কবরের অন্ধকারে

কবরের অন্ধকারে

০১.

এক্সকিউজ মি।

একটু অন্যমনস্ক ছিলাম। ফেব্রুয়ারি মাসের রাত দশটায় সদর স্ট্রিটের মোড়ে ট্রাফিক সিগনাল তখনও লাল। ফুটপাত ঘেঁষে আমার গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল, স্টার্ট বন্ধ করে দিয়েছিলাম। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। হঠাৎ ওই মৃদু কণ্ঠস্বর। চমকে উঠে দেখি, বাঁ দিকে আদ্ধেক ওঠানো কাঁচের ওপর এক যুবতীর মুখ।

চৌরঙ্গির এই এলাকায় সন্ধ্যা থেকেই ফুলওয়ালা লোকেদের উৎপাত শুরু হয়। তবে তারা নানাবয়সী পুরুষ। কদাচিৎ কোনো ভিখারি বা ভিখারিনী। কিন্তু মুখটি কোনো ভিখারিনীর নয়। স্ট্রিটল্যাম্পের আলো এখানে উজ্জ্বল, যদিও বৃষ্টিরেখা সেই উজ্জ্বলতাকে ঘষে ফেলার চেষ্টা করছিল। যুবতীর মাথায় জড়ানো স্কার্ফ। গায়ে ছাইরঙা জ্যাকেট। আর মুখখানিও মোটামুটি সুশ্রী। কণ্ঠস্বর আর চাহনিকে স্মার্ট বলা চলে।

একপলক এটুকু চোখে পড়ার পর ধরে নিয়েছিলাম নিশ্চিত কোনো কলগার্ল, কিংবা আরও খারাপ কোনো মেয়ে। তাই ঝটপট বলে উঠলাম, ডোন্ট ডিসটার্ব!

সে মুখে মিনতি ফুটিয়ে ব্যস্তভাবে বলল, শুনুন না প্লিজ! আমি খুব বিপদে পড়েছি।

বিপদে অনেকেই পড়ে–বিশেষ করে রাতের দিকে।

ছিঃ! কী ভাবছেন আমাকে? আমি আসলে জানতে চাইছি, আপনি কোনদিকে যাচ্ছেন।

কেন?

আমি পার্ক সার্কাসের ওদিকে যাব। কিন্তু ট্যাক্সি পাচ্ছি না। এদিকে বৃষ্টি।

বুঝলাম। কিন্তু বিপদটা কী?

বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। একটু আগে ফোনে খবর পেলাম। আমি কাছেই থাকি। তো ট্যাক্সি না পেয়ে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছি, যদি ওদিকে যেতে কেউ কাইন্ডলি আমাকে লিফট দেয়। আপনি কোনদিকে যাবেন?

পার্ক স্ট্রিট হয়ে যাব। কিন্তু…….

এই সময় ট্রাফিক সিগনাল সবুজ হয়ে গেল এবং আমি আর কিছু বলার আগেই মেয়েটি ভেতরে হাত ঢুকিয়ে লক করে রাখা দরজার হাতল খুলে গাড়িতে উঠে বসল। হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু পেছনের গাড়িগুলো প্রচণ্ড হর্ন বাজাতে শুরু করেছে। অগত্যা স্টার্ট দিয়ে এগোতে হলো।

এতক্ষণে লক্ষ্য করলাম, মেয়েটির পরনে জিনস। হাতে একটা মোটাসোটা হ্যান্ডব্যাগ আছে। চোখে চোখ পড়লে সে একটু হাসল। যে-সব গাড়িতে লিফট চাইছিলাম, সেগুলোয় লোকজন আছে। শুধু আপনার গাড়িটা ফাঁকা। পেছনের জানালার কাঁচ তুলে লক করে রেখেছেন। কিন্তু আমি সামনের জানালা দিয়েই দেখে নিয়েছিলাম, ব্যাকসিটে কেউ নেই।

যে বাবার অসুখের খবর পেয়ে এমনি করে ছুটে যেতে চায়, তার মুখে ওই হাসিটা বেমানান। অবশ্য একালের ছেলেমেয়েদের হাবভাব একেবারে অন্যরকম। এরা আমার পরের প্রজন্ম। তাই চুপ করে থাকলাম। পার্ক স্ট্রিটে এত রাতে গাড়ির ভিড় স্বাভাবিক বলা চলে। তবে আমি জানি এ সময় বার থেকে বেরুনো অনেকেই ড্রাঙ্ক অবস্থায় থাকে। তাই একটু সতর্কভাবে ড্রাইভ করছিলাম। মাঝে মাঝে একটা করে গাড়ি লাইন ছাড়িয়ে এদিক-ওদিক করছিল। একটু পরে বৃষ্টিটা বেড়ে গেল। সেই সঙ্গে এলোমেলো হাওয়া এবং মেঘের হাঁকডাক। ওয়াইপার অন করে দিলাম। সামনের কাঁচ বৃষ্টিতে ক্রমশ ঝাপসা হয়ে উঠছিল। বিদ্যুৎ ঝিলিক দিচ্ছিল। মেয়েটি জানালার কাঁচ পুরো তুলে দিয়ে আস্তে বলল, এবার শীতটা সত্যি পড়বে। তাই না?

আবার একটা গাড়ি হঠাৎ সামনে এসে গিয়েছিল। তাকে পাশ কাটাতে ডাইনে চলে গেলাম। তারপরই ঘটনাটা ঘটে গেল।

মেয়েটি আমার গা ঘেঁষে এল এবং আমার বাঁ কানের পেছনে শক্ত ঠাণ্ডাহিম কী একটা জিনিসের চাপ টের পেলাম। তারপর তার হুকুম কানে এল, ডাইনের রাস্তায় চলুন।

তার মানে?

যা বলছি করুন। লোডেড ফায়ার আর্মর্স। ট্রিগারে আঙুল। নড়াচড়া করলে বাঁচবেন না।

কী বলছেন?

 চুপ।

ততক্ষণে সব বুঝে গেছি। কিন্তু কী আর করা যাবে? বললাম, আমি না বাঁচলে গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করবে। তাতে আপনিও অক্ষত থাকবেন না।

আমি ড্রাইভিং জানি। বলে সে তার বাঁ হাত স্টিয়ারিঙে রাখল। কাজেই চুপচাপ চলুন। হা–এবার বাঁ দিকের লেনে ঢোকান।

এবার ব্যাপারটা সহজভাবে নিলাম। শেষ পর্যন্ত কী ঘটে দেখা যাক। আমার ফ্রেন্ড-ফিলোসফার-গাইড কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের পাল্লায় পড়ে এ যাবৎ অনেক রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারে নামতে হয়েছে। এখন শীতকালের এক বৃষ্টিঝরা রাতে অবশ্য আমি একা। এই অ্যাডভেঞ্চার কী ধরনের তাও এখনও বুঝতে পারছি না।

তাহলেও শেষাবধি যদি প্রাণে বেঁচে যাই, দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার জন্য একটা ক্রাইম স্টোরির উপকরণ পেতেও পারি। কিংবা রাতের কলকাতার এই ধরনের নতুন থ্রিল নিয়ে কোনো প্রতিবেদনও পাঠকদের মুখরোচক হবে।

মেঘের গর্জন, বৃষ্টি আর হাওয়ার উপদ্রব ক্রমশ বাড়ছিল। এ-গলি থেকে সে-গলি, এ-রাস্তা থেকে সে-রাস্তা দিয়ে সাক্ষাৎ এক দস্যুরানীর হুকুম মেনে কখনও জোরে কখনও আস্তে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। ফায়ার আর্মসের নলের চাপে কানের পাশটা জ্বালা করছিল। একসময় না বলে পারলাম না, প্লিজ! আপনার অস্ত্রটা একটু সরিয়ে নিন। বড্ড ব্যথা করছে।

সে হিসহিস করে বলল, চালাকি করবেন না। চুপচাপ চলুন। এবার ডাইনে বড় রাস্তায়।

রাস্তা এখন নির্জন। কদাচিৎ একটা করে গাড়ি আসছে বা পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। কোন রাস্তায় যাচ্ছি তা চিনতে পারছিলাম না। ধূসরতার ওপর কখনও কখনও আলোর ঝলক। চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছিল। চোখের কোনা দিয়ে লক্ষ্য করছিলাম, দস্যুরানী বারবার ঘড়িতে সময় দেখছিল।

অন্য কেউ হলে একটা চেষ্টা অন্তত করত। আচমকা ব্রেক কষেই মাথা সরিয়ে নিয়ে মেয়েটির কবজি ধরে ফেলত। কিংবা অন্য কৌশলের অভাব হতো না। কেন না এই যাত্রার সময়টা ছিল বেশ দীর্ঘ। আমার বয়সী এবং আমার মতো অভিজ্ঞ কোনো পূর্ণ যুবকের পক্ষে এই মেয়েটিকে কাবু করার ঝুঁকি যে কেউই নিত। কিন্তু আমি একজন সাংবাদিক। আমার পক্ষে শেষদৃশ্য পর্যন্ত। অপেক্ষা করাই সঙ্গত।

তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, হলিউডের অ্যাকশন-থ্রিলার ফিল্মে যা আকছার দেখেছি, তা আমার জীবনে ঘটবে, এবং এই মুমূর্ষ নগরী কলকাতায় এমন কিছু ঘটতে পারে, এটা একেবারে কল্পনাতীত ব্যাপার। কাজেই এটা উপভোগ্য। কিন্তু এই সাংঘাতিক থ্রিলারে এটুকুই আমার কাছে তেতো যে, ভিলেন-চরিত্র একটি মেয়ে এবং আমি একজন পুরুষ। মেল শোভিনিস্ট আমি নই। তবু পুরুষ তো বটে! সেই পুরুষত্বে খোঁচা খেতে খেতে আমি অস্থির। ক্রমশ ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিলাম।

একসময় ব্যাকভিউ মিররে দেখলাম একটা গাড়ি আসছে পেছন থেকে। ইচ্ছে করেই গাড়িটাকে সাইড দিলাম না। পেছনের গাড়িটা জোরালো আলো ফেলছিল। বারবার হর্ন দিচ্ছিল। পুলিশের গাড়ি হলে মন্দ হতো না। কিন্তু ততক্ষণে ফায়ার আর্মসের নল আমার কানের পাশে রীতিমতো গুতো মারতে শুরু করেছে এবং সেইসঙ্গে সাপের হিসহিস গর্জনে মেশানো হুকুমদারি, সাইড দিন! সাইড দিন বলছি।

গাড়িটা ডানদিক ঘেঁষে এল। তার ড্রাইভার হিন্দিতে কী সব খিস্তি করে তারপর এগিয়ে গেল। বললাম, বৃষ্টিতে কিছু দেখা যাচ্ছে না। আর কতদূর যেতে হবে?

কোনো চালাকি নয়। সামনের গাড়িটাকে যেতে দিন।

চোখ ঝলসে দিয়ে সামনে থেকে একটা গাড়ি এসে চলে গেল। পাশ দিয়ে যাবার সময় দুঃখের সঙ্গে দেখলাম, একটা পুলিশভ্যান। কিন্তু কী আর করা যাবে? দস্যুরানীকে ক্রমশ যেন উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। মাঝে মাঝে সে ঠোঁট কামড়ে ধরছিল। তারপর হুকুমদারি, ডাইনে….. এবার সোজা……বাঁদিকে……

বুঝতে পারছিলাম সে বড় রাস্তা এড়িয়ে যেতে চায়। কিন্তু এটাই আশ্চর্য, কলকাতার নাড়িনক্ষত্র যেন তার চেনা।

কিছুক্ষণ পরে বললাম, ড্রাইভ করতে আমার কষ্ট হচ্ছে। আমি ক্লান্ত।

বেশ তো। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। আস্তে চলুন। কিন্তু বাইরে কারও সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেই ট্রিগার টানব।

একটা সিগারেট খেতে পারি?

 চালাকি ছাড়ুন! নো টক।

প্লিজ! আমার কানের পাশটা বড় জ্বালা করছে। অস্ত্রটা সরিয়ে নিন। বিশ্বাস করুন, আপনি যেখানে যেতে চান পৌঁছে দেব।

আবার কথা বলে! সাবধান করে দিচ্ছি, আজ আমার মেজাজ ঠিক নেই।

ধমকের সঙ্গে ফায়ার আর্মসের নলের জোরালো খোঁচা খেয়ে যন্ত্রণায় উহ্ করে উঠলাম। স্টিয়ারিং থেকে হাত একটু সরে গিয়েছিল। দস্যুরানী বাঁ হাতে দ্রুত স্টিয়ারিং ধরে গাড়িটাকে একটা ল্যাম্পপোস্ট থেকে বাঁচিয়ে দিল। এখানে ফুটপাত সংকীর্ণ। দুধারে সারবন্দী গাছ। টানা পাঁচিল এবং মাঝে মাঝে একটা করে গেট দেখা যাচ্ছিল। রাস্তা স্বভাবত জনহীন। বৃষ্টিটা একটু কমে এসেছে। কিন্তু মেঘের গর্জন থামছে না। পশ এরিয়া বলে মনে হচ্ছিল। রাস্তাটা পাশাপাশি দুটো গাড়ি যাওয়ার মতো চওড়া এবং এঁকেবেঁকে এগিয়েছে। কোনো গাড়ি আর দেখছি না। একটা বাঁকের মুখে পৌঁছতেই সে বলে উঠল, এখানে নামিয়ে দিন। চ্যাঁচামেচি বা সিন ক্রিয়েট করবেন না। আমি টার্গেট মিস করি না, মাইন্ড দ্যাট।

গাড়ি দাঁড় করালাম। সে আমার কানের পাশে আগ্নেয়াস্ত্রের নল ঠেকিয়ে রেখেই বাঁ হাতে দরজা খুলল। তারপর নেমে গেল এবং আস্তে বলল, ধন্যবাদ! আপনার গাড়ি ছিনতাই করার দরকার হলো না।

আমি কিছু বলার আগেই সে গাড়ির পেছন দিয়ে অন্য পাশের ফুটপাতে উঠল। উঁকি মেরে দেখার সাহস হলো না। আস্তে সুস্থে একটা সিগারেট বের করে ধরালাম। রুমালে বাঁ কানের পাশটা ঘষে ড্যাশবোর্ডের আলোয় দেখে নিলাম। না। রক্ত-টক্ত ঝরছে না, যদিও মনে হচ্ছিল ঠাণ্ডাহিম নলের গুঁতো খেয়ে রক্ত ঝরছে।

কিন্তু এখানে আর থেমে থাকা উচিত নয়। সামনে কিছুদূর এগিয়ে ফুটপাতে একটা ছোট্ট দোকান চোখে পড়ল। দোকানটা পান-সিগারেটের। দোকানদার সবে ঝাঁপ ফেলতে যাচ্ছিল। আমাকে গাড়ি দাঁড় করাতে দেখে জিজ্ঞেস করল, বোলিয়ে সাব!

ইয়ে কৌন ইলাকা ভাই?

হেস্টিংস, সাব!

ইধার কৈ বড়া রাস্তা হ্যায়?

 লোকটা আমার হিন্দি শুনে এবার বাংলায় বলল, আপনি কোথায় যাবেন?

পার্ক স্ট্রিট।

সে প্রায় চোখ কপালে তুলে বলল, পার্ক স্ট্রিট! তো এদিকে কোথায় যাচ্ছেন?

পথ হারিয়ে ফেলেছি।

সে হাসল। গাড়ি ঘুরিয়ে লিন সাব! সিধা এই রাস্তায় যান। তারপর বড় রাস্তা পাবেন। রেসের ময়দান, ভিক্টোরিয়া

তার বাকি কথায় আর কান দিলাম না। বাঁ দিকে একটা গলি দেখা যাচ্ছিল। সেখানে গাড়ি ঘুরিয়ে জোরে বেরিয়ে গেলাম। এই রাস্তায় কোনো একটা গলি দিয়ে ঢুকেছিলাম। সেটা চিনতে পারলাম না বা চেনার চেষ্টাও করলাম না। শুধু এটুকু বুঝতে পারছিলাম, সাংঘাতিক মেয়েটি আমাকে শর্টকাটে এমনভাবে এনেছে, যাতে আমি এলাকাটা চিনতে না পারি।

কিন্তু এখন আর ও-সব কথা ভেবে লাভ নেই। রাত প্রায় এগারোটা বাজে। বৃষ্টি থেমে গেছে। কিন্তু বিদ্যুৎ ঝিলিক দিচ্ছে এবং মেঘের গর্জনে কানে তালা ধরে যাচ্ছে। ভোলা রাস্তায় গঙ্গা এবং ময়দানের ওপর ঠাণ্ডাহিম হাওয়া যথেচ্ছ দাপাদাপি করছে। পার্ক স্ট্রিটের মোড় পর্যন্ত জোরে গাড়ি চালিয়ে এসে গতি কমালাম।

ইলিয়ট রোডে আমার প্রাজ্ঞ বন্ধুর কাছে নিজের এই বোকামিভরা অ্যাডভেঞ্চারের ঘটনাটা শুনিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু এত রাতে ওঁকে বিরক্ত। করা ঠিক হবে কি?

তাছাড়া আমাকে ইস্টার্ন বাইপাস হয়ে সল্টলেকে ফিরতে হবে।

তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, সোজা নিজের ডেরায় ফেরা যাক। তারপর সকালে টেলিফোনে কথা বলে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে আসব। কেন না, ঘটনাটা বেশ কিছুটা গোলমেলে। কোনো ডানপিটে মেয়ে কোথাও যাওয়ার জন্য এত বেশি নাটকীয় ঘটনা ঘটাবে কেন?

ক্রমশ চাপা অস্বস্তি আমাকে পেয়ে বসছিল। ইস্টার্ন বাইপাসে পৌঁছে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলাম। কলকাতায় এবার জানুয়ারিতেও তত শীত পড়েনি।

ফেব্রুয়ারির এই বৃষ্টিটা শীত এনে দিল। এতক্ষণে আমার হাত স্টিয়ারিঙের শৈত্য টের পাচ্ছিল।…

.

ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছিল। সকাল নটা নাগাদ ব্রেকফাস্টের পর ধীরেসুস্থে কর্নেলকে টেলিফোন করতে যাচ্ছি, সেইসময় টেলিফোন বেজে উঠল এবং রিসিভার তুলেই তার গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। মর্নিং জয়ন্ত!

মর্নিং বস্। মেঘ না চাইতেই জল। আমি আপনাকে এক্ষুনি—

 এক মিনিট! জয়ন্ত, তোমার গাড়ির নাম্বার কত?

একটু অবাক হয়ে নাম্বারটা বলে জিজ্ঞেস করলাম, হঠাৎ গাড়ির নাম্বারের কথা কেন?

আমার অবশ্য তোমার গাড়ির নাম্বার মুখস্থ। তবু যাচাই করে নিলাম। যাই হোক, তোমার জন্য একটা দুঃসংবাদ আছে!

দুঃসংবাদ মানে?

 তুমি বিপন্ন ডার্লিং!

কী ব্যাপার বলুন তো?

 কাল রাতে তুমি কি হেস্টিংস এরিয়ায় গিয়েছিলে?

উত্তেজনা চেপে বললাম, যেতে হয়েছিল। ব্যাপারটা সাংঘাতিক।

 হ্যাঁ। খুবই সাংঘাতিক। ক্লিফটন রোডে একটা মার্ডার হয়েছে এবং

 মার্ডার! সর্বনাশ!

কথা শেষ করতে দাও। মার্ডারার তোমারই গাড়িতে গিয়েছিল। গাড়ির নাম্বার পাশের বাড়ির দারোয়ান লক্ষ্য করেছিল। জয়ন্ত, তোমার গাড়ির নাম্বারটা এমন যে দেখামাত্র মুখস্থ হয়ে যায়। যাই হোক, পুলিশ গাড়ির মালিককে খুঁজছে।

প্রায় আর্তনাদ বেরিয়ে গেল গলা থেকে। কর্নেল! আমি এখনই যাচ্ছি। আপনার সবটা শোনা দরকার।

এস। তবে গাড়িটা এনো না। ট্যাক্সি করে এস।

রিসিভার রেখে সিগারেট ধরালাম। কিছুক্ষণের জন্য গাঢ় আচ্ছন্নতা আমাকে পেয়ে বসল। তারপর ক্রমশ মরিয়া হয়ে উঠলাম। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম, গত রাতে ঘটনাটা হেস্টিংস থানায় জানিয়ে আসা উচিত ছিল। বড় ভুল হয়ে গেছে। স্রেফ বোকামির জন্য অনর্থক একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে হবে। সমস্যা হলো, পুলিশ তাদের নিজের পথে চলে। কর্নেল আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা তো করবেনই। কিন্তু গত রাতের হলিউডি অ্যাকশন-ফিল্মের ওই এপিসোড যে প্রকৃত বাস্তব, তা পুলিশকে বোঝানো তাঁর পক্ষেও সম্ভবত কঠিন হবে।…

.

০২.

 ঘটনাটা আমার মুখে সবিস্তারে শোনার পর কর্নেল প্রথমে অট্টহাসি হাসলেন। তারপর গম্ভীর হয়ে গেলেন। তাকে আমার বাঁ কানের পাশটা দেখিয়ে দিলাম। কারণ সকালে দাড়ি কাটার সময় আয়নায় দেখেছিলাম একটুখানি জায়গা তখনও লাল হয়ে আছে। অ্যান্টিসেপটিক মলমও ঘষে দিয়েছিলাম।

কর্নেল সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, ক্লিফটন রোডের সেই দারোয়ান পুলিশকে বলেছে, গাড়িটা ক্রিমরঙা! কাজেই সে ঠিক দেখেছিল। তোমার গাড়ি থেকে জিনস-জ্যাকেট পরা মেয়েটিকেও সে নামতে দেখেছিল। তারপর মেয়েটি ফুটপাত ধরে এগিয়ে যায়। এ পর্যন্ত সব ঠিক আছে। আর হ্যাঁ, তোমার গাড়ি কিছুটা এগিয়ে বাঁকের মুখে অপেক্ষা করছিল। কিছুক্ষণ পরে আবার গাড়িটা ফিরে আসে এবং উল্টোদিকে জোরে চলে যায়।

কিন্তু কাকে সে খুন করতে গিয়েছিল?

প্রদীপ সিনহাকে। ভদ্রলোকের অনেকরকম কারবার আছে। ফিল্ম প্রোডাকশন, রিয়্যাল এস্টেট বেচাকেনা, বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন, এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ইত্যাদি। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি।

ওঁর কথা বলার ভঙ্গিতে বিরক্ত হয়ে বললাম, ডিটেলস বলুন না! কীভাবে ওঁকে খুন করা হয়েছে, আপনিই বা কোন সূত্রে

আমাকে থামিয়ে কর্নেল বললেন, কদিন আগে প্রদীপ সিনহার স্ত্রী মালবিকা আমার কাছে এসেছিল। তার সন্দেহ হয়েছিল, তার স্বামী কোনো বিপজ্জনক ফাঁদে পা দিয়েছে। ওঁকে যেন সাবধান করে দিই। তো মালবিকা আমার পরিচিত। তার বাবা অশোক রায় ছিলেন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একসময় নামকরা শিকারী ছিলেন। কর্নেল একটা চুরুট ধরালেন। তারপর একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, কাল রাত বারোটায় মালবিকা আমাকে ফোন করেছিল। তার স্বামী বিছানা থেকে কখন নিপাত্তা হয়ে গেছেন। আমি ওকে বললাম, পুলিশে খবর দাও। পুলিশ এসেছিল ঘণ্টাখানেক পরে। ততক্ষণে বাড়ির দারোয়ান নরবাহাদুর তার মালিকের লাশ আবিষ্কার করেছে। প্রদীপ সিনহা বাড়ির পেছনে বাগানের একটা ঝোঁপের পাশে কাত হয়ে পড়েছিলেন। মাথার বাঁ দিকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে কেউ ওঁকে গুলি করে পালিয়েছে। পালিয়েছে পেছনের দরজা দিয়ে। ওদিকে একটা কানাগলি আছে।

কর্নেল চুপচাপ চুরুট টানতে থাকলেন। একটু পরে বললাম, দারোয়ান সেই মেয়েটাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখেনি?

নাহ। তার মানে, প্রদীপ সিনহা তার জন্য বাগানের দরজা খুলে রেখে অপেক্ষা করছিলেন।

পরের ঘটনা আপনি কি পুলিশসূত্রে জেনেছেন?

নাহ্। কর্নেল মাথা নাড়লেন। মালবিকা ভোর ছটায় আবার ফোন করেছিল।

চোখ বুজে উনি অভ্যাসমতো ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন। একটু পরে বললাম, আচ্ছা কর্নেল! এমন তো হতেই পারে, খুনী যে গাড়িতে চেপে গিয়েছিল, তার নাম্বারপ্লেট ভুয়ো। দৈবাৎ আমার গাড়ির নাম্বারের সঙ্গে মিলে গেছে। গাড়ির রঙটাও–

কর্নেল চোখ খুলে হাসলেন। হ্যাঁ। এটা হতেই পারে। কিন্তু তা হয়নি।

 প্লিজ কর্নেল! পুলিশকে আসল কথাটা না বললেই ঝামেলা মিটে যায়।

কর্নেল আমার দিকে একটুখানি তাকিয়ে থাকার পর বললেন, তুমি সহজে নিষ্কৃতি পাবে বলে মনে হচ্ছে না। পুলিশ মোটর ভেহিকলসে গাড়ির মালিকের নাম-ঠিকানা পেয়ে যাবে। তারপর তোমাকে জেরায় জেরবার করে ছাড়বে। তোমার পত্রিকা অফিসে খোঁজ নেবে, কখন তুমি বেরিয়েছিলে। তারপর সল্টলেকে তোমার প্রতিবেশীদের কাছে খোঁজ নেবে কখন তুমি ফিরেছিলে!

ওঃ কর্নেল! আপনি ভয় দেখাচ্ছেন।

মোটেও না। এটাই পুলিশের তদন্তপদ্ধতি। কর্নেল মিটিমিটি হেসে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, পাশের বাড়ির দারোয়ান ছাড়াও তোমার গাড়ির ওখানে যাওয়ার দ্বিতীয় প্রত্যক্ষদর্শী সেই পান-সিগারেটের দোকানদার।

এবার প্রচণ্ড অস্বস্তিতে আড়ষ্ট হয়ে পড়লাম। সত্যিই আমি বোকার ধাড়ি। যে কোনো বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এসব ক্ষেত্রে পুলিশকে ঘটনাটা জানাত! আসলে কাল রাতে আমাকে যেন বিবশ করে ফেলেছিল জিনস পরা সেই মেয়ে-খুনী। আমার বোধবুদ্ধি গুলিয়ে গিয়েছিল।

কর্নেল পাশের ঘরে ঢুকে গেলেন। একটু পরে পোশাক বদলে ফিরে এলেন। চলো বেরুনো যাক। এ সময় তোমার গাড়িটা পেলে ভালো হতো। কিন্তু বলে আমার কাঁধে হাত রাখলেন। ডার্লিং! আসলে তুমি বড় বেশি রোমান্টিক। যাই হোক, চলো।

কোথায় যাবেন?

 মালবিকা সিনহার কাছে।

আমার যাওয়া কি উচিত হবে? যদি সেই দারোয়ান লোকটা আমাকে চিনতে পারে?

দেখা যাক। এস তো।

অস্বস্তিটা সঙ্গ নিল। বড় রাস্তার মোড়ে কর্নেল ট্যাক্সি ডাকলেন। বরাবর দেখে আসছি, ওঁর সায়েবি বিশাল চেহারা এবং সম্ভবত সাদা দাড়ির জন্য কোনো ট্যাক্সিচালক ওঁকে না করে না। নাকি ওঁর গলা থেকে ঝোলানো বাইনোকুলার আর ক্যামেরা দেখে ওঁকে বিদেশি ট্যুরিস্ট ভাবে এবং মোটা বখশিসের লোভে পড়ে যায়!

ট্যাক্সি চলল কর্নেলের নির্দেশে। সেই খুনী মেয়েটির মতো কলকাতার নাড়িনক্ষত্র কর্নেলেরও চেনা। কিন্তু ক্রমশ আবার অস্বস্তি আমাকে আড়ষ্ট করে ফেলছিল। বললাম, মিসেস সিনহাকে টেলিফোনে জানিয়ে আসা উচিত ছিল যে আপনি যাচ্ছেন!

কর্নেল বললেন, আমি যাব তা মালবিকা জানে। অবশ্য কখন যাব তা বলিনি।

একটু ইতস্তত করে বললাম, আচ্ছা কর্নেল, যে দারোয়ান আমার গাড়ির নাম্বার দেখেছিল, আমাকে দেখে যদি সে চিনতে পারে?

কর্নেল হাসলেন। আগে তার সঙ্গে কথা বলে যেতে চাই। বলে আমার দিকে ঘুরলেন। পাশের বাড়ির সেই দারোয়ানের দৃষ্টিশক্তি যাচাই হয়ে যাবে। তবে তোমার এতে ভয় পাওয়ার কারণ নেই। বৃষ্টির মধ্যে আবছা আলোয় দেখা কোনো মুখ মনে রাখা খুব সহজ নয়। বুঝতে পারছি তুমি বলতে চাও যে তোমাকে সঙ্গে নিয়ে এলাম কেন। তাই না?

চুপচাপ তাকিয়ে আছি দেখে কর্নেল ফের বললেন, এটা তোমার মাথায়। আসা উচিত ছিল। আমি দেখতে চাই কোথায় তোমাকে গাড়ি থামাতে হয়েছিল এবং সেই মেয়েটি নেমে গিয়েছিল। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট।

হেস্টিংস এলাকা দিনের বেলায় স্বভাবত অন্যরকম দেখাচ্ছিল। শীতটা সত্যি জাঁকিয়ে পড়েছে। বড় রাস্তা থেকে ডাইনে ঘুরে একটা ছোট রাস্তায় ঢুকে কর্নেল বললেন, এটাই ক্লিফটন রোড। চিনতে পারছ কি?

