রেনবো অর্কিড রহস্য

রেনবো অর্কিড রহস্য

কর্নেলের জার্নাল থেকে

পঞ্চগড় নামে কোনও জনপদের কথা আমি হয়তো কস্মিনকালে জানতে পারতুম না, যদি না সেবার মার্চের শেষে কলকাতার হোটেল কন্টিনেন্টালে রাজকুমার সিংহ নামে এক রাজপুত রত্ন ব্যবসায়ী খুন হতেন। সত্যি বলতে কী, সেই খুনের ঘটনা ছিল জটিল রহস্যের অন্ধকারে ঢাকা এবং আমার জীবনের কয়েকটি মাইলস্টোনের মধ্যে মাত্র বারো ঘন্টায় এই হত্যা রহস্য উন্মোচন করে ফেলা একটি সেরা মাইলস্টোন। হ্যাঁ, এ নিয়ে আমার কিছু গর্ব আছে। আমি তো নিজেই অবাক হয়েছিলুম নিজের সেই কীর্তি দেখে। কিন্তু চিন্তা করা যায়? বারো ঘন্টা! মাত্র বারোঘন্টার মধ্যেই খুনীকে নির্ভুলভাবে শনাক্ত করা!

কিন্তু সে-ঘটনা ইনিয়ে বিনিয়ে আমার তরুণ সাংবাদিক বন্ধু জয়ন্ত চৌধুরী লিখে ফেলেছিল। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকাকে, সে আরও একধাপ উঁচুতে তুলেছিল। তার ফলে হল কী, লন্ডনের গোয়েন্দা পুলিস সংস্থা প্রখ্যাত স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্রাইম রিপোর্টার হিসেবে জয়ন্তকে তাদের কাজকর্মের নমুনা দেখাতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তাছাড়া এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে সে ক্রাইম রিপোর্টিং প্রশক্ষিণ শিবিরেও যোগদানের আমন্ত্রণ পেয়েছিল।

জয়ন্ত লন্ডন চলে যাওয়ার পর আমি পঞ্চগড় ভ্রমণের কথা ভাবছিলুম। শুনেছিলুম, বিহারের সিংভূম জেলায় পাহাড় আর অরণ্যের মধ্যে কৈলি নদীর তীরে পঞ্চগড় নাকি প্রকৃতির এক অসামান্য সৌন্দর্যভূমি। কিন্তু আমার অভ্যাস, কোনো অজানা জায়গায় যাওয়ার আগে সেখানকার খুঁটিনাটি তথ্য জেনে নেওয়া। তাছাড়া এ যাবৎকাল অনেক অপরাধীকে ধরিয়ে দিয়ে তাদের শত্রু করে ফেলেছি। নিজেকে। তারা জেলে জীবন কাটালেও তাদের আত্মীয়-স্বজন-অনুচররা তো থাকতেই পারে, যারা এই টেকোমাথা দাড়িওয়ালা বুড়ো লোকটির প্রতি ক্রুদ্ধ এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ। তাই যেখানে যাই, সেখানকার পুলিশ-প্রশাসনের উঁচুমহলকে আগে-ভাগে টেলিফোনে খবর দিয়েই যাই : আমি যাচ্ছি। দেখ বাপু, এ বুড়ো যেন কোনো বিপদে পড়ে না। হ্যাঁ, আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার। সামরিক জীবনের অসংখ্য শিক্ষা এখনও আমি ভুলিনি। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, জঙ্গল-যুদ্ধে অর্থাৎ গেরিলা ওয়ারফেয়ার-এর দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় আমার যেন একটা বাড়তি ইন্দ্রিয় গজিয়েছিল তা এখনও টিকে আছে। জঙ্গলের মধ্যে কোনো শব্দ শুনতে পেলে শব্দটা কীসের কোথায় এবং কতটা দূরত্বে হয়েছে, এখনও আমি তা টের পাই। সবচেয়ে আশ্চর্য, আমার ইনটুইশন। কতবার এই ইনটুইশন আমাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে!

কিন্তু না। নিজের সম্পর্কে বড় বেশি বড়াই করে ফেললুম। এবার আসল কথায় আসছি।  

এপ্রিলের মাঝামাঝি জয়ন্ত লন্ডনে চলে যাওয়ার কয়েকদিন পরে হোটেল এশিয়ায় প্রকৃতি ও পরিবেশের সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলুম। দেশের প্রকৃতি পরিবেশ বিজ্ঞানীরা ভালোই জানেন, মূলত কর্নেল নীলাদ্রি সরকার একজন প্রকৃতিবিজ্ঞানী, যাঁর প্রকৃত বাতিক বিরল প্রজাতির পাখি, প্রজাপতি, অর্কিড, ক্যাকটাস এইসব বিষয়ে। তারা এ-ও জানেন, ওই বাতিকের বশে কোথাও গিয়ে কেমন যেন অনিবার্যভাবে আমি কোনো রহস্যজটিল অপরাধের মুখোমুখি পড়ে যাই এবং তখন সেই রহস্যের জট খোলার জন্য প্রায় পাগল হয়ে পড়ি।

তো সেই সম্মেলনে ডঃ সুরজপ্রসাদ মিশ্র নামে একজন অর্নিথোলজিস্ট অর্থাৎ পক্ষীতত্ত্ববিশারদের সঙ্গে পরিচয় এবং ক্রমে নিবিড় ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল। আর ঘটনাচক্রে তার বাসস্থান সেই পঞ্চগড়। তিনি তার পরিচিত রাজপুত রত্ন ব্যবসায়ী রাজকুমার সিংহের খুনের ঘটনা ততদিনে জানতে পেরেছিলেন এবং আমার ভূমিকাও কিছুটা শুনেছিলেন। এর ফলেই আমি তার চোখে যেন একটি দামী জিনিস হয়ে উঠেছিলুম। সম্মেলন শেষ হওয়ার পর তিনি আমাকে তার সঙ্গে যেতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু প্রস্তুতির জন্য কয়েকটা দিন সময় আমাকে নিতে হয়েছিল।

শুধু অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল হওয়ার জন্য নয়। কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর সুনজরে থাকার দরুন আমি বিনি পয়সায় ট্রেনের ফার্স্টক্লাসে আরামে-আপ্যায়নে যাত্রার। সুবিধাভোগী। রাত নটা পঁয়ত্রিশে হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়েছিল। তারিখটা ছিল ঊনিশে এপ্রিল। যে কুপে আমি লোয়ার বার্থ পেয়েছিলুম, সেই কুপে একজন যুবক ও দুজন যুবতী যাত্রী ছিল। একটু পরে বুঝতে পেরেছিলুম, পাশের কুপে আরেকজন যুবক তাদের সহযাত্রী। সে এসে এদের সঙ্গে গল্প করছিল। তারা। বাঙালি এবং কলকাতাবাসী, তা-ও টের পেতে দেরি হয়নি। চেহারা, ব্যক্তিত্ব আর পোশাক-আশাকে তাদের বিত্তবান পরিবারের সন্তান মনে হয়েছিল। এ-ও বুঝতে পারছিলুম, তারা যুগল দম্পতি নয়। এই যুবতীদের সিঁথিতে সিঁদুর দেখার আশা করিনি। কারণ দুজনেই জিন্স এবং হাতকাটা পুরু রঙিন আঁটোসাঁটো গেঞ্জি পরেছিল। যুবক দুটিও জিনস এবং টিশার্টে সজ্জিত। তারা বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলছিল। মাঝেমাঝে হেসে উঠছিল। এটাই অবশ্য যৌবনের ধর্ম।

আমি জানালার পাশে বসে একটা সচিত্র অর্কিডের বইয়ের পাতায় চোখ রেখেছিলুম। টুপিটা তখনও খুলিনি। ওদের আলোচ্য বিষয় ছিল ওদেরই চেনাজানা কিছু মানুষ, পুরুষ এবং নারী। মাঝেমাঝে ওদের কথাবার্তায় অশালীনভাবে যৌনতার প্রসঙ্গ এসে যাচ্ছিল। তখন মনে হচ্ছিল, রেলদফতর আমার স্থান নির্বাচনে ভুল করেছেন। কিন্তু না। আমি একালের যুবক-যুবতীদের মেলামেশায় কোনো দোষ ধরি না। বরং এর পক্ষপাতী। কিন্তু এত বেশি নয়। শালীনতার মাত্রাটা রাত দশটার পর ছাড়িয়ে গেল, যখন পাশের কুপের যুবকটি এক যুবতাঁকে বলল–সুইট হানি বল্লরী! উইল ইউ প্লিজ কিস মি অন মাই লিপ?

যুবতীটি অর্থাৎ বল্লরী তার ঠোঁট দুই আঙুলে কামড়ে ধরে বলল-ইন্দ্রনীল। ডোন্ট বিহেভ লাইক আ ডার্টি ডগ।

ইন্দ্রনীল নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল–আমাকে ডগ বললে তো? দেখবে এবার পাগলা কুকুর হয়ে কামড়ে দেব। তারপর সে বেরিয়ে গেল।

বল্লরী আমার উপরের বার্থে উঠে গেল। অন্য যুবতীটি বলল-সৌর! তোমার বন্ধুটি বড় বাড়াবাড়ি করছে। আফটার অল, এটা আমাদের বেডরুম নয়। একজন বিদেশি বৃদ্ধ ভদ্রলোক আছেন। উনি কী ভাবছেন বলো তো!

উপর থেকে বল্লরী বলল–আমার আর ইন্দ্রনীলের ব্যাপারে তোমরা কোনো কথা বলবে না সুদক্ষিণা!

সুদক্ষিণা বলল–দেখ বল্লরী, এটা য়ুরোপ-অ্যামেরিকা নয়। ইন্ডিয়া। সৌর বলল–নাও। এই শুরু হল মেরা ভারত মহান। তুমি ভুলে যেও না, এদেশেই খাজুরাহো আছে। বাৎসায়নের কামসূত্র আছে। অন্য দেশের তুলনায় আমাদের পূর্বপুরুষেরা সেক্সকে এসেন্স অব লাইফ মনে করতেন।

সুদক্ষিণা বলল–বাজে কথা বোলো না। ট্রেন কখন পৌঁছবে যেন? ভোর সাড়ে পাঁচটায়।

বল্লরী বলল–আচ্ছা সৌর, পঞ্চগড় মানে তো পাঁচটা গড়। দ্যাট মিনস ফাইভ কোর্টস! হু বিল্ট দোজ কোর্টস?

সৌর মুচকি হেসে বলল ইন্দ্রনীল রায়ের পূর্বপুরুষ! রিয়্যালি! ওর চেহারা দেখেও কি টের পাও না কিছু? রাজপুত ওরিজিন। আর ওই স্বাস্থ্য। আর সৌন্দর্য। আর মানসিক শক্তি! তাই না সে তোমার কাছে

বল্লরী বলল–দ্যাটস এনাফ। স্টপ ইট।

সুদক্ষিণা ফিসফিস করে সৌরের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল–বিদেশি পর্যটক বুড়োকে দেখে কী মনে হচ্ছে বলব? ফাদার ক্রিসমাস!

আমার কানের শক্তির কথা আগেই বলেছি। সুদক্ষিণার কথা শোনার পর আমি আর চুপ করে থাকতে পারলুম না। বইটা বুজিয়ে রেখে বললুম–হ্যাঁ। ফাদার ক্রিসমাস বড় দেরি করে এসেছে এবং ভুল করে তাজা উজ্জ্বল খোলামেলা যৌবনের মধ্যে এসে পড়েছে। অথচ সে শিশুদেরই বেশি ভালবাসে।

তখনই ওরা কয়েক সেকেন্ডের জন্য হতবাক হয়ে পড়ল। উপর থেকে বল্লরী বলল সৌর! ইন্দ্রনীলকে ডেকে আন। তখন থেকে ওকে চিমটি কেটে সতর্ক করছিলুম। কিন্তু সায়েবদের দেশে এ ধরনের খোলামেলা আর খোলাখুলি কথাবার্তা স্বাভাবিক বলছিল সে। একবার আমেরিকা ঘুরে এসেই তার বিশ্বদর্শন হয়ে গেছে। সুদক্ষিণা বলল–এ কী বল্লরী! তুমি ইংরেজি কথা ছাড়লে কেন? বল্লরী বলল–আমার খুশি!

সৌর বলল–এই রে! ভদ্রলোককে সায়েব ভেবে বল্লরী ইংরেজি বলে ওঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছিল। কী যেন বলে একে? শো বিজনেস! ইনফিরিওরিট কমপ্লেক্স থেকেই বাঙালিরা এমনটি করে।

সুদক্ষিণা আমার দিকে ঘুরে বসল। বলল–আপনি সত্যিই বাঙালি? বললুম–সন্দেহের কারণ?

–আমাদের কলেজে একজন ফ্রেঞ্চ ফাদার পড়াতেন। তিনি যে কোনো বাঙালির মত বাংলা বলতে পারতেন।

আমি বুকপকেট থেকে একটা নেমকার্ড ওকে দিলুম। সুদক্ষিণা পড়তে থাকল-কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। নেচারোলজিস্ট! কী আশ্চর্য! প্লিজ কর্নেল সরকার! আপনি বর্ষীয়ান মানুষ, আপনার সামনে আমরা বাড়াবাড়ি করে। ফেলেছি।

তাকে থামিয়ে দিয়ে বললুম–যৌবন যৌবনের ধর্ম পালন করবে। যদিও প্রায় তরুণ বয়স থেকে আমার জীবন পাহাড় জঙ্গল মরুভূমিতে যুদ্ধ করে কেটেছে, আমি একজন অ্যাডভেঞ্চারারও বটে, কিন্তু যৌবনের বাঁচালতা আমার স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। হ্যাঁ সুদক্ষিণা, আমি উপভোগ করেছি!

এভাবেই হাওড়া-রাঁচি-হাতিয়া এক্সপ্রেস ট্রেনে যেতে যেতে আমার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল সুদক্ষিণা সেন, বল্লরী দাশগুপ্ত, সৌরজ্যোতি সিংহ এবং তারপর ইন্দ্রনীল রায়ের। ওরা চার বন্ধু বেড়াতে যাচ্ছে পঞ্চগড়। পঞ্চগড়ে ইন্দ্রনীলের ঠাকুরদার একটা বাড়ি আছে। ওদের পূর্বপুরুষ নাকি পঞ্চগড় জায়গির পেয়েছিল মোগল বাদশাহ আকবরের কাছে। তারপর সব উবে গেছে। এখন শুধু ওই হাভেলিবাড়ি ছাড়া আর কিছু নেই। বাড়ির একজন কেয়ারটেকার আছে। তার নাম ঝাব্বুলাল। সে সপরিবারে সেখানে বাস করে। ইন্দ্রনীলের বাবার এক বন্ধু ওখানে আছেন। তিনি বাঙালি। তার নাম ডাক্তার শচীন্দ্র অধিকারী। আগে হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। এখন ঘরে বসে ডাক্তারি করেন। তিনিই গাড়ি নিয়ে স্টেশনে আসবেন এবং চারজনকে যথাস্থানে পৌঁছে দেবেন।

আমি সেখানকার আতিথ্যে থাকব, তাদের জানিয়ে দিয়েছিলুম। ওরা কেউ ডঃ সুরজপ্রসাদ মিশ্রকে চেনে না। তাঁর নামও শোনেনি, যদিও কয়েকবার তারা দলবেঁধে পঞ্চগড়ে বেড়াতে গেছে।

কথায়-কথায় জানতে পেরেছিলুম, ইন্দ্রনীল একটা ব্যবসা-সংস্থার মালিক। সৌরজ্যোতি একটা কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত। বল্লরী একটা ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার। আর সুদক্ষিণা একটা বিজ্ঞাপন সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। এই সংস্থার তৈরি বিশাল সব সচিত্র বিজ্ঞাপন কলকাতার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আকাশ দখল করে শোভা বাড়ায়। সে যাই হোক, বাইরের জগতে পা দিলেই বিশেষত যুবক-যুবতীরা প্রকৃতির মত স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে, তা সত্য। প্রতি কুপে দুটো করে বার্থ। বল্লরী আমার উপরের বার্থে শুয়ে ছিল। সুদক্ষিণা আমার উল্টোদিকে লোয়ার বার্থে এবং সৌরজ্যোতি তার উপরের বার্থে শুয়েছিল।

আলো নিভিয়ে দিয়েছিল ওরা। কুপের দরজাও বন্ধ করে দিয়েছিল। একবার আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তখন দেখেছিলুম, বল্লরী বাইরে থেকে নিঃশব্দে ঢুকে দরজা আটকে আমার উপরের বার্থে উঠল। হয়তো বাথরুমে গিয়েছিল। আর একবার ঘুম ভেঙে দেখেছিলুম, সৌরজ্যোতি বাইরে থেকে ঢুকল এবং সুদক্ষিণাকে একটু খুঁচিয়ে দিয়ে উপরে উঠে গেল। সুদক্ষিণা ঘুমের ঘোরে বললউঃ! কী হচ্ছে?

কিন্তু তৃতীয়বার আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল কী একটা শব্দে। চোখ খুলে দেখলুম, সৌরজ্যোতি আমার উপরের বার্থ থেকে নেমে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। একটু পরে বল্লরীও নেমে বাইরে গেল। আমার রুচিবোধে আঘাত লাগার পক্ষে এই ধারণাটা যথেষ্ট যে, আমার উপরের বার্থে সৌর আর বল্লরী একত্র হয়েছিল। ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকলুম। পাশের লোয়ার বার্থে সুদক্ষিণা বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। সুদক্ষিণা বলেছিল–এই দেশটা ভারত। সেই কথাটা মনে পড়ে গেল। একবার আমেরিকার সানফ্রান্সিসকো থেকে গ্রে হাউন্ড বাসে লস অ্যাঞ্জেলসে যাওয়ার পথে রাত্রিবেলা আমার ডানদিকের দুটি সিটে এক মার্কিন যুবক আর এক মার্কিন যুবতাঁকে নিঃসঙ্কোচে যৌনকর্মে লিপ্ত হতে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলুম। আমার পাশের সিটে বসে এক হিপ্পানি প্রৌঢ় দিব্যি সেই জান্তব ক্রিয়া উপভোগ করছিলেন। সুদক্ষিণার কথাটা আবার মনে পড়ে গেল। এই দেশটা ভারত।

তারপরই মনে পড়ল সৌরজ্যোতির কথা। আমাদের পূর্বপুরুষেরা সেক্সকে এসেন্স অব লাইফ মনে করতেন। কিন্তু সে তো অতীতের কথা। তাছাড়া সেই কামচর্চা ছিল ধর্ম ও শিল্পের ব্যাপার। কিন্তু এই নতুন প্রজন্ম কি ধর্ম ও শিল্পের খোসা ছাড়িয়ে কদর্য বাস্তবকে জীবনে ফিরিয়ে আনতে চাইছে? নাঃ! একটা শ্বেতকায় জাতির জীবনযাত্রার একটা বিকৃত অংশের অনুকরণ ছাড়া কিছু নয়।

মনটা তেতো হয়ে গেল। ঘড়ি দেখলুম। রাত তিনটে চল্লিশ। চোখ বুজে ঘুমোতে চেষ্টা করলুম। সামরিক জীবনে আমি জঙ্গলে গাছের ডালে শুয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে পারতুম। কিন্তু এ রাতের ট্রেন জার্নিতে চওড়া বার্থে শুয়ে আর ঘুম এল না। চোখ বুজে শুয়ে থাকলুম। একটু পরে বল্লরী ও সৌরজ্যোতি ফিরে এসে যে যার বার্থে শুয়ে পড়ল।….

স্টেশনের প্লাটফর্মে গেটের কাছে আমার প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ডঃ সুরজপ্রসাদ মিশ্র। চার যুবক-যুবতী ব্যাগেজ গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর আমি বেরিয়েছিলাম। যাত্রীদের ভিড়ে তারা মিশে গিয়েছিল। ডাঃ মিশ্র আমাকে দূর থেকেই দেখতে পেয়ে হাত নাড়ছিলেন। আমার ব্যাগটা ওজনদার। কারণ তার মধ্যে ফোটো ডেভলাপ করার প্রিন্টের সরঞ্জাম আছে। সেটা তিনি আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে তাঁর গাড়ির ব্যাকসিটে ঢোকালেন। আমার পিঠে আঁটা কিটব্যাগ খোলার দরকার ছিল না। গলায় ঝোলানো ক্যামেরা আর বাইনোকুলার পেটের কাছে আটকে থাকল। ডঃ মিশ্র গাড়ি স্টার্ট দিয়ে স্টেশন চত্বর থেকে পিচে ঢাকা সংকীর্ণ রাস্তায় পৌঁছুলে নেহাত কৌতূহলে সেই দলটিকে খুঁজছিলুম। দেখলুম, তাদের নিয়ে একটা সাদা গাড়ি আমাদের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। তারা আমাকে লক্ষ্য করেনি। করলে হয়তো ভব্যতা বশে অন্তত হাত নাড়ত কেউ।

ডঃ মিশ্রকে জিজ্ঞেস করলুম–পঞ্চগড়ের বাঙালি ডাক্তার শচীন অধিকারীকে কি আপনি চেনেন?

ডঃ মিশ্র বললেন–হ্যাঁ। ওই সাদা গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন শচীনবাবু। স্টেশনে দেখা হয়েছে। আপনি কি ওঁকে চেনেন?

বললুম–না নাম শুনেছিলুম।

–ডাক্তারবাবু বলছিলেন, কলকাতা থেকে তাঁর ভাগ্নে-ভাগ্নিরা আসবে।

 ভাগ্নে-ভাগ্নি শুনে হাসি পেল। কিন্তু অন্য প্রসঙ্গে গেলুম–পঞ্চগড়ের রাজা ছিলেন নাকি এক বাঙালি। আপনি এ বিষয়ে কিছু জানেন? ডঃ মিশ্র একটু হেসে বললেন–সঠিক ইতিহাস জানি না। তবে শোনা কথা। মোগল আমলে এক রাজপুত সেনানী বাঙালি মেয়ে বিয়ে করে জাতিচ্যুত হয়েছিলেন। তিনি বাংলা মুলুকে বাস করতেন। পরে মোগল বাদশাহ আকবরের সেনাপতি মানসিংহকে পাঠানদের সঙ্গে যুদ্ধে সাহায্য করে ওই অঞ্চলে জায়গির পান। তার বংশধররা শুনেছি বাঙালি হয়ে যান। প্রবাদটি নিশ্চয় জানেন? এক রাজপুতের বারোটি হাঁটি। বাঙালি না হয়ে উপায় ছিল না।

–তাদের বংশধর নিশ্চয় আছেন?

–ছিলেন। তাকে আমি দেখিনি। বেণীমাধব রায় তার নাম। তার ছেলে প্রদীপ্ত নারায়ণ রায় কলকাতায় চলে যান। শুধু ওদের বাড়িটা বাঙালিটোলায় আছে। লোকে বলে, বাঙালি হাভেলি। ইংরেজদের কুঠিবাড়ি আর মোগল স্থাপত্যের জগাখিচুড়ি বলা যায়। একজন কেয়ারটেকার ফ্যামিলি নিয়ে সেখানে থাকে। কেউ বেড়াতে এলে ভাড়া দিয়ে গোপনে দুচার পয়সা রোজগার করে। কখনও-সখনও প্রদীপ্তবাবুর ছেলে বন্ধুবান্ধব নিয়ে ফুর্তি করতে আসে। আমি তাকে চিনি না। কেয়ারটেকার ঝাঝুলালের মুখে শুনেছি। তবে

ডঃ মিশ্র হঠাৎ চুপ করলে বললুম–তবে কী?

ডঃ মিশ্র হেসে উঠলেন–বাড়িটা নাকি ভূতুড়ে বলে বদনাম আছে। ঝাব্বুলাল নিজেও তা বিশ্বাস করে। সে নাকি বহুবার রাত দুপুরে দেখেছে, একজন তাগড়াই চেহারার লোক ঘোড়া ছুটিয়ে এসে হাভেলিতে ঢোকে। ঘোড়াটা লনে দাঁড়িয়ে থাকে। একটু পরে সেই লোকটা বেরিয়ে এসে ঘোড়ায় চেপে চলে যায়।

গেট নেই বাড়ির?

–গেট কবে ভেঙে পড়েছে। ঝাব্বুলাল কাঠের আগড় দিয়ে রেখেছে। ঘোড়সওয়ার ভূতের কাছে ওটা কোনো বাধাই নয়।

ডঃ মিশ্র হেসে উঠলেন। সংকীর্ণ পিচের রাস্তার দুধারে জঙ্গল। কোথাও রুক্ষ মাটির তরঙ্গায়িত বিস্তার। ইতস্তত জঙ্গলে ঢাকা টিলা পাহাড়। আর চোখে পড়ে উঁচু শৈলশিরা চারদিক ঘিরে ঘন নীল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝেমাঝে একটা করে আদিবাসীদের গ্রাম। প্রায় তিন কিলোমিটার পরে ডানদিকে একটা চওড়া নদী দেখতে পেলুম। নদীটা বালির চড়া আর পাথরের ভর্তি। ডঃ মিশ্র বললেন–এটা। কৈলি নদী। বর্ষায় নদীর রূপ ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। আর ওই দেখুন!

নদীর ওপারে পশ্চিমে পঞ্চগড়ের ধ্বংসাবশেষ ঘিরে ঘন জঙ্গল। এই জঙ্গলেও নাকি ভূতের ডেরা।

বাইনোকুলারে ধ্বংসাবশেষ আর জঙ্গল দেখছিলুম। বললুম–ঘোড়সওয়ার ভূত কি?

-না! শুনলে অবাক হবেন, গড়ের জঙ্গলের ভূত সুন্দরী যুবতীর বেশে ঘুরে বেড়ায়। দিন দুপুরেও নাকি অনেকে দেখেছে।

একটু হেসে বললুম বাঃ! তা হলে তো ওখানে গিয়ে দৈবাৎ তার দেখা পেলে ক্যামেরায় ছবি তুলব।

ভূতের ছবি নাকি ক্যামেরায় তোলা যায় না। ছবি ওঠেনা। তবে আপনার পক্ষে একটা সুখবর দিতে পারি। ওই গড়ের জঙ্গলে বিরল প্রজাতির একরকম অর্কিড আছে, যার ফুলে রোদ পড়লে রামধনুর ছটা দেখা যায়!

চমকে উঠে এবং খুশি হয়ে বললুম–ডঃ মিশ্র! আপনি রেনবো অর্কিডের কথা বলছেন। এই এপ্রিলেই ওই দুস্পাপ্য প্রজাতির অর্কিডের ফুল ফোটে।

তা হলে আপনি রেনবো অর্কিড আর সুন্দরী যুবতী ভূতের ছবি তুলতে ওখানে যেতে পারেন।

–আপনি আমার সঙ্গী হবেন তো?

হব। আমার অর্কিড দেখার ইচ্ছে না থাক, ভূত দেখার ইচ্ছে আছে। একা যেতে সাহস পাই না। এবার পূর্ব-পশ্চিমে একটা হাইওয়ে। হাইওয়ে পেরিয়ে চড়াইয়ে উঠল ডঃ মিশ্রের গাড়ি। তারপর সামনে একটু নিচু জনপদ দেখতে পেলুম। ডঃ মিশ্র বললেন–সোজা উতরাইয়ে নেমে গেলে বাঙালিটোলা। আমরা যাব ডাইনে। ওই এলাকাটায় বিত্তবানদের বাংলো বা রিসর্ট প্রচুর। আমি তত বিত্তবান না হলেও এই এলাকায় একটা বাংলোবাড়ি করেছি। পৈতৃক বাড়িটা ছিল শহরের ভিতরে ঘিঞ্জি গলিতে। সেটা বিক্রি করে ফাঁকা জায়গায় এসে আরাম পেয়েছি।

ডঃ মিশ্রের বাংলোবাড়িটা উঁচু জায়গায় সুন্দর ছবি হয়ে আছে। বোঝা যাচ্ছিল, একটা অনতিউচ্চ টিলার মাথা ছাঁটাই করে ওটা তৈরি করা হয়েছে। সঙ্কীর্ণ একটা পিচ রাস্তা বাংলোর গেটের সামনে বাঁক নিয়ে উত্তরে গাছপালার ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেছে। হাফ প্যান্ট গেঞ্জি পরা একটা মধ্যবয়সী লোক গেট খুলে দিয়ে আমার উদ্দেশে কপালে হাত ঠেকাল। সুদৃশ্য ফুলবাগিচার মধ্যে দিয়ে মুড়ি বিছানো পথে এগিয়ে বারান্দার সামনে মিঃ মিশ্র গাড়ি দাঁড় করালেন। এক প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা বারান্দায় আমাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। ডঃ মিশ্র আলাপ করিয়ে দিলেন রোমিলা! ইনিই সেই কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। কর্নেল সায়েব! নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন এই মহিলাটি কে?

বললুম–আপনার সহধর্মিণী মিসেস রোমিলা মিশ্র। আপনি বলেছিলেন, আপনার মিসেস এখানকার গার্লস কলেজের অধ্যাপিকা। পরস্পর নমস্কার বিনিময় করলুম। তারপর ডঃ মিশ্র ডাকলেন–রামভকত! সায়েবের ব্যাগটা গেস্টরুমে রেখে এসো।

অর্ধবৃত্তাকার প্রশস্ত বারান্দায় বসলুম। মিসেস মিশ্র বললেন আপনার বিচিত্র কীর্তিকলাপ সম্পর্কে আমার স্বামীর কাছে শুনেছি তাই আপনার সঙ্গে মুখোমুখি পরিচয়ের আগ্রহ আমার তীব্র ছিল। আমার সৌভাগ্য, আপনাকে সত্যিসত্যি মুখোমুখি পেলুম।

ডঃ মিশ্র বললেন–খুলেই বলি। আসলে কলকাতার প্রকৃতি-পরিবেশ সম্মেলনে হোটেল এশিয়ায় থাকার সময় ডঃ নরেন্দ্র গোস্বামী কর্নেল সায়েব সম্পর্কে অনেক রোমহর্ষক ঘটনার কথা আমাকে শুনিয়েছিলেন আমি ফিরে এসে সেগুলোই রোমিলাকে শুনিয়েছি।

বললুম–ডঃ গোস্বামী? ওঁর ওই এক অভ্যাস। তিলকে তাল করে ফেলেন।

 রোমিলা একটু হেসে বললেন–শুনেছি, আপনি যেখানে যান, সেখানেও নাকি রহস্য আপনার পিছু ছাড়ে না? আশা করি, পঞ্চগড়ে আপনি পেছনে রহস্য নিয়েই এসেছেন!

একটু মজা করার জন্য বললুম–কথাটা হয়তো ঠিকই। আমার পেছনে দুজন যুবক আর দুজন যুবতীর রহস্য নিয়ে এসেছি।

পরিচারিকা মাথায় ঘোমটা দিয়ে ট্রেতে প্রচুর স্ন্যাকস আর কফির ট্রে এনে টেবিলে রাখল। রোমিলা তাতে দেহাতি হিন্দিতে নটার মধ্যে ব্রেকফাস্ট রেডি রাখতে বললেন। মেয়েটি চলে গেল! তারপর ডঃ মিশ্র মিটিমিটি হেসে বললেন– পেছনে রহস্য মানে ডাক্তার অধিকারীর ভাগ্নে-ভাগ্নিরা। তাই না?

রোমিলা কৌতূহলী হয়ে বললেন–ব্যাপারটা একটু খুলে বল সুরজ।

–শুনলে না? কর্নেল সায়েব বললেন দুজন যুবক আর দুজন যুবতীর রহস্যই। স্টেশনে বাঙালিটোলার ডাক্তার শচীন অধিকারীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। উনি বললেন, কলকাতা থেকে ওঁর ভাগ্নে-ভাগ্নিরা পঞ্চগড়ে বেড়াতে আসছে। কর্নেল সায়েব নিশ্চয় তাদের মধ্যে কোনো রহস্য খুঁজে পেয়েছেন। কী কর্নেল সায়েব?

কফিতে চুমুক দিতে দিতে ট্রেন জার্নির আড়ষ্টতা কেটে যাচ্ছিল। ডঃ মিশ্রের কথার জবাবে বললুম–এমনিতেই একালের যুবক-যুবতীদের আচরণ আমাদের মত প্রবীণদের কাছে রহস্যময়। কিন্তু এক্ষেত্রে রহস্যটা হল, ওরা মোটেও ডাক্তার অধিকারীর ভাগ্নে-ভাগ্নি নয়।

রোমিলা জিজ্ঞেস করলেন–আপনি কী করে জানলেন?

–আমরা ট্রেনের একই কামরায় এসেছি। ওদের সঙ্গে আলাপও হয়েছে। ওদের মধ্যে একজনের নাম ইন্দ্রনীল রায়। ডঃ মিশ্রের মুখে বাঙালি হাভেলির প্রদীপ্ত নারায়ণ রায়ের নাম শুনেছি। ইন্দ্রনীল তারই ছেলে। সে তার একজন বন্ধু আর দুজন বান্ধবীকে নিয়ে নিজেদের বাড়িতেই বেড়াতে এসেছে। এই প্রথম আসা নয়, আগেও কয়েকবার সে এসেছে।

রোমিলা একটু হেসে বললেন–রহস্যটা কি এই যে, ডাক্তারবাবু কেন তাদের নিজের ভাগ্নে-ভাগ্নি বলছেন? কী সুরজ?

ডঃ মিশ্র বললেন–কর্নেল সায়েবকে জিজ্ঞেস কর উনি কী রহস্য টের পেয়েছেন!

বললুম–কিছু না। আমি মিসেস মিশ্রের সঙ্গে একটু কৌতুক করছিলুম। নিছক মজা করা।

রোমিলা বললেন–কিন্তু ডাক্তারবাবুই বা কেন ওঁদের ভাগ্নে-ভাগ্নি বলেছেন সুরজকে?

