ভয়ের ছাপ ক্রমশ যত তিনি কাছে আসছিলেন তৃত আমার চোখে পড়ছিল। তা হলেও তার সৌন্দর্যের কোনও তুলনা হয় না অন্তত আমি কোথাও এমন কোনও সন্ন্যাসিনীকে দেখিনি। তিনি লনের মাঝামাঝি এসে মৃদুস্বরে বললেন–গেট খোলাই আছে, আপনারা আসুন।

গেটের দুটি অংশ শুধু পরস্পরকে ছুঁয়ে ছিল। কর্নেল ঠেলতেই তা খুলে গেল। আমি ভেতরে ঢুকে আগের মতো গেট বন্ধ রাখলুম। কাছে গিয়ে কর্নেল বললেন–জানি না আপনার জীবনে কোনও ব্যাঘাত ঘটাতে এসেছি কি না। তবে অন্তত সজ্ঞানে তেমন কিছু করব না। আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। আর আমার সঙ্গী এই তরুণ বন্ধুর নাম জয়ন্ত চৌধুরী। কলকাতার দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক।

প্রতিমাদেবী শীতল মুখে এবং নিষ্পলক চোখে আমাদের দেখছিলেন এবার লক্ষ্য করলুম তার ঠোঁটের কোনায় কেমন যেন বাঁকা হাসির রেখা অথবা আমারই দেখার ভুল। তিনি ধীরে শ্বাস ছেড়ে বললেন–কর্নেল সাহেব কি আমার মামার কোনও নির্দেশ পেয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন?

কর্নেল বললেন–আপনার মামা কোথায় আমি জানি না। আপনি জানেন? প্রতিমা ঠোঁট কামড়ে ধরে মাথা নাড়লেন। তার পর মৃদু স্বরে বললেন–মামা আমার উপর রাগ করে নিজের বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। আমার মামিমা বেঁচে নেই। এঁদের একমাত্র ছেলে বরুণ থাকে আমেরিকায়। আমার এখন মনে হচ্ছে মামা বরুণের কাছে গিয়ে আছেন। আপনারা আসুন। বাংলোতে আমার জিনিসপত্র সবই আছে। বসার ঘরটাও আমি আগের মতোই রেখেছি, হঠাৎ যদি তিনি ফিরে আসেন।

আমার মনে হল শেষ বাক্যটা বলতে প্রতিমার কণ্ঠস্বর যেন করুণ হয়ে এল।

 কর্নেল জুতো খুলতে যাচ্ছিলেন। প্রতিমা বললেন–জুতো খোলার দরকার নেই। বাইরের লোকেরা এটাকে আশ্রম বলে জানে। কিন্তু এটা আশ্রম নয়।

কর্নেল বসার ঘরে ঢুকে বললেন কিন্তু আপনি সন্ন্যাসিনী। সন্ন্যাসিনী তো আশ্রমেই বাস করেন, কাজেই লোকে ভুল বলে না। ….,

দেখলুম ঘরের ভেতরটা আধুনিক আসবাবপত্রে সাজানো। দুটো সেলফ ভর্তি বই। অন্যদিকে চিনা ফুলদানিতে সাজান এক গোছ ফুল। সোফার সেন্টার টেবিলেও ফুলদানিতে এদিনের তাজা ফুল সাজানো। দেওয়ালে দেশ-বিদেশের শিল্পীদের পেন্টিং ঝুলছে। বুকসেলফের ওপর রবীন্দ্রনাথের একটা বড় ছবি। আমরা সোফায় বসে পড়লুম। প্রতিমা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন। কর্নেল বললেন আপনি বসবেন না?

প্রতিমা বললেন আমি আপনার জন্যে দুকাপ চা করে নিয়ে আসি।

কর্নেল একটু হেসে বললেন–সন্ন্যাস জীবনে চা খাওয়া নিষিদ্ধ কি না আমি জানি না তবে আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমরা বেশিক্ষণ বসব না। আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে এসেছি। বাই-দা-বাই এখানে কি টেলিফোন আছে।

প্রতিমা দেবী বললেন–মামার দুটো টেলিফোন ছিল। আমি ফেরত দিয়ে এসেছি। কারণ আমার কাউকে টেলিফোন করার দরকার হয় না।

কর্নেল জিজ্ঞাসা করলেন–আপনি কি এখানে একা থাকেন।

প্রতিমা বললেন–না, একটি আদিবাসী মেয়ে আমার সঙ্গে থাকে। তাকে একটা কাজে পাঠিয়েছি।

কর্নেল তার চোখে চোখ রেখে বললেন–আমি বুঝতে পারছি আপনার মনে প্রচণ্ড কৌতূহল জেগেছে আমি কেন আপনার কাছে এসেছি? যাই হোক আপনি সন্ন্যাস জীবন গ্রহণ করেছেন। আপনার পিছু ফিরে তাকানো নিষিদ্ধ।

প্রতিমা মাথা নেড়ে বললেন–আমি ওসব নিয়ে মাথা ঘামাই না। আমার আরাধ্য দেবতা কৃষ্ণ। কিন্তু আমি বৈষ্ণবী নই। আমি আমার দেবতার ধ্যানে দিন কাটাই। নেহাত বেঁচে থাকার জন্যে কিছু খেতে হয়। আরও শুনুন, আমার কোনও দীক্ষাগুরু নেই। আমার আত্মাই আমার দীক্ষাগুরু। কর্নেল বললেন–ঠিক আছে। আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই। সম্প্রতি এখানে নাকি কোনও কোনও রাত্রে সিংহের গর্জন শোনা যায়? কেউ কেউ নাকি সিংহটা দেখেছে?

লক্ষ্য করলুম, প্রতিমা একটু চমকে উঠেই নিজেকে সংযত করলেন। তার পর বললেন–আপনি কি সত্যিই সামরিক অফিসার? নাকি পুলিশের লোক?

কর্নেল তার শার্টের বুকপকেট থেকে তার একটা কার্ড বের করে বললেন এটা আপনি দেখে নিয়ে কাছে রাখতে পারেন। এমনও হতে পারে আমি আপনার কাজে লাগতে পারি।

 কার্ডটা দুহাত বাড়িয়ে করতলে নিয়ে চোখ বুলিয়ে দেখার পর প্রতিমার মুখে। একটা উজ্জ্বলতা ফুটে উঠল। তিনি শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার! আপনার কথা আমি একজনের মুখে প্রায়ই শুনতুম।

রাঘবেন্দ্র রায়চৌধুরী?

প্রতিমার মুখের উজ্জ্বলতা মুহূর্তে নিভে গেল। তিনি আস্তে আস্তে বললেন, কর্নেল সাহেব! দয়া করে ওই নামটা আর উচ্চারণ করবেন না। দৈবাৎ ওই নামটা আমার মনে ভেসে উঠলে আমি ক্রোধে উন্মাদ হয়ে উঠি।

কর্নেল বললেন–যেবার রাজবাড়ির এক সন্ন্যাসী, অভয়ানন্দের ক্ষতবিক্ষত লাশ জলপ্রপাতের কাছে পাওয়া যায় সেবারও এমনি সিংহের গর্জন নিয়ে গুজব রটেছিল সিংহগড়ে। প্রায় আমার ভয় হচ্ছে এবারও তেমন কিছু সাংঘাতিক ঘটনা ঘটতে পারে।

প্রতিমা তীব্র স্বরে বললেন–ওই লোকটার কাছে সেই কথা শুনেই কি আপনি সিংহগড়ে ছুটে এসেছেন?

কর্নেল একটু হেসে বললেন–না, আমার উদ্দেশ্য বিরল প্রজাতির প্রজাপতি দর্শন। কিন্তু কলকাতার সেই লোকটা আমাকে আপনার একটা পুরনো ফটো দিয়ে আপনার কথা বলেছিল। তাই আমি কৌতূহল সম্বরণ করতে পারিনি।

প্রতিমা মুখ নামিয়ে বললেন, আপনাকে আমার কিছু বলার আছে।

.

০৭.

আমি অবাক চোখে সন্ন্যাসিনী বেশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিমা দেবীকে দেখছিলুম অনুমান করতে চেষ্টা করছিলুম তাঁর বলার কথাটা কী হতে পারে। তিনি কি একটা নষ্ট প্রেমের কথা শোনাবেন। নাকি অভয়ানন্দের মৃত্যুরহস্য কর্নেলকে জানিয়ে দেবেন?

কর্নেল বললেন–আমি চুরুট টানতে অভ্যস্ত। আপনার অসুবিধা না থাকলে আমাকে একটা অ্যাশট্রে দিন।

প্রতিমা বুক সেলফের ওপর থেকে একটা অ্যাশট্রে এনে কর্নেলের সামনে রাখলেন। তার পর বললেন–মামা একসময় খুব সিগারেট খেতেন। পরে ছেড়ে দিয়েছিলেন।

কর্নেল লাইটার জ্বেলে চুরুট ধরিয়ে বললেন–আপনি দাঁড়িয়ে না থেকে বসলে ভাল হয়।

প্রতিমা বললেন–আমাকে আপনি তুমি বলুন। আপনি আমার মামার বয়সী।

কর্নেল একটু হেসে বললেন–হা, তুমি বললে একটু কাছাকাছি আসা যায়। সত্যি বলতে কি আমি কলকাতা থেকে তোমার কাছেই আসতে চেয়েছিলাম। যাইহোক, এবার বলো তুমি কী বলতে চাইছ।

প্রতিমা আবার ঠোঁট কামড়ে যেন নিজেকে সংযত করলেন। তার পর দেয়ালের কাছে রাখা কয়েকটা চেয়ারের মধ্যে একটা চেয়ার টেনে এনে কর্নেলের কাছাকাছি বসলেন।

বললেন–আমি অনেক বছর ধরে কোনও সোফা বা চেয়ারে বসিনি। মেঝেতে বসতেই অভ্যস্ত হয়েছি। কিন্তু আপনার কথায় এতদিন পরে আমি এইভাবে। বসলুম। আমার একটু অস্বস্তি লাগছে। তা লাগুক, আপনাকে দেখে আমার মনটা কেন যেন চঞ্চল হয়ে উঠেছে।

কর্নেল চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন বেশ তো তুমি কি বলতে চেয়েছ এবার তা নিঃসঙ্কোচে বলো। জয়ন্তের সামনে কথা বলতে কোনও বাধা নেই। প্রতিমা জোরে শ্বাস ছেড়ে বললেন–আপনি কি সত্যিই শুধু আমার কথা শুনেই আমার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছেন।

কর্নেল বললেন–তুমি ঠিকই ধরেছ। রাজবাড়ির ছোটবাবু অজয়নারায়ণ কলকাতায় তার মেয়েকে আনতে গিয়েছিলেন। তিনি আমার সঙ্গেও দেখা করতে যান। কারণ তার দাদা জলপ্রপাতের ওপরের জঙ্গলে দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির প্রজাপতি দেখেছেন। তুমি আমার কার্ডে দেখতেই পাচ্ছ প্রকৃতিবিজ্ঞান আমার নেশা। আর একটু পেশাও আমার আছে। এটা তোমার আগে জানা উচিত। আমি একজন রহস্যভেদী। অর্থাৎ কোথাও রহস্য দেখলে তা উন্মোচন করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠি।

প্রতিমা হাসবার চেষ্টা করে বললেন–আমাকে আপনি কি কোনও রহস্যের বিষয় বলে ভেবেছেন।

কর্নেল হাসলেন–হ্যাঁ তুমি রহস্যময়ী। তোমাকে কেন্দ্র করে একটা রহস্য যেন দানা বেঁধে আছে। তবে সেসব কথা থাক। তুমি যা বলতে চাইছিলে এবার বলো।

প্রতিমা বললেন–মামা আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই বয়সে আমার মধ্যে কী একটা আগুন ছিল, সবসময় তার উত্তাপ অনুভব করতুম। সেই উত্তাপ কখনও কখনও সহ্য করতে পারতুম না। রাঘবেন্দ্র এই সুযোগটা নিয়েছিল। কিন্তু পরে যখন বুঝতে পারলুম সে আসলে আমাকে বারবনিতার দলে ফেলেছে–আপনি পিতৃতুল্য। জয়ন্তবাবু আমার ছোট ভাইয়ের মতো। বলতে কুণ্ঠা নেই তার হাত থেকে আমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন এক আশ্চর্য মানুষ। রাজবাড়িতে ওদের সম্পত্তির একজন শরিকও তিনি।

কর্নেল বললেন–তুমি নিশ্চয় অভয়ানন্দের কথা বলছে।

প্রতিমা–হ্যাঁ। প্রথমে ছিলেন উনি অভয়নারায়ণ। পরে হিমালয়ে বেড়াতে গিয়ে এক সাধুর কাছে দীক্ষা নিয়ে আসেন। তার পর নিজের পরিচয় দিতেন অভয়ানন্দ ব্রহ্মচারী বলে। মামার সঙ্গে মাঝে মাঝে রাজবাড়িতে যেতুম। তার পর একদিন অভয়ানন্দকে দেখার ইচ্ছা হয়েছিল। হয়তো আমার ভুল, কিন্তু তার চেহারার মধ্যে একটা আশ্চর্য প্রভা দেখতে পেতুম। একদিন চুপি চুপি রাজবাড়ির পিছন দিয়ে তার ঘরে চলে গেলুম। ঠাকুরবাড়ি সংলগ্ন একটা ছোট ঘরে সে থাকত। অভয়ানন্দ আমাকে দেখে চমকে উঠেছিল। কিন্তু আমি তাকে একটা মিথ্যে কথা বলেছিলুম। বলেছিলুম রাঘবেন্দ্র আমাকে উত্ত্যক্ত করছে। আপনাকে বলা দরকার তখন রাজবাড়ির বড়বাবু, এমনকী, মামার চেয়েও রাঘবেন্দ্রের প্রভাব সিংহগড়ে বেশি ছিল। যত ডাকাত ও গুণ্ডা প্রকৃতির লোক ছিল তার হাতে। পুলিশও ছিল তার বন্ধু। আর আমাকে এসে উত্ত্যক্ত করতে সাহস পেত না। আমি নিজেই তার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলাম। কিন্তু পরে যখন তার মধ্যে আবিষ্কার করলুম সে শুধু আমাকে প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার বস্তু ভেবেছে, তখন তার ওপর আমার ঘৃণা জেগেছিল। হয়তো আমি নিজেই তাকে মেরে ফেলতে পারতুম কিন্তু তার ঝুঁকি ছিল। অভয়ানন্দের কাছে আমি ছুটে গিয়েছিলুম অনাদি স্বকীয় আলোতে নিজেকে আলোকিত করতে। কিন্তু ঝোঁকের বসে রাঘবেন্দ্রর সম্পর্কে একটা মিথ্যে কথা বলে ফেললুম। অভয়ানন্দ আমাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন–আমি সন্ন্যাসী এবং ব্রহ্মচারী। তুমি আমার কাছে অন্য কোনও আশা কোরো না, তবে তুমি যে জন্য এসেছ বললে, আমি তার প্রতিকার করব।

কর্নেল চোখ বন্ধ করে কথা শুনছিলেন। এবার চোখ খুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন–তারপরেই কি সিংহ গর্জনের গুজব ছড়িয়ে ছিল?