বললাম, হ্যাঁ। তবে মেয়েটি কোথায় আমাকে গাড়ি দাঁড় করাতে বলেছিল, চিনতে পারছি না।

পারবে। পারা উচিত। বলে কর্নেল ডাইনে সংকীর্ণ ফুটপাতের ওধারে টানা পাঁচিল দেখতে থাকলেন।

রাস্তাটা বাঁক নিতে নিতে এগিয়ে গেছে। কিছুটা চলার পর কর্নেল ট্যাক্সিচালককে থামতে বললেন। তারপর ভাড়া মিটিয়ে বাঁ দিকের ফুটপাতে নামলেন। আমি নেমে গিয়ে জায়গাটা চেনার চেষ্টা করলাম। ট্যাক্সিটা আস্তেসুস্থে এগিয়ে সামনের বাঁকের মুখে অদৃশ্য হলো। রাতের রাস্তার সঙ্গে দিনের রাস্তার কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছিলাম না, শুধু দুধারের একটানা উঁচু বা নিচু পাঁচিল। ছাড়া। কর্নেল রাস্তা পেরিয়ে ডান দিকের ফুটপাতে গেলেন। সেখানে একটা বাড়ির গেট এবং ফুটপাতের খানিকটা তাংশ ঢালু। বাড়িটাতে গাড়ি ঢোকার জন্য এই ব্যবস্থা। গেটের পাশেই একতলা একটা ঘর। ঘরটার একটা জানালা খোলা আছে। জানালাটা ঠিক ফুটপাতের ওপর এবং জানালা থেকে রাস্তাটা সামনাসামনি দেখা যায়।

বাড়িটার গেটের বাঁ দিকে মার্বেল ফলকে ইংরেজিতে লেখা আছে সুরঞ্জনা। নুড়ি বিছানো পথের দুপাশে রঙবেরঙের ফুলের গাছ। তারপর পোর্টিকো। বাড়িটা দোতলা। কিন্তু বিদেশি স্থাপত্যরীতিতে তৈরি। ঝকমকে লাল টালির ঢালু ছাউনির মধ্যে জ্যামিতিক ধাঁচ।

কর্নেল গেটের সামনে যেতেই বেঁটে নধরকান্তি একটা ফো লোক এসে দাঁড়াল। তারপর সম্ভবত কর্নেলের চেহারা দেখেই স্যালুট ঠুকল। কর্নেল মৃদুস্বরে বললেন, এটা কি সিনহাসায়েবের বাড়ি?

তক্ষুনি বুঝেছিলাম এই লোকটিই সেই দারোয়ান, যে আমার গাড়ির নাম্বার দেখেছিল। সে ভাঙা-ভাঙা বাংলায় বলল, না সার! সিনহাসায়েবের বাড়ি ওইটা আছে। লেকিন

৭ নম্বর ক্লিফটন রোডে সিনহাসায়েবের বাড়ি না?

কুতকুতে চোখে সে হাসল। এটা ৬ নম্বর আছে।

হ্যাঁ। আমারই ভুল। এ বাড়িটা কার?

মুখার্জিসায়েবের।

কর্নেল মার্বেল ফলকের দিকে তাকিয়ে বললেন, সরি! এটা এস. কে. মুখার্জির বাড়ি। তারপর আমার দিকে ঘুরে চোখে একটা ভঙ্গি করে বললেন, জয়ন্ত! তুমি এর সঙ্গে কথা বলতে পারো।

আমি বুঝতে পারলাম না ওর সঙ্গে কী কথা বলব। কিন্তু কর্নেলের কথা শুনে সুরঞ্জনার দারোয়ান সন্দিগ্ধ দৃষ্টে তাকিয়ে বলল, আপনারা কোথা থেকে আসছেন সার?

কর্নেল বললেন, নিউজপেপার থেকে। পুলিশের কাছে খবর পেয়েছি, গত রাতে প্রদীপ সিনহা নামে এক ভদ্রলোককে কে বা কারা নাকি মার্ডার করে গেছে। তো কাগজের লোকেরা পাশের বাড়ির লোকের কাছেও ঘটনাটা জেনে নিতে চায়। তো তোমার নাম কী ভাই?

আমি ফাগুলাল আছি সার! বলেই সে চঞ্চল হয়ে উঠল। আপনারা নিউজপেপার থেকে আসছেন? সকালে অনেক নিউজপেপারের লোক এসেছিল। আপনারা দেরি করে আসলেন!

জয়ন্ত, তুমি রিপোর্টারস নোটবই বের করো। ফাগুলাল কী বলে লিখে নাও।

অগত্যা পকেট থেকে একটা খুদে নোটবই বের করলাম। ফাগুলাল গেটের ফাঁকে তার মুখটা প্রায় গলানোর চেষ্টা করল। বলল, নিউজপেপারের লোকেরা কেউ আমাকে কুছু পুছ করেনি। তাহলে খাঁটি খবর পেয়ে যেত। সার! যে গাড়িতে খুনী এসেছিল, সেটা থেমে গিয়েছিল ওইখানে। আমি জানালার ধারে বসেছিলাম। তাই গাড়ির লম্বর

কর্নেল তাকে থামিয়ে বললেন, তখন রাত কটা মনে আছে?

এগারা কি সও-এগারা হবে।

অত রাতে তুমি জানালার ধারে বসেছিলে কেন?

আমার সায়েব কেলাবে যান। আসতে বহৎ রাত হয়ে যায়।

তা হলে মুখার্জিসায়েবের জন্য অপেক্ষা করছিলে বলো? বলে কর্নেল আমার দিকে আগের মতো তাকিয়ে চোখের সেই ভঙ্গি করলেন। জয়ন্ত, লিখে নাও। তারপর কর্নেল ফাগুলালের দিকে ঘুরলেন। গাড়িটা এসে দাঁড়াল। তারপর?

আগে গাড়ির লম্বর লিন। বলে সে আমার গাড়ির নাম্বার সঠিক বলে দিল। তো আমি দেখলাম, গাড়ি থেকে এক লড়কি নেমে এই গেটের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে।

লড়কি? পরনে শাড়ি ছিল তাহলে?

না সার! প্যান্ট ছিল। লেকিন মাথায় রুমাল বাঁধা। মুখ দেখেই চিনে নিলাম লড়কি আছে।

তারপর সে কী করল?

৭ লম্বর বাড়ি আর এই ৬ লম্বর বাড়ির বাউন্ডারি ওয়ালের মধ্যে ছোটা এক গলি আছে। সির তিন হাত গলি। লড়কি গলিতে ঘুসে গেল।

জানালা থেকে দেখতে পাচ্ছিলে?

ফাগুলাল বাঁকা হাসল। আপনি সমঝে লিন। ৭ নম্বর বাড়ির গেট আমার নজর হয়। কেন? কি–আপনি দেখে লিন, রাস্তা জেরাসা বাঁদিকে ঘুরেছে। দেখলেন কি না?

কর্নেল দেখে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ। ঠিক বলেছ। আচ্ছা ফাগুলাল, এবার। বলো গাড়িটা কী করল?

গাড়ি সামনে চলে গেল। মিনিট দো-চার বাদ ঘুরে এল। বহৎ স্পিডে চলে গেল।

ড্রাইভারকে দেখতে পেয়েছিলে?

ফাগুলাল মাথা নাড়ল। না সার! ঝুটমুট কেন বলব?

মুখার্জিসায়েব কখন ফিরেছিলেন?

আধাঘণ্টা বাদ। তারপর

এক মিনিট। তুমি গাড়িটার কথা বা মেয়েটির কথা মুখার্জিসায়েবকে বলেছিলে?

ফাগুলাল গম্ভীর মুখে বলল, তখন কেন বলব বলুন? আর সিনহাসায়েবের কথা বলবেন না। কত লড়কি উনহির বাড়িতে যানা-আনা করত। হরঘড়ি– চোখে চটুল হেসে সে চাপা গলায় ফের বলল, সিনেমার লোকের কারণে–

তার মানে রাত্রেও।

হ্যাঁ সার! ফাগুলাল শ্বাস ছেড়ে বলল, তো আমার সায়েব বাড়ি ঢুকলেন। তার পরে-বিশ মিনিট বাদ এসে আমাকে গেট খুলতে বললেন। আমি কুছু বুঝতে পারলাম না। একঘন্টা বাদ সায়েব ফিরে এলেন। আমাকে বললেন, সিনহা মার্ডার হয়েছে। তো ব্যস! ফাগুলাল উত্তেজিত হয়ে উঠল। আমি সায়েবকে সেই গাড়ি আর লড়কির কথা বললাম। পরে যখন পুলিশ আসল, পুলিশকে ভি বললাম।

রাস্তায় মাঝে মাঝে গাড়ি এবং লোকজন যাতায়াত করছিল। কেউ-কেউ সম্ভবত কর্নেলের চেহারা দেখে একটু কৌতূহলী হয়ে পড়ছিল। কর্নেল নিশ্চয় আঁচ করলেন, ছোটখাটো একটা ভিড় জমে উঠতে পারে। বললেন, ঠিক আছে। ফাগুলাল! আমরা চলি। জয়ত, এই যথেষ্ট! চলো, সিনহাসায়েবের বাড়িতে যাওয়া যাক।

টানা পাঁচিল এগিয়ে গেছে প্রায় কুড়ি মিটার। তারপর সেই সংকীর্ণ গলিটা দেখতে পেলাম। গলিতে কেউ হাঁটে বলে মনে হলো না–অন্তত আপাতদৃষ্টে। কোন আমলে পিচ পড়েছিল, তার একটু-আধটু চিহ্ন আছে মাত্র। খানাখন্দে রাতের বৃষ্টির জল জমে আছে। এবড়ো-খেবড়ো পাথরক চর ওপর দুধারের বাড়ি থেকে গাছপালার পাতা পড়ে গলে পচে গেছে। কনে গলিতে ঢুকে পড়লেন।

সামনে প্রায় পঁচিশ মিটার দূরে ৭ নম্বর বাড়ি গেটটা দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু সেখানে কাউকে দেখতে পেলাম না। কর্নেল চাপা গলায় ডাকলেন, হাঁ করে কী দেখছ? চলে এস।

ওঁকে অনুসরণ করলাম। গলিটা বেজায় সংকীর্ণ। পাশাপাশি কোনোক্রমে দুজন যাতায়াত করতে পারে। দুধারে মুখার্জিসায়েব এবং সিনহাসায়েবের বাড়ির পাঁচিল এখানে খুব উঁচু এবং কাঁটাতারের বেড়ায় ঘন লতাপাতার ঝালর। গলিটার অবস্থান এমন জায়গায়, যেখানে একটুও রোদ পড়ে না। কর্নেল একখানে একটু ঝুঁকে আস্তে বললেন, ফাগুলাল ঠিক বলেছে। মেয়েটি গলিতে ঢুকেছিল। জুতোর ছাপ দেখা যাচ্ছে।

আমি কিছু দেখতে পেলাম না। কিছুটা এগিয়ে গলিটা বাঁ দিকে ঘুরেছে। এবং সামনে আরও উঁচু একটা পাঁচিল। পাঁচিলে জীর্ণতার গাঢ় ছাপ, যেন এখনই ধসে পড়বে। কর্নেল একবার দেখে নিয়েই বললো, পোড়ো কারখানা সম্ভবত। এমনও হতে পারে জায়গাটা নিয়ে মামলা চলছে।

বলেই উনি থমকে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার?

কর্নেল কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে বললেন, এটা সে অর্থে কানাগলি নয়। সামনে বটগাছটা দেখতে পাচ্ছ। তার নিচে একটা ডোবা।

কর্নেলের পেছনে ছিলাম তাই বটগাছ বা ডোবাটা দেখতে পাইনি। এতক্ষণে লক্ষ্য করলাম, বাঁ দিকে একটা বন্ধ দরজা। বললাম, এই দরজা দিয়েই তাহলে–

কর্নেল ইশারায় আমাকে থামিয়ে দিয়ে হঠাৎ আবার ঝুঁকে পড়লেন। তারপর পচা পাতা আর জলভর্তি একটা গর্ত থেকে যে জিনিসটা তুলে নিলেন, সেটা একটা খুদে ফায়ার আর্মস। আমি হতবাক হয়ে গিয়েছি। কর্নেল কালো রঙের সেই অস্ত্রটা পরীক্ষা করার পর আপনমনে একটু হাসলেন। তারপর পকেট থেকে রুমাল বের করে জলকাদামাখা অস্ত্রটা তাতে জড়িয়ে জ্যাকেটের ভেতর পকেটে চালান দিলেন।

এতক্ষণে বললাম, মার্ডার উইপন!

কর্নেল ঘুরে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বললেন, সম্ভবত এর নলের গুঁতোয় তোমার কানের পাশটা লাল হয়ে আছে এখনও!

উত্তেজিতভাবে বললাম, কিন্তু পুলিশের এটা চোখে পড়া উচিত ছিল!

না পড়ার একটাই কারণ থাকতে পারে। পুলিশ এই দরজার পর বটগাছটার দিকে এগিয়ে যাওয়া দরকার মনে করেনি। তাছাড়া এখানে ফায়ার আর্মস কেনই বা খুনী ফেলে যাবে? একটা ফায়ার আর্মসের দাম কম নয়।

বলে কর্নেল হন্তদন্ত হাঁটতে থাকলেন, যেদিক থেকে এসেছিলাম, সেই দিকে ওঁকে অনুসরণ করতে গিয়ে আমার জুতো জলকাদা আর পচাপাতায় নোংরা হয়ে গেল।

এবার ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে ৭ নম্বর বাড়ির গেটে পৌঁছলাম! গেটটা বন্ধ। ভেতরে ঝাঁপালো বোগেনভিলিয়ার ছায়ায় বেঞ্চ পেতে দুজন বন্দুকধারী কনস্টেবল বসে আছে। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে একটা শক্তসমর্থ চেহারার লোক খৈনি ডলছে। এ বাড়ির গেটের ফলকে শুধু লেখা আছে অনুপমা। পাশের দেয়ালে পুরসভার মরচে-ধরা নীলরঙের একটা ফলকে লেখা ক্লিফটন রোড।

কর্নেল গলার ভেতর বললেন, কদিন আগে এ বাড়িতে এসেছিলাম। দেখা যাক, নরবাহাদুর আমাকে চিনতে পারে কি না।

বলে উনি একটু কাশলেন। কাশি শুনে ওরা তিনজনই তাকাল। তারপর খৈনি ডলা থামিয়ে নেপালি দারোয়ান নরবাহাদুর এগিয়ে এল। সেলাম ঠুকে গেট খুলে দিল সে। তারপর সবিনয়ে বলল, মেমসাব কর্নিসাবের জন্য ওয়েট করছেন।

কথাটা বলে সে ডাকল, লখিয়া! এ লখিয়া!

ফ্রক পরা একটি কিশোরী পোর্টিকোর ছাদে দাঁড়িয়েছিল। সে ঝাঝালো। গলায় বলল, বলো কী বলবে?

মেমসাবকে খবর দে। কর্নিলসাব এসেছেন!

 মেমসাহেব শুয়ে আছেন। আমাকে বলে দিয়েছে। কেউ যেন ডিসটার্ব না করে।

নরবাহাদুর খাপ্পা হয়ে বলল, মারকে মুখ তোড় দে গা। বোল–কর্নিলসাব এসেছেন।

কে এসেছেন?

কর্নিলসাব। বলে সে আমাদের দিকে ঘুরল। বহৎ হারামি আছে, বুঝলেন সার? আপনারা অন্দরে চলে যান। বাচ্চুকে থানায় লিয়ে গেল। জেরা করবে। শম্ভুকে ভি লিয়ে গেল। কর্নিলসাব! আপনারা যান। জিমের জন্য ডর করবেন না। জিম বাঁধা আছে।

কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন, তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে নরবাহাদুর!

সে নুড়িবিছানো রাস্তায় কর্নেলের সঙ্গ নিল। বলল, বলুন সার!

কর্নেল চাপা গলায় বললেন, তুমিই তো সিনহাসায়েবের ডেডবডি প্রথম দেখেছিলে?

জি সার! সে উত্তেজিতভাবে বলল, জিম খুব চিল্লাচিল্লি করছিল। তখন আমার নিদ টুটে গেল। তো চোর এসেছে মনে করল আমি। জানালা দিয়ে দেখলাম, সিনহাসাব বাগানের দিকে চলে যাচ্ছেন। আমার কেমন ডর বাজল। তো–

এইসময় পের্টিকোর তলা থেকে লখিয়া–সম্ভবত লক্ষ্মী আসল নাম, বেরিয়ে এসে মৃদুস্বরে বলল, মেমসায়েব ওপরে পাঠিয়ে দিতে বললেন।

কর্নেল নরবাহাদুরকে বললেন, তাহলে তোমার সন্দেহ হয়েছিল?

হাঁ সার! ওই দেখুন লাল ফুলের জঙ্গল। তার পাশে উনহির ডেডবডি ছিল।

ঠিক আছে। তুমি কনস্টেবলদের খৈনি খাওয়াও গিয়ে।

নরবাহাদুর চলে গেল। আমরা লখিয়াকে অনুসরণ করলাম। এতক্ষণ কোথাও কুকুরের চাঁচামেচি শোনা যাচ্ছিল। লখিয়া তার উদ্দেশে ধমক দিতে দিতে সিঁড়িতে উঠে বলল, চলে আসুন আপনারা। তারপর সে লাফ দিতে দিতে ধাপ ডিঙিয়ে ওপরে উধাও হয়ে গেল। কর্নেল চাপাস্বরে বললেন, আশ্চর্য!

কী আশ্চর্য, প্রশ্ন করে তার জবাব পেলাম না।…..

.

০৩.

 লখিয়া যে ঘরটাতে আমাদের বসতে বলে তার মেমসায়েবকে ডাকতে গেল, তার একটা দরজা দিয়ে পোর্টিকোর ছাদে যাওয়া যায়। ঘরটা বেশ বড়। মেঝে লাল কার্পেটে মোড়া। নানারকমের ভাস্কর্য আর আধুনিক চিত্রকলায় সাজানো। একপাশে সোফাসেট, অন্যপাশে ডিভান এবং আরও কয়েকটি সুদৃশ্য আসন। কোণের দিকে গোলটেবিলে রাখা একটা রঙিন ফোটো ঘিরে টাটকা ফুলের মালা। বুঝতে পারলাম, ওটাই প্রদীপ সিনহার ছবি। তবে ছবিটা সম্ভবত এখনকার নয়। কারণ তাঁর মুখে যৌবনের লালিত্য ঝলমল করছে। কর্নেলের কাছে শুনেছি, তার বয়স এখন ছিল চল্লিশের কাছাকাছি।

কর্নেল গম্ভীর মুখে বসে আছেন। এবার আমিও মৃদুস্বরে বললাম, সত্যিই আশ্চর্য!

কর্নেল আমার দিকে তাকালেন। কিছু বললেন না।

বললাম, মিঃ সিনহা বা তার স্ত্রীর আত্মীয়স্বজন কাকেও দেখছি না! ব্যাপারটা অস্বাভাবিক।

কর্নেল গলার ভেতর শুধু বললেন, হুঁ!

বেশ কিছুক্ষণ পরে ভেতরের দিকের একটা দরজার পর্দা তুলে এক সুন্দরী মহিলা ঘরে ঢুকলেন। মনে হলো বিষাদের প্রতিমূর্তি। খোলা চুল পিঠে ও কাঁধে এলোমেলো ছড়িয়ে পড়েছে। একটু আগে স্নান করেছেন মনে হচ্ছিল। কিছুটা তফাতে আস্তে বসে তিনি কাঁপা কাঁপা স্বরে বললেন, আমাকে ক্ষমা করবেন। এখন কারও সঙ্গে কথা বলার মতো মানসিক অবস্থা আমার নেই। তবু আপনি এসেছেন শুনে–

কর্নেল তার কথার ওপর বললেন, তুমি আজ ভোরে যখন ফোন করে সব জানালে, তখন আমি আসব বলেছিলাম।

মালবিকা এবার কান্নাজড়ানো স্বরে বললেন, কিন্তু এত দেরি করে এলেন কর্নেল! আমার ইচ্ছে ছিল, প্রদীপের ডেডবডিটা অন্তত আপনি এসে দেখবেন। বাবার কাছে শুনেছিলাম, আপনার চোখে কিছু এড়িয়ে যায় না।

পুলিশের চোখে কি কিছু এড়িয়ে গেছে বলে তোমার ধারণা?

 চোখের জল মুছে মালবিকা বললেন, জানি না।

কর্নেল একটু চুপ করে থেকে বললেন, আমার ওপর তোমার অভিমান হতেই পারে। কিন্তু আমি তো অন্তর্যামী নই। তোমার স্বামী কোনো ফাঁদে পা দিয়েছেন এবং তার ক্ষতি হতে পারে বলে তোমার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু সেদিন যখন তোমার কথামতো এ বাড়িতে এলাম, তখনও তুমি আমার প্রশ্নের উত্তরে তেমন কোনো সূত্র দিতে পারলে না। এখন আমি কয়েকটা কথার স্পষ্ট উত্তর চাই।

মালবিকা মুখ নামিয়ে বললেন, বলুন!

তোমার সঙ্গে মিঃ সিনহার দাম্পত্য সম্পর্ক কেমন ছিল?

আমি ওকে বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করেছিলাম, তা তো আপনি জানেন!

হ্যাঁ। জানি!

মালবিকা মুখ তুলে বললেন, আমার দিক থেকে সম্পর্ক ভালো রাখার কোনো ত্রুটি ছিল না–যদিও প্রদীপ পরে আমাকে অকারণ ভুল বুঝেছিল।

খুলে বলতে আপত্তি আছে?

না। বলে মালবিকা একবার আমার দিকে তাকালেন।

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ, আলাপ করিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। আমার বিশেষ স্নেহভাজন বন্ধু জয়ন্ত চৌধুরী। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক। সব কথা স্বচ্ছন্দে তুমি এর সামনে বলতে পারো।

মালবিকা একটু দ্বিধার ভঙ্গিতে বললেন, প্রদীপের ফিল্ম প্রোডাকশন কোম্পানির কথা আপনাকে বলেছিলাম। অনেক খারাপ মেয়েও এ লাইনে থাকে। খারাপ অর্থে কেরিয়ারিস্ট! কেরিয়ারের স্বার্থে তারা নিজেদের–তবে ও কথা থাক। প্রদীপের একটা ফিল্ম ফ্লপ করে গিয়েছিল। অনেক টাকার ব্যাপার। অথচ গত মাসে আবার একটা ছবি করার জন্য সে মেতে উঠেছিল। তারপর জানতে পারলাম, চিত্রা দত্ত নামে এক উঠতি নায়িকা ওকে তাতিয়েছে।

কী সূত্রে জানতে পারলে?

এ বাড়িতে মেয়েটি প্রায়ই আসত। প্রদীপ ফরম্যালি আলাপ করিয়েও দিয়েছিল। কিন্তু আমি প্রদীপকে নিষেধ করতাম। প্রদীপ ভাবত, আমি তার চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহ করছি। এ নিয়ে মাঝে মাঝে দুজনে প্রচণ্ড তর্কবিতর্কও হচ্ছিল। কিন্তু না–ঝগড়া নয়। আমি ওকে বোঝাবার চেষ্টা করতাম, মেয়েটি আসলে ওকে এক্সপ্লয়েট করতে চায়?

এক মিনিট। তুমি ফোনে বলেছিলে, পুলিশ জানতে পেরেছে গত রাতে নাকি একটি মেয়ে এসে তোমার স্বামীকে মার্ডার করে গেছে।

মালবিকা ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। এই সময় লখিয়া আমাদের জন্য ট্রেতে কফি নিয়ে এল। ট্রে রেখে সে কর্নেলকে আড়চোখে দেখতে দেখতে বেরিয়ে গেল। মালবিকা বললেন, কফি খান। বলছি।

কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, হ্যাঁ–বলো!

চিত্রা দত্ত যতবার এ বাড়িতে এসেছে, সঙ্গে একটা মেয়েকে দেখেছি। চিত্রা নিজে গাড়ি চালিয়ে আসত। মেয়েটি পোর্টিকোর নিচে গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকত। চিত্রার সঙ্গে আমি প্রথম থেকেই ততকিছু কথাবার্তা বলতাম না। এ ঘরে প্রদীপের সঙ্গে বসে সে কথা বলত। আমি–হ্যাঁ, স্বীকার করছি, আড়ি পেতেছি। আড়ি পেতেই শুনেছিলাম প্রদীপ ওকে হাসতে হাসতে বলছে, তোমার বডিগার্ডকে এই ছবিতে একটা রোল দিলে মন্দ হয় না।

কর্নেল গম্ভীর মুখেই বললেন, তার পরনে জিনস এবং মাথায় রুমাল জড়ানো থাকত?

হ্যাঁ। মালবিকা শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে বললেন, চিত্রাই প্রদীপকে মার্ডার করতে পাঠিয়েছিল ওকে।

কিন্তু মোটিভ কী থাকতে পারে?

মালবিকা একটু চুপ করে থেকে বললেন, পুলিশও আমাকে এ কথা বলছিল। আমি জানি না প্রদীপের সঙ্গে চিত্রার সম্পর্ক খারাপ হয়েছিল কি না। তবে

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, তবে কী?

আমাদের সারভ্যান্ট বাচ্চু নাকি চিত্রা দত্তের বাড়িতে একসময় কাজ করত। তাকে পুলিশ জেরা করার জন্য থানায় নিয়ে গেছে।

বাচ্চু চিত্রা দত্তের বাড়িতে কাজ করেছিল এ কথা পুলিশ জানল কী ভাবে?

বাচ্চু লক্ষ্মীরানীকে কবে তা বলেছিল। লক্ষ্মীরানী মানে যে মেয়েটিকে দেখলেন।

শম্ভু নামে আরও একজনকেও তো পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে? নরবাহাদুর বলল।

হ্যাঁ। শম্ভু রাঁধুনি! প্রদীপের বাবার আমল থেকে এ বাড়িতে আছে। শম্ভু পুলিশকে বলেছে, জিমের চিৎকারে সে নিচের ঘর থেকে জানালায় উঁকি দিয়েছিল। তারপর সে নাকি বাচ্চুর মতো কাকে আবছা দেখতে পায়। বাগানের খানিকটা জায়গায় আলো পড়ে। কিন্তু গাছের ছায়া–তাছাড়া বৃষ্টি পড়ছিল। ঝোড়ো বাতাস বইছিল। মালবিকা শ্বাস ছেড়ে ফের বললেন, শম্ভু সম্ভবত চিত্রার সেই বডিগার্ডকে দেখে বাচ্চু বলে ভুল করেছিল। কিন্তু পুলিশ ওকে আরও জেরা করবে।

বাচ্চু বা শম্ভু কেউ গুলির শব্দ শোনেনি?

না। আমিও শুনতে পাইনি। আসলে মেঘ ডাকছিল মাঝে মাঝে।

 তুমি গত রাতে বারোটা নাগাদ আমাকে ফোন করেছিলে?

মালবিকা এবার জোরে শ্বাস ছেড়ে বললেন, গত রাতে দশটা-সওয়া দশটায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কী একটা শব্দে–ঠিক জানি না, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। ইদানীং প্রদীপ সম্পর্কে আমার খুব অস্বস্তি আর আতঙ্ক হতো। তাই টেবিলল্যাম্প জ্বেলে দেখি, ও বিছানায় নেই। বাথরুমে গেছে ভাবলাম। কিন্তু আধঘণ্টা কেটে গেল। তারপর দেখি, দরজা ভেজানো আছে। তখন রাত প্রায় বারোটা। বেলের সুইচ টিপে নরবাহাদুরকে ডাকলাম। তারপর আপনাকে ফোন করলাম। কেন জানি না, সে-মুহূর্তে আপনার কথা আমার মনে পড়েছিল।

মালবিকা একটু ঝুঁকে দুহাতে মুখ ঢাকলেন। কর্নেল তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, মালবিকা! তোমার কিন্তু ভেঙে পড়লে চলবে না। এখন তোমাকে মরিয়া হয়ে। অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। মনে রেখো, তোমার স্বামীর অনেকগুলো কাজ-কারবার আছে। সেগুলোর আর্থিক অবস্থা তোমার জানা দরকার। আর একটা কথা। মিঃ সিনহার অ্যাটর্নি বা লইয়ার কে, তোমার জানার কথা। কে তিনি?

পাশের বাড়িতে থাকেন। এস. কে. মুখার্জি। ওঁর দারোয়ান ফাগুলালই সেই খুনী মেয়েটাকে একটা গাড়ি থেকে নামতে দেখেছিল। মিঃ মুখার্জি গত রাত থেকে যাতায়াত করছেন। খুব হেল্পফুল মানুষ।

এখন উনি কোথায় আছেন জানো?

ডেডবডি মর্গ থেকে শ্মশানে নিয়ে যাবেন। প্রদীপের বন্ধুবান্ধব আর কর্মচারীরা এসেছিল। তারা সবাই মর্গে অপেক্ষা করছে। বারোটা নাগাদ বডি ডেলিভারি দেবে।

তোমার স্বামীর আত্মীয়স্বজন?

আত্মীয়স্বজন বলতে ওর এক বোন। সে একজন জার্মানকে বিয়ে করে ফ্রাঙ্কফুর্টে থাকে। তার ঠিকানা আমি জানি না। প্রদীপ তার বোন সম্পর্কে কেন যেন উদাসীন ছিল।

কাগজপত্র খুঁজে দেখো। ঠিকানা পেয়ে যেতেও পারো। পেলে তাকে দুঃসংবাদটা দেওয়া তোমার কর্তব্য।

বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। মালবিকা চোখের জল মুছে বললেন, কিন্তু পুলিশের ওপর আমার ভরসা কম। আমি আপনার সাহায্য চাই।

আমি তো আছি। দেখা যাক পুলিশ কী করে। কর্নেল মালবিকার দিকে একটু তাকিয়ে থাকার পর ফের বললেন, তুমি চুপচাপ বিশ্রাম করো। ভেঙে পড়লে চলবে না। আর আমি আপাতত নিচে গিয়ে দেখি, কোথায় তোমার স্বামীর ডেডবডি পড়েছিল।

নরবাহাদুরকে বলুন। সে দেখিয়ে দেবে।

নিচে লনের ধারে দাঁড়িয়ে কর্নেল নরবাহাদুরকে ডাকলেন। সে হন্তদন্ত এগিয়ে এল। বলুন কর্নির্লসাব!

বাহাদুর! ঠিক কোথায় তোমার মালিকের ডেডবডি পড়েছিল দেখিয়ে দাও।

নরবাহাদুর কর্নেলের দিকে একটু অবাক চোখে তাকাল। তারপর বলল, আসুন!

বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে দেশি-বিদেশি উঁচু-নিচু অজস্র গাছ। ফাঁকা জায়গাগুলিতে মরশুমি ফুলের উজ্জ্বল ঝক এতক্ষণে রোদ পেয়ে ঝলমল করছে। পেছনের পাঁচিলের দরজা এখন ভেতর থেকে আটকানো আছে। বাড়ি থেকে প্রায় মিটার ছ-সাত দূরে একটা ছাতিমগাছের তলায় এগিয়ে গেল নরবাহাদুর। গাছের তলায় সবখানে ঝরা পাতা পড়ে আছে। রাতের বৃষ্টিতে পাতাগুলি ভিজে চবচব করছে। কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মালী কোথায় বাহাদুর?

