গোপন সংকেত

গোপন সংকেত

০১.

নিশিকান্ত লাহিড়ী আমার অনেক দিনের চেনা মানুষ। একসময় রাজনীতি করতেন। একবার বিধায়কও হয়েছিলেন। তারপর জানি না কী কারণে রাজনীতি ছেড়ে সমাজসেবী হয়ে উঠেছিলেন। ভবানীপুরে তার পৈতৃক বাড়িটি বিশাল। তার একটা অংশ তিনি প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা সমিতিকে দান করেছেন।

এদিন রবিবারের সকালে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে আমি ঢুকতেই তিনি বলে উঠলেন, কর্নেল সাহেব, আপনি সাংবাদিকদের সম্পর্কে যেন সাবধান থাকবেন। আপনি জানেন না সাংবাদিকের সঙ্গে থাকা মানেই বিষধর সাপের সঙ্গে থাকা।

এই আকস্মিক আক্রমণে আমি চমকে উঠেছিলাম। নিশিকান্তবাবুর মুখে অবশ্যই চাপা হাসি লক্ষ না করলে মুখ ফসকে বেফাঁস কথা বলেই ফেলতাম। কারণ আমি পেশাদার সাংবাদিক। স্মার্ট হবার চেষ্টা করে বললাম, আমরা সাংবাদিকরা কিন্তু যত্রতত্র দংশন করে বিষ ঢালি না।

কর্নেল তার প্রখ্যাত অট্টহাসি হেসে বললেন, সর্বনাশ! আমি তাহলে দেখছি সত্যি বিষাক্ত সাপ নিয়ে ঘর করছি। কিন্তু ব্যাপারটা কী বলুন তো মিঃ লাহিড়ী?

নিশিকান্তবাবু গম্ভীর হওয়ার ভান করে বললেন, কারণ আছে বলেই বলছি।

সুযোগ পেয়ে আমি বললাম, নিশিকান্তবাবু, অকস্মাৎ রাজনীতি থেকে পালিয়ে আসার কারণ তাহলে অনুমান করতে পারছি। সাংবাদিকদের অত্যাচারেই তাহলে আপনি রাজনীতি ছেড়েছিলেন?

নিশিকান্তবাবু বললেন, তা আর বলতে! কর্নেল সাহেব, আজও আমার কাছে ব্যাপারটা হেঁয়ালি থেকে গেছে। কেন যে জয়ন্তবাবুরা প্রতিদিন খবরের কাগজে আমার বিরুদ্ধে বিষ ঢালতে শুরু করেছিলেন জানি না।

বললাম, যতদূর মনে পড়ছে আমি কিন্তু সে-দলে ছিলাম না।

নিশিকান্তবাবু বললেন, কিন্তু একটা চক্রান্ত যে তার পেছনে ছিল সেটা আঁচ করা যায়।

কর্নেল বললেন, খুবই সম্ভব। তবে সেই চক্রান্তকারীকে কি আপনি চিনতে পারেননি?

নিশিকান্তবাবু জোরে শ্বাস ছেড়ে বললেন, থাক সেসব পুরনো কথা। আসলে, সৎ মানুষের পক্ষে এযুগের রাজনীতিতে ঠাই নেই। লোকেদের দুর্নীতি ফাঁস করে দিলে উল্টে তারা মিথ্যে কেলেঙ্কারি রটাবেই, এটাই নিয়ম।

এই সময় ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে কফি দিয়ে গেল। কর্নেল বললেন, কফি খান মিঃ লাহিড়ী। নার্ভ চাঙ্গা করুন।

নিশিকান্তবাবু কফি খেতে থাকলেন। ততক্ষণে তার চেহারার দিকে আমার দৃষ্টি গেল। শরীর আগের মতোই হৃষ্টপুষ্ট দেখালেও সম্ভবত বয়সের চাপে কেমন যেন আড়ষ্ট চেহারার সেই উজ্জ্বলতাও নেই। পরনের ধুতি-পাঞ্জাবিও তত নিভাজ নয়। আগে যখন তাঁকে দেখেছি, এমনকী প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার পরেও তিনি পোশাক-আশাকের ব্যাপারে বেশ পরিপাটি ছিলেন। পুরু গোঁফ সযত্নে রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। তবে চুল একেবারে পেকে সাদা হয়ে গেছে এখন।

কর্নেল সহাস্যে বললেন, জয়ন্ত তুমি কি মিঃ লাহিড়ীর মধ্যে কোনো পরিবর্তন খুঁজছ?

বললাম, আপনার দৃষ্টিকে ফাঁকি দেওয়া যায় না। তাছাড়া এই সাত সকালে আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই উনি কেন যেন বেজায় উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন।

নিশিকান্তবাবু হাসবার চেষ্টা করে বললেন, ওটা কিছু না। জয়ন্তবাবু যে বিষধর নন তা-ও জানি।

বললাম, তাহলে আমার সন্দেহ আপনার সমাজসেবার পিছনে আবার কিছু একটা ঘটেছে।

কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, বাঃ! জয়ন্তের পর্যবেক্ষণশক্তি আগের তুলনায় বেড়েছে।

নিশিকান্তবাবু কফিতে চুমুক দিয়ে আস্তে বললেন, আমাকে বজ্জাতটা কিছুতেই স্বস্তিতে থাকতে দেবে না।

বললাম, কেন? আবার কি খবরের কাগজে আপনাকে নিয়ে কিছু দুর্বাক্য লেখা শুরু হয়েছে? আমার তো চোখে পড়েনি।

কর্নেল বললেন, তুমি নিজে সাংবাদিক হয়ে কাগজ পড়ো না। পড়লে তোমাদের দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার প্রথম পাতার খবরটা তোমার চোখে পড়তো।

সেকী! বলে আমি হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিতে যাচ্ছিলাম। কর্নেল সেটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে চোখ কটমট করে বললেন, থাক, যা পড়নি, তা পড়ে সময় নষ্ট করো না।

 অবাক হয়ে বললাম, ব্যাপারটা একটু খুলে বলবেন?

কর্নেল বললেন, মিঃ লাহিড়ী, তাহলে জয়ন্তকে আপনিই বলুন কী ঘটেছে।

নিশিকান্তবাবু কফি শেষ করে রুমালে গোঁফ আর ঠোঁট মুছে গম্ভীর মুখে বললেন, আমার বাড়ির যে অংশে প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা সমিতি করেছিলাম সেই অংশের মালিক নাকি আমি নই। আমার চিরশত্রু ভবেশ কুণ্ডু দাবি করেছে। ওটা আমার কাকা শচীন লাহিড়ীর জায়গা। শচীনকাকা ঐ অংশটা স্কুল করার জন্য তার জীবদ্দশায় উইল করে গেছেন। সেই উইলে একটা ট্রাস্টি বোর্ডের কথা আছে। বোর্ডের চেয়ারম্যান নাকি জনৈক প্রতাপ অধিকারী। ভবেশ বিশ্বস্ত সূত্রে এই গোপন কথা জেনে এই উইলের খোঁজও পেয়েছে।

জিগ্যেস করলাম, উইল-টুইল তো থাকে অ্যাডভোকেটদের জিম্মায়। তাছাড়া যাদের সম্পত্তি দেওয়া হয়েছে তাদের কোর্টে প্রবেট করতে হয়। কিন্তু এতকাল তাহলে কেউ প্রবেট করেননি কেন?

কর্নেল বললেন, মিঃ লাহিড়ীর বিরোধী পক্ষের বক্তব্য অ্যাডভোকেট মিঃ লাহিড়ীর সঙ্গে চক্রান্ত করে উইলের কথা গোপন রেখেছিলেন। তারপর তিনি মারা যান। তার ছেলে নিখিলেশ তার বাবার কাগজপত্রের মধ্যে দৈবাৎ উইলটার খোঁজ পেয়ে গেছে।

নিশিকান্তবাবু বলে উঠলেন, মিথ্যে, একেবারে মিথ্যে কথা। আমার কাকার কোনো সন্তানাদি ছিল না। তাই আমাকেই তার অংশ দান করে যান। তার সত্যিকার উইল আমার কাছেই ছিল। গত সপ্তাহে ভবেশ কুণ্ডু সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ঐ আজগুবি কথা প্রচার করার পর আমি কাকার উইলের খোঁজ করলাম। আশ্চর্য ব্যাপার, সেই উইলটা তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোথাও পেলাম না। বাড়িতে আমার দূরসম্পর্কের এক বিধবা বোন রত্নময়ী আর কাজের লোক হরনাথ থাকে। দুজনেই বিশ্বাসী। তাদেরকে জিগ্যেস করলাম, তারা প্রায় কান্নাকাটি জুড়ে দিল। তারপর আজ আবার ভবেশ কুণ্ডুর বক্তব্য কাগজে দেখে কর্নেল সাহেবের কাছে ছুটে আসতে বাধ্য হয়েছি।

কর্নেল বললেন, মিঃ লাহিড়ী, আপনি তো বললেন আপনার কাকার তথাকথিত জাল উইলের সাক্ষীদের নাম জানতে পেরেছেন। তারা কি কেউ এখনো বেঁচে আছেন?

নিশিকান্তবাবু বাঁকা হেসে বললেন, নাহ, তারা সবাই কেওড়াতলার ঘাটে কবে চলে গেছে।

জিগ্যেস করলাম, আপনার কাকার আসল উইল কি রেজিস্টার্ড?

-না, তবে তার সাক্ষীদের মধ্যে শুধু একজনই বেঁচে আছে। তার নাম হিতেশ দাশগুপ্ত।

–ভবেশবাবুরা যে উইলের কথা বলছেন তা কি রেজিস্টার্ড?

–ভবেশ বলছে রেজিস্টার্ড। তাই আমি রেজেস্ট্রি অফিসে লোক লাগিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস সে উইলের কোনো কপির অস্তিত্বই নেই।

–অর্থাৎ আপনার মতে ঐ উইলটা জাল?

-হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। কিন্তু পাড়ায় গুজব শুনছি ভবেশ তার দলবল নিয়ে জোর করে আমার বাড়ির ঐ অংশটার দখল নেবে। মগের মুলুক পেয়েছে। ব্যাটাচ্ছেলে!

কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানছিলেন। বললেন, মিঃ লাহিড়ী, আপনাকে যা বলছিলাম আগে সেটাই করে ফেলুন। লোকাল থানায় গিয়ে ভবেশ কুণ্ডুর নামে একটা ডায়েরি করে রাখুন। আপনিও কম প্রভাবশালী নন। পুলিশ আপনার ডায়েরি নিতে বাধ্য হবে। আপনি আর সময় নষ্ট না করে এখনই থানায় চলে যান।

নিশিকান্তবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, যাচ্ছি, কিন্তু আপনিই আমার শেষ ভরসা কর্নেল সাহেব। আমার বাড়ি থেকে কী করে কাকার দানপত্রটা হারিয়ে গেল সেটা আগে আপনি তদন্ত করে দেখুন।

কর্নেল বললেন, তা অবশ্যই দেখব। কিন্তু আপনি পুলিশকে সে কথাটাও জানাতে ভুলবেন না।

পা বাড়াতে গিয়ে নিশিকান্তবাবু ঈষৎ দ্বিধার সঙ্গে বললেন, জানাব?

কর্নেল বললেন, অবশ্যই জানাবেন এবং শুধু এই কথাটি বলবেন কাগজে খবরটা পড়ার পর আপনি আজ সকালেই আপনার কাকাবাবুর দানপত্র অর্থাৎ উইলটার খোঁজ করেছিলেন। কিন্তু সেটা কোথাও খুঁজে পাননি।

-কিন্তু তাহলে তো পুলিশ এসে রত্নময়ী আর হরনাথকে জেরা করবে। পুলিশের যা মেজাজ, বলা যায় না খামোখা তাদের সন্দেহ করে অ্যারেস্টও করতে পারে।

যদি তাই করে, তাতে আপনি ভেঙে পড়বেন না। শুধু টেলিফোনে আমাকে জানিয়ে দেবেন। তবে আমার বিশ্বাস আপনি জোর দিয়ে তাদের সপক্ষে বললে পুলিশ তাদের গায়ে হাত দেবে না।

নিশিকান্ত লাহিড়ী কর্নেলের ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। তারপর আমি বললাম, শেষ পর্যন্ত আপনি এই উইলের লড়াই-এর কেসে নাক গলালেন?

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টিতে উইলের লড়াই হলেও এই কেসের আড়ালে একটা অন্য কিছু আছে।

-বলেন কী! কী করে তা বুঝলেন?

 কর্নেল হঠাৎ তার ইজিচেয়ার থেকে উঠে এসে সোফার যেখানে নিশিকান্তবাবু বসেছিলেন, তার তলায় হাত বাড়ালেন এবং কী একটা মুঠোয় তুলে এনে মিটিমিটি। হেসে বললেন, মিঃ লাহিড়ী এসে ওখানে বসার পরই পকেট থেকে এই জিনিসটা বের করে নাড়াচাড়া করছিলেন। তারপর তুমি যেই ঘরে ঢুকেছ, অমনি তোমাকে দেখে উত্তেজিত হয়ে ওঠার ফলে ওঁর হাত থেকে এটা নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়ল। আমার এই ড্রইংরুমের পুরোটাই কার্পেটে ঢাকা বলে জিনিসটা পড়ে গিয়েও কোনো শব্দ হয়নি। তারপর কথায় কথায় মিঃ লাহিড়ী এটার কথা ভুলে গেছেন। তবে এটা ঠিক, একসময় এটার কথা ওনার নিশ্চয়ই মনে পড়বে এবং এখানে আবার ছুটে আসবেন। তার আগে আমি এটার একটা ফোটো কপি করে রাখি।

এক মিনিট–বলে কর্নেল দ্রুত তার ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। আমি অবাক হয়ে বসে রইলাম। জিনিসটা কী হতে পারে ভেবেই পেলাম না।

সেই সময় ডোরবেল বাজল। তারপর ষষ্ঠীর সাড়া পেলাম। সে পর্দার ফাঁকে উঁকি মেরে বলল, দাদাবাবু, উনুনে কড়াই চাপিয়ে ফোড়ন দিচ্ছি। পুড়ে গেলেই কেলেঙ্কারি। অনুগ্রহ করে একবার দেখুন না দাদাবাবু, কে এল।

অগত্যা ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে ছোট্ট একটা ওয়েটিং রুম পেরিয়ে গিয়ে দরজা। খুললাম। অমনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার অর্থাৎ আমাদের প্রিয় হলদারমশাই প্রায় আমাকে পাশ কাটিয়ে ড্রইংরুমে ঢুকে পড়লেন। তারপর বললেন, খাইসে, কর্নেল স্যর গেলেন কই?

বলে সোফায় ধপাস করে বসে তিনি নস্যির কৌটো বের করলেন।

জিগ্যেস করলাম, হালদারমশাই, নিশ্চয় কোনো জব্বর কেস পেয়ে গেছেন?

প্রাইভেট ডিটেকটিভ একটিপ নস্যি নিয়ে নোংরা রুমালে নাক মুছে অদ্ভুত ভঙ্গিতে নিঃশব্দে হাসলেন। বললেন, তা পাইছি কইতে পারো। কিন্তু কর্নেল সাহেব গেলেন কোথা? সাড়ে নয়টা বাজে। এখন তো ওনার ছাদের বাগানে থাকার কথা নয়।

চাপাস্বরে বললাম, প্লিজ হালদারমশাই, আপনার কেসের একটু আভাস অন্তত দিন।

এই সময় কর্নেল বেরিয়ে আসছিলেন। মুখে কৌতুকের হাসি। বললেন, সাবধান হালদারমশাই, সাংবাদিকরা বিষধর সাপ। আর জয়ন্ত একজন সাংবাদিক।

গোয়েন্দাপ্রবর গুলি গুলি চোখে তাকিয়ে বললেন, হঠাৎ একথা কইলেন ক্যান কর্নেল স্যর?

আমি বললাম, ভবানীপুরের জনৈক নিশিকান্ত লাহিড়ী কিছুক্ষণ আগে কর্নেলকে বলে গেছেন সাংবাদিকরা বিষধর সাপ।

হালদারমশাই প্রায় নড়ে বসলেন, হ্যাঁ, কন কী? ভবানীপুরের নিশিকান্ত লাহিড়ী? কী কাণ্ড! আমি যে

তাকে থামিয়ে দিয়ে কর্নেল বললেন, আপনি মিঃ লাহিড়ী সংক্রান্ত কোনো কেস হাতে পেয়েছেন?

হালদারমশাই বললেন, তা হৈলে তো আপনি সবই জানেন।

কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে বললেন, না হালদারমশাই, আপনার কেসের খবর আমি জানি না। তবে হ্যাঁ, মিঃ লাহিড়ী তার বাড়ি থেকে একটা উইল চুরির কেস নিয়ে আমার কাছে এসেছিলেন বটে।

গোয়েন্দাপ্রবর উত্তেজিতভাবে বললেন, না, আমি ওনার কোনো কেস লইয়া আই নাই। তবে ওনার একটা অর্গানাইজেশন আছে, কী যেন নামডা–

আমি বলে দিলাম, প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা সমিতি।

–হঃ! সেই সমিতিতে একটা মাইয়া কাম করত। তারে উনি ডিসমিস করছেন। মাইয়াডার নাম নীলা রায়। কিন্তু কিছুদিন থেইক্যা কে বা কারা দুই প্রহর রাত্রে নীলার জানালার কাছে ফিসফিস কইর‍্যা একটা কথা কয়। কথাটা হৈল গিয়া হারানেরে ফেরত দে। টাকা পাইবি। প্রতি রাত্রে এই জ্বালাতন। নীলার বাবা নাই। মা আছে। কিন্তু তার অসুখ-বিসুখ। মাইয়াডা পুলিশের কাছে গিছিল। পাত্তা না পাইয়া নিউজ পেপারে আমার বিজ্ঞাপন দেইখ্যা কাইল আমার লগে যোগাযোগ। করসে। তো কাইল রাত্রে আমি ওগো বাড়ির কাছে ওৎ পাতছিলাম। আমারই ভুল। লোকটা যেই জানালার লগে গেছে, আমি ওরে তাড়া করছি। বস্তি এরিয়া। লোকটা পলাইয়া গেল। হেভি মিস্ত্রি! তাই না কর্নেল স্যর?

.

০২.

মার্চ মাসে সেই রবিবারের সকালে শুধু একটা নয়, পরপর দুটো রহস্য কর্নেলের জাদুঘরসদৃশ ড্রইংরুমে ঢুকে আবহাওয়াটা গম্ভীর করে তুলেছিল। লক্ষ করছিলাম কর্নেলের মুখটা কেমন যেন তুদো হয়ে উঠেছিল। ইতিমধ্যে ষষ্ঠীচরণ হালদারমশাই-এর জন্য স্পেশাল কফি দিয়ে গিয়েছিল। প্রাইভেট ডিটেকটিভ কফি খেতে খেতে একবার করে কর্নেলের দিকে তাকাচ্ছিলেন, আবার আমার দিকেও অর্থপূর্ণ দৃষ্টিনিক্ষেপ করছিলেন।

একটু পরে আবহাওয়া হালকা করার জন্য আমি বললাম, হেভি মিস্ত্রি নয় হালদারমশাই, এ একেবারে মিস্ট্রিতে মিস্ট্রিতে ধুন্ধুমার বাধিয়ে দিল। ঐ দেখুন আপনার কর্নেল স্যার যেন মিস্ত্রির ধাক্কায় ভূলুণ্ঠিত।

কর্নেল আমার রসিকতায় কান দিলেন না। দাড়ি থেকে চুরুটের ছাই ঝেড়ে ফেলে বললেন, হালদারমশাই, আপনার মক্কেল নীলা রায়কে আমি চিনি।

–চেনেন? বলে হালদারমশাই যেন চমকে উঠলেন।

–ক্যামনে চিনলেন? সে কি আপনার কাছেও আইছিল?

কর্নেল বললেন, না। তবে মিঃ লাহিড়ীর প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা সমিতির একজন মেম্বার আমি। কাজেই মাঝে মাঝেই আমাকে ওঁদের অফিসে যেতে হয়েছে। সেই সূত্রে নীলা মেয়েটিকে আমি চিনি।

আমি জিগ্যেস করলাম, মেয়েটির চাকরি কেন গিয়েছিল নিশ্চয়ই জানেন?

–জানি। নীলাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সেটা ঠিকমতো পালন করছিল না। তাছাড়া বহু গুরুত্বপূর্ণ চিঠি সে ফাইলে ফেলে রাখত। তাই এইসব সমিতিতে যে বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া যায়, সমিতি তা মিস করছিল। তবে আমি তাকে ছাড়িয়ে দিতে বলিনি। মিঃ গাঙ্গুলি নিজেই খাপ্পা হয়ে তাকে ডিসমিস করেছিলেন।

বললাম, কিন্তু তার ঘরের জানলার পাশে হারানেরে ফেরত দে বলে কে তাকে রাতবিরেতে উৎপাত করে, এর কারণ কি কিছু অনুমান করতে পারছেন?

কর্নেল মাথা নেড়ে বললেন, নাঃ।

হালদারমশাই বললেন, হারান কে বা কী–সেকথা আমি অনেকবার জিগ্যেস করছি, কিন্তু নীলা কয় সে এর কিছুই বুঝতে পারছে না।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, কর্নেল, এটা সেই লালুবাবুকে ফেরত দে-র মতো কেস নয় তো? লালুবাবু বলতে আসলে লাল রঙের পদ্মরাগ মণি। এই ঘটনাটা হালদারমশায়েরও নিশ্চয় মনে আছে?

এতক্ষণে হালদারমশাই ফিকফিক করে হেসে উঠলেন, জয়ন্তবাবু, সেই কেস লইয়া একখান বই লিখসেন না, কী যেন নাম তার?

বললাম, লালুবাবুর অন্তর্ধান রহস্য। এই কেসটা দেখছি হয়ে উঠবে হারানবাবুর অন্তর্ধান রহস্য।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, নাঃ, হাতে সময় কম। ঘটনাটা বড়োই গোলমেলে ঠেকছে। হালদারমশাই, আপনি এক কাজ করুন, আপনার মক্কেল নীলা রায় আমাকে চেনে। কিন্তু বুঝতে পারছি আমি ঐ সমিতির অন্যতম হর্তাকর্তা শুনে ভয়ে সে আমার কাছে আসতে পারছে না। আপনি বরং এখনি গিয়ে তাকে বলুন আজ সন্ধ্যায় ছটার সময় সে যেন আপনার সঙ্গে আমার কাছে আসে। সে হয়তো আসতে চাইবে না, কিন্তু আপনি তাকে যেভাবে তোক নিয়ে আসবেন। বলবেন আমি তার হিতাকাঙ্ক্ষী।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ উঠে দাঁড়ালেন এবং যথারীতি যাই গিয়া বলে সবেগে বেরিয়ে গেলেন।

তারপর সুযোগ পেয়ে আমি জিগ্যেস করলাম, নিশিকান্তবাবুর ফেলে যাওয়া জিনিসটার ফোটো তো তুলেছেন। এবার সেটা আমাকে দেখাতে কি আপত্তি আছে?