প্রতিমা আস্তে বলল, হ্যাঁ।

কর্নেল বললেন–তার পর কি অভয়ানন্দের ক্ষতবিক্ষত দেহ জলপ্রপাতের কাছে পাওয়া গিয়েছিল?

প্রতিমার চোখ ছলছল করছিল। তিনি আত্মসম্বরণ করে বললেন–আমি একটা সৎ মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলুম। জানতুম না রাঘবেন্দ্র তার ক্ষতি করতে পারে।

কল্পনাও করিনি এমন কিছু ঘটবে। প্রতিমা এবার কান্নাজড়ানো গলায় বললেন– কর্নেল সাহেব, আমি ওই নিষ্পাপ মানুষটার মৃত্যুর কারণ। রাজবাড়ির লোকেরা নাকি এরকম কিছু একটা সন্দেহ করত। কিন্তু রাঘবেন্দ্রর কাছে তারা অসহায়। এর কিছুদিন পরে আমার দিক থেকে কোনও ক্ষতির আশঙ্কা করে রাঘবেন্দ্র সিংহগড় ছেড়ে চলে যায়।

কর্নেল বললেন–তোমার ছবিটা কে তুলেছিল।

প্রতিমা বললেন–ওটা আমি নিজেই স্টুডিওতে গিয়ে তুলেছিলুম। আমার ওই বয়সে আমি খুব খেয়ালি ছিলুম। কখন কি যে করতুম নিজেই বুঝতুম না।

কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন–ছবিটা অভয়ানন্দের বিছানার তলায় কে রেখেছিল?

প্রতিমা ভিজে চোখ আঁচলে মুছে শান্তভাবে বললেন–যখন ছবিটা তুলি তখন তার একটা কপি রাঘবেন্দ্ৰ চেয়েছিল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সে অভয়ানন্দকে ফাসাতে চুপি চুপি তার বিছানার তলায় সেই কপিটা রেখে এসেছিল।

কর্নেল বললেন, তোমার নিজের কপিটা কি তোমার কাছে আছে?

প্রতিমা বললেন, না রাগ করে সেটা ছিঁড়ে ফেলেছি। নেগেটিভটা স্টুডিও দিয়েছিল আমাকে। সেটাও আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিলাম।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন–একটা কথা তোমাকে জিজ্ঞেস করতে চাই। অভয়ানন্দের কাছে কি তুমি কখনও ব্রোঞ্জের কোনও চাকতি দেখেছিলে?

প্রতিমা একটু চমকে উঠলেন। বললেন–অভয়ানন্দ বলেছিল তার দীক্ষাগুরু তাকে একজোড়া চাকতি দিয়েছিলেন। সেদুটো নাকি হাজার বছরের পুরনো দুটো সিল। হিমালয়ে সাধুবাবা ওদুটো কোথায় পেয়েছিলেন তা অভয়ানন্দকে বলেননি।

কর্নেল একটু হেসে বললেন–অভয়ানন্দের বিছানার তলায় একটা চাকতি আবিষ্কার করেছিলেন রাঘবেন্দ্র, ফটোর সঙ্গে সেটাও তিনি নিয়ে যান। এ ঘটনা সম্ভবত অভয়ানন্দের মৃত্যুর পর। আরেকটা চাকতি রাজবাড়ির ছোটবাবু অজয়নারায়ণ নাকি কুড়িয়ে পান ঠাকুরবাড়ির পুকুরপাড়ে। প্রতিমা অবাক চোখে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। রাজবাড়ির ছোটবাবুর কথা আমি বিশ্বাস করি না। অভয়ানন্দের ঘর থেকে রাঘবেন্দ্র আর ছোটবাবু পরপর একটা করে চাকতি খুঁজে পেয়েছিলেন।

কর্নেল বললেন–তুমি সেসব কথা বললে তা আমার জানা ছিল না। আমি বুঝতে পারছি অভয়ানন্দ সম্ভবত রাঘবেন্দ্রকে চার্জ করতে গিয়েই মারা পড়েন। তার মৃত্যু কোনও জন্তুর আক্রমণে হয়েছে এটা সাব্যস্ত করতে রাঘবেন্দ্র মৃতদেহটা ক্ষত-বিক্ষত করেছিল। কিন্তু এবার আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করছি, আশা করি সঠিক উত্তর দেবে।

প্রতিমা বললেন–আপনি কথা দিন রাঘবেন্দ্রকে খুঁজে বের করে শাস্তি দেবেন। কারণ আপনি নিজেই বললেন, আপনি রহস্যভেদী।

কর্নেল মৃদু হেসে বললেন–তার শাস্তি দেবার জন্য দেশের আইন আছে। আদালত আর প্রশাসন আছে। অনেক বছর আগের ঘটনা। তাহলেও পুলিশ নতুন করে তদন্ত শুরু করতে পারে আমি পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা করব। এবার তুমিই বলো এবার যে সিংহ গর্জনের গুজব ছড়িয়েছে সে ব্যাপারে তোমার মত কী?

প্রতিমা একটু চুপ করে থাকার পর খুব আস্তে বললেন–গুজবটা শোনার পর আমার ভয় হচ্ছে। যে আদিবাসী মেয়েটা আমার কাছে থাকে সে খুব সাহসী। আর আমার কাছে আত্মরক্ষার একটা অস্ত্র আছে সেটা আমার একটা রিভলবার। উনি আমাকে অস্ত্রটা ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। তবু কেন যেন মনে হয় একটা ভয়ঙ্কর পরিণাম আমার জন্য অপেক্ষা করছে। সিংহগর্জনের গুজব পুরনো ভয়ঙ্কর স্মৃতিকে ফিরিয়ে এনেছে। দিনে আমি তত ভয় পাই না। তবে রাত্রে আমার ঘুম হয় না। আদিবাসী মেয়েটি তির-ধনুক নিয়ে আমাকে পাহারা দেয়। সারারাত এ বাড়িতে আলো জ্বেলে রাখি।

কর্নেল বললেন–তুমি যদি অন্তত দুটো দিন সতর্ক থাকো আমার মনে হয় তোমার ভয়ের কারণটা আমি নির্মূল করে দিতে পারব।

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন তার পর বললেন আমরা উঠেছি ট্যুরিস্ট লজে। তোমার এখানে ফোন থাকলে ভাল হত। প্রতিমা বললেন, নিউ টাটা টাউনশিপ এরিয়ায় কয়েকটি বাঙালি ফ্যামিলি আছে, তাদের টেলিফোন আছে। আমাকে তারা সন্ন্যাসিনী বলে শ্রদ্ধা-ভক্তি করে। দরকার হলে আমি আপনাকে কারুর বাড়ি থেকে ফোন করব।

কর্নেল বললেন–তোমাকে তো শালবনটা পেরিয়ে যেতে হবে।

প্রতিমা বললেন–শালবনের পূর্বদিকটায় কঁকা জমি আছে। আমি দরকার হলে ওখান দিয়ে যেতে পারি। যদিও কখনও কোনও বাড়িতে যাইনি। তবে ওইসব বাড়ির মেয়েরা আমার কাছে এসেছে, সেই সূত্রে পরিচয়।

আমরা দুজনে বেরিয়ে লনে নেমে গেলুম। কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন এতসব ফুল, এদের সেবা তুমিই করো!

প্রতিমা বললেন–হ্যাঁ, মামার একটা জলের পাম্প আছে। নদী থেকে জল তুলতে অসুবিধা নেই। কর্নেল সাহেব আমার জীবনে এখন এইসব ফুল আর আমার আরাধ্য দেবতা শ্রীকৃষ্ণ আমাকে সুখি রেখেছেন। তাই যত ভয়ই পাই এই পরিবেশ থেকে যেন উঠে এসে আমাকে আশ্বাস দেয়। আমার ঠাকুর তো আছেনই।

কর্নেল পা বাড়িয়ে একটু হেসে বললেন–দেবতা বা প্রকৃতি সংসারে রক্তমাংসের মানুষকে রক্ষা করতে পারেন বলে আমি বিশ্বাস করি না। বরং আমি তোমাকে বলব তোমার ফায়ার আর্মস আর আদিবাসী মেয়েটির তির-ধনুক তোমাকে রক্ষা করবে।

প্রতিমা দেবীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা তার নির্দেশমতো বাংলো বাড়ির পাশ দিয়ে পায়ে চলা রাস্তায় এগিয়ে গেলাম। কিছুটা চলার পর শালবন। শালবনের। শেষ প্রান্তে দেখলুম অনেকখানি অঞ্চল পোড়ো জমি। তার পরে সুন্দর ছবির মতো নিউ টাউনশিপের ঘরবাড়ি। জমিটা পেরিয়ে গিয়ে দেখলুম পায়ে চলা পথটা ক্রমশ ঢালু হয়ে নেমে গেছে। তার পর পিচ রাস্তার যানবাহন ও মানুষজনের ভিড় চোখে পড়ল।

এতক্ষণে বললুম–কর্নেল, আমার কিন্তু প্রতিমা দেবীকে প্রকৃত সন্ন্যাসিনী বলে মনে হয়নি। ওটা ওঁর ছদ্মবেশ। নিজেকে বৈষ্ণবী বলতে চান না অথচ তার আরাধ্য দেবতা শ্রীকৃষ্ণ। তিনি কপালে রসকলি আঁকেননি। আমার ধারণা এই মহিলা সরল প্রকৃতির নন। ওঁর মনে জটিলতা আছে। তা আমি টের পাচ্ছিলুম।

কর্নেল সহাস্যে বললেন–হ্যাঁ, প্রতিমা রহস্যময়ী মেয়ে। আর ওকে বলে এলুম আমি রহস্যভেদী।

বললুম আপনি তো ঠিক তাই। রহস্যভেদ করতেই তো সিংহগড়ে এসেছেন। দুষ্প্রাপ্য প্রজাপতি দেখা নেহাত একটা উপলক্ষ। কিন্তু আমার ধারণা–

কর্নেল আমাকে কথা শেষ করতে দিলেন না একটা সাইকেল রিকশা ডেকে তাতে উঠে বসলেন। আমিও উঠে বসলাম। তার পর কর্নেল গেলেন-সোজা ট্যুরিস্ট লজ। এখন প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। কিন্তু তত গরম টের পাচ্ছিলুম না। আবহাওয়া বেশ স্নিগ্ধ। আমি আবার অসমাপ্ত কথাটা বলতে গেলুম। কিন্তু চোখ কটমটিয়ে বললেন–নো কথা, চুপচাপ চারপাশে দৃশ্য দেখতে দেখতে চলল। এত সুন্দর পাহাড়ি দৃশ্য আর কোথাও পাবে না।

ট্যুরিস্ট লজে পৌঁছনোর পর নিচের লাউঞ্জে ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতে তিনি কর্নেলকে বললেন–দুবার ফোন এসেছিল। আমি বলেছি কর্নেল সাহেব এখনও ফেরেননি।

কে ফোন করেছিল জিজ্ঞাসা করেছেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ। রাজবাড়ি থেকে বড়বাবু ফোন করেছিলেন। কর্নেল রিসিভার তুলে ডায়াল করতে থাকলেন। তার পর সাড়া এলে বললেন–কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি…হা বলুন বিজয়বাবু। সেকি উড়ো চিঠি। কী লিখেছে… আপনার অস্বস্তির কারণ নেই। আমি লাঞ্চের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে আপনার কাছে যাব।

.

০৮.

লাঞ্চের পর আমি অভ্যাসমতো বিছানায় গড়িয়ে পড়েছিলাম। বাঙালির চিরাচরিত বদঅভ্যাস সম্ভবত ভাতঘুম। আমি এর পাল্লায় প্রায়ই পড়েছি। কাল একে তো সারা রাত ট্রেনের জার্নি, তার পর প্রায় বেলা একটা অবধি কর্নেলের সঙ্গে সিংহগড়ে ঘুরে বেড়ানো। এর ফলে ভাতঘুম সহজেই আমাকে পেয়ে বসেছিল।

সেই ঘুম ভাঙল পরিচারকের ডাকে, তার হাতে চায়ের কাপ-প্লেট। তখনই বিছানায় উঠে বসে দেখলুম কর্নেল ঘরে নেই। বিকেলে আমার চা খাওয়ার অভ্যাস আছে। প্রায়ই কর্নেল সেই ব্যবস্থা করে দিয়ে বেরিয়ে গেছেন তা বুঝতে পারলুম। লোকটিও একটু হেসে বলল-বড়সাহেব ম্যানেজার বাবুকে বলে গিয়েছেন চারটে বাজলে আপনার কাছে যেন চা পাঠিয়ে দেওয়া হয়। লোকটি সেলাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। শরীরটা এখন ঝরঝরে লাগছিল বটে, কিন্তু একটু অভিমান, ও ক্ষোভও হল। কর্নেলের সঙ্গে আমার যাবার ইচ্ছে ছিল। কেন জানি না প্রতিমা দেবীর কথাবার্তা শোনার পর থেকে আমার মনে হচ্ছিল এত বছর পরে আবার সিংহ গর্জনের গুজব কোনও অঘটন ঘটাতে চলেছে। তাই কর্নেলের সঙ্গে থেকে রহস্যের সূত্রগুলো আঁচ করতে তীব্র ইচ্ছা ছিল। কর্নেল আমাকে ডাকলেই পারতেন। আমি ভাতঘুম ফেলে তার সঙ্গে বেরিয়ে পড়লুম।না হয় একটু কষ্ট হত।

কিন্তু কী আর করা যাবে,কর্নেলের হালচালই এরকম। মাঝে মাঝে ওর খেয়ালি স্বভাবের পরিচয় এভাবেই পেয়েছি। চা খাওয়ার পর উঠে দূরে টিলার পারে জঙ্গল এবং তার পেছনে নীল পাহাড়ের রেখা চোখে পড়ছিল। দক্ষিণের এই বারান্দা রোদ পড়েছে কোনাকুনি। একটা চেয়ার এনে বসলুম। এখন নিছক প্রকৃতির শোভা দর্শন করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। শরৎকালের শেষ সপ্তাহ। তাই যদি বিকেল ঘনিয়ে আসছিল। তত পাখিদের কলরব বেড়ে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পরে টেলিফোন বেজে উঠল। দ্রুত ঘরে গিয়ে রিসিভার তুলে সাড়া দিলুম। কর্নেলের কণ্ঠস্বর ভেসে এল-ডার্লিং, আশা করি তোমার ভাতঘুম ভালই হয়েছে। ক্লান্তিও ঘুচে গেছে।

আমি বললুম–আপনি আমাকে ঘুমোতে দিয়ে একা কেটে পড়েছিলেন, এটা আমার ভাল লাগেনি। আপনি কোত্থেকে বলছেন?