নরবাহাদুর বলল, সায়েব কদিন আগে মালীকে ভাগিয়ে দিয়েছেন। নতুন মালী খোঁজা হচ্ছে।

পুরনো মালীকে সায়েব ভাগিয়ে দিলেন কেন?

বহৎ হারামি ছিল সার! লখিয়াকে খারাব কথা বলেছিল। রুপেয়ার লালচ দেখিয়েছিল।

কর্নেল নিচের দিকে দৃষ্টি রেখেছিলেন। সম্ভবত কোনো সূত্র খুঁজছিলেন। শুধু বললেন, হুঁ!

নরবাহাদুর সামনে ফাঁকা একটুকরো জায়গায় কেয়ারি করা ঘন রঙ্গনা ফুলের সারির কাছে গিয়ে বলল, এখানে সার! এই দেখুন! ঘাসের ওপর কাত হয়ে পড়েছিলেন সায়েব। পুলিশ আমাকে পানি দিয়ে সাফা করতে বলল। তখন করলাম। লেকিন আভি খুনের দাগ দেখতে পাবেন। পানির পাইপ টেনে ফির সাফা করতে হবে।

একটু তফাতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। অস্বস্তিটা আবার আমাকে পেয়ে বসেছে। কর্নেল হাঁটু মুড়ে বসে ঘাস পরীক্ষা করছিলেন। নরবাহাদুর অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। সে জানে না কে এই কর্নিলসাব।

কর্নেল ফাঁকা জায়গা থেকে আবার ছাতিমতলায় গেলেন। তারপর আবার হাঁটু মুড়ে বসে ভেজা আর পচা একরাশ পাতা একটা কাঠি দিয়ে সরিয়ে কিছু দেখলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, এবার বলো বাহাদুর, তুমি কোথায় সায়েবকে আসতে দেখেছিলে?

নরবাহাদুর ততক্ষণে আঁতকে উঠে চোখ বড়ো করেছে। সে বলে উঠল, এখানে ভি খুন গিরেছে?

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। তোমার সায়েবকে গুলি করার সময় তিনি রঙ্গনা ঝোঁপের আড়ালে লুকোতে চেষ্টা করেছিলেন। যাই হোক, তুমি কোথায় ওঁকে। প্রথম দেখতে পেয়েছিলে বলো!

নরবাহাদুর কয়েক হাত তফাতে খিড়কির দিকে যাওয়ার সংকীর্ণ রাস্তায় গিয়ে বলল, এখানে সার! ওই দেখুন! আমার ঘরের জানালা থেকে নজর হবে। ওই দেখুন, দোতলার সানশেডের নিচে বাত্তি ভি আছে।

হাত তিনেক চওড়া রাস্তাটা মোরাম বিছানো। সেখানে দাঁড়িয়ে কর্নেল বাড়ির নিচের তলার একটা জানালা দেখিয়ে বললেন, ও ঘরে কে থাকে?

শম্ভু থাকে সার!

কর্নেল বাড়ির ওপরদিকে তাকালেন। আমিও মুখ তুলেছিলাম। সেই সময় চোখে পড়ল, লখিয়া একটা জানালা থেকে আমাদের দেখছিল। চোখে চোখ পড়ামাত্র সরে গেল।

কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুটটা লাইটারে ধরিয়ে নিয়ে বললেন, তোমার সায়েবের পরনে কী পোশাক ছিল বাহাদুর?

নাইট-ডিরেস ছিল।

কর্নেল খিড়কির দরজা পর্যন্ত গিয়ে তারপর ফিরে এলেন। বললেন, ওই দরজা যে খোলা আছে, প্রথমে কে দেখেছিল?

পুলিশ আসল। তারপর দেখল।

তোমরা কেউ লক্ষ্য করোনি?

 না সার। তখন মালিককে দেখব না আর কুছু দেখব।

কর্নেল হঠাৎ নরবাহাদুরের কাঁধে হাত রেখে চাপাস্বরে বললেন, তোমার সায়েবকে কে মার্ডার করতে পারে বলে তোমার মনে হয়?

নেপালি দারোয়ানের মুখে প্রচণ্ড অস্বস্তির ছাপ ফুটে উঠল। সে বলল, আমি কেমন করে জানব সার? লেকিন ছ লম্বর বাড়ির দারোয়ানজি ফাগুলাল খুনীকে দেখেছিল।

বাহাদুর! তোমার সায়েবের কাছে সিনেমার মেয়েরা আসত, নিশ্চয় তুমি জানো?

হাঁ সার! বাচ্চু আমাকে ভি বলেছিল, এখন যে হিরোইন যানা-আনা করে, বাচ্ছ তার নোকরি করত। আমি বললাম, নোকরি ছোড় দিলে কেন? তো বাচ্চু বলল, আমাকে রাখল না তো কী করব? সার! সেই হিরোইন আমার মালিককে বলেছিল, বাচ্চুকে লিন। আমার আর নোকর দরকার নাই। তখন সিনহাসাব বাচ্চুকে লিয়ে লিল। আমি পুলিশকে বলেছি সার!

কর্নেল শম্ভুর ঘরের সেই জানালার নিচে গিয়ে দাঁড়ালেন। কী দেখলেন উনিই জানেন। তারপর পা বাড়িয়ে বললেন, আচ্ছা বাহাদুর, তোমার সায়েবের কখানা গাড়ি আছে?

দো কার আছে সার! মেমসাবের একটা আর উনহির একটা।

ড্রাইভার আছে?

মেমসাব নিজে ডেরাইভ করেন। সিনহাসাবের ডেরাইভার জগদীশ আছে। সে বডির সাথে শ্মশানে যাবে। সুবামে চলে গিয়েছে।

গাড়ির গ্যারাজ তো ওপাশে? পেছন ঘুরেও যাওয়া যায় দেখছি।

হাঁ সার।

কর্নেল বাড়ির সামনে গিয়ে পোর্টিকোর তলায় দাঁড়ালেন। ওখান থেকে বাড়ির উত্তর দিকে গ্যারাজ ঘর দেখা যাচ্ছিল। গরাদ দেওয়া গেটে তালা আঁটা আছে। ভেতরে একটা সাদা আর একটা লাল রঙের গাড়ি দেখা যাচ্ছিল। নরবাহাদুর উদ্বিগ্ন মুখে কর্নেলের দিকে তাকিয়েছিল। বুঝতে পারছিলাম এই কর্নিল সাব কেন এতসব খোঁজখবর নিচ্ছেন, সে বুঝতে পারছে না।

কর্নেল তার দিকে ঘুরে বললেন, ঠিক আছে। চলি বাহাদুর!

নরবাহাদুর ওঁকে কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়ে থেমে গেল। নুড়ি-বিছানো পথে আমাদের আগে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে সে গেট খুলে দিল। সশস্ত্র কনস্টেবলদ্বয় কর্নেলের দিকে তাকিয়ে রইল।

ফুটপাতে গিয়ে কর্নেল বললেন, এখানে ট্যাক্সি পাওয়ার সম্ভাবনা কম। চলো! ওই গলিটা দিয়ে বেরিয়ে একটা বড় রাস্তা পাব।

রাস্তা পেরিয়ে উল্টোদিকের গলিতে ঢুকলাম। গলিটার দুধারে পাঁচিল এবং একটা করে বাড়ি। প্রতিটি বাড়িই যে বিত্তবানদের, তা স্পষ্ট। হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি সিনহাসায়েবের বাড়ির সিঁড়িতে ওঠার সময় আশ্চর্য বলছিলেন। তখন জবাব দেননি। এখন দিতে আপত্তি আছে?

কর্নেল বললেন, তোমারও চোখে পড়া উচিত ছিল।

কী?

লখিয়া–মানে, লক্ষ্মীরানীকে।

 কেন?

বাড়িতে অমন একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে। অথচ সে নির্বিকার। তাছাড়া– কর্নেল চুপ করে কিছুক্ষণ হেঁটে গেলেন। তারপর ফের বললেন, একটা আঠারো-উনিশ বছরের মেয়ে ফ্রক পরে থাকে?

অনিচ্ছাসত্ত্বেও হেসে ফেললাম। আপনি তা-ও লক্ষ্য করেছেন!

বৃষ্টির পর আজ বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। অথচ আজ সোয়েটার পরেনি। হাতাকাটা ফ্রক!

খ্রিস্টান মেয়ে হতে পারে।

 নাহ্। খ্রিস্টান মেয়েরা ওধরনের ফ্রক পরে না। আর কপালে টিপও পরে না।

ঠিক আছে। আপনি ওকে সন্দেহের তালিকায় রেখেছেন। এই তো?

কর্নেল কোনো কথা বললেন না। বেশ কিছুদূর চলার পর একটা বড় রাস্তা পাওয়া গেল। একটা ট্যাক্সি যেতে যেতে যেন কর্নেলকে দেখেই গতি কমাল। আমরা ট্যাক্সিতে উঠলাম।

.

ইলিয়ট রোডে কর্নেলের তিনতলার অ্যাপার্টমেন্টে ডোরবেলের সুইচ টেপার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দিল যষ্ঠীচরণ। সে উদ্বিগ্ন মুখে আমাকে বলল, দাদাবাবুর গাড়ি কী হলো? জানলা দিয়ে দেখলাম বাবামশাইয়ের সঙ্গে ট্যাক্সি থেকে নামছেন। পথে অ্যাকসিডেং হয়েছে নাকি?

কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন, গোয়েন্দাগিরি শিখে গেছিস তাহলে! জয়ন্তকে আজ গাড়ি নিয়ে আসতে দেখেছিলি। তাই না?

ষষ্ঠীচরণ ভড়কে গিয়ে বলল, আজ্ঞে বাবামশাই, দাদাবাবু তো গাড়ি নিয়েই আসেন।

কর্নেল তার ইজিচেয়ারে বসে বললেন, । তো জানালার ধারে কী করছিলি?

ষষ্ঠী ব্যস্তভাবে বলল, লালবাজারের লাহিড়িসায়েব তিনবার ফোন করেছিলেন। বলছিলেন, ফিরলেই তোমার বাবামশাইকে ফোন করতে বলবে। তাই–

কর্নেল হাসলেন। জয়ন্ত! ষষ্ঠীর কত উন্নতি হয়েছে দেখ। আর নালবাজারের নাহিড়িসায়েব বলে না। ফোং বলে না। তবে অ্যাকসিডেং বলল। ওটা ঠিক। অন্তত তোমার ক্ষেত্রে। বলে উনি টেলিফোন ডায়াল করতে থাকলেন।

ষষ্ঠী গোমড়ামুখে চলে যাচ্ছিল। রিসিভার কানে লাগিয়ে কর্নেল বললেন, তোর দাদাবাবুর এ বেলা নেমন্তন্ন।

দাদাবাবু সকালবেলা এলেই ওনার জন্যে রান্না করি। এ কি কোনো নতুন কথা? বলে ষষ্ঠী পর্দা তুলে ভেতরে অদৃশ্য হলো!

ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ির ফোনের কথা শুনে আমার অস্বস্তিটা বেড়ে গিয়েছিল। কর্নেলের দিকে তাকালাম। ফোনে সাড়া পেয়ে উনি বললেন, অরিজিৎ? কী ব্যাপার?……হ্যাঁ। গিয়েছিলাম।……..আসলে মিসেস সিনহার বাবা অশোক রায় আমার বন্ধু ছিলেন। তাই……আই সি। আজকাল পলিটিক্যাল প্রেশার তো সর্বত্র! যাই হোক, একটা কথা তোমাকে জানিয়ে রাখি। যে গাড়িতে খুনী গিয়েছিল…. কর্নেল প্রায় অট্টহাসি হাসলেন। জয়ন্ত এখানেই আছে। তার সঙ্গে কথা বলতে পারো।…..হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। গাড়ির নাম্বারটা ভুয়ো। দৈবাৎ জয়ন্তর গাড়ির নাম্বারের সঙ্গে মিলে গেছে।… দ্যাটস্ রাইট। দেখার ভুলও হতে পারে। অত রাতে বৃষ্টির মধ্যে…শোনো! ফিল্মের মেয়েটির পলিটিক্যাল গার্ডেন যখন চাপ দিচ্ছেন, তোমরা মেয়েটিকে বরং এড়িয়ে থাকো। আড়াল থেকে আমি কিন্তু আমার কাজ করে যাব। দেখো, তোমার লোকেরা যেন আমাকে বাধা না দেয়।…ও.কে.! ও.কে! রাখছি।

কর্নেল টেলিফোন রেখে আমার দিকে ঘুরে বসলেন। বললেন, তোমার ফঁড়া কেটে গেল। নাহ ডার্লিং! আমার জন্য নয়। ফিল্মস্টার চিত্রা দত্তের পলিটিক্যাল গার্জেনের নাম শুনেই পুলিশ এই কেসে তত খুঁটিয়ে তদন্ত করছে না। এতে আমার সুবিধেই হলো।

বললাম, ছেড়ে দিন। ঝামেলায় জড়িয়ে কী লাভ?

কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর থেকে রুমালে জড়ানো নোংরা সেই আগ্নেয়াস্ত্রটা বের করে টেবিলে রাখলেন। তারপর নির্বিকার মুখে বললেন, জড়াব না কী বলছ? এর চেয়ে অদ্ভুত রহস্য আর কী হতে পারে? গত রাতে একটি মেয়ে নিছক একটা টয় পিস্তলের নল তোমার কানের পাশে ঠেকিয়ে ক্লিফটন রোডে যেতে বাধ্য করল। আর–

ওঁর কথার ওপর বলে উঠলাম, কী অদ্ভুত! ওটা সত্যিকার ফায়ার আর্মস নয়?

নাহ। নিছক খেলনা পিস্তল।

.

০৪.

 খাওয়ার পর কর্নেল ড্রয়িং রুমে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। মুখে চুরুট। চোখ বন্ধ। আমি ডিভানে গড়িয়ে নিচ্ছিলাম। আজ ভাতঘুমটা এলই না। যতবার ভাবছি, একটি মেয়ে নিছক খেলনার পিস্তল আমার কানের পাশে ঠেকিয়ে বৃষ্টিঝরা শীতের রাতে আমাকে ইচ্ছেমতো ক্লিফটন রোডে যেতে বাধ্য করেছে, ততবার নিজের ওপর খাপ্পা হচ্ছি।

কিছুক্ষণ পরে প্রশ্নটা আমার মাথায় এসে গেল। ডাকলাম, কর্নেল!

বলো!

চিত্রা দত্তের বডিগার্ড মেয়েটি প্রদীপ সিনহাকে খুন করেনি। টয় পিস্তলে কাকেও খুন করা যায় না।

হুঁ।

হুঁ নয়। আপনি ব্যাপারটা ভেবে দেখুন! আমার ধারণা, সে একটা নির্দিষ্ট সময়ে–ধরা যাক, রাত সাড়ে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে মিঃ সিনহার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। নিশ্চয় দেখা করার কোনো বিশেষ কারণ ছিল। তাছাড়া মিঃ সিনহাই সম্ভবত খিড়কির দরজা খুলে রেখেছিলেন তার জন্য।

তোমার ধারণায় যুক্তি আছে। কর্নেল চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সে টয় পিস্তলটা ফেলে দিয়ে গেল কেন? না–ঠিক ফেলে দেওয়া বললে ভুল হবে। টয় পিস্তলটা এমন অবস্থায় ছিল, যেন কেউ ওটা। তাড়াহুড়ো করে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল।

বলে কর্নেল দাড়ি থেকে চুরুটের ছাই ঝেড়ে ফেললেন। তারপর হাত বাড়িয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করতে থাকলেন। কয়েকবার ডায়াল করার পর বিরক্ত মুখে বললেন, এই লাইনটা কিছুতেই পাওয়া যায় না। রিং হয়ে আবার তখনই এনগেজড় টোন। গোপালবাবুকে পেলে সুবিধে হতো।

জিজ্ঞেস করলাম, কে গোপালবাবু?

জয়শ্রী স্টুডিয়োর ম্যানেজার।

 সিনেমা স্টুডিয়ো? আপনি কি হিরোইন চিত্রা দত্তের ব্যাপারে–

টেলিফোন বেজে উঠল আমার কথার ওপর। কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। হ্যাঁ, বলছি। বলো কী ব্যাপার?…লুনা এসকর্ট সার্ভিস থেকে?..হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি। কিন্তু নামটা বলেনি?..ঠিক আছে। আমি যাবখন। তুমি আপাতত বাড়ি থেকে বেরিয়ো না।..না, না। সেজন্য নয়। বাড়ির সবকিছুতে তোমার নজর রাখা দরকার। বাড়ির লোকেদের ওপরও…হ্যাঁ। ঠিক আছে। ছাড়ছি।

টেলিফোন রেখে কর্নেল আমার দিকে তাকালেন। বললাম, মিসেস সিনহা?

 হ্যাঁ। লুনা এসকর্ট সার্ভিস নামে একটা সিকিউরিটি এজেন্সি থেকে মালবিকাকে ফোন করেছিল। ব্যাপারটা ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে। বলে কর্নেল ফোন গাইডের পাতা ওল্টাতে থাকলেন।

বললাম, ব্যাপারটা কী?

ওরা জানতে চাইছিল, চিত্রা দত্ত ওখানে আছেন কি না। কর্নেল ফোন গাইডের একটা পাতায় চোখ বুলোতে বুলোতে বললেন, চিত্রা দত্ত ওদের একজন লোক নিয়েছিলেন–লোক বলছিল, পুরুষ না মেয়ে, তা বলেনি–যাই হোক, সেই লোক ওদের অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে না এবং সেটাই নাকি ওদের নিয়ম।

ওরা জানে না প্রদীপ সিনহা খুন হয়েছেন?

মালবিকার ধারণা, ওরা এ খবরটা জানে না। মালবিকাও বলেনি। কালকের সব কাগজে অবশ্য খবর বেরিয়ে যাবে। কোনো সান্ধ্য দৈনিকে আজই বেরিয়ে যেতে পারে। আর–চিত্রা দত্তের সঙ্গেও ওরা যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেছিল। চিত্রার ফ্ল্যাটে তালা আঁটা। ফোনেও কেউ সাড়া দেয়নি। কর্নেলের মুখে বিরক্তি ফুটে উঠল। টেবিলের ড্রয়ার থেকে আতস কাঁচ বের করে বললেন, ফোন গাইডের অক্ষর পড়া এক ঝকমারি। আমার অবশ্য বয়স হয়েছে। তবু রিডিং গ্লাসের দরকার হয় না।

বললাম, তাহলে লুনা এসকর্ট সার্ভিস খুব উদ্বিগ্ন?

হওয়ারই কথা কর্নেল টেবিল ল্যাম্পও জ্বেলে দিলেন। হ্যাঁ। লুনা এসকর্ট–লুনা শব্দটা অস্পষ্ট। এগারো বাই ওয়ান বাই সি পার্ক লেন। বলে উনি টেবিল থেকে একটা খুদে প্যাড টেনে নিয়ে ফোন নাম্বার এবং ঠিকানা টুকে নিলেন।

এতক্ষণে একটু উত্তেজনা অনুভব করলাম। বললাম, চিত্রা দত্তের বডিগার্ড বেগতিক বুঝে তার সঙ্গেই কোথাও গা-ঢাকা দিয়েছে।

কর্নেল টেলিফোন ডায়াল করছিলেন। সাড়া পেয়ে বললেন, লুনা?…শুনুন! আমি জয়শ্রী স্টুডিয়ো থেকে বলছি। মিস দত্ত–মানে চিত্রা দত্ত আপনাদের জানাতে বলেছেন, ওঁকে যে বডিগার্ড আপনারা দিয়েছিলেন…হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুক্লা দাশ…আগে শুনুন। শুক্লাকে মিস দত্ত গত রাত থেকে খুঁজে পাচ্ছেন না।…মিস দত্তের শু্যটিং ছিল আউটডোরে। তাই নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। মিস দত্ত আজও আউটডোরে আছেন। আমাকে টেলিফোন বললেন…কী যেন জায়গাটার নাম–কো-কোকোকরাঝাড় না কি…ছাড়ছি। আমার দায়িত্ব পালন করলাম।

টেলিফোন রেখে টেবিল ল্যাম্পের সুইচ অফ করে কর্নেল হাসলেন। তারপর ঘড়ি দেখে হাঁক দিলেন, ষষ্ঠী! বেরুব। কফি খাইয়ে দে বাবা!

বললাম, মেয়েটির নাম শুক্লা দাশ?

হ্যাঁঃ! তুমি রাতের আলোয় শুক্লা না কৃষ্ণা দেখেছিলে?

খুব একটা ফর্সা নয়। আসলে খুঁটিয়ে যে দেখব, মুখ ঘোরাতে দিলে তো? মুখ ঘোরাতে গেলেই টয় পিস্তলের নলের খোঁচা!

টয় পিস্তল বোলো না! তখন ওটা তোমার কাছে সত্যিকার ফায়ার আর্মস!

হেসে ফেললাম। ওঃ! কী বিচ্ছিরি অপমান! রাতবিরেতে কোনো একলা মেয়েকে গাড়িতে লিফট দিতে নেই। অথচ আমি কী বোকার মতো–

না জয়ন্ত! তুমি অ্যাডভেঞ্চারের ঝুঁকি নিয়েছিলে বলো!

আমরা ঘটনাটা নিয়ে হাসি-পরিহাস চালিয়ে যেতে যেতে ষষ্ঠীচরণের কফি এসে গেল। তখন প্রায় পৌনে তিনটে বাজে।

বেরুতে তিনটে বেজে গেল। নিচের লনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা কোথায় যাচ্ছি?

টালিগঞ্জ এলাকায়।

 জয়শ্রী স্টুডিয়োতে নাকি?

হ্যাঁ। গোপালবাবুর সঙ্গে দেখা করা দরকার।

বড় রাস্তার মোড়ে ট্যাক্সি পাওয়া গেল। শীত চলে যাবার সময় হঠাৎ ঘুরে এসে কলকাতাকে জাপটে ধরেছে। এতে যেন বেজায় সাড়া পড়ে গেছে। মাঝে মাঝে ট্রাফিক জ্যাম সম্ভবত তারই কারণ। জয়শ্রী স্টুডিয়োর গেটে যখন নামলাম, তখন পৌনে চারটে বেজে গেছে।

গেট বন্ধ। কিন্তু পাশের একটা ঘরের দরজা খোলা। কর্নেল সেই ঘরের সামনে গেলেন। দেখলাম, এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক চেয়ারে বসে দু হাতে চায়ের কাপ আঁকড়ে ধরে চুমুক দিচ্ছেন। তার পরনে ছাইরঙা সোয়েটার। মাথায় কাঁচাপাকা একরাশ চুল এলোমেলো হয়ে আছে। কর্নেলকে প্রথমে তিনি দেখতে পাননি। চোখ ছিল টেবিলের দিকে। তারপর মুখ তুলে কর্নেলকে দেখেই নড়ে বসলেন। কী সর্বনাশ! কর্নেলসায়েব যে!

সর্বনাশ কিসের গোপালবাবু?

গোপালবাবু খিকখিক করে হেসে বললেন, বসুন! বসুন! ঠিক আপনার কথাই ভাবছিলাম একটু আগে।

কর্নেল বসলেন। পাশের চেয়ারে আমিও বসলাম। কর্নেল বললেন, আমিও আপনার কথা ভাবতে ভাবতে শেষ পর্যন্ত এসে পড়লাম। আলাপ করিয়ে দিই।

বুঝে গেছি। দৈনিক সত্যসেবক তো? কী মশাই? ঠিক চিনেছি কি না?

চিনেছেন তাহলে?

জয়ন্তবাবুকে চিনতে হবে? জয়ন্তবাবুর হয়তো স্মরণ নেই। গত বছর মার্চে কর্নেলসায়েবের বাড়িতে আলাপ হয়েছিল। ফিল্মস্টার অতনুকুমারের মার্ডারকেসের ব্যাপারে বলে গোপালবাবু কনোলের দিকে তাকালেন। চাপাস্বরে বললেন, প্রদীপ সিনহার মার্ডারকেস হাতে নিয়েছেন তো? ঘণ্টা দেড়-দুয়েক আগে কেওড়াতলা থেকে ফিরেছি। ফিল্মলাইনের অনেকে গিয়েছিল শ্মশানে। সত্যি কথা বলতে কী, জয়শ্রী স্টুডিয়োকে সিনহাসায়েবই চাঙ্গা করে তুলেছিলেন। আগের ছবি ফ্লপ। তা সত্ত্বেও–আসলে অতবড় বিজনেস ম্যাগনেট। বিশ-পঞ্চাশ লাখ কোনো ব্যাপারই নয়। যাক গে। ও রতন! কোথা গেলি রে? অনারেবল গেস্টদের জন্য চা নিয়ে আয়।

কর্নেল বললেন, চা খাব না গোপালবাবু!

সরি! আপনি কফি খান।

নাহ্। কফি খেয়েই বেরিয়েছি। ফোনে আপনাকে ধরার অনেক চেষ্টা করেও পেলাম না।

গোপালবাবু টেবিলের ওপর ঝুঁকে এসে চাপাস্বরে বললেন, আমি কো-অপারেট করব। বলুন, কী জানতে চান?

 চিত্রা দত্ত নামে একজন নতুন নায়িকা–

কর্নেলের কথার ওপর গোপালবাবু বললেন, হ্যাঁ। সিনহাসায়েবের সুনজরে পড়েছিল।

কিন্তু এই অভিনেত্রী সঙ্গে কেন বডিগার্ড নিয়ে ঘোরে, জানেন?

হুঁউ। জানি। আমাকে এসব খবর রাখতে হয়। মানে, খবর পেয়ে যাই। এই লাইনে অনেকেই অনেকের হাঁড়ির খবর রাখে। প্রটাই যে পুরোপুরি সত্যি, তা নয়। তবে হ্যাঁ কিছুটা সত্যি তো বটেই। গোপালবাবু গলার স্বর আরও চাপ করলেন। সিনহাসায়েবের মৃত্যুর খবর পেয়েই স্টুডিয়ো বন্ধ। যাদের শু্যটিং ছিল, স্বেচ্ছায় বন্ধ করে চলে গেছেন। তো আপনি চিত্রার কথা জানতে চান? চিত্রার আসল নাম লতিকা। দমদম এরিয়ায় বিয়ে হয়েছিল। তবে বিয়ের আগে থেকেই যাত্রা-থিয়েটারে অভিনয় করত। তারপর কীভাবে ফিল্ম লাইনে এসে যায়। এই অংশটুকু আমার জানা নেই। শুধু জানি, তখন তার বিয়ে হয়ে গেছে। হাজব্যান্ড নাকি কোনো অফিসে চাকরি করে। তার প্রচণ্ড আপত্তি ছিল। তখন লতিকা ডিভোর্সের মামলা করেছিল। ডিভোর্স পেয়েও যায়। কিন্তু সেই লোকটা ওর পেছনে গুণ্ডা লাগায়। তাই শেষ অব্দি বডিগার্ডের ব্যবস্থা করে দেন। সিনহাসায়েব।

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, আমি শুনেছি চিত্রার পেছনে কোনো প্রভাবশালী রাজনীতিক গার্জেন আছে। আপনি জানেন?

ওঃ হো! গোপালবাবু হাসলেন। ফিল্মমহলে কয়েকটা ট্রেড ইউনিয়ন আছে। সেগুলো সাধারণ কর্মী আর টেকনিসিয়ানদের। একটা ইউনিয়নের এখন বেশ দাপট। হু, সুমন হাজরা তার নাম। যাকে বলে জঙ্গি নেতা। গভমেন্টের ওপর মহলে সুমনবাবুর প্রভাব আছে। আমি জানি। তবে মজার কথা শুনুন। ক মাস আগে জোর গুজব রটেছিল–তাছাড়া ফিল্ম ম্যাগাজিনেও বেরিয়েছিল, সুমনবাবু চিত্রাকে বিয়ে করছেন। আসলে চিত্রা ভীষণ–ভীষণ কেরিয়ারিস্ট টাইপের মেয়ে। খুব মেজাজি। একটুখানি নাম হতে না হতেই দর হাঁকতে শুরু করেছে। এদিকে সিনহাসায়েব খুন হয়ে গেলেন। আমার তো সন্দেহ হচ্ছে, চিত্রার হাজব্যান্ড ব্যাটাচ্ছেলেই খুন করেছে। এরপর ভগবান না করুন, চিত্রার বরাতে কী আছে কে জানে!

চিত্রাকে এখন কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পারেন?

গোপালবাবু গম্ভীর হয়ে গেলেন। পরশু একবার এসেছিল শু্যটিং ছিল না। ডাইরেক্টর রানা গাঙ্গুলির সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিল দেখেছি। তারপর আর দেখিনি। আশ্চর্য! কেওড়াতলাতেও তো তাকে দেখলাম না! সর্বনাশ! লোকটা চিত্রাকেও মেরে গুম করে ফেলেনি তো? এই টেলিফোনটা দুদিন থেকে খারাপ। ওর ফ্ল্যাটে খোঁজ নেওয়া উচিত।

আমাকে ঠিকানাটা লিখে দিন গোপালবাবু!

গোপালবাবু ড্রয়ার থেকে একটুকরো কাগজ বের করে ঠিকানা লিখে দিলেন। ফোন নাম্বারও দিলাম। এই নাম্বারটায় টিক মেরে দিয়েছি। এটা ওর প্রাইভেট নাম্বার। ফোন গাইডে পাবেন না।

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ধন্যবাদ গোপালবাবু! চলি। দরকার হলে যোগাযোগ করব।

গোপালবাবু আমাদের সঙ্গে বেরিয়ে এসে বললেন, আপনারা গাড়িতে আসেননি?

কর্নেল হাসলেন। আমার গাড়ি তো কবে বিক্রি করে দিয়েছি। জয়ন্তর গাড়ির অসুখ হয়ে গ্যারাজে আছে। আমরা ট্যাক্সি পেয়ে যাব।

এক মিনিট। আমি গাড়ি বের করতে বলি। আপনাদের পৌঁছে দেব। খামোকা বসে থাকার মানে হয় না।

আমরা হেস্টিংস এরিয়ায় যাব। মিঃ সিনহার বাড়ি।

 তাতে কী হয়েছে? আপনাদের নামিয়ে দিয়েই যাব।…

গোপালবাবু নিজে ড্রাইভ করেন না। সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে বসে মুখটা পেছনে ঘুরিয়ে কর্নেলের সঙ্গে সারাপথ অনর্গল কথা বলছিলেন। বুঝতে পারছিলাম ভদ্রলোক বড্ড বেশি বকবক করেন। বাংলা সিনেমার বর্তমান দুরবস্থা থেকে শুরু করে আগের আমলের সুখের স্মৃতিচর্চা এবং তার ফাঁকে হঠাৎ করে উঠতি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে মুখরোচক গল্পগাছা।

ক্লিফটন রোডে শীতসন্ধ্যার আলো-আঁধারি পরিবেশে অবশেষে কর্নেলের নির্দেশে গোপালবাবুর গাড়ি দাঁড়াল। গোপালবাবু বললেন, সিনহাসায়েবের বাড়িতে কখনও আসিনি। ওঁর স্ত্রীর সঙ্গে একটা পার্টিতে আলাপ হয়েছিল। ওঁকে সান্ত্বনা জানিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু এখন বিরক্ত করা ঠিক হবে না। পরে টেলিফোনে কথা বলব বরং।

আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। কর্নেল বললেন, ধন্যবাদ গোপালবাবু!