কর্নেল বুকপকেট থেকে কাগজে মোড়া সেই জিনিসটা আমার হাতে দিলেন। মোড়ক খুলে দেখি সেটা একটা চৌকো ব্রোঞ্জের সিল। ইঞ্চি দুই লম্বা ও ইঞ্চি দুই চওড়া। সিলে খুদে হরফে অজানা ভাষায় কী সব লেখা আছে। মধ্যেখানে স্বস্তিকা চিহ্ন। সিলটার উল্টোপিঠে আঁকাবাঁকা কয়েকটা রেখা এবং তার উপরে একটা চন্দ্রকলা। তলার দিকে একটা ত্রিভুজ।

দেখার পর অবাক হয়ে বললাম, কী আশ্চর্য! এ তো মনে হচ্ছে প্রাচীন যুগের কোনো ঐতিহাসিক সিল। তা এমন একটা অমূল্য জিনিস নিশিকান্তবাবুর হাত থেকে নীচে পড়ে গেল আর তিনি টেরও পেলেন না? তার চেয়ে বড়ো প্রশ্ন, কেনই বা তিনি এটা হাতে নিয়ে বসেছিলেন?

কর্নেল সিলটা নিয়ে আগের মতো কাগজে মুড়ে পকেটস্থ করলেন। তারপর বললেন, মিঃ লাহিড়ীকে আমি তোমার চেয়ে অনেক বেশিদিন ধরে চিনি ও জানি। মানুষটি খেয়ালি প্রকৃতির। তাছাড়া আমার ধারণা, রাজনীতি করতে গিয়ে প্রচণ্ড ধাক্কা খাওয়ার পর ওঁর খানিকটা মানসিক গণ্ডগোলও ঘটেছে।

এই সময় টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল দ্রুত রিসিভারটা তুলে সাড়া দিলেন, হা মিঃ লাহিড়ী, আপনি আমার ঘরে যা ফেলে গেছেন তা আমি পেয়েছি। আপনি কি ওটা আমাকে দেখাতে এনেছিলেন … হ্যাঁ, বুঝেছি। আমি এখনই ওটা নিয়ে আপনাকে ফেরত দিতে যাচ্ছি। চিন্তা করবেন না… সেকী! এটা আমিই রাখব? কিন্তু, সিলটা কীসের, এটা তো আমার জানা দরকার … ঠিক আছে, তাহলে ওটা আমার কাছেই থাকল। সময়মতো আপনি এলে আলোচনা করা যাবে … হ্যাঁ, আসবার আগে আমাকে রিং করে আসবেন।

কর্নেল রিসিভার রেখে আমার দিকে তাকালেন। বললাম, বুঝতে পারছি সিলটা উনি আপনার সেফ কাস্টডিতে রাখতেই এসেছিলেন। কিন্তু ব্যাপারটা কী দাঁড়াল বলুন তো? ছিল জাল উইল আর খাঁটি উইলের লড়াই। হয়ে গেল একটা ঐতিহাসিক সিল আর হারানেরে ফেরত দে রহস্য।

কর্নেল চোখ বুজে দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, তোমাকে বরাবর বলেছি জয়ন্ত, What appears is not real.

হাসতে হাসতে বললাম, অর্থাৎ অবভাস তত্ত্ব।

কর্নেল হঠাৎ চোখ খুলে টেবিলের ড্রয়ার থেকে আতসকাঁচটা বরে করলেন। তারপর পকেট থেকে সিলটা বের করে মোড়ক খুলে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন। প্রায় মিনিট পনেরো সিলটার দুই পিঠ দেখার পর তিনি আপনমনে বললেন, সিলটা সম্প্রতি লোশন দিয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে। অথচ এতে ব্রাহ্মীলিপিতে কী যেন লেখা আছে। তার মানে প্রাচীন বৌদ্ধযুগের সিল। কিন্তু এ সিল মিঃ লাহিড়ী পেলেন কোথায়?

কথাটা বলে তিনি তখনকার মতো সিলটা তার শোবার ঘরের কোনো সুরক্ষিত জায়গায় রাখতে গেলেন।

কিছুক্ষণ পরে তিনি যখন বেরিয়ে এলেন তখন দেখলাম পোশাক বদলে ফিটফাট হয়েছেন। মাথায় কানঢাকা টুপি, গলায় ঝোলানো বাইনোকুলার ও ক্যামেরা, কিন্তু সেই কিটব্যাগটা নেননি। তিনি এসেই বললেন, চলো জয়ন্ত, একবার ঘুরে আসা যাক।

জিগ্যেস করলাম, কোথায় যাবেন?

-চলো তো।

তিনতলা থেকে নীচে নেমে এসে কর্নেল আমার গাড়ির সামনের সিটের বাঁদিকে বসলেন। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বেরোতেই তিনি শুধু বললেন, শ্যামবাজারের দিকে চলল। তারপর আমি বলে দেব কোথায় আমাদের থামতে হবে।

এদিন রবিবার। ছুটির দিন। মার্চের মাঝামাঝি। অবশ্য গরমও পড়েছে। রাস্তায় তত ভিড় নেই। তাঁর নির্দেশমতো বাগবাজার স্ট্রিট হয়ে কিছুদূর চলার পর ডানদিকের একটা গলিতে ঢুকে কর্নেল আমাকে গাড়ি থামাতে বললেন।

গলির ভেতরে হলেও বাড়িটা যে বনেদি সেটা তার ক্ষয়াটে স্থাপত্য দেখেই বুঝতে পারছিলাম। গেট খুলে দিল দারোয়ান। গাড়ি অপরিসর লনে ঢুকিয়ে দেখি ভেতরটা জঙ্গল হয়ে আছে। সামনে গাড়িবারান্দার ছাদে একজন সৌম্যকান্তি বৃদ্ধ ভদ্রলোক এসে দাঁড়িয়েছিলেন।

কর্নেলের নির্দেশে গাড়ি সেখানেই রেখে আমরা নামলাম। তার আগে দেখি দারোয়ান কর্নেলকে স্যালুট ঠুকে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। এবার সে এগিয়ে এসে বলল, বাবুজী আমাকে বলেছিলেন কর্নিলসাব আসবেন।

কর্নেল বললেন, এলাম, তবে একঘন্টা লেট হল রামলাল।

গাড়িবারান্দার উপর থেকে ভদ্রলোক বললেন, দশটা থেকে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। এখন এগারোটা বাজছে। আর একটু দেরি করে এলে আমি বেরিয়ে যেতাম।

কর্নেল জিগ্যেস করলেন, কোথায়?

–এক্কেবারে কৈলাস।

কথাটা বলে তিনি হেসে উঠলেন। গাড়িবারান্দার সিঁড়ির মুখে একটা তাগড়াই চেহারার লোক করজোড়ে কর্নেলকে সম্ভাষণ করে বলল, কর্তামশায়ের হুকুমে আমি সেই একঘন্টা থেকে ঘরবার করছি।

কর্নেল বললেন, বাঘা, তোমার গিন্নি মায়ের খবর কী?

–আজ্ঞে তিনি তো বিছানা ছেড়ে নড়তে পারেন না। আপনি আসবেন জেনে গিন্নিমা-ও খুব খুশি।

সিঁড়ি বেয়ে আমরা দোতলায় গেলাম। সেই ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার বিশ্বাস, উনি আপনার সেই তরুণ সাংবাদিক বন্ধু জয়ন্ত চৌধুরী।

কর্নেল বললেন, জয়ন্ত, ইনি আমার অনেক দিনের বন্ধু প্রসন্নকুমার ভাদুড়ি। হাইকোর্টে খুব জাঁকের সঙ্গে প্র্যাকটিস করেছেন। তারপর নিজেই অবসর নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।

দোতলায় একটা সেকেলে আসবাবে সাজানো সুন্দর পরিচ্ছন্ন ঘরে আমরা বসলুম। মিঃ ভাদুড়ি বললেন, জয়ন্তবাবুর জানা দরকার ওকালতির পেশা ছেড়েছিলাম নেহাত বিবেকের দংশনে। সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য করা আমার আর সহ্য হচ্ছিল না। যাক, সে এক লং স্টোরি। পেশা ছেড়ে তো চুপচাপ বসে থাকা যায় না। একটা কিছু করতে হয়।

কর্নেল বললেন, মিঃ ভাদুড়ি আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা সমিতির সঙ্গে যুক্ত আছেন। তুমি লনে দাঁড়িয়ে যে ঝোঁপজঙ্গল দেখছিলে সেগুলো দামি ভেষজ গাছগাছড়া।

একটু মজা করে বললুম, আমার যতটুকু জানা আছে, ভাদুড়ি, লাহিড়ী এসব বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের পদবি।

মিঃ ভাদুড়ি হো হো করে হেসে উঠলেন।

–ঠিক ধরেছেন। যার বাড়িতে আমাদের সমিতির অফিস, সে আমার শ্যালক। অর্থাৎ নিশিকান্ত লাহিড়ীর বোনকে আমি বিয়ে করেছি। তবে তার চেয়েও বড়ো কথা, নিশিকান্তের জীবনের সঙ্গে আমার জীবনেরও মিল আছে। দুজনেই দুবৃত্তদের আখড়া থেকে সরে আসতে পেরেছি।

এই সময় সেই বাঘা নামের লোকটি ট্রেতে কফি আর স্ন্যাক্স রেখে গেল।

একটু পরে কফি খেতে খেতে মিঃ ভাদুড়ি চাপা স্বরে কর্নেলকে বললেন, আপনি আজ সকালে টেলিফোনে আমাকে আভাস না দিলেও আঁচ করেছিলাম আমাদের সমিতির উপর একটা আঘাত আসছে। কারণ কদিন আগে ভবেশ। কুণ্ডুকী স্পর্ধা দেখুন, আমাকে ফোন করে বলেছে আপনি তো আইনজ্ঞ মানুষ, নিশিকান্তবাবুর কাকা শচীন লাহিড়ীর উইল যে জাল উইল নয়, তা প্রমাণ করবার জন্যে আবার এ বয়সে হাইকোর্টে চলে আসুন। কথাটা শুনে তাকে আমি ধমক দিয়ে বলেছি, তুমি সাদাসিধে খেয়ালি মানুষ নিশিকান্তের অনেক সর্বনাশ করেছ। আবার নতুন করে এই সর্বনাশের চক্রান্ত! এবার আমি তোমার বিষদাঁত ভেঙে দেব। নির্লজ্জ, হারামজাদা হ্যাঃ হ্যাঃ করে হাসতে হাসতে ফোন ছেড়ে দিল।

কর্নেল বললেন, আমি আপনার কাছে আজ আসতে চেয়েছিলাম একটা বিশেষ কারণে।

মিঃ ভাদুড়ি বললেন, স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন।

কর্নেল বললেন, ভবানীপুরে আপনার শ্বশুরমশায়ের ঐ বাড়িটার ব্যাপারে আমার একটা প্রশ্ন আছে। আপনাকে টেলিফোন করার পর আকস্মিক যোগাযোগে মিঃ লাহিড়ী আমার কাছে এসেছিলেন।

মিঃ ভাদুড়ি উত্তেজিত হয়ে বললেন, নিশিকান্ত গিয়েছিল! তাহলে নিশ্চয় নতুন কিছু ঘটেছে।

-না, তেমন কিছু ঘটলে আপনাকেও তিনি ফোন করে জানাতেন।

মিঃ ভাদুড়ি আক্ষেপের সঙ্গে বললেন, নিশিকান্তকে নিয়ে ঐ একটা সমস্যা। আনমনা ও খেয়ালি। কথায় কথায় রেগে যায়। জয়ন্তবাবু জানেন তো বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের ক্রোধ নাকি আইনসিদ্ধ। অর্থাৎ আমরা নাকি খুবই রাগী মানুষ। যাই হোক, কর্নেল সাহেব এবার বলুন আপনার প্রশ্নটা কী?

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছাড়ার পর শান্তভাবে বললেন, আপনার খুড়শ্বশুর শচীন লাহিড়ীকে কি আপনি দেখেছিলেন?

মিঃ ভাদুড়ি একটু অবাক হয়ে বললেন, বিয়ের পর মাত্র একবার দেখেছিলাম। আমাকে আশীর্বাদ করে সেদিনই চলে গিয়েছিলেন।

–তিনি কী করতেন জানেন?

–হ্যাঁ, শুনেছিলাম উনি সরকারি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ডাইরেক্টর ছিলেন। বিয়ে করেননি। কাজেই সন্তানাদি ছিল না। দেশের যত সব ধ্বংস্তূপ খোঁড়াখুড়ি করে বেড়ানো ছিল ওঁর নেশা ও পেশা। কিন্তু তার সম্পর্কে আপনার জানবার আগ্রহের কারণ কী?

-আছে। কেন, আপনার শ্যালক কি কখনো তাঁর সম্পর্কে–ধরুন কোনো গুপ্ত তথ্যের কথা বলেননি?

মিঃ ভাদুড়ি গম্ভীর মুখে একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, কোনো গুপ্ত তথ্যের কথা নিশিকান্ত আমাকে বলেনি, তবে আমার স্ত্রী একদিন কথায় কথায় আমাকে চুপিচুপি বলেছিলেন তার কাকার একটা ছোট্ট ব্রিফকেস ছিল। সেটা তিনি তার ভাইপোকে লুকিয়ে রাখতে বলেছিলেন। এই ঘটনার কয়েক মাস পরে আমার খুড়শ্বশুর ছোটনাগপুরের একটা পাহাড়ের মাথা থেকে পা ফসকে পড়ে মারা যান। গুজবটা আমিও শুনেছি, তাকে নাকি কারা গুপ্তধনের লোভে ধাক্কা দিয়ে পাহাড় থেকে ফেলে দিয়েছিল। সরকার থেকে একটা তদন্তও হয়েছিল। কিন্তু তদন্তকারীরা ঘটনাটিকে দুর্ঘটনা বলেই রায় দিয়েছিলেন। কেন, নিশিকান্ত কি আপনাকে এসব কথা বলেনি?

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, না বলেননি। হয়তো বলার দরকার মনে করেননি।

মিঃ ভাদুড়ি হঠাৎ খাপ্পা হয়ে বললেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস শয়তান ভবেশ কুণ্ডু আমার খুড়শ্বশুরকে ঐভাবে মেরে ফেলার চক্রান্ত করেছিল।

–ভবেশ কুণ্ডুর সঙ্গে মিঃ শচীন লাহিড়ীর তাহলে কি কোনো সম্পর্ক ছিল?

মিঃ ভাদুড়ি উত্তেজিত হয়ে বললেন, ভবেশের সঙ্গে আমার খুড়শ্বশুরের বয়সের অনেক তফাত। কিন্তু আমি শুনেছি ভবেশের সঙ্গে তিনি পাড়ার ক্লাবে দাবা খেলতেন। নিশিকান্ত মনে মনে ক্রুদ্ধ হলেও তাকে কিছু বলত না, এটুকু আমি জানি।

কর্নেল হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমার আজ একটু তাড়া আছে। আপনার কাছে আসতে দেরি করে ফেলেছি। অন্য আরেক জায়গায় আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। চলি।

মিঃ ভাদুড়ি আমাদের সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললেন, আপনি রহস্যভেদী মানুষ। সম্ভবত উইলের লড়াইয়ের আড়ালে কোনো রহস্য টের পেয়েছেন।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, হয়তো পেয়েছি। কিন্তু প্লিজ আপনি এ বিষয়ে আপনার শ্যালককে কিংবা অন্য কাউকে বলবেন না। আপনার সঙ্গে যেসব কথা আলোচনা করে গেলাম, তাও মিঃ লাহিড়ীকে বলবেন না। কারণ আপনি তো জানেন আপনার শ্যালক খেয়ালি ও হঠকারী স্বভাবের মানুষ।

গাড়িবারান্দার সিঁড়ি বেয়ে নেমে হঠাৎ ঘুরে কর্নেল বললেন, আর একটা জরুরি কথা–আমাদের সমিতিতে নীলা রায় নামে একটি মেয়ে কাজ করত তা তো আপনি জানেন, তাকে কাজে অবহেলার জন্য বরখাস্ত করা হয়েছিল।

মিঃ ভাদুড়ি যে চমকে উঠেছিলেন তা স্পষ্ট। তিনি সরাসরি বললেন, সেই মেয়েটি কি ভবেশের এজেন্ট ছিল বলে আপনার সন্দেহ হয়েছে?

না। তবে আপনাকে জানানো উচিত মনে করছি, মেয়েটি থাকে বস্তি এলাকায়। সেখানে রাতবিরেতে কে তাকে উত্ত্যক্ত করছে।

বস্তি এলাকায় তা হতেই পারে। তবে আপনি কি কিছু রহস্য খুঁজে পাচ্ছেন এতে?

লনে হাঁটতে হাঁটতে কর্নেল বললেন, পাচ্ছি। কারণ মেয়েটির জানলার কাছে রাতদুপুরে কেউ গিয়ে ফিসফিস করে বলে, হারানকে ফেরত দে।  

মিঃ ভাদুড়ি আবার হো হো করে হেসে উঠলেন, হারানকে ফেরত দে বলে? হারান আবার কে?

কর্নেল গাড়িতে বসেছেন। আমিও স্টিয়ারিং-এর সামনে বসেছি। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিতে যাচ্ছি, এমন সময় মিঃ ভাদুড়ি কর্নেলের পাশে ঝুঁকে চাপা স্বরে বললেন, কর্নেল সাহেব, আপনার গোয়েন্দা বুদ্ধি আর আমার ওকালতির বুদ্ধি। আমার মনে হচ্ছে মেয়েটি কী শুনতে কী শুনেছে।

কর্নেল তার দিকে তাকালেন। চোখে প্রশ্ন ছিল।

মিঃ ভাদুড়ি আরও চাপা স্বরে বললেন, আমার বিশ্বাস হারান নয়, হারানো জিনিসটা কেউ ফেরত চাইছে। সেই হারানো জিনিসটা কী হতে পারে তা আপনি মেয়েটিকে জেরা করে জেনে নিন।

কর্নেল হাসলেন, আপনি বুদ্ধিমান মিঃ ভাদুড়ি। যাই হোক, চলি। যথাসময়ে আবার দেখা হবে।

গাড়ি চালিয়ে বড় রাস্তায় পৌঁছে বললাম, ভদ্রলোক সত্যিই অভিজ্ঞ এবং বুদ্ধিমান। কিন্তু আমার মনে একটা খটকা লাগছে। তিনি কি নিছক নৈতিক কারণে পেশা ছেড়েছিলেন? নাকি বিশেষ কোনো কারণ ছিল?

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, সব কিছুতে রহস্য খুঁজতে যেও না জয়ন্ত। তুমি ওঁর মুখে বিবেক দংশন কথাটা শুনেছ ডার্লিং, পৃথিবীতে এখনও অনেক বিবেকবান মানুষ আছেন, তাই পৃথিবীটা চলছে।

কর্নেলের একথার কোনো জবাব নেই। তাই চুপ করে গেলাম।

.

০৩.

কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে দেখি লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের সাব-ইন্সপেক্টর নরেশ ধর বসে আছেন।

আমি তাকে দেখেই একটু চমকে উঠেছিলাম, কারণ পুলিশের গোয়েন্দারা সবসময় ব্যস্ত মানুষ। কর্নেলের ফেরার অপেক্ষায় তার এভাবে বসে থাকার মধ্যে গুরুতর কোনো ঘটনা থাকা সম্ভব।

কর্নেলও তাকে দেখে যে অবাক হয়েছেন তা টের পেলাম। তিনি বললেন, নরেশবাবু যে! এক লাহিড়ীর পাল্লায় পড়ে হন্তদন্ত ছুটে বেড়াচ্ছি। আশা করি আর এক লাহিড়ী আমাকে পাকড়াও করবার জন্যে আপনাকে পাঠায়নি।

নরেশবাবু সাদা পোশাকেই এসেছিলেন। হাসতে হাসতে বললেন, আমার বস ডিসি ডিডি অরিজিৎ লাহিড়ী এখন ছুটিতে আছেন, আপনার তা জানার কথা।

কর্নেল টুপি খুলে বাইনোকুলার ও ক্যামেরা টেবিলে রেখে তার ইজিচেয়ারে বসলেন। তারপর টাকে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, আমি আজ রাত নটাতেও ফিরতে পারতাম। ততক্ষণ নিশ্চয় আপনি আমার জন্য বসে থাকতেন না।

–ঠিক বলেছেন কর্নেল সাহেব। ততক্ষণ বসে না থাকলেও আবার আপনাকে একবার রিং করতে হত এবং যেহেতু আপনি বাইরে কোথাও যাননি, আমাকে আবার আসতে হত। এগারোটা নাগাদ রিং করতেই আপনার শ্রীমান ষষ্ঠীচরণ বলল, বাবামশাই বেইরেছেন তবে ফিরে এসে লাঞ্চো খাবেন। সঙ্গে খবরের কাগজের দাদাবাবুও আছেন যে। কাজেই বুঝতে পারছেন

কর্নেল তার কথার উপর বললেন, বুঝে গেছি। কিন্তু আজ রবিবারেরও এই বৃদ্ধের কাছে কী এমন দরকার হল বলুন।

নরেশবাবু একটু ইতস্তত করে বললেন, শেয়ালদার রেল ইয়ার্ডের ওখানে একটা ভোলা ওয়াগানের ভেতর একটা ডেডবডি পাওয়া গেছে।

কর্নেল বললেন, কার ডেডবডি?

-যুবতী বলা যায়। কেউ বা কারা তার গলা কেটে খুন করে বডিটা খোলা ওয়াগানে রেখে গেছে। প্লাস্টিকে জড়ানো বডি, তাই বোঝা যায় খুনটা অন্যত্র করা হয়েছে। যাই হোক, কেসটা আমাদের নিতে হয়েছে।

–এ তো আপনাদের সি আই ডি-র ব্যাপার। আমাকে এর সঙ্গে জড়াতে এসেছেন কেন?

নরেশবাবু কুণ্ঠিত মুখে বললেন, বডির ব্রেসিয়ারের ভেতরে একটি চিঠি পাওয়া গেছে। চিঠিটা আপনাকে উদ্দেশ করে লেখা। বলে তিনি বুকপকেট থেকে ভাঁজ করা একটুকরো কাগজ কর্নেলের হাতে দিলেন। কর্নেল দ্রুত চিঠিটা পড়ে নিয়ে আস্তে বললেন, আশ্চর্য! আমি তো সুস্নাত আচার্য নামে কাকেও চিনি না। সে নীলা রায় নামে একটি মেয়েকে চিঠি লিখে আমার কাছে পাঠিয়েছিল কেন?