কর্নেল বললেন–রাজবাড়ি থেকে, তুমি যদি আসতে চাও, বিজয়বাবুকে বললে গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন।

বললুম–তার আগে বলুন রহস্যময় কিছু ঘটেছে কি ওখানে।

কর্নেল বললেন–ঘটেছে, তবে খারাপ কিছু নয়। আমি তোমাকে ডাকছি। তার কারণ তুমি এই ঘটনা থেকে লেখার উপাদান পেতে পারো।

সঙ্গে সঙ্গে বললুম–তাহলে গাড়ি পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। কারণ গাড়িতে গেলে খুব শিগগির পৌঁছে যাব।

কর্নেল বললেন–ঠিক আছে আমি এখনই বিজয়বাবুকে খবর পাঠাচ্ছি। উনি ঠাকুরবাড়িতে আছেন। আচ্ছা রাখছি।

তখন প্যান্ট-শার্ট এবং হালকা একটা জ্যাকেট পরে নেমে এলাম। কারণ এখনই এখানে বাতাসে হিমের ঈষৎ প্রভাব টের পাওয়া যাচ্ছিল। বিশেষ করে সন্ধ্যার দিকেতে উষ্ণতা আরও কমে যাবে। প্যান্টের ডান পকেটে রুমাল জড়িয়ে আমার পয়েন্ট বাইশ ক্যালিবারের সিক্স রাউন্ডার রিভালবারটা নিতে ভুললুম না। তার পর দেখলুম সেন্টার টেবিলে এই ঘরের তালা ও চাবিটা রাখা আছে। জানাল বন্ধ করার পর বেরিয়ে গিয়ে দরজায় তালা এঁটে দিলুম। চাবিটা বুক পকেটেই থাকল। নীচে গিয়ে ম্যানেজারকে দেখতে পেলুম না। লাউঞ্জে ইতস্তত কিছু লোক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে। তাদের ট্যুরিস্ট বলে মনে হল। কিন্তু সাহেব তিনজনকে দেখতে পেলুম না। তারা নিশ্চয় জলপ্রপাতের ওদিকে জঙ্গল ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলুম।

আমার তর সইছিল না। বাংলোর গেট পেরিয়ে গিয়ে নিচে রাস্তায় দাঁড়ালুম। একটা কালো অ্যাম্বাসাডার নদীর ব্রিজ পেরিয়ে আসছে দেখতে পেলুম। গাড়িটা ঘুরে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে গেল। ড্রাইভারের চেহারা কালো পাথরে খোদাই করা যেন। সে একটা সেলাম ঠুকে পিছনের দরজা খুলে দিল। গাড়িতে উঠে বসলুম। ড্রাইভার ভাঙাভাঙা বাংলায় বলল–জানলা দুটোর কাঁচ তুলে দিতে কারণ। এখন বিকেলের দিকে এখানে খুব জোরে বাতাস বয়। আমি বাইরের লোক ওই বাতাসে ঝাপটানিতে আমার ঠান্ডা লাগতে পারে।

লক্ষ্য করলুম ড্রাইভার বাঁদিকে জানালার কাঁচ তুলে দিয়েছে। তার ডান দিকের কাঁচ অল্প একটুখানি তোলা। গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে সে এগিয়ে চলল। নদীর ব্রিজ পেরিয়ে গিয়ে যে গাড়ির গতি বাড়াল। তার পর যাচ্ছি তত যাচ্ছি। কাচের বাইরে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। শুধু ড্রাইভারের পাশ দিয়ে বাইরের কিছু অংশ চোখে পড়ছে।

ঘড়িতে দেখলুম সাড়ে চারটে বাজে। রাজবাড়ি পৌঁছতে বড়জোর পনেরো মিনিট লাগার কথা। এইবার সন্দেহ হল আমি কোনও ভুল গাড়িতে চড়িনি তো। এমন হতে পারে এই গাড়িটা অন্য কাউকে নিতে এসেছিল ভুল করে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। তাই জিজ্ঞাসা করলুম তুমি রাজবাড়ির ড্রাইভার তো। লোকটা মুখ ঘোরাল না। গলার ভিতরে কী বলল বুঝতে পারলুম না। আরও কিছুক্ষণ পরে দেখলুম একটা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যেন গাড়ি ছুটে চলেছে। অমনি আমার বুকটা কেঁপে উঠল। পকেট থেকে সাবধানে রিভলবারটা বের করে প্যান্টের পাশে হাত রেখে ধমক দিয়ে বললুম–এই ড্রাইভার তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?

ড্রাইভার তবু মুখ ঘোরাল না। গলার ভিতরে আবার কিছু বলল কিছুই বুঝতে পারলুম না। এবার আমার পক্ষে চুপ করে থাকা সম্ভব নয়। তার চোয়ালের নিচে রিভলবারের নল ঠেকিয়ে গর্জন করে উঠলুম-গাড়ি থামাও। এখনি গাড়ি থামাও। তা না হলে তোমার মাথা উড়ে যাবে। নোকটা এতক্ষণে মুখ ঘোরাবার চেষ্টা করল দেখলুম তার পাকানো গোঁফের নিচে বাঁকা হাসি। সে বলল, আমার মাথা যদি উড়ে যায় তাহলে এই স্পিডের গাড়ি আপনাকে তিনশো ফুট নিচে নিয়ে যাবে। তখন আপনার অবস্থা কী হবে ভেবে দেখুন।

আমি আবার গর্জন করে বললুম–গাড়ি থামাও বলছি। আমি গাড়ি চালাতে জানি।

এবার সে বলল–ঠিক জায়গায় এসে গিয়েছেন। খামোকা রাগারাগি করে লাভ নেই স্যার। আপনার একটা পিস্তল আর এখানে পাঁচ-ছটা পিস্তল আর বন্দুক। মাথা খারাপ না করে চুপচাপ বসে থাকুন।

হঠাৎ স্পিড কমতে কমতে গাড়িটা এক জায়গায় থামল। তখন রিভলবারটা আমার পকেটে ঢুকিয়ে রেডি রাখলুম। সে গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলে দিল এবং নামতে ইশারা করল।

গাড়ি থেকে নেমে দেখলুম আমি একটা পুরনো একতলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটার দুধারে এবং পেছনে ঘন জঙ্গল দেখা যাচ্ছে। দুজন লোক বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের দেখে ভদ্রলোক বলে মনে হল না। একজনের হাতে একটা বন্দুক। অন্য জনের হাতে একটা দেশি পিস্তল।

প্রথম কয়েক মুহূর্ত আমার আতঙ্কে অবশ হয়ে গিয়েছিল তার পর নিজেকে চাঙ্গা করে ফেললুম। এরকম অবস্থায় আগে কখন পড়িনি এমন নয়। ড্রাইভার দাঁত বের করে হেসে বলল-স্যার, আমার চোয়ালের তলাটা গর্ত করে ফেলেছেন এবার আসুন কর্তা মশায়ের সঙ্গে আলাপ করবেন।

জিজ্ঞেস করলুম–কে তোমাদের কর্তা মশাই?

ড্রাইভার বলল-আমার সঙ্গে আসুন। পাহাড় জঙ্গল জায়গা বাঘ ভাল্লুকও আছে। কাজেই পালাবার চেষ্টা করবেন না। ঘরের দরজা খোলা ছিল। ভিতরে আলো জ্বলে উঠল। দেখলুম কর্নেলের মতো গোঁফ দাড়িওয়ালা এক প্যান্ট শার্ট পরা.একটা লোক বসে আছে। তার মাথার চুল অবশ্য লম্বা পিছনদিকে মেয়েদের চুলের মতো হর্স টেল।.

লোকটি টেবিলের উলটো দিকে একটা নড়বড়ে চেয়ারে আমাকে বসতে বলল লক্ষ্য করলুম তার পিছনে একটা ক্যাম্প খাটে বিছানা পাতা। বিছানায় একটা বন্দুক রাখা আছে। লোকটার কণ্ঠস্বর অদ্ভুত। ভাঙা গলায় সে বলল–কান টানলে মাথা আসে। তোমাকে আনা হয়েছে এবার তোমার মাথাটিকেও আনা হবে।

বললুম কে আপনি? আমাকে এভাবে এখানে আনলেন কেন?

লোকটি বলল–তোমার কর্নেল বুড়োর কাছে দুটো ব্রোঞ্জের চাকতি আছে। তুমি চিঠি লিখে দাও। আমার লোককে যেন রাত আটটার মধ্যে চাকতি দুটো দেওয়া হয়। আর দেখো সাড়ে আটটা অবধি অপেক্ষা করে যদি চাকতি দুটো না পাই তাহলে তোমার মৃত্যু।

বলে সে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা জরাজীর্ণ প্যাড এবং ডটপেন এগিয়ে দিল।

আমি চিন্তা করছিলুম–আমি নিরস্ত্র নই। ইচ্ছে করল এই লোকটিকে গুলি করে মেরে দরজায় দাঁড়ানো ড্রাইভারকেও মারতে পারি। বাইরের লোক দুটো দৌড়ে এলে আমার আর দুটো গুলি খরচ হবে চারটে বডি এখানে ফেলে রেখে অ্যাম্বাসাড়ার গাড়িটা চালিয়ে চলে যেতে পারি নিরাপদ জায়গায়। কিন্তু সেটা হয়তো ঝুঁকির ব্যাপার হবে। যদি দৈবাৎ বাইরের স্বতন্ত্র লোকদুটোকে ধরাশায়ী না করতে পারি?

তার চেয়ে ব্যাপারটা কতদূর গড়ায় চুপচাপ দেখে নেওয়া ভাল। প্যাডটা টেনে নিয়ে আমি তার কথা মতো লিখতে শুরু করেছিলাম। এমন সময় ড্রাইভার বেটার ছেলে বলে উঠল-বাবুমশাই এই বাঙালিবাবুর পকেটে একটা পিস্তল আছে।

অমনি দাড়িওয়ালা লোকটা বিছানা থেকে বন্দুকটা তুলে নিয়ে আমার বুকে ঠেকাল তার পর বলল–আগে অস্ত্রটা দাও। তার পর লিখবে। বুকের বাঁদিকে ঠিক হার্টের উপর বন্দুকের নলের চাপ টের পাচ্ছি। সে সেফটি কাঁচ তুলে নিল। ট্রিগারে হাত রেখে বলল, তোমার ফায়ার আর্মস আমাকে তুলে না দিলে আমি ট্রিগার টানব। সে সময় কেন যেন আমার মনে হল লোকটা তার স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর ইচ্ছে করেই বিকৃত করছে। মাঝে মাঝে দু-একটি কথায় ওর আসল কণ্ঠস্বর যেন ধরা পড়ছে, যা আমার চেনা। কিন্তু আমার যা উদ্দেশ্য ছিল তা যখন কাজে লাগাতে পারিনি তখন আমার অস্ত্রটা ওকে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। তার দুচোখে হিংসার চাহনি জ্বলজ্বল করছিল। পকেট থেকে রিভলবারটা বের করে তার দিকে এগিয়ে দিলুম-সে ওটা দেখার পর বন্দুকের নল সরিয়ে নিল। তার পর বলল-যা বলছি। লিখে ফেলল।

ওর কথা মতো কর্নেলকে চিঠিটা লিখে তার তলায় নাম সই করলুম। চিঠিটা সে আমার হাত থেকে নিয়ে পড়ে দেখল। তার পর ড্রাইভারকে ডেকে সে বলল–এটা নিয়ে গিয়ে কার হাতে দিবি তা বুঝতে পারছিস।

ড্রাইভার এবার হিন্দিতে বলল–জি হাঁ সাব।

 তাহলে দেরি করিস না। গাড়ি একটু তফাতে রেখে। চিঠিটা দিয়ে যতক্ষণ না সে ফিরে আসে তুই অপেক্ষা করবি। তবে আমাকে এখানে আর পাবি না। আমি আমার নিজের ডেরায় থাকব। এই ছোকরাকে সেখানে নিয়ে যাব।

ড্রাইভার চিঠিটা নিয়ে বেরিয়ে গেল। তার পর আমারই রিভলবারের নল আমাকে তাক করে অন্য হাতে বন্দুক নিয়ে তাগড়াই চেহারার লোকটা বলল–চলো।

আমি বাইরে বেরুতেই সে ডাকল–তোরা এখানে আয়রে। সেই পিস্তল আর বন্দুকধারী লোক দুটো বারান্দার কাছে এল। দাড়িওয়ালা বলল-ঘরের ভিতরে দড়ি আছে, নিয়ে এসে এর হাত দুটো পিছন থেকে বেঁধে ফেল।