 না, না, কর্নেলসায়েব! ধন্যবাদ কিসের? এ তো আমার সৌভাগ্য।

গোপালবাবুর অ্যাম্বাসাড়ার গাড়ি বাঁকের মুখে উধাও হয়ে গেল। প্রথমে কিছুক্ষণ চিনতে পারছিলাম না কোথায় নেমেছি। কর্নেল রাস্তা পেরিয়ে ওপাশের ফুটপাতে গিয়ে বললেন, গোপালবাবু সব কথা রঙ চড়িয়েই বলেন। তা থেকে প্লাস-মাইনাস করে যেটুকু দাঁড়ায়, সেটুকু অবশ্য কাজে লাগানো চলে।

বললাম, রহস্যটা এবার ভীষণ পাচালো হয়ে গেল যেন।

কর্নেল শুধু হু বলে পাশের গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন। বাড়িটা এবার চিনতে পারলাম। কর্নেল উঁকি মেরে দেখে বললেন, পুলিশ পাহারা দেখছি না। তারপর ডাকলেন, বাহাদুর! বাহাদুর!

বাহাদুর এগিয়ে এল পোর্টিকোর দিক থেকে কর্নেলকে দেখে সে সেলাম ঠুকে গেটের তালা খুলে দিল। আমরা ঢুকলে সে আবার তালাটা এঁটে দিয়ে চাপা গলায় বলল, বাচ্চুকে পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে। শম্ভুকে ভি ছেড়ে দিয়েছে। তারপরে বাচ্চু শম্ভুর সঙ্গে ঝামেলা করছিল। আমি রুখে দিলাম। বাচ্চু শম্ভুকে মারতে যাচ্ছিল।

বাড়িটা এখন সকালের মতো স্তব্ধ। নরবাহাদুর ডাকছিল, লখিয়া! লখিয়া!

পোর্টিকোর ছাদে লক্ষ্মীরানীকে দেখা গেল। আবছা আলোয় দেখলাম তার গায়ে একটা চাদর জড়ানো আছে। বাহাদুর কর্নিসাবের খবর দিলে সে অদৃশ্য হয়ে গেল।

নরবাহাদুর আমাদের নিচের হলঘরে পৌঁছে দিয়ে চলে যাওয়ার পর সিঁড়ির ওপর থেকে লখিয়া বলল, মেমসায়েব আপনাদের আসতে বললেন।

আমরা দোতলায় সেই ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসলাম। একটু পরে মালবিকা এলেন। মনে হলো, ঘটনার আঘাত অনেকটা সামলে নিয়েছেন। কিন্তু মুখে গাম্ভীর্য থমথম করছে। আস্তে বললেন, কিছুক্ষণ আগে লুনা এসকর্ট থেকে। আবার কেউ ফোন করে জানতে চাইছিল, চিত্রা দত্ত এসেছেন কি না। আসেনি বলে ফোন নামিয়ে রাখলাম।

কর্নেল বললেন, চিত্রার বডিগার্ডের নাম জানতে পেরেছি। শুক্লা দাশ।

মালবিকার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আপনি পুলিশকে জানিয়েছেন?

 এখনও জানাইনি।

তাহলে আমি জানিয়ে দিচ্ছি।

না। দরকার হলে আমি জানাব।

মালবিকা শ্বাস ছেড়ে বললেন, মিঃ মুখার্জি একটু আগে এসেছিলেন। উনি বলছিলেন, ওঁর ধারণা, পুলিশ কেন যেন আর তত আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আমি ওঁকে আপনার কথা বললাম। পুলিশের ওপর মহলে আপনার প্রভাব আছে, তাও বললাম। মিঃ মুখার্জি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান। ওঁকে খবর দিচ্ছি।

কর্নেল হাত তুলে বললেন, একটু পরে। আগে একটা কথা জানতে চাই।

বলুন!

 তুমি নিশ্চয় জানো বাচ্চু চিত্রা দত্তের বাড়িতে কাজ করত।

জানি। আমি ওই রাফিয়ানটাকে সহ্য করতে পারি না। ওকে কালই ছাড়িয়ে দেব। আজ থানা থেকে ছাড়া পেয়ে এসে শম্ভুকে ও মারতে যাচ্ছিল। আমি বাহাদুরকে বলেছিলাম তখনই ওকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে।

লক্ষ্মীকে পেলে কীভাবে?

মালবিকা আস্তে বললেন, বাচ্চু এনে দিয়েছিল। লক্ষ্মী ওর পিসতুতো না মাসতুতো বোন। তবে মেয়েটি ভালো। বিশ্বাসী। ওর সরলতা–আমি বলতে চাইছি ইনোসে মাঝে মাঝে ওর বিপদ ডেকে আনে। আমাদের পুরনো মালী নবকান্তকে ওর জন্য বাধ্য হয়ে তাড়িয়ে দিয়েছি।

কর্নেল হাসলেন। লক্ষ্মীর বয়স, আমার ধারণা, আঠারো-উনিশ বছর! অথচ

মালবিকা দ্রুত বললেন, ওর মেন্টাল ম্যাচিওরিটি বয়সের তুলনায় কম। শাড়ি পরতে চায় না।

হ্যাঁ। সকালে দেখছিলাম হাতকাটা ফ্রক পরে আছে। ভোরবেলা থেকে আজ বেশ শীত পড়েছে। কিন্তু সোয়েটার গায়ে ছিল না। এখন অবশ্য চাদর জড়িয়েছে দেখলাম!

মালবিকা একটু অবাক হয়ে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বললেন, ওকে সেদিনই একটা নতুন সোয়েটার কিনে দিয়েছি। আগেরটা নবকান্তের টানাটানিতে–দ্যাটস আ ন্যাস্টি অ্যাফেয়ার! নতুন সোয়েটারটা গত রাতের ঘটনার সময় নিচের বাগানে পা হড়কে পড়ে নোংরা করে ফেলেছিল। কেচে শুকোতে দিয়েছিল। এখনও নাকি শুকোয়নি। তাই ওকে একটা চাদর দিয়েছি।

লক্ষ্মী কোন ঘরে থাকে?

আগে নিচের তলায় কিচেনের পাশে একটা ঘরে থাকত। পরে ওকে দোতলায় পেছনদিকের একটি ঘর দিয়েছি।

এইসময় লক্ষ্মী কফি আর স্ন্যাক্স নিয়ে এল ট্রেতে। তারপর কর্নেলের দিকে ওবেলার মতোই কেমন চোখে তাকাতে-তাকাতে বেরিয়ে গেল।

মালবিকা বললেন, মিঃ মুখার্জিকে ডাকি এবার!

একটু পরে। কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, তোমাদের খিড়কির দরজায় নিশ্চয় তালা আঁটা থাকে?

হয়তো থাকে। থাকারই কথা। আমি লক্ষ্য করিনি।

ওবেলা এসে আমি তালা দেখতে পাইনি। কিন্তু খুনী তো ওই দরজা দিয়েই ঢুকেছিল!

তাহলে পুলিশ তালাটা নিয়ে গেছে। মিঃ মুখার্জি বলতে পারবেন।

তোমার কি মনে হয়নি তোমার স্বামীই ওই দরজা খুলে খুনীকে বাড়ি ঢুকিয়েছিলেন?

মালবিকা মুখ নামিয়ে বললেন, হ্যাঁ। আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছিল। বৈকি। তবে ব্যাপারটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। প্রদীপের কাজকর্মের অনেক কিছু আমি জানি না। জানবার চেষ্টাও করিনি।

তুমি এখনই বাহাদুরকে জিজ্ঞেস করো, খিড়কির দরজায় তালা এঁটেছে কি না।

মালবিকা ডাকলেন, লক্ষ্মী!

 মেয়েটি তক্ষুণি ঘরে ঢুকে বলল, মেমসায়েব!

 নিচে গিয়ে বাহাদুরকে বল, পেছনের দরজায় তালা না দিয়ে থাকলে এখনই যেন তালা দেওয়ার ব্যবস্থা করে।

লক্ষ্মী বলল, বাহাদুর দুপুরে নতুন তালা এনে লাগিয়েছে।

তুই দেখেছিস?

না দেখলে মিছিমিছি বলছি নাকি! বলে লক্ষ্মী মুখটা করুণ করে ফেলল। মেমসায়েব! কাল একবেলার জন্য বাড়ি যাব। আবার মনে করিয়ে দিলাম।

ঠিক আছে। যাবি। বলেছি তো!

লক্ষ্মী চলে গেলে কর্নেল বললেন, মিঃ মুখার্জিকে তুমি বরং টেলিফোনে জানিয়ে দাও, আমি ওঁর কাছে যাচ্ছি। ওঁকে কষ্ট করে আসতে হবে না। আমার একটু তাড়া আছে।

মালবিকা হাত বাড়িয়ে রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন। তারপর সাড়া পেয়ে মৃদুস্বরে কিছু বললেন। আমরা একটু তফাতে বসে ছিলাম। তাই কথাগুলি শুনতে পেলাম না। টেলিফোন রেখে মালবিকা বললেন, আপনার কথা ওঁকে বলেছি। উনি আপনাকে কিছু কথা বলতে চান!

কর্নেল ঘড়ি দেখে ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়ালেন। মালবিকাকে সাবধানে থাকতে বলে। বেরিয়ে এলেন। সিঁড়িতে নামবার সময় বললাম, কুকুরটা চুপ করে আছে কেন?

কর্নেল বললেন, কুকুরের কথা পরে। চলো, মিঃ মুখার্জির সঙ্গে দেখা করা যাক।

নরবাহাদুর গেট খুলে দিল। আমরা বেরিয়ে গেলাম তারপর হঠাৎ কর্নেল ডাকলেন, বাহাদুর!

বোলিয়ে কর্নিলসাব!

পেছনের দরজায় কি তুমি নতুন তালা এঁটে দিয়েছ?

হাঁ সাব!

আচ্ছা বাহাদুর, লখিয়ার সোয়েটারে নাকি গতরাতে কাদা মেখে গিয়েছিল। তাই সে ওটা কেচে নাকি শুকোতে দিয়েছিল। তুমি কি শুকোতে দেওয়া সোয়েটারটা দেখেছ?

নরবাহাদুর অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, লাল রঙের সোয়েটার। লেকিন– হাঁ, হাঁ! লখিয়া বলছিল, সোয়েটারে বহৎ ময়লা লেগেছে। ধুলেও সাফা হবে না। তো আমি বললাম, এক নয়া সোয়েটার মা লো। মেমসাবকো বোলো।

তাহলে তুমি সোয়েটারটা শুকোতে দেখনি?

নেপালি দারোয়ান হাসল। কোথায় শুখা করবে? বাড়িতে এখন যা ধুপ পড়ে, তা গেরিজঘরের সামনে। শুখা করতে দিলে তো আমি দেখব? বহৎ ফন্দিওয়ালি আছে লখিয়া। মেমসাবের কাছে নতুন সোয়েটার লিবে।

কর্নেল সংকীর্ণ ফুটপাতে হন্তদন্ত হাঁটতে থাকলেন। লক্ষ্মীরানীর সোয়েটার নিয়ে ওঁর এত মাথাব্যথার কারণ কী বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ কর্নেল সেই সরু কানাগলিতে ঢুকে আস্তে বললেন, চুপচাপ এস। এমনভাবে পা ফেলবে যেন কেউ শুনতে না পায়।

ওঁর মতো পা টিপে টিপে এগিয়ে তারপর বাঁ দিকে ঘোরার সময় কর্নেল পকেট থেকে খুদে টর্চ বের করে পায়ের কাছে আলো ফেললেন। ফিসফিস করে বললেন, ওবেলা এসে বটগাছের শেকড়ের ফাঁকে একটুখানি চোখে পড়েছিল। তখন ভেবেছিলাম একটুকরো লাল রঙের ন্যাকড়া। তুমি এখানে দাঁড়াও। আমি আসছি।

লক্ষ্য করলাম, উনি পাঁচিলের ধারে ওঁড়ি মেরে এগিয়ে যাচ্ছেন একটু পরে ওঁর টর্চের আলো জ্বলে উঠেই নিভে গেল। তারপর তেমনি ভঙ্গিতে ফিরে এসে ফিসফিস করে বললেন, চলো। কেটে পড়া যাক।

ছিঁচকে চোরের ভঙ্গিতে দুজনে গলি থেকে বেরিয়ে ফুটপাতে পৌঁছুলাম। তারপর কর্নেল বললেন, মিঃ মুখার্জির বাড়িতে এখন যাচ্ছি না। চলো, সেই গলি দিয়ে বড় রাস্তায় যাওয়া যাক।

উল্টোদিকের নির্জন গলিতে ঢুকে বললাম, লক্ষ্মীর ফেলে দেওয়া সোয়েটার কুড়িয়ে আনলেন বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু ওতে কী এমন ইমপর্ট্যান্ট পয়েন্ট আছে বলে আশা করছেন?

কর্নেল হাসলেন। যখের ধন বলতে পারো। বাড়িতে গিয়ে খুলে দেখবখন।

এতক্ষণে দেখতে পেলাম ওঁর হাতে একটা কালো রঙের মোটাসোটা প্ল্যাস্টিক প্যাকেট ঝুলছে এবং ওপরের দিকে লাল রঙের সোয়েটারের একটুখানি অংশ বেরিয়ে আছে।

ট্যাক্সি চেপে ইলিয়ট রোডে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছুতে সাড়ে ছটা বেজে গেল। ষষ্ঠীচরণকে কড়া কফির হুকুম দিয়ে কর্নেল প্ল্যাস্টিকের প্যাকেট থেকে সাবধানে যেমন-তেমনভাবে ভাঁজ করে ঢোকানো লাল ফুলহাতা সোয়েটারটা বের করলেন। তারপর সোয়েটারের ভাঁজ খুলতেই বেরিয়ে পড়ল একশো টাকার নোটের পাঁচটা বান্ডিল। প্রতিটি বান্ডিলে ক্লিপ আঁটা এবং ব্যাঙ্কের ছাপানো স্লিপ সাঁটা আছে। দেখামাত্র বলে উঠলাম, পঞ্চাশ হাজার টাকা!

কর্নেল ব্যাঙ্কের নাম দেখে নিয়ে দ্রুত টেবিলের ড্রয়ারে নোটের বান্ডিলগুলো ঢোকালেন। তারপর সোয়েটারটা আগের মতো কালো প্ল্যাস্টিকের থলের ভেতর ঠেসে দিলেন।

অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম। এবার বললাম, আপনি কীভাবে জানলেন—

খানিকটা অনুমান, খানিকটা অঙ্ক ডার্লিং! কর্নেল সকৌতুকে হেসে উঠলেন। চোরের ওপর বাটপাড়ি! টাকাগুলোয় পচা পাতা আর জলকাদার ছোপ লেগে আছে। তার মানে, মিঃ সিনহার হাত থেকে ওগুলো ছিটকে পড়েছিল। যাই হোক, পঞ্চাশ হাজার টাকা কম কথা নয়। কেন এত টাকা সিনহাসায়েব শুক্লাকে দিতে গিয়েছিলেন, এটাই আপাতত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। শোনো! তুমি এই যখের ধন পাহারা দাও! কফি খেয়ে আমি একা বেরুব। আমি না ফেরা পর্যন্ত যেন কিছুতেই এখান থেকে নড়ো না। যত রাত হোক, তুমি থাকবে। সুযোগ পেলে ফোন করব।

এমন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম যে কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না।…

.

০৫.

কর্নেল সেই কালো প্লাস্টিকের থলেতে ঠেসে ভরা লাল সোয়েটারটা নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। বুঝতে পেরেছিলাম, ওটা সেই কানাগলিতে বটগাছের শেকড়ের তলায় আগের মতো রাখতে যাচ্ছেন। কিন্তু শেষাবধি এতে মিঃ সিনহার হত্যারহস্য ফাঁস হওয়ার ব্যাপারে কী সাহায্য হবে, তা ভেবেই পাচ্ছিলাম না। বড়জোর লক্ষ্মীরানীর বাড়াভাতে ছাই পড়বে। গত রাতে প্রদীপ সিনহার মৃতদেহ নরবাহাদুর যখন আবিষ্কার করে, তখন স্বভাবত একটা হইচই পড়ে যায় এবং মেয়েটি দৈবাৎ টাকার বান্ডিলগুলো দেখতে পেয়ে আত্মসাৎ করে। তখন খিড়কির দিকটা খেলা ছিল। কাজেই সে একফাঁকে টাকাগুলো একটা কালো প্ল্যাস্টিকের থলে যোগাড় করে সোয়েটারের ভেতর ভরে বাইরে লুকিয়ে রেখে আসে। টাকার প্রতি লোভ তার পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। তবে সে বয়সের তুলনায় মানসিকভাবে অপরিণত, মালবিকার এই ধারণা দেখা যাচ্ছে একেবারে ভুল।

কিন্তু এতে একটা খটকা থেকে যাচ্ছে। লক্ষ্মী সম্ভবত বোকা হবার ভান করে থাকত। কেন থাকত? তাছাড়া বাচ্চু তাকে মাসতুতো বা পিসতুতো বোন বলে ও বাড়িতে জুটিয়ে দিয়েছিল।

হঠাৎ মনে হলো, অভিনেত্রী চিত্রা দত্তই কি কোনো উদ্দেশ্যে ওদের দুজনকে প্রদীপ সিনহার বাড়িতে ঢুকিয়েছিল?

নাহ। যত ভাবব, তত মগজ গুলিয়ে যাবে। ঘড়ি দেখলাম। রাত প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। ষষ্ঠী একবার এসে জেনে গেল কফি খাব কি না। তাকে কফির বদলে চা আনতে বললাম।

চা দিতে এসে ষষ্ঠীচরণ মুচকি হেসে বলল, রাত্তিরেও দাদাবাবুর নেমন্তন্ন।

বললাম, না, না। আমার বাড়ি ফিরতেই হবে। সেই সকালবেলায় বেরিয়েছি।

আপনি কাগজের লোক। এতকাল দেখে আসছি আপনাকে। তাছাড়া বাবামশাইয়ের পাল্লায় পড়লে তো কথাই নেই।

এইসময় টেলিফোন বাজল। টেলিফোনের পাশেই বসে ছিলাম। রিসিভার তুলে সাড়া দিলাম। কণ্ঠস্বর চেনা মনে হলো। কর্নেলসায়েব আছেন নাকি?

আপনি কে বলছেন?

গোপাল কুণ্ডু। কর্নেলসায়েবকে দিন প্লিজ!

 আপনি কি জয়শ্রী স্টুডিয়োর গোপালবাবু?

 ঠিক ধরেছেন। তবে আমিও ধরেছি। আপনি জয়ন্তবাবু!

গোপালবাবুর খিকখিক হাসির শব্দ ভেসে এল। বললাম, কর্নেল একটু জরুরি কাজে বেরিয়েছেন। কখন ফিরবেন বলে যাননি। ওঁকে কিছু বলতে হবে?

আপনাকে বললেও চলে।

তাহলে বলতে পারেন। কর্নেল না ফেরা পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে বলে গেছেন।

ওঁকে বলবেন, বিশ্বস্ত সূত্রে–মানে ভেরি ভেরি রিলায়েব সোর্স বুঝলেন তো? সেই সোর্স থেকে এইমাত্র খবর পেলাম, চিত্রা দত্ত গত রাতে হোটেল ইন্টারন্যাশনালে ছিল। আজ মর্নিং ফ্লাইটে বোম্বে চলে গেছে। ওর বোম্বে যাওয়ার ব্যবস্থা নাকি আগেই করা ছিল। কিন্তু এর চেয়ে জব্বর খবর হলো, স্বয়ং সিনহাসায়েবমানে প্রদীপ সিনহা ওকে নিজের গাড়িতে সন্ধ্যা ছটা নাগাদ হোটেল ইন্টারন্যাশনালে পৌঁছে দেন। আমার সোর্স প্রত্যক্ষদর্শী। চিত্রার বডিগার্ডও যথারীতি সঙ্গে ছিল।

চিত্রা দেবী তাহলে বডিগার্ডসহ বোম্বে গেছেন?

সেটা অবশ্য জিজ্ঞেস করিনি। কর্নেলকে খবরটা দেবেন। উনি যদি এ বিষয়ে আরও কিছু জানতে চান, আমি তা জানাবার চেষ্টা করব। আমার বাড়ির নাম্বার কর্নেল জানেন। রিং করতে বলবেন।

বলব। ধন্যবাদ গোপালবাবু!

আরে মশাই! এতে ধন্যবাদের কী আছে? আপনার মনে পড়া উচিত, ফিল্মস্টার অতনুকুমারকে মার্ডারের কেসে আমি যেভাবে ফেঁসে গিয়েছিলাম, কর্নেলসায়েব না থাকলে আমার ফাঁসি বা যাবজ্জীবন জেল হতো। ওঃ! কর্নেলসায়েব এ যুগে এক ত্রাণকর্তা। তাঁর ঋণ কী দিয়ে শুধব বলুন?

আচ্ছা, রাখছি।

 মনে হলো, গোপালবাবু যেন একটু রসেবশে আছেন। কথাগুলো এলোমেলো না হলেও কিঞ্চিৎ জড়ানো। সম্ভবত হাতে পানপাত্র নিয়ে বসেছেন। তবে খবরটা গুরুত্বপূর্ণ। কাল সন্ধ্যায় প্রদীপ সিনহা চিত্রা দত্তকে হোটেলে পৌঁছে দিতে গিয়েছিলেন এবং তখন চিত্রার বডিগার্ড শুক্লাও সঙ্গে ছিল।

কিন্তু সেই শুক্লা কেন রাত দশটায় আমার গাড়িতে জোর করে উঠে প্রদীপ সিনহার বাড়িতে গেল? নির্দিষ্ট সময়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছিল ওঁর সঙ্গে সেটা স্পষ্ট। শুধু বোঝা যাচ্ছে না, সিনহাসায়েবকে কেউ গুলি করার সঙ্গে সঙ্গে সে পেছনের গলিতে টয় পিস্তল ফেলে দিয়েছিল কেন?

ষষ্ঠী কখন ভেতরে গিয়েছিল। পর্দা তুলে বলল, ততক্ষণ টিভি দেখবেন তো আসুন দাদাবাবু!

বললাম, না ষষ্ঠী। টিভি দেখতে আমার ভালো লাগে না। দল বেঁধে বাঁদরনাচ, নয় তো বাঘ-সিংহের মতো তুম্বো মুখের হাঁকডাক। কখনও ন্যাকা নেকিদের আধো-আধো বুলি।

ষষ্ঠী বাচ্চা ছেলের মতো হাসতে হাসতে অদৃশ্য হলো।

সাড়ে নটা বাজে। এখনও কর্নেলের পাত্তা নেই। একটা সিগারেট ধরাতেই হলো। সিগারেট ছাড়ার জন্য দু-তিনটের বেশি কিনি না। কিন্তু দিনে মোটমাট দু প্যাকেট কেনা হয়ে যায়। বিশেষ করে চিন্তাভাবনার সময়ে।

সিগারেটটা সবে শেষ করেছি, ডোরবেল বাজল। ষষ্ঠী টিভির সামনে বসে আছে। তাই উঠে গিয়ে দরজা খুললাম। কর্নেল নন। একজন সাদাসিধে প্যান্ট-শার্ট এবং হাফহাতা সোয়েটার পরা প্রৌঢ় ভদ্রলোক বিনীতভাবে নমস্কার করে বললেন, আমি কর্নেলসায়েবের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

বললাম, উনি বেরিয়েছেন। আপনি কোথা থেকে আসছেন?

বিডন স্ট্রিট থেকে। আমার নাম তারকনাথ দাশ। ভদ্রলোক করুণ মুখে বললেন, কর্নেলসায়েবের সঙ্গে আমার খুব জরুরি দরকার। উনি কখন ফিরবেন?

কখন ফিরবেন বলে যাননি। কী দরকার তা আমাকে বলতে পারেন। উনি এলে বলব। আপনি বরং কাল সকালে আসবেন।

কাইন্ডলি আমাকে কর্নেলসায়েবের জন্য ওয়েট করতে দিন।

ড্রয়িং রুমের ভেতর টেবিলের ড্রয়ারে পঞ্চাশ হাজার টাকা আছে। তাছাড়া এখন একটা রহস্যময় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আমি জড়িয়ে গেছি। এ মুহূর্তে কোনো অচেনা লোককে ঘরে ঢোকানো কি উচিত হবে? বললাম, আপনি নিচের লনে কিংবা গেটের কাছে ওয়েট করতে পারেন।

কথাটা বলেই ভদ্রলোকের দাশ পদবিটা আমার মাথার ভেতর হঠাৎ খোঁচা দিল। উনি হতাশমুখে আমার দিকে তখনও তাকিয়ে আছেন। এবার বললাম, আপনার সঙ্গে কি কর্নেলসায়েবের পরিচয় আছে?

তারকবাবু বললেন, আজ্ঞে না। আমি জয়শ্রী স্টুডিয়োর গোপালবাবুর কাছে গিয়েছিলাম। এইমাত্র ওঁর কাছ থেকে আসছি। উনিই কর্নেলসায়েবের নাম-ঠিকানা লিখে দিয়েছেন। এই দেখুন।

বলে উনি পকেট থেকে একটুকরো কাগজ বের করলেন। বললাম, কিন্তু গোপালবাবু এই তো কিছুক্ষণ আগে ফোন করেছিলেন। আপনার কথা তো বললেন না!

উনি একটু খেয়ালি মানুষ। হয়তো ভুলে গেছেন। আপনি ওঁকে ফোন করে জেনে নিতে পারেন।

আমি ওঁর ফোন নাম্বার জানি না বলে তারকবাবুর দিকে তাকালাম। আচ্ছা, ফিল্মস্টার চিত্রা দত্তের বডিগার্ড শুক্লা কি

আজ্ঞে হ্যাঁ। আমারই ছোট মেয়ে। ছোটবেলা থেকে জুডোক্যারাটে– তাছাড়া জিমন্যাস্টিক এ-সবেও ওর নেশা ছিল। স্কুল ফাইনাল পাস করে কাজকর্ম জোটাতে পারছিল না। শেষে একটা সিকিউরিটি এজেন্সিতে ঢুকেছিল। লুনা এসকর্ট সার্ভিস। তা প্রায় বছর তিনেক ওখানে কাজ করছে। কিছুদিন থেকে ওকে ওই ফিল্মস্টারের বডিগার্ড করেছিল ওরা। পাশের ফ্ল্যাটে ফোন আছে। কোনো রাতে বাড়ি না ফিরতে পারলে জানিয়ে দিত। কিন্তু কাল রাত থেকে কোনো খবর নেই। ওদের অফিসে গেলাম। ওঁরা বললেন, পুলিশকে জানানো হয়েছে। শুক্লা গত রাত থেকে রিপোর্ট করেনি। তখন ছুটে গেলাম গোপালবাবুর কাছে। তারকবাবু রুমাল বের করে নাক মুছলেন। বড় ডানপিটে মেয়ে সার! বাইশ বছর বয়স। ক্যারাটেতে ব্ল্যাক বেল্ট–

ওঁর কথা থেমে গেল। মুখ ঘুরিয়ে সিঁড়ির দিকে তাকালেন। উঁকি মেরে কর্নেলের টুপি দেখতে পেলাম। বললাম, কর্নেল এসে গেছেন!

কর্নেল উঠে এসে ভুরু কুঁচকে বললেন, কী ব্যাপার জয়ন্ত?

 শুক্লা দাশের বাবা ইনি।

কর্নেল তারকবাবুর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললেন, হু। আসুন! জয়ন্ত, তোমার কাণ্ডজ্ঞান নেই। এঁকে এখানে দাঁড় করিয়ে কথা বলছ!

কর্নেলের সঙ্গে আমরা ড্রয়িং রুমে ঢুকলাম। তারকবাবুকে বসতে বলে কর্নেল ভেতরে গেলেন। দেখলাম, তারকবাবু অবাক চোখে কর্নেলের জাদুঘর সদৃশ ড্রয়িং রুম দেখছেন। তার নিখোঁজ মেয়ে যে গত রাতে আমার কানের পেছনটা লাল করে দিয়েছে, সেই কথাটা ওঁকে রাগের বশে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু রাগ চেপে রাখা ছাড়া উপায় নেই।

কর্নেল পোশাক বদলে ফিরে এলেন। টুপি খুলে রাখার পর এখন ওঁর চওড়া টাক আলোয় ঝলমল করছিল। ইজিচেয়ারে বসে আস্তেসুস্থে চুরুট ধরিয়ে তারকবাবুকে বললেন, হ্যাঁ, বলুন।

তারকবাবু আমাকে বলা কথাগুলো আবার আওড়ালেন। কর্নেল সবটা শোনার পর বললেন, কিন্তু আপনি কি জানেন আপনার মেয়েকে পুলিশ খুঁজছে?

তারকবাবু কথাটা না বুঝেই বললেন, আজ্ঞে, লুনা এসকর্ট সার্ভিস পুলিশে অলরেডি খবর দিয়েছে তো। তাই পুলিশ ওকে খুঁজছে।

না তারকবাবু! পুলিশ আপনার মেয়েকে অন্য কারণে খুঁজছে।

আজ্ঞে?

হেস্টিংস এরিয়ার একজন বড় ব্যবসায়ী এবং ফিল্ম প্রোডিউসার প্রদীপ সিনহাকে খুনের দায়ে শুক্লাকে পুলিশ খুঁজছে। গত রাতে শুক্লা মিঃ সিনহাকে গুলি করে মেরে পালিয়েছে।

তারকবাবু নড়ে বসলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, অসম্ভব সার! এ কখনো হতে পারে না। শুক্লা জুডো-ক্যারাটেতে এক্সপার্ট। কিন্তু মানুষ খুন? না, না। আমি বিশ্বাস করি না। তাছাড়া সে বন্দুক-পিস্তল পাবে কোথায়? লুনা এসকর্ট সার্ভিস ওকে ফায়ার আর্মস দেয়নি। দিলে আমি জানতে পারতাম।

ফায়ার আর্মস সঙ্গে না থাকলে আপনার মেয়ে ফিল্মস্টার চিত্রা দত্তের বডিগার্ড হয়েছিল কোন সাহসে?