আমি ঘটনাটা শুনে খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম। কর্নেল আমার দিকে বিশেষ ভঙ্গিতে না তাকালে মুখ ফসকে বলে উঠতাম, এ তো সেই হালদারমশায়ের মক্কেল! তখনই উত্তেজনা চেপে গম্ভীর মুখে বললাম, কর্নেলের তো চেনাজানা লোকের সংখ্যা কম নয়। কর্নেলের হয়তো সুস্নাত নামে কারও সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। আর কর্নেলের যা স্বভাব তাকে নিজের নেমকার্ডও দিয়ে থাকবেন। এভাবে দেখলে ব্যাপারটার সুরাহা হবে।

 নরেশবাবু বললেন, জয়ন্তবাবু ঠিকই বলেছেন। আপনি একটু চিন্তা করলে হয়তো মনে পড়তে পারে।

কর্নেল তুম্বো মুখে বললেন, এই চিঠিটা আমি তাহলে রেখে দিচ্ছি। তারপর এর সূত্র ধরে সুস্নাত আচার্যকে খুঁজে বের করব। তবে দুঃখিত নরেশবাবু, আগাম কোনো ভরসা দিতে পারছি না।

নরেশবাবু সহাস্যে বললেন, কর্নেল সাহেবের প্রতি ভরসা আমাদের তবু থেকে যাবে। বলে নরেশবাবু উঠে দাঁড়িয়েছেন, কর্নেল বললেন, একটা কথা, এই চিঠিটা ডেডবডির ব্রেসিয়ারের ভেতর থেকে কে খুঁজে পেয়েছিল?

নরেশবাবু বললেন, এন আর এস হসপিটালের মর্গের ডাক্তার অনির্বাণ মণ্ডল। তিনি কী ভেবে গোপনে চিঠিটা আমার হাতেই তুলে দিয়েছিলেন।

কর্নেল বললেন, তাই বলুন। ডাঃ মণ্ডলের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। যাই হোক, ব্যাপারটা ডাঃ মণ্ডল, আপনি এবং আমার মধ্যেই গোপন থাকা উচিত মনে করছি। যথাসময়ে আপনাকে খবর দেব।

নরেশবাবু নমস্কার করে বেরিয়ে গেলেন। তারপর আমি এতক্ষণে যেন ডুবজল থেকে মাথা তুলে শ্বাস নিতে পারলাম। বললাম, কর্নেল, হালদারমশাইকে আপনি সন্ধ্যা ছটায় নীলা রায়কে সঙ্গে আনতে বলেছিলেন। এদিকে মেয়েটি বোঝা যাচ্ছে গত রাত্রে খুন হয়ে গেছে। কিন্তু এখনও হালদারমশাই এমন সাংঘাতিক খবর পাননি এটা ভেবে আশ্চর্য লাগছে।

কর্নেল কপট বিরক্তি দেখিয়ে বললেন, কী বিশ্রী আমার ভাগ্য জয়ন্ত! ষষ্ঠীচরণের সুস্বাদু লাঞ্চো খাবার আগেই আমার চিরশত্রু এক শয়তান সামনে একখানা রক্তাক্ত লাশ ফেলে দিল।

হাসতে হাসতে বললাম, এ তো কোনো নতুন ঘটনা নয়। পায়ের তলায় রক্তের ছাপ নিয়ে আপনি অনেক লাঞ্চো খেয়েছেন।

এই সময় চোখ পড়ল ষষ্ঠীচরণ পর্দার ফাঁকে গোমড়া মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সে লাঞ্চকে লাঞ্চো বলে। আমি তাকে বললাম, যষ্ঠী, তোমার বাবামশায়ের অবস্থা শোচনীয়।

ষষ্ঠী বলল, আজ সকালে টিকটিকিবাবু, তারপর হঠাৎ লালবাজারের ভদ্রনোককে দেখে আমি ঠিকই বুঝেছিলাম বাবামশায়ের ঘাড়ে উটকো বিপদ আসছে।

কর্নেল ঘুরে তার দিকে চোখ পাকিয়ে বললেন, আজ আমি স্নান করব। তুই একটু গরম জল তৈরি রাখবি।

ষষ্ঠী অদৃশ্য হল। আমি বললাম, আচ্ছা কর্নেল, হালদারমশাইকে একবার টেলিফোন করব?

করার দরকার হবে না। দোতলায় লিনডার কুত্তা চেঁচামেচি করছে। আমার ধারণা হালদারমশাই ছুটে আসছেন। কুকুরটার কেন যেন তাকে পছন্দ হয় না।

ঠিক তখনই বেল বাজল। আমি দ্রুত গিয়ে দরজা খুললাম। দেখলাম হালদারমশাই-এর মূর্তি যেন ঝড় খাওয়া কাকতাড়ুয়ার মতো। আমার পাশ দিয়ে সবেগে ড্রইংরুমে ঢুকে তিনি সকালের মতোই থপাস করে সোফায় বসলেন। তারপর হাঁসফাস করে বলে উঠলেন, কর্নেল স্যার, সাংঘাতিক কাণ্ড!

কর্নেল শান্তভাবে বললেন, এতে আপনার কিছু করার নেই। নীলা রায় যে খুন হয়ে যাবে সেটা আগে থেকে আঁচ করা সম্ভব ছিল না।

গোয়েন্দাপ্রবর ঢ্যাঙা মানুষ। আরও ঢ্যাঙা হয়ে বসে সবিস্ময়ে বললেন, আপনি খবর পাইসেন?

কর্নেল বললেন, পেয়েছি তবে এখন আর এ নিয়ে উত্তেজিত হবার কারণ নেই। শুধু জানতে চাইছি আপনি কোথায় কোন সূত্রে আপনার মক্কেলের খুনের খবর পেয়েছিলেন?

হালদারমশাই নস্যির কৌটো বের করে নোংরা রুমালে নাক মুছে তারপর বললেন, তখন আপনার কাছ থ্যেইকা আইয়্যা সোজা টালিগঞ্জের বস্তিতে নীলার ঘরে গিছলাম। তার মা কইল কিছুক্ষণ আগে নীলারে পাড়ার একটা পোলা ডাইক্যা লইয়া গেছে। নীলা কইয়্যা গেছে এক ভদ্রলোক তারে চাকরি দেবেন। আমি সেই ভদ্রলোকের পরিচয় জানতে চাইলাম। কিন্তু নীলার মা তা জানে না। তখন ঘরে এক পোলার নাম-ঠিকানা পাইলাম। তার বাড়ি বস্তি এলাকাতেই আর তার নাম হৈল গিয়া দুলাল। আমি তখনই দুলালের বাড়িতে গেলাম। তার বাড়িতে থাকার কথা না। তবে তার দিদি কইল দুলাল আর নীলারে সে পথে যাইতে দেখসে। দুলাল কইসে অরা নৈহাটি যাইব। নৈহাটিতে এক ভদ্রলোক নতুন কারবার খুলছেন, অনেক লোকজন লাগবো, দুলালও বেকার। তাই দুইজনে শেয়ালদা স্টেশনে যাইয়্যা ট্রেন ধরবো।

হালদারমশাই ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, কথাটা শুইন্যা আমার সন্দেহ হৈল। ভাবলাম, এখনই শেয়ালদা স্টেশনে তাদের দেখা পাইতেও পারি। কিন্তু প্ল্যাটফর্ম তন্ন তন্ন কইর‍্যা খুঁইজ্যাও ওদের দেখলাম না। তবু আমি আশা ছাড়ি নাই। এগারোটা অবধি প্ল্যাটফর্মে পইড়া রইলাম। তারপর কী আর করি। একখান ট্যাক্সি ধইর‍্যা আমার ফ্ল্যাটে গেলাম। স্নান কইর‍্যা খাইয়া লইলাম। সেই সময় টেলিফোন বাজল। রিসিভার তুইল্যা শুনি কোনো এক হালায় আমারে কইসে তোর। ক্লায়েন্টেরে এন আর এস মর্গে পাঠাইয়া দিয়াসি।

কর্নেল তার কথা থামিয়ে বললেন, তখন আপনি এন আর এস মর্গে গিয়ে খোঁজ নিয়েছেন?

হালদারমশাই দ্রুত বললেন, বডিও দেখসি। গলায় ড্যাগার চালাইয়া তারে মারসে। দুজন কনস্টেবল খাড়াইয়াসিল, তাদের থনে শুনলাম নীলার বডি একটা খালি ওয়াগানের ভিতর পাওয়া গেসে।

কর্নেল বললেন, তাহলে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হল সেই দুলাল হোক বা অন্য কেউ হোক, শেয়ালদা রেল ইয়ার্ডের কোনো নিরিবিলি জায়গায় দিনদুপুরে আচমকা তাকে জবাই করেছে তারপর বডিটা কাছাকাছি একটা খোলা ওয়াগানে ফেলে দিয়েছে। আমি লক্ষ করেছি, শেয়ালদা রেল ইয়ার্ডের কিছুটা অংশের একপাশে ঝোঁপঝাড় গাছপালা আছে। নিরিবিলি জায়গাও আছে।

এই সময় ষষ্ঠী দরজার ফাঁকে মুখ বের করে বলল, বাবামশাই, চানের জল রেডি।

কর্নেল বললেন, জয়ন্ত, তুমি স্নান করবে তো? যদি করো তাহলে অন্য বাথরুমে চলে যাও। হালদারমশাই বিশ্রাম করুন।

দেড়টার মধ্যে স্নানাহার সেরে কর্নেলের সঙ্গে ড্রইংরুমে ফিরে এলাম। তারপর অভ্যাসমতো ভাতঘুম দিতে ডিভানে শুয়ে পড়লাম। কর্নেল তার ইজিচেয়ারে বসে। চুরুট ধরিয়ে ডাকলেন, হালদারমশায়ের কি ঘুম পেয়েছে?

গোয়েন্দাপ্রবর ঘুমোননি। তিনি চোখ বুজে সোফার কোণে হেলান দিয়ে বসেছিলেন। কর্নেলের ডাকে সোজা হয়ে বসে বললেন, নাঃ! ঘুমাই নাই। হতভাগা মাইয়্যাডার বোকামির কথা ভাবতেছিলাম।

কর্নেল বললেন, এখন আর ভেবে লাভ নেই। এখন দরকার কাজে নেমে পড়া।

কন, কী করতে হইব?

 ইতিমধ্যে আমার চোখে ভাতঘুম এসে গিয়েছিল। দুজনের মধ্যে কী কথা হচ্ছিল শোনার আগ্রহ হচ্ছিল। কিন্তু এই এক বদ অভ্যেস, কখন ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলাম জানি না।

সেই ঘুম ভাঙল ষষ্ঠীচরণের ডাকে। তার হাতে চায়ের কাপ-প্লেট। সে হাসিমুখে বলল, বাবামশাই আর টিকটিকিবাবু আধঘণ্টা আগে কফি খেয়ে বেরিয়ে গেছেন। বাবামশাই আমাকে বলে গেছেন দাদাবাবুকে বলবি আমাদের ফিরতে দেরি হলেও যেন চলে না যায়।

ভাত ঘুমের পর কড়া চা পানের অভ্যাস থাকায় চায়ের দিকেই মন দিলাম। একটু পরে চা শেষ করে ষষ্ঠীকে ডেকে তার হাতে চায়ের কাপ-প্লেট দিয়ে বললাম, তোমার বাবামশাই আমার গাড়ি চুরি করে নিয়ে গেছেন কি?

ষষ্ঠী হেসে অস্থির হয়ে বলল, আপনার ফুলপ্যান্টের পকেট থেকে বাবামশাইকে চাবি নিতে দেখেছি।

বললাম, ঠিক আছে। আমি এখন ছাদের বাগানে গিয়ে বরং তোমার বাবামশায়ের উদ্ভুট্টে কাণ্ডকারখানা দেখি।

ষষ্ঠী বলল, তাই যান। আমি একটু পরে যাচ্ছি। কয়েকটা গাছে এক চুমুক করে জল দিতে হবে। তবে একটা কথা দাদাবাবু, পাশের বাড়ির নিমগাছের কাকগুলো বড্ড উৎপাত করে তা তো জানেন। একটা কাকতাড়ুয়া বসিয়ে রেখেছিলাম। তাকেও কাকগুলো ভয় করেনি। ঠুকরে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। তাই একখানা লম্বা লগিতে একগোছা কাকের ডানা বেঁধে রেখে দিয়েছি। অনুগ্রহ করে কাকেরা উৎপাত করলে আপনি লগিটা ধরে যেন তাড়িয়ে দেবেন। বজ্জাত কাকগুলো বেলা পড়ে এলেই বড্ড উৎপাত করে।

চিলেকোঠার সিঁড়ি বেয়ে কর্নেলের শূন্যোদ্যানে গিয়ে দেখলাম কাকগুলো গাছেই নিজেদের মধ্যে ঝগড়ায় ব্যস্ত। বেতের চেয়ারে বসে বাগানটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। দেশদেশান্তর থেকে সংগৃহীত উদ্ভট গড়নের সব ক্যাকটাস আর অর্কিড। এই বসন্তে তারা প্রচুর রঙবেরঙের ফুল ফুটিয়েছে। কিন্তু ফুলের দিকে বেশিক্ষণ মন দিতে পারলাম না। আজ সকাল থেকে যে জটিল রহস্যের দেখা। পেয়েছি সেই সঙ্গে আমার না দেখা এক যুবতীর রক্তাক্ত মৃতদেহ আমাকে ভাবিয়ে তুলল।

মনে পড়ল মিঃ ভাদুড়ি বলছিলেন রাতবিরেতে মেয়েটির জানালার কাছে কে বা কারা আসলে কোনো হারানো জিনিস ফিরে পেতে চায়। সম্ভবত তারা জানে মেয়েটির কাছেই তা লুকানো আছে। জিনিসটা কী হতে পারে? নিশিকান্তবাবুর কাকার কথা মনে পড়ল। উনি একজন আর্কিওলজিস্ট ছিলেন। তার একটা ব্রিফকেস নিশিকান্তবাবুকে তিনি লুকিয়ে রাখতে বলেছিলেন। তারপর তিনি ছোটনাগপুরের কোন পাহাড়ের চূড়া থেকে পড়ে মারা যান। এমন কি হতে পারে যে নীলা রায় কোনো সুযোগে সেটার কথা জানতে পেরেছিল? অবশ্য বাড়িতে নিশিকান্তবাবুর এক বিধবা দূরসম্পর্কীয় বোন রত্নময়ী আছেন। আমার ধারণা মহিলাদের পেটে কোনো কথা থাকে না। নীলা কি তার সঙ্গে কারও পরামর্শে খুব ভাব জমিয়েছিল?

নাহ্, অকারণ জল্পনায় কোনো লাভ নেই। তবে পয়েন্টগুলো কর্নেলের কাছে তুলব। এই সময় হঠাৎ নিমগাছের কাকের ঝক ঝগড়া করতে করতে ছাদের বাগানের দিকে চলে এল। তখনই আমি বীরদর্পে কাকের পালক-বাঁধা সেই লম্বা বাঁশটা যথাসাধ্য নাড়তে শুরু করলাম। কিন্তু কাকগুলো গ্রাহ্যই করল না। ষষ্ঠী এসে না পড়লে আমাকে রণে ভঙ্গ দিতে হত। সে এসেই আমার হাত থেকে বাঁশটা নিয়ে। চক্রাকারে শূন্যে ঘোরাতেই কাজ হল। তারপর কানে এল চিলেকোঠার সিঁড়ির মাথায় টুংটাং করে ঘন্টা বাজছে। তার মানে নীচে ঘরের দরজায় কেউ বেল বাজাচ্ছে। ষষ্ঠীচরণ অনেক সময় ছাদে থাকে। তখন ঘরে ফিরলে যাতে সে বুঝতে পারে তাই এই জোড়া বেলের ব্যবস্থা। বললাম, ষষ্ঠী, মনে হচ্ছে তোমার। বাবামশাই এসে গেছেন। আমি নীচে যাচ্ছি।

নেমে এসে অ্যাপার্টমেন্টের বাইরের দরজা খুলে দিলাম। দেখলাম কর্নেল আর নিশিকান্ত লাহিড়ী এসেছেন। তারা ভেতরে ঢুকলে জিগ্যেস করলাম, কর্নেল, হালদার-মশাইকে কোথায় রেখে এলেন?

কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, টালিগঞ্জ বস্তিতে। তবে গাড়ি চুরির জন্য আশা করি তুমি রাগ করনি।

বললাম, তা করিনি। রাগ করেছি আপনার পাশের বাড়ির নিমগাছবাসী কাকগুলোর উপর। ওঃ! কী সাংঘাতিক ঐ কালো কুচকুচে পাখিগুলো!

নিশিকান্তবাবু বললেন, জয়ন্তবাবু যে রীতিমতো একটা লড়াই করছিলেন তা ওঁকে দেখে বুঝতে পারছি।

সোফার একপাশে বসে বললাম, আপনি কর্নেলের পাল্লায় পড়লেন কীভাবে?

-কর্নেলের পাল্লায় নয়, পড়েছিলাম পুলিশের পাল্লায়। লালবাজারের একঝাক সি আই ডি অফিসার গিয়ে আমাকে জেরা করছিলেন। সেই সময় কর্নেল সৌভাগ্যক্রমে গিয়ে পড়ায় তাদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছি।

ততক্ষণে কর্নেল চিলেকোঠার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেছেন। উনি ষষ্ঠীর সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাকের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন কিনা জানি না। তবে দৃশ্যটা কল্পনা করে হাসি পেল।

নিশিকান্তবাবু আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বললেন, তখন সক্কালবেলায় সাংবাদিকদের বিষধর সাপ বলেছিলাম। জয়ন্তবাবু, তখন নিশ্চয় আমাকে শাপশাপান্ত করেছিলেন। তার ফল এবার ভুগতে শুরু করেছি।

হাসতে হাসতে বললাম, আমি নির্বিষ মিঃ লাহিড়ী। সে যাই হোক, লালবাজার। থেকে সি আই ডি পুলিশ আপনাকে জেরা করছিল কেন?

নিশিকান্তবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, একটা মেয়ে আমাদের সমিতিতে চাকরি করত। তার কাজকর্মে অসন্তুষ্ট হয়েই তাকে ডিসমিস করেছিলাম। এতদিন পরে সে কোথায় কেন খুন হয়েছে তা কি আমার জানার কথা! বুঝলেন না, এটা ঐ ভবেশ কুণ্ডুর চক্রান্ত। পুলিশমহলে ওর চেনাজানা লোক আছে। এই সুযোগে আমাকেও ঢিট করতে চায় আর কি!

একটু চুপ করে থাকার পর চাপা স্বরে বললাম, আপনি এই ঘরে একটা ব্রোঞ্জের সিল ফেলে গিয়েছিলেন সকালে। উইল নিয়ে লড়াইয়ের সঙ্গে এই সিলটার কি কোনো সম্পর্ক আছে?

নিশিকান্তবাবু চাপা স্বরে বললেন, না। ঐ সিলটা ছিল আমার কাকার ব্রিফকেসে। ব্রিফকেসে আরও অনেক কিছু প্রত্নদ্ৰব্য আছে, কিন্তু ব্রিফকেসের একটা পকেট থেকে কদিন আগে কাকার হাতে লেখা একটা নোট আবিষ্কার করলাম। তাতে তিনি ঐ সিলটার কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, এই সিলটার বয়স প্রায় দেড় হাজার বছর। এটার মধ্যে কিছু সাংকেতিক কথা লেখা আছে। ব্রাহ্মীলিপিতে লেখা হলেও আমি তার অর্থ উদ্ধার করতে পারিনি। যদি কোনো কারণে আমার মৃত্যু ঘটে, আমার আশা, আমাদেরই কোনো বংশধর এটা কাজে লাগাতে পারবে।

কর্নেল এসে গেলেন। তার পিছনে ষষ্ঠী। বললাম, কাকগুলো আশা করি রণে ভঙ্গ দিয়েছে।

কর্নেল তার ইজিচেয়ারে বসার পর জোরে শ্বাস ছেড়ে বললেন, মিঃ লাহিড়ীর ভগ্নিপতি যে হাইকোর্টের ওকালতি ছেড়ে দিয়েছেন, তা না হলে ঐ গাছটার মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করতাম। লোকটা এমন কুসংস্কারাচ্ছন্ন, গাছটা আমি কিনে নিতে চাইলে সে বলেছিল ঐ গাছ কাটলে তাদের বংশ উচ্ছন্নে যাবে। আর ঐ কাকগুলো নাকি সব ছদ্মবেশী দেবতা।

বললাম, মিঃ লাহিড়ীকে সি আই ডি অফিসারদের খপ্পর থেকে মুক্ত করে এনেছেন শুনলাম। পুলিশের বক্তব্য কী?

কর্নেল বললেন, নেহাত রুটিন এনকোয়ারি। ও নিয়ে ভাবার কিছু নেই। এখন আসল সমস্যা হল মিঃ লাহিড়ীকে নিয়ে।

নিশিকান্তবাবু চমকে উঠে বললেন, আমাকে নিয়ে? কি সমস্যা?

কর্নেল বললেন, আপনি আজকাল বড্ড বেশি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছেন। সকালে এসে ব্রোঞ্জের সিলটা আমাকে দেবার জন্য বের করেছিলেন, অথচ কথাবার্তার ঝেকে কখন সেটা আপনার হাত থেকে পড়ে গেছে আপনি খেয়ালই করেননি। পরে অবশ্য আপনি ফোন করেছিলেন। কিন্তু আপনাকে আমার বাড়িতে ডেকে আনার একটাই উদ্দেশ্য, আমার ধারণা, জাল উইল আর আসল উইলের লড়াই ছাড়াও অন্য কোনো গুরুতর ব্যাপার সম্ভবত আছে যা আপনাকে একটা দিশেহারা অবস্থায় ফেলেছে। তবে না, এখনই ও নিয়ে মুখ খোলার দরকার নেই। আগে কফি খান, স্নায়ুকে চাঙ্গা করুন। তারপর কোনো কথা গোপন না করে আমাকে সব জানান।

নিশিকান্তবাবু ফ্যালফ্যাল করে কর্নেলের মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন। এবার বললেন, কথাটা সকালে খুলে বলব ভেবেও বলিনি। আপনি ঠিকই ধরেছেন। এজন্যেই লোকেরা আপনাকে অন্তর্যামী বলে।

আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম। একটু হেসে বললাম, আমি এসে পড়ায় আপনি কি কথাটা বলতে পারেননি?