–সম্ভবত ডাক্তারবাবুকে ইন্দ্রনীল ডাক্তারমামা বলে। কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকতেও পারে অবশ্য।

রোমিলা ঘুরে আঙুল তুলে উত্তর-পশ্চিম কোণে নিচু জায়গায় একটা পুরোনো ক্ষয়াটে বাড়ির উপরটা দেখিয়ে বললেন–ওই দেখুন বাঙালি-হাভেলি। এখান থেকে বাড়িটা দেখা যায়।

বাইনোকুলারে বাড়িটা স্পষ্ট ধরা দিল। আমি উঁচুতে আছি বলে গাছপালার ফাঁকে নীচের সমতল ভূমিতে অনেকগুলো পুরোনো বাড়ি দেখতে পাচ্ছিলুম। কিছু বাড়ি জরাজীর্ণ আর আগাছার জঙ্গলে ভরা। বাঙালি হাভেলির ছাদের উপর একঝাঁক বুনো পায়রা খেলা করছে। দোতলা বাড়ির মুখটা পশ্চিমে। তাই এখান থেকে বাড়িটার পূর্ব-দক্ষিণ কোণের অংশ দেখা যাচ্ছে। বাইনোকুলার নামিয়ে চুরুট ধরালুম। ডঃ মিশ্র বললেন–ঘোড়সওয়ার ভূতটা দেখতে পেলেন নাকি?

নাঃ! সে তো রাত্রে যাতায়াত করে।

রোমিলা হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালেন। বাড়িটা ভুতুড়ে বলে বদনাম আছে। প্রদীপ্তবাবুর ছেলের সঙ্গে কর্নেল সায়েবের অলাপ হয়েছে। সেই সূত্রে ও বাড়িতে একরাত্রি সুরজকে সঙ্গে নিয়ে কাটিয়ে আসতে পারেন।

ডঃ মিশ্র বললেন–আপাতত ঘোড়সওয়ার ভূত নয়। আগে কর্নেল সায়েবের সঙ্গে পঞ্চগড়ের জঙ্গলে ঢুকে সেই সুন্দরী যুবতী ভূতকে দেখে আসতে চাই!

রোমিলা বললেন–দেখ! যেন তার প্রেমে পড়ো না, বাগে পেলে ঘাড় মটকে দেবে। গত বছরও একজনের লাশ পাওয়া গিয়েছিল না?

তার আগেও তো লাশ পাওয়া গিয়েছিল। আমার মনে হচ্ছে, দুবছরে অন্তত তিনটে লাশ।

ডঃ মিশ্র নড়ে বসলেন–কী আশ্চর্য! কথাটা কর্নেল সায়েবকে বলতে ভুলে গেছি। পঞ্চগড়ের জঙ্গলে গত দুবছরে চারটে না পাঁচটা লাশ পাওয়া গিয়েছিল।

জিজ্ঞেস করলাম–তারা সবাই কি স্থানীয় লোক?

না। সবাই নয়। একজন স্থানীয় লোক। বাকি সবাই বাইরের থেকে বেড়াতে এসেছিল।

স্থানীয় লোকটিকে চিনতেন?

–চিনতুম মানে, লোকটা ছিল পঞ্চগড় বাজারের এক ব্যবসায়ী। নামটা মনে নেই। বড় ব্যবসায়ী নয়। নেহাত চুনোপুঁটি বলা যায়। সে কেন পঞ্চগড়ের জঙ্গলে, ঢুকেছিল, এটাই একটা রহস্য।

–লোকগুলোকে কি একইভাবে মারা হয়েছিল?

হ্যাঁ। বুকে তিনটে ক্ষতচিহ্ন ছিল।

–প্রত্যেকের?

–হ্যাঁ। আমি অবশ্য সবগুলো লাশ দেখিনি। শুধু পঞ্চগড়ের রামেশ্বর রাওয়ের লাশটা দেখেছিলুম। কারণ সেদিন ওই জঙ্গলে একটা উড্ডাকের খোঁজ পেয়েছিলুম। ফেরার সময় দেখি, কয়েকজন আদিবাসী একটা গর্তের ধারে দাঁড়িয়ে উত্তেজিতভাবে কথা বলছে। আমাকে তারা ডাকতেই দৌড়ে গেলুম। গিয়ে দেখি ভয়ঙ্কর দৃশ্য। বুকের উপর তিনটে ক্ষতচিহ্নে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। মুখ দেখেই চিনতে পেরেছিলুম রামেশ্বর রাওকে। প্রথমে ভেবেছিলুম, ভালুকের নখের আঘাত। পরে বুঝতে পেরেছিলুম, ত্রিশূলজাতীয় কোনো অস্ত্রের আঘাতে রামেশ্বর মারা পড়েছে।

–পোস্টমর্টেম রিপোর্টে কী বলা হয়েছিল জানেন?

–আমার এক আত্মীয়, তখন পুলিস অফিসার ছিলেন। তার কাছে শুনেছিলাম, ত্রিশূল নয়। বাঘনখ নামে একরকম সেকেলে অস্ত্র আছে, তারই আঘাতে রামেশ্বর মারা পড়েছে। কোনো শত্রু ওঁকে ফাঁদে ফেলে মেরেছে।

রোমিলা বললেন–চুপ করো। ওটা বাসি রহস্য। কর্নেল সায়েবকে রামেশ্বরের ভূতের পিছনে ছুটতে বোলো না।

বললুম–না! ছুটছি না। সুন্দরী ভূতের সঙ্গে রামেশ্বরের ভূত এবং আরও কয়েকজনের ভূতের বোঝাপড়া হয়ে গেছে এতদিনে। উঃ মিশ্র বললেন কনেলেসায়েব অবশ্য পঞ্চগড়ের জঙ্গলে রেনবো অর্কিডের জন্য ছুটতে চান। আমি ওঁর সঙ্গী হবো বলে কথা দিয়েছি। ওঃ! রামেশ্বরের লাশ দেখার পর থেকে এ যাবৎ উড্ডাক পাখির খোঁজে একা ওদিকে পা বাড়াতে সাহস পাইনি।

বললুম–ডঃ মিশ্র মেয়েদের খবর রাখেন না। তাই মিসেস মিশ্রকে জিজ্ঞেস করি। গড়ের জঙ্গলে ওই সুন্দরীর ইহজীবনের কোনো হদিস কি আপনার জানা আছে?

রোমিলার মুখে যেন ছায়া ঘনিয়ে এলো। নাকি আমরই দেখার ভুল?

একটু চুপ করে থাকার পর তিনি বললেন–যখন বাজারের ওদিকে একটা ঘিঞ্জি গলির ধারে সুরজের পৈতৃক বাড়িতে থাকতুম, তখন হন্ডুলাল নামে একজন বুড়ো চাকর ছিল। তার কাছে শুনেছিলুম, কী একটা অদ্ভুত গল্প, এখন সবটা মনে নেই। শুধু যেটুকু মনে আছে, বলছি।

ডঃ মিশ্র সকৌতুকে তাঁর কাঁচা-পাকা গোঁফের দুই ডগা পর্যায়ক্রমে সূক্ষ্ম করতে থাকলেন। তাঁর চোখে হাসির উজ্জ্বলতা ফুটে উঠল। রোমিলা আস্তে আস্তে বললেন–বাঙালিটোলায় এক বিপত্নীক কবিরাজের একটিমাত্র মেয়ে ছিল। সুন্দরী শিক্ষিতা মেয়ে। তার নামটা হডুলাল বলেছিল। মনে পড়ছে না। রায়রাজাদের এক বংশধর তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু কবিরাজ রাজি হননি। কারণ রায়-রাজারা জাতে দো-আঁশলা। লোকে এখনও তামাসা করে বলে আরে ছো ছো! বাঙালি রাজপুত! তো কবিরাজ জাতিতে ব্রাহ্মণ। তারপর সেই রাজবংশধর লোকটি এক রাত্রে মেয়েটিকে বাড়ি থেকে জোর করে তুলে নিয়ে যান। পরদিন সকালে মেয়েটির লাশ পাওয়া যায় গড়ের জঙ্গলে। তার বাবা শোকে দুঃখে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। হডুলালের এ কথাটাও মনে আছে। অনেক বছর পরে গড়ের জঙ্গলে এক সাধু ঘুরে বেড়াতেন। হর্ভুলাল নাকি স্বচক্ষে দেখেছিল। সেই সাধু তারপর কোথায় চলে গেলেন বা তার কী হল, হডুলাল জানত না।

ডঃ মিশ্র বললেন–হ্যাঁ। আইনস্টাইন বলেছেন, কাল চিরবর্তমান। কর্নেলসায়েব! উঠে পড়ুন। প্রাতঃকৃত্য করে পোশাক বদলে তাজা হয়ে নিন। আজ। রোমিলা কলেজে যাচ্ছে না। আপনার সম্মানে একটা দিন ছুটিতে কাটাবে।

গেস্টরুমটা দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। সেখানে গিয়ে চোখে পড়ল নীচে একটা বিস্তীর্ণ উপত্যকা। কোথাও সবুজ ঝোপঝাড়, কোথাও একলা একটি গাছ, কোথাও তরঙ্গায়িত নগ্ন প্রান্তরে ছড়িয়ে থাকা নানা আয়তনের কালো-কালো পাথর। তার ওধারে ঘন নীল উঁচু পাহাড়। ল্যান্ডস্কেপটা বাইনোকুলারে একবার দেখে নিলুম। উত্তর-পূর্ব আমার বাঁদিকে দূরে একটা বিস্তীর্ণ জলা দেখা যাচ্ছিল। ডঃ মিশ্রকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন–ওটা ধরমতাল। প্রাকৃতিক জলাধার। ওখানে ধর্মদেবের মন্দির আছে। থাকুন তো। একদিন ওখানে আমরা তিনজনে পিকনিক করতে যাব।…..

পাখিগুড়া পথে পঞ্চগড়ের জঙ্গলের দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। কিন্তু নাক বরাবর পায়ে হেঁটে সেখানে পৌঁছনোর বাধা আছে। ডঃ মিশ্র বলেছিলেন– শুকনো কৈলি নদী পেরিয়ে যাওয়া সোজা। কিন্তু ওপারে বিষাক্ত আলকুশির জঙ্গল আছে। তা ছাড়া কয়েকটা দুর্গম টিলা আর প্রকাণ্ড সব গ্রানাইট শিলাখণ্ডে ঢাকা জায়গা পেরোনো মানুষের পক্ষে অসম্ভব।

তাই তাঁর গাড়িতে চেপে বেরিয়েছিলুম। তখন প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। রোমিলা দেবী বারবার আমাদের সাবধান করে দিয়েছিলেন। সুন্দরী ভূতিনী সম্পর্কে নয়, বিষধর সাপ সম্পর্কে। গড়ের জঙ্গলে নাকি সংঘাতিক সাপের ডেরা আছে। এই এপ্রিল মাসে তারা ক্ষুধার্ত হয়ে শিকারের খোঁজে গর্ত থেকে বেরিয়ে পড়ে।

আমাদের দুজনের পায়েই হাঁটুঅব্দি পরা শক্ত চামড়ার হান্টিং বুটজুতো। ডঃ মিশ্র পক্ষীতত্ত্ববিদ। তাই তার গলায় আমার মতই বাইনোকুলার আর ক্যামেরা ঝুলছিল। গাড়ি সেই হাইওয়েতে গিয়ে পশ্চিমে ঘুরল। তারপর চড়াইয়ে উঠে দেখলুম আদিবাসীদের কয়েকটা দোকান। কাঠ বা বাঁশ খুঁটির উপর শালপাতার ছাউনি। চা, তেলেভাজা, শুকনো কাঠ বা লকড়ির পাঁজা ছাড়াও বুনো শুয়োরের মাংসের দোকান চোখে পড়ল। গাড়ি দাঁড় করিয়ে কয়েকজন যুবক সেখানে আড্ডা দিচ্ছে। কেউ-কেউ মাঠের বেঞ্চে বসে চায়ের লিকার খাচ্ছে ভেবেছিলুম। ডঃ মিশ্র মুচকি হেসে বলল–টাটকা মহুয়ার মদ খাচ্ছে ওরা।

সেখানে একটা দোকানের পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমরা নামলুম। ডঃ মিশ্রকে দেখে আদিবাসী এক দোকানি সেলাম দিয়ে ঝকমকে দাঁত বের করে হাসল। আমার কাছে সরল আদিবাসীদের এই হাসি বরাবর শিশুর মত অনাবিল ও নিষ্পাপ মনে হয়। লোকটি দেহাতি হিন্দিতে বলল–দুই সাহেব মনে হয় গড়ের জঙ্গলে পাখির ছবি তুলতে যাচ্ছেন।

ডঃ মিশ্র বললেন–ঠিক বলেছ ইমানুয়েল। দেখ, তোমার কাছে আমার গাড়ি রেখে যাচ্ছি। লক্ষ্য রাখবে।

সে বলল–আপনার গাড়িতে কেউ হাত দেয়, সাধ্য কি মিছিরসায়েব! তবে একটা কথা বলি। ওই জঙ্গলে খালি হাতে যাচ্ছেন কেন? বন্দুক কই আপনার?

ডঃ মিশ্র বললেন–বন্দুক নিইনি আজ। দুটো লাঠি কেটে নেব কোনো গাছের ডাল থেকে।

ইমানুয়েল নিঃশব্দে হেসে বলল–আমি মনে মনে প্রভু যিশুকে আপনাদের মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করব।

ফাঁকা জায়গায় রোদ তত প্রখর না হলেও আরামদায়ক নয়। হাঁটতে হাঁটতে বললুম–এই অঞ্চলে আদিবাসীরা কি খ্রিস্টান?

ডঃ মিশ্র বললেন–না। ইমানুয়েল ওই পাহাড়ের নীচের গ্রামে থাকে। ওই গ্রামের সবাই খ্রিস্টান। পঞ্চগড় শহরে একটা খ্রিস্টান মিশনারি স্কুল আছে।

একটু পরে বাঁদিকে নেমে আমরা ঝোপঝাড় আর পাথরে ভর্তি একটা মাঠ পেরিয়ে গেলুম। আমরা সতর্কভাবে যতটা সম্ভব ফাঁকা জায়গা দিয়ে হাঁটছিলুম। একটু পরে বাঁদিকে শালবন আর ডানদিকে একটা টিলার মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে ডঃ মিশ্র বাইনোকুলারে সম্ভবত পাখি দেখে নিলেন। এখানে পাখিদের তুমুল কলরব কানে আসছিল।

ডঃ মিশ্র বললেন–উড্ডাক এই দিকটায় বাসা বাঁধতে পছন্দ করে। শালের জঙ্গলের মধ্যে শ্যাওড়াজাতীয় একরকম গাছ আছে। স্থানীয় লোকেরা বলে সেডু গাছ। ছোটছোট পাতা আর অজস্র ডালপালায় গাছটার চেহারা দেখার মত। চলুন! আগে আপনাকে রেনবো অর্কিডের এলাকায় নিয়ে যাই।

–সেটা কি গড়ের জঙ্গলে?

–হ্যাঁ। কিছুটা দুর্গম জঙ্গল। দুর্গের ধ্বংসাবশেষ প্রায় এক বর্গকিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে আছে। কোথাও অসাবধানে পা ফেললে গভীর গর্তে পড়ার ভয় আছে।

টিলার নীচে একটা পায়ে চলা পথ দেখে জিজ্ঞেস করলুম–এ পথে লোকজন যাতায়াত করে মনে হচ্ছে!

-হ্যাঁ। গড়ের জঙ্গলে আদিবাসীরা লুকিয়ে কাঠ কাটতে বা শিকার করতে যায়। তাছাড়া এই বনেই সাহসী ট্যুরিস্টরাও গড়ের জঙ্গলে ঢোকে।

একটু এগিয়ে চোখে পড়ল একটা ধ্বংসস্তূপ। পাথরের বড়-বড় ইটও দেখতে পেলুম। ধ্বংসস্তূপ থেকে ঝোপঝাড় আর অজস্র গাছ গজিয়েছে। পায়ে চলা পথটা ছেড়ে ডঃ মিশ্র দক্ষিণে পা বাড়ালেন। পথটা পশ্চিমে চলে গেছে। কিছুক্ষণ পরে আমি বললুম–ডঃ মিশ্র! আমার কিটব্যাগে জঙ্গলকাটা অস্ত্র আছে! এভাবে লতাপাতা ঝোপের মধ্যে হাঁটলে শিগগির আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ব।

পিঠের কিটব্যাগ থেকে সামরিক জঙ্গল-নাইফ বের করলুম। ওজনদার ভোজালির মত গড়ন। এবার আমি সামনে এবং ডঃ মিশ্র পিছনে। সামরিক জীবনের অভ্যাসে রাস্তা পরিষ্কার করতে করতে ঘাসে ঢাকা একটা ফাঁকা জায়গায় পৌঁছলুম। ডঃ মিশ্র বললেন–শর্টকাটে আসতে চেয়েছিলুম। ডানদিকে ওই যে উঁচু পাথরটা দেখছেন, ওটার উপর উঠে দাঁড়িয়ে রেনবো অর্কিডের খোঁজ করতে হবে। প্রকাণ্ড পাথরটা চৌকো। সম্ভবত কোনো তোরণের উপরকার ছাদ ছিল। দুধারে আরও চৌকো পাথর পড়ে থাকায় ওটার শীর্ষে উঠতে অসুবিধে হল না। ডঃ মিশ্র নীচে দাঁড়িয়ে থাকলেন। আমি প্রথমে খালি চোখে, পরে বাইনোকুলারে ওপাশের ঘন জঙ্গল খুঁজেও রেনবো অর্কিডের দেখা পেলুম না।

ডঃ মিশ্র জিজ্ঞেস করলেন–দেখতে পেলেন কি?

বললুম–আমারই দুর্ভাগ্য ডঃ মিশ্র।

–আপনি উত্তর-দক্ষিণ কোণের গাছগুলো লক্ষ্য করেছেন?

– এক মিনিট। বলে অমি এক বর্গমিটার পাথরের উপরে সাবধানে সেদিকে ঘুরে বসলুম। তারপর বাইনোকুলারে যা দেখলুম, তা রেনবো অর্কিড নয়। উঁচু গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে নগ্ন পাথরের একটু উঁচু চত্বরে বসে থাকা ইন্দ্রনীল সুদক্ষিণা-বল্লরী। সৌরজ্যোতি তাদের একটু তফাতে দাঁড়িয়ে আছে। হাত নেড়ে যেন বক্তৃতা করছিল সে। ডঃ মিশ্র ব্যস্তভাবে বললেন–দেখতে পাচ্ছেন?

–পাচ্ছি। বলে পাথরটা থেকে সতর্কভাবে নেমে এলুম। –ডঃ মিশ্র! আপনি এখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন। আমি রেনবো অর্কিডের ফুলগুলোর ছবি তুলে নিয়ে আসছি।

ডঃ মিশ্র একটু অবাক হলেন যেন –আমি সঙ্গে গেলে কি অসুবিধে হবে আপনার?

মোটেও না। অকারণ দুর্গম জঙ্গলে ঢোকার পরিশ্রম করে লাভ নেই। আপনি এখানে ততক্ষণ বিশ্রাম করুন। আমার দেরি হবে না। ডঃ মিশ্র একটা গাছের মোটা শেকড়ে বসে বললেন–ঠিক আছে। কিন্তু সাবধান! বুনো ভালুকের উৎপাত হয় এসময়। মহুয়ার ফল পেকে ওঠার গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে ওরা চলে আসে। বাঁদিকে কয়েকটা মহুয়া গাছ আছে দেখলুম।

তাকে আশ্বস্ত করে আমি স্তূপটার ওধারে চলে গেলুম। তারপর কখনও গাছের বা ধ্বংসস্তূপের আড়ালে উঠে দাঁড়িয়ে চারদিক দেখে নিয়ে পা টিপে টিপে এগাতে থাকলুম। পাথরের চত্বরটার দূরত্ব বাইনোকুলারে দেখে যতটা ভেবেছিলুম, তারও বেশি। প্রায় মিনিট দশেক হাঁটার পর দুপাশে দুটো ধ্বংসস্তূপের মাঝখানে গিয়ে গুঁড়ি মেরে বসলুম। সামনে দুটো লতায় ঢাকা গুল্ম থাকায় দলটিকে দেখতে একটু অসুবিধা হচ্ছিল। কিন্তু ওদের কথাবার্তা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল।

পরক্ষণে মাথায় এল, এ আমি কী করছি? কেন করছি? আড়ি পেতে প্রেমিক প্রেমিকাদের কথা শোনার মধ্যে মানসিক বিকার থাকে। এই বৃদ্ধ বয়সে সেই কদর্য মনোবিকারে কি আক্রান্ত হয়েছি আমি? এই চিন্তার সময় কানে এল সুদক্ষিণার কথা–তোমরা এসব কাণ্ড করবে জানলে আমি কিছুতেই তোমাদের সঙ্গে আসতুম না! কোনো মানে হয়?

সৌরজ্যোতি বলল কাণ্ডটা কী দেখলে তুমি? বোঝাপড়া করে নেওয়াটা কোনো ব্যাপারই নয়।

ইন্দ্রনীল বলল–সৌর! তুই কি আমার সঙ্গে ডুয়েল লড়তে চাস?

সৌরজ্যোতি বলল–ডুয়েল কীসের? নেচারের মধ্যে এসে কনফেশন। বল্লরী! তুমি বলো!

বল্লরী বলল–আমার কিছু বলার নেই।

 সৌরজ্যোতি বলল–নিশ্চয় আছে। তুমি সত্য কথাটা কেন স্বীকার করছ না?

কী সত্য কথা?

ইন্দ্রনীল তোমার কাছে ঋণী। অথচ আমি জানি, তার সঙ্গে সারা জীবনটা এক শয্যায় কাটানো তোমার পক্ষে সম্ভব নয়।

ইন্দ্রনীল বলল–সৌর! আমার শয্যাসঙ্গিনী হিসেবে বল্লরীকে আমি কল্পনাও করিনি। তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব আছে। ভবিষ্যতেও না থাকার কারণ নেই।

সুদক্ষিণা বলল–তা হলে তো বোঝাপড়া হয়ে গেল। ইন্দ্রনীল আর বন্ধুরী কখনও স্বামী-স্ত্রী হবে না।

বন্ধুরী বলল-স্টপ ইট! আমার এসব ভাল লাগে না।

সৌরজ্যোতি বলল–বল্লরী! এখনও বলছি মুখ বুজে থেকো না। তুমি অতল খাদের ধারে দাঁড়িয়ে আছ!

বল্লরী উঠে দাঁড়াল। তারপর পাথর থেকে লাফ দিয়ে নেমে হাঁটতে থাকল। সুদক্ষিণা দ্রুত নেমে গিয়ে তার কাঁধে হাত রাখল। ইন্দ্রনীল উঠে দাঁড়িয়ে বলল সৌর! আমার সন্দেহ হচ্ছে, বল্লরীকে তুই ব্ল্যাকমেল করতে পা বাড়িয়েছিস।

সৌরজ্যোতি হাসতে হাসতে বলল-শালুক চিনেছে গোপালঠাকুর! আয়! ওরা জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলবে।

ইন্দ্রনীল ক্ষোভের সঙ্গে বলল–তুই এভাবে এখানে একটা সিনক্রিয়েট করার জন্য এসেছিস, আমি বুঝতে পারিনি।

দুজনে চত্বর থেকে নেমে হাঁটতে থাকল। এই সময় একটা ভূতুড়ে বাতাস ঢুকল যেন। গাছপালা ঝোপঝাড় লতাপাতায় অদ্ভুত শনশন শব্দ উঠল। চারপাশে আলোড়নের মধ্যে মনে হল, কী যেন ঘটতে চলেছে কোথাও। আমার ইনটুইশন?

ডঃ মিশ্রের কাছে গিয়ে বললুম–যে অর্কিডের ফুল দেখলুম, তা রেনবো নয়। চলুন! অন্য কোথাও খুঁজে দেখি।

ডঃ মিশ্র বললেন–আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। বরং আজ থাক। রাতে লং ট্রেন জার্নির পর অন্তত একটা দিন বিশ্রাম নেওয়া উচিত। বরং আজ ফিরে চলুন। আদিবাসীদের মধ্যে আমার চেনাজানা লোক অনেক আছে। বিশেষ করে যারা জঙ্গলে ঘোরে, তাদের কাউকে বলে রাখলে সঠিক রেনবো অর্কিডের কাছে নিয়ে যাবে। ঠিক ক্লান্তি নয়, কী এক আচ্ছন্নতা আমাকে পেয়ে বসেছিল। ইন্দ্রনীল সৌরজ্যোতি-সুদক্ষিণা-বল্লরী এই চার যুবক-যুবতীর মধ্যে কী একটা গুরুতর সমস্যা আছে, এতে ভুল নেই। কিন্তু কি সেটা? সৌরজ্যোতি এবং বল্লরী সম্পর্কে আমার মনে ঘৃণা ভাবটা কিছুতেই যাচ্ছে না। আমারই ওপরের বার্থে সৌরজ্যোতি ও বল্লরী–ছিঃ! এটা যে আসলে আমার মত এক বৃদ্ধকে, প্রখ্যাত কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে চরমতম অপমান!

হাইওয়েতে পৌঁছে একবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বাইনোকুলারে পঞ্চগড়ের জঙ্গলের দিকটা খুঁটিয়ে দেখলুম। ওদের দেখতে পেলুম। ওদের কথাগুলো মাথায় ঢুকে মাছির মত ভনভন করছিল। অর্থ বুঝে নিতে পারছিলাম না। ওদের মধ্যে কী একটা ঘটেছে। সেটা কী? সৌরজ্যোতি বলল, বল্লরী একটা অতল খাদের ধারে দাঁড়িয়ে আছে। এর মানেই বা কী?

বাংলোয় ফেরার পর মিসেস মিশ্র একটু হেসে বললেন–কর্নেল সায়েব রেনবো অর্কিডের ফুল নিয়ে আসবেন ভেবেছিলুম। কোথায় সেই ফুল?

বললুম–আমার দুর্ভাগ্য মিসেস মিশ্র! রেনবো অর্কিড বা সুন্দরী ভূতিনী কিছুরই দর্শন পাইনি।

ডঃ মিশ্র বললেন–একটু সময় লাগবে। দুটোরই দেখা আমরা পেয়ে যাব। ওয়েট রোমিলা।

.

 কোথাও নিছক বেড়াতে কিংবা বিশেষ উদ্দেশ্যে গিয়ে চুপচাপ একস্থানে বসে সময় কাটানো আমার ধাতে নেই। ডঃ মিশ্রের বাংলোতে গেস্টরুমের বারান্দায় বসে নীচের উপত্যকার বিচিত্র রূপদর্শন করে অবশ্যই আনন্দ পাচ্ছিলুম। কিন্তু বিকেল চারটেয় মিশ্র দম্পতির সঙ্গে কফি পানের পর বেরিয়ে পড়ার ইচ্ছেটা তীব্র হয়ে উঠেছিল। কৈলি নদীর তীরে পাহাড়ি জনপদ দর্শনের কথা তুলতেই ডঃ মিশ্র উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন। রোমিলা দেবীরও আমাদের সঙ্গিনী হওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেতে পারে শুনে তিনি সংযত হলেন। সন্ধ্যার পর এই পশ এলাকা নাকি নিরাপদ নয়। বাংলোটা একেবারে শেষপ্রান্তে এবং রামভকত রোগা মানুষ। একটা ডোবারম্যান কুকুর পুষেছিলেন ডঃ মিশ্র। কিন্তু কুকুরটা গত মাসে অজানা অসুখে মারা পড়ার পর ডঃ মিশ্র আর কুকুর কেনেননি। যদিও উঁচু পেডিগ্রির একটা কুকুরের খোঁজে তিনি আছেন। ডঃ মিশ্র রোমিলাকে বন্দুকটা লোড করে রাখার পরামর্শ দিয়ে বেরোলেন। রামভকতকেও সাবধান করে দিলেন। গাড়িতে যেতে যেতে আমার মনে হচ্ছিল, সৌন্দর্যের সঙ্গে আতঙ্ক জড়িয়ে থাকাটা মানুষকে অসুখী করে। কিন্তু মিশ্র দম্পতির মধ্যে ওই জিনিসটা দেখছিলুম না। তাদের একটি মাত্র সন্তান ঊর্মিলা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। প্রায় প্রতিদিন রাত্রে সে বাবা মায়ের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে। গত রাতে রোমিলা মেয়েকে আমার সম্পর্কে জানিয়েছেন। ঊর্মিলা নাকি খুবই আগ্রহী। কর্নেল সায়েব-কে দেখতে সে সুযোগ পেলেই চলে আসবে।

উতরাইয়ে নেমে গাড়ি উত্তরমুখী হল। রাস্তাটা মোটামুটি চওড়া আর মসৃণ। বাঁদিকে কৈলি নদীর তীরে গাছের সারি আর ঝোপঝাড়। নানা রঙের বুনো ফুল চোখে পড়ছিল। ডান দিকে উঁচু জমির উপর পাঁচিল ঘেরা নতুন বা পুরোনো বাড়ি। সমতলে গিয়ে ডঃ মিশ্র বললেন–এখান থেকে বাঙালিটোলা শুরু হল। ডাইনে লক্ষ্য করুন। একসময় বাঙালিটোলায় জমটমাট অবস্থা ছিল। দুর্গাপুজো কালীপুজোর ধুমধাম ছিল। প্রবীণদের মৃত্যুর পর নতুন প্রজন্ম এখানে বাস করতে চাইছে না।

বললুম–বাঙালি হাভেলি কোনটা?

ডঃ মিশ্র হাসলেন–আপনি নিজেই চিনে নিতে পারবেন।

–তা হলে চিনেছি। ওই বাড়িটা।

–ইচ্ছে করলে বলুন, ডাক্তারবাবুর ভাগ্নে-ভাগ্নিদের সঙ্গে দেখা করবেন কি না।

করব। চলুন তো!

 ডঃ মিশ্র একটু এগিয়ে ডাইনে, একটুখানি চড়াই বেয়ে ওঠার পর বাঙালি রাজপুতের বাড়ির সামনের চত্বরে গাড়ি দাঁড় করালেন। গাড়ি থেকে নেমে দেখলুম, উঁচু বাউন্ডারিওয়ালে ঘেরা অনেকটা জায়গা নিয়ে দোতলা বাড়িটা মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। ভেঙেপড়া গেটে কাঠের আগড়। পাশে একতলা কয়েকটা ঘর। লনের দুধারে আগাছার জঙ্গল। লনের শেষে গাড়িবারান্দা। উপরে ও নীচে প্রকাণ্ড করিহিয়ান স্তম্ভের সারি। কিন্তু জানালাগুলোর ওপরে মোগল স্থাপত্যের ধাঁচে কারুকার্য করা অর্ধবৃত্তাকার খিলান। বাড়িটা দেখে কেন কে জানে একটু অস্বস্তি, জাগল। নিষ্প্রাণ স্তব্ধ একটা পুরোনো বাড়ি যেন অজস্র চোখ দিয়ে আমাদের দেখছে। অবশ্য নির্জন পুরোনো বিশাল স্থাপত্যের সামনে দাঁড়ালে অনেকের মনে হয় তো এমন একটা অস্বস্তি হয়।

ততক্ষণে ডঃ মিশ্রের ডাকে একটা পালোয়ান চেহারার মধ্যবয়সী লোক আগড় খুলে বেরিয়ে এসেছিল। তার মাথার চুল কাঁচাপাকা এবং মাঝখানে সিঁথি। দুই কানে রুপোর আংটা। গলায় একটা রুপোর চেন। বাঁ হাতের কব্জিতে তামার বালা। পরনে ফুলপ্যান্ট আর স্পোর্টিং গেঞ্জি। গোঁফটা মোটা এবং ঠোঁটের দুধার দিয়ে একটু নেমে এসেছে। চেহারা যা-ই হোক লোকটি বিনীত। সেলাম দিয়ে হিন্দিতে সে একটু হেসে বলল–মিছরিসায়েব কি এই হাভেলিতে পাখি দেখতে এলেন? তা স্যার, ছাদের উপর অনেক জংলি কবুতর আছে।

ডঃ মিশ্র বললেন–ঝাব্বুলাল। কলকাতা থেকে এই হাভেলির মালিকের ছেলে এসেছে। সঙ্গে বন্ধু-বান্ধবী নিয়ে এসেছে। তারা কোথায়?

ঝাব্বুলাল বলল–হ্যাঁ স্যার। তবে ওঁরা হাভেলিতে বসে থাকার জন্য তো আসেন না। দুবেলা কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ান। দুপুরে এসে খানাপিনা করে আবার কিছুক্ষণ আগে বেরিয়ে গেলেন।

ডঃ মিশ্র আমাকে দেখিয়ে বললেন–ইনি কর্নেল সায়েব। কলকাতা থেকে তোমার মালিকের ছেলের সঙ্গে এসেছেন। তাদের সঙ্গে ট্রেনে আলাপ হয়েছিল। তাই কর্নেল সায়েব দেখা করতে এসেছেন।

ঝাব্বুলাল আমাকে সেলাম দিয়ে বলল-সন্ধ্যার আগেই বাবুসায়েবরা ফিরে আসবেন। আমি ওঁদের বলব কর্নেল সায়েবের কথা।

ডঃ মিশ্র বললেন–চলুন কর্নেল সায়েব! আপনাকে পুরোনো টাউন আর নতুন টাউন দেখিয়ে আনি। কৈলি নদীর উপর হাইওয়েতে একটা ব্রিজ দেখেছেন। দ্বিতীয় ব্রিজটা পেরিয়ে পশ্চিমে একটুখানি গেলে নতুন টাউন।

পা বাড়িয়ে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালুম–আচ্ছা ঝাব্বুলাল এই বাড়ি সম্পর্কে একটা কথা শুনেছি। দুপুর রাতে নাকি কে ঘোড়ায় চেপে এই বাড়িতে ঢোকে। তারপর আবার চলে যায়। সত্যি?

ঝাব্বুলাল হাসল–না স্যার! লোকে মিথ্যা রটিয়েছে।

ডঃ মিশ্র বললেন–সে কী ঝাব্বুলাল! লোকে বলে, তোমার কাছেই ঘোড়সওয়ার ভূতের কথা তারা শুনেছে!