ক্যারাটেতে শুক্লা ব্ল্যাক বেল্ট হয়েছিল।

আপনি লুনা এসকর্ট সার্ভিসে গিয়ে জেনে নিন, ওরা তাকে ফায়ার আর্মস দিয়েছিল কি না।

তারকবাবুকে এবার উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। বললেন, শুক্লার কাছে শুনেছি, লুনা কাউকে সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে কোথাও রাখলে লাইসেন্স করা বন্দুক দেয়। তবে লুনাতে শুক্লা বাদে সবাই পুরুষমানুষ। এক্স-সার্ভিসম্যান।

কর্নেল চোখ বুজে হেলান দিলেন। জ্বলন্ত চুরুট কামড়ে ধরে বললেন, আপনি কী করেন?

আমি একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে ছোটখাটো একটা চাকরি করি। জয়সোয়াল ট্রেডিং কোম্পানি। ব্র্যাবোর্ন রোডে অফিস। তারকবাবু করজোড়ে বললেন, আমার মেয়েকে উদ্ধার করে দিন সার! আপনি পুলিশকে বুঝিয়ে বললে ওরা নিশ্চয় বুঝবে। শুক্লা কেন কাউকে খুন করবে?

ধরুন, চিত্রা দত্ত ওকে টাকার লোভ দেখিয়ে মিঃ সিনহাকে খুন করতে পাঠিয়েছিল?

এ কক্ষণো হতে পারে না। নিশ্চয় কোথাও কোনো গণ্ডগোল হয়েছে। শুক্লা সে-ধরনের মেয়ে নয় সার। লুনা ওকে মাসে মাত্র দু হাজার টাকা মাইনে দেয়। ইদানীং ফিল্মস্টারের বডিগার্ড হওয়ার পর তার কাছে মাঝে মাঝে বখশিস পেত। টাকার লোভ থাকলে তো

জোরে শ্বাস ছেড়ে তারকবাবু থেমে গেলেন। কর্নেল বললেন, হ্যাঁ, বলুন!

আর বেশি কী বলব সার? তারকবাবু রুমাল বের করে নাক ঝাড়লেন। চোখ মুছলেন। আমার মেয়েকে আমি চিনি।

আপনি লুনা এসকর্ট সার্ভিসে ফোন করে জেনে নিন, ওরা আপনার মেয়েকে ফায়ার আর্মস দিয়েছিল কি না। আমি লাইন ধরে দিচ্ছি।

কর্নেল টেবিলের ছোট্ট প্যাডে লিখে নাম্বার দেখে নিয়ে টেলিফোন ডায়াল করলেন। তারপর সাড়া পেয়ে বললেন, এখানে কথা বলুন।

তারকবাবু উঠে এসে টেলিফোন ধরলেন। লক্ষ্য করলাম, ওঁর হাত কাঁপছে। বললেন, ইয়ে–আমি শুক্লার বাবা বলছি। সান্যালসায়েব আছেন? ওঁকে দিন।…নমস্কার সার! আমি শুক্লার বাবা…প্লিজ শুনুন! আপনারা শুক্লাকে কি ফায়ার আর্মস দিয়েছিলেন?…অ্যাঁ? কী বললেন সার?…ও! বুঝেছি।…কিন্তু এদিকে খারাপ খবর আছে সার! একটু আগে জানতে পারলাম, হেস্টিংস এরিয়ার একজন বিজনেসম্যানকে খুনের দায়ে পুলিশ শুক্লাকে..আপনারা শুনেছেন? কিন্তু পুলিশকে বললেন না কেন শুক্লাকে টয় পিস্তল দিয়েছিলেন? খামোকা আমার মেয়ে… বলে তারকবাবু কর্নেলের দিকে ঘুরলেন। লাইন কেটে গেল। কিন্তু বুঝুন ব্যাপার! ওরা বলছে, শুক্লাকে ওরা খেলনার পিস্তল দিয়েছিল। যাত্রা-থিয়েটারে যে পিস্তল ইউজ করা হয়।

টেলিফোন রেখে তারকবাবু আগের জায়গায় গিয়ে বসলেন। কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, আপনার ঠিকানা রেখে যান। বাড়িতে ফোন থাকলে–

ফোন নেই সার! বরং অফিসের ফোন নাম্বার লিখে দিচ্ছি।

কর্নেলের প্যাডে নাম-ঠিকানা এবং অফিসের ফোন নাম্বার লিখে দিলেন। তারকবাবু। কর্নেল বললেন, আমি আপনার মেয়েকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করব। ইতিমধ্যে প্রয়োজন হলে আপনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। এই কার্ডটা রাখুন।

কার্ডটা আড়ষ্ট হাতে নিয়ে পকেটে ভরলেন তারকবাবু। তারপর আবার একদফা অনুরোধ জানিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

এবার কর্নেলকে গোপালবাবুর দেওয়া খবরটা জানিয়ে দিলাম। কর্নেল চুপচাপ শোনার পর বললেন, হু। ব্যাপারটা ক্রমশ আরও জট পাকিয়ে যাচ্ছে। তো এবার তোমার ধারণা কী, বলো জয়ন্ত!

আমার ধারণা সম্পর্কে আপনি কখনও সিরিয়াস নন। কারণ আমি বড্ড বোকা!

কর্নেল হাসলেন। না ডার্লিং! সিরিয়াসলি বলছি। আমি আমার থিয়োরিটা একটু ঝালিয়ে নিতে চাই।

একটু ভেবে নিয়ে বললাম, গোপালবাবুর তথ্যের ভিত্তিতে আমার মনে হয়েছে, কাল বিকেলের মধ্যে এমন কিছু ঘটেছিল, যাতে চিত্রার বিপদ ঘটতে পারে ভেবে মিঃ সিনহা তাকে হোটেল ইন্টারন্যাশনালে রেখে আসেন। সম্ভবত তাকে আপাতত বোম্বে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও তিনি করেন। কিন্তু সঙ্গে টাকা ছিল না বলে চিত্রার বিশ্বস্ত বডিগার্ড শুক্লাকে রাত এগারোটার মধ্যে তার বাড়িতে গিয়ে টাকা আনতে বলেন।

বাহ! তোমার ধারণায় যুক্তি আছে। কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, কিন্তু শুক্লার সঙ্গে টয় পিস্তল ছিল। কাজেই তাকে খুনী বলার যুক্তি ধোপে। টেকে না।

হ্যাঁ! আমার ধারণা শুক্লা খুনী নয়। এমন হতে পারে, হোটেলেই কেউ আড়ি পেতে সিনহাসায়েবের কথা শুনেছিল। সে আগেই এসে খিড়কির দরজা খোলা পেয়ে বাগানের মধ্যে ওঁত পেতে বসে ছিল। চিন্তা করুন, তখন বৃষ্টি পড়ছিল। মেঘ ডাকছিল। ঝোড়ো বাতাস বইছিল।

বলে যাও! বলে যাও!

শুক্লা ট্যাক্সি না পেয়ে আমার গাড়িতে উঠে আমাকে ক্লিফটন রোডে যেতে বাধ্য করে। তারপর সে কথামতো খিড়কি দিয়ে ঢোকে। সিনহাসায়েব টাকা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। তাকে টাকা দেওয়ার সময় ওঁত পেতে থাকা খুনী এসে গুলি করে সিনহাসায়েবকে। তার হাত থেকে নোটের বান্ডিল পড়ে যায়। এবার খুনী শুক্লাকে তাড়া করে। হয়তো গুলি ফসকে গিয়েছিল। অথবা–এমনও হতে পারে, তার হাতে গুলি লেগেছিল। টয় পিস্তল ছিটকে পড়ে। আহত অবস্থায় সে পালিয়ে যায়।

কিন্তু টয় পিস্তলটা কুড়িয়ে পেয়েছি কানাগলিতে এবং বটগাছের প্রায় কাছাকাছি।

তাহলে শুক্লাকে তাড়া করে গিয়ে গলিতে খুনী দ্বিতীয় গুলি ছুঁড়েছিল।

খুনীর কিন্তু টাকাগুলোর দিকে মন ছিল না। কারণ ওগুলো কুড়িয়ে পায় লক্ষীরানী।

আবার একটু ভেবে নিয়ে বললাম, তাহলে সিনহাসায়েবকে খুন করাই তার মোটিভ ছিল।

কেন?

কর্নেল! এমন কি হতে পারে না, চিত্রাকে নিয়ে সিনহাসায়েব এবং চিত্রার পলিটিক্যাল গার্জেন সুমন হাজরার মধ্যে রেষারেষি চলছিল?

কর্নেল দাড়ি থেকে চুরুটের ছাই ঝেড়ে বললেন, হুউ। তা অস্বীকার করা যায় না।

উৎসাহে বললাম, সুমন হাজরা নিজে এমন ঝুঁকি নেবে বলে মনে হয় না। সম্ভবত কোনো ভাড়াটে খুনীকে পাঠিয়েছিল।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, সর্বনাশ! রাত সাড়ে দশটা বাজে। তুমি রাতটা আমার এখানে কাটিয়ে যাও জয়ন্ত! তোমার কাজের ছেলেটিকে ফোনে জানিয়ে দাও। নাহ! এত রাতে সল্টলেকে ফেরার ট্যাক্সি পাবে না।

একটু হেসে বললাম, আপনার নৈশ অভিযানের বিবরণ শোনা যাক তাহলে!

খাওয়ার পর হবে। বলে কর্নেল হাঁক দিলেন, ষষ্ঠী!…

কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে এভাবে রাত কাটানো আমার কাছে নতুন কিছু নয়। কতবার তিনি আমাকে সল্টলেকের ফ্ল্যাটটা কাকেও ভাড়া দিয়ে তার কাছে থাকতে বলেছেন। কিন্তু সমস্যা হলো, ওঁর ডেরায় এসে থাকলে আমার খবরের কাগজের চাকরিটা বাঁচানো কঠিন হবে। কারণ প্রায়ই উনি বেরিয়ে পড়েন কোনো দুর্লভ প্রজাতির অর্কিড, ক্যাকটাস, পাখি বা প্রজাপতির সন্ধানে এবং কখনও দেশের বাইরে কোনো দ্বীপ দ্বীপান্তর কি মরুভূমিতে। অনেক সময় দুর্দান্ত রকমের অ্যাডভেঞ্চারেও পাড়ি জমান। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা অবশ্য রহস্য-রোমাঞ্চে ভরা স্টোরি প্রত্যাশা করে আমার কাছে। কিন্তু এ সবের একটা সীমা আছে। নিছক দুর্লভ প্রজাতির উদ্ভিদ বা প্রাণী সম্পর্কে লেখার। মতো বিশেষজ্ঞের অভাব নেই দেশে। সপ্তাহে এক কলম সচিত্র ধানাই-পানাই বিদেশি পত্রিকা থেকে টুকে দিলেই হলো।

এ রাতে যষ্ঠীচরণ আমাকে অবাক করে খাদির নতুন পাঞ্জাবি-পাজামা এমনকি একজোড়া নতুন চটিও সহাস্যে উপহার দিল। সে বলল, বাবামশাই কবে আপনার জন্য কিনে রেখেছেন, বলতে মনে ছিল না। এখানে রাত কাটাতে বরাবর দাদাবাবুকে বাবামশাইয়ের পোশাক পরতে হয়। আমিই বলেছিলাম, তার চেয়ে দাদাবাবুর সাইজমতো–

কর্নেল বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলে সে থেমে গেল। কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন, বক্তৃতা করবি, না আমাদের খেতে দিবি? কী জয়ন্ত? একটা নতুন আলোয়ানের কথা ভাবছ নাকি? শীত আজ আছে কাল নেই। সামনের বছর বেঁচে থাকলে দেখা যাবে। তবে আমার ঘরে যথেষ্ট ওম আছে। হেস্টিংস এরিয়ায় যা শীত, ওঃ!…

নতুন পাজামা-পাঞ্জাবি-চটি পরে সবে খেতে বসেছি, টেলিফোন বেজে উঠল। বিরক্ত মুখে কর্নেল তার বেডরুমে ঢুকে ফোনটা ধরলেন। ড্রয়িং রুমের টেলিফোনেরই এক্সটেনশন এই ফোনটা। শুনলাম, কর্নেল বলছেন, …কে? মালবিকা? কী ব্যাপার?… …সাংঘাতিক মানে? …অ্যাঁ? বলো কী? কখন?..বেহালায় ডগ হসপিটাল–মানে, নতুন…কিন্তু জিমি তো…হ্যাঁ, হ্যাঁ। সন্ধ্যায় তাই তোমার বাড়িতে জিমির সাড়া পাইনি। তুমি কি একা গেছ ওখানে? …ঠিক করেছ। মিঃ মুখার্জিকে বলো, তোমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে হঠাৎ একটা কাজে আটকে গিয়েছিলাম। তাই যেতে পারিনি। কাল সকালে বরং…ঠিক আছে। সাবধানে চলাফেরা করো! গুড নাইট!

ডাইনিং রুমে ঢুকে কর্নেল বললেন, মালবিকার কুকুর জিমি বিকেল থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আমরা চলে আসার পর মালবিকা লক্ষ্মীকে দিয়ে জিমির রাতের খাবার পাঠিয়েছিল। জিমির নাকমুখ দিয়ে নাকি রক্ত বেরুচ্ছিল। মালবিকা মিঃ মুখার্জিকে ফোনে খবরটা দেয়। তারপর দুজনে বেচারাকে বেহালা ডগ হসপিটালে নিয়ে গেছেন। সেখানে যাওয়ার পথেই জিমি মারা গেছে।

আমি আপনাকে বলেছিলাম কুকুরটার সাড়া পাচ্ছি না।

আসলে তখন আমার মাথায় ছিল লক্ষ্মীর লাল সোয়েটার। কর্নেল বললেন। বোঝা যাচ্ছে বাড়িরই কেউ মারাত্মক বিষ দিয়ে অ্যালসেশিয়ানটাকে মেরেছে। আজ রাতে আবার কিছু ঘটবে সম্ভবত।

ঘটবে যা, তা অনুমান করা যায়।

কর্নেল রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে বললেন, হুঁ। বলো।

খিড়কির দরজার তালা ভাঙবে বাচ্ছ। তারপর টাকা এবং লক্ষ্মীকে নিয়ে উধাও হয়ে যাওয়ার প্ল্যান করেছে।

দেখা যাক। মালবিকাকে সাবধানে থাকতে বললাম। বাহাদুরও এখন নিশ্চয় সতর্ক।

খাওয়ার পর দুজনে ড্রয়িং রুমে গেলাম। কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে চুরুট ধরালেন। তারপর অভ্যাসমতো হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন। বললাম, আপনি অতক্ষণ কোথায় ছিলেন, এবার বলুন। শোনা যাক।

কর্নেল আস্তে বললেন, লক্ষ্মীর সোয়েটার যথাস্থানে রেখে সোজা চলে গিয়েছিলাম হেস্টিংস থানায়। অরিজিৎ ওঁদের আমার কথা বলে রেখেছিল। কাজেই আপ্যায়নের ত্রুটি হয়নি। ও. সি. তোমার বয়সী। সবে প্রমোশন পেয়ে ওখানে গেছেন। নাম প্রশান্ত মণ্ডল। কিছুদিন স্কুলটিচার ছিলেন ভদ্রলোক। যাই হোক, জিজ্ঞেস করে বুঝলাম নামকাওয়াস্তে তদন্ত চলেছে। পলিটিক্যাল প্রেশারের আভাসও দিলেন। চিত্রা দত্তের বডিগার্ডের নাম ওঁরা জেনে গেছেন। তাকে খোঁজা হচ্ছে। লুনা এসকর্ট সার্ভিসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। ওদিকে লুনাও লালবাজার মিসিং স্কোয়াড়ের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছে। হা-শুক্লার ঠিকানা পাওয়া গেছে। ওদের বাড়িতে পুলিশ যাবে।

বললাম, এখনও যায়নি। গেলে তারকবাবু বলতেন বা এতক্ষণ ফোন করতেন আপনাকে।

হ্যাঁ। আজকাল পলিটিক্যাল প্রেশার এমন জিনিস, পুলিশকে সাবধানে পা বাড়াতে হয়।

অতক্ষণ আপনি থানাতেই কাটিয়ে দিলেন? বিশ্বাস হয় না।

কর্নেল চোখ খুলে একটু হাসলেন। পার্ক লেনে গিয়ে লুনা এসকর্ট সার্ভিসের অফিসটা বাইরে থেকে দেখে পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিছুক্ষণ পরে মনে হলো, আমি কি শুক্লার দর্শন পাব বলে এখানে ওঁত পেতে আছি? কী বোকা, কী বোকা! আসলে এখনও আকস্মিকতা ব্যাপারটাতে আমার বিশ্বাস থেকে গেছে। যদি দৈবাৎ–

কর্নেল আবার হেসে উঠলেন। বললাম, তারপর?

উল্টোদিকে মুনলাইট বার। তুমি তো চেনো। সেখানে গিয়ে ঢুকলাম। ওয়েটাররা আমাকে চেনে। ম্যানেজার ভদ্রলোকও চেনেন। একটা খালি টেবিলে এক জগ বিয়ার নিয়ে বসলাম। আবার সেই আশার ভূত আমাকে পেয়ে বসেছিল। যদি শুক্লা তার কোনো বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে এখানে ঢোকে! তুমি তো জানো, গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড এদের যুগলের জন্য দোতলায় ছোট-ছোট কেবিন আছে। আধঘণ্টা পরে বেরিয়ে এলাম। তারপর হাঁটতে হাঁটতে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট– হয়ে সোজা নিজের ডেরায়। কর্নেল একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে ফের বললেন, শুক্লা সম্পর্কে আমি সত্যিই ক্রমশ উদ্বিগ্ন জয়ন্ত!

সে নিশ্চয় কোথাও গা-ঢাকা দিয়ে আছে। পুলিশ চিত্রাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। শুক্লা তাদের লক্ষ্য। এখন যদি ট্রেড ইউনিয়ন নেতা সুমন হাজরা তাকে

কর্নেলের কথার ওপর বললাম, শুক্লাকে লুনা থেকে প্রদীপ সিনহাই চিত্রার বডিগার্ড হিসেবে জুটিয়ে দিয়েছিলেন। তাই না?

হুঁ! বলে কর্নেল কিছুক্ষণ চুপচাপ চুরুট টানতে থাকলেন। তারপর হঠাৎ সোজা হয়ে বসে টেবিলের ড্রয়ার টানলেন।

টাকার বান্ডিলগুলো নেই দেখে চমকে উঠেছিলাম। বললাম, টাকাগুলো?

তুমি যখন বাথরুমে ঢুকেছিলে, তখন ওগুলো আলমারির লকারে রেখে এসেছি। কাল সকালে অরিজিৎকে টেলিফোনে কথাটা জানাব। টাকাগুলো লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে গচ্ছিত থাকবে। বলে কর্নেল ড্রয়ারের ভেতর দিক থেকে রুমালে মোড়া সেই টয় পিস্তলটা বের করলেন।

তারপর টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে নলের ভেতরটা দেখতে থাকলেন। কিছুক্ষণ দেখার পর টেবিলের একেবারে নিচের ড্রয়ার থেকে একটা খুদে চিমটে বের করলেন। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, চিমটে দিয়ে নল সাফ করবেন নাকি?

কর্নেল আমার কথার জবাব না দিয়ে নলের ভেতর চিমটে ভরে কিছু টানাটানি করতে ব্যস্ত হলেন। একটু পরেই দেখি, গুটিয়ে রাখা লম্বা একটা ফিল্ম বেরিয়ে এল। ফিল্মটা টেবিল ল্যাম্পের আলোয় দেখার পর কর্নেল গম্ভীর। মুখে বললেন, নেগেটিভ ফিল্ম। এক মিনিট। গুনে দেখি। এক দুই তিন চার পাঁচ ছয় সাত আট নয়। বাকি দুটো ব্ল্যাঙ্ক।

কিসের ছবি?

মনে হচ্ছে সেক্সুয়াল ব্যাপার। তুমি শুয়ে পড়ো গে। আমি এখনই এগুলো প্রিন্ট করে ফেলব। কর্নেল পিস্তলটা ড্রয়ারে ঢুকিয়ে তুম্বো মুখে উঠে দাঁড়ালেন।

জিজ্ঞেস করলাম, সেক্সয়াল সিনের ফটো?

কর্নেল আমার দিকে চোখ কটমটিয়ে চাপাস্বরে বললেন, এখনও বুঝতে পারছ না প্রদীপ সিনহা পঞ্চাশ হাজার নগদ টাকার বিনিময়ে তার ব্ল্যাকমেলারের হাত থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন?…

.

০৬.

রাতে ভালো ঘুম হয়নি। বাথরুমের পাশে কর্নেলের ডার্করুম, যেখানে উনি নিজেই নিজের তোলা ছবি ডেভালাপ এবং প্রিন্ট করেন। ওঁর এ কাজের জন্য একটা পোর্টেবল সরঞ্জামও আছে। বাইরে কোথাও গেলে সেটা সঙ্গে নিয়ে যান। বিদেশি বিজ্ঞান ও প্রকৃতি বিষয়ক পত্রিকায় ওঁর সচিত্র প্রবন্ধ বেরোয় এবং তা থেকে বেশ রোজগারও হয়। সেই টাকায় ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো রহস্য ফাঁস করার অভ্যাস। কখনও ওঁকে এ ব্যাপারে কারও কাছে ফি নিতে দেখিনি। আসলে এ-ও ওঁর একটা হবি।

নেগেটিভ ফিল্মে যৌনদৃশ্যের কথা শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম প্রদীপ সিনহার চরিত্রদোষ ছিল। কিন্তু ফটোতে ওঁর ফিমেল পার্টনার কে হতে পারে? চিত্রা দত্ত, কিংবা অন্য কেউ? সে যেই হোক, প্রদীপ সিনহাকে কেউ ব্ল্যাকমেল করার জন্য আড়াল থেকে ছবিগুলো তুলে রেখেছিল। বোঝাই যায়, ওঁর স্ত্রী মালবিকাকে ছবিগুলো দেখানোর হুমকি দিয়ে ওঁকে কেউ ব্ল্যাকমেল করত। চিত্রা দত্ত, না কি তার বডিগার্ড শুক্লা দাশ? শেষে মূল নেগেটিভ ফেরত দেওয়ার রফা হয়েছিল নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকায়। অবশ্য সন্দেহের কাটা যুক্তিসঙ্গত কারণে শুক্লার দিকেই ঘুরে গেছে–অন্তত আমার কাছে।

ষষ্ঠীর ডাকে ঘুম ভেঙেছিল। তাকিয়ে দেখি, তার হাতে প্যাকেট মোড়া একটা নতুন টুথব্রাশ। সে সহাস্যে বলল, আটটা কখন বেজে গেছে। বাবামশাই আপনাকে ওঠাতে বারণ করেছিলেন। এই দেখুন, বাজার করতে গিয়ে টুথবেরাশ কিনে এনেছি। এত বেলায় বাসিমুখে চা খেতে নেই। উঠে পড়ুন!

বিছানা থেকে উঠে পড়লাম। বললাম, তোমার বাবামশাই কোথায়?

ছাদের বাগানে। অন্যদিন আটটার মধ্যে নেমে আসেন। বোধ করি, কোনো গাছে পোকা লেগেছে। বাইরের দরজায় চাবি এঁটে বাজারে গিয়েছিলাম। ওপরে আমাকে দেখলেই তো রাগ করেন। আপনি বাথরুম সেরে নিন দাদাবাবু!

বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলাম ষষ্ঠীর হাতে চায়ের পেয়ালা। সে জানে, সকালে আমি কর্নেলের মতো কফি খাইনে।

কর্নেল তখনও ছাদ থেকে নামেননি দেখে চায়ের পেয়ালা হাতে ছাদের বাগানে গেলাম। দেখলাম, প্রকৃতিবিদ হাঁটু মুড়ে বসে কঁঠালের মতো দেখতে একটা ক্যাকটাসে আতস কাঁচ দিয়ে কিছু দেখছেন। আমার দিকে না ঘুরেই বললেন, মর্নিং জয়ন্ত! আশা করি শেষ পর্যন্ত সুনিদ্রা হয়েছে!

বললাম, কুনিদ্রা বলতে পারেন!

সব কাগজেই সিনহাসায়েবের খবর বেরিয়েছে। তোমাদের কাগজে একটু ফলাও করে প্রায় হাফ কলাম। হেডিং দিয়েছে, রহস্যজনক হত্যাকাণ্ড। আজকাল রাজনৈতিক খবর একঘেয়ে হয়ে উঠেছে বলে খুনখারাপির খবরকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

ফটোগুলোর প্রিন্ট কেমন হয়েছে, তাই বলুন!

কর্নেল হাসলেন। তুমি এখনও ইয়ং ম্যান। এই সক্কালবেলা তোমাকে সেগুলো দেখালে তোমার চরিত্রদোষ ঘটবে।

প্রদীপ সিনহার মতো?

কর্নেল চুপচাপ নিজের কাজে মন দিলেন। খুদে একটা কাচিতে কাঁঠাল আকৃতির ক্যাকটাসটার কাটা হেঁটে দিলেন। তারপর সম্ভবত কীটনাশক ওষুধ স্প্রে করে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তুমি প্রদীপ সিনহার মতো বড়লোক নও। তবে তোমার যৌবন আছে। যৌবন অবশ্য যৌবনকে টানে। কিন্তু কোনো ফিল্ম নায়িকাকে নিছক যৌবন কাছে টানতে পারে কি না জানি না।

বুঝলাম, ছবিতে ফিমেল পার্টনার সেই চিত্রা দত্ত।

কর্নেল তার সরঞ্জাম গুটিয়ে কোণের দিকে ছোট্ট ঘরের ভেতর রেখে এলেন। ছাদের একটা পাইপের মুখে জলের ট্যাপ খুলে হাত ধুলেন। তারপর বললেন, চলো। ড্রয়িং রুমে বসে কথা বলা যাবে।

নিচে নেমে কর্নেল গার্ডেনিংয়ের জোব্বা খুলে ভেতরে ঢুকে গেলেন। আমি ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ পরে কর্নেল পোশাক বদলে ফিরে এলেন। ইজিচেয়ারে বসে বললেন, চিত্রাকে আমি দেখিনি। তাই বলতে পারছি না ফিমেল পার্টনার সে-ই কি না। তাছাড়া মনস্তাত্ত্বিক কারণেই বলা চলে, কোনো মেয়ে যতই কেরিয়ারিস্ট হোক, নিজের সঙ্গে কোনো পুরুষের গোপন যৌনদৃশ্যের ফটো তোলার জন্য কোনো তৃতীয় ব্যক্তিকে কাজে লাগাবে না।

আমার ধারণা ঠিক তা-ই।

তুমি কি চিত্রা দত্তের কোনো ফিল্ম দেখেছ?

নাহ্। নাম শুনেছি বলেও মনে পড়ছে না।

ষষ্ঠীচরণ কর্নেলের জন্য কফি রেখে গেল। কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, চিত্রার একটা ছবি দরকার। গোপালবাবুকে এখন ফোনে পাওয়া যেতে পারে।

কফির পেয়ালা টেবিলে রেখে টেলিফোন ডায়াল করার পর সাড়া পেয়ে কর্নেল বললেন, গোপালবাবু আছেন?…কখন ফিরবেন বলে গেছেন?…আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। উনি এলে ওঁকে বলবেন আমাকে যেন অবশ্য অবশ্য রিং করেন!..আচ্ছা। রাখছি।

বললাম, বাড়িতে নেই?

 কর্নেল কফিতে মন দিলেন। একটু পরে বললেন, দেখা যাক। উনি ফোন না করলে বরং জয়শ্রী স্টুডিয়োতে গিয়ে হানা দেব। জয়ন্ত, তুমি আমার এখানে ব্রেকফাস্ট সেরে নেবে। তারপর সল্টলেকে গিয়ে নির্ভয়ে তোমার গাড়িটা নিয়ে আসবে। গাড়ি থাকলে সুবিধে হয়। ফুয়েল খরচের জন্য চিন্তা করো না।

কী বলছেন? ফুয়েল খরচ দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার। চিফ অব দি নিউজ ব্যুরো সত্যদাকে সময়মতো জানিয়ে দেব। এমন একখানা এক্সক্লুসিভ স্টোরি পেলে সার্কুলেশন আবার বেড়ে যাবে। ইদানীং সার্কুলেশন একটু পড়ে যাচ্ছে।

কর্নেল চুপচাপ কফি শেষ করে আবার টেলিফোন ডায়াল করলেন। অরিজিৎ?…তুমি আমার গলা শুনেই চিনতে পারো। স্বাভাবিক ডার্লিং! তুমি গোয়েন্দাকর্তা নাম্বার ওয়ান।…না, না। তুমি…শোনো, যেজন্য আবার রিং করছি। ছাদের বাগানে গিয়ে হঠাৎ মনে হলো, টাকাগুলো বরং ক্লিফটন রোডে মিসেস সিনহার বাড়িতে এবং ওদের লইয়ার মিঃ এস. কে. মুখার্জির সামনে তোমাদের হাতে তুলে দেওয়া উচিত। এতে আইনের দিক থেকে আমি নিরাপদ থাকব। তাই না?…হ্যাঁ। তুমি থাকবে এবং হেস্টিংস থানার ও. সি. বা ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের উপস্থিত থাকা দরকার। …হ্যাঁ, তোমার উদ্বেগ টের পেয়েছিলাম। …থ্যাঙ্কস। রাখছি।

কর্নেল ফোন রেখে আমার দিকে তাকালেন। বললাম, কখন যাচ্ছেন ও বাড়িতে?