নিশিকান্তবাবু জোরে দুহাত নেড়ে বললেন, না-না, কর্নেলের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক তো আমি জানি। আসলে সত্যি আমি ক্রমশ দিশেহারা হয়ে পড়ছি। কী বলতে কী বলছি, কী করতে কী করছি, সময় সময়ে আমার মনে থাকে না। মাঝে মাঝে আমার ভয় হয়, আমি মানসিক রোগে ভুগছি না তো?

.

০৪.

কফি খাওয়ার পর নিশিকান্ত লাহিড়ী চাপা স্বরে বললেন, আমার ভুলও হতে পারে, তবে গত দুতিন মাস যাবৎ লক্ষ করছি রত্নময়ী হঠাৎ-হঠাৎ কোথায় বেরিয়ে যায়। আমাকে কিছু বলে যায় না। অবশেষে একদিন জিগ্যেস করেছিলাম সে অমন করে কোথায় যায়? রত্নময়ী চটে গিয়েছিল–আর যেখানেই যাই, তোমার শত্রুর বাড়ি যাই না, দাদা। আমার কি বাড়ির ভেতর সবসময় খাঁচার পাখির মতো আটকে থাকতে ভালো লাগে? কখনও আমার গুরুদেবের আশ্রমে যাই, কখনও যাই। শ্যামবাজারে শোভাদির কাছে। সে বেচারা অসুখ-বিসুখে ভুগে শয্যাশায়ী। তোমারও তো নিজের সহোদরা বোন, দাদা।

নিশিকান্তবাবু একদমে কথাগুলো বলার পর একটু চুপ করে থাকলেন। তারপর হঠাৎ একটু উত্তেজিত হয়ে বললেন, আমার কাজের লোক হরনাথ একদিন আমাকে চুপিচুপি বলল, আমাকে আপনি একদিন শ্যামবাজারে আপনার ভগ্নিপতির বাড়ি পাঠিয়েছিলেন। বাড়ির গেটে গিয়ে দেখলাম আপনার ভগ্নিপতি আর রত্নদি লনের পাশে শিউলি গাছের তলায় দাঁড়িয়ে চুপিচুপি যেন কী কথা বলছেন। আমি দারোয়ান রামুকে ডাকতেই দুজনেই চমকে উঠলেন, স্পষ্ট দেখেছি। আমি তো অতশত কিছু বুঝি না। রত্নদিকে জিগ্যেস করলাম, আপনি এখানে আসবেন জানলে তো বাবুমশাই আমাকে পাঠাতেন না। রত্নদি বললেন, এপাড়ায় আমার এক পুরনো বান্ধবীর কাছে এসেছিলাম। তাই ভাবলাম, কাছেই যখন এসে পড়েছি তখন একবার জামাইবাবুর সঙ্গে দেখা করেই যাই।

কর্নেল জিগ্যেস করলেন, হরনাথকে আপনি সেদিন কী কাজে পাঠিয়েছিলেন?

নিশিকান্তবাবু বললেন, জার্মানির একজন ইকোলজিস্ট কাগজে আমাদের সমিতির কাজকর্মের খবর পেয়ে চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠিটা আমি জামাইবাবুর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। কারণ চিঠিতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব ছিল। তা নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করার দরকার ছিল।

কর্নেল বললেন, রত্নময়ী গোপনে মিঃ ভাদুড়ির সঙ্গে কী কথা আলোচনা করতে পারেন বলে আপনার সন্দেহ হয়েছিল?

নিশিকান্তবাবু তেমনই উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে বললেন, কর্নেল সাহেব, হরনাথের মুখে ঐ কথা শুনে তারপর আমি গোপনে টেলিফোনে শোভার সঙ্গে যোগাযোগ করি। শোভা বলে, ব্যাপারটা আমিও টের পেয়েছি। তোমার জামাইবাবুর সঙ্গে রত্নদি যেন কী চক্রান্ত করছে বলে আমার সন্দেহ হচ্ছে। শোভা আরও বলে, তোমার জামাইবাবুকে সেদিন জিগ্যেস করেছিলাম রত্নদির সঙ্গে তোমার এত কথা কীসের? তোমার জামাইবাবু পরিহাস করে বললেন, এ বয়সে তোমার বোনটির সঙ্গে আমি চুপিচুপি প্রেম করছি। প্রেম করার বয়স কি আমাদের আর আছে?

কর্নেল বললেন, এ বিষয়ে আপনার কী ধারণা বলুন?

নিশিকান্তবাবু বললেন, সন্দেহবাতিকগ্রস্ত বলে বরাবরই আমার বেশ দুর্নাম আছে। কিন্তু আমি এ ব্যাপারে অকারণ সন্দেহ করছি না। জামাইবাবুর হাবভাব। ইদানিং আমার ভালো ঠেকছে না। তিনি গত সপ্তাহে হঠাৎ এক সন্ধ্যায় এসে আমার কাকা শচীন লাহিড়ীর সেই বিফ্রকেসটার কথা তুললেন। আমার কাকা নাকি তাকে বলেছিলেন এই বাড়ির এক গোপন স্থানে তিনি একটি মূল্যবান প্রত্নদ্রব্য লুকিয়ে রেখেছেন। এতদিন আমি কিছু ভাবব বলে জামাইবাবু কথাটা তোলেননি। তাঁর ধারণা সম্ভবত ভবেশ কুণ্ডুরাও সেই জিনিসটার লোভে জাল উইল তৈরি করে বাড়ির অর্ধেকটার দখল নিতে চাইছে। তার মানে সেই গোপন জিনিসটা বাড়ির যে অংশে আমি সমিতি তৈরি করেছি সেই অংশেই সম্ভবত লুকানো আছে। তার কথা শুনে আমি খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কাকাবাবু আমার কাছে সেকথা না বলে তার জামাইকে বলতে যাবেন কেন? যাই হোক, তারপর থেকে আমার মন খুবই বিক্ষিপ্ত। আপনি তো হরনাথকে চেনেন। তাকে আমি সতর্ক করে দিই। আমার অনুপস্থিতিতে সমিতির কোনো কর্মচারী হোক, বা রত্নময়ীই হোক, কেউ যেন আমার কোনো ঘরে ঢুকতে না পারে। তাছাড়া আমার প্রিয় অ্যালসেশিয়ান কুকুর টম তো আছেই। আমি বেরুলেই হরনাথকে বলে আসি, টমকে যেন চেন থেকে খুলে দেয়।

নিশিকান্তবাবুর কথা শেষ হল ক্লান্তভাবে। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে অবশ্য আমি সাংবাদিক হিসেবে লক্ষ করেছিলাম সত্যিই তিনি কিছুটা সন্দেহবাতিকগ্রস্ত মানুষ। দলের বিশ্বস্ত কর্মীদের প্রতিও খুব একটা আস্থা রাখতে পারতেন না। মোট কথা তিনি যে একজন খামখেয়ালি এবং কোনো কিছুতে থিতু হয়ে বসতে পারেন না তা আমার জানা ছিল। কিন্তু এবার মনে হল তার কাকার মৃত্যুর পর থেকেই প্রত্যেকের প্রতি তাঁর সন্দেহ যেন খুব বেড়ে গেছে।

কর্নেল চোখ বুজে হেলান দিয়ে চুরুট টানছিলেন। একটু পরে বললেন, আপনি অকারণ দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি কাল দশটার পর আপনার বাড়িতে যাব। যেভাবে সমিতির সদস্য হিসেবে যাই, সেভাবেই যাব। তারপর দেখা যাবে কেঁচো খুঁড়তে সত্যিই সাপ বেরোয় কি না!

নিশিকান্তবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, সাপ তো বেরিয়ে পড়েছে। যে মেয়েটিকে বরখাস্ত করেছিলাম সে হঠাৎ অমন শোচনীয়ভাবে খুন হয়ে গেল। কর্নেল সাহেব, আমি আবারও বলছি, নীলা রায় নিশ্চয় কিছু জানত।

–কী জানত বলে আপনি মনে করেন?

-ঐ যে জামাইবাবু যে গোপন দামি জিনিসটার কথা বলেছিলেন, সেটার খোঁজ হয়তো সে দৈবাৎ পেয়ে গিয়েছিল। এমনও হতে পারে জিনিসটা সে হাতিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু যার প্ররোচনায় তার এই কাজ তাকে সে সেটা দেয়নি।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, দেখা যাক আপনার ধারণা সত্যি কি না। তবে এখন আপনাকে বাড়ি ফিরতে হলে তো একটা গাড়ির দরকার। জয়ন্তর গাড়ি চুরি করে আমি আপনাকে তাতে চাপিয়ে এনেছি। চলুন, আমি আর জয়ন্ত আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।

নিশিকান্তবাবু হাত নেড়ে বললেন, না-না, জয়ন্তবাবু আর আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না। আমি ট্যাক্সি করেই বাড়ি ফিরব। আপনি চিন্তা করবেন না, আমি নিরস্ত্র হয়ে কখনও বেরোই না। রাজনৈতিক জীবনে একটা আর্মসের লাইসেন্স পেয়েছিলাম, সেটা আমার সঙ্গেই আছে।

বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন। আমার অবাক লাগল তার কাছে আর্মস থাকার জন্য নয়, সেই ব্রোঞ্জের সিলটার কথা ভুলে গেছেন দেখে। তিনি চলে যাওয়ার পর দেখলাম কর্নেলের দাঁতে কামড়ানো চুরুট থেকে নীল ধোঁয়া তার প্রশস্ত টাকের উপর ঘুরপাক খেতে খেতে ফ্যানের হাওয়ায় মিশে যাচ্ছে এবং তিনি চোখ বুজে ধ্যানস্থ। কিছুক্ষণ পরে তিনি চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন। তারপর আধপোড়া। চুরুটটা পাশের টেবিলে অ্যাশট্রেতে রেখে টেলিফোনের রিসিভার তুললেন। ডায়াল করার পর সাড়া এলে তিনি বললেন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। নরেশবাবু কি এখন অফিসে আছেন….বেরিয়েছেন। ঠিক আছে। আমি তাকে রিং করেছিলাম বলবেন……মাই গুডনেস, তপন বলছ? তুমি আবার ছুটির দিনে এই সন্ধেবেলায় অফিসে কী করছ…বুঝেছি। এসি প্রশান্তবাবুকে যেন ভুলেও বোলো না যে আমি নরেশবাবুকে খুঁজছিলাম…ও হ্যাঁ, নরেশবাবুকে মোবাইলে ধরা যায়, ভুলেই গিয়েছিলাম…..হা, সে নাম্বার আমার কাছে আছে…রাখছি।

কর্নেল রিসিভার রেখে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা খুদে নোটবই বের করলেন। তারপর আবার রিসিভার তুলে ডায়াল করতে থাকেন। বুঝতে পারলাম নরেশবাবুকে তার মোবাইল ফোনে ধরতে চান। কিছুক্ষণ পর সাড়া এলে তিনি বললেন, নরেশবাবু, কর্নেল সরকার বলছি…..আপনি এখন কোথায়….অকুস্থলে? তার মানে শেয়ালদার রেল ইয়ার্ডে….হা আমারও তাই ধারণা ছিল। ওখানে যথেচ্ছ জঙ্গল গজিয়ে আছে। কাজেই খুনির পক্ষে কাজটা সহজ হয়েছিল। আপনি কি এককাপ কফি খেয়ে যাবেন… হা, ওয়েলকাম।

বললাম, আপনার কথা শুনে বুঝতে পারছি দুলাল নামে ঐ ছোকরা কোনো ছলে নীলাকে রেললাইনের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে ঐ ঝোঁপের কাছে নিয়ে গিয়েছিল।

কর্নেল বললেন, আবার হালদারমশাই আসছেন। লিনডার কুকুরটার ভাষা আমি বুঝি।

তারপরই ডোরবেল বাজল। তারপর কর্নেল যথারীতি হাঁক দিলেন, ষষ্ঠী।

একটু পরে প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার ঘরে ঢুকে শান্তভাবে বসলেন। কর্নেল জিগ্যেস করলেন, আবার হঠাৎ আপনার আবির্ভাব দেখে অবাক হইনি। কিন্তু আপনাকে অমন করুণ দেখাচ্ছে কেন?

হালদারমশাই হাসবার চেষ্টা করে বললেন, আমি নীলার মায়ের কাছে। গেসিলাম। যাইয়্যা দেখি তাগো ঘরে তালা বন্ধ। বস্তি এরিয়া। তাই সতর্ক ছিলাম। গলির মোড়ে গাছের ছায়া ছিল। সেইহানে গেসি আর এক হালায় আমারে লেঙ্গি দিসে। রেডি ছিলাম, তাই রাস্তায় পইড়া যাই নাই। তক্ষুনি পিছু ফিরা লোডেড রিভলভার তাগ করলাম। হালা দৌড় দিল। আমিও তারে ফলো করলাম। তারপর শুনি কারা চোর চোর শব্দ করতাছে। মাথার উপর এক রাউন্ড ফায়ার কইর‍্যা সদর রাস্তায় গিয়া পড়লাম। তারপর কী করব ভাবতাছি, একখান খালি ট্যাক্সি যাইতেছিল। ড্রাইভার আমারে কইল, যাবেন নাকি স্যার? আমি কইলাম, হ।

সেই সময় ষষ্ঠীচরণ ভেতরের দরজা থেকে উঁকি মেরে বলল, বাবামশায়েরা কি আর কফি খাবেন?

কর্নেল বললেন, হতভাগা, দেখছিস না, হালদারমশাই এসে গেছেন। শিগগির কফি নিয়ে আয়।

কফি খাবার পর কর্নেল বললেন, কাল থেকে আপনাকে একটা দায়িত্ব দেব। তবে না, আপনার ক্লায়েন্টের পাড়ায় নয়। আপনাকে ভবানীপুরে নিশিকান্ত লাহিড়ীর বাড়ির কাছাকাছি জায়গায় ওৎ পেতে বসে থাকতে হবে। লক্ষ রাখার মতো ভালো জায়গা আছে সেখানে। গোড়া-বাঁধানো একটা বটগাছ আছে। সেখানে আপনি অনায়াসে সাধুবাবা সেজে বসে থাকতে পারবেন।

-কীসে লক্ষ রাখুম, তাই কন।

–আপনি দেখতে পাবেন বিশাল পুরনো বাড়িটার একতলায় প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা সমিতির সাইনবোর্ড আছে। ওটা একটা অফিস। সেখানে হয়তো অনেক রকম লোক যাওয়া-আসা করবে। কিন্তু আপনার দৃষ্টি থাকবে গেটের দিকে। সেখান থেকে কোনো ভদ্রমহিলা, তিনি বিধবা, বের হলে আপনি শুধু লক্ষ রাখবেন তিনি রিকশায় চেপে কোথাও যাচ্ছেন নাকি ট্যাক্সিতে চেপে যাচ্ছেন। আপনাকে ততক্ষণ কষ্ট করে বসে থাকতে হবে। উনি কতক্ষণ পরে ফিরছেন, সেই সময়ের হিসেবটা আপনাকে রাখতে হবে।

–সেই মহিলা কেডা?

–তিনি মিঃ নিশিকান্ত লাহিড়ীর দূরসম্পর্কের বিধবা বোন। কিন্তু খুব সাবধান। গেটের কাছে উঁকি মারতে যাবেন না।

গোয়েন্দাপ্রবর চমকে উঠে বললেন, ক্যান?

-ও বাড়িতে সাংঘাতিক একটা অ্যালসেশিয়ান আছে। সেটা ছাড়া থাকে।

হালদারমশাই হাসতে হাসতে বললেন, হঃ, বুঝছি।

একটিপ নস্য নিয়ে তিনি আগের মতো উদ্যমে সবেগে বেরিয়ে গেলেন।

রাত আটটায় এলেন ডিটেকটিভ সাব ইন্সপেক্টর নরেশ ধর। এবার আমি আর কফি খেলাম না। নরেশবাবু কফি খেতে খেতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার কাগজের রিপোর্টারও এসেছিলেন। রেল পুলিশের ঘরে আমাদের এসি প্রশান্তবাবু আর ওসি কন্ট্রোল সুজয়বাবু সাংবাদিকদের সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন। এসব ক্ষেত্রে একটু ভিড়ভাট্টা হয়, তবে বেশি প্রশ্ন করার সুযোগ দিইনি রিপোর্টারদের। যাই হোক, কর্নেল সাহেব, আমি আশা করেছিলাম আপনাকে কাছাকাছি কোথাও দেখতে পাব। কারণ সুস্নাত নামে কোনো হতভাগা মেয়েটিকে আপনার শরণাপন্ন হতে বলেছিল।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, শুনলে অবাক হবেন না, ভিকটিম নীলা রায় ছিল প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদারের ক্লায়েন্ট।

নরেশবাবু সকৌতুকে বললেন, হালদারমশাইকে তো ঘটনাস্থলে দেখলাম না।

–উনি তার ক্লায়েন্টের বাড়ির এলাকায় গোয়েন্দাগিরি করেছেন।

নরেশবাবু চাপাস্বরে বললেন, আপনি আপনার হাতের তাস দেখাবেন না তা জানি।

কর্নেল হাসলেন, ঐ তো দেখালাম।

-ওটা তাসের কোনা। যাই হোক, নীলার সঙ্গী সেই দুলাল হাজরার পাত্তা পেলে কেসটা অনেকটা ক্লিয়ার হবে।

আশা করি তার খোঁজে আপনাদের লোক বেরিয়ে পড়েছে।

 হ্যাঁ। তবে বেরুতে একটু দেরি হয়ে গেছে, এই যা।

কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুটটা ধরিয়ে বললেন, নীলার বাড়ি কি সার্চ করেছেন আপনারা?

-হ্যাঁ। তার বাড়ি সার্চ করেই মিঃ লাহিড়ীর বাড়িতে গিয়েছিলাম আমরা। যাক ওসব কথা। আপনি আমাকে কফি খেতে আমন্ত্রণ করেছেন। এবার আসল কথাটা : বলুন।

কর্নেল চুরুটের একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, সুস্নাতের লেখা চিঠিটা আমাকে আপনি দিয়েছিলেন। সেটা অন্তত আর একটা দিন আমার কাছে রাখা যাবে?

–নিশ্চয় রাখা যাবে। আমরাও সুস্নাতকে খুঁজছি।

কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, নরেশবাবু, আপনাদের কাজে যতটা স্কোপ আছে, এই বৃদ্ধের ততটা নেই। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, দুলাল হাজরা রেলওয়েরই কর্মচারী। আপনারা এই ব্যাপারটা হাতে নিন।

নরেশবাবু নড়ে বসলেন। বললেন, আশ্চর্য, ঠিক এই কথাটা আমার মাথাতেও ঘুরপাক খাচ্ছে। ধন্যবাদ কর্নেল সাহেব।

.

০৫.

রবিবার কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে বুঝতে পারি আমিও ফেঁসে গেছি। আমার আর সল্টলেকের ফ্ল্যাটে ফেরা হয় না। অবশ্য কর্নেল আমার জন্য সংলগ্ন বাথরুমসহ সুন্দর একটা শয়নকক্ষের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। সে-ঘরে আমার বাড়তি পোশাক-আশাক, দাঁতমাজা, দাড়িকাটা, স্নানের উপকরণ সবই সাজানো থাকে।

নীচে গাড়ি রাখবার অসুবিধা নেই। কর্নেলের একটা লাল রঙের ল্যান্ডরোভার গাড়ি ছিল। সেটা বেচে দিয়েছেন। তার সেই গ্যারেজে আমার গাড়ি রাখার অসুবিধা নেই। সে-রাতে খাবার পর লক্ষ করেছিলাম কর্নেলের ঘরে টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে এবং একখানা প্রকাণ্ড বই খুলে তিনি বসে আছেন। ওটা ওঁর অভ্যাস। তাই কোনোদিন এটা নিয়ে কিছু ভাবিনি। সকালে ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছিল। আটটায় কর্নেল ছাদের বাগানের সেবা করে নীচে এলেন। ততক্ষণে আমি দাড়ি কেটে ফিটফাট হয়েছি। ড্রইংরুমে গিয়ে দেখি কর্নেল টেলিফোনে কার সঙ্গে কথা বলছেন। কথা শেষ হলে রিসিভার রেখে অভ্যাসমতো বললেন, মর্নিং জয়ন্ত, আশা করি সুনিদ্রা হয়েছে। বললাম, মর্নিং বস্। সুনিদ্রা তো হয়ইনি, উৎকট সব স্বপ্ন দেখেছি। এই সময় ষষ্ঠী ট্রেতে কফি আর স্ন্যাক্স রেখে গেল।

কর্নেল তাকে ডেকে বললেন, ষষ্ঠী, উল্টোদিকের ফুটপাথে নীলচে রঙের হাওয়াই শার্ট আর প্যান্ট-পরা জয়ন্তর বয়সী এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে।

ষষ্ঠী বলল, কী বিপদ! হয়তো সে জগাদার দোকানে পান বা সিগারেট কিনছিল। তাকে আপনি সাধের বাগান থেকে নিশ্চয় উঁকি মেরে দেখেছেন।

কর্নেল হেসে ফেললেন, তুই হালদারমশায়ের চ্যালা হয়ে ঘুরবি। তোর টিকটিকিবাবুর লেজ হয়ে ঘুরবি।

ষষ্ঠী জোড়হাতে বলল, রক্ষে করুন বাবামশাই। আমি ও লাইনে নেই। কিন্তু এতক্ষণ সে যদি না থাকে ওখানে!

কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন, থাকবে। কাক তাড়াতে গিয়ে আমি উঁকি মেরে দেখেছি, সে আমার দিকে তাকিয়েই প্রণাম করল। আমার ধারণা, লিনডার কুকুরের গর্জন শুনে সে উপরে উঠতে সাহস পায়নি।

ষষ্ঠী বেরিয়ে গেল। আমি বললাম, কোনো যুবক আপনার কাছে এই সাতসকালে আসতে চায়। আর তা যদি হয় তাহলে আমার ধারণা সে কোনো রহস্য নিয়েই আপনার মতো প্রখ্যাত রহস্যভেদীর দ্বারস্থ।

কর্নেল আমার কথার কোনো জবাব দিলেন না। চুপচাপ কফি খেতে থাকলেন। কিছুক্ষণ পরে ষষ্ঠী নীলচে হাওয়াই শার্ট এবং প্যান্ট পরা এক যুবককে নিয়ে এল।

যুবকটি নমস্কার করে মৃদু স্বরে বলল, বাধ্য হয়ে আপনাকে একটু বিরক্ত করতে এলাম, কর্নেল সাহেব।

কর্নেল তার দিকে তাকিয়েছিলেন। বললেন, বিরক্ত হইনি। আমি কাল থেকে প্রতিমুহূর্তে তোমার জন্য প্রতীক্ষা করছিলাম।

বলে কর্নেল আমার দিকে ঘুরে চোখে হেসে আস্তে বললেন, জয়ন্ত, একে চিনতে পারছ?