–মিছরিসায়েব! আমি তামাশা করে ভুতের গল্প বলি। সব মিথ্যা কথা। ঝাব্বুলাল মিঃ মিশ্রের কাছে এলো। চাপা স্বরে বলল–আপনি পঞ্চগড়ের সবচেয়ে খাঁটি মানুষ স্যার! কর্নেলসায়েব তো বাইরের লোক। উনি শুনলেও ক্ষতি নেই। ইন্দরবাবু এই হাভেলি বেচতে চান। আমার তাতে ক্ষতি হবে। মাসে মাত্র দুশো টাকা মাইনে পাই। আপনি নিশ্চয় জানেন মিছরিসায়েব, এই হাভেলি আমি বাইরের ট্যুরিস্টদের ভাড়া দিয়ে কিছু রোজগার করি। এখন ভূতুড়ে বাড়ির বদনাম রটেছে বলে কেউ এ বাড়ি কিনতে চায় না।

ডঃ মিশ্র একটু হেসে বললেন–এমন করে কতদিন বিক্রি আটকে রাখবে তুমি?

–যতদিন পারি। মিছরিসায়েব! আমি বেঁচে থাকতে এ বাড়ি বিক্রি হতে দেবো না।

ঝাব্বুলাল! কর্নেলসায়েব কথাটা যদি ওঁর চেনা ইন্দুরবাবুর কানে তোলেন?

ঝাব্বুলালের চোখের চাউনি সহস্য বদলে গেল। আমার দিকে দৃষ্টি রেখে সে বলল–এই সায়েব ইন্দুরবাবুর কানে কথাটা তোলার আগে ওঁকে একটুখানি ইশারা দেবেন, এই ঝাব্বুলাল লোকটা কে আর কী তার পরিচয়।

 আমি চুপ করে থাকলুম। ডঃ মিশ্র বললেন–না, না কর্নেল সায়েব কদিনের জন্য বেড়াতে এসেছেন। উনি কাকেও এসব কথা বলবেন কেন? ঠিক আছে চলি ঝাব্বুলাল!

গাড়িতে উঠে বললুম–লোকটা অদ্ভুত চরিত্রের!

উঃ মিশ্র গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বললেন–আমিও খুব অবাক হয়েছি।

হঠাৎ ওর এসব কথা শুনে মনে হচ্ছে, প্রদীপ্তবাবুর ছেলে সম্ভবত বাড়িটা বিক্রি করার জন্যই এখানে এসেছে।

লোকটা আপনার সামনে এসব কথা খুলে বলল। এর আগে কি আপনি এমন কোনো আভাস তার কথায় পেয়েছিলেন?

–না। তবে নিজের সম্পর্কে ও যা বলল, তা কিছুটা সত্যি। এলাকার দুবৃত্তদের সঙ্গে ওর গোপন সম্পর্কের কথা অনেকে জানে।

লোকটার স্পর্ধা দেখে আমি চমকে উঠেছিলুম। আপনাকে প্রকারান্তরে যেন সে অপমান করল। এর কি কোনো কারণ আছে?

–না! আমার মনে হল ঝাব্বুলাল মদ খেতে খেতে উঠে এসেছিল। ওর কথা শুনে আমি ধরেই নিয়েছিলুম, নেশার ঘোরে কথা বলছে। আপনার দৃষ্টি আমার চেয়ে তীক্ষ্ণ।

একটু হেসে বললুম–আমি এই প্রথম ওকে দেখলুম। বুঝতে পারিনি ও মদ খেয়েছে।

ডঃ মিশ্র জোর দিয়ে বলল–হ্যাঁ। নেশার ঘোরেই কথা বলছিল ঝাব্বুলাল। এ ছাড়া ওর আচরণের আর কোনো ব্যাখ্যা হয় না। পুরোনো টাউনের রাস্তায় যানবাহন আর মানুষজনের ভিড় চোখে পড়ছিল। হর্ন দিলেও লোকেরা রাস্তা থেকে সরতে চায় না। ডঃ মিশ্র বললেন–এই জন্যই ওই পশ এলাকায় চলে গিয়েছিলুম। আর একটু পরেই অবশ্য ভিড় থাকবে না। নিউ টাউন প্ল্যান করে গড়া হয়েছে।

 কৈলি নদীর ব্রিজ পেরিয়ে দেখলুম মসৃণ রাস্তার দুধারে অনেকটা জায়গা রেখে ছিমছাম দোকান-পাট গড়ে উঠেছে। সামনে অস্তগামী সূর্য দূরের পাহাড়ের চূড়াকে রক্তিম করেছে। কিছুদূর চলার পর দুপাশে সুন্দর বাড়ি দেখতে পেলুম। লনে বর্ণাঢ্য ফুলবাগান। ডঃ মিশ্র বললেন–আমার এক বন্ধু ডঃ সুরেশ্বর শর্মার সঙ্গে আপনার আলাপ করিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল। উনি পদার্থবিজ্ঞানী। কলেজে অধ্যাপনা করেন। কিন্তু এখন হয়তো কলেজ থেকে ফিরে উনি বিশ্রাম নিচ্ছেন। পরে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আসা যাবে।

বলে উনি বাঁদিকে একটা রাস্তায় গাড়ি ঘোরালেন। এই ধরনের বেড়ানো আমার পছন্দ নয়। জিজ্ঞেস করলুম–এখন আমরা কোথায় যাচ্ছি?

ডঃ মিশ্র হাসলেন–এই রাস্তা দিয়ে হাইওয়েতে পৌঁছব। তারপর হাইওয়ে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে বাড়ি ফেরার পথ ধরব। আপনাকে পঞ্চগড়ের একটা আইডিয়া দিলুম আর কী! অর্থাৎ মোটামুটি টপোগ্রাফিক্যাল পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করলুম। এবার নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন, কেন বাইরে থেকে লোকেরা পঞ্চগড়ে বেড়াতে আসে? সায় দিলুম–হ্যাঁ। অসাধারণ বিউটি স্পট। পাহাড় জঙ্গল নদী আর ওই। প্রাচীন ঐতিহাসিক দুর্গের ধ্বংসাবশেষে রহস্যময় পরিবেশ।

–শুধু বাকি রইল রেনবো অর্কিড। আশা করি কাল সকালে বেরিয়ে জায়গাটা খুঁজে বের করব।

হাইওয়ে থেকে বাঁদিকে উত্তরে পিচরাস্তায় গাড়ি ঘোরালেন ডঃ মিশ্র। সুবে আলো জ্বলে উঠেছে তখন। এরপর ডাইনে পূর্বে বাঁক নিয়ে চড়াইয়ে ওঠার সময় নীচে বাঙালিটোলা হয়ে পুরোনো টাউনে যাওয়ার রাস্তায় হঠাৎ চোখে পড়ল, আমি যেহেতু গাড়ির বাঁদিকে বসে ছিলুম। ইন্দ্রনীল, সৌরজ্যোতি আর সুদক্ষিণা হন্তদন্ত হেঁটে চলেছে। বল্লরীকে দেখতে পেলুম না। হয়ত ওদের আগে আছে। গাছপালা। আর বাড়ির ফাঁক দিয়ে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য ওদের দেখেছি।

অবাক লাগল, ওরা পায়ে হেঁটে কোথায়-কোথায় ঘুরে বেড়ায়? ডাক্তারমামার গাড়িটা চাইলে নিশ্চয় ওরা পেয়ে যেত। পাহাড় জঙ্গল সম্পর্কে ওদের অভিজ্ঞতা কতটুকু, তা অবশ্য জানি না।

রোমিলা অর্ধবৃত্তাকার বারান্দায় বসে আমাদের প্রতীক্ষা করছিলেন।

 ডঃ মিশ্র গ্যারাজে গাড়ি রাখতে গেলেন। রোমিলা বললেনকতদূর ঘুরলেন আপনারা?

বললুম–অনেকদূর। আপনার হাতে লোডেড গান দেখব ভেবেছিলাম।

রোমিলা হাসলেন। আপনার বন্ধুর চেয়ে আমার সাহস বেশি। বসুন। কফির ব্যবস্থা করি।

.

বাইরে কোথাও গেলে আমার প্রাতঃভ্রমণের অভ্যাস আছে। ভোর পাঁচটায় উঠে বেরিয়ে পড়েছিলুম। রামভকতকে রাত্রেই বলা ছিল। তাই সে গেটের তালা, খুলে দিয়েছিল। মিশ্র দম্পতি তখনও শয্যা ত্যাগ করেননি। অবশ্য ডঃ মিশ্র আমার সঙ্গী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভোরের ভ্রমণে আমি একলা বেরোতেই চাই। এ আমার দীর্ঘকালের অভ্যাস। তাই তাকে ডাকিনি।

বাংলোর পেছনে পূর্বের উপত্যকায় তখনও গাঢ় ধূরত। উঁচু জমি থেকে ঝোপজঙ্গলের ভিতর ঢালু জায়গা দিয়ে নীচে নেমে নগ্ন ঊষর প্রান্তরে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছিলুম। কিছুদূর হেঁটে যাওয়ার পর, একখানে আমাকে চমকে দিয়ে লালঘুঘুর একটা দল উড়ে গেল। ডঃ মিশ্র না বললেও বুঝতে পেরেছিলুম, এইসব নগ্ন প্রান্তরে ক্ষয়াখবুটে গুল্ম ও পাথরের টুকরো ওই বিরল প্রজাতির ঘুঘুদের বিচরণক্ষেত্র।

কিন্তু বরাবর দেখেছি, কোথাও আমার লালঘুঘুদের দর্শন পাওয়ার সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের রহস্যের যোগসূত্র থেকে যায়। হয়তো এটা আমার নিছক কুসংস্কার। একটা আকস্মিক দৈবাৎ যোগাযোগ মাত্র।

কিন্তু আমার অস্বস্তি জেগে উঠল। সুন্দর এই উপত্যকায় রক্তাক্ত কোন লাশের মুখোমুখি আমি হতে চাইনে। তাই ঘুরে পশ্চিমে এগিয়ে চললুম। একটা টিলার গায়ে আদিবাসীদের বসতি দেখা যাচ্ছিল। বসতিটা এড়িয়ে আমি শালবনের ভিতর দিয়ে হেঁটে একটা পিচরাস্তা দেখতে পেলুম। এই রাস্তা দিয়েই কাল ভোরে আমি স্টেশন থেকে ডঃ মিশ্রের গাড়িতে তার বাংলোয় গিয়েছিলুম।

রাস্তাটা পেরিয়ে গিয়ে কৈলি নদীর শুকনো খাতে একটা পাথরে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলুম। তারপর বালির চড়া পেরিয়ে গিয়ে দেখলুম, নদীর পশ্চিমপাড়ের নীচে এক ফালি স্বচ্ছ জলধারা দক্ষিণ থেকে উত্তরে বয়ে যাচ্ছে। জলটুকু ডিঙিয়ে পাড়ে উঠতেই পঞ্চগড়ের সেই ঐতিহাসিক ধ্বংসস্তূপ চোখে পড়ল। বাইনোকুলারে গড়ের জঙ্গলে কিছুক্ষণ দেখার পর ঠিক করলুম, সেখানে গিয়ে রেনবো অর্কিড খুঁজে বের করব।

তখন পূর্বের দিগন্তে উঁচু পাহাড়ের শীর্ষে সূর্যের লাল ছটা আকাশের গায়ে কয়েকখণ্ড মেঘকে রঙিন করেছে এবং চরাচরে সেই রক্তিম আভা ঈষৎ প্রতিফলিত হয়েছে। কোথাও তরঙ্গায়িত নগ্ন, প্রান্তর, কোথাও ঝোপঝাড় আর নিঃসঙ্গ কোথাও গাছের তলা দিয়ে নেশাগ্রস্তের মত হাঁটতে হাঁটতে গড়ের জঙ্গলে পৌঁছুলাম। ততক্ষণে কোমল রোদ স্পষ্ট করেছে নিসর্গকে! গড়ের জঙ্গলে পাখির কলরব চারপাশে। কিন্তু পাখি দেখার দিকে আমার মন নেই। ধ্বংসস্তূপের ভেতরে আঁকাবাঁকা পথে মাঝেমাঝে থমকে দাঁড়িয়ে পরজীবী রেনবো অর্কিড খুঁজছি। কখনও বাইনোকুলারে, কোথাও খালি চোখে। কিছুক্ষণ পরে দেখলুম, কালকের দেখা সেই পাথরের চতুষ্কোণ চত্বরের কাছে এসে পড়েছি।

চত্বরে উঠে চারদিকে দেখে নিয়ে পা বাড়ালুম, তারপর পশ্চিমপ্রান্তে গিয়েই থমকে দাঁড়ালাম। মাথার ভিতরে যেন একটা ঠাণ্ডাহিম ঢিল গড়িয়ে গেল। নিজের ভাগ্যকে অভিশাপ দিয়ে একলাফে নীচে নামলাম। একটা গভীর ও প্রশস্ত গর্তের মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে আছে একটি রক্তাক্ত লাশ। মেয়েরই লাশ। পরনে জিনসের প্যান্ট আর গায়ে হাতকাটা গেঞ্জি। মুখটা একপাশে কাত হয়ে আছে। মুখটা দেখেই চমকে উঠেছিলুম। গর্তে নেমে সাবধানে মুখটা সোজা করতেই চিনতে এক মুহূর্ত দেরি হল না। মেয়েটি বল্লরী দাশগুপ্ত।

তার নিস্পন্দ দেহটা চিত করে দেখে নিলুম, বুকের দুপাশে আর গলার নীচে তিনটি ক্ষতচিহ্নে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। লাশটা যে অবস্থায় ছিল, তেমনই রেখে চত্বরের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল চাপ-চাপ রক্তের চিহ্ন। বল্লরীকে চত্বরের কিনারায় ত্রিশূল বা বাঘনখ জাতীয় অস্ত্রে (ডঃ মিশ্র যেমনটি বলেছিলেন) হত্যা করা হয়েছে। আঘাতের সঙ্গে সঙ্গেই সে ছিটকে এই গভীর গর্তে উপুড় হয়ে পড়েছে।

চত্বরে উঠে আবার সতর্কভাবে চারদিক দেখে নিয়ে আমি দক্ষিণে নেমে গেলুম। তারপর পূর্বে ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে কালকের সেই যুগল ধ্বংসস্তূপের মাঝখানে একটা পাথরে বসলুম। এতক্ষণে মনে পড়ল, গতকাল সন্ধ্যার সময় ইন্দ্রনীল, সৌরজ্যোতি ও সুদক্ষিণাকে খুব ব্যস্তভাবে বাঙালিটোলার রাস্তায় হেঁটে যেতে দেখেছিলুম। বল্লরীকে দেখতে পাইনি। তা হলে কি বল্লরী কোনো কারণে দলছাড়া হয়ে পড়েছিল এবং তাকে খুঁজে না পেয়ে বাকি তিনজন ফিরে যাচ্ছিল?

একটা কথা অবশ্য স্পষ্ট। গড়ের জঙ্গলে কোনো মাংসাশী প্রাণী নেই। আদিবাসীরা ক্রমশ তাদের শেষ করে ফেলেছে। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনের পরোয়া এই এলাকায় তারা করে না। তাই বল্ললীর লাশে কোনো প্রাণী কামড় বসায়নি।

এরপর অনেক প্রশ্ন মাথায় এল। ইন্দ্রনীলরা কি পুলিশকে খবর দেয়নি যে তাদের এক সঙ্গিনী দলছাড়া হয়ে জঙ্গলে হারিয়ে গেছে? নাকি তারা ঘটনাটা একেবারে চেপে গিয়ে কলকাতা চলে গেছে? ট্রেনে আসবার সময় যা-যা দেখেছিলুম এবং কাল এখানে বসে ওদের যে-সব কথা শুনেছিলুম, তাতে স্পষ্ট বুঝেছিলুম, তাদের মধ্যে একটা সমস্যা আছে এবং তারা একটা বোঝাপড়া করতে চায়। বল্লরীর এই পরিণতি কি সেই সমস্যার সঙ্গে যুক্ত?

কিছুক্ষণ পরে মনে হল, আমি এখানে চুপচাপ বসে আছি কেন? কীসের প্রতীক্ষা করছি? কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সামনে এ একটা স্পর্ধিত চ্যালেঞ্জ নয় কি?

তখনই উঠে দাঁড়ালুম। বোঝা যাচ্ছে, বল্লরীর মৃতদেহ সারারাত এখানে যখন কোনো প্রাণী ছোঁয়নি, তখন মৃতদেহ ফেলে চলে যাওয়া যায় এবং পুলিশকে ডিঃ মিশ্রের বাংলো থেকে ফোনে খবর দিতে কোনো অসুবিধে নেই।

তারপরই মাথায় এলো শকুনের কথা। রোদ আরও উজ্জ্বল হলে কঁকা জায়গায় গর্তে পড়ে থাকা লাশটা আকাশ থেকে শকুনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়িয়ে যাবে না। একটু ভেবে নিয়ে আমার পিঠে আঁটা কিটব্যাগ থেকে জঙ্গল নাইফটা বের করলুম। তারপর চত্বরের পশ্চিমে গিয়ে অনেকগুলো ঝোপ কেটে ফেললুম।

ঝোপগুলো লাশের উপর ফেলার আগে বল্লরীর লাশের তিনটে ফোটো তুলে নিলুম ক্যামেরায়। তারপর লাশটা ঝোপের তলায় একেবারে ঢেকে ফেললুম। এবার আর কিছু করার নেই। ফিরে গিয়ে পুলিশকে টেলিফোনে খবর দিতে হবে।

লম্বা পা ফেলে চত্বরের পশ্চিম দিক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলুম। কারণ সোজা উত্তরে এগিয়ে গেলে হাইওয়েটা আধ কিলোমিটারের মধ্যে পাওয়া যাবে। কাল ডঃ মিশ্রের সঙ্গে আমি গড়ের জঙ্গলের পূর্বপ্রান্ত দিয়ে ঢুকেছিলুম।

বাঁদিকে একটা শালবন, ডাইনে নগ্ন খানিকটা জায়গা। শালবনের দিকে না গিয়ে আমি নাক বরাবর হাঁটছিলুম। একটু পরে রোদে কী একটা জিনিস চকচক করছে দেখলুম। নেহাত কৌতূহলে কাছে গিয়ে দেখি, একটা সোনার চেনের টুকরো। চমকে উঠেছিলুম। এটা কি বল্লরীর গলায় দেখেছিলুম? মনে পড়ল না। কিন্তু একটা পাথরের ছায়ায় চেনের বাকি অংশটা কুড়িয়ে পেলুম। তারপর একটা লতাঢাকা গুল্মের কাছে দেখলুম, একটা ভ্যানিটি ব্যাগ পড়ে আছে। এটা বল্লরীর ব্যাগ কি না, তা পরীক্ষার ধৈর্য ছিল না। পিঠে আঁটা কিটব্যাগে কুড়িয়ে পাওয়া জিনিসগুলো ঢুকিয়ে হাইওয়ে লক্ষ্য করে হাঁটতে থাকলুম। অবশ্য মাঝেমাঝে একটু দাঁড়িয়ে বাইনোকুলারে দেখে নিচ্ছিলুম ইন্দ্রনীলরা পুলিশের সঙ্গে গড়ের জঙ্গলের দিকে আসছে কি না। নাকি গত রাতে পুলিশবাহিনীর সাহায্যে তারা গড়ের জঙ্গলে বল্লরীকে খুঁজতে বেরিয়েছিল এবং খুঁজে না পেয়ে ফিরে গেছে?

পরক্ষণে মনে হল, এমন কোনো চেষ্টা তারা করলে বল্লরীর মৃতদেহ খুঁজে পেত। ওই চত্বরটা তাদের চেনা জায়গা। সবচেয়ে অদ্ভুত মনে হল, গড়ের জঙ্গলে গত দুবছরে তিন-চারটে লাশ একই অবস্থায় পাওয়া গেছে। তা হলে এমন কি হতে পারে না কোনো হোমিসাইড্যাল ম্যানিয়াক সাধু-সন্ন্যাসীর বেশে ওই জঙ্গলে কোনো গোপন ডেরায় বাস করে এবং কাকেও একলা পেলেই বাঘনখ নামক সেকেলে অস্ত্র দিয়ে খুন করে?

ডঃ মিশ্রের বাংলোয় পৌঁছুতে সাড়ে সাতটা বেড়ে গিয়েছিল। তিনি আমাকে দেখে একটু কিছু আঁচ করে বলে উঠলেন–কর্নেল সরকার! আপনাকে উত্তেজিত দেখাচ্ছে কেন?

বললুম–ডঃ মিশ্র! আমি এখনই পুলিশকে একটা ফোন করতে চাই।…..

.

ডঃ মিশ্রের ড্রয়িং রুমে ঢুকে সোফায় বসলুম। তারপর আমার বুকপকেট থেকে ছোট্ট নোটবইটা বের করে পঞ্চগড় পুলিশ স্টেশনের নাম্বার দেখে নিলুম। ডঃ মিশ্র টেলিফোন গাইড বের করেছিলেন। রিসিভার তুলে আমি ডায়াল করছি দেখে তিনি গাইডটা হাতে নিয়ে বসে রইলেন। তাঁর উদ্বিগ্ন দৃষ্টি আমার দিকে। চোখের কোনা দিয়ে লক্ষ্য করলুম রোমিলা দেবীও দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছেন।

কয়েকবার রিং হওয়ার পর সাড়া এলো হিন্দিতে–নমস্তে! পঞ্চগড় পোলিস টিশান।

হিন্দিতেই বললুম–অফিসার-ইন-চার্জ গোপেশ্বর সিনহার সঙ্গে কথা বলতে চাই। খুব জরুরি কথা।

–সিনহা সায়েবকে নটার আগে পাওয়া যাবে না। আপনি কে বলছেন?

–আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। কলকাতা থেকে পঞ্চগড়ে এসেছি। আপনি কি ডিউটি অফিসার?

এক মিনিট। ডিউটি অফিসারকে দিচ্ছি।

কানে ভেসে এলো ডিউটি অফিসারকে ডাকা হচ্ছে। কেউ হাসতে হাসতে বলল, শর্মাজি বাথরুমে। দুঘন্টা পরে বেরোবেন। সকালের দিকে সর্বত্র পুলিশ স্টেশনে এক ঢিলেমি লক্ষ্য করেছি। তাই ধৈর্য ধরে বসে থাকলুম। প্রায় পাঁচমিনিট পরে গম্ভীর কণ্ঠস্বরে সাড়া এলো।

-ডিউটি অফিসার বলছি। হয়েছেটা কী? কে আপনি?

–আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

 –কে? কানিল নিলদারি সরকার! তাজ্জব নাম। একটু স্পষ্ট করে বলুন।

ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বরে বললুম–তামাশা করলে এর ফল আপনাকে ভুগতে হবে। ও. সি. গোপেশ্বর সিনহাকে জরুরি খবর দিন। কলকাতা থেকে রিটায়ার্ড মিলিটারি অফিসার কর্নেল সায়েব কথা বলবেন। দেরি করবেন না। তাকে নোক পাঠিয়ে বলুন, গড়ের জঙ্গলে একটি মেয়ে খুন হয়েছে। তার লাশ দেখে এসেছি।

আমার কথা শেষ হওয়ার পরই লাইন কেটে গেল। রিসিভার রেখে ডঃ মিশ্রের দিকে তাকালাম। তিনি হতবাক হয়ে শুনছিলেন। বললেন–গড়ের জঙ্গলে কোনো মেয়ের লাশ! হায় ভগবান!

বললুম–হ্যাঁ। সব বলছি। আমার গলা শুকিয়ে গেছে। এক পেয়ালা কফি চাই।

রোমিলা দরজার পর্দা সরিয়ে ডাকলেন–চামেলি! দেরি করছ কেন?

একটু পরেই ঘোমটা ঢাকা চামেলি কফি ও স্ন্যাক্সের ট্রে রেখে গেল। রোমিলা বসলেন। তারপর দ্রুত আমাকে একটা লম্বা কাপে কফি তৈরি করে দিলেন। ওই কাপটি কাল সন্ধ্যায় আমার কফির তৃষ্ণা লক্ষ্য করে মিসেস মিশ্র বরাদ্দ করেছেন। কফি খেতে খেতে সংক্ষেপে সব বললুম। থানার ডিউটি অফিসারের হঠাৎ ফোন রেখে দেওয়ার কথা শুনে মিঃ মিশ্র বললেন–আমি পুলিশের সার্কেল ইন্সপেক্টর বদ্রীনাথ রাওয়ের কোয়ার্টারের নাম্বার জানি। উনি আমার বিশেষ পরিচিত। এক মিনিট।

বললুম–সম্ভবত সিংভূমের পুলিশ সুপার তাকে আমার কথা বলে থাকবেন। আপনি কথা বলে আমাকে ফোনটা দেবেন।

ডঃ মিশ্র টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা নোটবই নিয়ে এলেন। তারপর বদ্রীনাথ রাওয়ের নাম্বার দেখে নিয়ে ডায়াল করলেন। সাড়া এলে তিনি বললেন–ডঃ সুরজ প্রসাদ মিশ্র বলছি, রাওজির সঙ্গে জরুরি কথা আছে। ….নমস্তে রাওজি। কলকাতা থেকে কর্নেল সরকার এসেছেন।….তা হলে তো ভাল কথা। ….উনি আমার অতিথি। উনি থানায় ফোন করেছিলেন। ডিউটি অফিসার শর্মা তার কথা শুনে ফোন রেখে দিয়েছেন। অথচ উনি একটা জরুরি খবর দিচ্ছিলেন।…রাওজি! কর্নেল সায়েব আমার পাশেই আছেন। ওঁর সঙ্গে কথা বলে জেনে নিন।

ডঃ মিশ্র আমাকে রিসিভার দিলেন। সি. আই. বদ্রীনাথ রাও আমার সাড়া পেয়ে বললেন–সুপ্রভাত কর্নেল সরকার! এস পি সায়েব না বললেও আমি নানাসূত্রে আপনার নাম শুনেছিলুম। আমার সৌভাগ্য! আপনার সেবার জন্য আমি সবসময় প্রস্তুত।

মনে হল, ভদ্রলোক বড্ড বেশি কথা বলেন। তাকে থামিয়ে সংক্ষেপে শুধু বললুম, প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে গড়ের জঙ্গলে রেনবো অর্কিডের খোঁজে গিয়েছিলুম। একটা চওড়া চৌকো পাথরের চত্বরের ধারে গভীর গর্তে একটি মেয়ের লাশ দেখেছি।

লাশের বর্ণনা দিয়ে শকুনের হাত থেকে বাঁচাতে আমি কী ব্যবস্থা করে এসেছি, তা-ও বললুম। আমার কথা শোনার পর মিঃ রাও বললেন–আমি গোয়েন্দা পুলিশের সূত্রে গতরাতে খবর পেয়েছিলুম, কলকাতা থেকে বাঙালি হাভেলির মালিকের ছেলে এক বন্ধু আর দুই বান্ধবীকে নিয়ে বেড়াতে এসেছে। তার এক বান্ধবী কাল বিকেলে বেড়াতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছে। যাই হোক, আমি ও.সি. মিঃ গোপশ্বর সিনহাকে তার কোয়ার্টারে রিং করে জানাচ্ছি। আশা করি শিগগির আপনার সঙ্গে আমাদের দেখা হবে। নমস্তে!

রিসিভার রেখে বললুম–কলকাতা থেকে বেড়াতে আসা যুবক-যুবতীদের মধ্যে কাল বিকেলে এক যুবতী নিখোঁজ হওয়ার খবর রাওজি জানে, তার মানে, ইন্দ্রনীল কাল সন্ধ্যায় পুলিশকে খবর দিয়েছিল। কিন্তু বুঝতে পারলুম না, বল্লরী দাশগুপ্ত কোথা থেকে কখন দলছাড়া হয়েছিল।

রোমিলা বললেন–ওদের হাভেলিতে বিদ্যুৎ বা টেলিফোন কিছুই নেই।

 ডঃ মিশ্র বললেন–আপনার সঙ্গে ওদের আলাপ হয়েছিল। আপনি একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার। বাঙালি। কলকাতার মানুষ আপনি ওদের নিশ্চয় বলেছিলেন, কোথায় উঠবেন?

বললুম—হ্যাঁ। বলেছিলুম। সুদক্ষিণাকে একটা নেমকার্ডও দিয়েছিলুম।

–আশ্চর্য ব্যাপার! ওরা আপনাকেও ব্যাপারটা জানাতে পারত! জানাল না কেন? তা ছাড়া ঝাব্বুলাল নিশ্চয় ওদের বলেছে, আপনি আমার সঙ্গে ওই হাভেলিতে গিয়েছিলেন!

–আপনি ঠিক বলেছেন ডঃ মিশ্র। বাইরে গিয়ে কেউ বা কারা বিপদে পড়লে তাদের ভাষা যা বা যাদের মাতৃভাষা, তাছাড়া একই জায়গার লোক–সে বা তারা এমনটি করবে না। ভাষা আর বাসস্থান অন্যত্র একটা পৃথক সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক যোগসূত্র গড়ে তোলে।

রোমিলা বিষণ্ণ মুখে বললেন–হতভাগিনী একইভাবে খুন হয়েছে। ত্রিশূল বা বাঘনখ, অস্ত্রটা একই। এর আগেও অন্তত তিনবার…ডঃ মিশ্র বললেন না। চারবার।

তো চারবার এবং এই নিয়ে পাঁচবার গড়ের জঙ্গলে লাশ পড়ল। আমি বলছি, খুনী একজনই। অনেকবছর আগে যে সন্ন্যাসীকে লোকে দেখতে পেত, আমার ধারণা, সে এক তান্ত্রিক। সে ওই জঙ্গল ছেড়ে চলে যায়নি। কোথাও গোপন ডেরায় সে লুকিয়ে থাকে।

কফি শেষ করে চুরুট ধরালুম। রোমিলা সিগারেট বা চুরুটের ধোঁয়া সহ্য করতে পারেন না। কিন্তু আমার এখন চুরুট না টানলে মাথা কাজ করবে না।

একটু পরে মনে পড়ল সৌরজ্যোতির কথা বল্লরী! এখনও বলছি মুখ বুজে থেকো না। তুমি একটা অতল খাদের ধারে দাঁড়িয়ে আছ। তা হলে সত্যি সে অতল খাদে গড়িয়ে পড়ে গেল অবশেষে? সৌরজ্যোতি কি অতল খাদ বলতে এইরকম কিছু বুঝিয়েছিল? অঙ্কটা মিলছে না। শরীরে তিনটে ক্ষতচিহ্ন এর আগেই চারটে লাশে দেখা গিয়েছিল। তবে ডঃ মিশ্রকে তার আত্মীয় পুলিশ অফিসার মার্ডার উইপনটা বাঘনখ বলেছিলেন, বল্লরীর ক্ষত দেখে আমার তা মনে হয়নি। বাঘনখ প্রাচীন অস্ত্র। ওই অস্ত্র ব্যবহারের পরিণামে ক্ষতের সঙ্গে গভীর আঁচড়েরও চিহ্ন থাকবে। তিনটে গভীর ক্ষতচিহ্ন দেখে আমার মনে হয়েছে। কোনো ভারী ও মোটা ত্রিশূলের আঘাত। বারুদ আবিষ্কারের আগে ত্রিফলা ভল্ল ব্যবহার করা হত যুদ্ধে। প্রাচীন যুগের যুদ্ধাস্ত্র বিষয়ে আমার সংগ্রহে একটা বই আছে। কিন্তু সেটা তো কলকাতায় আমার ড্রয়িংরুমের শেলফে এখন বন্দি।

হঠাৎ মাথায় এলো, মিসেস রোমিলা মিশ্র গার্লস কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপিকা। চুরুটটা চুপচাপ শেষ করলুম। ডঃ মিশ্র অ্যাশট্রেটা সামনে তুলে ধরলেন। তখনই সম্বিৎ ফিরল। বললুম–ছি ছি! আমি চুরুটের ছাইয়ে কার্পেট নোংরা করে ফেলেছি! খুবই দুঃখিত ডঃ মিশ্র! ডঃ মিশ্র একটু হেসে বললেন দুঃখিত হওয়ার কারণ নেই। আমিও তো আপনাকে অ্যাশট্রেটা দেখাতে ভুলে গিয়েছিলুম। চুরুটটা শেষ করে কোথায় ফেলবেন ভাবছিলেন দেখে অ্যাশট্রেটার কথা আমার মনে পড়ল।

বেরিয়ে গিয়ে দেখলুম, রোমিলা উত্তরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সম্ভবত বাঙালি হাভেলির দিকে তাকিয়ে আছেন। একটু ইতস্তত করে ডাকলুম–মিসেস মিশ্র। আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। রোমিলা দ্রুত কাছে এলেন–বলুন কর্নেল সরকার!

-আপনি ইতিহাসের অধ্যাপিকা। আপনার কাছে কি প্রচীন যুগের সুদ্ধাস্ত্র সম্পর্কে লেখা কোনো বই আছে?

দুঃখিত কর্নেল সরকার! আমি আধুনিক ইতিহাস পড়াই। প্রাচীন যুগের যুদ্ধাস্ত্র সংক্রান্ত বই আমার সংগ্রহে নেই। তবে আমার কলেজ লাইব্রেরিতে আছে।

–আপনি পঞ্চগড়ের প্রাচীন ইতিহাস সংক্রান্ত কোনো বই কি কলেজ লাইব্রেরিতে দেখেছেন?

পঞ্চগড়ের ইতিহাস বই আমার বাড়িতেই আছে। আঠারো শতকে লেখা এক ব্রিটিশ লেফটন্যান্ট কর্নেলের বই।

ডঃ মিশ্র বললেন–১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে লেখা বই। আমি রোমিলার পড়ার আগেই পড়েছি। রবার্ট ক্লিকটন তখন বিহারের এই অঞ্চলে ছিলেন। তবে রোমিলার কথা শুনে মনে হবে তখনকার ছাপা বই। তা কিন্তু নয়। বইটা দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে ছাত্রজীবনে কিনেছিলুম। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে রিপ্রিন্ট এডিশন। তখন কি জানতুম, আমি যাকে বিয়ে করব, সে ইতিহাসের অধ্যাপিকা হবে?