অরিজিৎ লালবাজারে পুলিশ কমিশনারের ঘরে রুটিন কনফারেন্স সেরে বেরুবে। পৌঁছুতে সাড়ে বারোটা তো হবেই। তুমি ব্রেকফাস্ট করেই ট্যাক্সিতে চলে যাবে। ফিরবে অন্তত সাড়ে দশটার মধ্যে।

তার আগেই ফিরে আসব। বলেই একটু অস্বস্তি হলো। আচ্ছা কর্নেল, মিঃ মুখার্জির দারোয়ান ফাগুলাল আমার গাড়ির নাম্বার দেখে হইচই বাধাবে না তো? লোকটাকে মনে হচ্ছিল, সব ব্যাপারে নাক গলানোর অভ্যাস আছে।

পুলিশের গাড়ির সঙ্গে তোমার গাড়ি থাকবে। কাজেই এ নিয়ে চিন্তা করো না।…

সল্টলেক থেকে ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস হয়ে আমার গাড়ি কর্নেলের বাড়ি পৌঁছুতে মাত্র আধঘণ্টা সময় নিয়েছিল। কাঁটায়-কাঁটায় দশটা বাজে। লনের পার্কিং জোনে গাড়ি রেখে কর্নেলের তেতলার অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে দেখি, ড্রয়িং রুমে জয়শ্রী স্টুডিয়োর গোপালবাবু, শুক্লার বাবা তারকবাবু এবং একজন তাগড়াই চেহারার ভদ্রলোক বসে আছেন।

কর্নেল আমাকে দেখে বললেন, এস জয়ন্ত! গোপালবাবু এবং তারকবাবুকে তুমি চেন। ইনি হলেন মিঃ রথীন্দ্র সান্যাল। লুনা এসকর্ট সার্ভিসের প্রোপাইটার। এক্স সার্ভিসম্যান। ডিফেন্স ভেহিকলস্ ডিপার্টমেন্ট থেকে রিটায়ার করে এই সিকিউরিটি এজেন্সি খুলেছেন। মিঃ সান্যালকে তো জয়ন্তের কথা আগেই বলেছি।

মিঃ সান্যালের সঙ্গে নমস্কার বিনিময় করে একটু তফাতে ডিভানে বসলাম। লক্ষ্য করলাম আগন্তুকদের মুখে কেমন গাম্ভীর্য আর উদ্বেগ থমথম করছে। গোপালবাবু বললেন, তা যা বলছিলাম, ঝটপট সেরে নিই। আমাকে বাড়ি ফিরে স্টুডিয়োতে দৌড়ুতে হবে।

তারকবাবু বললেন, সুমনবাবুর কথাটা আগে বলুন কর্নেলসায়েবকে।

গোপালবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, সেটাই তো বলছি। সুমন হাজরার কাছে–বুঝলেন কর্নেলসায়েব? তারকবাবুকে ভোরবেলা যেতে বলেছিলাম। কারণ নেতা লোকদের ব্যাপার। এই আছেন এই নেই। তারকবাবু লেকটাউনে ওঁর কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বলার পর

তারকবাবু বললেন, প্রথমে খেঁকিয়ে উঠেছিলেন। শেষে বললেন, জয়শ্রী স্টুডিয়োর ম্যানেজারকে দেখা করতে বলবেন। আমি আজ বাড়িতেই থাকছি। ঠাণ্ডা-লাগা জ্বর মতো হয়েছে।

গোপালবাবু হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, নিন! আপনিই বলুন!

বুঝলাম, মেয়ে নিখোঁজ হওয়ায় তারকবাবুর এই ব্যাকুলতা স্বাভাবিক। তিনি করুণ মুখে বললেন, না, না। মানে আসল কথাটা হলো শুক্লা ফিল্ম স্টারের সঙ্গে বোম্বে যায়নি। বেশ! তাহলে সে গেল কোথায়? এদিকে সান্যালসায়েবরা লালবাজারে জানিয়ে রেখেছেন। এখন উল্টে পুলিশ এসে ওঁকে–আবার আমাকেও হুমকি দিয়ে গেছে।

গোপালবাবু ঘড়ি দেখে বললেন, মোটকথা সকাল আটটা নাগাদ তারকবাবু ঘুম থেকে আমাকে ওঠালেন। সুমনবাবুকে তখনই রিং করলাম। তো অবাক কাণ্ড কর্নেলসায়েব! চিত্রা বোম্বে গিয়েই সুমনবাবুর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করেছে। কাজেই সুমনবাবু জানেন, চিত্রা কোথায় আছে। কিন্তু কেন হঠাৎ অমন করে বোম্বে গেল, সে-কথা হয়তো সুমনবাবুকে বলে থাকবে ফোনে। আমাকে সুমনবাবু ভেতরকার কথা কিছু বললেন না। তবে শুক্লার ব্যাপারে পুলিশকে বলবেন। আমার তো মনে হলো, আজই সুমনবাবু বোম্বে দৌড়ুবেন।

কর্নেল বললেন, সুমনবাবু প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। পুলিশকে উনি বলে দিলে নিশ্চয় শুক্লাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে।

মিঃ সান্যাল গম্ভীর মুখে বললেন, কিন্তু আমি আমার পুলিশসোর্স থেকে শুনেছি, পুলিশ শুক্লাকে মার্ডার-চার্জে অ্যারেস্ট করবে। কী অদ্ভুত ব্যাপার দেখুন কর্নেলসায়েব! আমার এজেন্সির কোনো লোকের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কোনো কমপ্লেন হয়নি। কারণ আমরা পুলিশকেও সহযোগিতা করি। পুলিশের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রেখে চলতে হয়।

বলুন, আমি কী করতে পারি এ ব্যাপারে? বলে কর্নেল চুরুট ধরালেন। শুক্লাকে যতক্ষণ পর্যন্ত খুঁজে না পাওয়া যাচ্ছে, ততক্ষণ আমার কিছু করার নেই।

আমার প্রব্লেম আপনি বুঝতে পারছেন। আমার এজেন্সির দুর্নাম রটে যাবে।

আপনারা শুক্লাকে টয়-পিস্তল দিয়েছিলেন কেন?

খুলেই বলি। শুক্লা ইনসিস্ট করত। সবসময় ক্যারাটে বা জুডো কাজে লাগানো যায় না। তাছাড়া যে ফিল্মস্টারের বডিগার্ড করে ওকে পাঠানো হয়েছে, শুক্লার ধারণা, ফায়ার আর্মস ছাড়া তাকে সে হয়তো বাঁচাতে পারবে না। দুদিন আগে শুক্লা ফিল্মস্টার চিত্রা দেবীকে তার ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়ে নিয়মমতো আমার অফিসে রিপোর্ট করতে এসেছিল। তখন রাত প্রায় দশটা। আমাদের অফিস চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে। শুক্লা বলল, আজ সন্ধ্যায় একটা সাংঘাতিক বিপদ থেকে বেঁচে এসেছে। প্রদীপ সিনহার বাড়িতে চিত্রা দেবী ওঁদের নেক্সট প্রোডাকশানের ব্যাপারে আলোচনা করতে গিয়েছিলেন। ওঁদের সঙ্গে চিত্রনাট্যকার ভদ্রলোকও ছিলেন। সন্ধ্যা সাড়ে ছটা নাগাদ ওঁরা ফিরে আসছিলেন। ক্লিফটন রোডের একটা গলি থেকে আচমকা একটা গাড়ি জোরে বেরিয়ে আসে। চিত্রা নিজে ড্রাইভ করছিলেন। শুক্লা স্টিয়ারিং ধরে ফেলেছিল। সে সামনের সিটে বসে ছিল। কিন্তু অ্যাকসিডেন্ট থেকে বেঁচে যাওয়ার চেয়ে সাংঘাতিক ঘটনা হলো, চিত্রার গাড়ির দিকে সেই গাড়ি থেকে কেউ গুলি ছুঁড়েছিল। গুলিটা সামনের ডোর প্যানেলের ওপরে লাগে। চিত্রা বেঁচে যান। ডোর প্যানেলের ওপর একটু জায়গার রঙ চটে গিয়েছিল শুধু। তার মানে, গুলিটা চিত্রার গাড়ির প্যারালালে ওই জায়গাটায় লেগে সোজা বেরিয়ে যায়। এরপর শুক্লা নিজে ড্রাইভ করে ওঁকে পৌঁছে দেয়।

কর্নেল বললেন, ইন্টারেস্টিং! কিন্তু এমন ঘটনার পর আপনারা ওকে নিছক টয় পিস্তল দিলেন?

প্রব্লেম হলো, আমাদের মাত্র পাঁচটা বন্দুকের লাইসেন্স আছে। সে-ও ডিফেন্সে আমার পরিচিত হায়ার র‍্যাঙ্কের এক অফিসারের সুপারিশে পাওয়া গিয়েছিল। একটা রিভলভারের লাইসেন্স আমার নিজের জন্য আছে। পয়েন্ট থার্টি সিক্স ক্যালিবার। সেটা তো শুক্লাকে দেওয়া যায় না। দিতে গেলে পুলিশের পারমিশন চাই। অনেক প্যারাফার্নেলিয়া আছে। আপনি তা নিশ্চয় জানেন!

কর্নেল হাসলেন। আমার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললেন, অবশ্য টয় পিস্তল অনেক সময় কাজে লাগে। কাগজে পড়েছিলাম, একবার বিমান ছিনতাইও করা হয়েছিল।

কিন্তু ওই পিস্তলটাতে এমন ব্যবস্থা ছিল, যাতে পর-পর আঠারোটা ফস্ কার্টিজ ফায়ার করা যায়। পটকার মতো শব্দ হবে। ধোঁয়াও বেরুবে। কিন্তু কেউ তাতে আহত হবে না।

পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে ট্রিগার টানলে?

কর্নেল চোখে হেসে আবার আমার দিকে তাকালেন। মিঃ সান্যাল বললেন, নাহ্! জাস্ট একটুখানি ছ্যাকা লাগবে। তার বেশি কিছু না।

গোপালবাবু নড়ে বসলেন। বাস্! কানের পাশে নল ঠেকিয়ে ফায়ার করলে কানের পর্দা আস্ত থাকবে? কারণ পটকার মতো শব্দের কথা বললেন!

তারকবাবু বললেন, আমাকে অফিসে যেতে হবে। কর্নেলসায়েব! আপনি দয়া করে শুক্লাকে খুঁজে বের করুন। করজোড়ে বলছি–

হাত তুলে কর্নেল বললেন, যথাসাধ্য করব।

মিঃ সান্যাল উঠলেন। আমারও অনুরোধ রইল সার! পুলিশসোর্সে আপনার পরিচয় আমি পেয়েছি বলেই তারকবাবুর সঙ্গে আপনার কাছে ছুটে এসেছিলাম। চলুন তারকবাবু! আপনাকে আমার গাড়িতে পৌঁছে দিয়ে লালবাজারে যাব। গোপালবাবু কি বেরুবেন? আপনার অবশ্য নিজের গাড়ি আছে। স্টুডিয়োতে যাবেন তো এখন?

আপনারা চলুন। গোপালবাবু সোয়েটারের ভেতর হাত ভরে নস্যির কৌটো বের করলেন। কৌটো খুলে বললেন, আমি এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করে তবে স্টুডিয়োতে যাব।

ওঁরা দুজন বেরিয়ে যাওয়ার পর কর্নেল বললেন, তাহলে বোঝা যাচ্ছে, চিত্রা নিজের তাগিদেই বোম্বে পালিয়েছে।

গোপালবাবু বললেন, মিঃ সান্যালের কথা শুনে তা-ই মনে হচ্ছে। শুধু বুঝতে পারছি না সুমন হাজরার মতো শক্ত গার্জেন থাকতে চিত্রা সিনহাসায়েবের সাহায্য নিল কেন?

গোপালবাবু, চিত্রার কোনো ছবি আমাকে যোগাড় করে দিতে পারেন?

এক্ষুণি পারি। আমার গাড়িতে খানকয়েক সিনেমা পত্রিকা পড়ে আছে। নিয়ে আসি। বলে গোপালবাবু হন্তদন্ত বেরিয়ে গেলেন।

কর্নেল আমার দিকে ঘুরে মিটিমিটি হেসে বললেন, ভাগ্যিস তুমি বেগড়বাঁই করোনি জয়ন্ত! তাহলে তোমার অন্তত কয়েক ইঞ্চি চুল জ্বলেপুড়ে যেত। ঘা। গজাত। ব্যান্ডেজ বাঁধতে হতো। জোর বেঁচে গেছ! ভবিষ্যতে আর কখনও কাউকে—

 ওঁর কথার ওপর বললাম, আমার লাইসেন্সড ফায়ার আর্মস এবার থেকে সবসময় সঙ্গে রাখব।

কর্নেল সকৌতুকে বললেন, সঙ্গে এনেছ বুঝি?

এনেছি।

বাহ। তবে–মাই গুডনেস! মিঃ সিনহার কেসে মর্গের রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারদের মধ্যে মতবিরোধ ছিল। ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ শেষ পর্যন্ত কী মত দিলেন জানা দরকার। বলে কর্নেল টেলিফোন ডায়াল করলেন। তারপর সাড়া পেয়ে বললেন, মিঃ মণ্ডল? আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।…হ্যাঁ। বারোটার মধ্যে পৌঁছে যাব। আপনি মিসেস সিনহা এবং ওঁদের লইয়ার মিঃ মুখার্জিকে জানিয়েছেন আশা করি? তো শুনুন! এখনই মনে পড়ল, মর্গের রিপোর্ট সম্পর্কে ফরেন্সিক এক্সপার্ট…অ্যাঁ? পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে নয় বলেছেন?…অন্তত দু মিটার ডিসট্যান্স থেকে?…হ্যাঁ। আপনার থিয়োরি ঠিক আছে। সেই ছাতিম গাছটার আড়াল থেকেই কেউ…হ্যাঁ, শুক্লা দাশ ছাড়া আর কে হতে পারে?…হ্যাঁ, হ্যাঁ। দেয়ার ওয়াজ এ থার্ড পার্সন, যাকে মিঃ সিনহা টাকাগুলো দিতে গিয়েছিলেন।…ইউ আর রাইট। ব্ল্যাকমেলের ব্যাপার। আচ্ছা, রাখছি। বারোটায় দেখা হবে। থ্যাঙ্কস।

বললাম, এই তৃতীয় ব্যক্তির কথা আপনি বলেছেন। আমার ধারণাও তা-ই। কিন্তু এখন তো চোখ বুজে বলা যায়, বাছুই খুনী।

কর্নেল চোখ বুজে টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, বলা কঠিন। এমন কি হতে পারে না যে, প্রদীপ সিনহা চুপিচুপি নেমে গিয়ে আগে খিড়কির দরজা খুলে রেখেছিলেন? সন্ধ্যার পর থেকে ওদিকে কেউ যায় না। কাজেই কোনো সুযোগে টাকার খবর জানতে পেরে কেউ শুক্লা পৌঁছনোর আগেই বাড়িতে ঢুকে ছাতিম গাছের আড়ালে ওঁত পেতে বসে ছিল। তারপর বৃষ্টি, ঝোড়ো হাওয়া

ডোরবেল বাজল। কর্নেল হাঁক দিলেন, ষষ্ঠী!

কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় ইন্টারলকিং সিস্টেম আছে। ভেতর থেকে খোলা যায়। বাইরে থেকে খোলা যায় না। কাজেই গোপালবাবু কিছুক্ষণ হাতল ঘোরানোর ব্যর্থ চেষ্টার পর ডোরবেলের সুইচ টিপেছেন। তিনি ভেতরে এসে বললেন, বড্ড বেয়াড়া দরজা আপনার!

ওঁর হাতে চারটে কল্পলোক পত্রিকা ছিল। কর্নেলের হাতে দিয়ে বললেন, আপনি এতে চিত্রা সম্পর্কে সচিত্র সরস গল্প পাবেন। কল্পলোকের বৃত্তান্ত তো! আসলে এতে পাবলিসিটি হয়। সব অভিনেতা-অভিনেত্রীই চায়, তাদের নিয়ে মুখরোচক গল্প রটে যাক। আমি চলি কর্নেলসায়েব!

হোটেল ইন্টারন্যাশনালে আপনার সোর্স আর কোনো খবর দেয়নি?

নাহ্। যাকে নিয়ে খবর, সে-ই তো ভোকাট্টা। চলি কর্নেলসায়েব! জয়ন্তবাবু চলি!

কর্নেল পত্রিকাগুলি হাতে নিয়ে ওপরের সংখ্যাটার মলাটে চোখ বুলিয়ে বললেন, হ্যাঁ। চিত্রাই বটে!

বললাম, দেখি, দেখি!

পত্রিকাগুলো আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে উনি উঠলেন। চারটে সংখ্যার মলাটে চারজন নায়িকার ছবি। তারপর লক্ষ্য করলাম, ছবিগুলো ফিল্মের বিজ্ঞাপন আসলে। কোণে খানিকটা জায়গায় ফিল্মের নাম, প্রযোজক-পরিচালক-নায়ক-নায়িকার নাম সুন্দর অক্ষরে ছাপা আছে। খুঁজতে খুঁজতে চিত্রার নাম বেরিয়ে পড়ল। অর্ধবসনা বললেই চলে। বিশেষ করে নারী-শরীরের এই ভঙ্গিতে একটা ছন্দ অবশ্যই আছে। কিন্তু আর্টকে চাপা দিয়েছে অশালীন যৌনতা। লাবণ্য ছাপিয়ে আদিম জৈব একটা চেতনা চোখকে জ্বালিয়ে দেয়। আমি ছবিটার দিকে আর তাকাতে পারলাম না। কারণ তখনই মনে পড়ে গেল এই যুবতী ছিল চল্লিশ বছর বয়সী প্রদীপ সিনহার সেক্স পার্টনার!

কর্নেল আলমারি খুলে একটা খাম বের করে ভেতর থেকে একটা প্রিন্ট টেনে চোখ বুলিয়েই রেখে দিলেন। খামটা আবার যথাস্থানে রেখে আলমারি বন্ধ করে ফিরে এলেন। ইজিচেয়ারে বসে বললেন, এ যুগে কেরিয়ারিজম শুধু মেয়েদের নয়, পুরুষদেরও বেপরোয়া করে তুলেছে। বরং পুরুষদের সুযোগটা বেশি। তাদের শরীরের মূল্য দিতে হয় না। মেয়েদের শরীর ছাড়া তত সুযোগ সামনে আসে না। নাহ! অনেকে আমাকে মেল শোভিনিস্ট ভাবতে পারে। আমি তা মোটেও নই। সম্ভবত চিত্রার ছোটবেলার পরিবেশ এজন্য দায়ী।

টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। …হ্যাঁ। বলো মালবিকা!..না, না। আমাকে ভুল বুঝেছ! আসলে পঞ্চাশ হাজার টাকার ব্যাপারটা তোমাকে আগে থেকে জানাইনি। কারণ তোমার টেলিফোনে কেউ আড়িপাতা যন্ত্র জুড়ে রাখেনি কে বলতে পারে? কাজেই আগে পুলিশকে জানিয়ে…মালবিকা! এটাই কিন্তু লিগ্যাল প্রশিডিওর। তুমি আইনজ্ঞ মিঃ মুখার্জিকে জিজ্ঞেস করতে পারো।…হ্যাঁ। এই কুড়িয়ে পাওয়া টাকার ব্যাপারে আমার একটা দায়িত্ব–মরাল অ্যান্ড লিগ্যাল–থেকে গেছে। কাজেই…না, না। তোমার চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমরা যথাসময়ে যাচ্ছি। তুমি শুধু মিঃ সিনহার চেকবইগুলো দেখে রাখো, কবে উনি ব্যাঙ্ক থেকে টাকাটা তুলেছিলেন। কেমন? রাখি তাহলে?…জাস্ট এ মিনিট! লক্ষ্মী বাড়ি গেছে?..বাচ্ছ?…হ্যাঁ। আমার বাচ্চুকে সন্দেহ হচ্ছে। জানো? গত রাতে আমি ভেবেছিলাম, তোমাকে বলি বাচ্চুকে যেন চোখে-চোখে রেখো। ওকে ছাড়িয়ে দিও না। কিন্তু…পেছনের দরজার তালা ভেঙে পালিয়েছে? পুলিশকে জানিয়েছ তো?…ব্যস। ঠিক আছে।

কর্নেল টেলিফোন রেখে আমার দিকে তাকালেন। বললাম, বাচ্চু সেই তৃতীয় ব্যক্তি, এতে এবার সিওর হওয়া যায়।

হুঁঃ!

আমিও কিন্তু গোড়া থেকে একথা বলে আসছি।

হুঁঃ!

কর্নেলের চোখ বুজে হুঁ-হুঁ করা আমার কাছে বরাবর হেঁয়ালি। বললাম, আপনি ধ্যান করুন। ততক্ষণ বরং আমি চিত্রার সম্পর্কে মুখরোচক চানাচুর চিবুতে থাকি।

মুখরোচক শুধু নয়, চক্ষুছানাবড়াকারীও বটে। প্রদীপ সিনহা আর সুমন হাজরাকে চিত্রার সঙ্গে জড়িয়ে কাব্যিক ভাষায় চমকপ্রদ প্রতিবেদন। কে লিখেছে, তার নাম নেই। অনেকগুলো রঙিন ছবি দিয়ে সাজিয়েছে।

হঠাৎ কর্নেল বললেন, জয়ন্ত! বেরুব। পোশাক বদলে আসি।

 মোটে তো এগারোটা বাজে!

আমরা ভবানীপুর হয়ে যাব।

একটু পরে যখন আমরা বেরুলাম, তখন কর্নেলের হাতে একটা ব্রিফকেস, যার ভেতর সেই পাঁচটা নোটের বান্ডিল আছে। টয় পিস্তলটা ওঁর টেবিলের ড্রয়ারে থেকে গেল।

কর্নেলের নির্দেশে পি জি হাসপাতালের পাশ দিয়ে এগিয়ে এ-রাস্তা থেকে সে-রাস্তা এবং তারপর একটা গলিতে ঢুকে শেষপ্রান্তে মোটামুটি চওড়া রাস্তার ধারে গাড়ি দাঁড় করাতে হলো। ব্রিফকেসটা আমার জিম্মায় রেখে কর্নেল বললেন, একটু অপেক্ষা করো। আসছি।

ব্রিফকেসে পঞ্চাশ হাজার টাকা। তাই অস্বস্তি হচ্ছিল। কর্নেল গাড়ির পেছনদিকে এগিয়ে যে বাড়ির গেটে ঢুকে গেলেন, সেটা একটা বিশাল বাড়ি এবং খুবই পুরনো। আসবার সময় লক্ষ্য করেছিলাম, এই এলাকায় এ ধরনের পুরনো প্রাসাদোপম বেশ কয়েকটি বাড়ি আছে। কোনো-কোনোটির অবস্থা জরাজীর্ণ। কোনোটি ভেঙে ফেলে বহুতল বাড়ি তৈরির আয়োজন চলছে।

সময় কাটছিল না। প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছিল, কেউ হয়তো আমাদের গাড়ি অনুসরণ করে এসেছে এবং অতর্কিতে এসে হামলা চালিয়ে ব্রিফকেসটা লুঠ করে পালাবে। জ্যাকেটের ভেতর আমার আগ্নেয়াস্ত্রটির দিকে মন পড়ে ছিল এবং কাছাকাছি কোনো গাড়ি এসে থামলেই তৈরি থাকছিলাম।

কর্নেল ফিরে এলেন প্রায় মিনিট কুড়ি পরে। গাড়িতে ঢুকে বললেন, যেদিক থেকে এসেছি সেদিকেই চলো। আমরা রেসকোর্সের পাশ দিয়ে যাব।

গাড়ি ঘুরিয়ে গলিপথে যাবার সময় জিজ্ঞেস করলাম, বনেদি বাড়ি মনে হলো। বাড়িটা কার?

কর্নেলকে খুব গম্ভীর দেখাচ্ছিল। আস্তে বললেন, তুমি চিনবে না। কলকাতার অনেক বনেদি পরিবারের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে, তা তো তুমি জানো। উনি চুরুট ধরিয়ে হেলান দিয়ে বসলেন। টুপিটা মুখের ওপর ঝুঁকে এসেছিল। ঠেলে তুলে দিলেন। তারপর চোখ বুজে একেবারে ধ্যানস্থ।

হেস্টিংস থানার সামনে গিয়ে দেখলাম, বেতারভ্যানে সশস্ত্র পুলিশ এবং কয়েকটি লাল জিপগাড়ি। ফুটপাতে একদঙ্গল কনস্টেবল। কয়েকজন অফিসার বেটন হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। কর্নেলকে দেখে একজন অফিসার এসে অভিবাদন। জানালেন। কর্নেল ব্রিফকেস নিয়ে নেমে গিয়ে বললেন, জয়ন্ত! তুমি কোথায়। গাড়ি পার্ক করবে জেনে নাও। আমি এখানে অপেক্ষা করছি।

পুলিশ অফিসারটি আমাকে বললেন, ওই সাদা অ্যাম্বাসাডারের পাশে পার্ক করুন।

গাড়ি লক করে এসে কর্নেলের সঙ্গে থানার গেটে ঢুকলাম। আস্তে বললাম, ব্যাপার কী? এত আয়োজন!

কর্নেল বললেন, স্বয়ং ডি সি ডি ডি আসবেন। তাছাড়া এমনও হতে পারে, নতুন কিছু ঘটেছে।

বলেন কী!

দেখা যাক।

ও. সি. মিঃ মণ্ডলের ঘরে ঢুকতেই তিনি কর্নেলকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন, বসুন স্যার! আপনাকে একটু আগে রিং করেছিলাম। আপনার সারভ্যান্ট বলল, আপনি বেরিয়ে গেছেন।

কর্নেল বসলেন। পাশের চেয়ারে আমিও বসলাম। কর্নেল বললেন, আলাপ করিয়ে দিই। জয়ন্ত চৌধুরী। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার রিপোর্টার।

মিঃ মণ্ডল আমাকে নমস্কারের একটু ভঙ্গি করে বললেন, ম্যান অব ওয়ার জেটির কাছে গঙ্গার ধারে ঝোঁপের মধ্যে একটা ডেডবডি পাওয়া গেছে। সম্ভবত জলে ছুঁড়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। চোখে পড়ে না এমন কতকগুলো ঝোঁপের ভেতর আটকে গিয়েছিল। খবর পেয়ে এস আই রাজেনবাবু গিয়েছিলেন। তিনি বডিটা তুলে মর্গে পাঠিয়ে দিয়েছেন। জিনস-জ্যাকেট পরা একটা মেয়ের ডেডবডি। পিঠের দিকে দু জায়গায় গুলি করে মারা হয়েছে। বডিতে রাইগর মর্টিসের শেষ পর্যায়ে পচ ধরার লক্ষণ ছিল।

কর্নেল আস্তে বললেন, শুক্লা দাশ। ফিল্মস্টার চিত্রা দত্তের বডিগার্ড।

হ্যাঁ সার। মর্গে তার বাবাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। একটু আগে খবর পেলাম, উনি তাঁর মেয়ের লাশ শনাক্ত করেছেন। বলে প্রশান্ত মণ্ডল একটু হাসলেন। এবার বাঞ্ছটাকে পেলেই প্রব্লেম সলভড়।…

.

০৭.

কর্নেলের আপত্তি সত্ত্বেও কফি আর বিস্কুট এল। ও. সি. প্রশান্ত মণ্ডলের অনুরোধে কর্নেল কফিতে চুমুক দিলেন। আমার অবশ্য এ মুহূর্তে উষ্ণ পানীয়ের দরকার ছিল। মিঃ মণ্ডল মাঝে মাঝে টেলিফোনে কারও সঙ্গে চাপা গলায় কথা বলছিলেন। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। চুরুট ধরিয়ে কর্নেল বললেন, বাচ্চুর ব্যাকগ্রাউন্ড জানতে পেরেছেন কি?

মিঃ মণ্ডল বললেন, হ্যাঁ। ফিল্মলাইনে ঘোরাঘুরি করত একসময়। অ্যান্টিসোশ্যাল তো বটেই। প্রোডিউসারদের কাছ থেকে টাকাকড়ি আদায় করত। কিন্তু আমাদের সার হাত-পা বাঁধা। পলিটিক্যাল প্রেসার আছে। ওকে জেরা করে কিন্তু কিছুই জানা যায়নি। হার্ড নাট যাকে বলে।

ওর আসল নাম কী?

স্বপন ঘোষ। বর্ধমানের গ্রামের ছেলে। ভগ্নীপতির কাছে থাকত। ঠিকানা পাওয়া গেছে। ওকে ছেড়ে দিতে হয়েছিল টেলিফোন বেজে উঠলে প্রশান্ত মণ্ডল রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। হ্যাঁ সার। এসে গেছেন।…লাহিড়িসায়েব এখনও বেরোননি?…ঠিক আছে।…হ্যাঁ, ধরছি। রিসিভার কাঁধে আটকে মিঃ মণ্ডল বললেন, কমিশনারসায়েবের ঘরে কনফারেন্স এখনও চলছে।…হ্যাঁ, বলুন সার! ডি সি-সায়েব আসছেন না?…আচ্ছা!..বুঝেছি।…হা সার, লিগ্যাল প্রব্লেম এসে গেছে।…আমি কর্নেলসায়েবকে দিচ্ছি। মিঃ মণ্ডল কর্নেলকে টেলিফোন দিয়ে বললেন, ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার অচিন্ত্য জানা আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।

কর্নেল সাড়া দিয়ে বললেন, বলুন মিঃ জানা..দ্যাটস রাইট। শুক্লা দাশের ডেডবডি লিগ্যাল প্রব্লেম সৃষ্টি করেছে।…আই এগ্রি।…শুনুন! টাকাগুলো আমি মিঃ সিনহার বাড়ির পেছনের গলিতে বটগাছের শেকড়ের মধ্যে আবিষ্কার করেছি–এই স্টেটমেন্ট আমি দিচ্ছি। কেমন?…হ্যাঁ। দ্যাটস মাচ।..দিচ্ছি। ধরুন।

ও. সি. প্রশান্ত মণ্ডলকে টেলিফোন দিলেন কর্নেল। একটু পরে টেলিফোন রেখে মিঃ মণ্ডল গম্ভীর মুখে বললেন, ঝামেলা বেড়ে গেল। আপনার অবশ্য কোনো অসুবিধে নেই। আপনি প্রদীপ সিনহার ফ্যামিলিফ্রেন্ড হিসেবে একটা সাদা কাগজে স্টেটমেন্ট লিখে দিন। কার্বন কপিতে আমি রিসিভড় বলে সই করে দিচ্ছি। কিন্তু তারপর এতগুলো টাকা থানার মালখানায় রাখা প্রব্লেম। লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে আজই পাঠিয়ে দেব বরং।

কর্নেলকে উনি দু শিট কাগজের ভেতর একটা কার্বন পেপার ঢুকিয়ে পিন এঁটে দিলেন। কর্নেল লিখতে থাকলেন। প্রশান্ত মণ্ডল আবার টেলিফোন তুলে ডায়াল করতে থাকলেন। মিসেস সিনহা? নমস্কার। আমি হেস্টিংস থানা থেকে ও. সি. প্রশান্ত মণ্ডল বলছি। আই অ্যাম সরি মিসেস সিনহা! টাকাটা আপনাকে ওভাবে হ্যান্ড ওভার করা যাচ্ছে না। লিগ্যাল প্রব্লেম এসে গেছে।…আপনি শুনুন! ফিল্মস্টার চিত্রা দত্তের বডিগার্ড শুক্লা দাশের ডেডবডি খুঁজে পেয়েছি আমরা। কাজেই কেসটা জটিল হয়ে গেছে।…হ্যাঁ। কর্নেলসায়েবকে বলছি। উনি আপনার কাছে গিয়ে সব বুঝিয়ে বলবেন। ফোন রেখে মিঃ মণ্ডল হাসলেন। ভদ্রমহিলা ফায়ার! কিন্তু কী আর করা যাবে। আমার হাত-পা বাঁধা।

কিছুক্ষণ পরে থানা থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠলাম। কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, প্রায় একটা বাজে। মালবিকার সঙ্গে দেখা করে যাওয়া দরকার। দশ মিনিটের বেশি সময় নেব না। তুমি গাড়িতে অপেক্ষা করবে।

ওঁর নির্দেশে ড্রাইভ করছিলাম। ক্লিফটন রোডে পৌঁছে বাঁদিকে একটা গলির মুখে গাড়ি রাখলাম। কর্নেল ব্যস্তভাবে বেবিয়ে গেলেন। এখান থেকে মিঃ মুখার্জি বা প্রদীপ সিনহার বাড়ি দেখা যায় না। ব্রিফকেসটা এখন খালি। কাজেই কোনো অস্বস্তিও নেই।

একটা সিগারেট পুড়ে শেষ হতে হতে কর্নেলকে দেখতে পেলাম। তেমনি ব্যস্তভাবে ফিরে আসছেন। রাস্তা পেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে বললেন, সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, মালবিকার হুকুমে নরবাহাদুর আর ড্রাইভার জগদীশ বাগানের শুকনো পাতা ঝেটিয়ে জড়ো করেছিল। এর ফলে আরও কিছু জায়গায় রক্তের দাগ বেরিয়ে পড়েছিল। তা ধুয়ে ফেলা হয়েছে। খিড়কির দরজায় নতুন একটা মজবুত তালা আঁটা হয়েছে।

মিসেস সিনহা কী বললেন, বলুন।

একটু চটে গেছে। অতগুলো টাকা ফিরে পেতে অনেক ঝামেলা হবে।

ওঁদের লইয়ার ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হলো?