অমনি আমার মস্তিষ্কে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ইনি নিশ্চয় সেই সুস্নাত।

যুবকটি সংকোচে সোফায় বসে বিনীতভাবে বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার নাম সুস্নাত আচার্য।

কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, তোমাকে লালবাজারের গোয়েন্দারা খুঁজে বেড়াচ্ছে, তা কি তুমি জানো?

সুস্নাত কাঁচুমাচু মুখে বলল, জানি। তবে নীলার এই সর্বনাশের জন্য আমি দায়ী নই। গত পরশু ওদের বস্তির কাছে আমার সঙ্গে নীলার দেখা হয়েছিল। আমি ওকে জিগ্যেস করেছিলাম, আমার চিঠিটা তুমি পেয়েছ? নীলা বলেছিল পেয়েছি। কিন্তু যাঁর কাছে তুমি যেতে লিখেছ, আমার মতো সামান্য মেয়েকে তিনি কি পাত্তা দেবেন? তাকে আমি অবশ্য বার দুই আমাদের অফিসে দেখেছি, মনে পড়ছে। তার চেহারা দেখে আমার মনে হয়েছিল উনি খুব উঁচুতলার মানুষ। তাছাড়া যে অফিস থেকে আমার চাকরি গেছে তিনি সেই অফিসের সঙ্গে যুক্ত। আমাকে উনি কিছুতেই পাত্তা দেবেন না।

সুস্নাত চুপ করলে কর্নেল বললেন, তারপর কী হল বলল।

সুস্নাত বলল, আমি তাকে কাল সকালে আপনার কাছে নিয়ে আসব বললাম। কিন্তু নীলা বলল, ওদের পাড়ার দুলাল হাজরা তার একটা চাকরির ব্যবস্থা করেছে। কাল সকালে সেখানে সে তাকে নিয়ে যাবে। এই সুযোগ ছাড়তে সে রাজি নয়। কারণ দুলাল হাজরা নাকি তাদের বস্তি এলাকার কয়েকজনকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে।

রেলওয়ে ডিপার্টমেন্টে?

সুস্নাত অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, আপনি তাহলে জানতে পেরেছেন? আমাকে কিন্তু নীলা বলেছিল শেয়ালদার রেলওয়ে ওয়ার্কশপের কাজ। আপাতত ট্রেনি হয়ে মাস তিনেক থাকতে হবে, তারপর চাকরি পাকা।

ইতিমধ্যে ষষ্ঠী সুস্রাতের জন্য এককাপ কফি রেখে গেল। কর্নেল বললেন, কফি খেয়ে চাঙ্গা হও। তারপর বলল তুমি কী করে আমাকে চিনলে?

সুস্নাত কফির পেয়ালা হাতে ধরে বলল, আপনি হয়তো ভুলে গেছেন স্যার, মিঃ লাহিড়ীদের সমিতি থেকে সন্তোষপুরে একটা পার্ক তৈরির প্ল্যান ছিল। সেই পার্কের নকশা আমিই করে দিয়েছিলাম। ছবি আঁকা আমার হবি। আপনি ছবিটা দেখে খুব প্রশংসা করেছিলেন।

কর্নেল সোজা হয়ে বসে বললেন, মাই গুডনেস! কথাটা একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম। মিঃ লাহিড়ী তো তোমাকে ভালো চেনেন।

–আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু নীলার চাকরি যাওয়ার পর আমি মিঃ লাহিড়ীর কাছে গিয়ে খুব অপমানিত হয়েছিলাম। নীলা নাকি তাঁর শত্রুপক্ষ ভবেশ কুণ্ডুর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। আমি অনেক বলেও তাকে বোঝাতে পারিনি।

কর্নেল বললেন, কফি খাও। বলে তিনি চুরুট ধরালেন।

সুস্নাত কফি শেষ করে বলল, নীলা ছিল অসম্ভব বোকা। নিজের বুদ্ধির দোষে আর টাকার লোভে সে একটা চক্রান্তে জড়িয়ে পড়েছিল।

-তাহলে সেই চক্রান্তের কথা তোমারও জানা?

-হ্যাঁ স্যার। সেই কথা বলার জন্যই আমি আজ মরিয়া হয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। কিন্তু কথাটা যে খুব গোপনীয়, স্যার।

কর্নেল বললেন, আলাপ করিয়ে দিই। জয়ন্ত চৌধুরী। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক। আমার কোনো কথা ওর কাছে গোপন থাকে না।

সুস্নাত করজোড়ে বলল, প্লিজ কর্নেল সাহেব, এসব নিয়ে কোনো খবর যেন কাগজে না বেরোয়। গতকাল খবরের কাগজে মিঃ লাহিড়ীর বাড়ি আর একটা উইল নিয়ে খবর বেরিয়েছিল, পড়েছিলাম।

তাকে আশ্বস্ত করে আমি বললাম, কোনো গোপন খবর কাগজে বের করা যায়, সুস্নাতবাবু। কারণ সাংবাদিকদের একটা দায়দায়িত্ব থাকে।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, খুলে বলো সুস্নাত।

সুস্নাত একটু চুপ করে থেকে বলল, মিঃ লাহিড়ীর বাড়িতে যেদিকটায় সমিতির অফিস, সে অংশে কোনো একটা ঘরে নাকি কোটি টাকা দামের একটা জিনিস লুকানো আছে। দুলাল নীলাকে কথাটা বলেছিল। তারপর একদিন সন্ধ্যার পর দুলাল তাকে নিয়ে ভবানীপুরে ভবেশ কুণ্ডু নামে এক ভদ্রলোকের কাছে যায়। তিনি নীলাকে একটা নকশা দিয়ে বলেন যে, যে জায়গায় জিনিসটা লুকানো থাকতে পারে তা লাল বিন্দু দিয়ে দেখানো আছে। দরকার হলে নীলা বিশ্বাসী কোনো বন্ধুর সাহায্য নিয়ে দিনের বেলাতেও জিনিসটার খোঁজ করতে পারে। ঠিক কোথায় আছে সেই জায়গাটা সম্পর্কে সে নিশ্চিত হয়ে ভবেশবাবুকে জানালে তিনি যেভাবে হোক তা উদ্ধার করবেন আর নীলাকে দশ হাজার টাকা দেবেন। কিন্তু যদি নীলা ঐ কথা কারও কাছে ফাঁস করে, তাহলে নীলার প্রাণ যাবে।

জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে সুস্নাত আবার বলল, কদিন পরে নীলা আমাকে বলেছিল সম্ভবত জিনিসটা কোথায় আছে সে জানতে পেরেছে। নীলা গরিব ঘরের মেয়ে। সে আমার সাহায্য চেয়েছিল। তারপর অনেক চিন্তা-ভাবনা করে আমি ওকে সতর্ক করে দিই। নীলা কান দেয়নি। তারপর তার চাকরি যায়। তখন স্বভাবত ভবেশ কুণ্ডু দুলালকে তার পেছনে লাগিয়ে উত্ত্যক্ত করতে শুরু করেন। গত সপ্তাহে আমাকে হঠাৎ বর্ধমানে একটা আত্মীয়বাড়ি যেতে হয়েছিল। যাওয়ার আগে তাড়াহুড়ো করে একটা চিঠিতে আপনার নাম-ঠিকানা দিয়ে ওকে যোগাযোগ করতে বলেছিলাম। তারপর চিঠিটা আমাদের কাজের লোক যদুর হাত দিয়ে গোপনে নীলার কাছে পাঠিয়েছিলাম। আমার খুব সন্দেহ, নীলার বাড়িতে যদুর যাওয়া এবং চিঠি দেওয়া দুলালের কোনো স্যাঙাত দেখতে পেয়েছিল।

কর্নেল বললেন, ভবেশ কুণ্ডু যে নকশাটা দিয়েছিলেন সেটা তো নীলা তোমাকে দেখিয়েছিল। তোমার কি সেই নকশাটা মনে আছে?

সুস্নাত পকেট থেকে খামে ভরা একটা ভাজ করা কাগজ টেনে বের করল। তারপর কর্নেলকে দিয়ে বলল, নীলা এটা আমাকে রাখতে দিয়েছিল। যে লাল চিহ্নটার পাশে টিক দেওয়া আছে ওখানেই নাকি জিনিসটা থাকতে পারে বলে নীলার মনে হয়েছিল।

কর্নেল আতসকাঁচ বের করে খুঁটিয়ে নকশাটা দেখলেন তারপর একটু হেসে বললেন, এটার সঙ্গে সদস্যদের কনফারেন্স রুমের মিল আছে। যেখানে টিক দেওয়া সেখানে একটা বিলিতি ল্যান্ডস্কেপ টাঙানো আছে। কিন্তু জিনিসটা কী হতে পারে তা কি তোমাকে নীলা খুলে বলেছিল?

-না। ভবেশবাবু তাকে নাকি বলেছিলেন জিনিসটা একটা চৌকো বাক্সের মধ্যে আছে।

কর্নেল কিছুক্ষণ চোখ বুঝে থাকার পর বললেন, সুস্নাত, তুমি কি জানো নিশিকান্তবাবুর কাকা শচীন লাহিড়ী সরকারি প্রত্নতত্ত্ব দপ্তরে ডাইরেক্টার ছিলেন?

-জানি। আমার সন্দেহ হয়েছিল কোথাও ধ্বংসাবশেষের মধ্যে মহামূল্যবান কিছু পেয়ে উনি তা আত্মসাৎ করেছিলেন। সরকারকে জমা দেননি। এও শুনেছি কোন পাহাড়ের চূড়া থেকে পড়ে গিয়ে ওঁর মৃত্যু হয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওঁর টিমের অন্য কেউ বা কারা ব্যাপারটা জানতে পেরেছিল। তারপর তাকে আচমকা ধাক্কা দিয়ে পাহাড় থেকে ফেলে দেয়।

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ, এসব কথা আমার জানা। তবে বুঝতে পারছি শচীনবাবু ছোটনাগপুর যাওয়ার আগে জিনিসটা বাড়িতে গোপন জায়গায় লুকিয়ে রেখেই গিয়েছিলেন। কাজটা বেআইনি। কাজেই সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চয় তদন্ত হয়ে থাকবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সেই তদন্তে কোন লাভ হয়নি।

সুস্নাত রুমালে মুখের ঘাম মুছে বলল, এবার আমার উপরও আঘাত আসতে পারে। তাই আমি কিছুদিনের জন্যে বাইরে কোথাও গা ঢাকা দিতে চাই।

কর্নেল বললেন, ঠিক আছে। তুমি বুদ্ধিমানের মতো কথা বলেছ। কিন্তু বাইরে যেখানেই থাকো, মাঝে-মাঝে টেলিফোন করে আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখো।

সুস্নাত কর্নেলের পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে গেল। কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, প্রণাম নেওয়ার অভ্যাস আমার নেই। তুমি যেখানেই যাও, সতর্ক হয়ে থাকবে। আর এই আমার কার্ডটা রাখো। বিপদে পড়লে পুলিশকে এটা দেখিয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবে।

নটার মধ্যে ব্রেকফাস্ট সেরে কর্নেল আমাকে নিয়ে বেরোলেন। যাবার সময় অবশ্য ভবানীপুরে মিঃ লাহিড়ীকে ফোন করে জানিয়ে দিলেন আমরা যাচ্ছি। প্রায় আধঘন্টা পরে ভবানীপুরে একটা পুরনো আমলের দোতলা বাড়ির গেটে পৌঁছালাম। দারোয়ান স্যালুট ঠুকে গেট খুলে দিল। নুড়ি বিছানো লন দিয়ে গাড়িবারান্দার নীচে গেলাম। নিশিকান্তবাবু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাদের তিনি ভিতরে নিয়ে যেতে চাইছিলেন। কিন্তু কর্নেল বললেন, আমরা বরং সমিতির অফিসে যাই চলুন।

বিশাল বাড়ির ডান পাশের বারান্দা দিয়ে পেছন দিকে গিয়ে দেখলাম ওদিকেও একটা গেট আছে, দারোয়ানও আছে। যে ঘরে ঢুকলাম সে ঘরটা বেশ চওড়া এবং কয়েকটা চেয়ার-টেবিল ও আলমারি আছে। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক কোনার একটা টেবিলে বসে টাইপ করছিলেন। কর্নেলকে দেখে তিনি নমস্কার করে উঠে দাঁড়ালেন।

কর্নেল বললেন, কেমন আছেন শীতলবাবু? ভদ্রলোক করুণ হেসে বললেন, আছি এই মাত্র। অফিসের অবস্থা দেখছেন তো। বাকি তিনজন কর্মীর কেউ আসেনি।

নিশিকান্ত হাসতে হাসতে বললেন, গুজব রটে গেছে ভবেশ কুণ্ডুরা নাকি এ বাড়িতে গুণ্ডা নিয়ে চড়াও হবে। এখনও মামলার শুনানি-ই হয়নি। অবশ্য সতর্কতার জন্য পুলিশে খবর দিয়েছিলাম। বাইরে একটা পুলিশ ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। আপনারা সোজা পথে এসেছেন তাই চোখে পড়েনি।

কর্নেল বললেন, চলুন, কনফারেন্স রুমে গিয়ে বসি।

ভিতরে আরও একটা বড়ো ঘর, মধ্যখানে একটা ডিম্বাকৃতি প্রকাণ্ড শ্বেত পাথরের টেবিল। টেবিল ঘিরে গদি-আঁটা পুরনো আমলের চেয়ার। কোথাও কুকুরের গর্জন শোনা যাচ্ছিল।

নিশিকান্তবাবু বললেন, হরনাথ কুকুর বেঁধে রেখেছে। আপনারা বসুন। আমি আসছি।

যাবার সময় তিনি ঘরের দুটো সিলিং ফ্যানই চালিয়ে দিয়ে গেলেন। জানালাগুলো খোলা, কিন্তু পর্দা ঝুলছে। আমি ঘরের দেওয়ালগুলো দেখছিলাম। এ বাড়ির পূর্বপুরুষের কয়েকটা অয়েলপেন্টিং আর বিদেশি বিশাল ল্যান্ডস্কেপ দেওয়ালে টাঙানেনা।

কর্নেল আমাকে চোখে ইশারা করে একটা ল্যান্ডস্কেপের দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর সেটা দুহাতে একটু তুলে ভেতরে কিছু দেখে নিলেন। চাপা স্বরে বললাম, ওটাই কি সেই গুপ্তস্থান?

কর্নেল ঠোঁটে আঙুল রেখে এগিয়ে এলেন। চেয়ারে বসে চাপা স্বরে বললেন, মিঃ লাহিড়ীকে অত বোকা ভাবার কারণ নেই। ছবিটা যে এর আগে অন্তত বার দুই সরানো হয়েছে তার দাগ দেওয়ালে লক্ষ করলাম।

এই সময় নিশিকান্তবাবু ফিরে এলেন। কর্নেলের মুখোমুখি বসে তিনি বললেন, অপেক্ষা করুন, কফি আসছে। ইতিমধ্যে একটা কাজের কথা সেরে নিই।

-বলুন মিঃ লাহিড়ী।

–আজ সকালে শ্যামবাজার থেকে জামাইবাবু ফোন করেছিলেন। বলছিলেন, বাড়িটা কাউকে বেচে দিয়ে ওঁদের এলাকায় যেন চলে যাই। গঙ্গার ধারে এক প্রমোটার ফ্ল্যাট করেছে। বারোশ স্কোয়ারফুট ফ্ল্যাট দোতলায় খালি আছে। আমি রাজি হলে উনি দরদাম নিয়ে কথা বলবেন। প্রোমোটার নাকি একসময় জামাইবাবুরই এক মক্কেল ছিলেন।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, আপনি নিশ্চয়ই রাজি হননি?

–আমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? আমাদের এই বাড়িটার এরিয়া প্রায় তিন একর। কত যত্ন করে ফুলবাগান আর গাছপালা দিয়ে সাজিয়ে রেখেছি। এই পরিবেশ ছেড়ে আমি দেশলাই বাক্সের ভিতর গিয়ে ঢুকব!

-ঠিক বলেছেন। তবে একটা কথা জিগ্যেস করছি। আপনার বাবা বেঁচে থাকতে আপনার কাকার সঙ্গে নিশ্চয় এই বাড়ির একটা ভাগাভাগি হয়েছিল?

হয়েছিল। বাবা উপরতলা এবং কাকা নীচের তলা, এভাবেই মৌখিক ভাগাভাগি হয়েছিল। উপরতলায় মোট পাঁচটা ঘর আছে। নীচের তলায় ছটা। কাকা নাকি নীচের তলাটা স্কুলের জন্য দিতে চেয়েছিলেন। আপনাকে আগেই। বলেছি, ভবেশ কুণ্ডু দাবি করছে একটা ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে আমার কাকা নাকি পুরো নীচের তলাটা উইল করে দিয়েছেন। অথচ উইল করে গেছেন আমারই নামে।

আবার সেই উইলের প্রসঙ্গ এসে পড়ায় আমি বিরক্ত বোধ করছিলাম। কিন্তু সেই সময় একটা তাগড়াই চেহারার লোক কফি আর দুটো সন্দেশের প্লেট এনে রাখল। তারপর কর্নেলকে সেলাম ঠুকে বলল, স্যার, এ বাড়িতে আসা যেন ছেড়েই দিয়েছেন।

কর্নেল হাসলেন, না, হরনাথ। তোমার বাবুমশাই মিটিং ডাকলে তবে তো আসব।

নিশিকান্তবাবু বললেন, আর মিটিং! এখন মাঝে-মাঝে মনে হচ্ছে সব ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়ে যাই।

উপরে কুকুরের গর্জন শোনা গেল। অমনি হরনাথ হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল।

কর্নেল বললেন, ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছি, মিষ্টি খাব না। কফিই যথেষ্ট।

কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, একটা প্রশ্ন করব। আশা করি সঠিক উত্তর দেবেন।

নিশ্চয় দেব। বলুন।

 কর্নেল টেবিলের উপর দিয়ে মুখটা একটু এগিয়ে নিয়ে গিয়ে চাপা স্বরে বললেন, নীলা রায় নামে যে মেয়েটি খুন হয়েছে, সে এখানে চাকরি করত। বাই এনি চান্স কোনোদিন কি তাকে এই ঘরে ঢুকে কোনো ছবি সরাতে দেখেছিলেন?

লক্ষ করলাম নিশিকান্তবাবু চমকে উঠে কর্নেল যে ছবিটা সরিয়ে কিছু দেখেছিলেন, সেই ছবিটার দিকে একবার তাকিয়ে নিলেন। তারপর গম্ভীর মুখে বললেন, হ্যাঁ। আপনি কীভাবে এটা জানলেন জানি না, তবে একদিন নয়, পরপর দুদিন তাকে একটা ছবির ফ্রেমে হাত দিতে দেখেছি। ধরা পড়ে অপ্রস্তুত হয়ে সে বলেছিল, ছবিগুলোতে ময়লা জমেছে। আমি পরিষ্কার করে দেব? আমি সেদিনই সিদ্ধান্ত নিলাম ওকে বরখাস্ত করতে হবে।

কর্নেল এরপর চুপচাপ কফি শেষ করলেন। তারপর চুরুট ধরিয়ে বললেন, আমার অনুমান ঐ ছবিটার তলায় দেওয়ালে কোনো গোপন চেম্বার আছে এবং তার মধ্যে একটা দামি জিনিস

কর্নেলের কথায় বাধা দিয়ে হতচকিত নিশিকান্ত লাহিড়ী ফিসফিস করে বললেন, আপনি সত্যিই অন্তর্যামী। গোপনীয় জিনিসটা আমি আরও গোপনীয় জায়গায় রেখে দিয়েছি। আমার ইচ্ছে ছিল সেটা বিক্রি করে যে দাম পাব তা দিয়ে একটা পার্ক করব। পার্কের জমি চন্দননগর পুরসভা আমাকে দেবে।

কর্নেল বললেন, বাঃ! যা জানতে চেয়েছিলাম, তা জানা হয়ে গেল। এবার চলি।

.

০৬.

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আমি জিগ্যেস করলাম, আপনি হালদারমশাইকে সাধুবাবা সেজে এই বাড়ির দিকে লক্ষ রাখতে বলেছেন। সেই বটগাছটা কোথায়?

কর্নেল বাঁদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ঐ দেখো সেই বটতলা। সাধুবাবাকেও দেখতে পাবে। কিন্তু না, ওদিকে মন না দিয়ে চলো আমরা কেটে পড়ি।

যাবার সময় কর্নেলের তাগড়াই শরীরের আড়াল দিয়ে একবার দৃশ্যটা দেখে নিলাম। সাধুবেশী হালদারমশাই গুলিগুলি চোখে আমাদের গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছেন।

বড় রাস্তায় পৌঁছে কর্নেল বললেন, আমরা বালিগঞ্জ হয়ে ঘুরে যাব।

জিগ্যেস করলুম, সেখানে কারও সঙ্গে দেখা করবেন নাকি?

কর্নেল বললেন, ওল্ড বালিগঞ্জ প্লেসে একটা বাড়িতে যেতে হবে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা নেই, কিন্তু তাতে অসুবিধা হবে না। রাস্তায় এখন যানবাহনের প্রচণ্ড ভিড়।

কর্নেলের নির্দেশে কখনও গলিপথে কখনও বড় রাস্তায়–এইভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। বরাবর দেখে আসছি কলকাতা শহরটা কর্নেলের একেবারে হাতের মুঠোয়। ওল্ড বালিগঞ্জ প্লেসে ঢুকে দুধারে গাছের সারি পেরিয়ে যেতে যেতে এক স্থানে কর্নেল বললেন, ব্যস, এইখানে গাড়ি রাখো।

গাড়ি লক করে কর্নেলকে অনুসরণ করলাম। একটা বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কর্নেল একটু জোরে কাশলেন। গেটের পাশের গুমটি ঘর থেকে একটা লোক বেরিয়ে তাকে দেখেই সেলাম দিল।

কর্নেল জিগ্যেস করলেন, তোমার সাহেব বাড়িতে আছেন তো?

লোকটি বলল, হ্যাঁ, কর্নেল স্যার। সাহেব এখন বেশি চলাফেরা করতে পারেন না। খেয়েদেয়ে নীচের ঘরে বসে বই ঘাঁটাঘাঁটি করেন।

কথাটা বলেই লোকটা গেটের একটা পাশ খুলে বলল, আপনারা আসুন। আমি ওনাকে খবর দিই।

অপরিসর লন পেরিয়ে সে নীচের তলার একটা ঘরে ঢুকল। তারপর বেরিয়ে এসে বলল, যান কর্নেল সাহেব।

পর্দা তুলে ভেতরে ঢুকে দেখি প্রশস্ত ঘরটা কর্নেলের ড্রইংরুমের মতো দেখতে হলেও আগাপস্তলা বইয়ের র‍্যাকে ঠাসা। তাছাড়া নানা সাইজের টুলের উপর রাখা আছে অজস্র ভাস্কর্য। ঘরের শেষ প্রান্তে জানালার কাছে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোককে দেখতে পেলাম। পরনে হাতকাটা সাদা ফতুয়া, একমাথা সাদা কঁকড়া চুল। গোঁফদাড়ি পরিষ্কার করে কামানো। তার সামনে প্রকাণ্ড এক সেক্রেটারিয়েট টেবিল। টেবিলে অগোছালো বইপত্র, কয়েকটা ছোটোখাটো ভাস্কর্য।

কর্নেলকে দেখে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বললেন, হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো, আমি দিবাস্বপ্ন দেখছি না তো?