তারা দুজনে যখন আমার হাত দুটো পিছন দিয়ে বাঁধছে নিজের ওপর আমার রাগ হল। কর্নেল বলেন-তুমি বোঝো সবই কিন্তু বড় দেরিতে। কথাটা খুব সত্যি। আমি চারটে নরহত্যা করে অনায়াসে পালিয়ে যেতে পারতুম। এর দায় পুলিশ কোনওভাবেই চাপাতে পারত না। কিন্তু সেই শুভ মুহূর্ত হাতছাড়া করেছি।

তারা টানতে টানতে আমাকে বাড়িটার পিছনের জঙ্গলে ঢোকাল। বেলা পড়ে এসেছে কিন্তু বোঝা যাচ্ছে জায়গাটা একটা টিলার মাথায় তাই সূর্যের আলোর ছটা এখনও সবকিছু স্পর্শ করছে। একটু পরেই সব স্পষ্টতা চলে গেল। জঙ্গলের ভিতরে ঘন ছায়া। তার পর দেখলুম বড়বড় পাথরের চাই ইতস্তত পড়ে আছে। সেগুলোর মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে একখানি সুন্দর একটা বাংলো বাড়ি দেখতে পেলুম। বাড়ির ওপাশে একটা নদীও চোখে পড়ল। পিস্তলওয়ালা লোকটি আমাকে দড়ি ধরে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছিল। বন্দুকওয়ালা লোকটি মনিবের হুকুমে এগিয়ে এগিয়ে বাংলোর গেটের তালা খুলল। তার পর দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে আলো জ্বেলে দিল। এতক্ষণে বুঝতে পারলুম আমাকে খুব বেশি দূরে নিয়ে আসা হয়নি। আঁকাবাঁকা পথে ঘুরতে ঘুরতে গাড়িতে এসেছে। যাতে আমি বুঝতে না পারি কোথায় যাচ্ছি। কিন্তু এটা তো সিংহগড়ের সেই নিউটাউনশিপ এরিয়া, সকালে যেখানে কর্নেল আর আমি প্রতিমাদেবীর বাড়িতে এসেছিলুম। কিন্তু এখন বুঝতে পারছিলুম না আমি, কোনও বাংলো বাড়িতে আমাকে বন্দি করে রাখা হচ্ছে। প্রথমে বসার ঘর তার পর দরজা খুলে একটা অপ্রশস্ত ঘরে আমাকে ঢোকানো হল। ঘরে একটা খাঁটিয়া পাতা আছে। তার উপর একটা বিছানা আর বালিস। বোঝা গেল এঘরে বাংলো বাড়িটার সাধারণ কর্মী বাস করে। একদিকে মাত্র একটা ঘুপচি জানলা। জানালার বাইরেটা অন্ধকার। সেই ঘরে আমাকে ঢুকিয়ে দিল। এক অসহ্য অবস্থা। কিন্তু কিছু করার নেই। শুধু ভাবতে থাকলুম শেষ অবধি। কর্নেল নিশ্চয় এমন একটা কিছু করবেন যাতে আমি এই নিষ্ঠুর বজ্জাতদের হাত থেকে প্রাণে বেঁচে যাই।

অনেক চেষ্টা করেও এক পাশে কাত কিংবা চিত হতে পারলুম না কারণ হাতটা এমনভাবে বেঁধেছে যে একটু নড়তে গেলে প্রচণ্ড ব্যথা করছে। অগত্যা ওই অবস্থায় শুয়ে রইলুম।

মুখে টেপ যেন আরও এঁটে গেছে। ঠোঁট দুটো ব্যথা করছে। অনেক চেষ্টা করেও হাতের বাঁধন আলগা করা গেল না। এখন শুধু প্রতীক্ষা। মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা। কিংবা কর্নেল নামক জীবনের জন্য প্রতীক্ষা।

.

০৯.

কিছুক্ষণ ওই অবস্থায় থাকার পর দেয়ালের দিকে কাত হবার চেষ্টা করলুম এই অবস্থায় সেটাও কঠিন, কিন্তু একটা কিছু করতেই হবে। নিজের চেষ্টার ওপর ভরসা। ফিরে এল যখন চিত হয়ে শুতে পারলুম। তার পর উঠে বসার জন্য চেষ্টা করতে থাকলুম। দুটো পা বিছানার নিচের দিকে একটু একটু করে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গেলুম। পা মেঝে স্পর্শ করার পর এতক্ষণে দুপায়ে ভর দিয়ে একটানে উঠে বসলুম। পেছন দিকে হাত বাঁধা থাকলে শরীরকে ইচ্ছেমতো চালনা করা যায় না। আমার সামনে হাত তিনেক দূরে দরজা। তা বাইরে থেকে বন্ধ করা আছে। ঘরের ভিতর উঁচুতে একটা কম পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। মুখ ঘুরিয়ে দেখে নিলুম। হাতের দড়ি কাটার কোনও অস্ত্র আছে কি না। কিছুই চোখে পড়ল না।

এইটুকু পরিশ্রমেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। এবার পেছনে দুহাতের কব্জিতে বাঁধা মোটা দড়িটা টানাটানি করে খোলার চেষ্টা করলুম কিন্তু দড়িটা এমনভাবে বাঁধা, টানাটানিতে একটু আলগা হলেও তা খোলা দুঃসাধ্য মনে হল।

এবার কী করব ভাবছি। এমন সময় বাইরে চাপা কথাবার্তার শব্দ কানে এল। তার পর এ ঘরের দরজার কপাটে তালা খোলার শব্দ শুনতে পেলুম। তখনই সাবধানে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার পাশে দেওয়ালের এক কোণে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। আমি মরিয়া হয়ে উঠেছিলুম। যা কিছুই ঘটুক এবার আমাকে একটা চান্স নিতেই হবে।

দরজাটা খুলে গেল এবং সেই পিস্তলধারী লোকটা চাপাস্বরে বলে উঠল একি জানালা দিয়ে পালাল নাকি।

তার পর সে ভিতরে এক পা বাড়াতেই আমি তার ঘাড়ের নিচে প্রচণ্ড জোরে আমার মাথা দিয়ে আঘাত করলুম। অমনি সে বিছানার উপর পড়ে গেল। আমি এক সেকেন্ডও দেরি না করে পা দিয়ে কপাটগুলো ঠেকিয়ে দিলুম। পরমুহূর্তে ওর কোমরে বসে পড়লুম। মট করে একটা শব্দ হল। তার আধখানা শরীর ছিল বিছানার উপরে আধখানা নিচে। সে ককিয়ে উঠেই চুপ করে গেল। তার হাতের দেশি পিস্তলটা এক পাশে ছিটকে পড়েছিল। সেটা পা দিয়ে বিছানার তলায় ঠেলে দিলুম। লোকটার আর সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। সে ধনুকের মতো বাঁকা অবস্থায় পড়ে রইল। অনুমান করলুম তার মেরুদণ্ডের কোনও অংশ নীচে নিশ্চয়ই ভেঙে গেছে এবং সে অজ্ঞান হয়ে গেছে। এবার দরজার দিকে ঘুরে খুব সাবধানে ভেজানো দরজা প্রায় নিঃশব্দে খুলে উঁকি মারলুম। ঘরের ভিতরে আলো নেই। শুধু বাইরের আলোর একটু ছটা পড়েছে। বাইরের দরজার পাশে বন্দুক হাতে ছায়ামূর্তির মতো সেই লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারলুম এঘরে যে ঘটনা ঘটেছে তা সে টের পায়নি। তা ছাড়া সম্ভবত ওদের মনিবও এখন এখানে নেই। আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর দেখলুম বন্দুকওয়ালা লোকটা বাঁ দিকে বারান্দার ওপর এগিয়ে গেল। এবার আমি খুব সাবধানে পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়ে খোঁজার চেষ্টা করলুম। ঘরের মেঝেয় কার্পেট বিছানো তাই আমার হাঁটা-চলার শব্দ হল না। ডান দিকে একটা দরজা খোলা ছিল। সেখানে গিয়ে দেখি, সেটাই ডাইনিং এবং কিচেন। ঘরে আলো না থাকলেও আমি যে ঘরে বন্দি ছিলুম সেই ঘরের বাল্বটা কিচেনে আলো ছড়াচ্ছিল। বোঝা গেল আমি কিচেন সংলগ্ন ঘরেই বলি ছিলুম। এবার কিচেনের একটা তাকে ছুরি চোখে পড়ল। তাকটা আমার বুকের সমান উঁচু। আমি পেছন দিকে ঘুরে বাঁধা হাতদুটো অনেক কষ্টে তুলে ছুরিটা ডানহাতের মুঠোয় ধরে একটু আড়ালে সরে গেলুম তার পর ছুরির উপর বাঁ হাতের বাঁধনটা ঘষতে শুরু করলুম। ছুরিটা ধারাল। বাঁহাতের দড়ি কেটে গেল। এবার মুক্ত বাঁহাত এবং দড়িবাঁধা ডান হাত সামনে এনে ডাইনিং টেবিলের উপর ডান হাত রেখে বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতের দড়িটা দ্রুত কেটে ফেললুম। তার পর মুখে আঁটা টেপটা খুলতে কষ্ট হল না। তার পর ছুরিটা হাতে নিয়ে উঁকি মেরে বন্দুকধারী লোকটাকে খুঁজলুম। কিন্তু তাকে দেখতে পেলুম না। এবার আমি যে ঘরে বন্দি ছিলুম সেই ঘরে গিয়ে বিছানার তলা থেকে দেশি পিস্তলটা বের করে পরীক্ষা করলুম। দেখলুম বুলেট কেসে অনেকগুলো গুলি ভরা আছে। আশ্চর্য লাগল, এগুলি সবই থ্রি-নট-থ্রি বুলেট! লম্বা নলওয়ালা এই পিস্তলটা যে দেশি তা আমি দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম। এতে থ্রি-নট-থ্রি বুলেট ব্যবহার করার ব্যবস্থা দেখে অবাক লাগল। আর দেরি করা চলে না। আমি ভেতরের ঘর দিয়ে এগিয়ে বাইরের বারান্দায় সাবধানে উঁকি দিলুম। দেখলুম বন্দুকওয়ালা লোকটা একটা চেয়ারে বসে সিগারেট টানছে। দরজা থেকে তার দূরত্ব বড়জোর তিন মিটার। আমি তাকে রিভলবার দেখিয়ে বন্দুকটা কেড়ে নিতে পারি হয়ত। তাকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য একটা গুলি ছোঁড়ার দরকার হতেও পারে।

আর দেরি করা চলে না। সিদ্ধান্ত নিয়েই দরজা দিয়ে বেরিয়ে এক লাফে এগিয়ে গিয়ে তার বুকে পিস্তলের নল ঠেকিয়ে বললুম, চুপ একটি কথাও না। আচমকা আক্রমণে তার হাতের বন্দুক পড়ে গিয়েছিল। বন্দুকটা পা দিয়ে টেনে আমার পিছন দিকে সরিয়ে দিলুম। তার পর তাকে চাপাস্বরে বললুম–চুপ করে এখানে বসে থাকবে। একটু নড়লে বা চিৎকার করলে আমি গুলি করব। সে ভয়ে ভয়ে বসে পড়ল। আমি তার বন্দুকটা তুলে নিয়ে কার্টিজ কেস খুলে দেখলুম একটা চার নম্বর কার্টিজ ভরা আছে। বন্দুকটা আবার ঠিক করে নিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেটের কাছে গেলাম। দেখলুম গেটটা বাইরে থেকে তালাবন্ধ। লোহার গরাদ দেওয়া গেট তাই সেটা ডিঙিয়ে যেতে অসুবিধা হল না। বাংলো থেকে কোনও আলো আসছিল না। কারণ এই দাড়িওয়ালা নোকটা বাংলোর আলো নিভিয়ে দিয়ে গেছে। বেরিয়ে গিয়েই সংকীর্ণ পিচের রাস্তায় দাঁড়িয়ে মনে হল আমি ভুল ভেবেছিলুম। এটা নিউটাউনশিপ এলাকা নয়, কারণ কাছাকাছি আর কোনও বাড়ি নেই। শুধু দূরে উত্তর দিকে গাছপালার ভিতর আলো দেখা যাচ্ছে। আমি সেই আলো লক্ষ্য করে কিছুটা এগিয়ে গেছি পিছন থেকে গাড়ির আলোর ছটা রাস্তায় পড়ল। ভাগ্যিস আমি রাস্তার ধারে ঝোপঝাড় এবং গাছপালার আড়াল দিয়ে হাঁটছিলুম। থমকে দাঁড়িয়ে পিছু ফিরে দেখলুম একটা গাড়ি এসে সেই দাড়িওলা লোকটার বাংলোর সামনে থামল। তার পর আলো নিভে গেল, ওটা যে সেই কালো অ্যাম্বাসাডার তা বুঝতে অসুবিধা হল না। আমি এবার গুঁড়ি মেরে এগিয়ে গিয়ে রাস্তায় উঠলুম তার পর বন্দুক কাঁধে এবং পিস্তলটা পকেটে ভরে কাটতে থাকলাম। হঠাৎ মনে হল আমার রিভলভারটা শয়তান দাড়িওয়ালা ঝেড়ে নিয়েছে। আমি কী করে সেটা তার কাছ থেকে উদ্ধার করব।

 এবার অতখানি মরিয়া হতে সাহস পেলুম না, ভাগ্যিস ওই লোকটা বাংলোয় ছিল না বলেই আমি নিজেকে মুক্ত করে আনতে পেরেছি। বরং এবার রাস্তা খুঁজে আমাকে কর্নেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতেই হবে। কিন্তু আমার হাতে বন্দুক দেখলে কেউ কি তার বাড়িতে আমাকে ফোন করতে দেবে? একটু ইতস্তত করার পর আমি বন্দুকটা রাস্তার ধারে একটা ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রেখে এগিয়ে গেলুম। এবার রাস্তার উপর আলো পড়েছে। বাঁ দিকে যে বাড়িটা দেখতে পেলুম সেই বাড়ির গেটের কাছে গিয়ে ডাকলুম কেউ কি আছেন, অমনি বাইরের আলোটা জ্বলে উঠল তার পর এক ভদ্রলোক হিন্দিতে প্রশ্ন করলেন–আপনি কাকে চান?