হলো। তিরিশ-বত্রিশের মধ্যে বয়স। সিনহাসায়েবকে প্রদীপদা বলতেন। বাড়ির লোক বলা চলে।

বড় রাস্তায় গিয়ে বললাম, আমার ধারণা সুমন হাজরা বাছুরও গার্জেন।

সেটা গোপালবাবু বলতে পারবেন।

 আচ্ছা কর্নেল, চিত্রা দত্তের গাড়ি লক্ষ্য করে কে গুলি ছুঁড়তে পারে?

যার পয়েন্ট থার্টি টু ক্যালিবারের ফায়ার আর্মস আছে।

বাচ্চু অ্যান্টিসোশ্যাল ছিল। কাজেই তার এমন একটা চোরাই অস্ত্র থাকতেই পারে।

তা পারে।

তাহলে সুমন হাজরাই ওর গার্জেন। কারণ চিত্রার সঙ্গে সিনহাসায়েবের মেলামেশা তার বরদাস্ত না হওয়ারই কথা।

কর্নেল শুধু হু বলে চুপ করলেন। সারা পথ আর কোনো কথা হলো না। কারণ উনি শুধু হুঁ  বললেই বুঝতে পারি কথা বলার মুড নেই।…

কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরলে ষষ্ঠীচরণ বলল, বাবামশাইকে এক ভদ্রলোক ফোন করেছিলেন। নম্বর লিখে রেখেছি। নাম বলেননি। এই দেখুন।

ষষ্ঠী প্যাডে আঁকাবাঁকা হরফে ইংরেজিতে নাম্বারটা লিখেছে। কর্নেল ওকে বাংলা শেখানোর পর এখন ইংরেজি শেখাচ্ছেন। দেখলাম, ষষ্ঠীর যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে বললেন, লুনা এসকর্ট সার্ভিসের নাম্বার। তার মানে মিঃ সান্যাল। পরে ফোন করা যাবে। ষষ্ঠী, আমরা খাব।

বললাম, আজ আমাকে কিন্তু অফিসে যেতেই হবে। সত্যদা কথায়-কথায় শাসান, এবার ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের কাছে আমার নামে কমপ্লেন করবেন। চিফ এডিটর ওঁকে বিশেষ পাত্তা দেন না।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, ক্লিফটন রোডের রহস্যময় হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে তুমি লড়ে যাচ্ছ বলে ওঁকে জানিয়ে দাও। না, না। এখন নয়। বিবেকানন্দ বলেছিলেন, খালি পেটে ধর্ম হয় না। আমার মতে, খালি পেটে কর্মও হয় না। তুমি স্নান করতে চাও তো করে নাও।

করব। আমার মাথা ভেঁ-ভোঁ করছে। আপনারা কথা আলাদা। সায়েবি কালচার। স্নান না করেই

শাট আপ! কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন, তোমার কেন, আরও অনেকের এই অদ্ভুত ধারণা আছে, সায়েবরা স্নান করে না। ওরা সুযোগ পেলে দু বেলা স্নান করে। আমার সপ্তাহে দু-তিন দিন স্নানের পেছনে আছে পুরনো সামরিক জীবনের অভ্যাস। বেশিরভাগ সময় বনজঙ্গলে পাহাড়পর্বত মরুভূমিতে কাটাতে হয়েছে। জল পেলেও স্নানের সুযোগ পেতাম না।

স্নান করে আমার জন্য কেনা সেই পাজামা-পাঞ্জাবি পরে কর্নেলের সঙ্গে সুস্বাদু লাঞ্চ সেরে নিলাম। তারপর ড্রয়িং রুমে গিয়ে দৈনিক সত্যসেবকের চিফ অব দি নিউজ ব্যুরো সত্যদাকে ফোন করলাম। কথাটা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে সত্যদা খেঁকিয়ে উঠলেন, এক্সপ্ল্যানেশন লেটার টাইপ হইতাছে। বুড়ার লগে ঘুরতাছ। উনি পক্ষী খুঁজছেন। তুমি কী খুঁজতাছ? অ্যাঁ?

বিশ্বাস করলেন না? তবে শুনুন, প্রদীপ সিনহার ফিল্ম প্রোডাকশনের হিরোইনের বডিগার্ড নিখোঁজ হয়েছিল। আজ গঙ্গার ধারে তার ডেডবডি পাওয়া গেছে। এদিকে–

সত্যদা ঝটপট বললেন, তুমি কোথায় আছ? গঙ্গার ধারে? না। কর্নেলের বাড়িতে। মিথ্যা কইয়ো না। বুড়ারে ফোন দাও।

কর্নেলের দিকে তাকালাম। কর্নেল টেলিফোন নিয়ে বললেন, সত্যবাবু নাকি? কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।..কী আশ্চর্য! আমার কণ্ঠস্বর শুনেও…হ্যাঁ। জয়ন্ত ঠিকই বলছে। ওকে অন ডিউটিতে রাখুন। কিন্তু সত্যবাবু, এক্সক্লুসিভ স্টোরি পেতে হলে আপনাকে মুখ বুজে থাকতে হবে।…তা আর বলতে? তবে এক কাজ করুন, আপনাদের ফটোগ্রাফার রামবাবুকে পি জি হসপিটালের মর্গে পাঠিয়ে দিন। যে-ভাবে হোক, অভিনেত্রী চিত্রা দেবীর বডিগার্ডের ডেডবডির একটা ছবি যেন তুলে রাখেন। ওঁকেও মুখ বুজে থাকতে বলবেন। হ্যাঁ। হ্যাঁ। কর্নেল হাসতে হাসতে টেলিফোন রেখে দিলেন।

জিজ্ঞেস করলাম, লুনা এসকর্ট সার্ভিসের মিঃ সান্যালকে ফোন করবেন না?

কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, শুক্লার ডেডবডির খবর দিতে চেয়েছিলেন মনে হচ্ছে।

আমি ডিভানে চিৎপাত হয়ে বললাম, আজ শীতটা কমে গেল।

 কিন্তু আজ তোমার ভাতঘুম বাড়ালে চলবে না জয়ন্ত! বড়জোর আধঘণ্টা।

বেরুতে হলে এখনই বেরিয়ে পড়ুন।

কর্নেল চুপচাপ কিছুক্ষণ চুরুট টানার পর বললেন, একটা প্রশ্ন কাল রাত থেকেই আমাকে জ্বালিয়ে মারছে। শুক্লা কি নিজেই মিঃ সিনহাকে ব্ল্যাকমেল করার জন্য ফটোগুলো তুলেছিল? নাকি এর পেছনে অন্য কারও প্ররোচনা ছিল? শুক্লার একটা ক্যামেরা থাকতেই পারে। ছিল কি না ওর বাবার কাছে। জেনে নেওয়া যায়। কিন্তু পরের প্রশ্ন, ফিল্মটার ডেভলাপিং, ওয়াশিং এবং প্রিন্টিংও করা হয়েছিল। নেগেটিভ দেখেই সেটা বোঝা যায়। এ ধরনের গোপন এবং অশালীন ছবি বাইরে প্রিন্ট করানোর রিস্ক আছে। কাজেই খুব জানাশোনা, এমনকি এমোশনাল সম্পর্ক আছে, তেমন কাউকে দিয়ে

ওঁর কথার ওপর বললাম, শুক্লার বয়ফ্রেন্ড থাকা অসম্ভব নয়। কে বলতে পারে বাচ্চুই ওর বয়ফ্রেন্ড নয়? বাচ্চুর ফিল্মলাইনে জানাশোনা ছিল। একজন অ্যান্টিসোশ্যাল ফিল্মজগতের কোনো ফটোগ্রাফারকে দিয়ে প্রিন্ট করিয়ে নিতে পারে। সিনেমার স্টিল পিকচার যারা তোলে, কিংবা ধরুন কোনো ফিল্ম ম্যাগাজিনের ফটোগ্রাফার–যাই হোক, আপনি মূল ব্যাপারটা ছেড়ে ছবির দিকে মন দিয়েছেন কেন, আপনিই জানেন।

কর্নেল আবার একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, কান টানলে মাথা আসে বলে একটা কথা আছে। শুক্লার ব্যাকগ্রাউন্ড যেটুকু জেনেছি, তাতে ওকে ডানপিটে আর আত্মবিশ্বাসী মনে হয়, তা ঠিক। কিন্তু প্রদীপ সিনহার মতো একজন বিজনেস ম্যাগনেটকে ব্ল্যাকমেল করা শুক্লার পক্ষে দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চার নয় কি?

কেন? মালবিকাকে একটা প্রিন্ট দেখালেই তাঁর স্বাণী কুপোকাত হয়ে যেতেন! ভদ্রমহিলাকে আপনি আমার চেয়ে ভালো চেনেন। কারণ তাঁর বাবা আপনার বন্ধু ছিলেন। মালবিকাকে দেখে আমার কিন্তু মনে হয়েছে অসাধারণ তেজস্বিনী মহিলা।

কর্নেল উজ্জ্বল চোখে আমার দিকে তাকালেন। বাহ্! তোমার চোখ আছে ডার্লিং!

ঠাট্টা করছেন!

মোটেও না। সিরিয়াসলি বলছি। তুমি তো শুনেছ, বাবার অমতে প্রদীপ সিনহাকে বিয়ে করেছিল মালবিকা। বাবার প্রপার্টি নেয়নি। অথচ একমাত্র মেয়ে। রায়সাহেব অগত্যা তার প্রপার্টি একটা ট্রাস্টিবোর্ডের হাতে দিয়ে গেছেন। ট্রাস্টিবোর্ড তাঁর উইল অনুসারে ন্যাচারাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি নামে একটা প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছে। কর্নেল অ্যাশট্রেতে চুরুট গুঁজে দিলেন। তারপর একটু হেসে বললেন, সে যাই হোক, পুলিশ এবং তোমার থিওরি হলো, বাই একসঙ্গে দু-দুটো খুন করেছে। কিন্তু চিন্তা করো! শুক্লার বডি পাওয়া গেছে গঙ্গার ধারে। বাচ্চু কি কাঁধে করে শুক্লার বড়ি অত দূরে ফেলতে নিয়ে গিয়েছিল? তাছাড়া একটা কথা। শুক্লার বডি লোকের চোখে পড়ল পুরো একটা দিনের পরের দিন সকালে। মিঃ সিনহাকে খুন করার পর শুক্লার বডি বাছুর পক্ষে কোথায় লুকিয়ে রাখা সম্ভব বলে মনে করো?

হ্যাঁ। এটা একটা পয়েন্ট।

তাছাড়া বাছুর সঙ্গে এমোশনাল সম্পর্ক থাকলে শুক্লাকে সে খুন করবে কেন?

টাকাগুলো একা আত্মসাতের লোভে।

কিন্তু টাকাগুলো বাচ্চুর চোখে পড়েনি। তার স্পষ্ট প্রমাণ, লক্ষ্মী ওগুলো দৈবাৎ দেখতে পেয়ে গায়ের সোয়েটার খুলে তার ভেতর লুকিয়ে ফেলেছিল। মিঃ সিনহার ডেডবডি দেখতে পাওয়ার পর বাড়ির অন্যেরা যখন তাই নিয়ে ব্যস্ত, তখন লক্ষ্মী সোয়েটারটা কানাগলিতে বটগাছের শেকড়ের তলায় লুকিয়ে রেখে আসে।

লক্ষ্মী কালো প্ল্যাস্টিকের ব্যাগ যোগাড় করার সময় পেল কখন?

নোটর বান্ডিল পরীক্ষা করে আমার মনে হয়েছে, মিঃ সিনহাই প্ল্যাস্টিকের ব্যাগে ভরে ওগুলো শুক্লাকে দেবার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আততায়ীর গুলিতে ব্যাগ হাত থেকে ছিটকে পড়ে। তাই মাত্র তিনটে বান্ডিলের ওপর পচা পাতা আর কাদার ছোপ লেগেছিল।

কিন্তু বাচ্চু খিড়কির তালা ভেঙে পালাল কেন?

নিশ্চয় কোনো বিশেষ কারণ ছিল। বাচ্চুকে না পেলে তার ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না।

লক্ষ্মীর সঙ্গে তার যোগসাজশের কথা আপনার থিয়োরিতে ছিল!

ছিল। এখন থিয়োরিতে গণ্ডগোল বেধেছে। কর্নেল হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালেন। যতক্ষণ না শুক্লার বডির পোস্টমর্টেম রিপোর্ট সম্পর্কে কিছু জানতে পারছি, ততক্ষণ আর নতুন কোনো থিয়োরি নয়। বলে ভেতরের ঘরে ঢুকে গেলেন কর্নেল।…

গাড়ি স্টার্ট দিলে কর্নেল বললেন, আগে ভবানীপুর।

 বললাম, সেই বনেদি বাড়িতে তো? ব্যাপারটা খুলে বলার অসুবিধে কী?

কর্নেল হাসলেন। নাহ্। আমরা এবার যাব ভবানীপুর থানায়।

আবার পুলিশের ডেরায়? ওঃ কর্নেল! এবার কিন্তু আপনার দুর্নাম রটে যাবে। আমার স্টোরিতে পুলিশের সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতা দেখে অনেকেই আমাকে চিঠি লিখে বলে, এ কীরকম রহস্যভেদী? পুলিশের সাহায্য ছাড়া কর্নেল এক পা বাড়াতে পারেন না!

কর্নেল অমনি গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, ভুলে যেও না জয়ন্ত, আধুনিক সমাজব্যবস্থাটাই এরকম যে একটার সঙ্গে অসংখ্য সম্পর্ক জড়িয়ে আছে। বিশেষ করে অপরাধসংক্রান্ত ব্যাপারে এ যুগে পুলিশের সাহায্য ছাড়া এগোনো খুব কঠিন। সমাজব্যবস্থার জটিলতা যত বাড়ছে, অপরাধের জটিলতাও তত বেড়ে চলেছে। তার চেয়ে বড় কথা, অনেক ক্ষেত্রে এমন একটা জরুরি তথ্যের দরকার হয়, যা পুলিশের রেকর্ড ছাড়া পাওয়া যায় না। ইজিচেয়ারে বসে কানে শোনা বা চোখে দেখা কিছু সূত্র থেকে অপরাধী শনাক্ত করার যুগ কবে চলে গেছে। অপরাধীরা এখন প্রখর বুদ্ধি এবং মেধার অধিকারী।

কর্নেলের বক্তৃতা বন্ধ করার জন্য বললাম, আহা! অত বললে আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ব।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর কর্নেল আস্তে বললেন, যে তথ্যটার আশায় যাচ্ছি, তা পেয়ে গেলে আর আমাকে ছায়ার সঙ্গে কুস্তি করতে হবে না।

হেসে ফেললাম। সুকুমার রায়ের পদ্য। ছায়ার সঙ্গে কুস্তি করে গাত্রে হলো ব্যথা!

ব্যথা? তা টের পাচ্ছি বটে।

চৌরঙ্গির মোড়ে জ্যাম ছিল। ভবানীপুর থানায় পৌঁছুতে প্রায় চারটে বেজে গেল। আমাকে অপেক্ষা করতে বলে কর্নেল থানায় ঢুকে গেলেন।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে তিনি উজ্জ্বল মুখে ফিরে এসে বললেন, গত রাতে ভাগ্যিস অরিজিৎকে বলে রেখেছিলাম, স্বয়ং ডি সি ডি ডির নির্দেশ। তিন বছর আগের ফাইল মালখানা থেকে খুঁজে বের করা সহজ নয়।

এবার ছায়াটা কায়া হয়ে গেল তো?

কর্নেল সিটে হেলান দিয়ে বসে চুরুট ধরালেন। এখনও একটু অস্পষ্টতা আছে। চলো! রেসকোর্সের পাশ দিয়ে গঙ্গার ধারে ম্যান অব ওয়ার জেটির কাছে যাব।

কোনো প্রশ্ন করলাম না। কারণ, বুঝতে পেরেছিলাম, শুক্লার লাশ যেখানে ফেলা হয়েছিল, সেই জায়গাটা দেখবেন। কিন্তু এটুকু বুঝলাম না, কেউ দেখিয়ে দিলে উনি সঠিক জায়গাটা কীভাবে খুঁজে বের করবেন।

আজ ছুটির দিন নয়। তাই গঙ্গার ধারে ভিড়টা কম। গাড়ি লক করে কর্নেলের সঙ্গে জেটিতে নেমে গেলাম। সামনে একটা মাঝারি যুদ্ধজাহাজ নোঙর ফেলে ভাসছে। লোকেরা জাহাজটার কাছে এসে দেখছে। শীতের হাওয়াটা এখানে জোরালো। কর্নেল বাইনোকুলারে পাড়ের দিকটা দেখছিলেন।

হঠাৎ বললেন, চলো! ফেরা যাক।

পাড়ের কাছে গিয়ে কর্নেল চক্ররেলের লাইনের ধারে হাঁটতে হাঁটতে (তখনও দ্বিতীয় হুগলিসেতু তৈরি হয়নি) একখানে থেমে আস্তে বললেন, ঝোঁপগুলোর ভেতর ডেডবডি ফেললে সহজে চোখে পড়বে না। দৈবাৎ কেউ জৈবকৃত্যে ওখানে ঢুকলে তবেই দেখতে পাবে। বাহ্! সাইট সিলেকশন খাসা! তবে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল। আর এক হাত তফাতে ডানদিক থেকে ফেললে কিন্তু ডেডবডি জলে গড়িয়ে পড়ত। ল্যাম্পপোস্ট থেকে আলো সরাসরি এখানে পড়ে না। এই উঁচু আকাশমণি গাছটার জন্য।

কর্নেলকে অনুসরণ করে গাড়ির কাছে গেলাম। বললাম, এবার?

এবার মালবিকার কাছে যাওয়া যাক। তখন কথা দিয়ে গিয়েছিলাম, সন্ধ্যায় এসে ডিটেলস আলোচনা করব। স্বামীকে ফাঁদ থেকে বাঁচানোর জন্য সে আমার সাহায্য চেয়েছিল। কিন্তু আমি বাঁচাতে পারিনি। এই ব্যর্থতার দায় অবশ্য আমার একার নয়। সেটাই ওকে বোঝানো দরকার। মালবিকা কোনো স্পষ্ট তথ্য দিতে পারেনি। নাকি কিছু জেনেও গোপন রাখতে বাধ্য হয়েছিল? এখন তো তার বলতে দ্বিধা থাকা উচিত নয়।

ক্লিফটন রোড এই আসন্ন সন্ধ্যায় আমার পক্ষে চেনা কঠিন হতো। কর্নেলের নির্দেশে ড্রাইভ করে ৭ নাম্বার বাড়ির গেটের সামনে দাঁড় করালাম। হর্ন শুনে নরবাহাদুর ভেতর থেকে উঁকি দিল। কর্নেল নেমে যেতেই সে ওঁকে দেখতে পেয়ে সেলাম করল। তারপর বলল, মেমসাব মুখার্জিসাবের সঙ্গে আভি চলে গেলেন। আপনার জন্য ওয়েট করছিলেন।

কখন ফিরবে বলে যায়নি?

না সার!

আমরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে চাই, বাহাদুর! অসুবিধা আছে?

নরবাহাদুর হাসল। কুছু অসুবিধা নাই। আপনি কর্নিলসাব তিন রোজ এসেছেন। মেমসাব আমাকে ভি বলেছেন, কর্নিলসাব উনহির বাবার দোস্ত। গেট খুলিয়ে দিচ্ছি। আসুন।

সে গেট খুলে দিলে গাড়ি লনে ঢুকিয়ে পোর্টিকোর কাছাকাছি রাখলাম। নরবাহাদুর গেটে তালা এঁটে কর্নেলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আসছিল। এই সময় পের্টিকোর তলা থেকে মধ্যবয়সী রোগাটে গড়নের একটা লোক বেরিয়ে। এসে দাঁড়াল। বাহাদুর তার উদ্দেশে বলল, শম্ভুদা! জলদি দো কাপ চায় লাও।

কর্নেল এসে শম্ভুর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমিই শম্ভু? পুরো নাম?

শম্ভু কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, আজ্ঞে সার, শম্ভুনাথ মোহান্ত।

বাহাদুর বলল, কর্নিলসাব! হলঘরে বসবেন, না বারান্দায় বসবেন?

কর্নেল বললেন, পরে বলছি। ততক্ষণ একটু কথাবার্তা বলি। আচ্ছা শম্ভু, তুমি তোমার ঘর থেকে সেরাতে বাচ্চুকে দেখেছিলে?

শম্ভু একটু ভড়কে গিয়ে বলল, আজ্ঞে সার, সেইরকম মনে হয়েছিল। কুকুরটা খুব চ্যাঁচামেচি করছিল। তাই তবে সার! মিথ্যা বলব না। স্পষ্ট দেখিনি! বিষ্টিবাদলার রাত। এদিকে ঝড়ের মতো অবস্থা।

কোথায় দেখতে পেয়েছিলে দেখিয়ে দাও তো!

শম্ভু উৎসাহে পা বাড়াল। বাড়ির বাঁ দিকে দক্ষিণে মস্ত ছাতিম গাছটার তলা দেখিয়ে সে বলল, মনে হচ্ছে, এখানেই দেখেছিলাম। কিন্তু আলো এদিকটায় পড়ে না, দেখছেন তো সার?

তখন রাত কত?

দশটার পরে। আমি আর ড্রাইভারবাবু একসঙ্গে খেয়ে যে-যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। বাচ্চু আগেই খেয়ে শরীর খারাপ বলে তার ঘরে শুয়ে পড়েছে। তার ঘর হলঘরের ওধারে। কুকুরটা পাশের করিডরে চেনে বাঁধা ছিল।

কুকুরটা তো মারা পড়েছে! কে মারল?

 বাহাদুর এবং শম্ভু একসঙ্গে বলল, বাচ্চু!

বিষ খাইয়ে মেরেছে। তাই না?

বাহাদুর বলল, হাঁ সার! ডাকটরসাব তাই বলেছেন।

কুকুরটা কি ফেলে দেওয়া হয়েছে?

না সার! মেমসাব ফেলে দেবেন কেন? উনি পলিথিনে প্যাক করলেন। আমি ওখানে মাটির নিচে গেড়ে দিয়েছিলাম। আজ রাজমিস্তিরি ডেকে আনলেন ড্রাইভারবাবু। গোর বাঁধিয়েছেন মেমসাব। মার্বেল পেলেটের অর্ডার দেওয়া ভি হয়েছে। বাহাদুর দম নিয়ে ফের বলল, এত্ত এত্তা খুন নিকলা!

তা হলে গাড়ির সিট তো ধুতে হয়েছে!

না সার! পলিথিনে জড়িয়ে নিয়ে গেলেন মেমসাব আর মুখার্জিসাব। তো জানোয়ার যখন মুর্দা হলো, তখন গাড়ির ডিকিতে ভরে আনলেন। আমি আর ড্রাইভারদা নামিয়ে আনলাম। এত্তা খুন। সকালে ড্রাইভারদা ডিকি আচ্ছাসে ধুয়ে দিল।

ড্রাইভার গিয়েছিল গাড়ি নিয়ে?

না সার! মুখার্জিসাব গাড়ি চালিয়ে গেলেন।

ফিরলেন কখন?

রাত–তখন রাত এগারোটানা, না। বারো বাজতে পারে।

শম্ভু বলল, কী বলছ বাহাদুর? মেমসায়েবের গাড়ির হর্ন শুনে আমিই তো তোমাকে ঘুম থেকে ওঠালাম। তখন প্রায় একটা বাজে।

কর্নেল বাইনোকুলারে সম্ভবত কুকুরের কবরটা দেখছিলেন। হঠাৎ ঘডি দেখে বললেন, না। আমরা আজ বরং চলি। বাহাদুর! তোমার মেমসায়েবকে বোলো কাল সকালে ফোনে কথা বলব। চলো জয়ন্ত!

রাস্তায় পৌঁছে কর্নেল বললেন, তুমি এগিয়ে সেই গলির মুখে গাড়ি রাখো। ওই যে–ডাইনে।

আপনি কোথায় যাবেন?

এখনই আসছি। মিঃ মুখার্জির দারোয়ান ফাগুলালকে একটা কথা জিজ্ঞেস করেই চলে আসব।

কর্নেলকে নামিয়ে দিয়ে গলিটার দিকে এগিয়ে গেলাম। প্রায় দশ মিনিট পরে কর্নেল ফিরে এসে বললেন, চলো! আজকের মতো এই যথেষ্ট। বাড়ি ফিরে কড়া কফি খাওয়া যাক।

ফাগুলালের কাছে কী ব্যাপার?

 ও জয়ন্ত! এখন কোনো কথা নয়।

অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে কর্নেল ষষ্ঠীচরণকে কফির হুকুম দিয়ে টুপি খুললেন। টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, হেস্টিংস এরিয়ায় কিন্তু বেশ শীত। আর এখানে কেমন যেন গরম আবহাওয়া। না, না। ফ্যান চালাতে বলছি না। চুপচাপ বসে কফির অপেক্ষা করো। কফি ঝিমিয়ে পড়া নার্ভকে চাঙ্গা করে।

ষষ্ঠী এইসময় পর্দার ফাঁকে মুখ বাড়িয়ে বলল, বাবামশাই! বলতে ভুলেছি। দুপুরের সেই নম্বরে আবার ফোন এসেছিল। বললাম, বাবামশাই নেই।

আগে কফি।

ষষ্ঠী অদৃশ্য হলো। কর্নেল চোখ বুজে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ সোজা হয়ে টেলিফোনের দিকে হাত বাড়ালেন। ডায়াল করার পর সাড়া পেয়ে বললেন, ..আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। ও. সি. মিঃ মণ্ডল আছেন?…হ্যাঁ, ওঁকে দিন। কিছুক্ষণ কাঁধে রিসিভার আটকে রাখার পর বললেন, মিঃ মণ্ডল? আমি কর্নেল…শুনুন! শুক্লা দাশের পোস্টমর্টেমের প্রাইমারি রিপোর্টে কী বলা হয়েছে?…পয়েন্ট থার্টি টু ক্যালিবার? মানে, একই রিভলভারের গুলি?…হ্যাঁ। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে তো নয়ই। শুক্লা পালিয়ে যাচ্ছিল। তাই পিঠে গুলি লাগে।…ঠিক আছে।…বাচ্চু পাকড়াও না হলে কেস দাঁড় করানো যাবে কি?…হ্যাঁ। আমিও তাই বলছি। আচ্ছা। ধন্যবাদ!

যষ্ঠী কফি আর স্ন্যাক্স নিয়ে এল ট্রেতে। কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে আমার দিকে হাসিমুখে তাকালেন। চিয়ার আপ জয়ন্ত! চিয়ার আপ!

হঠাৎ এত উল্লাসের কারণ কী?

কফি। ষষ্ঠী অসাধারণ কফি করে।

তা করে। কিন্তু আপনার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, সিনহাসায়েবের হত্যারহস্যের সমাধান করে ফেলেছেন!

কর্নেল হাসলেন। নাহ। ওই যে মিঃ মণ্ডলকে টেলিফোনে বলছিলাম। বাচ্চুকে না পেলে কেস দাঁড় করানো যাবে না।

কেন?

ওসব কথা এখন থাক। কফি খাও জয়ন্ত! নার্ভ চাঙ্গা করো! বলে কর্নেল কফিতে চুমুক দিলেন। ওঁর চোখে-মুখে উজ্জ্বলতা ঝলমল করছিল।

হঠাৎ মনে হলো, আইনজীবী এস. কে. মুখার্জির দারোয়ান ফাগুলালের কাছেই কি কর্নেল নতুন কোনো গুরুত্বপূর্ণ সূত্র পেয়ে গেছেন? কর্নেল বরাবর বলেন, অনেক সময় আমরা জানি না যে আমরা কী জানি। ফাগুলাল কি এমন কোনো কথা ওঁকে বলেছে, যার গুরুত্ব সে নিজেই জানে না?…

.

০৮.

 কফি শেষ করে কর্নেল চুরুট ধরালেন। তারপর বললেন, লুনা এসকর্ট সার্ভিসের রথীন্দ্র সান্যাল দুবার টেলিফোন করেছেন। এবার ওঁকে রিং করা যেতে পারে। আমার ধারণা, ওঁর এজেন্সির সুনামহানির আশঙ্কাতেই উনি আমাকে কাজে লাগাতে চান। বুঝলে জয়ন্ত? গোয়েন্দাগিরির প্রস্তাব দিলে আমি কিন্তু ফি চাইব। কত চাওয়া যায় বলো তো?