কর্নেল টেবিলের উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে করমর্দন করলেন। বললেন, ডঃ মুখার্জি, আগাম খবর জানিয়ে আসতে পারিনি। সেজন্য ক্ষমা করবেন। পরিচয় করিয়ে দিই–আমার তরুণ সাংবাদিক বন্ধু জয়ন্ত চৌধুরী।

আমরা বসার পর ডঃ মুখার্জি মিটিমিটি হেসে চাপাস্বরে বললেন, আপনার আকস্মিক আগমনের পেছনে কোনো কারণ আছে। ঠিক ধরেছি কি না বলুন?

কর্নেল বললেন, ঠিকই ধরেছেন। আড্ডা দিতে এলে নিশ্চয় টেলিফোন করে আসতাম। একটা সমস্যা এনেছি আপনার কাছে।

বলে কর্নেল বুকপকেট থেকে কাগজে জড়ানো সেই চৌকো ব্রোঞ্জের সিলটা তার হাতে দিলেন। ডঃ মুখার্জি মোড়ক খুলে সিলটা দেখে একটা বড়ড়া আতসকাঁচ দিয়ে বিড়বিড় করে দুর্বোধ্য ভাষায় কী সব আউড়ে গেলেন। ততক্ষণে বুঝতে পেরেছি এই ভদ্রলোক একজন পুরাতত্ত্ববিদ। তিনি সিলের দুই পিঠই খুঁটিয়ে দেখে বললেন, এই মহামূল্য পুরনো জিনিসটি আপনি কোথায় পেলেন?

কর্নেল বললেন, যথাসময়ে তা বলব। কাল রাত্রে একটা প্রাচীন বৌদ্ধ ইতিহাসের বই-এ আমি এই সিলটার ছবি দেখেছি। কিন্তু বইয়ের লেখক সম্ভবত এটার পাঠোদ্ধার করতে পারেননি। তাই শুধু লিখেছেন, রাজগৃহের মহাদত্ত নামে এক বণিক যবদ্বীপ থেকে এই সিলটা এনে আনুমানিক ২০৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বৌদ্ধরাজা শিখিধ্বজকে উপহার দিয়েছিলেন।

ডঃ মুখার্জি হেসে ফেললেন, এই সিলটার মধ্যে ব্রাহ্মীলিপিতে কতকগুলো সাংকেতিক শব্দ লেখা আছে। অন্য পৃষ্ঠায় চন্দ্রকলা এবং একটা ত্রিভুজের ছবি আঁকা আছে। আপনি যদি আমাকে আজকের দিনটা সময় দেন, আমি সংকেতবাক্য এবং ঐ ছবির মর্মোদ্ধার করতে পারব।

কর্নেল বললেন, আপনি এটা রাখুন। কিন্তু একটু সতর্কতা দরকার। কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটা রহস্য।

ডঃ মুখার্জি ভ্রূ কুঁচকে চাপা হেসে বললেন, রহস্য ছাড়া কি আপনি এভাবে আমার কাছে ছুটে আসতেন?

কর্নেল বললেন, আমি ব্রাহ্মীলিপি পড়তে পারি তা আপনি জানেন। কিন্তু আমি এই সংকেত রহস্যের জট খুলতে পারছি না। আর একটা কথা, সিলটা দেখে আমার মনে হয়েছে এর সঙ্গে কোনো গুপ্তধনের সম্পর্ক আছে।

–আছে, বলে ডঃ মুখার্জি সিলটার উপরে আতসকাঁচ রেখে কিছু দেখতে দেখতে বিড়বিড় করতে লাগলেন।

কথাগুলি আমি বুঝতে পারলাম না। কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমার হাতে একেবারে সময় নেই। আপনি আমাকে ঐ সংকেত-রহস্য ভেদ করে দিতে পারলে খুশি হব। কিন্তু আপনাকে আবারও বলছি বিষয়টি খুবই গোপনীয়। আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে।

ডঃ মুখার্জি বললেন, আমার এই ঘরে অনেক গোপন জায়গা আছে। আশা করি আপনি ভুলে যাননি কোনো প্রত্নদ্রব্য নিয়ে পরীক্ষায় গোপনীয়তার দরকার হলে আমি এই ঘরের তলার বেসমেন্টে গিয়ে ঢুকি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকবেন।

ডঃ মুখার্জির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠলাম। স্টার্ট দিয়ে বললাম, এই ডঃ মুখার্জি কি সরকারি প্রত্নতত্ত্ব দপ্তরে ছিলেন?

-না জয়ন্ত। উনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। এইসব অমূল্য প্রত্নদ্রব্য নিয়ে কোনো সরকারি আর্কিওলজিস্টের কাছে যাওয়া নিরাপদ নয়। অবসরপ্রাপ্ত হলেও তাদের মনে একটা দায়িত্ববোধ কাজ করে। তাই তাদের বিশ্বাস করা কঠিন।

কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে দেখি এক প্রৌঢ়া মহিলা সসংকোচে সোফার নীচে কার্পেটে বসে আছেন।

ষষ্ঠীচরণ বলল, বাবামশাই, এই দিদিকে সাধাসাধি করেও সোফায় বসাতে পারিনি। এদিকে উনি কিছুতেই আপনার সঙ্গে দেখা না করে যাবেন না।

কর্নেল সেই মহিলাকে দেখছিলেন। ইজিচেয়ারে বসে তিনি বললেন, আপনি উঠে বসছেন না কেন?

প্রৌঢ়ার পরনে সাদাসিধে শাড়ি। হাত শূন্য। সিৗথও শূন্য। হঠাৎ চাপাস্বরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন তিনি। তারপর করজোড়ে বললেন, সাহেব, আমি লোকের বাড়ি বাসন মেজে কাপড় কেচে পেট চালাই। বড় বিপদে পড়ে আপনার কাছে আসতে হয়েছে।

–আপনি থাকেন কোথায়?

–আমাকে আপনি-টাপনি বলবেন না, সাহেব। আমি টালিগঞ্জের দিকে একটা বস্তিতে থাকি।

আমি বলে উঠলাম, আপনি কি নীলা রায়ের মা?

অমনি মহিলা আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন, হ্যাঁ বাবা, আমি সেই হতভাগী মা। নিজের বুদ্ধির দোষে আমার লেখাপড়া জানা মেয়েটা খুন হয়ে গেল। আমি পুলিশবাবুদের পায়ে ধরে সাধাসাধি করেও দেখলাম ঐ হারামজাদা দুলাল হাজরাকে পুলিশ ধরবে না। কারণ সে ভবেশ কুণ্ডুর চেলা।

কর্নেল অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বললেন, আপনাকে আমার কাছে আসতে কে বলল? আমার ঠিকানা-ই বা কে দিল আপনাকে?

নীলার মা বললেন, আমাদের পাশের বাড়িতে একটা টেলিফোন আছে। আজ সকালে সেই বাড়ির একটা মেয়ে আমাকে ডেকে বলল আমার নামে ফোন এসেছে। সাহেব, জীবনে আমি কখনো ফোন ধরিনি। আমার হাত কাঁপছিল। কানে ফোন তুলে ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করলাম, কে ফোন করছ, বাবা? তখন জবাব এল, সুনু। কোত্থেকে ফোন করে আমাকে বলছে, মাসিমা, আপনি এখনই এই ঠিকানায় কর্নেল সাহেবের সঙ্গে দেখা করুন। আপনার চেহারা, বাড়ির ঠিকানা সব বুঝিয়ে দিল সুনু।

আমি জিগ্যেস করলাম, সুনু? সে আবার কে?

কর্নেল আমার দিকে চোখ কটমটিয়ে বললেন, সুস্নাত। বলে তিনি চুরুট-কেস থেকে একটা চুরুট বের করে ধরালেন। তারপর একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে আবার বললেন, অঙ্ক জয়ন্ত, অঙ্ক। সব কিছুই চলেছে অঙ্কের নিয়মে। সুস্নাত নামটা অনিবার্য ভাবেই সেই নিয়মেই সুনু হয়ে উঠেছে।

নীলার মা বললেন, সুনু জানত আমার মেয়ের কাছে একটা জিনিস ছিল। সুনুর কথামতো নীলার বালিশের ওয়াড়ের ভেতর থেকে সেই জিনিসটা বের করে আপনাকে দিয়ে যেতে এসেছি। এই দেখুন সেই জিনিস।

এই বলে তিনি কর্নেলের হাতে একটা কাগজের মোড়ক দিলেন।

কর্নেল মোড়কটা খুলতেই কয়েকটা পুরনো ব্রোঞ্জের সিল বেরিয়ে এল। সিলগুলো আগের সিলটার মতো পরিষ্কার করা নেই।

কর্নেল বললেন, পুলিশ আপনাদের বাড়ি সার্চ করেনি?

–আজ্ঞে না, সাহেব। আমার মেয়েই তো খুন হয়েছে। আমার বাড়ি পুলিশ এসেছিল। অনেক কথা জিগ্যেস করেছিল। কিন্তু ঘরের ভিতরটা উঁকি মেরে দেখেই চলে গিয়েছিল।

কর্নেল সিলগুলো টেবিলের ড্রয়ারে রেখে বললেন, আপনার নামটা বলেননি কিন্তু।

নীলার মা চোখ মুছে জোরে শ্বাস ছেড়ে বললেন, সাহেব, আমার নাম সুশীলা রায়। আমার স্বামীর নাম ছিল প্রভাস রায়। ভাগ্যের দোষে আমাদের এই দুরবস্থা। নীলার বাবা একটা কারখানায় চাকরি করত। সেই কারখানা বন্ধ হয়ে যেতেই আমরা অথৈ পাথারে ভেসে গিয়েছিলাম। নীলার বাবা ক্যানসারে মারা পড়ল। মেয়েকে সে লেখাপড়া শিখিয়েছিল কিন্তু আমি তত লেখাপড়া করার সুযোগ পাইনি। তাই লোকের বাড়ি কাজ করে সংসার চালাতাম। মধ্যে কয়েকমাস নীলা লাহিড়ীবাবুদের অফিসে একটা চাকরি পেয়েছিল। সে চাকরি কেন গিয়েছিল তা এখন বুঝতে পারছি। আপনাকে যে জিনিসগুলো দিলাম, এখন বেশ বুঝতে পারছি নীলা ওগুলো সেই অফিস থেকে চুরি করেছিল। কিন্তু আমার অবাক লাগছে নীলা নিজের বুদ্ধিতে এই কাজ কখনোই করেনি। শয়তান দুলাল হাজরার পাল্লায় পড়েই এই কাজ করেছিল। সুনু তাকে সাবধান করে দিয়েছিল। কিন্তু হতভাগী মেয়েটা। টাকার লোভে পড়েই এভাবে জীবনটা খোয়ালো। আমি এখন সব বুঝতে পারছি।

কর্নেল বললেন, আপনি ঠিকই বুঝেছেন। এই জিনিসগুলো সে দুলালকে দেয়নি। সম্ভবত টাকার দাবি করেছিল। অবশেষে দুলাল তার পেছনে লাগে। রাতবিরেতে নীলার জানলার পাশে ফিসফিস করে জিনিসগুলো সে চাইত। কিন্তু তাতে কাজ না হওয়ায় চাকরির লোভ দেখিয়ে আপনার মেয়েকে সে নিয়ে যায়। এবং খুন করে। যাই হোক, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমি পুলিশকে বলে দেব যেন আপনার বাড়ির দিকে চোখ রাখে। আপনাকে শুধু এটুকু আশ্বাস দিতে পারি আপনার মেয়ের খুনি ধরা পড়বে এবং তার শাস্তি হবে।

সুশীলা উঠে দাঁড়িয়ে কর্নেল এবং আমাকে প্রণাম করে বেরিয়ে গেলেন। তারপর আমি বললাম, কর্নেল, একটা অদ্ভুত কেস আপনি হাতে পেয়েছেন। রহস্যের সূত্রগুলো আপনার কাছে নিজে থেকেই চলে আসছে।

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, না জয়ন্ত, যদি এই ব্রোঞ্জের সিলগুলোকে রহস্যের সূত্র বলে মনে করো, ভুল করবে। মিঃ লাহিড়ীর কাকা শচীনবাবু বাড়ির নীচের তলার মালিক ছিলেন। কাজেই অনেক প্রত্নদ্রব্য তিনি সেখানে ছবির আড়ালে বা কুলুঙ্গিতে রেখে দিতেই পারেন। আসল রহস্যটা রয়ে গেছে অন্য কোথাও।

–অন্য কোথাও মানে মিঃ লাহিড়ীর কাছে। তিনি তো তার কাকার কোটি টাকা দামের জিনিস হাতিয়েই ফেলেছেন।

এই সময় ডোরবেল বাজল। কর্নেল যথারীতি হাঁকলেন, ষষ্ঠী!

 লালবাজার গোয়েন্দা দপ্তরের এস আই মিঃ নরেশ ধর ঘরে ঢুকে বললেন, আবার নিজের তাগিদেই কর্নেল সাহেবের কাছে আসতে হল।

বসুন নরেশবাবু। আগে কফি খেয়ে নার্ভ চাঙ্গা করুন।

নরেশবাবু ঘড়ি দেখে বললেন, প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। তার উপর মার্চেই যা গরম পড়েছে। এই গরমে কফি সহ্য হবে না।

–তাহলে ঠান্ডা কিছু খান।

–না কর্নেল সাহেব। আপনার বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ায় আপনার কাছে হাজির হয়েছি।

-বলুন নরেশবাবু।

–বাই এনি চান্স, নীলা রায়ের ব্রেসিয়ারের ভিতর যে চিঠিটা পাওয়া গেছে, তার লেখক সুস্নাত কি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ, করেছিল। তবে আমি তাকে আপাতত গা ঢাকা দিতে বলেছি।

নরেশবাবু হাসবার চেষ্টা করে বললেন, কী সর্বনাশ! তাকেই যে আমাদের এখন সবচেয়ে বেশি দরকার।

কর্নেল বললেন, তাকে গা-ঢাকা দেওয়ার কথা বলার কারণ দুলাল বা তার। সাঙ্গোপাঙ্গদের হাতে সুস্নাতের বিপদ অনিবার্য ছিল।

-দুলাল ব্যাটাচ্ছেলেকে শিগগিরই পেয়ে যাব। অন্তত আমার এই ধারণা। কারণ তার মুরুব্বিটি আপাতদৃষ্টিতে শক্তিমান। আমাদের পুলিশ মহলে এই ভদ্রলোকের কিছুটা প্রভাব আছে। কেননা তিনি রাজনীতিওয়ালা।

–আপনি কি ভবেশ কুণ্ডুর কথা বলছেন?

নরেশবাবু ভ্রূ কপালে তুলে বললেন, কী অবাক, আপনি তাহলে পুরো ব্যাকগ্রাউন্ড পেয়ে গেছেন?

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, একটা ব্যাকগ্রাউন্ড পেয়েছি। সেটা হল ভবেশ কুণ্ডু আর নিশিকান্ত লাহিড়ীর মধ্যে নিশিকান্তবাবুর কাকা শচীন লাহিড়ীর উইল নিয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধ। কোন উইল জাল আর কোন উইল খাঁটি তা আদালতেই প্রমাণ হবে। কাজেই এই ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।

নরেশবাবু আস্তে বললেন, ওটা আপনার ভাষায় অবভাস তত্ত্ব। হোয়াট অ্যাপিয়ারস ইজ নট রিয়াল।

কর্নেল সকৌতুকে বললেন, বেশ তাহলে রিয়াল ব্যাকগ্রাউন্ডটা আপনারা পেয়ে গেছেন, এই তো!

নরেশ ধর উঠে দাঁড়িয়ে সহাস্যে বললেন, আপনি অঙ্ক কষার কথা বলেন, লালবাজারের সি আই ডি মহলের সেবা ব্রেনগুলো এখন রিয়াল ব্যাকগ্রাউন্ড খুঁজতে ব্যস্ত।

বলে তিনি পা বাড়িয়ে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন, আমার হাতে খবর আছে আপনার প্রিয় হালদারমশাই সন্ন্যাসী সেজে নিশিকান্ত লাহিড়ীর বাড়ির দিকে নজর রেখেছেন।

কর্নেল বললেন, সে কী! আপনাদের পক্ষ থেকেও তাহলে ঐ বাড়িটার দিকে নজর রাখা হয়েছে?

–অস্বীকার করছি না। বলে নরেশ ধর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশায়ের টেলিফোন এল বেলা তিনটেয়। তখন কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে চুরুট টানছেন এবং আমি ভাতঘুমের জন্য ডিভানে গড়াচ্ছি। কর্নেল কথা বলার পর আমার দিকে ঘুরে বললেন, জয়ন্ত, হালদারমশাই এইমাত্র রত্নময়ীকে বাড়ি থেকে বেরুতে দেখেছেন। তাকে বললাম আপনি মহিলাকে সাধু বেশেই ফলো করে যান। সময়মতো তার গন্তব্য আমাকে রিং করে জানাবেন।

জিগ্যেস করলাম, নিশিকান্তবাবুর খবর জানালেন না হালদারমশাই?

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। মিঃ লাহিড়ী বেলা সাড়ে বারোটায় গাড়ি চেপে বেরিয়ে গেছেন। এখনও ফেরেননি। কাজেই আশা করছি হালদারমশাই একটা ভালো খবর আমাদের দিতে পারবেন।

এই সময় হঠাৎ একটা প্রশ্ন আমার মাথায় এসে গেল। বললাম, আচ্ছা কর্নেল, নীলার কাছে কেউ রাতবিরেতে হারানকে ফেরত দে বলত। আপনার মতে, কেউ তাকে আসলে হারানো কোনও জিনিস ফেরত চাইত। সেই হারানো জিনিস এই তিনটে ব্রোঞ্জের সিল নয় তো? নীলা হয়তো এগুলো তাকে হারিয়ে গিয়েছে বলেছিল।

কর্নেল সহাস্যে বললেন, তুমি বুদ্ধিমান, ঠিক ধরেছ।

.

০৭.

সেদিন খাওয়া-দাওয়ার পর যথারীতি আমি ডিভানে গড়াচ্ছিলাম, একবার ঘুরে দেখেছিলাম কর্নেল সেই তিনটে ব্রোঞ্জের সিল কী একটা লোশন দিয়ে ঘষে পরিষ্কার করছেন। দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তারপর ঘুম ভেঙেছিল মষ্ঠীচরণের ডাকে। ঐ দিনও তার হাতে চায়ের কাপ, ট্রে। সে একগাল হেসে বলেছিল, টিকটিকিবাবু এসেছিলেন। দেখে তো চিনতেই পারিনি। একেবারে সাধুবাবা। মাথায় জটা, মুখে গোঁফ-দাড়ি, পরনে লাল কাপড়। আর হাতে একখানা ত্রিশূল।

জিগ্যেস করেছিলুম, তুমি চিনলে কী করে?

ষষ্ঠী আরও হেসে বলল, আমার নাম ধরে ডাকলেন। আর ওনার সেই বাঙাল কথাবার্তা।

যাক, তারপর কী হল বলল।

তার কাঁধে লাল কাপড়ের ঝুলি ছিল। সেই ঝুলি নিয়ে বাথরুমে ঢুকলেন। তারপর চান করে আবার হালদারমশাই হয়ে বেরিয়ে এলেন। বাবামশাই আমাকে বললেন, দেখছিস তো ষষ্ঠী, গোয়েন্দাগিরি করতে হলে কত কষ্ট করতে হয়।

ষষ্ঠীচরণ অনেকক্ষণ হালদারবাবুর সাধুবাবার পোশাক নিয়ে বকবক করে গেল। তরপর জিগ্যেস করেছিলাম, আজও আমার গাড়ি চুরি গেছে নাকি?

ষষ্ঠীচরণ মিটিমিটি হেসে বলল, গেছে দাদাবাবু। বাবামশাই টিকটিকিবাবুকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেছেন। বলে গেছেন, ফিরতে একটু দেরি হতে পারে।

চা খাওয়ার পর আজ আর ছাদের বাগানে গেলাম না। আমার কাগজের অফিসে চিফ অফ দ্য নিউজ ব্যুরো সত্যদাকে ফোন করে কড়া ধমক খেলাম। তারপর ওঁকে বুঝিয়ে বললাম। একটা বড়ো কেস হাতে পেয়েছি। কর্নেলের পেছনে টো টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কেসটা ফাঁস হলে দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা ঢিঢ়ি ফেলে দেবে। একেবারে এক্সকুসিভ স্টোরি। অন্য কোনো কাগজ এর পাত্তা পাবে না। সত্যদা হুমকি দিয়ে বললেন, তোমার ঐ কেস ফসকে গেলে তোমার চাকরি নট হয়ে যাবে, সাবধান।

রিসিভার রেখে মনে মনে একটু হাসলাম। এখনও এই কেস সম্পর্কে আমার স্পষ্ট ধারণা নেই। শুধু এইটুকু বুঝেছি এর মধ্যে একটা প্রাচীন বৌদ্ধ যুগের জিনিস। লুকিয়ে আছে, যার দাম নাকি এখনকার বাজারে কোটি টাকা।

বইয়ের র‍্যাক থেকে খুঁজে একটা পুরনো ভ্রমণকাহিনি পেলাম। এরিক নিউবি বলে এক ভদ্রলোকের লেখা এ শর্ট ট্রাভেল ইন দি হিন্দুকুশ। বই-এ ফোটো। আছে। তা দেখে বইটা পড়তে উৎসাহী হলাম। সোফায় হেলান দিয়ে বসে বইটা পড়তে পড়তে আলো কমে এল। ষষ্ঠী এসে আলো জ্বেলে দিয়ে গেল। আফগানিস্তানের একটা উপজাতি অধ্যুষিত এলাকার চমকপ্রদ বিবরণ। লোকগুলোর মধ্যে বৌদ্ধধর্মের অনেক আচার থেকে গেছে, যদিও তারা মুসলমান।

আমি খুব আশা করছিলাম কর্নেলের হাতের রহস্যটা যখন বৌদ্ধধর্মের পটভূমিকায়, তখন দৈবাৎ কোনও ক্লু পেতেও তো পারি। তখনই মনে পড়ল কোথায় রাজগৃহ আর কোথায় হিন্দুকুশ! কিন্তু বইটার আকর্ষণ আমাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। কতক্ষণ পরে ডোরবেল বেজেছিল এবং হালদারমশাইসহ কর্নেল ঘরে ঢুকেছেন, লক্ষ করিনি। হালদারমশায়ের সম্ভাষণে বই বন্ধ করে তাকালাম।

জয়ন্তবাবু কী বই পড়তাছেন?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, জয়ন্ত খুব আশা করে হিন্দুকুশ এলাকার একটা উপজাতির বিবরণ পড়ছিল, যারা ছিল একসময় বৌদ্ধ।

কিছু না বলে বইটা কর্নেলের বইয়ের র‍্যাকে যথাস্থানে রেখে এসে বললাম, আজও আমার গাড়ি চুরি করেছিলেন।

কর্নেল হাসিমুখে বললেন, হ্যাঁ, হঠাৎ হালদারমশাই এসে আমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার পেছনে ছুটতে বাধ্য করেছিলেন। বলছি। আগে কফি খেয়ে নার্ভ চাঙ্গা করে নিই।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ একটিপ নস্যি নিয়ে বললেন, আপনার গাড়ি লইয়া না  যাইলে পক্ষীরে পাইতাম না। সব সময় ট্যাক্সি পাওয়া যায় না। তাই কর্নেল স্যার কইলেন, জয়ন্তর গাড়ি আজও চুরি করুম। বলে তিনি খি খি করে হেসে উঠলেন।

একটু পরে ষষ্ঠীচরণ কফি ও স্ন্যাকস দিয়ে গেল! চুপচাপ কফি খাওয়ার পর কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, আশা করছি, আজ রাত্রেই নীলা রায়ের খুনি ধরা পড়বে। তবে ওটা পুলিশের কাজ। নরেশবাবুকে টেলিফোনে যা বলার বলে দিয়েছি।

অধীর আগ্রহে বললাম, কিন্তু আপনারা গিয়েছিলেন কোথায়?