আমার ভাল হিন্দি আসে না তাই স্মার্ট হেসে ইংরাজিতে বললুম–আমি এদিকে এক বন্ধুর বাড়িতে এসেছিলুম কিন্তু তার বাড়ি খুঁজে পাচ্ছি না। তবে তার টেলিফোন নাম্বার আমি জানি। আপনি যদি আমাকে দয়া করে টেলিফোন করতে দেন বাধিত হব। ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বিধ্বস্ত চেহারা দেখে জিজ্ঞাসা করলেন কোথা থেকে আসছেন।

আমি বললুম–কলকাতায় থাকি। ট্রেন লেট করেছে। আমার বন্ধু প্রমোদ রায় শুধু বলেছিল নিউটাউনশিপ এরিয়ায় যাকে জিজ্ঞাসা করবে দেখিয়ে দেবে।

প্রৌঢ় ভদ্রলোক বললেন–প্রমোদ রায় এই নামেতে নিউ টাউনশিপে কেউ থাকে না।

বললুম–সে নতুন এখানে এসেছে। সরকারি অফিসার। বাংলোটা নিজের না। ভাড়া দিয়ে থাকে। আপনি যদি প্লিজ আপনার টেলিফোনটা ব্যবহার করতে দেন।

ভদ্রলোক বললেন–আসুন।

 ওঁর বসার ঘরে টেলিফোন ছিল। পর্দার ফাঁকে সম্ভবত তার স্ত্রী উঁকি মারছিলেন। আমি সোফায় বসে প্রথমে রাজবাড়িতে বিজয়বাবুকে ফোন করলুম। একটু পরে সাড়া এল, কে বলছেন?

বললুম–আপনি কি বিজয়বাবু বলছেন? আমি জয়ন্ত চৌধুরী।

বিজয়বাবু চমকে ওঠা কণ্ঠস্বরে বললেন–কী সর্বনাশ! আপনি এখন কোথা থেকে ফোন করছেন?

বললুম নিউটাউনশিপ থেকে এক ভদ্রলোকের বাড়ি থেকে।

বিজয়বাবু বললেন–ফোনে সব কথা বলা যাবে না। কর্নেল সাহেব আপনার খোঁজে বেরিয়ে গেছেন। ওঁর সঙ্গে পুলিশ ফোর্স আছে; আপনি জেনে নিন। যে বাড়ি থেকে ফোন করছেন তার নাম কী?

আমি ফোনের মাউথ পিসে হাত রেখে ভদ্রলোককে বললুম–আমার বন্ধুর খোঁজ পেয়ে গেছি। সে আমাকে নিতে আসছে। আপনি যদি দয়া করে আপনার নামটা বলেন। তাহলে সে এখান থেকে নিয়ে যাবে।

ভদ্রলোক বললেন–আমার নাম রামনাথ প্রসাদ। আমি একজন খনি ইঞ্জিনিয়ার, আপনি আপনার বন্ধুকে বলুন, আমার এই বাড়ির নাম্বার এ/৫, সেক্টর-৩।

আমি টেলিফোনে বিজয়বাবুকে কথাগুলো জানিয়ে দিলাম।

তিনি বললেন–বুঝেছি, অজয়কে পাঠাচ্ছি। সে এই এলাকার নাড়ি নক্ষত্র চেনে। ওর গাড়ি নেই। কর্নেল সাহেব আমার গাড়িটা নিয়ে গেছেন। বরং অজয়কে বলছি এখনে প্রাইভেট কার ভাড়া পাওয়া যায়। ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি থেকে একটা গাড়ি নিয়ে আপনাকে নিয়ে আসবে। কারণ বুঝতেই পারছেন সিংহের গুজবে সন্ধ্যার পর থেকে কোনও রিকশাওয়ালা রাস্তায় বেরোতে চায় না।

টেলিফোন রেখে আমি ভদ্রলোককে বললুম–অসংখ্য ধন্যবাদ। আমার বন্ধু একটু অসুস্থ তাই সে এক ভদ্রলোককে গাড়ি নিয়ে পাঠাচ্ছে। আমি বরং গেটের কাছে গিয়ে অপেক্ষা করি। রামনাথবাবু স্মিতভাবে একটু হেসে বললেন আপনাকে খুব বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে। অন্তত এক কাপ চা খান। বলে তিনি তার স্ত্রীকে চোখের ইশরায় চা করতে বললেন।

মিনিট দশের মধ্যেই গরম চা আর বিস্কুট এসে গেল। বিস্কুট খেলুম না। চা খেয়ে শরীর অনেকটা চাঙ্গা হল। আরও দশ মিনিট বসে থাকার পর গেটের কাছে আসতে গাড়ির হর্ন বাজতে শোনা গেল। আমি তখনই তাকে এবং তার স্ত্রীকে নমস্কার করে বেরিয়ে এলুম। দেখলুম অজয়বাবু গাড়ির ব্যাকসিটে বসে আছেন। তিনি নামবার চেষ্টা করছিলেন। আমি বললুম, থাক আপনারা গাড়ি ঘুরিয়ে নিন। আমি যাচ্ছি। বলে আমি হন্তদন্ত পিছিয়ে গিয়ে সেই ঝোপ থেকে বন্দুকটা তুলে নিলাম তারপরে রামনাথবাবু যাতে না দেখতে পান সেই ভাবে শরীরের একপাশে লম্বালম্বি আড়াল করে এগিয়ে গেলুম। গেটের সামনে গাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল। এবার মুখ উল্টোদিকে ঘোরাল। আমি এগিয়ে গিয়ে ডানদিকের ব্যাকসিটে উঠে বসলুম। আমার হাতে বন্দুক দেখে অজয়বাবু চমকে উঠে বললেন–এটা কী!

চাপা স্বরে বললুম–কোনও কথা নয়। আগে আমরা নিরাপদ জায়গায় পৌঁছই তার পর সব বলব।

রাতের দিকে সত্যিই সিংহগড় নিঝুম হয়ে আছে। রাস্তাঘাটে আলো আছে, জনমানব নেই, রাজবাড়ির দরজার গেটের সামনে পৌঁছাতে মিনিট কুড়ি লাগল। আসলে ড্রাইভার শর্টকাট করে এগুতে গিয়ে গাড়ি খানাখন্দে পড়ে আটকে যাচ্ছিল। তাই এতটা দেরি। বুঝতে পারলুম যেন সিংহের ভয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে চাইছে।

অজয়বাবু ড্রাইভারকে বললেন–জগদীশকে বোলো কাল সকালে গিয়ে পেমেন্ট করে আসব। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে চলে গেল। অজয়বাবু দারোয়ানকে গেট বন্ধ করতে বললেন তার পর পোর্টিকোর নীচে গিয়ে দেখলুম বিজয়বাবু দাঁড়িয়ে আছেন। তার চেহারায় স্পষ্ট উদ্বেগের ছাপ। আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে তিনি উপরে তার ঘরে গিয়ে ঢাকালেন। আমি সোফায় হেলান দিয়ে বসে বন্দুকটা পাশে রাখলুম। অজয়বাবু ঘরে ঢুকেছিলেন।

বিজয়বাবু জিজ্ঞাসা করলেন–আপনি বন্দুক কোথায় পেলেন?

অজয়বাবু বললেন–আচ্ছা বরং এক কাপ চা বা কফি খেয়ে নিয়ে তার পর কথা শোনা যাবে।

বললুম, যাঁর বাড়ি থেকে ফোন করেছিলুম তিনি আমাকে চা পানে আপ্যায়িত করেছেন। আমি আগের মতো চাঙ্গা হয়ে গেছি।

বিজয়বাবু বললেন–এবার বলুন কী হয়েছিল?

আমি যতদূর সম্ভব সংক্ষেপে কী ঘটেছিল পুরোটাই দুজনকে শুনিয়ে দিলুম। দুই ভাই আমার সাহস এবং দক্ষতার প্রশংসা করলেন তার পর আমি বললুম এবার বলুন কর্নেলের কী খবর।

বিজয়বাবু যা বললেন, তা সংক্ষেপে এই :

ট্যুরিস্ট লজে গাড়ি পাঠাতে একটু দেরি হয়েছিল। কারণ ড্রাইভার কী একটা কাজে বাইরে গিয়েছিল। অজয়বাবুও বাড়িতে ছিলেন না। বিজয়বাবু গাড়ি নিজে ড্রাইভ করতে পারেন কিন্তু কর্নেল ঘরে থাকায় তিনি কর্নেলের পরামর্শে। ড্রাইভারের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তার পর ড্রাইভার এলে ট্যুরিস্ট লজে গাড়ি নিয়ে যায়। কিন্তু আমাকে খুঁজে পায়নি। একজন রিকশাওয়ালা সেখানে ছিল। সে বলেছিল–একজন বাবুকে একটা কালো রঙের অ্যাম্বাসাড়ার গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে যায়। জোর করে নয় তিনি নিজেই উঠে গিয়েছিলেন গাড়িতে। ড্রাইভার ফিরে গিয়ে কথাটা জানাতেই কর্নেল ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। তিনি তখনই থানায় ফোন করে খবরটা দেন। অবশ্য কর্নেল এখানে আসার আগেই পুলিশ সুপারকে তাঁর সিংহগড় আসার কথা জানিয়েছিলেন। কর্নেল কালো রঙের অ্যাম্বাসাডার সম্পর্কে পুলিশকে খোঁজ নিতে বলেছিলেন। তা ছাড়া একটা কালো অ্যাম্বাসাডার জয়ন্তকে তুলে নিয়ে গেছে তা খুঁজে বের করা খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজারই মতো অসম্ভব ব্যাপার। ঠিক পাঁচটা নাগাদ একটা লোক এসে গেটে দারোয়ানকে একটা চিঠি দেয়। কর্নেল তখন কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। চিঠিটা পেয়ে তিনি পত্রবাহককে একটু দাঁড়াতে বলেন। তার পর বেরিয়ে গিয়ে তাকে ধরে ফেলেন। কর্নেল তার হাত মুচড়ে ধরতেই তার কোনও দোষ নেই, ওখানে একটা কালো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, তার ড্রাইভার এই চিঠিটা দিয়ে একটা জিনিস আনতে বলেছে। টাকার লোভে একাজ সে করেছে। কর্নেল বাইনোকুলারে গাড়িটা দেখতে পান। গাড়িটার মুখ উল্টো দিকে ঘোরানো ছিল। ড্রাইভার বাড়ির কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে তার পাঠানো লোকটার অবস্থা দেখে তখনই গাড়িতে উঠে উধাও হয়ে যায়। তার পর কর্নেল বিজয়বাবুর গাড়িতে চেপে কালো গাড়িটাকে সম্ভবত অনুসরণ করার জন্য ছুটে যান। এখনও তিনি ফেরেননি। বিজয়বাবু এবং অজয়বাবু খুব চিন্তায় আছেন। তারা বার বার থানায় টেলিফোন করছেন। থানা থেকে টেলিফোন আসছে। কর্নেল সাহেব ওসি এবং পুলিশ ফোর্স সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেছেন। কোথায় গেছেন তা বলে যাননি।

.

১০.

অবশেষে কর্নেলের সাড়া এল টেলিফোনে। বিজয়বাবু রিসিভার তুলেছিলেন। তিনি বললেন–কর্নেল সাহেব কোথা থেকে বলছেন? …জয়ন্তবাবু কিন্তু ফিরে এসেছেন। আমার কাছেই বসে আছেন। বলে তিনি রিসিভারটা আমার হাতে দিলেন। আমি সাড়া দিতেই কর্নেলের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর ভেসে এল। জয়ন্ত তুমি নির্বিঘ্নে ফিরতে পেরেছ তো? বললুম–নির্বিঘ্নে ফিরতে পেরেছি বলা যায়। ফিরেছি নিরস্ত্র হয়ে। আমার অস্ত্রটা আপনার মতো দাড়িওয়ালা পেল্লাই চেহারার একটা লোক কেড়ে নিয়েছে।

কর্নেল বললেন–তাহলে এখনই তোমার থানায় আসা দুরকার। আমি থানায়। আছি। আমাদের অভিযান ব্যর্থ হয়েছে। যাইহোক, এবার তোমাকে আনতে পুলিশের গাড়ি যাচ্ছে। আশাকরি এখানে আমাদের শত্রুপক্ষের কোনও লোক নেই যে-কথাটা শুনে তোমাকে ট্রাপ করতে গাড়ি পাঠাবে। বললুম–আমার অস্ত্রের বদলে একটা বন্দুক পেয়েছি। সেটা হাতে নিয়েই যাব। তাতে একটা চার নম্বর কার্তুজ ভরা আছে। কর্নেল টেলিফোন রেখে দিলেন। কথাটা বিজয়বাবুকে বললুম। তিনি বললেন আমি টেলিফোনের কাছে বসে থাকছি, অজয় আপনাকে গেটের কাছে নিয়ে যাবে।

অজয়বাবু বললেন–হ্যাঁ তাকে শনাক্ত করার চেষ্টা করেছি কিন্তু এখনও বুঝতে পারছি না। তবে দাদা আর কর্নেল সাহেব দারোয়ানের কাছে জানতে পেরেছেন। হরিয়া নামে যে ছোকরা মালির ভাগ্নে, সম্ভবত সেই শত্রুপক্ষকে খবরটা দিয়েছিল কারণ ড্রাইভারকে ডাকতে পাঠিয়ে ছিলুম হরিয়াকে দিয়ে। কর্নেল সাহেবের বিশ্বাস হরিয়া তখনই এ কাজটা করেছে আর আমাদের ড্রাইভারও এসে বলল সে রাস্তার ধারে বসে তাস খেলছিল। হরিয়াকে সে ছুটে যেতে দেখে। তার পর ড্রাইভার একটা কালো অ্যাম্বাসাডারও দেখতে পেয়েছিল। হরিয়া তার পর ফিরে এসে ড্রাইভারকে বলে–তোমাকে সাহেবরা ডাকছেন।

বললুম–হরিয়া এখন কোথায়?