ওঁর পরিহাসের মেজাজ লক্ষ্য করে বললাম, পঞ্চাশ হাজার টাকা।

ঠিক বলেছ! কর্নেল হাসিমুখে নাম্বারটা ডায়াল করতে থাকলেন। তারপর সাড়া পেয়ে বললেন, মিঃ সান্যাল আছেন?…কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। বলুন মিঃ সান্যাল! আপনি দুবার রিং করেছিলেন শুনলাম।…অজন্তা স্টুডিয়ো?….. বলেন কী!….ফটোগুলো আপনি নষ্ট করে দিন। বিপদে পড়বেন কিন্তু!….কী নাম। ছেলেটির?…না, না। এটা চেপে যান। কারণ ফটোর মেয়েটির পলিটিক্যাল গার্জেন আছেন। সাংঘাতিক লোক। আপনি কি ট্রেড ইউনিয়ন নেতা সুমন হাজরার নাম শুনেছেন?….তা হলে বুঝতেই পারছেন। আর শুনুন, শমীক নামে ছেলেটিকে সতর্ক করে দিন।…হ্যাঁ। ওকে বলুন, ব্যাপারটা জানাজানি হলে শুধু পুলিশ নয়, সুমনবাবুর মস্তানবাহিনী এসে স্টুডিয়ো জ্বালিয়ে দেবে।….চমৎকার কাজ করেছেন। আপনি বুদ্ধিমান।….শুক্লার খুনীকে খুব শিগগির ধরা হবে। জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড সি….যাই হোক, ভাগ্যিস আপনি আর কাউকে না জানিয়ে শুধু আমাকে জানালেন! ধন্যবাদ।

কর্নেল টেলিফোন রেখে আমার দিকে তাকালেন। বললাম, ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছি।

হ্যাঁ। শুক্লার মৃত্যুতে তার বয়ফ্রেন্ড শমীক স্বভাবত শোকগ্রস্ত। সে লুনার কাছাকাছি একটা সাধারণ স্টুডিয়োর কর্মচারী। শুক্লা তার কাছে গোপনে একটা। ক্যামেরা চেয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর নেগেটিভ ফিল্ম প্রিন্ট করতে দিয়েছিল। বয়ফ্রেন্ড মানে প্রেমিক তো বটেই। প্রেমিক ছেলেটি ফিল্ম ডেভালাপ করে একসেট প্রিন্ট নেগেটিভসহ শুক্লাকে দেয়। শুক্লার অজ্ঞাতসারে নিজে আরেক। সেট প্রিন্ট নিজের কাছে রাখে। শুক্লার খুন হয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে সে একটা কিছু আঁচ করে মিঃ সান্যালের শরণাপন্ন হয়েছিল।

ফিল্মস্টার চিত্রা দত্তকে কি ওরা চিনতে পেরেছে?

নাহ। চিনতে পারলে আমাকে মিঃ সান্যাল নামটা বলতেন। বলে কর্নেল একটু হাসলেন। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার! গত রাতে পার্ক লেনে গিয়ে লুনা এসকর্ট সার্ভিস খুঁজে বের করার পর আমি কেন যেন পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম।

আপনি তো বলেছেন আমাকে।

ইনটুইশন! আশ্চর্য জয়ন্ত, সত্যি আশ্চর্য! আমি অজন্তা স্টুডিয়োর সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। তারপর মুনলাইট বারে গিয়ে ঢুকেছিলাম। এখন মনে পড়ছে, আমি অজন্তা স্টুডিয়ো আর লুনার কর্মী শুক্লা দাশের যোগাযোগের সম্ভাবনা। নিয়ে একটু চিন্তাও করেছিলাম।

আপনি বরাবর দেখেছি, ইনটুইশনে বিশ্বাসী।

ঠিক বিশ্বাস নয়, অস্পষ্ট একটা ধারণা। অনেক মানুষের মধ্যে এই আশ্চর্য বোধটা কাজ করে। কর্নেলকে হঠাৎ একটু উত্তেজিত দেখাল। জয়ন্ত! শুক্লার মধ্যেও কি এমন কোনো বোধ কাজ করেছিল? আক্রান্ত হওয়ার মুহূর্তে সে-ই কি নলে নেগেটিভ ফিল্মভর্তি টয় পিস্তলটা পাঁচিলের ওধারে ছুঁড়ে ফেলেছিল? হ্যাঁ–এটা সম্ভব। খুবই সম্ভব। টয় পিস্তলটা দৈবাৎ পচা পাতা আর জলভর্তি একটা গর্তে গিয়ে পড়েছিল–এটা কি হতে পারে না?

কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন। একটু পরে বললাম, আজ রাতে যদি আর কোথাও না বের হন, আমি সল্টলেকে ফিরব।

কর্নেল চোখ বুজেই বললেন, না। আর কোথাও বেরুনোর দরকার নেই।

তা হলে আমি উঠছি।

হ্যাঁ। বুঝতে পারছি তুমি কুনিদ্রার ভয়ে পালাতে চাইছ। আমার ডেরায় রাত কাটালে তোমার সুনিদ্রার চান্স নেই। ঠিক আছে। অদ্য শেষ রজনী। ফ্ল্যাটে ফিরে সুনিদ্রা উপভোগ করো। হ্যাভ এ নাইস স্লিপ ডার্লিং! গুডনাইট।…

.

সকলে ঘুম ভাঙার পর হঠাৎ কর্নেলের কথাটা মনে পড়েছিল, অদ্য শেষ রজনী। তাড়াতাড়ি উঠে বাথরুম সেরে চা খাওয়ার পর কর্নেলকে ফোন করলাম। ষষ্ঠীচরণের সাড়া পেলাম। দাদাবাবু! বাবামশাই এখনও নামেননি।

ছাদের বাগান থেকে?

 আজ্ঞে। গিয়ে বলব নাকি?

না। আমি দশটার মধ্যে যাচ্ছি। আচ্ছা ষষ্ঠী, তোমার বাবামশাই গত রাতে আবার বেরিয়েছিলেন নাকি?

হ্যাঁ দাদাবাবু! খাওয়ার পর এক পুলিশ অফিসার এসেছিলেন। তার সঙ্গে বেরিয়েছিলেন। ফিরলেন রাত একটায়।

ঠিক আছে। রাখছি।

কর্নেলের অদ্য শেষ রজনী কথাটা আবার আমাকে উত্তেজিত করল। ব্রেকফাস্ট করে তখনই বেরিয়ে পড়লাম। দশটার আগেই পৌঁছে গেলাম কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে।

কর্নেল আমাকে দেখে বললেন, আশা করি সুনিদ্রা হয়েছে জয়ন্ত! তোমাকে ফ্রেশ দেখাচ্ছে।

আপনাকেও। তো আমি পুলিশের সঙ্গে আপনার নৈশ অভিযানের খবর পেয়ে গেছি।

কর্নেল হাসলেন। তুমি ফোন করেছিলে। ষষ্ঠী বলেছে।

কোথায় বেরিয়েছিলেন?

হেস্টিংস থানায়। বাচ্চুকে পুলিশ তার গ্রামের বাড়ি থেকে ধরে এনেছে। বাছুর সঙ্গে আমার কথাবার্তা হয়েছে। এদিকে আজ ভোর ছটায় মালবিকা আমাকে রিং করে জানাল, কাল সন্ধ্যা ছটায় গ্র্যান্ড হোটেলে ওদের কোম্পানির বোর্ড অব ডাইরেক্টর্সের জরুরি মিটিং ছিল। মিটিং শেষ হতে রাত এগারোটা বেজে যায়। তাই বাড়ি ফিরে আর আমাকে রিং করেনি। আমি ওকে বলেছি, সাড়ে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে আমি যাচ্ছি।

ঘড়ি দেখে বললাম, তাহলে তো এখনই বেরিয়ে পড়া উচিত।

তুমি অধৈর্য হয়ে পড়ছ দেখছি!

কারণ গত রাতে আপনি বলেছেন, অদ্য শেষ রজনী!

কর্নেল একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। হ্যাঁ। সেটাই হয়েছে সমস্যা। একটা করে মিনিট কেটে যাচ্ছে, একটু করে উদ্বেগ বেড়ে চলেছে। চূড়ান্ত বিস্ফোরণের জন্য এ যেন কাউন্টডাউন। বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। আলমারি খুলে সেই ব্রিফকেসটা নিয়ে এলেন। তারপর সেটা টেবিলে রেখে ইজিচেয়ারে বসলেন।

জিজ্ঞেস করলাম, ব্রিফকেসে তো আজ টাকা নেই। অন্য কিছু আছে। তাই না?

তোমার অনুমান করা উচিত।

 নেগেটিভ ফিল্ম, প্রিন্টগুলো, টয় পিস্তল ইত্যাদি।

হ্যাঁ। ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন শুধু একটা জরুরি ফোনের প্রতীক্ষা।

লক্ষ্মীরানীকে গ্রেফতার করার খবর আসবে বুঝি?

কর্নেলের গাম্ভীর্য ভাঙচুর হলো হা হা হাসিতে। ওঃ জয়ন্ত! বরাবর তোমাকে বলে আসছি, তোমাকে দক্ষ রিপোর্টার হতে হলে চাই তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণশক্তি!

অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওঁর দিকে।

হাসিয়ে থামিয়ে কর্নেল বললেন, কাল অনুপমা–মানে সিনহাসায়েবের বাড়িতে তুমি মুখ তুললেই দেখতে পেতে, লাল সোয়েটার পরে লক্ষ্মীরানী পোর্টিকোর ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা এগিয়ে যেতেই সে ভেতরে অদৃশ্য হলো।

মেয়েটি দেখছি বেপরোয়া!

এতে বেপরোয়া হওয়ার কিছু নেই। কারণ কোনো লাল সোয়েটারের কথা পুলিশকে আমি বলিনি। খুনের রাতে পুলিশ লক্ষ্মীকে যা জিজ্ঞাসাবাদ করার, তা করেছে। এখন মেডসারভ্যান্ট ছুটি নিয়ে বাবা-মায়ের কাছে যেতেই পারে। গিয়েছিল। এবং ফিরে এসেছে। বরং না ফিরলেই পুলিশ ওকে সন্দেহ করবে, হয়তো কিছু জানে। এটা আঁচ করেই সে ফিরে এসেছে।

ধড়িবাজ মেয়ে।

হ্যাঁ। তাতে কোনো ভুল নেই।

এতক্ষণে টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। তারপর হা-হুঁ করে গেলেন ক্রমাগত ফোন রেখে আমার দিকে তাকালেন। তখন জিজ্ঞেস করলাম, কার ফোন?

লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের এস আই মুকুল বিশ্বাস। বিডন স্ট্রিটে তারকবাবুর বাড়ি গিয়েছিলেন শুক্লার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের কাগজপত্র দেখতে। তারকবাবু সহযোগিতা করেছেন। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে শুক্লার পাশ বইয়ে নগদ দশ হাজার টাকা, দ্বিতীয় সপ্তাহে পনের হাজার টাকা জমা পড়েছে। তার মানে, ব্ল্যাকমেলিংয়ের যা নিয়ম। স্টেপ বাই স্টেপ টাকার অঙ্ক বাড়তে থাকে। তাগত্যা বাধ্য হয়ে প্রদীপ সিনহা পঞ্চাশ হাজার নগদ টাকা দিয়ে নেগেটিভ ফিল্ম ফেরত পাওয়ার জন্য রফা করেছিলেন। চলো, এবার বেরুনো যাক। ষষ্ঠী! আমরা বেরুচ্ছি!…

নিচের লনে গিয়ে কর্নেল বললেন, কিন্তু শুক্লার কাছে ছবির প্রিন্ট থেকে যেতে পারে, এ চিন্তা কেন করেননি প্রদীপ সিনহা? সেই প্রিন্টের জোরে আবার শুক্লা তাকে ব্ল্যাকমেল করে যেত। প্রদীপ সিনহার মতো মানুষ কেন একথা চিন্তা করেননি?

বললাম, আপনি কি এ বিষয়ে আমার মত জানতে চাইছেন?

হ্যাঁ! বলে কর্নেল গাড়িতে উঠলেন।

স্টার্ট দিয়ে বললাম, কোনো আতঙ্কের কারণ ছিল। আতঙ্ক মানুষকে হঠকারী করে।

হুউ। বলে কর্নেল চুপ করে গেলেন। সারা পথ একেবারে চুপ। ধ্যানস্থ।…

.

৭ নাম্বার ক্লিফটন রোডের বাড়ি অনুপমার সামনে একটা পুলিশভ্যান এবং লাল জিপগাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। গেটের সামনে এবং পাশে ফুটপাতের ওপর কয়েকজন কনস্টেবল জটলা করছিল। দেখেই চমকে উঠেছিলাম। আবার কোনো খুনখারাপি ঘটেছে নাকি?

কর্নেলের নির্দেশে বাইরে পুলিশভ্যানের কাছে গাড়ি দাঁড় করালাম। বললাম, নিশ্চয় আবার কিছু ঘটেছে।

কর্নেল জবাব দিলেন না। নরবাহাদুর তাকে দেখে সেলাম ঠুকে গেট খুলে দিল। তার মুখে উদ্বেগ লক্ষ্য করলাম। পোর্টিকোর নীচে থানার অফিসার-ইন চার্জ প্রশান্ত মণ্ডল এবং আরও দুজন অফিসার দাঁড়িয়ে ছিলেন। কর্নেলকে দেখে মিঃ মণ্ডল অভিবাদন জানিয়ে আস্তে বললেন, মিসেস সিনহা চটে গেছেন। সাড়ে এগারোটায় নাকি ওঁদের কোম্পানির হেডঅফিসে জরুরি মিটিং। ওঁকে বলেছি, কর্নেলসায়েব এলে আপনি যেতে পারবেন।

এস. কে. মুখার্জির খবর কী?

উনি ম্যাডামের কাছে আছেন।

চলুন। ভেতরে যাওয়া যাক।

নিচের হলঘরে আমরা ঢুকলাম। একটু পরে মুখার্জিসায়েব নেমে এসে বললেন, আপনারা বসুন। মিসেস সিনহা এখনই আসছেন। আসলে উনি খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন। বুঝতেই পারছেন, মিঃ সিনহার কোম্পানির অবস্থা সম্পর্কে শিগগির সবকিছু দেখেশুনে সিদ্ধান্ত না নিলে উনি প্রতারিত হতে পারেন। তিনি ঠোঁটের কোণে একটু বাঁকা হেসে কর্নেলকে বললেন, কর্নেলসায়েব কি মিঃ সিনহার কিলারকে ধরিয়ে দিতে এসেছেন?

কর্নেল চুরুট বের করে বললেন, আপনার কী মনে হচ্ছে?

হঠাৎ পুলিশফোর্স এসে বাড়ির চারদিক ঘিরে ফেলেছে লক্ষ্য করলাম। মিঃ মণ্ডলকে জিজ্ঞেস করলে উনি বললেন, ওঁরা কর্নেলসায়েবের অপেক্ষা করছেন। আমি জানি না, কর্নেলসায়েবের এ ব্যাপারে লিগ্যাল স্ট্যাটাস কী।

কর্নেল হাসলেন। আপনি কি চান না মিঃ সিনহার কিলার ধরা পড়ুক?

অবশ্যই চাই। আমি এখন মিসেস সিনহার অ্যাটর্নি। লিখিতভাবে এবং কোর্টে অ্যাফিডেবিট করে উনি আমাকে অ্যাটর্নির দায়িত্ব দিয়েছেন। কাজেই আমি ওঁর নিরাপত্তার জন্য স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন।

এই সময় মালবিকা সিনহাকে সিঁড়িতে দেখা গেল। রুষ্ট মুখে নামতে নামতে বললেন, আমি বুঝতে পারছি না কিছু। কর্নেল! এসব কী হচ্ছে? আমার বাড়ির লোকেদের পর্যন্ত বেরুতে দেওয়া হচ্ছে না। আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করার পর বেরুতে যাচ্ছিলাম। আমাকে বলা হলো, আপনি না আসা পর্যন্ত আমাকে থাকতে হবে।

কর্নেল বললেন, বসো মালবিকা! নরহত্যা বড় নির্মম ঘটনা। কাজেই আইনরক্ষকদের নির্মম হতে হয়। আমি অবশ্য আইনরক্ষক নই। তোমার বাবার একসময়ের বন্ধু। তাছাড়া তুমি তোমার স্বামীকে বাঁচানোর জন্য আমার সাহায্য চেয়েছিলে। আমি তোমার স্বামীকে বাঁচাতে পারিনি। সেই ব্যর্থতা আমার দায়িত্ব একটু বাড়িয়ে দিয়েছে, এই যা। তুমি বসো! তারপর আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দাও। আশা করি, তুমি সঠিক উত্তর দেবে।

মালবিকা নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে বলল, বলুন।

অভিনেত্রী চিত্রা দত্তের সঙ্গে তোমার স্বামীর অশালীন অবস্থার কোনো ফটো কি তুমি দেখেছিলে?

হ্যাঁ। কেউ ওটা ডাকে আমার নামে পাঠিয়েছিল।

তারপর তুমি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলে। তাই না?

হ্যাঁ। কিন্তু আপনি আমার বাবার বন্ধু ছিলেন। তাই আপনাকে–

বুঝতে পারছি, শালীনতাবশে তুমি সেটা আমাকে দেখাওনি। শুধু বলেছিলে, তোমার স্বামী কোনো বিপজ্জনক ফাঁদে পা দিয়েছে। তোমার স্বামী খুন হয়ে যাওয়ার পরে অবশ্য তুমি অভিনেত্রী চিত্রার কথা আমাকে বলেছিলে। বলে কর্নেল তাঁর ব্রিফকেস খুললেন। একটা ফুলস্কেপ সাইজের কাগজ বের করলেন। মালবিকা! তোমার বাবা অশোক রায় যৌবনে বিখ্যাত শিকারী ছিলেন। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন চালু হওয়ার পর তিনি একটা রাইফেল ক্লাব গড়ে তোলেন। তোমাকে তার মেম্বার করেছিলেন। তুমি একবার সারা ভারত রাইফেল ছোঁড়ার প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলে।

মালবিকা বলল, এ সব কথা কেন?

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, তোমার বাবা অশোক রায়ের রাইফেলের লক্ষ্যভেদ ছিল অব্যর্থ। কোথাও গুণ্ডা হাতিকে মেরে ফেলার দরকার হলে সরকার তোমার বাবার সাহায্য নিতেন। ওড়িশার জঙ্গলে একটা গুণ্ডা হাতিকে গুলি করার সময় খাদে পড়ে তিনি ভীষণ আহত হয়েছিলেন। তারপর বাকি জীবনের জন্য তিনি পঙ্গু হয়ে যান। তিন বছর আগের কথা। সেই সময় প্রদীপ সিনহার সঙ্গে তোমার পরিচয় হয়। প্রদীপ সিনহা তোমাকে ফিল্মে অভিনয়ের চান্স দিয়েছিলেন। তোমার বাবা তোমার এ ধরনের কেরিয়ার পছন্দ করেননি। এই নিয়ে বাবার সঙ্গে তোমার বিরোধের সূত্রপাত।

কিন্তু আপনি বলতে চান কী? আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।

তুমি ছিলে জেদি মেয়ে। প্রদীপ সিনহাকে তুমি বাবার অমতে বিয়ে করেছিলে। অশোকবাবুও ছিলেন জেদি মানুষ। সেই বিয়ে তিনি মেনে নেননি। তুমি বাড়ি থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলে। তার কিছুদিন পরে অশোকবাবু– তিনি রায়সায়েব নামে পরিচিত ছিলেন–তার সব সম্পত্তি প্রকৃতি বিজ্ঞান সংস্থাকে উইল করে দেন। তাঁর দুটি রাইফেল আর একটি শটগান ছিল। একটা আর্মস কোম্পানিকে বিক্রি করেন। কিন্তু তার একটা রিভলভার চুরি হয়েছিল। কবে চুরি হয়েছিল, তিনি জানতে পারেননি। ভবানীপুর থানায় তিনি লিখিতভাবে তা জানিয়েছিলেন। এই কাগজটা থানার জেনারেল ডায়েরির কপি।

মালবিকা ফুঁসে উঠল, আপনি কেন এসব কথা বলছেন?

কর্নেল একই সুরে বললেন, তোমাদের বাড়ির পুরাতন ভৃত্যই বলা চলে– বিশ্বনাথ ওরফে বিশু সেই প্রকৃতিবিজ্ঞান সংস্থায় তোমার বাবার ইচ্ছা অনুসারে চাকরি পেয়েছিল। দুই দিন আগে তার সঙ্গে দেখা করেছি। সে আমাকে অকপটে জানিয়েছে, রিভলভারটা তুমিই নিয়ে এসেছিলে। সে দেখেছিল, কিন্তু রায়সায়েবকে বলতে সাহস পায়নি।

মিঃ মুখার্জি বাঁকা হেসে বললেন, আপনার বলার উদ্দেশ্য মিসেস সিনহা। তাঁর স্বামীকে সেই রিভলভার দিয়ে খুন করেছেন?

কর্নেল নির্বিকার মুখে বললেন, হ্যাঁ। শুধু সিনহাসায়েবকে নয়, চিত্রা দত্তের বডিগার্ড শুক্লাকেও। কারণ শুক্লা মালবিকাকে রিভলভার হাতে দেখতে পেয়েই বেগতিক বুঝে পালানোর চেষ্টা করেছিল। মালবিকা প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়নি। হা-শুক্লার হাতে একটা ফায়ার আর্মস হিসেবে যেটা ছিল, সেটা এই টয় পিস্তল। কর্নেল টয় পিস্তলটা বের করে দেখালেন। এর নলে লুকোনো ছিল প্রদীপ সিনহা আর চিত্রা দত্তের অশালীন অবস্থার কয়েকটি ফটোর নেগেটিভ। চরম মুহূর্তে সে এটা পাঁচিলের বাইরে ছুঁড়ে ফেলেছিল।

দেখলাম, মালবিকা ঠোঁট কামড়ে ধরে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। মিঃ মুখার্জি বললেন, আপনি এ সব কথা প্রমাণ করতে পারবেন তো কর্নেলসায়েব?

কর্নেল শক্ত মুখে বললেন, পারব। অ্যালসেশিয়ান জিমিকে বিষ খাইয়ে মারলে তবেই শুক্লা দাশের রক্তাক্ত ডেডবডি সেই সুযোগে নিরাপদে বাইরে নিয়ে যাওয়া যায়। মালবিকার গাড়ির ডিকিতে শুক্লার ডেডবডি লুকানো ছিল। তাই ডিকিতে প্রচুর রক্তের দাগ ছিল। মরা কুকুরের রক্ত বলে শুক্লার রক্ত বাড়ির লোকেদের দিয়ে ডিকি ধুয়ে ফেলা সহজ হয়ে ওঠে। জোর দিয়ে বলছি, ডিকিতে শুক্লার রক্তের দাগ কারও সন্দেহের উদ্রেক না করে ধুয়ে ফেলার জন্যই জিমিকে বিষ খাইয়ে মারার দরকার হয়েছিল।

মিঃ মুখার্জি বাঁকা হেসে বললেন, প্রমাণ করতে পারবেন না কর্নেলসায়েব! বেহালার ডগ হসপিটালের ডাক্তার পি. কে. বাগচি জানেন–

কর্নেল তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আপনি এবং মালবিকা রাত দশটায় ডগ হসপিট্যাল থেকে বাড়ি ফিরেছিলেন। কিন্তু এ বাড়ির লোকেরাই বলেছে, আপনারা গাড়ি নিয়ে ফেরেন রাত প্রায় একটায়।

প্রশান্ত মণ্ডল বললেন, আমরা বেহালা ডগ হসপিটালে খোঁজ নিয়েছি।

মিঃ মুখার্জি চার্জ করার ভঙ্গিতে বললেন, আমাদের ফিরতে দেরি হওয়ার কারণ ছিল। কোর্টে তা বলব। কিন্তু কর্নেলসায়েব যে রিভলভারের কথা বলছেন, সেটাই যদি মার্ডার উইপন হয়–

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। মার্ডার উইপন। রায়সায়েবের চুরি হয়ে যাওয়া রিভলভারটা ছিল পয়েন্ট থার্টি টু ক্যালিবারের। পিঙ্কিনস্টন কোম্পানির তৈরি রিভলভার। নাম্বারও এই পুলিশ ডায়েরিতে লেখা আছে।

বেশ তো! সার্চ করে দেখুন, রিভলভারটা পান কি না। আইনবিদ তেমনি ব্যঙ্গের সুরে বললেন, গঙ্গার জলে ছুঁড়ে ফেলে দিলে অবশ্যি পাওয়া যাবে না।

পাওয়া যাবে। কারণ মালবিকা যার সাহায্য নিয়ে শুক্লা দাশের লাশ তার গাড়ির ডিকিতে ঢুকিয়েছিল, তার মুখ চিরকালের জন্য বন্ধ করতে আর একটা গুলি খরচের দরকার ছিল।

লোকটি কে জানতে পারি?

স্বপন ঘোষ ওরফে বাচ্চু। বাচ্চু ঘটনার পরের রাতে পেছনের দরজার তালা ভেঙে পালিয়েছিল। তার কারণ, সে আড়ি পেতে শুনেছিল, আপনি এবং মালবিকা তাকে খতম করে তার লাশ কীভাবে শুক্লার মতো গঙ্গার ধারে ফেলে দিয়ে আসবেন, তার চক্রান্ত করছিলেন। আর হ্যাঁ–বাচ্চুকে মালবিকা এক হাজার। টাকা বখশিস দিয়েছিল অবশ্য। তবে এ-ও ঠিক, বাচ্চু মূলত একজন অ্যান্টিসোশ্যাল। সে মালবিকাকে ব্ল্যাকমেল করার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু সে ধূর্ত। তাই পালিয়ে গিয়েছিল।

প্রশান্ত মণ্ডল বললেন, রাঁধুনি শম্ভু মোহান্ত ঘটনার রাতে বাচ্চুকে সত্যিই দেখতে পেয়েছিল। বাচ্চু আমাদের বলেছে, সে ঘুমোয়নি। তার ঘরের একটা জানালা খোলা ছিল। জানালাটা থেকে এই হলঘরের দরজা পর্যন্ত দেখা যায়। কুকুরের ডাকে সে সন্দেহবশে জানালায় উঁকি দেয়। সিনহাসায়েবকে চুপিচুপি বেরিয়ে যেতে দেখে। তার একটু পরেই মিসেস সিনহাকে যেতে দেখে সে আরও সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছিল। তার বক্তব্য, সায়েব-মেমসায়েব কদিন ধরে তর্কাতর্কি বা ঝগড়াও করছিলেন। তাই সে বেরিয়ে গিয়ে ছাতিম গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল। সিনহাসায়েব মালবিকাকে হঠাৎ ঘুরে দেখতে পান। তাই তার মাথার বাঁ দিকে গুলি লাগে। তিনি পড়ে যান। তারপর

মিঃ মুখার্জি বললেন, ওসব স্টেটমেন্ট বাচ্চুর। কোর্ট পুলিশের কাছে দেওয়া। স্টেটমেন্ট গ্রাহ্য করবে না। পুলিশ অফিসার হিসেবে নিশ্চয় আপনার তা জানা আছে। মার্ডার উইপন যতক্ষণ না আমার ক্লায়েন্টের কাছ থেকে উদ্ধার করতে পারছেন, ততক্ষণ এসব নিতান্ত সারক্যামস্ট্যান্সিয়াল এভিডেন্স মাত্র। এতে কোনো সুবিধে হবে না।

কর্নেল ব্রিফকেসে টয় পিস্তল এবং সেই পুলিশ ডায়রির কপি ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। প্রশান্ত মণ্ডল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, সার্চ ওয়ারেন্ট আমরা এনেছি। আমরা প্রথমে মিসেস সিনহার ঘর সার্চ করতে চাই।

কর্নেল বললেন, রিভলভারটা কোথায় লুকানো আছে আমি জানি।

 মিঃ মণ্ডল একটু অবাক হয়ে বললেন, কোথায় আছে?

কর্নেল একটু হাসলেন। বিখ্যাত জার্মান কোম্পানি পিঙ্কিনস্টন। তাদের তৈরি ফায়ার আর্মসের মূল্য মালবিকা বোঝে। তা ছাড়া বাচ্চুর জন্যও ওটা দরকার ছিল। তাই নিরাপদ জায়গায় অস্ত্রটা লুকিয়ে রাখতে হয়েছে। এমন একটা জায়গায়, যেখানে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না, একটা ফায়ার আর্মস আছে। তার আগে আমাকে রায়সায়েবের মতোই নির্মম হতে হচ্ছে। একটা নরহত্যা নির্বিবাদে যাতে করা যায় এবং কোনো সন্দেহ না জাগে, তার জন্য মালবিকা আমার সাহায্য চাইতে গিয়েছিল অর্থাৎ আমাকে এক্সপ্লয়েট করে একটা ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরি করতে চেয়েছিল–এটা আমার পক্ষে অপমানজনক। কাজেই মালবিকা আর তার সহচর শচীশকুমার মুখার্জিকে আমি দু-দুটো খুনের দায়ে গ্রেফতারের অনুরোধ জানাচ্ছি। মিঃ মণ্ডল!

মুখার্জিসায়েব এবং মালবিকার দুপাশে দুজন পুলিশ অফিসার গিয়ে দাঁড়ালেন।

কর্নেল বেরিয়ে গিয়ে বললেন, মিঃ মণ্ডল! বাগানের কোণে কুকুরের কবরটা খুঁড়লেই মার্ডার উইপনটা পেয়ে যাবেন। এখনই খুঁড়ে ফেলার ব্যবস্থা করুন।…

.

ফেরার সময় কর্নেলকে জিজ্ঞেস করলাম, মার্ডার উইপন কুকুরের কবরে লুকানো আছে, তা কেমন করে জানলেন?

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, কাল সন্ধ্যার আগে বাইনোকুলারে দেখছিলাম, কুকুরের কবরে মার্বেল ফলক বসানোর জায়গাটা ফাঁকা রাখা হয়েছে। তার মানে, প্রয়োজনে রিভলভারটা তুলে নিতে হলে ফলকটা সরানোই যথেষ্ট। পলিথিনে মোড়া কুকুরের মড়া। কাজেই যখন খুশি অস্ত্রটা তুলে নেওয়া যেত। তবে ব্যাপারটা স্রেফ অঙ্ক, জয়ন্ত! আগাগোড়া একটা ভগ্নাংশের অঙ্ক। তবে দৃশ্যটা কল্পনা করো! কবরের অন্ধকারে একটি মৃত্যুর পাশে আরও একটা মৃত্যুর বীজ যেন–ওই পিঙ্কিনস্টন রিভলভার।…