রোমিলা স্বামীর দিকে কপট রোষে কটাক্ষ করে ভেতের ঢুকে গেলেন। আমি বারান্দায় বসলুম। পুলিশের আবির্ভাবের জন্য মনের ভেতর তীব্র প্রতীক্ষার আলোড়ন চলেছে। ডঃ মিশ্র আমার পাশে বসলেন। একটু পরে রোমিলা মোটাসোটা একটি বই এনে দিলেন। বইটির পাতা উল্টে টেবিলে রেখে দিলুম।

একটু পরে টেলিফোন বেজে উঠল। ডঃ মিশ্র দ্রুত উঠে গেলেন। একটু পরে তিনি ফিরে এসে বললেন–ও.সি. মিঃ গোপেশ্বর শর্মা অ্যাম্বুল্যান্স এবং ফোর্স পাঠিয়ে দিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন। প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। আমার মনে হয়, আপনি এখনই ব্রেকফাস্ট করে নিন। মিঃ শর্মা একটু অপেক্ষা করলে ক্ষতি কী? রোমিলা! তুমি দেখ, শিগগির ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করা যায় কি না। কর্নেল সায়েব মিঃ শর্মার সঙ্গে গড়ের জঙ্গলে যাবেন, তা নিশ্চিত। আমিও যেতে চাই।

ব্রেকফাস্ট শেষ করার পর পুলিশের একটা জিপ চোখে পড়ল। জিপটা এসে বাংলোর গেটের ওধারে থামল। রামভকত গেট খুলে দিয়েছিল। কিন্তু জিপ থেকে তাগড়াই চেহারার একজন পুলিস অফিসার নেমে এগিয়ে এলেন। ডঃ মিশ্র বললেন–মিঃ সিনহা! আশাকরি কর্নেল সরকারকে চিনতে পেরেছেন?

লনে দাঁড়িয়ে মিঃ সিনহা করজোড়ে নমস্কার করে বললেন–দেরি হয়ে গেছে। কর্নেল সায়েব বুঝতেই পারছেন, পঞ্চগড়ের মত নকল শহরে কী অবস্থার মধ্যে আমাকে কাজ করতে হয়।

বললুম–নকল শহর বললেন কেন? আমি তো কাল ডঃ মিশ্রের গাড়িতে ঘুরে দেখেছি, অসাধারণ বিউটি স্পট। শহর বলতে যা বোঝায়, তার সব নিদর্শনই আছে।

–যাই হোক, আমি ডিউটি অফিসার জ্ঞানেশ শর্মার হয়ে ক্ষমা চাইছি। ভদ্রলোক পেটের অসুখে ভুগছেন। রিটায়ার করার বয়স হয়েছে। কানেও ভাল শুনতে পান না। তাই ওঁকে মর্নিং ডিউটি দিই। এই অঞ্চলে প্রধান অপরাধ বলতে জমি নিয়ে দাঙ্গা। সেগুলো বেশির ভাগই সন্ধ্যার দিকে বাধে।

নেমে গিয়ে বললুম–চলুন! যেতে যেতে কথা বলব।

 ডঃ মিশ্র বললেন–জিপে তো আমার স্থান হবে না। পেছনে আমর্ড ফোর্স দেখতে পাচ্ছি। আমি বরং আমার গাড়ি নিয়ে আপনাদের অনুসরণ করব। গড়ের জঙ্গলে তো কোনো গাড়িই ঢুকবে না। হাইওয়েতে গাড়ি রেখে সবাইকে হাঁটতে হবে।

মিঃ সিনহা আমাকে সঙ্গে নেবেন বলে নিজে ড্রাইভ করে এসেছেন। জিপে তার ডানদিকে উঠে বসলুম। কানে এলো, রোমিলা দেবী তার স্বামীকে আসতে নিষেধ করছেন। সম্ভবত ডঃ মিশ্র পুলিশের সঙ্গে গিয়ে কোনো ঝুট ঝামেলায় জড়িয়ে পড়বেন বলে তার আশঙ্কা আছে। সেটা স্বাভাবিক। ডঃ মিশ্র সরল মানুষ। গতকাল বিকেলে ঝাব্বুলালের মুখে শোনা কথাগুলো আমার সামনেই ডঃ মিশ্র তাঁর স্ত্রীকে বলছিলেন। কাজেই আমারও মনে হল, ডঃ মিশ্রকে কোনো সুযোগে ঝাব্বুলাল সম্পর্কে কিছু বলতে নিষেধ করব।

জিপ স্টার্ট দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে মিঃ সিনহা যেতে যেতে বললেন–আগে আপনার কথা শুনতে চাই। তারপর আমি যা জানি বলব। আমি সংক্ষেপে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে গড়ের জঙ্গলে রেনবো অর্কিডের খোঁজে যাওয়ার কথা বললুম। তারপর একটা পাথরের চত্বরে উঠে চারদিকে রেনবো অর্কিড খোঁজার পর কী ভাবে লাশটা আবিষ্কার করেছি, তা জানালুম। শকুনের চোখের আড়ালে রাখার জন্য ঝোপঝাড় কেটে লাশটা ঢেকে রাখার ব্যবস্থা করেছি শুনে মিঃ সিন্হা বললেন–আপনি প্রাক্তন সামরিক অফিসার। এ ধরনের উপস্থিত বুদ্ধি আপনার থাকা স্বাভাবিক।

বললুম– কলকাতার দলটি থানায় নিখোঁজ এক সঙ্গিনীর খবর দিয়েছিল কখন?

–তখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। ওরা নিজেরা গড়ের জঙ্গলেও নাকি খোঁজাখুঁজি করে এসেছিল। জানি না এটা সত্যি কি না। কারণ লাশটা আপনার চোখে পড়েছে। অথচ ওদের চোখে পড়েনি কেন?

–ওরা কাল কোথায় বেড়াতে গিয়েছিল?

–হাইওয়েতে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় এক কিলোমিটার পশ্চিমে পাতালভৈরবীর মন্দিরে গিয়েছিল। মন্দিরটা মাটির তলায়। সিঁড়ি বেয়ে নামতে হয়। নীচে সেবায়েত দেবীর সামনে ধ্যানমগ্ন থাকে, সেখানে একটা প্রদীপ জ্বলে মাত্র। আমি একবার সস্ত্রীক গিয়েছিলুম।

–তা হলে ওরা চারজনেই পাতাল মন্দিরে নেমেছিল?

বাঙালি হাভেলির মালিকের ছেলে ইন্দ্রনীল রায়–অবশ্য এখন নাকি সে তার বাবার মৃত্যুর পর নিজেই মালিক হয়েছে

–হ্যাঁ, বলুন!

–সে কথাটা ঠিকই বলেছে। চারজন দাঁড়ানোর মত জায়গা নেই পাতাল মন্দিরে। কাজেই সে লক্ষ্য করেনি বল্লরী দাশগুপ্ত নামে তার বান্ধবী সিঁড়ি বিয়ে নেমেছিল কি না। তার বন্ধু সৌরজ্যোতি এবং অন্য বান্ধবী সুদক্ষিণাও লক্ষ্য করেনি। বেরিয়ে আসার পর তারা বল্লরীকে খুঁজে পায়নি। তারা ভেবেছিল, বল্লরী তাদের সঙ্গে কৌতুক করার জন্য আশে-পাশে কোথাও লুকিয়ে আছে। কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজেও তাকে দেখতে পায়নি। তারা হাইওয়েতে পঞ্চগড়ের দিকে হাঁটতে থাকে। ভেবেছিল, বল্লরী কোনো বাস থামিয়ে তাতে চেপে হাভেলিতে ফিরে গেছে। হা–দুপুরে গড়ের জঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে বল্লরীর সঙ্গে নাকি সৌরজ্যোতির ঝগড়া হয়েছিল। সুদক্ষিণা অবশ্য বলেছে, বল্লরীর গলায় সোনার চেনটা নাকি নিছক কৌতুকের ছলে সৌর ছিঁড়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে। তাই তারা ভেবেছিল, হারটা খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে বল্লরী গড়ের জঙ্গলে গিয়ে ঢুকেছে।

তারা কি গড়ের জঙ্গলে গিয়েছিল?

–তারা জঙ্গলের আশেপাশে ঘুরে তার নাম ধরে ডাকাডাকি করেছিল। বেলা পড়ে আসছে। তাই বিশেষ করে সাপের ভয়ে তারা চলে আসে। তারা ভেবেছিল, হার খুঁজে পেয়ে বল্লরী ফিরে গেছে। গাড়ি হাইওয়েতে পৌঁছে পশ্চিমে ঘরল। তখন বললুম–আপনার কি মনে হয়নি তারা আগে থেকে তৈরি করা একটা ঘটনা অর্থাৎ বানানো কথা বলছে?

মিঃ সিনহা একটু পরে বললেন–তখন অবশ্য পৃথকভাবে প্রত্যেককে জেরার প্রশ্ন ওঠেনি। তাই আমিও ততকিছু লক্ষ্য রেখে তাদের কথা শুনিনি। একসঙ্গে গিয়ে একেকজন কথা বলছিল। তাতে গরমিল কিছু ছিল না। পরস্পর একটা ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিল। একজনের কথার সঙ্গে অন্যজন কথা জুড়ে দিচ্ছিল।

–আচ্ছা মিঃ সিনহা, এর আগে গত দুবছরে নাকি চারটে লাশ একই অবস্থায় গড়ের জঙ্গলে পাওয়া গিয়েছিল?

শুনেছি। কেস হিস্ট্রি থানায় আছে। পড়ে দেখেছিলুম। রহস্যজনক হত্যাকাণ্ড মনে হয়েছিল।

এবং এটাও!

মিঃ সিনহা ঠোঁটের কোণে হেসে বললেন–আমার মনে হয়, আপনি আমার মুখ দিয়ে কিছু বলতে চাইছেন।

–আপনি বুদ্ধিমান মিঃ সিনহা।

বাঁ হাতে স্টিয়ারিং ধরে ডান হাত কপালে সেলামের ভঙ্গিতে ঠেকিয়ে মিঃ সিনহা বললেন–সি. আই. সায়েবের কাছে আপনার সম্পর্কে অনেক আশ্চর্য কথা শুনেছি। আপনার নাকি তৃতীয় একটা চোখ আছে।

হাসলুমনা! তবে সামরিক জীবনে বেশি সময় জঙ্গলযুদ্ধে কাটিয়েছি। তা থেকে যেন একটা অতিরিক্ত ইন্দ্রিয় আমার জন্মে গেছে। জানি না, আমি নিজেই ভুল বলছি কি না। তবে জঙ্গলে ঢুকলে আমার ওই বাড়তি ইন্দ্রিয় যেন সক্রিয় হয়ে ওঠে। বল্লরীর মৃতদেহ আবিষ্কার সেই অদ্ভুত ইনটুইশনের ফলাফল। সিওর নই। তবে এরকম আমার মনে হয়।

-কর্নেল সায়েব! আমার মতে, এটা অন্যের চারটে ঘটনার মত নয়। শুধু এটুকুই বলতে পারি। কারণ আগের চারটে লাশ যাদের, তারা কেউ দল বেঁধে বেড়াতে যায়নি গড়ের জঙ্গলে। আর পঞ্চগড়ের ব্যবসায়ী লোকটি সম্পর্কে পুলিশ ফাইলে তদন্তকারী অফিসার নোট দিয়েছিলেন, সম্ভবত কেউ তাকে মূল্যবান জিনিস বিক্রির লোভ দেখিয়ে নির্জন জঙ্গলে ডেকেছিল। টাকা আর দামী জিনিস খুনী তাকে মেরে হাতিয়ে নেয়।

-বুকে ও গলায় তিনটে একই রকমের ক্ষতচিহ্ন এই পাঁচটি কেসেই দেখা যাচ্ছে।

–হ্যাঁ। এই পয়েন্টটা গুরুত্বপূর্ণ।

এবং এই পয়েন্টেই অন্তত বল্লরীর হত্যা রহস্যের চাবিকাঠি খুঁজলে মিলতে পারে।

–আপনার সঙ্গে আমি একমত। আমরা এসে গেছি। এবার আমাদের হেঁটে যেতে হবে।

আদিবাসীদের সেই দোকানগুলোর কাছে নেমে দেখলুম, পুলিশের একটা বেতার ভ্যান এবং আরও একটা জিপগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। অ্যাম্বুল্যান্সও চোখে পড়ল। ডঃ মিশ্র তার গাড়ি থেকে নেমে এসে বললেন–ডাক্তার শচীন অধিকারীর গাড়িতে কলকাতার দলটি এসেছে। ওই দেখুন গাড়িটা।

ও. সি. মিঃ গোপেশ্বর সিনহাকে একজন পুলিশ অফিসার গোপনে কিছু বলছিলেন। সেই সুযোগে আমি ডঃ মিশ্রকে কাল বিকেলে ঝাব্বুলাল যে-সব কথা বলেছিল, তা চেপে যেতে বললুম। তারপর দুজনে মিঃ সিনহার কাছে গেলুম। মিঃ সিনহা বললেন–আমাদের এক্সপার্ট টিম ইতিমধ্যে ওখানে পৌঁছে গেছে। এস. আই. রহমত খান বললেন, আদিবাসীদের মধ্যে ইমানুয়েল নামে একজন খ্রিস্টানের দোকান আছে এখানে। সে রহমত সায়েবকে বলেছে, কাল সূর্যাস্তের আগে ইমানুয়েল এখান থেকে একটা মেয়েকে গড়ের জঙ্গলের দিকে দেখেছিল। গড়ের জঙ্গলে মাঝে মাঝে নাকি সুন্দরী মেয়ের বেশে ভূত ঘুরে বেড়ায়। এই এলাকার লোকেরা এটা বিশ্বাস করে। তাই ইমানুয়েল সেই ভূত দেখেতে পেয়েই ভয় পেয়ে তার দোকানে এসে ঢোকে। সে গড়ের জঙ্গলের ওই ভূতকে দেখতে পায়, তার নাকি আপদ বিপদ ঘটে। তাই কাল বিকেলে দোকানে ঝাঁপ ফেলে সে। খ্রিস্টান মিশনের গীর্জায় পারিবাবার কাছে গিয়েছিল।

বললুম–রহমত সায়েবকে কি ইমানুয়েল নিজে থেকে এই কথা বলেছে?

না। রহমত সায়েব আদিবাসী দোকানদারদের জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন, কাল বিকেলে গড়ের জঙ্গলে তারা কাকেও যেতে দেখেছিল কি না। ওরা সরল মানুষ। অন্য কেউ কিছু দেখেনি বা লক্ষ্য করেনি। ইমানুয়েল জৈবকৃত্যের জন্য বেরিয়েছিল। তাই সে ভূতটাকে দেখতে পেয়েছিল।

–তার পোশাকের বর্ণনা দেয়নি ইমানুয়েল?

মিঃ সিনহা হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন–কর্নেল সায়েব! আপনি একটা মূল্যবান সূত্রের কথা তুলেছেন। রহমত সায়েবের মাথায় ওই প্রশ্নটা জাগেনি। কারণ তিনি ধরেই নিয়েছেন মেয়েরা শাড়ি পরে। ইমানুয়েলের কাছে কথাটা জানা দরকার। এখনই জেনে আসছি। প্লিজ, একটু অপেক্ষা করুন।

চারজন আমর্ড কনস্টেবলকে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়ে মিঃ সিনহা হাইওয়ের ধারে গেলেন। উঃ মিশ্র বললেন–কথাটা শুনে আমার অবাক লাগছে! একা কলকাতার দলভ্রষ্ট এক তরুণী গড়ের জঙ্গলের দিকে কোন সাহসে যাবে? তার চেয়ে বড় কথা, কী উদ্দেশ্যে সে যাবে?

বললুম–কাল দুপুরে এখানে বেড়াতে গিয়েছিল ওরা। ও.সি. মিঃ সিনহাকে সুদক্ষিণা বলেছে, সৌরজ্যোতি বল্লরীর গলা থেকে সোনার চেন খোলার ছলে টেনে ছিঁড়ে নাকি ছুঁড়ে ফেলেছিল।

–মিঃ সিনহা আপনাকে বলছিলেন?

–হ্যাঁ। হয়তো তখন হারটা ওরা খুঁজে পায়নি। তারপর বল্লরী হারটা বিকেলে খুঁজতে গিয়েছিল?

–অবিশ্বাস্য! অসম্ভব ব্যাপার। একা একটি মেয়ে–

ডঃ মিশ্র হঠাৎ থেমে গেলেন। আমি বাইনোকুলারে গড়ের জঙ্গল দেখতে থাকলুম। গাছপালার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল। উৎসুক আদিবাসীদের পুলিশ লাঠি উঁচিয়ে হটিয়ে দিচ্ছে। ইন্দ্রনীলদের দেখতে পেলুম না। পাথরের চত্বরটা এখান থেকে দেখা যাচ্ছিল না।  

ও.সি. মিঃ সিনহা এসে বললেন–ঝোপের মধ্যে ইমানুয়েল শুধু মেয়েটির মাথা দেখেছে। মেয়েটি মাঝেমাঝে এদিকে মুখ ঘুরিয়ে কী দেখছিল। মুখটা সুন্দরী মেয়ের এ বিষয়ে ইমানুয়েল নিশ্চিত। সে পোশাক দেখতে পায়নি। শুধু মুখ দেখেই ভয় পেয়ে দোকানে ঢুকে পড়েছিল।

বললুম–এটা স্বাভাবিক। ফাঁকা নগ্ন জায়গাটায় না গেলে এখান থেকে তার পোশাক দেখতে পাওয়া যাবে না।

পাথরের চত্বরের কাছে পৌঁছুতে আমাদের প্রায় কুড়ি মিনিট লাগল। গিয়ে দেখলুম, চত্বরে মুখ দুহাতে ঢেকে সুদক্ষিণা বসে আছে। সে কাঁদছে। ইন্দ্রনীল তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে বিস্ময় আর শোকের ছাপ স্পষ্ট। সৌরজ্যোতি গর্তটার কাছে নিস্পন্দ মূর্তির মত দাঁড়িয়ে নীচের গর্তে বল্লরীর মৃতদেহ দেখছে। ঝোপগুলো পুলিশ আর অ্যাম্বুলেন্সকর্মীরা তুলে উপরে ফেলেছে। একজন ফোটোগ্রাফার চারদিক ঘুরে ছবি তুলছিলেন। আমাকে দেখে ইন্দ্রনীল কিছু বলতে ঠোঁট ফাঁক করেছিল। কিন্তু বলল না। এক বাঙালি ভদ্রলোক ডঃ মিশ্রকে দেখে বলে উঠলেন–মিছরসায়েব! আবার একই ঘটনা ঘটল।

বুঝলুম, তিনি ডাক্তার শচীন অধিকারী। ও. সি. মিঃ সিনহা লাশটা দেখে নিয়ে একজন অফিসারকে বললেন–লাশ খাঁটিয়ায় তুলে নিয়ে যেতে বলুন। আপনি সঙ্গে যাবেন। তারপর অ্যাম্বুলান্সে চাপিয়ে হাসপাতালের মর্গে নিয়ে যাবেন।

.

 বল্লরীর রক্তাক্ত মৃতদেহ যখন হাসপাতালের কর্মীরা ওঠাচ্ছিলেন, ডঃ মিশ্র আমাকে খুব চাপা স্বরে বললেন–কর্নেল সায়েব! ডেডবড়ি উপুড় হয়ে পড়েছে। অথচ খুনী তার সামনের দিকে আঘাত করেছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত মনে হয়নি আপনার!

বললুম–অবশ্যই।

 ও. সি. মিঃ সিনহা আমার কাছে এলেন কী মনে হচ্ছে কর্নেলসায়েব?

–আপনার কী মনে হচ্ছে আগে শোনা যাক!

–এই গর্তে মেয়েটিকে খুন করা হয়নি। কারণ বডি উপুড় হয়ে পড়েছিল।

–পাথরের চত্বরের গায়ে রক্তের ছোপ দেখে মনে হচ্ছে, চত্বরের উপর থেকে গড়িয়ে গর্তে ফেলেছিল খুনী।

মিঃ সিনহা পাথরের চত্বরের কাছে গিয়ে বললেন–আপনার ধারণা হয়তো ঠিক। কিন্তু চত্বরের উপরে কোথাও রক্তের চিহ্ন নেই।

এই সময় একজন পুলিশ অফিসার সৌরজ্যোতিকে বলল–আপনি আপনার বন্ধুদের কাছে গিয়ে দাঁড়ান। আমাদের তদন্ত করতে দিন। সৌরজ্যোতি চুপচাপ চত্বরের অন্যপ্রান্তে ইন্দ্রনীল ও সুদক্ষিণার কাছে চলে গেল। মিঃ সিনহা খুঁটিয়ে চত্বরের উপরের দিকটা দেখে নিলেন। তারপর আমাকে চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করলেন–আপনি চত্বরের এখানে এসে গর্তের মধ্যে লাশটা দেখতে পেয়েছিলেন। তাই তো? বললুম–হ্যাঁ।

–অন্য কোথাও কি রক্তের চিহ্ন দেখতে পেয়েছিলেন?

 –না। তবে আমি তখন কোথাও রক্তের চিহ্ন খুঁজতে যাইনি।

ডাক্তার শচীন অধিকারী তার তথাকথিত ভাগ্নে-ভাগ্নির কাছে গিয়ে চাপাস্বরে কিছু আলোচনা করছিলেন। ডঃ মিশ্র চত্বরের নীচ দিয়ে ঘুরে তাদের কাছে গেলেন।

মিঃ সিনহা বললেন–আমাদের অফিসাররা চারদিক খুঁজতে বেরিয়েছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মেয়েটিকে অন্য কোথাও খুন করে এই গর্তে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। রক্তের চিহ্ন খুঁজলে পাওয়া যেতে পারে। তবে সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। গড়ের জঙ্গলের আয়তন কম নয়।

একটু দূরে কয়েকজন আদিবাসী পুলিশের তাড়া খেয়েও পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়েছিল। আমি একজন পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞেস করলুম-আপনারা কি ওদের কাছে কোনো খোঁজখবর নিয়েছেন?

তিনি বললেন–না স্যার! কারণ ওরা কী বলবে তা জানা কথা।

ভূতের কীর্তি?

কথাটা আমি গম্ভীর মুখেই বললুম। অফিসারটি হেসে ফেললেন। ঠিক বলেছেন স্যার!

তাদের দিকে তাকিয়ে আমি বললুম–লাশ তো চলে গেছে। ওরা এখনও দাঁড়িয়ে আছে কেন?

অফিসার বললেন–আমরা কী করছি তা দেখছে।

 ডাকলুম–ডঃ মিশ্র! একবার এদিকে আসুন!

ডঃ মিশ্র চত্বরের উপর দিয়ে আমার কাছে এলেন। বললেন–কিছু কি বুঝতে পেরেছেন?

না ডঃ মিশ্র। আমি আপনাকে একটা কারণে ডাকলুম। আপনি আদিবাসীদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। আমার সঙ্গে ওই আদিবাসীদের কাছে চলুন। মিঃ সিনহা চত্বরে রক্তের চিহ্ন খুঁজছেন। ততক্ষণ আমরা ওদের সঙ্গে কথা বলি।

কয়েকজন কনস্টেবল লাঠি হাতে দাঁড়িয়েছিল। আদিবাসীরা যাতে চত্বরের কাছে না আসতে পারে, সেদিকে লক্ষ্য রাখাই সম্ভবত ওদের ডিউটি। পাশ কাটিয়ে আমি ও ডঃ মিশ্র আদিবাসী দলটির দিকে এগিয়ে গেলুম। বললুম–আপনি ওদের জিজ্ঞেস করে জেনে নিন, এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে ওদের বক্তব্য কী? তাছাড়া কাল বিকেলে কেউ এদিকে এসেছিল কিংবা সন্দেহজনক কিছু দেখেছিল কি না, তা-ও জেনে নিন।

ডঃ মিশ্র আর আমাকে দেখে ওরা পরস্পর কিছু বলাবলি করল। তারপর ওদের চাঞ্চল্য দেখে মনে হল, ওরা এখনই ছুটে পালিয়ে যাবে। ডঃ মিশ্র একজনকে চিনতে পেরে দেহাতি হিন্দিতে বললেন–তুমি ভারুয়া না?

মাথায় একরাশ পাকা চুল আর প্রকাণ্ড সাদা গোঁফওয়ালা লোকটির পরনে ঢোলা হাফপ্যান্ট আর নোংরা গেঞ্জি। তার হাতে একটা ছোট্ট ভোতা দা ছিল। সে সেই দা দিয়ে হাঁটুর কাছটা চুলকে নিয়ে হাসল। তার নীচের পাটির কয়েকটা দাঁত ভাঙা দেখলুম। সে যা সব বলল, আমার বুঝতে তত অসুবিধে হচ্ছিল না।

ভারুয়া বলল–আমি সেই লোকটাই বটে। আপনি মিছরিজি। আমিও আপনাকে চিনি।

ডঃ মিশ্র বললেন–আবার লাশটা পাওয়া গেল গড়ের জঙ্গলে! তোমার কী মনে হয় ভারুয়া?

-মনে যা হবার তা হয়েছে।

খুলে বলবে বলেই তো তোমার কাছে এসেছি। তুমি যা বলবে, পুলিশকে তা জানাব না।

–এই বুড়ো দাড়িওয়ালা সায়েব কি মিশনের নতুন পারিবাবা?

ডঃ মিশ্র এবং আমি দুজনেই হেসে উঠলুম। ডঃ মিশ্র বললেন–না। উনি কলকাতার লোক। বাঙালি। ভারুয়া! উনি তোমার ভাষা বুঝতে পারছেন না। তোমাদের ছবি তুলতে এসেছেন। উনি ছবি তুলুন। তুমি আমাকে বলল, আবার গড়ের জঙ্গলে এই লাশের ব্যাপারে তোমার কী মনে হচ্ছে?

আমি ডঃ মিশ্রের ইঙ্গিতে ক্যামেরায় ওদের ছবি সত্যিই তুলে নিলুম।

ভারুয়া বলল–আমাদের সবাইকে একখানা করে ছবি দিতে হবে মিছরি সায়েব।

ডঃ মিশ্র বললেন–নিশ্চয় ছবি পাবে। এই বাঙালি সায়েব এখানে বেড়াতে এসেছেন। তোমাদের গ্রামেও এঁকে নিয়ে যাব। এবার তুমি কথাটা বলো!

ভারুয়া চাপা স্বরে বলল–কাল বিকেলে আমি পাখি মারতে এসেছিলুম। ওই উঁচু পাথরে বসে ঘুঘু বা পায়রা খুঁজছিলুম। আমার হাতে বাঁটুল আর গুলতি ছিল।

বলে সে গুলতি থেকে বাঁটুল ছোঁড়ার ভঙ্গি করল। ডঃ মিশ্র বললেন–তারপর কী হল বলল।

ভারুয়া তেমনই চাপাস্বরে বলল–ওই মেয়েটা ফুলপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরে আপনারা যেদিক থেকে আসছিলেন, সেইদিক থেকে এল। আমি ভয় পেয়েছিলুম। এই সেই ভূত কি না। কিন্তু মেয়েটা শুকনো মাটিতে–ওই যে টাড় মাটি, পাথর পড়ে আছে

-বুঝেছি। বল।

–সেখানে কী খুঁজে বেড়াল। তারপর চলে গেল। হা মিছরি সায়েব! সেই মেয়েটাই বটে।

–মানে, তারই লাশ! তুমি এতদূর থেকে চিনতে পারলে?

–চিনব না কেন মিছরি সায়েব? একই পোশাক। ফরসা রঙ। মাথার ছোট চুলে ঝুঁটি বাঁধা!

মেয়েটিকে তা হলে তুমি সোজা চলে যেতে দেখেছিলে?

–হ্যাঁ। সে বড় রাস্তায় উঠে গেল।

বললুম–তাহলে মিঃ সিনহা, আপনি এবং আমার ধারণা ঠিক। বল্লরীকে বাইরে কোথাও খুন করে ওই গর্তে ফেলে দিয়েছিল খুনী।

ডঃ মিশ্র বললেন–মর্গের রিপোর্টে খুনের সময় মোটামুটি জানা যেতে পারে।

ভারুয়া একটু হেসে বলল-আপনারা কী কথা বলছেন মিছরি সায়েব?

–বলছি মেয়েটিকে বাইরে খুন করে এখানে এনে ফেলে দিয়েছে খুনী।

–কিন্তু রক্ত তো পড়বে। কোথায় রক্ত?

বললুম–ডঃ মিশ্র! ওকে বলুন, এমন কি হতে পারে না কোথাও পলিথিন বা তেরপলের শক্ত কাপড়ে মুড়ে লাশটা এখানে এনেছিল খুনী?

ডঃ মিশ্র কথাটা বললেন। ভারুয়া গম্ভীর মুখে কী ভাবতে লাগল। তারপর সে আস্তে আস্তে বলল–ওদিকে পুলিশেরা রক্ত খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমাকে যেতে দেবে ওদিকে?

বলে সে আঙুল তুলে পূর্ব-দক্ষিণ কোণে একটা জঙ্গলে ঢাকা উঁচু ধ্বংসস্তূপ দেখাল। ডঃ মিশ্র বললেন–পুলিশ কিছু বলবে না। তুমি একা আমাদের সঙ্গে এসো।

আমরা দুজনে ভারুয়াকে নিয়ে এগোচ্ছি, মিঃ সিনহা বললেন কর্নেল সায়েব! ওই লোকটাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?

একটু হেসে বললুম–আপনারা আপনাদের কাজ করুন। আপাতত আমি রেনবো অর্কিডের সন্ধান পেয়েছি এর কাছে। আপনি শুনে থাকবেন, বিরল প্রজাতির অর্কিড সংগ্রহ আমার বাতিক।

ভারুয়া ও আমরা সেই উঁচু ধ্বংসস্তূপের কাছে যেতেই কানে এলো কোথাও কেউ মাটি খুঁড়ছে। আমি ডঃ মিশ্র ও ভারুয়াকে চুপচাপ দাঁড়াতে ইশারা করে নিঃশব্দে গুঁড়ি মেরে ডানপাশ দিয়ে এগিয়ে গেলুম। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য। একটা আলগা পাথর পায়ের চাপে নড়ে ওঠার শব্দেই সেই শব্দটা থেমে গেল এবং কারও ছুটে পালিয়ে যাওয়ার শব্দ কানে এলো। আমি স্কুপের উল্টোদিকে গিয়ে দেখি, কেউ একটা আগে বোজানো গর্ত থেকে মাটি খুঁড়ে পাশে জড়ো করছিল।

এই সময় উত্তেজিত ভারুয়া ও ডঃ মিশ্র এলেন। ভারুয়া চাপাস্বরে বলল, আজ সকালে এখানে লাশ দেখতে আসবার সময় সে ঝোপের মধ্যে বোজানো গর্তটা দেখেছিল। নিশ্চয় এই গর্তে কিছু পুঁতে রেখেছে খুনী।

আমি কিটব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট কিন্তু ভারী খন্তা বের করে ভারুয়াকে দিলুম। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাটির তলা থেকে বেরিয়ে পড়ল একটা যেমন-তেমন করে গুটিয়ে রাখা সস্তা তেরপল। সেটা টেনে বের করে একটু ছড়িয়ে দিতেই চাপ চাপ রক্ত দেখা গেল। বললুম–ডঃ মিশ্র! মিঃ সিনহাকে খবর দিন। ভারুয়াকে এখানে থাকতে বলে যান। আমি ততক্ষণ ধ্বংসস্তূপের উপরে উঠে লোকটাকে খুঁজে দেখব।

ডঃ মিশ্র চলে গেলেন। আমি অনেক চেষ্টার পর প্রায় কুড়ি ফুট উঁচু স্তূপের শীর্ষে উঠে বাইনোকুলারে পূর্ব ও দক্ষিণ দিকটা খুঁটিয়ে দেখতে থাকলুম। কিন্তু ওদিকটায় জঙ্গল খুব ঘন। দৃষ্টি বেশিদূর পৌঁছুল না। ও.সি. গোপেশ্বর সিনহা একা ছুটে এলেন। ততক্ষণে আমি স্কুপ থেকে নেমে এসেছি। মিঃ সিনহা রক্তমাখা তেরপল এবং গর্তটা দেখেই হাঁটু দুমড়ে বসে বললেন–ধন্যবাদ কর্নেল সায়েব! আপনার সত্যি তৃতীয় নয়ন আছে। আমাকে এ কথা বিশ্বাস করতেই হচ্ছে!

বললুম–মিঃ সিনহা! এই গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটি আবিষ্কারের কৃতিত্ব এই সরল আদিবাসী মানুষটির।

ডঃ মিশ্র বললেন–ওকে পুলিশের পক্ষ থেকে যেন বকশিস পাইয়ে দেবেন মিঃ সিনহা! ভারুয়ার সঙ্গে কর্নেল আমাকে কথা বলার জন্য ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা আদিবাসীদের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন।

মিঃ সিনহা একই ভঙ্গিতে বললেন–ব্যাপারটা তো শেষাবধি আমার পয়েন্টেই দাঁড়াচ্ছে। কর্নেল সায়েব আদিবাসীদের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন মনে। করেছিলেন। আর আমরা ওদের হটিয়ে দিয়েছিলুম।

গর্তের কাছে দাঁড়িয়ে চুরুট ধরালুম। সেই সময় আমার চোখের সামনে দুটি দৃশ্য ভেসে উঠল। হাইওয়ের ধার থেকে ইমানুয়েল দেখেছিল কাল বিকেলে একটি মেয়ে গড়ের জঙ্গলের কাছে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদিকে ভারুয়া মেয়েটিকে পুরো দেখতে পেয়েছিল। পরনে প্যান্ট গেঞ্জি পরা মেয়েটি কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছিল। তারপর সে চলে গিয়েছিল। বড় রাস্তার দিকে। তার মানে, বল্লরী একা এসেছিল এবং একা ফিরে গিয়েছিল।

সে যা খুঁজতে এসেছিল, তা আমি আজ প্রত্যূষে কুড়িয়ে পেয়েছি। ছেঁড়া সোনার চেনের দুটো অংশ আর একটা ভ্যানিটি ব্যাগ।

সুদক্ষিণা বলেছে, কৌতুকের ছলে সৌরজ্যোতি বল্লরীর সোনার চেন টেনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু বল্লরীর ব্যাগটা কে ছুঁড়ে ফেলেছিল? বল্লরী তার ব্যাগ রাগ করে নিজে ছুঁড়ে ফেলে দেবে কেন? সৌরজ্যোতি কি তার ব্যাগটাও ছুঁড়ে ফেলেছিল? তা যদি হয়, কোথায় চেন বা ব্যাগ পড়েছে, তা তখনই ওরা খুঁজে বের করতে পারত।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, বল্লরীকে এমন নৃশংসভাবে হত্যার মোটিভ কী? কিংবা যেভাবেই হোক, তাকে হত্যার মোটিভ কী?