অজয়বাবু বললেন–সে এখন থানার হাজতে ঢুকেছে।

গেটের একটা পাশ খোলা ছিল। সেই দিক দিয়ে আমরা বেরিয়ে গেলুম। আমার হাতে বন্দুক। রাজবাড়ির সামনের রাস্তায় ল্যাম্পপোস্ট থেকে আলো ছড়াচ্ছিল। রাত্রে এখানে কুয়াশা দেখা যায় তাই এখন আলোর ছটায় কুয়াশা সবকিছু আবছা করে তুলেছিল। একটু পরেই দুরে জোরাল দুটো আলো দেখা গেল। বুঝতে পারলুম পুলিশের গাড়ি আসছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই একটা জিপ এসে দাঁড়িয়ে গেল। একজন পুলিশ অফিসার আমাকে নমস্কার করার পর অজয়বাবুকে নমস্কার করে বললেন–কি মিঃ সিংহ চিনতে পারছেন?

অজয়বাবু সহাস্যে বললেন–আরে ছোটবাবু যে। আপনার সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয় না। যাই হোক, আপনাকে দেখে ভরসা হল। কর্নেল সাহেবের সঙ্গী। জয়ন্তবাবুকে আপনি নিয়ে যান।

জিপগাড়ির সামনের সিটে আমাকে উনি বসতে বললেন। তার পর আমার পাশেই উনি বসলেন। বললেন–একটু কষ্ট হবে কিন্তু এই জিপটার পিছনদিকে আর্মি ও ফোর্সের বসার জায়গা আছে। কাঠের বেঞ্চে আপনি বসতে পারবেন না।

কথাটা বলে তিনি আমার হাতে বন্দুকটা দেখে বললেন–আপনি কি সব সময় বন্দুক হাতে ঘোরেন?

আমি একটু হেসে বললুম–না; এটা যারা আমাকে কিডন্যাপ করেছিল তাদের একজনের বন্দুক। আমি এটা হাতিয়ে নিয়ে চলে এসেছি আর একটা দেশি পিস্তলও হাতাতে পেরেছি। সেটা আমার প্যান্টের পকেটে আছে। থানায় গিয়ে দেখতে পাবেন।

থানার ছোটবাবু বাঙালি। তিনিও হাসতে হাসতে বললেন–আপনি দেখছি। একজন গ্রেট অ্যাডভেঞ্চারার, কর্নেল সাহেবের কথা আগেই বড়বাবুর কাছে শুনেছিলুম। আজ সন্ধ্যার অভিযানে তাদের সঙ্গী হবার সুযোগ পাইনি।

বললুম–আপনি বাঙালি! আপনার বাড়ি কি বিহারে না অন্য কোথাও! ছোটবাবু বললেন–আমার বাড়ি এখানেই। এই সিংহগড়ে। আমার নাম মৃণাল চ্যাটার্জি। বছর দুই হল অনেক চেষ্টা করে এই থানায় বদলি হতে পেরেছি। এর আগে ছিলুম রামপুরে। সে একটা সাংঘাতিক জায়গা।

একটু হেসে বললুম যা ঘটে গেল তাতে দেখছি এটাও সাংঘাতিক জায়গা। মৃণালবাবু একটু গম্ভীর হয়ে বললেন হ্যাঁ, আমার ছেলেবেলায় সিংহগড়ের দুর্নাম ছিল। কিন্তু তার পর এটা শিল্পনগরী হয়ে ওঠায় অনেক ভদ্রলোক এসে বসবাস করেন। গত দুবছরে এখানে কিন্তু তেমন কোনও খারাপ ঘটনা ঘটে নি। এবারই কেন জানি না আপনাকে কারা কিডন্যাপ করেছিল তা ছাড়া আমার ছোটবেলার মতো আবার এখানে সিংহের গর্জন শোনা গেছে বলে গুজব রটেছে। স্থানীয় লোকেরা বলেছেন একটা কিছু ঘটবে। আমরা অবশ্য অ্যালার্ট আছি।

রাত্রের দিকে রাস্তাঘাট বাজার এলাকা সবই জনমানবহীন। শুধু রাস্তার, কুকুরগুলো এখানে ওখানে জটলা পাকিয়ে চেঁচামেচি করছে। বাজার ছাড়িয়ে গিয়ে ডাইনে ঘুরে কিছুটা চলার পর থানার গেটের সামনে জিপ দাঁড়াল। আমি বন্দুক হাতে মৃণালবাবুর সঙ্গে থানায় গিয়ে ঢুকলুম। বড়বাবু অর্থাৎ অফিসার-ইন-চার্জের ঘরে আমাকে নিয়ে গেলেন মৃণালবাবু। আমি ঘরে ঢুকতেই কর্নেল সহাস্যে বলে উঠলেন–বাঃ! জয়ন্ত একেবারে বন্দুক লুট করে এনেছ। বড় টেবিলের ওপাশে প্রায় দৈত্যকার শ্যামবর্ণ এক গুফো ভদ্রলোক পুলিশের পোশাক পরে বসেছিলেন। তিনি হাত বাড়িয়ে বললেন কাম অন মিঃ চৌধুরি। তাঁর সঙ্গে করমর্দন করতে গিয়ে বুঝলুম ইনিই বড়বাবু। আমি কর্নেলের পাশে বসলুম তার পর বললুম– কিডন্যাপারদের কাছ থেকে শুধু বন্দুকটাই আনিনি, ওদের একটা দেশি পিস্তল কেড়ে এনেছি। কিন্তু এটার বুলেট কেস খুলে দেখলে অবাক হয়ে যাবেন। দেশি পিস্তলে থ্রি-নট-থ্রি বুলেট ভর্তি আছে।

প্যান্টের পকেট থেকে পিস্তলটাও বের করলাম। প্রথমে কর্নেল সেটা পরীক্ষা করে দেখলেন। তার পর বড়বাবুকে দিলেন। আমি বন্দুকটা এবার বড়বাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললুম–আইনত এটা আপনাদের কাস্টডিতে জমা থাকবে।

কর্নেল আমাকে খুঁটিয়ে দেখছিলেন। তাঁর মুখের চুরুট নিভে এসেছিল। লাইটার জ্বেলে আবার ধরিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছাড়লেন তার পর বললেন–তোমার একটা স্টেটমেন্ট দরকার। বাংলো থেকে শুরু করে উদ্ধার হয়ে ফিরে আসা পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে সব তুমি ও.সি. সাহেবকে বলো। উনি তোমার স্টেটমেন্ট লিখে সই করিয়ে নেবেন।

বড়বাবু একটা মোটা প্যাড বের করলেন। কাগজের ফাঁকে কার্বন পেপার গোঁজা আছে। আমি যা কিছু ঘটেছে সবটাই বর্ণনা করলুম। তার পর সই করে দিলুম।

কর্নেল বড়বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন–মিঃ শর্ম, ওই বাংলোটা কি আপনি ডিটেক্ট করতে পারছেন?

ও.সি. সিংশৰ্মা ভুরু কুঁচকে গোঁফে তা দিচ্ছিলেন। একটু পরে বললেন–যতদূর মনে হচ্ছে ওটা নিউটাউনশিপের উত্তরে যে, কয়েকটা পুরনো বাংলো আছে। সেগুলোর মধ্যে একটা হতে পারে। নদীর ধারে যখন, তখন বাংলোটা–এক মিনিট। বলে তিনি টেবিলের নিচে বোতাম টিপলেন।

একজন কনসটেবল এসে সেলাম দিল।

ও.সি.মি শর্মা বললেন–রমেশজি কো. বোলাও।

কনসটেবল চলে যাবার একটু পরে একজন ফর্সা চেহারার প্রৌঢ় অফিসার এসে আমার পাশে বসলেন। মিস্টার শর্মা আমার পরিচয় দিয়ে বললেন–প্রথম কথা এই বন্দুক আর পিস্তলটা আমাদের কাস্টডিতে মিস্টার চৌধুরী জমা দিচ্ছেন তার একটা রিসিট করে দিতে হবে। এগুলি কোথায় পেয়েছেন সেগুলি ওঁর স্টেটমেন্টে আছে। এবার দ্বিতীয় কথা–আপনি তো এ থানায় আমার চেয়ে বেশি দিন আছেন। নিউটাউনশিপের উত্তরে নদীর ধারে কয়েকটা পুরনো আমলের বাংলো বাড়ি আছে। ঠিক প্রথম বাড়িটা কার আপনি জানেন?

রমেশজি একটু হেসে বললেন ওটার মালিক তো হাজারিলাল চৌবে। উনি ওখানে মাঝে মাঝে গিয়ে বাস করেন। নতুন বাড়ি করেছেন বাজারের পূর্বদিকে। নীচের তলায় ওঁর কারবারের গদি। উপরতলায় উনি বাস করেন।

মিস্টার শর্মা বললেন–তাহলে আমরা একবার বেরুতে চাই। হাজারিলালজির টেলিফোন নম্বর কি আপনি জানেন?

রমেশবাবু বুক পকেট থেকে একটা নোটবই বের করে পাতা উল্টে নম্বরটা খুঁজে বের করে বললেন–লিখে নিন স্যার।

মিস্টার শর্মা একটা নোট বইয়ে নম্বরটা লিখে নিয়ে রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন। তখনই সাড়া পাওয়া গেল।

মিস্টার শর্মা বললেন–আমি থানা থেকে ও.সি. বলছি। চৌবেজি আপনার পুরনো বাংলো কি এখন খালি আছে। নাকি কাউকে ভাড়া দিয়েছেন…

…কী নাম বললেন? চন্দ্রনাথ হাজরা? আপনার চেনা লোক?… ও আপনার শ্যালকের বন্ধু। আপনার শ্যালক কি এখানে আছেন?…

ও! বন্ধুকে পৌঁছে দিয়ে চলে গেছেন। ঠিক আছে। রাখছি। কারণটা পরে জানাব। নমস্তে…

রিসিভার রেখে মিঃ শর্মা কর্নেলের দিকে তাকালেন। কর্নেল বললেন–আমার মনে হয় এখনই বেরানো দরকার। জয়ন্ত যে লোকটিকে ছুঁ মেরেছে তাকে হয়তো এখন পাওয়া যাবে না, কারণ জয়ন্ত পালিয়ে আসার পর কোনও একসময় চন্দ্রকান্তবাবু সেখানে গেছেন।

কর্নেল বললেন–কালো অ্যাম্বাসাডারটার খোঁজ আশা করি রাতের মধ্যেই পাওয়া যাবে।

মিস্টার শর্মা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, হয়তো পাওয়া যেতে পারে, এখানে কালো অ্যাম্বাসাডার তত দেখা যায় না, এখন হাল আমলের গাড়ি সবাই ভালবাসে। যাইহোক, রমেশজি এই আর্মস দুটোর রিসিট রেডি করে রাখুন। পরে আমরা এসে নেব। কর্নেল এবং আমি আগে ঘর থেকে বেরোলাম। পিছনে ও.সি. মিঃ শর্মা–তিনি বললেন–আপনারা গেটের ওখানে গিয়ে দাঁড়ান। আমি রাজবাড়ির ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি পার্কিং জোন থেকে গাড়িটা গেটের সামনে নিয়ে আসতে। আমাদের জিপ আর একটা ভ্যান আপনার গাড়িকে এসকর্ট করে নিয়ে যাবে।

গেটে গিয়ে দাঁড়ানোর কিছুক্ষণ পরেই ছাইরঙা একটা ফিয়াট গাড়ি এসে দাঁড়াল। কর্নেল ড্রাইভারকে বললেন–তোমার কষ্ট হয়নি তো কিছু? ড্রাইভার বেরিয়ে সেলাম দিয়ে বলল–আমি সেপাইদের সঙ্গে গল্প করছিলুম। তাস খেলছিলুম।

কর্নেল বললেন–আরও কিছুক্ষণ তোমাকে কষ্ট করতে হবে। আমরা আর এক জায়গায় হানা দেব তার পর সেখান থেকে রাজবাড়ি।

কর্নেল তার অভ্যাসমতো ড্রাইভারের পাশের সিটে বসলেন। আমি বসলুম তার পিছনে। আমাদের সামনে ওসি শর্মার জিপ। জিপের পেছন দিকে একজন অফিসার এবং কয়েকজন কনসটেবল। আমাদের পিছন দিকে একটা প্রিজন ভ্যান। গাড়ি মোড় ঘুরে উত্তরের দিকে চলল। কিছুটা চলার পর ডান দিকে ঘনবসতি এলাকা। রাস্তা জনহীন। বাঁদিকে গাছপালা ও ঝোপঝাড়ের মধ্যে একটা করে বাংলোর মতো বাড়ি। কিন্তু আমাদের অনেক ঘুরে নদীর সমান্তরালে দক্ষিণ দিকে এগোতে হল। কোনও কোনও বাংলো বাড়িতে আলো জ্বলছে কিন্তু এদিকটা গাছপালায় ঢাকা। কিছুটা চলার পর রাস্তার বাঁ ধারে একটা বাংলোর মাথায় আলো জ্বলতে দেখলুম। জিপটা এগিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। আমাদের গাড়ি দাঁড়াল এবং পিছনে ভ্যান দাঁড়িয়ে গেল। তার পর দেখলুম পুলিশ অফিসার ও কনস্টেবলরা জিপ থেকে নেমে বাড়ির গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন। ওদিকে প্রিজন ভ্যান থেকে আরও কয়েকজন লাঠি ধারী কনস্টেবল বাংলোর চারপাশটা ঘিরে ফেলল। তাদের প্রত্যেকের হাতে টর্চ। গাড়ি থেকে নেমেই আমি বাংলোটা চিনতে পারলুম। দেখলুম বাংলোতে দারোয়ানের সেই চেয়ারটা এখনও আছে। কিন্তু সেই লোকটা বসে নেই, বাংলোর গেটে বাইরে থেকে তালা। একজন অফিসার একজন কনস্টেবলকে ডেকে তালাটা ভাঙার নির্দেশ দিলেন। কর্নেল এগিয়ে গিয়ে বললেন আমার কাছে মাস্টার কি আছে। তালা খোলা কঠিন হবে না। দেখছি এটা সাধারণ তালা।

কর্নেল অনায়াসে তালাটা খুলে ফেললেন। তার পর আমরা ভেতরে গেলুম। গিয়ে দেখলুম বাংলোর দরজায় তালা দেওয়া আছে। কর্নেলের পিঠে কিট ব্যাগে অনেক সরঞ্জাম থাকে। তিনি সেখান থেকে একটা স্কুড্রাইভার, হাতুড়ি বের করে তালাটা খুলে ফেললেন। তার পর ভেতরে টর্চের আলো ফেলে দেখে নিয়ে ঢুকে পড়লেন। তিনি সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিলেন। ঘরের ভেতরে কেউ নেই। আমাকে যে ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল সে ঘরের দরজা খোলা। সেই অজ্ঞান লোকটি নেই। বেডরুমে তালা আঁটা ছিল। এই তালাটাও কর্নেল সহজেই খুলে ফেললেন তার পর ভেতরে ঢুকে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিলেন। বিছানার ওপর বেডকভার চাপানো। বেড কভারটা তুলে ফেললেন। তার পর বালিস দুটো সরাতেই অবাক হয়ে দেখলুম আমার রিভলবারটা বালিসের তলায় যত্ন করে রেখে গেছে সেই দাড়িওয়ালা লোকটা। এটা কি তার ইচ্ছাকৃত। নাকি এটা সঙ্গে নিয়ে গেলে দৈবাৎ যদি সে ধরা পড়ে তার বিপদ হবে। কর্নেল অস্ত্রটা তুলে নিয়ে বললেন– মিস্টার শর্মা এই পয়েন্ট বাইশ ক্যালিবারের সিক্স রাউন্ডার রিভলভারটার মালিক জয়ন্ত চৌধুরী।

–জয়ন্ত তোমার পকেটে কাগজপত্র নিয়ে কি বেরিয়েছিলে?