গোয়েন্দাপ্রবর কিছু বলার আগেই কর্নেল বললেন, মিঃ লাহিড়ীর দূরসম্পর্কের বিধবা বোন রত্নময়ী গিয়েছিলেন ভবেশ কুণ্ডুর বাড়ি। তারপর তুমি যখন নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছ তখন হালদারমশাই একেবারে সাধুবেশে এসে খবর দিলেন রত্নময়ী ভবেশ কুণ্ডুর গাড়িতে চেপে বেরিয়ে গেছেন। ভবেশ কুণ্ডু নিজে ড্রাইভ করতে পারেন না। হালদারমশাই তাঁর বাড়ির গেটের পাশে রাস্তায় আসন করে বসেছিলেন। তার কানে আসে ভবেশ কুণ্ডু ড্রাইভারকে বলছেন, শ্যামবাজার যাব। খুব শিগগির যেতে হবে।

অবাক হয়ে বললাম, তাহলে কি ভবেশ কুণ্ডুর সঙ্গে নিশিকান্ত লাহিড়ীর জামাইবাবু মিঃ ভাদুড়ির কোনো যোগাযোগ আছে?

কর্নেল চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে চোখ বুজে হেলান দিয়ে বললেন, এইটেই তো আমাকে হতবাক করেছিল। রত্নময়ী শ্যামবাজারের অন্য কোথাও যেতে পারেন। ভেবেছিলাম, তাই মনে দ্বিধা নিয়ে মিঃ ভাদুড়ির বাড়ির একটু আগে গাড়ি রেখে। সর্তকভাবে বাইনোকুলারে চোখ রেখেছিলাম। আশ্চর্য ব্যাপার, একটা গাড়ি গাড়িবারান্দার তলায় দাঁড়িয়ে ছিল। আমি নাম্বারটা হালদারমশাইকে বলতেই উনি বললেন, হ্যাঁ, ঐ নাম্বারের গাড়িই ভবেশবাবুর গাড়ি।

আমি গাড়িটা আরও একটু তফাতে রেখে হালদারমশাইকে অপেক্ষা করতে বলেছিলাম। তারপর সোজা মিঃ ভাদুড়িকে চার্জ করতে চেয়েছিলাম। কেন তিনি তার শ্যালকের শত্রুপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন? কিন্তু সেই সুযোগ পেলাম না। গাড়ি থেকে নামতে যাচ্ছি, হালদারমশাই বললেন, ভবেশ কুণ্ডুর গাড়ি বেরিয়ে এসে রাস্তায় নেমেছে। কী আর করা যাবে! শুধু দেখে নিলাম ভবেশ কুণ্ডুর গাড়িতে এক প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা বসে আছেন। হালদারমশাই বললেন, উনি মিঃ লাহিড়ীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভবেশ কুণ্ডুর বাড়ি গিয়েছিলেন।

তখন হালদারমশাইকে ভদ্রমহিলার পরিচয় দিলাম। তারপর ভবেশ কুণ্ডুর গাড়ি ফলো করে চললাম।

কলকাতার রাস্তায় কোনো গাড়িকে ফলো করা খুব কঠিন। কিন্তু বাইনোকুলার থাকায় গাড়িটা মাঝে মাঝে দেখে নিচ্ছিলাম। যাই হোক, ভবানীপুরে মিঃ লাহিড়ীর বাড়ির কাছাকাছি একটা জায়গায় রত্নময়ীকে নামিয়ে দিয়ে ভবেশ কুণ্ডু চলে গেলেন।

আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর মিঃ লাহিড়ীর বাড়ির গেটের কাছে গাড়ি রেখে ভিতরে গেলাম। ততক্ষণে মিঃ লাহিড়ী বাড়ি ফিরেছেন। হরনাথকে দারোয়ান খবর দিল,তখন হরনাথ আমাদের নিয়ে গেল। যেতে যেতে সে চাপা স্বরে বলল, রত্নদির সঙ্গে কর্তামশায়ের খুব ঝগড়া হচ্ছে। কর্তামশাই বরাবর নিষেধ করেছেন, রত্নদি যেন একলা বাইরে না যান।

জিগ্যেস করলাম, আজ গিয়েছিলেন বুঝি?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। গিয়েছিলেন সেই দুপুরবেলায়। ফিরলেন এই এতক্ষণে।

একটু দ্বিধা দেখিয়ে বললাম, এসময় কর্তামশায়ের সঙ্গে দেখা করা উচিত হবে কি?

হরনাথ হাসতে হাসতে বলল, হ্যাঁ স্যার। আপনি গিয়ে পড়লে ওনাদের ঝগড়াঝাটি থেমে যাবে। টম কুকুর হলে কি হবে, ঝগড়াঝাটি সহ্য করতে পারে না। ঐ শুনুন না, কী বিচ্ছিরি চেঁচামেচি করছে।

আমাদের নীচের ঘরে বসিয়ে হরনাথ উপরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে নিশিকান্তবাবু নেমে এলেন। মুখে তখনও ক্রোধের ভাব স্পষ্ট। কোনো কথা না বলে তিনি ধপাস করে সোফায় বসলেন। আমি বললাম, দুপুরে ফোন করে আপনাকে পাইনি। এখান থেকে গিয়েই আপনাকে ফোন করার দরকার হয়ে পড়েছিল।

মিঃ লাহিড়ী মাথার চুল আঁকড়ে ধরে বললেন, রত্নকে নিয়ে আর পারা যাচ্ছে না। ওকে এত বারণ করেছি, তবু শ্যামবাজারে কোন আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাবেই আর সেখান থেকে জামাইবাবুর বাড়ি যাবে। আমি সোজাসুজি ওকে বললাম, জামাইবাবুর সঙ্গে ও যে চক্রান্ত করছে, তা আমি টের পেয়ে গিয়েছি। রত্ন ঝগড়া শুরু করল। বলল সে জামাইবাবুর কাছে গিয়ে থাকবে। শোভার সেবা করার জন্য একটি মেয়ে দরকার।

কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, যাই হোক, ইনিয়েবিনিয়ে সেই দীর্ঘ কাহিনি শোনানোর দরকার দেখছি না। মিঃ লাহিড়ীর কাছে তার কাকার সেই জিনিসটা দেখতে চাইলাম।

আমাকে অবাক করে উনি বললেন জিনিসটা কাছে রাখা নিরাপদ নয় ভেবে তিনি তার এক বিশ্বস্ত বন্ধু কমল অধিকারীর কাছে রেখে এসেছেন। তিনি শুধু বলেছেন, এটা তার কাকার রেখে যাওয়া একটা পাথরের পাত্র। নিছক প্রত্নদ্রব্য। কমল অধিকারী থাকেন ঢাকুরিয়ায়। তিনি একসময় পেশায় অ্যাডভোকেট ছিলেন। এই ভদ্রলোকের কাছেই নাকি তার কাকার আসল উইল রক্ষিত আছে।

কর্নেল চুপ করলেন। এবার গোয়েন্দাপ্রবর একটু হেসে বললেন, ফেরার পথে কী ঘটছে তা কইলেন না, কর্নেল স্যার?

 কর্নেল কোনো সাড়া দিলেন না।

 অবাক হয়ে বললাম, কী ঘটেছে, হালদারমশাই?

গোয়েন্দাপ্রবর মুচকে হেসে বললেন, একখান গাড়ি আমাদের ফলো কইর‍্যা আসতেছিল। সাদা রঙের মারুতি। পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে কর্নেল স্যার একপাশে গাড়ি দাঁড় করাইয়া একাই আউগাইয়া গেলেন। তারপর সাংঘাতিক কাণ্ড, বোঝেন জয়ন্তবাবু। ওখানে রাস্তার আলো খারাপ ছিল। ফুটপাতে একটা থামের আড়াল থেইক্যা কর্নেল স্যার আচমকা আর্মস বার কইর‍্যা মারুতির সামনের কাছে এক রাউন্ড ফায়ার করলেন। অমনি হৈহল্লা বাইধ্যা গেল। কর্নেল স্যারেরে কেউ লক্ষ করে নাই। উনি গাড়িতে আইয়া জোরে ডানদিকের গলিতে ঢুকলেন। লক্ষ করছিলাম ফুটপাতের লোকেরা আর গাড়িগুলি যে যে দিকে পারে পালানোর চেষ্টা করতাছে।

বললাম, কী সর্বনেশে কাণ্ড!

কর্নেল এতক্ষণে চোখ খুলে গলার ভিতরে বললেন, গাড়ির ড্রাইভার যে-ই হোক, সে ব্যাটাচ্ছেলে অক্ষত আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি ঠিক মাঝখানে ফ্রেমের নীচেই এক রাউন্ড গুলি ছুঁড়েছি।

তার মানে আপনি খুব খেপে গিয়েছিলেন? কিন্তু গাড়িতে গুলি না ছুঁড়ে সোজা গিয়ে সেই গাড়িতে যে বা যারা ছিল তাদের চার্জ করতে পারতেন। আপনার কাছে ক্যামেরা ছিল। তাদের ছবিও আপনি তুলে নিতে পারতেন। তাড়া করে গুলি ছুড়লেন কেন? আপনার এরকম আচরণ কখনও এতকাল লক্ষ করিনি। ব্যাপারটা কী? খুলে বলবেন?

কর্নেল তেমনি গম্ভীর মুখে বললেন, লোকটাকে একটু চমকে দিতে চেয়েছিলাম। আমি যে দরকার হলে তাকে গুলি করে মারতে পারি, এটা জানিয়ে দেওয়া উচিত মনে করছিলাম। তুমি তো জানো, ভারত সরকার আমাকে এই বিশেষ ক্ষমতাটা দিয়েছেন। আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনে আমি কাউকে গুলি করতেই পারি।

কর্নেলের মেজাজ দেখে আর কথা বাড়ালাম না।

টের পেয়ে হালদারমশাই গম্ভীর হয়ে গেলেন। একটু পরে টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল সাড়া দিয়ে বললেন, বলুন নরেশবাবু, আমার টিপস ঠিক কি না……ঠিক আছে, তাড়াহুড়ো করবেন না। শেষ রাতে বাড়ি ঘিরে ফেলে লোকটাকে পাকড়াও করবেন….হা, সে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি যে আপনারা এমন অভাবিত স্থানে তাকে পেয়ে যাবেন…ঠিক আছে, উইশ য়ু গুড লাক। 

রিসিভার রেখে কর্নেল ভেতরের ঘরে চলে গেলেন। এই সুযোগে হালদারমশাইকে জিগ্যেস করলাম, এই ব্যাপারটা কি আপনি কিছু জানেন, হালদারমশাই?

গোয়েন্দাপ্রবর আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন, আমি যখন এখানে আইছিলাম তখন কেউ কর্নেল স্যারেরে ফোন করছিল। কথাবার্তা শুইন্যা আমার সন্দেহ হইছিল কেউ য্যান ওনারে আমার ক্লায়েন্ট নীলা রায়ের খুনিরই খোঁজ দিল।

এবার জিগ্যেস করলাম, গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাবার পর কি কর্নেল কোথাও কাউকে টেলিফোন করেছিলেন?

-হ্যাঁ। সেন্ট্রাল এভিনিউতে একটা ফার্মেসি থেকে কর্নেল ফোন করেছিলেন। আমি জিগাইছিলাম, কারে ফোন করলেন। কর্নেল সাহেব শুধু কইছিলেন, লালবাজার সি আই ডি-কে অ্যালার্ট করে দিয়ে এলাম।

সেই সময় কর্নেল পোশাক বদলে ফিরে এলেন। এখন মুখে নির্মল হাসি। ইজিচেয়ারে বসে তিনি বললেন, জয়ন্ত, পার্ক স্ট্রিটের বিখ্যাত জুয়েলার্স চন্দ্র অ্যান্ড সন্স-এ একটা কেসের সময় তুমি বাইরে ছিলে। সেই কেসে মূল আসামী রণবীর গুপ্ত সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে খালাস পেয়েছে। দোষটা আমার নয়। পুলিশের চার্জশিটে কিছু আইনগত ত্রুটি ছিল। তোমার মনে পড়তে পারে, গত মাসে তোমাকে সেই কেসটার কথা বলেছিলাম। তোমাদের কাগজেই বেরিয়েছিল রণবীর খালাস পেয়েছে। আজ সন্ধ্যায় যে গাড়িটা ফলো করে আসছিল, সেই গাড়ির সামনের সিটের কাঁচ সরিয়ে একটা মুখ আমাকে দেখার চেষ্টা করছিল। আমি ছিলাম ড্রাইভিং সিটে। তার গাড়িটা ছিল আমার পিছনে একটু ডাইনের দিকে। তাই ব্যাকভিউ মিররে তাকে আমি দেখতে পেয়েছিলাম এবং দেখামাত্র চিনতে পেরেছিলাম। জয়ন্ত, আমার ধারণা এই কুখ্যাত ডাকাত রণবীর সম্ভবত মিঃ লাহিড়ীর এই কেসের সঙ্গে কোনো সূত্রে জড়িয়ে গেছে। স্বভাব যাবে কোথায়? রণবীরের কাজই হল দামি জুয়েল যে কোনো উপায়ে সংগ্রহ করে আবুধাবি অঞ্চলে পাচার করা। ওখানে অবশ্য জুয়েস-এর দাম এখানকার থেকে কম। তাই সেখানকার কোনো এজেন্টের সাহায্যে সে চোরা জুয়েল্স ইউরোপ-আমেরিকায় পাচার করে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে কোনো উপায়েই হোক সে মিঃ লাহিড়ীর কাছে রক্ষিত কোনো মূল্যবান জুয়েল্স-এর খোঁজ পেয়ে গেছে।

আমি উদ্বিগ্ন মুখে বললাম, কর্নেল, নিশিকান্তবাবু বলছিলেন তার কাকার রক্ষিত গোপন জিনিসটা বিক্রি করে চন্দননগরে একটা পার্ক তৈরি করবেন। তিনি কোনো সূত্রে এই রণবীরের পাল্লায় পড়েননি তো? আমার মনে হয়, নিশিকান্তবাবুকে আপনার লোকটার বিষয়ে সাবধান করে দেওয়া দরকার।

কর্নেল শুধু বললেন, যথাসময়ে করব।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ বলে উঠলেন, আচ্ছা, কর্নেল স্যার, এই রণবীরের কথা আপনি নরেশবাবুগো জানাইয়া দ্যান। তাতে কাম হইব।

কর্নেল তেমনই গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, দেখা যাক।

সে রাত্রে হালদারমশাইকে কর্নেল সকাল ৯টার মধ্যে এখানে আসার নির্দেশ দিয়েছিলেন। গোয়েন্দাপ্রবর খুব উত্তেজিতভাবে বেরিয়ে যাবার পর আমি জিগ্যেস করেছিলাম, নীলার মায়ের দিয়ে যাওয়া ব্রোঞ্জের সেই তিনটে সিল আপনাকে পরিষ্কার করতে দেখেছি। এই সিল তিনটে কি আপনি পড়তে পেরেছেন?

কর্নেল বলেছিলেন, ব্রাহ্মীলিপি আমি পড়তে পারি। কিন্তু এই সিল তিনটিতেও যা লেখা আছে, তা আমার পক্ষে মর্মোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে একটা কথা বুঝতে পেরেছি, এ তিনটে সিলের সঙ্গে অধ্যাপক ডঃ মুখার্জিকে দেওয়া সিলটার সম্পর্ক আছে। কারণ এ তিনটে সিলের পিঠেও ত্রিভুজ এবং চন্দ্রকলা আঁকা আছে। আর মাঝখানে ঢেউখেলানো কয়েকটা রেখা। যাই হোক, আগামী কালই রহস্যের কুয়াশা সরিয়ে ফেলতে চাই।

.

০৮.

সে রাত্রে ডিনারের পর কর্নেল অভ্যাস মতো ড্রইংরুমে ঢুকে তার ইজিচেয়ারে বসে চুরুট টানছিলেন। আমার মনে কৌতূহল ততক্ষণে তীব্র হয়ে উঠেছিল। কারণ কর্নেল বলেছেন আগামী কালই রহস্যের কুয়াশা তিনি সরিয়ে ফেলতে চান। সে কি এই কারণেই যে এক কুখ্যাত জুয়েলারি-স্মাগলার রণবীর গুপ্তের আকস্মিক আবির্ভাব ঘটেছে বলেই!

আমাকে দেখে কর্নেল মৃদু হেসে বললেন, তোমার মনে অস্থিরতা এত বেশি যে এখনও তুমি এই বৃদ্ধের সঙ্গ ছেড়ে বেডরুমের দিকে যাচ্ছ না।

বললাম, আপনি থট রিডিং জানেন।

কর্নেল আমার কথার জবাব না দিয়ে ফোনের রিসিভার তুলে নিলেন। তারপর ডায়াল করে সাড়া এলে বললেন, আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। আপনি কি ম্যানেজার মিঃ রঙ্গনাথনকে লাইনটা দেবেন?

কিছুক্ষণ ধরে থাকার পর কর্নেল বললেন, হ্যালো মিঃ রঙ্গনাথন, আশা করি আপনার কোনো কাজে ব্যাঘাত ঘটাইনি…..না, না, তত কিছু সিরিয়াস নয়। আমি শুধু জানতে চাইছি আজ হোটেল এশিয়ার কোনো বোর্ডারকে কি আপনাদের ট্রান্সপোর্ট সেকশন থেকে একটা সাদা মারুতি ভাড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন…আঁ, বলেন কী? গাড়িটা অ্যাকসিডেন্ট করে সামনের কাঁচ ভেঙেছে?……হ্যাঁ, কমপেনসেশন তো আপনারা আদায় করে নেবেন। আমি শুধু জানতে চাইছি বোর্ডারের নাম কী এবং কত নম্বর সুইটে আছেন…না, মিঃ। রঙ্গনাথন, এটা তেমন কোনো সিরিয়াস কেস নয়। আপনার হোটেলের সুনামের হানি হবে এমন কিছু ঘটবে না। আপনারা বরাবর আমাকে সাহায্য করেছেন। আশা করি এ সাহায্যটুকু পাব। আমি কথা দিচ্ছি এতে আপনার কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু আমার লাভ হবে…..হ্যাঁ, লিখে নিচ্ছি…

কর্নেল কাগজের একটা স্লিপ টেনে নিলেন, তারপর বললেন, বলুন মিঃ রঙ্গনাথন….বিজয় বর্মন, সুইট নম্বর সিক্স টু ওয়ান।…অনেক ধন্যবাদ, মিঃ রঙ্গনাথন।

তিনি রিসিভার রেখে দিয়ে আমার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হেসে বললেন, কী বুঝলে বলো জয়ন্ত।

বললাম, বুঝতে পারছি হঠাৎ এই রহস্যের আবর্তে আপনার চেনা এক স্মাগলার এসে জড়িয়ে পড়েছে বলে আপনার সন্দেহ। কিন্তু আপনি কি সত্যিই নিশ্চিত হবার মতো কোনো সূত্র পেয়ে গেছেন?

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, কথাটা গোপন রেখে তোমাকে শেষ মুহূর্তে চমকে দেব ভেবেছিলাম। তবে আরো চমক হয়তো অপেক্ষা করে আছে। তাই এই সূত্রটা জানিয়ে দিই। মিঃ লাহিড়ী বোনের সঙ্গে ঝগড়াঝাটির ফলে উত্তেজিত ছিলেন। উত্তেজনার ঝেকেই মুখ ফসকে আমার এবং হালদারমশায়ের সামনে বলে ফেলেছেন তার কাকার রক্ষিত জিনিসটার খদ্দের উনি পেয়ে গেছেন। ঢাকুরিয়ার অ্যাডভোকেট ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে জিনিসটা বেচতে যাবেন। খদ্দের টেলিফোনেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। এই খদ্দেরটি ভবেশ কুণ্ডুর পরিচিত।

মিঃ লাহিড়ী বলেন, আপনাকে বলিনি গত এক বছর যাবৎ হংকংবাসী এই ভদ্রলোক প্রায়ই কলকাতা এসে আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। মুখোমুখি বার তিনেক তার সঙ্গে কথাবার্তাও হয়েছে। আমি একবার জামাইবাবুকেও কথাটা বলেছিলাম, উনি আপত্তি করেননি। ক্যাশ টাকা দেবে, কাজেই আমি সতর্ক হয়েই। যাব।

জয়ন্ত, এরপর রহস্য ফাঁস করতে আর তো কোনো অসুবিধা নেই। নরেশবাবুকে বলে রেখেছি হোটেল এশিয়ায় কাল ভোরবেলা থেকেই স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিশ সাদা পোশাকে মোতায়েন থাকবে। যাগে, তুমি এবার ঘুমোতে যাও।

রাতটা ছিল বেজায় দুঃস্বপ্নে ভরা। ভালো ঘুম হয়নি। ভোরের দিকে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ষষ্ঠী দরজায় চা নিয়ে টোকা দিতেই ঘুম ভেঙেছিল। দরজা খুলে দেখি ষষ্ঠী দরজায় চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সে একটু হেসে বলল, আজ দাদাবাবু বহুত ঘুম ঘুমিয়েছেন। দুবার চা নিয়ে এসে ফিরে গেছি। কটা বাজে দেখেছেন?