কাল দুপুরে ওই চত্বরে দাঁড়িয়ে বল্লরীকে সৌরজ্যোতি বলছিল, বল্লরী এক অতল খাদের ধারে দাঁড়িয়ে আছে। এ কথার অর্থ কী? সৌরজ্যোতিকে জেরা করে এ-কথার মানে জেনে নিতেই হবে।

সৌরজ্যোতির সঙ্গে বল্লরীর যৌনসম্পর্ক ছিল। এ ব্যাপারে দুজনেরই স্থান কাল পরিবেশ জ্ঞান ছিল না। দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা কখনও প্রেমের নয়, নিছক জৈবতার, তার সাক্ষী আমি নিজে।

এটুকু ভেবেই হঠাৎ মনে হল, আমি ঘটনাটার ভুল ব্যাখ্যা করছি না তো? অন্য কোনো উদ্দেশ্যে বল্লরীর বার্থে সৌরজ্যোতি উঠতে পারে। ধরা যাক, কোনো গোপন জিনিস সুদক্ষিণার ও ইন্দ্রনীলের অজ্ঞাতসারে সৌরজ্যোতি বল্লরীকে রাখতে দিয়েছিল। হ্যাঁ, সে মেঝেয় দাঁড়িয়ে জিনিসটা দিতে পারত। কিন্তু এমন হতেই পারে। আমি পাছে জেনে যাই এই ভয়ে সে চুপিচুপি আমার পায়ের দিকে বার্থে ওঠার সিঁড়ি বেয়ে উঠে গিয়েছিল। কোনো গোপন আলোচনাও করছিল। ট্রেনের শব্দের জন্য আমি কিছু শুনতে পাইনি।

কর্নেল সায়েব!

ও. সি. গোপেশ্বর সিনহার ডাকে সচেতন হয়ে বললুম–বলুন মিঃ সিনহা!

–তেরপলটা ছেঁড়াখোঁড়া। এটার তলায় কয়েকটা নাইলনের দড়ি পাওয়া গেছে। তা হলে লাশটা তেরপলে ভরে দড়িতে বেঁধে বয়ে এনেছিল খুনী।

–খুনী যদি একে বয়ে আনে, তা হলে তার গায়ে যথেষ্ট শক্তি থাকা দরকার। বল্লরী স্বাস্থ্যবতী মেয়ে ছিল।

–ঠিক বলেছেন কর্নেল সায়েব!

–একটা লাশ বয়ে আনার সময় খুনীর পায়ের দাগ বা জুতোর ছাপ পড়া স্বাভাবিক। কিন্তু এলাকায় গত তিনমাস বৃষ্টি হয়নি! গড়ের জঙ্গলে প্রায় সর্বত্র ঘন ঘাস। আবার যেখানে মাটি নগ্ন, সেখানটা পাথরের মত শক্ত। এই গর্তটা খুঁড়তে খুনীর প্রচুর সময় লেগেছিল, তা অনুমান করা সহজ নয়।

ডঃ মিশ্র বললেন কর্নেল সায়েব! খুনী আবার গর্ত খুঁড়ে তেরপলটা নিয়ে যেতে এসেছিল। সেই কথাটা মিঃ সিনহাকে বলুন।

ডঃ মিশ্র আমার হাতের একটা তাস পুলিশকে দেখিয়ে দিলেন। পুঁতে রাখা তেরপল খুনী কেন আবার খুঁজে ফেরত নিতে এসেছিল–এই ব্যাপারটা আমার একটা নিজস্ব তদন্তের সূত্র ছিল। ডঃ মিশ্র সম্পর্কে তার বাংলো থেকে বেরোনোর সময় এই ভয়ই করেছিলুম। কিন্তু এখন কী আর করা যাবে। কথাটা মিঃ সিনহাকে বলতে হল। মিঃ সিনহা শুধু বললেন–খুব অদ্ভুত ঘটনা বলতে হবে।

বললুম–মিঃ সিনহা! খুনী যে আবার গর্ত খুঁড়ে তেরপল নিয়ে যেতে এসেছিল, এমন না হতেও পারে। সম্ভবত কোনো আদিবাসী জঙ্গলে কাঠ কাটতে এসে টাটকা বুজিয়ে রাখা গর্ত দেখে ভেবেছিল, ওখানে কেউ কিছু লুকিয়ে রেখেছে। আমাদের সাড়া পেয়ে ভয়ে সে পালিয়ে গেছে।

আমার যুক্তিটা মিঃ সিনহার মনঃপুত হল। তিনি বললেন–হ্যাঁ। এটা হতে। পারে। খুনীর সাহস হবে না এসময়ে গড়ের জঙ্গলে ঢুকতে। কারণ পুলিশ ফোর্স জঙ্গলে এখনও আছে।

তিনি ধ্বংসস্তূপের অন্যপাশে গিয়ে হাতের ইশারায় কনস্টেবলদের ডাকলেন। তারা এলে তেরপলটা গুটিয়ে বেঁধে সঙ্গে নিয়ে আসতে নির্দেশ দিলেন।

আমরা সেই পাথরের চত্বরের কাছে গেলুম। দুজন অফিসার আর সশস্ত্রবাহিনী ইন্দ্রনীলদের কাছাকাছি দাঁড়িয়েছিল। ডাক্তার শচীন অধিকারী আমাদের দেখে ঘুরে দাঁড়ালেন। গম্ভীর মুখে তিনি বললেন–মিঃ সিনহা কি মার্ডার উইপন খুঁজে পেয়েছেন?

মিঃ সিনহা একটু হেসে বললেন–না ডাক্তারবাবু! আমরা একটা পুরোনো তেরপল খুঁজে পেয়েছি। ওই দেখুন! তেরপলে জড়িয়ে লাশ বয়ে এনে ওই গর্তে খুনী ফেলে দিয়েছিল। তেরপলটা ধুয়ে রক্ত পরিষ্কার করলে আবার ওটা কাজে লাগবে। তাই খুনী ওটা পুঁতে রেখেছিল।

আমি এই সময় ইন্দ্রনীল, সৌরজ্যোতি ও সুদক্ষিণার মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছিলুম। শুধু ইন্দ্রনীলের মুখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য চমকে ওঠার স্পষ্ট ছাপ লক্ষ্য করলুম।

মিঃ সিনহা এবার গম্ভীর মুখে বললেন–রহমত সায়েব! আপনি আর পাণ্ডেজি দুজন আর্মড কনস্টেবল আর বাকি সবাইকে নিয়ে থানায় যান। ইন্দ্রনীলবাবুদের কাছে আমরা আরও কথা শুনতে চাই।

ওঁরা তিনজন থানায় যাবেন। ডাক্তারবাবু নিজের কাজে যেতে পারেন। আপনার সঙ্গে আপাতত কথা বলার কিছু নেই।

ডাঃ অধিকারী বললেন–ইন্দ্রদের কি আপনারা অ্যারেস্ট করলেন?

–না। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যাওয়া হবে।

 দলটির সঙ্গে ডাঃ অধিকারী কী সব কথা বলতে বলতে হাইওয়ের দিকে হাঁটতে থাকলেন। মিঃ সিনহা বললেন–ডাক্তারবাবু এই কেসে ইন্দ্রনীলদের জন্য উদ্বিগ্ন হতেই পারেন। কিন্তু ওঁর আচরণে উদ্বেগের খুব বাড়াবাড়ি লক্ষ্য করছি।

ডঃ মিশ্র বলে উঠলেন–ইন্দ্রনীল নাকি তার বাবার হাভেলি বিক্রি করতে এসেছে।

বেগতিক দেখে বললুম–আপনার কাজের লোক রামভকতের শোনা কথা। একে গুরুত্ব দেওয়ার মানে হয় না।

ডঃ মিশ্র আমার দিকে তাকিয়ে সংযত হলেন। একটু হেসে তিনি বললেন– আমি বলতে চাইছিলুম, ইন্দ্রনীল যদি সত্যি হাভেলি বেচতে চায়, ডাক্তার অধিকারী। দালালির কমিশন খাবেন। সম্ভবত তাই ইন্দ্রনীলকে নিয়েই ওঁর মাথাব্যথা।

আমি পাথরের চত্বরে দাঁড়িয়ে বাইনোকুলার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকটা দেখতে থাকলুম। মিঃ সিনহা আবার গর্তের কাছে গিয়ে কী পরীক্ষা করতে মন দিলেন। একটু পরে আমি বাইনোকুলার নামিয়ে ফেললুম-মিঃ সিনহা! আমি রেনবো অর্কিড দেখতে পেয়েছি। ভারুয়াকে নিয়ে যাচ্ছি। ডঃ মিশ্র কি আমার সঙ্গে যাবেন?

ডঃ মিশ্র বললেন, অবশ্যই যাব।

মিঃ সিনহা গর্তের ধারে দাঁড়িয়ে অন্যমনস্কভাবে বললেন কর্নেল সায়েব! আমি যথাসময়ে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। আমি জানি, অপরাধ রহস্যের চেয়ে প্রকৃতিতে আপনার আকর্ষণ বেশি।….

.

আমি পূর্ব-দক্ষিণে উঁচু ধ্বংসস্তূপের দিকে এগিয়ে গেলুম। ডঃ মিশ্র ভারুয়াকে ডেকে নিয়ে আমাকে অনুসরণ করলেন। সেই গর্তটার কাছে গিয়ে ভারুয়াকে আমি পঞ্চাশ টাকা বখশিস দিলুম। সে খুশি হয়ে টাকাটা নিয়ে তার হাফপ্যান্টের পকেটে রাখল। ডঃ মিশ্র অবাক হয়ে ইংরেজিতে বললেন–আপনি অতগুলো টাকা ওকে দিলেন! টাকা তো পুলিশের দেওয়ার কথা।

বললুম–উঃ মিশ্র! ভারুয়াকে বখশিস দিলুম অন্য উদ্দেশ্যে। আপনি এই জঙ্গলে কোথায় রেনবো অর্কিড দেখেছিলেন, ঠিক করতে পারছেন না। এখন ভারুয়াকে রেনবো অর্কিডের কথাটা বুঝিয়ে বলুন। সে বনচর মানুষ। নিশ্চয় ওই আশ্চর্য অর্কিডের ফুল তার দৃষ্টি এড়ায়নি। সে খোঁজ দিতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।

ডঃ মিশ্র দেহাতি ভাষায় ভারুয়াকে কথাটা বলতেই সে আমাদের ইশারায় অনুসরণ করতে বলল। জঙ্গল ক্রমশ দুর্গম হচ্ছিল। তাই আমি ভারুয়াকে আমার কিটব্যাগ থেকে নাইফ বের করে দিলুম। সে এবার ঝোপ লতাপাতা কাটতে কাটতে এগিয়ে চলল। সবখানেই প্রাচীন দুর্গের ধ্বংসাবশেষ আর ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা চৌকো গ্রানাইট পাথর। তাই হেঁটেযাওয়া বেশ কষ্টকর ব্যাপার। কিন্তু বনচর লোকটির উদ্যম অবাক হবার মত। বোঝা যাচ্ছিল, সে আমাদের রেনবো অর্কিডের এলাকায় পৌঁছে না দিয়ে থামবে না। প্রায় আধঘন্টা পরে একটা ঘাসে ঢাকা খোলা জায়গায় সে থামল। দক্ষিণে একটা টিলা দেখা যাচ্ছিল। সে আমাদের দাঁড়াতে ইশারা করে টিলাটার দিকে এগিয়ে গেল। তারপর টিলার নীচে হাতির মত উঁচু পাথরে উঠে গিয়ে উত্তর-পূর্ব কোণে ঘুরে তর্জনী দিয়ে সংকেত করল। আমি বাইনোকুলারে সেদিকটা দেখেই আনন্দে অস্থির হয়ে উঠলুম। নিবিড় এবং উঁচু গাছপালার ডালে ইতস্তত রামধনুর ছটা চোখে পড়ল। তখনই সেই দিকে হন্তদন্ত এগিয়ে গেলুম।

বেনবো অর্কিড পরজীবী। গাছের ডালে এদের আশ্রয়। প্রায় দেড়ফুট লম্বা সবুজ পাতা গাছের ডাল থেকে ঝুলছে। পাতার কেন্দ্রে প্রকাণ্ড লালচে ফুল ফুটেছে। সেই ফুলে রোদ পড়ে ইন্দ্রধনুর বিচিত্র বাহার দেখা যাচ্ছে। আমি ক্যামেরায় পরপর অনেকগুলো ছবি তুলে নিলুম। ডঃ মিশ্র বললেন–জায়গাটা এবার চিনতে পেরেছি। উড্ডাক পাখিটাকে এই গাছের ডালে দেখেছিলুম।

তিনি গাছটা দেখিয়ে দিলেন এবং বাইনোকুলারে উড্ডাকটা খুঁজতে থাকলেন। ততক্ষণে ভারুয়া আমাদের কাছে এসেছিল। সে তার ভাষায় বলল, সামনে কৈলি নদী। নদীর কাছে জঙ্গলের গায়ে মৌচাক ভাঙতে এসে ফুলগুলো সে দেখতে পেয়েছিল। দেবতার ফুল এ গুলো। তাই তাকে যদি ওই ফুল পেড়ে আনতে বলা হয়, সে হাজার টাকা বখশিস পেলেও তা পাড়বে না। ওই ফুলে হাত দিলে হাতে কুষ্ঠ হবে।

তার মনোভাব বুঝতে পারলুম, সে নিজে রেনবো অর্কিডের ঝাড় তো পেড়ে আনবেই না, আমরা যদি পেড়ে আনার চেষ্টা করি সে বাধা দেবে।

এমন একজন উপকারী লোকের সংস্কারে আঘাত দেওয়াটা উচিত মনে করলুম না। পরে গোপনে এসে ওই অর্কিড সংগ্রহ করে নিয়ে যাব। আমি জানি রেনবো অর্কিডের পরাগের নীচে বীজ কণিকার একটা ছোট্ট থলে আছে। একেকটা থলেতে প্রায় ৪৭ লক্ষ অর্কিডের বীজকণিকা থাকে।

ডঃ মিশ্রকে বললুম–ভারুয়াকে বিদায় দেওয়া যাক। আমরা বরং শুকনো কৈলি নদী পেরিয়ে গিয়ে স্টেশন থকে আসা পিচ রাস্তায় উঠব। তারপর হাইওয়েতে গিয়ে গাড়িতে চাপব।

ডঃ মিশ্র তাকে বুঝিয়ে দিলেন, এবার আমরা বাড়ি ফিরব। এখান থেকে রাস্তায় পৌঁছানোর কোনো অসুবিধে হবে না।

ভারুয়া তখনই যে-পথে এসেছিল, সেই পথে চলে গেল। একটু পরেই জঙ্গলের ভেতর সে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমরা ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে হেঁটে কৈলি নদীর ধারে পৌঁছালুম। একফালি জলস্রোত ঝিরঝির করে বয়ে চলেছে। নদীর পূর্ব পাড় রাস্তা থেকে ঢালু হয়ে নেমে এসেছে। ঢালু অংশে উঁচু ঘাসের জঙ্গল।

নদীর জলটুকু ডিঙিয়ে গিয়েই থমকে দাঁড়ালুম। ডঃ মিশ্র বললেন–কী ব্যাপার?

এখানে বালির চড়ায় তত উঁচু পাথর নেই। ইতস্তত যে সব পাথর ছড়িয়ে আছে, তা আকারে ছোট। কিন্তু আমার চোখে পড়েছিল বালির চড়ার পূর্ব দিকে ঢালের নীচে মোটর গাড়ির টায়ারের গভীর দাগ। কোনো গাড়ির দুটো চাকা কিনারার বালি পর্যন্ত এসে থেমে গিয়েছিল।

আর যেখানে থেমেছিল, সেখানে লম্বা অস্পষ্ট কিছু ছাপ। গুঁড়ি মেরে বসে সেই ছাপের একপ্রান্তে কালচে ছোপটা আতশ কাঁচে দেখে নিলুম। ডঃ মিশ্র উত্তেজিত ভাবে বললেন–কী এগুলো? উঠে দাঁড়িয়ে বললুম–কেউ রাস্তা থেকে ঢালু ঘাসের জমিতে একটা মোটরগাড়ির পেছনের দিকটা নামিয়ে এনেছিল। ওই দেখুন চাকার দাগে গর্ত হয়ে গেছে। আর ওখানে একফেঁটা রক্ত।

তার মানে? কী বলতে চাইছেন কর্নেল সায়েব?

আমার মনে হচ্ছে, বল্লরীর লাশ খুনী মোটরগাড়ির ডিকিতে ঢুকিয়ে এনে এখানে ফেলেছি। তারপর গাড়িটা চলে যায়। তেরপলে মোড়া লাশটা কেউ বা কারা তুলে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে নিয়ে গিয়ে সেই চত্বরের পাশের গর্তে ফেলে দেয়।

–কিন্তু কোনো পায়ের দাগ নেই কেন?

–জল ছিটিয়ে পায়ের দাগ নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। বালিতে জলের দাগ স্পষ্ট। খুনী এবং তার সহচর বুদ্ধিমান লোক। লক্ষ্য করে দেখুন ডঃ মিশ্র! স্টেশন রোডের ধারে ঘন জঙ্গল। শুধু একটা জায়গা সামান্য ফাঁকা। ওখান দিয়ে গাড়ি পিছু হটিয়ে চালু ঘাসের জমিতে নামলে রাস্তা থেকে চোখে পড়ার চান্স কম।

হেড লাইট?

–গাড়ি হেডলাইট বন্ধ রাখা হয়েছিল। খুনী এই জায়গাটা আগে থেকে দেখে রেখেছিল! হাইওয়ে বা এই স্টেশন রোডের অন্যত্র কোথাও গাড়ি থামিয়ে লাশ নামালে লোকের চোখে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। আর গাড়ি ছাড়া লাশ পঞ্চগড়ের বাঙালিটোলা থেকে কাঁধে বয়ে আনলে অসংখ্য লোকের চোখে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। গভীর রাতে লাশ বয়ে আনলে হাইওয়েতে পুলিশ পেট্রল আছে। তা ছাড়া ওই মোড়ে একটা গুমটি ঘর আছে পুলিশের। হাইওয়েতে প্রায়ই ডাকাতি হয়। তাই এই ব্যবস্থা।

বললুম–দুঃখের বিষয়, গাড়িটার চাকার দাগের ছাপ পড়েনি। বালিতে শুধু গর্ত হয়েছে। তবু দেখি, একটু ছাপও খুঁজে পাই নাকি। আমার কাছে ছাপ তোলার সরঞ্জাম নেই। ক্যামেরাই যথেষ্ট।

বলে বালির দুটো গর্তের উপর ইঞ্চি কয়েক অংশের যে অস্পষ্ট ছাপ ছিল, তার ছবি ক্যামেরায় তুলে নিলুম। তারপর বললুম–চলুন ডঃ মিশ্র! ঢালু ঘাসজমি বেয়ে আমরা রাস্তায় যাই।

ঢালু ঘাসজমিতে গাড়ির চাকার চাপে ঘাস চ্যাপটা হয়ে যাওয়ার দাস স্পষ্ট। আমরা দুজনে রাস্তায় উঠে গেলুম। একটা এক্কাগাড়ি ট্রেনযাত্রীর আশায় স্টেশনের দিকে যাচ্ছিল। সেটা থামিয়ে কোথায় যাব বলতেই এক্কাওয়ালা রাজি হয়ে গেল। ভাড়াটা অবশ্য একটু বেশিই হাঁকল সে। কিন্তু এখন ডঃ মিশ্রের বাংলোয় ফিরে গোপনে আমাকে বল্লরীর ভ্যানিটি ব্যাগটা খুলে দেখতেই হবে।

ডঃ মিশ্রের গাড়ি হাইওয়েতে যেখানে রাখা আছে, একাগাড়ি সেখানে যাবে না। কারণ হাইওয়েতে এসব গাড়ি যাতায়াত নিষিদ্ধ। হাইওয়ের মোড়ে তাই আমাদের নামতে হল।

দুজনে হাঁটতে হাঁটতে আদিবাসীদের দোকানের কাছে গিয়ে দেখলুম, সেখানে পুলিশের গাড়ি নেই। কাজ শেষ করে পুলিশ চলে গেছে। ইমানুয়েল বিষণ্ণভাবে বলল-মেয়ে মানুষটাকে আমি ভূত ভেবেছিলুম! আমারই ভুল।

.

ডঃ মিশ্রের বাংলোতে পৌঁছুতে সওয়া একটা বেজে গিয়েছিল। রোমিলা দেবী কলেজে গেছেন। ডঃ মিশ্র আমাকে স্নান করতে বলে নিজে স্নান করতে গেলেন। কিন্তু আমি গ্রীষ্মকালে সপ্তাহে তিনবার স্নান করি। এখানে অবশ্য গ্রীষ্মের প্রখর তাপ নেই। কিন্তু আজ আমার স্নানের দিন নয়। সংলগ্ন বাথরুমে ঢুকে হাতদুটো সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেললুম। দাড়ি ভিজে যাবে বলে শুধু চোখে ও কপালে জল ছেটালুম। টাক ভেজা তোয়ালেতে মুছে নিলুম। এতেই শরীর স্নিগ্ধ হয়ে উঠল।

ডাইনিং রুমে মালতী আমাদের খাবার পরিবেশন করল। ডঃ মিশ্র জাতিভেদ প্রথা মেনে চলেন তা জানতুম না। জানতে পারলুম, যখন তিনি জানিয়ে দিলেন রামভকত এবং তার স্ত্রী মালতী জাতিতে ব্রাহ্মণ।

 খেতে বসে আমি কথা বলা পছন্দ করি না। কিন্তু ডঃ মিশ্র বল্লরীর খুনের ব্যাপারে তার মাথায় যতরকম থিয়োরি এসেছে, তা জানাতে থাকলেন। আমি শুধু হুঁ দিয়ে গেলুম। তার একটা প্রধান থিয়োরি, বল্লরী ঝগড়া করে দলছাড়া হয়ে বাঙালিটোলায় ফেরার সময় কোনো লম্পটের পাল্লায় পড়েছিল। বাঙালিটোলা নির্জন এলাকা। তাই তাকে জোর করে তুলে নিয়ে কোনো পোড়ো বাড়িতে কেউ ধর্ষণ করে এবং গলা টিপে মেরে ফেলে। সে বল্লরীর চেনা কোনো লোক। বল্লরী ইন্দ্রনীলদের সঙ্গে এখানে আগেও কতবার বেড়াতে এসেছে। নিশ্চয় লোকটার সঙ্গে তার পরিচয়ও হয়েছিল।

আর ওই ত্রিশূল বা বাঘনখের ক্ষতচিহ্ন বল্লরীর মৃতদেহে আঘাতের ফলে হয়েছে। এই ক্ষত তৈরির কারণ গড়ের জঙ্গলে আরও চারটে একইভাবে মৃত লোকের দলে বল্লরীকে শামিল করা। পুলিশ এবং লোকেরা এতে বিভ্রান্ত হবে।

ডঃ মিশ্রের এই থিয়োরির শেষ অংশটুকু আমার যুক্তিযুক্ত মনে হল। তবে তার মৃতদেহে আঘাত করা হয়েছিল কি না, তা নিখুঁতভাবে পোস্টমর্টেমের ফলে জানা যেতে পারে।

খাওয়ার পর আমি গেস্টরুমে গিয়ে একটুখানি ঘুমিয়ে ক্লান্তি দূর করার জন্য দরজা বন্ধ করে দিলুম। জানালাগুলোতে পর্দা টানা ছিল। কিটব্যাগ থেকে সোনার হারের টুকরো আর ভ্যানিটি ব্যাগটা বের করে টেবিলে রাখলুম।

তাড়াহুড়ো না করে ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করার জন্য চুরুট ধরালুম। ফ্যান ফুল স্পিডে ঘুরছিল। তাই চুরুটের গন্ধে ঘরে দম আটকানো অবস্থা সৃষ্টি করতে পারছিল না। মাঝে মাঝে চুরুটের গন্ধ আমার নিজেরই কটু মনে হয়। কিন্তু এখন আমি একটি মৃত মেয়ের কুড়িয়ে পাওয়া ছোট্ট ব্যাগের সামনে বসে আছি। এর মধ্যে তেমন কিছু নাও পেতে পারি, যা আমাকে সত্যে পৌঁছুতে সাহায্য করবে। আবার এমনও তো হতে পারে, যা আমাকে সত্যে পৌঁছুতে সাহায্য করবে, তাকে আমি ভুল করে গুরুত্বই দিলুম না!

আসলে একটা সন্ধিকালের দিকে এগিয়ে চলার পথে এখন হাঁটছি। জানি না আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে। সাফল্যের সূত্র, না কি ব্যর্থ?

একটু পরে মনে হল, ব্যাগটাকে আমি যুক্তিহীনভাবে গুরুত্ব দিচ্ছি। তাই অবহেলার ভঙ্গিতে মধ্যেকার জিপটা টেনে ব্যাগ খুলে দিলুম। দুপাশে আরও দুটো ছোট জিপ আছে। মাঝখানের অংশ থেকে বেরিয়ে এল একটা সাদা রঙের গুটিয়ে রাখা রুমাল। রুমালের চারদিকে হাল্কা নীলপাড় এবং নীচে কয়েকটা হাল্কা নানা রঙের রেখা। বন্ধুরীর ঠোঁটে আমি রঙ দেখিনি। রুমালটা নেহাত মুখ মোছর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। তার তলায় একটা ছোট্ট চিরুনি, ছোট্ট গোল আয়না, কয়েকটা চুলের কালো ক্লিপ।

সেগুলো টেবিলে রুমালের নীচে রেখে অ্যাশট্রে চাপা দিলুম। তারপর বেরোলো একটা ইঞ্চি তিনেক লম্বা এবং স্পে-আঁটা পারফিউমের শিশি। একটা ডট পেন। তারপর খুদে প্যাড। প্যাডটা ইঞ্চি তিনেক চওড়া, ইঞ্চি চারেক লম্বা। ওপরে আলমারির ছাঁদে ছাপা মনোগ্রাম। আতস কাচের সাহায্যে পড়া গেল, ইংরেজি তিনটে অক্ষর : ও এ বি। প্যাডটায় কিছু লেখা নেই। তবে বেশ কিছু পাতা খরচ করা হয়েছে।

পেছনের সরু জিপটা টেনে খুললুম। একটু ফাঁক করতেই কতকগুলো ঝকঝকে সাদা নেমকার্ড দেখা গেল। বের করে দেখলুম, লেখা আছে : বি দাশগুপ্ত। তার নীচে ব্রাঞ্চ ম্যানেজার, ওভারসিজ এশিয়ান ব্যাঙ্ক লিমিটেড। সার্কাস অ্যাভিনিউ। কলকাতা। ব্যাঙ্কের ফোন নাম্বার এবং বাড়ির ফোন নাম্বার ওপরে-নীচে দেওয়া আছে। বোঝা গেল, এটা অফিসের কার্ড। তবে বাড়ির ফোন নাম্বার থাকায় বাড়ির ঠিকানা জানবার অসুবিধে নেই।

কিন্তু বল্লরী দাশগুপ্ত একটা বড় ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ছিল, এটা ভাবতে অবাক লাগছে। ট্রেনে তার সঙ্গে পরিচয়ের সময় এই বিস্ময়টা জাগেনি। ভেবেছিলুম। সাধারণ ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হওয়াটা তার মত শিক্ষিত এবং স্মার্ট যুবতীর পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়।

কার্ডগুলোর তলা থেকে বেরিয়ে এলো হিরে বসানো সোনার আংটি। আংটিটা আমি বল্লরীর আঙুলে দেখিনি। এটা কি কারও উপহার দেওয়া আংটি বলেই ব্যাগে লুকিয়ে রেখেছিল বল্লরী! সৌরজ্যোতির উপহার? আংটিটা টেবিলে রেখে বের করলুম একটা ভাঁজ করা কাগজ।

কাগজটা দেখে খুব আশা করেছিলুম, এতে অভাবিত কিছু পেয়ে যাব। কিন্তু ভজ খুলে দেখলুম, ওতে হিজিবিজি অঙ্ক কষে কেটে দেওয়া হয়েছে। কাগজটা ছইঞ্চি লম্বা আর চার ইঞ্চি চওড়া। ব্যাঙ্কেরই প্যাডের কাগজ। কারণ উপরে ঠিক মাঝখানে ও এ বি মনোগ্রাম ছাপানো। আতস কাচের সাহায্যে অঙ্কগুলো পড়ার চেষ্টা করলুম। পড়া গেল না। ডটপেনের কালো কালিতে লেখা হিসেব। কিসের হিসেব? একখানে পার্সেন্টেজের প্রতীক চিহ্ন % পড়া গেল কালিতে ঘষে ফেলা। বর্ণমালা কিংবা সংখ্যা পড়ার যন্ত্র আমার কিটব্যাগে নেই। কলকাতার পুলিশ হেড কোয়ার্টার লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে ওই যন্ত্র দেখেছিলুম। পঞ্চগড় থানায় তা থাকবে বলে মনে হল না। কিন্তু এই কাগজটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হল দুটি কারণে। এক :কাগজটা বল্লরী তার হ্যান্ডব্যাগে রেখেছে। দুই : ওই পার্সেন্টেজের প্রতীকচিহ্ন। ওটা কি শতকরা বার্ষিক সুদের হিসেব? এবার তৃতীয় একটা কারণ মাথায় এসে গেল। বল্লরী একটা বিদেশি ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার।

এই একটা কাগজ কী কাজে লাগবে জানি না। কিন্তু আমি কিটব্যাগের ভিতরে একটা খোপে চালান করে দিলাম। তারপর এ ব্যাগের সরু জিপটা টেনে খুললুম।

প্রথমে বেরিয়ে এলো চারটে একশো টাকার নোট। রেলের রিটার্ন টিকিট। তারিখ ২৪ এপ্রিল। তার মানে মাত্র চারদিনের জন্য বেড়াতে এসেছিল বল্লরী ও তার বন্ধুরা।

একটু খটকা লাগল। বল্লরী তার টিকিটটা আলাদা রেখেছে কেন? দলবেঁধে এলে একজনের কাছে টিকিট রাখা স্বাভাবিক।

কিছু খুচরো পয়সা আছে টাকার তলায়। তারপর হাতে শক্ত কী একটা জিনিস ঠেকল। সেটা বের করেই আমি চমকে উঠলুম। পয়েন্ট ২২ ক্যালিভারের একটা সিক্স রাউন্ডের রিভলভার। এটা কি চোরাই অস্ত্র? সেই খোপটার ভিতরে নিচের দিকে একটা খুদে জিপ আবিষ্কার করলুম। সেটা খুলে অস্ত্রটার লাইসেন্স-বুক পাওয়া গেল। গত জানুয়ারিতে রিনিউ করা লাইসেন্স।

একটা মারাত্মক অস্ত্র থাকতেও হতভাগিনী মেয়েটি এমন নৃশংসভাবে মারা পড়ল!

কাল বিকেলে সৌরজ্যোতি নাকি বল্লরীর গলা থেকে হার খুলে ছুঁড়ে ফেলেছিল। হারটা সে জোরে টেনেছিল! বল্লরীর হ্যান্ডব্যাগটাও তা হলে সে মজা করার ছলে ছুঁড়ে ফেলেছিল।

ইমানুয়েলের কথা অনুসারে বোঝা যায়, বল্লরী একা হার ও ব্যাগটা খুঁজতে গিয়েছিল।

কিন্তু পরে সে একা গিয়েছিল কেন? সৌরজ্যোতি ছুঁড়ে ফেলার পর সে নিশ্চয় খুঁজে পায়নি। শুধু সে একা নয়, অন্যরাও খুঁজেছিল–তারাও খুঁজবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু জায়গাটা এমন যে ছুঁড়ে ফেলা জিনিস তারা খুঁজে বের করতে পারেনি।

নাকি খুঁজে দেখার সময় কোথাও বাধা এসেছিল? কী সেই বাধা? নাকি পাতালমন্দিরে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো ছিল? হয়তো সন্ধ্যা হয়ে গেলে পাতাল মন্দিরে ঢোকা যায় না।

আমি সব জিনিস, যা যেখানে সেভাবে ছিল বল্লরীর হ্যান্ডব্যাগে ঢুকিয়ে জিপ এঁটে দিলুম। শুধু ভাঁজ করা কাগজটা আমার কিটব্যাগে থেকে গেল।

ঘড়ি দেখলুম, প্রায় তিনটে বাজে। বল্লরীর ব্যাগ আমার কিটব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলুম। ছেঁড়া হারটা বুকপকেটে রাখলুম।

উনি বিশ্রাম নিচ্ছেন। খুব বেশি রকমের হাঁটাহাঁটি হয়েছে। মিঃ সিনহা বললেন, কর্নেল সায়েবকে তার কোয়ার্টারে কফি পানের আমন্ত্রণ জানাতে চান।

আমি বললুম, উনি উঠলে জানিয়ে দেব। আপাতত রোমিলা কলেজ থেকে না ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আপনার আপত্তি নেই তো?