বললুম–হ্যাঁ। তার পর পকেট থেকে লাইসেন্সবুকটা বের করে মিঃ শর্মার হাতে দিলুম। উনি টর্চের আলোয় নাম্বার মিলিয়ে দেখার পর একটু হেসে বললেন–পরে আপনি আর একটা স্টেটমেন্টে উল্লেখ করবেন আপনার হারানো অস্ত্রটা কী করে পাওয়া গেছে। ওটা আপনি এখনই নিয়ে নিন।

রিভলবারটার বুলেট কেস দেখে কথাচ্ছলে বললুম শয়তানটা একটা বুলেট রাখেনি। ছটা বুলেট বের করে নিয়েছে।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, তোমাকে আবার নিরস্ত্র করে গেছে।

.

১১.

সে রাতে ট্যুরিস্ট লজে ফিরে যেতে প্রায় দশটা বেজে গিয়েছিল। রাজবাড়ির গাড়িটার সঙ্গে একটা পুলিশ জিপ আমাদের এসকর্ট করেছিল। ওটা কর্নেলের নয়, ওসি মিস্টার শর্মারই অতি সতর্কতা। তাঁর কাছ থেকে ফিরে আসার সময় তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন এ রাতে তিনিই সেই গুজবের সিংহ। ডিনারের পর কর্নেল বলেছিলেন-তোমাকে প্রথমে যে ঘরটাতে নিয়ে গিয়েছিল সেটা দিনের বেলায় কি খুঁজে বের করতে পারবে?

বলেছিলুম–পারব।

কর্নেল বলেছিলেন–আমি মিস্টার শর্মাকে বলে এসেছি ওই ঘরটা খুঁজে বের করতে। এবং সেই সঙ্গে আড়াল থেকে নজর রাখতেও বলেছি।

সে রাতে ঘুম আসতে চাইছিল না। বার বার মনে হচ্ছিল কি সাংঘাতিক রিক্স আমি নিয়েছিলুম। সম্ভবত কর্নেল আমাকে ঠাট্টা-তামাসা করে আমার বোকামি বা ভীরুতার কথা বলে থাকেন বলেই তাকে দেখাতে চেয়েছিলুম আমার মধ্যে বিপদে আপদে চ্যালেঞ্জ নেওয়ার ক্ষমতা আছে।

সবে ঘুমের টান এসেছে, এমন সময় বিরক্তিকর শব্দে টেলিফোনটা বেজে উঠল। কর্নেল টেলিফোনটা তার হাতের কাছেই টেনে নিয়েছিলেন, রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন।–

 কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি…প্রতিমা, কী ব্যাপার..সেকি, তোমার বাড়িতে তো ফোন নেই। এমন একটা ঘটনার পর তুমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে… না আমি বলছি আমাকে ফোন করে কোনও অন্যায় করোনি বরং সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাটা জানতে পেরে আমার সুবিধা হয়েছে।… তুমি সশস্ত্র কিন্তু অস্ত্র সব সময় কাজে না লাগতেও পারে। যেমন আজ জয়ন্ত সশস্ত্র থাকা সত্ত্বেও একটা লোকের পাল্লায় পড়েছিল। কাল মর্নিংএ গিয়ে বলব। যাই হোক, আমি থানার ওসি মিস্টার শর্মাকে তোমার ব্যাপারটা… জানাব না, কেন?… আচ্ছা ঠিক আছে। সাবধানে বাড়ি ফিরে যাও।

কর্নেল রিসিভার রেখে বললেন–জয়ন্ত কি ঘুমিয়ে পড়েছ?

বললুম–না, প্রতিমাদেবী কি কারও পাল্লায় পড়েছিলেন–আমার মতো? কর্নেল বললেন–তার বাড়িতে কেউ কখন ঢুকে পড়েছিল সে টের পায়নি। আদিবাসী মেয়েটিও জানতে পারেনি। তারা দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ার পর। দরজায় কেউ কড়া নাড়ে, তার পর চাপা গলায় প্রতিমাকে ডাকে। প্রতিমা জিজ্ঞেস করে লোকটা কে? সে খুব চাপা স্বরে বলে তুমি দরজা না খুললে আমাকে চিনতে পারবে না, আমি বিপন্ন। প্রতিমা বলে সে কে, তা না বললে দরজা খুলবে না। তখন লোকটা বলে তার কাছে নাকি সাংঘাতিক বোমা আছে। দরজা না খুললে সে বাংলো উড়িয়ে দেবে। তখনই প্রতিমা তার ফায়ার আর্মস এনে জানালার ফাঁক দিয়ে নল কাত করে এক রাউন্ড ফায়ার করে। সে লোকটার পায়ে গুলি ছুঁড়তে চেয়েছিল। কিন্তু তার পায়ে গুলি লাগেনি। সে ধুপধাপ শব্দে দৌড়ে পালিয়ে যায়। ততক্ষণে আদিবাসী মেয়েটি বুদ্ধি করে বারান্দার শীর্ষে রাখা বাল্বটা জ্বেলে দিয়েছিল। প্রতিমা জানালা দিয়ে দেখতে পায় গাছপালার ছায়ার আড়ালে একটা লোক পাঁচিল ডিঙিয়ে চলে গেল। প্রতিমা লক্ষ্য করেনি। কিন্তু তার আদিবাসী পরিচারিকা কুন্তি বলেছে লোকটার মাথায় বড় বড় চুল আর মুখে গোঁফ-দাড়ি ছিল।

আমি বলে উঠলুম তাহলে আমাকে যে বন্দি করে রেখেছিল সেই লোকটাই হবে।

কর্নেল বললেন–হাজারিলাল চৌবের ওই বাড়িটা সম্প্রতি ভাড়া করেছে। চন্দ্রনাথ নামে এক বাঙালি। কাজেই তার আসল নাম যাই হোক তাকে চন্দ্রনাথ বলেই ধরে নেব। চন্দ্রনাথ আমাদের এবং পুলিশের হামলা টের পেয়ে আগেই পালিয়ে গিয়েছিল। তার একটা আশ্রয়ের দরকার ছিল। অন্তত এ রাত্রের মতো। এও বোঝা যাচ্ছে চন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই প্রতিমার পরিচিত। যাক গিয়ে। আজ খুব ধকল গেছে। শুয়ে পড়ো।

বলে কর্নেল বিছানায় শুয়ে পড়লেন।

এলোমেলো নানা কথা ভাবতে ভাবতে আমিও কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। সেই ঘুম ভাঙল বাংলোর পরিচারকের ডাকে। সে আমার জন্য বেড টি এনেছিল কর্নেলের বিছানার দিকে ঘুরে দেখলুম বিছানা খালি তার মানে অভ্যাসমতো খুব ভোরবেলায় মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছেন।

পরিচারক আমার হাতে চয়ের কাপ প্লেট দিয়ে একটু হেসে বলল–বড়া সাব বাইরে গেছেন। উনি আমাকে বলে গেছেন ছোটা সাব যেন আটটার মধ্যে রেডি থাকেন।

বুঝতে পারলুম তার মানে আমরা বাইরে কোথাও ব্রেকফাস্ট করব। তখন সোয়া সাতটা বাজে। চা দ্রুত শেষ করে বাথরুমে গেলুম। তার পর গোঁফদাড়ি কামিয়ে এবং প্রাতঃকৃত্য সেরে বেরিয়ে এলুম। ছটা বুলেট শয়তানটা ইচ্ছে করেই নিয়ে গেছে। হঠাৎ মনে হল সে কি জানত আমার রিভলবার সে হজম করতে পারবে না? নাকি সে কর্নেলকে খুব ভয় করে? বাড়তি আরও এডজন বুলেট আমার কাছে ছিল। বরাবরই থাকে আমার রিভলবারটা আবার ছটা বুলেট লোড করে পকেটে রাখলাম। তার পর বারান্দায় গিয়ে একটা চেয়ারে বসে কর্নেলের অপেক্ষা করতে থাকলাম। কর্নেল ফিরে এলেন তখনও আটটা বাজেনি। যথারীতি তার পিঠে আঁটা আছে হ্যাঁভারস্যাকের মতো কিন্তু একটু লম্বাটে কিটব্যাগ। ব্যাগ থেকে প্রজাপতি ধরার জালের স্টিক উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গলায় ঝুলছে ক্যামেরা ও বাইনোকুলার। মাথায় টুপি। তিনি অভ্যাসমত সম্ভাষণ করলেন–মনিং ডার্লিং, আশা করি সুনিদ্রা হয়েছে।

বললুম–হ্যাঁ, কিন্তু আপনি তো কফি না খেয়ে বেরুবেন না।

কর্নেল বললেন–কফি খাওয়ার সময় নেই। আমাকে এই বেশেই বেরুতে হবে। গেটের কাছে বিজয়বাবু গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছেন। নিজেই ড্রাইভ করে এসেছেন। কর্নেল ভেতরে ঢুকে চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে তার পর বেরিয়ে এসে দরজায় তালা আটকালেন। তার পর বললেন–চলো, কফি খাব রাজবাড়িতে।

জিজ্ঞেস করলুম–আর কোনও নতুন খবর নেই তো।

তিনি বললেন–একটা ছোট খবর আছে। সেটা বড় খবরও হতে পারত। দৈবাৎ হয়ে ওঠেনি।

নিচের লাউঞ্জে ম্যানেজার আমাদের নমস্কার করলেন। আমরা বেরিয়ে গিয়ে লনে হাঁটতে থাকলাম। তখন বললুম–খবরটা কী?

কর্নেল বললেন–অজয়বাবুর মেয়ে সুজাতা একটু বেশি স্মার্ট। সে ভোরবেলা জগিং করতে বেরিয়েছিল। দারোয়ান ছোটেলাল তাকে নিষেধ করেছিল কিন্তু সে শোনেনি। নদীর ব্রিজ পর্যন্ত আসতেই সে দেখে একটা কালো অ্যাম্বাসাডার সামনের দিক থেকে এগিয়ে আসছে। ওইরকম গাড়িতে তোমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল। তাই সে সতর্ক হয়ে ওঠে। সে রাস্তা ডিঙিয়ে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে যায়। পুকুরপাড়ে ওদের বাড়ির একজন লোক দাঁড়িয়েছিল। সে তাকে কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক দিকে ভিতরে ঢুকতে সাহায্য করে। বাড়ি ঢুকে প্রথমে সে কাউকে কিছু বলেনি। তার হাবভাব দেখে তার মা কিছু আঁচ করেন। তখন সুজাতা কথাটা বলে দেয়।

অজয়বাবু নিরীহ মানুষ কিন্তু বিজয়বাবু কথাটা শোনামাত্র গাড়ি আর রাইফেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। তিনি প্রথমে যান জলপ্রপাতের দিকে তার পর ঘুরে আসছেন এমন সময় আমি রাস্তার ধারের একটা টিলা থেকে নেমে আসছিলাম। আমাকে দেখে তিনি দাঁড়িয়ে যান। তার পর তার গাড়িতেই ট্যুরিস্ট লজ অবধি এসেছি। তাঁর বাড়িতে আমাদের ব্রেকফাস্টের নেমন্তন্ন।

 বিজয়বাবুকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। তার পাশে রাইফেলটা খাড়া হয়ে আছে। কর্নেল তার বাঁ দিকে বসলেন। আমাকে দেখে বিজয়বাবু একটু হাসবার চেষ্টা করে বললেন–আসুন জয়ন্তবাবু গুজব রটেছিল একটা সিংহ এসে উৎপাত করছে। কিন্তু আসলে দেখছি সিংহটা হঠাৎ কালো রঙয়ের গাড়ি হয়ে গেছে।

বললুম–যে গাড়িটা সিংহের মতো আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল? বিজয়বাবু বললেন, তার পর গাড়িতে স্টার্ট দিলেন। ব্রিজ পেরিয়ে যাবার সময় তিনি বললেন–আচ্ছা কর্নেল সাহেব, আপনার কি মনে হয় না থানার কোনও পুলিশ প্রতিপক্ষের ঘুষ খেয়ে চুপ করে আছে। একটা কালো অ্যাম্বাসাডারকে এখনও খুঁজে বের করতে পারল না।

কর্নেল বললেন–গাড়িটা সম্ভবত এমন জায়গায় লুকিয়ে থাকে যে কেউ ভাবতেও পারে না সেখানে একটা গাড়ি আছে। এখন হাতে সময় থাকলে আমি গাড়িটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করতুম। কারণ রাত্রে শিশিরে গাড়ির চাকার দাগ ঘাসের জঙ্গলেও স্পষ্ট ফুটে ওঠার কথা।