দেওয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সওয়া আটটা বাজে। বাসি মুখে বেডটি খাওয়ার পর প্রাতঃকৃত্য সেরে এবং দাড়ি কামিয়ে ড্রইংরুমে গেলাম। দেখলাম, সেখানে কর্নেল নেই। ষষ্ঠীকে জিগ্যেস করলে সে বলল, বাবামশাই আজ ভোরবেলা বেরিয়েছেন। আপনার গাড়ি নিয়ে যাননি। ছাদের বাগান থেকে দেখেছি রাস্তার মোড়ে উনি ট্যাক্সিতে চেপে চলে গেলেন।

সেদিনের খবরের কাগজগুলো একটার পর একটা তুলে শুধু প্রথম পাতাগুলোয় চোখ বুলিয়ে নিলাম। তেমন কোনো ঘটনার খবর নেই। একটু পরে ডোরবেল বাজল। ভাবলাম কর্নেল হয়তো ফিরে এলেন। কিন্তু তার বদলে প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাই সবেগে ঘরে ঢুকে সোফায় বসলেন। তারপর বললেন, কর্নেল স্যার গেলেন কই?

বললাম, ভোরবেলা বেরিয়েছেন। কোথায় গেছেন আমিও জানি না।

হালদারমশাই চাপাস্বরে বললেন, একখান গোপন কথা এই সুযোগে কইয়্যা লই। কাইল মিঃ লাহিড়ী কইছিলেন, তাঁর দামি জিনিসটার খদ্দের পাইছেন। সে থাকবে

তার কথার উপর বললাম, হোটেল এশিয়ায়। এই তো? হালদারমশাই, কথাগুলো গতরাত্রে আপনার কর্নেল স্যার আমাকে জানিয়ে দিয়েছেন।

গোয়েন্দাপ্রবর খিকখিক করে হেসে উঠলেন। বললেন, হঃ, হোটেল এশিয়ায় আজ একখান বোমা ফাটব। বলে তিনি হাঁক দিলেন, ওহে ষষ্ঠী, এককাপ কফি লইয়া আও। চা খাইয়া তেষ্টা মেটে নাই।

ষষ্ঠী যেন তৈরিই ছিল। একটা ট্রেতে কফির পট, দুধ, তিনটে পেয়ালা আর দুপ্লেট স্ন্যাক্স দিয়ে গেল। আমি জিগ্যেস করলাম, তোমার বাবামশাই তো নেই, তিনটে পেয়ালা কেন?

ষষ্ঠী মুচকি হেসে বলল, জানালা দিয়ে দেখলাম বাবামশাই গেটের সামনে ট্যাক্সি থেমে নামছেন।

একটু পরেই ডোরবেল বাজল। তারপর কর্নেল হাসিমুখে ড্রইংরুমে ঢুকে সম্ভাষণ করলেন, মর্নিং জয়ন্ত, মর্নিং হালদারমশাই।

হালদারমশাই বললেন, মর্নিং কর্নেল। আমি কিন্তু আইতে দেরি করি নাই।

কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে বললেন, বাঃ, ষষ্ঠীটার দিব্যদৃষ্টি আছে।

কফি খেতে খেতে জিগ্যেস করলাম, ভোরবেলা বেরিয়েছিলেন শুনলাম।

কর্নেল বললেন, মিঃ লাহিড়ী এখনও জানেন না তার কাকা যে চৌকো পাথরের প্রত্নদ্রব্য রেখে গেছেন সেটা একটা আধার। সে আধার খুলতে হলে চারটে ব্রোঞ্জের সিলের লিপিরহস্য উদ্ধার করা দরকার।

বললাম, আপনি কি অধ্যাপক ডঃ মুখার্জির বাড়ি গিয়েছিলেন?

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। ডঃ মুখার্জি আমাকে দেখেই বলে উঠেছিলেন, কর্নেল সাহেব, আরও তিনটে সিল থাকার কথা। চারটে সিল মেলালে তবেই সঙ্কেতবাক্যের অর্থ পরিষ্কার হবে। যাই হোক আমি সিল তিনটে তাকে দিলাম। আধঘন্টার মধ্যে উনি জানিয়ে দিলেন, এগুলোতে তো একটা কষ্টিপাথরে তৈরি পেটিকার কথা আছে। সেই পেটিকা কীভাবে খোলা যাবে তা উনি একটা কাগজে আমাকে লিখে দিয়েছেন।

হালদারমশাই বললেন, আপনি মিঃ লাহিড়ীকে একথা কি জানাইয়া দিছেন?

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। কাজেই মিঃ লাহিড়ী কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর অ্যাডভোকেটের বাড়ি থেকে জিনিসটা নিয়ে আমার কাছে আসছেন। আমি তাকে একলা আসতে বলেছি।

কফি খেয়ে কর্নেল ভেতরের ঘরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি পোশাক বদলে বেরিয়ে এসে বললেন, জয়ন্ত, তুমি রেডি হয়ে এসো। সঙ্গে তোমার লাইসেন্সড় ফায়ার আর্মসটাও নিতে ভুলো না। হালদারমশাই নিশ্চয় রেডি হয়েই। এসেছেন।

হালদারমশাই তার প্যান্টের পকেটে হাত ভরে উত্তেজিত ভাবে বললেন, আমি এক্কেরে রেডি।

নিশিকান্ত লাহিড়ী এলেন প্রায় এক ঘন্টা পরে। ততক্ষণে আমরা ব্রেকফাস্ট করে ফেলেছি। মিঃ লাহিড়ীর স্নায়ু চাঙ্গা করতে আবার একদফা কফি দিয়ে গেল। ষষ্ঠী। কফি খেতে খেতে মিঃ লাহিড়ী বললেন, জিনিসটা তাহলে বের করি?

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ।

মিঃ লাহিড়ী একটা কাপড়ের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে এনেছিলেন। একেবারে সাদাসিধে একটু নোংরা ধরনের ব্যাগ। বোঝাই যাবে না ওটার ভেতরে প্রায় কোটি টাকার জিনিস ভরা আছে।

সেই ব্যাগ থেকে মসৃণ কষ্টিপাথরের প্রায় ছইঞ্চি লম্বা, পাঁচ ইঞ্চি চওড়া এবং ইঞ্চি তিনেক উঁচু রত্নাধারটি বের করে কর্নেলের হাতে দিলেন।

কর্নেল বুকপকেট থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করে রত্নাধারের নানা জায়গায় মৃদু চাপ দিতে শুরু করলেন। রত্নাধারের উপরে, তলায় এবং চারপাশে এইভাবে চাপ দেওয়ার পর রত্নাধারটির উপরের দিকটা যেন জাদুবলে খুলে টেবিলে পড়ল।

হাঁ করে তাকিয়ে দেখলাম ভিতরে একটা ইঞ্চি চারেক উঁচু বুদ্ধের মাথা। চুলগুলো কোঁকড়ানো। দুটি চোখের পাতা উজ্জ্বল নীল। চোখের তারা ঝকমকে লাল। বুদ্ধদেবের এই মাথা যে নিরেট সোনার তৈরি তা দেখেই বুঝেছিলাম। মাথার নীচে এক ইঞ্চি ফলকে সম্ভবত ব্রাহ্মীভাষায় কীসব কথা খোদাই করা আছে।

কর্নেল বললেন, রাজগৃহের বৌদ্ধ রাজাকে বণিক মহাদত্ত এই মূর্তিটা যবদ্বীপ থেকে কিনে নিয়ে গিয়ে উপহার দিয়েছিলেন।

নিশিকান্তবাবু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলেন। বললেন, এই বহুমূল্য প্রত্নদ্রব্য আমার আর বিক্রি করতে ইচ্ছে করছে না।

কর্নেল বললেন, ইচ্ছে না করলে বিক্রি করবেন না। কিন্তু এটা আপনার সেই খদ্দেরের কাছে নিয়ে গিয়ে দাম যাচাই করতে দোষ কী? আপনি এখনই হোটেল এশিয়ায় ফোন করে জানিয়ে দিন, জিনিসটা নিয়ে আপনি যাচ্ছেন। দরদাম এবং নগদ টাকাকড়ির লেনদেন সেখানেই হবে।

নিশিকান্তবাবু একটু ইতস্তত করার পর টেলিফোন করলেন। তারপর রিসিভার। রেখে বললেন, মিঃ বিজয় বর্মন আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।

কর্নেল বললেন, তাহলে চলুন, এখনই বেরুনো যাক। একটা কথা এখানে বলে রাখি। আমরা কিন্তু আপনার সঙ্গে ঘরে ঢুকব না। আরও একটা কথা, আপনি ঘরে ঢুকে যদি বিন্দুমাত্র বিপদের সম্ভাবনা দেখেন, কর্নেল সাহেব বলে চিৎকার করে উঠবেন। এই হোটেলে সব সুইটে ল্যাচ-কী আছে। ভেতর থেকে দরজা খোলা যায়। কিন্তু বাইরে থেকে চাবি ছাড়া ঢোকা যায় না।

নিশিকান্তবাবু কর্নেলের কথা শুনে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছিলেন। তিনি বললেন, তাহলে হরনাথকে ডেকে তাকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢুকব।

কর্নেল বললেন, দরকার নেই। হোটেলের ম্যানেজার মিঃ রঙ্গনাথনের কাছ থেকে আমরা ঐ সুইটের ডুপ্লিকেট চাবি চেয়ে নেব। কাজেই কোনো চিন্তা করবেন না। আপনি বুদ্ধমূর্তিটা এই কাগজে মুড়ে নিন। কষ্টিপাথরের রত্নাধারটা আলাদা থাক।

নিশিকান্তবাবু নিজের গাড়ি এনেছিলেন। হোটেল এশিয়া ল্যান্সডাউন রোডের মোড়ে। নিশিকান্তবাবুর গাড়ির একটু তফাতে আমার গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছিল। হোটেল এশিয়ার লনে নিশিকান্তবাবুর গাড়ি ঢুকে গেলে আমার গাড়ি গেটের একপাশে পার্কিং জোনে দাঁড় করালাম। লক্ষ করলাম একটু তফাতে পুলিশের একটা বেতার ভ্যান এবং লাল রঙের জিপ দাঁড়িয়ে আছে। আমি নামতে যাচ্ছিলাম, কর্নেল চাপাস্বরে বললেন, একটু পরে। ঐ দেখো, নরেশবাবু আসছেন।

দেখলাম নরেশ ধর সাদা পোশাকে হোটেলের গেট থেকে বেরিয়ে আসছেন। কাছে এসে তিনি মৃদুস্বরে কর্নেলকে বললেন, সাততলার সুইটটিকে আমাদের লোকেরা ঘিরে রেখেছে। কিন্তু একটা আশ্চর্য ব্যাপার, আমি হোটেলের লাউঞ্জে একটু আগে ভবেশ কুণ্ডু আর মিঃ লাহিড়ীর জামাইবাবু মিঃ ভাদুড়িকে পাশাপাশি বসে থাকতে দেখেছি। কিছু বুঝতে পারছি না।

কর্নেল বললেন, একটু পরেই বোঝা যাবে। তবে আজ শেষ রাতে দুলাল হাজরাকে পাকড়াও করতে পেরেছেন তো?

নরেশবাবু হাসতে হাসতে বললেন, আমি কল্পনাও করতে পারিনি দুলাল হাজরাকে মিঃ ভাদুড়ির বাড়িতে পেয়ে যাব।

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, এ বিষয়ে মিঃ ভাদুড়ির বক্তব্য কী?

নরেশবাবু বললেন, তাঁর বাড়ির কাজের লোকের সঙ্গে দুলাল হাজরার আত্মীয়তা আছে। কাজেই এই ব্যাপারে তিনি বিন্দুবিসর্গও জানেন না। তিনি তার রুণ স্ত্রীকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। নীচের তলায় রাত্রিবেলায় কে কী করছে তা তিনি কী করে জানবেন? কাজেই আমরা মিঃ ভাদুড়িকে আর ঘাঁটাইনি, আসামীকে নিয়ে চলে গিয়েছিলাম। এবার কর্নেল গাড়ি থেকে নামলেন। বললেন, নরেশবাবু, আপনি মিঃ রঙ্গনাথনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন কি?

-হ্যাঁ, করেছি। আপনার কথামতো ঐ সুইটের ডুপ্লিকেট চাবিও নিয়েছি।

কর্নেল বললেন, তাহলে আর দেরি নয়। চলুন, যথাস্থানে যাওয়া যাক।

হোটেলের লাউঞ্জে বিশাল গেট দিয়ে ঢুকে নরেশবাবু চাপাস্বরে বললেন, ভবেশবাবু বা মিঃ ভাদুড়িকে তো দেখতে পাচ্ছি না। আমরা সোজা লিফটের কাছে যেতেই কর্নেলের পূর্বপরিচিত ম্যানেজার মিঃ রঙ্গনাথন বিব্রত মুখে বললেন, দেখবেন স্যার, যেন এই হোটেলের কোনো দুর্নাম না হয়।

অটোমেটিক লিফট সাততলায় পৌঁছল। আমরা করিডর দিয়ে সাবধানে সুইট নম্বর সিক্স টু ওয়ানের দিকে এগিয়ে গেলাম।

কর্নেল এবং নরেশবাবু কপাটে কান পেতে কথা শোনার চেষ্টা করলেন। তারপর পায়ের শব্দে পিছু ফিরে দেখি লিফট থেকে সদ্য নেমে এগিয়ে আসছিলেন রত্নময়ী। আমাকে দেখামাত্র থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। কর্নেল মুখ ঘুরিয়ে তাকে দেখেই এগিয়ে গিয়ে বললেন, আপনি সময় মতো এসেছেন। ঐ ঘরের দরজায় গিয়ে টোকা দিন। দরজা খুলে গেলে ভিতরে ঢুকবেন।

রত্নময়ী কাঁদো কাঁদো মুখে চাপাস্বরে বললেন, আমাকে জামাইবাবু এখানে আসতে বলেছিলেন। আমাকে ওঁরা টাকার ভাগ দেবেন। তাই এসেছি, বাবা।

কর্নেল চাপাস্বরে বললেন, আমরা আড়ালে যাচ্ছি। আপনি এগিয়ে গিয়ে ঐ ঘরের দরজায় টোকা দিন। দরজা খুলে আপনার জামাইবাবু আপনাকে দেখলেই ডেকে নেবেন। সাবধান, আমাদের কথা যেন বলবেন না। তাহলে আপনার বিপদ হবে।

রত্নময়ী কুণ্ঠিতভাবে এগিয়ে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ালেন। আমরা করিডরের বাঁকে আড়ালে সরে গেলাম। একটু পরে কর্নেল উঁকি মেরে দেখে বললেন, ভদ্রমহিলা তার বখরা নিতে এসেছিলেন, পেয়েও যাবেন বলে মনে হচ্ছে। কারণ উনি ঘরে ঢুকতে পেরেছেন।

এবার লক্ষ করলাম, আশেপাশের করিডরে সাদা পোশাকের কয়েকজন পুলিশ পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কর্নেল চাপাস্বরে বললেন, নরেশবাবু, আপনি সটান গিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকবেন। আমরাও আপনাকে ফলো করব।

নরেশবাবু সিক্স টু ওয়ান সুইটের ল্যাচ কী-তে দ্রুত ডুপ্লিকেট চাবি ঘুরিয়ে ঘরের দরজা খুলে ফেললেন। তারপর ঘরে ঢুকে গেলেন। তার পিছনে কর্নেল, হালদারমশাই এবং আমি।

ঘরে ঢুকেই দেখি সে এক বীভৎস দৃশ্য! ঘরের মেঝেয় পড়ে আছে একটা লোক। আর ভবেশ কুণ্ডু একটা প্রকাণ্ড সুটকেস খুলে জিনিসপত্র তছনছ করছেন। মিঃ ভাদুড়ি বিছানা উল্টে ফেলে কিছু খুঁজছেন। আর রত্নময়ী হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কর্নেল ডাকলেন, মিঃ লাহিড়ী, আপনি কোথায়?

নিশিকান্তবাবু বাথরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। ভীত পাণ্ডুর মুখে তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, আমি ঘরে ঢুকে মিঃ বিজয় বর্মনের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছি। তারপর দরজায় টোকার শব্দ। আমার নিষেধ সত্ত্বেও মিঃ বর্মন গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। অমনি ভবেশ আর জামাইবাবু ঘরে ঢুকে মিঃ বর্মনের উপর লাফিয়ে পড়লেন। দুজনে ওঁকে মেঝেয় ফেলে একজন গলা টিপে ধরলেন আর একজন ওঁর মুখে বালিশ চেপে ধরলেন। অমনি আমি বুঝে গেলাম মিঃ বর্মনের টাকার লোভে ওরা দুজনে তাকে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলল। এবার ভবেশ উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকাতেই আমি দেখলাম দরজার দিকে গেলে ওর পাল্লায় পড়ব। তাই পিছনের বাথরুমে ঢুকে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। কর্নেল সাহেব বলে চেঁচাতে বলেছিলেন, কিন্তু আমার অবস্থা তখন শোচনীয়। আমার গলা দিয়ে স্বর বেরুচ্ছে না। প্রতিমুহূর্তে ভাবছি ভবেশ কুণ্ডু দরজা ভেঙে এসে আমার কাছ থেকে মূর্তিটা হাতাবে।

কর্নেল তার এক চরম শত্রু বিজয় বর্মন ওরফে রণবীর গুপ্তের পাশে বসে পরীক্ষা করে দেখছিলেন জীবনের কোনো স্পন্দন আছে নাকি। তিনি তখনই উঠে বিছানার মাথার টেলিফোন ডায়াল করে মিঃ রঙ্গনাথনকে বললেন, শিগগির একজন ডাক্তার পাঠিয়ে দিন। তারপর তিনি বিজয় বর্মনের নিস্পন্দ শরীরের উপর ঝুঁকে হৃৎপিণ্ডে দুহাতে চাপ দিতে থাকলেন। সেই সঙ্গে মাঝে মাঝে নিজের দাড়িওয়ালা মুখ তার মুখে রেখে জোরে শ্বাস ছাড়ছিলেন।

ওদিকে নরেশবাবুর নির্দেশে পুলিশবাহিনী ভবেশ কুণ্ডু আর মিঃ ভাদুড়ির হাতে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে গেল। অন্য একজন পুলিশ রত্নময়ীকে বলল, আপনার গায়ে হাত দেব না। আপনি চুপচাপ আমার সঙ্গে চলুন।

রত্নময়ী এতক্ষণে আর্তনাদ করে উঠলেন, আমি তো কোনো দোষ করিনি, বাবা। আমাকে জামাইবাবু আসতে বলেছিলেন তাই এসেছিলাম। ওরা যে একটা লোককে খুন করবে তা কি করে জানব?

পুলিশটি ধমক দিয়ে বলল, কোনো কথা নয়, চুপচাপ আমার সঙ্গে চলুন।

 বাইরে করিডরে তখন আশেপাশের বোর্ডাররা এসে ভিড় করেছিল। পুলিশবাহিনী ভিড় হঠাচ্ছিল।

একটু পরেই বিজয় বর্মনের কাশির শব্দ শুনলাম। বুঝতে পারলাম লোকটা প্রাণে বেঁচে গেছে। বন্ধ হৃৎপিণ্ড কর্নেল আবার চালু করতে পেরেছেন। অথচ এই লোকটা নাকি কর্নেলের এক ভয়ঙ্কর শত্রু। কাল সকালে ভয় দেখাতেই কর্নেল তার গাড়ির কাঁচে এক রাউন্ড গুলি ছুঁড়েছিলেন। বিজয় বর্মনকে তুলে সোফার গায়ে ঠেস দিয়ে রেখে কর্নেল বললেন, জয়ন্ত, হাঁ করে দেখছ কী? একগ্লাস জল দাও।

আমি বিছানার মাথার কাছে রাখা জলভরা জগটা কর্নেলের হাতে তুলে দিলাম। কর্নেল তার মুখেচোখে জল ছিটিয়ে দিলেন। বললেন, রণবীর, তোমার মুখে একটু জল দিচ্ছি। কিন্তু সাবধান, জলটুকু তাড়াহুড়ো করে গিলবে না।

রণবীর কর্নেলের হাত চেপে ধরে অতিকষ্টে বললেন, ক্ষমা।

কর্নেল বললেন, রণবীর, তুমি আমার যতই শক্র হও, তুমি আমার কাছে একজন মানুষ। সামরিক জীবনে আমাকে কতবার শক্রসৈন্যের মুখে জল দিতে হয়েছে।

এইসময় হোটেলের ম্যানেজার মিঃ রঙ্গনাথন একজন ডাক্তার নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। ডাক্তার রণবীর গুপ্তের পাশে বসতেই কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। গম্ভীর মুখে বললেন, ভবেশ গুপ্ত আর ভাদুড়ি ওকে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলতে চেয়েছিল।

মিঃ রঙ্গনাথন বললেন, সে কী! কেন?

কর্নেল বললেন, দুজনেই চক্রান্ত করেছিল বিজয় বর্মন ওরফে জুয়েলারি স্মাগলার রণবীর গুপ্তকে শ্বাসরোধ করে মেরে টাকাগুলো হাতাবে। তারপর মিঃ লাহিড়ীর মুখোমুখি হবে। দরকার হলে হয়তো মিঃ লাহিড়ীকেও হত্যা করে দুজনে একটা দামি মূর্তি হাতিয়ে নিত। যে ভদ্রমহিলাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল তাকেও কিছু টাকা দিত। কিন্তু রণবীর গুপ্ত তাদের চেয়ে ধূর্ত। নগদ টাকা সে এভাবে কখনো সঙ্গে রাখে না। বরাবর দেখে আসছি দুটো হোটেলে এসে সে থাকে। কাজেই টাকা দিতে হলে মিঃ লাহিড়ীকে সে সেই হোটেলেই নিয়ে যেত অথবা মিঃ লাহিড়ীকে এখানেই খুন করে মূর্তিটা হাতিয়ে নিয়ে কেটে পড়ত।

ডাক্তার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, মিঃ রঙ্গনাথন, ফোন করে বলে দিন, নীচ থেকে স্ট্রেচার নিয়ে আসতে। এই ভদ্রলোককে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।

হালদারমশাই গুম হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শুধু বললেন, কী কাণ্ড! অহিংসার সিম্বলেরে লইয়্যা জব্বর হিংসা!