একটু হেসে বললুম–মোটও না। রোমিলা দেবী এলে একসঙ্গে কফি খেয়ে তারপর বেরোব।

ডঃ মিশ্র খুশি হয়ে বললেন ঠিক বলেছেন। রোমিলা ফোন করেছিল। সাড়ে তিনটেয় পৌঁছে যাবে। আজ বিকেলে তার কোনও ক্লাস নেই।….

.

কিছুক্ষণ পরে গেটের দিকে চাপা হর্নের শব্দ শুনে দেখলুম, রামভকত গেট খুলে দিল এবং একটা সবুজ রঙের মারুতি গাড়ি চালিয়ে রোমিলা দেবী লনের উত্তর দিকে অদৃশ্য হলেন। বাংলোর উত্তর-পূর্বে গ্যারাজ ঘর আছে দেখেছিলুম। কিন্তু লক্ষ্য করিনি যে ডঃ মিশ্রের গাড়িটা ছাড়াও তার স্ত্রীর একটা সুন্দর গাড়ি আছে। রোমিলা দেবীর কাঁধে ব্যাগ ঝুলছিল। তিনি সোজা আমাদের কাছে চলে এলেন। ডঃ মিশ্র একটু হেসে বললেন–তোমার সঙ্গে কফি পান না করে কর্নেল সায়েব বেরোবেন না। ওদিকে ও.সি. মিঃ সিনহার কোয়ার্টারে তাঁর কফিপানের আমন্ত্রণ আছে।

রোমিলা কাঁধের ব্যাগটা টেবিলে রেখে একটা চেয়ার টেনে বসলেন। তারপর ব্যাগ খুলতে খুলতে বললেন কর্নেল সায়েব নিশ্চয় টের পেয়েছিলেন, আমি তার জন্য একটা অসাধারণ জিনিস এনেছি। ডঃ মিশ্র জিজ্ঞেস করলেন–শিগগির বের কর। দেখি, কী এনেছ! রোমিলা সাদা পলিথিন ব্যাগে মোড়া একটা চৌকো জিনিস বের করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন–বলুন তো এটা কী হতে পারে?

বললুম–ইতিহাসের অধ্যাপিকা কলেজ থেকে ফিরলেন। আমার জন্য অসাধারণ যে জিনিসটা এনেছেন, তা সম্ভবত কলেজ লাইব্রেরিতে খুঁজে পাওয়া কোনো পুরনো বই। বইটা ইতিহাস ছাড়া আর কী হতে পারে? সেটা ধুলো ময়লা লেগে এবং প্রাচীনতার কারণে নোংরা ও জীর্ণ। তাই পলিথিনের মোড়ক।

রোমিলা হাসলেন–আপনি সত্যি ধুরন্ধর মানুষ কর্নেল সায়েব।

আপনি ঠিকই ধরেছেন।

 আমি তা বলে আর ময়লা ঘাঁটছি না। এটা আপনি রাখুন।

 ডঃ মিশ্র বললেন–কী বই ওটা?

রোমিলা বললেন–আমার এক ছাত্রী ক্যাটালগে কী একটা বই খুঁজছিল। আমি তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলুম, তুমি তো প্রায়ই দেখি ক্যাটালগ খুঁজে বই বের কর। পঞ্চগড়ের ইতিহাস সংক্রান্ত একটা বই এক সায়েবের লেখা। সেটা নয়। অন্য কোনও বইয়ের খোঁজ রাখ? তখনই সে ক্যাটালগ খুঁজে একটা নাম্বার নিয়ে ড্রয়ারের সামনে গেল। তারপর একটা কার্ড খুঁজে বের করল।

ডঃ মিশ্র বললেন–আহা, বইটা কী বলে?

বেণীমাধব রায় তার লাইব্রেরির সব বই কলেজকে দান করেছিলেন। তাঁর ঠাকুরদা রাজা কন্দর্পনারায়ণ রায়ের লেখা ইংরেজি বই দি ওরিজিন অব রাজ ফ্যামিলি অব পঞ্চগড় অ্যান্ড দা হিস্টরি অব দেয়ার রাইজ অ্যান্ড ডিক্লাইন। তখনকার দিনে এইরকম লম্বা টাইটেলে বই লেখা হতো।

বইটা হাতে নিয়ে বললুম–ধন্যবাদ মিসেস মিশ্র!

রোমিলা উঠে দাঁড়িয়ে একটু হেসে বললেন–নাকে রুমাল বেঁধে পড়বেন। দুই হাতে রবারের গ্লাভস পরা উচিত। আমার গ্লাভস আছে। কিন্তু আপনার হাতে তা ঢোকানো যাবে না। আচ্ছা সুরজ! পাখি ঘাঁটাঘাঁটির জন্য একজোড়া গ্লাভস তুমি ব্যবহার করতে না?

ডঃ মিশ্র হাসলেন–আমার গ্লাভস কর্নেল সায়েবের প্রকাণ্ড হাতে ঢুকতে ফেটে যাবে।

বললুম–চিন্তা করবেন না মিসেস মিশ্র! আমার কিটব্যাগে মানুষের দরকারি সবরকম জিনিস আছে। মালতীকে কফি করতে বলে শিগগির এখানে চলে আসুন।

বইটা আমি ঘরে ঢুকে টেবিলে রেখে এলুম। পঞ্চগড়ের ইতিহাস বা তার রাজাদের পারিবারিক কাহিনী আমার কী কাজে লাগবে জানি না। কিন্তু কী একটা অবচেতন কৌতূহল আমাকে এগুলো জানাবার জন্য মাঝেমাঝে তাগিদ দিচ্ছে, এটা সত্য।

কিছুক্ষণ পরে তিনজনে একত্র কফিপান এবং বল্লরীর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে এলোমেলো আলোচনার পর উঠে পড়লুম। ডঃ মিশ্র গ্যারাজ থেকে গাড়ি আনতে গেলেন। আমি বাইনোকুলার, ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে পিঠে কিটব্যাগ এঁটে বেরোলে রোমিলা দেবী সকৌতুকে বললেন–ও.সি. মিঃ সিনহার কোয়ার্টার কি গড়ের জঙ্গলে যে, আপনি এই বেশে সেজেগুজে বেরোচ্ছেন?; বললুম মিঃ সিনহার কোয়ার্টার গড়ের জঙ্গলে নয়। কিন্তু কিছু বলা যায় না। ওঁর কোয়ার্টার থেকে গড়ের জঙ্গলে গিয়ে ঢুকতেও পারি!

-প্লিজ কর্নেল সায়েব! বিকেলের পর ওদিকে পা বাড়াবেন না। সুরজকেও আমি নিষেধ করে দিচ্ছি।

 হাসতে হাসতে বললুম–না! আজ আর গড়ের জঙ্গলে যাচ্ছি না। আপনি চিন্তা করবেন না।….

বাঙালিটোলা তেমনই নিঝুম। পুরোনো জনপদের ভিড় থেকে বাঁদিকে কৈলি নদীর সেতু পেরিয়ে পনেরো মিনিটের মধ্যে থানা এলাকায় পৌঁছে গেলুম। থানার সামনে একজন কনস্টেবল দাঁড়িয়েছিল। সে সেলাম দিয়ে বলল–ও.সি. সায়েব তার কোয়ার্টারে আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। ওই গেট দিয়ে ঢুকে ডানদিকে প্রথম বাড়িতে ও.সি. সায়েব থাকেন।

বলে সে হন্তদন্ত গাড়ির রাস্তা পেরিয়ে নাকবরাবর হেঁটে সেই বাড়ির কাছে গেল এবং অদৃশ্য হল। দুধারে সবুজ ঘাস আর রঙিন ফুল বাগানের মধ্য দিয়ে গাড়ি এগিয়ে গেল।

লনের একপাশে গাড়ি রেখে ডঃ মিশ্র বেরোলেন। আমি গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে ফুলবাগানে একটা প্রকাণ্ড প্রজাপতি দেখে ক্যামেরা তাক করেছিলুম। বিকেলের আলোয় প্রজাপতিরা চঞ্চল হয়ে উড়ছিল। একবার কোথাও তার বসার প্রতীক্ষা শুধু। ডঃ মিশ্র একটু তফাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বললেন–কী ব্যাপার!

প্রজাপতিটা একটা ফুলে বসামাত্র শাটারে চাপ দিলুম। তারপর গাড়ি থেকে নেমে বললুম–এখানে কণিষ্ক কানাসে প্রজাতির প্রজাপতি দর্শনের আশা করিনি।

ও.সি. মিঃ সিনহা এগিয়ে আসছিলেন। তিনি সহাস্যে বললেন–বিরল প্রজাতির প্রজাপতি যদি হয়, তা হলে কর্নেল সায়েব আমার কাছে ঋণী হয়ে থাকবেন।

বললুম–অবশ্য মিঃ সিনহা। শিকারীদের মত প্রকৃতিবিদদেরও কিছু সু বা কু সংস্কার থাকে। আমারও আছে। এই প্রজাতির প্রজাপতির দেখা মিললে আমি বুঝতে পারি, আমার সাফল্য সুনিশ্চিত।

ডঃ মিশ্র সকৌতুকে চাপা স্বরে বললেন সাফল্য বর্তমান হত্যারহস্য বিষয়ে কি?

আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল–হ্যাঁ।

মিঃ সিনহার বসার ঘরটা সুন্দর সাজান। সোফায় আমাদের বসতে বলে তিনি ভিতরে গেলেন। একটু পরে ফিরে এসে বললেন–কফি আসবার আগে কয়েকটা জরুরি কথা বলে নিই। বল্লরী দাশগুপ্তের বাবাকে কলকাতার পুলিশের মাধ্যমে খবর দেওয়া হয়েছিল। ভদ্রলোক একজন রিটায়ার্ড গভর্নমেন্ট অফিসার। বল্লরীর মা বেঁচে নেই। তার বাবা শুভময় দাশগুপ্তের সঙ্গে তার মামা নীতীশ সেন এসেছেন। মিঃ সেন একটা ফিনান্সিয়াল সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর। ওঁরা উঠেছেন গ্রিনভিউ হোটেলে। ওঁরা বডি শনাক্ত করেছেন মর্গে।

জিজ্ঞেস করলুম–ওঁরা কি বডি কলকাতা নিয়ে গিয়ে শেষকৃত্য করবেন?

–না। বাঙালিটোলায় কয়েকজন বাঙালি এখনও আছেন। কৈলি নদীর ধারে ওঁদের একটা শ্মশান আছে। ডাঃ শচীন অধিকারীর সঙ্গে ওঁদের আলাপ করিয়ে দিয়েছি। এতক্ষণে বডি ওঁরা ডেলিভারি নিয়ে শ্মশানে গেছেন।

–ওঁরা সৌরজ্যোতি, ইন্দ্রনীল আর সুদক্ষিণার সঙ্গে কথা বলেছেন কি?

–আমি দেখা করে ইচ্ছে মত প্রশ্ন করার প্রস্তাব দিয়েছিলুম। শুভময়বাবু বললেন, ওদের সঙ্গে কথা যা বলার কলকাতায় ফিরে বলবেন। ভদ্রলোক সামনে পেলে ওদের গুলি করে মারবেন বলে হুমকি দিচ্ছিলেন।

সৌরজ্যোতিরা কোথায় আছে?

–ওকে আর ইন্দ্রনীলকে থানার হাজতে রেখেছি। ওদের কথায় কিছু অসঙ্গতি লক্ষ্য করেছি। আজ রাতভর জেরা চলবে।

–সুদক্ষিণাও কি হাজতে আছে?

 মিঃ সিনহা ঠোঁটের কোণে হেসে বললেন–আমাদের থানায় মেয়েদের জন্য। একটামাত্র সেল আছে। সেখানে তিনটে চুরি, একটা খুন আর একটা ডাকাতি কেসে জড়িত মেয়ে আসামি আছে। ওদের পুলিশ হাজতে থাকার মেয়াদ এখনও শেষ হয়নি। বিভিন্ন দিনে ওদের কোর্টে তোলা হবে।

–সুদক্ষিণা তাদের সঙ্গে আছে?

 মিঃ সিনহা আস্তে বললেনকাল ইন্দ্রনীলদের সঙ্গে ওকে কোর্টে তুলতে হবে। তবে সুদক্ষিণাকে যা ভেবেছিলাম আমরা, সে তা নয়। তার সরলতা নিছক অভিনয় বলে আমার ধারণা। এই কেসে প্রকৃত তথ্য তার কাছেই পাওয়া যাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

ডঃ মিশ্র বললেন–তা হলে নিজে বেঁচে যাওয়ার জন্য পুলিশকে তার সব খুলে বলা উচিত। বলছে না কেন সে?

গোপেশ্বর সিনহা একটু চুপ করে থাকার পর বললেন–নিছক ধারণা। তবু বলছি, সুদক্ষিণা সম্ভবত ভেবেছে, দৈবাৎ ইন্দ্রনীল বা সৌরজ্যোতি এই কেসে রেহাই পেয়ে গেলে অথবা যদি তাদের শাস্তিও হয়, ওদের এমন কোনো বন্ধু বা স্বজন আছে, তাদের হাতে তার প্রাণ চলে যাবে।

বললুম–অর্থাৎ প্রাণের ভয়?

–ঠিক তা-ই। মিঃ সিনহা হাসলেন। অন্তত চব্বিশটা ঘন্টা চুন্নী, ডাকাতনী আর খুনী দেহাতি মেয়ের সংসর্গে কাটালে সুদক্ষিণা সব ঝুঁকি নিয়েও মুখ খুলতে, বাধ্য। দেখা যাক।

-বল্লরীকে খুনের মোটিভ কি খুঁজে পেয়েছেন আপনি?

–ত্রিকোণ প্রেমের পরিণাম। সৌরজ্যোতি আর ইন্দ্রনীল দুজনেই বল্লরীর প্রতি অনুরক্ত। সুদক্ষিণার কথায় এর আভাস পেয়েছি। বাঙালি হাভেলির কেয়ারটেকার ঝাব্বুলাল বলেছে, খুন হওয়া মেয়েটাকে নিয়ে দুই বাবুর মধ্যে ঝগড়া লক্ষ্য করেছিল সে। এর আগেও বল্লরী, ইন্দ্রনীল, সৌরজ্যোতি আর অন্য একটি মেয়ে বেড়াতে এসেছিল। সেবারও বল্লরীকে নিয়ে দুই বাবুর ঝামেলা বেধেছিল।

কতদিন আগে?

–বাঙালিটোলায় গতবছর কালীপুজো হয়েছিল। পুজোর সময় তার মালিকের ছেলে ইন্দ্রনীল, সৌরজ্যোতি, বল্লরী আর একটা মেয়েকে নিয়ে এসেছিল। তার নাম ঝঝুলাল ভুলে গেছে। তবে ইন্দ্রনীল আমাদের কাছে স্বীকার করেছে, তাদের সেই বান্ধবীর নাম লোপামুদ্রা গুহ। সে এখন নাকি মুম্বাইতে চাকরি করে।

এতক্ষণে একজন পরিচারিকা কফির ট্রে আনল। তার সঙ্গে যে মহিলা এলেন, তিনি নিশ্চয় মিসেস সিনহা। মিঃ সিনহা আলাপ করিয়ে দিলেন। কর্নেল সায়েবকে একটা চমক দেব বলে এই কফির আসর। স্বাগতা! তোমার আরাধ্য দেবতাকে চিনতে পারছ তো? স্বাগতা আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে এলেন। বাংলায় বললুমজুত প্রণামের যোগ্য বস্তু নয়।

মিঃ সিনহা হাসতে হাসতে ইংরেজিতে বললেন কর্নেল সায়েবের সত্যি তৃতীয় একটি চোখ আছে।

ভুরু কুঁচকে মৃদু হেসে বাংলায় বললুম–পাটনার বাঙালি মেয়ে। তাই না?

স্বাগতা হাসল–হ্যাঁ। আমি কলেজে পড়ার সময় থেকে কলকাতার দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা পড়তুম। জয়ন্ত চৌধুরীর লেখায় আপনার কত রোমাঞ্চকর কীর্তিকলাপ…..

তাকে থামিয়ে দিয়ে বললুম–আমার এই এক দুর্ভাগ্য স্বাগতা দেবী! এসেছিলাম গড়ের জঙ্গলে রেনবো অর্কিডের খোঁজে। চিরকালের এক আততায়ী আমার সামনে একটা মৃতদেহ ছুঁড়ে ফেলে চ্যালেঞ্জ জানাল। তো আপনার জীবনসঙ্গীকে বাংলা শেখাননি কেন? ইংরেজিতে কথা বলে আনন্দ পাই না– বিশেষ করে আমাদের স্বদেশ এই ভারতভূমি।

গোপেশ্বর তো ভাল বাংলা জানে!

গোপেশ্বর সিনহা বাংলায় বললেন–বলিনি আপনাকে এই চমকটা দেবার জন্য।

বললুম–দুজনেই তা হলে পাটনার অধিবাসী। সম্ভবত একই পাড়ার বাসিন্দা।

মিঃ সিনহা বললেন–পাটনার গদানিবাগে বাঙালির বাস। বাবা ছিলেন অধ্যাপক।

-বুঝেছি! তা সন্তানদি?

এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলসে পড়াশোনা করছে। মেয়ে ডঃ মিশ্রের মেয়ের সহপাঠিনী দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

স্বাগতা বললেন–জয়ন্তবাবু আপনার সঙ্গে আসেননি শুনেছি। কলকাতায় আমার মামার বাড়ি। কলকাতা গেলে আপনার সাহায্যে তারও দেখা নিশ্চয় পাব।

ডঃ মিশ্র এতক্ষণে একটু হেসে বললেন–আমি ভি কুছু কুছু বাংলা বোলতে জানি। কিন্তু আমি জানতে না পারছে, মিঃ সিনহার ওয়াইফ বাঙালিনী, কর্নেলসাব ক্যায়সে বুঝ করলেন?

বললাম–আমার প্রথম সন্দেহ ছিল, ও.সি. মিঃ সিনহা তার কোয়ার্টারে কফি পানের আমন্ত্রণ জানালেন কেন? তারপর আমাদের বসিয়ে তিনি ভেতরে গেলেন কেন? তৃতীয় সূত্র সন্দেহ হয়, স্বাগতা দেবীর চেহারা। বাঙালি যেখানেই বাস করুক, বিশেষ করে মেয়েদের চেহারায় কী একটা পৃথক লালিত্য আছে-না, আমি জানি অবাঙালি মেয়েদের তুলনায় বাঙালি মেয়েরা তত সুন্দরী নয়, হিন্দি ফিল্মই এর উদাহরণ–তো যাই হোক, মিঃ সিনহার অভিনয় তুলনাহীন। আজ কতক্ষণ গড়ের জঙ্গলে আমরা ঘুরেছি, উনি ঘৃণাক্ষরে জানতে দেননি, উনি ভাল বাংলা জানেন এবং ওঁর স্ত্রী বাঙালি মহিলা।

মিঃ সিনহা বললেন–এবং কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের গুণমুগ্ধ ভক্ত। সত্যসেবক পত্রিকায় ছাপা আপনার কত ছবি স্বাগতা খাতায় পেস্ট করে রেখেছে, কর্নেল সায়েব দেখলে অবাক হবেন।

ডঃ মিশ্র বললেন–মেয়েদের বয়স যা-ই হোক, মনে মনে বালিকা থেকে যায়।

–আপনার স্ত্রী তো ইতিহাসের অধ্যাপিকা!

 –তাতে কী?

মনে মনে বিব্রত এবং একটু বিরক্ত হচ্ছিলুম। এভাবে সময় নষ্ট করা ঠিক হচ্ছে না। মিঃ সিনহা একজন পুলিশ অফিসার। তাঁর চিন্তাধারা তার কাজের পদ্ধতি আমার চেয়ে পৃথক। কফি শেষ করে বললুম– মিঃ সিনহাকে এই চমকের জন্য ধন্যবাদ। আর স্বাগতা দেবীকে তার তৈরি উৎকৃষ্ট কফির জন্য ধন্যবাদ।

মিঃ সিনহার এখন পুলিশের মেজাজ নেই। প্রশ্ন করলেন কী করে জানলেন কফি স্বাগতারই তৈরি।

বললুম–স্বাগতা দেবী জানেন আমি কড়া কফি পান করি!

-ওঃ! তাই ডঃ মিশ্র বারবার দুধ মেশাচ্ছিলেন?

 স্বাগতা বললেন–এবং তুমিও।

স্বাগতাকে আবার ধন্যবাদ দিয়ে উঠে পড়লুম। বললুম–মিঃ সিনহা কি এখন অফিসে যাবেন না?

–অবশ্যই যাবো। এক মিনিট। আমি তৈরি হয়ে আসছি। আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে।

ও.সি. গোপেশ্বর সিনহা ভিতরে গেলেন। আমরা বেরিয়ে লনে নামলুম। ডঃ মিশ্র গাড়িটা ঘুরিয়ে আনতে গেলেন। এই সময় স্বাগতা সিনহা আমাকে চাপা স্বরে। বললেন–কর্নেল সায়েব! সব ঘটনা আমি জেনে নিয়েছি ওর কাছে। আমি কিন্তু শুনেছি ঝাব্বুলাল আর ডাক্তার অধিকারী রায়রাজাদের বাড়িটা বিক্রির তালে আছে। আমার সোর্স, কাজের মেয়ে লছমি। সে ঝাঝুলালের খুড়তুতো বোন। আমার ধারণা, বল্লরী টের পেয়েছিল, ইন্দ্রনীল রায়কে খুন করা হবে। তাই–

সে থেমে গেল কারণ ডঃ মিশ্রের গাড়ি আমার কাছে এসে গেছে।

একটু হেসে বললুম–ধন্যবাদ…..

.

ও.সি. গোপেশ্বর সিনহার সঙ্গে আমি হেঁটে যাচ্ছিলুম। ডঃ মিশ্রকে থানার পার্কিং জোনে গাড়ি রেখে অপেক্ষা করতে বলেছিলুম। হাঁটতে হাঁটতে স্বাগতার কথাগুলো বাজিয়ে দেখছিলুম। স্বীকার করা উচিত, তার ধারণা আমার থিয়োরর কাছাকাছি। কিন্তু থিয়োরি যতক্ষণ না একটা ভিত্তি পাচ্ছে, ততক্ষণ তা নিছক ধারণা। ঝাব্বুলাল মদের নেশার ঘোরে তোক বা যে অবস্থায় হোক, আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে বলেছে, সে রায়রাজাদের হাভেলি কিছুতেই বেচতে দেবে না। সম্ভবত সে জানে না, ইন্দ্রনীলের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। ওদিকে ডঃ মিশ্রকে সে পরোয়া করে না। না করতেই পারে। ডঃ মিশ্রের সঙ্গে বাঙালিটোলার কোনো সম্পর্ক নেই, সে তা জানে। তা ছাড়া উঃ মিশ্র যে তাকে ভয় করেন, ঝাব্বুলাল তাও জানে।

স্বাগতার ধারণার সঙ্গে আমার চিন্তার একটু মিল এখানেই। এই ঘটনায় ডাঃ অধিকারীর ভূমিকা কী? তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট, ডাঃ অধিকারীর একটা গাড়ি আছে। স্টেশন রোডে কৈলি নদীতে পিছু হটে যাওয়া গাড়িটার চাকার কয়েক ইঞ্চি দাগের ছবি তুলেছি। আজ রাতেই ছবিগুলো ডেভলাপ এবং প্রিন্ট করতেই হবে। কয়েকটি ফিল্ম নষ্ট হবে। তা হোক।

হাঁটতে হাঁটতে মিঃ সিনহা বললেন–আপনি দুপুরে সেই বিরল প্রজাতির অর্কিড খুঁজে পেয়েছিলেন কি?

বললুম–হ্যাঁ। ভারুয়া শুধু বনচর নয়, গড়ের জঙ্গল তার সবটাই চেনা।

আপনাদের ফিরতে দেখিনি। কোনদিক দিয়ে ফিরছিলেন?

কৈলি নদী পেরিয়ে স্টেশন রোড। তারপর হাইওয়েতে বাঁদিকে ঘুরে ইমানুয়েলের দোকানের পাশে রাখা ডঃ মিশ্রের গাড়িতে চেপেছিলুম। তখন আপনাদের সবাই চলে এসেছিলেন। তো, আপনি চত্বরটার পাশে গর্তের মধ্যে যেন কোনো সূত্র খুঁজে পেয়েছেন মনে হচ্ছিল?

–আমি বুঝবার চেষ্টা করছিলুম, খুনী লাশটা অন্য কোথাও না ফেলে ওই গর্তে কেন ফেলেছিল?

-কী মনে হয়েছে আপনার?

–খুনীর মনে হয়েছিল, লাশটা খুব শিগগির যেন কারও চোখে না পড়ে।

–ঠিক বলেছেন। কিন্তু ওই চত্বরটা কীসের জানেন?

–শুনেছি রায়রাজারা বৈদিক মতে যজ্ঞ করতেন ওখানে। ওটা চল্লিশ ফুট লম্বা চল্লিশ ফুট চওড়া। ১৬০০ বর্গফুট চত্বর। গ্রানাইট পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছিল। হা-ফেরার সময় নগ্ন পাথরে ভর্তি অসমতল মাঠ দিয়ে আসার সময় একটুর জন্য বেঁচে গেছি। পেছনে আমড কনস্টেবল ছিল দুজন। তারাও কী করবে ঠিক করতে পারেনি।

–বিষধর সাপ?

মিঃ সিনহা আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন–আপনার উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা করছি।

এলাকায় বিষধর সাপ থাকার কথা আগে শুনেছিলুম।

–সাপ কী বলছি! শঙ্খচূড়! আচমকা পায়ের শব্দ শুনে একটা পাথরের পাশ থেকে ফণা তুলল! মাত্র দুমিটার দূরত্ব! আমার বুকে ইচ্ছে করলেই ছোবল দিতে পারত।

-তারপর?

–আমার স্থির থাকা উচিত ছিল তারপর খুব আস্তে লোডেড রিভলভার বের করে গুলি করতে পারতুম। কিন্তু এক লাফে পিছিয়ে এসেছিলুম। কে বলে সাপ তাড়া করে না? সাপটা প্রায় লেজে ভর দিয়ে ছুটে এলো। অমনি ডাইনে সরে গেলুম। কনস্টেবল চিৎকার করছে সাপ! সাপ! বুঝুন অবস্থা। ওদের হাতে রাইফেল। যাই হোক, সাপটা আমার দিকে ঘুরতে একটু সময় লাগাল। তখন রিভলভার বের করে ফেলেছি। মাথা লক্ষ্য করে গুলি করলুম। পর-পর তিনটে গুলি।

–জায়গাটা কি ইমানুয়েলের দোকানের সোজা দক্ষিণে?

মিঃ সিনহা অবাক হলেন। –আপনি কি ওর পাল্লায় পড়েছিলেন? মিথ্যা কথা বললুম–হ্যাঁ। তবে পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিলুম। সম্ভবত ওর একটা জুটি আছে ওখানে। আর একটা কথা। কাছাকাছি কোথাও জলভরা ডোবা আছে। শঙ্খচূড় জলের কাছাকাছি এলাকায় থাকে।

কথা বলতে বলতে আমরা থানায় ঢুলুম। ডঃ মিশ্র আমাদের অনুসরণ করছিলেন। থানার বাড়িটা নতুন। পুলিশের জন্য আধুনিক সরঞ্জাম লক্ষ্য করলুম। করিডরের শেষপ্রান্তে ও.সি.-র ঘর খুলে দিল একজন কনস্টেবল। মিঃ সিনহা বললেন–বসুন আপনারা!

সেই কনস্টেবল ঘরে আলো জ্বালিয়ে পাখা চালিয়ে দিল। তারপর সেলাম ঠুকে বেরিয়ে গেল। মিঃ সিনহা বললেন কর্নেল সায়েব যদি আসামীদের সঙ্গে কথা বলতে চান, ডাকব। প্রথমে কাকে ডাকব বলুন!

বললুম–সৌরজ্যোতিকে।

মিঃ সিনহা টেবিলে আটকানো সুইচ টিপলেন। ঘন্টা শুনে একজন কনস্টেবল এসে সেলাম দিল। মিঃ সিনহা বললেন–এস. আই. শিউলাল প্রসাদকে গিয়ে বলল আর্মড কনস্টেবল নিয়ে কাস্টডি থেকে সৌরজ্যোতি সিংহকে এখানে যেন নিয়ে আসেন। দেরি নয়। শিগগির।

 কিছুক্ষণ পরে সৌরজ্যোতিকে নিয়ে এলেন একজন এস. আই.। ও.সি.-র ইঙ্গিতে এস. আই. শিউলাল ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। দেখলুম, সৌরজ্যোতির মধ্যে সেই স্মার্টনেস একটুও নেই। অবিন্যস্ত চুল। কয়েক ঘন্টার হাজতবাস আর জেরা অবশ্য যে কোনো মানুষকেই এমন নিষ্প্রভ করে তোলে। আমাকে দেখে সে বিস্মিত হয়েছিল। তাকে একটু তফাতে একটা চেয়ার দেখিয়ে মিঃ সিনহা বললেন–বসুন!

– ডঃ মিশ্র আর আমি মিঃ সিনহার মুখোমুখি বসেছিলুম। সৌরজ্যোতি বসল। টেবিলের অন্যপ্রান্তে। তারপর একটু কেসে গলা ঝেড়ে সে আমার দিকে তাকাল। তারপর ভাঙা গলায় বলল–ট্রেনে আসবার সময় আমরা বুঝতে পারিনি আপনি কে। আপনার সামনে অনেক বাঁচালতা করেছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন কর্নেল সায়েব, বল্লরীকে কে কী কারণে এমন সাংঘাতিকভাবে মারল, আমরা একটুও বুঝতে পারছি না। আপনি এই ঘটনায়—

তাকে থামিয়ে দিয়ে বললুম–আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। সৌরজ্যোতি করজোড়ে বলল–আপনি আমাকে তুমি বলুন!

–হ্যাঁ। তুমি বললে কাছাকাছি দাঁড়ানো যায়। কাজেই তুমিই বলব। কিন্তু প্রশ্নের সঠিক উত্তর চাইব।

–আপনি যা জানতে চাইবেন, আমি যতটুকু জানি তা নিশ্চয় বলব।

–শোনো সৌরজ্যোতি! তোমরা আমার কার্ডে যে পরিচয় দেখেছ, তা সত্যি। আমি সত্যই একজন প্রকৃতিবিজ্ঞানী। এখানে এসেছিলুম এক বিরল প্রজাতির অর্কিডের খোঁজে। আমি বৃদ্ধ মানুষ। আড়ি পেতে যুবক-যুবতীদের কথা শোনা অনেক বৃদ্ধের অভ্যাস। সেই অভ্যাস আমার নেই।

আমার এইসব কথা বলার উদ্দেশ্য ছিল, একটা ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরি। লক্ষ্য করলুম, সৌরজ্যোতির চোখদুটো ঈষৎ উজ্জ্বল হয়েছে। নিভে যাওয়া চুরুটটা লাইটার জ্বেলে ধরিয়ে নিলুম। মিঃ সিনহা অ্যাশট্রেটা আমার সামনে এগিয়ে দিলেন। ধোঁয়ার মধ্যে বললুম–কাল দুপুরে গড়ের জঙ্গলে তোমরা চারজন বেড়াতে গিয়েছিলে?

–হ্যাঁ। এখানে এলেই আমরা

–পাথরের বিশাল চত্বরটার উপর দাঁড়িয়ে তোমরা একটা বোঝাপড়ায় পৌঁছুতে চাইছিলে!

সৌরজ্যোতি চোখ নামিয়ে আঙুল খুঁটতে থাকল। একটু পরে বলল–আপনি শুনেছিলেন?

বললুম–কীসের বোঝাপড়া? সৌরজ্যোতি! আশা করি, সঠিক উত্তর পাব।

ইন্দ্রনীল আর বল্লরী পরস্পরকে ভালবাসত একসময়। এরা বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারপর ওদের মধ্যে সম্পর্কের ফাটল ধরেছিল। ওদের আগের সম্পর্কটা ফিরিয়ে আনতে আমি আর সুদক্ষিণা চেষ্টা করছিলুম। ভেবেছিলুম, পঞ্চগড়ে খোলামেলা পরিবেশে প্রকৃতির মধ্যে ফিরে গেলে যদি ওদের ভুল বোঝাবুঝি দূর হয়।

বাঃ! তো কিসের ভুল বোঝাবুঝি?

ইন্দ্রনীল বল্লরীকে চরিত্রে সন্দেহ করেছিল।

–সৌরজ্যোতি! কাল তুমি বলছিলে, বল্লরী একটা অতল খাদের ধারে দাঁড়িয়ে আছে। কেন?

সৌরজ্যোতি মুখ নামাল আবার। অস্বাভাবিক গাম্ভীর্যের ছাপ পড়েছে দেখলুম।

বললুম–দেরী করো না। আমার হাতে সময় কম। আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। সঠিক উত্তরের উপর তোমাদের তিনজনের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।

সৌরজ্যোতি মুখ তুলল। তারপর মৃদুস্বরে বলল–বল্লরী একটা ওভারসিজ ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার।

–জানি। সার্কাস অ্যাভেনিউ ব্রাঞ্চের ম্যানেজার ছিল সে।

–আপনি জানেন?

 –জানি। আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।

-বল্লরী ঝুঁকি নিয়ে ইন্দ্রনীলকে পাঁচ লাখ টাকা ব্যাঙ্ক থেকে ধার পাইয়ে দিয়েছিল। সুদ বছরে শতকরা আঠারো টাকা। সুদে আসলে দুবছরে তা বাড়লে কত হয় ভাবুন। অথচ ইন্দ্রনীলের ব্যবসা শেষ পর্যন্ত মার খেয়ে অচল অবস্থায় পৌঁছেছে। এমন কী, যে অ্যাসেট ব্যাঙ্ক বন্ধক নিয়েছিল, আর্থিক হিসেবে তা পঞ্চাশ হাজার টাকাও নয়।

–ইন্দ্রনীলের কথা ইন্দ্রনীলের মুখেই শুনব। কিন্তু ইন্দ্রনীল বল্লরীকে বিয়ে করলে কী ভাবে সেই আর্থিক সমস্যা মিটে যেত বলে তোমার ধারণা ছিল?