রাজবাড়িতে পৌঁছনোর পর আমরা দোতালায় বিজয়বাবুর ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসলুম। কর্নেল টেলিফোনের কাছে গিয়ে রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন তার পর নিজের নাম বললেন–ওসি মিস্টার শর্মা কি এখন কোয়ার্টারে আছেন? …আচ্ছা ঠিক আছে তাকে এখন কিছু বলার দরকার নেই। আমি ঠিকসময় গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করব। আপনি শুধু বলবেন আমি ফোন করেছিলাম। ফোন করার পর কর্নেল এসে সোফায় বসলেন। বিজয়বাবু তখন বাইরে। জিনস আর টপ পরা সুজাতা কাঁচুমাচু হেসে ঘরে ঢুকল। কর্নেল হাসতে হাসতে তাকে বললেন–ওটা কালো গাড়ি নয়। তোমার জ্যেঠু বলছিলেন যে ওটাই সিংহ, গাড়ির রূপ ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে তুমি বুদ্ধিমতী। জঙ্গলে না ঢুকলে তোমার খোঁজে আমাদের আবার সদলবলে বেরুতে হতো।

সুজাতা বলল–কর্নেল সাহেব আমি জঙ্গলে ঢোকার সময় একবার পিছু ফিরে দেখছিলুম গাড়ির কেউ আমাকে ফলো করছে কি না। কিন্তু শুধু দেখলুম ব্যাকসিটে একটা দাড়িওয়ালা তোক বসে আছে। তার হাতে যেন একটা ফায়ার আর্মস দেখেছি। না, চোখের ভুল নয়,ঠিকই দেখেছি। লোকটার দাড়ি আপনার মতো অত সাদা নয়। চোখে সানগ্লাস আছে। মাথার চুলগুলো বেশ বড়। তবে সে সাধু-সন্ন্যাসী নয়।

এই সময় বিজয়বাবু এসে ভাইঝিকে বললেন–তোমাকে কাল রাত্রে পইপই করে বলা হয়েছিল–এটা তোমার কলকাতা শহর নয়।

সুজাতা বাঁকা ঠোঁটে বলল–সিংহগড়ে তো বোকারাই থাকে। বুদ্ধিমান হলে লোকটা গাড়িতে থেকে নেমে আমাকে তাড়া করত। তার কাছে আর্মও ছিল। বলে সুজায় চলে গেল।

বিজয়বাবু বললেন–নটা বেজে এল। এঘরেই ব্রেকফাস্ট করা যাবে। তার পর বেরিয়ে পড়ব।

একটু পরেই ব্রেকফাস্ট এসে গেল। দিশি ব্রেকফাস্ট। গরম লুচি, আলুভাজা, ডিম পোচ আর সন্দেশ। তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট সেরে নিলুম। তার পর এল কর্নেলের কফি। কফি খেয়ে চুরুট ধরালেন কর্নেল। তার পর বললেন ওঠা যাক। বিজয়বাবু তার রাইফেলের অবস্থা দেখে নিলেন, সেফটি ক্যাচ পরীক্ষা করলেন। তার পর বেরুলেন–গায়ে ছাইরঙা স্পোর্ট গেঞ্জি। পরনে একই রঙের প্যান্ট পায়ে কর্নেলের মতো হান্টিং বুট।

ড্রাইভার গেটের বাইরে রাস্তার উপর অপেক্ষা করছিল। কর্নেল সামনের সিটে এবং আমি পিছনের ব্যাকসিটে। কর্নেল বললেন–প্রথমে থানায় যাব।

থানায় ওসি মিস্টার শর্মা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি আমাদের বসতে বললেন। তার পর চাপা স্বরে বললেন–জয়ন্তবাবু প্রথমে যে একতলা বাড়িটার কথা বলেছিলেন সেটা খুঁজে পাওয়া গেছে। ওটা একসময় একটা পাঠশালা ছিল। এলাকার আদিবাসী ছেলেমেয়েদের পড়াতেন একজন আদিবাসী পাদ্রি। কিন্তু জায়গা এমন দুর্গম যে প্রায় ওখানে নেকড়ে হানা দিত। এটা প্রায় বিশ বছর আগের কথা। তার পর থেকে ওটা খালি পড়ে আছে। কর্নেল বললেন–সেই বাংলোটায় এখনও পাহারা আছে কি?

মিস্টার শর্মা বললেন–আছে। হাজারিলাল চৌবে সকালে এসে এস. আই মৃণালবাবুকে সঙ্গে নিয়ে তার বাংলোর অবস্থা দেখে এসেছেন। আমরা তালা ভেঙেছি তাতে তিনি দুঃখিত নন। উনি আবার নতুন করে তালা দেবেন।

কর্নেল বললেন–কালো অ্যাম্বাসাডারটার খোঁজ করতে পারলেন?

মিস্টার শর্মা একটু হেসে বললেন আমাদের লোকেরা খোঁজ নিয়েছে ওই গাড়িটা এখানে সম্প্রতি এসেছে। ওটাকে মাঝে মাঝে নিউ টাউনশিপের দিকে যাওয়া আসা করতে দেখেছে কেউ কেউ।

কর্নেল বললেন–আমার ধারণা ওটা জলপ্রপাতের কাছাকাছি যে ঘাসের মাঠটা আছে তার পাশে ঘন জঙ্গলের মধ্যে রাখা হয় কারণ আমি আজ ভোরে জলপ্রপাতের কাছাকাছি গিয়ে বাঁদিকের ঘাসের জমিটা লক্ষ্য করছিলুম। কোথাও কোথাও ঘাসের ওপর চাকার দাগ লক্ষ্য করেছি। মিস্টার শর্মা বললেন–তাহলে আমি রমেশজিকে ফোর্স নিয়ে সেখানে পাঠিয়ে দিই। কী বলেন?

কর্নেল বললেন–হ্যাঁ, আমার মনে হয় গাড়িটাকে এখনও সেখানে পাওয়া যাবে। তা ছাড়া আজ ভোরে গাড়িটা একটা কীর্তি করেছে। কাছেই যে এমন গা ঢাকা দিয়ে থাকা যায়–এই বলে কর্নেল সংক্ষেপে অজয়বাবুর মেয়ে সুজাতার ঘটনাটা ওসিকে জানিয়ে দিলেন। মিস্টার শর্মাই তখনই রমেশবাবুকে ডেকে সব কথা বুঝিয়ে বলে এখনই ফোর্স নিয়ে বেরিয়ে পড়তে বললেন। কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন–আমি তা হলে এবার উঠি। গাড়িটা পেয়ে গেলে তার মালিককে খুঁজে বের করতে আপনার দেরি হবে না।

ওসি শর্মা বললেন–বিজয়বাবু রাইফেল নিয়ে বেরিয়েছেন ব্যাপারটা কী? সিংহ মারবেন নাকি?

বিজয়বাবু বাঁকা হেসে বললেন–মারব বলেই বেরিয়েছি। দেখা যাক। ওসি হাসতে হাসতে বললেন–খুন খারাপি করে ফেলবেন না, আমরা লোকটাকে জ্যান্ত ধরতে চাই।

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–আমরা যাচ্ছি। জলপ্রপাতের ওদিকে। প্রস্রবণের উপর রামধনু দেখা যায় শুনেছি। দেখে চোখ সার্থক করে আসি।

থানা থেকে বেরিয়ে বিজয়বাবু বললেন–আমরা পুলিশের গাড়ির সঙ্গে গেলে কালো গাড়িটা ওখানে আছে কিনা জানতে পারতুম।

কর্নেল বললেন–মিস্টার সিংহ আমরা জলপ্রপাতে যাবার আগে একবার নিউটাউনশিপে প্রতিমা রায়ের বাংলো বাড়িতে যাব।

বিজয়বাবু ভ্রু কুঁচকে বললেন–সেখানে কেন? আপনি কি ওই মহিলাকে চেনেন। উনি নাকি এখন সন্ন্যাসিনী হয়ে মামার বাড়িটাকে আশ্রম করে ফেলেছেন?

কর্নেল বললেন–হ্যাঁ, জানি। আমার সঙ্গে তার আলাপ হয়েছে। শুনলে অবাক হবেন, গত রাতে কালো অ্যাম্বাসাডারের মালিক সেই লোকটা তার কাছে আশ্রয় চাইতে গিয়েছিল। কাজেই একবার গিয়ে খবর নেওয়া দরকার।

বিজয়বাবু অবাক হয়ে শুনলেন–তার পর ড্রাইভারকে নিউটাউনশিপের প্রতিমার বাড়িতে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।

ড্রাইভার এলাকার নাড়িনক্ষত্র চেনে। সে পনেরো মিনিটের মধ্যে বাড়িটার দরজার কাছে গিয়ে গাড়ি দাঁড় করাল এবং হর্ন দিল।

দেখলুম একটি শক্তসমর্থ চেহারার প্রৌঢ়া হন্তদন্ত হয়ে এসে গেট খুলে দিল। ততক্ষণে কর্নেল নেমে তাকে জিজ্ঞেস করছিলেন–প্রতিমা আছেন কি না। সেই মেয়েটি চাপা স্বরে বলল–কিছুক্ষণ আগে একটা লোক এসেছে। ঠাকুরদিদি তার সঙ্গে কথা বলছে।

কর্নেল দ্রুত ভেতরে ঢুকে গেলেন। তাঁকে আমি অনুসরণ করলুম। বিজয়বাবু বেরিয়ে এলেন। কর্নেল হন্তদন্ত উঠে ঘরের বন্ধ দরজার কড়া নাড়লেন। বললেন–প্রতিমা, আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার; দরজা খুলুন। ভেতরে প্রতিমার মুখে যেন কেউ হাত চাপা দিয়েছে, তাই তার কণ্ঠস্বর গোঙানির মতো শোনাল।

কর্নেল কাঁধের বার কয়েক জোরাল ধাক্কা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সপাটে একটা দিক ভেঙে পড়ল। তারপরেই দেখলুম তাঁর হাতে উদ্যত রিভলবার। একটা গুলির শব্দ শোনা গেল। ভিতরের লোকটাই গুলি ছুঁড়েছে তা বোঝা গেল। একেই বলে মিলিটারি ট্রেনিং। কর্নেল সেই মুহূর্তেই ঝপ দেবার মতো ভেতরে নিজেকে ছুঁড়ে দিলেন। আমি ঘরে ঢুকে গেলুম। দেখলুম সোফার নিচে মেঝেতে তার মতো তাগড়াই চেহারার একটা লোকের বুকে বসে তার আর্মস ধরা হাতটা মোচড় দিচ্ছেন। তখনই চিনতে পারলুম। এই সেই দাড়িওয়ালা শয়তান যে আমাকে বন্দি করে রেখেছিল। প্রতিমাদেবী কান্নাজড়িত কণ্ঠস্বরে বললেন–আমারই ভুল। ও আমাকে একটা জরুরী কথা বলবে বলে, ঘরে ঢুকেই অস্ত্র বের করে জানলা বন্ধ করেছিল। চাপাস্বরে বলেছিল টু শব্দ করলে মারা পড়বে। তাই কুন্তি কিছু বুঝতে পারেনি। রিভলবারটা কেড়ে নিয়ে কর্নেল তাঁকে দাঁড় করালেন তার পর বললেন–জয়ন্ত এস, এর দাড়ি চুল পড়াও। তার পরই একে চিনতে পারবে।

আমি তার দাড়ি একটানে ওপড়াতেই সে হুহু হুহু করে উঠল। তার পর তার চুল ধরে টানছিলুম। এবার বলে উঠলুম একি কর্নেল! এ যে আপনার কলকাতার বন্ধু রাঘবেন্দ্র রায়চৌধুরী।

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন–প্রতিমা এই লোকটি আমার পুরনো বন্ধু কিন্তু আমি এর ভেতরের ইতিহাস কিছুই জানতুম না। আমি বুঝতে পারছি এই লোকটি ছিল তোমার পুরনো প্রেমিক। না, এতে লজ্জা পাওয়ার কোনও কারণ নেই। তোমার। একটা বয়সে এ ধরনের দুর্বলতা থাকতেই পারে। তবে এও সত্য তুমি এতদিন ধরে নিজের অবচেতনায় সেই দুর্বলতাকে লালন করে আসছিলে। যাইহোক, তুমি জয়ন্তর সঙ্গে গিয়ে তোমার পরিচিত সেই বাড়ি থেকে থানায় একটা ফোন করে দাও। থানার নম্বর জয়ন্ত জানে। ও তোমাকে বলে দেবে। তুমি ও.সি.কে বলবে কালো সিংহের মালিক প্রাক্তন এম.পি সাহেবের বাংলোয় ধরা পড়েছে। আমার কথা বলবে, তিনি যেন এখনই তোক নিয়ে এসে নিয়ে যান।

প্রতিমা বললেন–জয়ন্তবাবুকে যেতে হবে না। এখানে আপনি ফোন নাম্বার লিখে দিন।

একটা কাগজে ফোন নাম্বার লিখে দিলে তিনি বেরিয়ে গেলেন।

রাঘবেন্দ্ৰ নতমুখে দাঁড়িয়ে জোরে শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলছিলেন। বিজয়বাবু ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন–রাঘব, তোমার এত স্পর্ধা যে তুমি অভয়ানন্দের পাওয়া সেই ব্রোঞ্জের সিলদুটো দাবি করেছিলে। ওহে মূর্খ, কর্নেল সাহেব বলেছেন ওই সিলে গুপ্তধনের কোনও ঠিকানা নেই। ওটা প্রাচীন যুগের কোনও সামন্তরাজার সিল। নচ্ছার হতভাগা! এখনও তুমি এই হতভাগিনী প্রতিমার পিছু ছাড়োনি! ধিক তোমাকে! ·

কর্নেল বললেন–জীবনের এই প্রথম আমি একজন মানুষের আড়ালের চেহারা দেখতে পাইনি। আমার নিজের উপরেই রাগ হচ্ছে। যাই হোক, এখন পুলিশের গাড়ি এলেই কাজ শেষ। তার পর আমরা জলপ্রপাতের রামধনু দেখতে যাব।