–ইন্দ্রনীলের পঞ্চগড়ের বাড়িটা বিক্রি করলে বল্লরীর ব্যাঙ্কের টাকা শোধ হয়ে যেত।

-বল্লরীকে বিয়ে না করেও তোতা ইন্দ্রনীল এখানকার বাড়ি বিক্রি করে দেনা শোধ করতে পারত।

-হ্যাঁ। কিন্তু ইন্দ্রনীলের হাবেভাবে আমার আর সুদক্ষিণার সন্দেহ হয়েছিল, সে বল্লরীর ওপর যেন প্রতিশোধ নিতে চায়।

–কীসের প্রতিশোধ?

প্রেমে বিশ্বাসভঙ্গের। আপনি ট্রেনেই দেখেছেন, ইন্দ্রনীল বল্লরীর সঙ্গে যেভাবে কথা বলছিল, তা ছাড়া তার ঠোঁটে প্রকাশ্যে বল্লরীর কিস চাইছিল– আপনারই সামনে!

–হ্যাঁ। আমার সামনে। তার মানে কি তুমি বলতে চাইছ–আমার কথার ওপর সৌরজ্যোতি বলে উঠল–হি ওয়াজ ট্রিটিং হার অ্যাজ আ হোর!

দ্রুত বললুম–রাত তিনটের সময় ট্রেনে তুমি বল্লরীর বার্থে উঠেছিলে। কিছুক্ষণ পরে তুমি নেমে বেরিয়ে গিয়েছিলে। তারপর বল্লরী বার্থ থেকে নেমে বেরিয়ে গিয়েছিল!

সৌরজ্যোতি চমকে উঠেছিল। তার মুখ আবার আগের মত নিষ্প্রভ হয়ে গেল। সে মুখ নামাল।

-তোমার স্বীকার করার সাহস থাকা উচিত যে বল্লরীর সঙ্গে তোমার যৌন সম্পর্ক ছিল। আর ইন্দ্রনীল তা যেভাবেই হোক, জানতে পেরেছিল। তুমিই বললে, হি ওয়াজ ট্রিটিং হার অ্যাজ আ হোর! সৌরজ্যোতি মুখ নামিয়ে বসে রইল।

বললুম–গড়ের জঙ্গলে আবার কাল বিকেলে তোমরা কেন গিয়েছিলে?

–আমরা জানতুম জঙ্গলের ওই বিশাল পাহাড়ের চত্বরটা ইন্দ্রনীলের পূর্বপুরুষের যজ্ঞবেদি। সুদক্ষিণার বিশ্বাস, পূর্বপুরুষের ওই যজ্ঞবেদিতে ইন্দ্রনীলকে নিয়ে গিয়ে বল্লরীর সঙ্গে বোঝাপড়া সম্ভব। ইন্দ্রনীল নিজেই বলল, ওই যজ্ঞবেদিতে গিয়ে দাঁড়ালে তার মনে কী একটা পরিবর্তন ঘটে যায়। আমি জানি ওটা ইন্দ্রনীলের একটা সংস্কার। সুদক্ষিণার কথায় আমি ইন্দ্রনীলকে ওখানে একরকম জোর করে নিয়ে যাই। ইন্দ্রনীল কিন্তু যজ্ঞবেদিতে দাঁড়িয়ে বলেছিল, বল্লরীকে বিয়ে না করলেও এখানকার হাভেলি বেচে তার টাকা শোধ করে দেবে। তখন আমরা সোজা হেঁটে পাতালভৈরবীর মন্দির দর্শনে যাচ্ছিলুম।

আমি দ্রুত বুক পকেট থেকে ছেঁড়া সোনার চেনটা বের করে বললুম সুদক্ষিণা পুলিশকে বলেছে, তুমি হঠাৎ বল্লরীর গলা থেকে সোনার এই চেনটা হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেছিলে। কেন?

-বল্লরী, আশ্চর্য লেগেছিল আমার, ইন্দ্রনীলের গা ঘেঁষে তার একটা হাতের আঙুলে নিজের হাতের আঙুল ভরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বলল, তুমি ঠোঁটে চুমু চেয়েছিলে, এই নাও–অ্যান্ড শি রিয়্যালি কিসড অন হার লিপ! ব্যাপারটা আমার অসহ্য লেগেছিল। বল্লরীর ওই সোনার চেনটা ওর গলা থেকে টেনে ছিঁড়ে জোরে ছুঁড়ে ফেলেছিলুম! বল্লরীর ওই ছেনালি–সরি!

–তোমার অসহ্য লেগেছিল!

–হ্যাঁ।

–তাতেও তোমার রাগ পড়েনি! বল্লরীর হ্যান্ডব্যাগটা তুমি ছুঁড়ে ফেলেছিলে। বলে আমি পিঠের কিটব্যাগ খুলে বল্লরীর ব্যাগটাও বের করলুম।

ও.সি. মিঃ সিনহা অবাক চোখে তাকিয়ে দেখার পর সহাস্যে বললেন–আপনি ভারুয়ার চেয়েও বনচর।

সৌরজ্যোতি বলল–তারপর আমরা চারজনেই খুঁজছিলুম। কিন্তু হঠাৎ

বললুম–শঙ্খচূড় সাপের আবির্ভাব!

–হ্যাঁ একটা সাংঘাতিক সাপ। আমাদের সামনে লেজে ভর দিয়ে ফণা তুলেছিল। আমরা চারজনেই দৌড়ে হাইওয়েতে উঠেছিলুম।

–তারপর পাতালমন্দিরে গিয়েছিলে?

-হ্যাঁ। কিন্তু সুড়ঙ্গে নামবার সময় কখন চুপিচুপি বল্লরী চলে এসেছিল বুঝতে পারিনি।

-বল্লরী তার ব্যাগটার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। সে মরিয়া হয়ে আবার এটা খুঁজতে গিয়েছিল। আদিবাসী ইমানুয়েল হাইওয়ে থেকে আর ভারুয়া তাকে যজ্ঞবেদির ওধার থেকে দেখতে পেয়েছিল!

মিঃ সিনহা বললেন–মেয়েটিকে তাহলে দুঃসাহসী বলতে হয়। ব্যাগের সেই জিপটা খুললুম, যে খোপে বল্লরীর ছোট্ট রিভলভারটা আছে। সেটা দেখিয়ে বললুম–মিঃ সিনহা! বল্লরীর এই ফায়ার আর্মসটা লাইসেন্সড। বল্লরী এবার এই অস্ত্রটা সঙ্গে এনেছিল কেন, এটাই প্রশ্ন। সৌরজ্যোতি! তুমি কি জানতে বল্লরীর কাছে এই অস্ত্রটা ছিল?

সৌরজ্যোতি বলল–না।

সৌরজ্যোতি! তুমি জানতে বল্লরীর একটা রিভলভার ছিল এবং সেটা সবসময় সঙ্গে রাখার জন্য হ্যান্ডব্যাগে রেখেছিল। এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তুমিই তাকে তার অস্ত্রটা নিয়ে আসার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলে।

সৌরজ্যোতি মুখ নামিয়ে কী বলল, বুঝতে পারলুম না।

বললুম–তুমি আশঙ্কা করেছিলে, ইন্দ্রনীল তাকে কোনো সুযোগে মেরে ফেলবে। তাই না?

এবার সৌরজ্যোতি আস্তে বলল–হ্যাঁ।

–কিন্তু তুমি ইচ্ছে করেই কাল বিকেলে বল্লরীকে নিরস্ত্র করার জন্য তার ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলেছিলে!

সৌরজ্যোতি দুহাতে মুখ ঢেকে ভাঙা গলায় বলল–শঙ্খচূড় সাপ ওখানে আছে, তা আমি কেমন করে জানব? ব্যাগটা আমরা নিশ্চয় খুঁজে পেতুম। আমি বল্লরীকে বাঁচাতেই চেয়েছিলুম।

তোমার কথায় যুক্তি আছে। এবার বলো, ইন্দ্রনীলদের হাভেলিতে গিয়ে কাল সন্ধ্যায় তোমরা কেয়ারটেকার ঝাব্বুলালকে নিশ্চয় জিজ্ঞেস করেছিলে, বল্লরী একা ফিরে এসেছে কি না?

–জিজ্ঞেস করলুম। ঝাব্বুলাল বলল, আমাদের দলের কেউ একা ফিরে আসেনি।

ঝাব্বুলালকে কি তখন মাতাল মনে হচ্ছিল?

—হ্যাঁ। আগে এসেও দেখেছি, বিকেল থেকে সে মদ খেতে শুরু করে। তার একটা সাইকেল আছে। আমি বা ইন্দ্রনীল নিউ টাউনশিপের হোটেল গ্রিনভিউ থেকে প্যাকেটভর্তি খাবার নিয়ে আসি।

–কাল সন্ধ্যায় বল্লরীকে হাভেলিতে খুঁজে না পেয়ে তোমরা কী করেছিলে?

–থানায় এসেছিলুম। ডিউটি অফিসারকে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু উনি শুধু নিখোঁজ হওয়ার একটি ডায়েরি নিয়েছিলেন। ও.সি. সায়েব বাইরে ছিলেন।

মিঃ সিনহা বললেন অ্যাঁ। কর্নেল সায়েবকে তা বলেছি।

সৌরজ্যোতির দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তকিয়ে বললুম ইন্দ্রনীলের সঙ্গে সুদক্ষিণার কোনো এমোশনাল সম্পর্ক আছে?

–জানি না। তবে থাকতেও পারে। বল্লরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুদক্ষিণা। কিন্তু সুদক্ষিণা তত বেশি স্মার্ট নয়। তত সাহসী নয়।

–সৌরজ্যোতি! আমার শেষ প্রশ্ন। বল্লরীকে কে অমন নৃশংসভাবে খুন করেছে বলে তোমার ধারণা?

–গতরাতে আমার ঘুম আসছিল না। আমি আর ইন্দ্রনীল একটা ঘরে ওদিকে পাশের ঘরে বল্লরী আর সুদক্ষিণা, শোওয়ার ব্যবস্থা ছিল এরকম। যতবার এখানে এসেছি, এরকমই থেকেছি।

–গতরাত্রের কথা বলো!

–গতরাত্রে তখন কটা বাজে ঘড়ি দেখিনি, পাশ ফিরে শুয়েছিলুম। তখন গাড়ির শব্দ শুনেছিলুম। বাঙালিটোলার নীচের রাস্তায় রাত্রে গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক। তবে গাড়িটা কাছাকাছি থেমে গেল মনে হয়েছিল। তবে সে ব্যাপারে মন ছিল না। বল্লরী কোথায় গেল, এটাই চিন্তা ছিল। তারপর আস্তে দরজা খোলার শব্দে পাশ ফিরে বলেছিলুম, ইন্দ্র? ইন্দ্রনীল বলেছিল, বাথরুমে গিয়েছিলুম। বেশ কিছুক্ষণ পরে আবার গাড়ির শব্দ কানে এলো। গাড়িটা চলে গেল। এ থেকে আমি কোনো নির্দিষ্ট ধারণা গড়ে তুলতে পারিনি কে খুনী হতে পারে।

–ঠিক আছে। মিঃ সিনহা! সৌরজ্যোতিকে পাশের কোনো ঘরে রাখুন। আর ইন্দ্রনীলকে নিয়ে আসতে বলুন।….

.

সাব-ইন্সপেক্টর শিউলাল প্রসাদ ইন্দ্রনীল রায়কে নিয়ে এলেন। ও.সি. মিঃ সিনহা তাকে সৌরজ্যোতি যেখানে বসেছিল, সেখানে বসতে বললেন। শিউলাল প্রসাদ বেরিয়ে গেলেন।

ইন্দ্রনীল বসল। তার চেহারায় রুক্ষতার ছাপ। চোখ দুটো আবছা লাল। দৃষ্টি বেপরোয়া মানুষের মত নির্বিকার। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল-ট্রেনে আপনার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। আপনি নাকি একজন রিটায়ার্ড কর্নেল। আপনি এখানে কী করছেন?

মিঃ সিনহা পুলিশি মেজাজে বললেন কর্নেল সরকার আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চান।

–তার প্রশ্ন করার কোনো অধিকার কি আছে?

–আছে। সেটা কী ধরনের অধিকার আপনাকে জানাতে আমি বাধ্য নই। তবে এটুকু মনে রাখবেন, উনি আপনাদের হিতাকাঙ্ক্ষী। তাই উনি আপনার মুখে তার প্রশ্নের সঠিক উত্তর চান।

ইন্দ্রনীলের ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। সে বলল-ওকে কর্নেল সরকার! প্রশ্ন করুন।

বললুম–ওভারসিজ এশিয়ান ব্যাঙ্কের সার্কাস অ্যাভেনিউ ব্রাঞ্চের কাছে আপনি দুবছর আগে পাঁচ লাখ টাকা শতকরা বার্ষিক আঠারো টাকা সুদে ঋণ নিয়েছিলেন। ব্রাঞ্চ ম্যানেজার বল্লরী দাশগুপ্ত ঝুঁকি নিয়ে আপনাকে ঋণ মঞ্জুর করেছিল। আপনার ব্যাবসার স্থাবর অস্থাবর অ্যাসেট বা সম্পত্তির বাজারদর তখন সেই ঋণের টাকার তুলনায় অনেক কম ছিল। তাই না?

ইন্দ্রনীল নির্বিকার মুখে বলল–সো হোয়াট?

কথাটা সত্য কি না তা-ই বলুন।

 –সত্য। ব্যাঙ্ক ব্যবসায়ীদের ঋণ দেয়। এটা নতুন কথা নয়।

–কিন্তু বল্লরীর সঙ্গে আপনার এমোশনাল সম্পর্ক না থাকলে আপনি কোনোভাবেই অত টাকা ঋণ পেতেন না।

–ঠিক আছে। এমোশনাল সম্পর্ক ছিল।

–পরে সম্পর্কটা ভেঙে যায়। আর বল্লরী আপনার ঋণশোধের জন্য চাপ দিচ্ছিল। ঠিক বলছি?

–ঠিক! কিন্তু সেই জন্য তাকে আমি খুন করিনি।

–আমি বলছি না বল্লরীকে আপনি খুন করেছেন। কারণ বিষয়টা এখনও তদন্তসাপেক্ষ। আমি বলছি, এবার আপনি বল্লরীকে আপনার পঞ্চগড়ের হাভেলি বিক্রি করে ঋণের টাকা সুদসহ শোধ করার কথা বলে এখানে ডেকে এনেছিলেন। তাই না?

কর্নেল সরকার! আপনি নিশ্চয় জানেন, টাকা বল্লরীর নয়, ওভারসিজ এশিয়ান ব্যাঙ্কের। কাজেই তাকে টাকা দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তাকে অন্যবারের মত আমাদের সঙ্গে বেড়াতে আসতে বলেছিলুম। সে রাজি হয়েছিল।

–নাকি তাকে স্বচক্ষে দেখাতে চেয়েছিলেন যে সত্যি আপনি এখানকার বাড়ি বিক্রি করছেন, পাছে বল্লরী ব্যাঙ্কের পক্ষ থেকে আপনার ব্যবসার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি এবং আপনার বাড়ি ক্রোক করার জন্য কোর্টে না যায়?

ইন্দ্রনীল আবার বাঁকা হেসে বলল–ধরুন, তা-ই যদি হয়, তাতে আমার কি কোনো অপরাধ হয়েছে?

–কাল বিকেলে গড়ের জঙ্গল থেকে হাইওয়ের দিকে হেঁটে আসার সময় বল্লরী আর আপনি ঘনিষ্ঠভাবে, সঠিক ভাষায় বললে অশালীনভাবে হেঁটে আসছিলেন।

 –বল্লরী আফটার অল আমার বন্ধুও তো ছিল। ধরুন, তার সঙ্গে আবার আমার ভাব হয়েছিল!

–হুঁ। সৌরজ্যোতি সিংহ কি এর জন্যই বল্লরীর গলা থেকে সোনার চেন ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল?

ইন্দ্রনীল গম্ভীর মুখে বলল–আমি সন্দেহ করতাম বল্লরী এবার আমাকে ছেড়ে সৌরের সঙ্গে প্রেমের খেলায় মেতে উঠেছে। খুলেই বলছি। তার প্রতিক্রিয়া যাচাই করার জন্যই আমি বল্লরীর ঘনিষ্ঠ হয়েছিলুম। দেখলুম, আমার সন্দেহ অমূলক নয়। অবশ্য সে কৌতুকের ছলে সোনার চেনটা বল্লরীর গলা থেকে হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেছে। আমি তখন দ্বিতীয় চালটা চাললুম! বল্লরীকে কিস করলুম। বল্লরী বাধা দেওয়ার সুযোগ পায়নি। অমনই সৌর বল্লরীর হ্যান্ডব্যাগটা কেড়ে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল।

-দেখুন তো, ও.সি. মিঃ সিনহার সামনে যে ব্যাগটা আছে, ওটা বল্লরীর সেই ব্যাগটা কি না।

ইন্দ্রনীল চমকে উঠেছিল। আস্তে বলল–বল্লরীর ব্যাগ। ব্যাগ খুঁজতে আমরা সাপের মুখে পড়েছিলুম। সাংঘাতিক সাপ ওটা। আমি জানি গড়ের জঙ্গলের আশেপাশে অনেক বিষাক্ত সাপ থাকে। ওই সাপটা শঙ্খচুড়।

মিঃ সিনহা বললেন কর্নেল সায়েব বলেছিলেন, যে শঙ্খচুড়টা আমি গুলি করে মেরেছিলুম। তার একটা জুটি আছে। স্বভাবতই তার জুটি ক্ষিপ্ত অবস্থায় ছিল।

বললুম– ইন্দ্রনীলবাবু! পাতালকালীর মন্দির থেকে বেরিয়ে আপনারা বল্লরীকে দেখতে পাননি। আপনি তার সম্পর্কে তখন কী ভেবেছিলেন?

 ইন্দ্রনীল শান্তভাবে বলল–আমি জানতুম, বল্লরীর একা ব্যাগ খুঁজতে যাওয়ার সাহস হবে না। সে সৌরজ্যোতির ওপর খাপ্পা হয়ে আমাদের বাড়িতে চলে গেছে।

–আপনাদের বাড়িতে ফিরে আপনি নিশ্চয় কেয়ারটেকারকে বল্লরীর কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন।

–হ্যাঁ। ঝাব্বুলাল বলল, সে তাকে ফিরতে দেখেনি। তারপর আমরা দোতলায় বল্লরী আর সুদক্ষিণার ঘরে গেলুম।

–ওদের দরজায় তালা ছিল না?

–না। আমাদের ঘরের ভেতর দিয়ে ওদের ঘরে যাওয়া যায়। আমাদের ঘরের দরজায় তালা ছিল না। কারণ ঝাব্বুলাল থাকলে তালা দেওয়ার দরকার মনে করি না। তা ছাড়া বাড়িটা ভূতুড়ে বলে বদনাম আছে।

–টাকা-পয়সা?

–টাকা-পয়সা সবসময় আমাদের সঙ্গে থাকে। বাইরে গেলে প্রত্যেকে নিজের নিজের পার্স সঙ্গে নিয়ে যাই।

-বল্লরীর ব্যাগেজ?

–ব্যাগেজ টেবিলে অ্যাজ হট ইজ রাখা ছিল। বাথরুমেও সবকিছু ঠিকঠাক ছিল।

–আপনি কি জানেন বল্লরীর একটা লাইসেন্সড রিভলভার ছিল?

–ছিল তা জানতুম। তবে কোনোদিন তা দেখিনি বা দেখতে চাইনি।

–আপনি কি আপনাদের হাভেলি সত্যিই বিক্রি করার জন্য এসেছেন?

–হ্যাঁ। ডাক্তার শচীন অধিকারীকে আমরা সবাই মামা বলে ডাকি। মা তাকে দাদা বলে ডাকতেন। ডাক্তার অধিকারীকে আগে ফোনে জানিয়েছিলুম, এবার বাড়ির খদ্দের দেখে রাখেন যেন। যে-কোনো দামে বাড়িটা বেচতে চাই।

যে-কোনো দামে?

–ওটা কথার কথা। শচীন মামা জানতেন, বাড়িটার ন্যায্য দাম পনেরো লাখের কম নয়।

–ডাক্তারবাবু কি খদ্দের ঠিক করেই আপনাকে আসতে বলেছিলেন?

–হ্যাঁ। তাই শেষবারের জন্য বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে এসেছিলুম। এখানে কাল, সকালে পৌঁছুনোর পর শচীনমামার সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। উনি বলেছিলেন, মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী বাড়ি কিনতে রাজি হয়েছেন। কিন্তু তিনি জরুরি কাজে রাঁচি গেছেন। সন্ধ্যায় ফিরে আসার কথা। কিন্তু বল্লরীর জন্য আমরা কাল সন্ধ্যায় উদ্বিগ্ন হয়ে থানায় এসেছিলুম। তারপর তো–

ইন্দ্রনীল চুপ করল। বললুমঝাব্বুলাল কি আপনাদের বাড়িতে একা থাকে?

–না ওর বউ আর তিনটে ছেলেমেয়ে থাকে। আমরা পৌঁছুনোর আগের দিন ওর বউ ছেলে-মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে।

ঝাব্বুলাল কি মদ খায়?

–খায়। ও বিকেল থেকে রাত্রি পর্যন্ত মদ খেয়ে মাতাল অবস্থায় থাকে। ওকে নিয়ে সমস্যা আছে। ঠাকুরদা ওকে বাড়ির পাঁচ ডেসিমেল অংশ দান করে গেছেন। ওই অংশটা গেটের কাছে। মূল বাড়ি এবং বাকি অংশে ওর কোনো অধিকার নেই। অথচ মাতাল অবস্থায় ঝাব্বুলাল বলে, এ বাড়ির মালিক সে। ওটা নিছক মাতলামি। অন্য সময় সে খুব অমায়িক আর নম্র লোক। খুব বিশ্বাসী। এত বছর ধরে বাড়িটা সে এলাকার দুবৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা করে আসছে। অন্য কেউ হলে বাড়িটা বেদখল হয়ে যেত।

 লক্ষ্য করলুম, ইন্দ্রনীল ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে আসছে। বললুম–বল্লরীকে কে খুন করেছে বলে আপনার ধারণা?

ইন্দ্রনীল একটু চুপ করে থাকার পর শ্বাস ছেড়ে বলল–আমার ধারণা, বাঙালিটোলায় সে কোনো দুবৃত্তের কবলে পড়েছিল।

–আপনি বলতে চাইছেন, শি ওয়াজ রেপড অ্যান্ড মার্ডার্ড? 

–আমার তা-ই ধারণা। ও.সি. সায়েব বলতে পারেন মর্গের রিপোর্টে কী বলা হয়েছে।

ও.সি. মিঃ সিংহ বললেন–মর্গের ফাইনাল রিপোর্টে বল্লরীকে রেপ করার কথা বলা হয়নি। তাকে শ্বাসরোধ করে মারার পর ভারী আর মোটা ত্রিশূলের মত কোনো অস্ত্র তার বুকে বিদ্ধ করা হয়েছিল। আমি চমকে উঠিনি। কারণ আমার থিয়োরির সঙ্গে এটা মিলে গেছে। কিন্তু ইন্দ্রনীল প্রচণ্ড চমকে উঠেছিল। সে শ্বাসপ্রশ্বাসে মিশিয়ে উত্তেজিতভাবে বলল–তাকে কে শ্বাসরোধ করে মারবে? কেন মারবে?

বললুম–মর্গের রিপোর্ট অস্বীকার করার মত কোনো প্রমাণ কি আপনি দিতে পারে পারেন?

ইন্দ্রনীল একই ভঙ্গিতে বলল–বল্লরী গলায় ফাঁস এঁটে আত্মহত্যা করতে পারে!

-কেন?

গড়ের জঙ্গলের কাছে সৌরজ্যোতির আচরণ, আমার অবহেলা–তা ছাড়া প্রায় সাত লাখ টাকার ঋণ আমি শোধ করব কি না, না করলে তাকে চাকরি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে মামলায় ফাঁসাবে। এরকম অজস্র কারণ তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করতে পারে!

–পারে। কিন্তু তার মৃতদেহে ওই আঘাত করবে কে? কেন করবে?

ইন্দ্রনীল মুখ নামিয়ে বলল–আমি জানি না। বুঝি না।

–আপনাদের হাভেলিতে উপরে-নীচে কতগুলো ঘর আছে? আমার এই আকস্মিক প্রশ্নে ইন্দ্রনীল আবার চমকে উঠল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল—গুনে। দেখিনি। শুনেছি, পনেরোটা বা ষোলটা ঘর আছে। সবই তালাবন্ধ। কোন ঘরে কী আছে আমি জানি না।

–চাবি কার কাছে থাকে?

-সব চাবি কলকাতায় বাবার কাছে ছিল। আমি এখানে এলে শুধু আমাদের থাকার জন্য দু-তিনটে ঘরের চাবি নিয়ে আসি।

কাল সন্ধ্যায় বল্লরীকে আপনাদের ঘর ছাড়া আর কোথাও খোঁজেননি?

ইন্দ্রনীল তাকাল। একটু পরে বলল–না।

–গতরাত্রে আপনি ঘর থেকে একবার বেরিয়েছিলেন। কোথায় গিয়েছিলেন?

–কে বলল? সৌর?

–হ্যাঁ।

–বাথরুমে গিয়েছিলুম।

–হাভেলির কাছে কোনো মোটরগাড়ির শব্দ শুনেছিলেন?

ইন্দ্রনীল ফেটে পড়ল–বোগাস! এসব কোনো প্রশ্নই নয়। আমি আপনার কোনো প্রশ্নের উত্তর দেবো না। ওই বাস্টার্ড সৌর–ওকে আমি ছাড়ব না। ওকে আমি গুলি করে মারব। দা সেক্স-পার্ভাটেড ডগ!

ও.সি. মিঃ সিনহা টেবিলে বেটন ঢুকে ধমক দিলেন-স্টপ ইট! আনসার দ্য কোয়েশ্চন।

নো! আপনি যা খুশি করতে পারেন। আমি এই লোকটার কোনো প্রশ্নের উত্তর আর দেব না।

বললুম–দ্যাটস এনাফ মিঃ সিনহা! ওকে সোজা কাস্টডিতে নিয়ে যেতে বলুন। এবার জেনানা হাজত থেকে সুদক্ষিণাকে নিয়ে আসতে বলুন,

মিঃ সিনহার নির্দেশে এস. আই. শিউলাল প্রসাদ আর দুজন আর্মড কনস্টেবল ইন্দ্রনীলকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। ডঃ মিশ্র হাসবার চেষ্টা করে বললেন–গাড়ির কথায় ও এমন খেপে গেল কেন? অদ্ভুত তো!

বললুম–ঠিক বলেছেন ডঃ মিশ্র!

মিঃ সিনহা একটু হেসে বললেন–আমার মনে হয়, কর্নেল সায়েব ওর ক্ষতস্থানে খোঁচা মেরেছেন।

.

শিউলাল প্রসাদ সুদক্ষিণাকে নিয়ে এলেন এবং বেরিয়ে গেলেন। সুদক্ষিণার চেহারায় এখন নাগরিক স্মার্টনেস নেই। গ্রাম্য মেয়ের মত বিপর্যস্ত ভাব। সে আমাকে দেখেই ফুঁপিয়ে উঠলকর্নেল সরকার! আমাকে বাঁচান। আমি এদের সঙ্গে এসে এই সাংঘাতিক বিপদে পড়ব জানতুম না। আমার মানসম্ভ্রম বলতে আর কিছুই নেই। আপনি আমার বাবার মত!

ও.সি. সিনহা ধমক দিলেন– কান্নাকাটি নয়। ওই চেয়ারে বসুন।

বললুম–সুদক্ষিণা! তুমি কি বল্লরীকে খুন করেছ যে এমনভাবে ভেঙে পড়েছ? শান্ত হয়ে বসো। আমি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করব। যেন অবশ্য-অবশ্য সঠিক উত্তর দেবে। মিথ্যা উত্তর দিলে তোমাকে আমি বাঁচাতে পারব না।

আমি বল্লরীকে কেন খুন করব? আপনি যা জানতে চান, আমি বলব।

বলে সুদক্ষিণা রুমালে চোখ মুছল। তার পরনে জিনস এবং নীল হাতকাটা গেঞ্জি-মার্কিন মুলুকে এটাকে. টপ বলতে শুনেছি। কিন্তু টপের গলার কাছটা ছেঁড়া। তাই বুকের ঈষৎ অংশ দেখা যাচ্ছিল। মনে হল মেয়েটি এ বিষয়ে এখন অসচেতন।

বললুম–তোমার পোশাক ছিঁড়ল কী করে?

তখনই সে সচেতন হয়ে আব্রু রক্ষার চেষ্টা করে আস্তে বললযাদের সঙ্গে আমাকে রাখা হয়েছে, তারা আমাকে নেকেড করতে চাইছিল। সেন্ট্রি বাধা না দিলে

সে হঠাৎ চুপ করল। বললুম–তোমাকে বেশি প্রশ্ন করব না। আমার প্রথম প্রশ্ন, তুমি কি জানতে ইন্দ্রনীল তাদের বাড়ি বিক্রি করবে বলেই এখানে আসছে?

–বল্লরী বলেছিল। আমি ইন্দ্রনীলকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। সৌরজ্যোতি

–বলো!

সৌরজ্যোতি আমাকে বলেছিল, পঞ্চগড়ে গিয়ে বল্লরীর সঙ্গে ইন্দ্রনীলের মিটমাট করে দেবে। সে আমার সাহায্য চেয়েছিল।

–কীসের মিটমাট?

–ওদের মধ্যে ভুলবোঝাবুঝি চলছিল।

–তাতে সৌরজ্যোতির বা তোমার ইন্টারেস্ট কীসের?

–আফটার অল, আমরা পরস্পর বন্ধু।

–যদি বলি, বল্লরী সৌরজ্যোতির দিকে ঝুঁকেছিল এবং সৌরজ্যোতির সঙ্গে তোমার এমোশনাল সম্পর্ক ছিল এবং তুমি সৌরজ্যোতিকে ফিরে পেতে চেয়েছিলে?

সুদক্ষিণা মুখ নামিয়ে বলল–আমি মিথ্যা বলব না। সৌরজ্যোতি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে কল্পনাও করিনি। তাই ভেবেছিলুম, আমি সৌরজ্যোতিকে আর পাত্তা দেবো না এবং বল্লরীকে তার হাত থেকে ছাড়িয়ে ইন্দ্রনীলের সঙ্গে মিলিয়ে দেব।

-বল্লরী ওভারসিজ এশিয়ান ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার। ব্যাঙ্ক থেকে বল্লরী তাকে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছিল। বল্লরী এতে ঝুঁকি নিয়েছিল। কারণ। ইন্দ্রনীলের ব্যবসা সংস্থার কাগজপত্র ছিল ভুয়ো। তুমি কি একথা জানতে?

–জানতুম না। এখানে আসবার কয়েকজিন আগে বল্লরী একথা আমাকে বলেছিল।

কাল সন্ধ্যায় বল্লরীর খোঁজে তোমরা তিনজন ইন্দ্রনীলের হাভেলিতে ফিরে এসেছিলে। বল্লরীর খোঁজে কি তোমরা বাড়ির অন্য ঘরগুলো খুঁজেছিলে?

ঘরগুলো তালাবন্ধ ছিল। ইন্দ্রনীল বলেছিল আমাদের থাকার জন্য দু তিনটে ঘর বাদে সব ঘর তালাবন্ধ আছে। সে-সব ঘরের চাবি কলকাতায় সে ভুল করে ফেলে এসেছে। তাই আমরা বাড়ির চারপাশ, উপরে করিডর, বাথরুম-সবখানে বল্লরীকে খুঁজেছিলুম। তাকে দেখতে পাইনি।

–তুমি কি জানো বল্লরীর একটা লাইসেন্সড ফায়ার আর্মস ছিল? সুদক্ষিণা একটু পরে বলল-বল্লরী বলেছিল। আমি অস্ত্রটা দেখিনি।

তাকে জিজ্ঞেস করেছিলে কেন সে ফায়ার আর্মস কিনেছে?

-হ্যাঁ। বন্ধুরী বলেছিল, সে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। আত্মরক্ষার জন্য ব্যাঙ্ক থেকে তদ্বির করে তাকে অস্ত্রটার লাইসেন্স পাইয়ে দিয়েছে।

–একথা তুমি নিশ্চয় বিশ্বাস করোনি?

সুদক্ষিণা একটু ইতস্তত করে বললনা। মানে ব্যাঙ্কের ম্যানেজারদের আর্মস রাখার ব্যাপারটা আমি জানি না। দেশে তো কত ব্যাঙ্ক ডাকাতি হয়। কখনও শুনিনি ম্যানেজার তার ফায়ার আর্মস ব্যবহার করেছে। ওকে বলেছিলাম, যদি কারও ভয়ে আত্মরক্ষার জন্য ওটা কিনে থাকিস, কাজে লাগাতে পারবি না। আত্মরক্ষার জন্য কাকেও গুলি করার পর মামলার ঝামেলা আছে। বরং

–হুঁ। বলো!

বরং আমার মত যোগব্যায়াম, জুড়ো এইসব ট্রেনিং নিতে পারিস!

–তুমি জুডো যোগব্যায়াম এসবে ট্রেনিং নিয়েছ?

–হ্যাঁ। জুডো না জানলে মেয়েগুলো আমাকে সত্যি নেকেড করে ফেলত। অবশ্য সেন্ট্রি বেয়নেট উঁচিয়ে ধমক দিয়েছিল। কিন্তু সে তো ঘরের বাইরে ছিল।

হাসতে হাসতে বললুম–বাঃ! মিঃ সিনহা, খবর নিন, সুদক্ষিণা সেই খুনী মেয়েটিকে মেরে শুইয়ে রেখেছে কি না।

মিঃ সিনহাও হাসছিলেন–শুধু মেয়েদের হাজতঘরে নয়, পুরুষদের হাজতঘরেও মারামারি হয়। ও নিয়ে পুলিশ বিশেষ মাথা ঘামায় না, যদি না সাংঘাতিক কিছু ঘটে।

বললুম–সুদক্ষিণা! কাল রাত্রে তুমি তোমাদের ঘরে একা শুয়েছিলে! ভয় করছিল না?

–না। দরজা কাল রাত্রে ভেতর থেকে বন্ধ করে রেখেছিলুম।

রাত্রে হাভেলির কাছে মোটরগাড়ির শব্দ শুনতে পেয়েছিলে? সুদক্ষিণা স্পষ্টত চমকে উঠল। আস্তে বলল–রাত্রে তো ও পথে মোটরগাড়ি যাতায়াত করে। আমি বল্লরীর কথা ভাবছিলাম শুধু।

–ঠিক আছে। আমার শেষ প্রশ্ন, তুমি কি জান সেরাতে ট্রেনে আসবার সময় সৌরজ্যোতি চুপিচুপি আমার বার্থের ঠিক উপর বল্লরীর বার্থে উঠেছিল?

সুদক্ষিণা মুহূর্তে বদলে গেল। হিংস্র মুখে শ্বাস-প্রশ্বাস জড়িত কণ্ঠস্বরে বলল আমি ঘুমের ভান করে চোখ বুজে শুয়েছিলুম। ঘৃণায় দুঃখে রাগে আমি ভাবছিলুম, তখনই ওদের ধরে ফেলি। কিন্তু আপনার কথা ভেবে সিনক্রিয়েট করিনি। তারপর থেকে আমি নির্বিকার হয়ে উঠেছিলুম। তারপর থেকে যা-যা করেছিলুম, তা অভিনয় মাত্র।

–আমার প্রশ্ন শেষ মিঃ সিনহা, ওকে নিয়ে যেতে বলুন।….

.

সে রাত্রে ডঃ মিশ্রের বাংলোয় রোমিলা দেবীর কলেজ-লাইব্রেরি থেকে আনা জীর্ণ বইটা টেবিল ল্যাম্পের আলোয় পড়ার চেষ্টা করছিলুম। বাঙালি রাজপুত রাজা কন্দর্পনারায়ণ রায়ের পূর্বপুরুষের কীর্তিকথার সঙ্গে অদ্ভুত সব দৈব ঘটনা মেশানো আত্মগৌরবের বাঁচালতা! পাতা উল্টে যাচ্ছিলুম। প্রায় দেড়শো পাতার পর রায় রাজাদের অস্ত্রাগারের বর্ণনায় মন দিলুম। কয়েকটি পাতার পর অস্ত্রগুলোর রেখাচিত্র ব্লক করে ছাপানো আছে দেখে আগ্রহ জাগল। তারপর যা দেখলুম, তা আবিষ্কার বলা চলে। কাঠের দণ্ডের মাথায় বসানো ত্রিফলা ভল্ল। প্রতিটি অস্ত্র ব্যবহারের প্রক্রিয়া বর্ণনা করা হয়েছে। এই ত্রিফলা ভল্পটি অন্তত কুড়ি হাত দূর থেকে সবেগে নিক্ষেপ করলে একটি ফলা শত্রুর কণ্ঠমূলে অন্যদুটি বুকের দুপাশে আমূল বিঁধে যাবে। সেই উদ্দেশ্যে ভল্লটির একটি ফলার মাপ অন্যদুটি থেকে একটু পৃথক। একটি সমবাহু ত্রিভুজের শীর্ষকোণ যেন সেই বিশেষ ফলাটি। গোড়ার দিকটা প্রায় দেড়ফুট লম্বা এবং ওটার মধ্যে কাঠের দণ্ড ঢোকানো আছে।

পরবর্তী পাতায় তৎকালীন আগ্নেয়াস্ত্রের রেখাচিত্র। বন্দুক, পিস্তল, কামান। মোগল আমলে এইসব অস্ত্রও যুদ্ধে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এগুলো আমার বহুপঠিত মধ্যযুগের অস্ত্রশস্ত্রের বিবরণ। আমি সেই ত্রিফলা ভল্লটির দিকে তাকিয়ে রইলুম। যে-কোনো কাঠই কালক্রমে ভেঙে যেতে পারে। কিন্তু লোহায় মরচে ধরলেও ততকিছু ক্ষয় পাবে না। তা ছাড়া ফলার অংশে ইস্পাত ব্যবহারের নিদর্শন আমি অন্যত্র পড়েছি।

গত দুবছরে গড়ের জঙ্গলে চারটি লাশ পাওয়া গেছে। এবার একটি পাওয়া গেল। পাঁচটি লাশেরই কণ্ঠমূলে ও বুকের দুপাশে গভীর ক্ষত। ও.সি. গোপেশ্বর সিনহা বলেছিলেন, মর্গের ফাইনাল রিপোর্ট অনুসারে বল্লরীকে শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছিল। তারপর হা কন্দর্পনারায়ণ রায় বর্ণিত ত্রিফলা ভল্লের আঘাত করা হয়েছিল বল্লরীকে। এর একমাত্র উদ্দেশ্য, গড়ের জঙ্গলে বল্লরীর লাশকে আরও চারটে লাশের শামিল করা, যাতে পুলিশ বিভ্রান্ত হয়। যেন একজন খুনীই কোনও গুপ্ততন্ত্র বা অকাল্টের সাধনায় সিদ্ধিলাভ করার জন্য যাকে বাগে পায়, তাকে ভুলিয়ে গড়ের জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে এভাবে হত্যা করে। এ রাতে বাথরুমকে যথারীতি ডার্করুম করে ছবিগুলো ডেভালাপের পর প্রিন্ট করে দড়িতে ক্লিপ এঁটে ঝুলিয়ে রেখেছিলুম। ভোর পাঁচটায় নীচে পূর্বের উপত্যকায় কিছুদূর হেঁটে ফিরে এলুম সাড়ে আটটায়। আগে বাথরুমে ঢুকে দেখে নিলুম, ছবিগুলো শুকিয়েছে এবং প্রত্যেকটি ছবিই স্পষ্ট হয়েছে। গাড়ির টায়ারের কয়েক ইঞ্চি অংশও স্পষ্ট। ছবিগুলো কিটব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলুম।

ডঃ মিশ্র এসে সম্ভাষণ করলেন-মর্নিং কর্নেল সরকার! আজ মর্নিং ওয়াকে আপনার সঙ্গী হব প্ল্যান করেছিলুম। কিন্তু অভ্যাস! অ্যালার্ম দিয়ে রাখব ঘড়িতে, তার উপায় নেই। রোমিলার অত সকালে ওঠার অভ্যাস নেই। ঘুম ভেঙে গেলে তার আর ঘুম আসবে না। সারাটা দিন নাকি শরীর ভাল থাকবে না। তো আসুন। সামনের বারান্দায় কফি খাওয়া যাক। রোমিলা স্নান করে পুজোআচ্চা সেরে এখনই এসে যাবে।

অর্ধবৃত্তাকার বারান্দায় গিয়ে বললুম–ও.সি. মিঃ সিনহাকে ফোন করতে চাই।

করুন। আমি এখানে বসছি।

 ড্রয়িং রুমে ঢুকে টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করলুম। স্বাগতার সাড়া এল। রললুম–মর্নিং স্বাগতা! কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। আপনার সায়েব কি শয্যাত্যাগ করেছেন?

মর্নিং কর্নেল সরকার! ধরুন! ওকে দিচ্ছি।

একটু পরে গোপেশ্বর সিনহা বললেন–মর্নিং কর্নেল সায়েব! নতুন কোন খবর আছে কি?

বললুম–খবর আপনার কাছে জানতে চাই!

–কী খবর বলুন!

–গত দুবছরে গড়ের জঙ্গলে যে চারটে লাশ একই অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল, তাদের কেস হিস্ট্রি কি আপনি পড়েছেন?

-পাঁচনম্বর লাশ পাওয়ার পর খুঁটিয়ে পড়তে হয়েছে। আগের চারটে লাশকে আগে শ্বাসরোধ করে মারা হয়নি। সরাসরি ত্রিশূল বা ওইরকম অস্ত্র দিয়ে মারা হয়েছিল। চারজনই ব্যবসায়ী। তিনজন বাইরের এবং একজন স্থানীয়।

–মিঃ সিনহা! এখনই দায়িত্ববান একজন পুলিশ অফিসারকে ফোর্সসহ বাঙালি-হাভেলি-তে কেয়ারটেকারের ঘর সার্চ করতে পাঠান।

ঝাব্বুলালের ঘর? কেন?

–ওর ঘরে মার্ডার উইপন হয়তো পাবেন না। কিন্তু তার স্বনামে বা বেনামে কিংবা তার স্ত্রীর নামে স্থানীয় ব্যাঙ্কের পাস বই আর কিছু কাগজপত্র নিশ্চয় পাবেন।

–আপনি সিওর হলেন কী করে?

–এটা আমার অঙ্ক। কিন্তু একটা শর্ত আছে। যদি ঝাব্বুলালের ঘরে ওগুলো না পান, ডাক্তার শচীন অধিকারীর বাড়িতে পাবেন। পুলিশ এমনভাবে কাজ করে, যেন ডাঃ অধিকারী জানতে না পারেন। আমার ধারণা, তিনি এখন তার বাড়িতে রোগী দেখতে ব্যস্ত।

–ওকে কর্নেল সায়েব! কিন্তু দুজনের ঘরেই যদি ওসব না পাওয়া যায়?

–পঞ্চগড়ে কতগুলো ব্যাঙ্ক আছে?

–মাত্র দুটো।

–তা হলে দশটায় ব্যাঙ্ক খুললে ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। মনে রাখবেন, ঝাঝুলালের বা তার স্ত্রীর নামে অ্যাকাউন্ট থাকবে। বেনামে থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ককর্মীকে চার্জ করবেন বেরিয়ে পড়বে।

কৌতূহলী ডঃ মিশ্র এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি আমাকে চাপাস্বরে বললেন ঝাব্বুলাল ডাকনাম। ওর আসল নাম ধরমচাঁদ ধানুকী। মিঃ সিনহা বুললেন ঝাব্বুলাল এবং ডাক্তার অধিকারীকে আমরা ইচ্ছে করলে অ্যারেস্ট করতে পারি।

ঝাব্বুলালকে অ্যারেস্ট করবেন। ডাঃ অধিকারীকে এখন অ্যারেস্ট করা ঠিক হবে না। আর শুনুন! ডঃ মিশ্র বললেন, ঝাঝুলালের আসল নাম ধরমচাঁদ ধানুকী!

মিঃ সিনহার হাসির শব্দ ভেসে এলো।– ধানুকী? ওর পূর্বপুরুষ কি রায়রাজাদের তিরন্দাজ বাহিনীর লোক ছিল?

–সম্ভবত। মিঃ সিনহা! এখনই এই অপারেশন শুরু করা উচিত।

–ওকে! ওকে!

 রিসিভার নামিয়ে রেখে বাইরে এলুম। ততক্ষণে টেবিলে মালতী কফি ও স্ন্যাকসের ট্রে রেখে গেছে। রোমিলা দেবী চুপচাপ বসেছিলেন। আমাদের দেখে তিনি মৃদু হেসে বললেন–কারও সঙ্গে দুজনে চক্রান্ত করেছিলেন কেন?

বললুম–আপনাকে ধন্যবাদ। একটা মূল্যবান বই আমার জন্য সংগ্রহ করে এনেছেন।

–কিছু কাজে লাগল?

–হ্যাঁ। মার্ডার উইপনের খোঁজ পেলুম।

স্বামী-স্ত্রী দুজনেই অবাক হয়ে বললেন–আশ্চর্য!

–একটু আশ্চর্য বলতেই হবে। রায়রাজাদের অস্ত্রাগারের একটা ত্রিফলা ভল্ল ওই হাভেলিতে এখনও আছে। হয়তো আরও কিছু অস্ত্রও থাকতে পারে। তবে ওই ভল্লটা আছে, যা দিয়ে মোট পাঁচজনকে আঘাত করা হল এ পর্যন্ত।

.

ডঃ মিশ্রের গাড়িতে বাঙালিটোলায় বাঙালি হাভেলির সামনে পৌঁছে দেখলুম, ঝাব্বুলালের কোমরে দড়ি বেঁধে একজন তাগড়াই চেহারার কনস্টেবল দাঁড়িয়ে আছে। এস. আই. রহমত খান আমাকে দেখে কপালে হাত ঠেকিয়ে আদাব জানিয়ে বললেনঝঝুলাল দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করছিল। ওর হাঁটুর নীচে লাঠি ছুঁড়ে ওকে মাটিতে ফেলে দিয়েছিল ছোটেলাল সিং।

জিজ্ঞেস করলুম–ওর ঘর সার্চ করেছেন?

–জি কর্নেল সায়েব! ধরমচাঁদ ধানুকীর নামে দুটো ব্যাঙ্কে চল্লিশ আর তিরিশ মোট সত্তর হাজার টাকা ফিক্সড ডিপোজিট আছে। ও.সি. সায়েবকে বেতারে মেসেজ দিয়েছি। উনি এখনই এসে পড়বেন।

কনস্টেবলরা ওকে পাহারা দিক। চলুন, হাভেলির দোতলায় গিয়ে ইন্দ্রনীল রায় আর তার বন্ধুদের থাকার ঘরটা দেখি।

–এই ঝাব্বু! সদর দরজার চাবি দে!

ঝাব্বু বলল–চাবি ছোট রায়সায়েবের কাছে আছে।

বললুম–তাহলে সেই চাবি থানার মালঘরে জমা পড়েছে। হাতে সময় নেই। দরজা ভাঙতে হবে। শুধু দরকার একটা মোটা হাতুড়ি। আমার কিটব্যাগের হাতুড়ি সম্ভবত কাজে লাগবে না।

রহমত খান একজন কনস্টেবলকে বললেন–তুমি ঝাব্বুলালের রান্নাঘর থেকে কয়লা ভাঙা হাতুড়িটা নিয়ে এসো। হাতুড়িটা মোটা।

কিছুক্ষণ পরে সদর দরজা ভেঙে হলঘরে এবং সেখান থেকে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলুম। চওড়া বারান্দা। বড় বড় করিন্থিয়ান স্তম্ভ। দক্ষিণ দিকে এগিয়ে দেখলুম। থামে বাঁধা দড়িতে কয়েকটা কাপড় শুকোতে দেওয়া আছে। অতএব সামনের ঘরের দরজার তালা ভাঙা হল। ভেতরে ঢুকে দুধারে দুটো ক্যাম্পখাটে বিছানা পাতা দেখতে পেলুম। ভেতরের দরজাটা ঠেলতেই খুলে গেল। ও ঘরেও দুটো ক্যাম্পখাট। দুটো ঘর খুঁটিয়ে দেখার পর বেরিয়ে এসে বাঁদিকে তাকালেই চোখে পড়ল একটা করিডর এবং তার শেষপ্রান্তে উপরে ওঠার সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে উঠে বিশাল খোলামেলা ছাদে দাঁড়ালাম। তারপর পূর্বের কার্নিশের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা ড্রেন পাইপের কাছে থমকে দাঁড়াতে হল। ড্রেন পাইপের মুখে কালচে লাল কিছু ছোপ। আতস কাচ দিয়ে পরীক্ষা করে বুঝলুম, রক্তই বটে। তার মানে, এখানে মৃত বল্লরীর বুকে গলায় ত্রিফলা ভল্ল বেঁধানো হয়েছিল। জল ঢেলে ধোয়া হয়েছে। কিন্তু কেউ ভাবতে পারেনি এখানে কেউ রক্তের দাগ খুঁজতে আসবে। কার্নিশ থেকে নীচের দিকে তাকালাম। বাউন্ডারি ওয়াল পর্যন্ত ঝোপজঙ্গল ও গাছপালা গজিয়ে আছে।

একটু পরে আবছা কী একটা জিনিস, যা প্রকৃতির অন্তর্ভুক্ত নয় বলেই আমার চোখে পড়ল। সেটা কী তা স্পষ্ট করে দেখার জন্য বাইনোকুলারে চোখ রাখলুম। একপাটি জুতো। আরও একটু তফাতে ঝোপের ভিতর দ্বিতীয় পাটি জুতো আটকে আছে। বললুম–খানসায়েব! ভিকটিমের দুপাটি জুতো নীচে ফেলে দেওয়া হয়েছে। একজন কনস্টেবলকে বলুন, ও দুটো কুড়িয়ে গেটের কাছে নিয়ে যাক।

এবার আমি সেই ড্রেন পাইপের পশ্চিমে লাইম কংক্রিটের ছাদের দিকে গুঁড়ি মেরে খুঁজতে থাকলুম–কী খুঁজছি আমি জানতুম না, হয়তো ইনটুইশন আমাকে নিয়ে একটা কাজ করাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পরেই একটুখানি নীলাভ কাপড়ের ফালি চোখে পড়ল। আতস কাচ দিয়ে দেখার পর ওটা কুড়িয়ে নিলুম। একহাত দূরে পেয়ে গেলুম প্রায় দু ইঞ্চি চওড়া আর ইঞ্চি তিনেক লম্বা একটা নীলচে সিন্থেটিক পুরু কাপড়ের ফালি।

কুড়িয়ে নেওয়ার আগে দুটোরই ছবি তুলে নিলুম। ক্যামেরায় ফিল্মের একটা নতুন রোল লোড করেছিলুম আজ ভোরে। বললুম–খান সায়েব। আমাদের কাজ শেষ। চলুন, নীচে যাই।

গেটের কাছে তখনই জিপ থেকে নামছিলেন ও.সি. গোপেশ্বর সিনহা। তিনি কাছে এসে বললেন–আপনাকে অভিনন্দন জানিয়ে কী হবে! কর্নেল সায়েব, স্বাগতা আপনার সম্পর্কে যা বলেছিল, আশ্চর্যভাবে তা মিলে যাচ্ছে। আমরা এই দিকটা নিয়ে মাথা ঘামাইনি! বুঝতে পারছি, ঝাব্বুলাল এই হাভেলি বিক্রির লোভ দেখিয়ে খদ্দেরকে অগ্রিম টাকা আনতে বলেছে এবং তাকে রায়রাজাদের যজ্ঞবেদিতে কোনো অজুহাতে নিয়ে গিয়ে খুন করেছে। কিন্তু মার্ডার উইপন? বললুম–মার্ডার উইপন একটা ত্রিফলা ভল্ল। যুদ্ধাস্ত্র। আমার ধারণা, ঝাব্বুলাল সেটা এমন কোথাও রেখেছে, যেখানে রাখার কথা কেউ কল্পনাও করবে না।

মিঃ সিনহা রুষ্ট মুখে ঝাবুলালের দিকে বেটন উঁচিয়ে বললেন–এই উল্লুক! কোথা রেখেছিস ওটা!

বললুম–ওকে থানায় পাঠিয়ে দিন। আপনি ফোর্স নিয়ে আমাদের সঙ্গে চলুন।

 কোথায়?

–ডাঃ অধিকারীর বাড়ি।

ডঃ মিশ্র বললেন–গাড়ি এখানেই থাক। ডাঃ অধিকারীর বাড়ি দুটো বাড়ির পরে।

ডাঃ শচীন অধিকারীর বাড়ির সামনের চত্বরে রোগীর ভিড় দেখলুম। আমাদের দেখে তিনি ব্যস্তভাবে বেরিয়ে এসে নমস্কার করলেন।–আসুন! আসুন! আমার ভাগ্নে-ভাগ্নিদের এই বিপদে আমার পক্ষে যতটা সম্ভব, ততটা সাহায্য করব।

বললুম–আপনার গাড়িটা একবার দেখতে চাই ডাঃ অধিকারী! ডাঃ অধিকারীর মুখ শুকিয়ে গেল। তোলামি করে বললেন–গা-গাড়ি কেন? তা-তা ঠিক আছে। দেখবেন বৈকি।

গেটে ঢুকে বাঁদিকে গ্যারাজ ঘর। ঘরটায় তালা দেওয়া নেই। সম্ভবত একটু পরেই রোগী দেখতে যেতেন, কিংবা রোগী দেখার ছলে গাড়িটা কোনো মেকানিকের গ্যারাজে রেখে আসবেন।

গ্যারাজ খুলে ডাঃ অধিকারী বললেন–দে-দেখুন। কী-কী-কী….

বললুম–গাড়িটা বের করুন।

যা ভেবেছিলুম! তার প্যান্টের পকেটেই গাড়ির চাবি ছিল। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে লনে আনলেন। আমি টায়ারের কিছু অংশের রঙিন ছবি দুটো বের করে পিছনের চাকার সঙ্গে মিলিয়ে নিলুম। বললুম–মিঃ সিনহা! আপনি মিলিয়ে দেখুন! এই গাড়ির ডিকিতে বল্লরীর লাশ সস্তা ধরনের তেরপলে মুড়ে শক্ত করে বেঁধে ডাঃ অধিকারী নিয়ে গিয়েছিলেন স্টেশন রোডে। ঢালু ঘাসে ঢাকা জমিতে গাড়ি ব্যাক করে ডিকি থেকে লাশটা নদীর বালিতে ফেলে দেয় ওঁর সঙ্গী ঝাব্বুলাল। জায়গাটা দেখিয়ে দেবো যথাসময়ে। ডাঃ অধিকারী! আপনি গাড়ির ডিকি খুলুন।

আড়ষ্টভাবে ডাঃ অধিকারী ডিকি খুললেন। সেই ত্রিফলা ভল্লটা দেখা গেল। মিঃ সিনহা গম্ভীরমুখে বললেন–মার্ডার উইপন!

ডাঃ শচীন অধিকারী ভাঙা গলায় বললেন–আমি বল্লরীকে খুন করিনি! ইন্দ্র ইন্দ্রনীল–বিশ্বাস করুন, ইন্দ্রনীলের অনুরোধে গাড়িটা–গা-গা-গাড়িটাতে–

মিঃ সিনহা তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন–ইউ আর অ্যারেস্টেড।

আমরা গাড়িটাও আটক করে নিয়ে যাচ্ছি।

ডঃ মিশ্র আমাকে চাপা স্বরে বললেন–বড় রহস্যজনক ঘটনা। কিছুই তো বুঝতে পারছি না।

বললুম–কিছুক্ষণ পর সব বুঝতে পারবেন। চলুন। থানায় যাওয়া যাক।…

.

থানার দোতলায় একটা বড় ঘরে যেন একটা কনফারেন্স আয়োজন করেছিলেন ও. সি. গোপেশ্বর সিনহা। সি. আই. বদ্রীনাথ রাও উপস্থিত ছিলেন। সশস্ত্র পুলিশের কড়া পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমাদের সামনে একটু তফাতে চেয়ারে বসেছিলেন ডাঃ শচীন অধিকারী। তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল ঝাব্বুলাল। তারপর হাজত থেকে ইন্দ্রনীল, সৌরজ্যোতি ও সুদক্ষিণাকে নিয়ে এসেছিলেন দুজন পুলিশ অফিসার এবং সশস্ত্র কনস্টেবল। তাদের মুখে যুগপৎ চমক আর আতঙ্কের ছাপ লক্ষ্য করেছিলুম। ডাঃ অধিকারী আর ঝাব্বুলালকে দেখেই তাদের এই প্রতিক্রিয়া। এ ছাড়া আমার সামনে টেবিলের উপর রাখা ছিল দণ্ডবিহীন সেই ত্রিফলা ভারী ভল্ল।

সি. আই. বদ্রীনাথ রাও তাড়া দিলেন কর্নেল সরকার! আপনি এবার রহস্যের পর্দা তুলুন।

বললুম–আপনারা এই যে ত্রিফলা অস্ত্রটি দেখতে পাচ্ছেন, সেটি রায়রাজার পূর্বপুরুষের একটি যুদ্ধাস্ত্র। একটি শক্ত কাঠের দণ্ড এই গোড়ার দিকে গর্তে আটকানো থাকত। কাঠের দণ্ডটি কবে ভেঙেচুরে গেছে। কিন্তু ভল্লটি ঠিকই আছে। ঝাব্বুলাল এটি রায়রাজাদের হাভেলির কোনো ঘর থেকে চুরি করে নিজের ঘরে রেখেছিল। যাই হোক, গত দুবছরে গড়ের জঙ্গলে এই ভল্পের আঘাতে যে-চার জন খুন হয়, তারা প্রত্যেকেই ব্যবসায়ী। আপনারা জানেন, বাঙালিটোলায় অনেক বাড়ি পরিত্যক্ত এবং কেয়ারটেকাররা সেইসব বাড়ি দখল করেছে। অনেকে সেইসব বাড়ি বিক্রি করেছে। অনেকে এখনও খদ্দের খুঁজছে। ঝাঝুলালের প্রলোভনে পড়ে চারজন ব্যবসায়ী অগ্রিম টাকা নিয়ে আসে এবং ধূর্ত ঝাব্বুলাল ধর্মীয় আচার পালনের ছলে গড়ের জঙ্গলে রায়রাজাদের পবিত্র যজ্ঞবেদিতে তাদের নিয়ে যায়। তারপর এই ভন্ন দিয়ে তাদের খুন করে। ঝাবুলালের আসল। নাম ধরমচাঁদ ধানুকী। তার ঘরে স্থানীয় ব্যাঙ্কের দুটি পাস বই আর কাগজপত্র পুলিশ খুঁজে পেয়েছে। দেখা যাচ্ছে, মোট সত্তর হাজার টাকা সে ফিক্সড ডিপোজিট রেখেছে।

ইন্দ্রনীল উঠে ঝাব্বুলালকে ঘুষি মারার জন্য হাত তুলতেই একজন পুলিশ অফিসার তাকে ঠেলে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। ইন্দ্রনীল ঝাব্বুলালকৈ গালাগালি করছিল। তাকে ধমক দিয়ে চুপ করালেন সেই পুলিশ অফিসার।

 ঝাব্বুলাল গলার ভিতরে বলল–আমি নেমকহারাম, না ছোটবাবুজি তুমি নেমকহারাম। তোমাদের বাঁচাতে গিয়েই আমার এই অবস্থা। দ্রুত বললুম– ঝাব্বুলাল ঠিক বলছে। তার ছোটবাবুদের বাঁচানোর জন্য মৃত বল্লরীর গলায় ও বুকের দুপাশে ভল্ল বিঁধিয়ে একটা তেরপলে লাশটা মুড়ে ফেলেছিল সে। কিন্তু অত রাত্রে লাশ বয়ে নিয়ে অতদূরে গড়ের জঙ্গলে যেতে চায়নি সে। ইন্দ্রনীলরাও পালা করে লাশ বয়ে নিয়ে যেতে রাজি হয়নি। স্টেশন রোডে রাত্রেও যানবাহন চলে। কাজেই পরামর্শ নিতে ডাঃ অধিকারীর শরণাপন্ন হয় ওরা।

ডাঃ অধিকারী ভাঙা গলায় বললেন–আমি কী করব? ইন্দ্রনীলের বাবার অনেক নুন খেয়েছি। তিনি ছিলেন আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। আমাকে ঝাব্বুলাল ডেকে নিয়ে গেল। গিয়ে শুনলুম, কে বল্লরীকে আগেই হাভেলির ছাদে গলা টিপে মেরে ফেলে রেখেছিল। ইন্দ্রনীলদের বাঁচানো কর্তব্য মনে করেছিলুম। তাই গাড়িটা এনে ডিকিতে লাশটা ভরে সবাই মিলে চলে গেলুম স্টেশন রোডে। একটা ফাঁকা ঢালু জায়গায় গাড়ি পিছু হটিয়ে নদীর বালির চড়ায় থামিয়ে রাখলুম। ঝাব্বুলাল। ডিকিতে ওই ভল্ল রেখে দিয়েছিল জানতুম না। সুদক্ষিণা গাড়িতে বসে রইল। ঝাব্বুলাল, ইন্দ্রনীল আর সৌরজ্যোতি লাশ ফেলতে গেল যজ্ঞবেদির কাছে।

বললুম–ধুরন্ধর ঝাব্বুলাল খন্তা নিয়ে গিয়েছিল। তেরলপটা পুঁতে রেখে এসেছিল। পরে তার খেয়াল হয়, গর্তটা কোনো আদিবাসীর চোখে পড়বে। সে খুঁড়ে তেরপলটা বের করে রক্তের দাগ দেখে হইচই বাধাবে। তাই ঝাব্বুলাল সকালে আবার খুঁড়ে ওটা আনতে গিয়েছিল। আমার আর ভারুয়ার সাড়া পেয়ে সে পালিয়ে যায়।

সি. আই. বদ্রীনাথ রাও বললেন–আপনি বললেন হাভেলির ছাদে বল্লরীকে কেউ গলা টিপে খুন করে ফেলে রেখেছিল।

বললুম–হ্যাঁ কাল বিকেলে পাতালকালীর মন্দির থেকে বেরিয়ে ইন্দ্রনীল, সৌরজ্যোতি আর সুদক্ষিণা তিনজনে বল্লরীকে দেখতে না পেয়ে হাভেলিতে ফিরে যায়। তখন প্রায় সন্ধ্যা। তারা তিনজন বাড়ির চারপাশে খোঁজাখুঁজি করে। ঝাব্বুলাল বল্লরীকে ফিরতে দেখেনি। কারণ তখন সে তার ঘরে বসে মদ খাচ্ছিল। ওদিকে বল্লরী সাপের ভয়ে তো বটেই, তার হ্যান্ডব্যাগ খোঁজার চেষ্টা করে হাভেলিতে ফিরে আসে। সে ছাদে উঠে গিয়েছিল। তার মাথার ঠিক ছিল না। ইন্দ্রনীলদের ডাকাডাকিতে সে সাড়া দেয়নি। তারপর একজন তাকে ছাদে নিশ্চয় নীচে থেকে দেখতে পেয়েছিল। সে অন্য দুজনের অজ্ঞাতসারে চুপিচুপি ছাদে উঠে যায় এবং বল্লরীকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভান করে। কিন্তু তখনই তার মাথায় এসে যায়, এই তো একটা দারুণ সুযোগ। সে হঠাৎ বল্লরীর গলা দুহাতে টিপে ধরে হাঁটু দিয়ে বুকের নীচে আঘাত করে। বল্লরী মরিয়া হয়ে আততায়ীর বুকের কাছে পোশাক খামচে ধরেছিল। আততায়ী তার হাত থেকে পোশাক ছাড়িয়ে নিলেও দুটো টুকরো পড়ে ছিল। আজ সকালে এস. আই. রহমত খান এবং আমার বন্ধু ডঃ মিশ্রের সামনে তা কুড়িয়ে রেখেছি। মিঃ সিনহা বললেন–তা হলে ইন্দ্রনীল, সৌরজ্যোতি আর সুদক্ষিণার মধ্যে একজন খুনী। কে খুনী?

বললুম–কাল সন্ধ্যায় সুদক্ষিণা বলছিল হাজতের বন্দিনীরা তাকে নেকেড করার চেষ্টা করছিল। তারাই তার নীল রঙের টপের খানিকটা ছিঁড়ে ফেলেছে। কিন্তু এই দেখুন সেই ছেঁড়া টুকরো। আমি হাভেলির ছাদে কুড়িয়ে পেয়েছি। সুদক্ষিণা জুডোতে এক্সপার্ট, তা-ও স্বীকার করেছে। এবার দেখুন, বল্লরীকে কে একা পেয়ে গলা টিপে মেরেছিল।

মিঃ সিনহা এক লাফে সামনে এগিয়ে গেলেন। বললেন–সুদক্ষিণা! বল্লরী দাশগুপ্তকে খুনের দায়ে তোমাকে অ্যারেস্ট করা হল।

সুদক্ষিণা প্রায় গর্জন করে উঠল–বেশ করেছি। বল্লরী ওয়াজ আ হোর! আমার চোখের সামনে ট্রেনের বার্থে সৌরকে সে সেক্সয়্যাল প্লেজার দিচ্ছিল। এবার আমি সৌরকেও খুন করতুম। আমার দুর্ভাগ্য, সেই সুযোগ পেলুম না।

একজন অফিসার সুদক্ষিণার দুহাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দিলেন। সে সৌরজ্যোতির মুখে থুথু ছেটাল। সৌরজ্যোতি রুমালে মুখ মুছে বিড়বিড় করে কী বলল, বোঝা গেল না।

সুদক্ষিণাকে সেই অফিসার মিঃ সিনহার নির্দেশে নিয়ে গেলেন। মিঃ সিনহা আমার কাছে এসে বললেন–আমি তো কল্পনাও করিনি সুদক্ষিণা বল্লরীকে মেরে ফেলেছে!

বললুম–সৌরজ্যোতি আর ইন্দ্রনীল ছাদে গিয়ে ব্যাপারটা নিশ্চয় দেখেছিল। ওরা বলুক।

ইন্দ্রনীল বলল–আমরা গিয়ে দেখি, সুদক্ষিণা বল্লরীর নিস্পন্দ শরীরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে সৌরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ঝাব্বুলাল আমাদের পেছনে ছিল। সে এসে সুদক্ষিণাকে সরিয়ে দিল। তারপর আমি আর সৌর পরস্পর কথা বলে ঠিক করলুম, যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন থানায় গিয়ে বল্লরীর নিখোঁজ হওয়ার কথা জানিয়ে আসি নাহলে কিন্তু এই খুনের ঘটনায় আমরাও জড়িয়ে পড়ব। তাই থানা থেকে ফিরে নিজেদের স্বার্থে একটা উপায় খুঁজছিলুম। ঝাব্বুলাল সেই উপায় বাতলে দিল। কর্নেলসায়েব! আপনি আমাদের সাহায্য করুন।

বললুম–আমি আইনজ্ঞ নই। আইন তার নিজের পথে চলবে।

ডঃ মিশ্র বললেন–চলে আসুন কর্নেল সায়েব! এবার পুলিশের কাজ পুলিশ করুক। রোমিলা আমাদের জন্য ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করে উদ্বিগ্ন হয়ে প্রতীক্ষা করছে। চলুন।…..